ঘড়ি চলে টিক টিক

ঘড়ি চলে টিক টিক

বাংলাদেশ হবার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে শেষটায় নীলুরা করাচি থেকে ঢাকায় এলো। হাওয়াই জাহাজে আসতে বেশ লাগছিল তীর। রাশি রাশি তুলো-পেঁজা মেঘের ওপর দিয়ে কত মাঠ-ঘাট নদী-নালা পেরিয়ে, ঝকঝকে আলোমাখা ঢাকা….. ঢাকা।

হ্যাঁ, কতো দিন কতো আশা করে ….. করে …..শেষটায় সত্যি সত্যি তারা ঢাকায় এলো তাহলে! নীলুর মামা কোন এক কলেজের প্রফেসর, প্রথমে তার বাসাতেই গিয়ে ওঠল তারা।

কিন্তু মামা-বাড়ি এলে কি হয়, সব কিছু নীলুর কাছে কেমন যেন ওলট-পালট ঠেকে–মামী নামাজ পড়তে বসেছিলেন। নীলু জানে নামাজ পড়তে হয় পশ্চিম দিকে মুখ করে, কিন্তু তার কাছে মনে হল মামী যেন দক্ষিণ দিকে ফিরে নামাজ পড়ছেন।

কি একটা ব্যাপারে আব্বার হাতের ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সে আরো অবাক হল। আব্বার হাত ঘড়িতে বাজছে চারটে, কিন্তু মামাদের দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজিয়ে দিয়েছে কেন? ঘড়ি কোনটা যে খারাপ হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এমন সময় তার আব্বা নিজে থেকেই বললেন : ওহ হো; আমার ঘড়ির সময়টা তো ঠিক করে নিতে হবে; এখানকার ঘড়ি আবার আগে আগে চলে কিনা।

নীলু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল : তাহলে আসলে এখন কটা বাজে আব্বা, চারটে, না পাঁচটা? আব্বা এ-কথার পরিষ্কার কোন জবাব দিতে পারলেন না। কেমন একটু আমতা আমতা করে বললেন : আসলে ঠিক সময় বলে তো কিছু নেই; লোকে যা বলে তাই হয়। করাচির লোকেরা বলছে এখন চারটে বাজে, তাই তাদের কাছে এখন বিকেল চারটে। ঢাকার লোক বলছে এখন পাঁচটা বাজে, তাই তাদের ঘড়িতে এখন পাঁচটা।

কিন্তু নীলু বুঝতে পারল ব্যাপারটার মধ্যে কি একটা গোলমাল আছে। নইলে একই সময়ে এক এক জায়গার লোক খামাখা ঘড়িতে নিজেদের খেয়ালখুশি মাফিক এক একটা সময় বাজিয়ে রাখবে কেন? তার আব্বাও কথাটা বলেই বিজ্ঞানের প্রফেসর নিলুর মামার মুখের দিকে তাকালেন।

মামা কি একটা মোটা বই পড়ছিলেন। তার পাতা থেকে ঘার তুলে বললেন : আসলে সময়ের এই তফাতটা নেহাতই কল্পনা বা খেয়ালখুশির ব্যাপার নয়; মানুষ দরকারে পড়েই সময়ের নানা রকম নিয়ম-কানুন বানিয়েছে। যেমন ধর, ইস্কুলে পড়ায় সূর্য মাথার ওপর ওঠে বেলা ঠিক দুপুর হলে ঘড়িতে বারোটা বাজবে; সেইটেই হল আদত ঠিক সময়। কিন্তু দুনিয়াটা গোল বলে এর সব জায়গায় একই সময়ে ঠিক দুপুর হয় না। তাই বারোটাও আর সব জায়গায় একই সময়ে বাজে না। ঢাকায় যে সময়ে সূর্য মাথার ওপরে ওঠে কোলকাতায় ওঠে তার ৮ মিনিট পরে, করাচিতে দেড় ঘণ্টারও বেশি পরে। কাজেই দেখ, সারা দুনিয়ার জন্যে একটাই আসল ঠিক সময় বলে কিছু নেই।

শুধু তাই না। দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা যে গ্রীনিচের মান মন্দিরের ঘড়ি তাতেও সব দিনেই বারোটা বাজবার সময় সূর্য ঠিক আকাশের মাঝামাঝি থাকে না। মোটামুটিভাবে সূর্য মাঝখানে ওঠলে বারোটা বাজে বছরে চার দিন মাত্র। তার মানে দুনিয়ার সব সেরা ঘড়িও আসলে সূর্যের সময় ধরে চলে না, চলে মাঝামাঝি একটা কাল্পনিক সময় ধরে। সূর্যের সময় ওর সাথে গড়পড়তা ভাবে মিলে যায়। তাই একে বলে গ্রীনিচের গড় সময় বা Greenwich Mean Time (G.M.T.) *।

ভারতের লোকেরা তাদের কাজের সুবিধের জন্যে সারা দেশের একটা সাধারণ সময় ধরে নিয়েছে। তেমনি বাংলাদেশের আর পাকিস্তানের লোকেরা ধরেছে অন্য রকম সাধারণ সময়। বাংলাদেশের সময় পাকিস্তানের সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে, আর ভারতের সময় থেকে আধ ঘণ্টা এগিয়ে।

আসলে যুগ যুগ ধরে ঠিকমতো সময় মাপার কায়দা-কানুন নিয়ে মানুষের ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই। আগেকার দিনে কত রকম যে যন্ত্র বানানো হয়েছিল, শুনলে অবাক হতে হয়, কাল ছুটির দিন আছে নীলুকে সে সব কাহিনী শোনানো যাবে।

পরদিন মামা তার কথা রেখেছিলেন। দুপুর বেলা খেয়ে-দেয়ে উঠে নীলুকে তিনি যেসব কাহিনী শুনিয়েছিলেন, তার শুধু দরকারি কথাগুলো লিখে ফেললে এই রকম দাঁড়াবে:

সময় মাপার কাহিনী

আগেকার দিনে–ধর আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে–লোকে এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করে সময় মাপত যা এখন শুনলে আমাদের দস্তুরমতো হাসি পাবে। যেমন, ধর মঠে উপাসনার সময় ঠিক করবার একটা উপায় ছিল, ধর্ম গ্রন্থের পৃষ্ঠা হিসাব করা।–ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক।

ধর, তুমি ইতিহাসের বইখানা নিয়ে পড়তে বসেছ। এর প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা পড়তে তোমার মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময় লাগে। তুমি হয়তো বলতে পার, ১০ পৃষ্ঠা পড়া হলে আমি স্কুলে যাব; কিংবা ৫ পৃষ্ঠা আগে মিনি ডাকতে এসেছিল। ঠিক এমনি করে তখনকার দিনে সন্ধ্যে হলে মাঠের একজন সন্ন্যাসী ধর্মগ্রন্থ নিয়ে পড়তে বসত। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত এলেই বোঝা যেত রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে-তখন সে উঠে উপাসনার জন্যে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে দিত। আর তাই শুনে মঠের আশে-পাশের অন্য লোকেরাও টের পেতো যে, ভোর হয়ে এসেছে।

কিন্তু বুঝতেই পারছ এ-রকম করে সময় মাপা আসলে খুব সুবিধের ব্যাপার নয়। পড়া কারো তাড়াতাড়ি হয়, কেউ পড়ে ধীরে ধীরে। তাছাড়া সন্ন্যাসী বাবাজী একদিন বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল তো-ব্যস!

তার চেয়ে বরং দিনের বেলা সাধারণ কাজকর্মের জন্যে সূর্য দেখে সময় বলা অনেক সুবিধে। তাই পাড়াগাঁয়ে —-যেখানে ঘড়ি নেই, কিংবা লোকে মিনিট গুনে সময় হিসাব করার দরকার মনে করে না সেখানে আজও সূর্য দেখেই সময়ের হিসাব হয়। শহরের লোকেরা যেমন সময়ের চুলচেরা হিসাব করে, গাঁয়ের লোকদের তার দরকার হয় না। তাই তারা সোজাসুজি বলে সকাল বেলা, এক প’র বেলা, দুপুর বেলা, বিকেল বেলা, তারপর সন্ধ্যেবেলা, ব্যস! তাদের খাটুনি যেমন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটানা। সময়ের হিসাবও তেমনি নেহাত সাদামাটা।

আগেকার দিনে আজকের মতো শহর ছিল না, অফিস-আদালত, রেলগাড়ি–উড়োজাহাজ, রেডিও-কলকারখানা কিছুই ছিল না। কাজেই তখন সারা দেশের সময়ের হিসাবই চলত আজকের গাঁয়ের হিসাবের মতো। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেশে যত শহর-বন্দর গড়ে উঠতে লাগল, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে লাগল, মানুষের কাছে সময়ের দামও তত বেড়ে উঠল; মানুষ বুঝতে পারল আরো নিখুঁতভাবে সময়ের হিসাব রাখবার ব্যবস্থা করা দরকার।

সূর্যের ছায়া থেকে নিখুঁতভাবে সময় মাপার একটা কায়দা, যাকে বলে সূর্য

ঘড়ি, আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রথমে ব্যাবিলনে। আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনই ছিল দুনিয়ার মধ্যে সেরা শহর। সূর্য ঘড়ি ব্যাবিলন থেকে যায় গ্রীস দেশে। এই ঘড়িতে একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর ঘণ্টার সংখ্যাগুলো লেখা থাকত; তার ওপর খাড়া করে বসানো হত একটা তেকোণা লোহার ফক। এই ফলকের ছায়াই দাগকাটা পাথরের ওপর ঘড়ির

কাটার মতো সময় নির্দেশ করত। সূর্যঘড়ি আজকালও আমাদের দেশে দু-একটা দেখতে পাওয়া যায়।

সূর্য-ঘড়ির একটা মুশকিল হল, এতে শুধু যখন আকাশে সূর্য থাকে তখনই সময় দেখা যায়, কিন্তু আকাশে মেঘ করলে কিংবা রাতের বেলা এটা অচল। তখন সময় মাপার জন্যে করতে হয় অন্য ব্যবস্থা।

একটা ফুটো পাত্রে পানি ভরলে পানিটা ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যত বার পানি ভরা যাক সবটা পানি বেরিয়ে যেতে প্রত্যেক বার একই সময় লাগে। ঠিক এমনি তলায় ফুটোওয়ালা লম্বা সরু পাত্রে পানি ভরে তৈরি হল জল-ঘড়ি। সেও আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, এই ব্যাবিলন শহরেই।

পুরনো বইতে মিসর দেশের একটা অদ্ভুত রকমের দুধের ঘড়ির কথা পাওয়া যায়। প্রাচীন মিসরে নীল নদের ওপর একটা দ্বীপে ছিল ‘ওসিরিস’ দেবতার এক মন্দির। এই মন্দিরে থাকত তলায় ফুটোওয়ালা ৩৬০টা কলস আর প্রত্যেকটা কলসের জন্যে একজন করে সেবায়েত। রোজ ভোরে একজন সেবায়েত তার ঘড়ায় দুধ ভরত, আর ঠিক ২৪ ঘণ্টায় দুধটা যেত তার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে। তারপর আর এক পুরোহিত তার ঘড়া ভরত দুধ দিয়ে–এমনি করে চলত সারা বছর।

কিন্তু তার জন্যে মন্দিরে এতগুলো ঘড়া আর সেবায়েত রাখা হয়েছিল কেন সেটা আমাদের কাছে আজও এক রহস্য বলে মনে হয়। এমন হতে পারে যে, মাত্র দু-একটা ঘড়া আর দু-একজন সেবায়েত দিয়েও যে কাজটা চলে যেতে পারে সে বুদ্ধি হয়তো সেকালে ফ্যারাওদের মাথায় খেলে নি। কিংবা হয়তো ঘড়ায় দুধ ভরার জন্যে এতগুলো লোক রাখতে তখনকার রাজরাজড়াদের খুব বেশি খরচ পড়ত না।

সে যাই হোক বিলাসিত্তা করে দুধ ব্যবহার করা হলেও আসলে তো এর কায়দাটা জল-ঘড়িরই। পানির বদলে বালি ব্যবহার করে বালি-ঘড়িরও চলন হয়েছিল। দু’দিক মোটা মাঝখানটা সরু ফাঁদলের মতো দেখতে তার ভেতর দিয়ে ঝির ঝির করে মিহি বালি পড়ে। চাবি দেবার দরকার নেই, ঘড়িটা শুধু উলটো করে বসিয়ে দিলেই হল।

ধীরে ধীরে জল-ঘড়ির আরো উন্নতি হয়েছিল। যাতে ঘণ্টা মাপা যায় তার জন্যে পাত্রের গায়ে দাগ কাটা হল। দাগ কাটার

মধ্যেও অবশ্যি বেশ খানিকটা বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে। পাত্রের পানি আগাগোড়া সমান বেগে বেরোয় না। যখন পানি ভরতি থাকে তখন ওপরের বেশি চাপে পানি বেরোয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাপও কমে, ফুটো দিয়ে পানিও বেরোতে থাকে ধীরে ধীরে; আর সেই জন্যে দাগ কাটতে হয় ছোট-বড় করে।

কিন্তু মনে রেখো হাজার হাজার বছর ধরে আজকের মতো ঘরে ঘরে এসব ঘড়ির চল হয় নি। যে সব রাজ-রাজড়া, বড়লোকের বাড়িতে জল-ঘড়ি থাকত তাদের আবার ঘড়ির পানি বদলাবার জন্যে আলাদা চাকর রাখতে হত। তাই দেশের বেশির ভাগ সাধারণ লোকই দিনের বেলা সময়ের হিসাব রাখত সূর্যের দিকে তাকিয়ে, আর শেষ রাতে মোরগের ডাক শুনে–ঠিক আমাদের গাঁয়ের লোকেরা যেমন আজও করে।

সে যাই হোক, ব্যাবিলন আর মিসর থেকে জল-ঘড়ি তৈরির কায়দা ক্রমে ক্রমে গ্রীসে, তারপর রোমানদের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের বেশ খ্যাতি হয়েছিল জল-ঘড়ি তৈরির জন্যে। এই শহরেই প্রথম যে সব বুদ্ধিমান লোক ঘড়ি তৈরির কায়দা বার করেছিলেন তাঁদের হাত থেকে বিদ্যেটা কারিগরদের হাতে যায়। কারিগরদের হাতে এসে জল-ঘড়ির আশ্চর্য উন্নতি হয়। এখানে টেসিবিয়স (Ktesibius) নামে এক কারিগর অদ্ভুত কৌশলের সাথে তখন এক রকমের

ঘড়ি বানিয়েছিল; তাতে নাকি কখনো চাবি দিতে হত না বা পানি ভরতে হত না, অথচ শীত-গ্রীষ্মে ঘড়িটা ঠিক সময় দিয়ে যেত।

এইসব ঘড়ি ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের তীরে তীরে–ইতালীতে, ফ্রান্সে, আরো নানা দেশে। বাগদাদের বিখ্যাত খলিফা হারুনুর রশীদ ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সম্রাট শার্ল মানকে এক আজব রকমের জল-ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এই ঘড়িতে ঘণ্টা বাজত। ঘড়িতে যতটা বাজত ততগুলো তামার বল বেরিয়ে এসে ঢং ঢং করে পড়ত নিচে রাখা একটা তামার পাত্রে। তাছাড়া ঘড়িতে ছিল বারোটা দরজ; প্রত্যেক ঘণ্টায় একটা করে দরজা খুলে যেত। দুপুর বারোটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে বারোটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসত বারোজন ঘোড়সওয়ার। ঘড়ির চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তারা দরজাগুলো একে একে বন্ধ করে দিত। রোমান যুগে বক্তার সময় হিসাব এই ঘড়িতে নাকি এমনি আরো নানা করা হত জল-ঘড়ির সাহায্যে

আশ্চর্য ব্যাপার হত। ফ্রান্সের লোকেরা এই ঘড়ি দেখে দারুণ অবাক হয়ে যায়। সে সময়ে ইউরোপের পণ্ডিতরা ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ এইসব বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তখনও ফ্রান্সের বেশির ভাগ গীর্জাতেই ঘণ্টা বাজানো হত সূর্য দেখে; রাতে বড়জোর মোমবাতি বা প্রদীপের তেল পোড়ার হিসাব থেকে।

ইউরোপের বড় বড় পণ্ডিতরা কিন্তু সেই তখন থেকেই মাথা ঘামাচ্ছেন ঘণ্টাকে কি করে আরো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা যায় সেই সব কঠিন কঠিন আঁক-জোখ নিয়ে। এক মস্ত বড় পণ্ডিত ঘণ্টাকে ভাগ করার বুদ্ধি বাতলালেন এই বলে ও এক ঘণ্টা সমান চার কোয়াটার বা চার মুহূর্ত, চারশো আশি ‘আউন্স’ (?) বা পাঁচ হাজার ছ’শো চল্লিশ মিনিট।

মজার ব্যাপার হচ্ছে কাজের বেলা এই সব ভাগ কি করে মাপা যাবে তা নিয়ে তাঁদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না; কাগজে-কলমে ভাগ করে দিয়েই তারা খালাস। এর আরো অনেক পরে যখন পেণ্ডুলামওয়ালা ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে তখনই কেবল আদতে ঘণ্টাকে মিনিটে, আর মিনিটকে সেকেণ্ডে ভাগ করা গিয়েছে, তার আগে নয়।

.

দুধভাত খাওয়া ঘড়ি

খুব ছোট বেলায় আব্বার টেবিলের ওপর টাইম-পিস ঘড়িটা দেখে আমি ভাবতাম ওটা বুঝি জ্যান্ত, কেমন টিক টিক করে কথা কয়। মা-কে যদি জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা মা, ঘড়িটা কি খেয়ে থাকে–তাহলে মা রহস্য করে জবাব দিতেন ও কী আবার খাবে; ওটা দুধ-ভাত খায়!

তারপর বড় হয়ে ঘড়িকে খুলতে দেখেছি, নিজে খুলেছি। ওর ভেতর কত যন্ত্রপাতি, যেন একটা দস্তুরমতো কারখানা চলছে, কতো কি ধারকাটা চাকা সব ঘুরছে, সব শামুকের মতো ধীরে ধীরে–মিনিটের আর সেকেন্দ্রে দুটো কাটাকে শুধু ঘোরাবার জন্যে। কিন্তু সব কল-কবজা চলার জন্যেই তো শক্তির দরকার। রেল গাড়ি বা জাহাজ চলে কয়লা আর পানিতে অথবা তেলে; মানুষ চলে নানান রকম খাবার খেয়ে। কিন্তু ঘড়ি আসলে দুধ-ভাতও খায় না বা ওতে পানিও ভরতে হয় না। তাহলে ঘড়ি চলে কি করে?

ওলন দেখেছ তো? সেই যে রাজমিস্ত্রীরা ইট সাজাবার সময় ছোট পেতলের লাটুর মতো জিনিসের সাথে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখে গাঁথুনি সোজা হচ্ছে কিনা। প্রথম দিকে কাঁটাওয়ালা ঘড়ির যখন আবিষ্কার হয়, তখন তার কাঁটা ঘোরাবার জন্যে একটা কাঠিমের গায়ে সুতো পেঁচিয়ে এমনি ওলন ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। ভারি ওলনটা নিজের ওজনেই ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে আসতো; সেই টানে কাঠিমটা ঘুরতো, আর তার সাথে সাথে ঘুরতে ঘড়ির কাঁটাও।

এই রকম ওলনদার ঘড়ি প্রথম কে বা কারা আবিষ্কার করেছিলেন আজ আর তা ঠিকমতো বলার উপায় নেই; তবে এগুলো যে ইউরোপে গিয়েছিল আরব দেশ থেকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ থেকে হাজার খানেক বছর আগে আরবের লোকেরা ইউরোপের লোকের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেকখানি এগিয়ে ছিল।

যতদূর জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে সুলতান সালাহউদ্দিন তার বন্ধু বিলেতের সম্রাটের কাছে খুব সুন্দর একটা ওলনদার ঘড়ি উপহার পাঠিয়েছিলেন। তারও পঞ্চাশ বছর পরে সম্রাট প্রথম এডওয়ার্ডের হুকুমে লণ্ডনের পালামেন্ট ঘরের ওপরে ওয়েস্টমিনস্টারের চূড়োয় একটা মস্ত বড় ঘড়ি বসানো হয়; তার নাম দেওয়া হয় ‘বিগ টম’।

ওয়েস্টমিনস্টারের বিরাট উঁচু চূড়ো; তিনশো ষাটটা ধাপ ভেঙ্গে তবে তার। ওপরে উঠতে হতো। পুরো চারশো বছর ধরে বিগ টম ঘড়িটা ওখান থেকে ঘণ্টা বাজিয়েছে, আর সারা লণ্ডন শহরের লোক তাই থেকে সময়ের হিসাব ঠিক রেখেছে। তার পরে ওটাকে সরিয়ে সেখানে ‘বিগ বেন’ নামে আরো বড় একটা ঘড়ি বসানো হয়েছে।

ইউরোপের আর আর বড় শহরেও এমনি চূড়ার ওপর ঘড়ি বসানো শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের সম্রাট চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানি থেকে একজন খুব নামজাদা ঘড়ি কারিগরকে ডেকে পাঠালেন; তার প্রাসাদের চূড়োয় একটা ঘড়ি বসাতে হবে। আট বছর খেটেখুটে ঘড়ি তৈরি হল। তারপর সেই কারিগরকে–নাম তার হেনরি ডি-ভিকঘর দিয়ে, মাইনে দিয়ে সেই ঘড়ির চূড়োতে রেখে দেওয়া হল। তার কারণ তখনকার দিনে এসব ঘড়িতে দিনের মধ্যে কয়েক বার চাবি দিয়ে কাঠিমের ওপর ওলনের সুতোটা জড়াতে হত, আর তাই তার দেখাশোনা করবার জন্যে হরদম ঘড়ির সাথে লোকও রাখতে হত একজন।

আজকালকার চেয়ে আগেকার দিনের ঘড়িগুলো আসলেই ছিল একটু বেয়ারা রকমের জবড়জঙ্গ গোছের। কাটা মোটে একটা, শুধু ঘণ্টার কাঁটা; মিনিটের কাঁটা বলে কিছুই নেই। কিন্তু কী বিরাট সে ঘড়ির ওলন, বিরাট বিরাট তার কল–কবজা-দেখলেই ভয় পাবার কথা।

আমাদের ঘড়িতে আজকাল এক থেকে বারোটা পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। কিন্তু আজকাল রেলের ঘড়িতে যে রকম হিসাব, তখনকার ঘড়িতে ডায়ালটা এই রকম ২৪ ভাগে ভাগ করা থাকত। তারপর তখন ঘড়িতে দিনের শুরু ধরা সন্ধ্যেবেলা থেকে। অর্থাৎ সন্ধ্যের পরে একটা বাজত, তারপর আবার পরের দিন সন্ধ্যেবেলা বাজত ২৪টা। কিন্তু সাধারণ কাজের জন্যে ও-রকম হিসাবে নানান হ্যাঁঙ্গামা। বিকেল পাঁচটায় বেড়াতে বেরুব না বলে যদি ২৩ টা বলতে হয়, তাহলে কেমন শোনায় ছোট সংখ্যা নিয়ে হিসাব করাই লোকের পক্ষে সুবিধে। তাই ক্রমে ক্রমে ২৪ ঘণ্টার বদলে ঘড়ির দাগকে ১২ ঘণ্টায় ভাগ করার ব্যবস্থা হয়; আর দিনের শুরু ধরা হয় সন্ধ্যেবেলার বদলে দুপুর রাতের পর থেকে।

আসলে কিন্তু লোকে জবড়জঙ্গ জিনিস মোটেই পছন্দ করে না; সহজ জিনিসের দিকেই তাদের ঝোঁক। তাই প্রথম দিককার চূড়োর সেই দশ-পনের মণ ওজনের বিরাট বিরাট ঘড়িগুলো থেকে ছোট ঘড়ি তৈরির চেষ্টা চলতে লাগল। কম দামের মধ্যে ছোট ছোট ঘড়ি না হলে সাধারণ লোকে তা ব্যবহারই বা করবে কি করে, আর তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নাড়াচাড়াই বা করা যাবে কি করে? এসব চেষ্টার ফলে ক্রমে ক্রমে ঘড়ি ছোট হয়ে আজকের দেয়াল-ঘড়ি, টাইম-পিস আর হাত ঘড়ি তৈরি হয়েছে।

নাড়াচাড়া করা যায় এ-রকম একটা ঘড়ি তৈরি করা হয়, ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই-এর হুকুমে। তাই বলে এটাকেও যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো হাতে করে বয়ে নেয়া চলত না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হলে তাকে বাক্সবন্দী করে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হত।

তারপর ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে প্রথম পকেট-ঘড়ি তৈরি হয়; তৈরি করেন জার্মানির নুরেমবুর্গ শহরের পিটার হেনলীন (Peter Henlein) নামে এক কারিগর। লোকে বলে হেনলীনের ছিল বেজায় বুদ্ধি। এমন খুদে একটা ঘড়ি বানাবার জন্যে কম বুদ্ধি তো আর খরচ করতে হয় নি তাকে; বড় বড় ঘড়ির ওলন আর ওজন-টোজন সব বাতিল করে দিয়ে এবার ঘড়িকে চালাবার জন্যে ব্যবহার করা হল স্প্রিং।

একটা লম্বা স্পিং-কে যতই পেঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা যাক না কেন সেটা সুযোগ পেলেই সে পাঁচ খুলে ফেলার চেষ্টা করবে। এই স্প্রিং দিয়ে চালানো হল ঘড়ি। ঘড়িতে চাবি দিয়ে স্পিং-কে যত প্যাঁচ ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে, খোলার সময় আবার ততগুলো পাঁচই খুলে আসবে। কিন্তু স্প্রিং-কে তার ইচ্ছেমতো খুলতে দিলে হবে না, তাহলে এক সঙ্গেই সবটা খুলে যাবে। তাই এই স্প্রিং-এর সঙ্গে লাগানো হল গায়ে গায়ে ঠেকানো কতগুলো ধারকাটা চাকা, তারপর তার সাথে যোগ করা হল ঘড়ির কাঁটা। এই সবের ফলে নির্দিষ্ট হারে স্প্রিং-এর প্যাঁচ খুলবে, ঘুরবে ধারকাটা চাকাগুলো; আর তার সাথে ঘুরবে ঘড়ির কাঁটা দুটো।

প্রথম প্রথম যখন এমনি স্প্রিং-ওয়ালা ছোট ঘড়ি বের হল তখন ঘড়ির বাজারে রকম-বেরকম ফ্যাশনের স্রোত বই তে লাগল। প্রথম দিককার কতকগুলো ঘড়ি তৈরি হয়েছিল ডিমের মতো আকারের, তাদের নাম দেওয়া হল নুরেমবুর্গের ডিম’। তারপর ক্রমে ক্রমে বেরুতে লাগল প্রজাপতি বা ফুলের মতো ঘড়ি; নানা রকম লতা-পাতা-আঁকা, দামী দামী পাথর বসানো রকম-বেরকমের ঘড়ি।

এত সুন্দর আর বাহারে জিনিস পকেটে পুরে রেখে কি আর মনের শখ মেটে; শৌখিন লোকেরা তাই এ-সব ঘড়ি লোককে দেখাবার জন্যে মেডেলের মতো গলায়

আটকে গেলো দম বা বুকের ওপর ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ঘড়ির কারিগররা ছোট ঘড়ি বানাতে এমন ওস্তাদ হয়ে ওঠে যে তারা কানের দুলে বা হাতের আংটিতে বসানো যায় এরকম ঘড়ি বানাতে শুরু করে। এসব সূক্ষ্ম কাজে তাদের নিপুণতা দেখে আজও আমাদের অবাক হতে হয়।

আজকাল যেমন ঘড়ির সব অংশ কারখানায় ছাঁচে তৈরি হয়, তারপর কারিগররা সেগুলোকে শুধু একসাথে জুড়ে দেয়, আগেকার দিনে মোটেই সে-রকম ছিল না। তখন প্রত্যেকটা অংশই হাত দিয়ে বানাতে হত। কাজেই ঘড়ি আজ যেমন সস্তা হয়েছে, তখন মোটেই সে-রকম ছিল না। আর তাই সেকালে বড় বড় নবাব-জমিদার রাজ-রাজড়া ছাড়া আর কারো ঘড়ি কিনার সাধ্য হত না। অবশ্য রাজ-রাজড়ারা খুশি হয়ে কাউকে কাউকে ঘড়ি উপহার দিতেন।

ঘড়ির কাহিনী বলতে গিয়ে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে আবার একটু ফিরে যাওয়া যাক। বলেছিলাম নানা রকম ভাবে সময় মাপা যায়; যাতে নির্দিষ্ট হারে সময় লাগে–যেমন বই পড়তে পাতা গুনে, কিংবা বাতির তেল কতটা ফুরলো তাই দেখে আগে সময় মাপার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু তাবলে নিখুঁতভাবে সময় মাপবার জন্যে যেমন-তেমন সব রকম হিসাবের ওপর তো আর নির্ভর করা চলে না। যেমন ধর, কামারশালায় হাতুড়ি পেটাতে মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট হারে সময় লাগে; তাই বলে সময় মাপার জন্যে কেউ কি আর একটা হাতুড়ি পিটে যেতে পারবে? আর তাছাড়া হাতুড়ি পেটার সময় যে ঠিক একেই হারে হবে, তারও তো কোন নিশ্চয়তা নেই।

এইসব অসুবিধের কথা ঘড়ি তৈরি করতে গিয়ে মানুষ বহুদিন ধরেই ভাবছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ দেখেছে একদিন সকালে সূর্য ওঠা থেকে পরদিন সূর্য ওঠা পর্যন্ত সময়টা মোটামুটি স্থির। কাজেই সেই সময়কে সমান ২৪ ভাগ করে সূর্য-ঘড়ি তৈরি হল। কিন্তু তারও অনেক অসুবিধে।

জল-ঘড়িতে পাত্র থেকে সমান পরিমাণ পানি বেরিয়ে যেতে বার বার একই সময় লাগে; কিন্তু একটু ময়লা-টয়লা লেগে তলার ফুটোটা আটকে গেলেই সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল। তাছাড়া সবচেয়ে ভাল যে জল-ঘড়ি তাতে ও কেবল ঘণ্টার হিসাবই মাপা যেত, মিনিটের কোন কথা ছিল না। তারপর তৈরি হল কিছুটা উন্নত ধরনের ওলনদার ঘড়ি। কিন্তু এ ঘড়িও নিখুঁতভাবে সময় দিতে পারত না; তাকে সব সময় আকাশের সূর্যের সাথে মিলিয়ে ঠিক করে রাখতে হত। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে একটি ছেলে ঠিক এই কথা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিল? কোন জিনিস নির্দিষ্ট হারে সময় দেয়। তার নাম হল গালিলিও গালিলাই (Galileo Galilei)। গালিলিও আজ সারা দুনিয়ায় একজন সেরা বিজ্ঞানী বলে পরিচিত। কিন্তু সূর্যের চারধারে পৃথিবী ঘুরছে, এই সত্যি কথাটা বলার অপরাধে সেদিন সেই অন্ধযুগের লোকেরা তাকে প্রায় পুড়িয়ে মারবার যোগাড় করেছিল।

ছোট বেলায় গালিলিও একদিন গীর্জায় গিয়েছেন; মাথার ওপর একটা ঝাড়বাতিকে অনবরত দুলতে দেখে তাঁর মাথায় হঠাৎ বিদৎ খেলে গেল। তাঁর মনে হল প্রত্যেক দোলায় ঝাড়বাতিটার যেন একই রকম সময় লাগছে। তারপর তিনি অনেক পরীক্ষা করে দেখলেন, একটা সুতোর আগায় পাথর বা এমনি ভারি কিছু বেঁধে দোলালে তার প্রত্যেকটা দোলায় সব সময় ঠিক একই সময় নেয়। এই সময় অবশ্য নির্ভর করে সুতো কতখানি লম্বা তার ওপরে সুতো কমালে-বাড়ালে সময়ও সেইভাবে কমে-বাড়ে। সুতো বা সরু দণ্ডের আগাই ভারি কিছু বাঁধা এই ব্যবস্থাটার নাম হল পেণ্ডুলাম বা দোলক। এমনি করে গালিলিও এত দিনকার একটা মস্ত বড় সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। কিন্তু তিনি একে ঘড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেন নি; পেণ্ডুলাম দিয়ে ঘড়ি বানালেন আর একজন বিজ্ঞানী, নাম তার ক্রিস্টোফার হয়গেনস। তার ফলে ঘড়ি দিয়ে সময় মাপা আগের চাইতে অনেকখানি নিখুঁত হয়ে এলো। আগেকার ঘড়িতে ছিল শুধু ঘণ্টার কাঁটা; এবার তার সাথে যোগ কর হল মিনিটের কাঁটা, তারপর সেকেন্দ্রে কাঁটা।

ঘড়ির উন্নতি কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। দিন দিনই ঘড়ির আরো উন্নতি হচ্ছে, ঘড়ির দামও তেমনি কমছে, আর সাধারণ লোকদের কাছেও ঘড়ি পৌঁছচ্ছে। সব আবিষ্কারের বেলাতেই এমনি হয়। প্রথম প্রথম জিনিসটা থাকে নতুন; অল্প গুটিকয়েক লোক তার কথা জানে, আরো অল্প লোক তাকে ব্যবহার করতে পারে। তার পরেও বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলতে থাকে, আরো তার উন্নতি হয়, সমাজের সব রকম লোকের মধ্যে তার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।

সেকালে আজকের মতো বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয় নি, এত নানা রকমের কল-কবজার আবিষ্কারও হয় নি। বলতে গেলে, ঘড়ির কারিগররাই এই সব কল-কবজার আবিষ্কারের পথ দেখিয়ে ছিলেন। সেকালে যারা বড় বড় আবিষ্কার করেছেন তারা সবাই ছিলেন ঘড়ির কারিগর; যেমন বিলেতের আর্করাইট, হারগ্রী ফুলটন–এঁদের নাম হয়তো তোমরা শুনেছ। সুতো বোনার কল, কাপড়ের কল আর কলের জাহাজ আবিষ্কার করে এরা মানুষের জীবনযাত্রায় যুগান্তর এনেছেন। এই সব কল-কবজা বানাবার জন্যে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যে শেখেন নি। ঘড়ির কারখানায় হাতে-কলমে কাজ করতে করতেই তাদের সে শিক্ষা হয়েছে।

বিলেতে এই সব আবিষ্কার হবার পর সারা দেশ জুড়ে বিরাট বিরাট সব কল-কারখানা গড়ে ওঠতে লাগল। গাঁয়ের চাষীরা দল বেঁধে কাজের খোঁজে ছুটল শহরের দিকে; রাতারাতি আশে-পাশের সব কিছু যেন বদলে যেতে লাগল। আঠারো শতক ইতিহাসের দিক থেকে খুব দূরের কথা নয়। কিন্তু গেল এই দুশো বছরে বিজ্ঞান আর কল-কবজার সাহায্যে মানুষের জীবনে যা পরিবর্তন ঘটেছে তার আগের দুহাজার বছরেও তা হয় নি। এ-সবই হয়েছে যন্ত্রের আবিষ্কার থেকে; আর আসলে তার গোড়ায় রয়েছেন ঘড়ির কারিগররা।

সে সময়ের ঘড়ির কারিগররা শুধু যে দরকারি যন্ত্রপাতিই বানিয়েছিলেন তা নয়। তখনকার হাওয়া ছিল যন্ত্রের নেশায় ভরপুর! কারিগরদের নানা রকম যন্ত্র বানাবার এমন ঝোঁক চেপেছিল যে অদ্ভুত বুদ্ধি খাঁটিয়ে তারা বহু ধরনের আজব জিনিস বানাতে শুরু করে দেন। তার একটা হল ‘কলের মানুষ। কয়েক জন কারিগর এমন কলের খেলনা বানিয়ে ফেলেন যা মানুষের মতো গান গায়, বাঁশি বাজায়, লেখে, কাজ করে।

তারপর তৈরি হল কলের ক্যালেনডার। এই ক্যালেনডারে বছর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহের দিনগুলো আপনা আপনি পালটে যায়, ক্যালেন্ডার বদলাবার আর দরকার হয় না। জার্মানির স্ট্রাসবুর্গ শহরের বড় গীর্জাতে ঘড়ির সাথে এই রকম ক্যালেনডার রয়েছে সারা বছরের কোন তারিখ কি বার সেটা এর ডায়ালের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। প্রত্যেক বছর এই ক্যালেনডারের দিন-তারিখ আপনা থেকেই বদলায়।

বিলেতের পার্লামেন্ট ভবনের চূড়ায় বসানো ‘বিগ বেন’ ঘড়ির কথা একবার বলেছি। ‘বিগ বেন’ ঘড়ির রাজ্যে এক আশ্চর্য। কত বড় এই ঘড়ি, শুনবে? এর মোট ওজন ৫ টন, অর্থাৎ প্রায় ১৪০ মণ। চূড়োর চার দিকে এর চারটে মুখ, প্রত্যেকটা মুখ চওড়ায় ২৩ ফুট করে। মিনিটের কাঁটাটা লম্বায় ১৪ ফুট (চার মিটারের বেশি); সারা বছরে তাকে একশো মাইল পথ চলতে হয়। দুটো মিনিটের দাগের মধ্যে তফাত হচ্ছে এক বর্গফুট, আর ঘণ্টার সংখ্যাগুলো উঁচুতে দু’ফুট করে।

এই দানব ঘড়ি ‘বিগ বেন’-ই শুধু নয়, আমাদের ছোট ছোট হাত-ঘড়িগুলোও কিছু কম আশ্চর্য নয়। ওই ছোট খোলসটার মধ্যে অত সূক্ষ্মযন্ত্রপাতি কি করে পোরা হয়েছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। দেয়াল-ঘড়ির সময় ঠিক রাখা হয় দোলক বা পেণ্ডুলাম দিয়ে। কিন্তু হাতঘড়ি তো আর এমনি করে সব সময় এক অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না, ওতে তাই দোলক ব্যবহার করার উপায় নেই। তাহলে হাতঘড়ির সময় ঠিক রাখা হয় কি করে?–ফুলের মতো সরু তারের স্প্রিং দিয়ে। এই স্প্রিং ব্যালান্স হুইল নামে একটা চাকাকে দোলায়; দেয়াল-ঘড়িতে পেণ্ডুলামের দোলানি যেমন বরাবর ঠিক সময় দেয়, স্প্রিং-এর কাঁপুনির হারও তেমনি সব সময় একই থাকে। যে হয়গেনস দেয়াল-ঘড়ির জন্যে প্রথম পেলাম ব্যবহার করেছিলেন, তিনিই পকেট ঘড়ি চালাবার জন্যে প্রথম স্প্রিং দিয়ে দোলানো ব্যালান্স হুইল ব্যবহার করেন।

যন্ত্রপাতি যত ভালই হোক, মাঝে মাঝে বিগড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। ঘড়িও যে মাঝে মাঝে খারাপ হবে তাতে আর আশ্চর্য কি? ঘড়ি ভালভাবে চলবার জন্যে ওর ভেতরকার যন্ত্রপাতি বিশেষভাবে তৈরি জলপাই-এর তেল বা আরো ভাল কোন তেলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু বাতাস লাগতে লাগতে এই তেল ঘন হয়ে খারাপ হয়ে যায়। সূক্ষ্ম যন্ত্রগুলো গায়ে গায়ে ঘষা লেগে আর ভাল চলতে পারে না।

ধুলো-ময়লা, পানি বা ঝাঁকুনিতেও ঘড়ির খুব ক্ষতি করে। কিংবা ঘড়ির কোন স্প্রিং যদি ছিঁড়ে যায় তাহলেও তার টিক টিক শব্দ যায় থেমে। তখন তাকে ঘড়ির কারিগরের কাছে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। তবে সাবধানে ব্যবহার করলে ঘড়ি ঘন ঘন মেরামতের দরকার হয় না।

সব চাইতে নিখুঁতভাবে সময়ের হিসাব দরকার জাহাজ চালাবার জন্যে। গোড়াতেই বলেছি, দুনিয়ার এক এক জায়গায় সূর্যের সময় এক এক রকম। অথই সমুদ্রে জাহাজ ঠিক কোন জায়গায় আছে সেটা নিখুঁত ঘড়ি আর সূর্য বা তারা দেখে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, জাহাজে সাধারণ ঘড়িকে কিছুতেই ঠিক রাখা যায় না সমুদ্রের অনবরত ঝাঁকুনিতে ঘড়ি ফাস্ট কি স্লো হয়ে যায়। আর ঘড়ি সামান্য বেঠিক হলেও দিক ভুল হবার ভয় পদে পদে।

সেই জন্যে জাহাজের উপযোগী একটা নিখুঁত ঘড়ি তৈরি করে দেবার জন্যে ১৭১৪ সালে বিলেতের পার্লামেন্ট দশ হাজার পাউণ্ড পুরস্কার ঘোষণা করেন। সারা দুনিয়ার ঘড়ির কারিগরদের বহু বছরের চেষ্টার পর জন হ্যারিসন নামে এক ইংরেজ কারিগর আর ফরাসি কারিগর লে’রয় ক্রনোমিটার নামে বিশেষ ধরনের নিখুঁত ঘড়ি তৈরি করেন। কিন্তু এসব ক্রনোমিটার’ ঠিক সময় দিলে কি হবে, তার কল-কবজা আবার এত সূক্ষ্ম যে আবহাওয়া সামান্য বদলালে, ঠাণ্ডা কিংবা গরমে এর সময়ের এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। তাই জাহাজে ক্রনোমিটারকে রাখতে হয় বায়ুশূন্য কাঁচের পাত্রের মধ্যে।

আজকাল অবশ্য বেতার যোগাযোগের ব্যবস্থা হওয়ায় সারা নিয়া জুড়ে–এমন কি, জাহাজেও–ঠিক সময় রাখা অনেক সহজ হয়ে এসেছে। গ্রীনিচের এবং অন্যান্য জায়গার বড় বড় মান-মন্দিরে আকাশের তারার চলাচলের সাথে সব চাইতে নিখুঁত ঘড়ির সময় মিলিয়ে রাখা হয়। তারপর রোজই সেই সময় রেডিও মারফত ঘোষণা করা হয়; আর নিমেষের মধ্যে দুনিয়ার সব লোক তা জানতে পারে–রেডিওর সাথে মিলিয়ে নিজেদের ঘড়ি ঠিক করে নেয়।

মামা যখন ঘড়ির কাহিনী শেষ করলেন তখন বেশ রাত হয়েছে, নীলুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মামার বলার পরও নীলু শুনতে পেল টেবিল ঘড়িটা যেন বলে চলেছে? টিক্ টিক্…..টিক্ টিক্….টিক্ টিক্…..

——–
*গ্রীনিচ জায়গাটা লণ্ডনের কাছে। গ্রীনিচের ঘড়িতে যখন ভোর ছটা বাংলাদেশে তখন দুপুর বারোটা। বিলেতের ঘড়িগুলো ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পশ্চিম ইউরোপের সাধারণ সময় ধরে চলে –G.m.T-র এক ঘণ্টা আগে আগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *