১. মেজর স্যান্ডসের সম্পদ

দ্য ব্ল্যাক সোয়ান / রাফায়েল সাবাতিনি / রূপান্তর: কাজী আনোয়ার হোসেন

০১. মেজর স্যান্ডসের সম্পদ

বার্বাডোজ থেকে যাত্রা শুরু করে খাওয়ার পানি নেয়ার জন্য ফোর্ট রয়ালে নোঙর ফেলেছে হলুদ রঙ করা, ছিমছাম, পাল তোলা জাহাজ সেন্টর গ্রিীক পুরানের এক বিচিত্র জীব বুক পর্যন্ত মানুষ, নিচের দিকটা ঘোড়া]। শুধু পানিই নয়, এই সুযোগে প্রচুর ফলমূল তরিতরকারী কিনে নিচ্ছে নিগ্রো স্টুয়ার্ড ও বাবুর্চি।

জাহাজে ওঠার সিঁড়ির মাথায় কড়া ইস্তিরি দেয়া নীল কোট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যাপটেন ব্র্যানসাম– কোকো, মশলা আর আদা বিক্রেতা এক অতি আগ্রহী ইহুদিকে কিছুতেই উঠতে দেবেন না জাহাজে।

জেটিতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় এপাশ-ওপাশ দুলছে অনেকগুলো জাহাজের উঁচু মাস্তুল। তার পিছনে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট শহর ফোর্ট রয়ালের সাদা বাড়িগুলো। উত্তরে নীল আকাশে সদম্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আগ্নেয়গিরি মন্ট পেলে।

ক্যাপটেন ব্র্যানসামের দৃষ্টি কাকুতি-মিনতি রত ইহুদির ওপর থেকে বার বার স্থির হচ্ছে গিয়ে আধমাইল দূরে অগ্রসরমান একটা নৌকার ওপর। এইদিকেই আসছে ওটা। গরম পড়েছে খুব, কালো হ্যাটটা মাথা থেকে নামালেন তিনি, ভুরু থেকে আঙুল দিয়ে ঘাম ঝরিয়ে আবার চাইলেন লং বোটার দিকে।

সেন্টরের পিছনে উঁচু ডেকে পুরনো পালের তৈরি চাঁদোয়ার ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে অপরূপ সুন্দরী এক যুবতী, মিস প্রিসিলা হ্যারাডিন। আর সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরঘুর করে তার আরাম-আয়েশের তদারকি করছে মেজর স্যান্ডস। গরম লাগছে তারও। গত পাঁচ বছর এই এলাকায় কাটিয়েও আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি সে।

স্বেচ্ছায় বিদেশে চাকরি নিয়েছিল মেজর স্যান্ডস ভাগ্যক্রমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারে, এই আশায়। তাছাড়া তার বাবা যখন ওদের উইল্টশায়ারের এস্টেটটা জুয়া আর মদের পিছনে উড়িয়ে দিল, এছাড়া তার আর কোন উপায়ও ছিল না।

মেজর সংযত চরিত্রের মানুষ-ধীর, স্থির, ঠাণ্ডা, হিসেবি। সেই সঙ্গে কিছুটা বুদ্ধির ছিটেফোঁটা থাকলেই যে-কোনও মানুষ জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিধাতা ওই জিনিসটা একেবারেই দেননি তাকে, এমন কি বুদ্ধির যে অভাব আছে তা টের পাওয়ার ক্ষমতাও দেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার আশা পূর্ণ হতে চলেছে

অন্তত এটাই তার বিশ্বাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সে এসেছিল ঐশ্বর্যের অন্বেষণে, হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে হাতের মুঠোয় এসে গেছে সেটা।

ঐশ্বর্যটি, যেটা সে পেয়ে গেছে, বা যখন খুশি চাইলেই নিজের দখলে নিতে পারে; সেটি এখন শুয়ে আছে পালের কাপড় দিয়ে তৈরি চাঁদোয়ার নিচে। মেয়েটি রূপে-গুণে অতুলনীয়। সোনালী চুলের নিচে যে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত একটি মস্তিষ্ক আছে, তা বোঝা যায় ওর ঝকঝকে নীল চোখের দিকে চাইলে। এই মুহূর্তে মেয়েটি হাতে ধরা পাখাটা দোলাচ্ছে অল্প অল্প।

ওর বাবা, স্যার জন হ্যারাডিন, মেজর স্যান্ডসের মত একই উদ্দেশ্যে এসেছিলেন দেশ ছেড়ে এত দূরে। তারও সম্পদের ভাণ্ডার তলায় এসে ঠেকেছিল। নিজের এবং মাতৃহারা একমাত্র সন্তান এই মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই লীওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জের ক্যাপটেন– জেনারেলের পদটা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কলোনির যে-কোনও বুদ্ধিমান গভর্নরের জন্য প্রতি পদে অঢেল সম্পদ আহরণের সুযোগ রয়েছে। চাকরি-জীবনের ছয়টি বছর তিনি সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন –তারপর হঠাৎ জ্বরে পড়ে অকালে মারা গেছেন। কিন্তু ততদিনে মেয়ের জন্যে কেন্টে বিশাল এক সম্পত্তির ব্যবস্থা ও ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা জমা হয়ে গেছে।

মৃত্যুর আগে তিনি মেয়েকে বলে গেছেন, দেশে ফিরে তাঁর বোনের কাছে গিয়ে উঠতে, তার কথা মত চলতে।

বাবাকে হারিয়ে একজন সুবন্ধু হারাল প্রিসিলা। তবে গভীর বিষাদে তলিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ ও বন্ধুত্ব দিয়ে রক্ষা করেছে মেজর স্যান্ডস্।

বার্থোলোমিউ স্যান্ডস ছিল ক্যাপটেন-জেনারেলের সেকেন্ড-ইন–কমান্ড। গভর্নর হাউজেই থাকত সে, ফলে গত কয়েক বছরে প্রিসিলা তাকে পরিবারের একজন বলেই মনে করতে শুরু করেছিল। বিপদের সময় লোকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ায় কৃতজ্ঞচিত্তে তার ওপর নির্ভর করতেও শুরু করল। ফলে আশার আলো জ্বলে উঠল মেজর স্যান্ডসের বুকে। স্যার জনের মৃত্যুর পর তাকে যে অ্যান্টিগুয়ার গভর্নর করার সম্ভাবনা, অতি ক্ষীণ, এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তার মাথাতেও আছে। যদিও তার ধারণা এ-দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশিই ছিল তার। কিন্তু এ তো জানা কথাই যে, দেশ থেকে এখন একজন অনভিজ্ঞ, অযোগ্য লোক বাছাই করে বসিয়ে দেয়া হবে তার মাথার ওপর।

এটা বোঝার পরই মনস্থির করে ফেলেছে স্যান্ডস, তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব এখন মিস্ প্রিসিলার সেরা করা। এই কথা বলে মেয়েটার কাছে সে একজন নিঃস্বার্থ, মহান ব্যক্তির সম্মানও আদায় করে নিয়েছে। মেয়েটি এখন তার কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। প্রিসিলার ধারণা, তার বাবার মৃত্যুর পর ওই পদে স্বাভাবিক ভাবে স্যান্ডসেরই বসার কথা। এই ভুল ভাঙানোর কোনও আগ্রহ বোধ করেনি মেজর স্যান্ডস। বরং ভাব দেখিয়েছে, প্রিসিলার ভালমন্দ দেখা তার কাছে গভর্নর হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাকে এখন ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে, এই দীর্ঘ যাত্রায় কত রকম আপদ-বিপদ ঘটতে পারে। অরক্ষিত অবস্থায় একা একা তাকে সে কিছুতেই এত দূরের পথে যেতে দিতে পারে না। যদিও এখানের কাজ ফেলে প্রিসিলাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ায় গভর্নরশিপের পদটা তাকে হারাতে হচ্ছে, কিন্তু প্রিসিলার প্রতি তার যে দায়িত্ব সেটা এসবের চেয়ে অনেক বড়। এমন কি ওর বাবা বেঁচে থাকলে এটাই সমর্থন করতেন।

প্রিসিলার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ক্যাপটেন গ্রের হাতে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সেন্টরে চেপেছে সে। সঙ্গে অবশ্য নিগ্রো এক চাকরানী ছিল, কিন্তু সমুদ্রযাত্রায় মহিলা এতই অসুস্থ হয়ে পড়ল যে তাকে বার্বাডোজে নামিয়ে দিতে হয়েছে। এর ফলে স্যান্ডস আরও খুশি, মেয়েটিকে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার মাধ্যমে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার সাধনায় আর কোন ছেদ পড়বে না।

অনেক ভেবে সেন্টরকে পছন্দ করেছে মেজর স্যান্ডস: জাহাজটা ছিমছাম, কেবিনগুলো প্রশস্ত, সমুদ্রযাত্রার জন্য খুবই উপযোগী। অবশ্য দেশে রওনা হওয়ার আগে ক্যাপ্টেন ব্যক্তিগত কাজে দক্ষিণে বার্বাডোজের দিকে নিয়ে যাবে জাহাজ, তবে তাতে বরং তার লাভই; তাড়াহুড়ো তার পছন্দ নয়, ধীরে-সুস্থে প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে স্যার জন হ্যারাডিনের উত্তরাধিকারীর মনটা নিজের দিকে ফেরাতে হলে যাত্রা যত ধীর হয় ততই ভাল। সুযোগ একটা এসেছে বটে, কিন্তু সেটা নিজের অনুকূলে আনতে হলে কিছুটা সময় তো দরকারই।

মেয়েটিকে জয় করবার প্রধান বাধা তার বয়স। এ-বাধা অতিক্রম করতে হলে যে তার বেশ অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হবে, তা সে ধরেই নিয়েছে।

এখনও পঁচিশ হয়নি মিস প্রিসিলার, আর মেজর স্যান্ডসের বয়স বর্তমানে পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে– সোনালী পরচুলার নিচে চাদিটা প্রায় ফরসা। প্রথম দিকে মেয়েটির ব্যবহারে সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে তার বয়স সম্পর্কে ওর ধারণা স্পষ্ট, তাকে বাপ-চাচাঁদের পর্যায়ে বসিয়ে রীতিমত শ্রদ্ধা-ভক্তি-সমীহ করছে। ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়ে সে এখন অনেক কৌশলে, সূক্ষ্ম আকার ইঙ্গিতে মেয়েটিকে বোঝাবার চেষ্টা করছে এটা তেমন বড় কোন বাধা নয়। এখন এই দীর্ঘ যাত্রায় সে আশা করছে পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারবে। প্লিমাউথ রোড়সে নোঙর ফেলার আগেই যদি এই আকর্ষণীয়, সম্পদশালী, অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির মন তার দিকে ফেরাতে না পারে, তাহলে তার সমস্ত পরিশ্রম পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হবে। এই আশাতেই হিসেব কষে সে অ্যান্টিগুয়া ছেড়েছে। তবে জুয়ায় আস্থা নেই মেজর স্যান্ডসের –নিজের ওপর তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে, যে কাজে হাত দিয়েছে তাতে সে সফল হবেই হবে। মেয়েটির আরাম-আয়েশের দিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে সে: একটু আগে বালিশ এনে দিয়েছে কেবিন থেকে, এ-মুহূর্তে রূপোর কৌটোয় করে বিখ্যাত পেরুভিয়ান মিষ্টান্ন এনে ধরেছে মেয়েটির মুখের সামনে। মেয়ের মন না গলে যাবে কোথায়?

আপনি আমার জন্যে এত করছেন, মেজর স্যান্ডস, মিষ্টি হেসে বলেছে প্রিসিলা, যে ফিরিয়ে দিলে খারাপ দেখায়। কিন্তু… মাথা নাড়ল সে এপাশ-ওপাশ।

কপট রাগ দেখাল মেজর। আমাকে যদি সারাক্ষণ মেজর স্যান্ডস বলে ডাকতে থাক, তাহলে যাও, তোমার জন্যে আর কখনও কিছু আনব না। আপন লোকেরা আমাকে বার্থোলোমিউ বলে ডাকে। বুঝলে, বার্থোলোমিউ।

সুন্দর নাম, বলল মেয়েটি। তবে বেশি সুন্দর, আর অতিরিক্ত লম্বা। এই গরমে উচ্চারণ করার পক্ষে বেশ কঠিন।

আগ্রহের আতিশয্যে মেয়েটির কণ্ঠে হালকা ব্যঙ্গের আভাস টের পেল না মেজর। বলল, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে বার্ট বলে ডাকে। তুমি ইচ্ছে করলে ওই নামেই আমাকে ডাকতে পার, প্রিসিলা, সে অধিকার আমি দিচ্ছি তোমাকে।

ধন্যবাদ, বার্ট, মৃদু হেসে বলল মেয়েটা। আমি সম্মানিত বোধ করছি।

জাহাজের ঘণ্টিঘর থেকে দুটো করে চারবার ঘণ্টা বাজল। উঠে বসল মেয়েটা। আশ্চর্য! আটটা ঘণ্টা পড়ল, অথচ আমরা এখনও এখানে! ক্যাপটেন তো বলেছিলেন আরও আগেই আমাদের রওনা হয়ে যাওয়ার কথা। এত দেরি কিসের?

উঠে ছায়া থেকে বেরিয়ে এল প্রিসিলা। মেয়েটার পাশে ছায়ার মত লেগে থাকল মেজর স্যান্ডস। পিছনের খোলা ডেক থেকে দেখা গেল, হতাশ ইহুদি ফিরে যাচ্ছে ঘাটে, অন্যান্য বিক্রেতারাও পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে এতক্ষণ যে লং বোটটা দেখছিলেন ক্যাপটেন ব্র্যানসাম, সেটা এসে ভিড়ছে এখন জাহাজের গায়ে।

নৌকার ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে রূপার লেস লাগানো হালকা নীল টাফেটার স্যুট, পরা দীর্ঘ, ঋজু, শক্তিশালী এক লোক। কালো হ্যাঁটে গোঁজা একটা উটপাখির পালক। দস্তানা থেকেও ঝুলছে অনেকগুলো সূক্ষ্ম লেস।

আজিব চিড়িয়া! সাজগোজের বাহার দেখে তাজ্জব হয়ে গেছে মেজর স্যান্ডস। বলে উঠল, কে হতে পারে লোকটা?

আরও অবাক হয়ে গেল সে, যখন দেখল আশ্চর্য সাবলীল ভঙ্গিতে মই বেয়ে উঠে এল লোকটা। তার পিছনে একজন দো-আঁশলা লোক হালকা মালপত্র বয়ে আনছে। একটা চামড়ার থলে বিশেষ ভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করল মেজরের– পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ওতে ঠাসা রয়েছে স্বর্ণমুদ্রা। কয়েকটা পিস্তলের রূপালি বাঁটও দেখা গেল মালপত্রের সঙ্গে।

কয়েক মুহূর্ত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আগন্তুক কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে, তারপর ক্যাপটেনের অভিবাদনের জবাবে মাথা থেকে হ্যাট খুলে সামনে ঝুঁকে সম্মান জানাল।

ক্যাপটেন একটা হাঁক ছাড়তেই দুজন লোক মেইন হ্যাঁচ থেকে ক্যানভাসের ফিতে এনে ঝুলিয়ে দিল জাহাজের কিনারা দিয়ে নিচে। একটু পরেই দেখা গেল বড়সড় দুটো বাক্স টেনে তোলা হচ্ছে ডেকের ওপর।

লোকটা থাকবে বলে মনে হচ্ছে, বলল মেজর স্যান্ডস।

চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও লোক, বলল প্রিসিলা।

কথাটা পছন্দ হলো না মেজরের। বলল, তুমি বাইরের আঁক– জমক দেখে বিচার করছ, প্রিসিলা। বাইরের সাজ আসলে ধোঁকা দেয়। সঙ্গের লোকটাকে খেয়াল করে দেখো, ঠিক যেন জলদস্যু।

আমরা ইন্ডিজে রয়েছি, বার্ট, বলল মেয়েটি।

তা রয়েছি। সেজন্যেই তো বলছি, এখানে ওই বীরপুঙ্গবকে একেবারেই মানাচ্ছে না। ভাবছি, কে হতে পারে লোকটা!

বোসানের তীক্ষ্ণ বাঁশী বেজে উঠল এ সময়, হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল জাহাজের খালাসীরা। নোঙর তোলার আওয়াজ এল। একদল ছুটেছে পাল তোলার জন্য। মেজর বুঝতে পারল এই লোকটির জন্যেই এতক্ষণ থেমে ছিল জাহাজ, দেরি করা হচ্ছিল একেই তুলে নেয়ার জন্যে। দ্বিতীয়বারের মত উত্তর-পুবের বাতাসকে প্রশ্ন করল সে, ভাবছি, কে এই লোক?

স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছে মেজর স্যান্ডস সেন্টরে তৃতীয় একজন যাত্রী ওঠায়। এর ফলে বিঘ্ন হবে প্রিসিলার সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গ, নিভৃত আলাপচারিতায়।

.

০২.

মশিয়ে দো বাখনি

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডিনারে বসে জানা গেল নবাগতর পরিচয়। কিন্তু জানার চেয়ে অনেক বেশি অজানা রয়ে গেল রহস্যময় লোকটা। কৌতূহল নিবৃত্ত না হয়ে বরং আরও বেড়ে গেল কয়েকগুণ।

ক্যাপটেন ব্র্যানসাম-পরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের সবার। নামটা: মশিয়ে চার্লস দো বাখনি। বোঝা গেল ভদ্রলোক ফ্রেঞ্চ, তবে এত সুন্দর উচ্চারণে সাবলীল ইংরেজি বলে যে কথা শুনে বিদেশী বলে বোঝার উপায় নেই। অবশ্য খুব খেয়াল করলে কাঁধ ঝাঁকানোর ভঙ্গি, সৌজন্য প্রকাশের আতিশয্য ও খোলামেলা আচরণ থেকে আঁচ করা যায় যে লোকটা ইংরেজ নয়। প্রথম দর্শনেই এই সুদর্শন বিদেশীকে অপছন্দ হয়েছে মেজর স্যান্ডসের, পরিচিত হয়ে সেটার মাত্রা কিছুটা বাড়ল শুধু। বিদেশী সবকিছু তার দুচোখের বিষ।

মশিয়ে দো বাখনি খুবই লম্বা বলে কিছুটা চিকন দেখায়, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী। বয়স পঁয়ত্রিশের নিচেই। চেহারাতে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে– তেমনি চোয়ালের উঁচু হাড়, পুরু ঠোঁটের ওপর ছোট্ট কালো গোঁফ, কুচকুচে কালো জ্বর নিচে গাঢ় আয়ত চোখ, এমনিতে কোমল দৃষ্টি, কিন্তু কারও দিকে সরাসরি তাকালে সে বিব্রত, বিচলিত হয়ে পড়ে।

সহযাত্রীদের কৌতূহল মেটাবার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না নবাগতর মধ্যে। অতি সৌজন্য প্রকাশের মাধ্যমে আড়াল করে রাখল সে নিজেকে। মনে হলো আপন চিন্তায় মগ্ন। গন্তব্য সম্পর্কে ক্যাপটেনের সঙ্গে একটু আগে যা আলাপ হচ্ছিল তার সূত্র ধরল সে প্রথম সুযোগেই।

বেশ তো, না হয় ম্যারিগ্যালান্তে জাহাজ না-ই নিলেন, একটা বোটে করে তো আমাকে তীরে পৌঁছে দিতে পারেন।

আপনি আমার অসুবিধে ঠিক বুঝতে পারছেন না, বললেন ক্যাপটেন। গুয়াডিলুপের দশ মাইলের মধ্যে যাচ্ছি না আমি। বিপদ যদি ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে তার মোকাবিলা করতে রাজি আছি আমি, কিন্তু নিমন্ত্রণ করে বিপদ ডেকে আনতে রাজি নই। এটাই আমার জীবনের শেষ যাত্রা, আমি চাই এটা নিরাপদ যাত্রা হোক। ডেভনে আমার স্ত্রী আর চার বাচ্চা আছে, বাকি জীবন আমি ওদের সঙ্গে কাটাতে চাই। গুয়াডিলুপ হচ্ছে জলদস্যুদের আস্তানা, ওর থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। সেইন্ট ক্রয় পর্যন্ত যাওয়ায় রাজি হওয়া যায় বড় জোর, তবে সেটাও আমি নিরাপদ বলে মনে করি না।

তাই বুঝি? মৃদু হেসে নাক সিটকাল ফরাসী লোকটা ছি-ছি করার ভঙ্গিতে, অপর হাতে ধরা গ্লাস থেকে মদ পান করল।

খেপে গেলেন ব্র্যানসাম। আপনি হাসতে পারেন, মোশো, কিন্তু আমার হাসি আসছে না। আপনাদের ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীই তো পোষে ওই ডাকাতদের। যাক, বেশি কথার দরকার নেই, সেইন্ট ক্রয় পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যাব বলেছি, ব্যস, ওই পর্যন্তই। আমাকে কেটে ফেললেও গুয়াডিলুপে যাব না।

নড়ে উঠল প্রিসিলা, ঝুঁকে এল সামনে। আপনি জলদস্যুর কথা বলছেন, ক্যাপটেন ব্র্যানসাম?

হ্যাঁ! জবাব দিলেন ব্র্যানসাম, যা বলেছি সত্য বলেছি। প্রিসিলা ভয় পেয়েছে মনে করে আলোচনায় প্রবেশ করল মেজর। এসব কথা মেয়েদের সামনে না বলাই ভাল। তবে আজকাল আর বাচ্চাদেরও ভয় দেখানো যায় না এসব বলে। রেগে গিয়ে ভুরু কুঁচকে হ করে উঠলেন ক্যাপটেন ব্র্যানসাম। কিন্তু পরোয়া না করে বলেই চলল মেজর, জলদস্যুদের দিন অতীত হয়ে গেছে।

লাল হয়ে উঠল ক্যাপটেনের মুখটা। রাগ সামলে নিয়ে বিদ্রুপের সুরে বললেন, তা বটে। আজকের ক্যারিবিয়ান আসলে ইংলিশ লেকের মতই নিরাপদ! তারপর পূর্ণ মনোযোগ দিলেন প্লেটের দিকে।

এবার মেজর স্যান্ডস ধরল মশিয়ে দো বাখনিকে। তাহলে সেইন্ট ক্রয় পর্যন্ত যাচ্ছেন আপনি আমাদের সঙ্গে?

তার বেশি নয়, সংক্ষেপে জবাব দিল মশিয়ে দো বাখনি।

এর অর্থ; আমাকে ঘাঁটিয়ো না। কিন্তু সে ইঙ্গিত বুঝল না মেজর, জিজ্ঞেস করল, সেইন্ট ক্রয়ে কাজ আছে বুঝি আপনার?

না, কাজ নেই। একটা জাহাজ দরকার। ফ্রান্সে যাব।

লোকটার বোকামি দেখে অবাক হয়ে গেল মেজর। বলল, কিন্তু এই চমৎকার জাহাজে করেই তো আরামসে প্লিমাউথ পর্যন্ত যেতে পারেন আপনি, তারপর ওখান থেকে একটা বোট নিয়ে চ্যানেল পেরোলেই ফ্রান্স।

ঠিক, বলল মশিয়ে দ্য বাখনি। ঠিক বলেছেন। কথাটা মাথায় আসেনি আমার।

এবার ভয় পেল মেজর স্যান্ডস। বিশেষ করে তার কথার সূত্র ধরে প্রিসিলা যখন জানতে চাইল, তাহলে আপনি থাকছেন আমাদের সঙ্গে, মশিয়ে? মেজরের মনে হলো নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছে সে।

মেয়েটির দিকে স্থির, জ্বলজ্বলে চোখে চাইল মশিয়ে দো বাখনি, মুখে মধুর হাসি। বিশ্বাস করুন, মাদামোয়াযেল, আপনি চাইলে যে কেউ বাধ্য হবে তাই করতে।

কথা শুনে আত্মা চমকে গেল মেজরের, নাক ঝেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করল। কিন্তু না, লোকটার পরবর্তী কথায় আশ্বস্ত হলো সে আবার। লোকটা বলছে, কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, আমার এক বন্ধু অপেক্ষা করছে সেইন্ট ক্রয়ে, তার সঙ্গে আমার ফ্রান্সে যাওয়ার কথা।

তবে যে গুয়াডিলুপে নামতে চাইছিলেন? ফস্ করে বলে বসল মেজর। সেইন্ট ক্রয়ে তো নামতে বাধ্য হচ্ছেন আপনি ক্যাপটেন কিছুতেই রাজি না হওয়ায়, তাই না?

কথার গরমিল ধরিয়ে দিয়ে মশিয়ে দো বাখনিকে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেল মেজর। ধীর ভঙ্গিতে তার দিকে ফিরল ফরাসী লোকটা, হাসিটা রয়েছে মুখে, কিন্তু মাধুর্য হারিয়ে সে হাসিতে রয়েছে এখন একটা আমুদে তিরস্কারের ভঙ্গি।

ভদ্রতার খাতিরে মহিলাকে বলা কোনও কথার দোষ কি ধরতে আছে, মেজর স্যান্ডস? আসলে বলতে চাইছি, সহৃদয় মানুষের আচরণ। কি বলা যায় একে?

লজ্জা পেল মেজর স্যান্ডস ফরাসী লোকটার মুখে করুণার হাসি দেখে। অস্বস্তি বোধ করছে। ফট করে বলে বসল, মিথ্যাচারের কারণটা কি, মশিয়ে?

তাহলে বলুন, ভদ্রতারই বা কারণ কি? সৌজন্যের খাতিরে বলা কোনও কথাকে ইচ্ছে করলেই মিথ্যা বলা যায়। যার যেমন অভিরুচি। নির্দোষ কপটতার দায় যদি আমার ওপর চাপাতে চান, তাহলে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন কর্কশ সারল্যের দায়ে দোষী হিসেবে। আমরা কেউ কারও চেয়ে কম দোষী নই।

একথা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না, বলল স্যান্ডস। মেরে ফেললেও না।

তাহলে মাদামোয়াযেলই বলুন, কে বেশি দোষী, হাসতে হাসতে বলল মশিয়ে বাখনি।

কিন্তু সোনালী মাথাটা নাড়ল মিস্ প্রিসলি। উঁহু! তাহলে আপনাদের যেকোন একজনের বিরুদ্ধে রায় দিতে হবে আমাকে। বড়ই অপছন্দনীয় কাজ।

আপনাকে জড়ানো ভুল হয়েছে আমার, দয়া করে মাফ করবেন। ব্যাপারটা তাহলে অমীমাংসিতই থাক। বলেই ক্যাপটেন ব্র্যানসামের দিকে ফিরল ফ্রেঞ্চম্যান। আপনি কি ডোমিনিকায় থামছেন, ক্যাপটেন?

এরপর অন্য খাতে বইল আলাপচারিতা। অস্বস্তির সঙ্গে টের পেল মেজর স্যান্ডস, কিভাবে যেন হারিয়ে দিয়েছে তাকে ফরাসী লোকটা। ডিনারের পর প্রিসিলাকে পিছনের ডেকে একা পেয়ে বলল মেজর, মনে হচ্ছে, মিথ্যা ধরা পড়ে যাওয়ায় আমার ওপর রেগে গেছে ফরাসী লোকটা।

ডিনার-টেবিলে ফরাসী লোকটার প্রতি মেজরের খারাপ আচরণ ক্ষুব্ধ করেছে প্রিসিলাকে। আবার এখন সেই প্রসঙ্গ তোলায় খুবই বিরক্ত হলো সে।

কই, ধরা পড়ল কখন? বলল ও, আমি তো খেয়াল করিনি!

কী বলছ তুমি… চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে মেজরের। তারপর হা-হা করে হেসে উঠল। তুমি খেয়ালই করোনি? উল্টোপাল্টা কথা বলছিল তো লোকটা। আমি ওর চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি যে আমার সঙ্গে ধানাই-পানাই চলবে না। ধরা পড়ে রেগে গেছে ব্যাটা।

রাগটা বড় সুন্দর ভাবে গোপন করেছেন ভদ্রলোক, বলল প্রিসিলা।

অ্যাঁ? ও, হ্যাঁ, কপটতা ভাল জানে। তবে আমি ঠিক কায়দা মতই চেপে ধরেছিলাম। একেবারে টুটি টিপে। আসলে ও গুয়াডিলোপে যেতে চায়। কেন? কি গোপন করছে লোকটা উল্টোপাল্টা কথা বলে?

সে যাই হোক, ও নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।

তুমি খুব সহজ ভাবে নাও সবকিছু। কিন্তু আমি একজন সরকারী অফিসার, আমার তো তা করলে চলে না, প্রিসিলা। এদিকের সাগরে কি চলছে খোঁজ-খবর নেয়া আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

এত ভাবনার কি আছে? দুদিন পর লোকটা নেমেই তো যাচ্ছে।

তা যাচ্ছে। এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

 ধন্যবাদের কি হলো বুঝলাম না, বিরস কণ্ঠে বলল প্রিসিলা। মিশিয়ে দো বাখনির মত একজন প্রাণবন্ত মানুষ থাকলেই বরং যাত্রাটা আনন্দে কাটত, ধন্যবাদ দেয়া যেত ঈশ্বরকে।

কপালের মাঝখানে উঠে গেল মেজরের জোড়া। বল কি! ওকে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে তোমার?

আপনার মনে হয়নি? আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আপনার প্রতিটা আক্রমণ প্রতিহত করেননি উনি?

বুদ্ধিমত্তা! হায়, খোদা! একটা মিথ্যে বলতে গিয়ে যে-লোক লেজে-গোবরে করে ফেলে তার মধ্যে তুমি বুদ্ধিমত্তা খুঁজে পেলে!

কালো একটা হ্যাট দেখা গেল কোয়ার্টারডেকে। কম্প্যানিয়ন ওয়ে ধরে উঠে আসছে মশিয়ে দো বাখনি আফটার ডেকে। মেজরের কাছে এটাকে মনে হলো অনাহূত অনুপ্রবেশ, কিন্তু প্রিসিলার চোখজোড়া খুশিতে ঝিকমিক করে উঠল তাকে দেখে। একপাশে একটু সরে বসার জায়গা করে দিল সে মশিয়ে বাখনিকে। লোকটাকে সে-জায়গায় বসতে দেখে বুকের ভিতরটা পুড়তে শুরু করল মেজরের, কিন্তু মুখের চেহারায় ঠাণ্ডা, পরিশীলিত একটা ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করল সে।

মার্টিনিক এখন ঝাপসা মত দেখা যাচ্ছে দিগন্তে। সব কটা পাল তুলে তরতর করে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে সেন্টর উত্তর-পুবের ঝিরঝিরে অনুকূল হাওয়া পেয়ে। মশিয়ে দো বাখনি বলল, এই বাতাসটা পাওয়ায় সুবিধে হয়েছে অনেক, এটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। বছরের এই সময়টায় সাধারণত উত্তরা বাতাস বয়। পুবের ধাক্কাটা বজায় থাকলে আগামীকাল ভোরের আগেই ডোমিনিকা ছেড়ে অনেক দূরে সরে যাবে জাহাজ।

পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় মেজর। মশিয়ে দো বাখনিকে নিজের জ্ঞানের বহর দেখিয়ে মুগ্ধ করতে চাইল। আমি অবাক হচ্ছি, গুরুত্বহীন একটা ফরাসী বন্দর রোসোতে কেন চলেছে ক্যাপটেন ব্র্যানসাম। ওখানে তো জনা কয়েক ক্যারিব ছাড়া আর কিছুই নেই।

চট করে উত্তর দিল মশিয়ে বাখনি। সাধারণ কার্গোর বেলায়, আপনার কথাটা ঠিকই আছে, মেজর; রোসোয় যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু যে ক্যাপটেন কোম্পানির অনুমতি নিয়ে নিজেও কিছু কিছু ব্যবসা করে, তার জন্যে এ জায়গা খুবই লাভজনক হতে পারে। সম্ভবত এই জন্যেই ওদিকে চলেছে ক্যাপটেন ব্র্যানসাম।

আন্দাজটা যে সঠিক, তা বোঝা গেল পরদিন। রোসোয় নোঙর ফেলেই চামড়া কিনতে ছুটলেন ব্র্যানসাম। মার্টিনিকের তুলনায় অর্ধেক দাম এখানে চামড়ার। প্রচুর জায়গা রয়েছে জাহাজের হোল্ডে, ঠেসে ভরা হবে যতটা পারা যায়– ইংল্যান্ডে অনেক দাম পাওয়া যাবে এ চামড়ার।

দরদাম করে চামড়া কিনতে দু-একদিন দেরি হবে এখানে। তাই মশিয়ে দো বাখনি ডাঙায় গিয়ে গ্রাম থেকে ঘুরে আসার প্রস্তাব দিল সহযাত্রীদের। এক কথায় রাজি হয়ে গেল প্রিসিলা ফলে মেজর স্যান্ডসকেও যেতে হলো সঙ্গে।

তিনজনের জন্যে তিনটে ঘোড়া ভাড়া করা হলো। সহকারী হিসেবে সঙ্গে গেল দো বাখনির দো-আঁশলা ব্যক্তিগত পরিচারক, পিয়েখ। ওরা দেখতে চলল ডোমিনিকার বিখ্যাত ফুটন্ত লেক, আর লেইউ নদীর দুই তীরের ফসলী জমি।

সঙ্গে পাহারাদার নেয়ার জন্যে জেদ ধরেছিল মেজর, কিন্তু প্রস্তাবটা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল দো বাখনি। তার বক্তব্য: ডোমিনিকার ক্যারিবরা অত্যন্ত শান্ত, দ্র ও বন্ধুবৎসল লোক; ওদের তরফ থেকে ক্ষতি হওয়ার কোনই আশঙ্কা নেই।

যদি তা না হতো, জোরের সঙ্গে বলল সে, তাহলে জাহাজের সমস্ত লোক একসঙ্গে চেষ্টা করেও আমাদের রক্ষা করতে পারত না। আর আমিও কিছুতেই দ্বীপটা ঘুরে দেখার প্রস্তাব দিতাম না।

দুজনের মাঝখানে চলেছে প্রিসিলা। কিন্তু কথাবার্তা হচ্ছে মূলত বুদ্ধিমান, সুরসিক দো বাখনির সঙ্গেই। হাসি-গল্পে জমিয়ে রাখল লোকটা সারা দিন। ভেতর ভেতর যন্ত্রণা বোধ করলেও সহ্য করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই মেজর স্যান্ডসের। একমাত্র সান্তনাঃ দু একদিনেই বিদায় হবে আপদ।

প্রিসিলা এই লম্বা ঠ্যাঙের কুড়াল-মুখো লোকটার মধ্যে এত কি পেল তা ওর মাথায় ঢুকছে না। ওর চোখে-মুখে আনন্দ ও বিস্ময় খেলা করতে দেখেছে মেজর। যেন জ্বলজ্বলে ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে ধাধিয়ে গেছে ওর চোখ। এই লোকের সংস্পর্শে বেশি দিন থাকলে কি ঘটতে পারত, ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠছে সে ক্ষণে ক্ষণে। খোদাকে ডাকছে, প্রিসিলার বিশাল সম্পত্তির কথা যেন ব্যাটা টের না পায়, তাহলে এ জোঁককে সহজে আর ছাড়ানো যাবে না– নিজেকে দশগুণ আকর্ষণীয় করে তুলে ধরবে মেয়েটার সামনে।

লোকটা যে একজন ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে ভবঘুরে তাতে কোন সন্দেহ নেই মেজর স্যান্ডসের। তার ধারণা, এক নজর দেখেই যে-কোনও লোকের চরিত্র বোঝার ক্ষমতা সে রাখে। এই লোকটাকে চিনতে তার ভুল হয়নি। এ যে ভাগ্যান্বেষী এক সুযোগসন্ধানী, তার প্রমাণ পেয়ে গেল সে সেই সন্ধ্যাতেই।

জেটিতে পৌঁছে ঘোড়াগুলো ফেরত দেয়ার সময় একজন রুক্ষ চেহারার লোক, অপরিষ্কার জামায় যার মদ আর তামাকের গন্ধ, ক্যাপটেন ব্র্যানসামের সঙ্গে চামড়া নিয়ে দরকষাকষি করতে করতে হঠাৎ থমকে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল দো বাখনির মুখের দিকে। তারপর তার ভাঁজপড়া মুখে দুর্বোধ্য এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। মাথা থেকে তোবড়ানো টুপিটা সরিয়ে কিছুটা যেন বিদ্রুপের ভঙ্গিতে কুর্নিশ করল দো বাখনিকে।

আরে! কী আশ্চর্য! তুমি সেই দো বাখনি না?

থমকে দাঁড়াল দো বাখনি, তারপর ঠাট্টার সুরে বলল, তাই তো মনে হয়! তুমি বুড়ো মরনি দেখছি এখনও? তা ব্যবসা কেমন চলছে তোমার, লাফাখ?

প্রিসিলাকে নিয়ে এগিয়ে গেল মেজর স্যান্ডস, দো বাখনির বন্ধুর নমুনা দেখে দারুণ মজা পাচ্ছে। কিছুদূর সরে গিয়ে বলল, বাহ্! আমাদের ইস্তিরি দেয়া বিশিষ্ট ভদ্রলোকের বন্ধু-বান্ধবের ছিরি দেখেছ? না জানি কোন নরক থেকে উঠে এসেছে এই ভদ্রলোক!

বিরক্ত হলো প্রিসিলা মেজরের কথায়। ভাবল, লোকটার বুদ্ধি যেমন ভোঁতা, মনটাও তেমনি ঘোট। ও জানে, এসব কলোনিতে নানারকম লোকের সঙ্গেই পরিচয় হতে পারে মানুষের– ভাল করে না জেনে, না বুঝে হুট করে কোন মন্তব্য করা বোকামি। এতটা না হলেও মুখে এ ধরনেরই কিছু বলল প্রিসিলা।

আঁৎকে উঠল মেজর। কি বললে? তুমি ওর প্রতিরক্ষার ভার নিয়েছ মনে হচ্ছে?

রক্ষার প্রশ্ন আসছে কেন? কে আক্রমণ করতে যাচ্ছে ওঁকে.. আপনি? এসব কথা আপনার বলা উচিত হচ্ছে না, বার্ট। মশিয়ে দো বাখনি কখনও বলেননি যে তিনি ভার্সেই থেকে এসেছেন।

তার কারণ লোকটা জানে, ওসব ভান করতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে। তুমি বুঝতে পারছ না, মেয়ে, লোকটা ভ্যাগাবন্ড; ছন্নছাড়া এক ভাগ্যান্বেষী!

দ্বিমত প্রকাশ না করে কথাটা মেনে নিয়ে মেয়েটাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল মেজর।

আমারও ঠিক তাই মনে হয়, বলল প্রিসিলা। আনমনে মুচকি হাসল। বিপদসঙ্কুল জীবন আমার ভাল লাগে, দুঃসাহসী লোকদেরকে আরও।

বোবা হয়ে গেল মেজর কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপর মুখ খুলতে গিয়ে দেখল দো বাখনি ফিরে আসছে। বুকের ভিতর প্রিসিলার কথাগুলো গুমরে মরতে থাকল। তাই, রাতে, গ্রেট কেবিনে সাপার শেষ হতেই কথাটা আবার তুলল সে!

ডোমিনিকায় হঠাৎ পরিচিত কোনও বন্ধু পেয়ে যাওয়া আশ্চর্যের ব্যাপার, তাই না, মশিয়ে?

সত্যিই, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, সহজ ভাঙ্গতে স্বীকার করল ফরাসী ভদ্রলোক। ও এক বুড়ো সহযোদ্ধা ভাই।

মেজর স্যান্ডসের ভুরুজোড়া কপালে চড়ে গেল। আপনি সৈনিক ছিলেন, স্যার?

চোখে অদ্ভুত এক জ্যোতি, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল দো বাখনি মেজরের দিকে। যেন প্রশ্ন শুনে মজা পেয়েছে। হ্যাঁ, তা একরকম বলা যায়। বলেই ব্র্যানসামের দিকে ফিরে বলল, লাফাখের কথা বলছেন উনি। ও বলল, আপনার সঙ্গে নাকি ব্যবসা করছে। একটু চুপ করে থেকে বলল, সিওখ সাইমনের অধীনে সান্তা ক্যাটালিনায় ছিলাম আমরা একসাথে। পেরে ডি গুজম্যানের নেতৃত্বে স্প্যানিশরা আক্রমণ করে বসল। লাফাখ, আমি আর আরও দুজন– এই মোট চারজন বেঁচেছিলাম সে যুদ্ধে। সারাদিন জনার খেতে লুকিয়ে থেকে রাত হলে মেইনের দিকে পালিয়েছিলাম একটা ভোলা নৌকায় করে। আহত হয়েছিলাম আমি, বাম হাতটা ভেঙে গিয়েছিল গোলাবর্ষণে। সেই কারণেই বেঁচে গিয়েছিলাম সে-যাত্রা। অকেজো হয়ে যাওয়ায় পালিয়েছিলাম। বাকি তিনজন পরে আসে একে একে। ওটাই আমার জীবনের প্রথম জখম। বিশেরও কম ছিল তখন আমার বয়স, তাই অনেক ভোগার পরও সামলে নিতে পেরেছিলাম। যতদূর শুনেছি, আমরা এই চারজন ছাড়া সাইমন সহ সান্তা ক্যাটালিনার একশো বিশজন সৈন্যের আর সবাই মারা পড়েছিল। বাধা দেয়ায় খেপে গিয়ে একজনকেও জ্যান্ত রাখেনি পেরেজ, জবাই করেছিল নিষ্ঠুর ভাবে। দ্বীপের সমস্ত ফসল ধ্বংস করে দিয়েছিল।

মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে সবাই। এমন কি বিরূপ মেজর স্যান্ডস পর্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়েছে রহস্যময় লোকটার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামান্য হাসি ফুটল ফরাসীর মুখে। এর ফল অবশ্য পেয়েছে স্প্যানিয়ার্ডরা। প্রচুর রক্ত দিতে হয়েছে ওদের এজন্যে। কিন্তু সান্তা ক্যাটালিনায় ইংরেজ-ফরাসী মিত্র বাহিনীর ওপর ওরা যে নৃশংসতা দেখিয়েছিল, তার তুলনায় কিছুই না।

টেবিল পরিষ্কার হয়ে যেতে কেবিন থেকে গিটারটা নিয়ে এল মশিয়ে দো বাখনি। জানালার দিকে পিঠ দিয়ে স্টার্ন লকারের ওপর বসে নিজ দেশ প্রোভেন্সের কয়েকটা পল্লীগীতি গেয়ে শোনাল। তারপর গাইল গোটা দুয়েক কোমল পর্দার স্প্যানিশ প্রেমের গান।

কোমল অথচ পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠের মধুর গান শুনে চোখদুটো ভিজে এল প্রিসিলার, বুকের ভিতর কেমন যেন টনটন করছে। এমন কি মেজর স্যান্ডস পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হলো, মশিয়ে দো বাখনির গলাটা ভাল। কিন্তু অনভিজ্ঞ মিস প্রিসিলার ওপর লোকটার এমন অভাবিত প্রভাববিস্তার সে কোনও মতেই মেনে নিতে পারছে না, একটা কাটা খচখচ করে খোঁচাচ্ছে ওকে সারাক্ষণ।

পরদিন কোয়ার্টার ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ক্যাপটেন এ্যানসামের চামড়া লোডিং দেখছিল প্রিসিলা আর মেজর, এমন সময় দেখা গেল পিছনের গ্যাঙওয়ে দিয়ে সেখানে ঢুকল মশিয়ে দো বাখনি। সহজ ভঙ্গিতে ব্র্যানসামকে সম্মান দেখাল, শুধু ব্র্যানসাম নয়, পাশে দাঁড়ানো বোসানকেও। কোমর থেকে সামনে ঝুঁকে নিচের ভেলাগুলোয় কর্মব্যস্ত লোকদের দেখল সে কিছুক্ষণ, তারপর কি যেন বলল। দেখা গেল, হাসছে ওরা, পাল্টা জবাব দিচ্ছে ওদের কেউ কেউ, হাসছে দো বাখনিও। হ্যাচওয়ের পাশে লোডিঙের কাজে ব্যস্ত খালাসীদেরকেও কিছু বলল ও, ঝিক্ করে হেসে উঠল ওরা। একটু পর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে উঠে এল চামড়া বিক্রেতা লাফাখ, ক্যাপটেনের কাছে রাম চাইল। দো বাখনি তাকে সমর্থন করে চেপে ধরল ব্র্যানসমকে, ঠেলে নিয়ে চলল পিছনের গ্যাঙওয়ের দিকে। খুশি মনে গাল বকতে বকতে চলেছেন ক্যাপটেন, পিছন পিছন দস্যু-চেহারার লাফাখের ঘাড়ে হাত রেখে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দো বাখনি। দেখে আর সহ্য হলো না মেজরের।

লোকটা একটা ইতর। মান-সম্মান জ্ঞান বা শৃঙ্খলাবোধ বলে কিছু নেই ওর ভেতর! তিক্ত কণ্ঠে বলে বসল সে।

ভুরু কুঁচকে আড় চোখে ওকে দেখল প্রিসিলা। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, আমি তা মনে করি না।

করো না? রেলিঙে চাপ দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মেজর স্যান্ডস। বয়স্ক, মোটাসোটা লোকটাকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, স্বয়ংসম্পূর্ণ। বলল, ছোট জাতের লোকেদের সঙ্গে ওর গলায় গলায় ভাব আর অবাধ মেলামেশা দেখেও বুঝতে পারছ না ও কী পদের লোক? আমি তো ওদের সঙ্গে ওরকম ঘেঁষাঘেঁষি করতে পারব না। খুন করে ফেললেও না।

কেউ খুন করতে যাচ্ছে না আপনাকে, বার্ট, কঠিন গলায় বলল প্রিসিলা। আপনাকে ও কাজ করতে হবে না।

তোমাকে ধন্যবাদ, প্রিসিলা। সত্যিই হবে না।

কারণ, নিজের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষমতা থাকলেই শুধু একজন মানুষ ছোট-বড় সবার সঙ্গে অনায়াসে মিশতে পারে। সাধারণ লোকেরা পারে না। একটু বেশি নিষ্ঠুর হয়ে গেল কথাটা, কিন্তু লোকটার নাক কুঁচকানো আর তিরস্কারের ভঙ্গি ওকে চরম বিরক্ত করে তুলেছে।

বিস্ময়ে থ হয়ে গেল মেজর কয়েক মুহূর্ত। একটু পর ভাষা ফিরে পেয়ে তোতলাতে শুরু করল। আ-আমি, আমি বুঝতে পারছি না। তো-তোমার কথা…

আমার ধারণা, অযথা অন্যকে ছোট করে নিজের দাম বাড়ার প্রয়োজন পড়ে না মশিয়ে দো বাখনির। এসব করে যারা নিজেরা ছোট তারাই।

নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেতে বেশ সময় লাগল মেজরের। আরও কয়েক মুহূর্ত লাগল তার বুঝে নিতে যে এর সঙ্গে মুখ সামলে কথা না বললে হাতছাড়া হয়ে যাবে একটা বিশাল সম্পত্তি। অনেক কষ্টে গিলে নিল রাগটা। বলল, তুমি মাঝে মাঝে এমন ছেলেমানুষের মত কথা বলো না, প্রিসিলা! আমার জ্ঞান, বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার ওপর কি তোমার এতটুকু ভক্তি, শ্রদ্ধা বা আস্থা নেই? যাকগে, আজ বাদে কাল যে লোক বিদায় হয়ে যাবে আমাদের জীবন থেকে, যার সঙ্গে আর কোনদিনই দেখা হবে না, তার ব্যাপারে খামোকা কথা খরচ করার কোন অর্থ হয় না।

তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, দূর যাত্রায় সঙ্গী হিসেবে মশিয়ে দো বাখনির কোন বিকল্প হয় না। এ রকম প্রাণবন্ত একজন মানুষ সাথে থাকলে যাত্রাটা আর নিরানন্দ, ক্লান্তিকর মনে হতো না। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে স্যান্ডসের, সেই মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল প্রিসিলা, ওঁকে একবার অনুরোধ করে দেখবেন, বার্ট?

আমি? ওকে অনুরোধ করব? হাসির ভঙ্গি করল সে। বলো কি? ওকে অনুরোধ? আমি? খুন করে ফেললেও না। নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ তুমি।

হেসে উঠল প্রিসিলা, আর কিছু বলল না।

একটু পরেই প্রিসিলার জন্যে একটা বাস্কেটে করে তাজা কমলা নিয়ে কোয়ার্টার ডেকে উঠে এল মশিয়ে দো বাখনি। বলল, ওর সহকারী পিয়েখকে ডাঙায় পাঠিয়ে সংগ্রহ করেছে সে এগুলো। ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করল ও বাস্কেটটা। হাত ঝাড়া দিয়ে উড়িয়ে দিল দো বাখনি ধন্যবাদটা।

এ তো অতি সামান্য উপহার।

উপহারের পেছনের শুভেচ্ছাটুকুই তো আসল।

এর পর গল্পে মেতে গেল দুজন। একা একপাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে মেজর, কি উপহার দিলে খুশি হবে প্রিসিলা।গল্প-গুজব তেমন আসে না ওর। কিন্তু কি সহজ, সাবলীল ভাবে হাসছে দো বাখনি, মজার মজার কথা বলে হাসাচ্ছে প্রিসিলাকে। অথচ তার গুরুগম্ভীর, দায়িত্বপূর্ণ, অনুকরণীয় আচরণ এতদিনে কোন রেখাই ফেলতে পারেনি মেয়েটির মনে। ভাবছে, প্রিসিলার আকর্ষণে ব্যাটা যদি সেন্টরে চড়েই ইয়োরোপ যেতে চায় তাহলে কি হবে। প্রিসিলার ব্যবহারও কেমন যেন বেহায়ার মত লাগছে তার কাছে; সে-ই যদি অনুরোধ করে বসে, তাহলে?

.

০৩.

ব্র্যানসামের প্রার্থনা

সূর্যাস্তের একটু আগে ডোমিনিকা ছাড়ল সেন্টর। জাহাজের ডানপাশ থেকে আসছে বাতাস, সে বাতাস ঠেলে নিয়ে চলল ওকে পশ্চিমে আইল অভ এভর্মের দিকে। ফলে গুয়াডিলুপের অনেকটা দূর দিয়ে পার হয়ে যাবে জাহাজ।

খোশমেজাজে সাপার খেতে এলেন ব্র্যানসাম। পিছনের জানালা দিয়ে ফেলে আসা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। সবাইকে জানালেন, এই শেষ, আর কোনদিন ওই দ্বীপটা দেখতে পাবেন না তিনি। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র দুঃখ বোধ করছেন না, এখন দেশে ফিরে পরিবারের সবার সঙ্গে বাকি জীবনটা সুখে শান্তিতে, আনন্দে কাটাবেন তিনি। এতদিনের এত কষ্ট এইবার সার্থক হতে চলেছে। সমস্ত দায়িত্ব পালনের শেষে সমুদ্রের জীবন থেকে অবসর নিতে যাচ্ছেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে চলেছেন, যারা বলতে গেলে জীবনে কখনও তাকে কাছে পায়নি।

আশ্চর্য না? বললেন ক্যাপটেন। চার-চারটে ছেলে আছে আমার, প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক, অথচ না ওরা চেনে আমাকে, না আমি চিনি ওদের। হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার গোলগাল মুখটা। কিন্তু, এখন, ভবিষ্যটা আমাদের। অতীতের সবকিছু মেরামত করে নেব আমরা। আর ওই মিষ্টি, ধৈর্যশীলা বউটা আমার, এখন থেকে সারাক্ষণ ওর পাশে পাশে থাকব আমি। ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করব এতদিন দূরে থাকার বেদনা। লাফাখের সাথে এবারের ব্যবসাটা খুব ভাল হয়েছে। অনেক টাকায় বিক্রি করব আমি এই চামড়া।

লাফাখের কথায় বাস্তবে ফিরে এলেন ক্যাপটেন, মশিয়ে দো বাখনির দিকে ফিরলেন তিনি। ওই জলদস্যুটার সঙ্গে আপনার আবার দেখা হয়ে যাওয়া, রীতিমত আশ্চর্যের ব্যাপার, তাই না? ও না বললে, নামটা যতই পরিচিত ঠেকুক, আপনার পরিচয় আমার অজানাই থেকে যেত।

 ঠিক, বলল দো বাখনি। আশ্চর্যের ব্যাপারই। সব ছেড়েছুঁড়ে ও ভালই আছে দেখে ভরসা হচ্ছে আমার, ইচ্ছে করলেই মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

কান খাড়া হয়ে গেছে মেজরের। বাহ, দারুণ তথ্য আসতে শুরু করেছে। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বলতে চাইছেন, ওই ফরাসী চামড়াবিক্রেতা একসময় জলদস্যু ছিল?

উত্তর দিল দো বাখনি। সত্যি বলতে কি, সান্তা ক্যাটালিনায় থাকতে প্রায় সবাই আমরা তাই ছিলাম। তারপর মরগানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম।

মরগ্যান? নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না মেজর স্যান্ডস। আপনি কি হেনরি মরগানের কথা বলছেন?

স্যার হেনরি মরগান। হ্যাঁ। এখন যিনি জামাইকার গভর্নর।

কিন্তু…মানে, আপনি কি বলতে চাইছেন তার জলদস্যু-দলে আপনিও ছিলেন? ব্লাডি মরগানের লোক ছিলেন আপনি?

সহজ ভাবেই উত্তর দিল মশিয়ে দো বাখনি, হ্যাঁ। পোর্টো বেলো আর পানামায় আমি ছিলাম ওর সাথে। পানামায় আমি তার ফরাসী বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। আমরা সান্তা ক্যাটালিনার প্রতিশোধ নিয়েছিলাম সে সময়ে।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মেজরের মুখ। এতদিনে লোকটার সত্যিকার পরিচয় বেরিয়ে এল। ভাগ্যান্বেষী নয়, এ-লোক আসলে একজন পাক্কা জলদস্যু ছিল, হেনরি মরগানের দলের ভয়ংকর এক বোম্বেটে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটল, নিশ্চিন্ত মনে একফালি গুয়াভা চীফ তুলে নিয়ে নিজের জন্যে আর এক গ্লাস ওয়াইন ঢালছে মশিয়ে দো বাখনি, এমনি সময় ফেটে পড়ল মেজর।

তার মানে, আপনি একজন …একটা ঘৃণ্য ডাকাত, বোম্বেটে! আর একথা স্বীকার করতেও আপনার এতটুকু বাধছে না?

বার্ট! চেঁচিয়ে উঠল প্রিসিলা।

 মেজর স্যান্ডস, স্যার! বললেন ক্যাপটেন।

দুজনের কণ্ঠেই স্পষ্ট তিরস্কার। কিন্তু মশিয়ে দো বাখনি নির্বিকার। মৃদু হেসে এদের শান্ত করার জন্যে একটা হাত নাড়ল।

ডাকাত? বোম্বেটে? যেন মজা পাচ্ছে এমনি ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। না, না। অবৈধ যোদ্ধা বা ফিলিস্টার বলতে পারেন। কিংবা বাকেনিয়ার বা জলদস্যু

পুরু ঠোঁট বাঁকিয়ে জানতে চাইল মেজর, তফাৎ? দুটোয় তফাৎ কোথায়?

তফাৎ? আকাশ-পাতাল, মেজর।

ব্র্যানসাম ব্যাখ্যা দিলেন। জলদস্যুদের বিশেষ মিশন ছিল, বোম্বেটেদের তা থাকে না– তারা শুধুই পাইরেট বা ডাকাত। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের সরকারী অনুমোদন ছিল বাকেনিয়ারদের পিছনে, এখনও আছে। কারণ এরাই স্প্যানিয়ার্ডদের অত্যাচার ঠেকাবার, ওদের বাধা দেয়ার এবং দমন করার ক্ষমতা রাখত। এরা আক্রমণ করত শুধু স্প্যানিশ জাহাজ বা স্প্যানিশ কলোনি।

মুখ খুলল দো বাখনি। আর কারও ক্ষমতা ছিল না ওদের শায়েস্তা করার। নাক সিটকাবেন না, মেজর স্যান্ডস। পানামা আক্রমণের সময় আমাদের সঙ্গে যদি থাকতেন তাহলে বুঝতেন কী কষ্ট করেছি আমরা। যখন নদী-নালা, মাঠ-জঙ্গল পেরিয়ে না খেয়ে না দেয়ে ওখানে পৌঁছলাম, তখন টের পেয়ে গেছে স্প্যানিয়ার্ডরা, তিনগুণ সৈন্য আর অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। সেই অবস্থায় বিজয় ছিনিয়ে আনা মুখের কথা ছিল না।

আশ্চর্য! ওই লজ্জাজনক ম্যাসাকার নিয়ে আপনি আবার গর্বও করছেন? খেঁকিয়ে উঠল মেজর স্যান্ডস, ওটা ছিল ঘৃণ্য, নীচ, কাপুরুষের কাজ।

শান্ত কণ্ঠে বলল দো বাখনি, আপনি বড়ই অসহিষ্ণু, মেজর।

সঙ্গত কারণেই, গর্জে উঠল মেজর। একদল খুনে ডাকাতকে যতই রঙ চড়িয়ে গল্প সাজিয়ে মাহাত্ম্য দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন, আমাকে খুন করে ফেললেও ওরা যা তাই বলব আমি। ওটা কোনও যুদ্ধই ছিল না, মর্গানের অধীনে যারা ওতে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের গলাকাটা কসাই বা রক্তচোষা পিশাচ ছাড়া আর কোন উপাধি দেয়া যায় না।

ভয় পেলেন ব্র্যানসাম। আজকের মশিয়ে দো বাখনি যাই হোক না কেন, এক সময়ে বিখ্যাত জলদস্যু ছিল। এখন এসব অপমানজনক কথায় যদি বিগড়ে গিয়ে খেপে ওঠে তাহলে দক্ষ-যজ্ঞ কাণ্ড বেধে যেতে পারে, তখন সামলানো দায় হবে। সেন্টরে কোনও গোলমাল চান না তিনি। মেজরকে বাধা দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমনি সময় ধীর, শান্ত গলায় বলল দো বাখনি, আপনি কি বুঝতে পারছেন না, মেজর, আপনি যা বলছেন সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা? আপনার রাজার বিরুদ্ধে কথা বলছেন আপনি। আপনার মত এত সূক্ষ্ম ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকলে, আপনি যা বলছেন রাজাও মরগানকে তাই মনে করলে তাকে নাইট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতেন না, জামাইকার গভর্নরের পদে বসাতেন না।

ঠিক বলেছেন, জোর সমর্থন জানালেন ব্রানসাম। আর আপনার এটাও জানা থাকা দরকার, মোসু দো বাখনি স্যার হেনরি মরগানের অন্যতম প্রধান অনুচর– সাগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত।

আপত্তি মেজরের কাছ থেকে এল না, এল স্বয়ং মশিয়ে দো বাখনির তরফ থেকে।

না, না, সেসব এখন অতীত। আমি পদত্যাগ করেছি। আপনার মত বাকি জীবন আমিও শান্তিতে কাটাতে চাই। বাড়ি ফিরছি আমি।

সে যাই হোক, আপনারা পানামা বা পোর্টো বেলোতে যাই করে থাকুন না কেন, রাজার নিয়োগ পেয়ে কাজ করছেন বা করেছেন। কথাটা মেজর স্যান্ডসকে বুঝতে হবে।

কাকে কি বোঝাচ্ছেন? খেঁকিয়ে উঠল মেজর। আপনারা ভাল করেই জানেন, চোর ধরার দায়িত্ব দিয়েছেন আরেক চোরের ওপর। জলদস্যুর ভূমিকা সম্পর্কে যত বোলচালই মারুন, সবাই জানে, তারা এমনই দুর্বিষহ মহামার হয়ে উঠেছিল যে হেনরি মরগানকে নাইটহুড আর গভর্ণরের দপ্তরে ঘুষ দিয়ে রাজা তাকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন তারই সঙ্গী-সাথী ভাই-বেরাদারের বিরুদ্ধে।

এবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে আলোচনার ইতি টানল দো বখনি, একটু যেন ক্ষুব্ধ হয়েই। মদের গ্লাসটা তুলে নিয়ে মৃদু চুমুক দিতে থাকল সে আনমনে। আলোচনাটা চালিয়ে গেলেন ক্যাপটেন ব্র্যানসাম।

যাই হোক, এটা মানতেই হবে, স্যার হেনরি মরগানের কল্যাণেই এখন নিরাপদে সাগর পাড়ি দিতে পারছি। এটুকু প্রশংসা অন্তত তাঁর প্রাপ্য।

ক্রিপের হাসি হাসল মেজর। কাজটা বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে তাকে গতবার তো দেশে ডেকে নিয়ে কর্তব্যে অবহেলার জন্যে প্রায় ঝুলিয়েই দিয়েছিল। বিপদ এড়াবার জন্যে তাকে কিছু কাজ দেখাতেই হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, সাগরটাকে দুষিত করে তুলেছিল ওই মরগান ও তার জঘন্য চেলা-চামুণ্ডারাই!

ওঁর প্রাপ্যটুকু থেকে ওঁকে বঞ্চিত করবেন না, মেজর, বললেন ব্র্যানসাম। উনি যা করেছেন আর কারও পক্ষে ততটা করা সম্ভবই ছিল না।

কিন্তু মেজর তর্ক করে চলল। আসল কথা প্রিসিলার সামনে দো বাখনির চরিত্র হনন করে আত্মপ্রসাদ পেতে চাইছে সে। সকালে তাকে নির্মম ভাবে অপমান করেছিল মেয়েটা দো বাখনির গুণের প্রশংসা করে, এখন বুঝুক গুণধরটি কি চিজ। বলেই চলল, কি বলছেন আপনি, ক্যাপটেন? নিরাপদ সাগর কোথায় পেলেন আপনি? তাহলে গুয়াডিলুপের ত্রিসীমানায় যেতে আপনার এত ভয় কিসের? আমি শুনেছি টম লীচ নামে মরগানের এক বিদ্রোহী চেলা ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে গোটা ক্যারিবিয়ান সাগর চষে বেড়াচ্ছে।

নামটা শুনেই কালো হয়ে গেল ক্যাপ্টেন ব্র্যানসামের চেহারা। হ্যাঁ; টম লীচ। অতি নীচ এক নরকের কীট, নিষ্ঠুর এক পাষণ্ড। তবে মরগান ওকে ঠিকই ধরবে। শোনা যাচ্ছে, এই জলদস্যুর মাথার দাম ঘোষণা করেছে মরগান পাঁচশো পাউন্ড।

নড়ে উঠল দো বাখনি। মদের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, ওকে জলদস্যু বললে মনটা ছোট হয়ে যায়, ক্যাপটেন। টম লীচ হলো একটা জঘন্য, নিষ্ঠুর, নীচ বোম্বেটে।

তা ঠিক, মেনে নিলেন ক্যাপটেন। ওর চেয়ে খারাপ আর হয় না। অমানুষ। নীতির কোন বালাই নেই, দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও নেই খুনেটার। নির্মম এক জানোয়ার। ওকে ধরে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিতে পারলে বাঁচত সবাই। ডাকাতি, খুন আর নারী ধর্ষণ ওর কাছে ডালভাত। একবার এক…

লম্বা হাত তুলে বাধা দিল দো বাখনি।

 মিস প্রিসিলা বিব্রত বোধ করছেন, ক্যাপটেন।

মেয়েটার ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়েই লজ্জিত হয়ে মাফ চাইলেন ব্র্যানসাম।

আমি ভেবেছিলাম আপনারা আর কোনদিন থামবেন না, বলল মেয়েটা, খুনে বোম্বেটেদের নিয়েই কাটিয়ে দেবেন রাতটা। মেজর বুঝল, খোঁচাটা তাকে দেয়া হলো। দো বাখনির দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল প্রিসিলা। নগ্ন, কুৎসিত আক্রমণের মুখেও অসীম ধৈর্যের প্রমাণ দিয়ে রীতিমত শ্রদ্ধা অর্জন করেছে সে মেয়েটির। বলল, মশিয়ে দো বাখনি, দু-একটা গান শোনাবেন না আজ?

গিটার আনতে উঠে গেল দো বাখনি। মনমরা মেজর বুঝতে পারল, এত চেষ্টা করেও বেয়াড়া মেয়েটার চোখে ছোট করতে পারেনি সে লোকটাকে।

.

০৪.

ধাওয়া

স্যার হেনরি মরগান আর তার অবাধ্য সাগরেদ ভয়ঙ্কর টম লীচ সম্পর্কে সেন্টরের কেবিনে যা আলোচনা হলো সেটা ঐতিহাসিক সত্য। মরগানকে সত্যিই ইংল্যান্ডে ডেকে এনে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য জোর ধাতানি দেয়া হয়েছিল

যদিও স্বল্প সময়ে মরগান যা করেছে সেটাকে ছোট করে দেখবার উপায় নেই –দল ভেঙে দেয়ায় অসংখ্য জলদস্যু ফিরে গেছে তাদের প্রাক্তন পেশায়, স্বাভাবিক জীবনে অনেকে তাদের অ্যাডমিরালের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আইনের সপক্ষে, বেশিরভাগই সরকারী পুনর্বাসন পরিকল্পনার সুযোগ নিয়ে পঁচিশ একর জমি পেয়ে চাষাবাদে লেগে গেছে। কিন্তু যারা তারপরেও ডাকাতি করে বেড়াচ্ছিল তাদের অনেককেই সমুদ্রছাড়া করেছে মরগান, কিন্তু কিছু লোককে এখনও বাগে আনা সম্ভব হয়নি। কর্তৃপক্ষ আভাসে তাকে জানিয়েছে; তাদের সন্দেহ, তলে তলে ওদের মদত জোগাচ্ছে মরগান নিজেই, এবং সম্ভবত তাদের কাছ থেকে টাকা খাচ্ছে।

বিশেষ করে দুর্ধর্ষ দস্যু টম লীচের ব্যাপারে চাপ দেয়া হয়েছে মরগানকে। এই লোককে দমন করতে না পারলে তার কপালে খারাবি আছে, বলা যায় না, ফাসীও হয়ে যেতে পারে।

টম লীচ লোকটা যেমন চতুর, তেমনি নির্দয়, আর তেমনি দক্ষ নাবিক। এক দঙ্গল দস্যু গিয়ে জুটেছে তার সঙ্গে। ব্ল্যাক সোয়ান নামে চল্লিশ কামানের একটা বড়সড় জাহাজে করে বৈপরোয়া লোকটা গোটা ক্যারিবিয়ান সাগরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। মরগান এদিক থেকে ধাওয়া করলে ও যায় ওদিকে, ওদিক থেকে ধাওয়া করলে সরে যায় আরেকদিকে। মরগানের জলদস্যুর সংজ্ঞাকে কাঁচকলা দেখিয়ে সে এখন যে জাহাজ সামনে পড়ছে, তাকেই আক্রমণ করছে, লুট করছে, সবাইকে নির্বিচারে খুন করছে, তারপর ডুবিয়ে দিচ্ছে সেটা –তা সে যে দেশের পতাকাই বহন করুক না কেন। মাস দুয়েক আগে গ্রানাডার কাছে জামাইকা স্কোয়াড্রনের দুটো জাহাজ ওকে প্রায় ধরে ফেলেছিল, কিন্তু অসমসাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে সরকারী ফ্রিগেটের একটাকে ডুবিয়ে এবং অপরটাকে অচল করে দিয়ে সরে চলে যায় টম লীচ।

শুধু ক্যাপটেন ব্র্যানসামই নয়, এ-অঞ্চলের প্রতিটি জাহাজের প্রতিটি নাবিকই কায়মনোবাক্যে কামনা করে, ধরা পড়ক লীচ, পালের ভাণ্ডায় ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দেয়া হোক তাকে।

পরদিন সহযাত্রীদের নাস্তার জন্যে ডাকতে এসে মশিয়ে দো বাখনি দেখল উঁচু ডেকে দাঁড়িয়ে টেলিস্কোপ দিয়ে তিন-চার মাইল দূরের একটা জাহাজ দেখছেন ক্যাপটেন পুবদিকে। তার দুপাশে দাঁড়ানো মেজর স্যান্ডস ও মিস প্রিসিলা।

তরতর করে পশ্চিমে এগিয়ে যাচ্ছে সেন্টর, এভসের কয়েক লীগ দক্ষিণ-পুবে রয়েছে ওরা এখন। চারপাশে কোথাও ডাঙার কোন চিহ্ন নেই।

দো বাখনি কাছে এসে দাঁড়াতেই চোখ থেকে টেলিস্কোপ নামালেন ক্যাপটেন, ওটা দিয়ে জাহাজটার দিকে ইঙ্গিত করে যন্ত্রটা বাড়িয়ে ধরলেন ওর দিকে।

দেখুন তো, মোসু, আপনার কি মনে হয়?

টেলিস্কোপটা হাতে নিল বটে, কিন্তু ব্র্যানসামের চেহারাটা লক্ষ করেনি বলে অবস্থার গুরুত্ব টের পেল না দো বাখনি। মেজর ও প্রিসিলার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর ধীরে-সুস্থে চোখে তুলল ওটা। অনেকক্ষণ ধরে দেখল সে দূরবীন দিয়ে। যখন ওটা চোখ থেকে নামাল, তখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে চেহারা। গম্ভীর। একটি শব্দ উচ্চারণ না করে একপাশে সরে গিয়ে রেলিঙের ওপর কনুই রেখে আবার তাকাল জাহাজটার দিকে। এবার আরও বেশিক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখল ওটাকে।

জাহাজটার কালো রঙ করা উঁচু খোল দেখল, গলুইয়ে খোদাই করা রাজহাঁসটা দেখল, কামানগুলো গোনার চেষ্টা করল যতটা দেখা গেল, পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে থাকা পালগুলো লক্ষ করল, খেয়াল করল, পতাকা নেই কোনও।

আর ধৈর্য ধরতে না পেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপটেন, কী? কি বুঝলেন?

চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে ক্যাপটেনের দিকে ফিরল দো বাখনি। শান্ত, ঠোঁটে মৃদু হাসি।

চমৎকার একটা জাহাজ, বলেই সহযাত্রীদের দিকে ফিরল সে। নাস্তা দেয়া হয়েছে কেবিনে।

নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছিল খুব, কথাটা কানে যাওয়া মাত্র, প্রিসিলাকে নিয়ে কেবিনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল মেজর।

গ্যাঙওয়েতে ওরা অদৃশ্য হওয়া মাত্র হাসি মিলিয়ে গেল মশিয়ে দো বাখনির মুখ থেকে। ক্যাপ্টেনের জিজ্ঞাসু দুই চোখের দিকে সরাসরি চাইল সে অবিচলিত দৃষ্টি মেলে।

মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি আমি। তবে আমার মনে হয়, ঠিকই সন্দেহ করেছেন আপনি, ওটা টম লীচের জাহাজ, দ্য ব্ল্যাক সোয়ান।

আপনার কোনও ভুল হচ্ছে না তো?

না। ভুল হচ্ছে না। আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, ওটা আসছে এই জাহাজকে লক্ষ্য করেই।

বিড় বিড় করে অভিসম্পাত দিলেন ব্র্যানসাম নিজের ভাগ্যকে। ঠিক আমার শেষ যাত্রাতেই! শান্তিতে বাড়ি ফিরতেও দেবে না আমাকে! আপনি… আপনি কি মনে করেন ও আক্রমণ করবে আমাদের?

কাঁধ ঝাঁকাল দো বাখনি। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, ওর নাম টম লীচ। আপনার গতিপথ লক্ষ্য করেই আসছে ও।

অশ্লীল গালাগালি বেরিয়ে এল ক্যাপটেনের মুখ দিয়ে। নিজের ভিতর তেজ আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু বেচারা জানেন আগেই হেরে বসে আছেন তিনি। আবোল তাবোল বকতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন, ব্যাটা শুয়োরের বাচ্চা! হারামজাদা আসছে আমার সবকিছু শেষ করে দিতে। কোথায় আপনার স্যার হেনরি মরগান? ইংল্যান্ডের রাজা কি এইজন্যে তাকে নাইট উপাধি দিয়ে জামাইকার গভর্নর করেছে? কোথায় সে এখন?

এটুকু জেনে রাখুন, শেষ পর্যন্ত স্যার হেনরির কাছে ধরা পড়তেই হবে ওকে, বলল দো বাখনি।

শেষ পর্যন্ত! এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যেও ফরাসী লোকটার ধীর, স্থির, শান্ত চেহারা রাগ বাড়িয়ে দিল ক্যাপটেনের। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বে! তাতে আমার কি লাভ শুনি? আমি এখন কিভাবে উদ্ধার পাই?

কি করবেন ভাবছেন?

 হয় যুদ্ধ, নয়তো পলায়ন– এছাড়া আর কি করার আছে?

কোনটা আপনার পছন্দ?

দিশেহারা অবস্থায় কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে দেখবার চেষ্টা করলেন ব্র্যানসাম, তারপর অসহিষ্ণু কণ্ঠে ফেটে পড়লেন, কি করে যুদ্ধ করব? আমার চেয়ে দ্বিগুণ কামান আছে ওর, লোক আছে দশগুণ!

তাহলে পালাচ্ছেন?

 কি করে? এবার গলায় ফুটে উঠল হতাশা। আমার চেয়ে দ্বিগুণ পাল রয়েছে ওর।

জাহাজের মধ্য ডেকে কয়েকজন নাবিককে দেখা গেল, কপালে হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে তাকিয়ে রয়েছে দূরের ওই জাহাজটার দিকে। তবে কেউ কিছু সন্দেহ করেছে বা চিনতে পেরেছে বলে মনে হলো না।

আবার একবার টেলিস্কোপ চোখে তুলে ব্ল্যাক সোয়নের দিকে তাকাল দো বাখনি। চোখ না সরিয়েই মৃদু কণ্ঠে বলল, পাল যতই থাকুক, মনে হচ্ছে খুব কষ্ট করে এগোচ্ছে। অনেক বেশিদিন সাগরে আছে ওটা। তলায় প্রচুর আবর্জনা, কোনও সন্দেহ নেই তাতে। চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে বলল, ক্যাপটেন, আপনার জায়গায় আমি হলে গতিপথটা হাওয়ার দিকে দুই-এক পয়েন্ট সরিয়ে আনতাম। তাহলে ওর চেয়ে অনেক স্বচ্ছন্দে তর তর করে এগিয়ে যেতে পারবেন আপনি, একরাশ আবর্জনা টেনে আনছে ও, আপনাকে ধরতে পারবে না।

পরামর্শটা রাগিয়ে দিল ক্যাপটেনকে। কোথায় গিয়ে পৌঁছব তাহলে, সে খেয়াল আছে? ওই কোর্স ধরলে সোজা গিয়ে উঠব দুইশ মাইল দূরের পোর্টো রিকোতে, এর মধ্যে আর কোনও ডাঙা নেই।

তাতে কি? এই বাতাস- যতক্ষণ আছে, আপনার কাছাকাছি আসার উপায় থাকছে না ওর। এমন কি আপনি হয়তো ওকে পিছনে ফেলে অনেক এগিয়ে যেতে পারবেন। যদি এই দূরত্বটা ধরে রাখা যায়, তাহলেও তো আপনি নিরাপদ।

হয়তো, বললেন ব্র্যানসাম। যদি বাতাসটা বইতেই থাকে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কে দেবে আমাকে? বছরের এ সময়ে এটা অস্বাভাবিক বাতাস। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন ক্যাপটেন, ফলে রেগে যাচ্ছেন নিজেরই উপর। আপন মনে বললেন, যদি ডোমিনিকার দিকে ঘুরে দৌড় লাগাই? বেশি দূর না, অথচ সম্পূর্ণ নিরাপদ।

আপনি নাক ঘোরাতে গেলেই দেখবেন সবকটা পাল তোলা অবস্থায় ও কোনাকুনি ধেয়ে আসবে। ধরা খেয়ে যাবেন তখন, খুব অল্প সময়েই।

আতঙ্কিত অবস্থায় বিচার-বিবেচনা হারিয়ে ফেললেন ব্র্যানসাম, অটল থাকলেন নিজ সিদ্ধান্তে, কারণ আরও একটা কথা তার মাথায় খেলেছে এমনও তো হতে পারে, ডোমিনিকার দিকে রওনা দিলে হয়তো আর কোনও জাহাজের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, তখন অন্যদিকে সরে যেতে বাধ্য হবে ব্ল্যাক সোয়ান। আর কোনও পরামর্শে কান না দিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে জাহাজ ঘোরানোর হুকুম দিলেন তিনি কোয়ার্টারমাস্টারকে।

এতক্ষণে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল দো বাখনির। ব্র্যানসামের বোকামি দেখে বাজে একটা গালি বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করল ক্যাপটেনকে। কিন্তু ক্যাপটেন সোজা সাপ্টা জানিয়ে দিলেন এ জাহাজের অধিনায়ক তিনি, পরামর্শ শুনতে রাজি আছেন, কিন্তু কারও হুকুম মানতে রাজি নন।

ঘুরতে শুরু করল সেন্টর, একটু বাঁকা হয়ে গেল প্রথমটায়, তারপর আবার সোজা হয়ে চলল দক্ষিণে।

মাঝডেকে দাঁড়ানো নাবিকরা এই হঠাৎ দিক পরিবর্তনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল, এখন হুকুম পেল আবার তুলতে হবে গুটিয়ে রাখা টপ সেইল। ওরা ব্যাটলাইনের কাছে পৌঁছবার আগেই দেখা গেল পিছনের কালো জাহাজটার নাক ঘুরে গেছে এদিকে। এখন আর কারও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকল না, পরিষ্কার জানা গেল ব্ল্যাক সোয়ানের উদ্দেশ্য।

মুহূর্তে সেন্টরের সবাই জেনে গেল, পিছু নিয়েছে শত্রু। ফোকাল থেকে ভীতসন্ত্রস্ত নাবিকরা মাঝ-ডেকের  হ্যাচের কাছে এসে দাঁড়াল, সবাই তাকিয়ে আছে পিছনের জাহাজটার দিকে, কি সব বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে।

ব্র্যানসামের পিছু নিয়ে কোয়ার্টারডেকে চলে এসেছে দো বাখনি। অনেকক্ষণ ধরে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন ক্যাপটেন কালো জাহাজটাকে। যখন চোখ থেকে ওটা নামালেন, দেখা গেল, আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে তাঁর বড়সড় মুখটা।

আপনি ঠিক বলেছিলেন, কাঁপা গলায় স্বীকার করলেন তিনি। ডোমিনিকায় পৌঁছবার অনেক আগেই ওই নরকের কুকুরটা আমাদের ঘাড়ে উঠে আসবে। এখন কি করা যায়, মোসু? আগের কোর্সে ফিরে যাব?

পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন তিনি, দো বাখনির কথা শুনলে এই ভাবে ধরা পড়তেন না ওদের হাতে, অভিজ্ঞ একজন যোদ্ধা নাবিকের কথা ওভাবে উড়িয়ে দেয়া তার উচিত হয়নি; তাই আবার তার পরামর্শ চাইলেন তিনি নরম কণ্ঠে।

উত্তর দিতে সময় নিল দো বাখনি। কপাল কুঁচকে, চোখ ছোট করে ডুবে গেছে সে গভীর চিন্তায়। মনে মনে হিসেব কষা শেষ করে মাথা নাড়ল দো বাখনি।

না, ক্যাপটেন। দেরি হয়ে গেছে। আপনার সময় লাগবে আগের কোর্সে ফিরে যেতে, ওদের শুধু সামান্য এক কি দুই পয়েন্ট ঘুরতে হবে। আপনার এখন আর কোন উপায় নেই, এই কোর্সেই থাকতে হবে। এবং শুধু পলায়ন নয়, যুদ্ধও করতে হবে।

হায়, খোদা! কি নিয়ে যুদ্ধ করব আমি? এত বড় একটা জাহাজের বিরুদ্ধে?।

এর চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় যুদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে আনতে দেখেছি আমি মানুষকে।

ব্র্যানসাম দেখলেন, এতটুকু ঘাবড়ায়নি প্রাক্তন জলদস্যু; গম্ভীর, কিন্তু ভয়ের লেশমাত্র নেই তার চেহারায়। বললেন, তা বটে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। আপনার কোনও পরামর্শ আছে, মোসু?

মুহূর্তে কাট-ছাঁট, কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠল দো বাখনির হাবভাব।

আপনার লোক আছে কয়জন? বোসান আর কোয়ার্টারমাস্টারকে ধরলে সব মিলিয়ে ছাব্বিশজন। আর লীচের আছে তিনশোরও বেশি।

কাজেই ওকে কিছুতেই এ জাহাজে উঠতে দেয়া যাবে না। আমাকে আপনার কামানগুলোর ভার দিন, আমি আপনাকে দেখাব মেইন ডেকের যুদ্ধ কাকে বলে। অবশ্য যুদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে আপনাকেই। আমি জানাব আপনাকে কিভাবে কি করতে হবে।

ক্যাপটেনের ফ্যাকাসে মুখে রক্ত ফিরে আসতে শুরু করেছে। গদগদ কণ্ঠে বললেন, আমার কপাল ভাল যে আপনি এই জাহাজে আছেন, মোসু দো বাখনি।

দুঃখের বিষয়, আমার নিজের কপাল সম্পর্কে আমি অতটা নিশ্চিত নই, বাকা ভাবে উত্তর দিল দো বাখনি।

দো-আঁশলা সহকারী পিয়েখকে নিচের বাল্কহেড থেকে ডেকে নিল সে। গায়ের আকাশী নীল কোট, চমৎকার কেমব্রিক শার্ট, হ্যাট, পরচুলা, জুতো, মোজা সব খুলে ওর হাতে দিল কেবিনে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্যে। কোমর থেকে উপরের অংশ নগ্ন, মাথায় শুধু একটা স্কার্ফ জড়িয়ে বাঁধা। পেটা শরীরে কিলবিল করছে পেশী। গান ডেকের দায়িত্ব বুঝে নিল সে ক্যাপটেন ব্র্যানসামের কাছ থেকে।

নাবিকরা সবাই বুঝে নিয়েছে কি ঘটতে চলেছে। কিন্তু ঘাবড়ায়নি কেউ। এ যেন জীবনেরই একটা অংশ। বোসান স্পোট ওদেরকে নিজ নিজ কোয়ার্টারে যাওয়ার নির্দেশ দিল। মাস্টার গানার পার্ভেকে আটজন নিয়ে একটা দল তৈরি করতে বলা হলো। সংক্ষেপে দু-চার কথায় ক্যাপটেন ওদেরকে জানালেন গান ডেকের অধিনায়কত্ব করবেন মশিয়ে দো বাখনি, মূল যুদ্ধটা করবে গান ডেক, কাজেই সবার নিরাপত্তা নির্ভর করছে ওদেরই ওপর।

সবাইকে আদেশ দিল দো বাখনি নিচে গিয়ে কামানগুলোয় গোলা ভরে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতে। ওদের পিছু নেয়ার আগে ক্যাপটেনকে বলল, আপনি আমার ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব তাতে আমার ভূমিকাটুকু পালন করতে। কিন্তু আপনার ওপর নির্ভর করছে আমি আমার ভূমিকা পালন করতে পারব কি না। এখানে ভীরুতা, সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা সাবধানতায় কোন কাজ হবে না। আমরা যে বেকায়দা অবস্থায় পড়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। একটা কি দুটো গোলা ঠিক জায়গা মত লাগানোর ওপর নির্ভর করছে আমাদের সবার বাঁচা-মরা। কাজেই আপনাকে এমন ভাবে জাহাজ চালাতে হবে যাতে আমি কামান দাগার সুযোগ পাই। ঝুঁকি নিতে হবে আপনাকে। বুকে সাহস ধরুন, ক্যাপটেন। বেপরোয়া না হলে আমরা জিততে পারব না কিছুতেই।

 ঠিক আছে, ঠিক আছে, বললেন ক্যাপটেন। বুঝতে পেরেছি।

চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে নিচের ডেকে চলে গেল দো বাখনি। ওখানে পার্ভের নেতৃত্বে কামানগুলোয় গোলা ভরা হচ্ছে। চারপাশে চেয়ে বুঝে নিল দো বাখনি কি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে তার ব্ল্যাক সোয়ানের বিরুদ্ধে।

.

০৫.

মুখোমুখি

গ্রেট কেবিনে নাস্তা খেয়ে উঠল মিস প্রিসিলা ও মেজর স্যান্ডস। জানে না কি ঘটতে চলেছে। সহযাত্রী ভদ্রলোক ও ক্যাপটেনের অনুপস্থিতি কিছুটা বিসদৃশ ঠেকেছে ওদের কাছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নিগ্রো স্টুয়ার্ডের আমন্ত্রণে বসে পড়েছে টেবিলে।

পিয়েখকে দেখা গেল, একবোঝা কাপড়চোপড় নিয়ে ঢুকছে তার প্রভুর কেবিনে। মশিয়ে দো বাখনি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় শুধু বলল, তিনি ডেকে আছেন, সেখানেই নাস্তা করবেন। স্যামের কাছ থেকে কিছু খাবার আর ওয়াইন নিয়ে চলে গেল সে গান ডেকের উদ্দেশে।

কিছুটা অবাক হলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি ওরা।

নাস্তার পর গতরাতে রেখে যাওয়া দো বাখনির গিটারটা কোলে তুলে কিছুক্ষণ টুং-টাং করল প্রিসিলা অপটু হাতে। তারপর হঠাৎ বাইরে চোখ পড়তেই দেখতে পেল জাহাজটা।

আরে! একটা জাহাজ! চেঁচিয়ে উঠল সে। ভোলা পোর্ট দিয়ে কালো জাহাজটা দেখতে পেল মেজর স্যান্ডসও। তার কাছে সুন্দর লাগল জাহাজটা, পালগুলোকে মনে হলো যেন মেঘের ভেলা। দুজনের কেউই টের পেল না কী ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসছে চারপাশে।

নিচের অপরিসর ডেকে, মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করতে হচ্ছে দো বাখনিকে। টাচ-হোলে প্রাইমার ভরে দশটা কামান তৈরি করা হয়েছে ব্ল্যাক সোয়ানের চল্লিশটা কামানকে মোকাবিলা করার জন্যে।

কামানগুলোকে নিজ হাতে তাক করেছে দো বাখনি, বেশিরভাগই মুখ তুলে আছে প্রতিপক্ষের পালগুলো নষ্ট করে দেয়ার প্রতীক্ষায়। খোল ফুটো করার সুযোগ পাবে বলে ভরসা নেই, তাই প্রথমেই পালগুলো অকেজো করে দিতে চাইছে সে। একবার ব্ল্যাক সোয়ানের চলচ্ছক্তি ব্যাহত করতে পারলে পরে ভেবে দেখা যাবে এখন পালিয়ে যাওয়াই মঙ্গল, নাকি সম্মুখসমরে ওকে ঘায়েল করে ডুবিয়ে দেয়াই ভাল।

ওয়ার্ডরূম-পোর্ট দিয়ে কুঁজো হয়ে বসে দেখছে মশিযে দো বাখনি, দস্যু-জাহাজটা এগিয়ে আসছে, দ্রুত কমে আসছে দূরত্ব। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে এল ব্ল্যাক সোয়ান আধ মাইলের মধ্যে। এইবার আক্রমণে যাওয়া যায়, ভাবল দো বাখনি।

ওয়ার্ডরূম গানারকে সামনে পাঠাল দো বাখনি পার্ভেকে প্রস্তুত থাকার জন্যে বলতে, তারপর অপেক্ষা করতে থাকল, এই বুঝি হালটা ঘোরায় ক্যাপটেন। কিন্তু না, সময় পেরিয়ে গেল, যেদিকে যেভাবে চলছিল তেমনি চলতে থাকল সেন্টর, যেন মুখোমুখি হওয়ার কোনও দরকার নেই, পালাতে পারলেই বাঁচে ব্র্যানসাম।

এমনি সময়ে ব্ল্যাক সোয়ানের ঠোঁটের পাশ দিয়ে একগাদা ধোয়া বেরোতে দেখা গেল, এক মুহূর্ত পরই গর্জে উঠল কামানের আওয়াজ, তারপর সেন্টরের পঞ্চাশ গজ পিছনে ছলকে উঠল সাগরের পানি।

দো বাখনির কাছে এর মানে প্রত্যুত্তর দিতে হবে, ও ধরেই নিল নিশ্চয়ই ব্র্যানসামের কাছেও এর মানে ঠিক তাই। অবজার্ভেশন পোস্ট ছেড়ে এক দৌড়ে চলে এল সে গান ডেকে, দেখল, আগুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গানাররা। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে, কখন বামদিকের গানপোর্ট দিয়ে দেখা যায় ব্ল্যাক সোয়ানকে।

গোলার শব্দে চমকে উঠল গ্রেট কেবিনের দর্শক দুজন। বিস্ফারিত চোখে চাইল দুজন দুজনের দিকে, তারপর ব্যাপার কি জানার জন্যে একলাফে উঠে দাঁড়াল প্রিসিলা, রওনা হলো ডেকের দিকে।

জাহাজের মাঝ-ডেকে আটকানো হলো ওদের। সবার গম্ভীর চেহারা দেখে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে ফেলল ওরা। এমনি সময়ে কোয়ার্টারডেক থেকে হুঙ্কার ছাড়লেন ক্যাপটেন, হুকুম দিলেন এই মুহূর্তে নিচে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে।

মেজরের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল ধমক খেয়ে। দু-পা এগিয়ে চেঁচিয়ে জানতে চাইল সে, ক্যাপটেন, কি হচ্ছে এখানে?

নরক গুলজার হচ্ছে! খেঁকিয়ে উঠলেন ক্যাপটেন ব্র্যানসাম। কেটে পড়ুন এখান থেকে। মহিলাকে নিয়ে নিচের ডেকে চলে যান, এক্ষুণি।

বুক ফুলিয়ে আরও এক পা এগোল মেজর, আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে তার ক্যাপটেনের ব্যবহারে। কোমরে হাত রেখে বলল, আমি জানতে চাই এমনি সময়ে তার কথায় বাধা দিল কামানের বিকট আওয়াজ। জাহাজের পিছন দিকেই কোথাও পড়ল গোলাটা, মড়মড় আওয়াজ পাওয়া গেল কাঠ ভেঙে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ার।

ওখানে দাঁড়িয়েই থাকবেন আপনি মোটা মাথাটায় কিছুর বাড়ি খেয়ে খুন না হওয়া পর্যন্ত? আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে টের পাচ্ছেন না? এক্ষুণি দূর হন এখান থেকে, মহিলার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন!

এর পরেও আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল মেজর, প্রিসিলা তার আস্তীন ধরে টান দিল, ভয়ে সাদা হয়ে গেছে মুখ। চলে আসুন, বার্ট। আমরা নিচের ডেকে যাই।

আসলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মেজর। ডাঙার যুদ্ধ সে বোঝে, কিন্তু পানিতে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে যাওয়ায় অসহায় বোধ করছে সে, কি করবে দিশে পাচ্ছে না। পাশ থেকে একজন নাবিক বলল, আক্রমণ করেছে আমাদেরকে নরকের কীট ওই বেজন্মা টম লীচ।

গ্রেট কেবিনে ফিরে গেল ওরা। এখান থেকে পোর্ট হোল দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ধেয়ে আসা কালো জাহাজটা। মেয়েটাকে অভয় দেয়ার জন্যে এমন সব কথা বলতে শুরু করল মেজর যার এক বিন্দু সে নিজেই বিশ্বাস করে না।

ওদিকে রেগেমেগে কোয়ার্টারডেকে উঠে এসেছে দো বাখনি। কৈফিয়ৎ চাইছে, এতক্ষণ ধরে কি করছে ক্যাপটেন, জাহাজ না ঘোরালে সে কামান দাগবে কি করে। নির্দেশ দিল, এক্ষুণি পাল গুটান, পাশ ফেরান সেন্টরকে। জলদি করুন, নইলে…

খেপেছেন? জবাব দিলেন ক্যাপটেন। মাথা খারাপ আপনার! এখন এসব করতে গেলে সরে যাওয়ার আগেই আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে ওরা।

এতক্ষণ দেরি করেছেন বলেই ওরা এত কাছে আসার সুযোগ পেয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষে ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন আপনি আরও। কুইক, ম্যান! এখনও সময় আছে! ওর পাল ধ্বংস করে দিতে না পারলে আমাদের রক্ষা নেই। প্লীজ, আর সময় নষ্ট করবেন না। ঠিক আছে, পাল নামাবার দরকার নেই, হালটা একটু ঘোরান। তারপর বাকিটুকু ছেড়ে দিন আমার হাতে।

এতবড় বিপদের ঝুঁকি নেয়ার জন্যে জুয়াড়ির মত সাহস দরকার, সেটা নেই ব্র্যানসামের, তার ওপর এইমাত্র ফরাসী লোকটা যে ভাষায় সমালোচনা করল সেটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি– রেগে গেলেন তিনি, হারিয়ে ফেললেন বিচার-বুদ্ধি।

আপনি যান তো এখান থেকে! খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। হুকুম ঝাড়ছেন– কে এই জাহাজের কমান্ডার, মোসু? আপনি না আমি?

একহাতে ক্যাপটেনের বাহু ধরে অপর হাত তুলে দেখাল দো বাখনি, দেখুন, তাকিয়ে দেখুন!

সামনের টপসেইল উঁচু-নিচু করছে ডাকাতটা। তার মানে থামতে বলছে। মুহূর্তে বুদ্ধি খেলল, দো বাখনির মাথায়। বলল, এই কিন্তু আপনার শেষ সুযোগ, ক্যাপটেন। সুযোগটা চিনতে শেখেন। আপনি শুধু নির্দেশ মেনে নেয়ার ভান করবেন, তাতেই ওদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাব। ওটার গলুইয়ের আড়াআড়ি থামতে শুরু করবেন, এই ফাঁকে ওর খোল ফুটো করে দিচ্ছি আমি।

এসব জলদস্যুসুলভ ছল-চাতুরী আর কূট-কৌশল মোটেই পছন্দ হলো না ব্র্যানসামের। বললেন, আর ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে?

পালগুলো যদি ঘায়েল করতে পারি, ওরা কামান তাক করতেই পারবে না।

বুঝলাম। কিন্তু যদি না পারেন?

তাহলেও অবস্থা এখন যা আছে তার চেয়ে খারাপ হবে না।

দো বাখনির ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে দুর্বল হয়ে পড়ল ক্যাপটেনের সংকল্প। বুঝতে পারলেন, এটাই শেষ সুযোগ। বেপরোয়া কাজ, কিন্তু এছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই।

থামাচ্ছেন তাহলে? আবার তাগাদা দিল দো বাখনি। যা করবার একটু জলদি করুন। থামার আদেশ দিচ্ছেন আপনি?

এছাড়া আর তো কোন পথ দেখছি না।

বেশ, এই কথা থাকল তাহলে! বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল দো বাখনি নিচের ডেকে।

এদিকে দেরি দেখে অসহিষ্ণু টম লীচ আবার কামান দাগল সেন্টরের পাল লক্ষ্য করে। দড়িদড়া আর বাঁশ-কাঠ নিয়ে দড়াম করে ডেকে এসে পড়ল দুটো পাল।

আওয়াজ পেয়ে নিচে থেকে বুঝতে পারল দো বাখনি কি ঘটছে উপরে। ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, একটু যেন খুশিই হলো সে– এর ফলে দূর হয়ে যাবে ক্যাপটেন ব্র্যানসামের ইতস্তত ভাব। গানারদেরকে তৈরি থাকার আদেশ দিল সে। নিজেও একটা কামান নিয়ে প্রস্তুত হলো, সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে ঠিক সময়মত।

এমনি সময়ে আবার এল গোলাবর্ষণের আওয়াজ। গোটা জাহাজ কেঁপে উঠল এই আঘাতে। ছিটকে গিয়ে বাল্কহেডের গায়ে ধাক্কা খেল দো রাখনি। নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে এল আবার কামানের পাশে। থামছে সেন্টর, অপেক্ষা করছে গানাররা, এই বুঝি দেখা যাবে ব্ল্যাক সোয়ানের খোল। কিন্তু না, সামনে খোলা সাগর ছাড়া কিছুই নেই।

হঠাৎ বুঝতে পারল সে, গাধা ক্যাপটেন ভুল দিকে ঘুরিয়েছে জাহাজ। বাজে একটা গাল বকে, ব্যাপার কি জানার জন্যে ছুটল সে উপরের ডেকের উদ্দেশে।

যা দেখল তাতে দো বাখনির চক্ষু চড়কগাছ। এখন আর কিছুই করবার নেই। শেষের গোলাটা দৈবক্রমে সেন্টরের হালের মাথাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন এ জাহাজের উপর আর কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। পিছনের পোর্ট হোল দিয়ে দেখা গেল, এগিয়ে আসছে ব্ল্যাক সোয়ান, সেই সঙ্গে একটা-একটা করে নামিয়ে ফেলছে পাল। অর্থাৎ, এবার চড়াও হবে এ জাহাজে।

কিছু করার নেই আর এখন। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে বড় বেশি দেরি করে ফেলেছেন ব্র্যানসাম। যখন অনেক কষ্টে রাজি করানো গেল, তখন ভাগ্যদেবি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কপাল জোরে হালে লাগিয়ে দিয়েছে ওরা একটা গোলা।

সব শেষ! আমরা হেরে গেছি, স্যার! দো বাখনিকে দেখে প্রায় ককিয়ে উঠল স্বাস্থ্যবান ওয়ার্ডরূম গানার। এবার এসে উঠবে ওরা।

পাঁচশো,গজ দূরে এখন ব্ল্যাক সোয়ান, চোখ তুলে তাকাল সেদিকে দো বাখনি, দৃষ্টি শান্ত, নির্বিকার। হাঁটুতে ভর দিয়ে নিচু হলো সে, ধীরে-সুস্থে পিতলের একটা কামানে গোলা ভরছে। এই শেষ একটা চেষ্টা করবে সে হার মেনে নেয়ার আগে। সম্ভাবনা খুবই কম, তবু বলা যায় না কিছু কাজ এতে হতেও পারে।

উঠে দাঁড়িয়ে গানারের হাত থেকে আগুন নিয়ে জায়গা মত ছোঁয়াল সে, তারপর পিছু-ধাক্কা এড়াতে লাফিয়ে সরে গেল একপাশে। কিন্তু ঠিক যখন গোলাটা কামান থেকে বেরোচ্ছে, তখনই হাওয়া লেগে দুলে উঠল সেন্টর, সরে গেল কামানের মুখ। সেন্টর থেকে ছোঁড়া প্রথম ও শেষ গোলা ছুটে গেল খোলা সাগরের দিকে।

ওয়ার্ডরূম গানারের দিকে চেয়ে হাসল মশিয়ে দো বাখনি। ঠিক বলেছিলে, সব শেষ। এবার উঠে আসবে ওরা সেন্টরে, তারপর… জানোই তো- কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাকিটুকু বোঝাল সে। আগুনটা পোর্ট হোল দিয়ে সাগরে ফেলে দিল। ভাবল, এই মার্চেন্ট শিপের ভীতু ক্যাপটেনের কাছাকাছি থাকা উচিত ছিল তার। তাহলে হয়তো গানারদের কামান দাগার সুবিধে করে দেয়া ওর পক্ষে সম্ভব হতে পারত। কিন্তু এখন আর সেসব ভেবে কি লাভ, সেন্টরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। পাল নামাতে নামাতে এগিয়ে আসছে কালো জাহাজটা আহত শিকারের দিকে।

গানারের দিকে ফিরল দো বাখনি। ওপরে চলে যাও। গান ডেকের সবাইকে ডেকে নিয়ে যাও সঙ্গে। এখানে আর কিছুই করবার নেই কারও।

নিজে সে সিঁড়ি বাওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে পোর্ট হোল থেকে বাইরে বেরিয়ে রেলিং টপকে উঠে গেল ওপরের ডেকে। খালি গায়ে একজন লোককে ওভাবে উঠে আসতে দেখে ভয়ে জান উড়ে গেল প্রিসিলা ও মেজর স্যান্ডসের। যুদ্ধ করতে হতে পারে মনে করে তলোয়ারটা কোমরে ঝুলিয়ে নিয়েছে মেজর, ওটার বাটের উপর হাত চলে গেল তার। কিন্তু তার আগেই অভয় দিল দো বাখনির কণ্ঠ। সে বলল, যত দ্রুত সম্ভব নিজের কেবিনে পৌঁছানো দরকার তার, তাই ঘাম আর ধুলো-বারুদ মেখে নোংরা অবস্থায় এভাবে উঠে এসেছে।

মেজরের প্রশ্নের জবাবে বলল, যুদ্ধ শেষ। বোকা ব্র্যানসামটা আমাকে একটা গোলা ছোঁড়ার সুযোগও দিল না। লীচও গোলাগুলি বন্ধ করেছে। বোঝা যাচ্ছে এই জাহাজটা ওর দরকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে আসবে ওরা সেন্টরে।

অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝল ওরা দুজনই। এখন ঈশ্বর ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই ওকে রক্ষা করে, বুঝে নিয়ে ওখানেই হাঁটু ভাজ করে প্রার্থনায় বসে পড়ল প্রিসিলা। মেজরের চেহারায় চরম হতাশা ও। মৃত্যুভীতি।

মশিয়ে দো বাখনির চেহারা গম্ভীর, কিন্তু ভীতি বা হতাশার কোন চিহ্ন সেখানে নেই। মৃদু কণ্ঠে বলল, বুকে সাহস রাখুন, মাদামোয়াযেল। ঘাবড়াবেন না। আমি আছি এখানে। হয়তো আপনার কোন বিপদ হবে না। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়তো করতে পারব। মাঝে মাঝে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলি। দেখবেন, একটা কিছু বুদ্ধি বের করে ফেলব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। শুধু অল্প একটু বিশ্বাস।

কথা শেষ করে একছুটে নিজের কেবিনে গিয়ে ঢুকল মশিয়ে দো বাখনি, ডাক দিল পিয়েখকে।

উঠে দাঁড়িয়ে মেজরের দিকে সপ্রশ্নদৃষ্টিতে চাইল প্রিসিলা।

মেজর নিশ্চিত জানে অযথা বাগাড়ম্বর করে গেল নাটুকে ফরাসী লোকটা, কিন্তু সেকথা না বলে মেয়েটাকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার জন্যে বলল, ও কি করতে পারবে আমার মাথায় আসছে না। খুন করে ফেললেও আসবে না। তবে ওকে তো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বলেই মনে হলো। মানতেই হবে, অনেক গুণ আছে লোকটার। এমনও হতে পারে ও নিজেও যখন জলদস্যু ছিল, ওকে কিছু বলবে না ওরা। জানো তো কুকুরের মাংস খায় না কুকুর।

আবোলতাবোল বকে চলল মেজর, যদিও নিশ্চিত জানে– কোন আশা নেই। টম লীচ সম্পর্কে যা শুনেছে তার শতকরা দশভাগও যদি সত্য হয়, মৃত্যু অনিবার্য। খোদাকে মনে মনে ডাকছে, যেন খুব দ্রুত হয় মরণ। কিন্তু নিজের চেয়েও বেশি ভাবছে প্রিসিলা হ্যারাডিনের দুর্ভাগ্যের কথা। পাষণ্ডগুলো খুবলে খাবে ওকে। একবার ভাবল, তার চেয়ে ওকে এখনই মেরে ফেললে কেমন হয়?

একসময় কালো জাহাজের ছায়া পড়ল সেন্টরের উপর। এক সেকেন্ডের জন্যে রেলিঙের ধারে দাঁড়ানো অনেকগুলো ভয়ঙ্কর চেহারা দেখা গেল। একটা ট্রাম্পেট বেজে উঠল দস্যু-জাহাজে, সেই সঙ্গে ড্রামের শব্দ। তারপরই শোনা গেল অনেকগুলো মাস্কেটের গুলির শব্দ। ঠক-ঠক করে কাঁপছে প্রিসিলা।

এমনি সময়ে কেবিন থেকে বের হলো মশিয়ে দো বাখনি, তার পিছনে পিয়েখ। হাতে, বা মুখে কোথাও ধুলো-ময়লার চিহ্ন নেই; ধোপদুরস্ত জামাকাপড়; মাথায় কালো, কোকড়া পরচুলা; পায়ে কর্ডোভান লেদারের বুট; তলোয়ার তো আছেই, বেল্টে গোঁজা রয়েছে। দুটো পিস্তল।

বোঝা গেল, এতক্ষণ সাজগোজ করছিল লোকটা। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল ওরা দো বাখনির দিকে। সাজের এই কি একটা সময় হলো? সাজসজ্জার চেয়েও বেশি অবাক করল ওদের ওর সহজ, স্বচ্ছন্দ হাবভাব। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে সে ওদের দিকে। বলল, ক্যাপটেন লীচ হচ্ছে মহাপুরুষ। মহান জলদস্যুদের শেষ নমুনা। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হলে আনুষ্ঠানিকতার দরকার আছে।

চারদিকে নরক গুলজার হচ্ছে এখন। প্রচণ্ড শব্দে গোলা ফাটল কাছেই। ছিটকে পড়তে গিয়েও কোনও মতে টেবিলটা ধরে সামলে নিল দো বাখনি। মেজর স্যান্ডস বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে, আর প্রিসিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ল দো বাখনির বুকে।

বাঁচান! ফুঁপিয়ে উঠল সে, প্লিজ, আমাকে বাঁচান!

একহাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে দো বাখনি। কালো গোঁফের নিচে ঠোঁট জোড়া সামান্য প্রসারিত হলো। বুকের ওপর সেঁটে থাকা সোনালী মাথায় হাত বুলিয়ে দিল দো বাখনি। বলল, মনে হচ্ছে, পারব। খুব সম্ভব পারব।

নির্ভীক লোকটার ছোঁয়ায় অনেকটা দূর হয়ে গেল প্রিসিলার ভয়। ওদিকে প্রিসিলাকে ফরাসী লোকটার বুকে সেঁটে থাকতে দেখে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল মেজরের, ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে কটমট করে চেয়ে রইল দো বাখনির দিকে। তারপর চ্যালেঞ্জ করল, আপনি আর কী করতে পারবেন এখন?

দেখা যাক কি পারি। হয়তো অনেক কিছুই পারব, আবার, হয়তো কিছুই পারব না। তবে আমার সাফল্য নির্ভর করবে আপনাদের সহযোগিতার ওপর। চেহারা একটু কঠোর হলো দো বাখনির। আমার প্রতিটি কথায় সায় দিতে হবে আপনাদের– যাই বলি না কেন, শুনতে যেমনই লাগুক। একটা কথার প্রতিবাদ যদি করেন, মনে রাখবেন, আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব।

ধুপ-ধাপ আওয়াজ আসছে ওপরের ডেক থেকে। এসে পড়েছে। দস্যুরা। চিৎকার চেঁচামেচি চরমে উঠেছে। থেকে থেকে গর্জে উঠছে পিস্তল, বন্দুক। বোঝা যাচ্ছে, বাধা দেয়া হচ্ছে ওদের। পোর্ট হোল দিয়ে দেখা গেল ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল একটা লাশ, তারপর আরও দুটো।

ভয়ে শিউরে উঠল প্রিসিলা। সান্ত্বনা দিল দো বাখনি, এই শেষ হলো বলে। আর বেশিক্ষণ টিকবে না এরা। কমপক্ষে তিনশো অনুচর লীচের; আর সেন্টরের আছে মাত্র এক কুড়ির কিছু বেশি।

কান পাতল দো বাখনি, কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ এগিয়ে আসছে এদিকে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সে, আমার কথা মেনে নেবেন তো? অক্ষরে অক্ষরে? কথা দিন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি যাই বলেন না কেন।

আর আপনি, মেজর স্যান্ডস?

মুখ কালো করে কথা দিল মেজর। এবং তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নগ্ন পায়ে ধুপ-ধাপ আওয়াজ তুলে গ্রেট কেবিনের দরজার কাছে। চলে এল একদল দস্যু। ওপর থেকে এখনও মাঝে-মধ্যে কাতরানি ও চিৎকারের শব্দ এলেও বিজয়ীদের পৈশাচিক হাসিই শোনা যাচ্ছে বেশিরভাগ। একদল নেমে এসেছে লুটের মাল কি পাওয়া যায় দেখার জন্যে।

দড়াম করে খুলে গেল কেবিনের দরজা, বাল্কহেডে বাড়ি খেল। হাতে অস্ত্র আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে ঢুকল একদল দস্যু। ওদের তিনজন আর পিছনে পিয়েখকে দেখে থমকে দাঁড়াল। মেয়ে দেখে উল্লাসে হৈ হৈ করে উঠল কয়েকজন। এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু এক পা এগিয়ে বাধা দিল দো বাখনি। দুই হাত কোমরে গোজা দুই পিস্তলের বাটে।

দাঁড়াও! প্রচণ্ড এক ধমক লাগাল সে ওদের। আর এক পা এগোলে মাথার ঘিলু বের করে দেব! আমি দো বাখনি। যাও, তোমাদের ক্যাপটেন লীচকে ডেকে নিয়ে এসো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *