১. পাম্বাসার দাড়ি

মুন অব ইজরায়েল – হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড

অবশেষে পাম্বাসার দাড়ি টেনে ধরলাম আমি।

এখন ভাবতেও অবাক লাগে, এমন দুঃসাহসের কাজ কী করে করলাম আমি? যুবরাজ শেঠির প্রাসাদ না হয়ে অন্য যেকোনো জায়গা হলে, এর জন্যে গর্দান না যাক, দশ-বিশ যা বেত আমি অনায়াসে পেতে পারতাম।

একথা অবশ্য খুবই ঠিক যে আমাকে মরিয়া করে তুলেছিল ঐ বুড়ো শয়তানটার নিজেরই আচরণ। “দেখা করিয়ে দেব! দেব দেখা করিয়ে!”-বলে বলে দফায় দফায় ও কি কম ঘুষ নিয়েছে আমার কাছ থেকে! ঐ ঘুষ দিয়ে দিয়েই তো ফতুর হয়ে গেলাম আমি! গরিব নকলনবিশ, কত আর এনেছিলাম মেম্ফিস থেকে আসবার সময়! হোটেল খরচা সামন্যই দিয়েছি তা থেকে, বাদবাকি সবই গিয়েছে ঐ বদমাইশ বুড়োর জঠরে। “আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু-করে করে আজ এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে আমাকে যে আর একটা দিনও ট্যানিসে টিকে থাকবার মতো সম্বল আজ আর আমার নেই।

অথচ মেসি থেকে ট্যানিসে এসেছি আমি খোদ যুবরাজেরই আমন্ত্রণে। পৈতৃক পেশা লিপিকর্ম, নকলনবিশি। আমিও তাই দিয়েই জীবনযাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু কী জানি কী খেয়ালে একদিন শুরু করলাম গল্প লিখতে। পরের লেখা নকল করাও ছাড়লাম না অবশ্য, কারণ রোজগার যা কিছু, তা তো ঐ থেকেই। কিন্তু ওর সঙ্গে সঙ্গে লিখতে থাকলাম নিজের মগজ থেকে বার করা নানান রকম কাহিনি, আর তারই এক একটা নকল পাঠাতে থাকলাম দেশের সব শহরের গ্রন্থাগারে। উদ্দেশ্য, বিদ্বজ্জনেরা পড়ুন সে-সব। তাদের কারও যদি ভাল লেগে যায় দৈবাৎ, একটা স্বীকৃতি যদি পাই কারও কাছ থেকে, আখেরে তা কাজ দিতে পারে আমার।

পাঠিয়েছিলাম ঐ রকম একটা ভাসাভাসা উদ্দেশ্য নিয়ে। তখন কি জানি যে আশাতীত সুফল ফলবে তাতে! হঠাৎ একদিন মেম্ফিসের প্রদেশপাল আমায়, পাঠিয়ে দিলেন একখানা চিঠি। চিঠি লিখছেন স্বয়ং যুবরাজ শেঠি মেনাপ্টা। তিনি পড়েছেন আমার গল্প, আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন ট্যানিসে।

আমি তক্ষুনি সে-চিঠির একটা জবাব দিয়ে দিলাম। লিখলাম–আমি সম্মানিত, পুলকিত, মিশর যুবরাজের অনুগ্রহলিপি লাভ করে। যতশীঘ্র সম্ভব আমি ট্যানিস আসছি, তবে অনিবার্য ভাবেই তাতে কিছু বিলম্ব ঘটতে পারে, কারণ এখানকার কাজকর্ম শেষ না করে তো পারি না যেতে! অনেকের অনেক জরুরী নকলের কাজও তো রয়েছে আমার হাতে!

বস্তুত মেম্ফিসের কাজকর্ম শেষ করে ট্যানিসে পৌঁছোতে আমার প্রায় মাস তিনেক দেরি হয়ে গেল। পোঁছোলাম যখন, তখনই কি তড়িঘড়ি সাক্ষাৎ করতে পারলাম যুবরাজের সঙ্গে! যুবরাজ থাকেন সুরক্ষিত প্রাসাদের অভ্যন্তরে, বাইরে গিজগিজ করছে রক্ষী ও ভৃত্যের দল। সেই রক্ষী আর ভৃত্যেরা সঙ্গে করে ভিতরে না নিয়ে গেলে সাধারণ নাগরিকের সাধ্য কী যে যুবরাজের কাছে পোঁছোবে?

আমায় কাজে কাজেই রোজই এসে ধর্না দিতে হচ্ছে যুবরাজপ্রাসাদে। খোসামোদ করতে হচ্ছে এর-ওর-তার–“কি করে দেখা হতে পারে, বলে দাও ভাই?” “দেখা?”–তারা অনেকে কথাই কইছে না, কারণ তারা জানে যে দেখা করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। আবার দুই-একজন কইছেও কথা। তাদের সকলেরই বক্তব্য একই। তা হল এই যে পাম্বাসা ছাড়া অন্য কারও অধিকারই নেই বাইরের দর্শনার্থীকে যুবরাজের কাছে নিয়ে যাওয়ার।

“কে পাম্বাসা?”

এক বুড়ো, আন্দাজ ষাট হবে তার বয়স। এই বয়সেও বেশ শক্তসমর্থ। মুখে লম্বা দাড়ি, দুধের মতো সাদা। হাতে একখানা সোনা বাঁধানো খাটো লাঠি। তার কাছে আমার প্রার্থনা জানাতেই সে মৃদু হেসে বলল–“যুবরাজ? তার সঙ্গে দেখা করতে হলে পায়ে পায়ে মোহর ছড়াতে হবে বাপধন! পারবে?”

না পেরে উপায় কী? সেই থেকে শুরু হল মোহর ছড়ানো। দৈনিক একটা। দেখা হলেই পাম্বাসা হাত বাড়িয়ে দেয়, আমি একটা মোহর তুলে দিই সেই হাতে। “দাঁড়াও” বলে সে চলে যায় ভিতর পানে, এক চক্কোর ঘুরে এসে বলে–“আজ উনি বড় ব্যস্ত, কাল হবে।”

এইভাবে কতকাল যে মহাকাশে বিলীন হল, তার হিসাব দিলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশেষে, পকেটে আর মোহর নেই দেখে, একদিন মরিয়া হয়ে পাম্বাসার সেই সুদীর্ঘ সাদা দাড়ি আমি টেনে ধরলাম–“আজ দেখা করবই আমি। যদি না পাই দেখা, চেঁচিয়ে বলব সবাইকে কত মোহর তুমি আমার কাছে ঘুষ নিয়েছ মিথ্যে আশা দিয়ে!”

প্রাসাদ চত্বরে লোকারণ্য, যেমন প্রতিদিনই থাকে। রক্ষীরা আমাকে তেড়ে এল ঠিকই, কিন্তু বাইরের লোক যারা উপস্থিত ছিল, তারা এগিয়ে এল হই হই করে–“কী হয়েছে? হয়েছে কী?”

আমি পাম্বাসার ঘুষ নেওয়ার ইতিহাস তাদের কাছে খুলেই বলতে যাচ্ছি দেখে দমে গেল বদমাইশটা। কানে কানে বলল আমায়–“থাক, থাক, আর নালিশ ফরিয়াদে দরকার নেই। চল, দেখা করিয়েই দিচ্ছি তোমায়।”

এই বলে সে ভিতরে ঢুকল চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। আমি তার পিছু নিলাম। কত মহল, কত কক্ষ, কত অঙ্গন যে পেরুতে হল, তার লেখাজোখা নেই। অবশেষে একখানা ঘরের দোরগোড়ায় আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে পাসা ঢুকল ঘরের ভিতরে। দরোজায় পর্দা ঝুলছে, তার পাশে ফাঁকও রয়েছে একটু। আমি ভিতরটা দেখতে পাচ্ছি সেই ফাঁক দিয়ে।

ঘরখানা ছোট্ট। বলতে গেলে আমি যে দীনহীন নকলনবিশ মানুষ, আমার লেখার ঘরখানাও এর চাইতে ছোট নয়। টেবিলে খাগড়ার কলম, স্ফটিকের দোয়াত, রং-দানি থরেথরে সাজানো। কাঠের ফ্রেমে পিন দিয়ে সাঁটা প্যাপিরাসের কাগজ*। [* প্যাপিরাস এক রকম খাগড়া গাছ-এর বাকলকে কাগজের মতো ব্যহার করা হত প্রাচীনকালে।] আর দেয়ালের গায়ে গায়ে কাঠের তাক, তাতে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো, প্যাপিরাসে লেখা তাড়া তাড়া পাণ্ডুলিপি।

ঘরে আগুন জ্বলছে সুগন্ধি সীডার কাঠের। আর সেই আগুনের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং যুবরাজ। আমি অবশ্য আগে কখনো দেখিনি তাকে। কিন্তু তা বলে চিনতে কেন অসুবিধা হবে? মেম্ফিসের উদ্যানে তার মূর্তি দেখেছি না?

যুবরাজের হাতে একখানা প্যাপিরাসের পাণ্ডুলিপি। তিনি সেটা মেলে ধরে আছেন চোখের সামনে, আর সেই সুযোগে আমি লক্ষ্য করছি তাকে। দেখতে তাকে আমার চেয়ে অন্তত তিন-চার বছরের ছোট দেখায়, যদিও তার আর আমার জন্ম হয়েছিল একই দিনে।

হ্যাঁ, এ-কথাটা আগেই বলে নেওয়া উচিত ছিল বোধ হয়–একই দিনের জাতক যুবরাজ ও আমি। আরও হয়তো কয়েক হাজার শিশু এদেশের। সেই জন্মসূত্রে আমরা সবাই এক ধরনের ভাই, মিশরীয় জবানে বলে আমন-ক্ষেত্রজ যমজ ভাই। যুবরাজকে দেবাদিদেব আমন-রা’র অবতার বলেই গণ্য করা হয়, এবং নরদেহে যতদিন তিনি বিদ্যমান থাকবেন, তিনিই থাকবেন আমনের সেবাইত ও প্রতিনিধি।

কিন্তু সে-কথা থাকুক। বয়স আমাদের একই, তবু যুবরাজকে অনেক তরুণ মনে হয় আমার চেয়ে। তার দেহের লালিত্য স্বভাবতই আমার চেয়ে বেশি, তা ছাড়া তিনি হলেন সুখৈশ্বর্যে লালিত রাজার দুলাল, আমি হলাম খেটে খাওয়া নকলনবিশ মাত্র।

বেশ দীর্ঘকায় পুরুষ যুবরাজ, একহারা, ফর্সা। মিশরীদের মধ্যে অত ফর্সা রং খুব কম লোকেরই আছে। এর কারণ আর কিছু নয়, তার দেহে আছে সিরীয় রক্ত, মাতৃকুল থেকে। চোখ তার ধূসর, ঐ খুব জমকালো, তার পিতা মেনাপটার মতো। চোখের কোণে কপালে কতকগুলি বলিরেখা না থাকত যদি, তাঁর মুখখানিকে বলা যেত নারীসুলভ লালিত্যমণ্ডিত।

বেশ কিছুক্ষণ পাম্বাসা দাঁড়িয়ে আছে প্রভুর সমুখে, তিনি পাণ্ডুলিপিতেই তন্ময়। অবশেষে হঠাৎ এক সময়ে তিনি চোখ তুলে চাইলেন তার পানে–“ঠিক সময়েই এসে পড়েছ দেখছি।”

কী কোমল মধুর স্বর যুবরাজের! অথচ কী পুরুষালি ব্যঞ্জক দৃঢ়তায় পূর্ণ।

“তোমার তো বয়স হয়েছে। আর বয়স হলেই মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বেড়ে যায়, তাও তত জানে সবাই! তাহলে পাম্বাসা, তুমিও অবশ্যই জ্ঞানী লোক?”

“নিশ্চয়ই যুবরাজ! আপনার স্বর্গীয় জ্যাঠা খেমুয়াজ ছিলেন মস্ত বড় জাদুকর। ছেলেবেলায় তার জুতো পরিষ্কার করতাম আমি। তাহলে জ্ঞানী না হয়ে উপায় কী আছে আমার?”।

“তা হলে তুমি জ্ঞানী লোক, আঁ? সে জ্ঞান তাহলে তুমি এত যত্নে লুকিয়ে রেখেছ কেন বিজ্ঞবর? বিকশিত পদ্মের মতো মেলে দাও তোমার সে-জ্ঞানের ভাণ্ডার, আমাদের মতো দীনহীন মধুপেরা জ্ঞানমধু আহরণ করুক তা থেকে। যাক, এতদিন পরে এ-সুখবরটা পেয়ে আমি খুশি। খুশি হওয়ার কারণ কী, জান? এই যে বইখানা আমি পড়ছি, এটি জাদুবিদ্যার বই। এত জটিল, দুর্বোধ্য এর বিষয়বস্তু যে আমার ঐ স্বর্গীয় জ্যেষ্ঠতাত স্বর্গস্থ হওয়ার পরে ইদানীং আর বোধ হয় ধরাধামে এমন কেউ নেই যে তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারে। অবশ্য জ্যাঠার সম্পর্কে আমার মনে আছে শুধু এইটুকুই যে অতি হাস্যলেশহীন দুশমন চেহারার লোক ছিলেন তিনি, ঠিক যেমনটি আজকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ছেলে, আমার জ্যাঠতুতো ভাই আমেনমেসিস। তফাৎ শুধু এই যে তিনি ছিলেন জ্ঞানী, এদিকে আমেনমেসিসকে জ্ঞানী বলা, সে তার পরম শত্রুতেই বলতে পারবে না।”

“কিন্তু যুবরাজ যে খুশি হয়েছেন বললেন, খুশি হওয়ার কারণটা কী?”– পাম্বাসা জিজ্ঞাসা করল সেই রকম আদুরে সুরে, যে সুর অনেক প্রশ্রয় পাওয়া পুরাতন ভৃত্যের কথার মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায়।

“আহা, কারণ তো স্পষ্ট।” বললেন যুবরাজ–“তুমি যখন পিতৃব্য খেমুয়াজের মতোই বিজ্ঞ, তখন এই দুর্বোধ্য বইটা তুমি আমায় অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে পারবে। তুমি তো জানই পাম্বাসা, অকালে মরে না গেলে আমার বাবার বদলে ঐ জ্যাঠা খেমুয়াজই হতেন মিশরের ফারাও। তিনি যদি ফারাও হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই আগেভাগে সরে পড়ে থাকেন পৃথিবী থেকে, তা হলে বাবা পাম্বাসা, তার বিজ্ঞতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহই আর পোষণ করা যায় না। বোঝাই তো, কোনো সত্যকার বুদ্ধিমান লোক, নিতান্ত নিরুপায় না হলে কোনোদিনই মিশরের ফারাও হতে রাজি হতে পারে না।”

পাম্বাসা বিস্ময়ে হাঁ করে ফেলেছে একেবারে।

“ফারাও হতে রাজি হতে পারে না?”–এই পর্যন্তই সে বলেছে কেবল– যুববাজ বাধা দিলেন তাকে–“শোন হে জ্ঞানবৃদ্ধ পাম্বাসা, যা বলি তা শোন আগে। এই বইখানিতে দেওয়া আছে কিছু তুকতাকের বিবরণ, যাতে হৃদয়টা থেকে সব অবসাদ নিঃশেষে ধুয়ে মুছে বেরিয়ে যাবে। অবসাদ! বুঝেছ হে জ্ঞানবৃদ্ধ, অবসাদ! এ-বইয়ের মতে দুনিয়ার সব কিছু আধিব্যাধির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে সর্বজনীন ব্যাধি হল ঐটি, আর ও থেকে রেহাই পায় শুধু বেড়ালবাচ্চারা, কিছু কিছু শিশুরা এবং পাগলেরা। এ-বইয়ের মতে ও ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাত দুপুরে খুফুর পিরামিডের চূড়ায় উঠে পড়া। বছরের যে কোনো সময়ে উঠলে হবে না, উঠতে হবে সেই সময়টাতে যখন পূর্ণচন্দ্রকে দেখায় অন্য সময়ের চাইতে অনেক বড়। আর উঠবার পরে দাঁড়িয়ে থাকলেও চলবে না, স্বপ্নভৃঙ্গার থেকে কয়েক চুমুক স্বপ্নরস পান করে এই মন্ত্রটা পড়ে যেতে হবে গড়গড় করে। মন্ত্রটা বেশ বড়সড়, কিন্তু এমন এক ভাষায় লেখা, যা পড়বার মতো বিদ্যে আমার নেই!”

“যুবরাজ! মন্ত্র যদি সবাই পড়তে পারত, তাহলে তার আর কোনো দাম থাকত না”–সত্যকার বিজ্ঞজনের মতোই সাড়ম্বরে মন্তব্য করল পাম্বাসা।

‘“আর কেউই যদি তা পড়তে না পারে, তা হলে তো তা কারও কোনো কাজেই আসে না!”-জবাব দিলেন যুবরাজ।

পাম্বাসা একে একে অনেক জ্ঞানগর্ভ আপত্তি উত্থাপন করতে লাগল–“পড়তে পারা না-পারার কথা তো পরের কথা, আগে বিবেচনা করুন যুবরাজ, খুফুর পিরামিডের চুড়ায় মানুষ উঠবে কেমন করে? মসৃণ মর্মরে তৈরি গোটা পিরামিডটাই। দিন দুপুরেই তাতে এক পা উঠতে গেলে পা পিছলে যায়, রাত দুপুরের কথা তো ছেড়েই দিন। আর উঠতেই যদি না পারা গেল, তা হলে স্বপ্নভৃঙ্গারের রসপান করা বা মন্ত্র আওড়াননা, এসব কাজই বা করা যেতে পারে কেমন করে?”

“কেমন করে, আমি তো জানি না। জানতে পারলে বেঁচে যেতাম হে জ্ঞানবৃদ্ধ! কারণ অবসাদ থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমার মতো এতখানি উতলা আর কেউ কোনোদিন হয়েছে বলে আমি তো মনে করি না। তুকতাকের কথা বাদ দাও এখনকার মতো, মনটা কিসে একটু হাল্কা হয়, বালাতে পার?

‘‘বাইরে কতগুলি বাজিকর এসেছে যুবরাজ, তাদেরই একজন বলেসে আকাশের পানে একটা দড়ি ছুঁড়ে দেবে, আর সেই দড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে শেষ পর্যন্ত স্বর্গে বিলীন হয়ে যাবে।”

“এটা যখন তাকে করতে দেখবে নিজের চোখে, তখন তাকে নিয়ে এসো আমার কাছ। তার আগে নয়। আমি যতদূর জানি, মৃত্যুই হচ্ছে একমাত্র দড়ি, যা বেয়ে আমরা স্বর্গে উঠতে পারি, অথবা নামতে পারি নরকে।”

“ওটা যদি অপছন্দ হয়, যুবরাজ, তা হলে একদল নর্তকী এসেছে, এমন সব নর্তকী, আপনার পিতামহ মহান রামেসিসের আমলে এলে যারা দুর্দান্ত খাতির পেতো এদেশে।”

“পিতামহের আমল আর নেই হে জ্ঞানবৃদ্ধ! অন্য কিছু বাৎলাও, যদি পার।”

“আর তো কিছুই মাথায় আসে না যুবরাজ! তবে হ্যাঁ, বাইরে একটা লেখক দাঁড়িয়ে আছে, নামটা তার অ্যানা, রোগাপানা, চোখ-নাকওয়ালা একটা লোক, স্পর্ধা কম নয় তার, বলে কিনা সে নাকি যুবরাজদের আমন-ক্ষেত্রজ যমজভাই।”

“অ্যানা?” যুবরাজ কান খাড়া করলেন হঠাৎ–“মেম্ফিসের অ্যানা? গল্পলেখক অ্যানা? আরে বোকা বুড়ো, আগে একথা বলতে কী হয়েছিল তোমার? এক্ষুনি, এক্ষুনি নিয়ে এস।”

দোরগোড়ায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি অ্যানা এসবই শুনছি এতক্ষণ, পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখছিও সব। “এক্ষুনি নিয়ে এস”–যুবরাজের মুখ থেকে আদেশ বেরুনো মাত্র আমি পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়লাম কক্ষে, পাম্বাসার অপেক্ষা না রেখে। যুবরাজের সমুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলে উঠলাম, “অবধান করুন মহিমান্বিত সূর্যপুত্র, আমি সেই দীন লেখক।”

পাম্বাসা ফোঁস করে উঠেছে ওদিকে–“নিয়ম হল, আমি গিয়ে নিয়ে আসব তোমায় যুবরাজের দরবারে। তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজের খুশিতে তুমি চলে আস কী হিসাবে?” . “আর তুমি পাম্বাসা, তুমিই বা এই বরেণ্য লেখককে কুকুরের মতো দরোজার বাইরে ঠেলে রেখেছ কোন হিসাবে?”“তর্জন করে উঠলেন যুবরাজ–“ওঠো অ্যানা, মেজে থেকে ওঠো! সূর্যপুত্র-টুত্র উপাধি বাদ দাও এখনকার মতো, এটা তো দরবার নয়! কতদিন হল এসেছ ট্যানিসে?”

“অনেকদিন যুবরাজ! রোজ চেষ্টা করেছি আপনার সম্মুখে পৌঁছোবার, কিছুতেই পারিনি।”

“শেষ পর্যন্ত পারলে কী করে?”

সরলভাবে স্বীকার করলাম–“ঘুষ দিয়ে যুবরাজ! ঐটাই রীতি মনে হল। দরোজায় যারা আছে—”

যুবরাজ শেঠি বললেন–“বুঝেছি, বুঝেছি, ঐ দরোজার মালিকেরা! পাম্বাসা! একটা হিসাব দাও তো দরোজার মালিকদের কত সেলামি দিতে হয়েছে এই লেখক মহাশয়কে! হিসাব কর, আর তার দ্বিগুণ ওঁকে এনে দাও আমার তহবিল থেকে। এখন তুমি যেতে পার। গিয়ে এই ব্যাপারটার সুব্যবস্থা কর আগে।”

পাম্বাসার অবস্থা কী করুণ! চোখের কোণ থেকে একটা অনুনয়ের দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে সে বেরিয়ে গেল।

শেঠি বললেন–“এইবার তুমি বল তো অ্যানা, একদিক দিয়ে কিছু জ্ঞান তো তোমারও অবশ্যই আছে, বল তো রাজদরবারে চোর থাকা অনিবার্য কেন?”

“ঠিক সেই কারণে অনিবার্য, যুবরাজ, যে কারণে কুকুরের পিঠে মাছি থাকা অনিবার্য। মাছিকে খেতে হবে তো! ঘেয়ো কুকুরের পিঠে খাদ্য পায় সে।”

“ঠিক বলেছ তুমি”–বললেন যুবরাজপ্রাসাদের এই মাছিগুলি বেতন পায় কম। আমার হাতে যদি ক্ষমতা আসে কোনোদিন, আমি এর প্রতিকার করব। লোক থাকবে কম, মাইনে পাবে বেশি। যাক সে কথা, অ্যানা, তুমি বসো। তুমি আমায় জান না, কিন্তু আমি তোমায় জানি। জানি তোমার লেখার ভিতর দিয়ে। জানি তোমায়, ভালও বাসি। ঐ লেখারই জন্য! তোমার কথা সব বল আমায়।”

কী-ই বা কথা আমার? দুই-চার কথাতেই সব বলা হয়ে গেল। তিনি শুনে গেলেন, একটিও কথা না বলে। তারপর বললেন–“আমি তোমায় ডেকেছিলাম অনেকদিন আগে। তারপর রাজা-রাজড়াদের যেমন হয়, ভুলেও গিয়েছিলাম সে কথা। এত দেরি করলে কেন?”

“ওদিককার কাজকর্মের বিলিব্যবস্থার জন্য। তারপর একটা সংকও ছিল, শুধু হাতে যুবরাজের দর্শনে যাব না। একটা নতুন গল্প লিখেছি এর মধ্যে। আর সেটা উৎসর্গ করেছি যুবরাজকে। আশা আছে, সে ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন যুবরাজ।” এই বলে জামার ভিতর থেকে প্যাপিরাসের তাড়াটা বার করে টেবিলে রাখলাম।

যুবরাজের সুন্দর মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল–“বল কী! এ যে আমার মহৎ সম্মান! আমি পড়ব, তারপরে নির্দেশ দিয়ে রাখব যে মৃত্যুর পরে আমার সমাধিতে রক্ষিত হবে ঐ কাহিনি। সেখানে আমার আত্মাপুরুষ বসে বসে পড়বে তা।”

অবশ্য, তারপর হেসে বললেন–“আত্মাপুরুষের আগে এই দেহধারী শেঠিই অবশ্য তা পড়ে নেবে বারবার। আচ্ছা ও-কথা থাকুক, ট্যানিস দেখলে?”

“কী করে দেখব যুবরাজ? এসে অবধি তো এই প্রাসাদ চত্বরেই ঘুরঘুর করছি এর-ওর-তার খোসামোদ করে করে।”

‘তা হলে চল, আমিই তোমায় রাজধানী শহর দেখিয়ে আনি। এই রাত্রেই। তারপর ফিরে এসে দু’জনে মিলে খাব এখন, কথা কইতে কইতে।

আমি শির নত করে সম্মতি জ্ঞাপন করতেই যুবরাজ জোরে, জোরে হাততালি দিলেন একবার। আর তাই শুনে একজন ভৃত্য এসে ঘরে ঢুকল। তাকিয়ে দেখলাম–এ সেই পাম্বাসা নয়, অন্য লোক।

“দুটো আঙরাখা নিয়ে এস’–তাকে হুকুম করলে যুবরাজ–“আমি এই লেখক মশাইয়ের সঙ্গে শহর দেখতে বেরুবো! চারজন নিউবিয়ান দেহরক্ষী থাকবে আমার সঙ্গে, বেশি নয়। তারা থাকবে বেশ একটু পিছনে, আর পরনে থাকবে তার ছদ্মবেশ, তাদের বল পিছনের গুপ্তদ্বারে তৈরি থাকতে।”

ভৃত্য অভিবাদন করে প্রস্থান করল।

আর প্রায় তখন, তখনই সেই কক্ষে এসে প্রবেশ করল এক কাফ্রি ক্রীতদাস। তার হাতে দুটো মুখোশওয়ালা আঙরাখা। অনেকটা মরুভূমির উষ্ট্ৰচালকদের পরিচ্ছদের মতো। আমরা দুজনে পরে ফেললাম সেই পোশাক। তারপর ক্রীতদাসটি আলো ধরে আমাদের বাইরে নিয়ে গেল। উলটো দিকের দরোজা দিয়ে। কত কত ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে, একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম আমরা অবশেষে। এইবারে একটা চত্বর, সেটা পেরুতেই পাওয়া গেল পাঁচিল একটা, যেমন উঁচু তেমনি পুরু। সে-পাঁচিলে দুই কৰাটের দরোজা একটা। কবাটে আবার তামার পাত বসানো।

আমরা কাছে আসতেই দরোজটা খুলে গেল নিঃশব্দে। কে যে খুলে দিল, তা ঠাহর পেলাম না। কিন্তু বাইরে যেতেই একটা জিনিস সঙ্গে সঙ্গেই নজরে এল। আঙরাখা পরা চারজন লোক অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছে একটু তফাতে। আমাদের দিকে তারা যেন তাকিয়েও দেখল না। কিন্তু খানিকটা পথ চলবার পরই পিছন পানে তাকিয়ে দেখি, তারা ঠিক অনুসরণ করেছে আমাদের। অথচ ভাবটা তারা এমনিই দেখাচ্ছে যেন আমাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তাদের নেই।

আমি মনে ভাবছি, সার্থক জন্ম এই রাজা আর রাজপুত্রদের। একটি মাত্র অঙ্গুলি সংকেতেই তারা যাকে ইচ্ছা তাকে নিজেদের সেবায় নিয়োজিত করতে পারেন।

আর ঠিক সেই সময়েই যুবরাজ আমায় বলছেন–“দেখ অ্যানা, রাজা বা রাজপুত্র হওয়ার মুশকিল কত! প্রহরী না নিয়ে এক পা একা চলবার উপায় নেই। আর প্রহরী সঙ্গে থাকার মানে কী জান তো? মানে হল এই যে, তুমি কোথায় যাচ্ছ, কী করছ তার পূর্ণ বিবরণ অবিলম্বে গিয়ে হাজির হবে পুলিশের কাছে। আর সে পুলিশ তো ফারাও ছাড়া অন্য কারও আজ্ঞাবহ নয়!”

প্রত্যেকটা জিনিসেরই সাদা-কালো দুটো দিক আছে, ভাবলাম আমি।

.

২.

বেশ প্রশস্ত একটা রাজপথ ধরে আমরা চলেছি। পথের দুই ধারে তরুশ্রেণি, তার পিছনে চুনকাম করা সব বাড়ি। বোঙ্গুরে শুকনো ইটের গাঁথনি সে-সব বাড়িতে, ছাদ তাদের সমতল, প্রত্যেকটা বাড়ি চারদিকে বাগান দিয়ে ঘেরা। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়লাম যে-জায়গায়, সেটাকে বাজার বলেই মনে হল। আর সেই সময়ে পামবীথির মাথার উপরে হল পূর্ণচন্দ্রের উদয়। আকাশ পৃথিবী উঠল ঝলমলিয়ে, উজ্জ্বল দিবালোকে ওঠে যেমন।

শহরের নাম ট্যানিস বটে, কিন্তু মহান র‍্যামেসিস এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে র‍্যামেসিস নামেও অনেকে একে অভিহিত করে। সুন্দর শহর, কিন্তু আয়তনে মেম্ফিসের অর্ধেকও নয়। যদিও মেক্ষিসের আর আগের গৌরবের দিন নেই। রাজধানী উঠে গিয়েছে ওখান থেকে, কাজে কাজেই লোকও অনেক উঠে এসেছে এই ট্যানিসে।

এই বাজারটাই সবচেয়ে নাকি জমকালো বাজার শহরে। এর চারদিকে নানা দেবদেবীর বড় বড় মন্দির, প্রতি মন্দিরের সমুখে স্ফিংক-বীথি। মুখ রমণীর মতে, দেহ সিংহিনীর মতে, এই রকম সব অতিকায় প্রস্তরমূর্তি ছিল প্রাচীন মিশরের বৈশিষ্ট্য, এদেরই নাম স্ফিংকস্।

একদিকে দ্বিতীয় রামেসিসের বিরাট মূর্তি, অন্যদিকে একটা টিলার মাথায় ফারাওয়ের প্রাসাদ। শহরে প্রাসাদ আরও অনেক আছে, দরবারের বড় বড় লোক, মন্ত্রী, সেনাপতিরা, আর অভিজাতশ্রেণির ধনীরা বাস করেন তাতে। সাধারণ নাগরিকেরা থাকে ঐসব ছোট বাগান ঘেরা বাড়িতে, যা আমরা রাস্তার দুইধারে দেখতে দেখতে এসেছি।

নীলনদের একটি শাখা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। অনেক রাজপথই শেষ হয়েছে সেই শাখানদীর কূলে গিয়ে।

শেঠি দাঁড়িয়ে পড়েছেন বাজারের মাঝখানে। নীরবে নিরীক্ষণ করেছেন জ্যোৎস্নাধৌত প্রাসাদগুলির সৌন্দর্য। কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে ফিরে বললেন “অনেক পুরোনো এইসব বাড়ি, তবে ঐ যে আমনের মন্দির, আরটা-এর মন্দির, এ দুটি আমার ঠাকুর্দার আমলে আমূল মেরামত করা হয়েছিল। ঐ যে গোসেন প্রদেশে ইজরায়েলী দাসেরা থাকে, করানো হয়েছিল ওদের দিয়েই।”

“বহু অর্থ ব্যয় হয়েছিল নিশ্চয়ই!”–মন্তব্য করলাম আমি।

“অর্থ? মিশরের রাজা কি দাসদের পয়সা দেন নাকি?”–শুকনো জবাব পেলাম যুবরাজের কাছ থেকে।

রাত বেশি তো হয়নি। হাজার লোক বাজার চত্বরে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, দিনের মেহনত সাঙ্গ করে এসে আমরাও মিশে গেলাম সেই ভিড়ে, ট্যানিস বলতে গেলে মিশরের সীমান্তেই অবস্থিত। নানা দেশের লোক এসে একত্র মিলেছে এখানে। মরুভূমি থেকে এসেছে বেদুইন, লোহিত সমুদ্রতীর থেকে এসেছে সিরিয়া চিট্রিম দ্বীপের বণিক যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে ভূমধ্যসাগরের উত্তরবর্তী দেশ থেকে নানা ধরনের ভাগ্যান্বেষী নানান রকম ফন্দি-ফিকির মাথায় নিয়ে। দল বেঁধে বেঁধে জটলা পাকাচ্ছে তারা, গল্প করছে, হাসাহাসি করছে, আর নাহয় তো কোনো কথকের কাহিনি বা গায়কের গান শুনছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক এক জায়গায় নাচও হচ্ছে বিদেশিনী নর্তকীদের, ভিড় সেখানেই সবচেয়ে বেশি।

থেকে থেকে ভিড়টা দুই দিকে সরে যাচ্ছে দুই ভাগ হয়ে। খামোকা নয়, ধাবমান পাইকেরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে জনারণ্যের ভিতর, দুই হাতে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে মানুষগুলোকে, আর ক্রমাগত চিল্লাচ্ছে–“পথ ছাড়! পথ ছাড়! রথ আসছে অমুক লর্ডের বা অমুক লেডির, পথ ছাড় সবাই!” হাতের ঠেলায় কাজ হচ্ছে না দেখলে লম্বা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটোচ্ছেও মানুষগুলোকে।

হঠাৎ আবির্ভাব এক ধর্মীয় মিছিলের। দেবী আইসিসের এক দল পুরোহিত ঢোলা ঢোলা সাদা পোশাক পরে নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। আইসিস তো, চন্দ্রেরই দেবী! তার বিগ্রহ মাথায় নিয়ে চন্দ্রালোকে পথে পথে বিচরণ তো পূজা পদ্ধতিরই অঙ্গবিশেষ! জনতা সে বিগ্রহ দেখে ধূলায় লুটিয়ে পড়েছে ভক্তির আতিশয্যে।

এর পরে এল এক শবযাত্রা। বড়লোক মারা গিয়েছেন কেউ একজন, শোক করবার জন্য ভাড়া করে আনা হয়েছে যেসব লোক, গুনতিতে তারা এক পলটন বিশেষ। মৃতের বিবিধ গুণ তারস্বরে কীর্তন করে করে তারা কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে জনতার।

সবশেষে এল অন্য ধরনের আর এক মিছিল। একপাশের একটা অন্তরালবর্তী পথ থেকে বাজার চত্বরে এসে উঠল কয়েকশো লোক, বঁড়শির মতো বাঁকা নাক তাদের। দাড়িওয়ালা পুরুষ সব। অল্প কয়েকটি স্ত্রীলোকও দেখতে পাচ্ছি সে দলে। সবাই একসাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা, সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে তাদের আগে-পিছে।

এ-ধরনের লোক আমি আগে কখনো দেখিনি। যুবরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম—”এরা কে আবার?”

“দাস”–বললেন যুবরাজ বিরসকণ্ঠে–“ইজরায়েলী। গোসেনের লোক। গিয়েছিল নতুন খালের মাটি কাটতে। ঐ যে নতুন একটা খাল হচ্ছে না, শহর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত?”

নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছি। চলে যাচ্ছে ওরা সারি বেঁধে। একটা জিনিস লক্ষ করে অবাক হয়ে যাচ্ছি। দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে তারা সবাই, তবু চোখে তাদের কী উদ্ধত দৃষ্টি! আর ভঙ্গি তাদের কী হিংস্র! কাদায় জলে পরিচ্ছদ নোংরা, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে দেহ, তবু-তবু তেজ ওদের একটুও কমেনি যেন।

বেশ চলে যাচ্ছে ইজরায়েলী দাসেরা, হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেল। সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো ঐ দলের, সে ঠিক সমান তালে হাঁটতে পারছিল না, অন্যদের সঙ্গে। তার ফলে গোটা দলটারই গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে, একবার একেবারে থেমেই পড়ল তারা।

পাহারাওলাদের মধ্যে একজন অমনি ছুটে গেল বুড়োর কাছে। তার হাতে রয়েছে সিন্ধুঘোটকের চামড়ার চাবুক, তাই দিয়েই বুড়োর পিঠে বসিয়ে দিল কয়েক ঘা। চামড়া কেটে অমনি চুঁইয়ে পড়ল রক্ত।

বুড়োও ভয় পাওয়ার লোক নয়। তার হাতে আছে কোদাল, তাই মাথার উপরে ঘুরিয়ে প্রচণ্ড এক ঘা, তাই দিয়ে বসিয়ে দিল পাহারাওলার মাথায়। মাথাটা আমাদের চোখের সামনেই গেল গুঁড়ো হয়ে।

পাহারাওলা একজন নয়, কয়েক গণ্ডা। তারা যে যেখানে ছিল, এল দৌড়ে। সবাই মিলে পিটোতে লাগল বুড়োকে, বুড়ো মাটিতে পড়ে গেল। তারপর এল এক সৈনিক, সে দেখল অবস্থাটা, তারপর খাপ থেকে টেনে বার করল তরোয়াল*। [*সে-যুগে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হত ব্রঞ্জ দিয়ে । ব্রঞ্জ হল তামা আর টিনের সংযোগে উৎপন্ন মিশ্র ধাতু বিশেষ।]

আর তক্ষুনি ভিড়ের ভিতর থেকে ছুটে বেরুলো এক তরুণী। বসন তার অতি গরিবানা ধরনের, কিন্তু তার ভিতর থেকে যে সৌন্দর্য ফুটে বেরুচ্ছে, তুলনা তার কোথাও দেখিনি আমি।

এরপরেও বহু-বহুবার আমি দেখেছি মেরাপিকে। যে মেরাপি ইজরায়েলীদের সমাজে পরিচিত ছিল ইজরায়েল-চন্দ্রমা বলে। বহুক্ষেত্রে বহুরূপে দেখেছি তাকে। রানি সেজে আসতে দেখেছি তাকে হীরা-মণি-মাণিক্যে অলঙ্কৃত হয়ে, দেবী সেজে আসতে দেখেছি, চারিধারে পুণ্যজ্যোতি বিকীরণ করে, কিন্তু সেদিন সেই দাসজীবনের হীন পরিবেশে তাকে যতখানি অনবদ্য সৌন্দর্যের অধিকারিণী আমি দেখেছিলাম, ততখানি আর কোনোদিন কোনো ক্ষেত্রে দেখিনি।

ডাগর ডাগর দুটি নলিন নেত্র, নীলও নয় কালোও নয় তা, পূর্ণিমার জ্যোৎস্না এসে পড়েছে অশ্রুভরা সেই চোখ দুটির উপর। তামা রংয়ের বিপুল কেশ কোমল তুষারশুভ্র কণ্ঠে বক্ষে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে এলোমেলো গোছায় গোছায়। কমলকোমল দুখানি করপল্লব ব্যাকুল হয়ে কাকুতি করছে–“মেরো না গো, মেরো না বাবাকে।” কোথায় কোন দোকানে বুঝি আগুন জ্বলছে একটা, তারই রক্তালোকের আভায় দীর্ঘ তনুবল্লীটি প্রতীয়মান হচ্ছে যেন অপার্থিব জ্যোতিমালায় মণ্ডিত বলে।

মেরাপি আর্তনাদ করছে। মাটিতে পড়ে আছে বৃদ্ধ, তাকে আগলে দাঁড়িয়ে সকাতরে দয়াভিক্ষা করছে খগপাণি সৈনিকের কাছে। নাঃ, দয়া নেই ঐ পাষাণ সৈনিকের প্রাণে। কে তাকে রক্ষা করবে তা হলে? এদিকে-ওদিকে ব্যাকুলভাবে চাইতে চাইতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল যুবরাজ শেঠির উপরে, অমনি, অমনি সে চেঁচিয়ে উঠল–“আপনি, আপনি, আপনাকে দেখেই আমার মনে হচ্ছে মহাপ্রাণ আপনি। বিনা দোষে আমার বাবা খুন হতে যাচ্ছে। এও কি আপনি নীরবে দাঁড়িয়ে দেখবেন?”

সৈনিকটা চ্যাঁচাচ্ছে–“ওকে টেনে নিয়ে যাও, নইলে এক কোপে বাপবেটী দুটোকেই খতম করে দেব আমি।”

মেরাপি ততক্ষণে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে বাপের দেহের উপরে, পাহারাওলারা তাকে টেনে নিয়ে সরিয়ে দিল সৈনিকের আদেশে।

এদিকে যুবরাজ হুঙ্কার করে উঠেছেন—“থাম্ কসাই!”

সৈনিকও পালটা হুঙ্কার ছাড়ল–“কুত্তা! এত গোস্তাকি তোর যে তুই ফারাওর কাপ্তেনকে তার কর্তব্য শেখাতে আসিস?”-এই বলে যুবরাজের গালে বাঁ হাত দিয়ে এক চড় কষিয়ে দিল দুবৃত্ত।

দিয়েই সে আর কালবিলম্ব করল না। হাতের তরোয়াল আমূল বসিয়ে দিল ভূলুণ্ঠিত বৃদ্ধের বুকে। একবারটি কেঁপে উঠল বুড়োর দেহটা, তারপর নিশ্চল হয়ে গেল একেবারে, এক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ। সব নিস্তব্ধ এক মুহূর্তের জন্য, তারপরই সেই নিস্তব্ধতাকে দীৰ্ণবিদীর্ণ করে আর্ত হাহাকার উঠল একটা, এক পিতৃহারা অনাথিনীর কণ্ঠ থেকে।

যুবরাজ শেঠি ওদিকে, সেই এক মুহূর্ত তারও কণ্ঠ ছিল রুদ্ধ হয়ে, অবশ্যই অদম্য ক্রোধে। যখন বাক্যস্ফুরিত হল আবার, একটি মাত্র শব্দ তিনি উচ্চারণ করলেন–“রক্ষী।”

সেই চারজন নিউবীয় সৈনিক, যুবরাজেরই আদেশে যারা বরাবর একটু দূরে দূরেই সরে রয়েছে, তারা এই আহ্বান শুনে চোখের পলকে ভিড় ঠেলে ছুটে এল, কিন্তু তারা এসে পৌঁছোবার আগেই আমি, এই নকলনবিশ অ্যানা, ঝাঁপিয়ে পড়েছি সেই নরহস্তা সৈনিকের উপরে, টিপে ধরেছি তার গলা। সে তার রক্তমাখা তরোয়াল দিয়ে আঘাত করতে গেল আমাকে, কিন্তু আমার গায়ে রয়েছে ডিলা আঙরাখা, তরোয়ালের কোপ তাতে বসবে কেন? বিশেষ করে অত নিকটের আঘাত? তবে বাঁয়ের ঊরুর খানিকটা ছড়ে গেল বটে, তা যাক, সেদিনে দেহে শক্তি ছিল আমার, ধস্তাধস্তি করে সৈনিকটাকে ফেলে দিলাম মাটিতে, অবশ্য আমাকেও পড়ে যেতে হল তার সঙ্গে।

এরপর শুরু হল ভীষণ গণ্ডগোল। হিব্রু ক্রীতদাসেরা দড়ি ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সৈনিকদের উপরে, যেমন করে শিকারী কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে শেয়ালের উপরে। স্রেফ ঘুষি আর কিল মেরে মেরেই কাহিল করে ফেলল সৈনিকগুলোকে, সৈনিকেরা তখন তরোয়াল চালাচ্ছে আত্মরক্ষার জন্য, পাহারাওলারা হাঁকাচ্ছে চাবুক। নারীরা চিৎকার করছে ভয় পেয়ে, পুরুষেরা করছে ভয় দেখাবার জন্য। এদিকে সৈনিকটা গড়াতে গড়াতেও কায়দা করে নিয়েছে তরোয়াল হাঁকাবার, তুলেছে সেটা আমার মাথা লক্ষ্য করে। সব শেষ হল–ভাবছি আমি।

শেষই হত, কিন্তু যুবরাজ নিজেই সৈনিকটাকে টেনে সরিয়ে নিলেন আমার দেহের উপর থেকে। নিউবীয় রক্ষীরা এসে ধরে ফেলল তাকে। ততক্ষণে যুবরাজ আত্মপ্রকাশ করেছেন উচ্চৈস্বরে–“সবাই নিরস্ত হও। আমি আদেশ করছি নিরস্ত হতে, যুবরাজ শেঠি মেনাপ্টা, ফারাওর পুত্র, ট্যানিসের প্রদেশপাল”–এই বলেই তিনি মুখে উপর থেকে মুখাবরণটা টেনে খুলে ফেললেন। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ ।

সব নিস্তব্ধ আবার। সবাই তাকিয়ে আছে সেই মহিমান্বিত মুখাবয়বের দিকে। যে চিনতে পারছে, সেই তৎক্ষণাৎ নতজানু হয়ে বসে পড়ছে মাটিতে। কেউ কেউ বা ভয়ে সম্ভ্রমে অভিভূত হয়ে বলে উঠছে অনুচ্চস্বরে–“সম্রাটনন্দন মিশর যুবরাজের মুখে আঘাত করেছে একটা তুচ্ছ সৈনিক। রক্ত দিতে হবে ওকে এর জন্য।”

“ও-লোকটার নাম কী?” জিজ্ঞাসা করলেন যুবরাজ।

“খুয়াকা”–উত্তর দিল কেউ একজন।

নিউবীয় রক্ষীরা তাকে ধরেই রেখেছে। যুবরাজ আদেশ দিলেন–“আমন মন্দিরের সিঁড়ির নীচে নিয়ে চল ওকে।” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–“হেঁটে যেতে পারবে তো? না যদি পার, আমার কাঁধে ভর দিয়ে চল।”

যুবরাজের কাঁধে ভর দিয়ে আমি, নকলনবিশ অ্যানা, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম প্রায় একশো পা। ক্ষতবিক্ষত দেহ আমার, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট বোধ করছি তখন।

সিঁড়ির মাথায় প্রশস্ত চাতাল, সেইখানে উঠে আমরা থেমে গেলাম। আমাদের পিছনে রক্ষীবেষ্টিত হত্যাকারী, তারও পিছনে সেই বিশাল জনতা, যাদের চোখের সমুখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই জঘন্য হত্যাকাণ্ড। সিঁড়ির সবগুলো ধাপ পরিপূর্ণ করে সেই জনতা উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে যুবরাজের পানে।

যুবরাজ বসেছেন এক গ্রানাইট পাথরের বেদীতে। অত্যন্ত ধীর, শান্ত, সংযত তার কণ্ঠস্বর। তিনি বলছেন–“মহান রামেসিসের প্রতিষ্ঠিত এই ট্যানিস নগরের প্রশাসক আমি, এই নগরসীমার মধ্যে সর্বসাধারণের জীবনমৃত্যুর মালিক আমি ছাড়া আর কেউ নয়। যে-কোনো স্থানে যে-কোনো সময়ে বিচারালয় স্থাপনের অধিকার আমার আছে। সেই অধিকার বলে এইখানে এই মুহূর্তে আমি বিচারে বসেছি। আদালতের কাজ আরম্ভ হোক।”

“আদালতের কাজ আরম্ভ হল”–সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল জনতা।

‘ঘটনাটা এই”–বলছেন যুবরাজ–“খুয়াকা নামক ঐ লোকটা, পরিচ্ছদ দেখে ওকে ফারাওয়ের সৈন্য বাহিনীর জনৈক কাপ্তেন বলেই ধারণা হয়, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে নরহত্যার। এক বৃদ্ধ হিব্রুকে ও হত্যা করেছে। তাছাড়া লেখক অ্যানাকে হত্যা করার চেষ্টাও করেছে ও, কে সাক্ষী আছ, এগিয়ে এস। নিহত ব্যক্তির শব এখানে স্থাপন কর আমার সম্মুখে। আর সেই যে স্ত্রীলোকটি, যে ঐ বৃদ্ধকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, তাকেও নিয়ে এস সাক্ষ্য দেবার জন্য।”

সব আদেশই পালিত হল যুবরাজের। মৃতদেহ এনে চাতালে রেখে দেওয়া হল, রুদ্যমানা তরুণীকে এনে হাজির করা হল যুবরাজের সমুখে।

শেঠি বললেন–“সৃষ্টিকর্তা কেফেরার এবং সত্য ও ন্যায়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাট-এর নামে শপথ নিয়ে বল যে সত্য ভিন্ন অসত্য বলবে না এই বিচারালয়ে।”

তরুণী মুখ তুলে চাইল, তারপর নিম্নস্বরে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় নিবেদন করল–“মিশর যুবরাজ, আমি ইজরায়েলের দুহিতা, ওসব দেবদেবীর নাম নিয়ে শপথ আমি করতে পারি না।”

যুবরাজ বিস্মিতভাবেই ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন তার দিকে–’ইজরায়েলের দুহিতা, কোন দেবতার নামে তা হলে তুমি পার শপথ নিতে?”

“জাহভের নামে, যুবরাজ! জাহভেকেই আমরা এক এবং অদ্বিতীয় ভগবান বলে মানি। বিশ্বজগতের স্রষ্টা তিনিই।”

একটু হেসে যুবরাজ বললেন–“তারই অন্য নাম ঐ কেফেরা। যাক সে কথা। তুমি তাহলে তোমার ভগবান জাহভের নামেই শপথ নিতে পার।”

তখন তরুণী দুই বাহু মাথার উপরে তুলে শপথ গ্রহণ করল–’ইজরায়েলী জনগণের লেভি উপজাতির বৃদ্ধ নাথানের মেয়ে আমি, মেরাপি, ইজরায়েলের ভগবান জাহভের নামে এই শপথ নিচ্ছি যে আমি সত্য কথাই বলব, এবং পরিপূর্ণ সত্যই বলব।”

“তাহলে মেরাপি, তুমি আমাদের বল যে এই নিহত ব্যাক্তির মৃত্যু সম্বন্ধে কী তুমি জান?”

“আমি যা জানি, তার খানিকটা তো আপনিও জানেন যুবরাজ। উনি ছিলেন আমার পিতা, ইজরায়েলের অন্যতম পঞ্চায়েত সদস্য। এবার যখন ফসল পাকবার সময় এল, ঐ কাপ্তেন খুয়াকা এল গোসেনে। তার উদ্দেশ্য, ফারাওয়ের বেগার দেবার জন্য তোক বাছাই করবে। এসেই সে আমাকে দেখল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব করল যে আমাকে সে বিয়ে করবে। বাবা তাতে রাজি হতে পারলেন, কারণ শৈশব থেকেই আমি আমাদেরই জাতির একজনের সঙ্গে বাগ্‌দত্তা হয়ে আছি। তা ছাড়া মিশরীতে ইজরায়েলীতে বিয়ে আমাদের ধর্মমতে অচলও বটে। খুয়াকা কিন্তু এই বাধার কথা শুনে ক্ষেপে গেল, এবং বাবাকে পাকড়াও করল ফারাওয়ের বেগারের জন্য।”

যুবরাজ রুষ্টস্বরে মন্তব্য করলেন–“ফারাওয়ের বেগারের জন্য বুড়ো মানুষকেও যে ধরা যায়, তা আমার জানা ছিল না। ওর তো একটা বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া আছে?”

“আছে শুনেছিলাম’ –বলল মেরাপি–“কিন্তু খুয়াকা তা কই মানল? আসলে সে রেগে গিয়েছিল বাবার উপরে, তার সঙ্গে আমার বিয়েতে আপত্তি করার দরুন। তাই সে নিয়ে গেল তাকে, যদিও তিনি ইজরায়েলের একজন পদস্থ লোক! বেগার যাদের খাটতে হয়, তাদের পর্যায়ের মোটেই নন তিনি।

“বলে যাও তারপর”–“আদেশ করলেন যুবরাজ।

“একদল যুবক, আর সেই দলে একমাত্র বৃদ্ধ নাথানকে নিয়ে খুয়াকা চলে গেল গোসেন থেকে কয়েকদিন বাদেই আমি স্বপ্ন দেখলাম যে বাবা খুব অসুখে পড়েছেন। মনটা এত অস্থির হয়ে উঠল যে আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না, বওনা হয়ে পড়লাম ট্যানিসের পথে। আজই সকালে তার সঙ্গে দেখা হল আমার, আর আজই রাত্রে-যুবরাজ! যুবরাজ! তার পরের কথা তো জানেনই আপনি!”

“আর কিছু বলার নেই তোমার?”-জিজ্ঞাসা করলেন শেঠি।

বলার শুধু এইটুকু আছে, যুবরাজ! সকালে যখন আজ বাবাকে দেখতে পেলাম, তখন তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। ইজরায়েলের তিনি একজন মানী লোক, খালে নেমে কাদামাটি কেটে তোলার মতো কাজ তিনি যৌবনেই কখনো করেননি। আজ তত তিনি বৃদ্ধ, প্রায় অথর্ব। হ্যাঁ, খুবই অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি, সেই সময়ে আমি গিয়ে কিছু খাবার দিলাম তাঁকে। তিনি খেতে শুরু করেছেন, এমন সময়ে খুয়াকা গিয়ে হাজির সেখানে। আমার সমুখেই সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল–“মেরাপির সঙ্গে আমার বিয়ে তুমি দেবে কি না?” বাবা বললেন–“দেবার উপায় নেই, আমাদের দেশাচার তা হতে দেবে না।” তাতে খুয়াকা তাকে শাসিয়ে গেল–“বেশ, এই যদি তোমার শেষ কথা হয়, আজ রাত তোমার কাটবে না, দেখে নিও।”

মেরাপির সাক্ষ্য শেষ হল। এইবার যুবরাজ খুয়াকাকে সম্বোধন করে বললেন –“তোমার কী বলবার আছে, বল এইবার।”

কাপ্তেনটা নতজানু হয়ে বসে পড়ল যুবরাজের সমুখে–“বলবার কথা শুধু এইটুকু যুবরাজ, আপনাকে যে আমি আঘাত করেছিলাম, তা একমাত্র অজ্ঞতাবশতই। ছদ্মবেশ ধারণ করে স্বয়ং আমাদের ভাবী ফারাও আমাদের কার্যকলাপের উপরে দৃষ্টি রাখছেন, এ তো আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল! লম্বা আঙরাখা আপনার গায়ে, মাথার টুপিতে মুখখানাও ঢাকা। কী করে চিনব? রাজপুত্রের অঙ্গে আঘাত করলে তার দরুন অবশ্যই আমার প্রাণদণ্ড হতে পারে, কিন্তু অজ্ঞতাবশত যে অপরাধ করে বসেছি, তার দরুন ক্ষমাও কি আমি প্রত্যাশা করতে পারি না? ও-অপরাধে যদি আমি ক্ষমালাভ করি, তা হলে অন্য যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে এসেছে, তার দরুন কোনো দণ্ড আমার হওয়া উচিত নয়। ইজরায়েলীদের তো অহরহই বধ করছে মিশরীরা, তার আবার দণ্ড কী? ওরা তত দাস মাত্র! ওদের জীবনের আবার দাম কী?”

‘ইজরায়েলী নাথানের প্রাণের দাম কিছুমাত্র কম নয়, তোমার প্রাণের দামের চেয়ে। প্রাণ যারই হোক, সে-প্রাণ কেউ কেড়ে নিতে পারে না, বিচারকের মুখ থেকে প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা না বেরুলে।”

“আমি আইন জানি না যুবরাজ! ইজরায়েলীরা অহরহই মারা পড়ছে আমাদের হাতে, এর প্রাণ নিয়ে যে কোনো ঝামেলা হতে পারে, তা আমি ভাবিনি।”

‘আইন জান না? দুঃখের বিষয়, তোমার আর অবকাশও হবে না জানবার। কিন্তু তোমার পরিণাম দেখে সারা মিশর আজ থেকে জানতে পারবে যে বিচারক ভিন্ন অন্য কারও অধিকার নেই কারও প্রাণ নেবার। না, তুচ্ছতম এক ইজরায়েলীর প্রাণও না।”

যুবরাজ আদেশ দিলেন–“রক্ষীগণ। ওর শিরচ্ছেদ কর।”

.

৩.

সেই রাতেই আরও একটি সুন্দরী নারীর দর্শনলাভ ছিল আমর ভাগ্যে।

অবশ্য ইজরায়েল-চন্দ্রমা মেরাপির সঙ্গে স্রেফ সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এঁর কোনো তুলনাই চলে না। কিন্তু বংশগরিমা রাজমহিমার কথা বিবেচনা করলে ইনি তো সারা পৃথিবীতে নারীসমাজের শিরোমণি।

ইনি হলেন রাজনন্দিনী উসার্টি। ফারাওয়ের মহামান্যা দুহিতা মিশরের যুবরানি, ভবিষ্যতে সিংহাসনের অর্ধেকের অধিকারিণী।

আমরা প্রাসাদে ফেরার পরেই যুবরাজের নিজস্ব বৈদ্য এসে আমার জানুর সামান্য ক্ষতটা পরীক্ষা করলেন, মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজও করে দিলেন একটা। দেহের অস্বস্তি যখন খানিকটা হালকা হয়ে এল এইভাবে, তখন যুবরাজে আনিয়ে দিলেন নতুন পরিচ্ছদ আমার জন্য, তারপর আমায়, এই দীনহীন লেখককে পাশে নিয়ে বসলেন খেতে।

আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মিশর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর টেবিলে এই সামান্য আহার্য? দুটি মাত্র পদ, একটা নিরামিষ, একটা আমিষ। কোনোটাতেই বিশেষ মশলাপাতির প্রাচুর্য নেই। তাই দিয়েই পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন শেষ করলেন যুবরাজ। বরাবর যে তিনি ঐ রকম সাদাসিধে খাদ্যেই অভ্যস্ত, তাতে আর সন্দেহ রইল না আমার। একটা কথা থেকে থেকেই মনে পড়ছিল আমার, রাজর্ষি ইনি। এই যুবরাজ শেঠি। রাজর্ষি। ভোগসুখে নিস্পৃহ। এই নবীন যৌবনেই।

খেতে খেতে একটি প্রস্তাব করলেন যুবরাজ। তিনি আমাকে নিজের কাছেই রেখে দিতে চান, তাঁর নিজস্ব লেখক ও একান্ত সচিব করে। তাছাড়া, প্রাসাদে যে গ্রন্থসংগ্রহটি রয়েছে তার, তার তত্ত্বাবধায়কও বটে। বিনিময়ে যে-বেতনের কথা উল্লেখ করলেন তিনি, তার পরিমাণ আমার যোগ্যতার বিচারে খুবই বেশি বলে মনে হল আমার। কিন্তু আদায় করতে পারবে বলে আশা করো না। বেতন নির্ধারণের মালিক আমি বটে, কিন্তু বেতন দেওয়ার মালিক উজির নেহেসি। সে যে কী বস্তু, তুমি কল্পনাই করতে পারবে না। রাজকোষের এক একটা মুদ্রা যেন তার দেহের এক এক বিন্দু রক্ত। যা হোক, থাকবে তো তুমি আমার সঙ্গেই, খেতে না পেয়ে মরে যাবে না, এটুকু আশ্বাস আমি দিতে পারি। বেতন যদি পাও, যতটা পাবে ততটাই উপরি পাওনা বলে ধরে নিও।”

খেতে খেতে এক এক চুমুক পানীয়ও অবশ্য খাচ্ছিলাম আমরা। যে যার নিজস্ব পেয়ালা থেকে। এইবার কিন্তু তাক থেকে একটি স্ফটিকের পেয়ালা নিয়ে এলেন যুবরাজ, নতুন ধরনে তৈরি এক অতি সুন্দর পেয়ালা। সেই পেয়ালাতে কানায় কানায় দ্রাক্ষারস ঢেলে তিনি নিজে প্রথমে তা থেকে খেলেন একটু, তারপর পেয়ালা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে “খেয়ে ফেল। তোমার আমায় আজ থেকে স্থাপিত হোক অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। দুই দেহে এক প্রাণ হবে আমাদের। সূর্য-ক্ষেত্রজ যমজ ভাই আমার আরও অনেক আছে মিশরে, কিন্তু আত্মার আত্মীয় হবে তুমি একাই।”

“কী পুণ্যবলে আমার এ মহৎ সম্মান?’–আবেগে অভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

“পুণ্যবলে নয়, হৃদয়বত্তার গুণে। দুবৃত্ত খুয়াকাকে আক্রমণ করে তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলে। অথচ, তার সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত কলহ কিছুই ছিল না। সেই যে দুটো অপরাধ খুয়াকার, নাথানের হত্যা এবং আমার গালে চপেটাঘাত, এদের সঙ্গে তুমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে, এ-প্রত্যাশা কেউ করেনি। তবু তুমি ফেলেছিলে জড়িয়ে। ঐখানেই প্রমাণ যে হৃদয় তোমার মহৎ।”

একটু থেমে তারপর একটু হাসলেন শেঠি –“তোমাকে চাকরি দিয়ে এই যে নিজের কাছে আমি রাখতে চাইছি, এটার পিছনে আমার কোনো উদারতা নেই বন্ধু, বরং আছে পরিপূর্ণ স্বার্থবুদ্ধি। দুনিয়ায় মোটামুটি সৎ লোকই খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে, সেখানে যদি হঠাৎ আমি একটা মহৎ লোকের দেখা পেয়ে যাই দৈবানুগ্রহে, তাকে নিজের লোক করে নেবার একটা চেষ্টা তো আমি নিশ্চয়ই করব। নিজের উপকারের জন্যই করব?”

কথায়বার্তায় স্ফটিক পেয়ালার পানীয়টা শেষ হয়ে এসেছিল। এইবার সেটাকে সমুখে রেখে যুবরাজ চিন্তিতভাবে বললেন–“এটিকে নিয়ে এখন কী করা যায়? আমাদের বন্ধুত্বের সঙ্গে এ জিনিসটার যখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেল একটা, তখন এটা দেখতে হবে যে ভবিষ্যতে এ গিয়ে যেন আজেবাজে লোকের হাতে না পড়ে।”

“ভবিষ্যতে কী হবে, তা আজই কেমন করে জানা যায় যুবরাজ?” বললাম আমি।

“তা তো যায়ই না। আর যায় না বলেই ভবিষ্যৎ বলে আমি কিছুই রাখব না এ-পেয়ালাটার।”–এই বলে, তাক থেকে একটা ছোট্ট পাথরের হাতুড়ি নিয়ে পেয়ালার ঠিক মাথায় তা দিয়ে সবলে আঘাত করলেন যুবরাজ।

আর আশ্চর্য! আঘাত পেয়ে পেয়ালাটা গুঁড়ো গুড়ো হয়ে গেল না, যদিও তাই যাওয়াই ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। গুঁড়ো হয়ে গেল না, হয়ে গেল দুই ভাগ। এ যে কেমন করে হল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা, যুবরাজ বা আমি। আস্ত থাকতে আর গঠন-কৌশলের ভিতরে কোনো বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করিনি আমরা। অথচ বৈশিষ্ট্য তো ছিলই! অসাধারণ বৈশিষ্ট্যই ছিল কিছু।

উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পেয়ালাটার মাঝামাঝি যেন করাত দিয়ে চিরে দুই ভাগ করে ফেলেছে কেউ। দুটো নিখুঁত অর্ধেক, কোনো দিকে এক চুল পরিমাণ চিড়ও খায়নি। যুবরাজ অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন দুটো অর্ধাংশ, তারপর বললেন–“ভালই হল। একটা অর্ধেক তুমি নাও, আর একটা আমি নিই। আমরণ যত্ন করে রাখব আমরা, নিজের নিজের অংশ।”

একটা সুদৃশ্য পেটিকা ছিল গৃহকোণে, যুবরাজ গিয়ে নিজের অংশটি তারই ভিতর রেখে এলেন। আমার অংশ আমি আপাতত জামার ভিতরেই রাখলাম, পরে তুলে রাখব কোনো নিরাপদ স্থানে।

যুবরাজ ফিরে এসে টেবিলে বসবার সময় পাননি তখনো, আমিও জামার বোম সবগুলো তখনো এঁটে উঠতে পারিনি, এমন সময় দাড়িওয়ালা পাম্বাসা প্রায় ছুটতে ছুটতে কক্ষে এসে উঠল–“মহিমান্বিত ফারাওনন্দন! মহিমান্বিতা ফারাওনন্দিনী আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন। এই এসে পড়লেন বলে।”

এই বলেই সে আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল, বোধ হয় ফারাওনন্দিনীকে অভ্যর্থনা করে আনবার জন্যই। যুবরাজ আর এসে আসন গ্রহণ করলেন না। কক্ষের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন দরোজার দিকে মুখ করে। আমি যে টেবিলে বসে খুবই বিপন্ন বোধ করতে থাকব এই পরিস্থিতির মাঝখানে পড়ে, তা কি আর তিনি বুঝতে পারেননি? আমার দিকে না তাকিয়েও, পিছন পানে হাত নেড়ে তিনি আশ্বস্ত হতে বললেন আমায়, আশ্বাস আমি পেলাম বই কি! ঘর ছেড়ে পালাবার একটা কল্পনা মাথায় এসেছিল, সেটাকে মগজ থেকে বার করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এবং এমন ভাবে দাঁড়ালাম যাতে আমার নাতিক্ষুদ্র কলেবরখানা যুবরাজের আড়ালেই থাকে যথাসম্ভব।

এলেন উসার্টি, মহিমান্বিতা যুবরানি মিশরভূমির। রুদ্ধ কক্ষে যেন একটা বাতায়ন খুলে গেল হঠাৎ, আর সেই বাতায়ন পথে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল এসে মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর প্রপাত। মহিমময়ী মূর্তি। যে কোনোদিন দেখেনি, পরিচয় পায়নি, সেও প্রথম দৃষ্টিতেই উপলব্ধি করবে যে সমুখে যার আবির্ভাব ঘটল, বহুযুগের রাজমহিমার উত্তরাধিকারিণী তিনি, মহাবাহু মহান রামেসিসের রক্ত খরবেগে বইছে তার ধমনীতে।

“ভাল আছ তো?” সম্ভাষণ ঊটির।

“ভাল আছ তো?” সম্ভাষণ জানালেন শেঠি।

“ও-লোকটা কে?”প্রাকুটি ফুটে উঠল রাজনন্দিনীর ললাটে। চেষ্টা করেও নিজেকে আমি লুকোতে পারিনি যুবরাজের আড়ালে।

“আমার এক নবলব্ধ বন্ধু। বিখ্যাত গল্পলেখক। মেক্ষিসের অ্যানা। সুখবর শোনো, উনি এখন থেকে আমায় সঙ্গদান করতে রাজি হয়েছেন। থাকবেন এখানেই।”

“খাবেনও তোমার টেবিলেই?”–এইমাত্র যে একসাথে বসে খেয়েছি, টেবিলের দিকে তাকিয়েই রাজনন্দিনী তা ধরে ফেলেছেন। বিরক্ত হয়েছেন অতিমাত্রায়। কথা যখন কইলেন, সে বিরক্তি যেন সূঁচ দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে আমার মগজে ঢুকিয়ে দিলেন–“শেঠি! শেঠি! নিজের পদমর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা কবে আর জন্মাবে তোমার? একটা অভিজাতবংশীয় লোক হলেও বা আমরা তাকে সহ্য করে নিতে পারতাম তোমার সহচর হিসাবে। কিন্তু এ কী বল তো? লেখক? যারা মাটিতে বসে হাঁটুর উপরে প্যাপিরাস নিয়ে খাগড়ার কলম দিয়ে সাঁই সাঁই লিখে যায় অন্য লোকের মুখের কথা? অ্যামন-রা বা মাট বা টা, যে-দেবতার কথা বলবে, তারই শপথ নিয়ে আমি বলতে পারি।”

‘কিছু বলতে হবে না ভগ্নি, কিছু বলতে হবে না”–উসার্টিকে থামিয়ে দিলেন–“আমরা সবাই জানি যে রাজমর্যাদার বোঝা বইবার মতো শক্ত পিঠ তোমার যেমন আছে, তেমন আর ফারাও বংশধরের অন্য কারও নেই। কিন্তু কথাটা কী? বিনা কারণে তুমি যে রাত দুপুরে এই অপদার্থ ভাইটার ডেরায় পদার্পণ করনি, এটা অনুমান করে নিয়েই আমি সবিনয়ে জানতে চাইছি কথাটা কি?”

 “কথাটা একটু গুরুতরই”-রাজনন্দিনীর কণ্ঠস্বর দস্তুরমতো কটু–“তুমি নাকি আজই সন্ধ্যায় অকারণে এক সৈনিকের শিরচ্ছেদের আদেশ দিয়েছিলে?”

শেঠি হঠাৎ কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ফিরে তাকালেন আমার দিকে, পাশের দিকে এভাবে সরে গেলেন যে উসার্টির আর আমার মধ্যে অন্তরাল . আর কিছুমাত্র রইল না। আগে উসার্টি, শেঠি আর আমি ছিলাম একই সরলরেখায়, এখন তিনজনে দাঁড়ালাম ত্রিভুজের তিনটি কোণবিন্দুতে।

হ্যাঁ, উসার্টিকে আর আমাকে চোখাচোখি দৃষ্টি বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়ে যুবরাজ হাসতে হাসতে বললেন–“বন্ধু অ্যানা, একটা কথা আছে না যে মানুষ যত বাঁচবে, তত শিখবে। আজ একটা নতুন শিক্ষা পেলাম। এতকাল আমার জানা ছিল যে ফারাওয়ের দোরগোড়ায় ঘটছে যে-সব ঘটনা, তাও ফারাওয়ের কানে পৌঁছোতে লাগে ছয় মাস অন্তত। আজ কিন্তু দেখছি, অর্ধপ্রহর পেরুতে পেরুতে পুত্রের কুকীর্তির কথা জেনে ফেলেছেন সম্রাট। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে?”

“মোটেই এটা আশ্চর্য নয়, কারণ সম্রাটের কানের গোড়ায় সারাক্ষণই মোতায়েন রয়েছেন তোমার আমার জ্যাঠতুতো ভাই, রাজপুত্র আমেনমেসিস। তার চর আছে সারা মিশরে। এমন ঘটনা মিশরে ঘটে না, যার খবর সঙ্গে সঙ্গে তিনি পান না। সব খবরই পান, আর তোমার কুকীর্তিঘটিত কোনো খবর হলে তখনই তা পেশ করেন ফারাওয়ের সমুখে! ফারাওয়ের স্নেহ থেকে তোমায় বঞ্চিত করবার জন্য আমেনমেসিস যে নিজের ডান হাতখানা কেটে ফেলতে পারে, এটা তুমি সর্বদা মনে রেখো।”

শেঠির যেমন স্বভাব, একটা কিছু হালকা জবাবই দিতে যাচ্ছিলেন উসার্টিকে, কিন্তু উসার্টিই থামিয়ে দিলেন তাকে–“এ-সব কথা তৃতীয় ব্যক্তির সমুখে আলোচনা করা ঠিক নয়। তোমার যদি হ্রস্বদীর্ঘ জ্ঞান থাকত, তোমার ঐ লেখক বন্ধুকে অন্যত্র পাঠাতে, আমি ঘরে ঢুকবার আগেই। কিন্তু তা নেই যখন, আমি একটা মাত্র কথা, যে-কথা শুরু করেছিলাম, সেইটি বলেই এখনকার মতো প্রস্থান করব। অর্থাৎ, বাজার চত্বরে কাপ্তেন খুয়াকার শিরচ্ছেদের ব্যাপারটা নিয়ে ফারাওয়ের দরবারে যা একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তারই কথা।”

“চাঞ্চল্য!’–হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন শেঠি–“চাঞ্চল্য কেন হবে? ট্যানিসের প্রশাসক হিসাবে ট্যানিসৰাসীদের জীবনমরণের মালিক আমি। আমি বিচার করে যা করব, তা নিয়ে আলোচনার অধিকার কারও নাই।”

“ফারাওয়ের আছে”–দৃঢ়স্বরে বললেন উসার্টি–“আর ফারাওই ব্যাপারটা শুনতে চান তোমার মুখ থেকে। দরবারে আমিও ছিলাম সন্ধ্যাবেলায়। উঠে আসবার সময় ফারাও আমায় আদেশ করলেন তোমাকে দুটি কথা জানার জন্য। একটা হল এই যে, কাল সকালে তুমি দরবারে হাজির হবে এবং খুয়াকাঘটিত সব বৃত্তান্ত জানাবে তাকে। তাঁর দ্বিতীয় কথাটা আমি আর তুলছি না এখন। সেটা তৃতীয় ব্যক্তির সামনে তোল চলে না বলেই তুলছি না। সেটার সম্বন্ধে যা বলবার ফারাও নিজেই বলবেন তোমায়।”

অতঃপর উসার্টি বিদায় নিলেন, বিরক্তি আর ক্রোধ তিলমাত্র গোপন না করে। আর তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেঠি অত্যন্ত তিক্ত হাসি হাসলেন একটু। হেসে আমার পানে চেয়ে বললেন–“উসার্টি না তুলুক, দ্বিতীয় কথাটা যে কী, তা আমি আঁচেই বুঝে নিয়েছি। তুমি শুনতে চাও অ্যানা? শুনলে আমার বা উসার্টির ক্ষতি কিছু নেই। কারণ, শুধু তুমি কেন, মিশরবাসী একটা প্রাণীরও কাল বাকি থাকবে না সে-কথা শুনতে।”

‘যুবরাজ যদি সঙ্গত মনে করেন, বলুন। বললে যে আমি সম্মানিত মনে করব নিজেকে, তাও কি আর যুবরাজকে বলে দিতে হবে?”

“তবে শোন। কথাটা আমার আর উসার্টির বিবাহসংক্রান্ত। ফারাও বংশে ভাইবোনে বিয়ে হয়, তা অবশ্য শুনেছ তুমি?”

“শুনেছি যুবরাজ। এমন একটা ক্ষতিকর প্রথা কেন যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজকুলে এখনও চালু রয়েছে, অনেক চিন্তা করেও তা আমি বুঝতে পারিনি।”

“রাজরক্তের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য হে! যাতে সাধারণ রক্তের কোনো রকম ভেজাল এসে সে-রক্তে মিশতে না পারে।

“ভেজাল রক্তই হল জোরালো রক্ত, একথা শুনেছি যেন কোথায়—”

‘শুনেছ ঠিকই। কিন্তু রক্তের ব্যাপারে আমরা শুধু পবিত্রতাকেই মূল্য দিয়ে থাকি, জোর-টোর দরকার নেই আমাদের। আমরা তো দেবতা হে, দৈবীশক্তি দিয়েই পৃথিবী শাসন করছি এবং করব। গায়ের জোর, রক্তের জোর–এসবের কাঙাল হয় তারাই, যারা দেবতা নয়।”

এ কথার উত্তরে আমার বলবার অনেক কিছুই ছিল হয়তো, কিন্তু বললে সেটা ধৃষ্টতা হয়ে পড়বে কিনা, বুঝতে পারলাম না। যুবরাজ যে মহৎ, তার অনেক পরিচয়ই আমি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। কিন্তু এ-কথাও আমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের বয়স কয়েক ঘণ্টা মাত্র, আভিজাত্য সম্পর্কে ওঁর মনে কোনো গর্ব আছে কিনা, এত সামান্য পরিচয়ে সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে না। অতএব আমি চুপ করে গেলাম।

যুবরাজ কিন্তু চুপ করে নেই। ঠিক আমাকেই শোনাবার জন্য কিনা, তা বলতে পারি না, তবে নিম্নস্বরে বলে যাচ্ছেন কত কী। হয়তো নিজের মনকেই বোঝাচ্ছেন যে অনিবার্য যা, তা নিয়ে খেদ করা বুদ্ধির কাজ নয়। “দেশাচার, কৌলিক প্রথা, এ-সবের সঙ্গে লড়তে যাওয়া খুবই ঝুঁকির কাজ। ওঁ-বোঝা নিতে হবে কাঁধে তুলে, সেজন্য মন অনেকটা তৈরি হয়েই আছে আমার। একটা চিন্তাই এখন আমার মনে, ভয়ই বলতে পারি তাকে–যা, একটাই এখন ভয় আমার, বিয়ের পরে বনিবনাও হবে না বোধ হয় ওর সাথে। নমুনা তো এখনই দেখতে পাচ্ছি কিনা! সৈনিক খুয়াকার মৃত্যুটাকেই ও বড় করে দেখছে, বৃদ্ধ ইজরায়েলী নাথানের হত্যাকাণ্ডটাকে ও বাতিল করে দিতে চায় মামুলি দুর্ঘটনা বলে।”

হঠাৎ যুবরাজকে আমার দিকে চাইতে দেখে আমি অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে নিবেদন করলাম–“বিয়ের পরে অনেক স্ত্রী স্বামীর ছাঁচে নিজেকে নতুন করে গড়েও নেয় তো!”

“ওঃ, উসার্টি? কক্ষনো তা নেবে না। ভয়ানক জেদী, সাংঘাতিক গোঁয়ার। তার উপরে ও আবার বয়সেও দুই বছরের বড় আমার চেয়ে। তুমি হয়তো জান না। উসার্টি সহোদরা নয় আমার, বৈমাত্রেয় বোন। ওর জন্মের পরেই মারা যান ওর মা। তিনিও ছিলেন এই রাজবংশেরই দুহিতা। সেদিক দিয়ে ওরই আভিজাত্য আমার চেয়ে বেশি বলে ও মনে করে। কারণ আমার মাও রাজকন্যা ছিলেন যদিও, সে-রাজবংশ হল সিরিয়ার, মিশরের নয়।”

আমি আর বলবার মতো কিছু খুঁজে পাই না। অবশ্য আমি কিছু বলব বলে প্রত্যাশাও যুবরাজ করছেন না। কারণ এ একটা এমন সমস্যা, যার ভিতরে মতামত প্রকাশ করতে যাওয়া বাইরের লোকের পক্ষে অনুচিত ও অশোভন। যে মহিলা আজ বাদে কাল মিশরের রানি হবেন, তাঁকে রাখা দরকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে।

হঠাৎ যুবরাজ যেন স্বপ্নলোক থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এলেন, তটস্থ হয়ে বলে উঠলেন–“আরে, রাত যে দুপুর পেরিয়ে যায়। যাও, যাও, শুয়ে পড়। দেহের উপর দিয়ে ধকল তো কম যায়নি তোমার! কাল আবার ভোরবেলাতেই উঠতে চাও। দরবারে তো তোমাকেও যেতে হবে। ফারাও কী বলছেন, আমি বা কী বলছি, উসার্টি আমেনমেসিসরাও কিছু কিছু বলবেন সবাই, তার উপর রয়েছে বুড়ো শেয়াল ঐ উজির নেহেসি, যে যা বলবে, লিখে নেবে সঙ্গে সঙ্গে। দরবারের নিজস্ব লেখক তো আছেই। তবু ভাবী ফারাও হিসাবে আমারও অধিকার আছে নিজের লেখক দিয়ে সব কথা লিপিবদ্ধ করে নেওয়ার।”

হঠাৎ আমার পানে তাকিয়ে বললেন–“তুমি পারবে তো? খুব তাড়াতাড়ি লিখতে হয় কিন্তু। যাদের অভ্যেস নেই, তাদের পক্ষে কঠিন কাজ। আগেও লেখক ছিল আমার, সে ঠিকমতো কাজ চালাতে পারত না বলে সম্প্রতি পালিয়েছে কাজ ছেড়ে।” বলে হা-হা করে হেসে উঠলেন।

আমি মৃদু হেসে বললাম–“আমি পালাব না যুবরাজ! আপনাদের বরং কথা ) বলতে দেরি হবে, কিন্তু লিখতে আমার দেরি হবে না। আমার নিজের আবিষ্কৃত একটা সাংকেতিক লিখন পদ্ধতি আছে। আমি লিখি না, স্রেফ সাংকেতিক চিহ্ন বসিয়ে যাই প্যাপিরাসে। পরে অবসর সময়ে সেই সব চিহ্নের পাঠোদ্ধার করি। কোনোদিন কেউ ভুল ধরতে পারেনি।”

‘আরে বল কী?”–সোৎসাহে বলে উঠলেন যুবরাজ–“তুমি তো একটি রত্ন দেখছি! কমে তরোয়ালে সমান দক্ষ।

আমি হেসে বললাম–“আমার তরোয়ালের হাত তো দেখেননি যুবরাজ! দেখেছেন একটুখানি কুস্তিবাজি।”

“তা বটে। কিন্তু দুটোই এক গোত্র তো!”

আমি আর তখন প্রকাশ করলাম না যে কয়েক বৎসর আগে আমি যুদ্ধেও গিয়েছিলাম।

এইবার জোরে জোরে একবার হাততালি দিলেন যুবরাজ, আর তক্ষুনি সুদীর্ঘ শ্বেতশ্মশ্রুর পতাকা উড়িয়ে দোরগোড়ায় দেখা দিল সেই ঘুষখোর পাম্বাসা। যুবরাজ বললেন–“এঁকে সঙ্গে নিয়ে শোবার ঘর দেখিয়ে দাও। আমার পাশের ঘরটাই ইনি ব্যবহার করবেন। কোনো অসুবিধা যেন না হয় এঁর।”

আমি যুবরাজকে অভিবাদন করে বিদায় নিলাম রাত্রির মতো। আলো হাতে নিয়ে পাম্বাসা চলেছে আগে আগে, কিন্তু থেমেও যাচ্ছে মুহুর্মুহু, দাঁড়িয়ে পড়ছে আমার সমুখে, তোয়াজ করছে আমাকে নানানভাবে। “আপনি লেখক? হতেই পারে না তা, আপনি জাদুকর! খারের কাইয়ের চাইতেও বড় জাদুকর। নইলে এলেন, আর খোদ যুবরাজকে বশ করে ফেললেন তিন তুড়িতে? এ, ঐ কথাটা যদি আগে বলতেন, তাহলে কি আর আপনাকে এত ঘোরাঘুরি করতে হয় একবারটি যুবরাজের দেখা পাওয়ার জন্য? যা হোক, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে দেখতে পাবেন, বুড়ো পাম্বাসা আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য।”

ঘরের বিলিব্যবস্থা ঠিকমতো করে দিয়ে পাম্বাসা যখন বিদায় নেয়, তখনও তার কাকুতি-মিনতির বিরাম নেই–“দেখবেন জাদুর ওস্তাদ। রাতের বেলা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন না যেন, তা যদি যান, যুবরাজ ভাববেন–আমি গুম করেছি আপনাকে, আর হুকুম জারি করবেন আমার গুদানা নেবার।”

পরদিন বেলা এক প্রহরের মধ্যেই আমরা গিয়ে হাজির হলাম ফারাওর দরবারে, আমরা মানে যুবরাজ শেঠির পারিষদবর্গ সবাই। সভাগৃহটার আয়তন অতিবিশাল, মাঝে মাঝে কারুকর্মে খচিত কতকগুলি সুগোল স্তম্ভ। তাদেরই মাথায় বটে ছাদটা, কিন্তু কত ঊর্ধ্বে যে সে-ছাদ, নীচে থেকে সঠিক আন্দাজ করা যায় না। স্তম্ভগুলির ফাঁকে ফাঁকে স্বৰ্গত ফারাওদের অতিকায় সব মূর্তি-সমুচ্চ বেদীর উপরে দণ্ডায়মান।

রাজসিংহাসনের স্থান হল এই বিশাল দরবার গৃহের এক প্রান্তে। ঠিক সেই প্রান্তটিতেই যা হোক কিছু আলো আকাশ থেকে নেমে আসছে অদৃশ্য সব রন্ধ্রপথ দিয়ে। অন্য সব দিকেই ঘরটা প্রায় অন্ধকার। অন্ততপক্ষে আমার কাছে তোত

অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছিল, কারণ এইমাত্র বাইরের খর রৌদ্র থেকে আমি আসছি, আর একরম আবছা আলোতে চলাফেরার অভ্যাসও আমার নেই।

আমরা অপেক্ষা করছি দুটো স্তম্ভের মাঝখানে। যুবরাজ ইচ্ছা করলে অবশ্য সিংহাসনের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে বসতে পারতেন, বস্তুত যুবরাজের জন্য নির্দিষ্ট একটা স্বর্ণাসন বরাবরই থাকে ওখানে। কিন্তু যুবরাজের পছন্দ তাঁর পারিষদবর্গের মধ্যেই থাকা। সিংহাসনের কাছে যাওয়া? সে তখন যাবেন ফারাও এলে।

একটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শেঠি, আমরা নীরবে অপেক্ষা করছি তার পিছনে। হঠাৎ এক বপুম্মান পুরুষ আমাদের সমুখ দিয়ে সিংহাসনের দিকে চলে গেলেন। ভাবটা দেখালেন যেন যুবরাজকে দেখেননি তিনি। কিন্তু সেটা যে তাঁর ভানমাত্র, তা আমরা সকলেই বুঝলাম।

যুবরাজ আমাকে বললেন–“ঐ হল আমেনমেসিস, আমার জ্যাঠতুতো ভাই, তুমি তো নিশ্চয়ই এই প্রথম দেখলে ওকে? বল দেখি, ওর সম্বন্ধে কী রকম ধারণা ভোমার হল?”

আমি যুবরাজের কানে কানে বললাম “উনি আপনাকে পছন্দ করেন না। ওঁর মুখখানাও কালো, মনটাও কালো। আপনার অনিষ্ট করতে পারলে উনি ছাড়বেন না।”

শেঠি মাথা নাড়লেন, অর্থাৎ সায় দিলেন আমার কথায়। তারপর রহস্যের সুরে বললেন–“এটা তুমি বলেছ ঠিক। অমনি আর একটা কথাও ঠিক ঠিক বলতে পার কিনা, দেখ না চেষ্টা করে। আমার অনিষ্ট চেষ্টায় ও সাফল্যলাভ করবে কি? অর্থাৎ আমাকে হটিয়ে ও পারবে কি সিংহাসনে বসতে?”

“একথা আমি কী করে বলব যুবরাজ?”–প্রায় আঁতকে উঠেই আমি নিবেদন করলাম–“আমি তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই?”

“বাজে কথা। কাই তো বলে অন্যরকম’–হঠাৎ বলে উঠল তৃতীয় একটা কণ্ঠস্বর। চমকে উঠলাম আমি। এমন কি যুবরাজ পর্যন্ত চমকে উঠলেন–“একী? তুমি এখনও মরনি বোকেনঘোন? থিবিসে যখন সেবার বিদায় নিলাম তোমার কাছ থেকে, তখনই তো ভেবেছিলাম তুমি এক পা নামিয়েই রয়েছ কবরের ভিতর।”

তাকিয়ে দেখি, এক সুপ্রাচীন বৃদ্ধ। ফোকল্লা মুখে একগাল হেসে সে বলছে।–“কবরে এক পা? কোন দুঃখে? মোটে তো এই একশো সাত বছর বয়স আমার। জন্মেছি তোমার ঠাকুর্দারও যিনি ঠাকুর্দা, সেই প্রথম রামেসিসের আমলে। দ্বিতীয় রামেসিস, অর্থাৎ মহান রামেসিস, অর্থাৎ তোমার ঠাকুর্দার সঙ্গে খেলা করেছি ছেলেবেলায়। এখন আশায় আছি, কবরে পা দেবার আগে তোমার নাতিরও মুখ দেখে যাব। কিন্তু এ-ছেলেটি বাজে ওজর দেখাচ্ছে। ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা ওর আছে। স্বয়ং কাই বলেছে এ-কথা । আমন দেবতার ওস্তাদ জাদুকর।”

“কে কাই? তিনি আমার সম্পর্কে কী জানেন?”–বিরক্তভাবেই উত্তর দিলাম আমি।

“সকলের সম্পর্কে সকল কথাই জানেন কাই, যেমন জানেন তোমার আর যুবরাজের মধ্যে একটা স্ফটিক পেয়ালা ভাগাভাগির কথা।”

চমকে উঠলাম আমি, চমকে উঠলেন যুবরাজও। আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হল কাল রাত্রে কি যুবরাজের খাওয়ার ঘরে এদের কোনো চর আত্মগোপন করেছিল?

বোকেনঘোন্‌সু তখন এসে হাত ধরেছেন আমার, মমির হাতের মতো শীর্ণ শুনো একখানা হাত বাড়িয়ে। আর সেই হাতেরই স্পর্শে একটা যেন বিদ্যুত্তরঙ্গ প্রবাহিত হতে শুরু করেছে আমার ধমনীতে ধমনীতে।

বোকেনঘোন্‌সু তখন বলছেন–একটা নতুন অনুজ্ঞার সুর তার কথায় এখন। বলছেন–“তাকিয়ে দেখ সিংহাসনের দিকে। তাহলেই তুমি নিজের চোখে দেখতে পাবে–পর্যায়ের পরে পর্যায়ে ও-সিংহাসনের ভবিষ্যৎ।”

আমি তাকিয়ে দেখলাম। প্রথমেই দেখলাম নিবিড় কুয়াশা সেখানে। তারপর ধীরে ধীরে অপসৃত হতে লাগল সে-কুয়াশা। অবশেষে সিংহাসন স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হল আমার। কী আশ্চর্য! সে-সিংহাসনে যাঁকে উপবিষ্ট দেখলাম, তিনি যুবরাজ শেঠি নন। ঠাউরে দেখি, ক্ষণপূর্বে যাঁকে চলে যেতে দেখলাম সমুখ দিয়ে, সেই উদ্ধত আমেনমেসিসই বসেছেন সিংহাসনে।

কিন্তু কতক্ষণের জন্য? হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এল দলে দলে কালো কালো মানুষ, লম্বা তাদের দাড়ি, বঁড়শির মতো বাঁকানো তাদের নাক, তারা এসে আমেনমেসিসকে টেনে নামাল সিংহাসন থেকে, সে অভাগা কি জলের ভিতর পড়ল নাকি উলটে? ভারী জিনিস পড়লে জল যেমন ছকে ওঠে উঁচু হয়ে, ঠিক তেমনিই যেন উঠতে দেখলাম, আমেনমেসিসের পড়ার সময়।

আমেনমেসিস নেই, সিংহাসন কিন্তু খালিও নেই। সেখানে এবারে দেখছি আমার প্রভু ও বন্ধু যুবরাজ শেঠির শান্ত সৌম্য প্রসন্ন মূর্তিখানি–তার বামে সেই কাল রাত্রে যে-গর্বিতা রাজনন্দিনীকে দেখেছিলাম সেই উসার্টিই বসে আছেন পরিপূর্ণ রাজমহিমায়।

তারপর?

উসার্টি বসে আছেন তখনও সিংহাসনের অর্ধাংশ জুড়ে, কিন্তু বাকি আধখানায় শেঠি তো আর নেই! কখন তার মূর্তি সেখান থেকে অন্তর্ধান করেছে, টেরও পাইনি, কারণ আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল উসার্টির দিকে। শেঠি এখন নেই, তার জায়গায়, উসার্টির পাশটিতে এসে বসেছেন অন্য এক যুবক, তাকে আমি চিনি না, তবে লক্ষ্য করলাম তার একখানা পা খোঁড়া।

আরও কী দেখব কে জানে? অসীম আগ্রহ নিয়ে আমি তাকিয়েই আছি সিংহাসনের দিকে, এমন সময়ে হঠাৎ আমার স্বপ্নঘোর এক রূঢ় আঘাতে ভেঙে গেল। সে-আঘাত দূরত এক জয়ধ্বনির। বহু লোক একসাথে গর্জন করে উঠেছে–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও। ফারাও! ফারাও!”

বুঝলাম–ফারাও এসে পড়েছেন। ভবিষ্যতের ছায়া ফারাওদের এবার ছেড়ে দিতে হবে সিংহাসন, সেখানে আসন গ্রহণ করবেন বর্তমানের ফারাও মেনাপ্টা।

পরপর তিনবার একই নির্ঘোষ–“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও। ফারাও!” তৃতীয় জয়ধ্বনির রেশ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দরবারে প্রবেশ করলেন মহামহিম মিশর সম্রাট।

.

৪.

জীবন! রক্ত! শক্তি! প্রতিধ্বনি উঠল প্রতি সভাসদের কণ্ঠ থেকে।

প্রতি সভাসদ নতজানু হয়ে বসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে, প্রণিপাত করল মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রতি সভাসদ। এমন কি, যুবরাজও। এমন কি, অতি বৃদ্ধ বোকেনঘোন্‌সুও। দেবতা প্রণামের মতোই ভক্তিপূর্ণ সে প্রণাম। আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই তাতে। ফারাও মেনাটাকে সেই মুহূর্তে দেবতার মতোই মহীয়ান মনে হচ্ছিল। সিংহাসনের আশেপাশে যেখানে উপর থেকে এসে পড়েছে ঝলকের পরে ঝলক প্রখর সূর্যালোক, সেইখান দিয়ে আলোকপাতে স্নান করতে করতে যখন তিনি এগিয়ে আসছিলেন, মাথায় ঊর্ধ্ব মিশর আর নিম্ন মিশরের যুগ্ম রাজমুকুট, পরিধানে স্বর্ণখচিত রাজ পরিচ্ছদ আর হীরামাণিক্যের চোখ-ধাঁধানো অলঙ্কার, তখন কোনো দেবদেবীর চাইতে দৈবী মহিমায় এতটুকু নতুন বলে কেউ তাকে মনে করতে পারেনি। বুড়ো মানুষ, বার্ধক্যের আর দুশ্চিন্তার ছাপ সারা মুখে সুস্পষ্ট, কিন্তু তাঁর প্রতি অঙ্গ থেকে নিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে কী সর্বময়ী রাজমর্যাদা!

ফারাওয়ের দুই-এক পা পিছনে পিছনে আসছেন উজির নেহেসি, এক শুকনো, কোকড়ানো রাজপুরুষ, মুখখানা তার ঠিক যেন ভেড়ার চামড়ার কাগজ একখণ্ড। প্রধান পুরোহিত রয় আনছেন নেহেসির কাঁধে কাধ মিলিয়ে, আর রাজকীয় ভোজ টেবিলের তত্ত্বাবধায়ক হেরা। তারপর আরও অগুন্তি হোমরা-চোমরা মনিষ্যি, বোকেনঘোনসু সকলেরই নাম আর পদবী বলেছিলেন আমাকে, আমি আর অত শত মনে রাখিনি। সকলের পরে রক্ষীসেনা, কিছু মিশরী, কিছু বা কেশ-প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ।

এই বিরাট দঙ্গলের ভিতর নারী মাত্র একজন, তিনি উসার্টি। ফারাওর ঠিক পিছনেই তিনি আছেন, উজিরেরও আগে আগে। ফারাও সিংহাসনের নিকটস্থ হলেন যখন, উজির নেহেসি আর প্রধান পুরোহিত রয় দুজনে দুই দিক থেকে এগিয়ে এলেন তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে। কিন্তু ফারাও হাত নেড়ে হটিয়ে দিলেন তাদের, কাছে ডাকলেন কন্যা উসার্টিকে, আর তারই কাঁধে হাত রেখে উঠে বসলেন নিজের স্থানে। অনেকেরই মনে হল যে ফারাও ইঙ্গিতে তাঁদের বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে এই রাজনন্দিনীকে অবলম্বন করেই টিকে থাকবে মিশরের রাজশক্তি। রাজার আসন গ্রহণের পরে উসার্টিও বসলেন, সিংহাসনের পাদপীঠের প্রথম ধাপে।

আবার সেই বহুকণ্ঠের জয়ধ্বনি–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও!”

তারপর সব নীরব। ফারাও মৃদুস্বরে বলছেন উসার্টিকে–“আমেনমেসিসকে আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজবংশের আর আর সবাইও আছে। কিন্তু কই? — মিশরের যুবরাজ কোথায়? পুত্র শেঠিকে তো দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।”

“নিশ্চয়ই ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছেন আমাদের। আমার ভাই রাজকীয় আড়ম্বর থেকে দূরে থাকতেই ভালবাসেন।”

মৃদুস্বরেরই কথাবার্তা, তবু নীরবতা অতি গভীর বলে শেঠি সবই শুনতে পেয়েছেন। এখন আর লুকিয়ে থাকার উপায় নেই, একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি এগিয়ে গেলেন সিংহাসনের দিকে। তার ঠিক পিছনে বোকেনঘোন্‌সু ও আমি। অন্য পারিষদেরা কয়েক পা পিছনে। যুবরাজ এগিয়ে যাচ্ছেন, আর ডাইনে-বাঁয়ে জনগণ মাথা নুইয়ে তাকে সম্মান জানাচ্ছে।

সিংহাসনের সমুখে গিয়ে শেঠি নতজানু হয়ে অভিবাদন করলেন–“জয় হোক মহারাজের।” ফারাও জানালেন আশীর্বাদ –“কল্যাণ, হোক পুত্র! আসন গ্রহণ

সিংহাসনের অতি নিকটেই একখানা স্বর্ণাসন, শেঠি তাইতেই বসলেন। আরও একখানা স্বর্ণাসনও আছে একটু দূরে, সেটাতে আগে থেকেই উপবিষ্ট আছেন আমেনমেসিস।

যুবরাজের ইশারা পেয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার চেয়ারের পিছনে।

তারপর দরবারের কাজ শুরু হল। পেয়াদার আহ্বানে একে একে কত লোকই যে এল। প্রত্যেকের হাতে এক একটা প্যাপিরাসের তাড়া। তাতে দরখাস্ত লেখা। দরখাস্তগুলি গ্রহণ করছেন উজির, ফেলে দিচ্ছেন একটা চামড়ার বস্তার ভিতর।

এক কৃষ্ণকায় দাস সেই বস্তার মুখ মেলে ধরে আছে। অনেকদিন আগে যারা আর্জি দিয়েছে, তারা কেউ কেউ উত্তরও পেয়ে গেল এই সময়। দলিলখানা কপালে ঠেকিয়ে তারা দ্রুত বাইরে চলে গেল, ভিতরে দাঁড়িয়ে তা পড়বার হুকুম নেই।

তারপর একে একে দেখা দিতে লাগল দূর প্রদেশের শেখ সর্দারেরা, সিরিয়ার অসংখ্য কেল্লাদার ফৌজদারেরা, দস্যুহস্তে নিপীড়িত বণিকেরা, এমন কি রাজপুরুষদের অবিচারে নির্যাতিত কৃষকেরাও। প্রত্যেকেই আর্জি দাখিল করছে, দরবারের লেখকেরা প্রত্যেক আর্জির বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার লিখে ফেলছে, উজির বা সচিবেরা কোনো কোনো আর্জির জবাবও তড়িঘড়ি দিয়ে দিচ্ছেন।

ফারাও নিজে বসে আছেন চিন্তাকুল, নীরব। পূজাবেদীর উপরে পাষাণ বিগ্রহের মতো। সুদীর্ঘ দরবার গৃহ পেরিয়ে তার দৃষ্টি মুক্ত দ্বারপথে বেরিয়ে দূর আকাশের দিকেই নিবদ্ধ, যেন তাঁর ইহ-পরলোকের সব কিছু সমস্যার সমাধান ঐ আকাশপটেই লেখা আছে দুর্বোধ্য ভাষায়।

যুবরাজ পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে চুপি চুপি আমাকে বললেন–“বন্ধু অ্যানা, দেখছ তো, দরবার বড় বিরক্তিকর জায়গা। এখানে না এসে তুমি যদি মেম্ফিসে বসে গল্পই রচনা করে যেতে একটার পর একটা, সেটা ভাল হত তোমারও পক্ষে, দুনিয়ারও পক্ষে।”

আমি আর এ-কথার উত্তর দেবার সময় পেলাম না, দরবারের ও-প্রান্তে একটা চাঞ্চল্য টের পাওয়া গেল। ভিড় ঠেলে দুজন লোক এগিয়ে আসছে সিংহাসনের দিকে। একজন আগে, একজন পিছে। লম্বা দাড়ি দুজনেরই মুখে। একজনের কঁচাপাকা, আর একজনের দুধের মতো সাদা। দীর্ঘ দেহে সাদা দিলে পোশাক তাদের, তার উপরে পশমী আঙরাখা এক একটা, এরকম আঙরাখা শুধু মেষপালকেরাই পরে বলে জানতাম। হাতে তাদের কাটা গাছের লাঠি এক একখানা, তার সবগুলো কাটা যে চেঁচে দেওয়া হয়েছে, তাও নয়।

নোক দুটি ধীরে ধীরে আসছে, ডাইনে বা বাঁয়ে একবারও তাকাচ্ছে না। সব লোক ঝটিতি সরে যাচ্ছে দুই দিকে, পথ ছেড়ে দিচ্ছে তাদের, যেন তারা রাজাগজা জাতীয় কেউ। বস্তুত এতখানি সমীহ কোনো রাজা বা রাজপুত্রকেও সচরাচর করে না লোকে।

“ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা! ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা।”–ধ্বনি উঠল একটা। প্রত্যেকেই চাপা গলায় কথা কইছে বটে, কিন্তু শত শত লোকের মিলিত চাপা গলার ধ্বনিত সিংহগর্জনের মতোই ভয়াবহ।

ওরা দুটি গিয়ে ফারাওয়ের সিংহাসনের সমুখে দাঁড়াল, কোনো অভিবাদন না করেই। ফারাও তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, কথা কইছেন না। আর ফারাও যেখানে নির্বাক রয়েছেন, তার কর্মচারীরাই বা নীরবতা ভঙ্গ করে কী করে?

অবশেষে কথা কইলেন বয়ঃকনিষ্ঠ পয়গম্বরই, দাড়ি যাঁর কঁচাপাকা। বললেন–“আপনি আমায় চেনেন ফারাও, কেন আমি এসেছি, তাও জানেন।”

ফারাও খুব ধীরে ধীরে জবাব দিচ্ছেন, চিবিয়ে চিবিয়ে–“না চিনে উপায় কী? ছেলেবেলায় একসাথে খেলা করেছি যে আমার স্বৰ্গতা ভগ্নী তোমাকে নীলনদের খাগড়াবন থেকে তুলে এনে দত্তক নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, চিনি আমি তোমাকে। তোমার সঙ্গীকেও দেখেছি আগে। কিন্তু তোমাদের আগমনের উদ্দেশ্য আমি জানি না।”

“জানেন না যদি, তবে শুনুন আরও একবার। আমার আগমন আমার নিজের ইচ্ছায় নয়। আমি এসেছি, ইজরায়েলের ভগবান, একমাত্র ভগবান জাহভের আজ্ঞায়। তার দাবি হল এই যে তার উপাসকবৃন্দকে আপনি চলে যেতে দিন মিশর ত্যাগ করে। তারা বনে বনে কান্তারে কান্তারে তাদের ভগবানের অর্চনা করে বেড়াক গিয়ে।”

“কে তোমার জাভে? আমি জানি না তাকে। আমি আমন রা’র পূজক। মিশরে আরও বহু দেবদেবী আছেন, তাঁদেরও পূজক। জাইভের কথায় আমি কেন তোমাদের জাতিকে দেশ ছেড়ে যেতে দেব?”

“না যদি দেন ফারাও, তাহলে জাহভের রোষ যে কী বস্তু, তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। এদেশের সব দেবতার মিলিত-ক্ষমতাও জাহভের একার ক্ষমতার তুলনায় কিছু নয়। কেন যেতে দেবেন ইজরায়েলীদের, জিজ্ঞাসা করছেন? আমাকে জিজ্ঞাসা না করে বরং আপনার এই পুত্রকে জিজ্ঞাসা করুন। যুবরাজ শেঠিকে। জিজ্ঞাসা করুন, কাল রাত্রে এই নগরের রাজপথে কী ঘটনা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন, আর সেই ঘটনার জের হিসাবে কী দণ্ডাজ্ঞা তিনি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন?”

যুবরাজ কেন ফারাওর আদেশ ব্যতিরেকে মুখ খুলতে যাবেন? তিনি নীরব রয়েছেন দেখে পয়গম্বর বললেন–“যুবরাজ যদি কিছু বলতে না চান, বলবার লোক আমার আরও আছে। এগিয়ে এস, মেরাপি! ইজরায়েল-চন্দ্রমা।”

তক্ষুনি ভিড়ের ভিতর থেকে ধীর পদে বেরিয়ে এল মেরাপি, আগের রাতে যাকে কেন্দ্র করে লোমহর্ষক সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে বাজার চত্বরে, এবং আমন মন্দিরের চাতালে। ও যে এখানে আছে, তা আমরা ভাবতে পারিনি। ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা মামলার বনিয়াদ পাকা করেই গেথে তুলেছেন দেখছি। ধর্মোন্মাদ তারা হতে পারেন হয়তো, কিন্তু বিষয়বুদ্ধিতেও তারা কোনো মিশরী বেনিয়ার চেয়ে কম যান না।

মেরাপি এগিয়ে এসে নতজানু হল ফারাওর সমুখে, তারপরে বুঝি সে যুবরাজের পায়ের কাছেও অমনিভাবে প্রণিপাত করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে নিরস্ত করলেন যুবরাজই–“দরবারে একমাত্র প্রণম্য হলেন ফারাও। অন্য কাউকে এখানে সম্মান জানানো চলে না।”

তারপর মেরাপি তার পয়গম্বরের নির্দেশে পূর্ব-রজনীর কাহিনি বর্ণনা করে গেল আবেগের সঙ্গে এবং কাহিনি সমাপন করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল জনতার ভিতরে মিশে যাবার জন্য। পয়গম্বরেরা তখন নিজেদের দাবি আবারও উত্থাপন করলেন–“কী ধরনের অত্যাচার ইজরায়েলীদের উপরে হচ্ছে তা শুনলেন ফারাও। এর পরেও কি আপনি বলবেন যে ইজরায়েলীদের ধন-প্রাণ-সম্মান নিরাপদ মিশরভূমিতে?”

ফারাও ধীরে ধীরে বললেন–“কেন বলব না? হত্যাকাণ্ড তো আখছারই হচ্ছে। শুধু যে ইজরায়েলীরাই খুন হচ্ছে, তা নয়, হচ্ছে মিশরীরাও। তার জন্য দেশের সব লোক দেশত্যাগ করে যেতে চাইবে, এ তো অতি হাস্যকর কথা! হিব্রু নাথানের উপরে অত্যাচার করেছিল জনৈক সৈনিক, যুবরাজের সুবিচারে সঙ্গে সঙ্গেই সে যোগ্য দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। সুতরাং ও ব্যাপারে আমারও আর কিছু করবার থাকতে পারে না, ইজরায়েলীদেরও আর কিছু অভিযোগ থাকতে পারে না। ঐ ব্যাপারের উপরে ভিত্তি করে কেউ যদি দাবি করে যে ইজরায়েলীদের মিশর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে, তা হলে আমি বলব-উন্মাদ হয়েছে সে।”

এই পর্যন্ত বলে ফারাও থামলেন এক মুহূর্ত, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করলেন–“ফারাওয়ের যা বলবার তা তিনি বলেছেন। আপনারা যেতে পারেন।“

পয়গম্বরেরা নীরব। কিন্তু সেও কেবল এক মুহূর্তের জন্য। তারপরই তারা দুজনই সমস্বরে অভিসম্পাত দিতে শুরু করলেন ফারাওকে–“ভগবান জাহভের নামে আমরা অভিসম্পাত দিচ্ছি তোমাকে ফারাও। এই পাপের জন্য অচিরে তুমি মৃত্যুমুখে পতিত হবে। মিশরী জনগণকেও অভিশাপ দিচ্ছি আমরা। তারা ধ্বংস হবে। মরণ হবে তাদের খাদ্য, রক্ত হবে তাদের পানীয়। সারা দেশ আচ্ছন্ন হয়ে যাবে গভীর অন্ধকারে। তারপরে, অন্য ফারাও এসে মুক্তি দেবেন ইজরায়েলীদের।”

রাজদ্রোহ? সন্দেহ কী? কিন্তু ফারাও-দরবারে এ-কথা কারও মনে হল না যে এই ইজরায়েলী বিদ্রোহীদের এক্ষুনি দণ্ডিত করা উচিত যথোচিতভাবে। কেউ টু শব্দটিও করল না তাদের মুখের ঐ সব সর্বনাশা অভিশাপ শুনে, কেউ এগিয়ে এল না তাদের বন্দি করার জন্য। স্বয়ং ফারাও যেখানে নিশ্চল নির্বাক, তার ভূতেরা আর করবে কী?

যেমন এসেছিলেন পয়গম্বর যুগল, তেমনি ধীর পদক্ষেপে তারা বেরিয়ে গেলেন দরবার থেকে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

কথা কইলেন ফারাও। বেশ একটু উত্তেজনার সঙ্গেই–“ইজরায়েলীদের ও দাবি নতুন কিছু নয়। নিমকহারামের জাত ওরা। কয়েক শতাব্দী আগে ওদের দেশে হয়েছিল দারুণ দুর্ভিক্ষ। খেতে না পেয়ে ওরা হাজারে হাজারে চলে এসেছিল মিশরে, শরণার্থী হয়ে। তখন ইউসুফ ছিলেন মিশরের উজির, জাতিসূত্রে তিনি আবার ইজরায়েলী। ফারাওকে অনুরোধ করে তিনিই নিজের জ্ঞাতি-গোত্রীদের ঠাই করে দেন গোসেনে। সেই থেকে ঐ উর্বর প্রাদেশে বসবাস করছে ওরা, বংশবৃদ্ধি হয়েছে ওদের আশাতীত রকম, ধনেধান্যে ঐশ্বর্যবান হয়েছে জনে জনে, যেমনটা নিজেদের মরুদেশে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না ওদের।

“এইসব দাক্ষিণ্য আমাদের হাত থেকে অম্লান বদনে ওরা হাত পেতে নিয়েছে, বিনিময়ে করেছে শুধু একটি কাজ, ফসল তোলার সময়ে বিনা পারিশ্রমিকে ওদের কিছু লোক এসে খেটে দিয়েছে, দিচ্ছে আমাদের ক্ষেতে। চিরদিন দিয়েছে বিনা ওজরে, ইদানীংই ওরা বেসুরো গাইছে–খুব নাকি অত্যাচার হচ্ছে ওদের উপরে। হয়তো কোথাও কিছু হয়েও থাকতে পারে অত্যাচার, এই রাজধানী ট্যানিসে বা থিবিস মেফিসেই কি হচ্ছে না তা? সেই তিলকে তাল করে ঐ ধৃষ্ট পয়গম্বরেরা যদি দরবার কক্ষে এসে ফারাওকে অভিশাপ দিয়ে যায়, তা হলে রাজমর্যাদার আর রইল কী?”

দরবারে হোক বা অন্যত্র হোক, ফারাওয়ের উপস্থিতিতে তার অনুমতি বিনা অন্য কেউ কোনো মন্তব্য করতে পারে না। করে যদি, তাহলে ফারাওয়ের নিজের ভাষাতেই বলা যায় যে রাজমর্যাদার আর থাকে না কিছু। এক্ষেত্রেও তাই নীরব রয়েছে সকলে। এবং প্রতীক্ষা করছে ফারাও কতক্ষণে তার বক্তৃতা শেষ করবেন। কতক্ষণে ও কীভাবে?

অচিরেই শেষ করলেন, এবং একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। বললেন—“রাজমর্যাদা ওরা ক্ষুণ্ণ করে গেল, তা আমি মনে রেখেছি। তার জন্য সাজাও ওরা পাবে। কিন্তু সাজা দেবার আগে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে সত্যকার অভিযোগ ওদের কিছু আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে, স্বভাবতই সাজার কঠোরতা হ্রাস পাবে। এখন সেই নিশ্চিত হওয়াটা হয় কী করে? সরেজমিনে তদন্ত ছাড়া তো অন্য উপায় নেই। উজির, তুমি কী বল?”

উজির নেহেসি অথঘটিত ব্যাপারে ছাড়া নিজস্ব মতামত সহজে প্রকাশ করেন না, তিনি প্রভুর কথাতেই সায় দিলেন–সরেজমিনে তদন্ত ভালই। কাকে পাঠাতে চাইছেন ফারাও?”

“সারা মিশরে সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছেন আমার প্রিয় পুত্র মিশর-যুবরাজ শেঠি, একথা নিশ্চয় স্বীকার করবেন সকলে।”

“নিশ্চয়! নিশ্চয়?” শতকণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হল অকুণ্ঠ সমর্থন। শেঠি আমার কানে কানে বললেন–“ফারাও ঠাট্টা করছেন আমাকে। কাল খুয়াকার যে প্রাণদণ্ড দিয়েছি আমি, তারই দিকে ইঙ্গিত এটা, প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ।”

ওদিকে ফারাও বলে যাচ্ছেন–“তদন্ত করতে যাবেন যুবরাজ শেঠি। তবে তার সঙ্গে রাজপুত্র আমেনমেসিসও যাবেন। দুই ভাই একসঙ্গে গেলে ওঁদের সময় কাটবে ভাল। তাছাড়া দুইজনের দুটো মত পেলে আমি কর্তব্য নির্ধারণে সুবিধাও পাব অনেকখানি।”

শেঠি আবার কানে কানে বললেন আমায়–“আমায় বিশ্বাস করেন না ফারাও। বস্তুত তুমি দেখতে পাবে আমার আর আমেনমেসিসের দুটো মতে পার্থক্য দাঁড়িয়ে যাবে আকাশ-পাতাল, আর কার্যকালে ফারাও কাজ করবেন আমেনমেসিসেরই মতানুযায়ী, আমার নয়।”

আমি চমৎকৃত হয়ে বললাম–“তাহলে তো ফারাও একা আমেনমেসিসকে পাঠালেই পারতেন?”

“না, তা পারতেন না। আমেনমেসিসকে প্রাধান্য পেতে দেবেন না কিছুতেই, এমন একজন আছেন, যাঁর ইচ্ছাকে পদদলিত করার শক্তি থাকলেও রুচি নেই ফারাওয়ের। তিনি হচ্ছেন যুবরানি উসার্টি।”

ওদিকে ফারাও তুলেছেন নতুন একটা কথা। যা ইজরায়েলীদের সমস্যার চাইতেও গুরুতর ফারাও পরিবারের এবং জনসাধারণের পক্ষে। তিনি বলছেন ‘সম্ভব হলে আমি কালই রওনা হয়ে যেতে বলতাম রাজপুত্রদের। কিন্তু সম্ভব নয় সেটা। পক্ষকাল পরে ওঁদের যাত্রার দিন নির্দিষ্ট রইল। এই পক্ষকালের মধ্যে আর একটি কাজ আমাদের সেরে ফেলতে হবে। আনন্দোৎসব একটা। মিশর যুবরাজ শেঠির সঙ্গে মিশর যুবরানি উসার্টির শুভপরিণয়। আগামী তিন দিনের মধ্যেই হবে এই বিবাহ।”

যুবরাজ ভয়ানক চঞ্চল হয়ে উঠেছেন এই ঘোষণা শুনে। তা লক্ষ্য করে ফারাও পরিহাসের সুরে বলে উঠলেন–“তুমি যেন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যে এ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও তুমি জান না?”

“তা তো জানিই না! কানাঘুষো জল্পনা-কল্পনা অনেক হয়েছে অবশ্য এ-নিয়ে, কিন্তু ফারাওয়ের মুখ থেকে আচমকা এই প্রকাশ্য ঘোষণা নিঃসৃত হওয়ার আগে,

সরাসরি কোনো বার্তা বা ইঙ্গিত কেউ আমাকে দেয়নি।”

“সেকী? উসার্টিকে তো কাল রাত্রে এই কথা বলার জন্যই আমি তোমার মহলে পাঠিয়েছিলাম। উসার্টি কি লজ্জা পেয়েছিল বলতে?”।

হোক দরবার, উসার্টি ঝংকার দিয়ে উঠলেন–“লজ্জাশরম থাকে অবলাদের। আমি তাদের দলে নই। আমি গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু এমন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিল যুবরাজের কক্ষে, যার সম্মুখে এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলোচনা আমি সঙ্গত বা শোভন মনে করিনি। তা, নাই যদি বলে থাকি কাল, যুবরাজ বলতে পারেন না যে ফারাওয়ের এই ব্যবস্থাটি এমন কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। আবহমান কাল ফারাও পরিবারে ভাইবোনে বিবাহ হয়ে আসছে। আজ কি আমি নিজের ভাইকে ছেড়ে জ্ঞাতিভাই আমেনমেসিস বা সাপ্টাকে বিয়ে করতে যাব? বিশেষ যেখানে আমেনমেসিসের এক বৌ আগে থেকে আছে, আর সেখানে সাটার একখানা পা খোঁড়া?”

রাজকন্যার এই তর্জন-গর্জন শুনে অনেকে মুখ ফিরিয়ে হাসল, কিন্তু আমেনমেসিসের ওপাশ থেকে আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠল এক ল্যাংড়া যুবক “খোঁড়া তো হয়েছে কী? বরাতে থাকলে এই খোঁড়াও একদিন সিংহাসন পেতে পারে, আর পেতে পারে গর্বিতা উসার্টির বরমালাও।”

আবারও মুখ টিপে হাসছে সবাই। আমিই কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সাপটার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ আগে বোকেনঘোর মায়ামন্ত্রের বশে একে একে তিনটি পুরুষকে দেখতে পেয়েছিলাম আমি। ঐ সাপটাই সেই তৃতীয় পুরুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *