১.৬ ফিলিস্তীনের মেয়ে

ফিলিস্তীনের মেয়ে

গম্ভীর মুখে কক্ষে পায়চারী করছেন সুলতান আইউবী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন–

দেশের সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং হয়েও যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতার পথ অবলম্বন করছে শুধু জাতির কর্ণধারগণ। আমীর-উজীর-শাসক নামের বড় বড় জাতীয় নেতাদের তুমি দেখে থাকবে আলী! মিসরবাসীদের মুখে তো আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। জাতির সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করছে বড়। আমার সঙ্গে এই বড়দের শত্রুতা ব্যক্তিগত নয়। আমি তাদের স্বপ্লের মসনদ দখল করে আছি, এটাই তাদের অন্তর্জালার কারণ।

আলী বিন সুফিয়ান ও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ বসে নিবিষ্টচিত্তে শুনছেন সুলতানের বেদনাভরা কথাগুলো।

সময়টি ছিল ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের এক অপরাহ্ন বেলা। জুন-জুলাইয়ে বিদ্রোহ দমন করে সুলতান আইউবী সঙ্গে সঙ্গে আল-আজেদকে খেলাফতের মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগে তিনি সুদানীদের বিদ্রোহকে কৌশলে দমন করে সেনাবাহিনী থেকে সুদানী বাহিনীকে বিলুপ্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোন বিদ্রোহী নেতা, কমান্ডার কিংবা সৈনিককে সাজা দেননি; কৌশলে কার্যসিদ্ধি করেছিলেন।

তারপর যখন তারা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তখন সুলতান আইউবী এই উদ্ধত মস্তকগুলোকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য রণাঙ্গনে সুদানীদের লাশের স্তূপ তৈরি করেন। পদ-পদবীর তোয়াক্কা না করে তিনি গ্রেফতারকৃতদের কঠোর শাস্তি দেন। অধিকাংশকে জল্লাদের হাতে তুলে দেন আর অবশিষ্টদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন কিংবা দেশান্তর করে সুদান পাঠিয়ে দেন।

দু মাস হয়ে গেল, আমি রাজ্যের কোন খোঁজ নিতে পারছি না! এক একজন অপরাধী ধরে আনা হচ্ছে আর বিচার করে আমি তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে চলছি। দুঃখে আমার কলজেটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আলী! মনে হচ্ছে, আমি গণহত্যা করছি। আমার হাতে যারা জীবন দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই যে মুসলমান! বুক ফেটে কান্না আসতে চায় আমার। আক্ষেপের সাথে কললেন সুলতান আইউবী।

মুখ মুখলেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। বললেন—

সম্মানিত আমীর! একজন কাফির এবং একজন মুসলমান একই অপরাধে লিপ্ত হলে শাস্তি মুসলমানের-ই বেশী পাওয়া উচিত। কাফিরের না আছে বুদ্ধি-বিবেক, না আছে ধর্ম-চরিত্র। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের আলো পাওয়ার পরও একজন মুসলমান কাফিরের মত অপরাধ করা গুরুতর নয় কি? মুসলমানদের শাস্তি দিচ্ছেন বলে আপনি মর্মাহত হবেন না মহামান্য সুলতান! ওরা বিশ্বাসঘাতক, মুসলিম নামের কলংক। ইসলামী সাম্রাজ্যের বিষফোঁড় ওরা। ইসলামের নাম-চিহ্ন ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার জন্য যারা কাফিরদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে, এ জগতে মৃত্যুদন্ড-ই তাদের উপযুক্ত শাস্তি। পরকালে তাদের জন্য আছে জাহান্নাম।

শাদ্দাদ। আমার ব্যথা হল, মিসরে আমি শাসক হয়ে আসিনি। দেশ শাসন করার নেশা যদি আমার থাকত, তাহলে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি আমার সম্পূর্ণ অনুকূল। কিন্তু আমি জানি, ক্ষমতার লোেভ মানুষকে অন্ধ করে তোলে। মসনদপ্রিয় মানুষ চাটুকার-চালবাজদের পসন্দ করে বেশী। কিছু-ই না দিয়ে মিথ্যা প্রলোভন আর মনভোলানো রঙ্গিন ফানুস দেখিয়ে-ই তারা মাতিয়ে রাখে জাতিকে। শয়তানী চরিত্রের মানুষকে তারা আমলা নিয়োগ করে। তারা অধীনদের রাজপুত্রের মর্যাদা দিয়ে রাখে। নিজে হয় শাহেনশাহ। ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করা ব্যতীত তারা আর কিছুই বুঝে না।

তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তোমরা এই মসনদ আমার থেকে নিয়ে নাও। আমাকে শুধু তোমরা এই প্রতিশ্রুতি দাও যে, আমার পথে তোমরা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আর কিছু চাই না আমি। যে লক্ষ্য নিয়ে আমি ঘর থেকে বের হয়েছি, আমায় সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে দাও। হাজারো জীবন কোরবান করে এবং আরব মুজাহিদদের রক্তে নীল নদের পানির স্লং পরিবর্তন করে নুরুদ্দীন জঙ্গী মিসর ও সিরিয়াকে একীভূত করেছেন। এই ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যকে আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। সুদানকে মিসরের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ফিলিস্তীনকে মুক্ত করতে হবে ক্রুসেডারদের হাত থেকে। ইউরোপের ঠিক মধ্যাঞ্চলের কোথাও নিয়ে কোণঠাসা করে রাখতে হবে খৃষ্টানদের। এসব বিজয় আমাকে অর্জন করতে হবে আমার শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নয় আল্লাহর রাজ্যে তাঁর-ই শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মিসর যে পাঁকে জড়িয়ে রেখেছে আমায়। আমাকে তোমরা মিসরের এমন একটি ভূখন্ড দেখাও, যা ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ ও গাদ্দারী থেকে মুক্ত! আপুতকণ্ঠে বললেন সালাহুদ্দীন আইউবী।

এইসব ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে খৃষ্টানরা। কত জঘন্যভাবে ওরা ওদের মেয়েদেরকে বেহায়াপনার প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ভাবলে আমার মাথা হেঁট হয়ে আসে। ওরা ওদের চুম্বকাৰ্যক রূপ আর চাটুবাক্য দিয়ে ঘায়েল করছে আমাদের শাসকদের। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

ভাষার আঘাত তরবারীর আঘাতের চেয়েও মারাত্মক আলী। আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর খৃষ্টান মেয়েরা তোমার দুর্বলতা বুঝে এমন ধারায়, এমন ক্ষেত্রে, এমন যথোপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করবে যে, মোমের মত গলে গিয়ে তুমি তোমার তরবারী কোষবদ্ধ করে দুশমনের পায়ে অর্পণ করবে। খৃষ্টানদের অস্ত্র হল দুটি। ভাষা আর পশুবৃত্তি। মানবীয় চরিত্র ধ্বংস করে আমাদের মধ্যে এই পশুবৃত্তি ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য ওরা সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ব্যবহার করছে। এই অস্ত্র ব্যবহার করে-ই ওরা আমাদের মুসলিম আমীর-শাসকদের হৃদয় থেকে ইসলামী চেতনাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। বললেন সালাহুদ্দীন আইউবী।

শুধু আমীর-শাসক-ই নন সুলতান! মিসরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই অশ্লীলতার বিষবাষ্প মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ অভিযানে খৃষ্টানরা সফল। অর্থশালী মুসলিম পরিবারগুলোতেও এই বেহায়াপনার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

এটি-ই সর্বাপেক্ষা বড় আশংকা। খৃষ্টানদের সকল সৈন্য যদি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবু আমি তাদের মোকাবেলা করতে পারব; করেছিও। কিন্তু তাদের এই চারিত্রিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারব কিনা আমার ভয় হয়। মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যতপানে দৃষ্টিপাত করলে আমি শিউরে উঠি। তখন আমার কাছে মনে হয়, যদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এ ধারা রোধ করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে মুসলমান হবে নামমাত্র মুসলমান। তাদের মধ্যে ইসলামের নীতি-আদর্শ, সংস্কৃতি-চরিত্র কিছুই থাকবে না। খৃষ্টান সভ্যতা-সংস্কৃতি লালন করে মুসলমানরা গর্ববোধ করবে। প্রকৃত ইসলাম বলতে তাদের মধ্যে কিছুই থাকবে না।

মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো আমার জানা আছে। মুসলমান শত্রু চিনে না। তারা শক্রর পাতা আকর্ষণীয় জালে সরলমনে আটকে যায়।

পাশাপাশি খৃষ্টানদের দুর্বলতাগুলোও আমার অজানা নয়। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তা সন্দেহাতীত সত্য। কিন্তু ভিতরে তাদের মনের মিল নেই। ফরাসী-জার্মানী একে অপরের দুশমন। বৃটিশ-ইতালীয়রা একে অপরের অপছন্দ। মুসলমান তাদের সকলের শত্রু বলেই কেবল এই ইস্যুতে তারা একতাবদ্ধ হয়েছে। অন্যথায় তাদের পারস্পরিক বিরোধ শত্রুতার অপেক্ষা কোন অংশে কম নয়। তাদের ফিলিপ অগাস্টাস একজন কু-জাত ব্যক্তি। অন্যরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা মুসলিম শাসকদেরকে নারীর রূপ ও হিরা-মাণিক্যের চমক দেখিয়ে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। মুসলিম শাসকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাড়া দিলে ওরা পালাবার পথ পাবে না।

ফাতেমী খেলাফতের অবসান ঘটিয়ে আমি শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি। মসনদ পুনর্দখলের জন্য ফাতেমীরা সুদানী ও খৃষ্টানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। আমার জন্য এ এক নতুন সমস্যা। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

ফাতেমীদের কবিকে কাল মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন, আম্মারাতুল ইয়ামানীর কবিতা শুনে এক সময় আমিও আপুত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু খৃষ্টানরা তার সেই ভাষা আর গীতিকে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত করিয়ে ইসলামী চেতনাকে ভষ্ম করে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

আম্মারাতুল ইয়ামানী ছিল তকালের একজন নামকরা কবি। সে যুগে এবং তার আগেও সাধারণ মানুষ কবিদের প্রবল ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত। অগ্নিঝরা কবিতার মাধ্যমে তারা সৈন্যদেরকে উজ্জীবিত করে তুলত। শত্রুর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলত জনতাকে। আম্মারাতুল ইয়ামানীও সে–মানের একজন কবি। এক সময় সে কবিতার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে জিহাদী চেতনা জাগিয়ে তুলত।

কিন্তু পরবর্তীতে হতভাগাকে লোভে পেয়ে বসেছে। ফাতেমী খেলাফতের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে বিষ উদগীরণ করতে শুরু করে কবি আম্মারা। _ সন্দেহবশতঃ আকস্মিকভাবে একদিন হানা দেওয়া হয় তার গৃহে। অনুসন্ধান করে এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যে, লোকটি কেবল ফাতেমী খেলাফতের-ই নিমকম্বোর নয়–খৃষ্টানদের বেতন-ভোগী চরও বটে। মিসরীদের হৃদয়ে নপুংসক ফাতেমী খেলাফতের প্রতি সমর্থন এবং সুলতান আইউবীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে পুষত তাকে খৃষ্টানরা।

জাতির বিবেক বলে খ্যাত কবিরা পর্যন্ত যখন শত্রুর বেতনভোগী, তখন জাতির জন্য অপমান ও লাঞ্ছনা অবধারিত। ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন সুলতান আইউবী।

কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। বলে, ক্ষমতাচ্যুত খলীফা আল-আজেদের দূত সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইছেন।

সুলতানের কপালে ভাজ পড়ে যায়। ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করে বললেন, খেলাফত ছাড়া বুড়া আর আমার কাছে কি-ই চাইবে। দারোয়ানকে বললেন, ওকে আসতে বল।

আজেদের দূত কক্ষে প্রবেশ করে। বলে, খলীফা আপনাকে সালাম বলেছেন।

তিনি তো এখন আর খলীফা নন। দু মাস হয়ে গেল, আমি তাকে বরখাস্ত করেছি। এখন আপন প্রাসাদে তিনি আমার বন্দী। সুলতান বললেন।

অপরাধ মার্জনা করবেন সুলতান! দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিনা, তাই মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। সালামান্তে আল-আজেদ বলেছেন, তিনি গুরুতর অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। কিন্তু আপনার সাক্ষাৎ তার একান্ত প্রয়োজন। আমীরে মুহতারাম দয়া করে একটু আসলে ভীষণ উপকার হবে। দূত বলল ।

খানিকটা ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে সুলতান বললেন, এখনো তাহলে তিনি নিজেকে খলীফা-ই মনে করছেন। সে জন্যে-ই বুঝি আমাকে এই ডেকে পাঠানো, না!

না, আমীরে মেসের অবস্থা তার ভাল নয়। মহলের ডাক্তার আশংকা ব্যক্ত করেছেন। তিনি পুরনো এক রোগে ভুগছেন। চিন্তা ও রাগের সময় এ রোগ তার বেড়ে যায়। এখন তিনি রীতিমত শয্যাশায়ী।

একটু থেমে দূত আরো বলে, আপনাকে তিনি একা যেতে বলেছেন; কি যেন গোপন কথা আছে, যা আপনি ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না।

তুমি যাও, আমার সালাম জানিয়ে বলবে, সালাহুদ্দীন আইউবীর সব গোপন কথা-ই জানা আছে। তাকে বল গিয়ে গোপন কথা আল্লাহকে বলুক। আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করুন। বললেন সালাহুদ্দীন আইউবী।

নিরাশ মনে ফিরে যায় দূত।

সুলতান আইউবী দারোয়ানকে বললেন, ডাক্তারকে ডেকে আন। আলী বিন সুফিয়ান ও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের প্রতি তাকিয়ে সুলতান বললেন, আচ্ছা, লোকটি আমাকে একা যেতে বলল! কোন ষড়যন্ত্র আছে বোধ হয়। মহলে ডেকে নিয়ে আমাকে সে খুন করাতে চাইছে, এ আশংকা কি আমার অমূলক? আমার হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন কৌশলে তার প্রতিশোধ নেয়ার সাধ জাগা বিচিত্র কি?

আপনি যাননি ভালো-ই করেছেন। বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। আলী বিন সুফিয়ানও সমর্থন করলেন।

ডাক্তার আসলে সুলতান বললেন, আপনি আজেদের নিকট যান। লোকটি দীর্ঘদিন যাবত গুরুতর অসুস্থ বলে শুনেছি। মনে হচ্ছে, তার ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। আপনি গিয়ে তাকে দেখুন, চিকিৎসা করুন। তবে হতে পারে প্রাপ্ত সংবাদ মিথ্যে; তিনি অসুস্থ নন। তা-ই যদি হয়, আমাকে জানাবেন।

খলীফা থাকা অবস্থায় আল-আজেদ যে মহলটিকে খেলাফতের মসনদ হিসেবে ব্যবহার করতেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর তাকে সে ভবনে-ই বাস করতে দেয়া হয়। মহলটিকে তিনি অপূর্ব এক বিলাস-ভবন বানিয়ে রেখেছিলেন। দেশ-বিদেশের সুন্দরী নারীদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল তার হেরেম। দাসীদের ভীড় লেগে থাকত সব সময়। হাজার হাজার মোহাফেজ বাহিনী প্রস্তুত থাকত সর্বক্ষণ। সেনা কমান্ডারগণ দরবারে আসলে বসবারও অনুমতি ছিল না থাকতে হত হাতজোড় দাঁড়িয়ে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিপ্লব পাল্টে দেয় এ মহলের রূপ। আজেদ এখন : খলীফা নন। একজন সাধারণ নাগরিকের মত এ মহলে জীবন যাপন করছেন তিনি। মহলের বিলাসোপকরণগুলো যেমন ছিল তেমন-ই পড়ে আছে সেখানে। সেনা কমান্ডার আর মোহাফেজ বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এখান থেকে। তবে একটি সেনাদল চোখে পড়ছে এখনো। এরা খলীফা আল-আজেদের মোহাফেজ নয়–বন্দী আজেদের প্রহরী। খেলাফতের এই মসনদটি ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র, তাই এখন পাহারা বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। আজেদ এখন নিজ মহলে আইউবীর বন্দী। বৃদ্ধ হৃদরোগের রোগী। ক্ষমতা হারাবার শোক, বার্ধক্য, মদ-মাদকতায় এখন তিনি শয্যাগত।

অল্প কদিনেই মরণাপন্ন হয়ে পড়ে লোকটি। দুজন বিগত-যৌবনা মহিলা আর এক খাদেম সেবা-শুশ্রূষা করছে তার।

মহলের ডাক্তার বৃদ্ধকে ঔষধ খাইয়ে যান। ইত্যবসরে কক্ষে প্রবেশ করে দুই যুবতী। এক সময় তারা আল-আজেদের হেরেমের শোভা ছিল। একজন বৃদ্ধের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে অবস্থা জানতে চায়। অপরজন বৃদ্ধের মুখমন্ডলে দু হাতের পরশ দিয়ে তার সুস্থতার জন্য দুআ দেয়। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে দুই যুবতী। একজন বলে, আপনি আরাম করুন। আমরা আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে চাই না। অপরজন বলল, আমরা সারাক্ষণ পাশের কক্ষে-ই থাকি। প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠাবেন। যুবতীয় কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

আরো একরাশ বেদনা চেপে ধরে বৃদ্ধকে। আহ! বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পার্শ্বে দন্ডায়মান পৌঢ়া মহিলাদ্বয়কে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে এনে ক্ষীণ কণ্ঠে ভাঙ্গা স্বরে বলেন, মেয়ে দুটো কেন এসেছে জান? ওরা দেখতে এসেছে আমি কবে মরব। ওরা শকুন। ওদের শ্যেণদৃষ্টি আমার সম্পদের উপর। অপেক্ষা শুধু আমার মৃত্যুর। তোমরা ছাড়া এখন আমার আপন আর কে আছে? কেউ নেই, একজনও নেই। ফাতেমী খেলাফতের শ্লোগান দিয়ে যারা আমাকে উস্কে দিয়েছিল, তারা এখন কোথায়?

মৃতকল্প আজেদ নিজের বুকে হাত রেখে পার্শ্ব পরিবর্তন করেন। বড় কষ্ট হচ্ছে তার।

এ সময়ে দূত ফিরে এসে কক্ষে প্রবেশ করে এবং বলে, আমীরে মেসের আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন।

আহ! হতভাগা, বদনসীব সালাহুদ্দীন! আমার এই মুমূর্ষু অবস্থায় একটিবার আসলে কি হত তোমার! কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে অব্যক্ত কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ।

সালাহুদ্দীন আইউবীর না আসার ব্যাথায় বৃদ্ধের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। অতি ক্ষীণ কণ্ঠে থেমে থেমে বললেন, আমার সেবার জন্য এক সময়ে একপায়ে খাড়া থাকত যেসব দাসী-বাদী, হাত তালির শব্দ পাওয়া মাত্র ছুটে আসত যারা, তারাই এখন আমার মিনতিভরা ডাকেও আসে না, তা মিসরের আমীর সালাহুদ্দীন আইউবী আসবে কেন? এ আমার পাপের শাস্তি। এ শাস্তি আমাকে ভোগ করতেই হবে। আমার রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রাও কেটে পড়েছে। তাদের কেউ এখন আর আসে না। তবে আসবে। আসবে আমার জানাযায় । তারপর মহলে ঢুকে হাতে ধরে যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাবে। সকলের দৃষ্টি এখন আমার মৃত্যু আর আমার সম্পদের উপর!

রোগযন্ত্রণা বেড়ে যায় আজেদের। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত কোঁকাতে থাকেন তিনি। শুশ্রূষাকারী মহিলাদ্বয় ব্যথিত-হৃদয়ে শুনছে তার জীবনের অন্তিম কথাগুলো। সান্ত্বনা দেয়ার অষা তাদের নেই । চেহারায় তাদের কেমন যেন এক ভীতির ছাপ। যেন তারা আল্লাহর সেই গজবের ভয়ে ভীত, যা রাজাকে পথের ভিখারী আর ধনীকে ফকীরে পরিণত করে।

হঠাৎ–কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় তারা। চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায় । দেখে, অনুমতির অপেক্ষায় দরজায় দাঁড়িয়ে সাদা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক। অনুমতি পেয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন লোকটি। আজেদের শিরায় হাত রেখে সালাম করে বলেন, আমি মিসরের গভর্নর সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রাইভেট ডাক্তার। আপনার চিকিৎসার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।

সালাহুদ্দীন আইউবীর এতটুকু মানবতাবোধও কি নেই যে, এসে আমাকে এক নজর দেখে যেত! ডেকে পাঠাবার পরও তো একটু আসল না। বৃদ্ধ বললেন।

সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে আপনার চিকিৎসার জন্য। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি যে, তার ও আপনার মধ্যে যে অঘটন ঘটে গেছে, তারপর তিনি এখানে আসবেন না। দুজনের মধ্যে রীতিমত যুদ্ধ হল, জীবন হারাল হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু আপনার রোগমুক্তির চিন্তা তাঁর আছে। অন্যথায় আপনার চিকিৎসা করার আদেশ তিনি আমাকে দিতেন না। এ অবস্থায় বেদনাদায়ক কোন কথা আপনি মনে আনবেন না। নতুবা চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। ডাক্তার বললেন।

চিকিৎসা আমার হয়ে গেছে। মনোযোগ সহকারে তুমি আমার একটি পয়গাম শুনে নাও। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হুবহু শব্দে শব্দে পয়গামটি পৌঁছিয়ে দিও। আমার শিরা থেকে হাত সরিয়ে নাও। ইহজগতের সব হেকমত-বিজ্ঞান আর তোমার ঔষধ-পথ্যাদি থেকে আমি এখন সম্পূর্ণ নিরাশ।

শোন ডাক্তার! সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবে, আমি তার শক্ত ছিলাম না আমি শুক্রর ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য আমার না আইউবীর, তা জানিনা, নিজের পাপের কথা স্বীকার করছি আমি এমন এক সময়ে, যখন এ জগতে আমি ক্ষণিকের মেহমান মাত্র। সালাহুদ্দীনকে বলবে, আমার হৃদয়ে সবসময়ই তার প্রতি ভালবাসা ছিল এবং তার ভালবাসা হৃদয়ে বহন করেই আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমার অপরাধ, আমি সোনা-রূপা, হিরা-মাণিক্য আর ক্ষমতার মোহ হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলাম, যা ইসলামের মর্যাদার উপর বিজয়ী হয়ে গিয়েছিল।

আজ আমার মন থেকে সব নেশা দূর হয়ে গেছে। যারা সারাক্ষণ আমার পায়ে পড়ে থাকত, আমার দুর্দিনে সকলেই তারা কেটে পড়েছে। যে দাসীরা আমার আঙ্গুলের ইশারায় নাচ-গাইত, তারা আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে আছে। আমার দরবারে নগ্নদেহে নাচত যেসব রূপসী মেয়ে, আমি এখন তাদের ঘৃণার পাত্র।

শোন ডাক্তার! মানুষের সবচে বড় ভুল হল, মানুষ মানুষের দাসত্বে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর কথা ভুলে যায়। একদিন যে তার আল্লাহর নিকট উপস্থিত হতে হবে, যেখানে কোন মানুষ মানুষের পাপের বোঝা বহন করবে না–মানুষ সে কথা বেমালুম ভুলেই যায়। বদমাশরা আমাকে খোদার আসনে বসিয়েছিল। কিন্তু এখন যখন প্রকৃত খোদার ডাক এসে গেল, তখন সৰ হাকীকত আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে আজ আমি মুক্তির পথ খুঁজছি। শক্রর প্রতারণার শিকার হয়ে যত পাপ আর যত অন্যায় করেছি, অবলীলায় সব স্বীকার করে দয়াময় আল্লাহর নিকট তাওবা করে এবং সালাহুদ্দীনকে এমন কিছু বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে আমি মরতে চাই, যা বোধ হয় তার জানা নেই।

তুমি সালাহুদ্দীনকে বলবে, আমার মোহাফেজ বাহিনীর সালার রজব জীবিত আছে এবং সুদানের কোথাও আত্মগোপন করে আছে। যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে গিয়েছিল, ফাতেমী খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সে সুদানী এবং আস্থাশীল মিসরীদের নিয়ে বাহিনী গঠন করবে এবং খৃষ্টানদের থেকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করবে।

সালাহুদ্দীনকে তুমি আরো বলবে, সে যেন নিজের রক্ষীদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখে। তাকে একাকী চলাফেরা করতে নিষেধ করবে। রাতে যেন অধিক সতর্ক থাকে। ফেদায়ীদের নিয়ে রজব তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আইউবীকে তুমি আরো বলবে, তোমার জন্য মিসর এক আগ্নেয়গীরি। যাদেরকে তুমি আপন বলে মনে করছ, তাদের অনেকেই তোমার শত্রু। যারা তোমার সুরে সুর মিলিয়ে বিস্তৃত ইসলামী সাম্রাজ্যের শ্লোগান দিচ্ছে, তাদের মধ্যে খৃষ্টানদের পোয্য বিষধর সাপও আছে।

তার সামরিক বিভাগে ফয়জুল ফাতেমী পদস্থ একজন অফিসার। কিন্তু সে জানে না, সে-ও তার শত্রুদের একজন। রজবের ডান হাত সে। তার বাহিনীর তুর্কি, সিরীয় এবং আরব বংশোদ্ভূত কমান্ডার ও সৈন্যদের ব্যতীত আর কাউকে যেন সে বিশ্বাস না করে। এরাই শুধু তার ওফাদার এবং ইসলামের সংরক্ষক। মিসরী সৈন্যদের মধ্যে উভয় চরিত্রের লোক-ই আছে।

সালাহুদ্দীনকে বলবে, তুমি হয়ত জান না, সুদানী সৈন্যদের উপর যখন তুমি চুড়ান্ত আক্রমণ চালিয়েছিলে, তখন তোমার আক্রমণকারী বাহিনীতে দুটি বাহিনীর দুই কমান্ডার তোমার নির্দেশনা লংঘন করে তোমার অভিযানকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তোমার নিবেদিতপ্রাণ তুর্ক ও আরব সৈন্যরা তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে শেষ পর্যন্ত কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও তাদের কমান্ড অমান্য করে সুদানীদের উপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অন্যথায় এই দুই কমান্ডার যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করে তোমাকে ব্যর্থ-ই করে। দিয়েছিল বলা যায়।

মরণোন্মুখ ক্ষমতাচ্যুত খলীফা আল-আজেদ মর মর কণ্ঠে থেমে থেমে কথা বলছেন। ডাক্তার এক-দুবার তাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু হাতের ইশারায় তিনি ডাক্তারকে থামিয়ে দেন।

বৃদ্ধের মুখমন্ডল ঘামে ভিজে গেছে, যেন কেউ তার মুখে পানির ছিটা দিয়েছে। দুই মহিলা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে দেয়। কিন্তু ঘাম যেন ফোয়ারার মত নির্গত হচ্ছে। এ অবস্থায় আজেদ আরো কজন প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তার নাম বললেন, যারা সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর হল ফেদায়ী, রহস্যময় উপায়ে হত্যাকান্ড ঘটানো যাদের একমাত্র কাজ। আজেদ মিসরে খৃষ্টানদের জেঁকে বসার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে বললেন—

আমি যাদের কথা বললাম, আইউবীকে বলবে, এদেরকে তুমি মুসলমান মনে কর না। এরা ঈমান বিক্রি করে ফেলেছে। শোন ডাক্তার! সালাহুদ্দীনকে আরো বলবে, আল্লাহ তোমাকে কামিয়াব করুন এবং বিজয় দান করুন। তবে মনে রাখবে, আপনদের মধ্যে তোমার শত্রু দুপ্রকার। প্রথমতঃ তারা, যারা গোপনে তোমাকে ধোঁকা দিয়ে বেড়াচ্ছে, দ্বিতীয়তঃ তারা, যারা খোশামোদ করতে করতে তোমাকে খোদার আসনে নিয়ে বসাবে। মনে রাখবে, এই দ্বিতীয় শ্রেণীর দুশমন প্রথম শ্রেণী অপেক্ষা বেশী ভয়ংকর।

ডাক্তার! আইউবীকে আরো বলবে, শত্রুকে পরাজিত করে যখন তুমি নিশ্চিন্তে গদিতে বসবে, তখন আমার মত তুমিও উভয় জগতের রাজা হয়ে বস না যেন। নিরংকুশ রাজত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। মানুষ আল্লাহর অনুগত প্রতিনিধি মাত্র। এই মিসরে ফেরআউনের ধ্বংসাবশেষের প্রতি দৃষ্টি দাও, আমার পরিণতি দেখ। নিজেকে এম্‌নি পরিণতি থেকে রক্ষা করে চল।

ওষ্ঠাধর কেঁপে ওঠে আজেদের। কণ্ঠে জড়তা এসে যায় তার। আরো কিছু বলতে চায় বৃদ্ধ। কিন্তু কথার পরিবর্তে কণ্ঠনালী থেকে বেরিয়ে আসে গড়গড় শব্দ। মাথাট হেলে পড়ে একদিকে। ক্ষমতাচ্যুত খলীফা আল-আজেদ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস।

মহলে আজেদের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার সুলতান আইউবীর নিকট সংবাদ পাঠান। এক কালের দোর্দন্ড প্রতাপশালী খলীফা আজেদ মারা গেছেন। কিন্তু আশ্চর্য, তার মৃত্যুতে কাঁদছে না কেউ। জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত যে দু মহিলা তার পাশে ছিল, তাদেরকেই শুধু আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেল।

কয়েকজন কর্মকর্তাসহ মহলে প্রবেশ করলেন সুলতান আইউবী। বহিরাগত লোকজন আর দাসী-চাকরে গম্ গম্ করছে সমগ্র মহল। কারো মুখে শোকের ছায়া দেখতে পেলেন না সুলতান। সলেহে পড়ে যান তিনি। একজন সাবেক খলীফার মৃত্যু সংবাদে এলাম; কিন্তু অবস্থা দেখে তো এ মহলে কেউ মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে না! তাহলে বিষয়টা কী?

রক্ষী বাহিনীর কমান্ডারকে সুলতান আদেশ দিলেন, মহলের প্রতিটি কক্ষে ঘুরে দেখ, তল্লাশী চালাও। নারী-পুরুষ-যুবতী যাকে যেখানে পাও, বের করে বারান্দায় বসিয়ে রাখ। কাউকে মহলের বাইরে যেতে দেবে না। যত প্রয়োজন-ই দেখাক, কাউকে আস্তাবল থেকে ঘোড় নিতে দেবে না। সুলতান সমগ্র মহল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন।

সুলতান মৃত আজেদের কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু আশ্চর্য, একটি প্রাণীকেও শিয়রে বসে আজেদের জন্য কাঁদতে দেখলেন না তিনি। গোটা মহল নারী-পুরুষে পরিপূর্ণ। কিন্তু এতটুকু বিষাদের ছাপ নেই কারো মুখে । এক ফোঁটা অশ্রু পর্যন্ত নেই কারো চোখে ।

ডাক্তার সুলতান আইউবীকে ইংগিতে নিভৃতে নিয়ে যান। আজেদের অন্তিম কথাগুলো শোনান। অবশেষে ডাক্তার অভিমত ব্যক্ত করেন, এই বিদায়ের মুহূর্তে একবার এসে আপনার তাকে দেখে যাওয়া উচিত ছিল। সুলতান বললেন, উচিত ছিল অস্বীকার করি না। তবে আসিনি দুটি কারণে। প্রথমতঃ লোকটাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার এই ডেকে পাঠানোকে আমি ষড়যন্ত্র হতে পারে বলে সন্দেহ করেছিলাম। দ্বিতীয়তঃ ঈমান-বিক্রেতা বলে তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। একজন বিশ্বাসঘাতক ঘৃণ্য ব্যক্তিকে দেখতে আসায় আমার মন চাচ্ছিল না।

ডাক্তারের মুখে আল-আজেদের শেষ কথাগুলো শুনে অনুশোচনায় ফেটে পড়েন আইউবী। অস্থির-চিত্তে বললেন, হায়! না এসে তাহলে ভুল-ই করলাম! আসলে বোধ হয় তার মুখ থেকে আরো অনেক গোপন তথ্য বের করতে পারতাম। তাকে কোন গোপন কথা বুকে চেপে কবরে যেতে দিতাম না! …

বেশ কজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, আল-আজেদ বিলাসপ্রিয় ও বিভ্রান্ত লোক ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। সুলতান আইউবী-বিরোধী ষড়যন্ত্রেও তার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, তাও ঠিক। কিন্তু আইউবীর প্রতি তার বেশ অনুরাগও ছিল। আইউবীকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন।

দুজন ঐতিহাসিক এ-ও লিখেছেন, সুলতান আইউবী যদি আজেদের ডাকে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তাহলে আজেদ তাকে আরও অনেক তথ্য জানাতেন।

যা হোক, ইতিহাস একথা প্রমাণ করে যে, আজেদের ডাকে কোন প্রতারণা ছিল না। নিজের পাপমোচন এবং আইউবীর প্রতি হৃদ্যতা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই তিনি আইউবীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এই দুঃখ আইউবীকে বহুদিন পর্যন্ত দংশন করতে থাকে। আল-আজেদ যাদের ব্যাপারে যে তথ্য প্রদান করে গিয়েছিলেন, পরবর্তী অনুসন্ধানে তার প্রতিটি তথ্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ঐসব লোকের নামের তালিকা আলী বিন সুফিয়ানের হাতে দিয়ে সুলতান নির্দেশ দেন, এদের পিছনে গুপ্তচর নিয়োগ কর। অতীব গুরুত্ব সহকারে সতর্কতার সাথে এদের ব্যাপারে তথ্য সগ্রহ কর। তবে নিশ্চিত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করবে না। এমন পন্থা অবলম্বন কর, যেন অভিযুক্তকে হাতে-নাতে ধরা যায়, পাছে বিনা দোষে যেন কারো প্রতি অবিচার করা না হয়।

সুলতান আইউবী আজেদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করান। সেদিনেই অপরাহ্ন-বেলায় আজেদকে সাধারণ কবরস্তানে দাফন করা হয়। অল্প কদিনের মধ্যেই তার সেই কবরের নাম-চিহ্ন মুছে যায়।

সুলতান আইউবী মহলে তল্লাশী চালান। উদ্ধার করেন এত বিপুল পরিমাণ সোনা-হিরা-মাণিক্য ও মূল্যবান উপহার সামগ্রী, যা দেখে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান।

হেরেমের সকল নারী ও যুবতী মেয়েদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে সোপর্দ করে সুলতান আদেশ দেন যে, প্রত্যেকের নাম-পরিচয় ও বাড়ি-ঘরের ঠিকানা জেনে নাও। যারা নিজ বাড়িতে চলে যেতে চায়, নিজের তত্ত্বাবধানে তাদের পৌঁছিয়ে দাও। অমুসলিম কেউ থাকলে তাদের ব্যাপারে পূর্ণ তদন্ত চালিয়ে তথ্য নাও, কে কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে। কাউকে সন্দেহ হলে বন্দী করে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ কর।

সুলতান আইউবী মহল থেকে উদ্ধারকৃত অর্থ-সম্পদগুলো মিসরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোতে বন্টন করে দেন।

***

মৃত্যুর আগে আল-আজেদ তার রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার রজব সম্পর্কে বলেছিলেন, রজব সুদানে আত্মগোপন করে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে বাহিনী গঠন করছে এবং সহযোগিতার জন্য খৃষ্টানদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আলী বিন সুফিয়ান এমন ছয়জন জানবাজ বেছে নেন, যারা অভিজ্ঞ গুপ্তচর হওয়ার পাশাপাশি দুঃসাহসী যোদ্ধাও। তাদের কমান্ডার রজবকে চিনে। পূর্ণ পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে আলী বিন সুফিয়ান বণিক বেশে তাদেরকে সুদান প্রেরণ করেন। তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়, সম্ভব হলে রজবকে জীবিত ধরে আনবে, অন্যথায় সেখানেই হত্যা করবে।

তারা যখন রওনা হয়ে যায়, রজব তখন সুদানে ছিল না। তখন ফিলিস্তীনের এক বিখ্যাত দুর্গ শোবকে অবস্থান করছিল সে। ফিলিস্তীন তখন খৃষ্টানদের দখলে। সোবক তাদের প্রধান ঘাঁটি। খৃষ্টানদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে শোবকের মুসলমানরা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছিল। সেখানকার কোন মুসলমানের ইজ্জত তখন নিরাপদ ছিল না। ডাকাত বেশে খৃষ্টানরা মুসলমানদের কাফেলা লুট করে বেড়াত। অপহরণ করে নিয়ে যেত মুসলিম মেয়েদের। এ কারণেই সুলতান আইউবী সর্বপ্রথম ফিলিস্তীনকে পদানত করতে চাইছিলেন। তাছাড়া মুসলমানদের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসও খৃষ্টানদের দখলে। কিন্তু মুসলিম শাসকগণের অবস্থা ছিল এই যে, তারা খৃষ্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা ও খাতির-তোয়াজে ব্যস্ত। রজবও ছিল তেমনি একজন। সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে মদদ হাসিল করার জন্য-খৃষ্টানদের দুয়ারে ধরণা দিয়ে বসে আছে সে।

রজবের সম্মানে সোবকে নাচ-গান-বাদ্যের আসর চলছে। রজব কায়োমনে উপভোগ করছে সে অনুষ্ঠান। অপূর্ব সুন্দরী যুবতীরা নগ্নদেহে তার সামনে নাচছে, গাইছে। কিন্তু একটিবারও সে ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি যে, এই গায়িকাদের অধিকাংশই মুসলিম পিতা-মাতার সেইসব কন্যা, খৃষ্টানরা শৈশবে যাদের অপহরণ করে এনে বেহায়াপনার প্রশিক্ষণ দিয়ে এ পেশায় নিয়োজিত করেছে। স্বজাতির মেয়েদের নাচ দেখে, গান শুনে, তাদের হাতে মদ পান করে কাফিরদের আতিথেয়তা উপভোগ করছে রজব। রাতভর মদ আর নাচ-গানে মত্ত থাকে সে। পরদিন সকালে আলোচনার জন্য খৃষ্টানদের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেয়।

বৈঠকে উপস্থিত আছেন খৃষ্টান সম্রাট হে অফ লুজিনান ও কনরাড। আছেন বেশ কজন খৃষ্টান সেনা কমান্ডার।

রজব আগেই খৃষ্টানদের অবহিত করেছিল, সুলতান আইউবী এক সুদানী হাবশী গোত্রের উপাসনালয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে তার পুরোহিতকে হত্যা করে ফেলেছে। জবাবে সুদানীরা আইউবী বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তারা পিছনে সরে আসতে বাধ্য হয়।

শুধু তা-ই নয়–খলীফা আল-আজেদের ফাতেমী খেলাফত বিলুপ্ত করে আইউব খেলাফতে আব্বাসীয়াও ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মিসরের শাসন ক্ষমতায় কোন খলীফা থাকছেন না। সুলতান আইউবী নিজেই মিসরের স্বাধীন-সার্বভৌম শাসক হতে চাইছেন। এসবের মোকাবেলায় সুদানে গিয়ে আমি বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এ কাজে আমি আপনাদের সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।

এ বৈঠকে মিসরে বিশৃংখলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্যও রজব খৃষ্টানদের সাহায্যের আবেদন জানায়। 

সুলতান আইউবী যে হাবশী গোত্রটির ধর্মীয় অধিকারে নির্দয় হস্তক্ষেপ করেছে, প্রতিশোধের জন্য প্রথমতঃ তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সুদানে আরো বে কটি ধর্ম আছে, সেগুলোর অনুসারীদেরকে আইউবীর বিরুদ্ধে এই বলে উত্তেজিত করে তুলতে হবে যে, এই মুসলিম রাজাটি মানুষের ধর্মীয় উপাসনালয় ও পুরোহিত-দেব-দেবীর উপর আগ্রাসন চালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নতুন কোন অঘটন ঘটানোর আগে-ভাগে মিসরেই তার পতন ঘটাতে হবে। এভাবে মানুষের ধর্মীয় চেতনায় আগুন ধরিয়ে অনায়াসে তাদেরকে মিসর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব। বললেন খৃষ্টান সম্রাট কনরাড।–এক খৃষ্টান কমান্ডার বলল, মিসরের মুসলমানদেরকেও আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারি। শ্রদ্ধেয় রজব যদি অসন্তুষ্ট না হন, তাহলে তার-ই উপকারার্থে আমি এর ব্যাখ্যা প্রদান করব। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে এক মুসলমানের হাতে অন্য মুসলমানকে খুন করানো কঠিন কিছু নয়। আমাদের ধর্মে যেমন কোন কোন পাদ্রী নিজেই নিজেকে গীর্জার কর্তা বানিয়ে নিজের অস্তিত্বকে মানুষ ও খোদার মাঝে দাঁড় করিয়ে দেন, ঠিক তেমনি মুসলমানদের মধ্যেও কোন কোন ইমাম মসজিদের উপর নিজের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর এজেন্ট হয়ে বসেন।

আমাদের অর্থ আছে। এই অর্থ দিয়ে আমরা আমাদের পছন্দমত মুসলমান মৌলভী-মাওলানা তৈরি করে মিসরের মসজিদে মসজিদে বসাতে পারি। আমাদের কাছে এমন একজন খৃষ্টানও আছেন, যিনি ইসলাম ও কুরআন সম্পর্কে বেশ পারদর্শী। মুসলমান ইমামের বেশে তাকেও আমরা কাজে ব্যবহার করতে পারি। মসজিদে বসে ইমামদের সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবেও না–প্রয়োজনও হবে না। ঐ মৌলতদের মুখে মুসলমানদের মধ্যে আমরা এমন চিন্তাধারা ও কুসংস্কার সৃষ্টি করে দেব যে, তাদের মন থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীর ভক্তিশ্রদ্ধা এমনিতেই মুছে যাবে।

এ কাজ আমাদের এক্ষুণি শুরু করে দেয়া দরকার। সুলতান আইউবী মিসরে মাদ্রাসা খুলেছেন। সেখানে শিশু-কিশোর-যুবকদেরকে ইসলামের সঠিক চিন্তা-চেতনার তালীম দেয়া হচ্ছে। এর আগে মিসরে এমন কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ছিল না। মানুষ মসজিদে মসজিদে খোতবা শুনত। সে খুতবায় খলীফার স্তুতি-প্রশংসা-ই থাকত বেশী। এখন সালাহুদ্দীন আইউবী খোতবা থেকে খলীফার আলোচনা তুলে দিয়েছেন। যদি মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ও মনিসিক সচেতনা সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে আমাদের মিশন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আপনারা নিশ্চয় জানেন, ক্ষমতা পাকাঁপোক্ত করতে হলে জনসাধারণকে মানসিকভাবে পশ্চাদপদ আর দৈহিকভাবে পরনির্ভরশীল করে রাখা একান্ত আবশ্যক। বলল রজব।

মোহতারাম রজব! আপনি দেখছি নিজের দেশ সম্পর্কে কোন খবরই রাখছেন না যে, পর্দার আড়ালে সেখানে কী ঘটছে! সালাহুদ্দীন আইউবী রোম উপসাগরে যেদিন আমাদের পরাজিত করেছিলেন, এ কার্যক্রম তো আমরা সেদিনই শুরু করে দিয়েছি। আমরা প্রকাশ্য ধ্বংসযজ্ঞে বিশ্বাসী নই। আমরা ধ্বংস করি মানুষের মন-মস্তিঙ্ক আর চিন্তা-চেতনা। একটু ভেবে দেখুন মোহতারাম! দু বছর আগে কায়রোতে কটি পতিতালয় ছিল, আর এখন কটি? এই অল্প কদিনে বেশ্যাবৃত্তি কি সন্তোষজনকহারে বৃদ্ধি পায়নি? বিত্তশালী পরিবারগুলোতে যুবক-যুবতীদের মধ্যে আপত্তিজনক মন দেয়া-নেয়ার খেলা কি শুরু হয়ে যায়নি? আমাদের প্রেরিত খৃষ্টান মেয়েরা মুসলমান নারীর বেশ ধরে সেখানে মুসলমান পুরুষদের মাঝে দ্বন্ধ সৃষ্টি করে তাদেরকে খুনাখুনিতে লিপ্ত করিয়েছে। কায়রোতে আমরা অতি আকর্ষণীয় একটি জুয়াবাজি চালু করেছি। আমাদের প্রেরিত লোক দুটি মসজিদে ইমামতি করছে। অত্যন্ত চমৎকারভাবে তারা ইসলামের রূপ পাল্টে দিচ্ছে। জিহাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে তারা সেখানকার মুসলমানদের চেতনা নষ্ট করছে। আলেমের বেশে আমরা আরো বেশ কিছু লোক সেখানে পাঠিয়ে রেখেছি। তারা মুসলমানদেরকে যুদ্ধ-জিহাদের বিপক্ষে প্রস্তুত করছে। শত্রু-বন্ধুর ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী যে, অল্প ক বছরের মধ্যে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা এই দাঁড়াবে যে, তারা নিজেদেরকে গর্বভরে মুসলমান দাবি করবে; অথচ তাদের মন-মানসিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির উপর থাকবে ক্রুশের প্রভাব। শোন রজব! একটু বিলম্বে হলেও একটি সময় এমন আসবে, আজ যে মুসলমান ক্রুশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সে মুসলমান-ই সেদিন সভ্যতার প্রতীক বিশ্বাসে শ্রদ্ধাভরে ক্রুশ বুকে ধারণ করে চলবে। বলল এক খৃষ্টান কমান্ডার।

সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগ অত্যন্ত দক্ষ ও অতিশয় সতর্ক। এ বিভাগের প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে যদি হত্যা করা যায়, তাহলে সালাহুদ্দীন অন্ধ ও বধির হয়ে যাবে। বলল রজব।

তার মানে নিজে আপনি কিছুই করতে পারবেন না; সব আমাদের-ই করে দিতে হবে। শত্রুর গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তাকেও হত্যা করার যোগ্যতা আপনার নেই, তাই না? আপনি যদি বিবেক-বুদ্ধিতে এতই দুর্বল হন, তাহলে তো আপনি আমাদের লোকদেরও ধরিয়ে খুন করাবেন, আমাদের অর্থ-সম্পদ নষ্ট করবেন। বললেন সম্রাট কোনার্ড।

না, জনাব! আমাকে অত দুর্বল ভাববেন না। আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করার দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। ফেদায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আমি আলোচনাও করেছি। তারা সালাহুদ্দীন আইউবীর্কেও হত্যা করতে প্রস্তুত। বলল রজব।

সুদানের দিক থেকে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আপনি মিসরের সীমান্তকে অস্থিতিশীল করে। তুলুন। দেশের ভিতরে মানসিক ও অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাব আমরা। এদিকে আরবের কয়েকজন মুসলমান আমীর আমাদের কজায় এসে গেছেন। তাদের দু চারজনকে তো আমরা এমনভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছি যে, এখন তারা আমাদেরকে কর দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আক্রমণ চালিয়ে আমরা একটু একটু করে তাদের ভূখন্ড দখল করে চলেছি। সুদানের দিক থেকেও আপনি এ কৌশল অবলম্বন করে কাজ করুন। মুসলমানদের দুজন লোক এখনো রয়ে গেছে। নুরুদ্দীন জঙ্গী আর সালাহুদ্দীন আইউবী। এ দুজনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর পশ্চিম আকাশে ইসলামী দুনিয়ার সূর্য ডুবে যাবে। শর্ত হল, আপনাকে দৃঢ়পদ থাকতে হবে। আর আপনাদের মিসর যে আপনাদের-ই থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। বললেন সম্রাট কনরাড।

মৌলিক আলাপ-আলোচনার পর বৈঠকে কাজের কৌশল ও পদ্ধতি নিয়েও পর্যালোচনা চলে দীর্ঘক্ষণ। শেষে উদ্ভিন্ন-যৌবনা অনিন্দ্যসুন্দরী ও অতিশয় বিচক্ষণ তিনটি মেয়ে এবং বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে রজবকে বিদায় করা হয়। কায়রোর দুজন লোকের ঠিকানাও দেয়া হয় তাকে। তাদের যে কোন এজনের নিকট মেয়েগুলোকে গোপনে পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় রজবের হতে। দুজনের একজন হল সুলতান আইউবীর সামরিক বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা ফয়জুল ফাতেমী।

মেয়েদের দিয়ে কিভাবে কাজ নিতে হয়, রজবকে তা বলা হয়নি। তাকে শুধু এতটুকু অবহিত করা হয়েছে যে, ফয়জুল ফাতেমীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক আছে। মেয়েদেরকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার তা জানা আছে। তাছাড়া মেয়েরাও জানে তাদের কর্তব্য কী। রজবের সঙ্গে দেয়া এই মেয়ে তিনটি আরব ও মিসরের ভাষায় পারদর্শী।

দশজন রক্ষীর প্রহরায় রজব মেয়েদের নিয়ে রওনা হয়। আপাততঃ তার গন্ত সুদানের একটি পাহাড়ী অঞ্চল, যেখানে নারী বলি হত এবং যেখানে সুলতান আইউবীর জানবাজরা উম্মে আরারাহকে হাবশীদের কবল থেকে মুক্ত করে পুরোহিতকে হত্যা এবং তার আস্তানাকে ধ্বংস করেছিল । সুদানীদের পরাজয় এবং খলীফা আল-আজেদের ক্ষমতাচ্যুতির পর রজব পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল এবং এ স্থানকে নিজের আখড়ায় পরিণত করেছিল। হাবশীদের যে গোত্রটির পুরোহিতকে সুলতান আইউবী হত্যা করিয়েছিলেন, রজব তাদেরকে নিজের পাশে এনে জড়ো করেছিল। এখনো সে স্থানটিকে তারা দেবতার আখড়া বলে বিশ্বাস করছে। তারা পাহাড়ের অভ্যন্তরে যাচ্ছে না। মাত্র চারজন বৃদ্ধ ভিতরে যাওয়া-আসা করছে। তাদের একজন গোত্রের-ই ধর্মগুরু। পরলোকগত পুরোহিতের স্বঘোষিত স্থলাভিষিক্ত হয়ে বসেছে সে। ক্ষী হিসেবে তিনজন লোককে বেছে নিয়ে এখন সে পাহাড়ে আসা-যাওয়া করছে। সে অঞ্চলের-ই নিভৃত এক কোণে রজব তার আস্তানা গেড়েছিল। ফেরার হয়ে সে প্রথমে সেখানে আশ্রয় নিয়ে পরে মিসরের অধিবাসী এক খৃষ্টান এজেন্টের সঙ্গে ফিলিস্তীন চলে গিয়েছিল।

***

হাবশীদের এ গোত্রটি–যার নাম আংগুক–ভয়ে তটস্থ। কারণ, প্রথমতঃ তাদের দেবতার বলি পূরণ হয়নি। দ্বিতীয়তঃ তাদের পুরোহিত খুন হয়েছে। তৃতীয়তঃ তাদের দেবমূর্তির আস্তানাটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। সর্বোপরি গোত্রের হাজার হাজার যুবক দেবতার আপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পরাস্ত হয়ে অধিকাংশ নিহত হয়েছে আর অবশিষ্টরা পরাজয়ের গ্লানি ও জখম নিয়ে ফিরে এসেছে। আংগুকের ঘরে ঘরে মাতম চলছে। সর্বত্র বিরাজ করছে শোকের ছায়া।

তাদের কেউ কেউ এমনও ভাবতে শুরু করেছে যে, যিনি তাদের দেব-মূর্তিটি ভেঙ্গেছেন, তিনি বোধ হয় তদপেক্ষাও বড় দেবতা হবেন।

নিহত পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত ও ধর্মগুরু এ অবস্থা দেখে বললেন, দেবতার কুমীর কদিন যাবত অভুক্ত; তার পেটে খাবার দাও। তবেই তোমরা এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। হাবশীরা দেবতার কুমীরের জন্য কয়েকটি বকরি পাঠিয়ে দেয়। একজন আবেগের আতিশয্যে নিজের উটটি পর্যন্ত পুরোহিতের হাতে তুলে দেয়। কয়েকদিন পর্যন্ত এ পশুগুলো কুমীরদের ঝিলে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। কিন্তু গোত্রের মানুষের মনের ভীতি এতটুকুও কমল না।

এক রাতে পুরোহিত গোত্রের লোকদেরকে এক স্থানে সমবেত করে ঘোষণা দেয় যে, তিনি দেবতাদের সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হয়েছেন। দেবতারা তাকে ইংগিত করেছে যে, যেহেতু সময়মত নারী বলি হয়নি, তাই গোত্রের উপর এ বিপদ নেমে এসেছে। দেবতারা বলেছেন, এখন যদি একত্রে দুটি মেয়ে বলি দেয়া যায়, তাহলে বিপদ দুর হতে পারে। অন্যথায় দেবতা গোত্রের একটি মানুষকেও শান্তিতে থাকতে দেবেন না।

পুরোহিত আরো জানান যে, মেয়ে দুটো আংগুক হতে পারবে না, সুদানীও নয়। হতে হবে ভিনদেশী শ্বেতাঙ্গী।

পুরোহিত আরো কি যেন বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতটুকু শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোত্রের অসংখ্য অকুতোভয় সাহসী যুবক দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলে উঠে, যে কয়ে হোক, মিসর থেকে দুটি খৃষ্টান কিংৰা মুসলমান মেয়ে আমরা তুলে আনবই। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে হোক, এ বিপদ থেকে নিষ্কৃতি আমাদের পেতেই হবে।

তিন খৃষ্টান যুবতাঁকে নিয়ে রক্ষীদের সঙ্গে এগিয়ে চলছে রজব। এ সফর তার যেমন দীর্ঘ, তেমনি বিপদসংকুল। রজব আইউবী বাহিনীর দলত্যাগী ও বিদ্রোহী কমান্ডার। সুলতান আইউবী যে তার সীমান্তে টহল-প্রহরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তা তার জানা আছে। তাই সীমান্তের অনেকদূর ভিতর দিয়ে কাফেলাকে নিয়ে আসছে সে।

রজবের কাফেলায় আছে তিনটি উট। পানি, খাবার এবং খৃষ্টানদের দেয়া মাল-পত্রে বোঝাই উটগুলো। নিজেরা চলছে ঘোড়ায় চড়ে।

কয়েকদিন পথ চলার পর রজব দেবতার পাহাড়ে এসে পৌঁছে। শ্বেতাঙ্গী দুটি রূপসী মেয়ে বলি দিতে হবে পুরোহিত এ ঘোষণা দিয়েছিল মাত্র তার আগের দিন।

রজব এসে সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ করে পুরোহিতের সঙ্গে। রজবের সঙ্গে সাদা চামড়ার তিনটি সুন্দরী মেয়ে দেখে পুরোহিতের চক্ষু তো চড়ক গাছ। সীমাহীন আনন্দে প্রফুল্প হয়ে উঠেন পুরোহিত। দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়ার জন্য ঠিক এমৃনি দুটি মেয়ে-ই তার এয়োজন। পুরোহিত মেয়েদের ব্যাপারে জানতে চাইলে রজব বলে, আমি বিশেষ উদ্দেশ্যে এদেরকে সঙ্গে এনেছি।

পাহাড়ের অভ্যন্তরে সবুজ-শ্যামল মনোরম একটি জায়গা। স্থানটি তিনদিক থেকে পাহাড়ঘেরা। পূর্ব থেকেই তাঁবু খাটানো আছে। এটি-ই রজবের আস্তানা। রজব মেয়েদের নিয়ে যায় সেখানে।

মেয়েদের আরাম-আয়েশের সব আয়োজন-ই আছে এখানে। তাদের জন্য মদের ব্যবস্থাও করে রেখেছে রজব।

অনেক দীর্ঘ ও বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে রজব নিরাপদে এখানে এসে পৌঁছেছে। মনে তার বেশ আনন্দ। তাই সকলকে নিয়ে রাতে উৎসবের আয়োজন করে। নিজে মদপান করে, ক্ষী এবং মেয়েদেরও মদপান করায়।

মধ্যরাত। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ। রজবের রক্ষীরা গভীর নিদ্রায় বিভোর। এমন সময়ে পা টিপে টিপে রজব এগিয়ে আসে মেয়েদের তাঁবুতে। একটি মেয়ের বাহ ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে নিজের তাঁবুতে। রজবের মতলব বুঝে ফেলে মেয়েটি। বলে, আমি গণিকা নই। এখানে এসেছি আমি ক্রুশের দায়িত্ব পালন করতে অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। আপনার সঙ্গে আমি মদপান করতে পারি–যৌনকর্মে লিপ্ত হতে পারি না।

রজব হাসতে হাসতে মেয়েটিকে জোর করে তার তাঁবুতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মেয়েটি ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে রজবের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রজব পুনরায় হাত বাড়াতে চাইলে মেয়েটি দৌড়ে তাঁবুতে চলে যায়।

ঘটনাটি অপর দুমেয়ের কানে গেলে তারা তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। রজব বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা রজবকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না, এ আচরণ আপনার ঠিক হয়নি।

ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রজব। বলে, তোমরা কত পবিত্র মেয়ে আমার তা জানা আছে। বেহায়াপনা যাদের পেশা, তারা গণিকা নয় তো কি?

এ পেশার প্রয়োগ আমরা সেখানেই করি, যেখানে কর্তব্য পালনে এ-কাজ প্রয়োজন । হয়। নিছক বিনোদনের জন্য আমরা ও-সব করি না। বলল মেয়েটি।

মেয়েদের কথায় নিরস্ত হতে চাইল না রজব। অবশেষে কঠোর হল মেয়েরা। বলল, আমাদের সঙ্গে দশজন রক্ষী আছে। তারা আমাদের নিরাপত্তার জন্য-ই এসেছে। আগামীকাল-ই তাদের ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রয়োজন বোধ করলে আমরা তাদেরকে এখানে রেখে দিতে পারি কিংবা তোমাকে ফেলে রেখে তাদের সঙ্গে আমরা চলেও যেতে পারি। আশা করি সীমালংঘন থেকে তুমি বিরত থাকবে।

চুপসে যায় রজব। কিন্তু ভাবে মনে হচ্ছে, মেয়েদেরকে সে ক্ষমা করবে না।

কেটে যায় রাত।

পরদিন ফিলিস্তীন থেকে আসা দশ রক্ষীকে রজব বিদায় করে দেয়। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা এল। রজব মেয়েদের নিয়ে আড্ডায় বসেছে। হঠাৎ চারজন হাবশীসহ পুরোহিত এসে উপস্থিত। সুদানী ভাষায় পুরোহিত রজবকে বলে, দেবতা আমাদের উপর রুষ্ট হয়ে আছেন। তিনি দুটি ফিরিঙ্গী বা মুসলমান মেয়ের বলি চাচ্ছেন। তোমার এই মেয়েগুলো বলির জন্য বেশ উপযুক্ত। এর থেকে দুটি মেয়ে তুমি আমাকে দিয়ে দাও।

আঁতকে উঠে রজব। আগুন ধরে যায় তার মাথায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠে তার। বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকে পুরোহিতের প্রতি। অবশেষে বলে, এরা তো বলির মেয়ে নয়। এদের দ্বারা আমাকে বিশেষ ফজি নিতে হবে। এদের হাতে-ই তোমাদের দেবতাদের দুশমনকে হত্যা করতে হবে।

পুরোহিত বলল, না, তুমি মিথ্যে বলছ। তুমি এদেরকে এখানে আমোদ করার জন্য এনেছ। এদের দুজনকে আমরা বলি দেব-ই দেব।

রজব পুরোহিতকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করে; কিন্তু পুরোহিত কিছুতেই কিছু মানছে না। দেবতা সাওয়ার হয়ে বসেছে যেন তার মস্তকে। দুটি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে পুরোহিত বলল, এরা দুজন দেবতার জন্য উৎসর্গিত। আংকের মুক্তি এখন এদের হাতে। রজবকে বলল, মেয়েদের নিয়ে ব্যথা পালাবার চেষ্টা করবে না; আমাদের ফাঁকি দিয়ে তুমি এখান থেকে পালাতে পারবে না।  

মেয়েরা সুদানী ভাষা বুঝে না। পুরোহিত চলে যাওয়ার পর রজবকে বিমর্ষ দেখে তারা জিজ্ঞেস করে, লোকটা কী বলে গেল? তার কথা শুনে তুমি-ই বা এত অস্থির হয়ে পড়লে কেন? রজব রাখঢাক না করে পরিষ্কার বলে দেয় যে, লোকটা এখানকার দেব-মন্দিরের পুরোহিত। তোমাদেরকে তিনি বলি দিতে চাইছেন। দেবতারা নাকি তাদের উপর রুষ্ট হয়ে গেছেন। এখন নারী বলি দিয়ে তিনি এই অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে চান।

বলি কী জানতে চায় মেয়েরা। রজব জানায়, তোমাদের মাথা কেটে কার জন্য কদিন রেখে দেবে এবং দেহটা ঝিলে নিক্ষেপ করবে। ঝিলে অনেকগুলো কুমীর আছে। তারা তোমাদের দেহকে খেয়ে ফেলবে।

বলির ব্যাখ্যা শুনে মেয়েরা শিউরে উঠে। গায়ের লোম কাটার মত দাঁড়িয়ে যায় তাদের। শুকিয়ে যায় মুখের রক্ত। তাদের রক্ষা করার জন্য রজব কি চিন্তা করেছে জানতে চায় মেয়েরা। রজব বলে, আমি নানাভাবে তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেছি। তোমরা কারা, কোথা থেকে কেন এসেছ, তা-ও বলেছি। কিন্তু আমার কোন কথা-ই তার কানে পশেনি। দেবতার সন্তুষ্টি ছাড়া কিছুই বুঝছে না সে। আমি এখন তার দয়ার উপর নির্ভরশীল। অনুগ্রহ করে যদি তিনি তোমাদের মুক্তি দেন, তবেই তোমরা রক্ষা পাবে। আমি এদেরকে কাছে টানার ইচ্ছা করেছিলাম। এ গোত্রের লোকেরা আমার বাহিনীতে যোগ দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসে তারা এতই অনড় যে, দেবতাদের সন্তুষ্ট না করে তারা আমার কোন কথাই শুনতে রাজি নয়।; রজবের কথা শুনে মেয়েরা বুঝে ফেলে যে, সে তাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না কিংবা পুরোহিতকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাদেরকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে না। গতরাতে তারা রজবের দুর্মতির কিছুটা প্রমাণও পেয়ে গেছে। কাজেই রজবের ব্যাপারে মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাশ।

মেয়েরা তাঁবুতে চলে যায় । ভেবে-চিন্তে তিনজনে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা এখানে রজবেরুমনোরঞ্জন কিংবা হাবশীদের দেবতার বলির যূপকাষ্ঠে চড়ার জন্য আসিনি। জীবন রক্ষা করার চেষ্টা না করে এভাবে এক নির্মম অপমৃত্যুর মুখে নিজেদের ঠেলে দেয়ার কোন যুক্তি নেই। কাজেই যে করে থোক আমাদের পালাতে হবে। পালিয়ে আমাদের ফিলিস্তীন চলে যেতে হবে।

নিরাপদে সে রাত কেটে যায়। হাবশী পুরোহিত পরদিনও এসে রজবের সঙ্গে কথা বলে। মেয়েরা মনে মনে পলায়নের প্রস্তুতি নিয়েছে। রাতে ঘোড়াগুলো কোথায় থাকে, সেখান থেকে পালিয়ে বের হওয়ার পথ কোন্ দিকে, তা ভালভাবে দেখে নেয় তারা। এখান থেকে পালিয়ে ফিলিস্তীন পৌঁছা তিনটি মেয়ের পক্ষে অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার, তা মেয়েরা জানে তরু তাদের যেতেই হবে।

পুরোহিত চলে গেলে মেয়েরা রজবকে জিজ্ঞাসা করে, লোকটা আবার এসে কী বলে গেল? রজব বলল, কাল রাতে এসে তোমাদেরকে তারা এখান থেকে নিয়ে যাবে। লোকটি আমাকে হুমকি দিয়ে গেল যে, আমি যদি তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করি, তাহলে তারা আমাকে খুন করে কুমীরের ঝিলে নিক্ষেপ করবে।

আতঙ্কেল্প মধ্য দিয়ে কেটে যায় সারাটা দিন। পালাবার পরিকল্পনার কথা রজবকে জানায়নি মেয়েরা কারণ, রজবের উদ্দেশ্য তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। আর রজবের মনেও এমন কোন সন্দেহ জাগেনি যে, জীবন রক্ষা করার জন্য মেয়েগুলো পালিয়ে যেতে পারে। । পালাবার পথ চিনে নেয়ার জন্য কৌশল আঁটে মেয়েরা। তারা রজবকে বলে, নরকসম এই পার্বত্য এলাকার মধ্যখানে এমনি এক সবুজ-শ্যামল ভূখন্ড সত্যিই প্রকৃতির এক লীলা। চল, জায়গাটা একটু ঘুরে-ফিরে দেখে আসি। রজব তাদের ভ্রমণে নিয়ে যায়। কতটুকু অগ্রসর হওয়ার পর তাদের চোখে পড়ে সেই ভয়ানক ঝিল। ঝিলের এক কিরে লক্ষ হয়ে পড়ে আছে পাঁচ-ছয়টি কুমীর। ঝিলের পানি গাঢ় ও পুঁতিগন্ধময়।

রজব বলে, এই সেই ঝিল। হাবশীরা নারী বলি দিয়ে বলির মস্তকবিহীন দেহ এ ঝিলে নিক্ষেপ করে। আর এই সেই কুমীর, যারা বলির নারীদেহ খেলে দেবতারা তুষ্ট হয়। তোমাদেরও বলি দিয়ে পুরোহিত এই ঝিলে এসব কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এম্‌নি ভয়ানক দৃশ্য দেখে মেয়েদের মনে পালাবার ইচ্ছা আরো প্রবল হয়ে উঠে। ভ্রমণের বাহানায় পালাবার পথ-ঘাট ভালো করে দেখে নেয় তারা। পালাবার জন্য তারা নরম পথ চিনে নেয়, চলার সময় যেন পথে ঘোড়ার পায়ের শব্দ না হয়।

অপরদিকে হাবশী পুরোহিত পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে বসে গোত্রের লোকদেরকে সুসংবাদ প্রদান করছে যে, বলির জন্য মেয়ে আমি পেয়ে গেছি। আজ থেকে চার দিন পর পূর্ণিমার রাতে অনুষ্ঠিত হবে বলির পর্ব। পুরোহিত জানায়, বলি হবে দেব-মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের উপর। তারপর আমরা মন্দির পুনঃনির্মাণ করব। তারপর যারা আমাদের দেবতাদের অপমান করল, তাদের থেকে প্রতিশোধ নেব।

***

রাতের দ্বি-প্রহর। বিশেষ প্রশিক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় মেয়েরা। তারা রজব ও তার সঙ্গীদের এত পরিমাণ মদ পান করায় যে, সঙ্গে সঙ্গে তারা অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সহসা জাগ্রত হওয়ার কোন আশংকা নেই। কি পরিমাণ মদ খাওয়ালে একজন মানুষকে কত সময় অচেতন রাখা যায়, তা ওরা বেশ জানে।

উঠে দাঁড়ায় মেয়েরা। সফরের সামানাদি গুছিয়ে বেঁধে নেয়। ঘোড়ায় জিন লাগায়। তিনজন চড়ে বসে তিনটি ঘোড়ায়। দিনের বেলা ঠিক করে রাখা নরম মাটির পথে ঘোড়া ছুটায়। ভয়ানক এই বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে যায় তারা।

গন্তব্য তাদের ফিলিস্তীন। রজব তাদের যে পথে নিয়ে এসেছে, এগুতে হবে সে পথ ধরে-ই। তারা অস্বাভাবিক বিচক্ষণ মেয়ে। সামরিক দক্ষতাও আছে তাদের। কিন্তু তাদের একথা জানা নেই যে, বালুকাময় মরুভূমিতে পদে পদে এত প্রবঞ্চনা লুকিয়ে থাকে, যা অতি অভিজ্ঞজনদেরকেও বোকা বানিয়ে ছাড়ে। এই দীর্ঘ মরু অঞ্চলে একাকী চলে না কেউ চলে দল বেঁধে। সব রকম বিপদের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েই যাত্রা শুরু করে মানুষ।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু পথ অগ্রসর হয়ে মেয়েরা ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে চলছে তারা। অগ্রসর হয় আরো কিছু পথ। এবার তীব্রগতিতে ঘোড়া দুটায়। তীরবেগে ছুটে চলেছে ঘোড়া। বাকী রাতটুকু চলে একই গতিতে। রাতের মরুভূমি নিরুত্তাপ।

ভোর হল। পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হয়েছে। মেয়েদের চারদিকে গোলাকার টিলা। সম্মুখে বালুকাময় মাটির উঁচু উঁচু পাহাড়। মেয়েদের পথ রোধ করে দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিক-নির্ণয় করার চেষ্টা করে তারা। ঢুকে পড়ে টিলার ফাঁকে আঁকা-বাঁকা দুর্গম পথে। ঘোড়াগুলো পিপাসার্ত। নিজেদেরও পিপাসায় ধরেছে তাদের। ঘোড়াগুলোর সঙ্গে একটি করে পানির ছোট্ট মশক বাধা। একদিনও চলবে না সেই পানিতে। পানির অন্বেষায় কোথাও খেজুর বাগান আছে কি না খুঁজতে শুরু করে তিন মেয়ে। সূর্য উঠে এসেছে আরো উপরে। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে উত্তাপ। গরমে যেন মরুভূমি জাহান্নামে পরিণত হতে যাচ্ছে। না, খেজুর বাগান নেই আশেপাশে কোথাও, নেই এক ফোঁটা পানিও।

সূর্যোদয়ের পর এখনো ঘুমুচ্ছে রজব ও তার সঙ্গীরা। মদের নেশা ভালো করেই পেয়েছে তাদের। তিনজন হাবশীকে সঙ্গে নিয়ে এসে উপস্থিত হয় পুরোহিত। আগে যায় মেয়েদের তাঁবুতে। তবু শূন্য। রজবকে ঘুম থেকে জাগায় সে। বলে, কই, মেয়ে দুটোকে আমার হাতে তুলে দাও, জলদি কর। রজব তখনো বিছানায় শোয়া। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। কাকুতি-মিনতি করে মেয়েদের জীবন ভিক্ষা চায়। মেয়েদেরকে কি উদ্দেশ্যে এখানে এনেছে, আবারও তার বিবরণ দেয়। কিন্তু পুরোহিত তার কোন কথা-ই শুনছে না। দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নারী বলি তাকে দিতেই হবে। আর এদেরকে হাতছাড়া করলে বলি দেয়া তার অসম্ভব হয়ে পড়বে।

রজব সঙ্গীদের জাগাতে চাইলে হাবশীরা তাকে বাধা দেয়। বলে, পুরোহিত যা বলছেন, তার অন্যথা করলে পরিণতি ভাল হবে না। পুরোহিত জিজ্ঞেস করে, মেয়েগুলো কেথায়?

নিজের তাঁবুতে বসে বসেই রজব মেয়েদের ভাক দেয়। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। উঠে দাঁড়ায় রজব। মেয়েদের তাঁবুতে গিয়ে দেখে, তাঁবু শূন্য। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও দেখা গেল না তাদের। হঠাৎ রজবের দৃষ্টি পড়ে ঘোড়ার জিনের উপর। কিন্তু একি! তিনটি জিন-ই যে নেই! রজব দৌড়ে যায় আস্তাবলে। ঘোড়াও তো তিনটি উধাও! ঘটনাটা বুঝে ফেলে রজব। পুরোহিতকে বলে, আপনার ভয়ে ওরা পালিয়ে গেছে। ওদের ভাগিয়ে আপনি বেশ করেছেন।

তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে পুরোহিত। বলে, তুই ওদের ভাগিয়েছি। আমার আশা-ভরসা সব তুই মাটি করে দিলি! হাবশীদের বলে, একে নিয়ে বেঁধে রাখ । বেটা আংগুকের দেবতাকে আবার রুষ্ট করল। কয়েকজন সুদক্ষ অশ্বারোহী ডেকে আন। এক্ষুণি মেয়েদের ধাওয়া করতে বল। যেখান থেকে হোক, খুঁজে ওদের আনতেই হবে। এখনো বেশী দূর যেতে পারেনি তারা। যাও, জলদি কর।

রজবের যুক্তি-প্রমাণ, অনুনয়-বিনয় উপেক্ষা করে হাবশীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। হাত দুটো পিছনে করে একটি গাছের সাথে বেঁধে রাখে। তার ঘুমন্ত সঙ্গীদের অস্ত্রগুলো নিয়ে নেয়। তাদের হুমকি দিয়ে বলে, এখান থেকে এক চুল নড়বি তো খুন করে ফেলব।

ক্ষণিকের মধ্যে এসে উপস্থিত হয় ছয়জন অশ্বারোহী। মেয়েদের ধাওয়া করে ধরে আনার জন্য রওনা হয় তারা। বালির উপর তিনটি ঘোড়ার পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করে তীব্রবেগে ছুটে চলে ছয় ঘোড়সওয়ার। কিন্তু মেয়েদের নাগাল পাওয়া অত সহজ নয়। তাদের পলায়ন আর এই পশ্চাদ্ধাবনের মাঝে কেটে গেছে আট-দশ ঘন্টা।

হাবশী অশ্বারোহীদের মরুভূমির পথ-ঘাট সব চেনা। তদুপরি তারা পুরুষ। অল্প সময়ে তারা এগিয়ে যায় অনেক পথ। তীব্র বাতাস বইছে। বালি উড়ছে। তবু সমান গতিতে এগিয়ে চলছে তারা।

তিন ঘন্টা পথ চলার পর হাবশী অশ্বারোহীরা হঠাৎ দেখতে পেল, সম্মুখ আকাশে দিগন্তেরও উপরে মরুভূমির ধূলো-বালি ঘূর্ণাবর্তের মত পাক খেয়ে খেয়ে ধেয়ে আসছে। ভয়ার্ত চোখে বীর আরোহীরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে তীব্রগতিতে পিছন দিকে পালাতে শুরু করে তারা।

মরুভূমির দম্‌কা বাতাস, যাকে বলে সাইমুম। এ ভয়ংকর ঝড় বড় বড় টিলাকে বালু-কণায় পরিণত করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। রাশি রাশি টিলা মুহূর্তের মধ্যে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়। এই ঝড়ের মধ্যে কোন মানুষ বা পশু যদি দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকে, তাহলে উড়ে আসা বালি তার গায়ে বসে তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করে এবং ছোট-খাট একটি টিলা দাঁড়িয়ে যায় তার উপর।

বকা ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার মত আশেপাশে শক্ত কোন টিলা নেই। পালিয়ে নিজেদের পাহাড়ী এলাকায় ফিরে যেতে মনস্থ করে হাবশী অশ্বারোহী। কিন্তু সে পাহাড় য়ে অনেক দূর। তাছাড়া দমকা ঝড় পৌঁছে গেছে সেখানেও। সেখানকার বড় বড় বৃক্ষগুলো বাতাসের তোড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে চীৎকার করছে যেন।

ঝিলের কুমীরগুলো ভয়ে পাহাড়ের নালায় গিয়ে আত্মগোপন করে আছে। পুরোহিত একস্থানে হাটু গেড়ে বসে পড়ে হাত দুটো একবার মাটিতে একবার মাথায় খুঁড়ে হা-হুঁতাশ করছে আর বিলাপ করে বলছে, ওহে আংগুকের দেবতা! তোমার গজব সংবরণ কর। আর একটু ধৈর্য ধর দেবতা। অল্প পরেই আমরা দুটি মেয়েকে তোমার চরণে নিবেদন করছি। আমাদের প্রতি একটু দয়া কর দেবতা!

পলায়নপর মেয়েরাও এই ঝড়ের কবলে আক্রান্ত হয়। বালির আস্তর জমে যায় তাদের ও তাদের ঘোড়াগুলোর গায়ে । আতঙ্কগ্রস্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রনহীনভাবে ইতস্ততঃ দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর ও ঝড়-কবলিত তিনটি ঘোড়া মধ্যরাত পর্যন্ত এভাবে ছুটোছুটি করে। নিথর শরীরে নিরুপায় ঘোড়ার পিঠে বসে আছে তিন মেয়ে ।

একদিকে সীমাহীন ক্লান্তি, অপরদিকে প্রবল পিপাসা। ক্লান্তি ও পিপাসা ধীরে ধীরে ঘোড়াগুলোকে বেহাল করে তুলতে শুরু করে। হঠাৎ একটি ঘোড়া উপুড় হয়ে পড়ে যায়, পড়ে যায় তার আরোহী মেয়ে। ঘোড়াটি আবার উঠে দাঁড়ায়। আবার পড়ে যায়। মেয়েটি ঘোড়ার বুকের নীচে চাপা পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর ঢিলে হয়ে আসে আরেকটি ঘোড়ার দেহ। পিঠের জিন সরে যায় একদিকে। তার আরোহী মেয়েটিও কাত হয়ে পড়ে যায় সে দিকে। কিন্তু এক পা তার আটকে গেছে রেকাবে। মন্থর গতিতে চলছে ঘোড়া। মাটিতে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে। তৃতীয় মেয়েটি সাহায্য করতে পারছে না তাকে। ঘোড়া তার নিয়ন্ত্রণহীন। মেয়েটির চীঙ্কার কানে আসে তার। এক সময় স্তব্ধ হয়ে যায় তারও কণ্ঠ । বিহ্বলের মত কেবল তাকিয়ে থাকে তৃতীয় মেয়ে। ঘোড়র সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে হেঁচড়াচ্ছে মেয়েটির মৃতদেহ। ভয়ে আঁতকে উঠে তৃতীয় মেয়ে। যত সাহসী-ই হোক মেয়ে তো। চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে সে।

নিজের ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না তৃতীয় মেয়ে। পিছন ফিরে তাকায় সে। ধূলিঝড়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে।

মেয়েটি এখন একা। সে ভয়ে জ্ঞান-শূন্য হয়ে পড়েছে। ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে হাত দুটো এক করে আকাশপানে উঁচিয়ে ধরে। গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে বলতে শুরু করে–

আমার মহান খোদা! আসমান-জমিনের খোদা। তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমি গুনাহগার। আমার দেহের প্রতিটি লোম পাপে নিমজ্জিত। পাপ করতে-ই আমি এসেছিলাম। পাপের মধ্যেই আমি বড় হয়েছি। আমি যখন নিতান্ত অবুঝ শিশু, তখনই বড়রা আমাকে পাপের সম্মুখে নিক্ষেপ করেছিল। পাপে পাঠ শিখিয়ে তারা আমাকে বড় করেছে। তারপর বলেছে, যাও, এবার নিজের রূপ আর দেহ দয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত কর। মানুষ খুন কর। মিথ্যা বল, প্রতারণা কয়। আপাদমস্তক চরিত্রহীন হয়ে যাও। এ পথে নামিয়ে ওরা আমাকে বলেছিল, এটা তোমার ক্রুশের অর্পিত দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলে তুমি জান্নাত পাবে।

পাগলের মত চীৎকার করছে মেয়েটি। ধীরে ধীরে মন্থর হয়ে আসছে তার ঘোড়ার গতি। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলে, খোদা! যে ধর্ম সত্য, যে দ্বীন তোমার মনোপূতঃ আজ আমাকে তুমি তার মোজেজা দেখাও, সে ধর্মের উসিলায় আমাকে রক্ষা কর।

বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে উঠে মেয়েটির। পাপের অনুভূতি শিথিল করে তোলে তার পুরনো ধর্মের বাঁধন। মৃত্যুর ভয়ে ভুলে যায় সে কোন্ ধর্মের মেয়ে। নিজেকে পাপের সমুদ্রে নিমজ্জিত দেখতে পায় সে। হৃদয়ে তার এই অনুভূতি জাগতে শুরু করে, আমি পুরুষদের একটি ভোগ্য-সামগ্রী, আমি একটি প্রতারণার ফাঁদ। তার-ই শাস্তি এখন ভোগ করছি আমি।

চৈতন্য হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয় মেয়েটির। নিজেকে সামলিয়ে রাখার চেষ্টা করে সে। উচ্চকণ্ঠে আহ! বলে চীৎকার দিয়ে মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে সে বলে উঠে, আমাকে রক্ষা কর খোদা! আমাকে বাঁচাও। এমনি বেঘোরে প্রাণটা নিওনা তুমি আমার?

তখনি মেয়েটার মনে পড়ে যায়, সে এতীম । মৃত্যুর কবলে পড়লে অতীতের দিকে পালাতে চেষ্টা করে মানুষ। এ যুবতীটিও তার অতীতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওখানে তার নেই যে কেউ! মা নেই, বাপ নেই, ভাই-বোন কেউ নেই তার। তার মনে পড়ে যায়, খৃষ্টানরা তাকে লালন-পালন করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়ে এ পথে নিক্ষেপ করেছে। নিজের প্রতি নিজের-ই ঘৃণা জাগতে শুরু করে তার।

মেয়েটি এখন ক্ষমার প্রত্যাশী। কৃত পাপের পরিণাম থেকে মুক্তি পেতে চায় সে।

ঘোড়ার গতি তার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। কোন রকম পা টেনে টেনে চলছে ঘোড়াটি। ধীরে ধীরে ঝড়ও থেমে যায়। চৈতন্য হারিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে-ই উপুড় হয়ে পড়ে থাকে।

***

সুলতান আইউবী মিসরের সীমান্তে টহল প্রহরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন আগেই। তার তিনটি প্লাটুনের হেডকোয়ার্টার সুদান ও মিসর সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইল ভিতরে। হেডকোয়ার্টারের তাঁবু বসান হয়েছে এমন স্থানে, যেখানে ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার মত আড়াল আছে। কিন্তু এই দম্‌কা ঝড় তাদেরও নিরাপদ তাঁবুগুলো পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে গেছে। উট-ঘোড়াগুলোকে সামলানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ঝড় থামলে সৈন্যরা তাঁবু প্রভৃতি গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আহমদ কামাল এ তিন প্লাটুনের কমাণ্ডার। গৌরবর্ণ, সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান এক সুপুরুষ। বাড়ি তুরস্ক। ঝড় থামলে তিনিও বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং মালপত্র ও পশুপালের পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। আকাশ পরিষ্কার। ধূলো-বালি উড়ছে না এখন আর। অনেক দূরের বস্তুটিও এখন চোখে পড়ছে। এক সিপাহী হঠাৎ একদিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠে, কমাণ্ডার! কমাণ্ডার!! ঐ যে একটি ঘোড়া আর একজন আরোহী দেখা যাচ্ছে। ওটি আমাদের নয় তো?

সিপাহীর দৃষ্টির অনুসরণ করেন আহমদ কামাল বলেন, আরোহী মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের বাহিনীতে তো মেয়ে নেই। চল, দেখে আসি।

সিপাহীকে নিয়ে ছুটে যান আহমদ কামাল। অবনত মুখে অতি ধীরপদে এগিয়ে আসছে একটি ঘোড়া। খাবারের গন্ধ পেয়ে হেডকোয়ার্টারের ঘোড়াগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঘোড়াটি। ঘোড়ার পিঠে একটি মেয়ে। নিস্তেজ উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। বাহু দুটো তার ঘোড়ার ঘাড়ের দুদিকে ছড়ানো। মাথার চুলগুলো তার এলোমেলো ছড়িয়ে আছে সামনের দিকে।

আহমদ কামাল কাছে পৌঁছার আগে-ই ঘোড়াটি হেডকোয়ার্টারের ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে খাবার খেতে শুরু করে। ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়ান আহমদ কামাল। এক নজর তাকিয়ে নিরীক্ষা করেন মেয়েটিকে। তাকে রেকাব থেকে পা সরিয়ে দু হাতে করে ধরে নীচে নামিয়ে আনেন। সিপাহীর উদ্দেশে বলেন, জীবিত; বোধ হয় খৃষ্টান। এর ঘোড়াটিকে পানি পান করাও।

মেয়েটিকে নিজের তাঁবুতে নিয়ে যান আহমদ কামাল। মাথার চুল ও সর্বাঙ্গ তার ধূলোমলিন। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মেয়েটির মুখমণ্ডলে পানির ঝাঁপটা দেন তিনি। তারপর ফোঁটা ফোঁটা করে পানি দিতে থাকেন তার মুখে।

মিনিট দশেক পর চোখ খুলে মেয়েটি। বিস্ময়াভিভূত নেত্রে কয়েক মুহূর্ত আহমদ কামালের প্রতি তাকিয়ে থেকে হঠাৎ উঠে বসে সে। গৌরবর্ণ একটি লোককে পাশে দেখতে পেয়ে মেয়েটি ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি এখন ফিলিস্তীনে? মাথা দুলিয়ে আহমদ কামাল তাকে বুঝাতে চান, আমি তোমার ভাষা বুঝছি না। এবার মেয়েটি আরবীতে জিজ্ঞেস করে। আপনি কে? আমি কোথায়?

আমি ইসলামী ফৌজের একজন নগন্য কমাণ্ডার। আর তুমি এখন মিসরে। জবাব দেন আহমদ কামাল।

আঁতকে উঠে মেয়েটি। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ে পাংশুবর্ণ ধারণ করে তার মুখ। আবার চৈতন্য হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তার। বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকে আহমদ কামালের প্রতি।

অভয় দেন আহমদ কামাল। বলেন, ভয় কর না, আত্মসংবরণ কর। আমরা মুসলমান। মুসলমান বিনা অপরাধে কাউকে শাস্তি দেয় না।

সস্নেহে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আহমদ কামাল বললেন, আমি জানি, তুমি খৃষ্টান। কিন্তু এখন তুমি আমার মেহমান। তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। তুমি শান্ত হও, সুস্থ হও।

আহমদ কামাল একজন সিপাহীকে ডেকে মেয়েটির জন্য খানা-পিনার ব্যবস্থা করতে আদেশ করেন।

খাবার-পানি নিয়ে আসে সিপাহী। দেখা মাত্র পানির গ্লাসটি খপ করে হাতে তুলে নেয় মেয়েটি। মুখের সঙ্গে লাগিয়ে অতিশয় ব্যাকুলতার সাথে টক্ টক্ করে পানি পান করতে শুরু করে সে। গ্লাসটি ধরে ফেলেন আহমদ কামাল। টেনে ঠোঁট থেকে জোর করে সরিয়ে এনে বললেন, আস্তে, বেশী পিপাসার পর হঠাৎ এত পানি পেটে দিতে নেই। এখন খাবার খাও, পানি পরে পান কর। খাবারের পাত্রে হাত দেয় মেয়েটি। তৃপ্তি সহকারে আহার করে। ধীরে ধীরে স্বস্তি ও শক্তি ফিরে আসতে শুরু করে তার। ফিরে আসে মুখের জৌলুস। চাঙ্গা হয়ে উঠে তার দেহ।

আহমদ কামালের তাঁবুর পার্শ্বেই ছোট আরেকটি তাঁবু। এটি তাঁর গোসলখানা। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি আছে এখানে। দেখে-শুনে একটি খেজুর বাগানের নিকটে স্থাপন, করা হয়েছিল ক্যাম্পটি। তাই এখানে পানির কোন সংকট পড়ে না। আহারের পর আহমদ কামাল মেয়েটিকে সেই তাঁবুতে ঢুকিয়ে পর্দা ঝুলিয়ে দেন। গোসল করে মেয়েটি।

মেয়েটি অত্যন্ত সন্ত্রস্ত। আহমদ কামালের অভয় বাণীতে ভয় তার কাটেনি; শত্রুর আশ্রয়ে ভাল ব্যবহারের আশা করতে পারছে না সে। শৈশব থেকেই সে শুনে আসছে, মুসলমানের চরিত্র হায়েনার মত, নারীর সাথে তাদের আচরণ হিংস্র পশুর মত। তদুপরি হাবশীদের আচরণ, কুমীর ও মরুঝড়ের ভীতি চেপে ধরে আছে তাকে। দুই সঙ্গী মেয়ের নির্মম মৃত্যুর করুণ দৃশ্য আরো ভয়ার্ত করে তোলে তাকে। সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তটির কথা স্মরণে আসা মাত্র সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠে তার।

গোসল করার সময় মেয়েটির মনে জাগে, আমি আমার এই অপবিত্র অস্তিত্বকে ধুয়ে পরিষ্কার করতে চাই। কিন্তু দুনিয়ার এ পানি তো পবিত্র করতে পারবে না আমায়!

চরম অসহায়ত্ব ও উপায়হীনতা বোধ করে মেয়েটি। অবশেষে মনে মনে পরিস্থিতির হাতে তুলে দেয় নিজেকে। বলে, ভেবে আর লাভ কি, যা হবার হবে। মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে, এসেছি, আপাততঃ তা-ই বা কম কিসে!

গোসল সেরে তাঁবুতে ফিরে আসে মেয়েটি। এবার তার আসল রূপ ফুটে উঠে আহমদ কামালের সামনে। মন-মাতানো দেহটিতে তার রূপের বন্যা বইছে যেন। কোন সাধারণ মেয়ে হতে পারে না এ যুবতী। মিসরের এ অঞ্চলে এই ফিরিঙ্গী মেয়েটি আসল কিভাবে? কোত্থেকে-ই বা এল? বেজায় কৌতূহল আহমদ কামালের মনে। মেয়েটির পরিচয় জানতে চান আহমদ কামাল। জবাবে সে বলে, আমি কাফেলা হারিয়ে পথ ভুলে এসেছি। ঝড়ের কবলে পড়ে ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আশ্বস্ত হলেন না আহমদ কামাল। আরো তিন-চারটি প্রশ্ন করলেন তিনি। কাঁপতে শুরু করে মেয়েটির ওষ্ঠাধর। আহমদ কামাল বললেন, যদি বলতে, আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল; ঝড়ের কবলে পড়ে দস্যুদের হাত থেকে ছুটে এখানে এসে পড়েছি, তাহলে বোধ হয় আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারতাম। কাফেলা হারিয়ে পথ ভুলে যাওয়ার কথাটা আমি মানতে পারছি না।

ইত্যবসরে এক সিপাহী তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে একটি থলে ও একটি পানির মশক আহমদ কামালের হাতে দিয়ে বলে, এগুলো মেয়েটির ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা ছিল। থলেটি হাতে নিয়ে খুলতে শুরু করেন আহমদ কামাল। সঙ্গে সঙ্গে থতমত খেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে থলের মুখ চেপে ধরে মেয়েটি। ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার চেহারা। আহমদ কামাল থলেটি তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, নাও তুমি-ই খুলে দেখাও। শিশুর মত করে থলেটি পিছনে লুকিয়ে ফেলে মেয়েটি। ভয়জড়িত কণ্ঠে বলে, না, এটা কাউকে দেখা যাবে না।

আহমদ কামাল বললেন, দেখ, এমনটি আশা কর না যে, তোমার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে আমি বলব, ঠিক আছে চলে যাও! তোমাকে আটকে রাখার অধিকার হয়ত আমার নেই। কিন্তু লোকালয় থেকে বহু দূরে ঘোড়ার পিঠে নিঃসঙ্গ ও অচেতন অবস্থায় যে মেয়েটিকে পাওয়া গেল, তাকে আমি এমনিতেই ছেড়ে দিতে পারি না। তাছাড়া এই অসহায় অবস্থায় একাকী-ই বা তোমাকে ছেড়ে দিই কি করে। একটা মানবিক কতব্যও তো আমার আছে। ঠিকানা বল, আমার রক্ষী বাহিনীর হেফাজতে তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেব। অন্যথায় সন্দেহভাজন মেয়ে সাব্যস্ত করে আমি তোমাকে কায়রোতে আমাদের প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেব। আমি নিশ্চিত, তুমি মিসরীও নও, সুদানীও নও। তাহলে তুমি কে? এখানে-ই বা কেন এসেছ, এ প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই আমি তোমায় করতে পারি।

চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করে মেয়েটির। থলেটি ছুঁড়ে দেয় আহমদ কামালের সামনে। রশি দিয়ে বাঁধা থলের মুখ খুলেন আহমদ কামাল। ভিতরে আছে কয়েকটি খেজুর, আর অপর একটি থলে। কৌতূহল বেড়ে যায় আহমদ কামালের। এ থলেটিও খুললেন তিনি। পেলেন অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা আর সোনার তৈরি সরু শিকলে বাঁধা কালো কাঠের একটি কুশ। আহমদ কামাল বুঝে ফেললেন, মেয়েটি খৃষ্টান। তিনি বোধ হয় জানতেন না যে, খৃষ্টান মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য খৃষ্টান বাহিনীতে যোগ দিতে আসে, একটি ক্রুশে হাত ধরিয়ে তার থেকে শপথ নেয়া হয় এবং সে ছোট্ট একটি ক্রুশ সর্বক্ষণ সঙ্গে রাখে। আহমদ কামাল বললেন,থলেতে আমার প্রশ্নের জবাব নেই।

আমি যদি এইসবগুলো স্বর্ণমুদ্রা আপনাকে দিয়ে দিই, তাহলে কি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

কেমন সাহায্য? জানতে চান আহমদ কামাল।

আমাকে ফিলিস্তীন পৌঁছিয়ে দেবেন এবং আর কোন প্রশ্ন করবেন না। বলল মেয়েটি।

আমি তোমাকে ফিলিস্তীন পৌঁছিয়ে দিতে পারি। তবে প্রশ্ন করব অবশ্যই। বললেন আহমদ কামাল।

আমাকে যদি আপনি কিছু-ই জিজ্ঞেস না করেন, তাহলে তার জন্য আপনাকে আলাদা পুরস্কার দেব। বলল মেয়েটি।

কি পুরস্কার জানতে চান আহমদ কামাল।

আমার ঘোড়াটি আমি আপনাকে দিয়ে দেব। আর…

আর কি।

আর তিনদিনের জন্য আমি আপনার দাসী হয়ে থাকব।

আহমদ কামাল ইতিপূর্বে কখনো এতগুলো সোনা হাতে নেননি। এমন চোখ ধাঁধানো রূপ আর এমন মনোহারী নারীদেহও দেখেননি কোনদিন। সম্মুখে পড়ে থাকা চকমকে সোনার টুকরাগুলোর প্রতি তাকান আহমদ কামাল। তারপর চোখ চলে যায় তার মেয়েটির রেশম-কোমল চুলের প্রতি। সোনার তারের ন্যায় ঝিকঝিক করছে চুলগুলো। চোখ দুটোতে যেন তার যাদুর আকর্ষণ। এ চোখের যাদুময় চাহনি দিয়েই রাজ-রাজড়াদের একজনকে আরেকজনের শত্রুতে পরিণত করে এরা। তা-ও নিরীক্ষা করে দেখেন আহমদ কামাল।

আহমদ কামাল সুঠাম সুদেহী এক বলিষ্ঠ যুবক। সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত তিন প্লাটুন সৈনিকের কমাণ্ডার। কোন কাজে তাকে বাধা দেয়, জবাব চায়, এমন নেই কেউ এখানে।

তবু–

তবু তিনি সোনার মুদ্রাগুলো কুড়িয়ে থলেতে ভরেন। ক্রুশটিও থলেতে রাখেন। তারপর নির্লিপ্তের মত থলেটি ছুঁড়ে দেন মেয়েটির কোলের মধ্যে।

কেন, এ মূল্য কি কম? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

নিতান্ত কম। ঈমানের মূল্য আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারে না। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আহমদ কামাল।

এ ফাঁকে কি যেন বলতে চায় মেয়েটি। আহমদ কামাল তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বললেন–

আমি আমার কর্তব্য ও আমার ঈমান বিক্রি করতে পারি না। সমগ্র মিসর আমার উপর নির্ভর করে স্বস্তিতে ঘুমায়। তিন মাস আগে সুদানীরা কায়রো আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। আমি যদি এখানে না থাকতাম, কিংবা যদি আমি তাদের কাছে আমার ঈমান বিক্রি করে দিতাম, তাহলে এই বাহিনী কায়রোতে ঢুকে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাত। আমার চোখে তুমি সেই বাহিনী অপেক্ষাও ভয়ংকর। কেন, তুমি কি গোয়েন্দা নও?

না।

মরুভূমির ঝড়ো-বাতাস তোমাকে কোন জালিমের কবল থেকে রক্ষা করে এখানে পাঠিয়েছে কিংবা দমকা বায়ুর মধ্যে থেকে নিজে বেরিয়ে এসেছ, এমন একটা কিছু বলে-ই কি তুমি আমাকে বুঝ দিতে চাও? জানতে চান আহমদ কামাল।

জবাবে মেয়েটি আমৃতা আমতা করে যা বলল, তার কোন অর্থ দাঁড়ায় না। তাই আহমদ কামাল বললেন

ঠিক আছে, তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ, এসব জানবার প্রয়োজন আমার নেই। তোমার মত মেয়েদের মুখ থেকে সত্য কথা বের করানোর জন্য কায়রোতে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ আছে। আগামী কাল-ই আমি তোমাকে সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার পরিচয় তারা-ই নিবেন।

অনুমতি হলে আমি এখন একটু বিশ্রাম নিই, কাল কায়রো রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাব। বলল মেয়েটি।

গত রাতে এক তিল ঘুমুতে পারেনি মেয়েটি। আর দিনটি কেটেছে ভয়াবহ এক সফরের মধ্য দিয়ে। ক্লান্তিতে, অবসন্ন তার দেহ। আহমদ কামালের অনুমতি নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। অনি দু চোখের পাতা এক হয়ে আসে তার। রাজ্যের ঘুম এসে চেপে ধরে তাকে।

আহমদ কামাল দেখলেন, ঘুমের মধ্যে মেয়েটি বিড় বিড় করছে। অস্থিরতার কারণে মাথাটা এপাশ-ওপাশ করছে তার। মনে হল ঘুমের মধ্যেই কাঁদছে সে।

সাথীদের ডেকে আহমদ কামাল বলে দিলেন, একটি সন্দেহভাজন ফিরিঙ্গী মেয়েকে ধরে আনা হয়েছে। আগামীকাল তাকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে। আহমদ কামালের চরিত্র সকলের জানা। তার ব্যাপারে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই কারুর।

অঘোরে ঘুমুচ্ছে মেয়েটি। আহমদ কামাল তাঁবু থেকে বের হয়ে ঘোড়াটির কম যান। দেখে হতবাক হয়ে যান তিনি। এ যে উন্নত জাতের ঘোড়। এ জাতের ঘোড় । মুসলিম বাহিনী ছাড়া অন্য কারুর নেই। জিনটি ধরে উলট-পালট করে দেখেন আহ কামাল। জিনের নীচে মিসরী ফৌজের প্রতীক আঁটা। আহমদ কামালের বাহিনীর-ইনি এ ঘোড়াটি।

ঝড়ের কারণে হাবশীরা মেয়েদের পশ্চাদ্ধাবন ত্যাগ করে জীবিত ফেরত পৌ যায়। পুরোহিতের মিশ্চিত ধারণা, ঝড়ের কবলে পড়ে মেয়েরা প্রাণ হারিয়েছে ওদের ক ভেবে আর লাভ নেই। এর মধ্যে সময়ও কেটে গেছে বেশ। বিপদ নেমে এল রজবের উপর। পুরোহিত তাকে বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করছে, বল, মেয়েরা কোথায় রজব দিব্যি খেয়ে বলছে, আমি কিছুই জানিনা। আমাকে না জানিয়েই শুরা পালিয়েছে। বুজবের উপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে হাবশীরা। তরবারীর আগা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে রক্তাক্ত করছে আর বলছে, বল মেয়েরা কোথায়? রজবের সঙ্গীদেরকেও তারা গাছের সঙ্গে বেঁধে অত্যাচার শুরু করে। দেশ ও জাতির সঙ্গে গাদ্দারী করার শান্তি কোন করছে রজব। রাতেও তার বাঁধন খোলা হয়নি। আঘাতে আঘাতে চালনির মত ঝাঝা হয়ে গেছে তার দেহ।

আহমদ কামালের তাঁবুতে শুয়ে আছে মেয়েটি। সূর্যাস্তের আগে একবার জেগেছিল সে। তাকে খাবার খাওয়ান আহমদ কামাল। তারপর পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। তার থেকে দু-তিন গজ দূরে শয়ন করেন আহমদ কামাল। কেটে যাচ্ছে রাত। টি টি করে বাতি জ্বলছে তাঁবুতে। হঠাৎ চীৎকার করে উঠে মেয়েটি। ঘুম ভেঙ্গে যায় আহমদ কামালের। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তার দেহ। চোখে-মুখে ভীতির ছাপ। কাছে এসে বসেন আহমদ কামাল। কাঁপতে কাঁপতে আহমদ কামালের গা ঘেঁষে বসে মেয়েটি। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ওদের থেকে আমাকে বাঁচাও। ওরা আমায় কুমীরের ঝিলে নিক্ষেপ করছে। আমার মাথা কাটতে চেয়েছে ওরা।

কারা? জিজ্ঞেস করেন আহমদ কামাল।

ঐ কৃষ্ণাঙ্গ হাবশীরা। এখানে এসেছিল ওরা। ভয়জড়িত কণ্ঠে বলে মেয়েটি।

হাবশীদের বলির কথা জানতেন আহমদ কামাল। মনে তার সংশয় জাগে, বোধ হয় একে বলি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন। ভয় যেন আরো বেড়ে যায়। আহমদ কামালের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কর না; আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। আহমদ কামাল দেখলেন, ভয়ে মেয়েটি আধখানা হয়ে গেছে। তিনি তাকে সান্ত্বনা দেন। অভয় দিয়ে বলেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, এখান থেকে তোমাকে তুলে নিতে কেউ আসবে না। মেয়েটি বলল, আমি আর ঘুমাতে পারব না। আপনি বসে বসে আমার সাথে কথা বলুন। একা একা জেগেও আমি সময় কাটাতে পারব না। আমি পাগল হয়ে যাব।

আহমদ কামাল বললেন, ঠিক আছে, আমিও তোমার সঙ্গে সজাগ বসে থাকব। আলতো পরশে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আহমদ কামাল বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার কাছে আছি, ততক্ষণ তোমার কোন ভয় নেই।

দীর্ঘক্ষণ জেগে কাটায় মেয়েটি। আহমদ কামালও সজাগ বসে থাকেন তার পার্শ্বে। হাবশীদের ব্যাপারে তিনি মেয়েটিকে আর কোন কথা জিজ্ঞেস করেননি। তুরস্ক ও মিসরের গল্প শোনাতে থাকেন তাকে। আহমদ কামালের গা ঘেঁষে বসে আছে সে। আহমদ কামাল অত্যন্ত মিশুক মানুষ। রসের কথা বলে বলে মেয়েটির মন থেকে ভয় দূর করে দেন তিনি। এক সময় প্রসন্নচিত্তে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটি।

মেয়েটির যখন ঘুম ভাঙ্গে, রাতের তখন শেষ প্রহর। আহমদ কামাল নামায পড়ছেন। মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার প্রতি। তন্ময়চিত্তে আহমদ কামালের নামায পড়া দেখছে সে। দুআর জন্য হাত উঠান আহমদ কামাল। চোখ দুটো বন্ধ করেন। একনাগাড়ে নির্নিমেষ নয়নে মেয়েটি তাকিয়ে আছে আহমদ কামালের মুখের প্রতি। দুআ শেষ করে হাত নামান আহমদ কামাল। চোখ খুললে দৃষ্টি পড়ে জাগ্রত মেয়েটির প্রতি।

হাত তুলে খোদার কাছে আপনি কি প্রার্থনা করলেন কৌতূহলী মনে জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

অন্যায় প্রতিরোধের সাহস। জবাব দেন আহমদ কামাল।

আপনি কি খোদার কাছে কখনো সুন্দরী নারী আর সোনা-দানা চাননি।

এ দুটি বস্তু তো প্রার্থনা ছাড়াই আল্লাহ আমাকে দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ওসবের উপৰ্ম আমার কোন অধিকার নেই। আল্লাহ বোধ হয় আমায় পরীক্ষা নিতে চাইছেন। বললেন আহমদ কামাল।

আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, তিনি আপনাকে অন্যায়ের মোকাবেলা করার হিম্মত দিয়েছেন প্রশ্ন করে মেয়েটি।

কেন! তুমি কি দেখনি তোমার এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা আর তোমার রূপ-মাধুৰ্য্য তো আমাকে আমার আদর্শ থেকে এক চুল সরাতে পারেনি! এ আমার প্রচেষ্টা আর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের প্রতিফল। জবাব দেন আহমদ কামাল।

আল্লাহ কি গুনাহ মাফ করেন? জানতে চায় মেয়েটি।

আলবৎ তাওবা করলে আমাদের আল্লাহ মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন। শর্ত হল, তাওবা করার পর সে পাপ আবার করা যাবে না। জবাব দেন আহমদ কামাল।

আহমদ কামালের জবাব শুনে মাথা নত করে মেয়েটি। কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে দুজন। মেয়েটির ফোঁপানির শব্দ পান আহমদ কামাল। অবনত মাথাটা ধরে উপরে তুলে দেন তিনি। গুমরে কাঁদছে মেয়েটি। চোখ তার অশ্রুসজল। আহমদ কামালের হাত চেপে ধরে সে। হাতে চুমো খায় কয়েকবার। আহমদ কামাল নিজের হাত গুটিয়ে নেন। রুদ্ধকণ্ঠে মেয়েটি বলে, “আজ-ই আমরা সম্পর্কহীন হয়ে পড়ব। আমাকে পাঠিয়ে দেবেন কায়রো। আর হয়ত কোনদিন দুজনের সাক্ষাৎ ঘটবে না। আমার মন আমাকে বাধ্য করছে যে, আমি বলে দিই, আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি। তারপর আপনাকে জানিয়ে দিই, এখন আমি কী।

তোমার যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি নিজেই তোমার সঙ্গে যাব। এমন একটি স্পর্শকাতর গুরুদায়িত্ব আমি অন্য কারো উপর ন্যাস্ত করতে পারি না।

তবে কি শুনবে না আমার পরিচয়, আমার ইতিবৃত্ত নিরাশার সুরে বলল মেয়েটি।

উঠ, এসব শ্রবণ করা আমার কাজ নয়। বলেই তার থেকে বেরিয়ে গেলেন আহমদ কামাল।

***

কায়রো অভিমুখে এগিয়ে চলছে ছয়টি ঘোড়া। একটিতে আহমদ কামাল। তাঁর পিছনের ঘোড়ায় মেয়েটি আর তার পিছনে পাশাপাশি চলছে রক্ষীদের চারটি ঘোড়া। একেবারে পিছনে একটি উট। তাতে সফরের সামান-খাবার-পানি ইত্যাদি বোঝাইকরা।

আহমদ কামালের ক্যাম্প থেকে কায়রো অন্তত ছত্রিশ ঘন্টার পথ। এগিয়ে চলছে কাফেলা। মেয়েটি দু দুবার তার ঘোড়াটি নিয়ে আসে আহমদ কামালের পাশে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি তাকে পিছনে পাঠিয়ে দেন। কোন কথা বলছেন না মেয়েটির সঙ্গে। সূর্যাস্তের পর এক স্থানে কাফেলা থামান আহমদ কামাল। এখানে রাত যাপন করতে হবে। তাঁবু ফেলতে আদেশ করেন তিনি।

রাতে আহমদ কামাল নিজের তাঁবুতে ঘুমুতে দেন মেয়েটিকে। প্রদীপ জ্বালিয়ে গভীর ন্দ্রিায় তলিয়ে যান নিজে।

হঠাৎ চোখ খুলে যায় আহমদ কামালের। কে যেন আলতো পরশে হাত বুলাচ্ছে তার মাথায়। চমকে উঠেন তিনি। ঘুমের রেশ কাটিয়ে তিনি দেখতে পান, মেয়েটি তার শিয়রে বসা। মেয়েটির হাত তার মাথায়। দ্রুত উঠে বসেন আহমদ কামাল। তাকালেন মেয়েটির প্রতি। অশ্রুর বন্যা বইছে যেন তার চোখে। দু হাতে আহমদ কামালের হাত চেপে ধরে চুম্বন করে সে। শিশুর মত রয়ে রয়ে কাঁদতে শুরু করে। গম্ভীর চোখে একদৃষ্টে মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে থাকেন আহমদ কামাল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মেয়েটি বলল, আমি তোমার দুশমন। আমি গুপ্তচরবৃত্তি, তোমাদের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার মাঝে বিভেদ সৃষ্টি এবং সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার আয়োজন সম্পন্ন করতে ফিলিস্তীন থেকে তোমাদের দেশে রওনা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার হৃদয় থেকে তোমাদের প্রতি শত্রুতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন আর আমি গুপ্তচর নই, তোমাদের শত্রুও নই।

কেন? প্রশ্ন করেন আহমদ কামাল। কিন্তু জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি বললেন, তুমি একটি ভীরু মেয়ে। তুমি স্বজাতির সঙ্গে গাদ্দারী করছ। শূলে চড়েও তোমাকে বলা উচিত, আমি খৃষ্টান। মুসলমান আমার জাতশত্রু। ক্রুশের জন্য জীবন দিয়ে আমি গর্ববোধ করছি। বললেন আহমদ কামাল।

 কেন? প্রশ্ন করেছেন, তার জবাবটা শুনে নিন ভাই! আমার জীবনে আপনি-ই প্রথম পুরুষ, যিনি এই রূপ-যৌবনকে তুচ্ছ বলে ছুঁড়ে ফেললেন। অন্যথায় কি আপন, কি পর সকলের চোখেই আমি এক খেলনা। আমার দৃষ্টিতেও আমার জীবনের লক্ষ্য এই পুরুষদের নিয়ে তামাশা করব, আনন্দ দেব, আনন্দ নেব, রূপের জালে আটকিয়ে পুরুষদের ধোকা দেব, আয়েশ করব। প্রশিক্ষণও পেয়েছি আমি এ কাজের-ই। আপনারা যাকে বেহায়াপনা বলেন, আমার জন্য তা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল, একটি অস্ত্র। ধর্ম কি, আল্লাহর বিধান বলতে কি বুঝায়, তা আমি জানি না। আমি চিনি শুধু কুশ। শৈশবে-ই আমার মন-মগজে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিল, ক্রুশ হল খোদার নিদর্শন, খৃষ্টবাদের মহান প্রতীক। সমগ্র বিশ্বে কর্তৃত্ব করার অধিকার একমাত্র এই ক্রুশের অনুসারীদের আর মুসলমান হল ক্রুশের শত্রু। তাদের রাজত্ব করার অধিকার নেই। বেঁচে থাকতে চাইলে থাকতে হবে ক্রুসেডারদের পদানত হয়ে। একটি কথা-ই আমার ধর্মের মূল ভিত্তি জানি। আমাকে মুসলমানদের মূলোৎপাটনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বলা হয়েছিল, এটি তোমার পবিত্র কর্তব্য …..। 

এ পর্যন্ত বলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে মেয়েটি আহমদ কামালকে জিজ্ঞেস করে—

রজব নামে আপনাদের এক সালার আছে। তাকে জানেন আপনি?

জানি। সে খলীফার রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার। সুদানীদের মিসর আক্রমণের ষড়যন্ত্রে সে-ও জড়িত ছিল। জবাব দেন আহমদ কামাল।

এখন সে কোথায়, জানেন?

আমার জানা নেই। আমি শুধু এতটুকু আদেশ পেয়েছি যে, রজব পালিয়ে গেছে। যেখানে পাবে, সেখানেই ধরে ফেলবে। পালাতে চেষ্টা করলে তীর ছুঁড়ে শেষ করে দিবে।

আমি কি বলে দেব, এখন সে কোথায় সে সুদানে হাবশীদের নিকট আছে। সেখানে একটি মনোরম জায়গা আছে। সেখানে মেয়েদেরকে দেবতার নামে বলি দেয়া হয়। রজব সেখানেই অবস্থান করছে। আমি জানি সে দলত্যাগী সালার। তার সঙ্গে ফিলিস্তীন থেকে এসেছিলাম আমরা তিনটি মেয়ে।

অপর দুজন কোথায়?

সহসা বাচ্ছন্ন হয়ে উঠে মেয়েটির দুচোখ। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলে, “তারা মারা গেছে। তাদের মৃত্যুই আমাকে বদলে দিয়েছে।

এই বলে মেয়েটি আহমাদ কামালকে সুদীর্ঘ এক কাহিনী শোনায়। রজবের সঙ্গে কিভাবে তারা ফিলিস্তান থেকে এসেছিল, কিভাবে হাবশীরা তাদের দুটি মেয়েকে দেবতার নামে বলি দিতে চেয়েছিল, কিভাবে তারা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে, কিভাবে মরু ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে তার দুই সহকর্মী প্রাণ হারাল, সব কাহিনী সবিস্তারে বিকৃত করে মেয়েটি। সে বলে ঈমানণীতদান ২৮৭

আমি নিজেকে রাজকন্যা মনে করতাম। রাজা-বাদশাদের হৃদয়ে আমি রাজত্ব করেছি। একজন আল্লাহ আছেন, মৃত্যু আছে, এমনটি কল্পনায়ও আসেনি আমার কখনো। আমাকে পাপের সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। আমিও অবলীলায় অবগাহন করতে থাকি তাতে। অপার আনন্দ পেতাম সেই অবগাহনে। হাবশীদের মহল্লায় গিয়ে আমি হাঙ্গর-কুমীর দেখলাম। বলি দেয়া মেয়েদের মস্তক আর কর্তিত দেহ নিক্ষেপ করা হয় ওদের মুখে। রজব ও দুই সঙ্গী মেয়ের সাথে যখন ঘুরতে যাই, কুমীরগুলো তখন ঝিলের কূলে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল। তাদের কুৎসিত বিকট দেহ দেখে আমি কেঁপে উঠি। আমার এই দেহটিকে–যা রাজা-বাদশাদের মস্তক অবনত করে দেয়–হাবশীরা কুমীরের আহারে পরিণত করতে চেয়েছিল। আমাকে বলি দেয়ার দিন-তারিখ ধার্য হয়ে গিয়েছিল। আমি মৃত্যুর পরোয়ানা পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার দেহের প্রতিটি শিরা জেগে উঠে। আমি নিজের ভিতর থেকে আওয়াজ শুনতে পাই, এই হল রূপ আর দেহের অপব্যবহারের পরিণতি। আমি জীবন বাজি রেখে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। ফিলিস্তীন থেকে আমাদেরকে রজবের সঙ্গে পাঠান হয়েছিল। কথা ছিল, ও আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু সে নিজেই আমাদের প্রতি হাত প্রসারিত করে বসে…..।

হাবশীদের কঠিন অক্টোপাশ ছিঁড়ে রাতের আঁধারে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম আমরা তিনজন। রজব আমাদের কোন সহযোগিতা করেনি। হাবশীদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার কোন পদক্ষেপও সে নেয়নি। মরুভূমিতে আমাদের কোন আশ্রয় ছিল না। আমরা ঝড়ের কবলে পড়ে গেলাম। প্রথমে একটি মেয়ে ছিটকে পড়ে যায় ঘোড়ার পিঠ থেকে। তাকে পিষে ফেলে তার ঘোড়। দ্বিতীয় মেয়েটি যখন ঘোড়া থেকে পড়ে গেল, তখন এক পা আটকে গেল তার ঘোড়ার রেকাবে। ঝুলন্ত অবস্থায় ঘোড়ার সঙ্গে মাটিতে হেঁচড়াতে লাগল। এভাবে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তার ঘোড়া তাকে অন্ততঃ দু মাইলেরও বেশী পথ নিয়ে আসে। তার আর্তচীকারে আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এখনও তার সেই করুণ চীৎকার-ধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব, তার সেই চীৎকার আমার কানে বাজতেই থাকবে।

প্রবল ঝড়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে আমার ঘোড়া । আমি ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সঙ্গী দু মেয়েকে মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, আমার পরিণতি কী হবে। ওরা ছিল আমার চেয়েও রূপসী। বহু রাজা-বাদশাহ ছিল তাদের হাতের পুতুল। রূপের অহংকার ছিল তাদেরও। কিন্তু এমনি ভয়ংকর মৃত্যু তাদের চাপা দিয়ে রেখেছে মরুভূমির বালির নীচে।

আমি এখন একা। ঝড়ের শো শো শব্দকে মনে হতে লাগল, যেন মৃত্যু দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল্ করে হাসছে। আমার মাথার উপরে, সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে আমি ভুত-প্রেত ও মৃত্যুর অট্টহাসি শুনতে পেলাম।

এমন এক মহাবিপদে নিক্ষিপ্ত হয়েও আমি চৈতন্য হারাইনি। হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে আমি ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম। বুঝলাম, এ আর কিছুই নয়–আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আল্লাহর কথা মনে পড়ে যায় আমার। দু হাত উপরে তুলে উচ্চকণ্ঠে ডাকতে লাগলাম তাকে। কেঁদে কেঁদে তাওবা করলাম। ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তারপর চৈতন্য হারিয়ে যায় আমার …..।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ খুলে দেখলাম, আমি আপনার কজায়। আপনার গৌরবর্ণ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। ভাবলাম, আপনি ইউরোপিয়ান কেউ হবেন আর আমি ফিলিস্তীনে। এ ধোকায় পড়ে আমি কথা বললাম ইংরেজীতে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? আমি কোথায়? যখন জানতে পারলাম, আমি মুসলমানের কুজায় এসে পড়েছি এবং যেখানে আছি, জায়গাটা ফিলিস্তীন নয়–মিসর, তখন মনটা আমার ছ্যাৎ করে উঠে। ভয়ে আমি শিউরে উঠি। ভাবলাম, এভাবে দুশমনের হাতে এসে পড়ার চেয়ে ঝড়ে জীবন দেয়া-ই তো ভাল ছিল। জীবনে রক্ষা পেয়ে আমার লাভটা কী হল। প্রশিক্ষণে আমাদেরকে ধারণা দেয়া হয়েছিল, মুসলমানরা নারীর সাথে হিংস্র প্রাণীর ন্যায় আচরণ করে। আপনার পরিচয় পেয়ে আমার সে কথাটা-ই মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে যে আচরণ করলেন, তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত। আপনি এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা ছুঁড়ে ফেললেন, আমাকেও সরিয়ে দিলেন। আমার এই উপচেপড়া রূপ আর মধুভরা দেহ আপনাকে এতটুকুও আকর্ষণ করতে পারল না। এ এক পরম আশ্চর্য-ই বটে। কিন্তু তখনও আমার ভয় কাটেনি। মনে মনে ভাবছিলাম, যদি একজন সৎ মানুষ পেয়ে যেতাম, যে আমাকে একটু আশ্রয় দেবে, আমায় পবিত্র মনে নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেবে। আপনার চরিত্র যে এত পবিত্র, তখনও আমি তা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারিনি।

আমার আশংকা ছিল, রাতে আপনি আমায় উত্যক্ত করবেন। স্বপ্নে আমি কুমীর দেখলাম, হাবশী-হায়েনা ও মরুঝড়ের তান্ডব দেখলাম। ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। আপনি আমায় বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নিলেন, শিশুদের ন্যায় গল্প শুনিয়ে আমাকে শান্ত করলেন, ঘুম পাড়ালেন। শেষ রাতে জেগে দেখলাম, আপনি আল্লাহর সমীপে সেজদায় পড়ে আছেন। যখন আপনি দুআর জন্য হাত উঠালেন, চোখ বন্ধ করলেন, তখন আপনার চেহারায় যে আনন্দ, প্রশান্তি আর দ্যুতি আমি দেখতে পেলাম, ইতিপূর্বে আর কখনো এমনটি দেখিনি কারুর মুখে। আমি সন্দেহে পড়ে গেলাম, আপনি মানুষ না ফেরেশতা। এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা আর আমার মত যুবতী থেকে কোন মানুষ তো বিমুখ হতে পারে না!

আপনার মুখমন্ডলে আমি যে প্রশান্তি ও দীপ্তি দেখেছিলাম, তা আমার দুচোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, এ প্রশান্তি আপনাকে কে দিল? কিন্তু কেন যেন প্রশ্নটা চেপে গেলাম। আপনার অস্তিত্বে আমি এত প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছিলাম যে, আসল সত্য গোপন রেখে আপনাকে ধাঁধার মধ্যে রাখতে চাইলাম না। আমি চেয়েছিলাম, নিজের সব ইতিবৃত্ত আপনার কাছে প্রকাশ করি। বিনিময়ে আপনি আপনার এই চরিত্র-মাধুর্য আর এই প্রশান্তির পরশ দিয়ে আমার হৃদয়ের সব ভীতি, সব যন্ত্রণা দূর করে দেবেন। কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন না; আপনার কর্তব্য-ই ছিল আপনার কাছে প্রিয়।

আবেগের আতিশয্যে মেয়েটি আহমদ কামালের হাত চেপে ধরে এবং বলে, একেও হয়ত আপনি আমার প্রতারণা মনে করবেন। কিন্তু আপনার প্রতি আকুল নিবেদন, আমাকে সঠিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন, আমার হৃদয়ের কথাগুলো শুনুন। আপনার থেকে আর আমি বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। কাল আপনাকে পাপের আহ্বান জানিয়ে আমি বলেছিলাম, আপনি আমাকে দাসী বানিয়ে নিন। কিন্তু আজ নিতান্ত পবিত্র মনে আমি বলছি, যতদিন আমি বেঁচে থাকব, আমি আপনার-ই পায়ে পড়ে থাকব। দাসী হয়ে আমি আপনার সেবা করব। বিনিময়ে আমি চাই শুধু সেই প্রশান্তি, যা নামায পড়ার সময় আপনার চেহারায় আমি দেখেছিলাম।

আহমদ কামাল বললেন, আমাকে তুমি ধোঁকা দিচ্ছ, একথা যেমন আমি বলব না, তেমনি আমার জাতি এবং আমার মিশনের সঙ্গেও আমি প্রতারণা করতে পারি না। আমার কাছে তুমি আমানত। আমি আমানতে খেয়ানত করতে পারি না। তোমার সঙ্গে আমি যে আচরণ করেছি, তা ছিল আমার কর্তব্য। এ দায়িত্ব থেকে তখন-ই আমি অব্যাহতি পাব, যখন তোমাকে আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগের হাতে তুলে দে আর তারা আমাকে আদেশ করবেন, আহমদ কামাল! এবার তুমি চলে যাও।

মেয়েটি আসলেই প্রতারণা করছিল না। এবার কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে সে বলল, আপনার আদালত যখন আমাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করবে, আপনি তখন আমার হাত ধরে রাখবেন। আমার এই একটি মাত্র আবেদন আপনার কাছে। ফিলিস্তীন পৌঁছিয়ে দেয়ার কথা আমি আর আপনাকে বলব না। আপনার কর্তব্যের পথে আমি বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। আপনি শুধু আমাকে এতটুকু বলুন যে, আমি তোমার ভালবাসা বরণ করে নিয়েছি। আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিন, এ আবদার আমি আপনার কাছে করব না। কারণ, আমি একটি অপবিত্র মেয়ে। আমার শিক্ষাগুরুরা আমাকে পাথরে পরিণত করে দিয়েছে। আমার মধ্যে যে মানবিক চেতনা বলতে কিছু নেই; তা-ও আমি বুঝি। কিন্তু আল্লাহ আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ পাথর হতে পারে না। যে যেভাবেই গড়ে উঠুক, একদিন না একদিন এ প্রশ্ন করতেই হয় যে, সরল পথ কোনটি?

ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে রাত আর কথা বলে চলেছে দুজন। এক পর্যায়ে আহমদ, কামাল মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, তোমার মত মেয়েদেরকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে তাদের দ্বারা কি কাজ নেয়া হয়।

নানা রকম কাজ। কতিপয়কে মুসলমানের বেশে আমীরদের হেরেমে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারা প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা মোতাবেক আমীর-উজীরদের কাবু করে নেয়। তাদের যারা খৃষ্টানদের মনোপূতঃ লোকদেরকে উঁচু উঁচু পদে আসীন করানো হয়। যেসব কর্মকর্তা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধাচারণ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করানো হয়। মুসলমান মেয়েরা ততটা চতুর নয়। নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে বিভোর থাকে তারা। তারা মুসলিম শাসকদের হেরেমের রাণীর মর্যাদা পায় ঠিক; কিন্তু মুসলিমবেশী একটি খৃষ্টান কিংবা ইহুদী মেয়ে বিচক্ষণতার মাধ্যমে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখে। ফলে ইহুদী-খৃষ্টান মেয়েরাই হয়ে বসে হেরেমের দন্ডমুন্ডের অধিকারীনী।

বর্তমানে ইসলামী সরকারগুলোর আমীর-উজীরদের অন্ততঃ অর্ধেক সিদ্ধান্ত হয় আমার জাতির স্বার্থের অনুকূল।

মেয়েদের আরো একটি দল আছে। তারা ইসলামী নাম ধারণ করে মুসলমানদের স্ত্রী হয়ে যায়। তাদের কাজ হল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর মেয়েদের চিন্তা-চেতনা ধ্বংস করে তাদের বিপথগামী করে তোলা। তারা নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে কু-পথে নামিয়ে দিয়ে তাদের দ্বারা সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অবৈধ প্রেম-প্রণয় সৃষ্টি করিয়ে মুসলিম সমাজকে কলুষিত করে। আমার মত মেয়েরা অতি গোপনে আপনাদের এমন এমন পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে যায়, যারা শেষ পর্যন্ত তাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। আমার মত মেয়েদেরকে তারা এমনভাবে হেফাজত করে রাখে যে, তাদের প্রতি সামান্যতম সন্দেহের অবকাশও থাকে না। তারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে পরস্পর দ্বন্ধ-বিরোধ ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর মাঝে বিরাগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। ঠিক এমনি বরং এর চেয়ে জঘন্য এক কাজের জন্য আরো দুটি মেয়েসহ আমাকে তুলে দেয়া হয়েছিল রজবের হাতে।

রাতভর মেয়েটি খৃষ্টানদের গোপন কার্যক্রম ও মুসলমানদের ঈমান বেচাকেনার বিস্তারিত বিবরণ শোনাতে থাকে, আর আহমদ কামাল তন্ময় হয়ে তা শুনতে থাকেন।

***

পরদিন সূর্যাস্তের আগেই কায়রো পৌঁছে যায় কাফেলা। আহমদ কামাল আলী বিন সুফিয়ানের নিকট যান এবং মেয়েটির ব্যাপারে সম্পূর্ণ রিপোর্ট পেশ করেন। আহমদ কামাল আরো জানান, রজব এখন হাবশীদের কাছে। হাবশীরা যে স্থানে নারী বলি দিয়ে থাকে, রজব সেখানে তার আস্তানা গেড়েছে। আহমদ কামাল আলী বিন সুফিয়ানকে আরো বলেন, যদি আদেশ হয়, তাহলে আমি রজবকে জীবিত কিংবা মৃত ধরে আনতে পারি। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান সে আদেশ তাকে দিলেন না। কারণ, এরূপ অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিচক্ষণ ও সুদক্ষ স্বতন্ত্র বাহিনী-ই তার আছে। রজব পর্যন্ত পৌঁছানোর পন্থাও আহমদ কামাল আলীকে অবহিত করেন। রজবকে ধরে আনার জন্য তিনি আগেই একটি বাহিনী সুদান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে তিনি ছয়জন অতীব বিচক্ষণ সৈন্যকে রজবকে ধরে আনার জন্য আংগুক অভিমুখে রওনা করান। আহমদ কামালকে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দেন। মেয়েটিকে ডেকে আনেন নিজের কাছে।

আলী বিন সুফিয়ান আহমদ কামালকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে মেয়েটির সামনে বসিয়ে দেন। মুচকি একটি হাসি দিয়ে কথা বলতে শুরু করে মেয়েটি। কোন কথা-ই গোপন রাখল না সে। শেষে বলল, আমাকে যদি মৃত্যুদন্ড-ই দিতে হয়, তাহলে আমার একটি অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। আমি আহমদ কামালের হাতে মরতে চাই। মেয়েটি আহমদ কামালের এত অনুরক্ত কেন হল, তার বিবরণও দিল সে।

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটিকে কারাগারে প্রেরণের পরিবর্তে আহমদ কামালের হাতে অর্পণ করে নিজে সুলতান আইউবীর নিকট চলে যান। মেয়েটির সব কথা তিনি আইউবীকে অবহিত করেন। বলেন, আপনার অতিশয় নির্ভরযোগ্য সেনাকর্মকর্তা ফয়জুল ফাতেমী আমাদের দুশমন। তার-ই নিকট আগমনের পরিকল্পনা ছিল মেয়েদের। সুলতান আইউবী প্রথম বললেন, হয়ত বা মেয়েটি মিথ্যে বলছে। তোমাকে সে বিভ্রান্ত করছে। আমার জানামতে ফয়জুল ফাতেমী এমন ধারার লোক নয়।

আমীরে মুহতারাম! আপনি ভুলে গেছেন যে, লোকটি ফাতেমী। বোধ হয় এ কথাটাও আপনার মনে নেই যে, ফাতেমী ও ফেদায়ীদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক। এরা। আপনার অনুগত হতেই পারে না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

গভীর চিন্তায় হারিয়ে যান সুলতান আইউবী। সম্ভবতঃ তিনি ভাবছিলেন, এমন হলে বিশ্বাস করব কাকে? কাজ-ই বা করব কাদের নিয়ে কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, আলী! ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি আমি তোমায় দেব না। তুমি এমন কৌশল অবলম্বন কর, যেন অপরাধ করা অবস্থায় তাকে হাতে-নাতে ধরা যায়। আমি তাকে স্পটে গ্রেফতার করতে চাই। আর সে পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দায়িত্ব তোমার। ফয়জুল ফাতেমী যুদ্ধের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কর্মকর্তা। রাজ্যের সমর বিষয়ক সব তথ্য তার কাছে। লোকটি এত জঘন্য অপরাধের অপরাধী কি-না অতি শীঘ্র আমি তার প্রমাণ চাই।

আলী বিন সুফিয়ান গোপন তথ্য সগ্রহে অভিজ্ঞ। এটি তার সৃষ্টিগত প্রতিভা। তিনি কৌশল খুঁজে বের করলেন এবং সুলতান আইউবীকে বললেন, মেয়েটি যেসব বিপদ অতিক্রম করে এসেছে, তার ভীতি তার মন-মানসিকতাকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে এবং আহমদ কামালের প্রতি সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। কারণ, আহমদ কামাল তাকে বিপদসংকুল পথ থেকে উদ্ধার করেছে এবং তার সঙ্গে এমন পবিত্র আচরণ করেছে যে, তাতে মুগ্ধ হয়ে মেয়েটি এখন তাকে ছাড়া কথা-ই বলছে না। আমার আশা, আমি এই মেয়েটিকে কাজে লাগাতে পারব।

চেষ্টা করে দেখ। কিন্তু মনে রেখ, সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করার অনুমতি আমি তোমাকে কিছুতেই দেব না। ফয়জুল ফাতেমীর মত লোক দুশমনের ক্রীড়নক হয়ে গেছে, একথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বললেন সুলতান আইউবী।

আলী বিন সুফিয়ান চলে যান মেয়েটির কাছে। তাকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানান। জবাবে মেয়েটি বলল, আহমদ কামাল যদি বলেন, তাহলে আগুনে ঝাঁপ দিতেও আমি প্রস্তুত। সামনে উপবিষ্ট আহমদ কামাল বললেন, না, ইনিযেভাবে যা বলেন, তুমি তা-ই কর। পরিকল্পনাটা ভাল করে বুঝে নাও। আবেগমুক্ত হয়ে কাজ কর।

কিন্তু এর পুরস্কার আমি কী পাব? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

তোমাকে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে ফিলিস্তীনের দুর্গ শোবকে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। আর এখানে যে কদিন থাকবে, তোমাকে মর্যাদার সঙ্গে রাখা হবে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

নাহ, এ পুরস্কার যৎসামান্য। আমি যা চাইব, তা-ই আমাকে দিতে হবে। আমি ইসলাম গ্রহণ করব আর আহমদ কামাল আমাকে বিয়ে করে নেবেন। বলল মেয়েটি।

দাবীর দ্বিতীয় অংশটি সরাসরি নাকচ করে দেন আহমাদ কামাল। আলী বিন সুফিয়ান আহমদ কামালকে বাইরে নিয়ে যান। আহমদ কামাল বললেন, মেয়েটি মুসলমান হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও আমি তাকে দুশমন মনে করব। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, দেশ ও জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে এতটুকু তোমাকে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। আহমদ কামাল সম্মতি দেন। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি মেয়েটিকে বললেন, আমি যেহেতু এ যাবত তোমাকে অবিশ্বাস করে আসছি, তাই তোমাকে বিয়ে করতে আমি অস্বীকার করেছি। কিন্তু যদি তুমি প্রমাণ দিতে পার যে, আমাদের ধর্মের জন্য তোমার ত্যাগ স্বীকার করার স্পৃহা আছে, তাহলে আমি আজীবন তোমাকে ভালোবেসে যাব।

আলী বিন সুফিয়ানকে উদ্দেশ করে মেয়েটি বলল, বলুন, আমাকে কী করতে হবে। আমিও দেখে ছাড়ব, মুসলমান প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কতটুকু পরিপক্ক । আমার আরো একটি শর্ত হল, অভিযানে আহমদ কামাল আমার সঙ্গে থাকবেন।

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটির এ শর্তও মেনে নেন এবং আহমদ কামাল ও মেয়েটির বাসস্থানের ব্যবস্থা করার আদেশ দেন। তারপর কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আহমদ কামালের উপস্থিতিতে মেয়েটিকে তার কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করতে শুরু করেন।

***

তিনদিনের মাথায় আলী বিন সুফিয়ানের প্রেরিত ছয়জন সৈনিক গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তিন খৃষ্টান মেয়ে যেখান থেকে পলায়ন করেছিল, রজব যেখানে বন্দী আছে, হাবশীদের সেই দেবমন্দিরে এসে তারা উপনীত হয়। তারা সব কজন-ই উষ্ট্রারোহী। ছদ্মবেশে নয় এসেছে তারা মিসরী ফৌজের পোষাকে। হাতে তাদের বর্শা ও তীর-তলোয়ার। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা সরাসরি হাবশীদের দুর্গে ঢুকে পড়ে। হঠাৎ কোন দিক থেকে যেন একটি বর্শা এসে তাদের সম্মুখে মাটিতে বিদ্ধ হয়। এর অর্থ, থাম, আর এক পা-ও এগুবে না। তোমরা আমাদের দ্বারা অবরুদ্ধ । তারা থেমে যায়। পুরোহিত সামনে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে তার তিনজন হাবশী। হাতে তাদের বর্শা। পুরোহিত সতর্ক করে দিয়ে বলে, তোমরা আমার গুপ্ত তীরন্দাজদের কবলে আছ। বাড়াবাড়ি করলে একজনও জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে না।

তারা অস্ত্র সমর্পণ করে। হাতের বর্শা-তীর-তরবারী হাবশীদের সামনে ফেলে দেয়। উটের পিঠ থেকে নেমে আসে। কমান্ডার হাবশী পুরোহিতের সঙ্গে মোসাফাহা করে বলেন, আমরা আপনার সুহৃদ। বন্ধুত্ব নিয়েই ফিরে যাব। আচ্ছা, মেয়ে তিনজনকে বলি দিয়েছেন আপনি?

কম্পিত কণ্ঠে পুরোহিত জবাব দেন, না, কোন মেয়েরই বলি হয়নি! তা আপনি জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আমরা মিসরী ফৌজের বিদ্রোহী সেনা। আমরা আপনাদের দেবতার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাই। আপনাদের লোকেরা আমাদের বলেছে যে, দেবতার সমীপে নারী বলি না হওয়া-ই নাকি আপনাদের পরাজয়ের কারণ। আমরা রজবের সঙ্গে ছিলাম। আমরা তাকে বলেছিলাম, তিনটি ফিরিঙ্গী মেয়ে অপহরণ করে নিয়ে আসব এবং একটির স্থানে তিনটি মেয়ে বলি দিয়ে দেবতার কুমীরদের খাওয়াব। পরিকল্পনা মোতাবেক বহু দূর থেকে তিনটি মেয়ে অহরণ করে এনে আমরা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। মেয়েদের নিয়ে সে এখানে চলে এসেছিল। বলির কাজ সম্পন্ন হল কি-না আমরা তার খোঁজ নিতে এলাম। বললেন কমাণ্ডার।

ফাঁদে আটকে যান পুরোহিত। বললেন, রজব আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। তিনটি মেয়ে সে নিয়ে এসেছিল ঠিক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কু-মতলব পেয়ে বসে তাকে। বলির জন্য আমার হাতে অর্পণ না করে বেটা ভাগিয়ে দিয়েছে ওদের। ধরা পড়ে গেছে । নিজে। আমরা তাকে পাপের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি। আচ্ছা, তোমরা কি আমাকে দুটি মেয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পার? দেবতাদের অসন্তোষ যে দিন দিন বেড়েই চলেছে।

পারব মানে? অবশ্যই পারব। আপনি অপেক্ষা করুন; দেখবেন, অল্প কদিনের মধ্যেই আমরা মেয়ে নিয়ে হাজির হব। আমাদেরকে রজবের কাছে নিয়ে চলুন। মেয়েগুলো কোথায় আছে তাকে জিজ্ঞেস করি। বললেন কমাণ্ডার।

তাদের সকলকে ভিতরে নিয়ে যান পুরোহিত। এক স্থানে চওড়া ও গোলাকার একটি মাটির পাত্র। সেটি আরেকটি পাত্র দিয়ে ঢাকা। পুরোহিত উপরের পাত্রটি তুলে সরিয়ে রেখে নীচের পাত্রে হাত দেন। আস্তে আস্তে হাত বের করে আনেন। হাতে রজবের মাথা। মুখমন্ডলের আকৃতি সম্পূর্ণ অবিকৃত। চোখ দুটো আধা-খোলা। মুখ বন্ধ। টপটপ করে পানি ঝরছে মাথা থেকে। এগুলো কেমিক্যাল। মাথাটা যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য কেমিক্যাল দিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোহিত বললেন, দেহটি কুমীরদের খেতে দিয়েছি। এর সঙ্গীদেরও আমরা জীবন্ত ঝিলে নিক্ষেপ করেছি। অভুক্ত কুমীরগুলো খেয়ে ফেলেছে ওদের।

মাথাটা আমাদেরকে দিয়ে দিন, সঙ্গীদের নিয়ে দেখাব আর বলব, যে-ই আংগুকের দেবতার অবমাননা করবে, তাকেই এই পরিণতি ভোগ করতে হবে। বললেন কমাণ্ডার।

দিতে পারি। তবে শর্ত হল, সূর্যাস্তের আগে-ই ফিরিয়ে দিতে হবে। আংগুকের দেবতা এর মালিক। ফেরত না দিলে তোমার মাথাটাও কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বললেন পুরোহিত।

***

তিনদিন পর। রজবের কর্তিত মস্তক পড়ে আছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পায়ের কাছে। গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান সুলতান।

সে রাতের-ই ঘটনা। বারান্দায় শুয়ে আছেন আহমদ কামাল ও মেয়েটি। ছদিন ধরে দুজনে তারা থাকছেন একত্রে। মেয়েটির দাবী অনুযায়ী আহমদ কামালকে রাখা হয়েছে তার সাথে এক ঘরে। মেয়েটি বলছে, এক্ষুণি সে মুসলমান হতে প্রস্তুত। আহমদ কামালকে সে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আহমাদ কামাল বলছেন, আগে কর্তব্য পালন কর; তারপর বিয়ে। মেয়েটি আশংকা ব্যক্ত করে যে, কাজ উদ্ধার করে তাকে ধোকা দেয়া হবে। আহমদ কামাল এখনও তাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এতদিনে মেয়েটির মনের সব ভয় দূর হয়ে গেছে। এখন শান্ত মনে ভাবতে পারছে সে।

আহমদ কামাল ও মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে বারান্দায়। বাইরে প্রহরায় নিয়োজিত একজন সিপাহী। মধ্য রাতের খানিক আগে প্রহরী হাঁটতে হাঁটতে সরে যায় অন্যদিকে। এমন সময়ে কে যেন পিছন থেকে ঘাড় চেপে ধরে মেয়েটির। সঙ্গে সঙ্গে কাপড় বেঁধে দেয়া হয় তার মুখে। রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় তার হাত-পা।

তারা চারজন। ঘরের দরজা ছিল বন্ধ। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় একজন। আরেকজন তার কাঁধে পা রেখে দেয়াল টপকে প্রবেশ করে ভিতরে। ভিতর থেকে দরজা খুলে দেয় সে। বাকী তিনজনও ঢুকে পড়ে ভিতরে।

চারজনের মধ্যে অধিক সবল লোকটি মুখে কাপড় বেঁধে দেয় মেয়েটির। জাগতে না জাগতে মেয়েটিকে সে ঝাঁপটে ধরে কাঁধে তুলে নেয়। অপর তিনজন আহমদ কামালের মুখেও কাপড় পেঁচিয়ে, রশি দিয়ে হাত-পা শক্ত করে বেঁধে খাটের উপর-ই ফেলে রাখে। প্রতিরোধ করার সব সুযোগ বন্ধ করে দেয় তার। বাইরে নিয়ে গিয়ে মোটা কম্বল দিয়ে জড়িয়ে নেয়া হয় মেয়েটিকে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, কাঁধের বস্তুটি মানুষ।

শহর থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে ফেরআউনী আমলের জীর্ণ-পরিত্যাক্ত বিশাল এক বাড়ি। বাড়ি তো নয়, যেন এক ভুতের নগরী। ভীতিকর অনেক রূপকথা শোনা যায় বাড়িটির ব্যাপারে। যেমনঃ ভিতরে আছে উঁচু একটি পাথরের টিলা। এই টিলা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য কক্ষ। তার নীচে আছে আরো বেশ কটি কক্ষ। বাড়িটি সম্পর্কে যার সম্যক ধারণা আছে, ভিতরে প্রবেশ করে সে-ই কেবল ফিরে আসতে পারে। অন্যথায় মৃত্যু অবধারিত। পথ-ঘাট কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে গেছে, ঠাহর রাখা দুষ্কর। দীর্ঘদিন ধরে এ বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস করছে না কেউ। বাড়িটি এখন জিন-ভূত, দৈত্য-দানবের আবাস। সাপ-খোপ যে কত কি আছে, তার তো কোন ইয়ত্তা-ই নেই। সাপের ভয়ে বাড়ির পাশ দিয়েও হাঁটে না কেউ। এমনি আরো অনেক ভীতিপ্রদ কল্প-কাহিনী।

তথাপি এই চারজন মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে এই ভুতের বাড়িতে-ই ঢুকে পড়ে এবং বেরও হয় এমনভাবে যেন এখানেই তাদের বাস।

মেয়েটিকে নিয়ে তারা বাড়িটির গুহাসম কক্ষাদি ও আঁকা-বাঁকা ঘোর অন্ধকার অলি-গলি অতিক্রম করে অবাধে-অনায়াসে শাই শাই করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। সামনে কতগুলো প্রদীপ জ্বলছে। তাদের পায়ের আওয়াজে চামচিকাগুলো উড়াউড়ি, ফড়ফড় করতে শুরু করে । টিকটিকি ও সরিসৃপগুলো ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করে পালাতে থাকে। মাকড়সার জাল আর ময়লা-আবর্জনায় ভিতরটা পরিপূর্ণ।

মেয়েটিকে নিয়ে তারা পাথর কেটে নির্মিত একটি কক্ষে প্রবেশ করে। দীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। আলো দিয়ে পথ দেখিয়ে আগে হাঁটতে শুরু করে লোকটি।

সামনে নীচে অবতরণের কয়েকটি সিঁড়ি। তারা সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়ে। একদিকে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ে প্রশস্ত একটি কক্ষে। মেঝেতে বিছানা পাতা। বহুমূল্যের মনোরম একটি শতরঞ্জী শোভা পাচ্ছে তাতে। কক্ষটি বেশ সাজানো-গোছানো পরিপাটি। বিছানায় রেখে মুখের কাপড় সরিয়ে দেয়া হয় মেয়েটির। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মেয়েটি বলে, আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করা হল কেন? আমি মরে যাব, কাউকে আমার কাছে আসতে দেব না।

ওখান থেকে যদি তুলে না আনা হত, তাহলে আগামীকাল-ই তোমাকে জল্লাদের হাতে অর্পণ করা হত। আমার নাম ফয়জুল ফাতেমী। তোমাকে আমার নিকট-ই আসবার কথা ছিল। আর দুজন কোথায়? তুমি একা ধরা পড়লে কিভাবে? রজব কোথায়? বলল এক ব্যক্তি।

নিশ্চিন্ত হল মেয়েটি। বলল, “আমি যীশুর কৃতজ্ঞতা আদায় করছি। বড় বড় ভয়ানক বিপথ থেকে রক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আমায় তিনি গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দিলেন! এই বলে মেয়েটি ফয়জুল ফাতেমীর নিকট রজব, হাবশী গোত্র, মরুঝড়, সঙ্গী দুমেয়ের করুণ। মৃত্যু ও আহমদ কামালের হাতে ধরা পড়া পর্যন্ত সব কাহিনী আনুপুংখ বিবৃত করে। ফয়জুল ফাতেমী তাকে সান্ত্বনা দেন এবং যে চার ব্যক্তি মেয়েটিকে অপহরণ করে এনে দিয়েছে, ছয়টি করে সোনার টুকরা দিয়ে বললেন, তোমরা নিজ নিজ পজিশনে অবস্থান নাও। আমি কিছুক্ষণ পরে চলে যাব। এই মেয়েটি তিন-চারদিন এখানে থাকবে। আমি রাতে রাতে আসব। বাইরের খোঁজাখুঁজি শেষ হয়ে গেলে ওকে এখান থেকে নিয়ে যাব।

অপহরণকারী চার ব্যক্তি চলে যায় এবং ভবনটির চারদিকে এমনভাবে অবস্থান নিয়ে বসে, যেন বাইরের পরিস্থিতির উপর নজর রাখা যায়।

ফয়জুল ফাতেমীর সঙ্গে এক ব্যক্তি থেকে যান । ইনি মিসরী ফৌজের একজন কমান্ডার। ফয়জুল ফাতেমী তার এই সাফল্যে বেশ উৎফুল্ল। পাশাপাশি অপর মেয়ে দুটোর মৃত্যুতে শোকাহতও বটে। রজবের পরিণতির সংবাদ এখনো তার কানে পৌঁছেনি। তিনি বললেন, রজবকে ওখান থেকে বের করে আনা আবশ্যক। সে সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করার একটা আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু তার বিস্তারিত বিবরণ আমি এখনো জানতে পারিনি। সম্ভবতঃ ফেদায়ীদের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে। এ দুটো লোককে হত্যা করা এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন। এখন আমার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে কাল-ই আমি তোমাকে বিষয়টি অবহিত করব। এখন তুমি বিশ্রাম কর, আমি এখন যাই।

আপনার উপর সালাহুদ্দীন আইউবীর আস্থা আছে কেমন? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

এত বেশী যে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও তিনি আমার পরামর্শ নেন। জবাব দেন ফয়জুল ফাতেমী।

আমি জানতে পারলাম যে, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে সালাহুদ্দীন আইউবীর ওফাদার লোকের সংখ্যা-ই অধিক। আর সেনাবাহিনীও তার অনুগত। বলল মেয়েটি।

কথা ঠিক। তাঁর গোয়েন্দা বিভাগ, এত-ই বিচক্ষণ ও সতর্ক যে, কোথাও কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই তার খবর হয়ে যায়। তবে পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে আরো দুজন লোক আছেন, যারা আইউবীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন। মুহতারাম ফয়জুল ফাতেমী আপনাকে তাদের নাম বলতে পারবেন। বলল মিসরী কমান্ডার।

ফয়জুল ফাতেমী দুজনের নাম বললেন এবং মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে উচ্চ পর্যায়েই কাজ করতে হবে। আপাততঃ তোমার দায়িত্ব দুজন কর্মকর্তার মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা আর দুজনকে বিষ খাওয়ানো, তোমার পক্ষে তা একেবারে সহজ। তবে সমস্যা হল, তোমাকে প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে নিতে পারব না। তোমাকে পর্দানশীল মুসলিম নারীর বেশ ধরে কাজ করতে হবে। নতুবা ধরা পড়ে যাবে। এমনও হতে পারে, আমি তোমাকে ফিলিস্তীন ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে তোমার স্থলে অন্য মেয়ে আনিয়ে নেব, যাকে এখানকার কেউ চিনবে না। আমি যে গ্রুপ তৈরি করেছি, তার সদস্যরা অত্যন্ত বিচক্ষণ, অতীব তৎপর। সালারের নীচের কমান্ডার পর্যায়ের লোক তারা। এই চার ব্যক্তি–যারা এত বীরত্বের সাথে তোমাকে তুলে আনল–সে গ্রুপের-ই লোক।

আইউবীর বাহিনীতে আমরা অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেছি। সেনাবাহিনী ও জনগণের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করা জরুরী। বর্তমান অবস্থাটা হল, সিরীয় ও তুর্ক বাহিনী সদাচার, উন্নত চরিত্র এবং যুদ্ধের স্পৃহার কারণে মিসরীদের কাছে বেশ সমাদৃত ও শ্রদ্ধার পাত্র। সুদানীদেরকে পরাজিত করে তারা নগরবাসীদের মনে আরো শক্ত আসন গেড়ে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর এই মর্যাদাকে আমাদের ক্ষুণ্ণ করতে হবে। অপদস্থ করতে হবে সালার ও অপরাপর সামরিক কর্মকর্তাদের। এছাড়া আমরা ক্রুসেডার ও সুদানীদের আর কোন সাহায্য করতে পারি না। সরাসরি আক্রমণ কখনো সফল হবে না।

আইউবীর সেনাবাহিনী তাকে কামিয়াব হতে দিবে না। দেশের জনগণ সঙ্গ দেবে সেনাবাহিনীর। মিসরের একদিক থেকে যদি খৃষ্টানরা আর অপরদিক থেকে সুদানীরা একযোগেও হামলা চালায়, তবু আইউবীকে তারা পরাস্ত করতে পারবে না। তখন দেশের জনগণ আর সেনাবাহিনী মিলে কায়রোকে একটি শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করবে। কায়রোকে জয় করার জন্য আগে আমাদের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জনসাধারণের চিন্তা-চেতনায় অলিক ধ্যান-ধারণা ও সংশয় প্রবণতা এবং যুবকদের চরিত্রে যৌনপূজা ও লাম্পট্য সৃষ্টি করতে হবে।

আমাকে তো অবহিত করা হয়েছিল, এ কাজ দুবছর ধরে চলে আসছে। বলল মেয়েটি।

তা ঠিক। বেশ সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। আগের তুলনায় অপকর্ম বেড়েছে। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী একে তো নতুন ধরনের মাদ্রাসা খুলেছেন, দ্বিতীয়তঃ মসজিদগুলোতে খোতবা থেকে খলীফার নাম তুলে দিয়ে ভিন্ন এক চমক সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া তিনি মেয়েদেরকেও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছেন। বললেন ফয়জুল ফাতেমী।

ফয়জুল ফাতেমী আরো কি যেন বলতে চাইছিলেন। এমন সময়ে একজন প্রহরী হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফয়জুল ফাতেমীকে বলে, এ মুহূর্তে আপনি বেরুবেন না। বাইরে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ফয়জুল ফাতেমী ঘাবড়ে যান। প্রহরীর সঙ্গে কক্ষের বাইরে চলে আসেন। একটি উঁচু জায়গায় চুপিসারে বসে বাইরের দিকে তাকান। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। দিনের আলোর ন্যায় বাইরের সবকি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইতিউতি তাকিয়ে তিনি বললেন, এ যে আইউবীর সৈন্য। ঘোড়ও তো আছে দেখছি! চারদিক ভাল করে দেখে আস, আমি কোন দিক দিয়ে পালাতে পারি।

দেখা আমার হয়ে গেছে। কোন দিকে পালাবার পথ নেই। তারা পুরো প্রাসাদ ঘিরে রেখেছে। আপনি ওখানেই চলে যান। বাতিগুলো নিভিয়ে দিন। ওখান থেকে বের হলে ভুল করবেন। শর্করা ঐ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না। বলল প্রহরী।

ফয়জুল ফাতেমী অদৃশ্য হয়ে যান। প্রহরী উঁচুস্থান থেকে নেমে ভিতরে না গিয়ে দেয়ালের গা ঘেঁষে সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাইরে পঞ্চাশজন পদাতিক সৈনিক। অশ্বারোহী বিশ-পঁচিশজন। তারা গোটা প্রাসাদটিকে অবরোধ করে রেখেছে। লোকটি পা টিপে টিপে চলে যায় তাদের নিকট। এক সৈনিককে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ান কোথায়? ইংগিতে আলীকে দেখিয়ে দেয় সৈনিক। প্রহরী দৌড়ে যায় তার কাছে। আলীর সঙ্গে আহমদ কামাল। প্রহরী বলল, ভিতরে কোন আশংকা নেই। আপনার সঙ্গে আর দুজন লোক হলেই চলবে। আমার সঙ্গে আসুন।

যে চারজন লোক মেয়েটিকে অপহরণ করে এনেছিল, এ প্রহরী তাদেরই একজন।

দুটি মশাল প্রজ্বলিত করান আলী। আহমদ কামাল এবং চার সৈনিককে সঙ্গে নেন। দুজনের হাতে দুটি মশাল ধরিয়ে দেন, তরবারী কোষমুক্ত করেন সকলে। প্রহরীর পিছনে পিছনে ঢুকে পড়েন ভিতরে। ফয়জুল ফাতেমীর প্রহরী এখন আলী বিন সুফিয়ানের রাহ্বার। হঠাৎ কে একজন একদিক থেকে ছুটে এসে শাঁ করে চলে যায় ভিতরে। রাহবর বলল, এই যে গেল, বেটা ওদের লোক। টের পেয়ে ভিতরের লোকদেরকে সতর্ক করতে গেল। আপনারা আরো দ্রুত হাঁটুন। তীব্রবেগে এগিয়ে চললেন তারা। পথ দেখিয়ে নেয়ার কেউ না থাকলে এই আঁকা-বাঁকা পথে ঢুকে তারা দিশে হারিয়ে ফেলত কিংবা ভয়ে পালাতে বাধ্য হত। কিন্তু এখন তারা রাহবরের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দেই অগ্রসর হচ্ছে। অন্য একদিক থেকে দৌড়ে এল আরেকজন। পার্শ্ব দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, আমি ওদিকে যাচ্ছি। আপনারা আরো তাড়াতাড়ি আসুন। এ লোকটি রাহবরের সঙ্গী।

নীচে অবতরণের সিঁড়ির পার্শ্বের কক্ষে পৌঁছে যান আলী। নীচের কক্ষ থেকে কথার শব্দ ভেসে আসে তার কানে, আমরা প্রতারণার শিকার। এরা দুজন ওদের লোক। তারপর তরবারীর সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে কথা বলার আওয়াজ, একেও শেষ করে দাও, যেন কোন সাক্ষ্য দিতে না পারে।

মশালধারীদের পিছনে পিছনে দ্রুতগতিতে নীচে নেমে পড়েন আলী বিন সুফিয়ান ও আহমদ কামাল। রক্তের জোয়ার বইছে কক্ষে। দু হাতে পেট চেপে ধরে বসে আছে মেয়েটি। ফয়জুল ফাতেমীর সঙ্গে যে মিসরী কমান্ডার বসা ছিল, সে এবং আরেক ব্যক্তি লড়ছে ফয়জুল ফাতেমী ও তার এক প্রহরীর সঙ্গে। ফয়জুল ফাতেমীকে অস্ত্রত্যাগ করতে বললেন আলী বিন সুফিয়ান। সে হাতের তরবারী ছুঁড়ে ফেলে। আহমদ কামাল দৌড়ে যান মেয়েটির কাছে। পেট বিদীর্ণ হয়ে গেছে তার। বিছানার চাদরটি টেনে নিয়ে আহমদ কামাল মেয়েটির পেটটা কষে বেঁধে দেন এবং আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, অনুমতি হলে একে আমি বাইরে নিয়ে যাই। আলীর অনুমতি পেয়ে আহমদ কামাল মেয়েটিকে নিজের দু বাহুর উপর তুলে নেন। যন্ত্রণায় ছটফট করছিল মেয়েটি। বড় কষ্ট হচ্ছিল তার। তারপরও মুখে হাসি টেনে বলল, আমার কর্তব্য আমি পালন করেছি; তোমাদের আসামীকে আমি ধরিয়ে দিয়েছি।

ফয়জুল ফাতেমীকে এবং যে চারজন লোক মেয়েটিকে অপহরণ করেছিল, তাদের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকী দুজন আর ফয়জুল ফাতেমীর সঙ্গে থাকা মিসরী কমান্ডার আলী বিন সুফিয়ানের লোক।

এটি ছিল একটি নাটক। ফয়জুল ফাতেমীকে হাতেনাতে গ্রেফতার করার জন্য এ নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। মেয়েটি সহযোগিতা করেছে পুরোপুরি। কিন্তু আহত হয় নিজে।

নাটকটি এভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল যে, মেয়েটির গ্রুপের একজন অপরজনের পরিচয় লাভের জন্য যেসব গোপন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করার কথা, তার থেকে সেই ভাষা জেনে নেয়া হয়। মেয়েটি আরও জানিয়েছে যে, তার আগমন করার কথা ফয়জুল ফাতেমীর নিকট। আলী বিন সুফিয়ান তাঁর তিনজন বিচক্ষণ গোয়েন্দাকে কাজে লাগান। তাদের একজন ছিলেন কমান্ডার পদের লোক। তাদেরকে গোপন ভাষা শিখিয়ে দিয়ে বলা হয়, ফয়জুল ফাতেমীর নিকট গিয়ে তাকে বলবে, তিন মেয়ের একজন এখানে এসে গেছে। কিন্তু সে অমুকের হাতে অমুক ঘরে বন্দী। সেখান থেকে তাকে সহজে বের করে আনা যায়। তাদেরকে একথাও বলা হয় যে, ফয়জুল ফাতেমীকে একটি ভূয়া পয়গাম শোনাবে যে, রজব যে করে হোক, মেয়েটিকে রক্ষা করতে এবং তৎপরতা জোরদার করতে বলেছেন।

আলী বিন সুফিয়ানের নিয়োজিত গুপ্তচররা তিনদিনের মধ্যে ফয়জুল ফাতেমীর নাগাল পেতে সক্ষম হয় এবং তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তারা তার গুপ্ত বাহিনীর সদস্য। ফয়জুল ফাতেমী এ আশংকাও বোধ করেন যে, বন্দী মেয়েটি নির্যাতনের মুখে তার সংশ্লিষ্টতার কথা ফাঁস করে দিতে পারে। তাই বিলম্ব না করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনার পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। আলী বিন সুফিয়ানের প্রেরিত কমান্ডারকে তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। অবশিষ্ট তিনজনের দুজন আর নিজের দু ব্যক্তিকে নিয়ে চারজনের হাতে মেয়েটিকে তুলে আনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। মেয়েটিকে অপহরণ করে ফেরআউনী আমলের যে জীর্ণ ভবনটিতে পৌঁছিয়ে দেয়ার কথা, সে ভবনটিকে ফয়জুল ফাতেমী বেশ কিছুদিন ধরে তাদের গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

ফয়জুল ফাতেমীর এ পরিকল্পনার বিস্তারিত রিপোর্ট আলী বিন সুফিয়ানের কানে চলে আসে। কোন্ দিন কখন এই অভিযান পরিচালিত হবে, আলী বিন সুফিয়ান তা-ও অবগত হন। আহমদ কামাল ও মেয়েটিকে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়। বলা হয়, এ রাতে মেয়েটিকে অপহরণ করা হবে। তোমরা বারান্দায় ঘুমাবে। আক্রমণ হলে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে না।

মেয়ে ও আহমদ কামালের বাসস্থানের বাইরে প্রহরায় নিয়োজিত লোকটি গোয়েন্দা বিভাগের একজন সদস্য। কোন রাতে কিভাবে আক্রমণ হবে, তার কী করণীয়, সব তার জানা ছিল। আক্রমণকারীরা ছিল আলী বিন সুফিয়ানের লোক। ফয়জুল ফাতেমীর লোক ইলে খঞ্জরের আঘাতে তাকে খুন করত আগে।

এ রাতে ফয়জুল ফাতেমী ও কমান্ডার জীর্ণ ভবনে চলে যান। নির্দিষ্ট সময়ে অপহরণ অভিযান শুরু হয়। পাহারাদার আগেই এক দিকে কেটে পড়ে। অপহরণকারী দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করে। আহমদ কামাল জাগ্রত । কিন্তু ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। মেয়েটিকে তুলে নিয়ে অপহরণকারীরা যখন তার হাত-পা বাঁধতে শুরু করে, তখন তিনি ছটফট করতে শুরু করেন। অপহরণকারীরা মেয়েটিকে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়।

অপহরণের পর আলী বিন সুফিয়ান এসে আহমদ কামালের হাত-পায়ের বন্ধন খুলে। দেন। পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। অল্পক্ষণ পর তারা ফয়জুল ফাতেমীর আস্তানা অভিমুখে রওনা হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা ভবনটিকে ঘিরে ফেলেন।

ভিতর থেকে আলী বিন সুফিয়ানেরই এক ব্যক্তি তাদের দেখে কক্ষে গিয়ে ফয়জুল ফাতেমীকে সংবাদ দেয়। ফয়জুল ফাতেমীকে কক্ষের বাইরে নিয়ে এসে অবরোধ দেখিয়ে তাকে কক্ষে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। তার-ই পরামর্শে ফয়জুল ফাতেমী বের হওয়ার চেষ্টা না করে তার গোপন কক্ষে চলে যায়।

লোকটি আলী বিন সুফিয়ান ও আহমদ কামালকে ভিতরে নিয়ে যায়। পথ দেখিয়ে পৌঁছিয়ে দেয় ফয়জুল ফাতেমীর কক্ষে। ঠিক শেষ মুহূর্তে ফয়জুল ফাতেমী বুঝতে পারে যে, মিসরী কমান্ডার এবং মেয়েটির সংবাদ নিয়ে আসা দুই ব্যক্তি আসলে তার দলের লোক নয়। তিনি প্রতারণার শিকার। মেয়েটি একটি ভুল করেছে, তার মুখ থেকে এমন কিছু কথা বেরিয়ে গেছে, যাতে ফয়জুল ফাতেমী বুঝে ফেলেছেন, সে-ও এ প্রতারণায় জড়িত।

বিপদ দেখে ফয়জুল ফাতেমীর দু প্রহরী চলে যায় তার কাছে। কক্ষের ভিতরে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ফয়জুল ফাতেমী তরবারীর পিঠ দিয়ে আঘাত করে মেয়েটিকে আহত করে। পেট কেটে যায় তার।

ফয়জুল ফাতেমী ও তার দুই সঙ্গীকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন আলী। তিনজনকে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখেন। তাদেরকে রজবের কর্তিত মাথা দেখিয়ে বলেন, বন্ধুর পরিণতি দেখে নাও। তবে সরাসরি হত্যা করে আমি তোমাদের সাজা শেষ করে দেব না। দেশদ্রোহী ঈমান-বিক্রেতাদের দলে আর কে কে আছে, তোমাদের মুখ থেকে তা বের করে ছাড়ব। গাদ্দারীর পরিণতি যে কত ভয়াবহ, হাড়ে হাড়ে টের পাবে তোমরা। তোমাদেরকে আমি মরতেও দেব না, বাঁচতেও দেব না।

আহত মেয়েটির অবস্থা ভাল নয়। সর্বশক্তি ব্যয় করে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে ডাক্তারগণ। কিন্তু তার কাটা নাড়ি-ভুড়ি জোড়া দেয়া গেল না। কিন্তু তারপরও মেয়েটি নিশ্চিন্ত-উফুল্ল, যেন তার কিছুই হয়নি। দাবি তার একটি-ই, বিদায় বেলা আহমদ কামালকে আমার শিয়রে বসিয়ে রাখুন। পলকের জন্য আহমদ কামালকে চোখের আড়ালে যেতে দিচ্ছে না সে।

সুলতান আইউবী মেয়েটিকে দেখতে আসেন। আহমদ কামাল তার মাথার কাছে বসা। সুলতান কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র তার সম্মানার্থে উঠে দাঁড়াতে উদ্ধত হন তিনি। কিন্তু মেয়েটি খ করে তার হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে ফেলে তাকে। সমস্যায় পড়ে যান। আহমদ কামাল। সুলতানের উপস্থিতিতে তিনি বসতে পারেন না। সংকোচে মাথা নুয়ে আসে তার। সুলতান তাকে মেয়েটির কাছে বসার অনুমতি দেন। সুলতান সস্নেহে মেয়েটির মাথায় হাত বুলান, সুস্থতার জন্য দোয়া করেন।

তৃতীয় রাত্র। আহমদ কামাল বসে আসেন মেয়েটির শিয়রে। হঠাৎ মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় আহমদ কামালের প্রতি। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “আহমদ! তুমি আমায় বিয়ে করে নিয়েছ, না? আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। তুমিও তোমার ওয়াদা পূরণ করেছ! আল্লাহ আমার সব পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন, ….।

কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠে মেয়েটির। আহমদ কামালের ডান হাতটি নিজের দুহাতে চেপে ধরা ছিল তার। ধীরে ধীরে শ্লথ হয়ে আসে হাতের বন্ধন। টের পান আহমদ কামাল। কালেমা তাইয়্যেবা পড়তে পড়তে আহমদ কামাল মেয়েটিকে তুলে দেন আল্লাহর হাতে। পর দিন সুলতান আইউবীর নির্দেশে মেয়েটিকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

দু দিনের নির্যাতনেই ফয়জুল ফাতেমী ও তার সঙ্গীদ্বয় দলের সকলের নাম বলে দেয়। গ্রেফতার করা হয় তাদেরও। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আসাদুল আসাদী লিখেছেন, ফয়জুল ফাতেমীর মৃত্যুদণ্ডাদেশে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলেন সুলতান আইউবী।

প্রথম খণ্ড সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *