২. ভাগাভাগি

০৬. ভাগাভাগি

নামটা অনেকেরই জানা ছিল বলে, অথবা লোকটার শান্ত, আত্মবিশ্বাসী ভাব দেখে– কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, থমকে দাঁড়াল সবাই। নেতা উঁচু করে ধরে আছে একটা রক্তমাখা ম্যাশেটি। এই অবস্থায় জমে গেল যেন সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্যে। এমনি সময়ে সবাইকে ঠেলে এগিয়ে এল মাঝারি উচ্চতার এক লোক, চলনে তার প্যানথারের ক্ষিপ্রতা। সামনে আসতেই চিনতে পারল দো বাখনি, এসে গেছে টম লীচ।

লাল একটা ব্রীচ পরে আছে টম লীচ, বুক খোলা শার্টে রক্তের দাগ। হাতা গুটিয়ে রাখায় শক্তিশালী দুই বাহুর পেশী দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। কালো চুল ভুরুর উপর এসে পড়েছে। সরু নাকের খুব কাছে বসানো চোখ দুটোয় শয়তানী ও নীচতা। ম্যাশেটি বা ছোরার বদলে লীচের কোমরে ঝুলছে তলোয়ার– সবাই জানে, তলোয়ার-যুদ্ধে বর্তমান বিশ্বে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই।

কি হচ্ছে এখানে? বলেই থমকে গেল টম লীচ শান্ত কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী মানুষটার ওপর চোখ পড়তেই। চোখ দুটো বড় হলো, তারপর সরু হলো বিড়ালের চোখের মত। আরে! আমি কি ভুল দেখছি? আমাদের টপগ্যাল্যান্ট চার্লি না?

এক পা এগিয়ে পিস্তলের বাট থেকে হাত সরিয়ে সেটা বাড়িয়ে দিল মশিয়ে দো বাখনি টম লীচের দিকে।

ঠিক ধরেছ, দোস্ত। তবে তুমিও কম যাও না, যেখানে দরকার ঠিক সেখানেই হাজির। আমার অনেক খাটনি আর সময় বাঁচিয়ে দিয়েছ। আমি গুয়াডিলুপ যাচ্ছিলাম ওখান থেকে একটা জাহাজ আর কিছু লোক নিয়ে তোমাকে খুঁজতে বেরোব বলে। ঠিক সময় মতই আকাশ থেকে পড়েছ এই ডেকের ওপর, যেন জাদুর বলে!

বাড়ানো হাতটা ধরল না টম লীচ। আরও ছোট হলো চোখ দুটো, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়াল সামান্য নিচু হয়ে।

তোষামোদ হচ্ছে, দো বাখনি? ভেবেছ এভাবে আমাকে ভোলাতে পারবে? জানি, গালচালাকি আর ধূর্ততায় তোমার জুড়ি নেই। কিন্তু তাই বলে আমার সঙ্গেও? টম লীচকে ঘোল খাওয়াবে এত চালাক তুমি হওনি এখনও, চার্লি। বার দুই আপাদমস্তক চোখ বুলাল সে দো বাখনির ওপর। তোমার সর্বশেষ খবর জানি, মরগানের সঙ্গে আছ তুমি। ওর ডান হাত হিসেবে ওরই সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি আমাদের সবার সাথে।

যেন মজা পাচ্ছে, এমনি ভঙ্গিতে মিটি মিটি হাসল দো বাখনি। তা ঠিকই বলেছ একরকম। ওর পার্শ্বচরদের দুটোর যে-কোনও একটা বেছে নেয়ার সুযোগ দিয়েছিল ও হয় আমার সঙ্গে থাকো, নয়তো ঝুলে পড়ো ফাসীর দড়িতে। ওর হাতের মুঠোয় যতক্ষণ ছিলাম, ওর কথাতেই নাচতে হয়েছে আমাকে। যদি মনে করে থাক স্বেচ্ছায় আমি ওর কথায় নেচেছি, তাহলে বলতে হবে দো বাখনিকে আজও চিনতে পারনি তুমি। বিশ্বাস করো, প্রথম সুযোগেই কেটে পড়েছি আমি তোমার সঙ্গে যোগ দেব বলে।

আমার সঙ্গে যোগ দিতে? আ-মা-র সঙ্গে! আমার প্রতি, এত ভালবাসা তোমার, কই, কোনদিন তো টের পাইনি!

টিটকারী গায়ে মাখল না দো বাখনি। ভালবাসা জন্মায় প্রয়োজন থেকে। বিশ্বাস করো, টম, এই মুহূর্তে তোমাকে আমার ভয়ানক প্রয়োজন। আর এটাও জেনে রাখ, খালিহাতে আসিনি আমি। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কত টাকার ব্যাপার! স্বপ্নে হয়তো এক– আধবার এই পরিমাণ সম্পদ দেখে থাকতে পার, কিন্তু জাগরণে কোনদিন না। বিরাট ব্যাপার, টম। আমার একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। আমি যে-কাজে নেমেছি, বর্তমানে একমাত্র তোমারই আছে সে-কাজটা উদ্ধার করার সাহস, মোগ্যতা আর লোকবল। তাই চলেছিলাম তোমার কাছে।

এক পা এগিয়ে এল টম লীচ, তলোয়ারটা বেতের মত করে বাঁকিয়ে ধরা। কিসের সম্পদের কথা বলছ তুমি?

স্বর্ণ! সোনা-রূপার নৌবহর। এক মাসের মধ্যেই রওনা হবে।

টম লীচের অবিশ্বাসী, চঞ্চল দুই চোখে ঝিলিক দিল লোভ। কোত্থেকে?

হেসে উঠল দো বাখনি, মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। এখন নয়। পরে আলাপ করা যাবে এ নিয়ে।

বুঝলি লীচ। কিন্তু অনুচরদের সামনে ওর প্রশ্নের না-সূচক জবাব আসায় রেগেও গেল। আরও অনেক স্পষ্ট ভাবে জানতে হবে আমার।

 নিশ্চয়ই। আরও অনেক কিছুই জানানো হবে তোমাকে। তা নইলে তুমি রাজি হবে কেন?

মেজর স্যান্ডসের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ প্রিসিলাকে দেখতে পায়নি দস্যুটা। হঠাৎ মেজর একটু নড়ে উঠতে ওর চোখ পড়ল মেয়েটার ওপর। মুহূর্তে অশুভ কি যেন ছায়া ফেলল ওর চোখে-মুখে, সেই সঙ্গে নগ্ন লালসা। কে? কে এরা? কে ওই ডানাকাটা পরি?

এগোতে যাচ্ছিল, ওর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল দো বাখনি।

আমার স্ত্রী আর তার ভাই। গুয়াডিলুপে নিয়ে যাচ্ছিলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করবে বলে।

বোকা মেজর গলা পরিষ্কার করল এই ডাহা মিথ্যার প্রতিবাদ করবে বলে, কিন্তু সেটা টের পেয়ে ওর হাতে জোরে চাপ দিল প্রিসিলা।

তোমার বউ! মনে হলো দস্যুটার মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল কথাটা শুনে। আমি কোথাও কোনদিন শুনিনি বিয়ে করেছ তুমি!

হঠাৎ হয়ে গেল। জামাইকায়। যেন কথার ওখানেই শেষ, এমনি ভঙ্গিতে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। এবার আমাদের ব্যবসায়িক কথাবার্তাগুলো সেরে ফেলার আয়োজন করতে হয়, টম।

কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইল টম লীচ ফরাসী লোকটার দিকে। যোদ্ধার হাতে থাকত এ জাহাজটা, কিংবা ধরো, আমার হাতেই থাকত জাহাজের ভার, তাহলে তোমরা এ জাহাজে ওঠা তো দূরের কথা,কাছেই ভিড়তে পারতে না।

পারতাম না, তাই না? দারুণ চালাক লোক, কি বলো, উওগান? তোমার ধারণা, আমার চেয়েও ভাল যোদ্ধা তুমি? খুব একটা বিনয়ের পরিচয় দিচ্ছ না, চার্লি।

মাথা নাড়ল দো বাখনি। আমি হলে তোমাদের মোকাবিলার জন্যে দাঁড়াতাম না। তোমার জাহাজে যে পরিমাণ জঞ্জাল জমেছে, মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিলেই বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেত আমাদের, কোনদিন আর ধরতে পারতে না এ জাহাজ। অনেক বেশিদিন পানিতে আছ তোমরা, টম, জাহাজটা আর চলার যোগ্য নেই।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ লীচ দো বাখনির মুখের দিকে। তারপর বলল, দেখার চোখ আছে তোমার। সত্যিই। জাহাজের তলার জঞ্জাল ঠিকই আন্দাজ করেছ।

এক বোতল রাম, একটা পাত্রে তামাক, গোটা কয়েক পাইপ আর তিনটে মদ্যপানের পাত্র সাজিয়ে দিল পিয়েখ টেবিলের উপর। তারপর পিছিয়ে দাঁড়াল যে যা চাইবে এগিয়ে দেয়ার জন্যে।

মদ ঢেলে নিল ওরা। উওগানও বসে পড়ল টেবিলের একধারে; পাইপ ধরাল দো বাখনির দেখাদেখি। তামাক নিল না টম লীচ।

এবার শোনা যাক, কিসের নৌবহরের গল্প যেন বলছিলে?

গল্প বেশি বড় না। মাসখানেকের মধ্যে কাদিজ রওনা হবে তিনটে স্প্যানিশ জাহাজ। তিরিশ কামানের গ্যালিয়নটায় থাকবে ট্রেজার, বিশ কামানের দুটো ফ্রিগেট পাহারা দেবে ওকে দুপাশ থেকে। একটা জাহাজে যতটা ঐশ্বর্য তোলা সম্ভব তার চেয়েও বেশি আছে ওটায়। সোনা আর রূপায় মিলিয়ে যা আছে তার দাম হবে কমপক্ষে পাঁচ লাখ পিসেস অভ এইট প্রাচীন স্প্যানিশ মুদ্রা, প্রতিটির মূল্য এক ডলারের আট ভাগের এক ভাগ, এছাড়াও রয়েছে কয়েক বস্তা রিও ডি লা হাচার মুক্তা।

পাইপে টান দিতে ভুলে গেছে উওগান। দুজনেরই চোয়াল ঝুলে পড়েছে নিচে। এত বিশাল সম্পদের কথা কল্পনাও করতে পারে না ওরা। কথা যদি সত্য হয়, ক্যাপটেন ও মেট হিসেবে ওদের ভাগে যা পড়বে তাতে সারাজীবন আর রোজগার না করলেও চলবে– বিরাট ধনী হয়ে যাবে ওরা। প্রথমে মুখ বন্ধ করল লীচ, গোটা কয়েক অশ্লীল খিস্তি ঝাড়ল, তারপর সোজা-সাপ্টা বলল, বিশ্বাস করলাম না। আমাকে নরকে পাঠালেও বিশ্বাস করতে পারব না এই গাঁজাখুরি গল্প।

আমিও না, বলল উওগান। কসম খোদার!

তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল মশিয়ে দো বাখনির ঠোঁটে। আগেই তো তোমাদের বলেছি, স্বপ্নে এক-আধবার হয়তো দেখে থাকতে পার, কিন্তু জাগরণে এত টাকার কথা কল্পনাও করতে পারবে না তোমরা। তবে যা বলছি তা সত্য। এখন হয়তো টের পাচ্ছ, কেন আমি গুয়াডিলুপে চলেছিলাম একটা জাহাজ সংগ্রহ করে তোমাকে খুঁজে বের করে সাহায্যের অনুরোধ করব বলে? কপাল ভাল আমাদের– তার কারণ, অনেক সময় বেঁচে গেল আমার; তোমাকেও পেয়ে গেলাম, সেই সঙ্গে একটা জাহাজও। এটা ব্যবহার করতে পারব আমরা আক্রমণের সময়।

বিশাল ধন-সম্পদের কথায় মনের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে দস্যুদের, টের পেল না, এই দুটো কথার কোনটার পিছনেই অকাট্য কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি দো বাখনি, একটা কথাকে দাঁড় করিয়েছে অপরটার পরিপূরক হিসেবে। কিন্তু লোভে ঘোলা হয়ে গেছে ওদের বুদ্ধি। চেয়ারটা আরও কাছে টেনে নিল টম লীচ, দুই কনুই রাখল টেবিলের উপর।..

এবার আর একটু ভেঙে বলো দেখি। তুমি কি করে জানলে.এই খবর?

দৈবক্রমে। এই যেমন তোমাকে পেয়ে গেলাম দৈবাৎ। মনে হচ্ছে দেবতাদের আশীর্বাদ আছে আমাদের ওপর, টম। শোনো, বলছি। চমৎকার একটা ফাঁক-ফোকরহীন, বাস্তবভিত্তিক কাহিনী শুরু করল এবার দো বাখনি।

মাসখানেক আগে কেম্যান্স্ আইল্যান্ড থেকে ফিরছিল সে হেনরি মরগানের সঙ্গে। টম লীচের খোঁজে ওদিকে গিয়েছিল মরগানের ফ্ল্যাগশিপ, দো বাখনি ছিল সঙ্গের দুটো ফ্রিগেটের একটার দায়িত্বে। সারারাত তুমুল ঝড় বয়ে যাওয়ার পর এক সকালে ওরা দেখতে পেল গ্র্যান্ড কেম্যানের পাঁচ কি ছয় লীগ (এক লীগে তিন মাইল দক্ষিণে কোনও মতে কাত হয়ে ভেসে আছে একটা হালকা জাহাজ, তলিয়ে যাবে খানিক বাদেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে নাবিকদের উদ্ধার করে ওরা, তুলে নেয় জাহাজে। জানা গেল লোকগুলো স্প্যানিয়ার্ড। ওদের মধ্যে এক ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো খুবই উঁচু পদের অফিসার। ভদ্রলোকের নাম ওজেডা– হিসপ্যানিওলা পৌঁছানোর জন্যে ভয়ানক উদগ্রীব মনে হলো তাকে। রূপটা ওইদিকেই যাচ্ছিল, ঝড়ে পড়ে দিক হারিয়ে চলে এসেছে এদিকে। মারাত্মক আহত ছিল ভদ্রলোক। মাস্তুল ভেঙে পড়ায় চোট পেয়েছিল মেরুদণ্ডে। লোকটা শারীরিক যতটা কষ্ট পাচ্ছিল, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্ট পাচ্ছিল মানসিক ভাবে– সান ডোমিঙ্গোর স্প্যানিশ অ্যাডমিরালের জন্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে চলেছে সে, সেটা পৌঁছানোর আগেই যদি মরে যায়, সেই আশঙ্কায়।

বার্তাটা যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার, দারুণ কৌতূহল হলো। ওকে বললাম, আমাকে যদি ও বিশ্বাস করে বার্তাটা বলে, কিংবা একটা চিঠিতে যদি সেটা লিখে দেয়, আমি ওটা অ্যাডমিরালের হাতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিতে পারি। কিন্তু সে প্রস্তাব লোকটা এতই জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করল যে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল শতগুণ।

কিন্তু চিঠির কথাটা ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। সেই দিনই কয়েক ঘণ্টা পর মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে টের পেয়ে আমাকে খবর দিল লোকটা। অনুরোধ করল, ডুবে যাওয়া জাহাজের ক্যাপটেনকে যেন ডেকে পাঠাই, আর যেন একটু কালি-কলমের ব্যবস্থা করি। ব্যবস্থা করে দিলাম সব। তখনও জানি না, শিক্ষিত, চতুর ভদ্রলোক চমৎকার এক কৌশল আবিষ্কার করেছে। এমন এক চিঠি লিখল ভদ্রলোক যেটার মর্মোদ্ধার করা সাধারণ কোনও নাবিকের পক্ষে স্রেফ অসম্ভব। নাবিকদের বেশিরভাগই নিজের মাতৃভাষাও পড়তে পারে না। ল্যাটিন ভাষায় অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে লোকটা ক্যাপটেনকে দিয়ে এমন এক চিঠি লেখাল, যার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বুঝল না লেখক নিজেও। চমৎকার বুদ্ধি, কাজ হওয়ার কথা শতকরা একশো ভাগ, কিন্তু ওরা তো আর জানে না কতখানি কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।

সন্ধ্যায় মারা গেল ভদ্রলোক। নিশ্চিন্ত মনে চলে গেল পরপারে তার দায়িত্ব সে পালন করেছে।

সেই রাতেই একটা দুঃখজনক দুর্ঘটনায় কি করে যেন জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে হারিয়ে গেল সেই স্প্যানিশ ক্ষুপের ক্যাপটেন। গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটার কথা আর কেউ জানত না বলে ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কোন হৈ-চৈ হলো না। বেচারা কোন দুর্ঘটনায় পড়তে পারে মনে করে আগেই অবশ্য ওর বুটের লাইনিঙের ভিতর থেকে লুকানো চিঠিটা হাতিয়ে নিয়েছিলাম আমি।

গল্পের এই পর্যায়ে এসে শ্রোতাদের প্রশংসা গ্রহণ করবার জন্যে থামতে হলো মশিয়ে দো বাখনিকে। খুন শব্দটা একটিবারও উচ্চারণ না করেও ফ্রেঞ্চম্যানের হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি শুনে খুবই মজা পেল ওরা, হো-হো করে হেসে উঠল দুই দাগী ডাকাত, অকুণ্ঠ প্রশংসা করল দো বাখনির। মৃদু হেসে মাথা পেতে নিল সে প্রশংসা। তারপর এগিয়ে গেল তার গল্প নিয়ে।

তখনই টের পেলাম চালাকিটা। আমি অশিক্ষিত নই, এক সময় ল্যাটিন আমার ভালই জানা ছিল। কিন্তু সমুদ্রে এলে এসব কারও মনে থাকার কথা নয়। তাছাড়া, ওই লোকটার ল্যাটিন ছিল খুবই উঁচু দরের। কয়েকটা রোমান সংখ্যা আর এক আধটা শব্দ ছাড়া প্রায় কিছুই বুঝলাম না। তবে এক সপ্তাহ পর পোর্ট রয়ালে একজন পরিচিত ফরাসী যাজকের কাছ থেকে বার্তাটা অনুবাদ করিয়ে নিলাম।

কয়েক মুহূর্ত শ্রোতাদের আগ্রহী মুখের দিকে চেয়ে থাকল দো বাখনি, তারপর বলল, আমি কিভাবে জানতে পেরেছি শুনলে। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম, বুড়ো মর্গানকে ছাড়তে হবে এবার আমার, ইংরেজ সরকারের চাকরিটাও। কিন্তু এ-ও বুঝলাম, যে-কাজে হাত দিতে চাই, সেটা সুষ্ঠুভাবে করতে হলে একা পারব না, আমার সাহায্য দরকার। কাজেই মরগানকে বললাম, বহুদিন সমুদ্রে থেকে এখন দেশে ফেরার জন্যে প্রাণটা আমার কাদাকাটি করছে। কোনও সন্দেহ না করেই ছেড়ে দিল আমাকে মরগান। আমি জানতাম গুয়াডিলুপে এখনও খোঁজ করলে কিছু সাহসী লোক পাওয়া যাবে, আর আরও একটা জাহাজ সঙ্গে থাকলে তোমার কাজে অনেক সুবিধে হবে। তাছাড়া, ওখানে তোমার খবর পাওয়া যাবে, তাও জানতাম। তুমি যে ইদানীং ওখানেই লুটের মাল বিক্রি করছ এ-খবর অবশ্য মরগানেরও জানা আছে।

কথা থামিয়ে রামের পাত্রে চুমুক দিল মশিয়ে দো বাখনি।

নড়ে উঠল লীচ, টেবিলের উপর থেকে কনুই সরিয়ে নিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝলাম। এবার শোনা যাক আসল তথ্যটা।

এরই মধ্যে বলেছি। বিপুল সম্পদ নিয়ে প্লেট ফ্লীট কাদিজের পথে রওনা হবে মাসখানেকের মধ্যে, আয়ন বায়ুটা ঠিকমত চালু হলেই। চিঠিতে সম্পদের বর্ণনা দেয়া হয় স্প্যানিশ অ্যাডমিরালকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে, যাতে গুরুত্বটা সঠিকভাবে অনুধাবন করে দুটো যুদ্ধ জাহাজ তৈরি রাখেন তিনি ওটাকে পাহারা দিয়ে সমুদ্রের ওপারে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। এই হলো গোটা ব্যাপার।

গোটা ব্যাপার? কী বলছ তুমি? খেঁকিয়ে উঠল লীচ। কোথা থেকে ছাড়বে ওটা তা বুঝি কোন ব্যাপারই নয়?

মুচকে হাসল মশিয়ে দো বাখনি। তামাকের বাক্সটা টেনে নিয়ে বলল, ধরে নাও, কামপিচ থেকে ত্রিনিদাদ-এর মধ্যে কোনও এক জায়গা থেকে।

ভুরু কুঁচকে মুখ কালো করে ফেলল দস্যু। তার চেয়ে বলো, উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর মধ্যে কোনও এক জায়গা থেকে! রেগে গেছে সে। তুমি বলতে চাও তুমি জান না? না জানলে তোমার বাকি তথ্যের কি দাম?

হাসিটা আরও একটু বিস্তৃত হলো মশিয়ে দো বাখনির ঠোঁটে। নিশ্চয়ই জানি। ওটাই তো আমার গোপন কথা। ওই তথ্যই তো বিনিময় করতে চাইছি তোমাদের সঙ্গে। দস্যুদুজনের কুটি উপেক্ষা করে ধীর-স্থির ভঙ্গিতে পাইপ ধরাল দো বাখনি। ওর ব্যাপার-স্যাপার দেখে হাঁ হয়ে গেছে দুজনই। আর একটা কথা, বলল সে। আমি যতদূর জানতে পেরেছি, দুশো, বড়জোর আড়াইশো লোক থাকবে ওদের জাহাজে। আমাদের এই দুটো জাহাজ নিয়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করলে ওরা সামাল দিতে পারবে না।

ও নিয়ে ভাবছি না। আমি যেটা জানতে চাই, এবং এই মুহূর্তে, সেটা হলো কোথায় খুঁজব আমরা এই নৌবহরকে।

সেটা তোমার জানার কি দরকার? মাথা নাড়ল দো বাখনি। আমি তো সশরীরে থাকছিই। চুক্তিপত্রে সই হয়ে গেলে আমিই ঠিক জায়গায় নিয়ে যাব তোমাদের পথ দেখিয়ে।

তোমার ধারণা, আমরা চুক্তিপত্রে সই করতে চলেছি, তাই না?

তা না করলে তোমাকে বোকাই বলব আমি, টম। জীবনে তোমার কখনও এত বিপুল সম্পদ হাতানোর এমন সুযোগ আর আসবে না।

তুমি কি ভেবেছ তোমার কথায় চোখ-কান বাঁধা অবস্থায় আমি ঝাঁপিয়ে পড়ব?

চোখ-কান বাঁধার কোনও ব্যাপার নেই এতে। যেটুকু জানা দরকার তার সবই তুমি জেনেছ। তোমার যদি আপত্তি থাকে, বা মুরোদে না কুলায়, বেশ তো. গুয়াডিলুপে নামিয়ে দাও আমাকে। আমার কোনও সন্দেহ নেই ওখানে আমি…

দেখো, বাখনি, মুরোদ যে আমার যথেষ্ট আছে, তা ভাল করেই জান তুমি। আর এটাও তোমার জানা থাকা দরকার যে মানুষের মুখ খোলানোরও অনেক কায়দা আমার জানা আছে। বহু মানুষের ছাল ছাড়িয়েছি আমি। নাকি পায়ের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত কাঠি তোমার বেশি পছন্দ?

নাক উঁচু করে তিরস্কারের ভঙ্গিতে চাইল ওর দিকে দো বাখনি।

তুমি একটা ফালতু লোক, টম! আমি অতি ধৈর্যশীল মানুষ না হলে এই কথার জন্যে ঠিক গুলি করতাম তোমাকে।

 কি বললে? ফোঁস করে উঠল লীচ, মুহূর্তে তলোয়ারের বাঁটে চলে গেছে দস্যুর হাত।

সেটা দেখেও না দেখার ভান করল দো বাখনি। কি করে ভাবতে পারলে আমার মুখ খোলানো সম্ভব? আবার একবার ছাল ছাড়ানো কথা বলে দেখ, ছালই শুধু ছাড়াতে পারবে, ওই সম্পদের একটা পয়সাও হাতে পাবে না। তোমাকে আমার প্রয়োজন আছে, বলেছি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন আমাকে তোমার। এবং এটা শুধু তোমাকে পথ দেখিয়ে ওই জাহাজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই নয়। তোমাকে তো বলেছি, আরেকটা জাহাজ সংগ্রহ করতে চলেছিলাম গুয়াডিলোপে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেন্টর আমাদের হাতে এসে যাওয়ায় তার আর দরকার নেই। কিন্তু উপযুক্ত লোক চাই সেন্টরকে পরিচালনার জন্যে। আমিই সেই লোক। তুমি জান, দক্ষ, সাহসী যোদ্ধা হিসেবে তোমার চেয়ে খুব একটা পিছনে ছিলাম না আমি। এখনই ভেবে দেখো, বিপুল সম্পদ অর্জন করে এই সমুদ্র-জীবন থেকে অবসর নেয়ার এই সুযোগ তুমি গ্রহণ করতে চাও কিনা। নাকি মরগানের গোলা খেয়ে ডুবে মরার। জন্যে আরও কিছুদিন থাকতে চাও পানিতেই? কয়েক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে বলল, বলো, ক্যাপটেন, আমরা কি প্রাপ্তবয়স্ক, বুদ্ধিমান লোকের মত চুক্তির শর্ত নিয়ে আলাপ করব এখন?

নড়ে উঠল উওগান, জিভ দিয়ে ঠোঁট, ভিজিয়ে কথা বলে উঠল। কসম খোদার, ক্যাপটেন। চার্লির সব কথা শুনে তো ওকে অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না। ও যা চাইছে, ওর অবস্থায় তুমি হলেও কি ঠিক তাই চাইতে না?

ব্ল্যাক সোয়ানের মেটকে বাগে আনা গেছে বুঝতে পেরে পিছনে হেলান দিয়ে বসে পাইপ টানায় মন-প্রাণ ঢেলে দিল দো বাখনি। বিপুল ঐশ্বর্যের টোপ গিলে নিয়েছে উওগান। এই সুবর্ণ সুযোগ যাতে হারাতে

হয়, সেজন্যে প্রয়োজনে টম লীচের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে ও সাধ্যমত। ইতোমধ্যেই নিজের মতামত জানিয়ে দিয়েছে সে দস্যু-সর্দারকে।

তা তোমার চুক্তির শর্তটা কি শোনা যাক, বিরস কণ্ঠে বলল লীচ।

আমার জন্যে পাঁচ ভাগের এক ভাগ। সম্পদের দখল পাওয়া মাত্র।

কি বললে! চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লীচ। একরাশ কুচ্ছিত গালি-গালাচ বর্ষণ করল ফ্রেঞ্চম্যানের উদ্দেশে, তারপর ঝট করে ফিরল উওগানের দিকে, এই তোমার যুক্তিযুক্ত লোক, উওগান?

সোনা, রূপা আর মুক্তা মিলিয়ে কমপক্ষে দশ লাখ পিসেস অভ এইট দাম হবে এ-সম্পদের। আর এ জিনিস এমন কোন মাল নয় যে গুয়াডিলুপে নিয়ে গিয়ে তোমার বেচতে হবে দশভাগের একভাগ দামে।

এবার শুরু হলো দর কষাকষি। ঝগড়া বেধে যাওয়ার উপক্রম হলেই মধ্যস্থতা করছে উওগান। সে বুঝে গেছে, সম্পদটা হাতের মুঠোয় আনতে হলে এখন শান্তি বজায় রাখতে হবে যেমন করে হোক। অবশেষে অনেক টানাহেঁচড়ার পর সমঝোতায় এল ওরা।

কাগজ, কলম, কালি আনা হলো। পিয়েখকে পাঠানো হলো সবার প্রতিনিধি হিসেবে ডেক থেকে তিনজনকে ডেকে আনতে।

জলদস্যুদের নিয়ম অনুযায়ী লিখে ফেলা হলো চুক্তির শর্ত, নেতাদের সঙ্গে প্রতিনিধিরাও সই করল চুক্তিপত্রে।

কাজ সেরে অনুচরদের নিয়ে বেরিয়ে গেল লীচ, বড় কেবিনে একা বসে রইল দো বাখনি।

বাইরে বেরিয়ে লীচের সব রাগ গিয়ে পড়ল উওগানের উপর। ওর ধারণা, দরদামে ঠকে গেছে সে মেটের অতি আগ্রহের কারণে। ফলে তার বিরূপ মন্তব্য আর টিটকারীর লক্ষ্যে পরিণত হলো উওগান।

হয়েছে, ক্যাপটেন, শেষমেষ বলল উওগান। একটা গুরুত্বহীন বিষয়ে অনেক বেশি চেতে উঠছ তুমি। ও যদি অর্ধেক চাইত, আমি তাতেও রাজি হতাম, সই করতাম চুক্তিতে। রাজি হওয়া মানেই তো আর দিয়ে দেয়া নয়।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লীচ। চারপাশে লাশ আর রক্ত, কিন্তু সেদিকে লক্ষ নেই। লম্বা আইরিশম্যানের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল সে। উওগানও তাকিয়ে আছে ক্যাপটেনের দিকে, মুখে হাসি। প্লেট ফ্লীটের সমস্ত সম্পদ যখন আমাদের  হ্যাচের নিচে চলে আসবে, তখন নাহয় চার্লি সাহেবের সঙ্গে আরেকবার বসে কথা বলে নেয়া যাবে। তখন হয়তো আরও বুদ্ধি-বিবেচনার পরিচয় দেবে লোকটা। আর তা না দিলেই বা কি? দুর্ঘটনায় মানুষ মারা পড়ে না? তুমি তো ওই ডানাকাটা পরিটাকে এক পর্যায়ে কেড়েই নেবে– তাই না? মাই গড, ক্যাপটেন! কী জিনিস! ওর দিকে কিভাবে তাকিয়ে ছিলে তুমি দেখেছি আমি, তবে তোমাকে একটুও দোষ দিতে পারিনি।

ক্যাপটেনের ছোট ছোট চোখে ঝিলিক দিল অশুভ কি যেন।

ফরাসীদের একটা প্রবাদ আছে : অপেক্ষা করতে জানলে সবকিছুই আসবে তোমার কাছে। আসল কথা হলো, ক্যাপটেন, অপেক্ষা।

বেশ। চেষ্টা করে দেখব। গম্ভীর ক্যাপটেন লীচ। মনে হচ্ছে, একগাদা চামড়াই শুধু নয়, আরও কিছু দখল করেছি আমরা আজ।

.

০৭.

টপগ্যাল্যান্ট

খাপসহ পিস্তল আর তলোয়ার খুলে পিয়েখকে দিল মশিয়ে দো বাখনি। সাজসজ্জার অংশ হিসেবে এগুলো ঝুলিয়েছিল সে। কাজ হয়ে যেতেই ওগুলো বিদায় করে হালকা হয়ে নিল।

এবার কেবিনের দরজা খুলে ডাকল সহযাত্রীদের।

চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে দুজনেরই। প্রিসিলার ভয়ে, আর মেজরের অক্ষম রাগে।

আমরা জানতে পারি, আমাদের নিয়ে এবার কি করবেন বলে ঠিক করেছেন? বিরস কণ্ঠে জানতে চাইল মেজর।

একটু খেয়াল করলে ওর অবসন্ন ভাব দেখে ওরা বুঝতে পারত কিছুক্ষণ আগে কি চাপ গেছে দো বাখনির ওপর দিয়ে। এ মুহূর্তে এই কৈফিয়ত তলব অসহ্য ঠেকল ওর কাছে। তাই বলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাল না সে। মেজরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরল। এটুকু জানবেন, আমার সাধ্যমত ভালই করব আমি।

কারণ? মেজর স্যান্ডস উপেক্ষায় দমবার পাত্র নয়। আপনার পরিচয় যা জানা গেল, আপনি আমাদের ভাল করতে যাবেন কি কারণে?

ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল দো বাখনি। বুঝতে পারছি আপনারা আড়ি পেতে শুনেছেন সব। আমি যাই হই না কেন, তার পরেও আপনাকে এবং মাদামোয়াযেলকে আমি আশ্বাস দিতে চাই, আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দো বাখনির দিকে চাইল প্রিসিলা। ওই লোকটাকে যা বললেন, সব সত্যি? সত্যিই আপনি ওদের দলে যোগ দিচ্ছেন?

উত্তর দিতে যথেষ্ট সময় নিল মশিয়ে দো বাখনি। তারপর নরম সুরে বলল, আপনার প্রশ্ন থেকেই বোঝা যাচ্ছে আপনার মনে সন্দেহ আছে। আপনার ধারণা, এমন কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এটাকে আমি আপনার তরফ থেকে পাওয়া বিরাট একটা সম্মান হিসেবে গ্রহণ করছি। আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু সবিনয়ে জানাচ্ছি, হয়তো এর যোগ্য আমি নই।

তাহলে ক্যাপটেন ব্র্যানসামের অনুরোধে আপনি যে গান-ডেকের ভার নিলেন, যুদ্ধ করলেন, সব মিথ্যে, ভান?

যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তাই তো মনে হয়, কাঁধ ঝাঁকাল সে। অকাট্য প্রমাণের বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। তবে একটা বিষয় লক্ষ করতে অনুরোধ করব, সাময়িক ভাবে হলেও ক্যাপটেন লীচ আর তার দস্যুদলের হাত থেকে আপনাদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা আমি করেছি। একজন জলদস্যুর কথায় যদি আপনার পক্ষে আস্থা রাখা সম্ভব হয়, তাহলে জানবেন, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি আপনি যাতে ভালভাবে ইংল্যান্ডে পৌঁছতে পারেন। দুঃখের বিষয়, এখুনি সেটা সম্ভ নয়, দেরি হবে, হয়তো কিছুটা কষ্টও হবে আপনার। তবে আমার বিশ্বাস, তার বেশি কিছু নয়। আপনার কেবিনে নিশ্চিন্তেই থাকতে পারবেন এখন, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।

কথাটা শেষ করেই ডেকের দিকে পা বাড়াল দো বাখনি।

গ্যাঙওয়েতে একটা মৃতদেহের সঙ্গে হোঁচট খেতে গিয়ে কোনমতে সামলে নিল সে। ঝুঁকে দেখল, নিগ্রো স্টুয়ার্ড স্যাম। বড় কেবিনে ঢোকার সময় ওকে এখানে মেরে রেখে গেছিল ওরা। বেঁচে আছে কি না পরীক্ষা করেই সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।

জাহাজের মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে আছে লীচের চারজন অনুচর সহ সেন্টরের নিহত যোদ্ধাদের লাশ। গোটা ডেক রক্তে মাখামাখি।

কম্প্যানিয়নের গোড়ায় পড়ে রয়েছে ক্যাপটেন ব্র্যানসামের লাশ। কোয়ার্টারডেকে যাওয়ার পথে দেহটা ডিঙাতে হলো তাকে। বেচারা এই তো গত রাতেই বলছিল, এটাই তার শেষ সমুদ্রযাত্রা! ঠিক যখন সারাজীবনের কঠোর, সৎ পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে যাবে, ঠিক তখনই ঘটল এই মর্মান্তিক বিপর্যয়। একটা দীর্ঘশ্বাস, উঠে আসছিল বুকের ভিতর থেকে, সচেতন হয়ে চাপল সেটা দো বাখনি, চেহারা দেখে কিছুই বুঝবার উপায় নেই।

মেইন  হ্যাচের কাছে একটা জটলা। ওকে দেখেই কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, টপগ্যাল্যান্ট [উপর থেকে তৃতীয় পাল]! ওই যে টপগ্যাল্যান্ট।

বোঝা গেল, সবাই সব খবর জেনে গেছে। কারও জানতে বাকি নেই ও কে এবং কোথায় নিয়ে চলেছে ওদেরকে।

ওকে দেখতে পেয়ে ফোকাল থেকেও কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল ঠাট্টার ছলে বন্ধুবান্ধবদের দেয়া টপগ্যাল্যান্ট নাম ধরে। একটু থেমে হাত নাড়ল দো বাখনি সবার উদ্দেশে।

কোয়ার্টারডেকে উঠে এসে ও দেখল, লীচের তত্ত্বাবধানে আটকে যাওয়া জাহাজ দুটোকে ছাড়িয়ে আলাদা করার কাজে ব্যস্ত সবাই।

চুক্তিপত্র অনুযায়ী কথা ছিল, সেন্টরের দায়িত্বে থাকবে দো বাখনি, ব্ল্যাক সোয়ান থেকে দক্ষ কয়েকজন নাবিক চলে আসবে এই জাহাজে। ফ্রেঞ্চম্যানের যুক্তিতর্ক ও চাপাচাপিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল ক্যাপটেন লীচকে। দেখা গেল, দো বাখনির ক্ষমতা খর্ব করবার একটা কৌশল বের করে ফেলেছে লীচ ভেবেচিন্তে।

তোমার সঙ্গে উওগানও থাকবে এই জাহাজে, সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল সে। তোমার সহকারী দরকার হবে। তাছাড়া হ্যালিওয়েলকে পাবে তুমি সেইলিং-মাস্টার হিসেবে।

যদিও পরিষ্কার বুঝতে পারল যে ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা, চেহারায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেতে দিল না দো বাখনি। বলল, চমৎকার! কোনও আপত্তি নেই আমার। অবশ্য ওদের জানা থাকা দরকার যে আমার নির্দেশে চলবে এ জাহাজ। হাসিমুখে ফিরল সে উওগানের দিকে, এসো, কাজ শুরু করে দেয়া যাক। রাডার-হেড মেরামতের কাজে কাঠমিস্ত্রী লাগানো দরকার সবার আগে, তারপর জাহাজটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে –যা হাল হয়েছে এটার!

দো বাখনির আদেশ-নির্দেশ বিদ্রুপের ভঙ্গি নিয়ে লক্ষ করল টম লীচ, কিন্তু ওর কাজে কোন বাধা দিল না। দশ মিনিটের মধ্যেই কাজে লেগে গেল সবাই। লাশগুলো ফেলে দেয়া হলো সাগরে, ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হলো কোয়ার্টারডেক, ওয়েইস্ট আর পূপের সমস্ত রক্তের দাগ।

দক্ষতার সঙ্গে মাস্কুল ও পালের দড়িদড়া ঠিকঠাক করে নিয়ে রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল সে। একঘণ্টার মধ্যে দুটো জাহাজই যাত্রার উপযোগী হয়ে উঠল আবার। একশো লোক রয়ে গেল সেন্টরে, বাকি সবাইকে নিয়ে ফিরে গেল লীচ তার নিজের জাহাজে। যাওয়ার আগে জানতে চাইল কোনদিক বরাবর চলতে হবে এখন।

আপাতত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, বলল দো বাখনি। মারাকেবো উপসাগরের দ্বীপগুলোর দিকে যাব আমরা। যদি কোনও কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, কেপ ডি লা ভেলায় মিলিত হব।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চাইল লীচ। তাহলে ওখানেই আমরা অপেক্ষা করছি প্লেট ফ্লীটের জন্যে?

 আরে, না। জবাব দিল দো বাখনি। ওটা আমাদের প্রথম যাত্রা– বিরতি।

তারপর ওখান থেকে? চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে দেখল লীচ।

সেটা জানতে পারবে ওখানে পৌঁছানোর পর।

ক্রোধ দেখা দিল লীচের চেহারায়। দেখো, বাখনি, বলেই নিজেকে সামলে নিল সে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঝট করে পিছন ফিরল, দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল নিজের জাহাজে।

গ্রেট কেবিনের উপর থেকে ছায়াটা সরে যেতেই প্রিসিলা, আর মেজর স্যান্ডস বুঝতে পারল ব্ল্যাক সোয়ান সরে গেছে কিছুটা। দস্যুদের রেখে যাওয়া রাম পান করে এতক্ষণ এই বিপজ্জনক অবস্থায় নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল মেজর, এবার নড়ে উঠল। আধঘণ্টা আগে মতানৈক্যের কারণে তর্কটা যেখানে থেমেছিল, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করল কিছুতেই বুঝমে। আমি তোমায়, অভিজ্ঞতা আগামীবার আমাকে খুন করলেও মধ্যে। এবারের ভুত করতে শিখবে আর বলল

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, প্রিসিলা, এই লোকটার ওপর কি করে আস্থা রাখছ তুমি। আমি তো পারছি না, কিছুতেই না, আমাকে খুন করলেও না। এতেই বোঝা যায়, অভিজ্ঞতার কি পরিমাণ অভাব আছে তোমার মধ্যে। এবারের ভুলটা প্রমাণিত হলে আগামীবার আমার পাকা বিচারবুদ্ধির ওপর তুমি নির্ভর করতে শিখবে।

আগামী বলতে আমাদের কিছু নাও থাকতে পারে, বলল প্রিসিলা।

ঠিক। আমিও তো তাই বলছি। ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই আর আমাদের।

যদি এর পরেও কিছু থাকে, সেটা থাকবে মশিয়ে দো বাখনির বদান্যতায়।

ঠিক আগের জায়গাতেই ফিরে গেল তর্কটা। প্রিসিলা কিছুতেই মানতে রাজি নয় যে দো বাখনি আসলে একটা বদমাইশের হাড়ি।

কী বলছ তুমি! বাখনির বদান্যতায়? রাগের ঠেলায় পই করে ঘুরে অন্য দিকে ফিরল মেজর। গোটা কেবিনে বার দুয়েক পায়চারী করে ফিরে এল প্রিসিলার সামনে। এখনও তুমি বিশ্বাস কর লোকটাকে? ওই জঘন্য চরিত্রের দস্যুটাকে?

বিশ্বাস করার মত আর কাউকে তো পাচ্ছি না। উনি যদি আমাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হন… কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই কাঁধটা সামান্য ঝাঁকাল ও, যার অর্থ, তাহলে আর কেউ পারবে না।

মেয়েটা তার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, এটা পরিষ্কার। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তার পক্ষে এর আস্থা অর্জন করবার কোনও উপায়ও নেই। ফলে ক্রমেই তেতো হয়ে উঠছে মেজরের মেজাজটা।

সবকিছু শোনার পরেও তুমি এই কথা বলবে? ওকে আস্ত একটা পিশাচ জেনেও? একদল জঘন্য দস্যুকে ও পথ দেখিয়ে কোথায় কি করতে নিয়ে যাচ্ছে, জানার পরেও? তোমাকে নিজের বউ হিসেবে পরিচয় দেয়ার ধৃষ্টতা দেখানোর পরেও?

উনি এটা না বললে কী অবস্থা হতো আমাদের কল্পনা করতে পারেন? আমাদের বাঁচাবার জন্যেই ওঁকে বলতে হয়েছে এ কথা।

 তুমি ঠিক জান, এটাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল? মাথা নাড়ল মেজর। এই অন্ধবিশ্বাসই প্রমাণ করে কি পরিমাণ ছেলেমানুষ তুমি।

মেজর কি বোঝাতে চাইছে ঠিকই বুঝল প্রিসিলা, লাল হয়ে উঠল তার গাল, কিন্তু তার আচরণে বোঝা গেল মেজরের অবিশ্বাস তাকে স্পর্শ করেনি। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ গভীর ভাবে চিন্তা করল ও, প্রতিটা ঘটনা মনে আনার চেষ্টা করল। দো বাখনির পক্ষে একটা জোরাল যুক্তি মনে আসতে মুখ তুলল সে।

আপনি যেমন বলছেন, উনি যদি ততটাই জঘন্য চরিত্রের মানুষ হতেন, তাহলে আপনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে যাবেন কেন? আপনাকে তাঁর স্ত্রীর ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিপদমুক্ত করবেন কি কারণে?

থমকে গেল মেজর, কিছুক্ষণ উত্তর যোগাল না মুখে। কিন্তু দো বাখনির কোন সদুদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা কিছুতেই মানতে পারল না মন থেকে-খুন করলেও পারবে না। বলল, ওর আসল মতলব সম্পর্কে আমার আন্দাজটা বলব?

আন্দাজ! খারাপ কিছু আন্দাজ করতেই আপনার ভাল লাগছে। কেন? ফ্যাকাসে হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। উনি যদি ওদেরকে আপনার গলা কাটার সুযোগ দিতেন, তাহলে আর তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলার সুযোগ পেতেন না।

একজন কুখ্যাত ডাকাতের ওপর তোমার এমন অবিচল ভক্তি আর বিশ্বাস দেখে সত্যিই, প্রিসিলা, আমি মর্মাহত। চোখ-মুখ করুণ করে তুলল মেজর। আমার অনুমান যখন সত্যে পরিণত হবে…।

বাধা দিল প্রিসিলা। তাই বুঝি চাইছেন আপনি মনে মনে? আপনার পৌরুষ দেখে বলিহারি যাই। এমন ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আর কাজ পেলেন না, ভয় দেখাচ্ছেন অসহায় একটা মেয়েমানুষকে!

মরমে মরে গেল মেজর। অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল, মাফ করো, প্রিসিলা। তোমার জন্যেই চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আবোল তাবোল বকছি। বিশ্বাস করো, তোমার জন্যে আমি প্রাণ দিতেও

এবার বাধা এল মশিয়ে দো বাখনির কণ্ঠ থেকে। আশা করা যায়, মেজর, অতটা করার প্রয়োজন আপনার সম্ভবত পড়বে না।

চমকে গিয়ে পিছন ফিরল মেজর। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কুখ্যাত দস্যুটা। ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল সে। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে। কোনও চিন্তা নেই। আপাতত সব সামাল দেয়া গেছে, নিজস্ব অমায়িক ভঙ্গিতে বলল দো বাখনি। এ জাহাজের দায়িত্বে আছি আমি। আপনারা নিজেদেরকে আমার সম্মানিত অতিথি মনে করলে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করব।

আর …আর ক্যাপটেন ব্র্যানসাম? উনি…ওঁর কি হয়েছে? উদগ্রীব প্রশ্ন এল প্রিসিলার কাছ থেকে। গলাটা একটু কাঁপা কাঁপা, চোখে শঙ্কা।

মশিয়ে দো বাখনির চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। একটু চুপ করে থেকে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল, তিনি তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন। লড়াই করেছেন বীরের মত। তবে আর কিছুক্ষণ আগে, যদি এই রকম সাহসের পরিচয় দিতেন, তাহলে বেঁচে থাকতেন এখনও।

তার মানে, মারা গেছেন উনি? সাদা হয়ে গেল প্রিসিলার মুখ। কী আশ্চর্য জলজ্যান্ত, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একজন মানুষ, কত আশা নিয়ে চলেছিলেন পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে; তাঁর এমন আকস্মিক, নিষ্ঠুর মৃত্যু একেবারে হকচকিয়ে দিল ওকে।

মাথাটা সামান্য ঝোঁকাল দো বাখনি। কাল রাতেই তো বলছিলেন, এটাই তাঁর শেষ যাত্রা। ফলে গেল কথাটা। শান্তি হোক তাঁর আত্মার। ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে ছিলেন ভদ্রলোক, ভেবেছিলেন পরিবারের অতীত-ক্ষতি সব পুষিয়ে দেবেন। ভবিষ্যৎ কখনোই অতিতের ক্ষতি পূরণ করতে পারে না– কঠোর এই বাস্তব অভিজ্ঞতার আঘাত থেকে তো অন্তত বেঁচে গেলেন তিনি।

আশ্চর্য! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেজর। এখন কাঁদুনি গাইছেন, অথচ ইচ্ছে করলেই আপনি তাকে বাঁচাতে…।

মাথা নাড়ল মশিয়ে দো বাখনি। তা পারতাম না। এদিক সামলাতেই জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়! ওপরের ডেকে, যখন গেলাম, তখন সব শেষ। সব কাজ সেরেই নিচে নেমে এসেছিল লীচ।

আর আর সবাই? নাবিকরা?

 নির্বিকার কণ্ঠে বলল দো বাখনি, কাউকে বন্দী করা ক্যাপটেন লীচের নীতির বাইরে।

দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল প্রিসিলা। গা বমি-বমি করছে ওর। শুনল, নরম গলায় বলছে ফরাসী লোকটা, আপনারা দুজন এখন বিপদমুক্ত। অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছুটা দেরি মেনে নিতেই হবে, তাছাড়া আর কিছু নয়। এখন যখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে বৈরী ভাগ্যকে, আর কোনও ভয় নেই।

কি দাম আপনার আশ্বাসের? রুক্ষ কণ্ঠে জানতে চাইল মেজর।

সহিষ্ণুতার প্রতীক যেন দো বাখনি, নরম গলায় বলল, যত সামান্যই দাম হোক, এটুকুই আমার সম্বল। এতেই সন্তুষ্ট থাকা আপনার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, মেজর।

পাশ ফিরে পিয়েখকে পাঁচজনের জন্যে ডিনারের ব্যবস্থা করার আদেশ দিল। প্রিসিলার দিকে ফিরে বলল, আমার লেফটেন্যান্ট আর সেইলিং মাস্টার আমাদের সঙ্গে বসবে ডিনারে। এটা হয়তো এড়ানো যেত, কিন্তু এখুনি সেটা করা ঠিক হতো না। এছাড়া আর কোনও সময়ে কেউ আপনার প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করবে না। শুধু খাবার সময়টুকু ছাড়া এই কেবিন সম্পূর্ণভাবে আপনার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে থাকবে।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল প্রিসিলা, বোঝার চেষ্টা করছে কথাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না দো বাখনির চেহারা দেখে। সামান্য মাথা ঝাঁকাল ও, বলল, আমরা আপনার অধীনে রয়েছি, মশিয়ে। আপনি যেটুকু সৌজন্য দেখাবেন, যতটুকু অনুগ্রহ করবেন, সেটুকুই ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করব।

ভাঁজ পড়ল দো বাখনির ঘন কালো ভুরুতে। আমার অধীনে? ওহ, বুঝেছি, বলতে চাইছেন আমার রক্ষণাবেক্ষণে আছেন।

তফাৎ আছে কোন?

 হ্যাঁ, প্রিসিলা। বিশেষ করে আমরা সবাই যখন পারিপার্শ্বিকতার অধীন।

প্রিসিলার মনে হলো এই কথাটা দিয়ে বিশেষ কিছু যেন বোঝাতে চাইছে মশিয়ে দো বাখনি। আর একটু পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইবে, এমনি সময়ে বিশ্রী ভাবে নাক গলাল মেজর।

আপনি মিস্ হ্যারাডিনের নাম ধরে ডাকতে লেগেছেন যে বড়?

পরিস্থিতি, মেজর। তুমি কি ভুলে গেলে, প্রিয় বার্থোলোমিউ, ও আমার স্ত্রী, আর তুমি আমার শালা?

রাগে কাঁপতে শুরু করল মেজর, চোখ দুটো অগ্নিবর্ষণ করছে– মনে হচ্ছে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। ব্যাপারটা টের পেয়ে প্রথমে অবাক হয়ে গেল দো বাখনি, তারপর কঠোর কণ্ঠে বলল, আপনি আমাকে, বেকায়দায় ফেলে দেবেন মনে হচ্ছে, মেজর। আপনাদের দুজনেরই উচিত হবে এই মুহূর্ত থেকে আমাকে চার্লস বলে ডাকা। নইলে আপনাদের গর্দান তো যাবেই, সেই সঙ্গে যাবে আমারটাও। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাটা আপনার যতই অরুচিকর লাগুক, গলায় ফাঁস পরে বাতাসে দোল খাওয়ার চাইতে নিশ্চয়ই এটা বেশি অপাঙক্তেয় নয়। কথা শেষ করে দ্রুত পা ফেলে বেরিয়ে গেল, সে বাইরে।

রাগের ঠেলায় মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে মেজর। কোন মতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, সাহস দেখো! আমাকে শাসায়! খুনে একটা বদমাশ…

যাই বলুন না কেন, বার্ট, বাধা দিল প্রিসিলা, এটা বলতে পারবেন না যে ক্যাপটেন লীচকে মশিয়ে দো বাখনি ডেকে এনেছে সেন্টরে।

তাতে কি, সে তাকে স্বাগত জানিয়েছে। উত্তেজনার মাথায় টেরও পেল না সে, সত্যি কথাই বলেছে প্রিসিলা। ওই রক্ত-পিশাচটার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তুমি নিজের কানেই শুনেছ, ও বলেছে, লীচকেই খুঁজতে বেরিয়েছে ও আরেকটা ডাকাতির কাজে সাহায্য চাইবে বলে। কোন্ দিক দিয়ে ভাল হলো ও?

তাই ভাবছি।

ভাবছ? এতে ভাবনার কি আছে? সবই জান তুমি। বেচারা ব্র্যানসাম খুন হয়ে যাওয়ার পর ও-ই এখন এ-জাহাজের কমান্ডার।

তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না।

কী বলছ প্রমাণ হয় না! এতে এই প্রমাণ হয় যে লোকটা একটা খুনে ডাকাত, গলায় ছুরি চালানো কসাই, জঘন্য জলদস্যু…।

উঠে দাঁড়াল প্রিসিলা, কারণ পিয়েখকে দেখা গেল এইদিকে আসতে। চাপা গলায় বলল সে, আরও প্রমাণ হয় যে আপনি সত্যিই নির্বোধ। এই সত্যটা যদি গোপন রাখতে না পারেন, তাহলে নিজে তো মরবেনই, আমাদেরও মারবেন।

যেন আচমকা চাবুক মারা হয়েছে– চমকে উঠল, তারপর হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মেজর প্রিসিলার মুখের দিকে। বলে কি! এই সেদিনের ঘুড়ি –দুর্বল, নম্র, ভদ্র– এসব কি বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে এসব কি বলছে ও তার মত একজন বয়স্ক, দায়িত্বপূর্ণ, অভিজ্ঞ অফিসারকে? বিপদে পড়ে পাগল হয়ে গেল? ফুঁপিয়ে উঠে দম নিয়ে আবার শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু থামিয়ে দিল প্রিসিলা প্রায় একই ভাষায় বকা দিয়ে। পিয়েখ রান্নাঘরে ফিরে যেতেই এক পা এগিয়ে একটা হাত রাখল সে মেজরের বাহুতে। ফিস ফিস করে বলল, ওই লোকটার সামনে এসব কী যা-তা বকছেন! দিশে হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?

মেজরের কাছে মনে হলো, সাবধান করায় কোন দোষ নেই, কিন্তু যে ভাষায় তাকে সাবধান করা হয়েছে সেটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রচণ্ড আহত বোধ করেছে সে, সেকথা মেয়েটাকে বলতেও কসুর করল না। তারপর একেবারে বোবা হয়ে গেল। ওকে আর না ঘাঁটিয়ে নিজেও চুপ করে থাকল প্রিসিলা।

খেতে এল মশিয়ে দো বাখনি। সঙ্গে লম্বা আইরিশম্যান উগান আর একজন মাঝারি উচ্চতার বিশাল মোটা, চওড়া কাঁধের শক্তপোক্ত লোক– চিবুকের নিচে কয়েক ভজ গলকম্বল, কিন্তু নাক-চোখ সেই তুলনায় বিসদৃশরকম ছোট। জানা গেল এই লোকই সেইলিং-মাস্টার নেড হ্যালিওয়েল।

সবাই টেবিলে গিয়ে বসতেই হালকা পায়ে ছুটোছুটি করে খাবার পরিবেশন শুরু করল পিয়েখ।

মন্দভাগ্য ব্র্যানসামের চেয়ারটায় বসেছে দো বাখনি। প্রিসিলা ও মেজর স্যান্ডসকে নিজের ডান ধারে আলোর দিকে পিঠ দিয়ে বসাল সে, উওগানকে বসাল নিজের ঠিক বামে, আর হস্তিপ্রবর সেইলিং মাস্টারকে তার পাশে।

চুপচাপ খেয়ে উঠল সবাই। প্রথম দিকে একটু হাসি-তামাশার চেষ্টা করেছিল দস্যু দুজন, কিন্তু দে বাখনির শান্ত, শীতল ব্যবহার ও তথাকথিত মাদাম দো বাখনি ও তার ভাইয়ের নীরবতায় উৎসাহে ভাটা পড়েছে ওদের। গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে নিয়েছে উওগান, একটু যেন অসন্তুষ্ট; কিন্তু সেইলিং-মাস্টার বরং খুশিই হয়েছে, কথা বন্ধ হওয়ায় মন দিয়েছে কাজে– প্রচুর খেতে পারে লোকটা, এক মনে খেয়ে গেছে সে হাপুস-হুপুস শব্দ তুলে।

মেজর এই অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করা থেকে বহু কষ্টে বিরত রাখল নিজেকে। আর প্রিসিলা খাওয়ার ভান করল শুধু, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খেয়াল না করলে কেউ টের পাবে না যে প্রায় কিছুই খাচ্ছে না সে।

.

০৮.

 অধিনায়ক

সেন্টরের পিছনে উঁচু পূপে পায়চারি করছে মশিয়ে দো বাখনি। চাঁদ নেই, আকাশ ভরা ছোট-বড় অসংখ্য তারা মিটমিটে আলো দিচ্ছে। পিছনের পূপ ল্যাম্পের আলোয় ওর দীর্ঘ অবয়ব দেখা যাচ্ছে জাহাজের মাঝ-ডেক থেকে।

সূর্যাস্তের পরপরই বাতাস পড়ে গেছে, তবে দিক বদলায়নি। তর তর করে এগিয়ে চলেছে সেন্টর দক্ষিণ-পশ্চিমের কোর্স ধরে। শদুয়েক গজ পিছনে সেন্টরকে অনুসরণ করছে ব্ল্যাক সোয়ান, তিনটে পূপ ল্যাম্প দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর অবস্থান।

বাতাস পড়ে যাওয়ায় গরমে টিকতে না পেরে সেন্টরের নাবিকরা উঠে এসেছে মাঝ-ডেকে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসে পড়েছে তাস বা পাশা খেলবে বলে। গল্প, হাসি, আর মাঝেমধ্যে গালি-গালাচের শব্দ ভেসে আসছে। এরই মধ্যে একটা বেসুরো বেহালার সঙ্গে গান ধরেছে কেউ একজন। পরিচিত গান, পুরনো, কিন্তু এখনও তার আবেদন ফুরোয়নি, বাহবা দিচ্ছে অনেকেই।

এসব কিছুই কানে যাচ্ছে না দো বাখনির, গভীর চিন্তায় ডুবে আছে সে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যার সমাধান খুঁজছে মনে মনে।

মাঝরাতের দিকে কম্প্যানিয়ন ধরে নেমে এল সে, গ্যাঙওয়ে ধরে এগোচ্ছে কেবিনের দিকে। উওগান আর হ্যালিওয়েলকে দেখা গেল বাল্কহেড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওকে এগোতে দেখে চুপ হয়ে গেল ওরা, শুভরাত্রি জানাল।

গ্যাঙওয়েটা এখানে অন্ধকার। বাতিটা কেউ নিভিয়ে দিয়েছে। থমকে দাঁড়াল দো বাখনি। পরমুহূর্তে আশ্বস্ত হলো একটা মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে।

কণ্ঠটি শুধু বলল, মশিয়ে! নিশ্চিন্তে এগিয়ে গেল দো বাখনি। বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাহারায় ছিল এতক্ষণ পিয়েখ।

কেবিনে ঢুকে বাতির আলোয় দেখা গেল পিয়েখের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। ফরাসী ভাষায় দ্রুত অনেক কথা বলে গেল পিয়েখ। মনিবের কাছে রিপোর্ট করছে, এতক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে হ্যালিওয়েল আর উওগানকে কি বলতে শুনেছে।

হ্যালিওয়েল গজর-গজর করছিল, পাঁচভাগের এক ভাগ দিতে রাজি হয়ে মস্ত বোকামি করেছে লীচ; এটা মোটেই উচিত কাজ হয়নি। এই কথায় হেসে উঠল উওগান, বলল, কি করে ভাবতে পারলে চুক্তির এই অসম্ভব শর্ত মানা হবে? সম্পদ হাতে চলে এলে ওরা যা ভাল মনে করে। তেমনি একটা মানানসই অংশ ওকে দিতে চাইবে। তাতে যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে ওকে জবাই করে ফেলে দেয়া হবে সাগরে। ওর মত একটা বেয়াড়া, নাক-উঁচু, আত্মম্ভরী দাঁড়কাকের জন্যে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত উচিত ব্যবস্থা।

এসব কথায় অবশ্য হ্যালিওয়েল পুরোপুরি আস্থা আনতে পারেনি। ওর ধারণা, দো. বাখনি অত্যন্ত ধূর্ত, পিচ্ছিল পিশাচ; এতই ছল-চাতুরি জানে যে ওকে গায়ের জোরে বশে রাখা অসম্ভব। পানামায় স্প্যানিয়ার্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কত রকম চতুর ফাঁদ সে পেতেছিল, তার দুয়েকটা বর্ণনা করে শুনিয়েছে সে উওগানকে। দো বাখনিকে ছোট করে দেখা মস্ত ভুল হবে। কেবল চালবাজি, বা মেয়ে পটানোর ক্ষমতার জন্যে ওকে টপগ্যাল্যান্ট উপাধি দেয়া হয়নি, বেকায়দায় পড়লে ঠিক কোন্ কৌশলে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, সেটা ওর চেয়ে ভাল আর কার জানা আছে? লীচ বা তুমি কি মনে করেছ, তোমরা যা করবে বলে ভাবছ সে-সম্ভাবনার কথাটা ওর মাথায় আসেনি?

যদি এসেও থাকে, আর কি করার আছে ওর, বলো? এই ঝুঁকি না নিয়ে ও এই সম্পদ দখল করবে কি করে?

আমি জানি না, বলল হ্যালিওয়েল। জানলে আমিও দো বাখনির মত চতুর বলে খ্যাতি অর্জন করতাম। আমার কোনও সন্দেহ নেই, তোমরা কি করতে পার তা ভাল ভাবেই জানা আছে বাখনির, এবং সেটা সামাল দিতে সে কি করবে, তাও তার জানা।

বেহুদা দুশ্চিন্তা করছ নেড, বলল উওগান। আমরা যে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি, এটা তো ওর মাথাতেই আসবে না। আগের দিনের জলদস্যুদের মত ও নীতি নিয়ে চলে, চুক্তিভঙ্গের কথা কল্পনাও করতে পারবে না। আমরা আগামী কিছুদিন ওর সঙ্গে মানিয়ে চলব; যতই কষ্ট হোক ওর চাপাবাজি, হামবড়াই চাল মেনে নেয়ার ভান করব। তারপর কাজ ফুরোলে সব পাই-পাই করে শোধ দিয়ে দেব।

এরপরই দো বাখনিকে এদিকে আসতে দেখে চুপ করে গেছে ওরা।

পিয়েখের মুখে সব শুনল দো বাখনি, কিন্তু তার চেহারায় বিস্ময়, দুশ্চিন্তা বা রাগের কোন চিহ্ন ফুটল না। শান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি ভেবো না, পিয়েখ। এটাই আশা করেছিলাম আমি ওদের কাছে।

কিন্তু বিপদ, মশিয়ে?

হ্যাঁ, বিপদ আছে। মৃদু হাসল মশিয়ে দো বাখনি। সেটা যাত্রার শেষে। কিন্তু ততদিনে ওদের জান জ্বালিয়ে খাব আমি আমার চালবাজি দিয়ে। ততদিন পর্যন্ত আমাকে সহ্য করতে হবে, আমার কথায় নাচতে হবে ওদের। পিয়েখের কাঁধে একটা হাত রাখল। তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি ঝুঁকি নিয়ে আড়ি পেতে ঠিক করোনি, টের পেলে তোমাকে জবাই করে পানিতে ফেলে দিত ওরা। সাবধানে থাকো, পিয়েখ, তোমাকে আমার দরকার হবে। যাও, এখন শুয়ে পড়ে গিয়ে। আমাদের সবার জন্যে খুব কঠিন একটা দিন গেল আজ।

পরদিন সকালে উওগান আর হ্যালিওয়েলকে ডেকের উপর একসঙ্গে পেয়ে খানিকটা বাড়াবাড়ি করার ইচ্ছে জাগল মশিয়ে দো বাখনির। যে কথাটা অনুরোধের সুরে বললে ওরা হয়তো কিছুই মনে করত না, সেটাই আদেশের সুরে উচ্চারণ করল।

মাদাম দো বাখনির শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রায়ই ঘুম হয় না রাতে। তাই আমি চাই না সকালে তাকে কেবিনে গিয়ে কেউ বিরক্ত করুক। বুঝতে পেরেছ?

তার সামনে মাতব্বরী চাল দেখিয়ে এরকম সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ফরাসী লোকটা নিষেধাজ্ঞা ঝাড়ছে দেখে কালো হয়ে গেল উওগানের চেহারা। তা বুঝলাম, বলল সে। তবে নাস্তার কি হবে সেটা বুঝলাম না। আমাদের তো খেতে-টেতে হবে, অবশ্য তুমি যদি দয়া পরবশ হয়ে অনুমতি দাও তবেই সে প্রশ্ন আসে।

ওয়ার্ডরূমে নাস্তা খেতে পার, অথবা তোমাদের যেখানে খুশি। কিন্তু কেবিনে নয়। কথাটা বলেই উত্তরের অপেক্ষায় আর দাঁড়াল না ও, জাহাজটা ঘুরে পরিদর্শন করতে চলে গেল।

দো বাখনি কিছুটা দূরে সরে যেতেই হিস-হিস করে বলল উওগান, তা বটে! আমরা কর্কশ মানুষ, আমাদের সংসর্গ পছন্দ হচ্ছে না বিবি সাহেবের। কসম খোদার, নেড়! এই লোকটার দর্প যখন চূর্ণ হবে, আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। যাই হোক, আমরা এখন কি করি?

ওই, কাল রাতে তুমি যা বললে, চাপা গলায় বলল মোটা সেইল মাস্টার। রশি ছাড়তে থাকব, মৌজে রাখব ওকে। কোথায় নাস্তা খেলাম সেটা বড় কথা নয়, খাওয়াটাই বড় কথা। সত্যি বলতে কি, গতকাল ওদের সঙ্গে বসে খেতে আমার ভয়ানক : অস্বস্তি হয়েছে। খাবারগুলো যে পেটে গিয়ে খাট্টা হয়ে যায়নি, এই বেশি! থোঃ করে থুতু ফেলল মোটকু। চলো, ওয়ার্ডরূমেই যাই। স্বস্তির সাথে হাসি তামাশা করে খাওয়া যাবে।

ওর পিঠ চাপড়ে দিল উওগান। একদম ঠিক কথা বলেছ, নেড। ওদের সঙ্গে বসে মনে হচ্ছিল ওরা ভাবছে আমরা জঙ্গল থেকে উঠে এসেছি। আমাদের মনের ভাবটাও কোনও এক ফাঁকে জানিয়ে দিতে হবে ব্যাটাকে।

দো বাখনি যখন ফিরে আসছে তখনও দেখা গেল দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে উওগান আর হ্যালিওয়েল। এই যে, দো বাখনি, ডেকে থামাল ওকে উওগান। আমাকে আর নেড়কে ওয়ার্ডরূম চিনিয়ে দেয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। ওখানে বসে খেতে আমাদের এত ভাল লাগল যে আমরা ঠিক করেছি যে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন, প্রাণচঞ্চল বিবিসাহেব আর তার হোঁৎকা ভাইটাকে আর আমাদের উপস্থিতি দিয়ে বিরক্ত করব না। বুঝতে পেরেছ?

বিলকুল। ঠিক আছে, তোমাদেরকে এখন থেকে ওয়ার্ডরূমেই খাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি আমি। কথাটা বলেই কম্প্যানিয়ন হয়ে চলে গেল সে কোয়ার্টারডেকে।

একে অপরের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল ওরা কয়েক মুহূর্ত। ব্যাটা বলে কি! শেষে বলল উওগান। ও আমাদের অনুমতি দিচ্ছে! শুনলে কথাটা? আমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছে ও! আস্পর্দা দেখেছ? দুনিয়ার কোথাও এমন চিড়িয়া আর একটা খুঁজে পাবে তুমি?

দো বাখনি ততক্ষণে পিছনের পূপে চলে গেছে। রেইলিঙে ভর দিয়ে অনুসরণরত ব্ল্যাক সোয়ানের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে সে। আধঘণ্টার মত ওভাবে বাঁকা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ সোজা হলো। চিন্তার ভাবটা দূর হয়ে গেছে চেহারা থেকে, সেই জায়গায় দেখা দিয়েছে এক চিলতে সূক্ষ্ম হাসি।

ঘুরেই দ্রুতপায়ে ফিরে এল সে কোয়ার্টারডেকে। ওখানে দাঁড়িয়ে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করছে হ্যালিওয়েল। এই মুহূর্তে নিচে দাঁড়ানো কোয়ার্টারমাস্টারকে কি যেন বলছে।

হ্যালিওয়েলকে তাজ্জব করে দিয়ে জাহাজ থামানোর নির্দেশ দিল দো বাখনি। বলল, ব্ল্যাক সোয়ানকেও থামার সিগন্যাল দিতে হবে। আরও বলল, একটা নৌকা নামিয়ে ওকে ব্ল্যাক সোয়ানে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, ক্যাপটেন লীচের সঙ্গে জরুরী কথা আছে।

আধঘণ্টা পর ব্ল্যাক সোয়ানে উঠে গেল দো বাখনি টম লীচের একরাশ প্রশ্ন আর অযথা দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য একনাগাড়ে গালাগাল উপেক্ষা করে।

তোমাকে সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে কে বলেছে? অঢেল সময়, আছে আমাদের হাতে। যদি না থাকত, তাও আমি তাড়াহুড়োর চাইতে দ্য ব্ল্যাক সোয়ান। ধীর, নিশ্চিত পথে চলতেই বেশি পছন্দ করতাম।

তোমার পছন্দ-অপছন্দের কে পরোয়া করে, বাখনি? রেগে উঠল লীচ। তোমার পছন্দ আমার ওপর চাপাতে এসেছ মনে হচ্ছে?

আমি তোমার সঙ্গে আমাদের গন্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি, শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জবাব দিল দো বাখনি।

একদল নাবিক মাঝডেকে ভিড় করে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে দো বাখনিকে। ওর বর্তমান চলনে-বলনে যে ওরা মুগ্ধ, তা বলা যাবে না; ওর বীরত্ব, সাহসিকতা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং অসাধারণ, কীর্তিকলাপ সম্পর্কে অসংখ্য গল্প-কাহিনী জানা আছে ওদের, তাই এই ভক্তি।

ওর উত্তর শুনেই ফণা নামিয়ে ফেলল লীচ। এই তথ্যটা জানার জন্যেই তো আকুলিবিকুলি করছে ওর অন্তরটা। এটা একবার জানা হয়ে গেলে এই বেয়াড়া ফরাসী লোকটার ঔদ্ধত্য কি করে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেবে সেটা সে ভেবে রেখেছে।

চলো, নিচে চলল, বলেই হাঁটতে শুরু করল সে পথ দেখিয়ে। যেতে যেতে দুজনকে ডাকল সে সঙ্গে আসার জন্যে। বড়সড় একটা কেবিনে ঢুকে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল দো বাখনির সঙ্গে। একজন এলিস, উওগানের পরিবর্তে বর্তমান মেট, আর অপরজন সেইলিং মাস্টার বানড্রি। দুজনই খাটো আর গাট্টাগোট্টা। এলিসের চুল-দাড়ি সব লাল, আর বানড্রির চেহারা যদিও বসন্তের দাগ ভরা, মেটে রঙের, অভিব্যক্তিহীন, পরনের জামা-কাপড় বেশ ধোপ-দুরস্ত।

ওরা বসতেই বয়স্ক এক নিগ্রো রাম, লেবু আর চিনি পরিবেশন করল, তারপর লীচের ছোটখাট একটা গর্জন শুনে পালিয়ে বাঁচল।

এইবার, চার্লি, বলল লীচ, আমরা অপেক্ষা করছি।

সামনে ঝুঁকে ওক টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে সরাসরি লীচের চোখে তাকাল মশিয়ে দো বাখনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলল সে।

এই জাহাজের চলন দেখছিলাম আজ সকাল থেকে। নতুন কিছু নয়, তোমার হয়তো মনে আছে, গতকালই বলেছি তোমাকে– অনেক জঞ্জাল জমেছে ব্ল্যাক সোয়ানের নিচে। বহুদিন হয়ে গেছে এ জাহাজ সাগরে নেমেছে।

কথাটা ঠিক, সমর্থন করল ওকে বানড্রি। অবস্থাটা এখন এমনই যে, নাবিক হওয়ার দরকার নেই, যে-কেউ এটার দিকে একনজর তাকালেই বলে দিতে পারবে।

তোমাকে আমি কথা বলতে বলেছি? ধমক লাগাল লীচ। দো বাখনির কথায় সমর্থন দেয়ায় রেগে গেছে সে। আমি বললে মুখ খুলবে, তার আগে নয়, বুঝেছ? দো বাখনির দিকে ফিরল সে, হ্যাঁ, তারপর?

তোমাকে গতকাল বলেছি, তোমার তলায় এত জঞ্জাল জমেছে যে আমি যদি সেন্টরের ক্যাপটেন হতাম, তোমার আর ও জাহাজে উঠতে হতো না। যদি না ডুবিয়ে দিতাম, তাহলে এখন পর্যন্ত আমার পিছন পিছন ছুটতে হতো তোমাকে ধুঁকতে. ধুঁকতে; অথচ তোমার আছে পঁয়তাল্লিশটা কামান, আর তার অর্ধেকও নেই সেন্টরের।

কয়েক মুহূর্ত লাগল লীচের বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে, তারপর ব্যঙ্গের হাসি হাসল সে দো বাখনির মুখের উপর। দেখাদেখি এলিসও হাসছে দাঁত বের করে। কিন্তু বানড্রি গম্ভীর।

দেখো, চার্লি, বরাবরই তুমি গোলমাল পাকানোয় ওস্তাদ, দেমাকী ফুলবাবু; গালচালাকি, মিথ্যা আস্ফালন আর ছল-চাতুরিতে তোমার জুড়ি নেই। তবে এখন যা বলছ, সেটা তোমার অতীত সমস্ত রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি যোদ্ধা খারাপ তা বলছি না। এমনি এমনিই আর তোমাকে সবার সেরা, সবার ওপর টেক্কা দেয়া, উঁচু পাল টপগ্যাল্যান্ট টাইটেল দেয়া হয়নি। হা-হা করে শুকনো হাসি হাসল লীচ। বেশ তো, কিভাবে এই জাদুমন্ত্র দেখাতে শোনা যাক এবার।

তোমার সেইলিং-মাস্টার কিন্তু হাসছে না, দো বাখনি গম্ভীর।

তাই নাকি? ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল লীচ।

জবাবটা দিল দো বাখনি। তার কারণ ও আন্দাজ করতে পারছে আমার মনের কথাটা। নির্বোধ নয় ও। ও জানে, বাতাসের অনুকূলে নাকটা সামান্য ঘুরিয়ে নিলেই সেন্টর তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকত চিরকাল।

ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা এক কথা, আর আমাকে ডুবিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। আমি জানতে চাই, ডুবাতে কি করে।

 যে জাহাজকে দৌড়ে হারিয়ে দেয়া যায়, তাকে ডুবিয়ে দেয়া যায়, যদি দক্ষতার সঙ্গে চালানো যায়। সমুদ্র-যুদ্ধে দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাই আসল কথা। তুমি ভাল করেই জান তা। পাশ ফিরে কামান দেগেই চট করে আবার পিছন ফিরে তোমার টার্গেট ছোট করে দেয়া সেন্টরের পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল। প্যানথারের মত বারবার ক্ষিপ্র আঘাত হেনে সরে যাওয়া সম্ভব ছিল ওটার পক্ষে, ব্ল্যাক সোয়ানের জঞ্জাল জড়ানো হাল একেবারে মন্থর করে দিয়েছে তোমার গতিবিধি।

কাঁধ ঝাঁকাল লীচ রেগে গিয়ে। হয়তো পারতে, হয়তো পারতে না। কিন্তু তোমার পারা না পারার সঙ্গে আমাদের গন্তব্যের সম্পর্ক কি?

হ্যাঁ, বলল লালচুলো এলিস। নিজের বাহাদুরি ছাড়া আর কিছু বলার থাকলে বলে ফেললো।

ভদ্র ভাবে কথা না বললে আমার মুখ দিয়েও অভদ্র কথা বেরোতে শুরু করবে, মিস্টার! সেটা তোমার মোটেও ভাল লাগবে না, ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল দো বাখনি৷

টেবিলে চাপড় দিল লীচ। জ্বালাতন! গর্জন ছাড়ল সে। খালি কথার পর কথা চলতে থাকবে, যতক্ষণ না আমরা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ি, নাকি কাজের কথা হবে? আবারও জানতে চাইছি, চার্লি, এসবের সঙ্গে আমাদের গন্তব্যের কি সম্পর্ক?

অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমার আসল বক্তব্য হচ্ছে তোমাকে বুঝতে হবে, সত্যিকার যুদ্ধে জড়ানোর মত অবস্থায় নেই তোমার এ জাহাজ। প্লেট ফ্লীটের যুদ্ধ-জাহাজগুলোর ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা মস্ত ভুল হবে তোমার। বিশেষ করে ফ্রিগেটগুলোতে দক্ষ নাবিক ও যোদ্ধা থাকবে। আমরা এই দুই জাহাজ নিয়েই ওদের ঘায়েল করতে পারব, কিন্তু সেজন্যে আমাদের পারদর্শিতার প্রয়োজন পড়বে। তুমি মস্তবড় এক সাহসী যোদ্ধা-ক্যাপ্টেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু জাহাজটা ডাঙায় তুলে ঠিক করিয়ে না নিলে সেই তুমিও মার খেয়ে তৃত হয়ে যাবে। এতবড় ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না। কি বল?

তুমি বলেছ দুই-আড়াইশোর বেশি লোক থাকবে না ওদের ফ্লীটে।

ঠিকই বলেছি। কিন্তু ওদের ফায়ার পাওয়ারটা খেয়ালে রাখতে হবে না? আমাদের ষাটটার বিপক্ষে ওদের থাকবে সত্তরটা উন্নত মানের কামান। আমাদের দুটো, ওদের তিনটে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, জঞ্জালমুক্ত খোল। নিজের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যুদ্ধে যেতে চাও?

লীচের আক্রমণাত্মক ভাব-ভঙ্গি কিছুটা প্রশমিত হলো একথায়, কিন্তু এখনও মানতে পারছে না। বলল, পচে মরো তুমি! কেন ঝামেলা পাকাচ্ছ, চার্লি?

আমি পাকাচ্ছি না। ওটা পেকে বসে আছে। আমি বরং চাইছি ঝামেলা দূর করতে।

দূর করতে?

দূর করতে। আক্রমণের আগে তোমার ব্ল্যাক সোয়ানকে কাত করে মেরামত করে নেয়া উচিত।

মেরামত? খেপে উঠল লীচ, কুঁচকে গেছে ভুরুজোড়া। বলে কি ব্যাটা! মেরামত?

যদি বিপর্যয় এড়াতে চাও, এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল বানড্রি, ঠোঁট ফাঁক হলো ওর, মুখে সেটা জানাবে বলে, কিন্তু সে সুযোগ তাকে দিল না লীচ।

 তোমার কি ধারণা, আমাকে আমার কাজ শিখতে হবে তোমার কাছ থেকে?

যদি জাহাজ ডাঙায় না তোল, তাহলে বুঝতে হবে সত্যিই তার দরকার আছে।

ওটা তোমার কথা। আর তোমার কথাই দৈববাণী নয়। ব্ল্যাক সোয়ান যেমন আছে তাই নিয়েই তোমার তিন স্প্যানিয়ার্ডের মোকাবিলা করব আমি। ডাঙায় তোলার কথা আর আমার সামনে ভুলেও উচ্চারণ করবে না। যদি গর্দভ না হতে, তাহলে বুঝতে পারতে এখন ওসবের সময় হাতে নেই।

যতটা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশিই সময় আছে হাতে। পুরো একটা মাস হাতে আছে আমাদের, তারপর রওনা হবে ওদের প্লেট ফ্লীট। তার অনেক আগেই তোমার খোল পরিষ্কার করে, পেইন্ট করে, গ্রীজ লাগিয়ে তৈরি হয়ে যেতে পারবে তুমি।

যুক্তি-তর্কে না পেরে এবার, গোঁয়ার লোকের যা হয়, জেদ চেপে গেল লীচের। ঘেউ-ঘেউ করে উঠল সে খেপা কুকুরের মত। সময় থাক বা না থাক জাহাজ আমি ডাঙায় তুলব না। স্প্যানিয়ার্ডদের ভয় পাই না আমি। কাজেই ওসব কথা বাদ। এবার কাজের কথায় এসো। কোথায় যাচ্ছি সেটা বলে ফেলল এবার।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লীচের দিকে তাকিয়ে থাকল দো বাখনি। তারপর পাত্রের দটুকু একঢেকে গিলে নিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।

তুমি যখন মনস্থির করে ফেলেছ, আমার আর কিছুই বলার নেই। গোটা খোলে একগাদা জঞ্জাল নিয়ে যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে চাও, দিতে পার। কিন্তু এর মধ্যে আমি নেই। আর এত যে গন্তব্য গন্তব্য করছ, যাও না চলে যেদিক খুশি, কে মানা করছে?

হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল তিনজন ওর দিকে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, দুনিয়ার নিষ্ঠুরতম দস্যু ক্যাপটেন লীচের মুখের উপর কারও পক্ষে এই ভাষায় কথা বলা সম্ভব।

কি বলতে চাও তুমি? শেষ পর্যন্ত এলিসের মুখ দিয়ে বেরলো কথাটা।

এই বলতে চাই ক্যাপটেন লীচ যদি তার লোকজন আর জাহাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, যাক –আমি এর মধ্যে নেই। তোমরা বীরত্বের সঙ্গে চামড়া, তক্তা, কোকো আর মশলার জাহাজ আক্রমণ করে ডুবাতে থাকো, আমি সালাম দিয়ে কেটে পড়ব।

বসো তুমি! প্রচণ্ড এক হাঁক ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ক্যাপটেন। রাগে থরথর করে কাঁপছে।

নির্ভীক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল মশিয়ে দো বাখনি। তোমার কি আবার একটু ভেবে দেখার ইচ্ছে আছে?

ভেবে তুমি দেখবে-কোথায় দাঁড়িয়ে আছ, কার জাহাজে। আমার জাহাজে আমি বিদ্রোহ প্রশ্রয় দিতে পারি না। যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ, সেটা পূরণ করবে তুমি।

আমার মত করে। আমার শর্তে। অটল দাঁড়িয়ে থাকল দো বাখনি।

না। আমার ইচ্ছে মত। বুঝতে পেরেছ? আমিই এ জাহাজের অধিনায়ক।

যদি প্রত্যাখ্যান করি?

 ইয়ার্ড আর্ম [পাল টাঙাবার কাঠ] থেকে ঝুলবে তোমার লাশ। হয়তো বা আরও খারাপ কিছু ঘটবে।

তাই? ভুরু জোড়া উঁচু করে নাকে দুপাশ দিয়ে চাইল দো বাখনি লীচের দিকে, যেন ঘৃণ্য কোন পদার্থের দিকে চোখ পড়েছে। আমার কি মনে হয় জানো? আমার কেমন যেন সন্দেহ হয় যে আমি স্প্যানিশ গোল্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছি বলে তোমার লোকজন আমাকে এক বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে। ওরা যখন জানতে চাইবে কেন আমাকে ফাঁসী দিচ্ছ, কি জবাব দেবে, টম? বলতে পারবে, ওদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যেতে রাজি হইনি বলে এই শাস্তি দিচ্ছ? বিজয় নিশ্চিত করার জন্যে তোমাকে জাহাজের তলাটা পরিষ্কার করতে বলায় আমার অপরাধ হয়েছে, তাই এই শাস্তি– পারবে ওদের একথা বলে শান্ত করতে?

লীচের চেহারায় পরিবর্তন আসছে টের পেল দো বাখনি। এলিসের চেহারাতেও ক্যাপটেনের মতই দ্বিধা আর অস্বস্তি দেখতে পেল সে। বানড্রির চেহারা দেখে মনে হলো যেন বিপদে পড়েছে। প্রথমে সেই কথা বলল।

অনেক কথাই তো হলো, ক্যাপটেন, বাখনিকে পুরোপুরি ভুল বলা যাবে না।

আমি থোড়াই কেয়ার … শুরু করেছিল লীচ, কিন্তু এবার বাধা দিল এলিস।

সাবধান হওয়ার দরকার আছে, ক্যাপটেন। যেটা সত্য, তাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ঝগড়ায় লাভটা কি, টম, আমাদের সবার লক্ষ্য যখন এক। বাখনি চাইছে ওর নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও সবার মঙ্গল ও নিরাপত্তা। ওর সাহস যদি তোমার চেয়ে কম হয়, ও যদি তোমার মত বেপরোয়া হতে না পারে, ওকে দোষ দেয়া যায় কি?

তাছাড়া সাবধান হওয়ায় আমি তেমন দোষ দেখি না, আবার বলল বানড্রি। নাবিক হিসেবে আমি এটুকু বলতে পারি, জাহাজের অবস্থা ও যা বর্ণনা করেছে, তাতে একটুও ভুল নেই। হাতে সময় না থাকলে এক কথা ছিল, ঝুঁকি নেয়া যেত। কিন্তু হাতে যখন সময় আছে, এই সময়টাকে আমরা জাহাজ ঠিকঠাক করে নেয়ার কাজে ব্যবহার করি না কেন?

লীচ দেখল, তার নিজের লোকেরাই ওর পক্ষ ত্যাগ করেছে। পরিষ্কার বুঝতে পারল এখন তুরুপের তাস আসলে দো বাখনির হাতে। প্লেট ফ্লীট সম্পর্কে গোপন তথ্য রয়েছে ওর পেটে। যতক্ষণ এই তথ্য ফাঁস না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ওর ওপর জোর খাটানো যাবে না, ও যা বলবে তাতেই সায় দিয়ে যেতে হবে।

সামলে নিল সে নিজেকে। হাসি হাসি একটা ভঙ্গি করে বলল, ঠিকই বলেছ তোমরা। ঝগড়া-ফ্যাসাদের অর্থ হয় না। ঠিক আছে, আমার দোষ আমি মেনে নিচ্ছি, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তোমার কথাই থাকবে, চার্লি। তোমার সারা গায়ে সজারুর কাঁটা, কসম খোদার। বসে পড়ো, খানিকটা রাম নাও, এসো বন্ধুভাবাপন্ন। পরিবেশে আমরা এই সভার ইতি টানি। রামের পাত্রটা সামনে ঠেলে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল লীচ, মুখে তোষামোদের হাসি।

মশিয়ে দো বাখনির চেহারায় বিজয়ের চিহ্নমাত্র ফুটল না। তাকে শান্ত করা হচ্ছে বুঝে মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল সে, মাথা ঝাঁকিয়ে লীচের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। খানিকটা রাম ঢেলে নিয়ে বলল, সত্যি-সত্যিই মন থেকে তুমি রাজি তো, টম? জাহাজটা মেরামত করে ঠিক করে নিতে?

লীচও দেখল তার অমর্যাদা হোক সেটা দো বাখনির উদ্দেশ্য নয়, বরং মুখ রক্ষার উপকরণ এগিয়ে দিচ্ছে। বলল, আসলে দেখা যাচ্ছে তুমি একা নও, বানড্রিও মনে করছে এটার দরকার আছে, তাই আমারও মনে হচ্ছে কাজটা সেরে ফেলা মন্দ নয়। যদিও, সত্যি বলতে কি, এখনও আমি পুরোপুরি তোমার কথা মেনে নিতে পারিনি। তবে রাজি হয়েছি, হ্যাঁ।

তাহলে যেটা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি আমি… বলল দো বাখনি, এই মুহূর্তে আমাদের গন্তব্য হচ্ছে অ্যালবুকোয়ার্ক কীজ। ওখানে মালদিতা বলে ছোট্ট একটা জনবসতিহীন দ্বীপ আছে, আমার চেনা। একটা উপসাগর মত আছে ওখানে, দশ-বারোটা জাহাজ লুকিয়ে রাখা যাবে অনায়াসে। আর সাগর-বেলাটা ঠিক যেন জাহাজ মেরামতের জন্যেই তৈরি হয়েছে। এর চেয়ে ভাল জায়গা গোটা ক্যারিবিয়ান সাগরে আর কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি। ওখানে নিশ্চিন্তে কারও কোন সন্দেহের উদ্রেক না করে কাজ সারতে পারব আমরা। তাছাড়া আর একটা সুবিধে আছে জায়গাটার… এটুকু বলে একটু থামল সে, তর্জনী তুলল কথার গুরুত্ব বাড়াবার জন্যে। স্প্যানিশ প্লেট ফ্লীটকে আমি ঠিক যেখানটায় বাধা দিতে চাই, জায়গাটা সেখান থেকে মাত্র একদিনের পথ।

.

০৯.

বিরতি

জুনের প্রথম সপ্তাহে এক মঙ্গলবার সেন্টর দখল করে নেয় জলদস্যু টম লীচ। পরদিন মশিয়ে দো বাখনির সঙ্গে কথাবার্তার পর সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে দুই জাহাজের গতিপথ। ফলে গতি কমে গেছে ওদের। তার পরেও বৃহস্পতিবার সূর্যাস্তের সময় ডাঙা দেখা গেল ক্রস ট্রী থেকে। ওটা কেপ ডি লা ভেলা। রোববারের সকালে আলবুকোয়ার্কের নিচু দ্বীপগুলোর দেখা পাওয়া গেল।

গত পাঁচটা দিন এতই নিরুদ্বিগ্ন সময় কেটেছে যে প্রিসিলা ও মেজর ভাবতে শুরু করেছে হয়তো মশিয়ে দো বাখনির কথাই ঠিক, দুশ্চিন্তার কিছুই নেই, ইংল্যান্ড পৌঁছতে একটু দেরি হচ্ছে, এই যা।

আর মানসিক জোরের পরীক্ষায় ক্যাপটেন লীচকে হারিয়ে দিতে পেরে নিজের উপর বিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে গেছে মশিয়ে দো বাখনির। যদিও চেহারায় তার কোনও ছাপ পড়েনি। ভাল-মন্দ সব অবস্থাতেই নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা অভ্যাস করেছে সে।

যুদ্ধাবস্থা ছাড়া, ডাঙায় হোক বা পানিতে, শৃঙ্খলা বা কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য নেই জলদস্যুদের মধ্যে। ছোট-বড় সবাই সমান, এমনি একটা ভাব রয়েছে ওদের আচরণে। আক্রমণের সময় কঠোর আদেশ নির্দেশ জারি করলেও অন্য সময়ে ক্যাপটেনরা নিজেদেরকে অন্যের চেয়ে উঁচু ভাববে না, এই রকমই রীতি। তবে সাধারণের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে, জরুরী অবস্থায় তাদের ওপর হুকুম জারি করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে কর্তাব্যক্তিরা একটু দূরে দূরে থাকে; অন্যদের সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদে যোগ দেয় না।

মশিয়ে দো বাখনি এ ব্যাপারে অন্যদের থেকে একদম আলাদা। সেন্টরের কমান্ডার হিসেবে তার আচরণ অনেকটা রাজ-কর্মচারীর মত, দস্যু-সর্দারের মত মোটেও নয়। কিন্তু ডিউটির পর সম্পূর্ণ বদলে যায় তার আচরণ, যেন মুখোশটা ক্যাপটেনের কেবিনে খুলে রেখে এসেছে। বিনা দ্বিধায় সে তখন ডেকের সবার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে যায়, ওদের সঙ্গে পান করতে, এমন কি পাশা খেলতেও বাধে না তার।

প্রায়ই দেখে উওগান এখানে-ওখানে বসে বা দাঁড়িয়ে গল্প বলছে দো বাখনি, ওকে ঘিরে ধরে হাঁ করে গিলছে সেসব একদল জলদস্যু। মাঝে মাঝেই হা-হা করে হেসে উঠছে সবাই ওর রসিকতায়। শ্যাগ্রেস নদীর ধারে স্যান লরেঞ্জোর স্প্যানিশ দুর্গ ওদেরকে বোকা বানিয়ে কিভাবে দখল করে মরগানের দল, সে-সব ঘটনার প্রাঞ্জল বর্ণনায় কখনও হাস্য, কখনও বীর রসের অবতারণা করে মুগ্ধ করে দেয় ও শ্রোতাদের।

যেদিন কেপ ডি লা ভেলা দেখা গেল সেদিন কেবিন থেকে গিটারটা আনিয়ে নিল ও। নতুন চাঁদের নিচে হ্যাঁচ-কোমিঙের উপর বসে মৃদুমন্দ হাওয়ায় ছোট ছোট মিষ্টি স্প্যানিশ গান শোনাল সে ওদের সুরেলা কণ্ঠে। মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই, আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল মধুর গান শুনে। এমন কি আইরিশম্যান উওগানের শক্ত হৃদয়টাও কেমন যেন দুলে উঠল।

ব্যাপারটা কি বলো দেখি, হ্যালিওয়েলকে প্রশ্ন করল সে। জাদু জানে নাকি লোকটা? সাধারণ জলদস্যুরা ওকে কি পরিমাণ ভালবাসে বোঝা যায় ওদের কথা শুনে, আবার কি পরিমাণ ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভয় করে তাও বোঝা যায় ওর আদেশে ওদের যে-কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ্রহ দেখে। কি করে পারে লোকটা?

ফরাসী কৌশল, ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দিল সেইল-মাস্টার।

উওগান ছাড়া আরও একজন তীক্ষ্ণ সমালোচনার দৃষ্টিতে নজর রেখেছে মশিয়ে দো বাখনির উপর– মেজর স্যান্ডস।

ব্ল্যাক সোয়ান থেকে ফিরে এসেই ওদের জানিয়েছে মশিয়ে দো বাখনি যে, এখন থেকে উওগান বা হ্যালিওয়েল আর আসবে না এই কেবিনে। এমন কি পারতপক্ষে ও নিজেও আসবে না। তবে আমাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে সবাইকে যা বলা হয়েছে, তাতে মাঝে-মধ্যে এদিক থেকে ঘুরে না গেলে লোকে সন্দেহ করবে।

আপনার সম্পর্কে কোনও আপত্তি কখনও তুলেছি? প্রতিবাদ করল প্রিসিলা।

করলেও আপনাকে দোষ দিতাম না আমি। যাই হোক, আমি তো ওদেরই একজন, ওদের চেয়ে কোন দিক দিয়েই ভাল নই।

প্রিসিলার নীলচে-সবুজ চোখজোড়ায় ঘোর আপত্তি। আমি কখনোই একথা মেনে নেব না।

মেজর স্যান্ডসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তিনি শপথ করে বলবেন, এটাই একমাত্র সত্য কথা।

পিছনে দাঁড়ানো মেজর গলাটা পরিষ্কার করল, কিন্তু কিছু বলল না। ফরাসী লোকটার এই একটি কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে সে। কিন্তু তার হয়ে প্রিসিলাকে সাফাই গাইতে দেখে আবার রাগ চড়ে গেল তার মাথায়।

আমারই মত মেজর, স্যান্ডসও আপনার বদান্যতার জন্যে আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আমাদের জন্যে আপনি যা করছেন তার কোন তুলনা হয় না। আপনি না থাকলে আমাদের ভাগ্যে কি ঘটত তা উনি ভাল করেই জানেন। বিশ্বাস করুন।

পরচুলা পরা মাথাটা ঝুঁকিয়ে হাসল মশিয়ে দো বাখনি। নিশ্চয়ই বিশ্বাস করছি। মেজর স্যান্ডস তাঁর আন্তরিকতার ব্যাপারে কখনোই কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখেন না। লাল হয়ে উঠল মেজরের মুখটা, কিন্তু সেদিকে তাকাল না ফরাসী জলদস্যু, বলল, এই কেবিনে বন্দী। হয়ে থাকার আর কোনও দরকার নেই, মাদামোয়াজেল। আপনারা নির্ভয়ে বাইরের আলো-বাতাসে ঘোরাফেরা করতে পারেন। কেউ কিছু বলবে না, বললে তার ঘাড় মটকে দেব-সে ভয় আছে সবারই। পিছনের পূপে আবার আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।

ধন্যবাদ জানাল প্রিসিলা অন্তর থেকে। মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে গেল টপগ্যাল্যান্ট।

ফরাসী ডাকাতটার প্রতি প্রিসিলার কৃতজ্ঞতার বহর দেখে এতক্ষণ জ্বলে মরছিল মেজর, এইবার বেরিয়ে এল তার মনের বিষ। আমি বুঝতে পারছি না, এই তাঁদোড় দস্যুটা আমার কাছে কি আশা করে!

হয়তো কিছুটা সৌজন্য, জবাব দিল প্রিসিলা।

সৌজন্য। আমাকে খুন করলেও তো না! ওর প্রতি সৌজন্য দেখাতে যাব কি জন্যে? বিপদে পড়েছি বটে, তাই বলে ভাল-মন্দ বোঝার ক্ষমতা ও কি হারিয়ে ফেলেছি? আমরা জানি ও কে এবং কি।

এই যে আমাদের প্রাণ বাঁচালেন উনি, এটা কিছুই নয়? এর জন্যে কোন ধন্যবাদ ওঁর প্রাপ্য হয় না?

প্রিসিলা রেগে উঠতে পারে মনে করে চট করে নিজেকে সামলে নিল মেজর। নানান কথা ফেঁদে ওর মন গলাবার চেষ্টা করল। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে প্রিসিলার নিরাপত্তার কথা ভেবেই ও মাঝে মাঝে খেপে উঠছে যার-তার উপর। এক পর্যায়ে আচমকা প্রেম নিবেদন করে বসল সে। প্রিসিলা যখন তার আক্কেল সম্পর্কে প্রশ্ন তুলল, কথা আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিল সে। মেয়েটি যখন পিছনের উঁচু ডেকে হাওয়া খেতে যাবে বলে ঠিক করল, তখন পিছু পিছু সে-ও গেল। কিন্তু সেখানে মশিয়ে দো বাখনি গিয়ে হাজির হতেই গোমরা মুখে বসে রইল একপাশে চুপচাপ।

এখন ওরা চলেছে আলবুকোয়ার্ক কীজের দিকে, ওখানে কেন থামতে হচ্ছে, কতদিন দেরি হবে, ইত্যাদি টুকিটাকি অনেক কথাই জানাল ওদের মশিয়ে দো বাখনি। হঠাৎ প্রিসিলার এক প্রশ্নে একই সঙ্গে চমকে উঠল মেজর স্যান্ডস ও ফ্রেঞ্চম্যান।

আচ্ছা, মশিয়ে দো বাখনি, আপনি কিভাবে জলদস্যু হলেন বলবেন?

এতই আন্তরিকতার সঙ্গে কথাটা জানতে চাইল প্রিসিলা, যে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল দো বাখনি ওর মুখের দিকে, তারপর মৃদু হাসল।

আপনার প্রশ্ন শুনে মনে হয়, যেন আমার জলদস্যু হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা। কিন্তু সত্যিই কি আপনার কারণটা জানতে আগ্রহ হচ্ছে?

হচ্ছে। তবে হয়তো এভাবে প্রশ্ন করাটা আমার ঠিক হয়নি। আপনি বিব্রত বোধ করলে …

না-না, মোটেও না, বলল দো বাখনি। এই প্রথম কেউ জিজ্ঞেস করল কথাটা, তাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ও, তারপর মৃদু হেসে বলল, সামান্যই আছে যা আপনি জানেন না। তুলনের হুগুয়েনো এলাকার বাখনি পরিবারে আমার জন্ম। সিওখ সাইমনের কথা তো বলেছি আপনাদের, সান্তা ক্যাটালিনায় যিনি খুন হয়েছিলেন স্প্যানিয়ার্ডদের হাতে– উনি আমার কাকা হতেন। আমি তার সঙ্গে নতুন দুনিয়ায় এসেছিলাম স্বাধীন ভাবে কিছু করব বলে। বয়স ষোল-সতেরো, আইন ভাঙার চিন্তা ছিল না আমার মাথায়।

বাবা-মার সাত পুত্রের মধ্যে সবার ছোট আমি, ভাগ্যান্বেষণে না বেরিয়ে উপায় ছিল না। সান্তা ক্যাটালিনায় কাকা যখন মারা পড়লেন তখন এই অচেনা-অজানা জগতে আমি একা। আহত। সহায় নেই, সম্পদ নেই। বন্ধু বলতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া তিন সঙ্গী। আমাদের মনের মধ্যে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন, স্প্যানিয়ার্ডদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্যে যে-কোনও দলে যোগ দেয়ার জন্যে উন্মুখ। একটু সুস্থ হয়ে ওদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলাম মরগানের দলে।

মরগানের অধীনে খুব দ্রুত উন্নতি করলাম আমি। বংশ আমাকে আর কিছু না দিক, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা দিয়েছিল। সুযোগও পেলাম নিজের দক্ষতা দেখাবার। মরগান টের পেলেন, দল পরিচালনার জন্মগত গুণ রয়েছে আমার মধ্যে। দলের ফরাসী অংশটার নেতৃত্ব দিলেন তিনি আমার হাতে। আমি হলাম ওঁর লেফটেন্যান্ট। নৌ-যুদ্ধ ধরতে গেলে হাতেকলমে শিখেছি আমি ওঁর কাছে, ওঁর চেয়ে বড় শিক্ষক আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি আমার।

ইংল্যান্ড যখন জলদস্যুদের উৎসাহ দেয়া বন্ধ করল, দস্যুতা ছেড়ে মরগান জামাইকার গভর্নরের দায়িত্ব নিলেন, আমিও ওঁর সঙ্গে যোগ দিলাম রাজ-কার্যে। সত্যি বলতে কি, এই দুনিয়ায় আমার পরিপূর্ণ আনুগত্য রয়েছে শুধু ওই একজন লোকের প্রতিই– মরগান। এবং সম্ভবত, জীবিত কেউই আজ পর্যন্ত আমার মত এতটা বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারেনি ওঁর। মৃদু হাসল সে, বলল, আমার গল্প শেষ।

একটু চুপ করে থেকে বলল প্রিসিলা, তার মানে আইন ভঙ্গের দায়ে দোষী করতে পারবে না কেউ আপনাকে। কারণ, জলদস্যুতা যেই বে-আইনী ঘোষিত হলো, অমনি আপনি সরে গেছেন ওই জীবন থেকে।

আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না মেজরের পক্ষে। একসময় যদি বা এটা সত্য হয়ে থাকে, দুঃখের বিষয়, এখন আর সেটা সত্যি নয়।

হেসে উঠল মশিয়ে দো বাখনি, চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে বলল, এতে দুঃখ পাওয়ার কি আছে, মেজর? আপনার তো আরও খুশি হওয়ার কথা।

জবাব দিতে পারল না মেজর, থতমত খেয়ে গেছে সত্যি কথাটা শুনে। হাসিমুখে চলে গেল টপগ্যাল্যান্ট কোয়ার্টার ডেকে, ওখানে সূর্যের উচ্চতা মাপছে তখন হ্যালিওয়েল।

এতক্ষণে মাথায় এল একটা কথা। মরগানের বিশ্বাস ভঙ্গ করে আবার ডাকাতি-পেশায় ফিরে যেতে তো একটুও বাধেনি বদমাশ ব্যাটার! বিষোগার করল মেজর।

একথার কোন জবাব দিল না প্রিসিলা। নিজের চিন্তায় মগ্ন। মেজরও আর এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে সাহস পেল না, কারণ সে দেখেছে, দো বাখনির সমালোচনা করলেই খাট্টা হয়ে যায় মেয়েটার মেজাজ।

সেই রাতে খোলা ডেকে চাঁদের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে গান শোনাল মশিয়ে দো বাখনি জলদস্যুদের। পূপের মৃদু হাওয়ায় বসে সে গান শুনে প্রিসিলার মনে হলো : আহা, কী অসাধারণ গলা! আর কী মিষ্টি করেই না গায় মানুষটা!

.

১০.

জাহাজ মেরামত

রোববার নোঙর ফেলল ওরা আলবুকোয়ার্ক দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ মালদিতার পুব পাশের লেথুনে দশ ফ্যাদম পানিতে। চওড়ায় দ্বীপটা মাইলখানেকের কিছু কম, আর লম্বায় দুই মাইলের কিছু বেশি। জায়গাটা এমনই সুরক্ষিত যে লীচও স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে জাহাজ মেরামতের জন্যে এর চেয়ে ভাল জায়গা আর হতেই পারে না।

দ্বীপে বেশ জঙ্গল দেখা গেল। দক্ষিণে উঁচু পাড়ে কামান বসালে ধারে কাছে আসতে পারবে না কোন জাহাজ। অবশ্য ডাঙায় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা নেই বলে ব্যাপারটা খেয়ালই করল না লীচ, দো বাখনিও তাকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকল। সুন্দর একটা অর্ধচন্দ্রাকার বেলাভূমি আছে এ দ্বীপে, আর ঠিক মাঝখানে আছে চমৎকার মিষ্টি পানির একটা বড়সড় ঝর্না।

নোঙর ফেলেই আর সময় নষ্ট না করে দুই জাহাজ থেকেই নৌকা নিয়ে নেমে পড়ল লোকজন, দ্বীপের গাছ কেটে ভেলা বানাবে, ব্ল্যাক সোয়ানের মালপত্র নামিয়ে নেবে জাহাজটাকে হালকা করবার জন্যে।

তিনদিন চলল জাহাজ খালি করার কাজ। মাস্তুলটা ছাড়া সব, এমন কি ভারি কামানগুলোও, একে একে নামিয়ে নেয়া হলো দ্বীপে। এবার সবাই মন দিল ঘর তৈরির কাজে। সবার জন্যে লম্বা ব্যারাক আর ক্যাপটেন ও অফিসারদের জন্যে আলাদা একটা বড়সড় লগ কেবিন তৈরি হলো। তারপর পুরো একটা দিন ব্যয় হলো জাহাজটাকে টেনে ডাঙায় তুলে এক পাশে কাত করে শোয়াতে।

এরপর দুটো দিন বিশ্রাম নিল ওরা। তেজি রোদে আগাছা আর শ্যাওলা শুকিয়ে গেলে আগুন জ্বেলে ওগুলো দূর করতে সুবিধে হবে।

নোঙর ফেলা সেন্টরেই শান্তিতে রয়েছে মশিয়ে দো বাখনি তার কথিত আত্মীয়দের নিয়ে। কিন্তু উওগান আর হ্যালিওয়েল লীচকে কান মন্ত্রণা দিয়ে বাদ সাধল তাতে।

সেন্টরের একশো নাবিক রোজ সকালে উঠে কাজে চলে যায় ডাঙায়, সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ফিরে আসে জাহাজে। তাদের সঙ্গে সহজ ভাবে মেলামেশা করে দো বাখনি, মজার মজার গল্প শোনায়, গান শোনায়; আর সেটা অসহ্য ঠেকে একদিকে মেজর স্যান্ডস আর অপরদিকে উওগান ও হ্যালিওয়েলের কাছে।

মেজর তো একদিন ডিনারে বসে বলেই ফেলল, ওই ভয়ঙ্কর খুনে ডাকাতগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করে কী মজা পান আপনি?

মজা? লম্বা মুখ আরও লম্বা হয়ে গেল দো বাখনির। মানুষ যা করে তার সব কিছুতেই যদি সে মজা পেত, তাহলে তার চেয়ে সুখী আর কেউ থাকত না। আপনি বুঝি যা করেন তার সবকিছুতেই মজা পান? তাহলে তো আপনাকে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মানতে হবে।

ঠিক কি বলতে চাইছেন, বুঝলাম না।

বলছি, জীবনে আমরা যা যা করি তার বেশিরভাগই করি নিছক প্রয়োজনের তাগিদে ব্যথা বা ব্যারাম দূর করতে, প্রাণ রক্ষা করতে, জীবিকা উপার্জন করতে। ঠিক বললাম?

সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। মোটামুটি তাই করে সবাই। জানতে পারি, ঠিক কোন তাগিদে এমন মাখামাখি করেন আপনি ওদের সঙ্গে?

অতি সহজ। আমার ধারণা মিস প্রিসিলা বুঝতে পেরেছেন।

শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল প্রিসিলা ওর চোখের দিকে। মনে হয় পেরেছি। আপনি চাইছেন ওরা যেন আপনার প্রতি খুশি থাকে, অনুগত থাকে।

একা শুধু আমার প্রতিই নয়, আমাদের সবার প্রতি। লীচ যে একটা খল, নীচ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার তাতে কারও কোনও সন্দেহ আছে? আমার ধারণা, যদিও তীব্র লোভের বাঁধনে বাঁধা পড়েছে ও, অঢেল সম্পদের মোহ অন্ধ করে দিয়েছে ওকে– তবু কখন যে নিজের নীচ চরিত্রের কারণে সেই-সবের আকর্ষণ ছিন্ন করে অশুভ কিছু করে বসবে তার ঠিক নেই। আমি আশা করছি, এখন এদের সম্মান ও ভালবাসা অর্জন করতে পারলে প্রয়োজনের সময় এরা হয়তো আমাদের ঢল হিসেবে কাজে দেবে।

ভালবাসা! বিদ্রূপ ঝরে পড়ল মেজরের কণ্ঠে। তাহলে বলতেই হয়, বড় বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে জিনিসটা আপনাকে!

ঠিক বলেছেন। তবে একটা ব্যাপার আপনি মোটেও খেয়ালে আনছেন না, মেজর– কোনও কারণে যদি আমার মৃত্যু হয়, জেনে রাখবেন, আপনার ও মিস প্রিসিলারও মৃত্যু ঘটবে। এই একটা ব্যাপারে দয়া করে মনে কোনও সন্দেহ বা বিভ্রান্তি রাখবেন না। রক্তশূন্য হয়ে গেছে মেজরের মুখ। সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসল মশিয়ে দো বাখনি। শান্ত অথচ কঠোর গলায় বলল, আমি যে কৌশলে নিজের এবং আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি, আপনার সেটা, ঘোর অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু দয়া করে অকারণে বিদ্রূপ করবেন না। ক্যাপটেন লীচ একটা জঘন্য পশু, কখন অতর্কিতে আক্রমণ করে বসবে কেউ বলতে পারে না।

কথাটা শেষ করে মেজর স্যান্ডসের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল সে। প্রিসিলার উজ্জ্বল দুটো চোখ বলে দিল, আত্মম্ভরী মেজরকে বকা দিয়ে লা-জবাব করে দেয়ায় খুশি হয়েছে সে।

ঠিক এই একই সময়ে লগ কেবিনে ডিনারে বসেছে লীচ, সঙ্গে উওগান, হ্যালিওয়েল, এলিস আর বানড্রি। দো বাখনির বিরুদ্ধে বিষোদার করছে উওগান।

প্রথমে ওর কথায় মোটেই গুরুত্ব দিল না লীচ। আরে বাদ দাও, খেঁকিয়ে উঠল সে। যা খুশি করুক না, করতে থাকুক। স্প্যানিয়ার্ডদের সঙ্গে মোলাকাতটা হয়ে যাক, তারপর ও টের পাবে আমি কি খেলা দেখাই।

এই কথাটার অন্তর্নিহিত অশুভ ইঙ্গিত একটু যেন সচকিত করল এলিস ও বানড্রিকে। উওগান আর হ্যালিওয়েল জানলেও এদের বলেনি লীচ কাজ শেষ হলে কি আচরণ করা হবে দো বাখনির সঙ্গে চুক্তিপত্রে যাই থাকুক না কেন। এলিসের চোখ দুটো চকচক করে উঠল, কিন্তু বানড্রির চেহারায় কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না, চোখের পাতাদুটো সামান্য নিচু হয়ে আবার ঠিক হয়ে গেল।

মোটকু হ্যালিওয়েল সামনে ঝুঁকে এল। তুমি কি ভেবেছ, ক্যাপটেন, এ সম্ভাবনার কথা ওর মনে উদয় হয়নি?

হলে কি হবে শুনি? ও এখানে আমাদের হাতের মুঠোয় আছে, না কি? আমাদের হাত থেকে ছুটবে কি করে?

ছোট ছোট চোখদুটো ঘুরিয়ে উঁচু হয়ে থাকা চোয়ালের মাংসের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলল হ্যালিওয়েল। এলো, আর তোমার হাতে নিজেকে তুলে দিল, যেন কত না বিশ্বাস তোমার ওপর, তাই না?

অবস্থা যা দাঁড়াল, আর কি করার ছিল ওর? প্রশ্ন করল লীচ।

তাই বটে! বলল হ্যালিওয়েল। তাই তো মনে হয়। ও কি বলল তোমাকে? ওর ইচ্ছে ছিল গুয়াডিলুপে গিয়ে একটা জাহাজ আর লোক নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সেটা আর সম্ভব হলো না। আমার মনে হয় না ব্যাপারটা ওর কাছে ভাল লাগছে। যদি জাহাজ আর লোক নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারত, তাহলে আজ ওর এই অসহায় অবস্থা হত না। তাই না? আর তুমিও নিশ্চয়ই ধরে নিচ্ছ না যে মোসু দো বাখনি জানে না তার ভাগ্যে কি ঘটতে পারে।

মনে করো জানে। তাহলে কি? এই অবস্থার পরিবর্তন কি করে করবে ও?

এই পর্যায়ে অসহিষ্ণু উওগান ঢুকে পড়ল আলোচনায়। আহ্, তোমার কি মনে হয় না ও সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত এখন?

যেন সাপের কামড় খেয়েছে– ঝট করে সিধে হলো লীচ। খুলে বলল উগান।

একশোলোক নিয়ে জাহাজে রয়েছে ও এখন। আমরা এখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে আছি। ও কি করছে? নানান গল্প আর বোলচাল মেরে হৃদয় জয় করছে ওদের, রাতে চাঁদের আলোয় প্রেম-পাগল হলো-বেড়ালের মত ওয়াও-ওয়াও ডাক ছেড়ে স্প্যানিশ গান শোনাচ্ছে ওদের, জাদু করছে। ওদের সঙ্গে ওকে বা ওঁকে ওদের সঙ্গে রেখে আমি বুঝি না তুমি নিশ্চিন্ত থাক কি করে! নেড আর আমি আছি ওখানে, কোনদিন জানি ঘুম থেকে উঠে দেখব আমাদের গলা কেটে পানিতে ফেলে দিয়ে পাল তুলে চলে যাচ্ছে জাহাজটা, একশো জোয়ান নিয়ে ছুটছে ও স্প্যানিয়ার্ডদের বিরুদ্ধে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে! আর তুমি, টম? কাত হয়ে পড়ে আছ ডাঙায়। কোনও উপায় নেই ওদের অনুসরণ করার, আর উপায় যদি থাকতও, জানা নেই কোন দিকে গেছে হারামজাদা!

হায়, খোদা! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লীচ। মনে হচ্ছে যেন সামনেই গভীর গিরিখাদ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে ঘোড়সওয়ার। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল ওর এতদিন এই সম্ভাবনার কথাটা মাথায় আসেনি বলে। সন্দেহের কালো ছায়া চঞ্চল করে তুলল ওকে। কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় বানড্রি, ভাবলেশহীন লাশটা নড়ে উঠল।

কোথায় চললে, ক্যাপটেন?

বানড্রির ঠাণ্ডা, কর্কশ গলা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল লীচ। লীচের অনুচরদের মধ্যে একমাত্র এই বানড্রির পক্ষেই ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলা সম্ভব। চেহারায় কোনও ভাবের ছায়া খেলে না, কিন্তু লোকটার খুলির মধ্যে যে অত্যন্ত বিচক্ষণ একটা মস্তিষ্ক রয়েছে তা সবার জানা। ওকে হিসেবে রেখে চলতে হয় সবাইকে, এমন কি, সময় বিশেষে লীচকেও।

চার্লি যেন কোন চালাকি করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে চললাম।

উঠে দাঁড়িয়েছে বানড্রিও। বলল, তবে একটা কথা খেয়াল রেখো, স্প্যানিশ ফ্লীটকে ধরতে হলে ওর ওপরই নির্ভর করতে হবে আমাদের।

কথাটা খেয়ালে আছে আমার। বেরিয়ে গেল লীচ। একটু পরেই শোনা গেল ওর গলা, কাউকে হুকুম করছে একটা বোটে করে ওকে সেন্টরে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। নৌকায় পা দেয়ার আগে অবশ্য উওগানকে ডেকে নিচু গলায় কিছু নির্দেশ দিল। উৎসাহের সঙ্গে মাথা ঝকাল উওগান, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে।

সেন্টরের গ্রেট কেবিনে ডিনার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমনি সময়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল ক্যাপটেন লীচ। ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে চোখ বুলাল তিনজনের উপর। প্রিসিলার উপর থেকে চোখ সরাতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে ওর। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে লালসা। কি করে যেন টের পেয়ে গেল প্রিসিলা, পাশ ফিরে তাকিয়েই চমকে উঠল দস্যুটাকে দাঁড়ানো দেখে। প্রথম দিনের সেই রক্তাক্ত বুক খোলা শার্ট পরা লীচের তুলনায় আজকের ক্যাপটেন লীচকে রীতিমত ভদ্রলোক বলে মনে হলো প্রিসিলার। কিন্তু সে শুধু বাইরের চেহারায়। পোশাকের নিচে যে কী সাঙ্ঘাতিক বুনো একটা জানোয়ার রয়েছে তা বুঝতেও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। শিউরে উঠল সে ভিতর ভিতর।

সম্ভবত ওর এই শিহরণ টের পেয়েই পিছন ফিরল মশিয়ে দো বাখনি। ওরও বুঝতে অসুবিধে হলো না, বিপদ উঠে এসেছে বুক পর্যন্ত। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, একটা খালি চেয়ার টেনে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, এই যে, ক্যাপটেন। তোমার হঠাৎ আগমনে আমরা সম্মানিত বোধ করছি।

এগিয়ে এল ক্যাপটেন লীচ। বসার দরকার নেই। যা বলতে এসেছি বলেই চলে যাব। দো বাখনিকে অনুসরণ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মেজর স্যান্ডস, তার দিকে মাথাটা সামান্য ঝাঁকিয়ে মাথা নিচু করে বাউ করল সে প্রিসিলাকে। ওর চোখে চকচকে লোভ দেখে কেঁপে গেল প্রিসিলার বুকটা, কিন্তু মাথাটা সামান্য কাত করে প্রত্যুত্তর জানাতে দেরি করল না।

আধবোজা চোখে চেয়ে রয়েছে মশিয়ে দো বাখনি। প্রিসিলার উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে তার দিকে চাইল এবার লীচ। সেন্টরের লোকজনের জন্যে ডাঙায় কোয়ার্টার তৈরি করার হুকুম দিয়েছি আমি। যতদিন ব্ল্যাক সোয়ানের মেরামতের কাজ চলবে, ততদিন ব্রা ডাঙাতেই থাকবে। ওর ক্ষুদ্রাকৃতি চোখজোড়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দো বাখনির মুখের দিকে, লক্ষ করছে সেখানে ভাবের কোনও পরিবর্তন দেখা যায় কি না। কথাটা বোঝা গেছে?

হুকুমটা, হ্যাঁ। কিন্তু কারণটা, না। ওরা এখানে আরামেই ছিল, তাছাড়া এতে সুবিধেও অনেক।

হতে পারে, কিন্তু এটা আমি চাইছি না। চাতুরি খেলে গেল ওর চোখে। আমার লোক আমি আমার নিজের হাতের মুঠোতেই রাখতে চাই, চার্লি।

বেশ তো, বলল দো বাখনি।

ওর এই নিরাসক্ত ভাব কিছুটা হতাশ করল লীচকে, কিন্তু সন্দেহ তাতে বাড়ল বৈ কমল না। কারণ মানুষকে ও বলতে শুনেছে: মরগানের ওই ফরাসী লেফটেন্যান্টকে যখন দেখবে ঢিলেঢালা, নিরাসক্ত; বুঝবে সেই মুহূর্তে সে অত্যন্ত সজাগ, সচেতন ও সতর্ক। এই মুহূর্তে বড়ই অমায়িক ভাব দেখা যাচ্ছে ওর মধ্যে।

একটু চুপ করে থেকে আবার প্রিসিলার দিকে ফিরল দস্যু। আবার একটু বাউ করে বলল, আমি আশা করি, মাদাম, আমার পরবর্তী আদেশ আপনাকে অসন্তুষ্ট বা আপনার অসুবিধে করবে না। ভেবেচিন্তেই নিয়েছি এ-সিদ্ধান্ত। এবার নিজের ওপর জোর খাটিয়ে নজর ফিরাল সে দো বাখনির দিকে। তোমাদের জন্যেও একটা কুটির বানানো হচ্ছে।

এতক্ষণে বিরক্তি প্রকাশ পেল দো বাখনির চেহারায়। এতটা কি সত্যিই দরকার আছে? আমরা এখানে বেশ আরামেই আছি। লীচের উদ্দেশ্য সে ঠিকই টের পেয়েছে, এটা বোঝাবার জন্যে এর সঙ্গে জুড়ে দিল, আমাদের পক্ষে এতবড় একটা জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

তর্জনী দিয়ে নিজের চিবুকে টোকা দিয়ে মৃদু হাসল লীচ। তোমরা তিনজন পুরুষ লোক থাকছ এ জাহাজে। তিনজনের পক্ষে কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।

কপালে উঠে গেল দো বাখনির ভুরুজোড়া, আশ্চর্য, লীচ! তুমি হাসালে দেখছি!

হাসো, বলল লীচ, যত খুশি। তবে আমি যা করছি, বুঝেই করছি। আচমকা আকাশ থেকে পড়েছ তুমি, চার্লি। হঠাৎ একটা প্রস্তাব দিয়েছ আমাকে। তেমনি হঠাৎই যদি তোমার মাথায় পালানোর বুদ্ধি ঢুকে পড়ে, তোমাকে ধাওয়া করে ধরব সে ক্ষমতা নেই আমার। কাজেই, আজই ডাঙায় চলে যাবে তুমি সবার সঙ্গে। প্রিসিলার দিকে ফিরল আবার। ক্ষমা করবেন, মাদাম, আশাকরি। আপনার যাতে কোন অসুবিধে না হয়, সেটা আমি দেখব। আসবাব যা ইচ্ছে নিতে পারবেন আপনি। ডাঙায় থাকলে মাঝেমাঝে দেখা হয়ে যাবে আমাদের– আমার জন্যে সেটা হবে মস্তবড় সৌভাগ্য।

লীচ বিদায় নিতেই ঢিলেঢালা, অমায়িক ভাবটা দূর হয়ে গেল মশিয়ে দো বাখনির চেহারা থেকে। মাথা নিচু করে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে কিছুক্ষণের জন্যে। মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল বাকি দুজন। একটু পরেই ধ্যান ভঙ্গ হলো যেন, সচকিত হয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল পিছনের পোর্ট হোলের সামনে। জোর কাজের ধুম পড়ে গেছে দ্বীপে, চারদিকে কর্মব্যস্ততা। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকার পর হেসে উঠল সে, লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল ওদের দিকে– যেন সমাধান পাওয়া গেছে কঠিন সমস্যার।

কিছু বুঝতে পারলাম না, বলল মেজর। আগামাথা কিছু না। আমাকে খুন করে।

সহজ ব্যাপার, ধৈর্যের সঙ্গে বুঝিয়ে দিল দো বাখনি। ওর ভয়, ওর লোকদেরকে আমি পটিয়ে ফেলব। আপনার মাথায় যেটা ঢুকছিল না বলে আমার প্রতি বিদ্রূপ করছিলেন একটু আগে, সেটা ওর মাথায় ঢুকে পড়েছে– তাই সে সুযোগটা বন্ধ করে দিল।

বলেন কি! দো বাখনির খোঁচাটা গায়ে মাখল না মেজর, বিস্মিত কণ্ঠে বলল, সত্যিই তাই ছিল আপনার মনে?

বিরক্ত হলো দো বাখনি। আমার মনের কথা আপনাকে বলছি না আমি, মেজর; বলছি টম লীচের মনের কথা। বড়ই বিষাক্ত একটা মন। বিষাক্ত এবং ভয়ঙ্কর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *