বিলম্বিত রুশ পাসপোর্ট

বিলম্বিত রুশ পাসপোর্ট
The Belated Russian Passport

০১.

একটি পতঙ্গ উড়লেই বসন্ত।-পুডনহেড উইলসন’স ক্যালেণ্ডার

মধ্য-অপরাহ্ন কালে বার্লিন-এর ফ্রীড রিখস্ট্রাস-এর একটি মস্ত বড় বিয়ার সেলুন। একশটা গোল-টেবিলকে ঘিরে বসে ভদ্রজনরা। ধূমপান করছে, মদ খাচ্ছে; তৃষ্ণার্তদের কাছে ফেনায়িত মগ পৌঁছে দিতে সাদা পোশাক পরিহিত ওয়েটাররা এখানে সেখানে ছুটাছুটি করছে। প্রধান ফটকের কাছে একটা টেবিলে জুটেছে ডজনখানেক চটপটে তরুণ-মার্কিন ছাত্রের দল। একটা ইয়েল যুবক দেশভ্রমণের পথে জার্মান রাজধানীতে কয়েকটি দিন কাটিয়েছে। তাকে বিদায় জানাতেই এই পানোৎসবের আয়োজন।

একটা ছাত্র জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু প্যারিস, তোমার এই ভ্রমণকে মাঝ পথে এ ভাবে ছোট ছোট করছ কেন? তোমার মত একটা

আর একজন বলল, সত্যি তো। ব্যাপারটা কি? দেখ, ব্যাপারটা একটা পাগলামির মত দেখাচ্ছে; তাই তোমার উচিত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে কি?

প্যারিস-এর তরুণ তাজা মুখখানিতে একটা মেয়েলি আভা ছড়িয়ে পড়ল; একটু ইতস্তত করে সে স্বীকার করল যে গোলমালটা সেই রকমই।

বলল, এর আগে কখনও বাড়ি থেকে বের হই নি। এক-একটা দিন যাচ্ছে আর ক্রমেই বড় একলা লাগছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ একটি বন্ধুকেও দেখতে পাচ্ছি না, এ বড় সাংঘাতিক অবস্থা। নিজের মুখ রক্ষার জন্যই ভ্রমণটা শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের পেয়ে সে সাধ মিটে গেছে। কটা দিন যেন স্বর্গসুখে কেটে ছে; সেই নিঃসঙ্গ এককিত্বর মধ্যে আর আমি ফিরে যেতে পারব না। যদি কোন সঙ্গী থাকতু-কিন্তু তোমরাও জান যে আমার কোন সঙ্গী নেই, কাজেই সে কথা বলে লাভ নেই। যখন ছোট ছিলাম সকলে আমাকে মিস্ ন্যান্সি বলে ডাকত; মনে হচ্ছে এখনও আমি তাই আছি-মেয়েলি, ভীরু, যাই বল। আমার মেয়ে হওয়াই উচিত ছিল! এ অবস্থা আমি সইতে পারছি না; বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

ছেলেরা ভাল করে বোঝাল; বলল যে জীবনে একটা মস্ত ভুল সে করেছে, একজন বলল যাবার আগে অন্তত পক্ষে সেন্ট পিতার্সবুর্গ। দেখে যাওয়া তার উচিত।

প্যারিস অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল, ও কথা বলো না! ওটাই ছিল আমার প্রিয় স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নকে আজ আমি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। এ ব্যাপারে আর একটি কথাও আমাকে বলো না, কারণ আমার মনটা জলের মত তরল, কারও অনুরোধ আমি এড়াতে পারি না; আমি একা থাকতে পারি না; মনে হয় বুঝি মারা যাব। বুক পকেটে একটা টোকা দিয়ে সে বলল, পাছে মনের গতি বদলে যায় তাই এই সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছি, প্যারিসের টিকিট ও শয়ন-যানের ব্যবস্থা করেছি, আজ রাতেই চলে যাব। এস, পান করা যাক- এই ভরা গ্লাস- এটা বাড়ির জন্য।

বিদায় জানিয়ে সকলে চলে গেল। নিজের চিন্তা ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে রয়ে গেল আলফ্রেড প্যারিস। কিন্তু মাত্র মুহূর্তের জন্য। শক্ত-সমর্থ, চটপটে, করিৎকর্মা একটি মাঝবয়েসী লোক পাশের টেবিল থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে প্যারিস-এর পাশে বসে পড়ল। ভাব-ভঙ্গীতে সামরিক শিক্ষার স্পষ্ট প্রকাশ। বসেই সে একান্ত আগ্রহে কথা বলতে শুরু করল। তার চোখ, মুখ, ব্যক্তিত্ব, ও সারা দেহ থেকে শক্তির প্রাচুর্য উপছে পড়েছে। ভিতরটা যেন বাষ্পে ভর্তি-দৌড়ের ঘোড়ার মত ট ব ভাব-একটা শোঁ-শোঁ শব্দ যেন কান। পাতলেই শোনা যাবে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাদরে প্যারিস-এর সঙ্গে করমর্দন করল; কঠোর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলতে লাগল:

কিন্তু না, এ কাজ করবেন না; সত্যি করবেন না; এর চাইতে বড় ভুল আর হয় নাঃ পরবর্তী জীবনে অনুশোচনার অন্ত থাকবে না। আমার কথা শুনুন; এ কাজ করবেন না-করবেন না!

তার কথায় এমন একটা সহজ হৃদ্যতার সুর ছিল, ছিল এত খাঁটি সহানুভূতির আমেজ, যে যুবকটি র মন সাড়া না দিয়ে পারল না। তার চোখ সজল হয়ে উঠল; অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে যেন স্বীকার করে বসল যে কথাগুলি তাকে বিচলিত করেছে, কৃতজ্ঞ করেছে। এটা সতর্ক নবাগতের দৃষ্টি এড়াল না, সে খুসি হল, মুখের কোন কথার জন্য অপেক্ষা না করেই সে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে লেগে গেল:

না করবেন না, করলে ভুল করবেন। সব কথাই আমি শুনেছি-সেজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি-এত কাছে বসে ছিলাম যে না শুনে পারি নি। আপনি সত্যসত্যই সেন্ট পিতার্সবুর্গ দেখতে চান, তার একেবারে এত কাছে এসেও পড়েছেন, অথচ ভ্রমণ-সূচীকে হেঁটে আপনাকে চলে যেতে হচ্ছে, এ কথা ভেবে দেখুন আমার খুব খারাপ লাগছে। আর একবার ভেবে দেখুন-আঃ, ভেবে দেখতে আপনাকে হবেই। আর এত কাছে-দুপা এগোলেই দেখা হয়ে যাবে-তখন ভাবুন তো, স্মৃতির পাতায় কী অক্ষয় সঞ্চয়ই না হবে!

কথাপ্রসঙ্গে সে রুশ রাজধানী ও তার বিস্ময়কর নানা দর্শনীয় জিনিসের একটা ছবি এঁকে ধরল, আলফ্রেড প্যারিস-এর মুখে জল এসে গেল; তার সদ্য জেগে ওঠা মন যেন আকাঙ্ক্ষায় চীৎকার করে উঠল। তখন–

সেন্ট পিতার্সবুর্গ আপনাকে দেখতেই হবে-অবশ্যই দেখতে হবে। দেখে আনন্দ পাবেন-আনন্দ! আমি জানি, কারণ আমেরিকায় আমার জন্মস্থানটিকে আমি যত ভাল করে চিনি, এই জায়গাটাকেও আমি তেমনই ভাল করে চিনি। দশ বছর-দশ বছর ধরে এর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেখানকার যাকে জিজ্ঞাসা করবেন, সেই বলে দেবে; সকলেই আমাকে চেনে-আমি মেজর জ্যাকসন। কুকুরগুলো পর্যন্ত আমাকে চেনে। চলে যান; আপনাকে যেতেই হবে; সত্যি, যেতে হবে।

আলফ্রেড প্যারিস আগ্রহে কাঁপছে। সে যাবে। জিহ্বায় উচ্চারিত না হলেও তার মুখই এ কথা বলে দিচ্ছে। তার পরই-আবার সেই কালো ছায়া নেমে এল-দুঃখের সঙ্গে সে বলে উঠল।

না, না-কোন লাভ নেই; আমি যেতে পারব না। নিঃসঙ্গতায় আমি মরে যাব।

মেজর অবাক হয়ে বলল: নিঃসঙ্গতা! সে কি! আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি!

একান্ত অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব। খুব মনোরমও নয়। ঘটনায় গতি বড় বেশী দ্রুত। এটা কোন ফাঁদ নয় তো? অপরিচিত এই লোকটি কোন তাসের যাদুকর নয় তো? একটি ভ্রাম্যমান অপরিচিত ছেলের প্রতি এমন অযাচিত আগ্রহই বা কেন? তখনই মেজরের সরল, উজ্জ্বল মুখের দিকে চোখ পড়তেই যুবকটি লজ্জিত হল; তার মনে হল, লোকটির মনে কোন রকম আঘাত না দিয়ে তার হাত থেকে রেহাই পেলে ভাল হয়। সে বলে উঠল:

না, না, আপনি খুবই দয়ালু; তাই বলে আমার জন্যে এতখানি অসুবিধা তো আপনাকে ভোগ করতে দিতে পারি না-কিছুতেই পারি না।

অসুবিধা? মোটে ই না বাবা; আজ রাতে ও আমি এমনিতেই এখান থেকে চলে যেতাম। নটার এক্সপ্রেস-এ আমি যাচ্ছি। একসঙ্গে যাওয়া যাবে। একমুহূর্তও আপনার নিঃসঙ্গ লাগবে না। তাহলে কথা দিন!

এ অজুহাতও টিকল না। এখন কি করা যায়? প্যারিস হতাশ হয়ে পড়ল: সে বুঝল, এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার মত কোন ফন্দি তার মাথা থেকে বেরুবে না। তবু সে আর একবার চেষ্টা করে দেখবে, করলও; নতুন অজুহাতটা বলে শেষ করবার আগেই তার মনে হল এটা একেবারে মোক্ষম, এর আর কোন জবাব নেই।

কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা, ভাগ্যই বিরূপ। তা হবে না। এগুলো দেখুন-টিকিট গুলো বের করে সে টেবিলে রাখল। আমাকে একটানা প্যারিসে যেতে হবে; এই সব টিকিট ও মালপত্রের কুপন তো সেন্ট পিতার্সবুর্গ-এর জন্য বদলানো যাবে না, আর গেলেও অনেক টাকা লোকসান হবে; আর যদিও লোকসান দেবার মত টাকা এখন আমার কাছে আছে, কিন্তু নতুন করে টিকিট কাট বার পরে টাকায় টান পড়ে যাবে, কারণ আমার কাছে নগদে এই মাত্রই আছে,-একটা পাঁচশ মার্ক-এর ব্যাংক-নোট সে টেবিলের উপর রাখল।

মুহূর্তের মধ্যে টিকিট ও কুপনগুলি নিয়ে মেজর উঠে দাঁড়াল; সোৎসাহে বলল:

বেশ! ঠিক আছে। সবই নিরাপদে রইল। আমার খাতিরেই টি কিট ও মালপত্রের কুপন তারা পাল্টে দেবে; তারা আমাকে চেনে-প্রত্যেকেই চেনে। যেখানে আছেন সেখানেই বসে থাকুন; আমি এখনই আসছি। তারপর ব্যাংক-নোট টার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, কারণ নতুন টিকিটের জন্য হয় তো বাড়তি কিছু দিতে হতে পারে-পরমুহূর্তেই সে যেন দরজা দিয়ে উড়ে চলে গেল।

.

০২.

আলফ্রেড প্যারিস কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বড়ই আকস্মিক ঘটনা। যেমন আকস্মিক, তেমনই দুঃসাহসিক, অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। তার মুখটা হাঁ হয়ে ছিল, কিন্তু জিভ নড়ে নি; সে চেঁচিয়ে বলতে চেয়েছিল ওকে থামাও, কিন্তু তার ফুসফুসটায় বাতাস ছিল না; সে তাড়া করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার পা দুটো কাঁপা ছাড়া আর কিছু করতে চাইল না; কাঁপতে কাঁপতে পা দুটো আধ-ভাঙা হয়ে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। গলা শুকিয়ে গেল; হাঁপাতে হাঁপাতে ঢোক গিলতে লাগল; মাথাটা ঘুরতে লাগল। সে কি করবে সে জানে না। অবশ্য একটা কথা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল-তার উচিত আত্মস্থ হয়ে লোকটি কে ধরবার চেষ্টা করা। লোকটি অবশ্য টিকিটের টাকা ফেরৎ পাবে না, কিন্তু তাই বলে সে কি টিকিট গুলো ফেলে দেবে? না; সে নিশ্চয় রেল-স্টেশনে যাবে এবং অর্ধেক দামে টিকিট গুলো কাউকে বেচে দেবে; আর সে কাজটা আজই করবে, জার্মান শুল্ক বিভাগের ব্যবস্থা অনুসারে আগামীকাল টিকিট গুলোর কোন দাম থাকবে না। এই সব চিন্তা তাকে আশা দিল, শক্তি দিল; সে উঠে পা বাড়াল। কিন্তু দু পা এগিয়েই হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং কঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়ল। তার ভয় হল যে তার গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা হয়েছে-কারণ শেষ দফা বীয়ারের খরচ তারই দেবার কথা এবং তার কাছে একটা পেনিও নেই। এখন সে তো বন্দীর সামিল-সে স্থান ত্যাগের চেষ্টা করলে কি যে ঘটতে পারত তা ঈশ্বরই জানেন। সে ভীতআতংকিত, বিপর্যস্ত। সব কথা খুলে বলে কারও সাহায্য ও সহানুভূতি আকর্ষণ। করবার মত যথেষ্ট মনের জোরও তার নেই।

এই চিন্তাই তাকে কষ্ট দিতে লাগল। এত বোকা সে হল কেমন করে? এমন একটা স্পষ্ট ধোঁকাবাজের কথা সে শু নল কিসের প্রভাবে? ঐ তো ওয়েটার আসছে! কাঁপতে কাঁপতে সে খবরের কাগজের আড়ালে মুখ ঢাকল। ওয়েটার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। মনে হল ঘড়ির কাঁটা দুটো বুঝি থেমে আছে, তবু সেদিকে না তাকিয়ে সে থাকতে পারল না।

দশ মিনিট কেটে গেল। আবার ওয়েটার! আবার কাগজের আড়ালে মুখ ঢাকা। ওয়েটার থামল-যেন এক সপ্তাহ-তারপর চলে গেল।

দুঃখে-ভরা আরও দশটা মিনিট–আবার ওয়েটার; এবার সে টেবিলটা মুছল; মনে হল যেন একটা মাস কেটে গেল; তারপর দুমাস সে থেমে রইল; তারপর চলে গেল।

প্যারিস বুঝল, তার আর একটি দর্শন সে সইতে পারবে না; সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই হবে; পালাতে হবে। কিন্তু ওয়েটারটি পাঁচ মিনিট ধরে আশে পাশে ঘুরতে লাগল-মনে হল যেন মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে; আর প্যারিসের হতাশ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে, ধীরে ধীরে বার্ধক্য তাকে জড়িয়ে ধরছে, তার চুল গুলি ক্রমে সাদা হয়ে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত ওয়েটার একটু দূরে গেল-একটা টেবিলে থামল, একটা বিলের টাকা আদায় করল, আরও দূরে গেল, আর একটা বিলের টাকা নিল, আরও দূরে চলে গেল-প্যারিস-এর দুটি প্রার্থনারত চোখ সারাক্ষণ তার উপরেই নিবদ্ধ; তার বুক ধড়ফড় করছে, উদ্বেগে ও আশায় নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত তালে।

বিলের টাকা নিতে ওয়েটার আবার এক জায়গায় থামল; প্যারিস আপন মনে বলল–এই সুযোগ, পরে আর হবে না! দরজার দিকে পা বাড়াল! এক পা-দুপা-তিন-চার-প্ৰায় দরজার কাছে পৌঁছে গেছে-পাঁচ পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে-তার পিছনে কি আর একটা দ্রুত পায়ের শব্দ?-ভাবতেই তার ভেতরটা ধড়াস করে উঠল-ছপা-সাত; এবারে সে বাইরে এসে গেছে!-আট-নয়, দশ-এগারো-বারো-কেউ কি পিছু নিয়েছে!-মোড়টা ঘুরেই সে দৌড়তে গেল-তার কাঁধে একটা ভারী হাত পড়ল; তার গোটা শরীর অসাড় হয়ে পড়ল।

আর কেউ নয়, মেজর। সে কোন প্রশ্ন করল না, অবাকও হল না। স্বাভাবিক হাসিখুসি মেজাজেই বলল:

ঐ লোকগুলোই সব গোলমাল করল, আমাকে দেরী করিয়ে দিল; সেই জন্যই তো এত বিলম্ব ঘটল। টিকিট–ঘরে ছিল নতুন লোক; সে আমাকে চেনে না, আর নিয়মবিরুদ্ধ বলে টিকিট ও পাল্টে দিতে চাইল না; কাজেই অনেক খুঁজে পুরনো বন্ধুটিকে বের করলাম, সেই মহান মোগল-বুঝতেই তো পারছেন স্টেশন-মাস্টার-হাই-এই যে গাড়ি! গাড়ি!-গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড় প্যারি-কোচ য়ান, রুশ কন্সল-আপিস, ঘোড়া দুটোকে উড়িয়ে নিয়ে চুল!-বুঝলে, সেই জন্যই এত দেরী হল। কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে গেছে; সব কিছু সোজা, সরল; তোমার মালপত্র নতুন করে ওজন করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হয়েছে, টিকিট ও শয়ন-ব্যবস্থা পাল্টে নেওয়া হয়েছে, আর তার সব কাগজপত্রই আমার পকেটে মজুদ; ভাঙানিটাও আছে-তোমার হয়ে সেটা আমার কাছেই রেখে দিলাম। জলদি চালাও কোচ য়ান, জদি চালাও; ঘোড়াগুলো যেন ঘুমিয়ে না পড়ে।

গাড়ি ছুটে চলেছে বীয়ার-হল থেকে দূর থেকে দূরে। অনেক চেষ্টা করেও প্যারিস একটা কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একটু ফাঁক পেয়ে বলল, সে এখনই ফিরে গিয়ে ছোট খাট বিলটা মিটিয়ে দিয়ে আসতে চায়।

মেজর শান্ত গলায় বলল, ও নিয়ে মাথা ঘামিও না; ও ঠিক আছে, ওরা আমাকে চেনে, প্রত্যেকেই চেনে-পরে যখন বার্লিনে আসব তখন ও বিল মিটিয়ে দেব-জোরসে চালাও-হাতে আর মোটেই সময় নেই।

যথাসময়ের একটু বিলম্বে তারা রুশ দূতাবাসে পৌঁছে গেল। তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকল। একজন করণিক ছাড়া আর কেউ নেই। মেজর ডেস্কের উপর নিজের কার্ডটা রেখে রুশ ভাষায় বলল, একটু তাড়াতাড়ি যদি এই যুবকটির পাসপোর্ট টাকে পিতার্সবুর্গ পর্যন্ত অনুমোদন করিয়ে দেন-

দেখুন স্যার, সে ক্ষমতা তো আমার হাতে নেই; কন্সাল ও এই মাত্র চলে গেলেন।

কোথায় গেছেন?

গ্রামাঞ্চলে; সেখানেই তিনি থাকেন।

ফিরতে-

সকালের আগে নয়।

হায় কপাল! বেশ, দেখুন, আমি মেজর জ্যাকসন-তিনি আমাকে চেনেন; সকলেই আমাকে চেনে। আপনিই পাসপোর্ট টার ভিসা করে। দিন; তাকে বলবেন, মেজর জ্যাকসন-এর কথায় করেছেন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু কাজটা মারাত্মক রকমের নিয়মবিরুদ্ধ; করণিক রাজী হল না। কথাটা শুনে তার তো মূৰ্ছা যাবার উপক্রম।

আচ্ছা, তাহলে এক কাজ করুন, মেজর বলল। এই স্ট্যাম্প আর ফি–র টাকাটা রইল-সকালেই ভিসা করিয়ে এটাকে ডাকে পাঠিয়ে দেবেন।

করণিক ইতস্তত করে বলল, তিনি-তা, এটা হয় তো তিনি করবেন, কাজেই-

হয় তো? তিনি অবশ্য করবেন! তিনি আমাকে চেনেন-প্রত্যেকেই আমাকে চেনে।

ঠিক আছে, করণিক বলল। আপনার কথা আমি তাকে বলব। লোকটি কে বিচলিত মনে হল। ভীরু গলায় বলল, কিন্তু-কিন্তু-সীমান্তে পৌঁছে আপনাকে চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আর এত বেশী সময় কাটাবার মত কোন ব্যবস্থাও সেখানে নেই।

কে অপেক্ষা করবে? আমি অন্তত করছি না।

করণিক হতবুদ্ধি। বলল, আপনি নিশ্চয় চান স্যার যে এটা পিতার্সবুর্গে পাঠানো হয়!

কেন নয়?

কারণ সেক্ষেত্রে তো পাসপোর্টের মালিককে পঁচিশ মাইল দূরে সীমান্তে আটকে থাকতে হবে। সে অবস্থায় এতে তার কি লাভ হবে?

আটকে থাকতে হবে! কে বলল তাকে আটকে থাকতে হবে?

সে কি আপনি নিশ্চয় জানেন যে সঙ্গে পাসপোর্ট না থাকলে তারা তাকে সীমান্তে আট কে দেবে।

তা তারা করবে না! বড় কর্তা আমাকে চেনেন-প্রত্যেকেই চেনে। এই যুবকের জন্য আমি দায়ী থাকব। আপনি এটাকে সোজা পাঠিয়ে দেবেন পিতার্সবুর্গ-এ-হোটেল দ্য ইউরোপ-এ মেজর জ্যাকসন-এর প্রযত্নে। কনসালকে বলবেন, তিনি যেন দুশ্চিন্তা না করেন; সব ঝুঁকি আমি নিজে নিচ্ছি।

করণিক ইতস্তত রে পুনরায় বলল: স্মরণ রাখবেন স্যার, এই মুহূর্তে ঝুঁকিটা কিন্তু খুবই গুরুতর। নতুন বিধান চালু হয়েছে।

সেটা কি?

বিনা পাসপোর্টে রাশিয়ায় ঢুকলে দশ বছরের জন্য নির্বাসন।

চুলোয় যাক! রুশ ভাষায় কুললো না বলে এ কথাটা সে ইংরাজিতে বলল। মুহূর্তকাল কি যেন ভেবে আবার রুশ ভাষায় বলল: ওঃ, ঠিক আছে-সেন্ট পিতার্সবুর্গ-এর ছাপ মেরে ছেড়ে দেবেন। আমি খুঁজে নেব। সেখানে তারা সকলেই আমাকে চেনে-কর্তৃপক্ষের সকলে- প্রত্যেকে।

দেখা গেল, মেজরের মত ভ্রমণ-সঙ্গী হয় না; তরুণ প্যারিস তো একেবারে মুগ্ধ। তার কথায় রোদের ঝিলিক আর রামধনুর ছোঁয়া; চারদিকটা একেবারে ঝলমল করে ওঠে; সব কিছুকেই সে হাসিখুসিতে ভরিয়ে রাখতে জানে; আর জানে কখন কি কাজ করতে হবে আর কেমন করে করতে হবে। ফলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বাড়ির জন্য মন-কেমন-করা নির্জন নিঃসঙ্গ ছেলেটির কাছে এই দীর্ঘ যাত্রা যেন একটা রূপকথার স্বপ্ন হয়ে দেখা দিল। অবশেষে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে প্যারিস পাসপোর্টের কথাটা তুলল। কি যেন মনে হতেই বলল:

আচ্ছা, দূতাবাস থেকে আমার পাসপোর্ট টা নিয়ে আসা হয়েছে কিনা তা তো মনে পড়ছে না। নিশ্চয়ই এনেছেন, কি বলেন?

না ওটা ডাকে আসছে, মেজর অনায়াসে বলল।

ডা-ডাকে আসছে! ছেলেটি ঢোক গিলল, বিনা পাসপোর্টে ভ্রমণকারীর রাশিয়াতে যে কী হাল হয় সে সম্পর্কে যত রকম ভয় ও বিপদের কথা সে আগে শুনেছে সে সব কথা মনে হতেই ভয়ে তার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেল। ওঃ মেজর হায়, এখন আমার কি হবে! এমন কাজ আপনি করলেন কেন?

যুবকটির কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে মেজর বলল:

কিছু ভেব না বাবা, তিলমাত্র ভেব না। তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছ, তোমার কোন ক্ষতি হতে আমি দেব না। সেখানকার বড় কর্তা আমাকে চেনে, তাকে সব বুঝিয়ে বলব, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে- দেখো। তুমি এতটুকু মন খারাপ করো না-সব ঠিক হয়ে যাবে।

আলফ্রেড ভয়ে কাঁপতে লাগল। ভিতরে ভিতরে তার অস্বস্তির অন্ত নেই। তবু মেজরের সামনে সেটা প্রকাশ না করে বাইরে যথাসাধ্য হাসিখুসি ভাবই ফুটিয়ে চলতে লাগল।

সীমান্তে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে সে ভিড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল, আর মেজর ভিড় ঠেলে বড় কর্তাকে সব কিছু বোঝাতে ভিতরে চলে গেল। আলফ্রেড দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, অনেকক্ষণ পরে মেজর এসে হাজির হল। চুলোয় যাক সব! এ ইন্সপেক্টরটা একেবারে নতুন, আমি তাকে চিনিই না।

এক গাদা ট্রাংকের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আলফ্রেড হতাশভাবে বলে উঠল, হায়, হায়, আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল! ধাক্কার। চোটে সে হয় তো পড়েই যেত, মেজর তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ফেলল; তারপর একটা বাক্সের উপর বসিয়ে নিজের পাশে বসে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বলল:

মোটে কিছু ভেব না বাবা, একদম না; সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার উপর শুধু ভরসা রাখ। এই সাব-ইন্সপেক্টরটি হেরিং-মাছের মত দিন-কানা। এক নজর দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি শুধু আমার কথামত কাজ করবে। আমি গিয়ে আমার পাসপোর্ট টা ঠিকঠাক করিয়ে নেব; তারপর ঐ গ্রীলের মধ্যে যেখানে চাষা-ভুষো লোকেরা মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐখানে গিয়ে থামব। তুমি আগে থেকেই সেখানে থাকবে; গ্রিলের দিকে পিঠ দিয়ে ফোকড়ের ভিতর দিয়ে আমার পাসপোর্ট টা তোমাকে দিয়ে দেব আর তুমিও ভিড়ের পিছন পিছন এগিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট টা জমা দেবে। তারপর ভগবান ভরসা, আর ভরসা ঐ দিন-কানা হেরিং-মাছ। আসল ভরসা হেরিং-মাছ। ও ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তুমি মোটে ভয় পেয়ো না।

কিন্তু কিন্তু, আপনার চেহারার ও অন্যান্য বিবরণের সঙ্গে তো আমার কিছুই মিলবে না।

আহা, সব ঠিক হয়ে যাবে-একান্ন আর উনিশের তফাৎ তো-ও কানা ব্যাটা কিছুই ধরতে পারবে না-কোন চিন্তা করো না-সব ঠিক হয়ে যাবে।

দশ মিনিট পরে আলফ্রেড টলতে টলতে ট্রেনের দিকে এগিয়ে চলল, তখন তার ব্যবস্থা অতি কাহিল। অবশ্য হেরিং-মাছটাকে সে ঠিক মতই ধাপ্পা দিতে পেরেছে।

মেজর জাঁকিয়ে বলতে লাগল, আমি তো আগেই বলেছিলাম। আমি জানতাম, ছোট শিশুর মত ঈশ্বরের উপর ভরসা করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবেই।

তারপর সীমান্ত থেকে পিতার্সবুর্গ পর্যন্ত মেজর তার তরুণ সঙ্গীর জীবনকে এমনভাবে চাঙ্গা করে তুলল, তার রক্তচলাচল স্বাভাবিক করে দিয়ে মনটা এমন জাঁকিয়ে তুলল যে তার জীবনে হাসি-খুসি আর আনন্দ আবার ফিরে এল। ফলে বেশ খুসির পা মেলেই সে শহরে ঢু কল, বেশ উঁটের সঙ্গেই হোটেলে ঢুকে নামটা লেখাল। কিন্তু তার ঘরের সংখ্যাটা না জানিয়ে করণিক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল এবং সময় কাটাতে লাগল। মেজর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে সহজ ভাবেই বলল:

ও ঠিক আছে। আপনি আমাকে তো চেনেন-ওর ব্যবস্থা করে দিন; সব দায়িত্ব আমার। করণিক গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। মেজর বলল: আরে, ঠিক আছে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ওটা এসে পড়বে-ডাকে আসছে। এই তো আমার পাসপোর্ট, ওটাও এসে পড়বে।

করণিক ভদ্র, শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু কর্তব্যে অটল। ইংরাজিতে বলল:

সত্যি কথা বলতে কি মেজর, আপনার কথামত কাজ করতে পারলে আমি খুসি হতাম, পারলে নিশ্চয়ই করতাম; কিন্তু কোন উপায় নেই। আমি তাকে চলে যেতে বলতে বাধ্য; আর এক মুহূর্তও তাকে এখানে থাকতে দিতে পারব না।

প্যারিসের পা টলতে লাগল; মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বের হল; মেজর তাকে ধরে ফেলল; কাঁধের উপর হাত রেখে করণিককে মিনতি করে বলল:

শুনুন, আপনি তো আমাকে চেনেন-সকলেই চেনে-একে একটা রাত থাকতে দিন; আমি কথা দিচ্ছি-

করণিকটি মাথা নেড়ে বলল:

কিন্তু মেজর, আপনি আমাকে বিপদে ফেলছেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলেছেন। আমি-আমি এ সব কাজ করতে ঘৃণা বোধ করি; কিন্তু আমাকে পুলিশ ডাকতেই হবে।

দাঁড়ান, ও সব করবেন না। চলে এস বাবা, কোন ভয় নেই- সব ঠিক হয়ে যাবে। হাই, এই যে, কোচয়ান! উঠে পড় প্যারিস। গোয়েন্দা পুলিশের জেনারেলের প্রাসাদে চল-জোরসে চালাও; ছুটিয়ে দাও; শাঁ-শাঁ করে ঘোড়া ছুটু ক! এই তো ঠিক জায়গায় যাচ্ছি। কোন ভয় নেই। প্রিন্স বাস্কি আমাকে চেনেন, খুব হৃদ্যতা আমার সঙ্গে; তিনি এখনই সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

অতি দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে তারা সেই আলোকোজ্জ্বল প্রাসাদে যখন পৌঁছল তখন সাড়ে আট টা বাজে। শান্ত্রী জানাল, প্রিন্স এখন নৈশ ভোজে বসবেন, কাজেই কারও সঙ্গে দেখা করবেন না।

কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন, কথাগুলি বলে মেজর গম্ভীরভাবে তার কার্ডটা এগিয়ে দিল। আমার নাম মেজর জ্যাকসন। কার্ড টা ভিতরে পাঠিয়ে দাও; সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কার্ডটা ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হল; মেজর ও তার সঙ্গী বসবার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তাদের ডাক এল। জাঁকজমকপূর্ণ আপিস-ঘরে ঢুকে তারা প্রিন্সের মুখোমুখি দাঁড়াল। প্রিন্সের পরনে ঝকমকে পোশাক, আর মুখে বজ্র-মেঘের ভ্রূকুটি। সব কথা জানিয়ে মেজর অনুমতি চাইল, পাসপোর্টটা না আসা পর্যন্ত চব্বিশ ঘন্টার জন্য ছেলেটি কে থাকতে দেওয়া হোক।

নির্ভুল ইংরেজিতে প্রিন্স বলল, ওঃ, অসম্ভব! আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, বিনা পাসপোর্টে ছেলেটি কে এদেশে নিয়ে আসবার মত পাগলামি আপনি করলেন কেমন করে। সত্যি, আমি অবাক হয়ে গেছি মেজর। জানেন, ছেলেটি র দশ বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসন হবে; কোন উপায় নেই-আরে, ওকে ধরুন ভাল করে ধরা! বেচারি প্যারিস আবারও মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিল। এই যে তাড়াতাড়ি এটা খাইয়ে দিন। এই যে-আর এক চুমুক; ব্র্যাণ্ডিই এর ওষুধ। কি বল হে ছোকরা? এবার তুমি সুস্থ বোধ করবে। সোফায় । শুয়ে পড়। বেচারিকে এমন গাড়ায় ফেলে দিয়ে আপনি খুবই বোকার মত কাজ করেছেন মেজর। শক্ত হাতে ধরে যুবকটি কে শুইয়ে দিয়ে মাথার নীচে একটা কুশন দিয়ে মেজর তার কানে কানে বলল:

যতটা পার অসুস্থতার ভাব দেখাও! অভিনয় যেন নিখুঁত হয়; দেখতে পাচ্ছ উনি বেশ বিচলিত হয়েছেন; কোথাও একটা নরম মন আছে; গোঙানির মত করে বল, ওঃ, মা, মাগো, তাহলেই ওকে কাত করতে পারবে।

প্যারিস নিজে থেকেই কাজই বেশ ভালভাবেই করতে পারল। তা দেখে মেজর ফি সৃফিস্ করে বলল: চমৎকার! আবার কর। বার্নার্ড ও এর চাইতে ভাল অভিনয় করতে পারত না।

কিছুটা মেজরের কথার তোড়ে, আর কিছুটা ছেলেটার দুর্দশার ফলে, শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয় হল। প্রিন্স বলল: আপনার কথাই মেনে নিলাম, যদিও উচিৎ শিক্ষাই আপনার প্রাপ্য ছিল। ঠিক চব্বিশ ঘন্টা সময় দিলাম; তার মধ্যে যদি পাসপোর্ট না আসে তাহলে আমার কাছে আসবেন না। সাইবেরিয়ার হাত থেকে কোন ক্ষমা নেই।

মেজর ও যুবকটি যখন পঞ্চ মুখে তাকে ধন্যবাদ জানাতে ব্যস্ত, তখন প্রিন্স ঘন্টা বাজিয়ে দুজন সৈন্যকে ডেকে আনল; নিজের ভাষায় তাদের হুকুম করল–এই দুজন লোকের সঙ্গে যাও, চব্বিশ ঘন্টার জন্য ছেলেটির উপর নজর রাখ; তারপরেও যদি ছেলেটি পাসপোর্ট দেখাতে না পারে তাহলে তাকে সেন্ট পিটার ও সেন্ট পল কারাগারে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়ে দিও।

হতভাগ্যরা রক্ষীসহ হোটেলে ফিরে গেল, তাদের চোখের সামনে বসে খাওয়া শেষ করল, তারপর প্যারিস-এর ঘরে গিয়ে বসল। অপর সৈনিক দরজার বাইরে সটান শুয়ে পড়ে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।

আলফ্রেড প্যারিস-এর চোখে ঘুম নেই। একটি গম্ভীর সৈনিকের সঙ্গে আর ঘরের নিঃশব্দ নীরবতার চাপে সঙ্গীহীন ছেলেটির জোর করে টেনে-আনা ফুর্তির ভাব ক্রমেই শুকিয়ে যেতে লাগল, তার সাহসের ফাপানো বেলুনটার গ্যাস বেরিয়ে যেতে ক্রমেই সেটা চুপসে যেতে লাগল, তার ছোট বুকখানা কিসমিসের মত শুকিয়ে কুঁকড়ে গেল। ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই সে শোক, দুঃখ, ভয় ও হতাশার একেবারে অতলে তলিয়ে গেল। বিছানা? তার জন্য তো বিছানা নয়; যার মাথার উপর খড়গ ঝুলছে তার জন্য তো বিছানা নয়। ঘুম? ইহুদি সন্তানদের মত সে তো আগুনের মধ্যে ঘুমতে পারে না! তার কাজ শুধু মেঝেতে হেঁটে বেড়ানো। তাই করতে সে বাধ্য। সে দুঃখ করল, কাঁদল, প্রার্থনা করল।

অনেক দুঃখে শেষের সব বন্দোবস্ত সে করল; ভাগ্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য নিজেকে সাধ্যমত প্রস্তুত করল। চূড়ান্ত কাজ হিসাবে একটা চিঠি লিখল:

মাগো, মা আমার,-এই বিসর্গ কথাগুলি যখন তোমার কাছে পৌঁছবে, তোমার হতভাগ্য আলফ্রে ড তখন আর এখানে থাকবে না। না; অবস্থা আরও খারাপ; অনেক বেশী খারাপ। নিজের দোষে ও নির্বুদ্ধিতায় আমি একটা জুয়ারী অথবা পাগলের পাল্লায় পড়েছি। লোকটা আসলে কি তা আমি জানি না; তবে সে যাই হোক আমি মরেছি। কখনও মনে হয় সে জুয়ারী; আবার অনেক সময়ই মনে হয় লোকটা পাগল; কারণ তার মনটা যে ভাল আমি জানিঃ যে বিপদের মুখে সে আমাকে ঠেলে দিয়েছে তার হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে সে কঠোর পরিশ্রম করছে।

আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমিও সেই নামহারাদের একজন হয়ে যাব যারা চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হয়ে রাশিয়ার নির্জন বরফের উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাবে সেই রহস্য, দুঃখ ও চির-বিস্মরণের দেশে যার নাম সাইবেরিয়া! ততদিন আমি বেঁচে ও থাকব না; আমার বুক ভেঙে গেছে; আমি মরে যাব। আমার ছবিটা তাকে দিও; তাকে বলো, আমার স্মৃতিস্বরূপ ছবিটা সে যেন রেখে দেয়, আর এমনভাবে জীবনটা কাটায় যাতে যথাসময়ে সেই পরম জগতে সে আমার সঙ্গে মিলিত হতে পারে, যেখানে বিয়ের ব্যাপার নেই, বিরহ নেই, দুঃখ-কষ্ট নেই। আর্কি হেল-কে আমার হলুদ কুকুরটা দিয়ে দিও, আর অন্য কুকুরটা দিও হেনরি টেলরকে; আমার ব্লেজারটা দিও ছোট ভাই উ ইলকে, আর মাছ ধরবার সরঞ্জাম ও বাইবেলখানাও তাকেই দিও।

আমার আর কোন আশা নেই। পালাতে পারব না; বন্দুক হাতে নিয়ে সৈনিকটি দাঁড়িয়ে আছে; মুহূর্তের জন্যও আমার থেকে চোখ সরায় না, শুধু চোখ পিট পিট করে। তাকে ঘুষ দিতেও পারছি না; আমার টাকা পয়সা রয়েছে পাগলটার কাছে। আমার প্রত্যয়-পত্রটা রয়েছে ট্রাংকে; কখনও সেটা ফিরে পাব না-কখনও না। আমি জানি। হায়, আমার কি হবে! আমার জন্য প্রার্থনা করো মাগো, তোমার অসহায় আলফ্রেডে র জন্য প্রার্থনা করো। কিন্তু তাও আমার কোন কাজে লাগবে না।

.

০৪.

পরদিন খুব সকালে মেজর যখন আলফ্রে ডকে প্রাতরাশে ডেকে পাঠাল তখন তার চেহারা একেবারে ঝড়ো কাকের মত। তারা। রক্ষীদের খাওয়াল, সিগারেট ধরাল, মেজরের মুখে আবার খৈ ফুটতে লাগল, আর তারই জাদুর প্রভাবে ধীরে ধীরে আবার আলফ্রেড–এর মনে ভরসা ফিরে এলো, আবার সে আগের মতই হাসিখুসি হয়ে উঠল।

কিন্তু কিছুতেই সে ঘর থেকে বের হতে রাজী হল না। সাইবেরিয়ার ভূত তার কাঁধে চেপে বসেছে; কোন কিছু দেখার বাসনা তার নেই; রাস্তাঘাট, ছবির গ্যালারি, গির্জা-সব কিছু দেখার সময়ই দুই পাশে দুটি সৈনিক খাড়া থাকবে, জগৎসুদ্ধ লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাকে। দেখবে আর নানা মন্তব্য ছুঁড়ে মারবে-এ অপমান তার সহ্য হবে না। না, সে ঘরেই বসে থাকবে, তার বার্লিনের ডাক এবং স্বীয় নিয়তির জন্য অপেক্ষা করবে। সুতরাং সারাটা দিন মেজরও ঘরের মধ্যে তার পাশে বসেই কাটাল; একটি সৈনিক বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চ ল, নিশূ প, আর অপর সৈনিক বাইরে চেয়ারে বসে সারাক্ষণ টু লল; সারাটা দিন প্রধান সঙ্গীটি অভিযানের গল্প বলল, যুদ্ধের বর্ণনা শোনাল, বিস্ফোরক সব কাহিনী বানালো; অদম্য উৎসাহ ও বুদ্ধিদীপ্ত ভাষণের সাহায্যে ভয়গ্রস্ত ছাত্রটি কে কোন রকমে বাঁচিয়ে রাখল; তার নাড়িটা চালু রাখল। দীর্ঘ দিনটা শেষ হল, রক্ষীসহ দুই সঙ্গী নীচে মস্ত বড় খাবার ঘরে গিয়ে আসন নিল।

বেচারি আলফ্রেড দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতীক্ষার শেষ হবে। ঠিক সেই সময় দুজন ইংরেজ পাশ দিয়ে যাচিছল। তাদের একজন বলল, তাহলে আজ রাতে আর বালিন থেকে কোন চিঠি পাওয়া যাবে না।

প্যারিস-এর নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। ইংরেজ দুজন পাশের টেবিলেই বসল। অপর জন বলল:

না, অবস্থা ঠিক ততটা খারাপ নয়। প্যারিস-এর শ্বাসকষ্ট কমল। পরে টেলিগ্রামে খবর এসেছে। দুর্ঘটনার ফলে ট্রেনটা আটকা পড়েছে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ঘন্টা তিনেক দেরিতে আজ রাতেই ট্রেনটা এখানে পৌঁছবে।

এবার আর প্যারিস মাটিতে পড়ে গেল না, কারণ মেজর সময় মতই লাফ দিয়ে উঠে তাকে ধরে ফেলল। প্যারিসের পিঠ চাপড়ে তাকে চেয়ার থেক তুলে অভয় দিয়ে বলল:

চলে এস বাবা, মন ভাল রাখ, সত্যি ভয় পাবার কিছু নেই। পথ আমার জানা আছে। পাসপোর্ট নিয়ে মাথা ঘামিও না; সাত দিন দেরী হয় তো হোক না, পাসপোর্ট ছাড়াই চলে যাবে।

কোন কথাই প্যারিস-এর কানে গেল না; আশা এখন অতীত, বর্তমান শুধু সাইবেরিয়া। পা দুটো যেন শিসের মত ভারী। তাকে ধরে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেজর মার্কিন দূতাবাসে গেল; পথে তাকে আশ্বাস দিল, তার সুপারিশে মন্ত্রী তাকে একটা নতুন পাসপোর্ট দিতে মোটেই দ্বিধা করবে না।

সে বলল, এ তাসটা সব সময়ই আমার হাতে আছে। মন্ত্রী আমাকে চেনে-ঘনিষ্ঠ ভাবেই চেনে-এক সময় কোল্ড হারবার-এ আরও অনেক আহত সৈনিকের সঙ্গে সে ও আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পাশাপাশি শুয়ে কাটিয়েছি; মুখোমুখি দেখাসাক্ষাৎ খুব বেশী না হলেও সেই থেকে দুজনের মধ্যে মনে-মনে অনেক দহরম-মহরম। মনে সাহস আনো সোনা, অবস্থা তো বেশ অনুকূল বলেই মনে হচ্ছে! এই তো এসে পড়েছি, এবার সব দুর্ভাবনার অবসান! অবশ্য দুর্ভাবনার আর কি আছে!

সর্বকালের সব চাইতে ধনী স্বাধীন ও শক্তিমান প্রজাতন্ত্রের প্রতীকচিহ্নটি দরজার গায়ে আঁকা: বৃত্তাকার পাইন কাঠের উপর পাখা মেলেছে ঈগল; তার মাথা ও গলা রয়েছে তারকাখচিত পশ্চাৎপটের উপরে, আর তার নখে ধরা রয়েছে সেকেলে রণসম্ভার; সে দৃশ্য দেখে আলফ্রে ড–এর চোখে জল এল, দেশের জন্য গর্বে ভরে উঠল তার অন্তর, বুকের মধ্যে বেজে উঠল জয় কলাম্বিয়া ধ্বনি, সব ভয় ও দুঃখ দূর হয়ে গেল; কারণ এখানে সে নিরাপদ, নিশ্চিন্তা পৃথিবীর কোন শক্তি এ ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে তার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে না।

খরচ বাঁচাবার জন্য সর্বাপেক্ষা শক্তিমান প্রজাতন্ত্রের ইওরোপীয় দূতাবাসের জন্য নেওয়া হয়েছে নতলায় দেড়খানা ঘর, দূতাবাসের সদস্যদের মধ্যে আছে একজন মন্ত্রী বা রাষ্ট্রদূত যার মাইনে একজন ব্রেকম্যানের সমান, দূতাবাসের একজন সচিব যাকে দেশলাই বেচে ও বাসনপত্র মেরামত করে জীবিকানির্বাহ করতে হয়, একটি ভাড়াটে মেয়ে যাকে দোভাষীর কাজ ও অন্যান্য টুকটাক কাজ করতে হয়; আর আসবাবপত্রের মধ্যে আছে মার্কিন জাহাজের ছবি, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের একখানি প্রতিকৃত, একটা ডেস্ক তিনটে চেয়ার, কেরোসিন-বাতি, একটা বিড়াল, একটা ঘড়ি, আর আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি লেখা একটা পিকদানি।

পথ প্রদর্শকের সঙ্গে দুজন উপরে উঠে গেল। ডেস্কে বসে একজন লোক কি যেন লিখছিল। সে উঠে দাঁড়াল; বিড়ালটা লাফিয়ে নেমে ডেস্কের নীচে ঢুকে গেল; তাদের জায়গা করে দেবার জন্য ভাড়াটে মেয়েটি এক কোণে সরে গেল; সৈনিকরাও বন্দুক ঘাড়ে করে এক কোণে সরে গেল। আলফ্রেড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল; সুখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

মেজর পদস্থ কর্মচারীটির সঙ্গে সাদরে করমর্দন করল, সহজ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সব কথা বুঝিয়ে বলল, তারপর প্রয়োজনীয় পাসপোর্টের আবেদনটি জানাল।

অতিথিদের বসতে বলে কর্মচারীটি বলল: দেখুন, আপনি তো জানেন, আমি এই দূতাবাসের সচিব মাত্র; স্বয়ং মন্ত্রী যখন রাশিয়াতে রয়েছেন তখন আমি পাসপোর্ট মঞ্জুর করতে চাই না। এতে অনেক দায়-দায়িত্ব।

ঠিক আছে, তাকে ডেকে পাঠান।

সচিব হেসে বলল: কথা বলা যত সহজ কাজটা তত সহজ নয়। ছুটি কাটাতে তিনি এখন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

হায় স্কট! মেজর সরবে বলে উঠল।

আলফ্রেড আর্তনাদ করে উঠল; তার মুখ থেকে সব রক্ত মুছে গেল; সে একেবারে ভেঙে পড়ল।সচিব অবাক হয়ে বলল:

এতে হায় স্কট  বলার কি আছে মেজর? প্রিন্স আপনাদের চব্বিশ ঘন্টা সময় দিয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকান; কোন অসুবিধা নেই; এখনও আধ ঘন্টা সময় আছে; ট্রেন আসার সময়ও হয়ে গেছে; পাসপোর্ট ঠিক সময়ে এসে যাবে।

আরে মশায়, খবর আছে, ট্রেনটা তিন ঘন্টা লেটে আসছে। প্রতি মিনিটে ছেলেটার জীবন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আর ত্রিশ মিনিট বাকি! আধ ঘন্টার মধ্যে সে তো মরার সামিল হয়ে মহাকালে মিশে যাবে! ঈশ্বরের দোহাই, পাসপোর্ট আমাদের চাই-ই!

আঃ, আমি জানি, আমি মারা যাব! আর্তনাদ করে ছেলেটি ডেস্কের উপর দুই হাতে মুখ ঢাকল। সচিবের চেহারায় দ্রুত পরিবর্তন। দেখা দিল, তার মুখের প্রশান্তি মিলিয়ে গেল, উত্তেজনায় মুখটা লাল হয়ে উঠল; উঁচু গলায় বলে উঠল: অবস্থা যে কত সাংঘাতিক। তাতো বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি কি করতে পারি? কি পরামর্শই বা দেব?

ধুত্তোর ছাই! পাসপোর্ট টা দিয়ে দিন না!

অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব! ওর সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না; তিন দিন আগে ওর নামও জানতেন না! এ জগতে ওকে সনাক্ত করবার মত কেউ নেই। ও গেছে-ওকে বাঁচাবার কোন পথ নেই!

ছেলেটি আর্তনাদ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, প্রভু, প্রভু, এ পৃথিবীতে আলফুেড প্যারিস-এর আজই শেষ দিন!

সচিবের আরও পরিবর্তন দেখা দিল। করুণা, বিরক্তি ও অসহায়তা প্রকাশ করতে করতে হঠাৎ সে থেমে গেল, তার হাবভাব শান্ত হল; একান্ত নির্বিকার গলায় জিজ্ঞাসা করল, এটা কি তোমার নাম?

যুবকটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল–হ্যাঁ।

তুমি কোথা থেকে আসছ?

ব্রীজপোর্ট।

সচিব মাথা নাড়ল-আবার নাড়ল-নিজের মনেই কি যেন বলল। এক মুহূর্ত পরে:

সেখানেই তোমার জন্ম?

না; নিউ হ্যাভেন-এ।

আ-হা। সচিব মেজরের দিকে তাকাল। তারপর যা বলল তার চাইতে ইঙ্গিত করল বেশী। সৈনিকদের যদি তেষ্টা পেয়ে থাকে তো ওখানে ভষ্কা আছে। মেজর লাফ দিয়ে উঠে গ্লাসে ভক্ষা ভর্তি করে সৈনিকদের দিল। তারাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। জেরার পালা চলতে লাগল।

নিউ হ্যাভেন-এ কত দিন ছিলে?

তেরো বছর বয়স পর্যন্ত। ইয়েল-এ ভর্তি হবার জন্য দুবছর আগে চলে এসেছি।

সেখানে যখন ছিলে, কোন রাস্তায় বাস করতে?

পার্কার স্ট্রীট।

মেজর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সচিবের দিকে তাকাল। সচিব মাথা নাড়ল। মেজর আবার গ্লাসে ভদকা ঢালল।

কত নম্বর?

কোন নম্বর ছিল না।

বালকটি উঠে বসল। এমন সকরুণ দৃষ্টিতে সচিবের দিকে তাকাল যার অর্থ: এমনিতেই তো আমার দুঃখের অন্ত নেই, তার উপর আবার এই সব বোকাবোকা প্রশ্ন করে আমাকে ভোগাচ্ছেন কেন?

সেদিকে নজর না দিয়ে সচিব বলল, বাড়িটা কি রকম ছিল?

ইটের-দোতলা বাড়ি।

একেবারে পথের উপরে?

না, সামনে ছোট উঠোন আছে।

লোহার বেড়া?

না, খুঁটির বেড়া।

বিনা নির্দেশেই মেজর আবার ভদকা ঢালল-একেবারে ভর্তি করে। তার মুখের সজীবতা ফিরে এসেছে।

দরজা দিয়ে ঢুকেই কি দেখতে পাওয়া যায়?

 একটা সংকীর্ণ হল; তার শেষে একটা দরজা, আর আপনার ডান দিকে একটা দরজা।

আর কিছু?

টুপি রাখবার রেক।

ডান দিকের ঘরটা?

বসবার ঘর।

কার্পেট আছে?

হ্যাঁ।

কি রকম কার্পেট?

সেকেলে ধরনের উইলসন।

তাতে কোন ছবি?

হ্যাঁ ঘোড়ার পিঠে বাজপাখি-শিকারী।

মেজর ঘড়িটার দিকে তাকাল-মাত্র ছ মিনিট বাকি! গ্লাসে ভদকা ঢালতে ঢালতে সে একবার সচিবের দিকে, একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। তার চোখে জিজ্ঞাসা। সচিব ঘাড় নাড়ল। মেজর মুহূর্তের জন্য ঘড়িটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ঘড়ির কাটা আধ ঘন্টা পিছিয়ে দিল। তারপর লোকগুলিকে ডবল গ্লাস ভক্কা খাওয়াল।

হল এবং হ্যাট-রেকের পরের ঘরটা কি?

খাবার ঘর।

স্টোভ আছে?

ঝাঁঝরি?

তোমার নিজের লোকেরাই কি বাড়িটার মালিক ছিল?

হ্যাঁ?

এখনও মালিক আছে?

না; ব্রীজপোর্ট–এ চলে যাবার সময়ে বেচে দিয়েছে।

একটু থেমে সচিব বলল, খেলার সঙ্গীদের মধ্যে তোমার কি কোন ডাক নাম ছিল?

যুবকটির বিবর্ণ গালে একটু করে রং লাগছে; সে চোখ নামাল। একটু ইতস্তত করে দুঃখের সঙ্গে বলল, তারা আমাকে মিস্ ন্যান্সি বলে ডাকত।

কি যেন ভেবে নিয়ে সচিব আবার একটা প্রশ্ন খুঁজে বের করল।

খাবার ঘরে কোন অলংকারপাত্র ছিল?

মানে-না।

না? কিছু ছিল না?

মুস্কিল হল! এটা একটু অদ্ভুত নয় কি? ভেবে দেখ!

যুবকটি ভাবতে বসল, আর সচিব উৎকণ্ঠি তভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে বিপন্ন বালকটি বিষণ্ণ চোখ তুলে মাথা নাড়ল।

ভেবে দেখ-ভেবে দেখ! গম্ভীর মুখে কথাগুলি বলে মেজর আবার গ্লাস ভর্তি করল।

সচিব বলল, এবার বল তো, একটা ছবিও কি ছিল না?

নিশ্চয় ছিল। কিন্তু আপনি যে বললেন অলংকারপত্র।

আচ্ছা! ছবিটা সম্পর্কে তোমার বাবা কি বলতেন?

আবার রং ফিরে এল। ছেলেটি নীরব।

কথা বল, সচিব বলল।

কথা বল, চেঁচিয়ে বলতে গিয়ে মেজর অনেকটা ভদকা গ্লাসের বাইরেই ঢেলে ফেলল।

ছেলেটি কোনরকমে বলল, তিনি কি বলতেন সে-সে কথা আমি বলতে পারব না।

সচিব বলল, জলদি! জলদি কর! সময় নষ্ট করো না। নিজের বাড়ি আর মুক্তি, অথবা সাইবেরিয়া আর মৃত্যু-সব নির্ভর করছে তোমার জবাবের উপর।

ও, দয়া করুন! তিনি একজন ধর্মযাজক, আর-

তাতে কি হয়েছে; ওসব কথা থাক, নইলে-

তিনি বলতেন-সে রকম নারকীয়তম দুঃস্বপ্ন তিনি আর কখনও দেখেনি নি!

বেঁচে গেলে! বলেই সচিব তার কলম ও একটা নতুন পাসপোর্ট হাতে নিল। আমি তোমাকে সনাক্ত করছি; সে বাড়িতে আমি নিজে বাস করেছি, আর সে ছবিটাও আমার নিজের হাতে আঁকা!

মেজর চেঁচিয়ে বলল, আহা বাছা আমার, তুমি বেঁচে গেলে; আমার কোলে এস! এই শিল্পীটি কে সৃষ্ট করেছেন বলে আমরা চিরদিন ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব!-অবশ্য যদি সৃষ্টি করে থাকেন।

[১৯০২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *