৪. নাঙা তলোয়ার

১৭.  নাঙা তলোয়ার

পরদিন সকালে কেবিন থেকে সামান্য দূরে একটা পাথরের ওপর বিরস বদনে বসে আছে মশিয়ে দো বাখমি রোদ বিছানো লেগুনের দিকে মুখ করে, দেখছে নোঙর ফেলা সেন্টরকে।

উত্তর থেকে বাতাস ছেড়েছে আজ, ঝিরঝির আওয়াজ করছে পাম গাছের পাতাগুলো। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে কর্মরত লোকজনের হাঁক-ডাক। কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে ওরা, আর বড়জোর তিনদিন, তারপরই পানিতে ভাসবে ব্ল্যাক সোয়ান– শেষ হয়ে এল মালদিতার দিন, এরপর এ-দ্বীপ থাকবে শুধু স্মৃতিতে।

যথারীতি, পিয়েখ অনুপস্থিত। গত দুদিন শুধু সকাল নয়, বিকেলেও পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। এটা লক্ষ করেছে প্রিসিলা, ভেবেছে, সত্যিই কি বিশেষ কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে লোকটা? তা নইলে এ প্রসঙ্গ তুললেই বারবার এড়িয়ে গেল কেন মশিয়ে দো বাখনি? এখন আর এ নিয়ে কোনও কথা তোলে না সে।

সাধারণত দুপুরের আগে ফেরে না পিয়েখ কখনও, কিন্তু আজ হঠাৎ করে ফিরে এল সে নটার দিকেই। মশিয়ে দো বাখনির পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখন। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মশিয়ে দো বাখনি, গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে পিয়েখের মুখের দিকে।

হাসল পিয়েখ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। ফরাসী ভাষায় কথা হলো দুজনে। তারপর শার্টের ভিতরের পকেট থেকে একটা দূরবীন বের করে দিল সে মশিয়ে দো বাখনির হাতে।

মশিয়ে দো বাখনি একবার কেবিনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল প্রিসিলার পাহারায় মেজর স্যান্ডস আছে কি না। আছে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে পিয়েখের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলে।

আধঘণ্টার মধ্যেই দ্বীপের পশ্চিম তীরে পৌঁছে গেল ওরা। পিয়েখের আঙুল বরাবর দূরবীনটা তাক করল মশিয়ে দো বাখনি।

পাঁচ মাইলও হবে না, দেখা গেল তিনটে বিশাল জাহাজ আসছে এইদিকে। পতাকা নেই একটাতেও, কিন্তু তাই বলে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না মশিয়ে দো বাখনির।

দূরবীন যখন নামাল, তখন ওর ঠোঁটে হাসির আভাস দেখা দিয়েছে। বলল, মনে হচ্ছে একঘণ্টার মধ্যেই এসে যাবে। চলো, পিয়েখ, হাতে আর সময় নেই!

প্রায় দৌড়ে ফিরে এল ওরা। জঙ্গল থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়াল মশিয়ে দো বাখনি, দূরবীনটা ফেরত দিল পিয়েখের হাতে। পিয়েখ ওটা নিয়ে ওর তাঁবুতে ফিরে গেল, আর মশিয়ে দো বাখনি এসে ঢুকল প্রিসিলার কেবিনে। ওখানে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত রয়েছে প্রিসিলা, আর মেজর ঘুম ঘুম চোখে দেখছে ওকে। চমকে তাকাল ওরা, দেখল, একটা হুকে ঝুলিয়ে রাখা পরচুলা আর তলোয়ারটা নামাচ্ছে মশিয়ে দো বাখনি।

ওগুলো কেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল প্রিসিলা।

কাঁধ ঝাঁকাল মশিয়ে দো বাখনি। একটু ঘুরে আসি। সদা প্রস্তুত থাকাই তো ভাল। পরচুলাটা মাথায় চাপিয়ে কাঁধের উপর সুন্দর করে বিছিয়ে দিল সে। এটা পরে নিলে নিজেকে মনে হয় ভদ্রলোক, লোকের চোখে সম্মান বাড়ে।

ওর হাসিখুশি ভাব দেখে আর কোনও প্রশ্ন করল না কেউ। কেবিন থেকে বেরিয়েই একটু থামল ও। প্রিসিলার সঙ্গে শেষ একটু কথা বলে আসা কি উচিত ছিল? কিংবা মেজরকে শেষ কোন নির্দেশ? যা করতে চলেছে, খারাপ কিছু ঘটে যাওয়া তো খুবই সম্ভব।

একটু ভেবে স্থির করল, তার চেয়ে বরং পিয়েখের সঙ্গে কথা বলে চলে যাবে। সোজা গিয়ে ঢুকল সে পিয়েখের তাঁবুতে।

পিয়েখ, আমার যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, তুমি দেখবে মিস্ প্রিসিলাকে। তুমি তো জানই কি করতে হবে, তেমন কোনও অসুবিধে হবে না তোমার।

পিয়েখের চোখে মনিবের জন্যে ভয় আর উদ্বেগ ফুটে উঠল। মিশিয়ে, আপনি লড়াই করতে চলেছেন! অপেক্ষা করলে হতো না? এছাড়া আর কোন পথ নেই?

না। আর কোন পথ নেই, পিয়েখ। এটা আমার পাওনা হয়েছে নিজেরই কাছে।

মনিবের একটা হাত ধরল পিয়েখ, মাথা নিচু করে চুমু খেল সেই হাতের পিঠে। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মশিয়ে দো বাখনি। নিশ্চিন্তে থাকো, পিয়েখ। কিছু ভেবো না। বলেই দ্রুতপায়ে রওনা হয়ে গেল সে।

টম লীচের সঙ্গে দেখা করবে বলে চলেছিল, কপাল ভাল, ক্যাম্পের গজ পঞ্চাশেক আগেই পাওয়া গেল ওকে– উওগানের সঙ্গে পায়চারি করছে। ইচ্ছে করেই হাসিমুখে মাথা ঝুঁকিয়ে সহৃদয় সম্ভাষণ জানাল ওদের মশিয়ে দো বাখনি। বিরূপ দৃষ্টিতে জ কুঁচকে তাকাল ওর দিকে টম লীচ।

তুমি কি চাও এখানে?

আমি কি চাই? প্রশ্ন শুনে তাজ্জব হয়ে যাওয়ার ভান করল মশিয়ে দো বাখনি, মনে মনে খুশি– যেমনটা চেয়েছিল, ঠিক সেই মুডেই রয়েছে ক্যাপটেন। আবার বলল, আমি কি চাই? ভুরুজোড়া কপালে উঠে গেছে, ঠোঁট বাঁকিয়ে মাথা পিছনে হেলিয়ে মাতব্বরি চালে নাকের দুপাশ দিয়ে তাকাল সে লীচের দিকে।

ওর বেয়াদবি দেখে আগুন ধরে গেল লীচের মাথায়। সেই সঙ্গে আশা জাগল মনে, সাবধানে খেলালে গতকাল যা সম্ভব হয়নি, আজ হয়তো তা সম্ভব হতে পারে। বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই জিজ্ঞেস করেছি আমি। মনের মধ্যে শয়তানী কিছু থাকলে মানে মানে কেটে পড়ো।

দুই কোমরে মুঠো করা হাত রেখে এক পা এগিয়ে এল মশিয়ে দো বাখনি, ভদ্রতার লেশমাত্র দেখছি না তোমার ব্যবহারে, টম?

হাঁ হয়ে গেল উওগান। ও টের পাচ্ছে ব্যাপার কোনদিকে গড়াচ্ছে, কিন্তু বোকা ফরাসীটা কিছুই বুঝতে পারছে না, নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে ক্যাপটেন লীচের ফাঁদে।

ভীতু কুকুরের মত গতকাল যে লেজ দাবিয়ে কেটে পড়েছিল, আজ তার মুখে এই কথা শুনে অবাকই হলো লীচ, কিন্তু নিজের ভূমিকা থেকে নড়ল না।

ভদ্রতা? ইচ্ছে করেই দো বাখনির পায়ের কাছে একগাদা থুতু ফেলল সে। তোর মত বেজন্মার সঙ্গে আবার কিসের ভদ্রতা?

এর মানে? ভুরু নাচাল মশিয়ে দো বাখনি। আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছ মনে হচ্ছে? চাইছ, আমি কিছু একটা করে বসি?

তুই করে বসবি? হা-হা! আমার বিরুদ্ধে? হেসেই মরে যাব! বোলচাল মারা পর্যন্তই তো তোর দৌড়, তুই কী করে বসবি? তাহলে পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে পালাবে কে?

তোমার কি আমার সম্পর্কে তাই ধারণা?

গত কালই প্রমাণ পেয়েছি তার।

উওগান বুঝল, এখন ঝগড়া থামাবার ভান করা দরকার। এই যে! কি শুরু করলে তোমরা? সামনে বড় একটা কাজ আছে, সেটা খেয়াল রাখো। এখন কি ঝগড়া করার সময়? না, না, মিটিয়ে ফেলো।

আমিও তাই চাই, উগান, মিথ্যে বলল মশিয়ে দো বাখনি। গতকাল আমাকে জঘন্য কিছু কথা বলেছে টম, যেগুলো আমার সম্মানে লেগেছে। ও যদি এখন কথাগুলো ফিরিয়ে নেয়, আমি ওসব ভুলে যেতে রাজি আছি।

ও জানে লীচের পক্ষে কোটা সম্ভব আর কোন্‌টা নয়। ও চাইছে সবার চোখে যেন মনে হয়, লড়াইটা লীচই বাধিয়েছে আগ বাড়িয়ে, আপোসরফায় রাজি ছিল দো বাখনি। দেখা গেল লীচের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ঠিকই আন্দাজ করেছিল ও। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল লীচের।

কী? ভুলে যেতে রাজি আছিস? বেজন্মা কুকুর, তোর আবার সম্মান কি রে? কেবিনে ফিরে গিয়ে তোর ওই বেশ্যা

ব্যস, সময় উপস্থিত। উওগান বাধা দেয়ার আগেই এক-পা সামনে বেড়ে দড়াম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল ও ক্যাপটেনের চোয়ালে।

ভারসাম্য হারিয়ে দু-তিন কদম পিছিয়ে গেল ক্যাপটেন লীচ। রাগে লাল হয়ে গেছে ওর চেহারা। থরথর করে কাঁপছে সারা দেহ। কোট খুলতে শুরু করল সে। খোদার কসম! তোর কলজে কেটে বের করে কুত্তাকে দিয়ে খাওয়াব আমি!

থামো, ক্যাপটেন! মা মেরির নামে বলছি, প্রীজ, শান্ত হও! চেঁচিয়ে উঠল উওগান।

খানিকটা ঝাল ঝাড়ল লীচ উওগানের উপর। তুমি কি মনে করেছ কিল খেয়ে কিল হজম করার মানুষ টম লীচ? হ্যাঁ, শান্ত হব, তবে ওর কলজেটা কেটে নেয়ার পর। এইটুকু কথা বলতে গিয়েই ফেণা বেরিয়ে এসেছে ওর ঠোঁটের দুই কোণে। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি।

দুই হাত এক করে ডলছে উওগান। বুঝতে পারছে না কি করবে। লীচকে ধরতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। অসহায় ভঙ্গিতে দো বাখনির দিকে ফিরল। বোকার মত কি করে বসেছ দেখো!

ক্যাপটেনের দেখাদেখি বেগুনী টাফেটার তৈরি কোটটা খুলছে মশিয়ে দো বাখনি। বলল, আমার আর কি করার ছিল বলো? তুমি তো সাক্ষী, দেখলে সবই। শুধু আমাকে না, আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেসব কথা বের হলো ওই নোংরা কুকুরের বাচ্চার মুখ দিয়ে, তারপর আর সহ্য করা যায়?

কাজ থামিয়ে শুনল লীচ কথাগুলো। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে মুখ। গত কয়েক বছরের মধ্যে ওরই সামনে ওর সম্পর্কে এই শব্দ উচ্চারণ করবার দুঃসাহস হয়নি কারও। বিশেষ করে এই লোকের মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরোচ্ছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। গতকালই যে ভীরু, কাপুরুষের মত সব অপমান হজম করল, সে আজ এসব বলে কোন সাহসে? সংবিত ফিরে পেয়ে রাজ্যের অশ্লীল গালির তুবড়ি ছুটাল সে, তারপর দো বাখনির কি অবস্থা করবে তার রক্ত হিম করা বর্ণনা দিল। একটানে তলোয়ার বের করে নিয়ে খাপ ও বেল্ট ফেলে দিল সে দূরে। হুঙ্কার ছেড়ে বলল, নে! বাঁচা নিজেকে, দেখি! পরমুহূর্তে ঝাঁপ দিল সামনে।

মশিয়ে দো বাখনি তখন অর্ধেকও বের করতে পারেনি তার অস্ত্র। ওই অবস্থাতে কোনমতে আধখানা তলোয়ার দিয়েই একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠেকাল সে প্রথম আক্রমণ। তারপর লাফিয়ে সরে গিয়ে বাম হাতে ধরা পরচুলা আর তলোয়ারের খাপটা ফেলে দিল বালির উপর। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল পরবর্তী আক্রমণ ঠেকাবে বলে।

পঞ্চাশ গজ দূর থেকে সবই দেখেছে ব্ল্যাক সোয়ানে কর্মরত দস্যুরা। যেই দুই তলোয়ারে ঠোকাঠুকি লেগে আটকে গেল, দুজনই প্রতিপক্ষের শক্তি বুঝে নিচ্ছে– কাজ ফেলে দৌড় দিল ওরা রণক্ষেত্রের দিকে। একটু দূরে যারা বিশ্রাম নিচ্ছিল, তারাও লাফিয়ে উঠে ছুটল। বাচ্চা ছেলেদের মত হৈ-হৈ করে চেঁচাচ্ছে ওরা। এর চেয়ে মজার আর কিছু নেই ওদের কাছে। সোনা আর প্লেট ফ্লীটের কথা যদি কারও মনে এসেও থাকে, ঝেটিয়ে দূর করে দিয়েছে। সোনার চেয়ে অনেক আকর্ষণীয় এখন ওদের কাছে এই লড়াই।

হ্যালিওয়েল আর এলিসও দৌড়াচ্ছে, কিন্তু যেই দেখল বানড্রি যে কোনও মূল্যে লড়াই থামানোর জন্যে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে, তখন ওকে ঠেকাবার জন্যে কথা বলার ছলে থামাল ওকে। ওরা তিনজন যখন পৌঁছল তখন আর কারও লড়াই বন্ধ করার সাধ্য নেই। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রিং তৈরি করে ফেলেছে দস্যুরা। বানড্রির উদ্দেশ্য টের পেয়ে কেউ আর ওকে ভিতরেই ঢুকতে দিল না। কোনও জাহাজ আক্রমণের সময় ছাড়া কারও হুকুম মানার পাত্র তারা নয়।

যেন ওদের আনন্দ দানের জন্যে একটা প্রীতি-ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে– হা-হা করে হাসছে, প্রশংসা করছে, কে কেমন খেলছে। তাই নিয়ে মন্তব্য করছে সবাই।

ওদের মধ্যেও ভাল তলোয়ার-যোদ্ধা আছে, তারা বুঝে শুনেই প্রশংসা করছে। কারণ, আজ এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে যে-সব আশ্চর্য রণকৌশল দেখছে ওরা এমনটি আর কখনও দেখার সৌভাগ্য ওদের হয়নি।

তলোয়ারে টম লীচের খ্যাতি এমনি-এমনি হয়নি। বহুবার বহু যুদ্ধে সে প্রমাণ করেছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব। চট করে কাউকে মেরে ফেলা ওর নীতির বাইরে। প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে, আক্রমণের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে প্রথমে বুঝিয়ে দেয় সে ওর অসহায়ত্ব, তারপর মহানন্দে উপভোগ করে তার অক্ষমতা, মৃত্যুভীতি, অবশেষে মৃত্যু। পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে হরেক রকম কৌশল রপ্ত করেছে সে, চর্চা করেছে নিরলস ভাবে।

যুদ্ধে নেমেই শান্ত হয়ে গেছে টম লীচ। জানে ওকে কি করতে হবে। কাজেই আত্মবিশ্বাসেরও কমতি নেই। বেপরোয়া এই ফরাসী লোকটাকে ও দেখতে পারে না প্রথম থেকেই। লোকটার অস্তিত্বই ওর কাছে অসহ্য। প্রতি মুহূর্তে বুদ্ধিমত্তার চমক দিয়ে ছোট করছে লীচকে, আহত করছে ওর আত্মপ্রেমকে। আজ সুযোগ এসেছে। প্লেট ফ্লীটের খবর বের না করে ওকে খুন করবে না সে। তারপর দখল করবে ওর বউটাকে। কারও সাহস হবে না ওর বিরুদ্ধে যাওয়ার। যদি যায় তারও ব্যবস্থা আছে ওর কাছে।

গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে সারাক্ষণ শুধু এই স্বপ্নই দেখেছে সে। কৌশলে লোকটাকে আজ নামানো গেছে যুদ্ধে, ব্যস, আর চিন্তা নেই। এখন ওর তলোয়ারের আগায় ওরই করুণার ওপর নির্ভর করছে দাম্ভিক লোকটার ভাগ্য– জীবন, মরণ।

ওর নিজেরও। এখন ওর জয়ের ওপরই নির্ভর করছে ওর সমস্ত চাওয়া-পাওয়া। কোথায় যেন শুনেছিল, দো বাখনি ভাল তলোয়ার যোদ্ধা। তাতে যদিও কিছুই এসে যায় না, এর আগে অনেক নামী-দামী যোদ্ধাকে ঘায়েল করেছে সে, তবু সাবধানে এগোনোই স্থির করেছে সে। বিড়ালের মত স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ভঙ্গিতে ইটালিয়ানদের অনুকরণে ছোট ছোট লাফে সামনে বেড়ে, পিছিয়ে এসে; আক্রমণ করে বা আক্রমণের ভান করে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষার জোর কতখানি বুঝে নিচ্ছে সে।

ওদিকে সর্বাধুনিক ফরাসী ভঙ্গিতে লড়ছে মশিয়ে দো বাখনি। লাফ-ঝাঁপ নেই, মনে হয় যেন এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটা আঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছে নিপুণ ভাবে। সেই সঙ্গে লীচের ভঙ্গি নকল করে কৌতুক করছে, হেসে গড়িয়ে পড়ছে দর্শকরা এ ওর গায়ে।

কি ব্যাপার, যুদ্ধ করছ, নাকি নাচ দেখাচ্ছ, ক্যাপটেন?

এসব টিটকারীতে রেগে যাচ্ছে লীচ, বাড়িয়ে দিচ্ছে আক্রমণের তীব্রতা। কিন্তু সহজ ভঙ্গিতে কেবল কব্জির জোরে ঠেকিয়ে দিচ্ছে দো বাখনি সেসব আক্রমণ, কিছুতেই ওর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে পারছে না লীচ, তার পরপরই আসছে অভিনব কৌশলের প্রতি-আক্রমণ– লাফিয়ে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে সে। এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে লীচ, তার প্রতিপক্ষ সাধারণ কোন যোদ্ধা নয়, একে কাবু করতে হলে আরও অনেক সাবধান হতে হবে ওর।

তাই বলে আত্মবিশ্বাসে সামান্যতম চিড় ধরেনি তার। মনে মনে বলছে, রোসো, তোমার জোকারগিরি বের করছি আমি! তোমার মত বহু ধেড়ে শয়তানকে ধরাশায়ী করেছি আমি।

আবার আক্রমণে গেল ও। ঝনাৎ আওয়াজ তুলল তলোয়ারের ফলা। হালকা ভাবে ঠেকাল ওটা দো বাখনি। মুহূর্তে বাম হাতের ধাক্কায় তলোয়ারটা একপাশে সরিয়ে দিয়েই সামনে বাড়াল ওটা লীচ, দো বাখনির কাঁধ লক্ষ্য করে। কিন্তু দেখল, একই ভঙ্গিতে ওর তলোয়ারও সরিয়ে দিয়েছে দো বাখনি। একেবারে সামনে থেকে দুই প্রতিপক্ষ চেয়ে আছে একে অপরের চোখের দিকে। একলাফে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল লীচ। কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে এসেছে দো বাখনির তলোয়ারের আগাটা, সোজা লীচের বুক বরাবর। আঘাতটার দিক পরিবর্তন করতে পারল লীচ, কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত নয়– ওর ডান গালে দীর্ঘ আঁচড় কাটল দো বাখনির তলোয়ার। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত।

প্রথম জখমেই বাস্তবে ফিরে এল লীচ, বুঝল, অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে ও এবার। আরও নিচু হয়ে গেছে এখন, ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলছে।

ঘিরে থাকা লোকজনের কথাবার্তা কানে আসছে ওর। নিজের লোকের কাছে ছোট হয়ে গেছে ও। এই জখমের শোধ নিতে না পারলে শান্তি নেই। প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখার ফলেই ঘটেছে এটা, বুঝল, বাড়াবাড়ি করা মোটেই উচিত হয়নি। এখন সাবধানে এগোতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে দো বাখনির দুর্বলতা। এতক্ষণ নিজে আক্রমণ করতে গিয়ে হয়রান হয়েছে সে কেবল, স্থির করল, এবার প্রতিপক্ষকে সুযোগ দেবে আক্রমণের, নিজে অপেক্ষা করবে ওর দুর্বলতা খুঁজে বের করে নিয়ে উপযুক্ত সুযোগের।

যেন ওর মনের ইচ্ছে পূরণের জন্যেই আক্রমণভাগে এল এবার দো, বাখনি। মনে হলো ফ্রেঞ্চম্যানের তলোয়ারের আগাটা নেচে বেড়াচ্ছে লীচের চারপাশে। আঘাত ঠেকাতে গিয়ে এবার পিছিয়ে যেতে হচ্ছে লীচকে, নইলে কোন্ আঘাতে যে মরণ হবে টেরও পাবে না। পরপর পাঁচ-ছয়বার লাফিয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার পর দম ফেলার ফুরসত পেল ক্যাপটেন। এইবার, এতদিনে পরিষ্কার বুঝতে পারল টম লীচ, আসলে সে অপ্রতিরোধ্য নয়; অসি-যুদ্ধে তার চেয়েও অনেক বড় ওস্তাদ রয়েছে দুনিয়ায়। বুঝল, এই ফ্রেঞ্চম্যানের তুলনায় ওর গতি অনেক ধীর। জয়ের গর্ব এবং চর্চার অভাব জং ফেলে দিয়েছে ওর বিদ্যায়।

এতদিন যাদের চোখে মৃত্যুভয় দেখে উল্লাস অনুভব করেছে সে নিজের ভিতর, ঠিক তাদেরই মত একই অনুভূতি হলো ক্যাপটেন লীচের। অবধারিত পরাজয় টের পেয়ে হাত-পা কুঁকড়ে ঢুকে যেতে চাইছে পেটের ভিতর। কিন্তু ওর চোখে পরাজয় টের পেয়ে গেল প্রতিপক্ষ। পাছে তলোয়ার ফেলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে সেই ভয়ে আর কোন সময় দিল না ওকে মশিয়ে দো বাখনি। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণ আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য করল ওকে। পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছে লীচ আক্রমণের তোড়ে। ওকে রাগিয়ে তোলার জন্যে যা-তা বলছে, অপমান করছে দো বাখনি।

কুত্তার বাচ্চা, তুই দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবি, না তোকে এই গরমে গোটা দ্বীপে দাবড়ে বেড়াতে হবে আমার? পালাচ্ছিস কেন? তুই না কত বড় তলোয়ার-যোদ্ধা! দাঁড়া না সোজা হয়ে, বাধা দেয়ার চেষ্টা করু!

ভয়কে জয় করল প্রচণ্ড ক্রোধ, শুধু দাঁড়ালই না, চিতাবাঘের মত ঝাঁপ দিল লীচ সামনে। কিন্তু কোথায় দো বাখনি? চট করে একপাশে সরে গেছে সে। তার মানে, লীচের মনে হলো, অপ্রতিরোধ্য নয় দো বাখনিও, এখনও হয়তো জেতার সম্ভাবনা আছে। এই ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষকে পঙ্গু হয়তো করতে পারবে না সে, বলা যায় না, খুন করে ফেলা সম্ভব হতেও পারে। এখনও কিছু কৌশল রয়েছে ওর পকেটে। অনেক যত্নে রপ্ত করেছে সে এসব। আজ দেখাবে সে ফরাসী লোকটাকে তলোয়ারের জাদু কাকে বলে।

নব উদ্যমে রুখে দাঁড়াল ক্যাপটেন লীচ। মশিয়ে দো বাখনির প্রবল আক্রমণ ঠেকাতে ঠেকাতেই হঠাৎ এসে গেল সুযোগটা। ঠিক এই ভঙ্গিতেই চেয়েছিল সে প্রতিপক্ষকে। একটা আঘাত ঠেকিয়েই এমন ভঙ্গি করল যেন দো বাখনির কণ্ঠনালী ওর লক্ষ্য, কিন্তু প্রতিপক্ষের তলোয়ার ধর। হাতটা ওর আক্রমণ ঠেকাবার জন্যে ওপরে উঠতেই নিচু হয়ে চিতাবাঘের মত ঝাঁপ দিল সে, সামনে বাড়িয়ে ধরে আছে তলোয়ারের তীক্ষ্ণ ফলা। শরীরটা শূন্যে ভাসছে জমির সমান্তরালে, বাম হাতটা ঠেকে আছে মাটিতে। ইটালিয়ান কায়দায় এবার হাতটা পুরোপুরি লম্বা করে দিল দো বাখনির বুক সই করে। এই কৌশলে অতীতে অনেক বাঘা বাঘা যোদ্ধাকে ঘায়েল করেছে সে। এ-আক্রমণ ফেরাবার কোনও উপায় নেই।

কিন্তু কোথায় দো বাখনি? বিদ্যুদ্বেগে পাক খেয়ে শরীরটা বাম দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে সে, পরমুহূর্তে বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে লাফ দিয়েছে পিছনে। সামনে তলোয়ার চালিয়ে কোন বাধা না পেয়ে থতমত খেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল লীচ, ঘাড় ফিরিয়ে প্রতিপক্ষকে অন্য জায়গায় দেখে আছাড় খেতে খেতেই ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করল তলোয়ারটা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। বাম দিকে থেকে সড়াৎ করে ঢুকে গেল দো বাখনির তলোয়ার ওর পাজরে, হৃৎপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেল ডান দিক দিয়ে।

শেষবারের মত আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল জলদস্যুর দল, তারপরেই সব চুপ। ক্যাপটেন লীচের বুকে পা বাধিয়ে একটানে তলোয়ারটা বের করে নিয়ে কপালের ঘাম মুছল দো বাখনি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প।

বালিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে লীচ, ঘড় ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। পা আছড়াল বার কয়েক, তারপর একবার কেশে উঠে স্থির হয়ে গেল।

বড় আরামে গেলে, ক্যাপটেন, বলল মশিয়ে দো বাখনি। মাথাটা দোলাল এপাশ-ওপাশ।

.

১৮.

 টম লীচের মাথা

 চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে টম লীচ। দাঁতের উপর থেকে ঠোঁট সরে যাওয়ায় মনে হচ্ছে হাসছে। দলপতির আকস্মিক মৃত্যু থমকে দিয়েছে জলদস্যুদের। যুদ্ধ দেখেছে ওরা, মৃত্যু দেখেছে অনেক, কিন্তু টম লীচের মত এমন নিষ্ঠুর, দুর্দান্ত ক্ষমতাশালী, প্রাণবন্ত একজন লোক এভাবে মরে পড়ে থাকবে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতেই চিন্তা এল ওদের মাথায়–এবার কি? ক্যাপটেনের মৃত্যুর পর ওদের কার কপালে কি আছে? সবাইকে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বানড্রি, তার পিছন পিছন এলো এলিস আর হ্যালিওয়েল।

সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মশিয়ে দো বাখনি। তার মনেও অনিশ্চয়তা, কিন্তু চেহারায় তার কোনও প্রকাশ নেই। চারপাশে চেয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। বিশ গজ পিছনে দেখতে পেল, উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে এই দিকে চেয়ে রয়েছে প্রিসিলা, মেজর স্যান্ডস আর পিয়েখ। মেয়েটার মনের মধ্যে কি চলছে বুঝতে পারল ও। এখন যদি জলদস্যুরা, ক্যাপটেনের মৃত্যুর বদলা নিতে ওকে আক্রমণ করে বসে, তাহলে ওর মৃত্যু অবধারিত। প্রিসিলাকে নিয়ে তারপর ছিনিমিনি খেলবে ওরা।

এখনও কেউ ওর দিকে এগোচ্ছে না। খুব সম্ভব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কেউ জানে না কি করা উচিত এখন। কাজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার পড়ল চার নেতার উপর। উওগানের ওপর চোখ পড়ল ওর। বানড্রি যখন এগিয়ে এসে জানতে চাইল কি করে ব্যাপারটা ঘটল, তখন উওগানকে দেখিয়ে দিল মশিয়ে দো বাখনি।

ওকে জিজ্ঞেস করো। লড়াইটা আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছে ও সব।

লীচের চেয়ে দো বাখনির প্রতি বিদ্বেষের পরিমাণ একবিন্দু কম ছিল না উওগানের, ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সে-ও একজন সক্রিয় অংশীদার ছিল। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টাল উওগান। লীচ মারা পড়েছে। এখন দো বাখনিও যদি মারা যায়, তাহলে স্প্যানিশ ফ্লীট আক্রমণ করা হবে না ওদের। কাজেই বানড্রি, হ্যালিওয়েল আর এলিস যখন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে তখন স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দিল উওগান, হ্যাঁ। ঠিক বলছে. ও। তোমরা তো জানই ওর ওপর কেমন খেপে ছিল ক্যাপটেন। আজ এখানে একা পেয়ে যা-তা বলে ওকে অপমান করেছে, গায়ে পড়ে বাধিয়েছে লড়াই– এমন কি ওকে অস্ত্র বের করার সুযোগ না দিয়েই তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর উপর। যদি চট করে তখন চার্লি সরে না যেত, তাহলে খুন হয়ে যেত ওর হাতে।

সেটা তোমাদের জন্যে বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয় হতো, বলে উঠল মশিয়ে দো বাখনি। আমি খুন হলে তোমাদের স্প্যানিশ গোল্ডের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত চিরকাল। ও শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তোমাদেরও সবার সঙ্গে।

মনস্থির করে ফেলেছে বানড্রিও। মুখোশের মত অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। বলল, আমি ওকে বার বার সাবধান করেছি। কিন্তু কারও কথা শোনার পাত্র ছিল না ও, ওর যা খুশি সেটাই আর সবার জন্যে আইন বলে চালাবার চেষ্টা করত, বাধা পেলে ফুঁসে উঠত রক্ত-পিশাচের মত। যাক, যা হয়েছে আমার মনে হয় ন্যায্যই হয়েছে।

বানড্রির বক্তব্য মন দিয়ে শুনল সবাই, তারপর ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে যা ঘটল তার বর্ণনা ও ফলাফল বিশ্লেষণে মত্ত হয়ে পড়ল, মাঝে মাঝে হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে– যেন ব্যাপারটার এখানেই ইতি।

মশিয়ে দো বাখনি জানত, স্প্যানিশ পোন্ড উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ও নিরাপদ, কিন্তু আবেগের বশে কেউ ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে মনে করে প্রস্তুত ছিল– এত সহজে মেনে নেবে ওরা ওদের নেতার মৃত্যু তা ভাবতেও পারেনি। দেখা যাচ্ছে ঠিকই বলেছিল ও লীচকে: তোমাকে না হলেও চলবে এদের, কিন্তু আমাকে না হলে চলবে না।

তলোয়ারটা ধীরে সুস্থে খাপে পুরল মশিয়ে দো বাখনি, পোপাশাক তুলে নিয়ে পরতে শুরু করল। উওগান এগিয়ে এসে কোট পরতে সাহায্য করল ওকে। সেই ফাঁকে সবার অলক্ষে নিচু গলায় বলল, তুমি আমাদের কেবিনে একটু এলে ভাল হতো, মশিয়ে। নতুন ক্যাপটেন নির্বাচন করা হবে এখন। তারপর আরও আস্তে আরও নরম করে বলল, তোমার হয়ে কথা বলেছি আমি, চার্লি। নইলে হয়তো এতক্ষণে তোমারও লাশ পড়ে যেত। আমার সমর্থনে এ-যাত্রা বেঁচে গেলে, এটা মানো তো?

তাই নাকি? আমার তো ধারণা আমি বেঁচে আছি স্প্যানিশ প্লেট ফ্লীটের কারণে। যাই হোক, তোমার যদি ক্যাপটেন হওয়ার সাধ থাকে, সমর্থন জানাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তোমরা যাও, আমি আসছি একটু পরেই।

ঘুরে উঁচু পাড়ে দাঁড়ানো তিনজনের দিকে হাঁটতে শুরু করল মশিয়ে দো বাখনি।

ওকে আসতে দেখছে প্রিসিলা। শান্ত, অবিচলিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে লোকটা এদিকে, যেন দৈনন্দিন কোনও কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে। মানুষটা কি ইস্পাত দিয়ে তৈরি? এই যে একটু আগে একজন লোককে হত্যা করেছে, যেন সেটা কিছুই না; নিজে যে মারা পড়তে পারত, যেন তাতেও কিছুই এসে যায় না।

কাছে এসে যখন দাঁড়াল, ওর মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা চোখে পড়ল প্রিসিলার। কেন তা বলতে পারবে না, কিন্তু মানুষটার ভিতর আবেগ অনুভূতি আছে টের পেয়ে ভাল লাগল ওর, কৃতজ্ঞ বোধ করল।

আশা করি বেশি ভয় পাননি, সহজ, সহৃদয় কণ্ঠে বলল ও। আপনাকে যাতে এসব দেখতে না হয়, সেজন্যেই কিছু বলে আসিনি। মেজরের দিকে ফিরল এবার। হাঁ করে চেয়ে রয়েছে মেজর ওর দিকে, চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। দেখলেন, আমাদের চর্চাটা কাজে দিল। আমার মনটা আগাম দিচ্ছিল, মালদিতা ছাড়ার আগেই প্রয়োজন পড়বে এটা আমার।

আপনি কি ওকে…ও কি মা-মারা গেছে? তোতলাচ্ছে মেজর।

অসম্পূর্ণ কাজ করি না আমি, মেজর।

কথাটায় আরও কিছু আছে আঁচ করে চট করে ফিরল প্রিসিলা ওর দিকে। মানে, আপনি ওকে মারতেই চেয়েছিলেন? ওকে মারার জন্যেই গিয়েছিলেন ওখানে আপনি আজ?

প্রিসিলা যে ধাক্কা খেয়েছে টের পেল মশিয়ে দো বাখুনি। দু-হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝুঁকাল সে। উপায় ছিল না। এটা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। খুব বাড় বেড়ে গিয়েছিল লোকটার। বিশেষ করে আপনার জন্যে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ওর কপালে মরণ লেখা হয়ে গিয়েছে সেইদিনই। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে। অপেক্ষার সময়টুকু বড় কষ্টে ছিলাম, প্রিসিলা।

আমার জন্যে… ঢোক গিলল ও, আমার জন্যে ওকে খুন করতে হলো?

কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে চেয়ে রইল মশিয়ে দো বাখনি ওর মুখের দিকে, তারপর বলল, কারণ হয়তো আরও থাকতে পারে, কিন্তু ইচ্ছেটা পুরোপুরিই সেইজন্যে। আপনার সঙ্গে ও যে বেয়াদবি করেছে, আপনাকে নিয়ে ও যা পরিকল্পনা করেছে সেজন্যে ওকে হত্যা করে আমার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না।

মশিয়ে দো বাখনির বাহুতে হাত রাখল প্রিসিলা অনেকটা নিজেরই অজান্তে। মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে উঠল মেজরের। কিন্তু তার দিকে কারও খেয়াল নেই।

আমি ভয় পেয়েছিলাম –উঁহু, এতো ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম, আমারই জন্যে … ইশশ, আপনাকে যদি ও… ঢোক গিলল প্রিসিলা। একটু সামলে নিয়ে বলল, তারপর আরও ভয় লাগল। মনে হলো, মস্ত বিপদে আছেন আপনি; ওরা সবাই মিলে আপনাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবে।

সত্যিই বিপদে আছি, শান্ত কণ্ঠে বলল মশিয়ে দো বাখনি। কিন্তু না, ওখানে তেমন কোন বিপদ ছিল না; বিপদ আসলে আসছে সামনে।

এমনি সময়ে লাফিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল পিয়েখ।

মশিয়ে!

সাগরের দিকে মুখ ফিরাল মশিয়ে দো বাখনি। পাহাড়ের ওপাশ দিয়ে ঘুরে এদিকে চলে এসেছে বিশাল তিনটে লাল জাহাজ। পাশাপাশি আসছে ওরা মস্ত সব মেঘের মত পাল তুলে। একটু যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল সে, নিচু গলায় বলল, এই যে, এসে পড়েছে বিপদ!

সৈকতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে জলদস্যুরা জাহাজগুলোর দিকে, যেন জমে গেছে বরফ হয়ে। কারও মুখে টু-শব্দ নেই। কয়েক মুহূর্ত পর জাহাজগুলো একটু ডানদিকে ফিরতেই পরিষ্কার দেখা গেল ওগুলোর মাথায় পতপত করে উড়ছে ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ। সোজা এগিয়ে আসছে ওগুলো লেগুনের প্রবেশমুখের দিকে। এইবার মনে হলো নরক তার সবকটা পিশাচকে উগরে দিয়েছে মালদিতার সৈকতে। চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হল্লা, শাপ-শাপান্ত শুরু হয়ে গেছে, জটলা ভেঙে সন্ত্রস্ত ইঁদুরের মত ছুটছে ওরা যে যেদিকে পারে। কেউ ছুটল জঙ্গলের দিকে, একদল উওগানের পিছন পিছন দৌড়ে গিয়ে লুকাল কাত হয়ে পড়ে থাকা ব্ল্যাক সোয়ানের খোলের আড়ালে।

ওরা ধরেই নিয়েছে মরগানের জামাইকা স্কোয়াড্রনের জাহাজ এগুলো, এতদিন সাগরে এদিক ওদিক খুঁজছিল টম লীচের জাহাজ, আজ পেয়ে গেছে ওদের। নিশ্চয়ই এখন গোলাগুলি শুরু করে দেবে সৈকতের সবার উপর।

একমাত্র বানড্রি মাথা ঠাণ্ডা রাখল, বকাঝকা দিয়ে থামাল কয়েকজনকে। চেঁচাচ্ছে সে, আরে! কী হয়েছে? ভীতু ইঁদুরের মত দৌড়াদৌড়ি করছ কেন তোমরা? ভয়টা কিসের শুনি? এরা যারাই হোক না কেন, আমাদের সম্পর্কে কি জানে? ওরা দেখতে পাচ্ছে, একটা জাহাজ মেরামত করা হচ্ছে, আরেকটা চুপচাপ ভেসে আছে পানিতে। এর মধ্যে দোষের কি আছে?

কয়েকজন দৌড় থামিয়ে ফিরে এল ওর কথা শুনে।

মাথা ঠাণ্ডা রাখো এখন। এরা কেন এসেছে জানি না আমরা– খাবার পানি নিতেও আসতে পারে। আমরা যে এখানে আছি তা কারও জানার কথা নয়। এরা যদি মরগানের লোকও হয়, কাত হয়ে শুয়ে থাকা ব্ল্যাক সোয়ানকে চিনবে কি করে? উওগান গাধাটার পিছনে ও রকম দৌড় দিলে ওরা বুঝবে আমাদের মনে কোন পাপ আছে। শান্ত হও, দেখো ওরা কি চায়, তীরে আসে কি না; তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।

বানড্রির কথায় যুক্তি আছে বুঝতে পেরে এলিস আর হ্যালিওয়েল ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাইকে শান্ত করতে। চল্লিশ কামানের প্রথম জাহাজটা ঢুকে এল লেগুনে, তারপর পাশ ফিরে দাঁড়াল। দেখা গেল ওটার গান পোর্ট খোলা, ভয়ঙ্কর কামানগুলো যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত। এতক্ষণ বানড্রির কথায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে নিরুদ্বিগ্ন ভাব দেখিয়ে গল্প করার ভান করছিল যারা, পালাবার জন্যে এবার তাদের পিঠ সোজা হয়ে গেল।

এখন আর ধমক বা চোখ রাঙানিতে কাজ হবে বলে মনে হলো না। চঞ্চল হয়ে উঠেছে সবাই। ভয় পেয়েছে।

আরে, বোকারা! ও ওর দাঁত দেখাচ্ছে, কিন্তু তাতে কি? ওরা তো জানে না আমরা কারা, তাই জানিয়ে রাখছে প্রয়োজনে কামান দাগবে।

কিন্তু ওর সান্ত্বনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বড় জাহাজটা থেকে সাদা ধোয়া দেখা দিল, তার একমুহূর্ত পর ভেসে এল কামানের বিকট গর্জন, তারপর কেঁপে উঠল নিশ্চিন্তে ভাসমান সেন্টর। বুলওয়ার্ক থেকে চারদিকে ছিটকে পড়ল কাঠের টুকরো।

ভয় পেয়ে পাহাড়ের আড়াল থেকে একঝাক সী-গাল উঠল আকাশে, মিউমিউ আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ করছে ওদের শান্তিভঙ্গের জন্য। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ জলদস্য, বানড্রির পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশ শোনার আগ্রহ হারিয়েছে ওরা।

আবার দাগা হলো কামান, লক্ষ্য সেই একই– বুলওয়ার্ক। কিন্তু সেন্টর থেকে কোন প্রত্যুত্তর এল না, গান পোর্টগুলো যেমন ছিল তেমনি বন্ধই থাকল, কোথাও প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। কাজেই আপাতত কামান দাগা বন্ধ রাখল নবাগত যুদ্ধ-জাহাজ। পাল নামিয়ে নোঙর ফেলার কাজে ব্যস্ত এখন। বাকি দুটো জাহাজও নামিয়ে ফেলেছে পাল, নোঙর নামাচ্ছে।

কারও মনে আর কোন সন্দেহ থাকল না, সেন্টরের ওপর গোলা বর্ষণেই বোঝা গেছে জাহাজ তিনটে এদের সঙ্গে ভাব করতে আসেনি। ওরা শত্রুপক্ষ। এবং সম্ভবত এদের পরিচয় সম্পর্কে ওদের স্পষ্ট ধারণা আছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে সবাই জাহাজ তিনটের দিকে। নোঙর ফেলা হলে ওরা কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। এমন অসহায় অবস্থায় ফাঁদে পড়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওরা দোষটা কার।

বেশি সময় লাগল না, দেখা গেল একদল ছুটে আসছে উঁচু পাড়ে দাঁড়ানো দো বাখনির দিকে। দো বাখনির বামে দাঁড়ানো প্রিসিলা, আর প্রিসিলার বামে মেজর স্যান্ডস। ওদের সবার পিছনে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়েখ।

ঘটনাবহুল জীবনে কখনও এমন সচকিত, সজাগ ও সতর্ক বোধ করেনি মশিয়ে দো বাখনি। এই মুহূর্তটির জন্যেই চিন্তায় ছিল সে এতক্ষণ। প্রিসিলার দিকে একটু সরে এল সে, মৃদু কণ্ঠে বলল, এই সেই বিপদ। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন, ঘাবড়াবেন না।

এই বলে বুক টান করে সামনে এগোল মশিয়ে দো বাখনি অগ্রসরমান জটলার মোকাবিলা করতে। কয়েক পা এগিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, বাম হাতটা তলোয়ারের বাঁটের কাছে এমনভাবে রাখা যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে ডানহাতে একটানে বের করে আনা যায় অস্ত্রটা।

ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের মত এল ওরা। প্রায় দুশো লোক। কেউ মুঠি পাকিয়ে আঁকাচ্ছে ওর নাকের সামনে, কেউ অকথ্য গালাগাল দিচ্ছে, একজন একটা ম্যাশেটি হাতে ভঙ্গি করে দেখাচ্ছে ওটা দিয়ে কি করা হবে।

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল মশিয়ে দো বাখনি। ওরা একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালে ঝনঝনে, জোরাল কণ্ঠে জানতে চাইল, কি হচ্ছে এখানে? গাধার দল! তোমরা কাকে আক্রমণ করতে এসেছো! একমাত্র যার পক্ষে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা বের করা সম্ভব তাকে? পারবে আর কেউ তোমাদের রক্ষা করতে?

গোলমাল কমে এল। খুন করার আগে ওরা শুনতে চায় কি বলার আছে ফরাসী লোকটার। দো বাখনি দেখতে পেল, ভিড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে বানড্রি। সামনে এসেই ঘুরে দাঁড়াল সে, দুই হাত তুলে ভিড় করে আসা লোকেদের পিছনে সরাচ্ছে। আবারও প্রমাণ করল সে, আবেগে আপ্লুত হয়ে কিছু করে বসার চেয়ে সে বিচার-বিবেচনাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়।

দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমরা! কোনমতে বলল সে। গলা ভেঙে গেছে এতক্ষণ চেঁচিয়ে। সরে যাও। শুনতে দাও চার্লির কি বলার আছে। তারপর সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জাহাজগুলো কার? তোমার জানা আছে, চার্লি?

 কেন, তোমার জানা নেই? সামনেরটা রয়াল মেরি, মরগানের ফ্ল্যাগশিপ। জামাইকা স্কোয়াড্রনের জাহাজ এ তিনটে। মরগান আছে ওই জাহাজে। স্যার হেনরি মরগান। কিন্তু যা চায় তা পাবে না সে, দেরি করে ফেলেছে অনেক। টম লীচকে দরকার ছিল ওর।

হৈ-হৈ করে উঠল সবাই। শুধু কি টম লীচকেই চায়? তার অনুচরদের না? কি করে ভাবছে সে যে ওরা বেঁচে যাবে ওর হাত থেকে? আসলে কি ঘটবে ওদের কপালে?

আমার নিজের কথা আমি বলতে পারি, তিক্ত হাসি হাসল সে। কোনও সন্দেহ নেই তাতে। তোমরা যদি আমাকে জবাই করে ফাঁসীতে ঝুলানোর আনন্দ থেকে মরগানকে বঞ্চিত করতে চাও, বিশ্বাস করো, আমি বরং খুশি হব তাতে। আমার জন্যে এটা অনেক সহজ মৃত্যু হবে।

কথাটা মনে ধরল সবার। ঠিকই তো, যে লোক মরগানের লেফটেন্যান্ট ছিল, চাকরি ছেড়ে দেশে চলে যাওয়ার নাম করে আবার যে বোম্বেটেদের খাতায় নাম লিখিয়েছে, যোগ দিয়েছে ক্যাপটেন লীচের দলে, তাকে মরগানের কোনও রকম দয়ামায়া করার কথা নয়। ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে থমকে গেল সবাই। এটা তো ভাবেনি ওরা! দেখা যাচ্ছে, মস্ত ভুল হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।

এমনি সময়ে ব্ল্যাক সোয়ানের আড়াল থেকে বেরিয়ে এইদিকে ছুটে এল উওগান একদল লোক নিয়ে। ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে বুঝে নিয়েছে এভাবে মরগানের হাতে ধরা পড়ার জন্য দায়ী আসলে দো বাখনি। ওদের নিজেদের যা হওয়ার হবে, এই বিশ্বাসঘাতক ফরাসীটাকে সবার আগে ঝোলাতে হবে ফাসীতে।

দীর্ঘ হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে উঠল উওগান, ওর যা খুশি বলুক, আজকের এই অবস্থার জন্যে আমাদের টপগ্যাল্যান্ট চার্লিকেই ধন্যবাদ জানাতে হবে। ও-ই আমাদের নিয়ে এসেছে এখানে। ওরই কথায় এরকম কাত হয়ে শুয়ে অসহায় অবস্থায় ধরা পড়েছি আমরা মরগানের হাতে। হাত লম্বা করতেই ওর আঙুল চলে এল দো.বাখনির নাকের কাছে। সব দোষ ওর!

উওগানের এই বক্তৃতা অনেকের মনেই দো বাখনির প্রতি অন্ধ আক্রোশের সৃষ্টি করল। কিন্তু দো বাখনির দাবড়ি খেয়ে বোকা হয়ে গেল ওরা।

তুমি কি নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে আরেকজনের দিকে আঙুল তাক করে পার পেয়ে যাবে ভেবেছ, গাধা কোথাকার?

উওগানকে স্তম্ভিত করে দিল এই অভিযোগ। সবাই কান পাতল শুনবে বলে। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল দো বাখনি, আজ যদি আমরা অসহায় অবস্থায় ধরা পড়ে থাকি, এর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব তোমার, উওগান, আর তোমার ওস্তাদ কসাই টম লীচের। তোমরা যদি সতর্ক হতে তাহলে আজ আমাদের কামান থাকত ওই পাহাড়ের মাথায়, মরগানের বাপেরও সাধ্য হত না এই লেগুনে ঢুকে কামান দাগে।

ব্যাপারটা সবার বুঝে ওঠার জন্যে কিছুটা সময় দিল মশিয়ে দো বাখনি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, সেও যখন পাল্টা অভিযোগ করে তখন সবাইকে শুনতেই হয়।

তুমি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে ছুটে এসেছ এখানে, ভাবতে অবাকই লাগছে। কিন্তু আর সবাই তো আর তোমার মত গাধা না। সবারই বিচার-বুদ্ধি বলে কিছু আছে। তুমি বা তোমার ওস্তাদ টম লীচ, দুজনের কেউই নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখোনি কোনদিনই, না জলে, না ডাঙায়। প্রমাণ তো এই মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। তুমি বলছ দোষ আমার। আমি এখানে লীচকে নিয়ে এসেছিলাম, তার কারণ এর চেয়ে ভাল জায়গা ছিল না আমার খোঁজে। কিন্তু আমি কি তোমাদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করেছিলাম? আমি কি তোমাদের বলেছিলাম ওগুলো ওখানে সাগর-তীরে ওভাবে ফেলে রাখতে? হাত তুলে কামানগুলো দেখাল সে সবাইকে। তোমার কি ধারণা আমি সাবধান করিনি ওকে? আজ যদি আমাদের ষাটটা কামান তৈরি থাকত, মরগানের সাধ্য ছিল এই লেগুনে ঢোকে? কিন্তু আমার কথা শোনেনি ও।

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল উওগান, ওর একটা কথাও বিশ্বাস কোরো না কেউ! মিথ্যে কথা! ও কোনও পরামর্শ দেয়নি লীচকে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা!

বেশ মেনে নিলাম, মিথ্যে কথা। কিন্তু দয়া করে বলবে, তুমি এই উপদেশটা ওকে দাওনি কেন? আমাদের সবার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলে তোমরা, বলো সবার সামনে, কতটুকু পালন করেছ তোমরা তোমাদের দায়িত্ব? হাসল মশিয়ে দো বাখনি। তাহলে দোষটা আমার হচ্ছে কিভাবে? তোমাদের দায়িত্ব তোমরা পালন করোনি, সেজন্যে ছুটে এসেছ আমাকে দায়ী করতে, শুনি, কোন্ যুক্তিতে? উত্তর দাও, উওগান, সবাই শুনুক!।

সবাই চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, বলো! বলো! জবাব দাও!

হায়, খোদা! চেঁচিয়ে উঠল উওগান। নিজের তোলা অভিযোগ ফিরে এসেছে নিজেরই উপর। তোমরা কি এই মিথ্যাবাদীর কথা শুনবে? টপগ্যাল্যান্ট চার্লির কথা জানা নেই তোমাদের? ওর মত ধূর্ত আর খল চরিত্রের লোকের কথায় ভুলবে তোমরা? চালবাজির সাহায্যে ও তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তা বুঝতে পারছ না? আমি বলছি, ও হচ্ছে…

বলো, প্রতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নাওনি কেন? পাহাড়ের মাথায় কামান ফিট করনি কেন? গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাল একজন।

নিজের দোষের কৈফিয়ৎ দে আগে! প্রশ্নের জবাব দে, কুত্তির বাচ্চা! দাবড়ি লাগাল আরেকজন।

কাঁপতে শুরু করেছে উওগান। মানসচোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে নিজের মার খেয়ে ভর্তা হয়ে যাওয়া মৃতদেহটা। এদিক ওদিক চেয়ে কারও কাছ থেকেই সাহায্যের আশ্বাস পেল না। তবে মশিয়ে দো বাখনি এগিয়ে এল দুই কদম, কিছু বলতে চায়। জনতার রোষ নিজের ওপর থেকে সরানো গেছে, এইবার এই ব্যাটাকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়তো সম্ভব।

এই গাধার কথা ছাড়ো! বলল দো বাখনি সবার উদ্দেশে। টান দিয়ে ওকে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। এখন কার দোষ তা খুঁজে বের করলেই কি আমরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যাব? না। আমাদের ভাবতে হবে উদ্ধারের উপায় নিয়ে।

উদ্ধারের কথায় মুহূর্তে সবার মনোযোগ চলে এল ওর দিকে। সব কজন দস্যুর চোখ এখন মশিয়ে দো বাখনির মুখের উপর। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল মোটা নেড হ্যালিওয়েল আর লাল চুলো এলিস-উৎকর্ণ। পাশ থেকে বিচক্ষণ বানড্রি বলল, ভেবে দেখেছি। কসম খোদার, কোনও পথ নেই!

ওর কাঁধে একটা হাত রাখল মশিয়ে দো বাখনি। বুকে সাহস রাখো, বানড্রি! হতাশ হওয়ার কোনও কারণ এখনও ঘটেনি।

সাহসের কমতি নেই আমার! বলল বানড্রি। বিচার-বুদ্ধিরও কমতি আছে বলে মনে করি না আমি।

তারপরেও আরেকটা জিনিস থাকে, বানড্রি। সেটার নাম হলো উদ্ভাবনী ক্ষমতা।

তুমি যদি কিছু আবিষ্কার করতে পার যা আমাদের সাহায্যে আসবে, চার্লি, বলল চাঁদমুখো হ্যালিওয়েল, তাহলে বাকি জীবন তোমার পিছনে হাঁটব।

এই কথায় জোর সমর্থন জানাল সবাই একযোগে। তাকিয়ে আছে চিন্তারত দো বাখনির ভুরু কুঁচকানো মুখের দিকে। খানিক পরেই মৃদু হাসি দেখা দিল ওর মুখে। আশার আলো জ্বলে উঠল সবার চোখে।

একটা কথা জেনে রাখো, আজই শেষ। আজকের পর আর কোনদিন টপগ্যাল্যান্ট চার্লি তোমাদের নেতৃত্ব দৈবে না। একটু চুপ করে থেকে বলল, তবে এটাও জেনে রাখো, আমাদের রক্ষা পাওয়া সম্ভব; অন্তত তোমাদের যে বাঁচাতে পারব তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে গেল ওদের চোখ। দুর্বোধ্য আওয়াজ বের হলো অনেকের গলা দিয়ে। দো বাখনির এই আশ্বাস কিভাবে গ্রহণ করবে বুঝতে পারছে না। ঠিক এমনি সময়ে বুম! আওয়াজে সবাই পিছন ফিরে চাইল। মনোযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে ফ্ল্যাগশিপ থেকে। ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পামগাছে পড়ল গোলাটা।

দেখা গেল, জাহাজের ফোরটপসেইলটা উঠছে-নামছে। মনে মনে গুনছে দো বাখনি, গোনা শেষ হলে বলল, আমাদের নৌকা পাঠাতে বলছে।

সবাই ফিরল ওর দিকে। সহজ ভঙ্গিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করল মশিয়ে দো বাখনি। বলল, হুকুম মানতে হবে, নইলে কামান থেকে ছররা মেরে আমাদেরকে বিছিয়ে দেবে বালির ওপর। তোমাদের কয়েকজন লং বোটটা পানিতে নামাও। তুমি এর তদারকি করো, হ্যালিওয়েল।

তুমি আমাকে পাঠাবে নাকি! আত্মা চমকে গেল হ্যালিওয়েলের।

না-না। বোট নামানোর কসরত করতে থাকো, প্রয়োজনে নামাও পানিতে। ওদের দেখাও, নির্দেশ মত কাজ করছি আমরা। তাতে গোলাগুলি বন্ধ রাখবে ওরা। ধীরে কাজ করাও, তাড়াহুড়ো কোরো না।

ছয়-সাতজন লোক বাছাই করে নিয়ে থপথপ্ পা ফেলে রওনা, হয়ে গেল হ্যালিওয়েল। এই কয়জন যে গেল, এদেরকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিতে হলো। সবাইকে রক্ষা করার জন্যে কি অভিনব বুদ্ধি বের করেছে ফরাসী লোকটা, জানার জন্যে ওদের বুকের ভিতরটা আকুলি বিকুলি করছে।

এবার বানড্রির দিকে ফিরল মশিয়ে দো বাখনি। কিন্তু কথা বলল এমন স্বরে যেন উপস্থিত সবাই শুনতে পায়।

আমি যতদূর জানি মরগান শুধু একটা জিনিস চায়। যেমন করে হোক। এটার জন্যেই এসেছে ও এখানে। এর জন্যে ইংলিশ ক্রাউনের নামে পাঁচশো পাউন্ড পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। হ্য, পাঁচশো পাউন্ড! আমি জানি, প্রয়োজনে এর চেয়ে অনেক বেশি খরচ করতে রাজি হবে সে ওই জিনিসটার জন্যে। আমরা দর কষাকষি করব। আমাদের সবার মুক্তির বিনিময়ে তুলে দেব ওর হাতে সেই জিনিসটা। কপাল ভাল, ওটা দিতে আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। জিনিসটা হলো বিদ্রোহী টম লীচের মাথা।

দম আটকে ফেলল বানড্রি অভিনব প্রস্তাব শুনে। বুঝতে পারছে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু কথাটা শোনা মাত্র স্বস্তির শ্বাস ফেলল আর সবাই, দু-একজন হেসেও উঠল। কারণ মরগান জানে না মারা পড়েছে টম লীচ। এই তরফ থেকে জানানোও হবে না, ভাব দেখানো হবে, তাকে ধরতে গিয়ে খুন করতে হয়েছে।

কিন্তু এলিস একটা অসুবিধার কথা তুলল।

তা ঠিক, বলল সে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? কে যাবে মরগানের কাছে আমাদের প্রস্তাব নিয়ে ফিরে আসতে পারবে সে? আমি ভাল করে চিনি নেকড়েটাকে। যে যাবে তাকে ধরে প্রথমে পালের ডাণ্ডার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে, তারপর টম লীচের মাথাও চাইবে।

আসলে রাজিই হবে না, বলল বানড্রি জোরের সঙ্গে। কেন রাজি হবে? ওর মুঠির মধ্যে রয়েছি আমরা; ওর করুণার ওপর নির্ভর করছে এখন আমাদের সবার বাঁচা-মরা। কোনও কথাই শুনবে না, ও চাইবে শর্তহীন আত্মসমর্পণ। তাকাল দো বাখনির চোখের দিকে, তোমার তো এটা বোঝার কথা, দো বাখনি। এসব কী আবোলতাবোল বোঝাচ্ছ আমাদের?

বানড্রির কথায় চমকে উঠল সবাই। মন দিয়ে শুনল মশিয়ে দো বাখনি ওর কথাগুলো। তারপর মাথা নাড়ল এপাশ ওপাশ। মানুষের মন ভেঙে দিতে তোমার কোন জুড়ি নেই, বানড্রি। কে বলেছে ওর মুঠির মধ্যে রয়েছি আমরা? আমরা জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলে ও কি করবে? আমাদের পিছনে সৈন্য পাঠালে ওরা মারা পড়বে বেশুমার, সে কথা জানে না মরগান? আর আমাদের খাবারের মজুদ কি পরিমাণ আছে, কতদিন পর আমরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হব তার ঠিক আছে? চারপাশে চেয়ে দেখল আবার আলো ফিরে আসছে লোকের চোখে। আমার প্রস্তাব যে ও মানবেই তার কোন গ্যারান্টি নেই। সোজা নাকচ করে দিতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? ভেবে দেখো, টম লীচকে শেষ করা ওর জন্যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, লীচের কারণে সরকারের কাছে পদে পদে অপদস্থ হচ্ছে সে ইদানীং।

জোর সমর্থন এল সবার কাছ থেকে। মেনে নিতে বাধ্য হলো বানড্রি। বলল, ঠিক আছে, মানলাম, চেষ্টা করায় দোষ নেই। কিন্তু একটু আগে এলিস যে প্রস্তাব তুলল: কে নিয়ে যাবে তোমার প্রস্তাব? কে গিয়ে দাঁড়াবে মরগানের সামনে? আমার তো মনে হচ্ছে উওগানেরই যাওয়া উচিত, কারণ আমাদের নিরাপত্তার দিকটা দেখা লীচের পর ওরই দায়িত্ব ছিল।

আমি? আমাকে? ফোঁস করে উঠল উওগান। পচে মরো তুমি, শুয়োর কোথাকার! তোমারও দায়িত্ব ছিল সেটা।

আমি একজন শিপমাস্টার, নৌ-সেনা নই, গম্ভীর স্বরে জবাব দিল বানড্রি।

আরে, দাঁড়াও, দাঁড়াও! নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা ঠিক না। সমাধান আছে আমার কাছে। পিছন ফিরে প্রিসিলাকে দেখল সে। ওই যে আমার স্ত্রী। কেউ বলতে পারবে না নারীর বিরুদ্ধে কোনদিন যুদ্ধ করেছে মরগান। আজ পর্যন্ত কখনও কোন নারীর বিরুদ্ধে একটি আঙুল তোলেনি সে। কোন মেয়েকে জলদস্যু বলতেও পারবে না সে। ওর তরফ থেকে আমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে নেই। আর নৌকাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে ওর ভাই আর আমার কাজের লোক পিয়েখ। আমাদের দূত হিসেবে মাদাম দো বাখনি মরগানকে গিয়ে বলবে, আমাদের জীবন, আমাদের মুক্তি এবং আমাদের এই জাহাজ দুটোয় উঠে যেখানে খুশি চলে যাওয়ার স্বাধীনতার বিনিময়ে আমরা জীবিত বা মৃত টম লীচকে তুলে দিতে পারি তার হাতে।

কি করে আশা করছ যে এই প্রস্তাবে ও রাজি হবে? মশিয়ে দো বাখনির শান্ত মুখে স্থির হয়ে রয়েছে বানড্রির চোখের দৃষ্টি, প্রতারণার আভাস খুঁজছে।

কেন নয়? হালকা সুরে বলল দো বাখনি। ও জানে লীচই তোমাদের চালিকা শক্তি। লীচ শেষ হয়ে গেলে তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে যাবে এদিক ওদিক। সবচেয়ে বড় কথা, ওর এখন যত শীঘ্রি সম্ভব সরকারকে জানাতে হবে যে ধ্বংস হয়ে গেছে টম লীচ, তা নইলে ধ্বংস হয়ে যাবে ও নিজেই।

এরপর কিছুক্ষণ গুজুর-গুজুর করল ওরা, বানড্রি আর এলিসের মধ্যে ছোটখাট বিতর্ক হলো, কেউ একজন মাদাম দো বাখনির নিরাপত্তা সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলল –তবে সবার ধমক খেয়ে সে থেমে যেতে বাধ্য হলো। দো বাখনি নিজেই যখন প্রস্তাব দিয়েছে, তখন তার স্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব ওরই, এ নিয়ে অ্যথা মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আসল কথা, ওদের প্রস্তাবটা যাচ্ছে মরগ্যানের কাছে, কিন্তু ওদের কাউকে বিপদ ঘাড়ে নিতে হচ্ছে না।

আলোচনা শেষে কিছুটা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দো বাখনিকে জানাল ওরা, রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা যখন রয়েছে, ওরা রাজি; প্ল্যান মাফিক কাজ করা যেতে পারে।

.

১৯.

 স্যার হেনরি মরগান

 বেলাভূমির উপর দিয়ে হেঁটে নৌকার দিকে চলেছে প্রিসিলা। তার একপাশে মশিয়ে দো বাখনি আর অপরপাশে মেজর স্যান্ডস। এদের দুপাশ থেকে আঠার মত সেঁটে আছে বানড্রি আর এলিস। পিয়েখ হাঁটছে ওদের পিছনে। তার পিছনে আসছে জনা কয়েক জলদস্যু। প্রিসিলার মনে হচ্ছে চারপাশে যা ঘটছে সব অবাস্তব, স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছে বুঝি ও।

এই একটু আগে সিদ্ধান্ত হয়ে যেতেই প্রিসিলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মশিয়ে দো, বাখনি। তুমি শুনেছ, প্রিসিলা, তোমাকে কি করতে হবে?

মাথা ঝাঁকিয়েছে প্রিসিলা। শুনেছি। বলে বোবা, উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে ও ফ্রেঞ্চম্যানের মুখের দিকে। আরও কিছু যেন শুনতে চায়।

ওর কপালে এসে পড়া একগুচ্ছ চুল সরিয়ে দিয়েছে দো বাখনি। কোন ভয় নেই, লক্ষ্মী। স্যার হেনরি মরগান তোমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করবেন।

আমি জানি। তা নইলে তুমি আমাকে ওখানে পাঠাতে না। সোজা সাপটা জবাব দিয়েছে প্রিসিলা। তারপর ওর আসল ভয়টা বেরিয়ে এসেছে। আর তুমি?

আমি? হাসল দো বাখনি। আমার কথা চিন্তা কোরো না। ভাগ্যদেবির হাতে ভালই থাকব আমি। সব নির্ভর করবে এখন তোমার ওপর।

আমার ওপর?

হ্যাঁ, আমাদের প্রস্তাবটা বয়ে নিয়ে গিয়ে ঠিকমত ওর কাছে পৌঁছে দিতে পারার ওপর।

তাই যদি হয়, তাহলে নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পার তুমি আমার ওপর।

চলো তাহলে। হাতে সময় নেই। বোট তৈরি হয়ে গেছে। যেতে যেতে আমি বলে দিচ্ছি ঠিক কি বলবে তুমি মরগানকে।

একসাথে রওনা হয়েছে সবাই। মেজর হাঁটছে চুপচাপ। মনের খুশি যাতে প্রকাশ পেয়ে না যায় সেজন্যে মুখটা গোমড়া করে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস পাচ্ছে। হঠাৎ করে এই দোজখের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথ পেয়ে গিয়ে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে তার। এই তো, আর একটু গেলেই ইংল্যান্ডের জাহাজে উঠে পড়বে সে, তারপর আর তাকে পায় কে!

সবাইকে শুনিয়ে, প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার ভাবে উচ্চারণ করে বুঝিয়ে বলছে মশিয়ে দো বাখনি। মন দিয়ে শুনছে প্রিসিলা, কিন্তু মেজর তার নিজের চিন্তায় বিভোর। দুবার সতর্ক করেও তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি দো বাখনি।

ওদের কাজ হচ্ছে মরগানকে সোজাসুজি বলা, টম লীচকে সে পেতে পারে, তবে বিনিময়ে দ্বীপের সবাইকে তাদের নিজেদের জাহাজে করে যখন খুশি যেখানে খুশি চলে যাওয়ার অধিকার দিতে হবে। আরও কিছু যদি সে দাবি করে তাহলে এটুকু বলা যাবে: এরা ভবিষ্যতে দস্যুতা ছেড়ে দেবে, এমন কি তার নিদর্শন হিসেবে জাহাজ থেকে মরগানের চোখের সামনে কামানগুলো পানিতে ফেলে দিতেও রাজি আছে। ব্যস, এর বেশি আর কিছু না।

কিন্তু যদি এই শর্ত মানতে মরগান রাজি না হয়, তাহলে ওকে জানাতে হবে, অঢেল খাবার আর গোলাবারুদ আছে ওদের কাছে; তাই নিয়ে ওরা সরে যাবে জঙ্গলে। ওখানে দো বাখনির পরিচালনায় অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে পারবে ওরা। মরগান যদি সৈন্য পাঠিয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করতে চায়, তাহলে নির্বিচারে হত্যা করা হবে তাদের। লীচকে তো পাবেই না, ওদের কারও টিকিও স্পর্শ করতে পারবে না আগামী কয়েক মাস।

গোটা প্রস্তাব আগাগোড়া মুখস্থ বলে মহড়া দিতে হলো প্রিসিলাকে, যাতে এর সঙ্গে একটি শব্দও যোগ না হয়, কিংবা বাদ না পড়ে। এলিস আর বানড্রি গম্ভীর মুখে মাথা দুলিয়ে সায় দিল।

ভেজা বালিতে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ছয়জন লোক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে স্থির রেখেছে নৌকাটা। হ্যালিওয়েল বলল মাদামকে সে তুলে দেবে, মেজর আর পিয়েখ নিজেরাই হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে উঠবে নৌকায়।

কাঁপছে প্রিসিলা, রক্তশূন্য সাদা হয়ে গেছে মুখ। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। মশিয়ে দো বাখনির মুখোমুখি। দুই হাতে চেপে ধরল ওর দুবাহু।

চার্লস! শুধু এইটুকুই বলতে পারল মেয়েটা। আবার বলল, চার্লস! কণ্ঠে তীব্র বেদনা, দৃষ্টিতে গভীর আশঙ্কা।

মাথা নিচু করে চাইল দো বাখনি। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ল মমতা, রোদে পোড়া মুখে ঝিক্ করে উঠল মিষ্টি হাসি।

কোনও ভয় নেই, প্রিসিলা। আমি আবার বলছি, কোনও ভয় নেই। কিছু না। মেয়েদের সঙ্গে মরগানের কোনও ঝগড়া নেই।

প্রিসিলার চোখে মুহূর্তের জন্যে রাগের আভাস ফুটে উঠল। তুমি কি কোনদিন বুঝবে না, আমার নিজের জন্যে ভয় পাচ্ছি না আমি? আমাকে এতই নীচ ভাবতে পার?

হাসি মুছে গেল দো বাখনির মুখ থেকে। সেই জায়গায় দেখা দিল বেদনা। ছল ছল করছে চোখ দুটো। আর একটি কথাও বলতে পারল না। বানড্রির দিকে ফিরল সে। একটা মিনিট আমাদের একা কথা বলতে দেবে? বলা যায় না, হয়তো জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে না ওর সঙ্গে।

মাথা নাড়ল বানড্রি। দুঃখিত, চার্লি। আমরা এখন জানি ঠিক কি মেসেজ নিয়ে যাচ্ছে মাদাম বাখনি, কিন্তু তোমাদের আলাদা কথা বলতে দিলে আমরা জানব না আরও কি যোগ-বিয়োগ হচ্ছে আমাদের শর্তের সঙ্গে।

ওকে সমর্থন দিল এলিস।

কাজেই…কাঁধ ঝাঁকাল মশিয়ে দো বাখনি। আবার হাসি ফুটল ওর মুখে। বলল, কাজেই, বিদায়, প্রিসিলা, আর কিছু বলার নেই আমার। নিচু হয়ে ওর গালে চুমু খেতে গেল সে, চট করে মুখ সরিয়ে ঠোঁটে নিল প্রিসিলা চুমুটা।

চার্লস! নিচু, ধরা গলায় আবার ডাকল ও। দুঃখে পুড়ছে ওর কলজেটা।

হঠাৎ কাঠিন্য হারিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মশিয়ে দো বাখনির মুখ। পিছিয়ে গেল এক পা, হাত নাড়ল হ্যালিওয়েলের উদ্দেশে। মোটকু শিপমাস্টার পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ওকে, হাঁটু পানি ভেঙে তুলে দিল নৌকার পাটাতনে। মেজর আর পিয়েখও গিয়ে উঠল এবার। দুটো দাঁড় তুলে নিল ওরা হাতে। জলদস্যু ছয়জন হেঁইও বলে এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দিল নৌকাটা বেশি পানিতে। রওনা হয়ে গেল লং বোট, ছোট্ট একটা সাদা পতাকা পপত্ করে উড়ছে গলুইয়ে।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল দো বাখনি নৌকাটাকে। ভেবেছিল ফিরে তাকাবে বুঝি প্রিসিলা, শেষবারের মত দেখতে পাবে ওকে– কিন্তু না, তাকাল না ও। পিছন ফিরল দো বাখনি, বানড্রি আর এলিসের সঙ্গে তীর বেয়ে উঠে গেল উপরে।

লং বোটে চুপচাপ বসে অঝোরে কাঁদছে প্রিসিলা। আর সহ্য করতে না পেরে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে পিয়েখ বলল, মাদামোয়াজেল, দয়া করে কাঁদবেন না। কান্নার কিছুই নেই। কোনও ক্ষতি হবে না মশিয়ে দো বাখনির। বিশ্বাস করুন, ভালোয় ভালোয় শেষ হবে সব।

তা যদি না-ও হয়, বলল মেজর, তেমন তো কোনও ক্ষতি দেখছি না।

দো বাখনির জন্যে প্রিসিলাকে কাঁদতে দেখে তেতো হয়ে গেছে মেজরের মন, পানির ধারে ছোট্ট নাটকটাও ওর চোখ এড়ায়নি। তিক্ততার সঙ্গে সে অনুভব করতে পারছে, ওই বোম্বেটে কসাইটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রিসিলা। সে অবশ্য জানে, এই ভ্রম কেটে যেতে খুব বেশি দেরি হবে না। ইংল্যান্ডে ভদ্র পরিবেশে সম্ভ্রান্ত লোকজনের সমাজে কদিন ওঠা-বসা করলেই কি ওকে মানায় আর কোনটা মানায় না, বুঝে নেবে ওঁ অল্পদিনেই। কাজেই আশা ছাড়েনি সে, স্থির করেছে, এখন থেকেই ওকে ট্রেনিং দিয়ে ওর দৃষ্টিভঙ্গি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর কথা বলতেও সে ছাড়বে না। শেষ চুমুটা একেবারে আগুন জ্বেলে দিয়েছে ওর বুকে।

মেজরের মন্তব্যে অল্পক্ষণের জন্যে হলেও কান্না থামল ওর। কান্না ভেজা চোখে এখন আগুন ঝরছে। সোজা মেজরের চোখের দিকে চেয়ে কৈফিয়ৎ চাইল। এসব কী যা-তা কথা বলছেন? ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয় জ্ঞান করল মেজর। একজন মানুষ, যে নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দিল, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কি এই নমুনা দেখাচ্ছেন আপনি, মেজর?

ও আমাদের উদ্ধার করল কখন? বরং আমরাই এখন ওর আর ওর খুনে বন্ধুদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা করে দেখব।

 ও, এই বুঝেছেন বুঝি আপনি! তাহলে বলতেই হয়, যতখানি ধারণা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বড় গর্দভ আপনি!

প্রিসিলা! বৈঠা বাওয়া বন্ধ করে হাঁ করে চেয়ে রইল মেজর প্রিসিলার দিকে। এমন কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ তো দূরের কথা, মেয়েটা ভাবতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। এই কথা বলে ফেলা মানে তো সব শেষ হয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওর মনে হলো প্রিসিলার এখন মাথার ঠিক নেই, কি বলতে কি বলছে নিজেও জানে না। জোর করে মুখে প্রশ্রয়ের হাসি ফুটাল সে, বলল, এভাবে বলতে নেই, প্রিসিলা। তাতে সম্পর্কের অবনতি হয়, সমাজে চলা যায় না। এখন তো তুমি আর ছোটলোকদের সঙ্গে থাকবে না, ভদ্র সমাজে ফিরে ভদ্রলোকদের সঙ্গে বাস করতে হবে তোমাকে।

কোনও জবাব দিল না প্রিসিলা, তাই ওর মনের মধ্যে কি চলছে টের পেল না মেজর স্যান্ডস। আবার বৈঠা চালাতে শুরু করেছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লং বোট ভিড়ল এসে ফ্ল্যাগশিপের গায়ে।

মেজরের বাড়ানো হাত উপেক্ষা করে পিয়েখের সাহায্য নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল প্রিসিলা সবার আগে। তারপর উঠল মেজর স্যান্ডস, সব শেষে পিয়েখ।

ওপরে উঠে প্রিসিলা দেখল অভ্যর্থনার জন্যে জমকাল বেমানান পোশাক পরা মোটাসোটা এক প্রৌঢ় লোক পঁড়িয়ে রয়েছেন, তার হলুদ মুখে একজোড়া ঝোলানো গোঁফ ছাড়া দেখার কিছুই নেই। জাহাজের মাঝ-ডেক পর্যন্ত পৌঁছে এক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তার পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল সশস্ত্র নৌ-সেনা।

খোদা, রক্ষে করো! ব্যাপারটা কি? চেঁচিয়ে উঠলেন মোটা ভাদ্রলোক। কে তুমি, ম্যাডাম?

আমি প্রিসিলা হ্যারাডিন, স্যার জন হ্যারাডিনের মেয়ে। উনি লীওয়ার্ড আইল্যান্ডসের ক্যাপটেন জেনারেল ছিলেন। একটু থেমে বলল, আপনিই কি স্যার হেনরি মরগান?

পরচুলার উপর থেকে পাখির পালক গোঁজা হ্যাটটা নামিয়ে এক পা ভাঁজ করে মহা আড়ম্বরে সৌজন্য প্রদর্শন করলেন মোটা মানুষটা।

তোমার খেদমতের জন্যে প্রস্তুত, ম্যাডাম। কিন্তু টম লীচের জঘন্য লোকগুলোর সঙ্গে মিস প্রিসিলা হ্যারাডিন কি করছে? একজন ক্যাপটেন জেনারেলের মেয়ের জন্যে ব্যাপারটা একেবারেই বেঠিক, বেমানান হয়ে গেল না?

আমাকে দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছে, স্যার হেনরি।

খুনে ডাকাতদের তরফ থেকে? রক্ষে করো, খোদা! ওদের মধ্যে তুমি গেলে কি করে, ম্যাডাম?

এমনি সময়ে উঠে এল মেজর, একটু থেমে নেমে এল মাঝ ডেকে। ঘোষণার ভঙ্গিতে বলল, আমি মেজর স্যান্ডস। মেজর বার্থোলোমিউ স্যান্ডস, অ্যান্টিগুয়ায় পরলোকগত স্যার জন হ্যারাডিনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।

মরগানের গাঢ় চোখের দৃষ্টি মেজরকে দ্বিধায় ফেলে দিল। কেমন যেন একটা বিদ্বেষ মাখা টিটকারীর ভাব রয়েছে লোকটার মধ্যে। বোঝা গেল, মেজরের নাম বা পদবী কোনই গুরুত্ব পায়নি তার কাছে।

তাই যদি হয়, আপনার দায়িত্ব ফেলে কি করছেন আপনি এখানে? আপনারা কি অ্যান্টিগুয়াতে বন্দী হয়েছিলেন? কই, এমন কোনও খবর তো আসেনি আমার কানে?

আমরা সেন্টর নামের এক জাহাজে করে ইংল্যান্ডে ফিরছিলাম, পাশ ফিরে আঙুল তুলে দেখাল মেজর, ওই যে ওটা ওখানে। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিল দো বাখনি নামে এক ফ্রেঞ্চ ডাকাত। শুনেছি, এক সময় বদমাশটা আপনার লেফটেন্যান্ট ছিল।

আচ্ছা! আগ্রহ ফুটে উঠল মরগানের হলুদ মুখে, কিন্তু বিতৃষ্ণার ছাপ তাতে বাড়ল বই কমল না। ফ্রেঞ্চ ডাকাত, বদমাশ দো বাখনি, অ্যাঁ? বেশ, বেশ। বলে যান।

মেজরকে থামিয়ে আসল কথায় আসার চেষ্টা করে দেখল প্রিসিলা, কিন্তু তাকে আটকানো গেল না। টম লীচের সেন্টর আক্রমণ, দো বাখনির ওদের দলে যোগদান, প্রিসিলা ও তাকে স্ত্রী ও স্ত্রীর ভাই হিসেবে পরিচয় দেয়া– সব বলে গেল গড় গড় করে। প্রতিবার দো বাখনির নামটা উচ্চারণের আগে-পরে বিশ্রী কিছু বিশেষণ যোগ করতে ভুলল না। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে কর্কশ ভঙ্গিতে মেজরকে থামিয়ে দিলেন স্যার হেনরি।

ব্যাপার কি? আপনার কথা যদি সত্যি হয়, দেখা যাচ্ছে দো বাখনি লোকটা শুধু আপনাদের প্রাণই বাঁচায়নি, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে।

যদি আমার কথা সত্যি হয়? আত্মসম্মানে ঘা লেগে গেল তর্কবাগীশ মেজরের। আপনি বলছেন, যদি আমার কথা, সত্যি হয়! তার মানে কি, মিথ্যেও হতে পারত?

ফালতু তর্ক না করে বলুন তারপর কি হলো। আপনি যদি মিথ্যুক না হন, স্যার, আমি বলব, আপনি গত কয়েক বছরে আমার দেখা সবচেয়ে নীচ মনের জঘন্য ইতর।

 সাদা হয়ে গেল মেজর, তারপর লাল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, স্যার হেনরি, আমি রাজার কমিশনপ্রাপ্ত একজন

তাতে কি? আমিও তো তাই। আরও হাজারটা পাজি-বদমাশ পাওয়া যাবে, তারাও হয়তো তাই। তাতে কি প্রমাণ হয়? থলথলে মোটা হাত নেড়ে মেজরকে বাতিল করে দিলেন তিনি। অযথা সময় নষ্ট করছে ব্যাটা। আমি জানতে চাই, আমার জাহাজে কিভাবে এলে তোমরা, এবং কেন? প্রিসিলার দিকে ফিরে কর্কশ গলাটা সাধ্যমত নরম করে বললেন, তুমি বলো তো শুনি, ম্যাডাম।

আমরা মশিয়ে দো বাখনির তরফ থেকে আপনার জন্যে একটা বার্তা বয়ে এনেছি, স্যার হেনরি।

আচ্ছা! স্যার হেনরির সম্পূর্ণ মনোযোগ এসে গেল প্রিসিলার মুখের উপর। খেয়ালই করলেন না, ক্রুদ্ধ মেজর পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে।

আপনার সঙ্গে চুক্তির কয়েকটা শর্ত, স্যার হেনরি।

শর্ত? অ্যাঁ? ফুঁ দিয়ে বাতাস ছাড়লেন মরগান। শর্ত! অফিসারদের দিকে ফিরে বললেন, বুঝলে? শর্ত! তারপর মোটা কর্কশ গলায় হা-হা করে হাসলেন খানিকক্ষণ। আম্পর্দা দেখো! আমার পিস্তলের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই শর্ত দেয়! রক্ষে করো, খোদা! বেশ, বেশ। শোনা যাক এবার শর্তগুলো।

জলদস্যুরা জঙ্গলে ঢুকে ওখান থেকে বাধা দেবে, গোলাগুলি ও খাবারের অভাব নেই, ইত্যাদি সবই বলছিল প্রিসিলা, মাঝখান থেকে কর্কশ ভাবে বাধা দিলেন স্যার হেনরি। হয়েছে, থাক, ওসব বাদ দাও। শর্তগুলো শুনি।

বলল প্রিসিলা। মশিয়ে দো বাখনি জীবিত বা মৃত টম লীচকে তাঁর হাতে তুলে দেবে, জাহাজ থেকে সমস্ত কামান ফেলে দেবে পানিতে যদি স্যার হেনরি কথা দেন জলদস্যুদের একটা জাহাজে করে যখন খুশি, যেদিকে খুশি চলে যাওয়ার স্বাধীনতা দেবেন। এমন সুরে শর্তগুলো উচ্চারণ করল প্রিসিলা, যেন মেনে নেয়ার জন্যে অনুরোধ করছে দো বাখনির হয়ে।

স্যার হেনরির কৌতুক ভরা তীক্ষ্ণ চোখে সবই ধরা পড়ল, একবার পিছন ফিরে মেজরের বিরস মুখের দিকে চাইলেন তিনি, তারপর বিশাল মোটা গোঁফের আড়ালে হাসি চাপলেন।

হুম! বললেন তিনি। এবার শোনা যাক শর্ত না মানলে আমার কি দশা করে ছাড়বে তোমার দো বাখনি।

গড় গড় করে বলে গেল প্রিসিলা। ঠোঁটের কোণে একটুকরো বাঁকা হাসি নিয়ে মন দিয়ে শুনছেন এবার স্যার হেনরি। এই মোটা লোকটাকে প্রিসিলার মনে হলো দয়াহীন, মায়াহীন, অসম্ভব নিষ্ঠুর এক পাষাণ। তবু, কথার ফাঁকে ফাঁকে তার বাঁকা মন্তব্য শুনে মন খারাপ হয়ে গেলেও, মশিয়ে দো বাখনির হয়ে সাধ্যমত বোঝাবার চেষ্টা করল সে স্যার হেনরিকে তার এখন কি করা উচিত।

 আচ্ছা! সব শুনে বললেন স্যার হেনরি, তোমরা তো এখন সবরকম বিপদের ঊর্ধ্বে, তাই না? তোমাদের দুজনকেই অভিনন্দন। বুঝতে পারছি, ম্যাডাম, ওই বদমাশ দো বাখনির জন্যে তুমি এমন কাতর হয়ে তদ্বির করছ তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার কারণে। বলতেই হবে ব্যাটার কপাল ভাল!

তাহলে আপনি মেনে নিচ্ছেন ওর শর্ত? আগ্রহের আতিশয্যে এক পা এগিয়ে গেল প্রিসিলা স্যার হেনরির দিকে।

এবার আর গোঁফের আড়ালে হাসি চাপার চেষ্টা করলেন না তিনি, নরম চোখে চাইলেন প্রিসিলার দিকে। হয়তো যৌবনের কোন কথা মনে পড়ে গেছে তাঁর। চট করে ফিরলেন মেজরের দিকে। কিন্তু আপনি বোধহয় ততটা কৃতজ্ঞ বোধ করতে পারছেন না, মেজর?

আমার সব কথা সবাই ভুল বোঝে, বলল মেজর গম্ভীর কণ্ঠে, তবু আমি ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছি যে ওই লোকটার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করবার কোন কারণ আমি দেখছি না। যেটা ঠিক, তা ঠিকই; যেটা ভুল, সেটা ভুল। আমার পরিষ্কার ধারণা রয়েছে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আর কিছু না, দো বাখনি লোকটা আমাদেরকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ওদের গলাকাটা দস্যুদলে আপনার সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস আছে এমন একজনকেও পাওয়া যায়নি, তাই…।

বিশাল দেহ কাঁপিয়ে হঠাৎ হেসে উঠলেন স্যার হেনরি। হ্যাঁ, এই কথাটা আমি বিশ্বাস করি। আমার পালের ডাণ্ডার প্রতি ওদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা রয়েছে। আপনার কথাই হয়তো ঠিক, মেজর। হয়তো আপনিই ঠিক। হঠাৎ ঘুরল সে নৌ-সেনাদের তরুণ অফিসারের দিকে।

বারোজন লোক নাও, শার্পস। সাদা পতাকা নিয়ে তীরে যাও। ওই কুত্তার বাচ্চাদের গিয়ে বলল, শর্ত নিয়ে কথা বলার আগে আমি চাই পূর্ণ আত্মসমর্পণ– শুধু টম লীচেরই নয়, শয়তানের দোসর ওই বদমাশ বাখনিরও। ওই দুই বোম্বেটেকে এই জাহাজে পাওয়ার পর আমি ভেবে দেখব অন্যদের ব্যাপারে কি করা যায়। কিন্তু তার আগে নয়। ওদের আরও বোলো, আমার সবকটা কামান তাক করা রয়েছে সৈকতের দিকে। কাউকে জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে দেখলেই সব কটাকে ছররা মেরে শুইয়ে দেব। পরিষ্কার? যাও, ভাগো।

খটাশ করে বুটের গোড়ালী কে স্যালিউট করল লেফটেন্যান্ট। ওর তরুণ কণ্ঠের তীক্ষ্ণ নির্দেশ পেয়ে, এন্ট্রান্স ল্যাডারের দিকে রওনা হয়ে গেল একদল নৌ-সেনা।

হাসি ফুটেছে মেজরের মুখে। মাফ করে দিয়েছে সে রাডি মরগানকে। লোকটা কর্কশ স্বভাবের দস্যু হতে পারে, কিন্তু জানে কোন্ অবস্থা কিভাবে সামাল দিতে হয়।

সাদা হয়ে গেছে প্রিসিলার ঠোঁট, এক পা এগিয়ে এসে কাঁপা হাতে ধরল স্যার হেনরির মোটা বাহু।

স্যার … স্যার … ওর দুচোখে অনুনয়।

হাত নেড়ে অফিসারদের বিদায় দিয়ে ওর দিকে ফিরলেন স্যার হেনরি। তোমার সেবার জন্যে প্রস্তুত, ম্যাডাম।

স্যার, মেজর যা বললেন তা মোটেও সত্য নয়। আমি জানি, আমাদের এই কাজটা দিয়ে এখানে পাঠানোর আসল উদ্দেশ্য বিপদ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়া। ওঁর কাছে আমি যে কী পরিমাণ ঋণী … এত ভদ্র, এত মহৎ…

হো-হো করে হেসে উঠলেন স্যার হেনরি, তারপর গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকালেন– নাকের গোড়ায় কপালের কাছে দুটো ভাঁজ ভয়ঙ্কর অশুভ করে তুলেছে চেহারাটা।

অ্যাঁ? হ্যাঁ। তা ঠিক। মহিলাদের প্রতি সৌজন্যে এই ফরাসী বদমাশগুলো খুবই পটু, আর দো বাখনির তো কোন তুলনাই হয় না। কথাটা বলতে বলতে মেজরের দিকে ফিরে চোখ টিপলেন স্যার হেনরি।

গা ঘিনঘিন করে উঠল মেজরের। এরকম একটা অমার্জিত, অসভ্য লোক কি করে নাইটহুড বা গভর্নরশিপ পায়, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে।

আপনি ভুল বুঝেছেন, স্যার, বলল প্রিসিলা। ওঁর মত সত্যিকার একজন ভদ্রলোক

না, না, ম্যাডাম, বাধা দিলেন স্যার হেনরি। ঠিকই বুঝেছি আমি। ওই ব্যাটা বদমাশ দো বাখনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জানে বটে। ওর বয়সে আমি যা ছিলাম, তার চেয়ে ও অনেক-অনেক গুণ ওস্তাদ। ঠিকই বুঝতে পারছি আমি, নইলে আমার চামড়া ছিলে নিয়ো। বুড়ো হয়ে গেছি, মোটা হয়ে গেছি ঠিক, তবে এত চর্বির নিচে এখনও আমি একটা তরুণ হৃদয় বয়ে বেড়াচ্ছি, ম্যাডাম। বিশ্বাস করো।

বীতশ্রদ্ধ বোধ করল প্রিসিলা লোকটার প্রতি। কিন্তু সেই ভাবটা চেপে রেখে বলল, আপনি আমার কথা শুনছেন না, স্যার হেনরি। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আমার কথাগুলো একটু শুনুন।

এটুকু জেনে রাখো, ম্যাডাম, কোনও সুন্দরীর অনুরোধ হ্যারি মরগান আজ পর্যন্ত অবজ্ঞা করেনি। মনে হলো স্মৃতিচারণ করছে লোকটা, আর হাসছে মনে মনে। বলো, ম্যাডাম, কি বলবে?

মশিয়ে দো বাখনি সম্পর্কে বলছিলাম, স্যার। আমার জীবন, আমার সম্মান বাঁচিয়েছেন উনি। উনি…

আ মরো জ্বালা! তাই তো বুঝেছিলাম আমি! চোখ দুটো চকচক করছে তার, মজা পাচ্ছেন মেয়েটাকে জ্বালাতন করে।

বাধা উপেক্ষা করে বলে চলল প্রিসিলা, আমার বাবা সৎ একজন রাজ কর্মচারী ছিলেন। সেই সৎ লোকের মেয়ের জন্য তিনি যা করেছেন, সেটা কি তার বিচারের সময় বিবেচনায় রাখবেন দয়া করে?

নকল গাম্ভীর্যের সঙ্গে মাথাটা নানান ভাবে কাত করে দেখলেন তিনি প্রিসিলাকে। তারপর মনে হলো বিশাল ধড়টা আবার কেঁপে উঠতে চাইছে হাসির দমকে। বললেন, এটা তোমার হৃদয়ের দাবি, বুঝতে পারছি। আহা রে! বয়স কালে কত মেয়েরই না জীবন ও সম্মান রক্ষা করেছি, কই কেউ তো কোনদিন আমার হয়ে ওকালতি করতে আসেনি। তোমার মত একজনকেও পাইনি আমি আসলে, ম্যাডাম। ঠিক আছে, ওকে ফাঁসী দিতে হলে আস্তে করে নরম দড়িতে ঝোলাব!

কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালেন স্যার হেনরি মরগান। হাতির পা ফেলে এগিয়ে গেলেন সামনে, চিৎকার করে ডাকছেন বোসান আর গানারদের, ডাইনে-বাঁয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন লোকেদের।

.

২০.

 আত্মসমর্পণ

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল প্রিসিলা পিয়েখকে নিয়ে তীরের দিকে রওনা হলো লেফটেন্যান্ট শার্প ও তার লোকজন।

একজন অফিসার এসে জানতে চাইল মিস্ প্রিসিলা ও মেজর স্যান্ডস কি গ্রেট কেবিনে স্যার হেনরির অতিথি হবেন?

মেজর স্যান্ডস রাজি হয়ে গেল। বেশ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে এখন মেজাজ। বুঝে দেখেছে, অসন্তোষ পুষে রেখে লাভ নেই।

তাছাড়া, তার ধারণা, প্রিসিলার সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কটা কিছুটা হলেও জোড়া লেগেছে, যেহেতু দুজনেই দস্যু নাইট স্যার হেনরি মরগানের অমার্জিত ব্যবহারের শিকার। তাছাড়া ভেবে-চিন্তে দেখে মেয়েটাকে ক্ষমা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেজর। একে মেয়ে, তার ওপর অল্পবয়স, অনভিজ্ঞ; হঠাৎ করে এমন ঘটনাচক্রের আবর্তে পড়ে মাথাটা যদি ঠিক রাখতে না পারে, তাহলে ওকে দোষ দেয়া যায় না। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কেবিনে গেলে ভাল লাগবে তোমার, প্রিসিলা, বলল সে।

আপনাকে ধন্যবাদ, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল প্রিসিলা। এখানেই ভাল আছি।

যা ভাল মনে করেন, ম্যাডাম, বলে চলে গেল অফিসার।

বুলওয়ার্কে দুহাত রেখে ঝুঁকে তাকিয়ে দেখছে প্রিসিলা, দ্রুতবেগে তীরের দিকে চলেছে লং বোট। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সৈকতে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী মশিয়ে দো বাখনি। ধারে কাছেই রয়েছে বানড্রি, হ্যালিওয়েল আর এলিস। ওদের পিছনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে জলদস্যুর দল।

মেজর স্যান্ডস এসে দাঁড়াল পাশে। বলল, এমনি হঠাৎ করে বিপদ কেটে যাবে কল্পনাও করা যায়নি! কৃতজ্ঞতা আসছে আমার মনের ভিতর থেকে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল প্রিসিলা। এজন্যে আমরা চার্লস দো বাখনির কাছে ঋণী।

কথাটা মেনে নিতে না পারলেও প্রতিবাদ করে আরও অপ্রিয় না হওয়াই উচিত বলে মনে করল সে। বুঝল, অন্ধ, একগুঁয়ে হয়ে গেছে মেয়েটা, এখন উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে হবে ওর সবকিছু। দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। একমাস আগে ফোর্ট রয়াল বে-তে সেন্টরের অ্যাকোমডেশন ল্যাডার বেয়ে ওদের জীবনে অশুভ প্রভাব ফেলবার জন্যে এসে হাজির হয়েছিল যে সাক্ষাৎ শয়তান, দো বাখনি– তার খেলা শেষ। সমস্ত দুষ্কৃতির উপযুক্ত ফল পাবে সে এবার। ওরা চলে যাবে ইংল্যান্ডে। সেখানে পৌঁছলে পিছনে ফেলে আসা দুঃস্বপ্ন ভুলতে সময় লাগবে না। ও নিজেও মনে রাখবে না কিছু, তারুণ্যের সাময়িক মোহ ক্ষমা করে দেবে মন থেকে।

পৌঁছে গেল নৌকা, ঘঁাশ করে থেমে গেল বালিতে ঘষা খেয়ে। সবাই বন্দুক হাতে প্রস্তুত থাকল, একা লেফটেন্যান্ট নেমে গেল পারে।

দস্যুরা এগিয়ে এল মরগানের বার্তা শোনার জন্যে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল প্রিসিলা, স্যার হেনরির বক্তব্য শুনে প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার হলো দস্যুদলে। কিন্তু নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মশিয়ে দো বাখনি, দেখছে তার ভাগ্য কিভাবে নির্ধারণ হয়। শুধু একবার কিছুটা উত্তেজনা দেখা গেল তার মধ্যে, কয়েকটা কথা বলে ফেলল সে যখন দো বাখনির আত্মসমর্পণের দাবি পেশ করল লেফটেন্যান্ট।

যাও, মরগানকে গিয়ে বলল, এটাই যদি তার শেষ কথা হয়, তাহলে আমরা জঙ্গলে…

হ্যালিওয়েলের কনুইয়ের গুতো খেয়ে থেমে যেতে হলো তাকে। এগিয়ে এল মোটা শিপমাস্টার। রাখো! কোনও লাভ হবে না তাতে। ওসব করতে গেলে সেন্টরকে ডুবিয়ে দেবে মরগান, ঝাঁঝরা করে দেবে ব্ল্যাক সোয়ানের খোল। না খেয়ে মরা পর্যন্ত আটকে থাকব আমরা এই দ্বীপে।

দাঁড়াও! দাঁড়াও! চেঁচিয়ে উঠল বানড্রি। এত সহজে কাবু করা যাবে না আমাদের। প্রয়োজনে জাহাজ বানিয়ে নেব আমরা আরেকটা।

আমি এটুকু বলতে পারি, এবার কথা বলল লেফটেন্যান্ট, স্যার হেনরির সঙ্কল্প সহজে নড়ে না। তোমরা যদি তাঁর নির্দেশ অমান্য করো, জাহাজ দুটো তো যাবেই, একটা জাহাজ এখানে টহল দেয়ার জন্যে রেখে ফিরে যাবেন তিনি। এই মুহূর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া তোমাদের আর কোনও আশা নেই। লীচ আর দো বাখনিকে আমাদের হাতে তুলে দাও, হয়তো স্যার হেনরির করুণা লাভ করতেও পার। ওই দুজনকে তার চাই, বাধা দিলে সবাই তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।

তর্কের ঝড় উঠল। উওগান সমর্থন করল স্যার হেনরির দূতকে।

আর কি করতে পারি আমরা এছাড়া? চার্লিকে ওদের হাতে তুলে দেয়া নীতিতে বাধছে আমাদের, কিন্তু ওকে বাঁচাতে গিয়ে যদি আমরা সবাই মরে যাই, কার কি লাভ তাতে?

দুঃখজনক হলেও কথাটা সত্যি, বলল হ্যালিওয়েল।

কিন্তু বেঁকে বসল বানড্রি। স্প্যানিশ সোনার স্বপ্ন সে ভুলতে পারছে না। দো বাখনিকে রেখে দিতে পারলে এখনও হয়তো দখল করা যেতে পারে প্লেট ফ্লীট। উওগান আর হ্যালিওয়েলকে ভীতু, কাপুরুষ বলে গাল দিল সে, লেফটেন্যান্টকে বলল, কেবল লীচকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে মরগানকে। কিন্তু লেফটেন্যান্ট অনড়। তাগাদা দিল দ্রুত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার জন্যে, দর কষাকষির কোন সুযোগ নেই, জানাতে হবে হ্যাঁ অথবা না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সে ঘোষণা দিল, আর অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, জবাব না পেলে সে ফিরে যাবে এবার।

এতক্ষণে ভেঙে পড়ল ওদের মনোবল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বানড্রি বলল, তুমি তো দেখলে, চার্লি, চেষ্টার ত্রুটি করিনি আমি।

দেখলাম, গম্ভীর দো বাখনি। বুঝতে পারছি, আর কোন উপায় থাকলে আমাকে তোমরা ধরিয়ে দিতে না! বেশ, তাহলে বিদায়। রূপোর কাজ করা পরচুলা আর খাপে ভরা তলোয়ার তুলে দিল সে লেফটেন্যান্টের হাতে।

মাথা ঝুঁকিয়ে সেগুলো গ্রহণ করল লেফটেন্যান্ট। অপর একজনের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, এবার টম লীচ, প্লীজ। বলেই সচকিত ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাল লেফটেন্যান্ট। এতক্ষণে টের পেল দীর্ঘ আলোচনায় একবারও টম লীচকে দেখা যায়নি, তার মতামত জানা যায়নি।

হ্যাঁ, এবার টম লীচ, বলল বানড্রি। এক সেকেন্ড ইতস্তত করে তাকাল লেফটেন্যান্টের চোখে। জীবিত বা মৃত– এই ছিল শর্তের অঙ্গীকার।

অ্যাঁ? বলো কি? মারা পড়েছে আগেই? এতক্ষণ লাশ নিয়ে দরদাম করছিলে! তবে হ্যাঁ, শর্ত তাই ছিল, জীবিত বা মৃত।

মাথা ঝাঁকিয়ে বানড্রি রওনা হলো জটলার পিছনে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা লাশটার দিকে। মশিয়ে দো বাখনি ওর কাঁধে হাত রাখল, নিচু গলায় কিছু বলল। মুখোশের মত মুখে হাসির আভাস ফুটল, মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল সে জটলার দিকে। ধীর পায়ে ফিরে এসে নৌকায় উঠল দো বাখনি।

রয়াল মেরির লাল বুলওয়ার্ক থেকে সবই দেখল প্রিসিলা, সবই বুঝল। কান্নার মত একটা আওয়াজ বের হলো ওর কণ্ঠ থেকে। কাঁপা গলায় বলে উঠল, কাপুরুষের দল! বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ! নিজেদের চামড়া বাঁচানোর জন্যে ওরা, ওরা…

চেহারা থেকে সন্তুষ্টির চিহ্ন মুছে ফেলে, নীরস কণ্ঠে বলল মেজর, ওদের কাছ থেকে এর বেশি আর কি আশা করা যায়! টলে পড়ে যাচ্ছে দেখে চট করে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল সে প্রিসিলাকে। ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল ওকে মেইন  হ্যাচের কাছে, তারপর ওটার ঢাকনির উপর বসিয়ে দিয়ে পাশে বসে একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখল ওর কাঁধ, যেন কাত হয়ে পড়ে না যায়। ওর এই গভীর শোকে নিজের ঈর্ষাটুকু চেপে রাখতে সমর্থ হলো মেজর, কিন্তু একটি সান্ত্বনার কথা বলতে পারল না মুখ ফুটে।

এইভাবে কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারবে না প্রিসিলা, হুঁশ ফিরল হাতির পা ফেলে পাশ দিয়ে অ্যাডমিরালকে যেতে দেখে। কে যেন কোথায় বলল শার্পলস্ ফিরছে, শুনতে পেল প্রিসিলা যেন স্বপ্নের ঘোরে। জাহাজের কিনারায় দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড হাঁক ছাড়লেন স্যার হেনরি।

লীচ গেল কোথায়? ওকে আনতে পারেনি শার্প? গাধা কোথাকার! নিচে ছুটে যাও, অ্যালডার্সলি, বেঞ্জামিনকে ওর গানারদের নিয়ে তৈরি থাকতে বলো। ব্যাটাদের ঝাঁঝরা করে নরকে পাঠাব আমি! উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব কুত্তাগুলোকে! হেনরি মরগানের সঙ্গে ইয়ার্কি… বুলওয়ার্ক থেকে আর একটু ঝুঁকে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেন তিনি, এটা কি হলো, শার্পস? টম লীচ কোথায়?

এক্ষুণি এসে জানাচ্ছি, স্যার হেনরি! নিচ থেকে ভেসে এল লেফটেন্যান্টের গলা।

রয়াল মেরির গায়ে ঘষা খেয়ে থেমে গেল লং বোট। একটু পরেই ভীত, সন্ত্রস্ত চোখে দেখল প্রিসিলা উঠে আসছে মশিয়ে দো বাখনি– আসন্ন মৃত্যুর মুখেও অবিচলিত, বরাবরের মতই শান্ত; ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে এক টুকরো হাসি।

নিচ থেকে ওকে দেখেই চোখ-মুখ পাকিয়ে চেহারা ভয়ঙ্কর করে তুললেন স্যার হেনরি।

লীচ কোথায়? হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি। এর মানে কি?

 পিছন ফিরে পিয়েখের দিকে বামহাত বাড়িয়ে দিল দো বাখনি। রক্তাক্ত সেইল ক্লথে মোড়া ছোটখাট কি একটা দিল পিয়েখ ওর হাতে। একটু দুলিয়ে ছেড়ে দিল সেটা মশিয়ে দো বাখনি, ধুপ আওয়াজ তুলে পড়ল সেটা স্যার হেনরির পায়ের কাছে। ওটার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন অ্যাডমিরাল, তারপর আবার দো বাখনির দিকে।

ওর ঠিক যতটুকু আপনার দরকার ততটুকুই আছে ওখানে, বলল মশিয়ে দো বাখনি। যেটা চেয়েছিলেন আর কি। মাথা। ওটার মূল্য ঘোষণা করেছিলেন আপনি পাঁচশো পাউন্ড।

অ্যাঁ? জোরে শ্বাস ছাড়লেন স্যার হেনরি। খোদা, রক্ষে করো! আবার চাইলেন তিনি বান্ডিলটার দিকে। রক্ত বেরিয়ে এসে ডেক নষ্ট করছে। একটা পা বাড়িয়ে কাপড় সরিয়ে প্রথমে চেহারাটা দেখলেন তিনি, তারপর কষে একটা লাথি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ওটা আরেক দিকে। পাশে দাঁড়ানো লোকটাকে আদেশ দিলেন, ওটা সরাও এখান থেকে। তারপর আবার ফিরলেন দো বাখনির দিকে। নাকের গোড়ায় ভাঁজ।

অক্ষরে অক্ষরে কাজ করতে কে বলেছে তোমাকে, চার্লস?

হালকা পায়ে নেমে এল দো বাখনি।

 অর্থাৎ, স্বীকার করছেন, যা বলি তা করে দেখাতেও পারি?

 হুম! অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন মেনে নিলেন স্যার হেনরি। ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। ওদের শর্ত নিয়ে ভাবতে হবে আমার। খুলে বলো দেখি?

সব ব্যাখ্যা পেয়ে যাবেন আপনি, তবে সবার আগে এক হাজার পাউন্ড ছাড়ন।

এই না বললে পাঁচশো! চট করে মেজরকে সাক্ষী মানলেন তিনি। একটু আগে পাঁচশো পাউন্ডের কথা বলল না এই ছোকরা?

হাঁ করে চেয়ে রইল মেজর। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরলো না। প্রিসিলাও তাকিয়ে রয়েছে এদিকে, বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনাটা কি।

পাঁচশো আপনার ঘোষণা অনুযায়ী, বলল দো বাখনি। বাকি পাঁচশো বাজি ধরেছেন আপনি আমার সঙ্গে, বলেছিলেন পারব না ওর মাথা কেটে আনতে।

বলেছিলাম নাকি? বাবারে! এই ছোঁড়া দেখছি ফতুর করে দেবে আমাকে! সারা জীবন যা কামিয়েছিলাম, সব যাবে এখন এই গাঁটকাটার পকেটে!

আরও বেশি দেয়া উচিত, বলল দো বাখনি। শেষ তিনটে দিন দোজখে কাটাতে হয়েছে আমাকে। আপনি কথা মত পৌঁছতে পারেননি। এই তিনটে দিন ওই কুকুরটার অনেক অপমান আমার সহ্য করতে হয়েছে।

ওটা শোধবোধ হয়ে গেছে আজ, বললেন স্যার হেনরি। দেখলে না, কি সুন্দর ওদের হাত থেকে তোমাকে নিরাপদে বের করে আনলাম। তা, নইলে কি অবস্থা হতো চিন্তা করো। হাসলেন তিনি নিজের প্রশংসায় নিজেই। তবে হ্যাঁ। এতদিনে সত্যিই খুশি করতে পেরেছ আমাকে, চার্লস। চলো, বাপ, নিচে গিয়ে সব শুনব।

.

২১.

পাগলামি

রয়াল মেরির গ্রেট কেবিনে বসে আছে প্রিসিলা, মেজর স্যান্ডস, স্যার হেনরি মরগান আর মশিয়ে দো বাখনি। ওদের সঙ্গে রয়াল মেরির কমান্ডার মাঝবয়সী ক্যাপটেন অলড্রিজও বসেছেন।

গোটা ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত বিশদ বর্ণনা করছে মশিয়ে দো বাখনি। এখনও পাগল-পাগল লাগছে প্রিসিলার, সকাল থেকে এত রকম ধকলের পর ভাল করে বুঝতে পারছে না সব কিছু। মেজর স্যান্ডস ডুবে আছে গভীর বিষণ্ণতায়। মনে মনে কপাল চাপড়াচ্ছে, হায়, এ কি হলো! এ কি শুনছে সে, এ কী দেখছে!

একমাত্র মরগান রয়েছেন তুঙ্গে। বাজিতে পাঁচশো পাউন্ড হেরে যাওয়ার পরও। টম লীচের কারণে সরকারী চাপের মুখে বড়ই বেকায়দা অবস্থায় ছিলেন তিনি, এখন একেবারে মুক্ত বিহঙ্গের অবস্থা হয়েছে তাঁর, যখন-তখন দো বাখনির বয়ান থামিয়ে দিয়ে হা-হা করে হেসে নিচ্ছেন প্রাণ খুলে।

সেন্টর বেদখল হয়ে যাওয়ার পর দো বাখনি কিভাবে লীচকে বাগে আনল শুনে ঢালাও মন্তব্য করলেন তিনি, অনেক রকম পিশাচ দেখেছি, চার্লস। কিন্তু তোমার মত এত জঘন্য পিশাচ আর একটাও দেখিনি। হারা গেইম জিতে বসলে! মিথ্যার পর মিথ্যা সাজাতে তোমার জুড়ি নেই, এত বড় মিথ্যুক আর সৃষ্টি হয়নি খোদার দুনিয়ায়। ওদের কি দোষ দেব, গল্প শুনে আমারই ইচ্ছে করছে একদিনের পথ পেরিয়ে আক্রমণ করে বসি জাহাজ তিনটেকে, বিশ্বাস করো!

স্প্যানিশ প্লেট ফ্রীটের কথা বলছেন তো? ওটা হুট করে আসেনি মাথায়, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে সাজিয়েছি। তবে ওকে মালদিতায় এনে জাহাজ মেরামতে বাধ্য করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে।

দো বাখনির বক্তব্য শেষ হতে চেয়ারে নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করলেন ক্যাপটেন অলড্রিজ। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু একটা ব্যাপার ঠিক পরিস্কার হচ্ছে না আমার কাছে। আমরা পৌঁছে যাওয়ার পরও আপনি কেন লীচের সঙ্গে লড়াইটা করলেন? আপনি ভাল করেই জানতেন, লীচ এবার শেষ; তার পরেও নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল?

ঝুঁকি? মুখ বাঁকাল দো বাখনি। কোথায়, কিসের ঝুঁকি? বোম্বেটেদের মধ্যে তলোয়ারে ও ছিল অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু একজন তলোয়ার-যোদ্ধার কাছে ও তো নিতান্তই একজন বোম্বেটে।

সদুত্তর দিচ্ছ,না তুমি, চার্লস! বকা দিলেন মরগান।

এতক্ষণে আত্ম-সচেতন হয়ে উঠল দো বাখনি। চট করে একবার প্রিসিলার দিকে চেয়ে নিয়ে ইতস্তত করল, তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। কারণ অবশ্য ছিল। ও এমন কিছু করেছিল যা উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ব্যক্তিগত আক্রোশে পরিণত হয়েছিল ব্যাপারটা। তাছাড়া ও জীবিত থাকলে এত সহজে ওর দলটাকে বাগে পাওয়া যেত না।

 কি করতে পারত সে? একবার ফাঁদে আটকে গিয়ে…

এই ভদ্রলোক আর এই ভদ্রমহিলাকে জিম্মি করে নানান খে দেখাত সে।

প্রথমে মেজরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন স্যার হেনরি এই লোকটাকে জিম্মি করলে কার কি ক্ষতি ছিল। পরমুহূর্তে দৃষ্টি গেল তাঁর প্রিসিলার দিকে। হঠাৎ বুঝতে পেরে বিশাল হাত দিয়ে চাপড় মারলেন তিনি টেবিলে।

ওহ হো! তাই তো বলি! খোদা রক্ষে করো! এতক্ষণে বুঝেছি। ওর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে গিয়েছিলে তুমি!

আবার মোটা, কর্কশ গলায় হো-হো করে হেসে উঠলেন তিনি।

মেজর এই অমার্জিত কর্কশ আচরণে ক্ষুব্ধ বোধ করল। প্রিসিলা লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। ক্যাপটেন অলড্রিজের ঠোঁটে ফুটে উঠল মলিন একটুকরো হাসি।

একমাত্র মশিয়ে দো বাখনি বসে থাকল অভিব্যক্তিহীন মুখ নিয়ে। ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করল অ্যাডমিরালের আনন্দ কিছুটা কমে আসার জন্যে। তারপর শীতল কণ্ঠে বলল, রাজা আপনাকে নাইট করেছেন, জামাইকার গভর্নর করেছেন, কিন্তু তারপরেও, স্যার, খোদা আপনাকে যা করে পাঠিয়েছেন, সেই নিম্নরুচির জঘন্য জলদস্যই রয়ে গেছেন। আপনি। প্রিসিলা, আপনিদয়া করে এঁর কথায় মনে কিছু নেবেন না। এই কেবিনে বসলেও ওঁর আসল জায়গা হচ্ছে ফোকাসল।

চুলোয় যাক তোর বিরূপ সমালোচনা! গর্জে উঠলেন মরগান। কিন্তু হাসির দমকে কাঁপছে বিশাল ভুড়ি। গ্লাসটা তুললেন প্রিসিলার সম্মানে। রাগ কোরো না, ম্যাম। তোমাকে নিরাপদে উদ্ধার করা গেছে বলে বড় আনন্দ হচ্ছে আমার। ও, আর তোমাকেও, মেজর শোর।

মেজর স্যান্ডস, স্যার! বলল মেজর ঘাড় শক্ত করে।

ওই একই কথা, তীরেই তো থাকে ওসব, বলে তিনি হাসতেই থাকলেন।

গলা খাঁকারি দিয়ে নড়েচড়ে বসলেন ক্যাপটেন অলড্রিজ।

এবার কি আমরা কাজের কথায় আসতে পারি, স্যার হেনরি? মানে, তীরের ওই বদমাশগুলোর ব্যাপারে কি করা যায়?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, বলে দো বাখনির দিকে ফিরলেন তিনি। চার্লস, তোমার কি মনে হয়?

মশিয়ে দো বাখনির উত্তর যেন তৈরিই ছিল। প্রথমে সেন্টরে লোক পাঠিয়ে ক্ষতি যা করেছেন তা মেরামতের ব্যবস্থা করুন। ওটা আমাদের লাগবে। তারপর ব্ল্যাক সোয়ানের কামানগুলো টেনে নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে পানিতে ফেলার ব্যবস্থা করুন। সবশেষে ব্ল্যাক সোয়ানের খোলটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারি।

বোম্বেটেগুলোকে কোন শাস্তি না দিয়েই? অলড্রিজের কণ্ঠে বিস্ময়।

নানা ভাবে আঘাত পেয়ে বিতৃষ্ণার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মেজর স্যান্ডস। আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, এ হচ্ছে আরেক বোম্বেটের পরামর্শ! মশিয়ে দো বাখনি আত্মার আত্মীয় মনে করছেন ওদের, এটা পরিষ্কার– দস্যুর প্রতি দস্যুর মমতা!

গোটা কেবিন একেবারে চুপ হয়ে গেল। ধীরেসুস্থে মেজরের দিকে ঘুরলেন স্যার হেনরি মরগান। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন সোলজারের দিকে।

তোমার মতামত চেয়েছে কেউ? তুমি আচমকা কথা বলে উঠছ কেন মাঝখান দিয়ে?

চোর-ডাকাতের মুখে এরকম কড়া, ধমক– লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মেজর চেয়ার ছেড়ে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, স্যার, আমি রাজার কমিশন প্রাপ্ত

যার কমিশন প্রাপ্তই হও না কেন, গর্জে উঠলেন স্যার হেনরি। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, আমাদের কথায় নাক গলাচ্ছ কেন?

 যেহেতু আমি রাজার কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার

হয়েছে। এবার বসে পড়ো। তুমি আমাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করছ। বসো!

কিন্তু মাথা বিগড়ে গেছে মেজরের। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রাজার জাহাজে পৌঁছার পরও এসব লোকের ভুরু কোঁচকানি সহ্য করতে হবে তার? তাও প্রিসিলার সামনে? যেখানে একজন অফিসার হিসেবে উপযুক্ত সম্মান তার প্রাপ্য। বলল, আমার কথা আপনি শুনছেন না, স্যার! স্যার হেনরির মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে টের পেয়েও তোয়াক্কা করল না সে। বলে চলল, আমার অধিকার আপনি হরণ করতে পারেন না। এমন একটা প্রস্তাব আমার সামনে উত্থাপন করা হয়েছে, যার প্রতিবাদ করা একজন রাজ কর্মচারী হিসেবে আমার পবিত্র দায়িত্ব। এখুনি দো বাখনি যে প্রস্তাব দিলেন সেটা রাজার জন্যে অবমাননাকর।

চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে, কিন্তু গলার স্বর শান্ত, স্যার হেনরি বললেন, তোমার কথা শেষ হয়েছে, অফিসার?

এখনও শুরুই হয়নি, বলে কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করল সে। আজ মনের সব কথা শুনিয়ে ছাড়বে সে।

ওটা ছিল ভূমিকা, বলল মশিয়ে দো বাখনি নিচু গলায়।

দড়াম করে প্রচণ্ড একটা কিল মারলেন স্যার হেনরি টেবিলের উপর। বললেন, তোমাকে কি কেউ আজ পর্যন্ত শেখায়নি যে একজন অ্যাডমিরালের আদেশ মানতে হবে একজন মেজরের? আমার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে, নইলে একদম চুপ থাকবে।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন, স্যার।

কিছু ভুলছি না আমি! চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাডমিরাল। আমি তোমাকে তর্ক না করে বসতে বলছি। বসো! বেয়াড়াপনা করলে পুরে দেব কয়েদখানায়।

চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকল মেজর কিছুক্ষণ, কিন্তু স্যার হেনরির কুটির কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। ঝপ করে বসে পড়ল সে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে, বেয়াদবি প্রকাশ করতে তুলে দিল পায়ের ওপর পা।

স্যার হেনরি ফিরলেন দো বাখনির দিকে। হ্যাঁ, কি বলছিলে, চার্লস?

ক্যাপটেন অলড্রিজ মনে করছেন ব্ল্যাক সোয়ানের লোকগুলোকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে আমার ধারণা, এতে ভয় বা বিপদের কিছু নেই। অস্ত্র, জাহাজ আর নেতা ছাড়া ওরা সাধারণ মানুষের মতই অসহায়। যতদিনে লোকালয়ে ফিরতে পারবে, ততদিনে উচিত শিক্ষা হয়ে যাবে ওদের।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, বললেন স্যার হেনরি। একবার আড়চোখে মেজরকে দেখে নিয়ে যোগ করলেন, ওই মেজর বীচ যাই বলুক না কেন।

চেয়ারে সোজা হয়ে বসল মেজর, বলল, আপনাকে আগেও বলেছি, স্যার, আমার নাম স্যান্ডস।

অ্যাঁ? তফাৎ কি দুটোয়? বীচেই তো থাকে স্যান্ড, বীচের চেয়ে কোনদিক থেকে ভাল সেটা? উঠে দাঁড়ালেন। চলো, অলড্রিজ, আমরা কাজ করি গিয়ে। চার্লসের পরামর্শই নিচ্ছি তাহলে। ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে হলে এর চেয়ে সহজ উপায় আর নেই।

অলড্রিজ উঠে দাঁড়ালেন। স্যার হেনরি ঘুরতে গিয়েও থামলেন প্রিসিলার কাছ থেকে বিদায় নিতে। তোমার জন্যে কেবিন প্রস্তুত করার জন্যে আমি স্টুয়ার্ডকে পাঠাচ্ছি এখুনি। চার্লস, তোমার আর মেজর ডাস্টের জন্যেও।

উঠে দাঁড়িয়েছিল সবাই, মেজর সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে সৌজন্য প্রকাশ করল, কিন্তু মনে হলো মশিয়ে দো বাখনি কিছু বলতে চায়।

আপনি যদি অনুমতি দেন, স্যার হেনরি, অন্য জাহাজটায় করে আমি জামাইকায় ফিরতে চাই। যদি বলেন, আপনার হয়ে সেন্টরের চার্জ নিতে পারি আমি।

চোখ বড় করে চেয়ে রইলেন মরগান ওর দিকে, তারপর তাকালেন অন্য দুজনের দিকে। চেহারায় খুশির ভাবটা চাপতে পারল না মেজর। কিন্তু চমকে তাকিয়েছে প্রিসিলা, চেহারায় একটা দিশেহারা ভাব ফুটে উঠেছে। বিশাল গোঁফ টানলেন তিনি, তারপর শুরু করতে যাচ্ছিলেন, তোমার আবার কি- কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, চার্লস, তুমি যা ভাল বোঝ তাই করো। চলো, অলড্রিজ।

প্রায় গড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি ক্যাপটেনকে নিয়ে। মশিয়ে দো বাখনি কি বলে বিদায় নেবে ভাবছে, এমনি সময়ে উঠে দাঁড়াল প্রিসিলা। একেবারে চুপ হয়ে গেছে মেয়েটা, রক্তশূন্য, সাদা হয়ে গেছে চেহারা।

বার্ট, একটু ডেকে যাবেন কিছুক্ষণের জন্যে? বলল সে ধরা গলায়।

গদগদ ভঙ্গিতে একটা হাত বাড়াল মেজর প্রিসিলার দিকে। নিশ্চয়ই। চলো, প্রিসিলা।

মাথা নাড়ল প্রিসিলা। না, না। আপনাকে বলছি যেতে। আমি মশিয়ে দো বাখনির সঙ্গে দুয়েকটা কথা বলতে চাই, একা।

হাঁ হয়ে গেল মেজর। তুমি একা ওর সাথে কথা বলতে চাও? কি কথা? কিসের জন্যে? আমাকে খুন করলেও …

তাও কি জানতে হবে আপনার?

না, তা ঠিক নয়। কিন্তু তোমার কি মনে হয়… কিন্তু এমন কি কথা যা আমার সামনে বলা যায় না? তোমার..

আমি এমন কয়েকটা কথা বলতে চাই যার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। আপনি যাবেন?

কিন্তু তোমার কি মনে হয় না…

আমার কিছু মনে হয় না। আপনি যান তো এখন। প্লীজ যান।

দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে বলল মেজর, ঠিক আছে, তাই যদি তোমার ইচ্ছে, তাহলে যাচ্ছি। তবে কাছেই থাকছি আমি, তুমি ডাকলেই ছুটে চলে আসব।

আপনাকে ডাকার কোনও দরকার হবে না, বলল প্রিসিলা।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে গেল মেজর।

মশিয়ে দো বাখনির দিকে একবার চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল প্রিসিলা। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল দো বাখনি, মুখে কোন কথা নেই।

চার্লস! আস্তে করে ডাকল প্রিসিলা। সত্যি করে বলবে, কেন অন্য জাহাজে চলে যাচ্ছ?

পরিচয় হলো, দীর্ঘ একটা মাস কাছাকাছি আপদে বিপদে সুন্দর সময় কাটল– আর কি এটাকে টেনে লম্বা করা উচিত হতো? যেটা ঘটবেই, সেটা তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়াই ভাল।

দুজনের ব্যাপারে তুমি শুধু একাই সিদ্ধান্ত নেবে? যা মনে আসবে তাই?

সমাজ আছে না? মেজর স্যান্ডসকে জিজ্ঞেস করে দেখো…

আমার কাছে ওই লোকটা বা তার সমাজের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব নেই।

কিন্তু গুরুত্ব দিতে হয়। মৃদু হাসল দো বাখনি। তোমার মনে রাখা উচিত, মেজর স্যান্ডস যখন আমাকে বোম্বেটে, জলদস্যু, খুনে ডাকাত বলে, কথাটা মিথ্যে বলে না। আমি তো তাই-ই!

খুনে ডাকাত? তুমি?

তাই তো! আমার গায়ে মার্কা পড়ে গেছে।

কই? আমি তো কোন দাগ দেখি না? যদি দেখতাম, তাতেও কারও পরোয়া করার দরকার পড়ত না। তোমার মত ভদ্র, মহৎ, সাহসী, সত্যিকার পুরুষ আর তো চোখে পড়েনি আমার।

পড়বে। তোমার নিজের সমাজে ফিরে গেলে অনেক ভদ্র, অনেক মহৎ, অনেক সাহসী…

একটা কথা বুঝছ না কেন, চার্লস, ওদের কাউকে আমি চাই না। দো বাখনির একটা হাত তুলে নিল সে নিজের হাতে। তোমার এই গোয়ার্তুমির কারণে দুটো জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছ তুমি, চার্লস।

হাসল মশিয়ে দো বাখনি। আমার কথা তো আমি উচ্চারণ করিনি কোনদিন?

ভাবছ, তাই আর কেউ টের পায়নি?

তুমি পাগল হয়ে গেছ।

হঠাৎ করে হইনি। চিরকালই আমি তাই ছিলাম, চার্লস। যে সমাজের ভয়ে তুমি দুটো জীবন নষ্ট করতে চাইছ, কোনদিনই আমি তার তোয়াক্কা রাখিনি। বলো, সব জেনেও তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

তুমি আমাকে লোভী করে তুলছ, প্রিসিলা। তুমি যে স্বর্গের স্বপ্ন আমাকে দেখাচ্ছ…

স্বপ্ন নয়, চার্লস! আমি তোমাকে গ্রহণ করলে আমার সমাজও তোমাকে গ্রহণ করবে। আর তা যদি না করে, আমরা দুজন মিলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেব সে সমাজকে।

চোখে চোখে চেয়ে জানতে চাইল দো বাখনি, পরে পস্তাবে না তো, প্রিসিলা?

ওর বাহুডোরে ধরা দিল প্রিসিলা। কোনদিন না! দেখো তুমি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *