৩. উপসংহার

তৃতীয় খণ্ড

প্রথম অধ্যায়

উপসংহার

মুখ তুলে তাকালো কার্লা লেমারচেন্ট, চোখে ক্লান্তি আর বেদনার ছাপ। কাগজের বাণ্ডিলটা ছুঁয়ে বললো, এতো গোলমেলে ঠেকছে সব ব্যাপারটা, ভিন্ন-ভিন্ন দিক দিয়ে প্রত্যেকেই মাকে দেখেছেন। অথচ একটাই বক্তব্য, কেউ দ্বিমত নন দেখছি আসল ব্যাপারে।

এগুলো পড়ে খুব হতাশ হয়েছেন?

হ্যাঁ, আপনি হননি? না, অনেক মূল্যবান তথ্য আছে এই কাগজগুলোতে।

ভালো করতাম এগুলো না পড়লেই–পোয়ারো বললো কালার এই কথাটা শুনে, তাহলে আপনিও ঐ কথাটা চিন্তা করেছেন?

কার্লা ঝাঁকানো সুরে বললো, অ্যাঞ্জেলা মাসী ছাড়া মা ওটা করেছিলেন সবাই মনে করে। আর কেউ মানবে না মাসীর কথা। কারণ পেছনে যুক্তি নেই। শুধু কি কাজ হয় বিশ্বাসে?

ঐ ভাবেই তাহলে ব্যাপারটাকে আপনি নিয়েছেন?

 বলুন না অন্য কিভাবে নেওয়া যায়? যদি আমার মা করে থাকেন ওটা, তবে এই পাঁচ জনের মধ্যে করেছেন কেউ না কেউ। এবং আমি তার কারণও চিন্তা করে দেখেছি।

আহ! ব্যাপারটা ভারী আশ্চর্যের তো। বলুন শুনি।

না, না, শুধুই তত্ত্ব ওগুলো। যেমন ধরুন ফিলিপ ব্লেক–উনি ব্যবসা করেন শেয়ারের। প্রাণের বন্ধু বাবার হয়তো ওঁকে বিশ্বাসও করতেন আমার বাবা। শিল্পী বেশ অসাবধানী হয় টাকা পয়সার ব্যাপারে। ঝাটে পড়ে হয়তো ফিলিপ টাকা নিয়েও থাকতে পারেন বাবার কাছ থেকে। কিছু সইও করিয়ে নিয়ে থাকতে পারেন বাবাকে দিয়ে, তাহলে হয়তো সত্যি কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং তাকে বাঁচাতে পারতো বাবার মৃত্যুই। মনে হচ্ছে এই ধরনের কথা।

দেখছি খুব অযৌক্তিক চিন্তা করেননি। আর কি?

ঐ এলসার ব্যাপারটা। এখানে বলেছেন ফিলিপ ব্লেক যে বিষ নিয়ে কারসাজি বাবার ব্যাপারে নাকি বড় বেশি মাথা ঘামিয়ে ছিলেন এলসা, কথাটা তো সত্যি বলে আমার মনে হয় না। ধরুন এলসাকে আমার মা বললেন বাবাকে ডিভোর্স দেবেন না কিছুতেই। তাহলে যাই বলুন না কেন যে বড়লোকী ভাব এলসার মধ্যে আছে তার জন্যে সে বিবাহ চাইবে সম্মানজনক ভাবে। এবং খানিকটা ঐ বিষের জোগাড় করে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতো মাকে। হয়তো ক্যারোলিনের ক্ষতি না করে ভাগ্যদোষে বাবার ক্ষতি করে দিলো।

না, খুব ভুল চিন্তা করেননি এবারও আপনি। আর কি?

মানে, ধারণা হয়েছিলো আমার…মেরিডিথও এটা করে থাকতে পারেন।

তাই নাকি, মেরিডিথ ব্লেক?

হা। দেখুন খুনী খুনী মনে হয় ওঁর কথাবার্তা শুনলে। হয়তো মনে হবে না বাইরে থেকে কারণ খুব চাপা লোক উনি। যাকে উনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাকে বাবা বিয়ে করে নিয়েছিলেন। বিষ তৈরি করতেন মেরিডিথ। হয়তো কাউকে মারার জন্যেই ওগুলো উনি তৈরি করতেন। কি হয় বিষ খেলে এই সব ব্যাখ্যা করে নিজেকে উনি চেয়েছিলেন সন্দেহের অতীত করে রাখতে। হয়তো উনি ফঁসী কাঠে আমার মাকে ঝোলাতে চেয়েছিলেন, কারণ মা ওঁকে অনেককাল আগে প্রত্যাখ্যান করেন। অনেক সময় মানুষ উল্টোপাল্টা কথা বলে যার সঙ্গে কোনো সঙ্গতি থাকে না তার চরিত্রের। এ-ও তো হতে পারে তিনি নিজেকেই ওটা লেখার সময় বোঝাতে চেয়েছেন।

পোয়ারো বললো, অন্ততঃ এ ব্যাপারে ভুল করেননি আপনি সব সময় লেখাগুলোকে সত্যি বলে নেওয়া চলে না। ইচ্ছে করেই ভুল পথে চালাবার জন্যে মিথ্যে কথা বলা হয়ে থাকতে পারে।

হা, জানি এবং আমার মাথায় এটাও আছে।

 আর ভেবেছেন কিছু।

ধীরে ধীরে বললো কালা, আমি মিস উইলিয়ামসের কথা এগুলো পড়ার আগে চিন্তা করেছিলাম। স্কুলে অ্যাঞ্জেলা চলে যাবার ফলে চাকরী চলে যায় মহিলার। এবং যদি হঠাৎ অ্যামিয়াস মারা যান তবে স্কুলে যেতে নাও হতে পারে অ্যাঞ্জেলাকে। আমি কিন্তু বলতে চাইছি স্বাভাবিক মৃত্যুর কথাই। এবং যদি বিষ চুরির ব্যাপারটা মেরিডিথ না জানতে পারতেন তবে মৃত্যুকে ওই ভাবেই চালানো হতো, সর্দিগর্মি বা ঐ জাতীয় কোনো কারণে মারা গেছে। চাকরি হারাবার ভয়ে মানছি কাউকে খুন করার যুক্তিটা টিকবে না ধোপে। তবে সামান্য কারণে এর তো খুন হয়েছে এর আগে।

আমার এটা পড়ার আগে মনে হয়েছিলো তাই। কিন্তু তেমন তো মনে হয় না মিস উইলিয়ামসকে। তিনি একটুও অযোগ্য নন…।

তা তো ননই। এখনও বেশ চটপটে আর বুদ্ধিমতী ভদ্র মহিলা।

জানি। দেখাও যায় সেটা। ওকে মনে হয় খুব বিশ্বাসীও। আর আমাকে সেটাই ভাবিয়ে তুলেছে। আপনি তো সবই জানেন…পারেন তোতা বুঝতেও। সব সময়ে আপনি তো বলছেন প্রকাশ করতে চান প্রকৃত সত্যটাকে। মনে হয় আমার এবার আমরা সত্যটা পেয়েছি। বিশ্বাস করতে চান বলেই কখনো মিথ্যের ওপর জীবনের ভীত গড়া উচিত নয়। ঠিক আছে মেনে নিচ্ছি আমি নির্দোষ ছিলেন না আমার মা। মনের দুর্বলতার আর বাঁচাবার জন্যেই আমাকে মিথ্যে চিঠি লিখেছিলেন। বিচার করছি না তার আমি। মানুষের জেলে কি হয় তা জানা নেই আমার। মরীয়া হয়ে বাবার জন্যে ওটা করেও থাকতে পারেন মা, তাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। আবার ঐ ধরনের প্রাণশক্তিতে ভরপুর বাবাকেও দেবো না দোষ। বোধ হয় ওঁর উপায় ছিলো না…একজন অতো বড় শিল্পী, বাবার অনেক কিছুই ক্ষমা করা যায়।

পোয়ারো বললো, তাহলে…সন্তুষ্ট তো আপনি?

সন্তুষ্ট। কার্ল লেমারচেন্ট বললো। চেঁচিয়ে উঠলো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে।

ঝুঁকে পড়ে পোয়ারো হাত বুলিয়ে কালার পিঠে সান্ত্বনা দিলো। শুনুন, যখন লড়াই করা ঠিক দরকার আপনি তখনই লড়াই চাইছেন শেষ করতে বিশেষ করে যখন আমি এরকুল পোয়ারো ভালোভাবে ঘটনাটাতে বুঝতে শুরু করেছি।

হাঁ করে তাকালো কার্লা পোয়ারোর দিকে, মাকে ভালোবাসতেন মিস উইলিয়ামস, নিজের চোখে উনি দেখেছেন আত্মহত্যা বলে চালাবার জন্যে যা করেছিলেন মা। যদি আপনি বিশ্বাস করে থাকেন ওঁর…।

উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, সেটা এই জন্যে দেখেছিলেন যে আপনার মা স্বামীর আঙুলের ছাপটা বিয়ারের বোতলে লাগাচ্ছিলেন বিয়ারের বোতলে মনে রাখবেন–ঐ একটা ঘটনাই আমাকে স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে নিজের স্বামীকে আপনার মা খুন করেননি।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়

পাঁচটা প্রশ্ন পোয়ায়োর

০১.

 মিঃ পোয়ারো বললেন গলায় বিরক্তির সুর ফিলিপ ব্লেকের ট্র্যাজেডী সম্বন্ধে ক্রেল পরিবারের যা লিখে দিয়েছেন ধন্যবাদ তার জন্যে।

প্রচ্ছন্ন গর্ব জেগে উঠলো ফিলিপ ব্লেকের–অশেষ ধন্যবাদ। দেখলাম লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথাই, কি আশ্চর্য, তাই না?

বর্ণনা দিয়েছেন অপূর্ব সুন্দর, তবে বাদ পড়ে গেছে কিছু, তাই না?

 বাদ পড়ে গেছে? ভ্রু কুঁচকালের ফিলিপ ব্লেক।

সব সময়ে আপনার বর্ণনা আপনি খোলা মন নিয়ে পুরোপুরি লেখেননি, গলাটা পোয়ারোর ক্রমশঃ কঠিন হয়ে আসছে, খবর পেয়েছি আমি যে কোনো এক গ্রীষ্মকালের রাতে খুবই উদ্ভট সময়ে আপনার ঘর থেকে মিসেস ক্রেলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছিলো।

অনেকক্ষণ পরে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ফিলিপ বললেন, কে বলেছে আপনাকে?

সেটা বড় কথা নয় কে বলেছে। আমি যে জানি এটাই বড় কথা।

নিস্তব্ধতা নেমে এলো আবার, মনঃস্থির করে ফিলিপ ব্লেক বললেন, কেমন করে আপনি জানি না হঠাৎ ব্যক্তিগত ব্যাপারটা আমার জেনে ফেলেছেন, হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি, আমার বিবৃতির সঙ্গে অসঙ্গতি আছে এর। যদিও অসঙ্গতি নেই আমার মতে। ফলে বাধ্য হচ্ছি আমি সত্যি কথাটা বলতে।

আমার মনে কিছুটা বিদ্বেষ ভাব ছিলো ক্যারোলিন ক্রেলের প্রতি। তবে আকর্ষণ বোধ করতাম সেই সঙ্গে ওর প্রতি। হয়তো প্রথমটার জন্ম দিয়েছিলো শেষোক্তটিই। ওর প্রভাবটাকে আমার ওপর ঘৃণা করতাম এবং সেই জন্যেই ওর খারাপ দিকগুলো নিয়ে খালি আঘাত করবার চেষ্টা করতাম। পছন্দ করিনি ওকে, অথচ যেকোনো মুহূর্তে ওর সঙ্গে প্রেম করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিলো আমার পক্ষে। আমি ওকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতাম। অথচ আমাকে ও পাত্তা দেয়নি। ফলে কোনো দিনও ওকে আমি ক্ষমা করিনি।

যখন ঐ এলসা মেয়েটার প্রেমে মজলো অ্যামিয়াস তখন সুযোগ আমার এসে গেলো। বিনা কারণেই সম্পূর্ণ আমি আমার ভালোবাসার কথা ক্যারোলিনকে বলে ফেললাম। ও শান্ত ভাবে বলেছিলো, হ্যাঁ, তা তো আমি বরাবরই জানি। মহিলার কী ঔদ্ধত্য।

অবশ্য জানতাম আমিও যে ও ভালোবাসে না আমাকে। তবে ঐ অ্যামিয়াসের মতিগতি দেখে বেশ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলো ক্যারোলিন। মেয়েদের জয় করা সহজ এই রকম মানসিকতার। ও আমার কাছে সেই রাতে আসতে রাজী হয়েছিলো। এবং এসেওছিলো।

এবার চুপ করলো ফিলিপ। বোধ হয় পরের কথাগুলো বলতে বেশ ওর কষ্ট হচ্ছে।

ও এসেছিলো আমার ঘরে। তারপর খুব ঠান্ডা গলায় আমার আলিঙ্গনের মধ্যেই বলেছিলো ভালো নয় এটা। সে এক পুরুষে আসক্তা ও অ্যামিয়াস ক্রেলের, তা সে হোক ভালো অথবা মন্দ, ও যে ভালো ব্যবহার আমার প্রতি করেনি সেটা স্বীকার করলো এবং এটাও বললো যে ওর ছিলো না কোনো উপায় চাইলো ক্ষমা।

তারপর চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। আশ্চর্য হবেন শুনলে মিঃ পোয়ারো ওর প্রতি একশোগুণ ঘৃণা বেড়ে গেলো। শুনলে কি আপনি আশ্চর্য হবেন যে আমি কখনই ক্যারোলিনকে ক্ষমা করতে পারিনি? আমাকে যে ভাবে ও অপমান করেছিলো–এবং পৃথিবীতে আমার বিশেষ করে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে যে ভাবে ও খুন করেছিলো তার জন্যে ।

কাঁপতে কাঁপতে রাগে ফিলিপ ব্লেক বলে উঠলেন, কিছু বলতে চাই না এ ব্যাপারে শুনছেন? আমি কোনো উত্তর দেবো না। এবার আসুন। আর কোনোদিনও এই ধরনের প্রশ্ন করবেন না আমাকে।

.

০২.

আপনার অতিথিরা সেদিন কে কি ভাবে এবং কার পর কে বেরিয়েছিলেন ল্যাবোরেটরি থেকে সে সম্বন্ধে আমি জানতে চাই কিছু।

মিঃ মেরিডিথ ব্লেক প্রতিবাদ করে উঠলেন–কিন্তু মিঃ পোয়ারো ষোলো বছর পর…কি করে তা সম্ভব মনে থাকা? সবার শেষে ক্যারোলিন বেরিয়েছিলো আপনাকে তো বলেছি।

আপনার ও বিষয়ে ভুল হচ্ছে না তো…?

না…অন্ততঃ…তাই তো মনে করি…

চলুন ওখানে যাওয়া যাক। পুরো মাত্রায় আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, বুঝছেন তো।

মেরিডিথ আপত্তি জানাতে জানাতেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। দরজার তালা খুলে, খুলে দিলেন জানলার পাল্লাগুলোও। পোয়ারো বেশ মেজাজের মাথায় বলতে শুরু করলো–বন্ধু এবার মনে করুন গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি করার ব্যাপারটা আপনার অতিথিদের বলা হয়ে গেছে। একটু ভাবুন চোখ বন্ধ করে…।

মেরিডিথ বাধ্য ছেলের মতো তাই করলেন। একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে ধীরে ধীরে পোয়ারো ওটা নাড়াতে লাগলেন ব্লেকের নাকের সামনে, একটু কুঁচকে উঠলো নাকটা, বিড়বিড় করে মেরিডিথ শুরু করলেন বলতে-হা…হা…কী আশ্চর্য মনে পড়ে যাচ্ছে সব কথা…একটা হালকা কফি রঙের পোষাক ক্যারোলিন পরেছিলো। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো ফিলিপকে…সব সময়েই ও মনে করতো কোনো মানে হয় না আমার এই নেশাটার।

পোয়ারো বললো, চিন্তা করুন এবার, ঘর থেকে আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। আপনি যাচ্ছেন এখান থেকে লাইব্রেরীতে…সবার আগে ঘর থেকে কে বের হলো–আপনি কি?

এলসা আর আমি। আগে দরজা দিয়ে ও বেরিয়ে গেলো। ওর খুব কাছেই ছিলাম আমি কথা বলতে বলতে ওর সঙ্গে বাকীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবার বন্ধ করতে হবে তো দরজাটা। তারপরে ফিলিপ এলো। অ্যাঞ্জেলা ফিলিপের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো। অ্যামিয়াস এবং সব শেষে ক্যারোলিন ওদের পেছনেই ছিলো।

এ বিষয়ে তাহলে কোনো দ্বিধা নেই আপনার তো–সবার পরে ক্যারোলিন বেরোয়? কি করেছিলেন উনি তা কি দেখেছিলেন?

মাথা নাড়লেন মেরিডিথ, না, ঘরের দিকে আমি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বোঝাচ্ছিলাম এলসাকে কোন্ লতা তুলতে হয় পূর্ণিমার দিন…যত সব কুসংস্কারের গল্প। বেরিয়ে এলো ক্যারোলিন যেন ব্যস্ত একটু…তালা দিলাম দরজায়। মেরিডিথ কথা শেষ করে চোখ খুললেন, রুমালটা পকেটে ভরছিলো পোয়ারো। বেশ বিরক্ত হয়ে নাক টেনে মেরিডিথ বললেন মনে মনে, এ লোকটা কেন আবার সুগন্ধী ব্যবহার করে। মুখে বললেন, ওরা এইভাবেই বেরিয়েছিলো –এলসা, আমি, ফিলিপ, অ্যাঞ্জেলা আর ক্যারোলিন, আপনার কি এতে কিছু লাভ হবে?

ঠিক আছে সব। শুনুন এখানে আমি একটা জমায়েতের ব্যাপার করতে চাই। আশাকরি অসুবিধে হবে না…।

.

০৩.

 এলসা ডিটিশাম বাচ্চা মেয়ের মতো কৌতূহল দেখিয়ে বললেন বলুন।

ম্যাডাম একটা প্রশ্ন করতে চাই। করুন।

পোয়ারো বললো, সবকিছু, মানে শেষ হবার পর বিচার, মেরিডিথ ব্লেক আপনার কাছে কি বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন?

হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন এলসা, যেন বিবক্ত হয়েছেন খুব।

 হা-করেছিলেন। কেন?

তাতে কি আপনি আশ্চর্য হয়েছিলেন?

 হয়েছিলাম কি? পড়ছে না মনে।

কি বলেছিলেন আপনি?

এলসা হেসে উত্তর দিলেন? কি মনে হয় আপনার কী বলেছিলাম? অ্যামিয়াসের পরে– মেরিডিথ? আর কি হতে পারে এর চেয়ে হাস্যকর। বোকার মতো উনি ব্যবহার করেছিলেন।

মুচকি হেসে এলসা হঠাৎ বললেন, আমাকে বাঁচাতে উনি চেয়েছিলেন আমার দেখাশোনা করতেও–কথাটা এইভাবেই বলেছিলেন। মেরিডিথেরও অন্যদের মতো কেমন যেন ধারণা হয়েছিলো আমি বেশ কষ্ট পাচ্ছি ঐ ধরনের কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে!..বেচারা মেরিডিথ বুড়ো..গাধা কোথাকার। আবার এলসা জোরে হেসে উঠলেন।

.

০৪.

পোয়ারো আর একবার মর্মভেদী দৃষ্টির সম্মুখীন হলো মিস উইলিয়ামসের। একটা প্রশ্ন আছে আস্তে আস্তে জানালো। সম্মতি ঘাড় নেড়ে জানাতেই খুব সাবধানে পোয়ারো প্রশ্নটা করলো, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন খুব ছোট অবস্থাতে জখম হয়েছিলো। আমি দেখেছি দুজনের বিবৃতিতে উল্লেখ আছে তার। একটাতে বলা হয়েছে পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মিসেস ক্রেল ওকে মেরেছিলেন। উনি অ্যাঞ্জেলাকে মেরেছিলেন শাবল দিয়ে অন্যটায় আছে। কার কথাটা এর মধ্যে ঠিক?

মিস উইলিয়ামস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন–আমি কখনো শাবলের কথা শুনিনি। পেপার ওয়েট ব্যাপারটাই ঠিক।

এটা কার কাছ থেকে শুনেছিলেন?

অনেক দিন আগে অ্যাঞ্জেলা নিজেই আমাকে কথাটা বলেছিলো।

অ্যাঞ্জেলা ঠিক কথা বলেছিলো?

ও নিজের গালটা ছুঁয়ে বলেছিলো যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন দিদি পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরেছিলো বলে এই রকম হয়ে গেছে। তবে কখনো একথা যেন বলবেন না ওকে, ও কষ্ট পায় খুব।

ও কথা মিসেস ক্রেল কখনও আপনাকে বলেছিলেন?

 আভাসে। ব্যাপারটা আমি জানি উনি ধরে নিয়েছিলেন। ওঁকে আমি বলতে শুনেছিলাম, আমি জানি মনে করেন আপনি অ্যাঞ্জেলাকে আদর করে আমি নষ্ট করেছি। আমার সব সময়ে মনে হয় যে ক্ষতি করেছি আমি তার ক্ষতি পূরণ করার সাধ্য আমার নেই। আর একবার বলেছিলেন, স্থায়ী কারুর ক্ষতি করেছি এই চিন্তাটা চিরকাল মানুষের জীবনে গুরুভারের মতো চেপে বসে থাকে তা মনের ওপর।

ধন্যবাদ, মিস উইলিয়ামস। আমার জানার ছিলো এইটুকুই।

তীক্ষ গলায় উনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ঠিক আপনাকে বুঝতে পারছি না মিঃ পোয়ারো। ঐ যে দুঃখের ঘটনার বর্ণনা আমি লিখে দিয়েছি, অ্যাঞ্জেলাকে কি সেটা দেখিয়েছেন?

মাথা নাড়লো পোয়ারো, আর এখনও আপনি, কথাটা মিস উইলিয়ামস শেষ করলেন না।

পোয়ারো বললো, চিন্তা করুন এক মিনিট। একজন জেলে যদি দেখেন বসে আছে বারোটা মাছ নিয়ে, তখন মনে হতে পারে আপনার সত্যিকারের মাছটা বারোটা। কিন্তু নকল তো একটাও হতে পারে।

দৃপ্তকণ্ঠে বেশ জবাব দিলেন মিস উইলিয়ামস, অবাস্তব কথা খুবই, অথচ…। ।

..ও, অবাস্তব…কিন্তু অসম্ভব তো নয়…কারণ আমার একবার এক বন্ধু নিয়ে গিয়েছিলো একটা নকল মাছ (বুঝতেই পারছেন ওর নকল মাছ তৈরি করার ব্যবসা ছিলো) আসলের সঙ্গে তুলনা করার জন্যে। এবং যদি আপনি কারোর বৈঠকখানায় ইন্নিয়াস মাছগুলোকে মাছের অ্যাকোরিয়ামে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে করেন জ্যান্ত নয় ওগুলো, তবে ভুল করবেন, সোজা বাগদাদ থেকে ওগুলো প্লেনে করে আনা আনা হয়েছে।

আজেবাজে কী সব বকছেন? কেঁঝে উঠনে মিস উইলিয়ামস।

বকছি এই জন্যে যে আপনাকে আমি দেখাতে চাই চোখ দিয়ে মানুষ যা দেখে তা মন দিয়েও অনেক সময় দেখতে হয়…।

.

০৫.

রিজেন্ট পার্কের ফ্ল্যাটে বাড়িটার কাছে এসে পোয়ারো চলার গতিটা কমিয়ে দিলো।

তেমন কিছু অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনকে জিজ্ঞেস করার না থাকলেও এখানে আসা সামঞ্জস্যটা রাখার জন্যেই। পাঁচটা প্রশ্ন পাঁচজনকে করতেই হবে।

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন সাদর অভ্যর্থনা জানালো।

পেলেন কিছু?

 এগোতে পারছি শেষ পর্যন্ত।

ফিলিপ ব্লেক? মন্তব্য খানিকটা, অ্যাঞ্জেলা খানিকটা মন্তব্য, খানিকটা প্রশ্নের মাঝামাঝি সুরে অ্যাঞ্জেলা জানতে চাইল।

আমাকে এখনও কোনো প্রশ্ন করবেন না। এখনও সময় আসেনি। তবে অনুরোধ একটা করতে এসেছি, রাজী সবাই, এখন দয়া করে যদি আপনি একবার হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি আসেন।

আপনার কি উদ্দেশ্য ঘটাতে চান নাকি ষোলো বছর আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি?

দেখতে চাই আরও একটু সুস্পষ্ট ভাবে। তা আসছেন তো?

যাবো। এক সঙ্গে সবাইকে মনও চাইছে দেখতে, আপনার ভাষায় সকলকে আরও একটু সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবো।

সঙ্গে আনবেন সেই চিঠিটাও, যেটা দেখিয়েছিলেন আমাকে।

না, আপনাকে দেখিয়েছি বলেই দেখাতে হবে তার কোনো মানে নেই।

এ ব্যাপারে কিন্তু আপনার উচিত আমার কথামতো চলা।

নিশ্চয়ই না। হয়তো চিঠিটা নিয়ে যাবো, তবে দেখাবো কিনা সেটা নির্ভর করবে আমার ইচ্ছের ওপর।

ঠিক আছে।…প্রশ্ন করছি একটা…ঐ দুর্ঘটনাটা ঘটার কাছাকাছি সময় আপনি দি মুন অ্যাণ্ড দি মিক্স পেন্স উপন্যাসটা সমারসেট মমের লেখা তা পড়েছিলেন?

কি আশ্চর্য? হা, কিন্তু কি করে জানলেন আপনি?

আপনাকে শুধু দেখাতে চাই, তুচ্ছ ব্যাপারেও খুব আমি কেমন জাদু দেখাতে পারি। অনেক কিছু না বললেও আমি জানতে পারি।

.

তৃতীয় অধ্যায়

পুনর্গঠন

হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরের ল্যাবরেটারিতে বিকেলের রোদের আলোয় সবাই আবার এসে সমবেত হচ্ছেন। কাটতে চাইছে না বাড়িটার পরিত্যক্ত রূপটা।

মেরিডিথ ব্লেক একটু অস্বস্তির মধ্যে এলোমেলো ভাবে কালার সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন এক সময়ে, জানো বাছা, তুমি কয়েকটা দিক দিয়ে একেবারে তোমার মায়ের মতো, আবার একেবারেই নও কয়েকটা ব্যাপারে।

প্রশ্ন করলো কালা–মিল কোথায় আর অমিল কোথায়-শুনি বলুন না।

রঙ, হাঁটা চলা মায়ের মতো, তবে…বলি কিভাবে…অনেক বেশি স্পষ্ট।

ফিলিপ ব্লেক জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বাইরে, বিরক্তির রেখা ফুটে উঠছে কপালে, এর কি মানে হয়? এমন সুন্দর সন্ধ্যে বেলায় শনিবারের… ।

সবাইকে শান্ত করলেন এরকুল পোয়ারো এক কথায়, আমি ক্ষমা চাইছি…এভাবে গলফ খেলার সময় নষ্ট করার জন্যে…তবে আপনার প্রিয় বন্ধুর মেয়ের জন্যে…খেয়াল করে ওর কথা…।

ঘোষণা করলো খাস-খানসামা এসে–এসেছেন মিস ওয়ারেন। ওকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মেরিডিথ নিয়ে এলেন। অ্যাঞ্জেলা সময় নষ্ট করেও এসেছো, খুশী হলাম ভারী।

ছুটে গেলো কার্লা, এই যে অ্যাঞ্জেলা মাসী। তোমার প্রবন্ধ পড়লাম আজকের টাইমস পত্রিকায়। কী ভালোই না লাগে নামী আত্মীয় থাকলে, লম্বা মতো একজন, চৌকো চোয়ালওলা যুবককে দেখিয়ে বললো, এই হলো জন ব্যাটারি। আমি আর ও…ইচ্ছে আছে বিয়ে করবার…

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন বললেন, আঃ…জানতাম না তাতো…।

এগিয়ে গেলেন মেরিডিথ আর একজন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে–এই যে মিস উইলিয়ামস দেখা কত বছর পরে…।

রোগা, দুর্বল অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে এলেন গভর্নেস, একবার পোয়ায়োকে দেখে নিয়ে দামী সুট-প্যান্ট পরা লম্বা মতো একজনের দিকে তাকালেন।

এগিয়ে এসে অ্যাঞ্জেলা হাসি মুখে বললেন, নিজেকে আবার স্কুলের মেয়ে মনে হচ্ছে।

মিস উইলিয়ামস বললেন, আমার গর্ব হয় তোমার জন্যে বাছা, আমার মুখ রেখেছো তুমি। এই তো কালা, তাই না। নিশ্চয়ই ওর মনে নেই আমাকে…তখন বড্ড ছোট ছিলো…।

ফিলিপ অস্থির হয়ে উঠেছেন–এসব কী হচ্ছে? আমাকে তো কেউ বলেনি।

এটার নাম দিয়েছি আমি…অতীত ভ্রমণ। আসুন, বসি সবাই মিলে। কাজ শুরু হবে শেষ অতিথি এসে গেলেই। উনি এলেই…নামানো হবে আত্মাকে, পোয়ারো বললো।

বিরক্ত হয়ে ফিলিপ বললো, কি ছেলেমানুষী হচ্ছে এসব? নিশ্চয়ই আপনি কোনো চক্র ডাকতে যাচ্ছেন না প্ল্যানচেটের।

না, না, নিশ্চয়ই না। আলোচনা করবো শুধু অতীতের ঘটনা নিয়ে। আবির্ভাব হবে না ভূত-টুতের ঠিকই। তবে বলতে পারে কে এই মুহূর্তে এঘরে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিনের আত্মা নেই?

যা তা কি সব বকছেন, চেঁচিয়ে উঠতেই ফিলিপ খাস-খানসামা এসে লেডী ডিটিশাম এসেছেন জানালো।

লেডী ডিটিশাম এলেন, মুখের রেখায় ঔদ্ধত্য আর বিরিক্তির ক্ষীণ আভাস পরিস্ফুট। একটু হাসলেন মেরিডিথের দিকে তাকিয়ে শীতল দৃষ্টিতে। অ্যাঞ্জেলা আর ফিলিপের দিকে তাকিয়ে বসলেন একটা আলাদা চেয়ারে গিয়ে। দামী হারের বাঁধনটা গলা থেকে আলগা করে দিতেই লুটিয়ে পড়লো পেছন দিকে হা করে কার্লা দেখছিলো এলসাকে। তার জীবনে এই মহিলাটির জন্যেই ঐ সর্বনাশ নেমে এসেছিলো। তবে ঘৃণার বদলে তার দৃষ্টিতে ছিলো কৌতূহল।

এলসা বললো, দুঃখিত মিঃ পোয়ারো একটু দেরী হয়ে গেলো।

আপনি এসেছেন এটাই ম্যাডাম বড় কথা।

জোরে নাক টানতেই সিসিলিয়া উইলিয়ামস এলসা তাকালেন ওর দিকে, অবজ্ঞার ভাব। বললেন, অ্যাঞ্জেলা চিনতে পারতাম না তোমাকে। বলো তো কতোদিনের কথা, ষোলো বছর।

পোয়ারো কাজে লাগালো এই সুযোগটাকে, হ্যাঁ আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি যোবলা বছর আগেকার ঘটনা নিয়েই, বলে নিই তার আগে আমরা কেন জড়ো হয়েছি এখানে। কালার অনুরোধ সংক্ষেপে এবং তার দায়িত্ব নেওয়ার কথাটা বলে ফিলিপ আর মেরিডিথের তরফ থেকে ঝড় উঠতে যাচ্ছে প্রতিবাদের দেখে পোয়ারো তাড়াতাড়ি বললো, আমি কাজের ভারটা নিয়েছি–কাজও শুরু করেছি সত্যটা আবিষ্কার করার জন্যে।

পোয়ারোর কথা শুনতে শুনতে কার্লা অলক্ষে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো আগন্তুক পাঁচজনের মুখের ওপর এদেরই মধ্যে একজন। কেউ খুন করেছিলো ওর বাবাকে।

কল্পনা করতে লাগলো কালা–কাউকে না কাউকে এরা খুন করেছেন–রাগে পাগল হয়ে গিয়ে ফিলিপ ব্লেক একজন মহিলার গলা টিপে ধরেছেন, একটা সিদেল চোরকে মেরিডিথ রিভলভার দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন, হঠাৎ চলে গেলো গুলি, ভেবে চিন্তে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন গুলি করছেন কাউকে…সিলেক মোড়া সোফায় বসে প্রাচীন দুর্গে হুকুম দিচ্ছেন এলসা হতভাগাটাকে দুর্গের পাঁচিল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দাও তলায়। …নানা বিচিত্র এই ধরনের কল্পনার জগতে কালার মন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর একবার ভাবলো যেন ও প্রশ্ন করছে-মিস উইলিয়ামস কাউকে কখনো খুন করেছেন আপনি, উত্তর দিচ্ছেন উনি, মন দিয়ে অংক কষে, আজে বাজে চিন্তা না করে।

নাঃ পাগল হয়ে যাবো এসব চিন্তা করলে, পোয়ারোর কথাই তার চেয়ে শোনাই ভালো, সবই তো জানেন উনি।

বলে চলেছেন পোয়ারো, আমার কাজ এটাই…অতীত কাগজে উল্টো গিয়ারে চালিয়ে চলে গিয়ে যা ঘটেছিলো আসলে তা আবিষ্কার করা।

ফিলিপ ব্লেক বললেন, আমরা সবাই জানি ঘটনাটা, আপনি বলছেন। আপনি কিছু না ভেবেই কথাটা বললেন। কোনো ঘটনার সম্বন্ধে স্বীকৃত বয়ানটাই সত্যি হবে যে সব সময়ে এমন কোনো কথা নেই। যেমন মিঃ ব্লেকের কথা ধরা যাক–অপছন্দ করতেন উনি ক্যারোলিন ক্রেলকে। ওটা স্বীকৃত বয়ান আপনার মনোভাব সম্বন্ধে। কিন্তু যার সামান্যতম জ্ঞান আছে মনঃস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তারা কিন্তু ধরে নেবে উল্টা কথাটাই, ভীষণভাবে আপনি চাইতেন ক্যারোলিনকে, শুধু সমালোচনা করতেন না পাওয়ার দুঃখে। আবার মেরিডিথ ব্লেকের কথা দেখুন উনি মনে মনে বহু বছর ধরে ক্যারোলিনের প্রতি আসক্ত ছিলেন। উনি ক্যারোলিনের প্রতি নিজের বিবৃতিতে অ্যামিয়াসের ব্যবহারের প্রতিবাদ জানাতেন সে কথা বলেছেন। ভালো করে বিবৃতিগুলো পড়ে দেখলে জানা যাবে সুন্দরী তরুণী এলসার মতো আবির্ভাবের পরেই সব যেন শুরু করলো গোলমাল হতে। শ্রদ্ধা ভালোবাসা এতোদিনের অন্য পাত্রীতে সমর্পিত হলো।

প্রতিবাদ করার মতো মেরিডিথ শব্দ করলেন, মিষ্টি করে লেডী ডিটিশাম হাসলেন।

বলে চললো পোয়ারো, শুধু দৃষ্টান্ত দেবার জন্যে এগুলো আমি বললাম। খুনের কোনো সম্পর্ক নেই এর সঙ্গে। ঠিক আছে অতীত জগতে এবার ফেরা যাক। …বলে নিই কিভাবে করেছি এটা..আমি ক্যারোলিন ক্রেলের উকীলদের সঙ্গে আর সরকার পক্ষের সহকারী উকীলের সঙ্গে ক্রেল পরিবারের সঙ্গে পরিচিত বৃদ্ধ সলিসিটার আর উকীলের মুহুরীর সঙ্গে, আর তদন্তকারী মামলায় পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি। এবং কথা বলেছি প্রত্যক্ষদর্শী পাঁচজনের সঙ্গে, ঘটনার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন। আমি এবার মহিলাটির একটি পূর্ণাবয়স্ক ছবি আঁকার চেষ্টা করছি ঐসব তত্ত্বের ভিত্তিতে, যা জেনেছি তা হলো…ক্যারোলিন ক্রেল একবারের জন্যেও তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রতিবাদ করেননি (ঐ চিঠিটা মেয়েকে লেখা ছাড়া)।

কোনো রকম ভয়ের চিহ্ন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ করেননি তিনি, আগ্রহ দেখাননি কোনোরকম। পরাজিতের মনোভাব আগাগোড়া নিয়ে, আত্মসমর্পণ করেছিলেন ভাগ্যের কাছে। উনি হাজতে থাকাকালীনও খুব শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন এই বিপর্যয়কে। বোনের কাছে একমাত্র লেখা চিঠিটাতে নিয়তির এই নিষ্ঠুর পরিহাসের কথা তিনি বলেছিলেন। অথচ আমি কথা বলেছি যাদের সঙ্গে, প্রত্যেকেই তারা (মাত্র একজন বাদে) বলেছেন অপরাধী ক্যারোলিন ক্রেল।

মাথা নাড়লেন ফিলিপ, ও দোষী নিশ্চয়ই।

পোয়ারো বললো, রায় অন্যদের মেনে নেওয়াটা কাজ নয় আমার। আমি নিজে সাক্ষ্য প্রমাণগুলো পরীক্ষা করেছি। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে মানসিকতা ছিলো তথ্যটা তার সঙ্গে মেলে কতটা শুধু তাই পরীক্ষা করে আমি দেখেছি। এরজন্য পড়েছি পুলিশের ফাইল, প্রত্যক্ষদর্শীর পাঁচজনের বিবৃতি নিয়েছি, যেগুলোকে অবান্তর মনে করেছিলো পুলিশ সেগুলোকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি, এবং জোগাড় করেছি নতুন অনেক তথ্যও, যেমন–(ক) যেগুলোকে পুলিশ অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিলো এমন কিছু আলোচনা এবং ঘটনা, (খ) কি মনে করেছিলেন বা ভেবেছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল সে সম্বন্ধে অভিমত বিভিন্ন লোকের (আইনতঃ যদি গ্রাহ্য নয় ওগুলো) এবং (গ) কিছু তথ্য যা পুলিশের কাছে ইচ্ছাকৃত ভাবে চেপে যাওয়া হয়েছিলো।

আমি নিজেই এখন মামলাটার বিচার করতে পারি। মনে হয় এমনিতে খুন করার পক্ষে ক্যারোলিনের যথেষ্ট কারণ ছিলো, স্বামীকে উনি ভালোবাসতেন, প্রকাশ্যে স্বামী অন্য স্ত্রীলোক আসক্তির কথা বলেছেন এবং নিজেই স্বীকার করেছেন স্ত্রী তিনি খুব ঈর্ষাপরায়ণ।

কার্য সাধনোপায়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। উদ্দেশ্য থেকে একটা খালি সেন্টের শিশি যাতে কোনাইন ছিলো ক্যারোলিনের আলমারীতে তা পাওয়া গেছে। তাঁরই আঙুলের ছাপ আবার শিশির গায়ে। ক্যারোলিন স্বীকারও করেছিলেন পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে ওটা এই ঘর থেকে নিয়েছিলেন। সেদিন সবার শেষে এই ল্যারেটারি থেকে বেরিয়ে ছিলেন এবং একমাত্র হাতের যে ছাপ কোনাইনের বোতলে পাওয়া গেছে তাও ক্যারোলিনেরই। দেখা যাচ্ছে সব মিলিয়ে উনি চুরি করেছিলেন কোনাইন। আর একটা পরোক্ষ প্রমাণ আছে সেদিন আমায় মেরিডিথ ব্লেক বলেছিলেন, মনে পড়ছে দাঁড়িয়েছিলাম এইখানে, জুই ফুলের গন্ধ খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো। কিন্তু সেপ্টেম্বর ছিলো সেই মাসটা জুন-জুলাই হলো জুই ফুলের সময়।

অতএব বোঝা যাচ্ছে ক্যারোলিন বিষ চুরি করার মতলবটা আঁটার পর ব্যাগের মধ্যে থেকে জুইফুলের সেন্টের শিশিটা বের করে জানলা গলিয়ে সেন্টটা ফেলে দেন, তারপর বিষ ভরে নেন খালি শিশিটাতে।

মিঃ মেরিডিথ ব্লেককে কদিন আগে বলেছিলাম আমি কে কি ভাবে সেই দুর্ঘটনার দিন ঘর থেকে বেরিয়েছিলো সেই দৃশ্যটার পুনরাবৃত্তির অভিনয় করতে। ওকে জুই ফুলের সেন্ট মাখানো রুমাল নেড়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় শোকাতেই ওঁর মনে পড়ে যায় পূর্বস্মৃতি। মাঝে মাঝে বুদ্ধির চেয়ে প্রাণশক্তি অনেক বেশি কাজ করে।

আসা যাক এবার সেই সর্বনাশা দিনটার সকালবেলায়। মিস এলসা গ্ৰীয়ার প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন আমিয়াসকে বিয়ে করার কথা। চরম বিপদের মুখে ক্যারোলিনকে ঠেলে দিয়ে সে কথা আমিয়াস স্বীকারও করলেন, এ ব্যাপারে অনেকই সাক্ষ্য দিয়েছেন।

স্বামী স্ত্রী তুমুল ঝগড়া হলো পরদিন লাইব্রেরীর ঘরে। হল ঘর থেকে ফিলিপ ব্লেক শুনতে পেলেন ক্যারোলিন বলছেন, তোমাকে একদিন খুন করবো আমি। বাইরের চত্বর থেকে মিস এলসাও কথাটা শুনলেন। অ্যামিয়াস ক্রেল তারপর আরও খানিকটা রাগারাগির পর ছবি আঁকতে চলে গেলেন এলসাকে নিয়ে।

মনস্তাত্ত্বিকতার বিচারে এতোক্ষণ পর্যন্ত কোনো অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নানারকম গরমিল আসছে তার পরেই।

বিষ চুরি যাওয়ার কথা জেনে মেরিডিথ ব্লেক ভাইকে জানাচ্ছেন। অ্যাল্ডারবেরিতে চলে আসছেন আলোচনা জন্যে। শুনতে পেলেন কামান বাগানের কাছে এসে স্কুলে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাবার ব্যাপার নিয়ে তর্ক চলছে স্বামী স্ত্রীতে। খটকা লাগছে ঐখানেই। মিনিট কুড়ি আগে সামান্য, স্বামী স্ত্রীতে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। খুন করাকরির কথাও উঠেছে। তারপরে কি করে তুচ্ছ ঘরোয়া কথা বলতে স্ত্রী যান।

মেরিডিথের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললোবলি আপনার ভাষাতেই আপনি বলতে শুনেছিলেন অ্যামিয়াসকে, ঠিক হয়ে গেছে সব…আমি দেখবো ওর গোছ-গাছের ব্যাপারটা। তাই না?

হা, ঐ ধরনের কথা বটে, মেরিডিথ বললেন।

 পোয়ারো বলল ফিলিপের দিকে তাকিয়ে-তাই কি শুনেছিলেন আপনিও।

ফিলিপ ভ্রূ-কুঁচকে বললেন, আপনি না বলা পর্যন্ত মনে পড়েনি। কী একটা কথা হয়েছিল গোছ-গাছের।

মিঃ ক্রেল বলেছিলেন–মিসেস ক্রেল কিন্তু নয়?

অ্যামিয়াস বলেছিলো। তবে নিষ্ঠুরতা হবে মেয়েটার ওপর এ ধরনের কথা ক্যারোলিন বলেছিলো। কিন্তু ও নিয়ে এখন কেন আলোচনা হচ্ছে?

পোয়ারো বললো, আপনারা কেন আমার আপত্তির কারণটা দেখতে পাচ্ছেন না? অ্যামিয়াস ক্রেল কেন মেয়েটির গোছ-গাছের ব্যাপার দেখবেন? ঐ কাজটা তো মেয়েদের কাজ, বাড়িতে আছেন মিসেস ক্রেল, গভর্নেস আছেন, অতএব বুঝতে পারছেন তো…?

ফিলিপ অধৈর্য হয়ে বললেন, কি হয়েছে তাতে, খুনের কোনো সম্পর্ক নেই এর সঙ্গে।

 মনে করেন না আপনি?

আর একটা দেখুন ঘটনা…স্বামীকে একটু আগে খুন করে দেবার ভয় দেখান যিনি তিনিই বা কি করে ভার নেন ঠান্ডা বিয়ার পরিবেশন করার?

হঠাৎ মেরিডিথ বলে উঠলেন, মাথায় খুন করার পরিকল্পনা থাকলে ওটাই তো স্বাভাবিক, তাই তো মানুষ করে–গোপন করে মনের ভাব।

আপনি তাই মনে করেন তো? বিষ দেবার ব্যাপারে স্বামীকে মনস্থির করে নিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল। কামান বাগানেই স্বামী বিয়ার রাখে। ঔ বোতলে চাইলে বিষ দিয়ে রাখতে পারতেন নিশ্চয়ই।

আপত্তি জানালেন মেরিডিথ, না করতেন না তা, যদি খেয়ে ফেলে অন্য কেউ?

হ্যাঁ, পারতেন এলসা। আচ্ছা স্বামীকে খুন করার সিদ্ধান্ত আপনার মতে নিয়ে নেবার পর ও কি খুন না করার ব্যাপারে এলসাকে বিবেকের দিক দিয়ে ক্যারোলিন খুব একটা চিন্তা করতেন।

আচ্ছা আলোচনা থাক, এ নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকা যাক প্রকৃত তত্ত্বের মধ্যেই। স্বামীকে ঠান্ডা বিয়ার ক্যারোলিন পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে নিজেই ফিরে গিয়ে নিয়ে এলেন, তাই নয় শুধু স্বামীকে ঢেলে দিলেন নিজের হাতে-ওটা খেয়ে অ্যামিয়াস বলেছিলেন সব কিছুই খেতে আজ খারাপ লাগছে।

তারপর বাড়ির ভেতরে মিসেস ক্রেল চলে যান। লাঞ্চ খান, স্বাভাবিক ছিলেন বেশ। বলা হয়েছে একটু চিন্তান্বিত দেখা গিয়েছিলো তাকে। কোনো লাভ হয় না তাতে আমাদের, কারণ কোনো স্থির মানদণ্ড নেই খুনীর আচরণ সম্বন্ধে শান্তও থাকতে পারে খুনী, আবার হতে পারে উত্তেজিতও।

আবার কামান বাগানে যান খাবার পর, দেখেন গিয়ে স্বামী মৃত…এবং যা ভেবে রেখেছিলেন বলা যেতে পারে তাই হয়েছে দেখে প্রকাশ করেন উত্তেজনা, কথা বলেন ডাক্তার দেখাবার। সবাই তো জানেন এটা? এ ছাড়াও এখন কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে.যদি আপত্তি না থাকে আপনার, পোয়ারো শেষের প্রশ্নটি করলো গভর্নেস মিস উইলিয়ামসকে।

মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মিস উইলিয়ামের, বললেন, কথাটা গোপন রাখার ব্যাপারে কোন চুক্তি তো আমার হয়নি আপনার সঙ্গে। ফলে…।

গভর্নেস আস্তে আস্তে যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি পোয়ারো করলো।

নড়ে উঠলেন এলসা ডিটিশাম। তাকিয়ে থেকে হাঁ করে অবিশ্বাসের সুরে বললেন, ওটা আপনি নিজে দেখেছিলেন?

লাফিয়ে উঠলেন ফিলিপ, তাহলে তো চুকেই গেলো সব।

তার দিকে নিরীহ ভাবে তাকিয়ে বললো পোয়ারো–তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তীক্ষ্ণ গলায় অ্যাঞ্জেলা আপত্তি জানালো, একথাটা আমি বিশ্বাস করি না। তারপর গভর্নেসের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকালো।

উত্তেজিত মেরিডিথ, একমাত্র নির্বিকার মিস উইলিয়ামস বসে আছেন ঘাড় শক্ত করে। না, আমি ওটা নিজের চোখে দেখেছিলাম।

কিন্তু আপনার তো ওটা শুধু মুখের কথা, ধীরে ধীরে বললো পোয়ারো।

হ্যাঁ মুখেরই কথা, আমার কথায় মিঃ পোয়ারো কেউ সন্দেহ করুক আমি এটা পছন্দ করি না।

পোয়ারো মাথা নীচু করে বললো, সন্দেহ করছি না। যা বলেছেন আপনি সেটাই ঘটেছিলো। আর বুঝতে পেরেছি আপনার কথা থেকেই ক্যারোলিন ক্রেল খুনী নয়।

জন ব্যাটারি এই প্রথম মুখ খুললেন–আপনি কেন এ কথা বলছেন মিঃ পোয়ারো জানতে আমি আগ্রহী।

জানাবো নিশ্চয়ই। কি দেখেছিলেন মিস উইলিয়ামসনা, বিয়ারের বোতল থেকে ক্যারোলিন হাতের ছাপ মুছে সাবধানে স্বামীর হাতের ছাপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ারের বোতলে লক্ষ্য করুন। অথচ গ্লাসে কোনাইন ছিলো–বোতলে নয়। বিষ বোতলে ছিলোই না। এবং ক্যারোলিন সে কথা জানতেন না।

স্বামীকে খুন করার অভিযোগ যে মহিলা সম্বন্ধে আনা হচ্ছে, তিনি জানেন না বিষ দেওয়া হয়েছে কীভাবে। বিষ বোতলে ছিল ওঁর ধারণা।

প্রতিবাদ করলেন মেরিডিথ কিন্তু কেন…ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে পোয়ারো বললো, হা…কেন? আত্মহত্যা বলে ব্যাপারটা চালাবার জন্যে কেন মরীয়া হয়ে ঐ চেষ্টা করেছিলেন ক্যারোলিন? খুব সোজা তার উত্তরটা। কারণ জানতেন উনি ওঁর স্বামীকে কে বিষ দিয়েছে এবং তাকে পাছে সবাই সন্দেহ করে তাই বাঁচাবার জন্যে তাকে উনি বাধ্য হয়েছিলেন সব রকম ঝুঁকি নিতে।

এবার চিন্তা করা যাক আরও একটু এগিয়ে গিয়ে। কে হতে পারে সেই ব্যক্তিটি, তিনি কি বাঁচাতে চেয়েছিলেন ফিলিপ বা মেরিডিথকে? না, এলসা গ্ৰীয়ারকে? না সিসিলিয়া উইলিয়ামসকে? না, ক্যারোলিন যে কোনো মূল্যে শুধু একজনকে বাঁচাতে চেয়ে থাকতে পারেন।

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারনকে একটু থেমে পোয়ারো বললো, যদি দিদির চিঠিটা এনে থাকেন তবে দিন, সবাইকে আমি পড়ে শোনাই।

না স্পষ্ট জবাব অ্যাঞ্জেলার, মিঃ পোয়ারো আমি বুঝতে পারছি যে আমিই জামাইবাবুকে আপনার মনে খুন করেছি আর সে কথা দিদি জানতো। আমি এই অভিযোগ অস্বীকার করছি সম্পূর্ণ।

হাত বাড়ালো পোয়ারো, চিঠিটা…?

ওটা আমার চিঠি, আমারই ব্যক্তিগত ভাবে।

পরস্পরের দিকে দু’জন কম বয়সী মেয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন, শেষপর্যন্ত কার্লা লেমারচেন্ট বললেন, অ্যাঞ্জেলা মাসী, মিঃ পোয়ারোর অনুরোধ রাখলে ভালো হয়।

অ্যাঞ্জেলা ঝেঁঝে উঠলেন, কার্লা সত্যি, মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি তোমার। তোমার মা ছিলেন না উনি…তুমি… কি না…।

কেটে কেটে কার্লা পরিষ্কার করে বললো, হ্যাঁ, আমার মা ছিলেন উনি, চিঠিটা পড়া হোক সেই অধিকারেই বলছি।

পোয়ারোকে চিঠিটা দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা বেশ রাগত ভাবেই বললেন, না দেখানোই ভালো ছিলো এটা।

পোয়ারো শেষ চিঠিটা পড়লো ক্যারোলিনের। ধীরে ধীরে ঘরের কোণে অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে আসতে শুরু করেছে। কার্লার হঠাৎ মনে হলো কে যেন ঘরের মধ্যে এসেছে, রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে, শুনছে, নিঃশ্বাস পড়ছে তার, যেন সে অপেক্ষা করছে, মনে হলো ওর উনি এসেছেন এখানে…এখানে এসেছেন আমার মা…এখন ক্যারোলিন এই ঘরের মধ্যে।

হঠাৎ পোয়ারোর কণ্ঠস্বর সেই অদ্ভুত নৈশব্দ ভঙ্গ করে ভেসে এলো, নিশ্চয় আপনারা সবাই একমত হবেন আমার সঙ্গে যে চিঠিটা অদ্ভুত ভারী। সন্দেহ নেই সুন্দর, তবে অদ্ভুতও বটে। এতে বাদ পড়ে গেছে একটা উল্লেখযোগ্য জিনিস–কোনো প্রতিবাদ নেই নিজের অপরাধ সম্বন্ধে।

অ্যাঞ্জেলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন ওখান থেকেই, কোনো দরকার ছিলো না তার। নির্দোষ যে ক্যারোলিন, সে কথা জানাবার কোনো প্রায়োজন তিনি অনুভব করেননি বোনকে, কারণ জানতেন তিনি কেন জানেন প্রকৃত ঘটনাটা। বোনকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিলেন ক্যারোলিন, এবং যাতে ভয় পেয়ে অ্যাঞ্জেলা দোষ স্বীকার করে না ফেলে তাকে তার জন্যে ব্যস্ত রাখতে অন্য চিন্তায়। বারবার উনি একটা কথা লিখেছেন চিঠিতে–ঠিক আছে সব, লক্ষ্মী সোনা ঠিক আছে সব কিছু। অ্যাঞ্জেলা বললেন, কেন বুঝতে পারছেন না? আমি সুখী হই দিদি চাইছিলো।

হ্যাঁ তাই ঠিক। নিজের মেয়ের চেয়েও উনি অনেক বেশি আপনার কথা চিন্তা করেছিলেন। উনি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, মানুষকে তো ঋণ শোধ করতেই হবে।

সব বোঝা যায় এই একটা কথা থেকেই। ক্যারোলিন যে অপরাধ বোধ দীর্ঘকাল ধরে পুষে আসছিলেন মনের মধ্যে, ছোটো বোনের যে ক্ষতি করেছিলেন রাগের চোটে তার ঋণ শোধ করছেন। এবং সেটা করতে পেরে ভীষণ শান্তি পেয়েছিলেন মনে মনে ক্যারোলিন। যেহেতু মনে করেছিলেন তিনি অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তাই অতো বড় অভিযোগকে আদালতে শান্তভাবে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। নিন্দা, ঘৃণা কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি তাকে।

দেখুন এইবার, ক্যারোলিনের সব কাজকর্মের কতটা মিল পাই আমার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে। প্রথমতঃ এমন একটা ঘটনা ঘটে তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় যা মনে পড়িয়ে দিয়েছিলো ক্যারোলিনের কৈশোরের কথা-পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মারা অ্যাঞ্জেলার অ্যামিয়াসকে। ক্যারোলিনও ঐ ধরনের একটা কাজ করেছিলেন, তারপর চিৎকার করে অ্যাঞ্জেলা বলেছিলেন–আমি চাই মরুক অ্যামিয়াস। বিয়ারের বোতল নিয়ে পরদিন সকালে ঘাঁটতে দেখেন অ্যাঞ্জেলাকে। স্মরণ করুন মিস উইলিয়ামসের কথা, ওখানে ছিলো অ্যাঞ্জেলা। মনে হচ্ছিল ওকে অপরাধী…! বলতে চেয়েছিলেন গভর্নো পড়া ফাঁকি দেবার অপরাধে অপরাধী, আর তার অর্থ ছিলো ক্যারোলিনের কাছে অন্য। মনে রাখবেন এটাও অন্ততঃ তার আগে অ্যাঞ্জেলা একবার অ্যামিয়াসের মদের গ্লাসে একটা কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাই ভেবেছিলেন ক্যারোলিন।

ক্যারোলিন, অ্যাঞ্জেলার দেওয়া বোতলটা নিয়ে কামান বাগানে চলে যান। আপনারা তার পরের ঘটনা জানেন।

ক্যারোলিনের মনে তখনও সন্দেহ জাগেনি। লাঞ্চ খাবার পর তলায় গিয়ে ঐ অবস্থায় স্বামীকে দেখে সন্দেহ হয় প্রথমেই কে করতে পারে? …তবে কি অ্যাঞ্জেলা, বোনের সেই অপরাধী মুখটা নিজের কাছে ভেসে উঠলো ক্যারোলিনের মনে। প্রতিশোধ? না, জামাইবাবুর নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ। দিদির সম্বন্ধে ভীষণ খেয়ালী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এই বয়সের মেয়েরা। অতএব বাঁচাতে হবে বোনকে। অ্যাঞ্জেলার আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে মুছে ফেলার জন্যে তাই তিনি অতি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।

ক্যারোলিন তারপরেই অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে ভীত হয়ে উঠেছিলেন, দাদার প্রতি যদি অতি ভালোবাসর ফলে স্বীকার করে নেয় সে দোষ। তাই অ্যাঞ্জেলাকে কোনো গতিকে ইংল্যান্ডের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ক্যারোলিন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়

সত্য

জানলার দিক থেকে ধীরে ধীরে বাকীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ঘৃণা। উনি বললেন। অন্ধ, নির্বোধ সবাই আপনারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না, আমি খুন করলে স্বীকার করতামই। দিদিকে আমার জন্যে কষ্ট পেতে দিতাম না।

পোয়ারো বললো, কিন্তু একটা অবৈধ কিছু বিয়ার নিয়ে আপনি করেছিলেন।

 আমি? কিছু মেশানোর কথা বলছেন বিয়ারে?

পোয়ারো বললো মেরিডিথের দিকে ফিরে, শুনুন মিঃ ব্লেক, পরদিন সকালে আপনি ল্যাবরেটারিতে বলেছিলেন না বেড়াল ঢোকার কথা?

হা, সেটাতো মাত্র একটা বেড়াল।

 জানলেন কি করে সেটা, দেখে ছিলেন কি নিজের চোখে? না, তবে ফাঁক ছিলো যেটুকু জানলা তাতে বেড়াল ঢুকতে বড়ো জোর পারে। পারে না মানুষ।

কিন্তু মিঃ ব্লেক শার্সিটা তো নামাল ওঠানো যায়। তাহলে শুনুন-ধরুন খুনের ঘটনার দিন কেউ আপনার ল্যাবরেটারিতে সকালবেলায় ঢুকছিলো, কেউ যদি অ্যাল্ডারবেরি থেকে এসে থাকেন তবে ফিলিপ, এলসা ক্যারোলিন বা অ্যামিয়াস হবেন না, কারণ ওঁরা তখন কে কি করেছিলেন প্রমাণ আছে তার। দুজনে বাকী থেকে যায়–মিস উইলিয়ামস আর অ্যাঞ্জেলাও যাবেন। বাড়ি থেকে আপনি বেরোতেই দেখা হয়েছিলো মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলাকে উনি নাকি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। অ্যাঞ্জেলা বলছেন সমুদ্রে ঐ সময় স্নান করছিলেন। অথচ ওঁকে মিস উইলিয়ামস জলে দেখতে পাননি। অতএব হতে পারে সাঁতার কেটে অ্যাঞ্জেলা এখানে এসে কিছু নিয়ে যান ল্যাবরেটারি থেকে।

দৃঢ় স্বরে অ্যাঞ্জেলা বললেন, আমি ও ধরনের কিছু করিনি…অন্তত…না…।

বিজয়ীর হাসি হেসে পোয়ারো বলে উঠলো, আজ, তাহলে আপনার মনে পড়েছে দেখছি কথাটা আমায় তো আপনি বলেও ছিলেন একটা বিশ্রী রসিকতা জামাইবাবুর সঙ্গে করার জন্যে আপনি ঐ যাকে বলে বিড়ালের খাদ্য খানিকটা তাই সরিয়ে রাখবেন–মানে…।

ঝট করে মেরিডিথ বলে উঠলেন, ভ্যালেরিয়ান নিশ্চয়ই ভ্যালেরিয়ান।

হা, ঠিক তাই। এবং আপনি সেই জন্যেই বেড়ালের কান্ড মনে করেছিলেন ওটাকে। শব্দ শুনে ল্যাবরেটারিতে নেমে এসে সম্পূর্ণ ভ্যালেরিয়ানের গন্ধ অজান্তেই পেয়ে বিড়ালের কথা স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে পড়েছিলো। ভ্যালেরিয়ান খেতে বেড়াল ভালোবাসলেও, এমনিতে খুব খারাপ ওটার স্বাদ। তারই খানিকটা অ্যাঞ্জেলা জামাইবাবুর বিয়ারের সঙ্গে চেয়েছিলেন মেশাতে…।

আশ্চর্য হয়ে অ্যাঞ্জেলা বলে উঠলেন, ওটা কি ঠিক ঘটেছিলো এই দিনই, এখন মনে পড়ছে ওটা চুরি করার কথা, বিয়ারের বোতলে মেশানোর পর মুহূর্তে দেখেছিলো দিদি আমাকে, সেটাও মনে পড়ছে কিন্তু ঘটনাকে তার সঙ্গে জড়ানোর কথা কখনও চিন্তা করিনি। করবেনই বা কেন…ঐ দুটো ঘটনার মধ্যে আপনার মনে তো কোনো ক্ষোভ ছিলো না। সম্পূর্ণ আলাদা দুটো ঘটনা। একটা ছেলেমানুষী দুষ্টুমি, অন্যটা গভীর ট্রাজেডী। আপনিই অথচ বলেছিলেন, চুরি করেছিলাম আমি ইত্যাদি ইত্যাদি, জামাইবাবুর ড্রিঙ্কের সঙ্গে মেশাবার জন্যে। বললেন যে আপনি তো মিশিয়ে ছিলেন।

বলিনি, তার কারণ আমি ওটা করিনি। যখন খুলছিলাম বোতলের মুখটা এসে যায় দিদি। আহ, আর ভেবে নিলো দিদিও আমি করেছি।

অ্যাঞ্জেলা একটু থেমে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন আবার, সবাই তো আপনারা তাই মনে করেছেন? বিশ্বাস করুন জামাইবাবুকে আমি খুন করিনি। করলে বন্ধ করে থাকতাম না মুখ।

করোনি নিশ্চয়ই বোকারা ছাড়া একমাত্র একথা ভাবতে পারে না কেউ। পোয়ারোর দিকে রেগে তাকালেন মিস উইলিয়ামস।

পোয়ারো খুবই নিরীহ ভাবে বললো, বোকা নই আমি এবং সে কথা আমিও ভাবিনি। কে খুন করেছে অ্যামিয়াস ক্রেলকে আমি তা জানি ভাললাভাবেই।

একটু থামলেন। প্রমাণ করা হয়েছে যে ভাবে ঘটনা বাস্তবে তা না হলে মেনে নেওয়া যায় না কোনো প্রমাণকেই। নেওয়া যাক না কেন অ্যাল্ডারবেরির ঘটনাটাই। সেই চিরাচরিত কাহিনী দুটি মহিলা আর একজনের পুরুষের এটা প্রায় আমরা মেনেই নিয়েছি যে অ্যামিয়াস ক্রেল নিজের স্ত্রীকে অন্য একটি মহিলার জন্যে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। আমি কিন্তু বলছি–তার ওই রকম কোনো ইচ্ছেই ছিলো না।

দুর্বলতা আর মোহ মহিলাদের প্রতি তার বরাবরই ছিলো। কিন্তু চিরস্থায়ী হতো না কোনোটাই। যে সব মহিলার সঙ্গে আগে জড়িয়ে ছিলেন উনি তাদের অভিজ্ঞতা ছিলো কিছুটা, তাই বেশী কিছু অ্যামিয়াসের কাছ থেকে দাবি করতেন না। বয়স কম এবারকার মেয়েটির আশা-আকাঙ্ক্ষাও তার ভিন্নতর। বলি ক্যারোলিনের ভাষাতেই, ভীষণ ভাবে মেয়েটি ছিলো একনিষ্ঠ। কাটাকাটা কথাবার্তা হলে কি হবে, ভয়ংকর একমুখী একটা মন ছিলো ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই অল্পবয়সী মেয়েটির। যেভাবে স্বামীকে ক্যারোলিন ভালোবাসতেন, সেই গভীরতা এই মেয়েটির মধ্যেও দেখে তিনি আশংকিত হয়ে উঠেছিলেন, হয়তো তাকে স্বামী ছেড়ে এই মেয়েটিকে বিয়ে করতেও পারেন।

প্রশ্ন করতে পারেন এবার আপনারা, কেন অ্যামিয়াস ছলনা করবেন না তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। উত্তর আমার-ঐ ছবিটি। উনি চাইছিলেন শেষ করতে ছবিটা।

এই যুক্তিটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে–কিন্তু শিল্পীদের যাঁরা চেনেন, জানেন তারা। এবং প্রমাণ পাওয়া যায় এই কথার অ্যামিয়াস আর মেরিডিথের কথাবার্তা থেকে– অ্যামিয়াস কিছুটা বিব্রত হয়ে মেরিডিথের কাঁধে চাপড়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন–পরে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। একটা ছবি উনি আঁকছেন, দুটি মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলার আবর্তে পড়ে ব্যাঘাত ঘটাতে দিতে রাজী ছিলেন না অ্যামিয়াস শিল্প সৃষ্টিতে। তার কাছে ছবিটাই বড় ছিলো।

সত্যি কথাটা এলসাকে বললে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতো ছবি আঁকা। সেই জন্যে তার কথায় কোনো প্রতিবাদ করতে চাননি। ছবিটা দু-একদিনে হয়ে গেলে সত্যি কথাটা বলা যাবে। কথা দেবার ব্যাপারে মেয়েদের কাছে সহজ যেমন ছিলেন অ্যামিয়াস, তেমনি ভাঙতেও।

প্রথমে এলসাকে ভাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অ্যামিয়াস। তাকে সাবধানও করে দিয়েছিলেন। মেয়েটি কিন্তু পুতুল হয়ে গেলো নিয়তির হাতের। আর অ্যামিয়াস মেয়েদের ব্যাপারে বেশ উদার ছিলেন। এবং এও জানতেন এলসাও ফিরে যাবে মোহ কেটে গেলে।

আসলে স্ত্রী ছাড়া আর কারুর কথা অ্যামিয়াস কখনো গভীরভাবে ভাবেননি। তাকে কখনও মাথা ঘামাতে হয়নি স্ত্রীকে নিয়ে। এলসাকে ভাগাবেন ছবি আঁকাটা হয়ে গেলেই এবং যেমন আছেন নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তেমনি থাকবেন অ্যামিয়াস এই ধরনের ভাব নিয়ে যা খুশি তাই করে যাচ্ছিলেন। ঐ ধরনের মেয়ে ঘটিত ব্যাপারের পর অতীতেও ক্যারোলিন তো ওঁকে ক্ষমা করেছেন।’

কিন্তু মনে হয় আমার অ্যামিয়াস আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় সত্যিই চিন্তায় পড়েছিলেন। হয়তো কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন রাতে ক্যারোলিনকে। যাই হোক সারারাত ছটফট করে কাটাবার পর স্ত্রীকে সত্যি কথাটা বলেন সকালে প্রাতঃরাশের পর। তার মোহ কেটে গেছে এলসার প্রতি। ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না ছবিটা শেষ হলেই।

আর ক্যারোলিন ক্ষেপে গিয়েছিলেন ওই কথা শুনেই, তুমি আর তোমার মেয়ে মানুষগুলো এই কথাটায় এলসাকে আর পাঁচ জন মহিলাদের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো। ক্যারোলিন শেষে এ কথাও বলেছিলেন, একদিন তোমায় আমি খুন করবো।

স্বামীর প্রতি এলসার এই আচরণে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ক্যারোলিন। যখন হলঘরে ফিলিপ ক্যারোলিনকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলেন এ নিষ্ঠুরতা ভারী, তখন কিন্তু এলসার কথা তিনি চিন্তা করছিলেন।

লাইব্রেরী থেকে অ্যামিয়াস বেরিয়ে এসে ডাকলেন এলসাকে শেষ করতে হবে ছবি। জানতেন না উনি লাইব্রেরীর বাইরের দিকের জানলার তলায় বসে স্বামী স্ত্রীর সব কথাগুলো শোনেন এলসা গ্ৰীয়ার। এলসা আলোচনা সম্বন্ধে যা বলেছেন সবটা তার সত্যি নয়।

এবার কল্পনা করুন নিজের সম্বন্ধে স্বকর্ণে নিষ্ঠুর সত্যটা শুনলে কী অবস্থা হয়।

মেরিডিথের ল্যাবরেটরির সামনে আগের দিন বিকেলবেলায় সকলে বেরিয়ে আসছিলে, মেরিডিথ তখন দরজার দিকে পেছন ফিরে মুখোমুখি বসে গল্প করছিলেন এলসার সঙ্গে। তার মানে ক্যারোলিন ঘরের ঘরের ভিতর গল্প করছিলেন এলসা গ্ৰীয়ার পুরোটা দেখেছিলেন।

বিষ চুরি করতে ক্যারোলিনকে দেখেও এলসা কিছু বলেননি। লাইব্রেরীর ঘরের জানলার তলায় বসে স্বামী স্ত্রীর কথা শোনার সময় তার মনে পড়ে যায় ঐ বিষ চুরির কথা।

কামান বাগানে যাবার জন্যে এলসাকে ডাকলেন অ্যামিয়াস। এলসা ঘরে এলেন সোয়েটার আনবার অজুহাত দেখিয়ে। মেয়েদের পক্ষে জানা সহজ মেয়েদের গোপন রাখার জায়গাগুলো, তাই সাবধানে ফাউন্টেন পেনে কালি ভরার ডুপার দিয়ে হাতের দাগ না লাগিয়ে বিষটা বের করে নিয়েছিলেন এলসা।

তারপর কামান বাগানে যথারীতি আসা। এবং বিয়ারের সঙ্গে প্রথম সুযোগেই মিশিয়ে খাইয়ে দিলেন অ্যামিয়াসকে ওটা।

মনে মনে ওদিকে ভীষণ অস্থির ক্যারোলিন, ফিরতে দেখে এলসাকে (এবার সত্যিই গরমজামা সে নিতে এসেছিলেন) কামান বাগানে তাড়াতাড়ি গেলেন। স্বামী যা করতে চাইছেন এলসাকে নিয়ে, তা সম্পূর্ণ অমানবিক আচরণ, উনি সহ্য করতে পারছেন না ক্যারোলিন বললেন। অ্যামিয়াস বাধা পেয়ে ক্ষেপে লাল। জানিয়ে দিলেন পরিষ্কার এলসাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবেন ছবি শেষ হলেই।…ঠিক হয়ে গেছে সব…গোছগাছের ব্যাপারটা ওর, আমি কথা দিচ্ছি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবো ওকে।

এবং ফিলিপ মেরিডিথের পায়ের শব্দ ঠিক সেই মুহূর্তে পেয়ে বেরিয়ে আসেন ক্যারোলিন, মুখ বাঁচাবার জন্যে অ্যাঞ্জেলার কথা বলেন বিড়বিড় করে, যাতে মনে করে সবাই অ্যাঞ্জেলাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিলো। এবং, ওকে আমি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবো। কথাটা হয়ে দাঁড়ালো, আমি দেখবো ওর গোছগাছের ব্যাপারটা।

এই সময় এলসা হাসি হাসি মুখে ফিরছিলেন। শুরু হয়ে গেলো ছবি আঁকাও। ক্যারোলিনের ঘরে কোনাইনের শিশি পাওয়া যাবে ফলে তাকেই যে সবাই সন্দেহ করবে এ বিষয়ে এলসা নিশ্চিন্ত ছিলেন। আরও একটা সুযোগ করে দিলেন ক্যারোলিন নিজেকে জড়াবার।-বাড়ি থেকে ঠান্ডা বিয়ার আনলেন, স্বামীকে ঢেলেও দিলেন।

এক চুমুকে অ্যামিয়াস সবটা খেয়ে বলেছিলেন–সব কিছু আজ বিস্বাদ লাগছে। তার অর্থ ক্যারোলিনের দেওয়া বিয়ারের আগেও কিছু একটা তিনি খেয়েছিলেন এবং তখনও তার খারাপ স্বাদটা মুখে ছিলো। ফিলিপ ব্লেক আর একটা কথা অ্যামিয়াসের পা টলার কথা বলেছেন। তার মানে আস্তে আস্তে আগে খাওয়া কোনাইনের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

অসুস্থতাকে ঘৃণা করতেন অ্যামিয়াস, তাই শরীর খারাপ ভেতরে ভেতরে শুরু করা সত্ত্বেও কিছুই বললেন না মুখে।

ঘণ্টা পড়লো খাবার, যেটুকু বিষ কাছে ছিলো তাড়াতাড়ি করে তা অ্যামিয়াসের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে চলে গেলেন এলসা।

(নিশ্চয়ই কোথাও ড্রপারটাকে পথে ফেলে দেন।)

 ছায়ার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসায় মেরিডিথ শুধু চোখধাঁধানো আলো দেখতে পাচ্ছিলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে বন্ধু হাত-ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এবং এক অসাধারণ তীব্রতা চোখের দৃষ্টিতে।

কিছু কি বুঝতে পেরেছিলেন অ্যামিয়াস! কি ছিলো মনে জানি না, তবে মিথ্যে বলেনি চোখ আর ঝুলে পড়া হাত।

পোয়ালরা দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো ছবিটা দেখিয়ে বললো, এই ছবিটা সম্পর্কে বোঝা উচিত ছিলো আমার, কারণ অসাধারণ ছবিটা–নিহত মানুষটি এঁকেছেন তাঁর নিজের খুনীর ছবি। এটা একটা ছবি যাতে তার প্রেমিককে মেয়েটি মরতে দেখছে।

.

পঞ্চম অধ্যায়

পরিণাম

এক ভয়াবহ হিমশীতল নিস্তব্ধতা নেমে এলো এর পরেই। ঘরের মানুষের মাথাগুলো শুধু বোঝা যাচ্ছিলো অস্তগামী সূর্যের শেষ ক্ষীণ আলোয়।

একটু নড়েচড়ে বসে এলসা ডিটিশাম বললেন, মেরিডিথ বাইরে নিয়ে যান ওদের। আমি একটু একা থাকতে চাই মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে।

এলসা সবাই চলে যাবার পর বললেন, খুব চালাক আপনি, মিঃ পোয়ারো তাই না?

 উত্তর দিলো পোয়ারা, না। আবার এলসা বললেন, আপনি কি চান? স্বীকারোক্তি?

হা–পোয়ারো মাথা নেড়ে জানালো।

আমি সেরকম কিছুই করবো না। দুজনে এখানে বসে যা বলবো একান্তভাবে এটা আমাদের মুখের কথা হবে।

ঠিক তাই।

 আপনি কি করতে চান আমি তা জানতে চাই।

পোয়ারো বললো, আমি আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করবো কর্তৃপক্ষকে ক্যারোলিন ক্রেলকে মরণোত্তর রায়দানে ঘোষণা করা হোক নিরপরাধ।

এলসা বললেন-কি আশ্চর্য নিরপরাধ ঘোষণা করতে হবে অপরাধ না করা সত্ত্বেও? …যাই হোক কি ভাবছেন আমার ব্যাপারে?

আমার সিদ্ধান্ত জানাবো উপযুক্ত লোকেদের সামনে তারপর যা করবেন তারা। তবে আপনার বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রমাণ নেই আমার হাতে, শুধু তো অনুমানে কিছু করা যায় না। তাছাড়া বর্তমান মর্যাদার কথা আপনার চিন্তা করে কিছু করতে সাহস পাবে কিনা পুলিশ বলা যায় না।

পরোয়াও করি না আমি। জীবনের জন্যে লড়তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভালোই লাগবে আমার।

 হয়তো আপনার স্বামীর ভালো লাগবে না।

স্বামীর জন্যে চিন্তা করবো আপনি কি মনে করেন?

না মনে করি না তা। কারণ আপনি শুধু নিজেকে ছাড়া সারা জীবনে আর কারুর কথাই তো চিন্তা করলেন না গভীর ভাবে। হয়তো খুশি হতেন করলে।

আমার জন্যে আপনি এতো কেন চিন্তা করছেন?

এই জন্যে বাছা, অনেক কিছু শেখা তোমার বাকী আছে।

আবার কী বাকী আছে শেখার?

 দয়া, মমতা, সহানুভূতি…শিখতে হবে এগুলো। শুধু দুটো জিনিস তুমি জানো প্রেম, ঘৃণা।

বিষ চুরি করতে ক্যারোলিনকে দেখে ভেবেছিলাম ও চায় আত্মহত্যা করতে। কিন্তু পরদিন আমি পেলাম স্বামী-স্ত্রীর কথা শোনার পর। আমাকে তাড়িয়ে দেবে অ্যামিয়াস ছবি আঁকা হয়ে গেলেই। এবং আমার জন্যে ক্যারোলিন দুঃখ প্রকাশ করলো। সহানুভূতির ওর কাছ থেকে পেতে ঘৃণা করি। ফলে অ্যামিয়াসকে বিষ খাওয়ালাম। ওকে তিল তিল করে চোখের সামনে মরতে দেখে কি উল্লাস আমার হয়েছিলো তা বোঝাতে পারবো না…আমিয়াস মরছে দেখলাম।

হঠাৎ হতাশায় হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে এলসা বললেন, তখন আমি বুঝিনি যে নিজেকে আমি খুন করছি…ওকে নয়। …তারপর ফাঁদে পড়লো ক্যারোলিন…ভাল হলো না সেটাও। ওকে আঘাত দিতে পারলাম না ঠিক মতো…ও বোধ হয় আমার নাগাল ফসকে গেলো। এমন জগতে ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াস দুজনে চলে গেলো যেখানে ওদের ধরতে পারি না আমি। কিন্তু মরলো না ওরা, আমি মরলাম।

উঠে দাঁড়ালেন এলসা ডিটিশাম। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার আমি মরলাম।

সদ্য ফুটে উঠতে শুরু করছে হলঘরে এমন দুজন যুবক-যুবতীর পাশ দিয়ে চলে গেলেন উনি।

গাড়ির দরজা শোফার খুলে দিলো। গাড়িতে বসলেন লেডী ডিটিশাম। ফারের কম্বল দিয়ে শোফার পা ঢেকে দিলো।