১.১ আসামী পক্ষের উকিল

ফাইভ লিটল পিগস্ (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

ভূমিকা :- কার্লা লেমারচেন্ট

আগ্রহ আর প্রশংসার দৃষ্টিতে এরকুল পোয়ারো লক্ষ্য করছিলো মেয়েটিকে। মেয়েটি ঘরের মধ্যে এলো চাকরের পেছন পেছন।

তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য ওর লেখা চিঠিতে ছিলো না। সাদামাঠা একটা অনুরোধ মাত্র দেখা করার জন্যে, চিঠিটিতে কেন দেখা করতে চায় তার আভাস বিন্দুমাত্র দেওয়া হয়নি। ব্যবসাদারী ঢংয়ে ছোট্ট করে লেখা চিঠি, হাতের লেখার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে শুধু বোঝা যায় যে একজন কমবয়সী মহিলা কার্লা লেমারচেন্ট।

এখন সশরীরে সেই মেয়েটিই হাজির। ছিপছিপে গড়ন, লম্বা, বয়স কুড়ি-বাইশ হবে। মানুষ দুবার বাধ্য তাকাতে এই ধরনের যুবতীদের দিকে। পোষাক দামী ও সুন্দরও বটে, বেশ সামঞ্জস্য আছে কাঁধ আর মাথার মধ্যে। বেশ পুরু প্রাটি, চমৎকার নাকের গড়নটিও, সুস্পষ্ট চিবুকে দৃঢ়তার ছাপ। বেশ সতেজ প্রাণবন্ত চেহারা। এই সজীব ভাবটা রূপের চেয়েও বেশি সুস্পষ্ট।

এরকুল পোয়ারোর নিজেকে বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছিলো ঘরে মেয়েটি আসার আগে, এখন কেটে গেছে সেই ঝিমুনিটা, বেশ সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে নিজেকেও।

ওকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে পোয়ারো এগিয়ে এলো এবং বুঝতে পারলো তখনই পোয়ারোকে তীক্ষ্ণ ভাবে মেয়েটি তার গাঢ় ধূসর রঙের চোখ দিয়ে জরীপ করছে।

মেয়েটি পোয়ারোর বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেট বসার পর ধরালো। পোয়ারোকে লক্ষ্য করেই চললো দু-একটা টান দিয়ে।

পোয়ারো খুব শান্ত গলায় বললো, হ্যাঁ, আগেই স্থির করে নিতে হবে মনটা, তাই নয় কি?

মেয়েটি চমকে উঠল, মাফ করবেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথা। খুব আকর্ষণীয় মেয়েটির কণ্ঠস্বর, খসখসে ভাব আছে একটু, তবে ভীষণ ভাল লাগে সেটা।

মনস্থির করতে তো পারছেন না আপনি, ভাবছেন এসে পড়েছেন একটা হাতুড়ের কাছে, না আমার মতো সত্যিসত্যিই লোকই দরকার আপনার।

হেসে ফেললো মেয়েটি, আঁ…হা…ব্যাপার এই ধরনের আর কি। মঁসিয়ে পোয়ারো সত্যি বলতে কি, যা কল্পনা আমি করেছিলাম আপনার কিন্তু তার সঙ্গে মিল নেই।

এবং বৃদ্ধ আমি, তাই না? যা ভেবে আপনি এসেছিলেন তার চেয়েও বৃদ্ধ?

হ্যাঁ..তাও বটে অনেকটা…, মেয়েটি একটু দ্বিধাভাবে বললো, একটু স্পষ্টাস্পষ্টি কথাটা আমি বলতে চাই, দেখুন…আমার প্রয়োজন…প্রয়োজন নয় শুধু…আমার প্রয়োজন সবার সেরা সাহায্য।

থাকতে পারেন নিশ্চিত, সবার সেরা আমিই।

দেখছি আদৌ আপনি বিনয়ী নন, বললো কালা, ঠিক আছে আপনার কথা আমি মেনে নেবো মনে করছি।

পোয়ারো ধীর গলায় বলল, সকলকে যে পেশীর সাহায্য নিয়েই কাজ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দেখুন হাঁটা হামাগুড়ির সাহায্যে, পায়ের ছাপের মাপ নেওয়া, সিগারেটের টুকরো কুড়নো বা চাপে নুয়ে পড়া ঘাস ইত্যাদি নিয়ে আমি কাজ কারবার করি না। আমার কেবল চেয়ারে বসে চিন্তা করতে পারলেই চলে। শুধু এইটা কাজ করে…পোয়ারো নিজের ডিমের মতো মাথাটা দেখালো।

জানি। আর আপনার কাছে সেই জন্যেই এসেছি। দেখুন এক অসাধ্য-সাধন করতে হবে আপনাকে।

একটু নড়েচড়ে বসলো এরকুল পোয়ারো, ব্যাপারটা বেশ মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং হবে।

কার্লা লেমারচেন্ট জোরে নিঃশ্বাস নিলো, তারপর মাথা নিচু করে বললো, কার্লা নয়, আমার নাম ক্যারোলিন, আমার মায়ের নাম মিলিয়ে আমার নাম রাখা হয়েছিলো, আবার একটু থেমে নিয়ে বললো, আমাকে লেমারচেন্ট বলে সবাই জানলেও আমার আসল পদবী ক্রেল।

সামান্য চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো পোয়ারোর কপালে, ক্রেল মনে হচ্ছে যেন শোনা শোনা।

শিল্পী ছিলেন আমার বাবা, বেশ সুখ্যাতি ছিলো ছবি আঁকার ব্যাপারে–বাবা খুব নাম করা চিত্রশিল্পী ছিলেন অনেকে বলেন। তাই মনে হয় আমার…।

প্রশ্ন করলো পোয়ারো, অ্যামিয়াস ক্রেল?

হ্যাঁ। …মেয়েটি একটু থেমে তারপর বললো, আমার মা ক্যারোলিন ক্রেলের বিচার হয়েছিলো বাবাকে খুন করার জন্যে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ,…মনে পড়ছে বটে এখন…তবে খুব আবছা ভাবে। তখন আমি বিদেশে ছিলাম। কিন্তু অনেকদিন আগেকার ঘটনা সেটা।

ষোলো বছর, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো মেয়েটি। ভীষণ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখটা। এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা শুধু চোখগুলোতে।

 বুঝতে পারছেন আমার কথা? …মার শাস্তি হয়েছিলো বিচারে। অবশ্য ফাঁসি দেওয়া হয়নি, কারণ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্যে ওঁদের মতে অনেকটা কমে গিয়েছিলো অপরাধের গুরুত্ব। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় মাকে। তবে মা জেলেই এক বছরের মাথায় মারা যান। বুঝতে পারছেন? …সব কিছু হলো…ঘটলো…এবং হয়ে গেলো শেষও…।

অতঃপর, খুব ঠান্ডা গলায় পোয়ারো প্রশ্ন করলো।

হাতের মুঠি দুটো কার্লা লেমারচেন্ট নামের মেয়েটির শক্ত হয়ে উঠলো, ওর বলার মধ্যে থেমে থেমে বললেও অদ্ভুত ধরনের এক প্রত্যয় ছিলো। ও বলতে লাগলো,

ব্যাপারটা আপনাকে ঠিক মতো বুঝতে হবে–মানে যা বলতে চাইছি আমি। যখন ঘটেছিলো ব্যাপারটা তখন বয়স আমার প্রায় পাঁচ। তখন ব্যাপারটা বোঝার মতো বয়স আমার নিশ্চয়ই ছিলো না। মাকে…বাবাকে ঠিকই মনে আছে, আর আমাকে হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় তাও আমার মনে আছে। মনে আছে মোটাসোটা চাষী বৌ আর শুয়োরগুলোর কথাও…আমাকে স্নেহ করতো সবাই…আমার দিকে সবাই কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাতো আমি সে কথাও ভুলিনি। এটা বুঝতে পারতাম কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, যেমন বুঝতে পারে সব বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, কিন্তু সেটা যে কী তা জানতাম না।

আমাকে জাহাজে করে তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো, আমার কাছে সে যে দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার ছিলো। শেষ পর্যন্ত কানাডায় পৌঁছলাম আমি, দেখা হলো সাইমন মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। তারপর মনট্রিয়ালে মাসী লুইসি আর মেসো সাইমনের সঙ্গে আমি থাকতে লাগলাম। মাসীরা মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলতেন তারা শীগগীরই আসবেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে গেলে ওদের কথা ভুলেই গেলাম। কেমন যেন একটা আবছা ধারণা আমার জন্মে গেল তারা যেন আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। যদিও সেকথা খোলাখুলিভাবে আমাকে কেউ বলেননি। এবং যা হয় এরপর আমি আর ভাবতাম না মা বাবার কথা। আমার মাসীর বাড়িতে বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন মাসী আর মেসো। আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। অনেক বন্ধু বান্ধব হলো। আমার যে একটা অন্য নাম আছে তাও আমার মনে রইলো না। আমার যে লেমারচেন্ট পদবী নয় তাও গেলাম ভুলে। কানাডাতে ঐ নামই চলবে তা মাসী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এবং আমারও মনে হয়েছিলো হয়তো নিয়মটা তাই। কিন্তু ঐ যে পরে বলেছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে অন্য একটা নাম আমার আগে ছিলো।

কার্লা তারপর হঠাৎ তার একটু অহংকারীর মত মুখটা উঁচু করে বললো, দেখুন আমাকে, মনে হয় না যে দেখলে এমন একটা মেয়ে এ যে কোনো কিছুতেই সে ঘাবড়াবার পাত্রী নয়, বা কোনো দুঃশ্চিন্তা এর থাকতে পারে। অবস্থা আমার সচ্ছল, স্বাস্থ্যও সুন্দর। খারাপ নই দেখতেও, উপভোগ করতে জানি জীবনকে। যখন কুড়ি বছর বয়স ছিলো আমার তখন নিজেকে ছোট মনে করতাম না পৃথিবীতে কারুর চেয়ে।

কিন্তু আমার জীবনে তারপর থেকেই এল এক সমস্যা। নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে শুরু করলো। প্রসঙ্গঃ আমার বাবা মা। কে ছিলেন তারা? কি করতেন? হয়তো আমি উঠে পড়ে লাগতামও সবকিছু জানবার জন্যে।

মাসীরা কিন্তু তার আগেই আমাকে জানিয়েছিলেন সত্যি কথাটা। তখন পা দিয়েছি আমি একুশে। আমাকে ওঁরা অবশ্য বাধ্যই হয়েছিলেন বলতে কারণ আমার হাতে আমার টাকাকড়ি এখন তুলে দেওয়া হলো, আর জানেন আমার হাতে ঠিক তখনই এলো চিঠিটা। আমাকে উদ্দেশ্য করে যে চিঠিটা লিখে রেখে গিয়েছিলেন আমা মা মারা যাবার আগে।

মেয়েটির মুখের ভাব মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই কেমন যেন মলিন হয়ে উঠলো। সেই উজ্জ্বলতা আর নেই তার চোখের দৃষ্টিতে। তার বদলে সেখানে ফুটে উঠলো ছায়াঘেরা ছোট্ট দীঘির মতো শান্ত গভীরতা। আবার মেয়েটি বলতে শুরু করলো, আর আমি ঠিক তখনই সত্যি কথাটা জানতে পারলাম যে খুনের অপরাধে আমার মা দণ্ড পেয়েছিলেন। মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না কয়েক সেকেন্ড, আবার মুখ খুললো ধীরে ধীরে, আর একটা ব্যাপার আছে আপনাকে যেটা বলতেই হবে। আমার বিয়ের কথা এক জায়গায় ঠিক আছে। মাসীরা বলেছিলেন আমার বয়েস একুশ না হওয়া পর্যন্ত যেন আমি অপেক্ষা করি। ওরা কেন ও কথা বলেছিলেন তা এখন বুঝতে পারি।

একটু নড়েচড়ে উঠলো পোয়ারো, তারপর মুখ খুললো প্রথম, কি প্রতিক্রিয়া হলো আপনার বাগদত্তের ঐ কথা শুনে?

জনের? এসব পরোয়া করে না জন। আমাকে ও বললো ও এসব ঘটনা নিয়ে রাজী নয় মাথা ঘামাতে। ও আর আমি বলতে জন আর কার্লাকে শুধু বোঝে, ও চিন্তা করে না অতীত সম্বন্ধে। মেয়েটি আবার একটু ঝুঁকে বসে বললো, এখনও কিন্তু আমরা বাগদত্ত। কিন্তু এটা উড়িয়ে দেবার ব্যাপার নয় তা তো আপনি বোঝেন, আমার কাছে এমন কি জনের কাছেও নয়…মাথা ঘামাচ্ছি না অতীতটা নিয়ে, কিন্তু ভবিষ্যৎ?–হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠলো মেয়েটির, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো আমরা তো নিশ্চয়ই বিয়ের পর বাচ্চা চাইবো এবং আমাদের সন্তান এরকম একটা অস্বস্তিকর আশংকার মধ্যে মানুষ তোক এটা আমি চাই না।

পোয়ারো বললো, কিন্তু আপনি কি এটা বুঝতে পারেন না যে এই ধরনের হিংসাত্মক বা পাপের ঘটনা প্রত্যেক পরিবারের অতীত ইতিহাসে বিরল নয়?

ঠিক বুঝতে পারছেন না আপনি। আপনার কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু সাধারণতঃ তা কেউ জানে না বা মনে রাখে না। আমি যে জেনে ফেলেছি, তাছাড়া এই ধরনের ঘটনাটা যে আমার নিকটতম আত্মীয়ের জীবনে ঘটে গেছে। আমি দেখেছি মাঝে মাঝে জন যেন কেমন ভাবে তাকায় আমার দিকে। ধরুন ওকে যদি বিয়ের পর আমি আমার দিকে ঐভাবে তাকাতে দেখি?

কিভাবে মারা যান আপনার বাবা?

কার্লা অকপটভাবে পরিষ্কার করে বললো, বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো।

বুঝেছি, কথা বলে পোয়ারো চুপ করে গেলো।

কার্লা একটু পরে নির্লিপ্ত অথচ শান্তভাবে বললো, ধন্যবাদ আপনার সহৃদয়তার জন্যে। আমার কথাটা আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এতে কৃতজ্ঞ আমি। আপনি যে আমাকে স্তোক দেবার চেষ্টা করেননি মামুলী সান্ত্বনার কথা বলে এতেই মনে হয় কাজ হবে আমার।

আমি ভালই বুঝেছি আপনার ব্যাপারটা। একটা কথা বুঝতে পারছি না…আপনি আমার কাছ থেকে কি চান?

কার্লা খুব সরলভাবে জানালো, জনকে বিয়ে করতে চাই আমি। সত্যিই চাই। আমি মা হতে চাই দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের। এবং বাস্তবে যেন সেটা সম্ভব হয় আপনাকে তার জন্যে সাহায্য করতে হবে।

তার মানে–মানে আমি আপনার জনের সাথে কথা বলি আপনি কি তাই চান? না, না, বড্ড বেশি করে বোকামির কাজ হয়ে যাবে। যা বলতে চাইছিলেন আপনি তার সঙ্গে যেন এর কোথায় একটা দারুণ অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। খুলে বলুন না কি চান আপনি?

মঁসিয়ে পোয়ারো শুনুন, আমার কথাটা পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করুন–আমি আপনাকে একটি খুনের কেসের তদন্ত করার জন্যে নিয়োগ করতে চাইছি।

কি বলতে চাইছেন আপনি?

হ্যাঁ, চাইছি। খুনের কেস খুনেরই কেস, তা সে গতকালই হয়ে থাক, খুনটা বা ষোলো বছর আগেই হয়ে থাক তাতে যায় আসে না এমন কিছু।

কিন্তু…।

মঁসিয়ে পোয়ারো দাঁড়ান, আপনি এখনও শোনেননি সবটা, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আছে।

বলুন। আবার গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে পোয়ারো।

নির্দোষ ছিলেন আমার মা। কার্লা লেমারচেন্ট বললো।

পোয়ারো নিজের নাকটা ঘসতে ঘসতে বিড়বিড় করে বললো, ও হ্যাঁ, স্বাভাবিক খুবই..তাই অনুমান করেছিলাম আমিও…।

ভাবালুতার ব্যাপার নয় কিন্তু এটা। একটা চিঠি আছে মার লেখা। আমার জন্যে এটা রেখে গিয়েছিলেন মারা যাবার আগে। চিঠিটা আমাকে একুশে পা দিলে দেওয়া হয়। মা ওটা আমাকে একটি মাত্র কারণেই লিখেছিলেন–যেন কোনো সন্দেহ না থাকে আমার মনে। এটুকুই চিঠির মূল বক্তব্য। মা করেননি ও কাজটা আর আমি যেন বিনা দ্বিধায় সে কথাটা বিশ্বাস করি।

এরকুল পোয়ারোর দিকে যৌবন দীপ্ত একটি মুখ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দেখে ধীরে ধীরে সে বললো, তা তো বটেই…।

মৃদু হেসে কার্লা বললো, না, ঐ রকম ছিলেন না আমার মা। মনে করছেন আপনি হয়তো মিথ্যে কথাটা–মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে একটা আবেগের ঘোরে!…না মঁসিয়ে পোয়ারো, শুনুন কতগুলো এমন জিনিস থাকে যা খুব ভাল বোঝে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, মনে রাখে, আমার মনে আছে আমার মার কথা–যদিও টুকরো টুকরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, তবে কি ধরনের মানুষ তিনি ছিলেন তা মনে আছে। কখনো মিথ্যে কথা মা বলতেন না এমন কি স্নেহ মমতা দেখাতে গিয়েও না। মনে দুঃখ পাবে জানলেও সব সময়ে তিনি সত্যি কথাটা বলতেন। তার স্বাভাবিক এক অনীহা ছিল মিথ্যে সম্বন্ধে। উনি যে খুব ভালবাসতেন আমাকে তা মনে হয় না, তবে মাকে খুব বিশ্বাস করতাম আমি। এখনও করি। যদি মা বলে থাকেন বাবাকে খুন করেননি তিনি, তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই পারে না থাকতে যে খুন করেছেন মা। বিশেষ করে মৃত্যু আসন্ন এটা যখন উনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন তখন এই ধরনের একটা কথা যা কিনা মিথ্যে তা তিনি লিখে যেতে পারেন বলে বিশ্বাস হয় না আমার।

পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো মন খুব একটা সায় না দিলেও! যেন মেনে নিচ্ছে কথাটা। বলে চললো কার্লা, এবং জনকে বিয়ে করার ব্যাপরে সেই কারণেই আমার কোনো দ্বিধা নেই। কারণ মার দিক থেকে ও ধরনের কিছু ঘটেনি তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু জনের ব্যাপারটা আলাদা। সাধারণ সব মেয়েরই মত ও মনে করে নিজের মাকে আমিও নির্দোষ ভাবছি। ফলে পরিষ্কার হওয়া উচিত ব্যাপারটা। এবং মঁসিয়ে পোয়ারো ও কাজটা করতে হবে আপনাকেই।

আপনার কথাটা ঠিক তা ধরে নিচ্ছি…কিন্তু ইতিমধ্যে তা কেটে গেছে ষোলটা বছরও।

কাজটা খুবই কঠিন তা মানছি। কিন্তু এ কাজটা আপনি ছাড়া আর কেউই করতে পারবে না।

দুটো চোখ এরকুল পোয়ারোর ঝিকমিক করে উঠলো, এ হে হে, একেবারে আমাকে তুলে দিচ্ছেন গাছে।

আপনার কথা আমি শুনেছি, সব কেস যে করেছেন তাও জানি, জোগাড় করেছি কি ভাবে করেছেন সে খবরও। বেশিটা আপনি নির্ভর করেন মনঃস্তত্ত্বের ওপর, তাই না? আর কখনও তো ওটা বদলায় না। সিগারেটের টুকরো, পায়ের ছাপ, নুয়ে পড়া ঘাস–ওগুলো তো নশ্বর জিনিস, আপনার নিশ্চয়ই ওসবে দরকার হবে না। তবে খুঁটিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন ঘটনার পুরো বিবরণটা, তখনকার মানুষজনের সঙ্গেও দরকার পড়লে কথা বলতে পারেন। এখনও বেঁচে আছেন তাদের প্রায় সকলেই…এবং তারপর..তারপর…চেয়ারে হেলান দিয়ে আপনার কথাতেই বলছি শুধু চিন্তা করে তুলে ধরতে পারেন প্রকৃত ঘটনার স্বরূপ…।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরকুল পোয়ারো,-গোঁফে এক হাত দিয়ে তা দিতে দিতে বললো, মাদমোয়াজেল, দারুণ সম্মানিত বোধ করছি আমি। আমি আপনার এই অগাধ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো। আমি দায়িত্ব নিলাম খুনের রহস্য ভেদ করার। ষোল বছর আগেকার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে তুলে ধরবোই প্রকৃত সত্যকে আমি।

উঠে দাঁড়িয়েছে কালাও, উজ্জ্বল আভা তার চোখেও, কিন্তু শুধু মুখে বললো, বেশ।

পোয়ারো বললো আঙুল তুলে, এক মিনিট আর, সত্যের স্বরূপ আমি প্রকাশ করবো তা আমি বলেছি। পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন আমার মধ্যে ওঠে না। আপনার মা নির্দোষ আপনি বলেছেন, এখন সেটা আমি মেনে নিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত যদি তিনিই প্রমাণিত হন দোষী? কি হবে তখন?

অহংকারীর মতো কার্লা ঘাড় বেঁকালো, তার মেয়ে আমি। সত্যি কথাটা আমি জানতে চাই।

ঠিক আছে, দেখা হবে আবার তাহলে।

.

প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়

আসামী পক্ষের উকিল :

আমার মনে আছে কি না ক্রেল মামলা? স্যার মন্টেগু ডিপ্লিচ প্রশ্ন করলেন, নিশ্চয়ই আছে, মনে আছে খুব ভালোভাবেই বেশ আকর্ষণ ছিলো মহিলার, তবে কিছু একটা গণ্ডগোলও ছিল মাথায়। বড্ড বেশি আত্মসংযমের অভাব।

পোয়ারোর দিকে স্যার মন্টেগু আড়চোখে তাকালেন, কিন্তু কেন আমাকে ওকথা জিজ্ঞেস করছেন?

দরকার আছে আমার। এটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, স্যার মন্টেগু তার কুখ্যাত নেকড়ে হাসি হাসলেন, যে হাসি ধরিয়ে দিতো অতীতে সাক্ষীদের হৃৎকম্প বলে খ্যাতি আছে। আমি হেরে গিয়েছিলাম এই মামলাটায়। পারিনি মহিলাকে বাঁচাতে।

জানি, সংক্ষেপে সারলো পোয়ারো।

কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার মন্টেগু, অবশ্য আমার ততো অভিজ্ঞতাও তখন ছিলো না, তবে যতোটা করা সম্ভব মনের মানুষের পক্ষে ততটাই আমি করেছিলাম। খুব একটা এগোনো যায় না সহযোগিতা না পেলে। দরখাস্তও করেছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সব মা-বৌয়েরা, মহিলাটির ওপর সবার সহানুভূতি ছিলো।

স্যার মন্টেগু পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে হঠাৎ বেশ বিজ্ঞজনোচিত ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বললেন, যদি গুলি করতেন মহিলা, বা খুন করতেন ছুরি দিয়ে তবে আমি সাজাতে পারতাম মানুষ খুনের মামলা। কিন্তু বিষ…খেলা করা চলে না এটা নিয়ে। ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে ওঠে…খুবই জটিল।

কি ছিলো আসামী পক্ষের বক্তব্য, প্রশ্ন করলো পোয়ারো, যদিও ইতিমধ্যে সে পড়ে ফেলেছে পুরোনো খবরের কাগজ। জেনেও নিয়েছে পুরো ঘটনাটা, কিন্তু তার ভালই লাগছিলো না জানার ভান করতে। স্যার মন্টেগুর সামনে বিশেষ করে।

আরে ঐ আত্মহত্যার ব্যাপার। ও ছাড়া একমাত্র আর তো বলা যায় না কিছু। কিন্তু সেটিও তুলে ধরা যায়নি ঠিক মতো। আত্মহত্যা করার লোকই ছিলো না ক্রেল। আপনার কখনো ওর সাথে দেখা হয়নি, তাই না, না। ও একটা দারুণ প্রাণ চঞ্চল, খোশ মেজাজী মানুষ ছিলো। কলির কেষ্ট বিয়ার–পাগল..এই জাতীয় যা কিছু বাকি ওর সব গুণই ছিলো। প্রবল ছিল দেহ লালসা, এবং মনে হয় তার বেশ ভালই লাগতো। নিজের থেকে চুপচাপ বিষ খেয়ে এই ধরনের নোক খতম করবে নিজেকে এটা বোঝানো কষ্টকর জুরীদের। আদৌ তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ওটা হারা মামলা। আর ঠিক মতো তাল সামলে চলতে পারলেন না মহিলাও। আর উনি কাঠগড়ায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো। লড়াই করার কোনো চেষ্টাই ওর তরফ থেকে ছিলো না। আর আপনার মক্কেলকে যদি আপনি কাঠগড়ায় তুলতে না পারেন বুঝতেই পারছেন জুরীরা যা বোঝার বুঝে নেবেন।

পোয়ারো বললো, সহযোগিতা না পেলে কিছুই যে করা যায় না, একটু আগে বললেন–তাই কি এর মানে?

নিশ্চয়ই, জাদুকর তো আর আমরা নই, কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারছে আসামী জুরীদের ওপর, অর্ধেক লড়াই নির্ভর করে তারই ওপর। বহুবার দেখেছি আমি জুরীরা একমত হন না জজের বক্তব্য বোঝানোর সঙ্গে। করেছে ঠিকই বা ও করতেই পারে না একাজ–তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এই ধরনের মনোভাব। সংগ্রামী মনোভাব দেখাবার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি ক্যারোলিন ক্রেল।

কিন্তু কেন?

স্যার মন্টেগু কাঁধ ঝাঁকালেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে। জিজ্ঞেস করবেন না ও কথা। ক্যারোলিন ভালই বাসতো স্বামীকে, একেবারে ভেঙে পড়েছিলো নিজের অপরাধের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে। আমার বিশ্বাস আঘাতটা সামলাতে পারেননি বলেই।

মহিলাটি তাহলে আপনার মতে অপরাধ করেছিলেন?

একথা শুনে স্যার মন্টেগু যেন চমকে উঠলেন, আহ…মানে…মনে হয়েছিলো তো আমার আমরা ও কথাটা মেনে নিয়েই আলোচনা করছিলাম।

কখনো কি আপনার কাছে ক্যারোলিন ক্রেল অপরাধ স্বীকার করেছিলেন?

বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন স্যার মন্টেগু, না, না…নিশ্চয়ই না। কয়েকটা নীতিনিয়ম আছে আমাদের, আপনি নিশ্চয়ই জানেন। মক্কেল নির্দোষ তা ধরেই নেওয়া হয়। যদি এতো কৌতূহল থাকে আপনার তাহলে তো মুশকিল হলো দেখছি, কারণ আপনি তো আর মেহিউকে পাবেন না। এই মামলার ব্রিফ পেয়েছিলাম মেহিউর কাছ থেকেই আমি। এ ব্যাপারে বুড়ো মেহিউ অনেক ভাল বলতে পারতেন আমার থেকে। কিন্তু এখনতো আর উনি এ জগতে নেই। অবশ্য জর্জ মেহিউ নামে ওনার ছেলে আছে, কিন্তু সেও তো ষোলো বছর আগে বাচ্চা ছিলো। ব্যাপারটা অনেকদিন আগেকার, তাই না।

হ্যাঁ, জানি তা, আপনার অনেক কিছুই মনে আছে তা আমার ভাগ্য। স্মৃতি শক্তির প্রশংসা আপনার করতে হয়।

বেশ খুশি হলেন স্যার মন্টেগু, আস্তে আস্তে বললেন, মানে সকলেরই মনে থাকে হেডলাইনগুলো। বিশেষ, করে তো কথাই নেই যদি অভিযোগটা খুনের হয়। তাছাড়া কাগজে খুব হৈচৈ করেছিলো ক্রেল মামলাটা নিয়ে। ব্যাপারটা মেয়ে ঘটিত ব্যাপার তো, এর মধ্যে জড়িত ছিলো যে মেয়েটি, সে আবার দেখতে দারুণ, তবু শক্ত ধাতুতে গড়া।

যদি বারবার একটা কথা আমি জিজ্ঞেস করে ফেলি, আমায় ক্ষমা করবেন দয়া করে। একবার প্রশ্ন করছি আমি, দোষী ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল, আপনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে ছিলেন তো?

আবার কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার মন্টেগু, নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি সত্যি কথা বলতে কি, ও ব্যাপারে সন্দেহ করার কিছু ছিলো না তা আমার মনে হয়। হা…ওটা ক্যারোলিনই করেছিলো।

কি কি সাক্ষ্য প্রমাণ ছিলো ওঁর বিরুদ্ধে?–জানতে চাইলো পোয়ারো, খুবই খারাপ। উদ্দেশ্য ছিলো প্রথমেই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কয়েকবছর ধরে ছিলো অনেকটা কুকুর-বেড়ালের মতো, ঝগড়া হতো প্রায়ই। প্রায়ই কোনো না কোনো মেয়ের সঙ্গে স্বামীটি জড়িয়ে পড়তো। নিজেকে সংযত কিছুতেই রাখতে পারতো না। ঐ ধরনের স্বভাব ছিলো। মোটামুটি সহ্য করে নিতো স্ত্রীটি। কিছুটা লাগাম ছেড়ে রেখেছিলো মেজাজের কথা ভেবে, তাছাড়া একেবারে পয়লা-সারির চিত্রশিল্পী ছিলো স্বামীটি। অনেক দামে বিক্রি হতো ওর আঁকা ছবি। আমার অবশ্য ঐ ধরনের ছবি পছন্দ হয় না, তবুও অসাধারণ ওর ছবিগুলো একথা পারবো না অস্বীকার করতে।

ঐ যে বলছিলাম মাঝে মাঝে ঝঞ্ঝাট বাঁধতো মেয়েদের নিয়ে। মুখ বুঝে সব সহ্য করার মতো ভীরু মিসেস ক্রেল ছিলো না। চেঁচামেচিও হতো, এবং শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছেড়ে আবার স্বামীটি ফিরে আসতে স্ত্রীর আশ্রয়ে আবার ভুলেও যেতো ঐ সব ঘটনা। কিন্তু অন্য ধরনের ছিল শেষ ঘটনাটি। ভীষণ কম বয়েসী ছিলো এবারের মেয়েটি, মাত্র কুড়ি।

এলসা গ্ৰীয়ার ছিলো ওর নাম। ইয়র্ক শায়ারের এক ব্যবসাদারের একমাত্র মেয়ে। টাকা ও গোঁ দুটোই ছিলো মেয়েটির। আর সে ভাল বুঝতো নিজের প্রয়োজনটাও। অ্যামিয়াস ক্রেলের ওপর ওর নজর পড়লো। নিজের ছবি আঁকাবে ক্রেলকে দিয়ে। এই ধরনের সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ও অবশ্য প্রতিকৃতি আঁকতো না, তবে আঁকতো মানুষের ছবি। তাছাড়া মনে হয় না কোনো মহিলা তার নিজের ছবি ওকে দিয়ে আঁকাতো, কারণ কাউকে ছেড়ে ক্রেল কথা বলতো না। কিন্তু ও এঁকে ছিল এই মেয়েটির ছবি, আর শেষের দিকে জড়িয়েও পড়েছিলো পুরো মাত্রায়। ওর তখন চল্লিশ বছর বয়স হতে চলেছে। বুঝতেই পারছেন, বেশ কয়েক বছর হলো বিয়েও হয়ে গেছে। ওর একরত্তি মেয়ের জন্যে ভেড়া হয়ে ওঠার বয়েস হয়ে উঠেছিলো, আর এলসা গ্ৰীয়ার হলো সেই একরত্তি মেয়েটা। ক্রেল ওর জন্য পাগল হয়ে গিয়ে স্ত্রীকে তালাক দেবার চিন্তা করতে শুরু করেছিলো এলসাকে বিয়ে করার কথাও।

এটা মেনে নিতে রাজী ছিল না ক্যারোলিন ক্রেল, শাসিয়ে ছিলো স্বামীকে, ওদের কথাবার্তা দুজন মানুষ শুনে ফেলেছিলো, বিশেষ করে যখন তার স্বামী অ্যামিয়াসকে ক্যারোলিন বলেছিলো, যদি না ছাড়ে ওই মেয়েটাকে তবে ক্যারোলিন ওকে খুন করবে। এবং ওর শুধু ওটা মুখের কথা ছিল না। আগের দিন ঘটে ঘটনাটা, ওরা চা খেতে গিয়েছিলো এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। লতাপাতা নিয়ে শখের গবেষণা করতেন সেই প্রতিবেশীটি। নানা রকমের ওষুধ-বিষুধ বাড়িতেই তৈরি করতেন। কোনাইন ছিল ওঁর তৈরি করা ওষুধের মধ্যে একটা–এই বিষটা যে চিতি-বিষলতা চায়ের আসরে কত মারাত্মক এবং কাজ করে কিভাবে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিলো সামান্য।

ভদ্রলোক পরদিন সকালে আবিষ্কার করলেন অর্ধেক খালি কোনাইনের বোতলটা। সন্দেহ ঘোরালো হয়ে উঠলো ওঁর মনে। মিসেস ক্রেলের ঘরে একটা আলমারীর তলার তাকে ওরা মানে পুলিশরা খুঁজে পেয়েছিলো প্রায় খালি একটা বোতল।

এরকুল পোয়ারো সামান্য অস্বস্তিতে একটু নড়ে উঠলো, ওটা ওখানে অন্য কেউ রেখে দিয়ে আসতে পারে।

না, আদালতে স্বীকার করে মিসেস ক্রেল সেই রেখেছিলো বোতলটা ওখানে। ও কথাটা খুবই বোকার মত স্বীকার করে ফেলেছিলো, ওকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এমন কোনো ওর সলিসিটারও ছিলো না। তাই ও তরফ থেকে বোতলটা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতেই ও স্বীকার করে নেয়।

কিন্তু কেন?–আবার প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

বিষটা চুরি করে আত্মহত্যা করার জন্যেই একথা বলেছিলো ক্যারোলিন। কিন্তু কি করে বোতলটা খালি হয়ে গেলো তার কারণ কিছুই সে দেখতে পারেনি বা কেন শুধু তার এবারই আঙুলের ছাপ বোতলে পাওয়া গিয়েছিলো ওর পক্ষে সাক্ষ্যের এই অংশটা খুবই মারাত্মক। স্ত্রীর বক্তব্য ও আত্মহত্যা করেছে স্বামী অ্যামিয়াস ক্রেল। কিন্তু স্ত্রীর ঘরের আলমারীতে লুকোনো কোনাইনের বোতল থেকে কেউ যদি আত্মহত্যা করার জন্যে বিষ চুরি করে তবে তার আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে তো থাকা দরকার।

বিয়ারের সঙ্গে তো বিষটা দেওয়া হয়েছিলো, তাই না?

হ্যাঁ। মহিলাটি নিজেই বাগানে নিয়ে যায় বোতলটা বের করে ফ্রিজ থেকে, যেখানে ছবি আঁকছিলো তার স্বামী। নিজের হাতে মহিলা বীয়ার ঢেলে দিয়েছিলো তার স্বামীকে, তারপর স্বামীকে বিয়ারটা খেতে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। তারপর লাঞ্চ খেতে চলে যায় সবাই, স্বামী বাদে। প্রায়ই করতো এটা স্বামীটি। খেতে যেতো না খাবার টেবিলে, পরে স্ত্রী আর গভর্নেস দুজনে দেখতে পায় মরে পড়ে আছে অ্যামিয়াস ক্রেল। যে বীয়ার ও দিয়েছিলো ক্যারোলিনের বক্তব্য তাতে কোনো দোষ ছিলো না। বলতে চেয়েছিলাম আমরা অ্যামিয়াসের মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয় কোনো দুশ্চিন্তার যার ফলে নিজেই বীয়ারে বিষ মিশিয়ে খেয়ে নেয়। গল্পটা ধোপে টেকেনি। কারণ আত্মহত্যা করার মতো লোকই ছিলো না আমিয়াস। তাছাড়া সব ভেস্তে দিলো বোতলে আঙুলের ছাপটা।

ক্যারোলিনের আঙুলের ছাপ কি বোতলে পেয়েছিলো পুলিশ?

না, পায়নি। শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় বোতলে। তবে যখন গভর্নেস ডাক্তারকে টেলিফোন করতে দোতলায় যায় তখন ক্যারোলিনই একমাত্র মৃতদেহের কাছে ছিলো। এবং কোনো সন্দেহই এ বিষয়ে নেই যে নিজের আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে সেটা মুছে দিয়ে ছাপ লাগিয়ে নিয়েছিলো স্বামীর হাতের। দেখাতে চেয়েছিলো ক্যারোলিন যে ও যেন কখনই বীয়ারের বোতলটা ছোঁয়নি। কিন্তু কাজ হয়নি ওতে কোনো। বুড়ো রুডলফ সরকার পক্ষের কৌসুলী ছিলেন, কোর্টে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে খুব রগড় করেছিলো। কোর্টে হাতে কলমে সে দেখিয়ে দেয় যে ঐভাবে বোতল ধরা যায় না–আমরাও প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম যে বোতল ঐভাবে ধরা যায়। মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করার সময় বিশেষ করে। কিন্তু খুবই জোলো ছিলো যে আমাদের যুক্তিগুলো তা বলাই বাহুল্য।

এরকুল পোয়ারো বললো, বাগানে বীয়ারের বোতলটা নিয়ে যাবার আগে ওতে কোনাইন নিশ্চয়ই মেশানো হয়ে গিয়েছিলো?

কোনাইন ছিলোই না বোতলে, ছিলো গ্লাসে।

একটু থামলেন স্যার মণ্টেণ্ড–তাঁর ভারিক্কী সুন্দর মুখের ভাবটা পাল্টে গেলো হঠাৎ। মাথা খুব জোরে নেড়ে বললেন–আরে তাইতো, কী বলতে চাইছেন পোয়ারো আপনি?

পোয়ারো বললো, যদি নির্দোষ হবে ক্যারোলিন ক্রেল তাহলে কোনাইন বীয়ারে এলো কোত্থেকে? অ্যামিয়াস ক্রেল নিজেই রেখেছিলো আসামী পক্ষ থেকে তা বলা হয়েছিলো। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব আপনি বলছেন–এবং যদি আমাকে বলেন, তবে আমিও বলবো একমত আপনার সঙ্গে। অ্যামিয়াস ক্রেল ঐ ধরনের লোক ছিলো না। অতএব যদি কাজটা ক্যারোলিন না করে থাকে তবে অন্য কেউ নিশ্চয়ই ওটা করেছে।

স্যার মন্টেগুর প্রায় রাগে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো, উনি বললেন, মশাই আজেবাজে কথা ছাড়ুন তো। চাবকে কখনো মরা ঘোড়াকে ছোটানো যায় না। ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে অনেক বছর আগেই। ক্যারোলিনই করেছিলো খুন। যদি আপনি সেই সময় ওকে দেখতেন তাহলে কোনো সন্দেহই মনে থাকতো না। সব কিছু ক্যারোলিনের মুখে চোখে ফুটে উঠেছিলো। ভয় পায়নি একটুও এমনকি নার্ভাসও হয়নি। বিচারটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক ও যেন তাই চাইছিলো। তা বলতে হবে সাহস ছিলো মহিলার, সত্যিই ছিলো সাহস…।

এবং তৎসত্ত্বে, উনি একটা চিঠি লিখে রেখে যান মারা যাবার সময় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে, তাতে তিনি নিজেকে নিরপরাধ বলে গেছেন ঈশ্বরের নামে শপথ করে।

জোর দিয়েই কিন্তু আমি বলবো খুন করেছিলেন মহিলা, আমি-আপনিও ওর জায়গায় থাকলে তাই করতাম, বললেন স্যার মন্টেগু ।

উনি ঐ ধরনের মহিলা ছিলেন না তা বলছেন ওর মেয়ে।ওর মেয়ে বলছেন ফুঃ, সে এসব ব্যাপারের কী জানে? যখন বিচার চলছিলো তখন তো একেবারে বাচ্চা ছিলো মেয়েটা। বয়স ছিলো কত…চার…পাঁচ। ইংল্যান্ডের বাইরে কোনো আত্মীয় স্বজনের কাছে ওকে ওর নাম বদলে দিয়ে ওরা পাঠিয়ে দেয়। কতটুকুই বা মেয়েটা জানতে পারে, আর কতটুকুই বা মনে রাখতে পারে?

কখনও কখনও শিশুরা খুব ভাল মানুষ চিনতে পারে।

 হয়তো তা পারে, কিন্তু তা নয় এক্ষেত্রে। তবে খুব স্বাভাবিক এটাও যে বিশ্বাস করতে চায় না মেয়ে যে ঐ কাজটা তার মা করেছে। সে ঐ বিশ্বাস নিয়েই থাকুক না। তাতে তো কোনো ক্ষতি হবে না কারুর।

মাথা নাড়লো পোয়ারো, এই দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে প্রমাণ চাইছে এখন মেয়েটি।

স্যার মন্টেগু হাঁ হয়ে গেলেন তার স্বামীকে ক্যারোলিন ক্রেল খুন করেনি প্রমাণ চাই তার?

হা। মাথা নাড়লো পোয়ারো। তাই নাকি, কিন্তু পাবে না।

তাই কি মনে করেন আপনি, বিখ্যাত কিংস-কাউন্সেল পোয়ারোর কথা শুনে গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, আপনি খুব সৎ প্রকৃতির লোক আমার কিন্তু তা ধারণা ছিলো। কিন্তু পোয়ারো এসব কি করছেন? সরল মাতৃভক্তির সুযোগ নিয়ে একটি মেয়ের কিছু টাকা কমাতে চাইছেন?

আপনি জানেন না মেয়েটিকে। ও খুব সাধারণ মেয়ে নয়। একটা অস্বাভাবিক তেজ আছে মেয়েটার চরিত্রে।

তা হবে। আমার ভাবা উচিত ছিলো অ্যামিয়াস আর কারোলিন ক্রেলের মেয়ে যে ঐ ধরনেরই হবে। মেয়েটি কি চায়?

প্রকৃত সত্য জানতে।

হুম! আমার মনে হয় না প্রকৃত সত্যটা খুব উপাদেয় ঠেকবে ওর কাছে। পোয়ারো সত্যি কথা বলতে কি, ও ব্যাপারে আমার তো মনে হয় কোনো কারনেই থাকতে পারে না সন্দেহের। ক্যারোলিনই করেছিলো খুনটা।

স্যার মাফ করবেন, আমি নিজে নিঃসন্দেহ হতে চাই এ বাপারে। নিজের মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় পোয়ারো জানিয়ে দিলো।

নতুন করে আপনি আর কি করতে পারেন তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তখনকার খবরের কাগজে বিচারের খুঁটিনাটিগুলো পাবেন। হামফ্রে রুডলফ সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন। মারা গেছেন তো উনি, ভেবে দেখি দাঁড়ান, কে ছিলো জুনিয়ার? হা পড়েছে মনে, ছোকরা ছিলো একটা, যাক, হা হামফ্রের সহকারী ছিলো ফগই। কথা বলে দেখতে পারেন ওর সঙ্গে। তাছাড়া আরও কয়েকজন আছেন ঐ সময়কার। তবে পুরো ব্যাপারটা নতুন করে খুঁচিয়ে তোলার ব্যাপারে মনে হয় না নাক গলানোটাকে খুব একটা পছন্দ করবেন। তবে সাহস করে এটা বলতে পারি যে ওঁদের কাছ থেকে আপনি যা চাইবেন জানতে তা পাবেন। আপনার মত শয়তানের সঙ্গে বাঁচাতুরিতে এঁটে ওঠা মুশকিল।

ঐ যে কাদের কথা বলছিলেন যেন ঐ সময়কার, আমার খুব দরকার। ওঁদের কথা খুব আশাকরি মনে আছে আপনার।

একটু চিন্তা করলেন স্যার মন্টেগু, ভেবে দেখি দাঁড়ান। ব্যাপারটা তো অনেকদিন আগের। বলতে গেলে মাত্র পাঁচজন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এর মধ্যে চাকর-বাকরদের কথা ধরছি না কিন্তু…সবাই ওরা ভালো মানুষ, সন্দেহই করা যায় না ওদের।

ছিলেন পাঁচজন, আপনি তাই তো বললেন। আমাকে কিছু বলুন তাদের সম্বন্ধে।

আচ্ছা ফিলিপ ব্লেবোর কথা প্রথমেই বলি। সবচেয়ে বড় বন্ধু ক্রেলের, ওদের বন্ধুত্ব ছিলো ছোটবেলা থেকে। ওই বাড়িতেই ঐ সময়ে ফিলিপ ছিলো। বেঁচে আছে এখনও। মাঝে মাঝে দেখা হয় এখনও গলফের মাঠে। সেন্ট জর্জেস হিলে হলো ওর বাড়ি, দালালি করে শেয়ারের বাজারে। ও ভালো বোঝে ব্যবসাটা, পয়সা করেছে প্রচুর। একটু মোটা হয়ে যাচ্ছি ইদানীং।

বুঝলাম, কে তার পরে?

ফিলিপের বড় ভাই। এক ছোট খাটো জমিদার। লোকটা একটু ঘরকুনো ধরনের, থাকতো। বাড়িতেই।

একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠলো মনের মধ্যে। ওটাকে অতি কষ্টে পোয়ারো চাপা দিলো। সব সময়ে ছেলে ভুলানো ছড়া চিন্তা করা ওর উচিত নয় আদৌ। অথচ এই এক রোগ হয়েছে ইদানীং তার। ছড়ার সুরগুলো ওর মনের মধ্যে যখন তখন ঝংকার দিয়ে ওঠে, বাজারে এই শুয়োর ছানাটা গিয়েছিলো, বাড়িতেই রয়ে গেল ঐ শূয়োর ছানাটা…।

আপন মনে বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, রয়ে গেলো বাড়িতেই হা, কি যেন বলছিলেন?

বলছিলাম এর কথাই তো…সে এক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছিলো ওষুধপত্র গাছপালা মিলিয়ে। রসায়ন চর্চা করতো। ওর ছিলো ওটাই নেশা। দাঁড়ান মনে করে দেখি নামটা। মিল ছিলো সাহিত্যিকের নামের সঙ্গে। হ্যাঁ পড়ছে মনে…মেরিডিথ..মেরিডিথ ব্লেক। এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না।

কে তারপর?

তারপরে? সব গণ্ডগোলের দলে ছিলো তারপরের জনই। এই মামলা যে মেয়েটাকে নিয়ে এলসা গ্ৰীয়ার।

মাংসের কোর্মা খেয়েছিলো এই শূয়োর ছানাটা। আপন মনে পোয়ারো বিড়বিড় করে বললো।

পোয়ারোর দিকে বড় বড় চোখ করে স্যার মন্টেগু তাকালেন। এ কথা মানতে হবে ওর মা-বাবা মেয়েটাকে ভালোমতই খাইয়েছিলো মাংস। দারুণ নাছোড়বান্দা মেয়ে। তার তিনবার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তখনই। ওর কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের আদালতে যাওয়া আসা করাটা ছিলো জলভাতের মতো সহজ। তবে স্বামী পাল্টেছে প্রত্যেকবারই ভালো মক্কেল ধরে আগের বারের চেয়ে। উনি সম্প্রতি লেডি ডিটিশাম। ওর নাম পাবেন গুজব রটানো পত্রিকার যে কোনো একটার পাতা খুলুন।

আর বাকি দুজন?

বাড়ির গভর্নেস তো একজন। মনে নেই নামটা কাজের মহিলা বেশ। টমসন…জোনস্..এই ধরনের নাম ছিলো। বাচ্চা মেয়ে আর একটা, সৎ বোন ক্যারোলিন ক্রেলের। তখন বড়জোর পনের বছর বয়েস ছিলো। মেয়েটার খুব নাম হয়ে গিয়েছিলো। সাক্ষ্য দিয়েছিলো গুছিয়ে অতীতের অনেক কথা স্মরণ করে করে। ওয়ারেন–অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন। একবারে সাড়া জাগানো মহিলা হয়ে উঠেছে এখন। কদিন আগেই দেখা হয়েছিলো।

উঁউঁ করে কাদা শূয়োর ছানার মতো এই মেয়েটি তাহলে ছিলো না…।

পোয়ারোর দিকে অবাক হয়ে স্যার মন্টেগু তাকিয়ে রইলেন। নীরস গলায় তারপর বললেন, তাকে অবশ্য সারা জীবনই কাঁদতে হয়েছে, মুখটাকে একেবারে বিকৃত করে দিয়েছে মুখের এক পাশে একটা বিশ্রী দাগ।…আপনি সব ব্যাপারটা বুঝতে পারছি জানতে চান, পোয়ারো তাই না? আপনি পাবেন সব খবরই, চিন্তা করবেন না।

উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, ধন্যবাদ। আমাকে অনেক উপকার করলেন। যদি তার স্বামীকে মিসেস ক্রেল হত্যা না করে থাকেন। স্যার মন্টেগু মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, আঃ উনিই করেছেন বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা। তার এই মাঝপথের ব্যাঘাত পোয়ারো গ্রাহ্য না করে শেষ করলো নিজের আগেকার কথাটা–তবে যুক্তিগ্রাহ্য এটাই বলে মনে হয় যে কেউ না কেউ এই পাঁচজনের মধ্যে তা করেছে।

একজন এদের মধ্যে কাজটা করে থাকতে পারতো, কিন্তু করবে কেন খুঁজে পাচ্ছি না তার কোনো কারণ, কোনো কারণ নেই। আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত খুন এরা কেউই করেনি। মশাই পোকাটাকে মাথা থেকে তাড়ান তো।’

পোয়ারো মাথা নেড়ে স্যার মন্টেগুর কথার উত্তর না দিয়ে একটু হাসলো।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়

সরকার পক্ষের কৌসুলী

মিঃ ফগ এককথায় উত্তর দিলেন-নরকের কীটের মতো পাপী।

ভাবুকের মতো পোয়ারো তাকিয়ে রইলো ব্যারিষ্টার মিঃ ফগের চাচাছোলা কথায় তার মুখের দিকে।

স্যার মন্টেগুর, কিংস কাউন্সেল কোয়ান্টিন ফগের সঙ্গে মিল নেই একটুও। কর্মশক্তি, সম্মোহিনী শক্তি, স্বেচ্ছাচারিতার মূর্ত প্রতীক যেন স্যার মন্টেগু । একটু খোঁচা দিয়ে লোককে কথা বলার অভ্যেস আছে। দ্রুত নাটকীয় পরিবর্তন আচরণে ঘটিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পটু অপরের ওপর। শহুরে সুন্দর দেখতে, খুব মিষ্টি ব্যবহার এই মুহূর্তে, ম্যাজিকের মতো পর মুহূর্তেই রূপান্তর ঘটিয়ে ধূর্তের হাসি চাপা ঠোঁটে ফুটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন যেন তোমার ওপর।

রোগামতোন কোয়ান্টিন ফগ, চেহারা ফ্যাকাসে, মনে হয় না ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু আছে বলে। শান্ত ভাবে প্রশ্ন করেন, ভীষণ অভাব উত্তাপের–তবে ধীর স্থির এবং অবিচল আসল ব্যাপারে। যদি ছুঁচালো মুখ তলোয়ারের সঙ্গে স্যার মন্টেগুকে তুলনা করা যায় তবে তুরপুনের সঙ্গে করা যায় ফগকে। ফুটো করে চলেন ধীর ভাবে। ইনি অর্জন করেননি বটে সেরকম সাড়া জাগানো খ্যাতি, তবে নাম যশ আছে পয়লা সারির আইনজ্ঞ বলে। মামলায় সাধারণতঃ হারেন না।

পোয়ারো তাকে খুব চিন্তান্বিত ভাবে লক্ষ্য করে চলেছিলো। সে বললো, তাহলে তাই মনে হয়েছিলো আপনার?

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ফগ, আপনার আসামীর কাঠগড়ায় মহিলাকে দেখা উচিত ছিলো, বুড়ো হাম্পি রুডলফ আমার সিনিয়র, জেরায় জেরায় একেবারে কিমা করে ছেড়েছিলেন মহিলাকে।

ফগ একটু থেমে আবার বললেন, তবে যেন পুরো ব্যাপারটা ভালো ছিলো বড় বেশি মাত্রায়।

মিঃ ফগ কিছু মনে করবেন না, ঠিক ধরতে পারলাম না আপনার শেষ কথার মানেটা।

ফগ সুন্দর ভ্রূ-জোড়া কুঁচকে নরম আঙুল ঠোঁটে বোলাতে বোলাতে বললেন, কথাটা বলি কিভাবে? একটা চলতি কথা আছে ইংরেজদের মধ্যে, সেটা একমাত্র ভালো বোঝে ইংরেজরাই বসে থাকা পাখিকে গুলি করা–আমার বক্তব্য এই কথাটা বললে ঠিক বোঝানো যায়। কিছু কি বুঝতে পারছেন?

ইংরেজদের ঘরোয়া হলেও কথাটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি আমি তা আমার মনে হয়। প্রধান ফৌজদারী আদালতে, সব সময়ে ইংরেজরা তাদের প্রতিপক্ষকে হারাতে চায় একটু খেলোয়াড় সুলভ সুযোগ দিয়ে।

ধরেছেন ঠিক। ঐ অভিযুক্ত মহিলা কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো সুযোগই পাননি। মহিলাকে হাম্পি রুডলফ লাগিয়ে ছিলেন নিজের ইচ্ছে মতো, স্যার মন্টেগুকে দিয়ে শুরু হয়েছিলো, মহিলা দাঁড়িয়ে কাঠগড়ার মধ্যে। যেন একটা বাচ্চা মেয়ে বিরাট একটা পার্টিতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। প্রশ্ন করেছিলেন স্যার মন্টেগু আর শেখানো পড়ানো কাকাতুয়ার মতো মহিলা উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিরীহ অত্যন্ত, কথা মেপে মেপে বললেও আদৌ সেগুলো হতে পারছিলো না বিশ্বাসযোগ্য, জুরীর কাছে বিশেষ করে কোনো দোষ ছিলো না বুড়োর, চেষ্টা করেছিলেন যথাসাধ্য। কিন্তু কোনো সহযোগিতাই পাননি মহিলার পক্ষ থেকে। তারপর হাম্পি রুডলফ উঠেছিলেন জেরা করতে।

জেরায় জেরায় মহিলাকে উনি বানিয়ে ছেড়ে ছিলেন কিমা তা তো আগেই বলেছি। প্রত্যেকবার স্বীকার করিয়ে ছাড়ছিলেন তাঁর কথায় অসঙ্গতি মহিলার মুখ দিয়েই। তারপর শেষ বাণগুলো ছুঁড়তে শুরু করেছিলেন জেরা শেষ করার মুখে, আমার মতে আপনি, এই যে কথাগুলো মিসেস ক্রেল বলেছেন, যেমন কোনাইন চুরি করেছিলেন আত্মহত্যা করার জন্যে আপনি, সম্পূর্ণ মিথ্যে একথা। আমার মতে স্বামীকে খাওয়াবার জন্যে আপনি চুরি করেছিলেন। বিষটা, যিনি তখন অন্য এক মহিলার দিকে আপনাকে ছেড়ে বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এবং জেনে শুনেই আপনি বিষ দিয়েছিলেন স্বামীকে। …আহা, ঐ সুন্দর, শান্ত নরমশরম মহিলাটি তখন প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলেছিলেন… না না,…করিনি আমি।…আচ্ছা বলুন তো কোনো কাজ হয় এই ধরনের উত্তরে, বিশ্বাস করে কেউ, আমি দেখেছিলাম স্যার মন্টেগুর ঐ উত্তর শোনার পর চেয়ারের মধ্যে কেঁপে উঠেছিলো শরীরটা, পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন উনি–শেষ খেলা, কিছু করার আর নেই।

ফগ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর আবার শুরু করলেন বলতে, এখনও পর্যন্ত..ঠিক বুঝতে পারিনি একটা ব্যাপার। হয়তো মহিলা দারুণ ধূর্তের মতো চাল চেলেছিলেন। যে দয়া মায়া মানুষের মধ্যে বিশেষ করে অসহায় মহিলাদের প্রতি যে সুনাম আছে সহানুভূতির জন্যে, তিনি আবেদনটা তারই কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন ঠিক মতো। জুরী কেন শুধু, যারা যারা সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলো, যেন সবাই বুঝতে পেরেছিলো কতো অসহায় মহিলা, উনি কিছুমাত্র সুযোগ পাননি আত্মপক্ষ সমর্থন করার। মহিলা বিনা প্রতিবাদে হাম্পি রুডলফের নিষ্ঠুর আক্রমণের বিরুদ্ধে অসহায় প্রাণীর মতো আত্মসমর্পণ করেছিলেন। …তবে ওঁর কিছু বলারও ছিলো না ও ছাড়া। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছিলেন জুরীরাও–তাঁদের রায় ঘোষণা করা হলো, অপরাধী তবে সুপারিশ করা হচ্ছে সেই সঙ্গে দয়া দেখাবার।

ব্যাপারটা কি জানেন আসলে, আর একজন যে মহিলা ছিলো মামলাতে, তবে ঐ মেয়েটা যার বয়স কম, এঁর পার্থক্যটা ছিলো তার সঙ্গে একেবারে বিপরীত ধরনের। ঐ মেয়েটাকে প্রথম থেকেই তেমন পছন্দ করেননি জুরীরা। ওর ব্যাপারে কেউ সহানুভূতিশীলও ছিলো না। দারুণ সুন্দরী, পোড়খাওয়া, আধুনিকা মেয়েটা। যে সব মহিলা আদালতে ছিলেন তাদের চোখে ঘর ভাঙানি মেয়ে ছিলো ও। আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখলে ওই ধরনের মেয়েদের সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে নিজের নিজের ঘর সংসার সামলাতে, যেন মেয়ে তো নয়, যেন এক বাণ্ডিল সেক্স। তাদের যেন নেশা মা-বৌদের অধিকারগুলোকে ভাঙচুর করাই। তবে মেয়েটিকে স্যার বলতো একটা ব্যাপারে নিজেকেও বাদ দেয়নি ও। অ্যামিয়াস ক্রেলকে সে ভালোবেসেছিলো তা স্পষ্ট স্বীকার করেছিলো, এবং তাকে ভালোবাসতো ক্রেলও। ফলে অ্যামিয়াসকে তার নিজের সংসার থেকে জোর করে মেয়েটি চেয়েছিলো উপড়ে তুলে নিয়ে যেতে।

আমি ওকে এক দিক দিয়ে প্রশংসাও করি, বলতে হবে সাহস ছিলো। স্যার মন্টেগু কিন্তু জেরার সময় কিছু নোংরা প্রশ্ন করেছিলেন, ঘাবড়ায়নি মেয়েটা। উত্তর দিয়েছিলো চোখা চোখা। অবশ্য মেয়েটাকে পছন্দ করেননি জজও, আদালতও না। জজ কিন্তু জুরীদের অভিযোগের বয়ান পড়ে শোনানোর সময় মোটামুটি আসামীর সম্বন্ধে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। অস্বীকার না করলেও ঘটনাকে, আসামী যে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলো যথেষ্ট মাত্রায় প্ররোচিত হয়ে এ ধরনের আভাস দিয়েছিলেন।

হঠাৎ প্রশ্ন করলো এরকুল পোয়ারো, আত্মহত্যার ইঙ্গিতটা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা মেনে নেননি, জজ, না?

মাথা নাড়লেন ফগ, কোনো ভিত্তিই ওটার ছিলো না। মনে রাখবেন একবারের জন্যেও কিন্তু একথা আমি বলছি না যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছিলেন স্যার মন্টেগু তার তরফ থেকে। বরং বলা যায় আসামীকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ খেটেছিলেন। উনি দারুণ মামলা লড়েছিলেন। এক উদারমনা মুখ সন্ধানী, একটু অভিমানী অস্থির প্রকৃতির পুরুষ হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছে গভীরভাবে একটা কম বয়েসী মেয়ের সঙ্গে, তারপর জর্জরিত বিবেকে কশাঘাতে, অথচ আসতে পারছে না বেরিয়েও এমন এক মানুষের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মর্মস্পর্শী ভাষায় আদালতের সামনে। তারপর কীভাবে সেই পুরুষটি ধাক্কা খাচ্ছে, ঘৃণা করছে নিজেকে, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধাচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্যে, মনের মধ্যে টানা পোড়েন সন্তানের জন্যে, শেষ পর্যন্ত বদ্ধপরিকর সব কিছুর অবসান ঘটাবার জন্যে…এবং ঐ অকালে মৃত্যু তারই পরিণতি। এ জগৎ থেকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া। স্যার মন্টেগু অসাধারণ আর্গুমেন্ট করেছিলেন। অনেকের চোখে জল এসে গিয়েছিলো ওঁর কথায়। হতভাগ্য মানুষটাকে গভীর আসক্তি আর কর্তব্যবোধের টানাপোড়েনে যেন চোখের সামনে সবাই দেখতে পাচ্ছিলো। ভীষণ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিলো। তারপর ওঁর কথা যখন একসময় শেষ হলো, তখন ধীরে ধীরে কেটে গেলো যাদুর প্রভাবটাও। অ্যামিয়াস ক্রেল রূপকথার নায়ক হিসেবে বর্ণিত তার সঙ্গে সত্যিকারের অ্যামিয়াস ক্রেলের মিলটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো তখন কারণ সকলেরই জানা ছিলো ওর স্বভাব চরিত্রের কথা। ও আদৌ অতটা ভালো মানুষ ছিলো না। এমন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণও স্যার মন্টেগু পেশ করতে পারেননি যা দিয়ে জোরালো করে তুলতে পারতেন তার বক্তব্যকে। বরং বলতে আমি বাধ্য হবো বিবেক বুদ্ধি আসে সামান্যতম এমন মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায় না ক্রেলের। দারুণ ভালো নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, ভালো মেজাজে থাকলে, ও আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী মানুষ ছিলো, ওর ন্যায় নীতি বলতে যা ছিলো তা শুধু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে। হলফ করে এ কথা আমি বলতে পারি ও তা কখনো সে প্ররোচনা যতোই আসুক না কেন ছবি আঁকতো না আজে বাজে। এবং ও জীবনের অন্যক্ষেত্রেও ছিলো এক পুরো রক্ত মাংসের মানুষ, শতরূপে ভালোবাসতো জীবনকে, চাইতো বাঁচতে। আত্মহত্যা? ও তেমন মানুষই ছিলো না।

আসামী পক্ষ থেকে মনে হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের পথটা বাছা হয়নি ঠিকমতো, বললো পোয়ারো।

ফগ রোগা রোগা কাঁধ দুটো নাচিয়ে বললেন, কীই বা আর ছিলো করার, বসে থাকা চুপচাপ আর মামলা প্রমাণ করতে সরকার পক্ষকে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় ছিলো না। গাদাগাদা প্রমাণও ছিলো বিরুদ্ধে। মহিলা নিজের হাতেই বিষটা এনেছিলেন, স্বীকারও করেছিলেন চুরি করার কথাটা। উপায়, উদ্দেশ্য, সুযোগ, ছিলো সব কিছুই।

কৃত্রিমভাবে এগুলো যে সাজানো হয়েছিলো পরপর এটা প্রমাণ করার চেষ্টাও তো কেউ করে থাকতে পারে।

কাঠখোট্টার মত ফগ বললেন পোয়ারোর কথার উত্তরে, মহিলা স্বীকার করেছিলেন বেশিরভাগই অভিযোগ। তাছাড়া খুবই কষ্ট কল্পিত আপনার বক্তব্যটি। আমার মনে হয় আপনি সবটাই অনুমান করে নিচ্ছেন। অন্য কেউ খুন করে আপনার মনে হয় সবকিছু এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ভদ্রমহিলাই খুন করেছেন মনে হয়।

আপনি কি অযৌক্তিক মনে করছেন আমার বক্তব্যটাকে? পোয়ারো প্রশ্ন করলো পাল্টা।

ধীরে ধীরে ফগ বললেন, মনে হচ্ছে করছি। আপনার মতে কাজটা করেছিলো কোনো এক রহস্যময় অজ্ঞাত ব্যক্তি। কিন্তু আমরা তাকে পাবো কোথায়?

খুব নিকট আত্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যে অবশ্যই। পাঁচজনের কথা তো বলছিলেন, তাই না? কে এদের মধ্যে থাকতে পারে জড়িত?

পাঁচজন? দাঁড়ান, দেখি ভেবে, একজন তো হলো গাছপালার শেকড়-বাকর নিয়ে কী সব করতো ঐ বুড়ো অকর্মার ধাড়ীটা। নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক শখটা। তবে অমায়িক লোকটা। মানুষটা একটু ধোয়াটে গোছের। তা ওকে মনে হয় না ওই রহস্যময় অজ্ঞাত পুরুষ বলে। তারপর ঐ মেয়েটা, পারলে ও খুন করতো ক্যারোলিনকে। আদৌ অ্যামিয়াসকে না। তারপর ঐ দালালটা আসে শেয়ার বাজারে। আবার সে প্রাণের বন্ধু ক্রেলের। ওসব চলে গোয়েন্দা কাহিনীতে। এছাড়া তো আর কেউ নেই–ও হা… ওই সৎ বোনটা…না না সন্দেহ করা যায় না ওকে। মোটে তো চারজন হলো।

গভর্নেসের কথাটা কিন্তু আপনি বাদ দিয়ে গেলেন। মনে করিয়ে দিলো পোয়ারো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তো। গভর্নেস আজে বাজে লোক–আমাদের এতো মনে থাকে না সাধারণ মানুষের কথা। মনেও পড়ছে আবছা মহিলা মাঝ বয়েসী, মানুষ হিসেবে সিধেসাধা তবে কাজেরও ছিলো। হয়তো বলতে পারেন মনঃস্তত্ত্ববিদরা তার কোনো রকম গুপ্ত কামনা ছিলো ক্রেলের সম্বন্ধে, যার জন্যে খুন করেছে। যেমন হয় অবিবাহিতা মেয়েরা যাদের বয়স পেরিয়ে গেছে বিয়ের, এও সেরকম ছিলো। তবে ঠিক হবে না অভিযোগ আনাটা ওর বিরুদ্ধে। যতদূর মনে পড়ে আমার তার কোনো রকম মানসিক বিকারও ছিলো না।

বহুদিন আগের ঘটনা ব্যাপারটা তো?

তা তো পনেরো-ষোলো বছর হবেই। এবং সবটাই যে আমার মনে থাকবে এতদিন আগের ঘটনা এ আশাও করা উচিত নয় আপনার।

কিন্তু কি আশ্চর্য আপনি অবিশ্বাস্যভাবে সবকিছুই মনে রেখেছেন। দেখতে পান আপনি তাই না? যখন কথা বলেন আপনি মনে হয় তখন আপনার চোখের সামনে পুরো ছবিটা ভেসে ওঠে।

মাথা নাড়লেন ফগ ধীরে ধীরে, হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, দেখতে পাই আমি…চোখের সামনে একেবারে।

পোয়ারো বললো, আমার কিন্তু ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে জানতে, এটা কেন আপনার হয়?

কেন? একবার প্রশ্নটাকেই ফগ প্রশ্নের মতো করে উচ্চারণ করলেন, তারপর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো তার মুখটা, বেড়ে উঠেছে যেন আগ্রহও–ও হা কেন প্রশ্ন করছেন ভেসে ওঠে?

আপনার চোখের সামনে কি এতো সহজেই ভেসে ওঠে? সাক্ষীরা? কৌসুলীরা? জজ? না, দাঁড়িয়ে থাকা কাঠগড়ার আসামী?

শান্তভাবে ফগ বললেন, বোধ হয় এটাই আসল কারণ, ঠিক জায়গাটায় আপনি ঘা মারতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। ঐ মহিলাকেই আমি সব সম সময়ে দেখি। ব্যাপারটা ভারী মজার, ভাবালুতা। তবে সে গুণ নিশ্চয়ই মহিলার ছিলো। তিনি সত্যি সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন কিনা তা ঠিক বলতে পারছি না–কম নয় বয়সও, ক্লান্তির ছায়া চেহারায়, চোখের কোলে কালি। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই যেন সব কিছু আবর্তিত হচ্ছিলো। তাকেই নিয়ে যেন নাটক। অথচ উনি ওখানে বেশির ভাগ সময় থাকতেন না, শুধু দেহটা ওঁর থাকতো ওখানে, ওঁর মন, যেন চলে যেতো ওঁর আত্মা অনেক, অন্য কোথাও অনেক দূরে অন্য কিছুর সন্ধানে। শান্ত, বিনীত মৃদু হাসি সমাহিত মুখে, আলো ছায়ার খেলা চেহারায়। অনেক বেশি প্রাণবন্ত সব মিলিয়ে, বিশেষ করে সুন্দরী, সুতনুকা ঐ কমবয়েসী মেয়েটার চেয়ে তো বটেই। আমি প্রশংসা করি এলসা গ্ৰীয়ারকে, দারুণ তেজী মেয়ে। জানে লড়তে, ও একটুও ভেঙে পড়েনি জেরার মুখে। আবার আমি শ্রদ্ধা করি ক্যারোলিন ক্রেলকে, উনি চাননি লড়তে। কারণ যেন তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন আলো আঁধারের জগতে। উনি কখনও হারেনওনি, লড়ার চেষ্টা করেননি বলে।

ফগ একটু থেমে আবার বললেন, তবে আমার একটা ব্যাপারে ভুল হয়নি। উনি খুন করেছিলেন যাকে, তাকে ভালোও বাসতেন গভীরভাবে। ভালোবাসতেন এত বেশি যে সেই সঙ্গে মরে গিয়েছিলেন নিজেও। তখন অনেক কম আমার বয়স। ভীষণ ছটফট করছি নাম করার জন্য। অথচ আমাকে ভীষণভাবে এই ঘটনাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিলো। ক্যারোলিন ক্রেল ছিলেন এক অসাধারণ মহিলা এ কথা বলতে বাধ্য, তাকে আমি ভুলতে পারবো না কখনই…পারবো না।

.

তৃতীয় অধ্যায়

সলিসিটার কমবয়সী

প্রথম থেকেই খুব সাবধান হয়ে জর্জ মেহিউ কথাবার্তা বলছিলো, স্পষ্টভাবে হ্যাঁ না বলছিলো না কোনো কথার উত্তরেই।

মনে পড়েছে বটে মামলাটা, তবে স্পষ্টভাবে নয়। মামলার ভার ছিলো ওর বাবার হাতেই–আর তার বয়স তখন তো মাত্র উনিশ।

হ্যাঁ, খুব হৈহৈ পড়ে গিয়েছিলো মামলাটা নিয়ে, কারণ খুব বিখ্যাত লোক ছিলেন ক্রেল। দারুণ সুন্দর ওঁর আঁকা ছবিগুলো, ওঁর দুটো ছবি বিখ্যাত স্টেট গ্যালারিতে জায়গা পেয়েছে, তার মানে খুব একটা আজেবাজে শিল্পী উনি ছিলেন না।

এতোদিন পরে মঁসিয়ে পোয়ারো কেন যে মাথা ঘামাচ্ছেন ঐ মামলা নিয়ে সেটা ঢুকছে না তার মাথায়। ওঃ মেয়েটার কথা বলছেন? সত্যিই কি তাই? ঠিক তো? কানাডায়, মেয়েটা থাকতো নিউজিল্যান্ডে ও তো সব সময়েই তা শুনে এসেছে।

আস্তে আস্তে জর্জ মেহিউ একটু নরম হলো, ঘাড় কিন্তু পোয়ারো শক্ত করেই থাকলো।

 নিঃসন্দেহে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা মেয়েদের জীবনে। সহানুভূতি আছে গভীর, যেন বেশি ভাল হতো সত্যি কথাটা মেয়েটা না জানলেই। অবশ্য ওসব কথা বলে এখন আর লাভ নেই।

এখন জানতে চায় মেয়ে? কিন্তু আছেই বা কি জানবার? তখনকার কাগজে অবশ্য বিচারের খবরগুলো ছাপা হতো। এখন কিছুই ওর মনে নেই।

না। জজের মনে মিসেস ক্রেলের অপরাধ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাকে অবশ্য ক্ষমাও করা যায় কিছুটা পরিমানে। ঘর করা এই শিল্পীগুলোর সঙ্গে খুব সহজ কাজ নয়। ঐ ক্রেলের জীবনে যতদূর জানে সব সময় থাকতো একটা না একটা মেয়ে।

আর বোধ হয় খুব তীব্র ছিলো ঐ মহিলার অধিকার বোধটা। মেনে নিতে পারেননি বাস্তবকে। নিশ্চিন্ত হয়ে যেতেন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে এখনকার দিন হলে। তারপর জর্জ মেহিউ খুব সাবধান হয়ে বললেন, একটু ভেবে দেখি দাঁড়ান–এখন ঐ মেয়েটি মামলার লেডি ডিটিশাম।

তারও সেইরকম ধারণা, পোয়ারো জানালো।

মাঝেমধ্যে ওর কথা থাকে খবরের কাগজে। বহুবার ওকে আদালতে যেতে হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। শুনেছি প্রচুর টাকা পয়সাও আছে মেয়েটার। ডিটিশামকে বিয়ে করার আগে ও বিয়ে করেছিলো সেই বিখ্যাত অভিযাত্রীকে। সেই জাতীয় মেয়ে এলসা যারা বেঁচে থাকতে চায় সব সময় খবর হয়ে আর সুখ্যাতির চেয়ে কুড়োতে চায় বেশি কুখ্যাতি।

আচ্ছা। মিসেস ক্রেলের হয়ে কি আপনার ফার্ম অনেক দিন কাজ করেছিলো? হঠাৎ আলোচনার মোড় ফেরালো পোয়ারো।

মাথা নাড়লো জর্জ মেহিউ, জোনাথান অ্যান্ড জোনাথন সলিসিটার ফার্ম প্রথম দিকে মহিলার হয়ে মামলা দেখাশোনা করতো। পরে আর কাজ করতে চাইলেন না মিঃ জোনাথন। আমাদের, অর্থাৎ কথাবার্তা বলে আমার বাবার সঙ্গে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলেছিলেন মামলাটা। মিঃ জোনাথনের সঙ্গে যদি আপনি যোগাযোগ করেন তবে অনেক সুবিধে হতে পারে আপনার। অবশ্য ব্যবসা থেকে উনি এখন অবসর নিয়েছেন, সত্তরের ওপর বয়সও হয়ে গেছে। তবে উনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন ক্রেল পরিবারের সঙ্গে। এসব কথা উনি অনেক ভালো বলতে পারবেন আমার চেয়ে।

জর্জ মেহিউ পোয়ারোর সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, কথা বলে দেখতে পারেন আমাদের ম্যানেজিং ক্লার্ক এডমণ্ডসের সঙ্গে, এই মামলাটা নিয়ে উনি খুব মাথা ঘামিয়ে ছিলেন।

কম কথার মানুষ এডমণ্ডস। পোয়ারোকে তিনি আইন জানা লোকের মতো ভালোভাবে সাবধানী চোখে বিচার করতে লাগলেন। তারপর বললেন, মনে পড়েছে ক্রেলদের কেসের কথা।…বিশ্রী কেলেংকারীর ব্যাপার। পোয়ারোকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করার পর বললেন, আবার ও সব নিয়ে এতোকাল পরে কেন খোঁচাখুঁচি?

সব সময়ে আদালতের রায়টাই শেষ কথা হতে পারে না, এডমণ্ডস মাথা নাড়াতে নাড়াতে এই কথাটা বললেন, আমি আপনার কথাটাই যে ঠিক একথা বলতে পারছি না।

নিজের মনেই কিন্তু বলে চললো পোয়ারো, একটি মেয়ে ছিলো মিসেস ক্রেলের।

হা মনে পড়ছে। ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো বিদেশে আত্মীয়দের কাছে, তাই না?

ওর মা নিরপরাধ মেয়েটির দৃঢ় বিশ্বাস।

কাঁকড়া ভ্রূ মিঃ এডমণ্ডসের কুঁচকে উঠলো, ও এই ব্যাপার তা হলে?

 আপনি আমায় তেমন কিছু খবর কি দিতে পারেন মেয়েটির বিশ্বাসের সমর্থনে?

যেন চমকে উঠলেন এডমণ্ডস, তারপর মাথা ধীরে ধীরে নাড়িয়ে বললেন, তেমন কিছু খবর তো নেই আমার বিচার বিবেচনায়। আমি প্রশংসা করি মিসেস ক্রেলকে। উনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ভদ্রমহিলা আর যাই হোন না কেন। পাঁচজনের মত আর নয়। বেহায়াপনা ছিলো না একটুও। ঋজু ইস্পাতের মত, শুধু জড়িয়ে পড়েছিলেন একটা বাজে ঘটনার মধ্যে, তবে ভুল করেননি নিজের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতেও। দারুণ মহিলা।

কিন্তু খুনী তো বটেই? খোঁচা মারলো যেন পোয়ারো।

ভ্রূ কুঁচকে উঠলো এডমণ্ডসের, এবং অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শুরু করে দিলেন আগের চেয়ে। দিনের পর দিন ঠিক এই প্রশ্নটাই নিজেকে করেছি আমি। শান্তভাবে কাঠগড়ার মধ্যে বসে থাকতেন। তখন নিজের মনে আমি বলতাম, কিছুতেই বিশ্বাস করবো না আমি। তবে মিঃ পোয়ারো যদি আমার কথা মানেন তাহলে আমি বলবো একটুও অবকাশ ছিলো না অন্য কিছু বিশ্বাস করার। মিঃ ক্রেলের বীয়ারের গ্লাসে বিয লতার ঐ বিষ নিজের থেকে চলে আসতে পারে না। মেশানো হয়েছিলো ওটা আর যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আর কে করতে পারে মিসেস ক্রেল ছাড়া? পোয়ারোকে আবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখলেন এডমণ্ডস,-ও, ওই প্রশ্নটাই কি ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার মাথায়?

কি ধারণা আপনার? পোয়ারো প্রশ্ন করলো পাল্টা।

এডমণ্ডস বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বললেন, নাহ, উপায় ছিলো না অন্য কিছু ধারণা করার, উপায় ছিলো না কোনো।

আপনি মামলা চলার সময় আদালতে যেতেন?

প্রত্যেক দিন।

সাক্ষীদের কথা শুনতেন?

শুনেছিলাম।

কোনো অস্বাভাবিকতা, কপটতা কি কারুর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন?

মানে মিথ্যে কথা কেউ বলেছিলো কি না তাই চাইছেন তো জানতে? মিঃ ক্রেলের কি মৃত্যু কামনা করতো ওদের মধ্যে কেউ? মিঃ পোয়ারো মাফ করবেন, আপনি বড় বেশি মাত্রায় চিন্তা করছেন যা কিনা নাটুকে।

অনুনয় করলো পোয়ারো, ভেবে দেখুন একটু।

পোয়ারো তাকিয়ে রইলো এডমণ্ডসের ধারালো চোখের দিকে। খুব দুঃখিত এমন ভাব দেখিয়ে আস্তে আস্তে যেন বলতে শুরু করলেন এডমণ্ডস, বড্ড কটকটে আর প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলো ঐ মিস গ্রীয়ার মেয়েটা। যতোটা বলা উচিত ভদ্রভাবে বহুবার ছাড়িয়ে গিয়েছিলো তার মাত্রাও। তবে ও কখনো মিঃ ক্রেলের মৃত্যু চায়নি। ওরই তো ক্ষতি তাতে। ও অবশ্যই চাইতো মিসেস ক্রেলের ফাঁসি হোক–কিন্তু একটাই তার কারণ। হঠাৎ তার মনের মানুষটিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলেই। হয়ে উঠেছিলো বাধা পাওয়া বাঘিনীর মতো। ঐ যে তবে আগেই বলেছি যে অ্যামিয়াস মারা যাক তা এলসা চাইতো না। অবশ্য ফিলিপ ব্লেকও ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, প্রথম থেকেই ওঁর মনটা বিষিয়ে ছিলো, তাই কোপ মারতে ছাড়েন না সুযোগ পেলেই। তবে ভদ্রলোক যে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি মতো কোনো অন্যায় কাজ যে করেননি আমি একশোবার একথা বলবো। ক্রেলের বিশেষ বন্ধু ছিলেন ফিলিপ। মেরিডিথ ব্লেক ওঁর ভাই–অত্যন্ত বাজে সাক্ষী হিসাবে, অস্পষ্ট, দ্বিধাগ্রস্তভাবে সব সময়ে উত্তর দিয়েছিলেন। এই ধরনের সাক্ষীদের কথা শুনলে মনে হয় যেন মিথ্যে কথা বলছে। না বললে নয় যেটুকু, এঁরা কিছুই বলতে চায় না তার বাইরে। চায়নি মেরিডিথ ব্লেকও, তবে ওঁর পেটের কথা টেনে বের করেছিলো কেঁৗসুলী। আর ঐ গভর্নেস, ঠিকঠাক জবাব দিয়েছিলো কাটাকাটা কথায়। আজেবাজে কথা একটাও বলেনি। তবে বলেছিলো যা তার থেকে সে যে জানতো অনেক বেশি আমার এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আমারও নেই, বললো পোয়ারো। মিঃ অ্যালফ্রেড তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এডমণ্ডসকে লক্ষ্য করলো, নিশ্চয় উনি আভাস দিতে চাইছেন কোনো কিছুর।

.

চতুর্থ অধ্যায়

বৃদ্ধ সলিসিটার

এসেক্সে মিঃ ক্যালের জোনাথন থাকতেন। পোয়ারো সৌজন্য বজায় রেখে কয়েকটা চিঠি লেখালিখির পর পেয়ে গেলো একেবারে রাজকীয় আমন্ত্রণ, ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকতে হবে গিয়ে। সত্যিই এক অসাধারণ চরিত্রের মানুষ বৃদ্ধ। মিঃ জোনাথন যেন কম বয়েসী বেরসিক জর্জ মেহিউয়ের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ, অবশ্য সুপ্রাচীন জিনিসের প্রতি আকর্ষণের মতো মানুষের।

নিজের দৃষ্টিকোণ দিয়ে সবকিছুকে উনি পছন্দ করেন দেখতে এবং গভীর রাতে সুগন্ধী ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সেটা করতে ভালোবাসেন। তাড়াহুড়ো করে যে এরকুল পোয়ারো তার কাছে হঠাৎ না এসে সময় করে চিঠি লিখে দেখা করতে আসছে এটা খুব ভালো লেগেছে তাঁর। ফলে এখন বিস্তারিত আলোচনা করতে ক্রেল পরিবার সম্বন্ধে তাঁর খারাপ লাগবে না।

আমাদের ফার্মের সঙ্গে ক্রেল পরিবারের বহু পুরুষ থেকে পরিচয় ছিলো। আমি অ্যামিয়াস ক্রেল, তার বাবা রিচার্ড ক্রেলকেও জানতাম। এমন কি এনোক ক্রেল ওর ঠাকুর্দা তার সঙ্গে আলাপ ছিলো আমার। ওঁরা গ্রামের জমিদার ছিলেন, তাঁদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল মানুষের চেয়ে ঘোড়ার সঙ্গে। জীবন কাটাতেন ঘূর্তিতে, একটুও ভাবনা চিন্তার দাস ছিলেন না। কিন্তু তার ব্যতিক্রম ছিলেন রিচার্ড ক্রেলের স্ত্রী। চিন্তা খেলতো ওঁর মাথায়। অনেক বেশি প্রবল ছিলো প্রবৃত্তির চেয়ে চিন্তাশক্তি। বুঝতেন গান বাজনা, ভালোবাসতেন কবিতা, বাজাতে পারতেন তারের যন্ত্র, ভালো ছিলো না স্বাস্থ্য, পটের বিবির মতো বসে থাকতেন সোফার ওপর। খুব ভক্ত ছিলেন লেখক কিংসলের, তাই অ্যামিয়াস নাম রেখেছিলেন ছেলের। এই নিয়ে স্বামী ঠাট্টা করলেও, মেনে নিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।

অ্যামিয়াস কাজে লাগিয়েছিলো মা বাবার চরিত্রের এই ভিন্নমুখিতার পূর্ণ সুযোগ। ক্ষীণস্বাস্থ্যের মার কাছ থেকে শিল্পী ভাবটা পেয়েছিলো আর উদ্দাম, বেপরোয়া, নিষ্ঠুর ভাবটা পেয়েছিলো বাবার কাছ থেকে। আত্মকেন্দ্রিক ছিলো ক্রেল পরিবারের সব পুরুষরাই।

বৃদ্ধ, পোয়ারোকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সরু সরু আঙুলগুলো চেয়ারের হাতলে ঠুকতে ঠুকতে, মঁসিয়ে পোয়ারো শুধরে দেবেন ভুল হলে, তবে মনে হয় আমার আপনি আগ্রহী মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে, তাই না?

ওটাই হল আমার সব মামলার আগ্রহের বিষয়। আমার কাছে বিশেষ করে।

বুঝতে পারছি। আপনি কি জানতে চান অপরাধীদের মনে অগোচরে কি আছে তা। ব্যাপারটা দারুণ, ভালো লাগে খুব। অবশ্য ফৌজদারী মামলা হাতে নেয়নি আমাদের ফার্ম। ফলে আমরা একটা বড় ফার্মের হাতে মিসেস ক্রেলের মামলাটা তুলে দিই, ব্রিফ দেওয়া হয়েছিলো স্যার মন্টেগুকে। একটা দারুণ বুদ্ধিমান ছিলেন খুব তা নয়, তবে নাটক জমাতে পারতেন কোর্টে খুব চমৎকার আর খুব বেশি ছিলো ফী-টাও। ওঁর সঙ্গে নাটক করার ব্যাপারে মিসেস ক্রেল যে তাল দিতে পারবেন না, উনি যে এটা কেন ভাবেননি তা জানি না। আর যাই হোন মহিলা নাটুকে ছিলেন না।

তাহলে কি ছিলেন? আর আমি ঠিক ঐ জিনিসটাই জানতে চাই ভালোভাবে। জানতে চাইলো পোয়ারো।

বুঝেছি বুঝেছি, কিভাবে উনি ঐ কাজটা করলেন? সত্যিই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কিন্তু মহিলাটিকে বিয়ের আগে থাকতেই চিনতাম। ওঁর নাম তখন ছিলো ক্যারোলিন স্পলডিং। অশান্ত খুব, ওঁর জীবন ছিলো দুঃখের। যখন খুব ছোট ক্যারোলিন তখন ওঁর বাবা মারা যান। ক্যারোলিন বিধবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। অবশ্য পরে ওর মা আবার বিয়ে করেন। একটা বাচ্চাও হয়। সত্যিই তার পরের ব্যাপারটা খুব দুঃখের। মাঝে মাঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যে অদ্ভুত এক ঈর্ষা দেখা দেয়।

কাউকে কি ক্যারোলিন ঈর্ষা করতেন?

নিশ্চয়ই। ঘটে যায় একটা বিশ্রী ঘটনাও একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরেছিলেন নিজের সৎ বোনকে। একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় বোনটার, আর বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মুখটাও। অবশ্য পরে সব সময় ঐ ব্যাপারটা নিয়ে ক্যারোলিন দুঃখ প্রকাশ করতেন।..আর যত সামান্যই হোক না কেন বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা, এটাকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে ধরা হয়েছিলো বিচার চলার সময় জুরির সামনে।

বৃদ্ধ একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, সরকার পক্ষ ঐ ঘটনাটা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে ভীষণ রাগী চরিত্রের ক্যারোলিন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণা। অবশ্য ঠিক নয় কথাটা। না, ঠিক নয়।

বৃদ্ধ সলিসিটার আর এক দফা থেমে আবার শুরু করলেন স্মৃতি রোমন্থন করা। ক্যারোলিন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে এসে স্পলডিং থাকতেন। খুব ভালো ঘোড়ায় চড়তেন, বুদ্ধিমতীও বটে। ওঁকে রিচার্ড ক্রেল খুব পছন্দ করতেন। তাকে খুব ভালোবাসতেন মিসেস ক্ৰেলও। নিজের বাড়িতে সুখ-শান্তি ক্যারোলিন পেতেন না। বেশ হাসিখুশি থাকতেন অ্যাল্ডারবেরিতে এলে। ক্যারোলিনের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো অ্যামিয়াসের বোন ডায়না ক্রেলের সঙ্গে। তখন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে আসতে পাশের গ্রামের ফিলিপ আর মেরিডিথ ক্লিক। বরাবরই লোভী নোংরা স্বভাবের ছিলো ফিলিপ, টাকা পয়সা কি করে কামাতে হয় এ ছাড়া অন্য চিন্তা থাকতো না তার মাথায়। দোষ নেই স্বীকার করতে আমি পছন্দ করতাম না ছেলেটাকে। তবে খুব ভালো গল্প বলতো তা শুনেছি আর দারুণ সৎ ছিলো বন্ধুত্বের ব্যাপারে। তখন সকলেই মেরিডিথকে বলতো ন্যাকা-বোকা অভিমানী ছেলে। সব সময়ে গাছপালা, লতাপাতা, প্রজাপতি, পাখি, পোকামাকড় নিয়ে পড়ে থাকতো, যাকে আজকাল বলে প্রকৃতি পাঠ। ওদের বাবার মনে ঐ ছোকরা দুটোর জন্যে কম দুঃখ ছিলো না। একটা ছেলেও তার মনের মতো হলো না, যারা মাথা ঘামায় শিকার করা মাছ ধরা নিয়ে। মেরিডিথ পশু পাখি শিকার করার বদলে ভালোবাসতো ওদের পর্যবেক্ষণ করতে। আর গ্রাম ছেড়ে তো ফিলিপ চলো গেলো শহরে, অর্থ উপার্জন করতে হবে তার নেশা। সৈন্যবাহিনীর এক অস্থায়ী অফিসারের সঙ্গে ডায়নার বিয়ে হলো। আদৌ ভদ্রলোক লোকটা ছিলো না। এদিকে অ্যামিয়াস প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা অপরূপ সুন্দর দেখতে এতো জিনিস থাকতে পৃথিবীতে কেন যে নেশায় পড়লো ছবি আঁকার, কে পারে বলতে। এইসব কারণেই বোধহয় দুঃখে মারা যান রিচার্ড ক্রেল।

তারপর ক্যারোলিন স্পলডিংকে এক সময়ে বিয়ে করলো অ্যামিয়াস। সব সময়েই ওদের ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো মন কষাকষি, তবে ঠিক ছিলো ভালোবাসার বাঁধনটা। দুজনের জন্য দুজনেই পাগল হয়ে থাকতো। এবং এইভাবেই চলতো ওরা। কিন্তু অ্যামিয়াসও ছিলো ক্রেল পরিবারের পুরুষদের মতো বেশি মাত্রায় অহংকারী। ভালোবাসতো ঠিকই ক্যারোলিনকে তবে ক্যারোলিনকে কোনোদিনই বুঝবার চেষ্টা করেনি। চলতো নিজের খেয়াল খুশি মতো। অ্যামিয়াস আর পাঁচটা মেয়েকে আমার মতে ভালোবাসতে পারতো, কিন্তু ছবি আঁকার চেয়ে কাউকেই বড় করে নয়। অ্যামিয়াসের প্রথম প্রেম ছিলো ছবি। এবং কখনোই বেশি প্রাধান্য কোনো মেয়েকে শিল্পের চেয়ে দেয়নি। ওর জন্যে যে সব মেয়েরা প্রেরণা জোগাতো অ্যামিয়াস তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তো কিন্তু ওটা ফুরোলেই তার তাদের ভুলে যেতে সময় লাগতো না বিন্দুমাত্র। ভাবপ্রবণ বা রোমান্টিকও খুব বেশি ছিলো না। আবার ভোগী যে শুধু ছিলো তাও নয়। তবে তারই মধ্যে কিছুটা টান ছিল স্ত্রীর প্রতি। ক্যারোলিন খানিকটা স্বামীর চরিত্রের দুর্বলতার দিকটা মেনেই নিয়েছিলো বলতে হবে। এটাও জানতো যে তার স্বামী এক অসাধারণ শিল্পী। তাই শ্রদ্ধাও করতো। মাঝে মাঝে হৃদয়গত ব্যাপারে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতো তারপর ফিরে আসতো একসময় নেশা ছুটে গেলে এবং প্রায়ই সেই মেয়েটার ছবি নিয়ে ফিরে আসতো।

কারুর কিছু বলার থাকতো না এলসা গ্ৰীয়ারের ব্যাপারেও। কিন্তু এলসা গ্ৰীয়ার…মিঃ জোনাথন মাথা নাড়লেন হতাশ ভাবে।

মিঃ জোনাথন হঠাৎ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলেন, বেচারী আহা বেচারী…।

ওঃ তাহলে আপনার করুণা হয় মেয়েটির সম্বন্ধে?

হয়তো বুড়ো হয়ে গেছি বলেই হয়। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো আমি দেখেছি আমার চোখ জলে ভরে ওঠে যৌবনের এই অসহায়ত্ব দেখে। আঘাত পায় কত অল্পেতে, আবার এই যৌবন কী ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। যতটা এর উদারতা, ততটা স্বার্থপরতাও। মিঃ জোনাথন কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। উল্টো দিকে কাঁচের আলমারী থেকে বই একটা পেড়ে এনে পড়তে শুরু করলেন একটা পাতা,

তোমার ভালোবাসার অভিলাষ যদি এতই মহৎ হয়, বিবাহ চাও পরিণতিতে, তবে খবরটুকু পাঠিয়ে দিও আগামীকাল, যাতে চলে যেতে আমি পারি তোমার কাছে, তুমি আয়োজন করবে যখন এবং যেখানে উৎসবের। অঞ্জলি দেব আমার সমস্ত সম্পদ তোমার চরণে হে নাথ যেখানে নিয়ে যাবে, তোমার সাথে সেখানেই যাবো।

যৌবনের কথা হলো এই, জুলিয়েটের মুখে ভালোবাসার কথা। সংযম নেই কোনো, নেই কোনো পিছিয়ে আসা, তথাকথিত আনত নয়না কুমারীর সলাজ ভঙ্গী নেই। এখানে যৌবন মদমত্ত নারী সাহসিকা, অকুতোভয় হয়ে উঠেছে। শেক্সপীয়ার ভালোই জানতেন দেখছি যৌবন কি জিনিস। রোমিওকে নির্বিচারে আলাদা করে বেছে নিচ্ছে জুলিয়েট। ওথেলোকে চেয়ে বসেছে ডেসডিমোনা। কোনো দ্বিধা নেই তাদের জন্যে, দ্বন্দ্ব নেই তার দাবীতে অচল অহংকারী যৌবন–অটল হয়ে আছে।

চিন্তান্বিতভাবে পোয়ারো বললো, আপনি তাহলে বলছেন জুলিয়েটের ভাষাতেই এলসা গ্ৰীয়ার কথা বলেছিলো?

হ্যাঁ, বড়লোকের লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে ও ছিলো–যুবতী, সুন্দরী, ধনী। পুরুষ সঙ্গীকে মনের মতো খুঁজে পেয়েই দাবী করে বসলো তাকে। তবে অবিবাহিত যুবক রোমিওকে নয়। মাঝ বয়সী এক বিবাহিত চিত্রশিল্পীকে। এলসার কোনো বিধিনিয়ম জানা ছিলো না নিজের কামনাকে সংযত করার মতো। নিয়ে নাও যা চাও, একটাই আমাদের জীবন,–ওর জপমালা ছিলো আধুনিকতার এই মূলমন্ত্রটিই।

মিঃ জোনাথন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারের পিঠে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, তবে এক হিংস্র জুলিয়েট। যুবতী, নিষ্ঠুর অথচ দুর্বল ভীষণভাবে। পাশার চাল দেয় মরিয়া হয়ে হারবে হয়, নয় জিতবে। এবং ও জিতেছিলো তা তো মনে হয়… কিন্তু তারপর শেষ মুহূর্তে গিয়ে–শোনা গেল মৃত্যুর পদধ্বনি–সেইসঙ্গে এলসা গ্ৰীয়ার যে কিনা প্রাণবন্ত, আনন্দের উত্তাপে ভরা সে মরে গেলো। শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণা, নিষ্ঠুর, কঠোর হৃদয় এক মেয়ে রয়ে গেলো, সেই মহিলাটিকে যে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো যে সব সুখকে এলসার জীবনের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

মিঃ জোনাথন হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বললেন–আরে দেখুন তো ভাই, কি বলতে কি বলেছি, আমাকে এইটুকু অতি নাটকীয়তার জন্য ক্ষমা করবেন। স্কুল জীবনবোধসম্পন্ন যুবতী ছিলো এলসা। ওর চরিত্রে আকর্ষণীয় কোনো দিকই নেই আমার মতো গোলাপ সাদা যৌবন, ভরপুর হৃদয়ের আবেগে, বিবর্ণ’ ইত্যাদি। আর কি থাকে এইটুকু বাদ দিলে মেয়েটির জন্যে, একজন খ্যাতিমান পুরুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মামুলী একটা যুবতী হৃদয়ের সিংহাসনে বসাবার জন্যে ।

যদি বিখ্যাত শিল্পী না হতেন অ্যামিয়াস ক্রেল…বলতে শুরু করতেই পোয়ারো মিঃ জোনাথন সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন ঘাড় নেড়ে, ঠিক, ঠিক, ব্যাপারটা দারুণ ধরেছেন। বীরপূজা করে আজকালকার এলসারা। কিছু একটা করতে হবে পুরুষটিকে, কেউকেটা হতে হবে একজন।…অবশ্য ব্যাঙ্কের কেরাণী বা বীমার দালালের মধ্যেই ক্যারোলিন ক্রেল তার মনের মানুষ খুঁজে নিতে পারতো। মানুষ হিসেবে ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে ভালোবেসেছিলো, শিল্পী হিসেবে নয়। ক্যারোলিন অমার্জিত ছিলো না এলসা গ্ৰীয়ারের মতো… অথচ এলসা যুবতী, সুন্দরী, কিন্তু ও ভারী অসহায় আমার মনে হতো।

পোয়ারো শুতে গেলো নানা রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে। ওর চিন্তা ব্যক্তিত্বের সমস্যা নিয়ে। একটা বেহায়া মেয়ে ছাড়া এলসা আর কিছু নয় এডমণ্ডের চোখে। অথচ সে হলো শাশ্বত জুলিয়েট আর ক্যারোলিন ক্রেল বৃদ্ধ জোনাথনের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিন সম্বন্ধে প্রত্যেকে ভিন্নতর কথা বলেছে। ক্যারোলিনের পরাজিতের মনোভাবের জন্যে স্যার মন্টেগু ক্যারোলিনের নিন্দে করেছেন। যেন রোমান্সের প্রতিমূর্তি ক্যারোলিন কমবয়েসী ফগের মতে। ক্যারোলিন নিছক এক মহিলা এডমণ্ডসের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিনকে মিঃ জোনাথন বলেছেন এক অবাধ্য ঝোড়ো হাওয়া।

দেখলে কি দৃষ্টিতে দেখতে এরকুল পোয়ারো, আর এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের ওপরই পোয়ারোর অভীষ্ট সিদ্ধির ব্যাপারটি নির্ভর করছে।

পোয়ারো এখন পর্যন্ত আলাপ করেছে যত লোকের সঙ্গে তাদের মধ্যে সন্দেহ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি একজনও যে আর যাই হোক ক্যারোলিন ক্রেল, খুনীও বটে সেই সঙ্গে।

.

পঞ্চম অধ্যায়

পুলিস সুপারিনটেণ্ডেন্ট

চিন্তামগ্ন হয়ে অবসরপ্রাপ্ত পুলিস সুপার হেল পাইপে টান দিয়ে বললেন, আপনার এই চিন্তাটা মঁসিয়ে পোয়ারো বেশ উদ্ভট কিন্তু।

হয়তো বলতে পারেন সামান্য অসম্ভব, খুব সাবধানে ওর কথায় পোয়ারো সায় দিলো।

দেখুন বহুদিন আগেকার ব্যাপারটা, কথাটা হেল শুরু করতেই মনে মনে এরকুল পোয়ারো সামান্য বিরক্ত হয়ে উঠলো, যেমন বিরক্ত লাগে একই কথা বারবার শুনতে।

হা একটু বেড়ে যায় বৈ কি অসুবিধেটা, বিনীতভাবে বললো পোয়ারো।

খুঁচিয়ে তোলা অতীতকে, পুলিশ সুপার হেল প্রায় আপন মনে বলতে লাগলেন, তাও যদি একটা এর কোনো উদ্দেশ্য থাকতো…।

একটা উদ্দেশ্য আছে।

কি সেটা?

অনেকে তো আনন্দ পায় সত্যকে খুঁজে বের করার জন্যে, তাদেরই একজন আমি। তাছাড়া আপনি নিশ্চয়ই ঐ কমবয়সী মেয়েটিকে ভুলে যাবেন না।

হা, হা দেখা তো উচিত মেয়েটির দিকটাও। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো মাফ করবেন, উদ্ভাবনী শক্তির তো সীমা নেই আপনার। মেয়েটিকে একটা কিছু বানিয়ে দিন না বলে।

ঠিক মতো আপনি চেনেন না মেয়েটিকে।

আর ওসব কথা ছাড়ুন তো অভিজ্ঞ লোক আপনার মতো…মাঝে মাঝে বাধা দিয়ে পুলিশ সুপারের কথায় বলে উঠলো পোয়ারো, দেখুন ভাই আমি একজন উঁচুদরের মিথ্যেবাদী হতে পারি, হয়তো তাই মনে করেন আপনি আমাকে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের আমার নৈতিক সততা, নিজের নীতি নিয়েই আমি চলি।

মঁসিয়ে পোয়ারো দুঃখিত, ও কথা আপনাকে আঘাত দেবার জন্যে বলিনি। কিন্তু ধরতে গেলে এটা কি একটা মহৎ কাজ হবে না।

তাই কি সত্যি? ধীরে ধীরে হেল বললেন, সত্যি কি দুর্ভাগ্য মেয়েটির। একটা নিষ্পাপ সুখী মেয়ে ঠিক যখন যাচ্ছে বিয়ে করতে তখন কিনা পারলো জানতে তার মা খুনী। যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম তাহলে বুঝিয়ে দিতাম মেয়েটিকে ওটা আর কিছুই নয় আত্মহত্যা ছাড়া, বলতাম মামলাটা ঠিক মতো দাঁড় করাতে পারেননি স্যার মন্টেগু। ক্রেল নিজেই বিষ খেয়েছিলো মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলতাম এবং আপনার মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।

কিন্তু সন্দেহ যে আছে আমার মনে। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না এক মুহূর্তের জন্য। যে আত্মহত্যা করেছিলেন ক্রেল বিষ খেয়ে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় এটা সম্ভব বলে?

হেল আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে বললেন, জানেন?–না আমি মেনে নেবো সত্যি কথাটাই, আমি মানবো না আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য মিথ্যেকে। হেলের মুখ চোখ লাল হয়ে উঠলো কথাটা বলতে বলতে, সত্য সম্বন্ধে আপনি তো কথা বলছিলেন, তাই না। আপনাকে আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছি যে আমরা জানতে পেরেছিলাম ক্রেল মামলাতে সত্যের স্বরূপ।

একথা আপনার মুখ থেকে শোনার তাৎপর্য আলাদা। আপনাকে ভালোমতো জানি আমি, আপনি একজন সৎ এবং দক্ষ অফিসার। এবার আমায় একটা কথা বলুন, কখনোই কি আপনার মনে ক্রেলের অপরাধ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি?

পুলিশ সুপার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, না বিন্দুমাত্র না। মিসেস ক্রেলকেই কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা দোষী প্রমাণ করে, আমরা যে সকল তথ্য খুঁজে পেতে সংগ্রহ করেছিলাম তা জোরদার করে তোলে ঐ ধারণাটিকে।

যে সব সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছিলো মহিলার বিরুদ্ধে তার মোটামুটি একটা আভাস দিতে পারবেন কি?

পারবো। মামলার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিলাম আপনার চিঠিটা পাবার পর। হেল একটা ছোট্ট নোটবই বের করলেন, এতে মূল ঘটনাগুলো লিখে রেখেছি।

বন্ধু অশেষ ধন্যবাদ। আমার শুনতে ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে।

হেল একটু কেশে শুরু করলেন বলতে, তার কণ্ঠস্বরে সরকারী অফিসারের মেজাজের স্পর্শ পাওয়া গেলো। ইন্সপেক্টর কনওয়ে ১৮ই সেপ্টেম্বরের দুপুর ২টা বেজে ৪৫ মিনিটে একটা টেলিফোন পেয়েছিলেন ডাঃ অ্যান্ড ফসেটের কাছ থেকে। অ্যাল্ডারবেরির মিঃ অ্যামিয়াস ক্রেল মারা গেছেন হঠাৎ ডাঃ ফসেট তা জানিয়ে ছিলেন এবং মৃত্যু হয়েছে যে পরিস্থিতিতে এবং ঐ বাড়ির জনৈক অতিথি মিঃ ব্লেকের বক্তব্য থেকেও এটা পুলিশের কেস তার ধারণা।

ইন্সপেক্টর ফসেট সার্জেন্ট আর পুলিশের ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে সোজা অ্যাল্ডারবেরিতে চলে যান। ওখানে অপেক্ষা করছিলেন ডাঃ ফসেট, যেখানে মৃতদেহ পড়েছিলো তিনি পুলিশদের নিয়ে যান, ছোঁয়াছুঁয়ি করেনি কেউ অবশ্যই।

মিঃ ক্রেল ছবি আঁকছিলেন একটা ছোট্ট ঘেরা বাগানে বসে। সমুদ্র এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আর ক্ষুদে ক্ষুদে কামান বসানো আছে দেওয়ালের খাঁজকাটা জায়গাগুলোতে আর সেই কারণেই কামানের বাগান বলা হয় বাগানটাকে। বাগানটা বাড়ি থেকে প্রায় চার মিনিটের রাস্তা। সূর্যের আলো সেদিন পাথরের ওপর পড়ে সৃষ্টি করেছিল যে পরিবেশ, ছবি আঁকার পক্ষে সেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলো বলে উনি আর বাড়িতে ফেরেননি লাঞ্চ খাবার জন্যে। ঐ আলোটা পরে নাও থাকতে পারে। ফলে ক্রেল একাই আপন মনে কামান বাগানে ব্যস্ত ছিলেন ছবি আঁকতে। অবশ্য এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়, যে হতে হবে আশ্চর্য। মিঃ ক্রেল ভীষণ উদাসীন ছিলেন খাবার ব্যাপারে। একটুকরো স্যাণ্ডউইচ কখনো কখনো পাঠিয়ে দিলেই চলতো। তবে তিনি চাইতেন কেউ যাতে তাকে বিরক্ত না করে। জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছিলো ক্রেলকে মিস এলসা গ্ৰীয়ার (তিনি তখন ঐ বাড়িতেই থাকছিলেন) এবং মিঃ মেরিডিথ ব্লেক (নিকট একজন প্রতিবেশী)। অন্যান্যদের সঙ্গে লাঞ্চ খাবার জন্য এই দুজন বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলেন। সামনের খোলা চত্বরে বসে খাবার পর সবাই কফি খাচ্ছিলো। কফি শেষ করে মিসেস ক্রেল বললেন, নিচে যাচ্ছি, দেখি কত দূর এগোলো অ্যামিয়াসের কাজ। ওঁর সঙ্গে গভর্নেস মিস সিসিলিয়া উইলিয়ামস গেলো। একটা সোয়েটারের খোঁজ করছিলো গভর্নেস তার ছাত্রীর জন্যে, মিসেস ক্রেলের বোন মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন হলো ওর ছাত্রী। অ্যাঞ্জেলা খুব সম্ভব সমুদ্রের তীরে ফেলে এসেছিলো সোয়েটারটা তাই ওটার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।

এক সঙ্গেই এঁরা দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একটু ঢালু মতন বাগানে যাবার পথটা, একটা সামান্য জঙ্গল পার হয়ে যেতে হয়। কামান বাগানের দরজাটা কিছুদূর গেলেই চোখে পড়ে। কামান বাগানেও যাওয়া যায় ঐ পথটা দিয়ে আবার চাইলে সমুদ্রের তীরে সোজা চলে যাওয়া যায়।

সোয়েটারের খোঁজে গভর্নেস সিসিল চলে গেলো সমুদ্রের দিকে আর কামান বাগানে গেলেন মিসেস। মিসেস ক্রেল বাগানের ভেতর পা দিয়েই আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিসিলও ফিরে আসে। মিঃ ক্রেল বাগানের ভেতরে একটা আসনের ওপর পড়ে আছেন এলিয়ে, প্রাণ নেই দেহে।

সিসিল সঙ্গে সঙ্গে মিসেস ক্রেলের কথায় বাড়ি ফিরে যায় টেলিফোন করার জন্যে ডাক্তারকে। মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে যাওয়াতে তার ওপর টেলিফোন করার কাজটা চাপিয়ে ফিরে আসে কামান বাগানে সিসিল। ডাঃ ফসেট মিনিট পনেরোর মধ্যে আসেন। মিঃ ক্রেল কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন তিনি দেখেই বুঝতে পারেন। একটা থেকে দুটোর মধ্যে ডাক্তারের মতে মারা যাবার সময়। অবশ্য বোঝা যাচ্ছিলো না মৃত্যুর কারণটা, কোনো চিহ্ন নেই আঘাতের, আর খুবই স্বাভাবিক ক্রেলের মুখের ভাবও। এঁদের পারিবারিক ডাক্তার ডঃ ফসেট, ক্রেলের শরীর স্বাস্থ্য ভালো তা উনি জানতেন, তার কোনো অসুখ বা এধরনের কোনো দুর্বলতা ছিলো না। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে এই মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারলেন না। এই সময় ডাঃ ফসেটের সঙ্গে ফিলিপ ব্লেকের কিছু কথাবার্তা হয়।

হেল এতদূর বলে একটু থামলেন, আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করলেন বলতে, কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় যেন এবার শুরু হচ্ছে,

ঐ কথাগুলোই পরে মিঃ ব্লেক জানান ইন্সপেক্টর কনওয়েকে। এই ধরনের ছিলো কথাটা, ব্লেক সেদিন সকালে তার দাদা মেরিডিথের কাছ থেকে টেলিফোন পান একটা (দেড় মাইল দূরে হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে মেরিডিথ থাকতেন)। একজন সখের রসায়নবিদ ছিলেন মেরিডিথ ব্লেক, বোধহয় ভেষজ-বিজ্ঞানী বললেই ভালো হয়। মেরিডিথ নিজের গবেষণাগারে সকালে ঢুকে চমকে ওঠেন, বিষলতার বিষের শিশিটা যেটা তাকের উপর রাখা সেটা প্রায় খালি হয়ে গেছে। যদিও ওটা ভর্তি ছিলো আগের দিন। উনি ভাইকে খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে ফোন করে কি করা উচিত এক্ষেত্রে জানতে চান। দাদাকে সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপ অ্যাল্ডারবেরিতে চলে আসতে বলে সামনাসামনি যাতে আলোচনা করা যায় ব্যাপারটা নিয়ে। নিজেই খানিকটা পথ ফিলিপ এগিয়ে যান, তারপর একসঙ্গে দুই ভাই বাড়িতে ফেরেন। কি করা উচিত এক্ষেত্রে এ নিয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পেরে, ঠিক করলেন দুজনেই এনিয়ে আর এক দফা লাঞ্চের পর আলোচনা করা যাবে।

ইন্সপেক্টর কনওয়ে আরও খোঁজখবর নেবার পর যেসব নতুন তথ্য জোগাড় করেছিলো সেগুলো হলো এই অ্যাল্ডারবেরি থেকে আগের দিন বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচজন হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে যান। ওখানে চায়ের নেমন্তন্ন ছিলো। এই পাঁচজন হলেন মিঃ আর মিসেস ক্রেল, মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, মিস এলসা গ্ৰীয়ার, আর মিঃ ফিলিপ ব্লেক। ওখানে নেশা সম্বন্ধে মিঃ মেরিডিথ ব্লেক জোর আলোচনা জানান, তারপর সবাইকে নিজের গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে সব কিছু দেখান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সেই সময় কয়েকটা বিশেষ বিশেষ ওষুধের নাম বলেন মেরিডিথ, একটা হলো তার মধ্যে বিষলতার থেকে পাওয়া কোনাইন চিতল এক বিশেষ ধরনের বিষ। তারপর মেরিডিথ নানা গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেন বিষটার, বলেন দুঃখ করে যে এই ওষুধটার নামই ফার্মাকোপিয়া থেকে এখন উবে গেছে, অথচ কোনাইন খুব অল্প মাত্রায় খাইয়ে হুপিং কাশি, হাঁপানি সারানো যেতে পারে। অবশ্য পরে মারাত্মক দিক্ষাগুলো নিয়েও আলোচনা করেন বিষটার। কিভাবে এই বিষটার ক্রিয়া হয় তা বলার জন্যে একজন গ্রীক লেখকের বই থেকে মেরিডিথ খানিকটা অংশ পড়েও শুনিয়েছিলেন।

আবার একটু থামলেন পুলিশ সুপার হেল, তামাক ভরলেন পাইপে এবং শুরু করলেন কাহিনীর তৃতীয় অধ্যায় :

মামলাটা চীফ কনস্টেবল কর্নেল ফ্রিরে আমার হাতে দেয়। খুনটা সম্বন্ধে ময়না তদন্তের ফলাফল থেকে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। যতদূর জানি কোনাইন বিষ ময়না তদন্তে দেওয়া হয়েছিলো কিনা এই বিষয়ে সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে বিষটা এটা ভালোমতই জানতেন ডাক্তাররা। তাই মৃত্যুর দু-তিন ঘণ্টা আগে যে বিষটা দেওয়া হয়েছিলো তার প্রমাণ যথেষ্টভাবে পাওয়া গেলো। মিঃ ক্রেলের সামনে পাওয়া গিয়েছিলো একটা টেবিলের উপর খালি একটা গ্লাস আর বিয়ারের একটা খালি বোতল। পরীক্ষা করে দেখা গেলো দুটোরই তলানি, বোতলে কোনাইন ছিলো না, কিন্তু ছিলো গ্লাসে। জানতে পারলাম খোঁজ খবর নিয়ে যে একটা ছোট ঘরে কামান বাগানের এক একস বিয়ার আর বোতল হতে রাখা, ছবি আঁকতে আঁকতে ক্রেল যাতে সহজেই তেষ্টা পেলে পেতে পারেন। কিন্তু ঐ দিন সকালে বিশেষ করে মিসেস ক্রেল বাড়ি থেকে স্বামীকে এক বোতল সদ্য ঠান্ডা করা বিয়ার এনে দিয়েছিলো। যখন উনি বিয়ারটা আনেন তখন ছবি আঁকতে ব্যস্ত ছিলেন মিঃ ক্রেল। আর পোজ দিয়ে একটা কামানের উপর বসেছিলেন মিস এলসা গ্ৰীয়ার।

বোতল থেকে বিয়ার গ্লাসে ঢেলে মিসেস ক্রেল গ্লাসটা স্বামীর হাতে বাড়িয়ে দেন। এক ঢেকে সবটাই খেলেন ক্রেল ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে। মিঃ ক্রেলের নাকি ঐভাবেই বিয়ার খাওয়ার অভ্যেস ছিল। মুখটা খাওয়ার পর বিকৃত করে ক্রেল নাকি বলেছিলেন, সবিকছুরই স্বাদ যেন আজ খারাপ লাগছে। এলসা গ্ৰীয়ার হাসতে হাসতে ওর কথা শুনে বলেছিলো, লিভার।

মিঃ ক্রেল বলেছিলেন, তবে বেশ ঠান্ডা আছে আর যাই হোক না কেন কিন্তু।

একটু থামতেই হেল প্রশ্ন করলো পোয়ারো, কখন হয়েছিলো এটা?

আন্দাজ সওয়া এগারোটা। মিঃ ক্রেল তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন ছবি আঁকতে। জানা গিয়েছিলো এলসা গ্ৰীয়ারের বক্তব্যনুসারে যে মিঃ ক্রেল কিছুক্ষণ পরে বলেছিলেন যে বোধহয় ওঁর বাত হচ্ছে, কারণ সব আড়ষ্ট লাগছে হাত পা সব। এমন এক ধরনের মানুষ ছিলেন মিঃ ক্রেল, যাঁরা কিছুতেই মানতে রাজী হন না নিজের অসুস্থতার কথা এবং অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন যে শরীর খারাপ লাগছে। বিরক্ত হয়ে একটু পরে লাঞ্চ খেতে চলে যেতে বলেন সবাইকে, কারণ একলা থাকতে চান একটু। এমন একটুতেই যে উনি বিরক্ত হয়ে যান, সবাই এ কথা জানতেন।

ঘাড় নেড়ে পোয়ারো সায় দিলো, বলে চললেন হেল, ফলে কামান বাগানে ক্রেলকে একলা রেখে চলে গিয়েছিলো সকলে। কোনো সন্দেহই নেই এ বিষয়ে। উনি তারপরে বসে পড়েন। বোধহয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো পেশীতে পক্ষাঘাতের ক্রিয়া। উনি কোনোরকম সাহায্য পাননি হাতের কাছে এবং মিঃ ক্রেলকে গ্রাস করলো মৃত্যু এসে।

আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো।

কিন্তু তারপর শুরু করে দিলাম রুটিন মাফিক তদন্ত। তেমন অসুবিধা হয় না তথ্য সংগ্রহ করতে। মিসেস ক্রেল আর এলসা গ্ৰীয়ারের মধ্যে আগেরদিন বেশ খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। বেশ রাগত ভাবেই এলসা আপত্তি জানিয়েছিলো ফার্নিচার সাজানোর ব্যাপারে, বিশেষ করে, যখন আমি এখানে থাকছি।

মিসেস ক্রেল সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠেন, তোমার কথার মানে? আবার তুমি থাকতে যাচ্ছ কেন এখানে?

উত্তর দেয় এলসা গ্ৰীয়ার, ক্যারোলিন। যা আমি বলতে চাইছি সেটা ভান কোরো না না জানার। যেন তুমি মুখ গোঁজা উট পাখি বালির মধ্যে। অ্যামিয়াস আর আমি পরস্পরকে চাই তা তুমি ভালোই করেই জানো এবং শিগগির আমরা বিয়েও করতে যাচ্ছি। মিসেস ক্রেল বলেন, ও সব জানি না আমি কিছু।

এলসা গ্ৰীয়ার বলে, বেশ এখন থেকে তাহলে জেনে নাও।

অ্যামিয়াস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে বাগান থেকে ঘরে ঢোকেন, মিসেস ক্রেল স্বামীকে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন এটা কি সত্যি অ্যামিয়াস, তুমি যে বিয়ে করতে যাচ্ছ এলসাকে?

পোয়ারো খুব উৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করলো, মিঃ ক্রেল তার উত্তরে কি বলেছিলেন?

এলসা গ্ৰীয়ারের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গে অ্যামিয়াস যতদূর শোনা যায়, তোমার কি ওকথাটা না বললেই চলতো না। তোমার কি মুখ বন্ধ করে রাখার মতো লোপ পেয়ে গেছে বুদ্ধিসুদ্ধিও?

এলসা গ্ৰীয়ার বলেছিলো, ক্যারোলিনের সত্যি কথাটা জানা উচিত আমার তো মনে হয়।

স্বামীকে প্রশ্ন করেছিলেন মিসেস ক্রেল, সত্যি কি কথাটা?

অ্যামিয়াস স্ত্রীর দিকে মুখ সরিয়ে নিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলেছিলেন।

আবার মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, মুখ ফুটে বলো, বলো তুমি। জানতেই হবে আমাকে।

অ্যামিয়াস তখন বলেন, সত্যি কথাটা। তবে ওসব নিয়ে এই মুহূর্তে আমি রাজী নই আলোচনা করতে।

অ্যামিয়াস রাগে গরগর করতে করতে হুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, এলসা গ্ৰীয়ার বললো, শুনলে তো। তারপর অনেক কথা কাটাকাটি হয় ওদের মধ্যে, মিসেস ক্রেলকে নাকি এলসা বলেছিলো কেন অকারণে সে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওদের জীবনে, ঘটবার যা তা তো যাচ্ছেই ঘটতে। বুদ্ধি খরচ করে সবারই উচিত পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া। তবে হ্যাঁ, বন্ধুত্ব বজায় থাকতে পারে ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াসের মধ্যে। এলসার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

মিসেস ক্রেল তখন কি বলেছিলেন? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

জানা যায় সাক্ষীদের কথা থেকে যে এলসার ঐ কথা শুনে হেসে মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, এলসা, আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না। মিসেস ক্রেল কথাটা বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঘর থেকে তখন, তোমার কথার মানে? পিছন ফিরে তাকিয়ে মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, আমি অ্যামিয়াসকে খুন করে ফেলবো তোমার হাতে তুলে দেবার আগে।

একটু থামলেন হেল।

 বিশ্রী ব্যাপার খুব, তাই না?

মাথা নেড়ে পোয়ারো বললো, হ্যাঁ, তবে কে শুনেছিলো ঐ কথাগুলো?

 গভর্নেস সিসিল আর ফিলিপ ব্লেক। ঘরের মধ্যেই ছিলেন দুজন। নিশ্চয়ই ওরা খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন।

দুজনের বর্ণনায় ঘটনাটা সম্বন্ধে মিল ছিলো তো?

যথেষ্ট পরিমাণে–তবে মঁসিয়ে পোয়ারো জানেন তো দুজনে সাক্ষী কিন্তু হুবহু একভাবে একই দৃশ্য মনে রাখতে পারে না। আপনিও তো জানেন সেকথা। তাই না?

ঘাড় নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। তারপর যেন বললো চিন্তা করতে করতে, হ্যাঁ তবে দেখতে হবে… শেষ না করেই কথাটা পোয়ারো থেমে গেলো।

আবার শুরু করলেন হেল, বাড়িটায় তল্লাশী চালাই আমি। মিসেস ক্রেলের শোবার ঘরের একটা আলামারীর তলার তাকে একটা শিশি পাই গরম মোজার তলায়, তাতে লেবেল আঁটা ছিলো জুই ফুলের আতরের। অবশ্য খালিই ছিলো শিশিটা। ওর গায়ের আঙুলের ছাপ নিয়ে দেখলাম মিসেস ক্রেলের আঙুলের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে একমাত্র। পরীক্ষা ভালোভাবে করে দেখা গেলো জুইয়ের আতরের গন্ধ আছে সামান্য শিশিটাতে আর আছে কোনাইন হাইড্রো ব্রোমাইড অ্যাসিড।

শিশিটা মিসেস ক্রেলকে দেখাতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন যে মানসিক অবস্থা তার খুব ভালো যাচ্ছিলো না, তাই কোনাইনের বর্ণনা শুনে মেরিডিথ ব্লেকের মুখে একবার টুক করে গবেষণাগারে একলা ঢুকে পড়েছিলেন, ব্যাগ থেকে তারপর জুইয়ের আতরের শিশিটা নিয়ে জানলা গলিয়ে সবটা আতর ফেলে দিয়ে খালি করে নেন শিশিটা। আর বেশ খানিকটা কোনাইনের বোতল থেকে তাতে ঢেলে নেন। কেন করলেন একাজ জানতে চাইলে বলেছিলেন মিসেস ক্রেল, কয়েকটা কথা এমন আছে যার সবটা কিছুতেই আমি বলতে পারছি না। তবে ভীষণ আঘাত পেয়েছি আমি মনে। আমাকে ছেড়ে আমার স্বামী অন্য একজনকে বিয়ে করার চিন্তা করছিলেন। সেটা ঘটলে কোনো প্রয়োজন থাকে না বেঁচে থাকার, অন্ততঃ আমি বিষটা নিয়েছিলাম সেই কথা ভেবেই।

পোয়ারো বলে উঠলো হেল একটু থামতেই, সেটাও তো সম্ভব হতে পারে?

–মঁসিয়ে পোয়ারো হতে পারে। কিন্তু ওর মুখে যে কথা ঘটনার আগের দিন শোনা গিয়েছিলো তার সঙ্গে তো খাপ খায় না এটা। তাছাড়া একটা ঘটনা ঘটেছিলো তার পরের দিনও। কথাবার্তার কিছুটা ফিলিপ ব্লেক শুনেছিলেন আর অন্য খানিকটা অংশ এলসা গ্ৰীয়ারও শুনেছিলেন। সেদিন লাইব্রেরী ঘরে ঝগড়া হচ্ছিলো মিঃ আর মিসেস ক্রেলের মধ্যে। পাশের হল ঘরে ছিলেন ফিলিপ, শোনেন সেখান থেকে। বাইরের বারান্দায় খোলা জানালার পাশে এলসা ছিলেন। তাই শুনছিলো একটু বেশি।

ওরা কি শুনেছিলো? জানতে চাইলো পোয়ারো।

শুনেছিলেন ফিলিপ ব্লেক মিসেস ক্রেল বলেছেন–তুমি আর তোমার ঐ মেয়ে মানুষরা আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে খুন করতে। তুমি একদিন আমার হাতে খুন হবে।

আত্মহত্যার কথা কিছু বলেননি? ঠিক তাই। একটাও না। যদি তুমি করো এটা তাহলে আত্মঘাতী হবো আমি।উনি ও ধরনের কোনো কথা বলেননি। তেমন কোনো কথা মিস এলসা গ্রীয়ারের সাক্ষ্যেও শোনা যায়নি। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এলসা বলেছিলেন, সব জিনিসটাকে বুদ্ধি দিয়ে ক্যারোলিন বিচার করার চেষ্টা করো। আমার খুব প্রিয় তুমি এবং সব সময়ে তোমার আর তোমার বাচ্চার আমি মঙ্গল কামনা করি। তাই বিয়ে করতে যাচ্ছি এলসাকে সব সময়েই আমরা তো রাজী আছি পরস্পরকে মুক্তি দেবার ব্যাপারে। মিসেস ক্রেল তার উত্তরে বলেছিলেন, ঠিক আছে তবে যেন বলতে না শুনি কোনোদিন যে তোমাকে আমি সাবধান করে দিইনি। অ্যামিয়াস আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, তুমি কি বলতে চাইছো, ক্যারোলিন তখন বলেছিলো, আমি বলতে চাইছি যে তোমাকে আমি ভালবাসি এবং আমি তোমাকে হারাতে রাজী নই। বরং তোমাকে আমি মেরে ফেলবো তবুও কাছে যেতে দেবো না ওর।

একটু নড়েচড়ে বসলো পোয়ারো, মিস গ্ৰীয়ার যথেষ্ট নির্বুদ্ধিতার কাজই করেছিলেন এই প্রসঙ্গটা তোলার ব্যাপারে। বিবাহ বিচ্ছেদে মিসেস ক্রেল সম্মতি না দিয়েই তো সহজ করে তুলতে পারতেন কাজটা।

আমরা ঐ ব্যাপারে কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছিলাম, হেল বললেন, বিশ্বাস করে মিসেস ক্রেল তাদের বহুদিনের বিশ্বস্ত পারিবারিক বন্ধু মেরিডিথ ব্লেককে বলেছিলেন মনের কিছু কথা। মেরিডিথ খুব বিচলিত হয়ে এ নিয়ে আলোচনা করেন অ্যামিয়াসের সঙ্গে। মনে হয় যতদূর আগের দিন বিকেল বেলায় এই কথাবার্তাটা হয়েছিলো। সামান্য বকাবকিও করেছিলেন মেরিডিথ তার বন্ধুকে। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হবে ওদের বিবাদ বিচ্ছেদ হওয়াটা। তাছাড়া অত্যন্ত কম বয়সী মেয়ে এলসা গ্ৰীয়ার ওকে টেনে নিয়ে কোর্টে যাওয়াটা ভালো কাজ হবে না। মিঃ ক্রেল তার উত্তরে মুখটিপে হেসে বলেছিলেন, ওসব কিছুই চায় না এলসা। ও যাবে না কোর্টে। নিজেরাই এটা মিটিয়ে নেবো আমরা।

তাহলে তো মিস এলসা গ্রীয়ারের পক্ষে ঐভাবে সব কথা ফাঁস করে দেওয়াটা আরও বোকামির কাজ হয়েছে? বললো পেয়ারো।

আঃ আপনি মেয়ে মানুষদের চেনেন তো? এ ওর টুটি টিপে ধরতে পারলে কিছু আর চায় না, বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছিলো পরিস্থিতি। কেন যে অ্যামিয়াস ক্রেল ও ভাবে চলতে দিচ্ছিলেন তা আজও আমি পারি না বুঝতে। যা বলেছিলেন মেরিডিথ ব্লেককে তা থেকে জানা যায় তিনি ছবি আঁকাটা আগে চাইছিলেন শেষ করতে। আচ্ছা এর কোনো মানে হয়?

হা, হয় তা আমার মতে। আমার মতে হয় না। অকারণে মানুষটা বাট বাড়াতে চাইছিলো। 

এলসা গ্ৰীয়ার কথাটা যে ভাবে ফাঁস করে দিয়েছিলো, বোধ হয় তাতে খুব রেগে গিয়েছিলেন মিঃ ক্রেল।

হা, হয়েছিলেন তা, তাই বলেছিলেন মেরিডিথ ব্লেক, যদি ছবিটা শেষ করারই প্রশ্ন হতো, তাহলে কয়েকটা ফটো মেয়েটির তুলে নিয়ে কোনো অসুবিধে ছিলো কি কাজ করার? জল রঙ দিয়ে ছবি আঁকে এমন একজন কে আমি জানি। ওইভাবে ফটো তুলে ও কাজ করে।

মাথা নাড়লো পোয়ারো, না অনেকটা বুঝতে পারছি আমি শিল্পী ক্রেলকে। আপনাকে এ কথা মনে রাখতে হবে যে ঠিক ঐ সময়ে আর কিছুই ঐ ছবিটা ছাড়া ক্রেলের কাছে বড় হয়ে উঠতে পারেনি। যতো গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রশ্নটা বোধহয় ছবিটাই বড় হয়ে উঠেছিলো সবচেয়ে এই মুহূর্তে। তাই ওখানে মেয়েটির আসা বা থাকার ব্যাপারে তখন প্রাধান্য দিতে চাননি অন্য কোন প্রসঙ্গকে অবশ্য কারণটা মেয়েটি বুঝতে পারেনি। প্রেমটাই সব থেকে প্রধান হয়ে ওঠে মেয়েদের কাছে।

আমি কি তা আর জানি না? গাঢ় সুরে পুলিশ সুপার হেল বললেন।

পুরুষরা, বিশেষ করে একটু অন্য ধরনের হয়ে থাকে শিল্পীরা, আবার মন্তব্য করলো পোয়ারো।

শিল্পকলা সুপারিনটেন্টে বললেন ব্যাঙ্গের সুরে, যতসব বাজে কচকচি শিল্পকলা নিয়ে। ওটা আমি কখনই বুঝিনি এবং বুঝবোও না। যে ছবিটা ক্রেল আঁকছিলেন ওটা দেখা উচিত আপনার কোনো সামঞ্জস্য নেই কোথাও। এমনভাবে মেয়েটিকে এঁকেছে যেন মনে হচ্ছে কনকন করছে ওঁর দাঁত। ছবিটা পুরো বাজে। ছবিটা সম্বন্ধে বহুদিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে একটা বাজে চিন্তা ঘুরপাক খেত। মুছে ফেলতে পারতাম না কিছুতেই, বিশেষ করে মেয়েটিকে।

হেসে ফেললো পোয়ারো, দেখুন, আপনি কেমনভাবে না জেনে অসাধারণ যে অ্যামিয়াসের শিল্প তা স্বীকার করে নিচ্ছেন।

ছাড়ুন তো বাজে কথা। সুন্দর যা কিছু আনন্দ দেয় মনকে এমন জিনিস আঁকে না কেন শিল্পীরা? যতো সব কুৎসিত জিনিসগুলোকে খুঁজে পেতে নিয়ে পড়ে কেন?

অনেকেই যে আমাদের জন্য সৌন্দর্যকে বিচিত্র জায়গায় খুঁজে বেড়ান। বিজ্ঞের মতো বললো পোয়ারো।

মেয়েটা ভালো ছিল দেখতে ঠিকই, মেখেছিলো দারুন সাজগোজ আর রঙচঙ। আর পোষাক ছিলো না বললেই চলে। ওভাবে মেয়েদের পক্ষে পোষাক পরাটা শোভন নয়। মনে রাখবেন ষোল বছর আগেকার ঘটনাটা। অবশ্য এখন তো ঐ ধরনের পোষাক পরছে সব মেয়েরাই। কিন্তু আমার তখন খুব খারাপ লেগেছিলো। ফুলপ্যান্ট আর তার সঙ্গে সূতীর জামা, বুক খোলা। আর কিছু না।

খুব ভালো ভাবে মনে আছে অনেক কিছুই আপনার-বিড় বিড় করে পোয়ারো বলতো ধূর্তের মতো তাকিয়ে।

লজ্জা পেয়ে হেল বললেন, মানে, আমার যা মনে হয়েছিলো তখন আপনাকে তাই বলছি।

তা তো বটেই তা তো বটেই, হেলকে ভোলাবার জন্যে মিষ্টি করে বললো পোয়ারো। তারপর বললো, মিসেস ক্রেলের বিরুদ্ধে তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রধান সাক্ষী ছিল ফিলিপ ব্লেক ও এলসা গ্ৰীয়ার?

হ্যাঁ, খুব ক্ষেপে ছিলো দুজনেই। জোর সাক্ষ্য দিয়েছিলো। তবে গভর্নেস সিসিলকেও ডাকা হয় সরকার পক্ষ থেকে। ওর বক্তব্য আবার বেশি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছিলো ঐ দুজনের চেয়েও; প্রথম থেকেই মিসেস ক্রেলের সঙ্গে সিসিল পক্ষ নিতে শুরু করেছিলো। তবে সৎ বলে মহিলাটি কোনোকিছু লুকোছাপা না করে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলো সত্যি কথাই।

আর মেরিডিথ ব্লেক?

বেচারা! পুরো ব্যাপারটাতে এতো বেশি ভদ্রলোক ভেঙে পড়েছিলেন যে বলার নয়। তিনি যেন নিজেই দোষী। তখন নিজেকেই অপরাধী মনে করেছিলেন বিষয়টা তৈরি করার জন্যে। তাকে দোষ দেয় করোনার কোর্টও, বিষ সংক্রান্ত আইনের ১নং সিডিউল কোনাইন আর এই সল্টকে ফেলা হয়েছে। খুব ধমক-ধামক দিয়েছিলো আদালত ভদ্রলোককে। তাছাড়া উভয় পক্ষেরই বন্ধু ছিলেন তো উনি–মনে ওঁর খুব লেগেছিলো। বিশেষ করে এই ধরনের গ্রামাঞ্চলের ভদ্রলোকেরা ভীষণ অখ্যাতিকে ভয় পায়।

সাক্ষ্য দেয়নি মিসেস ক্রেলের ছোট বোনটি?

না। দরকার পড়েনি। যখন তার স্বামীকে ধমকাচ্ছিলেন মিসেস ক্রেল তখন ও ছিলো না ওখানে। এমন কিছু মেয়েটা জানতও না যা আমাদের মামলার ব্যাপারে কাজে লাগতে পারতো। শুধু ও দেখেছিলো ফ্রিজ থেকে মিসেস ক্রেল নিয়ে যাচ্ছেন ঠান্ডা বিয়ারের বোতল। মেয়েটাকে আসামী পক্ষ থেকে সমন জারি করে নিশ্চয়ই সাক্ষী হিসেবে আনা যেতো, তবে কোনো দরকার ছিলো না তার, কারণ কোনাইন তো পাওয়া যায়নি বোতলের মধ্যে।

মিসেস ক্রেল দুজনের চোখের সামনে কিভাবে বিষ মেশালেন গ্লাসে? জানতে চাইলো পোয়ারো।

দেখুন, প্রথমতঃ সেভাবে নিশ্চয়ই অ্যামিয়াস বা এলসা গ্ৰীয়ার নজর রাখেনি। তার মানে ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন অ্যামিয়াস ক্রেল আর সেখানে বসে এলসা গ্ৰীয়ার পোজ দিচ্ছিলেন সেদিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ক্যারোলিন ক্রেল বিয়ার ঢেলেছিলেন।

ঘাড় নাড়লো পোয়ারো। আবার হেল বলতে শুরু করলেন, ঐ বলছিলাম যা, মিসেস ক্রেলের দিকে দুজনেই তাকায়নি। নিশ্চয়ই মিসেস ক্রেলের কাছে ফাউন্টেনপেনে কালি ভরার ড্রপার জাতীয় কোনো ছোট্ট কাঁচের নল ছিলো, বিষটা যার মধ্যে ভরে রেখে ছিলেন। কারণ ঐ জাতীয় কাঁচের সরু নল বাড়ি থেকে বাগানে যাবার রাস্তার একধারে একেবারে গুঁড়োনো অবস্থায় আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম।

প্রায় আপন মনে বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, আপনাদের কাছে দেখছি একটা না একটা জবাব আছে সব কিছুরই।

মঁসিয়ে পোয়ারো দেখুন। যা আগে বলেছি কোনো রকম পরিবর্তন সে সম্বন্ধে না ঘটিয়েই এখন বলছি, স্বামীকে খুন করবে বলে ক্যারোলিন ভয় দেখিয়ে ছিলেন। মেরিডিথের গবেষণাগার থেকে মহিলা জিনিসটা সরিয়ে ছিলেন। মহিলাটিরই ঘরে খালি শিশিটা পাওয়া গেছে, এবং সেটা তিনি ছাড়া আর কেউই নাড়াচাড়া করেনি। মহিলা ঠান্ডা করা বীয়ার নিজের থেকেই পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বামীকে, অথচ মজার ব্যাপার এই যে কথাবার্তা ওঁদের মধ্যে বন্ধ ছিলো।

আশ্চর্যের ব্যাপার খুবই। আমি আগেই তো এ ব্যাপারে বলেছি, বললো পোয়ারো।

হ্যাঁ ধরা যায় এই ছোট্ট ব্যাপারটা থেকেই, মহিলা হঠাৎ কেন এতো সহৃদয় হয়ে উঠলেন? স্বামী বিয়ারের স্বাদ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন–খুব বিশ্রি কোনাইনের স্বাদও, কামান বাগানে এমনভাবে আসছেন যাতে আবিষ্কার করা যায় দেহটাকে, অন্য মহিলাকে কায়দা করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন টেলিফোন করতে কিন্তু কেন? যাতে বোতোল আর গ্লাশ থেকে ঐ সময়ের মধ্যে আঙুলের দাগটা মুছে ফেলে লাগিয়ে নিতে পারেন স্বামীর আঙুলের ছাপ। যাতে করে স্বামী মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছেন বলতে পারেন। গল্পটা চলে যেতে পারত চালালেও।

তবে মহিলা গল্পটা খুব ভালমতো ফঁদতে পারেননি, বললো পোয়ারো।

তা পারেননি। উনি অতো চিন্তা করার সময় পাননি। ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো ঈর্ষা। তখন একটাই চিন্তা মহিলার মাথায় কি করে সরিয়ে ফেলা যায় স্বামীকে। এবং তারপর যখন ব্যাপারটা শেষ হলো, যখন স্বামীকে উনি মৃত অবস্থায় দেখলেন ওখানে, তখন, আমার যতোদূর মনে হয়, মহিলা তখনই হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন, বুঝতে পারেন তিনি খুন করে ফেলেছেন এবং ফাসী হয় খুন করলে। এবং তখনই উনি মরিয়া হয়ে নিজেকে বাঁচবার একটি মাত্রই পথের কথা চিন্তা করেন, এবং আত্মহত্যা হলো সেটা…।

যুক্তি আছে আপনার কথায়। ওভাবে চিন্তা করে থাকতে পারেন মহিলা, বললো পোয়ারো, খুনটাকে প্রমাণ করতে পারলে আত্মহত্যা বেঁচে যেতেন উনি।

পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে এই অপরাধটা করা হয়েছে একদিক দিয়ে বিচার করলে, আবার তা নয় অন্য দিক দিয়ে বিচার করলেন। মহিলা সত্যি সত্যিই ভেবেছিলেন খুন করার কথা আমার তো বিশ্বাস হয় না। কাজটা রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে করে ফেলেন।

ভাবছি আমি…, আপন মনে বিড়বিড় করলো পোয়ারো।

হেল একটু আশ্চর্য হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, আমি কি ব্যাপারটা ঠিক মতো বোঝাতে পেরেছি আপনাকে মঁসিয়ে পোয়ারো যে সাধারণ মামলা এটা একটা?

প্রায়। তবে পুরোটা না। অদ্ভুত ব্যাপার আছে দু-একটা…।

আপনার ধারণা অন্য আর কি হতে পারে, বোঝাতে পারেন যুক্তি দিয়ে? বললেন হেল।

অন্যান্য মানুষগুলোর গতিবিধি সেদিন সকালে কেমন ছিলো? প্রশ্ন করলো পোয়ারো হেলকে।

আমি ওঁদের কাছে গিয়েছিলাম। খুঁটিয়ে খুঁজে খবর নিয়েও ছিলাম প্রত্যেকের সম্বন্ধে অন্য জায়গায় থাকার অজুহাত দেখিয়ে। খুনির সঙ্গে জড়িত না হবার যুক্তি মানুষ দেখাতে চায় এক্ষেত্রে তেমন ছিলো না কারুর-যাকেও না বিষ দিয়ে খুন করার ব্যাপারে। কেননা যদি কেউ কাউকে খুন করতে চায় বিষ খাইয়ে তবে হজমের ওষুধ বলে একটা ক্যাপসুল বিষ ভরা দিয়ে বলবে খাবার পর কালকে এটা খাবেন। এবং দেশের অন্য প্রান্তে সেই অবসরে চলে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতে পারে।

এক্ষেত্রে কিন্তু আপনার তাই হয়েছে বলে মনে হয় না নিশ্চয়ই, পোয়ারো বললো।

হজমের গণ্ডগোল ছিলো না অ্যামিয়াস ক্রেলের। তাছাড়া আমি এরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনাও দেখিনি। মেরিডিথ ব্লেক সে নানারকম জিনিস মিশিয়ে ওষুধ বিষুধ তৈরি করার সম্বন্ধ যে মনগড়া অনেক কথা যা কিনা উল্টোপাল্টা তা বলেছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো, তাই বলে নিজের ওপর যে অ্যামিয়াস প্রয়োগ করবে তা বিশ্বাস করি না আমি। এবং কেনই বা মেরিডিথ ক্রেলকে খুন করতে চাইবেন? বিচার করে সব কিছু দেখা যায় খুব গাঢ় ছিলো অ্যামিয়াস আর মেরিডিথের বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব ছিলো ওঁদের সবারই মধ্যে। অ্যামিয়াসের প্রাণের বন্ধু ছিলেন ফিলিপ ব্লেক। ভালোবাসা হয়েছিলো এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে। যদিও এর জন্য গভর্নেস সিসিলিয়া অ্যামিয়াসকে পছন্দ করতেন না খুব একটা তবে কারুর চরিত্রের নৈতিক দিকের জন্যে কেউ বিষ খাওয়াবে না। বাচ্চা মেয়েটা, অ্যামিয়াসের খটাখটি যে লাগতো না অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের সঙ্গে তা নয়, তবে ঐ রকম একটু হয়েই থাকে ঐ বয়সের মেয়েরা। তারা দুজনেই খুব ভালোবাসতো দুজনকে। অ্যাঞ্জেলাকে বাড়ির সবাই বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতো। আগেই তো শুনেছেন কারণটা। ক্যারোলিন ক্রেল রাগের চোটে পাগল হয়ে গিয়ে মারাত্মক ভাবে জখম করে ফেলেছিলেন তার সৎ বোন অ্যাঞ্জেলাকে। ক্যারোলিনের চরিত্রের মধ্যে এ থেকেই তা বোঝা যায় একটা বেপরোয়া ভাব ছিলো। তাই না?

বোঝা যায় বৈকি, চিন্তান্বিতের মতো পোয়ারো বলতে থাকলো, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের পক্ষে অসম্ভব নয় ক্যারোলিন, ক্রেলের ওপর বিদ্বেষ থাকা।

হয়তো তাই বলে, কিন্তু অ্যামিয়াস ক্রেলের বিরুদ্ধে নয়। আর তাঁর ছোট্ট বোনকেও ক্যারোলিন খুব ভালোবাসতেন। বোনকে তো উনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন মা বাবা মারা যাবার পর, আর ভীষণ ভালোবাসতেন আগেই বলেছি। আদর দিয়ে নাকি বোনের মাথা খাওয়া হয়েছে সবাই বলতো। দিদিকে অ্যাঞ্জেলাও খুব ভালোবাসতো, বোনকে যাতে ধারে কাছে না আসতে দেওয়া হয় মামলা চলার সময় এ ব্যাপারে ক্যারোলিন ভীষণ জেদ ধরেছিলেন। তবে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো মেয়েটা, দিদির সাথে জেলে গিয়ে দেখা করতে চাইতো, রাজী হননি উনি, ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন উল্টে লেখাপড়া করবার জন্যে।

খুব নাম করা মহিলা হয়ে উঠলেন মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ঘুরে বেড়ান ইতিহাসের ভগ্ন স্থূপে। বক্তৃতা দেন রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে এই আর কি।

এবং কারুরই মনে নেই মামলার কথা? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

হ্যাঁ তাই বলা যায়, ঘুরিয়ে বললে। কুমারী নামের পদবীও তো ভিন্ন ছিল ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলার। মা একজনই কিন্তু দুজন তো বাবা। স্পলডিং ছিলো ক্যারোলিনের আগেকার পদবী,

ঐ সিসিলিয়া উইলিয়ামস, কার গভর্নেস ছিলেন উনি, অ্যাঞ্জেলার না অ্যামিয়াসের মেয়ের?

অ্যাঞ্জেলার। আলাদা নার্স ছিলো মেয়েটার জন্যে, তবে সিসিলিয়ার কাছে যতোদূর শুনেছি। মাঝে মাঝে পড়াশোনা করতো সামান্য।

বাচ্চা মেয়েটা ঘটনাটা ঘটার সময় কোথায় ছিলো?

দিদিমার কাছে, লেডি ট্রেসি লিয়ানের কাছে ওকে নার্স নিয়ে গিয়েছিলো, ঐ বাচ্চাটিকে উনি খুব ভালোবাসতেন।

তাই নাকি, মাথা নাড়লো পোয়ারো।

আবার বলতে শুরু করলেন হেল, অন্যান্যরা কে কোথায় ছিলেন খুনের দিন, আমি বলতে পারি যদি জানতে চান।…জলখাবার সকালের খাবার পর এলসা গ্ৰীয়ার লাইব্রেরী জানালার কাছে খোলা বারান্দায় বসেছিলেন। উনি ওখানে বসেই শুনেছিলেন ঝগড়াঝাটি। তারপর কামান বাগানে চলে যায় এলসা ক্রেলের সঙ্গে এবং ছবি আঁকানোর জন্য লাঞ্চ পর্যন্ত সিটিং দেন।

সকালে ফিলিপ ব্লেকও বাড়িতে ছিলেন, উনিও ঝগড়ার কিছুটা শুনেছিলেন। কাগজ পড়ছিলেন অ্যামিয়াস আর এলসা চলে যাবার পর, তারপর সমুদ্রের দিকে যান দাদার ফোন পেয়ে দাদার সঙ্গে দেখা করতে। দুজন তারপর কথা বলতে বলতে কামান বাগানের পাশ দিয়ে আসেন, এলসা গ্ৰীয়ার ঠিক সেই সময় বাড়িতে গিয়েছিলো একটা সোয়েটার আনবার জন্যে, তার একটু শীত শীত করছিলো। ক্যারোলিন স্বামীর সঙ্গে অ্যাঞ্জেলার স্কুলে যাবার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

দুজনের এই সাক্ষাৎকার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো কিনা জানতে চাইলো পোয়ারো।

আদৌ নয়। স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কেঁঝে কথা বলছিলো অ্যামিয়াস। খুঁটিনাটি ঘর সংসারের ব্যাপারে আলোচনায় মনে হয় খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। ছাড়াছাড়িই যদি হয় তাহলে আগে থাকতে ব্যবস্থা করে নিতে হবে ধরে নিয়ে ক্যারোলিন কথা বলছিলেন।

মাথা নাড়লো পোয়ারো। আবার বলতে শুরু করলেন হেল, অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে মেরিডিথ আর ফিলিপ দুই ভাই দু একটা কথা বলেছিলেন। ইতিমধ্যে নিজের জায়গায় এলসা গ্ৰীয়ার ফিরে এসে বসে পড়েছেন। বোধ হয় অ্যামিয়াসও দুই-ভাইকে এড়াবার জন্যে তুলি নিয়েছিলো তুলে। মনের ভাবটা অ্যামিয়াসের বুকে নিয়ে ব্লেকরা বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিন্তু ওঁরা কামান বাগানে যখন ছিলেন ঠিক তখনই বাগানের ঘরে রাখা বিয়ারগুলো যে গরম, যাচ্ছে না খাওয়া, বলেছিলেন। এই ধরনের কথা বলেছিলেন অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিনও উনি পাঠিয়ে দেবেন বাড়ি থেকে ঠান্ডা বিয়ার।

আহা।

তাহাই বটে। যেন মধু ঝরছিলো ক্যারোলিনের মুখে তারপর ব্লেকরা দুইভাই বাড়িতে গিয়ে কথা বলছিলেন বাইরের চত্বরে বসে। ওদের বিয়ার দেওয়া হলো ওখানে।

তারপর অ্যাঞ্জেলা সমুদ্রে স্নান করতে গেলো, ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে বাগানের সামনে একটা ভোলা জায়গায় বসে মেরিডিথ ব্লেক আবার চুরি যাওয়া কোনাইন সম্বন্ধে শুরু করেছিলেন চিন্তা করতে। এলসা গ্ৰীয়ারকে ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিলো। তারপর মেরিডিথ কামান বাগানে গেলেন খাবারের ঘণ্টা বাজলে ওদের ডেকে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু তার সঙ্গে শুধু এলসাই গিয়েছিলেন। মেরিডিথ যাবার সময় লক্ষ্য করেছিলেন খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছিলো অ্যামিয়াসকে। তবে মনে হয়নি তেমন কিছু। কখনো শক্ত অসুখ করেনি অ্যামিয়াসের, খুবই ভালো ছিল স্বাস্থ্য, তাই মাথায় আসেনি অসুস্থ হয়েছে চিন্তাটা বরং মনোমত আঁকার ব্যাপারটা না হলে বেশ ক্ষুব্ধ হতেন অ্যামিয়াস, রাগারাগি করতেন। কেউ তখন ওঁকে ঘাঁটায় না, থাকতে দেয় একলা। এবং মেরিডিথ আর এলসাও সেদিন তাই করেছিলো।

অন্য চাকরবাকরেরা বাড়ির কাজে ব্যস্ত ছিলো, খাতা দেখছিলো সিসিলিয়া স্কুল ঘরে। পরে কিছু সেলাই-টেলাই করে চত্বরে বসে। বাগানে সকালে ঘুরে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ফলটল খেয়ে বেড়াচ্ছিলো গাছে চড়ে সাধারণতঃ যা করে বছর পনেরোর মেয়েরা আর কি। ফিরে এসে সমুদ্রে স্নান করতে চলে যায় ফিলিপের সঙ্গে।

পুলিশ সুপার হেল একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, কোনো রহস্যের সন্ধান এর মধ্যে পাচ্ছেন কি?

পোয়ারো বললো, আদৌ না, তাহলে এই একটি কথাই হেলের অনেক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করলো। একই ব্যাপার, ভাবছি আমি আমি…

ভাবছেন কি করবেন?

আমি এই পাঁচজনের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা শুনবো।

হেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মশাই খারাপ হয়ে গেছে আপনার মাথা। কারুর কথাই ওদের কারুর সঙ্গে মিলবে না। বুঝতে পারছেন না এই সামান্য ব্যাপারটা, দুজন কখনোই একটা ঘটনা একরকম ভাবে বলতে পারে না। তাছাড়া এতো বছর পরে আর কি হবে, পাঁচ রকম ভাবে বলবে পাঁচজনে খুনের কাহিনীটা।

আর আমি তো সেই জিনিসটাই চাই। তা থেকে শেখা যাবে অনেক কিছু। বললো পোয়ারো।