১.২ সপ্তম মেয়ে

সপ্তম মেয়ে

ক্রুসেডারদের নৌ-বহর ও সেনাবাহিনীকে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে মেরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এখনো মিসরের উপকূলীয় অঞ্চলেই অবস্থান করছেন। সাতদিন কেটে গেছে। সুলতান আইউবী খৃষ্টানদের থেকে জরিমানাও আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু রোম উপসাগর এখনো একের পর এক নৌ-জাহাজ গলাধঃকরণ করে চলছে আর উদগীরণ করছে মানুষের লাশ। মাঝি-মাল্লা ও সৈন্যরা আগুন ধরে যাওয়া জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। এখন এক এক করে ভেসে উঠছে তাদের-ই মৃতদেহ।

দূরে মাঝ দরিয়ায় সাতদিন পরও আজ কয়েকটি জাহাজের পাল বাতাসে ফড় ফড় করছে। কোন মানুষ নেই তাতে। ছেঁড়া পাল জাহাজগুলোকে সমুদ্রের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সেগুলোর তল্লাশী নেয়ার জন্য কয়েকটি নৌকা প্রেরণ করেন। বলে দেন, যদি কোন জাহাজ বা কিশতী অক্ষত থাকে, কাজে আসার মতো হয়, তাহলে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে আসবে। আর যেগুলো অকেজো, সেগুলোর মাল-পত্র বের করে আনবে।

খৃষ্টানদের ভাসমান জাহাজগুলোর তল্লাশী নেয়া হলো। যা পাওয়া গেলো, তন্মধ্যে বেশীর ভাগ অস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য আর মানুষের লাশ।

ভাসমান লাশগুলোকে সমুদ্রের ঊর্মিমালা তুলে তুলে তীরে ছুঁড়ে মারছে। লাশগুলোর কতিপয় আগুনেপোড়া। কিছু মাছেখাওয়া। অসংখ্য লাশ এমন যে, সেগুলোর গায়ে একটি বা একেরও অধিক তীর গাঁথা।

কাঠ-তক্তা ও ভাঙ্গা কিশতী অবলম্বন করে সাঁতার কেটে কেটে এখনো কিছু লোক কূলে এসে উঠছে। ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ক্লান্ত-অবসন্ন সেই ভাগ্যাহত লোকগুলোকে ঢেউ যাকে যেখানে ছুঁড়ে মারছে, লাশের মত সেখানেই পড়ে থাকছে আর মুসলমানরা তাদের তুলে আনছে। সমুদ্রতীরে মাইলের পর মাইল এই একই দৃশ্য বিরাজ করছে।

সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে মিসরের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যেখানে-ই কোন শত্রুসেনা সমুদ্র থেকে তীরে উঠে আসবে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে শুকনো পোশাক আর পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করার এবং আহত হলে ব্যাণ্ডেজ-চিকিৎসারও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তারপর একস্থানে জড়ো করছেন বন্দীদের।

ঘোড়ায় চড়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুলতান আইউবী। তার ছেড়ে কয়েক মাইল দূরে চলে গেছেন তিনি। সম্মুখে ছোট-বড় অনেকগুলো টিলা। টিলার একদিকে সমুদ্র আর পিছনে ধু ধু মরু-প্রান্তর। এই সবুজ-শ্যামল মরুদ্যানে সারি সারি খেজুর বৃক্ষ ছাড়াও আছে নানা প্রকার মরুজাত গাছ-গাছালী, ঝোঁপ-ঝাড়, বৃক্ষ-লতা।

সুলতান আইউবী ঘোড়া থেকে নামলেন এবং পায়ে হেঁটে টিলার পাদদেশ বেয়ে এগিয়ে চললেন। সঙ্গে তাঁর রক্ষী বাহিনীর চার অশ্বারোহী। সুলতান নিজের ঘোড়াটা রক্ষীদের হাতে দিয়ে তাদের সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। তিন সালারও আছে তাঁর সঙ্গে। তার মধ্যে একজন হলেন সুলতান আইউবীর অন্তরঙ্গ বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। এই যুদ্ধের মাত্র একদিন আগে তিনি আরব থেকে এসেছেন। ঘোড়াটা রক্ষীদের হাতে দিয়ে সুলতানের সঙ্গে হাঁটা দেন তিনিও।

এখন শীতের মওসুম। শান্ত সমুদ্র। সুলতান আইউবী হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেন অনেক দূর। দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলেন রক্ষীদের। এখন তার সামনে-পিছনে-বাঁয়ে উঁচু-নীচু টিলা। ডানে বালুকাময় সমুদ্রতীর। দু আড়াই গজ উঁচু এক খণ্ড পাথরের উপর উঠে দাঁড়ান সুলতান। দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন রোম উপসাগরের প্রতি। তাঁর ঈমান-আলোকিত অবয়বে বিজয়ের আনন্দ-দীপ্তি। এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছেন শান্ত-সমাহিত নীলাভ সমুদ্রপাণে। হঠাৎ নাকে হাত রেখে তিনি বলে উঠলেন–কেমন উকট একটা দুর্গন্ধ আসছে, না?

সমুদ্রোপকূলে এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করে সুলতান আইউবী ও তার সালারদের দৃষ্টি। কিসের যেন ফড় ফড় শব্দ কানে ভেসে আসে তাদের। তারপর হালকা চেঁচামেচি ও কনক শব্দ। উপর থেকে তিন-চারটি শকুন ডানা মেলে নীচে নামতে দেখা গেলো। টিলার আড়ালে সমুদ্রের তীরের দিকে অবতরণ করলো শকুনগুলো। সুলতান আইউবী বললেন–লাশ আছে।

ওদিকে হেঁটে গেলেন তারা। পনের-বিশ গজের বেশি যেতে হলো না। তিনটি লাশ। শকুনগুলো ভাগাভাগি করে খাচ্ছে লাশগুলো। পাঞ্জা করে একটি মানবমুণ্ড নিয়ে উড়ে গেলো এক শকুন। উঠে-ই চক্কর কাটে আকাশে। হঠাৎ পা থেকে ছুটে নীচে পড়ে যায় মুখটি। পতিত হয় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঠিক সামনে।

মুণ্ডটির চোখ দুটো খোলা। যেন চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। মুখমণ্ডলের আকৃতি ও মাথার চুল বলছে, এটি কোন খৃষ্টানের মাথা। সুলতান আইউবী অনিমেষ নয়নে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মুগুটির প্রতি। তারপর সালারদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন–এদের মুণ্ড সেইসব বিশ্বাসঘাতক ঈমান-বিক্রয়কারী মুসলমানদের মুণ্ড অপেক্ষা অনেক ভালো, যাদের ষড়যন্ত্রে আমাদের খেলাফত আজ নারী ও মদের চিতায় বলি হতে চলেছে।

খৃষ্টানরা ইঁদুরের ন্যায় আমাদের সালতানাতে ইসলামিয়াকে কুরে কুরে খেয়ে চলেছে। বললেন এক সালার।

আর আমাদের বাদশাহ তাদেরকে কর দিচ্ছেন। ফিলিস্তীন আজ ইহুদীদের কজায়। মহামান্য সুলতান! আমরা কি আশা রাখতে পারি যে, ফিলিস্তীন থেকে আমরা ওদেরকে বিতাড়ন করতে পারবো? বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না শাদ্দাদ! জবাব দেন সুলতান আইউবী।

আল্লাহর রহমত থেকে নয়–আমরা আমাদের ভাইদের থেকে নিরাশ হয়েছি। বললেন অপর এক সালার।

তুমি ঠিকই বলেছো। যে আক্রমণ বাইরে থেকে আসে, তা আমরা প্রতিহত করতে পারি। তোমরা কেউ কি ভেবেছিলে, কাফিরদের এতো বিশাল নৌ-সেনাবহরকে এতো সামান্য শক্তি দিয়ে এতো সাফল্যের সাথে আমরা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে পারবোর তোমরা হয়ত অনুমান করতে পারোনি, এই বহরে যে পরিমাণ সৈন্য আসছিলো, তারা সমগ্র মিসরে মাছির মতো ছেয়ে যেতো! মহান আল্লাহ আমাদেরকে সাহস দিয়েছেন। আর আমরা একটু কৌশল করে তাদের গোটা বহরকে সমুদ্রতলে ডুবিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার বন্ধুগণ! যে আক্রমণ ভিতর থেকে আসছে, অত সহজে তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না। তোমার ভাই যখন তোমার উপর আঘাত হানবে, তখন তুমি আগে ভাববে, সত্যিই কি এ-কাজ আমার ভাই করেছে, নাকি অন্য কেউ। তোমার মনে সংশয় জাগ্রত হবে, আমি ভুল বুঝছি না তো! বাহুতে তুমি তার উপর তরবারীর আঘাত হানার শক্তি পাবে না। আর যদি সাহস করে তরবারী উত্তোলন করেও ফেলো, তখন সুযোগ বুঝে দুশমন তোমাকে ও তাকে দুজনকে-ই খতম করে দেবে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান আইউবী।

সঙ্গীদের নিয়ে টিলার গা ঘেঁষে ঘেঁষে সুলতান আইউবী সমুদ্রতীরের দিকে এগিয়ে চললেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলেন। মাথা নুইয়ে বালি থেকে একটা কি যেন তুললেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বস্তুটি হাতের লুলুতে নিয়ে সকলকে দেখালেন।

কাঠের তৈরি একটি ক্রুশ। শক্ত একখণ্ড সুতায় বাঁধা। শকুনরা যে লাশগুলো খাচ্ছিলো, সুলতান আইউবী সেগুলোর বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলো দেখলেন। তারপর চোখ ফেললেন মুশুটির প্রতি, যা শকুনের পাঞ্জা থেকে ছুটে তাঁর সামনে এসে পড়েছিলো। দ্রুত হেঁটে আবার মুণ্ডটির কাছে গেলেন। মুণ্ডটির মালিকানা নিয়ে লড়াই করছে তিনটি শকুন। সুলতান আইউবীকে দেখে আড়ালে চলে যায় শকুনগুলো। সুলতান মুণ্ডের উপর কুশটি রাখলেন এবং দৌড়ে সালারদের নিকট চলে গেলেন। বলতে শুরু করলেন। আমি একবার খৃষ্টানদের এক কয়েদী অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার গলায়ও ক্রুশ ছিলো। সে আমাকে বলেছিলো, যেসব খৃষ্টান সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়, ক্রুশে হাত রেখে তাদের থেকে শপথ নেয়া হয় যে, ক্রুশের নামে তারা জীবনবাজি রেখে লড়াই করবে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে সর্বশেষ মুসলমানটি খতম না করে ক্ষান্ত হবে না। এই হলফের পর প্রত্যেক সৈন্যের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এখানে বালির মধ্যে আমি একটি ক্রুশ কুড়িয়ে পেয়েছি। কার ছিলো জানি না। রেখে দিয়েছি ঐ খুলিটির উপর, যাতে, তার আত্মা, ক্রুশবিহীন না থাকে। লোকটা ক্রুশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। একজন সৈনিককে তার শপথের মর্যাদা দেয়া উচিত।

মাননীয় সুলতান! আপনার অবশ্যই জানা আছে, খৃষ্টানরা জেরুজালেমের মুসলিম নাগরিকদেরকে কী পরিমাণ কষ্ট দিচ্ছে। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ওখানকার মুসলমানরা। লুণ্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত-সম্ভ্রম। আমাদের বন্দীদেরকে ওরা এখনো মুক্তি দেয়নি। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। খৃষ্টানদের থেকে কি আমরা এর প্রতিশোধ নেবো না? বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

প্রতিশোধ নয়–নেবো ফিলিস্তীন। কিন্তু ফিলিস্তীনের পথ যে আগলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শাসকগোষ্ঠী! বললেন সুলতান আইউবী।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে সুলতান আইউবী আরো বললেন, কুশে হাত রেখে সালতানাতে ইসলামিয়াকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে খৃষ্টানরা। আমি আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে শপথ নিয়েছি, ফিলিস্তীন উদ্ধার আমি করবো-ই। আমি সালতানাতে ইসলামিয়ার সীমানা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার বন্ধুগণ! আমার কাছে আমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। এক সময় এমন ছিলো যে, খৃষ্টানরা ছিলো রাজা, আমরা ছিলাম যোদ্ধা। আর এখন আমাদের বুজুর্গরা পরিণত হচ্ছেন রাজায় আর খৃষ্টানরা হচ্ছে যোদ্ধা। উভয় জাতির গতি-প্রকৃতি দেখে আমার মনে হচ্ছে, একটি সময় এমন, আসবে, যখন মুসলমানরা রাজায় পরিণত হয়ে যাবে ঠিক; কিন্তু তাদের উপর শাসন চালাবে খৃষ্টানরা। মুসলমানরা রাজা হওয়ার আনন্দে-ই বিভোর হয়ে থাকবে। তারা বলবে, আমরা স্বাধীন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাদের স্বাধীন সত্ত্বা বলতে কিছুই থাকবে না। তারা কাফিরদের দাসত্ব ছাড়া এক পা-ও চলতে পারবে না। আমি ফিলিস্তীন উদ্ধার করার সংকল্প গ্রহণ করেছি বটে, কিন্তু মুসলমানদের গাদ্দারী ঠেকাবে কে? খৃষ্টানদের মস্তিষ্ক বড় উর্বর। পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্যকে পুষছিলো কারা? আমাদের খেলাফত নিজের আঁচলে পুষেছিলো নাজি নামক একটি বিষধর সপকে। আমিই বোধ হয় মিসরের প্রথম গভর্নর, যে দেখতে পেয়েছে, এই বাহিনী দেশের জন্য অনর্থক-ই নয়–ভয়ঙ্করও বটে। নাজির চক্রান্ত যদি ফাঁস না হতো, তাহলে আমরা এই বাহিনীটির হাতে নিঃশেষ-ই হয়ে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ হাল্কা একটা শো শব্দ ভেসে আসে সকলের কানে। একটি তীর এসে গেঁথে যায় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দু পায়ের মাঝে বালিতে। সুলতান আইউবীর পিঠের দিক থেকে ছুটে আসে তীরটি। সেদিকে দৃষ্টি ছিলো না কারুর।

তীরটি যেদিক থেকে ছুটে আসে, হঠাৎ চমকে উঠে সেদিকে চোখ তুলে তাকায় সকলে। উঁচু-নীচু কয়েকটি টিলা ছাড়া দেখা গেলো না কিছু-ই। সবাই উঠে দাঁড়ান। দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের মত উঁচু একটি টিলার আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নেন। আরো তীর আসার আশঙ্কা আছে। খোলা ময়দানে তীরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহাদুরী নয়। মুখে আঙ্গুল রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সজোরে শিস দেন শাদ্দাদ। রেকাবে পা রেখে প্রস্তুত হয়ে-ই ছিলো রক্ষী বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে তাদের ঘোড়াগুলো। তার সঙ্গে তিনজন সালার ছুটে যান সেদিকে, যেদিক থেকে তীরটি এসেছিলো। তিনজন তিন পথে উঠে যায় টিলায়। সালাহুদ্দীন আইউবীও ছুটে যান তাদের পিছনে। দেখে এক সালার বললো, সুলতান! আপনি আসবেন না। কিন্তু তার বাধা মানলেন না সুলতান আইউবী।

ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে রক্ষী বাহিনী। সুলতান আইউবী তাদের বললেন, ঘোড়াগুলো এখানে রেখে টিলার পিছনে যাও। ওদিক থেকে একটি তীর এসেছে। যাকে-ই পাবে, ধরে নিয়ে আসবে।

একটি টিলার উপরে উঠে যান সুলতান। চারদিক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছোট-বড়, উঁচু-নীচু অসংখ্য টিলা চোখে পড়ে তার। সালারদের নিয়ে পিছন দিকে নেমে পড়েন তিনি। চারদিক ঘুরে-ফিরে দেখে আবার উঠে আসেন। টিলায় চোখ বুলিয়ে চতুর্দিক তাকালেন। কিন্তু নাম-গন্ধও নেই কোন মানুষের।  পাথুরে এলাকার ভিতরে, উপরে-নীচে, ডানে-বাঁয়ে সর্বত্র পাতিপাতি করে খুঁজে বেড়ায় রক্ষীরা। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না তারা।

নীচে নেমে সুলতান আইউবী সে স্থানে চলে আসলেন, যেখানে বালিতে তীরটি বিদ্ধ হয়েছিলো। সহকর্মীদের ডাকলেন এবং তীরটির গায়ে হাত রাখলেন। পড়ে গেলো তীরটি। সুলতান বললেন–দূর থেকে এসেছে, তাই পায়ের পাশে পড়েছে। অন্যথায় ঘাড়ে কিংবা পিঠে এসে বিদ্ধ হতো। আর বালিতেও বেশী গাঁথেনি। তীরটি হাতে তুলে নিয়ে সুলতান আইউবী দেখলেন এবং বললেন, হাশীশীদের নয়–খৃষ্টানদের তীর।

সুলতানের জীবন হুমকীর সম্মুখীন। বললেন এক সালার।

আর আজীবন হুমকীর মধ্যেই থাকবে–মুখে হাসি টেনে সুলতান বললেন–আমি রোম উপসাগরে কাফিরদের সেসব জাহাজ-কিশতী দেখার জন্য বের হয়েছিলাম, যেগুলো মাঝি-মাল্লাবিহীন ভাসছিলো। কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধুগণ! খৃষ্টানদের কিশতী সমুদ্রে ভাসছে ভাববেন না। তারা আবার আসবে। আসবে বজের মতো গর্জন করতে করতে। বর্ষিবেও। তারা আঘাত হানবে মাটির নীচ আর পিঠের পিছন থেকে। এখন থেকে খৃষ্টানদের সঙ্গে আমাদের এমন লড়াই লড়তে হবে, যা শুধু সৈন্যরা-ই লড়বে না। সামরিক প্রশিক্ষণে আমি নতুন এক মাত্রা যোগ করছি। তা হলো গোয়েন্দা লড়াই।

তীরটি হাতে নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন সুলতান আইউবী। রওনা দিলেন ক্যাম্পের দিকে। তাঁর সালারগণও ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। একজন নিজের ঘোড়া নিয়ে এলেন সুলতানের ডান দিকে। একজন আসলেন বাঁ দিকে। একজন অবস্থান নিলেন সুলতানের পিছনে, ঠিক তার সন্নিকটে, যাতে কোন দিক থেকে তীর আসলে তা সুলতানের গায়ে আঘাত হানতে না পারে।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তীর ছোঁড়া হলো। কিন্তু সে জন্য বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা নেই তার। খৃষ্টান গুপ্তচর ও কমাণ্ডোরা কিরূপ ক্ষতিসাধন করছে, নিজের তাঁবুতে বসে সালারদের কাছে তারই বিবরণ দিচ্ছেন তিনি। সুলতান আইউবী বললেন–আলী বিন সুফিয়ানকে আমি একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিলম্ব না করে তোমরা নিজ নিজ সিপাহী ও কমাণ্ডারদের মধ্য থেকে এমন কিছু লোক বেছে নাও, যারা হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বুদ্ধিমান, সূক্ষ্মদর্শী, দূরদর্শী ও উপস্থিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। তাদের মধ্যে থাকবে উটের ন্যায় দিনের পর দিন কুৎপিপাসা সহ্য করার শক্তি, সিংহের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ার দক্ষতা। যাদের দৃষ্টি হবে ব্যাঘ্রের ন্যায় সূক্ষ্ম, যারা দৌড়াতে পারে খরগোশ ও হরিণের মতো। যার বিনা অস্ত্রে লড়াই করতে পারে সশস্ত্র দুশমনের সঙ্গে। সর্বোপরি তাদের মধ্যে থাকবে না কোন প্রকার মদ-মাদকতার অভ্যাস। তারা লোভে পড়ে নীতি-নৈতিকতা ত্যাগ করবে না। যতো রূপসী নারী-ই তাদের হাতে আসুক, যত সোনা-দানা, অর্থ-বৈভব তাদের পায়ে নিক্ষিপ্ত হোক, সবকিছু উপেক্ষিত হয়ে দৃষ্টি থাকবে তাদের কর্তব্যের প্রতি।

তোমরা তোমাদের অধীন সকলকে বলে দাও, বুঝিয়ে দাও যে, গুপ্তচরবৃত্তি, সেনাদের মধ্যে অশান্তি-অস্থিরতা বিস্তার এবং চেতনার দিক থেকে সৈন্যদের অখর্ব করে ভোলার জন্য খৃষ্টানরা সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে। আমি .মুসলমানদের মধ্যে একটি দুর্বলতা লক্ষ্য করছি, তারা নারীর প্রলোভনে অল্প সময়ে অস্ত্র ত্যাগ করে। এমন কাজে আমি মুসলিম নারীদের কখনো দুশমনের এলাকায় প্রেরণ করবো না। আমরা নারীর ইজ্জতের মোহাফেজ। সেই ইজ্জতকে আমরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। আলী বিন সুফিয়ানের হাতে কয়েকটি মেয়ে আছে। কিন্তু ওরা মুসলমান নয়, খৃষ্টানও নয়। তারপরও আমি এর পক্ষপাতি নই।

তাঁবুতে প্রবেশ করে রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার। বলে, আমার বাহিনীর লোকেরা কয়েকজন পুরুষ ও কয়েকটি মেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। সুলতান। আইউবী বাইরে বেরিয়ে আসেন। তিন সালারও বেরিয়ে আসেন তাঁর সঙ্গে। বাইরে পাঁচজন লোক দণ্ডায়মান। লম্বা চোগা, পাগড়ী আর ধরণ-প্রকৃতি বলছে, লোকগুলো বণিক। সঙ্গে তাদের সাতটি মেয়ে। সব কটিই যুবতী এবং একজন অপেক্ষা অপরজন অধিক রূপসী।

রক্ষীদের একজন–যে সুলতান আইউবীর উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা তীরের উৎসের সন্ধানের গিয়েছিলো–বললো, আমরা সমগ্র এলাকা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করলাম; কিন্তু কোন মানুষের সন্ধান পেলাম না। পিছনে আরো দূরে চলে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম, এরা তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করছে। সঙ্গে তিনটি উট।

এদের তল্লাশী নেয়া হয়েছে কি? এক সালার জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, হয়েছে। বলছে, এরা ব্যবসায়ী। আমরা এদের জিনিসপত্র সব খুলে দেখেছি। দেহ-তল্লাশীও নিয়েছি। কিন্তু এই খঞ্জরগুলো ছাড়া আর কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। বলেই পাঁচটি খঞ্জর সুলতান আইউবীর পায়ের কাছে রেখে দেয় এক রক্ষী।

আমরা মারাকেশের ব্যবসায়ী। যাবো ইস্কান্দারিয়া। দুদিন আগে আমাদের অবস্থান ছিলো এখান থেকে দশ ক্রোশ পিছনে। পরশু সন্ধ্যায় এই মেয়েগুলো আমাদের হাতে আসে। তখন তাদের পরিধানের পোশাক ছিলো ভেজা। তারা আমাদের জানালো, তারা সিসিলির বাসিন্দা। খৃষ্টান সৈন্যরা এদের ঘর থেকে। উঠিয়ে এনে একটি জাহাজে তুলে নেয়। এরা গরীব পিতা-মাতার সন্তান। এরা বলছে, বিপুলসংখ্যক জাহাজ ও নৌকা রওনা হয়েছিলো। এদেরকে যে জাহাজে তোলা হয়েছিলো, তাতে কমাণ্ডার গোছের কয়েকজন লোক এবং বেশ কজন। সৈন্যও ছিলো। তারা নিজেরা মদ খেয়ে, এদেরও মদ খাইয়ে আমোদ করতে থাকে। সমুদ্রের এ-পারের নিকটবর্তী হলে জাহাজগুলোতে আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষগুলো জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। এদেরকে তারা একটি নৌকায় বসিয়ে জাহাজ থেকে সমুদ্রে নামিয়ে ভাসিয়ে দেয়। এরা বলছে, এদের কেউ নৌকা বাইতে জানে না। তাই মাঝি-মাল্লাবিহীন নৌকাটি সমুদ্রে হেলে-দুলে ভাসতে থাকে। পরে একদিন আপনা-আপনি-ইনৌকাটি কূলে এসে ভিড়ে। আমরা কূলের কাছাকাছি-ই অবস্থান করছিলাম। এরা আমাদের কাছে চলে আসে। বড় বিপন্ন অবস্থায় ছিলো মেয়েগুলো। আমরা এদের আশ্রয় প্রদান করি। এই অসহায় নারীদেরকে তাড়িয়েও দিতে পারছিলাম না; আবার বুঝেও আসছিলো না যে, এদেরকে আমরা কী করি। অগত্যা এদেরকে নিয়ে আমরা সম্মুখে রওনা হই এবং একস্থানে এসে ছাউনি ফেলি। হঠাৎ এই আরোহীগণ এসে পড়েন এবং আমাদের তল্লাশী নিতে শুরু করেন। আমরা তাদের নিকট এই তল্লাশীর কারণ জানতে : চাই। তারা বললেন, এটা মিসরের গভর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর–নির্দেশ। আমরা অনুনয়-বিনয় করে বলি, আমাদেরকে তোমরা সুলতানের কাছে নিয়ে চলো; তাঁকে-ই আমরা নিবেদন করবো, যেন এই অসহায় মেয়েগুলোকে তিনি তাঁর আশ্রয়ে নিয়ে নেন। চলার পথে আমরা এদেরকে কোথায় নিয়ে ফিরবো।

মেয়েদের সঙ্গে কথা বললে তারা সিসিলী ভাষায় জবাব দেয়। বড় ভীত-সন্ত্রস্থ মনে হলো তাদের। দু তিনজন একত্রে-ই কথা বলতে শুরু করে। সুলতান সালাহুদ্দীন বণিকদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ এদের ভাষা বুঝ কি? একজন বললো, শুধু আমি বুঝি। এরা নিবেদন করছে, সুলতান যেন এদেরকে তার আশ্রয়ে নিয়ে নেন। এরা বলছে, আমরা বণিক কাফেলার সঙ্গে যেতে রাজি নই। এমনও হতে পারে, পথে দস্যুরা আমাদের তুলে নিয়ে যাবে। তাছাড়া এখন যুদ্ধ চলছে। সর্বত্র খৃষ্টান ও মুসলিম সেনারা গিজগিজ করছে। আমরা সৈন্যদের অনেক ভয় পাই। ঘর থেকে যখন আমাদেরকে অপহরণ করা হয়, তখন আমরা কুমারী ছিলাম, খৃষ্টান সৈন্যরা জাহাজে আমাদেরকে গণিকায় পরিণত করেছে।

এক মেয়ে কিছু বললে বণিক তার তরজমা করে বললো, “মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে মুসলমানদের রাজার নিকট পৌঁছিয়ে দিন; হয়ত তিনি আমাদের প্রতি সদয় হবেন।

মুখ খুললো অপর এক মেয়ে। বণিক বললো, এই মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে আর যা-ই করুন, খৃষ্টান সৈন্যদের হাতে তুলে দেবেন না। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের স্ত্রী হতে পারবো এই নিশ্চয়তা পেলে আমি মুসলমান হয়ে যাবো।

পিছনে দাঁড়িয়ে মুখ লুকাবার চেষ্টা করছে দু তিনটি মেয়ে। মুখে তাদের ভীতির ছাপ। ভয়ে কিংবা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না তারা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বণিককে বললেন, এদেরকে বলল, এরা খৃষ্টানদের কাছে ফিরে যাক আর না যাক আমরা কিন্তু এদেরকে মুসলমান হতে বাধ্য করবো না। এই যে মেয়েটি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের স্ত্রী হওয়ার নিশ্চয়তার শর্তে মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো, তাকে বলল, আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না। কেননা, মেয়েটি এক অপারগ অবস্থায় ও বিপদের মুহূর্তে মুসলমান হতে চাইছে। তাদের বলো, যদি আমার প্রতি তাদের আস্থা থাকে, তাহলে মুসলিম নারীর ন্যায় তাদেরকে আমি আমার আশ্রয়ে নিয়ে নেবো। রাজধানীতে পৌঁছে আমি তাদেরকে জেরুজালেমে খৃষ্টান পাদ্রীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবো।

দোভাষী বণিকের মুখে সুলতান আইউবীর সিদ্ধান্তের কথা শুনে মেয়েরা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠে তাদের চোখে-মুখে। তারা সুলতান আইউবীর এই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে। সুলতান আইউবী মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র তাঁবুর ব্যবস্থা করেন এবং বাইরে সর্বক্ষণ একজন প্রহরী নিয়োজিত থাকার নির্দেশ দেন।

বন্দী মেয়েদের তাঁবু কোথায় স্থাপন করা হবে বলতে যাচ্ছিলেন সুলতান আইউবী। এমন সময় তাঁর সম্মুখে নিয়ে আসা হয় ছয়জন খৃষ্টান কয়েদী। লোকগুলোর পরনের কাপড় ভেজা। স্থানে স্থানে রক্তের দাগ ও বালিমাখা। মড়ার মত ফ্যাকাশে চেহারা, বিধ্বস্ত শরীর।

কমাণ্ডার জানায়, এরা এখান থেকে দেড়-দু মাইল দূরে সমুদ্রতীরে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো। এরা সমুদ্র মাঝে একটি ভাঙ্গা নৌকায় ভাসছিলো। ভিতরে। পানি ঢুকে একদিন নৌকাটি ডুবে যায়। এরা সাঁতার কেটে বহু কষ্টে কূলে এসে উঠে। ছিলো বাইশজন। এখন জীবিত আছে মাত্র এই ছয়জন।

তারা খৃষ্টান বাহিনীর সদস্য। সুলতান আইউবীর সামনে এসে বসে পড়ে ধড়াস্ করে। একজনের চেহারা বলছে, লোকটি সাধারণ সৈনিক নয়। সে কোকাচ্ছে। পোশাকে তার রক্তের দাগ নেই; আহতদের চেয়ে বেশী কষ্টে আছে বলে মনে হলো তাকে। মেয়েগুলোর প্রতি এক নজর দৃষ্টিপাত করে আবার কোঁকাতে শুরু করে লোকটি।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশ ছিলো, যখন যে ধরা পড়বে, তাকেই যেন তার সামনে হাজির করা হয়। সমুদ্রে খৃষ্টান বাহিনীর নৌ ও সেনাবহর ধ্বংস হওয়ার পর এখন জীবনে রক্ষা পাওয়া খৃষ্টান সেনারা একের পর এক বন্দী হচ্ছে আর নীত হচ্ছে সুলতান আইউবীর দরবারে। সুলতান আইউবী এ বন্দীদের প্রতিও চোখ তুলে তাকালেন; কিন্তু বললেন না কিছু-ই। তবে অফিসার গোছের যে লোকটি বেশী কোঁকাচ্ছিলো এবং যার পোশাকে রক্তের দাগ নেই, তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে নীরিক্ষা করে দেখলেন তিনি। ক্ষীণকণ্ঠে সালারদের বললেন, আলী বিন সুফিয়ান এখনো আসলো না! এই বন্দীদের তো অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিলো, এদের কাছ থেকে তথ্য নেয়ার প্রয়োজন ছিলো। এ কয়েদীর প্রতি ইঙ্গিত করে সুলতান বললেন–এ লোকটিকে কমাণ্ডার বলে মনে হয়। একে চোখে চোখে রাখতে হবে। আলী বিন সুফিয়ান আসলে বলবে, এদেরকে যেন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য নেয়। সম্ভবত এ লোকটা ভিতরে আঘাত পেয়েছে, হাড়-গোড় ভেঙ্গে গেছে। এদের এখনি আহত কয়েদীদের তাঁবুতে পাঠিয়ে দাও। খাবার-পানি দাও, ব্যাণ্ডেজ-চিকিৎসা করাও।

ছয় পুরুষ বন্দীকে নির্ধারিত তাঁবুর দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাদের প্রতি। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় মেয়েদেরও।

***

ফৌজি ক্যাম্পের সামান্য দূরে মেয়েদের জন্য তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে। সেখান থেকে কয়েকশ গজ দূরে আহত বন্দীদের তাঁবু। নতুন একটি তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে সেখানেও। পার্শ্বে মাটিতে পড়ে আছে ছয় নতুন আহত বন্দী। মেয়েগুলো তাকিয়ে আছে তাদের প্রতি।

তবু দুটো দাঁড়িয়ে গেছে। মেয়েরা চলে গেছে তাদের তাঁবুতে। আহত বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় নতুন তাঁবুতে। মেয়েদের তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে যায় একজন প্রহরী। অল্পক্ষণের মধ্যে খাবার চলে আসে। মেয়েরা আহার করে নেয়। একটি মেয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে নতুন আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন আর তার চেহারায় ভীতির ছাপ নেই। প্রহরী তার দিকে দৃষ্টিপাত করে। সে-ও প্রহরীর দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয় দুজনের। মেয়েটি মুখে হাসি টেনে ইঙ্গিতে বলে, আমি একটু ঐ আহত লোকগুলোর তাঁবুতে যেতে চাই। প্রহরীও ইশারায় তাকে বারণ করে। মেয়েদের তাঁবু থেকে বের হয়ে কোথাও যাওয়ার বা কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নেই। মেয়েদের ও আহত বন্দীদের তাঁবুর মাঝে অনেকগুলো বৃক্ষ। বাঁ দিকে মাটির একটি টিলা। টিলাটি ঝোঁপ-ঝাড়ে আচ্ছন্ন।

সূর্য ডুবে গেছে। রাত আঁধার হতে চলেছে। নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে প্রকৃতি। রাতের নিস্তব্ধতায় আহত বন্দীদের কোঁকানির শব্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দূরবর্তী রোম উপসাগরের কুলকুল রবও চাপা গুঞ্জনের ন্যায় কানে আসতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিজের তাঁবুতে বিরাজ করছে দিনের পরিবেশ। কারো চোখে ঘুম নেই সেখানে। তিন সালার উপবিষ্ট সুলতানের কাছে।

সুলতান আইউবী পুনরায় বললেন–আলী বিন সুফিয়ান এখনো আসলো না? কণ্ঠে তার অস্থিরতার সুর। একটু থেমে আবার বললেন–তার দূতও আসলো না, না?

কোন অসুবিধা হলে তো সংবাদ পেতাম। আশা করি সেখানে সব ঠিক আছে। বললেন এক সালার।

আশা তো এমন-ই থাকা উচিত। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার সৈন্য-ই যদি বিদ্রোহ করে বসে, তবে তো সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের সৈন্য মাত্র সাড়ে তিন হাজার। দেড় হাজার অশ্বারোহী আর দু হাজার পদাতিক। তাদের মোকালোয় সুদানী সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশী, অভিজ্ঞও বটে। বললেন সুলতান আইউবী।

নাজি ও তার কুচক্রী সহচরদের নির্মূল করার পর বিদ্রোহ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছাড়া সেনাবিদ্রোহ হয় না। বললেন অপর এক সালার।

আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্যে যে আলীকে দরকার! বললেন সুলতান আইউবী।

ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ অভিযানে সুলতান আইউবী নিজেই এসে পড়েছিলেন এখানে। সুদানী সৈন্যদের বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকায় আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে এসেছিলেন রাজধানীতে। এতক্ষণে ফিরে এসে সুলতানকে সেখানকার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার কথা। কিন্তু আলী আসলেন না এখনো । তাই সুলতান অস্থির। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে তার উৎকণ্ঠা।

সালারদের সঙ্গে কায়রোর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন সুলতান আইউবী। গোটা ক্যাম্প গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। জেগে আছে শুধু সেই সাতটি মেয়ে, সুলতান আইউবী যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পর্দা ফাঁক করে তাঁবুর ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে প্রহরী। ভিতরে বাতি জ্বলছে। টের পেয়ে জাগ্রত মেয়েগুলো ঘুমের ভান করে নাক ডাকতে শুরু করে। মেয়েগুলোকে গুণে দেখে প্রহরী। ঠিক আছে–সাতজন। ঘুমিয়ে আছে সবাই। পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে সরে আসে প্রহরী। বসে পড়ে তাঁবুর কাছ ঘেঁষে।

তাঁবুর পর্দাসংলগ্ন শায়িত মেয়েটি নীচ থেকে পর্দাটা উঁচু করে সতর্কতার সাথে বাইরে তাকায়। পার্শ্বের মেয়েটির কানে কানে বলে, বসে পড়েছে। পার্শ্বের জন তার পার্শ্বের জনকেও বলে, বসে পড়েছে। এভাবে এক এক করে সব কটি মেয়ের কানে খবর পৌঁছে যায়, প্রহরী বসে পড়েছে।

তাঁবুর অপর দরজার কাছে শুয়ে আছে যে মেয়েটি, সাবধানে উঠে বসে সে। মাটিতে বিছানো শয্যা। একটি কম্বল বিছানায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখে যে, দেখতে মনে হয়, কম্বলের নীচে একজন মানুষ শুয়ে আছে।

পা টিপে টিপে দরজার নিকটে চলে যায় মেয়েটি। পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে পড়ে তবু থেকে। অপর ছয়জন ধীরে ধীরে নাক ডাকতে শুরু করে।

প্রহরী জানে, এরা সমুদ্রের বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া আশ্রিতা–কোন বিপজ্জনক বন্দী নয়। তাই নিরুদ্বেগ বসে বসে ঝিমুচ্ছে সে।

পা টিপে টিপে টিলা অভিমুখে হাঁটা দেয় মেয়েটি। প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে টিলার কাছে পৌঁছে মোড় নেয় আরেকটি তাঁবুর দিকে। নতুন বন্দী ছয়জন অবস্থান করছে এ তাঁবুতে। অন্ধকার রাত। বেশ কিছু গাছ-গাছালিও আছে এখানে। প্রহরীরা মেয়েটিকে দেখে ফেলার কোন-ই জো নেই এখন।

মেয়েটি বসে পড়ে। পা পা করে এগিয়ে চলে সম্মুখে। বালির টিপির মত কতগুলো কি যেন দেখা যাচ্ছে সামনে। সেগুলোর আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে তাঁবুর নিকটে চলে আসে মেয়েটি। দরজার সামনে টহল দিচ্ছে একজন প্রহরী।

একটি টিপির আড়ালে শুয়ে পড়ে মেয়েটি। কালো ছায়ার মত তাকে দেখে ফেলে প্রহরী। মেয়েটি এখন দুই প্রহরীর মাঝে। একজন নিজের তাঁবুর প্রহরী। অপরজন অন্য জখমীদের তাঁবুর। তার আশঙ্কা, জখমীদের তাঁবুর প্রহরী এদিকে আসলে নিশ্চিত ধরা খেয়ে যাবে।

ইতিউতি দৃষ্টি ফেলে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে প্রহরী চলে যায় অন্য জখমীদের তাঁবুর দিকে। এ সুযোগে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর সন্নিকটে পৌঁছে যায় মেয়েটি। পর্দা তুলে ঢুকে পড়ে ভিতরে।

তাঁবুর ভেতরটা অন্ধকার। ক্ষীণ কণ্ঠে কোকাচ্ছে দু তিনজন জখমী। সম্ভবত তাঁবুর পর্দা ফাঁক হওয়া দেখে ফেলেছে এদের একজন। তাই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে–কে?

কে? প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, রবিন কোথায়? জবাব আসে, ঐ ও-দিকে তৃতীয়জন।

গুণে গুণে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে চলে যায় মেয়েটি। পা ধরে নাড়া দেয় তার। আওয়াজ আসে–কে? মেয়েটি জবাব দেয়–মুবী।

ধড়মড় করে উঠে বসে রবিন। হাত বাড়িয়ে বাহুবন্ধনে টেনে নেয় মেয়েটিকে। শুইয়ে দেয় নিজের বিছানায়। নিজের ও তার গায়ে একটি কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে বলে প্রহরী এসে পড়তে পারে, আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাক।

রূপসী কন্যা মুবীর দেহের উষ্ণতা গ্রহণ করে রবিন। মৌনতায় কাটে কিছুক্ষণ। তারপর রবিন বলে, তোমরা-আমার এই মিলনে আমি বিস্মিত। এ এক অলৌকিক ঘটনা। এতে প্রমাণিত হয়, যীশুখৃষ্ট আমাদের সাফল্য মঞ্জুর করেছেন।

ছয় আহত কয়েদীর যাকে সুলতান আইউবী ব্যতিক্রমী এবং উচ্চপদস্ত সেনা বলে অনুমান করেছিলেন, রবিন সেই ব্যক্তি। সুলতান আইউবী বলেও দিয়েছিলেন একে সাধারণ সিপাই বলে মনে হয় না, এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। আলী বিন সুফিয়ান এসে তদন্ত নেবে।

তোমার জখম কেমন? হাড়-গোড় ভেঙ্গে যায়নি তো? জিজ্ঞেস করে মুবী।

আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। একটি আঁচড়ও নেই দেহের কোথাও। আইউবীর সামনে ভান করেছিলাম মাত্র। জবাব দেয় রবিন।

তাহলে এখানে এসেছো কেন? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

মিসর প্রবেশ করে সুদানী বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইসলামী ফৌজ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঢুকবার কোন পথ পেলাম না। অবশেষে কৌশলের আশ্রয় নিলাম। এই পাঁচজন জখমীকে খুঁজে জড়ো করে জখমীর ভান ধরে এদের সঙ্গে আমিও ঢুকে পড়লাম। এখন তো পালাবারও কোন পথ পাচ্ছি না। জবাব দেয় রবিন।

এবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রবিন বলে, তুমি আমার দুটি প্রশ্নের জবাব দাও। প্রথম প্রশ্ন, আইউবীকে আমি জিন্দা দেখেছি। কারণটা কি? তীর নিঃশেষ হয়ে গেলো, নাকি হারামখোরটা কাপুরুষ হয়ে গেলো? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তোমরা সাতটি মেয়ের সব কজন মুসলমানদের হাতে বন্দী হলো কেন? ওরা পাঁচজন কি মরে গেছে, নাকি পালিয়ে গেছে?

না, তারা জীবিত আছে। তুমি বলছো, যীশুখৃষ্ট আমাদের বিজয় মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু আমি বলছি, আমাদের খোদা আমাদেরকে কোন একটা পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আর সালাহুদ্দীন আইউবীও এখনো জীবিত থাকার কারণ, তীরটা তার দুপায়ের মাঝে বালিতে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছিলো। বললো মুবী।

তীর কি কোন মেয়ে ছুঁড়েছিলো? ক্রিস্টোফর ছিলেন কোথায়? জানতে চায় রবিন।

না, তীর ছুঁড়েছিলেন ক্রিস্টোফর নিজেই। কিন্তু…

কিন্তু ক্রিস্টোফরের তীর ব্যর্থ গেছে, তাই না? যার তীরন্দাজী দেখে শাহ। অগাস্টাস অভিভূত হয়েছিলেন, এখানে এসে তার নিশানা এতই ব্যর্থ হয়ে গেলো যে, ছয় ফুট দীর্ঘ আর তিন ফুট চওড়া একটা সালাহুদ্দীন তার তীর থেকে বেঁচে গেলো! অভাগার হাতটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো বোধ হয়। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো রবিন।

ব্যবধান ছিল অনেক। তাছাড়া ক্রিস্টোফর বললেন, ধনুক থেকে তীরটি বের হবে হবে অবস্থায় একটি পোকা এসে তার চোখে পড়ে এবং সে অবস্থায়-ই লক্ষ্যহীনভাবে তীরটি বেরিয়ে যায়।

তারপর কী হলো?

যা হওয়ার ছিলো, তা-ই হলো। সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ছিলো তিনজন কমাণ্ডার এবং চারজন দেহরক্ষী। তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো। ক্রিস্টোফর টিলার আড়ালে নিরাপদে ফিরে আসেন। আমরা তীর-ধনুকগুলো বালিতে পুঁতে ফেলে উপরে উট বসিয়ে রাখি। আইউবীর সিপাইরা এসে পড়লে ক্রিস্টোফর জানালেন, তারা পাঁচজন মারাকেশী বণিক আর আমরা ছয়টি মেয়ে সমুদ্র থেকে উদ্ধার পেয়ে তাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। মুসলিম সৈন্যরা আমাদের সামান-পত্র অনুসন্ধান করে ব্যবসার পণ্য ছাড়া আর কিছু-ই পেলো না। তারা আমাদের সবাইকে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট নিয়ে যায়। আমরা ভাবে বুঝালাম যে, আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানি না। ক্রিস্টোফর আইউবীকে বললেন, তিনি আমাদের ভাষা বুঝেন। আমরা মেয়েরা চেহারায় ভীতি ও শঙ্কার ভাব ফুটিয়ে তুললাম।

সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আরো যেসব কথা হলো, রবিনকে সবিস্তার সব শোনালো মুবি। এই সাতটি মেয়ে এবং মারাকেশী বণিকবেশী পাঁচজন পুরুষ আক্রমণের দুদিন আগে কুলে অবতরণ করেছিলো। বণিকবেশী পুরুষ পাঁচজন ক্রুসেডারদের অভিজ্ঞ গুপ্তচর ও সেনাকমাণ্ডার। মেয়েগুলোও গুপ্তচর। তারা অত্যন্ত রূপসী। গুপ্তচরবৃত্তি ও মনন ধ্বংসের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তাদের। গোপনে হত্যাকাণ্ড সংঘটনেও তারা বেশ পারদর্শী। পুরুষ পাঁচজনের মিশন ছিলো সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা আর নাজির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। মিসরের ভাষা অনর্গল বলতে পারতো মেয়েগুলো। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর সামনে তা গোপন রাখে তারা। রবিন ছিলো এ মিশনের প্রধান। নাজির সঙ্গে সাক্ষাত করার পরিকল্পনা ছিলো তার। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের সতর্ক কৌশলের সাথে পেরে উঠলো না তারা।

তোমরা কি সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাঁদে ফেলতে পারো না? জিজ্ঞেস করে রবিন।

এখানে সবেমাত্র প্রথম রাত। আমাদের ব্যাপারে তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যদি তা সত্যমনে দিয়ে থাকেন, তাহলে তার অর্থ হলো, তিনি মানুষ নন পাষাণ। আমাদের কারো প্রতি তার আকর্ষণ থাকতো, তাহলে তিনি রাতে কাউকে না কাউকে নিজের তাঁবুতে অবশ্যই ডেকে পাঠাতেন। লোকটাকে হত্যা করাও অতটা সহজ নয়। একবার-ই তিনি উপকূলে এসেছিলেন। তীর ছোঁড়া হলো। ব্যর্থ গেলো তীর। সব সময় তিনি সালার ও রক্ষীদের প্রহরা বেষ্টনীতে থাকেন। এদিকে একজন মাত্র প্রহরী আমাদের মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে আর তার তাঁবুটি ঘিরে রেখে আছে গোটা রক্ষী ইউনিট।

ওরা পাঁচজন কোথায়? জিজ্ঞেস করে রবিন।

এই তো সামান্য দূরে। আপাতত ওরা সেখানেই থাকবে। জবাব দেয় মুবী।

শোনো মুবী! এই পরাজয়টা আমাকে পাগল করে তুলেছে। এ ব্যর্থতার সব দায়-দায়িত্ব যেন চাপছে এসে আমার ঘাড়ে। ক্রুশের উপর হাত রেখে শপথ তো আমরা সকলেই নিয়েছি। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের শপথ আর আমার মতো একজন দায়িত্বশীলের শপথে পার্থক্য অনেক। তুমি আমার মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করে। আমার কর্তব্যসমূহকে সামনে রেখে বিবেচনা করে। যুদ্ধের অন্তত অর্ধেকটা আমাদের মটির নীচ থেকে আর পিঠের পিছন থেকে আক্রমণ করে জয়লাভ করার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমি, তোমরা সাতজন এবং অরা পাঁচজন নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। এই ক্রুশ আমার থেকে জবাব চাইছে।

গলায় ঝুলন্ত ক্রুশটা হাতে নিয়ে রবিন বললো–এটিকে আমি আমার বুক থেকে আলাদা করতে পারি না।

রবিন মুবীর বুকে হাত বুলিয়ে তার ক্রুশটাও হাতে নিয়ে বললো, তুমি তোমার পিতা-মাতাকে ধোকা দিতে পারো, কিন্তু এই ক্রুশের মর্যাদা রক্ষায় উদাসীন হতে পারো না। তোমার উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে, তা তোমাকে পালন করতেই হবে। খোদা তোমাকে যে রূপ দিয়েছেন, তা-ই তোমাকে পাথর চিড়ে পথ করে দেবে। আমি তোমাকে আবারো বলছি, আমাদের এই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মিলন প্রমাণ করে, সফল আমরা হব-ই। আমাদের বাহিনী নোম উপসাগরের ওপারে সংগঠিত হচ্ছে। যারা মারা গেছে, তারা তো মারা গেছে। যারা জীবিত আছে, তারা জানে, এটি কোন পরাজয় নয়–ছিল এক প্রতারণা। তুমি তোমার তাঁবুতে ফিরে যাও; সঙ্গী মেয়েদের বলো, তারা যেন তাঁবুতে-ই পড়ে না থাকে। বারংবার যেন সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সালারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার মন জয় করার চেষ্টা করে এবং মুসলমান হওয়ার ভান ধরে। তারপর কী করতে হবে, তা তাদের জানা আছে।

সর্বাগ্রে আমাদের জানা দরকার, ঘটনাটা ঘটল কী? সুদানীরা কি আমাদেরকে ধোকা দিলো? বললো মুবী।

তা আমি নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারছি না। হামলার অনেক আগে আমি মিসরে কর্তব্যরত আমার গুপ্তচরদের মাধ্যমে তথ্য পেয়েছিলাম, সুদানী সৈন্যদের উপর সালাহুদ্দীন আইউবীর আস্থা নেই। অথচ তারা মিসরে মুসলমানদের নিজস্ব বাহিনী। আইউবী এসে যখন মিসরী বাহিনী গঠন করলেন, তখন তারা এই বাহিনীতে শামিল হতে অসম্মতি জানায়। তাদের কমাণ্ডার নাজি আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করলো। আমি নিজে তার পত্র দেখেছি এবং সত্যায়ন করেছি যে, হ্যাঁ, এটি নাজির-ই পত্র এবং এতে কোন প্রতারণা নেই। এখন আমার জানতে হবে, এমনটি কেন ঘটলো এবং কে ঘটালো। তথ্য সন্ধান নিয়ে নিশ্চিত না হয়ে আমি ফিরছি না। আমাকে লক্ষ্য করে শাহ আগাস্টাস বড় গর্ব করে বলেছিলেন, আমি মুসলমানদের ঘর থেকে একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে পারবো। এখন চিন্তা করো মুবী! এ ঘটনায় শাহ অগাস্টাস কত মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তিনি কি আমাকে মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা লঘু শাস্তি দিয়ে রক্ষা করবেন? উপরন্তু ক্রুশের অভিশাপ তো আছেই। বললো রবিন।

আমি সবই জানি রবিন। আবেগ ছেড়ে কাজের কথা বলো। এখন আমার করণীয় কী তা-ই বলো। বললো মুবী।

শোচনীয় পরাজয়ের কথা স্মরণ করে অবচেতন মনে কথা বলছে রবিন। মুবীর মতো চিত্তাকর্ষক এক রূপসী তরুণী যে তার বুকের সঙ্গে জড়ানো, একটি তন্বী-তরুণীর রেশম-কোমল এলো কেশগুচ্ছে যে তার মুখমণ্ডলের অর্ধেকটা আচ্ছন্ন, সে খবর-ই নেই তার। হঠাৎ মেয়েটার কোমল চুলের পরশ অনুভব করে রবিন বলে ওঠে, মুবী! তোমার এই চুল এমন-ই শক্ত শিকল যে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে এ শিকলে একবার বাধতে পারলেই দেখবে, নেটা তোমার গোলামে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু সর্বাগ্রে তোমাকে যে, কাজটি করতে হবে, তাহলো, ক্রিস্টোফর ও তার সঙ্গীদের বলবে, তারা যেন বণিকের বেশ ধরে নাজির নিকট যায় এবং তথ্য সংগ্রহ করে, তার বাহিনী কেন বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং আমাদের গোপন তথ্য কিভাবে ফাঁস হয়ে গেলো যে, সালাহুদ্দীন গুটিকতক সৈন্য দিয়ে কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে আমাদের তিন তিনটি সেনাবহর ধ্বংস করে দিলো। তাদেরকে এ বিষয়টিও জেনে নিতে বলবে, নাজি তলে তলে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে মিলে গেলো কিনা। আমাদের এভাবে ধ্বংস করার জন্য-ই। প্রতারণামূলক পত্র লিখলো কিনা। তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে আমাদের যুদ্ধ-পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি, ইসলামপন্থীরা সংখ্যায় যত নগণ্য-ই হোক, সম্মুখসমরে সহজে আমরা তাদেরকে পরাজিত করতে পারবো না। তাই তাদের শাসকমণ্ডলী ও সামরিক অধিনায়কদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করতে হবে আগে। এ লক্ষ্যে আমরা তোমার মতো বেশ কিছু মেয়েকে আরব শাসকদের হেরেমে ঢুকিয়ে রেখেছি।  আবারো তুমি কথা লম্বা করছো–বাধা দিয়ে মুবী বললো–আমরা নিজ বাসভবনে এক শয্যায় শুয়ে নেই। আমরা এখন দুশমনের হাতে বন্দী। বাইরে প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। রাত কেটে যাচ্ছে। হাতে সময় বেশী নেই। মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী হবে, তা-ই বলো। আমরা সাতটি মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। বলো কী করবো। এক তো বুঝলাম, নাজির কাছে যেতে হবে, তার প্রতারণার সন্ধান নিতে হবে। তারপর তোমাকে সংবাদ জানাবো কী করে? তোমাকে পাবো কোথায়?

আমি এখান থেকে পালিয়ে যাবো। তার আগে আমি এই ক্যাম্প, ক্যাম্পের লোকসংখ্যা এবং আইউবীর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেবো। এই লোকটি সম্পর্কে আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ক্রুশের জন্য একমাত্র বিপদ এই লোকটি। অন্যথায় ইসলামী খেলাফত আমাদের জালে আটকা পড়ে গেছে। শাহ এম্লার্ক বলতেন, মুসলমানরা এতো-ই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে যে, এখন চিরদিনের জন্য তাদেরকে আমাদের গোলামে পরিণত করতে প্রয়োজন একটিমাত্র ধাক্কা। কিন্তু তার এই প্রত্যয় আত্মপ্রবঞ্চনা বলে-ই প্রমাণিত হলো। এখানে অবস্থান করে আমাকে আইউবীর দুর্বল শিরাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তোমাদের পুরুষ পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে সুদানী বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে, তাদের দিয়ে বিদ্রোহ করতে হবে। তরে মনে রাখবে, সবচে বেশী প্রয়োজন হলো, আইউবী যেন জীবিত থাকতে না পারে। থাকেও যদি থাকবে আমাদের জিন্দানখানার সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত কখনো সূর্য চোখে দেখবে না, নজরে আসবে না আকাশের একটি তারকাও। তুমি আগে তোমার তাঁবুতে যাও এবং সহকর্মী মেয়েদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দাও। তাদের বিশেষভাবে জানিয়ে দাও, একটি লোককে তোমাদের এই রেশম-কোমল চুল, মায়াবী চোখ আর হৃদয়কাড়া দেহ দিয়ে এমনভাবে অথর্ব করে দিতে হবে, যেন সে আইউবীর আর কোন কাজেই না আসে। সম্ভব হলে তার ও আইউবীর মাঝে এমন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা একজন অপরজনের শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়। ভাল করে মনে রেখো, লোকটার নাম আলী বিন সুফিয়ান।

দুজন পুরুষের মধ্যে কিভাবে দুশমনি সৃষ্টি করতে হয়, তা তোমরা ভালো করেই জানো। যাও, সহকর্মী মেয়েদের ভালোভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্রিস্টোফরের নিকট পৌঁছে যাও। তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, তোমার তীর বুঝি আইউবীর উপর এসে-ই ব্যর্থ হলো? এবার সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব দাও আর তোমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করো।

মুবীর চুলে চুমু খেয়ে রবিন বললো–ক্রুশের জন্য প্রয়োজনে তোমাদের সম্ভমও বিলিয়ে দিতে হবে। তারপরও যীশুখৃষ্টের দৃষ্টিতে তোমরা মা মরিয়মের মত কুমারী-ই থাকবে। ইসলামকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসর জয় করার পালা।

***

রবিনের শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুবী। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দেয় বাইরে। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়লো না তার। মুবী বাইরে বেরিয়ে আসে। তাঁবুর আড়াল থেকে ইতিউতি দৃষ্টিপাত করে দেখে নেয় প্রহরী কোথায়। দূরে কারুর গোঙ্গানীর শব্দ শুনতে পায় সে। হতে পারে সে-ই প্রহরী। মুবী দ্রুত হাঁটা দেয় একদিকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দ্রুত হেঁটে পিছনের দিকে সতর্ক কান রেখে পৌঁছে যায় টিলার নিকটে। হাঁটা দেয় নিজের ভাবুর দিকে।

আধা পথ অতিক্রম করার পর দুজন মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসে মেয়েটির। মনে হলো, তার-ই তাঁবুর নিকটে কথা বলছে দুজন মানুষ। মুবীর মনে আশঙ্কা জাগে, প্রহরী হয়ত জেনে ফেলেছে, তাঁবুর একটি মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। হয়তো সে কারণেই সে অন্য কোন প্রহরী বা কমাণ্ডারকে ডেকে এনেছে। ভাবনায় পড়ে যায় মুবী। মুহূর্ত মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের তাঁবুতে যাওয়া এ মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তার চে অন্য পাঁচ পুরুষ সঙ্গীর কাছেই চলে যাই।

মুবীর বণিকবেশী পাঁচ মারাকেশী পুরুষ সঙ্গী এখান থেকে দেড় মাইল দূরে তাঁবু ফেলে অবস্থান করছে। তাদের কাছেই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটি।–কিন্তু আবার ভাবে, তার পালানোর ফলে অন্য মেয়েদের উপর বিপদ নেমে আসবে। খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। কিন্তু পরক্ষণেই হাঁটা দেয় সামনের দিকে। নিজের তাঁবু অভিমুখে লোক দুটো কী বলছে শোনার চেষ্টা করে। মুবী আরবী বুঝে। সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে সে মিথ্যা বলেছিলো, “ সিসিলি ছাড়া অন্য কোন ভাষা সে বুঝে না।

চুপ মেরে যায় তোক দুটো। এখন আর কোন কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাদের। পা টিপে টিপে আরো সামনে এগিয়ে যায় মুবী। এবার ডান দিক থেকে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায়। চকিত নয়নে ফিরে তাকায়। ঘন বৃক্ষরাজির মধ্যে কালো একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে তার। গতি পরিবর্তন করে টিলার দিকে হাঁটা দেয় মেয়েটি।

কোন বিপদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না মুবী। নিরাপদে টিলার উপরে উঠতে শুরু করে সে। টিলাটি তেমন উঁচু নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুবী টিলার উপরে উঠে যায়।

বড় বিচক্ষণ মেয়ে মুবী। কিন্তু যত চতুর-ই হোক মানুষ প্রতি পদে পূর্ণ সাবধানতা, রক্ষা করতে সমর্থ হয় না। অন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে সবসময় শতভাগ নিরাপদ থাকা অতি বিচক্ষণের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে।

টিলার চূড়ায় উঠে গেলেও বিচক্ষণ মেয়ে মুবী লোকটার চোখে পড়ে যায়। মুবী নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা খোলা চুলগুলো পিঠের উপর সরিয়ে দেয় সে। কিন্তু ক্ষীণ জ্যোত্সালোকে মেয়েটির উন্নত বক্ষ আর দীর্ঘ কালো ওড়না ধাওয়াকারী লোকটিকে জানিয়ে দেয়, এটি একটি মেয়ে।

লোকটি আইউবীর প্রহরীদের কমাণ্ডার। রাতের বেলা ক্যাম্পে টহল দিতে বেরিয়েছে। মুহূর্তটা প্রহরীদের ইউনিট পরিবর্তনের সময়। সুলতান আইউবী তিনজন অধিনায়কসহ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। আর সে জন্যে-ই কমাণ্ডার অধিক সতর্কতার সাথে টহল দিয়ে ফিরছে। সুলতান আইউবীর ব্যবস্থাপনা বড় কঠোর। প্রতি মুহূর্তে যে কোন দায়িত্বশীল আশঙ্কাবোধ করে, হয়ত এ মুহূর্তে সুলতান তদারকি করতে বেরিয়ে আসবেন।

কমাণ্ডার বুঝে ফেলে, টিলার উপর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সন্ধ্যায়-ই উপর থেকে কমাণ্ডারদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, খৃষ্টানরা চরবৃত্তি এবং নাশকতামূলক তৎপরতার জন্য মেয়েদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তাদের নিয়োজিত মেয়েরা হতে পারে মরু যাযাবরের বেশে। ভিক্ষুক বেশে ক্যাম্পে আসতে পারে ভিক্ষা করতে। কেউ আবার নিজেকে বিপন্ন নির্যাতিত বলে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে। কমাণ্ডারদের বলা হয়েছে, আজ-ই সাতটি মেয়ে, সুলতান আইউবীর আশ্রয়ে এসেছে। মহামান্য সুলতান বাহ্যত তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে সন্দেহভাজন আখ্যা দিয়ে আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। এ-সব নির্দেশনা শুনে এই কমাণ্ডার তার এক সঙ্গীকে বলেছিলো, আল্লাহ করুন, যেন এমন কোন মেয়ে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বসে! বলেই দুজন খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়েছিলো।

মধ্য রাতে যখন সমগ্র ক্যাম্প গভীর নিদ্রায় অচেতন, ঠিক তখনি টিলার উপর কমাণ্ডারের চোখে পড়লো এক নারীমূর্তি। প্রথমে তার ধারণা হয়, এটি কোন জিন-ভূত হবে হয়তো। কমাণ্ডার নতুন প্রহরীকে তাঁবুর সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলো, ভিতরে সাতটি মেয়ে আছে। পর্দা তুলে তাকালে ঠিক-ই সাতটি শয্যা দেখতে পায় প্রহরী। প্রতিটি মেয়ের মুখমণ্ডল কম্বল দিয়ে মুড়ি দেয়া। প্রচণ্ড শীত পড়ছিলো। সপ্তম কম্বলের তলে আসলেই মানুষ আছে কিনা তা আর যাচাই করে দেখেনি কমাণ্ডার। সপ্তম শয্যার মেয়েটি-ই যে টিলার উপর তার সামনে দণ্ডায়মান, তা তার অজানা।

কমাণ্ডার কিছু সময় চিন্তা করে। নিজেই মেয়েটির কাছে যাবে, নাকি তাকে নীচে নেমে আসার জন্য আদেশ করবে, কিংবা জিন-ভূত হলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করবে, ভেবে নেয় সে।

ভাবনার মধ্যে কেটে যায় কিছু সময়। কিন্তু এতক্ষণেও অদৃশ্য হয়নি মেয়েটি। বরং দু-তিন পা এগিয়ে গেছে আরো সামনে। আবার ফিরে আসে পিছনে। থেমে যায় এবার। কমাণ্ডার–যার নাম ফখরুল মিসরী–ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় টিলার নিকটে। উপর দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে–কে তুমি? নীচে নেমে আসে।

আহত হরিণীর মত লাফিয়ে ওঠে মেয়েটি। দৌড়ে চলে যায় টিলার অপর প্রান্তে। ফখরুল মিসরী এবার নিশ্চিত হয় এটি মানুষ-ই বটে।

কমাণ্ডার সুঠামদেহী এক সুপুরুষ। টিলাও তেমন উঁচু নয়। দীর্ঘ কয়েকটি পদক্ষেপে-ই উপরে উঠে যায় সে। চারদিক অন্ধকার। রাতের আঁধারে মেয়েটির পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় লোকটি। পিছু নেয় মেয়েটির।

টিলার অপর প্রান্ত দিয়ে নীচে নেমে তীব্রগতিতে দৌড়াতে শুরু করে মেয়েটি। কমাণ্ডারও নীচে নেমে ধাওয়া করতে শুরু করে তাকে। দু জনের মাঝে ব্যবধান অনেক। কিন্তু ফখরুল মিসরী পুরুষ, তদুপরি সৈনিক। সিংহের মত দৌড়াচ্ছে সে। টিলার পিছনে উঁচু-নীচু, শুষ্ক ঝোঁপঝাড় এবং মাঝে-মধ্যে দু চারটি বৃক্ষ। দীর্ঘক্ষণ দৌড়িয়ে এবার ফখরুল অনুভব করলো, সামনে কেউ নেই। দাঁড়িয়ে যায় সে। অনিমেষ চোখে তাকায় ডানে-বাঁয়ে ও সামনে-পিছনে। খানিক পর পিছনে বেশ বাঁয়ে মেয়েটির পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে।

প্রশিক্ষিত মেয়ে। রূপ-যৌবন ব্যবহারের পাশাপাশি সামরিক ট্রেনিংও পেয়েছে সে। খঞ্জর চালনার কৌশলও তার রপ্ত । দৌড়ে পালিয়ে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো সে। ফখরুল মিসরী তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেছে। এবার অন্য দিকে মোড় নিয়েছে মেয়েটি।

কানামাছি খেলছে যেন দুজন। কমাণ্ডারের যত সমস্যা অন্ধকারের কারণে। মেয়েটির পায়ের আওয়াজ-ই তার ধাওয়া করার একমাত্র অবলম্বন। চোখে দেখছে না কিছু-ই। মুবীর পা থেমে গেলে থেমে যায় ফখরুল মিসরীও। চলতে শুরু করলে সক্রিয় হয়ে উঠে ফখরুল মিসরী।

ফখরুল মিসরীর বুঝতে বাকী নেই, মেয়েটি তাগড়া যুবতী। বয়সী হলে এত দ্রুত এবং এত বেশী দৌড়াতে পারতো না।

মুবীর পুরুষ সঙ্গীদের ছাউনি সামান্য সামনে। ফখরুল মিসরীকে ফাঁকি দিয়ে ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে দৌড়ে ছাউনিতে পৌঁছে যায় মেয়েটি। হাঁক দেয় সঙ্গীদের। নারী কন্ঠের আর্ত-চীঙ্কার শুনে সন্ত্রস্থ হয়ে জেগে উঠে তারা। বেরিয়ে আসে তাঁবুর বাইরে। আলো জ্বালায়। তরবারী কোষমুক্ত করে নেয় ফখরুল মিসরী। হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় তাদের সম্মুখে। কমাণ্ডার দেখতে পায়, পাঁচজন মানুষ। পোশাকে প্রবাসী বণিক বলে মনে হলো তাদের। সম্ভবত মুসলমান। মেয়েটি তাদের একজনের দুপা দুবাহু দ্বারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মশালের কম্পমান আলোতে তার মুখমণ্ডলে প্রচণ্ড ভীতির ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বুকটা উঠানামা করছে তার। প্রচণ্ড শব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটি।

এই মেয়েটিকে আমার হাতে তুলে দাও। নির্দেশের সুরে বললো ফখরুল মিসরী।

একটি কেন, আমরা সাত সাতটি মেয়ে আপনার সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছি। মন চাইলে আপনি একে নিয়ে যেতে পারেন। বিনয়ের সুরে জবাব দেয় একজন।

না, না, আমি এর সঙ্গে যাবো না! এরা খৃষ্টানদের চেয়েও জংলী। এদের সুলতান মানুষ নয়–আস্ত একটা ষাড়, হিংস্র পশু। বেটা আমার হাড়-গোড় সব ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি তার কবল থেকে পালিয়ে এসেছি। লোকটার পদযুগল . আরো শক্ত করে ধরে কান্নাজড়িত ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো মুবী ।

কোন্ সুলতান? বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে ফখরুল মিসরী।

আর কে? তোমরা যাকে সালাহুদ্দীন আইউবী বলল, সেই সুলতান। জবাব দেয় মুবী। মুবী এবার কথা বলছে আরবীতে।

মেয়েটি মিথ্যে বলছে। বলেই ফখরুল জানতে চায়, এ কে তোমাদের আত্মীয় কি?

ভিতরে আসো দোস্ত! বাইরে ঠাণ্ডা পড়ছে। তরবারী কোষবদ্ধ করে নাও। আমরা ব্যবসায়ী। ভয়ের কোন কারণ নেই। মেয়েটির কাহিনী শোন। ফখরুল মিসরীকে উদ্দেশ করে বললো একজন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটি বললো, তোমার সুলতানকে আমি মর্দে মুমিন মনে করতাম। কিন্তু একটি রূপসী মেয়েকে হাতে পেয়ে তিনি ঈমানের কথা ভুলে গেলেন! অবশিষ্ট ছয়টি মেয়েরও তিনি। একই দশা ঘটিয়ে থাকবেন অবশ্যই।

অন্য মেয়েদের এই দশা ঘটিয়েছে সালাররা। সন্ধ্যায় তাদেরকে ওরা নিজ তাঁবুতে ডেকে নিয়ে যায় এবং হায়েনার মত উপভোগ করে ফিরিয়ে দিয়ে যায় । তাঁবুতে এখন তারা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। বললো মুবী।

ভাবান্তর ঘটে যায় ফখরুল মিসরীর। ধীরে ধীরে তরবারীটা কোষবদ্ধ করে তাদের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে পড়ে সে। বসে পড়ে পাতানো শয্যার এক কোণে। চুলোয় আগুন ধরিয়ে হাড়িতে করে পানি চড়ায় একজন। কফি তৈরি করার নামে কি যেন ঢালে পানিতে। ফখরুল মিসরীর পদমর্যাদা কি জানতে চায় আরেকজন। ফখরুল মিসরী জানায়, আমি পদস্থ একজন কর্মকর্তা–কমাণ্ডার। নানা রকম কথা বলে বণিকরাও আন্দাজ করে নেয়, লোকটি সাধারণ নয়–আসলেই পদস্থ কেউ হন। অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দুঃসাহসীও বটে।

বণিকদের একজন–যার নাম ক্রিস্টোফর–কমাণ্ডারকে মেয়েগুলো সম্পর্কে হুবহু সেই কাহিনী শোনায়, যা শুনিয়েছিলো সুলতান আইউবীকে।

মেয়েগুলো সুলতানকে প্রস্তাব করেছিলো, আমরা যেহেতু বাবা-মার নিকটও ফিরে যেতে পারবো না, খৃষ্টানদের কাছেও নয়, তাই আমরা মুসলমান হয়ে যাই। পদস্থ সাতজন সৈনিকের সঙ্গে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন। ক্রিস্টোফর বললো, আমরা শুনেছিলাম, নৈতিকতার প্রশ্নে সুলতান আইউবী আপোষহীন, চরিত্র তার পাথরের মতো অটল। ব্যবসার ধান্ধায় আমরা সব সময়-ই সফরে সফরে থাকি। বিপন্ন নিরাশ্রয় এই মেয়েগুলোকে কিভাবে আমরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। তাই নিরাপত্তার জন্য মেয়েগুলোকে সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু সুলতান মেয়েগুলোর সঙ্গে কী আচরণ করলেন, তা তো এই মেয়েটির জবানীতে নিজ কানেই শুনলেন!

মেয়েটির প্রতি তাকায় ফখরুল মিসরী। সুযোগ বুঝে মেয়েটি বলে, খোদা আমাদেরকে একজন ফেরেশতার আশ্রয়ে তুলে দিয়েছেন ভেবে আমরা মনে মনে বেশ খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু সূর্যাস্তের পর সুলতানের এক রক্ষী এসে আমাকে বললো, সুলতান তোমায় ডাকছেন। অন্য ছয় মেয়ের তুলনায় আমি একটু বেশী সুন্দরী। আমি কল্পনাও করিনি, তোমাদের আইউব আমায় অসৎ উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি সরল মনে চলে গেলাম। সুলতান মদের পিপার মুখ খুললেন। ঢেলে এক গ্লাস রাখলেন নিজের সামনে আর এক গ্লাস ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি খৃষ্টান, মদ পান করেছি শতবার। জাহাজে খৃষ্টান কমাণ্ডাররা আমার দেহটাকে খেলনা বানিয়ে রেখেছিলো। সালাহুদ্দীন আইউবীও একই মতলব আঁটলেন। মদ ও পুরুষ আমার জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু সুলতান আইউবীকে আমি ফেরেশতা মনে করতাম। তার পবিত্র দেহটাকে আমি আমার নাপাক শরীর থেকে দূরে রাখতে চাইছিলাম। কিন্তু খৃষ্টান নরপশু কমাণ্ডারদের চেয়ে তিনি অধিক ঘৃণ্য বলে প্রমাণিত হলেন। তোমাদের সুলতান আমার শরীরের হাড়-গোড় সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন।

সমুদ্রের মহাবিপদ থেকে খোদা আমাদেরকে উদ্ধার করলেন এবং ছুঁড়ে মারলেন এমন এক ব্যক্তির আশ্রয়ে, যে ফেরেশতারূপী সাক্ষাৎ হায়েনা। সুলতান-ই আমাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গের অন্য মেয়েরা তার সালারদের তাঁবুতে রয়েছে। আমি সুলতানের পা ধরে মিনতি করেছিলাম, আপনি আমায় বিয়ে করে নিন। তিনি বললেন, তোমার যদি আমাকে পছন্দ-ই হয়ে থাকে, তো বিয়ে ছাড়াই আমি তোমায় আমার হেরেমে স্থান দেবো। তিনি আমার সঙ্গে হায়েনার মত আচরণ করেছেন। ছিলেন মদে মাতাল। এক পর্যায়ে দু বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে আমাকে তিনি তার পার্শ্বে শুইয়ে দেন ……..। এক সময়ে যখন তার দু চোখের পাতা এক হলো, আমি উঠে সেখানে থেকে পালিয়ে এলাম। আমার কথায় তোমার বিশ্বাস না হলে তার রক্ষীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।

এই ফাঁকে ফখরুল মিসরীকে কফি পান করায় একজন। খানিক পর মেজাজে পরিবর্তন আসতে শুরু করে তার। ঘৃণাভরা কণ্ঠে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং বলে আমাদেরকে আদেশ দেন মদ-নারী থেকে দূরে থাকো আর নিজে মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে নারী নিয়ে রাত কাটান, না?

ফখরুল মিস্ত্রী অনুভব-ই করতে পারেনি, মেয়েটি তাকে যে কাহিনী শুনিয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, নিরেট মিথ্যা। মেজাজ তার কেন পাল্টে গেলো, তাও বুঝতে পারেনি সে।

কফি নয়–ফখরুল মিসরীকে খাওয়ানো হয়েছে হাশীশ। হাশীশের নেশায় পড়ে এমন আবোল-তাবোল বকছে সে। কিন্তু এ-যে নেশা, ও বুঝে আসেনি তার। নিজের কল্পনায় এখন সে রাজা। মশালের কম্পমান আলো নাচছে মেয়েটির মুখে। চিক্ চিক্ করছে তার বিক্ষিপ্ত কালোপ জ্বর পশমগুলো। পূর্বাপেক্ষা অধিক রূপসী বলে মনে হলো তাকে ফখরুল মিসরীর কাছে। মেয়েটিকে পাওয়ার নেশায় ব্যাকুল হয়ে উঠে তার হৃদয়। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে ওঠে–তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে নিতে পারি।

না, তুমিও আমার সঙ্গে সুলতানের ন্যায় একই আচরণ করবে। আমাকে তুমি তোমার তাঁবুতে নিয়ে যাবে আর আমি পুনরায় তোমাদের সুলতানের কজায় চলে যাবো। হঠাৎ ভয় পাওয়া মানুষের ন্যায় আঁৎকে উঠে দু পা পিছনে সরে গিয়ে বললো মেয়েটি।

আমরা এখন অপর ছয়টি মেয়েকে কিভাবে উদ্ধার করে আনা যায় ভাবছি। আমরা তাদের ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ভুল করে ফেললাম। বললো ব্যবসায়ীদের একজন।

ফখরুল মিসরীর দৃষ্টি মেয়েটির উপর নিবদ্ধ। এতো সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর দেখেনি সে কখনো। কারো মুখে রা নেই। অখণ্ড এক নীরবতা বিরাজ করছে। তাঁবুতে। সেই নীরবতা ভাঙ্গে ক্রিস্টোফর। বললো–তুমি কি আরব থেকে এসেছে, নাকি মিসরী?

আমি মিসরী। দু দুটো যুদ্ধে লড়েছি। দক্ষতার বলে এ পদ পেয়েছি। বললো ফখরুল মিসরী।

নাজি যে সুদানী যে বাহিনীটির সালার, এখন সেটি কোথায়? জিজ্ঞেস করে ক্রিস্টোফর।

সেই বাহিনীর একজন সৈনিকও আমাদের সঙ্গে নেই। জবাব দেয় মিসরী।

বলতে পারো, এমনটি কেন হয়েছে? সুদানীরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নেতৃত্ব ও কমাণ্ড মেনে নেয়নি। বাহিনীটি নিজেকে স্বাধীন মনে করতো। নাজি সুলতানকে বলে দিয়েছিলো, সে মিসর ছেড়ে চলে যাবে। কারণ, সে বিদেশী মানুষ। এ কারণে আইউবী মিসরীদের একটি বাহিনী গঠন করেন এবং যুদ্ধ করার জন্য এখানে নিয়ে আসেন। তোমাদের সুলতান তোমাদেরকে আত্মমর্যাদা ও সঙ্কর্মের উপদেশ দেয় আর নিজে আয়েশ করে চলে। তা যুদ্ধ। করে গনীমত কিছু পেয়েছো কি?…..। দু এক চাকা সোনা-রূপা পেয়েছে হয়তো! খৃষ্টানদের জাহাজ থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা-চাদী সুলতানের হাতে এসেছে। রাতের আঁধারে হাজার হাজার উটের পিঠে বোঝাই দিয়ে সেসব পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কায়রো। সেখান থেকে পাচার হবে দামেস্ক ও বাগদাদ। সুদানী বাহিনীটিকে নিরস্ত্র করে সুলতান তাদের গোলামে পরিণত করতে চায়। তারপর ফৌজ আসবে আরব থেকে। তখন তোমরা মিসরীরাও গোলাম হয়ে যাবে তাদের। বললো ক্রিস্টোফর।

***

ক্রিস্টোফরের প্রতিটি কথা হৃদয়ে বসে যাচ্ছে ফখরুল মিসরীর। ক্রিয়াটা মূলত কথার নয়–ক্রিয়া মুবীর রূপ আর হাশীশের। ক্রিস্টোফর এই কৌশল রপ্ত করেছে হাসান ইবনে সাব্বাহর হাশীশীদের নিকট থেকে। মুবী কল্পনাও করেনি, একজন মিসরী কমাণ্ডার তাকে ধাওয়া করে অবশেষে তারই মুঠোয় এসে ধরা দেবে। মেয়েটি জেনে ফেলেছে, মিসরী কমাণ্ডার আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানে না।

এবার মুবী আরো তথ্য দিতে শুরু করে সঙ্গীদের। বলে, রবিন জখমের ভান করে সুলতান আইউবীর জখমীদের তাঁবুতে পড়ে আছেন। তিনি বলেছেন, নাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে হবে, তিনি বিদ্রোহ কেন করলেন না কিংবা পিছন থেকে কেন তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করলেন না। তাছাড়া নাজি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন কিনা, রবিন তারও খোঁজ নিতে বলেছেন।

মুবীকে ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে দেখে ফখরুল মিসরী জিজ্ঞেস করে–ও কী বলছে?

একজন জবাব দেয়–ও বলছে, যদি এ লোকটি, অর্থাৎ তুমি যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিক না হতে, তাহলে ও তোমাকে বিয়ে করে নিতো। প্রয়োজনে ও মুসলমান হয়ে যেতেও প্রস্তুত আছে। কিন্তু ও বলছে, এখন আর কোন মুসলমানের উপর তার আস্থা নেই।

জবাব শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠে ফখরুল মিসরী। খপ করে মেয়েটির দু বাহু ধরে ফেলে নিজের কাছে টেনে আনে। আপুত কণ্ঠে বলে–খোদার কসম! আমি যদি রাজা হতাম, তবুও তোমার খাতিরে আমি সিংহাসন ত্যাগ করতাম। শর্ত যদি এ-ই হয় যে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারী ফেলে দেবো, তাহলে এই নাও আইউবীর তরবারী। নিজের কটিবন্ধ থেকে তরবারীটা বের করে কোষসহ মেয়েটির পায়ের উপর রেখে দেয় ফখরুল মিসরী। বলে–এ মুহূর্ত থেকে আমি আইউবীর সৈনিক নই, কমাণ্ডার নই।

আরো একটি শর্ত আছে। তোমার খাতিরে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো। ঠিক; কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী থেকে প্রতিশোধ আমি নেবো-ই। বললো মেয়েটি।

তার মানে তুমি কি তাকে আমাকে দিয়ে হত্যা করাতে চাও? জিজ্ঞেস করে ফখরুল।

মুবী তার সঙ্গীদের প্রতি তাকায়। পরস্পর চোখাচোখী করে সকলে। জবাবটা কী দেবে স্থির করে নেয় ক্রিস্টোফর। অবশেষে বলে–এক সালাহুদ্দীন বিদায় নিলে তাতে তেমন কি আর লাভ হবে। আসবে আরেক সুলতান। সেও হবে তার-ই মতো। গোলাম হয়েই থাকতে হবে মিসরীদের। কাজেই ও-সবের প্রয়োজন নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো; সুদানীদের সালার নাজির কাছে যাও এবং এই মেয়েটিকে তার সামনে উপস্থিত রেখে তাকে জানাও, সালাহুদ্দীন আইউবী আসলে কেমন মানুষ আর লক্ষ্য-ই বা তার কী?

বণিকবেশী খৃষ্টান কুচক্রীদের জানা ছিলো, খৃষ্টানদের সঙ্গে নাজির যোগসাজশ আছে এবং মুবী অকপটে তার সঙ্গে মিশন নিয়ে কথা বলতে পারবে। কিন্তু সুলতান আইউবী যে বিশ্বাসঘাতক নাজি ও তার সালারদের কৌশলে সংগোপনে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছেন, তা তাদের অজানা তথ্য নেয়ার জন্য নাজির কাছে যাওয়ার কথা ছিলো মেয়েটির। কিন্তু তার একা যাওয়া সম্ভব ছিলো না। ঘটনাক্রমে ফখরুল মিসরীকে পেয়ে গেছে সে। তাকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়।

মুবীকে নিয়ে রওনা হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয় ফখরুল মিসরীকে। একটি উট দেয়া হয় তাকে। পানির মশক এবং খাবারভর্তি একটি থলে বেঁধে দেয়া হয় উটের সঙ্গে। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কিছু জিনিস আছে, তাতে হাশীশ মেশানো। বিষয়টা জানা ছিলো মুবীর।

একটি লম্বা চোগা এবং ব্যবসায়ীর পোশাক পরিয়ে দেয়া হয় ফখরুল মিসরীকে। উটের পিঠে সম্মুখভাবে চড়ে বসে মেয়েটি। ফখরুল বসে পিছনে। চলতে শুরু করে উট।

আশ-পাশের কোন খবর নেই ফখরুল মিসরীর। এমনকি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেও সম্পূর্ণ উদাসীন সে। এ মুহূর্তে লোকটা জানে শুধু একটা-ই–পৃথিবীর একটি সেরা সুন্দরী যুবতী তার মুঠোয়, সুলতান আইউবীকে উপেক্ষা করে যে তাকে বরণ করে নিয়েছে! মুবীকে দু বাহুতে জড়িয়ে ধরে পিঠটা তার নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বসেছে ফখরুল মিসরী।

মুবী বললো–তুমিও আবার খৃষ্টান কমাণ্ডার আর তোমার সুলতানের মতো হায়েনার পরিচয় দেবে না তো? আমি এখন তোমার মালিকানাধীন, তোমার হাতের মুঠোয়। যা মন চায় করার সুযোগ তোমার আছে। তবুও আমি তোমায় ঘৃণার চোখে দেখবো।

তুমি যদি বলো, আমি এখনি উটের পিঠ থেকে নেমে যাবো। আমাকে তুমি শুধু এতটুকু বলল, তুমি মনে-প্রাণে আমাকে কামনা করছে, না-কি নিছক বিপদে পড়ে আমার আশ্রয়ে এসেছো? বাহুবন্ধন থেকে মুবীকে ছেড়ে দিয়ে বললো ফখরুল মিসরী।

না, তা নয়। আশ্রয় তো আমি ঐ ব্যবসায়ীদেরও নিতে পারতাম। কিন্তু। তোমাকে আমার মনে ধরেছে বলেই নিজের ধর্মটা পর্যন্ত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জবাব দেয় মুবী। আবেগময় কথা বলে মুবী ফখরুল মিসরীকে মাতিয়ে রাখে এবং কথায় কথায় রাত কাটিয়ে দেয়।

সফরটা ছিলো অন্তত পাঁচ দিনের । কিন্তু ফখরুল মিসরী পথ চলছে সাধারণ রাস্তা ছেড়ে অন্য পথে। কারণ, লোকটা দলছুট সৈনিক। ঘুম চাপতে শুরু করে মুবীর। তাই পিছনে হেলান দিয়ে মাথাটা ফখরুল মিসরীর বুকে এলিয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে। চলতে থাকে উট। জেগে আছে ফখরুল মিসরী।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সবেমাত্র ফজর নামায সমাপ্ত করেছেন। জায়নামাজ ছেড়ে এখনো ওঠেননি। কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান সংবাদ জানায়, আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন। সুলতান দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। সুলতানকে সালাম দেন আলী বিন সুফিয়ান। কিন্তু সালামের জবাব দেয়ার আগেই সুলতানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে–ওদিকের খবর কী? 

এখনো ভালো। তবে সুদানী সৈন্যদের মধ্যে অস্থিরতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তাদের মধ্যে আমি যে গুপ্তচর রেখে এসেছিলাম, তার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তাদের কোন একজন কমাণ্ডারও যদি নেতৃত্ব হাতে তুলে নেয়, তাহলে বিদ্রোহ ঘটে যাবে। জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে তাঁবুর ভিতরে চলে যান সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বললেন–নাজি ও তার অনুগত সালারদের আমরা খতম করেছি ঠিক; কিন্তু তারা সুদানীদের মধ্যে মিসরী ফৌজের বিরুদ্ধে ঘৃণার যে বিষ ছড়িয়ে গেছে, তার ক্রিয়া এতটুকুও কমেনি। তাদের অস্থিরতার আরেক কারণ তাদের অধিনায়কদের গুম হওয়া। গুপ্তচরদের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আমি এ সংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছি যে, তাদের অধিনায়করা রোম উপসাগরের রণাঙ্গনে গেছে। কিন্তু আমীরে মোহতারাম! আমার ধারণা, সুদানীদের মধ্যে সংশয়-সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। তাদের বিশ্বাস, তাদের সালারদের বন্দী করে খুন করা হয়েছে।

আচ্ছা, বিদ্রোহের ঘটনা যদি ঘটেই যায়, তাহলে মিসরে আমাদের যে সৈন্য আছে, তারা কী তা দমন করতে পারবে? তারা অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করতে পারবে কি? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে…….! জিজ্ঞেস করেন সালাহুদ্দীন আইউবী ।

আমার মনে হয়, আমাদের এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য তাদের মোকাবেলা করতে পারবে না। তবে আয়োজন একটা আমি করে এসেছি। আমি মহামান্য নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট দ্রুতগামী দুজন দূত প্রেরণ করেছি। তার সমীপে পয়গাম পাঠিয়েছি, মিসরে বিদ্রোহের ডামাড়োল শুরু হতে চলেছে। আমরা এ যাবত যে বাহিনী প্রস্তুত করেছি, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া তাদের অর্ধেক-ই অবস্থান করছে রণাঙ্গনে। সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমন করার জন্য আপনি শীঘ্র বাহিনী প্রেরণ করুন। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

ওদিক থেকে সহযোগিতার আশা খুব কম। গত পরশু এক দূত সংবাদ নিয়ে, এসেছিলো, নূরুদ্দীন জঙ্গী রাজা ফ্রাংকের উপর আক্রমণ করেছেন। এ আক্রমণ তিনি আমাদের সহযোগিতার জন্য করেছেন। সে সময়ে ফ্রাংকের কর্মকর্তা ও অধিনায়কগণ ছিলো রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর নৌ-বহরে। ফ্রাংকের কিছুসংখ্যক সৈন্য মিসরে প্রবেশ করে হামলা করতে চেয়েছিলো এবং আমাদের সুদানী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মিসরের সীমান্তে এসে উপনীত হয়েছিলো। সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী সেই বাহিনীর উপর আক্রমণ করে তাদের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন এবং রাজা ফ্রাংকের বিস্তর এলাকায় নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ক্রুসেডারদের থেকে জরিমানা বাবদ কিছু অর্থও আদায় করেছেন। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

তাঁবুর ভিতরে পায়চারী করতে শুরু করেন সুলতান আইউবী। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন—সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী থেকে আমি ওখানকার এমন পরিস্থিতির কথা জানতে পেরেছি, যা আমাকে অস্থির করে রেখেছে।

খৃষ্টানরা কি ওখানে পাল্টা আক্রমণ করবে বলে মনে করেন? জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।

আমার খৃষ্টানদের আক্রমণের পরোয়া বিন্দুমাত্র নেই। অস্থিরতা আমার এই জন্য যে, কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব যাদের, তারা মদের মটকায় ডুবে আছে। ইসলামের দুর্গের প্রহরীরা বন্দী হয়ে আছে হেরেমে। নারীর চুল বেঁধে ফেলেছে তাদের পা। চাচা আসাদুদ্দীন শেরেকোহকে ইসলামের ইতিহাস কখনো ভুলতে পারবে না। হায়! এ সময়ে যদি তিনি জিন্দা থাকতেন! যুদ্ধের ময়দানে তিনি-ই আমাকে টেনে এনেছিলেন। আমি বড় কঠিন কঠিন মুহূর্ত দেখেছি। চাচা শেরেকোহর বাহিনীর অগ্রগামী ইউনিটের আমি কমাণ্ড করেছি। তার সঙ্গে খৃষ্টানদের অবরোধে আমি তিন মাস কাটিয়েছি। চাচা সব সময় । আমাকে সবক দিতেন, বেটা! কখনো ভীত হয়ো না, ভয়-ভীতি থেকে নিজেকে সদা মুক্ত রাখবে। মহান আল্লাহর সাহায্যের প্রতি আস্থা রাখবে। ইসলামের পতাকা উচ্চে ধরে রাখবে সব সময়। আমি শেরেকোহর কমাণ্ডে মিসরী এবং খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ইস্কান্দারিয়ায় অবরোধে কাটিয়েছি দীর্ঘদিন। আমার মাথার উপর পরাজয় এসে গিয়েছিলো। আমার মুষ্টিমেয় সৈন্যের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছিলো। কিন্তু তারপরও বিজয় আমার পদচুম্বন করেছে। কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিলো, কী করে আমি আমার সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা রেখেছিলাম, আল্লাহ-ই তা ভালো জানেন। চাচা শেরেকোহ আক্রমণ করে সেই অবরোধ ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। সেই কাহিনী তো তুমি ভালো করেই জান আলী! ঈমান-বিক্রেতারা কাফিরদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আমাদের বিরুদ্ধে কিরূপ ঝড় সৃষ্টি করেছিলো, তা-ও তোমার অজানা নয়। কিন্তু এমন কঠিন মুহূর্তেও আমি সাহস হারাইনি, ভয় পাইনি।

আমার সবকিছু মনে আছে সুলতান! এত যুদ্ধ-বিগ্রহ আর হত্যা-লুণ্ঠনের পর আশা করেছিলাম, এবার মিসরীরা সোজা পথে ফিরে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দার মরে তো আরেক গাদ্দার এসে তার স্থান দখল করে। আমি বিশেষভাবে যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করছি, তা হলো, মিসরে এ যাবত যে কজন গাদ্দার আত্মপ্রকাশ করেছে, তারা সবাই দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি। ফাতেমী খেলাফত যদি হেরেমে ঢুকে না পড়তো, সুন্দরী নারীর আঁচলে বাধা না পড়তো, তাহলে আপনি আজ খৃষ্টানদের সঙ্গে লড়াই করতেন ইউরোপে, তাদেরই ভূখণ্ডে। কিন্তু আমাদের গাদ্দার বন্ধুরা এই ক্রুশ বনাম চাঁদ-তারার লড়াইকে মিসরের সীমানা অতিক্রম করতে দিচ্ছে না। রাজা যখন ভোগ-বিলাসে ডুবে যান, তখন প্রজাদের মধ্যে কিছু লোক রাজত্বের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শক্তি ও সাহায্য লাভ করে তারা কাফিরদের থেকে। ঈমান বেচা-কেনায় এত অন্ধ হয়ে পড়ে যে, তারা কাফিরদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং আপন কন্যাদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিতে পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করে না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আমি সব সময় এদেরকে-ই ভয় পাই। আল্লাহ না করুন, ইসলামের নাম যদি কখনো ডুবে যায়, ডুববে মুসলমানদের-ই হাতে। আমাদের ইতিহাস গাদ্দারদের ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমার মন বলছে, একদিন মুসলমানরা নিজেদের ভিটেমাটি কাফিরদের হাতে তুলে দেবে। মুসলমান যদি কোথাও বেঁচে থাকে, সেখানে মসজিদ থাকবে কম, গান-বাজনা ও বেশ্যালয় থাকবে বেশী। আমাদের মুসলিম পুরুষরা বুকে ক্রুশ ঝুলিয়ে গর্ববোধ করবে আর মেয়েরা আধুনিকতা-স্বাধীনতার নামে বেহায়ার মত রাস্তায় চলাচল করবে। আমি মুসলিম মিল্লাতের পতনের ঘনঘটা শুনতে পাচ্ছি আলী! তবে হাল ছাড়া যাবে না। তুমি তোমার বিভাগকে আরো সুসংহত, শক্তিশালী করো। দুশমনের এলাকায় গিয়ে কমাণ্ডে আক্রমণ এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য শক্ত-সামর্থ ও বিচক্ষণ যুবকদের খুঁজে বের করো। খৃষ্টানরা দিন দিন শক্তিশালী ও সক্রিয় হচ্ছে। তোমাকে এক্ষুণি যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, সমুদ্র থেকে যেসব খৃষ্টান সেনা জীবনে রক্ষা পেয়েছে, তাদের অধিকাংশ আহত। যারা আহত নয়, তারাও দিনের পর দিন সমুদ্রে সাঁতার কাটার ফলে আহতদের অপেক্ষাও বেশী বিপর্যস্ত। তাদের সকলের চিকিৎসা চলছে। আমি তাদের সকলকে দেখেছি। তুমি তাদের এক নজর দেখে নাও এবং জরুরী তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করো। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

দারোয়ানকে ডেকে নাস্তা আনতে বললেন সুলতান আইউবী। তারপর আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি মুখ ফিরিয়ে বলতে শুরু করলেন–গতকাল কয়েকজন আহত পুরুষ ও কয়েকটি মেয়েকে আমার সামনে হাজির করা হয়েছিলো। ছয়জন সমুদ্র থেকে উদ্ধার পাওয়া কয়েদী। তাদের একজনের প্রতি আমাদের সন্দেহ হয়, লোকটা সাধারণ সেপাই নয়। পদস্থ কোন অফিসার বোধ হয়। তুমি সর্বাগ্রে তার সাথে কথা বলো। আর পাঁচজন ব্যবসায়ী সাতটি খৃষ্টান মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো।

ব্যবসায়ীরা সুলতান আইউবীকে যা বলেছিলো, তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে তা শোনান। তিনি বললেন, আমি মেয়েগুলোকে মূলত বন্দী করেছি, যদিও তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছি। এই যে মেয়েগুলো বললো, তারা গরীব পরিবারের সন্তান, জ্বলন্ত জাহাজ থেকে নামিয়ে একটি নৌকায় বসিয়ে তাদের ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং নৌকা তাদেরকে কূলে এনে ফেলেছে, এসব বক্তব্য আমাকে সন্দেহে ফেলে দিয়েছে। আমি তাদেরকে একটি পৃথক তাঁবুতে রেখেছি এবং প্রহরার জন্য একজন সান্ত্রী দাঁড় করিয়ে রেখেছি। নাস্তাটা খেয়ে-ই তুমি ঐ কয়েদি আর মেয়েগুলোর কাছে চলে যাও।

অবশেষে সুলতান আইউবী মুখে মুচকি হাসি টেনে বললেন–গতকাল দিনের বেলা আমি উপকূলে টহল দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার প্রতি কোন দিক থেকে যেন একটা তীর ছুটে আসে। তীরটি আমার দু পায়ের মাঝে বালিতে এসে বিদ্ধ হয়।

সালাহুদ্দীন আইউবী তীরটি আলী বিন সুফিয়ানকে দেখিয়ে বললেন, এলাকাটা ছিলো পর্বতময়। রক্ষীরা চারদিকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন তীরান্দাজের দেখা পায়নি। পাওয়া গেছে এই পাঁচজন ব্যবসায়ী। রক্ষীরা তাদেরকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে। এই সাতটি মেয়েকে তারা আমার হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছে।

কী বললেন, তারা চলে গেছে! আপনি তাদের যেতে দিলেন! বিস্মিত কণ্ঠে বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

রক্ষীরা তাদের তল্লাশী নিয়েছিলো, তাদের কাছে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। বললেন সুলতান আইউবী।

তীরটি হাতে নিয়ে নিরীক্ষা করে দেখেন আলী বিন সুফিয়ান। বললেন, সুলতান আর গুপ্তচরের দৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য। সর্বাগ্রে আমি ঐ ব্যবসায়ীদের ধরার চেষ্টা করবো।

আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীর তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসলে দারোয়ান বললো, এই কমাণ্ডার সংবাদ নিয়ে এসেছেন, কাল যে সাতটি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছিলো, তাদের একজনের খোঁজ নেই। সুলতানকে সংবাদটা জানানোর প্রয়োজন আছে কি?

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। সংবাদদাতা কমাণ্ডার আলীর নিকটে এসে বললো–একটি খৃষ্টান মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হলো, ফখরুল মিসরী নামক কমাণ্ডার রাত থেকে উধাও। রাতের সান্ত্রীরা জানিয়েছে, ফখরুল মিসরী মেয়েদের তাঁবুর নিকট গিয়েছিলো। সেখান থেকে গেছে জখমীদের তাঁবুর দিকে। তারপর আর তাকে দেখা যায়নি। রাতে সে টহল দিতে বেরিয়েছিলো।

খানিকটা চিন্তা করে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, এ সংবাদ সুলতানকে এখনই দিও না। ফখরুল মিসরী রাতের যে সময়ে ডিউটিতে গিয়েছিলো, তখনকার সব সান্ত্রীকে সমবেত করো। আলী সুলতান আইউবীর রক্ষী বাহিনীর কমাণ্ডারকে বললেন, গতকাল যে রক্ষী ইউনিটটি সুলতানের সঙ্গে উপকূল পর্যন্ত গিয়েছিলো, তাদেরও আসতে বললো।

রক্ষীরা সেখানেই উপস্থিত ছিলো। সামনে এগিয়ে আসে চারজন। আলী বিন সুফিয়ান বললেন–কাল যেখানে তোমরা ব্যবসায়ী ও মেয়েদের দেখেছিলে, এক্ষুণি সেখানে চলে যাও। ব্যবসায়ীরা যদি এখনো সেখানে থাকে, তাহলে তাদের আটক করে ফেলল। আর যদি না পাও, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসো।

রক্ষীরা রওনা হয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান মেয়েদের তাঁবুর নিকট চলে যান। ছয়টি মেয়ে তাঁবুর বাইরে বসে আছে। সান্ত্রী দাঁড়িয়ে। মেয়েদের এক সারিতে দাঁড় করান আলী বিন সুফিয়ান। আরবীতে জিজ্ঞেস করেন–সপ্তম মেয়েটি কোথায়?

মেয়েরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মাথা নাড়ে। আলী বিন সুফিয়ান বললেন–তোমরা কি আমার ভাষা বুঝছো?

মেয়েরা বিস্ময়ের সাথে আলীর প্রতি তাকিয়ে থাকে। আলী তাদের চেহারা ও হাবভাব দেখে সন্দেহে পড়ে যান। তিনি মেয়েগুলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। আরবীতে বলেন, পরনের পোশাক খুলে এদের উলঙ্গ করে ফেলো, চারজন হায়েনা চরিত্রের সেপাই ডেকে আনন।

চমকে উঠে মেয়েরা মোড় ঘুরে পিছন দিকে তাকায়। সমস্বরে কথা বলতে শুরু করে দু তিনজন। নিজেদের অলক্ষ্যে আরবীতেই বলছে তারা আমাদের সঙ্গে তোমরা এরূপ আচরণ করতে পারো না। একজন বললো–আমরা তো আর তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ছি না।

মুখ থেকে হাসি বেরিয়ে আসে আলী বিন সুফিয়ানের। বললেন–আমি তোমাদের সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করবো। এক ধমকে-ই আরবী বুঝাতে ও বলতে শুরু করেছে। বড় ভালো মেয়ে তোমরা। এবার ধমক ছাড়াই বলে দাও, সপ্তম মেয়েটি কোথায়।

সকলেই অজ্ঞতা প্রকাশ করে। আলী বললেন–এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব আমি তোমাদের থেকে নিয়েই ছাড়বো। সুলতানকে বলেছিলে, তোমরা আরবী জানো না। আর এখন কিনা আমাদের মতোই আরবী বলছে। আমি কি তোমাদের এমনিতেই ছেড়ে দেবো? আলী বিন সুফিয়ান সান্ত্রীকে বললেন–এদেরকে তাঁবুর ভেতরে বসিয়ে রাখে।

রাতের প্রহরী এসে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান ফখরুল মিসরীর ডিউটির সময়কার প্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মেয়েদের তাঁবুর প্রহরী জানায়, ফখরুল রাতে তাকে, এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে জখমীদের তাঁবু দিকে গিয়েছিলো। খানিক পর আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই–কে তুমি? নীচে নেমে আসো। আমি সেদিকে দৃষ্টিপাত করে অন্ধকারে কিছুই দেখলাম না। সম্মুখে মাটির টিলার উপর ছায়ার মতো কী যেন দেখলাম। পরক্ষণেই ছায়াটি অদৃশ্য হয়ে গেলো।

তৎক্ষণাৎ আলী বিন সুফিয়ান ছুটে গেলেন সেখানে। টিলাটি উপকূলের সন্নিকটে। বালুকাময় মাটি। একস্থানে দু মাপের দুটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেলো। একটি সামরিক বুট পরিহিত পুরুষের। অপরটি ছোট জুতার ছাপ মেয়েলি বলে মনে হলো। মেয়েলি চিহ্নটি যেদিক থেকে এসেছে, আলী বিন সুফিয়ান ছুটে যান সেদিকে। এই চিহ্নটি তাকে নিয়ে যায় সেই তাঁবুর কাছে, যেখানে মুবী মিলিত হয়েছিলো রবিনের সঙ্গে। আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুর পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকে যান।

এক এক করে জখমী কয়েদীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন আলী বিন সুফিয়ান। সকলের চেহারা পরিমাপ করেন তিনি। রবিন বসে আছে। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখামাত্র কোকাতে শুরু করে সে। হঠাৎ ব্যথা উঠেছে তার। আলী বিন সুফিয়ান কাঁধে ধরে দাঁড় করিয়ে তাঁবুর বাইরে নিয়ে যান তাকে। জিজ্ঞেস করেন–রাতে তোমার তাঁবুতে একটি কয়েদী মেয়ে এসেছিলো। কেন এসেছিলো? রবিন কোন জবাব না দিয়ে আলীর প্রতি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন সে কিছুই বুঝছে না। আলী বিন সুফিয়ান ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন–তুমি কি আমার ভাষা বুঝ দোস্ত! আমি কিন্তু তোমার ভাষা বুঝি এবং বলতেও পারি। তোমাকেও আমার ভাষায়-ই জবাব দিতে হবে। কিন্তু রবিন অপলক চোখে তাকিয়ে-ই আছে, আলীর প্রতি। আলী বিন সুফিয়ান সান্ত্রীকে বললেন–একে তাঁবুর বাইরে রাখো।

আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুতে প্রবেশ করেন। অন্যান্য কয়েদীদের তাদের ভাষায় জিজ্ঞেস করেন–রাতে মেয়েটি এ তাঁবুতে কতক্ষণ ছিলো? সত্য কথা বলো, অযথা নিজেদের কষ্টে ফেলো না।

কথা বলছে না কেউ । ধমকি দেন আলী বিন সুফিয়ান। এবার এক জখমী বললো, একটি মেয়ে রাতে তাঁবুতে এসেছিলো এবং রবিনের শয্যায় বসে বা শুয়ে ছিলো।

এ লোকটি জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলো। আগুন এবং পানি দুয়ের-ই লীলা দেখে এসেছে লোকটি। যত ভীত ততটা আহত নয়। তবে তৃতীয় আর কোন বিপদে পড়তে প্রস্তুত নয় সে। সে জানায়, রবিন ও আগত মেয়েটির মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা তার জানা নেই। মেয়েটি কে, তা-ও সে বলতে পারে না। রবিনের পদ কি, তাও তার অজানা। সে জানায়, ক্যাম্পে আসার পূর্ব পর্যন্ত লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলো। এখানে আসার পর-ই সে এভাবে কোঁকাতে শুরু করেছে।

এক প্রহরীর দিক-নির্দেশনায় আলী বিন সুফিয়ান সেই পাঁচ ব্যক্তিকে দেখার জন্য চলে যান, যারা বণিক বেশে কিছু দূরে তাঁবু ফেলে অবস্থান করছে। আলীর রক্ষীরা আলাদাভাবে এক স্থানে বসিয়ে রেখেছে তাদের। রক্ষীরা আলী বিন সুফিয়ানকে তথ্য প্রদান করে, কাল এদের নিকট দুটি উট ছিলো; আজ আছে একটি। বিচক্ষণ গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য এতটুকু ইঙ্গিতই যথেষ্ট। অপর উটটি কোথায় গেলো, বণিকদের কাছে তার সন্তোষজনক কোন জবাব পাওয়া গেলো না। অনুসন্ধানে নেমে পড়েন আলী বিন সুফিয়ান। উধাও হওয়া উটের পদচিহ্ন পেয়ে গেলেন তিনি। বণিকদের বললেন–তোমরা সাধারণ কোন অপরাধে অপরাধী নও। অন্যায় তোমাদের গুরুতর। তোমরা গোটা একটি সাম্রাজ্য এবং তার সকল নাগরিকের জন্য বিপজ্জনক। তাই তোমাদের প্রতি আমি এতটুকু সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারি না। বলো তো, তোমরা কি ব্যবসায়ী?

হ্যাঁ, আমরা ব্যবসায়ী জনাব! আমরা নিরপরাধ। মাথা লেড়ে জবাব দেয় সকলে।

আলী বিন সুফিয়ান বললেন–তোমাদের সকলের হাতের উল্টা দিকটা একটু দেখাও দেখি। সকলে নিজ নিজ হাত উল্টো করে আলী বিন সুফিয়ানের সামনে এগিয়ে ধরে। আলী সকলের বাঁ হাতের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙ্গুলের মাঝখানটা দেখেন এবং একজনের বাহু ধরে সামনে নিয়ে আসেন। বললেন–ধনুক-তূনীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল!

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে লোকটি। আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীর এক রক্ষীকে নিজের কাছে ডেকে এনে তার বা হাতের উল্টো দিকটা লোকটাকে দেখান। আঙ্গুলের গোড়ায় উল্টো পিঠে একটি, দাগ আছে। তেমনি একটি দাগ বণিক লোকটির আঙ্গুলের পিঠেও বিদ্যমান। আলী বিন সুফিয়ান তাকে রক্ষী সম্পর্কে বলেন এ লোকটি সুলতান আইউবীর সেরা তীরান্দাজ। তার তীরন্দাজ হওয়ার প্রমাণ এই চিহ্ন।

বণিক লোকটির আঙ্গুলের উল্টো পিঠে অস্পষ্ট ধরনের একটি চিহ্ন, যেন এ স্থানে বারবার কোন একটি বস্তুর ঘর্ষণ লেগেছে। এটি তীর ঘর্ষণের দাগ। তীর ধরা হয় ডান হাতে। ধনুক থাকে বাঁ হাতে। তীরের অগ্রভাগ থাকে আঙ্গুলের উপর। আর তীর ধনুক থেকে বের হওয়ার সময় আঙ্গুলে ঘর্ষণ লাগে । এমনি দাগ থাকে প্রত্যেক তীরন্দাজের হাতে আলী বিন সুফিয়ান লোকটিকে বললেন, এই পাঁচজনের মধ্যে তুই-ই শুধু তীরান্দাজ। বল, ধনুক-তূনীর কোথায় রেখেছিস্?

পাঁচজন-ই নীরব। আলী বিন সুফিয়ান পাঁচজনের একজনকে ধরে রক্ষীদের বললেন–একে ঐ গাছটার সাথে বেঁধে রাখো।

লোকটিকে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রাখা হলো। আলী বিন সুফিয়ান তার তীরান্দাজের কানে কানে কী যেন বললেন। তীরন্দাজ কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তীর সংযোজন করে এবং গাছের সঙ্গে বাঁধা লোকটিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে। তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় লোকটির ডান চোখে। ছটফট করতে শুরু করে লোকটি। আলী বিন সুফিয়ান অপর চারজনকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমাদের মধ্যে আর যে ক্রুশের সন্তুষ্টি অর্জনে এভাবে ছটফট করে করে জীবন দিতে প্রস্তুত আছে, ওর দিকে তাকাও। লোকটির প্রতি চোখ তুলে তাকায় তারা। লোকটি ছটফট করছে আর চীৎকার করছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে তার তীরবিদ্ধ চোখ থেকে।

আমি ওয়াদা দিচ্ছি, তোমাদেরকে সসম্মানে সমুদ্রের ওপারে পৌঁছিয়ে দেবো। বলো, অপর উটটিতে করে কে গেছে, কোথায় গেছে? বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

তোমাদের একজন কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।  জবাব দেয় একজন।

আর একটি মেয়েও। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আলী বিন সুফিয়ানের কৌশল লোকগুলো থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয় যে, তারা কারা। কিন্তু তারা একটি মিথ্যা কথা বলে যে, মেয়েটি রাতে তাঁবু থেকে পালিয়ে এসে বলেছিলো, সুলতান আইউবী রাতে তাকে তার তাঁবুতে রেখেছিলেন এবং তিনি নিজেও মদপান করেন, মেয়েটিকেও পান করান। মেয়েটি পালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্থ অবস্থায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। তাকে ধাওয়া করার জন্য ফখরুল মিসরী নামক এক কমাণ্ডার আসে এবং মেয়েটির বক্তব্য শুনে উটের পিঠে বসিয়ে তাকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। মেয়েটি সুলতান আইউবীর নামে যে অপবাদ আরোপ করেছিলো, আলী বিন সুফিয়ানকে তার সব শোনায়।

আলী বিন সুফিয়ান মুচকি হেসে বললেন–তোমরা পাঁচজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও তীরন্দাজ। আর একটি মানুষ কিনা তোমাদের একটি মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো এবং একটি উটও। নিতান্ত নির্বোধ না হলে একথা বিশ্বাস করবে কেউ?

লোকগুলোর নির্দেশনা মোতাবেক আলী বিন সুফিয়ান মাটিতে পুঁতে রাখা ধনুক ও তূনীর উদ্ধার করেন। তাঁবুতে পাঠিয়ে দেন চারজনকে। ছটফট করতে করতে মরে গেছে পঞ্চমজন।

উটের পদচিহ্ন চোখে পড়ছে স্পষ্ট। দশজন আরোহী ডেকে পাঠান আলী বিন সুফিয়ান। মুহূর্ত মধ্যে এসে পৌঁছে দশ আরোহী। সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে উটের পায়ের দাগ অনুসরণ করে রওনা হন তিনি।

কিন্তু উটের রওনা হওয়া আর আলী বিন সুফিয়ানের এই পশ্চাদ্ধাবনের মাঝে চৌদ্দ-পনের ঘন্টার ব্যবধান। তদুপরি উটটি অতি দ্রুতগামীও বটে। দানা-পানি ছাড়া উট সবল ও তরতাজা থাকতে পারে অন্তত ছয়-সাত দিন। তাই পথে বিশ্রামেরও প্রয়োজন নেই। তার বিপরীতে পথে ঘোড়াগুলোর দানা-পানি ও বিশ্রামের প্রয়োজন পড়বে একাধিকবার। ফলে চৌদ্দ-পনের ঘন্টার ব্যবধান কাটিয়ে ফখরুল মিসরীকে ধরা সম্ভব হলো না আলীর। ধাওয়া খাওয়ার আশঙ্কায় পথে তেমন থামেনি ফখরুল।

পথে একটি বস্তু চোখে পড়ে আলী বিন সুফিয়ানের। একটি থলে। ঘোড়া থামিয়ে নেমে থলেটি তুলে নেন তিনি। খুলে দেখেন। খাদ্যদ্রব্য পাওয়া গেলো তাতে। থলেটির মধ্যে ছোট্ট আরেকটি পুটুলি। তার মধ্যেও কিছু আহার্য বস্তু। খাবারগুলো নাকের কাছে ধরে-ই আলী বিন সুফিয়ান বুঝে পেলেন, এতে হাশীশ মেশানো। পথে দু জায়গায় তিনি এমন কিছু আলামত পান, যাতে বুঝা গেলো, এখানে উট থেমেছিলো এবং আরোহী উপবেশন করেছিলো। খেজুরের বীচি, ফলের দানা ও ছিলকা ছড়িয়ে আছে এদিক-সেদিক। থলেটি সন্দেহে ফেলে দেয় আলী বিন সুফিয়ানকে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, হাশীশের নেশায় ফেলে মেয়েটি ফখরুল মিসরীকে তার রক্ষী বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তথাপি তিনি থলেটি নিজের কাছে রেখে দেন। কিন্তু থলের অনুসন্ধান ও অবস্থান বেশ সময় নষ্ট করে দিয়েছে তাঁর।

***

ফখরুল মিসরী ও মুবী গন্তব্যে পৌঁছুতে না পারলেও এবং পথে ধরা পড়ে গেলেও তেমন কোন অসুবিধা ছিলো না। কারণ, ইতিমধ্যে নাজি, ঈদরৌস ও তার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মী সুলতান আইউবীর বিষের ক্রিয়ায় দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। নাজি ফাতেমী খেলাফতের একজন সেনাপতি হলেও প্রকৃতপক্ষে সে-ই মূল রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বসেছিলো। সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে একজন ব্যর্থ ও অথর্ব গভর্নর প্রমাণিত করার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছিলো। মুসলিম শাসকবর্গ নিজ নিজ হেরেমে বন্দী হয়ে পড়েছে সেই রূপসী মেয়েদের হাতে, যাদের কেউ খৃষ্টান, কেউ ইহুদী। নাম তাদের ইসলামী। এদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে ভোগ-বিলাসিতা আর যৌনসম্ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মুসলিম শাসকগণ। ইসলামে নিবেদিত ও দেশপ্রেমিক সুলতান আইউবী এখন তাদের চোখের কাঁটা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী যদি না থাকতেন, তাহলে ইতিহাসে সালাহুদ্দীন আইউবী নামক কোন ব্যক্তির নাম-চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যেতো না। পৃথিবীর মানচিত্রে থাকতো না এতগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব।

সামান্য ইঙ্গিত পেলে-ই নুরুদ্দীন জঙ্গী সৈন্য প্রেরণ করতেন সুলতান আইউবীর সাহায্যে। সুদানী সৈন্যদের আহ্বানে খৃষ্টানরা যখন মিসর আক্রমণের জন্য রোম উপসাগরে ছড়িয়ে পড়লো, তখন সংবাদ পাওয়ামাত্র নুরুদ্দীন জঙ্গী এমন এক খৃষ্টান দেশের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে বসেন, যারা মিসর আক্রমণের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো। নুরুদ্দীন জঙ্গী নিজের সমস্যা অপেক্ষা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সমস্যাকে অধিক প্রাধান্য দিতেন।

কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মুসলিম সেনানায়ক ও অসামরিক ব্যক্তি অনুভব করলো, মিসরে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে অস্থিরতা ও বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে। সেই বিদ্রোহের আগুনে হাওয়া দিতে শুরু করলো তারা। তারা নেপথ্যে থেকে সুদানী সৈন্যদের উত্তেজিত করতে শুরু করলো। তারা গুপ্তচর মারফত জানতে পারলো, সুদানী সৈনদের সালারদের গোপনে হত্যা করে গুম করে ফেলা হয়েছে। সুদানী বাহিনীর নিম্নপদস্থ কমাণ্ডাররা সালারের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর মিসরে অবস্থানরত স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের উপর হামলা করার পরিকল্পনা আঁটছেন। সুলতান আইউবীর আধা ফৌজ এবং রাজধানীতে সুলতানের অনুপস্থিতি থেকে ফায়েদা হাসিল করতে চাচ্ছে তারা। সেই পরিকল্পনার আওতায় কালো মেঘের ন্যায় ইসলামের চন্দ্রকে ঢেকে ফেলতে চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ।

কায়রো পৌঁছে গেছেন আলী বিন সুফিয়ান। যাকে ধাওয়া করতে গেলেন, তার কোন সন্ধান পেলেন না। সুদানী হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত গোয়েন্দাদের . তলব করলেন। তাদের একজন জানালো, গতরাতে একটি উট এসেছিলো। তার আরোহী ছিলো দুজন। একজন পুরুষ একজন নারী। এখন তারা কোন্ ভবনে অবস্থান করছে, তাও অবহিত করে গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ান ইচ্ছে করলে এক্ষুণি হানা দিয়ে তাদেরকে ধরে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন, বিষয়টি জ্বলন্ত আগুনে ঘৃতাহুতি হতে পারে। সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। শুধু মুবী আর ফখরুল মিসরীকে গ্রেফতার করা-ই আলী বিন সুফিয়ানের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তার প্রধান লক্ষ্য, সুদানী বাহিনীর প্রত্যয় ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগতি লভি করা, যাতে এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা সহজ হয়।

গোয়েন্দাদের প্রতি নতুন নির্দেশনা জারী করেন আলী বিন সুফিয়ান। বেশ কিছু মেয়েও আছে তার গোয়েন্দাদের মধ্যে। তারা খৃষ্টান বা ইহুদী নয় মুসলিম। বিভিন্ন পতিতালয় থেকে তুলে আনা হয়েছে তাদের। কিন্তু তাদের প্রতি আলী বিন সুফিয়ানের আস্থা আছে ষোলআনা। তাদেরকে বলে দিলেন মুবীকে খুঁজে বের করতে।

চারদিন হলো, আলী বিন সুফিয়ান রাজধানীর বাইরে ঘুরে ফিরছেন। সুদানী ফৌজী নেতৃত্বের চারপার্শ্বে ঘুরপাক খাচ্ছে তার কর্মতৎপরতা।

আজ পঞ্চম রাত। বাইরে খোলা আকাশের নীচে বসে দুজন গোয়েন্দার নিকট থেকে রিপোর্ট নিচ্ছেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ান কখন কোথায় থাকেন, তা জানা থাকে তার লোকদের। দলের এক ব্যক্তি আরেকজনকে সঙ্গে করে তার নিকট আসে এবং বলে–এ লোকটাকে জঙ্গল থেকে ধরে এনেছি। ঢুলুঢুলু শরীরে লোকটা একবার পড়ছে আবার উঠে দু কদম সম্মুখে এগিয়ে পুনরায় পড়ে যাচ্ছে দেখতে পেলাম। পরিচয় জানতে চাইলে বললো, আমাকে আমার বাহিনী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। নাম নাকি ফখরুল মিসরী। লোকটি ভাল করে কথা বলতে পারছে না। এমনি সময়ে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে সে।

তুমি-ই কি সেই কমাণ্ডার, যে একটি মেয়ের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে এসেছে? জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।

আমি সুলতান আইউবীর পলাতক সৈনিক। মৃত্যুদণ্ডের অপরাধে অপরাধী। তবে আগে আমার পুরো ঘটনা শুনুন, অন্যথায় আপনাদের সকলের মৃত্যুদণ্ড বরণ করতে হবে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো লোকটি।

কথা বলার ভাব-ভঙ্গিতে আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেললেন, লোকটি নেশাগ্রস্থ। তাই তাকে নিজের দফতরে নিয়ে যান এবং রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা থলেটি তাকে দেখান। জিজ্ঞেস করেন। এই থলেটি কি তোমার? এর খাদ্য-দ্রব্য খেয়ে-ই কি তোমার এই দশা?

হ্যাঁ, ও আমাকে এর থেকে-ই খাওয়াতো। জবাব দেয় ফখরুল মিসরী।

থলের ভিতরে পাওয়া পুটুলিটি আলীর সামনে রাখা। ফখরুল মিসরী ঝট করে পুটুলিটি হাতে নিয়ে খুলে-ই মিষ্টির মত একটি টুকরা তুলে নেয়। আলী বিন সুফিয়ান খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলেন। ফখরুল মিসরী অস্থিরচিত্তে বলে, আল্লাহর ওয়াস্তে আমায় এটি খেতে দাও। এরই মধ্যে আমার জীবন। অন্যথায় আমি বাঁচবো না।

আলী বিন সুফিয়ান ফখরুল মিসরীর হাত থেকে টুকরাটি ছিনিয়ে নেন এবং বলেন–তোমার পূর্ণ কাহিনী শোনাও, তারপর না হয় এসব খেয়ে জীবন বাঁচাবে।

আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের পূর্ণ কাহিনী শোনায় ফখরুল মিসরী। ক্যাম্প থেকে মেয়েটিকে ধাওয়া করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ঘটনা পর্যন্ত সবিস্তার বিবরণ দেয় আলী বিন সুফিয়ানের কাছে। সে জানায়, বণিকরা আমাকে কফি পান করায়, যার ক্রিয়ায় আমি ভিন্ন এক জগতে গিয়ে উপনীত হই। বণিকরা তাকে যা যা বলেছে, তাও শোনায় সে আলী বিন সুফিয়ানকে। মেয়েটির ফাঁদে আটকা পড়া সম্পর্কে ফখরুল জানায়, বণিকদের দেয়া কফি পান করে আমি নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। মেয়েটির বিবৃত কাহিনী শুনে আমার মনে সুলতান, আইউবীর প্রতি অশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। আমি তাদের ফাঁদে আটকা পড়ি। উটের পিঠে বসিয়ে মূবী আমাকে কোথায় যেন নিয়ে রওনা হয়। তার প্রেমে পড়ে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

আমরা একটানা চলতে থাকি। মাঝে-মধ্যে সামান্য বিরতি দিয়ে মেয়েটি ছোট্ট পুটুলি থেকে আমাকে কি যেন খাওয়ায়। আমি নিজেকে রাজা ভাবতে শুরু করি। মেয়েটি আমাকে ভালবাসার নিশ্চয়তা দিয়েছিলো, ওয়াদা দিয়েছিলো আমাকে বিয়ে করবে। শর্ত দিয়েছিলো, আমি তাকে সুদানী কমান্ডারদের নিকট পৌঁছিয়ে দেবো।

আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। বিয়ে ছাড়াই মেয়েটিকে স্ত্রীর মত ব্যবহার করার চেষ্টা করি। মেয়েটি তার বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিয়ে প্রেম দিয়ে আমাকে পাগল করে তোলে।

তৃতীয়বার পানাহারের জন্য অবতরণ করে দেখি, থলে নেই। খাদ্যভর্তি থলেটি পথে কোথায় পড়ে গেছে যেন। পিছনে ফিরে গিয়ে থলেটি খুঁজে আনার জন্য বলে মুৰী। আমি বললাম, আমি পলাতক সৈনিক। আশঙ্কা আছে, দলের লোকেরা আমাকে ধাওয়া করবে। কিন্তু জিদ ধরে বসে মেয়েটি। বলে, না, যে করে-ই হোক থলেটি খুঁজে আনতে-ই হবে। আমি তাকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, আমাদের ক্ষুধায় মরে যাওয়ার ভয় নেই। একান্ত প্রয়োজন হলে পথে কোন বাড়িতে গিয়ে কিছু চেয়ে খাবো। কিন্তু লোকালয়ের কাছে ঘেঁষতে রাজি নয় মেয়েটি। আমি তাকে জোরপূর্বক উটের পিঠে বসিয়ে নিই এবং তার পিছনে বসে উট হকাই।

সেদিন ছিলো সফরের তৃতীয় দিন। সন্ধ্যার সময় মেয়েটি শহরের বাইরে সুদানীদের এক কমাণ্ডারের নিকট গিয়ে উপস্থিত হয়। আমি আমার মাথায় এমন অস্থিরতা অনুভব করলাম, যেন মাথায় কতগুলো পোকা কিলবিল করছে। ধীরে ধীরে আমি বাস্তব জগতে ফিরে আসি।

ফখরুল মিসরী বুঝতে পারেনি, তার এ অস্থিরতা হাশীশ না পাওয়ার ক্রিয়া। তার কাল্পনিক রাজত্ব আর স্বপ্নের জান্নাত থলের মধ্যে কোথায় মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। মেয়েটি তার সামনে কমাণ্ডারকে খৃষ্টানদের পয়গাম শোনায় এবং বিদ্রোহের জন্য উত্তেজিত করে। ফখরুল মিসরী পাশে বসে সব শুনতে থাকে। তার মাথার পোকাগুলো বড় হয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করে। নেশার ঘোের কেটে গেছে অনেকটা। আস্তে আস্তে তার মনে পড়তে শুরু করে, সে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু মুবীর ধারণা, ফখরুল মিসরী এখনো নেশাগ্রস্থ। তাই সে নির্দ্বিধায় ফখরুল মিসরীর সামনেই কমাণ্ডারদের বলে, সুলতান আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের মধ্যে এমন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে, যেন উভয়ই উভয়কে নারীলোলুপ ও মদ্যপ ভাবতে শুরু করে।

তাদের এই দীর্ঘ আলাপচারিতায় বিদ্রোহ নিয়েও কথা হয়। এতক্ষণে ফখরুল মিসরী সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠেছে। কিন্তু মাথার অস্থিরতা দারুণ পেরেশান করে রেখেছে তাকে। মেয়েটি কমাণ্ডারকে বলে, বিদ্রোহ যদি করতে হয়, তাহলে সময় নষ্ট করা যাবে না। সুলতান আইউবী এখন রণাঙ্গনে আছেন এবং মহা ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

মেয়েটি তাদেরকে একটি মিথ্যে কথা বলে যে, তিন-চারদিন পর খৃষ্টানরা দ্বিতীয়বারের মত আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এখানকার এই গুটিকতক সৈন্যকেও রণাঙ্গনে তলব করতে বাধ্য হবেন আইউবী। কমাণ্ডারও মুবীকে জানায়, ছয়-সাতদিনের মধ্যে সুদানী বাহিনী এখানকার সৈন্যদের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে।

এইসব কথোপকথন শুনতে থাকে ফখরুল মিসরী। মধ্য রাতের পর পৃথক একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে। তার শোয়ার ব্যবস্থা আছে সেখানে। মুবী ও কমাণ্ডারগণ অবস্থান করে অন্য কক্ষে। দুই কক্ষের মধ্যখানে একটি দরজা। বন্ধ করে দেয়া হয় দরজাটি। কৌতূহলী হয়ে উঠে ফখরুল মিসরী। কান খাড়া করে বসে দরজা ঘেঁষে। অপর কক্ষ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পায় সে। তারপর মেয়েটির কথা বলার আওয়াজ–লোকটাকে হাশীশের জোরে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। প্রেম নিবেদন করে রূপের মোহজালে তাকে আবদ্ধ করে রেখেছি। আমার একজন রক্ষীর প্রয়োজন ছিলো। হাশীশের থলেটি পথে কোথায় যেন পড়ে গেছে। ভোরে উঠে যদি খাবার না পায়, বেটা বড় পেরেশান করবে। তারপর থেকে ফখরুল মিসরীর কানে যেসব শব্দ ভেসে আসে, তাতে

পরিষ্কার বুঝা গেলো, তারা মদপান করছে, চলছে বেহায়াপনা। দীর্ঘ সময় পর কমাণ্ডারের কণ্ঠ শুনতে পায় ফখরুল মিসরী–এ লোকটি এখন আমাদের জন্য সম্পূর্ণ বেকার। হয় তাকে বন্দীশালায় ফেলে রাখো, নতুবা শেষ করে দাও।

প্রস্তাবে সায় দেয় মুবী।

পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে ফখরুল মিসরী। রাতের তখন প্রথম প্রহর। ফখরুল মিসরী কক্ষ থেকে বের হয়। পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। ভোর নাগাদ নিরাপদ দূরত্বে চলে যায় সে। মনে তার দ্বিমুখী সংশয়। পশ্চাদ্ধাবনের ভয়। উভয় দিকে-ই মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে সে। নিজের বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও অপরাধী, সুদানীদের হাতে ধরা পড়লে তো মৃত্যু নিশ্চিত।

 দিনভর একস্থানে লুকিয়ে থাকে ফখরুল মিসরী। নেশার টান, ভয় আর ক্ষোভ লোকটার দেহ ও দেমাগকে বেকার করে তুলছে। রাত নাগাদ চলনশক্তিও লোপ পেতে শুরু করে তার। অবশেষে তার এই অনুভূতিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায় যে, এখন দিন না রাত।নিজে এখন কোথায় আছে, তাও বলতে পারছে না সে। একবার ইচ্ছে হয়, ঐ খৃষ্টান মেয়েটাকে গিয়ে খুন করে আসে। আবার ভাবে, একটা উট বা ঘোড়া পেলে রণাঙ্গনে গিয়ে সুলতান আইউবীর পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবে। কিন্তু যা-ই সে ভাবছে, মুহূর্ত মধ্যে অন্ধকার এসে ঝাপসা করে দিচ্ছে তার সামনের সবকিছু।

এমনি অবস্থায় এই লোকটিকে পেয়ে যায় সে। লোকটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। তাই প্রশিক্ষণ অনুযায়ী ফখরুল মিসরীর সঙ্গে, সে বন্ধুত্ব ও সমবেদনামূলক কথা বলে এবং তুলে আলী বিন সুফিয়ানের নিকট নিয়ে আসে।

সুদানী বাহিনী যে আক্রমণ ও বিদ্রোহ করবে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জানা গেলো, এ বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারে যে কোন মুহূর্তে। আলী বিন সুফিয়ান একবার ভাবলেন, তিনি সুদানী কমাণ্ডারদের বিদ্রোহের ব্যাপারে সতর্ক করবেন এবং সুলতান আইউবীকে সংবাদ দেবেন। কিন্তু হাতে তার সময় নেই। ইত্যবসরে আলী বিন সুফিয়ান সংবাদ পান, সুলতান তাঁকে ডাকছেন। আলী বিন সুফিয়ান শশব্যস্তে উঠে রওনা দেন। মনে তার আশঙ্কা, সুলতানকে ময়দানে রেখে এসেছি; এখন তিনি এখানে, কোন অঘটন ঘটেনি তো!

সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন–আমি সংবাদ পেয়েছি, উপকূলে খৃষ্টানদের একটি গ্যাং অবস্থান করছে। তাদের কেউ কেউ এদিকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ময়দানে এখন আর আমার কাজ নেই। নায়েবদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। এদিকে কোন সমস্যা হলো কিনা ভেবে মনটা আমার বেজায় ছটফট করছিলো। তাই চলে আসলাম। এদিকের খবর কী? .

আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীকে সব খবর শোনান এবং বলেন, আপনি যদি অনুমতি দেন, তা হলে আমি মুখের অস্ত্র ব্যবহার করে বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টা করি কিংবা সুলতান জঙ্গীর সাহায্য আসা পর্যন্ত বিদ্রোহ মুলতবী রাখার ব্যবস্থা করি। এ কাজে আমি আমার গোয়েন্দাদের-ই কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সৈন্য কম। আক্রমণ হয়ে গেলে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা কঠিন হবে।

মাথা নত করে কক্ষে পায়চারী করতে শুরু করেন সুলতান আইউবী। গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান তিনি। আলী বিন সুফিয়ান তাকিয়ে আছেন সুলতানের প্রতি। হঠাৎ থেমে গেলেন সুলতান। বললেন

হ্যাঁ, আলী! তুমি তোমার ভাষা ও গুপ্তচরদের ব্যবহার করো। তবে আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে নয়–আক্রমণের পক্ষে। আমাদের উপর সুদানীদের হামলা করাই উচিত এবং তা হওয়া দরকার যখন আমাদের বাহিনী ব্যারাকে ঘুমিয়ে থাকে ঠিক তখন। .

বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সুলতানের প্রতি তাকিয়ে থাকেন আলী বিন সুফিয়ান। সুলতান বললেন–এখানকার সব কজন কমাণ্ডারকে ডেকে পাঠাও এবং তুমিও এসে পড়ো। সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে কঠোরভাবে বলে দেন, যেন তিনি কমান্ডারদের জানিয়ে দেন, তিনি যে ময়দান থেকে এখানে এসেছেন, তা যেন ঘুণাক্ষরেও অন্য কেউ না জানে। তিনি বলেন, এখানে আমার উপস্থিতি গোপন রাখা অত্যন্ত জরুরী। আমি অতি সাবধানে সন্তর্পণে চলে এসেছি।

* * *

তিন রাত পর।

আঁধার রাতের কোলে গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছে কায়রো। একদিন আগে। নগরবাসীরা দেখেছিলো, তাদের নবগঠিত মিসরী বাহিনীটি শহর ত্যাগ করে কোথাও যাচ্ছে। প্রচার হয়েছিলো, বাহিনী সামরিক মহড়ার জন্য শহরের বাইরে গেছে। নীলনদের কূলে বালুকাময় পার্বত্য এলাকায় উপনীত হয়ে তাঁবু গেড়েছে সৈন্যরা। বাহিনীর কেউ পদাতিক, কেউ অশ্বারোহী।

রাতের প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্ত। কায়রোর ঘুমন্ত বাসিন্দারা দূরে কোথাও প্রলয় সংঘটিত হওয়ার শব্দ শুনতে পায়। ঘোড়ার দ্রুত দৌড়াদৌড়ির আওয়াজও কানে আসে তাদের। জেগে উঠে ঘুমন্ত মানুষগুলো। তারা প্রথম প্রথম মনে করেছিলো, সৈন্যদের মহড়া চলছে। কিন্তু শোরগোল ধীরে ধীরে নিকটে চলে আসছে এবং স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠছে। ঘরের ছাদে উঠে দেখতে শুরু করে জনতা। লাল বর্ণ ধারণ করছে আকাশ। কারো কারো চোখে পড়ছে, নীল নদ থেকে আগুনের শিখা উঠে এসে আঁধার রাতের বুক চিরে ডাঙ্গায় এসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তারপর-ই শহরে হাজার হাজার ঘোড়ার ছুটোছুটি–দৌড়াদৌড়ির শব্দ-শশারগোল শুরু হয়ে যায়। শহরবাসীরা এখনো জানেনা, এটি মহড়া নয় রীতিমত যুদ্ধ। আর যে আগুন দেখা যাচ্ছে, তাতে সুদানী বাহিনীর সিংহভাগ পুড়ে ছাই-এ পরিণত হচ্ছে।

সুলতান আইউবীর এ এক অনুপম রণকৌশল। তিনি রাজধানীতে অবস্থানরত স্বল্পসংখ্যক সৈন্যকে নীল নদ ও বালুকাময় টিলার পর্বতশ্রেণীর মাঝে বিস্তীর্ণ মাঠে পাঠিয়ে দেন। তারা তাঁবু স্থাপন করে সেখানে অবস্থান নেয়। নিজের কৌশল ও দক্ষতা কাজে লাগান আলী বিন সুফিয়ান। সুদানী বাহিনীর মধ্যে গুপ্তচর ঢুকিয়ে তিনি বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে এবং কমাণ্ডার থেকে এই সিদ্ধান্ত আদায় করে নেন যে, রাতে যখন সুলতান আইউবীর সৈন্যরা গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকবে, ঠিক তখন সুদানী বাহিনী তাদের উপর হামলা চালাবে। ভোর নাগাদ এক একজন করে সৈন্য শেষ করে নির্বিঘ্নে রাজধানী দখল করে নেয়া হবে। আর সুদানী বাহিনীর অপর অংশকে রোম উপসাগরের কূলে অবস্থানরত আইউবী বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য প্রেরণ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা মোতাবেক সুদানী বাহিনীর একটি অংশকে নিতান্ত গোপনে রাতে রোম উপসাগরের রণাঙ্গন অভিমুখে প্রেরণ করা হয়। অপর অংশ নীল নদের কূলে অবস্থানরত সৈন্য বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এ বাহিনীটি সমুদ্রের স্রোতের ন্যায় এক মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তৈরী করা আইউবী বাহিনীর তাঁবুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মুহূর্ত মধ্যে অতি দ্রুত সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ তাঁবুগুলোর উপর আগুনের তীর ও তেলভেজা কাপড়ে প্রজ্বলমান গোলা বর্ষিত হতে শুরু করে। অগ্নিবর্ষণ করতে আরম্ভ করে নীলনদও। তবুগুলোতে আগুন ধরে যায়। আকাশময় ছড়িয়ে পড়ে অগ্নিশিখা। সুদানী বাহিনী তাঁবুতে না পেলো সুলতান আইউবীর বাহিনীর কোন সৈন্য, না পেলো কোন একটি ঘোড়া ও একজন আরোহী। সম্পূর্ণ শূন্য সবগুলো তাবু। এগিয়ে আসলো না কেউ মোকাবেলার জন্য। আর হঠাৎ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তাঁবু এলাকার সর্বত্র। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সমগ্র এলাকা।

সুদানী বাহিনীর জানা ছিলো না, সুলতান আইউবী রাতের প্রথম প্রহরে ছাউনীগুলো থেকে তাঁর বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে বালুকাময় টিলাসমূহের পিছনে লুকিয়ে রেখেছেন এবং তাঁবুগুলোতে শুকনো ঘাসের স্তূপ ভরে রেখেছেন। তাঁবুর উপরে এবং ভিতরে তেল ছিটিয়ে রেখেছেন। সুলতান আইউবী কিশতীগুলোতে ছোট ছোট মিনজানীক রেখে সন্ধ্যার পর যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

সুদানী বাহিনী যেই মাত্র ছাউনী এলাকায় প্রবেশ করে, অমনি সুলতান আইউবীর লুকিয়ে থাকা সৈন্যরা অগ্নিতীর এবং কিশতীতে রাখা মিনজানীক দ্বারা আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে দেয়। তাঁবুগুলোতে আগুন ধরে গেলে শুকনো ঘাস আর তেল এলাকাটাকে জাহান্নামে পরিণত করে। সুদানীদের ঘোড়াগুলো তাদের পদাতিক সৈন্যদের পিষতে শুরু করে। আগুনের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাদের। হাজার হাজার সৈন্যের আর্তচীৎকার আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তোলে। অন্ধকার রাতটাকে দিনে পরিণত করে প্রজ্বলিত আগুন। সুলতান আইউবীর মুষ্টিমেয় সৈন্য আগুনে প্রজ্বলমান সুদানীদের ঘিরে ফেলে। আগুন থেকে বেরিয়ে যে-ই পালাবার চেষ্টা করছে, তীর বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে সে।

ওদিকে সুদানীদের যে বাহিনীটি রণাঙ্গন, অভিমুখে সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তাদের ব্যাপারেও উপযুক্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন সুলতান আইউবী। সুলতানের কয়েকটি ক্ষুদ্র বাহিনী বিভিন্ন স্থানে ওঁৎ পেতে বসে আছে পূর্ব থেকে। অগ্রসরমান সুদানী বাহিনীর পিছন ভাগে আক্রমণ চালিয়ে হুলস্থুল সৃষ্টি করে দেয় গোটা বাহিনীতে। এক আক্রমণে যতটুকু ক্ষতিসাধন করা সম্ভব ছিলো, তা করে তারা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিপর্যস্ত সুদানী বাহিনী নিজেদের সামলে নিতে না নিতেই বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগের উপর আক্রমণ আসে আবারো। আক্রমণ চালিয়েই বিদুতিতে অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায় তারাও।

ভোর পর্যন্ত সুদানীদের এই বাহিনীটির উপর হামলা হয় তিনবার। মনোবল হারিয়ে ফেলে সুদানী বাহিনী। মোকাবেলা করার সুযোগ-ই পাচ্ছে না তারা। দিনের বেলা কমাণ্ডাররা বুঝিয়ে-শুনিয়ে মন ঠিক করে সৈন্যদের। কিন্তু রাতে ফেরার পথে গতরাতের ন্যায় একই দশা ঘটে তাদের। এবার অন্ধকারে তীরও বর্ষিত হয় তাদের উপর। অন্ধকারে ঘোড়ার ছুটোছুটির শব্দ শুনতে পায় তারা। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। এই ঘোড়াগুলোই তাদের করুণ দশা ঘটিয়ে যাচ্ছে নেপথ্যে থেকে।

তিন-চারজন ঐতিহাসিক–যাদের মধ্যে নীল পল ও উইলিয়াম অন্যতম। লিখেছেন, রাতের বেলা বিপুলসংখ্যক শত্রুসেনার উপর গুটিকতক সৈন্যের কমাল্টো আক্রমণ ও চোখের পলকে উধাও হয়ে যাওয়া ছিলো সুলতান আইউবীর এমনি এক রণকৌশল, যা খৃষ্টানদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। এভাবেই দুশমনের অগ্রযাত্রাকে দারুণভাবে ব্যাহত করতেন সুলতান আইউবী। কৌশলের মার-প্যাঁচে ফেলে তিনি শত্রু সেনাদের তার-ই নির্বাচিত স্থানে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করতেন। এ ঐতিহাসিকগণ সুলতান আইউবীর এই জানবাজ সৈন্যদের বীরত্ব ও বিদুপাতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এ যুগের সমর বিশ্লেষকগণ স্বীকার করে থাকেন যে, বর্তমানকার গেরিলা ও কমাণ্ডো অভিযানের আবিষ্কর্তা হলেন বীর মুসলিম যোদ্ধা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেই তিনি শত্রুপক্ষের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতেন।

এ কৌশল অবলম্বন করেই তিনি মাত্র দু রাতে বার কয়েক কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে সুদানী সৈন্যদের যুদ্ধ করার মনোবল শেষ করে দিয়েছেন। সুদানীদের নেতৃত্বে বিচক্ষণ কোন মেধা ছিলো না। বিধ্বস্ত এই সৈন্যদের সামাল দিতে পারলো না কমাণ্ডাররা। সুদানী সৈনিকের বেশে আলী বিন সুফিয়ানের কিছু লোকও ছিলো এ বাহিনীতে। তারা সংবাদ ছড়িয়ে দেয়, আরব থেকে এমন একটি বাহিনী আসছে, যারা সুদানীদের ঝড়ে-বংশে নির্মূল করে দেবে। সুদানী সৈন্যদের মধ্যে ভীরুতা ও পলায়নপ্রবণতা সৃষ্টি করার কাজে সফল হয় আলীর লোকেরা। শৃংখলা হারিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তারা। নীল নদের কূলে এই বাহিনীটির যে পরিণতি ঘটে, তা নিতান্ত-ই করুণ।

আরব থেকে বাহিনী আগমনের সংবাদ গুজব ছিলো না। সত্যি সত্যিই একদিন এসে পৌঁছে নুরুদ্দীন জঙ্গীর একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী। সংখ্যায় তারা বেশী নয়। ঐতিহাসিকদের কারো মতে দু হাজার অশ্বারোহী ও দু হাজার পদাতিক। মোট চার হাজার। কারো কারো মতে আরো কিছু বেশী। সে যাই হোক, এই বাহিনী সুলতান আইউবীর অনেক উপকারে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীটির নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন সুলতান।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এই আরব বাহিনী এবং নিজের বাহিনীর যৌথ অভিযান চালিয়ে সুদানীদের একজন একজন করে খুন করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি কৌশল অবলম্বন করেন। সুদানী কমাণ্ডারদের গ্রেফতার করেন এবং তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেন যে, এখন আর তাদের চূড়ান্ত পতন। ছাড়া কোন পথ নেই। তবে আমি তোমাদের সমূলে বিনাশ করবো না। সুলতানের শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলো কমাণ্ডাররা। সুলতান আইউবী তাদের ক্ষমা করে দেন এবং শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে সুদানীদের বেঁচে যাওয়া সৈনিকদের কৃষি-কর্মে পুনর্বাসিত করেন। তাদেরকে জমি দান করেন এবং চাষাবাদের জন্য সরকারী সহযোগিতা প্রদান করেন। তারপর তাদের অনুমতি প্রদান করেন, তোমাদের কেউ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে চাইলে হতে পারো।

এমনি বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সাথে সুদানীদের দমন করে সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনী এবং নিজের বাহিনীকে একত্রিত করে ওফাদার সুদানীদেরও তাদের সঙ্গে যুক্ত করে একটি সুশৃংখল শক্তিশালী বাহিনীর রূপ প্রদান করেন এবং খৃষ্টানদের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে শুরু করেন। আলী বিন সুফিয়ানকেও তার বিভাগকে পুনর্বিন্যস্ত করার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড আরো জোরদার করে চলেছে খৃষ্টানরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *