মৃত্যু-চাকতি

মৃত্যু-চাকতি*
The Death Disk

[*কার্লাইল-এর ‘লেটার্স অ্যাণ্ড ল্পীচেস অব অলিভার ক্রমওয়েল’ গ্রন্থে বর্ণিত একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা গল্পের মূল ভিত্তি। -মার্ক টোয়েন]

০১.

অলিভার ক্রমওয়েল-এর সময়কার কথা। কমনওয়েলথ বাহিনীতে তার সমমর্যাদাসম্পন্ন অফিসারদের মধ্যে কর্ণেল মেফেয়ার ছিল সর্বকনিষ্ঠ। তার বয়স তখন ত্রিশ বছর। বয়সে তরুণ হলেও সে ছিল অভিজ্ঞ সৈনিক; দেহ রোদে-পোড়া ও যুদ্ধ-জর্জর; তার সামরিক জীবন শুরু হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে; অনেক যুদ্ধ সে করেছে; রণক্ষেত্রে শৌর্যের পরিচয় দিয়ে ধাপে ধাপে সামরিক চাকরিতে পদোন্নতি লাভ করেছে, পেরেছে মানুষের প্রশংসা। কিন্তু এখন সে একটা গভীর গোলযোগে পড়েছে; তার সৌভাগ্য-সূর্যের উপর পড়েছে মেঘের ছায়া।

শীতের সন্ধা। বাইরে ঝড় ও অন্ধকার; ভিতরে বিষণ্ণ নীরবতা; কর্ণেল ও তরুণী পত্নী তাদের দুঃখের কথা অনেক বলেছে, সান্ধকালীন পাঠ শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে সন্ধার প্রার্থনা; হাতে আর কোন কাজ নেই; শুধু হাতে হাত ধরে আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা, চিন্তা করা-আর অপেক্ষা করা। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে তাদের হত না; তারা সেটা জানে, সে কথা মনে হতেই তার স্ত্রী শিউরে উঠল।

তাদরে একটি শিশু–আবি, সাত বছর বয়স, তাদের চোখের মণি। রাত্রির বিদায়-চুম্বনের জন্য সে এখনই এসে হাজির হবে; তাই কর্ণেল বলল:

চোখের জল মুছে ফেল; অন্তত ওকে বুঝতে দাও যে আমরা সুখী। যা ঘটতে চলেছে এখনকার মত আমাদেরও সেটা ভুলতে হবে।

তাই করব। আমার বুক ভেঙে যাবে, তবু বুকের মধ্যেই তাকে আটকে রাখব।

আর তিনি যা করেন ভালর জন্যই করেন, করুণাপরবশ হয়েই করেন-এই কথা মনে রেখেই আমাদের ভাগ্য-লিপিকে আমরা মেনে। নেব, ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করব।

আমরা বলব-তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। হ্যাঁ, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে একথা আমি বলতে পারি-যদি অন্তর দিয়েও বলতে পারতাম। আহা, যদি পারতাম! এই যে হাতখানিকে আমি শেষ বারের মত চেপে ধরে চুমো খাব-

শস! ও আসছে!

রাতের পোশাক পরা কোকড়া চুল ছোট মানুষটি দরজায় ভেসে এসে এক দৌড়ে বাবার কাছে ছুটে গেল। বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে সাদরে চুমো খেল-এক, দুই, তিনবার।

ও বাপি তুমি ও রকম ভাবে চুমো খেয়ো না; তুমি আমার সব চুল এলোমেলো করে দিলে!

ওঃ, আমি দুঃখিত, সত্যি দুঃখিত; তুমি আমাকে ক্ষমা করলে তো সোনা?

অবশ্যই করলাম বাপি। কিন্তু তুমি কি দুঃখিত?-দুঃখের ভান করছ না তো? সত্যি-সত্যি দুঃখিত?

বেশ তো, সেটা তুমি নিজেই বিচার কর আবি, দুই হাতে মুখ ঢেকে সে ফুঁপিয়ে কান্নার ভান করল। নিজের সৃষ্টি এই দুঃখজনক দৃশ্য দেখে শিশু টি নিজেই কেঁদে ফেলল; বাবার হাত ধরে টানে টানতে বলল:

না, না বাপি, তুমি কেঁদ না। আমি তোমাকে কাঁদতে বলি নি; আর কখনও বলবও না। দোহাই বাপি, টেনে আঙুলগুলো ফাঁক করবার চেষ্টায় একবার বাবার চোখটা দেখতে পেয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল:আরে, তুমি তো ভারী দুষ্টু বাপি, তুমি তো মোটেই কাঁদছ না! তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ! বেশ, আবি তার মায়ের কাছে চলল; আবিকে তুমি মোট্টে ভালবাস না।

সে নেমে যেতে চাইলেও বাবা তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল: না, তুমি আমার কাছেই থাক সোনা; বাপি দুষ্টুমি করেছে, তা স্বীকার করছে, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছে-হল তো, এবার একটা চুমো দিয়ে তোমার চোখের জলের দাগটা মুছিয়ে দিতে দাও-আবি তার বাপিকে ক্ষমা করুক, আর শান্তি হিসাবে আবি যা বলবে বাপি তাই করব; এই তো সব দাগ মুছে গেছে, এক গুছি চুলও এদিক-ওদিক হয় নি-এখন আবি যা হুকুম করবে।

এই ভাবে মিটমাট হয়ে গেল; মুহূর্তের মধ্যে রোদ উঠল, ঝলমলিয়ে উঠল শিশুর মুখ; বাবার গালে হাত দিয়ে টোকা মারতে মারতে শান্তির নাম করে সে বলল–গল্প! একটা গল্প!

ও কি!

বড়দের নিঃশ্বাস থেমে গেল। তারা কান পাতল। পায়ের শব্দ!বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে আবছা কানে আসছে। কাছে, আরও কাছে-জোরে, আরও জোরে-তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। বড়রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল; বাবা বলল: একটা গল্প, তাই না? মজার গল্প?

না বাপি; ভীষণ গল্প।

বাপি মজার গল্পেই ফিরে যেতে চাইল, কিন্তু আবিও তার দাবীতে অনড়-তাছাড়া, চুক্তিমতে সে যা হুকুম করবে তাই মানতে হবে। কর্নেল গোড়া সৈনিক, কথা যখন দিয়েছে তখন তা রাখতেই হবে। আবি বলল:

বাপি, সব সময়ই মজার গল্প ভাল নয়। নার্স বলে, লোকের সব সময় মজার দিন হয় না। তা কি ঠিক বাপি? নার্স তো তাই বলে।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল; তার চিন্তা আবার বিপদের দিকেই গেল। বাপি শান্ত গলায় বলল: ঠিক কথা সোনা। বিপদ তো আসবেই। সেটা দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি।

তাহলে তাই নিয়ে একটা গল্প বল বাপি-একটা ভীষণ গল্প। যা শুনে আমাদের শরীর কেঁপে উঠবে, মনে হবে বুঝি আমাদের নিয়েই গল্প। মামণি, তুমি আরও ঘন হয়ে বস, আবির একটা হাত ধর, যাতে গল্পটা যদি সত্যি সত্যি বেশী ভীষণ হয় তাহলে ঘন হয়ে বসার জন্য আমরা সকলেই সেটা সহ্য করতে পারব। বাপি, এবার তুমি শুরু করতে পার।

ঠিক আছে। এক সময়ে তিনজন কর্নেল ছিল-

আরে বাস্! কর্নেলদের তো আমি চিনি। খুব সোজা! তুমিই তো কর্নেল। কর্নেলদের পোশাকও চি নি। বলে যাও বাপি।

একটা যুদ্ধে তারা নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বসল।

বড় বড় কথাগুলি শিশুটির কানে বেশ ভালই শোনাল; বিস্ময়ে ও আগ্রহে চোখ তুলে তাকিয়ে সে বলল:

ওটা কি খেতে খুব ভাল বাপি?

বাপ-মা প্রায় হেসে ফেলল; বাবা বলল:

না, ওটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস সোনা। তারা হুকুম অমান্য করেছিল।

ওটা কি-

না; ওটাও খাবার জিনিস নয়। একটা যুদ্ধে হারতে বসে তাদের উপর হুকুম হল, শত্রুপক্ষের একটা শক্ত ঘাঁটির উপর আক্রমণের ভান করতে হবে যাতে কমনওয়েথ বাহিনী পশ্চাদপসরণের একটা সুযোগ পায়; কিন্তু অতি-উৎসাহবশে তারা হুকুমের চাইতে বেশী। করে ফেলল, নকল আক্রমণকে তারা আসল করে তুলল এবং হঠাৎ আঘাত হেনে ঘাঁটি টা দখল করে যুদ্ধ জয় করে ফেলল। তাদের। এই অবাধ্যতায় লর্ড জেনারেল খুব রেগে গেল, তাদের ভূয়সী প্রশংসা করল, এবং বিচারের জন্য তাদের লণ্ডনে পাঠিয়ে দিল।

ইনিই কি মহান সেনাপতি ক্রমওয়েল বাপি?

হ্যাঁ।

আমি তাকে দেখেছি বাপি! তিনি যখন সেজেগুজে তার বড় ঘোড়াটায় চড়ে সসৈন্যে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যান, তখন তাকে। এমন-এমন-দেখ, তাকে ঠিক কেমন দেখায় আমি বলতে পারছি না, তবে দেখে মনে হয় তিনি মোটেই খুসি নন, আর সৈন্যরা তাকে ভয় করে; কিন্তু আমি তাকে ভয় করি না, কারণ তিনি আমার দিকে সে ভাবে তাকান নি।

আঃ, সোনার মুখে যেন খই ফুট ছে! তারপর, কর্নেলরা বন্দী হয়ে লণ্ডনে এল; তাদের বিশ্বাস করে শেষ বারের মত পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি দেওয়া হল-

ও কি!

তারা কান পাতল। আবার পায়ের শব্দ। আবার সে শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল। মুখের বিবর্ণতা আড়াল করবার জন্য মা তার স্বামীর ঘাড়ে মাথাটা রাখল।

আজ সকালেই তারা এসে পৌঁচেছে।

শিশুটির চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।

ও কি বাকি! এটা কি সত্যিকারের গল্প?

হ্যাঁ সোনা।

বাঃ, কী মজা! সেই তো ভাল। বলে যাও বাপি। ও কি মামণি, তুমি কাঁদছ?

আমার কথা ছেড়ে দাও-আমি ভাবছিলাম–ভাবছিলাম সেই অসহায় পরিবারগুলির কথা।

কিন্তু তুমি কেঁদ না মামণি; সব ঠিক হয়ে যাবে-তুমি দেখো; গল্পে সব সময়ই তাই হয়। বাপি, সেইখানটা বল তো, যেখানে তারা সুখে-শান্তিতে বাস করতে লাগল; তাহলে মামণি আর কাদবে না। বলে যাও বাপি।

বাড়িতে পাঠাবার আগে তাদের টাওয়ার-এ নিয়ে যাওয়া হল।

টাওয়ার আমি চিনি! এখান থেকেই দেখা যায়। তুমি বলে যাও।

এ অবস্থায় যতটা পারি ভালভাবেই তো বলছি। টাওয়ার-এ সামরিক আদালত একঘণ্টা ধরে তাদের বিচার করল, তাদের দোষী সাব্যস্ত করল, এবং গুলি করে হত্যার আদেশ দিল।

মেরে ফেলবে বাপি?

হ্যাঁ।  

উঃ, কী দুষ্টু! মামণি, তুমি আবার কাঁদছ? কেঁদ না মামণি; দেখ না, এখনই গল্পের ভাল জায়গাটার চলে যাব। বাপি, মার জন্য একটু তাড়াতাড়ি বল তো; তুমি মোটেই তাড়াতাড়ি গল্প বলতে পার না।

আমি জানি আমি পারি না; তার কারণ হয় তো এই যে গল্প বলতে বলতে থেমে গিয়ে আমি চিন্তা করতে বসে যাই।

কিন্তু তা করো না বাপি; সোজা বলে যাবে।

তাই হবে। কর্নেল তিনজন-

তাদের তুমি চেনো বাপি?

হাঁ সোনা।

আহা, আমিও যদি চিনতাম! কর্নেলদের আমি ভালবাসি। তারা কি আমাকে চুমো খেতে দেবে? তোমার কি মনে হয়?

জবাব দিতে গিয়ে কর্নেলের গলাটা একটু কেঁপে উঠল, একজন নিশ্চয়ই দেবে সোনা! এই নাও-তার বদলে আমাকে চুমো দাও।

এই নাও বাপি-আর এই দুটো চুমো বাকি দুজনের জন্য। আমার বিশ্বাস, তারাও আমার চুমো নেবে; আমি তাদের বলব, আমার বাপিও একজন কর্নেল, আর খুব সাহসী; তোমরা যা করেছ সেও তাই করত; কাজেই অন্যরা যাই বলুক তোমরা যা করেছ সেটা অন্যায় হতে পারে না, আর সেজন্য তোমরা এতটুকু লজ্জিত হয়ো না। তাহলেই তারা আমাকে চুমো খেতে দেবে-দেবে না বাপি?

ঈশ্বর জানেন, নিশ্চয়ই দেবে মাগো!

মামণি! ওঃ, মামণি, ও রকম করে না। সুখের জায়গাটা এল বলে। বলে যাও বাপি।

তারপর, কেউ কেউ দুঃখিত হল-তারা সকলেই দুঃখিত হল; আমি সেই সামরিক আদালতের কথা বলছি; তারা লর্ড জেনারেলের কাছে গিয়ে বলল, তাদের কর্তব্য তারা করেছে, কিন্তু এখন তাদের প্রার্থনা যে দুজনকে রেহাই দেওয়া হোক, আর শুধু তৃতীয় জনকে গুলি করা হোক। তারা ভাবল, সৈনিকদের সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরার জন্য একজনই যথেষ্ট। কিন্তু লর্ড জেনারেল অত্যন্ত কড়া মানুষ: এই বলে সে তাদের তিরস্কার করল যে তারা নিজেদের কর্তব্য পালন করে এখন তাকে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করে তার সৈনিকের মর্যাদাকে কলংকিত করতে চাইছে। কিন্তু তারা জবাব দিল, তার মত উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকলে এবং ক্ষমাপ্রদর্শনের মহৎ অধিকার তাদের হাতে থাকলে তারা নিজেরা যা করত তার বেশী কিছু তাকে করতে তারা বলছে না। কথাটা তার মনে লাগল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগল; তার মুখের কিছুটা কঠোরতা যেন মিলিয়ে গেল। তাদের অপেক্ষা করতে বলে লর্ড জেনারেল তার নিভৃত কক্ষে চলে গেল প্রার্থনায় বসে ঈশ্বরের নির্দেশ লাভের আশায়। ফিরে এসে বলল: তাদের ভাগ্য-পরীক্ষা করতে হবে। তাতেই ব্যাপারটার ফয়সালা হবে এবং তাদের মধ্যে দুজন বেঁচে থাকবে।

তারা কি তা করেছিল বাপি, করেছিল? আর কে মরবে বলে স্থির হল-আহা, বেচারি!

না। তারা অস্বীকার করল।

ভাগ্য-পরীক্ষা করল না?

না।

কেন?

তারা বলল, মারাত্মক শুটিটা যে টেনে নেবে সে তো নিজের হাতে নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দেবে, আর যে নামেই ডাকা হোক সেটা তো আত্মহত্যা। তারা বলল, তারা খৃস্টান, আর বাইবল-এ মানুষকে আত্মনাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই কথা জানিয়ে দিয়ে তারা বলল, তারা প্রস্তুত-আদালতের দণ্ডাদেশ কার্যে পরিণত করা হোক।

তার অর্থ কি বাপি?

তাদের-তাদের গুলি করা হবে।

ও কি!

বাতাস? না। থপ-থপ-থপ-খট খট খট–আবার

দরজা খোল-লর্ড জেনারেলের নামে বলছি!

কী মজা বাপি, সৈন্যরা এসেছে!–সৈন্যদের আমি ভালবাসি। আমি তাদের দরজা খুলে দেব বাপি। আমি যাচ্ছি।

লাফ দিয়ে নেমে সে ছুটে গিয়ে আনন্দে চীৎকার করে বলল: ভিতরে এস! এস! বাপি, পদাতিক বাহিনীকে আমি চিনি!

সৈন্যদল মার্চ করে ঢুকল, কাঁধে কাধ মিলিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল; ভাগ্যহীন কর্নেলও খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সৌজন্য-বিনিময় করল; পাশে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী, অন্তরের বেদনায় অবনতমুখী, কিন্তু বাইরে তার কোন প্রকাশ নেই; ছোট শিশু টি চোখ নাচিয়ে সব কিছু দেখছে।…

বাবা, মা ও শিশু র দীর্ঘ আলিঙ্গন; তারপরই ধ্বনিত হল নির্দেশ: চুল টাওয়ার-আগে বাড়! সামরিক পদক্ষেপে ও মর্যাদার সঙ্গে কর্নেল বাড়ি থেকে মার্চ করে বের হল; তার পিছনে পদাতিক বাহিনী; দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

ওঃ মামণি, শেষটা কেমন ভাল হল! আমি তো বলেছি তাই হয়। সকলে টাওয়ার-এ গেল। তিনি তাদের দেখবেন! তিনি-

আমার কোলে এস; বেচারি কিছুই জানে না!..

.

০২.

পরদিন সকালে শোকাহত মা আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না; ডাক্তার ও নার্সরা তাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে ফি সৃফি স্। করে কথা বলছে; আবিকে সে ঘরে থাকতে দেওয়া হয় নি; তাকে খেলা করতে বলা হয়েছে-মামণি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গরম জামা পরে শিশুটি বাইরে গিয়ে রাস্তায় খেলতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল, এ রকম একটা অবস্থায় তার বাপিকে কিছু না জানিয়ে । টাওয়ার-এ রেখে দেওয়া হয়েছে-এ কাজটা যেমন বিস্ময়কর তেমনই অন্যায়। এর প্রতিকার হওয়া দরকার; সে নিজেই তার চেষ্টা করবে।

এক ঘণ্টা পরে সামরিক আদালতে লর্ড জেনারেলের কাছে হাজির করা হল। টেবিলের উপর কনুই দুটো রেখে সে গম্ভীর মুখে খাড়া। হয়ে বসে আছে; দেখেই বোঝা যায় কোন কিছু শুনতে উদগ্রীব। মুখপাত্রটি জানাল: আমরা তাদের পুনর্বিবেচনা করতে বলেছি; মিনতি করেছি; কিন্তু তারা অবিচল। ভাগ্য-পরীক্ষা তারা করবে না। তারা মরতে রাজী, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করবে না।

প্রোটেক্টর-এর মুখে অন্ধকার নেমে এল, কিন্তু কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল: তাদের সকলের মরা হবে না; তাদের হয়ে ভাগ্যপরীক্ষা করা হবে। আদালতের মুখ কৃতজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাদের ডেকে পাঠাও। ও পাশের ঘরে নিয়ে যাও। পিছমোড়া করে হাত বেঁধে দেয়ালের দিকে মুখ করে তাদের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দাও। এ সব হয়ে গেলে আমাকে যেন খবর দেওয়া হয়।

সকলে চলে গেলে সে বসে পড়ল। চাকরকে ডে কে হুকুম দিল: বাইরে যাও; সর্ব প্রথম যে ছোট শিশুকে যেতে দেখবে তাকে আমার কাছে নিয়ে এস।

লোকটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পরক্ষণেই ফিরে এল-সে আবিকে হাত ধরে নিয়ে এসেছে: আবির জামায় বরফের গুড়ো লেগে। আছে। মেয়েটি সোজা রাষ্ট্রে-প্রধানের কাছে চলে গেল। যে দুর্জয় মানুষটির নাম মাত্র শুনলেই পৃথিবীর সব বড় বড় মানুষ ও রাষ্ট্র থর থর করে কাপে, মেয়েটি তার কোলের উপর চড়ে বলল:

আমি আপনাকে চিনি স্যার আপনি তো লর্ড সেনাপতি; আমি আপনকে দেখেছি; আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন গিয়েছিলেন তখন দেখেছি। সকলেই ভয় পেয়েছিল; কিন্তু আমি ভয় পাই নি, আপনি তো চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকান নি; আপনার মনে পড়ে? আমার পরনে ছিল একটা লাল ফুক-সামনের দিকে নীল কাজ করা। আপনার মনে নেই?

সে হাসি দেখে প্রোটেক্টর-এর মুখের গম্ভীর রেখাগুলি নরম হয়ে এল। কি জবাব দেবে বুঝতে না পেরে বলল:

তাই বুঝি; দাঁড়াও, ভেবে দেখছি-আমি-

বাড়ির ঠিক সামনেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম-মানে আমাদের বাড়ির।

দেখ সোনা, আমার লজ্জিত হওয়া উচিত, কিন্তু কি জান-

শিশু টি তিরস্কারের সুরে বাধা দিল।

বুঝেছি, আপনার মনে নেই। কিন্তু আমি তো আপনাকে ভুলি নি।

দেখ, আমি লজ্জিত; কিন্তু তোমাকে আমি আর কোন দিন ভুলব না। কথা দিলাম। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না? চিরদিনের জন্য আমার বন্ধু হয়ে থাকবে না?

হ্যাঁ, নিশ্চয় থাকব, যদিও আমি বুঝি না কি করে সেদিনের কথা আপনি ভুলে গিয়েছিলাম; আপনার নিশ্চয় খুব ভোলা মন; আমারও কখনও কখনও ও রকম হয়; যাহোক, আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম, কারণ আমার ধারণা আপনি ভাল হয়ে থাকতে চান, ভাল কাজ করতে চান; আমার ধারণা আপনি খুব দয়ালু-কিন্তু আপনি আমাকে আরও ভাল করে জড়িয়ে ধরুন, ঠিক আমার বাপির মত করে-বড় ডো ঠাণ্ডা লাগছে।

ছোট্ট নতুন বন্ধুটি আমার, তোমার মনের মত করেই তো তোমাকে জড়িয়ে ধরতে হবে, কারণ এখন থেকে তুমিই যে হবে আমার পুরনো বন্ধু তোমাকে দেখে আমার ছোট্ট মেয়েটি র কথা মনে পড়ছে।-এখন আর সে ছোট টি নেই-কিন্তু একদিন সে তোমার মতই মিষ্টি আর সুন্দরী ছিল। সেও তোমার মতই আমার কোলের মধ্যে শুয়ে থাকত; তোমার মতই সে আমার সব শ্রান্তি-ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়ে আমার মনকে শান্তিতে ভরে দিত; আমরা ছিলাম কমরেড, সমান বয়সী, খেলার সাথী। সে যেন কত যুগ আগের কথা; সে সুখের আকাশ কোথায় মিলিয়ে গেছে; অথচ আজ তুমি আবার সেই আকাশকে ফিরিয়ে এনেছ;-সারা ইংলণ্ডের বোঝাটা তুমি ঘাড়ে তুলে নিয়েছ, আর আমি পেয়েছি ছুটি; তাই তো তোমাকে জানাই এই ভারবাহী মানুষটার আশীর্বাদ!

আপনি কি তাকে খুব, খুব ভালবাসতেন?

সে হুকুম করত আর আমি তামিল করতাম-এর থেকেই বুঝে নাও!

আপনি খুব ভাল। আমাকে একবার চুমো খাবেন না?

নিশ্চয় খাব-আর সেটাকে সৌভাগ্য বলেই মনে করব। এই নাও-এটি তোমার জন্য; আরে এই নাও-এটি তার জন্য। তুমি এর জন্য

অনুরোধ না করে হুকুম ও করতে পারতে, কারণ তুমি তো তার হয়েই এসেছ। তুমি যা হুকুম করবে, আমি তাই পালন করব।

এই পদোন্নতিতে মেয়েটি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল-আর তখনই তার কানে কিসের যেন শব্দ ভেসে এল; অনেক মানুষের একসঙ্গে চলার শব্দ।

সৈনিক! সৈনকি! লর্ড জেনারেল, আবি সৈনিকদের দেখতে চায়!

নিশ্চয় দেখবে; কিন্তু একটু অপেক্ষা কর; তোমাকে দিয়ে আমার একটা কাজ আছে।

একজন অফিসার ঘরে ঢুকে নীচু হয়ে অভিবাদন করে বলল, তারা এসেছে হুজুর। আবার অভিবাদন করে সে চলে গেল।

জাতির প্রধান কর্তা সিল করবার মোমের তিনটি চকিতি আবির হাতে দিল-দুটো সাদা, আর একটা উজ্জল লাল-কারণ এই চাকতিটা যার ভাগ্যে পড়বে সেই কর্নেলের জন্য বয়ে আনবে মৃত্যু।

আঃ, কী সুন্দর লাল চাকতিটা! এগুলো কি আমার?

না, এগুলো অন্যদের জন্য। ওই পর্দার কোণাটা তুলে ধর, তার ওপারে একটা খোলা দরজা আছে; দরজাটা পার হলেই দেখতে পাবে তিনটি লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে; তাদের পিঠ তোমার দিকে, আর প্রত্যেকেরই হাত পিছন দিকে এমনভাবে রাখা যে প্রত্যেকেরই একটা হাত বাটি র মত খোলা। প্রত্যেকের খোলা হাতের মধ্যে একটি করে এই চাকতি রেখে তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে।

আবি পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরে প্রোটে কর একা। সে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে লাগল: সংকট কালে এই শুভ চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছে নিশ্চয় তাঁর কাছ থেকে যিনি শরণাপন্ন বিপন্ন মানুষের কাছে সর্বদাই উপস্থিত হন সাহাস্যের হাত বাড়িয়ে। তিনি জানেন কার ভাগ্যে কি আছে, আর তাঁর ইচ্ছানুরূপ কাজ যাতে হয় সেজন্য তিনিই পাঠিয়েছেন এই নিষ্পাপ দূতটি কে। অন্যের ভুল হতে পারে, কিন্তু তাঁর কখনও ভুল হয় না। আশ্চর্য তাঁর রীতি-পদ্ধতি; তাঁর পবিত্র নাম সার্থক হোক!

পিছনের পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট পরীটি মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে থেকে জাগ্রত কৌতূহলের সঙ্গে সেই মৃত্যু-কক্ষের আসবাবপত্র এবং সৈনিক, অফিসার ও বন্দীদের কাঠ-কাঠ চেহারাগুলো দেখল; তার মুখখানি খুসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; নিজের মনেই বলল:আরে, এদের একজন তো আমার বাপি! তার পিঠ আমি চিনি। সব চাইতে সুন্দটা তো বাপিই পাবে! খুসি পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনটি খোলা হাতের মধ্যে চাকতি তিনটি রেখে দিল; তারপর তার বাবার বগলের নীচ দিয়ে উঁকি মেরে হাসি-ভরা মুখটা তুলে চেঁচিয়ে বলে উঠল;

বাপি! বাপি! তাকিয়ে দেখ তুমি কি পেয়েছ। ওটা আমিই তোমাকে দিয়েছি। মারাত্মক উপহারের দিকে এক নজর তাকিয়েই সে নতজানু হয়ে বসে ভালবাসা ও করুণায় বিদ্ধ হয়ে তার ছোট্ট নিষ্পাপ হত্যাকারিণীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। সৈনিক, অফিসার ও মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদ্বয় এই প্রচণ্ড শোকাবহ ঘটনার সামনে মুহূর্তের জন্য নিশ্চল জড়বৎ দাঁড়িয়ে রইল; পরক্ষণেই এই করুণ দৃশ্য তাদের অন্তরকে আঘাত করল, তাদের চোখ জলে ভরে এল, কোন রকম লজ্জাবোধ না করে তারা কাঁদতে লাগল। কয়েক মিনিটের জন্য ঘরের মধ্যে নেমে এল গভীর ও সশ্রদ্ধ নীরবতা; তারপর রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারটি অনিচ্ছুক পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গিয়ে বন্দীর কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বলল:

আমি দুঃখিত স্যার, কিন্তু এটা কর্তব্যের নির্দেশ।

শিশু টি বলল, কর্তব্যের কি নির্দেশ?

একে নিয়ে যেতে হবে। আমি দুঃখিত।

নিয়ে যাবেন? কোথায়?

নিয়ে যাব-যাব-ঈশ্বর আমার সহায় হোন!-নিয়ে যাব দুর্গের অন্য এক অংশে।

না, তা পারবেন না। আমার মামণি অসুস্থ, আমি বাপিকে বাড়িতে নিয়ে যাব।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটি বাবার পিঠে চেপে দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল।এবার আবি প্রস্তুত-চলে এস বাপি।

হায় মাগো, আমি তো যেতে পারব নাঃ ওদের সঙ্গে আমাকে যেতেই হবে।

লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে মেয়েটি সবিস্ময়ে চারদিকে তাকাল। তারপর এক দৌড়ে অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাটিতে পা ঠুকে বিক্ষুব্ধ গলায় বলল:

আপনাকে তো বলেছি আমার মামণি অসুস্থ; সে কথা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। ওকে ছেড়ে দিন-ছেড়ে দিতেই হবে।

হায় অবুঝ বালিকা, ছেড়ে দিতে পারলে আমিও খুসি হতাম। কিন্তু ওকে নিয়ে আমাকে যেতেই হবে। অ্যাটেনশন, রক্ষীগণ! সারিতে দাঁড়াও!…বন্দুক তোল!

…বিদ্যুৎচমকের মত আবি সেখানে থেকে চলে গেল। মুহূর্তকাল পরে লর্ড প্রোটেক্টরের হাত ধরে টানতে টানতে ফিরে এল। এই আশচর্য দৃশ্য থেকে উপস্থিত সকলে টান-টান হয়ে দাঁড়াল, অফিসাররা অভিবাদন করল, সৈনিকরা অস্ত্র নামাল।

ওদের থামতে বলুন স্যার! আমার মামণি অসুস্থ, বাপিকে তার চাই, সে কথা ওদের বলেছি, কিন্তু ওরা আমার কথায় না দিয়ে বাপিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

লর্ড জেনারেল বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে পড়ল।

তোমার বাপি? ওই লোকটি তোমার বাপি?

নিশ্চয়, ওইতো আমার বাপি। আমি তাকে এত ভালবাসি, আর এমন সুন্দর লাল চাকতিটা দেব অন্য একজনকে? কিছুতেই না।

প্রোটেক্টর-এর মুখে বেদনার ছায়া নামল। সে বলল:

আঃ, ঈশ্বর আমার সহায় হোন! শয়তানের প্ররোচনায় মানুষের পক্ষে যা নিষ্ঠুরতম কাজ তাই আমি করেছি-কিন্তু এখন তো কোন উপায় নেই, উপায় নেই! আমি এখন কি করি!

রুক্ষ মুখের উপর একটা নরম আলো নেমে এল; লর্ড জেনারেল সেই ক্ষুদে শক্তিময়ীর মাথায় হাত রেখে বলল:কোন কিছু না ভেবে যে প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছি সেটাই আমাকে রক্ষা করেছে; সে জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আর তাঁরই অনুপ্রেরণায় সেই ভুলে-যাওয়া প্রতিশ্রুতি তুমি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছ, হে অতুলনীয়া শিশু, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। অফিসার, এই বালিকার হুকুম তামিল করুন-আমার মুখের কথাই সে বলেছে। বন্দীকে ক্ষমা করা হল; তাকে মুক্ত করে দিন!

[১৯০১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *