আমাদের কত সামান্য হলেই চলে যায়, তবু দেখ, সেই সামান্যটুকুই হতে চায় না। রাজপ্রাসাদও নয়, বড়লোকদের ফ্ল্যাটবাড়িও নয়। দুখানা ঘর, একটু বারান্দা, কলঘর, একখানা রান্নাঘর, ব্যস হয়ে গেল। তা সেটুকুরও যা এস্টিমেট দাঁড়াচ্ছে তাতে চোখ উল্টে যায়। অনিন্দিতা আর তার মায়ের তাড়নায় না করেও উপায় নেই, কিন্তু বড্ড ভয় পাচ্ছি। বাবা, শেষ করতে পারব তো!
অনিন্দিতার বাবার মুখে দুশ্চিন্তার রেখাগুলি সকালের স্পষ্ট আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল চয়ন, দেশের লক্ষ মানুষের মুখেও কি একই দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে নেই! একই গল্প, একই টেনশন, একই অনিশ্চয়তা, এঁরা মানুষের কাছে একটু আশা-ভরসার কথা শুনতে চান। চয়ন কীই বা শোনাতে পারে!
ইট, সিমেন্ট, কাঠ যাতেই হাত দিতে যাই, হাতে যেন ছ্যাক লাগে। গত মাসখানেক ধরে কেবল দর জানতে বাজার ঘুরছি। যদি ছাদ ঢালাই না করে ওপরে টিন লাগাই তাহলে অনেকটা সস্তা হয়। কিন্তু এঁরা তো টিনের ঢাল শুনলেই ক্ষেপে যাচ্ছেন। এই যে তুমি টিনের চালের ঘরে আছে, তেমন কিছু খারাপ আছো কি? ওরা বুঝতেই চায় না।
চয়ন মৃদু স্বরে বলল, শুরু করলে ধীরে ধীরে হয়তো হয়ে যাবে।
দুর! সে চাকরি থাকলে হয়তো হত। তখন তো একটা আয় ছিল হে। এখন তো ঘরের টাকা ভেঙে খাচ্ছি। ফিক্সড ডিপোজিট রেখে খানিক সুদ হয় বটে, কিন্তু তাতে কি চলে?
আপনার পেনশন নেই?–
তাও আছে। তবে ওই যে বললুম, খরচ তো বাড়ে, কমে না।
ও। বলে চয়ন চিন্তিত হওয়ার একটা ভাব করল। কিন্তু অনিন্দিতার বাবার সমস্যা তাকে খুব একটা পীড়িত করছে না। করার কারণও নেই। বরং তার শুনতে একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর লাগে। মানুষটিকে তার খুব পছন্দও হয় না। ইনি এখনও মনে করেন, অনিন্দিতার সঙ্গে চয়নের বিয়ে হওয়াটা উভয় পক্ষের আর্থিক সমস্যার সমাধান ও লোকবলের অভাব মেটানোর জন্য দরকার। এবং এ ব্যাপারে চয়নের মতামতের যে কোনও দাম আছে তাও ইনি মনে করেন না।
অনিন্দিতার বাবা মিটমিটি চোখে তার দিক চেয়ে হঠাৎ বলল, তোমার তো বাবা ঝাড়া হাত-পা।
চয়ন একটু অবাক হয়ে বলল, অ্যা!
বলছিলাম, তোমার তো দায়-দায়িত্ব কিছু নেই। নো লায়াবিলিটি।
চয়ন বলল, তা বটে।
টিউশনিতে আজকাল আয়ও তো ভালই।
চয়ন সংকুচিত হয়ে বলে, কোনওরকমে চলে যায়।
দেবে নাকি আমাকে কিছু ধার? আমি সুন্দ দেবো।
চয়ন একটু হাঁ করে থাকে। একজন লোক তার কাছে ধার চাইছে, এই ঘটনাটাই তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে আবার কথা খুঁজে না পেয়ে বলে, অ্যাঁ!
বেশি নয়, হাজার দশেক পেলেই সামলে নিতে পারব।
চয়ন অবিশ্বাসের চোখে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে তার পূর্বাপর ঘটনাগুলো মনে পড়তে থাকে। কদিন আগে হেমাঙ্গ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ব্যাংকে তার কত টাকা আছে এবং তা দিয়ে কোনও একটা ব্যবসা বা টিউটোরিয়াল খোলা যায়। কিনা, বাস্তবিকই তখনও সে জানত না, ব্যাংকে তার কত টাকা আছে।
না জানার কারণ হল, সে জানতে চাইত না। ভাবত অনেক টাকা জমলে সে একদিন নিজেকে নিজেই একটা সুরঙ্গুইনদের। তার চেক-বই নেই, টাকাও তোলার দরকার হয় না। পাশ-বই এন্ট্রি করায় না। মাসে মাসে শুধু টাকা জমা দিয়ে যায়।
হেমাঙ্গ খোঁজ নিতে বলায় কয়েকদিন আগে সে ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তার সুদে আসলে একান্ন হাজার টাকার ওপর জমা আছে। টাকাটা তার অনেক বলে মনে হল। এতটা আশাই করেনি।
সেদিনই সন্ধেবেলা সে ঘটনাটা অনিন্দিতাকে বলে।
অনিন্দিতাও অবাক হয়ে বলেছিল, একান্ন হাজার! তাহলে তো তুমি বড়লোক।
আমি ভাবছি কিছু একটা এই একান্ন হাজার দিয়ে শুরু করব।
করো। খুব ভাল হবে। কী করবে বলো তো!
এখনও ভাবিনি। তুমিও ভেবে দেখো তো কী করা যায়। আমার খুব ইচ্ছে করে একটা মনোহারি দোকান দেই। হরেক জিনিস থাকবে, নানারকম খদের আসবে, বিনিময় হবে। বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার। বেঁচে থাকাটাকে টের পাওয়া যাবে।
করো, দোকানই করো।
কথা এইটুকু থেকে এতখানি গড়াল। অনিন্দিতা নিশ্চিত তার টাকার কথা। এঁর কাছে গল্প করেছে। করতেই পারে। সেটা শুনেই লোকটা ধার চেয়ে বসেছে বোধহয়।
অনিন্দিতার বাবা একটু ব্যগ্র গলাতেই বললেন, ভেবো না যে, শোধ দিতে পারব না। বাড়িটা করলে বাসা-ভাড়াটা তো বেঁচেই যাবে। সেটা তো তোমাকে মাসে মাসে দিয়ে যাবো। ওখানকার একটা ওষুধের দোকানে একটা চাকরিও পাকা হয়ে আছে আমার। মাসে আট শো টাকা। সেটা হলে তো কথাই নেই।
লোকটার ওপর রাগ হল না চয়নের। মায়া হল, এ যে তার চেয়ে অপদার্থ লোক! চয়ন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, আমার এত টাকা আছে বলে আপনার মনে হল না?
লোকটা অবাক হয়ে বলে, নেই? কিন্তু অনিন্দিতা যে বলছিল, তোমার নাকি অনেক টাকা আছে ব্যাংকে!
চয়ন একটু হাসল। বলল, অনেক কষ্টে জমিয়েছি। একটা দোকান দেওয়ার ইচ্ছে ছিল।
লোকটা চয়নের ডান হাতটা চেপে ধরে বলল, দোকান তোমার হবে। দশটি হাজার টাকা আমার বড় দরকার। বিশ হাজারই চাইতুম, কম করেই বলছি।
চয়ন নিজের দুর্বল হাতটা চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারল না। বলল, আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখব।
চেষ্টা নয়। বাবা, টাকাটা না দিলেই নয়। বড্ড বেঘোরে পড়ে গেছি। আমার বউ আর মেয়ে আমাকে বাড়ি-বাড়ি করে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতেও ইচ্ছে হয়। মেয়ের বিয়েটা আর হবে না। তা না হোক, বড়িটাই করে ফেলি। হিসেব করে দেখছি। এই দশ হাজার টান। পরে আমার।
আপনি অতি উতলা হচ্ছেন কেন? আমি ভেবে দেখছি।
কবে আসব বাবা?
চয়ন হাসল, আসবেন।
আমি বরং রোজই একবার তোমাকে মনে করিয়ে দিয়ে যাবো। কিন্তু একটা কথা। টাকার ব্যাপারটা যেন অনিন্দিতা বা তার মা না জানতে পারে তাহলে আস্ত রাখবে না। আমাকে।
চয়ন ম্লান হেসে বলল, ধার করা তো অপরাধ নয়।
তবু বলার দরকার নেই। আমি নির্লজ্জ বলে তোমার কাছে ধারটা চাইতে পারলুম। ওরা তো আমার সমস্যাটা জানে না।
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর চয়ন অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মানুষকে প্রত্যাখ্যান করার শক্তিটাও যে তার কেন নেই!–তার জানা আছে, এই ছাপোষা অবসরপ্রাপ্ত লোকটি কোনও দিনই তার টাকা শোধ দিতে পারবে না। তবু একে না। দিয়েই কি সে পারবে? বাধা হবে চক্ষুলজ্জা, বাধা হবে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়।
সকালের টিউশনি সেরে ফেলার পথে সে ব্যাংকে গেল এবং ভয়ে ভডে কাউন্টারে বলল, আমি যদি দশ হাজার টাকা তুলতে চাই তাহলে কী করতে হবে?
সুবেশ এবং সুভদ্র ক্লার্কটি বলল, অত টাকা তুলতে একটা প্ৰােয়র ইন্টিমেশন দিতে হয়। আপনি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করুন।
ম্যানেজারও একজন সুবেশ লোক, তবে কিছুটা গভীর। শুনে-টুনে একটা চেক-বই ইসু্য করে বললেন, কাল এসে টাকা নিয়ে যাবেন।
রাত্রিবেলা ভদ্রলোক আর একবার এলেন, গিয়েছিলে নাকি ব্যাংকে?
হ্যাঁ।
তুলেছো?
না। তবে কাল দেবে।
ভদ্রলোক স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, বাঁচালে বাবা। টাকাটা পেলেই কাজ শুরু করে দেবো। রাজমিন্ত্রির সঙ্গে কথা হয়ে আছে।
এটা বলেই ভদ্রলোক চলে গেলেন।
পরদিন টাকাটা দুপুরে তুলে আনল চয়ন। ভদ্রলোক রাত্রিবেলা এসে নিয়ে গেলেন। তারপর চয়নের একটু ফাঁকাফাঁকা লাগল। এর আগে সে আর কাউকে কখনও ধার দিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই প্ৰথম। এবং এতগুলো টাকা! তার ভুকু দুঃখও হচ্ছিল টাকাগুলোর জন্য। অনিন্দিতার বাবার যা অবস্থা তাতে ইচ্ছে থাকলেও টাকাটা শোধ করার উপায় ওঁর নেই।
টাকার কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চয়নের একটু সময় লাগল। পরদিন বিকেল পর্যন্ত অন্যমনস্কতাটা রয়ে গেল তার মোহিনী বলল, চয়নদা, আপনার কী হয়েছে? এত আনমাইভাল লাগছে কেন?
আপনার সবই শুধু এমনিই।
কত কী ঘটে যায়! বলে চয়ন লাজুক হাসল।
মোহিনী বলল, মা বলে, চয়নটা যা অন্যমনস্ক রাস্তায় ঘাটে অ্যাকসিডেন্ট না করে বসে!
না, ওসব ভয় নেই। অন্যমনস্ক থাকি বটে, কিন্তু একটা ইনস্টিংক্ট কাজ করে।
আচ্ছা, আপনি কি একটা খবর শুনেছেন?
কী খবর?
চারুমাসি ফিরে আসছে।
অবাক হয়ে চয়ন বলে, তাই নাকি!
হেমাঙ্গদা এসেছিল কাল। বলে গেল চারুমাসি নাকি ফোন করে কানাডা থেকে জানিয়েছে মাসের শেষেই ফিরে আসবে।
কেন?
একদম নাকি ভাল লাগছে না।
চয়ন, কেন কে জানে, খবরটায় খুশি হল। টিউশনি ফিরে পাবে বলে নয়, চারুশীলা পরম উদারতাবশে তাকে নানা। উপটৌকন দেবে বলেও নয়—যেন এক প্রবাসের আত্মীয় বা প্ৰিয়জন ফিরছে। এরকম তো তার আর কারও বেলায় হয় না!
টাকার কথাটা চয়ন ভুলে যেতে পারল এবার। আর কোনও কাটা খচখচ করল না তার মনের মধ্যে।
দিন দশেক বাদে একদিন ভদ্রলোক এসে সন্ধেবেলা বললেন, বাবা চয়ন, যা উপকার করেছে তা আর বলার নয়। বুধ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস একতলার গাঁথনিটা অনেক আগেই একটু করে রেখেছিলুম; বাড়িটা তাই টকাটক
যাচ্ছে।
সেটা তো খুব ভাল কথা।
টুকুধু একটু টান পড়তে পারে শেষের দিকে। যদি পড়েই, তুমি একটু দেখো বাবা।
আন পড়বে?
পাঁচ-দশ হাজার পড়তে পারে। ঠেকাটা পার করে দিও।
চয়ন লোকটার দিকে চেয়ে রইল। খুবই বিস্মিত সে। কিন্তু বিরক্ত নয়। এ লোকটার। আর কোনও সোর্স নেই।
একটা কথা ভেবেছি।
কি কথা?
বাড়ির অর্ধেকটা তোমার নামে লিখে দেবো।
সে কী! আমাকে দেবেন। কেন?
আমার তো ছেলে নেই, একটা মাত্র মেয়ে। লিখে দিলে তোমার কাছে আমার ঋণেরও খানিকটা শোধ হয়।
চয়ন প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, না না, তার দরকার নেই।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বলন, দুখানা তো মাত্র ঘর। তা হোক, একটা তুমি নাও।
আমি নিয়ে কী করব?
কেন, থাকবে! এ ঘরে তোমার কত কষ্ট হয়।
না, আমার কষ্ট হয় না। বেশ তো আছি।
তোমার মাসিমারও খুব ইচ্ছে তোমাকেও নিয়ে যায়।
কেন! আমি গিয়ে কী করব?
ওই যে বলেছিলুম তোমাকে, সবাই মিলে একটা টিম করে থাকব। তোমাকে আমাদের খুবই পছন্দ।
চয়ন মৃদু হেসে বলল, জানি। কিন্তু সেটা ভাল দেখাবে না। আমারও সুবিধে হবে না। অত দূরে গেলে টিউশনির অসুবিধে হবে।
আহা দূর কিসের! আমাদের অফিসের একটা লোক এৱোজ কাটোয়া থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করত, জানো?
তা হয়তো করে। কিন্তু আমি ততটা শক্ত মানুষ নই।
ভেবে দেখো বাবা। একটু ভাবো।
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, ভাববার কিছু নেই। এটা হয় না।
তাহলে ওই কথাই রইল। যদি শেষ দিকে ঠেকে যাই, পাঁচ-দশ হাজারের জন্য যেন কাজটা আটকে না থাকে, একটু দেখো বাবা। পাই পয়সা অবধি শোধ দেবো। সুন্দ সমেত।
আমি সুদ চাই না।
ন্যায্য পাওনা ছাড়বে কেন!
লোকটা চলে গেলে চয়ন দুঃখিত হৃদয়ে বসে রইল। সে কি একটুও কঠোব হতে পারে না!
মাস শেষ হয়ে নতুন মাসের শুরুতেই ফিরে এল চারুশীলা। মোট বারোটা সুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগ ভর্তি জিনিস। এয়ারপোর্টে নেমেই কোনওক্রমে কাস্টমস ডিঙিয়ে বাইরে পা দিয়েই বলে উঠল, উঃ, বাঁচলাম বাবা!
চারুশীলাকে রিসিভ করতে একটা বাহিনীই হাজির ছিল এয়ারপোর্টে। তার মধ্যে চয়নও। সে চারুশীলার মুখে যে স্বস্তির প্রকাশ দেখল তাতে হাসিই পাচ্ছিল তার। আনন্দের হাসি। এই অস্থিরচিত্ত মহিলা চয়নের একটা নিৰ্ভলরার স্থল। এই ফিরে আসা যেন চয়নের রুক্ষ শুষ্ক জীবনে মেঘের সঞ্চার। দুর্বল হাতে সেও গোটা দুই সুটকেস বইল। তিনখানা গাড়ি এবং চারটে ট্যাক্সিতে বোঝাই হল মাল ও মানুষ।
বাড়িতে বসে গেল একটা সভা। সুব্রত আসেনি। ছেলেমেয়ে নিয়ে শুধু চারুশীলা। তিনজনের মুখেই আনন্দ আর স্বস্তির হাসি। এই ভিড়ের মধ্যে চয়ন এক ধারে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়েছিল। তার শুধু চেয়ে থাকা। চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তার চোখে একটা দৃশ্য ধরা পড়ল। এই ভিড়ে ভিড়াক্কার জমায়েত ও উচ্চকণ্ঠ কথাবার্তার মধ্যে দু জোড়া চোখ মাঝে মাঝে পরস্পরের দিকে নিবদ্ধ ও নিষ্পলক হয়ে থাকছে। তারপর দুজনেই যেন লজ্জা পেয়ে সরিয়ে নিচ্ছে চোখ। বার বার।
হেমাঙ্গ হঠাৎ চারুশীলাকে বলল, বারোটা সুটকেস এনেছিস, তোদের তিন জনের পাওনা তো মোটে ছটা সুটকেস! তাও আমেরিকা থেকে এলে। বাকি ছটা কি মাশুল দিয়ে আনলি? কত গেল?
চারুশীলা চোখ পাকিয়ে বলে, সব জায়গায় তোর এত হিসেব কেন রে? মাশুল দিয়েছি বেশ করেছি।
আমেরিকার বাজার তো ফাঁকা করে দিয়ে এসেছিস দেখছি।
কিনবো না তো কি? কী সস্তায় কী সুন্দর সুন্দর জিনিস! যা দেখি তাই কিনতে ইচ্ছে করে।
ওইটেই তো তোর রোগ! কনজিউমারিজমের চূড়ান্ত।
আর তুই তুই কিছু কম যাস নাকি! বাড়িটাকে তো জিনিসের মিউজিয়ম বানিয়ে রেখেছিস।
হেমাঙ্গ ব্যথিত গলায় বলে, অতীতের কথা। আজকাল আর কেনাকাটা করিই না। তোকে দেখেই বৈরাগ্য এসেছে।
বেশি বকিস না। জাহাজে আমার আরও জিনিস আসছে।
গোটা জাহাজ বোঝাই করে নাকি?
হলেই বা। তোর মতো সন্নিসি তো নেই। আমার বাপু টাকা ওড়াতে ভাল লাগে।
চয়নের দিকে চেয়ে চারুশীলা হঠাৎ বলল, এই চয়ন, আমন চুপচাপ কোণে দাঁড়িয়ে কেন? ইস, কতকাল পরে চেনা মুগুলো আবু দেখছি! আমার হাঁফ ধরে গিয়েছিল। এসো তো চয়ন, আমার সামনে এসে বোসো। তোমার জন্য অনেক জিনিস এনেছি।
চয়ন মৃদু হেসে বলে, অত জিনিস দিয়ে কি করব? আমি তো একটা মানুষ। আপনি কত শার্ট প্যান্ট দিয়েছেন।
তাতে কি? আরও দেবো। ওই হেমাঙ্গর মতো বৈরাগী হয়ে থেকে না। ভাল পোশাক পরবে, ভাল খাবে।–দাবে। তোমার চেহারা একটু ফিরেছে।
বিদেশের গল্প উঠল। কফি আর বিদেশী বিস্কুট সার্ভ করা হল। সব কিছুর মধ্যে চয়ন শুধু দেখেছিল দুটি নিঃসঙ্গ মানুষের দু জোড়া চোখ মাঝে মাঝে জোড়া লাগছে। সরে যাচ্ছে। বার বার।
চারুশীলার ফিরে আসায় কলকাতাটা অনেক ঝলমলে হয়ে গেল চয়নের কাছে। বাতাসে যেন একটা আনন্দের বার্তা বয়ে যাচ্ছে। বড় খুশি হল। আরও খুশি হল, দু জোড়া চোখ দু জোডা চোখকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বলে। …
তিন মাসের মাথায় হঠাৎ এক সন্ধেবোলা অনিন্দিতা উঠে এল ছাদে।
শোনো, তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে।
চয়নের আজ শরীর ভাল নেই। বর্ষার শুরুতেই তার ঠাণ্ড লেগে সামান্য জ্বর হয়েছে। টিউশনিতে যায়নি; ঘরে বসে বই পড়ছিল। উঠে বসে বলল, বলো।
অনিন্দিতা দরজায় দাঁড়িয়ে তার দিকে গভীর চোখে চেয়ে বলল, তুমি কি বাবাকে টাকা দিয়েছো?
চয়ন মাথা নত করে বিরল, কে বলেছে?
বাবাই বলেছে। তবে সহজে নয়। আমরা বাবার লক্ষণ জানি। জেরা করে করে কথা বের করেছি।
চয়ন মৃদু স্বরে বলল, উনি ধার নিয়েছেন।
কত টাকা?
আপাতত দশ হাজার।
আপাতত মানে! আরও দেবে নাকি?
উনি বলেছেন, আরও কিছু লাগতে পারে।
অনিন্দিতা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ছি।
রাগ করছো কেন?
রাগ করব না! তুমি কত কষ্ট করে চালাও তা তো আমি জানি। বাবা কী আক্কেলে তোমার কাছ থেকে টাকা নিল তা বুঝতে পারছি না। লোকটা সারা জীবন এইসব করে বেড়াচ্ছে।
চয়ন মৃদু হেসে বলল, ছিল, তাই দিলাম।
ছিল মানে! কষ্ট করে টাকা জমিয়েছো, ব্যাংকে থাকলে সুদ হত। তোমার টাকার গল্পটা আমিই বাবা আর মায়ের কাছে করেছিলাম। সেইটেই ভুল হয়েছে দেখছি। টাকার গন্ধ পেয়েই তোমাকে এসে ধরেছে। আমাদের কিছু বলেনি। কিন্তু বাবার টাকার সব হিসেব আমরা জানি। বাড়তি দশ হাজারের হিসেব আমি ধরেছি। তারপর চেপে ধরায় বাবা স্বীকার করেছে যে, টাকাটা তুমি দিয়েছো। আচ্ছা চয়ন, বাবাকে টাকাটা দেওয়ার আগে তোমার কি উচিত ছিল না। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া! তুমি তো জানো না, বাবা কিরকম লোক।
চয়ন একটু হাসল।
অনিন্দিতা বলল, কাজটা খুব খারাপ করেছো। আমরা না জানতে পারলে টাকাটা তুমি আর ফেরত পেতে না। বাবা খারাপ লোক নয়। কিন্তু গরিব তো! গরিবের চরিত্র বলে কিছু থাকে না। তোমার টাকাটা বাবার শোধ দেওয়ার ক্ষমতাই নেই।
সেটা আমি জানতাম।
জেনেও দিলে? তুমি অদ্ভুত মানুষ। দশ হাজার টাকা এক কথায় যে দিয়ে দেয় সে কিন্তু বোকাও ।
কেন যে টাকাটা নিয়ে এত কথা বলছো! আমার লজ্জা করছে।
তোমার চেয়েও আমার লজ্জা ঢের বেশি। শোনো, বাবাকে আর একটি পয়সাও দেবে না। বাবাকে আমিও খুব বকে দিয়েছি।
তুমি আজ খুব উত্তেজিত।
আমার বড্ড সম্মানে লেগেছে। বাবা যদি টাকাটা শোধ দিতে না পারে তাহলে তোমার কী ধারণা হত বলো তো আমাদের সম্পর্কে?
খারাপ ভাবতাম না। লোকে তো অভাবে পড়েই নেয়!
তুমি জানো না। বাবার অভাব যতটা নয় তার চেয়ে বেশি হল উদ্বেগ। আমরা গরিব ঠিকই, কিন্তু একখানা ছোটো বাড়ি করার মতো টাকা বাবার ছিল। বসে থেকে থেকে সময় গেল, জিনিসের দাম বাড়ল, এই কৃপণতার কোনও মানে হয়!
চয়ন ফের মৃদু একটু হাসল।
তোমাকে আজই বাবা এক হাজার টাকা দিয়ে যাবে। বাকিটা শোধ দিতে একটু দেরি হতে পারে। কিন্তু দু মাসের মধ্যে নিশ্চয়ই।
আরে, অত তাড়াহুড়োর কি আছে!
তোমার নেই, আমার আছে। বুঝলে!
বুঝেছি। বাড়ি কাদুর?
ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। জানালা দরজা হয়নি, হবেও না। তবে বাঁশের ঝাঁপ দিয়ে কাজ চালানো যায়। দেখা যাক।
তুমি যে কেন এত উতলা হচ্ছে? বাড়িটা ওঁকে শেষ করতে দাও, তারপর টাকা শোধ দিলেও চলবে।
না, তা হয় না। তোমার কষ্টের টাকা, ও টাকা নেওয়া পাপ।
তা নয়। অনিন্দিতা, আর কেউ ওঁকে টাকাটা দেবে না। সন্দেহ করবে, অবিশ্বাস করবে, কিংবা দিলেও চড়া সুদ নেবে।
সে তো ঠিকই। কিন্তু এভাবেই আমাদের চলতে হবে। ভেবো না।
তুমি অকারণে রাগ করছে।
অকারণে নয়। বাবাকে আমি চিনি। উনি তোমাকে পেয়িং গেস্টও রাখতে চাইছেন। লোকটা খুব বোকা। বাস্তব বুদ্ধি কিছু নেই। উনি ভাবছেন তোমাকে আর আমাকে একটা সম্পর্কে বেঁধে ফেলা যাবে।
চয়ন মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।
অনিন্দিতা বলল, হেসো না। বাবার বোকামি দেখলে গা জ্বলে যায়।
আরও তিন মাস বাদে অনিন্দিতারা চলে গেল। বাড়ি যাহোক করে শেষ হয়েছে। বাকিটা বাড়িতে গিয়ে শেষ করবে। যাওয়ার সময় অনিন্দিতা খুব কেঁদেছিল। বলল, তোমার মতো একটা মানুষ কি আর পাবো? ভাল থেকো।
টাকাটা ওরা শোধ দিয়ে গেল। কিন্তু তাতে একটুও খুশি হল না চয়ন। মনে হল, না দিলেই বোধহয় ভাল ছিল। কত কষ্ট হল ওদের! হয়তো গয়না-টয়না বিক্রি করেছে।
Leave a Reply