৭. মৃত্যুপথের যাত্রী

২১.

মৃত্যুপথের যাত্রী

তিক্ত চেহারা করে বেরিয়ে গেছে অলিভার, আর তা লক্ষ করে তিক্ততায় ভরে গেল রোজামুত্রে অন্তরও। আজকের ঘটনাই মাপকাঠি, পরিষ্কার বুঝতে পারছে ও কতবড় অবিচার করেছে ও হতভাগ্য যুবকটির প্রতি। ক্ষণিকের উত্তেজনায়, আগপাশ না ভেবে ক্রমাগত দোষারোপ করে গেছে ও অলিভারকে। অবিশ্বাসের কথা বলে অলিভার, হয়তো সত্যিই কোনোদিন ও বিশ্বাস করতে পারেনি তাকে। অন্যায় হয়েছে… পাপ করেছে রোজামুণ্ড, কোনও সন্দেহ নেই।

প্রায়শ্চিত্তের তাগিদ এবার মেয়েটা নিজে অনুভব করল। অলিভার যদি ওভাবে বেরিয়ে না যেত, এখুনি হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইত ও। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। ছটফট করতে থাকল ওভিতরে ভিতরে। ঠিক করল, অলিভার পরেরবার এলেই দুহাত জুড়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে।

কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, দেখা পাওয়া গেল না দুর্ধর্ষ কর্সেয়ারের। অস্থিরতা বেড়ে গেল রোজামুণ্ডের। ভয় পেতে শুরু করেছে। সন্দেহ নেই, খুব শীঘ্রি হামলা চালাবেন সার জন। তারপর? নিজের কথা আর ভাবছে না ও, ভাবছে অলিভারের কথা। লড়াই শুরু হলে কী ঘটবে লোকটার ভাগ্যে? ইংরেজদের হাতে না হোক, নিজের দলের লোকই কি ওকে খুন করে ফেলবে না? বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অলিভার… রক্ত দিয়ে তার মূল্য দিতে হবে ওকে। অথচ কাজটা করেছে সে ওর-ই জন্য! সেজন্যেই ভয় পাচ্ছে রোজামুণ্ড–হয়তো ক্ষমা চাইবার সুযোগ পাবে না। সেক্ষেত্রে বাকি জীবন কাটাতে হবে তীব্র অনুশোচনায়।

মাঝরাত ঘনিয়ে এলে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ও। উঠে দাঁড়াল, সাবধানে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল পুপ-ডেকে। কয়েক পা যেতেই হোঁচট খেলো, দরজার ঠিক সামনে শুয়ে আছে একজন মানুষ, তার গায়ে পা লেগেছে। একটু নড়ল মানুষটা, কিন্তু জাগল না। মাস্তুল আর রেলিঙের লণ্ঠন থেকে ভেসে আসা আবছা আলোয় অলিভারকে চিনতে পারল রোজামুণ্ড, ঘুমোচ্ছে শান্ত ভঙ্গিমায়।

একটু ঝুঁকল ও, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অলিভারের পাশে। দুচোখ থেকে ঝরতে শুরু করেছে অশ্রু। ওর জানা ছিল না, অলিভার গতকালও এভাবে ঘুমিয়েছে। কিন্তু এখন… ওকে এই অবস্থায় আবিষ্কার করে বুকের ভিতর আলোড়ন অনুভব করছে। এই সেই মানুষ, যাকে ও অবিশ্বাস করেছে… দিয়েছে কষ্টের পর কষ্ট… অথচ সে-ই শক্ত পাটাতনে শুয়ে আছে ওরকারণে–নিজের শরীরকে বানিয়েছে বাধার প্রাচীর, যাতে কেউ ওর নাগালে পৌঁছুতে না পারে!

একটা গোঙানি বেরিয়ে এল রোজামুণ্ডের গলা দিয়ে, আর তা শোনামাত্র ঝট করে চোখ মেলল অলিভার। বিস্ময় ফুটল ওর চেহারায়।

কী হয়েছে? জানতে চাইল ও।

 জবাব দিতে পারল না রোজামুণ্ড। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এল। অলিভার উঠে বসেছে, ওকে নিজের অশ্রু দেখতে দিল না। চোখ, মুছে উল্টো ঘুরল। গলা যতটা পারে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় তোমার, লায়োনেল কি সার জনের জাহাজে পৌঁছে গেছে?

চকিতে শামিয়ানার দিকে নজর বোলাল অলিভার-বাদশাহ্ আর শাহজাদা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তা ছাড়া প্রশ্নটা করা হয়েছে ইংরেজিতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ইশারা করল দরজার দিকে। দুজনে ঢুকে পড়ল পুপ-কেবিনে।

দুশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না? বলল অলিভার… আধা-প্রশ্ন, আধা-অনুমানের সুরে।

হুঁ, মাথা ঝাঁকাল রোজামুণ্ড।

চিন্তার কিছু নেই, অলিভার আশ্বস্ত করল ওকে। শেষরাতের আগে কিছু করতে যাবেন না সার জন। ওই সময়ে হামলা করলে আমাদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাবেন কি না! লায়োনেল যে পৌঁছুতে পেরেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পথ বেশি লম্বা ছিল না; তা ছাড়া… খাড়ি থেকে বেরুনোর পরে দ্বীপের মাটিতে উঠে পড়তে পেরেছে ও। আমি হলে হেঁটে দ্বীপের উল্টোপাশে যেতাম, জাহাজের কাছাকাছি গিয়ে তারপর আবার নামতাম পানিতে। কিছু ভেবো না, ওর কোনও সমস্যা হবার কথা নয়।

বিছানায় বসল রোজামুণ্ড। প্রদীপের আলোয় চকচক করে উঠল ওর চোখের পানিতে ভেজা গাল।

সার জন যখন আসবেন, তখন কি লড়াই হবে? জিজ্ঞেস করল ও।

তা তো হবেই। আমরা হেরেও যাব। আজ এ-নিয়ে কথা হচ্ছিল… তুমি বোধহয় বুঝতে পারোনি। জার্বাতে অ্যাডমিরাল দ্রাগুতকে যেভাবে ফাঁদে ফেলেছিল অ্যাড্রিয়া ডোরিয়া, ঠিক একই অবস্থা এখন আমাদের। পার্থক্য একটাই–দ্রাগুতের সামনে পালাবার জন্য একটা বিকল্প পথ ছিল, কিন্তু এখানে তা নেই। সাহস রাখো, তোমার মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। একটু থামল অলিভার। এরপর নরম গলায় বলল, আমি প্রার্থনা করছি, আজকের পর থেকে তোমার জীবন যেন সুখে-শান্তিতে ভরে যায়। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা যেন বাজে একটা দুঃস্বপ্নের মত দেখায়, আর কিছু না।

কোনও উচ্ছ্বাস দেখা গেল না রোজামুণ্ডের মধ্যে। মাথা নিচু করে ফেলল ও। বলল, রক্ত না ঝরিয়ে যদি ব্যাপারটা সমাধা করা যেত, তা হলে খুব ভাল হতো।

ভয় পেয়ো না, ওর কথার ভুল অর্থ করে বলে উঠল অলিভার। তোমার যাতে কিছু না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখব আমি। যতক্ষণ লড়াই চলবে, এখানেই থাকবে তুমি। আমার বিশ্বস্ত কিছু লোক আগলে রাখবে দরজা। কেউ ফুলের টোকাও দিতে পারবে না তোমার গায়ে।

ভুল করছ তুমি! তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠল রোজামুণ্ড, ঝট করে তুলল মাথা। তোমার কি ধারণা আমি শুধু নিজের কথা ভাবছি? থামল ও, শ্বাস ফেলল জোরে জোরে। তোমার কী হবে?

আমাকে নিয়ে চিন্তা করায় ধন্যবাদ, বলল অলিভার। বিমর্ষ হয়ে গেল। সন্দেহ নেই, কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদান পাবো আমি। প্রার্থনা করছি, সেটা যেন দ্রুত পাই। তিলে তিলে যেন…

না-আ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রোজামুণ্ড। দাঁড়িয়ে গেল উত্তেজনায়। ওটা না!

আর কোনও বিকল্প আছে? স্নান হাসি দেখা দিল অলিভারের ঠোঁটে। এ ছাড়া আর কী-ই বা আশা করতে পারি আমি?

বেঁচে থেকে ইংল্যাণ্ডে ফিরতে হবে তোমাকে, বলল রোজামুণ্ড। সত্য প্রকাশ পাবে। সুবিচার পাবে তুমি।

এক মুহূর্তের জন্য ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল অলিভার। তারপর হেসে উঠল।

ইংল্যাণ্ডে আমি শুধু এক ধরনের সুবিচার আশা করতে পারি, বলল ও। ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর সুবিচার! নিশ্চিত থাকো, মেয়ে, ক্ষমার অযোগ্য কুখ্যাতি রয়েছে আমার। ভাল হয় সব এখানেই শেষ হয়ে গেলে। তা ছাড়া… যোগ করল ও ঠাট্টার সুর মিলিয়ে গেল কণ্ঠ থেকে, ভর করল বিষাদ, মৃত্যুই তো আমার প্রাপ্য। নিজের চোখেই আজ দেখেছ তুমি আমার সঙ্গীদের বিশ্বস্ততা আর ভালবাসা। বাদশাহ্-র বিরুদ্ধে পর্য গেছে আমার কারণে। চোখ বন্ধ করে এতকাল ঝাঁপ দিয়েছে বিপদের মুখে… শুধুমাত্র আমার কথায়। অথচ আজ ওদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আমি-ফাঁদে ফেলেছি, করেছি মরা আয়োজন। এই কলঙ্ক নিয়ে বাঁচতে চাই না আমি। মরে যাওয়া ভাল।

ওর কথা শুনতে শুনতে চেহারায় আতঙ্ক ফুটল রোজামুণ্ডের। ও আসলে ভাবতেই পারেনি, কর্সেয়ারদের সবাইকে মরতে হতে পারে।

জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বলতে চাইছ, আমার মুক্তির জন্য এই জাহাজের সবার প্রাণ যাবে? 

সেটাই ঘটবার সম্ভাবনা, সায় দিল অলিভার। তবে আমি একটা বুদ্ধি আঁটছি, সফল হলে হয়তো বা রক্তপাত এড়ানো যাবে।

ওই বুদ্ধিতে তুমি নিজে কি রক্ষা পাবে?

 বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করো কেন? বললাম তো, আমার প্রাণের কোনও মূল্য নেই। এমনিতেই আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। এখানে যদি না-ও মরি, আলজিয়ার্সে ফেরামাত্র আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন বাদশাহ্। কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।

ধপ করে বিছানায় আবার বসে পড়ল রোজামুণ্ড। শরীর কাঁপছে। ফিসফিস করে বলল, তা হলে আমি… আমিই তোমার মরণ ডেকে আনছি। লায়োনেলকে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনকে বাজি ধরে ফেলেছ তুমি-আর সেটা শুধু আমার মুক্তির জন্য। কঠিন হলো ওর কণ্ঠ। কে বলেছে তোমাকে এ-কাজ চরতে? আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কেন তুমি এমন একটা পদক্ষেপ নিলে? কোনও অধিকার নেই তোমার… আমাকে এমন জঘন্য একটা কাজের অংশীদার বানানোর। জেনেশুনে আমি তোমাকে মরতে দিতে পারি না, অলিভার! তাও আবার নিজের মুক্তির জন্যে!

আল্লাহকে ধন্যবাদ, তোমার কথায় কিছু যায়-আসে না, বলল অলিভার। তারপরেও বলছি, নিজেকে অপরাধী ভেবো না। তোমার দুর্দশার জন্য আমি একা দায়ী। তার ফলও আমারই ভোগ করা উচিত। মরলে মরব, তাও প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি। কাঁধ ঝাঁকাল ও। ইতস্তত করে বলল, হয়তো খুব বেশি চাওয়া হয়ে যায়, তবু… তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?

ভেজা চোখে ওর দিকে তাকাল রোজামুণ্ড। তুমি ক্ষমা চাইছ কেন? ক্ষমা তো চাইব আমি!

তুমি! অবাক হলো অলিভার।

অবশ্যই! তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলাম আমি, তোমার মুখ থেকে কিছু শুনতে না চেয়ে কান দিয়েছিলাম বাইরের লোকের কানকথায়। তারপরে আবার পুড়িয়ে ফেলেছিলাম তোমার চিঠি আর নির্দোষিতার প্রমাণপত্র। আমার বোকামির জন্যই তো এতকিছু ঘটেছে!

তিক্ত একটা হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে। আমি মনে করি না খুব একটা ভুল করেছিলে তুমি। আমাকে শয়তান ভেবেছিলে… আসলেও আমি তা-ই। আজ আমার এ-অভিযোগ স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই। খুব খারাপ ধরনের মানুষ আমি, রোজামুণ্ড, নইলে জলদস্যুর জীবন বেছে নিতে পারতাম না। নিলেও দস্যু হিসেবে এত উন্নতি করতে পারতাম না। এতেই প্রমাণ হয়, আমার ভিতরে সবসময়েই একটা শয়তান বাস করত। আমাকে চিনতে ভুল করোনি তুমি।

না! বিশ্বাস করি না আমি!

 এসব বলছ ক্ষণিকের আবেগে… মনের অপরাধবোধ হালকা করবার জন্য। কিন্তু আমার অন্ধকার দিকটা বহুদিন আগেই আঁচ করেছিলে তুমি। তোমার কোনও দোষ ছিল না।

ছিল! ছিল!!

রোজামুণ্ডের আকুতিতে প্রভাবিত হলো না অলিভার। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ও! তোমার সঙ্গে আমি যা করেছি, তা কোনও বিবেকবান মানুষ করতে পারে না… তাকে যতই প্ররোচিত করা হোক না কেন। সব পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি-মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে মানুষ যেভাবে বুঝতে পারে।

তুমি মরার জন্য এত উতলা হয়ে উঠলে কেন? হতাশায় বলে উঠল রোজামুণ্ড।

উতলা হইনি, বলল অলিভার, বরং মৃত্যুই উতলা হয়ে উঠেছে আমার জন্য। সান্ত্বনা একটাই-ভয় বা অনুশোচনা ছাড়া তাকে বরণ করে নিতে পারব। নিয়তি হিসেবে মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছি আমি, যার হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। মন হালকা হয়ে গেছে… খুশিও হয়েছি বলতে পারো… তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলায়।

উঠে দাঁড়াল রোজামুণ্ড, এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি হলো অলিভারের। বলল, পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত আমাদের, অলিভার। আর ক্ষমা যেহেতু সবকিছু মুছে দেয়, চলো… আমরা গত পাঁচ বছরের সমস্ত বাজে স্মৃতি ভুলে যাই।

মাথা নামিয়ে নিল অলিভার। এ কি সম্ভব? পাঁচ বছর পেছনে কি ফিরতে পারব আমরা? ফিরতে পারব গডলফিন কোর্টের সেই দিনগুলোতে?

জবাব দিতে পারল না বোজামুণ্ড।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অলিভার। ভুলের মাশুল সবাইকে শুনতে হয়। ফেরার কোনও পথ নেই আমাদের, রোজামুণ্ড। সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

হার মানতে রাজি নয় রোজামুণ্ড। বলল, তা হলে বন্ধই থাকুক ওগুলো। আমরা ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নতুন করে শুরু করব সবকিছু। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সাজিয়ে তুলব ভবিষ্যৎকে।

ওর কাঁধে হাত রাখল অলিভার। বড় ভাল মেয়ে তুমি। হায় খোদা, যদি আমরা এমন পরিস্থিতিতে না পড়তাম… বলতে বলতে থমকে গেল ও। তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিল হাত। হয়েছে। কী আমার? দুর্বল হয়ে পড়ছি! তোমার করুণা আমাকে নরম করে দিচ্ছে… আরেকটু হলেই ভালবাসার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কী বোকা আমি! ভালবাসা শুধু জীবিতদের জন্য-ভালবাসা তো জীবনেরই আরেক নাম। অথচ আমি তো মৃত্যুপথের যাত্রী! কোনও অধিকার নেই আমার ভালবাসার কথা বলবার।

না! না-আ! ওকে জাপটে ধরল রোজামুণ্ড। কাঁপছে থর থর করে। এ-সব বোলো না।

বড্ড দেরি হয়ে গেছে, রোজামুণ্ড, অলিভারের গলা ভেঙে গেল। গর্তে পড়ে গেছি আমি, উঠে আসার কোনও উপায় নেই। হাসিমুখে পরিণতিকে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

তা হলে আমিও তোমার সাথী হব, বলল রোজামুণ্ড। আর কিছু না হোক, একসঙ্গে থাকব আমরা!

এবার কিন্তু পাগলামি করছ! নরম গলায় তিরস্কার করল অলিভার। হাত বুলিয়ে দিল রোজামুরে সোনালি চুলে। তুমি মরে গেলে কী লাভ হবে আমার? অতৃপ্তি নিয়ে তুমি মরতে দিতে চাও আমাকে? না, রোজামুণ্ড, তুমি বেঁচে থাকলেই বরং উপকার হবে আমার। ইংল্যাণ্ডে ফিরে যেয়ো, প্রকাশ কোরো আমার কাহিনি। হয়তো বা তখন সহানুভূতি পাব মানুষের কাছ থেকে। ওরা বুঝতে পারবে, কেন আমি ধর্মত্যাগ করে জলদস্যুর জীবন বেছে নিয়েছিলাম।

ওর কথা শেষ হতেই বাইরে হৈচৈ শোনা গেল। ।

অ্যাই, কী হয়েছে? চেঁচিয়ে জানতে চাইল অলিভার।

শক্র! চিৎকার দিয়ে জবাব দিল কেউ। অস্ত্র ধরো সবাই! তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!!

রোজামুণ্ডের আলিঙ্গন থেকে সাবধানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অলিভার।, সময় হয়েছে, বলল ও। তারপর বেরিয়ে গেল পর্দা সরিয়ে।

.

২২.

 আত্মসমর্পণ

কেবিন থেকে বেরিয়েই জাহাজ-জুড়ে হুড়োহুড়ি দেখতে পেল অলিভার। আর দেখতে পেল লারোক-কে। সূর্যাস্তের পর থেকে পাহাড়চূড়ার পাহারায় ছিল ফরাসি লোকটা। হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাচ্ছে সে।

ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন! মালিক! শত্রু আসছে! জলদি উঠুন, বিপদ!

পুরো জাহাজ কাঁপছে উত্তেজিত পদশব্দে-ঘুম থেকে জেগে ছুটে আসছে সবাই। ফোক্যাসলে হাঁকডাক শুরু করল কে যেন। গুটিয়ে নেয়া হলো শামিয়ানা, তলা থেকে মারযাক-সহ বেরিয়ে এলেন আসাদ-আদ-দীন।

জাহাজের ডানপাশ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল বিস্কেন আর ওসমানি; ওয়েইস্ট ডেক থেকে এল ভিজিটেলো, জ্যাসপার আর একদল সশস্ত্র কর্সেয়ার। সবাই জড়ো হলো পুপ-ডেকে।

কী হয়েছে? বিরক্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন বাদশাহ।

এক নিঃশ্বাসে দুঃসংবাদ শোনাল লারোক। গ্যালিয়নটা নোঙর তুলেছে, মালিক। চলতে শুরু করেছে খাড়ির মুখ লক্ষ্য করে।

দাড়িতে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত বোলালেন আসাদ। মানে কী এর? ওরা কি আমাদের খবর জেনে গেছে?

নইলে রাতদুপুরে নোঙর তুলে এদিকে আসবে কেন? বলে উঠল বিস্কেন।

ঠিকই বলেছ, মাথা ঝাঁকালেন আসাদ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন অলিভারের দিকে। তোমার কোনও পরামর্শ আছে, শাকের-আল-বাহার?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল অলিভার। কী আর পরামর্শ দেব? আমাদের তো হাত-পা বাঁধা। অপেক্ষা করে দেখা যেতে পারে। যদি আমাদের খবর ওরা জেনেই থাকে, তা হলে ফাঁদে পড়ে গেছি। আল্লাহ্-আল্লাহ্ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। নইলে আজ আমাদের সবার কপালে মরণ আছে!

বরফের মত শীতল ওর কণ্ঠ। উদ্বেগ জাগিয়ে তুলল সবার মধ্যে। মারযাক কেঁপে উঠল আতঙ্কে।

জাহান্নামে যাও, শাকের! চেঁচিয়ে উঠল শাহজাদা কথা খুঁজে না পেয়ে। বাজে কথার আর জায়গা পাও না?

কপালে যা লেখা আছে, তা-ই ঘটবে, নির্বিকার গলায় বলল অলিভার। আমার কথায় কিছু যাবে-আসবে না।

তা তো বটেই, একমত হলেন বাদশাহ্। আল্লাহ্ সবার ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি না চাইলে কিছুই হবে না।

আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশ না নিয়ে বাস্তবসম্মত একটা বুদ্ধি দিল বিস্কেন।

ওরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে, এটাই ধরে নিই না কেন? এখুনি যদি চেষ্টা করি, হয়তো ওরা পৌঁছুনোর আগে বেরিয়ে যেতে পারব খাড়ি থেকে।

নিশ্চিত না হয়ে এগোনো ঠিক হবে না, মারযাক প্রতিবাদ জানাল। তুমি তো সেধে বাঘের মুখে ঝাঁপ দিতে বলছ।

অ্যাই, তুমি চুপ করো, বিরক্ত গলায় বললেন আসাদ। বিস্কেন মন্দ কিছু বলেনি। আল্লাহকে ধন্যবাদ, আজ রাতে বাতাস খুব একটা নেই। দাঁড় টেনে আমরা যতক্ষণে দশ লিগ যেতে পারব, ততক্ষণে পাল খাটিয়ে গ্যালিয়নটা এক লিগও এগোতে পারবে না।

মৃদু গুঞ্জনের সঙ্গে একমত হলো সবাই।

বিস্কেন বলল, খাড়ি থেকে শুধু বেরুতে পারলে হয়, ওরা। কিছুতেই ধরতে পারবে না আমাদেরকে।

ওদের কামানের কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি, বলে উঠল অলিভার। পালাবার এই কৌশলের ব্যাপারে আগে থেকেই সচেতন আছে ও, তাই চেষ্টা করছে ওদের মধ্যে দ্বিধা জাগাবার।

দূর থেকেই আমাদেরকে ঘায়েল করতে পারবে ওরা।

এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে আমাদেরকে, বললেন আসাদ। রাতের অন্ধকারের উপর আস্থা রাখতে হবে। এখানে বসে থাকা মানে ধ্বংস সুনিশ্চিত। ঘুরে আদেশ দিতে শুরু করলেন তিনি। আলি, জাহাজের বাঁধন খুলতে শুরু করো! ভিজিটেলো, তোমার মাল্লাদের ঘুম ভাঙাও… এক্ষুণি দাঁড় টানতে হবে ওদেরকে।

বাজতে শুরু করল সারেঙের বাঁশি। একটু পরেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল চাবুকের সপাং আর ক্রীতদাসদের আর্তনাদে।

বিস্কেনের দিকে ফিরলেন বাদশাহ্। গলুইয়ে চলে যাও। আমাদের লোকজনকে একত্র করো। অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকবে ওরা, শত্রু যদি জাহাজে চড়ার চেষ্টা করে, তা হলে বাধা দেবে।

কুর্নিশ করে ছুটে চলে গেল বিস্কেন। খানিক পর ব্যস্ত নাবিকদের হৈচৈ ছাপিয়ে গম গম করে উঠল আসাদের কণ্ঠ। নতুন আদেশ দিচ্ছেন তিনি।

তীরন্দাজেরা, অবস্থান নাও! গোলন্দাজেরা, চলে যাও কামানের পাশে। বারুদ আর সলতে তৈরি রাখো! সবকটা আলো নিভিয়ে দাও!

সবগুলো লণ্ঠন নিভে গেল চোখের পলকে। পুপ-কেবিনের প্রদীপও নিভিয়ে দিয়ে এল এক নাবিক। মূল মাস্তুলের লণ্ঠনটা নেভানো হলো না, তবে পাটাতনে নামিয়ে এনে ঢেকে দেয়া হলো পাতলা কাপড় দিয়ে। ওটার আবছা আলোয় কাজ করতে থাকল সবাই।

কিছুক্ষণ পর নিকষ অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে অন্ধের মত যাত্রা শুরু করল জাহাজ। অন্ধকার চোখে সয়ে এল খুব শীঘ্রি। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমায় ফুটে উঠল খাড়ির চারপাশের অবয়বগুলো।

ততক্ষণে প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেছে কর্সেয়ারদের। নিঃশব্দে যার যার দায়িত্ব পালন করে চলেছে তারা। মনের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও মুখে প্রকাশ করছে না কেউ। হাজার হোক, বাদশাহ্ আর শাকের-আল-বাহার ওদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছে–জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে যদি গতকালই বেরিয়ে যেত এই খাড়ি থেকে, তা হলে আজকের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

জাহাজের গলুই থেকে শুরু করে তিন সারিতে সাজানো হয়েছে প্রতিরোধ ব্যুহ। সবার সামনে রয়েছে তীরন্দাজের দল। তারপর দাঁড়িয়েছে তলোয়ারধারীরা। অন্ধকারেও চকচক করছে। তাদের অস্ত্র। ওয়েইস্ট ডেক থেকে মূল মাস্তুলের দড়িদড়া পর্যন্ত অবস্থান নিয়েছে তারা। পুপ-ডেকের দুই কামানে অবস্থান নিয়েছে তিনজন গোলন্দাজ। মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বালছে তারা, কাঁপা কাঁপা শিখায় আলোকিত হচ্ছে তাদের রুক্ষ চেহারা।

পুপ-ডেকের সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন আসাদ, কিছুক্ষণ পর পর দিয়ে যাচ্ছেন সংক্ষিপ্ত আদেশ-নির্দেশ। তার পিছনে, পুপ-কেবিনের বাইরের দিকের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অলিভার; ওড়নায় মুখ ঢেকে রোজামুণ্ডও বেরিয়ে এসেছে ভিতর থেকে, দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। কৌতূহল নিয়ে দেখছে নাবিকদের কর্মকাণ্ড।

হাল ধরেছে একজন, হুইলে দাঁড়িয়ে গেছে আরেক কর্সেয়ার। ফোকর দিয়ে বের করা হয়েছে সবকটা দাঁড়। আসাদ নির্দেশ দেয়ামাত্র সেগুলো একসঙ্গে নামানো হলো পানিতে। চাবুকের আওয়াজ হলো, তারপর মৃদু হেঁইয়ো হেঁইয়ো তালে দাঁড় টানতে শুরু করল মাল্লা-রা। খাঁড়ির মুখ লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে চলল জাহাজ।

পাটাতনের মাঝখানের তক্তা ধরে দ্রুত পায়চারি করছে সারেং ও তাদের সহকারীরা, কোনও ক্রীতদাসকে কাজে ফাঁকি দিতে দেখলেই চালাচ্ছে চাবুক। খুব শীঘ্রি গতি বেড়ে গেল জাহাজের। দুপাশ থেকে সরে যেতে লাগল স্থলভূমি, বড় হতে লাগল যেন খড়িমুখটা। ওপাশে সাগরের কালো পানি।

দমবন্ধ করা উত্তেজনা অনুভব করল রোজামুণ্ড, হঠাৎ আঁকড়ে ধরল অলিভারের বাহু। ফিসফিসিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আমরা কি ফাঁকি দিতে পারব সিলভার হেরনকে?

প্রার্থনা করছি যাতে না পারি, অলিভার বলল। কিন্তু সমস্যা হলো, আসাদ নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর মত অভিজ্ঞ ও দক্ষ ক্যাপ্টেন খুব কম আছে। পারলে উনিই পারবেন।

একটু পরেই খড়িমুখ পেরিয়ে খোলা সাগরে পৌঁছে গেল। জাহাজ। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল বিশাল এক গ্যালিয়নের অবয়ব-ওদের বাঁ দিকে, একটু সামনে, এক কেইবল দূরত্বে রয়েছে ওটা। উপরিভাগ ঝলমল করছে আলোয়।

আরও জোরে! চেঁচিয়ে উঠলেন আসাদ। আরও জোরে দাঁড় টা, বিধর্মীর বাচ্চারা! ভিজিটেলো, চাবুক যেন না থামে… শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে বের করে নাও কুত্তাগুলোর থেকে। তা হলেই শত্রু আমাদের নাগাল পাবে না।

বাতাস কেঁপে উঠল চাবুকের সপাং সপাং আর ব্যথাতুর ক্রীতদাসদের আর্তনাদে। তার সঙ্গে দ্রিম দ্রিম করে বেজে উঠল ঢাক, ওটার তালে তালে এবার পড়ছে দাঁড়–নামছে, উঠছে… নামছে, উঠছে। মুখ ঘুরিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটল জাহাজ।

জোরে! আরও জোরে! উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচাতে থাকলেন আসাদ-আদ-দীন। যেভাবেই হোক, এই গতি ধরে রাখতে হবে তাঁদেরকে।

আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। একটু পর উল্লসিত গলায় চিৎকার করে উঠল মারযাক। আল্লাহ্ মহান!

আসলেই তা-ই। পিছনে ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করেছে গ্যালিয়নের আলো। বাতাসের মোটেই তেজ নেই, সবকটা পাল খাটানোর পরেও মোটেই সুবিধে করতে পারছে না ওটা। হামাগুড়ি দেবার মত এগোচ্ছে… আর এদিকে চিতার ক্ষিপ্রতায় ছুটছে কর্সেয়ারদের জলযান। আগে কোনোদিন এভাবে ছোটেনি জাহাজটা… শাকের-আল-বাহারের আমলে তো নয়ই; কারণ শত্রুকে দেখে কোনোদিনই পালায়নি অলিভার। সামর্থ্য যা-ই থাকুক, সোজা হামলা চালিয়েছে।

গ্যালিয়নের ডেক থেকে হৈ-হল্লা ভেসে এল, আর তা শুনে অপ্রকৃতিস্থের মত হেসে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ওঠালেন, আল্লাহ্ আর রাসূলের নাম নিয়ে অভিশাপ দিতে শুরু করলেন শত্রুকে। তাঁর অভিশাপের জবাবেই বোধহয়… আচমকা একটা বজ্রপাতের মত গর্জন শোনা গেল গ্যালিয়নের পাশ থেকে। আবছাভাবে চোখে পড়ল ধোয়া আর আলোর আভা। পরমুহূর্তে ভারী একটা কিছু আছড়ে পড়ল কর্সেয়ার-জাহাজের পঞ্চাশ গজ ডানে, পানি ছিটকাল।

ভয়ে অলিভারের গায়ে সেঁটে এল রোজামুণ্ড, বুঝতে পারছেকামানের গোলা ছোঁড়া হচ্ছে ওদেরকে লক্ষ্য করে।

হা হা করে হেসে উঠলেন আসাদ। বেকুবের দল! বলে উঠলেন তিনি। ভয় পাবার কিছু নেই, আমার সৈন্যেরা! ওরা সেফ আন্দাজের উপর কামান দাগছে। অন্ধকারে আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা।

আমার তা মনে হয় না, ফিসফিসিয়ে রোজামুণ্ডকে বলল আলজার! তুমি আছ এ-জাহাজে। সে-কারণেই সম্ভবত আমাদেরকে ডোবাতে চাইছেন না সার জন।

ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের দিকে চাইল রোজামুণ্ড। সিলভার হেরনের বাতি মান থেকে মানতর হয়ে যাচ্ছে।

আমরা তো এগিয়েই যাচ্ছি! ভয়ার্ত গলায় বলল ও। এভাবে চলতে থাকলে ওরা কিছুতেই ধরতে পারবে না আমাদের।

একই ভয় অলিভারের ভিতরেও কাজ করছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, অলৌকিকভাবে যদি ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু না করে, ওর পরিকল্পনার বারোটা বাজতে চলেছে। মরিয়া হয়ে উঠল ও, আর সে-কারণেই মাথায় এল বেপরোয়া এক চাল।

একটাই উপায় দেখতে পাচ্ছি, বলল ও। কিন্তু ব্যাপারটা জুয়া খেলার মত হয়ে যায়। জিতলে জীবন… আর হারলে নিশ্চিত মৃত্যু।

পরোয়া করি না, বলল রোজামুণ্ড। মরলেও এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না আমাদের।

যে-কোনও পরিণতির জন্য তৈরি আছ তুমি?

বলিনি, আজ রাতে তোমার সঙ্গে জীবন দেব আমি? আহ্, কথা বলে সময় নষ্ট কোরো না!

তবে তাই হোক, গম্ভীর গলায় বলল অলিভার। রোজামুণ্ডের কবজি হাতের মুঠোয় ধরল ও। এসো আমার সঙ্গে।

সিঁড়ি ধরে পুপ-ডেক থেকে নেমে এল দুজনে। সারেং আর তাদের সহকারীদের ঠেলে এগিয়ে চলল পাটাতন ধরে। বিস্মিত দৃষ্টিতে অনেকে তাকাল ওদের দিকে, কিন্তু বাধা দিল না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।

সোজা ওয়েইস্ট ডেকে চলে গেল অলিভার। কাপড়ে ঢাকা লণ্ঠনটা তুলে ধরিয়ে দিল রোজামুণ্ডের হাতে। উপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন বাদশাহ, নেভাতে বললেন লণ্ঠন, কিন্তু তাতে কান দিল না অলিভার। মূল মাস্তুলের গোড়ায় পৌঁছে থামল। ওখানে জড়ো করে রাখা হয়েছে জাহাজের সবকটা বারুদের পিপে! একটা পিপের মুখ খুলে ফেলল ও, কাত করে ভিতরের সব বারুদ ছড়িয়ে দিল পাটাতনের উপরে। তারপর রোজামুণ্ডের হাত থেকে লণ্ঠন নিয়ে ওটা ধরল ঠিক খোলা বারুদের উপরে।

বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এল দর্শকদের মুখ দিয়ে। কিন্তু সে-আওয়াজ ছাপিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল অলিভার:

দাঁড় টানা বন্ধ করো!

ঢাকের আওয়াজ থেমে গেল। কিন্তু এরপরেও এক দফা দাঁড় ঘোরাল মাল্লারা।

থামাও দাঁড় টানা! আবার চেঁচাল, অলিভার। আসাদ, ওদেরকে থামতে বলুন। নইলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সবাইকে দোজখে পাঠিয়ে দেব। হুমকিটা জোরালো করার জন্য লণ্ঠনটা একটু নামাল বারুদের উপরে।

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল দাঁড় বাওয়া। পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত স্থবির হয়ে গেল প্রতিটি মানুষ-ক্রীতদাস, কর্সেয়ার, শাহজাদা… এমনকী স্বয়ং বাদশাহও। ফ্যাল ফ্যাল করে সবাই তাকিয়ে থাকল লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত দীর্ঘদেহী মূর্তিটার দিকে। যমদূতের মত দেখাচ্ছে ওকে, হুমকি দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর।

অনেকক্ষণ পর মুখের ভাষা খুঁজে পেলেন আসাদ। খ্যাপাটে গলায় বললেন, ইয়া আল্লাহ্! শাকের, তোমাকে কি জ্বিনে ধরেছে?

ঝট করে পিতার পাশে এসে দাঁড়াল মারযাক। চেঁচিয়ে উঠে বলল, অ্যাই! সবাই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হারামজাদাকে কেটে দুটুকরো করে দে!

হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হলো না সে। ধনুক নিয়ে এসেছে, ওটা তাক করল অলিভারের দিকে। খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন আসাদ, ছেলে কতবড় বোকামি করতে চলেছে, তা বুঝতে পেরেছেন।

কেউ যদি আমার দিকে এক পা-ও এগোয়, বারুদে আগুন দেব আমি, শীতল গলায় বলল অলিভার। আমার দিকে যদি তীর ঘেঁড়ো, শাহজাদা, একই ঘটনা ঘটবে-হাত ফসকে লণ্ঠনটা পড়ে যাবে বারুদের উপর। এখুনি যদি আল্লাহর পেয়ারা হতে চাও, চেষ্টা করে দেখতে পারো।

শাকের-আল-বাহার! দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন আসাদ, গলার সুর বদলে গেছে। কসম খোদার, পাগলামি ছাড়ো, বাছা!

পাগলামি করছি না আমি, শান্ত গলায় বলল অলিভার। খুব ভেবে-চিন্তেই কাজ করছি। আলজিয়ার্সে ফিরে ফাঁসিতে ঝোলার ইচ্ছে নেই আমার… ইচ্ছে নেই মান্নার বেঞ্চিতে ফিরে যাবারও।

যদি কথা দিই, অমন কিছু ঘটবে না তোমার ভাগ্যে?

বিশ্বাস করব না আমি। আপনার উপর থেকে সমস্ত আস্থা হারিয়েছি আমি, আসাদ। কারণ নিজেকে মাথামোটা ও একগুঁয়ে বলে প্রমাণ করেছেন আপনি। এ-ধরনের একজনের উপর বিশ্বাস রেখে অতীতে মস্ত বড় ভুল করেছিলাম… আর সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটাব না। গতকাল ঠাণ্ডা মাথায় বোঝাতে চেয়েছি আপনাকে, কিছুই কানে তোলেননি। আপনার লোভই আপনার সর্বনাশ ডেকে এনেছে, আসাদ। অথচ যদি আমার কথা শুনতেন, এসবের কিছুই ঘটত না। নিরাপদে ফিরে যেতে পারতেন দেশে, আমাকে মনের মত করে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন। আমার জীবন তুলে দিয়েছিলাম আমি আপনার হাতে, আপনি পরোয়াই করেননি। মুখে যত না আঁটে, তারচেয়ে বেশি গিলতে চেয়েছিলেন। এবার বুঝুন মজা!

অলিভারের প্রতিটা কথা শেলের মত বিদ্ধ হচ্ছে বাদশাহ-র অন্তরে। নিজের অজান্তেই খামচে ধরলেন পুপ-ডেকের রেলিং, আঙুলগুলো সাদা হয়ে গেল রক্ত সরে যাওয়ায়। জাহাজের অবশিষ্ট প্রতিটা মানুষ নীরব দর্শক হয়ে দেখছে সবকিছু।

তোমার দাবি জানাও, ফাসফেঁসে গলায় বললেন আসাদ। আল্লাহ্-র কসম, যা চাইবে তা-ই পাবে তুমি।

আমি সেটা গতকালই বলেছিলাম, কিন্তু আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, অলিভার বলল। আমার জীবন ও স্বাধীনতার বিনিময়ে আরেকজনের জীবন ও স্বাধীনতা।

পাশ ফিরলে দেখতে পেত ও, রোজামুণ্ডের চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা-প্রেমের দৃষ্টি বললেও সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না।

আমি তোমাকে ধনী বানাব, শাকের… দেব অভূতপূর্ব সম্মান! খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইছেন যেন আসাদ-আদ দীন। আমার ছেলের মত থাকবে তুমি। আমার পরে পুরো বাদশাহীর মালিক বানাব তোমাকে। হবু-বাদশাহ্ হিসেবে যে-ধরনের সমীহ আর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা উচিত, সব পাবে তুমি…

দুঃখিত, আমাকে কেনা যাবে না, আসাদ, বাধা দিয়ে বলল অলিভার। বিক্রি হবার মানুষ ছিলাম না আমি কোনোকালেই। ছিলাম স্রেফ এক অনুগত ভৃত্য… কিন্তু আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে সেই বাঁধন ছিঁড়ে দিয়েছেন আপনি। এখন আর আপনার হুকুম মানতে বাধ্য নই আমি। এখন শুধু আপনি আমার পরিণতির ভাগীদার হবেন, আর কিছু না। এককালে দুজনে একসঙ্গে বহু জাহাজ ডুবিয়েছি আমরা, আজ একসঙ্গে আপনি আমার সঙ্গে ডুববেন।

গজব পড়ুক তোমার উপরে, বেঈমান! চিৎকার করে উঠলেন আসাদ। দোজখে পচবে তুমি!

বাদশাহ্-র কণ্ঠে পরাজয়ের সুর কান এড়াল না। কর্সেয়ারদের। গুঞ্জন শুরু হলো পুরো জাহাজ জুড়ে। একটু পর এগিয়ে এল কয়েকজন। হাতজোড় করে মিনতি করল অলিভারের কাছে। মনে করিয়ে দিল তাদের আনুগত্যের কথা, অনুরোধ করল ওদেরকে যেন এভাবে মৃত্যুমুখে না ফেলে।

আমার উপর আস্থা রাখো, বলল ওদেরকে অলিভার। এতদিন বিজয় ছাড়া আর কিছু দিইনি আমি তোমাদেরকে। আজ… আমাদের শেষ অভিযানে পরাজয় উপহার দেব, তা হতে পারে না।

কিন্তু গ্যালিয়নটা তো আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসেছে! হাহাকার করে উঠল ভিজিটেলো।

সত্যিই তা-ই। হালকা বাতাসের সাহায্য নিয়ে ধীরে হলেও মূর্তিমান দানবের মত এগিয়ে আসছে সিলভার হেরন। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে ওটার অবয়ব। কর্সেয়ার জলযান লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে জাহাজটার গলুই। একটু পরেই একেবারে পাশে চলে এল। ওটার পাটাতন থেকে ভেসে এল ইংরেজ নাবিকদের বিজয়োল্লাস। লোহার আঁকশি ছুটে এল খুব শীঘ্রি, পাশাপাশি বেঁধে ফেলা হলো দুটো জাহাজকেই। আর তারপরেই বর্ম পরে, হাতে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে মুসলিম দস্যুদের জাহাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল যোদ্ধা। বারুদে আগুন ধরবার পরোয়া আর করল না কর্সেয়াররা। যা করে অভ্যস্ত, তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অস্ত্রের ভাষায় অভ্যর্থনা জানাল হামলাকারীদের।

অস্ত্রের ঝনঝনানিতে প্রকম্পিত হলো চতুর্পাশ। গ্যালিয়নের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে অলিভার। ইংরেজ যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সার জন কিলিগ্রু, তাঁর পাশেই রয়েছে লায়োনেল। ওরা দুজনেই সবার আগে চড়েছে ওদের জাহাজে। পাটাতনে পা রেখেই পেয়ে গেছে জ্যাসপার লেইকে। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে লায়োনেলের উদ্দেশে তলোয়ার চালাল লোকটা, কোনোমতে তার আঘাত ঠেকাল ছোট ট্রেসিলিয়ান। আবার তলোয়ার চালাল জ্যাসপার… আবার! একইভাবে চারপাশে চলছে আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণ। প্রমাদ গুনল অলিভার, রক্তগঙ্গা বইতে শুরু করেছে… ঘটে যাচ্ছে অনর্থক প্রাণহানি। চোখের সামনে। একের পর এক লাশ পড়তে দেখছে ও।

থামো তোমরা! সঙ্গীদের উদ্দেশে আরবীতে চেঁচিয়ে উঠল ও। তারপর ইংরেজিতে বলল, একটু থামুন, সার জন! আমার কথা শুনুন। থামান আপনার লোকজনকে। আমার কথা শেষ হবার পর নাহয় যা খুশি করবেন।

রোজামুণ্ডকে ওর পাশে দেখতে পাচ্ছেন সার জন, ভয় পেলেন পাছে ক্ষতি হয় মেয়েটার, তাই তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে হাত তুললেন, দাঁড়াতে বললেন নিজের যোদ্ধাদের।

কয়েক মুহূর্তের হৈ-হল্লার পর নেমে এল পিনপতন নীরবতা। দুপাশে সরে গেল দুই পক্ষের যোদ্ধারা।

অলিভারের দিকে ফিরলেন এবার সার জন। বললেন, কী বলার আছে তোমার, দলত্যাগী কুকুর?

প্রথমেই জানিয়ে দিতে চাই, অলিভার বলল, আপনি যদি এক্ষুণি আপনার লোকজনকে জাহাজে ফিরে যেতে না বলেন, তা হলে এটা বারুদে ছুঁড়ব আমি। হাত নেড়ে জ্বলন্ত লণ্ঠন আর পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা বারুদ দেখাল ও। আমার জাহাজ ডুবে যাবে… আর ওটার ওজনে ডুববে আপনারটাও। দুটোই একসঙ্গে বেঁধে রেখেছেন কি না!

হুমকি দিচ্ছ?

না, সতর্ক করে দিচ্ছি। অযথা রক্তপাতের প্রয়োজন নেই। যার জন্যে এসেছেন… মানে রোজামুণ্ডের কথা বলছি… ওকে কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই নিয়ে যেতে পারেন আপনি। শুধু যদি লড়াই না করেন… যদি কারও রক্ত না ঝরান।

চারপাশে চোখ বোলালেন সার জন। সশস্ত্র কর্সেয়ারদেরকে দেখে বুঝি হিসেব করে নিলেন, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে কতখানি ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। বললেন, দস্যুদের সঙ্গে চুক্তি করবার ইচ্ছে নেই আমার, তারপরেও… তোমার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, রাজি হব। আমি… তবে একটা শর্ত আছে। শুধু রোজামুণ্ডকে দিলে চলবে না, আমি আরেকজনকে গ্রেফতার করব বলেও মনস্থির করে এসেছি। জনৈক শাকের-আল-বাহার… এককালে যাকে অলিভার ট্রেসিলিয়ান বলে ডাকতাম আমরা… মানে, তুমি!

নির্দ্বিধায় মাথা ঝোঁকাল অলিভার। আমি রাজি। আত্মসমর্পণ করব আমি আপনার কাছে, কিন্তু কথা দিতে হবে-বাকিদের আপনি ছেড়ে দেবেন।

উত্তেজনায় ওর লণ্ঠন-ধরা হাতটা আঁকড়ে ধরল রোজামুণ্ড। আরেকটু হলেই বারুদে পড়ে যাচ্ছিল ওটা।

সাবধান, লেডি, হালকা গলায় বলল অলিভার, নইলে আমাদের মরণ ডেকে আনবে তুমি।

আমার তাতে কোনও দুঃখ থাকবে না, বলল রোজামুণ্ড।

এগিয়ে এসে চড়া গলায় প্রতিশ্রুতি দিলেন সার জন-অলিভার আত্মসমর্পণ করলে, আর রোজামুণ্ডকে তাঁর জিম্মায় তুলে দেয়া হলে কারও কোনও ক্ষতি করবেন না।

কর্সেয়ারদের দিকে ফিরল অলিভার। অনুবাদ করে শোনাল সার জনের বক্তব্য। বাদশাহকে অনুরোধ করল তাতে সম্মতি জানাতে।

মুখ বাঁকালেন আসাদু-আদ-দীন। তোমাকে তো ফাঁসিতেই ঝোলাতে চাইছে লোকটা… অসুবিধে কী? একটা বেঈমান আর বিধর্মী মেয়ের প্রাণের বদলে যদি ঝামেলা এড়ানো যায়, আমি তাতে বাধা দেব কেন?

সার জনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল অলিভার। আমি তা হলে আত্মসমর্পণ করছি। লণ্ঠনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল পানিতে।

কথাটা মুখ থেকে বেরুতে যা দেরি, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল কয়েকজন ইংরেজ যোদ্ধা, ঝটপট বেঁধে ফেলল ওর দুহাত। কেড়ে নিল তলোয়ার। রোজামুণ্ড ওর পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু সুযোগ পেল না। সার জন দ্রুত এগিয়ে এসে একটা কম্বল জড়িয়ে দিলেন ওর গায়ে। তারপর এক হাতে জাপটে ধরে দ্রুত নিয়ে যেতে শুরু করলেন নিজের জাহাজের দিকে। ভয় পাচ্ছেন, কর্সেয়াররা হয়তো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বসবে।

তেমন কিছু ঘটল না। নীরবে অলিভারকে বন্দি হতে দেখল জলদস্যুরা, দেখল ইংরেজ জাহাজে সওয়ার হতে। ওকে যখন ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছে যোদ্ধারা, তখন উপলব্ধি এল ওদের মনে-বুঝতে পারল শাকের-আল-বাহারের আত্মত্যাগের প্রকৃতি। হ্যাঁ, ধোকা দিয়ে শত্রু-জাহাজকে ওদের উপর চড়াও হতে দিয়েছে মানুষটা, কিন্তু নিজে আত্মসমর্পণ করে সবার জীবনও বাঁচিয়েছে! শেষ পর্যন্ত সঙ্গীদের প্রতিই অনুগত থেকেছে সে, অন্য কারও প্রতি নয়। আবেগ ভর করল কর্সেয়ারদের মধ্যে। তলোয়ার উঁচু করে হৈ হৈ করে উঠল তারা… প্রাণ থাকতে প্রিয় নেতাকে নিয়ে যেতে দেবে না। আসাদ চেঁচিয়ে ওদেরকে থামতে বললেন, কিন্তু তাতে কাজ হলো না। হলো অলিভারের চিৎকারে।

বন্ধুরা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কোরো না… মিথ্যেবাদী বানিয়ো না আমাকে! বলল ও। ভাল থেকো! আল্লাহ্ তোমাদের রক্ষা করুন… দিনে দিনে উন্নতি হোক তোমাদের!

সমস্বরে ওর আশীর্বাদের জবাব দিল দস্যুরা। কথা দিল, কোনোদিন ভুলবে না ওকে।

একটু পরেই কেটে দেয়া হলো সব বাঁধন, খুলে নেয়া হলো আঁকশি। কর্সেয়ারদের জাহাজের পাশ থেকে সরে এল সিলভার হেরন। মুখ ঘুরিয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

জাহাজকে আলজিয়ার্সের পথে রওনা হবার আদেশ দিলেন আসাদ-আদ-দীন। যা ঘটে গেছে, এরপর আর স্প্যানিশ স্বর্ণবাহী জাহাজের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাবার মানসিকতা নেই তার। ফেরার আদেশ দিয়ে চলে এলেন শামিয়ানার তলায়, তক্তপোশে বসে মুখ ঢাকলেন দুহাতে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে শরীর। অব্যক্ত এক যন্ত্রণা অনুভব করছেন বুকের ভিতর। রাগ-দ্বেষ হিংসা কেটে গিয়ে ভর করেছে অনুশোচনা। শাকের-আল বাহারের শেষ কাজটা শুধু কর্সেয়ারদের মধ্যে নয়, তার ভিতরেও জাগিয়ে তুলেছে ওর আনুগত্যের উপলব্ধি।

ভুল করেছেন তিনি, বুঝতে পারছেন আসাদ, মস্ত ভুল। মোহ আর ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, সে-কারণে হারিয়েছেন পুত্রসম ছেলেটিকে। পুরো নারীজাতিকে অভিশাপ দিলেন সে-কারণে, অভিশাপ দিলেন ভাগ্যকে… তবে সবচেয়ে বেশি অভিশাপ দিলেন নিজেকে।

পাটাতন থেকে পানিতে লাশ ফেলতে শুরু করেছে কর্সেয়াররা। ধুয়ে ফেলছে রক্ত। কেউ খেয়াল করল না, লাশের মধ্যে নেই ওদের এক সঙ্গী… প্রাক্তন এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন। নেই জীবিতদের মধ্যেও।

দুঃখে কাতর অবস্থায় আলজিয়ার্সে ফিরল কর্সেয়াররা। অভিযানে ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং ওদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে হারাবার শোকে। ইসলামের নামে অস্ত্র তোলার জন্য ওর চেয়ে বড় আর কোনও বীর দেখেনি ওরা কোনোদিন। কী ঘটেছিল, তা সাধারণ মানুষ কোনোদিন জানতে পারল না। কেউ সাহসই করল না সেই কাহিনি প্রকাশ করবার। এটুকু শুধু জানল সবাই, যুদ্ধে মারা যায়নি শাকের-আল-বাহার, বেঁচে আছে সে। সত্যের অভাবে জন্ম নিল গুজব, ছড়িয়ে পড়ল কল্প-কাহিনির ডালপালা। এর উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হলো এক অদ্ভুত কিংবদন্তি। পরের অর্ধশতাব্দীর প্রতিটি প্রহর প্রতীক্ষায় রইল মানুষ-একদিন ফিরে আসবে তাদের মহান বীর। শাকের-আল-বাহারের জন্য এই অপেক্ষা পরিণত হলো আলজিয়ার্সের দৈনন্দিন জীবনের এক অংশে।

.

২৩.

 ভিন্ন ধর্ম

 সিলভার হেরনের ফোক্যাসলে, একটা অন্ধকার কুঠুরিতে নিক্ষেপ করা হলো অলিভারকে! আত্মসমর্পণের পর থেকে ওর সঙ্গে আর একটি কথাও বলেননি সার জন। পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ওকে তোলা হয়েছে জাহাজে, খেদিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওখানে। পরিচিত আরেকটা মুখ দেখেছে অলিভার আসার পথে-লর্ড হেনরি গোড, ব্রিটেনের মহামান্য রানির লর্ড লেফটেন্যান্ট… তা থেকে বুঝতে পেরেছে, এই অভিযানে রাজপ্রাসাদের পৃষ্ঠপোষকতা আছে।

নিকষ আঁধারে অনেকক্ষণ অসহায়ের মত পড়ে রইল প্রাক্তন নাইট, নির্বিকারভাবে। কিছু ভাবছে না, অনুভব করছে না উদ্বেগ বা ভয়… মাথা ঘামাচ্ছে না ভবিষ্যৎ নিয়ে। নিজের দায়িত্ব পালন করেছে ওরোজামুণ্ডকে মুক্ত করেছে, প্রাণ বাঁচিয়েছে মুসলিম বন্ধুদের, লায়োনেলও খুব শীঘ্রি তার অপরাধের শাস্তি পাবে। এসবের পরে আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। নিজেকে তো মৃতই ধরে নিয়েছে, খামোকা দুশ্চিন্তা করে লাভ কী? সবকিছু তাই সঁপে দিয়েছে ভাগ্যের হাতে। যা ঘটে ঘটুক, পরোয়া করে না ও। হ্যাঁ, যদি ভাবত কী হারিয়েছে–মানে আলজিয়ার্সের বাদশাহী এবং কর্সেয়ার-বাহিনীর নেতৃত্ব আর কী–তা হলে হয়তো বা খারাপ লাগতে পারত। কিন্তু কোনোকালেই ওসবের প্রতি লোভ ছিল না ওর। খ্রিস্টান অভিজাত পরিবারে জন্ম নেয়া একজন ভদ্রলোকের জন্য অমন ভবিষ্যৎ শোভাও পায় না। যা ঘটেছে, তা-ই বরং অনেক ভাল।

হঠাৎ কুঠুরির ভিতরে একটা খসখসানির আওয়াজে বাস্তবে ফিরে এল অলিভার। ইঁদুর-টিদুর হবে, ভাবল ও। সোজা হয়ে বসে পা ঠকল মেঝেতে, প্রাণীটা যাতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তেমন কিছু ঘটল না, তার বদলে ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠ।

কে ওখানে?

চমকে গেল অলিভার। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, এতক্ষণ কুঠুরিতে ও একাই আছে বলে ভেবেছিল, এখন সে-ধারণা বদলে গেছে।

কে ওখানে? জবাব না পেয়ে আবার বলে উঠল মানুষটা। এত অন্ধকার কেন? কোথায় আমি?

জ্যাসপার লেইয়ের গলা চিনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না অলিভারের। শুধু বুঝতে পারছে না, লোকটা এখানে এল কী করে। ওর সঙ্গী-সাথীদের কারও তো বন্দি হবার কথা ছিল না।

শান্ত হও, বলল ও। সিলভার হেরনের ফোক্যাসলে আছ তুমি। কীভাবে এসেছ, তা জানি না।

কে আপনি? মাথা বোধহয় কাজ করছে না লেইয়ের। চিনতে পারছে না অলিভারের গলা।

আমাকে বারবারি উপকূলে শাকের-আল-বাহার বলে ডাকা হয়।

সার অলিভার! চমকে ওঠা কণ্ঠে বলল লেই।

হু… এখন সম্ভবত ওই নামেই ডাকতে পারবে, যদিও খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। ধারণা করছি, সাগরের পানিতে কবর হবে আমার। নইলে আমার কবরফলকে কোন্ নাম লেখা হবে, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেতে পারে অভিজাত ইংরেজরা। কিন্তু… তুমি এখানে কী করে এলে, জ্যাসপার? আমার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন সার জন–আর কোনও কর্সেয়ারকে বন্দি করবেন না। মনে তো হয় না তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করার মানুষ!

অতকিছু তো জানি না, বলল লেই, তবে লড়াইয়ের সময় মাথায় আঘাত পেয়ে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম আমি… আপনার ওই দুশ্চরিত্র ভাইটির গায়ে তলোয়ার বিধিয়ে দেবার পরে।

থমকে গেল অলিভার। কী বললে? তুমি লায়োনেলকে খুন করেছ?

আমার তা-ই বিশ্বাস, শান্তকণ্ঠে জানাল লেই। অন্তত তলোয়ারের ফলার দুফুট ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম ওর গায়ে। ওই যে… ওরা যখন লাফিয়ে আমাদের জাহাজে উঠল! সবার সামনে পেয়ে গিয়েছিলাম মাস্টার লায়োনেলকে। ভাবতেই পারিনি ওকে ওখানে দেখব।

নীরব হয়ে গেল অলিভার। হঠাৎ বুক খা খা করে উঠেছে। একটু পর নিজেকে সামলে বলল, সন্দেহ নেই, ওকে ওর প্রাপ্য শাস্তিই দিয়েছ তুমি। এ-কথাও ঠিক, সবার সামনে লায়োনেলকে পেয়ে যাওয়াটা একটু অবিশ্বাস্য বটে। আর যা-ই হোক, সামনে থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত মানুষ নয় ও।

তা হলে?

কে জানে, হয়তো ইচ্ছে করেই মরতে এসেছিল। ফাঁসির দড়ির চেয়ে তলোয়ারের ফলা অনেক ভাল না? আশা করি তা-ই ঘটেছে। ঈশ্বর ওর আত্মাকে শান্তি দিন।

আপনি আবার ঈশ্বরের কথা বলছেন? বিভ্রান্ত কণ্ঠে। জিজ্ঞেস করল লেই। আল্লাহ্-র কী হলো?

আল্লাহ্ বল, বা ঈশ্বর… সর্বশক্তিমান তো একজনই—তাই না? কী নামে ডাকলে, তাতে কী এসে-যায়? যাক গে, এবার বোঝা যাচ্ছে তোমাকে এখানে পাবার কারণ। লায়োনেল খুন হওয়ায় তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে ইংরেজরা–সার জনের সঙ্গে আমার চুক্তি হবার আগেই। সম্ভবত শাস্তি দেবার ইচ্ছে। হাসল অলিভার। অবশ্য… যদ্র জানি তোমার সম্পর্কে, বহুকাল আগে থেকেই ফাঁসিতে চড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছ তুমি। কাজেই নতুন কোনও দুঃসংবাদ দিচ্ছি না! ঠিক?

জবাব দিল না লেই। অন্ধকারে নড়ে উঠল। ও, মাথাটা টন টন করছে! ককিয়ে উঠল সে।

এর একটা চমৎকার অষুধ আছে… ফাঁসি! তিক্ত গলায় বলল অলিভার। আশা করছি সকাল হলেই ওটা জুটবে তোমার-আমার কপালে। দুঃখিত লেই, তোমার এ-পরিণতি চাইনি আমি। লায়োনেলের আসলে আমার হাতে খুন হওয়া দরকার ছিল। তা হলে তুমি বাকি কর্সেয়ারদের সঙ্গে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লেই। বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সার অলিভার? আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, কলেমা পড়ল অলিভার। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও উপাস্য নেই, এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত রাসূল।

ভিন্নধর্মীদের মন্ত্র পড়ছেন আপনি! বিরক্ত গলায় বলল লেই। এখন কি আর কোনও প্রয়োজন আছে তার? আলজিয়ার্স ছেড়ে এসেছি আমরা!

আমি ওটা নিজের স্বার্থের জন্য পড়ছি না, লেই। ইসলাম ধর্মকে সত্যিই মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছি আমি। ওটা স্রেফ ধর্ম নয়, জীবনযাপনের একটা ধারা… খুব সুন্দর এবং নিয়ন্ত্রিত একটি ধারা। দুঃখের বিষয়, খ্রিস্টানদের মধ্যে ওদের মত শৃঙ্খলা আমি কখনও দেখিনি।

মরার আগে এ-সব কী বলছেন? বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়ে মরতে চান আপনি?

ধর্ম কী? দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলল অলিভার। মানুষের বিশ্বাস বৈ আর তো কিছু নয়!

তারমানে আল্লাহ বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না আপনি, উপসংহারে পৌঁছুবার চেষ্টা করল লেই। মানছেন আসলে মনের বিশ্বাসটাকে।

ঠিক তার উল্টো। আমি আল্লাহকেই বিশ্বাস করি।

সত্যিকার আল্লাহ? যিনি আসমানের উপরে থাকেন?

 আর তো কোনও আল্লাহ্ নেই। আগেই তো বলেছি, তিনি এক-আমরা একেক ধর্মে একেক নামে ডাকি… এই আর কী।

যদি বিশ্বাসই করেন, ভয় হচ্ছে না আপনার?

কীসের ভয়?

নরকের… আগুনের… অনন্ত শাস্তির! গলা কেঁপে উঠল লেইয়ের।

শান্ত রইল অলিভার। ভয়ের কী আছে? আল্লাহ যেভাবে আমার ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, সেভাবেই কাজ করেছি আমি। যেভাবে আমাকে তৈরি করেছেন, তা-ই হয়েছি আমি। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো কিছুই করা সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে! তা হলে তার ইচ্ছে পালনের জন্য ভয় পাব কেন?

আপনি মুসলমানদের বুলি আওড়াচ্ছেন!

কারণ আমি মুসলমান… এবং এই ধর্ম আমাকে শান্তি দিচ্ছে! তোমার মত পাপীরও একই কাজ করা উচিত।

অন্ধকারে মাথা নাড়ল লেই। যদি ঈশ্বর বা আল্লাহতে বিশ্বাস করতাম, তা হলে তা-ই করতাম আমি। কিন্তু আজও আমি মনে-প্রাণে নাস্তিক রয়ে গেছি, সার অলিভার।

অলিভার হাসল। তোমার অবিশ্বাসে আল্লাহ্ উধাও হয়ে যাবেন না, কিংবা বিশ্বাস করলেও রাতারাতি উদয় হবেন না। অস্থির হয়ে আছ তুমি, লেই। আমার পরামর্শ হলো, প্রার্থনা করো তার উদ্দেশে। উপকার হবে তাতে।

আপনি প্রার্থনা করবেন না?

প্রার্থনার চেয়েও বেশিকিছু করব। তোমার প্রাণভিক্ষা চাইব আমি সার জনের কাছে।

উনি আপনার কথা শুনতে যাবেন কেন?

শুনতে হবে ওঁকে। ওঁর সম্মান জড়িত এতে। আমাকে কথা দিয়েছেন, কর্সেয়ারদের মধ্যে আমাকে ছাড়া আর কাউকে শাস্তি দেবেন না। তুমি ওদেরই একজন।

কিন্তু মাস্টার লায়োনেলকে খুন করেছি আমি।

সত্যি। কিন্তু ওর খুনির ব্যাপারে আলাদা কোনও শর্ত দেননি সার জন। এখন যদি ফাঁসিতে ঝোলান তোমাকে, প্রতিশ্রুতি-ভঙ্গকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এ-কথাটাই আমি বুঝিয়ে দেব ভদ্রলোককে।

বুকের উপর থেকে জগদ্দল এক পাথর যেন সরে গেল লেইয়ের–মনে হলো যেন মাথার উপর থেকে সরে গেছে মৃত্যুর ছায়া। নরক বা অনন্ত শাস্তির কথা আর বলল না সে, কটাক্ষ করল না অলিভারের ধর্মবিশ্বাস নিয়েও। বুঝে গেল, কে কোন্ ধর্মের উপর বিশ্বাস রাখবে, সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্তত ওর মত লোকের শোভা পায় না এ-নিয়ে কোনও ধরনের মন্তব্য করা। আর যদি নিজের ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে, সেটা সময় এলে ভেবে দেখা যাবে।

 নীরব হয়ে গেল লেই। মেঝেতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল, যদিও সফল হলো না তাতে। নৈঃশব্দ্য অসহ্য হয়ে উঠলে আবার অলিভারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে প্রাক্তন নাইট।

বিস্ময় জাগল লেইয়ের মনে। বুঝতেই পারছে না, এমন পরিস্থিতিঙে লোকটা ঘুমায় কী করে! ঘৃণিত এক জলদস্যু, ধর্মত্যাগী বিশ্বাসঘাতক, তার ওপরে ফেরারী আসামী—নিশ্চিত ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করছে অলিভারের জন্য। এরপরেও কি সামান্যতম দুশ্চিন্তা অনুভব করছে না সে? একবার ভাবল ডেকে তোলে তাকে, পরমুহূর্তে মত পাল্টাল। থাক, ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। পরেরবার যখন ঘুমাবে, তখন তো আর জাগতে পারবে না অদ্ভুত মানুষটা।

অন্ধকার কুঠুরিতে একাকী আপন-চিন্তায় ডুবে গেল জ্যাসপার লেই। যতই ভাবল, ততই অপরাধবোধ পেয়ে বসল তাকে। অলিভারের আজকের দুর্দশার পিছনে তার অবদান কম নয়। অথচ তারপরেও লেইয়ের জীবন বাঁচিয়েছে লোকটা আলজিয়ার্সে, আজও আবার তার হয়ে সার জনের কাছে জীবনভিক্ষা চাইবে বলে কথা দিয়েছে। এমন মহত্ত্ব কোনও সাধারণ মানুষের কাছে আশা করা যায় না। কিছু করা যায় না মানুষটার জন্য? আসল ঘটনা যতটুকু জানে লেই, তা যদি খুলে বলে সার জনের সামনে, তাতে কি প্রাণরক্ষা পাবে না অলিভারের? নিজের হঠকারিতার কাহিনি বলে হয়তো বিপদ ডেকে আনবে লেই, তবু চিন্তাটা কিছুতেই দূর করতে পারল না মাথা থেকে।

রাতভর ছটফট করল সে। জীবনে এই প্রথমবারের মত একটা ভাল কাজ করবে বলে ঠিক করেছে, কিন্তু সেটার সুযোগ পাবে কি না জানে না।

ভোর হতেই হাজির হলো কয়েকজন নাবিক, অলিভারকে নিয়ে যেতে এসেছে। সঙ্গে যেতে চাইল লেই, কিন্তু রাজি হলো না লোকগুলো।

তোমাকে নেবার কোনও আদেশ পাইনি আমরা, রুক্ষ গলায় বলল এক নাবিক।

না পেতে পারো, বলল লেই, কিন্তু সার জন জানেন না আমি কী বলতে চাই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা… দেরি হয়ে যাবার আগেই শোনা প্রয়োজন তার। দয়া করে নিয়ে চলো আমাকে না নিলে মস্ত ভুল করবে।

চুপ! গর্জে উঠল নাবিক। থাপ্পড় মারল লেইয়ের গালে। এত উতলা হয়ো না। খুব শীঘ্রি তোমার পালা আসবে। আপাতত এই বদমাশটার একটা গতি করে নিই!

লেই তারপরেও হাল ছাড়তে রাজি ছিল না, কিন্তু অলিভার হাত তুলে বাধা দিল তাকে। বলল, খামোকা মুখ খরচ করে লাভ নেই, তোমার কথা শুনবে না ওরা। কী জন্যে যেতে চাইছ, তা আমি বুঝতে পারছি, বন্ধু। সেজন্যে ধন্যবাদ। হাত বাঁধা আমার, নইলে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম। বিদায়।

লেইয়ের শূন্য দৃষ্টির সামনে ওকে নিয়ে গেল নাবিকরা। কুঠুরি থেকে বের করে আনল সকালে রৌদ্রস্নাত পাটাতনে। অন্ধকার থেকে এমন উজ্জ্বল আলোয় এসে চোখ কুঁচকে গেল অলিভারের, ক্ষণিকের জন্য সব সাদা সাদা ঠেকল, দেখতে পেল না কিছু। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ওকে এগিয়ে নিয়ে চলল নাবিকরা। অলিভার ধরে নিল, কোনও একটা কেবিনে ঢোকানো হবে ওকে, প্রহসনমূলক একটা বিচারের জন্য। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটল না। জাহাজের মাঝ বরাবর পৌঁছুতেই একজন অফিসার এসে দায়িত্ব নিল বন্দির, ওকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলল।

পাটাতনের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখা একটা দড়ির স্তূপে বসে পড়ল অলিভার, চারপাশে রইল সশস্ত্র প্রহরী। আশপাশ দিয়ে যাবার সময় জাহাজের সমস্ত নাবিক কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে ওর দিকে। হাজার হোক, ধর্মত্যাগী নাইট… তার ওপর আবার খ্রিস্টানদের যম, দুধর্ষ এক কর্সেয়ারকে তো রোজ রোজ দেখার সুযোগ মেলে না! দাড়ি-গোঁফে ঢাকা… পাগড়ি আর কোর্তা-পাজামা পরা মানুষটাকে দেখে বিশ্বাস করা মুশকিল, এ-মানুষ কোনও এককালে কর্নওয়ালের বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিল।

লোকজনের দৃষ্টিবাণকে অগ্রাহ্য করে চুপচাপ বসে রইল অলিভার। নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে পা নাড়াল, হাবভাবে ভয়-ডরের কোনও চিহ্ন নেই। ফাঁকে ফাঁকে, চঞ্চল দৃষ্টি বোলাল চারপাশে। রোজামুণ্ডকে খুঁজে ফিরছে।

কিন্তু কোথাও দেখা গেল না মেয়েটিকে। গত কয়েক ঘণ্টা থেকে জাহাজের কেবিনে পড়ে আছে সে। অলিভারের জানা নেই, ওর কারণেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে।

.

২৪.

 বিচার

জাহাজে দ্বিতীয় কোনও মহিলা নেই, তাই উপায়ান্তর না দেখে লর্ড হেনরি, সার জন আর জাহাজের ডাক্তার মাস্টার টোবিয়াস মিলে যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রূষা করছেন রোজামুণ্ডের। সিলভার হেরনে চড়ার পর থেকে আধো-অচেতন অবস্থায় আছে মেয়েটা।

যত রকম ওষুধ-পথ্য আছে, খাওয়ানো হয়েছে ওকে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে জাহাজের পিছনদিককার একটা আরামদায়ক কেবিনে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। বিশ্রাম প্রয়োজন ওর।

রোজামুণ্ডের চিকিৎসা হয়ে গেলে ওকে সার জন আর লর্ড হেনরির তত্ত্বাবধানে রেখে জাহাজের নীচের অংশে চলে এলেন মাস্টার টোবিয়াস। ওখানে আরও গুরুতর এক রোগী রয়েছে–লায়োনেল ট্রেসিলিয়ান। কর্সেয়ারদের জাহাজ থেকে আরও চারজন আহত নাবিকের সঙ্গে ওকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে।

ভোরের আলো ফুটলে লায়োনেলের খবর নিতে এলেন সার জন। তিনি হাজির হতেই রোগীর কাছ থেকে সরে এলেন টোবিয়াস। রক্তমাখা হাত ধুয়ে ফেললেন মেঝেতে রাখা গামলার পানিতে। তারপর তোয়ালে-তে হাত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন।

আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়, সার জন, হতাশ গলায় বললেন ডাক্তার। ও শেষ!

শেষ মানে? আঁতকে উঠলেন সার জন। মরে গেছে?

তোয়ালে নামিয়ে রাখলেন মাস্টার টোবিয়াস। শার্টের গোটানো হাতার ভাঁজ খুলতে শুরু করলেন। মরাটাই শুধু বাকি, বললেন, তিনি। শরীরে অত্তো বড় একটা ফুটো হবার পর জীবনের প্রদীপ জ্বলতে পারে না। ক্ষতটা বন্ধ করেছি আমি, কিন্তু আভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয়ে চলেছে ওর। মরার আগ পর্যন্ত চলবে ওটা। ওকে আপনি মৃতই ধরে নিতে পারেন। একটু থামলেন। সান্ত্বনা একটাই–জ্ঞান নেই ওর। ব্যথা-বেদনা অনুভব করবে না। শান্তিতে মারা যাবে। কোনও অভিব্যক্তি ফুটছে না তার মুখে। ডাক্তারি পেশায় মানুষের মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত তিনি। দায়সারা ভঙ্গিতে যোগ করলেন, বাকিদের মধ্যে ব্লেয়ার ইতোমধ্যে মারা গেছে। অন্য তিনজন সুস্থ হয়ে উঠবে।

শেষ কথাটা কানে গেল না সার জনের। পুত্র-তুল্য যুবকটির জন্য শোকাতুর হয়ে উঠেছে তার অন্তর।

ও কি একবারও জাগবে না? আকুল কণ্ঠে জানতে চাইলেন।

বললাম তো, ওকে মৃতই ধরে নিতে পারেন। দুঃখিত, ব্যাপারটা আমার ক্ষমতার বাইরে।

কাঁধ ঝুলে পড়ল সার জনের। চেহারা বিমর্ষ হয়ে উঠেছে। আমারও, বললেন তিনি। ওর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারব, কিন্তু ফেরাতে পারব না ছেলেটাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নিয়তির সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস এই প্রতিশোধ… বুকের জ্বালা হয়তো মেটে, কিন্তু ক্ষতিটা পূরণ হয় না।

সুবিচার করাটা আপনার দায়িত্ব, বললেন টোবিয়াস, প্রতিশোধ নেয়া নয়।

দুটোয় খুব বেশি কি পার্থক্য আছে? লায়োনেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সার জন। তাকালেন ফ্যাকাসে চেহারাটার দিকে, মৃত্যুর ছাপ পড়তে শুরু করেছে ওতে। অন্তত সুবিচারের খাতিরেও যদি একটু কথা বলতে পারত। অলিভার ট্রেসিলিয়ানকে যদি ওর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঝোলাতে পারতাম, মনের সাধ মিটত!

সেটা তো আর সম্ভব নয়, টোবিয়াস বললেন। তবে চিন্তার কিছু দেখছি না। লেডি রোজামুণ্ডের জবানবন্দি নিতে পারব আমরা। সার অলিভারের অপরাধ প্রমাণের জন্য ওটাই যথেষ্ট… মানে, আদৌ যদি প্রমাণের প্রয়োজন হয় আর কী।

হুঁ। কুখ্যাতিই যথেষ্ট। লোকটা মানুষ আর ঈশ্বর… দুইয়ের সঙ্গেই এত অপরাধ করেছে যে, এখন আর সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রয়োজন নেই। ওকে ক্ষমা করবার প্রশ্নই ওঠে না।

দরজায় টোকা পড়ল। এক ভৃত্য ঢুকল কামরায়। জানাল, লেডি রোজামুণ্ড জেগে উঠেছেন… এক্ষুণি দেখা করতে চেয়েছেন সার জনের সঙ্গে।

নিশ্চয়ই লায়োনেলের খবর জানতে চাইবে। মুখ কালো হয়ে গেল সার জনের। হায় যিশু, কী বলব ওকে আমি? মুক্তির আনন্দ নষ্ট করে দেব হবু-স্বামীর মৃত্যুর কথা বলে? মাথা নাড়লেন তিনি। চোখ ফেরালেন ডাক্তারের দিকে। আপনি এখানে থাকছেন তো?

অবশ্যই, সার জন, বললেন টোবিয়াস। তবে খুব বেশিক্ষণ থাকতে হবে না বোধহয়। লায়োনেলের করুণ দশার দিকে ইঙ্গিত করলেন।

ঈশ্বর ওকে শান্তি দিন, বিড়বিড় করলেন সার জন। তারপর বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে।

পাটাতনে পৌঁছে একটু থামলেন তিনি। মাস্তুলে একটা ফাঁসের দড়ি ঝোলাতে বলে গিয়েছিলেন, সেটার অগ্রগতি দেখলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন অলিভার ট্রেসিলিয়ানকে বন্দিশালা থেকে বের করে আনবার। একটু পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হাজির হলেন রোজামুণ্ডের কেবিনে।

জানালা গলে ঢুকে পড়া ভোরের কোমল রোদে আলোকিত হয়ে আছে কেবিন। একই সঙ্গে ঢুকছে ফুরফুরে হাওয়া। অনুকূল বাতাস পেয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছে সিলভার হেরন, পিছনে আবছা হয়ে এসেছে স্পেনের উপকূল। কিন্তু এসবের কোনও প্রভাব পড়ছে না রোজামুণ্ডের উপর। মলিন মুখে বসে আছে বিছানায়।

কেবিনে ঢুকে কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে বাউ করলেন সার জন। চেহারা থমথমে হয়ে আছে। গত পাঁচ বছরে চুল পাকতে শুরু করেছে তার, চুল ঝরে গিয়ে বড় হয়েছে কপাল… কিন্তু আজ সকালে বাড়তি কিছু ভাজ তাকে আরও বয়স্ক করে তুলেছে। এক রাতেই যেন দশ বছর বেড়ে গেছে বয়স। মাথার হ্যাট খুলে একটা চেয়ারে নামিয়ে রাখলেন।

উঠে দাঁড়াল রোজামুণ্ড। এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে। ওকে জড়িয়ে ধরলেন সার জন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন নিরাপদ। ঠিকমত বিশ্রাম নিয়েছ তো?

বিশ্রাম? বিস্মিত গলায় বলল রোজামুণ্ড।

বুঝতে পারছি, এই পরিবেশে আরাম পাচ্ছ না। কিন্তু কিছু ভেবো না। পূর্ণগতিতে ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে যাচ্ছি আমরা। খুব শীঘ্রি পৌঁছে যাব বাড়িতে। তারপর…

সার জনের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে সাবধানে ছাড়িয়ে নিল রোজামুণ্ড। দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলল, বাইরে নাবিকদেরকে বলাবলি করতে শুনলাম, আপনি নাকি আজই সার অলিভারকে ফাঁসি দেবেন?

ওর উদ্বেগের ভুল অর্থ করলেন সার জন। বললেন, অস্থির হবার কিছু নেই। বিচার-আচারে সময় নষ্ট হবে না মোটেই। মাস্তুলে ফাঁসির দড়ি চড়ানো হয়েছে। খুব শীঘ্রি বদমাশটাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দেব।

আঁতকে ওঠার মত আওয়াজ করল রোজামুণ্ড। একটা হাত উঠে গেল বুকের কাছে। রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন আপনি এমন একটা কাজ করতে চাইছেন, জানতে পারি?

কেন মানে! চমকে গেলেন সার জন। রোজামুণ্ডের কণ্ঠের এই সুর একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তীক্ষ্ণচোখে জরিপ করলেন ওর চেহারা। মনে হলো পাগলামি ভর করেছে মেয়েটার চেহারায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাই নরম গলায় বললেন, হুম, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। সার অলিভারকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। তোমার হয়ে আমিই প্রতিশোধ নেব।

আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন, সার জন, তীক্ষ্ণ গলায় বলল রোজামুণ্ড। আমি প্রতিশোধ নিতে চাইছি না। বরং জানতে চাইছি, কোন অভিযোগে আপনি অলিভারকে ফাঁসি দিতে চাইছেন।

এবার হতভম্ব হয়ে গেলেন সার জন। ব্যাপার কী? এভাবে কথা বলছে কেন মেয়েটা? হাবভাবে তো সম্পূর্ণ সুস্থ দেখাচ্ছে, তারপরেও লায়োনেলের বদলে মাথা ঘামাচ্ছে অলিভারের ফাঁসি নিয়ে!

আশা করি অন্তত তোমাকে সার অলিভারের অপরাধের ফিরিস্তি দিতে হবে না? নিজেকে সামলে নিয়ে বাঁকা সুরে বললেন তিনি। তুমি সবকিছুর চাক্ষুষ সাক্ষী!

তবু আমার কাছে ব্যাখ্যা করুন, কীভাবে নিজেকে বিচারক এবং শাস্তিদাতা ভাবছেন আপনি? কে আপনাকে অধিকার দিয়েছে একজন মানুষকে বিনা-বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানোর?

ত্… তোমার… রোজামুণ্ডের রুদ্রমূর্তির সামনে কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করল সার জনের, …তোমার কি মাথা খারাপ হলো, রোজামুণ্ড? সাগর থেকে আটক করা একটা জলদস্যুকে নিয়ে কী করব না করব…. তার জবাব চাইছ? তাও আবার আমার কাছে? হায় যিশু, তুমি যদি করুণা অনুভব করো ওর জন্য… যদিও কেন করবে বুঝতে পারছি না… জেনে রেখো, ওটাই ওর জন্য সবচেয়ে বড় করুণা।

প্রতিশোধ আর করুণাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন আপনি, সার জন, গম্ভীর গলায় বলল রোজামুণ্ড। করুণা হবে তখন, যখন ওকে আপনি ন্যায়বিচার পেতে দেবেন।

কথায় না পেরে মেঝেতে পা ঠুকলেন সার জন। ওকে ইংল্যাণ্ডে নিয়ে গিয়েই বা কী লাভ হবে? বিচার-শালিস যা-ই করো না কেন, একটাই পরিণতি অপেক্ষা করছে অলিভার ট্রেসিলিয়ানের জন্য। খামোকা বোঝা টানার কোনও মানে হয় না।

যেটাকে আপনি অর্থহীন ভাবছেন, ওর জন্য তা নয়। তা ছাড়া ন্যায়বিচার পাবার অধিকার প্রত্যেকটা মানুষের আছে।

কেবিনের ভিতর পায়চারি শুরু করলেন সার জন। রোজামুণ্ডের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু হঠাৎ করে মেয়েটা অলিভারের জন্য এমন উতলা হয়ে উঠল কেন, সেটাই বুঝতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত হার মানলেন। বললেন, বেশ, ও যদি বিচার চায়… বিচার করা হবে। ইংল্যাণ্ডে গিয়ে যদি আদালতে দাঁড়াতে চায়, তাতেও আপত্তি করব না। কিন্তু এসব করে যে ভাগ্য বদলাবে না, সেটা ওর জানা থাকা উচিত। রোজামুত্রে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। বাড়িয়ে দিলেন দুহাত। এদিকে এসো, লক্ষ্মী মেয়ে আমার। অনেক ঝড় গেছে তোমার উপর দিয়ে, তাই আসলে উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছ…।

পিছিয়ে গেল রোজামুণ্ড। হ্যাঁ, ঝড় গেছে, বলল ও, কিন্তু তাতে উপকারও হয়েছে। চোখের সামনে থেকে সরে গেছে পর্দা, পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি সবকিছু। উল্টোপাল্টা কিছুই বলছি না আমি, সার জন। চেহারা করুণ হয়ে উঠল ওর, কণ্ঠে আকুতি ফুটল। ওহ, দয়া করুন… দয়া করুন!

কী দয়া চাও তুমি, বাছা? কিছুই তো বলোনি এখন পর্যন্ত…

 নিজের জন্য না, আমি ওর জন্য দয়া চাইছি…

কার জন্য? বুঝেও বুঝতে পারছেন না সার জন।

অলিভারের জন্য! আর কে?

চোয়াল স্কুলে পড়ল সার জনের। কী শুনছি আমি? অলিভার ট্রেসিলিয়ানের জন্য দুয়া চাইছ তুমি? ওই ধর্মত্যাগী, শয়তান, জলদস্যুর জন্য? রোজামুও, তুমি পাগল হয়ে গেছ!

আমি ওকে ভালবাসি, ভেজা গলায় বলল রোজামুণ্ড।

পাথর হয়ে গেলেন সার জন। ভালবাসো? তুমি ওকে ভালবাসো? যার কারণে খ্রিস্টানরা সাগরে নামতে পারে না? যে তোমাকে আর লায়োনেলকে অপহরণ করেছিল? যার হাতে খুন হয়েছে তোমার ভাই?

অলিভার পিটারকে খুন করেনি, জোর গলায় বলল রোজামুণ্ড। সত্যটা আমি জানতে পেরেছি!

 নিশ্চয়ই ওর মুখ থেকেই? অভিব্যক্তিহীন গলায় বললেন সার জন। বিদ্রূপ করতে ভুলে গেছেন। সেটা বিশ্বাস করেছ?

 বিশ্বাস না করলে ওকে আমি বিয়ে করতাম না।

বিয়ে! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সার জন। বুঝতে পারছেন না, চমক এখানেই শেষ, নাকি আরও কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্যে। তুমি ওই কুখ্যাত জলদস্যুকে বিয়ে করেছ? কবে?

হ্যা… যে-দিন আমরা আলজিয়ার্সে পৌঁছুলাম, সে-রাতেই। শান্ত গলায় বলল রোজামুণ্ড!

যথেষ্ট হয়েছে, রোজামুণ্ড! এবার চেঁচিয়ে উঠলেন সার জন। আর না! ওকে ফাঁঁসিতে ঝোলাবার জন্য আর কোনও কারণ প্রয়োজন নেই আমার। অন্তত তোমার সঙ্গে ওর ওই অশুভ বন্ধন ছিন্ন করার জন্য হলেও মরতে হবে ওকে।

আপনি নিজ হাতে আমাকে বিধবা করতে চান? আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল রোজামুণ্ড।

না, আমি তোমাকে ওই শুয়োরটার কবল থেকে মুক্ত করতে চাই।

পায়ে পড়ি, আমার কথা শুনুন…

না, আর কিছুই শুনব না আমি। যথেষ্ট-র চেয়েও বেশি শুনে ফেলেছি ইতোমধ্যে। বেরিয়ে যাবার জন্য উল্টো ঘুরলেন সার জন।

ছুটে এসে তাঁর পথ আগলে দাঁড়াল রোজামুণ্ড। বলল, আমার কথা শুনতেই হবে আপনাকে। অনেক ভুগেছে অলিভার-দেহ-মন-আত্মা… সবদিক থেকে। ভুগেছে এমন এক অপরাধের জন্য, যা ও করেইনি। সেই ভোগান্তির মূলে রয়েছি আমি। আজ আমি জানি, ও পিটারের খুনি নয়। আমার বোকামির কারণেই সবকিছু হারিয়েছে ও, সময় থাকতে প্রমাণ করতে পারেনি নিজের নির্দোষিতা। আমি এ-ও জানি, অপহরণ করা হয়েছিল ওকে… কোনও সুযোগ দেয়া হয়নি আত্মপক্ষ সমর্থনের। এসবের কারণে ধর্মত্যাগী জলদস্যুর জীবন বেছে নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বেচারার। সব আমার দোষ! তাই এর সংশোধনও আমাকেই করতে হবে। ওকে ছেড়ে দিন, সার জন। যদি আমাকে ভালবাসেন…

চুপ! গর্জে উঠলেন সার জন। সহ্যের শেষসীমায় পৌঁছে গেছেন তিনি। আর একটি কথাও নয়। তোমাকে ভালবাসি বলেই আর কিছু শুনব না আমি, রোজামুণ্ড। মনে হচ্ছে শুধু শয়তানটার কবল থেকে নয়, তোমাকে তোমার নির্বুদ্ধিতার কবল থেকেও বাঁচাতে হবে আমাকে। নইলে তোমার মৃত বাবা আর ভাইয়ের চোখে অপরাধী হয়ে থাকব। পাগলামি করছ তুমি, মেয়ে। ক্ষণিকের আবেগে ঘোলা দেখছ সবকিছু। অসুবিধে নেই, কোনও একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে। সেদিন ধন্যবাদ জানাবে আমাকে।

ধন্যবাদ? হিসিয়ে উঠল রোজামুণ্ড। আমি আপনাকে অভিশাপ দেব। আজ যদি এ-কাজ করেন, সারাজীবন ঘৃণা করব আপনাকে–ঠিক যেভাবে একজন খুনিকে ঘৃণা করা উচিত। অন্ধ আপনি, সার জন! অন্ধ এবং বোকা!

ওর অগ্নিমূর্তির সামনে কুঁকড়ে গেলেন সার জন। পদস্থ এবং সম্মানিত মানুষ তিনি, ভয় পান না কাউকে। কিন্তু আজ মুখের উপর কন্যাতুল্য মেয়েটির অভিশাপ শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। নড়বড় করে উঠল আত্মবিশ্বাস। শুধু মান-ইজ্জতের কথা ভেবে চেহারা স্বাভাবিক রাখলেন। বললেন:

চুপ করো, মেয়ে, চুপ করো! পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ তুমি। জাদুটোনা করেছে তোমাকে অলিভার। ওকে নির্দোষ, অসহায় ভাবছ তাই; আর আমাকে ভাবছ খুনি! ঈশ্বর তোমার ঘোর কাটিয়ে দিন। বিশ্রাম নাও। আশা করি পরেরবার যখন দেখা হবে, সবকিছু সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাবে তুমি। যেতে দাও আমাকে।

না, কোথাও যাবেন না আপনি! গোঁয়ারের মত বলল রোজামুণ্ড। আপনাকে আমি যেতে দেব না।

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সার জন, থেমে গেলেন দরজায় একটা ছায়া পড়ায়। রাজকীয় ইউনিফর্ম পরে লর্ড হেনরি গোড় হাজির হয়েছেন ওখানে। ঘাড় ফিরিয়ে রোজামুণ্ডও দেখল তাকে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বলে উঠলেন লর্ড হেনরি, এতক্ষণ ধরে কী চলছে এখানে, সে-সম্পর্কে সচেতন নন। আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, লেডি!

ওর আরও বিশ্রাম দরকার, গোমড়ামুখে বললেন সার। এখনও ধকল কাটেনি ওর।

সার জন ভুল বলছেন, দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল রোজামুণ্ড। ঢুকতে দিল লর্ড হেনরিকে। আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

তা হলে তো খুবই ভাল কথা। ভুরু কুঁচকে দুজনের মুখ দেখলেন লর্ড হেনরি-উত্তেজনার লেশ মিলিয়ে যায়নি এখনও। কী ঘটেছে বুঝতে পারছেন না। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য আপনার জবানবন্দির প্রয়োজন হবে, লেডি রোজামুণ্ড। বিচারের জন্য বন্দিকে এরই মধ্যে জাহাজের পাটাতনে হাজির করা হয়েছে কি না! আপনার কি কোনও অসুবিধে আছে?

মোটেই না, মাই লর্ড, বলল রোজামুণ্ড। আমি জবানবন্দি দেবার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি।

না! মরিয়ার মত বলে উঠলেন সার জন। ওর কথা শুনবেন না, হেনরি…।

না শোনার ভান করে বলে চলল রোজামুণ্ড, যদ্র বুঝেছি, আমার সঙ্গে ও যা করেছে, সেটাই সবচেয়ে বড় অভিযোগ। এ-ব্যাপারে অবশ্যই আমার বক্তব্য শোনা দরকার আপনাদের।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, লর্ড হেনরি মাথা ঝাঁকালেন। একই সঙ্গে ভুরু কুঁচকে তাকালেন সার জনের দিকে। অবশ্য… অভিযোগটা মোটামুটি প্রমাণিতই বলা চলে। আপনার যদি কষ্ট হয়, জবানবন্দির আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যেতে পারি আমরা।

একটু ভুল হচ্ছে আপনার, মাই লর্ড, রোজামুণ্ড বলল। আমার জবানবন্দিটা অপরিহার্য, ওটা কিছুতেই এড়ানো যাবে না। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি!

প্রশ্নবোধক চোখে সার জনের দিকে তাকালেন লর্ড হেনরি। আপনি কী বলেন?

কাঁধ ঝুলে পড়ল সার জনের। বললেন, আমি আর কী বলব? যা খুশি করুক ও। পিছিয়ে গেলেন তিনি।

কয়েক মুহূর্ত রোজামুণ্ডের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেন লর্ড হেনরি। যেন পড়ার চেষ্টা করলেন ওর ভিতরটা। কী বুঝলেন কে জানে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আপনাকে তা হলে আর বাইরে যাবার কষ্ট দেব না, ব্যাপারটা এখানেই সেরে ফেলা যাক। ঠিক আছে? সম্মতির অপেক্ষায় না থেকে দরজার কাছে চলে গেলেন। পর্দা সরিয়ে বাইরে অপেক্ষারতদের উদ্দেশে বললেন, ভিতরে আসুন আপনারা। আর হ্যাঁ… বন্দিকেও নিয়ে আসতে বলুন।

কাঠের পাটাতন পায়ের শব্দে মুখর হয়ে উঠল। একটু পরেই কেবিনে ঢুকল জাহাজের বেশ কজন অফিসার। ভিতরের টেবিলের পাশে সাজানো হলো চেয়ার-বিচারকক্ষের মত করে। যার জন্য বিচারের প্রয়োজন নেই বলে ভেবেছিলেন সার জন, সেই অলিভারের বিচার শুরু হবে এবার।

.

২৫.

যুক্তি-তর্ক

টেবিলের পাশে আসন গ্রহণ করল সবাই। ঠিক মাঝখানে বসেছেন লর্ড হেনরি গোড়। রানির লর্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সবচেয়ে উঁচু পদমর্যাদা তাঁর, কাজেই আজকের বিচারকার্য তিনিই পরিচালনা করবেন। তার ডান পাশে বসেছেন সার জন কিলিগ্রু, এরপর ইয়োন্ডান নামে এক অফিসার। বায়ে রয়েছে। আরও দুজন।

টেবিলে ডানপ্রান্তের মাথায় একটা চেয়ার দেয়া হয়েছে রোজামুণ্ডকে, বিচারকদের কাছ থেকে সামান্য দূরত্বে। শান্ত ভঙ্গিতে ওখানে বসল মেয়েটা, কিন্তু চঞ্চল চোখে বিচারকদের জরিপ করতে দেখে বোঝা গেল–ভিতরে ভিতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় মরে যাচ্ছে সে।

নতুন পদশব্দ হলো এবার। কয়েক মুহূর্ত পরে পর্দা সরিয়ে কেবিনে ঢোকানো হলো বন্দি অলিভারকে। দুহাত এখনও পিছমোড়া করে বাঁধা। ওর দুপাশে রয়েছে রুক্ষ চেহারার দুই প্রহরী–পুরোদস্তুর রণসাজে সজ্জিত, হাতে নাঙ্গা তলোয়ার… বেচাল দেখলেই গেঁথে দেবে বন্দির শরীরে।

কেবিনের ছায়ায় ঢুকে চোখ পিটপিট করল অলিভার, দৃষ্টি মানিয়ে নিল ওখানকার পরিবেশের সঙ্গে। রোজামুণ্ডকে দেখতে পেয়ে একটু যেন স্বস্তি ফুটল চেহারায়। তারপর আবার চোখ ফেরাল বিচারকদের সমবেত পরিষদের দিকে। প্রহরীরা ধাক্কা দিয়ে দুপা সামনে এগোতে বাধ্য করল ওকে।

অলিভারের চেহারায় শঙ্কার ছাপমাত্র নেই, সাহেবি কেতায় মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল পরিষদকে।

সুপ্রভাত, ভদ্রমহোদয়বৃন্দ! হাসিমুখে বলল ও।

প্রত্যুত্তর দিল না কেউ, ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বন্দির মুসলিম সাজ-পোশাকই বিতৃষ্ণা জাগাচ্ছে সবার মনে। এই পোশাকে অভিবাদনটা মোটেই মানানসই হয়নি।

একটু পরে গলা খাঁকারি দিলেন সার জন। বললেন, আশা করি তুমি জানো, কী কারণে এখানে আজ হাজির করা হয়েছে তোমাকে?

উহু, বলল অলিভার, তবে আপনাদের উদ্দেশ্য আমি আন্দাজ করতে পারছি। বিচারের প্রহসন না করলেও চলত, আমার ভাগ্য তো ঠিক করেই রেখেছেন। যদি ভেবে থাকেন আমাকে ভয় পেতে দেখবেন, অথবা দেখবেন হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে… তা হলে মস্ত ভুল করছেন। গলার স্বর শীতল হয়ে উঠল ওর। একটা কথাই শুধু বলব-রোজামুণ্ডকে এ-সব না দেখালেও পারতেন।

লেডি রোজামুণ্ড এখানে নিজ ইচ্ছায় থাকছে! দাঁত খিঁচিয়ে বললেন সার জন।

হয়তো, বলল অলিভার। কিন্তু ও নিশ্চয়ই জানে না…

 সবকিছুই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি ওকে! রাগী গলায় বললেন সার জন।

একটু বিস্ময় নিয়ে রোজামুণ্ডের দিকে তাকাল অলিভার। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিল।

সেক্ষেত্রে, বলল ও, এ-ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই আমার। তবে বিচারকাজ শুরু করার আগে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে ঢাই। সার জন, আপনার সঙ্গে আমার আত্মসমপর্ণের বিষয়ে একটাই শর্ত ছিল-আমি ছাড়া আর কোনও কর্সেয়ারকে স্পর্শ করা যাবে না। আপনি ওই শর্ত মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে আসার পর আমি আবিষ্কার করলাম, জ্যাসপার লেই নামে আমার এক সঙ্গীকে বন্দি করা হয়েছে। এ তো শর্তের বরখেলাপ!

ও লায়োনেল ট্রেসিলিয়ানকে গুরুতর জখম করেছে, শীতল গলায় জানালেন সার জন। মরতে বসেছে বেচারা!

হতে পারে। কিন্তু মাস্টার লায়োনেলের হত্যাকারীর ব্যাপারে আলাদা কোনও চুক্তি হয়নি আমাদের মধ্যে… কিংবা চুক্তি হবার পরেও লায়োনেলকে জখম করেনি ও। কাজেই ওকে আটক করতে পারেন না আপনি। তা হলে কোথায় রইল আপনার কথার দাম? কোথায় রইল আপনার মর্যাদা?

মর্যাদার কথা বলছ? তুমি? রূঢ় গলায় বলে উঠলেন লর্ড হেনরি।

জী, মাই লর্ড, বলল অলিভার। তবে আমার মর্যাদা নয়, সার জনের মর্যাদা। বলার ভঙ্গিতে বিদ্রুপের সুর চাপা রইল না।

এখানে তোমার বিচার চলছে, অলিভার ট্রেসিলিয়ান! খ্যাপাটে গলায় বললেন সার জন।

তা-ই ভেবেছিলাম আমি, অলিভার বলল। আর এই বিচার করবার সুযোগ আপনি পেয়েছেন নির্দিষ্ট একটা চুক্তির বিনিময়ে। দুঃখের বিষয়, এখানে আসার পর দেখছি, চুক্তির মর্যাদা রাখতে জানেন না আপনারা। যাক গে, যা বলার বলে দিয়েছি আমি। এরপরেও যদি জ্যাসপার লেইকে আটকে রাখেন, বা ওকে কোনও ধরনের শাস্তি দেন… সেটার জবাব নিজের বিবেকের কাছে দেবেন।

অসহায় বোধ করলেন সার জন্য। অলিভারের যুক্তির সামনে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন। আসলেই… যা-ই করে থাকুক জ্যাসপার লেই, তাকে বন্দি করার কোনও অধিকার নেই তার। কিন্তু লোকটাকে ছেড়ে দেয়া মানে পুত্রসম লায়োনেলের হত্যাকারীকে ছেড়ে দেয়া। উভয়সঙ্কটে পড়ে গেলেন।

তা হলে কী করতে বলো আমাকে? অলিভারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি।

কী করবেন, সেটা তো আপনার মর্জি, সার জন, অলিভার বলল। কিন্তু কী করতে পারবেন না, তা বলতে পারি আপনাকে। জ্যাসপার লেইকে আটকে রাখতে পারেন না আপনি, ওর মতের বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যেতে পারেন না… এমনকী একটা আঘাতও করতে পারেন না ওকে। যদি ভুলক্রমে গ্রেফতার করে থাকেন লোকটাকে, তা হলে যত দ্রুত সম্ভব ভুলটা সংশোধন করে নেয়া উচিত। ওকে নিরাপদ কোনও জায়গায় নামিয়ে দেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। অবশ্য… পুরোটাই নির্ভর করছে আপনার উপরে। আপাতত এ-নিয়ে আর আলোচনা না করাই ভাল। আপনাদের কাজ শুরু করতে পারেন। আমি তৈরি আছি।

নীরবতা নেমে এল কেবিনে। কিছুক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। সবাই অনুভব করছে, বিচার শুরু হবার আগেই নৈতিক দিক থেকে তাদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার। খানিক পর নিজেকে সামলে নিলেন লর্ড হেনরি। কথা বললেন বন্দিকে উদ্দেশ্য করে।

অলিভার ট্রেসিলিয়ান, আজ তোমাকে এই আদালতের সামনে হাজির করা হয়েছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবার জন্য। জলদস্যু তুমি… আর ধরা পড়া জলদস্যুকে ফাঁসি দেবার অধিকার আছে যে-কোনও ক্যাপ্টেনের। বলতে পারো, তোমার বেলায় তা করা হবে না কেন?

মুখ বাঁকা করে হাসল অলিভার। বলল, এত আনুষ্ঠানিকতা না করলেও চলবে। কিছুই বলব না আমি। অযথা মুখ-খরচ করার অভ্যেস নেই আমার।

তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না, অলিভার, নরম গলায় বললেন লর্ড হেনরি। প্রধান বিচারক হিসেবে নিজের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছেন তিনি-বিদ্বেষ দেখাচ্ছেন না আসামীর প্রতি। যদি আনুষ্ঠানিক বিচার চাও, তা হলে তোমাকে ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাব আমরা।

কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার, বেরসিকের মত বলে উঠলেন সার জন। যে-সব অপরাধের জন্য তোমার বিচার হবে, সেগুলোর প্রায় সবকটাই ঘটেছে আমাদের এই লর্ড হেনরি গোডের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায়। কাজেই তোমার বিচার হবে কর্নওয়ালে, ওঁর-ই আদালতে। মহামান্য রানির লর্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে উনিই হবেন প্রধান বিচারক এবং রায়দাতা।

মহামান্য রানি ভাগ্যবতী… কর্নওয়ালে এমন যোগ্য একজন প্রতিনিধি আছে ভার! সকৌতুকে বলে উঠল অলিভার।

ঠাট্টায় কর্ণপাত করলেন না সার জন। বলে চললেন, অতএব বুঝতেই পারছ, বিচার এখানে হলো, না ওখানে… তাতে কিছু যায়-আসে না। তোমাকে শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হবে–কোথায় ফাঁসিতে ঝুলতে চাও। জলে, না স্থলে?।

আকাশটাই বা বাদ রাখলেন কেন? মুখের হাসি একবিন্দু মলিন হলো না অলিভারের। আকাশে ঝোলাতে চাইলে এক্ষুণি রাজি হয়ে যাব।

বিরক্তিসূচক একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল লর্ড হেনরির মুখ দিয়ে। সামনে ঝুঁকে তিনি বললেন, ঠাট্টা-মশকরা বন্ধ করো, অলিভার। নিজের মঙ্গলের জন্যই একটু সিরিয়াস হতে অনুরোধ করছি তোমাকে।

দুঃখিত, ঝোঁকটা সামলাতে পারিনি, অলিভার বলল। তবে হ্যাঁ, দস্যুতার অভিযোগেই যদি বিচার করতে চান আমার, খুব অভিজ্ঞ একজন সহযোগী পেয়েছেন আপনি। এ-সব ব্যাপারে সার জনের তুলনা হয় না।

প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ, কপট সুরে বললেন সার জন। তবে জলদস্যুতার অভিযোগ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে তোমার। এরচেয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ আছে তোমার বিরুদ্ধে।

তা-ই? একটা ভুরু উঁচু করল অলিভার। আশা করছি বাকি অভিযোগগুলো জলদস্যুতার মত নড়বড়ে নয়। নইলে… মানে যদি আইন-কানুন মেনে এগোতে চান আর কী… আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে আপনাদের। যাক গে, শোনান অভিযোগ। স্বীকার করছি, যতটা আশা করেছিলাম, তারচেয়ে মজাদার হয়ে উঠছে পুরো ব্যাপারটা।

তুমি কি জলদস্যুতার অভিযোগ অস্বীকার করছ? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন লর্ড হেনরি।

অস্বীকার? উঁহু। তবে আপনাদের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। কারণ আজ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের জলসীমায় কোনও জলদস্যুতা করিনি আমি। ইংল্যাণ্ডের কোনও আদালতে এ-অভিযোগে বিচার হতে পারে না আমার।

থমকে গেলেন লর্ড হেনরি। যুক্তিটা অপ্রত্যাশিত… একই সঙ্গে অকাট্য। আইনকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সত্যিই জলদস্যুতার অভিযোগে অলিভারের বিচার করতে পারেন না তিনি।

সার জন অবশ্য হার মানতে রাজি নন। রাগী গলায় বললেন, দস্যুতা করোনি মানে? কর্নওয়ালে হামলা চালাওনি তুমি? আরওয়েনাকে এসে জোর করে তুলে নিয়ে যাওনি…

থামুন, থামুন, এত উত্তেজিত হবেন না, তাকে বাধা দিল অলিভার। দয়া করে যে-কোনও আইনি কেতাব উল্টে দেখুন। জলদস্যুতা আর অপহরণ এক জিনিস নয়।

তা হলে অপহরণ-ই সই! গোঁয়ারের মত বললেন সার জন।

এভাবে বললে হবে না। যেটা যা, সেটাকে তা-ই বলতে বাধ্য আপনি।

কথা ঘোরাচ্ছ তুমি! ধড়াম করে টেবিলে কিল বসালেন সার জন। পরমুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেলেন, সংবরণ করলেন নিজেকে। গলা যতদূর পারেন স্বাভাবিক করে বললেন, অসুবিধে নেই, এখুনি সমাধান হবে সবকিছুর। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে, অলিভার, ইংল্যাণ্ডের আইনে অপহরণ একটা গুরুতর অপরাধ? এর জন্য মৃত্যুদণ্ড দেবার বিধান আছে। সঙ্গী বিচারকদের দিকে ফিরলেন তিনি। ভদ্রমহোদয়গণ, যদি একমত হন আমার সঙ্গে, তা হলে আর জলদস্যুতা শব্দটা উচ্চারণ করব না আমরা। তার কোনও প্রয়োজন নেই।

হ্যাঁ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা ঝাঁকালেন লর্ড হেনরি। জলদস্যুতার অভিযোগে বিচার করা যাবে না ওর। বন্দির যুক্তি অকাট্য। আমাদের জানামতে ইংল্যাণ্ডের জলসীমায়, কিংবা ইংল্যাণ্ডের কোনও জাহাজে লুটপাট করেনি সে।

নড়ে-চড়ে বসল রোজামুণ্ড। এই প্রথমবারের মত আশাবাদী হয়ে উঠছে ও। গালে ফিরে আসছে রক্তের আভা। চোখ জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনায়। ভাল একটা লড়াই উপহার দিচ্ছে অলিভার… এবং জিতছে। জলদস্যুতার অভিযোগ প্রত্যাহার হওয়ায় বড় একটা বিপদ কাটল। এবার পরেরগুলোর পালা।

ওর এই পরিবর্তন লক্ষ করল অলিভার, কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এখনও খুশি হবার মত কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মোটামুটি নিশ্চিত ও, যুক্তিতে হার মানলেও পিছু হটবে না প্রতিপক্ষ। ওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েই ছাড়বে।

তবে তা-ই হোক, সার জনের গর্জনে ধ্যান ভাঙল ওর। অপহরণ আর হত্যার অভিযোগেই ওকে ফাঁসিতে ঝোলাব আমরা। অলিভার ট্রেসিলিয়ান, এ-দুটো অভিযোগের বিষয়ে কিছু বলার আছে তোমার?

আমার কোনও কথাতেই প্রভাবিত হবেন না আপনারা, অলিভার কাঁধ ঝাঁকাল। কাজেই মুখ বন্ধ রাখা শ্রেয় মনে করছি। বিতৃষ্ণা ফুটল চেহারায়।. ধ্যাৎ, বন্ধ করুন এই তামাশা। ফাঁসি দিতে চান তো আমাকে দিয়ে দিন। দরকার হলে জলদস্যুদের মত হাত-পা বেঁধে ফেলে দিন পানিতে। অন্তত ইংল্যাণ্ডের আইন-আদালতের এমন অমর্যাদা করবেন না!

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সার জন। রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে। কী বললে, অসভ্য বদমাশ কোথাকার…।

খপ্‌ করে তার জামার হাতা টেনে ধরলেন লর্ড হেনরি, জোর করে বসতে বাধ্য করলেন। বসলেও ফুঁসতে থাকলেন সার জন, কিছুতেই শান্ত করতে পারছেন না নিজেকে।

বন্দির দিকে ফিরলেন লর্ড লেফটেন্যান্ট। বললেন, অলিভার ট্রেসিলিয়ান, এভাবে কথা বলা উচিত হচ্ছে না তোমার। কেন তামাশা ভাবছ এটাকে? তোমার বিচার করার অধিকার কি আমাদের নেই? খুনের অভিযোগ নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে তুমি, তারপর ধর্মত্যাগ করে বেছে নিয়েছ জলদস্যুর পেশা… পরে আবার আরওয়েনাকে হামলা চালিয়ে অপহরণ করেছ সম্ভ্রান্ত এক ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোককে। যত যুক্তিই খাড়া করো, যে-কোনও আদালতে দোষী সাব্যস্ত হবে। আমাদের এখানেও তা-ই হচ্ছ। অথচ এমন ভাব করছ, যেন শত্রুতা করছি আমরা তোমার সঙ্গে… নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও চেষ্টা করছি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার! এটা কি ঠিক?

সার, বলল অলিভার, আমাকে ফাঁসি দেবার অধিকার আছে আপনাদের, সেটা অস্বীকার করছি না… করবও না। যদি আমার ব্যবহারে অসম্মান প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আর কিছু বলার নেই আমার।

কিন্তু আমার আছে! তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠল রোজামুণ্ড। উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। এতক্ষণে মুখ খুলেছে ও।

রোজামুণ্ড! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন সার জন, নিজেও দাঁড়িয়ে গেলেন ওর দেখাদেখি। আমি অনুরোধ করছি…

ঝট করে হাত তুলল মেয়েটা, আর তা দেখে মুখে যেন তালা এঁটে গেল ভদ্রলোকের।

অপহরণের অভিযোগ… যেটা সরি অলিভারের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, বলল ও, ওটার ব্যাপারে কিছু বলার আছে আমার। যেহেতু আমাকেই অপহরণ করেছিল ও, সেহেতু এই অভিযোগ নিয়ে এগোবার আগে আমার বক্তব্য শোনা দরকার আপনাদের। এখানে যদি না শোনেন, ভবিষ্যতে আমি কথাগুলো দেশের আদালতে বলব।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সার জন। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। মেয়েটার পাগলামি আর ঠেকানো গেল না।

লর্ড হেনরি ফিরলেন রোজামুণ্ডের দিকে। তার কপালে ভাঁজ পড়েছে। বললেন, লেডি, অভিযোগ অস্বীকার করেনি এই বন্দি। ইংল্যাণ্ডের আদালতে বিচারের জন্যেও আবেদন জানায়নি। তাই আপনার জবানবন্দির কোনও প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্চিত থাকুন, দেশের আদালতেও ডাক পড়বে না আপনার।

এখানেই আপনি ভুল করছেন, মাই লর্ড, বলল রোজামুণ্ড। কেউ ডাকবে না… আমি নিজেই যাব আদালতে আপনাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করবার জন্য… যদি না আজ সার অলিভারকে ফাঁসি দেয়া থেকে আপনারা বিরত হন।

হতবাক হয়ে গেল সবাই। মুখের ভাষা হারাল।

কী বলছ তুমি, রোজামুণ্ড! অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠল অলিভার। পারলে চিমটি কাটত গায়ে, নইলে বিশ্বাস হচ্ছে না-রোজামুণ্ড ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছে।

বন্দি কর্সেয়ারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল রোজামুণ্ড, তারপর আবার ফিরল পরিষদের দিকে। বলল:

সার অলিভার যেহেতু অভিযোগ অস্বীকার করছে না, ওর হয়ে আমিই অস্বীকার করে দিচ্ছি। ও আমাকে অপহরণ করেনি, ভদ্রমহোদয়গণ। ওটা ছিল একটা নাটক। অলিভার ট্রেসিলিয়ানকে ভালবাসি আমি। সাবালিকা আমি, স্বেচ্ছায় ওর সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে… আলজিয়ার্সে গিয়ে স্বেচ্ছায় বিয়েও করেছি ওকে।

দেয়াল ফেটে একটা পরী বেরিয়ে এলেও বুঝি এতটা অবাক হতো না কেউ।

হতভম্ব গলায় লর্ড হেনরি বললেন, আ… আপনি ওর স্ত্রী?

মিথ্যে কথা! চেঁচিয়ে উঠলেন সার জন। ওকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে কথা বলছে রোজামুণ্ড।

তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হানল মেয়েটা তার দিকে। থমথমে গলায় বলল, আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি চিরকালই কাঁচা, সার জন। একবারও ভাবছেন না, যদি সত্যিই আমাকে অপহরণ করে থাকে অলিভার… যদি সত্যিই আমার উপর অত্যাচার চালিয়ে থাকে, তা হলে কেন ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করব আমি? কেন মিথ্যে কথা বলব? বাকিদের দিকে আবার তাকাল ও। যা বলার বলে দিয়েছি আমি, ভদ্রমহোদয়গণ। যদি ভুল করে না থাকি, সার। জন বা অন্য যে-কারও কথার চাইতে আমার কথা বেশি গুরুত্ব পাবে আইনের আদালতে।

হ্যাঁ, তা ঠিক, স্বীকার করলেন লর্ড হেনরি। গজরাতে থাকা সার জনকে বললেন, একটু শান্ত হোন, কিলিঞ। তারপর চোখ ফেরালেন অলিভারের দিকে। তুমি কিছু বলতে চাও?

আমি আর কী বলব? কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। বলার আছেটাই বা কী?

সব মিথ্যে! আবার চেঁচালেন সার জন। আমরা নিজেরা তার সাক্ষী। সে-রাতে আরওয়েনাকে হাজির ছিলাম আমরা, লর্ড হেনরি! আপনি-আমি দুজনেই! নিজ চোখে দেখেছি…।

আপনারা শুধু আমাদের অভিনয় দেখেছেন, শান্ত গলায় বলল রোজামুণ্ড। পিছনের ঘটনা জানা ছিল না আপনাদের।

সঁত-মুখ খিচালেন সার জন। অভিনয়? তা হলে কি বলতে চাও, তোমার হবু-স্বামী লায়োনেলও স্বেচ্ছায় গিয়েছিল তোমাদের সঙ্গে?

না, রোজামুণ্ড মাথা নাড়ল। লায়োলেকে নেয়া হয়েছিল ওর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য… ওর ভাইয়ের প্রতি করা . অপরাধ! এমন এক অপরাধ, যার জন্য ওর বদলে অলিভারকে দায়ী করছেন আপনারা।

কীসের কথা বলছেন আপনি, লেডি? জিজ্ঞেস করলেন লর্ড হেনরি।

আমার ভাই পিটারের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছি। অলিভার না, ওকে আসলে খুন করেছিল লায়োনেল ট্রেসিলিয়ান। সত্যটা যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্যে ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে অপহরণ করিয়েছিল ভাইকে… চেষ্টা করেছিল ওকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে।

এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! হুমকির সুরে বললেন সার জন। কল্প-কাহিনি শোনাচ্ছে এই মেয়ে। সাদাকে কালো, আর কালোকে সাদা বানাচ্ছে। শয়তান জলদস্যুটা বশ করেছে ওকে…

দাঁড়ান, বাধা দিয়ে বললেন লর্ড হেনরি, আমাকে সামলাতে দিন ব্যাপারটা। লেডি, বড়ই গুরুতর অভিযোগ আনছেন আপনি লায়োনেল ট্রেসিলিয়ানের বিরুদ্ধে। এর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে আপনার হাতে?

রোজামুণ্ড জবাব দেবার আগেই হেসে উঠলেন সার জন। কীসের প্রমাণ? ওই বদমাশটার শিখিয়ে দেয়া বুলি আউড়াচ্ছে ও। নিশ্চয়ই জাদু করেছে ওকে!

অলিভারও হেসে উঠল। জাদু করেছি? আপনার থলেতে দেখি অভিযোগের অন্ত নেই, সার জন। প্রথমে জলদস্যুতা, তারপর অপহরণ আর খুনের দায় চাপাতে চাইলেন আমার ঘাড়ে। এবার অভিযোগ আনছেন জাদুবিদ্যার? নাহ্, দেখাচ্ছেন বটে!

 থামবেন আপনারা? অধৈর্য গলায় বললেন লর্ড হেনরি। তারপর মনোযোগ ফেরালেন রোজামুণ্ডের দিকে। লেডি, আপনি কি আসলেই বলতে চাইছেন–পিটার গডলফিনকে লায়োনেল ট্রেসিলিয়ান খুন করেছে?

শুধু বলছি না, রোজামুণ্ড কণ্ঠে দৃঢ়তা ফোঁটাল, দরকার হলে কসম কাটব। লায়োনেল শুধু আমার ভাইকে খুনই করেনি, খুনের দায় চাপিয়ে দিয়েছে অলিভারের উপরেও। সবাই ভেবেছিল শাস্তির ভয়ে ইংল্যাণ্ড থেকে পালিয়ে গেছে ও… আমিও তা-ই ভেবেছি। অথচ আসল ঘটনা হলো…

আসল ঘটনা? গরগর করে উঠলেন সার জন। কীসের আসল ঘটনা? সব চালবাজি! রূপকথা শোনানো হচ্ছে আমাদেরকে!

ধৈর্য ধরুন, কিলি, বললেন লর্ড হেনরি। সত্য শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পাবেই। মিথ্যের আয়ু হয় ক্ষণস্থায়ী।

কিন্তু তার আগ পর্যন্ত সময় নষ্ট করছি আমরা! গম্ভীর হয়ে গেলেন সার জন।

কথা শেষ করুন, লেডি, লর্ড হেনরি বললেন। আপনি বলতে চাইছেন, ফেরারি হয়নি অলিভার ট্রেসিলিয়ান? ওর ভাই ওকে অপহরণ করিয়েছিল?

হ্যাঁ, রোজামুও খেই ধরল। তবে কাজটা শুধু খুনের অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য নয়, ট্রেসিলিয়ানদের সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হবার জন্যও করেছে লায়োনেল। অলিভারকে বিক্রি করে দেবার কথা ছিল বারবারি উপকূলে, কিন্তু তার আগেই ওকে বহনকারী জাহাজে হামলা চালায় স্প্যানিয়ার্ড-রা, ও ধরা পড়ে। ছমাস স্পেনের বিভিন্ন জাহাজে মাল্লা হিসেবে কাজ করেছে ও। শেষ পর্যন্ত কর্সেয়াররা ওর জাহাজে হামলা চালালে মুক্তি পায়। বেঁচে থাকার জন্য একটাই বিকল্প ছিল ওর সামনে-কর্সেয়ারদের সঙ্গে যোগ দেয়া… ধর্মত্যাগ করে জলদস্যু হয়ে যাওয়া! ওটাই করেছে অলিভার, আর তারপর…

পরের ঘটনা আমরা জানি, লেডি, বললেন লর্ড হেনরি। আপনার কাহিনি যদি সত্যি হয়, তা হলে কথা দিতে পারি, পরের ওসব ঘটনা খুব হালকা চোখে দেখা হবে যে-কোনও আদালতে।

সত্যি বলছি আমি, বিশ্বাস করুন!

করলাম বিশ্বাস। কিন্তু আপনি কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবেন এ-কাহিনির স্বপক্ষে?

আর কী প্রমাণ চাই আপনাদের। ওকে আমি আবার ভালবেসেছি… বিয়ে করেছি-প্রমাণ হিসেবে এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?

বাহ্, বাহ্! ভাল বলেছ! ফোড়ন কাটলেন সার জন।

ওটা, লেডি, শান্ত গলায় বললেন লর্ড হেনরি, প্রমাণ করে যে, আপনি একটা অদ্ভুত গল্প বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু গল্পটা যে সত্যি, তা কিন্তু প্রমাণ হয়নি। ধরে নিচ্ছি, এই গল্প আপনি অলিভার ট্রেসিলিয়ানের মুখেই শুনেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু লায়োনেল উপস্থিত ছিল ওখানে… সে নিজে স্বীকার করেছে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা।

লায়োনেল সম্পর্কে এ-কথা বলতে পারলে তুমি? হা যিশু! পারলে? প্রায় হাহাকার করে উঠলেন সার জন।

পারব না কেন? দৃঢ় গলায় বলল রোজামুণ্ড। মিথ্যে তো আর বলছি না।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন সার হেনরি, চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত বোলালেন মুখভর্তি দাড়িতে। বুঝে উঠতে পারছেন না কী ঘটছে। লেডি রোজামুণ্ড, বললেন তিনি, যা বলছেন, তা ভেবে-চিন্তে বলছেন তো? এমন একজনকে আপনি অভিযুক্ত করছেন, যার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করা সম্ভব নয়। যদি আপনার কাহিনি সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়, কলঙ্কে ঢেকে যাবে মাস্টার লায়োনেল ট্রেসিলিয়ানের স্মৃতি। তাই আরেকবার জিজ্ঞেস করছি–লায়োনেল কি আপনার সামনে নিজের দোষ স্বীকার করেছিল?

তা হলে আবারও শপথ করে বলছি আমি-হ্যাঁ, করেছে। অলিভার যখন আমার সামনে অভিযুক্ত করেছে ওকে পিটারের খুন আর ভাইয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে… স্বীকারোক্তি দিয়েছে ও। নিজ কানে শুনেছি! আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে, মাই লর্ড?

টেবিলের উপর দুহাত ছড়িয়ে দিলেন লর্ড হেনরি। এরপরে ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোবার মানে হয় না, কিলি। ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যেতে হবে সার অলিভারকে, ওখানেই বিচার হবে ওর।

 হতাশাব্যঞ্জক একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল সার জনের মুখ দিয়ে। আর এই সময় মুখ খুলল ইয়োল্ডান নামের অফিসারটি। কথা শুনে বোঝা গেল, বাকিদের মত আবেগের বশবর্তী হয়ে পরিচালিত হচ্ছে না সে।

মাই লর্ড, আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি সাক্ষীকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই। লর্ড হেনরি সম্মতি দিলে ফিরল সে রোজামুণ্ডের দিকে। লেডি, কোন্ পরিস্থিতিতে সার অলিভার তাঁর ভাইয়ের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন, বলবেন আমাদের?

আলজিয়ার্সে, ওর বাড়িতে। যে-রাতে আমরা ওখানে… বলতে বলতে থেমে গেল রোজামুণ্ড। আচমকা টের পেয়েছে, ওকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা বাকিরাও টের পেল।

সাগ্রহে সামনে ঝুঁকলেন সার জুন। সুকৌশলে ওর জবানবন্দিতে একটা ফাঁক সৃষ্টি করেছে ইয়োল্ডান, সেটার সদ্ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেছেন। থেমো না, বলে যাও, কপট অনুরোধের সুরে বললেন তিনি। যে-রাতে তোমরা ওখানে…

..যে-রাতে আমরা ওখানে পৌঁছুলাম, দুর্বল গলায় বলল রোজামুণ্ড। মুখ থেকে আবার রক্ত সরে যেতে শুরু করেছে।

তার মানে তখনই প্রথমবারের মত অলিভার ট্রেসিলিয়ানের নির্দোষিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছ তুমি, ঠিক?

হ্যাঁ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বীকার করতে বাধ্য হলো রোজামুণ্ড।

তারমানে দাঁড়াচ্ছে, বিজয়ের সুর ফুটল সার জনের কণ্ঠে, সে-রাতের আগ পর্যন্ত অলিভারকে পিটারের খুনি হিসেবে জানতে তুমি… এমনকী যখন ওর সঙ্গে আরওয়েনাক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে, তখনও! ভুল বলেছি?

মাথা নিচু করে ফেলল রোজামুণ্ড। বুঝতে পারছে, ওর মিথ্যে জবানবন্দি ধরা পড়ে গেছে।

জবাব দাও! ধমকে উঠলেন সার জন।

তার কোনও প্রয়োজন নেই, বললেন লর্ড হেনরি, গলায় বিষাদ। সব দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। লেডি রোজামুণ্ড আমাদেরকে বলেছেন, স্বেচ্ছায় অলিভার ট্রেসিলিয়ানের সঙ্গে আলজিয়ার্সে গিয়েছিলেন তিনি, ওখানে বিয়ে করেছেন তাকে–এটাই লোকটার নির্দোষিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছিলেন। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময় ওকে ভাইয়ের খুনি হিসেবে জানতেন তিনি। লেডি, এখনও নিশ্চয়ই বলবেন না, একজন খুনির সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছিলেন আপনি?

বন্ধ করা হোক এই তামাশা, উঠে দাঁড়ালেন সার জন। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৪১৮

না, দাঁড়ান, আকুতি ফুটল রোজামুণ্ডের গলায়। স্বীকার। করছি, অপহরণের বিষয়ে মিথ্যে বলেছি আমি। কিন্তু বাকি সব কথা সত্যি। সেজন্যেই অলিভারকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।

হাহ্, স্বীকার করছে ও! বিদ্রূপ করলেন সার জন।

না শোনার ভান করে বলে চলল রোজামুণ্ড, আমার জন্য হাজারো দুর্দশা ভোগ করেছে অলিভার, তাই স্বেচ্ছায় স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি ওকে। ভেবেছি হয়তো নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব ওভাবে। আমার কথা বিশ্বাস করুন, মাই লর্ড। আর যদি বিশ্বাস না-ও করেন, অন্তত ওর গতকালকের কাজটা তো গোনায় ধরবেন! ভুলে যাননি নিশ্চয়ই, ও যদি খবর না পাঠাত, তা হলে আপনারা কিছুতেই জানতে পারতেন না, গোপন ওই খাড়ির ভিতরে কর্সেয়ারদের জাহাজে বন্দি হয়ে আছি আমি।

শূন্য দৃষ্টি ফুটল বিচারকদের চেহারায়। যেন বুঝতে পারছেন না ওর কথা।

কী বলতে চাইছেন, লেডি? বললেন লর্ড হেনরি। ওটার সঙ্গে অলিভারের সম্পর্ক কোথায়?

সত্যিই জানেন না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন? রুক্ষ গলায় বলল রোজামুণ্ড! লায়োনেলকে অলিভারই পাঠিয়েছিল খবর নিয়ে, এ-কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।

দাঁতে দাঁত পিষলেন লর্ড হেনরি। এবার তিনিও রেগে গেছেন। চুপ করুন, লেডি! দয়া করে আর মিথ্যে কাহিনি শোনাবেন না। এতক্ষণ বিশ্বাস করিনি, কিন্তু এখন সত্যিই মনে হচ্ছে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হয়েছে কী আপনার? লায়োনেল নিজমুখে ওর পালানোর ঘটনা শুনিয়েছে আমাদেরকে। এ-ও বলেছে, অলিভার ট্রেসিলিয়ান ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে খুন করবার চেষ্টা করেছিল!

বাহ্, বলে উঠল অলিভার। লায়োনেল দেখছি মিথ্যেবাদী হিসেবে নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে!

ওর মত ঠাট্টা করতে পারছে না রোজামুণ্ড। চেঁচিয়ে উঠল রাগে, মিথ্যে কথা বলেছে ওই শয়তান, ছোটলোকটা!

বুঝে-শুনে কথা বলো, রোজামুণ্ড, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সার জন। তুমি একজন মৃত্যুপথযাত্রীর ব্যাপারে কথা বলছ… অযথা ওর অমর্যাদা কোরো না।

ওই ধারণা নিয়েই থাকুন, অলিভার বলল। বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভদ্রমহোদয়গণ, লায়োনেলের বদলে রোজামুণ্ডকে মিথ্যেবাদী ভেবে নিজেদের অদূরদৃষ্টির পরিচয় দিচ্ছেন আপনারা।

চুপ করো! থমথমে গলায় বললেন লর্ড হেনরি। আর কিছু শুনতে চাই না আমরা!

না চাইলেও শুনতে হবে! গোঁয়ারের মত বলল অলিভার। মুখ খোলার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার… কিন্তু রোজামুণ্ডকে আপনারা মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করবেন, তা-ও মেনে নিতে পারছি না। সত্য জানার জন্য আদালত বসিয়েছেন তো? বেশ, সত্যটাই জানাব আমি; প্রমাণ দেখাব সবকিছুর।

চোখ জ্বলজ্বল করছে ওর উত্তেজনায়। দ্রুতবেগে ওঠানামা করছে বুক। জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল, লড়াই করবার কোনও ইচ্ছে অবশিষ্ট ছিল না, ভিতরে। কিন্তু সবার সামনে রোজামুণ্ডের প্রেমের স্বীকৃতি নতুন এক আগুন জ্বেলেছে অন্তরে। লাভ হোক না হোক, সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করবার একটা তাড়না অনুভব করছে। এতে অন্তত রোজামুণ্ডের সত্যবাদিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ ওকে দোষারোপ করতে পারবে না ঘৃণ্য এক জলদস্যুর পক্ষ অবলম্বন করা নিয়ে।

পরিষদের সবার উপর দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল অলিভার! তারপর বলল, আমার জানা ছিল না, গতরাতে সার জনকে নিয়তি পরিচালিত করেছে। আমার সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করে যে-লোকটাকে তিনি ধরে এনেছেন, সেটা আসলে ভাগ্যেরই খেলা। ওর নাম শুনেছেন আপনারা-জ্যাসপার লেই, প্রাক্তন এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন… ওর জাহাজের নাম ছিল সোয়ালো। কিছুদিন আগে কর্সেয়ারদের হাতে ধরা পড়ে সে, এবং আমারই মত প্রাণ বাঁচানোর জন্য দলত্যাগ করে মিশে যায় ওদের সঙ্গে। ওই জ্যাসপার লেই-ই লায়োনেলের ভাড়া করা লোক ছিল, ভদ্রমহোদয়গণ! ও-ই আমাকে অপহরণ করেছিল লায়োনেলের নির্দেশে, চেষ্টা করেছিল আমাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে। কপাল খারাপ থাকায় স্প্যানিয়ার্ডদের হামলায় ডুবে যায় ওর জাহাজ, বন্দি হয় আমার সঙ্গে। বিশ্বাস না হলে ডাকুন ওকে। জিজ্ঞাসাবাদ করুন।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন বিচারকেরা। শেষ পর্যন্ত লর্ড হেনরি বললেন, ব্যাপারটা বড় কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে না? যে-লোক তোমার পক্ষে সাক্ষী দিতে পারে, ঠিক, তাকেই ধরে আনলেন সার জন?

কাকতালীয় নয়, মাই লর্ড। এর পিছনে চমৎকার ব্যাখ্যাও আছে। লায়োনেলের প্রতি ক্ষোভ আছে জ্যাসপারের। ওর ধারণা, লায়োনেলের ষড়যন্ত্রে অংশ নেবার কারণেই জাহাজ হারিয়েছে ও, ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। ওকে খুন করে তাই নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিল। গত রাতে সেজন্যেই লায়োনেলকে দেখমাত্র আক্রমণ করেছিল জ্যাসপার। সার জন, আপনি খেয়াল করেননি, আর কারও প্রতি মনোযোগ ছিল না। লোকটার? সরাসরি লায়োনেলকেই আক্রমণ করেছে?

জবাব দিলেন না সার জন।

 তারপরেও, বললেন লর্ড হেনরি, ঘটনাটা অস্বাভাবিক।

সত্য প্রকাশের জন্য মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক, অলৌকিক ঘটনার অবতারণা করেন সর্বশক্তিমান, হালকা গলায় বলল অলিভার। দেরি করবেন না। ডাকুন জ্যাসপারকে। যা খুশি জিজ্ঞেস করুন ওকে, যেভাবে খুশি জেরা চালান। সত্যটা বের করে নিন ওর পেট থেকে।

এ-সব সময় নষ্ট করার কৌশল ছাড়া আর কিছু না, বিরক্ত গলায় বললেন সার জন। এক দিনের জন্য যথেষ্ট রূপকথা কি শুনিনি আমরা? মাই লর্ড, আমি অনুরোধ করছি…

কথা শেষ হলো না তার, বাইরে থেকে ভেসে এল উত্তেজিত পদশব্দ। পরমুহূর্তে ঝট করে খুলে গেল কেবিনের দরজা। দেখা গেল মাস্টার টোবিয়াসের চেহারা।

সার জন! উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন তিনি। মাস্টার ট্রেসিলিয়ানের জ্ঞান ফিরেছে! আপনার সঙ্গে আর ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। জলদি আসুন। বেশিক্ষণ টিকবে না ও।

.

২৬.

রায়

বিচারকার্য স্থগিত হয়ে গেল, সার জনের পিছু পিছু সবাই ছুটল লায়োনেলের কেবিনের দিকে। প্রহরীরা অলিভারকেও নিয়ে চলল ওখানে। খুব শীঘ্রি মুমূর্ষ মানুষটার বিছানা ঘিরে দাঁড়াল ওরা। ফ্যাকাসে চেহারা আর প্রাণহীন চোখের দিকে এক পলক চেয়েই বুঝল, অনন্ত যাত্রায় পাড়ি জমাতে বসেছে ছেলেটা।

হাঁটু গেড়ে বিছানার পাশে বসলেন,সার জন। লায়োনেলের একটা হাত তুলে নিলেন নিজের দুহাতের মুঠোয়। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলেন, লায়োনেল! আমরা এসেছি!

খুব আস্তে আস্তে মাথা ঘোরাল লায়োনেল। চোখ বোলাল জমায়েত মানুষদের উপর। দুর্বল গলায় বলল, অলিভার… অলিভার কোথায়?

অস্থির হয়ো না, নরম গলায় বললেন সার জন। ওকে বন্দি করেছি আমরা। খুব শীঘ্রি শাস্তিও দেব…

না-আ! ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল লায়োনেল। ওর কিছু হয়নি তো? কোথায়?

আমি এখানে, জলদগম্ভীর গলায় বলল অলিভার। পাথরের মত মুখ করে রেখেছে ও, চেহারা ভাবলেশহীন। ভাই মরতে বসেছে, কিন্তু কোনও সহানুভূতি নেই।

অনেক কষ্টে মাথা একটু উঁচু করে ওকে দেখল লায়োনেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মত পাপীকে দয়া দেখিয়েছেন ঈশ্বর। ভুল সংশোধনের একটা সুযোগ দিয়েছেন… হোক সেটা এই পরিস্থিতিতে। দুহাত একত্র করল ও। আ… আমাকে ক্ষমা করে দাও, ভাই!

সামনে এগোল অলিভার, বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ বাধা দিল না ওকে। রসকষহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কীসের জন্য ক্ষমা চাইছ তুমি আমার কাছে?

জবাব দেয়ার চেষ্টা করল লায়োনেল, পারল না। কাশতে শুরু করল, শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমত। কাশির সঙ্গে বেরিয়ে এল কয়েক ফোঁটা রক্ত। তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেললেন সার জন।

ওহ! আঁতকে ওঠার মত আওয়াজ বেরিয়ে এল রোজামুণ্ডের গলা দিয়ে। বিছানার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। কথা বলো, লায়োনেল! ঈশ্বরের দোহাই, কথা বলো?

কাশি থামিয়ে মলিন হাসি হাসল লায়োনেল। ভাঙা গলায় বলল, ভয় পেয়ো না, সব বলে যব আমি… ঈশ্বর আমাকে সেজন্যেই এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিন, সার জন। আমি এক নিকৃষ্ট পাপী, আপনার স্পর্শ পাবার উপযুক্ত নই। পিটার গডলফিনকে আ… আমিই খুন করেছি।

কী! চমকে উঠলেন সার জন। একই সঙ্গে বাকিরাও।

হ্যাঁ। কিন্তু ওটা আমার পাপ নয়। আত্মরক্ষার জন্য ওর প্রাণ নিতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি–লড়াইটাও ছিল ন্যায্য। পাপ করেছি পরে। যখন সবাই অলিভারকে সন্দেহ করল, তার সুযোগ নিয়েছি আমি। সত্যি ঘটনা জানত আমার ভাই, তারপরেও রক্ষা করার চেষ্টা করেছে আমাকে… আর সেটার প্রতিদান দিয়েছি আমি বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে। নিজের জন্য ভয় পাচ্ছিলাম আমি… ওর প্রতি ঈর্ষাও অনুভব করছিলাম… তাই অপহরণ করাই ওকে…

গলার স্বর ম্লান হতে হতে থেমে গেল লায়োনেলের। নতুন করে কাশতে শুরু করল। দমকে দমকে মুখ উঠে আসছে রক্ত-মেশানো থুতু। বিছানার চাদর খামচে ধরে চেষ্টা করছে ব্যথা সামলানোর। ভয়াবহ দৃশ্য।

কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলো না রোজামুত্রে। অলিভারের জীবন বাঁচানোর জন্য নারীসুলভ আবেগ ত্যাগ করেছে। কড়া গলায় বলল, কথা শেষ করো! কাকে ভাড়া করেছিলে অলিভারকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য? নাম বলো তার!

সোয়ালো জাহাজের ক্যাপ্টেন… কাশি থামলে বলল লায়োনেল, …জ্যাসপার লেই।

চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল রোজামুণ্ডের, কিন্তু ক্ষান্ত দিল না। সময় থাকতে সমস্ত সত্য লায়োনেলের পেট থেকে বের করে নেবার পণ করেছে। বলল, এবার বলো গতকালকের ঘটনা। নিজে পালিয়ে এসেছ, নাকি সার অলিভারই তোমাকে পাঠিয়েছিল সিলভার হেরনে?

 থাক, লেডি, আর ওকে কষ্ট দেবার প্রয়োজন নেই। বাধা দিয়ে বললেন লর্ড হেনরি। যা বলার বলে দিয়েছে ও। ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করুন, কিলি। অন্ধ ছিলাম আমরা।

নীরবে মাথা ঝাঁকালেন সার জন, লায়োনেলের উপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না।

সার জন! ফিসফিসাল মুমূর্ষ যুবক। আছেন আপনি? এখনও? হাসার চেষ্টা করল। বিদায়, সার। পাপ করেছি আমি… তার মূল্যও দিয়েছি। আ… আমার হাত ধরুন, সার জন।

কাঁপতে থাকা একটা হাত তুলল সে। সেটা চেপে ধরলেন সার জন। এই দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারল না অলিভার।

লায়োনেল! ভাই আমার!! চেঁচিয়ে উঠল ও। দুহাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিছানার পাশে। পাগলের মত চুমু খেলো ভাইয়ের কপালে। গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়েছে। হারিয়ে গেছে গত পাঁচ বছর ধরে বুকের ভিতর জমে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ। জেগে উঠেছে ভ্রাতৃস্নেহ। আমার হাত খুলে দিন! চেঁচাল ও।

লর্ড হেনরির ইশারায় খুলে দেয়া হলো বাঁধন। লায়োনেলকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল অলিভার। ফিসফিসিয়ে বলল, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, ভাই। আর কোনও অভিযোগ নেই আমার।

অলিভার, লায়োনেল বলল, তুমি মহান… আর আমি স্রেফ একটা নরকের কীট। বড় ভুল করেছি আমি… এখন বুঝতে পারছি। তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছি তো? তাকাল লর্ড হেনরির দিকে। বলুন আমার ভাই বেকসুর কি না। দরকার হলে আরও স্বীকারোক্তি দেব আমি!

দরকার নেই, লর্ড হেনরি বললেন। ও নির্দোষ। আর কোনও অভিযোগ তোলা হবে না ওর বিরুদ্ধে… আমি কথা দিচ্ছি!

পোর্টহোল সূর্যের এক চিলতে আলো পড়ল লায়োনেলের মুখে। ফ্যাকাসে চেহারায় দেখা দিল আনন্দের চিহ্ন। যাক, আমি নিশ্চিন্ত, বলল ও। যা হবার হয়ে গেছে, ভাই। কিন্তু ভবিষ্যৎ এখন তোমার হাতে। হাসল একটু। কালকের সাঁতারটা বড় লম্বা ছিল। পেনারো থেকে ট্রেফুসিস পয়েন্টে পৌঁছুতেও অনেক সাঁতার কাটতে হয়েছে, কিন্তু তখন তুমি আমার সঙ্গে ছিলে। জানতাম, আমার শক্তি ফুরিয়ে গেলেও তুমি সাহায্য করবে আমাকে। কাল সন্ধ্যায় সে-আশা ছিল না। তখনই আমি তোমার অভাব বুঝতে পেরেছি, অলিভার। বুঝেছি তোমাকে আমার কতখানি দরকার।

কথা বোলো না! ওর ঠোঁটে আঙুল রাখল অলিভার।

শেষবারের মত হাসল লায়োনেল, তারপর কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। চিরদিনের মত।

হু হু করে কেঁদে ফেলল রোজামুণ্ড, মুখ ঢাকল দুহাতে। মাথা নামিয়ে নিলেন সার জন আর লর্ড হেনরি-সহ সবাই। আর অলিভার… ভাইয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে বসে রইল মূর্তির মত। বলতেও পারবে না কখন ওর চোখের কোণ থেকে নেমে এসেছে দুফোঁটা অশ্রু।

অনেকক্ষণ পর ওর কাঁধে হাত রাখলেন সার জন। সাবধানে আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লায়োনেলকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়, হাতদুটো ভাঁজ করে দিলেন বুকের উপর। তারপর একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন লাশটা।

উঠে দাঁড়াল অলিভার। অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় বুক দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে, চেহারায় পড়েছে বেদনার ছাপ।

চলো, ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন সার জন। দুজনে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। জাহাজের পাটাতনে পৌঁছে থামল। উদাস দৃষ্টিতে তাকাল খোলা সাগরের দিকে।

ও আমার ছেলের মত ছিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সার জন, যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন। সেই ভালবাসাই আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল।

আর ও ছিল আমার ভাই, বলল অলিভার শান্ত স্বরে। আল্লাহ্ ওকে বেহেশত নসিব করুন।

আ… আমি কি তোমার ক্ষমা চাইতে পারি? ইতস্তত করে বললেন সার জন! বুঝতেই পারছ, স্রেফ আবেগের বশে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম…

ভদ্রলোককে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই যেন দ্রুত হাত বাড়িয়ে দিল অলিভার, আন্তরিক ভঙ্গিতে করমর্দন করলেন সার জন। বললেন, আমরা আবার প্রতিবেশী হতে চলেছি, সার অলিভার। কথা দিচ্ছি, এবার আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে।

আমি আর বন্দি নই তা হলে? জিজ্ঞেস করল অলিভার।

না, সার অলিভার, বলে উঠলেন লর্ড হেনরি। ওদের পিছু পিছু এসেছেন তিনি। নিশ্চিন্তে ইংল্যাণ্ডে ফিরতে পারো তুমি। রানি তোমার কাহিনি শুনবেন, প্রয়োজনে সেটার সত্যতা জ্যাসপার লেইয়ের মাধ্যমে প্রমাণ করা হবে। পুরনো পদবী আর সম্মান আবার ফিরে পাবে তুমি, আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি তার।

ধন্যবাদ, কিন্তু পদবী-টদবী চাই না আমি। ধর্মও বদলাতে আগ্রহী নই, অলিভার বলল। তাতে কোনও সমস্যা আছে?

আমার তো মনে হয় না, লর্ড হেনরি বললেন। ধর্ম-কর্ম মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তা নিয়ে আপত্তি জানানোর অধিকার নেই কারও। হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমাকে তোমার বন্ধু বলে ভাবলে খুশি হব।

ধন্যবাদ, মাই লর্ড, বলে হাত মেলাল অলিভার।

রোজামুণ্ড এসে দাঁড়িয়েছে ওদের কাছে! ওকে লক্ষ্য করে গলা খাঁকারি দিলেন সার জন। আমাদের বোধহয় এবার যাওয়া, দরকার, লর্ড হেনরি, বললেন তিনি। অনেক কাজ পড়ে আছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বললেন লর্ড লেফটেন্যান্ট। সার জনের সঙ্গে চলে গেলেন জাহাজের অন্যদিকে। পাটাতনে একা রয়ে গেল রোজামুণ্ড আর অলিভার।

কয়েক মুহূর্ত নীরবে পরস্পরকে দেখল ওরা, তারপরেই অলিভারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রোজামুণ্ড। ওকে নিবিড় আলিঙ্গনে টেনে নেয় অলিভার।

আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল কৌতূহলী নাবিকেরা। অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখছে–পাগড়ি-কোর্তা পরা এক কর্সেয়ারের বুকে ইংরেজ অভিজাত নারী! তারচেয়েও অদ্ভুত হলো–দুজনকে মানিয়েছে বেশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *