এ কি স্বর্গ? না নরক?

এ কি স্বর্গ? না নরক?
Was It Heaven? Or Hell?

০১.

তুমি মিথ্যা বলেছ?

তুমি স্বীকার কর-সত্যি সত্যি স্বীকার কর-তুমি মিথ্যা বলেছ!

.

০২.

পরিবারটি তে ছিল চারটি মানুষ: ছত্রিশ বছর বয়স্ক বিধবা মার্গারেট লেস্টার; তার ষোল বছর বয়সের মেয়ে হেলেন লেস্টার; শ্ৰীমতী লেস্টারের দুই যমজ অবিবাহিতা মাসি হান্না এবং হেস্টার গ্রে, বয়স সাতষট্টি বছর। এই তিন রমণী ছোট্ট মেয়েটিকে আদর-যতিন করত; তার মিষ্টি মনের গতি-বিধির প্রতিচ্ছবি তারা দেখত তার মুখের আয়নায়; তার প্রস্ফুটিত সৌন্দর্য দেখে তারা তাদের মনকে তাজা করে তুলত; তার গলায় গান শুনত; কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবত যে মেয়েটির মধ্যে এই গুণগুলি আছে বলেই পৃথিবী তাদের কাছে কতখানি শূন্য হয়ে যেত; সব ভেবে তারা শিউরে উঠত। এমনি করেই জাগ্রত ও ঘুমন্ত সব অবস্থাতেই এই তিনটি নারী তাদের দিন ও রাত্রি কাটিয়ে দিত।

স্বভাবে এবং মনের দিক থেকে এই বয়ষ্ণু মাসিরা ছিল সত্যিই প্রিয়, স্নেহময়ী এবং ভাল, কিন্তু নৈতিকতা এবং আচরণের দিক থেকে তাদের শিক্ষা এত আপোষহীনভাবে কঠোর ছিল যে তা তাদের নির্দয় না হলেও বাহ্যত কর্কশ করে তুলেছিল। তাদের প্রভাব বাড়িতে এত বেশী কার্যকরী ছিল যে মা এবং মেয়ে তাদের নৈতিক ওধর্মীয় দাবীগুলিকে খুসি মনে, সন্তুষ্ট চিত্তে, আনন্দের সঙ্গে, বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল। এ রকম করা তাদের স্বভাবগতই হয়ে উঠেছিল। এবং সেই জন্যই এই শান্তিময় স্বর্গে কোন সংঘাত, বিরক্তি, দোষারোপ ও মনোমালিন্য ছিল না।

এখানে মিথ্যার কোন স্থান ছিল না। এখানে মিথ্যা ছিল চিন্তার অতীত। পরম সত্য, লৌহ-কঠিন সত্য, সুদৃঢ় এবং আপোষহীন সতাই এখানে প্রতিটি বক্তব্যকে নিয়ন্ত্রণ করত, তার পরিণতিতে যাই ঘটুক না কেন। অবশেষে একদিন পারিপার্শ্বিকের চাপে সেই বাড়ির আদরের মেয়েটি একটি মিথ্যা দিয়ে তার ঠোঁটকে কলঙ্কিত করল–এবং চোখের জলে, আত্ম-ধিক্কারের সঙ্গে তা স্বীকার করল। মাসিরা এমন বিহ্বল হয়ে পড়ল যে তা অবর্ণনীয়। মনে হয়েছিল বুঝি বা আকাশটা গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে, এবং পৃথিবীটা প্রচণ্ড সংঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা পাশাপাশি বসেছিল; মুখ ফ্যাকাশে ও কঠোর; নির্বাক হয়ে অপরাধীর দিকে তাকিয়েছিল; আর অপরাধী নতজানু হয়ে একবার এর কোলে আর একবার তার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, সহানুভূতি ও ক্ষমা ভিক্ষা করে কোন সাড়া না পেয়ে বিনীতভাবে দুজনের হাত চুম্বন করছিল, আর তারা দুজনেই তার কলংকিত ঠোঁটের ছোঁয়া থেকে তাদের হাত সরিয়ে নিচ্ছিল।

তারই ফাঁকে হেস্টার মাসি বরফ–কঠিন বিস্ময়ে দুবার বলল:

তুমি মিথ্যা কথা বলেছ?

তারই ফাঁকে হান্না মাসিও সবিস্ময়ে দুবার বলল:

তুমি স্বীকার কর-তুমি সত্যিই স্বীকার কর-তুমি মিথ্যা বলেছ!

এটুকুই তারা বলতে পেরেছিল। পরিস্থিতিটা ছিল নতুন, অশ্রুতপূর্ব ও অবিশ্বাস্য; তারা বুঝতে পারছিল না, তারা জানত না কি করে এর মোকাবিলা করবে; তাদের বাকশক্তি প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল।

অবশেষে ঠিক হল যে ভ্রান্ত শিশুটিকে তার অসুস্থ মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে; তাঁরও জানা দরকার কি ঘটেছে। হেলেন প্রার্থনা করল, মিনতি জানাল, অনুরোধ জানাল, এই বাড়তি অপমানের হাত থেকে তাকে রেহাই দেওয়া হোক, আর তার মাকেও এই দুঃখ ও যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা করা হোক; কিন্তু তা তে পারে না; কর্তব্যের খাতিরে এ দুঃখ সহ্য করতেই হবে, কারণ কর্তব্য সবকিছুর উপরে, কোন কিছুর জন্যই কর্তব্যচত হওয়া যায় না, কর্তব্যের ক্ষেত্রে কোন আপোষই সম্ভব নয়।

হেলেন তবুও মিনতি জানাল, বলল যে এ পাপ তার নিজের, তার মায়ের এতে কোন হাত ছিল না-তাহলে মা কেন তার জন্য কষ্ট পাবে?

কিন্তু মাসিরা তাদের ন্যায়বিচারে অনমনীয়;তারা বলল, বাবা মার পাপ যেমন সন্তানে বর্তায় তেমনই তার উল্টোটাও ন্যায়বিচারসম্মত; কাজেই এটাই ন্যায়সঙ্গত যে পাপী সন্তানের মাকেও সেই পাপের জন্য প্রাপ্য দুঃখ, যন্ত্রণা ও লজ্জার যথাযোগ্য অংশ ভোগ করতেই হবে।

তারা তিনজনে রোগিনীর ঘরের দিকে চলল।

এই সময় ডাক্তাবাবু ঐ বাড়ির দিকে আসছিলেন। যদিও তখনও তিনি বেশ কিছুটা দূরেই ছিলেন। তিনি ভাল চিকিৎসক ও ভাল মানুষ। তাঁর অন্তরটাও ভাল ছিল। কিন্তু তাঁর প্রতি ঘৃণা দূর হতে কোন একজন মানুষের লাগত এক বছর, দু বছর লাগত তাকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে, তিন বছর লাগত তাকে পছন্দ করতে, এবং চার থেকে পাঁচ বছর লগাত তাকে ভালবাসতে শিখতে। বেশী ধীরে ধীরে এবং কষ্ট করে এই শিক্ষা লাভ করতে হত। তবে তাতে লাভই হত। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী; সিংহের মত মাথা, সিংহের মত মুখ, কর্কশ কণ্ঠ স্বর; এবং মেজাজ মাফিক চোখ দুটি কখনও জলদস্যুর মত, কখনও রমণীসুলভ। কোন রকম সহবৎ জানতেন না, তার ধারাও ধারতেন না; কথাবার্তায়, আচরণে, সাহসে, স্বভাবে তিনি ছিলেন প্রচলিত ধারার পরিপন্থী। বেশ খোলামেলা লোক, তবে কিছুদূর পর্যন্ত; সব ব্যপারেই তাঁর একটা নিজস্ব মতামত আছে, আর সব সময়ই তা ঠোঁটের ডগায় শোনাবার জন্য তৈরিই থাকে; শ্রোতারা তা পছন্দ করছে কি না তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেন না। যাকে ভালবাসেন তাকে ভালই বাসেন, এবং উচ্চ কণ্ঠে তা জানিয়েও দেন। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন নাবিক; এবং সমুদ্রের নোনা হাওয়া তার মধ্য থেকে এখনও বেরিয়ে আসে। তিনি একজন কঠোর ও বিশ্বস্ত খ্রীস্টান; তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনিই দেশের শ্রেষ্ঠ খ্রীস্টান; তাঁর খ্রীস্টভক্তিই সম্পূর্ণ সঠিক, স্বাস্থ্যকর, সাধারণ জ্ঞানদ্বারা পূর্ণ, সমৃদ্ধ, তাতে কোন বিকৃতির স্থান নেই। যে সব লোক কৌশলে স্বার্থসাধন করতে চাইত, অথবা যারা তার চরিত্রের কোমল দিকটার সুযোগ। খুঁজে নিতে চাইত, একমাত্র তারাই তাকে বলত একমাত্র খ্রীস্টান-তবু এই শব্দটির সূক্ষ্ম তোষামোদের সুরটি তাঁর কানে বাজনার মত মনে হত; এবং তার প্রথম অক্ষরটি তার কাছে এত আনন্দজনক ও তীব্র মনে হত যে অন্ধকারে কোন ব্যক্তির মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও তিনি যেন তা দেখতে পেতেন। ডাক্তারটি যা বিশ্বাস করতেন, তা সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেন এবং সুযোগ পেলেই তার জন্য লড়াই করতেন; আর এই ধরনের সুযোগ আসতে বিরক্তিকর দীর্ঘ বিরতি ঘটলে তিনি নিজেই সে সময়টা কমিয়ে আনতেন। নিজস্ব স্বাধীন আলোকে তিনি ছিলেন গভীরভাবে বিবেকবান; এবং যা কর্তব্য বলে মনে করতেন; পেশাদারী বা নীতিবাগীশদের উপদেশের সঙ্গে তা মিলছে কি না সেটা তার কাছে কোন ব্যাপারই ছিল না। তরুণ বয়সে, যখন সমুদ্রে থাকতেন তখন তিনি অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করতেন, কিন্তু খ্রীস্টধর্ম গ্রহণের পরে তিনি একটা নিয়ম তৈরি করে নেন যে একান্ত প্রয়োজন না হলে অশ্লীল কথা বলবেন এবং পরবর্তী কালে কঠোরভাবে সে নিয়ম পালন করেই চলেছেন। সমুদ্রে তিনি ছিলেন পাঁড় মাতাল, কিন্তু খ্রীসটধর্ম গ্রহণের পরে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন দৃঢ় ও সরল নেশাহীন ব্যক্তি, এবং সেই থেকে কদাচিৎ গান করতেন-যখন কর্তব্য বলে মনে হত সেই রকম অবস্থা ছাড়া তিনি কখনই তা করতেন না; আর সে অবস্থা বছরে মাত্র কয়েকবারই ঘটত, তবে বার পাঁচেকের বেশী নয়।

স্বভাবতই এরকম মানুষ প্রভাবশালী ও আবেগপ্রবণ হয়। তিনিও তাই ছিলেন, এবং তার অনুভূতিকে ঢাকবার কোন প্রবণতাও তার ছিল না, অথবা থাকলেও সেটা প্রকাশ করতে কোন অসুবিধা বোধ করতেন না। মনের অবস্থা সব সময়ই তার মুখে ফুটে উঠত। যখনই তার চোখে কোমল আলো ফুটে উঠত তখনই বোঝা যেত যে তার মন ভাল আছে; আবার যখনই ভুরু কুঁচকে আসতো, তখনই ঘরের আবহাওয়া দশ ডিগ্রী নীচে নেমে যেত। বন্ধুদের বাড়িতে তিনি সকলেরই খুব ভালবাসার পাত্র ছিলেন, কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে সকলে খুব ভয়ও করত।

লেস্টারদের বাড়ির বাসিন্দাদের প্রতি তার একটা গভীর ভালবাসা ছিল, এবং এখানকার বাসিন্দারাও আগ্রহের সঙ্গে এই অনুভূতির প্রতিদান দিত। তার অতিমাত্রায় খ্রীস্টভক্তি নিয়ে তারা যেমন দুঃখপ্রকাশ করত, তেমনি তাদের খ্রীস্টভক্তিকেও তিনি খোলাখুলিভাবে অবজ্ঞা করতেন; তথাপি দুই পক্ষই পরস্পরকে সমান ভালবেসে চলত।

তিনি বাড়িটির দিকেই আসছিলেন-মাসিরা এবং অপরাধী মেয়েটি ও রোগীর ঘরের দিকেই যাচ্ছিল।

.

০৩.

পূর্ব বর্ণিত তিনজন বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিল: মাসিরা গম্ভীর, আর মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা বালিশে মাথাটা ঘোরাল; মেয়ের উপর নজর পড়তেই তাঁর ক্লান্ত চোখ দুটি সহানুভূতি ও উচ্ছ্বসিত মাতৃস্নেহে জ্বলে উঠল; দুহাত বাড়িয়ে তাকে আশ্রয় দিতে চাইল।

থাম! বলল হান্নামাসি; হাত বাড়িয়ে মেয়েটি কে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধা দিল।

হেলেন অন্য মাসি গম্ভীরভাবে বলল, তোমার মাকে সব বল। তোমার আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর; কোন কিছুই স্বীকার করতে বাকি রেখ না। বিচারকদের সামনে অভিভূত ও অসহায় হয়ে বাচ্চা মেয়েটি তার দুঃখের ঘটনার শেষ কথাটি পর্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, তারপর তীব্র আবেগে চিৎকার করে বলল:

মাগো, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার না? তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না!-আমি যে বড় নিঃসঙ্গ!

আমার বাচ্চা, তোকে ক্ষমা? ওরে, আমার কাছে আয়!-এখানে আমার বুকের উপর মাথা রাখ, শান্তিতে থা। তুই যদি হাজার মিথ্যে ও বলে থাকিস্-

একটা শব্দ হল-একটা সাবধানবাণী-গলাখাঁকারির শব্দ। মাসিরা চোখ তুলে তাকাল; তাদের পোশাকের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন যে ডাক্তারটি তাঁর মুখ বজ্র-মেঘের মত গম্ভীর। মা ও মেয়ে তাঁর উপস্থিতির কথা কিছুই বুঝতে পারে নি; তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বুকে বুক দিয়ে শুয়েছিল। অপরিমিত সুখে মগ্ন হয়ে, সব কিছু ভুলে। ডাক্তারটি তার সামনের এই দৃশ্য বহুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখলেন, কারণ অনুসন্ধান করলেন; তারপর হাত তুলে মাসিদের ইশারা করলেন। তাঁরা কাঁপতে কাঁপতে তাঁর কাছে গেল এবং বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তিনি নীচু হয়ে ফি সৃফি স্ করে বললেন:

আমি কি বলি নি যে এই রোগীকে সমস্ত উত্তেজনা থেকে দূরে রাখতে হবে? তোমরা কি সব যা তা করছিলে? এখান থেকে চলে যাও!

তারা কথা শুনল। আধ ঘণ্টা পরে হেলেনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বসবার ঘরে এলেন, প্রসান্ত উ ৎফুল্ল, রৌদ্রালোকে ঝলম। হেলেনকে জড়িয়ে ধরে আদর করে মিষ্টি মিষ্টি মজার কথা বললেন; আর সেও আবার তার ঝকঝকে ও সুখী রূপটি ফিরে পেল।

তিনি বললেন, তাহলে এখন বিদায় মা-মণি। তোমার ঘরে যাও, মার কাছ থেকে দুরে থেক এবং ভাল ভাবে থেক। দাঁড়াও-জিভটা বার কর। এই তো ঠিক আছে-তুমি একটা বাদামের মত সুস্থ! তবু গালটা টিপে দিয়ে বললেন, এখন পালাও; আমি তোমার মাসিদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সে এখান থেকে চেল গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের মুখে আবার মেঘ নেমে এল; বসে পড়ে তিনি বললেন:

তোমরা অনেক ক্ষতি করেছ-এবং হয়তো কিছু ভাল ও করেছ। কিছু ভাল, হ্যাঁ-সেরকমই মনে হচ্ছে। ঐ মহিলার অসুখটা হচ্ছে টাইফয়েড। তোমাদের জন্যই তা বোঝা গেল, আমার মনে হয় তোমাদের পাগলামির জন্য আর সেটাই কাজের কাজ হয়েছে। আমি তো এতদিন রোগটা ধরতেই পারছিলাম না।

এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বয় মহিলা দুজন ভয়ে কাঁপতে লাগল।

বস! তোমরা কি করতে চাও?

কি করতে চাই? আমরা এক্ষুণি তার কাছে যাব। আমরা-

সে রকম কিছুই করবো না; একদিনের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতি করেছ। তোমরা কি একটা খেলাতেই সব পাপ ও বোকামির বোঝা উড়িয়ে। দিতে চাও? আমি বলছি, বসে পড়। আমি ওঁর জন্য ঘুমের ব্যবস্থা করেছি; ওঁর ঘুমের প্রয়োজন; তোমরা যদি আমার আদেশ ছাড়া তাঁকে বিরক্ত কর আমি তোমাদের মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বার করে দেব-অবশ্য যদি কিছু ঘিলু থাকে।

বিপর্যস্ত ও বিক্ষুব্ধ হলেও তারা বাধ্য হয়েই বসে পড়ল। তিনি বলতে লাগলেন:

তাহলে এখন আমি এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা চাই; ওরা আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল যেন ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আবেগ আর উত্তেজনার সৃষ্টি হয় নি। তোমরা আমার আদেশ জানতে; তবু ওখানে যাবার এবং গোলমাল বাধাবার সাহস পেলে কি করে?

হেস্টার কাতর দৃষ্টিতে হান্নার দিকে তাকাল, হান্নাও হেস্টারের দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকাল-এই সহানুভূতিশূন্য অর্কেস্ট্রায় তারা কেউ ই অংশীদার হতে চাইছিল না। ডাক্তারই তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তিনি বললেন:

বলে ফেল হেস্টার।

তার শালের কোণটা আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে নাড়ত চোখ নামিয়ে দুর্বল গলায় হেস্টার বলল:

কোন সাধারণ কারণে আমরা আপনার অবাধ্য হই নি। ব্যাপারটা খুব গুরুতর। আমাদের কর্তব্যও বটে। কর্তব্যের ক্ষেত্রে কারও কোন পছন্দ থাকতে পারে না; সমস্ত সাধারণ বিবেচনাকে সরিয়ে রেখে তা পালন করতে হয়। আমরা তার মার সামনে তাকে অভিযুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে একটা মিথ্যা কথা বলেছিল।

ডাক্তার এক মুহূর্ত রমণীদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন; মনে হল তিনি একটি সম্পূর্ণ অর্থহীন কথা বোঝাবার জন্য মনে মনে চেষ্টা করছেন; তারপরই তিনি ফেটে পড়লেন;

সে একটা মিথ্যে কথা বলেছ! এই তো? হা ভগবান! আমি তো একদিনে লক্ষটা মিথ্যে কথা বলি। আর প্রত্যেক ডাক্তারই তাই বলে। এবং প্রত্যেক মানুষই, আপনাদের ধরেই বলছি-তাই বলে। আর এটাই এমন গুরুতর ব্যাপার হয়ে পড়ল যার জন্য তোমরা আমার আদেশ অমান্য করবার এবং ঐ মহিলাটির জীবন বিপন্ন করবার সাহস পেলে! শোন হেস্টার গ্রে, এটা পুরোপুরি পাগলামি; মেয়েটি এমন মিথ্যে বলতে পারে না যা অন্যের ক্ষতি করতে পারে। সেটা অসম্ভব-একেবারেই অসম্ভব। তোমরাও তা জান-দুজনেই জান; ভাল করেই জান।

হান্না তার বোনকে বাঁচাতে এগিয়ে এল।

এটা যে সে রকম ধরনের মিথ্যে কথা হান্না ঠিক তা বলে নি, আর তা ছিলও না। তবু এটা মিথ্যে তো বটে।

দেখ আমি বলছি, এ রকম বোকার মত কথা আমি আগে কখনো শুনি নি। বিভিন্ন রকম মিথ্যের মধ্যে পার্থক্য করার মত বুদ্ধিও কি তোমাদের নেই? তোমরা কি জান না যে উপকারী মিথ্যে আর আঘাতকারী মিথ্যের মধ্যে অনেক পার্থক্য?

সব মিথ্যেই পাপ সাঁড়াশীর মত ঠোঁট দুটি চেপে হান্না বলল, আর সমস্ত মিথ্যেই নিষিদ্ধ।

সেই একমাত্র খ্রীস্টান ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন। ঐ কথাটি কে তিনি পাল্টা আঘাত করতে চাইছিলেন, কিন্তু ঠিক কিভাবে এবং কোথা থেকে শুরু কবেন বুঝতে পারছিলেন না। অবশেষে শুরু করলেন:

হেস্টার, তুমি কি কোন মানুষকে অনাবশ্যক কোন লজ্জা বা আঘাত থেকে রক্ষা করতেও একটা মিথ্যে কথা বলবে না?

না।

কোন বন্ধুর জন্যও না?

না।

কোন প্রিয়তম বন্ধুর জন্যও না?

না। আমি বলব না।

ডাক্তার এই অবস্থায় নিঃশব্দে যুঝতে লাগলেন; তারপর প্রশ্ন করলেন:

তাকে তীব্র যন্ত্রণা, দুঃখ ও শোক থেকে রক্ষা করতেও না?

না। তার জীবন রক্ষা করতেও না।

আবার বিরত। তারপর:

তার আত্মার জন্যও না?

আবার নিশ্চুপ-যেন কিছুক্ষণের জন্য বিরতি-তারপর মৃদুস্বরে অথচ স্থির সিদ্ধান্তের সঙ্গে হেস্টার উত্তর দিল:

তার আত্মার জন্যও নয়।

কিছুক্ষণের জন্য কেউ কোন কথা বলল না; তারপর ডাক্তার বললেন:

হান্না, তোমারও কি একই কথা?

হ্যাঁ, সে উত্তর দিল।

আমি তোমাদের দুজনকেই জিজ্ঞাসা করছি-কেন?

কারণ এ রকম মিথ্যে কথা বলা, অথবা যে কোন মিথ্যে বলাই পাপ; যে কোন মিথ্যেই আমাদের আত্মাকে ভ্রষ্ট করতে পারে-আর যদি অনুশোচনা করবার মত সময় পাবার আগেই আমাদের মৃত্যু হয় তাহলে তাই ঘটবে।

আশ্চর্য..আশ্চর্য..এতো বিশ্বাসই করা যায় না। তারপর তিনি রুক্ষ্মস্বরে প্রশ্ন করলেন: এ রকম আত্মাকে কি রক্ষা করতেই হবে? তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অস্ফুট স্বরে গজর গজর করতে করতে ঠকঠক করে পা ফেলে দরজার দিকে এগোলেন। চৌকাঠের কাছে গিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ভর্ৎসনার সুরে বললেন: সংশোধন কর। তোমাদের ঘৃণ্য, ক্ষুদ্র আত্মাকে রক্ষা করতে তোমাদের এই নীচ, জঘন্য এবং স্বার্থপর প্রচেষ্টাকে বর্জন কর, এমন কিছু কাজের খোঁজ কর যাতে অন্তত কিছুটা মর্যাদা থাকে। আত্মাকে ত্যাগ কর। কোন মহৎ কাজে ত্যাগ কর। তখন যদি তা থেকে ভ্রষ্টও হও, তাহলেই বা তোমাদের কি যায় আসে? সংশোধন কর।

দুই ভাল মানুষ বৃদ্ধা অসাড়, বিধ্বস্ত, চূর্ণ-বিচুর্ণ উৎপীড়িত, অপমানিত হয়ে বসে রইল এবং ক্ষুব্ধ, তিক্ত চিত্তে এই সব অপবিত্র ভাষার কথাই ভাবতে লাগল। দুজনের মনেই খুব আঘাত লেগেছে; এ আঘাত তারা কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে না।

সংশোধন কর।

ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বারবার শব্দটির পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। সংশোধন কর-এবং মিথ্যে বলতে শেখ।

সময় বয়ে চলল; যথাসময়ে তাদের মনেরও পরিবর্তন ঘটল। মানুষের কর্তব্য তারা পালন করেছে-সেটা হল নিজেকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা; সেটা শেষ হলে তবেই মানুষ অন্য ছোট খাট বিষয় ও অন্য মানুষের কথা নিয়ে চিন্তা করতে পারে। এবার দুটি বৃদ্ধা মহিলার মন আবার তাদের আদরের বোনঝি এবং তার ভয়ঙ্কর রোগের দিকে ফিরে গেল; তাদের আত্মপ্রেম যে আঘাত পেয়েছিল তা তারা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেল, এবং তাদের হৃদয়ে তীব্র ইচ্ছা জাগল সেই দুঃখী মেয়েটি কে সাহায্য করার; তাকে আরাম দেবার; তাকে সেবা করার; তাদের দুর্বল হাতে যতখানি সম্ভব ততখানি তার জন্য পরিশ্রম করার; এবং তারই স্বাস্থ্যের সেবায় তাদের দুর্বল বৃদ্ধ শরীরকে পাত করার।

সে সুযোগে আমরা পাবই, চোখের জলে হেস্টার বলল। আমাদের মত সেবিকা আর কোথাও নেই, কারণ এমন কেউ নেই যে আমৃত তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দেবে। ভগবান জানেন, আমরাই তা করব।

আমেন! চোখের জলে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনুমোদন এবং সমর্থন জানিয়ে হান্না বলল। ডাক্তার আমাদের জানেন; আমরা যে আর তাঁর অবাধ্য হব না তাও জানেন; কাজেই তিনি আর কাউকে ডাকবেন না। সে সাহসই তিনি পাবেন না!

সাহস? হেস্টার রেগে গিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে বলল, ঐ খ্রীস্টান শয়তানটি সব পারে! কিন্তু এ সময় সে চেষ্টা করা তার পক্ষে ভাল হবে না। কিন্তু হান্না, যাই বল না কেন, তিনি গুণী জ্ঞানী এবং সৎ, এ রকম কিছু তিনি চিন্তাই করবেন না…..এখন নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে একজনের ঐ ঘরে যাবার সময় হয়েছে। উনি সেখানে কি করছেন? কেন উনি আসছেন না এবং কিছু বলছেন না?

তারা তাঁর পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তিনি ঢুকলেন, বলেন এবং কথা বলতে আরম্ভ করলেন।

মার্গারেট একটি অসুস্থ মহিলা, সে এখনো ঘুমোচ্ছে, কিন্তু সে শীঘ্রই জেগে উঠবে; তখন তোমরা কেউ তার কাছে যাবে। ভাল হয়ে। উঠবার আগে তার অবস্থা আরও খারাপ হবে। তাকে দিন রাত দেখাশুনা করার ব্যবস্থা করতে হবে। তার কতটা দায়িত্ব তোমরা দুজন নিতে পারবে?

সবটাই! দুই মহিলা একসঙ্গে চি কার করে বলল। ডাক্তারের চোখ চকচক্ করে উঠল; উৎসাহের সঙ্গে তিনি বললেন:

তোমাদের কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। তোমরা যতটা পারবে ততটা সেবাই তো করবে, কারণ এই শহরে এই পবিত্র কাজে তোমাদের সমকক্ষ আর কেউ নেই। কিন্তু তোমরা সবটা করতে পারবে না, এবং তোমাদের তা করতে দেওয়াটাও অপরাধ হবে। এটা তো বিরাট প্রশংসা, মূল্যবান প্রশংসা; তাও আবার এ রকম একটা লোকের কাছ থেকে দুই যমজ বৃদ্ধার মনের প্রায় সমস্ত ক্ষোভ দূর। হয়ে গেল। তোমাদের টি ল্লী এবং আমাদের বুড়ী ন্যান্সী বাদবাকিটা করবে-তারা দুজনেই ভাল নার্স, ওদের চামড়া কালো হলেও মনটা সাদা; ওরা সতর্ক, স্নেহময়ী, কোমল-একেবারে নিখুঁত দুজন সেবিকা!-হ্যাঁ, শোন! হেলেনের উপরেও একটু নজর রেখ, সেও অসুস্থ, এবং আরো বেশী অসুস্থ হতে পারে।

মহিলা দুজন সামান্য অবাক হল, যেন ঠিক বিশ্বাস করল না। হেস্টার বলল:

তা কি করে হয়? একঘণ্টাও হয় নি আপনি বলেছেন সে একটা বাদামের মত সতেজ।

ডাক্তার শান্তভাবে উত্তর দিলেন:

সেটা মিথ্যে বলেছিলাম।

মহিলা দুজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়াল; হান্না বলল:

আপনি কি করে এ রকম ঘৃণ্য স্বীকারোক্তি করছেন, তাও এ রকম উদাসীন সুরে, যখন আপনি জানেন যে এ ধরনের ঘটনায় আমাদের উপর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া-

চুপ! তোমরা বিড়ালের মত মূর্খ, তোমরা দুজনেই; তোমরা জান না কি কথা বলছ; তোমরা সব নীতিবাগীশ মূষিকদের মত; তোমরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিথ্যে বল, কিন্তু যেহেতু তোমরা মুখে তা বল না, বল শুধু তোমাদের মিথ্যাবাদী চোখ দিয়ে মিথ্যাবাদী গতিবিধি দিয়ে, তোমাদের বঞ্চনাকারী ভঙ্গী দিয়ে এবং ভ্রান্ত আকার ইঙ্গিত দিয়ে। তাই তোমরা ভগবানের সামনে পৃথিবীর সামনে সচ্ছন্দে নাক উঁচু করে বেড়াও; এবং সাধুকল্প অকলংক সত্যসন্ধানী হিসাবে নিজেদের প্রচার করে থাক; অথচ কোন মিথ্যা যদি কখনও তোমাদের আত্মার হিমঘরে ঢোকে তো তীব্র ঠান্ডায় জমে গিয়ে তারও মৃত্যু ঘটবে! যতক্ষণ না উচ্চারিত হচ্ছে ততক্ষণ কোন মিথ্যেই নয়-এ রকম বোকার মত ধারণা নিয়ে কেন তোমরা বড়াই করে বেড়াবে? চোখ দিয়ে মিথ্যে বলা আর মুখ দিয়ে মিথ্যে বলার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কিছুই না, একটু চিন্তা করলেই তোমরা তা বুঝতে পারবে। এ রকম কোন মানুষই নেই যে তার জীবনে রোজ ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে না; আর তোমরা-আরে, তোমরা দুজনেই তো বল তিরিশ হাজার মিথ্যে কথা, তবু তোমরাই এক কপট আতংকে জ্বলে উঠে ছ কারণ আমি ঐ শিশুটিকে একটি কল্যাণকর নিষ্পাপ মিথ্যে বলেছি তাকে তার কল্পনার হাত থেকে বাঁচাতে-যে কল্পনার গতি রোধ না করলে এক ঘন্টার মধ্যে রক্ত গরম হয়ে আবার তার জ্বর আসত।

এস, একসঙ্গে বসে ব্যাপারটা চিন্তা করি। সবিস্তারে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করি। যখন তোমরা দুজন রোগীর ঘরে গোলমাল পাকাচ্ছিলে তখন যদি জানতে যে আমি আসছি তখন তোমরা কি করতে?

কি করতাম?

তোমরা পালিয়ে যেতে এবং হেলেনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে-তাই নয় কি?

মহিলা দুজন চুপ।

তোমাদের ইচ্ছে এবং উদ্দেশ্য কি হত?

কি?

আমার কাছে তোমাদের দোষ ঢাকা; তোমরা আমাকে ভুলিয়ে এই অনুমান করাতে যে মার্গারেটের উত্তেজনা কি কারণে ঘটেছে তা তোমরা জান না। এক কথায়, আমাকে মিথ্যে কথা বলতে-নিঃশব্দে মিথ্যে। উপরন্তু, সম্ভবত একটা ক্ষতিকর মিথ্যে।

যমজ মহিলা দুজনের মুখ লাল হয়ে উঠল; কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না।

তোমরা শুধু যে অগণিত নিঃশব্দ মিথ্যে বল তাই নয়, তোমরা মুখেও মিথ্যে বল-তোমরা দুজনেই বল।

না, তা ঠিক নয়।

হ্যাঁ, তাই ঠিক। তবে তোমরা যা বল তা ক্ষতিকর নয়। ক্ষতিকর মিথ্যে উচ্চারণ করার কথা তোমরা স্বপ্নেও ভাবতে পার না। তোমরা কি জান যে এটাও একটা স্বীকৃতি-একটা স্বীকারোক্তি?

আপনি কি বলতে চান?

এটি একটি অচেতন স্বীকৃতি যে আকারহীন মিথ্যে কোন অপরাধই নয়; এটি একটি স্বীকারোক্তি যে তোমরা হামেশাই এই রকম পার্থক্য করে থাক। যেমন, গত সপ্তাহে সেই ঘৃণ্য হিগবিদের সঙ্গে খানার টেবিলে বসবার জন্য তোমরা শ্রীমতী ফস্টার নাম্নী বৃদ্ধাটির নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে একটি চিরকুট লিখে দুঃখ প্রকাশ করেছিলে এবং জানিয়েছিলে যে তোমরা যেতে পার নি বলে ভীষণ দুঃখিত হয়েছ। এটা তো মিথ্যে কথা। এত বড় নির্ভেজাল মিথ্যে আর কোনদিন উচ্চারিত হয় নি। পার তো অস্বীকার কর হেস্টার-আর একটা মিথ্যে দিয়ে অস্বীকার কর।

হেস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল।

তা চলবে না। উত্তর দাও। এটা কি মিথ্যে ছিল, না ছিল না?

দুই মহিলারই গাল লাল হয়ে উঠল; অনেক কষ্ট ও চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তারা স্বীকার করল:

এটা মিথ্যেই ছিল।

ভাল-সংশোধন শুরু হয়েছে; তোমাদের এখনো আশা আছে; তোমাদের প্রিয়তম বন্ধুর আত্মাকে বাঁচাতেও তোমরা একটি মিথ্যে কথা বলবে না, কিন্তু একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলার অসুবিধে থেকে নিজেদের বাঁচাতে বিনাদ্বিধায় তা গল্প করে বলবে।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হেস্টার দুজনের হয়ে ঠান্ডা গলায় বলল:

আমরা মিথ্যে বলেছিলাম; আমরা তা বুঝতে পেরেছি; এ রকম আর ঘটবে না। মিথ্যে বলা পাপ। আমরা কোন মিথ্যে কথাই আর বলব না, তা যে রকমই হোক, এমন কি ভদ্রতা বা পরোপকারের জন্যও না; ঈশ্বর যে দন্ডের বিধান দিয়েছেন তার যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে কাউকে রক্ষা করতেও না।

ওঃ, কত তাড়াতাড়ি তোমাদের পতন ঘটবে। আসলে, ইতিমধ্যেই তোমরা ভুল করে বসেছ, কারণ এক্ষুণি তোমরা যা বললে সেটি ও মিথ্যে। বিদায়! সংশোধন কর! তোমাদের মধ্যে একজন রোগীর ঘরে যাও।

.

০৪.

বারো দিন পরে।

মা এবং শিশু টি সেই ভয়াবহ রোগের কবলে পড়ে ভুগেই চলেছে। দুজনেরই বাঁচবার আশা খুব সামান্য। দুই বোনকেই ফ্যাকাসে ও বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল কিন্তু তারা তাদের সেবার কাজ ত্যাগ করে নি। তাদের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ছিল, কিন্তু তাদের মনোবল ছিল অবিচলিত ও অনমনীয়। বারোটি দিন ধরে মা শিশুটির জন্য ব্যাকুল হচ্ছিল, আর শিশুটি মার জন্য; কিন্তু দুজনেই জানত তাদের এই আকুল প্রার্থনা পূর্ণ হবে না। প্রথম দিনে-যখন মাকে বলা হল যে তার অসুখটা টাইফয়েড, তখন সে খুবই ভয় পেল। সে জিজ্ঞাসা করল, আগের দিন হেলেন যখন রোগীর ঘরে স্বীকারোক্তি করার জন্য এসেছিল, তখনই সে রোগটা বাঁধিয়ে বসেছিল কি না; হেস্টার তখন তাকে বলল যে ডাক্তারবাবু এই ধারণাটাকে একেবারে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও এটা সত্যি কথা তবু হেস্টারের তা বলতে কষ্ট হল, কারণ সে ডাক্তারের কথায় বিশ্বাস করে নি; কিন্তু যখন এই খবরে মায়ের মুখে আনন্দ দেখতে পেল, তখনই তার বিবেকের দংশন অনেকটা কমে এল। সেদিন বিকেলেই হেলেনকে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় নিয়ে যাওয়া হল। রাত্রে তার অবস্থা আরো খারাপ হল। সকালে তার মা জিজ্ঞাসা করল:

সে ভাল আছে তো?

হেস্টার চুপ করে গেল, তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বেরোল না। মা নির্জীবের মত তাকিয়ে রইল, চিন্তা করল, অপেক্ষা করল; হঠাৎ

সে ফ্যাকাসে হয়ে গেল এবং হাঁপাতে হাঁপাতে বলল:

হা ভগবান! কি হয়েছে? সে কি অসুস্থ?

তখন বেচারি মাসির যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয় বিদ্রোহী হয়ে উঠল; তার মুখে কথা ফুট ল;

না-শান্ত হও; সে ভাল আছে।

অসুস্থ রমণীর সমস্ত হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। বলল:

এই সুখের কথাগুলির জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমাকে চুম্বন কর। এই কথাগুলি বলার জন্য তোমাদের কি বলে যে শ্রদ্ধা জানাব।

হেস্টার এই ঘটনা হান্নাকে জানাল; ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে হান্না বলল:

বোন, এটা যে মিথ্যে কথা।

হেস্টারের ঠোঁট করুণভাবে কাঁপতে লাগল; একটা ঢোক গিলে বলল:

হান্না, আমি জানি এটা পাপ, কিন্তু আমার করার ছিল না। আমি তার মুখে যে ভয় আর যন্ত্রণা দেখেছিলাম তা আমি সহ্য করতে পারি

সেটা কোন ব্যাপারই নয়। এটা মিথ্যাই। ভগবান এর জন্য তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবেন।

উঃ, আমি তা জানি, হেস্টার হাত মুচড়ে চিৎকার করে বলল, কিন্তু এখনও যদি আবার সে রকম হয় তো আমার কিছু করার থাকবে

না। আমি জানি আমি আবার এ কাজই করব।

তাহলে সকালে আমার জায়গায় তুমি হেলেনের কাছে থাক। আমিই সব কিছু তাকে জানাব।

হেস্টার তার বোনকে জড়িয়ে ধরল, মিনতি করল।

এ কাজ করো না হান্না, করো না-তুমি তাকে মেরে ফেলবে।

আমি অন্তত সত্যি কথাটা বলব।

সকালে মায়ের জন্য একটি নিষ্ঠুর সংবাদ তাকে বয়ে আনতে হল আর সে জন্য সে তৈরি হয়েই এল। সে যখন কাজ সেরে ফিরে এল, হেস্টার তখন বিবর্ণ, কম্পিত মুখে হলঘরে অপেক্ষা করছিল। সে ফি সৃফিস্ করে বলল:

হায় দুর্ভাগিনী, নিঃসঙ্গ মা! খবরটা শুনে সে কি করল?

হান্নার চোখ জলে ভরে উঠল। সে বলল:

ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, আমি তাকে বলেছি যে শিশুটি ভাল আছে।

হেস্টার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সকৃতজ্ঞভাবে বলে উঠল, ভগবান তোমাকে রক্ষা করুন, হান্না! শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রশংসার বন্যায় সে তাকে ভাসিয়ে দিল।

এরপর থেকে তারা তাদের শক্তির সীমা সম্পর্কে অবহিত হল, এবং ভাগ্যকে মেনে নিল। নম্রভাবে আত্মসমর্পণ করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কঠিন প্রয়োজনের কাছে তারা নতি স্বীকার করল। প্রত্যেক দিন সকালে তারা মিথ্যে কথাটি বলত, আর প্রার্থনার সময় সেই পাপকে স্বীকার করত; ক্ষমা ভিক্ষা করত না, কারণ তারা তার উপযুক্ত নয়, তবে তারা দেখাতে চাইত যে তারা তাদের অপরাধ সম্পর্কে সচেতন এবং তারা তা লুকোতে বা তার জন্য কোন অজুহাত দিতে চায় না।

দিনের পর দিন বাড়ির শিশু প্রতিমাটি যখন একটু একটু করে অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল, শোকাকুলা মাসি দুজন তখন রোগাক্রান্ত মায়ের কাছে তার ফুরন্ত শোভা ও তাজা সৌন্দর্যের কথা অতিরঞ্জিত করে বলত, আর মা যখন খুসির উচ্ছ্বাসে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাত তখন তারা বুকের মধ্যে অনুভব করত ছুরিকাঘাতের যন্ত্রণা!

প্রথম দিকে যখন শিশুটির একটা পেনসিল ধরার মত শক্তি ছিল তখন সে ভালবেসে মাকে ছোট ছোট সুন্দর চিঠি লিখত; তাতে সে তার অসুস্থতার কথা গোপন রাখত; তার মাও কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে দুটি চোখ ভরিয়ে সেগুলি বারে বারে পড়ত, বারে বারে চুম্বন করত, এবং মূল্যবান জিনিসের মত বালিশের তলায় জমিয়ে রাখত।

তারপর এমন একদিন এল যখন তার হাত থেকে সে শক্তিও চলে গেল, তার মন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল, জিভ শোচনীয়ভাবে অসংলগ্ন প্রলাপ বকতে আরম্ভ করল। বেচারী মাসীরা পড়ল গভীর সংকটে। মায়ের জন্য আর কোন সুন্দর চিঠি আসে না। তারা যে কি করবে বুঝতে পারছিল না। হেস্টার সাবধানে ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করল, একটা সম্ভাব্য কৈফিয়ৎ খুঁজতে চেষ্টা করল, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ল। মায়ের মুখে সংশয় ঘনালো, তার পর দেখা দিল শংকা। হেস্টার তা দেখল, বুঝল বিপদ আসন্ন এবং অবস্থার মোকাবিলা করতে উদ্যোগী হল। পরাজয়ের কবল থেকে জয়কে ছিনিয়ে আনার দৃঢ়সংকল্পে নিজেকে শক্ত করল। সে শান্ত স্বরে মাকে বুঝিয়ে বলল:

আমি ভেবেছিলাম, হেলেন রাত্রে স্লোয়েন্স এ গিয়েছিল একথা জানলে তুমি কষ্ট পাবে; সেখানে একটা ছোট খাট ভোজসভা ছিল, এবং যদিও তুমি এতটা অসুস্থ থাকায় সে যেতে চায় নি, তবু আমরা তাকে জোর করে পাঠিয়েছিলাম, কারণ তার বয়স অল্প এবং সময় কাট বার জন্য অল্প বয়সের এই সমস্ত আনন্দের তার প্রয়োজন আছে; আমাদের এ বিশ্বাস আছে যে তুমি আমাদের এ ব্যবস্থা মেনে নেবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, সে এসেই তোমাকে চিঠি লিখবে।

তোমরা কত ভাল; আমাদের কত ভালবাস ও আমাদের জন্য কত চিন্তা কর! মেনে নেব কি বলছ? আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার দুর্ভাগা ছোট্ট নিঃসঙ্গ মেয়েটি! তাকে বলো, আমি চাই সে যতটা পারে আনন্দে থাকুক-এ সব আনন্দ থেকে তাকে আমি একটু ও বঞ্চিত করতে চাই না। শুধু স্বাস্থ্যটা ভাল রেখে যেন চলে-একটু কুই আমি চাই।তার স্বাস্থ্য যেন খারাপ না হয়; সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। সে যে এই ছোঁয়াচ থেকে বেঁচেছে এজন্য আমি কত কৃতজ্ঞ-আহা কত অল্পের জন্য সে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে, হেস্টার মাসি! চিন্তা কর তো ঐ সুন্দর মুখখানি জ্বরে বিবর্ণ হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। এ চিন্তাও আমার কাছে অসহ্য। তাকে সুস্থ রেখ। তাকে তাজা রেখ। আমি যেন তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি; সেই আদরের মেয়েটি–বড় বড় নীল উৎসুক চোখ দুটি; আঃ কী মিষ্টি, শান্ত আর মনোলোভা! হেস্টার মাসি গো, সে কি আগের মতই সুন্দর আছে?

ওঃ সে আগে যা ছিল তার চেয়েও বেশী সুন্দর; উজ্জ্বল ও রমণীয় হয়েছে-হেস্টার ঘুরে দাঁড়াল; লজ্জা ও দুঃখ লুকোতে ওষুধের শিশি হাতড়াতে লাগল।

.

০৫.

কিছুক্ষণ পরে মাসি হেলেনের ঘরে একটা কঠিন দুরুহ কাজ নিয়ে পড়ল। ধৈর্য এবং আগ্রহের সঙ্গে নিজেদের অসাড় ও নড়বড়ে আঙ্গুল দিয়ে তারা দরকারি চিঠি টা জাল করার চেষ্টা করছিল। বারবার বিফল হলেও একটু একটু করে তারা উন্নতি করতে লাগল। সবচেয়ে দুঃখের কথা, সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার হল, সেখানে দেখবার মত কেউ ছিল না; তারা নিজেরাও এ সম্বন্ধে সচেতন ছিল না। প্রায়ই চিঠিটার উপরে তাদের চোখের জল পড়ে সেটাকে নষ্ট করে দিচ্ছিল; মাঝে মাঝে হয়তো একটা এলোমেলো কথা চিরকুট টিকে বিপজ্জনক করে তুলছিল; তবে অবশেষে হান্না এমন একটা খসড়া তৈরি করল যার লেখা হেলেনের লেখার হুবহু নকল এবং যা যে কোন সন্দেহপ্রবণ চোখকেও ফাঁকি দেবার মত। সে চিঠি টা মায়ের কাছে নিয়ে গেল; মা আগ্রহের সঙ্গে সেটি নিল, চুমো খেল, আদর করল, বারবার তার দামী কথাগুলি পড়তে লাগল, এবং গভীর খুসিতে চিঠির শেষের অংশটি সবিস্তারে পড়তে লাগল:

মাউসি গো, আমি যদি তোমাকে দেখতে পেতাম, তোমার চোখে চুমো খেতে পারতাম, আর তোমার হাত দুটি যদি আমাকে জড়িয়ে থাকত! আমি খুব খুসি যে আমার অভ্যেস লো তোমাকে বিরক্ত করে না। তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ। সকলেই আমাকে ভালবাসে, তবু মাগো, তোমাকে ছাড়া আমি কত নিঃসঙ্গ।

আহা বাছারে, আমি জানি ঠিক কি তার মনের অবস্থা। আমাকে ছাড়া সে কখনও পুরোপুরি সুখী হতে পারে না, আর আমি-ওঃ, আমি তো তার চোখের আলোয়ই বেচে আছি। তাকে বলো, সে তার খুসিমত তার অভ্যাসগুলি বজায় রাখতে পারে আর হান্না মাসি-তাকে বলো, আমি এতদূর থেকে পিয়ানোর আওয়াজ শুনতে পাই না, তার গানের মিষ্টি সুরও না। ভগবাম জানেন, আমার কত ইচ্ছে, যদি শুনতে পারতাম! কেউ জানে না ঐ কণ্ঠ সুর আমার কাছে কত মধুর; কোনদিন তা থেমে যাবে-সে কথা ভাবতেও-! তোমরা কাঁদছ কেন?

শুধু এই জন্য-এই জন্য-যে এটা একটা স্মৃতি। যখন আমি আসছিলাম সে গাইছিল, লোমও হৃদ কী করুণ সুর। যখনই সে এটা গায় আমি বিচলিত হয়ে পড়ি।

আমিও। তার বুকের মধ্যে যখন যৌবনের দুঃখ গুমড়ে ওঠে; এবং অলৌকিক উপায়ে সে দুঃখকে দূর করতে সে যখন গান গায় তখন সে যে কী হৃদয়বিদারক সৌন্দর্য…..হান্না মাসি?

বল মার্গারেট?

আমি বড় অসুস্থ। মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ মধুর সুর আমি আর শুনতে পাব না।

বলো না-বলো না, মার্গারেট! আমি তা সহ্য করতে পারি না!

মার্গারেট অভিভূত হল, বিচলিত হল, আস্তে আস্তে বলল:

এস-এস, আমার দুহাত দিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকি। কেঁদ না। এখানে-আমার গালের উপর তোমার গালটা রাখ। শান্ত হও। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যদি পারি আমি বাঁচব। ওঃ সে যে আমাকে ছাড়া কি করছে?…সে কি প্রায়ই আমার কথা বলে?-আমি জানি সে বলে।

ওঃ সব সময়-সব সময়!

আমার মিষ্টি মেয়ে। সে যে মুহূর্তে বাড়িতে আসবে তখনই আমাকে চিঠি লিখবে তো?

হ্যাঁ- প্রথম মুহূর্তেই। সে তার জিনিসপত্র রাখবার জন্যও অপেক্ষা করবে না।

আমি জানতাম। সে এই রকমই আবেগময়ী, স্নেহশীলা। জিজ্ঞসা না করেও আমি জানতাম, তবু তোমাদের মুখে শুনতে চাইছিলাম। আদুরে স্ত্রী জানে যে তার স্বামী তাকে ভালবাসে, তবু প্রতিদিন সে তাকে সে কথা শুধু শোনবার আনন্দের জন্য… এবার সে কলম ব্যবহার করেছে। সেটাই ভাল; পেনসিলের দাগ মুছে যেতে পারে, আর তা হলে আমার আফশোষ হত। তোমরাই কি পরামর্শ দিয়েছ যাতে সে কলম ব্যবহার করে?

হ্যাঁ-না-সে-এটা তার নিজস্ব ধারণা?

মা খুসি হল; বলল:

আমি আশা করেছিলাম তোমার ঐ কথাই বলবে। এ রকম ভাল আর বিচক্ষণ মেয়ে দেখা যায় না!…হান্না মাসি?

বাছা, মার্গারেট?

যাও, তাকে বল আমি সব সময় তার কথা চিন্তা করি, তাকে আদর করি। তোমরা আবার কাঁদছ। আমার জন্য এত চিন্তিত হয়ো না; আমার মনে হয় এখনও পর্যন্ত ভয়ের কিছু নেই।

শোকার্ত বার্তাবাহিকটি গিয়ে সেই সব কথা মেয়েকে বলল: কিন্তু কিছুই তার কানে গেল না। মেয়েটি তখন প্রলাপ বকছে; জ্বরতপ্ত চোখে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে; চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুই চিনতে পারছে মা।

তুমি কি-না, তুমি তো আমার মা নও। আমি তাকে চাই-ওঃ আমি তাকে চাই। এক মিনিট আগেও সে এখানে ছিল, আমি তাকে চলে যেতে দেখি নি। মা কি এখন আসবে? তাড়াতাড়ি আসবে? এখনই কি আসবে?..এখানে কত বাড়ি …সব যেন আমাকে চেপে ধরেছে…এবং সব কিছু ঘুরছে, পা খাচ্ছে আর ঘুরছে…উঃ, আমার মাথা, আমার মাথা!-এই ভাবে সে অনবরত কাল্পনিক যন্ত্রণায় ছট ফ টু করতে লাগল; সীমাহীন অস্থীরতায় হাত দুটি ছুঁড়তে লাগল।

বেচারী হান্না অস্ফুট করুণ সুরে সান্ত্বনা দিতে দিতে তার শুকনো ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে দিতে লাগল, তার উত্তপ্ত ভুরুতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, এবং তার মা যেএসব না জেনে সুখেই আছে সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে লাগল।

.

০৬.

প্রতিদিন মেয়েটি অতলে, অতিদ্রুত আরও অতলে, মৃত্যুর গভীরে তলিয়ে যেতে লাগল,আর প্রতিদিন সেই শোকার্তা সেবিকারা তার উজ্জ্বল স্বাস্থ্য ও সুন্দর চেহারার মিথ্যা সমাচার সুখী মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে লাগল; মার জীবনযাত্রাও তখন প্রায় সমাপ্তির পথে। প্রত্যেকদিন তারা মেয়েটির হাতের লেখা নকল করে মিষ্টি চিঠি গুলি লিখত, এবং অনুতপ্ত বিবেক ও রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত, মা আকুল হয়ে সেগুলি পড়ছে, আদর করছে, আর অমূল্য জিনিসের মত সেগুলি সঞ্চয় করে রাখছে, কারণ সেগুলি লিখেছে একটি মিষ্টি মেয়ে, সেগুলি তার কাছে পবিত্র, কারণ তার সন্তানের স্পর্শ সেগুলিতে লেগে আছে। তারা এইসব কিছু দেখত আর কাঁদত।

অবশেষে সেই দয়ালু বন্ধুটি এল যে সবার জন্য নিয়ে আসে স্বস্তি এবং শান্তি। মৃদু আলো জ্বলছিল। ভোরের আগেকার গম্ভীর নিস্তব্ধ তার মধ্যে আবছা মূর্তিগুলি নিঃশব্দে হলঘরটি তে নড়াচড়া করতে লাগল, হেলেনের বিছানার পাশে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল। সময় যে হয়ে এসেছে তাও সকলে বুঝতে পারল। মুমূর্ষ মেয়েটি চোখের পাতা বন্ধ করে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে; বুকের উপরকার চাদরটা। ধীরে ধীরে উঠানামা করছিল, কারণ তার জীবনীশক্তি ক্রমেই শেষ হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পরে পরেই একটা দীর্ঘশ্বাস অথবা ক্ষীণ। ফোপানির শব্দ ঘরের নিস্তব্ধ তাকে ভঙ্গ করতে লাগল। তখন সবার মনে একই চিন্তার ভিড়: করুণ মৃত্যু; একটু একটু করে মহা অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া; বেচারি মাও এখানে উপস্থিত নেই যে একটু সাহায্য করবে, সাহস দেবে; আশীর্বাদ করবে।

হেলেন ছটফট করতে লাগল; হাত বাড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কি যেন হাতড়াতে লাগল, যেন সে কিছু চাইছে-কয়েক ঘণ্টা হল সে অন্ধ হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তটি সমাগত; সকলেই তা বুঝল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হেস্টার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, আহা, বাছা আমার সোনা আমার! মুমূর্ক্স মেয়েটির মুখে খুসির আলো ঝঝ করে উঠল; যে দুটি হাত তাকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে মায়ের হাত মনে করে সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ওঃ, মামণি, আমি কত সুখী-আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম-এখন আমি মরতে পারি।

দুঘণ্টা পরে হেস্টার সবকিছু জানাবার জন্য তৈরি হল। মা জিজ্ঞাসা করল:

মেয়ে কেমন আছে?

ভাল আছে।

.

০৭.

একগুচ্ছ সাদা ও কালো সিল্কের কাপড় বাড়িটার দরজার ঝুলিয়ে দেওয়া হল; সেগুলি বাতাসে দুলে মর্মরিত হচ্ছিল, যেন ফিসফিস্ করে দুঃসংবাদ ঘোষণা করছে। দুপুরে মৃতদেহ সৎকারের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হল; পবিত্র শিশুর দেহটি শবাধারে শোয়ান হল; সুন্দর মিষ্টি মুখখানিতে গভীর প্রশান্তি। হান্না এবং কৃষ্ণাঙ্গী মেয়ে টি ল্লী-এই দুটি শোকার্ত প্রাণী পাশে বসে বিলাপ করছে। কাঁপতে কাঁপতে হেস্টার ঘরে এল; সে তখন ভীষণ বিপদে পড়েছে। সে বলল:

মা একটি চিরকুট চাইছে।

হান্নার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। এ কথাটা সে চিন্তাই করে নি; তার মনে হয়েছিল যে তাদের দুঃখের কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বুঝল তা হয় নি। কিছুক্ষণ সেই দুটি নারী শূন্য দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল; তারপর হান্না বলল:

এ থেকে উদ্ধার পাবার আর কোন পথ নেই-চিঠি ওকে দিতেই হবে, নইলে অন্য কিছু সন্দেহ করবে।

এবং সব বুঝে ফেলবে।

হ্যাঁ। এতে তার বুক ভেঙ্গে যাবে।

মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখ জলে ভরে এল। আমিই লিখব, সে বলল।

হেস্টার চিরকুট টা নিয়ে গেল। শেষের লাইন কটি তে লেখা ছিল:

মাউ সি গো, মিষ্টি মা গো, আমরা খুব শিগগিরই একসঙ্গে হব। এটা খুব ভাল খবর না? কথাটা কিন্তু সত্যি; ওরা সকলেই বলছে এটা। সত্যি ।

মা দুঃখ পেল; বলল:

আহা বাছারে, যখন সে জানবে তখন কি করে সহ্য করবে? আমি জীবনে আর কখনও তাকে দেখতে পাব না। কথাটা নির্মম, বড় নির্মম। সে সন্দেহ করে নি তো? তোমরা তাকে সাবধানে রাখছ তো?

সে মনে করে তুমি খুব শিগগির ভাল হয়ে উঠবে।

হেস্টার মাসি গো, তোমরা কত ভাল, সাবধানী। তার কাছে এমন কেউ যায় না তো যা তাকে অসুখের ছোঁয়াচ লাগাতে পারে?

সেটা তো অপরাধ হবে।

কিন্তু তোমরা তো তাকে দেখ।

হ্যাঁ-তবে দূর থেকে।

সেটাই ভাল। অপরাধকে বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু তোমরা দুই অভিভাবক যেন দেবদূত-ইস্পাতও তোমাদের মত খাঁটি নয়। অন্য কেউ হলে অবিশ্বাসী হত, ঠকাত, মিথ্যে কথা বলতেও পারত।

হেস্টারের চোখের পাতা নেমে এল; ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল।

হেস্টার মাসি, আমি তাকে মনে করে তোমাকে চুম্বন করছি; যখন আমি চলে যাব এবং বিপদ কেটে যাবে, তখন তার মিষ্টি ঠোঁটে এই চুম্বনটি এঁকে দিও; তাকে বলো, তার মা এটি পাঠিয়েছে, এবং তার মায়ের সমস্ত ভগ্নহৃদয় একে জড়িয়ে আছে।

এক ঘন্টার মধ্যে মূতের মুখের উপর অশ্রুবর্ষণ করতে করতে হেস্টার তার করুণ কর্তব্যটি সমাধা করল।

.

০৮.

আবার প্রভাত হল, দিনের আলো ফুটল, সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে। হান্না ভগ্নস্বাস্থ্য মায়ের কাছে নিয়ে এল সেই সুসংবাদ, সেই সুন্দর চিঠি, যাতে আবারও লেখা হয়েছে, আমাদের আর বেশী অপেক্ষা করতে হবে না মা গো, এবার আমরা মিলিত হব।

একটা ঘণ্টার গম্ভীর ধ্বনি, আর্ত সুর বাতাসে ভেসে এল।

হান্না মাসি, ঘণ্টা বাজছে; আর একটি শোকার্ত হৃদয় বিশ্রাম পেয়েছে। আমিও অচিরেই পাব। তোমরা দেখো, ও যেন আমার কথা ভুলে না যায়।

ওঃ, ভগবান জানেন সে কখনও ভুলবে না!

হান্না মাসি, একটা আশ্চর্য সুর কি শুনতে পাচ্ছি? মনে হচ্ছে, অনেকের পায়ের শব্দ যেন একসঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

আমরা আশা করেছিলাম তুমি তা শুনতে পাবে না। অল্প কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে, শুধু-শুধু হেলেনের জন্য, বেচারী তো ঘরের মধ্যেই বন্দী হয়ে থাকে। কিছু গান-বাজনা হবে-সেও তো গান-বাজনা ভালবাসে। আমাদের ধারণা এতে তুমি কিছু মনে করবে না।

মনে করব? ওঃ না-ওর মন যা চায় তাই ওকে দাও। তোমরা ওকে কত ভালবাস, আমাকেও কত ভালবাস! ঈশ্বর সর্বদা তোমাদের মঙ্গল করুন।

কিছুক্ষণ শোনবার পর:

কী মধুর! এটা ওরই অর্গান। ও কি নিজেই বাজাচ্ছে? তোমাদের কি মনে হয়? নিস্তব্ধ বাতাসে সেই মৃদু মনমাতানো সুর তার কানে ভেসে এল। হ্যাঁ, এ তারই হাতের স্পর্শ, আমি এ সুর চিনি। ও গান গাইছে, আরে-এ যে একটা স্তোত্র। সবচেয়ে পবিত্র, বড় মর্মস্পর্শী, বড়ই শান্তিময়।…মনে হচ্ছে আমার সামনে স্বর্গের দরজা খুলে গেছে।…আমি যদি এখনই মরতে পারতাম….

নিস্তব্ধ তা ভঙ্গ করে দূর থেকে ভেসে এল সে সুরের বাণী:

হে ভগবান, তোমার কাছে যাব,
আরও কাছে,
 যদি ক্রুশের পথেও হয়,
তাতেই আমার মুক্তি।

স্তোত্রটি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি আত্মাও চিরবিশ্রামের দেশে চলে গেল; আর জীবনে যারা ছিল এক, মরণেও তারা বিচ্ছিন্ন হল না। দুই বোন, কাঁদতে কাঁদতে ও হাসতে হাসতে বলল:

কি ভাগ্যি, সে কখনও জানতে পারে নি।

.

০৯.

মধ্যরাত্রে তারা একসঙ্গে বসে শোক করছিল, এমন সময় অপার্থিব উজ্জ্বল আলোর বৃত্তের মাঝ খানে আবির্ভূত হল দেবদূত। বলল:

মিথ্যাবাদীদের জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট আছে। সেখানে তারা চিরকাল–চিরকাল নরকের আগুনে জ্বলবে। অনুশোচনা কর!

প্রিয় বিয়োগে ব্যথিত দুই নারী তার সামনে নতজানু হয়ে হাত জোর করে পাকা চুলে ভরা মাথা শ্রদ্ধায় নত করল। কিন্তু তাদের জিভ মুখের ভিতর আটকে রইল; তারা বোবা হয়ে রইল।

কথা বল! যাতে আমি স্বর্গের অধীশ্বরের কাছে তোমাদের বার্তা নিয়ে যেতে পারি এবং তার আদেশ নিয়ে আসতে পারি। সে আদেশের বিরুদ্ধে কোন আবেদন গ্রাহ্য হয় না

আবার তারা মাথা নীচু করে অভিবাদন করল। একজন বলল:

আমরা বিরাট পাপ করেছি আর সেজন্য লজ্জাও পাচ্ছি, একমাত্র পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত অনুশোচনাই আমাদের মুক্ত করতে পারে, কিন্তু আমরা হতভাগ্য জীবরা মানবিক দুর্বলতার শিকার; আমরা জানি, আবার যদি ঐ রকম নির্মম অবস্থায় পড়ি তাহলে আবার আমাদের। পতন হবে, আবারও আমরা আগের মতই পাপ করব। যারা শক্তিমান তারাই বেঁচে থাকে এবং মুক্তি পায়, কিন্তু আমাদের কোন আশাই মাথা উঁচু করে তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল। দেবদূত চলে গেল। যখনই তারা বিস্মিত হয়ে কাঁদতে লাগল, তখনই সে আবার এল; নীচু হয়ে তাদের কানে কানে আদেশটি জানাল।

.

১০.

সেটা কি ছিল স্বর্গ? অথবা নরক?

[১৯০২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *