ক্যানভাসারের কাহিনী

ক্যানভাসারের কাহিনী
The Canvasser’s Tale

গরিব, বিষণ্ণ-নয়ন অপরিচিত লোকটি! এই ভাবটিই ফুটে উঠেছিল তার মুখের বিনীত ভাবে, তার ক্লান্ত দৃষ্টিতে ও জীর্ণ ভদ্র পোশাকে। ফলে তার বগলে একটা পোর্টফোলিও থাকা সত্ত্বেও আমার বুকের অসীম শূন্যতায় যেটুকু বদান্যতার বীজ তখনও অবশিষ্ট ছিল তাকেই সে নাড়া দিল। নিজের মনেই বললাম, দেখ, ঈশ্বর তার এই সেবককে আর একটি ক্যানভাসারের হাতে সঁপে দিয়েছেন।

আসলে এ সব লোক সব সময়ই আগ্রহ সৃষ্টি করে থাকে। এবং ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে উঠবার আগেই লোকটি আমাকে তার। কাহিনী বলতে শুরু করল, আর আমিও মনোযোগ ও সহানুভূতি সহকারে তা শুনতে লাগলাম। তার কথাগুলি অনেকটা এই রকম:

আমি যখন একটি নিষ্পাপ ছোট শিশু তখনই আমার বাবা-মা মারা যায়। আমার খুড়ো ইথুরিয়েল আমাকে বুকে তুলে নিয়ে নিজের সন্তানের মত মানুষ করতে লাগলেন। এই বিরাট বিশ্বে তিনিই ছিলেন আমার একমাত্র আত্মীয়; কিন্তু তিনি ছিলেন ভাল মানুষ, ধনী ও উদারহৃয়। ভোগ-বিলাসের মধ্যেই তিনি আমাকে মানুষ করতে লাগলেন। টাকা দিলে যা পাওয়া যায় এমন কোন জিনিসের অভাব আমার ছিল না।

যথাসময়ে আমি গ্র্যাজুয়েট হলাম এবং একজন নায়েব ও একজন খানসামাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হলাম। চার বছর ধরে বহু দূরবর্তী অঞ্চলের সৌন্দর্যের বাগানে নিশ্চিন্ত পাখা মেলে উড়ে বেড়ালাম। আমার ভাষা চিরদিনই কাব্যের সুরে বাঁধা; তাই আশা করি। এ ধরনের ভাষা ব্যবহারের অনুমতি আপনি আমাকে দেবেন; তাছাড়া, আপনার চোখ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনিই ঐ ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, আর সেই জন্যই সাহস করে আপনার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলেছি; সেই সব দূর দেশে যে সুধাময় আহার্য আমি গ্রহণ করেছি তাতে আত্মা, মন ও হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেখানকার ধনী লোকদের মধ্যে শোভন ও মূল্যবান বিরল দ্রব্যাদি সংগ্রহের যে রীতি প্রচলিত ছিল সেটাই আমার জন্মগত সৌন্দর্যপ্রীতিকে সব চাইতে বেশী করে আকর্ষণ করল, আর কুক্ষণে আমার খুড়ো ইথুরিয়েলকে এই মনোরম সংগ্রহ-বৃত্তির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করে তুললাম।

এই ভদ্রলোকের ছিল ঝিনুকের বিরাট সংগ্রহ; আর একজনের ছিল সমুদ্রের জমাট ফে না দিয়ে তৈরি পাইপের চমৎকার সংগ্রহ; আর একজনের ছিল এমন সব স্বাক্ষরের সংগ্রহ যার পাঠোদ্ধার করা যায় না; একজনের ছিল প্রাচীন চীনামাটির বাসনের অমূল্য সংগ্রহ একজনের ছিল মনমাতানো ডাক-টি কিটে র সংগ্রহ; এমনই কত-কত রকম সংগ্রহ; আর সে সব কথাই আমি খুড়োকে চিঠি লিখে জানালাম। শীঘ্রই আমার চিঠি র ফ ল ফ লতে শুরু করল। আমার খুড়োও একটু একটু করে সংগ্রহের নেশায় মেতে উঠলেন। আপনি হয় তো জানেন, এ সব নেশা কত দ্রুত বাড়ে। দেখাতে দেখতে তার নেশা ও চরমে উঠল, যদিও আমি তা জানতাম না। মস্ত বড় মাংসের ব্যবসার দিকে আর তাঁর নজর রইল না। ক্রমে সে ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ অবসর নিয়ে অবসর সময়টাকে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের খোঁজে ব্যয় করতে লাগলেন। প্রচুর অর্থের মালিক তিনি, কাজেই অর্থের অভাব হল না। শুরু করলেন গরুর ঘণ্টা দিয়ে। সংগৃহীত ঘন্টায় পাঁচ টা বড় চ ঘর ভর্তি হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যত রকমের গরুর ঘণ্টা তৈরি হয়েছে সব তিনি সংগ্রহ করলেন-শুধু একটি ছাড়া। অধুনালুপ্ত সেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি ছিল অপর একজন সংগ্রহকারীর দখলে। সেটার জন্য খুড়ো প্রচুর টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু সে লোক কিছুতেই বিক্রি করবে না। বুঝতেই পারছেন তার অনিবার্য পরিণতি কি দাঁড়াল। একজন সত্যিকারের সংগ্রহকারীর কাছে অসমাপ্ত সংগ্রহের কোনই মূল্য নেই। তখন তার মন ভেঙে যায়, সব কিছু বিক্রি করে দেয়, অন্য কোন কর্মক্ষেত্রে সে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

আমার খুড়োও তাই করলেন। এবার তিনি ইট সংগ্রহ নিয়ে পড়লেন। চমৎকার একটি বড় মাপের সংগ্রহও হল। কিন্তু আবার দেখা দিল। সেই একই বাধা; আবার তার মন ভেঙে গেল; দুস্প্রাপ্য ইট খানির মালিক এক অবসরপ্রাপ্ত মদ-চোলাইকারীর কাছে তিনি অতিপ্রিয় সংগ্রহগুলি বেচে দিলেন। তারপর তিনি হাত দিলেন আদিম মানুষের চকমকি পাথরের টাঙ্গি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজে। কিন্তু ক্রমে তিনি জানতে পারলেন, যে সব কারখানায় এই সব জিনিস তৈরি হয় তারা তাকে ছাড়াও অন্য সব সংগ্রহকারীকেও সেগুলি সরবরাহ করছে। তারপর শুরু কলেন আজটে ক-শিলালিপি ও খড়ভর্তি তিমি সংগ্রহের কাজ-কিন্তু অবিশ্বাস্য পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ের পরে সেখানেও জুটল ব্যর্থতা। তার সংগ্রহ হয়ে এসেছে এমন সময় গ্রীনল্যাণ্ড থেকে এল এমন একটা খড়খড়ি তিমি, আর মধ্য আমেরিকার চান্দারোঙ্গো অঞ্চল থেকে এল এমন একখানি আজটে ক-শিলালিপি যাতে আগেকার সব নিদর্শনগুলিকেই তুচ্ছ মনে হল। খুড়ো তড়িতে ছুটে গেলেন এই দুটি মানিক সংগ্রহ করতে। খড়খড়ি তিমিটি পেলেন, কিন্তু শিলালিপিখানি পেয়ে গেল অপর এক সংগ্রহকারী। আপনি হয়তো জানেন, একখানি আসল চান্দারোঙ্গো এতই মূল্যবান যে কোন সংগ্রহকারী একবার সেটা হাতে পেলে সে বরং তার পরিবারকে বেচে দেবে, তবু সেটাকে হাতছাড়া করবে না। কাজেই আমার খুড়ো সব কিছু বেচে দিল; চোখের সামনে তার আদরের সংগ্রহগুলো চলে গেল, আর ফিরে এল না; মাত্র একটি রাতের মধ্যেই তার মাথার কয়লা-কালো চুল বরফের মত সাদা হয়ে গেল।

এত দিনে তিনি থামলেন; ভাবতে লাগলেন। তিনি বুঝলেন, আবার ব্যর্থ হলে তিনি মারাই যাবেন। স্থির করলেন, এর পরে তিনি এমন একটা জিনিস বেছে নেবেন যা কেউ সংগ্রহ করে না। খুব সাবধানে মনস্থির করে আবার কাজে নামলেন-এবার তিনি সংগ্রহ করবেন। প্রতিধ্বনি।

কি বললেন?-আমি প্রশ্ন করলাম।

প্রতিধ্বনি স্যার। তিনি প্রথমে কিনলেন জর্জিয়ার প্রতিবি-সেটা চারবার ধ্বনিত হয়; তারপর কিনলেন মেরল্যাণ্ড-এর ষষ্ঠ ধ্বনি; তারপর মেইন-এর ত্রয়োদশ-ধ্বনি; তারপর কার-এর নয়-ধ্বনি; আর তার পরেরটি টেনেসি-র দ্বাদশ-ধ্বনি; বলতে গেলে এই শেষেরটা তিনি বেশ সস্তায় পেয়ে গেলেন, কারণ পাহাড়ের যে চূড়ায় শব্দটি প্রতিফলিত হত সেটা ভেঙে পড়ায় সে প্রতিধ্বনিটা। মেরামতের বাইরে চলে গিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, কয়েক হাজার ডলার খরচ করে তিনি ওটা মেরামত করে নিতে পারবেন এবং রাজমিস্ত্রি লাগিয়ে উচ্চ তাটাকে আরও বাড়িয়ে প্রতিধ্বনির শক্তিটাকে আরও তিন গুণ বাড়িয়ে নিতেও পারবেন। কিন্তু যে বাস্তুকার কাজটনিল সে এর আগে কখনও প্রতিধ্বনি সংক্রান্ত কাজ না করায় পুরো জিনিসটাকেই বরবাদ করে ফেলল। সে হাত দেবার আগে এটা শাশুড়ির মত বকবক করতে পারত, কিন্তু এখন এটা মূক-বধিরদের শিবির ছাড়া আর কোথাও কাজে লাগবে না। দেখুন, এরপর তিনি বিভিন্ন রাজ্যে ও অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলি সস্তা দামের ছোট ছোট দোনলা প্রতিধ্বনি এক লটে কিনে নিলেন; এক লটে কেনা হল বলে তিনি শতকরা কুড়ি ভাগ ছাড় পেলেন। তারপর কিনলেন অরিগন-এর প্রতিধ্বনিকারক একটা ভাল গ্যাটু লিং-বন্দুক, আর তাতে খরচ পড়ল প্রচুর। গ্রেট পিট একো নামক যে অরিগন-প্রতিধ্বনিটি খুড়ো কিনলেন সেটা ছিল বাইশ ক্যারেটের, আর সেটার দাম ছিল দুশ ষোল হাজার ডলার।

এদিকে আমার দিন কাট ছিল গোলাপের পথে পা ফেলে। আমি তখন জনৈক ইংরেজ জমিদারের একমাত্র মনোরমা কন্যার পাণিপ্রার্থী, তার প্রেমে উন্মাদ। তাকে কাছে পেলে আমি যেন সুধা-সমুদ্রে সাঁতার কাটি। আমাকে নিয়ে পরিবারের লোকজনরাও খুসি, কারণ সকলেই জানে যে পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের মালিক খুড়োর আমি একমাত্র উত্তরাধিকারী। অবশ্য তখন আমরা কেউই জানতাম না যে আমার খুড়ো ইতিমধ্যে সংগ্রহকারীদের দলে ভিড়ে গিয়েছেন।

এবার কিন্তু আমার অজ্ঞাতসারেই মেঘ ঘনিয়ে এল আমার মাথার উপরে। ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে সেই স্বর্গীয় প্রতিধ্বনি সমগ্র জগতের কাছে যার পরিচয় মহান কোহিনুর অথবা প্রতিধ্বনি-গিরি নামে। সেটা ছিল পঁয়ষট্টি ক্যারেটের মাল। দিন শান্ত থাকলে আপনি যে কোন শব্দ করুন না কেন পনেরো মিনিট ধরে তার প্রতিধ্বনি আপনার কানে বাজতে থাকবে। কিন্তু কি কাণ্ড দেখুন, ঠিক সেই সময় আরও একটি ঘটনা ঘটল-দেখা দিল আরও একজন প্রতিধ্বনি সংগ্রহকারী। দুজনই ছুটে গেল সেই অতুলনীয় সম্পদটি। কিনতে। সম্পদটি আসলে হল-নিউ ইয়র্ক রাষ্ট্রের উপকণ্ঠ স্থ দুটি ছোট পাহাড় ও তাদের মধ্যবর্তী একটি অগভীর ছায়াঘেরা জলাশয়। দুজন একই সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হল, কিন্তু কেউ কারও খবর জানত না। প্রতিধ্বনিটা কোন একজনের সম্পত্তি নয়; উইলিয়ামসন বলিভার জার্ভিস হল পূব দিককার পাহাড়ের মালিক, আর হার্বিসন জে. ব্লেড সো হল পশ্চিম দিককার পাহাড়ের মালিক মাঝ খানের জলাশয়টি হল সীমানা-রেখা। সুতরাং আমার খুড়ো যখন ত্রিশ লক্ষ দু শ পঁচাশী ডলার দিয়ে জার্ভিস-এর পাহাড়টা কিনছিলেন, তখন ত্রিশ লক্ষ ডলারের কিছু বেশী দিয়ে অপর পক্ষ কিনছিল ব্লেডসো-র পাহাড়টা।

এখন, এর স্বাভাবিক পরিণতিটা বুঝতে পারছেন তো? আরে, পৃথিবীর এই মহত্তম প্রতিধ্বনিটির মালিকানা চিরদিনের মত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, কারণ পৃথিবীর এই রাজসিক প্রতিধ্বনিটির মাত্র অধ্বংশের মালিকানা গেল এক-এক জনের দখলে। এই অংশীদারী মালিকানা নিয়ে দুজনের একজনও খুসি নয়, অথচ কেউ কাউকে নিজের অংশটা বিক্রিও করবে না। শুরু হল গালাগালি, ঝগড়া ও বুক-জ্বালা। অবশেষে যে তীব্র বিদ্বেষ একমাত্র একজন সংগ্রহকারীই অপর একজন সংগ্রহকারী ভাইয়ের প্রতি পোষণ করতে পারে তারই বশে অপর সংগ্রহকারীটি তার পাহাড়কে কেটে ফেলতে উদ্যত হল।

বুঝতেই তো পারছেন, যে যখন প্রতিধ্বনির মালিক হতে পারল না তখনই সে স্থির করল যাতে আর কেউ সেটা না পায়। সে পাহাড়টাকেই সরিয়ে দেবে; তাহলে তো আমার খুড়োর প্রতিধ্বনিকে ফিরিয়ে দেবার কিছুই থাকবে না। খুড়ো বাধা দিতে গেলেন, কিন্তু সে লোকটি বলল, প্রতিধ্বনির এই অংশের মালিক আমি; আমি এটাকে নষ্ট করে দেব; আপনি আপনার দিকটার ব্যবস্থা দেখুন গে।

আমার খুড়ো লোকটির বিরুদ্ধে একটি স্থিতাবস্থার নির্দেশ আদায় করে নিলেন। অপর লোকটি ও আপিল করে উচ্চতর আদালতে মামলা লড়তে লাগল। ক্রমে সে মামলা গড়াল যুক্ত রাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট  পর্যন্ত। দুজন বিচারক বলল, প্রতিধ্বনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি; এটা দৃষ্টি ও সপর্শযোগ্য না হলেও ক্রয়যোগ্য, বিক্রয়যোগ্য ও তার ফলে করধার্যযোগ্য; অপর দুজন বলল, প্রতিধ্বনি স্থাবর সম্পত্তি, কারণ এটা স্পষ্টতই জমির সঙ্গে জড়িত এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরযোগ্য নয়; অপর বিচারকগণ বলল, প্রতিধ্বনি মোটে ই কোন সম্পত্তি নয়।

শেষ পর্যন্ত স্থির হল: প্রতিধ্বনি সম্পত্তিই বটে; পাহাড় দুটি ও সম্পত্তি; দুজনই দুটো পাহাড়ের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মালিকানার অধিকারী, কিন্তু প্রতিধ্বনির ক্ষেত্রে দুজন সম-ভাড়াটে মাত্র; সুতরাং নিজের পাহাড় কেটে ফেলবার সম্পূর্ণ অধিকার বিবাদীর আছে, কারণ সেই পাহাড়টার একমাত্র মালিক, কিন্তু তার ফলে প্রতিধ্বনির ক্ষেত্রে আমার খুড়োর যদি কোন ক্ষতি হয় তার ক্ষতিপূরণ বাবদ তাকে ত্রিশ লক্ষ ডলার মূল্যের ইনডেমনিটি বণ্ড-এ সই করতে হবে। সেই রায়ে আমার খুড়োর অংশের প্রতিধ্বনিকে প্রতিফলিত করবার জন্য বিবাদীর সম্মতি ব্যতিরেকে তার পাহাড়টাকেই ব্যবহার করা থেকেও খুড়োকে বিরত থাকতে বলা হল; তিনি শুধু তার পাহাড়টাকে ব্যবহার করতে পারবেন; এই পরিস্থিতিতে তার অংশের প্রতিধ্বনি যদি সক্রিয় না হয় সেটা খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু আদালতের হাতে তার কোন প্রতিকার নেই। আদালতের নির্দেশে, খুডোর সম্মতি ছাড়া বিবাদীকেও তার অংশের প্রতিধ্বনিকে খুড়োর পাহাড়ে প্রতিফলিত করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। তাহলেই বুঝুন, কী অপূর্ব পরিণতিই না হল! কেউ সম্মতিও দেবে না, আর এই বিস্ময়কর মহৎ প্রতিধ্বনিটি অকেজো হয়েই পড়ে থাকবে। সেইদিন থেকেই এই চমৎকার সম্পত্তিটি সিল করে অ-বিক্রয়যোগ্য করে রাখা হয়েছে।

আমার বিয়ের দিনের এক সপ্তাহ আগেকার কথা। আমি তখনও আনন্দ-সাগরে সাঁতার কাট ছি; আমাদের বিয়েতে যোগ দিতে দূর-দূরান্ত থেকে ভদ্রজনরা এসে সমবেত হয়েছে; এমন সময় এল আমার খুড়োর মৃত্যুসংবাদ; আর সেই সঙ্গে এল তার উইলের একটা নকল; তাতে আমাকেই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। তিনি চলে গেছেন; হায়, আমার একমাত্র উপকারী প্রিয়জন আর নেই! সেকথা ভাবলে আজও আমার বুকের ভিতরটা উথলে ওঠে। উইলটা জমিদারবাবুর হাতে দিলাম; চোখের জলে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হওয়ায় আমি সেটা পড়তে পারলাম না। জমিদারবাবু সেটা পড়ে কঠোর স্বরে বলল; বাপু হে, একে তুমি সম্পত্তি বল?-কি জানি, তোমাদের মুদ্রাস্ফীতির দেশে হয় তো তাই বলে। তুমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছ একটা বড় মাপের প্রতিধ্বনির সংগ্রহ-অবশ্য আমেরিকা মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রতিধ্বনিসমূহকে যদি সংগ্রহ বলা চলে। শুধু তাই নয়, তুমি ঋণে একেবারে আকণ্ঠ ডুবে আছ; সব কটি প্রতিধ্বনিই মর্টগেজে বাঁধা। দেখ বাপু, আমি নিষ্ঠু র নই, কিন্তু আমার সন্তানের কল্যাণ তো আমাকে দেখতেই হবে; যদি এমন একটি প্রতিধ্বনিও তোমার থাকত যাকে সৎভাবে তুমি তোমার নিজস্ব বলতে পার; যদি এমন একটি প্রতিধ্বনিও তোমার থাকত যা দায়বদ্ধ নয়; আমার মেয়েকে নিয়ে যার উপর তুমি নির্ভর করতে পারতে এবং সৎভাবে পরিশ্রম করে অনুশীলনের দ্বারা তার উন্নতি বিধান করে একটা জীবিকার সংস্থান করে নিতে পারতে, তাহলে আমি না বলতাম না; কিন্তু একটি ভিখারীর সঙ্গে তো আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি না! অতএব আদরের মেয়েটি আমার, ওকে পরিত্যাগ কর; আর তুমি বাপু তোমার মর্টগেজ-কণ্টকিত প্রতিধ্বনি নিয়ে সরে পড়; চিরদিনের মত আমার চোখের সম্মুখ থেকে দূর হয়ে যাও।

সুন্দরী সিলেস্টিন চোখের জলে বুক ভিজিয়ে দুখানি প্রেমময় বাহু বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল; শপথ করে বলল, পৃথিবীতে যদি একটি প্রতিধ্বনিও আমার না থাকে তথাপি স্বেচ্ছায়, সানন্দে সে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু তা হল না। পরস্পরের কাছ থেকে আমাদের ছিনিয়ে নেওয়া হল। কাঁদতে কাঁদতে বারো মাসের মধ্যেই সে মারা গেল, আর আমি বেঁচে রইলাম একাকি বিষণ্ণচিত্তে জীবনের দীর্ঘপথ পরিক্রমা করতে, আর প্রতিদিন প্রতিটি ঘণ্টা সেই মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানাতে যার ফলে যে-রাজ্যে দুষ্টরা কষ্ট দিতে পারে না আর ক্লান্ত পথিক পায় বিশ্রাম সেখানে আমরা আবার মিলিত হতে পারব। এবার স্যার, আপনি যদি আমার পোর্ট ফোলিও-র ভিতরকার এই মানচিত্র ও নক্সাগুলি দেখেন তাহলে আমি নিশ্চয়ই এত স্বল্পদামে আপনাকে একটি প্রতিধ্বনি বিক্রি করতে পারব যা এ ব্যবসায় নিযুক্ত আর কোন লোকই আপনাকে দিতে পারবে না। এই যে এটা দেখছেন, ত্রিশ বছর আগে আমার খুড়ো এটা। কিনেছিলেন দশ ডলার দিয়ে, সারা টেক্সাস-এ এটা মধুরতম প্রতিধ্বনি, আর আপনাকে এটা আমি দেব মাত্র–

তার আগে আমার কথা শুনুন আমি বললাম। দেখুন, আজ সারাটা দিন মুহূর্তের জন্যেও ক্যানভাসারদের হাত থেকে রেহাই মেলে নি। দরকার না থাকলেও একটা সেলাই-যন্ত্র কিনেছি; একটা মানচিত্র কিনেছি যার সবটাই ভুলে ভরা; একটা ঘড়ি কিনেছি যেটা চলে না; একটা পোকা মারার বিষ কিনেছি যেটা পোকাদের বড়ই প্রিয় পানীয়; কত যে অকেজো জিনিস কিনেছি তার শেষ নেই; কিন্তু এ রকম বোকামি আর করব না। আপনি অমনি দিলেও আপনার কোন প্রতিধ্বনি আমি নেব না। আমার বাড়িতেই ও জিনিস রাখব না। যারা আমার কাছে প্রতিধ্বনি বেচতে আসে তাদের আমি ঘৃণা করি। এই বন্দুকটা দেখছেন তো? আপনার জিনিসপত্র নিয়ে এখনই সরে পড়ুন: বৃথা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাবেন না।

কিন্তু সে শুধু একটি বিষণ্ণ মিষ্টি হাসি হাসল, আর আরও কিছু নক্সা বের করে দেখাতে লাগল। এর ফলাফল তো আপনারা ভালই জানেন, কারণ একবার কোন ক্যানভাসারকে ঘরের দরজা খুলে দিলে আর রক্ষা নেই, আপনাকে পরাজয় মানতেই হবে।

একটি দুঃসহ ঘটা এই লোকটির সঙ্গে কাটাবার পরে আমিও তার সঙ্গে আপোষ করলাম। ভাল অবস্থায় দুটো দো-লা প্রতিধ্বনি। কিনলাম, আর অন্য আরেকটি গছিয়ে দিয়ে সে জানাল যে এটা বিক্রয়যোগ্য নয়, কারণ এটা শুধুই জার্মান ভাষায় কথা বলতে পার। সে বলল, এই মেয়ে-পুতুলটি এক সময় চমৎকার বহু ভাষাবি ছিল, কিন্তু কি করে যেন তার মুখের তালুটা নেমে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *