ভাল ছোট ছেলেটির কাহিনী

ভাল ছোট ছেলেটির কাহিনী
The Story of the good Little Boy

এক সময়ে একটি ভাল ছেলে ছিল। তার নাম জ্যাকব ব্লিভেন্স। বাবা-মা যতই বাজে ও যুক্তিহীন কথাই বলুক না কেন সে সব সময় তাদের কথা মত চলত; সর্বদা লেখাপড়া করত; সাবাথ-স্কুলে যেতে কখনও দেরী করত না। যদিও সে ভাল ভাবেই বুঝত যে হকি খেলাটা তার পক্ষ ভাল, তবু সে হকি খেলত না। যত সুবিধাই পাওয়া যাক না কেন, সে কখনও মিথ্যা বলত না। সে শুধু বলত, মিথ্যা বলা খারাপ, আর তাই তার পক্ষে যথেষ্ট। আর সে এত বেশী সৎ ছিল যে তাকে দেখে সকলেই হাসাহাসি করত। জ্যাকবের। চাল-চলনগুলোই ছিল সব চাইতে অদ্ভুত। রবিবারে সে গুলি খেলত না, পাখির বাসা লুঠ করত না, বাঁদরগুলোকে বিরক্ত করত না; কোন রকম ভাল আমোগ-প্রমোদের প্রতিই তার টান ছিল না। অন্য ছেলেরা যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করত, কিন্তু কোন ফল হত না। আগেই বলেছি, তাদের মনে একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে ছেলেটি পীড়িত, আর সেই জন্যই তারা তাকে ঘিরে রাখত; তার যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর রাখত।

এই ছোট ভাল ছেলেটি স্কুলের সব বই পড়ত; তাতেই সে সব চাইতে বেশী আনন্দ পেত। তার জীবনের গোপন কথাই ছিল-সেই সব বইতে। স্কুলের বইতে যে সব ভাল ছোট ছেলেদের কথা লেখা থাকে সেগুলি সে বিশ্বাস করত; তাদের উপরেই সে সব সময় ভরসা করত। তার বড়ই ইচ্ছা করত, তাদের কেউ যদি জীবন্ত হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াত; কিন্তু কেউ আসত না। হয় তো তার সময়ের আগেই তারা সবাই মরে গেছে। যখনই কোন ভাল ছেলের গল্প সে পড়ত তখনই আগেই শেষের পাতাটা উল্টে সে দেখে নিত ছেলেটির কি হল, সে চাইত তার দিকে চোখ রেখে সে হাজার হাজার মাইল পার হয়ে যাবে; কিন্তু কিছুই হত না; সেই ভাল ছোট ছেলেটি সব সময়ই শেষ অধ্যায়ে গিয়ে মারা যায়; সেখানে থাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটা ছবি; তার আত্মীয়-স্বজনরা ও স্কুলের ছেলেরা কবরটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের পরনে খাটো পাঁৎলুন ও ঢাউস বনেট; সকলেই হাতে বড় বড় রুমাল নিয়ে কাঁদে।

জ্যাকবের মনে বড় সাধ, তাকে যদি কোন স্কুলের বইতে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তার ইচ্ছা, তাকে বইতে রাখা হবে, ছবি এঁকে দেখানো হবে কিছুতেই সে মায়ের কাছে মিথ্যা বলবে না। আর তাই নিয়ে অতি আনন্দে মায়ের সে কী কান্না! আরও ছবি থাকবে-ছটি ছেলেমেয়েসহ একটি ভিখারিণীকে সে দরজায় দাঁড়িয়ে একটি পেনি ভিক্ষা দিচ্ছে, আর বলে দিচ্ছে সে যেন পেনিট। তার ইচ্ছামতই খরচ করে, তবে সে যেন অমিতব্যায়ী না হয়, কারণ অমিব্যায়িত পাপ। ছবিতে আরও দেখানো হবে-যে খারাপ ছেলেটি সে স্কুলু থেকে আসবার সময় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তার মাথায় বাড়ি মেরে হি! হি! করে তাড়া করবে, পরম উদারতা বশত সে তাকেও কিছু বলবে না। ছোট জ্যাক ব্লিভেন্স-এর এই ছিল মনের সাধ। স্কুলের বইতে যেন সে স্থান পায়। অবশ্য যখন সে ভাবত যে ঐ ছোট ভাল ছেলেটি সব সময়ই মরে যায় তখন তার কিছুটা খারাপ লাগত। সে বেঁচে থাকতে ভালবাসে, তাই স্কুলের পাঠ্য বইয়ের ভাল ছেলে হবার এই একটা বেজায় বড় অসুবিধা। সে জানত, ভাল ছেলে হওয়াটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। সে জানত, পাঠ্য বইয়ের ছেলেগুলোর মত অতটা অলৌকিক ধরনের ভাল হওয়াটা যক্ষ্মা রোগের চাইতেও মারাত্মক। সে জানত, এ ধরনের ছেলেরা বেশী দিন বাঁচে না; এমন কি তাকে যদি কোন বইতে ঢোকানোও হয়, সে হয় তো মরবার আগে বইটা দেখেই যেতে পারবে না; আর যদি তার মরবার আগের বইটা বের করা হয় তাহলেও বইটার পিছনে তার অন্ত্যেষ্টির ছবি না থাকায় বইটা মোটেই জনপ্রিয় হবে না। তাছাড়া, মরবার সময় সে যদি সবাইকে ভাল ভাল উপদেশ শু নিয়ে দিতে না পারে তাহলেও তো ব্যাপারটা ঠিক স্কুল পাঠ্য বইয়ের মত হবে না। কাজেই শেষ পর্যন্ত সে মনস্থির করে ফেলে-সে বেঁচে থাকবে, যতদিন সম্ভব ঝুলে থাকবে, আরে সময় যেদিন আসবে তার জন্য মৃত্যুকালীন বক্তৃতাটু আগে থেকেই তৈরি করে রাখবে।

কিন্তু যে কারণেই হোক এই ছোট ভাল ছেলেটির পক্ষে সব কিছু ঠিক ঠিক মত ঘটল না; বইয়ের ভাল ছোট ছেলেটি র বেলায় যা যা ঘটে থাকে, তার বেলায় সে রকমটা ঘটল না। তারা সব সময়ই ভাল থাকে, আর খারাপ ছেলেদের পা ভাঙে; কিন্তু তার বেলায় কোথায় যেন একটা স্তু টিলে থাকায় ব্যাপারটা ঘটে গেল অন্য রকম। জিম ব্লেককে আপেল চুরি করতে দেখে সে গাছতলায় গিয়ে তাকে বইয়ের সেই খারাপ ছেলেটির গল্প পড়ে শোনাতে লাগল যে প্রতিবেশীর গাছ থেকে আপেল চুরি করতে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলেছিল; কিন্তু এ ক্ষেত্রে জিম গাছ থেকে পড়ল ঠিকই, কিন্তু পড়ল ঠিক তারই ঘাড়ে, আর ভাঙ ল তারই হাত, জিমের আঘাতই লাগল না। জ্যাকব ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। বইতে তো এ রকমটা লেখা নেই।

আর একদিন কতকগুলি খারাপ ছেলে একটি অন্ধ লোককে কাদার মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলে তার আশীর্বাদ পাবার আশায় জ্যাকব তাকে সাহায্য করতে ছুটে গেল; কিন্তু অন্ধ লোকটি তাকে আশীর্বাদ তো করলই না, উল্টে হাতের লাঠি উঁচিয়ে তার মাথায় মেরে শাসিয়ে বলল, এভাবে তাকে সাহায্য করবার ভান করতে এলে সে আবারও মাথায় লাঠির ঘা বসাবে। বইতে তো এরকম কথা লেখা নেই। জ্যাকব বইয়ের পাতা উল্টে অনেক খুঁজল।

আরও একটা কাজ করবার খুব ইচ্ছা জ্যাকবের। যে খোঁড়া কুকুরটার কোথাও কোন আশ্রয় নেই, যেটা খুবই ক্ষুধার্ত ও নির্যাতিত, সেটাকে বাড়িতে এনে আদর করে পুষবে আর কুকুরটার অক্ষয় কৃতজ্ঞতা লাভ করবে। শেষ পর্যন্ত সে রকম একটা কুকুর পেয়ে সে খুব খুশি হল। সেটাকে বাড়ি নিয়ে এল, পেট ভরে খাওয়াল, আর তারপরে যেই না তাকে আদর করতে গেল অমনই সেটা তেড়ে এসে তার সব জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলে একটা অঘটন কাণ্ড সৃষ্টি করে বসল। সে ভাল ভাল বই খুঁজে দেখল, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। বইতে যে জাতের কুকুরের কথা লেখা আছে এটা তো সেই জাতের কুকুর, কিন্তু এর আচরণটা উলেটা। ছেলেটি যা কিছু করে তাতেই বিপদে পড়ে। পাঠ্যবইয়ের ছেলেরা যে সব কাজ করে পুরস্কর পায় সেই সব কাজ করেই এ ছেলেটির ক্ষতির অন্ত থাকে না।

একদিন স্কুলের যাবার পথে সে দেখতে পেল কতকগুলি খারাপ ছেলে পালতোলা নৌকো নিয়ে স্ফুর্তি করতে যাচ্ছে। সে ভীষণ ভয়। পেয়ে গেল, কারণ বই পড়ে সে জেনেছে, যে সব চেলে রবিবারে নৌকো নিয়ে বেড়াতে যায় তারা নির্ঘাত ডুবে মেরে। সুতরাং তাদের সতর্ক করে দেবার জন্য সে দৌড়ে গিয়ে একটা ভেলায় চাপল, কিন্তু একটা কাঠ উল্টে যেতেই সেও ছিট কে জলে পড়ে গেল। অনতিবিলম্বেই একটি লোক তাকে উদ্ধার করল, ডাক্তার তার পেট থেকে পাম্প করে জল বের করে দিল; কিন্তু ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে সে ন সপ্তাহ বিছানায় পড়ে রইল। কিন্তু সব চাইতে দুর্বোধ্য ব্যাপার হল, নৌকোর খারাপ ছেলেগুলো সারাদিন ফুর্তি করে কাটাল এবং একান্ত বিস্ময়করভাবে বহালতরিয়তে জীবন্ত বাড়ি ফিরে এল। জ্যাকব ব্লিভেন্স বলল, এরকমটা সে কোন বইতে পড়ে নি। সে। একেবারে বোবা বনে গেল।

ভাল হয়ে উঠে সে কিছুটা দমে গেল, কিন্তু কিছুতেই চেষ্টা ছাড়ল না। সে বুঝতে পেরেছে, এতদিনে যতটুকু অভিজ্ঞতা তার হয়েছে সেটা কোন বইতে স্থান পাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়; কিন্তু ভাল ছোট ছেলের জীবনের শেষ মেয়াদ পর্যন্ত তো সে এখনও পৌঁছে নি, কাজেই সে যদি ধৈর্য ধরে চালিয়ে যেতে পারে তাহলে একদিন না একদিন সে যে কেল্লা ফতে করতে পারবে সে আশা তার আছে। আর কিছু যদি নাও হয়, মৃত্যকালীন বক্তৃতাটা তো তার হাতের মুঠোতেই রয়েছে।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাল ভাল বই পড়ে সে জানতে পারল, এবার তার পক্ষেকেবিন-বয় হয়ে সমুদ্রে যাবার সময় হয়েছে। জাহাজের এক কাপ্তেনের সঙ্গে দেখা করে সে তার আবেদনপত্র পেশ করল; কাপ্তেন যখন প্রশংশাপত্র দেখতে চাইল তখন একটা পুস্তিকা বের করে সগর্বে তার লেখা গুলোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল–জ্যাকব ক্লিভেন্সকে, স্নেহময় শিক্ষক। কাপ্তেন ছিল কড়া ধাতের গোলা লোক। সে খেঁকিয়ে উঠল, গোলি মার ও সবে! এতে তো প্রমাণ হয় না তুমি থালা-বাসন ধুতে পার কি না, বা ময়লা জলের বাতি টানতে পার কি না। তোমাকে দিয়ে চলবে না। সারা জীবনে জ্যাকব কখনও এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে নি। পুস্তিকায় একজন শিক্ষকের প্রশংসাপত্র জাহাজের কাপ্তেনের মন গলাতে পারে না, তার বরাতে সম্মানের কাজ জোটে না, সে লাভের মুখ দেখে না-এ রকমটা কখনও হয় না-আজ পর্যন্ত যত বই সে পড়েছে কোথাও এ রকমটা ঘটতে দেখে নি। নিজের চোখ কানকেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

ছেলেটির সময় খুবই খারাপ চলছে। তার বড় বড় বইতে যা লেখা আছে সেভাবে কোন কিছুই চলবে না। অবশেষে একদিন ছোট খারাপ ছেলেদের খোঁজ করতে গিয়ে সে দেখল, পুরনো লোহার কারখানার কাছে একদল খারাপ ছেলে চোদ্দ-পনেরোটা কুকুরকে নিয়ে বেশ মজা করছে; কুকুরগুলোকে সার দিয়ে একসঙ্গে বেঁধে তাদের লেজের সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসেরিন-এর খালি টিন বেঁধে দেবার উদ্যোগ করছে। জ্যাকব-এর হৃদয় বিগলিত হল। একটা টিনের উপর বসে পড়ে (কর্তব্য করতে গিয়ে গায়ে চটচটে আঠা লাগবে বলে ভয় করলে চলে না) সে একেবারে সামনের কুকুরটার কলার চেপে ধরল এবং তিরম্নরের দৃষ্টিতে দুষ্টু টম জোনস-এর দিকে তাকাল। কিন্তু ঠিক সেই সময় অল্ডারম্যান ম্যাকওয়েল্টার রেগে টং হয়ে সেখানে হাজির হল। খারাপ ছেলেগুলো সব দৌড়ে পালিয়ে গেল, কিন্তু জ্যাক ব্লিভেন্স নিজের নির্দোষিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং স্কুল-পাঠ্য বইতে যেভাবে ওঃ স্যার! বলে বক্তৃতা শুরু হয়ে থাকে ঠিক সেইভাবে একটি গম্ভীর ছোট খাটো বক্তৃতা শুরু করে দিল। অল্ডারম্যান কিন্তু বক্তৃতা শুনবার জন্য অপেক্ষা করল না। জ্যাক ব্লিভেল-এর কান ধরে চারদিকে ঘুরিয়ে তার পাছায় কসাল এক থাপ্পড়, আর সঙ্গে সঙ্গে ভাল ছোট ছেলেটি গুলির মত ছাদ ফুড়ে সূর্যের দিকে উড়ে চলল; সেই পনরোটা কুকুর ঘুড়ির লেজের মত তার পেছনে ঝুলতে লাগল। পৃথিবীর বুকে। সেই অল্ডারম্যান বা সেই পুরনো লোহার কারখানার চিহ্নমাত্রও আর চোখে পড়ল না। আর জ্যাকব ক্লিভেন্স? এই ঝামেলায় পড়ে তার শেষ মৃত্যকালীন বক্তৃতাটি আর দেওয়া হল না; অবশ্য সে যদি সেই বক্তৃতাটি পাখিদের শু নিয়ে থাকে সে আলাদা কথা। যদিও তার শরীরের একটা বড় অংশ পার্শ্ববর্তী কোন জেলার একটি গাছের মাথায় পড়েছিল, তবু তার বাকি অংশটা ভাগ হয়ে পড়েছিল চারটি শহরে, এবং তার ফলে সে জীবিত আছে কি মারা গেছে এবং এ ঘটনা কি ভাবে ঘটেছে তা নিয়ে তাদের পাঁচটি তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছিল। এভাবে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়া একটি ছেলেকে আপনারা কখনও দেখেন নি।

যে ভাল ছোট ছেলেটি পাঠ্যবইয়ের মত করে বেঁচে থাকতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছিল এইভাবে সে মারা গেল। একমাত্র সে ছাড়া এ কাজ আর যে করেছে সেই জীবনে উন্নতি করেছে। তার ব্যাপারটা সত্যি উল্লেখযোগ্য। হয় তো কোন দিনই এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না।

[১৮৭০]

*একখানি উরন্ত খবরের কাগজের পাতা থেকে এই গ্লিসারিন-দুঘটনাটি গৃহীত হয়েছে; জানা থাকলে লেখকের নামটি আমি বলে দিতাম।-মার্ক টোয়েন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *