১.১ নারীর ফাঁদ

ঈমানদীপ্ত দাস্তান – ১ (প্রথম খণ্ড)
সিরিজ – নারীর ফাঁদ – ১ / ঐতিহাসিক উপন্যাস
এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ / অনুবাদ –মুহাম্মদ মুহিউদ্দী

প্রকাশকের কথা

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর শাসনকাল। পৃথিবী থেকে বিশেষত মিশর থেকে ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলে ক্রুশ প্রতিষ্ঠার ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে খৃস্টানরা। ক্রুসেডাররা সালতানাতে ইসলামিয়ার উপর নানামুখী সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনার পাশাপাশি বেছে নেয় নানারকম কুটিল ষড়যন্ত্রের পথ। গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা ও চরিত্র-বিধ্বংসী ভয়াবহ অভিযানে মেতে উঠে তারা। মুসলমানদের নৈতিক শক্তি ধ্বংস করার হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে অর্থ, মদ আর ছলনাময়ী রূপসী মেয়েদের। সুলতান আইউবীর হাই কমান্ড ও প্রশাসনের উচ্চস্তরে একদল ঈমান-বিক্রেতা গাদ্দার তৈরি করে নিতে সক্ষম হয় তারা। ইসলামের মহান বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী পরম বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, দু:সাহসিকতা ও অনুপম চরিত্র মাধুরী দিয়ে সেইসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ছিনিয়ে আনেন বিজয়। সুলতান আইউবী ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে অস্ত্র হাতে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ লড়েছিলেন, খৃস্টানরা মুসলমানদের উপর যে

অস্ত্রের আঘাত হেনেছিলো, ইতিহাসে ক্রুসেড যুদ্ধ নামে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সালতানাতে ইসলামিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত খৃস্টানদের নাশকতা, গুপ্তহত্যা ও ছলনাময়ী রূপসী নারীদের লেলিয়ে দিয়ে মুসলিম শাসক ও আমীরদের ঈমান ক্রয়ের হীন ষড়যন্ত্র এবং সুলতান আইউবীর তার মোকাবেলা করার কাহিনী এড়িয়ে গেছেন অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ। সেইসব অকথিত কাহিনী ও সুলতান আইউবীর দু:সাহসিক অভিযানের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলী নিয়ে রচিত হলো সিরিজ উপন্যাস ঈমানদীপ্ত দাস্তান। ভয়াবহ সংঘাত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও সুলতান আইউবীর ঈমানদীপ্ত কাহিনীতে ভরপুর এই সিরিজ বইটি ঘুমন্ত মুমিনের ঝিমিয়েপড়া ঈমানী চেতনাকে উজ্জীবিত ও শাণিত করে তুলতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পাশাপাশি বইটি পূর্ণমাত্রায় উপন্যাসের স্বাদও যোগাবে। আল্লাহ কবুল করুন।

বিনীত
মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন
১১৪, সবুজবাগ, ঢাকা।

.

১.১ নারীর ফাঁদ

১১৫৭ সালের এপ্রিল মাস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আপন চাচাতো ভাই খলীফা সালেহ-এর গভর্নর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন–

তোমরা খাঁচায় বন্দী রং-বেরংয়ের পাখি নিয়ে ফুর্তি করো। নারী আর সুরার প্রতি যাদের এতো আসক্তি, তাদের জন্য সৈনিক জীবন খুবই বেমানান।

খলীফা সালেহ আর তার বংশজ গভর্নর সাইফুদ্দীন গোপনে মুসলিম খেলাফতের চিরশত্রু ক্রুসেডারদের চক্রান্তে ফেঁসে গেলেন। খেলাফতের রাজভাণ্ডার–মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত, দিনার-দেহরাম দিয়ে এই দুই শাসক ক্রুসেডারদের প্ররোচিত ও সহযোগিতা করতে লাগলেন সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে। সুলতান আইউবীকে হত্যা করার চক্রান্ত আঁটা হলো ।

একদিন ঠিক কাক্ষিত সুযোগটি এসে গেলো ক্রুসেডারদের হাতে। তাঁরা মুসলিম শাসকদের মধ্যেই তালাশ করছিলো দোসর । খলীফা সালেহ স্বেচ্ছায় ক্রুসেডারদের সেই ভয়ানক চক্রান্তে পা দিলেন। খলীফা ও ক্রুসেডারদের সমন্বিত চক্রান্তে দু দুবার হত্যার উদ্দেশ্যে আইউবীর উপর আঘাত হানা হলো। দুবারই সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তছনছ করে দিলেন। ঘাতকদের সব চক্রান্ত। আঘাতে-প্রত্যাঘাতে পরাস্ত করলেন শত্রুদের। ফাঁস হয়ে গেল গভর্নর সাইফুদ্দীনের চক্রান্তের খবর।

গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে ক্রুসেডারদের দোসর গাদ্দার সাইফুদ্দীন ঘর-বাড়ী, বিত্ত-বৈভব ফেলে পালিয়ে গেলো। গভর্নরের আবাস থেকে উদ্ধার হলো বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ, বিলাস-ব্যসন। গভর্নরের বাড়িতে পাওয়া গেলো দেশী-বিদেশী অনিন্দসুন্দরী যুবতী, তরুণী, রক্ষিতা। এদের কেউ ছিলো নর্তকী, কেউ গায়িকা, কেউ বিউটিশিয়ান, কেউ ম্যাসেঞ্জার। সবই ছিলো সাইফুদ্দীনের মনোরঞ্জনের সামগ্রী ও ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের জঘন্য উপাদান।

সাইফুদ্দীনের বাড়ীতে আরো পাওয়া গেলো নানা রঙের নানা প্রজাতির অসংখ্য পাখি। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলানো ছিলো বিভিন্ন ভঙ্গিমার নগ্ন, অর্ধনগ্ন। নারীদের উত্তেজক অশ্লীল ছবি। সুরাভর্তি অসংখ্য পিপা।

সালাহুদ্দীন খাঁচার বন্দী পাখীদের মুক্ত করে দিলেন। গভর্নরের বাড়ীতে বন্দী সেবিকা, নর্তকী, বিউটিশিয়ান ও শিল্পী-তরুণীদের আপনজনদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন

তোমরা দুজনে কাফের-বেঈমানদের দ্বারা আমাকে হত্যা করাবার অপচেষ্টায় মেতেছো। কিন্তু একবারও ভেবে দেখোনি, তোমাদের এই চক্রান্ত মুসলিম খেলাফতের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তোমরা আমাকে হিংসা করো। তাই আমাকে তোমরা ধ্বংস করে দিতে চাও। দু দুইবার আমাকে হত্যা করার জন্যে লোক পাঠিয়েছে; কিন্তু সফল হতে পারোনি। আবার চেষ্টা করে দেখো, হয়তো সফল হবে। তোমরা যদি আমাকে এ নিশ্চয়তা দাও যে, আমার মৃত্যুতে ইসলামের উন্নতি হবে, মুসলমানদের কল্যাণ হবে, তাহলে কাবার প্রভুর কসম করে বলছি, আমি তোমাদের তরবারী দিয়ে আমার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করিয়ে তোমাদের পদতলে উৎসর্গ করতে অসিয়ত করে যাবো। আমি তোমাদের শুধু একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কাফের-বেঈমানরা কখনো মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না। ইতিহাস তোমাদের চোখের সামনে। আমাদের সোনালী অতীতের দিকে একবার ফিরে দেখো। আশ্চর্য, রাজা ফ্রাংক-রেমণ্ডের মত প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিম শাসকরা তোমাদের সাথে একটু বন্ধুত্বের অভিনয় করলো, আর অনি তোমরা তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহস যুগিয়েছো! ওরা যদি সফল হতো, তাহলে ওদের পরবর্তী প্রথম শিকার হতে তোমরা-ই। এরপর হয়তো দুনিয়া থেকে ইসলামী খেলাফত মুছে ফেলার কাজটিও সমাধা হতো।

তোমরা তো যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য ও যুদ্ধ পরিচালনা তোমাদের ঐতিহ্যের অংশ। অবশ্য প্রত্যেক মুসলমান-ই আল্লাহর সৈনিক আর আল্লাহর সৈনিক হওয়ার পূর্বশর্ত ঈমান ও কার্যকর ভূমিকা।

তোমরা খাঁচার পাখি নিয়ে ফুর্তি করো। মদ-নারীর প্রতি যাদের এত আসক্তি, সৈনিক জীবন ও যুদ্ধ পরিচালনা তাদের জন্যে খুবই বেমানান। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো। আমার সাথে জিহাদে শরীক হও। যদি না পারো, অন্তত আমার বিরুদ্ধাচারণ থেকে বিরত থাকো। আমি তোমাদের অপরাধের কোন প্রতিশোধ নেবো না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।

-সালাহুদ্দীন আইউবী

গভর্নর সাইফুদ্দীন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন চক্রান্তে মেতে উঠলো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর চিঠি পড়ে তার মধ্যে দ্বিগুণ প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। যোগ দিলো ইহুদী হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক স্কোয়াডের সাথে। শুরু হলো নতুন চক্রান্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহর স্কোয়াড দীর্ঘ দিন ধরে ফাতেমী খেলাফতের আস্তিনের নীচে কেউটে সাপের মতো বিরাজ করছিলো।

***

হাসান ইবনে সাব্বাহ্ একজন স্বভাব-কুচক্রী। ফাতেমী খেলাফতের শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে সে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তৎপর। শুভাকাতক্ষীর পোশাকে সর্বনাশী ষড়যন্ত্রের হোতা সে। অতি সংগোপনে ইসলামী খেলাফতকে ধ্বংস করতে গোপনে গড়ে তোলে ঘাতক বাহিনী। বিস্ময়কর যাদুময়তায় সাধারণ মানুষের কাছে সজ্জন হিসেবে আসন গেড়ে নেয় তার বাহিনী। অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দেয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস।

হাসান ইবনে সাব্বাহর গুপ্ত বাহিনীতে রয়েছে চৌকস নারী ইউনিট। ওরা যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ। প্রাঞ্জল ভাষা ও বাকপটুতায় দক্ষ তারা। তাদের সংস্পর্শে গেলে যে কোন কঠিন মনের অধিকারী আর আদর্শিক পুরুষও মোমের মত গলে যায়। চক্রান্ত বাস্তবায়নে মাদক, নেশা, আফিম, হাশীশ, নাচ-গান ও ম্যাজিকের আশ্রয় নেয় তারা। এমনকি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হাসান বাহিনীর নারী গোয়েন্দারা নিজেদের দেহ বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দীর্ঘ কঠোর প্রশিক্ষণ-অনুশীলনের মাধ্যমে উপযুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় তাদের মূল কাজ। হাসান বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ ইসলামী খেলাফতকে নির্মূল করতে এমন একটি ঘাতক বাহিনীর জন্ম দেয় যে, এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত গোয়েন্দারা বেশ-ভূষা ও ভাষা বদল করে কৌশলী আচার ব্যবহার দ্বারা ফাতেমী খেলাফতের শীর্ষ ব্যক্তিদের একান্ত বডিগার্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও হাত করে নেয়। এর ফলে বড় বড় সামরিক কর্মকর্তারা গুপ্ত হত্যার শিকার হতে থাকেন। কিন্তু ঘাতকের কোন নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না।

অল্পদিনের মধ্যেই হাসান বাহিনীর গুপ্তদল ফেদায়ী নামে সারা মুসলিম খেলাফতে ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়। এদের প্রধান কাজ রাজনৈতিক হত্যা। এ কাজে এরা বেশী ব্যবহার করে সুন্দরী যুবতী আর মদ। শরাবে উচ্চমানের বিষ মিশিয়ে আসর গরম করার পর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে তারা। কিন্তু তাদের মদ-নারী সালাহুদ্দীন আইউবীর বেলায় অকার্যকর। অবৈধ নারী সম্ভোগ আর হারাম মদ-সুরায় আইউবীর আজন্ম ঘৃণা। সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার একমাত্র উপায় অতর্কিত আক্রমণ। কিন্তু এটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। সুলতান সালাহুদ্দীন সবসময় থাকেন প্রহরী-পরিবেষ্টিত। তাছাড়া তিনি নিজেও খুব সতর্ক।

দু দুটি আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর সালাহুদ্দীন আইউবী ভেবেছিলেন, আমীর সালেহ ও গভর্নর সাইফুদ্দীন হয়তো তাঁর চিঠি পেয়ে তওবা করেছে। ওরা হয়তো আর তার সাথে দুশমনি করবে না। কিন্তু না, ওরা প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে আছে। নতুন করে তৈরী করলো সালাহুদ্দীনকে খতম করার সুগভীর চক্রান্তের ফাঁদ।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ক্রুসেডার ও সাইফুদ্দীনের হামলা প্রতিহত করে বিজয়োল্লাসের পরিবর্তে পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন। অগ্রণী আক্রমণ করে শত্রুপক্ষের আরো তিনটি এলাকা দখল করে নিলেন তিনি। বিজিত এলাকার অন্যতম একটি হলো গাঁজা।

গাঁজার প্রশাসক জাদুল আসাদীর তাঁবুতে এক দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। মাথায় তার শিরস্ত্রাণ। শিরস্ত্রাণের নীচে মোটা কাপড়ের পাগড়ী।

তাঁবুর বাইরে প্রহরারত দেহরক্ষী দল। আইউবীর দেহরক্ষীরা যেমন লড়াকু, তেমনি চৌকস।

রক্ষী দলের কমাণ্ডার কেনো যেনো প্রহরীদের রেখে একটু আড়ালে চলে গেলো। এক দেহরক্ষী সালাহুদ্দীনের তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিলো। ইসলামের অমিততেজী সিপাহসালার তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। দু চোখ তার মুদ্রিত। চিৎ, হয়ে শুয়ে আছেন সালাহুদ্দীন। প্রহরী চকিত নেত্রে খাস দেহরক্ষীদের একবার। দেখে নিলো। দেহরক্ষীদের তিন-চারজন দেখলো ওই প্রহরীর উঁকি মারার দৃশ্য। চোখাচোখি হলো পরস্পর। তারা বিষয়টি আমলে নিলো না। অন্যান্য প্রহরীদের নিয়ে গল্প-গুজবে মেতে উঠলো। বাইরের প্রহরী এই সুযোগে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলো। কোমরে তার ধারাল খঞ্জর। বের করে এক নজর দেখে নিলো সেটা। বিড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সালাহুদ্দীনের দিকে। ..

ঠিক তখনই পার্শ্ব পরিবর্তন করলেন আইউবী। খঞ্জর বিদ্ধ হলো সালাহুদ্দীন আইউবীর মাথার খুলি ঘেষে মাটিতে।

এই মুহূর্তে পার্শ্ব পরিবর্তন না করলে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যেতো তার খুলি। সালাহুদ্দীন আইউবী বিদ্বেগে ধড়মড় করে শোয়া থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বুঝে ফেললেন, কী ঘটছে। ইতিপূর্বে দুবার একই ধরনের আক্রমণ হয়ে গেছে তার উপর। কালবিলম্ব না করে ঘাতকের চিবুকে পূর্ণ শক্তিতে একটা ঘুষি মারলেন আইউবী। চিবুকের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার মট মট শব্দ শোনা গেলো। পিছনের দিকে ছিটকে পড়ে ভয়ানক আর্তচীৎকার দিলো ঘাতক।

এই ফাঁকে আইউবী খঞ্জর তুলে নিলেন হাতে। প্রহরীর ভয়ার্ত চীকারে দৌড়ে আরো দুই দেহরক্ষী তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলো। তাদের হাতে খোলা তরবারী। সুলতান বললেন, “ওকে গ্রেফতার করো। কিন্তু আইউবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরাও। আইউবী নিজের খঞ্জর দিয়েই দুই তরবারীর মোকাবেলা করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে গেলো ঘাতক দল।

ইত্যবসরে বাইরের দেহরক্ষী দলের সবাই ঢুকে পড়লো তাঁবুতে। লড়াই বেঁধে গেলো প্রচণ্ড। আইউবী দেখলেন, তাঁর নির্বাচিত দেহরক্ষীরা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত। বোঝার উপায় ছিলো না, এদের মধ্যে কে। তার অনুগত আর কে শক্রর এজেন্ট। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থা নিরীক্ষণ করলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিপক্ষের তরবারীর আঘাতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লো উভয় পক্ষের কয়েকজন। আর কিছুসংখ্যক মারাত্মক আহত হয়ে কাতরাতে লাগলো। আহত অবস্থায় পালিয়ে গেলো বাকিরা।

লড়াই থেমে যাওয়ার পর অনুসন্ধানে ধরা পড়লো, আইউবীর একান্ত দেহরক্ষীদের মধ্যে সাতজনই হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক সদস্য। যে ঘাতক প্রথম আঘাত হেনেছিলো, তাকে আইউবী নিজেই দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। ওই নরাধম তাঁবুতে প্রবেশ করার পর ভিতরের পরিস্থিতি পরিকল্পনার বিপরীত হয়ে গেলো। ওর আর্তচীকারে বাকিরাও তাঁবুতে প্রবেশ করলে প্রকৃত প্রহরীরাও ঘটনা আঁচ করতে পেরে দ্রুত প্রতিরোধে এগিয়ে এলো। শত্রুদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেলো। এ যাত্রায়ও বেঁচে গেলেন আইউবী।

ঘাতকের বুকে তরবারী রেখে আইউবী জিজ্ঞেস করলেন–কে তুমি? কোত্থেকে কীভাবে এখানে এসেছো? আর কে তোমাকে এ কাজে পাঠিয়েছে? সত্য স্বীকারোক্তির বিনিময়ে আইউবী ঘাতকের প্রাণ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ঘাতক বলে দিলো, সে ফেদায়ী, আমীর সালেহ-এর এক কেল্লাদার গভর্নর গোমস্তগীন এ কাজে নিযুক্ত করেছে তাকে।

সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলিম মিল্লাতের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। খুই কাছেও কখনোই বিস্মৃত হবার নন তিনি।

সালাহুদ্দীন আইউবীর কীর্তি-কাহিনী ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাসে সংরক্ষিত। তবে তাঁর জীবন ও কর্মের বাঁকে বাঁকে আপনজন ও স্বগোত্রীয়দের হিংসাত্মক শত্রুতা, চরিত্র হনন, চারপাশের মানুষদের দ্বারা বিছানো বহু বিস্তৃত ভয়ংকর চক্রান্তজাল, শত্রুপক্ষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আঘাত আর তাঁর মিশন ব্যর্থ করতে খৃষ্টান-ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের পাতা ফাঁদের কথা ইতিহাসের পাতায় বিস্তারিত বিবৃত হয়নি। সেসব অজানা ইতিহাস আমি বলার ইচ্ছা রাখি।

***

১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। সালাহুদ্দীন আইউবী সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করলেন। ফাতেমী খেলাফতের কেন্দ্রীয় খলীফা তাঁকে এ পদে নিযুক্ত করে বাগদাদ থেকে প্রেরণ করেন।

মিসরের সেনাপ্রধান ও শাসকের গুরুত্বপূর্ণ পদে আইউবীর মত তরুণের নিযুক্তি স্থানীয় প্রশাসকদের দৃষ্টিতে ছিলো অনভিপ্রেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদের দৃষ্টিতে আইউবী হলেন যথোপযুক্ত ব্যক্তি। বয়সে তরুণ হলেও আইউবী শাসক বংশের সন্তান। বাল্যকাল থেকেই কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে রপ্ত করেছেন যুদ্ধবিদ্যা। অল্প বয়সেই যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণ করেছেন নিজের বিরল প্রতিভা ও অসামান্য দূরদর্শিতা।

সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টিতে দেশ শাসন বাদশাহী নয়–জনসেবা। জাতির ইজ্জত-সম্মান, সমৃদ্ধি-উন্নতি এবং সেবার মাধ্যমে নাগরিকদের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-ই শাসকদের দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু তিনি । ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা-অনৈক্য, একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্যে আমীর-ওমরার মধ্যে খৃষ্টানদের সাথে ভয়ংকর বন্ধুত্ব স্থাপনের আত্মঘাতি প্রতিযোগিতা।

শাসকদের সিংহভাগ জাগতিক বিলাস-প্রমোদে মত্ত। মদ, নারী আর নাচ-গানে শাসক শ্ৰেণী আকণ্ঠ ডুবন্ত। জীবনকে জাগতিক আরাম-আয়েশের বাহারী রঙে সাজিয়ে রেখেছে কর্তারা। মিল্লাতের ঐতিহ্য, মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যত ও সম্ভাবনাকে শাসক শ্রেণী নিক্ষেপ করেছে অতল-গহ্বরে।

আমীর, উজীর, উপদেষ্টা ও বড় বড় আমলার হেরেমগুলো বিদেশী খৃষ্টান সুন্দরী তরুণীদের নৃত্য-গীতে মুখরিত। শাসকদের হেরেমগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে খৃষ্টান-ইহুদীদের প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা কিশোরীরা। শাসকদের বোধ ও চেতনা সব ওদের হাতের মুঠোয়। খৃষ্টান গোয়েন্দা মেয়েরা মুসলিম শাসকদের হেরেমে অবস্থান করে মদ-সুরা, নাচ-গান আর দেহ দিয়ে শুধু শাসকদের কজায়-ই রাখছে না–মুসলিম খেলাফতের প্রাণরস ভিতর থেকে উঁই পোকার মত খেয়ে খেয়ে অসাড় করে দিচ্ছিলো তারা।

খৃষ্টান রাজারা ইসলামী সালতানাতগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। মুসলিম শাসকদের মধ্যে বপণ করছে সংঘাত ও প্রতিহিংসার ধ্বংসাত্মক বীজ। এ কাজে খৃষ্টানরা এতই সাফল্য অর্জন করলো যে, কিছুসংখ্যক মুসলিম শাসক খৃষ্টান সম্রাট ফ্র্যাংককে বাৎসরিক ট্যাক্স দিতে শুরু করলেন। পরস্পর প্রতিহিংসাপরায়ণ মুসলিম শাসকদের ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলোতে গোপন সন্ত্রাস ও হামলা চালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিরাপত্তা চাঁদা আদায় করছিলো খৃষ্টান রাজারা। প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেও ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করতে প্রজাদের রক্ত শুষে ট্যাক্স আদায় করে খৃষ্টান রাজাদের বাৎসরিক সেলামী আদায় করছিলো মুসলিম শাসকরা।

সামাজিক সংঘাত, আত্মকলহ ও শ্রেণীগত বিরোধে তখন মুসলমানদের একতা-সংহতি বিলীন। ধর্মীয় দলাদলি, মাযহাবী মতবিরোধে মুসলিম সম্প্রদায় শতধা বিভক্ত। হাসান ইবনে সাব্বাহ নামের এক ভণ্ড ইহুদী-পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে মিসরের সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আভির্ভূত হয়। গোপনে গড়ে তোলে নিজস্ব গোয়েন্দা, সেনা ও সুইসাইড বাহিনী। এরা জঘন্য গুপ্ত হত্যায় এই প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, হাশীশ বাহিনী রূপে সারা মিসরে এরা খ্যাত।

এই সাব্বাহ বাহিনীর সাথে সালাহুদ্দীনের পরিচয় বাগদাদে। মাদরাসা নিজামুল মুলুকে পড়াশোনাকালীন সময়ে সালাহুদ্দীন জানতে পারেন; সাব্বাহ বাহিনীর গুপ্তঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো নিজামিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা নিজামুল মুককে।  

নিজামুল মুলক ছিলেন মুসলিম খেলাফতের একজন যশস্বী গভর্নর। সুশাসক ও গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন তিনি। মুসলমানদের সর্বাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এবং ইহুদী-খৃষ্টানদের বিপরীতে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতেই গভর্নর নিজামুদ্দীন গড়ে তোলেন মাদরাসা নিজামিয়া। অল্পদিনের মধ্যে নিজামিয়া মাদরাসা বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষায় খ্যাতি লাভ করে। ওখানকার শিক্ষার্থীরা ইসলাম বিরোধীদের উপযুক্ত মোকাবেলা করার যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। মাদরাসা নিজামিয়ায় আবশ্যিক রাখা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরকলা। ।

খৃষ্টানদের কাছে এ বিষয়টি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠে তাদের অস্তিত্বের জন্যে। তাই ওরা চক্রান্ত আঁটে। ওদের যোগসাজশে নিজামুল মুলকের দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয় সাব্বাহ বাহিনী। সাব্বাহ বাহিনীকে হাত করে খৃষ্টান চক্রান্তকারীরা হত্যা করে নিজামুল মুলককে। এ ঘটনা সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্মের প্রায় শত বছর আগের।

নিজামুল মুল্‌কের মৃত্যু হলেও মাদরাসা নিজামিয়া বন্ধ হয়ে যায়নি। অব্যাহত থাকে ইসলামের সৈনিক তৈরীর প্রচেষ্টা। ওখানেই জাগতিক ও ধর্মীয় বিশেষ করে যুদ্ধ-বিদ্যায় প্রশিক্ষণ নেন সালাহুদ্দীন। রাজনীতি, কূটনীতি, ভূগোল, ইতিহাস ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কৌশলের উপর আইউবীর গভীর আগ্রহের কারণে নুরুদ্দীন জঙ্গী ও চাচা শেরেকোই তার জন্যে স্পেশাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষা অবস্থায়ই তাকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা লাতের জন্যে। সর্বক্ষেত্রেই দেখা যেতো আইউবীর অসাধারণ যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা। অনুপম কর্মকৌশলে মুগ্ধ হয়ে জঙ্গী তাকে মিসরের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এখান থেকেই আইউবীর সংগ্রামী জীবনের সূচনা।

***

সেনাপ্রধান ও গভর্নর হয়ে মিসরে পদার্পণ করলেন সালাহুদ্দীন আইউবী। রাজকীয় অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল তার সম্মানে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা করলো জমকালো অনুষ্ঠানের। সার্বিক আয়োজনের নেতৃত্ব দিলেন সেনা অধিনায়ক নাজি।

নাজি মিসরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান, পঞ্চাশ হাজার নিয়মিত বাহিনীর অধিনায়ক। মিসরে নাজি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি। মুকুটহীন সম্রাট। ভবিষ্যত গভর্নর হিসেবে নিজেকেই একমাত্র ফাতেমী খেলাফতের যোগ্য উত্তরসূরী মনে করেন তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীর নিয়োগে স্বপ্নভঙ্গ হলো তার। তবে দমে গেলেন না তিনি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে দেখেই নাজি আশ্বস্ত হলেন, এই বালক তার জন্যে মোটেও সমস্যা হবে না। নিজের দাপট যথারীতি বহাল রাখতে পারবেন তিনি।

আইউবীর আগমনে বড় বড় সেনা অফিসার ও গুরুত্বপূর্ণ আমলাদের অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত হলো। অনেকেই নিজেকে ভাবছিলো মিসরের ভাবী গভর্নররূপে। তরুণ সালাহুদ্দীনকে দেখে চোখাচোখি করলো তারা। অনেকের দৃষ্টিতে ছিলো তাচ্ছিল্যের ভাব। তারা জানতো না সালাহুদ্দীন আইউবীর যোগ্যতা। শুধু জানতো, সালাহুদ্দীন শাসক পরিবারের ছেলে। তাঁকে চাচা শেরেকোহর স্থলাভিষিক্ত করে পাঠানো হয়েছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর সাথে তার আত্মীয়তা রয়েছে।

এক প্রবীণ অফিসার টিপ্পনী কাটলো–ছেলে মানুষ আমরা তাকে গড়ে নেব।

অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন আর অফিসারদের সমাবেশে আইউবী প্রথমে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন। নাজির কটাক্ষ চাহনি আর কর্মকর্তাদের বিদ্রূপ আইউবী উপলব্ধি করলেন কি-না বলা মুশকিল। তবে বয়স্ক, অভিজ্ঞ ও প্রবীণ কর্মকর্তাদের ভীড়ের মধ্যে নিজেকে নিতান্তই বালক মনে হচ্ছিলো তাঁর। দ্রুত নিজেকে সামলে অফিসারদের প্রতি মনোযোগী হলেন আইউবী। পিতার বয়সী জেনারেল নাজির প্রতি হাত বাড়িয়ে দিলেন মোসাফাহার জন্যে। তোষামোদে সিদ্ধহস্ত নাজি পৌত্তলিকদের মত মাথা নীচু করে কুর্নিশ করলো আইউবীকে। তারপর কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো–

আমার বুকের শেষ রক্তফোঁটা দিয়ে হলেও তোমাকে হেফাজত করবো। তুমি আমার কাছে শেরেকোহ ও জঙ্গীর পবিত্র আমানত।

আমার জীবন ইসলামের মর্যাদার চেয়ে বেশী মূল্যবান নৃয় সম্মানিত জেনারেল! নিজের প্রতি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। ক্রুসেডারদের চক্রান্ত কালো মেঘের মত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। নাজির হাতে চুমো খেয়ে বললেন আইউবী।

জবাবে মুচকি হাসলেন নাজি, যেন আইউবী তাকে মজার কোন কৌতুক শোনালেন।

নাজি অভিজ্ঞ অধিনায়ক। মিসরের সেনাবাহিনীর অধিপতি। তার বাহিনীতে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার সুদানী, যারা সবাই প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। নাজির মুচকি হাসির রহস্য আইউবী বুঝতে না পারলেও এতটুকু অনুধাবন, করলেন যে, এ কৌশলী ও বিজ্ঞ সেনাপতিকে তাঁর বড় প্রয়োজন।

নাজি মিসরেই শুধু নয়–গোটা ইসলামী খেলাফতের মধ্যে একজন ধুরন্ধর প্রকৃতির সেনাপতি। নিজ দক্ষতায় পঞ্চাশ হাজার সুদানী বাহিনী দিয়ে স্পেশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন সে। তার অধীন সৈন্যরাই পালন করতো শাসকদের দেহরক্ষীর দায়িত্ব। মিসরের গভর্নরের দেহরক্ষীর দায়িত্বও ন্যস্ত ছিলো নাজির স্পেশাল বাহিনীর হাতে। স্পেশাল বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক নাজির অনুগত। তার নির্দেশে অকাতরে জীবন দিতে সামান্যতম দ্বিধা করে না কেউ। বিরাট বাহিনীর কর্তৃত্বের বদৌলতে নাজি মিসর ও আশ-পাশের অন্যান্য শাসকদের জন্য ছিলেন । একটি ত্রাস। শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর কূটচালে নাজি এ অঞ্চলের মুকুটবিহীন সম্রাট। তাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন শক্তি কারো নেই। কূটকৌশলে নাজি এমনই দক্ষ যে, সরাসরি সিংহাসনে আসীন না হলেও তাকে মনে করা হতো মসনদের কারিগর। নিজের কূটচালে নাজি ইচ্ছেমত শাসকদের ক্ষমতায় আসীন করতেন আর ইচ্ছে হলে সরিয়ে দিতো। প্রশাসনে নাজিকে বলা হতো সকল দুষ্টবুদ্ধির আধার। সালাহুদ্দীন আইউবীর কথার জবাবে নাজির মুচকি হাসির রহস্য অন্যরা হয়ত ঠিকই বুঝে নিলো। সালাহুদ্দীন অতসব গভীর চিন্তা না করলেও এতটুকু ঠিকই ধরে নিলেন, এই শক্তিধর সেনাপতিকে তার বড় বেশি প্রয়োজন।

অনেক পথ সফর করে এসেছেন মহামান্য গভর্নর! খানিক বিশ্রাম করে নিন। বললো প্রবীণ এক অফিসার।

আমার মাথায় যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, আমি সে গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য নই। এই দায়িত্ব আমার ঘুম আর আরাম কেড়ে নিয়েছে। আপনারা আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন, যেখানে কর্তব্যসমূহ আমার অপেক্ষা করছে। বললেন আইউবী।

দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগে আহারটা সেরে নিলে ভাল হয় না? আইউবীর উদ্দেশে বললো নাজির সহকারী।

একটু কী যেন চিন্তা করলেন আইউবী। তারপর হাঁটা দিলেন সামনের দিকে।

বিশাল এক হলরুম। আইউবীর ডানে নাজি, বায়ে নাজির সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড ঈদরৌস। আগে পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গার্ড অব অনার দিচ্ছে নাজির স্পেশাল বাহিনীর নির্বাচিত সদস্যরা। স্পেশাল বাহিনীর সৌকর্য, সুঠামদেহ, উন্নত হাতিয়ার, অভ্যর্থনা আর গার্ড অব অনারের বিন্যস্ত আয়োজন দেখে আইউবীর চোখ আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠলো। এমন একটি সুগঠিত বাহিনীর স্বপ্ন-ই দেখছিলেন তিনি।

কিন্তু হলের গেটে গিয়ে আইউবী স্তম্ভিত হলেন। চিন্তায় ছেদ পড়লো তাঁর। থমকে দাঁড়ালেন তিনি।

সুরম্য হলঘর। প্রবেশ পথে উন্নত গালিচা বিছানো।

দরজায় পা রেখেই মলিন হয়ে গেলো আইউবীর চেহারা। নেমে এলো বিষাদ। চার উর্বশী তরুণী তাকে দেখেই নৃত্যের ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে ঝুঁকে অভিবাদন জানালো। তাদের হাতে ঝুড়িভর্তি তাজা ফুল। ফুলগুলো শৈল্পিক ভঙ্গিতে ছিটিয়ে দিতে থাকলো আইউবীর পদতলে, তার যাত্রা পথে।

তরুণীদের পরনে মিহি রেশমের সাদা ধবধবে ঘাগরী। পিঠে ছড়ানো সোনালী চুল। তাদের ঝুলেপড়া জুলফি বাড়িয়ে তুলেছে চেহারার রওনক। তরুণীদের শরীরের দ্যুতি সূক্ষ্ম কাপড়ের বাইরে ঠিকরে পড়ছে যেনো। ওদের নৃত্য-ভঙ্গিমার তালে বেজে উঠলো তবলা। সানাইয়ের সুর। সঙ্গীতের মূৰ্ছনা।

তাজা ফুল পায়ের কাছে নিক্ষিপ্ত হতেই দ্রুত পা পিছিয়ে নিলেন আইউবী। ডানে নাজি আর বাঁয়ে নাজির সহকারী। আইউবীকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান

জানালো তারা।

মোলায়েম ফুল-পাপড়ি মাড়াতে আসেনি সালাহুদ্দীন। ঠোঁটে রহস্যময় হাসির আভা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন আইউবী। এমন নির্মল রহস্যময় হাসি আর দেখেননি কখনো নাজি।

আমরা জনাবের চলার পথে আসমানের তারা এনেও বিছিয়ে দিতে পারি মাননীয় গভর্নর! বললেন নাজি।

আমার যাত্রা পথে শুধু একটা জিনিস বিছানো থাকলে তা আমাকে সন্তুষ্ট করবে। বললেন আইউবী।

আদেশ করুন হুজুর কেবলা!–গদগদ চিত্তে বললো নাজির সহকারী কোন্ সে জিনিস, যা আপনার পায়ের তলায় ছড়িয়ে দিলে আপনাকে আনন্দ দেয়?

ক্রুসেডারদের লাশ। ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সুরে মুচকি হেসে বললেন আইউবী। নিমিষেই তার চেহারা কঠিন হয়ে গেলো। চোখ থেকে ঠিকরে বেরুতে থাকলো অগ্নিদৃষ্টি। ভসনামাখা অনুচ্চ আওয়াজে বললেন

মুসলমানদের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয় জেনারেল।

মুহূর্তের মধ্যে পার হয়ে গেলো অফিসারের মুখমণ্ডল।

আইউবী বললেন আপনারা কি জানেন না, খৃষ্টানরা মুসলিম সালতানাতকে ইঁদুরের মত কুরে কুরে টুকরো টুকরো করছে? বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে আমাদের? জানেন কি, কেন সফল হচ্ছে ওরা? যে দিন থেকে আমরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ফুলের পাপড়ী মাড়াতে শুরু করেছি, নিজেদের যুবতী কন্যাদের নগ্ন করে ওদের সম্ভ্রম ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছি, সেদিন থেকে ব্যর্থতা-ই হয়ে গেছে আমাদের বিধিলিপি। আমরা মাতৃত্বের মর্যাদা আর নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে পারছি না। আপনারা জেনে রাখুন, আমার দৃষ্টি ফিলিস্তীনে নিবদ্ধ। আপনারা আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিসরেও কি ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করতে চান?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা এক নজর দেখে জলপাম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠলেন আইউবী–

আমার পথ থেকে ফুলগুলো সরিয়ে নাও। ফুল মাড়িয়ে গেলে ও-ফুলের কাটা আমার হৃদয়টাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমার পথের তরুণীদের হটাও। আমি চাইনা ওদের রেশমী চুলে আটকে পড়ে আমার তরবারী অকেজো হয়ে যাক।

আর আমাকে কখনও হুজুর কেবলা বলে সম্বোধন করবেন না। কঠোর ঝাঝের স্বরে বললেন আইউবী। তাঁর তিরস্কারে যেন অফিসারদের দেহ থেকে মাথাগুলো সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

হুজুর কেবলা তো তিনি, যার আনীত কালেমা পড়ে আমরা সবাই মুসলমান হয়েছি। এই অধম তার নগণ্য অনুগত উম্মত মাত্র। আমি তার পয়গাম বুকে ধারণ করেই মিসর এসেছি। তার আদর্শ রক্ষায় আমি আমার জীবন কোরবান করেছি। খৃষ্টানরা আমার বুক থেকে এই পবিত্র পয়গাম ছিনিয়ে নিতে চায়, মদের জোয়ার রোম সাগরে ডুবিয়ে দিতে চায় ইসলামের ঝাণ্ডা। আমি আপনাদের বাদশা হয়ে আসিনি–এসেছি ইসলামের একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক হয়ে।

নাজির ইশারায় তরুণীরা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আড়াল হয়ে গেলো। দ্রুতপায়ে হলরুমে প্রবেশ করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

রাজকীয় দরবার হল। মাঝখানে এক লম্বা টেবিলে থোকা থোকা ফুলের তোড়া। দীর্ঘ চওড়া টেবিলের চারপাশে সাজানো রাজসিক খাবার। আস্ত মুরগী, খাসির রান, দুম্বার বক্ষদেশের মোলায়েম গোশতের রকমারী আয়োজন। কক্ষময় খাবারের মৌতাত গন্ধ।

টেবিলের এক পার্শ্বে রক্ষিত সালাহুদ্দীনের জন্যে বিশেষ আসন। আইউবী দৃঢ়পদে আসনের পাশে দাঁড়ালেন। পাশের এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন

মিসরের সব নাগরিক কি এ ধরনের খাবার খেতে পায়?

না, সম্মানিত গভর্নর। সাধারণ মানুষ তো এ ধরনের খাবার স্বপ্নেও দেখে না।

তোমরা কি সে জাতির সদস্য নও, যে জাতির সাধারণ মানুষ এমন খাবার স্বপেও দেখে না?

কারো পক্ষ থেকে কোন জবাব এলো না।

এখানে ডিউটিরত যত কর্মচারী আছে, সবাইকে ডেকে ভিতরে নিয়ে এসো। এ খাবার তারা সবাই খাবে। নির্দেশের স্বরে বললেন আইউবী।

সালাহুদ্দীন একটি রুটি হাতে নিয়ে তাতে দু টুকরো গোশত যোগ করে খেয়ে নিলেন। দ্রুত আহারপর্ব শেষ করে নাজিকে নিয়ে গভর্নরের দফতরে চলে । গেলেন।

জাঁকজমকপূর্ণ গভর্নর হাউজ। দফতর নয়, যেন এক জান্নাতি বালাখানা। দাফতরিক প্রয়োজনের চেয়ে আয়েশী আয়োজন-উপকরণ-ই বেশী। দফতরের বিন্যাসে মারাত্মক বৈষম্য। গভর্নর হাউজের দাফতরিক পরিস্থিতি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন আইউবী। তার আগেই এখানে চলে আসা আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে দেখে নিয়েছেন গভর্নর হাউজের খুঁটিনাটি। আইউবী নাজির কাছ থেকে জেনে নিলেন বিভিন্ন বিষয়।

দু ঘন্টা পর গভর্নর হাউজ থেকে বেরিয়ে এলো নাজি। দ্রুতপায়ে নিজের ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এক লাফে ঘোড়ায় আরোহণ করে লাগাম টেনে ধরলেন। প্রশিক্ষিত ঘোড়া ক্ষিপ্রগতিতে চলে গেলো দৃষ্টিসীমার বাইরে।

নিঝুম রাত। নাজির খাস কামরায় জমে উঠেছে মদের আসর। মদপানে যোগ দিয়েছে নাজির একান্ত সহযোগী দুই কমাণ্ডার। আজকের আসরের আমেজ ভিন্ন। কোন নৃত্যগীত নেই। সবার চেহারা রুক্ষ। গ্লাসের পর গ্লাস ঢেলে দিচ্ছে সাকী। গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে তিনজন।

নীরবতা ভঙ্গ করে নাজি বললেন–

এসব যৌবনের তেজ, বুঝলে? ক দিনের মধ্যেই দেখবে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

অভাগা কথায় কথায় বলে–কাবার প্রভুর কসম! ইসলামী সালতানাত থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত না করে আমি বিশ্রাম নেব না।

হু! সালাহুদ্দীন আইউবী!–তাচ্ছিল্যভরে উচ্চারণ করলো এক কমাণ্ডার সে জানে না, ইসলামী সালতানাতের নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। এখন হুকুমত চালাবে সুদানীরা।

আপনি কি বলেননি, স্পেশাল বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সব সুদানী?–নাজিকে জিজ্ঞেস করলো অপর কমাণ্ডার–বলেননি, যাদেরকে তিনি নিজের সৈন্য মনে করছেন, ওরা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ঈদরৌস! আমি বরং তাকে আশ্বাস দিয়েছি, এই পঞ্চাশ হাজার সুদানী শার্দুল তাঁর আঙুলের ইশারায় খৃষ্টানদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ওদের নিশানা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। অচিরেই ওদের বিশ্বাসের প্রতীক ক্রুশ ভূলুণ্ঠিত হবে। কিন্তু–

থেমে গেলেন নাজি।

কিন্তু আবার কি? আগ্রহের সাথে জানতে চাইলো উভয় কমাণ্ডার।

নাজি বললেন, কিন্তু সে আমাকে বললো, মিসরের নাগরিকদের নিয়ে একটি সেনা ইউনিট গড়ে তুলুন। বললো, এক এলাকার মানুষের উপর সৈন্যবাহিনীকে সীমিত রাখা উচিত নয়। সে আমাদের বাহিনীর সাথে মিসরীয়দের মিশ্রণ ঘটাতে চায়।

তা, আপনি কী বললেন?

আমি তাকে বলেছি, শীঘ্রই আপনার হুকুম তামিল করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আমি কখনই এমনটি করব না। বললেন নাজি।

সালাহুদ্দীন আইউবীর মেজাজ-মর্জি কেমন দেখলেন? নাজিকে জিজ্ঞেস করলো ঈদরৌস।

দেখেই বোঝা যায়, খুব জেদী।

আপনার অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কাছে সালাহুদ্দীন কোন ফ্যাক্টর নয়। নতুন গভর্নর হলো তো, তাই কিছুটা গরম গরম ভাব। দেখবেন, অল্প দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বললো অন্য কমাণ্ডার।

আমি তাঁর মনোভাব বদলাতে দেব না। আমি তাকে ঘোরের মধ্যেই রাখতে চাই। ক্ষমতার নেশায় বুঁদ করে রেখেই তাকে শায়েস্তা করবো। বললেন নাজি।

নাজির খাস ভবনে গভীর রাত পর্যন্ত সুরাপান আর সালাহুদ্দীন আইউবী সম্পর্কে নানা আলোচনা হলো। নাজি সহকর্মীদের নিয়ে ঠিক করলেন যদি সালাহুদ্দীন আইউবী তার কতৃত্বের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে ওঠে, তবে তারা কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হলো।

একদিকে চলছে নাজির চক্রান্ত। অপরদিকে সালাহুদ্দীন আইউবী গভর্নর হাউজে অফিসারদেরকে তার নিয়োগ ও কর্মকৌশলের কথা ব্যাখ্যা করছেন। আইউবী অফিসারদের জানালেন আমি মিসরের রাজা হয়ে আসিনি আর আমি কাউকে অন্যায় রাজত্ব করতেও দেবো না।

আইউবী অফিসারদের বললেন—সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া ইসলামী খেলাফতের দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এখানকার সেনাবাহিনীর কাঠামো ও বিন্যাস তার পছন্দ নয়, তা-ও অবহিত করলেন। বললেন–পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের স্পেশাল বাহিনীতে সবাই সুদানী নাগরিক। ব্যাপারটি ঠিক নয়। কোন কাজে আঞ্চলিকতার প্রাধান্য থাকা অনুচিত। আমরা সব অঞ্চলের মানুষকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে চাই। সবাই যাতে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের সেবায় কাজ করতে পারে। তাতে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দূর হবে। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতিকল্পে এ পদক্ষেপ ফলপ্রসূ অবদান রাখবে।

আইউবী অফিসারদের জানালেন–আমি জেনারেল নাজিকে বলে দিয়েছি, তিনি যেন মিসরের লোকদেরকে সেনাবাহিনীতে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করেন।

আপনি কি বিশ্বাস করেন, নাজি আপনার নির্দেশ পালন করবে? আইউবীর কাছে জানতে চাইলেন একজন প্রবীণ সচিব।

কেন? সে আমার নির্দেশ অমান্য করবে নাকি?

এড়িয়ে যেতে পারেন–সচিব বললেন–এ ফৌজী কার্যক্রমে তার একক আধিপত্য। তিনি এ ব্যাপারে কারো হুকুম পালন করেন না, বরঞ্চ অন্যকে পালন করতে বাধ্য করেন।

আইউবী চুপ হয়ে গেলেন। যেনো কথাটি তিনি বুঝতেই পারেননি। সচিবের কথায় তার কোন ভাবান্তর হলো না। কিছুক্ষণ ভাবলেশহীন নীরবে বসে থেকে তিনি সবাইকে গভর্নর হাউজ থেকে বিদায় করে দিলেন।

আলী বিন সুফিয়ান খানিকটা দূরে বসে আছেন। আইউবী তাঁকেই শুধু থাকতে ইশারা করলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর তাকে কাছে ডাকলেন।

আলী একজন দক্ষ গোয়েন্দা। বয়সে আইউবীর বড়। কিন্তু শরীরের শক্ত গাঁথুনি, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা আর দীর্ঘ প্রশিক্ষণ আলীকে যুবকে পরিণত করেছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিশ্বস্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও দূরদর্শী কমাণ্ডার হিসেবে আলীর অবস্থান সবার উপরে। মিসরের স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতি আর অবিশ্বস্ততার দিকটি বিবেচনায় রেখে জঙ্গী আলীকে আইউবীর সহকর্মী হিসেবে মিসর প্রেরণ করেন সালাহুদ্দীনের অধীনে শুধু আলী নিজেই আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার হাতেগড়া সুদক্ষ এক গোয়েন্দা ইউনিট। এরা কমাণ্ডো, গেরিলা অভিযান ও গোয়েন্দাকমে পটু। প্রয়োজনে আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতেও এর দ্বিধা করে না।

আলীর সবচেয়ে বেশী প্রশংসনীয় গুণটি হল, তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর একই আদর্শে বিশ্বাসী। ইসলামী খেলাফত ও মুসলমানদের কল্যাণে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে আলী আইউবীর মত সদা প্রস্তুত।

তুমি কি লক্ষ্য করেছো আলী! ওই অফিসার বলে গেলো, নাজি কারো হুকুম তামিল করে না, অন্যদেরকে সে নির্দেশ মানতে বাধ্য করে শুধু।

জী, শুনেছি। আমার মনে হয়, স্পেশাল বাহিনীর প্রধান নাজি নামের এই লোকটি খুবই কুটিল। এ লোক সম্পর্কে আগে থেকেই আমি অনেক কথা জানি। পঞ্চাশ হাজার সৈন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নেয়; অথচ প্রকৃত পক্ষে ওরা নাজির ব্যক্তিগত বাহিনী। ব্যক্তিস্বার্থে লোকটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামোটিই নষ্ট করে দিয়েছে। প্রশাসনের পদে পদে অনুগত চর। বসিয়ে রেখেছে।

সেনাবাহিনীতে সব এলাকার লোকের অনুপ্রবেশ ঘটানোর সিদ্ধান্তে আপনার সাথে আমি একমত। অচিরেই আমি এ ব্যাপারে আপনাকে বিস্তারিত জানাবো। সুদানী সৈন্যরা খেলাফতের আনুগত্যের বিপরীতে নাজির আনুগত্য করে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেনাবাহিনীর কাঠামোটাই আমাদের বদলে ফেলতে হবে কিংবা এ পদ থেকে নাজিকে সরিয়ে দিতে হবে।

আমি প্রশাসনে আমার শত্রু তৈরী করতে চাই না আলী! নাজি আমাদের হাড়ির খবর রাখে। এ মুহূর্তে ওকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরাতে আমি তরবারী হাতে নেইনি। আমার তরবারী শত্রুর রক্তের পিয়াসী। আমি সদাচারণ ও ভালোবাসা দিয়ে নাজিকে বাগে আনার চেষ্টা করছি। তুমি ওর সৈন্যদের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে আমাকে জানাও বাহিনীটা আমাদের কতটুকু অনুগত।

নাজি আনাড়ী লোক নয়। ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে ওর দুষ্ট মানসিকতা বদলানোর অবকাশ নেই। নাজি এ-সবের অনেক ঊর্ধ্বে। বেটা একটা সাক্ষাত শয়তান। ক্ষমতা, চালবাজী, দুষ্কর্মই তার পেশা এবং নেশা । লোকটা এত-ই ধূর্ত ও চালাক যে, তোষামোদ দ্বারা সে পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দিতে পারে।

সালাহুদ্দীন আইউবীকেও ঘায়েল করার জন্যে চালবাজী শুরু করলেন নাজী। সামনে কখনো তিনি নিজের আসনে পর্যন্ত বসেন না। জী, হ্যাঁ খুব ভালো, সব ঠিক রাজ্যের যত তোমোদ ও চাটুকারিতার উপযোগী শব্দ-বাক্য আছে, সবই তিনি আইউবীর সঙ্গে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। আইউবীর আস্থা অর্জনের জন্যে মিসরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে লোক রিক্রুট করতে শুরু করলেন তিনি।

ধূর্তামিপূর্ণ আচরণে আইউবী নাজির প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেন। নাজি আইউবীকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, স্পেশাল বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক খেলাফতের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত। সুদানী ফৌজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। তারা আপনাকে পেয়ে খুবই গর্বিত। আপনার সম্মানে তারা একটি সংবর্ধনার আয়োজন করার জন্যে আমার কাছে আবেদন করেছে। ওরা আপনাকে সম্মান জানাতে চায়; আপনাকে নিজেদের মতো করে কাছে পেতে ওরা খুব-ই উদগ্রীব।

সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। বললেন–আমি আপনার ফৌজের দেয়া সংবর্ধনায় যাবো।

কিন্তু দাফতরিক কাজের ঝামেলায় আইউবী নাজির অনুষ্ঠানের জন্যে সময় বের করতে পারছিলেন না। তাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পিছিয়ে গেলো কয়েক দিনের জন্য।

***

নিঝুম রাত। নাজি তার খাস কামরায় অধীন দুই কমাণ্ডার নিয়ে সুরাপানে বিভোর। গায়ে হালকা কাপড়, পায়ে নুপুর, চোখে-মুখে প্রসাধনী মেখে অস্পরা সেজে কামোদ্দীপক ভঙ্গিতে নাচছে দুই সুন্দরী নর্তকী।

নাজির খাস কামরায় যে কারোর প্রবেশাধিকার নেই। যারা নাজির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি আর একান্ত সেবিকা, নর্তকী, সাকি একমাত্র তাদেরই সিডিউল মতো নাজির ঘরে প্রবেশের অধিকার আছে। দারোয়ান জানতো, কখন কাদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।

হঠাৎ নাজির ঘরে প্রবেশ করে কানে কানে কি যেনো বললো দারোয়ান। নাজি দারোয়ানের পিছনে পিছনে উঠে এলো সঙ্গে সঙ্গে। দারোয়ান নাজিকে পার্শ্বের কক্ষে নিয়ে গেলো।

কক্ষে উপবিষ্ট এক পৌঢ়। সাথে এক তরুণী। যৌবন যেন ঠিকরে পড়ছে মেয়েটির দেহ থেকে। নাজিকে দেখেই তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালো। চোখের চাহনিতে গলে পড়লো, মায়াবী আকুতি। তরুণীর রূপের জৌলুসে তন্ময় হয়ে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো নাজি।

তরুণীর গায়ে ফিনফিনে হালকা পোশাক। খুব দামী না হলেও বেশ আকর্ষণীয়।

নাজি অভিজ্ঞ নারী শিকারী। নিজের ভোগের জন্যই শুধু নয়, নারীকে তিনি ব্যবহার করেন অন্য বহু কাজে। বড় বড় অফিসার, আমীর-উমরাকে নারীর ফাঁদে ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা নাজির অন্যতম কৌশল। সুন্দরী তরুণীদের গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার করেও নাজি সৃষ্টি করে রেখেছে নিরাপদ এক জগৎ। এ জগতে আধিপত্য শুধুই নাজির।

কসাই জন্তু দেখেই যেমন বলতে পারে এতে কত কেজি গোশত হবে, নাজিও নারী দেখলেই বলতে পারে, ও কী কাজের হবে, কোন্ কাজে একে ব্যবহার করলে বেশী ফায়দা পাওয়া যাবে।

নারী ব্যবসায়ী, চোরাচালানী, অপহরণকারীদের সাথে নাজির গভীর হৃদ্যতা। ওরা সবসময়ই নাজির জন্যে নিয়ে আসে সেরা চালান। নাজি অকাতরে অর্থ দিয়ে কিনে নেয় তার পছন্দনীয় মেয়েদের। এই পৌঢ় লোকটিও নারী ব্যবসায়ীর মতো। গায়ে আজানুলম্বিত সুদানী পোশাক। নাজিকে বললো, এই মেয়েটি নাচ-গানে বেশ পারদর্শী। মুখের ভাষা যাদুমাখা। কথার যাদুমন্ত্রে পাথর গলাতে পারে। যে কাউকে মুহূর্তের মধ্যে বশ করতে পারঙ্গম। আর রূপ-লাবণ্য তো আপনার সামনেই। আমি এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনে কমই দেখেছি। আপনিই এর যোগ্য বলে সরাসরি আপনার কাছে নিয়ে এলাম।

তরুণীর সৌন্দর্যে নাজি মুগ্ধ । মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা যাচাই করার জন্যে দু-চার কথায় তরুণীর ইন্টারভিউ নিয়ে নিলেন নাজি। তরুণীর সাথে কথা বলে নাজির মনে হলো, এ অনেক এক্সপার্ট। এ ধরনের মেয়েই তিনি তালাশ করছেন। সামান্য প্রশিক্ষণ দিলেই একে বিশেষ কাজে ব্যবহার করা যাবে।

দাম-দস্তর ঠিক হলো। মূল্য বুঝে নিয়ে চলে গেলো বেপারী। নাজি খাস কামরায় নিয়ে গেলেন মেয়েটিকে। কক্ষে তখন তুমুল নৃত্য-গান চলছে।

নাজি ঘরে প্রবেশ করতেই ওদের নাচ বন্ধ হয়ে গেলো। নাজি নতুন মেয়েটিকে নাচতে বললেন।

পরিধেয় কাপড়ের পাট খুলে দু পাক ঘুরে হাত-পা-কোমর দুলিয়ে নাচ শুরু করতেই ওর নাচের মুদ্রা ও মনকাড়া ভঙ্গি দেখে হ্যাঁ হয়ে তোলেন নাজি ও তার সহকর্মীরা। অনির্বচনীয় এই তরুণীর নাচ। এ যেন নাচ নয়, মরুর বুকে তীব্র ঝড়। সে ঝড়ে মানুষের কামভাব, দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণাকে শুধু একই তন্ত্রে পুঞ্জিভূত করে। মেয়েটির উর্বশী শরীর, কণ্ঠের সুরলহরী আর অঙ্গের পাগলকরা কম্পন মুহূর্ত মধ্যে মাতিয়ে তুললো নাজির কক্ষটিকে।

নাজি এবং তার সাথীরাই অবাক হলো না শুধু। দুই পুরাতন নর্তকীর চেহারাও পাণ্ডুর হয়ে গেলো ওর যাদুময়ী কণ্ঠ আর নাচের তালে। নাজির মনে হলো, খুব বেশী সস্তায় অনেক দামী জিনিস পেয়ে গেছেন তিনি। যোগ্যতা ও সৌন্দর্যের হিসেবে দাম অনেক বেশী হওয়া উচিত ছিলো মেয়েটির।

নাজির প্রতি ঝুঁকে নাচের ভঙ্গিতে কুর্নিশ করলো তরুণী। নাচের ঘুর্ণনে বার বার নাজির গায়ে বুলিয়ে দিচ্ছিলো কোমল অঙ্গের মোলায়েম পরশ। তরুণীর সৌন্দর্যে আনমনা হয়ে পড়লো নাজি।

আচমকা সবাইকে বিদায় করে দিলো নাজি। দরজা বন্ধ। কক্ষে শুধু নাজি আর তরুণী। কাছে ডাকলো তরুণীকে। বসাল নিজের একান্ত সান্নিধ্যে।

নাম কী তোমার? 

জোকি।

বেপারী বললো, তুমি নাকি পাথর গলাতে পারো। আমি তোমার এই যোগ্যতার পরীক্ষা নিতে চাই।

কোন্ সে পাথর, যাকে পানি করে দিতে হবে বলুন?

নয়া আমীর ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আইউবীকে। তাকে পানির মত গলিয়ে দিতে হবে তোমাকে। বললেন নাজি।

সালাহুদ্দীন আইউবী? জিজ্ঞাসা করলো জোকি।

হা, সালাহুদ্দীন আইউবী। তুমি যদি তাকে বশে আনতে পারো, তবে আমি তোমাকে তোমার ওজনের সমান স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেবো।

তিনি কি মদপান করেন?

না। মদ, নারী, নাচ-গান, আমোদ-ফুর্তিকে সে এমনই ঘৃণা করে, যেমন একজন মুসলমান শূকরকে ঘৃণা করে।

আমি শুনেছি, আপনার কাছে নাকি এমন যুবতীও রয়েছে, যাদের দেহের সৌন্দর্য আর কলা-কৌশল নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওদের যাদু কি ব্যর্থ?

এ ক্ষেত্রে আমি ওদের পরীক্ষা করিনি। আমার বিশ্বাস, তুমিই এ কাজের জন্য উপযুক্ত। আমি তোমাকে আইউবীর আচরণ-অভ্যাস সম্পর্কে আরো বলবো।

আপনি কি তাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করাতে চান?

না। এখনই এমন কিছু করতে চাই না। তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ নেই। আমি শুধু তোমার রূপের জালে তাকে ফাঁসাতে চাই। তাকে আমার পাশে বসিয়ে শরাব পান করাতে চাই। তাকে হত্যা করার ইচ্ছা থাকলে সে কাজ হাশীশ গোষ্ঠী দিয়ে আরো সহজেই করান যেতো।

তার মানে আপনি তাঁর সাথে মিত্রতা গড়ে তুলতে চান, তাই না?

জোকির দূরদর্শিতায় অভিভূত হলেন নাজি।

কথার ফাঁকে জোকি নিজের দেহের উষ্ণতায় নাজিকে কাছে নিয়ে এলো। গায়ের সুগন্ধি, সোনালী চুল, মায়াবী চোখের চটুল চাহনী আর মুখের যাদুময়তায় নাজি ক্রমশ এলিয়ে দিচ্ছিলো নিজেকে জোকির দিকে।

জোকির বুদ্ধিদীপ্ত কথায় নাজি তার সোনালী চুলের গোছা হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন–হ্যাঁ জোকি! আমি তার সাথে দোস্তী করতে চাই। তবে সে দোস্তী হবে আমার আনুগত্য ও মর্যাদার ভিত্তিতে। আমি চাই সেও আমার পানের আসরের একজন অতিথি হোক।

এর জন্য আমাকে কী করতে হবে বলুন।

নাজি একটু ভাবলেন। বললেন, বলছি তোমাকে কী করতে হবে। তবে তার আগেই তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর কথায় রয়েছে আমার চেয়েও বেশী যাদু। তোমার ভাষা, সৌন্দর্য, চালাকীর যাদু যদি কার্যকর

হয়, তবে তোমাকে জীবন্ত রাখা হবে না। সালাহুদ্দীন আইউবীও তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আর আমাকে ফাঁকি দিয়েও তুমি রক্ষা পাবে না। এ জন্যই আমি তোমাকে সব খোলাখুলি বলছি। অন্যথায় তোমার মতো একটি বাজারী মেয়ের সাথে আমার ন্যায় একজন সেনা অধিনায়ক প্রথম সাক্ষাতেই এতো কথা কখনও বলে না।

ভবিষ্যতই বলবে কার কথা ঠিক থাকে। আপনি আমাকে শুধু এতটুক বলে দিন, সালাহুদ্দীন আইউবী পর্যন্ত আমি কীভাবে পৌঁছবো? বললো জোকি।

আমি তাঁর সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করছি। সেটি হবে রাতের বেলায়। খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। ওই রাতে তাঁকে অনুষ্ঠানস্থলে একটি তাঁবুতে রাখবো। তোমাকে সেই তাঁবুতে ঢুকিয়ে দেবো। শুধু এতটুকু কাজের জন্যই আমি তোমাকে আনিয়েছি।

ঠিক আছে। বাকি পরিকল্পনা আমিই ঠিক করে নেবো।

***

চক্রান্তের জাল বুনতেই শেষ হলো রাত। রাতৈর চাদর ভেদ করে বেরিয়ে এলো দিন। আবার রাত। সমতালে চললো দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহীতার বিপরীতমুখী স্রোতের ধারা। এক দিকে আলী ও আইউবী। অপরদিকে নাজি ও তার সহযোগীরা। এভাবে পেরিয়ে গেলো আরো কয়েক রাত। সালাহুদ্দীন আইউবী প্রশাসনিক কাজে বেজায় ব্যস্ত। নতুন সৈন্য রিক্রুটমেন্টের ঝামেলায় নাজির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদানের অবসর পাচ্ছেন না তিনি।

ইত্যবসরে নাজি সম্পর্কে আলী যে রিপোর্ট দিলেন, তা শুনে আইউবীর মনে দেখা দিলো গম্ভীর হতাশা। বললেন তার মানে কি তুমি বলতে চাচ্ছো, এ লোকটি খৃষ্টানদের চেয়েও খতরনাক?

নাজি খেলাফতের আস্তিনে একটি কেউটে সাপ। নাজির দীর্ঘ দুষ্কর্মের ফিরিস্তি শুনিয়ে আলী বললেন। নাজি কিভাবে খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের চক্রান্তের জালে আটকিয়ে নিঃশেষ করছে এবং অন্যদের তার নির্দেশ মান্য ও আনুগত্য করতে বাধ্য করছে তাও জানালেন। বললেন, তার নিয়ন্ত্রিত সুদানী বাহিনীর সিপাইরা আপনার কমাণ্ড অমান্য করে তার কথা শুনবে তাতে সন্দেহ নেই। আপনি এ ব্যাপারে কী চিন্তা-ভাবনা করেছেন মাননীয় আমীর। শুধু চিন্তায় করিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি। বললেন আইউবী।

নতুন রিক্রুটমেন্টদের সুদানী সৈন্যদের সাথে মিশিয়ে দেবো। যার ফলে এরা না হবে সুদানী, না হবে মিসরী। নাজির একক আধিপত্য ও ক্ষমতা আমি খর্ব করে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। এটি সমাপ্ত হলেই তাকে তার উপযুক্ত জায়গায় সরিয়ে আনবো।

আমি বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হয়েছি যে, নাজি খৃষ্টানদের সাথেও গাঁটছড়া বেঁধেছে। আপনি যে সময়টায় জীবনের তোয়াক্কা না করে ইসলামী খেলাফতের শক্তিবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চেষ্টা করছেন, ঠিক তখন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আপনার এ প্রচেষ্টাকে বানচাল করার চক্রান্ত করছে নাজি। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

এ ব্যাপারে তুমি কী করছো?

প্রতিরোধ কৌশলের ব্যাপারটি আমার উপরে ছেড়ে দিন। আমার কাজের অগ্রগতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা আমি যথাসময়েই আপনাকে অবহিত করবো।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি নাজির চার পার্শ্বে গোয়েন্দাজাল বিছিয়ে দিয়েছি। ওর চলাচলের পথ ও অবস্থানে এমন দেয়াল তৈরী করে রেখেছি, যে শুনতেও পায়, অনুধাবন করতে পারে। প্রয়োজনে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে। আমার গোয়েন্দাদের ব্যারিকেডের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নাজির নেই।

আলী বিন সুফিয়ান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিশ্বস্ত ব্যক্তি। শুধু বিশ্বস্তই নন, আলীর কর্ম দক্ষতার উপরও আইউবীর আস্থা অপরিসীম। তাই তার পরিকল্পনার বিস্তারিত কিছু জানার প্রয়োজন বোধ করেননি আইউবী।

আলী বললেন–আমি জানতে পেরেছি, নাজি আপনাকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করছে। এ তথ্য সঠিক হলে, আমি না বলা পর্যন্ত আপনি তার সংবর্ধনা সভায় যাবেন না। এটা আমার অনুরোধ।

উঠে দাঁড়ালেন আইউবী। দু হাত পিছনে বেঁধে মেঝেতে পায়চারী করতে লাগলেন। পায়চারী করতে করতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ চিরে। হঠাৎ দৃঢ়পদে দাঁড়িয়ে আলীর উদ্দেশে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন

আলী! জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকার চেয়ে জন্মকালেই মরে যাওয়া অনেক ভালো। আমার মাঝে মধ্যে-মনে হয়, জাতির ঐসব লোকই ভাগ্যবান, সুখী, যাদের মধ্যে কোন জাতীয় চিন্তা নেই। তাদের কওমের ইজ্জত-সম্মান, ইসলাম ও মুসলিমের অবনতি-উন্নতি নিয়ে কোন উদ্বেগ নেই, মাথা ব্যথা নেই। বড় আরামে তাদের জীবন কাটে। আয়েশের ঘাটতি হয় না তাদের জীবনে।

ওরা হতভাগ্য সম্মানিত আমীর!

হ্যাঁ, আলী! ওদের নির্বিকার জীবন দেখে যখন আমার মধ্যে এসব চিন্তা ভর করে, তখন কে যেন আমার কানে কানে তোমার কথাটিই বলে দেয়। আমার ভয় হয় আলী! আমরা যদি মুসলিম মিল্লাতের অধঃপতনের ধারা ঠেকাতে না পারি, তবে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম জাতি মরু-বিয়াবান আর পাহাড়-জঙ্গলে মাথা কুটে মরবে।

মিল্লাত আজ শতধাবিচ্ছিন্ন। খেলাফত তিন ভাগে বিভক্ত।

আমীররা নিজেদের খেয়াল-খুশী মতো দেশ শাসন করছে। খৃষ্টানদের কাছে। বন্ধক দিয়ে দিয়েছে মিল্লাতের মর্যাদা। ওদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে রয়েছে তারা। আমার ভয় হয়, এ ধারা অব্যাহত থাকলে খৃষ্টানদের গোলামে পরিণত হবে সমগ্র জাতি। ওদের হুকুমবরদার হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে। এই অবস্থায় আমাদের কওম জীবিত থাকলেও পরিণত হবে অনুভূতিহীন এক মানবগোষ্ঠীতে।

আলী! বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের দিকে চেয়ে দেখো। আমাদের শাসকদের অবস্থা কী করুণ হয়েছে!

আইউবী নীরব হয়ে গেলেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কণ্ঠ তার ভারী হয়ে এলো। ঘরময় পায়চারী করতে লাগলেন তিনি।

নীচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। দাঁড়ালেন মাথা সোজা করে। আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন–

কোন জাতির ধ্বংস উপকরণ যখন জাতির ভেতর থেকেই উত্থিত হয়, তখন আর তাদের ধ্বংস রোখা যায় না আলী! আমাদের খেলাফতের আমীর-উমরার নৈতিক অধঃপতন যদি রোধ করা না যায়, তবে খৃষ্টানদের আর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে না। পারস্পরিক সংঘাত, বিদ্বেষ, লোভ আর হিংসার যে আগুন আমরা নিজেদের মধ্যে প্রজ্বলিত করেছি, ঈমান ও জাতির মর্যাদা ও কর্তব্যকে ভুলে আত্মঘাতী যে সংঘাতে আমরা লিপ্ত হয়েছি, খৃষ্টানরা তাতে ঘি ঢালবে শুধু। আমরা ওদের চক্রান্তে নিজেদের আগুনেই ধ্বংস হয়ে যাবো। জাতির শেষ রক্তবিন্দুটুকু পর্যন্ত আমাদের আত্মঘাতী সংঘাতেই ব্যয়িত হবে।

জানি না, আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো কি-না। হয়ত খৃষ্টানদের কাছে আমার পরাজয়বরণ করতে হবে। আমি কওমকে এ কথাটাই জানিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিতে চাই শুধু কাফেরের সাথে মুসলমানদের সখ্য হতে পারে না। বেঈমানদের সাথে ঈমানদারদের বন্ধুত্ব হতে পারে না। খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের সমঝোতা হতে পারে না। ওদের শুধু বিরোধিতা নয়–কঠোরভাবে দমন করাই মুসলমানদের কর্তব্য। এতে যদি যুদ্ধ করে জীবনও দিতে হয়, তাতে আমার কোন দুঃখ নেই।

আপনার মধ্যে হতাশা ভর করেছে মাননীয় আমীর! কথা থেকেই বোঝা যায়, আপনি নিজের সংকল্পে সন্দিহান। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

হতাশা আমাকে ভর করেনি আলী! নিরাশা আমাকে কখনো কাবু করতে পারে না। আমি আমৃত্যু কর্তব্য পালনে সামান্যতম ত্রুটি করবো না। বললেন আইউবী।

ফের আলীর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আইউবী বললেন সৈন্যভর্তির কাজটি বেগবান করে। এমন সব লোকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করবে, যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

আর জরুরী ভিত্তিতে তুমি একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট গড়ে তোল। তারা গোয়েন্দাগীরির পাশাপাশি শত্রু, এলাকায় রাতে গুপ্ত হামলা চালাবে। তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে, যাতে মরুভূমির উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই ইউনিটের সদস্যরা হবে বাঘের চেয়ে ক্ষিপ্র, বাজের মত তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন, হরিণের মতো সতর্ক আর সিংহের মতো সাহসী। মদের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ থাকবে না। নারীর প্রতি হবে নিরাসক্ত। সর্বোপরি ঈমানদার, নিষ্ঠাবান মুসলমানদেরকে এই স্কোয়াডে প্রাধান্য দিবে।

আলী! এ কাজটি তুমি খুব তাড়াতাড়ি সমাধা করে ফেললো। খেয়াল রাখবে, আমি সংখ্যাধিক্যে বিশ্বাসী নই। আমি চাই জানবাজ যোদ্ধা। অথর্বদের সংখ্যাধিক্য আমার দরকার নেই। আমি চাই এমন যোদ্ধা, যাদের মধ্যে আছে দেশপ্রেম, জাতিসত্ত্বার প্রতি যাদের আছে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার, যারা হবে সত্যনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ–যারা আমার উদ্দেশ্য ও সংকল্পকে অনুধাবন ও ধারণ করতে সক্ষম। যারা কখনও এমন সংশয়াপন্ন হয় না যে, কেন আমাদের প্রাণঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত করা হচ্ছে।

***

দশদিন চলে গেলো। এই দশদিনে আমীরে মেসেরের সৈন্য বাহিনীতে দশ হাজারের বেশী অভিজ্ঞ যোদ্ধা ভর্তি হলো।

অপরদিকে এ দশদিনে নাজি জোকিকে ট্রেনিং দিয়েছে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে কীভাবে তার রূপের জালে ফাঁসাতে হবে।

জোকি ভেনাসের মতো সুন্দরী। নাজির যে সহকর্মীই জোকিকে দেখেছে, সে, মন্তব্য করেছে, মিসরের ফেরাউন জোকিকে দেখলে তাকে পাওয়ার জন্যে সে খোদা দাবির কথা ভুলে যেতো।

নাজির নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী চক্রান্ত বাস্তবায়নে তৎপর। শক্তি, সামর্থ ও যোগ্যতার বিচারে এরা অসাধারণ।

নাজি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন, আলী বিন সুফিয়ান আইউবীর প্রধান উপদেষ্টা। একজন চৌকস আরব গোয়েন্দার মতোই মনে হয় আলীকে। আলীর সহযোগিতা থাকলে আইউবীকে ঘায়েল করা কঠিন হবে বুঝে নাজি আগে তার গোয়েন্দা বাহিনীকে আলীর পিছনে নিয়োগ করলেন। তিনি গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেন, আলীর গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখবে এবং সুযোগ পেলেই তাকে হত্যা করবে।

সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাঁসানোর জন্যে জোকিকে প্রস্তুত করছিলেন নাজি। অথচ মরক্কোর এই স্বর্ণকেশীর সোনালী চুলে বাঁধা পড়লেন তিনি নিজে। নাজি বিন্দুমাত্র টের পেলেন না, জোকির মুক্তাঝরা হাসি, অনুপম বাচনভঙ্গি আর নাচ-গানের ফাঁদে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি নিজেই।

জোকি নাজিকে এততাই আসক্ত করে ফেললো যে, চক্রান্তের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় সে মেয়েটিকে নিজের কোলে বসিয়ে রাখতো। নাজিরই দেয়া পোশাক, সুগন্ধি আর প্রসাধনী ব্যবহার করে জোকি তাকে বেঁধে ফেললো। ফেঁসে গেলেন নাজী তার রূপ-যৌবনের মাদকতায়, যাদুকরী চাহনী আর দেহের উষ্ণতায়।

এ কয়দিনে নাজি ভুলে গেলেন তার একান্ত প্রমোদ সঙ্গীনীদের, যাদের নাচ-গান আর শরীরের উষ্ণতা ছিলো তার একান্ত চাওয়া-পাওয়া। চার-পাঁচ দিন চলে গেলো। একবারের জন্যও তিনি সেবিকাদের একান্তে খাস কামরায় ডাকলেন না। এ কয়দিন সারাক্ষণ জোকিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন নাজি।

এই নর্তকী-সেবিকা–রক্ষিতাদের কাছে নাজি পরম আরাধ্য। এদের কাছে নাজির সান্নিধ্য ছিলো নারীত্বের বিনিময়ে দীর্ঘ ত্যাগের পরম পাওয়া। মুহূর্তের জন্যে তার সান্নিধ্য হাতছাড়া করা ছিলো এদের জন্যে মৃত্যুসম যন্ত্রণা।

জোকির আগমনে নাজির এ পরিবর্তন সহ্য করতে পারলো না দুই নর্তকী-রক্ষিতা। মেয়েটাকে হত্যা করে পথের কাটা সরিয়ে দেয়ার ফন্দি করলো ওরা। কিন্তু কাজটি সহজ নয় মোটেই।

জোকির ঘরের বাইরে সার্বক্ষণিক দুই কাফ্রীকে পাহারাদার নিযুক্ত করলেন নাজি। জোকি ঘর থেকে বের হতো না তেমন। অনুমতি নেই নতর্কীদেরও ঘরের বাইরে যাওয়ার। বহু চিন্তা-ভাবনা করে ওরা হেরেমের এক দাসীকে প্ররোচিত করার সিদ্ধান্ত নিলো।

দুজন ঠিক করলো, দাসীর মাধ্যমে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবে জোকিকে।

***

আলী বিন সুফিয়ান মিসরের পুরাতন আমীরের দেহরক্ষী বাহিনী বদল করে আইউবীর দেহরক্ষী বাহিনীতে নতুন লোক নিয়োগ করলেন। এরা সবাই আলীর নতুন রিক্রুটকরা সৈন্য। যোগ্যতার বিচারে এরা অদ্বিতীয়। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান–বিশ্বস্ত আর সাহস ও বীরত্বে সকলের সেরা।

নিজের গড়া গার্ড বাহিনীর পরিবর্তন মেনে নিতে পারলেন না নাজি। কিন্তু প্রকাশ্যে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ দেখালেন না তিনি। উল্টো গার্ড বাহিনীর পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে মোসাহেবী কথায় ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এরই ফাঁকে বিনয়ের সাথে আবার আইউবীকে সংবর্ধনায় যোগদানের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন।

আইউবী নাজির দাওয়াত গ্রহণ করলেন। বললেন, দু-একদিনের মধ্যে জানাবো আমার পক্ষে কোন্‌দিন অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে। মনে মনে কূটচালের সফলতায় উল্লসিত হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন নাজি।

নাজি চলে যাওয়ার পর আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের সাথে পরামর্শ করলেন। জানতে চাইলেন কোন্ দিন নাজির অনুষ্ঠানে যাওয়া যায়।

এখন যে কোন দিন আপনি অনুষ্ঠানে যেতে পারেন। আমার আয়োজন সম্পন্ন। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

পর দিন নাজি দফতরে এলেই আইউবী জানালেন, যে কোন রাতেই আপনার অনুষ্ঠানে যাওয়া যেতে পারে।

নাজি অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করলেন। আইউবীকে ধারণা দিলেন, অনুষ্ঠানটি হবে জমকালো, অতিশয় আড়ম্বরপূর্ণ। শহর থেকে দূরে। মরুভূমিতে। উপস্থিত হবে বিশিষ্ট নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। সৈন্য বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কুচকাওয়াজ ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে। অন্ধকার রাতে মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে পুরো অনুষ্ঠান। বিভিন্ন তবু থাকবে। সম্মানিত আমীরসহ সবারই রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হবে অনুষ্ঠানস্থলে। রাতে সৈন্যরা একটু আমোদ-ফুর্তি, নাচ-গান করবে।

আইউবী অনুষ্ঠানসূচী শুনছিলেন নাজির মুখ থেকে। নাচ-গানের কথা শুনেও তিনি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না।

নাজি একটু সাহস সঞ্চয় করে বার কয়েক ঢোক গিলে বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, সেনা বাহিনীতে বহু অমুসলিম সদস্য আছে। তাছাড়া দুর্বল ঈমানের অধিকারী নওমুসলিমও আছে অনেক। তারা মহামান্য আমীরের সৌজন্যে সংবর্ধনা সভায় একটু প্রাণ খুলে ফুর্তি করতে আগ্রহী। এজন্য তারা ওই দিন মদপানের অনুমতি চায়। তারা এ বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় ও আনন্দময় করে রাখতে চায়।

আপনি তাদের অধিনায়ক। আপনি প্রয়োজন বোধ করলে আমার অনুমতির প্রয়োজন কি বললেন আইউবী।

আল্লাহ মহামান্য আমীরের মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দিন। তোষামোদের সুরে বললেন নাজি। সামনে ঝুঁকে অনুগত গোলামের মত কুর্নিশের ভঙ্গিতে বললেন, অধম কোন্ ছার! আপনি যা পছন্দ করেন না, তার অনুমতি চেয়ে………!

আপনি ওদের জানিয়ে দিন, সংবর্ধনার রাতে হাঙ্গামা-বিশৃংখলা ছাড়া সামরিক নিয়ম মেনে তারা সবই করতে পারবে। মদপান করে কেউ যদি হাঙ্গামা বাঁধায়, তবে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। বললেন আইউবী।

নাজি কৌশলে মুহূর্ত মধ্যে ব্যারাকে এ খবর ছড়িয়ে দিলো। সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছেন। শরাব-মদ, নাচ-গান সবকিছু চলবে সেখানে। আইউবী নিজেও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। একথা শুনে সৈন্য বাহিনীতে হুলস্থুল পড়ে গেলো। একজন আরেকজনের দিকে জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। তাদের চোখে রাজ্যের বিস্ময়, এসব কী শুনছি আমরা! কেউ কেউ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, এসব নাজির মিথ্যা প্রচার। নিজের ইমেজ বাড়ানোর জন্য তিনি ভূয়া প্রচারণা চালাচ্ছেন।

কেউ আবার সাবধানে মন্তব্য করলো, নাজির যাদু আইউবীকে ঘায়েল করে ফেলেছে। সৈন্য বাহিনীতে যারা সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা সৃষ্টি করলে এ সংবাদ।

অপরদিকে এ সংবাদ নাজির ভক্ত সেনা অফিসারদের হৃদয়-সমুদ্রে বয়ে আনলো খুশির বন্যা। আইউবীর আগমনের পর থেকেই সেনাবাহিনীতে মদ-সুরা, নাচ-গান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এ কদিনে সেনাবাহিনীর মদ্যপ, লম্পট, প্রমোদবিলাসী অফিসারদের দিনগুলো কেটেছে খুব কষ্টে। যা এবার শুকনো হৃদয়-মন একটু ভিজিয়ে নেয়ার ফুরসত পাওয়া যাবে। তারা এই ভেবে উৎফুল্ল যে, কিছুদিন পরে হয়তো আমীর নিজেও মদ-সুরায় অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

আলী বিন সুফিয়ান ছাড়া আর কেউ জানতেন না, সালাহুদ্দীন আইউবীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মদপান ও নাচ-গানের এ অনুমতি দানের রহস্য কী।

***

অবশেষে একদিন এসে পড়লো কাক্সিক্ষত সন্ধ্যা। সূর্য ডুবে গেছে। মরু বিয়াবানে নেমেছে চতুর্দশী জোস্নার ঢল। চারদিকের মরুর বালু জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় চিক্ চিক্ করছে। অসংখ্য মশালের আলোয় মরুভূমি উদ্ভাসিত।

ময়দানের একধারে বিশাল জায়গা জুড়ে সারি সারি তাঁবু। মাঝামাঝি স্থানে সুশোভিত মঞ্চ। অপরূপ কারুকার্যে সাজানো। রং-বেরঙের ঝাড়বাতি আর প্রদীপ্ত মশাল মঞ্চটিকে করে তুলেছে স্বপ্নীল। পাশেই বিশিষ্ট নাগরিক ও অফিসারদের বসার প্যান্ডেল। চতুর্দিকে হাজার হাজার সশস্ত্র প্রহরী। প্রাচীরের মতো নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা।

মঞ্চ থেকে একটু দূরে অনুপম শিল্প সুষমায় তৈরী করা হয়েছে একটি সুদৃশ্য তাঁবু। সেখানে রাতযাপন করবেন স্বয়ং আমীরে মেসের।

আলী বিন সুফিয়ান রাত নামার আগেই আইউবীর জন্য নির্ধারিত তাঁবুর আশেপাশে গোয়েন্দা বাহিনীর কমাপ্তোদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। এ সময় নাজি তার বিশেষ তাঁবুতে জোকিকে শেষ নির্দেশনা দানে মহাব্যস্ত।

জোকি আজ সেজেছে অপরূপ সাজে। আকাশ থেকে যেন মর্তে নেমে এসেছে কোন রূপের পরী। কড়া সুগন্ধী দিয়ে স্নাত হয়েছে মেয়েটি। সূক্ষ্ম কারুকার্যের ধবধবে সাদা কাশফুলের মত কোমল এক প্রস্থ কাপড়ে সেজেছে জোকি। সোনালী চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে উনাক্ত কাঁধে। শ্বেতশুভ্র কাঁধের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জোকিকে করে তুলেছে স্বপ্নকন্যা। পটলচেরা হরিণী চোখে কাজল মেখে যেন হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী। কণ্ঠে তো রয়েছেই যাদুর বাঁশি। নৃত্যে রয়েছে হৃদয় ছিনিয়ে নেয়ার তাল। মাতাল করা তার সুরলহরী। এমন কোন দরবেশ নেই, আজ জোকিকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে। হালকা কাপড় ভেদ করে ঠিকরে বেরুচ্ছে জোকির বিস্ফোরমুখ রূপ-লাবণ্য। রঙিন ঠোঁটের স্মিত হাসিতে যেন ঝরে পড়ছে গোলাপের পাপড়ী।

জোকির আপাদমস্তক একবার গভীর নিরীক্ষার দৃষ্টিতে দেখলেন নাজি। সাফল্যের নেশায় মনটা ভরে উঠছে তার। কিন্তু তারপরও সতর্ক নাজি। জোকিকে আবার সাবধান করে দিলো–যদি তোমার এই অপরূপ অনিন্দসুন্দর দেহখানা দিয়ে আইউবীকে বশ করতে না পারো, তাহলে প্রয়োগ করবে মুখের যাদু। আমার শেখানো কথাগুলো ভুলো না যেন। সাবধান! তাঁর কাছে গিয়ে, আবার তার দাসী হয়ে যেয়ো না। তুমি তার কাছে হবে ডুমুরের ফুল, যা দূর থেকে দেখা যায়; কখনো ছোঁয়া যায় না।

এই রূপ-লাবণ্য দিয়ে তুমি তাকে ভৃত্য বানিয়ে নেবে। আমার বিশ্বাস, তুমি পাথর গলাতে পারবে। মিসরের এই টিই জন্ম দিয়েছিলো ক্লিওপেট্টার মতো রূপসীকে। নিজের সৌন্দর্য, প্ররোচনা, যাদুকরী কূটচাল আর রূপের আগুনে গলিয়ে সীজারের মত লৌহমানবকেও মরুর বালিতে পানির মতো বইয়ে দিয়েছিলো সে। ক্লিওপেট্টা তোমার চেয়ে বেশী সুন্দরী ছিলো না। আমি এতোদিন তোমাকে ক্লিওপেট্রার কৌশলই শিখিয়েছি। রমণীর এ চাল ব্যর্থ হয় না কোনদিন।

নাজির কথায় মুচকি হাসলো জোকি। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলো নাজির উপদেশগুলো। মিসরের এই রাতের মরুতে নাগিনীর রূপ ধরে ইতিহাসের পুরনো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তির আয়োজন করলো নতুন এ ক্লিওপেট্টা।

সূর্য ডুবেছে একটু আগে। আঁধারে মিলিয়ে গেল পশ্চিম আকাশের লালিমা। জ্বলে উঠলো হাজারো মশাল।

ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অনুষ্ঠানের দিকে পা বাড়ালেন আইউবী। মিসরের নতুন আমীরের সম্মানে নাজির এই সংবর্ধনা, সামরিক মহড়া। মিসরের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

আইউবীর ডানে-বাঁয়ে, আগে-পিছে আলী বিন সুফিয়ানের অশ্বারোহী রক্ষী বাহিনী। ওরা আলীর কমাণ্ডো বাহিনীর বিশেষ সদস্য। দশজনকে আইউবীর ভাবুর চার দিকে নিযুক্ত করা হয়েছিলো আগেই।

সংবর্ধনা। রাজকীয় অভ্যর্থনা। সুলতান আইউবী ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। বেজে উঠলো দফ। পর পর তোপধ্বনি। আমীরে মেসের সালাহুদ্দীন আইউবী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মুখরিত হয়ে উঠলো মরু উপত্যকা।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানালেন নাজি। বললেন, ইসলামের রক্ষক, জীবন উৎসর্গকারী সেনাবাহিনী আপনাকে খোশ আমদেদ জানাচ্ছে। তারা আপনার ইঙ্গিতে জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। আপনি তাদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখুন। আপনাকে পেয়ে তারা ভীষণ গর্বিত।

সালাহুদ্দীন আইউবী মঞ্চে নিজ আসনের সামনে দাঁড়ালেন। চৌকস সৈন্যদলের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার দিলো। তিনি তাদের সালাম গ্রহণ করলেন। রাজকীয় মার্চ ফাষ্ট করে ওরা আড়ালে চলে গেলো।

রাজকীয় আসনে বসলেন আইউবী। দূর থেকে কানে ভেসে এলো এক অশ্ব কুরধ্বনি। প্যান্ডেলের আলোর সীমানায় এলে দেখা গেলে, দুই প্রান্ত থেকে চারটি ঘোড়া ক্ষীপ্রগতিতে মঞ্চের সামনে ময়দানের মাঝ বুরাবর এগিয়ে আসছে। প্রত্যেক ঘোড়ায় একজন করে সওয়ার। সবাই নিরস্ত্র।

দেখে মনে হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। কিন্তু না, চোখের পলকে মঞ্চের সোজাসুজি এসে থেমে গেলো তারা। আরোহীরা এক হাতে লাগাম টেনে ধরে অন্য হাত প্রসারিত করে প্রতিপক্ষকে ডিঙিয়ে যেতে চাইলো। এক পক্ষ অপর পক্ষের আরোহীকে ঘোড়া থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। এক আরোহী প্রতিপক্ষের আরোহীকে বগলদাবা করে তার বাহন থেকে নিজের বাহনে নিয়ে দ্রুত দিগন্তে হারিয়ে গেলো। ঘোড়া থেকে ময়দানে পড়ে ডিগবাজী খাচ্ছিল দুই

আরোহী। অশ্ববাহিনীর এই ক্রীড়া-নৈপুণ্যে উপস্থিত দর্শকদের হর্ষধ্বনিতে, মরুভূমি কেঁপে উঠলো। হর্ষধ্বনিতে কানে তালা লাগার উপক্রম হলো।

এদের পর দু প্রান্ত থেকে আরো চারজন করে অশ্বারোহী অনুরূপ ক্রীড়া-নৈপুণ্য দেখালো। একে একে এলো উল্লারোহী, পদাতিক বাহিনী। এলো নেজা, বল্লম ও তরবারীধারী সৈনিকরা। নানা রকম নৈপুণ্য দেখালো। দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হর্ষধ্বনিতে অনুষ্ঠানস্থল মুখরিত হয়ে উঠলো।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সৈনিকদের ক্রীড়া-নৈপুণ্য দেখে খুশী হলেন। এমন সৈনিকের প্রত্যাশা-ই মনে লালন করেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ানের কানে কানে বললেন, এ সৈনিকদের যদি ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত করা যায়, তাহলে এদের দিয়েই খৃষ্টানদের পরাজিত করা যাবে।

নাজিকে সরিয়ে দিন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। নাজি না থাকলে এদেরকে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত করা কঠিন হবে না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির মতো অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সিপাহসালারকে অপসারণ না করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুয়াপানের সম্মতি দিয়ে তিনি নিজ চোখে দেখে নিতে চাচ্ছিলেন নাজির নিয়ন্ত্রিত সৈনিকরা আরাম-আয়েশে, ভোগ-বিলাসিতায় কতটুকু নিমজ্জিত; রণকৌশল ও কর্মদক্ষতায় কতটুকু পটু।

নাজির সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন ক্রীড়া-নৈপুণ্য, অ-মহড়া, কমাণ্ডে অভিযানের প্রদর্শনীতে প্রমাণিত হলো যুদ্ধবিদ্যা ও বীরত্ব-সাহসিকতায় তারা অসাধারণ। কিন্তু মহড়া শেষে যখন আহারের পর্ব এলো, তখনই ধরা পড়লো তাদের আসল চরিত্র।

বিশাল প্যান্ডেলের একদিকে সৈনিকদের খাওয়ার আয়োজন; অপরদিকে আমীর, পদস্থ অফিসার ও বিশিষ্ট নাগরিকদের আহারের ব্যবস্থা। অনুষ্ঠান তো নয়, যেন সুলাইমানী আয়োজন। হাজার হাজার আস্ত খাসি, দুম্বা, মুরগী আর উটের রকমারী রান্না। আরো যত রকম প্রাসঙ্গিক খাদ্য সামগ্রী হতে পারে, কোনটি বাকি রাখেননি নাজি। খাবারের মৌ মৌ গন্ধ গোটা প্যাণ্ডেল জুড়ে।

সৈনিকদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে শরাবের মশক। খাবারের চেয়ে যেন মদের প্রতিই তাদের আগ্রহ বেশী। আহার শুরু হতে না হতেই সৈনিকদের মধ্যে মদের মশক দখলের হড়োহুড়ি শুরু হলো। ক্ষুধার্ত কুকুরের মত খাবারে হামলে পড়লো সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যে নিঃশেষিত আহারের অবশিষ্টাংশ আর মদের সোরাহি নিয়ে শুরু হলো ওদের চেঁচামেচি, হৈ-হুঁল্লোড়। উচ্ছংখলতা ও হৈ-হুঁল্লোড় ছড়িয়ে পড়লো ছাউনীর বাইরেও।

নীরবে আইউবী পর্যবেক্ষণ করলেন সৈনিকদের আহরপর্ব। ভাবলেশহীন তার চেহারা। তিনি গভীরভাবে কিছু ভাবছেন চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সৈনিকদের উচ্ছংখল আচরণে তিনি নির্বা।

নাজিকে জিজ্ঞেস করলেন–হাজার হাজার সৈনিকের মধ্যে অনুষ্ঠানের জন্যে আপনি এদের কী করে বাছাই করলেন? এরা কি আপনার বাহিনীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম সৈনিক?

না, মহামান্য আমীর–ভূতের মত অনুগত ভঙ্গিতে বললেন নাজি–এই দু হাজার সৈন্য আমার বাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক। আপনি তো এদের মহড়া দেখলেন। যুদ্ধের ময়দানে এদের দুঃসাহসিক লড়াই দেখলে আপনি বিস্মিত হবেন। দয়া করে এদের সাময়িক বিশৃংখলা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। এরা আপনার ইঙ্গিতে জীবন বাজী রাখতে প্রস্তুত। আমি মাঝে-মধ্যে এদের একটু অবকাশ দেই, যাতে মরার আগে রূপ-রসে ভরা পৃথিবীর স্বাদ কিছুটা উপভোগ করে নিতে পারে।

আইউবী নাজির অযৌক্তিক ব্যাখ্যায় কোন মন্তব্য করলেন না। আইউবীকে তোষামোদের ঝরনায় স্নাত করে নাজি যখন বিশিষ্ট মেহমানদের কাছে নিজের বাহাদুরী প্রকাশে ব্যস্ত, এ সুযোগে সালাহুদ্দীন আইউবী আলীকে বললেন—

আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম, দেখেছি। সুদানী ফৌজ মদ আর বিশৃংখলায় অভ্যস্ত। তুমি বলেছিলে এদের মধ্যে ইসলামী চেতনা ও দেশপ্রেম নেই। আমি দেখছি এদের সামরিক মোগ্যতাও নেই। এই বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠালে যুদ্ধের চেয়ে এরা নিজের জীবন বাঁচানোর ধান্ধায় থাকবে বেশী। গনীমতের সম্পদ লুণ্ঠনের নেশায় থাকবে বিভোর। বিজিত এলাকায় নারীদের বাগে নিয়ে তাদের সাথে পাশবিক আচরণ করবে নিশ্চিত।

এর প্রতিকার হলো, আমাদের নতুন রিক্রুটকৃত মিসরীয় সৈনিকদেরকে এদের সাথে একীভূত করে দেয়া। তাহলে ভালোরা ভ্রষ্টগুলোর নৈতিকতাবোধ উন্নত করতে পারবে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সালাহুদ্দীন আইউবী মুচকি হাসলেন। বললেন–আলী! তুমি দেখছি আমার মনের কথাই বলছে! আমিও কিন্তু তা-ই ভাবছিলাম। কিন্তু বিষয়টা আমি এখনই প্রকাশ করতে চাই না। সাবধান! এ পরিকল্পনার কথা যেন কেউ জানতে না পারে।

আলী বিন সুফিয়ানের অসাধারণ মেধা। তিনি চেহারা দেখেই মানুষের মনের লেখা পড়ে ফেলতে পারেন। মানুষ চেনার ব্যাপারে আলী কখনো ভুল করেন না। তিনি আইউবীকে কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন। এ সময়ে মঞ্চের সামনে, হঠাৎ করে জ্বলে উঠলো বাহারী ঝাড়বাতি। মঞ্চের সামনে দামী গালিচা বিছানো। বাদক দলের যন্ত্রে বেজে উঠলো মনমাতানো সুর। ব্যাণ্ড দলের সুরের লহরি আর মরুর মৃদু বাতাসে দুলতে শুরু করলো মঞ্চের শামিয়ানা।

 মঞ্চের পিছন থেকে বাজনার সুরে সুরে নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে এলো একদল তরুণী। সংখ্যায় বিশজন। পরনে নাচের ঝলমলে পোশাক। আধখোলা দেহ। উক্ত কাঁধে ছড়ানো রেশমী চুল।

মরু রাতের মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে তরুণীদের গায়ের কাপড়। চোখ-মুখ; ঢেকে দিচ্ছে চুল। প্রত্যেকের পোশাকের রঙ ভিন্ন; কিন্তু শরীরে গড়ন এক। সবাই উর্বশী তরুণী। আবক্ষ খোলা বাহু দিগন্তে প্রসারিত। বকের মত ডানা মেলে যেন। এক গুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ উড়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে না তাদের পায়ের নড়াচড়া। এগিয়ে আসছে নৃত্যের ছন্দে দুলে দুলে, যেন বাতাসে ভর করে।

মঞ্চের সামনের গালিচায় এসে অর্ধ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেলো তারা। আইউবীর দিকে দু হাত প্রসারিত করে একই সাথে মাথা ঝুঁকালো সবাই। ওদের খোলা চুল এলিয়ে পড়লো কাঁধে। যেন কতগুলো তারা খসে পড়ছে আসমান থেকে। মাথার উপর কারুকার্যমণ্ডিত শামিয়ানা। পায়ের নীচের মহামূল্যবান কার্পেট। নর্তকীদের লতানো শরীর আর অপূর্ব সুরের মূর্ঘনায় সৃষ্টি হলো এক স্বপ্নীল নীরবতা।

মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে দৈত্যের মত এক হাবশী ক্ষীপ্রগতিতে এগিয়ে এলো। পরনে চিতা বাঘের চামড়ার মত পোশাক। হাতে বিশাল এক ডালা। ডালায় আধফোঁটা পদ্মের ন্যায় একটি বস্তু।

তরুণীদের অর্ধবৃত্তের সামনে এসে ডালাটা রেখে দ্রুত আড়াল হয়ে গেলো হাবশী।

সঙ্গীত দলের বাজনা তুঙ্গে উঠলো। বেজে উঠলো আরো জোরে। ডালা থেকে ধীরে ধীরে উত্থিত হলো এক কলি। দেখতে দেখতে সব পাপড়ী মেলে ফুটন্ত গোলাপের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো এক অপ্সরী।

মনে হচ্ছিলো লাল মেঘের আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে দ্বাদশীর চাঁদ। এক অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী। ঠোঁটে মুক্তা ঝরানো হাসির ঝিলিক। এ যেন মাটির মানুষ নয়, এক হিরে-পান্নার তৈরী ভিন গ্রহের মায়াবিনী।

দু হাত প্রসারিত করে নৃত্যের তালে এক পাক ঘুরে অভিবাদন জানালো তরুণী। আইউবীর দিকে চোখের পটলচেরা কটাক্ষ হেনে পলক নেড়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। অভ্যাগত দর্শকরা নৃত্য সঙ্গীতের বাজনা আর তরুণীদের আখি মুদিরায় তন্ময়। নিঃশ্বাসটি বেরুচ্ছে না কারো।

আইউবীর দিকে তাকালেন আলী বিন সুফিয়ান। ঠোঁটে রহস্যপূর্ণ হাসি। বললেনল মেয়েটি এতটা সুশ্রী হবে ধারণা করিনি।

আমীরে মেসেরের জয় হোক বলতে বলতে এগিয়ে এলেন নাজি। আইউবীর সামনে এসে গদগদ চিত্তে বললেন–এর নাম জোকি। আপনার খেদমতের জন্যে একে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আনিয়েছি। এ তরুণী পেশাদার নর্তকী বা বারবণিতা নয়। মেয়েটি ভালো নাচতে ও গাইতে জানে। এটা এর শখ। কখনো কোন অনুষ্ঠানে নাচে না।

মেয়েটির পিতা আমার পরিচিত। মাছ ব্যবসায়ী। বাপ-বেটি দুজনই আপনার খুব ভক্ত। এই মেয়েটি আপনাকে পয়গম্বরের মতো শ্রদ্ধা করে। এক কাজে আমি এর বাবার সাথে সাক্ষাত করতে এদের বাড়ী গেলে মেয়েটি আমাকে বললো–শুনেছি, সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের আমীর হয়ে এসেছেন। মেহেরবানী করে আপনি তাঁর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন। তাঁর পায়ে উৎসর্গ করার মতো আমার জীবন আর নাচ ছাড়া কিছুই তো নেই। আল্লাহর কসম! আমি তার খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে ধন্য হতে চাই।

মহামান্য আমীর! আপনার কাছে নাচ-গানের অনুমতি চেয়েছিলাম শুধু এ মেয়েটিকে আপনার খেদমতে পেশ করার জন্যে।

আমি নগ্ন নারী আর নাচ-গান পছন্দ করি না, একথা কি আপনি ওকে বলেছিলেন? আর যে মেয়েদের আপনি পোশাক-পরিহিতা বলছেন, ওরা তো উলঙ্গ। বললেন আইউবী।

মাননীয় আমীর! আমি ওকে বলেছিলাম, মিসরের আমীর নাচ-গান পছন্দ করেন না। ও বললো, মাননীয় আমীর আমার নাচে অসন্তুষ্ট হবেন না। আমার নাচে কোন নোংরামী থাকবে না, থাকবে শৈল্পিক উপস্থাপনা। মাননীয় আমীরের সামনে আমি নৃত্যের শিল্প সুষমাই উপস্থাপন করবো। মেয়েটি আরো বললো, হায়! আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে মহামান্য আমীরের দেহরক্ষী বাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজের জান তার জন্যে কুরবান করে দিতাম। স্বলাজ কম্পিত কণ্ঠে বললেন নাজি।

আপনি চাচ্ছেন, আমি মেয়েটিকে কাছে ডেকে ধন্যবাদ দিয়ে বলি, তুমি হাজার হাজার পুরুষের সামনে উদ্দাম নৃত্যে চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েছে, পুরুষের পাশবিক শক্তি উস্কে দিতে তুমি খুবই পারঙ্গম, এজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, তাই না?

না, না আমীরে মেসের! এমন অন্যায় চিন্তা আমি কস্মিনকালেও করিনি। কাচুমাচু হয়ে বললেন নাজি।

আমি তাকে এই নিশ্চয়তা দিয়ে এনেছি যে, এখানে এলে আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবো। আপনার সাক্ষাতে ধন্য হতে প্রচণ্ড বাসনা নিয়ে সে অনেক দূর থেকে এসেছে।

আপনি ওর দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন। ওর নাচে পেশাদারিত্বের নোংরামী নেই। নেই কোন পাপের আহ্বান। আছে শৈল্পিক কৌশলে আত্মোৎসর্গের বিনয়ভরা মিনতি। একটু চেয়ে দেখুন, মেয়েটি আপনাকে কী অপূর্ব শ্রদ্ধামাখা । দৃষ্টিতে দেখছে। নিঃসন্দেহে ইবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু এই মেয়ে ওর অনুপম নাচ, মোহিনী দৃষ্টি সবকিছু উজাড় করে দিয়ে আপনার ইবাদত করছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আপনি ওকে আপনার তাঁবুতে যাওয়ার অনুমতি দিন। ওকে মনে করুন সেই মহিয়সী মা, যার উদর থেকে জন্ম নেবে ইসলামের সুরক্ষক জানবাজ মুজাহিদ। ও হবে সেই বীরপ্রসূ মায়েদের একজন। ও সন্তানদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত সান্নিধ্যধন্য ভাগ্যবতী।

নাজি আবেগময় ভাষায় আইউবীকে বিশ্বাস করাতে চাইলো যে, এই মেয়েটি .. এক সম্ভ্রান্ত পিতার নিষ্পাপ কন্যা।

ঠিক আছে, ওকে আমার তাঁবুতে পৌঁছিয়ে দেবেন বলে নাজিকে আশ্বস্ত করলেন আইউবী।

***

নিজের অপূর্ব নৃত্যকলা দেখাচ্ছিলো জোকি। ধীরে ধীরে শরীর সংকোচিত করে একবার গালিচার উপর বসে যাচ্ছিলো আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। শারীরিক সংকোচন ও সংবর্ধনের প্রতি মুহূর্তে জোকির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো আইউবীর প্রতি। ওর ভূবনমোহিনী মুচকি হাসির মধ্যেই ফুটে উঠেছিলো মনের হাজারো কথামালা, বিনয়-নম্র আত্মোৎসর্গের আকুতি। জোকির চারপাশে অন্য মেয়েরাও ডানাকাটা পরীর বেশে উড়ছে মনোহারী প্রজাপতির মতো পাখা মেলে। মরুভূমির চাঁদনী রাতের আকাশে কোটি তারার মেলায় অসংখ্য ঝাড়বাতির আলোয়, শিল্পমণ্ডিত চাদোয়ার নীচে মনে হচ্ছে যেন স্ফটিকস্বচ্ছ পানির পুকুরে রাণীকে কেন্দ্র করে সাঁতার কাটছে একদল জলপরী।

সালাহুদ্দীন আইউবী নীরব। কী ভাবছেন বলা মুশকিল। মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে নাজির সৈন্যরা। সবাই যেন মৃত্যু-যন্ত্রণায় বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধুকছে। ভ্যাব-ড্যাবে চোখে তাকাচ্ছে নতর্কীদের প্রতি। দর্শকরা হারিয়ে গেছে স্বপ্নীল জগতে। একটানা বেজে চলছে সঙ্গীতের মৃদু তরঙ্গ। মরুভূমির নিশুতি রাতে অল্পক্ষণ মঞ্চস্থ হচ্ছে ইতিহাসের গোপন অধ্যায়, যা জানবে না সাধারণ মানুষ। যা স্থান পাবে না ইতিহাসের পাতায়।

নিজের সাফল্যে নাজি খুব খুশি। জোকি দেখিয়ে যাচ্ছে যাদুকরী নাচ। সমতালে চলছে বাজনা। গম্ভীর হচ্ছে রাত।

***

রাত অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। বিরতি টানা হলো নৃত্যসঙ্গীতে। সবাই চলে গেলো যার যার তাঁবুতে। জোকি শৈল্পিক ভঙ্গিতে হেলে-দুলে প্রবেশ করলো নাজির কামরায়।

নিজের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন আইউবী। দক্ষ কারিগরের হাতে সাজানো তাঁবু। মেঝেতে ইরানী কার্পেট। দরজায় ঝুলান্ত রেশমী পর্দা। রাজকীয় পালঙ্কে চিতা বাঘের চামড়ায় মোড়ানো বিছানা। ঝুলানো ঝাড়বাতির আলোয় তাঁবুর ভিতরে চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতা। বাতাসে দুর্লভ আতরের সুবাস।

আইউবীর পিছনে পিছনে তাঁবুতে ঢুকলো নাজি। বললেন–ওকে একটু সময়ের জন্যে পাঠিয়ে দেবো কি? আমি ওয়াদা ভঙ্গকে খুব ভয় করি।

হ্যাঁ, দিন। বললেন আইউবী।

শিয়ালের মত নাচতে নাচতে নিজ তাঁবুর দিকে লাফিয়ে চললেন নাজি।

কয়েক মুহূর্ত পরে প্রহরীরা দেখলো আইউবীর তাঁবুর দিকে অতি সন্তর্পণে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে এক তরুণী। গায়ে তার নর্তকীর পোশাক।

আইউবীর তাঁবুর চারপাশে প্রখর আলোর মশাল। নাজি তাঁবুর চতুর্দিকে। কোন আলোর ব্যবস্থা রাখেননি। ব্যবস্থাটা করেছেন আলী বিন সুফিয়ান। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যেই এ আয়োজন, যাতে কোন দুষ্কৃতিকারীর আগমন হলে পরিষ্কার তাকে চেনা যায়। বিশেষ প্রহরার জন্যে আইউবীর তাঁবুর প্রহরীদেরও নিযুক্তি দেন আলী।

তাঁবুর কাছে আসতেই মশালের আলোয় প্রহরীরা দেখতে পেলো নর্তকীকে। এই সেই নর্তকী। এখনও গায়ে তার নাচের ফিনফিনে পোশাক। ঠোঁটে মায়াবী হাসির আভা।

পথ রোধ করে দাঁড়ালো প্রহরী দলের কমাণ্ডার। বললো, এদিকে যেতে পারবে না তুমি।

মহামান্য আমীর আমাকে তার তাঁবুতে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললো জোকি।

হু! সালাহুদ্দীন আইউবী তোমার ন্যায় বাজে মেয়েদের সাথে রাত কাটানোর মত আমীর নন।

না ডাকলে কোন সাহসে আমি এখানে আসবো?

কার মাধ্যমে তোমাকে ডেকে পাঠালেন?

সেনাপতি নাজি আমাকে বলেছেন, মহামান্য আমীর তোমাকে তার তাঁবুতে ডেকেছেন।

বিশ্বাস না হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন। যেতে না দিলে আমি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমীরের নির্দেশ অমান্য করার দায়দায়িত্ব আপনার।

দেহরক্ষী কমাণ্ডার বিশ্বাস করতে পারছিলো না, সালাহুদ্দীন আইউবী এক নর্তকীকে রাতে তার শয়নঘরে ডেকে পাঠাবেন। আইউবীর চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্কে কমাণ্ডার অবগত। সে এ আদেশও জানতো যে, কেউ নর্তকী-গায়িকাদের সাথে রাত কাটালে তাঁকে একশ দোররা মারা হবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো কমাণ্ডার। কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত কমাণ্ডার আইউবীর তাঁবুতে ঢুকে পড়লো।

কম্পিত কণ্ঠে বললো–বাইরে এক নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে। ও বলছে হুজুর জাঁহাপনা নাকি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?

হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আইউবী।

বেরিয়ে এলো কমাণ্ডার।

আইউবীর তাঁবুতে প্রবেশ করলো জোকি। প্রহরীদের ধারণা, এক্ষুণি সালাহুদ্দীন আইউবী নর্তকীকে তাঁবু থেকে বের করে দেবেন। তারা আমীরের সে নির্দেশের জন্যে তাঁবুর কাছেই অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু না। এমন কোন আওয়াজ ভিতর থেকে এলো না।

রাত বাড়ছে। ভিতর থেকে ভেসে আসছে ফিসফিস কণ্ঠস্বর। অস্থির পায়চারী করছে দেহরক্ষী কমাণ্ডার। তাঁর মাথায় তোলপাড় করছে আকাশ-পাতাল ভাবনা। এক প্রহরী কমাণ্ডারকে বলেই বসলো–ও….. যত আইন শুধু আমাদের বেলায়

হ্যাঁ, আইন আর শাসন অধীনদেরই জন্য। শাস্তির যত খড়গ প্রজাদের জন্যে। বললো এক সিপাই।

মিসরের আমীরের জন্যে কি দোররার শাস্তি প্রযোজ্য নয়? বললো অন্য এক সিপাই।

না, রাজা-বাদশার কোন শাস্তি হয় না–ঝাঝের কণ্ঠে বললো কমাণ্ডার হয়ত সালাহুদ্দীন আইউবী মদও পান করেন। আমাদের উপর কঠোর শাসনের দণ্ড ঠিক রাখতে প্রকাশ্যে একটা পবিত্রতার ভান করেন মাত্র।

একটি মাত্র ঘটনায় সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি সৈনিকদের এত দিনের বিশ্বাস কপুরের মত উড়ে গেলো। এতদিন যাদের কাছে সালাহুদ্দীন ছিলেন একজন ইসলামী আদর্শের মূর্তপ্রতীক, সে স্থলে তাদের কাছে এখন তিনি ভালো মানুষীর ছদ্মাবরণে পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বিলাসী চরিত্রহীন এক আরব শাহজাদা।

নাজি আজ পরম উফুল্ল। সালাহুদ্দীন আইউবীকে ঘায়েল করার সাফল্যে আজ মদ স্পর্শ করেনি সে। আনন্দে দুলছে লোকটা। সহকারী ঈদরৌসও নাজির তাঁবুতে বসা।

গেলো তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। মনে হয় আমাদের তীর সালাহুদ্দীন আইউবীর অন্তর ভেদ করেছে। মন্তব্য করলো ঈদরৌস।

আমার নিক্ষিপ্ত তীর কবে আবার ব্যর্থ হলো?

বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নাজি। ব্যর্থ হলে দেখতে, আমাদের ছোঁড়া তীর সাথে সাথে আমাদের দিকেই ফিরে আসতো।

আপনি ঠিকই বলেছেন। মানবরূপী একটা যাদুর কাঠি জোকি। বললো ঈদরৌস। মনে হয় ও হাশীশীদের সাথে কখনো থেকে থাকবে। না হয় মেয়েটা আইউবীর এমন পাথরের মূর্তি ভাঙ্গল কী করে।

আমি ওকে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, হাশীশীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। সাফল্যের ভঙ্গিতে বললেন নাজি। এখন আইউবীর গলা দিয়ে মদ ঢুকানোর কাজটি শুধু বাকি।

কারো পায়ের শব্দে লাফিয়ে উঠে তাঁবুর বাইরের এলেন নাজি। না, জোকি নয়। এক প্রহরী স্থান বদল করতে হেঁটে যাচ্ছে। নাজি আইউবীর তাঁবুর দিকে তাকালেন। দরজায় পর্দা ঝুলানো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী।

বিজয়ের হাসিমাখা কণ্ঠে তাঁবুর ভিতরে বসতে বসতে নাজি বললেন এখন আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আমার জোকি এতক্ষণে পাথর গলিয়ে পানি করে ফেলেছে।

***

রাতের শেষ প্রহর। আইউবীর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো জোকি। নাজির তাঁবুতে না গিয়ে উল্টা দিকে রওনা দিলো ও। পথেই আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত এক ব্যক্তি দাঁড়ানো। ক্ষীণ আওয়াজে ডাকলেন জোকি! দ্রুত পায়ে জোকি চলে গেলো লোকটির কাছে। লোকটি জোকিকে নিয়ে একটি তাঁবুতে প্রবেশ করলো।

জোকি অনেকক্ষণ কাটালো ওই তাঁবুতে। তারপর বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিলো নাজির তাঁবুর দিকে।

নাজি তখনও জাগ্রত। বারকয়েক তাকিয়ে দেখেছে আইউবীর তাঁবুর দিকে। সে জোকির আগমনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু জোকিকে আসতে দেখেনি। তার ধারণা, জোকি সালাহুদ্দীন আইউবীকে রূপের মায়াজালে আবদ্ধ করেছে। আসমানের সুউচ্চ অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে জোকি তার মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে।

ঈদরৌস! রাত তো প্রায় শেষ। ও-তে এখনো এলো না!

ও আর আসবেও না–বললো ঈদরৌস–আমীর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। এমন হীরের টুকরোকে শাহজাদারা কখনো ফিরিয়ে দেয় না–এ কথাটি কখনো আপনি ভেবেছেন কি মাননীয় সেনাপতি?.

না তো! এ দিকটি আমি মোটেও ভাবিনি।

এমনও হতে পারে যে, আমীর জোকিকে বিয়ে করে ফেলবেন–বললো ঈদরৌস–তখন আর মেয়েটি আমাদের কাজের থাকবে না।

ও খুব সতর্ক মেয়ে। অবশ্য নর্তকীদের উপর ভরসা করা যায় না। তাছাড়া জোকি পেশাদার নর্তকী মেয়ে। এ ধরনের কাজে সে অভিজ্ঞ। ধোকা দেয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বললেন নাজি।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে নাজি। তার এতক্ষণের সাফল্যের ঝিলিককে ঘন মেঘমালার আড়ালে হারিয়ে দিয়েছে বিপরীত চিত্তা। এমন সময় পর্দা ফাঁক করে তাঁবুতে প্রবেশ করলো জোকি। হাসতে হাসতে বললো, এবার আমায় ওজন করুন আর পাওনা চুকিয়ে দিন।

আগে বল কী করে এলে? পরম আগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন নাজি।

আপনি যা চাচ্ছিলেন, তা-ই করেছি। কে বললো, আপনাদের সালাহুদ্দীন আইউবী পাথর? আবার উনি নাকি ইস্পাতের মত ধারালো, মুসলমানদের জন্যে আল্লাহর রহমতের ছায়া?

পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুড়তে জোকি বললো, সে এখন এই বালু কণার চেয়েও হালকা। এখন সামান্য বাতাসই উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাঁকে।

তোমার রূপের যাদু আর কথার মন্ত্র তাকে বালুতে পরিণত করেছে বললো ঈদরৌস–নয়তো হতভাগা পাথুরে পর্বতই ছিলো।

ছিলো বটে, তবে এখন বালিয়াড়িও নয়।

আমার সম্পর্কে কোন কথা হয়েছে কি? জিজ্ঞেস করেন নাজি।

হ্যাঁ, হয়েছে। সালাহুদ্দীন আইউবী জিজ্ঞেস করেছেন, নাজি কেমন মানুষ। আমি বলেছি, মিসরে যদি আপনার কারো উপরনির্ভর করতে হয়, সেই লোকটি একমাত্র নাজি। তিনি জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে কিভাবে চিনি? বলেছি, নাজি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি আমাদের বাড়িতে যেতেন এবং আমার পিতাকে বলতেন, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর গোলাম। তিনি যদি আমাকে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, নির্ধিধায় আমি তা করতে প্রস্তুত। তারপর তিনি বললেন, তুমি তো সতী-সাধ্বী মেয়ে। বললাম, আমি আপনার দাসী; আপনার যে কোন আদেশ আমার শিরোধার্য। তিনি বললেন, কিছু সময় তুমি আমার কাছে বসে থাক। আমি তার পার্শ্বে গা ঘেষে বসে পড়লাম। মুহূর্ত মধ্যে তিনি মোম হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমরা দুজন প্রেমের অতল সমুদ্রে হারিয়ে গেলাম। পরে তিনি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, জীবনে আমি এই প্রথমবার পাপ করলাম; তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি বললাম, না, আপনি কোন পাপ করেননি। আমার সঙ্গে আপনি প্রতারণাও করেননি, জোর-জবরদস্তিও নয়। রাজা-বাদশাহদের ন্যায় আদেশ দিয়ে আপনি আমায় ডেকে আনেননি। আমি নিজেই এসে স্বেচ্ছায় আপনার হাতে ধরা দিয়েছি। আসবো আবারো। বললো জোকি।

আনন্দের আতিশয্যে নাজি বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটিকে। নাজি ও জোকিকে মোবারকবাদ জানিয়ে ঈদরৌস বেরিয়ে যায় তাঁবু থেকে।

***

মরুর রহস্যময় রাতের উদর থেকে জন্ম নিলো যে প্রভাত, তা অন্য কোন প্রভাতের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে প্রভাত-কিরণ তার আঁধার বক্ষে লুকিয়ে রেখেছিলো এমন একটি গোপন রহস্য, যার দাম সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর স্বপ্নের সালতানাতে ইসলামিয়ার মূল্যের সমান, যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যৌবন লাভ করেছেন সুলতান আইউবী।

গত রাতে এ মরুদ্যানে যে ঘটনাটি ঘটলো, তার দিক ছিলো দুটি। একটি দিক সম্পর্কে অবগত ছিলেন শুধু নাজি আর ঈদরৌস। অপর দিক সম্পর্কে অবহিত ছিলো সুলতান আইউবীর রক্ষী বাহিনী। আর সুলতান আইউবী, গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান ও জোকীর জানা ছিলো ঘটনার উভয় দিক।

সুলতান আইউবী ও তাঁর সহকর্মীদের মর্যাদার সাথে বিদায় জানান নাজি। পথের দু ধারে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে সুলতান আইউবী জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে সুদামী ফৌজ। কিন্তু এই শ্লোগানের কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না সুলতান। সামান্য একটু হাসির রেখাও দেখা গেলো না তার দু ঠোঁটের ফাঁকে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেন সুলতান। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে নাজির সঙ্গে করমর্দন করে ছুটে চলেন তিনি।

হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ান ও এক নায়েবকে সঙ্গে করে কক্ষে প্রবেশ করেন। বন্ধ হয়ে যায়, কক্ষের দরজা। বেলা শেষে রাত নামে। আঁধারে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। বাইরের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই কক্ষের এই তিনটি প্রাণীর। খাবার তো দূরের কথা, এত সময়ে এক ফোঁটা পানিও ঢুকলো না কক্ষে। কক্ষের দরজা খুলে যখন তিনজন বাইরে বের হন, রাত তখন দ্বি-প্রহর।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে চলে যান আইউবী। রক্ষী বাহিনীর এক কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের কাছে এগিয়ে এসে বিনীত সুরে বললো–মোহতারাম! বিনা বাক্যব্যয়ে আপনাদের আদেশ মান্য করে চলা আমাদের কর্তব্য। তথাপি একটি কথা না বলে পারছি না। আমার ইউনিটে এক রকম হতাশা ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি নিজেও তার শিকার হতে চলেছি।

কেমন হতাশ? জানতে চান আলী বিন সুফিয়ান।

আমার অভিযোগকে যদি আপনি গোস্তাখী মনে না করেন, তবেই বলবো। আমাদের মহামান্য গভর্নরকে আমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা মনে করতাম এবং সর্বান্তকরণে তার প্রতি ছিলাম উৎসর্গিত। কিন্তু রাতে ………। বললো কমাণ্ডার।

রাতে সুলতান আইউবীর তাঁবুতে একটি নর্তকী গিয়েছিলো, তা-ই তো? তুমি কোন গোস্তাখী করোনি। অরাধ গভর্নর করুন কিংবা ভূত্য করুক, শাস্তি। দুজনের-ই সমান। পাপ সর্বাবস্থায়-ই পাপ । তবে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমীরে মেসের ও নর্তকীর নির্জন মিলনের সঙ্গে পাপের কোন সংশ্রব ছিলো না। বিষয়টা কী ছিলো, তা এখনই বলবো না; সময়ে তোমরা সবই জানতে পারবে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ান কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, মন দিয়ে আমার কথাগুলো শোন আমের বিন সালেহ! তুমি একজন প্রবীণ সৈনিক। তোমার ভালো করেই জানা আছে, সেনাবাহিনী ও সেনা কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপন–রহস্য থাকে, যার সংরক্ষণ আমাদের সকলের কর্তব্য। নর্তকীর আমীরে মেসেরের তাঁবুতে রাত কাটানোও তেমনি এক রহস্য। তুমি তোমাদের জানবাজদের কোন সংশয়ে পড়তে দিও না। রাতে সুলতানের তাঁবুতে কী ঘটেছিলো, তা নিয়ে কাউকে ভুল বুঝবার সুযোগ দিও না।

আলী বিন সুফিয়ানের বক্তব্যে কমাণ্ডার নিশ্চিত হয়ে যায়। দূর হয়ে যায় তার মনের সব সন্দেহ। বাহিনীর অন্য সকলের মনের খটকাও দূর করে ফেলে সে।

পরদিন দুপুর বেলা। আহার করছেন সুলতান আইউবী। ইত্যবসরে সংবাদ আসে, নাজি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করছে। সুলতানের খাওয়া শেষ হলে কক্ষে প্রবেশ করেন নাজি। তার চেহারা বলছে, লোকটা সন্ত্রস্ত ও ক্ষুব্ধ। খানিকটা চড়া গলায় বললো, মহামান্য আমীর! এ-কি আদেশ জারি করলেন আপনি! পঞ্চাশ হাজার অভিজ্ঞ সুদানী ফৌজকে মিসরের এই আনাড়ী বাহিনীর মধ্যে একাকার করে দিলেন!

হ্যাঁ, নাজি! আমি গতকাল সারাটা দিন এবং আধা রাত ব্যয় করে এবং গভীরভাবে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি যে বাহিনীটির সালার, তাকে মিসরী বাহিনীর সঙ্গে এমনভাবে একাকার করে ফেলবো যে, প্রতিটি ইউনিটে সুদানী সৈন্যের সংখ্যা থাকবে মাত্র দশ শতাংশ। আর এতক্ষণে তুমিও নির্দেশ পেয়ে গেছো, তুমি আর এখন সে বাহিনীর সালার নও, তুমি সেনা হেডকোয়ার্টারে চলে আসবে।

মহারাজ! আপনি আমাকে এ কোন্ পাপের শাস্তি দিচ্ছেন? বললেন নাজি।

আমার এ সিদ্ধান্ত যদি তোমার মনঃপূত না হয়ে থাকে, তাহলে তুমি আমার সেনাবাহিনী থেকে সরে দাঁড়াও। বললেন সুলতান আইউবী।

আমি বোধ হয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। আমি, আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন মনে করি। হেডকোয়ার্টারে আমার অনেক শত্রু আছে।

শোন! প্রশাসন ও সেনাবাহিনী থেকে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা যেন চিরতরে দূর হয়ে যায়, তার জন্যই আমার এ সিদ্ধান্ত। আরেকটি কারণ, আমি চাই সেনাবাহিনীতে যার পদমর্যাদা যত উঁচু হোক কিংবা যত নিচু, যেন কেউ মদপান ও ব্যভিচার না করে এবং কোন সামরিক মহড়ায় নাচ-গান না হয়। বললেন, সুলতান আইউবী।

কিন্তু আলীজাহ! আমি তো আয়োজনটা হুজুরের অনুমতি নিয়েই করেছিলাম। বললেন নাজি।

তা ঠিক। তুমি যে বাহিনীটিকে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সৈনিক বলে দাবি করতে, মদ ও নাচ-গানের অনুমতি আমি তার আসল রূপটা দেখার জন্যই দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈন্যকে আমি বরখাস্ত করতে পারি না। তাই মিসরী ফৌজের সঙ্গে একাকার করে আমি তাদের চরিত্র শোধরাবো। আর তুমি এ কথাটিও শুনে নাও যে, আমাদের মধ্যে কোন মিসরী, সুদানী, শামী ও আজমী নেই। আমরা মুসলমান। আমাদের পতাকা এক, ধর্মও অভিন্ন। বললেন সুলতান আইউবী।

আমীরে মোহতারাম কি ভেবে দেখেছেন, এতে আমার মর্যাদা কোথায় নেমে যাবে? ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন নাজি।

দেখেছি; তুমি যার যোগ্য, তোমায় সেখানেই রাখা হবে। নিজের অতীতের পানে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নাও। নিজের কারগুজারী আমার কাছে শুনতে চেও না। যাও, তোমার সৈন্য, সামান-পত্র ও পশু ইত্যাদির তালিকা প্রস্তুত করে এক্ষুণি আমার নায়েবের কাছে হস্তান্তর করো। সাতদিনের মধ্যে আমার হুকুমের তামিল সম্পন্ন হয়ে যায় যেন।

কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাইলেন নাজি। কিন্তু সুযোগ না দিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান সুলতান আইউবী।

***

সুলতান আইউবীর তাঁবুতে জোকির রাত যাপনের সংবাদ পৌঁছে গেছে নাজির গোপন হেরেমে। নাজির হেরেমের অন্যান্য মেয়েদের মনে জোকির বিরুদ্ধে হিংসার আগুন প্রজ্বলিত হয়ে আছে পূর্ব থেকে-ই। এই হেরেমে জোকির আগমন ঘটেছে মাত্র কদিন হলো। কিন্তু প্রথম দিনটি থেকেই তাকে নিজের সঙ্গে রাখতে শুরু করেছেন নাজি। পলকের জন্য চোখের আড়াল করছেন না সে নবাগতা এই মেয়েটিকে। থাকতে দিয়েছেন আলাদা কক্ষ।

মহলের অন্য মেয়েদের জানা ছিলো না, নাজি জোকিকে সালাহুদ্দীন আইউবীকে মোমে পরিণত করার এবং বড় রকম নাশকতামূলক পরিকল্পনায় কাজ করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। জোকি নাজিকে হাত করে নিয়েছে, এ দেখেই মহলের অন্য মেয়েরা জ্বলে-পুড়ে ছাই হচ্ছে।

হেরেমের দুটি মেয়ে জোকিকে হত্যা করার কথাও ভাবছিলো। এবার তারা দেখলো, স্বয়ং মিসরের গভর্নরও মেয়েটিকে এমন পছন্দ করে ফেলেছেন যে, জোকিকে তিনি রাতভর নিজের তাঁবুতে রাখলেন। এতে পাগলের মতো হয়ে পড়েছে তারা।

জোকিকে হত্যা করার পন্থা দুটি। হয়ত বিষ খাওয়াতে হবে, অন্যথায় অড়াটিয়া ঘাতক দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হবে। এর একটিও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, জোকি এখন নিজের কক্ষ থেকে বের হয় না এবং তার কক্ষে ঢুকে বিষ প্রয়োগও সম্ভব নয়।

হেরেমের সবচে চতুর চাকরানীটিকে হাত করে নিয়েছিলো তারা। এবার দাবি অনুপাতে পুরস্কার দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে চাকরানীর কাছে। বিচক্ষণ চাকরানী বললো, সালারের শয়নকক্ষে ঢুকে জোকিকে বিষপান করানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর দ্বারা খুন করা যেতে পারে। তবে এর জন্য সময়ের প্রয়োজন।

জোকির গতিবিধির প্রতি দৃষ্টি রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় চাকরানী। মহিলা এ-ও বলে, আমি কোন সুযোগ বের করতে না পারলে হাশীশীদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তবে তারা বিনিময় নেয় অনেক। বিনিময় যত প্রয়োজন হয়  দবে বলে নিশ্চয়তা দেয় মেয়ে দুটো।

***

ক্ষুব্ধ মনে নিজ কক্ষে পায়চারী করছেন নাজি। তাকে শান্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে জোকি। কিন্তু উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে তার ক্ষোভ।

আইউবীর কাছে আপনি আমাকে আরেকবার যেতে দিন। আমি লোকটাকে বোতলে ভরে ফেলবো। বললো জোকি।

লাভ হবে না। কমবখৃত তার নির্দেশনামা জারি করে ফেলেছে; যার বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে। লোকটা আমার অস্তিত্বই শেষ করে দিলো। তোমার যাদু তার উপর অচল। আমার বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্রটা কে করলো, তা আমি জানি। বেটা আমার ক্রমবর্ধমান মর্যাদা ও যোগ্যতায় হিংসা করছে। আমি মিসরের গভর্নর হতে যাচ্ছিলাম। আমি মিসরের শাসকবর্গের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতাম। অথচ আমি ছিলাম একজন সাধারণ সালার। এখন আমি একজন সালারও নই। গর্জে উঠে বললেন নাজি। দারোয়ানকে বললেন, ঈদরৌসকে এক্ষুণি ডেকে আনন।

সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয় নাজির নায়েব ঈদরৌস। নাজি বলেন, আমি এর উপযুক্ত একটা জবাব ঠিক করে রেখেছি।

কী জবাব জানতে চায় ঈদরৌস।

বিদ্রোহ। বললেন নাজি।

শুনে নির্বাক নিষ্পলক নাজির প্রতি তাকিয়ে থাকে ঈদরৌস। ক্ষণকাল নীরব থেকে নাজি বললেন, তুমি অবাক হয়েছে? এই পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্য আমাদের ওফাদার হওয়ার ব্যাপারে তোমার কোন সন্দেহ আছে? এরা কি? সালাহুদ্দীন আইউবীর তুলনায় আমাকে ও তোমাকে বেশী মান্য করে না? তুমি কি ম তোমার বাহিনীকে এই বলে বিদ্রোহের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে পারবে না যে, সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদেরকে মিসরীদের গোলামে পরিণত করছে; অথচ মিসর তোমাদের?

গভীর, এক নিঃশ্বাস ছেড়ে ঈদরৌস বললো, এরূপ কোন পদক্ষেপ নিয়ে আমি চিন্তা করে দেখিনি। বিদ্রোহের আয়োজন আঙ্গুলের এক ইশারায়-ই হতে । পারে। কিন্তু মিসরী বাহিনী আমাদের বিদ্রোহ দমন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। বাইরের সাহায্য নেয়ার ব্যবস্থাও তাদের আছে। সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে । জড়িয়ে পড়ার আগে সবদিক ভালো করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

আমি সবই ভেবে দেখেছি। খৃষ্টান সম্রাটদের কাছে সাহায্যের আবেদন। পাঠাচ্ছি। তুমি দুজন দূত প্রস্তুত করো। তাদের অনেক দূর যেতে হবে। এসো, আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোন। জোকি! তুমি তোমার কক্ষে চলে যাও। বললেন নাজি।

নিজ কক্ষে চলে যায় জোকি। নাজি ও ঈদরৌস পরিকল্পনা আঁটে সারা রাত জেগে।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দুই বাহিনীকে একীভূত করার সময় ঠিক করেছিলেন সাত দিন। কাগুঁজে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। পূর্ণ সহযোগিতা করছেন নাজি। কেটে গেছে চারদিন। এ সময়ে নাজি আরেকবার সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে। কিন্তু কোন অভিযোগ করেননি। বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে সে সালাহুদ্দীন আইউবীকে নিশ্চিন্ত করে দেয় যে, সপ্তম দিনে দুই বাহিনী এক হয়ে যাবে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নায়েবগণও তাকে নিশ্চিত করে, নাজি বিশ্বস্ততার সাথে সহযোগিতা করছে। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের রিপোর্ট ছিলো ভিন্ন রকম। আলীর গোয়েন্দা বিভাগ রিপোর্ট করেছে, সুদানী ফৌজের সিপাহীদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিশংখলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মিসরী ফৌজের সঙ্গে একীভূত হতে তারা সম্মত নয়। তাদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মিসরী ফৌজের সঙ্গে একীভূত হলে তাদের অবস্থান গোলামের মতো হয়ে যাবে। তারা গনীমতের সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে এবং তাদেরকে গাধার মত খাটতে হবে। সবচে বড় ভয়, তাদের মদপান করার অনুমতি থাকবে না। 

আলী বিন সুফিয়ান এ রিপোর্ট সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে পৌঁছিয়ে দেন। জবাবে সুলতান বললেন, এরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিলাসিতা করে আসছে তো, তাই হঠাৎ এই পরিবর্তন মনোঃপূত হচ্ছে না। আশা করি ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের গা-সহা হয়ে যাবে। এতে চিন্তার কিছু নেই।

আচ্ছা ঐ মেয়েটির সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়েছে কি? জিজ্ঞেস করেন সুলতান।

না। ওর সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমার লোকেরাও ব্যর্থ হয়েছে। নাজি তাকে বন্দী করে রেখেছে। জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।

পরের রাতের ঘটনা।

সবেমাত্র আঁধার নেমেছে। জোকি তার কক্ষে উপবিষ্ট। ঈদরৌসকে সঙ্গে নিয়ে নাজি তার কক্ষে বসা। ঘোড়ার পদশব্দ শুনতে পায় জোকি। দরজার পর্দাটা ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকায় সে। বাইরে দীপের আলোতে দুজন আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে দেখতে পায় মেয়েটি। পোশাকে তাদেরকে বণিক বলে মনে হলো তার। কিন্তু ঘোড়া থেকে অবতরণ করে যখন তারা নাজির কক্ষের দিকে পা বাড়ায়, তখন তাদের চলনে বুঝা গেলো, লোকগুলো ব্যবসায়ী নয়।

ইত্যবসরে বাইরে বেরিয়ে আসে ঈদরৌস। তাকে দেখেই থেমে যায় আগন্তুকদ্বয়। সামরিক কায়দায় সালাম করে ঈদরৌসকে। ঈদরৌস তাদের চারদিক ঘুরে, আপাদমস্তক গভীরভাবে নিরীক্ষা করে বলে, অস্ত্র কোথায় দেখাও। চোগার পকেট ও আস্তিনের ভিতর থেকে অস্ত্র বের করে দেখায় তারা। ক্ষুদ্র আকারের একটি তরবারী ও একটি করে খঞ্জর। তাদেরকে ভিতরে নিয়ে যায় ঈদরৌস।

গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায় জোকি। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে নাজির কক্ষপণে হাঁটা দেয়। কিন্তু দারোয়ান দরজায় তার গতিরোধ করে বলে, ভিতরে যেতে পারবেন না, নিষেধ আছে। জোকি বুঝে ফেলে, বিশেষ কোন ব্যাপার আছে। তার মনে পড়ে যায়, দু রাত আগে নাজি তার উপস্থিতিতে ঈদরৌসকে বলেছিলো, আমি খৃষ্টান সম্রাটদের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। তুমি দুজন। দূত প্রস্তুত করো; অনেক দূর যেতে হবে। তারপর আমাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে বিদ্রোহের কথাও বলেছিলো।! নিজের কক্ষে চলে যায় জোকি। জোকি ও নাজির কক্ষের মধ্যখানে একটি দরজা, যা অপর দিক থেকে বন্ধ। এ দরজাটির সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যায় জোকি। অপর কক্ষে নাজির কথা বলার ফিসফিস শব্দ শোনা গেলেও বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।

কিছুক্ষণ পর নাজীর পরিষ্কার কণ্ঠ শুনতে পায় জোকি। সে বলছে, বসতি থেকে দূরে থাকবে। সন্দেহবশত কেউ তোমাদের ধরার চেষ্টা করলে সর্বাগ্রে পত্রটি গায়েব করে ফেলবে। জীবন বাজি রেখে কাজ করবে। পথে যে-ই তোমাদের গতিধ করবে, নির্দ্বিধায় তাকে শেষ করে দেবে। সফর তোমাদের চার দিনের; কিন্তু পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবে তিন দিনে। দিকটা মনে রেখ; উত্তর-পশ্চিম।  

বাইরে বেরিয়ে পড়ে আগন্তুকদ্বয়। জোকিও বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। নাজি ও ঈদরৌস দাঁড়িয়ে আছে ফটকের সামনে। আরোহীদের বিদায় দেয়ার জন্যই তারা বের হয়েছে বোধ হয়।

দুটি ঘোড়ায় চড়ে দু আরোহী ছুটে চলে দ্রুত। জোকিকে দেখে নাজি ডাক দিয়ে বলেন, “আমি বাইরে যাচ্ছি, অনেক কাজ আছে, ফিরতে দেরী হবে, তুমি আরাম করো। একাকী ভালো না লাগলে হেরেমে ঘুরে আসো।

হাত তুলে ঠিক আছে বলে সম্মতি জানায় জোকি।

মহল ত্যাগ করে চলে যায় নাজি ও ঈদরৌস। কক্ষে প্রবেশ করে জোকি। চোগা পরিধান করে কটিবন্ধে খঞ্জর বাঁধে। কক্ষের দরজায় তালা দিয়ে হাঁটা দেয় হেরেমের দিকে।

জোকির কক্ষ থেকে হেরেমের দূরত্ব কয়েকশ গজ। দারোয়ানকে অবহিত করে হেরেমে প্রবেশ করে সে। অপ্রত্যাশিতভাবে জোকিকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে হেরেমের মেয়েরা। এই প্রথমবার হেরেমে প্রবেশ করলো জোকি। হেরেমের মেয়েরা তাকে সম্মানের সাথে স্বাগত জানায়। যে দুটি মেয়ে । তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিলো, সহাস্যে অভিবাদন জানায় তারাও। কক্ষময় ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জোকি। সবার সাথে কথা বলে ফেরত রওনা হয়। যে চতুর চাকরানীটি তাকে খুন করার দায়িত্ব নিয়েছিলো, বিদায়ের সময় সেও সেখানে উপস্থিত। গভীর দৃষ্টিতে জোকির আপাদমস্তক একবার দেখে নেয় সে। জোকি বেরিয়ে পড়ে বাইরে।

হেরেমের প্রাসাদ আর নাজির বাসগৃহের মধ্যবর্তী জায়গাটা অনাবাদী; কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু। হেরেম থেকে বেরিয়ে জোকি নাজির বাসগৃহে না গিয়ে দ্রুতগতিতে হাঁটা দেয় অন্যদিকে। ওদিকে একটি সরু গলিপথও আছে।

অতি দ্রুত হাঁটছে জোকি। হঠাৎ গলিপথের পনের-বিশ গজ পিছনে একটি কালো ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে তার। সেটিও এগিয়ে চলছে দ্রুত। হয়তো বা কোন। মানুষ। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটি কালো চাদরে আবৃত থাকায় তাকে ভূত বলেই মনে হলো জোকির কাছে।

হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় জোকি। সাথে সাথে ভূতের গতি বেড়ে যায় আরো বেশী। সামনে ঘন ঝোঁপ-ঝাড়। তার মধ্যে অন্তহিত হয়ে যায় জোকি। সেখান থেকে আড়াই থেকে তিনশ গজ সম্মুখে সুলতান আইউবীর বাসগৃহ, যার আশপাশে সেনা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের আবাস।

জোকি যাচ্ছিলো ওদিকেই। মেয়েটি ঘন ঝোঁপের মধ্য থেকে বের হলো বলে, এমন সময় বাঁ দিক থেকে ছায়া মূর্তিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোছনা রাত। তবু গয়াটির মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না। তার পায়ের কোন শব্দ নেই। হাতটা উপরে উঠে যায় ছায়াটির। জোছনার আলোয় একটি খঞ্জর চিক করে ওঠে এবং বিদ্যুগতিতে জোকির কাঁধ ও ঘাড়ের মধ্যখানে এসে বিদ্ধ হয়। জোকির মুখ থেকে কোন চীঙ্কার বেরোয়নি। খঞ্জর তার কাঁধ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এতো গভীর জখম খেয়েও মেয়েটি দ্রুতগতিতে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে। ছায়া মূর্তিটি তার উপর পুনর্বার আক্রমণ চালায়। এবার জোকি আক্রমণকারার খঞ্জরধারী হাতটা নিজের বাহু দ্বারা প্রতিহত করে নিজের খঞ্জরটা তার বুকে সেঁধিয়ে দেয়। আঘাত খেয়ে ছায়া মূর্তিটি চীৎকার করে ওঠে। এবার জোকি বুঝতে পারে আক্রমণকারী মূর্তিটি একজন নারী। জোকি খঞ্জরটা তার বুক থেকে বের করে পুনরায় আঘাত হানে। এবার বিদ্ধ হয় ছায়া মূর্তির পিঠে। আঘাত লাগে নিজের পাজরেও। ছায়া মূর্তিটি ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

আক্রমণকারী লোকটা কে দেখার চেষ্টা করলো না জোকি। ছুটে চললো গন্তব্যপানে। তার শরীর থেকে ফিনকি ধারায় রক্ত ঝরছে। জোৎস্নালোকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাসগৃহ দেখতে পাচ্ছে জোকি। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর মাথাটা চক্কর খেয়ে ওঠে তার। চলার গতি মন্থর হতে শুরু করেছে। জোকি চীৎকার করে ওঠে–আলী! আইউবী! আলী! আইউবী!

পরনের পোশাক রক্তে লাল হয়ে গেছে জোকির। সীমাহীন কষ্টে পা টেনে টেনে অগ্রসর হচ্ছে মেয়েটি। গন্তব্যের কাছে চলে এসেছে সে। কিন্তু বাকি পথ অতিক্রম করা সম্ভব মনে হচ্ছে না। দেহের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে অনর্গল ডেকে । চলছে আলী ও আইউবীকে।

নিকটেই একস্থানে একজন টহল সেনা টহল দিয়ে ফিরছিলো। জোকির ডাক শুনে ছুটে আসে সে। জোকি তার গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে বললো–আমাকে আমীরে মেসেরের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। দ্রুত অতি দ্রুত। সান্ত্রী মেয়েটিকে পিঠে তুলে সুলতান আইউবীর বাসগৃহ অভিমুখে ছুটে যায়।

***

নিজ কক্ষে বসে আলী বিন সুফিয়ানের নিকট থেকে রিপোর্ট নিচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কক্ষে তাঁর দুজন নায়েবও উপস্থিত। আলী বিন সুফিয়ান বিদ্রোহের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। সে নিয়েই আলাপ-আলোচনা করছেন তাঁরা। চরম ভয়ার্ত চেহারায় কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। বলে, এক সেপাহী একটি জখমী মেয়েকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, মেয়েটি নাকি আমীরে মেসেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে।

শুনেই আলী বিন সুফিয়ান ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরের ন্যায় কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। সুলতান আইউবীও তার পেছনে পেছনে ছুটে যান। ইত্যবসরে মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে। সুলতান আইউবী বললেন–তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকো। মেয়েটিকে সুলতান আইউবীর খাটের উপর শুইয়ে দেয়া হলো। মুহূর্ত মধ্যে বিছানাপত্র রক্তে ভিজে যায়।

ডাক্তার-কবিরাজ কাউকে ডাকতে হবে না–ক্ষীণ কণ্ঠে মেয়েটি বললো আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।

তোমাকে কে জখম করলো জোকি আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন।

আগে জরুরী কথাগুলো শুনুন–জোকি বললো–উত্তর-পূর্ব দিকে ঘোড়া হাঁকান। দুজন অশ্বারোহীকে যেতে দেখবেন। উভয়ের পোশাকই বাদামী বর্ণের। একটি ঘোড়া বাদামী, অপরটি কালো। লোকগুলোকে দেখতে ব্যবসায়ী মনে হবে। তাদের সঙ্গে সালার নাজির লিখিত পয়গাম আছে, যেটি খৃষ্টান সম্রাট ফ্রক বরাবর পাঠানো হয়েছে। নাজির এই সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করবে। আমি আর কিছু জানি না। আপনাদের সালতানাত কঠিন বিপদের সম্মুখীন। অশ্বারোহী দুজনকে পথেই ধরে ফেলুন। বিস্তারিত তাদের নিকট থেকে জেনে নিন। বলতে বলতে চৈতন্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে মেয়েটি।

অল্পক্ষণের মধ্যে দুজন ডাক্তার এসে পৌঁছেন। তারা মেয়েটির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চেষ্টা শুরু করেন। মুখে ঔষধ খাইয়ে দেন। ঔষধের ক্রিয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে জোকি বাকশক্তি ফিরে পায়। জরুরী বার্তা তো আগেই জানিয়ে দিয়েছে। এবার বিস্তারিত বলতে শুরু করে। নাজি ও ঈদরৌসের কথোপকথন, তাকে নিজ কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া, নাজির ক্ষুব্ধ হওয়া–দৌড়-ঝাঁপ এবং দুজন অশ্বারোহীর আগমন ইত্যাদি সব কথা। শেষে জোকি বললো, আক্রমণকারী কে ছিলো, আমি জানি না। তবে আমার আঘাত খেয়ে আক্রমণকারী যে চীৎকারটা দিয়েছিলো, তাতে বুঝা গেছে লোকটা মহিলা। জোকি আক্রমণের স্থান জানায়। তৎক্ষণাৎ সেখানে দুজন তোক প্রেরণ করা হয়। জোকি বাঁচবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করে। তার পেট ও পিঠে দুটি গভীর জখম।

জোকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। বেশির ভাগ রক্ত আগেই ঝরে গেছে। সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাত ধরে চুমু খেয়ে বললো–আল্লাহ আপনাকে এবং আপনার সাম্রাজ্যকে নিরাপদ রাখুন। আপনি পরাজিত হতে পারেন না। সালাহুদ্দীন আইউবীর ঈমান কতত পরিপক্ক আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তারপর আলী বিন সুফিয়ানকে উদ্দেশ করে বললো–আমি কর্তব্য পালনে ত্রুটি করিনি তো? আপনি আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমি তা পালন করেছি।

তুমি প্রয়োজনের বেশি দায়িত্ব পালন করেছে–আলী বিন সুফিয়ান বললেন–আমার তো ধারণাই ছিলোনা, নাজি এতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত এবং তোমাকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। আমি তোমাকে শুধু গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রেরণ করেছিলাম।

হায়, আমি যদি মুসলমান হতাম!–জোকি বললো–তার চোখে অশ্রু নেমে আসে। বললো–আমার এ কাজের যা বিনিময় দেবেন, আমার অন্ধ পিতা ও চিররুগ্ন মাকে দিয়ে দেবেন। তাদের অক্ষমতাই বারো বছর বয়সে আমাকে নর্তকী বানিয়েছিলো।

জোকির মাথাটা একদিকে ঝুঁকে পড়ে। চোখ দুটো আধখোলা। ঠোঁট দুটোও এমনভাবে আছে, যেনো মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে। ডাক্তার তার শিরায় হাত রাখেন এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি তাকিয়ে মাথা নাড়ান। জোকির প্রাণপাখি আহত দেহের খাঁচা থেকে বেরিয়ে গেছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন–মেয়েটার ধর্ম যা-ই থাকুক, তাকে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দাফন করো। ইসলামের জন্য মেয়েটা নিজের জীবন দান করেছে। ইচ্ছে করলে আমাদেরকে ধোকাও দিতে পারতো।

দারোয়ান কক্ষে প্রবেশ করে বললো, বাইরে এক নারীর লাশ এসেছে। সুলতান আইউবী ও আলী বেরিয়ে দেখেন। মধ্য বয়সী এক মহিলার লাশ। অকৃস্থলে দুটি খঞ্জর পাওয়া গেছে। মহিলাকে কেউ চেনেনা। এ নাজির হেরেমের সেই চাকরানী, যে পুরস্কারের লোভে জোকির উপর সংহারী আক্রমণ চালিয়েছিলো।

জোকিকে রাতেই সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হলো। আর চাকরানীর লাশ পূর্ণ অবজ্ঞার সাথে গর্তে নিক্ষেপ করা হলো। তবে দুটো কর্মই সম্পাদন করা হলো গোপনে।

সময় নষ্ট না করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী উন্নত জাতের আটটি তাগড়া ঘোড়া এবং আটজন কমাণ্ডো নির্বাচন করে তাদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের কমাণ্ডে লজির প্রেরিত লোক দুটিকে ধাওয়া করে ধরতে পাঠিয়ে দেন।

জোকি ছিলো মারাকেশের এক নর্তকী। কেউ জানতো না তার ধর্ম কী ছিলো। তবে মুসলমান ছিলো না; খৃষ্টানও নয়। আলী বিন সুফিয়ান জানতে পারেন, সুদানী ফৌজের সালার নাজি একজন কুচক্রী ওঁ শয়তান চরিত্রের মানুষ। তার অন্দর মহলের খবরাখবর জানার জন্য আলী গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একটি তথ্য জানতে পারেন, নাজি হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের ন্যায় প্রতিপক্ষকে রূপসী মেয়ে ও হাশিশ দ্বারা ফাঁদে আটকায় এবং নিজের অনুগত বানায় কিংবা খুন করায়। আলী বিন সুফিয়ান বহু খোঁজাখুঁজির পর এক ব্যক্তির মাধ্যমে জোকিকে মারাকেশ থেকে আনান এবং কৌশলে নাজির নিকট পাঠিয়ে দেন। মেয়েটির মধ্যে এমনই জাদু ছিলো যে, নাজি তাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাসানোর কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মেয়েটি যে তারই জন্য একটি পাতা ফাঁদ, তা সে জানতো না। সুলতান আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে নাজি নিজেই জোকির ফাঁকে আটকে যায়। জোকির মাধ্যমে তার গোপন সব তথ্য চলে যেতে ওক করে আইউবী ও আলীর কানে। এই তথ্য গ্রহণই ছিলো মহড়ার দিন মেয়েটিকে নিজ তাঁবুতে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের তাৎপর্য। তাঁবুতে নিয়ে সুলতান আইউবী মেয়েটির সঙ্গে প্রেম নিবেদন করেননি–নাজির কাছে থেকে তার প্রাপ্ত তথ্যাবলীর রিপোর্ট গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটির দুর্ভাগ্য যে, নাজির হেরেমে তার শত্রু জন্মে যায়, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আঁটা হয় এবং তাকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়।

***

আট দ্রুতগামী অশ্বারোহী নিয়ে ছুটে চলছেন আলী বিন সুফিয়ান। গন্তব্য দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। সম্রাট ফ্রাংকের হেডকোয়াটার কোথায় তার জানা আছে। সে পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ-ঘাটও চেনা।

এখন পরদিন ভোর বেলা। রাতে তেমন বিশ্রাম করেননি। আরবী ঘোড়া ক্লান্ত হয়েও তাগড়া থাকে। দূর দিগন্তে খেজুর বীথির মধ্যে দুটি ঘোড়া দেখতে পান আলী। রাস্তা পরিবর্তন ও আড়ালের জন্য তিনি টিলার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে, লছেন। মরুভূমির ভেদ-রহস্য তার জানা আছে। লোকালয় ফেলে এখন অনেক দুরে চলে এসেছেন তিনি। বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা নেই তার।

চলার গতি আরো বাড়িয়ে দেন আলী বিন সুফিয়ান। সামনের দুই আরোহী আর তাঁর দলের মধ্যকার ব্যবধান কমপক্ষে চার মাইল ছিলো। এখন দূরত্বটা কমিয়ে এনেছেন তিনি। কিন্তু ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আলী বিন সুফিয়ান ও তার বাহিনী এখন খেজুর বীথির নিকটে এসে পৌঁছেছেন। সম্মুখের আরোহী দুজন দু মাইল দূরে একটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলছে। বোধ হয় তাদের ঘোড়াও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আরোহী দুজন ঘোড়া থেকে অবতরণ করে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

ওরা পাহাড়ের আড়ালে বসে পড়েছে বলেই আলী বিন সুফিয়ান রাস্তা বদল করে ফেলেন।

দু দলের মাঝে ব্যবধান কমে আসছে। এখন দূরত্বটা কয়েক শ গজের বেশি হবে না। সম্মুখের আরোহীদ্বয় আড়াল থেকে সামনে চলে আসে। পিছনে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসা ঘোড়ার পদধ্বনি শুনে ফেলেছে তারা। তারা একদিকে সেরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আলী বিন সুফিয়ানের ঘোড়ার গতি আরো বেড়ে যায়। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ঘোড়া আপত্তি জানায় না। তারাও জানে, এই মিশনে আলী ও আইউবীকে সফল হতেই হবে। অতএব, কর্তব্যে অবহেলা করা চলবে না।

দলবলসহ পাহাড়ের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন আলী। দুটি ঘোড়া সে পথে অতিক্রম করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেলো। কিন্তু এখনো বেশিদূর যেতে পারেনি। বোধ হয় পিলেয় ভয় ধরে গেছে তাদের। সম্ভবত তারা বেরুবার পথ পাচ্ছে না। একবার ডানে, একবার বাঁয়ে ছুটাছুটি করে ফিরছে শুধু।

আলী বিন সুফিয়ান ঘোড়াগুলো এক সারিতে বিন্যস্ত করে সামনে-পিছনে ঘুরিয়ে দেন এবং পলায়নপর আরোহীদের কাছাকাছি পৌঁছে যান। দু দলের মাঝের দূরত্ব এখন মাত্র একশ গজ। এক তীরন্দাজ ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে তীর ছোঁড়ে। তীরটা একটি ঘোড়ার সামনের এক পায়ে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ঘোড়াটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আরো কিছু দৌড়-ঝাপের পর পলায়নপর লোক দুজন আলীর বাহিনীর বেষ্টনীতে চলে আসে। তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

আলী বিন সুফিয়ান তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা মিথ্যা বলে। নিজেদের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তল্লাশি নেয়ার পর সেই বার্তাটি পাওয়া গেলো, যেটি নাজি তাদের দিয়ে প্রেরণ করেছিলো। উভয়কে হেফাজতে নিয়ে নেয়া হলো। ঘোড়াগুলোকে বিশ্রামের জন্য সময় দেয়া হলো। অভিযান সফল করে আলী বিন সুফিয়ান ফেরত রওনা হন।

অস্থিরচিত্তে অপেক্ষা করছেন সুলতান আইউবী। দিন কেটে গেছে। রাতটাও অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে সুলতান আইউবী ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখ লেগে গেছে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় কতোক্ষণ বসে থাকা যায়।

রাতের শেষ প্রহরে আইউবীর কক্ষের দরজায় আলতো করাঘাত পড়ে। তার চোখ খুলে যায়। ধড়মড় করে উঠে দরজা খোলেন। আলী বিন সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনে দণ্ডায়মান তার আট অশ্বারোহী ও দু কয়েদি। সুলতান আইউবী আলী এবং কয়েদী দুজনকে নিজের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে যান এবং নজির পত্ৰখানা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। প্রথম প্রথম তার চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে ওঠলেও পরক্ষণেই মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নাজির বার্তাটি বেশ দীর্ঘ। সে খৃষ্টানদের জনৈক সম্রাট ফ্রাংককে লিখেছে, অমুক দিন, অমুক সময় ইউনানী, রোমান ও অন্যান্য খৃষ্টানদের সমুদ্র পথে রোম উপসাগরের দিক থেকে সৈন্য অবতরণ করিয়ে আক্রমণ করুন। আপনার আক্রমণের সংবাদ পেলেই পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্য আইউবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে। মিসরের নতুন বাহিনী আপনার আক্রমণ ও আমার বিদ্রোহের একসঙ্গে মোকাবেলা করতে পারবে না। বিনিময়ে সমগ্র মিসর কিংবা মিসরের সিংহভাগ অঞ্চলের শাসন আপনাকে দান করা হবে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বার্তাবাহী লোক দুজনকে কয়েদখানার পাতাল প্রকোষ্ঠে ফেলে রাখেন। তৎক্ষণাৎ নিজের নতুন বাহিনী প্রেরণ করে নাজি ও তার নায়েবদের নিজ গৃহে নজরবন্দি করে ফেলেন। হেরেমের সকল নারীকে মুক্ত করে দেন এবং নাজির যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন। এ সকল অভিযান গোপন রাখা হয়।

নাজির উদ্ধারকৃত পত্রটিতে আক্রমণের যে তারিখ ছিলো, সুলতান আইউবী সেটি পরিবর্তন করে অন্য তারিখ লিখে দুজন বিচক্ষণ লোককে সম্রাট ফ্রাংকের নিকট প্রেরণ করেন। বলে দেন, তোমরা নিজেদেরকে নাজির লোক বলে পরিচয় দেবে। তাদের রওনা করিয়ে সুলতান সুদানী বাহিনীকে মিসরী বাহিনীতে একীভূত করে ফেলার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন।

আটদিন পর দূতরা ফিরে আসে। তারা সম্রাট ফ্রাংককে নাজির পত্র পৌঁছিয়ে উত্তর নিয়ে আসে। ফ্রাংক লিখেছেন, আমার আক্রমণের দুদিন আগে যেনো সুদানীরা বিদ্রোহ করে, যাতে আইউবীর আক্রমণ মোকাবেলা করার হুঁশ-জ্ঞান না থাকে। আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীর অনুমতিক্রমে এই দূত দুজনকে নজরবন্দি করে রাখেন, যাতে তথ্য ফাঁস হওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকে।

যেসব স্থানে খৃষ্টানদের নৌযান এসে ভেড়ার কথা, সুলতান আইউবী সেই স্থানগুলোতে নিজের সৈন্য লুকিয়ে রাখেন।

পত্রে উল্লেখিত তারিখে সম্রাট ফ্রাংক আক্রমণ চালান। নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী রোম উপসাগরে আত্মপ্রকাশ করে। ঐতিহাসিকদের পরিসংখ্যান মোতাবেক খৃষ্টানদের যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা ছিলো একশত পঁচিশ। তন্মধ্যে বারোটি ছিলো বেশ বড়। সেগুলোতে বোঝাই ছিলো সৈন্য, যারা মিসর আক্রমণ করতে এসেছিলো। এই বাহিনীর কমাণ্ডার ছিলেন এম্লার্ক, যার পালতোলা জাহাজগুলোতে রসদ ছিলো। লাইন ধরে আসছিলো জাহাজগুলো।

প্রতিরক্ষার কমাণ্ড নিজের হাতে রাখেন সুলতান আইউবী। তিনি খৃষ্টানদেরকে সাগরের কূলে ভেড়ার সুযোগ দেন। সর্বাগ্রে বড় জাহাজটি লঙ্গর ফেলে। হঠাৎ তার উপর আগুনের বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এগুলো মিনজানিক দ্বারা নিক্ষিপ্ত আগুন। মুসলমানদের বর্ষিত এই অগ্নিগোলা খৃষ্টানদের জাহাজ কিশতিগুলোর পালে আগুন ধরিয়ে দেয়। কাঠের তৈরি জাহাজগুলোর গায়েও আগুন ধরে যায়। অপর দিক থেকে মুসলমানদের লুকিয়ে থাকা জাহাজ এসে পড়ে। তারাও খৃষ্টানদের জাহাজের উপর আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এখন মনে হচ্ছে, যেনো রোম উপসাগরে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে এবং সাগরটা জ্বলছে। খৃষ্টানদের জাহাজগুলো মোড় ঘুরিয়ে পরস্পর ধাক্কা খেতে ও একটি অপরটিতে আগুন ধরাতে শুরু করে দেয়। নিরুপায় হয়ে জাহাজের খৃষ্টান সেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের যারা কূলে এসে ভিড়ে, তারা সুলতান আইউবীর তীরন্দাজদের নিশানায় পরিণত হয়।

ওদিকে নুরুদ্দীন জঙ্গী সম্রাট ফ্রাংকের দেশের উপর আক্রমণ করে বসেন। ফ্রাংক মিসর প্রবেশের জন্য তার বাহিনীকে স্থলপথে রওনা করিয়ে নিজে নৌ। বাহিনীতে যোগ দেন। নিজ দেশে আক্রমণের সংবাদ শুনে বড় কষ্টে তিনি দেশে ফিরে যান। গিয়ে দেখেন সেখানকার চিত্র-ই বদলে গেছে।

রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বহরটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সৈন্যরা আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে এবং আইউবীর সৈন্যদের তীর খেয়ে প্রাণ হারিয়েছে। তাদের এক কমাণ্ডার এম্লার্ক প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি আত্মসমর্পণ করে সন্ধির আবেদন জানালে সুলতান আইউবী চড়া মূল্যের বিনিময়ে তা মঞ্জুর করেন। ইউনানী ও সিসিলির কয়েকটি জাহাজ রক্ষা পেয়েছিলো। সুলতান আইউবী তাদেরকে জাহাজগুলো ফিরিয়ে নেয়ার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু ফেরার পথে সমুদ্রে এমন ঝড় ওঠে যে, সবগুলো জাহাজ নদীতে ডুবে যায়।

১১৬৯ সালের ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ খৃষ্টানরা তাদের পরাজয়ে স্বাক্ষর করে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে জরিমানা আদায় করে।

কিন্তু এ জয়ের পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবন ও তার দেশ মিসর আগের তুলনায় বেশির সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।

2 Comments
Collapse Comments

আমি এমন একটা সাইট খুজছিলাম পেয়েও গেলাম।***

আলী বিন সুফিয়ানের ফলোয়ার নাইমুর রহমান October 24, 2023 at 9:44 am

হায়রে, আলী বিন সুফিয়ান আমি হতেচাই আল্লাহ তুমি আমায় কবুল করো। জোকির সৌন্দর্যে নাকি ফেরোয়ান খোদা দাবি করা ভুলে যাবে এই সুন্দর্যের মেয়েটা যখন লাস্টে বলল যে আমি যদি মুসলিম হইতাম তখনও তো কালেমাটা পড়তে পারতো।
আল্লাহর তৌফিক ছাড়া কেউ মুসলমান হইতে পারে না আমি মুসলমান আলহামদুলিল্লাহ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *