২. গ্ৰেহাউন্ড বাস স্টেশন

০৬.

নিউইয়র্ক, ১৯৩৬- এর আগে আমি কখনও বাস ডিপোতে প্রবেশ করিনি। গ্ৰেহাউন্ড বাস স্টেশন, উত্তেজনায় ভরপুর। বাসটা বিরাট, ওয়াশরুম আছে। আরামদায়ক সিট। সাড়ে চারদিনের লম্বা সফর। সফরটা ক্লান্তিকর। কিন্তু আমি আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলাম।

বাস স্টেশনে পৌঁছে গেলাম, নিউইয়র্ক, পকেটে তিরিশ ডলার। এর বেশি মা-বাবা দেবে কেমন করে?

আমি ওয়াই এম. সি. এ-র ম্যানেজারকে ফোন করে একটা ঘর বুক করলাম। ঘরটা ছোটো। সপ্তাহে চার ডলার করে ভাড়া লাগবে। আমি জানি, তিরিশ ডলার নিয়ে বেশিদিন লড়াই করা যাবে না।

আমি ওয়াই এম সি এ-র ম্যানেজারকে বলেছিলাম একটা চাকরি দিতে পারেন?

–আমাদের অতিথিদের জন্য একটা চাকরি পরিষেবা আছে।

বাঃ, সেটা কি এখন পাওয়া যাবে?

উনি একটা কাগজ তুলে আনলেন। বললেন– আর. কে, ও জেফারসন থিয়েটারে একটা কাজ আছে। তুমি কি করবে? ১৪, স্ট্রিটে।

–আমায় যেতেই হবে। আমি বললাম।

 ম্যানেজার একটুকরো কাগজের ওপর কী সব লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন এটা নিয়ে কাল সকালে থিয়েটারে চলে যাও।

এই প্রথমবার আমি নিউইয়র্কে এসেছি, বেশিক্ষণ সময় কাটায়নি। অথচ একটা চাকরি। পেতেই হবে।

চাকরিটা পেয়ে গেলাম। বাবা মাকে খবরটা দিলাম।

মা বলল- ভীষণ ভালো লাগছে। তুই সফল হয়ে ফিরিস বাবা।

প্রথম সন্ধ্যেটা আমি নিউইয়র্ক শহর আবিষ্কারে মেতে উঠলাম। হ্যাঁ, এই শহরের একটা আলাদা জাদু আছে।

সব কিছুই মস্ত বড়ড়া, দু-পাশের বাড়ি, মার্কেট, রাস্তাঘাট, নিয়ন আলো, ট্রাফিক, এমন কী মানুষজন পর্যন্ত।

আর. কে, ও জেফারসন থিয়েটার, ১৪ স্ট্রিট, একটা পুরোনো দোতলা বাড়িতে অবস্থিত। আর কে, ও, থিয়েটারের অংশ।

আমি ৩৮ নম্বর ব্লকে চলে গেলাম। কাগজটা থিয়েটার ম্যানেজারের হাতে দিলাম। উনি তাকিয়ে বললেন- এ ধরনের কাজ কখনও করেছ?

-না, স্যার।

–ঠিক আছে। হাঁটতে পারবে?

–হ্যাঁ, স্যার।

ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে পারবে?

—হ্যাঁ, স্যার।

–তাহলে তুমি এই কাজটা করতে পারবে। প্রতি সপ্তাহে ১৪ ডলার করে পাবে। ছদিন কাজ করতে হবে। তোমার কাজ শুরু হবে বিকেল ৪-২০ থেকে। শেষ হবে মাঝরাতে।

–ঠিক আছে।

তার মানে আমি সারাদিন কাজ করতে পারব। গান লিখতে পারব। বিভিন্ন সংগীত পরিচালকদের দরজায় ঘুরতে পারব।

–ওই ঘরে চলে যাও। দেখো কোনো ইউনিফর্ম পাও কিনা।

আমি একটা ইউনিফর্ম পাওয়ার চেষ্টা করলাম।

ম্যানেজার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ঠিক আছে, ব্যালকনিতে চোখ রাখো।

–কোন ব্যালকনি?

 –এখানেই তোমার কাজ কাল থেকে শুরু হবে।

কাল থেকে আমি সংগীত রচয়িতা হিসেবে আমার নতুন জীবন শুরু করব।

 ব্রিল বিল্ডিং, ১৬১৯ ব্রডওয়েতে অবস্থিত। ৪৯ নম্বর স্ট্রিটে। সেখান থেকেই অভিযান শুরু করলে কেমন হয়?

একটার পর একটা গান ভেসে আসছে, রাস্তায় দরজায় যে সমস্ত নাম ঝুলছে সেগুলো চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। সংগীত জগতের বিশিষ্ট মানুষদের অফিস এখানেই। এখান থেকেই একের পর এক সংগীত প্রতিভার জন্ম হয়েছে। কত নাম করব? কোলে পোরটার, আরভিন বারলিন, রিচার্ড রজারস, জর্জ এবং ইরা গাউইন, জেরম কার্ন– আরও কত নাম।

আমি টি. বি. হার্মস অফিসে পৌঁছে গিয়ে ডেস্কে বসে থাকা লোকটিকে বললাম সুপ্রভাত, আমি সিডনি সেলডন।

কী করব আপনার জন্য?

 আমি  মাই সাইলেন্ট সেলফ  নামে একটা গান লিখেছি। আপনারা এই গানটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।

–হ্যাঁ, ওনার মুখে একটু হাসি, মনে পড়েছে। এখন কি আর রাজী নন?

–না, এই গানটা অনেকবার বেতারে প্রচারিত হয়েছে। হোরেস হেইডট এই গানটা অনেকবার বাজিয়েছেন।

নতুন কিছু আছে?

–হ্যাঁ। কাল সকালে আসব।

তারপর শুরু হল নতুন কাজ। মানুষজনকে আলো ফেলে সিট দেখাতে হচ্ছে। ম্যানেজার ঠিকই বলেছিলেন, এই কাজটা যে কেউ করতে পারে। একটাই ব্যাপার খুব খারাপ লাগে। বারবার একই সিনেমা দেখতে হবে। যখন আমার কাজ শেষ হয়ে যেত, আমি পেছনের সিটে বসে থাকতাম। সবার দিকে নজর রাখতাম।

একের পর এক সিনেমা দেখছি। মাথা ঝিমঝিম করছে। মধ্যরাত। কাজ শেষ হয়ে গেছে। হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। ছোট্ট ঘরটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। জানি, একদিন এই ঘরটা একটা মস্ত বড়ো রাজপ্রাসাদে রূপান্তরিত হবে। আমি গান লিখব, সেই গান মানুষ পাগলের মতো ভালোবাসবে।

সকালবেলা উঠে টি. বি. হার্মসে যাব। কিন্তু একটাই প্রশ্ন, ওরা আমার কোন গানটা আগে প্রকাশ করবে? আমি ইতিমধ্যে অনেকগুলো গান লিখে ফেলেছি। এ হ্যান্ডফুল অফ স্টারস, হোয়েন লাভ হ্যাঁজ গন ,  দ্য ঘোস্ট অফ মাই লাভ  আরও কত কী?

পরের দিন সকাল আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। টি. বি. হার্মস পাবলিশিং কোম্পানির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খুলল নটার সময়। মিঃ টাস্কার এলেন।

তিনি আমার হাতের বিরাট খামটা দেখে বললেন- কয়েকটা গান এনেছেন কি?

-হ্যাঁ, স্যার।

তিনি অফিসে বসলেন। আমি খামটা ওনার হাতে তুলে দিলাম।

উনি বললেন- এখানে অপেক্ষা করতে হবে না। সুযোগ পেলে পড়ে দেখব। কালকে আসুন, কেমন?

আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে।

 আমি জানি, আর চব্বিশ ঘণ্টা বাদে আমার নতুন উত্তরণ হবে।

ইউনিফর্ম পরে আর. কে. ও জেফারসনে বসে আছি। ম্যানেজারকে ব্যালকনিতে দেখা গেল। অনেকে হাসাহাসি করছে। শেষ রোতে এক তরুণ তরুণী বসে আছে। দেখলাম, তারা আলো আঁধারে অসভ্য খেলা শুরু করেছে। আমি উদাসীনতার ভান করে সামনে থেকে চলে গেলাম।

সকাল আটটা, মিঃ টাস্কার একটু আগে এসেছেন। দরজা খুললেন সুপ্রভাত সেলডন।

মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছি। অফিসের ভেতরে চলে গেলাম।

–মিঃ টাস্কার, গানগুলো পড়েছেন কি?

উনি বললেন- অসাধারণ লেখা।

 আমার মুখে উজ্জ্বল আলো, এবার উনি কী বলবেন?

আমি জানতে চাইলাম কোনটা আপনার ভালো লেগেছে?

দুর্ভাগ্য, এখন এসব গানের কোনো প্রয়োজন নেই।

মনটা খারাপ হয়ে গেল কিন্তু একটাও কি ভালো লাগল না?

–নতুন কিছু আছে কি? তিনি আমার হাতে খামটা তুলে দিলেন।

এইভাবেই আলোচনাটা শেষ হয়ে গেল। আমার মনে আশার সঞ্চারণ- একবার যখন শুরু হয়েছে, আমি এর শেষ না দেখে ছাড়ব না।

আমি অন্যান্য প্রকাশকের দরজায় ঘুরতে শুরু করলাম। সকলেই জানতে চাইছেন, আগে কোনো গান কি প্রকাশিত হয়েছে?

-না, স্যার।

–আমরা নতুন কোনো সংগীত রচয়িতাকে সুযোগ দিই না। কয়েকটা প্রকাশিত হলে তবেই আসবেন, কেমন?

কী করে আমি গান প্রকাশ করব? কেউ যদি আমাকে পাত্তা না দেয়? সপ্তাহ কেটে গেল। থিয়েটারে সময় যাচ্ছে। অবসর সময়ে গান লিখছি।

অসাধারণ কতগুলো ছবি দেখে ফেললাম। সান ফ্রানসিসকো, মাই ম্যান গডফ্রে, শ্যাল উই ড্যান্স? ইত্যাদি।

টাকা ক্রমশ কমে আসছে। নাতালিয়া কুড়ি ডলারের চেক পাঠিয়ে ছিল। সেটা ফেরত দিয়েছি। আমি জানি, বাড়ির কী পরিস্থিতি। বাবা কাজ করছে না। সাংসারিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আমি এখন কেন আমার নিজের কথা চিন্তা করছি? নিজেকে অসম্ভব স্বার্থপর বলে মনে হয়। নতুন একগোছ গান তৈরি হয়েছে। আবার প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরলাম। তারা একই রকম কথা বলল- কোনো গান প্রকাশিত হলে তবেই আসবেন। নতুনদের আমরা সুযোগ দিই না।

আমাকে তখন হতাশা গ্রাস করেছে। সবকিছুই নিরাশ বলে মনে হচ্ছে। আমি কি সারাজীবন এইভাবে হাতড়ে মরব নাকি? কেউ আমার গান শুনতে চাইবে না?

১৯৩৬ সালের ২ নভেম্বর। আমি আমার মা বাবাকে একখানা চিঠি লিখেছিলাম। সেই চিঠির অংশবিশেষ এখানে তুলে দেওয়া হল।

-তোমাদের সুখী করার জন্য আমি প্রাণপাত পরিশ্রম করছি। কিন্তু মনে হচ্ছে, আমার সুখ বুঝি একটা অলৌকিক ঘটনা। আমি কখনও সুখকে করায়ত্ত করতে পারব না। বাতাসের মধ্যে সুখ ভেসে চলেছে, সমুদ্রের ওপর দিয়ে, সবুজ প্রান্তরের ভেতর দিয়ে, গাছ এবং ছোটো নদীর মধ্যে দিয়ে, কৃষিক্ষেত্র এবং বৃষ্টিস্নাত পর্বতচূড়ার ওপর দিয়ে। প্রথমে আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। তারপর সে আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভালো লাগছে না কোনোকিছু। হায় ঈশ্বর, কোথায় গেল আমার ভাগ্যের সেই বাতাস, যা আমাকে উদ্দীপ্ত করবে।

.

পরদিন সকালবেলা, ওয়াই এম সি এ লবিতে আমার মতো একজনকে দেখতে পেলাম। এক মনে কী যেন লিখে চলেছে। সে মনে মনে গুনগুন করে কী যেন গাইছে, হয়তো গান লিখছে।

আমি প্রশ্ন করলাম– তুমি কি গান লেখো?

সে বলল- হ্যাঁ।

–আমিও লিখি। আমি সিডনি সেলডন।

ও হাত বাড়িয়ে বলল- আমার নাম সিডনি রোসেনথাল।

 একটা দীর্ঘ বন্ধুত্বের সূত্রপাত হল। সকালটা আমরা গানে গানে ভুবন ভরিয়ে দিলাম।

পরের দিন সকালবেলা, কাজ শুরু হবে, থিয়েটারের ম্যানেজার আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন- তুমি বাকারের পোশাক পরো। বার্কার না আসা পর্যন্ত তার জায়গায় তোমাকে কাজ করতে হবে। সারাদিন কাজ করবে। তোমাকে থিয়েটারের এখানে ওখানে ঘুরতে হবে। বলবে, এখানে আর সিট নেই। তাড়াতাড়ি আসুন। তোমাকে আরও বেশি পয়সা দেব।

আমার মনে আনন্দ। হ্যাঁ, বেশি টাকা আসবে।

কত পাব?

–প্রতি সপ্তাহে ১৫-৪০।

তার মানে এক ডলার করে মাইনে বৃদ্ধি পেল।

ইউনিফর্ম পরলাম। রাশিয়ান আর্মি জেনারেল বলে মনে হল। বার্কারের কাজের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। মাঝে মধ্যে চিৎকার করছি এক্ষুনি বসার জায়গা পাবেন, কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে না।

সুন্দর কণ্ঠস্বর আনার চেষ্টা করলাম, বললাম– একই পয়সায় দু-দুটো বই। একজন মানুষ কি দুবার বাঁচতে পারে? আসুন-আসুন-দেখুন। এমন একটা স্মৃতি আপনারা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। না, অপেক্ষা করতে হবে না। টিকিট প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

আসল বার্কার কোনো দিন এইভাবে স্বরোৎক্ষেপণের মধ্যেমে মাদকতার সৃষ্টি করেনি। আমি নতুন একটা জগতের জন্ম দিলাম। এখনও সময় আছে। সুযোগ পেলেই প্রকাশকদের দরজাতে গিয়ে হাজির হই। লোকে আমার গান শুনবে না? সিডনি রোসেনথাল আর আমি একসঙ্গে কয়েকটা গান গাইলাম। অনেক প্রশংসা পেলাম। কিন্তু স্বপ্ন সফল হল না।

সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে। দশ সেন্ট পকেটে পড়ে আছে। থিয়েটার থেকে ব্রিল বিল্ডিং-এ গেলাম। ভাবলাম, কী খাব? পাঁচ সেন্ট দিয়ে হটডগ, নাকি কোকাকোলা? অনেকটা হাঁটতে হবে। নাঃ, শুধু হটডগ খেলে হয়।

কয়েকদিন কেটে গেছে। বার্কারের কাজ এগিয়ে চলেছে। মনটা নানা কারণে খারাপ হয়ে গেছে।

আমি তখন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে লোক জড়ো করছি। বলছি কনকোয়েস্ট ছবিটা দেখতেই হবে। গ্রেটা গার্বো আর চালর্স বয়ারের অসাধারণ অভিনয়। এর পাশাপাশি আর একটা ছবি দেখতে পাবেন। নাথিং সাক্রেড। সেখানেও অনেক ভালো অভিনেতারা আছেন। আসুন-আসুন, আপনি যদি প্রেমিক হয়ে থাকেন, প্রেম কী, তা জানতে হলে দেখতে আসুন। বেশি খরচ হবে না– ৩৫ সেন্ট। এত সহজে দুটো ছবি। তাড়াতাড়ি করুন। তাড়াতাড়ি করুন।

হুড়মুড় করে দর্শকরা এল। পরের ছবির জন্য আমি আরও মজা করার চেষ্টা করলাম।

পরের সপ্তাহে একজন অদ্ভুত লোক আমার দিকে এগিয়ে এল। সে বলল- চিকাগো থেকে যে কুত্তার বাচ্চাটা এসেছে, সে কোথায়?

লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে আমি বললাম কেন?

–আর. কে. ও থিয়েটারের ম্যানেজার বলেছে, এখন থেকে তাকে সবাই যেন নকল করে। সে বেজন্মাটা মোহমায়ার সৃষ্টি করেছে।

আমি কোনরকমে বলি- লোকটা কোথায় চলে গেছে, সে এলে আপনার কথা বলব। তারপর পুরোনো ঢঙে চিৎকার করতে শুরু করি, ভেতরে গেলে এখনই বসার জায়গা পাবেন। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না… দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না…।

আবার শুরু হল আমার অভিযান। একের পর এক প্রকাশকের দরজায় ঘুরছি। বিকেলবেলা ফাঁকা থাকতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি সপ্তাহে তিনদিন সিনেমা দেখতে পাচ্ছি। ব্যালকনির সবথেকে সস্তার সিটে বসে আমি দেখলাম অনেকগুলো বিখ্যাত ছবি।

আমার নতুন বন্ধু সিডনি রোসেনথাল একটা চাকরি পেয়েছে। একদিন সে বলল আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়?

এক সপ্তাহ বাদে আমরা ওয়াই এম সি এ ছেড়ে ইউনিয়ান হোটেলে চলে এলাম। এটা থার্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে অবস্থিত। দুটো বেডরুম, আর একটা লিভিংরুম পাওয়া গেল। ওয়াই এম সি এ-র তুলনায় এটা বোধহয় একটুকরো স্বর্গ।

মার একটা চিঠি হাতে এল। শোনা গেল, নিউইয়র্কে আমার এক দূর সম্পর্কের দাদা থাকে। সে নাকি একটা ক্যাসিনোতে চেকরুম পেয়েছে। লং আইল্যান্ডে। মা বলল, আমি যেন অবশ্যই তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তার নাম ক্লিফোর্ড উলফে।

সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল– আমি শুনেছি তুমি নিউইয়র্কে এসেছ। থাকো কোথায়?

আমি বললাম।

–তুমি কি চেকরুমে আমার সঙ্গে কাজ করবে? সপ্তাহে তিনরাত।

–হ্যাঁ। আমি করব। আমার এক বন্ধুকেও আনব?

নিয়ে এসো।

কাজ শুরু হল। আমরা দুজনেই লং আইল্যান্ডে কাজ করতে যেতাম। গ্লেনকোভ ক্যাসিনোতে। দায়িত্ব ছিল মাথার টুপি আর কোট পাহারা দেওয়া। তিন ডলার করে পেতাম। এছাড়া বুফের টেবিলে গিয়ে পেট ভরে খেতে পারতাম।

একটা গাড়ি আমাকে তুলে নিয়ে যেত। ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রাপথ। সন্ধ্যার অবসান। আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসতাম। যে বেশি টাকাটা আমার হাতে এল, সেটা মার কাছে পাঠাতাম। মা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা ফেরত পাঠিয়ে দিত।

এক সন্ধ্যায় আমি চেকরুমের দিকে এগিয়ে গেছি। ক্লিফোর্ড আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল- তুমি যে স্যুটটা পড়ে আছে, সেটা ছিঁড়ে গেছে। নোংরা।

-হ্যাঁ।

–আর কোনো স্যুট নেই? আমি মাথা নাড়লাম- আমার ওয়াড্রোবে একটা মাত্র ব্রিফকেস থাকতে পারে।

সে বলল- আমরা এটা দেখছি।

পরের রাত। আমি গ্লেনকোভে পৌঁছে গেছি। দাদা আমার হাতে একটা নীল রঙের স্যুট দিয়ে বলল, যাও, আমার দরজির কাছে চলে যাও, দেখো এটা তোমার ফিট করছে কিনা।

এরপর আমি যখনই গ্লেনকোভে যেতাম, ওই স্যুটটা পরতাম।

আমার মনোভাবে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হচ্ছে। আনন্দ অথবা বেদনা কিছুই জাগছে । ১৯৩৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর। মা-বাবাকে লিখেছিলাম– এখন ইচ্ছেশক্তি অনেকটা কমে এসেছে। আমি জানি না শেষ পর্যন্ত জিততে পারব কিনা।

এক মাস বাদে আমি লিখেছি গান লেখার ব্যাপারটা অনেক কমে এসেছে। হয়তো, কোনো একদিন নাম করতে পারব। এখন কিছুই বলতে পারছি না।

মাথার ভেতর অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। দু-দুটো এপিসোড লিখে ফেলেছি। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী হবে বুঝতে পারছি না। একটা ছন্নছাড়া পরিবেশ।

এক থিয়েটারের ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করলাম। হাতে একটা পাণ্ডুলিপিও ছিল। ম্যানেজার আমার পাণ্ডুলিপিটা পড়েও দেখলেন না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন- না, এখানে আপনার কোনো জায়গা হবে না।

নতুন এক ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন আমার নাম ম্যাক্স রিচ। আপনি কে?

আমি নাম বললাম।

ম্যাক্সের নাম আমি জানতাম। ইতিমধ্যে তাঁর লেখা দুটো গান বেতারে বাজছে। জনপ্রিয় হয়েছে একটা হল  স্মাইল, ডার্ন ইয়া স্মাইল। আর দ্বিতীয়টি হল  দ্য গার্ল ইন দ্য লিটল গ্রিন হ্যাট।

–সিডনি, আপনার কোনো গান কি প্রকাশিত হয়েছে?

একই প্রশ্ন। আমি বললাম না, আমি দরজার দিকে পা বাড়ালাম।

উনি হাসলেন– ব্যাপারটা পাল্টাতে হবে। আপনি কি আমার হয়ে কাজ করবেন?

আমি অবাক, এটাই বোধহয় একটা সুযোগ। আমার স্বপ্ন।

আমি বললাম- এটা আমার ভালোবাসা।

–তিনতলায় আমার একটা অফিস আছে। কাল সকাল দশটায় আসুন। আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করব। সঙ্গে গানগুলো আনবেন, কেমন?

আমি আমতা আমতা করছি। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব, মিঃ রিচ। আমি কোনোরকমে বলেছিলাম।

সিডনি রোসেনথালকে সব কথা বললাম। সে বলল–ধন্যবাদ। ম্যাক্স রিচ যে কোনো গান প্রকাশ করতে পারবে।

সময় হলে আমি তোমার গানগুলোও দেখাব।

 আগে নিজের ভবিষ্যৎ ভাবার চেষ্টা করো কেমন।

সেই রাতে আমরা দুজন হৈ-হৈ করে ডিনার সেরেছিলাম। আমি এত উত্তেজিত যে খেতে পারছি না। এবার বোধহয় আমার সত্যিকারের ভাগ্যের উদয় হচ্ছে।

ম্যাক্স রিচ এক অসাধারণ মানুষ, প্রথম দর্শনেই আমার মনে হয়েছে।

 মা-বাবাকে জানাব কি? একটু সময় হাতে থাক।

রাতের অন্ধকার, আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ম্যাক্স রিচের মতো এক নামকরা মানুষ কেন আমার সাথে কাজ করতে রাজী হবেন? সমস্ত প্রকাশক আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার মানে? আমাকে আরও একবার আশাহত হতে হবে হয়তো।

সকাল দশটা। ম্যাক্স রিচ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তখন একটা গ্ৰেহাউণ্ড বাসের যাত্রী। চিকাগোতে ফিরতে হবে।

.

০৭.

১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে ভগ্ন মনোরথ হয়ে চিকাগোতে ফিরে এলাম। বাড়ির সবাই আমার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মা বলেছিল, ওরা জানে না, কত বড়ো প্রতিভার অপমৃত্যু হয়ে গেল।

অর্থনৈতিক অবস্থাটা একই রকম আছে। আমাকে আবার বিশমার্ক চেকরুমে কাজ করতে হবে। দিনের বেলা একটা রেস্টুরেন্টে কাজ পেলাম। গাড়িগুলো দেখাশোনা করা। এটা রজারস পার্কে অবস্থিত।

এক সন্ধ্যেবেলা আমার স্টুয়ার্ট ওয়ারনার আর তার বউ ভেরা অ্যাপার্টমেন্টে এল ডিনারের জন্য। তাদের সঙ্গে চার্লি ফাইনও ছিল। আমি সস্তার চিনা খাবার আনিয়ে ছিলাম। তখন ভেরা কথায় কথায় বলল- আমি আসছে সপ্তাহে সাক্ৰামেনটোতে যাব, ক্যালিফোর্নিয়াতে।

ক্যালিফোর্নিয়া– এই নামটা আমার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের সৃষ্টি করল। হলিউড, নতুন এক জগতের রাস্তা হয়তো আমার জন্য খুলে যাবে। আমি কি সেখানে যাব? একটার পর একটা স্বপ্ন দেখছি। শেষ অব্দি আমি বলেছিলাম- আমি কি সঙ্গে যাব?

তারা সকলে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।

 ভেরা বলল- সিডনি, তুমি কী করে যাবে?

আমি বললাম আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভেরার সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছি।

তারা নীরবতা পালন করল।

বাবা বলেছিল– এইমাত্র তুমি এসেছ, এখনই আবার চলে যাবে?

-হ্যাঁ, হলিউডে একটা চাকরি পেলে ভালো হয়।

না, আমরা দেখছি, এখানে একটা ভালো কাজ পাওয়া যায় কিনা?

আমি জানি, চিকাগো কখনও আমাকে ভালোবাসবে না। চিরকাল আমাকে এই চেকরুম আর ড্রাগস্টোরেই কাজ করতে হবে। আর ভালো লাগছে না।

কিছুক্ষণের নীরবতার পর মা বলল- সিডনি যা চাইছে ওকে তা করতে দেওয়া উচিত। এসো, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আর চিন্তা করব না। তিন সপ্তাহের মধ্যে ওখানে যদি কোনো কাজ না পাও, তাহলে চলে এসো কিন্তু।

আমি জানি, হলিউডে আমার চাকরি পাকা। যতই ভাবছি, ততই আশাবাদী হয়ে উঠছি।

এবার সত্যি সত্যি অশান্তির অবসান হবে। পাঁচদিন বাদে আমি জামাকাপড় গোছাতে শুরু করেছি। ভেরা আর তার মেয়ে কারমেলের সাথে সাক্ৰামেনটোতে যেতে হবে। 

রিচার্ডের মন খুবই খারাপ- তুই কেন আবার চলে যাচ্ছিস? এই তো এলি।

আমি বললাম- তোকে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস পাঠাব কেমন?

শেষ অব্দি আমরা সাক্ৰামেনটোতে পৌঁছে গেলাম। ভেরা এবং কারমেলকে গুডবাই জানিয়ে একটা সস্তার হোটেলে গিয়ে উঠলাম। পরের দিন সকালে বাস ধরে গেলাম সান ফ্রানসিসকোতে, সেখান থেকে লস এঞ্জেলস।

লস এঞ্জেলসে এসেছি হাতে একটা স্যুটকেস আর পকেটে ৫০ ডলার নিয়ে। লস এঞ্জেলস টাইমসের একটা কপি কিনলাম। সস্তার ঘর ভাড়া নিতে হবে।

একটা ব্যাপার আমার মনে এল, তা হল, এখানে বোর্ডিং হাউসের জন্য অনেক টাকা জমা দিতে হয়। এটা হলিউড। কিছু দূরেই সানসেট বুলেভার্দ।

তা হলে থাকব কোথায়? শেষ অব্দি খুঁজে খুঁজে একটা বাড়ি পেলাম। শান্ত পরিবেশে অবস্থিত।

আমি ডোরবেলে হাত দিলাম। বছর চল্লিশের এক হাসি খুশি ভদ্রমহিলা দরজাটা খুলে দিলেন।

-হ্যালো, বলল তোমাকে কীভাবে সাহায্য করব?

–আমার নাম সিডনি সেলডন। আমি কি কদিন এখানে থাকব?

–আমি গ্রেসি সাইডেল, ভেতরে এসো।

আমি স্যুটকেস নিয়ে হলে প্রবেশ করলাম। হ্যাঁ, এই বাড়িটাকে বোর্ডিং হাউস করা হয়েছে। মস্ত বড়ো লিভিং রুম, ডাইনিং রুম, ব্রেকফাস্ট রুম, কিচেন। বারোটা বেডরুম। বেশির ভাগেই লোক আছে। চারটে সাধারণ বাথরুম।

 আমি বললাম ভাড়া প্রতি সপ্তাহে ৪.৫০, তাই তো। এর মধ্যে ব্রেকফাস্ট ধরা আছে।

গ্রেসি সাইডেল আমার দিকে তাকালেন। আমার ছেঁড়া শার্ট। বললেন তুমি যদি চাও, আমি প্রতি সপ্তাহে চার ডলার করে নেব। 

 আমি ওনার দিকে তাকালাম, বললাম না, আমি সাড়ে চারই দেব। কিন্তু কতদিন থাকতে পারব, জানি না।

উনি হেসে বললেন –ঠিক আছে। তোমার ঘরটা দেখাই।

ঘরটা ছোটো, কিন্তু সুন্দরভাবে সাজানো। আমি গ্রেসির দিকে তাকিয়ে বললাম–ভাগ্য বোধহয় সদয়।

-ভালো। এই হল ফ্রন্ট ডোরের চাবি। তুমি কিন্তু এখানে কোনো মেয়েকে আনতে পারবে না।

-না, আনব না।

–এসো, তোমার সঙ্গে অন্য বোর্ডারদের আলাপ করানো যাক।

উনি আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন। কয়েকজন বোর্ডার বসে আছেন। চারজন লেখকের সঙ্গে দেখা হল। তিনজন অভিনেতা, একজন পরিচালক, একজন গায়ক। সময় এগিয়ে গেল। আমি পরে জেনেছিলাম, এরা সবাই স্বপ্নভাঙা মানুষ। পকেটে পয়সা নেই, সঙ্গতি নেই, শুধু কল্পনা করতে ভালোবাসেন।

বিলি হল গ্রেসির বারো বছরের ছেলে। সে স্বপ্ন দেখে একদিন ফায়ারম্যান হবে। এটা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন।

আমি মা-বাবাকে ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দিলাম।

বাবা বলল –তিন সপ্তাহের মধ্যে চাকরি না পেলে তুমি কিন্তু ফিরে আসবে। এটাই আমার শেষ কথা।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা গ্রেসির বোর্ডাররা বিরাট লিভিং রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। যুদ্ধের : গল্প বলছে।

–সেলডন, এটা একটা মস্ত বড় সংগ্রাম। প্রত্যেক স্টুডিওতে একটা গেট আছে। গেটের ভেতর প্রোডিউসাররা বসে থাকেন। তারা নতুন প্রতিভার সন্ধান করছেন। তাদের দরকার নতুন পরিচালক, অভিনেতা এবং লেখক। তুমি যদি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো, তা হলে ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পাবে না। বাইরের লোকের জন্য গেট চিরদিন বন্ধ থাকে।

আমি ভাবলাম কীভাবে ভেতরে ঢুকব।

আমি জানলাম হলিউড বলে কিছু নেই। যেমনটি আমি ভেবেছিলাম। কলম্বিয়া পিকচারস, প্যারামাউন্ট এবং আর কে ও হলিউডে অবস্থিত। মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার আর সেলজনিক ইন্টারন্যাশনাল আছে কালভার সিটিতে। ইউনিভারসাল স্টুডিও আছে ইউনিভারসাল সিটিতে। ডিজনি স্টুডিও আছে সিলভার লেকে, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স আহে সেঞ্চুরি সিটিতে। রিপাবলিক স্টুডিও আছে স্টুডিও সিটিতে।

গ্রেসি একটা পত্রিকা আমার হাতে তুলে দিলেন। পত্রিকাটির নাম ভ্যারাইটি। এর মধ্যে সিনেমা জগতের অনেক খবর থাকে। দেখলাম, একুশ দিন হাতে আছে। তার মধ্যে একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কী ভাবে চাকরি পাব?

পরের দিন সকালবেলা, ব্রেকফাস্টের আসর। টেলিফোন বাজল। টেলিফোনে উত্তর দেওয়া অলিম্পিক লড়াইতে পদক জেতার মতো। সবাই ছুটে গেছে। কেউ জানে না, এই ফোনটা কার জন্য আসছে? কার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে?

অভিনেতা ফোনটা ধরল। একমুহূর্ত শুনে গ্রেসির দিকে তাকিয়ে বলল আপনার ফোন।

হতাশার অন্ধকার। এই ফোন কারও জীবনরেখা হল না। আমি লস এঞ্জেলসের একটা ট্যুরিস্ট গাইড কিনেছিলাম। গ্রেসির বোর্ডিং হাউসের সব থেকে কাছাকাছি কলম্বিয়া পিকচারস। সেখান থেকেই অভিযান শুরু করতে হবে। এই স্টুডিওটা গোইয়র স্ট্রিটে অবস্থিত। সানসেটের কাছে। না, এর সামনে কোনো দরজা নেই।

আমি ঢুকে গেলাম। বয়স্ক চেহারার এক প্রহরী ডেস্কে বসে ছিল। সে একটা রিপোর্টের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল। সে বলল–কী দরকার?

আমি বললাম আমার নাম সিডনি সেলডন। আমি একজন লেখক হতে চাই। কার সঙ্গে দেখা করব?

সে বলল –অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে?

আমি বললাম না।

সে বলল –তা হলে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হবে না। সে আবার রিপোর্ট পড়তে শুরু করল।

আমি দু-সপ্তাহ ধরে ঘুরে বেড়ালাম। লস এঞ্জেলস শহরটা অনেকটা ছড়ানো ছেটানো। এখানে অনায়াসে ঘোরা যায়। কিন্তু কী হবে?

 প্রত্যেকটা স্টুডিওর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। প্রহরীরা একই রকম নির্মম এবং হৃদয়হীন। আমার মনে হত, তারা সকলেই বোধহয় একই মানুষ। একই পোশাক পরে ডিউটি দিচ্ছে।

আমি একজন লেখক হব একই প্রশ্ন এবং উত্তর।

–অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

–না।

–তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে যাও।

হলিউড একটা ক্যাবারে, আমি ক্ষুধার্ত, আমি তাকিয়ে আছি, দরজায় চাবি দেওয়া।

টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে, সময় পিছলে যাচ্ছে।

যখন স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাঘুরি করি না, তখন ঘরে বসে থাকি। গল্পগুলো টাইপ মেশিনে টাইপ করি।

একদিন গ্রেসি ঘোষণা করলেন আমি দুঃখিত, এবার থেকে আর ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে না।

 কেন? এ প্রশ্ন কে করবে? সকলেরই টাকা বাকি পড়ছে। উনি বোধহয় আর আমাদের রাখতে চাইছেন না।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল। অসম্ভব খিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট কেনার পয়সা নেই। একটা গল্প লিখতে হবে। মন দিতে পারছি না। শেষ অব্দি আমি কিচেনে গেলাম, গ্রেসি দাঁড়িয়ে আছেন, স্টোভ পরিষ্কার করছেন।

আমি কী বলব? আমি বললাম–গ্রেসি, আমি নতুন নিয়মটা শুনেছি। কিন্তু কিছু কি পাওয়া যাবে? কয়েকদিনের মধ্যেই…

উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –তুমি তোমার ঘরে চলে যাও।

আমার ভাগ্য ভেঙে গেছে। আমি ঘরে ফিরে এলাম। টাইপরাইটারের সামনে বসে আছি। হ্যাঁ, আমি সকলকে বিরক্ত করছি কেন? কাজে মন দেবার চেষ্টা করলাম। না, এত খিদে পেলে কি গল্প লেখা যায়?

পনেরো মিনিট বাদে দরজায় কার হাতের শব্দ। দরজা খুলে দিলাম। গ্রেসি দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা ট্রে। মস্ত বড়ড়া গ্লাসে কমলালেবুর রস, কফি, শূয়োরের মাংস আর ডিম।

উনি বললেন–গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নাও।

 এটাই বোধহয় আমার জীবনের সব সেরা ব্রেকফাস্ট এবং স্মরণযোগ্য।

আমি ফিরে এলাম। একদিন বিকেলবেলা। আর একটা কর্মক্লান্ত দিন শেষ হয়ে গেল।

অটোর কাছ থেকে চিঠি এসেছে। বাস টিকিট এসে গেছে। হ্যাঁ, এত বিচ্ছিরি কাগজ আমি কখনও দেখিনি।

বাবা লিখেছে –আসছে সপ্তাহে বাড়ি চলে এসো কেমন। ভালোবাসা।

 চারদিন বাকি আছে। কোথায় যাব? ঈশ্বর হয়তো হাসছেন।

সেই সন্ধেবেলা আমি লিভিং রুমে বসেছিলাম। গ্রেসি এক বোর্ডারের সঙ্গে কথা বলছেন।

 একজন বলল আমার বোন এম জি এম, এ চাকরি পেয়েছে। গল্প পাঠিকা হিসেবে।

তার মানে? আমি অবাক।

সে বুঝিয়ে দিল গল্পের সারাংশটা প্রযোজকদের শোনাতে হয়। তারা তো এত বেশি সময় পায় না। কোনো কোনো সময় আবার সারাংশটা তৈরি করতে হয়। আমার মন ছুটে চলেছে। ইতিমধ্যে আমি স্টেনবেকের অসাধারণ উপন্যাস  অফ মাইস অ্যান্ড মেন  পড়ে ফেলেছি।

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। আমি ওই বইটার সারাংশ তৈরি করে ফেললাম।

পরের দিন দুপুরবেলা। ছটা স্টুডিওতে ওটা পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি জানি, দু-একদিনের মধ্যে খবরটা পেয়ে যাব।

তিন নম্বর দিনটা এসে গেল। কোনো চিঠি আসেনি। শুধু ভাই একটা চিঠি পাঠিয়েছে।

 চতুর্থ দিনে মায়ের চিঠি এল।

পরের দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। রবিবারের টিকিট কাটা আছে। আর একটা স্বপ্ন মরে গেল। আমি গ্লেসিকে বললাম আমি রোববার সকালে চলে যাব।

তিনি বললেন কিছু কি করব আমি?

আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি আপনার ঋণ কোনোদিন শেষ করতে পারব না। কিন্তু আমার স্বপ্ন ভেঙে গেছে।

উনি বলেছিলেন স্বপ্ন দেখার অবসান করো না কিন্তু।

পরের দিন সকালবেলা, টেলিফোনটা বাজল। এক উঠতি অভিনেতা ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিসিভারটা নিয়ে সে বলল –গুডমর্নিং। কে?

তার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন–ডেভিড সেলজনিকের অফিস?

 ঘরে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। ডেভিড হলেন হলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা। তিনি অসাধারণ কতগুলো ছবির জন্ম দিয়েছেন। যেমন – আ স্টার ইন বর্ন, ডিনার অ্যাট নাইট,  আ টেল অফ টু সিটিজ, ডেভিড কপারফিল্ড। ওই অভিনেতা বলল

-হ্যাঁ, সে এখানে আছে।

কে সে?

অভিনেতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল –এই ফোনটা তোমার সেলডন।

আমার হাত-পা কি ভেঙে গেল? আমি ছুটে গেলাম।

এক মহিলার কণ্ঠস্বর –আপনি কি সিডনি সেলডন?

-হ্যাঁ।

–আমি অ্যানা বলছি। ডেভিডের সেক্রেটারি। ডেভিড একটা সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের সংক্ষিপ্তসার চাইছেন। কিন্তু আমাদের কোনো রিডারকে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমি হাজির আছি, আমি তো আছি বলতে চেয়েছিলাম।

–মিঃ সেলজনিক, আজ সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ওই সারাংশটা চাইছেন। এটা চারশো পাতার একটা উপন্যাস। আমাদের সংক্ষিপ্তসারগুলো তিরিশ পাতার বেশি হয় না। এর সঙ্গে দুপাতার একটা অবতরণিকা থাকবে। একটা প্যারাগ্রাফের মধ্যে মন্তব্য লিখতে হবে। আজ ছটার মধ্যে পাঠাতে হবে কিন্তু। আপনি কি পারবেন?

এটাই সেলজনিক স্টুডিওতে ঢোকার একমাত্র চাবিকাঠি। চারশো পাতার উপন্যাসটা পড়তে হবে। কোনো জায়গা থেকে একটা ভালো টাইপমেশিন সংগ্রহ করতে হবে। তিরিশ পাতার সারাংশ লিখতে হবে। সবকিছু সন্ধে ছটার মধ্যে।

আমি বললাম হ্যাঁ, আমি পারব।

-এখনই কালভার সিটিতে চলে আসুন। বই নিয়ে যান।

–আমি এখনই যাচ্ছি।

ঘড়ির দিকে তাকালাম নটা বেজে তিরিশ মিনিট। কালভার সিটিতে পৌঁছোতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। তার মানে?.টাইপিস্টকে খুঁজতে হবে। তিরিশ পাতার সিনপসিস তৈরি করতে হবে। এটাই আমার জীবনের শেষ সুযোগ।

এগারোটার সময় কালভার সিটিতে পৌঁছে গেলাম। সাত ঘণ্টার মধ্যে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে হবে।

আমার অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল।

.

০৮.

কালভার সিটি পৌঁছোতে একটা স্ট্রিটকার এবং দুটো বাসের সাহায্য নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বাসের প্যাসেঞ্জারদের দিকে আমি তাকালাম। তাদের বলতে চেয়েছিলাম, ডেভিড সেলজনিকের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি। বাসটা আমাকে সেলজনিক ইন্টারন্যাশনাল স্টুডিওর কাছে নামিয়ে দিল।

স্টুডিওটা বিরাট, জর্জিয়ান স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। ওয়াশিংটন স্ট্রিটের দিকে মুখ করা। এই স্টুডিওটার অনেক ছবি আমি সিনেমাতে দেখেছি।

আমি ভেতরে ছুটে গেলাম। এক ভদ্রমহিলা ডেস্কের আড়ালে বসেছিলেন।

 আমি বললাম মিঃ সেলজনিকের সেক্রেটারির সাথে অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে।

–আপনার নাম?

–সিডনি সেলডন।

উনি নীচু হয়ে ডেস্ক থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন –এটা আপনার জন্য।

-আমি কি একবার সেলজনিকের সঙ্গে দেখা করতে পারব না?

–না, উনি খুবই ব্যস্ত মানুষ।

প্যাকেটটা ধরে আমি বাড়ির বাইরে চলে এলাম। এম জি এম স্টুডিওর দিকে তাকালাম। ছটা ব্লক দূরে অবস্থিত। পরিকল্পনাটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। হ্যাঁ, সিমুর একবার তার প্রাক্তন স্ত্রী সিডনি সিনগারের কথা বলেছিল।

–সিমুর, তুই কি কখনও তাকে দেখেছিস?

হ্যাঁ, সে হলিউডে গেছে, এম জি এম এ চাকরি করছে। এক মহিলা পরিচালিকা ডরোথি আরজনারের কাছে।

আমি সিডনি সিনগারকে জিজ্ঞাসা করব সে কি আমাকে সাহায্য করবে?

এম জি এম স্টুডিওতে পৌঁছে গেলাম। লবির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড বলল- কী দরকার?

পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম আমি সিডনি সিনগারের সঙ্গে দেখা করব।

–সিডনি? ডরোথির সেক্রেটারি?

–হ্যাঁ।

উনি কি জানেন?

–হ্যাঁ। আমি মিথ্যে বললাম।

সে ফোনটা তুলে এক্সটেনশনে ডায়াল করে বলল –সিডনি সেলডন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমার নামটা আরও একবার বলল।

কিছুক্ষণ পরে বলল- কিন্তু উনি যে বলছেন…?

তখন আমি ভগবানকে প্রার্থনা করছি একটা হা-বাচক শব্দ শোনার জন্য।

প্রহরী রিসিভারটা নামিয়ে রেখে বলল –২৩০ নম্বর ঘরে চলে যান।

হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে।–ধন্যবাদ।

-এলিভেটরে যান।

করিডরে পৌঁছে গেলাম, তিনতলায়। সিডনির অফিসটা একেবারে কোণে। আমি ঢুকে গেলাম–হ্যালো সিডনি।

-হ্যালো। কণ্ঠস্বরে এতটুকু উষ্ণতা নেই।

 আমি জানি সিমুরের সাথে তার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সে তাই হয়তো আমাকে সহ্য করতে পারছে না। আমি কেন এখানে এলাম? সে কি আমাকে বসতে বলবে না?

–তুমি এখানে কী করছ?

–এটা একটা লম্বা গল্প।

–আমি এখন লাঞ্চ খেতে যাব। হাতের কবজিতে বাধা ঘড়ি দেখে সে বলল।

–না, এখন যাবে না।

–সে কী?

–সিডনি, আমার একটা সমস্যা হয়েছে। আমি সংক্ষেপে পুরো গল্পটা বলে দিলাম। নিউইয়র্ক, লেখক হবার স্বপ্ন, স্টুডিও গেট পার হতে না পারার যন্ত্রণা। সকালে ডেভিড সেলজনিকের সেক্রেটারির ফোন।

সে সব কিছু শুনল। আমার গল্পটা শেষ হয়ে গেছে। তার ঠোঁট শক্ত। সে বলল তুমি সেলজনিকের কাজ নিয়ে এখানে এসেছ। আর আমি তোমার জন্য টাইপ করব?

–আমি তা বলছি না। আমি বলছি, আমি আশা করেছিলাম। তোমাকে কষ্ট দিলাম বলে দুঃখিত। হ্যাঁ, তোমার ওপর আমার কোনো অধিকার নেই।

-না, তুমি তো তা জানো। এখন তুমি কী করবে?

–আমি এই বইটা সেলজনিককে দিয়ে আসব। কাল সকালে চিকাগো চলে যাব। ধন্যবাদ। সিডনি, তুমি যে আমার জীবনকাহিনী শুনেছ, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। গুডবাই।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেছি।

–শোনো।

 আমি তাকালাম।

–এই ব্যাপারটা তোমার জীবন পালটে দেবে, তাই তো?

আমি মাথা নাড়লাম, উত্তেজনায় কথা বলতে পারছি না।

–প্যাকেটটা ভোলো। দেখি ভেতরে কী আছে?

আমি বললাম –সিডনি?

 সে বলল –চুপ করো। আগে বইটা দেখতে দাও।

-তার মানে তুমি…।

-কেন পাগলামি করছ, আমি চেষ্টা করব। তোমার প্রতিজ্ঞা আমার ভালো লাগছে। তার মুখে এই প্রথম হাসি, আমি তোমায় সাহায্য করব।

আমার সমস্ত শরীরে আনন্দের অগ্নিশিখা। আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না।

–এটা খুব বড়ো বই, তুমি কি ছটার মধ্যে সারাংশ তৈরি করতে পারবে?

সে বইটা আমার হাতে তুলে দিল। আমি ভালোভাবে তাকালাম। হ্যাঁ, এক ধরনের রোমান্টিক গল্প, যেটা দর্শকরা ভালোভাবে উপভোগ করবে।

সিডনি জিজ্ঞাসা করেছিল –তুমি কীভাবে কাজটা করবে?

–আমি ছোটো ছোটো বাক্যে পরিণত করব। তারপর তোমাকে বলব, তুমি টাইপ করবে।

সে মাথা নেড়ে বলল দেখা যাক, তোমার এই পরিকল্পনাটা কাজ করে কিনা।

আমি তার উল্টোদিকে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। পাতাগুলো ওল্টাতে শুরু করলাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা হল। আমি টুকরো টুকরো অংশ মুখে বলতে শুরু করলাম। সে টাইপ করা শুরু করল।

আমি জানি না, কেন সিডনি সেদিন আমাকে সাহায্য করেছিল। হয়তো আমার অসহায় অবস্থা দেখে। আমি কখনও এই রহস্যটা জানতে পারব না। আমি জানি, সেদিন সমস্ত দুপুরবেলা সে ডেস্কে বসেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক চোখে।

ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে, সামনের দিকে। বেলা চারটে। অর্ধেকটা শেষ হয়েছে।

সিডনি বলল–চারটে বেজে গেছে। আমি আরও তাড়াতাড়ি বলার চেষ্টা করলাম।

তিরিশ পাতার সারাংশ শেষ হল। দুপাতার অবতরণিকা। এক পাতায় পর্যালোচনা। ছটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে।

সিডনি আমার হাতে শেষ পাতাটা তুলে দিল।

আমি বললাম কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না।

ও হাসল–একটা লাঞ্চ হলে ভালো হয়।

আমি ওর ঠোঁটে একটা আলতো চুমু দিলাম। পাতাগুলো নিয়ে ছুটতে শুরু করেছি।

ইন্টারন্যাশনাল স্টুডিওতে পৌঁছে গেলাম। এক মিনিট বাকি আছে।

একই ভদ্রমহিলা ডেস্কের পেছনে বসে আছে। পরিচয় দিলাম। শোনা গেল সেক্রেটারি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি করিডর দিয়ে ছুটছি। এটা একটা সূত্রপাত। এর থেকে এক মস্ত বড় বিস্ফোরণ হয়ে যাবে।

আমি সেক্রেটারির অফিসে পৌঁছে গেলাম। ভেতরে ঢুকলাম।

উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন আমি চিন্তায় ছিলাম।

–কোনো সমস্যা হয়নি। আমি প্যাকেটটা তার হাতে তুলে দিলাম। উনি তাকিয়ে আছেন।

-দারুণ হয়েছে, এই এনভেলপের মধ্যে আপনার পারিশ্রমিক দশ ডলার আছে।

–ধন্যবাদ। পরের সারাংশটা কখন করতে হবে?

উনি বললেন আমি দুঃখিত। আমাদের সম্পাদক কালকেই চলে আসবেন। মিঃ সেলজনিক সাধারণত বাইরের কাউকে এই দায়িত্বটা দেন না। আসলে আপনি হয়তো ভুল করে ওনাকে লেখাটা পাঠিয়ে ছিলেন।

তার মানে? আমি কখনও ডেভিড সেলজনিকের দলভুক্ত হতে পারব না? না, এই স্বপ্নটাও হয়তো শেষ হয়ে যাবে। আমার মনে হতাশা, কিন্তু আমাকে তো আনন্দ পেতেই হবে।

গ্রেসির কাছে পৌঁছে গেলাম। তার ছেলেরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

-ডেভিডকে কেমন দেখতে? সে কী বলে?

 –তোমরা কি একসঙ্গে কাজ করবে? 

 এতগুলো প্রশ্ন, আমি কোনটার জবাব দেব? আর কত মিথ্যে বলব?

আমি বললাম এই সন্ধেটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।

ঘরে চলে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করলাম। টেবিলের ওপর বাসের টিকিট, আমার হতাশার প্রতীক। আমাকে আবার চেকরুমে ফিরতে হবে। ড্রাগ স্টোর এবং পার্কিং জোন। সেই এক ঘেয়ে জীবন। নাঃ এর থেকে আমার মুক্তি নেই।

নাতালি ফোন করেছে– হ্যালো, কবে তুই আসবি? ঠিক আছিস তো?

–আমি ভালো আছি, মা। তোমাকে একটা ভালো খবর দিচ্ছি মা, এইমাত্র ডেভিড সেলজনিকের জন্য একটা কাজ করলাম। উপন্যাসের সংক্ষিপ্তসার।

–দারুণ খবর। মানুষটা কেমন রে?

এই প্রশ্নের কী জবাব দেব? আমি চিৎকার করে বলেছিলাম- মা, দরজাগুলো আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। আর কয়েকদিন সময় লাগবে।

মা একটু চিন্তা করে বলল ঠিক আছে ডার্লিং, কবে আসবি জানাস। আমি কখনওই বাড়ি আসব না।

পরের দিন সকাল, বাস স্টেশনে গেলাম। টিকিটটা বেচে পয়সা নিলাম। সারাদিন চিঠি লিখলাম, সমস্ত বড়ো বড়ো স্টুডিওর ঠিকানাতে। দেখা যাক, ভাগ্যের চাকাটা খোলে কিনা।

চিঠিটা ছিল এইরকম এই মাত্র আমি ডেভিড সেলজনিকের হয়ে একটা বইয়ের কাজ শেষ করেছি। এখন যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত।

দুদিন বাদে টেলিফোনের আর্তনাদ। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স আমায় প্রথম ডেকেছে, তারপর প্যারামাউন্ট, প্রত্যেক সারাংশের জন্য ৫-১০ ডলার করে পাচ্ছি।

প্রত্যেকটা স্টুডিওতে নিজস্ব সম্পাদক আছে। যখন বেশি কাজের চাপ পড়ে, তখনই বাইরের লোককে ওরা ডেকে পাঠায়। আমি একদিনে একটা উপন্যাস শেষ করতে পারি। স্টুডিওতে গিয়ে উপন্যাসের কপিটা নিয়ে আসি। গ্রেসির বোর্ডিং হাউসে চলে আসি। বইটা পড়ে ফেলি। সারাংশটা টাইপ করি। আবার স্টুডিওতে চলে যাই। সপ্তাহে দু-তিনটে করে কাজ পাচ্ছি। কিন্তু সিডনির সাহায্য হয়তো আর দরকার হবে না।

টেলিফোন করলাম একজন লোককে। তার সাথে তখনও দেখা হয়নি। তিনি হলেন গর্ডান মিশেল। তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। মোশন পিকচারস আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাকাডেমির টেকনিক্যাল ব্রাঞ্চের প্রধান।

আমি ভেরা ফাইনের নাম বললাম। আমি একটা চাকরি চাইছি। একথাও জানালাম।

 উনি বললেন দেখা যাক, তোমার জন্য কী করতে পারি।

শেষ অব্দি আমি ওই অ্যাকাডেমিতে কাজ করার সুযোগ পাব?

পরের দিন সকালবেলা আমি ওনার সঙ্গে অফিসে দেখা করলাম।

উনি বললেন তুমি বিকেলবেলা এখানে এসো। প্রোজেকশন রুমে গিয়ে আমাদের ছবিগুলো দেখো।

আমি বললাম–কাজটা কী?

-আমাদের ছবিগুলো দেখতে হবে।

 আমি অবাক হয়ে গেছি।

উনি ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। আমাদের এই অ্যাকাডেমি বিভিন্ন মানুষের চোখে ছবি কেমন তা বোঝার চেষ্টা করে। তোমার কাজ হল, একটা ছবি কতবার দেখানো হচ্ছে, সেটা লিখে রাখা। এর জন্য তোমাকে আমরা প্রতিদিন তিনডলার করে দেব।

নতুন একটা জীবন শুরু হল। প্রথমে যে ছবিটা দেখেছিলাম, সেটা হল দি ম্যান হু লিভস টোয়াইস । আমি প্রত্যেকটা শব্দ মনে রাখার চেষ্টা করলাম। একই ছবি বারবার দেখতে হচ্ছে। সারাদিন অপেক্ষা করছি টেলিফোনের শব্দ শুনব বলে।

১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। একটা ফোন এল। কোন স্টুডিও থেকে ইউনিভারসাল।

-আপনি কি কাল সকালে আসতে পারবেন?

আবার তিন ডলার।

-হ্যাঁ।

মিঃ টাউনসেন্ডের অফিসে চলে যাবেন।

ইউনিভারসালের সম্পাদক হলেন টাউনসেন্ড। আমি স্টুডিওতে পৌঁছে গেলাম।

–আপনার সারাংশটা খুবই সুন্দর হয়েছে। আমি সব কটা পড়েছি। একজন স্টাফ রিডারের দরকার। আপনি কি যোগ দেবেন?

আমি অবাক। উনি বলছেন– সতেরো ডলার করে দেওয়া হবে প্রতি সপ্তাহে। সপ্তাহে ছ দিন। সকাল নটা থেকে সন্ধে ছটা। সোমবার থেকে কাজটা শুরু হতে পারে।

সিডনিকে ফোন করে খবরটা দিতে হবে। সিডনি সাহায্য না করলে আজ আমি কোথায় তলিয়ে যেতাম।

একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর।

 আমি সিডনি সিনগারের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলাম।

ভদ্রমহিলা কে, জানতে চাইলাম। উনি ডরোথি।

 আমি বললাম, ম্যাডাম, মিস সিনগারের সঙ্গে দেখা হবে?

ভদ্রমহিলা বলেছিলেন সিনগার চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। কোনো ঠিকানা লিখে রেখে যাননি।

ঘটনাটা আকস্মিক। এবং অপ্রত্যাশিত। হায় সিডনি, তোমাকে আমি আর কখনও খুঁজে পাইনি, কিন্তু তোমার ঋণ আমি কখনও পরিশোধ করতে পারব না।

ইউনিভারসাল একটা সুন্দর স্টুডিও। ১৯১২ সালে তৈরি হয়েছিল।

আমার কাজ শুরু হল, সোমবার সকালবেলা। মনের ভেতর নানা আশার গুঞ্জরণ। একটার পর একটা সেটের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। কী অদ্ভুত এই জগৎ। কখনও পশ্চিম দেশের শহর, ভিক্টোরিয়ান হাউস, সানফ্রানসিসকো স্ট্রিট এবং নিউইয়র্কের রাস্তা।

টাউনসেন্ড আমার কাজটা বুঝিয়ে দিলেন। আমাকে একটার পর একটা চিত্রনাট্য পড়তে হবে। সেগুলো নীরব ছবির জন্য তৈরি করা হয়েছে। কীভাবে এগুলোকে টকি অর্থাৎ সবাক চলচিত্রে পালটানো যায়, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে হবে। বেশির ভাগ চিত্রনাট্য একেবারে বাজে।

এভাবেই দিন কেটে গেছে। কাজটা ক্রমশ ভালো লাগছে। একমাস কেটে গেল। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল।

মা-বাবাকে সব কথা জানাইনি। তারা চাইবে, আমি যেন চিকাগোতে ফিরে আসি। আমি জানতাম, আমার ভবিষ্যৎ এই শহরের সঙ্গে গাঁথা। আমাকে আর একটা চাকরি খুঁজতে হবে। কিছুদিনের জন্য। তারপর আবার স্টুডিওর হাতছানিতে সাড়া দেব।

খুঁজতে খুঁজতে একটা চাকরির সন্ধান পেলাম। হোটেলে সুইচবোর্ড অপারেটরের দরকার। কোনো অভিজ্ঞতা লাগবে না। সপ্তাহে কুড়ি ডলার পাওয়া যাবে। ব্রান্ট হোটেলের নাম লেখা আছে।

হলিউড বুলেভার্দে ব্রান্ট হোটেল অবস্থিত। লবিটা একেবারে ফাঁকা, হোটেল ম্যানেজার ছাড়া।

আমাকে কাজটা বুঝিয়ে দেওয়া হল। দুটো প্লাগ আছে। একটাকে বলে সিস্টার প্লাগ, আলো জ্বালাতে হলে এই প্লাগটা গর্তে ঢুকিয়ে দিতে হবে। কোন ঘরে আলো জ্বালাতে হবে, তার নাম্বার পাশে দেওয়া আছে।

ম্যানেজার ঠিক কথা বলেছিলেন, সুইচবোর্ড চালানোর ব্যাপারটা একটা শক্ত কাজ নয়। এটা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই জ্বলে। যখন একটা আলো জ্বলে ওঠে, আমি প্রথম সারিতে প্লাগ লাগিয়ে দিয়ে বলি- মিঃ ক্লেম্যান, আপনার জন্যই এই আলোটা জ্বালা হয়েছে।

আমি গেস্টদের খাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। মিঃ ক্লেম্যান হয়তো ২৩১ নম্বর ঘরের বাসিন্দা। সিসটার প্লাগটা ২৩১ নম্বর গর্তে ঢুকিয়ে দিই। বোতামটা টিপে দিই। শব্দ হতে থাকে। খুবই সহজ ব্যাপার। আমি ভাবলাম, আস্তে আস্তে আমাকে নাইট ম্যানেজার হতে হবে।

তারপর জেনারেল ম্যানেজার হব। এইভাবে আমাকে বসে থাকলে চলবে না।

দুটো রাত কেটে গেছে। রাত তিনটে। একজন গেস্ট সুইচবোর্ডে শব্দ করেছেন নিউইয়র্কের একটা নাম্বার –এখুনি ধরতে হবে।

উনি আমার হাতে একটা নাম্বার দিলেন। আমি রুম প্লাগটা ঢুকিয়ে নিউইয়র্কের নাম্বারে ফোন করলাম।

অনেকক্ষণ বাদে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

–হ্যালো?

–একটা ফোন কল আছে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করবেন।

আমি সুইচ বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু কীভাবে এই কলটা পাঠিয়ে দেব? না, এখানে কোনো নির্দেশ দেওয়া নেই।

আমি অনেককে জাগিয়ে তুললাম। তারা বিরক্ত হল। ব্যাপারটা কেমন গোলমালে হয়ে গেল। সকালবেলা হোটেলের ম্যানেজার এলেন। আমি আমতা আমতা করে সব ঘটনা বলার চেষ্টা করলাম।

ওনার মুখ রাগে থমথম করছে। ইতিমধ্যে খবরটা ওনার কানে পৌঁছে গেছে। আমাকে চাকরিটা হারাতে হল। না, আমি হোটেলচেনের ম্যানেজার হব না।

এবার ড্রাইভিং ইনস্ট্রাকটর। চাকরিটা আমি নিলাম। ছাত্ররা এলোমেলো। লাল আলোর ইশারাতে থমকে থামতে জানে না। ব্রেক এবং অ্যাকসিলেটরের মধ্যে কী পার্থক্য তা বুঝতে পারে না। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। অন্ধ অথবা আত্মহত্যা করতে চাইছে। কাজটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।

এর পাশাপাশি স্টুডিও পাড়াতে ঘোরাঘুরি চলছে। টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের জন্য সারাংশ লিখেছি। জেমস ফিসার হলেন সেখানকার সম্পাদক, এক সুভদ্র চেহারার নিউইয়র্ক বাসিন্দা।

এক সন্ধেবেলা উনি আমাকে বললেন তুমি কাল ফাঁকা আছো?

-হ্যাঁ, মনে মনে আমি ভাবলাম, আরও তিন ডলার।

–দশটায় দেখা হবে?

নিশ্চয়ই। দশ ডলার, আমি ভাবছি। আবার টাকা কম পড়তে শুরু করেছে।

অফিসে পৌঁছে গেলাম। তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, তুমি এখানে স্টাফ হিসেবে যোগ দেবে?

–হ্যাঁ, কাজটা আমার ভালো লাগবে।

–তোমাকে ভাড়া করা হল। সপ্তাহে ২৩ ডলার করে দেওয়া হবে।

আমি আবার শো-বিজনেসে ফিরে এলাম।

.

০৯.

টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের কাজটা একেবারে অন্যরকম। ইউনিভারসাল স্টুডিওর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে সব কিছুই ঘড়ির কাঁটা দিয়ে আবর্তিত হয়। কারণ এখানকার প্রযোজনার মাথায় বসে আছেন ড্যারিয়েল জানুক। ধুরন্ধর মানুষ। তিনি জানেন, কীভাবে মানুষের মন জয় করতে হয়।

লেখকদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছ তার। একবার তিনি বলেছিলেন যে কোনো চলচ্চিত্রের সফলতা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর। গল্প, গল্প এবং গল্প। গল্প ছাড়া আর কোনো কিছু নেই।

ফক্সে বারোজন স্টাফ রিডার চাকরি করছেন। পঁয়ত্রিশ থেকে ষাট বছর বয়স পর্যন্ত। তাদের বেশির ভাগই কোনো আধিকারিকের নিকট আত্মীয়।

জুলিয়ান জনসন, ফক্স স্টুডিওর এক এগজিকিউটিভ। আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। তাকে আমি এক উদ্দীপ্ত মানুষ বলতে পারি। লম্বা চেহারা। একবার বিয়ে করেছিলেন নাইট ক্লাবের মহারানিকে। বিয়েটা ভেঙে গেছে।

উনি বললেন সিডনি, তুমি এখন শুধু মিঃ জানুকের হয়ে কাজ করবে। যখনই তিনি নতুন একটা ছবি শ্যুটিং করতে চাইবেন, অথবা নাটকে রূপায়িত করতে চাইবেন, তখনই তোমার ডাক পড়বে।

ব্যাপারটা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।

মনে আনন্দ আর ধরে না। আমি নতুন নতুন উপন্যাস পড়ার সুযোগ পেলাম। শুধু তাই নয়, নতুন নাটকের হালচাল কী, তাও বুঝতে পারলাম।

 জানুক নতুন বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। আমাকে অনেক সময় মাঝরাত অব্দি কাজ করতে হত। কাজটা আমার ভালা লাগত। কিন্তু লেখক কবে হব? স্টুডিও জুনিয়ার রাইটার ডিভিশন নামে একটি বিভাগ খুলল।

আমি জুলিয়ান জনসনকে বলেছিলাম, ওখানে যোগ দিলে ভালো হয়।

উনি বলেছিলেন- না, তুমি জানুকের হয়ে কাজ করছ, এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ।

আমার অফিসটা ছিল একটা কাঠের বাড়ির মধ্যে। রাতে একেবারে ফাঁকা থাকত। একাকীত্বের যন্ত্রণায় ভুগতাম। অন্ধকারকে ভয় পেতাম। একরাতে জানুকের অনুরোধে একটা কাজ করছি, গল্পটা ভূতের।

টাইপ করছি। এইভাবে–

সে আলমারির দরজাটা খুলে ফেলল, কী আশ্চর্য, মৃতদেহটা তার ঘাড়ের ওপর পড়ে গেছে।

ঠিক তখনই আমার অফিসের ক্যাবিনেটটা খুলে গেল। বইগুলো হুড়মুড় করে কাঁধের ওপর পড়ে গেল। সমস্ত ঘরে বুঝি কাঁপুনি শুরু হয়েছে। আমি দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

হ্যাঁ, এটা এক ভয়ংকর ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা।

সেপ্টেম্বরে এক অচেনা মানুষ আমার অফিসে এসে বলল আমার নাম অ্যালান জ্যাকসন। আমি কলোম্বিয়াতে থাকি। আমি একজন রিডার।

আমি বলেছিলাম- আপানকে দেখে ভালোই লাগছে। বলুন কী করতে পারি।

ভদ্রলোক বললেন আমরা একটা গিল্ড তৈরি করতে চলেছি। আপনি যোগ দিলে ভালো লাগবে।

তার মানে একটা সংগঠন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন? আমার তো তেমন কোনো ভূমিকা নেই। আমি জানি, বেশির ভাগ রিডারেরই এ ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা আছে।

আমি বলেছিলাম ঠিক আছে, সাহায্য করব।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই এই গিন্ডে যোগ দিতে উৎসুক। আমি অ্যালান জ্যাকসনকে খবরটা দিয়েছিলাম। উনি হেসে বলেছিলেন–বাঃ, ভাল। অন্য স্টুডিওতেও যোগাযোগ করতে হবে।

মেট্রো গোল্ডউইন মেয়র স্টুডিওতে একটা আলোচনা সভা ডাকা হল। বিভিন্ন স্টুডিও থেকে ছ-জন রিডারকে নিয়ে একটা কমিটি তৈরি হল।

এডি ম্যানিক্সস, মেট্রো গোল্ডউইন মেয়রের এক বিশিষ্ট পথিকৃৎ।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের সমস্যা কী?

একজন বললেন- মিঃ ম্যানিক্স, আমাদের জীবন যাত্রার মান অনেক কমে গেছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়, কিন্তু সেই তুলনায় পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না।

এডি ম্যানিক্স বললেন আমি এসব গল্প শুনতে চাই না। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলন।

অধিবেশনটা শেষ হয়ে গেল।

দেখা দিল দারুণ বিশৃঙ্খলা। দু ঘণ্টা কেটে গেছে, রিডারস গিল্ডের অবস্থা কী হবে? শেষ অব্দি ঠিক হল, প্রতি সপ্তাহে স্টাফ রিডারদের ২১.৫০ ডলার করে দেওয়া হবে। যারা বাইরে থেকে কাজ করতে আসবে, তাদের আরও ২০ শতাংশ দেওয়া হবে। আমাকে ওই গিল্ডের সহসভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।

আমি বাবা-মাকে সব খবর দিতাম। খবর শুনে তারা আনন্দে অধীর। আমার বাবা। সকলের কাছে গল্পটা বলতে শুরু করল।

একজন নতুন বোর্ডার এসেছে গ্রেসির বোর্ডিং হাউসে। লাজুক চোখের এক ছেলে। নাম বেন রবার্টস। আমারই মতো বয়স। গায়ের রঙ কালো, পাতলা ফিনফিনে চুল এবং মুখে হাসি। সবসময় কৌতুক করতে ভালোবাসে। আমরা অচিরেই বন্ধু হলাম।

বেনও একজন লেখক। কিন্তু সে ছোটো ছোটো লেখাতেই মন দিতে চায়। প্রতি সন্ধ্যায় আমি এবং বেন ড্রাগ স্টোরে চলে যেতাম। ডিনারের সময় স্যান্ডউইচ খেতাম। অথবা কোন সস্তার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসতাম। বেন খুবই শক্তিশালী। যথেষ্ট মগজ আছে তার। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা একটা গল্প লিখে ফেললাম। সমস্ত স্টুডিওতে পাঠালাম। কোনো সুযোগ আসবে কি?

বৃথা প্রতীক্ষা, সুযোগ এল না।

বেন এবং আমি আর একটা গল্প লিখলাম। একই ভাবে পাঠালাম। এবারও কোনো সুযোগ এল না।

তিন নম্বর গল্পটাও লেখা হল। হতাশার আচ্ছাদন।

একদিন আমি বললাম একটা রহস্য গল্প লিখলে কেমন হয়? নাম দেব ভয়ংকর ছুটির দিন।

আমি বেনকে গল্পটা বললাম। তার ভালো লাগল। গল্পটা লিখে সব স্টুডিওতে পাঠালাম। কোনো শুভ সংবাদ এল না।

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আমি বোর্ডিং হাউসে ফিরে এসেছি। বেনের সঙ্গে দেখা হল। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।

–আমি গল্পটা একজন প্রোডিউসারকে দিয়েছিলাম। টেড রিচমন্ড, পি আর সি-তে আছেন।

এটা একটা ছোট্ট স্টুডিও। প্রোডিউসার রিলিজিং করপোরেশন।

উনি  ডেনজারাস হলিডে  গল্পটাকে ভালো বলেছেন। ৫০০ ডলার দেবেন। আমাদের চিত্রনাট্য লিখতে হবে।

আমার মনে আনন্দ- হ্যাঁ, কাজটা করতেই হবে। হলিউডের সমস্যা হয়তো সমাধান হবে। নতুন কেউ এখানে জায়গা পায় না। নিউইয়র্কের কথা মনে পড়ল।

তার মানে? আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে।

ডেনজারাস হলিডে লেখা শুরু হল।

কয়েক মাস আগে আমার সাথে রায় ক্রোসেটের দেখা হয়েছিল। সে লেল্যান্ড হেওয়ার্ড এজেন্সির একটা বিভাগে কাজ করে। এই এজেন্সিকে আমরা সব থেকে বড়ো ট্যালেন্ট এজেন্সি বলতে পারি। ভদ্রলোক আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। বলেছিলেন সাহায্যের দরকার থাকলে যোগাযোগ করতে।

আমি রায়কে ফোন করলাম। টেড রিচমণ্ড সম্বন্ধে খবরটা দিলাম।

— আমি বললাম–বেন এবং আমি আমাদের প্রথম গল্পটা বিক্রি করেছি। ডেনজারাস হলিডে।

কাকে?

 –পি আর সি।

–কে পি আর সি?

 আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত বড়ো একজন মানুষ, অথচ পি আর সি-র নাম শোনেন নি?

আমি বললাম একটা স্টুডিও, প্রোডিউসার রিলিজিং করপোরেশন। টেড রিচমণ্ড নামে একজন প্রোডিউসার আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি ৫০০ ডলার দেবেন বলেছেন। চিত্রনাট্য লিখতে হবে।

ব্যাপারটা কি শেষ হয়ে গেছে?

–না, আমরা একটু সময় নিয়েছি।

–পরে ফোন করছি, রায় বললেন, ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

 দু ঘন্টা কেটে গেছে। আবার ফোনের আর্তনাদ তোমাদের গল্পটা প্যারামাউন্টে বিক্রি করে দিলাম। ওরা তোমাকে একহাজার ডলার দেবে। তোমাদের চিত্রনাট্য লিখতে হবে না।

আমি অবাক হয়েছিলাম। এমন ঘটনা কেন ঘটল? প্রত্যেকটা স্টুডিওতে গল্পের সংক্ষিপ্তসার থাকে। রায় প্যারামাউন্টে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ডেনজারাস হলিডে আর একটা স্টুডিও কিনে নিচ্ছে।

রায়, আমি বলেছিলাম, ব্যাপারটা ভালো, কিন্তু আমরা এই প্রস্তাবটা মানতে পারব না।

–তুমি কী বলছ? তুমি দুগুণ অর্থ পাবে। সত্যিকারের ভালো স্টুডিও।

–না, টেড রিচমণ্ডের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।

–সব ব্যাপার বুঝিয়ে বলো। উনি সব বুঝতে পারবেন।

–আমি চেষ্টা করব।

আমি জানি টেড রিচমন্ড কখনও এই প্রস্তাবটা মেনে নেবেন না। মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম। শোনা গেল, উনি কাটিং রুমে আছেন। ওনাকে এখন ব্যস্ত করা যাবে না।

আমি বলেছিলাম উনি একটু ফাঁকা হলে আমাকে ফোন করবেন।

এক ঘন্টা বাদে আমি আবার ফোন করলাম। এখনও ওনাকে পাওয়া গেল না।

সেদিন বিকেলবেলা তিনবার ফোন করে শেষে হতাশ হলাম।

 রায় ক্রোসেটকে ফোনে বললাম, রিচমণ্ড আমার ফোনে সাড়া দিচ্ছেন না। তা হলে প্যারামাউন্টের সাথেই কাজটা শেষ করুন।

 চারঘন্টা আগেই ব্যাপারটা হয়ে গেছে।

বেন এল, সব ব্যাপারটা বললাম। বেন উত্তেজিতভাবে বলল ভীষণ ভালো খবর। প্যারামাউন্ট নাম করা স্টুডিও। টেড রিমণ্ডকে কী বলব?

ভালো প্রশ্ন। সেই বিকেলে আমি টেডের বাড়িতে ফোন করলাম। উনি ফোন ধরলেন।

আমার বুক কাঁপছিল। আমি বললাম অনেকবার আপনাকে ফোন করেছি, আপনি কেন ফোন করেননি?

–আমি দুঃখিত, কাটিং রুমে ছিলাম।

 –আপনি ফোন করলে ভালো হত। বেন আর আমি একটা কাজ করেছি।

–কী কাজ?

-প্যারামাউন্ট আমাদের  ডেনজারাস হলিডে  গল্পটা কিনে নিয়েছে। আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। গল্পটা বিক্রি করে দিয়েছি।

–সে কী? আমি তো এটাকে ফ্লোরে পাঠাব বলে ঠিক করেছি।

-আপনি চিন্তা করবেন না। বেন আর আমি আর একটা গল্প লিখব। এর নাম হল  সাউথ অফ পানামা। এটা নাটক, ভালোবাসার গল্প, এর মধ্যে শিহরণ আছে, অনেক . ঘাত-প্রতিঘাত আছে। এত সুন্দর লেখা আমরা কখনও লিখতে পারিনি।

উনি বললেন ঠিক আছে, আমার এবং অ্যালেক্সের সাথে পিগ-এ দেখা করো। আগামীকাল সকাল আটটায়।

অ্যালেক্স হলেন পি আর সি-র এগজিকিউটিভ প্রধান।

আমি বললাম আমি সেখানে চলে যাব। বেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ আর ডিমার খাব না। এসো, দুজনে বসে বসে একটা সুন্দর প্রেমের গল্প ভাবি। যার মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত থাকবে। কাল সকাল সাতটা পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে।

সমস্ত রাত জেগে কেটে গেল। একটার পর একটা ভাবনা মাথায় আসছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা একটা সুন্দর গল্পের প্লট পেয়েছিলাম। আমরা সাউথ অফ পানামা। শেষ করলাম। তখন ঘড়িতে সকাল পাঁচটা বাজে।

বেন বলল চলল, এবার দেখাতে হবে।

সাতটার সময় ঘড়িতে অ্যালার্ম দিলাম। দুঘণ্টা ঘুমোতেই হবে।

অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। গল্পটা পড়লাম। এই গল্পটা মোটই ভালো লাগছে না। চরিত্রগুলো হাস্যকর। সংলাপ জমছে না। কিন্তু অ্যালেক্স আর টেডের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

আটটার সময় ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেলাম। টেড এবং অ্যালেক্স, দুজনে একটা বুথে বসেছিলেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমি গল্পটার দুটো কপি দিলাম।

অ্যালেক্স বললেন–এখনই পড়লে ভালো হয়।

 টেডও তাই বললেন।

তারা দুটো কপিতে চোখ রাখলেন। পড়া শুরু করলেন। আমি তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। তারা পাতা উলটে যাচ্ছেন, একটার পর একটা পাতা। কোনো কথা বলছেন না।

আমি বুঝতে পারছি। এত চাপ থাকলে কি গল্প লেখা যায়?

গল্পটা শেষ হল।

অ্যালেক্স আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –অসাধারণ।

টেড বললেন দারুণ হয়েছে। হ্যাঁ, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে,  ডেনজারাস হলিডে -র থেকে এটা অনেক ভালো হয়েছে।

আমি কী শুনছি, বিশ্বাস করতে পারছি না।

–পাঁচশো ডলার দেব। তুমি এবং বেন এর চিত্রনাট্য তৈরি করবে।

বেন এবং আমি একটা অলৌকিক কাজ করেছি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দু-দুটো গল্প লিখে ফেলেছি। শুধু লেখা নয়, গল্প দুটো বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।

সে রাতে আমি এবং বেন হলিউডের একটা ক্লাসিক রেস্তোরাঁতে গিয়েছিলাম। আনন্দের মুহূর্তকে উদযাপন করতে। এই প্রথম আমরা এত বড়ো রেস্তোরাঁর খরচ চালাতে পারছি। এভাবেই আমার চব্বিশতম জন্মদিনটা কোথায় হারিয়ে গেল।

সাউথ অফ পানামা প্রোডিউসার রিলিজিং করপোরেশন এটাকে নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করল। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যোগ দিয়েছিল। প্যারামাউন্ট  ডেনজারাস হলিডে , নিয়ে নাটক করল, নাম দিল ফ্লাই-বাই-নাইট।

বেন আর আমি সেখানে ছোটোখাটো ভূমিকা পেয়েছিলাম। আমি ফক্সের কাজটা ছেড়ে দিলাম। মিঃ জানুকের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছি না। বেন এবং আমি আর একটা গল্প বিক্রি করলাম। বোয়োড হিরো  শিরোনামে। মনোগ্রাম নামে একটা ছোট্ট স্টুডিওতে।  ডেনজারাস লেডি  এবং গাম্বলিং ডটারস বিক্রি করলাম পি আর সি-কে। প্রতিটা গল্পের জন্য পাঁচশো ডলার করে পাচ্ছি। দুজনে ভাগ করে নিচ্ছি।

এবার আরও কিছু গল্প লিখতে হবে। জাতীয় চিত্রনাট্যকার হিসেবে আমাদের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

রিপাবলিক স্টুডিওর প্রোডিউসার লিওনার্দ ফিল্ডসের সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাদের কাছ থেকে গল্প কিনলেন। নাম মিঃ ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ইন দ্য কাটার কেস। এই গল্প এবং চিত্রনাট্যের জন্য আমরা দুজনে ৬০০ ডলার পেয়েছিলাম।

কাজ এগিয়ে চলেছে। দিনগুলো আরও কর্মমুখর হয়ে উঠেছে।

ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিনে চিকাগোতে এলাম। রিচার্ড এবং মা-বাবাকে দেখে খুবই ভালো লাগল। পাড়া প্রতিবেশীদের বলা হয়েছিল। বাবার চোখে আমি বিশ্ববিজয়ী বীর। যার পায়ের তলায় থরথর করে হলিউড কাঁপছে।

বাড়ির পরিবেশ ভালো লাগল। রিচার্ড বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে। সে গ্রামার স্কুল থেকে। গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। এবার হাইস্কুলে যাবে। মা-বাবার ঝগড়া এখনও আগের মতো চলেছে। রিচার্ড মধ্যস্থ থাকার চেষ্টা করছে। আমি মা-বাবার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললাম। কিন্তু তিক্ততা আকাশ ছুঁয়েছে। একে অন্যকে সহ্য করতে পারছে না।

আমি ভাবলাম–রিচার্ডকে হলিউডে নিয়ে যেতে হবে। একজন সাহায্যকারী চাই। আমি রিচার্ডকে প্রস্তাবটা দিলাম। বললাম-হলিউড হাইতে যাবি?

সে অবাক কী বলছ?

–আমি তোকে নিয়ে যাব। কিছুক্ষণের নীরবতা।

–হ্যাঁ, তারপর সে রাজী হল কি?

এক সপ্তাহ বাদে রিচার্ড গ্রেসির বোর্ডিং-এ ঢুকে পড়ল। আমি তাকে সব জায়গায় পরিচয় করালাম। তাকে এত আনন্দিত এর আগে কখনও দেখিনি। কতদিন আমরা একে অন্যকে ছেড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। চিকাগো থেকে আসার পর তিনমাস কেটে গেছে। বাবা আর মা ডিভোর্সের জন্য আবেদন করেছে। এই ঘটনাটা আমার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

একদিন সকালে আমি একটা টেলিফোন কল পেলাম।

–সিডনি?

–হ্যাঁ।

–হাই, আমি বব রাসেল।

 বব রাসেল কে? কোনো সেলসম্যান কি?–আমি দুঃখিত আমার এখন সময় নেই।

-আমরা ম্যাকস রিচের জন্য গান গেয়েছিলাম।

 আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবতেই পারিনি কে? সিডনি রোসেলথাল?

বব রাসেল, সে বলল, আমি হলিউডে আসছি।

 এক সপ্তাহ কেটে গেছে। বব রাসেল গ্রেসির বোর্ডিং হাউসে এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখে ভালো লাগল। আগের মতোই আশাব্যঞ্জক তার চরিত্র।

-তুমি এখনও গান লেখো?

–হ্যাঁ, তুমিও গান লেখা ছাড়োনি তো?

রিচার্ড খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হলিউড হাইতে তার বেশ কয়েকটা বন্ধু জুটেছে। অনেককে সে গ্রেসির বোর্ডিং হাউসে নিয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে সেখানে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাচ্ছে।

একরাতে আমাদের একটা ডিনার পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হল। আমি আকস্মিক দুর্ঘটনাতে আঘাত পেয়ে তিনদিন বিছানাতে কাটাতে বাধ্য হলাম।

একদিন সন্ধেবেলা মা আমাকে ফোন করে বলল –ডার্লিং, তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে। আমি আবার বিয়ে করতে চলেছি।

আমার মনে উত্তেজনা। আমি বললাম–কে?

–ওর নাম মার্টিন লীব। সে খেলনা তৈরি করে।

–খবরটা খুবই ভালো। কখন তার সাথে আমার দেখা হবে?

–তোমার ওখানে আসছি, কেমন?

 রিচার্ডকে খবরটা দিলাম। সেও খুব উত্তেজিত।

পরের ফোনটা এল বাবার কাছ থেকে সিডনি, আমি বিয়ে করতে চলেছি।

-কে?

–তার নাম অ্যান কার্টিস। ভারী সুন্দরী মহিলা।

কবে দেখা হবে?

–আমি ওখানে যাব।

আমার অবাক হবার পালা।

 বব রাসেল এসে গেছে। পুরোনো পরিবেশ জমে উঠেছে বোধহয়।

শেষ গানটা সে আমাকে শোনাল। একটা অন্যরকম গান।

আমি পিয়ানোতে বাজালাম। বললাম, অসাধারণ হয়েছে। একটা খবর দিলাম, শনিবার একটা নতুন ক্লাবের জন্ম হবে, একজন গায়িকা সেখানে গান গাইবে। এই গানটা তাকেই দেওয়া যেতে পারে।

পরের দিন আমি ক্লাবে গেলাম। ওই ভদ্রমহিলা গানের অনুশীলন করছিল। তাকে গানটা দেখানো হল। সে বলল আমি পঞ্চাশ ডলার দেব।

আমরা টাকাটা নিয়ে ববের হাতে তুলে দিলাম। বব বলল এবার বোধহয় আমি সত্যিকারের পেশাদার লেখক হলাম।

হলিউডে মাঝে মধ্যে ছোটোখাটো বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। ইওরোপে এবার সত্যিকারের ঝড় শুরু হবে। ১৯৩৯ –জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করল। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।

১৯৪০–ইতালি জার্মানির সঙ্গে হাত মেলাল। ইউরোপে যুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠেছে। আমেরিকা এখনও পর্যন্ত তার নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখছে।

১৯৪১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণ করল জাপানিরা। পরের দিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

যুদ্ধ ঘোষণা করার পর এক ঘণ্টা কেটে গেছে। মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের প্রধান লুইস বি, মেয়ার একটা মিটিং ডাকলেন। সেখানে সকলে উপস্থিত হয়েছিলেন।

মেয়ার বললেন –পার্ল হারবারের ঘটনা আপনারা সকলে জানেন। আমাদের লড়াই করতে হবে। আমরা আমাদের মহান প্রেসিডেন্টের হাত শক্ত করব।

***

বেন, বব আর আমি আরও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

বেন বলল–ফোর্ট ডিক্সে একটা ট্রেনিং ফিল্ম ইউনিট আছে। আমি সেখানে নাম নথিভুক্ত করব।

সারাদিন ধরে তার প্রস্তুতি চলল। এক সপ্তাহ বাদে সে পূর্বদিকে চলে গেল।

 আমি ববকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তুমি এখন কী করবে?

–আমি জানি না, আমার শরীরটা খুব একটা ভালো নয়। আমাকে ওরা আর্মিতে নেবে না। আমি নিউইয়র্কে চলে যাব। দেখা যাক কী করতে পারি। তুমি কী করবে?

–আমি বিমানবাহিনীতে যোগ দেব।

 ১৯৪২ সালের ২৬শে অক্টোবর। আমি বিমানবাহিনীতে আবেদন করলাম। যাতে আমার এই আবেদনটা গ্রাহ্য হয় সেজন্য আমি তিনজন বিখ্যাত মানুষের সুপারিশপত্রও জুড়ে দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারটাও যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে করতে হয়েছে। বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি কংগ্রেস সদস্যের কাছে চিঠি দিলাম। লিখলাম– দেশকে সেবা করতে আমি বদ্ধপরিকর। তাই তাদের সাহায্য দরকার। দুমাস লেগেছিল তিনখানা চিঠি জোগাড় করতে।

এবার ফেডারেল বিল্ডিং-এর সাথে একটা যোগাযোগ করতে হবে। এটা লস এঞ্জেলসের ডাউন টাউনে অবস্থিত। সেখানে একটা পরীক্ষা হবে। দুশো জন আবেদনকারী ছিল। পরীক্ষার মধ্যে সবকিছু ছিল। তর্কবিদ্যা থেকে ভাষার গঠন, অঙ্ক এবং সাধারণ জ্ঞান। চারঘন্টার পরীক্ষা।

অঙ্কের পরীক্ষা আমাকে বোকা বানিয়ে দিল। স্কুল ছাড়ার পর অঙ্কের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনদিন কেটে গেছে। বলা হল এখনই আমাকে বিমানবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। শারীরিক পরীক্ষা হবে। আমি অবাক হলাম। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি। মাত্র তিরিশজন আবেদনকারীকে নেওয়া হয়েছে।

এবার শারীরিক পরীক্ষা হবে। আমি নিশ্চয়ই এই পরীক্ষায় পাশ করব।

পরীক্ষা হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন তোমার কি কোনো শারীরিক অসুখ আছে?

–না, শেষ অব্দি বললাম, আমার হার্নিয়া আছে। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হবে না।

যে করেই হোক আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেই হবে। এটাও একটা নতুন স্বপ্ন।

আমাকে আর একটা অফিসে পাঠানো হল। আমার হাতে দুটো ইনডেক্স কার্ড তুলে দেওয়া হল। এবার চোখের পরীক্ষা হবে।

আমাকে বলা হল ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

সব শেষ হয়ে গেল। গ্রেসির কাছে ফিরে গেলাম। রিচার্ডকে সব কিছু জানালাম।

রিচার্ডের মন খারাপ হয়ে গেছে। রিচার্ড বলল তুমি থাকবে না দাদা, আমার একলা থাকতে খারাপ লাগবে।

আমি আশ্বস্ত করে বলেছিলাম–গ্রেসি তোর দেখাশুনা করবেন। মা আর মারতি কদিনের মধ্যেই এখানে আসবে। যুদ্ধ তো আর চিরদিন চলবে না।

পরের দিন সকালে আমি ডাঃ ফ্রেড সেভনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। প্রথম কার্ডে তার নাম লেখা ছিল। অনেকেই সেখানে ভিড় জমিয়েছে। সকলেরই চোখের পরীক্ষা হবে। একঘন্টা বসার পর ডাক পেলাম।

তিনি কার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন এখানে বসুন, আপনি কি পাইলট হবেন? এর জন্য ২০/২০ দৃষ্টি শক্তি দরকার।

তিনি আমাকে একটা ছোটো ঘরে নিয়ে গেলেন। দেওয়ালে একটা চার্ট ঝুলছিল। ডাঃ সেভন ঘরটা অন্ধকার করলেন। তারপর বললেন, ওপর থেকে সবকিছু পড়তে।

দুটো লাইন পড়লাম। আরও লাইন এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই দুটো লাইন পড়তে পারলাম না।

লাইট জ্বেলে দেওয়া হল। ডাক্তার কিছু একটা লিখলেন।

–এটা রিসেপশনিস্টকে দিন। উনি বললেন।

আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার নাম লেখা আছে। তলায় লেখা আছে চোখের দৃষ্টি খুবই খারাপ। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কোনো কিছুই আমার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।

রিসেপশনিস্ট বললেন- স্যার, আপনার কার্ডটা কোথায়?

আমি কথা শুনতে না পাওয়ার ভান করে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

এক ঘন্টা বাদে আমি আমার চোখের ডাক্তারের কাছে পৌঁছে গেলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম।

তিনি বললেন- হ্যাঁ, চোখের দৃষ্টি ভালো না হলে কেউ পাইলট হতে পারে না।

–আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?

এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর কতগুলো গ্লাস বের করে আমার হাতে দিলেন। বললেন- এখনই ব্যাপারটা দেখতে হবে। তোমার কী সমস্যা বলো। কয়েকটা ওষুধ দেব, তা হলেই দৃষ্টিশক্তি বেড়ে যাবে।

আমি হাতে হাত রাখলাম।

 দ্বিতীয় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ডাঃ এডওয়ার্ড গেল।

পরের দিন সকাল দশটা।

 তার অফিসেও একই রকম মানুষের ভিড়।

আমি ভেতরের ঘরে চলে গেলাম। কার্ডটা ডাঃ গেলের হাতে তুলে দিলাম। তিনিও বললেন–এয়ার ক্রপ, বসুন।

ঘরটা অন্ধকার করা হল। দেওয়ালে চার্ট টাঙানো ছিল। তিনি আমাকে পড়তে বললেন। কী আশ্চর্য, মস্ত বড়ো একটা  A  ছাড়া আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উনি অবাক হয়ে গেছেন এই চোখের দৃষ্টি নিয়ে আমি সেনাবাহিনীতে কাজ করব কী করে?

–ডাক্তার, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, সমস্ত সপ্তাহ জুড়ে ভীষণ পরিশ্রম গেছে। চোখ দুটো ক্লান্ত। আমার প্রিয় কাকার মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটা সাংঘাতিক। আপনি কি আমাকে আর একটা সুযোগ দেবেন?

উনি আমার কথা শুনলেন। বললেন তাতে কিছু লাভ হবে কী?

 আমার কণ্ঠস্বরে একটা মরিয়া ভাব ছিল।

 উনি মাথা নেড়ে বললেন –কালকে একবার আসতে পারেন। কিন্তু…..

–অনেক ধন্যবাদ।

 আমি আবার আমার ডাক্তারবাবুর কাছে চলে গেলাম।

আমি বললাম আপনি কী গ্লাস দিয়েছেন। কতক্ষণ পরতে হবে। আমি তো তিরিশ মিনিট ধরেই চশমা পরেছি।

বুঝতে পারলাম, এই চার্টটা আমাকে মুখস্থ করতে হবে।

 কিন্তু বিভিন্ন চার্টে কি একই রকম বর্ণ সংস্থাপন করা হয়? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

পরের দিন সকাল দশটায় আমি আবার ডাঃ গেলের অফিসে গিয়ে হাজির হলাম।

উনি বললেন আপনি কেন এসেছেন?

–আর একবার চেষ্টা করতে দোষ কী?

আমরা একই ঘরে ফিরে গেলাম। আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। আমি চেয়ারে বসলাম। চার্টের লেখাগুলি পড়ার চেষ্টা করলাম। ডাঃ পিটারস ঠিকই বলেছিলেন। এখন লেখাগুলো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। শেষ লাইনটা পর্যন্ত পড়ে ফেললাম।

লাইট জ্বলে উঠল। ডাঃ গেল অবাক। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন আমি জীবনে এমন ঘটনা কখনও দেখিনি। তিনি বললেন, শেষের দুলাইনে আপনি দু-একটা বর্ণ পড়তে পারেননি, আপনার ২০/২০ কেন, আরও বেশি দৃষ্টিশক্তি আছে।

পরের দিন সকালে আমি আর্মি অফিসারের কাছে রিপোর্ট করলাম। এটা ফেডারেল বিল্ডিং-এ অবস্থিত। তিনি আমার কার্ডের দিকে তাকালেন। বললেন –ঠিক আছে, এবার আপনাকে কিছু শিক্ষা নিতে হবে।

তার মানে আমি সরাসরি যোগ দিতে পারব না?

–হ্যাঁ, আপনি কি ওয়ার ট্রেনিং সার্ভিসের নাম শুনেছেন?

–না, স্যার।

–এটা হল আর্মি এয়ার ক্রুপের একটা নতুন বিভাগ। একে সিভিল এয়ার পেট্রল বলা হয়। এখানে আপনাকে অনেক কিছু শেখানো হবে। আপনি কী করে ফেরি নিয়ে ইওরোপে যাবেন, তা আপনাকে শিখতে হবে। অথবা যদি আপনি ফ্লাই ইনস্ট্রাকটর হতে চান, তাহলেও আপনাকে অনেকগুলি বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হবে। কিন্তু আপনি যুদ্ধ বিমান চালাবেন না। আপনি কি তাই চালাতে চাইছেন?

-হ্যাঁ, স্যার। আমি তাই চাইছি।

–আপনি তো নিয়মিত সৈন্য হবেন না। আপনাকে নিজস্ব ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনাকে ক্যাডারদের মতো টাকা দেওয়া হবে। তাহলে হবে তো?

-হ্যাঁ, স্যার।

–আপনাকে রিফিল্ডের উটাইতে যেতে হবে। আজ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে।

আমার মন অধীর হয়ে উঠেছে।

মা তার নতুন স্বামীর সঙ্গে আমাদের কাছে এল। রিচার্ড আর আমি তাদের আনতে গেলাম। ভদ্রলোক খর্বাকৃতি। মাথায় ধূসর চুল। মুখে খুশি-খুশি ভাব। তাকে আমার পছন্দ হয়ে গেল। আমরা তার সঙ্গে রাতের খাবার খেলাম। সব কথা গুছিয়ে বললাম।

মারতি বললেন –তোমার একটা ইউনিফর্ম দরকার। চলল, আমরা শপিং করতে যাই।

ইউনিফর্ম সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। মারতি আমাকে একটা আর্মি নেভি স্টোরে নিয়ে গেলেন। সুন্দর অফিসারের ইউনিফর্ম কিনে দিলেন। এর সঙ্গে ছিল চামড়ার ফ্লাইং জ্যাকেট। একটা সাদা রুমাল কিনলাম, গলায় ঝুলিয়ে রাখব বলে। মনে হবে, আমি যেন সত্যিকারের পাইলট।

আমেরিকা যেন যুদ্ধে জেতে, এমন একটা মনোভাব নিয়ে আমি শিক্ষানবীশ হয়ে গেলাম।

.

১০.

রিফিল্ড ছোট্ট একটা শহর। ছ-হাজারের মতো জনসংখ্যা। চারপাশে মনরো পাহাড়ের উপস্থিতি। ভারী সুন্দর একটা হোটেল, মেইন স্ট্রিটে অবস্থিত। আমরা ক্যাডাররা আমাদের ঘরে পৌঁছে গেলাম। সবাই লবিতে গেলাম। এক লম্বা চেহারার ভদ্রলোক, ইউনিফর্ম পরা, সামনে এসে দাঁড়ালেন।

তিনি বললেন–সকলেই চেক করেছো?

 আমরা একসঙ্গে বললাম–হ্যাঁ, স্যার।

–আমি ক্যাপটেন অ্যান্ডারসন, তোমাদের চিফ ইনস্ট্রাকটর। পনেরো মিনিটের দূরত্বে এয়ারপোর্ট অবস্থিত। একটা বাস তোমাদের সকাল ছটার সময় এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। রাতে ভালো করে ঘুমোবার চেষ্টা কোরো।

উনি চলে গেলেন। পরের দিন সকালে আর্মি বাস এসে আমাদের এয়ার ফিল্ডে নিয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

তিনি কাছাকাছি বাড়িতে চলে গেলেন। আমরা সকলে তাকে অনুসরণ করলাম। এই বাড়িটাকে একটা স্কুলে পরিণত করা হয়েছে। ঘরগুলো যেন ক্লাসঘর।

আমরা বসলাম।

তিনি বললেন তোমাদের ছ মাসের ফ্লাইং কোর্স শেখানো হবে। কিন্তু এখন যুদ্ধ চলছে, আমরা তিনমাসে এটা শেষ করব। তোমরা ম্যাপ পড়তে শিখবে, বাতাসে কীভাবে বিমান ভেসে থাকে, সে বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করবে। এর পাশাপাশি আবহাওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারেও তোমাদের কিছু শেখানো হবে। এই ব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে চাও?

আমরা কেউ প্রশ্ন করতে চাইলাম না।

ক্লাস শুরু হল। অনেকগুলো বই পড়তে হল। সারাদিন ক্লাসের মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

ঘাড়ের ওপর চাপ পড়ে গেছে। একটার পর একটা ক্লাস। এতটুকু ফুরসত নেই। হাসিঠাট্টা করার উপায় নেই।

ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন অনর্গল বলে চলেছেন। তিনমাসে কি ছমাসের পাঠক্রম শেষ করা সম্ভব?

রোজ একই গতানুগতিক রুটিন পালন করতে হচ্ছে। ক্লাস শেষ করার পর ফিন্ডে গিয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে হচ্ছে।

একদিন ক্লাসে ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন বললেন তোমাদের দুটো জিনিসের ওপর নজর দিতে হবে। সবসময় সামনের দিকে তাকাবে। আর পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখবে শত্রুপক্ষের বিমান আশে-পাশে এসেছে কিনা। যতটা উঁচুতে উঠবে, তার সঙ্গে গতি বজায় রাখতে হবে। কখনও যেন বিমানটা দুর্ঘটনায় না পড়ে।

এবার সত্যিকারের ট্রেনিং শুরু হল। হ্যাঁ, আকাশ আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের সীমারেখা। আমরা ৭৫০০ ফুট উঁচুতে উড়ে গেলাম।

ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন বললেন- এবার আমরা ঘুরপাক খাব।

 বিমানটা ঘুরতে শুরু করেছে। এটাই সত্যিকারের সমস্যা।

আমি কিছুতেই বিমানটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠছে চোখে-মুখে। আমার এই বিপর্যয় দেখে ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন খুবই হতাশ হয়েছেন।

পরের দিন আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

শেষ পর্যন্ত বিমানটাকে নামানো হল। ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন জিজ্ঞাসা করলেন তুমি, আজ সকালে ব্রেকফাস্ট খাওনি?

-হ্যাঁ, স্যার।

–কাল থেকে তুমি লাঞ্চের আগে কিছু খেও না, কেমন?

–তার মানে? এতক্ষণ না খেয়ে থাকব কী করে?

এই প্রথম ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন আমাকে নিয়ন্ত্রণ শেখালেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমার এক ধরনের অসুখ করেছে। তখন থেকে আমি আরও অনুভবী হয়ে উঠলাম। কাজের প্রতি মনোযোগ বেড়ে গেল।

প্রত্যেক সপ্তাহে আমি রিচার্ডকে ফোন করতাম। মাকেও ফোনে সব কিছু জানাতাম।

একদিন রিচার্ড আমাকে একটা খুশির খবর দিল।

সে বলল–সিডনি, আমিও যুদ্ধে যোগ দেব।

হঠাৎ আমার মনে হল, এ কী, রিচার্ড তো এখন আর ছোট্ট ছেলেটি নেই।

আমি বললাম তোকে অনেক ধন্যবাদ।

ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন আমাকে আরও পাকাঁপোক্ত করে তুলতে চাইলেন। একদিন তিনি দেখলেন, ইঞ্জিনটা ঠিক মতো কাজ করছে না। তিনি বললেন–সেলডন, এখনই তোমাকে জরুরি অবতরণ করতে হবে।

আমি নীচের দিকে তাকালাম। নামাবার মতো কোনো জায়গা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু চোখে মুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি আনা চলবে না। আমি ধীরে ধীরে প্লেনটাকে আরও নীচে নিয়ে এলাম। তারপর অবতরণ করার মতো একটা জায়গা পেলাম।

যখন আমি অবতরণ করতে যাব, ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন মেশিনটা চালিয়ে দিলেন। বললেন –আবার ওপরে উঠে যাও।

একদিন ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন বললেন এবার তোমাকে একাই বিমান চালাতে হবে।

উত্তেজনায় সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।

-একটা কথা মনে রেখো, উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে গতিকে নিয়ন্ত্রণ করো। তা না হলে সর্বনাশ।

আমি প্যারাস্যুটটা দেখে নিলাম। এই প্রথম বিমানে আমি একা। সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসের বুকে উড়ান পাখি ভেসে গেল। অসাধারণ অনুভূতি। স্বাধীনতার স্বপ্ন। পৃথিবীর সীমারেখা পার হয়ে মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছি, এমন একটা অনুভূতি।

আমি ৬১০০ ফুট উচ্চতায় উড়ে গিয়েছিলাম।

সেখানে আমাকে কুড়ি মিনিট থাকতে বলা হয়েছিল। ঘড়ির দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, এবার ভালোভাবে অবতরণ করতে হবে। আমি নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছি। তারা ফিন্ডে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য।

কোথায় অবতরণ করতে হবে তা আগে থেকে বলা আছে। আমি মাটির কাছাকাছি নেমে এলাম। আলটিমিটারের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, কতটা গতি রাখতে হবে, তা আমি ভুলে গেছি। আসলে সব কিছুই তখন মাথার বাইরে চলে গেছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেলাম। যে কোনো মুহূর্তে বিমানটায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমি গতি আর উচ্চতার সূত্র মনে করার চেষ্টা করলাম। মনটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। যদি ভুল হয়, তাহলে আমার মৃত্যু হবে। সমস্ত শরীরে ভয় ঢুকেছে। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি আবার নামতে শুরু করলাম। হা, ফরমূলাটা একেবারে ভুলে গেছি। হাজার ফিট নেমে গেছি। এখন ঘণ্টায় ৬০ মাইল গতি রাখতে হবে।

৩০০ ফুট, ঘণ্টায় ৫০ মাইল গতি রাখতে হবে। আমার গতিটা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে?

বিমানটা আছড়ে পড়ল মাটির ওপর। দুলে উঠল। আবার আছড়ে পড়ল, আবার দুলে উঠল। শেষ পর্যন্ত স্থির হল। আমি ব্রেক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। কাঁপতে কাঁপতে বিমান থেকে বেরিয়ে এলাম।

ক্যাপটেন অ্যান্ডারসন শহরে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন –এ কী করলে? এমন করে কেউ বিমান নামায়।

আমার সমস্ত শরীরে ঘাম, না, ভুল হয়ে গেছে। পরের বার ভুল হবে না।

–আমাদের অভিধানে পরের বার বলে কিছু নেই। তোমাকে এখনই করতে হবে।

আমার মাথা ঘুরছে, এখনই?

-হ্যাঁ, তুমি বিমানটাকে আবার ওড়াবে।

উনি বোধহয় ঠাট্টা করছেন। আমি অপেক্ষা করছি। আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করছি এখনই কি আমায় উড়তে হবে?

উনি বললেন–হ্যাঁ, এটা আমার আদেশ।

সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিমানটাকে আবার বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম। মনটা শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। ক্লাসে যা শিখেছিলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। এবার আমার মনটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি পনেরো মিনিট আকাশে ছিলাম। এবার সুন্দরভাবে বিমানটাকে নামিয়ে আনলাম।

বিমানের সামনে এগিয়ে এসে ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন বললেন ভালো হয়েছে। কাল আবার তোমাকে বিমান ওড়াতে হবে।

এরপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। তখন পাঠক্রম প্রায় শেষ হয়ে আসছে। একটা স্মরণযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল।

সেই সকালে আমি সবে মাত্র বিমানটাকে ওড়াব, ক্যাপ্টেন অ্যান্ডারসন বললেন –আমরা শুনেছি ঝড় আসছে, সেলডন। ঝড়ের দিকে নজর দিতে হবে। ঝড়ের সংকেত দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বিমানটাকে অবতরণ করাবে।

আমি বিমানটাকে আকাশের বুকে ভাসিয়ে দিলাম। পাহাড়ের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ওপর নীচে হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছি। হ্যাঁ, এই পথে ঝড় আসতে পারে।

আমি কী করব?

খবরটা সর্বত্র হয়তো ছড়িয়ে পড়বে। রেডিও এবং টেলিভিশনে সারা পৃথিবী জানতে চাইবে, আমি নিরাপদে অবতরণ করতে পারলাম কিনা। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে কি? অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র? না, এ হল আমার দিবাস্বপ্ন। আমাকে সাহসের পরিচয় দিতে হবে।

হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এল। এবার আমার বিমানটা ঝড়ের মুখে আটকে পড়েছে। আমি অন্ধের মতো চালাবার চেষ্টা করছি। চারপাশে কালো মেঘের হাতছানি। এয়ারফিল্ড দেখতে পাচ্ছি না। আমি জানি, যে কোনো মুহূর্তে পাহাড় চূড়ার সঙ্গে ধাক্কা লাগতে পারে। এক সেকেন্ডে আমি হয়তো জীবন থেকে মৃত্যুর কাছে চলে যাব।

সামনে কোনো এয়ারফিল্ড আছে কি? কোনদিকে?

 বিমানটা অসহায়ের মতো দুলছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কাগজের শিরোনাম–পাহাড়টাকে এড়িয়ে যাব কী করে? আমি ছোটো বৃত্তের মাধ্যমে নীচে নামার চেষ্টা করছি। নীচে আরও নীচে। কোনো একটা নিরাপদ জায়গায় কিছুক্ষণ ভেসে থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমি মাটি থেকে ৩০ ফুট উঁচুতে চলে এলাম। এখন কিছু কিছু দেখতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, ক্রু-রা সব তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

আমি কোনরকমে বিমানটাকে অবতরণ করালাম। আমার প্রশিক্ষক এগিয়ে এলেন। তিনি খুবই রেগে গেছেন।

তিনি বললেন আমি তো বলেছি ঝড়টাকে লক্ষ্য করতে।

-হ্যাঁ, আমি ঝড়ের দিকে নজর রেখেছিলাম।

ক্যাপটেন অ্যান্ডারসন একদিন বললেন এবার ট্রেনিং শেষ হয়েছে। তোমরা বিমান ওড়াতে শিখে গেছে। কিন্তু এখন হাতে যথেষ্ট যুদ্ধ বিমান নেই। তাই কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তখনই আমার মনে বেন রবার্টসের কথা এল। আমি ভাবলাম, নিউইয়র্কে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়?

আমি সকলকে গুডবাই জানালাম। প্লেন ধরে নিউইয়র্কে উড়ে চলেছি। এখনই বেনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।