৫. দুর্ঘটনা? আত্মহত্যা? হত্যাকাণ্ড?

যেমন মরালী যায়উড়ে যায়দূর দূর মালবার পাহাড়ের কোল

০১.

 তিনজন নারী গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন জীবনানন্দের জীবনকে। তার মা কুসুমকুমারী, তাঁর প্রথম আশ্রয়, তার কবিতার প্রথম অনুপ্রেরণা। অবশ্য তাঁর মায়ের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাঁর স্ত্রী লাবণ্য, যার সঙ্গে তাঁর নৈকট্যই ঘটেনি, তিনি দূরত্বেই ছিলেন বরাবর। আর শোভনা, যিনি ক্ষণকাল নিকটে ছিলেন জীবনানন্দের, তারপর চলে গেছেন তার সীমানার বাইরে, বহুদূরে। অথচ এই একজন নারীকেই তিনি বরাবর মনের ভেতর বহন করে বেড়িয়েছেন অবিরাম। তার মনের যাবতীয় প্রেম তিনি সাজিয়ে রেখেছেন তার জন্যই। শোভনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দিন কাটাবার বছর বিশ পরও সেই ১৯৪৮ সালে, যখন তিনি জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত, তখনো তার মনে গভীরভাবে জেগে আছে শোভনা। এই সময়ে লেখা তাঁর অনেক রাতে হুমায়ুন প্লেসের থেকে নামের গল্পে অদ্ভুতভাবে উপস্থিত হয় প্রাক্তন প্রেমিকা।

এই গল্পে সোমনাথ নামের এক লোক অনেক রাতে হুমায়ুন প্লেস থেকে বেরিয়ে চৌরঙ্গীতে এসে দাঁড়িয়েছে। এত রাত পর্যন্ত কোথায় সে ছিল, কোথায় ঘুরেছে, কী করেছে নিজেই সে খেয়াল করতে পারছে না। শেষ ট্রাম চলে গেছে, কোনো রকম একটা বাস পেয়ে তাতে চড়ে বাড়ি ফিরেছে। সে থাকে একটা বাড়ির দোতলার ছোট্ট একটা ঘরে একা। নিচের তলার লোকেরা মূল দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সোমনাথ দেখে তার দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু তার মনে পড়ে বের হবার আগে। আলো নিভিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সে। কী ব্যাপার বুঝতে পারে না। কোনো উপায় না পেয়ে, দেয়ালের পাশে পাইপ বেয়ে দোতলায় ওঠে। দেখে তার ঘরে আলো জ্বলছে। কিছু চুরি গেছে কি না বোঝার চেষ্টা করে সোমনাথ। কিন্তু কিছু চুরি যায়নি। তার ঘরে তেমন দামি কিছু নেই, আছে কিছু বই। বাতি নিভিয়ে শুতে যাবে। তখন হঠাৎ শোনে ঘরের ভেতর এক নারীকণ্ঠ। সোমনাথ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বলে, কে?

নারীকণ্ঠ বলে, আমি, বাতি জ্বালিও না। সোমনাথ চিনতে পারে এ সেই নারীর কণ্ঠস্বর, যাকে উজাড় ভালোবাসা দিতে চেয়েছিল একদিন।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমি এখানে?

না, সোমনাথের ঘরে ঠিক কোনো মানুষ নেই, শুধু একটি কণ্ঠস্বর আছে। সেই নারী কণ্ঠস্বরের সাথে আলাপ চলে :

সোমনাথ : বারো বছর পর তোমার সাথে দেখা…এতদিন কোথায় ছিলে?

কণ্ঠস্বর : যত জায়গায় থাকা সম্ভব হতে পারে।

সোমনাথ : শুনেছিলুম প্যারিসে গিয়েছিলে

 কণ্ঠস্বর : ও, সে কথা তোমার কানেও ঢুকেছে?

 সোমনাথ; কবে গিয়েছিলে?

কণ্ঠস্বর : বম্বিং-এর সময়।

সোমনাথ : প্যারিস তো ওপেন সিটি হলো, জার্মানরা নিয়ে নিল…

.

এভাবে সোমনাথ সেই নারী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্ধকারে গল্প করতে থাকে। তার প্রাক্তন প্রেমিকা কী করে এক মুসলমান বড়লোক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে আটকে পড়েছিল, সেসব গল্প করে। তাদের মধ্যে বিয়ে হতে পারত কি না, সেসব বিবেচনা করে। তারপর অনেক রাতে সেই নারী কণ্ঠস্বর বিদায় নেয় এবং সোমনাথ মদের বোতল নিয়ে বসে। এক অশরীরী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্ধকারে যুদ্ধ, প্রেম, রাজনীতির আলাপ চলে এই অভিনব গল্পে। সশরীরে না হলেও নেহাত এক কণ্ঠস্বর হিসেবেই কি শোভনাকে উপস্থিত করতে চেয়েছেন তিনি?

.

০২.

যে শোভনাকে জীবনানন্দ নিরন্তর বহন করেছেন মনের ভেতর, তিনি আসাম থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চলে গিয়েছিলেন কলকাতা, সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন ডায়োসেশন কলেজে। কেতাদুরস্ত ব্রিটিশ কায়দার কলেজ। ওখান থেকে বিএ পাস করে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে শোভনা চলে যান শিলংয়ের লেডি কিং স্কুলে। সেখানে শোভনার বিয়ে হয় ইঞ্জিনিয়ার সুহৃদ মজুমদারের সঙ্গে। বার্ড অ্যান্ড কোম্পানি নামের এক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছিলেন সুহৃদ। চাকরি করেছেন ভারতের নানা জায়গায় এবং শ্রীলঙ্কাতে। শোভনা তাঁর সঙ্গে দেশ বিদেশ ঘুরেছেন। শেষে এসে স্থায়ী হয়েছেন কলকাতায়। কলকাতার কমলা গার্লস স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু মেয়েদের জন্য বিশেষ ক্যানটিন খুললে পশ্চিমবঙ্গের সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় শোভনাকে এর প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেন। বিধান রায়ের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ ছিল তাদের। এই সচ্ছল, সার্থক জীবনযাপনের ফাঁকফোকরে তিনি কি কখনো স্মরণ করেছেন তাঁর মিলুদা, জীবনানন্দকে?

ভূমেন্দ্র গুহ খুঁজে বের করেছিলেন শোভনাকে, দেখা করেছেন তাঁর সঙ্গে। শোভনা তখন দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। ফোনে যোগাযোগ করে একটা তারিখ নিয়ে ভূমেন্দ্র হাজির হয়েছিলেন শোভনার বাড়িতে। জীবনানন্দের ডায়েরিজুড়ে, কবিতাজুড়ে যে শোভনার জন্য আকুতি, তার দেখা পাওয়ার উত্তেজনায় ছিলেন ভূমেন্দ্র। ভূমেন্দ্রর সামনে লাঠিতে ভর দিয়ে এলেন শোভনা। শোভনা তখন তার বার্ধক্যে, ফরসা, ছিপছিপে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ভূমেন্দ্র যখন শোভনার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তার বছর খানেক আগে ১৯৯৯ সালে জীবনানন্দের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। জীবনানন্দকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে তখন। শোভনা ধীরকণ্ঠে বললেন, আজকাল মাঝে মাঝে টিভিতে দেখি মিলুদাকে নিয়ে আলোচনা হয়। আমি সেসব অনুষ্ঠান মিস করি না। মিলুদা যে কালে কালে এমন একজন বিখ্যাত কবি হয়ে উঠবে, এত দিন পরও লোকে তার কথা এমন বলাবলি করে আমি তো তা কখনো আঁচই করতে পারিনি। অবাক লাগে।

এরপর শোভনা স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগলেন, মিলুদা তো সারাক্ষণ কবিতা নিয়েই থাকতেন। শুধু ওই কবিতা কবিতা করে কি লোকে বাঁচতে পারে? আমি নিজের জীবন নিয়েই তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, মিলুদার কবিতার খোঁজখবর আর রাখতে পারিনি…খুব মনে আছে তার প্রথম কবিতার বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ডাকে যখন আমার নামে বইটা এল, আমি লজ্জা আর ভয় পেয়েছিলাম। মনে মনে খুশিও হয়েছিলাম খুব। বইটা তো আমি আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছিলাম অনেক দিন। তারপর সব জানাজানি হয়ে যায়…আমি ওদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে গেছি। মিলুদা আসলে বিয়ে করতে চায়নি। বিয়ে করার জন্য একজন পুরুষ মানুষ কি ত্রিশ একত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত বসে থাকে? আমাদের জ্যাঠামশাই মনোমোহন চক্রবর্তী ওই যে ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সম্পাদক উনিই জোর করে বিয়েটা করালেন। তার ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের ওই বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য করালেন। মিলুদা তো সারাটা জীবন মুখচোরা, সবাইকে সন্তুষ্ট করাতে ব্যস্ত। বাবা-মার বাধ্য। উনি তো কবি মানুষ, বিয়ে করবার দরকার কী ছিল? ওর স্ত্রী তো ভয়ংকর মহিলা। মিলুদার সাথে একদম বনেনি। মিলুদার জীবনটা ভাজাপোড়া করে ছেড়েছে।

ভূমেন্দ্র অবশ্য বলতে পারেননি, এতই যদি বোঝেন তাহলে আপনি নিজে কেন তাকে গ্রহণ করেননি। আলাপের এক ফাঁকে হঠাৎ শোভনা বললেন, মিলুদা আমাকে চিঠি লিখত, চিঠিগুলো কিন্তু এখনো সব আছে আমার কাছে। ভূমেন্দ্রর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। যেন দারুণ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, চিঠিগুলো কি দেখা যায়? শোভনা একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলেন, আরেক দিন আসুন। আরেক দিন বিপুল আগ্রহ নিয়ে গেলে ভূমেন্দ্রকে হতাশ করে শোভনা বলেছিলেন, না, চিঠিগুলো নেই, খুঁজে পাচ্ছি না। শোভনা কি এর মধ্যে ভেবেচিন্তে ঠিক করেছেন যে ওই চিঠিগুলো তিনি আর প্রকাশ্য করবেন না? জীবনানন্দের এই দুর্লভ প্রেমপত্রগুলো পড়বার সুযোগ থেকে সকলকে বঞ্চিত করলেন শোভনা। শোভনা যে তার জীবন থেকে চলে গেছেন চিরতরে, তা জীবনানন্দ ভাঙা মন নিয়ে মেনে নিয়েছিলেন অনেক আগেই :

তুমি চলে গেলে
যেমন মরালী যায়–উড়ে যায়–দূর দূর মালবার পাহাড়ের কোল।
পিছনে চায় না ফিরে তিমির অতীত তীরে–কোন দ্বিধা কোন ব্যথা নাই?
…তুমি আর আসবে না জানি জীবনের প্রথম ফসল
এখন আসিছে সন্ধ্যা আর শীত আর তীব্র শিশিরের জল—

.

কালো ট্রাঙ্কের প্রহেলিকা

০১.

নতুন শতাব্দীর ক্রান্তিকালে জন্ম নিয়ে একটা শতাব্দীর অর্ধেকটুকু পাড়ি দিয়ে ১৯৫০ সালের দিকে এসে জীবনানন্দ জীবনের কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছেন, ঠেকেছেন একেবারে কিনারে। কিনার থেকে তিনি জীবনকে দেখছেন তখন। সেই ছিটকে পড়া জীবন নিয়েই লিখছেন গল্প-উপন্যাস। তাঁর অস্পষ্ট রহস্যময় সিঁড়ি নামের গল্পের এক চরিত্র বলে, জীবনের কেন্দ্র থেকে যেসব উপন্যাসের জন্ম হয়, সে সব ভালো লাগে না আমার আজকাল আর। বরং জীবনের কিনার ঘেঁষে মৃত্যুর অশরীরের অস্পষ্ট গন্ধের ভিতর যে সমস্ত গল্পের জন্ম হয়, সেগুলো নেড়েচেড়ে সন্ধ্যা ও রাত্তির বেশ কেটে যায় আমার।

মাল্যবানসহ গোটা বিশেক উপন্যাস লিখেছেন তিনি, লিখেছেন এক শর ওপর গল্প। কিন্তু একটাও ছাপাননি। লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর খাটের নিচের ট্রাঙ্কে। সাহিত্যে মোটামুটি পরিচিতি পেয়ে যাবার পর এমন বিশাল লেখালেখিগুলো লুকিয়ে রাখার মতো ঘটনা বাংলা সাহিত্যে নেই। বিশ্বসাহিত্যেও আছে কি? কাফকা তার বন্ধুকে বলেছিলেন তাঁর অপ্রকাশিত লেখা পুড়িয়ে ফেলতে। জীবনানন্দের তেমন ইচ্ছা ছিল না। সেসব গল্প-উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সযত্নে রেখে দিয়েছেন তিনি ট্রাঙ্কে। কবিতা ছাপালেন কিন্তু গল্প, উপন্যাস ছাপালেন না কেন?

হতে পারে তিনি তাঁর কবিতা নিয়ে যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, কথাসাহিত্যের ব্যাপারে অতটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেননি। ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর উপন্যাস বিচারের মানকে তিনি রেখেছিলেন অনেক ওপরে। সে সময় তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার উজ্জ্বল উপন্যাসিক। জীবনানন্দ এঁদের লেখাকে গভীরভাবে পাঠ করেছেন, এঁদের নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন কিন্তু তিনি তাঁর আরাধ্য করে রেখেছিলেন টলস্টয়, টমাস মান কিংবা দস্তয়ভস্কির মতো বিশ্বসেরা ঔপন্যাসিকদের। তার গল্প-উপন্যাসগুলো সেই বিশ্বসাহিত্যের মান স্পর্শ করেছে কি না, তা নিয়ে হয়তো সংশয় ছিল তাঁর। অবশ্য সিদ্ধান্ত নিলেও কোনো প্রকাশক তাঁর গল্প-উপন্যাস ছাপাতে আগ্রহী হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। জীবনানন্দের মৃত্যুর পরও সেসব উপন্যাস ছাপাতে অনেক নামজাদা পত্রিকা গড়রাজি ছিল। তারা এগুলোকে দেখেছে নেহাত এক কবির আনাড়ি কথাসাহিত্য চর্চার নমুনা হিসেবে। নিজ খরচে ছাপাবার মতো বাস্তবিক অবস্থা তার ছিল না। আবার এ-ও হতে পারে যে তিনি নিজেই কবি পরিচয়ের বাইরে না আসবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হয়তো একান্ত নিজের তৃপ্তির জন্য, বিশেষ মানসিক, জাগতিক সংকট মোকাবিলার উপায় হিসেবে গল্প-উপন্যাসগুলো লিখেছেন। কাউকে পড়াবার জন্য নয়। লেখা ছাপানো যেমন লেখকের ইচ্ছা, না ছাপানোও তেমন লেখকের ইচ্ছা হতেই পারে। কবিতা না উপন্যাস–কোন পথ ধরতে চান এ নিয়ে তাঁর দ্বিধার নমুনা আছে ডায়েরিতে।

তা ছাড়া লক্ষ করা যায় তাঁর কবিতায় ব্যক্তি জীবনানন্দ তেমন উপস্থিত নন, তিনি আছেন পরোক্ষে অথচ গল্প-উপন্যাসে তিনি খুবই আত্মজৈবনিক। জীবনানন্দ কি দ্বিধান্বিত ছিলেন জনসমক্ষে এতটা উন্মুক্ত হতে? চেয়েছিলেন কি যে এসব আসলে তার মৃত্যুর পরই আসুক জনসমক্ষে? তাঁর ট্রাঙ্কে রাখা পাণ্ডুলিপিগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ এবং একদিন যে লোকে এর খোঁজ করবে সে বিশ্বাস তাঁর ছিল। সে প্রমাণ আছে তাঁর গল্পের বয়ানেই।

.

০২.

তার ‘নক্ষত্রের বিরুদ্ধে মানুষ’ গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী চরিত্র বলছে :

‘আমার কতগুলো খাতা আছে।

 কিসের খাতা।

অনাদি একটু হেসে, হিসেবের খাতা নয়, আমি মাঝে মাঝে লিখতাম টিখতাম।

এ অপরাধ তাহলে–

হ্যাঁ সকলেরই আছে। আমার মতন লোকেরই দিন। দশ বছর আগেও আমার ভয় হতো চোর যদি কাপড়চোপড় ভেবে বাক্স দুটি ভরে নিয়ে যায়–এই খাতার বাক্স ঘর যদি আগুনে পুড়ে যায়–উইয়ে যদি কেটে যায় তাহলে পৃথিবীর অনেক দর্শন বিজ্ঞানের চেয়েও বড় জিনিস হারিয়ে যাবে…এই পাণ্ডুলিপি নেড়েচেড়ে এইরকম একটা নির্জন আনন্দ আমি পেয়েছি। আমার সাংসারিক জীবনটাকে সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি করতে পারিনি তাই। এ বেশ ভালো হয়েছে।

তোমার সেই পাণ্ডুলিপিগুলো আছে আজও?

 আছে।

কিছু ছাপাওনি?

না, মরবার আগে এখনো এও যেন একটা সান্ত্বনা যে এই লেখাগুলো আমাকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে…’

.

মৃত্যুর পর লেখা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে–এমন বিশ্বাস তার গহন মনে ছিল সব সময়। সে কারণেই কি তিনি প্রকাশ না করলেও কাফকার মতো অপ্রকাশিত লেখা ধ্বংস করতে চাননি? শুধু গল্প না, অপ্রকাশিত কবিতাগুলো নিয়েও তার ছিল এমন আত্মবিশ্বাস। তাঁর উপন্যাসে চরিত্ররাও এমন গভীর বিশ্বাসে কবিতা লিখে না ছাপিয়ে লুকিয়ে রাখে। তারা জানে তাদের কবিতাগুলো মূল্যবান এবং তা একদিন মানুষ পড়বে এবং আক্রান্ত হবে। আমরা চারজন উপন্যাসের কবি চরিত্র বলে, ‘কাজেই ঠিক করেছি–যখন খুশি কবিতা লিখব, কিন্তু কাউকে দেখাতে যাব না। আমি যত দূর বুঝে দেখেছি, তাতে মনে হয় যে, যে কবিতাগুলো না ছিঁড়ে জমিয়ে রেখেছি, সেগুলো কোন না কোন হৃদয়কে কোন না কোন দিন আলো দেখাবে, জলের কণিকাদের আঘাতের মতো ঘরোয়া প্রতাঁকের আশ্রয়ে সমাজকে বহন করে ফিরতে; কথা ভাবাবে তার পরেও কথা ভাবাবে–অনেক কাল …’

.

নিরুপম যাত্রা উপন্যাসের গোপন কবিও ভাবে, এ কবিতাগুলো কাউকে দেখাইনি। অনেক ক্ষণ সময় কেটে যায়। অবাক হয়ে ভাবি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে নিজেকে স্থির রাখা। ভাবতে-ভাবতে অনেক মুহূর্ত কেটে যায়, এক সময় নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করি এই ভেবে যে আলেকজানড্রিয়ার লাইব্রেরি যখন ধ্বংস হয়ে যায় তখন এমন অনেক অনেক চিন্তা ও কল্পনার সম্ভার ধোঁয়ায় মিশে গেছে যার তুলনায় আমার এ কবিতাগুলো কিছুই নয়। শেষ পর্যন্ত সেক্সপিয়রের সমস্ত কাব্যও ত এক দিন বরফের নিচে ধ্বসে যাবে। পৃথিবীতে একটি মানুষও থাকবে না। কিন্তু তবুও থেকে-থেকে মনে হয় আলেকজানড্রিয়ার লাইব্রেরির সমস্ত লুপ্ত ঐশ্বর্যের চেয়েও আমার কবিতাগুলোর ইঙ্গিত ও মূল্য ঢের চমৎকার ছিল, শেক্সপিয়র যা দিতে পারেনি–তাই ত দিয়েছিলাম আমি।…

.

অতলান্ত খাদের গহ্বরে

০১.

সাহিত্যে বিশ্বমানের ধন-দৌলত তাঁর তোরঙ্গে ভরে রেখে যাচ্ছেন এমন বিশ্বাস গোপনে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু সংসারের তোরঙ্গ তখন তার ফাঁকা। পকেটে ফুটো পয়সা নেই তার। টাকা অর্জনে সর্বব্যাপী ব্যর্থতা তাঁকে তখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

এ সময়ে লেখা জীবনানন্দের সুতীর্থ উপন্যাসের এক চরিত্র বরিশালের কথ্য ভাষা ব্যবহার করে বলে, ‘সফলতা পেতে দুটো জিনিসের দরকার–এক টাকা, আর এক জুকের নাগান লাইগ্যা থাকা, আমি শুধু তোমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম আর এক্কেবালে তাজ্জব মাইরা ভাবতেছিলাম যে আমিত্তির নাহান প্যাঁচে প্যাঁচে রস সেই জিনিসের, হেইয়ার নাম ট্যাহা…’

সেই ট্যাহা সত্যিই জীবনানন্দের হাতে তখন একদম নেই। স্বরাজ-এর চাকরিটা ছাড়বার পর জীবনানন্দ বাস্তবিক কপর্দকহীন হয়ে পড়লেন। উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় আসার পর বরিশালে জমানো যে টাকাপয়সা কিছু ছিল, সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। তখন একেবারে শূন্য হাত তার। টাকা এবং জোকের মতো লেগে থাকার স্পৃহা দুটার কোনোটাই তার নেই। আগে বেকার অবস্থায় কলকাতার মেসের ভাড়া দিতে না পারলে বরিশালের বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারতেন। মাথা গোঁজার একটা ঠাই, দুবেলা খাওয়ার একটা বন্দোবস্ত হতো। কিন্তু কলকাতায় সে সুযোগ তাঁকে কে দেবে? তিনি তখন এক অতলান্তিক খাদে। এর মধ্যে তার ভাই অশোকানন্দ কলকাতা থেকে বদলি হয়ে গেলেন দিল্লি। জীবনানন্দ তখন ভাড়া নিলেন ওই ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িটাই। অশোকানন্দ ভাড়ার টাকাটার জোগান দিতে লাগলেন। জীবনানন্দ আবার একটা টিউশনি নিলেন, লাবণ্য শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন একটা বাচ্চাদের স্কুলে। কোনো রকম কায়ক্লেশে সংসার টেনে নিচ্ছেন তখন জীবনানন্দ। আবারও হন্যে হয়ে খুঁজছেন একটা কোনো নিয়মিত চাকরি। আবার সেই পুরোনো চক্র।

এ সময় একদিন সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে চিঠিতে লিখলেন :

‘প্রিয়বরেষু,

আশা করি ভালো আছেন। বেশি ঠেকে পড়েছি, সেজন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন।

এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয় ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি। আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই–আমাদের মত দুচারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এরকম দাবী গ্রাহ্য করবার মতো বিচার-বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন–সেজন্য গভীর ধন্যবাদ।

লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব–না হয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছসাত মাস (তার বেশী নয়) দেরী হতে পারে…’

সঞ্জয়ের নিজের তখন আর্থিক সংকট, পূর্বাশা পত্রিকা বন্ধ হবার জোগাড়। চার-পাঁচ শ টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা তখন তার ছিল না। সঞ্জয় এবং পূর্বাশা পত্রিকার সত্যপ্ৰসন্ন জীবনানন্দের জন্য একটা কাজ জোগাড় করার সব রকম চেষ্টা করতে লাগলেন। সত্যপ্রসন্ন একবার জীবনানন্দকে এক ব্যাংকিং করপোরেশনে নিয়ে গেলেন, সেখানে বিশেষ সুবিধা হলো না, একবার কিছু ইংরাজি নোটবই লিখে দেবার কাজ করতে দিলেন, জীবনানন্দ রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত পারলেন না লিখতে।

এ সময় মুর্শিদাবাদে থাকা অচিন্ত্যকুমারকে লিখলেন, …আমি বিশেষ কোন কাজ করছি না আজকাল। লিখে, পড়িয়ে অল্পস্বল্প রোজগারে চলে যাচ্ছে। একটা চাকরীর জন্য দরখাস্ত করেছিলাম, রেফারেন্স চেয়েছিলো, তার ভেতর তোমার নামও দিয়েছি। ওসব চাকরী হবে না। সব ছেড়ে দিয়ে শুধু লিখে যেতে পারলে ভালো হতো। সেটা অনেকদিন থেকেই সম্ভব হচ্ছে না।…

অবস্থা তার তখন এমন দাঁড়িয়েছে যে জুনিয়রদের কাছ থেকে তাঁর নিজের চাকরির রেফারেন্স নিতে হচ্ছে। এ সময় জনৈক অনিল বিশ্বাস, মুর্শিদাবাদের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি, তাঁর লেখা একটা কবিতার বই জীবনানন্দকে পাঠালেন রিভিউ লিখবার জন্য। জীবনানন্দ সেই অনিল বাবুকে লিখলেন রিভিউ লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, তারপরও লিখবার চেষ্টা করবেন। তারপর লিখলেন, …আমি আজকাল বড় মুস্কিলের ভেতর আছি, কাজ খুঁজছি। কলকাতায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কিছু করতে পারেন? কালকের কাগজে দেখলাম একজন ইংরাজির লেকচারার চায়। আমার বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে ওসব জায়গায় এ ধরনের কাজেও যেতে দ্বিধা করলে চলবে না। আপনি তো মুর্শিদাবাদে আছেন। হয়তো কিছু করতে পারবেন…

একজন তাকে বই পাঠিয়েছেন রিভিউ করতে আর তিনি নির্লজ্জের মতো রিভিউ লেখার বদলে তার কাছে চাকরি চাইছেন, এই হচ্ছে তখন তাঁর অবস্থা। একদিন দমদম মতিঝিল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর কাছে গেলেন জীবনানন্দ, উনি তাঁর বিএম কলেজের সহকর্মী ছিলেন। তাঁকে গিয়ে ওই মতিঝিল কলেজে একটা চাকরি দেবার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। একপর্যায়ে বললেন, তিনি একটা আত্মজীবনী লিখছেন এবং নরেন্দ্র গাঙ্গুলী যদি তাঁকে চাকরিটা দেন, তাহলে তিনি নরেন্দ্র বাবুর নাম আত্মজীবনীতে উল্লেখ করে তাকে অমর করে রাখবেন। এই রকম সব উদ্ভট কাণ্ডকারখানা জীবনানন্দ করছেন তখন। মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। এবার গেলেন তাঁর এককালের ছাত্র নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। নারায়ণ তখন সিটি কলেজে শিক্ষক, তাঁকে বললেন তার কলেজে কোনো চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কি না। নারায়ণ জানালেন চেষ্টা করবেন। উঠে আসবার আগে জীবনানন্দ নারায়ণকে বললেন, একটা কথা, চাকরি যদি হয় তাহলে আমার বেতনটা যেন তোমার চেয়ে অন্তত এক টাকা বেশি হয়, হাজার হোক আমি তো তোমার শিক্ষক, তাই না? দারুণ নাজুক পরিস্থিতিতে নিজের সম্মানটুকু বজায় রাখবার মর্মান্তিক চেষ্টা তখন করছেন জীবনানন্দ।

একদিন রাস্তায় দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা হলে জানতে চাইলেন গদ্য লিখলে কি কবিতার চেয়ে বেশি পয়সা পাওয়া যাবে? এ সময় শিক্ষা নিয়ে প্রবন্ধ লিখে ছাপালেন দেশ পত্রিকায়। নিবন্ধ লিখলেন এবং তা দেশ-এ ছাপা হলো, কিছু টাকা পেলেন। একদিন হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর বাড়িতে। বুদ্ধদেব তখন একটা ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায়। প্রতিভা বসুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা উপন্যাস লিখে কেমন টাকা পাওয়া যায় একটু বলবেন? বুদ্ধদেব কেমন টাকা পায়?’

হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রতিভা বসু। জীবনানন্দের পরিচিত অনুজ লেখক অশোক মিত্র সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন, ‘…উত্তর ভারতে অবস্থান করছি, জীবনানন্দের কাকুতিভরা পোষ্টকার্ড প্রায় প্রতি সপ্তাহে, যদি উদ্যোগী হয়ে আমরা ওর জন্য, দিল্লি উত্তরপ্রদেশ-পাঞ্জাব-রাজস্থান যে কোন জায়গায়, একটি শিক্ষকতা পদের ব্যবস্থা করে দিতে পারি, মাসে তিনশ টাকা হলেও তিনি সন্তুষ্ট!…চূড়ান্ত অভাবগ্রস্ত সংসার, খুব সম্ভব এঁর ওঁর তার কাছে সাময়িক সাহায্য ভিক্ষাও করতে হয়েছে তাকে। মফস্বল শহরের নির্জনতম মানুষটি কাশ-বেতফুল হোগলার বন, ধানসিঁড়ি নদী থেকে কলকাতার নির্বাসিত হতভম্ব, সর্বস্বলুণ্ঠিত, প্রায় শূন্যতাঘেঁষা অস্তিত্ব। বেঁচে থাকার ভয়, জীবিকাহীনতার ভয়, হিসাব না মেলাতে পারার ভয়, পড়শীদের ভয়, হয়তো বন্ধুদের ভয় পর্যন্ত…’

কিছু বাড়তি আয়ের জন্য এ সময় লাবণ্য একটা কমার্শিয়াল কোম্পানিতে নাটকে নামেন। কলেজে থাকতে নাটক করতেন লাবণ্য। চালোর্মী ক্লাব থেকে রঙমহলে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে নাটকে বউরানীর পাট করলেন। কেউ কেউ তাঁকে সিনেমায় নামবার পরামর্শও দিলেন। নামবেন কি না ভাবছেন তখন লাবণ্য।

একপর্যায়ে উপায়ান্তর না দেখে জীবনানন্দ তাঁর এককালীন ছাত্র নরেশ গুহকে একটা চিঠিতে লিখলেন, ‘…আমার এখানে একটা বড় room ও খানিকটা isolated বারান্দা (রান্না ইত্যাদি করা যেতে পারে। যা আপনি অনেক আগে একবার দেখেছিলেন–খালি আছে। sublet করতে চাই। আপনার জানাশোনা কোনো লোক একজন হলেই ভালো কিম্বা বড়জোর দুজন–থাকলে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিলে খুশি হব।…’

এ সময় জীবনানন্দের সেই ঘরটায় সুরুচি মজুমদার নামের এক বিধবা মহিলা ভাড়া নিলেন, তিনি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করতেন। এই মহিলা এরপর হয়ে উঠলেন জীবনানন্দের জীবনের বিভীষিকা। কিছুদিন যেতেই দেখলেন সেই মহিলার ঘরে নানা রকম লোকের আনাগোনা, হইহুল্লোড়, পানাহার। জীবনানন্দ অবিলম্বে সেই মহিলাকে বাড়ি ছাড়তে বললেন। কিন্তু সেই মহিলা কিছুতেই উঠবেন না এ বাড়ি থেকে জানালেন। জীবনানন্দ প্রভাবশালী লেখক তারাশঙ্করের শরণাপন্ন হলেন, উকিলের সাথে যোগাযোগ করলেন, একপর্যায়ে খোঁজখবর করতে লাগলেন কোনো গুন্ডাকে দিয়ে এই মহিলাকে উৎখাত করানো যায় কি না। কোনো কাজ হলো না। মহিলা বহাল তবিয়তে তার বাড়িতে সাবলেট থেকে হইহুল্লোড় চালিয়ে গেলেন।

.

০২.

এ সময় একদিন সঞ্জয়ের বাড়িতে গেছেন জীবনানন্দ। সঞ্জয়, ভূমেন চা খাচ্ছিলেন। তাকে দেখেই সঞ্জয় বললেন, আসুন আসুন। আপনার মুখ দেখে বুঝতে পাচ্ছি কিছু একটা অঘটন ঘটেছে।

জীবনানন্দ বললেন, না না, তেমন কিছু না। এমনি এলাম আপনাদের এখানে।

সঞ্জয় : না, না জীবনানন্দ বাবু লুকাবেন না। বলুন।

জীবনানন্দ: না মানে যে কিছু টাকার জন্য ঠেকে পড়েছিলাম। তো সেজন্য গিয়েছিলাম দেশ পত্রিকা অফিসে। ভাবলাম ওদের কয়েকটা কবিতা দিয়ে অগ্রিম কিছু টাকা পাওয়া যায় কি না।

সঞ্জয় : তা কী বলল ওরা। জীবনানন্দ : না, মানে ওরা বললেন যে এভাবে অগ্রিম তারা দেন না। আরও বললেন যে এত কবিতার তাদের দরকার নেই। আমাকে দুতিনটা রেখে যেতে বললেন। যখন ছাপা হবে তখন টাকা পাঠিয়ে দেবেন বললেন।

সঞ্জয় : তা আপনি কী করলেন, দুতিনটা কবিতা দিয়ে এলেন?

 জীবনানন্দ : হ্যাঁ, তাই দিয়ে এলাম। ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

সঞ্জয় কিছু বললেন না। পাশের ঘরে গিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসে বললেন, আপনি বসুন, আমি এখনই আসছি। ভূমেনকে বললেন জীবনানন্দকে সঙ্গ দিতে। বললেন তিনি এখনই চলে আসবেন।

ভূমেন আর জীবনানন্দ বসে রইলেন। ঠিক কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তাঁরা। চা পড়ে রইল সামনে। ঠান্ডা হয়ে চায়ের ওপর সর পড়ল। ঘণ্টা খানেক পরে সঞ্জয় এসে বললেন, দেশ-এর সুরেশ মজুমদারের কাছে গিয়েছিলাম তাকে শুধু এই কথাটা বলতে যে সামান্য কিছু টাকার জন্য জীবনানন্দ কিছু লেখা নিয়ে এসেছিলেন আপনাদের কাছে, আপনারা নেননি ফেরত দিয়েছেন। তাতে জীবনানন্দ অপমানিত হননি, তিনি মান অপমানের ঊর্ধ্বে, সময় একদিন তা বলবে, অপমানিত হয়েছি আমরা সবাই, যারা সাহিত্য সেবা করি বলে ভাবি।

জীবনানন্দ খুব কুণ্ঠিত হয়ে পড়লেন, বারবার বলতে লাগলেন, কেন এসব করতে গেলেন। উনিও তো চাকরি করেন। চাকরির কিছু নিয়মকানুন আছে। কী দরকার ছিল তাঁকে বলবার…

সত্যপ্রসন্ন এক ফাঁকে এসে জীবনানন্দের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। বললেন, আপাতত চলুক, আমরা তো আছি।

সঞ্জয় চেয়ার টেনে জীবনানন্দের সামনে এসে বসলেন এবং তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, শুনুন জীবনানন্দ বাবু, এখন যারা কবিতা লিখছে এরা কেউ কবি নয়। কবি একমাত্র আপনি, এটা জেনে রাখবেন। আপনিই আমাদের এই দেশটাকে, এই সময়টাকে সবচেয়ে ভালো চিনেছেন, ধরেছেন। আপনি রবীন্দ্রনাথের পরে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গ্লোবাল রাইটার। হুইটম্যান থেকে শুরু করে ইয়েটস, এলিয়ট, ডিলান টমাসের সাথে আপনার আত্মীয়তা।

জীবনানন্দ একটু উসখুস করতে লাগলেন, তারপর বললেন, একজন সচেতন কবিকে এতজন অগ্রজ বা সমসাময়িক কবি একই সঙ্গে প্রভাবিত করতে পারেন?

সঞ্জয় রেগে গেলেন, আমি তো প্রভাবের কথা বলছি না জীবনানন্দ বাবু, বলছি আত্মীয়তার কথা। অন্য কবিদের প্রভাব থাকতে পারে, আপনার আছে আত্মীয়তা, আপনি এদের বংশধর, অন্যরা কেউ না…

.

বিধাতা, তোমার কাজ সাঙ্গ হয় নাই

০১.

জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী তখনো বেঁচে আছেন। তাঁর আদরের মিলুকে জীবনযুদ্ধে জর্জরিত হতে দেখছেন। এই জটিল জটাজালে জড়ানো ছেলের বেদনা তিনি আর কী করে লাঘব করবেন? দূর থেকে তাঁকে দেখেছেন শুধু। কুসুমকুমারী যে দিনলিপি লিখতেন, তাতে একদিন লিখেছেন, …মিলু রে তোর তুলনা নাই। মাতৃগতপ্রাণ সন্তান আমার। ভগবানকে আঁকড়াইয়া ধর–তিনিই তোর সহায়।

বিশ্বাসী কুসুমকুমারীর মনে হয়েছে ভগবানই তার এই বিপর্যস্ত ছেলেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু জীবনানন্দ কি তা মনে করতেন? ঈশ্বরে কি বিশ্বাস করতেন তিনি? তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাসের তত্ত্ব-তালাশ করি।

অনেক আগে অচিন্ত্য তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঈশ্বর মানেন? জীবনানন্দ বলেছিলেন, মানুষের নীতিবোধ মানি।

.

০২.

ঈশ্বর বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কথাবার্তা আছে তাঁর বিভা উপন্যাসে। উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে, বিভা মেয়েটা একটা ময়না কিনেছে। সে ময়নাটার পায়ে ফোঁড়া। বিভার বাবা তাকে বলছেন এতগুলো পয়সা দিয়ে খামোখা কেন এই পাখি কিনেছ?

বিভা বলছে, ভেবে দেখো এ বেচারা পাখি দুটো যদি আমার কাছে না আসত, তাহলে এদের কী রকম বিপদ হতো?

বিপদ, কাদের?

পাখিদের।

কী রকম?

এই দেখো ময়নাটার ডানার নিচে কেমন একটা ফোঁড়া হয়েছে। বিভা খুব আগ্রহে বেদনায় তার বাবাকে দেখাতে লাগল।

ভদ্রলোক একবার তাকিয়ে বললেন, মরুক গে, ফোঁড়া হয়েছে তো আমার কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে।

ফোড়াটার দিকে তাকিয়ে বিভা বলে, এতে তোমার কষ্ট হয় না?

 এই ময়নার ফোড়ার জন্য?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোক একটা সোফায় বসে পড়ে বললেন, জীবন আমার অতটা শৌখিন এখনো হয়ে ওঠেনি, বিভা।

এ রকম করে বিচার কোরো না বাবা। আমি জানি এই পাখি দুটো আমার কাছে না থাকলে বড় কষ্ট পেত। এই রকম ফোড়া নিয়ে শীতের ভেতর পথে পথে ঘোরা…জীবনের নানা কাজে আমি ভগবানের হাত দেখি। এ দুটো পাখিকে তিনি আমার কাছেই পাঠাতে চেয়েছেন। কেন জানো? তিনি জানেন যে আমি এদের খুব পরিচর্যা করব। শান্তিতে রাখব এই দুটো পাখিকে।

.

বিভার বাবাঃ এই পাখি দুটোর বেলাই তিনি এত কথা ভাবেন। আর কারু বেলা ভাবেন না কেন?

–তা ভাবেন।

–কই নমুনা তো দেখি না।

বিভা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু একটা কাণ্ড হয়ে গেল। ময়নাটা কোন ফাঁকে বিভার কোল থেকে লাফিয়ে কার্পেটের ওপর গিয়ে বসেছে। সকলেই হঠাৎ তটস্থ হয়ে দেখল একটা বিড়াল এসে এক মুহূর্তের ভেতর পাখিটার ঘাড় মটকে সেটাকে নিয়ে ছুট দিল।

সুদর্শন তাদের কাজের লোক বিড়ালটাকে তাড়া দিতেই ময়না পাখিটাকে কার্পেটের মাঝপথে ফেলে চলে গেল বিড়াল 9

পাশের মেস থেকে লেখক দেখছে…দেখলাম পাখিটার মাথা নেই, যতদূর চোখ যায় ময়নার মাথাটা কোথাও আবিষ্কার করতে পারলাম না, জানি না কী হয়েছে। ওই বিড়ালটাই খেয়ে ফেলল নাকি…

বিভা ভাবছিল পাখিটার ফোড়া সারাবার জন্য ভগবান তাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন কিন্তু ফোঁড়া সারানো তো দূরের কথা এবার এক বিড়াল এসে পাখির ঘাড়ই মটকে দিল, কার্পেটের ওপর পড়ে আছে মাথা কাটা ময়না। কোনো ভগবান তাকে বাঁচাতে পারল না। পুরো দৃশ্যটার ভেতর আছে বীভৎসতা আর চাপা কৌতুক।

বিভার বাবা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভগবানের বিশেষ প্রিয় ভেবে পাখিটাকে যে ঈর্ষা করছিলাম, সে ঈর্ষার পাত্র সে নয় শেষ পর্যন্ত।…

বিভার মা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে বললে, শুনছ?

বিভার বাবা বললেন, কী হলো আবার।

সুদর্শনটা কী!

কেন, কী করল?

পাশের বাড়ির সেই কেঁদো বিড়ালটা, সেই সোহাগীটাকে এমনি করে মাথায় লোহার ডান্ডা মারলে যে সেটা কাতরাতে-কাতরাতে গেল মরে।

বিভার বাবা বিভার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা আমি এখন সুদর্শনকে মারব। তারপর বিভা মারবে আমাকে। এই রকমই।…কিন্তু বিভা অনেক কিছু শিখলে, এখন থেকে যেখানে সেখানে ভগবানের হাত বা মঙ্গল উদ্দেশ্য দেখতে যেও না। নিজে যদি শান্তিতে থাকতে পার তাই যথেষ্ট। পরকে আশ্বাস বা সান্ত্বনা দেবার মত শক্তি আমাদের কারুরই নেই।

.

০৩.

ঈশ্বর-ভাবনার দিক দিয়ে এই যে তাঁর সংশয়বাদিতা, এ নিয়ে আরও সরাসরি কথা আছে তাঁর পূর্ণিমা উপন্যাসে, ‘সুশৃঙ্খল বিধাতা হলে এই কয়টি জীবনকে এমনি করেই সাজাত। কিন্তু সুশৃঙ্খল বা উচ্ছখল–বিধাতা বা শয়তান বলে কেউ কোথাও নেই। কিংবা আছে কি? কে জানে? থাকলে ঢের বেশি শান্তি পাওয়া যেত–নালিশ করে কিংবা প্রার্থনা করে কিংবা বিদ্রোহী হয়ে–কিংবা ভবিতব্যতাকে স্বীকার করে। জীবনের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থার সামঞ্জস্যের দিক দিয়েও ব্যবধানটা এমন অসংলগ্ন হয়ে পড়েছে। যে সৃষ্টিতে নক্ষত্রেরা থাকে কিন্তু তাদের অপর্যাপ্ত নীচে কোনো দিকেই কারো কোনো সহানুভূতি নেই, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনো সাহায্য নেই, নিজের কোনো শক্তি নেই, কোনো আকস্মিক যাদু বা ভেল্কির পৃথিবী ও যুগ নেই, বিধাতা, ধর্ম বা সন্ন্যাসেও কোনো বিশ্বাস নেই, তা থাকলেও একটা সম্বল শান্তি খাটত বটে’।

অনেক নিরাশ্রয়তার ভেতর এ-ও এক নিরাশ্রয়তা জীবনানন্দের। বিশ্বাসী মানুষের মতো ঈশ্বরে আশ্রয় নিয়ে প্রশান্তি পাবার উপায় তার নেই। ঈশ্বরকে কখনো কখনো অবশ্য তিনি স্মরণ করেছেন একজন শিল্পী হিসেবে। ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ গল্পে যেমন লিখেছেন, ‘একটা মৃত পোকা তুলে নেই; মাখনের মতো শাদা পাখনা, ছোট্ট শরীরের মধ্যে চোখ মুখ গলা বুক পা ডানা দেহের কারুকার্যে তাজমহলের শিল্পগুণের চেয়ে একটুও কম সহিষ্ণুতা কৌশল ও যত্ন দেখায়নি তো! লক্ষ লক্ষ বার এই রকম গভীর সাধনার পরিচয় দিয়েছে এই কীটনির্মাতা। কিন্তু তবুও মৃত্যু ও অন্ধকারের মধ্যে এই অবর্ণনীয় প্রয়াস মুহূর্তে-মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তবুও বিরাম নেই তো শিল্পীর’।

.

০৪.

কীটনির্মাতাকে শিল্পীই ভেবে নিচ্ছেন তিনি। আবার কখনো বিধাতাকে স্মরণ করেছেন খুব বিষণ্ণ, অভিমানে। লিখেছেন :

ইচ্ছা হয় কোন দূর প্রান্তরের কোলে গিয়ে শ্যামাপোকাদের ভীড়ে
কাশ মাখা সবুজ শরতে
 বসে থাকি; আবার নতুন করে গড়ি সব,
আবার নতুন করে গড়ে তুমি;
বিধাতা, তোমার কাজ সাঙ্গ হয় নাই;
মানুষ ঘুমায়ে থাক–এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাক
 কাঁচপোকা মাছরাঙ্গা পানকৌড়ি চড়াই।
একদিন হবে নাকি তাই?
 বিধাতা, তোমার কাজ সাঙ্গ হয় নাই।

.

০৫.

 কুসুমকুমারী দেখলেন তাঁর মিলুর আঁকড়ে ধরবার কেউ নেই। ভগবান নেই, বন্ধু, পরিজন নেই। জীবনানন্দকে এমন নিরালম্ব রেখেই ১৯৪৮-এ মারা গেলেন জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ, যার ভোরের প্রার্থনার সংগীতে ঘুম ভাঙত জীবনানন্দের, বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত যার জন্য জেগে থাকতেন, যিনি তার ভেতর খুঁজে দিয়েছিলেন সেই মন্ত্র কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। কুসুমকুমারী মারা গেলেন বরিশালে তাঁর প্রিয় গৈলা গ্রাম, বগুড়া রোড থেকে অনেক দূরে কলকাতায় এক ছোট গলিতে। মায়ের মৃত্যুর পর জীবনানন্দ লিখেছেন, ভাবনা বেদনা সংকল্প স্বপ্নের কোনো ক্ষয়ক্ষতির হাতে, ইতিহাসের অন্ধকার ক্ষমতার হাতে মা নিজেকে কোনদিন সমর্পিত করতে যাননি। যে বড় ভূমিকা তার পাওয়া উচিৎ ছিলো সংসারে সে পটভূমি পাননি তিনি। কিন্তু তাহলে কি হবে, তিল ধারণের মত তুচ্ছ ভূমিকায় দেখিয়েছেন ব্রহ্মাণ্ড প্রতিফলিত হয়ে উঠতে পারে।

.

কোথায় শুভ মানবিকতার ভোর?

০১.

ব্যক্তিগত জীবনটা তখন দুমড়েমুচড়ে গেছে জীবনানন্দের। ভেঙে গেছে তার স্বপ্নের সিঁড়ি। কিন্তু এই ভাঙা সিঁড়ি কি শুধু তাঁর নিজের জীবনেরই? তিনি বরাবর তাঁর নিজের পৃথিবী, নিজের সময় ছাড়িয়ে তাকিয়েছেন বড় পৃথিবী, বড় সময়ের দিকে। সেই বড় পৃথিবী, বড় সময়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছে ব্যর্থতা শুধু তাঁর একার জীবনে নয়, ব্যর্থতা যেন পুরো সভ্যতারই। তিনি যেন সেই সামগ্রিক ব্যর্থতার নগণ্য একজন ধারক মাত্র। এ সময়ে লিখেছেন : ‘মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে/ বড়ো বড়ো নগরীর বুক ভরা ব্যথা’। সেই প্রবল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের ভেতরও জীবনানন্দ খাড়া রেখেছেন তাঁর কবিতার মাস্তুল। মুখ থুবড়ে পড়ে পড়তেও লিখে গেছেন কবিতা। তাঁর মনে হয়েছে এই যে স্বপ্নের সিঁড়ি ভেঙে যাওয়া, এ যেন শুধু তাঁর নিজের জীবনেরই পরিণতি নয়, এ পরিণতি বিশ্বসংসারেরই। এ সময় লেখা তাঁর কবিতায় এই উপমাটা বারবার এসেছে, একটা সিঁড়ি স্বর্গে উঠতে গিয়ে মাঝপথে গেছে ভেঙে :

প্রেম নেই–প্রেমব্যাসনেরও দিন শেষ হয়ে গেছে;
একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের
আকাশে উঠেছে।
উঠে ভেঙে গেছে।
কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর …

অথবা

কোথায় সমাজ, অর্থনীতি?–স্বৰ্গগামী সিঁড়ি?
 ভেঙে গিয়ে পায়ের নিচে রক্ত নদীর মতো–
মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী
 হয়ে কি আজ চারিদিকে গণনাহীন ধূসর দেয়ালে

ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল করে। তার মনে তখন এই গভীর প্রশ্ন যে বিশ্বজুড়ে প্রগতি, উন্নয়ন, বৈষম্যহীন সমাজ, অর্থনৈতিক মুক্তির এই যে সব আয়োজন তা কি শেষ পর্যন্ত নিজের নিজের স্বার্থের দেয়ালে ঘেরা এক-একটা বৃত্ত দখল করে বসবারই ফন্দি? হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তেমন স্মরণীয় শতক তো তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না–

মানুষেরা বার-বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে;
নব-নব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে;
তবুও কোথাও সেই অনির্বচনীয়
স্বপনের সফলতা-নবীনতা–শুভ্র মানবিকতার ভোর?
নচিকেতা জরাথুস্ট্র লাওৎ-সে এঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী
 হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছে?
অন্ধকারে ইতিহাসপুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মতো মনে হয়
 যতই শান্তিতে স্থির হয়ে যেতে চাই;
কোথাও আঘাত ছাড়া–তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই।…

সবকিছু মিলিয়ে তার মনে তখন ভর করেছে তীব্র ক্ষোভ আর ক্রুর ঘৃণা :

পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
 স্থূল হাতে ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত–ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে
 ব্যবহৃত-ব্যবহৃত
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো হো করে হেসে উঠলো :
 ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে শুয়োরের মাংশ হয়ে যায়?
হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!
চারিদিককার অট্টহাসির ভিতর একটি বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে
অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হয়ে উঠলো যেন;
পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতদেহের দুর্গন্ধের মতো…

.

ভীষণ হতাশার ভেতর মনকে চোখ ঠারা দিয়ে অনেক সময় বুঝিয়ে রেখেছেন, যাকে তিনি বলেছেন টেমপোরারি সাসপেনশন অব ডিজবিলিভ। এখন তাতেও যেন কুলাচ্ছে না আর :

পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু
এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান।
 হৃদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে
হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান;
 এ-রকম একদিন মনে হয়েছিলো;
… … …
আমরা তো বহুদিন লক্ষ্য চেয়ে নগরীর পথে
হেঁটে গেছি; কাজ করে চলে গেছি অর্থভোগ করে;
ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে।
গ্রন্থকে বিশ্বাস করে পড়ে গেছি;
 সহধর্মীদের সাথে জীবনের আখড়াই, স্বাক্ষরের অক্ষরের কথা
মনে করে নিয়ে ঢের পাপ করে, পাপকথা উচ্চারণ করে,
তবুও বিশ্বাসভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে জীবনের যৌন একাগ্রতা
হারাইনি;–তবুও কোথাও কোনো প্রীতি নেই এতদিন পরে।

.

০২.

জীবনের শুরুটা তার হয়েছিল একটা নিষ্পাপ পৃথিবীতে। মনের ভেতর লালন করেছেন নানা সত্য, সুন্দর, কল্যাণের আভা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর, দেশভাগোত্তর সেই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছে শুধু তাঁর নিজের জীবনে না, কোথাও সত্য, সুন্দর, কল্যাণের সেই আভা আর অবশিষ্ট নেই। তাঁর এমনও আশঙ্কা হচ্ছে যে হাজার বছরের ইতিহাসে বুঝি সেই সত্য, সুন্দর, কল্যাণকামী স্বর্ণযুগ ছিল না কখনো, এ এক মায়াই শুধু :

সময়ের ব্যাপ্তি যেই জ্ঞান আনে আমাদের প্রাণে
তা তো নেই,–স্থবিরতা আছে–জরা আছে।
চারিদিক থেকে ঘিরে কেবলি বিচিত্র ভয় ক্লান্তি অবসাদ
রয়ে গেছে। নিজেকে কেবলি আত্মক্রীড় করি; নীড়
 গড়ি। নীড় ভেঙে অন্ধকারে এই যৌন যৌথ মন্ত্রণার
 মালিন্য এড়ায়ে উক্রান্ত হতে ভয়
পাই। সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যুশব্দ এসে
ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে-ভয় পাই-গুহায় লুকাই;
 লীন হতে চাই–লীন–ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে
 চাই। আমাদের দুহাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম।

জীবনানন্দের সেই ১৯৪৮ পেরিয়ে গেছে বহুকাল, আজকে এই দুই হাজার সতেরো সালে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে এই মুহূর্তেও তো শোনা যায় একই রক্তশব্দ, মৃত্যুশব্দ। সে শব্দ আসে সিরিয়া থেকে, গাঁজা থেকে, সোমালিয়া থেকে।

জীবনানন্দের মনে তখন অনুযোগ :

আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে?
আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য বলে গেছে…

কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ
আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠে :
… … …
আমরা যে কমিশন নিয়ে ব্যস্ত-ঘাঁটি বাঁধি
ভালোবাসি নগর ও বন্দরের শ্বাস
 ঘাস সে বুটের নিচে ঘাস শুধু–আর কিছু নয় আহা–
মোটর যে সবচেয়ে বড়ো এই মানব জীবনে
 খঞ্জনারা নাচে কেন তবে আরফিঙা বুলবুলি কেন ওড়াউড়ি করে
বনে বনে?

এই ভাবনাকেই আরেকটু টেনে নিয়ে তাঁর সুতীর্থউপন্যাসের চরিত্র বলে, ‘মানুষ, মানে যারা মারণমন্ত্র, শেল তৈরি করতে পারে? তার চেয়ে যারা তালপাতার ব্যাগ তৈরি করতে পারে তারা বেশি মানুষ। যারা একশোবার করে ইউরোপ আমেরিকায় এশিয়ায় কনফারেন্স পাতায় আর ভাঙে, পরস্পরকে বজ্জাৎ বলে গালাগাল দেয়–একেবারে উৎখাত করে ফেলবার ফিকিরে থাকে, তারাই তো মানুষ এখনকার পৃথিবীতে : আর তাদের তাঁবেদাররা–ব্যাঙ্কে অফিসে–ডিপার্টমেন্টাল চেয়ারে বসে পৃথিবীর সর্বত্র। এর চেয়ে বেশি মানুষ মনে করি আমি যারা নদীর পারে, হোগলার ক্ষেতের পাশে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কি করে বাবুই পাখিগুলো বাসা তৈরি করে, তেমনি শান্তিতে তেমনি নীড় মানুষের জন্যেও তৈরি করবার প্রেরণা পায় তারা, কিন্তু তারপরেই উপলব্ধি করে মানুষ তো মারীবীজ হাঁকিয়ে চলেছে পৃথিবীতে–বাবুইদের সঙ্গে মানুষের তো কোনো মিল নেই–কি করে স্থিরতা পাবে মানুষ পৃথিবীতে–কি করে শান্তি পাবে?… পৃথিবী যে খারাপ নয়, মানুষ যে সত্যিই ভালো, প্রাণের গঙ্গা যে রক্তে নাওয়াবে না মানুষকে আর, কোনো বিপ্লবেরই দরকার হবে না একদিন সমাজ যে সুস্থ ও শুভ হয়ে উঠবে সকলের জন্যে, জীবন যে বাস্তবিকই আশা-ভরসা, এসব জিনিসে কোন আপ্ত বিশ্বাস নেই আমার। সেটা থাকলেই ভালো হত; এ যুগে বিশ্বাস কাঁচিয়ে গেলে অভিজ্ঞতা ও যুক্তি দিয়ে তাকে ফিরে পাওয়া যায় না আর’।

বিশ্বাস তখন জীবনানন্দের সত্যিই কাঁচিয়ে গেছে। চারদিকের এই ছুটে চলা থেকে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়ে তিনি স্থির হয়ে ভাবতে চান কোথায় ছুটে চলেছি আমরা। তাঁর সমসাময়িক অন্য কবিরা যখন আধুনিকতাকে উদযাপন করছেন, তিনি তখন যন্ত্রের জয়জয়কার ভরা সেই আধুনিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকেন, একেবারে গোড়ায় হাত রাখেন :

ভেবেছিলাম মানুষ ইতিহাসের হাতে ক্রমেই বড়ো হবে
 মেশিনকে বশ করে খেলার চেয়ে।
হয়ে পড়ে সফলতায় প্রবীণ-তবুও মানুষ খেয়ে
 মেশিন ক্রমেই আজ পৃথিবীর এক শক্তি হলো
প্রেমের ছেদ হয়ে তার নিউক্লিয়ার বোমীয় ক্ষমতা
 বেড়েই গেল–জ্ঞানের পরিণামের মানে হলো
এই ধরনের পৃথক করার কথা?…

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই তাহলে ফল? তাই সেই জ্ঞানের মূল ধরেই প্রশ্ন তুললেন তিনি;

মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া, বিশেষণ;
এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল;
জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভীড়
শুধু-বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময়
 জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে
জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।

কথা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমরা একটা প্রেমের পৃথিবীই তৈরি করব। তা হলো কি? ট্রাম, রেলগাড়ি পেরিয়ে সে সময়ের কলকাতা শহরে আধুনিকতার, বিজ্ঞানের নতুন চমক মোটরকার। মানুষকে বিস্মিত করে ট্রাম, রেলগাড়ির চেয়েও দ্রুততায় পথে-প্রান্তরে ছুটে চলেছে মোটরকার। চারদিকে যখন মোটরকারের জয়জয়কার, তিনি তখন সন্দেহের চোখে তাকালেন এই মোটরকারের দিকে। মোটরকার তার কাছে খটকার মতো মনে হতে লাগল। মোটরকার যে দ্রুততা উপহার দিচ্ছে, তিনি সেই গতি নিয়েই প্রশ্ন তুললেন। প্রশ্ন তুললেন এই যে গতি তা কিসের জন্য? এই গতি আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চায়? খুব দ্রুত কোথাও পৌঁছে আসলে কী অর্জন করতে চাই আমরা? তিনি লিখলেন :

একটা মোটরকার
খটকা হয়ে আসে।
… … …
পরিষ্কার ভোরের বেলা
দেশের মটরশুঁটি কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে-হাঁটতে
 হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি
 লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে
হিজল গাছ দুটোর নিচে দিয়ে
ঊনিশ শো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার
 ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটছে;
পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে,
 ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বন্ধুর মতো সহসা
অগোচর,
 মাঠ-নদী যেন নিশ্চেষ্ট,
সহসা যেন প্রতিজ্ঞা হারিয়ে ফেলে,

এই মোটর অগ্রদূত,
সে ছুটে চলেছে
 যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত;

একটা মোটরকারের পথ
সব-সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।
… … …
রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার কার হু হু করে ছুটছে
 প্যারিসে–নিউইয়র্কে-লন্ডনে–বার্লিনেভিয়েনায়–কলকাতায়;
সমুদ্রের এপার-ওপার ছুঁয়ে
অসংখ্য তারের মতো,
 রাতের উল্কার মতো,
 জঙ্গলের রাতে অবিরল চিতার মতো,
মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প ও আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে;
 কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।

একটা মোটরকারের পথ-মোটরকার
 সব-সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
 অন্ধকারের মতো।

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে-হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
 পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই এসে বহন করুক : আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
 হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
 নক্ষত্রের নিচে।

জীবনানন্দ ঘোষণা করছেন কোথাও পৌঁছাবার তাড়া নেই তাঁর, জীবনের বিবিধ সফলতার উত্তেজনা নিয়ে অন্যরা ব্যস্ত থাকুক, তিনি টের পেয়েছেন যে এই অতীব সচল পৃথিবীতে তিনি বস্তুত গভীরভাবে অচল এক মানুষ। তিনি টের পেয়েছেন পৃথিবীতে অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে এবং ইতিমধ্যে শিয়াল আর শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়েছে তাঁর হৃদয় :

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই–প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
 যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
 শকুন আর শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়…

সেই ১৯৪৮ সালের বিক্ষুব্ধ সময়ের এই কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হলো জীবনানন্দের পঞ্চম কবিতার বই সাতটি তারার তিমির। বইটা জীবনানন্দ হুমায়ুন কবিরকে উৎসর্গ করলেন, দুর্দিনে যিনি তাঁকে স্বরাজ-এর চাকরিটা দিয়েছিলেন।

.

লিচুগাছে পেঁচা নেমে আসে

০১.

স্বরাজ এর চাকরি ছেড়েছেন বছর পাঁচেক হলো, এর ভেতর কোনো নিয়মিত চাকরি আর জোগাড় করতে পারেননি জীবনানন্দ। কলকাতার আশপাশে কয়েকটা কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন কিন্তু স্থায়ী কোনো চাকরি পাননি তখনো। সাহিত্য পরিমণ্ডল থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন তিনি। সে সময় কলকাতায় একদিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বাসায়, অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবনে নিয়মিত সাহিত্যের সভা হতো। কিন্তু জীবনানন্দ দুটোর কোনো আড্ডায়ই যেতেন না। তত্ত্ব আর পাণ্ডিতের বিদগ্ধ আবহাওয়ায় মাপা কথার আসর সেসব। জীবনানন্দ সঞ্জয়কে বলেছিলেন, ওসব সভাটভায় সাহিত্যের বিশেষ কিছু লাভ হয় না।

তিনি তখন পৃথিবীর ওপর নেমে আসা অদ্ভুত আঁধারের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ, ভীত, ক্লান্ত। কিন্তু চারদিকের এই রক্তশব্দ আর মৃত্যুশব্দের ডাইনির নাচ দেখে তিনি কী আর করতে পারেন? কতটুকু আর ক্ষমতা তার, নেহাত এক অক্ষম শব্দকর্মী তিনি। শব্দে শব্দে তাঁর নাজুক আশা আর আকুতিটুকু জানাতে পারেন শুধু :

এখানে অর্জুন ঝাউয়ে যদিও সন্ধ্যার চিল ফিরে আসে ঘরে
যেতে আর সাধ নেই পৃথিবীর ঘরের ভিতরে।
একে একে নক্ষত্রেরা দেখা দেয়–লিচু গাছে পেঁচা নেমে আসে;
গোরুর গাড়ির ঘুন্টি সাড়া দিয়ে চলে যায় সন্ধ্যার বাতাসে,
আস্তে যাচ্ছে গাড়ি আকাশ প্রান্তর ভেঙ্গে মৃদু বাতি নিয়ে
 চুপে চুপে কুয়াশায় যাচ্ছে মিলিয়ে,
 সোনালী খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে তার মুখে তার শান্ত অন্ধকার;
ভালো; তবু আরো কিছু চাই আজ পৃথিবীর দুঃসহ ভার বইবার
 প্রয়োজনে; তবুও মানবজাতি রক্তস্রোতে বার বার শক্তিশালী
 নদী না হয়ে এ স্নিগ্ধ রাত্রি–পথ হয়ে যেত যদি…

.

০২.

কলকাতায় বসে তিনি বহুকাল লিচুগাছে পেঁচা নেমে আসতে দেখেন না আর। এ সময় তিনি খুব করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন বরিশাল নিয়ে। ফিরে যেতে চান। তাঁর প্রিয় মাটিতে। কিন্তু সে মাটি তখন অন্য দেশে। ১৯৫৩ সালে এ বাংলার কবি কায়সুল হকের কাছে পাঠানো একটা চিঠিতে লিখেছেন : …পূর্ব পাকিস্তান আমার জন্মস্থান, সেখানে যেতে আমি অনেক দিন থেকেই ব্যাকুল, কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে জোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না…। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলছে ভাষা আন্দোলন। আগের বছর ঘটে গেছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে হত্যাযজ্ঞ। জীবনানন্দ খুব মনোযোগের সঙ্গে সেসব ঘটনা লক্ষ করেছেন, ভাষা নিয়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় ভীষণভাবে তাড়িত হয়েছেন তিনি। বাংলা ভাষা নিয়ে এক দৃষ্টিপ্রসারী লেখা তিনি লিখলেন সে সময়। পূর্ব বাংলার কথ্য ভাষার শক্তি এবং তাতে সাহিত্য রচনার সম্ভাবনার কথা তিনি বললেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। কলকাতার সুধীসমাজ যে সে ভাষাকে উপহাস করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান যে বৃহত্তর বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ, সে কথা তিনি জোর গলায় ঘোষণা করলেন সে প্রবন্ধে। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ভবিষ্যৎ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, খণ্ডনের আগে বাংলাদেশ বড় ছিলো…এবার সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের আমরা হারিয়েছি…আমার মনে হয় বাংলার শ্রেষ্ঠ উপভাষাগুলো পূর্ব (ও উত্তর) বাংলায় এবং সেখানে কয়েকশ বছর ধরে সিদ্ধি লাভ করেছে। পূর্ব বাংলার প্রবাদে বচনে ছড়ায় গীতিকায় ও মুখের ভাষার বিশদ ও ক্রান্তিগভীর তাৎপর্যে তার প্রমাণ রয়েছে। উপভাষাগুলো মাতৃভাষা থেকে উৎপন্ন হয়ে মাতৃভাষাকে নিয়ন্ত্রিত ও নতুন নতুন সূচনা নিয়ে উৎপন্ন হতে সাহায্য করে। উনিশ শতকের বাংলাসাহিত্য ও মুখের ভাষা (অন্তত শিক্ষিত সমাজে সবচেয়ে বেশী প্রসার পেয়েছিলো। প্রায় পুরোপুরি পশ্চিম বাংলা ঘেঁষা ছিলো। পূর্ব বাংলায় তখন ও তার অনেক আগে থেকেও উপভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছিলো, মুখের ভাষা বিকাশ পাচ্ছিল, কিন্তু এদিককার সুধী সাহিত্যিক বা চলতি সমাজের খেয়ালে তা বড় একটা আসেনি, ক্কচিৎ এলেও উপহাসনীয় হিসেবে ছাড়া বিশেষ উল্লেখ কিছু মনে হয়নি।…পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে কিছুকাল থেকে আলোড়ন চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত লোকই বরাবর বাংলা ব্যবহার করে আসছে। শিক্ষিতেরা ইংরাজি জানেন। কিন্তু যত মহই হোক বিদেশী ভাষা। রাষ্ট্রের ভাষা দেশী হওয়া দরকার। বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের দেশজ ভাষা, এভাষা যে স্বরূপ মুখে ও সাহিত্যে পূর্ব বাংলা এতদিন ধরে গড়ে তুলেছে তা বিশেষভাবে সেখানকার মুসলিমদের মুখে ও মননে গড়া জিনিস, সমস্ত বাংলাদেশ সে সব ভাষা ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে…পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা ও জনভাষা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এমন সময় আসবে যে পূর্ব বাংলার উপভাষাগুলো কারো মুখে কোথাও শুনতে পাওয়া যাবে না। এত ভালো, এত বড় বড় উপভাষা এরকম ভাবে যদি ফুরিয়ে যায় তাও যেতে পারে কারণ মানুষের বুদ্ধিবিচার প্রায়ই মূল্য সংরক্ষণ করতে চাইলেও ইতিহাস শাদা চোখে দেখে সব।

.

০৩.

বরিশালে ফিরতে না পারলেও এই বাংলা থেকে ওপারে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠতেন জীবনানন্দ। কবি শামসুর রাহমান এবং কায়সুল হক এ সময়ই ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা করতে। শামসুর রাহমান লিখেছেন তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি কেমন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ বসতে দেওয়ার মতো কোনো চেয়ার ছিল না তাঁর ঘরে। ঝকঝকে বারান্দায় বসে পড়েছিলেন শামসুর রহমান আর কায়সুল হক। জীবনানন্দ তখন খুব বিধ্বস্ত, ক্লান্ত। তবু পরম আগ্রহে গল্প করেছেন পূর্ব বাংলা নিয়ে। বলেছেন বরিশালের কথা, বলেছেন বরিশালে বেশ কিছু লেখার পাণ্ডুলিপি ফেলে এসেছেন তিনি। আফসোস করেছেন সেগুলো হয়তো আর কোনো দিন উদ্ধার করতে পারবেন না এই ভেবে। শামসুর রাহমান ঠাট্টা করে বলেছেন, সেগুলো নিশ্চয়ই এখন সব ধূসর পাণ্ডুলিপি হয়ে গেছে? এ কথা শুনে জীবনানন্দ অনেক দিন পর তার সেই কাঁধ ঝাঁকানো হাসি হেসেছেন অনেকক্ষণ।

.

জীবন লালসার উল্টো পিঠ

০১.

এই সময়টাতেই জীবনানন্দের সঙ্গে পরিচয় হলো ভূমেন্দ্র গুহর। সে সময় মেডিকেলের ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহ তার আর কিছু বন্ধুকে নিয়ে ময়ূখ নামে এক দ্বিমাসিক কবিতার পত্রিকা করতেন। তাঁদের পত্রিকার জন্য জীবনানন্দের একটা কবিতা পাবার আশায় ভূমেন্দ্র এবং তাঁর বন্ধু স্নেহাকর, সমর বেশ কদিন ঘোরাঘুরি করেন ল্যান্সডাউন রোডের জীবনানন্দের বাড়ির আশপাশে কিন্তু ভেতরে যাবার সাহস পান না। জীবনানন্দের বোন সুচরিতা রাস্তায় তাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে নিজে গিয়ে পরিচিত হন এবং পরিচয় করিয়ে দেন জীবনানন্দের সঙ্গে। ভূমেন্দ্রর পূর্বপুরুষ বরিশালেরই তা জানতে পেরে উফুল্ল হয়ে ওঠেন জীবনানন্দ। জেনে আনন্দিত হন যে ভূমেন্দ্রর জীবনের একটা অংশ কেটেছে বরিশালে। ভূমেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনি বরিশালের জাহাজঘাটা দেখেছেন? আলেকান্দা হয়ে হেঁটেছেন কখনো? কালীবাড়ি রোড়, বগুড়া রোড?

ভূমেন্দ্র বলেছেন, কালীবাড়ি রোডে আমাদের একটা কাঠের দোতলা বাড়ি ছিল…

জীবনানন্দ বলেছেন, সেখানে জীবনের একটা বিশাল উন্মুক্ততা ছিল, এখানে এসব কোথায় পাবেন?

ভূমেন্দ্র ও তাঁর বন্ধুদের প্রকাশিত ময়ুখ পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন জীবনানন্দ। পাশে দাঁড়িয়ে ভূমেন্দ্র বলেন, আপনার কবিতা আমাদের নিমগ্ন করে।

জীবনানন্দ ময়ূখ-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলেন, কারণটা একদিন জেনে যাবেন। কিন্তু আপনারা ধূসর পাণ্ডুলিপির পরের থেকে পড়ে দেখবেন। ওখানে একটু অগোছালো হয়ে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আপনারা ধূসর পাণ্ডুলিপি দেখেছেন কি? এখন অবশ্য পাওয়া যায় না।

ভূমেন বলেন, আসলে বুদ্ধদেব প্রমুখ আপনার শেষ দিকের কবিতাগুলো যেভাবে বোঝেন, আমরা সেভাবে বুঝি না। আমাদের মনে হয় মানুষের জীবনের এবং তার ইতিহাসের দুটি প্রান্ত আপনাকে ব্যস্ত রাখে।

জীবনানন্দ চুপচাপ শুনলেন, হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলেন, আরেক দিন আসবেন। কথা হবে।

তারপর আচমকা বলেন, আমি একটা বড় অসুবিধার মধ্যে আছি। আমাকে মোটামুটি একটা ভাড়ায় কোনো বাসাবাড়ি খুঁজে দিতে পারেন? সত্যিই জরুরি।

জীবনানন্দ তখন তাঁর সেই ভাড়াটে মহিলা সুরুচি মজুমদারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করতে না পেরে নিজেই এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। সেই থেকে অসমবয়সী ভূমেন্দ্রর সঙ্গে জীবনানন্দের এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হলো। কিন্তু ভূমেন্দ্র সেই বন্ধুত্বের স্বাদ পেলেন না বেশি দিন। পরিচয়ের বছরখানেকের ভেতরই নিঃশেষিত হলো জীবনানন্দের আয়ু। তাঁর মৃত্যুর পর বরং ভূমেন্দ্রর বন্ধুত্ব শুরু হলো জীবনানন্দের গুপ্ত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে। দীর্ঘমেয়াদি, প্রগাঢ় সেই বন্ধুত্ব।

কিন্তু যে কদিন ভূমেন্দ্র জীবনানন্দকে পেলেন, সে কদিন তার সঙ্গে কাটালেন নিবিড়, আন্তরিক অনেকগুলো দিন, ক্ষণ, মুহূর্ত। বাড়িতে আড্ডা দিলেন, একসঙ্গে কলকাতায় ঘুরলেন, সিনেমা দেখলেন। জীবনানন্দ তাঁকে আপনি থেকে তুমি সোধন করতে লাগলেন।

তখন কলকাতায় ছাদখোলা বাস ছিল। একদিন সেই খোলা ছাদের বাসে অনেকক্ষণ ঘুরছেন ভূমেন্দ্র আর জীবনানন্দ। ভূমেন্দ্র জীবনানন্দকে বললেন, তাঁরা বন্ধুরা মিলে চক্ৰবেড়ে রোডের মেয়েদের স্কুলের যে চিলেকোঠায় থাকেন, সেই ঘরটায় একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ছাদের আংটায় শাড়ি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে সে। ভূমেন্দ্র বললেন, বাড়ির ছাদের আংটায় সেই মেয়ের শাড়ির একটা ছোট টুকরো এখনো লেগে আছে। জীবনানন্দ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। শুনতে শুনতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার জনস্রোত দেখলেন। তারপর বললেন, মেয়েটি কেন আত্মহত্যা করল তোমরা খোঁজ করেছ? খোঁজ করলে দেখতে লোকে যা বলবে, পুলিশে যা বলবে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যা বলবে তার থেকে কারণটা হয়তো আরও বেশি আবছা…তুমি তো ডাক্তারি পড়ো, মানুষকে জন্মাতে মরতে দেখো, তোমার এ রকম মনে হয় না? এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু ঠিক জীবন লালসার উল্টো পিঠ, মৃত্যু যথেষ্ট আগ্রাসীও হতে পারে হয়তো, তাই না…

.

০২.

দু-একটা টিউশনি, লাবন্যের স্কুলের চাকরি নিয়ে কোনো রকম সংসার চলছে তখন জীবনানন্দের। তাঁর মেয়ে মঞ্জু, আর ছেলে সমরানন্দ দুজনের শরীরেই তখন নানা রকম অসুখ। পড়াশোনায় দুজনের কেউই ভালো নয়। কোনো রকম কায়ক্লেশে পরীক্ষায় পাস করে তারা। অব্যাহত চাকরির চেষ্টায় জীবনানন্দ তখন একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরের ভেতর দিন কাটিয়ে চলেছেন।

এ সময় জীবনানন্দের ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। ডাক্তার বললেন নিয়মিত হাঁটতে হবে। হাঁটতে কোনো আপত্তি নেই জীবনানন্দের। বরিশালে থাকতে ভাই অশোককে নিয়ে হেঁটে যেতেন দূরদূরান্তে। কল্পনাতেও তিনি হাজার বছর ধরে হেঁটেছেন। এ সময় তিনি কলকাতায় প্রতি বিকেলে হাঁটার ব্যাপারটাকে একটা রুটিনে পরিণত করলেন। তাঁর হাঁটার সঙ্গী হিসেবে যুক্ত হলেন সুবোধ রায় বলে একজন ভদ্রলোক। তিনি সাহিত্য অনুরাগী, জীবনানন্দের কবিতার পাঠক, নিরীহ মানুষ। জীবনানন্দ সুবোধ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করতেন। তাঁর ভাই অশোকানন্দ এক লেখায় লিখেছেন, দাদা, বহু লোকের কাছ থেকে বহু আঘাত পেয়েছিলেন, অনেক জ্ঞানপাপী তাকে যথার্থ মূল্য দিতে নারাজ, এমন একটা ধারণা তাঁর ছিল। সুতরাং অভিপ্রায় সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সকলেই তাঁর কাছে suspect হয়ে থাকত।

সুবোধ বাবুর অভিপ্রায় সম্পর্কে তিনি যেন নিশ্চিত হয়েছিলেন। টের পেয়েছিলেন নিরাপদ এ লোক তাঁর সঙ্গ চায় মাত্র। প্রতি বিকেলে সুবোধ বাবুর সঙ্গে তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে কিছুটা পশ্চিমে তারপর রস রোড ছুঁয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে সোজা চলে যেতেন গড়িয়াহাট গোলপার্ক। সেখানে একটা লম্বা চক্কর দিয়ে ফিরে আসতেন বাড়িতে। সুবোধ বাবুর সঙ্গে কোনো গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলাপ করতেন না তিনি। নানা হালকা বিষয়ে কথা হতো তাঁর সঙ্গে। যেসব কথা আর কারও সঙ্গে বলা হয়ে উঠত না, সেসব নিয়ে কথা বলতেন তাঁর সঙ্গে। সে সময় জীবনানন্দের মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছিল। হাঁটতে হাঁটতে সুবোধ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আমার টাকটা বোঝা যায় পেছন থেকে?

সুবোধ বললেন, বোঝা যায় বৈকি, সূর্যবন্দনা করেন তো, এবার টেকো চাদি ফাটিয়ে ছাড়বে আপনার জ্বলন্ত সূর্য।

জীবনানন্দ বললেন, সূর্যকে ভয় নেই। ভয় রাত্রিকে। কিছুদিন পর লাইটপোস্টের তলা দিয়ে হাঁটাই যাবে না। চাঁদনি রাতে দেখেছেন কোনো দিন পদ্মার ইলিশকে ডিগবাজি খেতে?

টাকের এমন কাব্যময় উপমা নিয়ে দুজনে হাসাহাসি করলেন। কিছুদূর হেঁটে হঠাৎ থেমে জীবনানন্দ বললেন, শুনছেন, ভাউয়া ডাকে। সুবোধ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাউয়া কী?

জীবনানন্দ : ব্যাঙ, বরিশালের ভাষায় ব্যাঙকে বলে ভাউয়া।

.

বিনা দামে ওষুধ

০১.

লিখে জীবন ধারণ করতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ, তা হয়নি। শিক্ষকতাকে জীবিকা হিসেবে নিলেও সে পেশাকে পছন্দ করেননি। শিক্ষকতায় আর ফিরে যাবেন না ভেবে রেখেছিলেন। সংবাদপত্রের পেশা চেষ্টা করেছেন, নানা ব্যবসারও চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনোটাতেই সফল হতে পারেননি তিনি। চাকরির দুর্মর চেষ্টায় আবারও মর্মান্তিক পাঁচ বছর কাটিয়ে অবশেষে একটা চাকরি মিলল জীবনানন্দের ১৯৫৩-তে এসে। শিক্ষকতারই চাকরি, যে চাকরিতে তিনি আর ফিরবেন না ভেবেছিলেন। কিন্তু সেসব ভাবনা-বিলাসের সুযোগ নেই তার তখন। তিনি হাওড়া গার্লস কলেজের ইংরাজি বিভাগে যোগ দিলেন। জীবনানন্দের এক অনুরাগী পাঠক ভারতবর্ষ পত্রিকার সহসম্পাদক গোপালচন্দ্র রায়ের চেষ্টায় এই চাকরিটা হলো তাঁর।

এ বছরই আচমকা খবর পেলেন সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর বর্ধিত সংস্করণের বই বনলতা সেন-এর জন্য নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁকে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গেলেন জীবনানন্দ, পুরস্কার হিসেবে তাঁকে ১০০ টাকা এবং একটা ছোট ক্রেস্ট দেওয়া হলো। তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী স্মৃতিচারণা করেছেন, বাবাকে দেখলাম অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে একটা ক্রেস্ট ঢুকিয়ে রাখছেন খাটের নিচে। জানতে চাইলাম : ওটা কী বাবা? বাবা বললেন, ওই আরকি।

এ সময় জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত জলার্ক পত্রিকার তরুণ সম্পাদক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁকে জানালেন লেখক অন্নদাশঙ্কর বলেছেন তিনি মনে করেন জীবনানন্দ হলেন এ সময়ের শুদ্ধতম কবি।

নানা সংগ্রামে তাঁর জীবনীশক্তি তখন প্রায় নিঃশেষিত। এই সময়ে এসে তাঁর এই নতুন চাকরি, এই পুরস্কার, এই প্রশংসা তার মনে তেমন কোনো অনুরণন আনে না। এসবই তাঁর কাছে তখন ওই আরকি!

জীবনানন্দ এক কবিতায় লিখেছিলেন :

মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি
 কেউ দেয়–বিনি দামে–তবে কার লাভ

.

০২.

হাওড়া কলেজের চাকরিটা ভালো, তাঁকে ইংরাজি বিভাগের প্রধান করা হলো। কিন্তু এই চমৎকার সুযোগটা পাবার কিছুদিন পরই, শিক্ষকতার সেই পুরোনো চক্রে ফিরে কেমন শ্বাসরুদ্ধ বোধ করতে লাগলেন তিনি। চাকরিটা পেয়ে বরং নিজেকে কেমন পরাজিত লাগতে লাগল তার। নিজেকে প্রশ্ন করলেন জীবন আর জীবিকাকে কি কিছুতেই মেলানো যাবে না আর? আহত হরিণ তো সবচেয়ে উঁচুতে লাফ দেয়। তিনি হঠাৎ খুব সাহসী হয়ে উঠলেন। একদিন সুচরিতাকে ডেকে বললেন, কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। শুধু লিখব আর কিছু করব না। আচ্ছা, কলকাতার আশপাশে কোনো একটা ছোট্ট জমি পাওয়া যাবে না, যেখানে একটা মাটির ঘর বানিয়ে থাকা যাবে, মাটির উপর খালি পায়ে হাঁটা যাবে?

তাঁর কারুবাসনা উপন্যাসে একবার লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোনো এক বিস্তৃত প্রান্তরে আমার বাংলো তৈরি করব। চারদিকে বাবলাগাছের ঘন নিবিড় বেড়া দিয়ে মাঠটাকে রাখব ঘিরে। কিংবা বুনো কাঠ দিয়ে; ছোটখাট নানা ঝুমকো লতা, কুঞ্জ লতা ও অপরাজিতার আলিঙ্গনে আলো-বাতাস কাক শালিখ ও পাখ-পাখালির সাড়া-শব্দে নিতান্তই বাঙালির ঘরোয়া জিনিস, পাশে হয় ত মেঘনা, ধানসিঁড়ি, জলসিঁড়ি, কর্ণফুলী, অথবা ইছামতী; মাঠের ভিতর ইতস্তত অশথগাছ, বাঁশের জঙ্গল, আম-কাঁঠাল, বেতের বন, কাশ, কালসোনা ঘাস, ফড়িং, প্রজাপতি, চোত-বোশেখের দুপুর, শরতের রাত, হেমন্তের বিকাল, অপার্থিব বট।

কিন্তু সেই অপার্থিব বটের বাংলাদেশ থেকে তত দিনে তিনি ছিটকে এসে পড়েছেন অনেক দূরের এক পৃথিবীতে। তবু কলকাতার কংক্রিট থেকে বেরিয়ে একটা কোনো বিকল্প জীবন খুঁজছিলেন তখন। সুচরিতা আর ভূমেন্দ্র মিলে জীবনানন্দের জন্য একটা জায়গা খুঁজতে নেমেও পড়লেন। শেষে টালিগঞ্জের কাছে পুটিয়ারী এলাকায় সস্তায় একটা জায়গা পাওয়া গেল। একদিন ভূমেন্দ্র আর সুচরিতার সঙ্গে সে জায়গাটা দেখতে গেলেন জীবনানন্দ। একটা খালের ওপর বাঁশের সাঁকোতে পার হলেন, নিচে টলটলে পানি। জীবনানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, জায়গাটা আর কত দূর?।

ভূমেন্দ্র : আরও বেশ খানিকটা হাঁটা পথ।

জীবনানন্দ : এখানে, ঠিক এই খালের পাড়ে কোনো জায়গা পাওয়া গেল না?

ভূমেন্দ্র : এসব জায়গা তো বিক্রির নয়, দাদা।

 কিছুক্ষণ ভাবলেন জীবনানন্দ। তারপর বললেন, থাক, আজ ফিরে চলো।

.

আহত হরিণ লাফিয়ে উঠেই কি টের পেল যে এতটা দুঃসাহস করবার শক্তি আসলে তার নেই। অনেকটা রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

.

উনিশশ চুয়ান্ন নেমে আসে

০১.

নেমে আসে ১৯৫৪ সাল। জীবনানন্দ দাশের জীবনের অন্তিম বছর।

একটা গোছগাছের প্রবণতা যেন তখন জীবনানন্দের। এযাবৎ লেখা পত্রের একটা হিসাব-নিকাশ করবার আগ্রহ দেখা গেল তার ভেতর। এ বছর প্রকাশ করলেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন। সেই সংকলনে স্পষ্ট জানিয়ে রাখলেন যে অধিকাংশ পাঠক, সমালোচক তার কবিতা আসলে ঠিক বোঝেননি। এ-ও মেনে নিলেন যে সমসাময়িকদের পক্ষে তাঁর কবিতার শেষ পরিচয় পাওয়া কঠিন। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় তিনি লিখলেন, …আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেয়া হয়েছে, কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার, কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্ৰতীকী, সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট। আরো নানা রকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবাই আংশিকভাবে সত্য–কোন কোন অধ্যায়ে খাটে, সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।…যিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি, তার কবিতার এ রকম সংগ্রহ থেকে পাঠক ও সমালোচক এ কাব্যের যথেষ্ট সংগত পরিচয় পেতে পারেন, যদিও শেষ পরিচয় লাভ সমসাময়িকদের পক্ষে নানা কারণেই দুঃসাধ্য।

এর কিছুদিন আগে জলার্ক পত্রিকার সম্পাদক সুরজিৎকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, আমার কবিতা সম্পর্কে নানা জায়গায় নানা রকম লেখা দেখেছি, মন্তব্য শুনেছি, প্রায় চৌদ্দ আনি আমার কাছে অসাড় মনে হয়েছে…

তিনি টের পেয়ে গেছেন তাঁর লেখার যথার্থ পাঠক পাবার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক প্রজন্ম। তিনি প্রস্তুত আছেন। একবার তিনি নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদের জার্নাল, যা একধরনের ডায়েরি, নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আলোচনা করতে গিয়ে জিদের ডায়েরির একটা লাইন উদ্ধৃত করেছিলেন, I do not write for the coming generation but for the following one.

অর্থাৎ কিনা, আমি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখি না বরং তারও পরের প্রজন্মের জন্য লিখি। জিদ বলছেন তিনি যা লিখছেন সেটা তার সমসাময়িক প্রজন্মের জন্য তো নয়ই, দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্যও নয়, তিনি লেখেন তৃতীয় প্রজন্মের জন্য। আঁদ্রে জিদের এই লাইনটার ভেতর একটা গোপন অহংকার আর ক্ষোভ আছে। জিদের জার্নালের পৃষ্ঠা থেকে নেহাত কাকতালীয়ভাবে এই লাইনটা জীবনানন্দ তুলে এনেছেন বলে মনে হয় না। ছদ্মবেশে এটা জীবনানন্দের নিজেরই প্রস্তাব।

.

০২.

এই বছরেই, সেই ১৯৫৪-তে তিনি এমন কিছু করলেন, যা আগে কখনো করেননি। তিনি বরাবর সভা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু এ বছর দু দুটো বড় অনুষ্ঠানে নিজে গিয়ে কবিতা আবৃত্তি করলেন জীবনানন্দ। এ বছর ২৮ ২৯ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে আয়োজন করা হলো কবিতাপাঠের। সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত, ড. নীহাররঞ্জন রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ ছিলেন আয়োজক। কবিরা নিজেরা নিজেদের কবিতা পড়বে দর্শকদের উপস্থিতিতে এই ছিল পরিকল্পনা। চিঠি দিয়ে জীবনানন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হলো অনুষ্ঠানে। বলা হলো, অনুষ্ঠানের আগে আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কারণ প্রখ্যাত নট শম্ভুমিত্র কবিদের আবৃত্তি প্রশিক্ষণ দেবেন। জীবনানন্দ কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। তবে আবৃত্তি প্রশিক্ষণে যাবেন না জানিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানের দিন জীবনানন্দ হাজির হলেন সিনেট হলে। সবার শেষে তাঁর নাম ডাকা হলে জীবনানন্দ মঞ্চে উঠে দর্শকদের দিকে না তাকিয়ে একেবারে মাইক্রোফোনের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে খানিকটা নার্ভাস ভঙ্গিতে পড়লেন তার বনলতা সেন কবিতাটা। ভারী কণ্ঠে, আবেগ মিশিয়ে কবিতাটা পড়লেন জীবনানন্দ। পিনপতন নীরবতায় দর্শক সে আবৃত্তি শুনল। পড়া শেষ করবার পর জীবনানন্দ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন মুহুর্মুহু হাততালির ভেতর দর্শক চিৎকার করছে ওয়ান মোর, ওয়ান মোর। জীবনানন্দ বেশ বিহ্বল হয়ে পড়লেন। শ্রোতাদের অনুরোধে আরও দুটা কবিতা পড়লেন তিনি। কবিতা পাঠ শেষে কারও সঙ্গে কথা না বলে চলে গেলেন হল ছেড়ে।

এ বছরই কলকাতা রেডিও আয়োজন করল কবিদের কবিতাপাঠের একটা অনুষ্ঠানের। আমন্ত্রণ জানানো হলো জীবনানন্দকে। জীবনানন্দ এ অনুষ্ঠানে যেতেও রাজি হলেন। অনুষ্ঠানের তারিখ ১৩ অক্টোবর ১৯৫৪। জীবনানন্দের। ভেতর একটা অস্থিরতা দেখা গেল এ সময়। বেশ কজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাদের বললেন ১৩ অক্টোবরের পরে আসতে।

.

০৩.

তার মধ্যে আরও নানা নতুন প্রবণতা দেখা গেল এ সময়। যেমন এ সময় এক বিচিত্র ঝোঁক চাপল জীবনানন্দের। কাজকর্ম ফেলে গিয়ে বসে থাকতে লাগলেন চিড়িয়াখানায়। কখনো টেনে নিয়ে যেতেন সুবোধ বাবুকে, কখনো একাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন কোনো জন্তুর খাঁচার সামনে। মানুষের সংসর্গের বদলে তিনি গিয়ে দাঁড়াতেন বাঘ, গন্ডার, হাতির কাছাকাছি। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে দেখতেন জিরাফ কেমন তার দীর্ঘ গলা নীলিমার দিকে ছড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যায়।

.

০৪.

এ সময় আরও অদ্ভুত কাণ্ড করলেন তিনি একদিন।

১৯৫৪ সালের ১১ অক্টোবর বিকেলের দিকে হঠাৎ অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ত্রিকোণ পার্কের কাছে ভাই অশোকানন্দের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন জীবনানন্দ। বাড়িতে অশোক, নলিনী নেই। সুচরিতা বিয়ে করেননি, মাঝে মাঝে তমলুক থেকে সুচরিতা এসে থাকেন, তিনিও নেই। কেউ কাজ থেকে ফেরেননি। বাড়ির কাজের লোক জানতে চাইল, কী ব্যাপার?

জীবনানন্দ বললেন, না মানে এই ফ্ল্যাটের কেউ কি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে কোনো জায়গায় ট্রামের নিচে পড়ে আহত হয়েছে? কাজের মেয়ে লতিকা বললেন, না তো, এমন কিছু তো শুনিনি।

জীবনানন্দ : ও আচ্ছা ঠিক আছে। এরা বাড়িতে ফিরলে বোলো যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে।

সন্ধ্যায় সুচরিতা তমলুক থেকে ফিরে অশোকানন্দের বাড়িতে গিয়ে এই খবর শুনেই ছুটে গেলেন জীবনানন্দের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে।

সুচরিতা জীবনানন্দকে বললেন, তুমি লতিকাকে কী বলে এসেছ, বলো তো। সবাই তো ভয়ে অস্থির। কী ব্যাপার বলো তো? তোমার কি শরীর খারাপ?

জীবনানন্দ বললেন, না না, আমার শরীর খারাপ হতে যাবে কেন? আমি ঠিকই আছি। রাস্তা পার হবার সময় শুনলাম লোকে বলাবলি করছে ক্রিকোণ পার্কের কাছের কে একজন ট্রামের নিচে পড়েছে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম ওদের বাড়ির কেউ না তো? তাই জানতে গিয়েছিলাম…।

এরপর জীবনানন্দ হঠাৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসতে লাগলেন। তাঁর সেই বিশেষ হাসি, যে হাসির সঙ্গে যোগ দেওয়া যায় না।

সুচরিতা : তোমার যা কাণ্ড দাদা, কোথায় কী শুনলে আর তাই নিয়ে কী কাণ্ড করে বসলে। মেজদা নিনি তো ভয়ে অস্থির। চলো একবার সেখানে। সবার সঙ্গে দেখা করবে।

জীবনানন্দ সুচরিতার সঙ্গে যেতে যেতে বললেন, তোরা একটু সাবধানে চলাফেরা করবি বুঝলি, যা রটে তার কিছু কিছু তো ঘটেও। সাবধানের মার নাই।

তার পরদিন ১২ অক্টোবর ঠিক একই ব্যাপার ঘটালেন জীবনানন্দ। আবার বিকেলে অশোকানন্দের বাড়িতে গেলেন। আবার দেখলেন ঘরে কেউ নেই। আছে শুধু কাজের মেয়ে লতিকা। তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা এই ফ্ল্যাটে সবাই ঠিকঠাক আছে তো? কারও কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি তো?

লতিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল, কিছু বলতে পারল না।

সেদিন সন্ধ্যায় আবার সুচরিতা ছুটে এলেন জীবনানন্দের বাড়িতে। সুচরিতা এসেই রেগে বললেন, তোমার হয়েছেটা কী বলো তো? তোমাকে কে রোজ রোজ এই একই খবর দেয়? তোমার নিশ্চয়ই কোনো অসুখ করেছে, দাদা।

এই বলে সুচরিতা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন। জীবনানন্দ খুব লজ্জিত হয়ে পড়েন। কিছু বলেন না। গম্ভীর হয়ে ঝিম মেরে বসে থাকেন অনেকক্ষণ।

একসময় জীবনানন্দ বলেন, কী করি বল তো, দেশপ্রিয় পার্কের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখলাম লোকজনের একটা জটলা বেঁধে গেছে। সবার ভেতর কেমন একটা উদ্বেগ, চঞ্চল ভাব, সবাই বলাবলি করছে, আবার একটা অ্যাকসিডেন্ট হলো। লোকে বলছিল লোকটা ট্রাঙ্গুলার পার্কের ওই একই বাড়ির। আমি অবশ্য নিজের চোখে দেখিনি। ওই ভিড়ের ভেতর গিয়ে আমি আর কী করতে পারতাম? আমি ভাবলাম তোদের বাড়িরই কেউ হবে তেমন তো কোনো কথা নেই, তবু আরেকবার একটু খোঁজ নেওয়া দরকার। তাই তো চলে গেলাম তোদের ওখানে। আমি বুঝতে পারছি শুধু শুধু তোদের বিব্রত করছি। তোরা সবাই ভালো আছিস, সুস্থ আছিস, এটা না জেনে নিলেও কি চলে বল?

সুচরিতা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গেই থাকব, দাদা। তাহলেই তোমার এসব ভূতের ভয় কাটবে।

জীবনানন্দ : তাই কর না কেন খুকি? তোকে তো কত বলেছি–তুই একা মানুষ তোর আর ঝামেলা কী, চলে আয় না আমার এখানে।

.

এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে

০১.

পরদিন ১৩ অক্টোবর রেডিও অনুষ্ঠান। সুচরিতা সকালেই গিয়ে হাজির হলেন ল্যান্সডাউন রোডে। জীবনানন্দের কাছে গিয়ে বললেন, সব ঠিক আছে তো দাদা, তুমি ভালো তো? কবিতা রেডি করেছ?

জীবনানন্দ : সব ঠিক আছে, খুকু।

 বিকেলে অনুষ্ঠান। ধুতি, পাঞ্জাবি, পাম্প শু পরে রেডি হলেন। হঠাৎ সুচরিতা দেখলেন তাঁর জুতার সামনের জায়গাটা ছেঁড়া, ফাঁক দিয়ে খানিকটা কড়ে আঙুলের আভাস দেখা যাচ্ছে। জীবনানন্দ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, এ জুতা পরে কী করে যাই?

সুচরিতা বললেন, দাঁড়াও দাদা, আমি দেখছি। তোমার পায়ের মাপ যেন কত? সাত না?

জীবনানন্দ : হ্যাঁ, সাতই তো।

তখনো হাতে বেশ সময় ছিল। সুচরিতা দ্রুত গড়িয়াহাটা গিয়ে একটা নতুন পাম্প শু কিনলেন। সেটা পরে জীবনানন্দ গেলেন রেডিওতে। সেখানে এসেছেন সে সময়ের আরও স্বনামধন্য কবিরা। একটু কাঁপা গলায় জীবনানন্দ গভীর একাগ্রতায় পড়লেন তাঁর মহাজিজ্ঞাসা নামের কবিতা :

…নিরন্তর বহমান সমুদ্রের থেকে খসে গিয়ে
সময়ের জালে আমি জড়িয়ে পড়েছি
যতদূর যেতে চাই, এই পটভূমি ছেড়ে দিয়ে
চিহ্নিত সাগর ছেড়ে অন্য এক সমুদ্রের পানে
 ইতিহাস ছেড়ে দিয়ে ইতিহাসহীনতার দিকে–
 মনে হয় এই আধ কণা জল দিয়ে দ্রুত রক্ত নদীটিকে
সচ্ছল অমল জলে পরিণত করতে চেয়েছি…

তাঁর যাপিত জীবনের একটা সংক্ষিপ্ত ঘোষণাপত্র কি এই কবিতা? তিনি জানেন, তাঁর কবিতার মূল্য নিরূপণ হয়ে ওঠেনি, হয়তো হবেও না সহসা। কিন্তু লোকে তাকে ভুল না বুঝুক এ তো তার অনেক দিনের চাওয়া। সেই কবেকার ডায়েরির পাতায় লিখেছেন, লোকে যাতে তাঁকে ভুল না বোঝে, সে জন্য তাকে লিখে যেতে হবে। লিখলেন তো প্রচুর, তবু লোকে কি তাঁকে ঠিক বুঝল? ঘোর সন্দেহ ছিলে তাঁর। তাই কি এক আকুল চেষ্টায় রেডিওর ইথারে ইথারে এ কথাই প্রচার করে যেতে চাইলেন যে আর কিছু না পারলেও লিখে পৃথিবীর রক্তনদীটাকে খানিকটা সচ্ছল, অমল করে তুলতেই চেয়েছিলেন তিনি? তিনি তো আগেই জানিয়েছেন যে ইতিহাসের দুঃখের খনির ভেতর তিনি গেছেন এই বিশ্বাস নিয়েই যে একদিন সেখানে শোনা যাবে শুশ্রষার জলঝরনার ধ্বনি, লিখেছিলেন :

আমি তবু বলি,
এখনও যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
 সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী করে যে মহানীলাকাশ,
ভাবা যাক–ভাবা যাক–
ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
 ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত
 শত জলঝর্ণার ধ্বনি…
তাঁর তো বিশ্বাস ছিল যে :
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে–এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
 প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ
 আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

তিনি কি লেখেননি?

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে…

.

০২.

রেডিও অনুষ্ঠানের পরদিন ১৪ অক্টোবর সকালবেলা সুবোধ বাবু এলেন জীবনানন্দের বাড়িতে। রেডিওতে বিভিন্ন কবির পড়া কবিতা নিয়ে কথা বললেন দুজন। জীবনানন্দ বললেন, বিকেলে আসছেন তো হাঁটতে?

সুবোধ বাবু বললেন, শরীরটা ভালো নেই। বুঝতে পারছি না। ভালো বোধ করলে আসব।

বিকেলে সুবোধ বাবু এলেন না। জীবনানন্দ একাই বেরিয়ে গেলেন হাঁটতে হাঁটতে লাগলেন ল্যান্সডাউন রোড দিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে গড়িয়াহাটা গোল পার্কের দিকে। তখন হেমন্তকাল। পাতা ঝরছে চারদিকে। তিনি হাঁটছেন একা একা। ঝরা পাতা এসে পড়ছে তার গায়ে। কী ভাবছেন তখন তিনি? মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি, নিজের, মানুষের। দূর কোনো অন্তিম প্রভাতে মানুষের ক্রমমুক্তি হবে, এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। তিনি যাকে কাজ বলে জেনেছেন সে কাজ নিষ্ঠার সাথে করেছেন। এখন তাহলে কী কর্তব্য তাঁর? হাঁটতে হাঁটতে তিনি কি তখন তাঁর জীবন প্রণালী উপন্যাসের চরিত্রের মতো ভাবছেন, এ-রকম চিরকাল চলতে পারা যায় নাকি? মাঠ-প্রান্তর ভেঙে, জানা-অজানার ওপারে, জ্যোৎস্নার আকাশে-বাতাসে বুনো হাঁসের মতন, যে-পর্যন্ত, যে-পর্যন্ত শেষ গুলি এসে বুকের ভিতর না লাগে!

পুরো পথ ঘুরে আবার রাসবিহারী মোড়ে এসেছেন তিনি। বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম একটা প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মতো দ্রুত ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে তখন। ট্রাম এগিয়ে আসছে, তিনিও এগিয়ে যাচ্ছেন।

.

একটি জাহাজ ছেড়ে গেল

০১.

ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া আহত জীবনানন্দকে আনা হলো শম্ভুনাথ হাসপাতালে। তিনি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে শুয়ে রইলেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। তাঁর ভেঙে যাওয়া বুকের পাজর, পায়ের হাড়কে জড়িয়ে থাকা ব্যান্ডেজ ছাপিয়ে দেখা যেতে লাগল রক্তের ছোপ। স্যালাইন, ইনজেকশন চলল তাঁর। নেওয়া হলো এক্স-রে। তিনি জং ধরা এক লোহার খাটে শুয়ে রইলেন। তার চারপাশে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের রোগীর ভিড়, তাদের গোঙানোর শব্দ, মেঝের একদিকে বোতল থেকে গড়িয়ে পড়া রোগীর প্রস্রাব, এক কোণে এক মৃতদেহ।

ভূমেন্দ্র আর তার ময়ুখএর বন্ধু স্নেহাকর, জগদিন্দ্র, দিলীপ মিলে পালা করে রাত জেগে বসে রইলেন জীবনানন্দের বিছানার পাশে। তাঁদের সঙ্গে হাসপাতালের করিডরে চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বিনিদ্র সুচরিতা।

ক্ষতবিক্ষত জীবনানন্দকে দেখতে চাইলেন না তাঁর সুহৃদ সঞ্জয়। তার বাড়িতে একটা মাদুর পেতে ধ্যানে বসলেন। সেখানে বসে রইলেন সারাটা দিন, রাত। মাদুরে বসে জীবনানন্দকে নিয়ে লিখলেন কবিতা, তুমি ঘুমে কেঁদে ওঠো বলে আমি অপরাধে জাগি।

গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন বলে নোংরা ইমার্জেন্সি থেকে জীবনানন্দকে নেওয়া গেল না হাসপাতালের সংরক্ষিত কেবিনে।

রোগী একজন কবি জানতে পেরে নার্স শান্তি মুখার্জির উদ্বিগ্নতা বেড়ে গেল, একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে জীবনানন্দের গা, মুখ মুছিয়ে দিলেন, চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিলেন চুল। তার মাথার কাছের টেবিলে একটা ফুলদানিতে রেখে দিলেন ফুল। অপরিচ্ছন্ন ইমার্জেন্সির একটা কোণকে শান্তি করে তুললেন মরূদ্যান।

মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এল জীবনানন্দের। তিনি অস্ফুট জানতে চাইলেন, আমি কোথায়?…এখন ভোর না সন্ধ্যা? তিনি বললেন, আমি কী দেখতে পাচ্ছি জানো? বনলতা সেনের পাণ্ডুলিপির রং। তিনি আবার চোখ বুজলেন। দ্রুত হোট ছোট শ্বাস নিতে লাগলেন। তাঁর শরীর পুড়ে যেতে লাগল জ্বরে।

ভূমেন্দ্র আর তাঁর বন্ধুরা নিজেদের চাঙা রাখবার জন্য কিনে আনলেন কবিতার বই বনলতা সেন। হাসপাতালে জীবনানন্দকে সেবারত সবাইকে উপহার দিলেন এক কপি, দিলেন শান্তি মুখার্জিকেও।

নিরুপায় হয়ে একপর্যায়ে সঞ্জয় দ্বারস্থ হলেন জীবনানন্দের আজীবনের শত্রু সজনীকান্তের, ক্ষমতাবান মানুষ তিনি, যদি জীবনানন্দের এই নাজুক সময়ে সব বিরূপতা ভুলে উন্নত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন। সবাইকে বিস্মিত করে সজনীকান্ত মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্রকে নিয়ে হাজির হলেন হাসপাতালে। বিধানচন্দ্র আদেশ দিয়ে গেলেন উন্নত চিকিৎসার, কেবিনে স্থানান্তরের। সঞ্জয় কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে সজনীকান্ত এবার সবাইকে বিমূঢ় করে বললেন, আমি কি জানতাম না যে জীবনানন্দ বাবু কত বড় কবি, কত বড় মানুষ। নইলে শুধু তার কবিতা নিয়েই এত কথা বলার তো দরকার হতো না আমার।

অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও জীবনানন্দকে কেবিনে স্থানান্তর সম্ভব হলো না। দেরি হয়ে গেছে তত দিনে, আক্রান্ত হয়ে গেছে তার দুটো ফুসফুসই। তাঁকে নড়ানো সম্ভব হলো না। ইমার্জেন্সি রুমেই একটা পর্দা দিয়ে আড়াল তৈরি করা হলো শুধু।

জীবনানন্দের শরীরের অবনতি ঘটছে শুনে সঞ্জয় অবশেষে দেখতে এলেন হাসপাতালে। জীবনানন্দ চোখ মেলে দেখলেন সঞ্জয়কে। সঞ্জয়ের হাতটা টেনে নিজের গালের ওপর রাখলেন তিনি। জড়ানো গলায় বললেন, একটা কমলালেবু খেতে পারব? জীবনানন্দ একবার কমলালেবু নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন :

একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
 আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
 একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে।

 মৃত্যুপথযাত্রীর চোখে উজ্জ্বল টইটম্বুর কমলা জীবনের বহমানতারই আহ্বান। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবনানন্দ যখন একটা কমলালেবু খেতে চাচ্ছেন, তখন তিনি নিজেও মুমূর্ষ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পরের তার কাঙ্ক্ষিত কমলারূপী নিজেকেই খুঁজছিলেন যেন তিনি।

সারা রাত ডিউটি শেষে নার্সের পোশাক পাল্টে, একটা ছাপা শাড়ি, কপালে টিপ দিয়ে খুব ভোরে শান্তি মুখার্জি এসে হাজির হলেন ভূমেন্দ্রদের ময়ূখ এর আস্তানায়। অপ্রস্তুত সেই যুবকদের সামনে গিয়ে ভীষণ সংকোচে বলতে লাগলেন, এত বড় একজন লোকের জীবন-মরণ সংকটে নার্সিং করার সুযোগ পেয়েছি, একজন নার্স এর চেয়ে বেশি আর কী কামনা করতে পারে? আপনারা আমাকে বইটা দিলেন বলেই না জানতে পেলাম। কবিতাগুলো পড়েছি, ভালো করে তো সব বুঝতে পারি না কিন্তু তবু টানে তো, এত টানে যে…অন্তত কয়েকটা কবিতা আমাকে বুঝিয়ে দেবেন?… হতভম্ব হয়ে থাকেন ময়ূখ-এর সকলে।

হাসপাতালে ভর্তি হবার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সেদিন ২২ অক্টোবর ১৯৫৪। মাঝরাতের দিকে জীবনানন্দের খাস খুব দ্রুত হতে লাগল। শান্তি অক্সিজেনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু দেখা গেল কৃত্রিম অক্সিজেনেও আর কুলাচ্ছে না। জীবনানন্দ নিশ্বাস নিতে পারছেন না। তাঁর নিশ্বাস ছোট হতে হতে, ছোট হতে হতে একসময় থেমে গেল। নিস্তেজ হয়ে গেলেন জীবনানন্দ। শান্তি দৌড়ে ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করলেন, চোখ পরীক্ষা করলেন। দেখলেন জীবনানন্দের আঙুলের ডগা, জিব নীল হয়ে গেছে, যেন বিষ খেয়েছেন তিনি। ডাক্তার জীবনানন্দকে মৃত ঘোষণা করলেন। তখন রাত ১১টা ৩৫ মিনিট। খোঁজ পেয়ে তার মাদুরে বসেই সঞ্জয় লিখলেন, একটি জাহাজ ছেড়ে গেল…

.

০২.

 পরদিন জীবনানন্দের মরদেহ ল্যান্সডাউন রোডের ক্ষুদ্র গলি পেরিয়ে কলকাতার কোলাহল, ব্যস্ত জীবনস্রোত কেটে রওনা হলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। এই শতাব্দীপ্রাচীন শহরে কোথাও কোনো আঁচড় লাগল না। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের সেই বালিগঞ্জ ডাউন ট্রামে উঠতে উঠতে ঘাড় ঘুরিয়ে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করলেন, কে গেলেন?

তাকে হয়তো বলা যেত, গেলেন একজন লেখক, যিনি বিরল এবং বিশুদ্ধভাবে ছিলেন ব্যর্থ।

.

০৩.

শূন্যে অবশ্য ভেসে রইল অমীমাংসিত সেই জিজ্ঞসা, জীবনানন্দের এই মৃত্যু তাহলে কী–

দুর্ঘটনা?

আত্মহত্যা?

 হত্যাকাণ্ড?

Leave a Reply to Pulak Dutta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *