১.২ ছোট্ট শূয়োর ছানাটা

ষষ্ঠ অধ্যায়

বাজারে গিয়েছিল এই ছোট্ট শূয়োর ছানাটা…

 ফিলিপ ব্লেকের চেহারা হুবহু মিলে গেলো স্যার মন্টেগুর দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে। বেশ ধনী, ধূর্ত, হাসিখুশি মানুষ শুরু করেছেন একটু মোটা হতে।

সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় শনিবার দেখা করার সময় এরকুল পোয়ারো ঠিক করেছিলো। গলফ খেলছিলেন ফিলিপ বাজী রেখে বন্ধুর সঙ্গে। বল ফেলা হয়ে গেছে ১৮নং গর্তে, বলা যায়। পাঁচ পাউণ্ড জিতে ফেলেছেন, ফলে বেশ প্রসন্ন মন মেজাজ।

নিজের পরিচয় দিয়ে পোয়োরো উদ্দেশ্যটা জানালো দেখা করার। অবশ্য তার কৌতূহল আজ তত তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না।

হায় ভগবান, আবার এতদিন পরে এসব কেন?

এখানে খুব বেশি পাত্তা পাবে না তা পোয়ারো জানে। তাই হাল্কা করে বললো, মানুষের এটাই তো স্বভাব। এই আমি বা আপনি, যারা আমরা জগৎটাকে চিনি মানুষ সম্বন্ধে কোন মোহ নেই আমাদের মধ্যে, ভ্রান্ত ধারণা নেই। সবাই তো আর খারাপ লোক নয়, সবাইকে তো সেই সঙ্গে আবার আদর্শরূপ বলে দেখানো যায় না।

ফিলিপ বেশ খুশি মনে বললেন, আমি বহুদিন আগেই মোহ বিসর্জন দিয়েছি।

আর শুনেছি খুব সুন্দর নাকি আপনি গল্প বলেন।

 আনন্দে চক চক করে উঠলো ফিলিপ ব্লেকের চোখ, তাও শুনেছেন?

পোয়ারো উত্তরে মাপা হাসি হাসলেন, বেশ আরাম করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ফিলিপ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে।

হঠাৎ মনে হলো পোয়ারোর এক আত্মপরিতৃপ্ত শূয়োর ছানার মতো দেখাচ্ছে ফিলিপকে বাজারে গিয়েছিলো এই ছোট শূয়োর ছানাটি…।

এই ফিলিপ ব্লেক কেমন মানুষ? একটা এমন মানুষ যার ভাবনা চিন্তা নেই কোনো, অবস্থাপন্ন, সুখী, কিছুই নেই দুঃশ্চিন্তা বলতে। বিবেকের তাড়না নেই অতীতের কোনো ব্যাপারে, এ যেন পেট পুরে খাওয়া একটা শূয়োর ছানা যে বাজারে গেছে–এবং দামটা পুরো উসুল করেছে…।

ফিলিপ ব্লেকের তো এককালে আরো অনেক কিছু থেকে থাকতে পারতো। নিশ্চয়ই আরও দেখতে সুন্দর ছিলো বয়সকালে। হয়তো একটু ছোট চোখটা, কিন্তু ওটা মানিয়ে যেতে পারে ভালো স্বাস্থ্যের যুবকের ক্ষেত্রে। এখন পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে ফিলিপের বয়স। তার মানে তখন বয়স ছিলো চল্লিশ-এর কোঠায়। যৌবনের তখন অনেক দাবী, সব সময় সবগুলো যে মিটতো তাও নয়…

যে সব চালু কথা দিয়ে কথা শুরু করতে হয় সেই ভাবে বললো পোয়ারো, আপনি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন…।

না, বুঝতে পারছি না সত্যি বলছি। এত লোক থাকতে আপনি কেন? আপনি লেখক?

 না তা ঠিক নয়…মানে একজন গোয়েন্দা আমি। এর আগে এমন বিনীত ভাবে কখনো কথা বলেছে কিনা সন্দেহ পোয়ারো।

আমরা সবাই সে কথা জানি, বিখ্যাত এরকুল পোয়ারো।

প্রশংসার ফাঁকে ফিলিপ ব্লেকের কথায় কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গের হুল লুকানো ছিল। একটু বিরক্ত হলো পোয়ারো, জীবনে সাফল্য অর্জন করেছে বলে এই মানুষটা এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না তেমন। এতো অপমান চূড়ান্ত।

পোয়ারো কৃত্রিম কৃতজ্ঞতার মুখোশ এঁটে বললো, খুব খুশি হলাম আমি এই জেনে যে আমাকে চেনেন আপনি। আমার সাফল্যের মূলে আছে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি এক অদ্ভুত মনঃস্তত্ত্ব–সেই অনন্ত প্রশ্ন মানুষের আচরণ সম্পর্কে কেন? মিঃ ব্লেক জানেন এখন প্রধান হয়ে উঠেছে বর্তমান জগতে অপরাধের মূলে এই প্রশ্নটিই। আগে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার ছিলো এটা। বিখ্যাত অপরাধের কাহিনীগুলোর পুনরাবৃত্তি করা হতো আগেকার যুগে একটি মাত্র দৃষ্টিকোণের বিচারে স্নেহের ব্যাপারটা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এখন পাল্টে গেছে কিন্তু। এখন দেখা যায় ভীষণ অহংকারী স্ত্রী, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে স্বামীকে, তাই হীনম্মন্যতার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে স্বামী-স্ত্রীকে খুন করে। খুন করেছে একটি মেয়ে তার বাবাকে, কারণ মেয়েটি তিন বছর বয়সে দারুণ বকুনী খেয়েছিলো তার বাবার কাছে। আর আমি সেই জন্যই বলছিলাম কি খুব বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে এ যুগে অপরাধের মূল কারণটাই।

ফিলিপ ব্লেক ছোট্ট একটু হাই তুলে বললেন, অপরাধের বেশির ভাগ কারণটা তো বোঝা যায় স্পষ্ট, আমার মতে আসল কারণ হলো টাকা পয়সা।

চেঁচিয়ে উঠলো পোয়ারো, আঃ। বলেন যে কি মশাই, কারণটা স্পষ্ট বোঝা যায় না কখনই আর আসল ব্যাপার হলো সেটাই।

আর আপনার বিশেষত্ব সেখানেই?

মিঃ ব্লেক ঠিক ধরেছেন, আমার বিশেষত্ব ওইখানেই। অতীতের অপরাধ কাহিনীগুলোকে মনঃস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ দিয়ে নতুন করে লেখা উচিত। মনঃস্তত্ত্বই হলো অপরাধে আমার বিশেষত্ব। আর আমি স্বীকার করে নিয়েছি সেই দায়িত্বটা।

আশাকরি এতে আমদানী ভালোই হয়। ফিলিপ ব্লেক হাসির ভাব দেখালেন দাঁত চেপে।

হয় মনে হয়…নিশ্চয়ই হয়…রইলো অভিনন্দন। আচ্ছা এবার এর মধ্যে আসি কি করে আমি বলুন তো?

বলবো নিশ্চয়ই। ক্রেল মামলার ব্যাপারটায়।

ফিলিপ ব্লেক কথাটা শুনে একটুও চমকে উঠলেন না, বরং বললেন, চিন্তার সুরে, ও হ্যাঁ। …ক্রেল মামলা…।

পোয়ারো উদ্বেগের সঙ্গে বললো, মিঃ ব্লেক খুব অসন্তুষ্ট হচ্ছেন না তো আপনি?

ওই…ওই ব্যাপারে, ফিলিপ ব্লেক কাধ ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন, না, মানুষের যে ব্যাপারে কোনো হাত নেই, সে সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হওয়ার। প্রকাশ্য ব্যাপার তা ক্যারোলিন ক্রেলের মামলা, ওটা যে কেউ নিয়ে লিখতে পারে। তাতে কোনো আপত্তি করবার কারণ আমার থাকতে পারে না। ব্যাপারটা আমি খুবই অপছন্দ করি তা আপনাকে বলতে আমার আপত্তি নেই, আমার বিশেষ বন্ধু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল। আমার খারাপ লাগবে পুরো ব্যাপারটা নতুন করে খুঁচিয়ে তুলতে কিন্তু আর কি করা যায়? অহরহ তো ঘটছেই এসব।

মিঃ ব্লেক আপনি দেখছি কথা বলছেন দার্শনিকের মতো?

না। না। খোঁচা খেলেই যে পাল্টা আঘাত দিতে হয় আমি এটা মানি না। তবে অন্যদের মতো আপনি ততো খারাপ কিছু করবেন না তা আমার বিশ্বাস।

রেখে ঢেকে যতোখানি সম্ভব ভদ্রভাবে লেখা যায় নিশ্চয়ই ততোটা করবো, আশা রাখি।

হো হো করে ফিলিপ ব্লেক হেসে উঠলেন, আর সত্যিকারের প্রাণের ছোঁয়া তাতে ছিলো না, হাসি আর চাপতে পারছি না আপনার কথা শুনে।

কিন্তু মিঃ ব্লেক ব্যাপারটা সম্বন্ধে সত্যি বলছি আমি আগ্রহী, টাকাকড়ির ব্যাপার নয় এটা শুধু। আমি নতুন করে গড়তে চাই অতীতের ঘটনাকে, যা ঘটেছিলো আঁকতে চাই তার আসল রূপটা। অন্তরালে যা কিছু ছিলো সবার সামনে সেগুলো তুলে ধরতে চাই…।

বললেন ফিলিপ ব্লেক, কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার এর মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয় না। খুবই স্থল, পারিবারিক ঈর্ষা ব্যাপারটা। আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলো ব্যাপারটা সম্বন্ধে সেটা জানতে পারলে মিঃ ব্লেক আমি ভীষণ খুশি হবো।

ফিলিপ হঠাৎ রেগে উঠলেন, লাল হয়ে গেলো মুখ চোখ, প্রতিক্রিয়া! প্রতিক্রিয়া! দয়া করে অতসব গাল ভরা কথা বলবেন না। তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে আমি দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিক্রিয়া নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে দিতে পারি না, সে সময় বা মনোভাব তখন ছিলো না আমার। মশাই আপনি বুঝতে পারছেন না, খুন হচ্ছে আমার বন্ধু–তাকে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে, যদি একটু তৎপর আমি থাকতাম তাহলে বোধ হয় বাঁচাতে পারতাম তাকে।

মিঃ ব্লেক কেন একথা বলছেন আপনি।

এই জন্যে বলছি যে ধরে নিচ্ছি আমি আপনি ইতিমধ্যে এই মামলার খবরাখবর পড়ে নিয়েছেন।..যদি তা হয় শুনুন আমার দাদা মেরিডিথ ঐ দিন সকালে ফোন করে আমাকে জানান যে, যে সব গাছ-গাছড়া নিয়ে উনি গবেষণা করেন তার মধ্যে খুবই মারাত্মক একটা রস এবং তার ল্যাবরেটারি থেকে সেই রকম চুরি গেছে একটা বিষ। দাদাকে আমি আসতে বললাম, আলোচনা সামনে বসে করে যা করলে ভালো হয় সবচেয়ে তাই করা যাবে। মিঃ পোয়ারো কী রকম নির্বোধের মতো কাজ করেছিলাম বুঝতে পারছেন তো, সঙ্গে সঙ্গে আমার তো অ্যামিয়াসকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিলো। দাদার ল্যাবরেটরি থেকে ক্যারোলিন মারাত্মক বিষ চুরি করেছে, অতএব তুমি আর এলসা সাবধান হও নিজেদের ব্যাপারে।

ফিলিপ ব্লেক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন, পায়চারি করতে করতে বললেন, কী ভাবছেন মশাই এ ব্যাপারটা নিয়ে? আপনার কি ধারণা আমি চিন্তা করিনি? আমি জানতাম, আমার ওকে বাঁচাবার সুযোগ ছিলো। তা না করে অকারণে দাদার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইলাম। চুরি করেছে বিটা ক্যারোলিন, এবং ওটাকে কাজে লাগাবেই সে দেরী না করে। আর ঠিক হলোও তাই। ক্যারোলিন প্রথম সুযোগেই কাজ সেরে ফেললো। জানতাম আমি জানতাম যে বেশ বিপদ ঘনিয়ে আসছে অ্যামিয়াসের, অথচ আমি কিছুই করিনি…।

মিঃ ব্লেক অযথা দোষ দিচ্ছেন নিজেকে, আপনার হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো না…।

 ফিলিপ মাঝপথে বাঁধা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো। বলতে পারতাম অ্যামিয়াসের কাছে গিয়ে, অবশ্য ও হয়তো বিশ্বাস করতো না। হেসে উড়িয়ে দিতো নিজের বিপদের কথা উঠলে। কত বড় যে শয়তান ছিলো ক্যারোলিন একথা কোনোদিনও বুঝতে পারেনি অ্যামিয়াস। বোঝার চেষ্টাও করেনি। অবশ্য আমি ক্যারোলিনের কাছে গিয়েও বলতে পারতাম কোনাইন চুরি গেছে দাদার ল্যাবরেটরি থেকে, যদি অ্যামিয়াস বা এলসা কেউ মরে তবে কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না ফঁসীর দড়ি থেকে, কাজ হতে পারতো এতে। তাছাড়া জানিয়ে দেওয়া যেত পুলিশকেও যে চুরি গেছে বিষ। করা যেতো অনেক কিছুই। শুধু করা যায়নি দাদার জন্যে। বাড়ির বড় ছেলে দাদা। পেয়ে গিয়েছিলো বেশ খানিকটা সম্পত্তিও, কুঁড়েমি আর নড়বড়ে ভাব সব কাজে। এই ঘটনাটা ঘটে গেলো দাদা দেরী করলো বলেই।

আপনার মনে তাহলে একটুও সন্দেহ নেই যে কে চুরি করেছিলো বিষটা? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

নিশ্চয়ই না এটা ক্যারোলিনের কাজ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি যে খুব ভালোভাবে ক্যারোলিনকে চিনি।

ব্যাপারটা ভারী ইন্টারেস্টিং তো। কি ধরনের মহিলা ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল একটু বলবেন কি মিঃ ব্লেক?

লোকে মনে করেছিলো মামলা চলার সময় ও একটা নিষ্পাপ মহিলা অকারণে আঘাত পাওয়া। কিন্তু ওরকম আদৌ ক্যারোলিন ছিলো না।

তাহলে উনি কেমন ছিলেন?

 ফিলিপ তীক্ষ্ণভাবে বললেন, আপনি কি সত্যি সত্যিই জানতে চান তা?

অবশ্যই।

সম্পূর্ণ বিকৃত চরিত্রের এক মেয়ে মানুষ ছিলো ক্যারোলিন। ওর ব্যবহার সুন্দর ছিলো মনে রাখবেন। এমন একটা মিষ্টিভাব ছিলো ব্যবহারে সবাই যাতে প্রতারিত হয়। এমন একটা হতাশার ভাব চোখের দৃষ্টিতে ফুটে থাকতো যে সাহায্য করতে সহানুভূতি জানাতে ওকে সবাই ছুটে আসতো আগবাড়িয়ে। ইতিহাস তো এককালে পড়েছিলাম, মেরী, কুইন অফ স্কট মনে হয় ঐ ধরনের মহিলা ছিলেন। সব সময়ে স্বভাবে মধুর বাইরে থেকে। আকর্ষণ চুম্বকের মতো অথচ যেন জড়িয়ে আছে দুর্ভাগ্য এবং ঠান্ডা মাথায় ভেতরে ভেতরে ফন্দী এঁটে চলেছে। কাকে কিভাবে সরিয়ে ফেলা যায়। তাই করেছিলো ক্যারোলিনও প্রচণ্ড বদ স্বভাবের দিক দিয়ে।

ওরা আপনাকে বলেছে কিনা জানি না আমি, তবে প্রশ্নটা মামলা চলার সময় ভীষণ গুরুত্ব পেয়েছিলো–আগে যা বলেছিলো বোনের সঙ্গে ক্যারোলিন তার কথা বলছি। প্রচণ্ড ঈর্ষা আবার বিয়ে করেন ক্যারোলিনের মা, ওর মায়ের অসাধারণ টান দেখে ছোট্ট অ্যাঞ্জেলার ওপর সহ্য করতে পারেনি, ভেঙে দিতে চেয়েছিলো মাথাটা একটা শাবল দিয়ে খুব জোরে লাগেনি ভাগ্য ভালো। বলুন তো কি ভয়ংকর ব্যাপার?

তা তো বটেই, মাথা নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। বুঝলেন, আসল ক্যারোলিন হলো এই। ওকে প্রথম হতে হবে সব ব্যাপারেই। ও কিছুতেই পিছিয়ে থাকতে রাজী নয়। একটা আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী শয়তান ওর মধ্যে বাসা বেধেছিলো, ওই পরিণতি তারই।

আবেগপ্রবণ একটু দেখালেও, ও ছিলো ভেতরে ভেতরে দারুণ হিসেবী। ও যখন কম বয়সে অ্যাল্ডারবেরিতে থাকতো তখন সবাইকে আমাদের একবার করে বাজিয়ে নেবার পর ঠিক করেছিলো নিজের প্ল্যান, তখন কোনো টাকা পয়সা ওর ছিলো না। ওর পেছনে অবশ্য আমি কখনই ছুটিনি। বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে তখন আমি তৈরি করতে ব্যস্ত নিজের পথ। (মজার ব্যাপার এই যে আমি এখন মেরিডিথ এবং বেঁচে থাকলে অ্যামিয়াসকেও সামর্থ্য রাখি কিনে নেবার।) মেরিডিথকে প্রথমে বাছলেও ক্যারোলিন বিয়ে করলো শেষ পর্যন্ত অ্যামিয়াসকে। এমনি টাকা পয়সা অ্যাল্ডারবেরি ছাড়া বেশি না থাকলেও অ্যামিয়াস শিল্পী হিসেবে যে নাম করবে এতে ক্যারোলিনের সন্দেহ ছিলো না, জুয়া খেলতে বসে ভাগ্য নিয়ে? ক্যারোলিন অবশ্যই জিতেছিলো, কারণ অ্যামিয়াস পরে অর্থ উপার্জন করে প্রচুর।

অ্যামিয়াস অর্থ এবং প্রতিভার স্বীকৃতি দুটোই পায়। ছবি ওর বিক্রি হতো। আচ্ছা আপনি কি ওর কোনো ছবি দেখেছেন? …আসুন, একটা আছে ওখানে।

ফিলিপ একটা ছবি দেখালেন খাবার ঘরে গিয়ে বাঁদিকের দেওয়ালে যা ঝোলানো ছিলো। আঁকাটা গতানুগতিক। একটা পালিশ করা মেহগিনি কাঠের টেবিলের ওপর রাখা পাত্রে গোলাপফুল। অদ্ভুত রঙ আর কি ব্যবহার তুলির। যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা গোলাপের গুচ্ছ। তার ছায়া পড়েছে কাঠের পালিশের ওপর। যেন প্রাণের আবেগের স্পর্শে পুরো জিনিসিটাই থরথর করে কাঁপছে।

অনেকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে পোয়ারো ফিরে এলো বসবার ঘরে।

আমি আদৌ ছবিটবি বুঝি না তবে এই ছবিটাকে কি জানি আমি ভীষণ দেখি, দারুণ, অসাধারণ ভাললা…। যেন আপন মনে ফিলিপ ব্লেক বললেন।

স্বীকার করলো পোয়ারো, সত্যিই অসাধারণ। তারপর সিগারেট ধরালেন দুজনে।

এবং এই সেই অসাধারণ শিল্পী…এই গোলাপের ছবি যে এঁকেছিলো, কয়েকটা আরও বিখ্যাত ছবি সৃষ্টি করেছিলো–এমন অকাল মৃত্যু কিনা তার? শেষ পর্যন্ত ওর মতো প্রাণবন্ত শিল্পী কিনা ঈর্ষা আর হিংসার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে গেলো…।

আমি খুব কড়াকড়ি কথা বলছি আপনি বলবেন–বলবেন আমি অকারণে অকরুণ হচ্ছি ক্যারোলিনের প্রতি। ওর ছিলো মোহিনী শক্তি সেটা আমি নিজেই অনুভব করেছি। তবে সূক্ষ্ম আবরণের আড়ালে তার যে আসল একটা কুটিল নিষ্ঠুর মন লুকিয়ে আছে আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম…।

হঠাৎ পোয়ারো বলে উঠলো, অথচ বলা হয়েছে আমাকে যে ক্যারোলিনের বিবাহিত জীবনে ক্রেলকে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলা?

ঠিক তাই, আর ঠিক এটাও যে সবাইকে সে কথা জানাতেও ক্যারোলিন কসুর করেনি। সে যেন সব সময়েই শহীদের ভূমিকা নিয়ে থাকতো। বেচারি অ্যামিয়াস, নরকের মতো ছিলো ওর বিবাহিত জীবন, অসাধারণ শিল্প প্রতিভা ছবি আঁকার মতো না থাকলে হয়তো ও পাগল হয়ে যেতো। অ্যামিয়াস তার মুক্তি শিল্প সৃষ্টির মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলো। যখন ও ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে যেতো তখন ওকে স্পর্শ করতে পারতো না সাংসারিক কোনো কিছুই। চেঁচামেচি ঝগড়া-ঝাটি ক্যারোলিনের সব কিছুকেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে সপে দিতো ছবির মধ্যে। আর ঝগড়া? সাতদিন তো সপ্তাহে হতোই। ক্যারোলিন ওতে আনন্দ পেতো। ক্যারোলিন প্রতিবার ঝগড়ার পর পুঁদ হয়ে থাকতো এক অনাস্বাদিত তৃপ্তির মধ্যে। আর যেন অ্যামিয়াস নিজের মধ্যে থাকতে পারতো না, বিশৃঙ্খলায় ভরে যেতো সব কিছু। শান্তি চাইতো ও, তার বদলে পেতো শুধু অশান্তিতে ভরা জীবন যা কিনা অকারণে তৈরি করা। উচিতই ছিলো না ওর মতো মানুষের বিয়ে করা। বিয়ের বাঁধনে ধরা দেওয়া এই ধরনের শিল্পীদের উচিত নয়।

আপনি কি এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানতেন?

মিঃ পোয়ারো দেখুন ও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। আর অভিযোগ করার, এসব ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে না, সবই দেখা যায় চোখ থাকলে। তাছাড়া অ্যামিয়াসের লাগানো স্বভাব ছিলো না। তবে মাঝে মাঝে বলতো, যতো নষ্টের গোড়া এই মেয়ে মানুষগুলোই কিংবা; বিয়ে কোরো না ভুলেও, নরক এর থেকে অনেক ভালো।

আপনি কি এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানতেন?

হ্যাঁ, এটা বুঝতে পারতাম যে ক্রমশঃ ওরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এক অসাধারণ সুন্দর মেয়ের সঙ্গে ও বলেছিলো ওর আলাপ হয়েছে। এর আগে এই ধরনের মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি ওর। ওর কথায় আমি যে গুরুত্ব দিতাম তা নয়, কারণ মাঝে মাঝে ও এই ধরনের কথা বলতো। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে এই ধরনের অসাধারণ মহিলার পরিচয় ঘটতো।

আবার মাসখানেক পরে হাঁ করে চেয়ে থাকতো অ্যামিয়াস সেই মেয়েটির কথা তুললে কারণ সে ভুলে বসে আছে ইতিমধ্যে। তবে সত্যিই অন্য ধরনের মেয়ে ছিল এলসা গ্ৰীয়ার, যখন আমি কিছুদিন অ্যাল্ডারবেরিতে কাটাতে এসেছিলাম, তখন দেখা হয় ওর সঙ্গে এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম অসাধারণ মেয়ে। অ্যামিয়াসকে মেয়েটা ভালোমতোই ফেলেছিলো গেঁথে।

তাহলে এলসা গ্ৰীয়ারকেও দেখছি পছন্দ হয়নি আপনার, বললো পোয়ারো।

পছন্দ হয়নি। পুরোদস্তুর শিকারী মেয়ে ও, একেবারে গ্রাস করে নিতে চেয়েছিলো অ্যামিয়াসকে। তবে আমার মতে এলসা মেয়েটা অনেক ভালো হতো অ্যামিয়াসের জীবনে ক্যারোলিনের তুলনায়। আর ঠিক এটাও নিজেকে না জড়ানোই ভালো হতো মেয়েদের ব্যাপারে আমার বন্ধুর পক্ষে। অথচ ঐ ভুলই করে এসেছিলো ও বার বার। অবশ্য অন্য কোনো মহিলা এলসা আর ক্যারোলিন ছাড়া তেমনভাবে জীবনে ছাপ ফেলতে পারেনি অ্যামিয়াসের জীবনে।

জানতে চাইলো পোয়ারো তার মেয়েকে অ্যামিয়াস ভালোবাসতেন কিনা।

অ্যাঞ্জেলাকে? আহ। অ্যাঞ্জেলাকে সবাই আমরা ভালোবাসতাম। দারুণ ফুটফুটে মেয়ে। রোজ ওর গভর্নেসের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতো। হ্যাঁ, অ্যাঞ্জেলাকে ভালোবাসতো অ্যামিয়াসও তবে রেগে যেতো খুব বাড়াবাড়ি করলে। আর কি আশ্চর্য ক্যারোলিন এসে তখন অ্যাঞ্জেলাকে আড়াল করে দাঁড়াতো। ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াসের মধ্যে তাই নিয়ে মাঝে মাঝে মন কষাকষি হতো। আবার খবরদারী খুব বেশি করতো বলে অ্যাঞ্জেলাও আমিয়াসের ওপর চটে থাকতো। ঐ বছরের শরৎকালে অ্যামিয়াস নিজে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, ফলে আরও ক্ষেপে ওঠে মেয়েটা। মেয়েটা স্কুলে যেতে ভালোবাসত না তা নয়, কিন্তু অ্যামিয়াস যেভাবে জোর করে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাচ্ছিলো, তার ফলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মেয়েটা। অ্যাঞ্জেলা বদলা নেবার জন্য নানারকম বদমাইসিও করছিলো। মেয়েটাকে সামলানো যাচ্ছে না গভর্নেস সিসিলিয়াও বলেছিলেন।

পোয়ারো বললো ফিলিপ একটু থামতেই, জানতে চেয়েছিলাম আমি তার মেয়েকে অ্যামিয়াস ভালোবাসতেন কিনা, মেয়ে বলতে তার নিজের মেয়ের কথা আমি বলছিলাম।

ও। আপনি কার্লার কথা বলছিলেন, ওকে ভীষণ ভালোবাসতো। ভালো মেজাজ থাকলে মেয়ের সঙ্গে খুব খেলতো। তবে যদি আপনি ভেবে থাকেন তেমন ভালোবাসলে মেয়েকে এলসাকে আটকাতো বিয়ে করাটা? না, অ্যামিয়াস মেয়েকে তেমনভাবে ভালোবাসতো না।

আচ্ছা ক্যারোলিন ক্রেল কি ভালোবাসতো তার মেয়েকে?

ঠোঁট বেঁকালেন ফিলিপ ব্লেক, মা হিসেবে ক্যারোলিন ভালো ছিলো না একথা বলছি না। না, বলতে পারি না সেকথা। তবে একটা ব্যাপার…।

মিঃ ব্লেক, বলুন?

ফিলিপ ব্লেক যেন বেশ কষ্ট করে বললেন, আমার আজও দুঃখ হয় একটা ব্যাপারের জন্যে, সেই বাচ্চা মেয়েটাও রকম একটা দুর্ঘটনার মুখে অতো অল্প বয়সে তাকে পড়তে হয়েছিলো। ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো অ্যামিয়াসের মাসতুতো বোনের কাছে। আশাকরি আসল ঘটনাটা নিশ্চয়ই ওর কাছে লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন মাসী আর মেসোমশাইরা।

মাথা নাড়লো পোয়ারো, একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে সত্যের, সে কখনও লুকিয়ে রাখতে পারে না নিজেকে। বহু বছর পরেও না।

ধীরে ধীরে ফিলিপ বললেন, আশ্চর্যের ব্যাপার।

নিজের কথার সূত্র ধরে পোয়ারো বলতে লাগলো, সত্যের খাতিরে মিঃ ব্লেক আমি একটা কাজ করতে বলছি আপনাকে।

কি কাজ?

বিনীত প্রার্থনা আমার তখন যা যা ঘটছিলো অ্যাল্ডারবেরিতে তার একটা সঠিক বিবরণ আমায় লিখে দিন আপনি। অর্থাৎ খুন আর খুনের আনুষঙ্গিক বর্ণনা লিখতে বলছি আপনাকে।

আরে মশাই এতোদিন পরে ভীষণ ভুল থেকে যেতে পারে লিখতে গেলে।

কেন তা হবে। বরং সুবিধেই হয় বহুদিন পরে লিখতে গেলে, আর যা কিছু ফালতু সব বাদ পড়ে যায়।

কিন্তু বিবেক? অতোদিন আগেকার ঘটনা মিঃ পোয়ারো, যদি কথাবার্তা মনে করতে না পারি ঠিকমতো?

মিঃ ব্লেক, নির্ভুল ভাবে যতোটা সম্ভব লেখার চেষ্টা করবেন, আমার তাতেই কাজ হবে।

খুব অবাক হয়ে তাকালেন ফিলিপ ব্লেক পোয়ারোর দিকে, কিন্তু কেন? সব ঘটনা তো পুলিশের ফাইলে ভালোভাবে লেখা আছে?

 আমি ঘটনাকে মিঃ ব্লেক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করতে চাইছি। আমার শুধু ঘটনা জেনে লাভ নেই। আপনি ঘটনা এবং তথ্যগুলোকে বাছবেন কিভাবে আমি সেটাই জানতে চাই। আর সেই বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি চাই সময় আর আপনার স্মৃতিই সহায়ক হোক। ঘটেছিলো যে সব ঘটনা। বলা হয়েছিলো যে সব কথা,আমি পুলিশ ফাইলেই সেগুলো বা সেগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে আপনি বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন আমি বিশেষভাবে সেগুলোই জানতে চাই।

বেশ কড়াভাবে প্রশ্ন করলেন ফিলিপ, আপনি কি আমার বক্তব্য ছাপবেন?

নিশ্চয়ই না, ওগুলো একমাত্র আমিই পড়বো একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে আসার জন্যে।

এবং একটা লাইনও আমার সম্মতি ছাড়া ব্যবহার করবেন না?

নিশ্চয়ই না।

 হুম। মিঃ পোয়ারো আমি খুব ব্যস্ত লোক তা তো আপনি জানেন।

নিশ্চয়ই জানি। আপনার ওটা লিখতে গেলে সময় নষ্ট আর কষ্ট দুই হবে। এর জন্যে তাই বলছিলাম আপনি নিশ্চয়ই এর জন্যে কী নেবেন।

ফিলিপ ব্লেক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, না। যদি লিখি, লিখবো পয়সা না নিয়েই।

এবং লিখছেন আপনি? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

তবে মনে রাখবেন, স্মৃতিশক্তি নির্ভুল নাও হতে পারে আমার।

মনে রাখবো।

তা হলে লিখব–লেখাও উচিত আমার। অন্তত একদিক দিয়ে, আমি আমার বন্ধু অ্যামিয়াস ক্রেলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ এইভাবে শোধ করবো।

.

সপ্তম অধ্যায়

বাড়িতে এই ছোট্ট শূয়োর ছানাটি রয়ে গেলো…

এরকুল পোয়ারো দারুণ সাবধানী। ছোটোখাটো ব্যাপারেও ফিলিক ব্লেকের মতো মেরিডিথ ব্লেক যে হবেন না এটা ধরে নিয়েই খুব সাবধানে এরকুল পোয়ারো এগোতে চাইলো। এখানে লাভ নেই তাড়াহুড়ো করে, বরং এগোতে হবে ধীরে সুস্থে।

দুর্ভেদ্য দুর্গ মেরিডিথের মতো আক্রমণ করতে হলে এখোননা উচিত ভালোভাবে তৈরি হয়ে এবং তার জন্যে দরকার উপযুক্ত পরিচয়পত্র। এবং আনতে হবে সেই পরিচয়পত্র সমাজের উঁচু ধাপে যারা আছেন পেশায় আর সামাজিকতায় সমাজের উঁচু ধাপে তাদের কারুর কাছ থেকে। কর্মসূত্রে সৌভাগ্যবশতঃ পোয়ারোর পরিচয় হয়েছিল নানা কাউন্টি পরিবারের সঙ্গে, মেরিডিথের পরিচয় আছে ডিভনশায়ার কাউন্টির দুজন নামকরা লোকের সঙ্গে এটা জানতে পেরে প্রথমে পোয়ারো লেডী মেরী লিটন গোরে, জমিদার বিধবা পত্নী আর পরে হাজির হলো মেরিডিথের কাছে ঐ কাউন্টির অবসর প্রাপ্ত এক অ্যাডমিরালের চিঠি নিয়ে।

মেরিডিথ ব্লেক কিছুটা অবাক হয়ে পোয়ারোকে স্বাগত জানালেন।

ইদানীং তার মনে হতে শুরু করেছে পৃথিবীটা আগের মতো আর নেই। তার মধ্যে যে কী জিনিস বেসরকারী গোয়েন্দাগুলো তা অবশ্য বলার নয়। অথচ লেডী মেরী লিটন গোরে লিখেছেন, আমার একজন পুরানো এবং শ্রদ্ধেয় বন্ধু এরকুল পোয়ারো। আপনি তাকে দয়া করে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন, করবেন তো? এবং সমাজের যে স্তরের মহিলা মেরী লিটন গোরে তাতে নিশ্চয়ই তিনি বন্ধুত্ব রাখবেন না মামুলী বেসরকারী গোয়েন্দার সঙ্গে এবং লিখেছেন অ্যাডমিরাল ক্রনশ, ছোকরা খুব ভালো দারুণ বুদ্ধিমান। কৃতজ্ঞ থাকবো এর উপকার করলে। খুব মজার মানুষ,আপনাকে নানা ধরনের গল্প শোনাতে পারে।

এবং এখন সশরীরে সেই মানুষটি সামনে এসে হাজির। সত্যি লোকটি অনুপযুক্ত পোষাক উল্টোপাল্টা জুতো বোম লাগানো। …কিস্তৃত গোঁফ অবিশ্বাস্য রকমের। উপযুক্ত মানুষ নয় মেরিডিথ ব্লেকের, কখনও শিকার টিকার করেছে দেখলে মনে হয় না। উপরন্তু বিদেশী।

পোয়ারো মনে মনে একটু হেসে নিলো মেরিডিথের মনের কথা বুঝতে পেরে।

পোয়ারো বুঝতে পেরেছিলো পশ্চিম দেশে আসার সময় তার আগ্রহ ট্রেনে বসে ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। এবার নিজের চোখে সে দেখতে পাবে ষোলো বছর আগে সেই জায়গা যেখানে ঘটেছিলো ঐ ঘটনাটা।

দুটি কমবয়েসী ভাই এখানে এই হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে থাকতেন, অ্যাল্ডারবেরিতে প্রায়ই যেতেন, ঠাট্টা তামাশা, গল্প করতেন, টেনিস খেলতেন, অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় করে তোলবার চেষ্টা করতেন, এমনকি ক্যারোলিনের সঙ্গেও। এই জমিদারী প্রাসাদ থেকেই সেই অভিশপ্ত সকালে অল্ডারবেরিতে গিয়েছিলেন মেরিডিথ, প্রায় সোল বছর আগে। যে মানুষটা খানিকটা অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তাকে ভদ্রভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন তাকে পোয়ারো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো।

অনুমান করেছিলো যা ঠিক তাই–মেরিডিথ ব্লেক ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের জমিদারদের মতোই খোলামেলা আচরণের মানুষ এবং আকর্ষণ খুব বেশি বাইরের জগতের প্রতি।

একটা পুরানো টুইড কোট গায়ে মাটি আবার ঝুলঝুলে, রোদে জলে মানুষ হওয়া হাসি খুশি একটা মানুষ, হারিয়ে গেছে গোঁফের আড়ালে মেরিডিথ ব্লেক সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তার ছোট ভাই ফিলিপ ব্লেকের থেকে একটু দ্বিধার ভাব স্বভাবে, মনে হয় ইনি বয়সের ভাবের শ্লথ হয়ে এসেছেন যেমন, আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন ছোট ভাই।

তাড়াহুড়ো করলে এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যাবে না। পোয়ারো বেশ চিন্তা করে ঢিলে-ঢালা ভাবে শুরু করলো এগোতে। মাত্র কয়েক বছরের বড় হলেও মেরিডিথকে অনেক বেশি বুড়ো দেখায়।

রক্ত আছে জমিদারী আভিজাত্য। এমন ভদ্রলোককে বশ করতে পেরেছে বেশ কায়দা করে, পোয়ারো দেখে মনে মনে খুশি। লেডী মেরী আর অ্যাডমিরাল ক্রনশ ছাড়াও প্রসঙ্গ এলো এমন কিছু নামকরা লোকের যাঁদের চেনেন দুজনেই। পোয়ারোর পরিচিতি দেখে মেরিডিথ খুশি মোটামুটি।

বেশ সভ্যভব্য ভাবে পোয়ারো ব্যক্ত করলো আগমনের উদ্দেশ্যটা। মিস ক্রেল–মিস লেমার চেণ্টের সনির্বন্ধ অনুরোধে লিখতে হবে বইটি। কোনো ভুলভ্রান্তি, অতিশয়োক্তি যাতে না হয় তার জন্যে সাবধান হয়…।

মেরিডিথ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন পোয়ারোর কথা শেষ হবার আগেই, এতো নরকঘাঁটা মশাই একেবারে, যো…লো…বছর আগে কি ঘটেছে, তা নিয়ে এতোদিন পরে খোঁচাখুঁচি করার কোনো মানে দেখি না আমি।

পোয়ারো অসহায়ের ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, আমি একমত আপনার সঙ্গে, তবে চাহিদা ঐ ধরনের জিনিসের আছে বলেই তো নতুন ভাবে অতীতের ঘটনাকে পরিবেশন করতে হচ্ছে।

এটা খুবই অপমানজনক মনে হচ্ছে আমার কাছে।

বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, আমি সত্যিই দুঃখিত। একটা দারুণ নিষ্ঠুর জগতে বাস করতে হচ্ছে আমাদের। মিঃ ব্লেক আশ্চর্য হবেন শুনলে এরকম কতো আসল রূপ অপ্রীতিকর ঘটনার আবিষ্কার করে জীবনকে আমি সহজতর করে তুলেছি অনেকটা। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার হাত থেকে এ ব্যাপারে মিস ক্রেলকে মুক্তি দিতে আমি উৎসুক ভীষণ ভাবে।

আপন মনে বললেন মেরিডিথ, সেই বাচ্চাটা ছোট্ট কার্লা। বেশ বড়সড়ো তো হয়ে উঠেছে এখন নিশ্চয়ই। বিশ্বাসই করা যায় না…।

জানি হু হু করে তো সময় কেটে যায়, তাই না?

বড় বেশি হু হু করে..দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেরিডিথ বললেন।

চিঠিটাতো মিস কার্লার আপনি পড়লেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনি ঐ অতীতের ঘটনাটা সম্বন্ধে বিস্তারিত সব কিছু জানবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন উনি।

মেরিডিথ বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন? নতুন করে খোঁচানো কেন আবার? কি প্রয়োজন অতীতকে নতুন করে জানবার?

ভালো করে অতীতটাকে জানেন বলেই আপনি একথা বলতে পারছেন মিঃ ব্লেক। কিন্তু মিস কার্লা একবার ভেবে দেখুন কিন্তু জানে না কিছুই। কতটুকু আর থাকে সরকারী নথিপত্রে।

সত্যি আমি একেবারে বেচারি মেয়েটার কথা গিয়েছিলাম ভুলে। সত্যিই খুব খারাপ ওর অবস্থাটা। নিশ্চয়ই মনে খুব দুঃখ পেয়েছে সত্যি কথাটা জানার পর।

আইনের কচকচানিতে শুধু কিন্তু সত্যের প্রতি সুবিচার করা যায় না। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসগুলো দরকার সেগুলোকেই দেওয়া হয় বাদ–মনের আবেগ, অনুভূতি, নাটকের পাত্রপাত্রী, কমাতে পারে অপরাধের গুরুত্ব এমন অবস্থা…।

পোয়ারো চুপ করলো এতোটা বলে, সহ অভিনেতার মতো সঙ্গে সঙ্গে কথার খেই ধরে শুরু করলেন বলতে মেরিডিথ, এমন অবস্থা কমাতে পারে অপরাধের গুরুত্ব। ঠিক তাই। যদি সত্যি ঐ ধরনের অবস্থা থাকে, তবে নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে তা ছিলো। আমার পুরানো বন্ধু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল, আমাদের পরিবারের পরিচয় ওদের পরিবারের সঙ্গে বহু যুগের, তবে খোলাখুলি একথা স্বীকার করতেই হবে যে ভালো ছিলো না ওর স্বভাব, শিল্পী ছিলো, সে বিষয়ে সন্দেহই নেই কোনো, এবং বোধহয় সেইজন্যই তার ঐ ধরনের চরিত্র ছিলো। ঐ ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি মাঝে মাঝে ও সৃষ্টি করে ফেলতো। সাধারণ ভদ্রলোক সে পরিস্থিতি কখনই কল্পনা করতে পারে না।

আমার আগ্রহ বাড়ছে আপনার মুখে একথা শুনে। মাঝে মাঝে আমি তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলাম, মানে ঐ পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে, তবে মানুষ ভাল বংশের। জাগতিক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই ওঁর মতো করবেন না।

মেরিডিথের রোগা মুখটার মধ্যে এতক্ষণ দ্বিধার ভাব ছিলো, এবার কেটে গিয়ে সেটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললেন, তবে আসল ব্যাপারটা হলো সাধারণ মানুষ ছিলো না অ্যামিয়াস। শিল্পী মানুষ, শিল্পকে জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো। আমি এইসব শিল্পী-টিল্পীদের ঠিক বুঝতে পারিও না, পারিনি। তবে ক্রেলকে আজীবন বন্ধুত্ব সূত্রে বুঝতে পারতাম একটু-আধটু। ওকে জন্ম থেকে চিনি তো, আমাদের খুব মিল আছে ওদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে। ও ষোলআনা খাঁটি মানুষ শিল্পী অ্যামিয়াসকে বাদ দিলে, আমাদেরই মতো পুরোপুরি। তাছাড়া সৌখীন শিল্পী ও আবার ছিলো না, অ্যামিয়াস একটা প্রতিভা সবাই বলতো। হয়তো ঠিক, এবং সেই কারণেই বোধহয় ও ছিলো অস্থিরচিত্ত একটু বেশি। ও অন্য জগতের মানুষ হয়ে যেতো ছবি আঁকার সময়, ঘুরে বেড়াতো স্বপ্নের রাজ্যে। অ্যামিয়াস আবার বাস্তব জগতে ফিরে আসতে ছবি শেষ হলে।

ওঁর কথা পোয়ারো বুঝতে পারছে কিনা ঐভাবে তাকাতেই ঘাড় নাড়লো সে, অর্থাৎ বুঝেছে।

বুঝতে পেরেছেন দেখছি আপনি। এবার মনে হয় বুঝতে পারছেন আপনি ঐ রকম, কেন হয়েছিলো পরিস্থিতিটা, ঐ মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলো অ্যামিয়াস, পাগল হয়ে উঠেছিলো বিয়ে করার জন্যে। মেয়েটার জন্য এমনকি বৌ-মেয়েকেও রাজী ছাড়তে। কিন্তু ছবি আঁকতে যেহেতু শুরু করেছে তাই শেষ না করা পর্যন্ত ওটা অন্য কোনো চিন্তায় ঠাই পাচ্ছিলো না ওর মাথায়। আর ওর ঐ ব্যবহারের সঙ্গে যে জড়িত দুটি মহিলা অ্যামিয়াস সেটাও খেয়াল করতে চেষ্টা করেনি।

মিঃ ক্রেলের মনের কথা মহিলা দুজনও কি বুঝতে পারেননি? জানতে চাইলো পোয়ারো।

হ্যাঁ, একদিক দিয়েই তো বটেই। বোধহয় এলসা মেয়েটি বুঝতে পেরেছিলো। ও পাগলের মতো ভালোবাসতো অ্যামিয়াসের ছবি আঁকার ব্যাপারটাকেও এবং স্বভাবতই বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিলো ওর অবস্থা। আর ক্যারোলিন…।

…ক্যারোলিন, দেখুন…আমি সব সময়ই ক্যারোলিনকে পছন্দ করতাম। সময় ছিলো একটা…আমি যখন…ওঁকে আমি চেয়েছিলাম বিয়েও করতে। কিন্তু অঙ্কুরেই সে ব্যাপারটা বিনাশ হয়ে গিয়েছিলো। তবুও…তবুও…ওর কাজে লাগতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

মাথা নাড়িয়ে পোয়ারো সায় দিলেও চিন্তা করতে লাগলো মনে মনে মেরিডিথের শেষ কথাটা নিয়ে। প্রাচীনপন্থী একটু অভিব্যক্তি হলেও প্রেমের ব্যাপারে উনি যে দারুণ রোমান্টিক আর আত্মনিবেদিত একথা তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেমে প্রতিদান পাবার আশা না করেই, নিজেকে সমর্পণ করতে পারার মতো মানুষ এই মেরিডিথ। পোয়ারো বললো খুব সাবধানে, এই যে মহিলাটির প্রতি…অবিচার যে করা হচ্ছিলো…আপনি তার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করেছিলেন?

হা করেছিলাম। আমি বলতে গেলে অ্যামিয়াসকে এ ব্যাপারে বেশ বকাবকিও করেছিলাম।

কবে?

ঐ ঘটনাটা যেদিন ঘটালো ঠিক তার আগের দিন। আমার এখানে ওরা এসেছিলো চায়ের নেমন্তন্ন রাখতে। অ্যামিয়াসকে আমি আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম খোলাখুলি। এমন কি বলেছিলাম এও যে, ও ভালো করছে না কাজটা।

এই কথাই তাহলে আপনি বলেছিলেন?

 হা, কথাটা ওর কানে ঢুকেছিলো আমার মনে হয় না।

ঢোকেনি সম্ভবতঃ, বললো পোয়ারো।

ব্যাপারটা ক্যারোলিনের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমি বলেছিলাম। যদি বিয়ে করতেই চাও ঐ মেয়েটাকে, কেন এক বাড়িতে রেখেছে, নির্লজ্জের মতো ক্যারোলিনের চোখের সামনে এমনভাবে নিজেকে কেন জাহির করছো? কেউ সহ্য করতে পারে না এ অপমান।

কৌতূহল বাড়ছে পোয়ারোর।

অ্যামিয়াস তার উত্তরে কী বলেছিলেন?

মেরিডিথ নাক কুঁচকে বললেন, অ্যামিয়াস বলেছিলো–এটা মেনে নিতে হবে ক্যারোলিনকে।

ভ্রূ বেঁকে উঠলো পোয়ারোর, উত্তর কী নিষ্ঠুরের মতো।

ঘেন্না ধরে গিয়েছিলো তো আমার। ঠিক রাখতে না পেরে মেজাজে বলেছিলাম যেমন সে বুঝতে পারে না নিজের স্ত্রীকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, ঠিক তেমন চিন্তা করছে না কেন ঐ এলসা মেয়েটার কথাও। অবস্থাটা যে ওর পক্ষে বেশ ঘোরালোলা? আমিয়াস তার উত্তরে বলেছিলো, এটা মেনে নিতে হবে এলসাকেও …তারপর বলেছিলো অ্যামিয়াস, মেরিডিথ তুমি জানো, এখন যে ছবিটা আমি আঁকছি, আমার এটাই হবে সবার সেরা ছবি। এটা অসাধারণ ছবি হচ্ছে, কাজ বন্ধ করতে পারি না দুজন ঈর্ষাকাতর মহিলার জন্যে, না বন্ধ করবো না।

তর্ক করেও কোনো লাভ ছিলো না ওর সঙ্গে। সামান্য ভদ্রতা বোধটুকু পর্যন্ত ভুলে গেছো তুমি, আমি বলেছিলাম। জীবনের সব নয় ছবি আঁকাটাই। আমার কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে ও বলেছিলো, কিন্তু নিশ্চয়ই আমার কাছে।

আমার রাগ তখনও পড়েনি। বলেছিলাম ওঁকে ওর ব্যবহারটা ক্যারোলিনের সঙ্গে আদৌ ভদ্র নয়। অ্যামিয়াস দুর্বিষহ করে তুলেছে ক্যারোলিনের জীবনটাই। ও বলেছিলো তার উত্তরে, আমি দুঃখিত ওর জন্যে, সত্যিই দুঃখিত। মেরিডিথ আমি জানি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করছে না। কিন্তু সত্যি কথাটা। আমি নরক করে তুলেছি ক্যারোলিনের জীবন। তবে দেবীর মত সর্বংসহা ও যেন। ওকে আমি আমার সব কথাই বলেছি উচ্ছঙ্খল জীবনের।

তারপর কড়াভাবে আমি অ্যামিয়াসকে বলেছিলাম, আর যাই করুক যেন নষ্ট না করে বিবাহিত জীবনটা। মেয়েটার কথাতো সবার ওপরে চিন্তা করতে হবে। আরও বলেছিলাম আমি, এলসার মতো মেয়েরা বুঝতে পারছি মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে পুরুষের। তবুও বিয়ের মতো ব্যাপারটাকে তার জন্যে নষ্ট করা উচিত নয়। খুবই কম এলসার বয়স। হয়তো এখন ওর পছন্দ হচ্ছে এই টাক মাথাকেই। নিশ্চয়ই এর জন্যে পরে পস্তাবে। এই সম্পর্কটা তুমি ভেঙে দিয়ে ফিরে যাও স্ত্রীর কাছে।

অ্যামিয়াস তার উত্তরে কি বললেন? ও যেন বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে মনে হচ্ছিলো। আমার কাঁধ চাপড়ে বললো, মেরিডিথ তুমি খুব ভালো মানুষ, তবে আবেগে ভরা বড় বেশি। অপেক্ষা করো ছবিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত। স্বীকার করবে তখন আমি ভুল করিনি।

গোল্লায় যাক তোমার ছবি। আমি বলেছিলাম। অ্যামিয়াস চাপা হাসি হেসে বলেছিলো যে সব মানসিক বিকারগ্রস্ত ইংল্যান্ডের মেয়ে মানুষরা তা করতে পারে না। আমি তখন বললাম –অন্ততঃ ক্যারোলিনকে ছবিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত এর থেকে দূরে রাখতে পারতে। আমার কোনো দোষ নেই এতে। বলেছিলো অ্যামিয়াস। নিজেই গোপন ব্যাপারটা এলসা ফাস করে দিয়ে লজ্জায় ফেলতে চেয়েছিলো ক্যারোলিনকে। কেন, অ্যামিয়াস প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলো সব কিছু খোলামেলাভাবে এলসা করতে চাইতো। একথা ঠিকই যত খারাপই হোক না কেন ওর আচরণে এলসা নিজের সততা বজায় রাখতে চেয়েছিলো।

পোয়ারো মন্তব্য করলো, এতো বেশি দুঃখ কষ্টের বোঝা সতোর জন্যে।

এই মন্তব্যটার মানে মেরিডিথ ঠিক মতো বুঝতে না পেরে একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, সেই সময়টা আমাদের কাছে ছিলো খুবই খারাপ।

একমাত্র অ্যামিয়াস ক্রেলকে ঐ পরিস্থতিটা প্রভাবিত করেনি, বললো পোয়ারো।

এবং কেন, এই জন্যে যে ও ভীষণভাবে অহংকারী ছিলো। এখন মনে পড়ছে ওর একটা কথা, ও আমায় হাসতে হাসতে বলেছিলো মেরিডিথ চিন্তা কোরো না, মিটে যাবে সব সমস্যাই।

পোয়ারো আপন মনে বললো, আশাবাদী অবিশ্বাস্য রকমের।

সেই ধরনের পুরুষ ছিলো অ্যামিয়াস যারা কখনই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে মেয়েদের গ্রহণ করে না। ওকে জানিয়ে দেওয়া আমার উচিত ছিলো যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্যারোলিন।

আপনাকে কি ক্যারোলিন তেমন কোনো কথা বলেছিলেন?

না ঐ ভাষায় ঠিক নয়। তবে বিকেলবেলায় সেদিন যেমন থমথমে ওর মুখ দেখেছিলাম ওই রকম প্রতিদিন দেখতাম। বেশি বড় হাসছিলো আর কথা বলছিলো। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার ছাপ চোখের তারায় ফুটে উঠেছিলো। আহা বেচারি!

মিনিট দুই কোনো কথা বললো না এরকুল পোয়ারো। পরের দিন যে মহিলাটি তার স্বামীকে খুন করতে চলেছেন তার ছবিটি ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন মেরিডিথ।

মেরিডিথ এতক্ষণে অনেক স্বচ্ছন্দ হয়ে এসেছেন, কথা বলে চলেছেন অনর্গল আর পোয়ারো শুনে চলেছে নিবিষ্ট মনে। যেন নিজের মনে মেরিডিথ কথা বলছেন। বলতে লাগলেন এভাবে, উচিত ছিলো আমার সন্দেহ করা। প্রথমে ক্যারোলিনই ঐ নেশা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা শুরু করেছিলো। দোষ নেই স্বীকার করতে, তাতে আমি খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। আলাদা একটা নেশা আছে গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করার। এককালে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো এমন অনেক লতাপাতা আছে। কিন্তু এখন ঔষধ বিজ্ঞানের পাতা থেকে বাতিল হয়ে গেছে। কোনো কোনো গাছপালার কাঁথ দিয়ে করা যায় অসাধ্য সাধন, আশ্চর্য লাগে ভাবলেও। এসব জানা থাকলে অর্ধেকের বেশি রোগে ডাক্তারই ডাকতে হয় না।

এই তো কাগজে সেদিন পড়েছিলাম কতো ভেষজ বাতিল ঔষুধ ব্যবহার করছেন ডাক্তাররা। আর পাচ্ছেন সুফলও। কিন্তু আমি সাধনা করে যাচ্ছিলাম নিজের জন্যে, সমাজের যেটুকু উপকারেই আসি না কেন। তাছাড়া শেকড়-বাকড় সংগ্রহ করা, জাল দেওয়া সেগুলো থেকে নির্যাস বের করা, কম আনন্দ পাওয়া যায় না এই ধরনের বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকর্মে। মনে আছে আমার আমি সেদিন চিতি বিষলতার কথা বলেছিলাম। দুবার ফুল ফোটে বছরে, পেকে ফলগুলো হলদে সবার আগই তুলে নিতে হবে। আজকাল উঠে গেলেও কোনাইনের ব্যবহার, অব্যর্থ ফল দেয় হুপিংকাশি, হাঁপানিতে।

পোয়ারো প্রশ্ন করলো, এতো কথা নিয়ে আপনার ল্যাবরোটারিতে আপনি আলোচনা করেছিলেন।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হ্যাঁ সব দেখিয়েছিলাম, কি কি কাজ নানা ওষুধের তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। বিষের কথা উঠলো কথা প্রসঙ্গে। নাম করলাম বেলেডোনা অ্যাট্রোপিনের। খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিলো ওরা।

ওরা? কাদের কথা বলছেন ওরা বলতে, যেন একটু আশ্চর্য হলেন মেরিডিথ ব্লেক, ধারণা ছিলো তার সেদিনের কথা পোয়ারো সবটাই জানে।

ওহ, পুরো দলটা। বলছি, দাঁড়ান, ফিলিপ, অ্যামিয়াস, ক্যারোলিন, অ্যাঞ্জেলাও ছিলো। আর এলসা গ্ৰীয়ার ছিলো।

 ব্যাস, মাত্র এই ক’জন?

 হা, মনে পড়ছে তাইতো, নাহ, ভুল হচ্ছে না তো। কেন কেউ কি আর থাকতে পারে?

মনে হয়েছিলো আমার খুব সম্ভব গভর্নেস…।

ওহ বুঝেছি, নাঃ গভর্নেস সেদিন বিকেলে ছিলো না। দেখছি নামটাও ভুলে গেছি। চমৎকার মহিলা, ভীষণ সজাগ নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে। ওকে খুব জ্বালাতো অ্যাঞ্জেলা মনে হয়।

কিন্তু কেন?

দেখুন, বেশ ভালোই ছিলো মেয়েটা। তবে ওর মাথায় মাঝে মাঝে চাপতো ভূত। একটা না একটা সব সময় পিছনে লেগে থাকতো। অ্যামিয়াস খুব পরিশ্রম করে একদিন একটা ছবি আঁকছিলো, টেবিলের ওপর অ্যাঞ্জেলা রেখে এসেছিলো একটা ছোট শামুক। অ্যামিয়াস সেদিন দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলো, তারপরেই তো মেয়েটাকে স্কুলে পাঠাতে হবে ঠিক করে।

স্কুলে পাঠালো অ্যাঞ্জেলাকে? হ্যাঁ, অবশ্য তার মানে আমি এ বলতে চাইছি না যে ওকে ভালোবাসতো না অ্যামিয়াস। বাসতো ঠিকই, তবে দুষ্টুমি করতো যে বড্ড। আর মনে হতো আমার…

আপনার কি মনে হতো?

অ্যাঞ্জেলাকে যেন অন্ধের মতো ভালোবাসতো ক্যারোলিন, সেটা সহ্য করতে পারতো না অ্যামিয়াস। অবশ্য একটা কারণ তারও আছে, আমি সেটা বলতে চাই না এখন, কিন্তু…।

বাধা দিলো পোয়ারো, কারণটা এই যে একাকার রেগে গিয়ে ক্যারোলিন একটা এমন কাণ্ড করেছিলেন যার ফলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটার মুখ।

ওঃ তাহলে আপনি কারণটা জানেন দেখছি। ওটা আমি আর নিজের মুখে বলতে চাইছিলাম না। অতীতের জন্যে অতীতের কথা থাকাই ভালো। হ্যাঁ, ক্যারোলিন ঐ কারণে অ্যাঞ্জেলা সম্বন্ধে ও, যা করেছে তা যেন কিছুতেই পর্যাপ্ত নয় মনে করতো।

পোয়ারো ঘাড় নাড়লো চিন্তা করতে করতে, আর অ্যাঞ্জোলা? তার কি কোনো রাগ ছিলো সৎ বোনের বিরুদ্ধে?

না, না, চিন্তা করবেন না ওসব। দিদিকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতে অ্যাঞ্জেলা। ও আদৌ পুরোনো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতো না। বরং ক্যারোলিনই বলা যায় যেন ঘটনাটা ভুলতে পারতো না।

অ্যাঞ্জেলা বোর্ডিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারটা কি ভালো মনে নিয়েছিলো?

মেরিডিথ স্পষ্টভাবে, জানালেন পোয়ারোর এই প্রশ্নের উত্তরে, না, নেয়নি। ভীষণ রেগে গিয়েছিলো অ্যামিয়াসের ওপর। এবং বোনের পক্ষ নেওয়া সত্ত্বেও ক্যারোলিন, গোঁ ধরে বসে রইলো অ্যামিয়াস, বোর্ডিংয়ে পাঠাবেই অ্যাঞ্জেলাকে। এমনিতে বেশ সাদাসিধে মানুষ ছিলো অ্যামিয়াস, কিন্তু ক্ষেপে গেলে একবার আর তাকে শান্ত করা যেতো না, হার মানতে হয়েছিলো ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলা দুজনকেই।

বোর্ডিংয়ে পাঠাবার কথা ছিলো অ্যাঞ্জেলাকে, তাই না, কবে?

যে সেসন শুরু হয় শরৎকালে, তাতে। ওরা গোছগাছ করছিলো ওর জিনিসপত্র। আর কয়েকদিন পরেই হয়তো যেতো ও দুর্ঘটনাটা না ঘটলে। ঐদিন সকালে কিছু জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করার কথা ছিলো।

হঠাৎ এখানে প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আর ঐ গভর্নেস?

আপনি কি বলতে চাইছেন…গভর্নেস?

গভর্নেস কি চোখে নিয়েছিলো অ্যাঞ্জেলাকে বোর্ডিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারটা। তার তত চলে যাবার কথা চাকরি? তাই না?

ও হ্যাঁ, তাই তো দাঁড়ায় একদিক দিয়ে। তখন কার্লার বয়স পাঁচ কি ছয়, গভর্নেসের কাছে পড়াশুনা করতো একটু আধটু। একজন নার্স ওর জন্য ছিলো বটে। তবে মিস উইলিয়ামসকে ওর জন্যে ওরা রাখতো কিনা সন্দেহ। ওই নামটা এই তো মনে পড়ে গেছে। সিসিলিয়া উইলিয়ামস। কেমন মজার ব্যাপার দেখছেন, নামটা মনে পড়ে গেলো কথা বলতে বলতে।

তা ঠিক, এখন আপনি অতীত জগতে চলে গেছেন। তাই না? আপনার চোখের সামনে নতুন করে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে, তখন যেভাবে কথা বলছিলো লোকেরা হাত-পা নেড়ে ছিলো কিভাবে, সবই নিশ্চয়ই মনে পড়ছে?

ধীরে ধীরে মেবিডিথ ব্লেক বললেন, বলতে পারেন তা। তবে বাদ পড়ে যেতে পারে মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়তে পারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোই। ধরুন ক্যারোলিনকে ছেড়ে দিতে চাইছে অ্যামিয়াস একথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম ভীষণ, অথচ মনে পড়ছে না আমার ঐ ছাড়াছাড়ির কথাটা আমি শুনেছিলাম কার কাছ থেকে অ্যামিয়াস, না এলসা? অবশ্য মনে আছে এটাও যে এলসাকে আমি চেষ্টা করেছিলাম বোঝাবার ও কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো আমার কথা সেকেলে পন্থী নাকি আমি। ঠিক কথাটা, সেকেলে পন্থা আমি, তবে ভুল ছিলো না আমার বক্তব্যটাও, স্ত্রী মেয়েকে ছেড়ে বিয়ে অন্য কাউকে করতে চাওয়াটা ঠিক হয়নি অ্যামিয়াসের পক্ষে।

হ্যাঁ, ঘটনাটা তবে মনে রাখবেন ষোলো বছর আগেকার, এখনকার মতো সহজে তখনকার দিনে বিবাহ বিচ্ছেদ হতো না। অথচ আধুনিক হতে চেয়েছিলো এলসা, ওর মতে স্বামী-স্ত্রী যদি একসঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারে তাহলে বিচ্ছেদ হওয়াই ভালো। যেহেতু একদিনও ঝগড়া না করে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন কাটাতে পারছিলো না, তাই ছাড়াছাড়ি হওয়াটাই মঙ্গলজনক সন্তানের মুখ চেয়েই।

এবং আপনার মনোমত হয়নি এলসার যুক্তিটা? প্রশ্ন করলে পোয়ারো।

ধীরে ধীরে মেরিডিথ ব্লেক বললেন, সব সময়ে আমার কেমন যেন মনে হয়েছিলো নিজেই জানে না এলসা সে কি বলছে। কিছু বইপড়া, কিছু শোনা কথা বন্ধু-বান্ধবের মুখে তোতাপাখির মতো আওড়ে যেতো। কথায় একটা গভীর দুঃখের ব্যাপার ছিলো ওর ব্যাপারে। অথচ কম বয়সী খুব আত্মবিশ্বাসী খুবই। একটা নিজস্ব ধর্ম আছে যৌবনের, মিঃ পোয়ারো তাই না–সব কিছুকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়।

অথচ কাজটা ভালো করছে না অ্যামিয়াস, বয়সের তফাৎ দুজনের মধ্যে প্রায় কুড়ি বছর…ওদের ব্যাপারে এইসব মনে করে নাক গলাতে গিয়েছিলাম। হয়নি ফল, কখন হতও না। আমি কাউকে ঠিক মত কিছু বোঝাতে পারি না।

নিজের যে দুর্বলতার সমালোচনা মেরিডিথ করছেন বুঝতে পেরে পোয়ারো পাল্টাতে চাইলো প্রসঙ্গটা–এখনও আপনার ঐ ওষুধ বিষুধের ল্যাবরেটরিটা আছে?

কড়া জবাব এলো সঙ্গে সঙ্গে, না। নষ্ট করে ফেলেছি সব, ওসব ঐ ঘটনার পর আর কেউ রাখে। বলতে পারেন আপনিও তো আমি ওই ব্যাপারটার মুলে ছিলাম।

না, না মিঃ ব্লেক। দেখছি আপনি বড় বেশি স্পর্শকাতর। কিন্তু বুঝতেই বা-আপনি পারছেন না কেন যদি আমি ঐ নোংরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রাখতাম তাহলে তো ঘটতো না দুর্ঘটনাটা। আমি উল্টে অহংকার করে জাহির করার জন্যে নিজের বিদ্যে লেকচার দিয়েছিলাম কোনাইন সম্বন্ধে। কাজ করেছিলাম কী বোকার মতোই না। এমনকি লাইব্রেরি ঘরে ফিরে গিয়ে একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছিলাম ওদের বই থেকে, যেখানে ফিডো সক্রেটিসের মৃত্যু বর্ণনা করছে। রচনাটা অসাধারণ। কিন্তু ঐ দৃশ্যটা তারপর থেকে আমায় হানা দিয়ে আসছে বারবার।

কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো কোনাইনের বোতলে।

 ক্যারোলিন ক্রেলের।

আপনারটা নয় কেন?

সেদিন আমি বোতলটা ধরিনি, তাছাড়া এর ৫-৬ দিন আগেই ঝাড়ামোছা করেছিলাম সব। আমার সব কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা স্বভাব।

তালা বন্ধ রাখতেন ঐ ঘরের দরজা?

 অবশ্যই।

আপনার ল্যাবরেটারি থেকে কখন ক্যারোলিন ক্রেল কোনাইন চুরি করেছিলেন?

মেরিডিথ ব্লেক খুব অনিচ্ছা নিয়ে উত্তর দিলেন, সবার শেষে ঘর থেকে বেরিয়েছিলো। ক্যারোলিনই। ওকে ডেকেছিলাম আমি। খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে এলো ও, চোখে মুখে উত্তেজনা।

আচ্ছা, আপনার সঙ্গে সেদিন ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছিলো?

মেরিডিথ গলা নামিয়ে উত্তর দিলেন, সোজাসুজি হয়নি। ও যে মনের দিক দিয়ে খুব বিপর্যস্ত ছিলো আগেই একথা তো বলেছি। এক সময়ে আমরা দুজনে যখন শুধু একটু একলা ছিলাম, ক্যারোলিনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছু কি ঘটেছে নাকি, ও বলেছিলো তার উত্তরে, ঘটে গেছে তো সবকিছুই……বুঝতে পারতেন ওর কথাটা শুনলে কেমন হতাশ হয়ে গিয়েছিলো ও।

ও বলেছিলো, শেষ হয়ে গেছে সব কিছুই। মেরিডিথ শেষ হয়ে গেছি আমিও। হঠাৎ তারপর হাসতে হাসছে চলে গেলো দলের কাছে। এর আগে ওকে কখনও আমি এরকম অস্বাভাবিক ও উদ্দামভাবে খুশি হতে দেখিনি।

পোয়ারো চীনেম্যানদের মতো ভাবলেশহীন মুখ করে বললো, ও বুঝেছি…ঐ হয়েছিলো…তাই না…।

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে টেবিলে ঘুসি মেরে প্রায় মেরিডিথ চেঁচিয়ে উঠলেন, তবে আপনাকে একটা কথা বলছি মিঃ পোয়ারো–মামলা চলার সময় যখন ক্যারোলিন বললো ও নিয়েছিলো বিষটা নিজের খাবার জন্যেও তখন সত্যি কথাই বলেছিলো, আমি হলফ করে বলতে পারি। ওর খুন করার ইচ্ছে ছিলো না। না, ছিলো না। ওর মাথায় ও চিন্তাটা পরে এসেছিলো।

এরকুল পোয়ারো বললো, আপনি এ বিষয়ে ভুল করছেন না তো যে ওঁর মাথায় এসেছিলো ঐ চিন্তাটা পরে?

আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কি বলছেন। বোকার মতো কেমন যেন তাকিয়ে কথাটা মেরিডিথ বললেন।

খুন করার চিন্তাটা আগে ক্যারোলিনের মাথায় আসেনি এ বিষয়ে নিশ্চিত তো আপনি, আর খুন যে ক্যারোলিনই করেছেন এ কথাটা বিশ্বাস করেন আপনি?

এলোমেলো হয়ে গেলো মেরিডিথের নিঃশ্বাস

কিন্তু যদি তা…যদি তা না হয়..আপনি তাহলে কি বলতে চাইছেন…একটা দুর্ঘটনা এটা…?

যে ঠিক তাই, তা নয়।

মিঃ পোয়ারো আপনি খুব আশ্চর্য কথা শোনাচ্ছেন?

তাই কি? ক্যারোলিন ক্ৰেল, আপনিই তো বলেছেন ধীরস্থির প্রকৃতির মহিলা ছিলেন। খুন করে কি শান্ত প্রকৃতির মেয়েরা।

ঠিকই শান্তশিষ্ট ছিলো, তবে ভীষণ ঝগড়া করতো মাঝে মাঝে।

তাহলে শান্তশিষ্ট যতোটা বলছেন ততোটা নয়।

 কিন্তু ক্যারোলিন তো…ওহ, বুঝিয়ে এসব জিনিস বলা যে কী কষ্টকর…।

বলুন, চেষ্টা করছি আমি বোঝবার।

একটু আলগা ছিলো ক্যারোলিনের জিভটা–কথা বলতো বড় ঝেঝে। বলতে পারতো মুখের ওপর, ঘেন্না করি আপনাকে, মরণ হয় না কেন আপনার। কিন্তু তাই বলে ঘটুক ওগুলো তা নিশ্চয়ই চাইতো না।

আপনার মতে তাহলে খুন করার মতো ব্যাপারটা একেবারেই খাপ খায় না মিসেস ক্রেলের চরিত্রের সঙ্গে।

মিঃ পোয়ারো আপনি কিন্তু দারুণ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। শুধু আমি বলেছি–হ্যাঁ খাপ খায় না ওর চরিত্রের সঙ্গে। ভীষণভাবে ওঁকে খোঁচানো হয়েছিলো বলেই হয়তো কাজটা করে ফেলেছিলো উত্তেজিত হয়ে। স্বামীকে এমনিতে ও ভীষণ ভালোবাসতো। শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু যে কোনো মহিলা ও রকম পরিস্থিতিতে পড়লে…মানে…খুন করে ফেলতে পারে। ঘাড় দুলিয়ে পোয়ারো বললো, আপনার সঙ্গে একমত আমি।

আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম কথাটা শুনে। সত্যি তা ভাবতেই পারিনি। এবং সত্যিও না কথাটা। কারণ আসলে ক্যারোলিন পারে না ওটা করতে।

মিঃ ব্লেক কিন্তু একথা তো স্বীকার করবেন অবশ্যই আপনি যে ক্যারোলিন খুনী আইনের চোখে।

হাঁ করে তাকালেন আবার মেরিডিথ ব্লেক পোয়ারোর মুখের দিকে, আরে মশাই–যদি ও করে না থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বিকল্প একটা কিছু হতে হবে? দুর্ঘটনা? তা নয় নিশ্চয়ই। আবার বলা যাচ্ছে না আত্মহত্যাও। বিশ্বাস করবে না কেউ, ওসব করতেই পারে না অ্যামিয়াসের মতো লোক।

তা ঠিক। স্বীকার করলো পোয়ারো।

তাহলে কি আর হতে পারে? জানতে চাইলেন মেরিডিথ।

 পোয়ারো খুব ঠান্ডা গলায় বললো, আমিয়াস ক্রেলকে অন্য কেউ খুন করেছিলো এটাও তো হতে পারে?

অসম্ভব।

সত্যিই তাই মনে করেন আপনি?

হা কে আর খুন করতে চাইবে ওকে? কেই বা ওকে খুন করতে পারে?

আপনারই বেশি ভালো জানা উচিত আমার চেয়ে।

 সত্যি সত্যিই আপনি কিন্তু বিশ্বাস করেন না…।

হয়তো না। আমার ভালো লাগে পরীক্ষা করে সম্ভাবনাগুলোকে দেখতে। …আচ্ছা একটু গভীরভাবে আপনি চিন্তা করে বলুন তো আমায়…।

মেরিডিথ পোয়ারোর দিকে মিনিট দুই চুপ করে চেয়ে থাকলেন, মাথা নেড়ে তারপর বললেন, আমি কিছুতেই অন্য কোনো বিকল্প কল্পনা করতে পারছি না, পারছি না চেষ্টা করেও। নির্দোষ ক্যারোলিন আমি আগ বাড়িয়ে একথা বিশ্বাস করতে চাই, অবশ্য অন্য কাউকে যদি সন্দেহ করার কোনো সঙ্গত কারণ থাকে। খুন করেছে ক্যারোলিন ও চিন্তা করতেও আমি চাই না। কিন্তু কে কে ছিলো আর। ফিলিপ, অ্যামিয়াসের প্রাণের বন্ধু। এলসা? অবিশ্বাস্য। আমি, আমাকে কি দেখতে লাগে খুনীর মতো, সম্ভ্রান্ত একজন গভর্নেস? কয়েকটা বিশ্বাসী চাকর, এরপর হয়তো আপনি বলবেন খুন করেছিলো অ্যাঞ্জেলা? না, মিঃ পোয়ারো বিকল্প নেই কোনো। ওকে খুন করতে পারে না অ্যামিয়াসের স্ত্রী ছাড়া আর কেউ। তবে ওকে এটা করতে বাধ্য করেছিলো অ্যামিয়াসই, সেই অর্থে বলতে পারেন আত্মহত্যা।

অর্থাৎ মারা যান, আমিয়াস নিজের কৃতকর্মের ফলেই নিজের হাতে না মরলেও? কথাটা বলে পোয়ারো তাকালো মেরিডিথের দিকে।

কল্পনা বড় বেশি করা হয়ে যাচ্ছে, তাই না? ঐ কথাটাই ঠিক তবুও বলি, বিশেষ করে বোঝা যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের দিকটা দেখলেই।

আচ্ছা, মিঃ ব্লেক আপনি কি একথা এখনও ভেবে দেখেছেন নিহত মানুষটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে চিন্তা গবেষণা করলে খুনের উদ্দেশ্যটা জানা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে?

কোনোদিনও ওরকম ভাবিনি বটে, তবে মনে হয় কথাটা ভুল নয় আপনার।

এবং নিহত মানুষটি সেই জন্যেই কেমন ছিলেন, খুন হয়েছিলেন কি পরিস্থিতিতে এগুলো জানতে উৎসুক আমি। আপনি এবং আপনার ভাই আমাকে সাহায্য করছেন এ বিষয়ে…।

মেরিডিথ আদৌ কান দিলেন না পোয়ারোর কথায়, তার সমস্ত মনোযোগ অতোগুলো কথার মধ্যে একটি শব্দ দাবী করছিলো, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ফিলিপ।

হা।

ওর সঙ্গেও আপনি কথা বলেছেন?

নিশ্চয়ই।

হঠাৎ মেরিডিথ কড়া সুরে বলে উঠলেন, আপনার সবার আগে আসা উচিত ছিলো আমার কাছে।

পোয়ারো নম্র-ভদ্র-ভঙ্গী করে বললো, আমার জ্যেষ্ঠত্বের অগ্রাধিকার সূত্রানুসারে উচিত ছিলো আগে আপনার কাছেই আসা। জানতাম আমি মিঃ ফিলিপ ব্লেকের চেয়ে আপনি বড়ো। তবে পারছেন তো বুঝতে, লন্ডনের কাছে থাকে আপনার ভাই, তাই সহজ হয়েছিলো আগে দেখা করাটা।

তখনো কমেনি মেরিডিথের রাগটা, বিরক্তির ভাব ঠোঁটে ফুটিয়ে বললেন, আপনার তবুও উচিত ছিলো আগে আমার কাছে আসা।

পোয়ারো কোনো উত্তর দিল না এবার, ফলে আবার বলতে শুরু করলেন মেরিডিথ, পক্ষপাতিত্ব আছে ফিলিপের।

তাই নাকি?

আসলে এই ধরনের পক্ষপাতিত্বের দোষ ওর মনের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, চট করে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে পোয়ারোকে আবার বললেন, আপনার কাছে ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে বলেনি?

এতোদিন পরে, বিশেষ কোনো দরকার আছে কি তার?

মেরিডিথ চট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানি। এতোদিন আগের ঘটনা, চুকে বুকে গেছে সবকিছুই। সব লাভ লোকসানের ঊর্ধে ক্যারোলিনও। তবুও একটা ভুল ধারণা আপনি নিয়ে থাকবেন আমি এ চাই না।

এবং মনে হয় আপনার ছোট ভাই একটা ভুল ধারণা আমার মনে জন্মে দিতে পারেন?

সত্যি কথা বলতে কি, হয় কথাটা কিভাবে বলি…ওদের মধ্যে…মানে এক অদ্ভুত ধরনের শত্রুতা ছিলো ফিলিপ আর ক্যারোলিনের মধ্যে।

কেন? মেরিডিথকে বেশ বিরক্ত আর চঞ্চল করে তুললো পোয়ারোর প্রশ্নটা।

কেন কি করে জানবো আমি কেন? এভাবেই ঘটে এগুলো। ফিলিপ সুযোগ পেলেই খোঁচা মারতো ক্যারোলিনকে। ওকে অ্যামিয়াস বিয়ে করার পর বেশ রেগেই গিয়েছিলো ফিলিপ। ওদের ছায়া এক বছরেরও বেশি মাড়াতো না। অথচ সব সময়েই অ্যামিয়াস ছিলো ওর প্রাণের বন্ধু। ক্যারোলিন ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বের, ফিলিপ এই ধরনের আশংকা করতো।

ফাটল ধরেছিলো কি?

না, নিশ্চয়ই না। ভীষণ ভালোবাসতো ফিলিপকে, অ্যামিয়াস। ঠাট্টা নিজেদের মধ্যে করলেও শেষ দিন পর্যন্ত চিড় খায় না বন্ধুত্বে।

আপনার ভাই এলসা গ্ৰীয়ারের ব্যাপারটা কি চোখে নিয়েছিলেন?

কঠিন বলা। তবে বেশ বিরক্ত হয়েছিলো অ্যামিয়াসের পাগলামির জন্যে। শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না প্রায়ই বলতো। অ্যামিয়াসকে মাঝখান থেকে কষ্ট পোয়াতে হবে। তবে ক্যারোলিনকে আমার ধারণা ঐভাবে অপদস্থ হতে দেখে বোধহয় ফিলিপ ক্ষীণ একটা আনন্দ উপভোগ করতো মনে মনে।

চমকে উঠলো পোষারো, সত্যি কি ওরকম কিছু ভাবতেন উনি? না না, আমায় ভুল বুঝবেন না। বড়জোড় বলতে পারি আমি ওই ধরনের একটা চিন্তা অগোচরে ওর মনের মধ্যে থাকতে পারতো। নিজেও ও বুঝতে পারতো কিনা সন্দেহ। ফিলিপের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, তবে একই রক্ত দুজনের শরীরে বইছে তো। মোটামুটি বুঝতে পারে এক ভাই অন্য ভাইয়ের চিন্তাভাবনা।

আর ঐ দুর্ঘটনা ঘটার পরে? মেরিডিথ ব্লেক জোরে মাথা নাড়লেন, ব্যথার ঢেউ মুখের ওপর বয়ে গেলো। বললেন, বেচারি ফিলিপ কষ্ট পেয়েছিলো ভীষণ মানসিক। খুবই ভালবাসতো অ্যামিয়াসকে। বছর দুয়েকের ছোট্টো ছিল ফিলিপ, ফলে একটু বেশিই পেয়েছিলো আঘাতটা। এবং দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলো ক্যারোলিনের ওপর।

তাহলে ফিলিপের মনে তখন অন্ততঃ কোনো সন্দেহ এ ব্যাপারে ছিলো না।

কারুরই ছিলো না আমাদের। ..এতদিন পরে আজ আপনি এসে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছেন পুরানো ব্যাপারটা।

আমি না, ক্যারোলিন ক্রেল? মেরিডিথ ব্লেক বোবার মতো তাকিয়ে থেকে বললেন, ক্যারোলিন? মানে বুঝতে পারছি না আপনার কথা।

পোয়ারো, মেরিডিথের চোখে চোখ রেখে বললো, দ্বিতীয় ক্যারোলিন ক্রেল।

আস্তে আস্তে মেরিডিথের মুখে উত্তেজনার ভাবটা মিলিয়ে গেলো, ও হ্যাঁ, বাচ্চা মেয়েটা, কার্লা–আপনাকে ভীষণ ভুল বুঝছিলাম একটুর জন্য আমি।

আসলে আমি ক্যারোলিনের কথা বলছি আপনি ভেবেছিলেন? ভেবেছিলেন আপনি কিছুতেই ক্যারোলিন-কি ভাবে বলি?–শান্তি পাচ্ছেন না কবরের মধ্যে।

কেঁপে উঠলেন মেরিডিথ, না মশাই, না, চুপ করুন।

ঐ মহিলা একটা চিঠি লিখেছিলেন মেয়েকে আপনি জানেন, শেষ চিঠি, আর উনি নির্দোষ তাতে লিখেছিলেন।

অবিশ্বাসের সুর গলায়, মেরিডিথ বলে উঠলেন, ক্যারোলিন ঐ কথা লিখেছিলো?

হা বললো পোয়ারো, কেন আশ্চর্য লাগছে খুব?

আদালতে ওকে দেখলে একথা শুনে আপনিও আশ্চর্য হতেন। অসহায়, বেচারী, ওকে সবাই তাড়া করে চলেছে ব্যাধের মতো। এবং সামান্যতম চেষ্টা পর্যন্ত বাঁচবার জন্যে ও করছে না।

তবে কি হার মেনে নিয়েছিলেন উনি?

্না, না, ওর এই ধরনের পরাজিতের মনোভাব ছিলো না। আমার মনে হয়েছিলো সে যে মানুষটিকে ভালবাসতো সে তাকেই খুন করে ফেলেছে জানতে পেরে এটা হয়ে গিয়েছিলো ওই রকম। জেনেশুনেই নয়তো করেছে।

আপনি কি এখনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন।

ও, এই ধরনের চিঠি লেখার কথা বলছেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আপনি?

 মিথ্যা ভাষণ তো হতে পারে সৎ উদ্দেশ্যে, আভাস দিলো পোয়ারো।

হতে পারে, মনের দ্বিধাভাব কাটিয়ে কথাটা বলেই মেরিডিথ বলে উঠলেন, না, হতে পারে না তা, ও ধরনের কাজ ক্যারোলিনের চরিত্রে সম্ভব নয়…।

মাথা নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। সে কথা কার্লা লেমারচেন্টও বলেছিলো। তবে শৈশবের স্মৃতির ওপর নিজের করে ওর বক্তব্য বলা। মেরিডিথ ব্লেক সেদিক দিয়ে অনেক ভাল ভাবে ক্যারোলিনকে চিনতেন। পোয়ারো এই প্রথম সমর্থন পেলে কার্লার বিশ্বাসের।

যেন নিজের মনে মেরিডিথ বলতে লাগলেন, যদি…যদি ক্যারোলিন নির্দোষ হয়…তবে তো একটা বিরাট পাগলামি পুরো ব্যাপারটাই।…না, না, অন্য কিছু আমি ভাবতে পারছি না। পোয়ারোর দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন, আপনি? কী মনে করেন আপনি?

পোয়ারো সামান্য নিস্তব্ধতার পর বললো, আমি এখনও পর্যন্ত কিছু ভাবিনি। আমি এখন শুধু অতীত সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে সংগ্রহ করে চলেছি। কেমন ছিলেন ক্যারোলিন। কেমন ছিলেন অ্যামিয়াস ক্রেল। অন্য যারা ঐ সময়ে ছিলেন, কেমন মানুষ ছিলেন তাঁরা। ঠিক কি কি ঘটেছিলো ঐ দুদিন। আমার দরকার এগুলো। তারপর বিশ্লেষণ করতে বসবো ঘটনাগুলোকে নিয়ে। আপনার ভাই ও ব্যাপারে সাহায্য করছেন। ওঁর মনে আছে ঘটনা সম্বন্ধে যেটুকু আমাকে তার একটা বিবরণ লিখে দিচ্ছেন।

মেরিডিথ কড়া গলায় বললেন, আপনার ও থেকে লাভ হবে না তেমন কিছু। খুব ব্যস্ত মানুষ ফিলিপ। ওর মনে থাকে না অতীতের সব কথা। হয়তো তথ্য ভুল দিয়ে বসবে।

বাদ পড়ে যেতে পারে ফাঁক থেকে, যেতে পারে, বুঝি সেটা। হঠাৎ কথার মধ্যে কথা বলে উঠলেন মেরিডিথ। বলছিলাম কি আমি…একটু লাল হয়ে গেলেন লজ্জায়, আপনি যদি চান–পারি আমিও মানে ওর লেখাটা আমার লেখার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে আপনি পারবেন। ভালো হবে না?

পোয়ারো খুব খুশি হয়ে বললো, হবে, আমার কাছে আপনার লেখাটাও ভীষণ মূল্যবান হবে। একেবারে পরিকল্পনা পয়লা সারির।

ঠিক তাই। লিখবো আমি। কিছু পুরানো ডাইরি আছে আমার। আমার ভাষা-টাষা তেমন ভালো নয়, ভুল লিখি বানানও। অতএব আমার কাছে খুব ভালো একটা আশা করবেন না।

আহা, আপনার কাছ থেকে আমি তো কোনো সাহিত্য চাইছি না, স্রেফ সরল বর্ণনা ঘটনার। কি বলেছিলো কারা, কেমন কে দেখতে, ঠিক ঘটেছিলো কি এই সব চাই জানতে। এমন কি জানাবেন অপ্রাসঙ্গিক মনে করলেও। পরিবেশটাকে সব কিছু মিলিয়ে জানা সম্ভব হবে।

মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছি, যে সব জায়গা বা মানুষদের দেখেননি আপনি একটা কল্পনা তাদের সম্বন্ধে হবে আপনার পক্ষে।

ঘাড় নেড়ে স্বীকার করলো পোয়ারো, আপনার কাছে আর একটা অনুরোধ আছে। এরই লাগোয়া অ্যাল্ডারবেরির জমিদারীটা, ওখানে সম্ভব হবে কি একবার চাওয়া। মানে দুর্ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিলো সেটা আমি নিজের চোখে একবার দেখতে চাই।

তা যেতে পারি নিয়ে, কিন্তু বদলে গেছে অনেক।

কিছু তৈরি করা হয়নি তো নতুন করে? উদগ্রীব হলো পোয়ারো।

না, অতো খারাপ হয়ে যায়নি ঘর বাড়ির অবস্থা। এখন ওটা একটা হোস্টেল হয়ে গেছে। ছেলে-ছোকরা থাকে অনেক। ঘরগুলো ছোট করা হয়েছে পাটিশন করে। কিছু কিছু বদলেছে। উঠোনগুলোও।

কেমন ছিলো আগে নিশ্চয়ই আমাকে আপনি বুঝিয়ে দিতে পারবেন?

চেষ্টা করবো যতোটা সম্ভব। মেরিডিথ পোয়ারোকে একটা ঢালু লনের পথ দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।

কে বিক্রি করলো অ্যাল্ডারবেরির বাড়িটা?

যে একজিকিউটার ছিলে কার্লার পক্ষে তারা। অ্যামিয়াস মারা যায় উইল না করেই, ফলে মেয়েরই প্রাপ্য এখন সব সম্পত্তি। কারণ মেয়েকে ক্যারোলিনও তার অংশ দিয়ে যায়।

কিছু দেননি সৎ বোনকে?

মোটামুটি ভালোই টাকাকড়ি রেখে গেছেন অ্যাঞ্জেলার বাবা।

ঘাড় নাড়লো পোয়ারো, বুঝেছি।..কিন্তু আপনি আমায় এ কোথায় নিয়ে চলেছেন? সমুদ্রের তীর তো সামনেই দেখতে পাচ্ছি।

আপনাকে এখানকার ভূগোলটা একটু বুঝিয়ে দিতে হবে দেখছি। সব দেখতে পাবেন একটু এগোলেই।…একটা খাঁড়ি ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন…ওটাকে লোকে উটের খাঁড়ি বলে কারণ উটের গলার মতো দেখতে বলে। ছোটখাট একটা নদীর মুখের মতো। অ্যাল্ডারবেরিতে ড্যাঙ্গা দিয়ে যেতে গেলে যেতে হয় অনেকটা ঘুর পথে। যাতায়াত এই খাড়ি নৌকো করে করলে সময় ও পথ দুটোই কম লাগে। অ্যাল্ডারবেরি হল খাঁড়ির উল্টো পাড়ে। এই তো দেখা যাচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে।

ওরা একটা সরু তীরের কাছে এসে পড়েছে কথা বলতে বলতে, ছোট্ট একটু জঙ্গল সামনে, তার পাশ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাল্ডারবেরির চুড়ো।

দুটো নৌকো তীরের ওপর তোলা। একটা নৌকো ঠেলাঠেলি করে জলে ভাসিয়ে দুজনে এগোতে লাগলেন উল্টো পাড়ের দিকে দাঁড় বেয়ে।

আগে আমরা খুব একটা ঝড় বৃষ্টি না হলে এইভাবেই যেতাম। গাড়ীতে গেলে প্রায় তিন মাইল লাগে ঘুরপথে।

দুজনে ওপাড়ে পৌঁছে আবার একটা সরু পথ দিয়ে শুরু করলেন হাঁটতে। গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে পথটা বেরিয়ে এগিয়ে গেছে পাথর বসানো দেওয়ালের গা ঘেঁষে। মেরিডিথ বললেন সেটা দেখিয়ে, ওরা ঐটাকে কামান বাগান বলতো। একটা বাঁক নেবার পর একটা দরজা দেখা গেলো দেওয়ালের গায়ে। দুজনে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

গাছের ছায়ায় ছায়ায় আসছিলেন এতোক্ষণ বেশ, ফাঁকা জায়গায় এখানে ঢুকে হঠাৎ পোয়ারোর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। খোলামেলা সুন্দর উঁচু জমি কামান বসানো দেওয়ালের ফোকরে ফেঁকরে। দূরে সমুদ্র গাঢ় নীল রঙের।

জায়গাটা চমৎকার। বললেন মেরিডিথ। সিমেন্ট কংক্রিটের একটা নতুন বাড়ি বাগানের পেছন দিকটায়। আগে কিন্তু এটা ছিলো না, ওখানেই অ্যামিয়াস ছবি আঁকতো। তখন বেঞ্চ, টেবিল পাতা থাকতো। দেখছি খুব একটা বদলায়নি।

তাহলে এখানেই ঘটনাটা ঘটেছিলো? আগ্রহের সুর পোয়ারোর গলায়।

হ্যাঁ, ওখানে বেঞ্চটা ছিল, ঐ শেডটার পাশে। অ্যামিয়াসকে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো ওটার ওপরেই। এমনিতে ছবি আঁকার সময় মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে বেঞ্চটার ওপর একমনে ইজেলের ওপর দেখতো ছবিটাকে। তারপর এক সময় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ক্যানভাসের ওপর তুলি বোলাতে শুরু করতো পাগলের মতো।

মেরিডিথ আবার শুরু করলেন একটু থেমে, ব্যাপারটা সেই জন্যেই খুব স্বাভাবিক লেগেছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন অ্যামিয়াস বিশ্রাম করছে চোখ বুজে। কিন্তু ভোলা চোখ আর শক্ত হয়ে ওঠা দেহটাকে দেখেই বাড়ে সন্দেহ। ঐ ভাবে…ঐ ভাবেই তো ঘটে।…ব্যথা নেই কোনো…

যে প্রশ্নটা পোয়ারো করলো যেন সেটা আশা করেছিলেন মেরিডিথ, প্রথম কে দেখেছিলো?

ও দেখেছিলো। ক্যারোলিন, লাঞ্চ খাবার পর। দেখেছিলাম সব শেষে আমি আর এলসা, মানে জীবিত অ্যামিয়াসকে। মনে হয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো বিষের ক্রিয়া। যাই হোক সবটা তো আমি লিখেই দিচ্ছি। আমার পক্ষে সহজ হবে সেটাই।

তারপর হুড়মুড় করে কোনো কথা না বলে মেরিডিথ হাঁটতে লাগলো ওর পেছনে পেছনে।

দুজনে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আর একটা উঁচু মতন জায়গায় পৌঁছলেন। মেরিডিথ গাছগাছালির মধ্যে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে ছিলো একটা বেঞ্চ তার টেবিল। আমি এখানে সেদিন সকালে বসেছিলাম। তখন অবশ্য এখানে এতো গাছপালা ছিলো না পরিষ্কার দেখা যেতে কামান বসানোর দেওয়ালটা। ঘাড় বেঁকিয়ে ঐখানে বসে এলসা পোজ দিয়েছিলো। মেরিডিথ নিজের ঘাড়টা বেঁকিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

ওখান থেকে বাড়ির দিকে এগোলেন। জর্জিয়ান প্যাটার্নের। আগেকার দিনের বাড়ি। প্রায় পঞ্চাশটা খুপরি করা হয়েছে কাঠের সবুজ লনের ওপর। এগুলো নতুন। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা এখানে থাকে। হৈ চৈ লেগে থাকে বোর্ডিং বাড়ির। সকলেই নতুন এখানকার বাসিন্দারা, অতএব কিছু দেখার নেই। ফেরা যাক চলুন। আবার হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে ফিরে এলেন মেরিডিথ আর পোয়ারো।

মেরিডিথ হঠাৎ বলে উঠলেন, জানেন, আমি ঐ ছবিটা কিনে নিয়েছিলাম। অ্যামিয়াস যে ছবিটা আঁকছিলো। যদি ছবিটা নোংরা মনের লোকর হাতে পড়তো তাহলে কেচ্ছা কাহিনী ফলাও করে প্রচার হতোই নানারকম, যাতে সেটা না হয় তার জন্যে ওটা আমি নিজেই কিনে নিই। চমৎকার ছবি। এটাই ওর সেরা শিল্পকর্ম তা বলতো অ্যামিয়াস। শেষ হয়ে এসেছিলো প্রায়। মাত্র দু-একদিনের কাজ বাকি ছিলো। দেখতে চান…দেখবেন নাকি একবার ছবিটা।

দেখবো নিশ্চয়ই।

মেরিডিথ হলঘর পার হয়ে একটা ছোট্ট ঘরের দরজা খুললেন। ঘরটা বোধহয় তেমন ব্যবহার করা হয় না। ধুলোময়লার ভ্যাপসা বন্ধ। বেশ কষ্ট করে মেরিডিথ একটা জানলা খুললেন। এঁটে গিয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটাকে এক ঝলক মিষ্টি গন্ধ এসে ভরিয়ে দিলো। বলার দরকার পড়লো না ঘরটা যে কি তা। বেশ তাক কয়েকটা, সেখানে এখনও শিশি-বোতল রাখার ছাপগুলো আছে। একটা বেসিন গাঁথা দেওয়ালে। কিছু অকেজো রাসায়নিক গবেষণার যন্ত্রপাতি।

নিঃশ্বাস বুক ভরে নিয়ে মেরিডিথ বাইরের দিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, সব কথা কত সহজে মনে পড়ে যায়। জুইফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম এইখানে দাঁড়িয়ে–আর নির্বোধের মতো কথার জাল বুনে চলেছিলাম। গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেছিলাম আমার ওষুধ পত্রের।

পোয়ারো জানলা দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়িয়ে জুই ফুলের একটা ছোট্ট ডাল ছিঁড়ে নিলো। মেরিডিথ বড় বড় পা ফেলে হেঁটে গেলেন একটা দেওয়ালের দিকে। ছবি ঝুলছে একটা, যাতে ময়লা না পড়ে তার জন্য এটা একটা বড় কাগজ দিয়ে ঢাকা।

মেরিডিথ কাগজটা একটানে সরিয়ে দিলেন। পোয়ারোর নিঃশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো। অ্যামিয়াস ক্রেলের এর আগে পোয়ারো মোট চারটে ছবি দেখেছে। দুটো স্টেট গ্যালারীতে, লণ্ডনের একটা ছবির দোকানে অন্য একটা আর একটা গোলাপ গুচ্ছের। আর চোখের সামনে এখন ভেসে উঠেছে এমন একটা ছবি, যেটাকে শিল্পী নিজে সবার সেরা বলেছেন। এবং বুঝতে পারলো পেয়ারোও সত্যিই অ্যামিয়াস এক অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্পী।

ছবিটাকে একটা ভাসা-ভাসা জিনিস বলে মনে হচ্ছিলো প্রথম নজরে, যেন ভালো একটা পোস্টার। সুস্পষ্ট উল্টোপাল্টা রঙের স্কুল ব্যবহারের চিহ্ন। কটকটে হলদে রঙের জামা একটা মেয়ের পরনে প্যান্ট গাঢ় নীল রঙের। উত্তাপ নীল রঙের সমুদ্রের পটভূমিতে ধূসর রঙের দেওয়ালের ওপর বসে।

বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে কিন্তু প্রথম দর্শনে। সূক্ষ্ম বিকৃতি সামান্য সামান্য নানা জায়গায় ঘটানো হয়েছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগায় অসাধারণ উজ্জ্বল আর স্বচ্ছ আলোর খেলায় ছবিটা। আর মেয়েটি…।

..এবং প্রাণবন্ত অদ্ভুত। যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্যে যেন জ্বলজ্বল করছে ছবিটার সব কিছুই। যেন কথা বলছে মুখটি আর চোখ…।

প্রাণের স্পন্দন অতিমাত্রায় স্পষ্ট সেখানেও। মোহময়ী যৌবনের প্রতীক। তাহলে অ্যামিয়াস ক্রেল এটাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন এলসা গ্ৰীয়ারের মধ্যে যার ফলে শান্তির প্রতিমূর্তি ক্যারোলিনকেও উপেক্ষা করার জন্যে উনি অন্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এক অফুরন্ত প্রাণশক্তি এলসা, যেন এলসাই যৌবন।

অপূর্বসুন্দর দেহলতা, উদ্ধত, অহংকারী, হেলানো মাথাটা, জয়ের আনন্দের জিগীষা চোখের দৃষ্টিতে, যেন তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, লক্ষ্য করছে…করছে অপেক্ষা…।

বলে উঠলো পোয়ারো, অসাধারণ–দারুণ অসাধারণ ছবি।

একটু যেন মেরিডিথের গলাটা কাপলো, এতো বাচ্চা মেয়েটা

ঘাড় নেড়ে পোয়ারো ঠিক করে নিলো মনে মনে তারপর ভাবলো, সাধারণ এই কথাটা বলার সময়, কি ভাবে পুরুষেরা, এ তো বাচ্চা। নিষ্পাপ কতো, কতো অসহায়। কিন্তু তা তো নয়, যৌবন। বড় স্থূল যৌবন, উদ্ধত বড়, নিষ্ঠুর বড়। এবং আর একটা জিনিস–কত অল্পেই ভেঙে পড়ে যৌবন।

পোয়ারো বেরিয়ে এলো মেরিডিথের সঙ্গে। নাহ এবার দেখা করতে হবে এলসা গ্ৰীয়ারের সাথে। কালের স্পর্শে এই যৌবনবতী, মোহময়ী, বিজয়িনী স্কুল প্রকৃতির মেয়েটি পাল্টেছে কতোটা দেখা দরকার তা। আগ্রহ বাড়ছে পোয়ারোর।

তাকে অনুসরণ করে চলেছে যেন মেয়েটির দৃষ্টি। পোয়ারোকে কিছু বলতে চাইছে।

যদি পোয়ারো এটা বুঝতে পারতো কী বলতে চাইছে, তাকে রক্ত মাংসের মহিলাটিই বা কি বলতে পারে, কিংবা এমন কথা বলতে চাইছে ঐ চোখ দুটো যা বলতে পারবে না সত্যিকারের মহিলাটি?

বিজয়িনীর অস্মিতা চোখের ভাষায় জগতকে তুচ্ছ করা। অথচ তার হাত থেকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে করায়ত্ত শিকারটিকে।

হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ফলে কামনার ধন, চোখের আলোয় কি পাওয়া যাবে এখনও বঞ্চিতের, হতাশার শেষ ম্লান আভাটুকু।

শেষবারের মতো পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে আর একবার ছবিটা দেখে নিলো।

একবারে যেন জীবন্ত।

হঠাৎ পোয়ারোকে এক অজানা আশংকা এসে গ্রাস করলো…।

.

অষ্টম অধ্যায়

রোস্ট করা মাংস পেয়েছিলো এই ছোট্ট শূকরছানাটি..

 ডারউইন টিউলিপ ফুলের বাহার ব্রুকস্ট্রীটের বাড়িটার জানলা বাক্সে। দরজা দিয়ে সাদা লাইলাব ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছে হল ঘরে রাখা পবরাট ফুলের পাত্রের থেকে।

পোয়ারোর হাত থেকে একজন মাঝবয়সী খানসামা টুপি আর ছড়িটা নিলো। ওটা নিয়ে গিয়ে আর একজন চাকর যথাস্থানে রাখলো। আস্তে আস্তে খানসামা পার্থক্য বজায় রেখে বললো, স্যার এই পথ দিয়ে আসুন।

হলঘর পার হয়ে একটা ঘরের দরজা একটু খুলে নিখুঁত ভাবে এরকুল পোয়ারোর নামটা উচ্চারণ করে তার আগমন বার্তা খানসামা ঘোষণা করলো।

একজন রোগা লম্বা মতন ভদ্রলোক উঠে এসে পোয়ারোকে স্বাগত জানালেন।

এখনও চল্লিশ পার হননি লর্ড ডিটিশাম। শুধু তিনি লর্ড খেতাবধারী জমিদারই নন, কবিও বটে একজন। প্রচুর অর্থব্যয়ে তার লেখা ছুটি কাব্যনাটিকা মঞ্চস্থ করা হয়েছিলো এবং দুটিই মঞ্চসফল। বেশ উঁচু কপালটা, ধারালো ভাব চিবুকে, অপ্রত্যাশিতভাবে চোখ আর মুখটা সুন্দর। লর্ড ডিটিশাম বললেন, মিঃ পোয়ারো বসুন।

পোয়ারো বাড়ানো সিগারেটটা নিলো, সযত্নে দেশলাই জ্বেলে লর্ড ডিটিশাম ওটা ধরিয়ে দিলেন, তারপর বললেন চিন্তা করতে করতে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনি যে দেখা করতে এসেছেন আমি তা জানি।

পোয়ারো বললো, লেডি ডিটিশাম আমাকে দয়া করে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দিয়েছেন। ওহ হ্যাঁ।

বেশ কিছুক্ষণ লর্ডকে অস্বস্তিকর ভাবে চুপ করে থাকতে দেখে পোয়ারো বললো, আপনার আশা করি তাতে আপত্তি নেই, লর্ড ডিটিশাম।

হঠাৎ স্বপ্নালু মুখে হাসি ফুটে উঠলো চকিতে, মিঃ পোয়ারো আজকাল স্বামীদের আপত্তিতে ততো আর গুরুত্ব কেউ আরোপ করে না।

আপনার তাহলে আপত্তি আছে?

না, আমি তা বলতে পারি না। তবে আমি অস্বীকার করতে পারছি না যে একটু আতঙ্কের প্রতিক্রিয়া যে আমার স্ত্রীর মনের ওপর হবে তা নয়, বলছি খোলাখুলি ভাবেই। অনেক বছর আগে তখন আমার স্ত্রীর বয়েস অনেক কম, তখন তাকে যেতে হয়েছিলো এক দারুণ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে। আমার ধারণা যে সেই আঘাতটা কাটিয়ে উঠেছে বলেই। সে সেটা ভুলেও গেছে আমার বিশ্বাস। আপনি এতোদিন পরে এলেন এবং পুরোনো স্মৃতি যে জাগিয়ে তুলবে আপনার প্রশ্নাবলী একথা অস্বীকার করা যায় না।

সত্যিই আমি খুব দুঃখিত এর জন্যে। বিনীতভাবে পোয়ারো বললো।

বুঝতে পারছি না ঠিক, এর ফল কি হবে।

লর্ড ডিটিশাম আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, যত সংক্ষেপে কাজটা সারা যায় সারবো। এবং যতোটা সম্ভব কম দুঃখ দেবার চেষ্টা করবো লেডি ডিটিশামকে। উনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কোমল এবং কাতর হয়ে ওঠেন অল্পে।

হঠাৎ পোয়ারোকে চমকে দিয়ে লর্ড ডিটিশাম জোরে হেসে উঠলেন, এলসা? এলসা ঘোড়ার মতো শক্তি রাখে।

তাহলে…? পোয়ারো খুব বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

লর্ড ডিটিশাম বললেন, যে কোনো মানসিক আঘাত সহ্য করবার ক্ষমতা রাখে আমার স্ত্রী। কেন সে আপনার সাথে দেখা করতে রাজী হয়েছে আপনি কি তা জানেন?

ধীর ভাবে পোয়ারো বললো, কৌতূহল?

শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠলো লর্ডের চোখে, তাহলে ধরতে পেরেছেন?

এটাই তো স্বাভাবিক। সব সময়েই মহিলারা বেসরকারী গোয়েন্দাদের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের নরকে যাবার পরামর্শ দেন পুরুষেরা।

নরকে যাবার পরামর্শ কিছু মহিলাও দিতে পারেন।

 হ্যাঁ, তবে দেখা করার পর, আগে নয়।

ঠিক হয়তো, একটু থামলেন লর্ড ডিটিশাম, তা আসল উদ্দেশ্যটা কি এই বইটি লেখার পেছনে?

কাঁধ ঝাঁকালো পোয়ারো, পুরানো দিনের সুর লোকে খুঁজে বেড়ায় সন্ধান করে পুরানো দিনের নাটকের, পোক চায় পুরানো দিনের, আবার অনেকে পুরানো দিনের কথা জানতে চায় নতুন করে।

ফুঃ! বললেন লর্ড ডিটিশাম, যদি তা বলেন তবে আমিও বলবো ফুঃ। কিন্তু তাই বলে আর পাল্টে দিতে পারেন না মানুষের স্বভাব। এক ধরনের নাটক খুন করা। মানবজাতির আগ্রহ নাটক সম্বন্ধে সেই অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে।

বিড়বিড় করে লর্ড ডিটিশাম বললেন, তা জানি, তা জানি…।

বুঝতে পারছেন তাহলে…লেখা হবে বইটা। কর্তব্য হলো আমার দেখা যাতে কোনো ভুল তথ্য ঢুকে না যায়, বিকৃত যেন না হয়ে যায় কোনো ঘটনা।

ধারণা ছিলো আমার তো সত্য ঘটনা জনসাধারণের সম্পত্তি, লর্ড ডিটিশাম বললেন।

তা ঠিক, কিন্তু নিশ্চয়ই তার ব্যাখ্যাগুলো নয়।

 রাগতভাবে হঠাৎ ডিটিশাম বললেন, মিঃ পোয়ারো জানতে পারি কি এ কথার মানে?

লর্ড ডিটিশাম দেখুন, নানা পন্থা আছে, ঐতিহাসিক কোনো সত্য ঘটনাকে দেখার। যেমন ধরুন মেরী কুইন অফ স্কাটস–ওঁকে কেউ শহীদ বলেছে, বা কেউ নীতিজ্ঞানহীন স্বার্থপর মহিলা হিসেবে ওঁকে এঁকেছেন, কেউ বলেছেন একজন সরলমনা দেবী ছিলেন মেরী, ওঁকে কেউ খুনী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দেখেছেন। উনি ছিলেন অনেকের মতে ভাগ্য আর পরিস্থিতির শিকার। মনে করতে পারে যার যা খুশি।

কিন্তু এক্ষেত্রে, তার স্ত্রী খুন করে অ্যামিয়াস ক্রেলকে। অবশ্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিচার চলাকালীন এবং অবাঞ্ছিভাবে বেশ কিছুটা ঝঞ্ঝাটে আমার স্ত্রী জড়িয়ে পড়েন। খুব বিরূপ হয়ে উঠেছিলো সাধারণ মানুষ তার প্রতি।

একটু প্রখর ইংরেজদের নীতিজ্ঞানটা। পোয়ারো বললো।

আপনার?

আমার, সুস্থ নৈতিক জীবনযাপন আমি করি। তবে নীতিজ্ঞানের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই তার সঙ্গে।

লর্ড ডিটিশাম বললেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কেমন ছিলেন ঐ মিসেস ক্রেল মহিলাটি। শুধু কি স্ত্রীর অপমানিত ব্যাপার, না অন্য কিছু ছিলো এর পেছনে?

সেটা জানতে পারেন আপনার স্ত্রী, জানালো পোয়ারো।

 ঐ মামলাটা সম্বন্ধে আমার স্ত্রী একটা কথাও আজ পর্যন্ত বলেনি।

যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো পোয়ারোর আগ্রহ, যেন দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে…।

আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো লর্ডের গলার স্বর।

কবির সৃজনধর্মী মানস কল্পনা…। উঠে গিয়ে লর্ড ডিটিশাম ঘণ্টা বাজালেন, আপনার জন্যে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছে…।

পোয়ারো খানসামার সঙ্গে পা ডুবে যাওয়া নরম কার্পেটের ওপর হাঁটতে লাগলো। পোয়ারো দু থাক সিঁড়ি ভেঙে একটা ঘরের মধ্যে এলো। শুধু অর্থের প্রাচুর্য চারপাশে। চারদিকে মায়াজাল সৃষ্টি করেছে স্তিমিত আলোয়, ফুলের বাহার সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে। দামী জিনিস লর্ড ডিটিশামের ঘরটায় থাকলেও তাতে রুচির পরিচয় ছিলো। এখানে কিন্তু বড় বেশি স্থূলভাবে প্রকট হয়ে আছে অর্থের প্রাচুর্য। এখানে অহংকারটাই প্রধান রুচির বদলে। মনে মনে পোয়ারো বললো, মাংস রোস্ট করা,…হ্যাঁ, রোস্ট করা মাংস।

এটা বসবার ঘর লেডি ডিটিশামের উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা ম্যান্টলপীসের পাশে।

পোয়ারোর মাথার মধ্যে একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠলো, তা সরাতে পারলো না শত চেষ্টাতেও যৌবনেই মৃতা…।

পোয়ারোর–এ কথাটাই মনে হলো এলসা ডিটিশামের দিকে তাকিয়ে।

তার পক্ষে এলসাকে চেনা সম্ভব হতো না মেরিডিথ ব্লেকের বাড়িতে দেখা ছবিটা দিয়ে। ঐ ছবিটা ছিলো, যৌবনের প্রাণশক্তির মূর্ত প্রতীক। পোয়ারো যাঁকে এখন দেখছে, তার মধ্যে চিহ্নমাত্র নেই যৌবনের, যৌবন কোনো কালে ছিলো বলে মনে হয় না। তবে অস্বীকার করা যায় না একথা যে এলসা সুন্দর এবং সুন্দরী আছেন এখনও, পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে এগিয়ে এলেন এলসা। খুব বেশি নয় বয়সও, বড়জোর ছত্রিশ। সযতনে কুচকুচে কালো চুল বাঁধা। অপূর্ব সুন্দর দেহের বাঁধুনী।

মনের মধ্যে পোয়ারোর একটা অব্যক্ত ব্যথার সুরে গুমরে উঠলো। বৃদ্ধ বলেছিলেন জোনাথন জুলিয়েটের কথা। কিন্তু এলসার মধ্যে সেই জুলিয়েটের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। জুলিয়েট, রোমিওকে হারিয়ে মরে গিয়েছিলো যৌবনেই।

অথচ মরেনি এলসা গ্ৰীয়ার…। মিঃ পোয়ারো আমার খুবই আগ্রহ আছে। বসুন, আমাকে কি করতে হবে বলুন, কোনো উত্থান পতন নেই এলসা ডিটিশামের জানায়, কথাগুলো বলে গেলেন এক সুরে।

মনে হলো পোয়ারোর, ওঁর কিন্তু কোনো আগ্রহই নেই। এঁকে কোনো কিছুই আর আকর্ষণ করে না।

বড় বড় ধূসর রঙের চোখ–নিষ্প্রাণ হ্রদের মতো। পোয়ারো এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ করে থাকে যা তাই করলো, গেয়ে উঠলো সম্পূর্ণ উল্টো সুরে, ম্যাডাম সব গুলিয়ে ফেলছি আমি, গুলিয়ে যাচ্ছে সব।

না, না, কেন তা হবে? লেডি ডিটিশাম বললেন।

কারণ মনে হচ্ছে আমার নতুন করে অতীতের নাটকটাকে গড়ে তোলার চেষ্টাটা ভীষণ বেদনার হবে আপনার পক্ষে।

কথাটা শুনে এলসা বেশ খুশি হলেন। হ্যাঁ, বেশ আনন্দ, মুখে সত্যিকারের আনন্দের আভা ফুটে উঠলো।

মনে হচ্ছে আপনার মাথার মধ্যে কথাটা আমার স্বামী ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আগেই তো দেখা হয়ে গেছে। তবে কিছুই বুঝতে পারেন না উনি। কখনও পারেনওনি। আমাকে যতোটা স্বামী স্পর্শকাতর মনে করেন আমি অতোটা নই।

তখনো এলসার খুশির আমেজটা কাটেনি, বললেন, জানেন কারখানার মজুর ছিলেন আমার বাবা। অনেক টাকা পয়সা করেন প্রচুর খেটে। মোটা চামড়া না হলেও কাজটা করা যায় না। আমারও তাই।

মনে হলো পোয়ারোর ও কথাটা সত্যি। মোটা চামড়া না হলেও কেউ ও ভাবে এসে উঠতো না ক্যারোলিন ক্রেলের বাড়িতে।

লেডি ডিটিশাম বললেন, কি করতে হবে বলুন আমাকে?

ম্যাডাম আর একবার বলছি, আপনার কষ্ট হবে না তো পুরানো দিনের স্মৃতিচারণ করতে?

লেডি ডিটিশাম একটু চিন্তা করতেই শুরু করলেন। হঠাৎ পোয়াবোর তাই দেখে মনে হলো অত্যন্ত খোলামেলা মনের মহিলা এলসা। মিথ্যে কথা প্রয়োজনে বলতে পারেন, আদৌ ইচ্ছাকৃতভাবে নয়।

ধীরে ধীরে এলসা বললেন, না, কষ্ট হবে না। তবে বোধহয় হলে ভালো হতো…।

কেন?

ধৈর্য্যের বাঁধ যেন এলসা ডিটিশামের ভেঙে পড়লো, বললেন, কত বেদনার অনুভূতি না থাকাটা…।

এবং মনে হলো এরকুল পোয়রোর হ্যাঁ, মরে গেছে এলসা গ্ৰীয়ার।

অবশ্য মুখে বললো, লেডি ডিটিশাম যাই হোক, এতে কিন্তু বেশ সহজ হয়ে উঠবে আমার কাজটা।

এলসা খুশি মনে প্রশ্ন করলেন, আপনি কী জানতে চান?

ম্যাডাম আপনার স্মৃতিশক্তি তো ভালোই?

ভালো বলেই তো মনে হয় মোটামুটি।

এবং আপনি পুরানো দিনের কথা তুললে কষ্ট পাবেন না এটাও ঠিক তো?

না হবে না। মানুষ তো ব্যথা পায় ঘটনাগুলো ঘটার সময়েই। পরে নয়।

…কিছু কিছু লোকের জানি তাই হয় বলে।

কিছুতেই এডওয়ার্ড এ কথাটার মানে বুঝতে চায় না আমার স্বামী। ওর ধারণা মামলা, বিচার আর ঐসব ব্যাপারগুলো দারুণ ক্ষতির ছিলো আমার পক্ষে।

ছিলো নাকি?

উত্তরে এলসা ডিটিশাম বললেন, না বরং ওগুলো বেশ উপভোগ আমি করেছিলাম।…ওহ ভগবান, স্যার মন্টেগু ঐ বুড়ো জেরায় জেরায় আমাকে খতম করতে চেয়েছিলো। ভালোই লেগেছিলো ওঁর সঙ্গে আমার লড়তে। চেপে ধরতেও পারেননি আমাকে।

আত্মতৃপ্তির সুরটা কথাগুলো বলার সময় পোয়ারোর কান এড়ালো না। বলেই চললেন এলসা, মোহভঙ্গ করছি না তো আপনার। একটা কুড়ি বছরের মেয়ে, একেবারে ধরাশায়ী হয়ে পড়া উচিত ছিলো তার তো, মানে লজ্জায় অপমানে। আমি অথচ হইনি। ওঁরা যা বলেছিলেন আমাকে আমি গায়ে মাখিনি সেসব কথা। শুধু আমি একটা জিনিসই চাইছিলাম।

সেটা কি?

ফাঁসিতে ঝোলাতে ক্যারোলিনকে, সঙ্গে সঙ্গে এলসা ডিটিশাম বললেন।

লেডি ডিটিশামের হাত ভারী সুন্দর লম্বাটে ধরণের গড়ন হাতের তা লক্ষ্য করলো পোয়ারো। নখ বাঁকানো, শিকারী প্রাণীর থাবা।

প্রতিহিংসাপরায়ণ মনে করছেন আমাকে আপনি? ক্ষতি করলে আমার, কেউ আঘাত করলে আমাকে প্রতিশোধ নিতে আমি দ্বিধা করি না। সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মহিলা ছিলো আমার চোখে ঐ মহিলাটি। অ্যামিয়াস আমাকে চাইছে ও জানতো। ওকে ছেড়ে অ্যামিয়াসের আমাকে বিয়ে করতেও ইচ্ছে আছে। আর ঠিক সেই কারণে যাতে ওকে আমি না পাই তাই খুন করে ফেললো স্বামীকে নিজের হাতে।

সুদূর প্রসারিত করে পোয়ারোর পাশ দিয়ে দৃষ্টিকে এলসা ডিটিশাম আবার বললেন, আপনি কি কাজটাকে নীচতা বলে মনে করেন না।

আপনি কি ঈর্ষার ব্যাপারটা বোঝেন না, বা বোঝার চেষ্টা করেন না সহানুভূতি দিয়ে লেডি ডিটিশাম?

না, করি না। যদি হেরে যান আপনি, হেরে গেছেন। যদি না পারেন স্বামীকে বেঁধে রাখতে, তাকে যেতে দিন ভদ্রভাবে। এই মুঠোর মধ্যে জিনিসটা পুরো রাখা একেবারেই পছন্দ করি না আমি।

হয়তো আপনি অ্যামিয়াস ক্রেলকে বিয়ে করলে তা বুঝতে পারতেন।

আমার তো মনে হয় না তা, আমরা…এলসা হঠাৎ একটু হাসলেন। মনে হলো পোয়ারোর ঠিক হাসি নয় হাসিটা, তাতে ভয়ের ছাপ আছে। যেন বাস্তব অনুভূতির সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই তার। কথাটা ঠিক মতো আপনাকে বলে রাখা ভালো। কখনই একথা মনে করবেন না যে এক সরল মেয়েকে অ্যামিয়াস ক্রেল ভুলিয়ে তার সর্বনাশ করেছিলো। ব্যাপারটার জন্যে আমাদের মধ্যে আমার দায়িত্বই বেশি ছিলো। আমি ওকে পাবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলাম একটা পার্টিতে দেখা হবার পর থেকেই।

এক হাস্যকর অনুকরণ–এ এক অসম্ভব ভাবে হাস্যকর প্রচেষ্টা অনুকরণ করার অথচ

 আমার সর্বস্ব আমি নিবেদিত তোমার চরণে

হে আমার প্রভু, সঙ্গে যাব যেথা লয়ে যাবে…

জানতেন যদিও বিবাহিত অ্যামিয়াস,

অনুপ্রবেশকারীরা অবৈধভাবে দণ্ডিত হবে, ছাপানো নোটিশ ছাড়া বাস্তব জগতে কিন্তু আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। যদিও তার স্ত্রীকে নিয়ে সুখী না হতে পারে, আর সুখী হয়। আমাকে পেলে, তবে বাধা থাকবে কেন তা হবার পথে? একটাই তো মাত্র জীবন।

কিন্তু অ্যামিয়াস তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সুখীই ছিলেন একথা তো শুনেছি।

না। ঝগড়া করতে কুকুর-বেড়ালের মতো। স্বামীর খুঁত ধরে বেড়াতো সব সময়। ওঁর স্ত্রী কি জঘন্য মেয়েমানুষ ছিলো।

একটা সিগারেট ধরালেন এলসা উঠে গিয়ে, তারপর বললেন মৃদু হেসে, হয়তো ক্যারোলিনের প্রতি অবিচার করেছি আমি। কিন্তু সত্যিই বলছি সে বড়ো কদর্য মনের মেয়েমানুষ ছিলো।

ভীষণ দুঃখের কিন্তু ঘটনাটা, ধীরে ধীরে বললো পোয়ারো।

হ্যাঁ, সত্যিই ভীষণ দুঃখের ঘটনাটা, কথাটা বললেন এলসা আগেকার সেই ক্লান্ত সুর, তারপর যেন হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে বলে উঠলেন, আমাকেও কিন্তু দুর্ঘটনাটা শেষ করে দিয়েছিলো। মরণ হয়েছিলো আমারও। আমার জীবনে তারপর থেকে আর কিছু নেই অসীম শূন্যতা ছাড়া। আমি যেন…যেন আমি কাঁচের পাত্রে রাখা একটা খড়পোড়া মাছ, বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন এলসা শেষের কথাটা বলতে বলতে।

আপনার জীবনে কি তাহলে অ্যামিয়াস ক্রেল অতোটা জুড়ে ছিলেন?

এলসা কথাটা ঘাড় নেড়ে স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু একটু বিষাদের যেন ছায়া আছে সেই…স্বীকৃতির মধ্যে।

মনে হয় এক পেশে মন নিয়ে সব সময় আমি চলতাম,..মনে হয় উচিত সবারই জুলিয়েটের মতো অবসান ঘটিয়ে দেওয়া নিজের জীবনের। কিন্তু…কিন্তু লোকে ধরে নেবে সেটা করলে পরে আপনি হেরে গেছেন, পরাজিত হয়েছেন জীবনের যুদ্ধে।

আর তা না করলে, একটু খোঁচা মারলো পোয়ারো।

থেকে যায় সব কিছুই তো…আগের মতোই ঠিক..যদি জোর করে একবার বেরিয়ে আসা যায় সব বাধা ছিঁড়ে। পেরেছিলাম আমি। তাই আমার কাছে ওটা ততো আর বড় হয়ে ওঠেনি। চিন্তা করে দেখেছিলাম আমি এগিয়ে যেতে হবে আমাকে পরের ধাপে পা ফেলে।

হ্যাঁ, পরের ধাপ। বুঝতে পারলো পরিষ্কার পোয়ারো এই মহিলা পরের ধাপে পা ফেলেছেন প্রচণ্ড মানসিকতা দৃঢ়তা নিয়ে। মহিলা এখনও সুন্দরী, পুরুষের মনোহারিণী, তীক্ষ্ণ নখ নিয়ে শিকারী পাখির মতো আঁকড়ে ধরে জীবনের যে অংশটা শূন্য হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ তা ভরিয়ে তুলতে চাইছেন। বীর পূজা–বিয়ে হয়েছিলো নাম করা বৈমানিকের সঙ্গে। বিখ্যাত একজন অভিযাত্রী। অ্যামিয়াস ক্রেলের মতো নিশ্চয়ই ছিলেন আরনল্ড স্টিভেনসন। অন্ততঃ শরীর স্বাস্থ্যে-সৃজনধর্মী শিল্পী এলেন তারপরেই ডিটিশাম।

এলসা ডিটিশাম বললেন, কখনও ভণ্ডামি দেখা যায়নি আমার মধ্যে। আমি ভীষণ পছন্দ করি স্পেন দেশের প্রবাদ বাক্যটা–বলেছেন ঈশ্বর, চাও যা গ্রহণ করো, এবং মূল্য দাও তার যথোচিত, তা সারা জীবনে আমিও করে এসেছি। যা পেয়েছি চেয়েছি, আর সব সময়ে তার মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত।

এরকুল পোয়ারো বললো, সেটা আপনার জানা নেই, তা হলো এই যে অনেক এমন জিনিস আছে যা কেনা যায় না টাকা দিয়ে।

পোয়ারোর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন, শুধু টাকা পয়সার কথা আমি কিন্তু বলিনি।

না, না, আমি বুঝেছি সেটা। তবে এমন অনেক জিনিস পৃথিবীতে আছে সেগুলো বিক্রি করার জন্যে নয়।

বাজে কথা।

পোয়ারোর ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো, হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠলে কারখানার শ্রমিকের যে ঔদ্ধত্য ফুটে ওঠে, এলসার গলায় ফুটে ওঠে সেই সুরটাই।

পোয়ারোর মনের আকাশে নেমে এলো বিষাদের ছায়া–এক রূপসী নারী সামনেই বসে, তাকে কলুষিত করতে পারেনি কালের হস্তাবলেপ, অথচ অসীম ক্লান্তির ছাপ চোখের দৃষ্টিতে সে আর যেন জীবনের ভার বইতে পারছে না। অ্যামিয়াস ক্রেল এই মেয়েটিরই ছবি এঁকেছিলেন।

 এলসা ডিটিশাম বললেন, আপনার বইয়ের কথা শুনি, বলুন। লিখছেন কেন, কি উদ্দেশ্যটা।

কি বলি বলুন তো…সাড়া জাগানো অতীতের ঘটনাকে বর্তমানের মাদক রসে জারিত করে পরিবেশন করা ছাড়া আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

কিন্তু লেখক তো আপনি নন? না অপরাধতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ।

তার মানে লেখকরা অপরাধ সংক্রান্ত বই লিখতে গেলে পরামর্শ নেন আপনার?

 সব সময়ে না। দায়িত্ব এক্ষেত্রে কাঁধে চেপেছে।

কে চাপিয়েছে?

মানে, একজনের ইচ্ছাপূরণ করার জন্যেই বলা যেতে পারে যে বইটা প্রকাশ করার চেষ্টা চলছে।

সেই একজন কে?

মিস কার্ল লেমারচেন্ট।

মেয়েটি কে?

 অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন ক্রেলের মেয়ে।

এলসা একমুহূর্ত চেয়ে রইলেন হাঁ করে, ও হা, মেয়ে একটা ছিলো বটে। মনে পড়ছে। তা এখন সে তো বড় হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, একুশ বছর।

দেখতে কেমন হয়েছে?

বেশ লম্বা, গাঢ় রং মার মত সুন্দরী এবং সাহস আর ব্যক্তিত্ব তার দুইই আছে।

একটু চিন্তা করে এলসা বললেন, দেখা করতে ইচ্ছে করছে ওর সঙ্গে।

আপনার সঙ্গে মেয়েটি দেখা না করতে চাইতে পারে।

চমকে উঠলেন এলসা। কেন? ও বুঝেছি। বাজে ব্যাপার যতোসব। ওর মনে তো ওসব কথা না থাকাই উচিত। ওর বয়স তখন তো দু বছরেরও বেশি ছিলো না।

জানে মেয়েটি তার মায়ের বিচার হয়েছিলো তার বাবার হত্যাকারী হিসেবে।

আর ধারণা ওর আমারই দোষটা?

সেটাই তো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।

কাঁধ নাচালেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে, কখনো এরকম বেওকুফির কথা শুনিনি। যদি সামান্য বুদ্ধি দিয়ে ক্যারোলিন কাজ করতো…।

তাহলে আপনার কোনো দায়িত্ব নেই আপনি বলছেন।

কেনই বা থাকবে? আমি লজ্জা পাবার মতো কিছুই করিনি। আমি ভালোবাসতাম অ্যামিয়াসকে, ওকে চেয়েছিলাম সুখী করতে।

এলসা দূর মনস্কের মতো তাকালেন পাল্টে গেলো মুখের ভাব। ছবির এলসা গ্ৰীয়ারের চেহারাটা পোয়ারোর সামনে ভেসে উঠলো। বলে উঠলেন হঠাৎ, আপনাকে যদি দেখতে পারতাম; ব্যাপারটা যদি আপনি আমার তরফ থেকে দেখেন, তাহলে দেখতেন…।

ঝুঁকে বসলো পোয়ারো আর আমি ঠিক সেইটাই করতে চাই। এই দেখুন না, মিঃ ফিলিপ ব্লেক, তখন তো উনি বর্তমান ছিলেন, উনি তখনকার একটা খুঁটিনাটি বিবরণ কষ্ট করে লিখে দিচ্ছেন আমাকে। মিঃ মেরিডিথ ব্লেকও দেবেন বলেছেন। আপনি এখন যদি…।

এলসা ডিটিশাম জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন, ওই দুজন! এক নম্বরের হাঁদা ছিলেন ফিলিপ আর সব সময়ে ক্যারোলিনের পাশে ঘুর ঘুর করতেন মেরিডিথ। তবে ভালো মানুষটি। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে ওঁদের লেখা থেকে কিছুই আপনি জানতে পারবেন না।

লক্ষ্য করতে লাগলো পোয়ারো। এলসার মধ্যে কীভাবে আবার সঞ্চার হচ্ছে প্রাণের, জ্বলজ্বল হয়ে উঠছে চোখ দুটো। হঠাৎ বললেন ভয় পাইয়ে দেবার মতো করে, আপনি সত্যি কথাটা জানতে চান? না, না, বই লেখার জন্য নয়, শুধু নিজের জন্যে আপনার…।

কিছুই প্রকাশ করা হবে না আপনার বিনা অনুমতিতে।

আমার নিজেই সত্যি কথাটা লিখতে ইচ্ছে করছে; উত্তেজিত হয়ে উঠলেন বলতে বলতে এলসা ডিটিশাম, যদি পুরোনো দিনের কথা লিখতে হয়…লিখবো…দেখাবো আপনাকে যে খুন করেছিলো ক্যারোলিনই। বাঁচতে চাইতো অ্যামিয়াস। উপভোগ করতে চাইতো জীবনটা। ঘৃণা কখনই ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠা উচিত নয়। অথচ এটা হয়েছিলো ক্যারোলিনের ক্ষেত্রে এবং আমিও ঘৃণা করি ওকে এর জন্যে…ঘৃণা করি…ঘৃণা করি…।

পোয়ারোর কাছে উঠে এলেন এলসা, চেপে ধরে কোটের হাতটা, বললেন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন আপনি…আপনাকে করতেই হবে। আমি অ্যামিয়াস–আমরা ভীষণ ভালোবাসতাম দুজন দুজনকে…একটা জিনিস আপনাকে দেখাচ্ছি দাঁড়ান।

একটা ঘরের কোণের টেবিলের দেরাজ টেনে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা চিঠি গুপ্ত খোপ থেকে নিয়ে এলেন এলসা। বিবর্ণ হয়ে গেছে কালিটা। উদ্ধত, প্রতিহিংসাপরায়ণা একটি মেয়ের মতো মুখ ভার করে পোয়ারোর হাতে গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এলসা ডিটিশাম।

পোয়ারো খুললো চিঠিটা। এলসা-স্বপ্নের খুকু সোনা আমার। পৃথিবীতে বোধহয় তোমার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। কিন্তু আমি তবুও ভয় পাচ্ছি–অনেক বয়স হয়ে গেছে আমার-মাঝ বয়সী আমি একটা রাগী মানুষ স্থিরতা বলতে আমার মধ্যে কিছুই নেই। ভরসা রেখো না আমার ওপর, বিশ্বাস করো না আমাকে–আমি ভালো নই একটুও–শুধু ছবি আঁকা ছাড়া। ওটাই একমাত্র ভালো দিক আমার। অতএব তুমি কোনোদিনও বলতে পারবে না আমাকে যে তোমাকে সাবধান করে দিইনি।

রূপসী আমার যাই হোক না কেন, আমার চাই-ই তোমাকে, প্রয়োজনে যে আমি শয়তানের দ্বারস্থ হতেও রাজী তা জানো নিশ্চয়ই তুমি। এমন একটা ছবি আঁকবো তোমার যাতে মাথা ঘুরে যাবে মাথামোটা মানুষগুলোর,আমি পাগল তোমার জন্যে–ঘুমোতে পারছি না, ভালো লাগছে না খেতে।

এলসা…এলসা..এলসা…চিরকালের জন্যে আমি তোমারই…আমি মৃত্যুতেও তোমার। অ্যামিয়াস।

ষোল বছর আগেকার লেখা, বিবর্ণ হয়ে গেছে কালি, ছিঁড়ে পড়ার জোগাড় পাতাটা, অথচ জীবন্ত ভাষাটা, যেন থরথর করে কাঁপছে প্রাণশক্তিতে…

পোয়ারো তাকালো এলসার দিকে, কিন্তু না, কোনো নারীকে চোখের সামনে দেখতে পেল না। দাঁড়িয়ে আছে তার বদলে প্রেমে পড়া একটি বালিকা। আবার পোয়ারোর মনে পড়ে গেলো জুলিয়েটের কথা।

.

নবম অধ্যায়

কিছুই জোটেনি এই ছোট্ট শূয়োর ছানার–

কিন্তু কেন, মিঃ পোয়ারো তা কি জানতে পারি আমি?

কি উত্তর হওয়া উচিত প্রশ্নটার পোয়ারো চিন্তা করতে লাগলো, একজোড়া ধূসর রঙের তীক্ষ্ণ চোখ যে লক্ষ্য করে চলেছে তাকে এটা বুঝতে পারছিলো।

পোয়ারো বিরাট একটা ফ্ল্যাট বাড়ির ওপর তলায় এসেছে। এখানে ছোট্ট ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাট। ঐ এক চিলতে ঘরের মধ্যে রান্না করা, খাওয়া-বসা, শোয়া, সবই করা হয়। এতো সুন্দর করে তারই মধ্যে সাজিয়ে রেখেছেন, যে মনে মনে মিস সিসিলিয়া উইলিয়ামসকে তারিফ না করে পোয়ারো থাকতে পারলো না। সুন্দর রঙ লাগানো। দেওয়ালে কিছু নাম করা ছবির কপি ঝুলছে। পারিবারিক ফটোও আছে, তবে ঝাপসা হয়ে এসেছে সেগুলো।

কার্পেট, ফার্নিচার সবেরই দৈন্যদশা, সিসিলিয়া উইলিয়ামস খুব অভাবের মধ্যে আছেন বুঝতে অসুবিধে হলো না।

আবার তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো মিস উইলিয়ামসের, আমার যা মনে আছে ক্রেল মামলা সম্বন্ধে সেটা জানতে চান আপনি? কিন্তু কেন?

এরকুল পোয়ারো সম্বন্ধে তার বন্ধু-বান্ধবদের ধারণা যে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে তার ডাহা মিথ্যে কথা বলতে বাধে না। অথচ সে অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিলো এক্ষেত্রে। মিস উইলিয়ামস হলেন সেই ধরনের জবরদস্ত ইংরেজ গভর্নেস যারা অসাধারণ এক কর্তৃত্বের অধিকারী। এবং অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়া তাদের যায় না।

ফলে বই লেখার মিথ্যে কথাটা পোয়ারো না বলে আসল উদ্দেশ্যটা সরাসরি সংক্ষেপে বললেন।

মিস উইলিয়ামস মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন, খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার কথা শুনতে, কেমন হয়েছে ও, কতো বড়টি হয়েছে জানতে ইচ্ছে করছে।

দেখতে হয়েছে ভারী সুন্দর, সাহস আর মানসিক দৃঢ়তাও সমান আছে।

 ভালো, মিস উইলিয়ামস সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।

 জেদীও আছে একটু, একবার ধরে যেটা তার শেষ না দেখে ছাড়ে না।

গভর্নেস চিন্তা করতে করতে প্রশ্ন করলেন, শিল্পীভাব ওর মধ্যে আছে কি?

 মনে হয় না।

মিস উইলয়ামস নীরস ভাবে বললেন, একটা ব্যাপারে অন্ততঃ থাকা গেলো নিশ্চিন্ত।

যে মহিলার শিল্পীদের সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব আছে সেটা বোঝা গেল এই কথা থেকে।

আবার একটু থেমে বললেন, মনে হচ্ছে আপনার বর্ণনা থেকে তার মায়ের মতোই দেখতে হয়েছে।

খুব সম্ভব। আপনি হয়তো ওকে দেখলে বলতে পারবেন। দেখতে চান নাকি?

দেখতে তো নিশ্চয়ই চাই। চেনাজানা মেয়ে এককালের এখন কতো বড়ো হয়ে উঠেছে দেখতে মন চায় বৈকি। যখন শেষ দেখি ওকে তখন ওর বয়েস মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। দেখতে ছিলো ভারী মিষ্টি, শান্ত, বড় বেশি খেলনা নিয়ে খেলতো নিজের মনে। নিষ্পাপ, সরল শিশু ছিলো।

বলতে হবে ভাগ্য ভালো, তার ভীষণ কম ছিলো বয়েসটা, তা না হলে সহ্য করতে পারতো না ঐ মানসিক আঘাতটা। কিন্তু একটা ঘটেছে ও এটা বুঝতে পেরেছিলো। তবে নিশ্চয়ই সঠিকভাবে কিছুই জানতে পারেনি। বাচ্চাদের পক্ষে ওগুলো তো সুখের নয়।

মিস উইলিয়ামস বললেন, যতোটা ভাবছেন আপনি ততোটাতো নাও হতে পারতো।

কার্লা লেমারচেন্ট…আলোচনা ছোট্ট কার্লা ক্রেলের বিষয়টা নিয়ে শেষ করার আগে একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করবো যদি কেউ বলতে পারে তা আমার ধারণা তবে সে আপনিই।

বলুন? জানবার ইচ্ছেটা প্রবল কথার মধ্যে।

পোয়ারো নিজের বক্তটাকে বোঝাবার জন্যে হাত নেড়ে বলতে শুরু করলো, একটা খুব মুগ্ধ তারতম্য আছে, তবে আমি তা ঠিক মতো বুঝতে পারি না।

বুঝতে পারি কালার কথা বলার সময় সব কথা বলে উঠতে পারছি না ঠিকমতো। অপর পক্ষের কাছ থেকে মেয়েটার প্রসঙ্গ উঠলে তেমন সাড়াও পাই না, না মনে করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত ঠিক মতো যেন না চিনতেও পারে। অথচ ঠিক নয় এটা তো। মেয়েটা এসব ক্ষেত্রে নিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তেমন না হলেও পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে সবকিছুর মূলে। পরিত্যাগ করা স্ত্রীকে বা পরিত্যাগ করতে না চাওয়ার পেছনে নিজস্ব কারণ থাকতে পারে অ্যামিয়াস ক্রেলের কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের সাধারণ ক্ষেত্রে খুব বড় হয়ে ওঠে বাচ্চা ছেলেমেয়ের প্রশ্নটা। অথচ মেয়েটাকে এক্ষেত্রে কেউ পাত্তাই দেয়নি, আমার কাছে এটা খুব আশ্চর্য মনে হয়েছে।

চট করে মিস উইলিয়ামস বলে উঠলেন, আপনি ঠিক মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটাই ধরতে পেরেছেন। মিঃ পোয়ারো আপনি ঠিক বলেছেন। আর একটু আগে সেইজন্যেই আমি বলছিলাম যে ভিন্নতর পরিবেশে কার্লাকে পাঠিয়ে দেওয়াটা ভালই হয়েছিলো একদিক দিয়ে। সাংসারিক জীবনে বড় হবার পর একটা কিসের অভাব থেকে যেতো তা না হলে।

বেশ সতর্ক হয়ে একটু ঝুঁকে বসে আবার শুরু করলেন বলতে মিস উইলিয়ামস, কর্মসূত্রে স্বাভাবিক ভাবেই মা-বাবা আর ছেলেমেয়েদের দেখতে হয়েছে নানা সমস্যার দিক আমাকে। বহু ছেলেমেয়ে বরং বলা উচিত ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ মা-বাবার কাছ থেকে আদর শাসন পেয়ে থাকে মাত্রাতিরিক্ত। ওদের ওপর বড় বেশি নজরদারি করা হয়, আদরের অত্যাচার হয় বড় বেশি। তাই তারা এই স্নেহ বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্তি চায়। অলক্ষ্যে থাকতে চায় সবার। আর তো কথাই নেই এক সন্তান হলে, তাদের বড় বেশি ক্ষতি করে ফেলে মায়েরা। স্বামীর সঙ্গে তারা ঠিক পরবর্তীকালে মানিয়ে চলতে পারে না, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বোধ হয় একটু অবহেলার মধ্যে মানুষ হলেই ভালোভাবে গড়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের মনের স্বাস্থ্য। বড় পরিবারের মধ্যে এটা দেখা যায়, আর ততো ভালো নয় যাদের অবস্থা, সব সময়ে মা-বাবারা ব্যস্ত থাকেন কাজে, ভালোবাসারও ঘাটতি হয় না সন্তানদের প্রতি।

আবার আছে অন্যদিকও। দেখা যায় অনেক সময় নিজেদের নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে। স্বামী-স্ত্রীরা যে সময়ই পায় না সন্তানের দিকে নজর দেবার। ছেলেমেয়েরা সে সব ক্ষেত্রে মনে করে যে তাদের পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মিঃ পোয়ারো একটা কথা কিন্তু মনে রাখবেন অবহেলার কথা আমি বলছি না, ধরা যাক মিসেস ক্রেলের কথা, সহজে দেখা যায় না ওরকম মা, ভীষণ ভালোবাসতেন কার্লাকে, তার যত্ন করতেন, দেখতেন খাওয়া-দাওয়া, খেলতেন, গল্প করতেন ওর সঙ্গে। অথচ অজ্ঞান ছিলেন স্বামী বলতে, সবচেয়ে বড় অংশটা স্বামীই তাঁর জীবন থেকে গ্রাস করে নিয়েছিলেন। যেন শুধু তার স্বামীর জন্য উনি বেঁচে থাকতেন আর নিজেকে স্বামীর মধ্যেই খুঁজে পেতেন। আবার একটু থেমে বললেন, মনে হয় আর যা পরে উনি করেছিলেন সেটা প্রমাণ করে আমার কথাই।

পোয়ারো বললো, ওদের মধ্যে তার মানে স্বামী-স্ত্রীর বদলে প্রেমিক-প্রেমিকার ভাবটাই থাকতো বড় হয়ে।

মিস উইলিয়ামস যেন এই ধরনের কথায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন, হ্যাঁ চাইলে বলতে পারেন সে কথা। ভীষণ ভালোবাসতেন স্বামী-স্ত্রী দুজন-দুজনকে। তবে হাজার হোক স্বামীরা পুরুষ মানুষ তো।

যেমন করে ধনীরা বলশেভিক বলে, যেভাবে পুঁজিপতি বলে খাঁটি কমুনিস্টরা, ঠিক সেই রকম পুরুষ মানুষ কথাটা উচ্চারণ করলেন ঘৃণার সুরে সিসিলিয়া। আজীবন কুমারী থেকে গভর্নেস হিসেবে জীবন কাটিয়ে যাওয়ার ফলে তার যে অনীহা আছে পুরুষ জাত সম্বন্ধে এটা বোঝা যায় ঐ কথাটা শুনে।

পুরুষদের আপনি পছন্দ করেন না, না।

মিস উইলিয়ামস বিরস ভাবে বললেন, যা কিছু ভালো পৃথিবীর সব পুরুষদের ভোগে লাগে।

তবে চিরকাল তো আর এরকম চলতে পারে না।

পোয়ারো বললো মিস উইলিয়ামসের চরিত্রের গভীরতর দিকটা ভালোভাবে বোঝাবার জন্যে, আপনি আমিয়াস ক্রেলকে পছন্দ করতেন না?

করতামই না পছন্দ তো, বরদাস্ত করতাম না মিঃ ক্রেলের আচরণও। বহুকাল আগেই ওঁর স্ত্রী হলে আমি ছেড়ে ওঁকে চলে আসতাম। ব্যাপার আছে কতগুলো যা মেনে নিতে পারে না মেয়েমানুষেরা।

কিন্তু মেনে নিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল তো?

হা।

তবে উনি কি ভুল করেছিলেন? হা করেছিলেন। মেয়েমানুষের কিছুটা আত্মসম্মান থাকা উচিত, সহ্য করা যায় না অপমান।

মিসেস ক্রেলকে কি আপনি এই ধরনের কোনো কথা বলেছিলেন?

না। আমার সেরকম কোনো অধিকার ছিলো না। আমায় চাকরী দেওয়া হয়েছিলো অ্যাঞ্জেলাকে পড়াবার জন্যে মিসেস ক্রেলকে উপদেশ দেবার জন্যে নিশ্চয়ই নয়।

আপনার পছন্দ হতো মিসেস ক্রেলকে?

ভালোবাসতাম ভীষণ, গলার সুর কেতাদুরস্ত দক্ষ গভর্নেসের নরম হয়ে এলো, ফুটে উঠলো স্নেহ ভালোবাসার আদ্রা। ওঁকে ভীষণ ভালোবাসতাম, ভীষণ দুঃখও হয়।

আপনার ছাত্রীকে–অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন?

যতো ছাত্রী ছিলো আমার তাদের মধ্যে ও সবার সেরা ছিল। বুদ্ধিমতী খুব, একটু রগচটা, বেপরোয়া, ওকে অনেক ব্যাপারে মনের মতো চালোনা করে যেতো না। তবে অমন অসাধারণ মেয়ে চরিত্রের দিক দিয়ে দেখা যায় না।

আবার বললেন একটু থেমে, সব সময়ে আমার আশা ছিল বিরাট একটা কিছু করবে। এবং করেওছে। ওর সাহারা সম্বন্ধে লেখা বইটা কি আপনি পড়েছেন? অ্যাঞ্জেলা ফাইয়ুমে খোঁড়াখুঁড়ি করে আবিষ্কার করেছে কিছু প্রাচীন সমাধি মন্দিরও। আমার গর্ব হয় এর জন্যে। অ্যাল্ডারবেরিতে আমি ছিলাম মাত্র আড়াই বছর। ঐটুকু সময়ের মধ্যে মনে হয় পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধে আমি ওর আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলাম।

আচ্ছা, যখন স্কুলে পাঠানোর কথা হয়েছিলো ওকে নিশ্চয়ই আপনি বাধা দিয়েছিলেন? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

মিঃ পোয়ারো আদৌ না। বরং প্রস্তাবটাকে আমি পুরোপুরি সমর্থন করেছিলাম। …ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বলি আপনাকে। অত্যন্ত ভালো ছিলো অ্যাঞ্জেলা মেয়েটি। মন ওর খুব ভালো ছিলো, তবে সে চলতো একটু ঝোঁকের মাথায়। আর অবাধ্য ছিলো বড় বেশি, তবে কোনো কিছু মেনে চলতে চায় না ওই বয়সটাই তো। মেয়েরা কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে খুব অস্থির থাকে নিজের সম্বন্ধে। তাই ছিলো অ্যাঞ্জেলাও, সে কখনো গম্ভীর আর পর মুহূর্তেই দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে বাচ্চার মতো। স্কুলে যাওয়াটা খুব ভালো এই বয়সে। নিজের মতো আরো অনেকের সংস্পর্শে এসে বেশ ভদ্র হয়ে ওঠে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। বাড়ির পরিবেশ নিশ্চয়ই অ্যাঞ্জেলার ভালো ছিলো না। মিসেস ক্রেল অতি আদর দিয়ে বিগড়ে দিয়েছিলেন মাথা। ফলে সব সময় অ্যাঞ্জেলাও তার দিদিকে ধরে থাকতো আঁকড়ে। আর মিঃ ক্রেল সহ্য করতে পারতেন না এই ব্যাপারটাই। মিঃ ক্রেল চাইতেন স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সোল আনা ভালোবাসা নিজের একান্ত করে পেতে। মিঃ ক্রেলও খুব স্নেহ করতেন অ্যাঞ্জেলাকে এটাও ঠিক। সম্পর্ক এমনিতেই ভালোই ছিলো, মিসেস ক্যারোলিন ক্রেলকে নিয়ে ঝাট হতো। অভিযোগ করতেন অ্যাঞ্জেলা আর মিঃ ক্রেল দুজনেই অন্যজনের ওপর মিসেস ক্রেল পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন। মিঃ ক্রেলও সব পুরুষদের মতো ছিলেন অত্যন্ত জেদী আর খেয়ালী, সবাই ওঁকে নিয়ে হৈহৈ করুক ওঁর ইচ্ছে। অ্যাঞ্জেলার সাথে মাঝে মাঝে ওর ঝগড়া লাগলে, মিসেস ক্রেল আগলাতেন তার বোনকেই। ফলে মিঃ ক্রেল আরও চটতেন। আবার অ্যাঞ্জেলা কেঁদেকেটে একাকার করে দিতে স্বামীকে সমর্থন করলে। কখনো কখনো মিঃ ক্রেলের বিয়ারে দুষ্টুমী করে মিশিয়ে রাখতো নুন, বিছানায় ছেড়ে দিত এক গাদা গুগলি শামুক। মিঃ ক্রেল শেষ ঘটনাটা ঘটার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন স্কুল বোর্ডিংয়ে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাতেই হবে। অ্যাঞ্জেলা আগে নিজের থেকেই বলেছিলো স্কুলে যাবার কথা, কিন্তু কান্নাকাটি শুরু করে দেয় এবারে খুব ভয় পেয়ে। স্কুলে পাঠাতে রাজী ছিলেন না মিসেস ক্রেল, আমি খুব করে বোঝতে দিলেন মত। অ্যাঞ্জেলারই যে ওতে মঙ্গল হবে একথা শোনার পর দক্ষিণ উপকূলের বিখ্যাত হলস্টন স্কুলে পাঠাতে মিসেস ক্রেল রাজী হয়েছিলেন। তবে প্রসন্ন ছিলেন

মনে মনে, আর তো পাগল হয়ে উঠেছিলো অ্যাঞ্জেলা। একটা চাপা রাগের স্রোত বইছিলো ওই তিনজনের মধ্যে, মানে ঐ ঘটনাকে নিয়ে।

তার মানে এলসা গ্ৰীয়ার? জানতে চাইলো পোয়ারো।

সঙ্গে সঙ্গে মিস উইলিয়ামস বললেন ঝাঝালো ভাবে ঠিক তাই। এবং ঠোঁট বন্ধ করলেন কথাটা বলেই।

আপনার কি ধারণা এলসা গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে?

আদৌ আমার কিছু বলার নেই। সম্পূর্ণ নীতি-জ্ঞানহীন যুবতী মাত্র।

ছিলেন তো খুবই কম বয়সী? নিশ্চয়ই বোঝবার মতো বয়স ছিলো। কোনো অজুহাত ওঁর তরফ থেকে ছিলো না। থাকার কথাও নয়। মিঃ ক্রেলকে তো ভালোবাসতো মেয়েটি। মনে হয় আমার…

দুম করে কথার মাঝখানে বলে উঠলেন মিস উইলিয়ামস, তা প্রেমে পড়েছিলেন বটে। আমাদের হৃদয়বৃত্তি মিঃ পোয়ারো যাই হোক না কেন, ভীষণ জরুরী নিজের কর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা। নীতিটিতির বালাই ছিলো না মেয়েটির। উনি একেবারেই ভেবে দেখেননি যে মিঃ ক্রেল বিবাহিত, নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্যে নির্লজ্জের মতো ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে চলেছিলেন। ঠিক মতো শিক্ষাদীক্ষা ওঁকে ছোটবেলায় দেওয়া হয়নি এছাড়া আর কোনো যুক্তিই তো খাড়া করা যায় না।

উনি নিশ্চয়ই মিঃ ক্রেলের মৃত্যুতে খুব আঘাত পেয়েছিলেন।

পেয়েছিলেন তা। তবে ওই মেয়েটিকেই দায়ী করা যায় সব কিছুর জন্য। খুন যে উনিই করেছেন তা বলছি না। তবে তাই দাঁড়ায় ব্যাপারটা। ইচ্ছাকৃতভাবেই কোণঠাসা করা হয়েছিলো ক্যারোলিন ক্রেলকে। আপনাকে ভোলাখুলি ভাবেই বলছি মিঃ পোয়ারো, আমার ইচ্ছে হতো মাঝে মাঝে খুন করে ফেলি দুজনকেই। অন্য মেয়ের স্ত্রীর সামনে প্রশ্রয় দেওয়া ঐ মেয়েটা বড় বেশি নির্লজ্জও ছিলো। অ্যামিয়াস ক্রেলের শাস্তিটা সত্যি কথা বলতে কি ঠিকই হয়েছিলো। যারা ঐ ধরনের ব্যবহার করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঐ রকমই পরিণতি হয়।

দৃঢ়ভাবে কী আপনি বিশ্বাস করেন… মিস উইলিয়ামস ঝাঝালো গলায় বলে উঠলেন পোয়ারোর কথার মাঝখানে, দৃঢ়ভাবেই আমি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাকে বিশেষ মর্যাদা দিই। দেশের সমাজের অধঃপতন হয় এটা না করলে। সত্যি সত্যিই মিসেস ক্রেল ভীষণ ভালোবাসতেন স্বামীকে এবং কখনো অবিশ্বাসের কাজ করেননি। অথচ স্বামী তারই সামনে নিজের প্রেমিকাকে বাড়িতে এনে তুলছেন। যেন বড় বেশি চাপ দেওয়া হয়েছিলো স্ত্রীর ধৈর্য্যের ওপর, এবং স্বামীকে তার ফল ভোগ করতেও হলো।

আপনি ঠিক বলেছেন, কাজটা মিঃ ক্রেল ভালো করেননি, কিন্তু উনি যে একজন নামকরা শিল্পী তা মনে রাখতে হবে।

উইলিয়ামস গরগর করে উঠলেন রাগে, হা, হা জানি তা, সবাই আজকাল দেখাতে চায় এই অজুহাতটা। মদ খাওয়া, চেঁচামেচি করা, অসৎ হওয়া দাম্পত্য জীবনে এইসব বেহিসেবী বেলেল্লাপনার জন্যে সুন্দর পথ আর কি সাফাই গাইবার। যাই বলুন না কেন বিচার করলে সবকিছু জানা যায় উনি কী ধরনের শিল্পী ছিলেন। ওঁর ছবি নিয়ে দু-চার বছর হৈ হৈ করা যায়। আর নয় তারপর। আরে উনি ছবি আঁকতেই জানতেন না। ফ্লোরেন্সে আমি একসময় ছবি আঁকা শিখেছিলাম কয়েকবছর। আমি পরিচিত বড় বড় শিল্পীদের হাতের কাজের সঙ্গে। না…আর যাই বলুন মিঃ পোয়ারো আমায় মিঃ ক্রেলের ছবির প্রশংসা করতে বলবেন না।

স্টেট গ্যালারীতে কিন্তু দুটো ছবি আছে, মনে করিয়ে দিলো পোয়ারো।

 নাক সিটকালেন মিস উইলিয়ামস, থাকতে পারে। শিল্পী এপস্টেইনের তৈরি একটা মূর্তি তো ওখানে আছে। তাতে কি হয়েছে?

বুঝে নিলো পোয়ারো আর আলোচনা করে লাভ নেই শিল্প নিয়ে, তার চুড়ান্ত মতটা মিস উইলিয়ামস জানিয়ে দিয়েছেন। পাল্টালো সে প্রসঙ্গ।

যখন মিসেস ক্যারোলিন ক্রেল তার স্বামীর দেহটাকে দেখেছিলেন আপনি তখন তো ওঁর সঙ্গে ছিলেন।

হ্যাঁ,আমি আর মিসেস ক্রেল দুজনে দুপুরের খাওয়ার পর একসঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। স্নান সারার পর ওর সোয়েটারটা অ্যাঞ্জেলা হয় সমুদ্রের তীরে বা নৌকোর ওপর এসেছিলো ফেলে। মেয়েটি বড় অসাবধানী ছিলো নিজের জিনিসপত্র সম্বন্ধে। একসঙ্গে কামান বাগানের দরজার কাছে পর্যন্ত এসে সমুদ্রের দিকে দু-চার পা এগিয়েছি আমি, আমাকে মিসেস ক্রেল ডাকলেন। ইজেলের কাছে বেঞ্চের ওপর গিয়ে দেখি মিঃ ক্রেল এলিয়ে পড়ে আছেন, প্রাণ বেরিয়ে গেছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে।

উনি কি ওটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন?

মিঃ পোয়ারো আপনার প্রশ্নের মানেটা ধরতে পারছি না ঠিক মতো? তবে হ্যাঁ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল। বললেন আমাকে ডাক্তার ডাকতে টেলিফোন করে। সত্যিই যে উনি মারা গেছেন এটা স্পষ্টভাবে তখনো পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারিনি।

আর টেলিফোন করতে গেলেন আপনি?

আমার মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে দেখা হয় কিছুটা দূর যাবার পর। তাকে টেলিফোন করার ভারটা দিয়ে মিসেস ক্রেলের কাছে আমি আবার ফিরে এলাম। আশংকা হচ্ছিলো আমার উনি অজ্ঞান-টজ্ঞান না হয়ে যান।

মিস উইলিয়ামস শুকনো গলায় বললেন, নিজেকে উনি বেশ শান্ত সংযত করেই রেখেছিলেন, কান্নাকাটি করে এলসা গ্রীয়ারের মতো পাগলামি করেননি।

পাগলামি কি ধরনের? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

মিসেস ক্রেলকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন মিস এলসা গ্ৰীয়ার।

উনি তার মানে বুঝতে পেরেছিলেন যে অ্যামিয়াস ক্রেলের মৃত্যুর জন্যে মিসেস ক্ৰেলই দায়ী?

মিস উইলিয়ামস কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, না মনে হয় না তা। তখন পর্যন্ত এ সন্দেহটা জাগেনি। চেঁচিয়ে মিস গ্ৰীয়ার বলে উঠেছিলেন, ক্যারোলিন এসব কর্ম তোমার। ওকে তুমি মেরেছো। তোমারই দোষটা। কিন্তু স্পষ্টভাবে একথা বলেননি যে ওকে বিষ। দিয়েছো তুমি। তবে মনে হয় আমার এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিলো না মিস গ্রীয়ারের মনে।

আর মিসেস ক্রেল? একটু যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন মিস উইলিয়ামস, মিঃ পোয়ারো আমার পক্ষে কি অতোটা বাড়াবাড়ি করা ভালো হবে? মিসেস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে কি ভাবছিলেন তা আমার পক্ষে জানা কি সম্ভব?

উনি কি দারুণ ভয় পেয়েছিলেন নিজের কৃতকর্মের ফলে…? ও রকম কিছু মনে হয়েছিলো কি?

না-না…ঠিক ভাবে বলতে পারবো না তা হয়েছিলো কিনা, তবে হতভম্ব হয়ে গেলেন বলা চলে ভয় পেয়েছিলেন। হ্যাঁ, ভয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক তো সেটাই।

পোয়ারোর যেন কথাটা পছন্দ হলো না, বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয় স্বাভাবিক সেটাই…প্রকাশ্যে কী ধরনের মনোভাব দেখিয়েছিলেন স্বামীর মৃত্যু সম্বন্ধে মিসেস ক্রেল?

আত্মহত্যা, এটা আত্মহত্যার ঘটনা উনি বলে আসছিলেন প্রথম থেকেই।

একান্তে আপনার সঙ্গে কথা বলার সময়েও কি ঐ কথা বলেছিলেন তিনি, না প্রকাশ করেছিলেন অন্য কিছু অভিমত?

না, আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন উনি আমাকে বোঝাতে যে আত্মহত্যা ছাড়া ওটা আর কিছুই নয়। একটু বিব্রত দেখে মিস উইলিয়ামসকে দুম করে প্রশ্ন করে বসলো পোয়ারো, আচ্ছা আপনি কি বলেছিলেন এ ব্যাপারে?

মিঃ পোয়ারো সত্যিই কি কোনো দাম আছে আমার মতামতের?

আমি তো মনে করি আছে…। এমন কিছু একটা ছিলো পোয়ারোর কথার মধ্যে যার ফলে ইতস্তত করতে করতে মিস উইলিয়ামস বললেন, আমি বলেছিলাম মনে হয়, মিসেস ক্রেল নিশ্চয়ই, এটা আত্মহত্যারই ঘটনা।

আপনি কি নিজের বক্তব্যটা বিশ্বাস করেছিলেন?

মিস উইলিয়ামস হঠাৎ শক্ত করে উঁচু করলেন মাথাটা, বললেন, না, করিনি। কিন্তু মিঃ পোয়ারো একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন, সব সময়েই আমি ছিলাম মিসেস ক্রেলের দিকে। সহানুভূতি দেখাবার প্রশ্ন উঠলে সেটা পুলিশের দিকে না গিয়ে, যেভো মিসেস ক্রেলের দিকেই।

ছাড়া পান উনি, আপনি নিশ্চয়ই এটা চাইতেন?

হ্যাঁ, চাইতাম।

তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর মেয়ের মনের ইচ্ছে সম্বন্ধেও সহানুভূতি থাকবে আপনার।

 আমি সব করতে পারি কার্লার জন্যে।

 একটা বিশদ বর্ণনা দিতে কি ঐ দুর্ঘটনার আপত্তি আছে আপনার?

মানে ওটা কার্লা পড়বে? তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না আপত্তির। ওকি বদ্ধপরিকর পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে দেখবার জন্যে?

হাঁ, তবে অভয় দেন যদি তো বলি ওর কাছে সত্যটা গোপন রাখলেই ভালো হতো…।

মিস উইলিয়ামস বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, না, অনেক বেশি ভালো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোটা। দুঃখ এড়াবার জন্যে বিকৃত করার কোনো অর্থ হয় না সত্যকে। কার্লা নিশ্চয়ই প্রকৃত সত্যটা জেনে মর্মান্তিক ব্যথা পেয়েছে, বোধ হয় এখন জানতে চায় ঘটনার খুঁটিনাটি, সে সত্যিকারের বলিষ্ঠ মনের পরিচয়ই দিচ্ছে। ঠিকঠাক একবার জেনে নিলে ও এ নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারবে ভবিষ্যৎ জীবন।

পোয়ারো বললো, বোধ হয় আপনার কথাই ঠিক।

 বোধ হয় না আমার কথাটাই ঠিক, মিস উইলিয়ামস বেশ জোর দিয়ে বললেন কথাটা।

কিন্তু একটা কথা, আরো একটু গুরুতর ব্যাপারটা। জানা শুধু নয়, ও চায় প্রমাণও যে ওর মা নির্দোষ।

বেচারী, করুণভাবে মিস উইলিয়ামস কথাটা বললেন।

 আপনি তো ঠিক ঐ কথাটাই বললেন, তাই না মিস উইলিয়ামস?

ও তাই আপনি একটু আগে বলেছিলেন ভালো হতো ওর কাছে সত্যটা গোপন রাখলেই। তবে আমার মতে যা হয়েছে সবচেয়ে ভালো সেটাই। খুবই স্বাভাবিক মাকে নির্দোষ জানতে চাওয়াটা, আর সুস্পষ্টভাবে সত্যের স্বরূপ জানাটা যে বেশ কঠিন ব্যাপার তাও অজানা নয় আমার। তবে কার্লা নিশ্চয়ই আপনার কথানুযায়ী মনের জোর নিয়ে স্বীকার করে নেবে সত্যকে।

তাহলে সত্য এটাই যে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আপনার?

ঠিক মতো আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না যে?

এমন কোনো ফাঁক-ফোকর কি আপনি দেখতে পান না যা দিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করা যায় মিসেস ক্রেলকে।

সে রকম কোনো সম্ভাবনাকে আদৌ খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা তো করা হয়নি।

 মহিলা তৎসত্ত্বেও ঐ আত্মহত্যা কথাটার ওপর জোর দিয়ে গেছেন বরাবর।

মিস উইলিয়ামস শুকনো গলায় বললেন, ওঁর তরফ থেকে এছাড়া আর বলার কিছু তো ছিলো না।

জানেন কি আপনি মিসেস ক্রেল মারা যাবার আগে যে চিঠিটা তার মেয়ের উদ্দেশ্যে লিখে রেখে গিয়েছেন, উনি তাতে নির্দোষ বলেছেন নিজেকে।

মিস উইলিয়ামস প্রায় কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠলেন, উনি খুব অন্যায় কাজ করে গেছেন।

তাই কি মনে হয় আপনার?

 হা, হয়। আপনিও দেখছি বেশিরভাগ পুরুষের মতোই বড় বেশি আবেগপ্রবণ।

অসন্তুষ্ট হলো পোয়ারো, আবেগপ্রবণ নই আদৌ আমি।

অনেকেরই তো মিথ্যা ভাবপ্রবণতা থাকে। একটা ঐ রকম পবিত্র মুহূর্তে কি মিথ্যে কথা ওরকম লিখতে পারে? না লেখা উচিত, দুঃখ লাঘব করা মনের মেয়ের, হা, তা হয়তো অনেক মহিলা করতে পারেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না মিসেস ক্রেল তা করতে পারেন বলে। সাহস ছিলো ওঁর, সত্যবাদী তো বটেই। মেয়েকে যদি বিচার না করার উপদেশ দিয়ে যেতেন তাহলে মনে হয় সেটাই ঠিক হতো আমার মতো।

পোয়ারো একটু রাগতভাবে বললো, যা লিখে গেছেন ক্যারোলিন ক্রেল তা সত্যি কি না একথাটা বিচার করে দেখতেও কি চান না আপনি?

নিশ্চয়ই চাই না।

অথচ স্বীকার করেছেন আপনি যে ওঁকে ভালোবাসতেন আপনি?

 বাসতাম। আমার ওঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর স্নেহ ছিলো।

তাহলে…।

মিস উইলিয়ামস অদ্ভুতভাবে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছেন না আপনি, আমি কি বলি না বলি আজ এতোকাল পরে সেটার কি কোনো মূল্য আছে? ধরুন যেমন, ক্যারোলিন ক্রেল যে অপরাধী আমি তা জানি।

কি বললেন? পোয়ারো চমকে উঠলো।

সত্যি কথাটা। সত্যি কথাটা তখন চেপে গিয়ে ভালো করেছিলাম কি মন্দ করেছিলাম সে কথা অবান্তর, তবে এটা সত্যি চেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কাছ থেকে এ কথাটা স্পষ্ট জেনে যান যে ক্যারোলিন ক্রেল অপরাধী আমি জানি…।

.

দশম অধ্যায়

উ…উ..উ কেঁদে উঠলো এই ছোট্ট শুয়োরছানাটি–

পরিষ্কার দেখা যায় অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের ফ্ল্যাট থেকে রিজেন্টস পার্ক। হু হু করে হাওয়া আসছে খোলা জানলা দিয়ে, ভয়ংকর গাড়ী ঘোড়ার শব্দ না থাকলে মনে হতো বসে আছি কোনো গ্রামাঞ্চলে।

পোয়ারো দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মুখ ফেরালো জানলা থেকে, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন ঘরে ঢুকছেন।

পোয়ারো এর আগেও অ্যাঞ্জেলাকে দেখেছে। অ্যাঞ্জেলার বক্তৃতা শুনেছে রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে। নীরস কিছু বিষয়টা হলেও পাণ্ডিত্য আর সুন্দর অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বক্তৃতা অসাধারণ করে তুলেছিলো সেদিনের পরিবেশকে। নেই দ্বিধা, পুনরাবৃত্তি নেই, জটিলতা নেই বক্তব্যে, উল্টে সামান্য বিষয়কেই অসামান্য করে তোলার ক্ষমতা মানবিকতার ছোঁয়ায় মহিলার আছে। শিক্ষিত মনের এই ধরনের মানুষ খুব পছন্দ পোয়ারোর।

খুব কাছ থেকে আজকে দেখার পর মনে হলো পোয়ারোর ঐ কাটা দাগটা মুখে না থাকলে অ্যাঞ্জেলাকে অসাধারণ সুন্দরী বলা যেতে পারে। নিখুঁত সৌষ্ঠবের সঙ্গে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোতে একটু শানিত ভাব আছে। চওড়া কাঁধটা আর কিছুটা পুরুষালি হাঁটার ভঙ্গীটা।

এমন কিছু নিশ্চয়ই নেই অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের মধ্যে যা দেখে মনে হতে পারে উউ করে কাঁদতে পারে এই ছোট্ট শুয়োর ছানাটি। কিন্তু ক্ষতচিহ্ন ডান গালের, কুঁচকানো দাগ পাশের চামড়াতে, খানিকটা বিকৃতি ডান চোখটার, বেশ খানিকটা সব মিলিয়ে সৃষ্টি করে রেখেছে বীভৎসতা। কেমন যেন মনে হলে পোয়ারোর, দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ফলে মহিলা সম্পূর্ণ উদাসীন নিজের বিকৃতি সম্বন্ধে। তদন্ত করতে গিয়ে এই ব্যাপারে যে পাঁচজন সম্বন্ধে কেন্দ্রীভূত হয়েছে তার আগ্রহ, প্রথম জীবনে তারা বেশ ভালোভাবে শুরু করলেও তেমন কোনো কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেননি পরবর্তী জীবনে। শুধু ব্যতিক্রম অ্যাঞ্জেলা। ধরা যাক প্রথমেই এলসা গ্ৰীয়ার, রূপ যৌবন, সম্পদ তার কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না। অথচ কীটদৃষ্ট কুঁড়ির মতোই অকালে ব্যর্থ হয়ে গেছে তার জীবন যৌবন। এরপর সিসিলিয়া উইলিয়ামস আসে, তার কোনো অহংকার নেই পার্থিব ধনসম্পদের। অথচ ভিক্টোরিয়ার আমলের শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ। এ বিষয়ে কোনো আক্ষেপও নেই সিসিলিয়ার মনে। সব সময় তিনি কর্তব্যে অটল, মনে ঈর্ষা, অসন্তোষ বা দুঃখ নেই কিছুই। উল্টে এমন মানসিকতা নিয়ে অনীহা দূরের কথা জীবন সম্বন্ধে যেন একটু কমেনি সব কিছুকে ভালোবাসার আগ্রহ।

আর এখন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের সামনে বসে আছে পোয়ারো। শারীরিক বিকৃতি নিয়ে জন্মের কিছুকাল পর থেকেই হেয় হয়ে থাকতে হতো যাকে সবার সামনে। কিন্তু আজ সে আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। সেই অবাধ্য ছোট্টবেলার দুষ্টু মেয়েটি এখন অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্না, পরিণত হয়েছেন বিদূষী মহিলায়। মনে হলো পোয়ারোর খুব সুখী আর সফল মহিলা।

পোয়ারো খুব একটা পছন্দ করে না এই ধরনের মহিলাদের। নারীসুলভ সূক্ষ্ম কোমলতার মিশেল ঘটেছে তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে। পোয়ারো বেশ উদ্দাম, চঞ্চলা, ময়ূরীর মতো বর্ণাঢ্য মহিলাদের বেশ ভালোবাসে।

পোয়ারো কার্লা লেমারচেণ্টের সঙ্গে সংক্ষেপে সাক্ষাৎকারের বিবরণ বললো।

 অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

 সেই ছোট্ট কালা, এখানেও এসেছে না কি? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে ওকে।

আপনি ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি, না?

 উচিত ছিলো রাখা, রাখিনি, স্কুলে যাই আমি যখন, তখন ও চলে গিয়েছিলো কানাডাতে। মাঝে মাঝে দু-একবার বড় দিনের উপহার দেওয়া-নেওয়াই ছিলো একমাত্র যোগসূত্র আমাদের। ও নিশ্চয়ই এতদিনে খাপ খাইয়ে নিয়েছে কানাডার পরিবেশের সঙ্গে।

স্বাভাবিক এ রকম ধারণা করাটাই। নাম বদলানো, জায়গা পাল্টানো। নতুন জীবন, কিন্তু সব সময় তা হয় না বাস্তবে।

কার্লার সঙ্গে ধীরে ধীরে তার যোগাযোগ, মার চিঠি, ইংল্যান্ডে আসার উদ্দেশ্য পোয়ারো সব বললো।

একহাতে বিক্ষত গালটা চেপে একমনে ঘাড় কাৎ করে সব কথা শুনলেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, শান্তভাবে পোয়ারোর কথা শেষ হলে বললেন, ভালো কাজই করেছে কার্লা।

চমকে উঠলো পোয়ারো, এ ধরনের কথা সে এই প্রথম শুনলো। আপনি তাহলে কার্লাকে সমর্থন করছেন মিস ওয়ারেন?

নিশ্চয়ই। কামনা করছি ওর সাফল্যও। যা সাহায্য দরকার এর জন্যে আমি করবো। এ ব্যাপারে আমি নিজের থেকে কিছু করতে না পারার জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করি।

আপনি কি তাহলে মনে করেন একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কার্লার ধারণাকে? ঠিক ওর ধারণাটা?

নিশ্চয়ই। ও কাজটা ক্যারোলিন করেনি। জানতাম আমি, সে কথা এখনও জানি।

 আপনার কথা শুনে আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। কথা বলেছি যার সঙ্গে, প্রত্যেকে তারা…।

অ্যাঞ্জেলা বাধা দিয়ে দুম করে বললেন, কান দেবেন না ওসব কথায়। ভীষণ জোরদার যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সাক্ষ্য প্রমাণগুলো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু আমার বিশ্বাসের মূলে আছে দিদি সম্বন্ধে আমার ধারণা। তাকে যতোদূর আমি জেনেছি, ওকাজ করতেই পারে না দিদি।

অতো জোর দিয়ে কি মানুষ সম্বন্ধে একথা বলা যায়?

হয়তো অনেক ক্ষেত্রে যায় না। অনেক রকমের চমক থাকে যে মানুষরূপী প্রাণীদের মধ্যে এ বিষয়ে আমি একমত আপনার সঙ্গে। কিন্তু বিশেষ কারণ আছে ক্যারোলিনের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি আমি।

অ্যাঞ্জেলা গালের দাগটা দেখিয়ে বললেন, দেখছেন এটা? মনে হয় এর কথাও শুনেছেন?

মাথা নাড়লো পোয়ারো, হা, ক্যারোলিনের কাজ এটা। আর আমি নিশ্চিতভাবে এই জন্যেই জানি, জানি যে খুন করতে ও পারে না।

অন্যদের কাছে কিন্তু আপনার যুক্তিটা ধোপে টিকবে না।

 ঠিক বলেছেন, লোকে উল্টো ভাববে বরং। এবং সেই ভাবেই ঐ ঘটনাকে কাজে লাগানো হয়েছিলো। বদ মেজাজী যে ক্যারোলিন তারই প্রমাণ হিসেবে বার বার বলা হয়েছিলো ঐ ঘটনার কথা। যেহেতু ঐভাবে আমার মত বাচ্চা মেয়েকে আঘাত করতে পেরেছিলো, তাই খুন করাটা অবিশ্বাসী স্বামীকে তারপক্ষে সমানভাবে সম্ভব।

সূক্ষ্ম পার্থক্যটা যে আছে আপনার বক্তব্যে সেটা আর কেউ না বুঝুক বুঝতে পারছি আমি। প্রচণ্ড রগচটা যারা প্রথমে তাদের পক্ষে বিষ চুরি করা, পরে ঠান্ডা মাথায় কাউকে পরের দিন বিষ খাওয়ানোর ব্যাপারটা সু-যুক্তির কথা নয় খুব একটা।

অধৈর্য হয়ে উঠলেন অ্যাঞ্জেলা পোয়ারের কথায়, বললেন, আমি আদৌ ও কথা বলতে চাইনি। খুব সহজ করে দাঁড়ান বুঝিয়ে বলি আপনাকে আমার বক্তব্য। আপনি মনে করুন একজন সাধারণ স্নেহশীল, দয়ালু মানুষ। আবার তীব্র ঈর্ষাও থাকতে পারে আপনার মধ্যে। মনে করুন এমন একটা সময় এলো আপনার জীবনে যখন সংযত করে রাখা নিজেকে কঠিন, এমন তখন হতে পারে যে আপনি রাগের বশে এমন কিছু করে ফেলতে পারেন যা পড়ে খুনের পর্যায়ে। আপনার মনে তখন যে দুঃখ, শোক, অনুশোচনা আসবে একবার তার কথা ভাবুন। সহজে ক্যারোলিনের মতো কাতর মহিলার পক্ষে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন সেই দুঃখ আর অনুশোচনার হাত থেকে। এবং সে কখনো নিষ্কৃতিও পায়নি। আমি যে তখন একথা বুঝেছিলাম তা নয়, অতীতের কথা পরবর্তীকালে চিন্তা করে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। সব সময়ে আমাকে আঘাত করার ব্যাপারটা ওকে দগ্ধ করতে অনুশোচনায়। ও যেন অনুশোচনার হাত থেকে কখনো রেহাই পায়নি। চিরকালের মতো মনের শান্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। প্রতিটি ঘটনার মধ্যে আমার সঙ্গে তার ব্যবহারের সেই ভাবটা জড়িয়ে থাকতো সব সময়ে। ও অ্যামিয়াসের সঙ্গে আমার জন্যে ঝগড়া করতো। কখনো ও আমার দোষ ধরেনি। বরং ঈর্ষা বোধ করতাম আমিই। অ্যামিয়াসকে নানাভাবে উত্যক্ত করতাম। অ্যামিয়াসের বিছানায় একবার তো কাটাচুয়া রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যারোলিন প্রত্যেকবারই ঝগড়া করেছে। আমার হয়ে।

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, এ ধরনের কাজ আমার পক্ষে খুবই খারাপ ছিলো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। অবাধ্য হয়ে উঠেছিলাম ভীষণ আমি। কিন্তু এখন সে কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। তার কি প্রভাব পড়েছিলো ক্যারোলিনের ওপর তাই নিয়েই তো আলোচনা করছিলাম। আমরা মনের মধ্যে একবার সেই যে হিংসের ভাব জেগেছিলো ক্যারোলিনকে তার স্মৃতি সচেতন করে রাখতো সব সময়ে যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় ঐ ধরনের ঘটনার। এবং সতর্ক প্রহরায় নিজেকে রাখবার নিজস্ব পদ্ধতিও সে বের করে নিয়েছিলো। একটা হলো সেই পদ্ধতির মধ্যে ভাষার অসংযম। ও মনে করতো আমার ধারণা যে মনের রাগটা যদি প্রকাশ করে নেয় ভাষার মধ্য দিয়ে তাহলে কাজের মধ্য দিয়ে তা করার আর দরকার পড়বে না। এবং পদ্ধতিটা যে কার্যকর সেটা তার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে বুঝে নিয়েছিলো। ক্যারোলিনকে সেইজন্য মাঝে মাঝে বলতে শুনতাম এই ধরনের কথা, টুকরো টুকরো করে অমুককে কেটে আস্তে আস্তে ভাজবে ফুটন্ত তেলে। কখনো আমাকে বা অ্যামিয়াসকে বলতো, খুন করে ফেলবো তোমাকে, আমাকে চটালে। সহজেই এইভাবে সে ভীষণ রাগারাগি করে ঝগড়া করতো। ও নিজের চরিত্রের এই দুর্বলতার দিকটা জানতে এবং রাগটাকে ঝগড়াঝাটি করে ভিন্ন পথে চালিয়ে দিতো। প্রায়ই অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়ে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন প্রচণ্ড ঝগড়া করতো।

হ্যাঁ, শুনেছি সে কথা। কুকুর-বেড়ালের মতো নাকি ওঁরা ঝগড়া করতেন, বললো পোয়ারো।

বললেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ঠিকই করতো তবে বড় বাজেভাবে ব্যাপারটাকে আদালতে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। ঝগড়া করতো ওরা, অকথ্য ভাষায় নিষ্ঠুরের মতো রাগ মেটাতে নিজেদের মনের আর যে ঝগড়াটাকে ওরা উপভোগ করতে একথা বোঝবার ক্ষমতা ছিলো না অন্যদের। অথচ আনন্দ পেতে ওরা, পেতেন অ্যামিয়াসও। ঐ ধরনের স্বামী স্ত্রী ছিলো ওরা। অভিনয় আর আবেগপূর্ণ দৃশ্য দুজনেই ভালবাসতো। সাধারণতঃ পুরুষেরা তা পছন্দ করে না, শান্তি চায় তারা। কিন্তু শিল্পী ছিলেন অ্যামিয়াস, উনি চিৎকার, চেঁচামিচি, ভয় দেখানো এমনকি আঘাত দিতে ভালোবাসতেন প্রচণ্ড। কিছু সামান্য হারালে বাড়ি তোলপাড় করে ফেলতেন। আর মনের মধ্যে এই সব করে রাগ বেরিয়ে যাবার একটা পথ খুঁজে পেতো। অবিশ্বাস্য মনে হলেও শুনতে এইভাবে অবিরাম ঝগড়া আর ভাব করার মধ্য দিয়ে ভীষণভাবে উপভোগ করতে জীবনটাকে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন।

একটা অধৈর্যের ভাব ফুটে উঠলো অ্যাঞ্জেলার মধ্যে, যদি ওরা ওখান থেকে আমাকে তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে না দিতো, ডাকতো সাক্ষ্য দিতে, আমি বলতাম এসব কথা।…তবে মনে হয় না আমার কথা বিশ্বাস করতে বলে। কিন্তু ঠিক এটাও সেদিন যে বলতে পারতাম এই কথাগুলোই, কোনো স্থিরতা তার ছিলো না। একটা চিন্তা মাথায় ছিলো এই ধরনের, ভাবিনি স্বপ্নেও কাউকে কোনো দিন বলতে পারবো।

দূরমনস্কভাবে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে আবার অ্যাঞ্জেলা বললেন, যা বলতে চাইছি আমি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন আপনি?

পোয়ারো জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো, বুঝতে পারছি স্পষ্ট আর আপনার কথাগুলো যে ঠিক অনুভব করতে পারছি সেটাও। এমনকিছু লোক আছে মতের মিল হওয়াটা যাদের কাছে খুব একঘেয়ে লাগে। নাটকীয়তার চমক তাদের জীবনযাত্রায় আনার জন্যে প্রয়োজন দেখা দেয় মতবিরোধ সৃষ্টি করার।

ঠিক তাই।

একটা কথা কি মিস ওয়ারেন জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনার মনের ভাব তখন কি ছিলো?

অ্যাঞ্জেলা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন, হতাশা আর বিভ্রান্তি। সে এক দুঃস্বপ্নের সময় গেছে। গ্রেপ্তার হলো ক্যারোলিন প্রায় তিনদিন পরে। আমার ঘৃণা, চাপা রাগ আর সবার ওপরে আমার ছেলেমানুষী ভাবটার কথা এখনও মনে আছে আমার। ভুল করে গ্রেপ্তার করেছে আমি ভেবেছিলাম। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। আমার জন্যে ভীষণ ক্যারোলিন ভাবিত ছিলো, ও চাইত আমাকে এর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে মিস উইলিয়ামসকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলো এক আত্মীয়ের বাড়ি। পুলিশ তাতে আপত্তি করেনি। তারপর ঠিক হলো যখন যে সাক্ষ্য দিতে হবে না আমাকে, সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের স্কুলে তখন পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়ে গেলো।

আমি অবশ্য একটুও যেতে চাইনি। বোঝানো হলো আমাকে যে মানসিক প্রচণ্ড ক্ষতি হবে ক্যারোলিনের যদি আমি থাকি সামনে। ফলে আমি বাধ্য হই চলে যেতে।

আবার একটু থেমে শুরু করলেন বলতে, মিউনিখে আমি চলে গেলাম। যেদিন বের হয় আদালতের রায়, তখন আমি সেখানে। ক্যারোলিনের সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম, যেতে দেয়নি ওরা। ক্যারোলিন এ ব্যাপারটায় বুঝতে ভুল করেছিলো।

ঠিক যে আপনি বুঝেছিলেন মিস ওয়ারেন একথা মনে করবেন না। ভালোবাসতেন খুব এমন একজন কাউকে দেখতে গেলে জেলখানায় কমবয়সী স্পর্শকাতর মেয়ের মনে ভয়ানক চাপ পড়তে পারতো।

হয়তো তাই।

হঠাৎ অ্যাঞ্জেলা উঠে দাঁড়ালেন, রায় বের হবার পর, আমাকে একটা চিঠি দিদি লিখেছিলো। আমি ওটা কাউকে দেখাইনি, তবে মনে করছি এখন আপনাকে দেখানো উচিত বলে। কী ধরনের মহিলা ছিলো ক্যারোলিন সেটা বুঝতে চিঠিটা সাহায্য করতে পারে। আপনি কার্লাকেও ওটা চাইলে দেখাতে পারেন। অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়ালেন, আমার সঙ্গে আসুন, ক্যারোলিনের আমার ঘরে একটা ছবি আছে।

অবাক বিস্ময়ে দ্বিতীয়বার ছবিটার সামনে স্তব্ধ হয়ে পোয়ারো দাঁড়িয়ে রইলো।

এটা ছবি হিসেবে খুব একটা উঁচুদরের নয়–আর শিল্পমূল্য নিয়েও মাথা ঘামালো না পোয়ারো।

…ডিমের মতো মুখটা নিটোল চোয়াল আর গালটা, মুখে ভীরু মিষ্টভাব। এই মুখের মালিক যেন একটা অনিশ্চয়তায় ভুগতেন নিজের সম্বন্ধে। আবেগপ্রবণ, চাপা সৌন্দর্য। জোরালো তীব্রভাব মেয়ের মুখের আর এর মধ্যে পরিস্ফুট প্রাণশক্তির অভাব।–উৎসাহ, উদ্দীপনা আর যে আনন্দ জীবনটা ভোগ করার কার্লা লেমারচেণ্টের সত্তায় ফুটে আছে, সেটা যে পিতৃ-সূত্রে পাওয়া কোনো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে।

অ্যাঞ্জেলা চিঠিটা নিয়ে ফিরে এসেছেন। বললেন শান্তভাবে, দেখলেন তো দিদিকে, এবার পড়ুন চিঠিটা।

পোয়ারো চিঠিটা সাবধানে খুললো, প্রায় ষোল বছর আগে চিঠিটা লিখেছিলেন ক্যারোলিন ক্রেলঃ

অ্যাঞ্জেলা আমার ছোট, তুমি দুঃসংবাদ শুনবে এবং দুঃখও পাবে, কিন্তু তোমাকে যা আমি বলতে চাইছি তা হলো এই যে এটাই ঠিক…ঠিক হয়েছে। কখনও তোমাকে আমি মিথ্যে কথা বলিনি, সত্যিই যে আমি সুখী একথাটাও বলছি না মিথ্যে–আমি যেন সত্যিই বাস করছি এক সততা আর শান্তির জগতে। ঠিক হলো এটাই সোনা, ঠিক হলো এটাই। আমার জন্যে অতীতের দিকে তাকিয়ে দুঃখ, শোক কোরো না, এগিয়ে যাও নিজের জীবনযাত্রায় সফল হও। তুমি পারবে তা আমি জানি। সোনা ঠিক হয়েছে এটাই, আমি চলে যাচ্ছি আমার অ্যামিয়াসের কাছে। একসঙ্গে যে আমরা মিলিত হবোই আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে। আমি বাঁচতে পারি না ওকে ছেড়ে। …একটা কাজ কোরো আমার মুখ চেয়ে কিন্তু…সুখে থেকো। আমি বলছি…সুখে আছি আমি। শোধ তো করতেই হবে নিজের ঋণটুকু। শান্তিকে মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়াটাই আনন্দের স্বরূপ।

তোমার প্রিয় দিদি
ক্যারোলিন

চিঠিটা আরেকবার এরকুল পোয়ারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লো।

সুন্দরি ভারী চিঠি…অসাধারণ…অত্যন্ত সাধারণ চিঠি।

খুব অসাধারণ মানুষ ছিলো ক্যারোলিনও।

হ্যাঁ, অদ্ভুত একটা মন ছিলো তার..আচ্ছা আপনার এই চিঠিটা পড়ে মনে হয় নিশ্চয়ই নির্দোষ ছিলেন আপনার দিদি?

নিশ্চয়ই মনে করি। আদৌ স্পষ্টভাবে কিন্তু কথা বলা হয়নি।

কারণ জানতো দিদি যে আমি তাকে কোনোদিন স্বপ্নেও অপরাধী ভাবতে পারি না।

হয়তো তাই…তাই হয়তো…কিন্তু অন্যভাবে ব্যাপারটাকে তো দেখা যেতে পারে। হতে পারে এটাও যে উনি পাপটা করেছিলেন এবং প্রায়শ্চিত্ত করে শান্তি পাচ্ছেন মনে।

ক্যারোলিনকে যে রূপে আদালতে দেখা গিয়েছিলো তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে এই ব্যাখ্যাটা বলে পোয়ারোর মনে হলো। এবং যে বিশ্বাসটা এতদিন পর্যন্ত ভীষণ জোরদার হয়েছিলো পোয়ারোর মধ্যে, যেন চিড় ধরতে শুরু করেছে সেটাতে। তত্ত্ব আর তথ্য জোগাড় হয়েছে যে সব সবগুলোই বিপক্ষে ক্যারোলিনের, আজ তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে এই চিঠিটাও।

অটল প্রত্যয় নিয়ে অন্যদিকে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন। ও যে দিদিকে ভালোভাবে চিনতো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে। কিন্তু ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই চেনাটার সঙ্গে দিদির প্রতি অন্ধ তার ভালোবাসা, ফলে তার বিশ্বাস, কতোটা গ্রহণযোগ্য তার মতামত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

বুঝতে পেরেই পোয়ারোর মনের ভাবটা যেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন বললেন, না, মিঃ পোয়ারো, জানি আমি দিদি আমার অপরাধী নন। সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো বললো, ঈশ্বর জানেন, আপনার বিশ্বাসের মূলে আমি চাইছি না আঘাত করতে। কিন্তু বাস্তবসম্মত ভাবে আমাদের উচিত চিন্তা করা। আপনি বলছেন অপরাধী নন আপনার দিদি। ঠিক আছে, আসলে কী ঘটেছিলো তাহলে বলুন।

অ্যাঞ্জেলা চিন্তা করতে করতে মাথা নাড়লেন, আমি একমত আপনার সঙ্গে, বলা ওটা কঠিন। আমার ধারণা এবং দিদিও বলেছিলো তাই, আত্মহত্যা করেন আমিয়াস।

যতদূর আপনি ভদ্রলোকটিকে চিনেছিলেন, তাতে কি ওটা করা সম্ভব তাঁর পক্ষে?

সম্ভব নয় খুব একটা।

অথচ দিদির বেলায় যেটা অসম্ভব বলেছেন স্পষ্টভাবে, এক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে তেমন অসম্ভব বলতে পারছেন না, তাই না।

না, কারণ অনেক অসম্ভব কাজ অনেক লোক অনেক সময় করে ফেলতে পারে, যেটা তার পবিত্র ধর্মবিরোধী আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা আপনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে যদি তাদের জানেন, তবে চরিত্র বিরোধী আদৌ মনে হবে না।

ভালোভাবে আপনি আপনার জামাইবাবুকে চিনতেন?

 হ্যাঁ, তবে যতটা চিনতাম দিদিকে ততোটা নয়। আত্মহত্যা করেছেন অ্যামিয়াস আমার কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার মনে হয় করেও থাকতে পারেন। আসলে তাই করেছিলেন উনি।

আপনি অন্য কোনো কারণ ভাবতে পারেন না?

অ্যাঞ্জেলা আমার অভিমতটাকে শান্ত মনে মেনে নিলেন বটে কিন্তু কোনোরকম প্রচেষ্টা করার চিহ্নমাত্র প্রকাশ করেন না। বুঝতে পারছি আপনার কথা…আমি কখনো চিন্তা করিনি সেরকম কোনো সম্ভাবনার কথা…বলতে চাইছেন আপনি অন্য কেউ খুন করে থাকতে পারে? ঠান্ডা মাথায় কেউ ঐ খুনটা করেছিলো?

হতেও তো পারে, পারে না?

হা হতে পারে…কিন্তু মনে হচ্ছে কি খুব একটা সম্ভব বলে?

অসম্ভব মনে হচ্ছে কি আত্মহত্যার চেয়েও?

বলা কঠিন সেটা…আর কাউকে তো এমনি সন্দেহ করা যায় না। চিন্তা করলেও অতীতের কথা সেটা এখন পারছি না মেনে নিতে।

ঠিক আছে, চিন্তা করা যাক সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে। পরিচিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে কে…মানে বলছি কি…ওটা কার পক্ষে করা সম্ভব?

দাঁড়ান ভাবতে দিন। আচ্ছা, খুন করিনি আমি। আর ঐ এলসা বেচারীও করেনি। মেয়েটা রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিল অ্যামিয়াস মারা গেলে। আর কে ছিলো ওখানে? মেরিডিথ ব্লেক? উনি খুব ভক্ত ছিলেন দিদির। অবশ্য সেটা হতে পারে একটা উদ্দেশ্য। হয়তো অ্যামিয়াসকে সরিয়ে দিয়ে উনি বিয়ে করার কথা চিন্তা করে থাকতে পারেন দিদিকে। অবশ্য তাহলে অ্যামিয়াসকে উনি সোজাসুজি বলতে পারতেন, এলসাকে নিয়ে তুমি কেটে পড়ো। ক্যারোলিনকে আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে…। না, কিছুতেই আমি খুনি মনে করতে পারি না মেরিডিথকে। বড্ড ভীরু আর সাবধানী বড় বেশি। কে ছিলো আর?

স্মরণ করিয়ে দিলো পোয়ারো, মিস উইলিয়ামস? ফিলিপ ব্লেক?

অ্যাঞ্জেলার মুখ কয়েক মুহূর্তের জন্যে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো, মিস উইলিয়ামস? খুন করতে পারে বলে কল্পনাও করা যায় না, বাড়ির গভর্নেস। সব সময়ে মিস উইলিয়ামস আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর সৎ চরিত্রের মহিলা ছিলেন।

আবার একটু থেমে বলতে লাগলেন, অবশ্য ক্যারোলিনকেও উনি খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন, উনি সব কিছু করতে পারতেন দিদির জন্যে। মিস উইলিয়ামস তাছাড়া ঘেন্না করতেন অ্যামিয়াসকে। উনি উগ্র সমর্থক ছিলেন নারী স্বাধীনতার। আর ভীষণ অপছন্দ করতেন পুরুষদের। এটাই কি খুন করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি? নিশ্চয়ই নয়।

পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আমার আগ্রহ ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে আপনার কথায়। প্রশ্ন করি একটা, আপনি কেন একথা বললেন?

কিছুই বলছি না নির্দিষ্ট করে। যেটুকু আমার মনে আছে ফিলিপ ব্লেক সম্বন্ধে তার ভিত্তিতে বলতে পারি বেশ স্থল আর স্বার্থপর ধরনের মানুষ ছিলেন উনি।

এবং স্থূল আর স্বার্থপর মানুষরা খুনটুন করতে পারে এরকম ধারণা একটা আপনার আছে?

অসুবিধা নিজের দূর করার জন্যে যে কোনো নিষ্ঠুর পথ এই শ্রেণীর লোক অবলম্বন করতে পারে। তাই না?

হা মনে হয় ঠিকই বলেছেন আপনি। একটা এরকম ব্যাপার আছে। কিন্তু মনে হয় আমার আরও ঘটনা কিছু আছে। কি হতে পারে ফিলিপ ব্লেকের অভিসন্ধিটা?

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন কোনো উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিলেন না। মেঝের দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে রইলেন।

পোয়ারো বললো, অ্যামিয়াস ক্রেলের ভীষণ প্রিয় বন্ধু ছিলেন তো উনি, তাই না?

ঘাড় নেড়ে অ্যাঞ্জেলা সায় দিলেন।

কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার মিস ওয়ারেন, এমন ঘটনা কিছু আছে যেটা আমাকে বলছেন না আপনি। দুজনের মধ্যে কি ঐ এলসা মেয়েটাকে নিয়ে রেষারেষি ছিলো?

সজোরে ঘাড় নেড়ে অ্যাঞ্জেলা বললো, না, না, ফিলিপ না।

তাহলে কি ব্যাপারটা? অ্যাঞ্জেলা খুব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, বেশ কয়েক বছর কোনো কোনো ঘটনা হঠাৎ মনের মধ্যে কি করে ভেসে ওঠে তা কি আপনি জানেন? কথার মানেটা আমার বুঝিয়ে বলছি। বয়েস যখন আমরা এগারো, একজন তখন আমাকে একটা গল্প বলেছিলাম। আমি গল্পটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। আর মাথাও ঘামাইনি সে নিয়ে, ভুলেই গিয়েছিলাম গল্পটা। একটা নাটক বছর দুয়েক আগে দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো গল্পটা। আর এতো আমি চমকে উঠেছিলাম যে আমার মুখ দিয়ে বেশ জোরে কথা বেরিয়ে এলো, আরে চালের পুডিং নিয়ে সেই বাজে ঘটনার গল্পটার মানে যে বেশ বুঝতে পারছি এখন। অথচ কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগের আভাস নেই ঐ দুটি ঘটনার মধ্যে।

পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি।

তাহলে যা বলতে যাচ্ছি এখন আপনি সেটাও বুঝতে পারবেন। একটা হোটেলে একবার ছিলাম। হাঁটছি লম্বা বারান্দা দিয়ে হঠাৎ এক পরিচিত মহিলা একটা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ওঁর ওটা কিন্তু শোবার ঘর ছিলো আর অন্যের শোবার ঘর থেকে তিনি যে বেরিয়ে এলেন সে কথা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিলো মুখের ভাবে।

আর অ্যাল্ডারবেরিতে সঙ্গে সঙ্গে একদিন রাতে ফিলিপ ব্লেকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা ক্যারোলিনের মুখের ভাবটার অর্থ বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো পোয়ারো, অ্যাঞ্জেলা তাকে বাধা দিয়ে বলতে থাকলেন, আমি কিছুই সে রাতে বুঝতে পারিনি। যতটুকু জানে ওই বয়সের মেয়েরা, বোঝে, তাই জানতাম আমিও বুঝতাম, কিন্তু ঐ ঘটনার সঙ্গে মেলাতে পারিনি তা। আমার কাছে ক্যারোলিনের বেরিয়ে আসাটা ফিলিপ ব্লেকের শোবার ঘর থেকে খুবই সাধারণ ঘটনা বলে মনে হয়েছিলো। মিস উইলিয়ামস বা আমার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মতোই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এমন একটা অদ্ভুত ভাব ক্যারোলিনের চোখে মুখে দেখেছিলাম যার অর্থ প্যারিসের হোটেলে মুখের ভাব ওই মহিলার দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক মতো।

আস্তে আস্তে পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আপনি যা বলছেন তা আমাকে চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আমি কথা বলছি ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে, মনে হয়েছিলো আমার আপনার দিদিকে উনি ভীষণ ঘেন্না করেন এবং আগেও করতেন।

অ্যাঞ্জেলা বললেন, জানি। বুঝিয়ে বলতে পারবো না আমার কথাটা, তবে ঘটেছিলো ঘটনাটা।

আস্তে আস্তে পোয়ারো মাথা নাড়লো। ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর ওর যেন কেমন মনে হয়েছিলো কোথায় যেন বলা হচ্ছে অসত্য। মাত্রাতিরিক্ত বিদ্বেষটা যে ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সেটা মনে হয়েছিলো পোয়ারোর।

কথাবার্তার অংশ বিশেষ মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে তার মনে পড়তে লাগলো। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো অ্যামিয়াসকে বিয়ে করাতে…ওদের বাড়ির দিকে একবছরেরও বেশি মাড়ায়নি।

তাহলে কি ভালোবাসা ছিল ফিলিপের সঙ্গে ক্যারোলিনের। আর সেই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো অ্যামিয়াসকে বিয়ে করার ফলে?

হ্যাঁ, ভীষণ রাগী আর ভীষণভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ছিলো ফিলিপ। ওর সম্বন্ধে মনে মনে ভাববার চেষ্টা করলো পোয়ারো। হাসিখুশি সৌভাগ্যশালী মানুষ। আত্মতৃপ্ত গফের মাঠ আর সুন্দর বাড়ি নিয়ে। ফিলিপ ব্লেকের মনোভাব কেমন ছিলো ষোলো বছর আগে? অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন তখনও বলে চলেছেন, এটা আমি বুঝতে পারি না। দেখুন আমি ঠিক বুঝতে পারি না ভালোবাসাবাসি ব্যাপারটা, ওটা কখনো আমার জীবনে আসেনি। আপনাকে ঘটনাটা এই জন্যে বললাম যদি এই ব্যাপারে সাহায্য হয় কোনো হয়তো এর কোনো সম্পর্কও ঘটনার সঙ্গে থাকতে পারে।