৩. অসাধারণ একটি উড়ান

১১.

অসাধারণ একটি উড়ান। বিরাট বাণিজ্যিক প্লেন। অনেক প্যাসেঞ্জারের ভিড়। আমার দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

নিউইয়র্কে এসে থামলাম। এটাই তো ব্রিল বিল্ডিং। আর কে, ও জেফারসন এবং ম্যাক্স রিচের অফিস। অনেক স্মৃতির গুঞ্জন।

বেন রবার্টস ইতিমধ্যেই খবর পেয়েছে। সে এয়ারপোর্টে এসেছে আমাকে স্বাগত জানাবে বলে।

আমরা হোটেলে গেলাম।

সে বলল–আমি এখন ফোর্ট ডিক্সের হয়ে কাজ করছি। আমি সিনেমার সাথে যুক্ত হয়েছি। তুমি জানো না, এটা কত সুন্দর অভিজ্ঞতা। তুমি নিউইয়র্কে কী করবে? কতক্ষণ থাকবে?

আমি বললাম এক ঘন্টা হতে পারে। এক সপ্তাহও হতে পারে।

আমি আমার অবস্থাটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বললাম যে কোনো সময় কর্তৃপক্ষের ডাক আসতে পারে।

আমরা একটা হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলাম। আগে থেকেই ঘর বলা ছিল। আমি বললাম দূর থেকে একটা ফোন কল আসবে ম্যাডাম, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে দেবেন কিন্তু।

বেন আর আমি পরবর্তী রাতে ডিনার খেয়েছিলাম।

সকালবেলা, আমি আমার এজেন্ট লুইস সুত্রকে ফোন করলাম। ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকেন। আমি নিউইয়র্কে এসেছি, সেকথা জানালাম।

–অফিস যাচ্ছেন না কেন?

উনি বললেন আমার পার্টনার জুলেসের সঙ্গে দেখা করুন।

জুলেস, নিউইয়র্ক অফিসের প্রধান, বছর চল্লিশ বয়স, দেখতে শুনতে খুব একটা খারাপ নয়।

উনি বললেন লুই, আপনাদের আসার কথা বলেছে। আপনি কি কোনো প্রোজেক্টে কাজ করবেন?

-হ্যাঁ।

–আমার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্ট আছে। আপনি কি জান কিপুরার নাম। শুনেছেন?

-হ্যাঁ, শুনেছি।

–জান কিপুরা হল ইওরোপের একটা মস্ত বড় অপেরা স্টার। তার স্ত্রী মার্থা এগারথেরও খুব নাম আছে। তারা সেখানে অনেকগুলি মুভি তৈরি করেছেন। তারা ব্রডওয়েতে কিছু দেখাতে চলেছেন।  দ্য মেরি উইডো।

মেরি উইডো, ফ্রানজ লেহাবের এক বিখ্যাত অপেরা। এমন একজন রাজার গল্প, যিনি এক ছোট্ট ভূমিখণ্ডের প্রধান ছিলেন। তিনি এক বিধবাকে ভালোবাসতেন।

–এই বইটার সারাংশ লিখে দিতে হবে। আপনি কি কাজটা করতে চাইছেন?

আমি কি এখন তা আর পারব? নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

শেষ পর্যন্ত জান এবং মাথার সঙ্গে দেখা হল। অসটর হোটেলে। কিপুরা দরজা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –আপনি কি লেখক?

-হ্যাঁ।

–ভেতরে আসুন।

জান কিপুরা একজন শক্তিশালী চেহারার মানুষ। বছর চল্লিশ বয়স। কথার ভেতর হাঙ্গারীয় টান আছে। মার্থা রোগা এবং আকর্ষণীয়া। লম্বা চুলের অধিকারিণী। মুখে আমন্ত্রণী হাসি।

-বসুন। কিপুরা বললেন।

আমি বসলাম।

–দ্য মেরি উইডোকে আমরা দেখাতে চাইছি। জুলেস বলেছেন, আপনি একজন ভালো লেখক। আপনি ইতিমধ্যে কী কী লিখেছেন?

আমি গড়গড় করে বলে গেলাম ফ্লাই বাই-নাইট, সাউথ অফ পানামা।

তারা আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন।

জান বললেন আমরা পরে জানাব।

তিরিশ মিনিট বাদে আমি জুলেস জিগলারের অফিসে পৌঁছে গেলাম।

জিগলার বললেন –হ্যাঁ, ওনারা ফোন করেছিলেন। কাজটা আপনাকে করতে হবে।

আবার ঘন কালো মেঘের অন্ধকার। আমি জানি না, কীভাবে এগিয়ে যাব। ব্রডওয়ের জন্য কবে চিত্রনাট্য লিখব?

জুলেস জিগলার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনার শরীর ঠিক আছে?

মনের এই ভাব গোপন রেখে আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।

আমি হোটেল রুমে ফিরে এলাম। বেন রবার্টসকে সব কথা কি জানাব? আমরা কি আবার একসঙ্গে কাজ করব?

ফোর্ট ডিস্কে তাকে ধরে ফেললাম। সে বলল –নতুন কিছু?

–হ্যাঁ, দ্য মেরি উইডোর ওপর সারাংশ লিখতে হবে।

–তুমি কি মদ খেয়েছ?

–কেন? বেন কোনো কথা বলছে না।

পরের দিন সকালে আমি থিয়েটারে গেলাম। সেখানেই দ্য মেরি উইন্ডো দেখানো হবে। নিউ অপেরা কোম্পানি এই পরিবেশনার জন্য পয়সা ঢালছে। এর অন্তরালে এক মধ্যবয়সিনী ভদ্রমহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। তার নাম ইরিয়ন।

এটা একটা প্রথম শ্রেণীর প্রযোজনা। ক্যারিওগ্রাফিটা অসাধারণ। বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জর্জ সেটা তৈরি করেছেন। তাঁকে এই দেশের অন্যতম সেরা ক্যারিওগ্রাফার বলা হয়। ভদ্রলোকের বয়স খুব একটা বেশি নয়। অসাধারণ নাচতে পারেন। মুখে সুন্দর হাসি আছে। উচ্চারণে রাশিয়ান ভাব।

পরিচালক হলেন বিখ্যাত ফেলিক্স ব্রেনটান। পরিবেশনা করছেন রবার্ট স্টোলজ। নর্তকীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মিলা স্লাডোভা, এক ইওরোপীয় নর্তকী।

আমি এদের সকলের সঙ্গে দেখা করলাম।

ডিরেক্টর বললেন- আধুনিক শব্দ ব্যবহার করতে হবে।

 আর একজন বললেন –ব্যাপারটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া চাই।

সব কিছু একসঙ্গে কী করে হবে? বেন আর আমি আনন্দে মেতে উঠলাম। ফোর্ট ডিক্স নিউজার্সিতে অবস্থিত। সেখানে বেনকে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। সে রাতে নিউইয়র্কে আসে। আমরা একসঙ্গে ডিনার খাই। একসঙ্গে কাজ করি। কাজ করতে করতে রাত দুটো বেজে যায়। তবুও উৎসাহে ভাটা পড়ে না।

এই প্রথম ব্রডওয়ের হয়ে একটা নাটক লিখতে চলেছি। সমস্ত শরীর উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। বেনের সঙ্গে কাজ করা অনেকটা সহজ। তার মধ্যে একটা সুন্দর সৃজনশীলতা আছে। সে আমার থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।

প্রথম অঙ্কটা লেখা শেষ হল। সেটা নিয়ে আমি আমার প্রযোজক ইরিয়নের কাছে গেলাম। তিনি পাতাগুলো ওলটাতে থাকলেন।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –অসম্ভব। এটা হতেই পারে না।

আমি অবাক, আমি তো চেষ্টা করেছি।

-আপনি কি আমাকে বোকা বানাবেন? আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

–আমি দুঃখিত। বলুন কোথায় ভালো হচ্ছে না, আমি আবার লিখে নিয়ে আসছি।

 তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন। এটা একটা অভাবিত আঘাত। আমি কি ব্রডওয়ের জন্য নাটক লেখার যোগ্য নই?

আমি সেখানে বসে আছি। নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছি।

জর্জ বালানচিন এবং ফেলিক্স ব্রেনটানো অফিসে এলেন।

–আপনার প্রথম অঙ্ক সম্পর্কে আমি শুনেছি। দেখি কী লেখা আছে?

তারা দুজনে পড়তে শুরু করলেন।

আমি মুখে শব্দ শুনতে পেলাম ফেলিক্স ব্রেনটানোর, তারপর হাসি। জর্জ বালানচিন।

তারা পড়তে পড়তে হেসে দিয়েছেন। আহা, এটা তাদের ভালো লেগেছে।

পড়াটা শেষ হল। ফেলিক্স ব্রেনটানো আমাকে বললেন –সিডনি, দারুণ হয়েছে। আপনার কাছ থেকে যা আশা করি সবই পেয়েছি।

জর্জ বালানচিন বললেন দ্বিতীয় অঙ্কটা এমনই ভালো হবে তো?

এই খবরটা বেনকে শোনাতে হবে।

হোটেলে গিয়ে আমি টেলিফোনের কাছে চলে এলাম। ভেবেছিলাম আর্মি এয়ার ক্রপ থেকে যে কোনো মুহূর্তে খবর আসতে পারে। সব সময় তাই নিজেকে তৈরি রাখতে হত।

নিউইয়র্ক একটা একাকীত্বের শহর বলা যেতে পারে। এখানে কারোর সাথে বিশেষ কথা হয় না। ইতিমধ্যে ব্যালেরিনা মিলার সঙ্গে আলাপ হল। এক রবিবার, রিহার্সাল ছিল না। তাকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করলাম। সে আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল।

আমি তাকে তার মন ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম। আমি তাকে সার্ডিতে নিয়ে গেলাম। তখন আমি ইউনিফর্ম পরে ছিলাম। ডিনার খেতে খেতে মিলা আর আমি আসন্ন উপস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমি তার মনের টগবগে ভাবটা বুঝতে পারলাম। ডিনার হয়ে গেল। আমি চেকের জন্য বললাম, ৩৫ ডলার। আমি কী করে মেটাব? অনেকক্ষণ চেকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখন ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন হয়নি।

মিলাডা জানতে চাইল কিছু গোলমাল হয়েছে?

আমি বললাম না, তারপর বললাম আমি এখনই আসছি।

আমি প্রবেশ পথের দিকে চলে গেলাম। সেখানে ওই হোটেলের মালিক দাঁড়িয়ে ছিলেন।

–মিঃ সার্ডি?

–হ্যাঁ।

এখন আমি কী বলব? উনি তো আর দানছত্র খুলে বসেননি।

–এটা আমার চেকের ব্যাপারে।

তিনি আমার দিকে তাকালেন। তিনি এমন অনেক জোচ্চোরকে আগে দেখেছেন।

-কিছু ভুল হয়েছে?

-এই মুহূর্তে আমার কাছে পয়সা নেই। আমি লক্ষ্য করছি, মিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা। আমি আবার বললাম, মিঃ সার্ডি, আমি নাটক লিখি। এই নাটকটা ম্যাজেস্ট্রিক থিয়েটারে দেখানো হবে। রাস্তার ওপারে। থিয়েটার এখনও খোলেনি। যখন পয়সা পাব, আমি টাকাটা দিয়ে যাব। আপনি কি এইটুকু বিশ্বাস আমায় করতে পারেন?

তিনি বললেন কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো সময় আমার হোটেলে খেতে আসবেন।

আমি বললাম আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

–না-না, ধন্যবাদ দেবার কী আছে?

এই ভাবেই সমস্যাটার তাৎক্ষণিক সমাধান হল।

আমাদের প্রযোজক ইওলানডা, বেন এবং আমাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। কোনো লেখাপড়ার আগেই তিনি একটা খারাপ মন্তব্য করতেন।

তিনি বলেছিলেন এই পরিবেশনটা একেবারে ফ্লপ হবে।

আমি ভেবেছি, উনি বোধ হয় মানসিক রোগিনী।

জর্জ বালানচিন, ফেলিক্স ব্রেনটানো, রবার্ট স্টোলজ– সকলেই আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

রিহার্সালের সময় ইওলানডা মাঝে মধ্যে বেশি কাজ করাতেন। সকলকে আদেশ দিতেন।

একদিন রিহার্সালের মাঝে একটুখানি সময় দেওয়া হয়েছে।

বালানচিন বললেন তোমার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।

–জর্জ, কিছু কি খারাপ হয়েছে?

-না, ভিনটন ফ্রিডলে নামে আমার এক বন্ধু আছে। সে একটা নতুন নাটক তুলতে চাইছে। সে একজন লেখকের সন্ধান করছে। আমি আপনার কথা বলেছি। সে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব।

-সত্যি কথা? আমিও দেখা করতে চাইছি।

বালানচিন তাঁর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন। একটার সময় দেখা করতে হবে।

দুটো ব্রডওয়ের নাটক একই সঙ্গে অভিনীত হবে? এটা অবিশ্বাস্য।

ভিনটন ফ্রিডলে এক বিখ্যাত প্রযোজক। তার অনেকগুলো মঞ্চ সফল উপস্থাপনা আছে। ফানি ফেস, গার্ল ক্রেজি ইত্যাদি। তাকে আমরা এক করিৎকর্মা মানুষ বলতে পারি।

–জর্জ, আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছে।

–আমি চেষ্টা করব।

আমি জ্যাকপট নামে একটা শো উপস্থাপনা করতে চলেছি। এই শো-এর ভেতর এমন একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে, যে যুদ্ধ ফেরত বন্দীদের জন্য টাকা তুলতে চাইছে।

গল্পটার মধ্যে মজা আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি এর মধ্যে একজন চিত্রনাট্যকারের সন্ধান পেয়েছি। তার নাম গাই বোলাটন। কিন্তু তার লেখার মধ্যে বেশির ভাগ ইংরাজি প্রাচীনপন্থা। আমি নতুন ইংরাজি শব্দ আমদানি করতে চলেছি। এই কাজটা কি আপনার ভালো লাগবে?

–অবশ্যই ভালো লাগবে, আমি বললাম, আমার সাথে আর একজন সাহায্যকারী আছে, বেন রবার্টস। সে আমার সাথে কাজ করবে।

ফ্রিডলে বললেন –ঠিক আছে। এই নাটকটার চিত্ররূপ দিয়েছেন ভারনন ডিউক এবং হাওয়ার্ড ডিয়েজ।

ব্রডওয়ে একটি স্মরণযোগ্য নাম।

কবে থেকে শুরু করা যায়?

–এখন থেকে।

-হ্যাঁ, যে কোনো মুহূর্তে ওই সংস্থা থেকে রিপোর্টের কথা বলা হতে পারে। তখন আমাকে ছেড়ে যেতে হবে।

ফ্রিডলে কথা বললেন আমরা ইতিমধ্যেই কুশীলবদের ঠিক করেছি। অ্যালান জোনস এবং ন্যাটি ফাত্রে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।

-অসাধারণ উপস্থাপন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। ফ্রিডেল আমাকে নিয়ে আলভিন থিয়েটারে ঢুকে পড়ল।

স্টেজের ওপর দক্ষিণ দেশের একটা বিরাট বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছি।

-আপনি বললেন যে, এই গল্পটা হচ্ছে এমন এক মার্কিন সৈন্যকে নিয়ে যে…

এটা আমার গত শো-এর সেট। ফ্রিডলে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। শো-টা একবারে ফ্লপ হয়েছে। আমরা এই সেটটাকে আবার ব্যবহার করব। তাতে অনেক পয়সা বেঁচে যাবে।

আমি বুঝতে পারছি না, কী করে গথিক যুগের দক্ষিণ দেশীয় ম্যানসনকে একটা আধুনিক কালের যুদ্ধসংক্রান্ত গল্পের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে।

–আমাকে এখনই অফিসে ফিরতে হবে। গাই বোলটনের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, তিনি এক আকর্ষণীয় ইংরেজ। তিনি পি. জি. ওডহাউসের জন্য বেশ কয়েকটি চিত্রনাট্য লিখেছেন। আমি জানি না, উনি আমাকে সাহায্য করবেন কিনা?

অথচ উনি বললেন- আমরা একসঙ্গে কাজ করব, ব্যাপারটা ভাবতেই অবাক লাগছে।

আমি হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেল গার্ডকে বললাম আমার কোনো মেসেজ আছে। কি?

-না, মি সেলডন।

তা হলে? পরবর্তী উড়ানে আমায় বোধহয় আর কখনও ডাকা হবে না।

আমি হোটেলে ফিরে গিয়ে বেনকে ফোন করলাম ফোর্ট ডিস্কে।

–তুমি আর আমি ভিনটন ফ্রিডলের হয়ে কাজ করব।

অনেকক্ষণের নীরবতা- ওরা মেরি উইডো নিয়ে নিয়েছে?

–না, মেরি উইডোর ব্যাপারে পাকা কথা বলতে হবে।

–কী করে সব শেষ হল?

-আমি জানি না। জর্জ বালানচিন সব কিছু ঠিক করেছেন। আমরা গাই বোলটন নামে এক ইংরেজ সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা করব এবং তার অধীনে কাজ করব।

.

১২.

আমি ব্যস্ত এবং খুশি। প্রতি মুহূর্তে ফোন কলের জন্য অপেক্ষা করি।

পরবর্তী তিন মাসে আমি অনেকগুলো চিত্রনাট্য লিখে ফেললাম। মেরি উইডো, জ্যাকপট, আরও অন্য দুই একটা।

একদিন রোববার সকালবেলা নিউইয়র্কে একটি বিনোদন আসরে গিয়ে আমি উপস্থিত হলাম। যে সমস্ত সৈনিকেরা কিছুদিনের জন্য এসেছে, তাদের মন চাঙ্গা রাখাই এই আসরের উদ্দেশ্য। সেখানে সুন্দর সুন্দর গান বাজানো হয়। সুন্দরী মেয়েরা নাচ প্রদর্শন করে। পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এ বুঝি যুদ্ধ নামক মরুভূমিতে এক টুকরো মরূদ্যান।

আকর্ষণীয় চেহারার সোনালি চুলের একটি মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল আপনি কি নাচতে চান, সোলজার?

নাচটা সবে শুরু হবে, কে যেন আমার কাঁধে হাত রেখেছে।

আমি বললাম এই তো নাচ শুরু হচ্ছে। এখন কেন?

 আমি তাকিয়ে দেখলাম– দুজন বিরাট আকারের মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন।

একজন বললেন- সোলজার, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। চলুন আমরা থানায় যাব।

-কেন? কী সমস্যা?

–নিজেকে অফিসার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন?

–আপনারা কী বলছেন?

–আপনি অফিসারের ইউনিফর্ম কেন পরেছেন? আপনার কোনো পরিচয়পত্র আছে?

-না, আমি একজন অফিসার নই। আপনারা মস্ত বড়ো ভুল করছেন। আমাকে এই পোশাকটা পরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

–কে অনুমতি দিয়েছেন? আপনার মা?

ওঁরা জোর করে আমাকে সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন।

আমার সমস্ত শরীরে এবং মনে ভয়ের আকুতি- আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না, আমি এয়ার ক্রুপের একটা স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সাথে যুক্ত আছি।

ওঁরা আমাকে তখন দরজার কাছে নিয়ে গেছেন।

–আপনারা কি ওয়ার ট্রেনিং সার্ভিসের নাম শুনেছেন?

না।

আমরা বাইরে বেরিয়ে এসেছি। একটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে।

–ভেতরে চলে যান।

–আমি বললাম আমি কখনই যাব না। আপনারা এখনই একটা ফোন করতে পারেন। আমি ওয়ার ট্রেনিং-এর সঙ্গে যুক্ত। আমরা এই ধরনের পোশাক পরতে পারি।

দুজন পুলিশ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। একজন বললেন- ঠিক। আচ্ছা কোথায় ফোন করতে হবে?

আমি নাম্বারটা দিলাম। একজন পুলিশ বললেন- তুমি এর ওপর নজর রাখো, আমি এখনই ফোন করে আসছি।

কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। উনি ফিরে এসেছেন। মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি।

 অন্যজন জিজ্ঞাসা করলেন– কী হয়েছে?

আমি একজন জেনারেলের সঙ্গে কথা বললাম। ওয়ার ট্রেনিং সার্ভিস সম্পর্কে উনি কিছু জানেন কিনা জানতে চাইলাম। হ্যাঁ, এটা হল আর্মি এয়ার ক্রুপের একটা ব্রাঞ্চ।

অন্যজন আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন– আমি দুঃখিত। আমরা ভুল করেছি।

আমি আবার ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু সেই মেয়েটি ইতিমধ্যে তার নাচের সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে।

.

গাই বোলটনের সঙ্গে কাজ করার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে। অনেকগুলো জনপ্রিয় নাটক লিখেছেন। সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করেন।

তিনি লং আইল্যান্ডে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে বেন আর আমি সেখানে চলে যাই।

এক সন্ধ্যেবেলা ডিনার পার্টি। আমি এক সুন্দরী মহিলার উল্টো দিকে বসে আছি।

মেয়েটি বলল- গাই আমাকে সব কথা বলেছে। তুমি নাকি ব্রডওয়ের জন্য একটা সংগীত মুখরিত চিত্রনাট্য লিখছ? ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয়।

আমি জানতে চাইলাম– তার মানে?

–আমি অভিনয় করতে চাইছি।

–তোমার নাম কী?

–ওয়েনডি ব্যারি।

ওয়েনডি ব্রিটিশ। সে ইতিমধ্যে কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করেছে। অবশ্য সবই ইংল্যান্ডে।

ডিনার শেষ হয়ে গেল। আমি জানতে চাইলাম– সবকিছু ঠিক হয়েছে?

সে মাথা নেড়ে বলল- চলো একটু হেঁটে আসি।

আমরা বাইরে এলাম, চাঁদের আলোর উদ্ভাস চারপাশ। এখন ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। চাঁদ ছাড়া আলোর উৎস নেই।

হঠাৎ সে কাঁদতে শুরু করল। আমি কান্নার কারণ জানতে চাইলাম।

সে বলল- আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে অকারণে মারধোর করে।

কথাগুলো কোনোরকমে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।

-কেন? তুমি কেন তাকে বাধা দাও না?

–আমি জানি না, তাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।

 সে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম।

–ওয়েনডি, আমার কথা শোনো। তুমি আর আঘাত পেয়ো না। তাকে ছেড়ে যাবার চেষ্টা করো।

–আমি জানি না, কবে পারব। আমি এখন যাচ্ছি।

–ঠিক আছে। আবার দেখা হবে। তুমি কি নিউইয়র্কে থাকো? কাল রাতে কী করছ?

ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল- কাল রাতে আমার কোনো কাজ নেই।

ডিনারে আসবে?

 –এলে ভালো হবে।

পরের দিন রাত্রিবেলা, ওয়েনডি আর আমি সার্ভিতে ডিনার খেলাম। একে অন্যের সাহচর্য উপভোগ করলাম। পরের দু-সপ্তাহের মধ্যে আমরা বন্ধুত্বের আবরণে বাধা পড়লাম।

শুক্রবার সকালবেলা আমি একটা টেলিফোন পেলাম।

–সিডনি?

–হ্যাঁ।

–তুমি কি জীবনকে উপভোগ করতে চাইছ?

–হ্যাঁ, কেন?

–তাহলে ওয়েনডি ব্যারির সঙ্গে আর কখনও দেখা করো না।

–তুমি কে কথা বলছ?

–তুমি কি জানো না, কে তাকে কিনে নিয়েছে?

না, সে কখনও আমাকে তার নাম বলেনি।

 বাগসি সাইগেল।

 এরপর আমি আর কখনও ওয়েনডিকে দেখতে পাইনি।

.

দুজন জ্যাকপট স্টার বেরিয়ে গেল। অ্যালান জোন্স এবং নানেট্টি ফাব্রে। জোন্স এক বিখ্যাত মভি স্টার। ভারী সুন্দর দেখতে, ছ-ফুটের ওপর লম্বা, সুদেহের অধিকারী, সুন্দর হাসি আছে ঠোঁটে। গলায় গান আছে চমৎকার। তাকে এখনই আইকন বলা যায়।

নানেট্রি ইতিমধ্যেই দর্শকদের মন জয় করেছে। কুড়ি বছর বয়স হয়নি। শরীরটা খুবই আকর্ষণীয়।

হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারলাম এই উপস্থাপনাটা দাঁড়িয়ে যাবে।

একদিন রিহার্সাল হয়ে গেছে। এই নাটকের ডিরেক্টর রয় হারগ্রেভ আমাকে বললেন চিত্রনাট্যটা অসাধারণ হয়েছে।

ইওলানডার কথা মনে পড়ে গেল। আমি বললাম- ধন্যবাদ রয়।

আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। সে এই জাতীয় নাটক উপস্থাপিত করতে চাইছে। তুমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে?

না, এখন আর সময় কোথায়? আমি আর বেন দু-দুটো নাটকের সংলাপ লিখছি। আমাকে যে কোনো সময় যুদ্ধে যোগ দিতে হবে।

তার নাম রিচার্ড কলমার। সে ডরোথিকে বিয়ে করেছে।

আমি খবরের কাগজের পাতায় ডরোথির নাম দেখেছি। সে এবং কলমার ব্রডওয়েতে এক জনপ্রিয় জুটি।

–ডিক, আমি তার সাথে কবে কথা বলব?

রয় হারগ্রেভ একটা ফোন করলেন। ফোন শেষ হয়ে গেল। উনি বললেন– কাল সকাল দশটায়।

রিচার্ড ইতিমধ্যেই অনেকগুলো মঞ্চ সফল নাটক পরিবেশনা করেছেন।

তার সঙ্গে যোগাযোগ হল, তিরিশ বছর বয়স হয়নি। রোগা চেহারা। উদ্দীপনার ছাপ আছে।

তিনি বললেন- রয় তোমার বিষয়ে সবকিছু বলেছে। আমি একটা ফ্যানটাসি মিউজিক্যাল করতে চলেছি। অনেক খরচ করা হবে। সেট সেটিং-এ কোনো কার্পণ্য করা হবে না। এটা হল শোপ অপেরা লেখকের গল্প। যে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখে, সে সুলতানের কাছে খবর বলবে। না হলে তার মৃত্যু হবে।

–ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে। এই ভূমিকাতে কে অভিনয় করবে?

–ভেরা জোরিনা।

বিখ্যাত ব্যালে নতকী, সে এখন এক ব্রডওয়ে স্টারে পরিণত হয়েছে। জর্জ বালানচিনকে বিয়ে করেছে।

–রোনাল্ড গ্রাহাম তার বিপরীত ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবেন। তুমি কি ডরোথির সাথে কোনো শো করেছ?

–না, কিন্তু একজন সাহায্যকারী চাই।

–বেন রবার্টস, কবে থেকে শুরু হবে।

এখন থেকে। ঘুম চলে গেছে চোখের পাতা থেকে। একটার পর একটা কাজ এসে গেছে। এতটুকু সময় পাচ্ছি না।

আমি তখনও আমার ইউনিফর্ম পরে আছি। যে কোনো সময় ফ্লাইটের ট্রেনিং হবে আশায় আছি। তার আগে কতটা সময় পাব?

ঈশ্বর বোধহয় তাকিয়েছেন আমার দিকে।

রিচার্ড কলমারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দু-ঘন্টা কেটে গেছে। কাজটা আমি নিয়েছি, ফোন বেজে উঠল।

আমি মেজর বেকার বলছি। কাল সকাল নটায় আপনাকে ক্যাপ্টেন বার্নসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে আর্মি হেড কোয়টারসে।

আমার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার অবস্থা খুবই খারাপ। আমার হাতে তিন-তিনটে নাটকের সংলাপ। এক রাতের মধ্যে কী করে শেষ করব?

ক্যাপ্টেন বার্নস এক লম্বা চেহারার টাকমাথা মানুষ। ইউনিফর্ম পরে আছেন। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমাকে বসতে বললেন। আমি প্রাথমিক শিক্ষানবিশী শেষ করেছি কিনা জানতে চাইলেন। তারপর বললেন, আপনাকে সেকেন্ডারি ফাইট স্কুলে পাঠানো হবে। এখানে অন্য প্লেন দেওয়া হবে।

-কেন?

যুদ্ধ এখন পাল্টে গেছে, আমরা রক্ষণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হব। এখন ফাইটার পাইলটদের দরকার। আপনার চোখের দৃষ্টি খুবই ভালো।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি আরও অনেক কথা বললেন। তার মানে, এখন আমাকে সবসময় সৈনিক হতে হবে।

কিন্তু আমি তা পারব কি?

হোটলে ফিরে এলাম। বেনকে ফোন করলাম। বললাম অনেকক্ষণ রাত জেগে কাজ করতে হবে।

-কেন? কী হয়েছে?

দেখা হলে সবকিছু বলব।

বেন আমার সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল, চিন্তা করো না। নাটকটা আস্তে আস্তে লিখলেই চলবে।

পরবর্তী তিনদিন আমরা অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। একটার পর একটা থিয়েটারে যাচ্ছি। সংলাপটা ঠিক মতো লিখতে হবে।

চতুর্থ দিন, আমি হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেল ক্লার্ক আমার হাতে একটা চিঠি তুলে দিল- লেখা আছে- শুভেচ্ছা।

আমি পড়তে শুরু করলাম। চিত্রনাট্যকার হিসেবে আমার নতুন পেশা শুরু হচ্ছে। হ্যাঁ, সংলাপগুলো দারুণ হয়েছে। আমি জানি, আবেগকে এখন আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। আমি আয়নার দিকে তাকালাম, আমার চোখে এত জল কেন? জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার যন্ত্রণা? আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।

পরের দিন সকাল নটা, আমাকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছোতে হল। ক্যালিফোর্নিয়াতে যে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি। তিরিশ মিনিট ধরে পরীক্ষা চলল। আমাকে ডাক্তারের চেম্বারে দেখা করতে বলা হল।

ভদ্রলোক কতগুলো কাগজের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনার মেডিকেল রিপোর্ট বলছে, আপনার হার্নিয়া আছে।

–হ্যাঁ, স্যার। প্রথম পরীক্ষার সময় আমি এটা বলেছিলাম।

যদি কোনো সময় আপনি হার্নিয়াতে আক্রান্ত হন, তাহলে কী হবে? না আপনাকে আমরা কখনও নির্বাচিত করব না। আপনাকে আমি অযোগ্য বলে লিখে দিলাম। আরও জানাতে হবে, আপনাকে এই সৈন্যদলে আর লাগবে না।

আমি অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। এই ঘটনাটা কীভাবে মেনে নেব বুঝতে পারছিলাম না। তারপর চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

উনি বললেন- ইউনিফর্মটা খুলে দিয়ে যান।

আমি আবার সাধারণ মানুষে পরিণত হলাম।

কী সব ভাবতে ভাবতে একটা কাপড় জামার দোকানে ঢুকে পড়লাম। দুটো স্যুট কিনলাম, কতগুলো ছোটো প্যান্ট, শার্ট এবং টাই। হ্যাঁ, এবার চিত্রনাট্যকার হিসেবেই আমার সবসময়ের জীবন শুরু হবে।

.

১৯৪৩ সালের ৪ঠা আগস্ট, দি মেরি উইডো ম্যাজেস্টিস থিয়েটারে শুরু হল। এটা ব্রডওয়ের অন্যতম জনপ্রিয় নাটকে পরিণত হয়।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হচ্ছে

। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছে অসাধারণ উপস্থাপনা।

দ্য হেরাল্ড ট্রিবিউন লিখল শহরের সকলে অবাক হয়ে গেছে।

 দ্য মিরর-এ প্রকাশিত হল- অসাধারণ বৈচিত্র্যসম্পন্ন এবং সংগীতবহুল।

 দ্য জার্নাল আমেরিকান মন্তব্য করল- একটা কৌতুক পরিপূর্ণ হাসির গল্পকথা।

ওয়াল্টার উইনচেল লিখলেন– আগস্ট মাসেই এর প্রস্ফুটন ঘটে গেছে। দ্য মেরি উইডো সাধারণ মানুষ দারুণভাবে গ্রহণ করেছে।

হ্যাঁ, এবার বোধহয় আমি নাম করতে চলেছি।

.

১৩.

ডরোথিকে এক সৃজনশীল মহিলা বলা যেতে পারে, কৌতুকবোধ আছে মনের মধ্যে। সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে ভালোবাসেন।

প্রথমদিকে উনি ছিলেন একজন ক্রাইম রিপোর্টার। তারপর ব্রডওয়ে এবং হলিউডের নামকরা সাংবাদিক হয়ে উঠেন। বিভিন্ন বিষয়ে অন্ততদন্তমূলক লেখালেখিতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ডঃ শ্যাম শেফার্ডের বিচারের কথা লিখেছেন অকপটভাবে।

ডরোথি এবং বেন একসঙ্গে ড্রিম উইথ মিউজিক-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। গাই বোলটন এবং আমি জ্যাকপট-এর চিত্রনাট্য শেষ করলাম। ভিনটন ফ্রিডলে ব্রডওয়েতে। এলেন ওপেনিং শো দেখতে। এভাবেই তখন জীবন এগিয়ে চলেছে।

১৯৪৪ সালের ১৩ই জানুয়ারি। অলভিন থিয়েটারে জ্যাকপট শুরু হল। বেশির ভাগ সমালোচক এটাকে ভালো বলেছিলেন।

আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমাদের সবথেকে বড় সফলতা আসতে চলেছে।

ড্রিম উইথ মিউজিক–এক অসাধারণ উপস্থাপনা, ভিনটন ফ্রিডলে নন, রিচার্ড কোলমার এই পরিবেশনার অন্তরালে অর্থ সাহায্য করলেন। ব্রডওয়েতে বিস্ফোরণ ঘটে গেল। স্টুয়ার্ট চানি সব কটা সেট সাজিয়েছিলেন। মাইলস হোয়াইট কসটিউমের পরিকল্পনা করেছিলেন। জর্জ বালানচিন ছিলেন ক্যরিওগ্রাফার।

বেন আর আমি সময়টা ভাগ করে নিয়েছি। আমি ডরোথির জন্য চিত্রনাট্য লিখছি। কখনও তার সুন্দর সাজানো অ্যাপার্টমেন্টে পা রাখার অনুমতি পাচ্ছি। বেন এবং আমি রাতের অন্ধকারে কাজ করছি। হোটেলে বসে, বেন তো এখন ফোর্ট ডিস্কে চাকরি পাবে। সেদিকটাও মানিয়ে চলতে হবে।

এক সন্ধেবেলা বেন আর আমি লিখছিলাম। আমি একটা কলম ফেলে দিয়ে সেটা তোলার চেষ্টা করছি। আমার হার্নিয়াটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। আমি ছটফট করতে থাকলাম। নড়তে চড়তে পারছি না। বেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করল। তিনদিনের জন্য আমাকে হাসপাতালে থাকতে হল। অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে। মনটা কেমন যেন হয়ে গেছে।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম, আবার কাজ শুরু হল। কাজটা শেষও হয়ে গেল।

ডরোথি, বেন এবং আমি থিয়েটার হলে বসে আছি। রিহার্সাল দেখছি। হ্যাঁ, রিহার্সাল দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, আসল পরিবেশনা কেমন হবে। স্টেজে নিত্যনতুন টিউমের ভিড়। অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। ভেরার নাচের আসর কি?

এই নাটকটি শুরু হয়েছে ভেরা এবং রোনাল্ডের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। তারা দুজনেই প্রথম রজনীতে উতরে গেলেন।

মা এবং মাতরি প্রথম দিন নিউইয়র্কে এসেছিল। আমরা প্রথম সারিতে বসেছিলাম। থিয়েটারে অনেক মানুষের সমাবেশ ঘটে গেছে। বেন আর আমি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।

মনে হচ্ছে নাটকটা বোধহয় আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। দিনে দিনে দর্শকদের সমাবেশ আরও বাড়ছে।

ড্রিম উইথ মিউজিক নাটকটির মধ্যে দুটো অঙ্ক এবং তেরোটা দৃশ্য ছিল। প্রথম দৃশ্য শুরু হবার আগে আফ্রিকান-আমেরিকান শো-গার্লদের নাচ প্রদর্শনের ব্যবস্থা হল। এই ব্যাপারটা জনসাধারণের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এটা একটা নতুন উপস্থাপনা। ধীরে ধীরে বাজনার ছন্দ বাড়তে থাকে। ওই স্বল্পবসনা সুন্দরীরা স্টেজ ফ্লোরের ওপর এসে দাঁড়ায় একে একে। দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

এটা হল শুরুর কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী যেন ঘটে গেল।

এবার ভেরা জোরিনার মঞ্চে আসার পালা। সে হল বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যালে নর্তকী, একবার নাচতে নাচতে সে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিল। দর্শকরা শিহরিত হয়ে উঠল। বেন আর আমি সিটে বসে ঘামছি।

দুটো দৃশ্যের পরের কথা। ভেরা আর রোনাল্ড অসাধারণ পোশাকে সুসজ্জিত। তারা সেন্টার স্টেজে এসে দাঁড়াল। এবার একটা প্রেমের দৃশ্য অভিনীত হবে। হালকা চাঁদের আলো। প্রেক্ষাপটে আরণ্যক পটভূমি। বেন এবং আমি যেসব সুন্দর শব্দ লিখেছিলাম, সেগুলো এবার উচ্চারিত হবে। শেষ পর্যন্ত দৃশ্যটা ভালোভাবে উতরে গেল। জনগণ স্তব্ধ হয়ে সবকিছু শুনছে।

হঠাৎ আলোটা নিভে অন্ধকার হয়ে গেল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। জোরিনা এবং গ্রাহাম স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা সংলাপ বলে যাবার চেষ্টা করল। একটু বাদে থেমে গেল। অনেকক্ষণ বাদে আলো ফিরে এল।

ফ্ল্যাশলাইটের আলো, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার মাথার ওপর আলো ধরা হল। বুঝতে পারা গেল, একটা অসাধারণ দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে।

এটা হল ব্রডওয়ের ইতিহাসে সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমরা শান্তভাবে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম। জানি, সমালোচনার বিষতীর আমাদের বিদ্ধ করবে।

কোনো কোনো সমালোচক অবশ্য সহানুভূতির দৃষ্টিতে সব কিছু বিচার করার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের উদ্যমের প্রশংসাও করা হয়েছিল। মনটা ভীষণ দমে গেল। এই ধরনের বিপর্যয় আমরা কেউই আশা করিনি।

ড্রিম উইথ মিউজিক অভিনয় শেষ হয়ে গেছে। এক ভদ্রলোকের ফোন পেলাম। উচ্চারণের ভেতর হাঙ্গেরিয় ছাপ আছে। তিনি নিজেকে লাডিসলাস নামে পরিচয় দিলেন। জর্জ হ্যালি নাকি আমাকে ফোন করতে বলেছেন।

জর্জ হ্যালি হলিউডের এক বিখ্যাত লেখক। আমি জানতে চাইলাম– কী করব আপনার জন্য?

-আমরা কি একসঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারি?

আমি ফোনটা ঝুলিয়ে রেখে জর্জ হ্যালির সঙ্গে কথা বললাম, ভদ্রলোকের পরিচয় জেনে নেবার চেষ্টা করলাম।

জর্জ হেসে বললেন- উনি এক বিখ্যাত হাঙ্গেরিয় চিত্র নাট্যকার। ইওরোপে ওনার যথেষ্ট নাম আছে। সেখানে অনেকগুলো হিট ছবির লেখক।

উনি আমার সঙ্গে কী করতে চাইছেন?

–তোমার জন্য একটা ভালো প্রস্তাব আছে। উনি এমন একজনকে খুঁজছেন, যিনি ইংরাজি বলতে পারেন, তুমি দেখা করো। কোনো অসুবিধা হবে না।

আমার হোটেলে লাঞ্চের আয়োজন। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল কর্মক্ষম। খুব একটা লম্বা নয়, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে। তিনশো পাউন্ডের নীচে ওজন। তবে শরীরের মধ্যে একটা আকর্ষণী ছাপ আছে।

ওর সাথে বাদামী চুলের এক মহিলাকে দেখলাম, উনি পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার স্ত্রী মারিকা।

আমরা হাতে হাত রাখলাম। আমরা বসলাম। উনি বললেন- আমরা দুজনেই একই পথের পথিক। ইওরোপে আমরা অনেক কিছু করেছি।

আমি জানি, লাডিসলাস আমাকে সবকিছু বলেছেন।

 –মারিকা আর আমি ভবিষ্যৎ নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইছি। আপনি কি আমাদের জন্য নাটক লিখবেন?

কী ধরনের নাটক?

–এটা এমন একজন সৈনিকের গল্প, যুদ্ধের শেষে তিনি তার ছোট্ট শহরে ফিরে এসেছেন। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। রণক্ষেত্রে ওই যুবক অন্য মেয়েকে ভালোবেসেছেন।

ব্যাপারটা খুব একটা উত্তেজক কী? আমি মনে মনে বললাম। মুখে বললাম আমি দুঃখিত। এখন খুব ব্যস্ত আছি।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করবে একজন মহিলা, অর্থাৎ আমরা, একজন মহিলা সৈনিকের কথা বলব।

আশ্চর্য, এটা একটা নতুন উপস্থাপনা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ওই মেয়েটির সামনে এখন মস্তবড়ো সমস্যা। প্রাক্তন প্রেমিক অথবা ওই সৈনিক, কাকে সে মন দেবে?

মারিকা জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কি কাজটা করবেন?

–হা, আমি আগ্রহী, কিন্তু আমার একজন সহকারী আছে। লাডিসলাস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–ঠিক আছে। আমরা তাকেও না হয় পারিশ্রমিক দেব।

আমি সেদিন বিকেলে বেনকে ডেকে সব কথা বললাম।

বেন বলল আমার সাহায্য ছাড়া তুমি এটা করতে পারবে। এখন অনেকটা সময় অফিসের কাজে চলে যাচ্ছে।

–তুমি থাকবে না?

-হ্যাঁ, হয়তো কিছুদিন। আশা করি, এই কাজটা ভালো ভাবেই উতরে যাবে।

লাসি অর্থাৎ ওই হাঙ্গেরিয় ভদ্রলোক এবং মারিকা আমার উল্টোদিকে বসলেন। কাজটা শুরু হল। লাসির কথা বোঝা খুবই শক্ত। মারিকা মোটামুটি ভালো ইংরাজি বলতে পারেন। এই নাটকটার নাম দেওয়া হল স্টার ইন দ্য উইনডো।

চারমাসে সংলাপ লেখা শেষ হল। আমার এজেন্ট একটা প্রযোজক দলকে এই নাটকটা দেখাল। তারা এটা উপস্থাপন করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ঠিক করা হল, জোসেফ এই নাটকটি পরিচালনা করবেন। কে কোন ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবেন, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু হল।

পেগি, ব্রডওয়ের এক বিখ্যাত অভিনেত্রীকে ওই মহিলার চরিত্রটা দেওয়া হবে। আমরা অনেক পুরুষের পরীক্ষা নিলাম। কিন্তু কে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তা ঠিক করা সম্ভব হল না। একদিন আমার এজেন্ট এক তরুণ অভিনেতার ছবি নিয়ে এল।

হয়তো তাকেই আমরা নির্বাচিত করব।

সে স্ক্রিপটা পড়তে শুরু করল। অবশেষে সেই উত্তেজক মুহূর্ত। ভালোভাবেই মুখের অভিব্যক্তি দেখিয়ে ছিল সেই ছেলেটি। তার অভিনয় ক্ষমতা দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি। সে হল কির্ক ডগলাস।

রিহার্সাল শুরু হল। পেগি এবং কির্ক এক অসাধারণ যুগলে পরিণত হয়েছে। রিহার্সাল শেষ হল। আমরা এবার নাটক উপস্থাপন করব। ওয়াশিংটনে আমাদের কাজ শুরু হবে। সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। বেশির ভাগ সমালোচক প্রশংসা করেছেন।

আমার মনে আনন্দ, ড্রিম উইথ মিউজিকের মতো বিপর্যয় এখানে হয়নি। তা হলে? ব্রডওয়েতে বোধহয় আমি পায়ের তলায় শক্ত জমির সন্ধান করতে পারলাম।

১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি, ব্রডওয়েতে এই ছবির প্রথম অভিনয়। ইতিমধ্যেই নামটা পাল্টে রাখা হয়েছে  এলিস ইন আর্মস । প্রথম দিন অভিনয়ের শেষে আমরা সার্ডিতে গেলাম, সমালোচনার ব্যাপারটা বোঝার জন্য। তাছাড়া একটু আনন্দ অনুষ্ঠান করতে হবে বৈকি।

বেশির ভাগ সমালোচক তীক্ষ্ণভাবে নাটকটাকে আক্রমণ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এটি এক দুর্বল উপস্থাপনা। অবশ্য কেউ কেউ এর অন্তরালের সৃজনীসত্তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

হা, হয়তো সমালোচকরা ঠিকই বলেছেন। ব্রডওয়ের জন্য নাটক লিখতে গেলে আরও বেশি অনুভবী হওয়া দরকার। আরও মসৃণ চিন্তাভাবনা করতে হবে।

কী ঘটছে, আমি তা বুঝতে পারছি। তার মানে? এমন হতে থাকলে বাকি জীবনটা হোটেল ঘরে বসে দুঃখ জানাতে হবে। আমি ঠিক করলাম হলিউডে ফিরে যাব। সেখানে আমি আবার মৌলিক লেখায় মন দেব। সেটা বিক্রির চেষ্টা করব। হয়তো একটু অনিশ্চয়তা আছে! সবশেষে আছে সৃজনশীলতার আনন্দ।

পরের দিন সকালবেলা আমি কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলাম। হ্যাঁ, একটা ভালো কিছু লিখতে হবে।

তিরিশ পাতার একটি সারাংশ। নাম দিলাম সাডেনলি ইট স্প্রিং । এটা হলিউডের জন্য তৈরি করেছি।

লস এঞ্জেলসে যাবার পথে চিকাগোতে থামলাম। মা এবং মারতির সঙ্গে দেখা করতে হবে।

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল– এই হল আমার লেখক ছেলে।

আমি  এলিস ইন আর্মস  এর সমালোচনার কথা বললাম, না বললে মা হয়তো দুঃখ পাবে।

কিন্তু মা সব কথা জেনে গেছে। মা বলল নাটকের নাম পরিবর্তন করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি।

আমি চিকাগোতে কদিন ছিলাম। মাসিদের সঙ্গে দেখা করলাম। ফ্রান, এমা আর পাউলিন তারা ডেনভার থেকে এসেছিল। তারা আমাকে পেয়ে খুবই গৌরব বোধ করেছে।

একজন বলল– ব্রডওয়েতে ড্রিমস উইথ মিউজিক এবং এলিস ইন আর্মস -এর মতো সাফল্য অন্য কোনো নাটক পায়নি।

সব শুনে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেল। পরিচিত প্রিয়জনরা আমায় কত ভালোবাসে।

এবার বিদায় জানাবার পালা। আমি তখন উড়ান পাখির সওয়ার হয়ে হলিউডের দিকে চলেছি।

এই হল সেই হলিউড। এখন আমার কী পরিচয়? আমি মিলিটারী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি। দুটো ব্রডওয়ে হিটসের রচয়িতা, পাশাপাশি দুটো ফ্লপও আমার নামের পাশে জ্বলছে।

সময় এগিয়ে চলেছে। সৌভাগ্য বলতে হবে। জ্যাকপট-এর এক অভিনেত্রী বেভারলি হিলসে একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট রেখেছিল। সে ওই অ্যাপার্টমেন্টটা আমাকে ভাড়া দিতে রাজী হল। এটা পাম ড্রাইভে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা অল্পবয়সী ছেলে দরজাটা খুলে দিল। তার নাম বিল। সে জানত, আমি সেখানে যাব।

আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। ছোট্ট সাজানো অ্যাপার্টমেন্ট, একটা শোবার ঘর, ছোট্ট লিভিং রুম আর একটা কিচেনেট।

এবার এখানেই শুরু হবে আমার সংগ্রাম।

এবার আমি কোথায় যাব? কামেল স্ট্রিটে গিয়ে গ্রেসির সঙ্গে দেখা করতে হবে। সব কিছুই একরকম আছে, মুখখানা একটু পাল্টে গেছে। হ্যাঁ, নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলের দল বোর্ডিং-এ ভিড় করেছে। আগামী দিনের তারকা, পরিচালক অপেক্ষা করে আছেন কাক্ষিতে টেলিফোন কলের জন্য।

গ্রেসি এতটুকু পাল্টাননি। এখনও একই রকম চেহারা বজায় রেখেছেন। সকলকেই উপদেশ দিচ্ছেন, যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টা করছেন।

আমাকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন- তুমি এখন কত বিখ্যাত হয়ে । উঠেছ।

আমি জানি না এই বিশেষণটা আমি পেতে পারি কিনা।

-হা কোনো রকম চলে যাচ্ছে।

অতীতের স্মৃতিচারণ করে বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি চলে এলাম, এজেন্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

উইলিয়াম মরিস এজেন্সির সঙ্গে একটা চুক্তি হল। এটি হলিউডের অন্যতম সেরা এজেন্সি। স্যামি নামে এক অল্পবয়েসী ভদ্রলোক এটি পরিচালনা করে থাকেন। তিনি আমাকে আরও কয়েকজন এজেন্টের সাথে কথা বলিয়ে দিলেন।

তাদের মধ্যে একজন হাইড, তিনি বললেন- আপনার কথা অনেক শুনেছি। আমরা একসঙ্গে কিছু উত্তেজক কাজ করতে পারব।

ডোনা হলওয়ের সঙ্গে দেখা হল। লম্বা, পাতলা চেহারা, চোখের তারা ধূসর কিন্তু বুদ্ধির ছাপ আছে। তিনি আমার হাতে হাত রেখে বললেন–হ্যালো মিঃ সেলডন, আপনি আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন ভেবে মনে আনন্দ জাগছে।

-হ্যাঁ, এই এজেন্সিটা আমার ভালো লাগল। আমি বললাম, আমি মৌলিক গল্প নিয়ে এসেছি, সেগুলো দেখাতে চাইছি।

স্যামি বললেন– এখন থেকেই কি কাজ শুরু হবে? আমাদের ক্লায়েন্টদের তালিকায় এডি ক্যান্টর আছেন, একটা সমস্যা হল, স্ক্রিপ্টটা কেমন তা না দেখে কিছুই বলা যাবে না।

তারপর? নতুন অভিযান শুরু হল।

.

১৪.

এডি ক্যান্টর গোটা দুয়েক মুভির পরিচালক। আমাদের দেশের অন্যতম সেরা হাস্যকৌতুক শিল্পী। ব্রডওয়েতে একাধিকবার তার মুখ দেখা গেছে। নিজস্ব টেলিভিশন শো আছে, সেটা অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

আমি রক্সবারিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। বেভারলি হিলসে তার বাড়িটি অবস্থিত। খর্বাকৃতি মানুষ, সব সময় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। কথা বলতে বলতে আসছেন। শুনছেন, তখনও হাসছেন।

সিডনি, এই হল অবস্থা, আর কে ও অনেকগুলো স্ক্রিপ্ট বাতিল করেছে। আমি রেডিও রাইটার্সের কথা বলতে পারি, আমি এখন খুবই ব্যস্ত, এমন একটা স্ক্রিপ্ট দরকার যা তিন-চার মাস ধরে দর্শকদের মন ভরিয়ে রাখবে। এমন কিছু ব্লকবাস্টার গল্প কি আছে আপনার কাছে?

–আমি চেষ্টা করে দেখব।

-ঠিক আছে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি, প্রথম খসড়াটা হয়ে গেলে আমাকে দেখাবেন। যদি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে বাজিমাৎ করব। আর পয়সা কড়ি? এ ব্যাপারে আপনাকে বঞ্চিত করা হবে না। সপ্তাহে আটদিন কাজ করতে হবে একথা যেন মনে থাকে।

আমি বুঝতে পারলাম, এখানে সবকিছু খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে।

টেলিফোনটা বেজে উঠল, উনি বললেন- আমি এডি ক্যান্টর বলছি।

এইভাবে আবার একটি কর্মব্যস্ত দিন শুরু হল।

আমরা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করলাম। এমন একটা নাটক, যেখানে এডি এবং জোয়ান ডেভিস প্রধান ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবেন। লেখাটা শুরু হল, আমি এডির বাড়িতে বসে লিখতাম। সকাল থেকেই কাজটা শুরু হত। বিকেল সাতটা পর্যন্ত লিখতাম। শনিবার এবং রোববারেও ছুটি নিতাম না।

তারপর অখণ্ড অবসর। আমার সাথে এক সুন্দরী মহিলার দেখা হল, আমরা একসঙ্গে ডিনারের আসরে উপস্থিত হলাম।

আমি জানতে চেয়েছিলাম– সন্ধ্যেবেলা তুমি কী করো?

সিডনি, আমাকে অন্য কারোর সাথে থাকতে হয়। আমি তোমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি, এখন মন ঠিক করতে পারছি না।

–সেই লোকটি কে?

-তার নাম যোসে, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। সে এক বিখ্যাত পিয়ানোবাদক। সারা পৃথিবীতে কনসার্ট করে বেড়ায়। এম জি এমের সাথেও তার ভালো যোগাযোগ আছে, প্যারামাউন্ট এবং ফক্সেও সে বাজায়।

না, তার সাথে লড়াইতে আমি নিশ্চয়ই হেরে যাব।

.

মেয়েটি আমাকে বলেছিল– তুমি নাকি এক কোকাকোলা, যোসে আমাকে বলেছে।

–তার মানে?

–তোমার মতো অনেক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তোমার আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

সেই মেয়েটির সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি।

এডি ক্যান্টর এবার আর কে ও-র সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চলেছে। আমি আমার চিত্রনাট্যটা তুলে দিয়েছি। সেটা আর কে ও-তে পাঠানো হবে।

একদিন স্যামি আমাকে বলল- সিডনি, মনে হচ্ছে তোমাকে বোধহয় বাদ দেওয়া হবে।

.

আমি বললাম- কেন?

 ক্যান্টর তার রেডিও লেখকদের নিয়ে এসেছেন।

সে কী? এত পরিশ্রম সব ব্যর্থ হল?

এভাবেই হলিউড আমাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়েছিল।

.

১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে জাপানীরা আত্মসমর্পণ করে। রিচার্ড বাড়িতে ফিরে আসে। আমি তাকে দেখার জন্য ছটফট করছি।

বড়োদিনের আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে সেপ্টেম্বর, রিচার্ডের জাহাজ সান ফ্রানসিসকোতে এসে গেছে। আমরা লস এঞ্জেলসে একসঙ্গে ডিনার সারলাম। মন এবং শরীরের দিক থেকে সে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে! কী ঘটেছে তা জানতে আমার মন আগ্রহী হয়ে উঠেছে, সে কোথায় কোথায় গেছে? নিউ গুমিয়া থেকে মোরাসাই, লুজন।

ব্যাপারটা কেমন?

আমার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল- এটা নিয়ে কখনও আলোচনা করা উচিত নয়।

আমি বুঝতে পারলাম একাকীত্বের যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে।

সে আবার বলল- ম্যারি আমার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছে। আমি সেই চাকরিটা নেব। তাহলে মায়ের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটাতে পারব।

আমার মনে আনন্দ। আমি জানি ম্যারি তাকে সাহায্য করবে।

স্যাম আমাকে পরের দিন ডেকে বলল সাডেনলি ইট স স্প্রিং -এর দুটো খবর আছে।

আমি বললাম– দারুণ, কোথা থেকে এসেছে?

–একটা এসেছে ওয়ালটার ওয়াগনার থেকে, তারা অনেকগুলো মঞ্চসফল নাটকের প্রযোজক।

–আরেকটা।

–ডেভিড সেলজনিক।

আমার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়ে গেছে। ডেভিড সেলজনিক সত্যি?

হ্যাঁ, উনি তোমার ছোট্ট ছোট্ট ঘাত-প্রতিঘাতগুলোকে ভালো বলেছেন। হয়তো এখানেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।

আমি টাকার কথা খুব একটা চিন্তা করছি না, আমি শুনেছি উনি নাকি এই ধরনের লেখার জন্য পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার দিয়ে থাকেন।

আমি ভাবছি ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে কাজ করতে পারলে কত বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারব।

তাহলে? কার বিষয়টা আগে ভাবা যায়? অবশ্যই ডেভিডের। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পরের দিন সকালে আমি ডেভিড এবং ডোরের সঙ্গে কথা বললাম। ডেভিড এক লম্বা ভদ্রলোক, চেহারার মধ্যে ব্যক্তিত্ব আছে। বিরাট ডেস্কের উল্টোদিকে বসে ছিলেন। সাজানো অফিস। ডোরে এক কালো চেহারার মানুষ। তার চোখে মুখে দীপ্ত বুদ্ধির ছাপ। আমরা হাতে হাত রাখলাম।

ডেভিড বললেন- সেলডন, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমি খুবই খুশি।

এর আগে কতবার আমি চেষ্টা করেছি, প্রতিবারই আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হত।

উনি বললেন- আপনার গল্পটা অসাধারণ, আমার মনে হচ্ছে এটা দর্শকদের উদ্বেলিত করবে।

ডোরে বললেন- হা, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

ডেভিড আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ওয়াগনার থেকে আপনি একটা সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু আপনার এজেন্টেদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল এখানেই ব্যাপারটা ভালো হবে।

হয়তো এটাই আমার ভাগ্যরেখা, আমি ভাবলাম।

কাজ করতে শুরু করলাম, আর কে ও স্টুডিওতে। সাডেনলি ইটস স্প্রিং, তখন ধীরে ধীরে তার আসল রূপ ধরছে। এখন আর কে ও মঞ্চসফল একটা নাটক দেখাচ্ছে, তা হল ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ । এর পাশাপাশি দি ফারমার্স ডটার ও দেখানো হচ্ছে।

এই চিত্রনাট্যটা লিখতে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। এমন একটা গল্প যাতে উচ্ছন্নে যাওয়া এক প্লেবয় চরিত্র আছে, অল্পবয়েসী একটি মেয়ে এবং তার বোন। একজন বিচারককেও আনা হয়েছে।

আমি ভাবলাম, এই চিত্রনাট্যটা দর্শকদের দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করবে। আমি জানি ডেভিড এটাকে পাল্টে দেবেন। কীভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরবেন।

লেখা এগিয়ে চলল। মাঝে মধ্যে মনে আবেগের সঞ্চালন, কখনও অভিমানের অনুভূতি। একটানা লিখে চলেছি, ক্লান্তি আসছে না। মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি। একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল, সে তার বান্ধবীকে নিয়ে খাচ্ছিল। তার নাম ব্রাউন ডার্বি। সে বলল সিডনি, জ্যানের সঙ্গে আলাপ করো।

জ্যানে নিউইয়র্ক থেকে এসেছে, ভারি আমুদে চেহারার ছটফটে স্বভাবের মেয়েটি। টগবগ করে ফুটছে। তাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তাই হল। আমরা একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলাম। দু-মাস ঘোরাফেরার পর আমরা বিয়ে করলাম।

হনিমুনের সময় কোথায়? সাডেনলি ইটস স্প্রিং  নিয়ে তখন খুবই ব্যস্ত।

একমাসের পর আমরা বুঝতে পারলাম জ্যানে আর আমি দুই ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা। আমাদের ভালো লাগা বিষয়গুলির মধ্যে কোনো মিল নেই। পরবর্তী ন-মাস আমরা বিয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত দেখলাম এটা এক অসম্ভব কাজ, তখন বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দুজনেই রাজী হলাম। একটা অব্যক্ত ব্যথা আমাকে আক্রান্ত করল। যেদিন ডিভোর্সটা হয়ে গেল, আমি জীবনে প্রথমবারের মতো মাতাল হয়েছিলাম।

বাড়ির এই অবস্থা, স্টুডিওর অবস্থা মোটামুটি ভালো। চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়েছে।

ডেভিড আমাকে তার অফিসে ডেকে বললেন- আপনার স্ক্রিপ্টটা আমরা ক্যারি গ্রান্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।

-উনি কী বললেন?

উনি বললেন এটা উপস্থাপনা করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

 আমার মনে আনন্দ, খবরটা সাংঘাতিক।

–আমরা সারলি টেমপল এবং মেরনা ল-এর সাথে চুক্তি করেছি।

–আহা অসাধারণ ভূমিকা নির্বাচন।

আরভিং রেইস এই নাটকটা পরিচালনা করবেন, ক্যারি গ্রান্ট আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন।

কমেডি চরিত্রে ক্যারির নাম সকলেরই প্রথম পছন্দ। এখানে কোনো দ্বিতীয় বিবেচনা চলতে পারে না। ক্যারিকে না পাওয়া গেলে অন্য কারোর নাম মনে করা যেতে পারে।

ক্যারির আচরণ আমার ভালো লাগে। ভারী সুন্দর চেহারা তাঁর, বুদ্ধির ছাপ আছে, মনটা সদা চঞ্চল। অন্য নক্ষত্রদের মতো নিজেকে ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দী রাখেন না।

ক্যারির জন্ম হয়েছিল এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে। সার্কাসে জীবনের সূত্রপাত হয়।

তারপর ধীরে ধীরে জীবনের ধারা পাল্টে যায়। ক্যারি গ্রান্ট নিজেই এখন এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন।

একবার তিনি বলেছিলেন– সকলেই ক্যারি গ্রান্ট হতে চায়, কিন্তু এই হওয়ার অন্ত রালে কত দুঃখ যন্ত্রণা আছে, সেটা কি কেউ বোঝে?

সারলি টেম্পলের সাথে দেখা হল, আঠারো বছরের এক উদ্ভিন্ন যৌবনা, ছোটোবেলা থেকেই সে মোশান পিকচার জগতের সাথে যুক্ত। তার ছবি অনেক টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এত নাম আছে, কিন্তু আচরণের মধ্যে অহংকারের ছাপ নেই।

মেরনা ল এক প্রতিভাশালিনী অভিনেত্রী, সে দ্য থিন ম্যান সিরিজ-এ অভিনয় করেছে।

এই কাস্টিং দেখে আমি খুবই উদ্দীপ্ত।

ক্যারি এবং আমি মাঝে মধ্যেই লাঞ্চের আসারে গিয়ে বসি। ক্যারির সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।

ক্যারি গ্রান্ট আমাকে অবাক করে দেয়। কীভাবে জনগণকে আকর্ষণ করা যেতে পারে, সেই মন্ত্র সে সযত্নে শিখেছে।

একদিন ক্যারি ডোরেকে ফোন করলেন। ক্যারি এবং আমার লাঞ্চ খাওয়া শেষ হল, এবার ডোরের সাথে কথা বলতে হবে।

ক্যারির দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। হ্যাঁ, ব্যারিকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে।

আমরা সাউন্ড স্টেজে পৌঁছে গেলাম, আরভিং রেইস বললেন– সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকবেন।

বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, সকলেই তাকিয়ে আছেন।

 আরভিং বললেন– ক্যামেরা, তারপর বললেন- আকসান।

 আমি অনেকক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে ছিলাম। এটা হল আমার স্বপ্ন সফলতার আর্ট কাহিনী।

একদিন ডেভিড আমাকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন- এখন ন্যাশনাল ব্রাদারহুড সপ্তাহ পালিত হবে। সব ধর্মকে একীভূত করার জন্য ছোটো ছোটো সিনেমা তৈরি হবে।

আমি জানতাম, কিন্তু এ ধরনের চিত্রনাট্য লেখবার কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না।

আমি ভাবলাম কী বিষয়ে লেখা যায়।

উনি বললেন- অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেকের জন্য মাত্র দু-মিনিট করে সময় ধার্য করা হয়েছে।

পরের দিন আমি একটা দু-পাতার পাণ্ডুলিপি তুলে দিলাম ডেভিডের হাতে। ডেভিড পড়তে শুরু করলেন। ভ্যান জনসনের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি পাশের বাংলোতে থাকেন।

আমি ওটা নিয়ে ভ্যানের সাথে দেখা করলাম। আমাকে দেখে তিনি দরজা খুলে দিলেন। আমি পরিচয় দিলাম, ভ্যান তখন এম জি এমের অন্যতম বড় তারকা।

আমি বললাম- এখানে দুটো পাতা আছে, খুব তাড়াতাড়ি শুটিং শুরু হবে।

 উনি বললেন- ধন্যবাদ, গত রাত্রে একটা সাংঘাতিক স্বপ্ন দেখলাম।

কী স্বপ্ন?

–মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার থেকে এক মস্তবড় তারকা নেমে আসছে। কিন্তু সংলাপ পাল্টে দেওয়া হচ্ছে, স্বভাবতই সে খুব ভয় পেয়ে গেছে। তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

আমি হাসলাম না, অহেতুক চিন্তা করবেন না, আপনার মুখের সংলাপ কিন্তু পাল্টানো হবে না।

উনি হাসলেন, তারপর বললেন- কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি তৈরি হয়ে আসছি।

আমি সেলজনিকের অফিসে ফিরে এলাম।

সব কিছু ঠিক আছে।

 ডেভিড বললেন– ভ্যানের সংলাপ পাল্টাতে হবে।

–ডেভিড, আমি এইমাত্র ওনার সাথে কথা বলে এসেছি। গতরাতে উনি ঘুমোত পারেননি, উনি এই একই আশংকা করছিলেন।

যা হবার হোক, এইভাবে শব্দ পাল্টাতেই হবে।

 উনি আমাকে নতুন নির্দেশনা দিলেন। আমি অত্যন্ত দ্রুত অফিসে চলে এলাম, নতুন করে চিত্রনাট্যটা লিখে আবার ডেভিডকে দেখালাম।

উনি বললেন ঠিক হয়েছে।

আমি ভ্যান জনসনের বাংলোতে ছুটে গেলাম, দরজা খুলে দিলেন উনি।

–আমি তৈরি।

 –ভ্যান, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে, ডেভিড মনে করছেন এটা আরও ভালো।

আমি নতুন পাতাগুলো ওনার হাতে তুলে দিলাম। ওনার মুখ সাদা হয়ে গেছে।

–সিডনি ওই স্বপ্নটা তাহলে সত্যি হল?

মাত্র দুটো কথা, আশা করি আপনার অসুবিধা হবে না।

 উনি বললেন- ঠিক আছে।

 আমি ডেভিডের অফিসে ফিরে গেলাম।

 উনি বললেন- না, আরেকটু পাল্টানো দরকার, এইভাবে সংলাপ পাল্টে দিতে হবে।

এইবার আমার চিৎকার করার পালা– ডেভিড, উনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। এইভাবে বার বার শব্দ পাল্টালে ব্যাপারটা মারাত্মক হয়ে উঠবে।

-উনি তো একজন অভিনেতা, তাই তো? তাহলে কেন উনি আপোস করবেন না।

অনিচ্ছুকভাবে আমি আমার অফিসে গিয়ে আবার নতুন করে লিখলাম।

 ভ্যান জনসনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা খুব খারাপ অভিজ্ঞতা।

আমি আবার বাংলোতে গেলাম, উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- কী? আবার কি শব্দ পাল্টাছেন নাকি?

–ভ্যান, মাত্র দুটো শব্দ। আমি কথা দিচ্ছি শেষবারের মতো, আর আপনাকে বিরক্ত করব না।

–দেখি আমার জন্য কী লিখে এনেছেন?

 শেষ পর্যন্ত আমি তাকে শান্ত করে বলেছিলাম- সেটে আসুন, তখন আলোচনা হবে।

আমি ডেভিডের অফিসে যাইনি, ডেভিডের সাথে বোঝাঁপড়া শেষ হয়েছে।

পরের দিন রিচার্ডের ফোন পেলাম। রিচার্ড জানিয়েছে, সে এখন বিয়ে করতে চলেছে।

আমার মনে উত্তেজনা, কে এই মেয়েটি?

 –জোয়ান, জোয়ান এবং রিচার্ড শিকাগোতে একসঙ্গে স্কুলে পড়ত।

কবে বিয়েটা হবে?

 –তিন সপ্তাহ পরে।

 –তখন তো আমি দেশের বাইরে থাকব, একটা ছবির শুটিং-এর জন্য।

–ঠিক আছে, পরে যখন তুমি এখানে ফিরে আসবে তখন না হয় ওর সঙ্গে দেখা হবে। আমরা তোমার ওখানে বেড়াতে যাব।

রিচার্ড এবং তার বউ লস এঞ্জেলসে এসেছিল একমাস পরে। তারা একে অন্যকে ভীষণ ভালোবাসে। আমরা ঘটনা সম্পৃক্ত একটি সপ্তাহ কাটিয়ে ছিলাম। তারপর ওরা চিকাগোতে ফিরে গেল।

পরের দিন সকালে আমি অফিসে এলাম। সেক্রেটারী বললেন মি. ডেভিড, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।

ডেভিড বললেন- সিডনি, কয়েকটা শুভ সংবাদ আছে।  

 কী?

–আমি এই ছবিটার নাম পাল্টে দিচ্ছি। আমরা একে আর  সাডেনলি ইটস স্প্রিং  নামে আর ডাকব না।

–তা হলে? কী নাম হবে?

–দ্য ব্যাচিলার অ্যান্ড দ্য ববি সক্সার।

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। উনি কি মজা করছেন?

–ডেভিড, কেউ পয়সা দিয়ে এমন একটা ছবি দেখতে আসবে কি?

শেষ পর্যন্ত আমার অনুমানটা মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

.

১৫.

 দ্যা ব্যাচিলার অ্যান্ড দ্যা ববি সক্সার  ছ-হাজার সিটযুক্ত রেডিও সিটি মিউজিক হলে প্রদর্শিত হল। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো মুভি থিয়েটার। পাঁচ সপ্তাহ ধরে এটি নিয়মিত অভিনীত হতে থাকে। থিয়েটার জগতের ইতিহাসে এত বড়ো সফলতা অন্য কোনো থিয়েটার পায়নি। ইংল্যান্ডে তখনও পর্যন্ত এটা দ্বিতীয় স্থানে ছিল। সামনে ছিল শুধু গন উইথ দ্য উইন্ড।

সমালোচকরা প্রশংসা বাক্যে ভরিয়ে দিয়েছিলেন।

এই নাটকের সব থেকে বড়ো সম্পদ এর কুশিলবরা। এজন্য পরিচালক নিজেই ছিলেন আনন্দিত এই মুভিটা বক্স অফিসে ব্লু রিবন অ্যাওয়ার্ড পেল। অস্কারের জন্য মনোনীত করা হল। আমি জানি না, কীভাবে এই আনন্দ উপভোগ করব। হলিউডের সিঁড়ি এবার আকাশ অভিসারী হয়ে উঠেছে।

আর একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে হল– অর্কিডস ফর ভার্জিনিয়া। এ-ডি, আর কেওর একজন পরিচালক এটি পছন্দ করলেন।

এর জন্য আমাকে পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল।

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ডোরেকে এগজিকিউটিভ প্রোডিউসারের পদে বসানো হল। তিনি হলেন আর কে ও-র প্রধান প্রোডাকসন ম্যানেজার।

উনি একদিন তার অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। অর্চিডস ফর ভার্জিনিয়ার জন্য অভিনন্দন জানাতে।

ডোরে বললেন- এ ডি আপনার চিত্রনাট্যটা পরিচালনা করতে চাইছে।

আমি বললাম- ভীষণ ভালো খবর।

 –আমি চাই না, স্টুডিও এটি কিনে নিক।

–কেন?

আমি এই গল্পটা নিয়ে ছবি করতে চাইছি না। এটা হল এমন এক পুরুষের গল্প, যে তার স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাসী, তাকে হত্যা করতে চাইছে।

-কিন্তু ডোরে

না, এই গল্পটা আপনাকে ফিরিয়ে দেব।

আমি বললাম ঠিক আছে নিয়ে আসুন।

 অন্য একটা পরিকল্পনা করতে হবে।

আমি জানতাম না, ডোরের এই অনুভূতি আমার জীবনটাকে পাল্টে দেবে। আমার এজেন্ট স্যামি বলল- এম জি এম-র সঙ্গে কথা হচ্ছে। দু-সপ্তাহের গ্যারান্টি হবে। তারা তোমাকে দিয়ে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস -এর চিত্রনাট্য লেখাতে চাইছে।

আমি এই বইটা কখনও পড়িনি। জেন অস্টিন, লেখিকার কথা মনে পড়ছে। এক অসাধারণ ছোঁয়া আছে ওই উপন্যাসের মধ্যে।

এম জি এম হলিউডের সব থেকে নামী সংস্থা।

তারা বিশ্ব পরিচিত সিনেমা উপহার দিয়েছে। গন উইথ দ্য উইন্ড, মিট মী ইন সেন্ট লুইস, দ্যা উইজার্ড আফ ওজ, দ্য ফিলাডেলফিয়া স্টোরি, ইত্যাদি।

উনত্রিশ বছর বয়স। এম. জি-এম-এর সাম্রজ্যে প্রবেশ করলাম। অবাক হয়ে গেলাম। এম জি এম নিজেই একটা ছোটো শহর। নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আছে। জল এবং খাদ্যের অপর্যাপ্ত জোগান।

স্টুডিওটা মস্ত বড়ো। সেখানে সপ্তাহে একটা ছবির শুটিং শেষ হতে পারে। ১৫০ জন লেখক আছেন। এম জি এম-র সঙ্গে চুক্তি করা আছে তাদের। তাদের মধ্যে বিখ্যাত উপন্যাসিক এবং চিত্রনাট্যকাররা আছেন।

প্রথম দিন গিয়ে আমি বিরাট হলে বসে লাঞ্চ খেলাম, আমাকে রাইটার্স টেবিলে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় দশ-বারোজন লেখকের ভিড় জমে গেছে। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করছেন।

 আমাকে একটা ছোট্ট অফিস দেওয়া হল। একজন সেক্রেটারি দেওয়া হল।

আমরা প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস নিয়ে আলোচনা করব। আমি মেয়েটিকে বলেছিলাম। তুমি কি এই উপন্যাসের একটা কপি আমার জন্য আনতে পারবে? আমি এটা আদ্যোপান্ত পড়তে চাই।

মেয়েটি একটা স্টুডিও নাম্বারে ফোন করে আমার কথা বলল।

 তিরিশ মিনিটের মধ্যে বইটা আমার টেবিলে চলে এল।

স্টুডিওর ব্যবস্থা সম্পর্কে আর কী বলব। প্রত্যেক স্টুডিওতে একটা গ্রন্থাগার আছে। গবেষণার বিভাগ, কুশিলবদের জন্য আলাদা বিভাগ, সেট কেমন হবে, তার জন্য একটা বিভাগ, সিনেমাটোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট, এছাড়া ব্যবসায়িক সংক্রান্ত আলাদা বিভাগ।

পরের দিন সকালবেলা, স্যামি আমার অফিসে এসে বলল- তুমি কী করছ?

–আমি কাজটা শুরু করেছি।

–আর্থার ফ্রেড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছেন।

–কেন?

–উনিই বলবেন।

আর্থার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিলাম। তিনি ইনসিওরেন্স সেলসম্যান হিসেবে তাঁর পেশা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে নামকরা সংগীত রচয়িতা হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত অনেকগুলি গানের সুরও দিয়েছেন। যেমন, দ্য ব্রডওয়ে মেলোডি, গুডমর্নিং, অন আ সানডে আফটারনুন ইত্যাদি।

লুইসের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। লুইসের মাধ্যমে তিনি প্রযোজক হয়ে উঠেছেন।

ফ্রেড সম্পর্কে অনেক গুজব বাতাসে ভাসছে। তিনি নাকি কোনো বিষয়ে আদ্যোপান্ত না জেনে তার মধ্যে প্রবেশ করতে চান না।

প্রথম দিনের অভিনয়। ফ্রেডকে আমন্ত্রণ জানানো হল।

 আর একবার ফ্রেড আমার কাছে এসেছিলেন।

স্যামি এবং আমি হলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলাম। আর্থার ফ্রেডের অফিসে যেতে হবে। এটা তিনতলায় অবস্থিত।

ডেস্কের ওধারে ফ্রেড বসেছিলেন। চেহারাটা মোটামুটি ভালো পঞ্চাশ বছর বয়স ছাড়িয়ে গেছে। মাথায় ধূসর পাতলা চুল।

-সেলডন। বসুন।

 আমি বসলাম।

–আমার একটা সমস্যা হয়েছে। আমি একটা স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়েছি। কিন্তু কোন ভূমিকায় কে অবতীর্ণ হবেন, বুঝতে পারছি না। প্রত্যেকে আমার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে। স্ক্রিপ্টের মধ্যে সংগীতের ছোঁয়া আছে। লেখাটাও খুব ভালো হয়েছে। তবে প্লটটা ঠিক হয়নি। প্লটটা অত্যন্ত জটিল। একটু পরিবর্তন করতে হবে। আপনি কি সাহায্য করবেন?

-হ্যাঁ, আমি এখন প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডাইস নিয়ে কাজ করছি।

 ফ্রেড বললেন- এটাও আপনার খারাপ লাগবে না।

-কী নাম ছবিটার?

–ইস্টার প্যারাডে। আপনি আরভিন বার্লিনের সাথে কাজ করবেন?

এটা এক সুন্দর মুহূর্ত। এম জি এম-এ আমার তৃতীয় দিন। কিংবদন্তী মহানায়ক আরভিন বার্লিনের সাহচর্যে আসার সুযোগ পেলাম।

আমি বললাম এই কাজটা করতে পারলে নিজেকে ধন্য বলে মনে করব।

জুডি গারল্যান্ড এবং জেনি কেলি প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।

আমি মুখের অভিব্যক্তি না পাল্টে বললাম ঠিক আছে, এটাও ভালো খবর।

–আমি চাইছি, এখনই উপস্থাপনটা শুরু হোক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

–ঠিক আছে তাই করা হবে।

–এই চিত্রনাট্যটা ভালো করে দেখুন। কোথায় কোথায় পরিবর্তন হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করবেন। আগামীকাল আরভিনের সাথে আপনার বৈঠক হবে।

আমি ফ্রেডের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।

ইস্টার প্যারাডের আসল চিত্রনাট্যটা লিখেছেন আলবার্ট এবং ফ্রান্সিস। এই ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট সুনাম আছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে একটা সুন্দর জগৎ তৈরি করেছেন। পরবর্তীকালে তারা ব্রডওয়ের বিখ্যাত নাটক, দ্য ডায়েরি অফ অ্যানা ফ্রাঙ্ক-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।

কিন্তু ফ্রেডের মন্তব্য সঠিক ছিল। এই চিত্রনাট্যের মধ্যে একটু কৌতুকের ছোঁয়া দরকার। তা না হলে সাধারণ দর্শকদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে।

তারা আর এই থিয়েটারটি দেখার জন্য ভিড় জমাবেন না। 

তবে কাজটা ক্লান্তিকর। কারও লেখার ওপর কারুকাজ করা। এটা কি খুব সহজ? আমি নতুন করে ভাবনা চিন্তা করা শুরু করলাম।

পরদিন সকালবেলা, আর্থার ফ্রেডের অফিসে আমার ডাক পড়ল। সেখানে এক খর্বাকৃতি মানুষ বসেছিলেন। চোখের তারায় ঔৎসুক্য।

–ইনি হলেন আরভিন বার্লিন।

এক মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে আনন্দের শিহরণ। এই ভদ্রলোক আলেকজান্ডার স র‍্যাগটাইম ব্যান্ড-এর মতো অসাধারণ গল্প লিখেছেন! গড ব্লেস আমেরিকা, দেয়ার’স নো বিজনেস লাইক শো বিজনেস, পুত্তিন টপ হ্যাট- সব তার লেখা?

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। আমি নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি আমার হাতে হাত রাখলেন– এখন থেকে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, তিনি উঁচু গলায় কথা বলেছিলেন।

 আমি নিউইয়র্কে আমার অভিজ্ঞতার’কথা বললাম না। সেখানে আমি গান রচয়িতা হিসেবে ওনাকে হারিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা হাতে হাত রেখেই কাজ করব। আমি কেন অযথা ওনাকে চিন্তিত করে তুলব।

অনেকের কথাই মনে হচ্ছে। আরভি বার্লিনের মতো স্বনামধন্য মানুষ মাঝে মধ্যেই আমার অফিসে আসছেন।

বয়স ষাট বছর হলে কী হবে, তার চোখে মুখে এক কিশোরের চঞ্চলতা। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। রাইটার্স টেবিলে লাঞ্চে যোগ দিচ্ছি। অন্যান্য চিত্রনাট্যকাররা কে কী ভাবনা-চিন্তা করছেন তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। একটার পর একটা শু্যটিঙের কাজ এগিয়ে চলেছে। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এসে যোগ দিয়েছেন।

সাউন্ড স্টেজের ব্যাপারে অনেকটা জ্ঞান অর্জন করলাম। এতদিনে আমি বুঝতে পারছি কীভাবে একটা চিত্রনাট্যকে সিনেমায় রূপান্তরিত করা হয়।

ইস্টার প্যারাডের চিত্রনাট্য লেখাটা শেষ হল। একদিন স্যামি আমার অফিসে এসে প্রবেশ করলেন।

–সিডনি তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে। এম জি এম তোমার সঙ্গে দীর্ঘকালীন চুক্তি করতে চলেছে।

আনন্দে আমি আত্মহারা– তা হলে? আমার স্বপ্ন সফল হল।

-হ্যাঁ, অনেক দিন ধরেই আমি মনে মনে ভেবেছিলাম। হলিউডের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করব।

–এখনও পর্যন্ত চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতে পারিনি, তার মুখে হাসি, তবে এটা হবেই, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আমি আবার উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাম। আমি আমার চিত্রনাট্যটা আর্থার ফ্রেডের হাতে তুলে দিলাম। তার প্রতিক্রিয়া শোনবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে আছি। কিছুক্ষণের নীরবতা, তার মানে ওনার এটা পছন্দ হয়নি।

আর একটা দিন চলে গেল, আমি চিত্রনাট্যটা আরও একবার পড়লাম। হ্যাঁ, নিউইয়র্কের সমালোচক ঠিকই মন্তব্য করেছেন, আমার মধ্যে কোনো সুপ্ত প্রতিভা নেই। সংলাপগুলো এত খারাপ যে উচ্চারণ করা সম্ভব হবে না।

আর্থার ফ্রেড বোধহয় আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না।

এক সপ্তাহ কেটে গেছে, আর্থার ফ্রেডের সেক্রেটারি আমাকে ফোন করলেন।

–মিঃ ফ্রেড আপনার সাথে আগামীকাল অফিসে দেখা করতে চাইছেন, সেখানে জুডি গারল্যান্ড এবং জেনি কেলি আসবেন। ঠিক সকাল দশটায়।

আমার মনে একটা অদ্ভুত আতঙ্কের শিহরণ। কেন ওনাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে, সেই রহস্যাটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তার মানে? আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? সেই জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হবে।

মিটিংটাতে আমি অবশ্যই যাব।

সেই রাতে ঘুমোতে দেরি হয়েছিল। রাতে স্বপ্নের মধ্যে আর্থার ফ্রেডকে দেখতে পেলাম, আমার অত্যন্ত বাজে লেখাটা নিয়ে তিনি চিৎকার করছেন।

সকাল হয়েছে, আমি আবার সিদ্ধান্ত নিলাম সেখানে যাব, কিন্তু কোনো কথা বলব না। তাদের সমালোচনা শান্তভাবে শুনবো। শান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসব। এক ঘণ্টা আগেই আমার প্রস্তুতি শুরু হল।

সকাল দশটা। আমি আর্থারের অফিসে পৌঁছে গেছি। তিনি ডেস্কের ওপাশে বসেছিলেন, তিনি বললেন- লেখাটা অসাধারণ হয়েছে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, এটা কি ব্যঙ্গাত্মক উক্তি?

জুডি গারলান্ড এসে প্রবেশ করলেন। তিনি বোধহয় আমার পুরোনো বান্ধবীর মতো, মিকি রুমির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অ্যান্ডি হার্ডিতে। এবার ডরোথি গেলের পালা।

জুডি অনেকদিন ধরেই এম জি এমের সাথে কাজ করছেন, বলা যেতে পারে একেবারে কিশোরীবেলা থেকে। অনেকগুলো ছবিতে অসামান্য অভিনয় করেছেন। পনেরো বছর বয়সে অভিনয় জগতে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। এখন অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ন বছরে উনিশটা ছবিতে অভিনয় করেছেন।

তবে তাঁর সম্পর্কে নানা গুজব বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তিনি নাকি ড্রাগে অভ্যস্ত। রাত্রিতে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমোতে যান। একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। আমি জানি না এই ঘটনাটা কেন ঘটেছিল।

আমাকে উনি চিনতেন, আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন- হ্যালো সিডনি, আপনার চিত্রনাট্য আমার ভালো লেগেছে।

এক মুহূর্তের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। শুধু ধন্যবাদ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলাম।

আর্থার ফ্রেড বললেন- হ্যাঁ, সত্যি একটা অসামান্য রচনা।

 দরজা খুলে গেল, জেনি ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। জেনি আমার আরেক পরিচিত মুখ। অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন। অনেক দিন ধরেই তাকে আমি চিনি।

তিনি এগিয়ে এসে জুডি এবং আর্থারের দিকে তাকালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এই যে লেখক মশাই, আপনার জন্য একটা ভালো কাজ আছে।

আর্থার ফ্রেড প্রশ্ন করলেন– কাজটা কি আপনি করতে পারবেন?

আমি তখন ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি বলার চেষ্টা করলাম- কী ধরনের কাজ?

 জুডি বললেন- এটা আমার জন্য করতে হবে।

জেনি বললেন- আমার জন্যেও বলা যেতে পারে।

আর্থার ফ্রেডের মুখে হাসি একটা ছোট্ট মিটিং সারতে হবে, সোমবার থেকে শুটিং শুরু হবে।

মিটিং শেষ হয়ে গেল, আমি অফিসে ফিরে এলাম, জিনিসপত্র আর গোছাতে হবে না।

আমার সেক্রেটারি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন– কী হয়েছে আমি কি জানতে পারি, স্যার?

ঘটনা পরম্পরা আমার মন পরিবর্তনে বাধ্য করেছে।

শুক্রবার, আর্থার ফ্রেড আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। উনি বললেন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি বললাম- কী সমস্যা? চিত্রনাট্যে কোনো অসুবিধা?

না। জেনি কেলি, ভলিবল খেলতে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে পড়ে আছেন।

 –তাহলে শ্যুটিংটা কি পরে হবে?

–আমি আপনার স্ক্রিপ্টটা ফ্রেডের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। উনি গতবছর অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এখনও এই ব্যাপারে সমান উৎসাহী।

আমি মাথা নাড়লাম- ফ্রেডের বয়স আটচল্লিশ বছর, জুডি পঁচিশ বছর, দর্শক কখনওই এই জুটিকে মেনে নেবে না। এই জুটি কখনওই সফল হবে না।

উনি বললেন দেখা যাক ফ্রেড কী বলেন।

ফ্রেড হ্যাঁ বলেছিলেন। তার মানে আবার একটা নতুন উন্মাদনা। তার সাথে আর্থার ফ্রেডের অফিসে দেখা হল পরের দিন। তিনি বললেন, স্ক্রিপ্টটা চমৎকার হয়েছে, সংলাপগুলো মন ভরিয়ে দেয়। মন দিয়ে কাজ করতে হবে।

আমি ওনার দিকে তাকালাম, কে বলবে ওনার আটচল্লিশ বছর বয়েস, দেখে পঁচিশের বেশি মনে হয় না। পেশার প্রতি অসামান্য আনুগত্য আছে ওনার, জিনজার রজার্সের সাথে একটা বইতে অসামান্য অভিনয় করেছেন।

সোমবার থেকে কাজটা শুরু হল। ইস্টার প্যারোডের প্রথম শু্যটিঙের দিন। ফ্রেড একেবারে কোণের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার প্রথম শটটা নেওয়া হবে। অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর ছুটে এলেন, জুডিকে বললেন মিস গারল্যান্ড এবার আপনি তৈরি তো?

জুডি বললেন- না, আরেকটু বাকি আছে। গল্পটা তাড়াতাড়ি শুনে নিতে হবে।

আমি গল্প বলা শুরু করলাম। আমি জানি শ্যুটিং করার সময় কত টাকা নষ্ট হয়। এক এক মুহূর্তের দাম আকাশছোঁয়া।

আমি বলেছিলাম- জুডি গল্পটা পরে শেষ করলে কেমন হয়? এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার?

-না, গল্পের শেষটা না জানা অবধি আমি অভিনয় করতে পারব না।

জুডি, আপনি কি এই ছবিতে অভিনয় করতে চাইছেন না?

জুডি গারল্যান্ড বললেন না।

-কেন?

 উনি কিছু একটা ভেবে বললেন আমি কী করে ফ্রেডের সাথে  খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করব? আপনার চিত্রনাট্য অনুসারে তাকে চুমু খাবার কথা। কিন্তু যে মানুষকে আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি তাকে চুমু দেব কীভাবে?

আমরা জানতাম এই দুজন সুপারস্টার পরস্পরের পরিচিত। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম জুলির স্বভাবটা কেমন।

আমি বললাম- সঙ্গে আসুন। আমি জুডির হাত ধরে স্টেজের এককোণে চলে গেলাম। সেখানে সকলেই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম- ফ্রেড, ইনি হলেন জুডি গারল্যান্ড।

উনি হাসলেন, আমি আপনার অভিনয়ের মস্তবড়ো ফ্যান।

জুডিও বললেন আমিও আপনার অভিনয় ভালোবাসি।

এবার ডিরেকটার চার্ক ওয়ালটার এসে গেছেন। উনি বললেন, আপনারা ঠিক জায়গায় বসে পড়ুন।

এভাবেই একটা সমস্যার চটজলদি সমাধান হল। ইস্টার প্যারাডের শ্যুটিং শুরু হল।

একদিন আমি রিহার্সাল হলে পৌঁছে গেছি, একা একা ফ্রেড নতুন নাচের মহড়া দিচ্ছে। ভারী সুন্দর কোমর ঘোরাচ্ছেন। উনি আমাকে দেখতে পাননি। এক মুহর্তের জন্য থামলেন, আমি ওনার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, ফ্রেড, এভাবে নাচতে হবে।

উনি বললেন- ঠিক আছে। আমি ওইভাবে নাচটা করার চেষ্টা করব।

শ্যুটিং শুরু হতে চলেছে। আর্থার ফ্রেড জুল নামে এক অভিনেতাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি হাস্যকৌতুক জগতের রাজা। ওনার জন্য একটা ছোট্ট ভূমিকা ছিল। এবার ওনার কাজ শুরু হবে, আমার হার্নিয়াটা আবার বেড়ে পড়ল, আমি বিছানাতে শুয়ে থাকতে বাধ্য হলাম।

ফোন বেজেই চলেছে, জুলসের সিডনি আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

—তিনদিন বিছানাতে শুয়ে থাকতে হবে।

–না, আমি এখনই যাব।

–অসম্ভব যন্ত্রণা। আমি কথা বলতে পারছি না জুলস, এখন আসবেন না, আমার শরীর ভালো নেই।

-আপনার সেক্রেটারী বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমি আসছি।

আমি আরেকটা ব্যথা কমাবার ট্যাবলেট খেতে বাধ্য হলাম, দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছি।

পনেরো মিনিট কেটে গেছে, জুলস আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন– আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।

–নিউইয়র্ক থেকে আমাকে আনা হয়েছে, আমাকে একটা ছোট্ট ভূমিকাতে অভিনয় করতে হবে। কিছু একটা করার চেষ্টা করুন।

এটাই হল একটা সমস্যা, এত যন্ত্রণা, আমি কথা বলতে পারছি না।

 উনি বললেন আমার শ্যুটিং কিন্তু আগামীকাল।

আমি চোখ বন্ধ করলাম, ওনার জন্য যে ভূমিকাটা তৈরি করেছিলাম সেটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। এমন একজন মানুষ যে নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন।

উনি বললেন- এই দৃশ্যটার মধ্যে কিছুই নেই।

-হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম জুলস উত্তরটা খুবই সোজা। কয়েকটা শব্দ পাল্টাতে হবে। শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রটা সকলের মনে দাগ কেটেছিল।

ইস্টার প্যারাডে বক্স অফিসে বিজয় পতাকা উড্রীন করে। ব্লু রিবন অ্যাওয়ার্ড পায়। ডব্লু জি এ স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল, ১৯৪৮ সালের সেরা আমেরিকান চলচ্চিত্র হিসেবে। আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়, এর সাথে পুরস্কৃত করা হয় ফ্রান্সেস গুডরিজ এবং অ্যালবার্ট হকার্টকে।

এম জি এম যতগুলো সংগীত সমৃদ্ধ ছবি তৈরি করেছিলেন, তার তালিকায় ইস্টার প্যারাডের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। প্রত্যেক বছর ইস্টার উৎসবে এই সিনেমাটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়। গত সাতান্ন বছর ধরে এমন ঘটনাই ঘটে আসছে।