সে কি জীবিত না মৃত?

সে কি জীবিত না মৃত?
Is He Living or Is He Dead?

১৮৯২ সালের মার্চ মাসটা আমি রিভিয়েরা-র মেন্টেন-এ কাটাচ্ছিলাম। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরবর্তী মন্টি কালো এবং নাইস-এ সর্বসাধারণের জন্য যে সব সুখ-সুবিধা আছে, ব্যক্তিগতভাবে সেই সব সুখ-সুবিধা অবসর যাপনের এই জায়গাটাতেও পাওয়া যায়। তার অর্থ, এখানে আছে প্রচুর রোদ, স্বাস্থ্যপ্রদ হাওয়া, আর উজ্জ্বল নীল সমুদ্র; অথচ মানুষের হৈ-হট্টগোল ও নানা রকম পোশাকের পারিপাট্য এখানে চোখে পড়ে না। মেন্টোন শান্ত, সরল বিশ্রামস্থল; ধনী ও জাঁকজমকবিলাসীরা সেখানে যায় না। আমি বলতে চাই, ধনী লোকরা সাধারণতই সেখানে যায় না। মাঝে মাঝে এক আধজন ধনী মানুষ এসে পড়ে। সম্প্রতি সেই রকম একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। কিছুটা গোপন রাখবার জন্য তাকে আমি স্মিথ বলে ডাকবল।

একদিন হোটেল দ্য আংলে-র দ্বিতীয় প্রাতরাশের সময় সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল:

জলদি! যে লোকটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তাকে লক্ষ্য করুন। তার সব বিবরণ টুকে নিন।

কেন?

লোকটিকে জানেন?

হ্যাঁ। আপনি আসবার আগে থেকেই তিনি এখানে আছেন। লোকে বলে, তিনি লায়ন্স থেকে আগত একজন বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত, খুব ধনী রেশমীবস্ত্র প্রস্তুতকারক। আমার ধারণা, লোকটি এই পৃথিবীতে একাবের একা, কারণ সব সময়ই তাকে বিষণ্ণ ও স্বপ্নদর্শী বলে মনে হয়, আর কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। তার নাম থিয়োফিল ম্যানান।

ভেবেছিলাম, এবার স্মিথ খুলে বলবে মঁসিয়ে ম্যাগনান-এর প্রতি তার এই অতি-আগ্রহের কারণ কি; কিন্তু তার পরিবর্তে সে যেন একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে ডুবে গেল এবং কয়েক মিনিটের জন্য আমার কাছ থেকে এবং বাকি পৃথিবীর কাছ থেকেও হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝে চিন্তার সুবিধা হবে বলে চকচকে সাদা চুলের মধ্যে আঙুল বুলোতে লাগল, আর এদিকে প্রাতরাশ ক্রমেই ঠাণ্ডা হতে লাগল। অবশেষে বলল:

না, একেবারেই হারিয়ে গেছে; কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

কি মনে করতে পারছেন না?

হান্স এণ্ডারসন-এর একটি ছোট্ট সুন্দর গল্প। কিন্তু একেবারেই ভুলে মেরে দিয়েছি। কিছুটা অংশ এই রকম: একটি শিশুর ছিল খাঁচার বন্দী একটা পাখি। পাখিটাকে সে ভালবাসে, কিন্তু কিছু না ভেবেচিন্তেই তাকে অবহেলা করে। পাখিটা গান গায়, কিন্তু কেউ তা শোনে না। কেউ সেদিকে মন দেয় না; যথাসময়ে পাখিটা ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর হয়, তার গান বিষণ্ণ ও দুর্বল হতে হতে একসময় থেমে যায়-পাখিটা মারা যায়। শিশুটি আসে, দুঃখে তার মন কাতর হয়; তারপর চোখের জলে শোক করতে করতে সে তার সঙ্গীদের ডেকে এনে যথাযোগ্য জাঁকজমক ও দুঃখের সঙ্গে পাখিটাকে কবর দেয়। বেচারিরা জানতেও পারে না যে জীবিত কালে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে ও আয়েসে-আরামে রাখতে চেষ্টা না করে কবিদের না খাইয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তারপর তাদের সৎকারে ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজে যথেষ্ট টাকা পয়সা খরচ করবার এই অপকর্মটি শুধু শিশু রাই যে করে তা নয়। এখন-

কিন্তু এইখানে আমাদের আলোচনায় বাধা পড়ল। সেদিন সন্ধা দশটা নাগাদ স্মিথের সঙ্গে দেখা হতেই সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল একসঙ্গে ধুমধাম ও গরম স্কচ–হুঁইস্কি খাবে বলে। ঘরটা খুব আরামদায়ক। ভাল চেয়ার, উজ্জ্বল বাতি, ভাল অলিভ কাঠের খোলা আগুন। তার উপর সোনায় সোহাগার মত বাইরে ভেসে আসছে সমুদ্রের বিক্ষিপ্ত তরঙ্গগর্জন। দ্বিতীয় দফা সুচ ও অনেক রকম অলস ও স্তানির পরে স্মিথ বলল:

এতক্ষণে আমরা দুজনই প্রস্তুত-আমি একটি আচ র্য ইতিহাস বলতে, আর আপনি সে ইতিহাস শুনতে। অনেক বছর ধরে কথাটা গোপন রয়েছে-আমার ও অপর তিনজনের গোপন কথা; এবার আমি সে গোপনতা ভাঙতে চলেছি। আপনি বেশ আরাম পাচ্ছেন তো?

সম্পূর্ণ। বলে যান।

সে যা বলে গেল এই তার মর্মার্থ:

অনেক বছর আগে আমি ছিলাম একজন তরুণ শিল্পী-খুবই তরুণ-এখানে কিছু ছবি আঁকি, ওখানে কিছু ছবি আঁকি, এই ভাবে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে আরও দুজন ফরাসী তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল; তারাও আমার মত ঐ একই কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমরা ছিলাম যেমন সুখী তেমনই গরীব, অথবা যেমন গরীব তেমনই সুখী-যেমন ইচ্ছা কথাটাকে সাজিয়ে নিতে পারেন। ক্ল ফেরে ও কার্ল বুলাজার-এই হল ছেলে দুটির নাম; বড়ই ভাল ছেলে দুটি; দারিদ্রকে দেখে মনের সুখে হাসতে পারে; সুখে-দুঃখে একই মনোভাব। বজায় রাখতে পারে।

শেষ পর্যন্ত ব্রেতোঁ গ্রামে পৌঁছে আমরা গভীর গাড্ডায় পড়ে গেলাম, আর সেখানেই আমাদেরই মত গরীব আর একটি শিল্পী আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কজনকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচাল–ফ্রাঁসোয়া মিলেৎ

কী! বিখ্যাত ফ্রাঁসোয়া মিলে?

বিখ্যাত? তখন সে আমাদের চাইতে বেশী বিখ্যাত ছিল না। এমন কি নিজের গ্রামেও তার কোন খ্যাতি ছিল না। সে এতই গরীব ছিল যে শালগম ছাড়া আর কিছুই আমাদের খাওয়াতে পারত না; এমন কি মাঝে মাঝে শালগমেরও অভাব ঘটত। আমরা চারজন হলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু অত্যুৎসাহী বন্ধু অত্যাগসহন বন্ধু। একসঙ্গে সাধ্যমত ছবি আঁকতে লাগলাম; ছবি স্কুপের পর প জমতে লাগল; কিন্তু কদাচিৎ তার একখানা হাতছাড়া হত। একসঙ্গে বেশ কাট ছিল, কিন্তু মাঝে মাঝে দুর্দশা একেবারে চরমে উঠত।

দুই বৎসরাধিক কাল এইভাবে চলল। অবশেষে একদিন ক্ল বলল:

দেখ ভাইরা, এতদিনে আমরা শেষ প্রান্তে পৌঁচে ছি। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?-একেবারে শেষ প্রান্তে। সকলেই আঘাত করতে উদ্যত-আমাদের বিরুদ্ধে সকলে একজোট হয়েছে। সারা গ্রাম ঘুরে এসেছি; যা বললাম তাই ঠিক। পাই-পয়সা পর্যন্ত সব ধার মিটিয়ে দিলে তারা আমাদের আর এক সেন্টিমও ধার দেবে না।

আমরা বড়ই ঘাবড়ে গেলাম। প্রত্যেকের মুখই হতাশায় সাদা হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, আমাদের অবস্থা বড়ই সঙ্কট পূর্ণ। অনেকক্ষণ সকলেই চুপচাপ। অবশেষে মিলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:

আমার তো মাথায় কিছুই আসছে না-কিছু না। তোমরা কিছু বাতুলাও বাছাধনরা।

কোন সাড়া নেই; অবশ্য বিষণ্ণ নীরবতাকে যদি সাড়া বলা যায় তো আলাদা কথা। কার্ল উঠে দাঁড়াল; কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করল; তারপর বলল:

বড়ই লজ্জার কথা! এই ক্যানভাসগুলোর দিকে তাকাও, স্তূপের পর স্তূপ এমন সব ভাল ছবি যা ইওরোপের যে কেউ এঁকে থাকে-তা

সে যেই হোক না কেন। হ্যাঁ, ভ্রমণরত অনেক অপরিচিত লোকই এ কথা বলেছে-অথবা এ ধরনের কথাই বলেছে।

কিন্তু একটা ছবিও কেউ কেনে নি। মিলে বলল।

তা না কিনুক, এ কথা তারা বলেছে; আর কথাটাও সত্যি। ঐ যে তোমার দেবদূত, ওটার দিকে তাকাও। কেউ কি বলবে যে-

আঃ, কার্ল-আমার ঐ দেবদূত-এর দাম উঠেছিল মাত্র পাঁচ ফু।

কখন?

কে দিতে চেয়েছিল?

সে কোথায়?

সেটা নাও নি কেন?

থাম-সকলে এক সঙ্গে কথা বলো না। ভেবেছিলাম সে আরও বেশী দেবে-আমার নিশ্চিত বিশ্বাসটা হয়েছিল-তাই আমি চেয়েছিলাম।

আচ্ছা-আর তারপর?,

সে বলল আবার আসবে।

বজ্র ও বিদ্যুৎ! কেন ফ্রাঁসোয়া-

আহা, আমি জানি-আমি জানি। ওটা ভুল হয়েছিল। আর আমিও তখন বোকা ছিলাম। বাপুরা, আমি তো ভাল বুঝেই কাজটা করেছিলাম। সে কথা তোমরা নিশ্চয় স্বীকার করবে; আর আমি-

নিশ্চয়, নিশ্চয়, আমরাও তা জানি; তোমার মনটা তো ভালই। কিন্তু দেখ, আবার যেন বোকামি করো না।

আমি? এখন যদি কেউ এসে ওটার জন্য একটা বাঁধাকপিও দিতে চায়-তখন দেখো।

একটা বাঁধাকপি! আঃ, ও নাম করো না-আমার জিভে জল আসছে। আরও ছোট খাট জিনিসের কথা বল।

কার্ল বলল, বাছারা, এই ছবিগুলোর কি গুণের কমতি আছে? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

না।

এগুলো কি খুব উঁচুদরের ছবি নয়? এ প্রশ্নের উত্তর দাও।

হ্যাঁ।

এতই বড় ও উঁচু দরের জিনিস যে, কোন বিখ্যাত লোকের নাম এদের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারলে প্রচণ্ড দামে এ গুলি বিক্রি হয়ে যাবে। তাই নয় কি?

নিশ্চয়ই তাই। কেউ এতে সন্দেহ করবে না।

কিন্তু আমি ঠাট্টা করছি না-সত্যি তাই নয় কি?

সে কি, নিশ্চয় তাই-আমরাও ঠাট্টা করছি না। কিন্তু তাতে কি হল? তাতে আমাদের কি আসে-যায়?

আসে-যায় কমরেডগণ-এই সব ছবির সঙ্গে আমরা একটি বিখ্যাত নাম জুড়ে দেব।

আমাদের আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কার্ল-এর দিকে তাকাল। এটা আবার কি রকমের ধাঁধা? একটা বিখ্যাত নাম ধার পাওয়া যাবে কোথায়? আর সেটা ধার করবেই বা কে?

কার্ল বসে পড়ে বলল:

এবার আমি একটা খুব গুরুতর প্রস্তাব করতে যাচ্ছি। আমি মনে করি, ভিক্ষাবৃত্তির হাত থেকে আমাদের বাঁচ বার এটাই একমাত্র উপায়; আমি বিশ্বাস করি, এটাই তার নিশ্চিত উপায়। মানবেতিহাসের বহুসংখ্যক দীর্ঘপ্রতিষ্ঠিত ঘটনার উপরেই আমার এই মতামত প্রতিষ্ঠিত। আমি বিশ্বাস করি, এই পরিকল্পনা আমাদের সকলকেই ধনী করে তুলবে।

ধনী! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে!

না, মাথা খারাপ হয় নি।

হ্যাঁ, হয়েছে-তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কাকে তুমি ধনী বল?

প্রতিটি ছবির দাম এক লাখ ফ্রাঁ।

সত্যি ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি জানতাম।

হ্যাঁ, তাই হয়েছে। কার্ল, এত দুঃখ-কষ্ট তুমি সইতে পারছ না, আর-

কার্ল, একটা বড়ি খেয়ে সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়।

আগে একটা ব্যাণ্ডেজ বেঁধে নাও-তার মাথায় ব্যাণ্ডেজ, আর তার পরে

না, ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ওর পায়ে; আমি লক্ষ্য করেছি-বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই ওর মাথার গোলমাল চলছে।

অত্যন্ত কঠোর কন্ঠে মিলে বলে উঠল, চুপ কর! বাছাকে তার বক্তব্য বলতে দাও। বলহে বাপু, তোমার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বল কার্ল। ব্যাপারটা কি?

আচ্ছা, তাহলে প্রথমেই ভূমিকাস্বরূপ বলি, মানুষের ইতিহাসের একটা সত্যকে তোমরা লক্ষ্য কর: অনেক মহৎ শিল্পীর সৃষ্টিকর্মই তার অনাহারে মৃত্যু ঘট বার আগে কখনও স্বীকৃতি লাভ করে নি। এটা এত বার বার ঘটেছে যে এর উপর ভিত্তি করে আমি একটা সাধারণ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে চাই। নিয়মটা হল: আমরা ভাগ্য পরীক্ষা করব-আমাদের একজনকে অবশ্যই মরতে হবে।

কথাগুলি এতই শান্ত ও অপ্রত্যাশিতভাবে বলা হল যে আমরা প্রায় লাফিয়ে উঠতে ভুলে গেলাম। তারপর শুরু হল সমস্বরে নানা রকম উপদেশ বর্ষণ-ডাক্তারী উপদেশ-কার্লের মাথার ব্যামোকে সারাতে হবে। কিন্তু কার্ল সেই হৈ-চৈ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য-ধরে

অপেক্ষা করে তারপর আবার পরিকল্পনার কথা পাড়ল:

হ্যাঁ, অন্য সবাইকে এবং নিজেকে বাঁচাতে আমাদের একজনকে মরতে হবেই। এ নিয়ে ভাগ্য-পরীক্ষা করা হবে। যার নাম উঠবে সেই হবে বিখ্যাত শিল্পী, আর আমরা সকলে হব ধনী। চুপ কর, এখন চুপ কর-আমি যা বলছি, সব জেনে শুনেই বলছি। এটা হচ্ছে আমার কথা। যাকে মরতে হবে আগামী তিন মাস ধরে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ছবি এঁকে যাবে, যতদূর সম্ভব ছবির পূর্জি বাড়াবে-শুধু ছবিই নয়, না! রেখা চিত্র, স্টাডি, স্টাডি র, প্রত্যেকটির উপর ডজনখানেক ব্রাশের টান-সেগুলো অবশ্যই অর্থহীন হবে, কিন্তু ছবিতে স্বাক্ষরিত তার নামের একটা বৈশিষ্ট্য তাতে থাকবে; দিনে পঞ্চাশটা আঁকতে হবে, প্রত্যেকটাতেই সহজবোধ্য কিছু বৈশিষ্ট্য বা রীতি-পদ্ধতির প্রকাশ থাকবে-তোমরা তো জান সে সবেরই তো আসল বিক্রি-কোন মহান শিল্পীর মৃত্যুর পরে সেগুলিই তো অবিশ্বাস্য রকমের মোটা দামে বিক্রি হয়ে পৃথিবীর সব যাদুঘরে সংগৃহীত হয়ে থাকে। সে রকম টন-টন শিল্পকর্ম আমাদের হাতে মজুত থাকবে! ইতিমধ্যে আমরা বাকি কজন মুমূর্ষকে সেবা করেত, প্যারিসে ও অন্য জায়গায় ছবির ক্রেতাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকব-বুঝতেই তো পারছ, আসন্ন ঘটনার জন্য প্রস্তুত হওয়া আর কি; তারপর সব কিছু ঠিক ঠিক মত ব্যবস্থা হয়ে গেলেই মৃত্যুর খবরটা সর্বত্র ছড়িয়ে দেব এবং ঘটা করে একটা শোকযাত্রার আয়োজন করব। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে তো?

ন-না; অন্তত সবটা-

সবটা বুঝতে পার নি, এই তো? আসলে কেউ ই মারা যাচ্ছে না; শুধু নাম পাল্টে উধাও হয়ে যাবে; একটা নকল শবাধারকে আমরা কবর দেব, তার জন্য কাঁদব, আর সমস্ত জগৎ আমাদের সহায় হবে। আর আমি-

তাকে কথা শেষ করতেও দেওয়া হল না। সকলেই সমর্থনসূচক উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়ল; লাফিয়ে উঠে ঘরমর নেচে-কুঁদে একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। ঘন্টার পর ঘন্টা এই মহান পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কথা বললাম:এমন কি ক্ষুধাতৃষ্ণা পর্যন্ত ভুলে গেলাম। শেষ পর্যন্ত সব কিছুরই সন্তোষজনক ব্যবস্থা হয়ে যাবার পরে ভাগ্য পরীক্ষা করা হল এবং তাতে মিলে নির্বাচিত হল-অর্থাৎ তথাকথিত মৃত্যুর জন্য নির্বাচিত হল।

পরদিন খুব সকালে প্রাতরাশ সেরেই আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম-অবশ্যই পায়ে হেঁটে। প্রত্যেকের সঙ্গে মিলেৎ-এর ড জনখানেক ছবি-উদ্দেশ্য সেগুলির বিক্রর ব্যবস্থা করা। কার্ল-এর লক্ষ্য প্যারিস-আসন্ন মহাদিবস উপলক্ষে মিলেৎ-এর খ্যাতিকে গড়ে তোলার কাজ সে শুরু করবে সেখানে। ক্লদ ও আমি আলাদাভাবে ফ্রান্সের দূর দূর অঞ্চলকে বেছে নিলাম।

কত সহজে ও আরামে আমরা কাজ শুরু করতে পেরেছিলাম সে কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কাজ শুরু করবার আগে দুদিন একটানা হাঁটলাম। তারপর একটা বড় শহরের উপকণ্ঠস্থ একটা ভিলার স্কেচ করতে শুরু করলাম-কারণ দোতলার বারান্দায় বাড়ির মালিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। ব্যাপারটা দেখতে মালিক নেমে এল-আমি জানতাম সে আসবে। তার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলবার জন্য আমি দ্রুত কাজ করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে প্রশংসার বাণী বেরিয়ে আসতে লাগল। ক্রমে একান্ত উৎসাহের সঙ্গে সে জানাল যে আমি একজন মহৎ শিল্পী!

ব্রাশটা রেখে দিয়ে ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মিলেং-এর আঁকা একখানা ছবি বের করে এক কোণে লেখা নামটার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সগর্বে বললাম:

এ স্বাক্ষরটা আপনি নিশ্চয় দেখেছেন? দেখুন, তার কাছেই আমার শিক্ষা-দীক্ষা! কাজেই নিজের কাজটা তো আমার ভালভাবেই জানা উচিত।

লোকটি অপরাধীর মত বিব্রত মুখে তাকিয়ে চুপ করে রইল। আমি দুঃখের সঙ্গে বললাম:

আপনি ফ্রাঁসোয়া মিলেৎ-এর স্বাক্ষর চেনেন না-এ কথা নিশ্চয়ই বলবেন না!

স্বাক্ষরটা সে সত্যি চিনতে না। কিন্তু এমন সকৃতজ্ঞ লোক বুঝি আর হয় না। সে বলে উঠল:

না, না! আরে, এটা অবশ্যই মিলে ৎ-এর স্বাক্ষর। জানি না এতক্ষণ কোন্ কথা ভাবছিলাম। এ স্বাক্ষর তো অবশ্যই আমার চেনা।

তারপরেই সে ছবিটা কিনতে চাইল; কিন্তু আমি বললাম, ধনী না হলেও অতটা গরীব আমি নই। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আট শ ফ্র। দামে ছবিটা তাকে দিয়ে দিলাম।

আট শ!

হাঁ। মিলেৎ হয় তো একটা শূকরমাংসের চপের বদলেই ওটা বেচে দিত। হ্যাঁ, ঐ ছোট ছবিটার জন্য আমি পেলাম আট শ ফু। আহা, আজ যদি আশি হাজার দিয়েও ছবিটা ফেরৎ পেতাম। কিন্তু সে দিন চলে গেছে, লোকটির বাড়ির একটা সুন্দর ছবি এঁকে দশ ফুঁ দামে সেটা তাকে দিতে চাইলাম, কিন্তু যেহেতু আমি এত বড় একজন গুরুর ছাত্র সেজন্য অত অল্প দামে সে ওটা নিতে রাজী হল না; ফলে ওটার জন্য পেলাম একশ ফু। সঙ্গে সঙ্গে আট শ ফুঁ মিলেৎ-কে পাঠিয়ে দিয়ে পরদিন আবার যাত্রাশুরু করলাম।

কিন্তু এবার আর পায়ে হেঁটে নয়-না। গাড়িতে চেপে। সেই থেকে গাড়ি চেপেই চলাফেরা করি। প্রতিদিন একখানি মাত্র ছবি বিক্রি করি; কখনও দুখানা বিক্রির চেষ্টাও করি না। ক্রেতাকে সব সময়ই বলি:

ফ্রাসোয়া মিলেৎ-এর ছবি বিক্রি করাই তো আমার পক্ষে বোকামি, কারণ লোকটি আর তিন মাসও বাঁচবে না, এবং সে মারা যাবার পরে এ ছবি তো টাকা দিলেও আর মিলবে না।

এই ছোট ঘটনাকে যতদূর সম্ভব প্রচার করে বেড়াতে লাগলাম এবং এই ভাবে সেই পরম লগ্নের জন্য জগদ্বাসীকে প্রস্তুত করে তুললাম।

ছবিগুলো বিক্রি করবার সব কৃতিত্বই আমার-কারণ এই ফন্দিটা আমিই বের করেছি। শেষের যে রাতে আমরা অভিযানের পরিকল্পনা করিছিলাম সেই সময়েই এই প্রস্তাবটা আমি সকলের সামনে রাখি এবং আমরা তিনজনই একমত হই যে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করবার আগে এই ব্যবস্থাটাকে ভাল রকম পরীক্ষা করে দেখা হবে। কিন্তু তিন জনের বেলায়ই ফন্দিটা খুব কাজে লাগল। আমাকে পায়ে হাঁটতে হয়েছে মাত্র দুদিন; ক্লদ ও হেঁটেছে মাত্র দুদিন-বাড়ির এত কাছে মিলে কে খ্যাতিমান করে তোলার ব্যাপারে আমাদের দুজনের মনেই যথেষ্ট ভয় ছিল; কিন্তু কার্ল হেঁটে ছিল মাত্র অর্ধেক দিন-একটা বিবেকহীন রাস্কেল-আর তার পর থেকেই সে চলাফেরা করেছে ডিউকের মত।

মাঝে মাঝেই কোন গ্রাম্য সংবাদপত্রের সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত; তার সহায়তায় কাগজে একটা সংবাদও ছাপার ব্যবস্থা হয়ে যেত; সে সংবাদে একজন নতুন শিল্পীকে আবিষ্মরের কথা থাকত না, থাকত ফ্রাঁসোয়া মিলেৎ-এর সর্বজনপরিচিতির ঘোষণা; কোন সংবাদেই তার কোন প্রশংসার কথা লেখা হত না, লেখা হত এই শিল্পগু রুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে মাত্র একটি কথা-কথনও আশার কথা, কখনও নৈরাশ্যের, কিন্তু সব সময়ই তার সঙ্গে মেশানো থাকত চরম অবস্থার জন্য আতংকের কথা।

সংবাদপত্রের সেই সব অনুচ্ছেদগুলিকে দাগ দিয়ে আমরা পাঠিয়ে দিতাম মিলেৎ-এর ছবি যারা আমাদের কাছ থেকে কিনেছে তাদের ঠিকানায়।

কার্ল অচিরেই প্যারিস উপস্থিত হয়ে বেশ ভাল হাতে কাজ গুছিয়ে ফেলল। সংবাদদাতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে মিলে ৎ-এর স্বাস্থ্যের সংবাদ ইংলণ্ডে, সারা ইওরোপে, আমেরিকায়, পৃথিবীর সর্বত্র প্রচারের ব্যবস্থা করে ফেলল।

কাজের শুরু থেকে ছয় সপ্তাহের শেষে আমরা তিনজন প্যারিসে মিলিত হয়ে কাজে বিরতি টানলাম এবং মিলে ৎ-এর কাছে নতুন করে ছবি পাঠানো বন্ধ করবার নির্দেশ দিলাম। বাজার বেশ চড়েছে; একেবারে সরগরম অবস্থা; তাই ভাবলাম, আর অপেক্ষা না করে অবিলম্বে মোক্ষম আঘাত হানা দরকার। তাই মিলেৎকে লিখে দেওয়া হল, সে যেন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শু কিয়ে হাড়সর্বস্ব হয়ে যায়, কারণ আমরা চাই সে যেন দশ দিনের মধ্যেই মারা যেতে পারে।

তারপর টাকাকড়ি গুণে দেখলাম, তিনজনে মিলে আশিখানা ছোট ছবি ও স্টাড়ি বিক্রি করেছি এবং তার জন্য পেয়েছি ঊনসত্তর হাজার ফ্ল। সর্বশেষ ছবিখানি বিক্রি করেছে কার্ল। এবং মোক্ষম দাও মেরেছে। দেবদূত ছবিটা সে বেচে ছে বাইশ শ ফু। দামে।

মিলেৎ-এর বাজার-দর তখন কতখানি উঠেছে!-অবশ্য তখনও আমরা বুঝতে পারি নি যে এমন একটা দিন আসছে যখন ঐ ছবিটা পাবার জন্য সারা ফ্রান্সে লড়াই লেগে যাবে এবং কোন অপরিচিত লোক লঞ্চাশ হাজার নগদ দিয়ে ওটা কিনে নেবে।

কাজ-কর্ম গুটিয়ে ফেলবার আগে সেদিন রাতে আমরা শ্যাম্পেন সহযোগে নৈশভোজন সমাধা করলাম। পরদিন ক্লদ ও আমি জিনিসপত্র বেঁধেছেদে শেষের কটা দিন মিলেৎ-এর সেবাশুশ্রূষা করার জন্য চলে গেলাম। অহেতুক কৌতূহলী লোকজনদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে প্যারিসে কার্ল-এর কাছে দৈনিক বুলেটিন পাঠাতে লাগলাম, যাতে বিভিন্ন মহাদেশের সংবাদপত্রের মারফ ৎ অপেক্ষমান পৃথিবীর কাছে সংবাদটা পৌঁছে দেওয়া যায়। অবশেষে এল শেষের সেই দুঃখের দিনটা;

সৎকার-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য কার্ল ও যথাসময়ে এসে হাজির হল।

সেই বিরাট সৎকার-অনুষ্ঠানের কথা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। পৃথিবী জুড়ে সে কী হৈ-চৈ না পড়ে গিয়েছিল! দুই পৃথিবীর সব বড় বড় লোক এসে তাদের শোক নিবেদন করেছিল। আমরা চার অত্যগসহন বন্ধুই শবাধার বয়ে নিয়ে গেলাম; অন্য কাউ কে হাত লাগাতে দিলাম না। সেটা তো করতেই হবে, কারণ শবাধারের ভিতরে একটা মোমের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই ছিল না; কাজেই অন্য যে কোন শবাধারবাহকই এত কম ওজনের শবাধার দেখলে সন্দেহ প্রকাশ করে বসত। হ্যাঁ, সেই পুরনো চারজন-যারা একদা দুঃখের দিনে স্বেচ্ছায় একসঙ্গ সে দুঃখকে ভাগ করে ভোগ করেছিল, আর আজ যে দুঃখের দিনে স্বেচ্ছায় একসঙ্গে সে দুঃখকে ভাগ করে ভোগ করেছিল, আর আজ যে দুঃখ চিরদিনের মত আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে-সেই পুরনো চারজনই শবাধারটা বহন-

কোন্ চারজন?

আমরা চারজন-কারণ মিলেৎ নিজের শবাধার বহন করেছিল। বুঝতেই পারছেন, সে ছিল ছদ্মবেশে-একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের পরিচয়ে।

আশ্চর্য!

আশ্চর্য হলেও সত্য। আচ্ছা, তারপর থেকেই ছবির দাম কী ভাবে বাড়তে লাগল সে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। আর টাকা? অত টাকা নিয়ে কি করব তাই ভেবে পেতাম না। আজ প্যারিসে এক ভদ্রলোকের নিজেরই আছে সত্তরখানা মিলেট–এর আঁকা ছবি। সে আমাদের দিয়েছিল কুড়ি লক্ষ ফ্লা। আর যে ছটি সপ্তাহ আমরা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলমা তখন মিলে ঘরে বসে যে ঝুড়ি-ঝুড়ি স্থে ও স্টাডি করেছিল, আজকাল আমরা সেগুলোকে কি দামে যে বিক্রি করি-অবশ্য যখনই কোন একটা আমরা হাতছাড়া করতে রাজী হই-সে কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।

এক আশ্চর্য ইতিহাস-একেবারেই আশ্চর্য!

হ্যাঁ-তা বলতে পারেন।

আর মিলেৎ-এর কি হল?

কথাটা গোপন রাখতে পারবেন তো?

ত পারব।

আজ খাবার ঘরে যে লোকটির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম তার কথা মনে আছে? সেই হল ফ্রাঁসোয়া মিলেত।

মহান-

স্কট! হ্যাঁ। এই একটি ক্ষেত্রে জনসাধারণ একটি প্রতিভাকে না খেয়ে মরতে দেয় নি, আর যে পুরঙ্কুর ছিল তার প্রাপ্য তাই দিয়ে

ভরিয়েছে অন্যের পকেট। অন্ততঃ এই গায়ক পাখিটির বেলায় তার মধুর সঙ্গীতে কান না দিয়ে পরে এক বিরাট সৎকার-অনুষ্ঠানে। জাঁকজমক করে তার দাম দেওয়া হয় নি। আর সে ব্যবস্থাটা আমরাই করেছিলাম।

[১৮৯৩]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *