আজব বলের রহস্য

আজব বলের রহস্য – কিশোর কর্নেল সমগ্র ৪ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

“এক কিলো তুলো ভারী, না এক কিলো লোহা ভারী?” ষষ্ঠীচরণ ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে চলে যাচ্ছিল। এই বেমক্কা প্রশ্নে হকচকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “আজ্ঞে বাবামশাই?”

তার বাবামশাই’ মানে, আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চোখ কটমটিয়ে বললেন, “এক কিলো তুলো আর এক কিলো লোহার মধ্যে কোনটা বেশি ভারী?”

ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল, “নোহা।” সে সবসময় ‘ল’-কে নি’ এবং ‘ন’-কে ‘ল’ করে ফেলে।

আমি হোহো করে হেসে ফেললুম। ষষ্ঠী গাল চুলকোতে-চুলকোতে সম্ভবত ভুলটা খোঁজার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, “ঠিক বলেছিস। বকশিস পাবি।”

ষষ্ঠী খুশি হয়ে চলে গেল। কর্নেল পেয়ালায় কফি ঢালতে থাকলেন। মুখে সিরিয়াস ভাবভঙ্গি। আমি একটু ধাঁধায় পড়ে গেলুম। কর্নেল আমার হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে বলল, “ষষ্ঠী কিন্তু ঠিক বলেনি।”

“বলেছে।”কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “তুমি কী বলতে চাইছ জানি, জয়ন্ত। এ-ধরনের প্রশ্নকে আগের দিনে বলা হত ‘জামাই-ঠকানো প্রশ্ন’! এক কিলো তুলো আর এক কিলো লোহা। দুটোরই ওজন যখন এক, তখন একটা আর-একটার চেয়ে ভারী হতে পারে না। ঠিক কথা। কিন্তু সত্যিই তুলোর চেয়ে লোহা অনেক ভারী জিনিস। আয়তন ডার্লিং, আয়তন! তুমি আয়তনের কথাটা ভুলে যাচ্ছ। আমরা যখন কোনো বস্তুকে দেখি, আগে সেটার আয়তনই চোখে পড়ে। এক কিলো তুলোর যা আয়তন, তা যদি লোহার হয়, তা হলে লোহাটাই বেশি ভারী নয় কি?”

বিরক্ত হয়ে বললুম, “কিন্তু ভারী বলতে তো ওজনই বোঝায়।”

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “। তবে ভুলে যাচ্ছ, আমরা আয়তন বাদ দিয়ে কোনো বস্তুকেই কল্পনা করতে পারি না। একটু তলিয়ে ভাবা দরকার জয়ন্ত! বস্তুর যেমন ওজন আছে, তেমনই আয়তনও আছে।”

“আপনার যুক্তির মাথামুণ্ডু নেই। আমি দুঃখিত।”

কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, “আচ্ছা জয়ন্ত, সমান আয়তনের কোনো ধাতু, ধরো, একটা ক্রিকেটবলের সাইজ লোহা, সোনা আর সিসের মধ্যে কোনটা বেশি ভারী?”

একটু ভেবে বললুম, “সম্ভবত সোনা।”

“হুঁ, সোনা। আমরা সচরাচর যেসব জিনিস হাতে নাড়াঘাটা করে থাকি বা মোটামুটিভাবে হাতের কাছে পাই, তাদের মধ্যে সোনা সবচেয়ে ভারী এবং সেটা আয়তনের দিক থেকে।” বলে কর্নেল হেলান দিলেন এবং চোখ বন্ধ। সাদা দাড়ি এবং চওড়া টাকে বাঁ হাতটা পর্যায়ক্রমে বুলোতে থাকলেন। এটা ওঁর চিন্তাভাবনার লক্ষণ।

বললুম, “ব্যাপারটা কী? আজ সকালবেলায় হঠাৎ এসব নিয়ে মাথাব্যথার কারণ কী বুঝতে পারছি না।”

কর্নেল একই অবস্থায় থেকে বললেন, “ওই শোনো ডার্লিং! দোতলায় লিন্ডার প্রিয় কুকুর রেক্সি চেঁচামেচি জুড়েছে। সিঁড়িতে ধুপধুপ ভারী পায়ের শব্দ। এবার কলিং বেল বাজাটা অনিবার্য।” বলে হাঁকলেন, “ষষ্ঠী!” এবং চোখ খুলে সিধে হয়ে বসলেন।

সত্যিই কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠীর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপর কর্নেলের এই জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে দু’টি মূর্তির আবির্ভাব ঘটল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম।

একজন মাঝারি গড়নের ছিমছাম চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরনে ধুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবি। অন্যজন একেবারে দানো বললেই চলে। পেল্লায় গড়নের পালোয়ান। পরনে হাফপেন্টুল ও স্পোর্টিং গেঞ্জি। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গলায় চাঁদির তক্তি। তার মাথায় একটা ছোট্ট চটের থলে, যে-ধরনের থলেতে বাজার করা হয়। থলের মুখটা দড়ি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা আছে। পালোয়ান লোকটি দু’টি পেশিবহুল হাতে থলেটি ধরে আছে এবং এই মোলায়েম এপ্রিলে সে দরদর করে ঘামছে, টলছে এবং হাঁফাচ্ছে। ফেস-ফোঁস শব্দ ছাড়ছে নাক-মুখ থেকে।

ভেবেই পেলুম না একটা তোবড়ানো থলের ভেতর কী ওজনদার জিনিস আছে যে এমন পেল্লায় গড়নের মানুষকে কাহিল হতে হয়েছে।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, “কী রে ভোঁদা? দাঁড়িয়ে থাকবি, না নামাবি?”

পালোয়ান হাঁসফাঁস শব্দে বলল, “ধরতে হবে।”

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “জয়ন্ত! এসো, আমরা ওকে একটু সাহায্য করি। ভবেশবাবু, মনে হচ্ছে আপনাকেও হাত লাগাতে হবে। ষষ্ঠী! তুইও আয়।”

ষষ্ঠী দরজার পরদায় উঁকি মেরে পিটপিটে চোখে ব্যাপারটা দেখছিল। এগিয়ে এল। তারপর আমরা সবাই মিলে পালোয়ানের মাথা থেকে চটের থলেটি নামিয়ে টেবিলে রাখলুম।

বলছি বটে নামিয়ে রাখলুম, যেন আস্ত একটা পাহাড়কে কাত করে ফেললুম। থলের ভেতরে কী আছে কে জানে, মনে হল, অন্তত পাঁচ কুইন্টালের কম নয় সেটির ওজন। টেবিলটা যে মড়মড় করে ভেঙে গেল না, এটাই আশ্চর্য! তবে টেবিলে রাখার সময় বাড়িটাই যেন ভূমিকম্পে নড়ে উঠল। অবশ্য মনের ভুল হতেও পারে।

কর্নেল থলে খুলতে ব্যস্ত হলেন। পালোয়ান মেঝের কার্পেটে বসে হুমহাম শব্দে বলল, “ফ্যান! ফ্যান! জল!”

ষষ্ঠী ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিল। তারপর জল আনতে দৌড়ল। ততক্ষণে কর্নেল দড়ি খুলে থলেটা ফাঁক করেছেন। দেখলুম, থলের ভেতর ক্রিকেটবলের সাইজের কালো একটা জিনিস। অবাক হয়ে বললুম, “এই জিনিসটা এত ভারী? কী এটা?”

ভবেশবাবু সোফায় বসে বললেন, “সেটাই তো রহস্য মশাই! তবে তার চেয়ে বেশি রহস্য, আমার বাথরুমে জিনিসটার আবির্ভাব।”

যে-টেবিলে আজব বলটি রাখা হয়েছে, সেটি কর্নেলের রিসার্চ-ক্ষেত্র বললে ভুল হয় না। টেবিলটি এতদিন ধরে দেখে আসছি। কিন্তু সেটি যে এমন শক্তিশালী তা এই প্রথম জানতে পারলুম। অমন ওজনদার জিনিসের চাপে একটুও মচকাল না। কর্নেল ড্রয়ার থেকে আতসকাঁচ বের বের করে ততক্ষণে খুঁটিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছেন। এদিকে পালোয়ান পর-পর তিন গ্লাস জল খেয়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে। ভবেশবাবু খুব আগ্রহের সঙ্গে কর্নেলের দিকে লক্ষ রেখেছেন।

আমি ভবেশবাবুকে বললুম, “প্লিজ, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি?”

ভদ্রলোক একটু বদরাগী অথবা উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। যে-জন্যই হোক, খ্যাক করে উঠলেন। “ওই তো বললুম মশাই! রহস্য! আর রহস্য বলেই কর্নেলসায়েবের কাছে আসা।” বলে কর্নেলের দিকে তাকালেন। “কিছু আঁচ করতে পারলেন স্যার?”

কর্নেল আতশকাঁচ রেখে সোফার কাছে জানালার ধারে তাঁর ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। বললেন, “আপাতত কিছু বোঝা যাচ্ছে না ভবেশবাবু! জিনিসটা সত্যিই রহস্যময়। কিছুটা সময় লাগবে।”

ভবেশবাবু বললেন, “বেশ তো! যত ইচ্ছে সময় নিন। তবে স্যার, সত্যি বলতে কী, ওই বকশিশ জিনিস আমার ফেরত নিয়ে যেতেও আপত্তি আছে! বাস্! গতকাল বিকেলে বাথরুমে ওটা আবিষ্কারের পর থেকে যা-সব ঘটেছে, সবই তো আপনাকে টেলিফোনে বলেছি।”

পালোয়ান এতক্ষণে মেঝে থেকে উঠে সোফায় বসল। তার ওজনও কম নয়। সোফা মচমচ শব্দে কেঁপে উঠল। সে বলল, “ভূতুড়ে জিনিস স্যার! মামাবাবুকে এত বলছি, কানে করছেন না। নির্ঘাত ওটা ভূতের ঢিল।”

কর্নেল বললেন, “ঠিক। ভূতটা সারারাত ঢিলটা ফেরত নিতে বাড়ি চক্কর দিয়েছে। নানারকম ভয়-দেখানো আওয়াজ করেছে। তাই না ভবেশবাবু?”

ভবেশবাবু বললেন, “হ্যাঁ স্যার! সারারাত ঘুমোতে পারিনি। জানলার বাইরে ফিসফিস। দরজায় টোকা। বাগানে শাঁইশাঁই ঘূর্ণি হাওয়া। তারপর ছাদে বেহালার বাজনা! আমার অমন দাপুটে অ্যালসেশিয়ান টারজন, স্যার, সে পর্যন্ত ভয়ে কুঁকড়ে কাঠ।”

পালোয়ান ভেদা বলল, “আর সেই ঝনঝন শব্দটা, মামাবাবু? সেটার কথা বলুন!”

“হ্যাঁ, ঝনঝন শব্দ।” ভবেশবাবু চাপা গলায় বললেন, “ঘুম ভেঙে প্রথমে ভাবলুম, পাড়ায় কোথায় মাইকে খত্তাল বাজছে। পরে বুঝলুম, না–অন্য কিছু।”

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “ভূতের কেত্তন!”

পালোয়ান সোফা কাঁপিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসতে লাগল। তারপর তার মামাবাবুর ধমক খেয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। আমি ওকে বললুম, “ভোঁদাবাবু! আপনি তো ব্যায়ামবীর..”।

পালোয়ান ঝটপট বলল, “আমার নাম জগদীশ। তবে আপনি ব্যায়ামবীর বললেন, সেটা ঠিকই। গত বছর স্টেট মা এগজিবিশনে ওই টাইটেল পেয়েছি।”

বলে সে ডান হাত তুলে তাগড়া-তাগড়া পেশি ফুলিয়ে নমুনা দেখাল। দেখার মতো বস্তু হলেও আমার কেন যেন অস্বস্তিকর লাগে। মানুষের শরীরকে মানুষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিকট করে তোলে এবং সেজন্য খেতাবও জুটে যায়! একে দেহসৌষ্ঠব বা সৌন্দর্য বলে প্রশংসাও করা হয় শ্রী’ শব্দ সহযোগে। ব্যাপারটার মানে বুঝি না। কিন্তু কর্নেল জগদীশ ওরফে ভোঁদার পেশি-প্রদর্শনীর তারিফ করে বললেন, “অসাধারণ।”

আর অমনি পালোয়ানটি উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা অঁক শব্দ করে শরীর বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়াল, যেমনটি ‘দেহশ্রী’-ক্যাপশনযুক্ত ছবিতে দেখা যায়। ষষ্ঠী ফের অতিথিদের জন্য কফি-টফি আনছিল। থমকে সভয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

ভবেশবাবু ধমক দিলেন, “খুব হয়েছে। আর বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নেই। কাল রাত্তিরে কোথায় ছিল পালোয়ানি? ঠকঠক করে কেঁপে মা-মা-মা-মা করে আমাকে জড়িয়ে ধরে..!”

কাঁচুমাচু হেসে পালোয়ান বসল। বলল, “মানুষ তো নয়! মানুষ হলে এক আছাড়ে ছাতু করে ফেলতুম। ভূত-প্রেতের সঙ্গে পারা যায়? ওদের তো বডি নেই।”

কর্নেল বললেন, “যাই হোক, খুব মেহনত করেছ তুমি। কফি খেয়ে চাঙ্গা হও।”

“কফি-চা এসব আমার মানা।” পালোয়ান বলল, “তবে কর্নেল-সার, ইওর অনার।” বলে সে কফির পেয়ালা তুলে একটানে গরম কফি গিলে ফেলল। তারপর স্ন্যাক্সের সবটাই প্রকাণ্ড দুই হাতের চেটোয় তুলে মুখে ভরল।

ভবেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমিও ভাগনেবাবাজির মতো চা-কফি খাই না। আর মনের যা অবস্থা, খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। আমি উঠি স্যার! আপনি এই রহস্যের কিনারা করুন।”

মামা-ভাগনে চলে যাওয়ার পর বললুম, “তা হলে আপনার লোহা ভারী না তুলো ভারীর রহস্যের সূচনাটা বোঝা গেল। কিন্তু সবটা খুলে না বললে মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে!”

কর্নেল হেলান দিয়ে বসে নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, “ওই ভদ্রলোক, ভবেশবাবু একজন লোহালক্কড়ের ব্যবসায়ী। দোকান বড়বাজারে। বাড়ি দমদম এলাকায়। গত পরশু একটা লোক ওঁর দোকানে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে ওই জিনিসটা বেচতে নিয়ে গিয়েছিল। উনি লোহা ভেবে ওটা ওজন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওজনে সাঙ্তিক ভারী এবং জিনিসটা লোহাও নয়। তাই কেনেননি। হঠাৎ নাকি গতকাল দুপুরে ওঁর স্ত্রী বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে জিনিসটা মেঝেয় দেখতে পান। তিনিও নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অবাক হন। ওঁকে ফোন করেন। তারপর যা ঘটেছে, তুমি তো শুনলে।”

“কিন্তু তা হলে তো রহস্যটা অনেক বেশি বেড়ে গেল দেখছি!”

“হুঁ। আমাদের হালদারমশাইয়ের ভাষায় বলা চলে প্রচুর রহস্য!”

হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কে. কে. হালদারের কথা শুনে বললুম, “আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। ভবেশবাবুর বাড়িতে যা-সব ঘটেছে, তার রহস্যভেদে হালদারমশাইকে লাগিয়ে দিন। আর জিনিসটা কী, সেটা জানার জন্য বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তই যথেষ্ট। খবর পেয়েছি, উনি বনে কী একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে যোগ দিয়ে সদ্য কলকাতা ফিরেছেন।”

কর্নেল হাসলেন। “তোমার প্ল্যান আমার মাথায় অনেক আগেই এসেছে, ডার্লিং! সাড়ে ন’টা বাজে। চন্দ্রকান্তবাবুর আসার সময় হয়ে গেল। হালদারমশাই এতক্ষণ ছদ্মবেশে ভবেশবাবুর বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরছেন আশা করি। একটু অপেক্ষা করো।”

“একটা ব্যাপার অদ্ভুত লক্ষ করছি।”

“একটা কেন জয়ন্ত, সবটাই।”

“না…মানে, আমি বলতে চাইছি, যে-লোকটা ভবেশবাবুকে ওই জিনিসটা বেচতে গিয়েছিল, তার হাত থেকে কেন এবং কী করে ওটা ভবেশবাবুর বাথরুমে ঢুকে পড়ল?”

“এ-বিষয়ে তোমার কী ধারণা, শুনি।”

“লোকটা কোনো অজানা কারণে জিনিসটা ভবেশবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল এবং তা দিয়েছে।”

এই সময় কলিং বেল বাজল। তারপর বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চৌধুরী হন্তদন্ত ঘরে ঢুকে দমফাটানো গলায় বললেন, “স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি পঞ্চান্ন পয়েন্ট ছয়! ভাবতে পারেন? তামার আট পয়েন্ট নয়। সিসের এগারো পয়েন্ট চৌত্রিশ। সোনার উনিশ পয়েন্ট তিরিশ। ইউরেনিয়ামের প্রশ্ন তুলছি না। কারণ খালি হাতে তেজস্ক্রিয় ধাতু ঘাঁটা বিপজ্জনক। কিন্তু পৃথিবীর কোনো ধাতুর আপেক্ষিক গুরুত্ব অত বেশি হতেই পারে না। পঞ্চান্ন পয়েন্ট ছয়! আমার মাথা বনবন করে ঘুরছে। পশ্চিম জার্মানির বন থেকে ফিরে এই বনবন করে মাথা ঘোরা। ধুস!”

বেঁটে গাবদাগোবদা মানুষ, চিবুকে নিখুঁত তিনকোনা দাড়ি, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ধপাস করে সোফায় বসলেন। কর্নেল প্যাটপেটে চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, “জিনিসটা আপনি তো দেখেননি। হাতে পাওয়া দূরের কথা। তা হলে কী করে ওটার আপেক্ষিক গুরুত্ব হিসেব করলেন চন্দ্রকান্তবাবু?”

বিজ্ঞানীপ্রবর দাড়ি চুলকে ফিক করে হাসলেন। “ও! গোড়ার কথাটা বলাই হয়নি। দিন-তিনেক আগে রেডারে টের পেলুম কী-একটা খুদে জিনিস কলকাতার আকাশে এদিক-সেদিক করে বেড়াচ্ছে। তক্ষুনি কমপিউটারের সামনে বসে পড়লুম। বড্ড ফিচেল জিনিস মশাই! ঠিক আপনার ওইসব প্রজাপতির মতো। চিন্তা করুন, ছটফটে রংচঙে বিরল প্রজাতির প্রজাপতি দেখলে আপনার কেমন অবস্থা হয়।”

টিপ্পনি কাটলুম, “কর্নেল খাঁটি পাগল হয়ে যান তখন।”

“ঠিক তাই,– বিজ্ঞানী সায় দিলেন। “আমার অবস্থাও তাই হয়েছিল। ওটাকে ফলো করতে-করতে দক্ষিণ-পশ্চিমে থিতু হতে দেখলুম। আলট্রাসোনিক রে পাঠিয়ে জানলুম, একরকম শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করছে ওটা। সেই শব্দতরঙ্গের সূত্রে অপেক্ষিক গুরুত্ব মাপা হয়ে গেল। সারারাত তাই নিয়ে হিসেবনিকেশ করেছি। সকালে হঠাৎ আপনার ফোন। যাই হোক, জিনিসটা কি এসে গেছে?”

কর্নেল বলার আগে আমি বললুম, “ওই দেখুন।” চন্দ্রকান্ত তড়াক করে উঠে টেবিলের কাছে গেলেন। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা নানারকম যন্ত্র বের করে ওটার গায়ে ঠেকাতে থাকলেন। সেই সঙ্গে নোটবই বের করে খসখস করে কীসব লিখেও নিলেন। শেষে বললেন, “হু। আশ্চর্য! জিনিসটা একটা অপার্থিব ধাতু। কোনো গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছে পৃথিবীতে। এটা আমার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া দরকার।”

বললুম, “কিন্তু নিয়ে যাবেন কী করে? সাঙ্ঘাতিক ওজন। আপনার রোবট ধুন্ধুমারকে সঙ্গে আনা উচিত ছিল।”

“ধুন্ধু’র আজকাল বড় দুষ্টুমি জেগেছে, বুঝলেন?” বিজ্ঞানী গম্ভীর হয়ে বললেন, “এটা পেলে হয়তো ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দেবে। আসলে আজকাল চারদিকে যেরকম ক্রিকেট নিয়ে বাড়াবাড়ি! ধুন্ধু’র দোষ নেই। বাগান থেকে খেলার মাঠটা দেখা যায়। ক্রিকেটবল অনেক সময় বাগানে এসে পড়ে। ধুন্ধু কুড়িয়ে ছুঁড়ে দেয়। হতভাগা এক্কেবারে ভুলে গেছে যে, সে মানুষ নয়, মেশিন। মানুষের মধ্যে বেশিদিন থাকলে যা হয়!”

কর্নেল বললেন, “তা হলে ওটা ট্রাকে চাপিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাক। নাকি ভবেশবাবুর পালোয়ান ভাগনেকে ওবেলা আসতে বলব? সে-ই কিন্তু জিনিসটা এতদূর বয়ে এনেছে।”

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত একটু হেসে বললেন, “বিকল্প ব্যবস্থা না করেই কি এসেছি ভাবছেন?” তিনি একটা ইঞ্চি ছয়েক লম্বা যন্ত্র দেখালেন। “দেখতে পাচ্ছেন? বলুন তো এটা কী?”

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা দোলালেন।

“এ. জি. এল.। আমার আবিষ্কার।” চন্দ্রকান্ত হাসলেন। “মহাকাশের কোথাও দাঁড়িয়ে এটার সাহায্যে পৃথিবীকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি মশাই! অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি লিফটার। যা-তা জিনিস নয়। এটা দিয়ে যদি জয়ন্তবাবুকে ছুঁই, উনি ভরহীন এবং ওজনহীন হয়ে পড়বেন।”

বললুম, “বাঃ! বেশ মজা তো!”

“মজা!” বাঁকা হেসে বিজ্ঞানী বললেন, “ভরহীন হলে কী অবস্থা হবে, বুঝতে পারছেন? ওজনহীন হলে না-হয় পাখির মতো উড়ে বেড়াবেন। কিন্তু ভরহীন হলে? পরমাণু কেন, স্রেফ কণিকা-উপকণিকা হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থায় স্পেসে বিলীন হয়ে যাবেন। আপনার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

আঁতকে উঠে বললুম, “সর্বনাশ!”

চন্দ্রকান্ত আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে বললেন, “ফোটনেও পরিণত হতে পারেন।”

কর্নেল বললেন, “চন্দ্রকান্তবাবু, তা হলে আপনার এ. জি. এল. ওই আজব বলটি ছুঁলে তো কেলেঙ্কারি!”

“না। এই লাল সুইচটা দেখছেন। এটা পদার্থের ভরকে জিরোতে পরিণত করে। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আমি একটু জোক করছিলুম। যাই হোক, এই সুইচটা টিপব না! টিপব এই সাদা সুইচটা। এটা ওজনকে জিরো করে দেবে। ভর এবং ওজনের মধ্যে সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। অথচ দেখুন, এই শর্মা সেই অসাধ্যসাধন করেছে।” বলে চন্দ্রকান্ত থলের মুখটা খুলে আজগুবি বলটার গায়ে যন্ত্রটা চেপে ধরলেন।

অমনি একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।

বিদঘুঁটে বলটা শূন্যে ভেসে উঠল এবং বাঁই করে খোলা জান.. দিয়ে উধাও হয়ে গেল। চন্দ্রকান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, “যাঃ! পালিয়ে গেল! পালিয়ে গেল!” তারপর জানলায় গিয়ে উঁকি দিলেন।

কর্নেলের গলায় সবসময় বাইনোকুলার ঝোলে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলায় গিয়ে বাইনোকুলার চোখে তুললেন। তারপর সেখান থেকে ব্যস্তভাবে ছাদের সিঁড়ির দিকে চললেন।

ছাদে কর্নেলের বাগান, গোয়েন্দাপ্রবর হালদারমশাই যেটির নাম দিয়েছেন শূন্যোদ্যান। সেখানে অদ্ভুত, বিকট, বিদঘুঁটে গড়নের সব উদ্ভিদ। ক্যাকটাস, অর্কিড, আরও কত বিচিত্র গাছপালা। সেই শূন্যোদ্যানে পৌঁছে দেখলুম চন্দ্রকান্ত তার যন্ত্রগুলোর এটা টিপছেন, ওটা টিপছেন এবং কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে পশ্চিমের আকাশ দেখছেন। এপ্রিলের উজ্জ্বল নীল আকাশে অবাধ শূন্যতা। দেখতে দেখতে চোখ টাটিয়ে গেল আমার।

একটু পরে বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “মনে হচ্ছে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ায় গেল। ওখানে প্রচুর লোহালক্কড়ের দোকান আছে অবশ্য। দেখা যাক।”

চন্দ্রকান্ত ব্যস্তভাবে বললেন, “না। না। ওটার গতি সেকেন্ডে প্রায় হাজার কিলোমিটার। এই দেখুন। আমার ধারণা, এতক্ষণে ওটা সাহারা মরুভূমিতে পৌঁছে গেছে। আমার এখনই ল্যাবে ফেরা উচিত। কমপিউটারের সামনে বসতে হবে। প্রচুর হিসেবনিকেশ করতে হবে, প্রচুর!”

“হ্যাঁ, প্রচুর। তবে যন্ত্রে হইব না। এ সায়েন্টিস্টের কাম না মশায়! ডিটেকটিভের হাতে ছাইড়া দেওনই ভালো।”

ঘুরে দেখি, সিঁড়ির দিক থেকে এগিয়ে আসছেন গোয়েন্দা কে. কে. হালদার। মুখে রহস্যময় হাসি। কর্নেল বললেন, “খবর বলুন হালদারমশাই! এতক্ষণ আপনার জন্য হা-পিত্যেশ করছি!”

হালদারমশাই আগে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, “ভবেশ রক্ষিত লোকটা ভালো না। পুলিশ-সোর্সে আগে খবর নিয়েছিলাম। তিনবার চোরাই মালের দায়ে ধরা পড়েছিল।”

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। কোনো বিদায়সম্ভাষণ করলেন না। বুঝলুম, বাড়ি ফিরেই ল্যাবে ঢুকবেন।

কর্নেল বললেন, “চলুন হালদারমশাই! নীচে গিয়ে কফি খেতে-খেতে আপনার তদন্ত রিপোর্ট শোনা যাক।”

একটু পরে ড্রয়িংরুমে বসে প্রচুর দুধে প্রায় সাদা কফি ফুঁ দিয়ে খেতে-খেতে প্রাইভেট গোয়েন্দা কৃতান্তকুমার হালদার তার তদন্ত রিপোর্ট দিলেন।

আজকাল কোনো জিনিসই ফেলনা নয়। পুরনো ছেঁড়া জামাকাপড় বা জুতো, কৌটো-শিশি-বোতল, অ্যালুমিনিয়ামের টুটাফাটা পাত্র থেকে শুরু করে গেরস্থালির পরিত্যক্ত সমস্ত আবর্জনা কেনবার জন্য লোকেরা অলিগলি হাঁক দিয়ে বেড়ায়, “বিক্কিরিওলা! বিক্কিরি-ই-ই-ই!” হালদারমশাই বিক্কিরিওলা সেজে ভবেশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন। ভবেশ-গিন্নি খুব জাঁদরেল মহিলা। বিক্কিরিওলা বড্ড বেশি খোঁজখবর নিচ্ছে দেখে ডাকাতের চর ভেবে পালোয়ান ভাগনেকে ডাক দেন। ভাগ্যিস, তখন সে মামার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। উনি পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছেন আঁচ করেই গোয়েন্দা কেটে পড়েন। তবে আজব বলটার কথা ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সত্যি একটা প্রচণ্ড ভারী খুদে বল বাথরুমে পড়েছিল। গত রাতে বাড়ির আনাচেকানাচে ভূতেরা উৎপাতও করেছে বটে। কিন্তু সন্দেহজনক ব্যাপার হল, বড়বাজারে ভবেশবাবুর দোকানে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে যে-লোকটা ওই ভুতুড়ে বল বেচতে গিয়েছিল, তার চোখ ট্যারা এবং গতকাল বিকেলে ভবেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি একটা গলিতে যে-লোকটাকে সিঁটিয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তার চোখও ট্যারা। কাজেই হালদারমশাই থানা থেকে হাসপাতালের মর্গ ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছেন। তার হাতে এখন বড় তথ্য মৃত লোকটির নামধাম।

নোটবই খুলে গোয়েন্দামশাই বললেন, “গজকুমার সিং। ৮২/৩/ই চারু মিস্ত্রি লেন। জায়গাটা বেলঘরিয়ায় একটা মেসবাড়ি। গজকুমারের রেস খেলার নেশা ছিল। ওঁর মেসের লোকেরা বললেন, ফালতু লোক। মাথায় ছিট ছিল। ইদানীং বড়াই করে বলতেন, শিগগির কোটিপতি হয়ে যাবেন। হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছেন।”

এইসময় ফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। “…লোকেট করতে পেরেছেন? খুব ভালো কথা। …না, না। আপত্তি কী? শুভস্য শীঘ্রং। হাঃ হাঃ হাঃ! এই বুড়ো বয়সে মহাকাশযাত্রা? …ঠিক আছে। রাখছি।” ফোন রেখে কর্নেল মিটিমিটি হেসে হালদারমশাইকে বললেন, “গ্রহান্তরে গোয়েন্দাগিরি করবেন নাকি হালদারমশাই?”

আমি অবাক। হালদারমশাই সম্ভবত কিছু না বুঝেই ঝটপট নস্যি নাকে খুঁজে বললেন, “হুঃ!”

.

দুই

কর্নেলের কথামতো সন্ধে ছ’টা নাগাদ যখন বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের বাড়ি পৌঁছলুম, দেখি, হালদারমশাই আগেই চলে এসেছেন। যথারীতি এক প্লেট সিন্থেটিক পকৌড়া এবং কফি খেয়ে নস্যিতে নাক জেরবার করে ফেলেছেন। মুখে চাপা উত্তেজনা থমথম করছে। চন্দ্রকান্ত তার ল্যাবে ছিলেন। এসে খুশি-খুশি মুখে বললেন, “সুস্বাগত জয়ন্তবাবু! আপনি মহাকাশ থেকে কিটো গ্রহে পৌঁছেও রেগুলার আপনার দৈনিক ‘সত্যসেবক’ পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠাতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হল, আপনাদের কাগজের অফিসের টেলেক্স তা রিসিভ করতে পারবে না। দেখা যাক, যদি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি।”

বললুম, “রিপোর্ট পরে হবে চন্দ্রকান্তবাবু! আমরা কিটো গ্রহে যাচ্ছি বললেন। সেটা কোথায়?”

“সেকেন্ডে গ্যালাক্সিতে। তবে ও-নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। গ্রহ ইজ গ্রহ।”

“সেখানে বাতাস আছে তো?”

বিজ্ঞানী হাসলেন, “কয়েকশো টন বাতাস সঙ্গে নিয়ে যাব। আপনি তো আমার এ. জি. এল. যন্ত্রটি দেখেছেন। বাতাসকে চাপ দিয়ে ঘনীভূত করে ফেলব। এ. জি. এল. তার ওজন জিরো করে ফেলবে। ব্যস!”

কোথায় প্রিঁ-প্রিঁ শব্দ হল। চন্দ্রকান্ত বললেন, “ধুন্ধু সন্দেহজনক কিছু দেখেছে। এক মিনিট, আসছি।”

চন্দ্ৰকান্তের এই বাড়িটা দমদম শহরতলি এলাকায় এক টেরে। এলাকাটা গ্রাম বলেই মনে হয়। চারদিকে ঘন গাছপালা। হালদারমশাই সন্দেহজনক শব্দটা কান পেতে শুনে তড়াক করে উঠে বললেন, “বসুন, আসছি।”

বললুম, “ধুন্ধু’র পাল্লায় পড়বেন কিন্তু!”

অমনি গোয়েন্দাপ্রবর বসে পড়লেন। বেজার মুখে বললেন, “হঃ! ওই এক হতচ্ছাড়া! জয়ন্তবাবু, ওই পাজিটাকে যদি সঙ্গে নেন সায়েন্টিস্ট, আমি কিন্তু যাচ্ছি না।”

মনে পড়ল, সেবার চুপিচুপি বিজ্ঞানীর বাড়ি ঢুকতে গিয়ে হালদারমশাইয়ের কী অবস্থা হয়েছিল ধুন্ধু’র হাতে। কিন্তু এমনিতে শ্রীমান ধুন্ধু বেশ খোশমেজাজি রোবট। ইদানীং তাকে চন্দ্রকান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাচ্ছেন। ধাতব গলায় বেশ গায় সে।

চন্দ্রকান্ত ফিরে এসে বললেন, “ধুন্ধুটা ভিতু হয়ে যাচ্ছে দিনে-দিনে। অন্ধকারে বেড়াল দেখেও চমকে ওঠে।”

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল এসে পড়লেন। ওঁর পিলোব্যাগে প্রজাপতি-ধরা নেটের স্টিক উঁকি মেরে আছে চেনের ফাঁকে। অবাক হয়ে বললুম, “চন্দ্রকান্তবাবু! কিটো গ্রহে প্রজাপতিও আছে নাকি?”

বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ অট্টহাসি হাসলেন। বিজ্ঞানী বললেন, “আহা! চান্স মিস করতে নেই। যদি সত্যিই থাকে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আমরা কতটুকু জানি মশাই, যাই হোক, আমাদের রেডি হওয়া দরকার। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাইম সিডিউল পেয়েছি সাড়ে সাতটা থেকে আটটা। এই আধঘণ্টা পৃথিবীর স্পেস-উইন্ডোর ট্রাফিক আমাদের জন্য বরাদ্দ।”

হালদারমশাই নড়ে উঠলেন। “সেটা কী?”

কর্নেল বললেন, “আমি বুঝিয়ে বলছি। চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি স্পেসশিপ রেডি করুন ততক্ষণ।”

বিজ্ঞানী চলে গেলে কর্নেল বললেন, “পৃথিবীর আকাশ থেকে মহাকাশে পৌঁছনো একটা সমস্যা, হালদারমশাই! যেখান-সেখান দিয়ে বেরনো যায় না। একটা নিরাপদ যাত্রাপথ আছে, সেটাই স্পেস-উইন্ডো। কোনো দেশ থেকে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্পেসশিপ পাঠাতে হলে আগে জানা দরকার পথটা ফাঁকা আছে কি না। নইলে অন্য দেশের পাঠানো স্পেসশিপের সঙ্গে ঠোক্কর লাগতে পারে। তা ছাড়া উল্কার বিপদ আছে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। সেইসব বিপদ-আপদ এড়িয়ে নিরাপদ পথ আবিষ্কার করতে হয়েছে।”

হালদারমশাই খুব মাথা নাড়ছিলেন বটে, মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু বুঝতে পারছেন না।

বিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “আপনারা ল্যাবে’চলে আসুন। ল্যাবের গেট নাম্বার টু’র সামনে দাঁড়ান। লিফট পাবেন। লিফট সরাসরি স্পেসশিপে পৌঁছে দেবে। কুইক!”

ল্যাবে ঢুকে দু’নম্বর গেটের সামনে আমরা দাঁড়ালুম। দরজা দু’পাশে সরে লিফট দেখা গেল। লিফটে ঢুকে হালদারমশাই ফিসফিস করে বললেন, “সেই পাজি ধুন্ধুটা সঙ্গে যাচ্ছে না তো?”

নেপথ্যে চন্দ্ৰকান্তের হাসি শোনা গেল। “ধুন্ধু মাস্ট মিঃ হালদার। তবে ওকে ভয় পাবেন না। ওকে বলে দিয়েছি, ও আপনার বন্ধু হয়ে থাকবে!”

স্পেসশিপে ঢুকে বুঝলুম গড়ন ডিমালো এবং ছাদের একটা গম্বুজের মাথায় বসানো। চন্দ্ৰকান্তের পাশে কর্নেল বসলেন। আমি আর হালদারমশাই বসলুম পেছনে। তারপর হালদারমশাই হঠাৎ আঁতকে উঠে বললেন, “গেছি! গেছি!”

পেছন থেকে ধুন্ধু ওঁর কাঁধে হাত রেখেছে। হাসতে হাসতে বললুম, “ধুন্ধু আপনার কাঁধে হাত রেখে বন্ধুতা জানাচ্ছে, হালদারমশাই! আপনিও ওকে বন্ধুতা জানান।”

হালদারমশাই ভয়ে-ভয়ে ঘুরে ধুন্ধু’র চিবুকে ঠোনা মেরে আদর করলেন, “লক্ষ্মীসোনা!”

চন্দ্রকান্ত বললেন, “আমরা উড়ছি। রেডি!”

একটা ঝাঁকুনি লাগল। তারপর কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলুম, নীচের অজস্র আলোর ফুটকি দেখতে-দেখতে মিলিয়ে গেল। হালদারমশাই ফিসফিস করে বললেন, “আচ্ছা জয়ন্তবাবু! আমাদের স্পেসসুট পরালেন না তো সায়েন্টিস্টমশাই! আমার কেমন যেন ঠেকছে!”

চন্দ্রকান্ত তা শুনতে পেয়ে সহাস্যে বললেন, “এই শর্মার সেটাই কৃতিত্ব মিঃ হালদার। স্পেসসুট-টুট সবই প্রিমিটিভ করে ফেলেছি। কত কিলোমিটার বেগে যাচ্ছি, জানেন? সেকেন্ডে দু’হাজার মাইল। ওই দেখুন, সূর্য ঝলমল করছে।”

হালদারমশাই বললেন, “কিন্তু রোদ্র কোথায়? আকাশই বা এত কালো কেন? ধুস!”

তিনি নস্যি নিলেন। অমনি ধুন্ধু পিছন থেকে মুণ্ডু এগিয়ে দিল। হালদারমশাই খি-খি হেসে তার নাকে খানিকটা নস্যি গুঁজে দিলেন। ধুন্ধু নস্যির চোটে ধাতব হাঁচি হাঁচতে হাঁচতে কাত হয়ে পড়ল। চন্দ্রকান্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “মিঃ হালদার! কেলেঙ্কারি করবেন দেখছি। ধুন্ধু’র নড়াচড়ায় স্পেসশিপ ব্যালান্স হারালেই…এই রে! সর্বনাশ!”

হালদারমশাই প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “ক্কী? কী? কী?”

চন্দ্রকান্ত খুটখুট শব্দে বোম টেপাটেপি করতে করতে বললেন, “গতিপথ বদলে গেছে। আপনি মশাই বড্ড ঝামেলা বাধান! এই রে! আমরা কোথায় চলেছি কে জানে?”

কর্নেল চুপচাপ নির্বিকার মুখে চুরুট টানছেন। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলুম। বললুম, “চন্দ্রকান্তবাবু, অ্যাসিডেন্ট হবে না তো?”

“হবে কী মশাই? হয়ে গেছে।” বিজ্ঞানী তেতো মুখে বললেন, “আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি।”

“কিন্তু স্পেসশিপ ভেঙে পড়বে না তো?”

“দেখা যাক।”

আরও ভয় পেয়ে হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালুম। উনি মুখ চুন করে বসে আছেন। বললুম, “এবার কী হবে ভাবুন তো হালদারমশাই!”

গোয়েন্দা ভদ্রলোক বললেন, “হঃ। ভাবতাছি। তবে আমারে দোষ দেবেন না য্যান। ওই পাজি হতচ্ছাড়া নাক বাড়াইয়া…”

উনি থেমে গেলেন। ধুন্ধু আবার নাক বাড়িয়েছে ওঁর কাঁধের ওপর দিয়ে। বিজ্ঞানী টের পেয়ে ধমকে দিলেন, “ধুন্ধু! ট্রাট ট্রাট ট্রাট!”

ওটা নিশ্চয় সাঙ্কেতিক ভাষা। ধুন্ধু ধাতব স্বরে বলল, “ক্রাট ক্রাট ক্রাট!”

“ক্রিও ক্রিও ক্রিও!” হুঙ্কার দিলেন বিজ্ঞানী।

ধুন্ধু তার চৌকো থাবা দিয়ে হালদারমশাইয়ের কাধ আঁকড়ে ধরল। কর্নেল বললেন, “নস্যি হালদারমশাই! ধুন্ধু নস্যির মজা টের পেয়েছে। না পেলে আপনার কাঁধের হাড় ভেঙে দেবে। শিগগির!”

হালদারমশাই দ্রুত নস্যির কৌটো বের করে বাকি নস্যির সবটাই ধুন্ধু’র নাকে খুঁজে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল ধুন্ধু’র বিকট হাঁচি এবং হাঁচতে হাঁচতে সে এমন নড়তে থাকল, স্পেসশিপ বেজায় ঝাঁকুনি খাচ্ছিল। চন্দ্রকান্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ইমপসিবল! নিন! কোথায় নামছেন, দেখুন আপনারা।”

নীচে রোদে ঝকমকে সোনালি বালি। যতদূর চোখ যায়, শুধু বালি। অসমতল, কোথাও সমতল বালির বিস্তার। কাছে ও দূরে বালিরই পাহাড়। জায়গাটা মরুভূমি তাতে সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড বালি উড়িয়ে স্পেসশিপ অবশ্য নিরাপদে থামল। কর্নেল দরজা খুলে নেমেই বললেন, “বাঃ! অসাধারণ।”

তারপর উনি যথারীতি চোখে বাইনোকুলার তুলে চারদিক দেখতে থাকলেন। আমি আর হালদারমশাই দরজা খুলে নেমে গেলুম। ঘড়ি দেখে অবাক। সাতটা চল্লিশ বাজে! তার মানে দশ মিনিটের জার্নি। ঘড়িতে একই তারিখ যে। সাধারণ জ্ঞানে বুঝলুম, আমরা নিশ্চয় পশ্চিম দিকে সূর্যের পেছন-পেছন ছুটে এসেছি। তাই এখন বিকেলের দেখা পাচ্ছি এখানে। কিন্তু কী বিচ্ছিরি গরম!

হালদারমশাইয়ের দোষেই মহাকাশযাত্রা ব্যর্থ এবং পৃথিবীর কোনো সৃষ্টিছাড়া মরুভূমিতে এসে পড়েছি। হালদারমশাইকে সম্ভবত সেজন্যই কাতর দেখাচ্ছে। তাই ওঁকে সান্ত্বনা দিতে বললুম, “সত্যি বলতে কী, আমার আনন্দ হচ্ছে জানেন হালদারমশাই? কোন্ উদ্ভুট্টে গ্রহে গিয়ে কী বিপদে পড়তুম কে জানে। তার চেয়ে এটা বরং ভালোই হল।”

হালদারমশাই কিন্তু বেজার মুখে বললেন, “হঃ! ভালোই হল! মরুভূমিতে আইয়া পড়ছি। এখন বেদুইন ডাকাতগুলি আইয়া পড়লেই গেছি!”

“আপনি বেদুইনের কথা ভাবছেন কেন? এটা মেক্সিকোর মরুভূমিও হতে পারে।”

হালদারমশাই চাপা স্বরে বললেন, “আমি ডিটেকটিভ, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। নামবার সময় গম্বুজওয়ালা ঘর দেখছিলাম একখানে। আরবের ড্যাজার্ট না হইয়া যায় না।”

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, “হুঁ, ‘ড্যাজার্টে’ অনেক হ্যাজার্ড আছে মনে হচ্ছে হালদারমশাই!”

“ক্যান, ক্যান?” হালদারমশাই তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

“ওইদিকে বালির পাহাড়ের মাথায় একটা বেঁটে লোক দেখলুম। গোল কুমড়োর গায়ে নাক-মুখ-চোখ এঁকে দিলে যেমন দেখায়, তেমনি চেহারা। লোকটার হাত-পা কিছু নেই। দিব্যি গড়াতে গড়াতে ওধারে উধাও হয়ে গেল। কুমড়ো-মানুষের দেশে এসে পড়েছি আমরা।”

রসিকতা করছেন ভেবে একটু হেসে বললুম, “কুমড়োপটাশের দেশে বলুন!”

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হাসির কথা নয়, ডার্লিং! মনে হল, কুমড়ো-মানুষটা বসতিতে খবর দিতে গেল।” বলে ডাকলেন, “চন্দ্রকান্তবাবু! নেমে আসুন।”

বিজ্ঞানী স্পেসশিপের ভেতর বসে কীসব করছিলেন। তড়াক করে নেমে এসে বললেন, “আশ্চর্য কর্নেল, খুবই আশ্চর্য! আমরা পথভ্রষ্ট হইনি। সঠিক জায়গায় পৌঁছেছি।”

চমকে উঠে বললুম, “সেই কিটো গ্রহে এসে গেছি নাকি?”

চন্দ্রকান্ত খুশি-মুখে বললেন, “হ্যা! খামোকা ধুন্ধুকে দোষ দিচ্ছিলুম। ধুন্ধু দু’-দু’বার জার্ক না দিলেই বরং গতিপথ থেকে এক ডিগ্রি সরে যেতুম। ফলে কী হত জানেন? অনন্তকাল মহাকাশে ভেসে বেড়াতুম। কর্নেল! চলে আসুন। জয়ন্তবাবু! মিঃ হালদার! কুইক। ডিটেক্টরের কাঁটা সেই বলটার দিকে তাক করে আছে। আমরা সেদিকেই এবার যাব।”

কর্নেল আবার বাইনোকুলারে দূরে কিছু দেখছিলেন। বললেন, “যাওয়ার আগে কুমড়ো-মানুষদের একটা গ্রুপফোটো নিতে চাই চন্দ্রকান্তবাবু!”

“কুমড়ো-মানুষ!” বিজ্ঞানী অবাক হয়ে বললেন। “কই, কোথায়?”

“ওই দেখুন, দলবেঁধে গড়াতে গড়াতে আসছে।”

এবার ব্যাপারটা চোখে পড়ল। সেই বালির পাহাড় বেয়ে অন্তত শ’খানেক জ্যান্ত কুমড়ো গড়াতে-গড়াতে নামছিল। সমতলে নেমে এবার তারা গড়াতে-গড়াতে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। অবিকল প্রকাণ্ড ফুটবল মনে হচ্ছে। মাঝে-মাঝে কয়েকটা যেন কিক খেয়ে আকাশে উঠছে। আবার নেমে পড়ছে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, “কী বিপদ! নাঃ, ধুন্ধুকে বের করি। কিছু বলা যায় না।”

তিনি স্পেসশিপের পেছনের খোপের দরজা খুলে দিলেন। শ্রীমান ধুন্ধুমার বেরিয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়াল। হালদারমশাই তার কাছ ঘেঁষে রইলেন। চন্দ্রকান্তকে দেখলুম, হাতে মারাত্মক লেসার-পিস্তল নিয়েছেন।

কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু ক্যামেরা তাক করে আছেন।

কুমড়ো-মানুষেরা আমাদের প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। নাঃ! দাঁড়াবে কী করে? ঠ্যাংই তো নেই। কাজেই থামল বলা ভালো। এই সময় লক্ষ করলুম, কেমন অদ্ভুত চাপা একটা ঝাঁ-আঁ শব্দ হচ্ছে। ওটাই কি ওদের ভাষা? ক্রমে চোখে পড়ল, ওদের মধ্যে নানা বয়সি কুমড়ো-মানুষ আছে। তারপর সবাই আমাদের জিভ দেখাতে থাকল।

হালদারমশাই খাপ্পা হয়ে বললেন, “অসভ্যতা দ্যাখছেন? মুখ ভ্যাঙায় কেমন!”

কর্নেল টেলিলেন্স ফিট করে কয়েকটা ছবি নিলেন। তারপর আমাদের অবাক করে সোজা এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। চন্দ্রকান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, “যাবেন না! যাবেন না!”

আমিও চেঁচিয়ে ডাকলুম, “কর্নেল! কর্নেল!”

কর্নেল কান করলেন না। সেই আঁ-আঁ শব্দটা এখন থেমে গেছে। হালদারমশাই চাপা স্বরে বললেন, “বিপদ বাধবে! ওই দ্যাখেন, কর্নেল-স্যারেরে চক্কর দিয়া ঘিরতাছে।”

কিন্তু এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পেল, যখন দেখলুম, কর্নেলও ওদের মতো জিভ বের করে অনবরত ভেংচি কাটার ভান করছেন।

তারপর সে এক বিচিত্র ব্যাপার। কুমড়ো-মানুষগুলো কর্নেলের ওপর এসে পড়ল। কেউ ওঁর কাঁধে, কেউ ওঁর মাথায় চড়ল। মাথারটি কর্নেলের টুপি খুলে নিজের মাথায় পরল এবং কর্নেলের চকচকে টাকে সেঁটে বসে রইল। একজন ওঁর দাড়িতে আটকে গেল। এবার আরও আজব দৃশ্য। সার্কাসে লোহার বলের ওপর পা রেখে বলটাকে গড়াতে-গড়াতে এগনো দেখেছি। কর্নেল কি সে-খেলাও জানেন? ওঁর পায়ের তলায় কয়েকটা কুমড়ো-মানুষ এবং উনি দিব্যি নাচার ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছেন। এদিকে ওঁর চারপাশে ওড়াউড়ি করছে আরও সব কুমড়ো-মানুষ। সম্ভবত বসার জুতসই জায়গা খুঁজছে।

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ব্যস্তভাবে বললেন, “মনে হচ্ছে, কর্নেলকে ওরা বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। অসহ্য বেয়াদপি! ধুন্ধু। টুট টুট, ক্রুট ক্রুট!”

ধুন্ধু বালির ওপর দমাস-দমাস পা ফেলে এগিয়ে গেল। ওকে পেছনে দেখামাত্র কুমড়ো-মানুষের একটা দঙ্গল কঁ-আঁ শব্দে তেড়ে এল। ধুন্ধু’র ওপর তারা প্রকাণ্ড ঢিলের মতো পড়তে থাকল। ধুন্ধু টাল সামলে নিয়ে খপ করে একটাকে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলল।

কিন্তু তার কিছুই হল না। সে আবার গড়াতে-গড়াতে এসে লাফ দিয়ে ধুন্ধুর একটা কানে এসে পড়ল। চন্দ্রকান্ত বললেন, “ওই যাঃ!”

দেখলুম, ধুন্ধু নেতিয়ে হাঁটু দুমড়ে ধরাশায়ী হল। চন্দ্রকান্ত বললেন, “বাঁ কানের নীচেই সুইচ। চাপ পড়লে ধুন্ধু ইনঅ্যাক্টিভ হয়ে যায়।” বলে তিনি লেসার-পিস্তল উঁচিয়ে দৌড়ে গেলেন।

লেসার-পিস্তলের গুলিতে কোনো কাজ হল না। কুমড়ো-মানুষেরা কর্নেলের মতোই বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে নাচাতে-নাচাতে নিয়ে চলল। উনি পেছন ফিরে চেঁচিয়ে কিছু বললেন। বোঝা গেল না।

হালদারমশাই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কোনো মানে হয়? ব্যাটাচ্ছেলেরা…”

ওঁর কথা থেমে গেল। আমাদের পেছনে স্পেসশিপ। তার আড়ালে কখন একদঙ্গল কুমড়ো-মানুষ এসে লুকিয়ে ছিল টের পাইনি। আচমকা তারা এসে হালদারমশাইকে ঘিরে ফেলল এবং তারপর একই দৃশ্য দেখতে পেলুম। ঢ্যাঙা গোয়েন্দাপ্রবর নাচতে-নাচতে চলেছেন আর চাঁচাচ্ছেন, “জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! বাঁচান, বাঁচান!”

কিন্তু আমার দিকে কুমড়ো-মানুষদের লক্ষ নেই কেন? একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম। এ তো ভারি অপমানজনক ব্যাপার! আমাকে ওরা বন্দী করল না, গ্রাহ্যই করল না! আমি কি এতই ফেলনা? আঁতে বড্ড ঘা লাগছিল এবং অভিমান হচ্ছিল।

আর-এক আশ্চর্য ব্যাপার, সূর্য যেখানকার সেখানেই আছে। এ কি তা হলে এক চির-বিকেলের দেশ? সোনালি বালির ওপর নরম গোলাপি রোদ্দুর। একটু ভ্যাপসা গরম আছে, এই যা। একটুও বাতাস বইছে না। কুমড়ো-মানুষেরা তিন বন্দীকে নিয়ে বালির পাহাড় পেরিয়ে উধাও হয়ে গেলে ধুন্ধুর কাছে গেলুম।

হঠাৎ মনে হল, ধুন্ধুর এক কানে অফ করার সুইচ আছে যখন, অপর কানেও কি পালটা অন করার সুইচ নেই?

যেই কথাটি মাথায় আসা, ডান কানের সুইচটা টিপে দিলুম। অমনি ধুন্ধু ঝনঝন শব্দে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে ঘুরে একখানা স্যালুট ঠুকল। খুশি হয়ে বললুম, “হ্যালো ধুন্ধু! কনগ্রাচুলেশন!”

ধুন্ধু তার ধাতব কণ্ঠস্বরে বলল, “ট্রাও ট্রাও ট্রাও!”

এই রোবট-ভাষা আমি বুঝি না। ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বললুম। স্পেসশিপের কাছে গিয়ে দেখি, সে আমার ইশারা বুঝতেই পারেনি। বালির পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরুক হতচ্ছাড়া! আমার তেষ্টা পেয়েছে, যা-সব আক্কেল গুড়ুম করা কাণ্ড ঘটল! স্পেসশিপে ঢুকে জলের ফ্লাক্স থেকে অনেকটা জল খেলুম। চন্দ্ৰকান্তের সিটে গিয়ে স্পেসশিপ চালানোর চেষ্টা করব নাকি?

এই ভেবে উঠতে যাচ্ছি, চোখে পড়ল ধুন্ধু দমাস-দমাস করে বালির পাহাড়টার দিকে হেঁটে চলেছে। রাগে গা জ্বালা করছিল। কিন্তু কী আর করা যায়? নিজের আসনে বসে সিগারেট ধরালুম। এখন আমি মরিয়া। বরাতে যা আছে ঘটুক।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ কী একটা শব্দ। দরজা খোলা ছিল বলেই কানে এল। তাকিয়ে দেখি, কী আশ্চর্য, একটা রোগা খেকুটে চেহারার মানুষ, হ্যাঁ, আমার মতোই মানুষ, অবাক চোখে স্পেসশিপটা দেখছে।

.

তিন

এমন সৃষ্টিছাড়া এক জায়গায় মানুষ দেখলে মানুষের মনে আনন্দ উপচে পড়ে। লাফ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বললুম, “নমস্কার, নমস্কার!”

মানুষটি চমকে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেলেন। তারপর ভয়ে-ভয়ে বললেন, “আপনি মানুষ বটে তো?”

হাসতে হাসতে বললুম, “আপনার সন্দেহের কারণ? আমি জলজ্যান্ত মানুষ।”

“ওরে বাবা! জ্যান্ত বললেন নাকি?”

“হ্যাঁ। জ্যান্ত বইকি। আপনার মতোই জ্যান্ত।”

“উঁহু। আমি কিন্তু জ্যান্ত নই, মড়া।”

বড় রসিক লোক তো! হো-হো করে হেসে বললুম, “আপনার রসিকতায় বড় আনন্দ পেলুম। এতক্ষণ এই কুমড়ো-মানুষদের দেশে যা-সব কাণ্ড হল, বাপস্! আপনাকে দেখে ধাতস্থ হওয়া গেল। তা মশাইয়ের নাম?”

“আপনার নাম আগে শুনি।”

“জয়ন্ত চৌধুরী। স্পেশ্যাল রিপোর্টার। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।”

“ওরে বাবা! এখানেও রিপোর্টার?” বলে ভদ্রলোক আরও সরে গেলেন। “আরে! আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?”

“ভয় পাব না? মরেও রেহাই নেই দেখছি। পেছনে রিপোর্টার লেলিয়ে দিয়েছে।”

“মরে মানে?”

“হু, পৃথিবীতে মশাই, রিপোর্টারদের জ্বালাতেই হার্টফেল করেছি। ওঃ! প্রশ্নে-প্রশ্নে জেরবার। এই বল কোথায় পেলেন? কে দিল? কী ধাতুতে তৈরি? আমার…”

“বল?” সন্দিগ্ধ হয়ে বললুম, “মশাইয়ের নাম?”

“ঈশ্বর গজকুমার সিং।”

“গজকুমার সিং! আপনি…কী আশ্চর্য! আপনিই তো সেই আজব বল বিক্রি করতে গিয়েছিলেন ভবেশবাবুর দোকানে?” বলেই ওঁর চোখের দিকে তাকালুম। চোখ দুটি ট্যারা! তা হলে ইনি সত্যিই সেই লোকটা।

গজকুমারবাবু বিষণ্ণ মুখে বললেন, “আর বলবেন না! বলটা আমার ঠাকুরদা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সেই থেকে আমাদের বিহার মুলুকের বাড়িতে ছিল। খুলে বলছি মশাই, আমি একজন রেসুড়ে। আগামী শনিবার একটা ঘোড়ার ওপর মোটা দান ধরব ভেবে ওটা বাড়ি থেকে মেসে এনে রেখেছিলুম। তারপর বেচতে যদি গেলুম, বিক্রি হল না। ফেরার পথে কী করে খবর হল কে জানে, আঁকে-ঝাঁকে খবরের কাগজের রিপোর্টার ঘিরে ধরল। প্রাণে মারা পড়লুম।”

“বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি এখানে কী করে এলেন?”

গজকুমারবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তা তো জানি না। শুধু জানি, আমি মরে গেছি। তারপর একটু আগে চোখ খুলে দেখি, ওইখানে বালির ওপর শুয়ে আছি। উঠে বসলুম। তখন আপনার এই গাড়িটা চোখে পড়ল। চলে এলুম।”

“গজকুমারবাবু! সমস্ত ব্যাপারটা রহস্যময়। আমার ধারণা, আপনি সত্যি মারা পড়েননি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। ভুল করে আপনাকে মড়া ভেবে মর্গে ঢোকানো হয়েছিল। তারপর কেউ বা কারা আপনাকে এই কুমড়ো-মানুষদের গ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছে!”

গজকুমারবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “যাগে! একটা সিগারেট দিন।”

সিগারেট দিলুম। উনি আরামে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, “মরুভূমি তো। তাই বড্ড গরম। তা আপনি কী যেন বললেন, কুমড়ো-মানুষ না কি?”

“হ্যাঁ। এই গ্রহের নাম কিটো। এখানে অবিকল কুমড়োর মতো মানুষরা থাকে। তাদের হাত-পা নেই। গড়াতে-গড়াতে, লাফাতে-লাফাতে চলে। আমার তিন সঙ্গীকে তারা ধরে নিয়ে গেছে।”

“আপনাকে ধরে নিয়ে যায়নি কেন বলুন তো?”

“সেটাই তো ভাবছি।”

গজকুমারবাবু আমাকে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, “আমার মনে হচ্ছে, ওরা কী করে টের পেয়েছে, আপনি কাগজের রিপোর্টার। তাই আপনাকে এড়িয়ে গেছে। আপনি প্রশ্নে-প্রশ্নে জেরবার করে হাঁড়ির খবর বের করবেন এবং জব্বর স্কুপ ঝাড়বেন। সেই ভয়েই আপনাকে ধরে নিয়ে যায়নি।”

“কিন্তু আপনাকে ধরে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কেন যায়নি?”

গজকুমারবাবু কঁচাপাকা চুল আঁকড়ে ধরে একটু ভাবলেন। তারপর খোঁচাখোঁচা গোঁফদাড়ি খুব করে চুলকে নিয়ে বললেন, “বালিতে বেজায় পিঁপড়ে। জ্বালা করছে। কুমড়ো-মানুষদের দেশে পিঁপড়েগুলোও একই গড়নের। গোটাকতক টিপে মেরেছি। …হ্যাঁ, আপনি একটা ভালো প্রশ্ন তুলেছেন, আমাকে ধরে নিয়ে যায়নি কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমাকে যে বা যারা এখানে নিয়ে এসেছে, তাকে বা তাদের ওরা ভয় পায়। কিন্তু কথা হল, কে বা কারা আমাকে এখানে নিয়ে এল? আপনি ঠিকই বলেছেন জয়ন্তবাবু! সমস্ত ব্যাপারটাই রহস্যময়।”

একটু ইতস্তত করে বললুম, “এক কাজ করা যাক। চলুন না, দুজনে চুপিচুপি ওই বালির পাহাড়ের দিকে যাই। গিয়ে দেখি, আমার সঙ্গীদের কী অবস্থা হল। মানুষ হয়ে মানুষকে বাঁচানো কর্তব্য নয় কি? আমাদের রিস্কটা নেওয়া উচিত।”

গজকুমারবাবু বললেন, “চলুন। কিন্তু হাতে অন্তত একটা লাঠি-ফাটি থাকলে ভালো হত। এই আজগুবি মরুভূমিতে একটা ঝোঁপঝাড় পর্যন্ত নেই। দেখুন না, আপনাদের গাড়ির ভেতর রড-টড পান নাকি। যা হোক কিছু পেলেই চলবে। অগত্যা একটা হাতুড়ি কি ভ্রু ড্রাইভার। ছুরি থাকলে আরও ভালো। কুমড়ো-মানুষ বললেন। প্যাক করে পেটে ঢুকিয়ে দেব।”

উনি খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠলেন। তবে যুক্তিটা মন্দ নয়। স্পেসশিপে ঢুকে চন্দ্ৰকান্তের সিটের পাশে সৌভাগ্যক্রমে টুলস-ব্যাগটা পেয়ে গেলুম। হাতুড়ি বা ছুরি নেই। নানা সাইজের ভ্রু-ড্রাইভার, প্লাস, আরও কতরকম টুকিটাকি জিনিস আছে। বুদ্ধি করে দুটো বড় সাইজের ক্রু-ড্রাইভার নিলুম।

দু’জনে এভাবে সশস্ত্র হয়ে বালির পাহাড়টার দিকে হাঁটতে থাকলুম। এতক্ষণে টের পেলুম, যে ঝাঁ-আঁ শব্দ তখন শুনেছি, তা এই বালির ভেতর থেকে উঠছে। বইতে পড়েছি, পৃথিবীর বহু মরুভূমিতে বালির ওপর চলাফেরা করলে অদ্ভুত সব শব্দ হয়। কোথাও কোথাও নাকি অর্কেস্ট্রাও শোনা যায়।

বালিতে হাঁটার সমস্যা আছে। দ্রুত এগনো যায় না। তাতে ক্রমাগত অস্বস্তিকর ঝাঁ-ঝাঁ ঝনঝন শব্দ। পাহাড়টা আন্দাজ শতিনেক ফুট উঁচু। কিন্তু যতবার উঠতে যাই, পা হড়কে গড়িয়ে পড়ি। দু’জনে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অপেক্ষাকৃত শক্ত জায়গা পেলুম। সেখান দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে উঠলাম। তারপর চোখে পড়ল, নীচে উপত্যকার মতো একটা জায়গা এবং সত্যিই স্বর্গোদ্যান বলা চলে।

উজ্জ্বল সবুজ গাছপালা, সুন্দর ঝিরঝিরে ঝরনাধারা এবং ওলটানো বিশাল বাটির মতো অসংখ্য রং-বেরঙের ঘর। ঝরনার ধারে একটা সবুজ ঘাসের মাঠ। মাঠে কুমড়ো-মানুষদের ভিড়। কিন্তু আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, আমার সঙ্গীদের ওরা ধরে নিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু বন্দী করে রাখেনি। তিনটে মোড়ার মতো গড়নের নিটোল রঙিন আসন দিয়েছে বসতে। তিনজনের হাতেই আধখানা প্রকাণ্ড ডিমের খোলার মতো পাত্র। ওঁরা তারিয়ে-তারিয়ে কিছু খাচ্ছেন। ধুন্ধু’র অবস্থা অন্যরকম। সে চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। বুঝলুম, বেয়াদপি করেছিল। তার শাস্তি। কুমড়ো-মানুষরা নাচানাচি করছে। যেন রং-বেরঙের বড়-বড় বেলুন উড়ছে। গজকুমারবাবু ফিসফিস করে বললেন, চলুন, এরা খুব সজ্জন মনে হচ্ছে। আমার খুব খিদেও পেয়েছে।”

বললুম, “আগে বুঝে নিন, আপনাকে ওরা পছন্দ করছে কি না।”

গজকুমারবাবু ঔড্রাইভার নাচিয়ে বললেন, “বেগড়বাঁই করলে প্যাক করে ঢুকিয়ে দেব। চলে আসুন।”

বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। দু’হাত তুলে সাড়া দিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে গেলেন। কুমড়ো-মানুষেরা থেমে গেল এবং এদিকে তাকাল। তারপর গজকুমারবাবুকে কর্নেলদের মতোই পায়ের তলায় ঢুকে নাচাতে-নাচাতে নিয়ে গেল!

দেখলুম, আমার বৃদ্ধ বন্ধু চোখে বাইনোকুলার তুললেন। তারপর হাত নেড়ে চলে যেতে ইশারা করলেন। খুব রাগ হল। আমাকে কেন হেনস্থা করা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কুমড়ো-ব্যাটাচ্ছেলেরা আমাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। অথচ গ্রাহ্য করছে না।

গোঁ ধরে ঢাল বেয়ে নামতে থাকলুম। খানিকটা নেমেছি, কয়েকটা খোকা কুমড়ো-মানুষ বাই-বাই করে ফুটবলের মতো এসে আমাকে ধাক্কা মারল। গড়িয়ে পড়ে গেলুম। তারপর যেই উঠে দাঁড়াই, অমনি বাঁই করে গায়ে পড়ে আর আছাড় খাই।

বুঝলুম, আমাকে যে-কোনো কারণেই হোক, এরা পছন্দ করেনি। রাগ করে ঢালে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে ফিরে এলুম।

তাতেও রক্ষা নেই। বিচ্ছু খোকাগুলো উড়ে এসে দমাদ্দম গায়ে পড়ছে। ঠাসা বালিশের মতো জিনিস। তাই আঘাতটা গায়ে তত বাজছে না। কিন্তু আছাড় খাচ্ছি।

কী আর করা যাবে? অগত্যা স্পেসশিপে ফিরে এলুম। বালির ওপর হাঁটাহাঁটিতে খিদে পেয়েছে। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত নিশ্চয় সঙ্গে খাবার-দাবার এনেছেন। কিন্তু কোথায় তা? খোঁজাখুঁজি শুরু করলুম। একখানে ইংরেজিতে লেখা আছে : খিদে পেলে একটা ক্যাপসুল খান। না পেলে দুটো খান। তারপর একটা খান।

একটা ক্যাপসুল খেলুম। ফ্লাস্ক থেকে জল খেয়ে ঢেকুর তুলে আসনে হেলান দিলুম। এটা চন্দ্ৰকান্তের আসন। কী খেয়াল হল, বোতামগুলো টিপতে শুরু করলুম, হয়তো রাগের চোটে মরিয়া হয়েই। তারপর হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি।

এবং স্পেসশিপ আকাশে উঠে পড়েছে।

সর্বনাশ! যদি অনন্ত মহাকাশে চিরকাল ভেসে চলে? ভয় পেয়ে সামনে যে বোতাম দেখি, টিপে ধরি। তারপর এক চিররাত্রির দেশ। শুধু আকাশভরা তারা আর অন্ধকার। ভয়ে চোখ বুজে গেল।

কতক্ষণ পরে ফের ঝাঁকুনির চোটে খুলে দেখি, বাইরে নীলাভ আশ্চর্য আলো। আবার কোথায় এলুম কে জানে! দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল সামনে ভিশনস্ক্রিনে ফুটে উঠেছে ইংরেজিতে সতর্কবাণী : নামতে পারো। কিন্তু সাবধান, পৃথিবীর চেয়ে মাধ্যাকর্ষণ ৯০ শতাংশ কম। উড়ে যাওয়ার সুখ পাবে। তবে নামা কঠিন হবে। তাই বুকে হেঁটে চলবে।

কী বিপদ! আমি কি সরীসৃপ?

ব্যাপারটা খারাপ লাগছে এই ভেবে যে আমাকে কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বড্ড বেশি হেনস্থা করতে চাইছে। কাগজের লোক হওয়ার জন্যই কি? গজকুমারবাবুর কথাটা মনে ধরল।

নেমেই মনে হল কী একটা শক্তি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তাই তক্ষুনি উপুড় হয়ে গিরগিটির মতো হাঁটতে থাকলুম। নীলচে রোদ্দুরে মায়াময় দেখাচ্ছে জায়গাটা। তবে বালি নেই, শক্ত পাথর। মাটিও চোখে পড়ল না। এখানে-ওখানে ন্যাড়া পাথরের স্তূপ। দূরে ও কাছে ছোট-বড় বিচিত্র গড়নের বিশাল ভাস্কর্যের মতো পাহাড়। পাথরের রং ঘন কালো।

হঠাৎ দেখি, সামনে একটা ক্রিকেট বলের সাইজের পাথর পড়ে আছে, কর্নেলের ঘরে যেমনটি দেখেছিলুম।

মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। পাথরটা হাতে নিলুম এবং উঠে দাঁড়ালুম। হুঁ, ঠিকই ধরেছি। এই পাথর নিয়ে দিব্যি দু’ঠ্যাঙে চলাফেরা করা যায়–স্বচ্ছন্দে মানুষের মতোই। মাধ্যাকর্ষণ এখানে কম। তাই পাথরটা খুব কাজের।

তা হলে কি সেই পাথর এখানকারই? তার চেয়ে বড় কথা, এটা কোন্ গ্রহ এবং পৃথিবী থেকে কত দূরে?

ভাবতে ভাবতে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছি, দেখি, খানিকটা দূরে একটা পাথরের চাইয়ের ওপাশে কালো লোমশ গোরিলার মতো একটা প্রাণী হেঁটে যাচ্ছে। তার মাথার চুলের সঙ্গে এমনি একটা পাথর বাঁধা। টিকিতে পূজারী ব্রাহ্মণ যেমন করে ফুল বেঁধে রাখেন।

কিন্তু এ তো সর্বনেশে ব্যাপার! যেখানে অমন সাঙ্ঘাতিক প্রাণীর বসবাস আছে, সেখানে চলাফেরা করা নিরাপদ নয়। বিশেষ করে ওই পেল্লায় গড়নের প্রাণীদের সঙ্গে এঁটে ওঠার মতো অস্ত্রও সঙ্গে নেই।

কিন্তু মানুষের স্বভাব অজানাকে জানা। আমি এই আদিম সহজাত স্বভাব থেকে নিষ্কৃতি পেলুম না। জায়গাটা ভালো করে দেখার জন্য সাবধানে পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলুম। তারপর দেখি, একশো গজ দূরে একটা টিলার গায়ে বিশাল চৌকো সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ দিয়ে গোরিলা-মানুষেরা যাতায়াত করছে। সবারই চুলের সঙ্গে এমনি পাথরের বল বাঁধা।

অনেকক্ষণ ধরে ঘাপটি মেরে বসে লক্ষ রাখলুম। একসময় দেখলুম, প্রকাণ্ড এক গোরিলা-মানুষ বেরিয়ে এসে একটা উঁচু চত্বরে দাঁড়াল। তার হাতেও একটা বল। বলটা সে ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে। তারপর হা-হা করে বিকট হেসে উঠল। আর সব গোরিলা-মানুষও হাসিতে যোগ দিল। কানে তালা ধরে গেল সেই তুমুল হাসির শব্দে। ওদিকে বলটা উধাও হয়ে গেল।

এবার আর-একজন গোরিলা-মানুষ চত্বরটায় উঠল। তার হাতেও একটা বল। সে বলটা ছুড়ল। কিন্তু বলটা আকাশে না গিয়ে সোজা একটা পাহাড়ের ওপর পড়ল। বেচারা কাঁচুমাচু মুখে নেমে গেল।

কিন্তু এ তো দেখছি যেন ডিসকাস ছোঁড়ার খেলা! তা হলে কি এদের এই খেলারই বল দৈবাৎ পৃথিবীতে গিয়ে পড়ে?

আনন্দে নেচে উঠলুম। আমাদের অভিযানের লক্ষ্য যদি হয় সেই ওজনদার বলের রহস্য উন্মোচন, তা হলে সেই কৃতিত্ব আমার বরাতে জুটে গেল। কিন্তু কৃতিত্ব নিয়ে এখন করবটা কী? কোন কিটো গ্রহে কর্নেলরা রয়ে গেলেন, আর কোথায় আমার প্রিয় পৃথিবী, আর কোথায় এই অজানা গ্রহ!

স্পেসশিপের কাছে ফিরে এলুম। যানটি এমন জায়গায় নেমেছে, প্রায় চারদিকেই প্রকাণ্ড সব পাথরের স্তূপ। তাই ওদের চোখে পড়বে না। কিন্তু দৈবাৎ কেউ যদি এদিকে এগিয়ে আসে?

এবার বিকট হল্লার শব্দ, মাঝে-মাঝে হা-হা-হা-হা প্রচণ্ড হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবত আজ ওদের খেলাধুলোর উৎসব চলেছে। তাই এদিকে কারও আসার চান্স কম। এই সুযোগে আরও কয়েকটা বল কুড়িয়ে স্পেসশিপে বোঝাই করা যাক।

এত কম মাধ্যাকর্ষণ, কাজেই গোটা ছয়েক বল কুড়িয়ে আনা কঠিন হল না। তারপর বোতাম টিপতে থাকলুম, আগের মতোই এলোপাথাড়ি। এতে কাজ হল। কঁকুনি দিয়ে স্পেসশিপ আকাশে উঠে পড়ল। কিন্তু তারপর টালমাটাল অবস্থা। বিমান ঝড়ের মধ্যে পড়লে যেমন হয়। ভিশনস্ক্রিনে ফুটে উঠল : ‘বেশি ভারী হয়ে গেছি। ওজন কমাও। নইলে বিপদ।

মনমরা হয়ে একটা দুটো তিনটে করে ছ’টা পাথর ছুঁড়ে ফেলার পর বাকি রইল আমার হাতেরটা। ভিশনস্ক্রিনে ফুটল : ‘আরও ওজন কমাও।

রাগ করে বললুম, “ধ্যাত্তেরি! তুমি যাই বলো, হাতেরটা ফেলছি না। এটা আমার আবিষ্কারের সাক্ষী!”

ভিশনস্ক্রিনে বারবার লাল হরফে ফুটে উঠতে থাকল : ‘বিপদ…বিপদ…বিপদ..

তারপর ঝাঁকুনি খেলুম। স্পেসশিপ নেমেছে। সেই গ্রহ বলেই মনে হচ্ছে। কারণ নীচে রোদ্দুর এবং কালো পাথুরে পারিপার্শ্বিক। আবার তা হলে গোরিলা-মানুষদের গ্রহেই ফিরে এলুম!

বলটা প্যান্টের পকেটে ভরে নেমে গেলুম সাবধানেই। একটা সমতল উপত্যকার মতো জায়গা। দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখছি, হঠাৎ কী-একটা এসে আমার ওপর পড়ল এবং হ্যাঁচকা টান। দেখলুম, ল্যাসো ছুঁড়ে কেউ আমাকে আটকেছে এবং টানছে। আমি পড়ে যাচ্ছি না, তার কারণ বোঝা সহজ। কিন্তু ল্যাসোটার অন্য প্রান্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না। বহু দূর থেকে কেউ ল্যাসো ছুঁড়েছে। কম মাধ্যাকর্ষণের গ্রহে এটা সম্ভব। কিন্তু কে সে? কোনো গোরিলা-মানুষ হলে সত্যিই বিপদ। ভাষা না জানলে কাউকে কিছু বুঝিয়ে বলা কঠিন। ভাষা যে কী অসাধারণ জিনিস, এতক্ষণে মাথায় সেটা স্পষ্ট হল।

বন্দিদশায় চলেছি তো চলেছি। কতক্ষণ পরে দেখতে পেলুম, একটা ছোট্ট নদীর ধারে পাথরের চৌকো বাড়ি। বাড়ির সামনে, কী অবাক, আমার মতোই একটা মানুষ! তার হাতে ল্যাসোর ডগা। তার চেহারা বেজায় রাগী। মুখটা চিনাদের মতো। চিবুকে ছাগলদাড়ি। ঠোঁটের দু’ধার দু’চিলতে সূক্ষ্ম গোঁফ। পরনে আলখাল্লার মতো পোশাক। মাথায় চুঁচলো টুপি। টুপির ডগায় একই রকম একটা বল বসানো।

সামনাসামনি হলে সে ইংরেজিতে বলল, “আমি সেই চাংকো, দ্বিতীয় ব্রহ্মাণ্ডের সম্রাট। ওহে প্রথম ব্রহ্মাণ্ডের পুঁচকে ছোকরা! কোন সাহসে তুমি বিনা অনুমতিতে আমার সাম্রাজ্যে ঢুকেছ?”

খট করে মিলিটারি স্যালুট ঠুকে বললুম, “বেয়াদপি মাফ করবেন সম্রাট বাহাদুর। আমি দৈবাৎ এখানে এসে পড়েছি। যদি অনুমতি পাই, সব কথা খুলে বলব।”

সম্রাট চাংকো কুতকুতে চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, “তোমাকে ভালো ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত ওই লোকটার ভেঁপো ভাগনেটার মতো নও। বিচ্ছুটা আমায় বলে কী–সে নাকি প্রথম ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় ‘দেহশ্রী’ খেতাব পেয়েছে। হাঃহাঃহাঃহাঃ!”

সন্দিগ্ধ হয়ে বললুম, “আপনি ভবেশবাবুর ভাগনে ভেদা-পালোয়ানের কথা বলছেন কি? তাদের কী করে পেলেন এখানে?”

সম্রাট চাংকো ফঁস খুলে খুব হেসে-টেসে বললেন, “ধরে এনেছি। তবে পালোয়ানের অবস্থা দেখবে এসো।”

.

চার

পালোয়ানের অবস্থা করুণই বটে! পরনে সেই হাফপেন্টুল আর স্পোর্টিং গেঞ্জি। কিন্তু এ কী দশা তার!

একটা বিশাল হলঘরের ভেতর তাকে ছাদে টিকটিকির মতো সেঁটে থাকতে দেখলুম। ডাকলুম, “জগদীশবাবু! জগদীশবাবু!”

পালোয়ান সিলিং থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে কাতর মুখে বলল, “দাদা, আমি নামতে পারছি না। যতবার নামবার চেষ্টা করছি, সিলিংয়ে আরও সেঁটে যাচ্ছি।”

“মাধ্যাকর্ষণের অভাব, জগদীশবাবু!” একটু হেসে বললুম, “আপনার উচিত ছিল এখানকার একটা বল কুড়িয়ে পকেটে রাখা। তা হলে ওজন বেড়ে যেত, দিব্যি চলাফেরা করতে পারতেন।”

“রেখেছিলুম তো! ওই লোকটা কেড়ে নিল।”

সম্রাট চাংকো খাপ্পা হয়ে বললেন, “লোকটা! তুমি আমাকে লোকটা বলছ? আমি সম্রাট চাংকো। আমার সঙ্গে ফাজলামি? যাও তোমাকে বল দিতুম, আর দিচ্ছি না।”

বললুম, “সম্রাটবাহাদুর, আপনার আর এক অতিথি কোথায়?”

সম্রাট চাংকো চোখ পাকিয়ে বললেন, “অতিথি? সে তো আমার বন্দী। তাকে প্রথম ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে নোংরা জায়গা থেকে ধরে এনেছি।”

“কেন সম্রাটবাহাদুর?”

“আমার বন্ধুর নাতি তাকে একটা বল বেচতে চেয়েছিল। সে তাচ্ছিল্য করে কেনেনি। ছাদে দাঁড়িয়ে দূরবীনযন্ত্রে আমি সব দেখেছি। ওকে পরীক্ষার জন্য বলটা ওর বাড়িতে পর্যন্ত পাঠিয়েছিলুম। সেই বলকে সম্মানে পুজো না করে সে এই হোঁতকা পালোয়ানের মাথায় চাপিয়ে এক দাড়িওলা বুডোর বাড়ি নিয়ে গেল। ওঃ! অসহ্য, বড় অসহ্য অপমান!” এই বলে সম্রাট চাংকো দাঁত কিড়মিড় করতে থাকলেন।

জিজ্ঞেস করলুম, “আপনার বন্ধুর নাম?”

“ঐরাবত সিং। প্রথম ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে নোংরা গ্রহে তার জন্ম।”

“পৃথিবী সত্যিই বড় নোংরা গ্রহ, সম্রাটবাহাদুর!”

সম্রাট চাংকো আমার কাঁধে হাত রেখে চুপিচুপি বললেন, “কাউকে বোলো না! আমার জন্মও সেখানে। রাগ করে পালিয়ে এসেছি। ছ্যা-ছ্যা! দিনরাত্তির ঝগড়াঝাটি, খুনোখুনি, দলাদলি। সামান্য স্বার্থের জন্য লড়াই। ঘেন্না ধরে গিয়েছিল হে! বিশেষ করে আমার বন্ধু ঐরাবত সিং-ওই যে কী বলে তোমাদের পৃথিবীতে, হুঁ, ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিল। হেরে গেল। তোমাদের ভালো করার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু কেন হারল জানো কি? তাকে কারচুপি করে হারিয়ে দিল। রাগে-দুঃখে বেচারা হার্টফেল করে মারা গেল। খবরটা পেলুম দেরিতে। তখন আমি কুমড়ো-মানুষদের গ্রহ সবে জয় করেছি।”

শোনামাত্র বলে ফেললুম, “কুমড়ো-মানুষদের গ্রহেই আমার তিন সঙ্গী এখন বন্দী। দয়া করে ওদের উদ্ধার করুন, ইওর এক্সেলেন্সি! তাদের মধ্যে আপনার বন্ধুর নাতিও আছেন।”

সম্রাট চাংকো হা-হা করে হেসে বললেন, “সবই জানি হে ছোকরা! আমার দূরবীনযন্ত্রে সবই দেখেছি। একটু অপেক্ষা করো। আমার বাহিনী পাঠিয়েছি সেখানে। তাদের নিয়ে আসবে।”

এমন সময় একজন বিকট চেহারার গোরিলা-মানুষের কাঁধে চেপে ভবেশবাবুর আবির্ভাব ঘটল। কাঁধ থেকে নেমে ভবেশবাবু আমাকে দেখতে পেলেন। অবাক হয়ে বললেন, “মশাইকে চেনা-চেনা ঠেকছে?”

পরিচয় দিয়ে বললুম, “আপনার ভাগনেকে একটু বুঝিয়ে বলুন, যেন সম্রাটবাহাদুরকে সম্মান দেখান। তা না হলে ওঁকে টিকটিকি হয়েই কাটাতে হবে।”

গোরিলা-মানুষটি ততক্ষণে লাফ দিয়ে দিয়ে পালোয়ানকে কাতুকুতু দিতে শুরু করেছে। কাতুকুতুর চোটে পালোয়ান হেসে অস্থির এবং সিলিং-এ বুক ঠেকিয়ে এদিক-ওদিক করে বেড়াচ্ছে। সম্রাট চাংকোও খুব হাসছেন। ভবেশবাবু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “উপযুক্ত শাস্তি! পালোয়ানি দেখাবে বেপাড়ায়? নাও, বোঝে ঠ্যালা। আমি তোমাকে বাঁচাব না। তুমি হেসে মরো আর যাই করো। হতভাগা বুন্ধু!”

বললুম, “সম্রাটবাহাদুর! যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে। এবার ওঁকে রেহাই দিন।”

“তুমি বলছ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। কথা দিচ্ছি, ও যাতে আর বেয়াদপি না করে আমি দেখব।”

সম্রাট চাংকো গোরিলা-মানুষটিকে অদ্ভুত ভাষায় বললেন, “হাম্বো জাম্বো কাম্বো।” তারপর আলখাল্লার ভেতর থেকে একটা বল বের করলেন। গোরিলা-মানুষটি চলে গেল। তখন সম্রাট চাংকো পালোয়ানকে বললেন, “ওহে পালোয়ান! বল ছুঁড়ে দিচ্ছি। লুফে নিতে হবে। দেখি, তোমার হাতের তাক। না লুফতে পারলে আটকে থাকবে কিন্তু!”

পালোয়নের দিকে ফের দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তার মামা বললেন, “তোকে বলতুম ক্রিকেট খেলাটা শিখে নে! শিখলে কাজে লাগত।”

চারবারের বার বলটা ক্যাচ ধরল পালোয়ান এবং ধুপ করে নামতে পারল। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম অভ্যাসে, “আউট! আউট! আউট!”

সম্রাট চাংকো চোখ কটমট করে বললেন, “আর যাই বলল হে ছোকরা, তোমাদের ওই নোংরা জায়গার ভুতুড়ে খেলার টার্মগুলো আওড়াবে না। কান পচে যায়।”

পালোয়ান মুচকি হেসে বলল, “দাদা! সত্যিই আউট করে দিয়েছি বলুন! কেমন একখানা ক্যাচ ধরেছি।”

“আবার? আবার?” সম্রাট চাংকো হুঙ্কার দিলেন, “বল কেড়ে নেব বলে দিচ্ছি।”

“ভোঁদা-পালোয়ান ভড়কে গিয়ে জিভ কাটল, “সরি স্যার!”

“স্যার নয়, ইওর এক্সেলেন্সি বলো!”

ভোঁদা মুখ-তাকাতাকি করছে এবং তার মামা চোখ-ইশারা করছেন। আমিও করছি। সম্রাট চাংকো ক্রুদ্ধ হয়ে চোখ পিটপিট করছেন। অগত্যা ভোঁদা বলল, “সরি, ইওর এক্সেলেন্সি!”

সম্রাট চাংকো খুশি হয়ে বললেন, “এসো।”

ঘরের পর ঘর, সবই কালো, তারপর ঘর। অনেক গোলকধাঁধা পেরিয়ে একটা ঘরে পৌঁছলুম আমরা। এতক্ষণে বুঝলুম, সম্রাট চাংকো একজন বিজ্ঞানী। চন্দ্রকান্তবাবুর চেয়ে উঁচুদরের বিজ্ঞানী নিঃসন্দেহে। বিশাল ল্যাব। কতরকম যন্ত্র। জার। কত বিচিত্র সব কমপিউটার। এককোণে সোফায় আমাদের বসতে বললেন সম্রাট চাংকো। বসার পর তারিফ করে বললুম, “আমাদের বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তেরও একটা ল্যাব আছে। তবে এর কাছে নস্যি!”

সম্রাট চাংকো বাঁকা হেসে বললেন, “চন্দ্রকান্ত বিজ্ঞানের বোঝে কী? ও তো একটা বুন্ধু।”

“তাঁকে আপনি চেনেন সম্রাটবাহাদুর?”

“আলবাত চিনি। আমার সঙ্গে তাইপেতে আলাপ হয়েছিল একটা সেমিনারে। যাই হোক, এবার ওদের ধরে আনার ব্যবস্থা করি।” বলে সম্রাট চাংকো একটা যন্ত্রের সামনে বসলেন, “শুধু একটাই সমস্যা। কুমড়ো-মানুষগুলো বেয়াড়া। খুব আমুদে স্বভাবের কিনা! তাই আমাদের জিনিস পেলে ছাড়তে চায় না। দেখা যাক। নইলে আমার গোরিলা-সেনা পাঠাতে হবে। ওদের ওরা খুব ভয় পায়।”

বিশাল ভিশনস্ক্রিনে এবার ফুটে উঠল সেই কিটো গ্রহের মনোরম সবুজ উপত্যকা আর রং-বেরঙের কুমড়ো-মানুষ। আমার বৃদ্ধ বন্ধু চোখে বাইনোকুলার রেখে যথারীতি এদিকে-ওদিকে, সম্ভবত পাখি খুঁজছেন অথবা প্রজাপতি। কিটো গ্রহে পাখি-প্রজাপতি দেখেনি। তবে কর্নেলের চোখ। কিছু বলা যায় না!

গজকুমারবাবুকে দেখলুম রেসের আয়োজন করেছেন। কুমড়ো-মানুষেরা দৌড়চ্ছে। উনি হাততালি দিচ্ছেন। হালদারমশাই একটা ডিমাললা বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করছেন। গগায়েন্দার স্বভাব। আর বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত নোটবইতে কীসব টুকছেন। কুমড়ো-মানুষেরা রেসের জায়গায় ভিড় করেছে।

সম্রাট চাংকো বললেন, “ওদের এক্সরের ল্যাসেতে বন্দী করে আনা যায়। যেভাবে আমার বন্ধুর নাতি আর এই মামা-ভাগনেকে ধরে এনেছি। কিন্তু চন্দ্রকান্ত মহা ধূর্ত। ওর পকেটে একটা রে-ডিটেক্টর আছে। টের পেয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেই সমস্যা। কুমড়ো-মানুষদের ঘরগুলো এমন ধাতুতে তৈরি, কোনো অদৃশ্য রশ্মিই ঢুকতে পারবে না। হুঁ, গোরিলা-বাহিনীই পাঠানো যাক।” বলে হাঁক দিলেন, “টাম্বো মাম্বো জাম্বো!”

অমনি ভিশনস্ক্রিনের দৃশ্য মুছে একদঙ্গল গোরিলা-মানুষের ছবি ফুটে উঠল। তারপর দেখলুম। সেই দানোর মতো গোরিলা-মানুষ, যে ভোঁদা-পালোয়ানকে কাতুকুতু দিচ্ছিল, গোরিলা-মানুষদের চুলের ডগা থেকে আজব বলগুলো খুলে নিল।

সঙ্গে-সঙ্গে তারা বাই-বাই শূন্যে ভেসে উঠল এবং দেখতে দেখতে উধাও হয়েও গেল। সম্রাট চাংকো বসে রইলেন। এই সুযোগে ফিসফিস করে ভবেশবাবুকে বললুম, “আপনি ওই গোরিলা-মানুষটার কাঁধে চেপেছিলেন কেন?”

ভবেশবাবু তেতোমুখে অমনি চাপা স্বরে বললেন, “ইচ্ছে করে কি চেপেছি মশাই? ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে কী পেয়েছে কে জানে। যখন-তখন এসে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে বেড়ায়। আর নামবার চেষ্টা করলেই কাতুকুতু।”

সম্রাট চাংকো ঘুরে বললেন, “কীসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে যেন? সাবধান!”

ঝটপট বললুম, “না, ইওর এক্সেলেন্সি! আমরা আপনার ক্ষমতার প্রশংসা করছি।”

“এ কী ক্ষমতা দেখছ হে ছোকরা! আসল ক্ষমতা দেখবে, চাঁদুটাকে আসতে দাও আগে।”

“চাঁদু, মানে চন্দ্রকান্তবাবুর কথা বলছেন কি?”

সম্রাট চাংকো অট্টহাসি হেসে বললেন, “আবার কার?” বলে তিনি খুটখুট করে বিজ্ঞানী চন্দ্রান্তের মতোই কমপিউটারের বোতাম টিপতে থাকলেন। একটু পরে ভিশনস্ক্রিনে একটা অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠল। প্রথমে মনে হল একটা বাজপাখি উড়ে আসছে। কিন্তু ক্রমে সেটা বড় হতে থাকল। তখন দেখলুম বাজপাখি গড়নের একটা বিকট মানুষ, দু’টি প্রকাণ্ড ডানা।

সম্রাট চাংকো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। বললেন, “সর্বনাশ! আবার ঈগল-মানুষটা হানা দিতে আসছে দেখছি! জানি না, আমার কোন প্রজাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে। সমস্যা হল, ওকে কোনো অস্ত্রেই কাবু করা যায় না।” বলে একটা ছোট্ট স্পিকার হাঁকলেন, “আম্বো ডাম্বো হ্রাম্বো! আম্বো ডাম্বো হ্রাম্বো!”

তারপর আসন ছেড়ে উঠে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা ওঁকে অনুসরণ করলুম। একটু পরে খোলা চত্বরে দেখলুম সম্রাট চাংকো একটা লম্বাটে পিস্তল তাক করে আছেন। নীলচে রোদ্দুরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ঈগল-মানুষটা আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গোরিলা-মানুষদের অবস্থা দেখে মায়া হল। তারা তাড়াহুড়ো করে যে-যেখানে পারছে, লুকিয়ে পড়ছে। আড়াল থেকে বড়-বড় পাথরও ছুঁড়ছে কেউ-কেউ। মাধ্যাকর্ষণ কম। তাই প্রকাণ্ড পাথরগুলো আকাশে ছুটে যাচ্ছে। আশ্চর্য, ঈগল-মানুষটা পায়ের নখ দিয়ে পাথর ধরে ফেলে পালটা ছুঁড়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেগুলো তুলোর মতো উড়তে উড়তে বহু দূরে গিয়ে আস্তে-আস্তে নেমে যাচ্ছে। সম্রাট চাংকোর পিস্তল থেকে নীল-লাল-হলুদ আলোর গুলি শাঁই-শাই করে বেরিয়ে ঈগল-মানুষটাকে আঘাত করছে। কিন্তু তার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ধোঁয়া হয়ে চাপচাপ উড়ে যাচ্ছে। আকাশ যেন ক্রমে সাদা মেঘে-মেঘে ঢেকে গেল। তার ভেতর একটা অতিকায় ঈগলের ওড়াওড়ি।

ভেঁদা-পালোয়ান হঠাৎ খেপে গেল। আঁক শব্দে পেশী ফুলিয়ে বলল, “তবে রে বদমাশ!” তারপর সে ঊরুতে থাপ্পড় মেরে ঈগল-মানুষটাকে কুস্তিতে চ্যালেঞ্জ করতে লাগল, “চলা আও! কাম অন!” ।

ভবেশবাবু ধমক দিলেন, “আঁই বাঁদর! মারা পড়বি যে! সাঙ্ঘাতিক নখ দেখতে পাচ্ছিস না?”

ভোঁদা-পালোয়ান গর্জে বলল, “নখ ভেঙে ছাতু করে দেব। কাম ইন ঈগলকা বাচ্চা!”

আমি বললুম, “জগদীশবাবু! জগদীশবাবু! আগে গোটাকতক বল কুড়িয়ে নিন। তা হলে ঈগল-মানুষটাকে নামিয়ে এনে লড়তে পারবেন। সম্রাটবাহাদুর! আপনার ল্যাসো কোথায়?”

সম্রাট চাংকো বলে উঠলেন, “খাসা বুদ্ধি! তুমি বকশিশ পাবে হে ছোকরা! আমার মাথা খুলে গেছে। হায়, হায়! কেন যে এটা অ্যাদ্দিন মাথায় ঢোকেনি?” বলে তিনি আলখাল্লা থেকে সেই ল্যাসোটা বের করলেন। ঝটপট কয়েকটা বল কুড়িয়ে পালোয়নের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “আমি ওকে আটকাচ্ছি। তুমি রেডি হও, পালোয়ান!”

তিনবারের বার ল্যাসোটা ঈগল-মানুষের এক পায়ে আটকে গেল। আমি আর ভবেশবাবু ল্যাম্বোর গোড়ায় হাত লাগালুম। তিনজনে টানতে থাকলুম হেঁইয়ো-হেঁইয়ো করে। ঈগল-মানুষটার জোরে এঁটে ওঠা কঠিন। পালোয়ান এবার বলের ওজনে খুব ওজনদার মানুষ। সে-ও হাত লাগাল। এতক্ষণ ঈগল-মানুষ জব্দ হল। নীচে নামানো গেল তাকে। তারপর পালোয়ান একটা বল ছুড়ল তার দিকে। ঠকাস করে লাগল ডানায়। আমরা তিনজনে ততক্ষণে পাথুরে মাটিতে উপুড় হয়েছি।

পালোয়ান ফের বল ছুঁড়তে যাচ্ছিল, নিষেধ করে বললুম, “না, না। ওজন কমে যাবে আপনার। এবার কুস্তি শুরু করুন। কিন্তু সাবধান! ঠুকরে না দেয়!”

পালোয়ান বলল, “ওজন বেড়েই তো প্রবলেম দাদা! লাফাতে পারছি না যে! ওজন কমাই আগে। তারপর এক লাফে…।” বলে বাড়তি বলগুলো ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ সে থামল। বলল, “নাহ দাদা! বলসুষ্ঠু ওর পিঠে চাপব। তা হলে কাবু হবে। আপনারা টেনে আটকে রাখুন।”

ঈগল-মানুষটার ডানার ঝাঁপটানিতে ঝড় বইছিল। পালোয়ান চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একাকে লাফ দিয়ে তার পিঠে চেপে গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ঈগল-মানুষটা তীক্ষ্ণ ঠোঁট ঘুরিয়ে বিকট ক্রা-ক্রা গর্জন করতে করতে নেতিয়ে পড়ল। পালোয়ান একগাল হেসে বলল, “রামটিপুনির চোটে ব্যাটাচ্ছেলের দম বেরিয়ে গেছে।”

সে ঈগল-মানুষটার পিঠে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভবেশবাবু বললেন, “নেমে আয় ভোঁদা! আর বীরত্ব দেখাতে হবে না।”

পালোয়ান একলাফে নামল। তারপর বাড়তি বলগুলো ঈগল-মানুষের প্রকাণ্ড ঠোঁটের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “বডি উড়ে যাবে না! এ কী জায়গা বাবা! বলগুলো না থাকলে উড়ে যায় মানুষ।”

ঈগল-মানুষ পড়ে রইল। সম্রাট চাংকো পালোয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমার ওপর খুব খুশি হয়েছি যে, ছোকরা! এসো, তোমাকে এক গ্লাস অমৃত খাইয়ে দিই। চিরজীবী হবে। তবে বলে রাখা উচিত, এই গ্রহ ছেড়ে তোমাদের ওই নোংরা গ্রহে গেলে কিন্তু অমৃত-শরবত কোনো কাজ দেবে না। ভেবে দ্যাখো, কী করবে।”

ভবেশবাবু ভাগনেকে চোখের ইশারায় খেতে নিষেধ করলেন। কিন্তু পালোয়ান বলল, “মামাবাবু! আমি আর পৃথিবীতে ফিরব না। এখানেই কুস্তির আখড়া খুলব। গোরিলা-মানুষদের বডি বিল্ডআপ শেখাব। ওদের অমন তাগড়াই বডি। কিন্তু কোনো কাজে লাগাতে জানে না। খেলা বলতে খালি বল ছোঁড়া। ধুস! ও তো পুঁচকে ছেলেমেয়েদের খেলা।”

ল্যাবে ফিরে সম্রাট চাংকো এক গ্লাস অমৃত দিলেন ভোঁদাকে। সে মামাবাবুর ফের নিষেধ সত্ত্বেও টো-টো করে খেয়ে বলল, “ওঁদেরও দিন দাদু! একলা খাওয়া কি…”

সম্রাট চাংকো ফুঁসে উঠলেন, “দাদু? দাদু মানে? সম্রাট চাংকোকে তুমি দাদু বলছ?” রফা করে দিয়ে বললুম, “দাদু, মন্দ না ইওর এক্সেলেন্সি! তবে সম্রাটদাদু বলাই উচিত।”

“ওকে! সম্রাটদাদু বলো।”

ভোঁদা বলল, “সম্রাটদাদু! মামাবাবু আর এই রিপোর্টারবাবুকে এক গ্লাস করে অমৃত দিন।”

সম্রাট চাংকো চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন, “তুমি রিপোর্টার নাকি হে ছোকরা? সর্বনাশ! আগে জানলে তো সাবধান হয়ে যেতুম। হুঁ, সবাইকে পৃথিবীতে ফেরার অনুমতি দেব। তোমাকে নয়।”

“কেন সম্রাটবাহাদুর?”

“ওরে বাবা! ফিরে গিয়ে তুমি কাগজে আমার কথা লিখবে আর আঁকে-ঝকে এখানে রিপোর্টার এসে জুটবে। আমাকে জেরবার করবে। আমি ওতে নেই। রিপোর্টাররা বড্ড ডিসটার্ব করে?”

“না, সম্রাটবাহাদুর! আজকাল রিপোর্টারদেরই যেচে-পড়ে সবাই খবর দেয়। পাবলিসিটি চায় কাগজে। সে-যুগ আর পৃথিবীতে নেই।”

“আমি পাবলিসিটি চাইনে।” গম্ভীর মুখে এ-কথা বলে এক গ্লাস অমৃত বের করলেন সম্রাট চাংকো, “নাও, খেয়ে ফেলো। পৃথিবীতে তোমাকে ফিরতে যখন দিচ্ছি না, তখন তুমি এটা খাও। এই মামা-ভদ্রলোকের লোহালক্কড়ের ব্যাবসা আছে। এখানে খামোকা পড়ে থাকলে ব্যাবসার লোকসান হবে। শুধু ওঁকে ফিরে যেতে দেব।”

অমৃতটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেয়ে দেখলুম, স্বাদটা মন্দ না। কতকটা বেলের শরবতের মতো স্বাদ। ভবেশবাবু করুণ মুখে বললেন, “অগত্যা এক গ্লাস জল পেলে হত। তেষ্টা পেয়েছে, এ-বয়সে এতক্ষণ দড়ি ধরে টানাটানি করে বড্ড টায়ার্ড হয়ে গেছি সম্রাটবাহাদুর!”

সম্রাট চাংকো ফিক করে হাসলেন, “ঠিক আছে। আপনাকে জলের বদলে অমৃতই দিচ্ছি। তবে ওই নোংরা গ্রহে ফিরলে অমৃতের গুণ টিকবে না। সাবধান মশাই! পৃথিবীতে ফিরে যেন নিজেকে অমর ভাববেন না।”

ভবেশবাবু সোফায় বসে তারিয়ে-তারিয়ে অমৃত খেতে থাকলেন। মুখে অমায়িক ভাব ফুটে উঠল। চাপা স্বরে বললেন, “লোহালক্কড়ের ব্যাবসাটা এখানে করতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু চলবে কি? ওই গোরিলা-মানুষগুলো কেনাকাটা-বিক্রিবাটা বোঝে বলে মনে হয় না। খালি হাম্বা-হাম্বা করে বেড়ায় গোরুর মতো!”

পালোয়ান-ভাগনে শুধরে দিল, “না মামাবাবু! হাম্বো হাম্বা!”

“ওই হল আর কি! তবে ভোঁদা, তুই কি সত্যি এখানে থাকবি ভেবেছিস?”

“হুঁউ।”

ভবেশবাবু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন, “তোর নামে সম্পত্তি উইল করে দিতুম। আর নবডঙ্কাটিও পাবি না কিন্তু! ভেবে দেখ।”

ভোঁদা পালটা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “নবডঙ্কাটি! আমি লোহালক্কড়ের মধ্যে থেকে আপনার মতো মরচে ধরে যাব নাকি?”

মামা-ভাগনের মধ্যে ঝগড়া বাধার উপক্রম হয়েছিল, সেই সময় ভিশনস্ক্রিনে একটা দৃশ্য ফুটে ওঠায় তা থেমে গেল। গোরিলা-মানুষদের সঙ্গে ধুন্ধুর যুদ্ধ বেধেছে। কুমড়ো-মানুষরাও দমাদ্দম গোরিলা-মানুষদের ওপর পড়ছে। আর গোয়েন্দা-হালদারমশাই ফঁক বুঝে গোরিলা-মানুষদের টিকি থেকে লোহার বল খুলে ফেলছেন। অমনি তারা ভড়কে গিয়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে। সম্রাট চাংকো হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, “তবে রে ব্যাটা টিকটিকি!”

.

পাঁচ

এবার যুদ্ধটা দেখার মতো হত। কিন্তু সম্রাট চাংকো বেরিয়ে গেলেন। আমরাও বেরোলুম। উনি ব্যস্তভাবে হাতের একটা খুদে যন্ত্রের মাথায় বল কুড়িয়ে আটকে ট্রিগারে চাপ দিতে থাকলেন এবং বলগুলো উধাও হয়ে গেল। বুঝলুম, গোরিলাবাহিনীকে বল জোগাচ্ছেন। তা না হলে ওরা এই গ্রহে ফিরে বিপদে পড়বে। একটার-পর-একটা বল ছুঁড়ছিলেন সম্রাট চাংকো। সেই সময় ভবেশবাবু ফিসফিস করে বললেন, “জয়ন্তবাবু! এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। চলুন, পালিয়ে যাই!” ।

কথাটা মনে ধরল। ভোঁদাকে ইশারা করলুম। সে গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

তখন ভবেশবাবু তার কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে থাকলেন। সম্রাট চাংকো ক্রমশ বল ছুঁড়তে-ছুঁড়তে এগিয়ে চলেছেন। আমাদের লক্ষ করার সময় নেই ওঁর।

আজব পুরী থেকে বেরিয়ে পড়তে অসুবিধে হল না। কারণ সব প্রহরী গোরিলা-মানুষ তাদের সম্রাটের কাছে গিয়ে জুটেছে এবং হাম্বা হাম্বো করে সম্ভবত তার জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তা ছাড়া তারা তাদের বাহিনীর বিপদ টের পেয়েও থাকবে।

সোজা গিয়ে পৌঁছলুম। স্পেসশিপের কাছে। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, কোনো গোরিলা-মানুষ ওটার কোনো ক্ষতি করেনি। আসলে জায়গাটা ওদের বসতি এলাকা থেকে দূরে।

স্পেসশিপে মামা-ভাগনেকে ঢুকতে বললুম। দু’জনে মুখ-তাকালাকি করে অবশেষে ঢুকলেন। তারপর ভোঁদা বলল, “দাদা! এটা কী প্লেন? এমন প্লেন তো কখনও দেখিনি।”

বললুম, “এটা স্পেসশিপ। প্লিজ, চুপচাপ বসে থাকুন। সিটবেল্ট শক্ত করে বেঁধে নিন। আর বলগুলো বাইরে ফেলে দিন।”

স্পেসশিপটা চালানোর অভিজ্ঞতা খানিকটা হয়েছে। বলগুলো থাকলে আগের অবস্থা হত। তাই বলগুলো অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেলতে হল। মামা-ভাগনে এতে আপত্তি করলেন না। ওঁরা পালাতে পারলে বাঁচেন বলেই মনে হচ্ছিল। ভোঁদা-পালোয়ান কিছুক্ষণ আগেই এই গ্রহে থাকতে জেদ ধরেছিল। এখন সে খ্যাখ্যা করে হেসে বলল, “বাপস! এখানে মানুষ থাকে? ওদিকে আমার ক্লাবের অ্যানুয়াল ফাংশন পয়লা বোশেখ। কত্ত কাজ বাকি আছে।”

বোম টিপে স্পেসশিপে স্টার্ট দিলুম। এবার লক্ষ করলুম, প্রত্যেকটা বোতামে নির্দেশ লেখা। আছে। কাজেই আর আমাকে পায় কে? স্পেসশিপ নিমেষে আকাশে উঠে গেল।

কিন্তু কুমড়ো-মানুষদের সেই কিটো গ্রহে যাব কী করে? খুঁজতে-খুঁজতে একটা বোতামে লেখা দেখলুম, “এনকোয়ারি।” সেটা টিপতেই ছোট্ট ভিশনস্ক্রিনে সবুজ হরফে ফুটে উঠল, “সামনে টাইপমেশিন। যেখানে যেতে চাও, সেই হরফগুলো টেপো। সাবধান! ভুল হরফে আঙুল পড়ে না। যেন।”

টাইপমেশিনে কে. আই. টি. ও হরফগুলো টিপে দিলুম।

মিনিটখানেক পরে ভিশনস্ক্রিনে ফুটে উঠল, ‘এসে গেছে। নামতে হলে ডাউন লেখা বোতাম টেপো।

ব্যস! চিরবিকেলের দেশের বালিয়াড়িতে স্পেসশিপ নামল। ভোঁদা জানলা দিয়ে দেখে বলল, “এ কোথায় এলুম দাদা? রাজস্থানের মরুভূমি নাকি?”

বললুম, “না জগদীশবাবু! নামুন। কুমড়ো-মানুষদের দেশে এসে গেছি। এখন আমার সঙ্গীদের খোঁজে বেরোতে হবে।”

ভোঁদা নেমে গেল, আমিও নামলুম। ভবেশবাবু বললেন, “আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে। আপনারা যা হয় করুন মশাই! আমি এখন ঘুমোব।”

এটা আগের জায়গা নয়। কুমড়ো-মানুষদের সেই বসতিটা থেকে কতদূর পৌঁছেছি কে জানে? বললুম, “আসুন জগদীশবাবু! এবার কিন্তু রীতিমতো একটা অভিযান হবে। সম্রাট চাংকোর ল্যাবে

যে বসতিতে লড়াই দেখেছেন, সেটা খুঁজে বের করা দরকার।”

ভোঁদা চিন্তিতমুখে বলল, “চারদিকেই তো মরুভূমি!”

“চলুন। দেখা যাক। একটা বালির পাহাড় কোথায় আছে, আগে সেটাই খুঁজতে হবে।”

কিছুদূর চলার পর ভোঁদা বলল, “এক কাজ করা যাক দাদা! এখানে বালির ঢিবি করে চিহ্ন দিয়ে রাখি। তারপর আপনি যান ওই দিকে, আমি যাই এই দিকে। এক ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে না পেলে ফিরে আসব এখানে। কেমন?”

“মন্দ বলেননি! ঠিক আছে। আপনি বাঁ দিকে যান, আমি ডান দিকে। পরের বার আমি সামনে, আপনি পেছনে। তবু যদি খুঁজে না পাই আমরা, তা হলে আবার উড়ে অন্য একখানে গিয়ে নামব।”

ভোঁদার ওজন ভারী। তাই তার চলার গতি কম। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করে মনে হল, ভুল জায়গায় নেমেছি। সেই ঝা-ঝ বাজনাটা তো শোনা যাচ্ছে না।

চলেছি তো চলেছি। দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেল। বালির নিচু টিলা আছে অনেক। কিন্তু সেইরকম কোনো উঁচু টিলা দেখতে পাচ্ছি না। দূরে এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে খুঁজছি, হঠাৎ সামনে একটা বালির ঢিবি নড়তে শুরু করল। তারপর বেরিয়ে পড়ল দুটো জ্বলজ্বলে নীল চোখ এবং তারপর একটা প্রকাণ্ড কঁকড়া–অবিকল কুমডোর গড়ন। কিটো গ্রহের সব প্রাণীই দেখছি একই গড়নের।

ভীষণ চেহারার বিশাল কাকড়াটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। পিছু হটতে থাকলুম। কেন যে বুদ্ধি করে হাতে কিছু নিইনি! সেই ক্রু-ড্রাইভার দুটো কুমড়ো-মানুষদের বসতিতে পড়ে আছে কোথাও। প্রাণীটা আমাকে আক্রমণ করতেই আসছে। মরিয়া হয়ে দু’হাতে দু’মুঠো বালি তুলে ওটার চোখে ছুঁড়ে মারলুম। তাতে কিছু হল না।

কুমড়ো-কাঁকড়াটা আমাকে খপ করে ধরে তুলে নিজের পিঠে বসিয়ে নিল এবং নড়বড় করে চলতে শুরু করল। হাতির পিঠে চলার মতো অবস্থা। তার ওপর কাঁকড়াটা নাচতে-নাচতে চলেছে। ফলে আমিও প্রায় নাচছি। একটু পরে মনে হল, প্রাণীটা হিংস্র নয়। কুমড়ো-মানুষদের মতোই আমুদে দেন। দুটো দাঁড়া দিয়ে আমার কোমর আঁকড়ে রেখেছে। তাই পড়ে যাচ্ছি না। কিন্তু নাচতে হচ্ছেই।

তারপর তার গতি বাড়ল। যেন দ্রুতগামী ট্রাক।

সামনে অনেক বালির ঢিবি দেখা যাচ্ছিল। সেগুলো নড়তে নড়তে বেরিয়ে পড়ল আরও একদঙ্গল কুমড়ো-কাঁকড়া। সবাই ঘিরে ধরল। তারপর চারদিক থেকে দাঁড়া বের করে আমাকে টানাটানি শুরু করল তারা। আমার বাহক কিছুতেই আমাকে হাতছাড়া করবে না। এদিকে টানাটানির চোটে আমি অস্থির। এবার একটু করে খোঁচাও লাগছে। পোশাক ফর্দাফাই হয়ে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত কী ঘটত বলা যায় না, হঠাৎ আকাশে শনশন শব্দ শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা ঈগল-মানুষ নেমে আসছে।

অমনি কুমড়ো-কাকড়াগুলো ঝটপট বালিতে গা-ঢাকা দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এই সুযোগে আমি লাফ দিয়ে নীচে নামলুম। ঈগল-মানুষটা একটা কুমড়ো-কাকড়াকে ধরে টানাটানি করছিল। সে বেচারা গা-ঢাকা দেবার সুযোগ পায়নি।

দেখে মায়া হল। প্রাণীগুলো পৃথিবীর একজন মানুষ নিয়ে একটু আমোদ করতে চেয়েছিল শুধু। শয়তান ঈগল-মানুষটাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়? পালোয়ান থাকলে দেখার মতো একটা লড়াই বাধত সন্দেহ নেই।

আবার দু’খাবলা হাতে বালি তুলে নিলুম। এটাই এখন আমার অস্ত্র। ঈগল-মানুষটার চোখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলুম।

এতে কাজ হল। কাঁকড়াগুলো বালির প্রাণী। ঈগল-মানুষটা তা নয়। কাজেই বিকট ক্র্যাঁ-ক্র্যাঁ চিৎকার করে ডানা ঝাঁপটাতে-ঝাঁপটাতে উড়ে পালাল। নির্ঘাত অন্ধ হয়ে গেছে শয়তানটা!

সে পালিয়ে যাওয়ার পর কঁকড়াগুলো বেরোল। এবার তারা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ। চারদিক ঘিরে অদ্ভুত শব্দ করতে থাকল তারা। আঃ! ভাষা জিনিসটার মাহাত্ম্য আবার হাড়ে হাড়ে বুঝলুম। একটু পরে ইশারায় ওদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলুম, আমার মতো প্রাণী দেখেছে কি না। যদি দেখে থাকে, আমাকে যেন সোজা পৌঁছে দেয়।

অনেক অঙ্গভঙ্গি করার পর সেই প্রকাণ্ড কুমড়ো-কাকড়াটা এগিয়ে এসে খপ করে আমাকে ধরে পিঠে বসিয়ে নিল। তারপর দ্রুত ছুটে চলল। এবার যত যাচ্ছি, বালির ভেতর ঝাঁ-ঝাঁ বাজনা শোনা যাচ্ছে। তা হলে সঠিক দিকেই যাচ্ছি আমরা। কিছুক্ষণ পরে আনন্দে দেখলুম, সেই বালির লম্বাটে পাহাড়টা সামনে দেখা যাচ্ছে। এবার কাঁকড়া-ভদ্রলোক সাবধানে এগোচ্ছিলেন। বুঝলুম, কাঁকড়া হওয়ার বিপদ এখানে পৃথিবীর চেয়ে কম নয়। কাকড়া কার না প্রিয় খাদ্য? চাপা স্বরে ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে সাহস দিচ্ছিলুম।

পাহাড়ের মাথার কাছাকাছি আমাকে নামিয়ে দিয়ে তিনি জোরে ছুটে পালিয়ে গেলেন। হাত নেড়ে তাঁর উদ্দেশে বললুম, “বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে। আপনাদের সঙ্গে দেখা না করে এই গ্রহ ছেড়ে যাব না।”

নীচে সেই কুমড়ো-মানুষদের বসতি। কিন্তু খাঁ-খাঁ নিঝুম কেন? সাবধানে নেমে গেলুম সবুজ উপত্যকায়। তারপর দেখলুম, তিনটে গোরিলা-মানুষের মড়া ঝরনার জলে পাথরে আটকে আছে। দারুণ যুদ্ধ হয়ে গেছে তা হলে! আরও খানিকটা এগিয়ে দেখি, ঢিবিঘরের ভেতর থেকে প্যাটপ্যাট করে অনেকগুলো কুমড়ো-মানুষ আমাকে উঁকি মেরে দেখছে। হাত নাড়তে-নাড়তে এগিয়ে গেলুম। কিন্তু তারা দরজা বন্ধ করে দিল।

মনমরা হয়ে ঝরনার ধারে গেলুম। এবার কয়েকটা কুমড়ো-মানুষের থ্যাতলানো মড়া দেখে শিউরে উঠলুম। তা হলে আমার সঙ্গীদের ওরা বন্দী করে নিয়ে যেতে পেরেছে! স্পেসশিপের কাছে পৌঁছনো দরকার। আবার সম্রাট চাংকোর পুরীতে ফিরে যেতে হবে সেই আজব বলের গ্রহে। ওঁদের উদ্ধার করতেই হবে।

আনমনে বালির পাহাড়টার দিকে চলেছি, হঠাৎ কী এক গন্ধ ভেসে এল। গন্ধটা খুব চেনা। নাক উঁচু করে শুঁকতে শুঁকতে টের পেলুম, চুরুটের গন্ধ। কিটো গ্রহের কুমড়ো-মানুষেরা কি চুরুট খায়? তা ছাড়া চুরুট তো নেহাত পৃথিবীর জিনিস!

এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকলুম, কে চুরুট খাচ্ছে। তারপর ডান দিকে ঝরনাধারার বাঁকে একটা ঝোঁপের মাথায় চকমকে কিছু দেখা গেল। জিনিসটা নড়ছে।

তারপর চিনতে পারলুম, ওটা একটা টাক এবং পার্থিব মাথারই টাক। অমনি চেঁচিয়ে উঠলুম, “কর্নেল! কর্নেল!”

বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ ঘুরে দাঁড়ালেন। মুখটা গম্ভীর। দৌড়ে কাছে গিয়ে বললুম, “আপনাকে সম্রাট চাংকোর গোরিলা-বাহিনী ধরে নিয়ে যায়নি?”

“তা হলে খুশি হতে?” কর্নেল একটু হাসলেন, “খুশি অবশ্য আমিও হতুম। কিন্তু কে জানে কেন, ওরা আমার চাইতে আমার টুপিটাকেই বন্দী করতে ব্যস্ত হল। যাকগে, প্রচুর পাখি দেখা হল ততক্ষণ। প্রজাপতি দেখলুম না, শুধু পাখি। আশ্চর্য ডার্লিং, সব পাখিই কুমড়ো-মানুষগুলোর মত দেখতে। পা নেই, ঠোঁট নেই। তবে শুধু দুটো ডানা আছে।”

“এখানে দেখলুম এতবড় একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। আপনি তখন কী করছিলেন?”

কর্নেল শ্বাস ছেড়ে বললেন, “সে বড় অদ্ভুত যুদ্ধ, জয়ন্ত! আমার মতো একজন প্রাক্তন যোদ্ধা অমন বিচ্ছিরি যুদ্ধ কখনও দেখেনি। বিনা অস্ত্রে যুদ্ধ বড্ড আদিম ধরনের ব্যাপার। আঁচড়ানো, কামড়ানো, কাতুকুতু…ছা-ছ্যা!” বলে পোড়া চুরুটটা ঝরনার জলে ফেলে দিলেন, “তোমার খবর বলো!”

আগাগোড়া সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিলুম। শোনার পর কর্নেল বললেন, “চাংকোর কথা চন্দ্রকান্তবাবু বলছিলেন। তিনিও নাকি এক বিজ্ঞানী। তবে পৃথিবীতে ওঁর নামে হুলিয়া বের করেছে

পুলিশ! ফিরলেই অ্যারেস্ট হয়ে জেল খাটতে হবে। তাই গ্রহান্তরে পালিয়ে এসেছেন।”

ব্যস্ত হয়ে বললুম, “চলুন! স্পেসশিপের সাহায্যে চন্দ্রকান্তবাবুদের উদ্ধার করতে হবে।”

প্রকৃতিবিদ যেন অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে পা বাড়িয়ে বললেন, “কিটো গ্রহ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কী সুন্দর সব বৃক্ষলতা, কত আশ্চর্য রং-বেরঙের আজব পাখি! শুধু ষষ্ঠীর কথা ভেবেই মন কেমন করছে। চলো!”

হাঁটতে-হাঁটতে বললুম, “আশ্চর্য মানুষ আপনি! আজব বলের রহস্য ফাঁস করতে অভিযানে বেরোলেন, আর সেসব ছেড়ে এখন কিটো মুল্লুকের প্রকৃতির জন্য হা-হুঁতাশ করছেন!”

“না, মানে, এখানকার লোকগুলো বড় সজ্জন। কর্নেল গম্ভীর মুখে মন্তব্য করলেন।

বালির পাহাড়টা ডিঙিয়ে কিছু দূর গেছি, সেই কঁকড়া-ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মনে হল, উনি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। হাত নাড়তেই এগিয়ে এসে আমাকে পিঠে চাপালেন। কর্নেলের সাদা দাড়ি একবার ছুঁয়ে শিশি শব্দ করলেন। বোধ হয়, শিশি মানে খি-খি হাসি!

দু’জনকে পিঠে বয়ে তরতর করে দৌড়লেন দৌড়বীর। স্পেসশিপের কাছে পৌঁছে দেখি, ভেতরে ভবেশবাবু ঘুমোচ্ছেন। ওঁর ভাগনের পাত্তা নেই। কঁকড়া-ভদ্রলোক চলে গেলেন। বললেন, “ভবেশবাবুকে জাগিও না। ঘুমনো মানুষকে জাগাতে নেই। তা ছাড়া জেগে উঠলেই নিরুদ্দিষ্ট ভাগনের জন্য হইচই বাধাবেন। চলো, আমরা সম্রাট চাংকোর গ্রহে পাড়ি জমাই। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করা দরকার।”

“কিন্তু জগদীশবাবু কোনো বিপদে পড়েননি তো?” চিন্তিত হয়ে বললুম, “বালির ঢিবির কাছে ওঁর অপেক্ষা করার কথা। দেখলুম না তো!”

কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখতে দেখতে বললেন, “বোধ হয় পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেঁদা-পালোয়ান। তবে ভয় নেই, ডার্লিং! কিটো গ্রহ খুব নিরাপদ জায়গা।”

স্পেসশিপে ঢুকে স্টার্ট দিলুম। কঁকুনির চোটে ঘুম ভেঙে গেল ভবেশবাবুর। রাঙা চোখে তাকিয়ে বললেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে ভোঁদা? আমার ঘুম ভাঙিয়েছিসতোকে এক পয়সার প্রপার্টি দেব না আর।”

কর্নেল পেছনে ঘুরে বললেন, “ভবেশবাবু! আমার মনে হচ্ছে, আপনার ঘুমটা এখনও ভাঙেনি।”

“আঁ!” বলে ভবেশবাবু চোখ কচলাতে থাকলেন। তারপর চারপাশ দেখে নিয়ে ফিক করে হাসলেন, “অ। তা হতচ্ছাড়া ভোঁদাটা কোথায়? কারও সঙ্গে কুস্তি লড়ছে নাকি?”

“তা বলা যায় না।” কর্নেল বললেন, “তবে ভাববেন না। ওকে কেউ এঁটে উঠতে পারবে না।”

“কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোথায় বলুন তো?”

“সেই আজব বলের দেশে।”

ভবেশবাবু খুশি হলেন, “সম্রাট চাংকো লোকটা বাজে। ওর পাল্লায় পড়া ঠিক হবে না। তবে আমি স্যার এবার অন্তত একডজন বল কুড়োব। নিয়ে গিয়ে বেচতে পারলে প্রচুর লাভ হবে। সম্রাট চাংকোর কাছে শুনেছি, একটা বল থেকে পুরো একটা জাহাজের খোল বানানো যায়। শুধু একটাই সমস্যা, বলগুলোর ভেতর ভূতের বাস। তাই অমন সুড়ুত করে পালিয়ে যায়। ভূতের রোজা ডেকে ভূতটাকে তাড়াব। চাংকোবাবুর দেশে গিয়েই থাকবে ওরা।”

বললুম, “ভবেশবাবু! চাংকোবাবু বলবেন না। বললেই বিপদে পড়বেন।”

ভবেশবাবু গম্ভীর হলেন, “না, না। এখানে আপনাদের সামনে বলছি। ওঁর রাজ্যে গিয়ে বলব না।”

স্পেসশিপটা বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত এমনভাবে তৈরি করেছেন, আমার মতো আনাড়িরও চালাতে আর অসুবিধে হচ্ছিল না। সব নির্দেশ দেওয়া আছে। ক্রমশ সেগুলো বুঝতে পেরে গেছি। কর্নেল আমার তারিফ করছিলেন বারবার। গোরিলা-মানুষদের দেশ, অর্থাৎ সম্রাট চাংকোর গ্রহে পৌঁছনোর জন্য বুদ্ধি খাঁটিয়ে টাইপরাইটারে যে ইংরেজি হরফগুলো টিপলুম, তার মানে দাঁড়ায়, ‘যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে এসেছি, সেইখানে যেতে হবে।

ভিশনস্ক্রিনে ফুটে উঠল, ওকে।

সেই নীলাভ রোদের গ্রহে স্পেসশিপ নামল। প্রথমে দরজা খুলে আমি হেঁটমুণ্ডে নেমে একটা বল কুড়িয়ে পকেটে ভরে দুই ঠ্যাঙে সোজা হলুম। তারপর দুটো বল কুড়িয়ে কর্নেল এবং ভবেশবাবুকে দিলুম। ওঁরা বল পকেটস্থ করে নেমে এলেন। সমতল উপত্যকাতেই নেমেছি, যেখানে আগের বার নেমেছিলুম। এমন অদ্ভুত আলোয় বেশি দূর দৃষ্টি চলে । সম্রাট চাংকোর পুরী কুয়াশার মতো আবছায়ায় লুকিয়ে আছে কোথায়।

কর্নেল বাইনোকুলার চোখে তুলে বললেন, “সামনে সোজা এগিয়ে গেলে সম্রাট চাংকোর বাড়ি। চত্বরে কী একটা হচ্ছে। রেস নাকি? গজকুমার সিংহের কীর্তি! গোরিলা-মানুষদের রেসে নামিয়েছেন। কিটো গ্রহেও কুমড়ো-মানুষদের নিয়ে রেস লড়িয়েছিলেন।”

বললুম, “এবার কিন্তু আমি লুকিয়ে যাব, কর্নেল! সম্রাটবাহাদুর আমার ওপর রেগে আছেন। আপনি আগে চলে যান বরং। আপনাকে পেলে খুশিই হবেন উনি।”

কর্নেল হনহন করে হেঁটে উধাও হয়ে গেলেন। ভবেশবাবু ব্যস্তভাবে বল কুড়িয়ে পকেট বোঝাই করতে থাকলেন। বললুম, “নিয়ে যাবেন কেমন করে? স্পেসশিপে নেওয়া যাবে না যে!”

ভবেশবাবু বললেন, “দেখা যাক, কী হয়। তবে মশাই, আমি ওখানে যাচ্ছি না। বল কুড়নো শেষ। এবার আমি গাড়ির ভেতর গিয়ে ঘুমাব। কী খাওয়াল অমৃত বলে, খালি ঘুম পাচ্ছে।”

তিনি স্পেসশিপে ঢুকে পড়লেন। আমি সাবধানে চলতে থাকলুম। কিছু দূর চলার পর সেই নদীটা দেখতে পেলুম। নদীর বাঁকের কাছে আবছায়ার ভেতর সম্রাট চাংকোর বাড়ি দেখা গেল। একটা চাপা হট্টগোলও কানে এল। কী করা উচিত ভাবছি, সেই-সময় মাথার ওপর শনশন শব্দ। তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। একটা ঈগল-মানুষ নেমে আসছে আমার দিকে।

একলাফে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। তারপর দেখলুম, ঈগল-মানুষটার পিঠে কেউ বসে আছে এবং তার মাথার ঝুঁটি ধরে মোচড় দিচ্ছে। ঈগল-মানুষটা ক্রা-ক্রা বিকট চেঁচিয়ে শনশন শব্দে নীচে নামল। তারপর তার পিঠ থেকে নামল ভোঁদা-পালোয়ান।

নেমেই সে ঈগল-মানুষটার সঙ্গে যেন কানামাছি খেলতে শুরু করল। ঈগল-মানুষটা ঠোঁট হাঁ করে যেদিকে ঘুরছে, পালোয়ান একলাফে তার উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, “জগদীশবাবু! জগদীশবাবু!”

পালোয়ান আমাকে দেখেই খ্যাখ্যা করে হেসে বলল, “পাখিটা কানা দাদা! তাই ওর পিঠে চাপতে অসুবিধে হয়নি।” বলে সে লেজটা ধরে ফেলল এবং পালোয়ানের কাণ্ড, বাই-বাই করে চক্কর খাইয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলল। ঝপাস শব্দে ঈগল-মানুষটা জলে পড়ে স্রোতের বেগে ভেসে গেল। ডানা ভিজে গেলে আর ওড়ার ক্ষমতা নেই। তা হলে কিটো গ্রহে এই ঈগল-মানুষটাকেই অন্ধ করে দিয়েছিলুম!

ভোঁদা-পালোয়ান খুব হেসে বলল, “খুব জব্দ। তা দাদা, মামাবাবুর খবর কী?”

“স্পেসশিপের ভেতর ঘুমোচ্ছেন।”

ভোঁদা বলল, “ঘুমোক। লোহালক্কড়ের ভেতর বসে মামাবাবুর ঘুমনো অভ্যেস। আর এ তো গাড়ির ভেতর নরম গদি!”

.

ছয়

আমার কাছে সব শোনার পর ভোঁদা-পালোয়ান তার হাফপ্যান্টের দুই পকেটে অনেকগুলো বল কুড়িয়ে ভরল। তারপর বলল, “এগুলো কেন নিলুম জানেন? গোরিলা-মানুষদের সঙ্গে দরকার হলে ফাইট দেব। আপনিও নিন দাদা। ধরতে এলেই ঠাই করে ছুঁড়বেন। ঠ্যাঙে ছুঁড়বেন, নয় তো নাকে। মানুষের বডির ঠ্যাঙ আর নাক, খুব ভাইটাল জায়গা।”

বুদ্ধিটা মনে ধরল। আমিও অনেক বল কুড়িয়ে পকেট বোঝাই করলুম। তারপর দু’জনে সম্রাট চাংকোর পুরীর দিকে সাবধানে এগিয়ে গেলুম।

বড়-বড় পাথরের আড়াল দিয়ে গেটের কাছে পৌঁছলুম আমরা। দু’জন প্রহরী গোরিলা-মানুষ পা ছড়িয়ে দু’ধারে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তা হলে সম্রাট চাংকোর গ্রহে এটা নিশ্চয় রাত্রিবেলা। তাই আলো এত কম! ভোঁদা ফিসফিস করে বলল, “টিকিতে বাঁধা বল খুলে নিলেই এরা জব্দ। আকাশে ভেসে বেড়াবে। আপনি বাঁ দিকের সেন্ট্রির, আমি ডান দিকের সেন্ট্রির বল খুলে নেব। কাম অন, দাদা!”

দু’জন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে কাছে গিয়ে দুই প্রহরীর টিকি থেকে বল খুলে ফেললুম। অমনি তারা আকাশে উঠে গেল। কিন্তু কী ঘুম রে বাবা! আকাশে ভেসেও নাক ডাকাতে থাকল। ভেতরে বিশাল প্রাঙ্গণে ভিড়। গোরিলা-মানুযেরা চক্কর দিয়ে দৌড়চ্ছে। গজকুমার সিং একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। তার পেছনে সিংহাসনে সম্রাট চাংকো বসে আছেন। একপাশে বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে হাসিমুখে বসে থাকতে দেখলুম। কিন্তু গোয়েন্দা-হালদারমশাই কোথায়?

পাছে কারও চোখে পড়ি, আমরা বাঁ দিকের একটা ঘরে ঢুকে পড়লুম। সেই হলঘর। জনপ্রাণীটি নেই। হঠাৎ মাথার ওপর থেকে চিচি করে কেউ বলল, “গেছি! এক্কেরে গেছি! ও জয়ন্তবাবু! আমারে লামান!”

মুখ তুলেই হালদারমশাইকে দেখতে পেলুম। সিলিং-এ টিকটিকির মতো সেঁটে আছেন। বুঝলুম সম্রাট চাংকো শাস্তি দিয়েছেন। চাপা গলায় বললুম, “বল কেড়ে নিয়েছে তো? ঠিক আছে। একটা বল ছুঁড়ে দিচ্ছি। ক্যাচ ধরুন।”

বারবার বল ছুড়ি, কিন্তু হালদারমশাই ধরতে পারেন না। ভোঁদা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি কখনও ক্রিকেট খেলেননি। কী আপনি? আজকাল ক্রিকেট খেলে না, এমন কেউ আছে?”

হালদারমশাই করুণ মুখে বললেন, “ক্রিকেটবল দেখলেই ভয় করত যে! মনে হত, চোখে এসে পড়বে। জয়ন্তবাবু! ট্রাই এগেন।”

পাঁচবারের বার বলটা খপ করে ধরে ফেললেন গোয়েন্দাপ্রবর। তারপর ধপাস করে মেঝেয় নামলেন। বললুম, “বলটা পকেটে ঢোকান আগে।”

“হঃ!” বল পকেটে ঢুকিয়ে হালদারমশাই বললেন, “খবর কন শুনি।”

“খবর পরে হবে। কর্নেলকে দেখেছেন?”

“উ! কর্নেল-স্যার আমাকে দেখেও দেখলেন না। ওই ঘরে ঢুকে গেলেন।”

তিনজনে সেই ঘরে ঢুকে গিয়ে দেখি, কর্নেল একটা ইজিচেয়ারে বসে আছেন। মুখে চুরুট, চোখ বন্ধ এবং নাক ডাকছে। ডাকলুম, “কর্নেল! কর্নেল!”

কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন, “শুয়ে পড়া ডার্লিং! অনেক রাত হয়েছে।”

হালদারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, “এ কি ঘুমনোর সময় কর্নেল-স্যার?”

“চাংকোবাহাদুরের বেডরুম এটা। শুয়ে পড়ুন।” আবার কর্নেলের নাক-ডাকা শুরু হল।

সম্রাট চাংকোর রাজকীয় বিছানার দিকে তাকিয়ে হালদারমশাই বললেন, “হঃ!” তারপর হঠাৎ বিকট হাই তুলে সেদিকে এগিয়ে গেলেন এবং শুয়ে পড়লেন।

ভোঁদাই হাই তুলে বলল, “দাদা! বিচ্ছিরি ঘুম পাচ্ছে কেন বলুন তো? আমি শুই?”

বলে সে মেঝেতেই চিতপাত হল। তারপর টের পেলুম আমারও ঘুম পাচ্ছে। সম্রাট চাংকোর বেডরুমে কি ঘুমের ওষুধ ছড়ানো আছে?

একটা গদিআঁটা আসনে বসে হেলান দিলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি। কী একটা চাঁচামেচিতে সেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন বুঝলুম আমাকে একটা গোরিলা-মানুষ কাতুকুতু দিচ্ছে। এক লাফে উঠে দাঁড়ালুম। গোরিলা-মানুষটা ক্ষান্ত হল সঙ্গে-সঙ্গে। সম্রাট চাংকো রাগে ফুঁসছেন। দাঁত কিড়মিড় করছেন। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ফিক-ফিক করে হাসছেন কেন জানি না। ভেঁদা-পালোয়ান মেঝেয় বসে আছে। দুটো গোরিলা-মানুষ তাকে কাতুকুতু দিচ্ছে। কিন্তু তার পেশী ফুলে ঢোল। সুবিধে করতে পারছে না ওরা। যত কাতুকুতু দিচ্ছে, পালোয়ান তত পেশী ফোলাচ্ছে।

আর হালদারমশাইকে কাতুকুতু দিচ্ছে অন্তত একডজন গোরিলা-মানুষ। কিন্তু ওঁর ঘুম ভাঙছে । তাই সম্রাট চাংকো হাত দুটো ছুঁড়ে খুব চ্যাঁচামেচি করছেন।

ঘরে কর্নেলকে দেখতে পেলুম না। গজকুমার সিংয়ের জন্য একটা চমৎকার বিছানা পাতা হয়েছে। তিনি ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু ওঁর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে না কেউ। সম্রাট চাংকোর বন্ধুর নাতি। তাই কি এই খাতির?

সম্রাট চাংকো গর্জন করলেন, “ক্র্যাম্বো হ্রাম্বো ল্যাম্বো!”

গোরিলা-মানুষেরা হালদারমশাইকে এবার চ্যাংদোলা করে তুলল। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে ফিসফিস করে বললুম, “সর্বনাশ! একটা কিছু করা উচিত আমাদের।”

বিজ্ঞানী চোখের ইশারায় আমাকে চুপ করতে বললেন। সম্রাট চাংকো তার বিছানা ঝেড়ে সাফ করে শুয়ে পড়লেন। তারপর জড়ানো গলায় বললেন, “ভ্রাম্বো লাম্বো নাম্বো।”

গোরিলা-মানুষেরা সঙ্গে-সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সম্রাট চাংকো নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকলেন। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত বললেন, “এই মন্সের অপেক্ষায় ছিলুম। চলে আসুন, জয়ন্তবাবু! চাংকোর ল্যাবে যাই।”

ভোঁদা আমাদের সঙ্গ নিয়ে বলল, “ওই দাদা যে পড়ে রইলেন?” চন্দ্রকান্ত ফিক করে হেসে বললেন, “আমাদের পৃথিবীর ভাষায় উনি মড়া–স্রেফ ডেড বডি।” চমকে উঠে বললুম, “সর্বনাশ! তা হলে গজকুমার সিং নাম বলেছিলেন, সেটাই সত্যি!”

সেই ল্যাবে পৌঁছে চন্দ্রকান্ত জবাব দিলেন, “উনি একজন যথার্থ মৃত মানুষ। কাজেই ওঁকে নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।”

অবাক হয়ে বললুম, “কী আশ্চর্য! আপনার নিশ্চয় কোনো ভুল হচ্ছে।”

“নাহ।” বলে চন্দ্রকান্ত ডাকলেন, “কর্নেল! আপনি কোথায়?”

কর্নেলের সাড়া এল যেন আমাদের পায়ের তলা থেকে, “চলে আসুন! পেয়ে গেছি।”

চন্দ্রকান্ত খুঁজছিলেন। মেঝের দিকে দৃষ্টি। একখানে একটা চৌকো গর্ত দেখতে পেয়ে বললেন, “এই যে!” সেই গর্তের ভেতর সিঁড়ি নেমে গেছে, নীল আলো জ্বলছে। আমরা তিনজনে নীচে নেমে গিয়ে দেখি, এ-ও আর-এক ল্যাব। সেখানে শ্রীমান ধুন্ধু চিত হয়ে শুয়ে আছে। বিজ্ঞানী তার কানে মোচড় দিয়ে ওঠালেন।

কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়ল। সারবন্দী কাঁচের কফিনের ভেতর কী আর কে ভেসে আছে একটা করে মৃত মানুষ। কর্নেল বললেন, “চন্দ্রকান্তবাবু! চাংকোর কীর্তি দেখুন!”

চন্দ্রকান্ত সপ্রশংস ভঙ্গিতে বললেন, “জেনেটিক্সে চাংকোর মাথা বরাবরই ভালো খেলত। অপূর্ব! পৃথিবীর সব বেওয়ারিশ লাশ এক্সরে-ল্যাসোর সাহায্যে তুলে নিয়ে এসে প্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু স্টেজগুলো লক্ষ করছেন কি?”

বললেন, “হ্যাঁ। প্রাণ দিয়ে চাংকো তাকে পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষে পরিণত করছেন। আমরা যেসব গোরিলা-মানুষ দেখলুম, তারা ক্রোম্যাগনন প্রজাতির। বিবর্তনতত্ত্বকে নিয়ে চাংকো খেলা করছেন। অসাধারণ প্রতিভাধর বিজ্ঞানী!”

“গজকুমারবাবুকেও গোরিলা-মানুষ করবে চাংকো।” বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত দুঃখিতমুখে বললেন, “আমার বড্ড খারাপ লাগছে ভাবতে।”

কর্নেল হাসলেন, “খারাপ লাগলেও কী আর করা যাবে, বলুন! পৃথিবীর নিয়ম হল, সেখানে যে মরে যাবে, সে চিরমৃত। এই গ্রহে সে জীবিত হচ্ছে, এটা মন্দ না। আহা, প্রাণ জিনিসটা বড় সুন্দর। তা একেবারে হারিয়ে যাওয়ার চাইতে এ তো ভালোই!”

বিজ্ঞানী দাড়ি চুলকে বললেন, “এ আমার সাবজেক্ট নয়। আমি অ্যাস্ট্রো-ফিজিসিস্ট। কাজেই বায়োলজি, ফিজিওলজি বা জেনেটিক্সে আমার মাথাব্যথা নেই। চলুন, ফেরা যাক। ধুন্ধু, ট্রাও ট্রাও!”

ভোঁদা বলে উঠল, “ডিটেকটিভদ্রলোককে মেরে গোরিলা-মানুষ করবে না তো? ওঁকে কোথায় নিয়ে গেল, দেখা উচিত স্যার।”

চন্দ্রকান্ত নড়ে উঠলেন, “তাই তো! কর্নেল শিগগির চলুন! ডিটেকটিভদ্রলোকের কথা একবারে ভুলে গেছি। ধুন্ধু! বড্ড শব্দ করছ! টুও ট্রও ট্রও।”

কিছুক্ষণ পরে আমরা চত্বরে বেরিয়ে দেখি, হালদারমশাইকে গোরিলা-মানুষেরা একটা পাথরের স্তম্ভে বেঁধেছে এবং বড়-বড় পাথরের চাই ছুঁড়ছে। আঁতকে উঠেছিলুম। কিন্তু পাথরগুলো হালদারমশাইয়ের গায়ে লেগে ঝুরঝুর করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। হুঁ, মাধ্যাকর্ষণ কম। তাই এখানকার পদার্থের ওজন কম। শুধু এই বলগুলো ছাড়া। যদি গোরিলা-মানুষেরা বল ছুঁড়ে মারে? চন্দ্রকান্তকে ফিসফিস করে কথাটা বলতেই উনি ধুন্ধুকে লেলিয়ে দিলেন। কিন্তু তাকে ওরা গ্রাহ্য করল না। কর্নেল ডাকলেন, “হালদারমশাই! হালদারমশাই!”

কোনো সাড়া নেই। আপাদমস্তক বাঁধা অবস্থায় উনি বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আসলে পাথর ছুঁড়ে-ছুঁড়ে গোরিলা-মানুষগুলো নেতিয়ে পড়েছে ক্রমশ। বুঝলুম, এরা ক্রোম্যাগনন প্রজাতির মানুষ। তাই পাথর ছাড়া অন্য অস্ত্রের কথা জানে না। জানলে এতক্ষণ হালদারমশাই বেঘোরে মারা পড়তেন। ওদিকে ধুন্ধু এবার বেদম থাপ্পড় চালাতে শুরু করেছে। কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, “নস্যি, হালদারমশাই! নস্যি!”

অমনি উনি চোখ খুললেন। বললেন, “কী! কী! ওঃ! অনেকক্ষণ নস্যি লই নাই। নাকটা কেমন করতাছে!” তারপর টের পেলেন সব। খাপ্পা হয়ে চাঁচালেন, “আমারে বাঁধল কেডা? এই ভূতগুলি? তবে রে!”

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বাঁধন খুলে দিলেন। গোরিলা-মানুষেরা বাধা দিল না। আসলে তারা ধুন্ধুর থাপ্পড় খেয়ে বড় ক্লান্ত। কর্নেল তাদের দিকে ঘুরে বললেন, “ভ্রাম্বো! থাম্বো! নাম্বো!”

অমনি তারা চলে গেল। বোধ হয়, ঘুমোতেই গেল। বললুম, “আপনি ওদের ভাষা বোঝেন, কর্নেল?”

কর্নেল বললেন, “কানে শুনে-শুনে একটুখানি শিখে নিয়েছি।”

হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কই নস্যি?”

কর্নেল পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে দিয়ে বললেন, “কুমড়ো-মানুষদের ঘরে ফেলে এসেছিলেন। দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে রেখেছিলুম।”

বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের এতক্ষণে স্পেসশিপের কথা মনে পড়ল। বললেন, “কিন্তু আমার স্পেসশিপ? পৃথিবীতে ফিরব কী করে আমরা?” তিনি দাড়ি চুলকোতে থাকলেন উদ্বিগ্নমুখে।

বললুম, “স্পেসশিপ ইনট্যাক্ট আছে। চলুন, সেখানে নিয়ে যাই।”

স্পেসশিপের কাছে গিয়ে আর-এক দৃশ্য দেখে ভড়কে গেলুম। ভবেশবাবুর সঙ্গে একদঙ্গল গোরিলা-মানুষের লড়াই বেধেছে। ওরা ওঁকে পাথর ছুঁড়ে মারছে। পালটা উনি ছুড়ছেন সেই আজব বল। বলের ধাক্কায় ওরা কুপোকাত হচ্ছে। চন্দ্রকান্ত বললেন, “কী বিপদ! এবার ওরা যদি বল ছোঁড়ে?”

ভোঁদা বলল, “তবে রে!” তারপর দৌঁড়ে গেল। সে গোরিলা-মানুষদের টিকি থেকে বল খুলে নিতে শুরু করল। ফলে ওরা আকাশে ভেসে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি শুরু করল।

ভবেশবাবু আমাদের দেখে বললেন, “বনমানুষগুলোর বড় বাজে স্বভাব। বেশ ঘুমোচ্ছি। হঠাৎ দরজা খুলে কাতুকুতু দিতে শুরু করেছে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, অত বড়-বড় পাথর আমার গায়ে পড়ে ছাতু হয়ে গেল কেন বলুন তো? আমি তো ভোঁদার মতো পালোয়ান নই!”

কর্নেল বললেন, “পরে বুঝিয়ে বলব। ঢুকুন ভবেশবাবু! পৃথিবীতে ফেরা যাক। আমার চুরুটের স্টক শেষ।”

ভোঁদা বলল, “গোরিলা-মানুষগুলোর জন্য দুঃখ হচ্ছে, বল কেড়ে নিলুম বটে! ওরা নামবে কী করে? এক মিনিট। বলগুলো ওদের দিকে ছুঁড়ে দিই। তারপর ভে-কাট্টা করব।” সে বলগুলোকে কুড়িয়ে ছুঁড়তে শুরু করল। গোরিলা-মানুষেরা লুফে নিল এবং নামল। কিন্তু আর আক্রমণ করতে এল না। দল বেঁধে করুণ মুখে তাকিয়ে রইল। ধুন্ধু থাপ্পড় তুলে কী জানি কেন হাত নামাল। মানুষের সঙ্গণে তার মানুষ-ভাব এসেছে।

আমরা স্পেসশিপে ঢোকার পর হালদারমশাই বললেন, “আরে কী কাণ্ড! আরও সব গোরিলা-মানুষ আসছে অ্যাটাক করতে। কুইক সায়েন্টিস্টমশাই!”

জানলা দিয়ে দেখি, উপত্যকা জুড়ে হাজার-হাজার গোরিলা-মানুষ আসছে। কিন্তু মারমুখী বলে মনে হচ্ছে না। নীলাভ আলোয় প্রতিটি মুখে বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ। ওরা হাত নেড়ে আমাদের কি বিদায় জানাচ্ছে? একদা ওরা আমাদের পৃথিবীরই মানুষ ছিল। সেই স্মৃতি কি ওদের অবচেতনা থেকে জেগে উঠেছে? মনটা খারাপ হয়ে গেল। পৃথিবীতে ওরা মৃত। এখানে ওরা জীবিত।

আমাদের মহাকাশযানের চারদিক ঘিরে গোরিলা-মানুষেরা হাত নাড়ছিল। আমরাও ভেতর থেকে হাত নাড়লুম। সম্রাট চাংকো এখন তার ঘুমঘরে ঘুমোচ্ছেন। তিনি জানতে পারছেন না, তার, প্রজারা কী করছে এখন। নীল আশ্চর্য সুন্দর আলোয় হাজার-হাজার বিষণ্ণ আদিম মুখ।

আমরা পাঁচজন মানুষ আকাশে ভেসে যেতে-যেতে নীচে তাদের শেষবারের মতো দেখে নিলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *