জীবনের পাঁচটি বর

জীবনের পাঁচটি বর
 The Five Boons of Life

০১.

জীবনের প্রভাতকালে একটি ভাল পরী তার ঝুড়ি নিয়ে এসে বলল:

এতে কতকগুলি উপহার আছে। একটি নাও, বাকিগু লি রেখে দাও। সাবধান, খুব বুদ্ধি করে পছন্দ করো; আহা; খুব বুদ্ধি করে পছন্দ করো! কারণ এদের মধ্যে শুধু একটি ই মূল্যবান।

উপহার ছিল পাঁচ টি : যশ, ভালবাসা, অর্থ, সুখ, মৃত্যু।

একটি যুবক সাগ্রহে বলল: চিন্তা করার কোন দরকার নেই; সে সুখ পছন্দ করল।

সে পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ল আর যৌবনে উপভোগ করার মত সমস্ত সুখ খুঁজে নিল। কিন্তু সময় এলে দেখা গেল সুখই স্বল্পস্থায়ী ও হতাশাব্যঞ্জক, ব্যর্থ এবং শূন্য; এবং তারা প্রত্যেকেই চলে যাবার সময় তাকে অবজ্ঞা করে যায়। অবশেষে সে বলল: এতগুলো বছর আমি নষ্ট করলাম। যদি আর একবার পছন্দ করবার সুযোগ পেতাম, তাহলে বুদ্ধিমানের মত পছন্দ করতাম।

.

০২.

পরী এসে বলল:

চারটি উপহার বাকি আছে। আর একবার পছন্দ কর; আর মনে রেখ-সময় চলে যাচ্ছে আর এদের মধ্যে কেবল একটি ই হলো মূল্যবান।

লোকটি অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করল, তারপর ভালবাসা বেছে নিল; পরীর চোখে যে জল দেখা দিল তা সে লক্ষ্য করল না।

অনেক অনেক বছর পরে লোকটিকে একটা শূন্য বাড়িতে একটি মৃতদেহের পাশে বসে থাকতে দেখা গেল। সে আপনমনে বলছে:  একের পর এক তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর এখন এখানে শুয়ে আছে সে, আমার শেষ প্রিয়তমা। নিঃসঙ্গতার পর নিঃসঙ্গতা এসে আমাকে বিধ্বস্ত করেছে; কারণ সেই বিশ্বাসঘাতক বণিক ভালবাসা আমাকে যে সুখের মুহূর্তগুলি বিক্রি করেছে তার

প্রতিটির বিনিময়ে আমি তাকে দিয়েছি হাজার হাজার দুঃখময় মুহূর্ত। তাই আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাকে অভিশাপ দিচ্ছি।

.

০৩.

আবার পছন্দ কর। সেই পরী আবার বলল। এতগুলো বছর নিশ্চয়ই তোমার শিক্ষা হয়েছে। তিনটি উপহার বাকি আছে। মনে রেখো-তার মধ্যে একটি ই হলো মূল্যবান; তাই বুদ্ধি করে পছন্দ করো।

লোকটি অনেকক্ষণ ভালব, তারপর বেছে নিল যশ; আর পরীটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল।

অনেক বছর পার হয়ে গেলে সে আবার এল, এবং লোকটি যখন দিনের শেষে এক নির্জন জায়গায় বসে চিন্তা করছিল তখন তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সে জানতো লোকটির মনের কথা:

আমার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িতে পড়ল, আমার প্রশংসা ছিল সকলের মুখে মুখে কিছু সময়ের জন্য সেটা আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু সে কত অল্প সময়ের জন্য! তারপর এল ঈর্ষা; তারপর কুৎসা; তারপর ঘৃণা; তারপর লাঞ্ছনা। তারপর এল বিদ্রূপ, যাতে আছে শ্রেষের ইঙ্গিত। এবং সবশেষে এল করুণা, সব খ্যাতির অন্তিম শয্যা। হায়, খ্যাতির পরিণাম কী তিক্ত ও দুঃখবহ। প্রথমে লোকে কাদা ছোড়ে, আর পরিণতিতে দেয় অবজ্ঞা আর অনুকম্পা।

.

০৪.

তবু আবার পছন্দ কর। পরীর কণ্ঠ স্বর। দুটি উপহার বাকি আছে। হতাশ হয়ো না। শুরুতে এদের মধ্যে কেবল একটি ই ছিল মূল্যবান, এবং সেটি এখনও এখানে আছে।

অর্থ-সেই তো শক্তি। আমি কী অম্বই ছিলাম! এতদিন বেঁচে থেকে সুখ পাব। খরচ করব, উড়িয়ে দেব, সকলকে চমকে দেব। যারা আমাকে বিদ্রূপ করেছে, অবজ্ঞা করেছে, তারা আমার সামনে ধুলোয় গড়াগড়ি যাবে, আর আমি আমার ক্ষুধার্ত হৃদয় তাদের ঈর্ষায় পূর্ণ করব। মনের সমস্ত বিলাস, আনন্দ ও মনোহারী বস্তু, এবং দেহের যত সন্তুষ্টি মানুষের কাছে প্রিয়-সব আমি পাব। একের পর এক সব আমি কিনব! সমাদর, সম্মান, শ্রদ্ধা, পূজা-এই অতি সাধারণ পৃথিবী-জীবনের নকল রসের যে সমস্ত পসরা সাজিয়েছে তার সব আমি কিনব, কিনব, কিনব। অনেক সময় নষ্ট করেছি, আর এতদিন বোকার মত পছন্দ করেছি; কিন্তু যা হাবর তা হয়েছে; তখন মুখ ছিলাম, তাই যা ভাল মনে হয়েছে তাই করেছি।

তিনটি বছর পার হয়ে গেল; এমন একদিন এল যেদিন লোকটি একটি ছোট্ট চিলেকোঠা ঘরে বসে কঁপছিল; শরীর শুকিয়ে গেছে, চোখ বসে গেছে, ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে, পোশাক ছিঁড়ে গেছে; শুকনো রুটি র ছিকা চিবোতে চিবোতে বিড়বিড় করে বলছে:

ধিক জীবনের সব উপহারকে, কারণ তারা শুধু ঠাট্টা আর গিটি করা মিথ্যাই। মিথ্যাই তাদের বলা হয়, উপহার। তারা উপহার নয় ঋণমাত্র। সুখ, প্রেম, যশ, অর্থ: এরা হলো ব্যথা, শোক, লজ্জা ও দারিদ্র-পৃথিবীর এই সমস্ত স্থায়ী হত্যের সাময়িক ছদ্মবেশ মাত্র। পরী ঠিকই বলেছিল, তার ভাঁড়ারে কেবল একটি উপহারই ছিল দামী, কেবল একটি উপহারই মূল্যহীন নয়। সে উপহার অপরিমেয়; যা। মধুর ও প্রিয়, যা স্বপ্নহীন অনন্ত নিদ্রায় ডুবিয়ে দেয় সেই ব্যথাকে, যা দেহকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ, আর সেই লজ্জা ও শোককে যা মনকে কুড়ে কুড়ে খায়-তার সঙ্গে তুলনায় অন্য উপহারগুলি যে কত সস্তাও তুচ্ছ তা আমি আজ বুঝতে পারছি। সেই উপহার আমাকে এনে দাও! আমি ক্লান্ত, আমি বিশ্রাম করব।

.

০৫.

পরী এল; আবার সঙ্গে নিয়ে এল চারটি উপহার; তার মধ্যে ছিল না মৃত্যু। সে বলল:

আমি এক মায়ের আদরের ছোট্ট শিশুকে সেটা দিয়ে দিয়েছি। সে অজ্ঞান ছিল, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করত, আমাকে বলেছিল পছন্দ করে দিতে। কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করে দিতে বল নি।

ওঃ, কি দুর্ভাগা আমি। আমার জন্য কি কি আছে?

যা তোমার ও প্রাপ্য নয়: বৃদ্ধ বয়সের অসংযত আপমান।

[১৯০২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *