৩. জেমি ম্যাকগ্রেগর

১১.

জেমি ম্যাকগ্রেগর আর মাত্র এক বছর বেঁচেছিল। এই সময় সীমাটাই মার্গারেটের জীবনে সব থেকে উল্লেখযোগ্য প্রহর। জেমি তখন একেবারে অসহায়, কথা বলতে পারছে না। নড়াচড়া করতে পারছে না। মার্গারেট তার স্বামীর সেবা শুশ্রূষা করল। সেবিকার মতো। সমস্ত দিন এবং রাত পরিশ্রম করে চলেছে। দিনের বেলা তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে করিডরের ওপর দিয়ে নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে মার্গারেট সোয়েটার বোনে। তার সাথে কথা বলে। ছোটোখাটো সমস্যা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়। হ্যাঁ, কেটি আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। রাতের অন্ধকারে জেমির কঙ্কাল দেহটা ঘরের দরজায় এসে আঘাত করে। আহা, ছোট্ট ছেলের মৃতদেহের পাশে শুয়ে থাকে। মার্গারেট তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।

ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল এখন ক্রুগার ব্রেন্ট সংস্থাটা চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ডেভিড এই বাড়িতে আসে। মার্গারেট কিছু কাগজে সই করে দেয়। এই অবস্থা দেখে ডেভিড খুবই কষ্ট পায়। বিশেষ করে জেমি, মানুষটা কেমন যেন হয়ে গেছে।

মার্গারেট একদিন তার স্বামীকে বলেছিল, জেমি, ডেভিড কিন্তু সত্যি ভালো ছেলে।

হাতের বোনা থামিয়ে দিয়ে মার্গারেট আবার বলল–তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সে তোমার মতো এত চালাক নয়। আর তোমার মতো এত উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়। জেমি, তোমার মতো এত শক্তি কি তার আছে? তোমার সমস্ত স্বপ্ন সফল হয়েছে। এই কোম্পানিটা একদিন আরও বড়ো হবে।

সে আবার উলের গাছি হাতে তুলে নিয়ে বলল–ছোট্টো কেটি কথা বলতে শিখেছে। সে আজ সকালে মা বলে ডেকেছে।

জেমি বসেছিল, চেয়ারের মধ্যে, একটা চোখে ভাসছে বিষণ্ণতা।

-ছোট্ট মেয়েটা তোমার মতো দেখতে হয়েছে। তোমার মতো মুখ। কালে কালে সে সুন্দরী হয়ে উঠবে।

পরের দিন সকালবেলা মার্গারেটের ঘুম ভেঙে গেল। জেমি ম্যাকগ্রেগর মারা গেছে। সে জেমির হাতে হাত রাখল।

-শান্তিতে থাকো, আমি সব সময় তোমাকে ভালোবেসেছি, জেমি গুডবাই, আমার প্রিয় ভালোবাসা।

এখন এই পৃথিবীতে মার্গারেট একা। স্বামী এবং পুত্র চলে গেছে। সে বেঁচে আছে। আর বেঁচে আছে তার ছোট্ট মেয়ে। মার্গারেট ছোট্ট মেয়েটির ঘরে গেল। কেটির দিকে তাকিয়ে থাকল। [-ক্যাথেরিন, কেটি, গ্রিক শব্দ থেকে এই নামটি এসেছে। এক সময় ওই নামটা দেওয়া হত সন্ন্যাসিনীদের আর রানিদের।]

মার্গারেট ভাবল, কেটি, তুমি বড়ো হয়ে কী হবে?

***

দক্ষিণ আফ্রিকাতে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। জাতিগত বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে। এক দিকে বুয়েররা এবং অন্যদিকে ব্রিটিশরা। ১৮৯৯ সালের ১২ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, কেটির সপ্তম জন্মদিন। ব্রিটিশরা বুয়েরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তিনদিন বাদে অরেঞ্জ ফ্রিস্টেটকে আক্রমণ করা হল। ডেভিড মার্গারেটকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল কেটিকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু মার্গারেট রাজী হল না।

মার্গারেট বলল–আমার স্বামীর আত্মা এখানে আছে।

ডেভিড আরও বোঝাবার চেষ্টা করল –আমি বুয়েরদের পক্ষে যোগ দিচ্ছি। কিন্তু আপনার কী হবে?

মার্গারেট বলল –আমি কোম্পানিটাকে চালাবার চেষ্টা করব।

পরের দিন সকালে ডেভিড চলে গেল।

***

ব্রিটিশরা ভেবেছিল, এই যুদ্ধে সহজে জয়লাভ করবে। তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হবে না। তারা ছুটির আনন্দে যুদ্ধ করছিল। শেষ পর্যন্ত হাইট পার্ক ব্যারাকে খারাপ খবর পৌঁছে গেল। খবরগুলো কেমন?

নভেম্বর ২৭, ১৮৯৯ কেপস স্কোয়াড্রন।

রবিবার, ট্রান্সভাল পিটোরিয়া।

বুয়েররা যুদ্ধে জয়লাভ করছে।

ব্রিটিশরা অবাক হয়ে গেছে। এটা বুয়েরদের নিজস্ব ভূমিখণ্ড, তারা দৃঢ় সংকল্প এবং কঠিন প্রতিজ্ঞায় অটল। প্রথম যুদ্ধে ব্রিটিশরা হেরে গেল। হা, সব কিছুর বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াল। আরও বেশি সৈন্য পাঠানো হল। কিম্বারলেকে অবরোধ করা হল। ভীষণ লড়াইয়ের পর কিছু কিছু জায়গার ওপর তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হল। বুয়েররা কিন্তু তখনও সমানে সমানে লড়াই করে চলেছে।

***

ক্লিপড্রিফট শহর –মার্গারেট যুদ্ধের প্রতিটি খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। সে জানে, এখন গুজব বাতাসে ভাসছে। কী হবে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। গুজবের ওপর নির্ভর করে কি বাঁচা যায়?

একদিন সকালে মার্গারেটের কর্মচারীরা তার অফিসে এসে বলল–ব্রিটিশরা ক্লিপড্রিফটের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা আমাদের সকলকে মেরে ফেলবে।

-না, তারা আমাদের গায়ে হাত দেবে কেন?

পাঁচ ঘণ্টা কেটে গেছে। মার্গারেটকে বন্দী করা হল। সে হল যুদ্ধবন্দী।

 মার্গারেট এবং কেটিকে পারবেবার্গে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অনেকগুলো বন্দীশালা খোলা হয়েছে। সমস্ত দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে এমন অনেক শিবির স্থাপিত হয়েছে। বন্দিদের মস্ত বড়ো খোলা মাঠে রেখে দেওয়া হয়। চারপাশে সুরক্ষিত প্রহরীর দল আছে। আছে ইলেকট্রিক তারের পাহারা। বন্দীদের অবস্থা শোচনীয়।

মার্গারেট কেটিকে কোলে তুলল। এবং বলল- চিন্তা করো না, তোমার কোনো কিছু হবে না।

কিন্তু তার এ বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত থাকল না। প্রত্যেকটা দিন আরও বেশি আতঙ্ক এনে দিচ্ছে। তারা দেখল, অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে অনাহারে, অনেকে জ্বরের আক্রমণে থরথর করে কাঁপছে। ডাক্তার নেই, শুশ্রূষা নেই। খাবার নেই। একটা ধারাবাহিক দুঃস্বপ্ন। এইভাবে তিন-তিনটে বছর কেটে গেল। অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে মার্গারেট এবং কেটি তখন অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। তারা খাবারের আশায় হাঁ করে বসে থাকে। জীবনের জন্য হাত পেতে ভিক্ষা করতে হয়। মার্গারেটের জীবন আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে কেটে চলেছে। মার্গারেট দেখল, অনেকের মৃত্যু হচ্ছে চোখের সামনে। হ্যাঁ, কেটিও বুঝতে পেরেছে তার জীবনদীপ নিভে যাবে। সে এখন আর কিছুই করতে পারবে না। ক্ষমতা? ক্ষমতা থাকবে কী করে? তোমার কি স্বাধীনতা আছে? তুমি কি খাদ্য পাচ্ছো? হ্যাঁ, মৃত্যু-মৃত্যুই এখন একমাত্র কাঙ্খিত বিষয়।

একদিন কেটি ভাবল, আমাকে আরও বেশি ক্ষমতা জোগাড় করতে হবে। এমন ক্ষমতা যা দিয়ে আমি বিশ্বের রানি হব।

***

ভীষণ লড়াই চলেছে। নানা জায়গা থেকে খবর আসছে। শেষ পর্যন্ত বুয়েররা ওই ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে পেরে উঠল না। ১৯০২ সাল। অনেক দিনের লড়াই শেষ হয়েছে। বুয়েররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। বাহান্ন হাজার বুয়ের যোদ্ধা সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল। বত্রিশ হাজারের মৃত্যু ঘটেছে। মারা গেছে অনেক স্ত্রী এবং শিশুর দল। যারা বেঁচেছিল, তাদের মনের ভেতর তিক্ততা। অনেককে পাঠানো হয়েছে কনসেনটেশন ক্যাম্পে।

একদিন এই ক্যাম্পের দরজা খুলে দেওয়া হল। মার্গারেট এবং কেটি আবার ক্লিপড্রিফটে ফিরে এল।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। শান্ত রবিবার। ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল ফিরে এসেছে। যুদ্ধ তাকে আরও অভিজ্ঞ করে তুলেছে। সে আরও শান্ত এবং গম্ভীর হয়েছে। মার্গারেট তার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ডেভিড অনেক বছর রণক্ষেত্রে কাটিয়েছে। সে জানত না, মার্গারেট এবং কেটি বেঁচে আছে কিনা। তাদের ফিরে আসতে দেখে সে আনন্দিত হয়ে উঠল।

ডেভিড বলল–হ্যাঁ, আমি ভাবতেই পারছি না…

–এসব অতীতের ঘটনা, ডেভিড, আমরা এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাব।

 ভবিষ্যৎ কী? ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড।

***

১৯০০ সাল। ইতিহাসের পাতায় একটি উল্লেখযোগ্য বছর। শান্তির নতুন শতাব্দী শুরু হল। নতুন আশার সঞ্চারণ। হ্যাঁ, অনেক আকর্ষণীয় আবিষ্কার। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ হাতের মুঠোয় এসে গেছে। এরোপ্লেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে চলেছে। জলের তলায় চলেছে সাবমেরিন। পৃথিবীর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো বেড়ে চলেছে। চারদিকে নতুনত্বের ছোঁয়া। পরবর্তী ছমাসে মার্গারেট এবং ডেভিড সব সুযোগের সদ্ব্যবহার করল।

কেটি এখন আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। সে জানে, তার মা ব্যবসা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। হা, সে এক বুনো কিশোরী, যা খুশি তাই করতে পারে। একদিন বিকেলবেলা মার্গারেট বাড়ি ফিরেছে। জরুরি দরকার আছে। সে দেখল, তার চতুর্দশী কন্যাটি লুইর ছেলের সাথে লড়াই শুরু করে দিয়েছে।

মার্গারেট বিশ্বাস করতে পারছে না। মার্গারেট চিৎকার করে ডেকে বলল তুই করছিস কী? একদিন তোকে এত বড়ো কোম্পানি চালাতে হবে। আর আজ তুই এই ভাবে সময় নষ্ট করছিস?

.

 দ্বিতীয় খণ্ড

কেটি ও ডেভিড
 ১৯০৬-১৯১৪

১২.

 ১৯১৪ সালের এক উষ্ণ গ্রীষ্মরাত। কেটি ম্যাকগ্রেগর একলা তার অফিসে বসে কাজ করছেন। ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের অফিস। জোহানেসবার্গের হেডকোয়ার্টার। তিনি অটোমোবাইলের শব্দ শুনতে পেলেন। কাগজগুলো নামিয়ে রাখলেন। জানালার দিকে হেঁটে গেলেন। বাইরের দিকে তাকালেন। দুটি পুলিশের গাড়ি এবং একটা ওয়াগন বাড়িটার সামনে এসে থেমেছে। কেটির চোখে মুখে বিস্ময়। দেখা গেল, জনাছয়েক ইউনিফর্ম পরা পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে অত্যন্ত দ্রুত বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। তারা বাড়ির প্রবেশ পথের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। জানালার কাঁচে কেটির অবয়বের প্রতিফলন। হ্যাঁ, তিনি যথেষ্ট রূপবতী, বাবার হালকা ধূসর চোখের আদল পেয়েছেন, মায়ের যৌবন উচ্ছল শরীর।

অফিসের দরজাতে হাতের আওয়াজ।

–ভেতরে আসুন।

 দরজা খুলে গেল। ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিশ ভেতরে ঢুকলেন। একজনের গায়ে সুপারিটেনডেন্টের পদক আঁটা আছে।

কী হয়েছে? কেটি রাগের স্বরে জানতে চাইলেন।

–এই সময় আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত, মিস ম্যাকগ্রেগর। আমি হলাম সুপরিটেনডেন্ট কমিনসকি।

কী সমস্যা সুপারিটেনডেন্ট?

–আমরা একটা রিপোর্ট পেয়েছি জেল পালানো হত্যাকারী এই বাড়িতে একটু আগে ঢুকেছে।

কেটির চোখে মুখে আতঙ্ক- এই বাড়িতে?

-হ্যাঁ, ম্যাডাম, লোকটা সাংঘাতিক এবং সশস্ত্র।

কেটি উদ্বিগ্নচিত্তে বললেন– তাহলে? সুপারিটেনডেন্ট, এখনই তাকে ধরে নিয়ে যান।

-হ্যাঁ, সেটাই তো আমরা করতে চাইছি। মিস ম্যাকগ্রেগর। আপনি কি সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন?

না, আমি তো এখানে একা আছি, অনেক লুকোবার জায়গা আছে। অনুগ্রহ করে ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।

-হ্যাঁ, আমরা কাজ শুরু করছি ম্যাডাম।

 সুপারিটেনডেন্ট তার অন্য সহকর্মীদের ডাকলেন। বললেন- তোমরা সবাই বাড়িটার নানা জায়গাতে চলে যাও। বেসমেন্ট থেকে শুরু করো। ছাদ অব্দি তন্নতন্ন করে খুঁজবে। কোনো অফিস কি তালাবন্ধ?

আমার মনে হয় দুই একটা ঘর বন্ধ আছে। আমি খুলে দিচ্ছি।

সুপারিটেনডেন্ট কমিনকসি বুঝতে পারলেন, কেটি খুবই ভয় পেয়েছেন। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। যখন জানতে পারলেন যে, লোকটা সশস্ত্র, ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেল।

কেটি রিপোর্টটা হাতে নিলেন, যেটার ওপর কাজ করছিলেন, কিন্তু মন দিতে পারছেন না। পুলিশ সমস্ত বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। কেটির সমস্ত শরীরে শিহরণ। ওরা কি খুঁজে পাবে?

তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে। প্রত্যেকটা লুকিয়ে থাকার সম্ভাব্য জায়গা। পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে। সুপারিটেনডেন্ট কেটির ঘরে ফিরে এলেন।

এখনও খুঁজে পাইনি ম্যাডাম, কিন্তু ভয় পাবেন না যেন।

-আমি খুবই ভয় পেয়েছি, সুপারিটেনডেন্ট। কী বলছেন? জেল পালানো হত্যাকারী এখানে ঢুকে পড়েছে? অনুগ্রহ করে তাকে খুঁজে বের করুন।

–আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের সঙ্গে প্রশিক্ষিত কুকুর আছে।

 করিডর থেকে কুকুরের ডাক শোনা গেল। একটু বাদে বিরাট চেহারার একটা কুকুর ঢুকে পড়ল। হ্যাঁ, একটা নয়, দুটো, জার্মান শেফার্ড।

–এরা গোটা বাড়িতে ঘুরে বেড়াবে। দেখা যাক কী হয়?

সুপারিটেনডেন্ট আবার কেটির দিকে তাকালেন।

–এক ঘণ্টার মধ্যে আপনি কখনও ঘর ছেড়ে গেছেন কি?

 –হ্যাঁ, আমি ফাইলরুমে গিয়েছিলাম। সেই সময়ের মধ্যে লোকটা কী….

কেটির কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক- আবার ভালো করে দেখুন।

 সুপারিটেনডেন্ট আবার ইঙ্গিত করলেন-কুকুর দুটো ঝাঁপিয়ে পড়ল। হ্যাঁ, এবার তাদের তল্লাশি শুরু হয়েছে।

কুকুর দুটো ভীষণ ক্ষুধার্ত। তারা একটা বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল।

কেটি চিৎকার করে বললেন– তাহলে? লোকটা ওখানে লুকিয়ে আছে?

সুপারিটেনডেন্ট তার বন্দুকটা বের করলেন- এটা খুলে ফেলো।

দুজন পুলিশ ছুটে এসে দরজার ওপর ধাক্কা দিল। দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে কেউ নেই। হ্যাঁ, একটা কুকুর পায়ের নখ দিয়ে আঁচড়াতে শুরু করল।

–এই দরজাটা কোথায় গেছে?

–একটা ওয়াশরুমে।

দুজন পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেটাকেও ভোলা হল। ভেতরে কেউ নেই।

তার মানে, কুকুরটা কী বোকা বনে গেল।

সুপারিটেনডেন্ট বললেন– এরকম আচরণ কুকুররা কখনওই করবে না।

 তখনও কুকুর দুটো মাটি আঁচড়াচ্ছে।

 কোনো একটা রহস্যজনক ব্যাপার আছে। কিন্তু লোকটা কোথায়?

 দুটো কুকুর কেটির ডেস্কের ড্রয়ারের কাছে চলে এল। তখনও চিৎকার করছে।

কেটি বলল- এটাই বোধহয় উত্তর। লোকটা আমার ড্রয়ারে লুকিয়ে আছে, তাই বলতে চাইছেন?

সুপারিটেনডেন্ট কমিনকসি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন– আপনাকে বিবক্ত করার জন্য দুঃখিত, মিস ম্যাকগ্রেগর। তিনি বললেন, এই কুকুর দুটোকে এখান থেকে নিয়ে যাও।

-হ্যাঁ, আমরা যাচ্ছি। কিন্তু…

কেটি আবার বললেন আপনারা যাবেন না?

–মিস ম্যাকগ্রেগর, আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমার লোকেরা এই বাড়ির সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। আমি বলছি, লোকটা এখানে নেই। এটা বোধহয় কোনো বাজে বিপদসংকেত। আমি ক্ষমা চাইছি।

কেটি আমতা আমতা করে বললেন আপনি আমার সন্ধ্যেটা নষ্ট করে দিলেন।

.

কেটি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। শেষ পুলিশের গাড়িটা চলে গেল। যখন তারা চলে গেল, তিনি ডেস্কের ড্রয়ারটা খুললেন। সেখান থেকে রক্তরঞ্জিত একজোড়া ক্যানভাসের জুতো বের করলেন– দুখানা জুতো নিয়ে হাসতে হাসতে একটা দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন, সেখানে লেখা আছে- একান্ত ব্যক্তিগত। ভেতরে ঢুকলেন। ফাঁকা, তবে– দেওয়ালের সঙ্গে একটা সিন্দুক আটকানো আছে। এটা হল গুরুত্বপূর্ণ ঘর। এখানে কোম্পানির সমস্ত হিরেগুলো রেখে দেওয়া হয়। জাহাজে করে বাইরে পাঠাবার আগে। অত্যন্ত দ্রুত কেটি নির্দিষ্ট সংখ্যা ঘোরালেন। দরজাটা খুলে গেল। হ্যাঁ, অনেকগুলো ধাতু নির্মিত সেফ ডিপোজিট বাক্স রয়েছে। ভল্টের মধ্যে। থরে থরে হিরে সাজানো আছে। আর এই ঘরের ভেতর অর্ধ অচেতন হয়ে পড়ে আছে বান্দা।

কেটি তার দিকে তাকিয়ে বললেন- ওরা চলে গেছে।

বান্দা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। হাসার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, আমি কী করে এখানে এসেছি, তুমি কি তা জানো?

কেটি বান্দাকে উঠে দাঁড়াবার জন্য সাহায্য করলেন। বান্দার সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা।

জুতো পরতে পারবেন কি?

 কেটি জুতো জোড়া হাতে দিলেন। এবার কেটি বললেন– এবার বাইরে বেরোতে হবে।

বান্দা মাথা নেড়ে বলল- আমি নিজেই যাব, যদি ওরা আমাকে ধরার চেষ্টা করে, তা হলে তুমি দূরে সরে যেও। আমার সমস্যাতে তুমি নিজেকে কেন জড়াবে?

ব্যাপারটা আমি দেখছি।

বান্দা শেষ বারের মতো ওই ভল্টের দিকে তাকাল।

কেটি জানতে চাইলেন কয়েকটা সঙ্গে রাখবেন? বান্দা কেটির দিকে তাকাল তোমার বাবা একবার আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছিল। অনেক দিন আগে।

কেটি বললেন আমি জানি।

না, টাকার আমার দরকার নেই। এই শহরটা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে।

–আপনি কী করে জোহানেসবার্গের বাইরে যাবেন?

–আমি একটা উপায় বের করেছি।

–আমার কথা শুনুন, পুলিশ সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সব জায়গার ওপর তাদের সর্তক নজর আছে। আপনি এভাবে বিপদের মুখোমুখি হবেন না।

বান্দা শান্তভাবে বলল- তুমি অনেক করেছ।

কোনোরকমে জুতো পরে নিল। হ্যাঁ, ভাঙাচোড়া একটা মানুষ। তার শার্ট এবং জ্যাকেটে রক্তের দাগ। মাথায় চুলের ধূসরতা।

কেটি আবার তাকালেন- আহা, যখন কেটি ছোটো ছিল, তখন বান্দা ছিল পরিপূর্ণ যুবক।

বান্দা, ওরা যদি আপনাকে দেখে ফেলে, তাহলে মেরে ফেলবে। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

কেটি রোড ব্লকের কথা জানতেন। জোহানেসবার্গ থেকে বেরোবার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ পেট্রল দিচ্ছে। বান্দাকে যে করেই হোক ধরতে হবে, কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে– জীবিত বা মৃত অবস্থায়। রেল স্টেশনেও পুলিশের নজর।

–আমার মনে হয়, তোমার বাবার থেকেও আমি ভালো বুদ্ধি বের করতে পারব।

 বান্দার কণ্ঠস্বরে দুর্বলতা। কেটি বুঝতে পারলেন, অনেকটা রক্ত ক্ষরণ হয়েছে।

কথা বলবেন না, শক্তি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। সব কিছু আমার ওপর ছেড়ে দিন।

কেটি নিজের ওপরে অসম্ভব বিশ্বাস স্থাপন করলেন। তিনি জানেন বান্দার জীবন তিনি বাঁচাতে পারবেন।

আমি একটা গাড়ি ডাকতে যাচ্ছি। গাড়িটা সরু গলি দিয়ে বেরিয়ে যাবে। দশ মিনিট সময় দিন। তারপর বাইরে আসবেন। আমি পেছনের দরজায় থাকব। গাড়ির মধ্যে শুয়ে থাকবেন। যাতে কেউ দেখতে না পায়। আপনার গায়ে একটা কম্বল চাপা দেব।

-কেটি, তুমি কি জানো, সব কটা গাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হবে?

–আমরা তো অটোমোবাইলে চড়ব না। কেপটাউন থেকে সকাল আটটায় একটা ট্রেন ছাড়বে। আমি আমার নিজস্ব গাড়িটি তার সঙ্গে জুড়ে দেব।

–সে কী? তুমি তোমার নিজস্ব গাড়ি করে আমাকে নিয়ে যাবে?

–হ্যাঁ, তাই করব।

বান্দা যন্ত্রণার মধ্যেও হাসার চেষ্টা করল তোমরা সত্যি দারুণ কাজ করতে পারো।

***

তিরিশ মিনিট কেটে গেছে। কেটি গাড়ি চালিয়ে রেলরোড ইয়ার্ডের কাছে পৌঁছে গেছেন। বান্দাকে ব্যাকসিটের নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। গায়ের ওপর কম্বল চাপা দেওয়া। রোড ক্রশ পার হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এবার কেটির গাড়ি ট্রেন ইয়ার্ডের কাছে এসে পড়েছে। হ্যাঁ, কেটি দেখতে পেলেন, কয়েকজন পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা পরিচিত মূর্তি ভেসে উঠল।

সুপারিটেনডেন্ট কমিনসকি?

উনি অবাক হয়ে গেছেন মিস ম্যাকগ্রেগর? আপনি কোথায় চলেছেন?

কেটি অত্যন্ত দ্রুত হেসে বললেন আমি কি এক দুর্বলচিত্তের মেয়ে নাকি সুপারিটেনডেন্ট? সত্যি কথা বলব? আমার অফিসে যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে দিয়েছে। আমি এই শহর ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। খুনিটা ধরা পড়লে ফিরে আসব। ওকে কি পাওয়া গেছে?

না, ম্যাডাম, আমরা চেষ্টা করছি। আমরা সমস্ত জায়গাতে সতর্ক নজর রেখেছি। লোকটা পালাবার চেষ্টা করলে তাকে ধরে ফেলব।

-হ্যাঁ, তাই করুন।

 –আপনি কোথায় যাবেন?

–আমার রেলওয়ে কামরাটা ওখানেই আছে। আমি কেপটাউনে যাব।

–আমরা কাউকে দেব কি?

না, ধন্যবাদ সুপারিটেনডেন্ট। দরকার লাগবে না। আমি জানি, আপনি যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন। কিন্তু আমি একাই পারব। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। কেটি এবং বান্দা প্রাইভেট কামরার মধ্যে পৌঁছে গেছেন। এর দেয়ালের রং কুচকুচে কালো।

–অন্ধকার রঙের জন্য দুঃখিত। কেটি বললেন। আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছি না।

বান্দাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। কেটি বললেন- এখানে শুয়ে থাকার চেষ্টা করুন। কেউ এলে ওয়াশরুমে ঢুকে যাবেন।

বান্দা বলল- ধন্যবাদ।

কেটি গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকলেন। তারপর বললেন–কেপটাউনে গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। আমি অবশ্য আপনার সঙ্গে থাকব।

বান্দা অবাক তার মানে?

আপনি কি একা একা যাবেন নাকি?

বান্দা মাথা নেড়ে বলল- হা, তুমি দেখছি তোমার বাবার মতো।

***

সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই। একটা ইঞ্জিন এসে প্রাইভেট কামরাটাকে মূল গাড়ির সঙ্গে জুড়তে শুরু করে দিয়েছে। এই গাড়িটা এবার কেপটাউনের উদ্দেশ্যে যাত্রা কররে।

সকাল আটটা। কেটি বান্দার দিকে তাকালেন, গল্পটা শুনতে হবে– গতকাল রাত থেকে বান্দার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

বান্দা কেটির দিকে তাকাল– কোথা থেকে শুরু করব? কীভাবে? তাও বুঝতে পারছি না। বান্টুদের তাদের পৈত্রিক ভূমিখণ্ড থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। সেখান থেকে শুরু করলে কেমন হয়? নাকি পল ক্রুগারের কথা বলব, ট্রানভালের প্রেসিডেন্ট। দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে যিনি ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- আমরা সমস্ত কালো মানুষদের ওপর আমাদের প্রভুত্ব কয়েম করব। তারা চিরদিন ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকবে।

নাকি গল্পটা অন্য কোনোভাবে শুরু হতে পারে? সিসিল রোডসের সেই উচ্চাশা? যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা শুধুমাত্র সাদাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

বান্দা শেষ পর্যন্ত বলল– পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।

গল্পের মধ্যে অনেক দুঃখজনক উপাদান। বান্দার বড়ো ছেলে একটা রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। পুলিশ সেটা ভেঙে দেবার জন্য চেষ্টা করে। এলোপাথারি গুলি চালাতে থাকে। দাঙ্গা বেধে যায়। ছেলেটাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের দিন সকালে তাকে তার কারাকক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়।

পুলিশ বলছে, এটা আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু আমি জানি, এটা হল ঠাণ্ডা মাথায় খুন।

কেটি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললেন- হায় ঈশ্বর, ও তো একটা বাচ্চা ছেলে। হ্যাঁ, তারা একসঙ্গে কতদিন খেলেছেন। একসঙ্গে মিশেছেন। ছেলেটাকে দেখতে খুবই সুন্দর ছিল।

কেটি আবার বললেন আমি অত্যন্ত দুঃখিত বান্দা। তারপর কী হয়েছে বলুন?

–তাকে খুন করার পর আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। আমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে। কেটি, আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। পুলিশ আমাকে শত্রু বলে ঘোষণা করল। তারা একটা ডাকাতির অপরাধে আমাকে গ্রেপ্তার করল, যে ডাকাতি আমি কখনও করিনি। আমাকে কুড়ি বছরের জেল দিল। তারপর আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। একটা গার্ডকে গুলি করে মেরে ফেলা হল। তারা আমাকে দোষ দিল। আমি কিন্তু কোনোদিন বন্দুক ব্যবহার করিনি।

–আমি জানি, কেটি বললেন, কিন্তু আপনাকে লুকিয়ে রাখতে হবে, নিরাপদে এবং ভালোভাবে।

–এই ব্যাপারে তোমাকে জড়িয়ে ফেলা হল। আমি খুবই দুঃখিত।

না, আমি তো নিজেই এ ব্যাপারে জড়িয়েছি। আসলে আপনি আমার বড়ো বন্ধু।

বান্দা হাসল- এই প্রথম একজন শ্বেতাঙ্গিনী আমার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলছে। তোমার বাবা, বান্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তুমি কি সত্যি আমাকে কেপটাউনে নিয়ে যাবে?

–আমরা কি কেপটাউনে যাব না?

–হ্যাঁ, যেতে পারি, নাও পারি।

–আমি একজন মহিলা, যখন তখন আমার মনোভাব পরিবর্তন করব।

মধ্যরাত, ট্রেনটা একটা স্টেশনে এসে থেমেছে। কেটি তার নিজস্ব কামরাটাকে কেটে দেবার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, এটাকে সাইডিং-এ রাখা হল। সকালবেলা কেটির ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি বান্দার খাটের দিকে তাকালেন। খাটটা ফাঁকা। বান্দা চলে গেছে। হ্যাঁ, বান্দা বোধহয় আর সমঝোতা করতে চাইছে না। কেটির দুঃখ হল। কিন্তু কেটি জানেন, বান্দা এখন নিরাপদেই আছেন। তার অনেক বন্ধু আছে। কেটি ভাবলেন, ডেভিডের কাছে এই কথা বললে কেমন হয়?

***

ডেভিড চিৎকার করে বলেছে তুমি এত বোকামোর কাজ করলে কেন?

কেটি জোহানেসবার্গে ফিরে এসে সব কথা বললেন।

তুমি নিজের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করলে। এমন কাজ কি করতে আছে? যদি পুলিশ বান্দাকে এখানে খুঁজে পেত, তাহলে তোমাকে নিয়ে তারা ছেলেখেলা করত।

কেটি শান্তভাবে বললেন- হ্যাঁ, তারা বান্দাকে মেরে ফেলত।

ডেভিড হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বললেন- তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না?

–হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু…

 কেটির চোখে আগুন জ্বলছে।

তুমি এখনও ছোট্ট মেয়ে রয়ে গেলে।

কেটি হাত তুলে আঘাত করার চেষ্টা করলেন। ডেভিড সেই হাত ধরে ফেলেছেন কেটি, নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো।

অনেক দিন আগে, তখন কেটির বয়স মাত্র চারবছর একটা ছেলে তার পেছনে লাগত। যখন ডেভিড আসত ছেলেটা পালিয়ে যেত। কেটি ছেলেটাকে ধরবার চেষ্টা করত।

ডেভিড বলত- কেটি, তোমাকে শিখতে হবে। কী করে রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। মেয়েরা কখনও মারামারি করে না।

কেটি বলত– আমি কি একটা ছোট্ট মেয়ে নাকি?

এভাবেই সময় কেটে যেত।

কেটি তার রাগ সংবরণ করলেন।

ডেভিড বললেন- তুমি এখন কী করবে?

কেটি চুপচাপ বসে থাকলেন। কী করা যায়? ডেভিডের সাথে বন্ধুত্ব এবং সাহচর্য? ডেভিডের সবকিছুই তার ভালো লাগে। ডেভিড হল এই পৃথিবীতে একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, যে কেটির সবকিছু বুঝতে পারে। যখন ডেভিড শহরে থাকে, সে কেটির সঙ্গে সময় কাটায়। বিনোদনের মুহূর্ত, জেমি একবার ডেভিডকে তার অভিযানের কথা বলেছিল। এখন সেই গল্প ডেভিড কেটিকে বলে থাকে।

–ওই নৌকোটার কথা বলো?

ডেভিড সব কিছু বলে।

–ওই হাঙরগুলোর কথা বলো, সামুদ্রিক ঝড়?

কেটি মায়ের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না, মার্গারেট এখন ক্রুগার বেন্ট লিমিটেড নিয়ে খুবই ব্যস্ত।

মার্গারেট প্রত্যেক রাতে জেমির সঙ্গে কথা বলেন। হ্যাঁ, ঘুমোতে যাবার আগে হয়তো। বলেন- ডেভিড আমাকে খুবই সাহায্য করছে জেমি, সে সবসময় কেটির চারপাশে থাকে। কেটি জানে না, শেষ পর্যন্ত কী হবে।

তিনি মাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেন, কোনো ব্যাপারে তিনি মায়ের সাথে একমত হতে পারেন না। না, ড্যানসিং ক্লাসে যেতে কেটির মোটেই ইচ্ছে করে না। মনে হয়, সময়টা যদি রাগবি খেলে কেটে যেত তাহলেই ভালো হত।

রাস্তার ছেলেদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কেটি স্কুলে যাওয়া শুরু করল। দুষ্টুমিতে রেকর্ড করে বসল। মার্গারেটকে হেডমিসট্রেস ডেকে পাঠালেন। প্রতি মাসে একবার করে। আহা, কেটিকে স্কুলে রেখে দেওয়া হল।

–আমি ওকে বুঝতে পারছি না মিসেস ম্যাকগ্রেগর। হেড মিসট্রেস বলেছিলেন, মেয়েটা বুদ্ধিমতী, কিন্তু এমন দুষ্টুমি করে কেন?

মার্গারেট এই প্রশ্নের উত্তর জানতেন না।

***

ডেভিডের কাছে কেটি শান্ত এবং জব্দ হত। একবার ডেভিড এসে বললেন– তোমাকে আজ বিকেলে একটা জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে, তাই তো?

-আমি ওসব পার্টিতে যেতে ভালোবাসি না।

ডেভিড কেটির দিকে তাকিয়ে বললেন– আমি জানি কেটি, তুমি ভালোবাসো, আসলে যে মেয়েটার জন্মদিন তার বাবা আমার এক বন্ধু। তুমি না গেলে খারাপ লাগবে।

কেটি তাকিয়ে বলেছিল- তাহলে আমায় যেতেই হবে?

এইভাবে কেটির মনোভাবে অনেক পরিবর্তন হল। দেখা গেল ডেভিডকে সে ভালোভাবেই মেনে চলেছে।

***

যখন কেটির বয়স দশ বছর, একদিন ডেভিডকে বলেছিল– আমি বান্দার সঙ্গে দেখা করব।

ডেভিড অবাক– এটা সম্ভব নয়, কেটি। বান্দা অনেক দূরে থাকে।

–তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে ডেভিড? নাকি আমি একা চলে যাব।

পরের সপ্তাহে ডেভিড কেটিকে নিয়ে বান্দার ফার্মে গিয়েছিল। ভারি সুন্দর জায়গা। শান্ত এবং নিঃশব্দ। সেখানে বান্দা গম ফলায়। মেষ পালন করে এবং উটপাখি পুষেছে। সেখানকার ব্যবস্থা খুবই সুন্দর। ছোটো ছোটো কুটির। শুকনো মাটি দিয়ে তৈরি। জীবনযাত্রার মধ্যে একটা সরলতা আছে।

বান্দা ডেভিডের পাশে ওই গম্ভীর মুখের কেটিকে দেখে বলেছিল- তুমি জেমি ম্যাকগ্রেগরের মেয়ে, তাই তো? 

তুমি বোধহয় বান্দা, কেটি শান্তভাবে বলেছিল, তুমি আমার বাবার জীবন বাঁচিয়েছিলে, তাই তোমাকে আমি ধন্যবাদ দিতে এসেছি।

বান্দা হেসে বলেছিল- হ্যাঁ, তোমাকে কে এই গল্প বলেছে? এসো, আমার পরিবারের সকলের সঙ্গে পরিচিত হও।

বান্দার বউ দেখতে খুব সুন্দরী। বান্টু জাতের এক রমণী। তার নাম নাটামা। বান্দার দুটো ছেলে আছে- বড়োটা কেটির থেকে বছর সাতেকের বড়ো, ছোটোটা অতটা বড়ো নয়।

বড়ো ছেলেকে দেখলে বান্দার কথাই মনে পড়ে যায়।

কেটি সমস্ত বিকেলটা দুটো ছেলের সঙ্গে গল্প করে, খেলে কাটিয়ে দিয়েছে। তারা কিচেনে বসে খাওয়া দাওয়া করল। ডেভিড এখানে থাকতে পারছে না। কালো পরিবারের সাথে মিশতে পারছে না। সে বান্দাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। কিন্তু এই সমাজের সাথে মিশবে কী করে?

ডেভিড আবার বান্দার রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বান্দা নাকি জন। টেঙ্গোর একজন অনুগামী। ওই ভদ্রলোক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছেন। খনির যাঁরা মালিক তারা ওই কালোলোককে খারাপ চোখে দেখেন। সরকার কালো লোকদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সরকার বলেছে, সব কালো লোকের ওপর দশ শিলিং করে কর ধার্য করা হবে। যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে না, তাদেরই এই করের আওতায় আনা হবে। সমস্ত দক্ষিণ আফ্রিকাতে মারাত্মক জাতি দাঙ্গা লেগে গেছে।

সন্ধ্যে হব-হব। ডেভিড বলল- এবার চলো, বাড়ির দিকে যাত্রা করি। কিন্তু অনেকটা পথ ঘোড়ার পিঠে করে যেতে হবে।

–এখন নয়, কেটি বান্দার দিকে তাকিয়ে বলল– ওই হাঙরের গল্প বলো।

মাঝে মধ্যে ডেভিড কেটিকে নিয়ে বান্দার সাথে দেখা করতে যায়। ধীরে ধীরে বান্দার সাথে তাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়ে উঠল।

***

দিন কাটছে, কেটির ছেলেমানুষি কিছুতেই কাটছে না। দিনে দিনে সে আরও উদাসীন এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সে কোনো কাজে অংশ নিচ্ছে না। তার বয়সী মেয়েরা কত শান্ত স্বাভাবিক। সে খনিতে যেতে ভালোবাসে, শিকারে যায়, মাছ ধরে, ক্যাম্পে শুয়ে থাকে–এই জীবনটাকে কেটি খুব ভালোবেসে ফেলেছে।

একদিন কেটি এবং ডেভিড ভাল নদীতে মাছ ধরছিল। কেটি একটা মস্ত বড়ো ক্রাউট ধরে ফেলল। ডেভিড কিছুই ধরতে পারেনি।

ডেভিড বলল- তোমার ছেলে হয়ে জন্মানো উচিত ছিল।

কেটি রেগে গিয়ে বলল- ডেভিড, তা হলে আমি কি তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম?

ডেভিড হাসল।

–আমরা বিয়ে করব, তুমি কি জানো ডেভিড?

–আমার ভয় হচ্ছে কেটি, তোমার থেকে আমি বাইশ বছরের বড়ো, তোমার বাবার বয়সী। তুমি একদিন একটা ছোট্ট ছেলের সন্ধান পাবে। দারুণ সুন্দর দেখতে এক যুবক।

–আমার ছোটো ছেলের দরকার নেই। আমি তোমাকে চাই।

–তুমি কি এ ব্যাপারে সত্যি মত ঠিক করেছ? তাহলে আমি বলব, একজন মানুষের হৃদয় কোথায় থাকে বলো তো?

–আমাকে বলো।

পেটের মধ্যে। এসো, ওই ক্রাউট মাছটাকে পরিষ্কার করো। ওটা দিয়ে আজ দুপুরে লাঞ্চ সারা যাবে।

***

কেটির মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, একদিন সে ডেভিড ব্ল্যাকওয়েলকে বিয়ে করবে। কারণ এই পৃথিবীতে ডেভিডের মতো আর কোনো পুরুষের সন্ধান সে কখনও পাবে না।

প্রতি সপ্তাহ মার্গারেট ডেভিডকে একদিন ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। নিয়মানুসারে কেটি ডিনারের আসরে প্রধান স্থান নিয়ে থাকে। প্রত্যেক শুক্রবার যখন ডেভিড আসে, কেটিকে ডাইনিং রুমে দেখা যায়। অথচ অন্য দিন সে রাতের খাবারের সময় আশেপাশে থাকে না। ডেভিড সাধারণত একলা আসে। মাঝে মধ্যে কোনো একজন মহিলাকে নিয়ে আসে, কেটি সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়েটিকে অপছন্দ করতে শুরু করে।

কেটি একদিন ডেভিডকে একলা পেয়ে বলেছিল– আমার সামনে ওই স্বর্ণকেশিনীদের কখনও আনবে না। অথবা কোনো সময় বলেছিল- ওরা কী বিচ্ছিরি পোশাক পরে।

ওই মেয়েরা কি মাদাম অ্যাগনেসের ভাড়া করা মেয়ে?

***

কেটির বয়স তখন চোদ্দো। হেডমিসট্রেস মার্গারেটকে ডেকে বললেন- মিসেস ম্যাকগ্রেগর, আমি একটা অভিজাত স্কুল চালাই। কেটি থাকলে আমার স্কুলের অবস্থা খারাপ হবে।

-ও এখন কী করছে?

–ও অন্য ছেলেমেয়েদের এমন ভাষা শেখাচ্ছে, যা আমরা বাপের জন্মে শিখিনি। মিসেস ম্যাকগ্রেগর, ওসব শব্দ ও কোথা থেকে শিখেছে?

মার্গারেটের মুখ অবাক হয়ে গেছে। কেটি তার রাস্তার বন্ধুদের কাছ থেকে এই ভাষাগুলো শিখছে। হ্যাঁ, মার্গারেট চিন্তা করলেন, এবার ওই খেলার অবসান ঘটাতে হবে।

হেডমিসট্রেস বললেন- আপনি এখনই ওর সঙ্গে কথা বলুন। আমরা শেষ সুযোগ দেব।

-না, আমি একটা অন্য জিনিস চিন্তা করছি। আমি কেটিকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেব।

মার্গারেট ডেভিডকে তার পবিকল্পনার কথা বলেছিলেন।

ডেভিড বলেছিল না, একাজ কখনও করা উচিত নয়।

-আমি থাকতে পারছি না। হেডমিসট্রেস আজকে অভিযোগ করছেন, কালকে অন্য কেউ করবে। আমার মেয়েটার কী হয়েছে? ও তো ছেলেদের জীবনযাপন করতে চাইছে। না, ডেভিড, আমি ওর মনোভাব বুঝতে পারছি না।

–ও কিন্তু খুবই চালাক এবং বুদ্ধিমতী।

না, ওকে স্কুল থেকে আমি ছাড়িয়ে আনব।

কেটি সেদিন বিকেলবেলা বাড়ি ফিরেছে, মার্গারেট রাগে ফেটে পড়লেন।

কেটি রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল- তুমি আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?

-হ্যাঁ, আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।

–আমি এখান থেকে চলে যাই। আমার সব বন্ধুরা এখানে আছে, তুমি আমাকে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করতে চাইছ?

–হ্যাঁ, তুমি যদি আমার কথা না শোনো, তাহলে তাই হবে।

তারা রাস্তার ছেলে নয়, তারা ভালো পরিবারের ছেলে।

আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। তুমি একটা বোর্ডিং স্কুলে চলে যাবে। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

–তাহলে আমি আত্মহত্যা করব, কেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল।

–তাই করো। ওপরে অনেকগুলো বেড আছে, যাও, গলায় ব্লেড চালিয়ে দাও। অথবা দেখো, এখানে কোথাও বিষ পাওয়া যায় কিনা।

কেটি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল- মা, তুমি একাজ কখনও করতে পারো না।

মা মেয়েকে আদর করে বললেন- তোকে আমি কত ভালোবাসি, সেটা জানিস? তুই কদিন বাদে এক কিশোরী কন্যায় রূপান্তরিত হবি। তোর বিয়ে দিতে হবে। এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে?

-এটা সত্যি নয়, কেটি বলেছিল, ডেভিড এ ব্যাপারে কিছুই মনে করে না।

এর মধ্যে ডেভিড এল কোথা থেকে?

–আমরা বিয়ে করতে চলেছি।

 মার্গারেট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মিসেস ট্যালিকে বলিস, তোর জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে।

–মার্গারেট ঠিক করলেন কেটিকে চেলটেনহ্যামে পাঠাবেন। ওখানে অনেকগুলো ভালো ইংলিশ বোর্ডিং স্কুল আছে। সেখানে শুধু মেয়েরাই পড়াশোনা করতে পারে। গ্লসটারশায়ারে। এটাই কেটির পক্ষে সবথেকে ভালো স্কুল। এখানে সাংঘাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিয়ম শৃঙ্খলার কঠিন অনুশাসন মেনে চলা হয়, মস্ত বড়ড়া বাগানের মধ্যে স্কুলটা অবস্থিত।

এখানকার হেডমিসট্রেস মিসেস কিয়েটন। তার স্বামীর সাথে ডেভিড ব্যবসা করে। কেটিকে ভরতি করতে কোনো অসুবিধা হবে না।

কেটি যখন এই কথা শুনল, তখন সে আগুনের মতো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। আমি ওই স্কুল সম্পর্কে সব কথা শুনেছি। না, আমি ওখানে যাব না। তুমি কী ভেবেছ?

-হ্যাঁ, তোমাকে সহবত শিখতে হবে। মার্গারেট বলেছিলেন।

আমি সহবত শিখব না। আমার মাথা খুব পরিষ্কার।

–শোনো, শুধু মাথা দিয়ে তুমি ভালো কাজ করতে পারবে না। তুমি কি মদ্দা ছেলে হবে নাকি?

না, আমি মেয়ে হতে চাই না, এভাবে মেয়ে হয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ? তোমরা কেন আমাকে একা ছেড়ে দিচ্ছে না।

–কেটি, ভবিষ্যতে আর কখনও এই ভাষা ব্যবহার করবে না।

 কেটিকে এবার সত্যি যেতে হবে।

ডেভিড লন্ডনে, যাবে ব্যবসার কাজে। একদিন মার্গারেট জিজ্ঞাসা করলেন কেটিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি না, সেখানে ও কেমন থাকবে।

ডেভিড বলল- এ বিষয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।

–হ্যাঁ, চিংকার করে কেটি বলতে থাকে, আমাকে এভাবে অন্য জায়গায় ঠেলে দিও না। ওখানে আমি মরে যাব!

***

প্রাইভেট রেলওয়ে গাড়ি। ক্লিপড্রিফট থেকে কেপটাউনের দিকে চলেছে। সেখান থেকে সাউদম্পটন। জাহাজে চড়ে। এই অভিযানটা মোটেই ভালো ছিল না। চার সপ্তাহ সময় লেগেছিল। কেটির সমস্ত অহংকার ধুলোয় মিশে গেল। কিন্তু ডেভিডের সাথে এতক্ষণ থাকতে পারছে, এতেই তার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার কাছে এটা একটা আগাম মধুচন্দ্রিমা। সে ভাবল, আহা, আমাদের মধ্যে এখনও বিয়ে হয়নি। তাতে কী?

 জাহাজে ডেভিড অনেক গল্প বলত। কেটি অবাক হয়ে শুনত। মাঝে মধ্যে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে থাকত।

একদিন কেটি প্রশ্ন করল– ডেভিড, তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?

ডেভিড বলল না, তোমাকে আমি ভুলতে পারি? এসো, তোমাকে আর একটা গল্প শোনাব।

কী গল্প?

–এই গল্পগুলো তুমি একদিন বলবে, তুমি সেইসব কোম্পানির গল্প বলবে, যেগুলো আরও বড়ো হয়ে উঠছে। তুমি আমাদের কোম্পানির কথাও জানতে পারবে। তোমার এই কোম্পানিটার অন্তরালে তোমার বাবার অবদান আছে।

-আমি কি আমার বাবার মতো?

–হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে, তারই মতো সাহসী হয়েছ। তারই মতো স্বাধীনচেতা মনোভাব।

–হ্যাঁ, আমি কি সত্যি সত্যি সাহসী?

তুমি একটা উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে। যে লোকটা তোমাকে বিয়ে করবে, তার সারা জীবন শেষ হয়ে যাবে।

কেটি মনে হাসল। হায় হতভাগ্য ডেভিড, তোমার জন্য আমার করুণা হচ্ছে।

***

ডাইনিং রুম। এই সমুদ্রযাত্রার শেষ রাত।

 ডেভিড জিজ্ঞাসা করল– তোমাকে আমি মোটেই বুঝতে পারি না কেটি।

–সত্যি কি?

–তুমি কেন তোমার মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করো?

সত্যি কি?

ডেভিডের মুখ লাল হয়েছে তোমাকে আমি কবে বুঝব?

একদিন আমাকে বুঝতে পারবে।

–তুমি কেন তোমার বয়সী মেয়েদের মতো নও?

–ওই রকম হতে হলে আমি মরে যাব। তুমি কি সত্যি সত্যি অন্য কাউকে ভালোবাসো?

–ঠিক জানি না।

–তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। কিছুদিন সময় দাও। আমি আর একটু বড়ো হই। আমি খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি অন্য কাউকে সহ্য করতে পারব না, ডেভিড!

কেটির আচরণের মধ্যে এমন একটা আবেগ, ডেভিড অবাক হল। ডেভিড কেটির হাতে হাত রেখে বলল– কেটি, যখন আমার বিয়ে হবে, যদি আমার বিয়ে হত। তাহলে তোমার বয়সী আমার মেয়ে থাকত, সেটা কি ভেবে দেখেছ?

কেটি উঠে দাঁড়াল। এমন একটা শব্দের কথা বলল, মনে হল এক্ষুনি বোধহয় বিপর্যয় ঘটে যাবে। সে চিৎকার করে বলল- ডেভিড ব্ল্যাকওয়েল, তুমি এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে নরকের অন্ধকারে চলে যাও।

ডাইনিং রুমে বসে থাকা সকলে অবাক চোখে কেটির দিকে তাকিয়ে ছিল।

***

লন্ডনে তারা তিনদিন ছিল। কেটি প্রত্যেকটা মুহূর্তকে ভালোবেসেছে।

ডেভিড বলল- আমি টিকিট কেটেছি, থিয়েটারের জন্য।

ধন্যবাদ ডেভিড, আমি দেখব।

-হ্যাঁ, এই থিয়েটার তোমার জন্য নয়।

–কেন?

 তারপর তারা থিয়েটার দেখতে গেল।

 তারপর তারা থিয়েটার দেখতে গেল।

লন্ডন শহরটা কেটির খুব ভালো লেগেছে। মনোমোটর গাড়ি আছে, গ্যারেজ আছে, মহিলারা সুন্দর পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেসের পোশাক। কত সুন্দর গয়না। আহা, মানুষরা সুপুরুষ। তাদের পোশাকের বাহার দেখার মতো। কেটিরা রিজে ডিনার খেল, স্যাভয়তে সাপার সারল। তারপর ডেভিডকে যেতে হবে। কেটি ভাবল, আমরা এখানে আবার আসব, আমি আর ডেভিড, একসঙ্গে।

***

চেলটেনহ্যাম মিসেস কিয়োটনের অফিস।

ডেভিড বলল- কেটিকে আপনি নিয়েছেন, এ জন্য ধন্যবাদ।

–এখানকার জীবনটা ওর ভালোই লাগবে। আর আমার স্বামীর বন্ধুকে সাহায্য করতে পারলাম, এতে আমি কৃতার্থ।

কেটি জানত না, তাকে প্রতারিত করা হল। হা, ডেভিড আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

কেটি ভীষণ রেগে গেল। সে ডেভিডকে গুডবাই পর্যন্ত বলেনি।

.

১৩.

 চেলটেনহ্যাম স্কুলটা অসহনীয়। এখানকার নিয়মনীতি খুবই কড়া। মেয়েদের একই ধরনের ইউনিফর্ম পরতে হয়। একই ধরনের নিকার। দশ ঘণ্টা ধরে স্কুলের ক্লাস চলে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আগে থেকে হিসেব করে বাধা। মিসেস কিয়োটন এ ব্যাপারে খুবই কঠিন। তিনি হাতে একটা লোহার দণ্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ান। মেয়েদের শিখতে হয় সহবত এবং শৃঙ্খলা। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু, যাতে একদিন তারা সুগৃহিনী হয়ে ওঠে।

— কেটি মাকে লিখেছিল– আমি একটা রক্তাক্ত বন্দিশালায় বন্দিনী হয়েছি। মেয়েগুলো ভয়ংকর। তারা বিচ্ছিরি পোশাক পরে। তারা ছেলেদের সম্পর্কে নানা কথা বলে। মাস্টাররাও হয়েছে সাংঘাতিক। আমি এখানে থাকব না, আমি একদিন পালিয়ে যাব।

কেটি কয়েকবার স্কুল থেকে পালাবার চেষ্টা করেছে। অন্তত তিনবার। প্রত্যেকবার সে ধরা পড়েছে। তাকে ধরে আনা হয়েছে। সে এর জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেনি।

একবার কেটির নাম ভোলা হল সাপ্তাহিক মিটিং-এ। একজন শিক্ষক বললেন এই মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। তাকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

মিসেস কিয়োটন বলেছিলেন– আপনার কথার সত্যতা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু এটাকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখব। যদি আমরা কেটি ম্যাকগ্রেগরকে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে সে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

তার মানে কেটিকে বোর্ডিং স্কুলে থাকতে হল।

***

কেটি ফার্মের ব্যাপারে আগ্রহী। এটা সকলকে অবাক করে দিয়েছে। এই বাগানে অনেক কিছু তৈরি হয়। শুধু সবজি নয়, তার পাশাপাশি মুরগি উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে। গোরুর খামার, শুয়োরদের থাকার জায়গা, ঘোড়াদের আস্তাবল। কেটি বেশিরভাগ সময় এখানে কাটায়। যখন মিসেস কিয়োটন এই খবরটা শুনলেন। তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন।

হেডমিস্ট্রেস তার সহকর্মীদের ডেকে বললেন- দেখো, ধৈর্য ধরে কাজ করলে কত কিছু হয়। কেটি শেষ পর্যন্ত জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছে। একদিন সে এক মস্ত বড়ো জমিদারকে বিয়ে করবে। তার কাজে সাহায্য করবে।

পরের দিন সকালবেলা এই খামারের মালিক অসকার ডেনকার হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বললেন- আপনার একজন ছাত্রী কেটি ম্যাকগ্রেগর, ওকে আমার ফার্ম থেকে এখনই দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।

-কেন? কী হয়েছে? মিসেস কিয়োটন জিজ্ঞাসা করলেন–ও তো খারাপ মেয়ে নয়।

না, কিন্তু সে কীসে আগ্রহী তা জানেন কি? সে জন্তু-জানোয়ারদের সাথে বিচ্ছিরি ব্যবহার করে।

ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে গেছেন তা হলে? আবার কথা বলতে হবে।

***

কেটি এখন অনেক কিছু ভুলে গেছে। সে এটাকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। তার মুখ সবসময় ভার হয়ে থাকে। কী আশ্চর্য, যাকে সে সবথেকে বেশি ভালোবাসে, তাকেই ঘৃণা করে। সে একটা একটা করে দিন গুনতে থাকে, কতদিন ডেভিডের সঙ্গে দেখা হয়নি। আহা, কবে আমি এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাব।

চোখ বন্ধ করলে আর একটা বিচ্ছিরি ছবি ভেসে ওঠে কেটির মনের পর্দায় আমি নেই, ডেভিড কি অন্য কোনো মেয়েকে ভালোভাসছে? যদি তাই করে, তা হলে দুজনকে আমি মেরে ফেলব, হ্যাঁ, তার জন্য ফাঁসি হলেও আমি কিছু মনে করব না।

ডেভিডের কাছ থেকে একটা ছোট্ট চিঠি এসেছে ডেভিড লন্ডনে আসছে, কেটির সঙ্গে দেখা করবে। কেটির কল্পনা আরও জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, অনেকগুলো লুকোনো খবর আছে ওই চিঠির মধ্যে। লন্ডনে ও কেন আসছে? আমার কাছে কেন? শুধু কি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য? নাকি সেই খবরটা দেবে, ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমাকে আর বিয়ে করবে না। ও আমার জীবন থেকে আলাদা হয়ে যাবে?

কেটির কষ্টকল্পনা আকাশ ছুঁয়েছে। ডেভিড এসে গেল। কেটি তার ক্লাসমেটদের গুডবাই বলে বলল আমার প্রেমিক এসেছে, আমি চললাম।

মেয়েরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু একজন বলেছিল– কেটি মিথ্যে কথা বলছে।

একটুখানি দাঁড়া, তাহলে দেখতে পাবি। লোকটা লম্বা এবং সুন্দর। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

শেষ পর্যন্ত ডেভিড এল। সে দেখল, সমস্ত মেয়েরা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, তারা বোধহয় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এবং মুখ টিপে হাসছে। একটু বাদে ডেভিড সব ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তার চিবুক লজ্জায় লাল হয়েছে। সে ওখান থেকে পালিয়ে গেল।

কী আশ্চর্য, ওরা এমন করে আমায় দেখছে, যেন আগে কোনো পুরুষ দেখেনি। ডেভিড বলল, সে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কেটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি কিছু বলেছ?

-না, আমি কিছু বলিনি। কেন বলব?

 তারা বিরাট ডাইনিং রুমে পাশাপাশি বসে খেল। ডেভিড বাড়ির গল্প বলল।

-মা তোমাকে ভালোবাসা জানিয়েছে। তুমি গরমের ছুটিতে যাবে তো?

মা কেমন আছে?

–মা ভালো আছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম করছেন।

–কোম্পনি ভালো যাচ্ছে, ডেভিড?

এই কথা শুনে ডেভিড অবাক হয়ে গেছে- হ্যাঁ, কেন বলো তো?

কেটি মনে মনে ভাবল, একদিন ওই কোম্পানিটা আমার হবে, তুমি আর আমি সব কিছু ভাগ করব।

কেটি বলল- না, আমার জানতে ইচ্ছে করছে।

ডেভিড কেটির দিকে তাকাল– সে কী, তুমি কিছু খাচ্ছো না কেন?

খেতে কোনো কিছু ভালো লাগে না কেটির। সে ওই সুন্দর মুহূর্তটার অপেক্ষাতে আছে। যখন ডেভিড বলবে- এসো কেটি, তুমি এখন পরিপূর্ণ যুবতী। আমি তোমাকে আন্তরিকভাবে চাইছি। আমরা এবার বিয়ে করব।

ডেজার্ট এসেছে, চলে গেছে। কফি এল এবং চলে গেল। না, ডেভিডের মুখ থেকে এই শব্দগুলো বেরোচ্ছে না কেন?

শেষ পর্যন্ত ডেভিড ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল এবার আমায় যেতে হবে। না হলে ট্রেন মিস করব।

কেটি বুঝতে পারল, ওই শব্দগুলো কখনও ডেভিড বলবে না।

কেটিকে দেখে ডেভিড অবাক হয়ে গেছে। কয়েক মাসে কেটির মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হ্যাঁ, তার উন্মাদনা কমে এসেছে। তার সেই ছটফটে ভাবটাও অনেকটা কমে গেছে।

ডেভিড কেটির হাতে হাত রেখে বলল বলল, তোমার জন্য আমি কী করব?

কেটির চোখে জল। তবুও সে হাসি মুখে বলল- ডেভিড, তুমি আমাকে একটা সাহায্য করবে। আমাকে এই জীবন থেকে মুক্তি দেবে?

কেটি হেঁটে চলে গেল। না, কোনো কথা বলল না!

***

মার্গারেটের মনে হচ্ছে, তিনি বোধহয় কেটির অবর্তমানে থাকতে পারছেন না। সে মেয়েটা অসম্ভব জেদি, অবাধ্য, তা সত্ত্বেও মার্গারেটের জীবনে মেয়েটা ছিল অনেকখানি। মার্গারেট আরও বুঝতে পারলেন, কেটিকে তিনি সত্যি ভালোবাসতেন। একদিন কেটি সত্যিকারের এক ভালো মেয়ে হয়ে উঠবে। মার্গারেটের দৃঢ় বিশ্বাস।

গরমের ছুটিতে কেটি বাড়িতে এল।

 মার্গারেট জানতে চাইলেন স্কুল কেমন চলছে?

–আমার ওটা ভালো লাগে না, ওখানে এত বাধা নিষেধ, আমি পছন্দ করি না।

মার্গারেট জানতে চাইলেন ওই স্কুলের অন্য মেয়েরা কেমন?

-কেন? একথা জানতে চাইছ? কেটি শান্তভাবে বলল, ওদের কথা জেনে কী হবে? ওরা ওদের জীবন তো ওখানে কাটাবে। ওরা জীবনের আসল মানেটা খুঁজে পায়নি।

মার্গারেট চিৎকার করে বললেন কেটি, তুই কি সারা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে যাবি।

–আমাকে এমনভাবে বকো না তো? দক্ষিণ আফ্রিকাতে এসব ব্যাপার শেখানো হয় না। ওখানে কারা থাকে বলে তো? চিড়িয়াখানার বন্দি পশুরা। তারা কি কোনো দিন হিরের খনি দেখেছে? সোনার খনি?

–কেটি, আবার সেই বড়ো বড়ো কথা?

কেটি বলল- হ্যাঁ, আমি একদিন স্কুল থেকে চলে আসব। তুমি কিন্তু দুঃখ পাবে না?

–সে কীরে?

 কেটি বলল- হা, আসবই, দেখো একদিন!

***

এক ঘণ্টা বাদে কেটি বাড়ি ফিরেছে। সে বাইরে গিয়ে মাঠে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে রাগবি খেলছিল।

মার্গারেট ভাবলেন, না, যত খরচই করি না কেন, কেটির মন পাল্টানো যাবে না।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা কেটি বলল- ডেভিড কি শহরে আছে?

না, ও অস্ট্রেলিয়ায় গেছে। কাল ফিরে আসবে মনে হচ্ছে।

শুক্রবার আসবে? রাত্রিবেলা?

 সম্ভবত, মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ডেভিডকে ভালোবাসিস, তাই না।

কেটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল- হ্যাঁ, ও একজন খুবই ভালো মানুষ।

-হ্যাঁ, মনে হচ্ছে, মার্গারেট বললেন। তিনি হাসলেন, কেটি প্রতিজ্ঞা করেছে ডেভিডকে বিয়ে করবে।

–আমি ওকে ঘৃণা করি না, মা, আমার মনে হচ্ছে, একজন মানুষ হিসেবে ওকে আমি ভালোবাসি।

***

শুক্রবারের ডিনার। ডেভিড এসেছে।

কেটি এগিয়ে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। হাতে হাত দিয়ে কানে কানে বলল– ডেভিড তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি না থাকাতে খুব খারাপ লেগেছে। তুমি কি আমার জন্য কষ্ট পেয়েছ?

ডেভিড বলল- হ্যাঁ, পেয়েছি। তারপর ভাবল, হা ঈশ্বর, সত্যি কী পেয়েছি! এই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে আমি কী করব? মেয়েটা আর একটু বড়ো হোক, তারপর না হয় ভাবা যাবে।

তখন কেটির বয়স মোলো বছর। সে পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে উঠতে পেরেছে। তার কালো চুল আরও বড়ো হয়েছে। কাঁধ ছাপিয়ে গেছে। তার চেহারার মধ্যে জেগেছে নমনীয়তা। হ্যাঁ, এমন একটা ব্যাপার যা ডেভিড কখনও আগে দেখেনি, সে এক অসাধারণ রূপবতী যুবতী হতে চলেছে। তার মধ্যে আছে বুদ্ধিমত্তার তাৎক্ষণিক বহিপ্রকাশ। আহা, যে কোনো পুরুষের কাছে সে হবে পরম উপাদেয় এবং আদরের সম্পত্তি।

ডিনারের সময় ডেভিড জিজ্ঞাসা করল স্কুলে কেমন লাগছে কেটি?

কেটি বলল- খুবই ভালো লাগছে। আমি অনেক কিছু শিখতে পারছি। ম্যাডামরা অসাধারণ। হ্যাঁ, অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে।

মার্গারেট কথা না বলে বসেছিলেন।

ডেভিড, তুমি কি আমাকে খনিতে নিয়ে যাবে?

–হ্যাঁ, এভাবেই তুমি তোমার ছুটি কাটাবে?

–হ্যাঁ।

সারাদিন সময় লাগে হিরের খনিতে পৌঁছোতে, তার মানে সারাদিন সে ডেভিডের সঙ্গে থাকতে পারবে।

-মা যদি বলেন, অনুমতি দেন, তাহলে যেও।

–মা, দাও না।

–ঠিক আছে ডার্লিং, ডেভিড, তুমি সঙ্গে থেকো কিন্তু। তুমি থাকলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করি।

মার্গারেট জানেন, এই ব্যাপারে তার কোনো সংশয় নেই।

***

ক্রুগার ব্রেন্টের হিরের খনি, নানা দিকে ছড়িয়ে আছে। এক জায়গাতে বিরাট কাজ হচ্ছে। কয়েকশো শ্রমিক কাজ করে চলেছে। তারা মাটি খুঁড়েই চলেছে, পাথরের গায়ে আঘাত করছে। পরিষ্কার করছে, আবার নতুন উদ্যমে কাজ করছে।

ডেভিড কেটিকে বলল–এটা আমাদের কোম্পনির সবথেকে বড়ো খনি। এখানে অনেক অফিস আছে, তোমাকে সবকিছু দেখাব?

ডেভিড আরও বলতে চেষ্টা করল, প্রত্যেকটা হিরের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। কেটি চোখ বড়ো বড়ো করে সবকিছু শোনার চেষ্টা করল। ভাবল, আহা লোকটার মাথাটা এত পরিষ্কার। ও সব কিছু জানে।

–কিম্বারলিতে অন্যরকমের খনি আছে, সেখানকার হিরেগুলো আকারে বড়ো হয়।

আহা, ডেভিডের মাথায় এত বুদ্ধি গজগজ করছে!

ডেভিড কথা বলেই চলেছে। কেটি মন দিয়ে সবকিছু শোনার চেষ্টা করছে।

পরবর্তী দু ঘণ্টা ধরে তারা খনির নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়াল। তারপর লাঞ্চের আসর। কেটির কাছে মনে হল, এই দিনটা স্বর্গীয় মোড়কে মোড়া!

***

কেটি বিকেলবেলা বাড়ি ফিরেছে। মার্গারেট জানতে চাইলেন- কেমন লাগল?

-মা, খনিতে গেলে কী যে আনন্দ হয়! মনে হয়, আমি যেন অন্য কোথাও চলে গেছি।

আধ ঘন্টা বাদে মার্গারেট জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। কেটি মালীর ছেলের সাথে কুস্তি খেলায় মেতে উঠেছে।

পরবর্তী বছর, কেটির চিঠি এল স্কুল থেকে। চিঠির মধ্যে আশার বাণী আছে। তাকে হকি দলের ক্যাপটেন করা হয়েছে। সে ক্লাসের মধ্যে সবার আগে এগিয়ে গেছে। আহা, স্কুলটা খুব একটা খারাপ নয়, কেটি লিখেছে। কিন্তু দুটো একটা মেয়ের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। সে তার দু-তিনজন বান্ধবীকে নিয়ে গরমের ছুটিতে আসবে। মার্গারেটের মনে আনন্দ। আহা, আবার এই বাড়িতে কিশোরী কণ্ঠের কলতান শোনা যাবে। আমার মেয়েকে কতদিন বাদে কাছে পাব। স্বপ্ন সত্যি হবে। জেমি, আর আমি, আমরা তো অতীত হয়ে গেছি। ম্যাগি ভাবলেন, কেটি হল ভবিষ্যৎ। আহা, আমাদের সামনে একটা সোনালি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে।

***

কেটি গরমের ছুটি কাটাতে বাড়িতে এল। মনে হল, সে বুঝি এখন একজন পরিপূর্ণা যুবতী হয়ে উঠেছে। ক্লিপড্রিফট শহরের সুন্দরীরা তার সাথে গল্প করতে এসেছিল। কেটি তাদের প্রতি নিস্পৃহ আচরণ দেখিয়েছে। ডেভিড এখন আমেরিকাতে। কেটি তার জন্য অপেক্ষা করছে। ডেভিড বাড়িতে এল। কেটি হতভম্ব হয়ে গেল। সে সাদা পোশাক পরেছে, কালো ভেলভেটের একটা কিছু চাপিয়েছে ওপরে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। যৌবনবতী শরীরটা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

ডেভিড এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করল। কী আশ্চর্য, কেটির প্রত্যুত্তর দারুণ। ডেভিড অবাক চোখে তাকাল। হ্যাঁ, বেশ কিছুটা পরিবর্তন। অচেনা অজানা একটা অনুভূতি। চোখের তারার এই আকুতি আগে তো ছিল না।

ডেভিড বুঝতে পারল। কেটির মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কেন? ডেভিড জানে না, সবকিছু পাল্টে যাবে কিনা।

***

স্কুলে কেটির শেষ বছর। এক সন্ধ্যায় ডেভিড হঠাৎ সেখানে গিয়ে পড়েছিল। সে মাঝে মধ্যে চিঠি দেয়, টেলিফোন করে। এবার আগাম কোনো সংবাদ দিল না।

কেটি এগিয়ে এল। ভীষণ ভালো লাগছে।

–তুমি কিছু বলোনি কেন?

 –কেটি, আমি তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব।

কেটি জিজ্ঞাসা করল কিছু হয়েছে?

-তোমার মায়ের শরীর খারাপ।

কেটি বলল- ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।

***

মায়ের চেহারা দেখে কেটি অবাক হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে দেখা হয়েছিল। মার্গারেটকে দেখে মনে হচ্ছিল, উনি বোধহয় স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময়ী। কিন্তু এখন মুখটা ফ্যাকাশে। চোখের তারায় বীভৎস ধূসরতা। সেই উদ্যম কোথায় হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, উনি যেন, এক রোগাক্রান্ত রমণী। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছেন।

কেটি তার মায়ের পাশে বসেছিল। বলল- মা, আমি দুঃখিত।

 মার্গারেট কেটির হাতে হাত দিলেন। কেটি, আমার যাবার সময় হয়েছে, আমি জানি, তোমার বাবা আমাকে ডাকছে।

তিনি কেটির দিকে তাকালেন। তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছো? নাকি পাচ্ছো না? তারপর বললেন- হ্যাঁ, আমি জানি, তোমার বাবার চারপাশে কেউ ছিল না। কিন্তু এখন? আমার তো তুমি আছো।

তিনদিন বাদে মার্গারেটকে সমাহিত করা হল। কেটির মন শোকে আচ্ছন্ন। সে বাবাকে হারিয়েছে, ভাইও নেই, কিন্তু, এই অতীতের স্মৃতি তার খুব একটা মনে নেই। মায়ের মৃত্যুতে সে সত্যিকারের শোক পেয়েছে। কেটি তখন অষ্টাদশী, এই পৃথিবীতে একেবারে একা। একটা আতঙ্ক এসে গ্রাস করেছে।

ডেভিড সবকিছু শান্তভাবে দেখছে, কবরখানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। বাড়িতে ফিরে আসার পর কেটি কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল মা, আমাকে এত ভালোবাসত ডেভিড, আমি মাকে ভালোবাসতে পারলাম কই? শুধু তো কষ্ট আর জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে গেলাম।

ডেভিড বলল– কেটি নিজের সম্পর্কে এমন কথা কেন চিন্তা করছ?

না, আমি খালি যন্ত্রণাই দিয়েছি, আমি যদি দিনগুলো ভালোভাবে কাটাতাম? ডেভিড, কেন এমন হল?

ডেভিড দাঁড়াল। কেটির কান্না কিছুটা থামল। ডেভিড বলল- তুমি শান্ত হবার চেষ্টা করো। কেটি, জীবনের ভালো মুহূর্তগুলোকে মনে করার চেষ্টা করবে।

-হ্যাঁ, চেষ্টা করব, কিন্তু এখন আমি কোথায় যাব?

পরের দিন সকালে কেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হল।

ডেভিড বলল- স্কটল্যান্ডে তোমার পরিবার আছে।

সেখানে আমি যাব না, সেটা পরিবার নয়, তাদের আমি আত্মীয় বলতে পারি। কেটির কণ্ঠস্বরে তিক্ততা ঝরে পড়ছে, বাবা যখন এখানে এসেছিল, ওরা হেসেছিল, কেউ সাহায্য করেনি। একমাত্র মা সাহায্য করেছে, মা এখন বেঁচে নেই। না, আমি ওখানে যাব না।

ডেভিড সেখানে বসে চিন্তা করে বলল– তাহলে? স্কুল শেষ হওয়ার পর কোথায় যাবে? ডেভিড আরও বলে চলল তোমার মা চেয়েছিল, তুমি যেন কোম্পানিটা দেখো।

কেটি কোনো কথা বলল না। সে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।

***

স্কুলের ক্লাস শেষ হয়ে গেল। তারপর ডেভিড হাজির হল।

***

জোহানেসবার্গ থেকে ক্লিপড্রিফট, ঘোড়ার পিঠে যাত্রা, না, নিজস্ব রেলওয়েতে।

ডেভিড বলল- তুমি কি জানো, এই সবকিছু এখন তোমার? তুমি এখন বিশ্বের সবথেকে ধনী মহিলা। তুমি কী করবে? তুমি অনেক লক্ষ পাউন্ডের এই কোম্পানিটা বিক্রি করতে পারো। ডেভিড বলতে থাকে, অথবা রাখতে পারো। এ ব্যাপারে তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।

কেটি বলল- আমি বুঝতে পারছি না। আমার বাবা হিরের সন্ধানে এখানে এসেছিল। ডেভিড, বাবাকে আমি কী বলব? একজন অভিযাত্রী? নাকি অর্থ অপহরণকারী? আর এই কোম্পানি? এর সাথে এমন দুজন গার্ডের নাম যুক্ত আছে, যারা বাবাকে মারতে চেয়েছিল। এটাকে কি আমি বাঁচিয়ে রাখব? আমি বুঝতে পারছি না। না, ক্রুগার ব্রেন্ট, আমাকে সবসময় জ্বালাতন করে, আমি এই কোম্পানিটা বিক্রি করব না।

ডেভিড শান্তভাবে বলল- আমি কি এখানে থাকব?

–হ্যাঁ, আমার তাই ইচ্ছে। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি একটা বিজনেস স্কুলে ভর্তি হব।

–বিজনেস স্কুল? ডেভিডের কণ্ঠস্বরে আগ্রহ এবং আতিশয্য।

–এটা ১৯১০, কেটি মনে করাল। জোহানেসবার্গে অনেকগুলো বিজেনস স্কুল আছে, এখানে মেয়েরা ভরতি হওয়ার অনুমতি পায়।

শেষ পর্যন্ত কেটি ঠিক করল, সে এমনই একটা স্কুলে ভরতি হবে।

.

১৪.

এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন উন্মাদনা। যখন কেটিকে জোর করে চেনটেনহ্যামে পাঠানো হয়েছিল, জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে প্রত্যেকটা ক্লাসে সে নতুন কিছু শিখতে পারছে, যেটা ভবিষ্যতে তার কাছে সহায়ক হয়ে উঠবে। এই পাঠ্যসূচির মধ্যে একদিকে যেমন হিসাবশাস্ত্র আছে, অন্যদিকে আছে প্রশাসন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং ব্যবসা পরিচালনার নানা সূত্র। প্রত্যেক সপ্তাহে ডেভিড ফোন করে জানতে চায় কেটি কেমন আছো?

কেটি বলল- ডেভিড, ব্যাপারটা সত্যি উন্মাদনাজনক।

একদিন সে আর ডেভিড একসঙ্গে কাজ করবে, পাশাপাশি কাজ করতে করতে রাত আসবে, একদিন হঠাৎ ডেভিড তার দিকে তাকিয়ে বলবে– কেটি, ডার্লিং, আমি কী বোকা নির্বোধ। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? একমুহূর্ত পরে সে স্বইচ্ছায় ডেভিডের আলিঙ্গনে ধরা দেবে।

কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে নিজেকে তৈরি করতে হবে। কেটি আবার হোমওয়ার্কে মন দিল।

দু-বছর ধরে এই পাঠ্যসূচিটা চলতে থাকবে। কেটি ক্লিপড্রিফটে এল তার কুড়িতম জন্মদিনের আসরে যোগ দিতে। ডেভিড তাকে আনতে স্টেশনে গিয়েছিল। কেটি হাত নাড়তে নাড়তে উড়ন্ত প্রজাপতি হয়ে উড়ে এসে ডেভিডকে জড়িয়ে ধরে বলল- ডেভিড, তোমাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে।

ডেভিড একটু রেগে গিয়ে কেটিকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল- হ্যাঁ, তোমাকে দেখেও ভালো লাগছে আমার।

তার আচরণের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা চোখে পড়ল।

কিছু হয়েছে কী?

 না, সকলের সামনে এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরো না।

কেটি ডেভিডের দিকে তাকিয়ে বলল ঠিক আছে, ভবিষ্যতে তোমাকে আর কখনও এভাবে বিরক্ত করব না।

***

তারা গাড়িতে বাড়ি ফিরছে। কেটির দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড, হ্যাঁ, একটা স্ফুটনোম্মুখ গোলাপ বুঝি। শরীরের সর্বত্র সুন্দর স্বর্গীয় আভা। অনেকটা পাল্টে গেছে কেটি। ডেভিড মনে মনে চিন্তা করল, না, আমি কখনওই ওর অসহায়তার সুযোগ নেব না।

সোমবার সকালবেলা কেটি ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের নতুন অফিসে এসে পা রাখল। এখানে একটা নতুন জগৎ গড়ে উঠেছে। এই জগতের আলাদা ভাষা আছে। এখানে অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কতগুলো বিভাগ তৈরি হয়েছে। কোথাও স্থানীয় বিভাগ, কোথাও আবার এজেন্টদের অফিস, কোনো জায়গাতে আবার শুধুমাত্র ব্রাঞ্চ নিয়ে আলোচনা হয়। এই কোম্পানি এখন অনেক জিনিস তৈরি করছে, হাতে গুনে বোধহয় শেষ করা যাবে না। একদিকে যেমন ইস্পাতের কারখানা আছে, অন্যদিকে আছে গবাদি পশুদের আগার। আছে রেললাইন, জাহাজের সম্ভার আরও কত কী। এর পাশাপাশি পুরোনো ব্যবসাও সমানতালে এগিয়ে চলেছে। খনি থেকে হিরে আর সোনা তুলে আনা, জিঙ্ক, প্লাটিনাম আর ম্যাগনেশিয়ার। সমস্ত সময় কাজ চলেছে ঘড়ির কাঁটা ধরে।

ক্ষমতা– কেটি বুঝতে পারল, ক্ষমতার জন্যই আমরা সবাই লালায়িত। কেটি অফিসে গিয়ে বসল। ডেভিডের কথাগুলো সে অবাক হয়ে শুনছে। সে ভেবে আশ্চর্য হচ্ছে, তাদের কোম্পানির এক-একটা সিদ্ধান্তের ফলে সারা পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজাররা নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। নানা আলাপ আলোচনা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেভিড আবার এই পরিকল্পনাগুলোকে পাল্টাতে বাধ্য হয়।

কেটি জানতে চেয়েছিল- তুমি কীভাবে এতগুলো কাজ করো?

কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা ম্যানেজারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। একজন ম্যানেজার ভাবেন যে, তিনি পৃথিবীর অধীশ্বর। তিনি একাই ক্ষমতা দখল করবেন। এটা কখনওই হতে দেওয়া উচিত নয়। চলো, কোথাও গিয়ে লাঞ্চ খাওয়া যাক।

ডেভিড কেটিকে বিরাট প্রাইভেট ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল। কেটির অফিসের পাশেই এটা অবস্থিত। একজন ভদ্রলোক অপেক্ষা করছিল, বেশি বয়স নয়। পাতলা চেহারা, চোখের তারায় ঔৎসুক্যের বাদামী আভা।

ডেভিড বলল– এ হল ব্রাড রজারস। ব্রাড, এই তোমার নতুন বস, কেটি ম্যাকগ্রেগর।

ব্রাড হাত বাড়িয়ে বলল- মিস ম্যাকগ্রেগর, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমি আনন্দিত।

ডেভিড বলল– ও হল আমাদের গোপন অস্ত্র। ও ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। যদি আমি কখনও চলে যাই। তুমি চিন্তা করো না। কেটি, ব্রড সবকিছু চালাতে পারবে।

যদি আমি চলে যাই–এই চিন্তাটাই কেটির মনের মধ্যে ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কেটি জানে, ডেভিড কখনও কোম্পানিকে ছেড়ে যেতেই পারবে না। কেটি লাঞ্চের আসরে বসে আর কিছু চিন্তা করল না। লাঞ্চের পর তারা দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করল।

 ডেভিড সাবধান করে দিয়ে বলল– আরও রাজনৈতিক সংঘর্ষ দেখা দেবে। শুধু তাই নয়, সরকার একধরনের নতুন ট্যাক্স বসাতে চলেছে।

কেটি জানতে চাইল– এটা কী ধরনের ট্যাক্স?

কালো মানুষ, বাদামী মানুষ এবং ইন্ডিয়ানদের দু-পাউন্ড করে মাথা পিছু দিতে হবে। এটা একমাসের মাইনের থেকে বেশি।

কেটি বান্দার কথা ভাবল, এবার অন্য বিষয়ে আলোচনা হল।

***

নতুন জীবনটাকে কেটি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের অন্তরালে লক্ষ লক্ষ পাউন্ডের জুয়াখেলা। হ্যাঁ, ব্যবসার ভেতর এ ধরনের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব থাকাই দরকার। মনে যার সাহস আছে, সে-ই শেষ পর্যন্ত ডারবি ম্যাচে জিততে পারে।

ডেভিড কেটিকে বলেছিল- শোনো, ব্যবসা হল একটা খেলা। যে ভালো খেলতে পারে, সে-ই জয়যুক্ত হয়। তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, তুমি কঠিন কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে নেমেছ। সামান্য শৈথিল্য দেখালেই সর্বনাশ। আমি তোমাকে এই খেলার সর্বোত্তম খেলোয়াড হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছি।

হ্যাঁ, তখন থেকেই কেটি এক অনুভবী এবং মনোযোগী ছাত্রী। যে করেই হোক এই খেলাটা তাকে শিখতে হবে। 

কেটি একা ওই বিরাট বাড়িটায় বাস করে। সেখানে অনেক চাকরের দল আছে। সে আর ডেভিড শুক্রবার রাতে ডিনারে উপস্থিত হয়। কিন্তু অন্য কোনো রাতে ডেভিড আসতে চায় না। কোনো একটা কারণ দেখিয়ে দেয়। ব্যবসায়িক প্রহরে তারা একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু কখনও ডেভিডকে আগ্রহী বলে মনে হয় না। এই ব্যাপারটা কেটি বুঝতে পারে না।

***

একুশতম জন্মদিন, ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেডের সমস্ত শেয়ার কেটির হাতে তুলে দেওয়া হল। এবার সে আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির ওপর তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে।

কেটি বলেছিল– চলল, এই দিনটাকে স্মরণ করে আজ রাত্রে আমরা ডিনার খাই।

–আমি দুঃখিত, কেটি, অনেক কাজ করতে হবে।

কেটি একা সেই রাতে খেল। বুঝতে পারছে না, ডেভিডের এই শীতল আচরণের অর্থ কী? ডেভিড কি কালা বোবা অন্ধ নাকি? আমার ভালোবাসা কেন বুঝতে পারে না।

কোম্পানি এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা নতুন জাহাজের লাইন বসাতে চলেছে।

তুমি আর ব্রাড নিউইয়র্কে চলে যাও, ব্যাপারটা শেষ করে এসো। ডেভিড কেটিকে বলেছিল, তোমার একটা ভালো অভিজ্ঞতা হবে।

কেটি চেয়েছিল, ডেভিড যেন তার সফরসঙ্গী হয়। কিন্তু এই কথাটা বলতে কেমন যেন লাগল। কেটি ভাবল, শেষ অব্দি ডেভিডকে ছাড়াই আমি কাজটা করতে পারব। এছাড়া আমি তো কখনও আমেরিকাতে যাইনি। নতুন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তখন সে উন্মুখ হয়ে উঠেছে।

***

ব্যবসায়িক কাজটা সুন্দরভাবে হয়ে গেল। ডেভিড কেটির হাত ধরে বলেছিল সেখানে গিয়ে দেখবে একটা নতুন জগৎ।

কেটি এবং ব্রাড কোম্পানির বিভিন্ন শাখা অফিসে গেল। ডেট্রয়েট থেকে শিকাগো, পিটসবার্গ থেকে নিউইয়র্ক। কেটি এই বিরাট দেশটা দেখে অবাক হয়ে গেল। এর আগে কেটি ডাকহারবার পর্যন্ত গিয়েছিল। অথবা অন্য কোনো জায়গাতে। তাকে বিখ্যাত শিল্পী চালর্স ডানা গিভসনের বাড়িতে রাতে খাবারের নেমতন্ন করা হল। সেখানে বারোজন উপস্থিত ছিল। কেটি ছাড়া সকলেই একটা ছোট্ট দ্বীপের বাসিন্দা, এই দ্বীপটার নাম হল আইসেলবোরো।

গিভসন কেটিকে বলল- এই অঞ্চলটার একটা সুন্দর ইতিহাস আছে। অনেক বছর আগে বস্টন শহর থেকে মানুষেরা ছোটো ছোটো নৌকোতে চড়ে এই দ্বীপে এসেছিল। এই দ্বীপে আসার পর তারা নিজেদের বাড়িঘর তৈরি করে। এখানে প্রায় ৫০টা পরিবার বাস করে। তুমি কি লাইটহাউসটা দেখেছ?

হ্যাঁ।

–এই লাইটহাউসের একজন পরিচালক আছে, আর আছে তার চালাক কুকুরটা। যখন কোনো নৌকো সেখান দিয়ে যায় কুকুরটা ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।

কেটি হেসে বলল- না, তুমি মজা করছ?

না, সবথেকে অবাক কাণ্ড কী বলো তো? কুকুরটা কিন্তু কানে কালা। সে কী করে বলো তো? সে স্পন্দনের অনুভব নেবার চেষ্টা করে।

 কেটি আবার হেসে বলল- তাহলে? তোমরা একটা আশ্চর্য দ্বীপের বাসিন্দা, তাই তো?

কাল সকালে তুমি সব জায়গায় ঘুরে দেখো, কেমন?

সকালবেলা কেটি এই দ্বীপের একমাত্র হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। সে একটা ঘোড়া ভাড়া করল এবং ঘোড়ার গাড়ি। তারপর নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াল। ভারী ভালো লাগল এই ছোট্ট দ্বীপটাকে!

দ্বীপের একেবারে শেষে একটা কবরক্ষেত্র।

কেটি বলল- এখানে একটু থামবে?

 সে গাড়ি থেকে নেমে এসে ওখানে দাঁড়াল।

একটা পাথরের স্মারকচিহ্ন। লেখা আছে– জবপেন ডেলটন, ২৫ জানুয়ারি, ১৭৯৪ সালের ৪৭ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার নীচে স্মৃতিলেখা। লেখা আছে, এই পাথরের নীচে এমন একজন শুয়ে আছেন, ঈশ্বর তাকে আশ্রয় দিয়েছেন।

কেটি অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই শান্ত স্তব্ধ নীরব নিথর প্রকৃতির জগতে। তারপর আবার ঘোড়ার গাড়িতে ফিরে এল।  

কেটি জানতে চাইল শীতকালে এখনকার আবহাওয়া কেমন হয়?

ছেলেটি বলল- ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ে। চারদিকে বুঝুরু তুষারপাত। তখন যাতায়াত করা অসম্ভব হয়ে যায়।

ভারী সুন্দর এই প্রকৃতি। একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি দেখতে পাওয়া গেল। সামনে বুনোগোলাপ আর পপির বাগান। কয়েকটা জানালা দরজাও চোখে পড়ল। সবুজ রং করা। কেটি একবার ভেবেছিল, ভেতরে ঢুকবে। জানতে চাইল- এই বাড়ির মালিক কে?

–এই বাড়ির মালিক ছিলেন মিসেস ট্রেবেন। তিনি কয়েক মাস আগে মারা গেছেন।

–এখন এখানে কে থাকে?

আমি যতদূর জানি, বাড়িটা ফাঁকাই আছে।

 –এটা কি বিক্রি হবে?

গাইড কেটির দিকে তাকিয়ে বলল- হ্যাঁ, হতে পারে হয়তো, কিন্তু বাইরের কেউ এটা কিনতে পারবে না। দ্বীপবাসীরা এ ব্যাপারটা পছন্দ করে না।

এক ঘন্টা বাদে কেটি ওই এস্টেটের লইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। জানতে চাইল, ট্রিবেন হাউসটা বিক্রি আছে কিনা?

লইয়ার হেসে বলেছিলেন- এর উত্তরে আমি হা এবং না– দুটোই বলব।

–তার মানে কী?

–হ্যাঁ, এটা বিক্রি হবে। কেউ কেউ এটা কেনার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে।

কেটি ভাবল- এই দ্বীপের পুরোনো বাসিন্দারা, তাই তো? যদি আমি এটা কিনতে চাই?

ভদ্রলোক বললেন- বাড়িটার দাম কিন্তু অনেক।

কত টাকা?

–পঞ্চাশ হাজার ডলার।

–তাহলে এটা আমার জন্য ব্যবস্থা করুন।

***

এই বাড়ির ভেতরটা ভারি সুন্দর। কেটি অবাক হয়ে গেছে। ভারি সুন্দর একটা হল। চারপাশে কাঁচের দেওয়াল। হলের একদিকে মস্ত বড়ো বলরুম। অন্যদিকে একটা লিভিংরুম। আর আছে ফায়ার প্লেস। একটা লাইব্রেরি দেখা গেল। বিরাট কিচেন, আয়রন স্টোভ এবং পাইন কাঠের টেবিল। বাটলারের ব্যানট্রি এবং লন্ড্রিরুমও আছে। নীচের তলায় ছটা বেডরুম, এখানে পরিচারকরা থাকতে পারে এবং একটি বাথরুম। ওপরের তলায় একটা মস্ত বড়ো বেডরুম। তার ভেতর চারটে ছোটো ছোটো বেডরুম আছে। কেটি যা ভেবেছিল, তার থেকে বাড়িটা অনেক বড়। কেটি ভাবল যখন আমার আর ডেভিডের ছেলেপুলে হবে, তখন সবকটা ঘর লাগবে। কাছেই সমুদ্র। একটা নিজস্ব ডক আছে।

কেটি লইয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল– এটা আমাকে নিতেই হবে।

কেটি এই বাড়িটার নাম রাখবে সিডারহিল হাউস। সে ক্লিপড্রিফটে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। ডেভিডের কাছে সুখবরটা দিতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যাওয়া কেটির কাছে বুনো উন্মাদনায় ভরা। ডাকহারবারের ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। এমন একটা স্মারক চিহ্ন যেটা সে ডেভিডের হাতে তুলে দেবে। হ্যাঁ, এই বাড়িটাকে সে আরও ভালোবাসবে।

কেটি এবং ব্রাড ক্লিপড্রিফটে ফিরে এল। কেটি অত্যন্ত দ্রুত ডেভিডের ঘরে পৌঁছে গেল। ডেভিড ডেস্কে বসে আছে এবং কাজ করছে। তাকে দেখে কেটির মনে আবার সেই পুরোনো আবেগের স্পন্দন। ডেভিড তাকে অভিবাদন জানিয়ে উঠে দাঁড়াল।

-কেটি, এসো।

কেটি কিছু বলার আগে ডেভিড বলল– আমি তোমাকেই প্রথম জানাচ্ছি। আমি বিয়ে করতে চলেছি।

.

১৫.

ছ-সপ্তাহ আগের ঘটনা। দিনগুলো অত্যন্ত দ্রুত কেটে গেছে। ডেভিড একটা খবর পেয়েছে, এক বিখ্যাত আমেরিকান হিরক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে, টিমওনীল ক্লিপ ড্রিফটে আছে, ডেভিড যেন তাকে ডিনারের আসরে আমন্ত্রণ জানায়। ডেভিড এসব পর্যটকদের সাথে সময় কাটাতে মোটেই ভালোবাসে না। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম। সে তার গ্রাহককে চটাতে চাইল না। সে কেটিকে বলতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন হয়ে যাবে। আসলে কেটি তখন সেখানে ছিল না। সে উত্তর আমেরিকাতে কোম্পানির একটা প্ল্যান দেখতে গেছে। সঙ্গে ব্রাড রজারস। ডেভিড ঠিক করল, সে ওনীলের হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হবে।

ওনীল বলল আমার মেয়ে সঙ্গে আছে। আমি কি তাকে আনতে পারি?

ডেভিড মোটেই এক বালিকার সাথে সময় কাটাতে চায়নি। সে শান্তভাবে বলেছিল, না, আমি কিছু মনে করব না।

তারা গ্রান্ড হোটেলে দেখা করল। ডাইনিং রুমের মধ্যে। যখন ডেভিড এল, তখন ওনীল এবং তার মেয়ে সেখানে বসে আছে। ওনীল এক ভারী সুন্দর চেহারার আমেরিকান ভদ্রলোক। সবেমাত্র পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। তার মেয়ের নাম জোসেফাইন। হ্যাঁ, এত সুন্দরী মেয়ে ডেভিড তার জীবনে কখনও দেখেনি। জোসেফাইনের বয়স সবেমাত্র তিরিশ হয়েছে। আকর্ষণীয় চেহারা। ফুরফুরে সোনালী চুল। নীল স্বচ্ছ দুটি চোখের তারা। তাকে দেখে ডেভিডের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

ডেভিড বলল- আমি দুঃখিত। শেষ কালে একটু কাজ এসে গিয়েছিল।

জোসেফাইন তার দিকে তাকিয়ে আছে। জোসেফাইন শান্তভাবে বলল আমার বাবা আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছে, মিঃ ব্ল্যাকওয়েল। আমি জানি, আপনি খুবই ব্যস্ত মানুষ।

-না-না, তা নয়, ডেভিড আমতা আমতা করে বলতে থাকে।

জোসেফাইন বলল- হ্যাঁ, আপনার আসল নামটাও আমি জানি, ডেভিড, তাই তো?

ডিনার তখনও শেষ হয়নি। ডেভিড চিন্তা করল জোসেফাইন ওনীলকেই কাছে পেতে হবে। মেয়েটি বুদ্ধিমতী, তার মধ্যে কৌতুকবোধ আছে। ডেভিড হঠাৎ তার প্রতি একটা অজানা আকর্ষণ অনুভব করল। ডেভিডের কাছ থেকে সে অনেক কিছু জানতে চাইছে। সন্ধ্যেটা শেষ হয়ে গেল। ডেভিড মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছে।

ডেভিড টিম ওনীলকে বলেছিল– আপনারা কোথায় থাকেন?

সান ফ্রানসিসকোতে।

কবে চলে যাচ্ছেন?

আসছে সপ্তাহে।

জোসেফাইন ডেভিডের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল- ক্লিপড্রিফটকে কি আমরা একটা সুন্দর শহর বলতে পারি? যদি তাই হয়, তাহলে বাবাকে বলব, আরও কদিন এখানে থেকে যেতে।

–আমি এটাকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা করছি। হিরের খনি দেখতে কবে যাবেন?

জোসেফাইন বলল- যখন আপনি বলবেন।

ডেভিডের মনে হল, সে যদি এই দুই আগন্তুককে নিয়ে বেরোতে পারে, তাহলে বোধহয় ভালো হয়। কিন্তু কোম্পানির নিয়মানুসারে কোনো অধস্তন কর্মচারীর হাতেই এই কাজটা দেওয়া হয়। হঠাৎ সে বলল- কালকে সময় হবে কী? আগামীকাল অন্তত ছটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। ডেভিডের হঠাৎ মনে হল, ওইসব মিটিং-এ না গেলেও হয়তো চলবে।

***

সে ওনীলদের নিয়ে মাটির তলায় নেমে গেল। বারোশো ফুট নীচে একটা চাকা লাগানো খাঁচা ধীরে ধীরে নীচে নেমে যাচ্ছে। ছ  ফুট চওড়া এবং কুড়ি ফুট লম্বা। চারটে কম্পার্টমেন্ট আছে। সবকিছু দেখে আগন্তুকরা অবাক হয়ে গেছে।

জোসেফাইন হেসে বলল- হিরেগুলোকে কেন ক্যারেটে ওজন করা হয়?

ক্যারেট নামটা এসেছে ক্যারট বীজ থেকে। ডেভিড সবকিছু বুঝিয়ে বলল, আসলে এখানে ওজনটা ঠিক থাকে। এক ক্যারেটের অর্থ হল কুড়ি মিলিগ্রাম।

জোসেফাইন বলল- ডেভিড, আপনি কত কিছু জানেন।

মেয়েটি শুধু হিরের কথাই বলছে কেন? যখন সে কাছে আসছে, একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে তার শরীর থেকে। যতবার ডেভিড জোসেফাইনের দিকে তাকাচ্ছে, তার মনে উন্মাদনা এবং উত্তেজনা।

ডেভিড ওনীলকে বলেছিল– কাল যদি ফাঁকা থাকেন, তা হলে কি আসবেন? আপনি এখানে অর্থ লগ্নী করতে পারেন।

বাবা কিছু বলার আগেই জোসেফাইন বলল- হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই আসব।

***

জোসেফাইন এবং তার বাবার সঙ্গে ডেভিডের রোজই দেখা হচ্ছে। একটু একটু করে ডেভিড জোসেফাইনকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলছে।

ওনীলদের সাথে ডিনারের আসর। টিম ওনীল বললেন–আজ আমি খুব ক্লান্ত, ডেভিড। আমি না গেলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?

ডেভিড তার আনন্দ লুকোবার চেষ্টা করছিল।

না স্যার, আমি বুঝতে পারছি।

জোসেফাইন ডেভিডের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হেসে বলল আমি আপনাকে আনন্দ দেবার চেষ্টা করব।

ডেভিড জোসেফাইনকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট গেল। দোকানটা সবেমাত্র খুলেছে। ঘরে অনেকের ভিড়। ডেভিডকে অনেকে চিনতে পেরে টেবিলের ব্যবস্থা করল। আমেরিকান গান বাজছিল।

ডেভিড জানতে চাইল তুমি কি নাচতে চাও?

–হ্যাঁ, আমি নাচতে পছন্দ করি।

এক মুহূর্তের মধ্যে জোসেফাইন ডেভিডের আলিঙ্গনে ধরা পড়েছে। এটা বোধহয় একটা ম্যাজিক। ডেভিড ধীরে ধীরে তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরছে। হ্যাঁ, ওই তো, জোসেফাইন জবাব দিতে শুরু করেছে।

-জোসেফাইন, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

জোসেফাইন ডেভিডের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল- প্লিজ ডেভিড, একথা কখনও বলো না।

-কেন?

–আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

–কেন? তুমি আমায় ভালোবাসো না?

জোসেফাইনের মুখে হাসি, চোখের তারায় উজ্জ্বলতা।

–আমি তোমাকে পেতে চাইছি ডার্লিং, তা কি আমি তোমায় বলব?

বলো।

–আমি কখনও এই ক্লিপট্ৰিফটে থাকতে পারব না। তাহলে পাগল হয়ে যাব।

–একবার চেষ্টা করে দেখবে।

–ডেভিড, তুমি আমাকে লোভ দেখিও না। আমি জানি, আমাদের বিবাহিত জীবন, কখনও সুখের হবে না। পরবর্তীকালে আমরা একে অন্যকে ঘৃণা করতে থাকব। তাই মনে হয়, এই সুন্দর সম্পর্কটার ওই পরিণতি হওয়া উচিত নয়। এসো, তোমাকে গুডবাই জানিয়ে চলে যাই।

ডেভিডের মুখের দিকে তাকাল জোসেফাইন। ডেভিড বুঝতে পারল জোসফাইনের সমস্ত শরীরটা মোমের মতো গলছে।

শেষ পর্যন্ত জোসেফাইন জানতে চাইল ডেভিড, তুমি কি সানফ্রানসিসকোতে গিয়ে থাকতে পারবে?

-এটা একটা অসম্ভব চিন্তা, ওখানে আমি কী করব?

এসো, আমরা কাল সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বাপীর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করব।

***

টিম ওনীল বলেছিল- জোসেফাইন গতরাতের সংলাপের কথা আমাকে বলেছে। দেখো, তোমাদের দুজনেরই একটা সমস্যা আছে। আমার কাছে একটা সমাধান আছে, যদি সেটা তুমি মানতে চাও।

আমি মানতে চাইছি, স্যার।

 ওনীল একটা বাদামী চামড়ার ব্রিফকেস বের করে কতগুলো ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে এল। বলল, জমানো খাবার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? 

আমি কিছুই জানি না।

-১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবসা প্রথম শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। অনেক দূরের পথে পাড়ি দিতে দিতে খাবারটা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেলের কামরা পেয়েছি। কিন্তু কেউ এমন কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি, যার সাহায্যে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ট্রাক পাওয়া যেতে পারে। ওনীল একটা ব্লপ্রিন্টের দিকে হাত দিয়ে বলল- আমি এর ওপর পেটেন্ট নিয়েছি। এই ব্যাপারটা খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লবের সৃষ্টি করবে ডেভিড।

ডেভিড ওই ব্লুপ্রিন্টের দিকে তাকিয়ে বলল– মিঃ ওনীল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

না, এটা কোনো ব্যাপার নয়, আমি এমন একজন প্রশিক্ষিত মানুষকে খুঁজছি, যে এ ব্যাপারে মন দিতে পারবে। সে এই ব্যবসাটা চালাতে পারবে। এর মধ্যে একটা সোনালী সুন্দর স্বপ্ন আছে। আমি এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সকলের সাথে কথা বলেছি। তুমি ভাবতেই পারছ না, এটা একদিন কত বড়ো হবে। তোমার মতো কাউকে আমরা চাই।

জোসেফাইন বলেছিল– এই কোম্পানির হেডকোয়ার্টার হবে সানফ্রানসিসকো।

ডেভিড অনেকক্ষণ নীরব হয়ে বসে রইল- হ্যাঁ, এই খবরটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর বলল– এর পেটেন্ট কি আপনি পেয়ে গেছেন?

হা।

আমি ব্লুপ্রিন্টটা একটু দেখব? কাউকে দেখাব?

 অবশ্যই দেখাতে পারো।

***

ডেভিড টিম ওনীলের দেওয়া ব্লুপ্রিন্টের ওপর চোখ রাখল। সানফ্রানসিসকোতে ওনীলের যথেষ্ট সুনাম আছে। একসময় উনি বার্কলে কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেখানেও তাকে সকলে শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করত। এই ব্যবসা সম্পর্কে ডেভিডের অ-আ-ক-খ জ্ঞান নেই। কিন্তু এটা বুঝতে হবে।

–পাঁচদিনের মধ্যে আমি ফিরে আসব ডার্লিং, তুমি এবং তোমার বাবা কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?

হ্যাঁ, আমরা অনন্তকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করব। জোসেফাইন কাঁদো-কাঁদো মুখে বলেছে।

ডেভিড ট্রেন ধরে জোহানেসবার্গে গেল। এডওয়ার্ড ব্রডরিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার সব থেকে বড়ো মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মালিক।

ডেভিড ওই প্রিন্টটা ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বলল- স্যার, এ বিষয়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত চাইছি।

-হ্যাঁ, জমানো খাদ্য সম্পর্কে আমি খুব একটা বেশি কিছু জানি না। কিন্তু আমি জানি, কারা এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবে। তুমি বিকেলবেলা এসো, আমি কয়েকজন বিখ্যাত এক্সপার্টকে ডেকে পাঠাব।

***

বিকেল চারটে, ডেভিড প্ল্যান্টে ফিরে এসেছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। অনিশ্চয়তার আক্রমণে। সে জানে না, কাকে কীভাবে কথা বলবে। দু-সপ্তাহ আগে সে এই ধরনের কোনো কথা শুনলে হয়তো অবাক হত। ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড ছাড়তে হবে, সেটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এই কোম্পানি তার অস্থিতে রক্তে মজ্জায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর সঙ্গে তার আত্মার আত্মীয়তা। কিন্তু এখন? এখন সে সানফ্রানসিসকোতে একটা অন্য কোম্পানি চালাতে চলেছে। এটা কি উন্মাদের পরিকল্পনা? কিন্তু এর অন্তরালে একটি কারণ আছে। সে হল ওই জোসেফাইন ওনীল।

দুজন মানুষ ঘরে বসেছিলেন, এডওয়ার্ড ব্রডরিক বললেন– উনি ডাঃ ক্র্যাফোর্ড, আর উনি মিঃ কাউফম্যান।

তারা পারস্পরিক অভিনন্দন বিনিময় করলেন।

ডেভিড জানতে চাইল আপনারা কি এই ব্লপ্রিন্টটা দেখেছেন?

ডঃ ক্র্যাফোর্ড বললেন- হ্যাঁ, আমরা দেখেছি মিঃ ব্ল্যাকওয়েল, আমরা ভালোভাবে পরীক্ষা করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিস এর ওপর পেটেন্ট দিয়েছে। মিঃ ব্লাকওয়েল, যিনি এই পেটেন্ট নিয়েছেন, তিনি নিশ্চয়ই খুব ধনী ব্যক্তি।

ডেভিড মাথা নেড়ে তাকাল।

–এটা একটা মস্ত বড়ো আবিষ্কার। এটা কেউ কেন আগে ভাবেনি, আমরা সেটাই চিন্তা করছি। আমার মনে হয়, এটা আপনি কখনও হাতছাড়া করবেন না।

ডেভিড বুঝতে পারছে না, কীভাবে এই কথাতে তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। সে টিম ওনীলের দিকে তাকাবার চেষ্টা করল। শেষবারের মতো ভাবল, জোসেফাইন কি দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে রাজি হবে না? না, ডেভিডকে এখন একটা কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

ক্লিপড্রিফটে ফিরে আসার পর সে অনেকক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করল। কোম্পানিটা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে হবে, এমন একটা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, যে বিষয়ে তার প্রাথমিক জ্ঞান নেই। সে একজন আমেরিকান, কিন্তু আমেরিকা এখন তার কাছে একটা বিদেশী রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু নয়। সে পৃথিবীর অন্যতম বড় কোম্পানির একটা অত্যন্ত উঁচু পদে আসীন। এই কাজটাকে সে ভালোবাসে। জেমি এবং মার্গারেট ম্যাকগ্রেগর তার প্রতি ভালো আচরণ করে এসেছে। এখন কেটি। ছোট্টবেলা থেকে কেটিকে সে চোখের সামনে থেকে দেখেছে। আহা, সেই দুষ্ট-দুষ্টু চেহারার ছেলে-ছেলে স্বভাবের মেয়েটি এখন কত পাল্টে গেছে। এখন কেটিকে এক অসামান্য রূপবতী তরুণী বলা যেতে পারে। কেটির সমস্ত জীবনের ছবিগুলো ফটো অ্যালবামে সাঁটা আছে। সে পাতার দিকে তাকাল– আহা, কেটির বয়স তখন মাত্র চার, আট, দশ, চোদ্দো, একুশ– অসামান্য কিছু অনুভূতি।

ক্লিপড্রিফটের ট্রেন এসে গেছে।

ডেভিড ঠিক করল, সে ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড ছেড়ে দেবে না।

 সে গাড়ি চালিয়ে সোজা গ্রান্ড হোটেলে পৌঁছে ওনীলের ঘরে গেল।

 জোসেফাইন দরজা খুলে বলল- ডেভিড?

ডেভিড জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে উষ্ণ চুমুর চিহ্ন এঁকে দিল। বুঝতে পারল, জোসেফাইন উন্মুখ হয়ে তাকে আদর করতে চাইছে।

ডেভিড, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারিনি। তুমি আর কখনও আমার কাছ থেকে দূরে চলে যেও না।

***

মনের ভেতর নানা অশান্তি। ডেভিড অপেক্ষা করছে, কখন কেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরবে। সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলেছে। একটা নতুন জীবন শুরু করতে হবে। কখন জোসেফাইনকে বিয়ে করবে তা নিয়ে চিন্তা করছে।

এখন কেটি ফিরে এসেছে, কেটির সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল- আমি বিয়ে করতে চলেছি।

এই শব্দগুলো কেটিকে আচ্ছন্ন এবং অবাক করেছে। হঠাৎ সে যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে। কোনো রকমে সে ডেস্কটা ধরে উঠে দাঁড়াল আমাকে মরতে হবে, হ্যাঁ, আমাকে শান্তভাবে মরতে দাও।

হঠাৎ সে বলল, মুখে হাসি এনে ডেভিড, ওর কথা বলো।

তার কণ্ঠস্বরে এক অদ্ভুত নীরবতা ও কে?

–ওর নাম জোসেফাইন ওনীল। বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিল। আমি জানি, তোমার সাথে ওর বন্ধুত্ব হবে। কেটি, ভয় নেই, মেয়েটি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী আর ভালো স্বভাবের।

-হ্যাঁ, ডেভিড, তুমি যাকে ভালোবাসো, সে তো ভালো হবেই।

ডেভিড কিছু বলার চেষ্টা করছিল– কেটি, আমি এই কোম্পানিটা ছেড়ে দেব।

সমস্ত পৃথিবী বুঝি হুড়মুড় করে কেটির পায়ের তলায় ভেঙে পড়েছে–হ্যাঁ, বিয়ে করার জন্য তুমি কোম্পানি ছাড়বে কেন?

না, ঠিক তা নয়, জোসেফাইনের বাবা সানফ্রানসিসকোতে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে চলেছেন। আমায় সেখানে যেতে হবে।

তার মানে? তুমি এখন থেকে সানফ্রানসিসকোতে থাকবে?

-হ্যাঁ, ব্রাড রজারস আমার কাজটা ভালোভাবে করতে পারবে। কেটি, আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না, নিজের সাথে লড়াই করে কীভাবে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।

-ঠিক আছে, ডেভিড। তুমি কাউকে ভালোবাসলে আমার কী বলার আছে? কখন আমি ওই নববধুটির সাথে দেখা করব।

ডেভিড হাসল– কেটির কাছে এই খবরটা দিতে পেরেছে, এখন অনেকটা হালকা লাগছে। সে বলল- আজ রাতে তুমি কি ফাঁকা আছে?

-হ্যাঁ, আমি অবশ্যই যাব।

কেউ দেখতে পেল না। কেটির দুচোখ দিয়ে তখন অবিরত অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে।

***

তারা চারজন ম্যাকগ্রেগর ম্যানসানে ডিনারের আসরে বসেছে। কেটি যখন জোসেফাইনকে দেখল, তখন অবাক হয়ে গেল। সত্যি জোসেফাইনের মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য আছে। তার উপস্থিতিটা সমস্ত পরিবেশকে পাল্টে দিয়েছে। তার সামনে কেটি কিছুই নয়। একটা কুৎসিত এবং শয়তানি। হ্যাঁ, ব্যাপারটা আরও খারাপ হল জোসেফাইন এত সুন্দরী? আভিজাত্যের সাথে সৌন্দের্যের সংমিশ্রণ। ডেভিডকে সে খুবই ভালোবাসে। 

ডিনার খেতে খেতে টিম ওনীল কেটিকে তার নতুন ব্যবসা সম্পর্কে অনেক কথা বলছিলেন।

কেটি চোখ বড়ো বড়ো করে শোনার ভঙ্গি করছিল। কেটি শেষ পর্যন্ত বলল- ব্যাপারটা খুবই আকর্ষক।

ওনীল বললেন– না, আপনার কোম্পানির মতো অত বড়ো নয়। আমরা খুব ছোটো থেকে শুরু করতে চাইছি। তবে ডেভিড যখন আছে, আমি সুনিশ্চিত, কোম্পানিটা একদিন বড়ো হবেই।

ওর এই কথায় কেটি সম্মতি জানিয়ে বলেছিল–হ্যাঁ, ডেভিডের মতো মানুষ পেয়েছেন, আপনার চিন্তা অনেকটা দূর হয়ে গেছে।

এই সন্ধ্যের স্মৃতিটা কেটি ভুলে থাকার চেষ্টা করবে। মাঝে মধ্যেই সে তাকাচ্ছিল ডেভিড এবং জোসেফাইনের দিকে। বেশ বুঝতে পারছিল, তারা ট্যারা চোখে একে অন্যকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে হাতে হাত এবং ঠোঁটের কোণ থেকে উথলে ওঠা মিষ্টি-দুষ্ট আমন্ত্রণ হাসির চিহ্ন। কেটির মন তখন খুবই খারাপ। হায় ঈশ্বর, আমি কেন আত্মহত্যা করতে পারছি না।

হোটেলে ফেরার পথে জোসেফাইন বলল- ওই মেয়েটি তোমাকে খুব ভালোবাসে, ডেভিড।

ডেভিড হেসে বলেছে কে? কেটিং ও তো এই একটুকরো এক ছোট্ট মেয়ে। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। একদিন দেখো ও তোমাকেও খুব ভালোবাসবে।

জোসেফাইন হাসি গোপন করে ভাবল- হায়! ছেলেরা কেন এত বোকা হয়!

***

পরের দিন সকালবেলা, ডেভিডের অফিস। টিম ওনীল আর ডেভিড মুখোমুখি বসে আছে।

ডেভিড বলল- মাস দুয়েক সময় লাগবে, আমি ভাবছি যে টাকাটা লাগবে, এটা শুরু করতে, তার কী ব্যবস্থা হবে! বড়ো কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলা যেতে পারে হয়তো। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারটাতে আমার কোনো অধিকার নেই। আমার মনে হয় নিজেরাই লগ্নি করা উচিত। আশি হাজার ডলার পেলে তবে বোধহয় কাজ শুরু হতে পারে। আমার হাতে প্রায় চল্লিশ হাজার ডলার আছে, আরও চল্লিশ হাজার ডলার লাগবে।

টিম ওনীল বললেন আমার হাতে দশ হাজার ডলার আছে। আমার এক ভাইয়ের কাছ থেকে হাজার পাঁচেক ডলার আনতে পারব।

ডেভিড বলল- তাহলেও আমরা পঁচিশ হাজার ডলার জোগাড় করতে পারব না। ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিলে কী হয়।

ওনীল বললেন- আমরা এখনই সানফ্রানসিসকোতে চলে যাব। তোমার জন্য সব কিছু সাজিয়ে ফেলব কেমন?

.

জোসেফাইন আর তার বাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রওনা হল।

কেটি বলেছিল আমাদের প্রাইভেট রেলওয়ে গাড়িতে করে ওদের পাঠালে কেমন হয়? অন্তত কেপটাউন পর্যন্ত।

-তাহলে ভালোই হবে, কেটি।

জোসেফাইন চলে গেল। ডেভিডের মনে হল, তার হৃদয়ের আদ্ধেকটা কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে। কখন সে সানফ্রানসিসকোতে যাবে তাই নিয়ে চিন্তা করতে থাকল।

পরের কয়েক সপ্তাহ দারুণ কর্মব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। ব্রাড রজারসকে সব বোঝাতে হচ্ছে। আরও কয়েকজন সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি হল। ডেভিড আর ব্রাড নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে।

কিন্তু উপযুক্ত লোক কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত এ মাসের দিকে তারা চারজনকে নির্বাচিত করল। তারা ব্রাড রজারসের সঙ্গে কাজ করবে। তারা বাইরে কর্মরত। অতি শীঘ্র তাদের এখানে ডেকে আনা হবে। প্রথম দুজনের ইন্টারভিউ ভালোই হল। কেটি ডেভিড এবং ব্রাডকে বলেছিল, এদের মধ্যে একজনকে নিতে হবে।

পরের দিন সকালবেলা তৃতীয় জনের ইন্টারভিউ শুরু হল। ডেভিড কেটির ঘরে ঢুকে পড়ল। তার মুখ বিবর্ণ।

সে বলল আমার চাকরিটা কি এখনও আছে, নাকি কি আমাকে বিতারিত করা হয়েছে?

কেটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়েছে। সে দাঁড়িয়ে উঠে প্রশ্ন করল- কী হয়েছে, ডেভিড?

ডেভিড কোনো কথা বলতে পারছে না। সে শুধু বলল কিছু একটা ঘটেছে।

 কেটি ডেস্কের পেছনে পৌঁছে গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করল- কী হয়েছে, খুলে বল।

–আমি এইমাত্র টিম ওনীলের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। উনি ব্যবসাটা বিক্রি করে দিয়েছেন।

তার মানে কী?

হ্যাঁ, আমি যা বলছি সব সঠিক। উনি দু-লক্ষ ডলার পেয়েছেন, এমন কী এটা রয়ালটিও পেয়েছেন।

ডেভিডের কণ্ঠস্বরে তিক্ততা।

ওখান থেকে ম্যানেজার নেওয়া হয়েছে। উনি আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এত টাকার ব্যাপার উনি উপেক্ষা করতে পারেননি।

কেটি ডেভিডের দিকে তাকাল- জোসেফাইন? সে কী বলেছে? সে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটাতে রেগে গেছে?

সে একটা চিঠি দিয়েছে। সে বলেছে, আমাকে এখনই সানফ্রানসিসকোতে চলে যেতে। সেখানে গেলেই সে আমাকে বিয়ে করবে।

তাহলে তুমি যাচ্ছো কি?

না, আমি যাচ্ছি না। ডেভিড রাগে ফেটে পড়েছে। আমি ওটাকে একটা মস্ত বড়ো কোম্পানি করতে পারতাম। কিন্তু তারা তাড়াহুড়ো করতে গেল।

-ডেভিড, তুমি তারা বলছ কেন? শুধু ওনীলের কথা বলল।

না, জোসেফাইনের অনুমতিতেই ব্যাপারটা করা হয়েছে।

–ডেভিড, আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।

–কিছুই বলার নেই, আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুলটা করলাম।

কেটি ডেস্কে চলে গেল। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা যে কাগজে লেখা ছিল সেটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল।

***

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেছে। ডেভিড আবার কাজের মধ্যে ঢুকে গেছে। এই তিক্ততার কথা ভুলে গেছে। জোসেফাইনের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিল। চিঠিগুলো বাজে কাগজের বাক্সে ফেলে দিয়েছে। পড়ে পর্যন্ত দেখেনি। না, ওই মেয়েটিকে মনের জগত থেকে বিদায় দিতে হবে। কেটি ডেভিডের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু এখন আর আগ্রহ কিংবা কৌতূহল দেখাতে পারছে না।

***

টিম ওনীলের কাছ থেকে চিঠি পাবার পর দেখতে দেখতে ছটা মাস কেটে গেছে। কেটি এবং ডেভিড আবার আগের মতো পাশাপাশি বসে কাজ করছে। নানা জায়গাতে, যাচ্ছে। একা একা সময় কাটাচ্ছে। কেটি সবসময় ডেভিডের ক্ষত উপশম করার চেষ্টা করছে। কেটির কথা মতোই ডেভিড পোশাক পরে, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। কেটি চেষ্টা করছে ডেভিডের জীবনের পূর্ণতা এনে দিতে। কিন্তু বেশি দূর এগোতে সে চাইছে না। শেষ পর্যন্ত সে তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলল।

ডেভিড এবং সে রিও-ডি-জেনেরোতে গিয়েছিল। একটা নতুন খনির অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে। তারা হোটেল ডিনার শেষ করল, কেটি ঘরে ফিরে এল। সে একটা সুন্দর কিমোনো এবং স্লিপার পরেছে। গল্প শেষ হয়ে গেল।

ডেভিড হাত বাড়িয়ে বলল- আজকের মতো যথেষ্ট। এবার তুমি শুতে যাবে।

কেটি শান্তভাবে জবাব দিল- তুমি কি এখন শোক প্রকাশ করবে?

অবাক হয়ে ডেভিড বলল– কীসের জন্য?

–জোসেফাইন ওনীলের জন্য।

–ও আমার জীবন থেকে চলে গেছে।

 –তাহলে সেই ধরনের ব্যবহার করো।

–তুমি কী বলতে চাইছ, আমি বুঝতে পারছি না, কেটি।

কেটি এখন ভীষণ রেগে গেছে। সে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে বলল- তুমি এখনও বুঝতে পারছ না, আমি কী বলতে চাইছি? আমাকে চুমু দাও।

-কী বললে?

ডেভিড, আমি তোমার বস, আমি যা বলব, তাই তোমায় করতে হবে। আমাকে চুমু দাও।

সে জোর করে ডেভিডকে চুমু খেল। তাকে জড়িয়ে ধরল। সে বুঝতে পারল, ডেভিড তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে এবং অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত ডেভিড আস্তে আস্তে কেটিকে চুমু দিল।

-কেটি?

ঠোঁটে ঠোঁট মিশে গেছে, শেষ অব্দি কাঁদতে কাঁদতে কেটি বলল- আমি ভাবতে পারিনি, তুমি এমন ব্যবহার করবে।

***

ছ-সপ্তাহ বাদে তারা বিয়ে করল। ক্লিপড্রিফট শহর এত বড়ো অনুষ্ঠান এর আগে কখনও দেখেনি। এই শহরের সবথেকে বড়ো চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠানটা হল। টাউনহলে হল রিসেপশন। শহরের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পাহাড় প্রমাণ খাবার রাখা হল। বিয়ারের বোতল খোলা হল। হুইস্কি এবং শ্যামপেনের ছড়াছড়ি। সংগীত বিশারদেরা আনন্দের গান বাজাচ্ছিল। সূর্য যখন এল, এই বিনোদনের আসর শেষ হল। ডেভিড এবং কেটি ফিরে গেল।

কেটি বলল– আমি এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হব, তুমি এসো এসো কিন্তু।

.

ভোরের আলো ফুটব-ফুটব করছে। কেটি বিরাট বাড়িতে একলা প্রবেশ করল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে গিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়ল। সে একটা পেইন্টিং-এর দিকে তাকাল। ফ্রেমের ওপর বোম লাগানো আছে। বোতামে হাত দিল। পেইন্টিংটা একটুখানি সরে গেল। একটা সেফ বেরিয়ে এসেছে। সে সাবধানে ওটা খুলল। হ্যাঁ, এই তো শর্তের কাগজটা রয়েছে। থ্রি স্টার মিট প্যাকিং কোম্পানি, শিকাগো। কেটি ম্যাগগ্রেগর সেটা কিনে নিয়েছে। আহা, টিম ওনীলের কাছ থেকে, সবকিছু। দু-লক্ষ ডলার দিয়ে। কেটি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর কাগজগুলো ঠিক জায়গাতে রেখে দিল। ডেভিড এখন আমার, চিরদিন ডেভিড আমার থাকবে। ক্রুগার ব্রেন্ট লিমিটেড কোম্পানি, আমরা দুজনে মিলে এই কোম্পানিকে পৃথিবীর সবথেকে সফল সংস্থায় পরিণত করব। জেমি এবং মার্গারেট ম্যাকগ্রেগর হয়তো এটাই চেয়েছিলেন।