ভ্রমণসঙ্গীর ভূমিকায়

ভ্রমণসঙ্গীর ভূমিকায়
 Playing Courier

এমন দিন তো আসবেই যখন আমাদের যেতে হবে আই-লে-বাই থেকে জেনেভায় এবং সেখান থেকে অনেকগুলি বিশৃংখল একদিনের পথ পেরিয়ে ব্যাভেরিয়ার বেরুথ-এ। আমার মত এ রকম একটা বড় যাত্রীদলের দেখাশুনা করবার জন্য আমাকে একজন ভ্রমণ-সঙ্গী তো অবশ্যই নিতে হবে।

কিন্তু আমাকে দীর্ঘসূত্রতায় পেয়ে বসল। সময় কাটতে লাগল। অবশেষে হঠাৎ একদিন আমার চৈতন্য হল যে আমাদের যাত্রা আসন্ন এবং কোন ভ্রমণ-সঙ্গী যোগাড় হয় নি। তখন একটা বোকার মত কাজ করে বসলাম, অবশ্য তখন এতটা বুঝি নি। ভাবলাম-প্রথম দিকটা কোন রকম সাহায্য ছাড়াই চালিয়ে নেব-আর তাই করলাম।

চারজনের দলকে নিয়ে নিজেই আই থেকে জেনেভা পৌঁছলাম। আড়াই ঘণ্টার দূরত্ব, আর গাড়ি বদলের কোন ব্যাপার ছিল না। কোন রকম দুর্ঘটনাই ঘটল না; শুধু একটা চামড়ার ব্যাগ ও কিছু টুকিটাকি জিনিস প্ল্যাটফর্মে ফেলে যাওয়া ছাড়া; অবশ্য তাকে তো আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সে রকম তো হামেশাই ঘটে। কাজেই বেরথ পর্যন্ত সারাটা পথ আমিই দলকে নিয়ে যেতে রাজী হলাম।

এটাই হল ভুল, যদিও তখন তা মনে হয় নি। এমন অনেক ব্যাপার আছে যার কথা আমি ভাবিই নিঃ ১, কয়েক সপ্তাহ আগে যে দুজনকে জেনেভার বোডিং হাউসে রেখে গিয়েছিলাম তাদের এনে হোটেলে তুলতে হবে: ২, বড় জাহাজ-ঘাটায় যারা ট্রাংক জমা রাখে তাদের জানাতে হবে, সেখানে রেখে আসা আমাদের সাতটা ট্রাংক হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে এবং হোটেলের ছোট ঘরে স্তূপ করে রাখা সাতটা ট্রাংক নিয়ে যেতে হবে: ৩, আমাকে খুঁজে বের করতে হবে ইওরোপের কোন্ অঞ্চলে বেরুথ অবস্থিত এবং সেখানকার জন্য সাতখানা রেলের টিকিট কিনতে হবে: ৪, নেদারল্যাণ্ডে জনৈক বন্ধুর কাছে টেলিগ্রাম করতে হবে: ৫, এখন বিকেল দুটো; আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে এবং রাতের প্রথম ট্রেনটা ধরতে হবে, আর শয়নব্যবস্থাযুক্ত টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে; ৬, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে।

আমার মনে হল, শয়ন-ব্যবস্থাযুক্ত গাড়ির টিকিট টাই সব চাইতে জরুরী; কাজেই নিশ্চিত হবার জন্য স্টেশনে গেলাম; হোটেলের পিয়নরা সব সময় কাজের লোক হয় না। দিনটা খুব গরম; গাড়িতে যাওয়াই আমার উচিত ছিল; কিন্তু ভাবলাম যে হেঁটে গেলে কিছু অর্থের সাশ্রয় হবে। তা কিন্তু হল না, কারণ আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলে দূরত্বটা তিনগুণ বাড়িয়ে ফেললাম। টিকিট চাইতেই তারা জানতে চাইল আমি কোন্ পথে যেতে চাই; তাতেই আমি গোলমালে পড়ে গেলাম, আর মাথাও ঘুরে গেল। পথের হদিস আমি কিছুই জানি না, আর পথ যে দুটো হতে পারে সে ধারণাও আমার ছিল না; কাজেই ফিরে গিয়ে মানচিত্র দেখে পথ ঠিক করে তারপর আবার ফিরে আসাই ভাল বলে মনে হল।

এবার একটা গাড়ি নিলাম। কিন্তু হোটেলে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই মনে পড়ল সিগারেট ফুরিয়ে গেছে; কাজেই ভাবলাম, মনে থাকতে থাকতেই কিছু সিগারেট নিয়ে আসাই ভাল। মোড়েই সিগারেটের দোকান, তাই গাড়ির কোন দরকারই নেই। কোচুয়ানকে একটু অপেক্ষা করতে বলে গেলাম। টেলিগ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে এবং কি লেখা হবে সেটা মনে মনে ঠিক করতে গিয়ে। সিগারেট ও গাড়ির কথা কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সমানে হাঁটতে লাগলাম। টেলিগ্রামটা হোটেলের লোক দিয়েই করাব ভেবেছিলাম, কিন্তু যেহেতু ডাকঘরটা তখন আর বেশী দূরে ছিল না তাই ভাবলাম নিজেই করে যাই। কিন্তু যত কাছে ভেবেছিলাম আসলে তা নয়। শেষ পর্যন্ত ডাকঘরে পৌঁছে টেলিগ্রামটা লিখে করণিকের হাতে দিলাম। করণিকটি রুক্ষদর্শন, অস্থিরচিত্ত মানুষ; এমন গড়গড় করে ফরাসী ভাষায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল যে সে সব কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে আবার আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু একজন ইংরেজ ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জানাল, টে লিগ্রামটা কোথায় পাঠাতে হবে তাই সে জানতে চাইছে। তাকে কিছু বলতে পারলাম না, কারণ টেলিগ্রামটা আমার নয়; তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, দলেন একজন লোকের হয়ে আমি টেলিগ্রামটা করছি মাত্র। কিন্তু ঠিকানা না পেলে করণিক কিছুতেই শান্ত হল না; তখন আমি বললাম, সে যদি একান্তই ঠিকানাটা চায় তাহলে আমি ফিরে গিয়ে সেটা নিয়ে আসতে পারি।

যা হোক, ভাবলাম প্রথমে গিয়ে লোক দুটিকে নিয়ে আসি, কারণ সব কাজই শৃংখলার সঙ্গে পর পর করা উচিত, এবং এক সঙ্গে একটা কাজ করাই ভাল। তখন মনে পড়ে গেল, ওদিকে আর একটা গাড়ি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার টাকা ধ্বংস করছে; কাজেই আর একটা গাড়ি ডে কে কোচ য়ানকে বললাম, হোটেলে গিয়ে সেই গাড়িটাকে ডেকে নিয়ে এসে আমি না আসা পর্যন্ত যেন ডাকঘরেই অপেক্ষা করে।

গরমের মধ্যে অনেকটা পথ হেঁটে তবে লোক দুটির কাছে পৌঁছলাম। সঙ্গে অনেক মোটাঘাট থাকায় তারা আমার সঙ্গে আসতে পারল না, কারণ তাদের একটা গাড়ি দরকার। একটা গাড়ি ডাকতে বেরিয়ে গেলাম। কোন গাড়ি পাবার আগেই এক সময় দেখলাম, বড় জাহাজঘাটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি-অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল-তাই ভাবলাম, আর কয়েক পা এগিয়ে ট্রাংকগুলোর ব্যবস্থা । করে গেলে তো অনেক সময় বেঁচে যাবে। প্রায় মাইল খানেক হেঁটে ও বড় জাহাজঘাটার দেখা পেলাম না, কিন্তু পেলাম একটা চুরুটের দোকান; তখনই চুরুটের কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম, বেরুথ পর্যন্ত যখন যাচ্ছি তখন তো পথে অনেক চুরুট দরকার। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আমি কোন্ পথে যাচ্ছি। বললাম, আমি জানি না। জুরিখ ও অন্য আরও অনেকগুলি জায়গার নাম করে সে জানাল, সেই পথ দিয়ে যাওয়াই ভাল। সে আবার জানাল, রেল-কর্তৃপক্ষ তাকে যে বাটা দিয়ে থাকে সেটা বাদ দিয়েই সে প্রতি টি কিট বাইশ ডলার হিসাবে আমাকে সাতখানা দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রু টিকিট দিতে পারে। প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চড়ে চড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাজেই তার কাছ থেকেই টিকিট কিনলাম।

ক্রমে ন্যাচারেল অ্যান্ড কোং-এর ও দাম-ঘর পেয়ে গেলাম; তাদের বললাম, আমাদের সাতটা ট্রাংক হোটেলে পাঠিয়ে দিয়ে যেন ছোট ঘরটায় ডাই করে রেখে দেয়। মনে হল, সব কথাগুলো টেলিগ্রাম করা হল না, কিন্তু ওর চাইতে বেশী কিছু আমার মাথায় এল না।

তারপর ব্যাংকটা দেখতে পেয়ে কিছু টাকা চাইলাম, কিন্তু আমার প্রত্যয়পত্রটা কোথায় যেন ফেলে রেখে আসায় টাকা তুলতে পারলাম না। মনে পড়ল, যে টেবিলে টে লিগ্রামটা লিখেছি নিশ্চয় সেখানেই ফেলে এসেছি; কাজেই একটা গাড়ি নিয়ে ডাকঘরে ছুট লাম;উপরে উঠে গেলে তারা বলল, একটা প্রত্যয়পত্র টেবিলের উপর ছিল বটে, কিন্তু এখন সেটা পুলিশ কর্তৃপক্ষের হাতে এবং আমাকেই সেখানে গিয়ে প্রমাণ দাখিল করে তবে সেটা নিতে হবে। তারা একটা ছেলেকে আমার সঙ্গে দিল; আবার সেই একই পথে ফিরে গিয়ে মাইল দুই হেঁটে তবে সেখানে পৌঁছলাম; তারপরই গাড়ি দুটোর কথা আমার মনে পড়ে গেল; ছেলেটি কে বলে দিলাম, ডাকঘরে ফিরে গিয়ে সে যেন গাড়ি দুটোকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। তখন রাত হয়ে গেছে; মেয়র খেতে গেছে। ভাবলাম, আমিও খেয়ে আসি, কিন্তু ভারপ্রাপ্তকর্মচারীটি অন্য রকম ভাবায় আমি থেকেই গেলাম। মেয়র ঘরে ঢু কল সাড়ে দশটায়, কিন্তু এসেই বলল, এত রাতে আর কিছু করা যাবে না-আমি যেন পরদিন সকাল ৯-৩০-এ আসি। অফিসারটি আমাকে সারা রাত আটকে রাখতে চাইল; বলল, আমি একটি সন্দেহভাজন লোক, সম্ভবত প্রত্যয়পত্রটি আমার কাছে নেই, এবং প্রত্যয়পত্র কাকে বলে তাই আমি জানি না, কিন্তু প্রত্যয়পত্রের আসল মালিককে ওটা ফেলে যেতে দেখেই জিনিসটা হাতাতে চাইছি, কারণ আমার প্রকৃতিই নাকি এমন যে মূল্যবান হোক আর নাই হোক যা পাওয়া যায় তাই আমি হাতিয়ে নিতে চাই। কিন্তু মেয়র জানাল যে সে আমার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু দেখতে পাচ্ছে না, আমিএকটি সাধারণ মানুষ, শুধু একটু মনভোলা এই যা। কাজেই মেয়র আমাকে ছেড়ে দিল, আর আমিও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনটে গাড়ি নিয়ে স্বস্থানে ফিরে গেলাম।

যেহেতু আমি তখন একেবারে হাড়-পরিশ্রান্ত, এবং ভেবেচিন্তে কোন রকম জবাব দেবার মত মনের অবস্থাও আমার নেই, তাই ভাবলাম যে এত রাতে আর অভিযাত্রী দল-কে বিরক্ত করে কাজ নেই, কারণ আমি জানতাম যে হলের অপর প্রান্তেই একটা খালি ঘর আছে; কিন্তু সেখানে আমারআর পৌঁছনো হল না, কারণ আমার জন্য গভীর উদ্বেগবশত আমার উপর কড়া নজর রাখা হয়েছিল। পরপর চারটে চেয়ারে অভিযাত্রীদল খাড়া বসেছিল-শাল প্রভৃতি সব কিছুই তাদের গায়ে চড়ানো, আর ঝুলি-ঝোলা ও পথনির্দেশিকা কোলের উপর জড়ো করা। চার ঘণ্টা ধরে তারা ঐ একভাবে বসে আছে আর বোতলের পর বোতল চালিয়েছে। সত্যি, তারা অপেক্ষা করেই ছিল-আমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। বুঝতে পারলাম, একটা সুপরিকল্পিত আকস্মিক অথচ চমৎকার কৌশল ছাড়া এই লৌহকঠিন সীমান্তকে ভেঙে নিজের পথ করে নেওয়ার আর কোন উপায় নেই; সুতরাং আমার টুপিটাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুঁড়ে দিয়ে লাফ-ঝাঁপ করে সেদিকে এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে বললাম:

হা-হা-হা, আমি এসেছি-এসেছি বঁধু হে!

কিন্তু সব একেবারে নিশ্চুপ। একটুকু সাড়াশব্দ হল না। তবে আমি চালিয়েই গেলাম; তা ছাড়া কিছু তো করবার ছিল না, কারণ যেটুকু আত্মবিশ্বাস আমার ছিল ততক্ষণে এই মারাত্মক বাধার সামনে তাও কার্যত নিঃশেষ হয়ে গেছে।

মন যতই ভারী থাকুক তবু আমি হাসিখুসি হতে চেষ্টা করলাম। হাল্কা হাসি-তামাসা দিয়ে ওদের হৃদয়কে ছুতে চেষ্টা করলাম, ওদের মুখের তিক্ততার ভাবকে নরম করতে চাইলাম; চাইলাম এই বিশ্রী পরিস্থিতিটাকে একটা খুসির মেজাজ ছড়িয়ে দিতে; কিন্তু আমার ব্যবস্থাটা সুপরিকল্পিত হয় নি। পরিবেশটা তার উপযুক্ত নয়। কারও মুখে একটু করো হাসি ফুঁ ট ল না; বিরক্ত-কুঞ্চিত মুখগুলির একটা রেখাও নরম হল না; ঐ সব বাচ্ছন্ন চোখের জমাট বরফ আমি এতটুকু গলাতে পারলাম না। আর একটা খুসির হাওয়া বহাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু অভিযাত্রী দলের কর্তা মাঝ পথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল:

কোথায় ছিলেন?

কথার ভঙ্গীতেই বুঝলাম, সোজাসুজি কাজের কথায় যাওয়া চাই। তাই আমার ভ্রমণ-কাহিনী শুরু করে দিলাম। কিন্তু তাতেও কথার মাঝ খানেই বাধা।

আর দুজন কোথায়? তাদের জন্য আমাদের উদ্বেগের সীমা নেই।

ওঃ, তারা ভাল আছেন। একটা গাড়ি নিয়ে যাবার কথা ছিল। এখনই সেখানে যাচ্ছি, আর-

বসে পড়ুন! আপনার কি খেয়াল নেই যে এখন এগারোটা বাজে? তাদের কোথায় ছেড়ে এসেছেন?

বোর্ডিং হাউসে।

সঙ্গে নিয়ে এলেন না কেন?

কারণ তাদের ঝোলাঝুলি গুলো বয়ে আনা যায় না। তাই ভাবলাম-

ভাবলেন! ওসব ভাবনা-চিন্তা ছাড়ুন। বোডিং-হাউসটা এখান থেকে দুমাইলেন পথ। আপনি কি গাড়ি না নিয়েই গিয়েছিলেন?

আমি-মানে, ইচ্ছেটা তা ছিল না, তবে পাকেচক্রে ঘটে গেল।

কি করে ঘটল?

আমি ছিলাম ডাকঘরে; সেখানেই মনে পড়ল, এখানে একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছি;তাই খরচ বাঁচাবার জন্য আর একটা গাড়িকে পাঠালাম-

কোথায় পাঠালেন?

এখন ঠিক মনে পড়েছে না; তবে যতদূর মনে হয়, নতুন গাড়িটা এসে হোটেল থেকেই যাতে পুরনো গাড়িটাকে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয় তার ব্যবস্থা করতে।

তাতে লাভটা কি হত?

লাভ কি হত? কেন, তাতে খরচ টা কমত;কমত না কি?

তার জায়গায় নতুন গাড়িটা ভাড়া করে ধরে রেখে খরচ কমত?

কোন কথা বললাম না।

নতুন গাড়িটাকে আপনার কাছেই ফিরে যেতে বললেন না কেন?

ওহো, তাই তো করেছিলাম। এবার মনে পড়ছে। হ্যাঁ, তাই করেছিলাম। মনে পড়েছে, আমি যখন-

আহা, তাহলে সেটা আপনার কাছে ফিরে যায় নি কেন?

ডাকঘরে? গিয়েছিল তো।

তাহলে বোর্ডি–হাউসে আপনি হেঁটে গেলেন কেন?

আমি-আমি ঠিক মনে করতে পারছি না কি ঘটেছিল। ও, হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে। নেদারল্যাণ্ডস্-এ পাঠাবার জন্য টেলিগ্রামটা লিখেছিলাম এবং-

তবু ভাল যে একটা কাজ করেছেন! ওটাও যদি না পাঠাতেন-কি হল! ওভাবে অকাচ্ছেন কেন! আপনি আমার দৃষ্টিকে এড়াতে চাইছেন। ঐ টেলিগ্রামটা খুবই জরুরী-ওটা আপনি পাঠান নি!

পাঠাই নি তা তো বলি নি।

বলবার দরকার হয় না। হা ভগবান, টেলিগ্রামটা যে ভাবেই হোক পাঠানো উচিত ছিল। কেন পাঠান নি?

দেখুন এত কাজ ছিল, এত কিছু ভাববার ছিল। আমি-মানে ওখানকার লোকগুলো আবার ভারি কড়া, আমি টেলিগ্রামটা লিখবার পরে-

খুব হয়েছে, ও সব কথা রাখুন:কৈফিয়তে তো কাজটা হবে না-না জানি আমাদের সম্পর্কে সে কি ভাববে?

আহা, ঠিক আছে, ঠিক আছে; সে ভাববে যে টেলিগ্রামটা আমরা হোটেলের লোকদের দিয়েছিলাম, আর তারাই-

ঠিকই তো! তাই বা করলেন না কেন? সেটাই তো বুদ্ধিমানের মত কাজ হত।

তা ঠিক। কিন্তু তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আমাকে এ ব্যাপারে নিশচত হতে হবে, ব্যাংকে যেতে হবে, কিছু টাকা তুলতে হবে।

দেখুন, এত সব ভাবতে পারার জন্য নিশ্চয় আপনার কিছুটা বাহাদুরি আছে, আর আপনার প্রতি আমি কঠোরও হতে চাই না;তবু আপনি নিশ্চয় শিকার করবেন যে আপনি আমাদের সকলকেই যথেষ্ট বিপদে ফেলেছেন, এবং তার সবটাই কিছু অনিবার্য ছিল না। কত টাকা তুলেছেন?

দেখুন, আমি-আমি ভেবেছিলাম যে-যে-

যে কি?

যে-দেখুন, আমার মনে হচ্ছে এ অবস্থায়-আপনি তো জানেন আমরা অনেক লোক, এবং-এবং-

কি মিনমিন্ করছেন? এদিকে মুখ ফেরান, আমাকে বলুন-সে কি, আপনি টাকা তোলেন নি?

দেখুন, ব্যাংকের লোকটি বলল–

ব্যাংকের লোকের কথা থাক। আপনার নিজের তো একটা বুদ্ধিবিবেচ না থাকা দরকার। ঠিক বুদ্ধির কথা বলছি না, কিন্তু এমন কিছু-

দেখুন, সোজা কথা হল আমার প্রত্যয়পত্রটা তখন সঙ্গে ছিল না।

প্রত্যয়পত্র সঙ্গে ছিল না?

প্রত্যয়পত্র সঙ্গে ছিল না।

বারবার একই কথা বলবেন না। কোথায় ছিল?

ডাকঘরে।

সেখানে কি করছিল?

দেখুন, আমিই ভুল করে সেখানে ফেলে এসেছিলাম।

বলেন কি! অনেক ভ্রমণ-সঙ্গী আমি দেখেছি, কিন্তু তাদের কেউই-

আমি তো যথাসাধ্য করেছি।

তা তো অবশ্যই করেছেন, আর আপনাকে বকাও আমার অন্যায় হয়েছে। আপনি তো আমাদের জন্য খাটতে খাটতে মরে যাচ্ছেন, আর সেজন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ না হয়ে আমরা শুধু এখানে বসে বসে নিজেদের বিরক্তির কথাই ভাবছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো সকাল ৭-৩০ মিনিটের ট্রেনটাও ধরতে পারি। টিকিট গুলো কিনেছেন তো?

তা কিনেছি-আর বেশ সস্তায়ই কিনেছি। দ্বিতীয় শ্রেণী।

খুব ভাল। অন্য সকলেই তো দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করে, কাজেই আমরাও তো ঐ সর্বনেশে বাড়তি খরচটা বাঁচাতেই পারি। কত লাগল?

টিকিট প্রতি বাইশ ডলার-একটানা বেরুথ পর্যন্ত।

আরে, লণ্ডন ও প্যারিস ছাড়া আর কোথাও একটানা টিকিট কিনতে পাওয়া যায় বলে তো জানতাম না।

অনেকে হয়তো কিনতে পারে না; কিন্তু অনেক পারে-আর মনে হচ্ছে আমিও তাদের একজন।

দামটা নিশ্চয় বেশী লেগেছে।

ঠিক উল্টো; কারবারী তার কমিশনটাও ছাড়া দিয়েছে।

কারবারী?

হ্যাঁ-একটা চুরুটের দোকান থেকে টিকিট গুলো কিনেছি।

তাই বুঝি । আমাদের তো খুব সকালে উঠতে হবে, কাজেই বাঁধাছাদার সময় পাওয়া যাবে না। আপনার ছাতা, আপনার রবারের ছুতো, আপনার চুরুট–কি হল?

রেখে দিন ও সব; চুরুট গুলো ব্যাংকে ফেলে এসেছি।

শোন কথা! আর ছাতা?

ওটা ঠিক আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

তার মানে?

আহা, ঠিক আছে; সে আমি বুঝব- 

ছাতাটা কোথায়?

এই তো এক পা এগোলেই-বেশী সময়-

কোথায় আছে?

দেখুন, মনে হচ্ছে চুরুটের দোকানে ফেলে এসেছি; কিন্তু সে যাই হোক-

আপনার পা বের করুন তো। ঠিক যা ভেবেছি! আপনার রবারের জুতো কোথায়?

সে দুটো-মানে

কোথায় রবারের জুতো?

চারদিকে এমন শুকনো-আর সকলেই বলছে আর এক ফোঁটাও বৃষ্টি হবে না।

আপনার-রবারের-জুতো-কোথায়?

দেখুন-ব্যাপারটা এই রকমভাবে ঘটেছে। প্রথমত, অফিসার বললেন–

কোন্ অফিসার?

পুলিশ অফিসার; কিন্তু মেয়র, তিনি-

কোথাকার মেয়র?

জেনেভার মেয়র, কিন্তু আমি বললাম-

থামুন; আপনার হয়েছে কি?

আমার? কিছু হয় নি তো। তারা দুজনই আমাকে থাকতে বলল, এবং-

কোথায় থাকতে বলল?

দেখুন ব্যাপারটা হল-

আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? কি কাজে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত বাইরে ছিলেন?

ওহো, দেখুন, প্রত্যয়পত্রটা হারিয়ে ফেলবার পরে আমি-

কি আজেবাজে বকে চলেছেন। এবার এক কথায় আমার প্রশ্নের জবাব দিন তো। আপনার রবারের জুতো জোড়া কোথায়?

সেগুলো-দেখুন, সেগুলো জেলার জেলখানায় আছে।

একটু মন-কড়া হাসি হাসলাম, কিন্তু তাতে কাজা হল না। আবহাওয়া বিরূপ। তিন-চার ঘণ্টা জেলখানার কাটানোটা অভিযাত্রী দলের কাছে হাসির ব্যাপার বলে মনে হল না। তলিয়ে দেখলে, আমার কাছেও মনে হবার কথা নয়।

সব ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে বললাম; তখন দেখা গেল, আমরা সকালের ট্রেনটা ধরতে পারি না, কারণ তা হলে আমার প্রত্যয়পত্রটা ফেলে রেখেই যেতে হয়। এক সময় মনে হয়েছিল যে একটা মনোমালিন্য নিয়েই আমাদের শুতে যেতে হবে, কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেটা ঘটল না। কথাপ্রসঙ্গে ট্রাংকের কথা উঠলে আমি জানালাম, সে ব্যবস্থাটা আমি করে এসেছি।

এ ব্যাপারে আপনি খুবই ভাল, চিন্তাশীল পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান লোকের মতই কাজ করেছেন;কাজেই আপনার এতখানি দোষ ধরা আমাদের দিক থেকে খুবই লজ্জার ব্যাপার হয়েছে; ও বিষয়ে আর একটা কথাও বলা হবে না। সব কাজটাই আপনি সুন্দর ভাবে, প্রশংসনীয়ভাবে সম্পন্ন করেছেন; আপনার সম্পর্কে অকৃতন্ত্রের মত কথা বলায় আমি দুঃখিত।

এ কথায় আমি আরও বেশী আঘাত পেলাম; আমার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল; কারণ ট্রাংকঘটিত ব্যাপারটায়ও আমি খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম না। কোথায় যেন কিছু একটা ত্রুটি থেকে গেছে; ত্রুটিটা ঠিক যে কোথায় তাও বুঝতে পারছি না, আবার এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে নাড়াচাড়াও করতে পারছি না, কারণ ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে।

অবশ্য সকালে যখন দেখা গেল যে সকালের ট্রেনে আমরা যেতে পারছি না তখন তা নিয়ে একটু হৈ-চৈ হল। কিন্তু আমার অপেক্ষা করবার মত সময় ছিল না। গোলমালের শুরুটা শুনেই আমি প্রত্যয়পত্রের খোঁজ বেরিয়ে পড়লাম।

ট্রাংকের ব্যাপারটার যদি কোন সুরাহা করা যায় সেই ভরসায় সেখানে গেলাম। অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভারপ্রাপ্ত লোকটি জানাল। আগের দিন সন্ধায়ই ট্রাংকগুলো জাহাজে করে জুরিখ-এ পাঠানো হয়ে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, টিকিট ছাড়াই সে কাজটা করা হল কেমন করে।

সুইজারল্যাণ্ডে টিকিট দরকার হয় না। ট্রাংকের মাশুলটা দিলেই যেখানে খুসি পাঠাতে পারেন। আপনার হাত-ব্যাগটা ছাড়া আর কিছুই বিনা মাশুলে নিতে পারবেন না।

সে বাবদ কত খরচ হয়েছে?

একশ চল্লিশ ফ্রাঁ।

আট শ ডলার। ট্রাংকের ব্যাপারে নিশ্চিয় কিছু ভুল হয়েছে।

তারপর কুলির সঙ্গে দেখা করলাম। সে বলল:

আপনার ভাল ঘুম হয় নি, তাই না? আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনি যদি একজন ভ্রমণ-সঙ্গী চান তো একটি ভাল লোক কাল রাতে এসেছে; নাম লুডি; পাঁচ দিন তার কোন কাজ নেই। আমরা তাকে সুপারিশ করছি; গ্রাণ্ড হোটেল বিড় রিভাজ-ও তাকে সুপারিশ করেছে।

সে প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিলাম। আমার মনোবল এখনও ভেঙে পড়ে নি। তাছাড়া এ ভাবে ধরা পড়তেও আমি চাই নি। নটা নাগাদ আমি জেলার জেলখানায় ছিলাম, আশা করেছিলাম মেয়র হয় তো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই একবার আসতে পারে; কিন্তু তা আসে নি।সেখানে খুবই একঘেয়ে লেগেছিল। যতবার কোন কিছুতে হাত দিতে গিয়েছি, বা কোন কিছু দেখতে চেষ্টা করেছি, বা কিছু করতে চেয়েছি, প্রতিবারই পুলিশ বলেছে ওটা নিষিদ্ধ। ভাবলাম, ফরাসী ভাষায় একটু কথা বলে দেখি, কিন্তু তাও শুনবে না। তার নিজের ভাষা শুনে যেন আরও চটে গেল।

শেষ পর্যন্ত মেয়র এল আর সব গোলমালের অবসান হল। এক মিনিটের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট বসানো হল–কোন মূল্যবান সম্পতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলেই এ কাজটি করা হয়-যথারীতি সব ব্যবস্থা হল, সান্ত্রী বসানো হল, গির্জার প্রার্থনা হল, আমার বিনা সিলের চিঠিটা এনে খোলা হল, তার মধ্যে কয়েকখানা ফটোগ্রাফ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না; কারণ এতক্ষণে আমার মনে পড়ল যে ফটোগ্রাফ গুলো রাখবার জন্য আমি প্রত্যয়পত্রটা খামের ভিতর থেকে বের করে নিয়ে অন্য পকেটে রেখে দিয়েছিলাম; আমার সত্যতা প্রমাণের জন্য অন্য পকেট থেকে সেটা বের করে সকলকে দেখিয়ে অত্যন্ত পুলক অনুভব করলাম। কোর্টের সদস্যরা তখন উদাস চোখে পরষ্পরের দিকে তাকাল তারপর আমার দিকে তাকাল, এবং পুনরায় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে দিল; কিন্তু আমার একা একা ঘোরা উচিত নয় এই মন্তব্য করে আমার পেশার কথা জানতে চাইল। আমি বললাম, আমি একজন ভ্রমণ-সঙ্গী। শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা চোখ তুলে তাকাল, আর আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাংকের দিকে ছুট লাম।

যা হোক ভ্রমণ-সঙ্গী হিসাবে ইতিমধ্যেই আমি খুব বেশী করে নিয়ম শৃংখলা মানতে শিখে গেছি; তাই ডাকঘরে না গিয়ে আগে ছুট লাম অভিযাত্রী দলের সেই দুজন লোকের সন্ধানে। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আরাম করছিল; অনেক বলে-কয়ে সেটাতেই উঠে বসলাম। এতে গতি কিছু বাড়ল না, তবে আরামে যাওয়া হল, আর সেটা আমার ভালই লাগল। সুইজারল্যাণ্ডের স্বাধীনতার ষষ্ঠ শতবার্ষিকী এবং চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী উৎসব চলছে পুরো দমে; রাস্তায় রাস্তায় পতাকার সমারোহ।

ঘোড়া ও গাড়ির চালক তিন দিন তিন রাত ধরে মদ গিলেছে, বিছানার সাথে কোন সম্পর্কই হয় নি। আমার মত তাদেরও তখন ঘুমে ঢুলুঢুলু ভাব। কিন্তু এক সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম। ভিতরে ঢুকে ঘণ্টা বাজালাম এবং দাসীকে বললাম আমার সঙ্গী দুজনকে তাড়াতাড়ি বের করে দিতে। সে যে কি বলল কিছুই বুঝতে না পেরে আবার আমার রথেই ফিরে এলাম।

চুপচাপ বসে রইলাম। এক সময় কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। আগন্তুক একজন পুলিশ। তাকিয়ে দেখলাম ইতিমধ্যেই একটি। নতুম দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। একটা ভিড় জমে গেছে। সকলের চোখেই কৌতূহল ও সন্দেহ। ঘোড়াটা ঘুমিয়ে আছে। কোচোয়ানও তথৈবচ। কতকগুলি ছোকরা পথের পতাকাগুলি চুরি করে এনে তাকে ও আমাকে অপূর্ব সাজে সাজিয়েছে। সে এক বিশ্রী দৃশ্য। পুলিশ-অফিসার বলল:

আমি দুঃখিত, কিন্তু এ ভাবে তো আপনাকে সারা দিন এখানে ঘুমুতে দিতে পারি না।

আমি আহত হলাম। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম, ক্ষমা করবেন, আমি তো ঘুমুচ্ছিলাম না; একটু ভাবছিলাম।

দেখুন, ইচ্ছা হলে আপনি অবশ্যই ভাবতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ভাবতে হবে নিজের মনে; আপনি যে গোটা অঞ্চকেই বিরক্ত করে তুলেছেন।

অত্যন্ত সস্তা ঠাট্টা। সকলে হো-হো করে হেসে উঠল। রাতের বেলা কখনও কখনও আমার নাক ডাকে; কিন্তু দিনের বেলায় এ হেন জায়গায় আমি যে সে কাজ করব তা তো সম্ভব নয়। যা হোক, ভীড় সরিয়ে দিয়ে অফিসার জানাল যে, আমাদের আর বেশীক্ষণ সেখানে থাকা চলবে না, অন্যথায় সে ভাড়া আদার করতে বাধ্য হবে-সে বলল, এটাই আইন, তবে যেহেতু আমাকে দেখে সেকেলে লোক বলে মনে হচ্ছে তাই-

এবার তাকে গম্ভীরভাবে বাধা দিয়ে আমি বললাম যে, আজকের দিনে আমিও তো একটু আমোদ-আহ্লাদ করতে পারি, বিশেষ করে। যখন এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগ রয়েছে।

ব্যক্তিগত যোগ? কেমন করে?

কারণ ছশ বছর আগে আমার এক পূর্বপুরুষই এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।

লোকটা এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল; তারপর আমাকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল:

পূর্বপুরুষ! আমার তো মনে হয় আপনি নিজেই স্বাক্ষর করেছিলেন। কারণ পুরাকালের যে সব প্রাচীন নিদর্শন আমি-কিন্তু যাক সে কথা। এখানে কি জন্য আপনি এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন?

আমি বললাম:

আমি মোটে ই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি না। মাত্র পনেরো মিনিট হল এখানে আছি; তারা দস্তানা ও বই ফেলে এসেছে, তাই সেগুলো আনতে গেছে। তখন তারা কে আর আমিই বা কি জন্যে এসেছি সব তাকে বললাম।

পুলিশটি খুব বিগলিত হয়ে উঠল এবং জানালা দিয়ে বের-করা মাথা ও গলাগুলোকে লক্ষ্য করে আমার সঙ্গী দুজনের কথা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল। তখন একটি মেয়ে সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলল:

ওঃ, তারা? সে কি, আমিই তো তাদের একটা গাড়ি ডেকে দিলাম; তারা তো অনেকক্ষণ হল চলে গেছে-তা সাড়ে আটটায়।

গোলমেলে ব্যাপার। আমি ঘড়িটা দেখলাম, মুখে কিছু বললাম না। অফিসারটি বলল:

দেখুন, বারোটা বেজে গেছে। আপনার আরও ভাল করে খোঁজ করা উচিত ছিল। এই প্রচণ্ড রোদে আপনি পৌনে এক ঘণ্টা ধরে ঘুমুচ্ছেন। রোদে যে পুড়ে গেছেন-কালো হয়ে গেছেন। আশ্চর্য! হয় তো ট্রেনটাই ধরতে পারবেন না। আপনি খুব মজার লোক মনে হচ্ছে। কাজকর্ম কি করেন?

বললাম, আমি একজন ভ্রমণসঙ্গী। লোকটা যেন হতভম্ব হয়ে গেল। তার সম্বিৎ ফিরে আসার আগেই আমরা হাওয়া।

হোটেলের তিন তলায় উঠে দেখি আমাদের ঘরগুলো ফাঁকা। তাতে আমি অবাক হলাম না। ভ্রমণ-সঙ্গী নজরের বাইরে গেলেই দলের লোকটা কেনাকাটা করতে বেরিয়ে যায়। ট্রেনের সময় যত এগিয়ে আসে ততই তারা বেশী করে বাইরে যায়। বসে বসে ভাবছি কি করা যায় এমন সময় চাকরটা আমাকে দেখতে পেয়ে জানাল, অভিযাত্রী দল আধ ঘণ্টা হল স্টেশনে চলে গেছে। এই সর্বপ্রথম তারা একটা বুদ্ধির কাজ করেছে। কিন্তু আমাকে যে গোলমালে ফেলে দিল। এ ধরনের কাজের ফলেই ভ্রমণ-সঙ্গীদের বড়ই অসুবিধার পড়তে হয়। সব কিছু সে ঠিকঠাক করে এনেছে এমন সময় দলের লোকটা এমন একটা কাণ্ড করে বসবে যাতে সব ব্যবস্থা একেবারে তচনচ হয়ে যায়।

দুপুর ঠিক বারোটায় ট্রেন ছাড়বার কথা। এখন বারোটা বেজে দশ। দশ মিনিটের মধ্যেই আমি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। হাতে যথষ্ট সময় নেই, কারণ এটা একটা বিদঙ্গতি এক্সপ্রেস ট্রেন, আর ইওরোপে বিদ্যুৎগতি এক্সপ্রেস ট্রেনগুলি বিজ্ঞাপিত দিনেই ছাড়ার ব্যাপারে বেশ কিছুটা খুঁতখুঁতে। প্রতীক্ষালয়ে শুধু আমার দলের লোকরাই বসে আছে; অন্য সকলেই গিয়ে ট্রেনে চড়ে বসেছে। তারা। সকলেই শ্রান্ত, বিচলিত ও বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের সান্ত্বনা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে আমরা ছুটে বেরিয়ে পড়লাম।

কিন্তু না; এখানেও আমাদের কপাল খারাপ। দ্বাররক্ষী টিকিট গুলো দেখে সন্তুষ্ট হল না। অত্যন্ত সতর্কতা ও সন্দেহের সঙ্গে নেড়ে চেড়ে দেখল; তারপর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অপর একজন কর্মচারীর ডাকল। দুজনে টিকিট গুলো ভাল করে দেখে আর একজন কর্মচারীকে ডাকল। তারা আবার অন্যদের ডাকল, সকলে মিলে আলোচনার পর আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগল, নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত আমি কাকুতি-মিনতি করে বললাম, সময় বয়ে যাচ্ছে, কাজেই তারা যেন তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে আমাদের ছেড়ে দেয়। তখন তারা অতিশয় ভদ্রভাবে জানাল যে টি কিট গুলোতে কিছু গোলমাল আছে; কাজেই তারা জানতে চাইলে, টিকিট গুলো আমি কোথা থেকে নিয়েছি।

এতক্ষণে গোলমালের কারণটা বুঝতে পারলাম। আপনারা তো জানেন, একটা চুরুটের দোকান থেকে আমি টিকিট গুলো কিনেছিলাম, কাজেই সেগুলোর গায়ে তামাকের শুল্ক বিভাগ থেকে পাশ করিয়ে নেওয়া এবং ঐ গন্ধের দরুন প্রাপ্য গুগু জ্জ টা আদায় করা। সুতরাং স্থির করলাম যে এ সব ক্ষেত্রে সব কথা খোলাখুলি বলাই ভাল। তাই বললাম:

ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদের ফাঁকি দিতে চাই না। এই রেলের টিকিট গুলো-

মাফ করবেন মঁসিয়ে? এগুলো মোটেই রেলের টিকিট নয়।

ওহো, তাহলে এই দোষ?

আজ্ঞে হ্যাঁ মসিয়। এগুলো লটারির টিকিট; আর সে লটারিও হয়ে গেছে দুবছর আগে।

আমি এমন ভাব দেখালাম যেন ব্যাপারটা ভারী মজার; এ অবস্থায় এ ছাড়া আর কিছু তো করার থাকে না; আর কোন লাভও নেই; অথচ চারদিক থেকে সকলে করুণা করতে থাকে, আপনার কাজেই জন্য লজ্জাবোধ করে। একদিকে দুঃখ ও পরাজয়ের মর্মপীড়া, আর অন্যদিকে আপনার দলের লোক, যারা আপনার প্রাণের প্রাণ, আধুনিক সভ্যতার রীতি অনুসারে যাদের কাছে ভালবাসা ও শ্রদ্ধাই আপনার প্রাপ্য, তারাও অপরিচিত জনের কাছে আপনাকে এভাবে অপদস্থ হতে দেখে অপমানিত ও বিভ্রান্ত।

খুসি-খুসি মেজাজে আমি বললাম, ঠিক আছে, এ রকম ছোট খাট দুর্ঘটনা তো সকলের বেলায়ই ঘটতে পারে-দুমিনিটের মধ্যেই আমি সঠিক টিকিট নিয়ে আসছি; তারপর ট্রেনে চেপে সারা পথ ফুর্তি করতে চলে যাব। যথাসময়ে টি কিট ও পেলাম, ছাপ-টাপ দেওয়া ঠিক-ঠিক টিকিট, কিন্তু সগুলি আমার আর নেওয়া হল না, কারণ ঐ হারানো লোক দুটি কে খুঁজতে গিয়ে হয়রান হয়ে আমি ব্যাংকে যেতেই ভুলে গেছি, অতএব টাকাও তোলা হয় নি। কাজেই ট্রেন ছেড়ে দিল, আর আমাদেরও হোটেলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না। তাই গেলাম।

হোটেলে ফিরে আমাদের ভাল ঘরগুলো পাওয়া গেল না; এদিক-ওদিক ছড়ানো ঘর পাওয়া গেল। যা হোক করে ওতেই চলে যাবে। ভাবলাম, এবার সব কিছু ভালভাবে চলবে, কিন্তু দলের প্রধান হুকুম করল, ট্রাংকগুলো উপরে পাঠিয়ে দিন। মন খারাপ হয়ে গেল। ঐ ট্রাংকের ব্যাপারে নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু আছে। সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সে কথা বলতে গেলাম, কিন্তু হাতের ইসারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে জানাল, আমরা এখানেই তিন দিন থাকব ও বিশ্রাম নেব।

আমি বললাম, ঠিক আছে; ঘণ্টা বাজাবার দরকার নেই। আমি নিজেই গিয়ে ট্রাংকের ব্যবস্থা করছি। একটা গাড়ি নিয়ে আমি সোজা মিঃ চার্লস্ ন্যাচ রেল-এর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, তাদের কি নির্দেশ দিয়েছিলাম।

সাতটা ট্রাংক হোটেলে পাঠিয়ে দিতে হবে।

কোন ট্রাংক ফিরিয়ে আনবার কথা ছিল কি?

না।

আপনি ঠিক জানেন যে উঁই করা সাতটা ট্রাংক ফিরিয়ে আনতে আপনাকে বলি নি?

নিশ্চয় বলেনি নি।

তাহলে পুরো চোদ্দটা ট্রাংকই জুরিখ, বা জেরিকো, বা অন্য কোথাও চলে গেছে, আর অভিযাত্রী দল সেখানে পৌঁছে দেখবে যে হোটেলে সব কিছু মিলে একটা তালগোল-

কথাটা শেষ করতে পারলাম না; আমার মাথাটা ঘুরতে লাগল। এ অবস্থায় কথা শেষ হল কি না হল তা কারও খেয়ালই থাকে না; বরং ভয় হয় বুঝি বা কোন গাড়ি, বা গরু বা অন্য কিছুতে চাপা পড়ে যাব।

গাড়িটার কথাও ভুলে গেলাম। পায়ে হেঁটে ফিরে যেতে যেতে অনেক ভেবেচিন্তে স্থির করলাম পদত্যাগ করব, কারণ অন্যথায় আমাকেই ছাড়িয়ে দেবে। কিন্তু নিজে গিয়ে পদত্যাগ করাটা কোন কাজের কথা নয়; একটা চিঠি লিখেই তো সে কাজ হতে পারে। কাজেই মিঃ লুডি কে ডেকে পাঠালাম; তাকে বললাম, নানা রকম অসুবিধার জন্য একজন ভ্রমণসঙ্গী শীঘ্রই পদত্যাগ করছে, এবং যেহেতু তার হাতে এখনও চার পাঁচ দিন সময় আছে সেই হেতু সে যদি চায় তো ঐ শূন্যস্থানে তাকে আমি ভর্তি করে দিতে পারি। সব কিছু ব্যবস্থা করে তাকে পাঠিয়ে দিয়ে অভিযাত্রী দলকে জানিয়ে দিলাম যে, মিঃ ন্যাচ রেল-এর লোকজনদের ভুলে এখানে আমাদের কোন ট্রাংকই নেই, যদিও জুরিখ-এ যথেষ্টই আছে; কাজেই মালগাড়ি হোক আর মেরামতি গাড়িই হোক, তারা যেন প্রথম ট্রেন ধরেই অবিলম্বে যাত্রা করে।

সে কাজ সেরে এসে মিঃ লুডি আমাকেও যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল-হা আমাকে অবশ্যই যেতে হবে। তারপর দুজনে মিলে ব্যাংকে গেলাম টাকা তুলতে ও আমার চুরুট এবং তামাক নিতে, চুরুটের দোকানে গেলাম লটারির টিকিট ফেরৎ দিয়ে টাকা বুঝে নিতে ও ছাতাটা ফেরৎ নিতে, মিঃ ন্যাচরেল-এর কাছে গেলাম তাড়া মিটিয়ে গাড়িটাকে ফেরৎ পাঠাতে, এবং জেলার জেলখানায় গেলাম আমার রবারের জুতো নিতে ও মেয়র এবং সুপ্রিম কোর্টকে বিদায়কালীন চিঠি (p.p.c) দিতে; আর সেই ফাঁকে মিঃ লুডি আমাকে জানাল অভিযাত্রীদলের গরম হাওয়ার কথা। বুঝলাম, কাজটা ছেড়ে দিয়ে ভালই করেছি।

বিকেল ৪টা পর্যন্ত জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম; মনে আশা, ততক্ষণে হাওয়া যদি একটু ঠাণ্ডা হয়। তারপর জুরিখ-গামী তিনটের এক্সপ্রেস ট্রেনটা ধরবার জন্য যথাসময়ে স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম এবং অভিযাত্রীদলের সঙ্গে মিলিত হলাম। তারা এখন লুডি–র লোক। দেখলাম, তাদের সব রকম জটিল ব্যবস্থাকেই সে অনায়াসে ও বেশ ভাল ভাবেই চালিয়ে নিচ্ছে।

দেখুন, যতদিন স্বপদে ছিলাম, ক্রীতদাসের মত খেটেছি এবং সাধ্যমত সব কাজ করেছি; অথচ এই সব লোক শুধু আমার ত্রুটি গুলির কথাই মনে রেখেছে, ভাল কাজের কথা নয়। আমার হাজারটা ভাল কাজের কথা ভুলে গিয়ে শুধু একটা কথা নিয়েই অনবরত মাথা ঘামিয়েছে-কথাটা হল, জেনেভার ভ্রমণসঙ্গী হয়ে যত কাজ আমি করেছি তাতে একটা সার্কাসের দলকে জেরুজালেম-এ নিয়ে যাওয়া যায়, অথচ আমার দলটাকে আমি শহর থেকেই বের করতে পারি নি। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম যে এ কথা আমি আর শুনতে চাই না, শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাদের মুখের উপর বলে দিয়েছি যে কারও প্রাণ বাঁচাতে আমি আর কখনও ভ্রমণসঙ্গী হব না। যদি বেঁচে থাকি তো এ কথা আমি প্রমাণ করে যাব। এ কাজ অত্যন্ত শক্ত, মাথা ঘুলিয়ে দেয়, অতি-পরিশ্রমে শরীর কাহিল হয়ে যায়। এতে তিলমাত্র কৃতজ্ঞতার স্থান নেই: শুধু হৃদয় আহত হয় আর মন হয় রক্তাক্ত।

[১৮৯১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *