টলমল পদভরে

টলমল পদভরে

১৯৫০ সনের ১৫ই আগস্ট। রাত তখন গোটা নয়েক হবে। হঠাৎ ঘড়-বাড়ি দালান-কোঠা সব দুলে উঠল। মাথার ভেতরটা আচমকা বোঁ করে ঘুরে উঠতেই সবাই বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী। ভূমিকম্প, ভূমিকম্প’ : একটা মাতাল দৈত; যেন তার পায়ের দাপটে পৃথিবী কাঁপিয়ে এগিয়ে আসছে–ক্রমাগত এগিয়ে আসছে….।

তারপর জানা গেল, দৈত্যটা সারা দেশের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে পাহাড়-নদী, শহর-গ্রাম, বাড়ি-ঘর সব দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গিয়েছে। কেবল আসামেই নয়–ঢাকায়, কোলকাতায়, এমন কি আসাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে পর্যন্ত এই ভূমিকম্পের ধাক্কা গিয়ে লেগেছে। রোজকার রোজ খবরের কাগজে বড় বড় হরফে ছাপা হতে লাগল আসামের ভূমিকম্পের খবর।

পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দুনিয়াতে এত বড় ভূমিকম্প কখনোও হয় নি। আসামের উত্তর-পুব সীমান্তের কোণায় তিব্বতের পাহাড়ের ভেতর থেকে এই ভূমিকম্পের শুরু। তার জোরালো কাঁপুনির ধাক্কায় প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে পুণার মান-মন্দিরে ভূমিকম্পের কাঁপুনি-ধরা যন্ত্রের কাঁটা যায় একদম বিগড়ে। কোলকাতা শহরেও কাঁপুনি-মাপা কাটা যন্ত্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাহলেই এখন বোঝ কী ভীষণ ব্যাপারখানা!

ভূমিকম্পে আসামের তিন ভাগের দুভাগ এলাকাতেই সব চাইতে বেশি ক্ষতি হয়। হাজার হাজার ঘড়-বাড়ি ভেঙ্গে পড়ে। তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা হল, ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ের বিরাট বিরাট ধ্বস নেমে ব্রহ্মপুত্র এবং অন্যান্য নদীর পথ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্রহ্মপুত্র, ডিব্ৰু, দিহাং, সুবনসিরি–এই সবগুলো নদীতে বিপুলভাবে বান ডাকে। আর এই বানে সারা দেশ ভেসে গিয়ে হাজার হাজার গরু, মোষ, জন্তু-জানোয়ার, মানুষ মারা পড়ে।

ভূমিকম্পের পরে যারা উড়োজাহাজে করে ওসব এলাকা সফর করে এলেন তারা বললেন, সমস্ত পাহাড়ী দেশের চেহারা রাতারাতি একদম বদলে গিয়েছে। হিমালয় পর্বতের বিরাট একটা অংশকে নাকি আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না অনেক পাহাড়ের চূড়া বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। নদীর পথ-ঘাট গিয়েছে বদলে। আবর আর মিমি পাহাড়ের কাছে কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সমস্ত সভ্য জগৎ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে পড়েছে।

বড় একটা কাণ্ড ঘটলে যেমন হয়, আসামের ভূমিকম্পের পর নানান জনে এর সম্বন্ধে নানান কথা বলতে শুরু করলেন। কেউ বললেন, গৌরীশৃঙ্গের চূড়োটা এইবার আরও খানিকটা উঁচু হয়ে গিয়েছে। কেউ বলেন, না না, আসল কথা হচ্ছে। সমস্ত হিমালয় পাহাড়টাই আস্তে আস্তে দক্ষিণ দিকে নেমে আসছে। আবার কেউ বলেন, ওসব কিছুই নয়–দুনিয়া পাপে-তাপে এমন ভরে উঠেছে যে পৃথিবীর আর মোর্টেই সহ্য হচ্ছে না, এটা তারই একটা লক্ষণ মাত্র!

কিন্তু যত জনে যত কথাই বলুক, ১৫ই আগস্টের পর থেকে কিছুদিনের মধ্যে আসামের নানা জায়গায় ছোটখাট সব মিলিয়ে কয়েক শো ভূমিকম্প হল। বিজ্ঞানীরা বললেন, ওতে ঘাবড়াবার কিছু নেই; বড় রকম একটা ভূমিকম্পের পর ওসব ছোটখাট ধাক্কার রেশ মিটতে এক বছরও লাগতে পারে।

ভূমিকম্প সম্বন্ধে মানুষের ভয় চিরকালের। আর ভয় থাকবে না-ই বা কেন? এ তো আর বাঘ-ভালুক সাপ নয় যে, দল বেঁধে শিকার করে কাবু করা যাবে। ধরিত্রী যখন হঠাৎ একবার উত্তাল হয়ে ওঠে তখন মাঝে মাঝে একেবারে প্রলয়কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। কাজেই আগের দিনের মানুষ ভূমিকম্পকে দৈব ব্যাপার মনে করে ভয় করবে, এ তো খুবই স্বাভাবিক।

আগেকার দিনে একদল লোক ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে বলত সহস্র ফণাওয়ালা নাগরাজ বাসুকি পৃথিবীকে তার মাথার ওপর নিয়ে আছেন; মাঝে মাঝে হয়রান হয়ে তিনি পৃথিবীকে এক ফণা থেকে আরেক ফণার ওপর নিয়ে যান আর তখনই ভূমিকম্প হয়।

গ্রীকদের পুরাণেও ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে এমন ধরনের এক কাহিনী আছে। তবে তারা বলত, নাগরাজ বাসুকি-টাসুকি নয়, পৃথিবীটা রয়েছে আসলে দেবতা হারকিউলিসের কাঁধের ওপরে। তিনি তাকে এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে বদলি করেন; তাই ভূমিকম্প দেখা দেয়।

আজকের বৈজ্ঞানিক যুগে অবশ্য এ ধরনের কাহিনী আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কেননা, আজকের একেবারে বাচ্চা ছেলেটিও জানে যে, হারকিউলিসের কাঁধও নয় বাসুকির ফণাও নয়, পৃথিবীটা নেহাতই শূন্যের ওপর ঝুলে আছে।

প্রকৃতির নিয়মের রাজত্বে কোন রকম ব্যতিক্রম ঘটলেই প্রলয় হয়–ভূমিকম্পও এমনি একটা প্রলয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাবতেন, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র এগুলো আজকে যেমনটি আছে তেমনি চিরকাল থাকবে; এর কোন রকম ব্যতিক্রমের কথা চিন্তা করাও ছিল তাদের কাছে পাপ। তাই কোন জায়গায় হঠাৎ কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গেলেই তারা দারুণ হকচকিয়ে যেতেন।

কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে মানুষের সব কিছু জানবার ইচ্ছেও বেড়েছে। তার ফলেই আজ আমরা প্রকৃতির এমন নানা রহস্যের খোঁজ পেয়েছি যাতে মানুষের জীবন আগের চাইতে অনেক বেশি সহজ আর সুন্দর হয়ে উঠেছে।

মানুষের এই অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহের দরুনই আজ আমরা জানি যে, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র ঠিক আজকে যেমনটি রয়েছে চিরদিন এরকম থাকতে পারে না—পরিবর্তন হবেই। আজ যেখানে বিরাট পাহার দাঁড়িয়ে আছে, একদিন হয়তো সেখানে হবে বিশাল সমুদ্র; আজ যেখানে আছে গভীর সমুদ্র সেখানে হয়তো বা সৃষ্টি হবে হিমালয়ের মতন বিশাল পর্বত।

আর তোমরা শুনে অবাক হবে, দুনিয়ার সব চাইতে বড় পর্বত যে হিমালয়, সেটা একদিন সত্যি সত্যি সমুদ্রের নিচে ডুবে ছিল। ভূ-বিজ্ঞানীদের (অর্থাৎ যেসব বিজ্ঞানী দুনিয়ার গড়ন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন) মতে, দুনিয়াতে বড় বড় যত পাহাড় আছে তার মধ্যে হিমালয়ের বয়সই নাকি সব চাইতে কম; এত কম যে ‘বুড়ো খোকা’ হিমালয়ের নাকি এখনও গড়ে ওঠাই শেষ হয় নি। একটু যুতসই মতো নড়েচড়ে বসতে গিয়েই আসামের ভূমিকম্পটা হয়ে গেল।

হিমালয়ের জন্ম সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেন, একবার একটা বিরাট ভূমিকম্প হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তলাটা মিন্দানাও দ্বীপের কাছে অনেকখানি বসে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর উলটো দিকে গজিয়ে ওঠে বিরাট হিমালয় পর্বত। এটাও সেই ভূমিকম্পেরই কীর্তি।

তোমরা হয়তো বলবে, হিমালয় যে একদিন সত্যিই সমুদ্রের নিচে ছিল, তা কী করে বোঝা গেল?-হ্যাঁ, তারও প্রমাণ আছে বৈকি। বিজ্ঞানীরা হিমালয় পাহাড়ের চূড়োয় বরফের ভেতর থেকে এমন সব ফসিল হয়ে যাওয়া শামুক, ঝিনুক আর মাছের হাড় খুঁজে বের করেছেন যেগুলো বহু লক্ষ বছর আগে গভীর সমুদ্রের তলাতেই কেবল পাওয়া যেত। এ থেকেই বোঝা যায় পৃথিবীর ওপর একটা ওলট-পালট হয়ে সমুদ্রের নিচে থেকে পাহাড়টা ওপরের দিকে মাথা তুলে দিয়েছিল, আর তখনই ওই সব শামুক আর মাছের কাঁটাগুলোও ওপরে ওঠে যায়।

তোমরা শুনে আরো আশ্চর্য হবে, আজ যেখানটায় চাটগাঁ শহর সে জায়গাও যে এককালে সমুদ্রের তলায় ডুবে ছিল বিজ্ঞানীরা চাটগাঁয় পাহাড়ের মাটির স্তর পরীক্ষা করে নাকি তারও প্রমাণ পেয়েছেন।

ঐতিহাসিক যুগেই একবার মানুষের চোখের সামনে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়। ১৭৫৫ সালে এক ভূমিকম্পে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরের একটা অংশ ষাট হাজার লোক নিয়ে মাত্র ছ’মিনিটের মধ্যে একদম সমুদ্রের ভেতর তলিয়ে যায়।

করাচির কিছুটা নিচে ভারতের ম্যাপে দেখবে একটা ঠোঁটের মতন জায়গা বেরিয়ে আছে-এটাকে বলে কাথিওয়াড় উপদ্বীপ। এর উত্তরে যে কচ্ছ উপসাগর, এটা মাত্র দুশো বছর আগেও ছিল একটা শুকনো জায়গা। জায়গাটা ১৮১৯ সালে সমুদ্রের ভেতর ডুবে গিয়েছে।

আজকাল বিজ্ঞানীদের মত হচ্ছে, সব সময়েই দুনিয়ার ওপরে কোন না কোন জায়গায় ছোটখাট ভূমিকম্প হচ্ছেই। প্রতি বছর দুনিয়াতে ছোটবড় কয়েক লক্ষ ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্প বা ১৯৬৮ সালে ইরানের খোরাসান এলাকায় যে ভূমিকম্পে এক সঙ্গে প্ৰয় ২৫,০০০ লোকের প্রাণ হারায়। এত বড় ভূমিকম্প খুব কমই হয়ে থাকে।

ভূমিকম্পের নানান কারণ থাকতে পারে; যেমন জোয়ার-ভাটার টান, জলপ্রপাত, আগ্নেয়গিরি এই সব। তাছাড়া, পৃথিবীটা সব সময় তার মেরুদণ্ড ত্যারচা রেখে সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তার জন্যেও নাকি এর ভেতরে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়।

তবে মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানীদের মতে ভূমিকম্পের আসল কারণ হচ্ছে মাটির নিচে কোন স্তর ফেটে যাওয়া—-যাতে করে আশেপাশের স্তরগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে সেখানে পড়তে থাকে। তাহলেই তোমরা এবার প্রশ্ন করে বসবে, কিন্তু এই স্তরগুলো ফাটে কেন?

প্রশ্নটা মোটেই সহজ নয়–তবু একবার বোঝার চেষ্টা করা যাক।

পৃথিবীর ওপরটা দিব্যি ঠাণ্ডা দেখলে কি হয়, ভেতরে এর এখনও দস্তুরমতো গরম। যারা মাটির নিচে খনির ভেতরে নেমে কাজ করে তারাই এটা জানে। ভেতরটা এত গরম যে, মাটির শ’খানেক কিলোমিটার নিচেই ধাতুগুলো প্রায় গলা অবস্থায় রয়েছে পৃথিবীর ওপরকার অংশটা তারই ওপরে ভাসছে।

পৃথিবীর ভেতরকার এই তাপ সব সময়েই নানানভাবে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে–আর তার ফলে পৃথিবীটা ক্রমে ক্রমে ঠাণ্ডা হচ্ছে আর সংকুচিত হয়ে আসছে। তাছাড়া পৃথিবীর ওপরকার লক্ষ লক্ষ টন ওজনের পাহাড় পর্বত আর মাটির স্তরের চাপ পড়ছে ভেতরের ওই প্রায় তরল অংশের ওপরে। এর দরুনও ভেতরকার স্তরের খানিকটা সংকোচন হয়। অবশ্যি এই সংকোচন খুবই সামান্য–একশো বছরে হয়তো কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র।

কিন্তু এসবের জন্যে পৃথিবীর বাইরের দিককার স্তরগুলোর ওপর একটা দারুণ রকমের চাপ পড়ছে–অনেক সময় চাপের চোটে এগুলো বাঁকা হয়ে ভাঁজ হয়ে যায়।

ধর, একটা রবারের বলের ওপর তুমি আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিচ্ছ, এতে বলটা খানিকটা টোল খেয়ে সংকুচিত হয়ে যাবে। তারপর হাতটা ছেড়ে দাও, সঙ্গে সঙ্গে নিচু জায়গাটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। এই যে আগের অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা, এর নাম হচ্ছে স্থিতিস্থাপকতা গুণ।

পৃথিবীরও এই রকম স্থিতিস্থাপকতা আছে। তাই চাপ পড়ে কুঁচকে যাওয়া স্তরগুলো সব সময়েই আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইছে। চাপ বাড়তে বাড়তে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছয় যে স্তরগুলো আর কিছুতেই তা সইতে পারছে না, তাহলে স্তরটা হঠাৎ ফেটে যায়। কিংবা হঠাৎ যদি কোন প্রাকৃতিক কারণে চাপ বেশি রকম কমে যায় তাহলেও স্তর ফাটতে পারে।–আর অমনি শুরু হয় একটা বিরাট আলোড়ন।

আরো এক ধরনের ভূমিকম্প হয়। ধরো, হিমালয় পর্বত থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ওজনের কাদা-বালি-পাথর ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, সিন্ধু এই সব নদীর মোহনায় এসে পড়ছে। এগুলো জমে জমে এই সব অঞ্চলের মাটির ওপর বিপুল এক চাপ দিচ্ছে। এই চাপ সইতে না পেরে অনেক সময় দুর্বল জায়গায় স্তর-বিপর্যয় হয়, আর অমনি তা ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে।

অবশ্য এটা ঠিক যে, সাধারণত আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি জায়গাতেই ভূমিকম্প বেশি হয়। তাই লোকে মনে করে আগ্নেয়গিরির জন্যেই ভূমিকম্প হচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তার উলটো। কোন জায়গার পাথুরে স্তর ভাজ হয়ে ফেটে গেলেই মাটির নিচ থেকে ভেতরের সব গলা ধাতু, লাভা আর নানান রকম বাষ্পীয় পদার্থ ছিটকে বেরুতে থাকে প্রবল বেগে। সেই জন্যে প্রায়ই ভাঁজপর্বতের কাছাকাছি আগ্নেয়গিরি থাকে, আর সেখানে ভূমিকম্প বেশি হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের ধার দিয়ে এমনি বহু ভাঁজপর্বত আছে।

জন মিলনে নামে একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী প্রথম ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। দুনিয়ার ইতিহাসে যত বড় বড় ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে পুরনো বই ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি তার তালিকা করেন। তা থেকে নাকি দেখা যায় দুনিয়াতে ভূমিকম্পের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

খুব দূরে ভূমিকম্প হলেও তার ঢেউ-এর কঁপনি ধরবার জন্যে মিলনে সাহেব এক রকম যন্ত্র তৈরি করেছেন তার নাম হচ্ছে ‘সাইসমোগ্রাফ’ (Seismograph)। আজকাল সব দেশের মানমন্দিরেই এই যন্ত্র রাখা হয়। অবশ্য, এখন এর আরো অনেক উন্নতি হয়েছে।

কোন জায়গায় ভূমিকম্প হলেই তা ঢেউ-এর আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে–ঠিক পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন ঢেউ ওঠে, তেমনি। ভূমিকম্পের নানান ধরনের ঢেউ হয় লম্বালম্বি ঢেউগুলো সেকেণ্ডে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলে। আড়াআড়ি ঢেউগুলোর বেগ এর চাইতে কিছু কম। যন্ত্রে এই সব ঢেউয়ের কাঁপুনি থেকেই কত দূরে আর মাটির কতখানি নিচে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে বিজ্ঞানীরা তা বুঝতে পারেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের ওপর যে সব কারণে টানাপোড়েন পড়ে আর স্তরটা ধ্বসে যায় তার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু আবহাওয়ার ব্যাপারে যেমন আমরা কখন ঝড়-বৃষ্টি হবে তা অনেক আগেই হাওয়া অফিস থেকে বলে দিতে পারি, ভূমিকম্পের ব্যাপারে তেমনিভাবে কোন সময়ে কোন স্তরটা ধ্বসে পড়বে তা আগে থেকে বলা যায় না। সাধারণত দেখা যায়, পূর্ণিমা বা অমাবস্যার কাছাকাছি ভূমিকম্প বেশি হয়। যে টানে জোয়ারের পানি ফুলে ওঠে হয়তো ঠিক একই টানে দুর্বল স্তরটা চাপ সইতে না পেরে ফেটে যায়।

তবে, বিজ্ঞানীরা কিছুতেই প্রকৃতির কাছে হার মানতে রাজি নন। হয়তো একদিন এমন যন্ত্র তারা আবিষ্কার করে ফেলবেন যাতে কোথায় কোন সময়ে মাটির স্তর দুর্বল হয়ে পড়েছে আর শীগগিরই ভূমিকম্প হবে তা আগেভাগেই টের পাওয়া যাবে। আর সে সব জায়গার লোকে সাবধান হয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারবে।

ভূমিকম্পকে আগে থেকে ঠেকানো না গেলেও, ভূমিকম্পে ক্ষতি যাতে কম হয় তার জন্যে কংক্রিটের বাড়িগুলো বেশ টেকসই বলে মনে হয়। তাই আজকাল সাবেক ইটের বাড়ি ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে। জাপানে হরহামেশা ছোটখাট ভূমিকম্প লেগেই আছে; সেখানে ভূমিকম্প থেকে বাঁচার জন্যে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি তৈরির রেওয়াজ উঠে গিয়ে তার জায়গায় তৈরি হচ্ছে বিরাট বিরাট কংক্রিটের বাড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *