একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা

একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা
 
A Curious Experience

যতদূর স্মরণে আছে, মেজর আমাকে এই গল্পটি ই বলেছিল:

১৮৬২-৬৩-এর শীতকালে আমি ছিলাম কন-এর অন্তর্গত নিউ লণ্ডন-এর ট্রাম্বুল দুর্গের অধিনায়ক। হতে পারে, সেখানে আমাদের জীবন যুদ্ধক্ষেত্রের মত ততটা কর্মব্যস্ত ছিল না; তবু কাজকর্ম একেবারে কম ছিল না-কাজের অভাবে শুধু মাথা চুলকে চিন্তাগুলিকে সতেজ রাখার মত ব্যবস্থা ছিল না। একটা কথা, সারা উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া তখন নানা রহস্যময় ৫ জবে ভর্তি ছিল-যেমন, বিদ্রোহী গুপ্তচররা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং আমাদের উত্তরাঞ্চলের দুর্গগুলিকে উড়িয়ে দেবার, আমাদের হোটেল গুলি পুড়িয়ে দেবার, আমাদের শহরগুলিতে সংক্রামক ব্যাধির বীজাণুযুক্ত জামা-কাপড় ছড়িয়ে দেবার জন্য তারা নিজেদের প্রস্তুত করছে। সে সব কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। এই সব নিয়ে আমাদের সর্বদাই সজাগ থাকতে হত, আর তার ফলে আমাদের শিবির-জীবনের চিরাচরিত একঘেয়েমিও অনেকটাই দূর হয়ে যেত। তাছাড়া, আমাদের ঘাঁটি টা ছিল নতুন সৈন্য-সংগ্রহের কেন্দ্র-কাজেই শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে, স্বপ্ন দেখে, ফুর্তি করে কাটিয়ে দেবার মত সময় আমাদের ছিল না। আরে, একটা সারা দিনে যত নতুন সৈন্য ভর্তি করা হত, যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও তার শতকরা পঞ্চাশ জনই আমাদের হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে সেই রাতেই আমাদের উপর চড়াও হত। তাছাড়া এত বেশী টাকা-কড়ি তারা পেত যে পালাবার সুবিধা করে দেবার জন্য একজন নতুন সৈনিক শান্ত্রীকে তিন-চার শ ডলার পর্যন্ত ঘুষ দিতে পারত এবং তারপরেও যে পরিমাণ লুঠের অর্থ তার হাতে থাকত তা দিয়ে একজন গরিব মানুষও প্রচুর সম্পত্তির মালিক হতে পারত। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমাদের জীবন তখন ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই কাটত না।

একদিন। আমার বাসায় আমি একা। কিছু লেখার কাজ করছিলাম। এমন সময় চোদ্দ-পনেরো বছরের বিবর্ণ, বিধ্বস্ত চেহারার একটি ছেলে ঘরে ঢুকে আভূমি নত হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলল:

এখানে কি সৈন্যদলে নাম লেখানো হয়?

হ্যাঁ।

আমার নামটা কি তালিকাভূক্ত করবেন স্যার?

না হে! দেখ বাবা, তোমার বয়স অল্প, বড়ই অল্প।

তার মুখে হতাশা ফুটে উঠল; কিছুক্ষণ পরেই দেখা দিল গভীর নৈরাশ্য। চলে যাবার জন্য ঘুরে গিয়েও ইতস্তুত করে আবার আমার দিকে ফিরে বলল:

আমার বাড়ি-ঘর নেই, এ জগতে আমার কোন বন্ধু নেই। আপনি যদি আমার নামটা তালিকাভুক্ত করতেন!

কিন্তু সে প্রশ্নই উঠতে পারে না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে কথাই তাকে বললাম। তারপর তাকে স্টোভটার পাশে বসে শরীরটাকে গরম করতে বলে আরও বললাম:

এখনই কিছু খেতেও পাবে। তুমি ক্ষুধার্ত।

সে কোন কথা বলল না; বলবার দরকার ছিল না; তার বড় বড় দুটি নরম চোখে সে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যেত না। সে স্টোভটার পাশে বসল। আমি লিখতে লাগলাম। মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখছিলাম। লক্ষ্য করলাম, নোংরা ও ছেঁড়া হলেও তার জামা-কাপড় ও জুতো স্টাইল ও মাল-মশলার দিকে থেকে বেশ ভাল। বিষয়টা অর্থপূর্ণ। তার উপর তার কণ্ঠ স্বর নীচু ও সুরেলা; চোখ দুটি গভীর ও বিষণ্ণ; তার আচরণ ও ঠিকানা ভদ্রজনোচিত; স্পষ্টই বোঝা যায় ছেলেটি বিপদে পড়েছে। ফলে তার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে গেল।

যা হোক, ক্রমে ক্রমে আমি আমার কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম এবং ছেলেটির কথা একেবারেই ভুলে গেলাম। এভাবে কতক্ষণ কেটে ছিল জানি না, কিন্তু এক সময় আমি চোখ তুললাম। ছেলেটির পিঠ ছিল আমার দিকে, কিন্তু তার মুখটা এমন ভাবে ঘোরানো ছিল যে তার একটা গাল আমি দেখতে পাচ্ছিলাম-সেই গাল বেয়ে অশর ধারা নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে।

নিজের মনে বললাম: ঈশ্বর আমার সহায় হোন! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে ছেলেটি অভূক্ত রয়ে গেছে। তখন আমার এই পাশবিক আচরণের সংশোধন করতে তাকে বললাম, আমার সঙ্গে এস বাপু; তুমি আমার সঙ্গেই খাবে। আজ আমি একা আছি।

সকৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে সে আমার দিকে তাকাল। খুসির আলোয় তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টেবিলের কাছে গিয়ে আমি না বসা পর্যন্ত সে চেয়ারের পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বসল। ছুরি-কাটা হাতে নিলাম-ঐ হাতেই নিলাম, তারপরই থেমে গেলাম, কারণ ছেলেটি তখন মাথাটা নামিয়ে নীরবে প্রার্থনা করছে। আমার বাড়িরও শৈশব কালের সহস্র স্মৃতি আমার মনের সামনে ফুটে উঠল; দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম ধর্মবোধ এবং আহত মনে তার শান্তির প্রলেপ, তার সান্ত্বনা, আরাম ও শক্তি থেকে আজ আমি কত দূরে সরে এসেছি।

খেতে খেতেই লক্ষ্য করলাম, তরুণ উইকলো-তার পুরো নাম রবার্ট উইকলো-তোয়ালের ব্যবহার জানে; আর-এককথায় বলতে গেলে আমি বুঝতে পারলাম যে ছেলেটি ভাল শিক্ষা-দীক্ষাই পেয়েছে; তার বিস্তারিত বিবরণে কি কাজ। তার সহজ সরলতা আমার মনকে জয় করে নিল। প্রধানত তার সম্পর্কেই নানা কথা প্রসঙ্গে তার ইতিহাস জেনে নিতে আমার কোন অসুবিধাই হল না। সে যখন বলল যে লুসিয়ানাতে তার জন্ম আর সেখানেই সে বড় হয়েছে, তখন তার প্রতি আমার টান আরও বেড়ে গেল, কারণ আমি বেশ কিছুদিন সেই অঞ্চলেই কাটিয়েছি। মিসিসিপির সব উপকূল অঞ্চলটা আমি ভালই চিনি, তাকে ভালবাসি, আর এমন কিছু দীর্ঘদিন আগে। সেখান থেকে চলে আসি নি যাতে আমার মনের টানে ভাঁটা পড়তে পারে। তার মুখ থেকে প্রতিটি জায়গার নাম শুনতে আমার এত ভাল লাগছিল যে সেই নামগুলি শুনবার জন্যই আমি আলোচনার মোড়কে সেই দিকে ঘুরিয়ে দিতে লাগলাম: ব্যাটন রুজ, প্ল্যাকুমিন, ডোনাল্ড–সভিল, ষাট–মাইল পয়েণ, বোনেট-কারে, স্টক ল্যাণ্ডিং, ক্যারল্টন, স্টীমশিপ ল্যাণ্ডিং, স্টীমবোট ল্যাণ্ডিং, নিউ অর্লিয়েন্স, টু সুপিটোলাস স্ট্রীট, এসপ্লানেড়, রু দ্য বোঁ ঐফাত সেন্ট চার্লস হোটেল, টি ভোলি সার্কল, শেল রোড়, লেক পর্ণ চারট্রেন; আমার। বিশেষ করে মজা লাগছিল আর. ই. লী, নাট চেজ, এক্লিপস্, জেনারেল কুইট ম্যান, ডানকান এফ, কেনার ও অন্যান্য পুরনো পরিচিত স্টামারগুলোর নাম শুনতে। এই সব নাম শুনে সে সব জায়গার স্মৃতি এতদূর সপষ্ট হয়ে আমার মনে ফুটে উঠতে লাগল যে মনে। হল বুঝি বা সত্যি আমি সেখানে ফিরে গিয়েছি। সংক্ষেপে এই হল ছোট্ট উইকলোর ইতিবৃত্ত

যখন যুদ্ধ শুরু হল তখন সে তার পঙ্গু খুড়ি ও বাবা ব্যাট ন রুজ-এর সঙ্গে একটা বড় ও সমৃদ্ধ বাগানে বাস করত। পঞ্চাশ বছর ধরে বাগানটা ছিল ওদের পরিবারেরই সম্পত্তি। বাবা ছিল ইউনিয়ন-এর লোক। নানাভাবে তার উপর নির্যাতন চালান হল, কিন্তু সে তার নীতিকেই আঁকড়ে ধরে রইল। শেষ পর্যন্ত একদিন রাতে একদল মুখোশধারী লোক তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিল আর পরিবারের সকলে। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেল। তাড়া খেয়ে তারা আজ এখানে কাল সেখানে কাটাতে লাগল, আর দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও দুর্দশা কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল। পঙ্গু খুড়ি শেষ পর্যন্ত শান্তি পেল: দুঃখে ও রোদ-জলে তার মৃত্যু হল; পথচারী বাউণ্ডুলের মত খোলা মাঠের মধ্যে সে মারা গেল; বৃষ্টির অশ্রান্ত ধারা ঝরে পড়ল তার দেহে; মাথার উপরে চলতে লাগল ঝড়ের গর্জন। তার কিছুদিন পরেই একদল সশস্ত্র লোকের হাতে বাবাও ধরা পড়ল; ছেলেটির কাতর মিনতিতে ক্ষেপ না করে তার চোখের সামনেই বাবাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। [এইখানে তরুণটির চোখে একটা বিষময় আলো জ্বলে উঠল; আত্মমগ্ন ভাবেই সে বলতে লাগল: আমি যদি তালিকাভুক্ত না। হতে পারি তো কোন ক্ষতি নেই-একটা পথ আমি পাবই-একটা পথ আমি পাবই।] বাবার মৃত্যু ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে বলে দেওয়া হল যে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে যদি ঐ অঞ্চল থেকে চলে না যায় তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে। সেই রাতে হামাগুড়ি দিতে দিতে সে নদীর ধারে গেল এবং একটা বাগানের ঘাটের কাছে লুকিয়ে রইল। এক সময় ডান কান এফ, কেনার স্টীমারটি সেখানে থামলে সে সাঁতার দিয়ে স্টীমারের পিছনে বাঁধা ডিঙ্গিতে লুকিয়ে পড়ল। সকাল হবার আগেই স্টীমারটা স্টক ল্যাণ্ডিং-এ পৌঁছল, আর সেও লুকিয়ে তীরে গিয়ে উঠল। তিন মাইল হেঁটে নিউ অর্লিয়ান্স-এর গুড চিল্ডেন স্ট্রীটে তার এক কাকার বাড়িতে গিয়ে হাজির হল এবং কিছু দিনের মত তার বিপদ কেটে গেল। কিন্তু এই কাকাও ইউনিয়ন-এর লোক; অনতিবিলম্বে সেও স্থির করল যে দক্ষিণ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়াই ভাল। কাজেই তরুণ উইকলোকে সঙ্গে নিয়ে সেও লুকিয়ে একটা সমুদ্রগামী জাহাজে চেপে বসল এবং যথাসময়ে নিউ ইয়র্ক পৌঁছে গেল। সেখানে তারা অ্যাস্টর হাউস-এ উঠল। ব্রড ওয়ে ধরে হেঁটে বেড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন দৃশ্য দেখে কিছুদিন উইকলোর বেশ ভালই কাটল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা পরিবর্তন দেখা দিল-তাতে অবস্থা আবার খারাপের দিকেই গেল। প্রথম দিকে কাকা বেশ হাসিখুসি ছিল, কিন্তু এখন তাকে প্রায়ই চিন্তিত ও হতাশ দেখা যেতে লাগল; তাছাড়া, তার মেজাজও খিট খিটে হয়ে উঠল। প্রায়ই বলতে লাগল, টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আয়ের কোন পথ নেই-দুজন তো দূরের কথা, একজনের চলার মতো টাকাও নেই। তারপর একদিন সকালে সেও উধাও হয়ে গেল-প্রাতরাশের টেবিলে ও এল না। ছেলেটি আপিসে খোঁজ নিয়ে জানল, তার কাকা আগের দিন রাতেই বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেছে-করণিকটি র বিশ্বাস বোস্টন-এ গেছে, তবে সঠিক সে বলতে পারে না।

ছেলেটি আবার নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন হল। কি যে করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত স্থির করল, কাকার খোঁজে বের হওয়াই ভাল। স্টীমার ঘাটে গিয়ে জানতে পারল, তার পকেটে যৎসামান্য যা আছে তাতে বোস্টন যাওয়া চলবে না, নিউ লণ্ডন পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে; কাজেই সেই বন্দরের টিকিট ই কাট ল; মনে মনে ভরসা করল, বাকি পথটা যাবার ব্যবস্থা ঈশ্বরই করে দেবেন। তিন দিন তিন রাত সে নিউ লণ্ডনের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে, লোকের দয়ায় কখনও কিছু খেয়েছে, কখনও একটু ঘুমিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সব আশা ছেড়ে দিয়েছে; সাহস ও আশা দুইই চলে গেছে। যদি সৈন্যদলে ভর্তি হতে পারে, তার চাইতে কৃতজ্ঞ কেউ হবে না; যদি সৈন্য নাও হতে পারে, একটা ঢাক-বাজিয়ে ছেলেও কি সে হতে পারে না? আহা, সকলকে খুসি করতে সে কঠোর পরিশ্রম করবে, কত কৃতজ্ঞ থাকবে!

বিস্তারিত বিবরণ বাদ দিয়ে উইকলোর এই ইতিহাসই সে আমাকে বলল। আমি বললাম:

দেখ বাপু, এখন তুমি একজন বন্ধুর কাছেই আছ-তোমার আর কোন কষ্ট হবে না। তার চোখ দুটি চক্‌চক্‌ করে উঠল। সার্জেন্ট জন। রেবার্ণকে ডেকে পাঠালাম-সে হার্ট ফোর্ড-এর অধিবাসী, এখনও হার্টফোর্ড-এই থাকে; হয় তো তুমি তাকে চেন-আর বললাম: রেবার্ণ, গায়কদের দলে এই ছেলেটির থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি তাকে ঢাক-বাদক হিসাবে ভর্তি করে নিচ্ছি। আমার ইচ্ছা তুমি ওর দেখাশুনা করবে আর ওর প্রতি যাতে ভাল ব্যবহার করা হয় সেদিকে নজর রাখবে।

একখনকার মত অবশ্য ঘাঁটির সৈন্যাধ্যক্ষ ও ঢাক-বাদক ছেলেটির মধ্যে যোগাযোগের ইতি ঘটল, কিন্তু অসহায় বন্ধুহীন ছোট ছেলেটি যথারীতি আমার মনের মধ্যে চেপে বসে রইল। আমি তার উপর নজর রাখলাম; আশা করেছিলাম সে খুসিতে ঝলমল করবে, ক্রমেই আনন্দমুখর হয়ে উঠবে, কিন্তু না, দিনের পর দিন কাটতে লাগল, তার কোন পরিবর্তন হল না। সে কারও সঙ্গে মেশে না; সব সময়। অন্যমনস্ক থাকে, সর্বদাই কি যেন ভাবে; মুখোনি সর্বদাই বিষণ্ণ। একদিন সকালে রেবার্ণ গোপনে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। সে বলল:

আশা করি আপনি কিছু মনে করবে না স্যার; সত্য কথা বলতে কি, গায়করা সব এতই বিরক্ত হয়ে উঠেছে যে তারা কিছু বলতে ইচ্ছুক।

কেন? কি হয়েছে?

এই উইকলো ছোকরাকে নিয়েই গোলমাল স্যার। গায়করা তার উপর এত চটে গেছে যে আপনি কল্পনাও করতে পারবে না।

বলে দাও, বলে যাও। সে কি করেছে?

প্রার্থনা করে স্যার।

প্রার্থনা!

হ্যাঁ স্যার; এই ছোকরার প্রার্থনার জ্বালায় গায়কদের জীবনে কোন শান্তি নেই। সকালে সকলের আগে সে প্রার্থনা করে; সারা দুপুর তাই করে; আর রাতে-দেখুন, রাতের বেলা সে তাদের মধ্যে শুয়ে থাকে যেন একটা ভূতে-পাওয়া মানুষ! ঘুম? দিব্যি করে বলছি, তারা ঘুমুতেই পারে না; সারা রাত সে ওই চালিয়ে যায়। প্রথমে ব্যাণ্ড-মাস্টারকে ধরে; তার হয়ে প্রার্থনা করে। তারপর যায় প্রধান বিউ গল-বাদকের কাছে; তার হয়ে প্রার্থনা করে। তারপর যায় পিতলের ঢাকির কাছে; তাকেও দলে টানে। এমনি করে একে একে সকলকেই দলে ভেড়াতে চেষ্টা করে। কি জানেন স্যার, তাকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়েও কোন ফল হয় না; একে তো তখন সেখানে অন্ধকার, তার উপর বড় ঢাকটার আড়ালে বসে সে প্রার্থনা করে; কাজেই জুতোর ঝড় বয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসে না; বরং সেটাকে প্রশংসা বলেই মনে করে। তারা চীৎকার করে বলে, আঃ থাম হে বাপু। আমাদের একটু বিশ্রাম করতে দাও। ওকে গুলি কর। আঃ, বাইরে একটু বেড়িয়ে এস। এমনি সব কথা। কিন্তু তাতে কি? সে এ সবে কিছুই মনে করে না! একটু থেমে আবার বলতে লাগল; ছেলেটা একটু বোকাও আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবগুলো জুতো কুড়িয়ে একত্র করবে, জোড়ায়-জোড়ায় আলাদা করবে এবং যার যার জুতো তার জায়গায় রেখে দেবে। জুতোগুলো এত বেশী বার তার দিকে ছোঁড়া হয়েছে যে সব জুতো সে চিনে। ফেলেছে-চোখ বুজেই সেগুলোকে সঠিকভাবে আলাদ করতে পারে।

আবার একটু খানি বলতে লাগল:

কিন্তু সব চাইতে শোচনীয় অবস্থা হয় যখন প্রার্থনা শেষ করে-অবশ্য তার প্রার্থনা যদি কখনও শেষ হয়-সে বাঁশি বাজিয়ে গান শুরু করে দেয়। আপনি তো জানেন, যখন সে কথা বলে তখনই তার গলায় মধু ঝরে, আপনি তো জানেন, তার কথা শুনে একটা লোহার কুকুরও দরজা ছেড়ে এসে তার হাত চাটতে চায়। কিন্তু সে যখন গান ধরে, তখন ব্যাপারই আলাদা! ছোকরার গানের কাছে বাঁশির সুরও কর্কশ শোনায়। আঃ, অন্ধকারে তার গলা দিয়ে যখন নীচু স্বরে নরম মিঠে সুরের ফোয়ারা ছোটে তখন মনে হবে আপনি স্বর্গে। আছেন।

এর মধ্যে শোচনীয় অবস্থাটা কি হল?

আহা, সেই কথাই তো বলছি স্যার। সে যখন গান ধরে–

এই তো আমি-গরীব, ভাগ্যহীন, অন্ধ-

শুধু একটি বার এ গান শুনুন, আপনিও গলতে শুরু করবেন; আপনার চোখ জলে ভরে উঠবে! সে যাই থাক না কেন, তাই আপনার মরমে পশিবে-আপনাকে টেনে নিয়ে আসবে। শুধু কান পেতে শুনুন

তুমি শিশু পাপের ও তাপের, বহু দুঃখের ভাপের,
আগামী দিনের কথা থাক, আজই বুঝে নাও যা তোমার ভাগের;
তোমার জন্য আছে ভালবাসা
ঈশ্বরের দেওয়া ভালবাসা

ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনলেই আপনার মনে হবে, আমরা সব অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর, দো-পেয়ে জন্তু। সে যখন গানে গানে বলে তার বাড়ির কথা, তার মায়ের ও শৈশবের কথা, অতীত স্মৃতির কথা, যা কিছু আজ আর নেই, মৃত বন্ধুদের কথা, তখনই আপনার মনে পড়ে যাবে জীবনে যা কিছু আপনি ভালবেসেছেন ও ভালবেসে হারিয়েছেন-আহা, সে যে কত সুন্দর, কত স্বর্গীয় স্যার-কিন্তু হায় ভগবান, কী হৃদয়বিদারক! গাইয়ে-বাজিয়ের দলটা-তারা সকলেই কাঁদতে শুরু করে-সব বেটা শয়তান যারা ছেলেটাকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়ে তারাই হঠাৎ বাংক থেকে নেমে এসে অন্ধকারে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে! হ্যাঁ তাই করে-তাকে কত আদরের নামে ডাকে, ক্ষমা চায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গোটা সেনাবাহিনী যদি ছোকরার একগাছি চুলেও হাত দেয় তো তাদের সঙ্গেই তারা লড়ে যাবে!

আবার চুপচাপ।

সব কথা বলা হয়েছে তো? আমি বললাম।

হ্যাঁ স্যার।

কিন্তু তাহলে অভিযোগটা কি? তারা কি করতে বলে?

কি করবেন? কেন স্যার, তারা চায় আপনি ওর গান করাটা বন্ধ করে দিন।

মার্ক টি কেমন গল্পসমগ্র

কী আশ্চর্য! তুমিই তো বললে তার গান স্বর্গীয় বস্তু।

তা তো বটে ই। বড় বেশী স্বর্গীয় যে। মাটির মানুষ তা সইতে পারে না। এতে শরীর গুলিয়ে ওঠে, ভিতরের সবকিছু বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়; দুঃখ যেন উথলে ওঠে, মন খারাপ হয়ে যায়, দুষ্টুবুদ্ধিতে ভর করে, মনে হয় নরক ছাড়া আর কোথাও বুঝি তার স্থান নেই। সব সময় মনটা এত হু-হুঁ করে যে মুখে স্বাদ থাকে না। জীবনে সুখ থাকে না। আর তারপর সে কী কান্না! জানেন-প্রতিদিন। সকালে লজ্জায় কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতেও পারে না।

দেখ, ব্যাপারটা যেমন অদ্ভুত, অভিযোগটাও তেমনই। তাহলে তারা সত্যি সত্যি চায় যে গান বন্ধ হোক?

হ্যাঁ স্যার, সেটাই তাদের কথা। বেশী কিছু তারা চায় না; তারা চায় প্রার্থনাটা বন্ধ হোক, অন্ততঃ তার কিছু ছাট কাট করা হোক। কিন্তু আসল জিনিস হল ঐ গান। তারা মনে করে গানটা বন্ধ হলে তারা প্রার্থনাটা কোন রকমে মেনে নেবে।

সার্জেন্টকে বললাম, বিষয়টা ভেবে দেখব। সেদিন রাতে লুকিয়ে গায়কদের আস্তানায় ঢুকে কান পাতলাম। সার্জেন্ট অতিরঞ্জিত করে কিছু বলে নি। অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে আসা প্রার্থনা শুনলাম; বিরক্ত লোকগুলির গালাগালি শুনলাম, বাতাসে জুতো ছোঁড়ার শা-শা শব্দ এবং বড় ঢাকটার উপর ধুপধাপ শব্দ শুনলাম। ব্যাপারটা মনে লাগল, আবার মজাও লাগল। ক্রমে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে ভেসে এল গান। ঈশ্বর, কী তার করুণ আকুতি, কী আকর্ষণ! পৃথিবীতে কেউ কোন দিন এত মিষ্টি, এত মনোরম, এত পবিত্র ও মন গলিয়ে দেওয়া গান শোনে নি। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে এলাম; কারণ আমার মধ্যেও যে ভাবে আবেগ উথলে উঠ ছিল সেটা একটা দুর্গের অধিনায়কের মোটেই উপযুক্ত নয়।

পরদিন প্রার্থনা ও গান বন্ধকরবার হুকুম জারি করলাম। পরবর্তী তিন চারটি দিন এত উত্তেজনা ও বিরক্তির মধ্যে কেটে গেল যে ঢাকী ছেলেটার কথা একবারও মনে এল না। কিন্তু একদিন সার্জেন রেবার্ণ এসে হাজির হল; বলল:

স্যার, নতুন ছেলেটি অবাক কাণ্ড করছে।

কি রকম?

দেখুন স্যার, সারাক্ষণ সে লিখেই চলেছে।

লিখছে? কি লিখছে-চিঠি?

জানি না স্যার; যখনই সে কাজ থেকে ছুটি পায় তখনই একা একা দুর্গের চারদিকে ঘুরঘুর করে বেড়ায়-আমার তো মনে হয় দুর্গের

এমন কোন গর্ত বা কোণ নেই যেখানে সে যায় নি-আর সারাক্ষণ কাগজ-পেন্সিল নিয়ে কি যেন লেখে।

খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করে চলতে চাইলাম, কিন্তু যে ব্যাপারে তিলমাত্র সন্দেহ দেখা দিয়েছে তাকে তো উপেক্ষা করা চলে না। উত্তরাঞ্চলে যা সব ঘটে চলেছে তার ফলে আমাদের সদাই সতর্ক থাকতে হয়, সব কিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখতে হয়। মনে পড়ে গেল যে, ছেলেটি এসেছে দক্ষিণ থেকে-দক্ষিণ সীমান্তের লুসিয়ানা থেকে-আর বর্তমান পরিস্থিতিতে এ চিন্তাটা মোটেই স্বস্তিকর নয়। তথাপি রেবার্ণকে নতুন হুকুমটা দিতে আমার খুবই কষ্ট হল। মনে হল, বাবা হয়ে আমি যেন ছেলেকে লজ্জা ও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। রেবার্ণকে বললাম, সে যেন চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকে, আর ছেলেটির অজান্তে তার লেখা কোন কাগজ হাতাতে পারলেই যেন আমাকে এনে দেয়। তাকে সতর্ক করে দিলাম, ছেলেটির উপর যে নজর রাখা হয়েছে এ কথা যেন সে কোন মতেই বুঝতে না পারে। আরও হুকুম দিলাম, ছেলেটির স্বাধীন চলাফেরায় যেন বাধা দেওয়া না হয়, তবে যখনই সে শহরের দিকে যাবে তখনই যেন দূর থেকে তাকে অনুসরণ করা হয়।

পরবর্তী দুদিনে রেবার্ণ বারকয়েক আমাকে খবর দিল। কোন কাজ হয় নি। ছেলেটি লিখেই চলেছে, কিন্তু রেবার্ণ কাছাকাছি হাজির। হলেই সে নির্বিকারভাবে কাগজটা পকেটে পুরে ফেলে। দুবার সে শহরের একটা পরিত্যক্ত, পুরনো আস্তাবলে গেছে, আর, দু এক মিনিট থেকেই বেরিয়ে এসেছে। এ সব ব্যাপারকে তো উপেক্ষা করা চলে না-সব কিছুই কেমন যেন সন্দেহজনক। ক্রমেই আমিও যে অস্বস্তি বোধ করছি সে কথাও স্বীকার করছি। নিজের বাসস্থানে ফিরে গিয়ে আমার সহকারী সৈন্যাধ্যক্ষকে ডেকে পাঠালাম; খুব। বুদ্ধিমান ও সুবিবেচক অফিসার; জেনারেল জেমন ওয়াটসন ওয়েব-এর ছেলে। সেও চিন্তিত হল, বিস্মিত হল। অনেকক্ষণ ধরে দুজনে কথাবার্তা বলে এই সিদ্ধান্ত করলাম যে, একটা গোপন তল্লাসির ব্যবস্থা করা দরকার। স্থির করলাম, নিজেই সে কাজের ভার নেব। সেই মত সকাল দুটো নাগাদ গিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে গায়কদের আস্তানায় হাজির হলাম! তখন সকলেরই নাক ডাকছে। শেষ পর্যন্ত আমার ঘুমন্ত পোষ্যপুরের কাছে পৌঁছে গেলাম, এবং কারও ঘুম না ভাঙিয়ে তার পোশাক-আশাক ও কিট টা হাতিয়ে নিয়ে আবার চুপিচুপি বুকে হেঁটে ফিরে এলাম। আমার বাসায় ফিরে দেখি ফলাফল জানবার অধির আগ্রহে ওয়েব আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে সঙ্গে তল্লাসি শুরু করে দিলাম। পোশাক-আশাক আমাদের হতাশ করল। পকেটের মধ্যে পেলাম সাদা কাগজ, পেন্সিল; আর পেলাম একটা ছোট ছুরি আর এমন সব বাজে টুকিটাকি জিনিস যা ছোট ছেলেরা কুড়িয়ে জমা করে রাখে। অনেক আশা নিয়ে। কিট টায় হাত দিলাম। পেলাম শুধু ধমকানি!-একখানি ছোট বাইবেল; তার পুস্তানির পাতায় লেখা; হে অপরিচিত, মায়ের অনুরোধ, আমার ছেলেটির প্রতি করুণা করো।

ওয়েব-এর দিকে তাকালাম-সে চোখ নামিয়ে নিল; সে আমার দিকে তাকাল–আমি চোখ নামালাম। কারো মুখে কথা নেই। শ্রদ্ধার সঙ্গে বইটাকে যথাস্থানে রেখে দিলাম। ইতিমধ্যে কোন কথা না বলে ওয়েব উঠে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সাহসে বুক বেঁধে আবার সেই অস্বস্তিকর কাজে নেমে পড়লাম; আগের মতই বুকে হেঁটে লুটের জিনিস যথাস্থানে রাখতে গেলাম। যে কাজ করতে চলেছি এটাই তার উপযুক্ত ব্যবস্থা। কাজটা শেষ করে মনে মনে বেশ খুসি বোধ করলাম।

পরদিন দুপুরে রেবার্ণ যথারীতি খবর জানাতে এল। তাকে বাধা দিয়ে বললাম:

এসব বাজে কাজ-কর্ম বন্ধ কর। একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আমরা ভয়ে তোলপার করে বেড়াচ্ছি, অথচ তার কাছে একখানা ধর্মপুস্তক ছাড়া আর কিছুই নেই।

সার্জেট অবাক চোখে তাকিয়ে বলল:

কিন্তু স্যার, আপনার হুকুম মতই তো আমরা কাজ করছি; আর কিছু লেখাও হাতে এসেছে।

তাতে কি হয়েছে? কেমন করে পেলে?

চাবির ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম সে লিখছে। যখন মনে হল লেখাটা শেষ হয়ে এসেছে তখন খুক করে একটু কাশলাম। দেখলাম সে কাগজটা দলা পাকিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল, আর চারদিক তাকিয়ে দেখল কেউ আসছে কি না। তারপর বেশ নির্বিকারভাবে আরাম করে বসল। তখন আমি ঘরে ঢুকলাম, কিছুক্ষণ আরামে কাটালাম, তারপর একটা কাজে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। কোন রকম অস্বস্তি প্রকাশ না করে সে সোজাসুজি চলে গেল। কয়লার আগুনটা সবে ধরানো হয়েছিল; লেখাটা একটা কয়লার চাঙড়ের ওপাশে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল; সেটাকে বের করলাম; এই সে কাগজটা; দেখুন, মোটেই পুড়ে যায় নি।

কাগজটার উপর চোখ বুলিয়ে দুএকটা লাইন পড়েই সার্জেন্টকে বললাম ওয়েবকে পাঠিয়ে দিতে। পুরো কাগজটাতে এই রকম লেখা

ফোর্ট ট্রাম্বুল, ৮ই

কর্ণেল, আমার তালিকায় সবশেষে যে তিনটি বন্দুকের কথা আছে তার ছিদ্রের ব্যাস সম্পর্কে আমার ভুল হয়েছে। সেগুলি ১৮ পাউণ্ডের; বাকি সব অস্ত্র যেমনটি লিখেছি ঠিক তাই। সেনাবাহিনী সম্পর্কে যা জানিয়েছি তাই আছে, শুধু যে দুটি পদাতিক বাহিনীর সীমান্তে যাবার কথা ছিল তারা আপাতত এখানেই থাকছে-কতদিন থাকবে তা এখনই বুঝতে পারছি না, তবে শীঘই পারব। আমরা মনে করি সব কিছু বিবেচনা করে আপাতত ব্যাপারটা স্থগিত রাখাই ভাল যতদিন

তারপর আর লেখা নেই-রেবার্ণ এই সময়ই কেশে ওঠায় লেখক বাঁধা পায়। ঠাণ্ডা মাথায় তার এই নীচ তার দমকা হাওয়ায় ছেলেটির প্রতি আমার স্নেহ, তার প্রতি শ্রদ্ধা, তার দুঃসময়ে তাকে সাহায্য করা-সব একমুহূর্তে নিভে গেল।

কিন্তু সে সব কথা থাক। এখন শুধু কাজ-যে কাজ গভীর মনোযোগসাপেক্ষ। ওয়েব ও আমি চিঠিটা নিয়ে অনেক আলোচনা করলাম, ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলাম। ওয়েব বলল;

বড়ই দুঃখের কথা যে লিখতে লিখতে সে বাধা পেল! একটা কিছু স্থগিত রাখা হচ্ছে, যতদিন-সে কখন? কি সেই ব্যাপার? সম্ভবত সে কথাও সে লিখত-ব্যাটা ধার্মিক বিচ্ছ!

আমি বললাম, হ্যাঁ, একটা তাস হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু চিঠির এই আমরা ট্রা কারা? তারা কি দুর্গের ভিতরকার ষড়যন্ত্রকারী, না বাইরের?

ঐ আমরা কথাটা যেমন অস্বস্তিকর তেমনই অর্থপূর্ণ। যা হোক, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে কোন লাভ নেই বুঝে আমরা বাস্তবে নেমে গেলাম। প্রথমত, শান্ত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণ করে পাহারার ব্যবস্থাটা কঠোর করা হল। তারপর ভাবলাম, উইকলোকে ডেকে তার কাছ থেকে সব কথা বের করে নেই; কিন্তু অন্য পদ্ধতি ব্যর্থ না হওয়া পর্যন্ত সে কাজটা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হল না। আগে আরও কিছু লেখা হস্তগত করতে হবে; কাজেই সে ভাবেই কাজ শুরু হল। এবার মাথায় একটা মতলব এল: উইকলো কখনও ডাকঘরে যায় না-হয় তো পরিত্যক্ত আস্তাবলটাই তার ডাকঘর। আমার ব্যক্তিগত করণিককে ডেকে পাঠালাম-যুবকটি জার্মান, নাম স্টার্ণ; একেবারে জাত-গোয়েন্দা। সব কথা জানিয়ে তাকে কাজে লেগে যেতে বললাম। এক ঘণ্টার মধ্যেই খবর এল, উইকলো আবার লিখতে শুরু করেছে। তার পরেই খবর এল, সে শহরে যাবার অনুমতি চেয়েছে। তাকে কিছুক্ষণ আটকে রেখে দেওয়া হল, আর সেই অবসরে স্টার্ণ গিয়ে আস্তাবলে লুকিয়ে রইল। একসময় সে দেখল, উইকলো ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এল, চারদিক ভাল করে দেখল, এককোণে রাখা জঞ্জালের মধ্যে কি যেন লুকিয়ে রাখল, তারপর ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেল। স্টার্ণ লুকনো জিনিসটার উপর লাফিয়ে পড়ল-একখানা চিঠি-এবং সেটা আমাদের কাছে এনে দিল। চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই, কোন স্বাক্ষরও নেই। আগে যা পড়েছি তারই পুনরাবৃত্তি করে তারপর লেখা হয়েছে:

আমরা মনে করি ব্যাপারটা স্থগিত রাখাই ভাল যতদিন না ঐ দুদল সৈন্য এখান থেকে চলে যায়। মানে ভিতরকার চারজনের তাই মত; অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি-দৃষ্টি আকর্ষণ করার ভয়ে। চারজন বলছি কারণ দুজন এখানে নেই; সৈন্যদলে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জায়গায় আরও দুজনের এখানে আসা একান্তভাবে প্রয়োজন। যে দুজন চলে গেছে তারা ত্রিশ-মাইল পয়েন্ট থেকে আগত দুই ভাই। খুব গুরুতর সংবাদ আছে, কিন্তু এ ভাবে জানাতে ভরসা পাচ্ছি না; অন্যভাবে চেষ্টা করব।

বাচ্চা শয়তান! ওয়েব বলল; কে ভেবেছিল যে সে একটা গুপ্তচর? যা হোক, ও নিয়ে ভেব না; আমাদের হাতে যা খোঁজ-খবর আছে সেগুলি মিলিয়েই দেখা যাক অবস্থা কি দাঁড়ায়। প্রথম, আমাদের মধ্যে একটি বিদ্রোহী গুপ্তচর আছে; তাকে আমরা চিনি। দ্বিতীয়, আমাদের মধ্যেই এমন আরও তিনজন আছে যাদের আমরা চিনি না। তিন, এই সব গুপ্তচররা ইউনিয়ন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সহজ সরল পথেই আমাদের মধ্যে এসেছে এবং স্পষ্টতই তাদের দুজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে। চতুর্থ, বাইরে অনেক সহকারী গুপ্তচর রয়েছে-সংখ্যা অনির্দিষ্ট। পঞ্চম, উইকলোর হাতে একটা খুব গুরুতর খবর আছে যা সে এইভাবে পাঠাতে ভরসা করছে না বলে অন্যভাবে জানাতে চেষ্টা করবে। এই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি। আমরা কি উইকলোর কলার চেপে ধরে তার স্বীকারোক্তি আদায় করব? অথবা যে লোক আস্তাবল থেকে চিঠি গুলো নিয়ে যায় তাকে পাকড়াও করে সব কথা বলতে তাকে বাধ্য করব? অথবা এখন চুপচাপ থেকে আরও কিছু জানবার জন্য অপেক্ষা করব?

স্থির হল, শেষ পন্থাই অবলম্বন করা হবে। ভেবে দেখলাম, এখনই কোন চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার নেই, কারণ সম্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে ঐ দুটি পদাতিক বাহিনী চলে না যাওয়া পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা অপেক্ষা করবে। স্টার্ণকে আরও অনেক কিছু ক্ষমতা দিয়ে বলে দেওয়া হল, উইকলো-র যোগাযোগের অন্য পদ্ধতিটা কি সেটা বের করতে সে যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আমরা একটা বড় রকমের খেলাই খেলতে চাই; আর সেজন্য গুপ্তচরদের যত বেশী দিন সম্ভব সন্দেহের বাইরে রাখতে চাই। কাজেই আমরা স্টার্ণকে নির্দেশ দিলাম, অবিলম্বে আস্তাবলে ফিরে যেতে এবং সব কিছু ঠিক থাকলে উইকলোর চিঠি টা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিতে, যাতে ষড়যন্ত্রকারীরা সেটা পেয়ে যায়।

ক্রমে রাত হল। নতুন কিছুই ঘটল না। রাতটা যেমন ঠাণ্ডা, তেমনই অন্ধকার; একটা ঝড়ো হাওয়া বইছে। অনেক বারই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম, নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখলাম, সব কিছু ঠিক আছে কি না, শান্ত্রীরা সতর্ক হয়ে পাহারা দিচ্ছে কি না। সর্বত্রই দেখলাম, তারা সজাগ ও সতর্ক; রহস্যময় বিপদের গু জব বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে; প্রহরীর সংখ্যা দ্বিগুণ করায় সে গু জব সমর্থিত হয়েছে। ভোরের দিকে একবার ওয়েব-এর সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল; তীব্র বাতাসের মধ্যে সেও বেরিয়ে এসেছে; বলল, সেও ঘুরে ঘুরে দেখছে সব কিছু ঠিকমত চলছে কি না।

পরের দিন ঘটনার গতি কিছুটা দ্রুততর হল। উইকলো আরও একটা চিঠি লিখল; স্টার্ণ তার আগেই আস্তাবলে পৌঁছে দেখতে পেল চিঠিটা সে যথাস্থানে জমা রাখল; উইকলো সরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে চিঠিটা হাতিয়ে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে উইকলোর পিছু নিল; সাদা পোশাকের একজন গোয়েন্দা আবার তার পিছু নিল, কারণ দরকার হলে সে যাতে প্রয়োজনীয় সাহায্য পেতে পারে তার ব্যবস্থা করাই আমরা সমীচিন মনে করেছিলাম। উইকলো সোজা চলে গেল রেলওয়ে স্টেশনে, নিউ ইয়র্ক থেকে ট্রেনটা না আসা । পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল, তারপর গাড়ি থেকে যত যাত্রী নামল তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ইতিমধ্যে সবুজ গগলস্ পরা ছড়ি হাতে একটি বয়স্ক লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে উইকলোর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ল এবং কারও প্রত্যাশায় চারদিকে তাকাতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে তার কাছে ছুটে গিয়ে উইকলো তার হাতে একটা খাম গুঁজে দিল ও তারপরই ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক পরের মুহূর্তেই স্টার্ণও চিঠিখানা ছিনিয়ে নিল এবং গোয়ান্দাটির পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল: বৃদ্ধ লোকটির পিছু নাও-তাকে দৃষ্টির আড়াল করো না। তারপরেই সেও ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে সোজা দুর্গে এসে হাজির হল।

দরজা বন্ধ করে আমরা বসে গেলাম। রক্ষীকে নির্দেশ দেওয়া হল কাউ কে যেন ঢুকতে না দেয়।

প্রথমে আস্তাবলে পাওয়া চিঠিটা খোলা হল। তাতে লেখা ছিল:

পবিত্র মিত্রপক্ষ। যথারীতি বন্দুকের মধ্যে গত রাতে যথাস্থানে রাখা প্রভুর নির্দেশ পেয়েছি; এর দ্বারা নীচু মহল থেকে পাওয়া পূর্ববর্তী সব নির্দেশ বাতিল করা হয়েছে। নির্দেশ যথাযোগ্য হাতে পৌঁচেছে এই মর্মে প্রয়োজনীয় ইঙ্গিত বন্দুকের মধ্যে রেখে দিয়েছি

ওয়েব বাধা দিয়ে বলল: ছেলেটার উপর এখন সর্বদাই নজর রাখা হচ্ছে না কি?

আমি বললাম, হ্যাঁ; তার আগেকার চিঠি টা হাতে পাওয়ার পর থেকেই তার উপর কড়া নজর রাখা হয়েছে।

তাহলে সে কোন জিনিস বন্দুকের মধ্যে ভরছে, আবার বের করে নিচ্ছে, অথচ ধরা পড়ছে না, এটা কেমন করে হয়?

আমি বললাম, দেখ, এটা আমিও ভাল করে বুঝতে পারছি না।

আমিও পারছি না, ওয়েব বলল। এর একটি মাত্র অর্থই হতে পারে যে, শান্ত্রীদের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে। কোন না কোন ভাবে তাদের যোগসাজস ছাড়া এ জিনিস ঘটতেই পারে না।

রেবার্ণকে ডেকে হুকুম দিলাম, সে যেন বন্দুক লি পরীক্ষা করে দেখে কিছু পাওয়া যায় কি না। আবার চিঠি পড়া শুরু করলাম:

নতুন নির্দেশগুলি অবশ্য পালনীয়; তাতে বলা হয়েছে, আগামী কাল সকাল ৩ ঘটিকায় MMMMM হবে FFFFF। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ট্রেনে বা অন্য ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আসবে দুশ এবং যথাসময়ে যথাস্থানে হাজির হবে। আজই সংকেতটা বিলি করে দেব। যদিও কিছু খবর প্রকাশ পেয়েছে, কারণ শান্ত্রীদের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে এবং সেনাপতিরা গতকাল রাতে বেশ কয়েকবার টু হল দিয়েছে, তবু আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত। W. W. আজ দক্ষিণ থেকে আসবে এবং অন্য পদ্ধতিতে গোপন নির্দেশ পাবে। সকাল ঠিক দুটোর সময় তোমরা দুজন অবশ্য ১৬৬-তে উপস্থিত থাকবে সেখানেই B.Bএর দেখা পাবে, বিস্তারিত নির্দেশাদি সেই দেবে। সংকেতবাক্য গতকালের মতই থাকছে, শুধু উল্টে দেওয়া হয়েছে-প্রথম অংশটা শেষে ও শেষের অংশটা আগে বসিয়ে নিও। মনে রেখ XXXX। ভুলো না। মনে সাহস রাখ; পরবর্তী সূর্য ওঠার আগেই তোমরা বীরের মর্যাদা পাবে; তোমাদের খ্যাতি হবে চিরস্থায়ী; ইতিহাসে একটি মৃত্যুহীন পাতা তোমরা যোগ করে যাবে। আমেন।

বজ্র ও দেবতা মার্স, ওয়েব বলে উঠল, দেখে মনে হচ্ছে অবস্থা বেশ গরম হয়ে উঠেছে!

আমি বললাম, অবস্থা যে বেশ ঘোরাল হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তারপর বললাম:

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা বেপরোয়া অভিযান আসন্ন হয়ে উঠেছে। প্রশ্নই উঠতে পারে না। তারপর বললাম:

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা বেপরোয়া অভিযান আসন্ন হয়ে উঠেছে। আজ রাতেই যাত্রার শুরু-সেটাও পরিষ্কার। অভিযানের আসল চেহারা অর্থাৎ তার পদ্ধতি-ঐ সব অর্থহীন M ও F-এর পুটুলির মধ্যে ঢাকা পড়ে গেছে; কিন্তু আমার ধারণা, আকস্মিকভাবে ঘাঁটি দখল করাই এই অভিযানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমাদের অত্যন্ত দ্রুত এগোতে হবে। আমি মনে করি, উইকলোর ব্যাপারে এই লুকোচুরির নীতি চালিয়ে আর কোন লাভ নেই। সকাল দুটোর সময় যাতে সমবেত দলটার উপর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি সেজন্য যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের জানতেই হবে ১৬৬ টা কোথায় অবস্থিত, আর সে তথ্য জানবার নিঃসন্দেহ ও ঐত পথ হচ্ছে ওই ছেলেটার কাছ থেকে সে কথা আদায় করা। কিন্তু কোন রকম কাজে হাত দেবার আগে প্রথমেই সব ব্যাপারটা সমর দপ্তরের গোচরে আনতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে সর্বময় ক্ষমতা চেয়ে নিতে হবে।

তারে পাঠাবার জন্য সংকেতের সাহায্যে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হল; সেটা পড়ে অনুমোদন করে পাঠিয়ে দিলাম।

চিঠিটার আলোচনা শেষ করে আমরা খোঁড়া ভদ্রলোকের হাত থেকে ছিনিয়ে আনা চিঠিটা খুলোম। তার মধ্যে দুখানা সম্পূর্ণ সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছুই ছিল না! আমাদের সব আগ্রহ ও প্রত্যাশার উপর কেউ যেন ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল। মুহূর্তের জন্য আমরাও বুঝি ঐ কাগজের মতই ফাঁকা হয়ে গেলাম, আর ততোধিক বোকা। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের জন্য; পরক্ষণেই অদৃশ্য কালির কথা আমাদের মনে পড়ে গেল। কাগজখানাকে আগুনের উপর ধরে গরম লেগে তাতে কি লেখা ফুটে ওঠে দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম; কিন্তু কয়েকটা অস্পষ্ট টান ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তখন সার্জেনকে ডেকে পাঠিয়ে কাগজটা নিয়ে সব রকম পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাতে বলে দিলাম। তাকে আরও বলে দিলাম, যে মুহূর্তে সঠিক পরীক্ষার দ্বারা চিঠির লেখা ফুটিয়ে তুলতে পারবে তৎক্ষণাৎ যেন সে সব কথা আমাদের জানিয়ে দেয়। এই বাধা আমাদের বিব্রত করে তুলল; যত দেরী হচ্ছে ততই আমাদের বিরক্তি বাড়ছে; তখনও আমাদের পুরোপুরি আশা যে, এই চিঠিটা থেকেই ষড়যন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোপন কথা আমরা জানতে পারব।

এমন সময় সার্জেন্ট রেবার্ণ এসে হাজির। তিনটে গিট দেওয়া ফুট খানেক লম্বা এক টুকরো টোয়াইন সুতো পকেট থেকে বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরল।

বলল, উপকূল-সীমান্তের একটা বন্দুকের মধ্যে এটা পেয়েছি। সবগুলো বন্দুকের ভিতর থেকে ঘড়িটা বের করে ভাল করে পরীক্ষা। করেছি; এই সুতোটা ছাড়া আর কিছুই পাই নি।

তাহলে প্রভুর নির্দেশ যে ভুল হাতে পড়ে নি সেটা বোঝাবার সংকেত হিসাবেই উইকলো এই সুতোর টুকরোটা ব্যবহার করেছে। তখনই হুকুম দিলাম, গত চব্বিশ ঘণ্টা যে সব শাস্ত্রী ওই বন্দুকটার কাছাকাছি ছিল তাদের প্রত্যেককে অবিলম্বে আলাদা আলাদা ভাবে আটক রাখা হোক এবং আমার সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া কারও সঙ্গে যেন তাদের যোগাযোগ রাখতে না দেওয়া হয়।

এবার এল সমর-সচিবের কাছ থেকে চিঠি। তাতে লেখা:

হেবিয়াস কর্পাস স্থগিত রাখুন। সামরিক আইনে আটক করুন। প্রয়োজন মত গ্রেপ্তার করুন। উৎসাহ ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করুন। দপ্তরকে অবহিত রাখুন।

এবার কাজে নামবার মত ব্যবস্থা হল। লোক পাঠিয়ে সেই খোঁড়া ভদ্রলোকটি কে গোপনে গ্রেপ্তার করিয়ে সকলের অলক্ষে দুর্গে নিয়ে আসা হল। তাকে কড়া পাহারায় রাখা হল। সব রকম যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হল। প্রথমে তর্জন-গর্জন করলেও পরে সে হাল ছেড়ে দিল।

পরবর্তী খবর হল, উইকলো যখন দুজন নবনিযুক্ত সৈনিকের হাতে কিছু গুঁজে দেয় তখন রক্ষীরা তা দেখে ফেলে, আর সে পিছন ফিরবার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পাকড়াও করে আটক করে। দুজনের কাছেই একটু করো কাগজে এই রকম লেখা পাওয়া গেছে।

ঈগল পাখির তৃতীয় অভিযান
স্মরণ রেখ XXXX
১৬৬

নির্দেশ মত সাংকেতিক টেলিগ্রামের মারফ ৎ দপ্তরকে সব খবর জানিয়ে একটু করো লেখার বিবরণও পাঠিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে উইকলোর ব্যাপারে সব মুখোশ খুলে ফেলবার মত যথেষ্ট শক্তি আমরা অর্জন করেছি; কাজেই তাকে ডেকে পাঠালাম। অদৃশ্য কালি-তে লেখা চিঠি টাও ফেরৎ নিয়ে এলাম; সেই সঙ্গে সার্জন জানাল যে তার পরীক্ষায় এখনও কোন ফল হয় নি, তবে ভবিষ্যতে দরকার হলে অন্য অনেক রকম ভাবে সে এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারে।

ইতিমধ্যে উইকলো ঘরে ঢুকল। তাকে খুব শ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তবে সে বেশ সংযত ও স্বচ্ছন্দই ছিল। যদি কোন রকম সন্দেহ তার মনে জেগেও থাকে, চোখ-মুখ দেখে তা বোঝবার উপায় নেই। একটু সময় দাঁড় করিয়ে রেখে ভালভাবেই বললাম:

দেখ বাপু, মাঝে মাঝে ই তুমি ঐ পুরনো আস্তাবলে যাও কেন?

কোন রকম অপ্রস্তুত না হয়ে সরল ভাবেই সে জবাব দিল:

দেখুন স্যার, সেটা আমিও ঠিক জানি না; কোন বিশেষ কারণও নেই; শুধু আমি একটু একা থাকতে চাই, আর সেখানে গেলে আমার ভাল লাগে।

ভাল লাগে, বলছ?

হ্যাঁ স্যার, আগের মতই নির্দোষ সরলতার সঙ্গে সে উত্তর দিল।

শুধু এই জন্যই সেখানে যাও?

দুটি বড় বড় নরম চোখে শিশু সুলভ বিস্ময় প্রকাশ করে সে বলল, হ্যাঁ স্যার।

ঠিক বলছ?

হ্যাঁ স্যার, ঠিক বলছি।

একটু থেমে আমি বললাম:

উইকলো, তুমি এত লেখ কেন?

আমি? আমি তো বেশী লিখি না স্যার।

লেখ না?

না স্যার। ও হো, ওই সব আঁকিবুকির কথা বলছেন? তা একটু করি, মজা পাবার জন্য।

আঁকিবুকিগুলো দিয়ে কি কর?

কিছুই করি না স্যার-ফে লে দিই।

কখনও কাউকে পাঠাও না?

না স্যার।

হঠাৎ কর্ণেলকে লেখা চিঠিটা তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। ঈষৎ চমকে উঠে পরক্ষণেই সে সামলে নিল। তার গালে একটু লালের ছোপ পড়ল।

তাহলে এই আঁকিবুকিটা পাঠিয়েছিলে কেন?

কোন ক্ষ-ক্ষতি করতে আমি চাই নি স্যার!

ক্ষতি করতে চাও নি! সেনাবাহিনীর প্রতি, তোমার পদমর্যাদার প্রতি তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ, আর বলছ ক্ষতি করতে চাও নি?

মাথা নীচু করে সে চুপ করে রইল।

কথা বল। মিথ্যে কথা রাখ। এ চিঠি কার জন্য লিখেছিলে?

এবার সে বিব্রত বোধ করল; কিন্তু শীঘই সে ভাব সামলে নিয়ে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে বলল:

আপনাকে সত্য কথাই বলব স্যার-পুরো সত্য। কারও জন্যই ও চিঠি আমি লিখি নি। নিজের মনের সুখেই লিখেছি। এখন বুঝতে পারছি কী ভুল আর বোকামিই না করেছি। বিশ্বাস করুন স্যার, অপরাধ যদি কিছু করে থাকি তো ঐ পর্যন্তই।

খুসি হলাম। এ রকম চিঠি লেখা খুবই বিপজ্জনক। তুমি যে এই একটি মাত্র চিঠিই লিখেছ, আশা করি সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ স্যার, সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

তার ধৃষ্টতা বিস্ময়কর। কী আশ্চর্য আন্তরিকতার সঙ্গে সে মিথ্যা কথাগুলি বলে যাচ্ছে। আমার ক্রমবর্ধমান ক্রোধকে শান্ত করতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর বললাম:

উইকলো, স্মৃতিকে নেড়ে চেড়ে দেখ তো দুতিনটি ছোট খাট ব্যাপারে যা জানতে চাই তার জবাব দিতে পার কি না।

যথাসাধ্য চেষ্টা করব স্যার।

তাহলে শুরু করি-এই প্রভুটি  কে?

চমকে উঠে সে আমাদের মুখের দিকে তাকাল; কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মুহূর্তের মধ্যে আবার গম্ভীর হয়ে সে শান্তভাবে জবাব দিল:

আমি জানি না স্যার।

তুমি জান না?

না স্যার।

ঠিক বলছ তুমি জান না?

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে সে যথেষ্ট চেষ্টা করল, কিন্তু চাপটা বড়ই বেশী; ধীরে ধীরে তার থুতনিটা বুকের উপর ঝুলে পড়ল; সে চুপ করে গেল; সেইখানে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে বোতামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল যে যত খারাপ কাজই করে থাকুক তবু তাকে দেখে করুণা হল। ইতিমধ্যে নীরবতা ভঙ্গ করে আমি প্রশ্ন করলাম:

পবিত্র মিত্রপক্ষ কারা?

তার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল; দুটি হাত তুলে এমন ভঙ্গী করল যেন কোন হতাশ জীব সহানুভূতির জন্য আবেদন জানাচ্ছে। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। মাটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েই রইল। সে কি বলে শুনবার অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। দেখতে দেখতে তার গাল বেয়ে চোখের জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম:

আমার প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতেই হবে বাপু। সত্য কথাই তোমাকে বলতে হবে। পবিত্র মিত্রপক্ষ কারা?

সে নীরবেই কাঁদতে লাগল। তখন আমি কিছুটা শক্ত গলায় বললাম:

জবাব দাও!

অনেক চেষ্টা করে আবেদনের ভঙ্গীতে মুখ তুলে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কোন রকমে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।

দয়া করুন স্যার। এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, কারণ আমি জানি না।

কি বললে!

সত্যি স্যার, আমি ঠিকই বলছি। এই মুহূর্তের আগে পবিত্র মিত্রপক্ষ-এর কথা আমি কখনও শুনি নি। বিশ্বাস করুন স্যার, সত্যি তাই।

হায় ভগবান! তোমার এই দ্বিতীয় চিঠি টার দিকে তাকাও; এই যে, পবিত্র মিত্রপক্ষ কথাটা দেখতে পাচ্ছ? এখন কি বলবে?

যেন তার প্রতি মহা অন্যায় করা হয়েছে তেমনই আহত দৃষ্টি মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে আবেগভরে বলে উঠল:

এটা একটা নিষ্ঠুর তামাসা স্যার; সাধ্যমত ভাল কাজ করতেই আমি চেষ্টা করেছি, কখনও কারও কোন ক্ষতি করি নি, তবু কেন তারা আমার সঙ্গে এমন খেলা খেলছে? কেউ আমার হাতের লেখা নকল করেছে; এ চিঠির একটি লাইনও আমি লিখি নি; এ চিঠি ও এর আগে কখনও দেখি নি!

আঃ, কী অকথ্য মিথ্যাবাদী তুমি! এই যে, এটার সম্পর্কে তুমি কি বলতে চাও?-অদৃশ্য কালিতে লেখা চিঠিটা পকেট থেকে বের করে তার চোখের সামনে মেলে ধরলাম।

তার মুখটা সাদা হয়ে গেল-মরা মানুষের মুখের মত সাদা। টলতে টলতে দেয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিল। একটু পরে শোনা যায় কি যায় না এমনই দুর্বল গলায় জিজ্ঞাসা করল:

আপনি-আপনি এটা পড়েছেন?

সত্য কথাই বলতাম, কিন্তু তার আগেই মুখ ফসূকে একটা মিথ্যা হ্যাঁ বেরিয়ে গেল। দেখলাম, ছেলেটির চোখে আবার সেই সাহস ফিরে এসেছে। তার কথা শুনবার জন্য অপেক্ষা করলাম, কিন্তু সে চুপ করেই রইল। তখন আমি বললাম:

 এই চিঠির যা বক্তব্য সে বিষয়ে তোমার কি বলার আছে?

পরিপূর্ণ সংযমের সঙ্গে সে জবাব দিল:

শুধু বলতে চাই, বক্তব্যগুলি সম্পূর্ণ নিরীহ ও নির্দোষ; তাতে কাউকে আঘাত করা হয় নি।

তার কথাকে অপ্রমাণ করতে তো পারব না, তাই নিজেই কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। এরপর কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

যা হোক, একটা ধারণা মাথায় আসায় স্বস্তি পেলাম। বললাম:

তুমি ঠিক বলছ যে প্রভু এবং পবিত্র মিত্রপক্ষ সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না, আর এই চিঠি যেটাকে তুমি জাল বলছ সেটাও তুমি লেখ নি?

হ্যাঁ স্যার-ঠিক বলছি।

ধীরে ধীরে গিঁট দেওয়া টোয়াইন সুতো বের করে বিনা বাক্যব্যয়ে তার সামনে তুলে ধরলাম। নিপূহভাবে সেটার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চোখ ফেরাল। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তবু রাগ চেপে স্বাভাবিক গলায়ই বললাম:

উইকলো, এটা দেখতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ স্যার।

এটা কি?

একটু করো সুতো বলে মনে হচ্ছে।

মনে হচ্ছে! এটা একটু করো সুতোই বটে। এটাকে চিনতে পারছ?

যতদূর শান্তস্বরে সম্ভব জবাব দিল, না স্যার।

কী আশ্চর্য অচঞ্চল ভাব তার! কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রইলাম, যাতে সেই নীরবতা আমার বক্তব্যকে আরও জোরদার করে তুলতে পারে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে গম্ভীরভাবে বললাম:

দেখ বাপু, এতে তোমার কোন লাভ হবে না-একেবারেই না। প্রভুর কাছে পাঠানো এই সংকতে, উপকূল-সীমান্তের একটি বন্দুকের মধ্যে পাওয়া এই গিট দেওয়া সুতো-

বন্দুকের মধ্যে পাওয়া! না, না, না! বন্দুকের মধ্যে বলবেন না, বলুন ঘড়ির একটা ফাটলের মধ্যে!-এটা নিশ্চয় একটা ফাটলের মধ্যে ছিল! নতজানু হয়ে বসে দুই হাত একত্র করে সে মুখটা তুলল। সে মুখ ভয়ে এতই উদ্ভ্রান্ত ও ছাইয়ের মত হয়ে গেছে যে দেখলে করুণা হয়।

না, এটা বন্দুকের মধ্যে ছিল।

ওঃ, কোথাও কিছু ভুল হয়েছে! হা ভগবান, আমি গেলাম! লাফ দিয়ে উঠে তাকে ধরবার জন্য উদ্যত হাতগুলিকে এড়িয়ে সে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগল, সেখান থেকে পালাবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পালানো অসম্ভব। তখন আবার হাঁটু ভেঙে বসে প্রাণপণ শক্তিতে চেঁচিয়ে উঠে সে আমার পা জড়িয়ে ধরল; আর কাতর স্বরে মিনতি করে বলতে লাগল, হায়, আমার প্রতি করুণা করুন! আমাকে দয়া করুন! আমাকে ধরিয়ে দেবেন না; তাহলে তারা আমাকে এক মুহূর্তও বাঁচতে দেবে না! আমাকে আশ্রয় দিন, রক্ষা করুন। সব কথা বলব!

তাকে শান্ত করে, তার ভয় দূর করে তার মনটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। তখন আমি প্রশ্ন করতে লাগলাম, আর সে অবনত চোখে মাঝে মাঝে ই অবিশ্রাম ঝরে পড়া চোখের জল মুছতে মুছতে বিনীতভাবে জবাব দিতে লাগল:

তাহলে মনেপ্রাণে তুমি বিদ্রোহী?

হ্যাঁ স্যার।

এবং প্তচর?

হ্যাঁ স্যার।

বাইরের সুস্পষ্ট নির্দেশ অনুসারেই তুমি কাজ করছিলে?

হ্যাঁ স্যার।

স্বেচ্ছায়?

হ্যাঁ স্যার।

নিশ্চয়ই খুসি মনে?

হ্যাঁ স্যার; অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। দক্ষিণ আমার দেশ; আমার অন্তর দক্ষিণী; আর তার জন্যই আমি সব কিছু করেছি।

তাহলে তোমার প্রতি অন্যায় এবং তোমার পরিবারের নির্যাতনের যে কাহিনী তুমি আমাকে বলেছিলে সেটা উপস্থিত মত বানানো ছিল?

তারা-তারা আমাকে এই কথাই বলতে বলেছিল স্যার।

আর যারা তোমার প্রতি করুণা করেছিল, তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিল, তুমি চেয়েছিলে তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে, তাদের

ধ্বংস করতে। হায় পথভ্রান্ত যুবক, তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি কত নীচু?

জবাবে সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

যাক সে কথা। কাজের কথায় এস। এই কর্নেল কে? সে কোথায় থাকে?

সে ডুকরে কেঁদে উঠল; কিছুতেই জবাব দিতে চাইল না। বলল, একথা বললে তাকে খুন করে ফেলবে। আমি ভয় দেখালাম, সত্য কথা না বললে তাকে অন্ধকার ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কথা দিলাম, সব কথা খুলে বললে যে কোন বিপদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করব। কিন্তু মুখে যেন কুলুপ এঁটে অনমনীয় দৃঢ়তায় সে চুপ করে রইল। তখন আমিও ব্যবস্থা নিলাম।

অন্ধকার সেলটা একনজর দেখেই তার মত পাল্টে গেল। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে সে সব কথা বলতে স্বীকার করল।

তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। এবার সে কর্ণেল-এর নাম বলল, তার বর্ণনা দিল। বলল, শহরের সেরা হোটেলে সাধারণ নাগরিকের পোশাকে তাকে পাওয়া যাবে। পুনরায় ভয় দেখালে তবে সে প্রভুর নাম ও বিবরণ বলে দিল। বলল, আর, এফ, গেলর্ড নামে পরিচিত প্রভু-কে পাওয়া যাবে নিউ ইয়র্কের ১৫, বণ্ড স্ট্রীট-এ। তখনই শহরের পুলিশের বড়কর্তাকে টেলিগ্রামে ঐ নাম ও বিবরণ জানিয়ে দিয়ে বললাম, গেলর্ড কে গ্রেপ্তার করা হোক, এবং আমি না ডেকে পাঠানো পর্যন্ত আটক করে রাখা হোক।

তারপর বললাম, আমি জানি কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী বাইরে আছে-সম্ভবত তারা নিউ লণ্ডন-এই আছে। তাদের নাম ও বিবরণ বল।

তিনজন পুরুষ ও দুটি স্ত্রীলোকের নাম ওবিবরণ সে দিল-তারা সকলেই শহরের বড় হোটেলে আছে। নিঃশব্দে লোক পাঠিয়ে তাদের

সব কজনকে ও কর্নেল-কে গ্রেপ্তার করে দুর্গে এনে আটক করলাম।

তারপর-এই দুর্গের মধ্যে তোমার যে তিনজন সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারী আছে তাদের সব খবর আমি জানতে চাই।

মনে হল, এবার সে একটা মিথ্যা কথা বলে আমাকে ভাঁওতা দিতে যাচ্ছিল; কিন্তু তখনই আমি তাদের দুজনের কাছে যে রহস্যময় দু টুকরো কাগজ পাওয়া গিয়েছিল সেটা মেলে ধরলাম তার সামনে, আর তাতে চমৎকার ফল পেলাম। তাকে বললাম, দুজনকে আমরা ধরতে পেরেছি, তাকে দেখিয়ে দিতে হবে তৃতীয় জনকে। এতে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল; চেঁচিয়ে বলল:

দয়া করে আমাকে ও কাজ করতে বলবেন না; সে সেখানেই আমাকে খুন করে ফেলবে!

আমি বললাম, ওসব বাজে কথা; তাকে রক্ষা করবার জন্য কাছাকাছি আমি লোক রেখে দেব; তাছাড়া সব লোকদেরই নিরস্ত্র অবস্থায় হাজির করা হবে। আমার হুকুমে সব নবনিযুক্ত সৈনিকদের এক জায়গায় জডে করা হল, আর সে বেচারী কঁপতে কাঁপতে এসে যথাসম্ভব নির্লিপ্তভাবে তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তাদের একজনকে একটি কথা বলে পাঁচ পা যেতে না যেতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হল।

উইকলো পুনরায় আমাদের সামনে হাজির হতেই তিনজনকে ডেকে আনা হল। তাদের একজনকে এগিয়ে এসে দাঁড়াতে বলে আমি বললাম:

উইকলো, মনে থাকে যেন, আসল সত্য থেকে একচুলও সরবে না। এই লোকটি কে, আর এর সম্পর্কে তুমি কি জান?

কোন উপায় নেই বুঝতে পেরে ফলাফলের চিন্তা দূরে সরিয়ে সে লোকটির মুখের উপর চোখ রেখে বিনা দ্বিধায় নীচের কথাগুলি বলে গেল:

এর আসল নাম জর্জ ব্রিস্টো। এসেছে নিউ অর্লিয়েন্স থেকে; দুবছর আগে ছিল উপকুলবাহী জাহাজ ক্যাপিট ল-এর দ্বিতীয় মেট; লোকটি বেপরোয়া; মানুষ খুন করার অপরাধে দুবার জেল খেটেছে-একবার লোহার রড় দিয়ে খুন করেছিল একজন খালাসিকে, আর একবার খুন করেছিল একটা মজুরকে সে জল মাপবার ওলনটা তুলতে রাজী হয় নি বলে। ও একটি গুপ্তচর, আর সেই কাজ করবার জন্যই কর্নেল ওকে এখানে পাঠিয়েছে। ৫৮-তে সেন্ট নিকোলাস জাহাজে যখন বিস্ফোরণ ঘটে তখন ও ছিল সেই জাহাজের তৃতীয় মেট; এবং একটি খালি নৌকোয় করে নিহত ও আহতদের যখন তীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তাদের জিনিসপত্র লুট করবার অপরাধে প্রায় মরতে বসেছিল।

এইভাবে সে লোকটির পুরো জীবন-বৃত্তান্ত বলে গেল। তার কথা শেষ হলে আমি লোকটিকে বললাম:

এ বিষয়ে তোমার কি বলার আছে?

এ রকম নারকীয় মিথ্যা আর কেউ কখনও বলে নি স্যার।

তাকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিয়ে একে একে অন্যদের ডাকলাম। ফল একই। ছেলেটি প্রত্যেকেরই বিস্তারিত ইতিহাস বলে গেল; এতটুকু ইতস্তত করল না; কিন্তু দুটি বদমাসই একবাক্যে জানাল যে ছেলেটি র কথা সর্বৈ মিথ্যা। তারা কিছুই স্বীকার করল না। তাদেরও কয়েদখানায়া পাঠিয়ে দিয়ে একে একে বাদবাকি সব কয়েদীদের হাজির করলাম। উইকলো তাদের সকলের কথাই বলল–দক্ষিণের কোন্ শহর থেকে তারা এসেছে, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কার কি সম্পর্ক তারও বিস্তারিত বিবরণ দিল।

কিন্তু তারা সকলেই ছেলেটির কথা অস্বীকার করল এবং কেউই কোন কথা কবুল করল না। পুরুষরা রাগ দেখাল, মেয়েরা কান্নাকাটি করল। তাদের কথা হল, তারা সকলেই নির্দোষ; এসেছে পশ্চিম অঞ্চল থেকে; ইউনিয়নকে তারা পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে বেশী ভালবাসে। বিরক্ত হয়ে সবগুলোকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে আবার উইক্লােকে জেরা শুরু করে দিলাম।

নং ১৬৬ কোথায়, এবং B, B. কে?

কিন্তু এখানে সে অনড় হয়ে দাঁড়াল। উপরোধ বা ভীতিপ্রদর্শন-কোনটাতেই কাজ হল না। সময় বয়ে যাচ্ছে-তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পা বেঁধে তাকে ঝুলিয়ে দিলাম। যতই যন্ত্রণা বাড়তে লাগল ততই সে চীৎকার করতে লাগল। সে চাকার অসহ্য। কিন্তু

আমিও অবিচল। শীঘ্রই সে চীৎকার করে বলল;

ওঃ, দয়া করে আমাকে নামিয়ে দিন; আমি বলব!

না-আগে বল, তারপর নামাব।

প্রতিটি মুহূর্তই যন্ত্রণাদায়ক। কাজেই তার মুখে কথা ফুটল:

নং ১৬৬, ঈগল হোটেল!-উপকুলবর্তী একটা বাজে সরাইখানার নাম করল; সেখানে যত রাজ্যের দিন-মজুর, জাহাজী নাবিক আর কুখ্যাত লোকদের আডড়া।

তাকে মুক্ত করে দিয়ে জানতে চাইলাম, এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য কি।

ফোঁস ফোঁস করতে করতেই ঈষৎ উদ্ধতভঙ্গীতে সে বলল, আজ রাতে দুর্গ দখল করা।

ষড়যন্ত্রের সব পাণ্ডাদের ধরতে পেরেছি কি?

না। ১৬৬-তে যাদের জমায়েত হবার কথা তাদের ছাড়া বাকিদের হাতে পেয়েছেন।

স্মরণ কর XXXX-এ কথার মানে কি?

কোন কথা নেই।

১৬৬-তে যাবার সংকেত কি?

কোন জবাব নেই।

FFFFF ও MMMM অক্ষর-গুচ্ছ দুটি অর্থ কি? জবাব দাও। নইলে আবার ফাঁসাদে পড়বে।

কিছুতেই জবাব দেব না। তার আগে মরব। এখন করুণ যা আপনার খুসি।

উইকলো, কি বলছ ভাল করে ভেবে দেখ। এই কি শেষ কথা?

নিষ্ফম্প গলায় দৃঢ়স্বরে সে বলল:

এই শেষ কথা। আমার দেশকে আমি ভালবাসি, আর উপরের সূর্য যত কিছুর উপর কিরণ বর্ষণ করে তাকে করি ঘৃণা-এ যেমন নিশ্চিত, তেমনই নিশ্চিত আমার কথা। এ সব কথা প্রকাশ করবার আগে আমি মৃত্যুকেই বরণ করব।

আবার তাকে পা বেঁধে ঝুলিয়ে দিলাম। বেচারী যখন যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল। সে দৃশ্য হৃদয়বিদারক, কিন্তু তার কাছ থেকে আর কিছুই জানা গেল না। প্রতিটি প্রশ্নের একই জবাব তার আর্তকণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল; আমি মরতে জানি; আমি মরব; কিন্তু কিছুতেই বলব না।

হাত ছেড়েই দিতে হল। বুঝতে পারলাম, সে মরবে তবু কবুল করবে না। সুতরাং নীচে নিয়ে গিয়ে তাকে কড়া পাহাড়ায় রেখে দেওয়া

তারপর বেশ কয়েক ঘন্টা সময় সমর দপ্তরে টেলিগ্রাম পাঠাতে এবং নং ১৬৬-তে ঝাঁপিয়ে পড়বার উদ্যোগ-আয়োজন করতেই আমরা ব্যস্ত রইলাম।

সে এক উত্তেজনা-ভরা সময়-সেই অন্ধকার তিক্ত রাত। খবর ফাঁস হয়ে গেছে; সমগ্র বাহিনী সদাসতর্ক। শান্ত্রীর সংখ্যা তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। মাথা লক্ষ্য করে তাক করা বন্দুকের সামনে না দাঁড়িয়ে কেউ দুর্গে ঢুকতে বা দুর্গ থেকে বেরতে পারছে না। যা হোক, ওয়েব ও আমার দুশ্চিন্তা এখন আগেকার চাইতে অনেক কম, কারণ অনেকগুলি বড় বড় পাণ্ডা আমাদের মুঠোয় ধরা পড়ায় ষড়যন্ত্রের জোর এখন স্বভাবতই অনেকটা কমে গেছে।

স্থির করলাম, যথাসময়ে নং ১৬৬-তে হানা দেব, B. B. কে পাকড়াও করব, এবং বাকি সকলের আসার অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে থাকব। সকাল একটা পনের মিনিট নাগাদ আধা ডজন বাছাই-করা যুক্তরাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর লোককে সঙ্গে নিয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় উইকলো ছোকরাকেও সঙ্গে নিলাম। আমরা চলেছি নং ১৬৬-তে; যদি দেখি যে সে আমাদের মিথ্যা বলে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে তাহলে ঠিক পথ দেখাতে তাকে বাধ্য করতে পারব; অন্যথায় কৃতকর্মের ফল তাকে অবশ্য ভোগ করতে হবে।

চুপি চুপি পা ফেলে সরাইখানাটায় পৌঁছে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। ছোট মদের ঘরটাতে আলো জ্বলছে; বাকি বাড়িটা। অন্ধকার। সামনের দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে সেটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর জুতো খুলে সকলে মদের ঘরে ঢুকলাম, জার্মান মালিকটি চেয়ারে বসেই ঘুমুচ্ছে। তাকে আস্তে জাগিয়ে তুলে বললাম, জুতো খুলে আমাদের আগে আগে চল; খবরদার, টু শব্দটি করবে না। বিনা বাক্যব্যয়ে সে কথা মতই কাজ করল; বেচারি ভয়ানক ভয় পেয়ে গেছে। ১৬৬-র পথে চলতে হুকুম দিলাম। একদল বিড়ালের মত নরম পায়ে বেশ কিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা লম্বা হলের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দরজার ঘসা কাঁচের ভিতর দিয়ে ভিতরকার আবছা আলো দেখতে পেলাম। অন্ধকারে আমার গা ছুঁয়ে মালিক ফি সৃফিস্ করে জানাল, এটাই ১৬৬। দরজায় চাপ দিলাম-ভিতর থেকে বন্ধ। একটি দশাসই চে হারার সৈনিকের কানে কানে হুকুম জারি করলাম; তারপর সকলে কাধ লাগিয়ে চাপ দিতেই দরজাটা কা থেকে খুলে গেল। পলকের জন্য বিছানায় একটি মূর্তিকে দেখতে পেলাম-তার মাথাটা তীরের মত মোমবাতির দিকে ঝুঁকে পড়ল; আলোটা নিভে গেল; আমাদের ঘিরে নেমে এল নিরস্ত্র অন্ধকার। একলাফে বিছানার উপর পড়ে আমার হাঁটু দিয়ে লোকটাকে চেপে ধরলাম। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য বন্দী ভীষণভাবে চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু বাঁ হাত দিয়ে তার গলাটাও সজোরে চেপে ধরলাম। সেই অবস্থায়ই রিভলবারটা বের করে ঘোড়াটাকে টেনে তার ঠাণ্ডা নলটা তার গালের উপর চেপে বসালাম।

বললাম, এবার যে কেউ একটা আলো জ্বালাও! একে আমি বাগে এনেছি।

তাই করা হল। দেশলাই জ্বলে উঠল। বন্দীর দিকে তাকালাম। হায় জর্জ! এ যে একটি স্ত্রীলোক!

তাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলাম; বেশ একটু ভয়ই পেয়েছি। প্রত্যেকেই বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। সকলেরই যেন বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে। সত্যি, কাণ্ডটা যেমন আকস্মিক, তেমনই চমকপ্রদ।

তরুণীটি কাঁদতে শুরু করে দিল; বিছানার চাদরে মুখ ঢাকল। মালিক সবিনয়ে বলল:

আমার মেয়ে; এমন একটা কাজ সে করছিল যেটা ঠিক নয়।

তোমার মেয়ে? এই তরুণী তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, সে আমার মেয়ে। কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় আজ রাতেই সে সিনসিনাটি থেকে বাড়ি এসেছে।

বড়ই গোলমেলে ব্যাপার; ছেলেটা আবার মিথ্যা বলেছে। এটা সঠিক ১৬৬ নয়; এও B. B. নয়। ওহে উইকলো, সঠিক ১৬৬-তে আমাদের নিয়ে চল, নইলে-আরে! ছেলেটা কোথায় গেল?

পালিয়েছে; নির্ঘাৎ পালিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, তার কোন হদিসই পাওয়া গেল না। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি। কেন তাকে বেঁধে একজন সৈন্যের হাতে রেখে দিই নি সে বোকামি তো আমারই। কিন্তু সে কথা ভেবে এখন আর কোন লাভ নেই। এ অবস্থায় কি করা উচিত-সেটাই আসল প্রশ্ন। এই মেয়েটি ও তো B. B. হতে পারে। আমি তা বিশ্বাস করি না। কিন্তু অবিশ্বাসকে তো প্রমাণ বলে মানা যায় না। কাজেই শেষ পর্যন্ত হলঘরের অপর প্রান্তে ১৬৬-র উল্টো দিকের একটা খালি ঘরে আমার লোকজনদের মোতায়েন করে হুকুম জারি করে দিলাম, যে কেউ মেয়েটির ঘরের দিকে যাবে তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে এবং পুনরাদেশ পর্যন্ত সরাইখানার মালিককেও যেন কড়া নজরে তাদের সঙ্গেই রাখা হয়। তারপরই দুর্গের অবস্থা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে অতিদ্রুত সেদিকে পা চালিয়ে দিলাম।

হ্যাঁ, সবই ঠিক ছিল। আর ঠিকই রইল। সারা রাত জেগে বসে রইলাম। কিছুই ঘটল না। আবার ভোর হয়েছে দেখে, এবং তারকা-রেখালাঞ্ছিত পতাকা যে তখনও ট্রাম্বুল দুর্গের মাথায় উড়ছে এ কথা সরকারী দপ্তরকে টেলিগ্রামে জানাতে পেরে মনে অবর্ণনীয় পুলক অনুভব করলাম।

বুকের উপর থেকে মস্ত বড় একটা বোঝা নেমে গেল। তবু কড়া পাহারা বা উদ্যোগ-আয়োজনে কোন রকম ঢিল দিলাম না; বর্তমান পরিস্থিতিতে তা করা চলে না। বন্দীদের একে একে ডেকে তুললাম, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের জ্বালাতন করলাম, কিন্তু কোন কাজ হল না। তারা দাঁত কড়মড় করল, চুল ছিঁড়ল, কিন্তু কোন কথাটি ফাঁস করল না।

দুপুর নাগাদ নিখোঁজ ছেলেটির খবর এল। সকাল ছটায় এখান থেকে আট মাইল দূরে তাকে দেখা গেছে-পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে পায়ে হেঁটে। সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারোহী বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট ও একটি সাধারণ সৈনিককে পাঠিয়ে দিলাম তার খোঁজে। বিশ মাইল গিয়ে তবে তারা তার দেখা পেল। একটা বেড়া ডিঙিয়ে কর্দমাক্ত মাঠ পেরিয়ে সে শ্রান্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে গ্রামের শেষ। প্রান্তের একটা পুরনো ধাঁচের অট্টালিকার দিকে। একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘুর পথে এগিয়ে গিয়ে লেফটেন্যান্ট উল্টো দিক থেকে সে বাড়িতে পৌঁছে গেল এবং ঘোড়া থেকে নেমে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। কেউ কোথাও নেই: পাশের একটা ঘরে ঢুকে গেল; সেটাও ফাঁকা; সে ঘর থেকে সামনের ঘর বা বসবার ঘরে যাবার দরজাটা খোলা সে ঘরে পা দিতে যাবে এমন সময় একটা নীচু গলা তাদের কানে এল; কে যেন প্রার্থনা করছে। শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা থামল। লেফটেন্যান্ট মাথাটা ভিতরে গলিয়ে দেখতে পেল বসবার ঘরের এক কোণে একটি বৃদ্ধ ও একটি বৃদ্ধা নতজানু হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধ লোকটি ই প্রার্থনা করছিল। তার প্রার্থনা শেষ হবার মুখেই উইকলো ছোকরা সামনের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকল। দুই বুড়ো-বুড়ি লাফ দিয়ে তার কাছে এগিয়ে এসে ছেলেটি কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চীৎকার করে বলতে লাগল:

আমাদের খোকা! আমাদের সোনা! ঈশ্বরের আশীর্বাদ। হারানো মানিক ফিরে পেয়েছি! মৃত্যুর পরেও সে জীবিত ফিরে এসেছে!

কি রকম বুঝছেন স্যার? সেই ক্ষুদে শয়তান এই রকম বাড়িতে জন্মেছে, লালিত-পালিত হয়েছে; মাত্র একপক্ষ কাল আগে আমার বাসায় ঢুকে একটা করুণ কাহিনীর জাল বুনে আমাকে ধোঁকা দেবার আগে জীবনে সে কোন দিন এ বাড়ি ছেড়ে পাঁচ মাইলও যায় নি। এ কথা বেদ-বাক্যের মতই সত্য। ঐ বৃদ্ধ তার বাবা-একজন শিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত পাদরি; আর ঐ বৃদ্ধা তার মা।

ঐ ছেলে ও তার ক্রিয়াকাণ্ড বোঝাতে আরও দুএকটি কথা বলছি। পরে জানা গেল, ছেলেটি সস্তা উপন্যাস ও চাঞ্চল্যকর গল্পে ভর্তি পত্র-পত্রিকা রাক্ষসের মত গিলত-সুতরাং গভীর রহস্য ও ঝকমকে বীরত্বের কল্পনা তাকে সব সময় হাতছানি দিত। তারপর আমাদের চারপাশে বিদ্রোহী গুপ্তচরদের গোপন চলাফে লা, তাদের মহৎ উদ্দেশ্য ও তাদের দুতিনটে লোমহর্ষক কার্যকলাপের বিবরণ খবরের কাগজের প্রতিবেদনে পড়ে পড়ে তার কল্পনা একেবারে উদ্দাম হয়ে ওঠে। কয়েকমাস যাবৎ তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল এক ইয়াংকি যুবক। সে যেমন কথা বলতে ওস্তাদ, তেমনিই তার কল্পনাশক্তিও প্রবল। মিসিসিপি নদী ধরে নিউ অর্লিয়ান্স থেকে দু তিনশ মাইল উজান পর্যন্ত চলাচলকারী একটা মালবাহী নৌকোয় সে যুবকটি বছর দুই মাড ক্লার্ক [তার মানে ছোট ভাণ্ডারী)-এর কাজ করেছিল-কাজেই সেই অঞ্চলের কিছু নাম ও বিবরণ সে সহজেই আয়ত্ত করে নিয়েছিল। এদিকে যুদ্ধের আগে দেশের ঐ অঞ্চ লটায় আমি দুতিন মাস কাটিয়েছিলাম; ফলে ঐ অঞ্চ লটার যৎ সামান্য যে জ্ঞান আমার হয়েছিল তার ফলে ছেলেটি সহজেই আমাকে বোকা বানাতে পেরেছিল; কিন্তু একজন আজন্ম লুসিয়ানিয়াবাসী মাত্র পনেরো মিনিট কথা বললেই তার সব ফাঁকিবাজী ধরে ফেলতে পারত। তার রাজদ্রোহাত্মক কাজের কয়েকটি জটিল কথার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সে কেন বলেছিল যে সে মরবে তবু বলবে না তা জানেন কি? তার কারণ সে নিজেই তা জানত না!-সেগুলির কোন অর্থই হয় না; অগ্র-পশ্চাৎ মা ভেবেচিন্তেই কল্পনার বশেই সে কথাগুলো বলে ফেলেছিল; ফলে হঠাৎ যখন সেগুলো বুঝিয়ে দেবার ডাক পড়ল তখন কোন ব্যাখ্যাই তার মাথায় এল না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, অদৃশ্য কালি-তে লেখা চিঠিতে কি কথা লুকিয়েছিল তা সে বলতে পারে নি, তার কারণ ঐ চিঠিতে কোন গুপ্ত কথাই ছিল না, ওটা নেহাতই একটা সাদা পাতা। বন্দুকের মধ্যে সে কখনও কিছু রাখে নি, তার রাখবার ইচ্ছাও তার হয় নি, কারণ আসলে সে চিঠি গুলো লিখত সব কাল্পনিক লোকদের উদ্দেশ্য করে; যখনই সে আস্তাবলে একটা চিঠি লুকিয়ে রেখে দিত তখনই আগের দিন রেখে যাওয়া চিঠিটা তুলে নিত; ঠিক সেই রকম গিঁট দেওয়া সুতোটাও সে চিনত না, কারণ আমি যখন তাকে সেটা দেখালাম তখনই সে প্রথম সেটা দেখল; কিন্তু যখনই আমি তার কাছে জানতে চাইলাম ওটা কোথা থেকে এসেছে, তখনই সে রোমান্টিকভাবে। একটা গল্প ফেঁদে বসল এবং বেশ ভাল ফলও পেল। মিঃ গেলর্ড ও তারই আবিষ্ণুর; ঠিক সেই সময় ১৫ বণ্ড স্ট্রীটে কোন বাড়িই ছিল না-তিন মাস আগেই বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কর্ণেলও তারই আবিষ্কার; অন্য যে সব হতভাগ্যদের গ্রেপ্তার করে তার সামনে হাজির করেছিলাম তাদের কাল্পনিক জীবন-বৃত্তান্তও তারই কল্পনার সৃষ্টি; B. B.-ও তার সৃষ্টি; বলা যেতে পারে যে নং ১৬৬-ও তারই আবিষ্কার, কারণ সেখানে পৌঁছবার আগে সে জানতই না যে ঈগল হোটেল-এ ঐ নম্বরের কোন ঘর আছে। দরকার মতই সে যে কোন মানুষ বা ঘটনার মনগড়া বিবরণ তৈরি করেছে। আমি যখন বাইরের গুপ্তচরদের কথা জানতে চাইলাম তখন সে সঙ্গে সঙ্গেই যে সব অপরিচিত লোকের বিবরণ বলে গেল তাদের সে হয় তো হোটেলে দেখেছিল এবং ঘটনাক্রমে তাদের নামগুলিও শুনেছিল। আরে, সেই সব উত্তেজনাপূর্ণ দিনের একটা আড়ম্বরপূর্ণ, রহস্যময়, রোমান্টিক জগতে সে বাস করত; আমি তো মনে করি, সে জগৎটাই তার কাছে সত্য; সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সে জগৎটাকে সে উপভোগ করত।

কিন্তু আমাদের সে যথেষ্ট বিপদে ফেলে দিল; অসম্মানের এক শেষ হল। বুঝতেই পারছেন, তার জন্য পনেরো বিশ জনকে গ্রেপ্তার করে দুর্গের মধ্যে আট কর করা হল; প্রত্যেকের দরজায় শান্ত্রী মোতায়েন করা হল। বন্দীদের মধ্যে অনেকেই ছিল সৈন্যদলের লোক তাই তাদের কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে হয় নি; কিন্তু বাকিরা ছিল দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত প্রথম শ্রেণীর সব নাগরিক ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের খুসি করা বড় শক্ত। তারা তো রেগে আগুন হয়ে গেল; কেলেংকারীর আর শেষ রইল না। আর ঐ দুটি মহিলা-একজন ওহিয়োর জনৈক কংগ্রেসী সদস্যের স্ত্রী, অপর জন পশ্চিমের জনৈক বিশপ-এর বোন-দেখুন, আমাকে লক্ষ্য করে যে ঘৃণা, বিদ্রূপ, ও ক্রুদ্ধ অশ্রুজল তারা বর্ষণ করলেন তার স্মৃতি আমার অনেক কাল মনে থাকবে-আর আমিও মনে করে রাখব। গগলস্ পরা সেই বৃদ্ধ খোঁড়া ভদ্রলোক ফিলাডেলফিয়ার একটি কলেজের প্রেসিডেন্ট–এখানে এসেছিলেন ভাই-পোর শেষকৃত্যে যোগদান করতে। তিনি আগে কখনও উইকলোকে চোখেও দেখেন নি। অথচ শেষকৃত্যে যোগদান করার পরিবর্তে বিদ্রোহী গুপ্তচর হিসাবে তাকে জেলে তো ঢুকতে হলই, উপরন্তু উইকলো আমার বাসায় আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় এক নাগাড়ে বলে গেল যে সে একটি জালিয়াৎ, ক্রীতদাস-ব্যবসায়ী ঘোড়া-চোর, এবং গালভেস্টন-এর কুখ্যাত ও ণ্ডার আডড়ার একজন পাক্কা বদমাস। বেচারি বুড়ো ভদ্রলোকটি এ ধাক্কা সামলাতে পারবেন বলে মনে হয় না।

আর সমর দপ্তরের কথা! হায় আমার কপাল, কাহিনীর সে অংশের এখানেই যবনিকা পড়ুক!

মন্তব্য। এই পাণ্ডুলিপিটা আমি মেজরকে দেখিয়েছিলাম। তিনি বললেন: সামরিক ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় না থাকায় আপনি কিছু ছোট খাট ভুল করেছেন। তবু বিবরণটা খুবই সুন্দর হয়েছে-চালিয়ে দিন; সামরিক লোকরা সেগুলি পড়ে একটু হাসবে, আর বাকি পাঠকরা ধরতেই পারবে না। ইতিহাসের আসল ঘটনাগুলি আপনি ঠিকই ধরেছেন এবং ঠিক যেভাবে ঘটে ছিল সেই ভাবেই লিখেছেন। এম. টি.

[১৮৮১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *