কালো বাক্সের রহস্য

কালো বাক্সের রহস্য

ছেঁড়া ঘুড়ির পেছনে

আচায্যিপাড়ার স্বপন কবে তার জ্যাঠামশায়ের শ্রাদ্ধে ন্যাড়া হয়েছিল সেই থেকে ওর নাম ন্যাড়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ন্যাড়া বললে ভারি রেগে যেত। আজকাল সয়ে গেছে। বাড়িতেও সবাই তাকে ন্যাড়া বলে।

তা ন্যাড়াই ব্যাপারটা দেখেছিল।

এই মহকুমা শহরের পাশ ঘেঁষে গেছে রেললাইন। স্টেশনের ওধারে রেলইয়ার্ড হবে বলে প্রায় এক বর্গকিলোমিটার জায়গা রেলদফতর দখল করে রেখেছেন। সেখানে আগাছার জঙ্গল, হাজামজা একটা ঝিল আর ঘাসেভরা মাঠ আছে। সেই মাঠে অনেক ছেলে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ায় কিংবা খেলাধুলা করে। ন্যাড়া গিয়েছিল ঘুড়ি ওড়াতে।

শীতের বিকেল। কনকনে উত্তুরে হাওয়া বইছিল। ন্যাড়ার ঘুড়ি একটা গোত্তা খেয়ে গাছের ডগায় সুতো জড়িয়ে গণ্ডগোল বাধিয়েছিল। ন্যাড়া গাছে চড়তে তত পটু নয়। আর গাছটাও মস্তো ঝকড়া বট। অগুনতি ঝুরি। তলাটা ততক্ষণে বেশ আঁধার দেখাচ্ছিল।

ন্যাড়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখেছিল, কেউ কোথাও নেই। যেসব ছেলে তার মতো ঘুড়ি ওড়াতে এসেছিল বা ক্রিকেট খেলছিল, কখন একে একে চলে গেছে।

ন্যাড়ার মনে শুধু ভূতের ভয়। এমন নিরিবিলি জায়গা, তার ওপর আসন্ন সন্ধ্যা আর এমন বটগাছের মতো আশ্রয়। ভূতেরা কি এমন জায়গা ছেড়ে থাকতে চায়?

কিন্তু অমন সুন্দর ঘুড়িটাও এখন একটুও ফেঁসে যায়নি। শান্তভাবে আটকে আছে। অনেকখানি সুতোও রয়েছে। ন্যাড়া শেষ পর্যন্ত সাহস করে বটগাছে উঠেছিল। মোটা ছড়ানো একটা ডালে। কয়েক-পা এগোলেই মাথার ওপর হাত বাড়িয়ে ঘুড়িটা ছাড়ানো যায়।

সে সবে ঘুড়িটা ছাড়িয়েছে, হঠাৎ নিচে কোথাও শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ হল। ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে দেখল, দুজন লোক সবে এসে দাঁড়িয়েছে এবং চাপা গলায় কী বলাবলি করছে। একজনের চেহারা একেবারে জল্লাদের মতো। গোঁফ, গালপাট্টা তো আছেই। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। পরনে কালো পাতলুন আর কালো গেঞ্জি। একজনের হাতে বন্দুক, অন্যজনের হাতে পিস্তল। তার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গায়ে চাদর। তাদের পায়ের কাছে একটা কালো রঙের ছোট্ট বাকসো রয়েছে। বাকসোটা তারা বয়ে এনেছে বোঝাই যায়। কিন্তু লোক দুটোকে যেন এর আগে কোথাও দেখেছে। পিস্তলধারী মুখটা চাদরে ঢেকে রেখেছে বলে চেনা যাচ্ছে না।

ন্যাড়া বিশেষ করে বন্দুক-পিস্তল দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। লোকদুটো নিশ্চয় ডাকাত-গুন্ডা না হয়ে যায় না। পাছে ন্যাড়াকে তারা মেরে ফেলে, ন্যাড়া টু শব্দটি করেনি। সে চুপচাপ গিরগিটির মতো ডালের সঙ্গে নিজেকে আটকে রেখে ব্যাপারটি দেখছিল।

আলো ক্রমে মরে যাচ্ছিল। আবছা আঁধারে লোক দুটো তারপর অদ্ভুত কাণ্ড শুরু করেছিল। তারা বটতলায় জুতোর ঠোক্কর মেরে যেন একটা অদৃশ্য ফুটবল নিয়ে খেলা করছিল। খানিক পরে একজন বলে উঠেছিল—এসো, হাত লাগাও।

তারপর দুজনে হাঁটু দুমড়ে বসে মস্তো দুটো ছোরা বের করেছিল। সেই ছোরা দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা আংটা বেরুতেই সেটা দুজনে মিলে জোর টানাটানি করেছিল। ততক্ষণে বটতলায় আঁধার ঘন হয়েছে। ন্যাড়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু টের পেয়েছিল। কালো বাকসোটা দুজনে বয়ে এনে তারপর কিছুক্ষণ যেন বেমালুম নিপাত্তা হয়ে গেল। আর কোনও সাড়া-শব্দই নেই।

সেই শীতে ন্যাড়া তো জমে হিম হয়ে গেছে। অথচ সাহস করে নেমে আসতে পারছে না। ঘুড়ির মায়া আর নেই তখন। প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসাটাই বড় কথা। কিন্তু নামলেই যদি গুন্ডা দুটোর সামনে পড়ে?

অথচ ওরা গেল কোথায়? বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি?

না। একটু পরে টর্চের আলো জ্বলল নিচে। সেই আলোয় ন্যাড়া যা দেখল, তাতে হতবাক হয়ে বসে রইল। একটা চৌকো গর্তের ধারে একজন বসে গর্তের ভেতর আলো ফেলেছে। আরেকজন সেই গর্তে নেমে কী একটা টানাটানি করছে। কালো বাকসোটা তার পায়ের কাছে গর্তের মধ্যেই রয়েছে। গর্তটা কিন্তু নিছক গর্ত নয়, চৌকো পাথরে বাঁধানো চৌবাচ্চা যেন।

গর্তের লোকটা হঠাৎ বলে উঠল—পাওয়া গেছে।

ওপরকার লোকটা বলল—খুলে ফ্যালো।

ফের বিষাক্ত গ্যাস বেরুতে পারে আগের মতো।

পরীক্ষা করে দ্যাখো তাহলে। আগের বার নিশ্চয় সব বেরিয়ে গেছে।

ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ। গর্তের লোকটা কী একটা যন্ত্র বের করে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল—নেই।

তাহলে ভেতরে ঢুকে যাও। আমি টর্চ নেভাচ্ছি। কেউ দেখে ফেলতে পারে। ঠিক আছে! আমার কাছে টর্চ আছে।

গর্তের ওপরকার টর্চ নিভে গেল। গর্তের ভেতর টর্চ জ্বলল। লোকটা সেই কালো বাকসোটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসল। তারপর আর তাকে দেখা গেল না।

বটতলার নিচে তখন ঘন অন্ধকার। এত শীতেও ন্যাড়ার গায়ে যেন ঘাম জমছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এটা একটা স্বপ্ন না বাস্তব ঘটনা। কে ওরা? ওই বাকসোতে কী আছে? আর এই পোড়ো জঙ্গুলে জায়গায় কি তাহলে মাটির নিচে কোনও গোপন ঘর আছে—যেখানে লোকটা বাকসোটা লুকোতে নিয়ে গেল।

সময় কাটতে চায় না। ঝিলের ওদিকে শেয়াল ডাকছিল। মাথার ওপর পাচা ডেকে উঠছিল। ভাগ্যিস নিচের লোকটা প্যাচাটা দেখার জন্য টর্চ জ্বালেনি। তাহলেই ন্যাড়াকে দেখতে পেত এবং নিশ্চয় গুলি করে মারত। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ ন্যাড়ার মনে হল, ওদের গলার স্বর যেন চেনা।

কতক্ষণ পরে নিচে ফের আলোর ঝলক। তারপর দুজনের কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল।

সব ঠিক আছে। হুম।

উঠে এসো ঝটপট। সব ঢাকাটুকি দেওয়া যাক।

অলো জ্বালার দরকার নেই। এসো, হাত লাগাও।

নিচে অস্পষ্ট একটা ভারী শব্দ হল। তারপর অনেক রকম বিদঘুটে খসখস, ধুপধাপ শব্দ হতে থাকল। তারপর ন্যাড়া টের পেল, ওরা চলে গেল। বটতলায় তখন ঘন আঁধার আর নীরবতা। আর হিম।

একটু পরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঘুড়ির মায়া ছেড়ে ন্যাড়া গাছ থেকে নেমে এসেছিল। তারপর এক দৌড়ে স্টেশন। স্টেশন থেকে সটান বাড়ি।

সে-রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। কিন্তু ঘটনাটা বাবা-মা কিংবা আর কাউকে বলেনি—পাছে ওঁরা ওকে গাছে ওঠার জন্য বকাবকি করেন। তাছাড়া এই বিদঘুটে ব্যাপারটা তারা যে বিশ্বাস করবেন না, ন্যাড়া তা জানত। উলটে মিথ্যে বলার জন্য তাকে মার খেতে হবে বরং।

রহস্যময় কালো বাকসো

ন্যাড়া স্বভাবে যাকে বলে আপনভোলা ছেলে। খানিকটা খেয়ালিও বটে। তারপর কতদিন স্টেশনের ওপারে সেই মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে বা বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেও গেছে। কিন্তু বটতলার সেই রহস্যময় ঘটনার কথা নিয়ে আর গা করেনি। বন্ধুরাও হয়তো তাকে মিথ্যুক বলে বসবে।

তাছাড়া বটগাছটার এমন ভূতুড়ে চেহারা যে দিনদুপুরে ওখানে যেতেই বুক কাঁপে।

ঘুড়িটা কয়েকদিনের মধ্যেই বাতাসের চোটে ফাটাফুটি হয়ে শুধু কঙ্কালটুকু আটকে রয়েছে।

কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে ন্যাড়ার ছোটমামা শংকরবাবু এলেন বেড়াতে। বড়দিনের ছুটি কাটাতে ফি বছর তিনি লিটনগঞ্জে দিদির বাড়িই আসেন। এ শহরটা ভারি ছিমছাম আর সুন্দর। একটা নদীও বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। জলবায়ু মোটামুটি স্বাস্থ্যকর।

শংকরবাবু নানা দেশ ঘুরেছেন। চমৎকার গল্প করতে পারেন। ছোটমামা এলে ন্যাড়া তো আহ্লাদে আটখানা হয়। সব সময় ছায়ার মতো ওঁর সঙ্গে ঘোরে।

বিকেলে শংকরবাবু বেড়াতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে শ্রীমান ন্যাড়া।

শংকরবাবু সম্প্রতি আফ্রিকার চাঁদ রাজ্যে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটা বিশাল হ্রদ আছে। তার ওপর আছে ভাসমান দ্বীপ। সেইসব দ্বীপে একটা করে বসতি রয়েছে। মজার কথা, দ্বীপগুলো সারাদিন হ্রদে একখান থেকে আরেকখানে ভেসে বেড়ায়। আর বসতিগুলো যেন জাহাজ। সেইসব গল্প বলছিলেন শংকরবাবু।

শেষে কথায়-কথায় বললেন—তবে সব দেশের চেহারাই দিনে-দিনে বদলে যাচ্ছে। খালি তোদের লিটনগঞ্জ দেখছি, বরাবর একইরকম রয়ে গেল!

ন্যাড়া বলল—আচ্ছা ছোটমামা, সেবার কোথায় যেন গিয়েছিলে—সেই যে সুড়ঙ্গের মধ্যে লোকেরা বাস করে। বাইরে বেরুবার দরকার হয় না। সেটা কী দেশ ছোটমামা?

ও। সে তো দক্ষিণ মেরুতে। আন্টার্কটিকায়। বলে শংকরবাবু একচোট হাসলেন। কিন্তু তারা তো বিজ্ঞানী। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে গিয়ে আন্টার্কটিকায় বরফ খুঁড়ে পাতালনগরী বানিয়ে বাস করছেন। কতরকম পরীক্ষা করছেন। সে আসলে তাদের গবেষণাকেন্দ্র। বুঝলি?

ন্যাড়া লাজুক হেসে বলল—আমার বড্ড ভুলো মন, ছোটমামা। তুমি তাই বলেছিলে বটে। এই দ্যাখো না, সুড়ঙ্গ বলতেই মনে পড়ে গেল…

বলে হঠাৎ চুপ করে গেল সে। শংকরবাবু বললেন—কী রে? থামলি যে?

ন্যাড়া ওঁর একটা হাত চেপে ধরে বলল-ছোটমামা, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?

শংকরবাবু অবাক হয়ে বললেন—কোথায় রে?

আহা। এসো না! তোমাকে আমি সুড়ঙ্গ দেখাব।

বলে ন্যাড়া শংকরবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। শংকরবাবু জানেন, তার এই ভাগনেবাবাজি বরাবর বড় খামখেয়ালি ছেলে। অদ্ভুত স্বভাবচরিত্র। মাঝে মাঝে যা সব করে, পাগলামি বলেই মনে হয়। তার ওপর বড় জেদিও বটে।

তাই চুপচাপ হাসিমুখে ওর সঙ্গে চললেন। চলা তো নয়, যেন গাড়িতে যাওয়া। ন্যাড়া তাকে প্রায় দৌড় করিয়ে নিয়ে চলেছে। স্টেশনে গিয়েও থামল না! ওভারব্রিজ পেরিয়ে একেবারে সেই পোড়ো মাঠে হাজির করল। সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে বটতলায়।

বটতলায় ন্যাড়া হাত ছেড়ে দিয়ে কী যেন খুঁজছে দেখে শংকরবাবু বললেন—ব্যাপারটা কী বলবি তো বাঁদর ছেলে। এতখানি পথ আমায় দৌড় করালি। বাস। এবয়সে এত ধকল বরদাস্ত হয়? দম বেরিয়ে গেছে একেবারে।

ন্যাড়া একবার ওপর দিকে বটগাছের ডালপালার দিকে তাকাল। তারপর নিচের দিকে তাকাল। দৌড়ে গিয়ে শুকনো পাতা সরাতে আরম্ভ করল।

শংকরবাবু বললেন—ও কী রে! ও কী করছিস?

ন্যাড়া ব্যস্তভাবে বলল—সুড়ঙ্গের কথা বললুম না। সেই সুড়ঙ্গটা এখানেই আছে।

অ্যা। বলিস কী! বলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শংকরবাবু।

শুকনো পাতার তলায় মাটির চাঙড় সরাচ্ছিল ন্যাড়া। একটু পরেই সে চেঁচিয়ে উঠল—ছোটমামা! ছোটমামা! কাম অন! পেয়ে গেছি।

শংকরবাবু হেঁট হয়ে দেখলেন, একটা চৌকো পাথর রয়েছে এবং তার মধ্যিখানে একটা লোহার মজবুত আংটা। বললেন—তাজ্জব ব্যাপার! এ কী রে ন্যাড়া!

সুড়ঙ্গের দরজা ছোটমামা।

তুই টের পেলি কীভাবে? পরে বলব।

আগে এটা ওঠাও না!

দুজনে আংটা ধরে পাথরটা তুলে একপাশে রাখল। নিচে কবরের মতো একটা গর্ত দেখা গেল। এখনও দিনের আলো প্রচুর। শংকরবাবু গর্তে লাফ দিয়ে নামলেন। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন—এ কী!

ন্যাড়া হাঁটু গেড়ে গর্তের মাথার দিকে বসে রয়েছে। বলল—সুড়ঙ্গের ভেতরে একটা কালো বাকসো দেখতে পাবে। ওর মধ্যে গুপ্তধন আছে।

বলিস কী! বলে শংকরবাবু সুড়ঙ্গের দরজাটা টেনে খুললেন। ভেতরে ঘন অন্ধকার। পকেট থেকে সিগারেট-লাইটার বের করে জ্বাললেন। তারপর ভেতরে ঢুকে গেলেন। কয়েক পা এগিয়ে টের পেলেন, এটা একটা ছোট ঘর। মাটির নিচে পাথরের দেয়াল ও ওপরে ছাদ রয়েছে। আর ঘরের মধ্যিখানে একটা কালো পাথরের ছোট্ট কবর। কবরের গায়ে ফারসি ভাষায় লেখা একটা ফলক আছে। এটা সম্ভবত কোনো শিশুর কবর। শংকরবাবুর মনে পড়ল, কয়েকশো বছর আগে এখানে বাংলার তুর্কি সুলতানদের রাজধানী ছিল। এই মাটির তলায় গোপন কবর নিশ্চয় কোনা সুলতানবংশীয় শিশুর। পাছে শত্রুপক্ষ সুলতানবংশীয় শিশুর মৃতদেহের অসম্মান করে, তাই হয়তো গোপনে এভাবে ভূগর্ভে কবর দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু তার চেয়ে অবাক কাণ্ড, কবরের ওপর সত্যি একটা কালো বাকসো রয়েছে। বাকসোটা ছোট্ট। শংকরবাবু সেটা তুলে নিলেন। বিশেষ ভারী নয়।

ওপর থেকে ন্যাড়ার চাপা গলার আওয়াজ ভেসে এল—শিগগির ছোটমামা! শিগগির! বাকসো নিয়ে চলে এসো। কারা যেন আসছে!

শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে বেরিয়ে বললেন—ন্যাড়া, ধর এটা। আমি দরজা এঁটে দিই।

ন্যাড়া কালো বাকসোটা নিয়ে বলল—মনে হচ্ছে, সেই লোকদুটো আসছে ছোটমামা! শিগগির!

শংকরবাবু ঝটপট গর্ত থেকে উঠলেন। তারপর আংটা লাগানো পাথরটা আগের মতো চাপা দিয়ে তার ওপর মাটির চাঙড়গুলো বসিয়ে দিলেন। শুকনো পাতা ছড়ালেন। একেবারে আগের মতো স্বাভাবিক দেখাল জায়গাটা।

ন্যাড়া আঙুল তুলে ওপাশের মাঠে দুজন লোককে দেখিয়ে বলল—ওরা আসছে। কেটে পড়া যাক ছোটমামা! ওদের কাছে বন্দুক আছে কিন্তু।

লোকদুটো ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। কারণ বটগাছটার ঝুরি আছে অজস্র। তা ছাড়া ওপাশে ঝোপঝাড়ও রয়েছে। শংকরবাবু বাকসোটা বগলদাবা করে বললেন—চলে আয় ন্যাড়া।

দুজনে উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলেন।

তারপর অনেকখানি জঙ্গলের আড়ালে এগিয়ে ঘুরপথে নদীর ব্রিজে পৌঁছোলেন। সেখান থেকে রেললাইন ডিঙিয়ে একেবারে সোজা বাড়ির পথে।…

শ্রীমান ন্যাড়ার অন্তর্ধান

কলকাতার ইলিয়ট রোডে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটটি ড়ো ঘুঘুর বাসা বলে পরিচিত। বুড়ো ঘুঘু বলতে কর্নেলকেই বোঝায়। ধুরন্ধর লোককেই ঘুঘু বলা হয়। তবে কদর্থে। কিন্তু কর্নেলের বেলায় এই ঘুঘু-নাম সদর্থে। এই বুড়োর মতো বিচক্ষণ ও ক্ষুরধার বুদ্ধির গোয়েন্দা কদাচিৎ দেখা যায়। লোকে বলে, তার টাক পড়ার কারণ বুদ্ধির তেজে চুল উঠে গেছে। আর সেইসব চুলই নাকি সাদা দাড়ি হয়ে গজিয়েছে।

যাই হোক, সেদিন শীতের সকালে কর্নেল তাঁর ড্রইং রুমে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে এক ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন।

এই ভদ্রলোক আর কেউ নন, শংকরবাবু। লিটনগঞ্জের শ্রীমান ন্যাড়ার সেই ছোটমামা।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন—হুম। তারপর কী হল বলুন।

শংকরবাবু বললেন—বাকসোটা খোলার বহু চেষ্টা করেও খুলতে পারলুম না, বাকসোটা ইস্পাতের পাতে তৈরি মনে হল। তাই পরদিন ওটা গোপনে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চলে এলুম। আমার এক বন্ধুর ছোট্ট মেশিনটুলসের কারখানা আছে। তার ওখানেই খোলার ব্যবস্থা করব ভেবেছিলুম। কিন্তু বন্ধুও হার মানলেন। বললেন, এটা কোনওভাবে খোলা সম্ভব নয়। বিদেশে একরকম ইলেকট্রনিক করাত আছে, তা দিয়ে কাটা যেতে পারে। শুনে তো ভারি দমে গেলুম। বাকসোটা ফেরত নিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছি, দেখি লিটনগঞ্জ থেকে আমার জামাইবাবু অর্থাৎ শ্রীমান ন্যাড়ার বাবা অসীমবাবু হাজির। ব্যাপার কী? না—ন্যাড়ার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে আসেনি শুনে তো উনি ভেঙে পড়লেন। তখন …

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন—অসীমবাবু বাকসোর ব্যাপার জানেন?

না। কাকেও বলিনি। আমার বন্ধু জগন্ময়কেও বলিনি, কীভাবে কোথায় ওটা পাওয়া গেছে।

হুম। তারপর?

তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জামাইবাবুকে তো লিটনগঞ্জ পাঠালুম। লালবাজার মিসিং স্কোয়াডে ন্যাড়ার ছবি দিয়ে নিখোঁজের খবরও দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যা আঁচ করেছিলুম, তাই ঘটেছে। আমার কাছে কাল হঠাৎ একটা বেনামী চিঠি এসে হাজির। তাতে লেখা আছে : তোমার ভাগনেবাবাজি শ্রীমান ন্যাড়া আমাদের হাতে। যদি ওকে ফেরত চাও, তাহলে পত্রপাঠ আমাদের বাকসোটি এই ঠিকানায় রেখে এসো। মনে রেখো, দু-দিনের বেশি অপেক্ষা করতে রাজি নই।…

কোনও নাম নেই চিঠিতে?

আজ্ঞে না।

চিঠিটা সঙ্গে এনেছেন?

হ্যাঁ। এই যে। শংকরবাবু একটা খাম বার করে এগিয়ে দিলেন।

কর্নেল চিঠিটা খুলে পড়ার পর বললেন—হুম! বি টি রোডের ধারে জায়গাটা। একটা বাগানবাড়ি আছে ওখানে। পেছনে গঙ্গার ধারে সায়েবি আমলের কবরখানা। বাকসোটা ওখানে পৌঁছে দিতে হবে! আচ্ছা শংকরবাবু, বাকসোটা এখন কোথায় রেখেছেন?

শংকরবাবু চাপা গলায় বললেন—আমার বেডরুমে। তবে এমনভাবে রেখেছি, কেউ টের পাবে না।

কীভাবে, শুনি?

আমরা বনেদি পরিবার কলকাতার। আমার ঠাকুরদা স্বর্গত ঈশানচন্দ্র ঘোষের নাম শুনে থাকবেন। উনি প্রখ্যাত শিকারি ছিলেন। আমার বাবা বারীন্দ্রনাথ নামকরা শিকারি ছিলেন। তিনি কবছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বাড়িটা পুরোনো আমলের। দেয়ালে অনেক জায়গায় গুপ্ত আলমারি রয়েছে। বাইরে থেকে এতটুকু ধরা যাবে না। আমার বেডরুমে একপাশের দেয়ালে ওইরকম একটা গুপ্ত আলমারি আছে। তার মধ্যে রেখেছি বাকসোটা।

কর্নেল চিঠিটা মুড়ে খামে ঢুকিয়ে বললেন—এটা আমার কাছে রইল। আপত্তি নেই তো?

শংকরবাবু ব্যস্তভাবে বললেন—মোটেও না, মোটেও না। এমনকি, বাকসোটাও আপনার জিম্মায় রাখবার কথা ভেবেছি, কর্নেল! এতকাল ধরে আপনার কত সব কীর্তির কথা কাগজে পড়েছি। মনে মনে কতবার ভেবেছি, আপনার সঙ্গে আলাপ করে আসব। সময় হয় না। বিশেষ করে শুনেছি, একসময় আপনারও আমার মতো দেশ-বিদেশে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল!

এখনও আছে। বলে কর্নেল হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। যাকগে চলুন শংকরবাবু, আগে সেই বাকসোটা দেখে আসি। তারপর শ্রীমান ন্যাড়ার উদ্ধারের কথা ভাবা যাবে।

একটু পরে শংকরবাবুর নীল রঙের মোটরগাড়িটি ছুটে চলল উত্তর কলকাতার দিকে। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে গিয়ে বি টি রোডে পৌঁছে শংকরবাবু বললেন—এটাই আশ্চর্য লাগছে। যেখানে ওরা বাকসোটা ফেরত দিতে বলেছে, সে জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে।

কর্নেল চোখ বুজে কী ভাবছিলেন। শুধু বললেন—হুম!

.

ডানলপ ব্রিজ ছাড়িয়ে আরও দু-কিলোমিটার এগিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট রাস্তায় গাড়ি মোড় নিল। তারপর সামনে একটা গেট দেখা গেল। ওটা শংকরবাবুর পৈতৃক বাড়ি, অমর নিকেতন।

গঙ্গার ধারে বিশাল এলাকা জুড়ে এই বাড়ি। বাগান রয়েছে। ফুল বাগিচা আছে। আগের আমলে বনেদি বড়লোকের বাড়ি যেমন ছিল তেমনি। গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াল।

                        রহস্য আরও ঘনীভূত

শংকরবাবুর বেডরুম দোতলার পুব-দক্ষিণ কোণে। অবিবাহিত মানুষ। বাড়িতে লোক বলতে উনি, ওঁর দূর সম্পর্কের এক পিসিমা যোগমায়াদেবী, আর রাঁধুনি সিধু ঠাকুর, বাজার সরকার মদনবাবু, চাকর হারাধন। হারাধন বুড়ো হয়ে গেছে। শংকরবাবুকে একরকম কোলেপিঠে করে সেই মানুষ করেছে। বাইরের কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না ওঁদের মধ্যে মনিব-চাকর সম্পর্ক।

কর্নেল ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন-আপনিও কি শিকারি?

শংকরবাবু হেসে জবাব দিলেন—হা। ওটা তিন-পুরুষের নেশা বলতে পারেন। তবে আজকাল তো দেশ থেকে বনজঙ্গল প্রায় উজাড়! জন্তুজানোয়ারও বিশেষ নেই-টেই। যা কিছু আছে, তা সরকারি অভয়ারণ্যে বাস করছে। কাজেই আজকাল শিকারে যাওয়া হয় না।

কর্নেল বললেন—যা গে। এবার সেই বাকসোটা বের করুন।

শংকরবাবু ঘরের দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করে দিলেন আগে। তারপর সুইচ টিপে বাতি জ্বাললেন। একপাশের দেয়ালে লম্বা-চওড়া একটা ছবি টাঙানো আছে। বিলিতি চিত্রকরের আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ছবিটা একটু ঠেলে একটা খুদে বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের প্রায় দু-ফুট লম্বা এক ফুট চওড়া একটা অংশ ছোট্ট কপাটের পাল্লার মতো খুলে গেল। তখন ভেতরে হাত ভরে কালো একটা বাকসো বের করে আনলেন।

ফের বোতাম টিপে দেওয়ালের গুপ্ত খোঁদলটা আগের মতো ছবিচাপা দিলেন। বাকসোটা টেবিলে এনে রাখতেই কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন সেটার দিকে। বললেন—এই সেই বাকসো?

হ্যাঁ কর্নেল। এই সেই আজগুবি বাকসো।

কর্নেল টেবিলল্যাম্পের সুইচ টিপে বাকসোটা দেখতে দেখতে তার মুখে প্রচণ্ড বিস্ময় ফুটে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন—আশ্চর্য! আশ্চর্য!

শংকরবাবু বললেন-কী আশ্চর্য কর্নেল?

শংকরবাবু, মনে হচ্ছে এটা একটা ঐতিহাসিক বাকসো। এর গায়ে খুব ছোট হরফে ফারসিভাষায় কী সব লেখা আছে। আমি ফারসিভাষাটা মোটামুটি জানি। একসময়ে ইরানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদ্রোহী একদল কুর্দ উপজাতির হাতে বন্দি হয়েছিলাম। কুর্দদের মাতৃভাষা ফারসির অপভ্রংশ কুর্দিস্তানি। কিন্তু তারা ফারসিও ভালো জানে। যাই হোক, পরে ব্রিটিশ সেনারা আমাকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু মাঝখান থেকে কুর্দিস্তানি আর ইরানি অর্থাৎ ফারসি আমার শেখা হয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলছি শংকরবাবু, সংস্কৃত ও ফারসি কিন্তু আর্যজাতির ভাষার গোষ্ঠীতে যমজ ভাই-বোন বলতে পারেন। এ দু-ভাষায় বিস্তর শব্দ একরকম। তাদের মানেও এক।

কর্নেলের এই বকবক করা বদ অভ্যাস। শংকরবাবু শুনেছিলেন, এ বুড়ো না জানে এমন কোনো বিষয় নেই। যাই হোক, শংকরবাবু উৎসাহ দেখিয়ে বললেন-তাহলে ওতে কী লেখা আছে, বলুন তো কর্নেল?

কর্নেল আতস কাচের সাহায্যে বাক্সের লেখাগুলো পড়তে পড়তে বললেন—আমি অনুবাদ করে যাচ্ছি বাংলায়। আপনি লিখে নিন।

শংকরবাবু একটা প্যাডে লিখতে শুরু করলেন।

১০০০ হিজরি সনে পরম প্রতাপশালী জায়গিরদার মইনুদ্দিন শাহ আল-তামাসের একমাত্র পুত্র আজিমুদ্দিন করুণাময় ঈশ্বরের আহ্বানে মাত্র দ্বাদশ বর্ষ বয়সে স্বর্গধামে প্রস্থান করিলেন। তাহার শোকগ্রস্ত বৃদ্ধ পিতা মিশর হইতে এক সাধকের আশীর্বাদস্বরূপ যে অগণিত রত্ন পাইয়াছিলেন, তাহা এই কৃষ্ণবর্ণ ধাতুনির্মিত পেটিকায় রাখিয়া স্বর্গীয় বালকের সমাধিতে যাপন করিলেন।

কিন্তু এই পেটিকা এক মহাতপস্বী অলৌকিক শক্তিধর ফকিরের মন্ত্রপূত। যে ইহা হরণ করিবে, তাহারই সর্বনাশ ঘটিবে। অতএব হে ঘৃণ্য তস্করবৃন্দ! হুশিয়ার। ইহা স্পর্শ করিও না।…

সুকৌশলে নির্মিত এই পেটিকা এমন এক ধাতুতে নির্মিত যে ইহা কোনোভাবেই খোলা যাইবে না। ইহা ভাঙাও অসম্ভব। অতএব, হে লোভী মানুষ! বৃথা সে-চেষ্টা করিও না।…

এই পেটিকার একস্থলে প্রায় অদৃশ্যে ছুঁচের ন্যায় একটি ছিদ্র আছে। সেই ছিদ্রপথে ইহার চাবি প্রবেশ করাইলে তবেই ইহা খোলা সম্ভব। চাবিটি স্বর্গীয় বালকের কেশের মধ্যে লুকোনো রহিল।

কিন্তু হুশিয়ার! পুণ্যাত্মা বালকের মৃতদেহ স্পর্শ করিও না। ফকিরের অভিশাপ হইতে রক্ষা পাইবে না।…

লেখা শেষ করে শংকরবাবু কর্নেলের মুখের দিকে তাকালেন। কর্নেল তখনও বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছেন। শংকরবাবু বললেন—১০০০ হিজরি সন কত খ্রিস্টাব্দ কর্নেল?

কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন—১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। বাংলায় তখন তুর্কি সুলতানের রাজত্ব। কিন্তু লিটনগঞ্জের ওই পোড়ো মাঠে জঙ্গলের মধ্যে মাটির তলায় কবরের হদিস পেল কে? কীভাবে পেল?

হুম! সেটাই ভাববার কথা। শুধু তাই নয়, আজিমুদ্দিনের কবরে যে এমন গুপ্তধন আছে, তার খববই বা সে কেমন করে জোগাড় করল?

ন্যাড়া বলছিল, একা নয়—দুজন ছিল।

হুম বলে কর্নেল কী যেন ভাবতে থাকলেন। তারপর হঠাৎ নড়ে উঠলেন। বললেন—আচ্ছা শংকরবাবু, লিটনগঞ্জ তো আপনার চেন; জায়গা। ওখানে কি কোনও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা আছে?

শংকরবাবু ব্যস্তভাবে বললেন—আছে, আছে। তবে সেটা তো বেসরকারি সংগ্রহশালা। কমলাক্ষ বাঁড়ুয্যে নামে এক ভদ্রলোকের বেজায় ঐতিহাসিক বাতিক আছে। বলতে গেলে সংগ্রহশালাটা ওঁর চেষ্টাতেই হয়েছে। এলাকা খুঁজে নানারকম প্রাচীন মূর্তি, দলিল-দস্তাবেজ জোগাড় করেন উনি।

কর্নেল বললেন—হুম! চলুন, আজই আমরা লিটনগঞ্জ রওনা দিই। কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে আলাপ করা খুব দরকার।

শংকরবাবু অবাক হয়ে বললেন—কিন্তু ন্যাড়ার উদ্ধারের কী হবে? ওরা যে আজ আর আগামীকাল পর্যন্ত সময় দিয়েছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন-ভাববেন না। ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাকসো পাওয়া। ন্যাড়াবাবাজিকে মেরে ফেলাটা তো উদ্দেশ্য নয়। ওরা ভালোই জানে, ছেলেটাকে মেরে ফেললে আপনারা বাকসোটা সোজা পুলিশের হাতে দেবেন। আমি অপরাধীদের চরিত্র নিয়ে বহুকাল ঘাঁটাঘাঁটি করছি, শংকরবাবু। ওরা যদি নিছক টাকা দাবি করত, তাহলে ভাবনার কথা ছিল। আসল কথা, ওরা চায় বাকসোটা। কাজেই নিশ্চিন্ত থাকুন। তাছাড়া আগামীকাল বিকেলের মধ্যে আমরা ফিরে আসছি।

কথা বলতে বলতে কর্নেল এগিয়ে পশ্চিমের একটা জানলা একটু খুলে উঁকি দিলেন। তারপর খে বাইনোকুলার রেখে বললেন—হুম! ওরা আপনার বাড়ির দিকে নজর রেখেছে।

সে কী! বলে শংকরবাবু কাছে গেলেন। কর্নেল তাকে বাইনোকুলারটা দিলে তাতে চোখ রেখে শংকরবাবু বললেন—গঙ্গার ঘাটে যে লোকটা ছিপ ফেলে বসে আছে, সেই কি?

ঠিক ধরেছেন। কর্নেল সরে এলেন। তারপর বললেন—বাকসোটা যথাস্থানে লুকিয়ে ফেলুন। তারপর চলুন, এখনই বেরিয়ে পড়া যাক!

বাকসোটা আগের জায়গায় রেখে ছবিটা ঠিকঠাক করে আলো নিভিয়ে শংকরবাবু জানালাগুলো খুলে দিলেন। পশ্চিমে একবার উঁকি মেরে বললেন- ছিপ নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে, কর্নেল।

যাক গে। আপনি রেডি হয়ে নিন শিগগির। আর হ্যাঁ, অনুবাদের কাগজটা আমাকে দিন। ওটা পুড়িয়ে ফেলা দরকার।

শংকরবাবু বেরিয়ে গেলেন কাগজটা দিয়ে। হারাধনকে খাওয়ার আয়োজন করতে বলবেন। এদিকে কর্নেল কাগজটা পুড়িয়ে ছাইদানিতে গুঁজে দিলেন।

একটু পরে হারাধন ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। শংকরবাবু এসে বললেন—পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। কাজেই পেটপুরে খেয়ে নিন কর্নেল!

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—আমি তত ভোজনবিলাসী নই। আপনার হারাধন দেখছি দশজন পালোয়ানের খাবার এনেছে।

হারাধন একগাল হেসে বলল-তা আজ্ঞে, আপনার যা পালোয়ানি চেহারা, ওটুকুন আপনার এক গেরাস মাত্তর।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন …

কমলাক্ষের শয়তানি

ন্যাড়া মোটামুটি বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু সে ভারি সরল। সেটাই তার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরদিন সকালে ছোটমামু শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। ন্যাড়া স্টেশনে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছে, পথে কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি হন হন করে আসছিলেন। পাড়াসম্পর্কে কাকা বলে ন্যাড়া। তাই বলেছিল—ও কাকু। ট্রেন যে এইমাত্তর ছেড়ে গেল!

কমলাক্ষ থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন-যাঃ! তাহলে আর কী হবে? ওবেলা যাবখন। আয় বাবা নেড়ু তোর সঙ্গে গল্প করতে করতে যাই।

সেই সময় হঠাৎ ন্যাড়ার মনে চমক খেলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় যে দুটো লোক মাটির তলার ওই কবর খুঁড়তে গিয়েছিল তাদের একজনের গলার স্বর অবিকল কমলাক্ষের মতো না? ন্যাড়া বলেছিল—হা কাকু, তোমার জাদুঘরে যেসব জিনিস রেখেছ, সেসব কোথায় পেয়েছ গো?

কমলাক্ষ বলেছিলেন—ওসব খুঁজে বের করতে হয় রে। অনেক মেহনতের কাজ। ধরু, অনেক সময় মাটির তলাতেও পাওয়া যায়।

ন্যাড়া বলে উঠেছিল—ও কাকু, তাহলে সেদিন সন্ধেবেলা স্টেশনের ওপারে বটতলায়…

অমনি কমলাক্ষ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিলেন—চুপ, চুপ। কাকেও বলিস নে। তা হা রে, তুই কীভাবে জানলি?

ন্যাড়া ফিক করে হেসে বলেছিল—বা রে! তখন আমি গাছের ডালে আটকানো ঘুড়ি পাড়ছিলুম না? তোমাদের কাছে বন্দুক ছিল। তাছাড়া চিনতেও পারিনি। তাই সাড়া দিইনি!

সর্বনাশ! কমলাক্ষ বলেছিলেন। তা এখন চিনলি কী করে?

তোমার গলার স্বরে।

তুই ভারি বুদ্ধিমান ছেলে, নেড়ু। তা হা রে, কাকেও বলেছিলি নাকি কথাটা?

হুঁউ। ছোটমামাকে।

তারপর, তারপর?

সরলমনা খামখেয়ালি ছেলে ন্যাড়া ছোটমামার নিষেধ ভুলে সব কথা বলে ফেলল। কিন্তু ধূর্ত কমলাক্ষের এটা নিতান্ত ছল। আগের দিন সন্ধেবেলা জঙ্গলে বাকসো নিয়ে পালানোর সময় আবছা একপলক তিনি দেখেছিলেন, দুটো লোক জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের একজন বয়সে বাচ্চা। কিন্তু সে যে ন্যাড়া হতে পারে, ভাবেননি তখন। পরে, ওই মাঠে যেসব ছেলে খেলা করতে যায়, তাদের প্রত্যেকের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন, একটা বয়স্ক লোক আর একটা কমবয়সি ছেলেকে কাল সন্ধ্যার আগে ওখানে কেউ দেখেছিল নাকি। হরিহর উকিলের ছেলে সতু বলেছিল, ন্যাড়া হতে পারে। ন্যাড়ার ঘুড়ি প্রায় আটকে যায় বটগাছটায়। আর হা, কাল তার সঙ্গে কে একজন অচেনা লোকও ছিল।

কমলাক্ষের সঙ্গীর নাম মাধব। লিটনগঞ্জে লোকে তাকে বলে মেধোগুন্ডা। কমলাক্ষ তার সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের অছিলায় প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক মূর্তি সংগ্রহ করেন এবং মাধবের সাহায্যে তা বিদেশে বিক্রি করেন। আজকাল ওসব পুরনো মূর্তি বা জিনিসের চোরাচালানি কারবার চলছে দেশ বিদেশে। কাজটা বেআইনি। হংকং শহরে এক ব্যবসায়ী এই কারবার করে। তার এজেন্ট আছে কলকাতায়। মাধবের সঙ্গে সেই এজেন্টের যোগাযোগ আছে। এভাবে কমলাক্ষ কত প্রত্নদ্রব্য যে মাধবের সাহায্যে পাচার করেছেন, ইয়ত্তা নেই। কমলাক্ষ ও মাধব সেই টাকা আধাআধি ভাগ করে নেন। পুলিশ টের পায় না। কারণ ওই সংগ্রহশালা! সারা দেশের পণ্ডিতরা কমলাক্ষের ব্যক্তিগত চেষ্টায় গড়ে তোলা জাদুঘরের কত প্রশংসা করেন। মন্ত্রীরাও কতবার দেখে যান। কিন্তু তার জাদুঘরে নেহাত মামুলি কিছু পুরোনো দলিলপত্তর, কিছু পোড়ামাটির মূর্তি বা মুদ্রা ছাড়া তত দামি কিছু নেই। যা দামি, তা তো পাচার হয়ে যায়। আসলে কমলাক্ষের চোরাচালানি কারবারের একটা অজুহাত হল ওই জাদুঘর।

যাই হোক, কমলাক্ষ ও মাধব আগের দিন সন্ধ্যায় মাটির তলার কবরে কালো বাকসোটা আর দেখতে পাননি। এখন ন্যাড়ার মুখে সব জেনে তিনি তো মনে মনে রেগে আগুন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না।

ন্যাড়া বলেছিল—হ্যাঁ কাকু, কালো বাকসোটা তোমরা ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলে কেন গো?

কমলাক্ষ চেপে গেলেন। আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল এই : লিটনগঞ্জে পিরের দরবারে ফকিরের কাছে কিছু টাকার বিনিময়ে এমন ঘটনার আভাস পেয়েছিলেন কমলাক্ষ। সেই সূত্র ধরে আজিমুদ্দিনের কবর খুঁজে বের করেছিলেন। বাকসোটাও পেয়েছিলেন, কিন্তু বাকসোটা কিছুতেই। খুলতে বা ভাঙতে পারেননি। মাধবও অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে দুজনে ঠিক করেছিলেন, আপাতত যেখানে বাকসোটা ছিল সেখানে থাক। ইতিমধ্যে বিদেশি কোনও ধাতুবিদ্যা বিশারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাক। তারপর একদিন বাকসোটা তার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে

কিন্তু হঠাৎ ন্যাড়ার ছোটমামার পাল্লায় পড়ে সেটা বেহাত হয়ে গেল।

এ সেদিন ন্যাড়া তাদের বাড়ি ঢুকলে কমলাক্ষ গেলেন মাধবের কাছে। মাধব সব শুনে খেপে গেল। সে বলল—এক কাজ করা যাক্ কমলদা। ওই ক্ষুদে বজ্জাতটাকে আমরা চুরি করে লুকিয়ে রাখি। তারপর বেনামী চিঠি দিই হারামজাদা শংকরচন্দ্রটাকে।

বাধা দিয়ে কমলাক্ষ বলেছিলেন—উঁহু ন্যাড়ার বাবাকেই উড়ো চিঠি দিতে হবে। ছেলের জন্য মমতা বাবারই বেশি হবে। বুঝলে না?

এরপর দুজনে চক্রান্ত করে ন্যাড়াকে চুরির ফিকিরে বেরিয়েছিল।

আপনভোলা ছেলে ন্যাড়া সন্ধ্যার আগে ঘুড়ি উড়িয়ে ফিরে আসছে, তার সামনে একটা জিপগাড়ি দাঁড়াল। মাধবের চোখে কালো চশমা। শীতের সময় বলে টুপিতে মুখের ও মাথার অনেকটা ঢাকা। সে ড্রাইভ করছিল। কমলাক্ষ ডাকলেন—নেড়ু! বাড়ি চললি বুঝি? আয়, জিপে করে পৌঁছে দিই।

ন্যাড়া জিপে উঠতেই কমলাক্ষ তার নাকের সামনে রুমাল চেপে ধরল। উগ্র কী এক ঝাঝালো গন্ধ টের পেল ন্যাড়া। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, সে দেখল একটা অচেনা ঘরে শুয়ে আছে। পাশে বসে আছেন কমলাক্ষ। মুখে অমায়িক হাসি।

ন্যাড়া ওঠার চেষ্টা করতেই বললেন—উঁহু, উঠো না! উঠো না!

ন্যাড়া বলল—কেন? আমার কী হয়েছে?

অ্যাকসিডেন্ট! কমলাক্ষ বললেন। তোমাকে জিপে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলুম, মনে পড়ছে?

ন্যাড়া বলল—হ্যাঁ, হ্যাঁ।

পথে আমাদের জিপ উলটে যায়। ভাগ্যিস, আমি ছিটকে পড়েছিলুম। বেঁচে গেছি। তুমিও বেঁচে গেছ। তবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে!

আমি তো ভালো আছি। আমার কিছু হয়নি!

হয়েছে। চুপ করে শুয়ে থাকো।

ন্যাড়া উঠে বসে বলল—না। আমি বাড়ি যাব।

অমনি কমলাক্ষ আচমকা একটা ছুরি বের করে বললেন—চুপ টু শব্দ করলে মুণ্ডু কেটে ফেলম। চুপ করে শুয়ে থাকো।

কমলাক্ষের হিংস্র চেহারা দেখে ন্যাড়া ভয়ে অবশ হয়ে গেল। এই সময় মাধব ঘরে ঢুকে বলল—কথা না শুনলে ওর হাত-পা বেঁধে রাখতে হবে কমলদা।

কমলাক্ষ নিষ্ঠুর হেসে বললেন—দরকার হবে না। নেড়ু বড় ভালো ছেলে। আর নড়াচড়া করলে ওকে শ্রীমান ডালকুত্তার জিম্মায় রেখে দেব। কই হে মাধব, তোমার প্রিয় ডালকুত্তা জনকে একবার নিয়ে এস।

ন্যাড়া আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল, মাধব কোনার দিক থেকে একটা ভয়ংকর চেহারার ডালকুত্তাকে এনে তার বিছানার খাটের একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখল। ডালকুত্তাটা কুৎসিত জিভ বের করে কুতকুতে হিংস্র চোখে ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

মাধব বলল—একটু নড়তে চেষ্টা করলে জন তোমার গলায় দাঁত বসাবে। সাবধান।

কমলাক্ষ বললেন-ঠিক আছে। এবার আমরা নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ি, চলো মাধব!

দুজনে বেরিয়ে গেল। বাইরে দরজায় তালা আটকানোর শব্দ শুনল ন্যাড়া। সে নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে রইল। পায়ের দিকে রাক্ষুসে প্রাণীটা নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটু নড়লেই গর্জন করে টুটি কামড়ে ধরবে।

কমলাক্ষকাকু যে এমন শয়তান, ন্যাড়া কোনওদিন কল্পনাও করেনি।…

[ফকিরের বুজরুকি

লিটনগঞ্জে পৌঁছে কর্নেল কিন্তু শংকরবাবুর সঙ্গে ন্যাড়াদের বাড়ি গেলেন না। বললেন—এখানকার পুলিশ সুপার অজিতেশ আমার পরিচিত। আমি ওঁর সাহায্যে সরকারি ডাকবাংলোতেই থাকার জায়গা করে নেব। আপনি ভাববেন না শংকরবাবু।

সরকারি আপিস এলাকায় পুলিশ সুপারের বাংলো। শংকরবাবুর গাড়ি তার গেটে দাঁড়াল। কর্নেল গেট খুলে ভেতরে গেলেন।

একটু পরে শংকরবাবু দেখলেন, পুলিশ সুপার আর কর্নেল কথা বলতে বলতে আসছেন গেটের দিকে।

কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই পুলিশ সুপার অজিতেশ বলে উঠলেন—আরে তুমি শংকর না?

শংকরবাবুও লাফিয়ে উঠলেন—অজু! তুমি! কী আশ্চর্য! তুমি যে আমার জামাইবাবুর এলাকায় পুলিশের বড়কর্তা সেজে বসে আছ, স্বপ্নেও ভাবিনি! তুমি সেই বালুরঘাটে না কোথায় ছিলে না। এখানে বদলি হলে কবে?

অজিতেশ বললেন—সবে দু সপ্তাহ। যা গে চলে এস। এ বেলা আর জামাইবাবুর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। কী বলেন কর্নেল?

কর্নেল এতক্ষণ হাঁ করে চেয়েছিলেন। এবার বললেন—ডার্লিং অজিতেশ! শংকরবাবু—থুড়ি, শ্রীমান শংকর নিশ্চয় তোমার সহপাঠী ছিল ছাত্রজীবনে?

অজিতেশ বললেন—হা কর্নেল। আমরা দুজনে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তুম।

যা গে। তাহলে শংকরকে তুমি বললে, দোষ হবে না। কর্নেল সকৌতুকে বললেন। তারপর অভ্যাসবশে দাড়িতে ও টাকে একবার করে হাত বুলিয়ে নিলেন।

গাড়ি বাংলার গেটের পাশে রেখে তিনজনে সুরকি-বিছানো লন পেরিয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলেন। সেখানে বসে কর্নেল ও শংকর মোটামুটি ঘটনাটা পুলিশ সুপার অজিতেশের কাছে বর্ণনা করলেন।

সবটা শুনে অজিতেশ বললেন—আমার ধারণা, শংকরের ভাগনেকে চুরি করে ওরা কলকাতাতেই কোথাও রেখেছে। কাজেই ওকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সেখানকার পুলিশ দফতরেই যোগাযোগ করা দরকার। আর কর্নেল সাহেব তো এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। লালবাজারের পুলিশকর্তাদের সঙ্গে ওঁর প্রচণ্ড খাতির। তাছাড়া ওঁর নিজের ক্ষমতা ও বুদ্ধিও সামান্য নয়। তবে স্টেশনের ওপারে পোডড়া মাঠের জঙ্গলে মাটির তলায় যে কবরের কথা শুনলাম, তা পাহারার দায়িত্ব আমার রইল।

একদল সাদা পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ ওখানে আনাচে-কানাচে চব্বিশঘণ্টা ওত পেতে থাকবে। কাকেও বটতলায় গিয়ে কিছু করতে দেখলেই পাকড়াও করবে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—কিন্তু আমি আর শংকর যে ওখানে গিয়ে হানা দিতে চাই। আমাদের ওপর তোমার লোকেরা, হামলা করলেই তো মুশকিল।

অজিতেশ বললেন—সে ব্যবস্থা করে রাখব। কর্নেল, আপনার চেহারা তো একেবারে সাহেবের মতো। আর শংকর আপনার সঙ্গে থাকবে। আমার লোকেদের সেটা বলে রাখব। কর্নেলকে চিনতে তাদের ভুল হবে না। তার উপর মাথায় টাক, মুখে দাড়ি।

আবার তিনজনে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে ট্রে ভর্তি খাবার ও কফি এল। দুপুরে খাওয়া পথেই সেরে নিয়েছিলেন। কথা বলতে-বলতে বিকেল হয়েছে। শীতও বেড়েছে। কফি খেয়ে চাঙ্গা হবার পর শংকর বিদায় নিলেন। উনি জামাইবাবুর বাড়ি থাকবেন। ইতিমধ্যে ফোন করে অজিতেশ কর্নেলের জন্য নদীর ধারে সুদৃশ্য বাংলোর ব্যবস্থা করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পরে অজিতেশ তার জিপে করে কর্নেলকে সেই বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে এলেন।

বাংলোয় দুটো ঘর। পাশের ঘরে এক সরকারি অফিসার এসেছেন। কর্নেলের ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। নিচে নদী। নদীর ওপারে ঘন বাঁশবনে ঢাকা একটা গ্রাম। রেললাইনটা বাংলোর পূর্বে। পুবের বারান্দায় দাঁড়ালে স্টেশনের ওধারে সেই পোডড়া মাঠের শেষে জঙ্গল ও বটগাছটা দেখা যায়।

শীতের দিন শিগগির ফুরিয়ে এল। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে সেই দূরের বটগাছটা দেখছিলেন। কুয়াশা ও আঁধারে সেটা ঢাকা পড়লে বাইনোকুলার রেখে এলেন ঘরে। শংকরের এখনই এসে পড়ার কথা।

আনমনে লনে পায়চারি করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন কর্নেল। মাথায় টুপি, পরনে ওভারকোট এবং হাতে ছড়ি নিয়েছেন। লিটনগঞ্জে শীতটা বড্ড বেশি পড়েছে এবার।

শংকর আসতে দেরি করছেন কেন? কর্নেল উদবিগ্ন হয়ে ঘড়ি দেখলেন। সওয়া ছটা বেজে গেল। ছটায় আসার কথা।

গেট খুলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই সময় একটু তফাতে কে চিৎকার উঠল—ইয়া পির মুশকিল আসান। যাঁহা মুশকিল তাহা আসান। তারপরই এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল।

কর্নেল চমকে উঠেছিলেন। পকেটে টর্চ আছে। কিন্তু জ্বাললেন না। দ্রুত আলো লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু আলোটা রাস্তার ধারে জ্বলছে না। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপঝাড়। তার ভেতর দেখা যাচ্ছে। তখন পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগিয়ে গেলেন।

যেখানে আলোটা জ্বলছে, সেখানটা একটা পিরের মাজার বলেই মনে হল। উঁচু চৌকানো পাথরে বাঁধানো বেদির মতো একটা চত্বর রয়েছে। তার পাশে একটা প্রকাণ্ড কাঠমল্লিকা গাছ। গাছের তলায় আগুনের কুণ্ড জ্বেলে বসে আছে এক ফকির।

ফকিরের পরনে কালো আলখেল্লা। গলায় অজস্র পাথরের মালা। মাথায় কালো পাগড়ি। তার কোলে একটা প্রকাণ্ড লোহার চিমটে রয়েছে। ফকির চোখ বুজে বসে বিড়বিড় করে কী মন্তর আওড়াচ্ছে আর আগুনে ধুনো ছড়াচ্ছে। তখন আগুনটা হু হু করে জ্বলে উঠছে।

কর্নেল গিয়ে সামনে দাঁড়ালে ফকির চোখ খুলল। তারপর নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তখন কর্নেল বললেন—সেলাম ফকিরসায়েব।

ফকির এবার মৃদু হেসে সামনে বসতে ইশারা করল।

কর্নেল বললেন—ফকিরসায়েব কি এই পিরের মাজারের (সমাধির) সেবক?

ফকির জবাব দিল, হ্যাঁ বেটা। লেকিন তুম কঁহাসে আয়া? চেহারা দেখে মালুম হচ্ছে কি, তুমলোক আংরেজ সাহাব আছ। লেকিন বাংলায় বাত ভি বলছ। তাজ্জব!

আমি ইংরেজ পুরো নই, ফকিরসাহেব। অর্থেক ইংরেজ, অর্ধেক বাঙালি।

তাজ্জব! ক্যায়সে?

আমার বাবা বাঙালি ছিলেন। মা ইংরেজ ছিলেন।

ফকির হেসে উঠল। তব্‌ বেটা, তুম অ্যাংলো-ইন্ডিয়েন আছে, তো ঠিক হ্যায়! বোলো, ক্যা মাংতা মেরা পাস? হামার কাছে কী চাও?

কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ফকিরের পায়ের কাছে রাখলেন। ফকির অমনি খপ করে সেটা তুলে নিয়ে আলখাল্লার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল। তার চোখে লোভের আনন্দ চকচক করছিল। ফিসফিস করে বলল—বোলো বেটা, ক্যা মাংতা তুম?

কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন-ফকিরসায়েব, আপনি তো সিদ্ধপুরুষ। বলুন তো জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ-আল-তামাসের ছেলে আজিমুদ্দিনের কবর কোথায় আছে।

অমনি ফকির নড়ে উঠল। তার চোখে আগুন ঠিকরে বেরুতে থাকল যেন। সেই দশ টাকার নোটটা বের করে বলল—ইয়ে লো তুমহারা রূপেয়া! নিকাল যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, সে কী ফকিরসায়েব! চটে যাচ্ছেন কেন?

ফকির ক্রুদ্ধস্বরে বলল—দেখো, ইয়ে টাউনকা কমলাবাবুনে বহত দফে হামার কাছে এসেছে ঔর এহি বাত পুছেছে। হামি বোলে নাই। কিসিকো হাম ইয়ে ছুপা বাত (গুপ্ত) বলবে না। কমলাবাবু হামাকে খুন করতে ভি এসেছিল। তো আমি এইসা জাদুকা খেল জানে, কমলা জান লিয়ে ভেগে গিয়েছিল। বলে ফকির হিংস্র মুখে ক্রুর হাসি হাসল।

কর্নেল বললেন, কিন্তু কমলাক্ষবাবু তো আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পেয়ে গেছে। তা জানেন?

ফকির চমকে উঠে বলল—সাচ্ বাত?

হাঁ ফকিরসায়েব। এমনকী সে আজিমুদ্দিনের কবরের সেই কালো বাকসোটাও হাতিয়ে নিয়েছে।

ফকির ফের ক্রুর হেসে বলল-ফয়েদা হবে না। ও বাক্সের চাবি কঁহা সে মিলেগা?

কেন? আজিমুদ্দিনের মমিকরা লাশে—মানে তার চুলের মধ্যে লুকোনো আছে।

ফকির জোরে মাথা নেড়ে বলল—কবর ছুঁড়ে আমি দেখেছে। আজিমুদ্দিনের লাশের মাথা নেই। কৌন ডাকু কাট লিয়া।

কর্নেল চমকে উঠলেন। বলেন কী ফকিরসায়েব!

ফকির এবার শান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আজিমুদ্দিনকা শির যিকা পাস হ্যায়, চাবিভি উসকা পাস হ্যায়।

বলে ফকির ফের চোখ বুজল। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকল। তারপর সে আলখেল্লার ভেতর থেকে একমুঠো ধুনো বের করে আগুনে ছড়ালে। আগুনটা দপকে উঠল। তখন ফকির হঠাৎ গর্জে বলে উঠল—চলা যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!

কর্নেল সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, ফকির ফের আরেক মুঠো ধুনোর মতো কী জিনিস আগুনে ফেলল। কিন্তু এবার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল।

আগুনের কুণ্ড থেকে মুহূর্তে হু হু করে সাদা ঘন একরাশ ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। তার উৎকট গন্ধে কর্নেল তক্ষুনি পিছিয়ে এলেন। ওদিকে সেই ধোঁয়া বেশ কিছুক্ষণ হু-হু করে আকাশে ওঠার পর আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আগুনটাও নিভে গেছে ইতিমধ্যে। কর্নেল টর্চ জ্বেলে দেখলেন, ফকির অদৃশ্য।

এখানে ওখানে টর্চ জ্বেলে সমাধি এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে আর ফকিরকে দেখতে পেলেন

কর্নেল। তখন বিস্মিত মনে ফিরে এলেন রাস্তায়।

বাংলোয় ফিরে দেখলেন, গেটে শংকরবাবুর গাড়ি রয়েছে। শংকর তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেলকে দেখে শংকর একটু অবাক হয়ে বললেন- আপনাকে অমন দেখাচ্ছে। কেন? কী হয়েছে কর্নেল?

কর্নেল বললেন—বলছি। আগে চৌকিদারকে কফি করতে বলো, শংকর। বলে ঘরের দরজা খুলে আরামকেদারায় এলিয়ে পড়লেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।..

মুণ্ডহীন মমি

কিছুক্ষণ পরে কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তখন শংকর বললেন—কী হয়েছিল, বলবেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন—বিষাক্ত গ্যাসের ঝঝে মাথা ঘুরছিল।

শংকর অবাক হয়ে বললেন—বিষাক্ত গ্যাস। কোথায় ছিল?

তখন কর্নেল এক ফকিরের সঙ্গে আচমকা দেখা হওয়া এবং যা যা ঘটেছে, সব বললেন। শেষে বললেন—বলতে পারো, ফকিরের সঙ্গে আজিমুদ্দিনের কবরের সম্পর্ক আছে, জানলুম কী করে? ওটা নেহাত আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কারণ কী জানো শংকর? আমি বরাবর দেখেছি, পিরের দরগার ফকিররা বংশানুক্রমেই ফকির এবং এলাকার প্রাচীন মুসলমান শাসকদের ইতিহাস তাদের মুখস্থ থাকে। তাই ওখানে জঙ্গলের মধ্যে পিরের দরগায় ওই ফকিরকে দেখে আমি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো আজিমুদ্দিনের কবরের কথা জিগ্যেস করলুম। ফলও পেলুম হাতে নাতে। তবে এই ফকিরবাবাজি দেখছি সাংঘাতিক লোক। ওর কাছে একরকম পাউডার আছে। তা আগুনে ছুঁড়লে মারাত্মক গ্যাস সৃষ্টি হয়। প্রাচীন হেকিমি শাস্ত্রে এই অদ্ভুত জিনিসটার কথা পড়েছিলুম! এবার স্বচক্ষে দেখলুম।

শংকর বললেন—একটা কথা বুঝতে পারছি না। আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা, তা জানলেন কী ভাবে?

অতি সাধারণ বুদ্ধিতে। কর্নেল একটু হাসলেন। দ্যাখো শংকর, মানুষের মৃত্যুর পর কয়েকদিনের মধ্যে চুল খসে যায়। কাজেই চুলের মধ্যে চাবি লুকিয়ে রাখার প্রশ্ন ওঠে তখন, যখন কি না চুল খসে পড়ার উপায় থাকে না। অর্থাৎ চুলসুদ্ধ মৃতদেহ মমি করা হলে, তবেই চুলের মধ্যে চিরকালের জন্যে চাবি লুকিয়ে রাখা যায়।

শংকর বিস্মিতভাবে বললেন—কিন্তু মমি করার প্রথা তো সেই মিশরের লোকেরা তিন-চার হাজার বছর আগে জানত! ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এদেশে মমি করার কথা তো শুনিনি!

কর্নেল বললেন-না শংকর। ওই প্রচলিত ধারণা একেবারে ভুল। আমাদের দেশে হিন্দুরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু মুসলমান ও খ্রিস্টানরা কবরে রাখে। প্রাচীন আমল থেকেই অনেক অভিজাতবংশীয় মুসলমান কিংবা রাজাবাদশাদের মৃতদেহ কবরে দেওয়ার আগে একরকম মশলা মাখানো হত। এক শ্রেণির লোক এই বিদ্যা জানত। তবে মিশরের মমির মতো এসব মমি হাজার হাজার বছর টিকত না। সচরাচর দুই থেকে পাঁচশো বছর অন্তত অক্ষত থাকত। কাজেই আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা হয়েছিল, তা স্বাভাবিক।

শংকর বললেন—পুলিশ সুপার অজিতেশের সাহায্যে আমরা প্রকাশ্যে ওই কবর খুঁড়ে দেখতে পারি, ফকিরের কথা সত্যি কি না। কর্নেল, কালই ব্যাপারটা দেখা যাক।

কর্নেল জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন—না শংকর। কবর প্রকাশ্যে খুঁড়তে গেলে এলাকার মুসলমানরা তাতে প্রবল আপত্তি করবেন। স্বধর্মীয়ের মৃতদেহ তারা অন্যধর্মের লোকেদের হাত ছোঁয়াতে দেবেন না। কাজেই ব্যাপারটা আজ রাতেই গোপনে সেরে ফেলতে হবে।

বাংলোয় ফোন রয়েছে। কর্নেল পুলিশ সুপারকে ফোনে কথাটা জানালেন। তারপর ফোন রেখে শংকরকে বললেন—অজিতেশ ঘণ্টাখানেক পরেই এসে পড়বে। তা শংকর, শ্রীমান ন্যাড়ার বাবা-মা নিশ্চয় ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

শংকর বললেন-তা আর বলতে!

তুমি কি ওদের সব কথা বলেছ?

না। তাহলে তো দিদি-জামাইবাবুকে সামলানো কঠিন হবে। কেউ ন্যাড়াকে আটকে রেখেছে কিংবা আমি সেই উড়ো চিঠি পেয়েছি—এসব কোনও কথা ঘুণাক্ষরে ওঁদের বলিনি। বলেছি—নিশ্চয় কলকাতা বেড়াতে গেছে একা। ও যা খেয়ালি ছেলে। একবার কিন্তু একা কলকাতা পালিয়েছিল, জানেন?

তাই বুঝি?

হ্যাঁ তবে বড় বুদ্ধিমান ছেলে। খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। অথচ কবে সেই দু বছরের বাচ্চা যখন, তখন মায়ের কোলে চেপে এসেছিল।

কর্নেলের কান ছিল শংকরের কথায়, কিন্তু দৃষ্টি ছিল সামনে ফুলবাগিচার দিকে। হঠাৎ তিনি এক ধাক্কায় শংকরকে চেয়ার থেকে ফেলে দিলেন এবং নিজেও শুয়ে পড়লেন। পরক্ষণে প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল গুলি ছোঁড়ার। ঘরের দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবির কাচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল। বারুদের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে চৌকিদার চিৎকার করে উঠল—ডাকাত পড়েছে! ডাকাত পড়েছে!

এক লাফে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং জানালার পাশে নিজেকে আড়াল করে টর্চ জ্বাললেন। তার অন্য হাতে গুলিভরা রিভলভার দেখা গেল।

কিন্তু তখনই ফের স্তব্ধতা ঘনিয়ে এসেছে। ফুলবাগিচার ওদিকে কেউ নেই। চৌকিদার বোধ করি চেঁচিয়ে ওঠার পরই আতঙ্কে চুপ করে গেছে।

শংকর মেঝে থেকে উঠে বললেন—আমি কৃতজ্ঞ, কর্নেল। আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে গুলিটা আমার মাথায় লাগত। পেছনের ছবিটা চূর্ণ হওয়া দেখেই তা টের পাচ্ছি। কিন্তু ওদের এত সাহস হল কীভাবে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন—দুবৃত্তদের পক্ষে এমনটা স্বাভাবিক শংকর। কিন্তু আমি একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আততায়ীর গুলির লক্ষ্য ছিলে তুমি। অথচ ন্যাড়াকে যারা চুরি করেছে, তারা তোমাকে খুন করতে চাইবে কেন? তোমাকে মেরে ফেললে তো বাকসোটা পাবার আশাই আর থাকবে না। কাজেই মনে হচ্ছে, এই বাকসো-রহস্যের পেছনে আরও একটা দল রয়েছে।

শংকর অবাক হয়ে বললেন-তারা আবার কারা।

শিগগির সেটা খুঁজে বের করব। এখন বরং ওই খোলা জানলাটা বন্ধ করে দিই। এই শীতে ওটা খুলে রেখেছিলুম, বাইরের দিকটায় লক্ষ রাখার জন্য। এখন বুঝতে পারছি, কাজটা ঠিক করিনি। তাছাড়া এখন থেকে আমাদের পদে পদে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

বলে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে কর্নেল আরাম কেদারায় বসলেন। শংকর বারবার ভয়ে ভয়ে খোলা দরজার পর্দার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তা দেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন—না শংকর। আততায়ী যেই হোক, দরজা দিয়ে হামলা করার সাহস তার নেই। থাকলে সে দূর থেকে গুলি না ছুঁড়ে সোজা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই হামলা করত।

কিছুক্ষণ পরে পুলিশ সুপার অজিতেশ তার দলবল নিয়ে এসে পড়লেন। সব শুনে। বললেন—আমারই ভুল হয়েছে। বাংলোটা পাহারার ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। যাই হোক, সে-ব্যবস্থা করছি। এখন চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।

রাতের অন্ধকারে সবাই মিলে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশদল সতর্কভাবে চলল।

রেললাইন পেরিয়ে সেই পোড়ো মাঠে কিছুটা এগিয়ে ওঁরা জঙ্গলে ঢুকলেন। তখনও কেউ টর্চ জ্বালেননি। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তাতে প্রচণ্ড শীত। কুয়াশার মধ্যে আকাশের নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে। স্টেশনের দিকটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। বাতিগুলো আবছা জ্বলছে।

বটতলার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দেখাদেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন—কী একটা শব্দ হচ্ছে যেন।

শংকর ও অজিতেশ কান পেতে শুনে বললেন—হ্যাঁ।

কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তেমনি চাপা গলায় বললেন—একসঙ্গে সবগুলো টর্চ জ্বালতে হবে। রেডি। ওয়ান-টু-থ্রি।

একসঙ্গে প্রায় একডজন টর্চের আলো জ্বলে উঠল। সামনে দেখা গেল তিনটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে একমুহূর্ত হতচকিত হয়ে গিয়েছিল তারা। তারপর দৌড়ে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেল।

গুপ্ত কবরের পাথরের ঢাকনা সরানো হয়েছে। এবার গর্তের ভিতর থেকে এক লাফে একটা লোক প্রায় ডিগবাজি খেয়ে অন্ধকার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।

অজিতেশের নির্দেশে সেপাইরা সেই মুহূর্তেই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছে।

ওদিকে জঙ্গলে বারবার টর্চের ঝলক, বন্দুকের আওয়াজ কয়েকবার, তারপর পাকড়ো পাকড়ো চেঁচামেচি শোনা গেল।

কর্নেলরা কবরের কাছে দৌড়ে এলেন। এসে টর্চের আলোয় দেখলেন, গর্তের মধ্যে মৃতদেহের কফিনটা টেনে এনে রেখেছে। কফিনের ঢাকনা খোলা! তার ভেতরে একটা পোশাকপরা মৃতদেহ রয়েছে। বালকেরই মৃতদেহ। কিন্তু তার মুণ্ড নেই। কবন্ধ মৃতদেহটা মমি করা।

কর্নেল, শংকর আর অজিতেশ তিনজনেই কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর একসঙ্গে বলে উঠলেন, তাই তো।

তারপর কর্নেল গর্তে নামলেন। বহুক্ষণ ধরে মমিটা পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর বললেন—ফকির ঠিকই বলেছিল দেখছি। কে বা কারা মুণ্ডু কেটে নিয়ে গেছে, কিন্তু একথা ঠিক যে মুণ্ডুটা কাটা হয়েছে গত কয়েকদিনের মধ্যেই।

অজিতেশ বললেন—কীভাবে বুঝলেন?

কর্নেল হাসলেন। বললেন-খুব সোজা যুক্তি। শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে যাবার আগে মুণ্ডু কাটা হয়নি। তাহলে যে মুণ্ডু কেটেছে, সে কি বাকসোটা ফেলে রেখে যেত? কাজেই শংকরবাবু বাকসো নিয়ে যাবার পরই কাজটা করা হয়েছে।

অজিতেশ ও শংকর সায় দিয়ে বললেন—ঠিক, ঠিক।

কর্নেল বললেন-মুণ্ডু যে কেটেছে সে জানে বাকসো যেই হাতাক্, চাবি এই মুণ্ডের চুলের মধ্যে আছে। কাজেই তার উদ্দেশ্য হল, কাটা মুণ্ডুর চুল খুঁজে চাবি বের করা এবং বাকসোটা উদ্ধার করা।

শংকর বললেন—তাহলে একাজ কমলাক্ষেরই।

কর্নেল আনমনে বললেন—বলা কঠিন। দেখা যাক। তবে এস, মৃতদেহটা আমরা যথাস্থানে রেখে আগের মতো সমাধিস্থ করি। আর অজিতেশ, তুমি তোমার কথামতো আপাতত কিছুদিন এখানে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করো।

অজিতেশ বললেন—তা আর বলতে। তবে আমারই ভুল। ভেবেছিলুম, কাল সকাল থেকে পাহারার ব্যবস্থা করব। বুঝতে পারিনি, আজ রাতেই কেউ কবরে হামলা করবে।

গুপ্ত কবর আগের মতো ঢেকে দেওয়ার একটু পরে সেপাইরা ফিরে এসে জানাল—ওদের পাকড়াও করা যায়নি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন।…

ন্যাড়ার কারসাজি

নেহাত খিদে সইতে পারে না বলে ন্যাড়া ওদের দেওয়া খাবার খেয়েছে। খাবার সময় অবশ্য হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিল মাধব। তবে খুনে ডালকুত্তাটা সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে রয়েছে। কুতকুতে চোখে ন্যাড়াকে দেখছে তো দেখছেই।

এভাবে একটা দিন একটা রাত কেটে গেল। পরদিন সকালে কমলাক্ষ ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বললেন—বাবা নেড়ু, আজ সন্ধ্যার মধ্যেই তুমি ছাড়া পাবে। তবে সেটা নির্ভর করছে তোমার ছোটমামার ওপর। সে যদি জায়গামতো বাকসোটা রেখে যায়, তবেই। নৈলে ….

ন্যাড়া ভয়েভয়ে জিগ্যেস করল–নৈলে কী হবে?

কমলাক্ষ তার প্যান্টের পকেট থেকে সেই ছুরিটা বের করে বললেন—স্রেফ জবাই হয়ে। যাবে। বুঝলে তো?

ন্যাড়া আঁতকে উঠে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল-কেন কমলকাকু? আমার কী দোষ?

কমলাক্ষ নিষ্ঠুর হেসে বলল—তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া। তুমি না বললে তো শংকর ব্যাটা বাকসোর হদিশ পেত না।

ন্যাড়া মনে-মনে বুদ্ধি এঁটে বলল—আচ্ছা কমলকাকু, আমি যদি নিজের হাতে ছোটমামাকে চিঠি লিখে দিই যে বাকসোটা ফেরত দাও, নৈলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে?

কমলাক্ষ খুশি হয়ে বলল-খুব ভালো কথা। এই তো চাই।

বলে সে একটুকরো কাগজ আর ডটপেন এনে দিল। ন্যাড়ার হাতের বাঁধনও খুলে দিয়ে বলল, ঝটপট লিখে ফেল দিকি তাহলে!

এই সময় মাধব ঘরে ঢুকে ব্যস্তভাবে বলল—সর্বনাশ হয়েছে কমলদা! কমলাক্ষ চমকে উঠে বলল-কী? কী হয়েছে মাধব?

এইমাত্র লিটনগঞ্জ থেকে আমার লোক ট্রাঙ্ককল করে খবর দিল। মাধব ব্যস্তভাবে বলতে থাকল। বটতলার কবরে কড়া পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। আর তার চেয়েও সাংঘাতিক কথা, আজিমুদ্দিনের মমিকরা মড়ার মুণ্ডুটা নাকি কে কেটে নিয়ে গেছে। আমার লোকেরা কবর খুঁড়ে সেটা আবিষ্কার করেছে, হঠাৎ পুলিশ হাজির।

কমলাক্ষ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল—বলো কী মাধব! এই তো সেদিনই কফিন খুলে দেখলুম, মুণ্ডু রয়েছে। হঠাৎ মুণ্ডুটা কাটল কে? কেনই বা কেটে নিয়ে গেল?

মাধব চাপা গলায় বলল— এ নিশ্চয় ব্যাটা হাসান ফকিরের কীর্তি। শেষবার ব্যাটা বলেছিল না? কালো বাকসোর চাবি মমিকরা লাশের মধ্যেই কোথাও আছে!

হ্যাঁ। বলেছিল বটে। কিন্তু আমরা তো হাতড়ে দেখেছিলুম। পাইনি!

এখন মনে হচ্ছে চাবিটা মুণ্ডুর মধ্যেই ছিল।

হুম! কিন্তু কে তাহলে মুণ্ডু কেটে নিয়ে গেল?

মাধব একটু ভেবে বলল— সেটা জানতে হলে ব্যাটা হাসান ফকিরকে ধরে আনা দরকার। ওর পাগলামির নিকুচি করেছে। আমি এখনই আমার লোককে ট্রাঙ্ককল করে হুকুম দিচ্ছি, ফকিরকে যেভাবে হোক এখানে নিয়ে আসতে হবে।

চিন্তিতমুখে কমলাক্ষ বললেন—যা করার শিগগির করো!

মাধব বেরিয়ে গেল। তখন ন্যাড়া বলল—তাহলে চিঠি লিখি কমলকাকু?

হ্যাঁ, লেখো। বলে কমলাক্ষ কাগজ-কলম এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন-যা বলি, লেখো।

ন্যাড়া গোটাগোটা হরফে লিখতে থাকল :

ছোটমামা, আজ রাত বারোটায় গঙ্গার ধারে খ্রিস্টান কবরখানায় অর্জুন গাছের তলায় কালো বাকসোটা রেখে যাবে। তাহলে আধঘণ্টা পরে এরা আমাকে তোমার বাড়ির গেটে পৌঁছে দেবে। যদি একথা না শোনো, তাহলে এরা আমার মুণ্ডু কেটে ফেলবে। ইতি ন্যাড়া।

চিঠিটা কমলাক্ষ কয়েকবার পড়ার পর ভঁজ করে পকেটে পুরলেন। তারপর আগের মতো ন্যাড়ার হাত দুটো খাটের দুপাশে পায়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে বেরিয়ে গেলেন। ভয়ংকর ডালকুত্তাটা পাহারায় রইল।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ন্যাড়ার চোখে পড়ল খাটে তার মাথার পাশে বালিশের একধারে যেখানে কমলাক্ষ বসেছিলেন, সেখানে কমলাক্ষের সেই ছুরিটা পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাড়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কমলাক্ষ তখন ন্যাড়াকে ভয় দেখাতে ছুরিটা বের করেছিলেন। কিন্তু ন্যাড়া নিজের হাতে শংকরবাবুকে চিঠি লিখতে চাইলে খুশির চোটে ছুরিটা পকেটে না ঢুকিয়ে ওখানেই রেখে কাগজ কলম আনতে গিয়েছিলেন টেবিলে। তারপর ভুলেই গেছেন ছুরিটার কথা।

ন্যাড়া ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ফন্দি আঁটতে থাকল।

ভয় শুধু ডালকুত্তাটাকে। নড়লেই সে নাকি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর।

শীত বলে দয়া করে ওরা ন্যাড়াকে একটা কম্বল দিয়ে গেছে। ন্যাড়া ভাবল, কম্বলটা হয়তো কাজে লাগানো যায়। সে খুব আস্তে কাত হয়ে শোবার ভান করল। ওইটুকু নড়াচড়াতেই ডালকুত্তাটা গরগর করে উঠল। কিন্তু সে ন্যাড়ার পায়ের কাছে খাটের পায়ার সঙ্গে শেকলে বাঁধা রয়েছে। চেনটা অবশ্য যথেষ্ট লম্বা। ন্যাড়া কম্বলমুড়ি দিল এবার। কিন্তু এতে ডালকুত্তাটা আপত্তি করল না।

এবার সে কম্বলের খানিকটা অংশ কৌশলে বালিশের পাশে রাখা ছুরির ওপর চাপাল। তারপর মুখটা বাড়িয়ে কম্বলের ভেতর ছুরির বাঁটটা কামড়ে ধরল। এখন আর অসুবিধে হল না। ছুরিটা খুব ধারালো। দাঁতে বাঁট কামড়ে ডান হাতের দড়ির বাঁধনে ফলাটা সাবধানে কয়েকবার ঘষতেই বাঁধন কেটে গেল।

ডালকুত্তাটা মাঝে মাঝে গরগর করছে বটে, তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতলব নেই বলেই মনে হচ্ছে।

বাঁ হাতের বাঁধন কাটতে দেরি হল না ন্যাড়ার। এবার সে কম্বলের ফাঁক দিয়ে ডালকুত্তাটার দিকে তাকাল। ডালকুত্তাটা তার দিকে তাকিয়েছিল। এই সময় হঠাৎ ঘুলঘুলি থেকে একটা চামচিকে উড়ে এসে ডালকুত্তাটার কাছে পড়ল। অমনি সে গরগর করে ঝাঁপিয়ে গেল চামচিকেটার দিকে।

এই মোক্ষম সুযোগ। ন্যাড়ার দু হাত খোলা। শুধু পা দুটো তখনও বাঁধা। ডালকুত্তাটা চামচিকের দিকে ঝাঁপ দেওয়া মাত্র সে কম্বলটা তার ওপর ফেলে দিল। কম্বলে জড়িয়ে-মড়িয়ে ডালকুত্তার তখন ভীষণ রাগ হয়েছে। সে গরগর গোঁ গোঁ গর্জন করতে করতে যত লাফালাফি করে কম্বল তত জড়িয়ে যায়।

সেই সুযোগে ন্যাড়া ঝটপট দু পায়ের বাঁধন কেটে ফেলেছে। তারপর এক লাফে খাট থেকে নেমে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে।

বেচারা ডালকুত্তা তখন কম্বল জড়ানো অবস্থায় গড়াতে গড়াতে কেন কে জানে—হয়তো জীবনে এমন বিদঘুটে ব্যাপার কখনও ঘটেনি তার; সেই আতঙ্কে খাটের তলায় ঢুকে পড়ল।

ন্যাড়া এতক্ষণে নিশ্চিন্তে ঘরের ভেতরটা দেখতে থাকল।

ঘরটায় আলো খুব কম। ঘুলঘুলি থেকে একটুখানি রোদের ছটা এসে ঢুকেছে মাত্র। সে একটা জানলা খুলে দিল। একতলাতেই রয়েছে। জানালার ওপাশে জঙ্গুলে জায়গা। তার ওদিকে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। ডাইনে-বাঁয়ে একটু তফাতে কলকারখানা রয়েছে।

এদিকে ঘরের ভেতরে কতকালের পুরোনো আসবাবপত্র আর ছেড়া তোষক, নারকেল ছোবড়ার গদি আর একদঙ্গল বালিশ পড়ে রয়েছে! মনে হল, এটা কোনও পোড়ো বাগানবাড়ির পেছনের দিক।

ন্যাড়া দরজা টেনে দেখল বাইরে থেকে আটকানো আছে। অমনি সে নিরাশ হয়ে গেল। জানালার রড খুব পুরু আর শক্ত। সে বেরুবে কেমন করে?

সে ভাবতে থাকল। একটু পরে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। কোনা থেকে কয়েকটা ছেড়া বালিশ এনে সে বিছানায় লম্বালম্বি রাখল। এখন একটা কম্বল দরকার। ডালকুত্তাটা কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে রয়েছে এবং মাঝে মাঝে অদ্ভুত চাপা শব্দ করছে! অন্যসময় হলে ন্যাড়া হেসে কুটিকুটি হত।

কোনা খুঁজতে গিয়ে ন্যাড়া একটা ছেড়া তুলো বেরকরা লেপ পেয়ে গেল। সে সেটা এনে বালিশের ওপর ঢাকা দিল। দেখলে মনে হবে, শ্রীমান ন্যাড়াই যেন আগের মতো শুয়ে আছে। মাথাঅবদি ঢেকে রেখেছে। জানালা বন্ধ করেছে বলে হঠাৎ বাইরে থেকে ঢুকে ওরা ব্যাপারটা টের পাবে না সম্ভবত। অন্তত টের পেতে একটু দেরি তো হবেই। ততক্ষণে ন্যাড়া …

হ্যাঁ, এবার তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে।

কোনার দিকে তোশক আর গদির আড়ালে ন্যাড়া গিয়ে লুকিয়ে বসে রইল।

তারপরে বসে আছে তো আছেই। কেউ আসে না। না কমলাক্ষ, না মাধব—কিংবা ওদের সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা—যে ন্যাড়াকে খাবার দিতে আসে।

ভালকুত্তাটা কি আরামে ঘুমোচ্ছে এবার?

ঠিক তাই। কম্বলের মজাটা টের পেয়ে গেছে সে। তাই আর সাড়াশব্দ নেই।

কতক্ষণ কেটে গেল তারপর তালা খোলার শব্দ হল। ন্যাড়া সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হল।

দরজা খুলে সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা ঢুকল। তার হাতে যথারীতি একটা থালা। তাতে ভাত-তরকারি রয়েছে। ন্যাড়াকে খাওয়াতে এসেছে।

সে খাটের কাছে এসে ডাকল—কই খোকাবাবু, ওঠ। খেয়ে নাও।

অমনি ন্যাড়া ঠিক খরগোশের মতো একলাফে উঠেই দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেল। লোকটার হাত থেকে ভাতের থালা পড়ে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল চাপা গলায়—পালাচ্ছে! পালাচ্ছে! ধর, ধর!

ন্যাড়া পাশের ঘর থেকে ততক্ষণে বারান্দায়, বারান্দা থেকে একটা উঠোনে—তারপর উঠোনের ওপাশে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ছোট্ট একটা গলিতে পৌঁছে গেছে।

সেখান থেকে সে সোজা দৌড় লাগাল। তারপর একেবারে গঙ্গার ধারে গিয়ে পড়ল। ঘন আগাছার জঙ্গল ওখানটা। তার নিচে অথৈ জল। ন্যাড়া বুঝতে পারল না, কোনদিকে যাবে।

জঙ্গলটার শেষে একটা কারখানার পাঁচিল দেখা যাচ্ছিল। সে মরিয়া হয়ে সেদিকেই দৌড়ুল। এইসময় তার কানে এল, পেছনে কোথাও গরগর গর্জন করছে বুঝি সেই হিংস্র ডালকুত্তাটাই।

সে ঝোপের আড়ালে উঁকি মেরে যা দেখল, তাতে তার আতঙ্ক বেড়ে গেল। সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা ডালকুত্তাটা নিয়ে জঙ্গলে তাকে ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে।

ন্যাড়া কারখানার পাঁচিলের কাছে এসে বাঁদিকে তাকাল। একটা বটগাছের তলায় নৌকা বাঁধা রয়েছে।

সে দৌড়ে গিয়ে নৌকোয় উঠল। দুজন লোক বুড়ো জেলে ও তার ছেলে সব খাওয়াদাওয়া সেরে বিড়ি টানছিল। অবাক হয়ে ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

ন্যাড়া ব্যাকুলভাবে বলল—আমাকে বাঁচাও। ডালকুত্তা নিয়ে ওরা আমাকে ধরতে আসছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!

বুড়ো জেলে তীরের আগাছার জঙ্গলটা দেখে নিয়ে ব্যস্তভাবে বলল—খোকাবাবু, তুমি ছইয়ের ভেতর লুকিয়ে পড়ো। আমি দেখছি।

ন্যাড়া ছইয়ের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে রইল।

একটু পরে তীরের দিকে আওয়াজ এল—ও বুড়ো! এদিকে একটা ছেলেকে দেখেছ?

বুড়ো মাথা নেড়ে বলল—না কর্তা! দেখিনি তো! তারপর সে তার ছেলেকে ইশারা করল নৌকোর কাছি খুলতে।

নৌকোটা মাঝগাঙের দিকে এগিয়ে চলল। বুড়োর ছেলেটা একটু হেসে ন্যাড়াকে জিগ্যেস করল—কী হয়েছে বলো তো খোকাবাবু?

ন্যাড়া বলল-বলব। আগে আমাকে দূরে কোনও ঘাটে পৌঁছে দাও।

বুড়ো জেলে হাল ধরে বসেছিল। বলল—বুঝেছি। ছেলেধরার পাল্লায় পড়েছিলে। আজকাল ছেলেধরার উৎপাত হয়েছে।

ন্যাড়া ছইয়ের ভেতর নিরাপদে বসে দেখতে পাচ্ছিল, কমলাক্ষর লোকটা তখনও আগাছার জঙ্গল ছুঁড়ে হন্যে হচ্ছে।…

ফকিরের পুনরাবির্ভাব

লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় তখন কর্নেল, শংকর, অজিতেশ গম্ভীর মুখে আলোচনা করছিলেন। ন্যাড়াকে বাঁচাতে হলে আজই রাতে বি. টি. রোডের ধারে খ্রিস্টান কবরখানার কাছে কালো বাকসোটা রেখে আসতে হবে। একটু আগে শংকরের কাছে কলকাতা থেকে হারাধন ট্রাঙ্কক করেছে। শংকর তাকে জানিয়েছিলেন, কোনও নতুন ঘটনা ঘটলে যেন তক্ষুনি লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় ফোন করে। হারাধন জানিয়েছে, কিছুক্ষণ আগে একটা উড়ো চিঠি কেউ গেটের লেটারবক্সে রেখে গেছে। চিঠিটা শ্ৰীমান ন্যাড়াই লিখেছে।

অজিতেশ পরামর্শ দিলেন, লালবাজার থেকে পুলিশ বাহিনী নিয়ে কবরখানাটা ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। উনি ফোন করে লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগে সে কথা জানাবেন। তাছাড়া কর্নেলেরও প্রভাব আছে পুলিশ মহলে।

কিন্তু শংকরের তাতে ঘোর আপত্তি। কারণ ওরা অতি ধূর্ত। পুলিশ ওত পেতেছে টের পেলে ন্যাড়াকে খুন করে ফেলতে পারে।

কর্নেল গুম হয়ে বসে কী ভাবছিলেন। কতক্ষণ পরে বললেন—হুম্! এক কাজ করা যাক। শংকর, তুমি এখনই কলকাতা ফিরে যাও।

শংকর বললেন—আর আপনি?

আমি বরং বিকেলের ট্রেনে ফিরব। ততক্ষণে একটা কাজ সেরে নিতে চাই এখানে।

কিন্তু …

কর্নেল বাধা দিয়ে একটা হাত তুলে শংকরকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন—আশঙ্কার কারণ নেই। আমার এখনও ধারণা, ন্যাড়াবাবাজিকে ওরা প্রাণে মারবে না। কারণ তাহলে বাকসো পাবার কোনও আশাই থাকবে না। তাই বলছি, তুমি ফিরে গিয়ে তোমার শোবার ঘরে ওই রহস্যময় জিনিসটি পাহারা দাও। আমি ঠিক সময়ে ফিরব এবং তোমাকে দর্শন দেব।

শংকর একটু চমকে উঠে বললেন—তাহলে আপনি কি সন্দেহ করছেন, আমার বেডরুমে ওরা হানা দিতে পারে?

বিচিত্র নয়।

শংকর একটু হেসে বললেন—ওই গুপ্তস্থানের হদিশ আমি ছাড়া কেউ জানে না।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন—তবু সাবধানের মার নেই। ওরা ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠবে। তোমার লোকেদের হাত করার চেষ্টা করবে হয়তো।

কর্নেল! আমার লোকেরা খুবই বিশ্বাসী।

শংকর! টাকা এমন জিনিস অসম্ভবকে সম্ভব করে। তাছাড়া আজকাল মানুষের নৈতিক চরিত্র ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। লোভ মানুষের আত্মাকে গ্রাস করছে। তাই বলছি, তোমার এখনই বাড়ি ফেরা উচিত।

অজিতেশ সায় দিয়ে বললেন-কর্নেল ঠিকই বলেছেন শংকর। বরং তুমি চাইলে কলকাতায় লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগকে তোমার বাড়ির দিকে নজর রাখতেও অনুরোধ করতে পারি।

শংকর কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন—ঠিক, ঠিক। অজিতেশ, তুমি এখনই সে ব্যবস্থা করো বরং। শংকর পৌঁছবার আগেই গোয়েন্দা পুলিশ ছদ্মবেশে শংকরের বাড়ি পাহারা দিক। তুমি ওদের বলে দাও, সন্দেহজনক কোনও জিনিস বাড়ি থেকে কেউ নিয়ে বেরুলেই যেন তাকে পাকড়াও করা হয়।

শংকর তক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন। ন্যাড়াদের বাড়ি গিয়ে তাদের আশ্বাস দিয়ে কলকাতা রওনা হবেন। মোটর গাড়িতে পৌঁছোতে ঘণ্টা চারেক লাগবে বড়জোর।

একটু পরে অজিতেশও চলে গেলেন।

কর্নেল বারান্দায় এসে বসলেন একা। আজিমুদ্দিনের মমির কথা ভাবছিলেন তিনি। হতভাগ্য বালক! তার নির্বোধ জায়গিরদার পিতা ভদ্রলোক যদি না অত্যাশ্চর্য বহুমূল্য রত্ন তার কবরে রাখতেন, তার মৃতদেহের এই অসম্মান ঘটত না! না জানি কত স্নেহে লালিত হয়েছিল ওই বালক! জীবিত অবস্থায় তার গায়ে এতটুকু আঘাত করার ক্ষমতা কারও ছিল না। মৃত্যুর পর তার মাথাটাই কাটা গেল! মানুষের লোভ এত পৈশাচিক হতে পারে যে মৃতদেহেও আঘাতে তার হাত কাঁপে না।

কর্নেল মনশ্চক্ষে বালক আজিমুদ্দিনকে দেখছিলেন। মন মমতায় কোমল হয়ে উঠছিল। কে জানে, কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে পাঁচশো বছর আগে ছেলেটি অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। বয়স কত হতে পারে তার? কর্নেল মমিটা দেখে অনুমান করেছেন, দশ থেকে বারো বছরের বেশি নয়। বাকশোর গায়ে সে কথা লেখাও আছে বটে।

হ্যাঁ, ঠিক এমনি এক বালকের মমিকরা মৃতদেহ নিয়ে গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে হইচই উঠেছিল। মিশরের কিশোর ফারাও তুতেনখামেনের মমি। আশ্চর্য, তুতেনখামেনের মমির অভিশাপের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। যাঁরা তুতেনখামেনের কবর খুঁড়ে তার মমি আবিষ্কার করেছিলেন, তারা একে একে সবাই রহস্যময়ভাবে মারা পড়েন।

আজিমুদ্দিনের মমির কি তেমন কোনও অভিশাপ আছে?

জরুর!

কর্নেল চমকে উঠে তাকালেন। সবিস্ময়ে দেখলেন, কখন সেই কালো আলখেল্লা পরা ফকির এসে বাংলোর বারান্দায় তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ফকির কি অলৌকিক শক্তিধর? জাদুকর সে? সে কি অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হতে পারে?

আর কর্নেলের মনের কথাই বা জানতে পারল কী ভাবে? কর্নেল অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন—আসুন ফকির সাহেব! আপনার সঙ্গে দেখা করব বলেই আমি এখনও এখানে রয়ে গেছি।

ফকির মৃদু হেসে বলল—বেটা তুমি শোচ করছিলে কী, আজিমুদ্দিনের লাশে কোন লানৎ (অভিশাপ) আছে কি না। তাই তো?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি মনের কথা বুঝতে পারেন ফকির সায়েব?

বেটা! মানুষের মনের কথা তার মুখে ফুটে ওঠে।

বসুন ফকির সায়েব। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

কথা আমারও আছে। তবে এখানে নয়, ঘরে চলো। গোপনে বলব।

দুজনে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

ফকির কিছুক্ষণ চোখ বুজে কী যেন ভাবতে থাকল। কর্নেল তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফকির চোখ খুলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বলল—আমি সংসারবিরাগী ফকির। ধনের লোভ আমার নেই, বেটা। যারা আজিমুদ্দিনের লাশের মাথা কেটেছে, তাদের শাস্তি খোদা দেবেন। বললুম না? আজিমুদ্দিনের আত্মার অভিশাপ লাগবেই তাদের। তাই তোমাদের বলি, যদি অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাও, বাকসোটা ফেরত দাও। কবরের মধ্যে রেখে এস।

কর্নেল চমকে উঠে বললেন—বাকসোটা আমাদের কাছে আছে, কে বলল আপনাকে?

ফকির হাসল। আমি জানি। মিথ্যা বলে লাভ নেই বেটা।

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন—ঠিক আছে। বাকসো ফের কবরে রাখা হবে। কিন্তু আজিমুদ্দিনের কাটা মাথার হদিশ জানতে চাই। আপনি আমার সাহায্য করুন তাহলে।

ফকির বলল—জরুর। বলো, কী সাহায্য চাও?

আপনি কোন কোন লোককে এ পর্যন্ত আজিমুদ্দিনের কবরের ওই বাকসো এবং তার চাবির কথা বলেছেন? আগে এসব কথা জানতে চাই।

ফকির অনুশোচনার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল একটুখানি। তারপর উর্দুমেশানো বাংলায় যা বলল, তা হল এই :

কমলাক্ষবাবু কোনও ইংরেজি কেতাবে জায়গিরদার ও তার অকালমৃত ছেলের কাহিনি পড়েছিলেন। এই ফকির বংশানুক্রমে এলাকার ইতিহাস জানে। তাই কমলাক্ষ বারবার তার কাছে। এসে কবরের হদিশ জানতে চাইতেন। তিনি বলতেন—এলাকার পুরাকীর্তি এবং প্রত্নদ্রব্য সংরক্ষণ করাই তার ব্রত—যাতে ওগুলো ধ্বংস না হয়ে যায়। ফকিরের পা ছুঁয়ে তিনি প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন, গুপ্ত কবরের খোঁজ দিলে সেখানে সরকারি সাহায্যে একটা দরগা বানিয়ে দেবেন এবং ফকিরকেই তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেবেন।

শেষপর্যন্ত ফকির তাঁর কথায় রাজি হয়ে গুপ্ত কবরের হদিশ দিয়েছিল। কিন্তু কমলাক্ষের মনে। যে এমন শয়তানি লোভ আছে, ভাবেনি।

একথা শোনার পর কর্নেল জিগ্যেস করলেন—কমলাক্ষবাবু ছাড়া আর কাকেও কি গুপ্ত কবরের কথা বলেননি ফকিরসায়েব? মনে করে দেখুন তো?

ফকির চোখ বুজে ভাবতে থাকল। তারপর সে নড়ে বসল। বলল—না, আর কাকেও বলিনি। তবে …

তবে? বলে কর্নেল আগ্রহের সঙ্গে তার দিকে তাকালেন!

ফকির বলল—আমার মনে হছে, আরেকজনের পক্ষে ব্যাপারটা জানা সম্ভব।

কে? কে সে?

সেই জায়গিদারের বংশধর বলে দাবি করে একটা লোক। তার নাম লতিফ খাঁ।

কোথায় থাকে সে?

লিটনগঞ্জেই। লোকটা হেকিমি চিকিৎসা করে। তোপখানার কাছে তার হেকিমি দাওয়াখানা আছে। লোকটা কিন্তু পাজির পাঝাড়া। যেমনি তিরিক্ষি মেজাজ, তেমনি কুচুটে। আমার সঙ্গে তার বনিবনা নেই।

কর্নেল বললেন—ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না ফকির সাহেব। বাকসোটা আমরা কবরেই ফেরত দেব এবং ওখনে যাতে স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতত্ত্ব দফতরকে সেজন্য অনুরোধ জানাব। তবে তার আগে আমি মমিমুণ্ডটা উদ্ধার করতে চাই।

ফকির হাত তুলে বলল-খোদার দয়ায় তুমি সফল হও বেটা।

তারপর সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল এবং বেরিয়ে গেল। কর্নেল তাঁর পিছনে-পিছনে বেরুলেন। কিন্তু বেরিয়েই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ফকিরকে দেখতে পেলেন না। এ ফকির কি সত্যি অলৌকিক শক্তিধর কোনও সিদ্ধপুরুষ? কর্নেল ভারী একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন—মানুষ এই বিস্ময়কর বিশ্বের কতটুকুই বা জানতে পেরেছে? কত আশ্চর্য শক্তি বিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে তো এখনও রয়ে গেছে! …

কলকাতা থেকে দুঃসংবাদ

কর্নেলের গোয়েন্দাগিরি ছাড়াও এক বিচিত্র নেশা আছে। পাখি, প্রজাপতি বা পোকামাকড়ের জীবন সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল অসামান্য। দুপুরে খাওয়ার পর রোদুরে লনে চেয়ার পেতে বসেছিলেন, হঠাৎ নদীর ধারে কোনও গাছ থেকে কী একটা পাখির ডাক শুনে নড়ে বসলেন।

তারপর ঘর থেকে তক্ষুনি বাইনোকুলারটা এনে চোখে রেখে পাখিটাকে খুঁজতে থাকলেন।

হ্যাঁ, ওই তো গাবগাছের ডালে ছোট্ট রঙিন পাখিটা মনের সুখে গান গাইছে।

কর্নেল একটু অবাক হলেন। এমন পাখি তো এর আগে কখনও দেখেননি। কেতাবে পড়েছিলেন বটে। এই দুর্লভ প্রজাতির পাখির একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। দৌড়ে ঘরে গেলেন ফের ক্যামেরা আনতে।

কিন্তু সেই সময় ফোন বেজে উঠল ক্রিরিরিরিরিং! ক্রিরিরিরিরিং।

কী আপদ! বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে বললেন-হ্যালো! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে সাড়া এল—ধরুন। কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল আছে।

কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে পাখির কথা ভুলে গেলেন। শংকর ছাড়া আর কে ফোন করবে কলকাতা থেকে? কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

একটু পরে শংকরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—কর্নেল! কর্নেল! যা বলছিলেন, তাই হয়েছে! বাকসো উধাও!

কর্নেল চমকে উঠে বললেন—সে কী!

হ্যাঁ কর্নেল! এইমাত্র পোঁছে আবিষ্কার করলুম, দেয়ালের ছবিটা সরিয়ে কে গুপ্ত আলমারি থেকে বাকসোটা হাতিয়েছে। হারাধন কান্নাকাটি করছে। সে কিছু জানে না।

হুম্। বাড়ি থেকে তোমার কোনও লোক উধাও হয়নি তো?

হ্যাঁ হয়েছে। বাজার সরকার মদনবাবু থলে হাতে সকালে বাজার করতে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। এখন বেলা প্রায় দুটো বাজে।

পুলিশকে জানিয়েছ নাকি?

না। এই তো সবে ঘরে ঢুকে সব দেখে তারপর আপনাকে ফোন করছি।

ঠিক আছে। তুমি লোকাল থানায় খবর দাও। তবে বাকসোর কথা বলো না। বললা যে টাকাকড়ি চুরি করে ভদ্রলোক কেটে পড়েছেন। একটা ফোটো আছে কি মদনবাবুর?

আছে। বাবার মৃত্যুর সময় গ্রুপ ফোটো তোলা হয়েছিল। তার মধ্যে…

ভালো। ফোটোটা পুলিশকে দাও।

কিন্তু ন্যাড়াকে তাহলে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না কর্নেল!

ভেব না শংকর। বরং বাকসোটা যখন ওরা মদনবাবুর সাহায্যে হাতিয়েছে, তখন ন্যাড়াকে ধরে রাখার দরকার হবে না। দেখবে, ওকে ওরা ছেড়ে দেবে। এসব ক্ষেত্রে খুনখারাপি করলে ওদেরই বিপদের ঝুঁকি আছে। কাজেই নিশ্চিন্ত থাকো।

আপনি শিগগির চলে আসুন, কর্নেল! বাকসোটা…

বাকসো যদি কমলাক্ষ হাতিয়ে থাকেন, আমার কলকাতা ফেরার দরকার দেখি না। বরং তুমিই চলে এস লিটনগঞ্জে।

বাস্। আবার একশো কিলোমিটার মোটরজার্নি?

পারবে না?

এক মুহূর্ত পরে শংকর বললেন-ঠিক আছে। পারব।

পেটপুরে খেয়ে তবে বেরিও কিন্তু। তার আগে থানায় খবরটা দাও।

আচ্ছা। ছাড়ছি!

আচ্ছা।

কর্নেল ফোন রেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল পাখিটার কথা। অমনি ক্যামেরা আর বাইনোকুলার নিয়ে দৌড়ে বেরুলেন।

চৌকিদার তার ঘরের বারান্দা থেকে বুড়ো কর্নেলকে ওইভাবে দৌড়তে দেখে হকচকিয়ে উঠেছিল।

কিন্তু কর্নেল নদীর ধারে গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করছেন দেখে সে আপন মনে হাসতে লাগল। এই বুড়োসাহেব বড় খামখেয়ালি মানুষ!

ওদিকে শাটার টেপার আগেই পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে চোখের আড়ালে কোথায় উধাও। কর্নেল অপ্রস্তুত।

বাইনোকুলার চোখে রেখে তন্নতন্ন খুঁজেও আর দেখতে পেলেন না। দুঃখিত মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আনমনে একটা চুরুট ধরালেন।

তারপর গাছের তলায় বসে চুরুটটা টানতে থাকলেন। নিচে নদীর বুকে কোথাও সোনালি বালির চড়া পড়েছে। কোথাও স্বচ্ছ নীল জল তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। কর্নেলের চোখ প্রকৃতির দিকে, কিন্তু কান পাখপাখালির ডাক শুনছে। তন্ময় হয়ে রয়েছে। মনে ক্ষীণ আশা, সেই ছোট্ট সুন্দর পাখিটা আবার যদি ডেকে ওঠে।

কালো হেকিমি দাওয়াই ও খুনখারাপি

হ্যাঁ, আবার পাখিটা ডেকে উঠল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে। প্রকৃতি যাকে কণ্ঠস্বর দিয়েছে, সে কি গান না গেয়ে পারে? কর্নেল কান পাতলেন। এবার কিন্তু ডাকটা ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে।

কতক্ষণ ঠাহর করার পর বুঝলেন, কখন পাখিটা নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে। ওপারে ঘন বাঁশবন। বাঁশবনের ভেতর সে নিরিবিলিতে মনের সুখে গান ধরেছে।

কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে নদীতে নামলেন। এসব সময় তার পা কোথায় পড়ছে, খেয়াল থাকে না। জায়গায় জায়গায় সোনালি বালির চড়া, আবার কোথাও ঝিরঝিরে কাজল জলের স্রোত। কোথাও আবার ডোবার মতো জল জমে রয়েছে। আচমকা কর্নেল তেমনি একটি ডোবামতো জায়গায় হুড়মুড় করে পড়লেন। কোমর অব্দি ড়ুবে গেল।

এই শীতের ঋতুতে ব্যাপারটা আরামদায়ক নয় মোটেও। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লেন বটে, কিন্তু চোখে বাইনোকুলারটা রয়ে গেল।

এমনি করে ওপারে পৌঁছে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে বাঁশবনে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ক্যামেরা তাক করে পাখিটার ছবি তুললেন। পরপর কয়েকটা।

তারপরই পাখিটা যেন টের পেল, তার ছবি তোলা হচ্ছে। অমনি সে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল বাঁশবনের ওপর দিয়ে। তাকে লক্ষ করতে গিয়ে কর্নেলের চোখে পড়ল, একটু তফাতে ঝোপের মধ্যে এইমাত্র কেউ হেঁট হল। তার মাথার একটা কিস্তুত গড়নের ছুঁচলো টুপি রয়েছে। টুপি পরে ঝোপের মধ্যে হেট হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার মোটেও নয়। তাই কর্নেল পা টিপে টিপে বাঁশবনের ভেতর ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলতে থাকলেন।

ভেজা প্যান্ট শার্ট কোর্টে কোমর অব্দি হিমে জমে অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু কর্নেল এ বয়সেও হাড়ে প্রচুর তাকত রাখেন। গ্রাহ্য করলেন না।

বাঁশবনের শেষে একটা আগাছার জঙ্গল। তার ওপাশটা মুসলিমদের গোরস্থান বলে মনে হল। একটা উঁচু ও চওড়া ঝোপের পাশে উঁকি মেরে বসে পড়ে কর্নেল।

একটা ঢ্যাঙা রোগা গড়নের লোক হাঁটু দুমড়ে বসে একটা কিছু করছে। তার মাথার ছুঁচোলো টুপিটার মতোই চেহারাও বিদঘুটে। যেন হাড়গিলে শকুন। নাকটা বেজায় লম্বা! গাল বলতে কিছু নেই। চিবুক থেকে লম্বা এক চিলতে ছাগল দাড়ি এসে বুকে নেমেছে। তার পরনে ময়লা জোকারের মতো জামা আর চুস্ত পাজামা। পায়ে নাগরা জুতো। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে।

দু হাতে একটা খুরপি ধরে সে মাটি কোপাচ্ছে।

কর্নেল সামান্য একটু মাথা উঁচু করে যা দেখলেন, তাতে যত অবাক হলেন, তত আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।

লোকটা যেখানটায় কোপাচ্ছে, সেখানটা একটা মাটির কবরের অংশ। কবরটা গ্রামের কোনও সাধারণ মানুষেরই কবর। তত বেশি পুরোনো নয়। কবর খুঁড়ছে কেন লোকটা? ও কি কঙ্কালটা চুরি করতে চায়? কঙ্কাল বিক্রি হয় গোপনে। চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োজনে কঙ্কাল লাগে। চোরাবাজারে তাই দেশবিদেশের কঙ্কাল বিক্রি হয় মোটা টাকায়।

এরপর লোকটা বসে পড়ল। কর্নেল শুধু তার মাথার পেছনটা আর কাধের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছিলেন। সে কী করছে পুরোটা দেখতে গেলে অনেকটা ঘুরে ওপাশে যেতে হয়। কিন্তু তা করতে গেলে তার চোখে পড়ার সম্ভাবনা।

একটু পরে লোকটা উঠে দাঁড়াল।

তার হাতে একটা বাঁকাচোরা শেকড় দেখতে পেলেন কর্নেল। তখন কর্নেল মনে মনে হেসে ফেললেন।

না, লোকটা কঙ্কাল চুরি করছিল না। নেহাত একটা গাছের শেকড় সংগ্রহ করছিল। গাছটা কবরে গজিয়েছিল নিশ্চয়।

হুম, এই লোকটাই তাহলে লিটনগঞ্জের সেই হেকিম লতিফ খাঁ নয় তো? কর্নেল চমকে উঠে দেখলেন, সর্বনাশ! লোকটা হন হন করে তার ঝোপটার দিকেই এগিয়ে আসছে যে!

সরে পড়ার ফুরসত পেলেন না কর্নেল। সে ঝোপ ঠেলে হুড়মুড় করে এসে একেবারে তার গায়ের ওপর পড়ল এবং ভয়ে কিংবা রাগে চেঁচিয়ে উঠল—অ্যাই বাপ!

কর্নেল অপ্রস্তুত হেসে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আদাব ঠুকে সসম্ভ্রমে বললেন—সেলাম হেকিমসাহেব! সেলাম, বহুৎ সেলাম!

হ্যাঁ লোকটা হেকিম লতিফ খাঁ-ই বটে। ভুরু কুঁচকে বলল—আপনি কে আছেন? এই জঙ্গলে কী করছেন?

কর্নেল বাইনোকুলার ও ক্যামেরা দেখিয়ে বিনীতভাবে বললেন—আমি পাখপাখালির ছবি তুলতে বেরিয়েছি হেকিমসাহেব। ওই ডালে একটা পাখি বসে ছিল। তার ছবি তুলছিলাম। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, পাখির ছবি তুলতে হলে চুপিচুপি এইভাবে গা ঢাকা দিয়ে বসতে হয়।

হেকিম এবার দাঁত বের করে হাসল। হাঁ, হাঁ। আপনারা ইউরোপিয়ান সাহাব আদমির এইসা খ্যাল আছে বটে। একবার এক সাহাবলোকএসে ঠিক এমনি করে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। হামি দেখেছে। তবে আপকা মাফিক বাংলা বোলি সে বলতে পারত না।

কর্নেল বুঝলেন, তার চেহারা দেখে হেকিম খাঁটি ইউরোপবাসী বলে ভুল করেছে। এটা স্বাভাবিক। এ ভুল তাকে দেখে সবাই করে। যাই হোক, এ সুযোগে তিনি ইউরোপীয় হয়ে গেলেই মঙ্গল। বললেন—জি হাঁ হেকিমসায়েব। আমি বাংলা মুল্লুকে অনেক বছর আছি কিনা। তবে উর্দুও বলতে পারি।

এরপর দুর্জন উর্দুভাষায় কথা বলতে বলতে নদীতে নামলেন। সে-সব কথাবার্তা হল এই :

আমি যে হেকিম, তা কীভাবে বুঝলেন?

কেন? আপনার হাতে গাছের শেকড় আর ওই খুরপি।

ঠিক, ঠিক।

তাছাড়া এখানে এসে আপনার কত নাম শুনেছি। আপনার দাওয়াই খেলে মড়াও নাকি উঠে বসে।

তা মা বাবা আর খোদার দয়ায় ওকাজটা আমি ভালোই পারি।

দেখুন হেকিমসায়েব, আমার কোমরে প্রায়ই খুব ব্যথা হয়। দাওয়াই দেবেন?

নিশ্চয় দেব। ওই তো আমার কাজ। তবে আমার দাওয়া-খানায় যেতে হবে।

তাই যাব। তবে দয়া করে আসুন, ওই বাংলোয় আমি যাচ্ছি। একটু চা খেয়ে যাবেন।

বেশ তো চলুন।

নদী পেরিয়ে দুজনে বাংলোয় পৌঁছলেন। কর্নেল চৌকিদারকে চায়ের আদেশ দিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে মুখোমুখি বসলেন।

ফকির বলেছিল, হেকিম লতিফ খাঁ বদমেজাজি লোক। কিন্তু তাকে মোটেও তেমন মনে হল না কর্নেলের। লোকটি যে ভদ্রবংশীয় ত তার আদবকায়দা আর কথার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে।

কথায়-কথায় কর্নেল একসময় বলল—আচ্ছা হেকিমসায়েব, শুনেছি এখানে নাকি এক মস্তো জায়গিরদার ছিলেন। আপনি তারই বংশধর?

লতিফ খাঁ মাথা উঁচু করে বলল—আপনি ঠিকই শুনেছেন।

আচ্ছা খা-সাহেব, ইতিহাসের কেতাবে পড়েছিলাম এখানে আপনার পূর্বপুরুষদের আমলে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ মমি করা হত। তা কি সত্যি?

হেকিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—কিছুটা সত্যি। আপনি বিদেশি। আজ আছেন, কাল নেই। তাই সে গোপন কাহিনি আপনাকে বলছি।

বলে হেকিম লতিফ খাঁ এই কাহিনি শোনাল :

আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ তাল-তমাসের মনে সুখ ছিল না। কারণ তার কোনও পুত্রসন্তান নেই। তাই তিনি আরব ও পারস্যের নানা মুসলিম তীর্থে ফকির ও অলৌকিক শক্তিধর সাধকের কাছে পুত্র কামনায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে খোঁজ পেলেন, মিশরদেশের এক সাধক আজম শাহের কাছে গেলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে।

মুইনুদ্দিন তখনই মিশরে গিয়ে সেই সাধকের শরণাপন্ন হলেন। অনেক কাকুতি-মিনতির পর আজম শাহ বললেন—ঠিক আছে। আজ রাতদুপুরে তুমি আমার আস্তানায় একা এসো। তোমাকে আমি একটা অত্যাশ্চর্য জিনিস দেব। সেটা নিয়ে গিয়ে তুমি ও তোমার স্ত্রী ধুয়ে জল খাবে। তাহলে তোমাদের পুত্রলাভ হবে। কিন্তু সাবধান, এই জিনিসটি অপার্থিব একটি রত্নবিশেষ। একটি কৃষ্ণবর্ণ ধাতুনির্মিত ছোট পেটিকার মধ্যে এটা রেখে দেবে। আর দেখ মানুষ মরণশীল প্রাণী। তোমার পুত্রও একদিন মারা যাবে। তার যখনই মৃত্যু হোক, তার কবরের মধ্যে ওই রত্নসমন্বিত পেটিকাটিও অবশ্য সমাহিত করতে হবে। নতুবা সাংঘাতিক বিপদ ঘটবে।

মুইনুদ্দিন সেই অত্যাশ্চর্য কৃষ্ণবর্ণ রত্নপেটিকা নিয়ে দেশে ফিরলেন। সাধক তাকে পেটিকার চাবি দিয়েছিলেন। চাবির সাহায্যে পেটিকা খুলে রত্নটি বের করে ধুয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে সেই জল পান করলেন।

পরবৎসর তাঁর পুত্রলাভ হল। সাধকের নাম অনুসারে তার নাম রাখলেন আজিমুদ্দিন।

কিন্তু দুঃখের কথা, বারো বছর বয়সে সেই সুন্দর ছেলেটি এক অজ্ঞাত ব্যাধিতে মারা পড়ল। শোকে ভেঙে পড়লেন মুইনুদ্দিন।

তিনি মিশরে গিয়ে ওইসময় একজন কারিগরের খোঁজ পেয়েছিলেন—যে মৃতদেহ মমি করতে জানত। তাকে তিনি খেয়ালবশে সঙ্গে করে এনেছিলেন।

আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ মমি করার ইচ্ছা হল হতভাগ্য পিতার। মিশরবাসী সেই লোকটি তার আদেশ পালন করল। কিন্তু সাধক আজমশাহের নির্দেশে সেই রত্নপেটিকা কবরে রাখতে হবে। সাধারণ কবরে রাখলে তা চুরি যাবার আশঙ্কা ছিল! কারণ এই আজব পেটিকা ও রত্নের কথা ততদিনে রটে গিয়েছিল।

তাই ভূগর্ভে গোপন কবর দেওয়া হল আজিমুদ্দিনকে। রত্নপেটিকাটিও তার কবরের মধ্যে রাখা হল।….

হেকিম লতিফ খাঁ চুপ করলে কর্নেল বললেন–তারপর?

আর কী?

সেই গুপ্ত কবরের সন্ধান। নিশ্চয় আপনি রাখেন?

মুহূর্তে হেকিমের মেজাজ বদলে গেল। বিকৃতমুখে বললেন—না। আপনাকে যে কাহিনি বললুম, তা আমার বাবার কাছে শোনা। কিন্তু এই গাঁজাখুরি গল্পে আমার একটুও বিশ্বাস নেই।

চৌকিদার ইতিমধ্যে চা এনে দিয়েছিল। হেকিম চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তেমনি বিকৃতমুখে হেসে ফের বলল—দয়া করে এ সম্পর্কে আমায় আর কোনও প্রশ্ন করবেন না সায়েব! যদি কোমরের বেমারির দাওয়াই চান, আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন—এক ভদ্রলোক দেখা করতে আসবেন। তাই এখন যাওয়ার অসুবিধা আছে। সন্ধ্যায় যাবখন।

আচ্ছা আদাব। বলে হেকিম লতিফ খা বেরিয়ে গেল।

কর্নেল অবাক হয়ে বসে রইলেন। মমি করার ব্যাপারটা হেকিম কিছুটা সত্যি বলে স্বীকার করল। কিন্তু বাকিটা গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিল কেন?

অথচ আজিমুদ্দিনের কবরে সত্যি একটা অদ্ভুত ধাতুতে তৈরি কালো পেটিকা পাওয়া গেছে। এবং সেটা কর্নেল স্বচক্ষে দেখেছেন। কর্নেল আগাগোড়া ব্যাপারটা ভাবতে থাকলেন। ঘণ্টা দুই পরে ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে বললেন—হ্যালো। কর্নেল বলছি।

কর্নেল, আমি অজিতেশ।

কী খবর ডার্লিং?

খবর সাংঘাতিক! একটু আগে তোপখানার কাছে পোড়ো একটা বাড়িতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। টাটকা খুন। তাকে ছোরা মেরে পালিয়েছে কেউ। নিহত লোকটা…

কে, কে অজিতেশ?

শংকরবাবুর সেই বাজার সরকার। কারণ তার পকেটে তার নাম ঠিকানা লেখা একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেছে। ঠিকানায় কেয়ার অফ শংকরবাবুর নাম রয়েছে।

আমি যাচ্ছি! বলে কর্নেল ফোন রেখে দিলেন।

গোরস্তানে অভিযান

তোপখানার এদিকটায় মুসলমানপাড়া। এলাকা জুড়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তুপ ছড়িয়ে রয়েছে। সেইসব ধ্বংসস্তুপে আগাছার জঙ্গলও গজিয়েছে। একপাশে মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা আর কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শীতের বেলা ফুরিয়ে গেছে। বাতি জ্বলেছে। সবে। কর্নেল ওই রাস্তায় ভিড় দেখতে পাচ্ছিলেন। একদল পুলিশ সেই ভিড় ঠেকিয়ে রেখেছে। পুলিশের জিপ, ভ্যান আর একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অজিতেশ কর্নেলকে দেখে এগিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন—লাশ কোথায়?

ওই যে, ওখানে পোডড়াবাড়ির মধ্যে।

বলে অজিতেশ কর্নেলকে নিয়ে রাস্তার পাশে আগাছার জঙ্গল ঠেলে ঢুকলেন। পোড়ো বাড়িটা আসলে কোনও একটা নবাবি অতিথিশালার একটা অংশ। ভেঙেচুরে একাকার। শুধু একটা ঘর কোনওক্রমে টিকে আছে। একটা হ্যাসাগ রাখা হয়েছে লাশের কাছে। লাশটা সেই ঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পিঠে কাধের কাছে একটা ছোরা তখনও বিঁধে রয়েছে। তাই বেশি রক্ত বেরুতে পারেনি।

হাসপাতালের ডাক্তারবাবু পুলিশ সুপারের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। ইশারা পেয়ে ছোরাটা টেনে বের করলেন। এক ঝলক জমাট রক্ত বেরিয়ে এল। কর্নেল মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আরও সব পুলিশ অফিসার লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা ততক্ষণে মোটামুটি তদন্ত করে ফেলেছেন ঘটনাটার। কিন্তু কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম।

কর্নেল হেঁট হয়ে ঘরের মেঝে পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। বারান্দা থেকে উঠোনে টর্চের আলো ফেলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন। পুলিশ অফিসাররা তাই দেখে বাঁকা মুখে হেসে পরস্পর তাকাতাকি করছিলেন। এ বুড়ো আবার কে—বেমক্কা নাক গলাতে এসেছে এবং পুলিশ সুপার তাকে এত খাতির করছেন!

কর্নেল উঠোনের কোনা থেকে কী একটা কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন।

ওদিকে লাশ ধরাধরি করে হাসপাতালের লোকেরা অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। মর্গে নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেম করা হবে। ডাক্তারবাবুও চলে গেলেন।

অজিতেশ এতক্ষণে কর্নেলের কাছে এসে বললেন-কী বুঝলেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন—আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মদনবাবু কারুর কথামতো সেই কালো বাকসোটা কলকাতা থেকে এনে এই পোড়ো বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন। আচমকা তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খুনি বাকসোটা নিয়ে ভেগেছে। ছোরাটা তুলে নেওয়ার সময় পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।

কেন সময় পায়নি, অনুমান করতে পারছেন?

সম্ভবত কেউ এসে পড়েছিল।

কোনও সূত্র খুঁজে পেলেন কি কর্নেল?

কিছু পেয়েছি বইকি। বলে কর্নেল একটু হাসলেন।

বলতে আপত্তি আছে?

কর্নেল বললেন—তোমায় বলতে আপত্তি কীসের? প্রথম সূত্র—ঘরের ভেতর ভাঙা কড়িকাঠ স্কুপের আড়ালে সুরকির গুঁড়োয় জুতোর ছাপ আছে দেখলুম। কেউ মদনবাবুর জন্যে আগে থেকেই ওখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। তবে সে ছোরা মারেনি। যে মেরেছে, সে বাইরে থেকে আচমকা ঢুকে মেরেছে এবং সম্ভবত এক-ঝটকায় মদনবাবুর ব্যাগটা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।

বলে কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো বাঁকাচোরা শেকড় বের করলেন।

অজিতেশ অবাক হয়ে বললেন—ওটা কী? কোথায় পেলেন?

উঠোনের কোনায়। খুনি পালাবার সময় এটা তার হাত থেকে পড়ে গেছে।

ওটা একটা শেকড় না?

হ্যাঁ শেকড়। আর এই দ্যাখো, এতে একটু রক্ত লেগে রয়েছে।

অজিতেশ অবাক হয়ে বলল—খুনির হাতে এই শেকড় ছিল? কেন?

কর্নেল একটু হেসে বলল—অজিতেশ! খুনি কে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তাকে সম্ভবত এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?

অজিতেশ ব্যস্তভাবে বললেন—দোহাই কর্নেল! দয়া করে আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন, কে সে? এখনই তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশবাহিনী পাঠাব।

কর্নেল আনমনে বললেন—আমারই বুদ্ধির ভুল! আঃ তখনই যদি…

কর্নেল! আবার হেঁয়ালি করছেন আপনি!

কর্নেল স্থিরদৃষ্টে পুলিশ সুপারের দিকে তাকিয়ে বললেন-অজিতেশ! জনা চার-পাঁচ বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ অফিসার নিয়ে তুমি এখনই আমার সঙ্গে এস। আমার ধারণা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?

অজিতেশ তক্ষুনি পুলিশ অফিসারদের ডেকে জিপে উঠতে বললেন। তারপর কর্নেলকে ডেকে বললেন—আমরা রেডি। চলে আসুন কর্নেল।

কর্নেল জিপের সামনে অজিতেশের পাশে বসে বললেন—সোজা আমার বাংলোয় চলো। ওখানে জিপ রেখে আমরা যথাস্থানে রওনা দেব।

জিপ প্রচণ্ড বেগে ছুটল। আলো আর ভিড়েভরা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে জিপ নদীর ধারে সরকারি বাংলোয় পৌঁছোল। কর্নেল বললেন—সবাই আমার সঙ্গে আসুন। কোনও শব্দ করবেন না টর্চ রেডি রাখুন। কেউ যেন গুলি ছুঁড়বেন না। সাবধান! যদি কেউ আক্রমণ করে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে কেউ আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না!

অজিতেশ ও পুলিশ অফিসাররা কর্নেলকে অনুসরণ করলেন।

কর্নেল অন্ধকারে নদীর দিকে হাঁটছিলেন। সেই গাবতলায় পৌঁছে একটু দাঁড়ালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন—নদীর ওপারে যেতে হবে আমাদের। দেখবেন, কেউ যেন জলে না

পড়েন।

কুয়াশার মধ্যে মিটমিটে নক্ষত্রের আলো নদীর জলে কোথাও কোথাও ঝিকমিক করছে। সাবধানে বালির চড়া পেরিয়ে সবাই ওপারে পৌঁছলেন।

সামনে বাঁশবন নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। বাঁশের পাতা থেকে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। একবার পাচা ডেকে উঠল বিশ্রী শব্দে। তারপর গোরস্থানের ওদিকে

শেয়াল ডাকতে লাগল।

কর্নেল আগে, পুলিশ অফিসাররা পেছনে। কাঁটাঝোপে বারবার কাপড় আটকে যাচ্ছে। আছাড় খেতে হচ্ছে। শুকনো পাতা শিশিরে ভিজে গেছে বলে জুতোর শব্দ হচ্ছে না। কিছুটা চলার পর কর্নেল দাঁড়ালেন। কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু কোনও শব্দ শোনা গেল না। আবার কিছুটা এগিয়ে কর্নেল ফিসফিস্ করে বললেন—রেডি! টর্চ জ্বালাতে হবে। ওয়ান টু থ্রি…

সঙ্গে সঙ্গে সাতটা টর্চ জ্বলে উঠল।

সেই উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল, জায়গাটা একটা গোরস্থান। আর সেখানে একদঙ্গল শেয়াল মাটি শুকছে একটা সদ্যখোঁড়া কবরের কাছে। তাদের চোখগুলো নীল।

হঠাৎ আলোয় তারা ভড়কে গিয়ে চোখের পলকে গা ঢাকা দিল। কর্নেল সদ্যখোঁড়া কবরটার কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

অজিতেশ বলে উঠল—কী ব্যাপার কর্নেল? এর মাথামুণ্ডু কিছু যে বুঝতে পারছি না।

কর্নেল মাটির কবরের গর্তে আলো ফেলে হতাশস্বরে বললেন-দেরি হয়ে গেছে! আজিমুদ্দিনের মমি-মুণ্ডু এখানেই লুকিয়ে রেখেছিল সে। মদনবাবুকে খুন করে বাকসোটা হাতিয়ে সোজা এখানে এসেছিল। তারপর মমি-মুণ্ডুটা তুলে নিয়ে গোপন জায়গায় চলে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় সে মুণ্ডু থেকে চাবি খুঁজে বের করেছে এবং বাকসো খুলে রত্নটিও পেয়ে গেছে।

অজিতেশ উত্তেজিত ভাবে বললেন—কর্নেল! কর্নেল! কী সব বলছেন আপনি? কার কথা বলছেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ গোরস্থানের অন্যপ্রান্ত থেকে কার বিকট চিৎকার শোনা গেল—ইয়া পির মুশকিল আসান! যাহা মুশকিল তাহা আসান!

টর্চের আলো গিয়ে পড়ল ওদিকে। দেখা গেল সেই কালো আলখেল্লা ও কালো টুপিরা ফকির হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।

অজিতেশ অবাক হয়ে বললেন, আরে! এ তো দেখছি পিরের মাজারের সেই পাগলা ফকির! এ আবার এখানে জুটল কেন?

কর্নেল বললেন–চুপ। ফকির কী বলে আগে শোনা যাক।

ফকির নির্ভয়ে গটগট করে চলে এল সামনে। তারপর বলল—বাবালোক! সরকারের টর্চের ব্যাটারি কি খুব সস্তা হয়ে গেছে? না কি কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ডাল! কর্নেলসাহাব! ওনাদের বলুন, বেফায়দা আলো জ্বেলে লাভ কী? এটা গোরস্থান। এখানে পিদিমের আলোই মানায়।

বলে সে তার হাতের লণ্ঠনটি রেখে আলখেল্লার ভেতর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালল। কর্নেল বললেন—টর্চ নিভিয়ে ফেলুন আপনারা!

তারপর ফকিরকে বললেন—ফকির সায়েব! আপনার কথাই সত্যি হল। হেকিম লতিফ খাঁ সত্যি আজিমুদ্দিনের মুণ্ডু চুরি করে এনে এই কবরে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর …

বাধা দিয়ে ফকির বলল—তারপর বাকসো চোরকে খুন করে বাকসোও হাতিয়েছে। এই তো?

কর্নেল বললেন—আপনি তাহলে সবই জানেন দেখছি!

বেটা আমি সর্বচর। সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই। তো সেলাম পুলিশসায়েব! আপনিও এসেছেন। দেখছি। লেকিন লতিফ খাঁকে আর ছুঁড়ে বের করতে পারবেন? সে এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

অজিতেশ কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন— ফকিরসায়েব! আপনার অজানা কিছুই নেই। লতিফ খাঁ এখন কোথায়, আপনি নিশ্চয় জানেন!

ফকিরের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। সে বলল—তাকে ধরে ফেলব বলে আমিও তার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাটা খুব ধূর্ত। অন্ধকারে ঘুরপথে এগিয়ে আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তবে যেখানেই লুকিয়ে বাকসো খুলে আজব মণি বের করুক, তাকে আমি পাকড়ে ফেলব।

বলেই ফকির গতকাল সন্ধ্যার মতো আলখেল্লার ভেতর থেকে কী একটা বের করে লণ্ঠনের ওপর ছড়িয়ে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে দুর্গ সাদা একরাশ ধোঁয়ায় সারা গোরস্থান ঢেকে গেল। কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন—সরে আসুন! সরে আসুন সবাই। বিষাক্ত গ্যাসে মারা পড়বেন।

সবাই এক দৌড়ে অনেকটা তফাতে সরে গেলেন। একটু পরে ধোঁয়া মিলিয়ে গেলে টর্চের আলোয় দেখা গেল, গোরস্থান নির্জন। ফকির অদৃশ্য হয়েছে।

অজিতেশ গম্ভীর মুখে বললেন—তাহলে কী করা যাবে কর্নেল?

কর্নেল বললেন-কিছু মাথায় আসছে না। লতিফ খাঁ হেকিমকে খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদা থেকে হারানো ছুঁচ উদ্ধার করা একই ব্যাপার। বিশেষ করে এই রাত্রিবেলার অন্ধকারে এ কাজ অসম্ভব!

আমার অসহ্য লাগছে কর্নেল! ব্যাটা খুনি তো বটেই, তার ওপর আজিমুদ্দিনের কবরের বহুমূল্য রত্ন নিয়ে নির্বিবাদে ভেগে পড়বে?

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন—সকাল হোক তারপর দেখা যাবে। বরং তুমি এ রাতে তোমার গোয়েন্দাবাহিনীকে কাছে গাও, অজিতেশ! যদি তারা কোনও হদিশ দৈবাৎ পেয়ে যায়, ভালোই।

সবাই মিলে নদীর দিকে পা বাড়ালেন। নদী পেরিয়ে বাংলোয় পৌঁছে কর্নেল বললেন—তাহলে এলো অজিতেশ। আমি বড্ড ক্লান্ত। বিশ্রাম করতে চাই।

পুলিশ সুপার সদলবলে জিপে চেপে গেলেন।

কর্নেল গেট পেরিয়ে লনে পা বাড়াতেই দেখলেন, বারান্দায় শংকর বসে আছেন। কর্নেল বললেন—শংকর যে! কখন এলে!

এইমাত্র। এসে তো সব শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছি!

হ্যাঁ, তোমার বাজার সরকার ভদ্রলোক বেঘোরে খুন হয়ে গেছেন।

পাপের প্রতিফল, কী বলব? কিন্তু কর্নেল, শ্রীমান ন্যাড়ার জন্যে আর যে মন মানছে না! খালি মনে হচ্ছে, তাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ওদিকে ওর বাবা-মার অবস্থা শোচনীয়। সব কথা খুলে বলিনি বটে, কিন্তু কতক্ষণ চেপে রাখব আর?

কর্নেল চেয়ারে ধুপ করে বসে বললেন—হ্যাঁ, বাকসো হাতছাড়া হয়ে গিয়ে কমলাক্ষ খেপে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু না—আমার বিশ্বাস, ন্যাড়াবাবাজীবনকে সে মেরে ফেলবে না। কারণ তাতে তার আর এখন কোনও লাভই হবে না। তুমি ভেব না শংকর। বরং আমাকে ভাবতে দাও।… বলে কর্নেল চোখ বুজে কী যেন ভাবতে থাকলেন।

ন্যাড়ার বাড়ি ফেরা

ন্যাড়া দুপুরবেলায় মাঝগাঙে বুড়ো জেলের নৌকোয় ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে মনের সুখে পেট ভরে ভাত খেয়েছে। বন্দিদশায় কি খেতে ভালো লাগে? তাই খিদেয় নাড়ি চো চো করছিল। তার ওপর টাটকা ধরা গঙ্গার ইলিশ।

ন্যাড়াকে দেখে বুড়ো জেলে আর তার জোয়ান ছেলের খুব মায়ামমতা জেগেছিল মনে। আহা, ভদ্দর লোকের সুন্দর ছেলেটা—বয়স কতই বা হয়েছে? দশ বারো বই নয়। তাকে কিনা ছেলে ধরা ডাকুরা চুরি করে এনেছিল। তবে বুড়ো জেলে হেসে খুন হয়েছিল।—খুব নবডংকাটি দেখিয়ে কেটে পড়েছে বাবা। ওরা যেমন বুনো ওল, তুমি তেমনি বাঘা তেঁতুল! এবারে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। চলো, তোমায় আমরা স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। রেলগাড়ি করে চলে যাবে।

বুড়ো বিকেলে তাই করেছে। বাপ-ব্যাটা মিলে ইছাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে। ন্যাড়াকে। ঘাটে নৌকো বেঁধে রেখে এসেছে।

তারপর লিটনগঞ্জের টিকিট কেটে দিয়েছে। ন্যাড়া তার সঙ্গে দাদু পাতিয়েছে। বলেছে—ও দাদু! তোমার ঠিকানা বলো লিখে নিচ্ছি। টিকিটের টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বলব বাবাকে।

জেলেবুড়ো জিভ কেটে বলেছে—ছি, ছি! ও কী কথা নাতি ভাই! ও টাকা ফেরত নেব না। বরং বাপ বেটা মিলে নৌকো নিয়ে আমরা উজানে যাব যখন, তখন তোমাদের লিটনগঞ্জে গিয়ে উঠবখন। তখন তোমার মায়ের কাছে দু-মুঠো খেয়ে আসব। ওতেই সব শোধ!

ন্যাড়া বলেছে—কবে যাবে জেলেদাদু!

-এখন তো শীত। বর্ষায় যাব। ঠিক যাব। আমরা তো জলচরা মানুষ ভাই। ট্রেন এসে গেছে। তখন ন্যাড়াকে তুলে নিয়ে বুড়ো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় সাবধান করে দিয়েছে। আর যেন বদমাশদের পাল্লায় না পড়ে ন্যাড়া! ট্রেন ছেড়ে দিলে কয়েক পা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে জেলে বুড়ো। তারপর হঠাৎ তার খেয়াল হয়েছে—এই গো, সারাদিন সঙ্গে রইলে। নামটা তো জানা হল না ছেলের।

ন্যাড়া চলন্ত ট্রেনের জানালায় মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলেছে—স্বপনকুমার রায়। ওখানে সবাই আমায় ন্যাড়া বলে ডাকে—এ-এ-এ!

ট্রেনে বড় ভিড় ছিল। দিনটা শনিবার। তাই শহুরে বাবুর দল রবিবারের ছুটি কাটাতে যে-যার দেশের বাড়ি চলেছে।

তবু ন্যাড়া খুব সাবধানে নজর রেখে বসে রইল। কমলাক্ষ বা মেধো গুন্ডা যদি তার খোঁজে দৈবাৎ এ ট্রেনে উঠে থাকে!

প্রতি স্টেশনে লোকেরা উঠল-নামল। কিন্তু ওদের দেখা না পেয়ে ন্যাড়া আশ্বস্ত হল। লিটনগঞ্জ প্রায় চার ঘণ্টা লেগে গেল পৌঁছতে। চেনা স্টেশনে নামল যখন, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত সাড়ে আটটা বাজে। বেশ শীত করছে। গায়ে মোটে একটা শার্ট, পরনে হাফ প্যান্ট। পায়ের জুতো সেই ঘরে পড়ে আছে।

প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে ন্যাড়া ভয়েভয়ে ফের চারদিকে তাকিয়ে কমলাক্ষদের খুঁজল। তারপর গেটে টিকিট দিয়ে রাস্তায় হনহন করে এগোল। স্টেশন রোডে ল্যাম্পপোস্ট থেকে যে আলো ছড়াচ্ছে, তা কুয়াশায় ম্লান। ন্যাড়া শীতে ঠকঠক করে কেঁপে প্রায় দৌড়ুচ্ছিল। বাস রিকশো আর পায়েচলা লোকের সঙ্গে দেখা অবশ্য হচ্ছে। কিন্তু একটু পরে বাঁদিকে মোড় নিয়ে যে রাস্তার তাদের পাড়ায় ঢুকতে হবে, সেটা বেশ নির্জন। নাকি বাজার ঘুরে অন্যপথে বাড়ি ঢুকবে?

এই লিটনগঞ্জেই ন্যাড়ার জন্ম। এর নাড়িনক্ষত্র এ বয়সেই তার জানা। অথচ তার জীবনে এমন একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে যে, এখন এই রাতেরবেলা চিরচেনা লিটনগঞ্জ তার কাছে অজানা এক রহস্যময় আর বিভীষিকায় ভরা শহর হয়ে উঠেছে।

খালি মনে হচ্ছে, সামনের ওই লোকটাই বদমাশ কমলকাকু কিংবা মেধো গুন্ডা। কখনও মনে হচ্ছে, অন্ধকার জায়গাগুলো থেকে ওরা তার দিকে নজর রেখেছে। এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে।

মোড়ে এসে ন্যাড়া একটু দাঁড়াল। বাজার ঘুরে অন্য রাস্তায় বাড়ি যাবে, নাকি এই রাস্তায় শর্টকাটে পৌঁছুবে? এ রাস্তার দুধারে ফাঁকায় একটা করে বাড়ি আর মাঝেমাঝে ফুলফলের বাগিচা। এ পাড়াটা খুব নির্জন। এটা হাউসিং কলোনি একটা। সবখানে এখনও বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়নি। আগাছার জঙ্গল বা গাছপালাও রয়ে গেছে।

মোড়ে যেখানে ন্যাড়া দাঁড়িয়েছে, সেখানে শহরের জলের ট্যাংক। উঁচু লোহার ফ্রেমের মাথায় বসানো। হঠাৎ ন্যাড়া দেখল, ওই উঁচুতে রাখা বিশাল ট্যাংকের পেছন দিকে ঘন ছায়ায় ভেতর থেকে একটা লোক সাঁৎ করে বেরিয়ে এল।

লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা। মাথায় চুঁচলো একটা টুপি রয়েছে। তার কাঁধে একটা ভারী ব্যাগ ঝুলছে। ব্যাগটা এক হাতে চেপে সে কুঁজো হয়ে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে উলটোদিকের ইট ও টালিভাটার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

ন্যাড়া লোকটিকে তক্ষুনি চিনতে পেরেছে। আরে। এ তো সেই মুসলমান পাড়ার হেকিমসায়েব!

রাস্তায় ওকে দেখলেই ন্যাড়া তার বন্ধুরা পেছনে লাগে। সুর ধরে চেঁচায়- ও খা-সায়েব! ও খা-সায়েব! একটু দাওয়াই দেবে?

হেকিম বড় বদমেজাজি আর পাগলাটে স্বভাবের লোক। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে ওদের। ন্যাড়ারা তখন হাসতে হাসতে পিছু হটে।

হেকিমসায়েব এমন করে চুপিচুপি ভাটার দিকে কোথায় গেল? ন্যাড়া হাঁ করে তাকিয়ে রইল। বাড়ি যাবার কথা, কমলাক্ষ বা মেধো গুন্ডার কথা—সব ভুলে গেল।

ইট ও টালিভাটাটা এখন পোড়ো হয়ে গেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় পুকুরের মতো গর্ত বা খাল আর ঢিবি রয়েছে। ঢিবিতে জঙ্গল গজিয়েছে। সতুবাবুরা একসময় রোডস ডিপার্টমেন্টের জন্য ইট ও টালি সাপ্লাই দিতে ওখানে ভাটা বানিয়েছিলেন। দুটো মস্তো চিমনি রয়ে গেছে।

হেকিমসায়েব ওখানে ঢুকল কেন? আর ওর ব্যাগে কী এমন ভারী জিনিস আছে যে অমন করে কুঁজো হয়ে পা ফেলছিল সে?

ন্যাড়ার মাথায় এই এক রোগ। তার খেয়াল চড়লে আর জ্ঞানগম্যি থাকে না। সে দৌড়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে দেখার চেষ্টা করল, হেকিমসায়েব যাচ্ছেটা কোথায়? কিন্তু ওদিকটা ঘন অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ হতাশভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ন্যাড়ার সম্বিৎ ফিরল। এদিকটা শীতটাও বেজায় বেড়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঠেকে কাঁপুনিতে অস্থির। ন্যাড়া ওখান থেকে মোড়ে ফিরে এল। তারপর প্রায় চোখ বুজে নির্জন রাস্তা দিয়ে দৌড় লাগাল।

এক দৌড়ে পরের মোড়ে এসে সে ডান দিকে ঘুরল। তারপর গলিরাস্তায়, আরেক দৌড়ে একেবারে বাড়ির দরজায় পৌঁছোল।

রোয়াকে উঠেই সে চেঁচিয়ে উঠল—মা! ওমা!

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে তার মায়ের গলা ভেসে এল—কে রে?

ন্যাড়া ভয়েভয়ে বলল—আমি।

সুনন্দা দরজা খুলেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন—ওগো! ন্যাড়া এসেছে! ন্যাড়া! তারপর ছেলেকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।

ভেতরে রমেনবাবু-ন্যাড়ার বাবা চুপচাপ বসেছিলেন। শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে গর্জে বললেন—ওরে হতভাগা! আয়, মজা দেখাচ্ছি তোর!

ন্যাড়া মায়ের বুকে মিশে আছে। নির্ঘাত বাবা একচোট চড়থাপ্পড় আগে মেরে বসবেন—ব্যাপারটা কত সাংঘাতিক তা বুঝতেই চাইবেন না হয়তো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রমেনবাবুরও চোখে জল। ধরা গলায় বললেন—অমন করে বাড়িপালানো অভ্যাস করলে তুই কি মানুষ হতে পারবি খোকা? দেখো দিকি কাণ্ড। আজ দুদিন ধরে বাড়িতে রান্নখাওয়া বন্ধ!

যাক্, বাবাও কেঁদে ফেলেছেন। ন্যাড়া নিশ্চিন্ত। বাড়িতে খুব সাড়া পড়ে গেছে। দিদি অমিতা ওর গালে চিমটি কেটে গরম জল করতে গেল। বাবা একটা গরম চাদরে ন্যাড়াকে জড়িয়ে ফেললেন। সুনন্দা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন বাড়িময়।

সেই হট্টগোলের সময় হঠাৎ কোত্থেকে শংকরবাবু হাজির।

বাড়ি ঢুকে ন্যাড়াকে দেখে তিনি কয়েকমুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

ন্যাড়া মিটিমিটি হাসছিল।

শংকরবাবুর মুখে কথা ফুটল অবশেষে। বলে ফেললেন—তোকে ওরা ছেড়ে দিল তাহলে? ন্যাড়া বলল—হুঁ, তাই বুঝি? আমি বুদ্ধি করে পালিয়ে এসেছি।

রমেনবাবু ও সুনন্দা অবাক হয়ে বললেন—অ্যাঁ! সে কী কথা!

শংকরবাবু বললেন—সব বলছি। সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ন্যাড়া যে প্রাণে বেঁচে পালিঃ আসতে পেরেছে, এজন্যে ওকে পুরস্কার দেওয়া দরকার।

রমেনবাবু বললেন—আহা! বলবে তো কী হয়েছিল?

শংকরবাবু জবাব দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ ন্যাড়া বলে উঠল—ছোটমামা! একটা কথা শোনো। আমি স্টেশন থেকে আসছি, তখন সতুবাবুদের ভাটার মধ্যে মুসলমানপাড়ার হেকিম লোকটা ভারী ঝোলা কাঁধে নিয়ে চুপিচুপি ঢুকে পড়ল। তারপর…

শংকরবাবু সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছিলেন। বললেন—জামাইবাবু! আমি একটু পরে আসছি। বলে সবাইকে অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর…

নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন

লিটনগঞ্জের বাজার এলাকা বাদে রাত নটা না বাজতে বাজতেই এই শীতে সবগুলো পাড়া নিশুতি নিঃঝুম হয়ে পড়ে। বাজারেও অবশ্যি খাঁ খাঁ অবস্থা। কিছু কিছু দোকান খোলা এবং লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে বাতি কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। এই নির্জন নিঃঝুম রাস্তায় পুলিশ সুপারের জিপ এগিয়ে চলেছে স্টেশনরোডের দিকে। একটু পেছনে চলেছে। একটা মস্তো পুলিশভ্যান। তাতে বসে রয়েছেন সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর কয়েকজন অফিসার।

জিপে আছেন পুলিশ সুপার অজিতেশ, কর্নেল আর শংকর।

শংকরের মুখে খবর পেয়েই এই অভিযান। সতুবালাদের পোড়ো ইটভাটার দিকে ঘুরপণে এগিয়ে চলেছেন ওঁরা।

জলের ট্যাংকের কাছে পৌঁছে কথামতো পুলিশভ্যান থামল। সশস্ত্র সেপাইরা আর অফিসাররা নিঃশব্দে ইটভাটার চারদিক ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলেন অন্ধকারে। ঝোপে জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে শিকারি বাঘের মতো ওরা পা বাড়ালেন।

জিপটা একটু তফাতে রেখে কলে, শংকর আর অজিতেশ দ্রুত এগিয়ে চললেন ভাটার দিকে।

বিশাল পোড়োভাটায় খানাখন্দ, ঢিবি, আর চিমনির কথা আগেই বলা হয়েছে। পুরো এলাকা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। তার ওপর কুয়াশা।

ভাটায় ঢোকার জন্য সরু একফালি পথ আছে। সে-পথে ইতিমধ্যে ঘাস ও জঙ্গল গজিয়েছে। কিন্তু পথটায় খোয়া বিছানো থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিছুটা এগিয়ে কর্নেল থমকে

দাঁড়ালেন।

ফিসফিস করে বললেন—এই ভাটার নিশ্চয় একটা অফিসঘর ছিল। সেটা কাছাকাছি থাকা উচিত।

অজিতেশ বললেন—হা। দিনে এখান দিয়ে যেতে চোখে পড়েছে বটে। মনে হচ্ছে সামনে ঢিবিমতো জায়গায় দরমার বেড়ার কয়েকটা ঘর আছে।

শংকর বললেন—টর্চ জ্বেলে দেখে নিলে হত।

কর্নেল বললেন—মাথা খারাপ? অন্ধকারেই এগুতে হবে। এ ব্যাপারে আমার অবশ্যি অসুবিধে হয় না। কেন না, বনেজঙ্গলে বহুবার রাতবিরেতে জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলতে যাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। তোমরা আমার পেছনে-পেছনে এস।

এসব কথা ফিসফিস করেই বলাবলি করছিলেন তিনজনে। খানিকটা এগিয়ে অন্ধকারে আবছা একটা উঁচু জায়গা নজরে এল। খোয়াবসানো পথটা সোজা সেখানে উঠে গেছে। হ্যাঁ, ওই তো ভাটার সেই অফিসগুলো সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ তিনজনেই থমকে দাঁড়ালেন। একটা আলো জ্বলে উঠল কোথাও। হয়তো ওই ঘরের মধ্যেই দরমাবেড়ার দেয়ালের কোনও ফাটল দিয়েই আলোটা দেখা যাচ্ছে বুঝি।

পা টিপে টিপে তিনজনে আলোটা লক্ষ করে এগুতে থাকলেন। সেই সময় কী একটা জন্তু দৌড়ে পালিয়ে গেল ঝোপঝাড় ভেঙে। শেয়াল-টেয়াল হেবে। দরমাবেড়ার ঘরগুলোর পেছনে ঘন ঝোপ গজিয়েছে। সেই ঝোপে ঢুকে একটা ফাটলে কর্নেল উঁকি মারতে যাচ্ছেন, এমন সময় ঘরের ভেতর চাপা গলায় কে কথা বলে উঠল-লতিফ খা! তোমায় এখনও সাবধান করে দিচ্ছি, পবিত্র ওই মণি তোমার পাপের হাতে ছোঁবার চেষ্টা কোরো না। সর্বনাশ হবে!

কী অবাক! এ তো সেই পিরের মাজারের জাদুকর ফকিরের গলা!

দরমাবেড়ার দেয়ালের অবস্থা আঁঝরা। এখন তিনজনে তিনটে ফাটলে চোখ রেখেছেন। ভেতরে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন।

কালো আলখাল্লাধারী ফকির দাঁড়িয়ে আছে মেঝেয়। তার সামনে উবু হয়ে বসে আছে হেকিম লতিফ খাঁ। তার চোখেমুখে একটা ক্রুর ভঙ্গি। তার হাতের কাছে সেই ঐতিহাসিক কালো পেটিকা বা ছোট্ট বাকসোটা রয়েছে।

আর তার চেয়েও সাংঘাতিক, পেটিকার পাশে আজিমুদ্দিনের মমি-মুণ্ডুটা রয়েছে।

হেকিমের হাতে একটা সুচের মতো সূক্ষ্ম মিহি জিনিস। সে ফকিরের কথার জবাবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। –এ আমার বংশের সম্পদ। আমারই প্রাপ্য; ওসব ভয় আমায় দেখিও না। তাছাড়া তুমি তো বাপু সংসারত্যাগী ফকির, তোমার এসব বাজে ব্যাপারে নাক গলানোর দরকারটা কী? যাও! এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও! নৈলে তোমাকেও জবাই করে ফেলব!

বলে লতিফ খাঁ বাঁ হাতে একটা মস্ত ছোরা বের করে উঁচিয়ে ধরল।

ফকির এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল—আমি জানি তুমি তা পারবে। তুমি ছদ্মবেশী শয়তান! জায়গিরদার বংশের কলঙ্ক তুমি! কিন্তু এখনও সাবধান করে দিচ্ছি লতিফ খাঁ, ওই মণি স্বর্গের বস্তু। মিশরের সাধক আজমশাহ কঠোর সাধনায় ওই রত্ন আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন এক দেবদূতের কাছে। দোহাই তোমার, যদি বাঁচতে চাও-পেটিকা খুলো না!

লতিফ খাঁ বাঁকা হেসে বলল—এটার মধ্যে নিছক একটা নীলকান্ত মণি আছে—পুরুষানুক্রমে আমরা শুনে আসছি। কিন্তু কেউ আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পায়নি বলেই মণিটা হাতাতে পারেনি! এতদিনে আমার পূর্বপুরুষের সম্পদ আমি হাতিয়েছি। তুমি…

বাধা দিয়ে ফকির বলল—কিন্তু কবরের সন্ধান আমিই তোমায় দিয়েছিলুম লতিফ খাঁ! ওঃ! কী ভুলই না করেছিলুম!

লতিফ খাঁ বলল—কীসের ভুল? তুমি ঠিকই করেছিলে! কিন্তু মাঝখানে ব্যাটা কমলাক্ষ কী ভাবে টের পেয়ে বাগড়া দিয়েছিল। তাকে তো এবার পুলিশ ধরবেই! ইতিমধ্যে মণিটা নিয়ে আমি ইরানে পালিয়ে যাব। তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও, বলো। হা—তোমাকে আমি এই মণিবেচার টাকার কিছু ভাগ দিতে রাজি আছি।

ফকির বলল-লতিফ খাঁ! বাচালতা কোরো না। আবার বলছি, তুমি ওই মমি-মুণ্ডু আর বাকসো কবরে রেখে এস গে। ওঠো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। কবরের ওখানে পুলিশ সারাক্ষণ–পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি এরকম বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি করতে জানি। সেই ধোঁয়ার দাপটে পুলিশ দূরে সরে যাবে। সেই সুযোগে ঝটপট দুজনে কবরের মধ্যে এগুলো রেখে আসব।

লতিফ খাঁ তেমনি বিদঘুটে খ্যাক খ্যাক হাসি হেসে হেসে বলল—চুপ! এই দেখো, তোমার সামনেই আমি পেটিকা খুলছি। আমার পূর্বপুরুষের ঐশ্বর্য দেখে চোখ দুটো সার্থক করো, ফকিরসায়েব!

বলে সে সুচের মতো চাবিটা বাক্সের একস্থানে চেপে ধরল। ফকির দু হাত তুলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—লতিফ খা! সাবধান!

কর্নেল, অজিতেশ ও শংকর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। অবাক হয়ে এবার দেখলেন, কালো পেটিকার ওপরের অংশ আস্তে আস্তে ঠেলে উঠছে। তার এক বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকল।

পেটিকার ফাঁক দিয়ে অত্যুজ্জ্বল নীল আভা ঠিকরে বেরুতে লাগল। ঘরের ভেতর নীল তীব্র আলো পড়তে থাকল।

আবার ফকিরের চিৎকার শোনা গেল—হুঁশিয়ার লতিফ খাঁ! পালিয়ে এস! পালিয়ে এস!

তারপর ফকির এক লাফে বাইরে গিয়ে পড়ল। আর পেটিকার ওপরের অংশ খাড়া হয়ে ওঠার পর দেখা গেল, গোলাকার একটুকরো নীল উজ্জ্বল বস্তু রয়েছে ভেতরে এবং ঘরের ভেতরে সুতীব্র নীল আলোর ঝলকানি। লতিফ খাঁ দুচোখে আতঙ্ক ঠিকরে পড়ছে। সে স্থির হয়ে গেছে।

তারপর ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। নীল মণিটা একটু করে শূন্যে ভেসে উঠতে থাকল। কিন্তু লতিফ খাঁ তেমনি স্থির। যেন নীলরঙের একটা মমি হয়ে গেছে সে।

নীল মণিটা এবার শূন্যে ভেসে দরজার দিকে চলল। বাইরে ফকিরের চিৎকার শোনা গেল ফের—হুশিয়ার! হুশিয়ার!

কর্নেল, অজিতেশ আর শংকর একলাফে ঘরের সামনের দিকটায় চলে গেলেন। তারপর দেখলেন, নীলবর্ণ উজ্জ্বল সেই মণি নক্ষত্রের মতো ভেসে চলেছে ভাটার ওপর। সারা এলাকা তীব্র নীল বৈদ্যুতিক আলোয় ভরে গেছে।

তারপর হঠাৎ মণির গতিবেগ বাড়ল। হু হু করে আকাশে উঠে পড়ল। তারপর প্রচণ্ড বেগে নক্ষত্রের দিকে উড়ে চলল। দেখতে দেখতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা আকাশের নক্ষত্রলোকে মিলিয়ে গেল। আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক।

তিনজনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। এবার কর্নেল বলে উঠলেন— লতিফ খাঁর সাড়া নেই কেন? বলে টর্চ জ্বেলে ঘরের ভেতর আলো ফেললেন।

লতিফ খাঁ তেমনি হাঁটু দুমড়ে স্থির হয়ে বসে আছে। কর্নেল ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন—লতিফ খাঁ! লতিফ খাঁ! তার দুপাশে শংকর ও অজিতেশ এসে দাঁড়ালেন।

পেছন থেকে ফকিরের গলা শোনা গেল—লতিফ খাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কর্নেল সায়েব!

ফকির দৌড়ে এসে তার লম্বা চিমটেটা লতিফ খাঁয়ের গায়ে ঠেকাতেই সবাই স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন গুঁড়ো গুঁড়ো একরাশ জমাট ছাই ছাড়া ওই দেহটা আর কিছুই নয়। ফকির কালো পেটিকা আর মমি-মুণ্ডটা দু হাতে তুলে নিয়ে বলল—আর কী? চলুন সবাই এগুলোকে আজিমুদ্দিনের কবরে রেখে আসি।…

দরমাবেড়ার ঘরের মধ্যে লোভী লতিফ খায়ের ভস্মীভূত মৃতদেহ পড়ে রইল। ওঁরা সবাই ভাটা থেকে রাস্তায় গিয়ে পৌঁছলেন।

অজিতেশ এবার হুইসল বাজিয়ে পুলিশ বাহিনীকে ফেরার সংকেত দিলেন। ভাটার চারদিক। ঝোপের আড়ালে বসে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য সবাই দেখেছে! এবার নিঃশব্দে একে একে ফিরে আসছিল।

এবার জিপ ও ভ্যান এগিয়ে চলল স্টেশনের ওধারে সেই পোড়ড়া জমিতে বটতলার দিকে—যেখানে বালক আজিমুদ্দিনের কবর আছে। ফকির জিপের সামনে কর্নেলের পাশে বসে আছে। তার কোলের ওপর মমি-মুণ্ড আর কালো পেটিকা।

যেতে-যেতে কর্নেল একবার শুধু বলে উঠলেন—এই বিরাট পৃথিবীতে এখনও কত রহস্য রয়েছে, বিজ্ঞান তার সীমানায় যেতে পারেনি। তবে যাই বলি না কেন, এত রহস্য আছে বলেই জীবনটা এত লোভনীয় এবং বরণীয়।

ফকির অস্পষ্টস্বরে বিড়বিড় করে কী মন্ত্রপাঠ করতে থাকল। আর কেউ কোনও কথা বললেন না।….

.

তখন ন্যাড়া মায়ের পাশে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে সে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিল।

আকাশ থেকে একটা নীলরঙের উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়ল। স্টেশনের ওপাশের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সে। দৌড়ে যেই নক্ষত্রটা কুড়োতে গেছে, অমনি ফের সেটা উড়ে চলেছে। দুঃখিত মনে ন্যাড়া দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নীল নক্ষত্রটা আকাশে ভেসে গিয়ে একস্থানে আটকে যেতেই ন্যাড়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

সুনন্দা ডাকছিলেন—ন্যাড়া! ও নেড়ু! কঁদছিস কেন? স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি! ন্যাড়া জেগে উঠেছে! জবাব না দিয়ে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দিল। আজ রাতে শীতটাও বড্ড পড়েছে। কুঁকড়ে আরামে শুয়ে রইল। কিন্তু স্বপ্নটা তার মন খারাপ করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *