৩০,০০০ পাউণ্ডের দান-পত্র

৩০,০০০ পাউণ্ডের দান-পত্র
The 30,000 Pound Bequest

০১.

লেকসাইড একটা সুন্দর ছোট শহর। জনসংখ্যা পাঁচ কি ছ হাজার। শহরটি বেশ ছিমছাম করে সাজানো, দূর পশ্চিমের অন্য সব শহরের মতই। গির্জায় আসন-ব্যবস্থা পঁয়ত্রিশ হাজার লোকের; দূর পশ্চিমে ও দক্ষিণে এই ধরনের ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। সেখানে প্রত্যেকেই ধর্মপ্রাণ, প্রতিটি প্রটে স্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি সেখানে বাস করে। লেকসাইডে উঁচু-নীচুর ভেদ নেই-অন্তত সেট। স্বীকার করা হয় না; প্রত্যেকেই প্রত্যেককে আর তার কুকুরকে চেনে; সর্বত্র সহজ মেলামেশা ও বন্ধুত্বের আবহাওয়া।

সালাডিন ফস্টার একটা বড় দোকানের হিসাবরক্ষক; লেকসাইড–এর একমাত্র মোটা বেতনের কর্মচারী। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর; চোদ্দ বছর সে এই দোকানে চাকরি করছে; বিয়ের সপ্তাহে বছরে চার শ ডলার বেতনে কাজ শুরু করেছিল; বছরে এক শ ডলার করে বেড়ে চার বছরে অনেক উপরে উঠে ছে; সেই থেকে সে আট শতে থেমে আছে-বেতনের অংকটা ভালই, আর সে যে তার যোগ্য সকলেই তা স্বীকার করে।

স্ত্রী ইলেকট্রা তার যোগ্য সহধর্মিণী, যদিও তার মতই-স্বপ্নদর্শী ও কল্পনাবিলাসী। বিয়ের পরে-তখন তো সে উনিশ বছরের ছোট্ট মেয়েটি ই ছিল তার প্রথম কাজই হল শহরের শেষ প্রান্তে এক একর জমি কেনা এবং নগদে দামটা মিটিয়ে দেওয়া-মাত্ৰ পঢ়ি শ ডলার হলেও সেটাই তখন তার সর্বধন। সালডিনের সঞ্চয় ছিল আরও পনেরো কম। সেখানে স্ত্রী একটা সৰ্জী বাগানু করল, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগে চাষবাসের ব্যপস্থা করল এবং শতকরা একশ বাগ মুনাফা ঘরে তুলল। সালাডি নের প্রথম বছরের বেতন থেকে ত্রিশ ডলার সেভিংস ব্যাংকে রাখল, দ্বিতীয় বছরের বেতন থেকে ষাট, তৃতীয় বছর থেকে একশ এবং চতুর্থ বছরের বেতন থেকে রাখল দেড়শ ডলার। সালাডিনের বেতন বছরে আট শ-তে উঠল; ইতিমধ্যে সংসারে দুটি শিশুর আবির্ভাব হয়েছে, খরচ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও ইলেকট্রা সেই বেতন থেকে বছরে দুশ করে ব্যাংকে রেখেছে। বিয়ের সাত বছর পরে সেই বাগানের জমির মাঝ খানে দু হাজার ডলার ব্যয়ে একটি সাজানো-গোছানো আরামদায়ক ছোট বাড়ি তৈরি করল, এবং অর্ধেক দাম নগদে দিয়ে গৃহপ্রবেশ করল। সাত বছর পরে সব দেনা শোধ হয়ে গেল এবং কয়েক শ ডলার বাড়তি আয়ের ব্যবস্থাও হল।

জমির দাম বেড়ে যাওয়াতেই এই বাড়তি উপার্জনটা হল। অনেক আগেই স্ত্রীটি আরও দু-এক একর জমি কিনেছিল; এখন ভাল লাভে সেই জমি ভাল ভাল লোকের কাছে বিক্রি করে দিল। তারাও এখানে বাড়ি করবে, ভাল প্রতিবেশী হবে, তার নিজের ও মেয়েদের ভাল সঙ্গী হবে। বছরে একশ ডলার লগ্নী থেকেও তার একটা বাঁধা আয় আছে। ছেলেমেয়েদের বয়স বাড়ছে, দেখতে সুন্দর হচ্ছে; বেশ সুখেই তার দিন কাটছে। স্বামী নিয়ে সে সুখী, মেয়েদের নিয়ে সুখী, আর স্বামী ও মেয়েরাও তাকে নিয়ে সুখী। এখান থেকেই শুরু হল ইতিহাস।

ছোট মেয়ে ক্লাইটেম নেস্ট্রার-সংক্ষেপে ডাক নাম ক্লাইটি–বয়স এগারো, তার দিদি গোয়েণ্ডোলেন-সংক্ষেপে গোয়েন-বয়স তেরো; মেয়ে দুটি বড় ভাল। নাম দুটি শুনলেই বোঝা যায় বাবা-মার রক্তে আছে কল্পনা-বিলাসের ছোঁয়া; আবার বাবা-মার নাম শুনলেও বোঝা যায় যে সে ছোঁয়াটুকু বংশগত। সুখী পরিবারটির সকলেরই একটা করে আদরের নাম ছিল। সালাডিনের নামটা অদ্ভুত ও মেয়েলি-স্যালি; ইলেকটার নামও তাই, একটু পুরুষালি-আলেক। সারাটা দিন স্যালি একজন ভাল হিসাবরক্ষক ও বিক্রেতা; সারাদিন। আলেক একজন ভাল ও বিশ্বস্ত মা ও গৃহকর্ত্রী, যেমন চিন্তাশীল তেমনই ব্যবসায় বুদ্ধিসম্পন্ন; কিন্তু রাতের বেলা আরামদায়ক শোবার ঘরে ঢুকেই কাজের জগৎটাকে তারা দূরে সরিয়ে দেয়, চলে যায় আর একটা সুন্দরতর জগতে, পরস্পরকে নানা রোমান্স পড়ে শোনায়, স্বপ্ন দেখে, বড় বড় প্রাসাদ ও প্রাচীন কালের বিরাট সব দুর্গের আলোকোজ্জ্বল হৈ-চৈ ও জাঁকজমকের মধ্যে রাজা, রাজপুত্র এবং অভিজাত নারী-পুরুষদের সাহচর্যে সময় কাটিয়ে দেয়।

.

০২.

এবার এল একটা বড় সংবাদ! হতবুদ্ধিকর সংবাদ-আসলে আনন্দের সংবাদ। এল একটা পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে সেখানে পরিবারের একমাত্র জীবিত আত্মীয়টি বাস করত। সে স্যালির আত্মীয় হয় দূর সম্পর্কের খুড়ো, আর না হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় জ্ঞাতি ভাই; নাম টি বিউরি ফস্টার, বয়স সত্তর, চিরকুমার, বিখ্যাত ধনী, আর সেই অনুপাতে মেজাজটাও রুক্ষ ও খিট খিটে। অতীতে একবার স্যালি তার সঙ্গে পত্রযোগে আলাপ করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে ভুল আর কখনও করে নি। এতদিনে ট্রিবিউ রি স্যালিকে চিঠি লিখে জানিয়েছে যে তার মৃত্যু আসন্ন, আর তাই সে স্যালিকে নগদ ত্রিশ হাজার ডলার দিয়ে যেতে চায় ভালবেসে নয়, যেহেতু এই টাকা তাকে অনেক দুঃখ ও হতাশা ভোগ করিয়েছে তাই তার ইচ্ছা যে টাকাটা এমন হাতে পড়ুক যেখানে তার অনিষ্টকর কাজটা যথারীতিই চলবে বলে সে আশা করে। তার উইলে এই দানের উল্লেখ থাকবে এবং টাকাটা দেওয়া হবে। অবশ্য এই শর্ত সাপেক্ষে যে স্যালি উইলের অছিদের কাছে প্রমাণ করতে পারবে যে মুখের কথায় অথবা চিঠিপত্রে সে কখনও এই দানের কথা জানত না, মৃত্যুপথযাত্রীর শাশ্বত বাসস্থানে যাত্রা সম্পর্কে কোন খোঁজখবর সে করে নি, এবং সৎকার-অনুষ্ঠানে যোগ দেয় নি।

যে মুহূর্তে আলেক এই চিঠির প্রচন্ড ধাক্কাকে সামলে উঠল, তখনই সে আত্মীয়টির বাসস্থলে লোক পাঠিয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রের গ্রাহক হয়ে গেল।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তখন এই মর্মে বোঝা-পড়া হল যে আত্মীয়টি যতদিন জীবিত আছে ততদিন তারা কারও কাছে এই বড় খবরটা প্রকাশ করবে না; কারণ তা করলে হয়তো কোন অজ্ঞান লোক কথাটাকে মৃত্যুশয্যার পাশে নিয়ে গিয়ে এমন ভাবে বিকৃত করে বলবে যাতে মনে হবে যে তারা অবাধ্যের মত এই দানের জন্য কৃতজ্ঞ হয়েছে, এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রকাশ্যে এ কথাটাকে স্বীকার ও প্রকাশ করার মতই অপরাধ করেছে।

সারাটা দিন স্যালি পুথিপত্র ওলোট-পালোট করে কাটালি; আলেও কোন কাজেই মন দিতে পারল না। দুজনই তখন একই স্বপ্ন

ত্রিশ হাজার ডলার!

সারাটা দিন এই প্রেরণাময় শব্দের গু ও নই তাদের মাথায় অনুরণিত হতে লাগল।

বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত আলেকই সব টাকা-পয়সা নিজের হাতের মুঠোয় রেখে এসেছে; অপ্রয়োজনে একটা কপর্দকও খরচ করা কাকে বলে স্যালি তা জানে না।

ত্রিশ হাজার ডলার। গুঞ্জন চলতেই থাকল। অনেক টাকা, চিন্তার অতীত টাকা!

সারা দিন ধরে আলেক ভাবল টাকাটা কি ভাবে লগ্নি করা যায়, আর স্যালি ভাবল কি ভাবে সেটা খরচ করা যায়।

সেদিন রাতে আর রোম্যান্স পড়া হল না। বাবা-মাকে চুপচাপ ও আশচর্য রকমের গোমড়া-মুখ দেখে মেয়েরা অনেক আগেই সরে পড়ল। দুটো পেন্সিল সারাক্ষণ কর্মব্যস্ত রইল-পরিকল্পনার লেখাজোখা চলতে লাগল। অবশেষে স্যালিই প্রথম কথা বলল:

আঃ, চমৎকার হবে আলেকা প্রথম এক হাজার দিয়ে আমরা গ্রীষ্মকালের জন্য একটা ঘোড়া ও বগি-গাড়ি কিনব, আর শীতকালের জন্য একটা ছোট জাহাজ ও চামড়ার পোশাক।

আলেক দৃঢ় সিদ্ধান্তের ভঙ্গীতে বলল:

মূলধন ভাঙিয়ে? সেটি হচ্ছে না। কোটি কোটি পেলেও না।

স্যালি খুব হতাশ হল; তার মুখের আলোই নিভে গেল।

অনুযোগের সুরে বলল, আঃ আলেক! সারা জীবনই তো কঠোর পরিশ্রম করেছি, টানাটানি করে চালিয়েছি; এখন তো আমরা ধনী হয়েছি; এখন-

সে কথা শেষ করল না; আলেকের চোখের দৃষ্টি নরম হয়েছে; তার কথায় সে যেন গলেছে; তবু স্যালিকে বোঝবার মত করে বলল:

দেখ বাপু, মূলধনটা আমরা খরচ করব না, সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার থেকে যা আয় হবে-

তাতেই হবে, তাতেই হবে আলেক! তুমি কত ভাল! বেশ মোটা আয়ই হবে, আর সেটা যদি আমরা খরচ করি।

তা হবে না বাপু, মোটেই তা হবে না; তার একটা অংশ তুমি খরচ করতে পার। তার মানে একটা সঙ্গত অংশ। কিন্তু মূলধনের পুরোটাই-প্রতিটি পেনি-কাজে লাগাতে হবে। সেটাই যে উচিত কাজ হবে তা তুমি নিশ্চয় বোঝ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই। কিন্তু ততদিন যে অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ছ মাস আগে তো সুদের প্রথম কিস্তিটা পাওয়া যাবে না।

হ্যাঁ-আরও বেশী দেরিও হতে পারে।

আরও দেরি? কেন? ওরা কি ষান্মাসিক সুদ দেয় না?

সে রকম লগ্নি করলে দেয়; কিন্তু আমি, সে রকম লগ্নি করব না।

তাহলে কি রকম করবে?

যাতে মোটা সুদ পাওয়া যায়।

মোটা। তা ভাল। কি রকম লগ্নি বল তো?

কয়লা। নতুন খনি। আমি দশ হাজার রাখতে চাই।

খুব ভাল কথা আলেক। সে সব শেয়ার সত্যি ভাল। কিন্তু কত পাওয়া যাবে? কখন পাওয়া যাবে?

প্রায় এক বছরে। ছ মাসে তারা শতকরা দশ দেবে। আমি সব জানি; এই সিনসিনাটি সংবাদপত্রেই বিজ্ঞাপন আছে।

পুরো মূলধনটাই তাহলে আটকে দাও। আমি এখনই চিঠি লিখে গ্রাহক হয়ে যাচ্ছি-কাল হয় তো দেরি হয়ে যাবে।

সে লেখার টেবিলে ছুটে যাচ্ছিল, কিন্তু আলেক বাধা দিল। তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল:

মাথা খারাপ করো না। টাকাটা পাবার আগেই গ্রাহক হওয়া চলবে না; সে কথা জান না?

স্যালির উৎসাহ দু-এক ডিগ্রি কমলেও সে পুরো শান্ত হল না।

কেন বল তো আলেক? তুমি তো জান টাকাটা আমরা পাবই-আর শিগগিরই পাব। হয় তো এতক্ষণে তার সব দুঃখের অবসান হয়েছে। আমার তো মনে হয়-

আলেক শিউরে উঠে বলল:

কি বলছ স্যালি? এ রকম কথা বলতে নেই; এ যে কেলেংকারির কথা।

আহা, কথাটাকে ও ভাবে নিচ্ছ কেন? আমি তো বলছি কথার কথা।

তাই বলে এরকম অলক্ষুণে কথা বলবে? তুমি বেঁচে থাকতে কেউ তোমাকে ও রকম কথা বললে তোমার ভাল লাগত?

তা হয় তো লাগত না। যাক গে, টি বিউরির কথা থাক আলেক। তার চাইতে কাজের কথা হোক। আমার তো মনে হয় খনিই পুরো ত্রিশ হাজারের উপযুক্ত স্থান। আপত্তি আছে?

এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা? সেটাই আপত্তি আর কি!

ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ। বাকি বিশ নিয়ে কি করবে? সেটা কোথায় রাখবে ভেবেছে?

তাড়াতাড়ি করার কিছু নেই; বাকিটা সম্পর্কে কিছু করবার আগে খোঁজ খবর নিতে হবে।

তুমি যখন মনস্থির করেই ফেলেছ তখন তাই হবে, স্যালি একটা নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল:

এখন থেকে দশ হাজারে বছরে বিশ হাজার লাভ আসবে। সেটা তো আমরা খরচ করতে পারব, তাই না আলেক?

আলেক মাথা নাড়ল।

বলল, না গো, প্রথম অর্ধ-বার্ষিক লভ্যাংশটা পাবার আগে অতটা উঠবে না। তার কিছু অংশ তুমি খরচ করতে পারবে।

ধুত্তোর, মোটে ঐটুকু-আর তার জন্য গোটা বছরটা হাঁ করে থাকতে হবে! যত সব-

আহা, একটু ধৈর্য ধর! তিন মাসের মধ্যেও লভ্যাংশটা ঘোষিত হতে পারে-সে সম্ভাবনাও তো রয়েছে।

ওঃ জলি! ধন্যবাদ। স্যালি লাফিয়ে উঠে স্ত্রীকে একটা চুমো খেল। তিন হাজার-একেবারে গুণে গুণে তিন হাজার! তার কতটা আমরা খরচ করতে পারব আলেক? একটু বাড়াও প্রিয়ে, হ্যাঁ, এই তো ভাল মানুষের মত কথা।

আলেক এতই খুসি হয়ে গেল যে সে চাপে পড়ে যে-টাকাটা দিতে রাজী হল তার মতে সেটা বেহিসেবী খরচের চূড়ান্ত-এক হাজার ডলার। স্যালি তাকে আধ ডজন চুমো খেল, কিন্তু তাতেও যেন তার সব আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হল না। কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসার ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে আলেক বুঝি সব বিবেচনা হারিয়ে ফেলল; সে প্রিয়তমাকে আরও কিছু মঞ্জুর করে ফেলল-দানের যে বিশ হাজার তখনও বাকি ছিল তার থেকেও বছরে যে পঞ্চাশ ষাট হাজার পাওয়া যাবে বলে তার আশা তা থেকেও দু হাজার দিতে রাজী হয়ে গেল। খুসিতে স্যালির চোখে জল এসে গেল; সে বলল:

ওঃ, তোমাকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছা করছে! করল ও তাই। তারপর নোট–বইটা টেনে নিয়ে সকলের আগে কি কি বিলাস-সামগ্রী কিনবে তার একটা তালিকা প্রস্তুত করতে বসে গেল। ঘোড়া-বগি-ছোট নৌকো-পোশাক-পেটে টু–লেদারের জুতো-কুকুর-টু পি-গির্জার আসন-নতুন দাঁত-আচ্ছা আলেক!

বল?

হিসাব কষে যাচ্ছ তো? ঠিক আছে। বিশ হাজার লগ্নি করা কি হয়েছে?

না, ও নিয়ে তাড়া নেই; আগে দেখি শুনি, ভাবি।

কিন্তু তুমি যেন হিসাব করছ; সেটা কি নিয়ে?

আরে, কয়লা থেকে যে ত্রিশ হাজার আসছে সেটা কি কাজে লাগবে সেটা ভাবতে হবে না?

স্কট! কী মাথা! আমার তো মাথায়ই আসে নি। কি ভেবেছ? কতদূর ভেবেছ?

বেশী দূর নয়-দু তিন বছর। দু বার পাল্টা লগ্নি করেছি-একবার তেলে, একবার গমে।

বাঃ আলেক, চমৎকার! মোট কত দাঁড়াল?

আমি তো মনে করি-তা, কোন রকম ঝুঁকি না নিয়েই বলা যায় যে একশ আশি হাজার তো হবেই, হয় তো বেশীই হবে।

বটে! খুব আশ্চর্য, তাই না? অনেক কষ্ট পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা সুদিনের দেখা পেয়েছি আলেক!

বল।

মিশনারীদের জন্য আমি কিন্তু পুরো তিন শই খরচ করব-এখন তো আমাদের আর খরচের জন্য ভাবতে হবে না।

 এর চাইতে ভাল কাজ আর কি হতে পারে গো; আর এটা তো তোমার মত মানুষেরই উপযুক্ত, যা নিঃস্বার্থ ছেলে তুমি।

প্রশংসা শুনে স্যালির খুসির সীমা রইল না; তবু সে যথার্থই জানাল যে, আলোকের জন্যই এ সব কিছু সম্ভব হয়েছে, কারণ সে না থাকলে স্যালির হাতে টাকাটা আসতই না।

তারপর তারা শুতে গেল; খুসির উদ্দামে ভুলেই গেল যে বসবার ঘরে মোমবাতিটা তখনও জ্বলছে। পোশাক ছাড়বার আগে কথাটা মনেই পড়ল না; স্যালি বলল, পুড়ছে পুড়ুক, ওটু কু এখন আমাদের সইবে, হাজার-শক্তির মোমবাতি একটা তো। কিন্তু আলেক নেমে গিয়ে নিভিয়ে দিল।

ফল ভালই হল; কারণ ফি রবার সময় তার মাথায় এমন একটা মতলব এল যাতে একশ আশি হাজার দেখতে দেখতে পাঁচ লাখ হয়ে যাবে।

.

০৩.

আলেক যে ছোট সংবাদপত্রটার গ্রাহক হয়েছিল সেটা বৃহস্পতিবারের কাগজ; টিলবিউরির গ্রাম থেকে পাঁচ শ মাইল দূরে সেটা এসে পোঁছল শনিবার টি বিউরির চিঠি টা ছাড়া হয়েছিল শুক্রবার; মরতে একটা দিন দেরি হওয়ায় খবরটা সে সপ্তাহের কাগজে ছাপা হতে পারে নি। অবশ্য পরের সপ্তাহের সংখ্যায় প্রকাশ হবার পক্ষে যথেষ্ট সময় ছিল। ফলে তার ভাগ্যে সন্তোষজনক কিছু ঘটল কিনা সেটা জানবার জন্য ফস্টারকে পুরো একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতে হল। সপ্তাহ আর কাটতে চায় না; মনের উপর চাপও বাড়ে। অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকবার সুযোগ না থাকলে তারা হয়তো সে চাপ সহ্য করতেই পারত না। সে সুযোগ যে ছিল তাতো আমরা আগেই দেখছি। স্ত্রী একের পর এক টাকা জমিয়ে যাচ্ছে, আর স্বামী সে টাকা খরচ করে চলেছে-অবশ্য স্ত্রী তাকে যতটা পর্যন্ত খরচ করতে দিচ্ছে।

অবশেষে শনিবার এল। এক সাপ্তাহিক সাগামোর। মিসেস ইভার্সলি বেনেট তখন উপস্থিত ছিল। সে প্রেবিটেরিয়ান পাদরির স্ত্রী; একটা দাঁতব্যের ব্যাপারে ফস্টারদের কাছে এসেছিল। মিসেস বেনেট দেখল একজনও তার একটি কথাও শুনছে না; সব আলোচনা হঠাৎ থেমে গেছে। কাজেই ক্ষুব্ধ হয়ে সে উঠে চলে গেল। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই একান্ত আগ্রহে আলেক খবরের কাগজের মোড়কটা ছিঁড়ে ফেলল। দুজনেই অতি দ্রুত শোক-সংবাদের উপর চোখ বুলিয়ে নিল। নৈরাশ্য! টি বিড় রির কথা কোথাও উল্লেখ নেই। আলেক জন্ম থেকেই খৃস্টান, তার কর্তব্যবোধ প্রখর। নিজেক সংযত করে দু পয়সা পরিমাণ লোক দেখানো খুসির ভাব দেখিয়ে বলল:

তিনি যে এ যাত্রা বেঁচে গেছেন সেজন্য আমাদের কৃতজ্ঞ-

ধিক তার মোটা চামড়াকে, আমার ইচ্ছা হচ্ছে-

স্যালি। তোমার কি চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই।

রেখে দাও চক্ষুলজ্জা! সে রেগে বলল। তোমারও তো মনে মনে এই একই ভাব। আর লোক-দেখানো বক-ধার্মিক না হলে তুমিও এই কথাই বলতে।

তার মর্যাদাবোধ মুক্ষুণ্ণ হওয়ায় আলেক বলল:

এরকম নিষ্ঠুর অসঙ্গত কথাগুলি তুমি কেমন করে বলতে পারলে আমি তো ভেবেই পাই না। বক-ধার্মিক আবার কি জিনিস!

স্যালি মনে ব্যথা পেল; তবু নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার বক্তব্য বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত এই সাব্যস্ত হল যে পরবর্তী সপ্তাহের কাগজের জন্য তাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে-যে ভাবেই হোক টি বিউরির মৃত্যুটা পিছিয়ে গেছে। এই কথা ভেবে তারা বিষয়ান্তরে গেল এবং আগের মতই খুসি মনে সংসারের কাজকর্মে মন দিল।

এদিকে, আসল কথাটা জানা থাকলে তাদের এ চিন্তা কিন্তু ভুল হয়েছে। টি বিউরি তার কথা রেখেছে, অক্ষরে অক্ষরে রেখেছে; সে মারা গেছে; যথাসময়েই মারা গেছে। আজ চারদিন হল সে মারা গেছে, মরে বাসি হয়ে গেছে; সে পুরোপুরি মরেছে, সম্পূর্ণরূপে মরেছে, কবরখানায় আগত যে কোন নবাগতের মতই মরেছে; আর সে খবরটা। এ সপ্তাহের সাগামোর-এ প্রকাশ করবার মত যথেষ্ট সময় দিয়েই মরেছে; কিন্তু ঘটনাচক্রে সংবাদটা ছাপা হয় নি; সে ধরনের দুর্ঘটনা কোন শহরের সংবাদপত্রে ঘটতে পারত না, কিন্তু সাগমোর-এর মত একটা গেঁয়ো সংবাদপত্রে হামেশাই ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় পাতাটা পূরণ করা সবে শেষ করা হয়েছে এমন সময় হোস্টেলার্স লেড়ি স অ্যাণ্ড জেন্টস্ আইসক্রিম পার্লার্স থেকে বিনি পয়সার এক কোয়ার্ট স্ট্রবেরি ফলের রস এসে হাজির হল, আর সেজন্য সম্পাদকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বেপরোয়া প্রচেষ্টার ধাক্কায় বেচারি টিলবিউরির এক স্টিক পরিমাণ শোক-সংবাদটি পড়ে গেল।

তারপর স্ট্যাণ্ডিং-গ্যালিতে যাবার পথে টি বিউরি-র শোক-সংবাদটা পাই হয়ে ছাপাখানার অন্য হরফের সঙ্গে মিশে গেল। তা না হলে পরবর্তী কোন সংখ্যায় সংবাদটা নিশ্চয় ছাপা হত। কিন্তু ছাপাখানায় কোন সংবাদ একবার পাই হয়ে গেলে সেখানেই তার অন্ত্যেষ্টি হয়ে যায়; কখনও তার পুনর্জন্ম ঘটে না; তার ছাপা হবার সম্ভাবনা চিরদিনের মত নষ্ট হয়ে যায়। আর তাই, টি বিউরি চাক বা না চাক, কবরে শুয়ে প্রাণ ভরে যতই সে বকবক করুক-তার মৃত্যু-সংবাদ সাপ্তাহিক সাগামার-এর পাতায় এসে কোনদিনই দিনের আলো দেখতে পাবে না।

.

০৪.

পাঁচ টি সপ্তাহ একঘেয়েভাবে কেটে গেল। প্রতি শনিবারে সাগামোর নিয়মিতভাবেই এল, কিন্তু টি বিউরি ফ স্টারের কোন উল্লেখ তাতে পাওয়া গেল না। স্যালির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল; সক্ষোভে বলল:

কী যকৃৎরে বাবা, এ যে দেখছি অমর!

আলেক তাকে কড়া ধমক লাগাল; গম্ভীরভাবে বলল:

নিজের সম্পর্কে এ রকম একটা মন্তব্য শোনার পরেই যদি হঠাৎ তোমার মৃত্যু ঘটে তাহলে কেমন লাগবে?

বিশেষ কিছু না ভেবেই স্যালি জবাব দিল, আমার ভাগ্য ভাল যে সে রকম অবস্থা কখনও হবে না।

এই ভাবে ছ মাস চলে গেল। সাগামোর এখনও টি বিউরি সম্পর্কে নীরব। স্যালি অনেকবার আকারে-ইঙ্গিতে ব্যাপারটা জানতে চেয়েছে, কিন্তু আলেক তাতে নজর দেয় নি। এবার সে সাহস করে সোজাসুজি প্রস্তাব করল, সে ছদ্মবেশে টিবিউ রির গ্রামে যাবে এবং প্রসঙ্গক্রমে ব্যাপারটা জানতে চেষ্টা করবে। প্রস্তাবে বাধা দিয়ে আলেক বলে উঠল:

তুমি ভেবেছ কি? তোমাকে নিয়েই তো যত ঝামেলা আমাকে পোয়াতে হয়। কখন যে আগুনে পুড়ে মর সেই ভয়ে সারাক্ষণ ছোট ছেলের মত তোমার উপর নজর রাখতে হয়। যেখানে আছ সেখানেই থাক!

কেন আলেক? আমি কথা দিচ্ছি, ধরা না পরেই কাজটা আমি করতে পারব।

স্যালি ফস্টার, কেন বুঝতে পারছ না যে তোমাকে তো সর্বত্র খোঁজ-খবর নিতে হবে?

হলই বা; তাতে কি? আমাকে কেউ সন্দেহ করবে না।

শোন একবার কথা! আরে, একদিন তো অছিদের কাছে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি কোন খোঁজ-খবর কর নি। তখন কি হবে?

এ-কথাটা তার মনে ছিল না। সে জবাব দিল না; জবাব দেবার মত কিছু ছিল না। আলেক বলল:

ও মতলব মন থেকে নামাও; আর কখনও এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। টি বিউরি তোমার জন্য ফাঁদ পেতেছে। এট যে ফাঁদ অ কি বুঝতে পারছ না? সেও তোমার উপর নজর রেখেছে; আশা করছে যে এই ভুলই তুমি করবে। কিন্তু আমি যতদিন আছি ততদিন তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে না। স্যালি!

বল?

যতদিন বেঁচে থাকবে-একশ বছর বাঁচলেও-কখনও খোঁজ-খবর করবে না। কথা দাও!

ঠিক আছে, একটা নিঃশ্বাস ফেলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বলল।

তখন আলেক নরম হয়ে বলল:

অধৈর্য হয়ো না। আমাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে; আমরা অপেক্ষা করতে পারি; তাড়াহুড়ার কিছু নেই। আমাদের অল্পসল্প নিশ্চিত আয় যা আছে সেটা ক্রমাগত বাড়ছে; আর ভবিষ্যতের ব্যাপারেও আজ পর্যন্ত আমি কোন রকম ভুল করি নি-আমাদের আয়। হাজারে-হাজারে, অযুতে-অযুতে বাড়ছে। আমাদের মত সম্ভাবনাময় পরিবার এ রাজ্যে আর একটি ও নেই। এর মধ্যেই তো আমরা টাকার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছি। তা কি তুমি জান না?

হ্যাঁ, তাতো বটেই আলেক।

তাহলে ইশ্বর আমাদের জন্য যা দিয়েছেন সেজন্য তাঁকে ধন্যবাদ দাও। অকারণে দুশ্চিন্তা করো না। ইশ্বরের বিশেষ সাহায্য ছাড়া কি এই প্রচুর সম্পত্তি আমরা করতে পারতাম?

ইতস্তত করে, না, তা হয় তো পারতাম না। তবে-

আঃ, চুপ কর! আমি জানি তুমি কোন ক্ষতি করতে চাও না, কিন্তু তুমি মুখ খুললেই এমন সব কথা বলতে আরম্ভ কর যে আমার গা শিউরে ওঠে। তোমাকে নিয়ে আমার ভয়ের অন্ত নেই। এতদিন আমি বজ্রকে ভয় করতাম না, কিন্তু এখন বজ্রের ডাক শুনলেই আমি- তার গলা ধরে গেল; কথা শেষ না করেই সে কাঁদতে লাগল।

স্যালি অবস্থা বুঝে চুপ করে গেল; কিন্তু মনে মনে মতলব ভাঁজতে লাগল। অনেক ভেবেচিন্তে মতলব একটা বের করল। এক শিলিং এক শিলিং করে অনেক দিন ধরে যে মূল্যবান অর্থ সে জমিয়েছে তাই দিয়ে সে বাড়ির মাথায় একটা ব-বারণ-দণ্ড বসিয়ে নিল।

কিছুদিন পরে আবার সেই পুরনো স্বভাব ফিরে এল।

অভ্যাসের কী আশ্চর্য ক্ষমতা! কত সহজে, কত তাড়াতাড়ি অভ্যাস গড়ে ওঠে–ছোট খাট অভ্যাসও আমাদের সত্তাকেই বদলে দেয় সব। আকস্মিক ভাবে যদি পর পর দুদিন সকাল দুটো পর্যন্ত জেগে থাকতে হয় তাহলেই শরীর অসুস্থ বোধ হয়, কিন্তু পর পর আরও কয়েকদিন সেটা ঘটলেই সেটা অভ্যাস হয়ে যায়; আবার এক মাস যদি হুইস্কি কাওয়া যায়-কিন্তু এ সব তো সকলেরই জানা কথা।

আকাশে অট্টালিকা গড়ার অভ্যাস, দিবাস্বপ্নের অভ্যাস-কত তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে! সেটাই একটা বিলাস হয়ে দেখা দেয়; অলস মুহূর্তে কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে আমরা উড়ে যাই; তার মধ্যেই মশগুল হয়ে থাকি; কল্পনার মায়ায় ভুলে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ি-হাঁ, এত তাড়াতাড়ি আর এত সহজে আমাদের স্বপ্ন-জীবন আর বাস্তব-জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় যে তাদের আর আমরা আলাদা করে চিনতেই পারি না।

একে একে আলেক একখানা শিকাগোর দৈনিক পত্রিকা ও ওয়াল স্ট্রীট পয়েন্টার পত্রিকার গ্রাহক হল। টাকা লগ্নি করার দিকে নজর রেখে সে সারাটা সপ্তাহ কাগজ দুখানা অন্ন তন্ন করে পড়ে। বাস্তব ও আধ্যাত্মিক জগতের ঋণ-পত্রের লেনদেন ও লাভ-লোকসানের হিসাব সে এত দ্রুত ও এত সফলতার সঙ্গে করতে পারে যে তা দেখে স্যালির বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কোন ক্ষেত্রেই তার মাথা ঘুরে যায় না।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আলেক ও স্যালির কল্পনাশক্তি বেশ পেকে উঠল। দুজনই যেন যন্ত্রের মত কাজ করতে লাগল। ফলে আলেক দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে কল্পনায় টাকার পাহাড় জমিয়ে তোলে, আর স্যালি ও সমান তালে সেটাকে খরচ করতে থাকে। গোড়ায় তাদের হিসাবের ব্যাপারটা ছিল দুর্বল, কারণ তখন তাদের কোনরকম শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না, অভিজ্ঞতা ছিল না, অনুশীলন ছিল। না। এখন সেগুলো করায়ত্ত হওয়ার কাল্পনিক দশ হাজার ডলারের লগ্নিটা শতকরা তিন শ ডলার লাভ পিঠে নিয়ে এসে হাজির হয়!

ফস্টার দম্পতির কাছে সে এক মহাদিন। আনন্দে তারা বাক্যহারা। বিস্ময়ে ও আনন্দে অভিভূত হয়ে বসে বসে তারা এই প্রচণ্ড সত্যটাকেই উপলব্ধি করতে চেষ্টা করল যে কাল্পনিক নগদ অর্থে তারা তখন কয়েক লক্ষ ডলারের মালিক হয়ে বসেছে।

সে এক স্মরণীয় রাত্রি। ক্রমেই তারা যে প্রচণ্ড ধনী হয়ে উঠেছে এই বোধটা দুজনের মনের মধ্যে স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তারা টাকার একটা বিলি-বন্দোবস্ত করে ফেলল। এই স্বপ্নদশী দম্পতির চোখ দিয়ে যদি আমরা তাকাতে পারতাম তাহলে দেখতে পেতাম-তাদের পরিচ্ছিন্ন ছোট কাঠের বাড়িটা উধাও হয়ে গেছে, আর তার জায়গায় দেখা দিয়েছে সামনে ঢালাই লোহার বেড়া দিয়ে। ঘেরা একটা দোতলা ইটের বাড়ি দেখতে পেতাম-বসবার ঘরের সিলিং থেকে একটা তিন থাকওয়ালা গ্যাসের ঝাড়-লণ্ঠন ঝুলছে; সাধারণ মোটা কার্পেটের জায়গায় মেঝেতে পাতা হয়েছে গজ প্রতি ডলার দামের উঁচু দরের ব্রুসেলস্-কার্পেট, সাধারণ অগ্নিকুণ্ডটা উধাও হয়ে সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে একটা অভিজাত অগ্নিকুণ্ড। তাছাড়াও দেখতে পেতাম আরও অনেক কিছু-বগি গাড়ি, ভাল। পোশাক, টুপি, কত কি।

সেদিন থেকে মেয়েরা ও প্রতিবেশীরা সেই পুরনো কাঠের বাড়িটা চোখে দেখলেও আলেক ও স্যালি দেখতে লাগল একটা দোতলা পাকা বাড়ি; সেদিন থেকে এমন একটা রাতও কাটে না যেদিন আলেক কাল্পনিক গ্যাসের বিল নিয়ে মাথা না ঘামায়, আর স্যালির মুখ থেকে তাকে বেপরোয়া মন্তব্য না শুনতে হয়: তাতে কি হল? এ খরচ করবার সামথ্য আমাদের আছে।

ধনী হবার সেই প্রথম রাতে ঘুমুতে যাবার আগেই ফস্টার দম্পতি ঠিক করল যে এই উপলক্ষে একটা উৎসব করতে হবে। স্থির হল-একটা পার্টি দেওয়া হবে। কিন্তু মেয়েদের আর প্রতিবেশীদের কি বলে বোঝাবে? তারা যে ধনী হয়েছে এ কথা তো বাইরে প্রকাশ করা যাবে না। স্যালি প্রকাশ করতেই চেয়েছিল, কিন্তু আলেকের ঠাণ্ডা মাথা, সে তাতে রাজি হল না। সে বলল, যদিও টাকাটা হাতে পাওয়ারই সামিল, তবু যতদিন সত্যি সত্যি হাতে না আসছে ততদিন অপেক্ষা করাই ভাল। কথাটাকে গোপন রাখতেই হবে-কি মেয়েদের কাছে, কি প্রতিবেশীদের কাছে।

দুজনেই মুস্কিলে পড়ে গেল। উৎসব তারা করবেই, উৎসব করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কিন্তু কথাটাই যখন গোপন রাখতে হবে, তখন উৎসবটা কিসের? তিন মাসের মধ্যে কোন জন্মদিন নেই। টিলবিউরিকেও উপলক্ষ করা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে চিরকাল বেঁচে থাকবে। তাহলে কি নিয়ে তারা উৎসব করবে? শেষ পর্যন্ত স্যালির মাথায়ই মতলবটা এল। মুহূর্তে সব গোলমালের নিষ্পত্তি হয়ে গেল। তারা উৎসব করবে আমেরিকা আবিরকে উপলক্ষ করে। চমৎকার ধারণা!

স্যালির কথা শুনে আলেকের গর্বের সীমা নেই-আলেক বলল, এ চিন্তা তো তার মাথায়ই আসত না। প্রশংসায় ডগমগ হলেও স্যালি মুখে বলল, এটা আর এমন কি, যে কারও মাথায়ই এটা আসতে পারত। তাতে আলেক সগর্বে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল:

অবশ্য! যে কেউ পারত-যে কউ! যেমন হোসান্না ডি কিন্স! অথবা এডেলবার্ট পিনাট–হ্যাঁ, তারা একবার চেষ্টা করেই দেখুক না!

একটা চল্লিশ একর জমির দ্বীপ আবিষ্কারের কথা যদি ধর, সেটাও তারা পারত কি না সন্দেহ; আর একটা পুরো মহাদেশ আবিষ্কার! আরে স্যালি ফস্টার, তুমি তো ভাল করেই জান যে পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেলেও সে কাজ তাদের দিয়ে হত না।

হায় নারী, তার তো বুদ্ধিশুদ্ধি আছে! তবু ভালবাসার বশে সে যদি স্বামীকে একটু বেশী বড় করে দেখেই থাকে তো সেটা দোষের হলেও সে দোষ যেমন মিষ্টি তেমনই মধুর, আর তাই অবশ্যই ক্ষমার যোগ্য।

.

০৫.

উৎসব ভালই জমল। যুবক ও বৃদ্ধ সব বন্ধুরাই হাজির হল। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ছিল ফুঁ সি ও গ্রেসি পিনাট ও তাদের ভাই এডেলবার্ট–একজন উঠতি টিনের কারিগর; আর ছিল হোসান্না ডি কিন্স জুনিয়র, সেও একজন পলস্তারার কারিগর, সবে তার শিক্ষানবীশী শেষ করেছে। বেশ কয়েক মাস হল এডেলবার্ট ও হোসান্না। গোয়েণ্ডোলেন ও ক্লাইটেমনেস্ট্রার দিকে নজর দিতে শুরু করেছে, আর মেয়ে দুটির বাপ-মাও তাতে মনে মনে বেশ পুলকই অনুভব করেছে। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ তাদের মনোভাব বদলে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুটি মেয়ে ও দুজন কারিগরের মধ্যে একটা সামাজিক ব্যবধান গড়ে উঠেছে। মেয়ে দুটি এখন আরও উপরের দিকে নজর দিতে পারে-আর দেওয়াই উচিত। হ্যাঁ, তাই। উকিল বা বণিকের নীচে কাউকে বিয়ে করা তাদের পক্ষে ঠিক হবে না; আর সে ব্যাবস্থা তাদের বাবা-মারাই করবে; তারাই দেখবে যাতে অসম-যোটক না হয়।

এই সব ভাবনাচিন্তা অবশ্য গোপনে গোপনেই চলছিল; বাইরে তার কোন প্রকাশ ছিল না। তবু তাদের চলনে-বলনে এমন কিছু বাইরে প্রকাশ পাচ্ছিল যার প্রশংসা করলেও অতিথিরা ভিতরে ভিতরে কিছুটা অবাক হচ্ছিল। সকলেই এ নিয়ে আলোচনা করল, কিন্তু কারণটা কেউ অনুধাবন করতে পারল না। এটা যেমন আশ্চর্য তেমনই রহস্যময়। কেউ কেউ অবশ্য না বুঝেই মন্তব্য করল:

দেখে মনে হচ্ছে এরা যেন কোন সম্পত্তি হাতে পেয়েছে।

ব্যাপার তো আসলে তাই।

স্যালি বলল: এখনই কথাটা ভেঙো না; ওরা মনে ব্যথা পাবে। এ ব্যাপারে তোমার কি কাউকে মনে ধরেছে? কারও কথা ভেবেছ। কি?

না, সে রকম কিছু আলেক ভাবে নি। বাজারটা যাচাই করে দেখতে হবে-তাই করেছে মাত্র। যেমন, উঠতি উকিল ব্র্যাডি শ ও উঠতি দাঁতের ডাক্তার ফুঁ টন-এর কথা তাদের মনে হয়েছে। স্যালি চায় তাদের একদিন ডি নারে নেমন্তন্ন করতে। কিন্তু আলেকের মত-এখনই নয়; তাড়া তো কিছুই নেই। দুজনের উপরই নজর রাখ, অপেক্ষা কর; এ রকম গুরুতর ব্যাপারে ধীরে সুস্থে চললে কখনও লোকসান হয় না।

দেখা গেল তারা বুদ্ধির কাজই করেছে; কারণ তিন সপ্তাহের মধ্যেই আলেক এমন একটা দাও মারল যাতে কাল্পনিক এক লক্ষ ডলার চড়চড় করে চার লক্ষ ডলারে উঠে গেল। সেদিন রাতে আলেক ও স্যালি একেবারে মেঘের দেশে ভেসে গেল। এই প্রথম তারা ডিনারে শ্যাম্পেন হাজির করল। আসল শ্যাম্পেন না হলেও যে পরিমাণ কল্পনা তার পিছনে খরচ করল সে তুলনায় বেশ ভাল জিনিস। প্রস্তাবটা স্যালির, তবে আলেকেরও তাতে সায় ছিল। মেয়েদের বিয়ের কথা নতুন করে উঠল। দাঁতের ডাক্তার অথবা উকিলের কথাই উঠল না; তাদের পণ্যের মধ্যেই ধরা হল না। বাতিল হয়ে গেল। মাংস চালানদারের ছেলে আর গ্রাম্য ব্যাংকারের ছেলের কথা উঠল। কিন্তু আগের মতই এবারও তারা অপেক্ষা করে ভেবেচিন্তে দেখবার নীতিই গ্রহণ করল।

ভাগ্য আবার প্রসন্ন হল। সদাজাগ্রত আলেক একটা দাঁও পেয়ে গেল; মোটা দাঁও, ঝুঁকিও অনেক, তবু সে দুঃসাহসের সঙ্গে ডানা মেলল। কিছুদিন বুক কাপল, মনে অস্বস্তি দেখা দিল, কারণ ফ কালেই নির্ঘাৎ ধ্বংস। তারপর ফ ল বেরুল। আনন্দে বাক্যহারা হয়ে আলেক অনেক কষ্টে শুধু বলল:

অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে স্যালি-আমার এবার পাক্কা দশ লাখের মালিক!

স্যালি কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ফেলল। বলল:

আহা ইলেক্ট্রা, রমণী-রত্ন তুমি, মাথার মণি তুমি; এতদিনে আমরা ভয়হীন হলাম; টাকার মধ্যে গড়াগড়ি দিলাম। আর আমাদের কৃপণতা করা সাজে না। এবার চাই ভিউ ভ ক্লিকোৎ

মাংস-চালানদার ও ব্যাংকারের ছেলেদের শিকেয় তুলে রেখে তারা এবার লাট সাহেবের ছেলে ও কংগ্রেস-সদস্যের ছেলের কথা ভাবতে বসল।

.

০৬.

ফস্টারদের কাল্পনিক অর্থনীতি যে ভাবে লাফিয়ে-লাফিয়ে চলতে শুরু করল তার বিস্তারিত বিবরণ অনুসরণ করা বড়ই শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। আশ্চর্য তার গতি; মাথা ঝিমঝিম করে; চোখে ধাঁধা লাগে। আলেক যাতে হাত দেয় তাই রূপকথার সোনা হয়ে যায়; তার উজ্জ্বলতায় আকাশ পর্যন্ত ঝ সে ওঠে। লাখের পর লাখ-বন্যার স্রোতের মত উদ্দাম তার গতি-বেড়েই চলেছে-বেড়েই চলেছে। পঞ্চাশ লাখ-এক কোটি দশ কোটি–বিশ-ত্রিশ-তার কি শেষ নেই?

এই অদ্ভুত বিকারের মধ্যে দুটি বছর কেটে গেল-নেশায় মত্ত ফস্টাররা সময়ের গতি বুঝতেও পারল না। তাদের সম্পদ এখন কোটি কোটি ডলারকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি ভাল কোম্পানির পরিচালক-সভার তারা সদস্য হয়েছে; যত দিন যেতে লাগল ততই কোটির উপর কোটি জমতে লাগল-এক ধাপে পাঁচ, কখনও এক ধাপে দশ। তিনশ কোটি দ্বিগুণ হল-তার দ্বিগুণ। হল–আবার-আবার!

অর্বুদ-বৃন্দ-পদ্ম-মহাপদ্ম!

ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে পড়ল। একটা হিসাব-নিকাস করে সব কিছু বোঝা দরকার। ফস্টাররা সেটা বুঝল, অনুভব করল, উপলব্ধি করল যে কাজটা করা একান্ত প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে তারা এটাও বুঝল যে এত বড় একটা কাজকে সুষ্টভাবে সুসম্পন্ন করতে হলে একটানা কাজ করতে হবে-মাঝ খানে বন্ধ রাখা চলবে না। দশ ঘণ্টার কাজ; কিন্তু একটানা দশ ঘণ্টা অবসর তারা কোথায় পাবে? স্যালিকে প্রতিদিন সারা দিন পিন, চিনি, আর কাপড় বেচতে হয়; আলেককেও প্রতিদিন সারা দিন রান্না করতে হয়, বাসন ধুতে হয়, ঝাটি দিতে হয়, বিছানা করতে হয়। সাহায্য করবারও কেউ নেই, কারণ উঁচু সমাজে চলাফেরার জন্য মেয়েদের রেহাই দিতেই হয়। ফস্টাররা জানে একটানা দশ ঘণ্টা সময় পাবার একটাই উপায় আছে-মাত্র একটা উপায়। নামটা বলতে দুজনেরই লজ্জা করতে লাগল; দুজনই অপেক্ষা করে রইল, যদি অপর জন নামটা বলে। শেষ পর্যন্ত স্যালি বলল:

কাউকে তো বলতেই হবে। আমিই বলছি। ধর, নামটা আমি বলেই ফেলেছি। জোর গলায় উচ্চারণ করলাম বলে কিছু মনে করো না।

আলেকের মুখ লাল হয়ে উঠল, তবু সে কৃতজ্ঞ বোধ করল। আর কোন কথা না বলে তারা অবসর-দিনটা (Sabbath) ভঙ্গ করল। একমাত্র সেই দিনই তাদের একটানা দশ ঘণ্টা ছুটি। আর এক পা অগ্রসর হলেই পতনের শুরু। অন্যরাও এই পথ ধরবে। প্রচুর অর্থ হাতে এলে তার প্রলোভনে অনভ্যস্ত মানুষের নৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে।

পর্দাগুলো নামিয়ে দিয়ে তারা অবসর-দিনটা ভঙ্গ করল। অনেকক্ষণ ধরে কঠোর পরিশ্রম করে বিষয়-সম্পত্তির একটা তালিকা তৈরি করল। বড় বড় সব নামের দীর্ঘ মিছিল। রেল-ব্যবস্থা, স্টীমার লাইন, স্ট্যাণ্ডার্ড ওয়েল, সামুদ্রিক তার, টেলিগ্রাম-ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে শুরু করে ক্লাইক, ডি বিয়ার্স, টামানি গ্রাফ ট ও ডাক বিভাগ পর্যন্ত।

লাখ লাখ ডলার, সবই নিরাপদ লগ্নিতে রাখা, স্বর্ণপ্রসূ, সুদ-প্রদানকারী। আয় বছরে ১২০,০০০,০০০ ডলার। একটানা খুসির শব্দ করে আলেক বলল:

এই যথেষ্ট তো?

যথেষ্ট আলেক।

এখন আমরা কি করব?

চুপচাপ থাকব।

ব্যবসা থেকে অবসর নেব?

ঠিক তাই।

আমি সম্মত। অনেক ভাল কাজ করা হয়েছে; এবার লম্বা বিশ্রাম নেব; টাকাটা ভোগ করব।

খুব ভাল! আলেক!

বল?

আয়ের কতটা আমরা খরচ করতে পারি?

সবটাই।

স্বামীর মনে হল তার গা থেকে এক জন ওজনের শিকল খুলে পড়ল। একটা কথাও বলল না; তার সুখ ভাষার অতীত।

তারপর থেকে তারা বিশ্রাম-দিনটি ভেবেই চলল। সেটাই প্রথম ভুল পদক্ষেপ। প্রতি রবিবার প্রাতঃকালীন প্রার্থনার পরেই তারা সারাটা দিন নতুন নতুন মতলব বের করার কাজে কাটিয়ে দেয়-কেমন করে টাকা খরচ করা যায় তারই মতলব। মাঝ রাত পর্যন্ত ঐ কাজই চলতে থাকে। প্রথম খরচের ফন্দি এল স্যালির মাথায়-চর্বি-বাতির খরচ। প্রথমটায় আলেক চিন্তিত হয়েছিল; তারপর চিন্তা করা ছেড়ে দিল। স্যালি মোমবাতি ব্যবহার করতে শুরু করল, আর সেজন্য ভাড়ার তোলপাড় করতে লাগল। অনভ্যস্ত হাতে অনেক টাকা এলে সেটা অভিশাপেবই সামিল; এতে তার নৈতিক অধঃপতন ঘটে। ফস্টাররা যখন গরিব ছিল; তখন আগু ণিত মোমবাতি দিয়া তাদের বিশ্বাস করা যেত। কিন্তু এখন তারা-না। সে কথা থাক। মোমবাতি থেকে আপেল তো এক পা পথ: স্যালি আপেলের অভ্যাস করল; তারপর সাবান; তারপর মিছরি; তারপর টিনের খাবার; তারপর চিনেমাটির বাসন। একবার অধঃপতনের পথে পা দিলে খারাপ থেকে আরও খারাপের পথে নেমে যাওয়া কত সহজ।

ইতিমধ্যে ফস্টারদের আর্থিক অভিযানের আরও অনেক অগ্রগতি ঘটেছে। কল্পনার পাকা বাড়ির স্থান দখল করেছে এক সুরম্য প্রাসাদ-সেখানে তকমাধারী চাকর-বাকর গিজগিজ করছে, দেশ-বিদেশের রাজধানী থেকে অভ্যাগত খ্যাতিমান ও শক্তিমান সব অতিথিরা জমায়েত হয়েছে।

সে প্রাসাদ এখান থেকে অনেক অনেক দূরে উদয়-সূর্যের দিকে-তার দূরত্ব অপরিমেয়-জ্যোতির্বিজ্ঞানে ও পরিমাপেও অনেক দূর-মার্কিন অভিজাত রাজ্যের উঁচু সমাজের পবিত্র দেশের রোড় দ্বীপের নিউ আইল্যাণ্ড-এ। নিয়ম বেঁধে তারা প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানের পরেই প্রতিটি অবসর-দিবসের বাকি সময়টা কাটায় সেই প্রাচুর্যে-ভরা বাড়িতে, কখনও ইওরোপে, কখনও তাদের নিজস্ব পালতোলা নৌকোতে চেপে। লেকসাইড–এর এক প্রান্তে অবস্থিত এই বাড়িতে বাস্তব জীবনের কঠোর, কঠিন ছটা দিন কষ্টে সূষ্টে কাটিয়ে সপ্তম দিনে চলে যায় রূপকথার রাজ্যে-এটাই এখন তাদের নিয়মিত কর্মসূচী ও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

কঠোর সংযত বাস্তব জীবনে তারা পুরনো দিনের মানুষ-পরিশ্রমী, কর্মনিষ্ঠ, সতর্ক, বাস্তববোধসম্পন্ন, স্বল্পব্যয়ী; ছোট্ট প্রেবিটে রিয়ান গির্জার অনুগামী; মানসিক ও আধ্যাত্মিক সর্বশক্তি নিয়ে গির্জায় সুউচচ কঠোর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত। কিন্তু স্বপ্ন-জীবনে তারা কল্পনার একান্ত অনুবর্তী-সে কল্পনা যেমনই হোক, যত পরিবর্তনশীলই হোক।

সমৃদ্ধির শুরু থেকেই ফস্টাররা তাদের কাল্পনিক খরচ পত্রের বহর বাড়িয়ে দিয়েছিল; কিন্তু তার পরে যত সমৃদ্ধি বাড়ছে ততই তাদের খরচ ও ধাপে ধাপে বাড়ছে। কালক্রমে সে খরচ সত্যি মাত্রা ছাড়িয়েছে। প্রতি রবিবারেই আলেক একটা দুটো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলে, একটা দুটো হাসপাতাল বানায়; তা ছাড়া একটা দুটো রাওটন হোটেল; এক গাদা গির্জা। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে মাঝে মাঝে মনোমালিন্যও দেখা দিত। স্যালি হয় তো আলেকের খরচের বহরের জন্য তাকে খোঁটা দিত। তা শুনে আলেক অভিমানভরে কেঁদে ফেলত। তখন স্যালি তাকে সান্ত্বনা দিত, ক্ষমা চাইত। আলেক আবার স্বামীকে বুকে জড়িয়ে ধরত।

.

০৭.

একদা রবিবার অপরাহ্নে দুজনে তাদের স্বপ্নের পালতোলা নৌকায় গ্রীষ্মের সাগর-বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল; অলস বিলাসে নৌকোর পিছনের গলুইতে হেলান দিয়ে বসে ছিল, দুজনই নিপ, যার যার চিন্তায় মগ্ন। দুজনের এই নীরবতা সম্প্রতি বড়ই বেড়ে গেছে; আগেকার সেই ঘনিষ্ঠ তায় ও সহৃদয়তার যেন ভাঁটা পড়েছে। এখন (রবিবারগুলোতে) আলেক বুঝতে পারে যে তার পতি-দেবতাটি ক্রমেই অহংকারে ফেঁপে-ফুলে উঠছে, বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।

কিন্তু সে-তার নিজেরও কি দোষ-ত্রুটি নেই? তা তো আছেই। একটা কথা সে স্যালির কাছেও গোপন রেখেছে, তার প্রতি অসম্মানজনক ব্যবহার করেছে, আর সে জন্য অনেক কষ্টও পেয়েছে। সেই চুক্তি ভেঙে ছে, আবার তার কাছে সেটা লুকিয়েছে। লোভের বশবর্তী হয়ে সে আবার ব্যবসায়ে নেমেছে। তাদের যথাসর্বস্বর ঝুঁকি নিয়ে দেশের যত রেল-ব্যবস্থা, যত কয়লা ও ইস্পাত কোম্পানি সব সে কিনে নিয়েছে, আর পাছে বেঁফাস কথার ফাঁকে স্যালি ব্যাপারটা জেনে ফেলে সেই ভয়ে অবসর-দিবসের প্রতিটি ঘণ্টা কাঁপতে কাঁপতে কাটিয়েছে।

আচ্ছা-আলেক?

বল।

তুমি কি জান আলেক, আমরা একটা ভুল করে চলেছি-মানে, তুমি ভুল করছ? আমি বিয়ের ব্যাপারটার কথা বলছি। সে উঠে বসল। একটা ব্যাঙের মত গোলগাল, উদার-ব্রঞ্জের বুদ্ধমূর্তির মত। গম্ভীর গলায় বলল, ভেবে দেখ, পাঁচ বছর পার হয়ে গেল। গোড়া থেকেই তুমি সেই একই নীতি আঁকড়ে ধরে আছ: আমরা যেমন যেমন উঠছি, তুমিও প্রতিটি ধাপের জন্য পাঁচ পয়েন্ট করে বাড়িয়ে দিচ্ছ। যখনই ভাবি এবার বিয়েটা লাগবে তখনই একটা বড় কিছু তোমার নজরে আসে, আর আমাকে হতাশ হতে হয়। তোমাকে খুসি করা বড়ই শক্ত। একদিন হয় তো আমার সব হারিয়ে ফেলব। প্রথমে আমার দাঁতের ডাক্তার ও উকিলকে বাতিল করেছি। ঠিকই করেছি-যথার্থ কাজ করেছি। তারপর বাতিল করেছি ব্যাংকারের ছেলেকে ও মাংস-চালানকারীর ছেলেকে-সেটাও ঠিকই করেছি। তারপর বাতিল করেছি কংগ্রেস-সদস্যের ছেলে ও লাট সাহেবের ছেলেকে-এটাও ঠিকই হয়েছে, তা মানছি। তারপর সেনেট রের ছেলে ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্টের ছেলে-তাও ঠিকই হয়েছে, কারণ ঐ সব পদমর্যাদার কোন স্থায়িত্ব নেই। তারপর তুমি অভিজাত সমাজের দিকে হাত বাড়ালে; ভাবলাম এতদিনে তেলে হাত পড়েছে; সেখানে ডুব দিলেই পেয়ে যাব কোন প্রাচীন। বংশ-সম্ভ্রান্ত, পবিত্র, দেড়শ বছরের প্রাচীনতায় সমৃদ্ধ; আর তারপরেই বিয়ে। কিন্তু না, এমন সময় ইওরোপ থেকে এল একটি আসল অভিজাত দম্পতি, আর সঙ্গে সঙ্গে আগেকার দো-আঁসলাদের তুমি ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আমি হতাশ হলাম। আলেক! সেই থেকে কী দীর্ঘ মিছিল! ব্যারনেট দের বাতিল করলে ব্যারনদের জন্য; ব্যারনদের বাতিল করলে ভাই-কাউণ্ট দের জন্য; ভাইকাউন্ট দের আর্লদের জন্য; আর্লদের মার্কুইসদের জন্য; মাকুইসদের একজোড়া ডিউকের জন্য। আর নয় আলেক, এবার নগদানগদি সওদা করে ফেল! তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। তোমার হাতুড়ির নীচে মাথা দিয়েছে চারজন ডিউক; চার দেশের; সকলেই বংশমর্যাদায় পোক্ত; সকলেই আকণ্ঠ ঋণে ডুবে আছে। সকলেই উঁচু বংশের লোক, কাজেই আমাদের আপত্তি থাকতে পারে না। আলেক, আর দেরি করো না, আর ঝুলিয়ে রেখো নাঃ সবগুলো ছক মেলে ধর, মেয়েরা পছন্দ করে নিক!

আলেক সারাক্ষণই মিটি মিটি হাসছিল; অবাক করে দেবার একটা খুসির ঝিলিক তার চোখে। শান্ত গলায় বলল:

স্যালি, রাজবংশ হলে কেমন হয়?

বলে কি! বেচারি স্যালি! মুহূর্তের জন্য তার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। তারপরই আত্মস্থ হয়ে লাফ দিয়ে স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও আবেগে মুখর হয়ে উঠল:

জর্জের দিব্যি! আলেক, তুমি কত বড়-সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহিলা তুমি! তুমি যে কত বড় তা আমি কোন দিনই বুঝতে পারব না। তোমার মনের গভীরতার সন্ধান আমি কোন দিন পাব না। অথচ আমি কি না তোমার কাজের সমালোচনা করছিলাম। আমি কিন্তু প্রিয়তমে, আমার আর দেরি সইছে না-সব কথা খুলে বল!

প্রশংসামুগ্ধ নারী তখন স্বামীর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে চুপি চুপি একটি রাজপুত্রের নাম বলল। বেচারির তখন দম বন্ধ হবার উপক্রম। উল্লাসে তার মুখটা ঝলমলিয়ে উঠল।

বলল, আচ্ছা! বেশ বড় মাছ ধরেছ! তার তো আছে একটা জুয়ার আড়ড়া, একটা কবরখানা, একজন বিশপ ও একটা গির্জা-সব তার নিজস্ব। আর আছে মূল্যবান শতকরা পাঁচ শ সুদের কোম্পানির কাগজ; ইওরোপের সব চাইতে নির্দায় সম্পত্তি। আর কবরখানাটা-সেটা তো পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে অভিজাত-আত্মহত্যাকারী ছাড়া আর কাউকে সেখানে জায়গা দেওয়া হয় না। অবশ্য জমি বেশী নেই; তবে যা আছে তাই যথেষ্ট: কবরখানার ভিতরে আট শ একর, আর বাইরে বিয়াল্লিশ। একটা রাজত্ব-সেটাই তো আসল কথা; জমিটা কিছু না। জমি তো যথেষ্টই আছে; সাহারাটা জুড়ে দিলেই হল।

আলেকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে খুব খুসি। বলল:

ভেবে দেখ স্যালি-এ পরিবারের কেউ কখনও ইওরোপের রাজা-রাজরাদের বাইরে বিয়ে-থা করে নি; আমাদের নাতিরা সিংহাসনে বসবে!

সত্যি আলেক-তারা হাতে রাজদণ্ড ধরবে, ইচ্ছামত সেটাকে চালনা করবে, ঠিক যেভাবে আমি গজকাঠি চালাই। খুব ভাল সম্বন্ধ ধরেছ। কিন্তু ভাল করে বেঁধেয় তো? ফস্কে যাবে না?

না, না। সেটুকু ভরসা আমার উপর করতে পার। তাছাড়া, এ লোক লোকসান নয়, লাভ। অপরটি ও তাই।

সে আবার কে আলেক?

মহামহিমরাজবংশীয় সিগিসমুণ্ড-সিগফ্রীড–লয়েনফেল্ড–ডি কেলম্পিয়েল-শোয়ার্টজেনবের্গ ব্লুট ওয়াট, কাট জেনিয়ামের বংশানুক্রমিক গ্র্যাণ্ড ডিউক।

আরে! তুমি বলছ কি!

ঠিকই বলছি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পার, আলেক বলল।

স্যালির মন খুসিতে ভরে উঠল। আবেগে সে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল:

কী আশ্চর্য ব্যাপার, আর কী সুন্দর! জার্মেনির তিনশ চৌষট্টিটি প্রাচীন জনপদের মধ্যে এটি ই প্রাচীনতম ও শ্রেষ্ঠ; বিসমার্ক যখন সব জমিদারি ছেটে ফেলেছিলেন তখন যে কটি বংশের রাজত্ব রক্ষা পেয়েছিল এটি তাদেরই অন্যতম। সে রাজত্ব আমি চিনি, সেখানে। আমি ছিলাম। সেখানে আছে একটা রঞ্জু-পথ, একটা মোমবাতির কারখানা, আর একটা সেনাদল। স্থায়ী বাহিনী। পদাতিক ও অশ্বারোহী। তিনটি সৈনিক ও একটা ঘোড়া। আলেক, অনেক অপেক্ষা করেছি, অনেক মনস্তাপ সয়েছি, অনেক আশাভঙ্গ হয়েছে, কিন্তু ঈশ্বর জানেন এবার আমি খুসি হয়েছি। আর এ বই তুমি করেছ, তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ প্রাণাধিকা। কবে হচ্ছে?

পরবর্তী রবিবার।

ভাল। বেশ রাজকীয় মর্যাদায় দুটো বিয়েরই ব্যবস্থা করতে হবে কিন্তু। তবে আমি যতদূর জানি কোন রাজবংশের পক্ষে একটি মাত্র বিবাহ-প্ৰথাই স্বীকৃত; সেটা অসম বিবাহ (morganatic)।

তার অর্থ কি স্যালি?

তা জানি না; তবে সেটাই রাজকীয় প্রথা-একমাত্র রাজাদের মধ্যেই প্রচলিত।

তাহলে তাই হবে। সেই বিয়েই আমি চাই। অসম বিয়েই হবে, নচেৎ বিয়েই হবে না।

আনন্দে হাত ঘসতে ঘসতে স্যালি বলল, তাহলে তো পাকাই হয়ে গেল! আমেরিকাতে এ বিয়ে এই প্রথম। নিউ পোর্ট শু নে ঈর্ষায় জ্বলবে।

তারপরই তারা চুপ করে গেল। স্বপ্নের পাখায় ভর দিয়ে উড়ে গেল পৃথিবীর দূর দূর দেশে-সব মুকুট ধারী ও তাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানাতে এবং নিখরচায় তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে।

.

০৮.

তিন তিনটি দিন স্বামী-স্ত্রী মেঘের বুকে মাথা রেখে বাতাসে বেড়াতে লাগল। চার পাশটাকে দেখতে লাগল আবছা দৃষ্টিতে, যেন গুণ্ঠনের ভিতর দিয়ে। স্বপ্নেই ডুবে রইল; কেউ কথা বললে শুনতে পায় না; শুনলেও বুঝতে পারে না; কথার জবাব দেয় আবোল-তাবোল। স্যালি ঝোলা গুড় বেচ ল ওজনে, চিনি বেচুল গজ মেপে, আর মোমবাতি চাইলে দিল সাবান। ওদিকে আলেক বিড়ালটাকে ধুতে পাঠিয়ে নোংরা কাপড়কে দুধ খাওয়াতে বসল। সকলেই অবাক, হতবাক। ফস্টারদের হল কি?

তিন দিন। তারপর শুরু হল ঘটনা। অবস্থা ভালর দিকেই গেল; আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে আলেকের কাল্পনিক বাজার চড়তে লাগল। আরও-আরও চড়তে লাগল! কেনা দাম পার হয়ে গেল। আরও-আরও আরও চড়ছে! কেনা দামের পাঁচ পয়েন্ট বেশী-তারপর দশ-পনেরো-বিশ! এমন সময় আলেকের কাল্পনিক দালালরা কল্পনার বহুদূর জগৎ থেকে পাগলের মত চিৎকার করে বলতে লাগল, বেচে দাও! বেচে দাও! ঈশ্বরের দোহাই, বেচে দাও!

আশ্চর্য খবরটা সে স্যালিকে শোনাল। স্যালিও বলল, বেচে দাও, বেচে দাও-ভুল করো না। বেচে দাও! কিন্তু আলেক ঠোঁট চেপে বসে রইল; বলল, যদি মরতেও হয় তবু আরও পাঁচ পয়েন্ট না ওঠা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবেই।

এই অপেক্ষাই কাল হল। ঠিক পরদিনই দেখা দিল সেই ঐতিহাসিক মন্দা-রেকর্ড মন্দা-সর্বধ্বংসী মন্দা-ওয়াল স্ট্রীটের নীচ থেকে মাটি সরে গেল-পাঁচ ঘণ্টায় সোনার মত দামী সব কোম্পানির কাগজের দাম পঁচানব্বই পয়েন্ট পড়ে গেল, আর কোটি পতিরা সব বোয়ারির পথে পথে ভিক্ষা করতে লাগল। আলেক যতক্ষণ পারল তার সব কাগজ ধরে রাখল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আর ডাক মেটাতে পারল না তখন তার কাল্পনিক দালালরাই সব বেচে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভিতরকার পুরুষটি হাওয়া হয়ে গেল, বেরিয়ে এল চিরন্তন নারী। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল:

আমারই দোষ, আমাকে ক্ষমা করো না, আমি তা সইতে পারব না। আমরা এখন পথের ভিখারী! ভিখারী! কী দুঃসহ অবস্থা। বিয়ে হবে না; সে আশা শেষ হয়ে গেছে; এখন তো দাঁতের ডাক্তারকেও পাওয়া যাবে না।

একটা কটু ভর্ৎসনা স্যালির জিভে এসেছিল: আমি তো পায়ে ধরে সেধেছিলাম বেচে দিতে, কিন্তু তুমি- সে কথা সে বলল: অনুতপ্ত মানুষটাকে আরও আঘাত দিতে তার মন চাইল না। বরং একটা মহত্তর চিন্তা তার মাথায় এল। সে বলল:

আলেক আমার, ভেঙে পড়ো না; সব কিছু শেষ হয়ে যায় নি! আমার খুড়োর দান-করা অর্থের একটা পেনিও তুমি কখনও লগ্নি করো নি, লগ্নি করেছ শুধু তার ভবিষ্যতে প্রাপ্য উপস্বত্ত্ব; তোমার অতুলনীয় অর্থনৈতিক বিচার-বুদ্ধির দ্বারা ভবিষ্যতে যে অর্থ উপার্জিত হতে পারত, আমরা শুধু সেটাই হারিয়েছি। অতএব মনে ফুর্তি আনো, দুঃখ দূর কর; আমাদের ত্রিশ হাজার এখনও অক্ষতই আছে; আর ইতিমধ্যে যে অভিজ্ঞতা তুমি অর্জন করেছ, ভাব তো দু বছরের মধ্যেই তুমি কি না করতে পারবে! বিয়ে তো আর ভেঙে যাচ্ছে না, একটু শুধু পিছিয়ে যাচ্ছে।

কথাগুলি বড় ভাল। আলেকও বুঝল কথাগুলি ঠিক, আর তার ফল হল বিদ্যুতের মত দ্রুতগতি। তার চোখের জল থেমে গেল; তার মনও আবার আগের মতই চাঙ্গা হয়ে উঠল। উজ্জ্বল চোখে, সকৃতজ্ঞ অন্তরে প্রতিজ্ঞার ভঙ্গীতে হাতটা তুলে সে বলে উঠল:

এখানে দাঁড়িয়ে এখনই আমি ঘোষণা করছি-

একজন আগন্তুকের আগমনে তার কথায় বাধা পড়ল। সাগামোর পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক। তার এক বিস্মৃতপ্রায় ঠাকুরমার জীবনযাত্রা প্রায় সমাপ্তির মুখে কর্তব্যবোধে তার সঙ্গে একবার দেখা করতেই সম্পাদক-মশাই লেক-সাইডে এসেছিল; তার সঙ্গে একটু ব্যবসায়িক স্বার্থ যোগ করে সে খোঁজ খবর করে ফস্টারদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কারণ তারা নানা কাজে এতই ব্যস্ত যে চার বছরের গ্রাহক-চাঁদা পাঠাবার কথা তাদের মনেই ছিল না। তাদের কাছে পাওনা হয়েছে ছ ডলার। স্বভাবতই এ হেন আগন্তুক ফস্টারদের কাছে খুবই স্বাগত। এ লোকটি খুড়ো টি বিউরির কবর, তার কবর-যাত্রার কত বাকি সে খবর নিশ্চয়ই রাখে। তারা অবশ্য কোন রকম প্রশ্নই করতে পারবে না, কারণ তাতে দান-পত্রের শর্ত ভঙ্গ করা হবে; তবে সে বিষয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে করতে এক সময় না এক সময় প্রত্যাশিত খবরটা অবশ্যই জানা যাবে। কিন্তু সে পথে কাজ হল না, সম্পাদক সে পথেই হাঁট ল না। কিন্তু কৌশলে যা ঘটানো গেল না, আকস্মিকভাবেও তা ঘটে গেল না। কি একটা কথাপ্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে সম্পাদক বলল:

আরে! এ যে দেখছি টিলবিউরি ফ স্টারের মতই কড়া লোক!

হঠাৎ কথাটা শুনেই ফস্টার দম্পতি লাফ দিয়ে উঠল। সেটা লক্ষ্য করে সম্পাদক ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে বলল:

কোন রকম আঘাত দেবার ইচ্ছা আমার ছিল না। এটা একটা কথার কথা মাত্র; কি জানেন, একটা ঠাট্টার কথা-তার বেশী নয়। আপনাদের কোন আত্মীয় বুঝি?

মনের জ্বলন্ত আগ্রহকে কোন রকমে চাপা দিয়ে স্যালি নিস্পৃহতার ভান করে বলল:

আমি-মানে-ঠিক যে জানাশোনা তা নয়, তবে তার কথা শুনেছি বটে।

সম্পাদক ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের কথায় ফিরে যেতেই স্যালি বলল, তিনি-তিনি কি-মানে ভাল-

তিনি ভাল আছেন কি না? সে কি, তিনি তো পাঁচ বছর হল শওল-এ (সেখানে আত্মাদের বাস) আছেন!

ফস্টাররা শোকে কাঁপতে লাগল, যদিও দেখে মনে হবে আনন্দের কাপুনি। কোন রকম ধরা না দিয়ে স্যালি বলল:

আহা, এই তো জীবন, এর হাত থেকে কারও রেহাই নেই-এমন কি ধনীরাও পার পায় না।

সম্পাদক হাসল।

বলল, যদি টিলবিউরিকে মনে করে কথাটা বলে থাকেন তো বলি, তার বেলায় কথাটা খাটে না। এক কপর্দকও তার ছিল না। শহরের খরচে তাকে কবরস্থ করা হয়েছিল।

দু মিনিট ফস্টাররা পাথরের মত বসে রইল। তারপর ফ্যাঁকাসে মুখে ভাঙা গলায় স্যালি জিজ্ঞাসা করল:

এ কথা সত্যি? আপনি জানেন এটা সত্যি?

তাই তো মনে হয়। আমিই তো অছিদের একজন ছিলাম। একটা ঠেলাগাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেটা আমার কাছেই রেখে গিয়েছিল। গাড়িটার চাকা না থাকায় কোন কাজেই লাগত না। তবু একটা জিনিস তো বটে; তাই দায় মেটাবার জন্য একটা ছোট শোক-সংবাদের মত লিখেছিলাম, কিন্তু সেটা যেন খবরের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।

ফস্টারদের কানে কোন কথাই ঢুকছে না-তাদের পাত্র পূর্ণ হয়েছে, তাতে আর কিছুই ধরবে না মাথা নীচু করে তারা বসে রইল; বুকের যন্ত্রণা ছাড়া আর কোন বোধ তাদের নেই।

এক ঘণ্টা পরে। তারা তখনও সেই ভাবেই বসে আছে-মাথাটা নীচু, নিশ্চল, নির্বাক। আগন্তুক কখন চলে গেছে তারা জানতেও পারে নি।

তারপর তারা নড়েচড়ে বসল; শ্রান্তভাবে মাথা তুলল; বিস্মিত, চকিত দৃষ্টিতে যেন স্বপ্নের ঘোরে পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর ছেলেমানুষের মতে আবোল-তাবোল বকতে লাগল। মাঝে মাঝেই একটা কথা বলতে বলতে মাঝ খানে থেমে যাচ্ছে; আবার চুপ করছে; যেন কি করছে না করছে তাই বুঝতে পারছে না। কখনও বা সমবেদনায় ও সমর্থনে পরস্পরের হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে; যেন বলতে চাইছে: আমি তোমার কাছেই আছি, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করব না, দুজনে মিলেই সব সহ্য করব; কোথাও না কোথাও মুক্তি আছে, বিস্মৃতি আছে; কোথাও না কোথাও কবর আছে, শান্তি আছে; ধৈর্য ধর, সেদিন দূরে নয়।

আরও দু বছর তারা বেঁচে রইল। তাদের মনের উপর নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার; সর্বদাই চিন্তা করে, অস্পষ্ট অনুতাপ আর বিষণ্ণ স্বপ্নের মধ্যে ডুবে থাকে, কোন কথা বলে না; তারপর একই দিনে এল তাদের মুক্তি।

শেষের দিকে স্যালির বিধ্বস্ত মনের উপর থেকে মুহূর্তের জন্য অন্ধকারটা সরে গিয়েছিল। সে বলেছিল;

আকস্মিক ও অসাধু পথে অর্জিত প্রচুর অর্থ তো একটা ফাঁদ। তাতে আমাদের কোন উপকার হয় নি; তার উৎকট আনন্দ ছিল। একান্তই ক্ষণস্থায়ী। অথচ তারই জন্য আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম আমাদের সুন্দর, সরল, সুখী জীবন-আমাদের দেখে অন্যরা যেন সতর্ক হয়।

চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল; তারপর মৃত্যুর শীতল হাত যখন ধীরে ধীরে তার হৃৎপিণ্ডের দিকে এগিয়ে এল, চৈতন্য যখন মস্তিষ্ক থেকে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তখন সে বিড় বিড় করে বলতে লাগল:

মৃত্যু তাকে দিল দুঃখ, আর সে প্রতিশোধ নিল আমাদের উপর, অথচ আমরা তার কোন ক্ষতি করি নি। তার মনে সেই বাসনাই ছিল: নীচ কৌশলের সঙ্গে সে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিল ত্রিশ হাজার; সে জানত আমরা সেটাকে বাড়াতে চেষ্টা করব, আর সেই চেষ্টায়ই আমাদের জীবন নষ্ট হবে, আমাদের বুক ভেঙে যাবে। আর একটু খরচ করলেই সে অর্থবৃদ্ধির এই ইচ্ছার হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারত; যে কোন দয়াবান মানুষ তাই করত; কিন্তু তার মনে ছিল না উদারতা-ছিল না করুণা-ছিল না-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *