রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি
Political Economy

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সব সুপরিচালিত সরকারেই ভিত্তিস্বরুপ। সর্ব যুগের যারা জ্ঞানীজন তারা এই বিষয়টির উপরে

[এইখানে আমার লেখা বাধাপ্রাপ্ত হল; খবর এল, একটি অপরিচিত লোক নীচে দরজায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নীচে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম, তার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলাম; তবে সারাক্ষণই আমি সচেষ্ট ছিলাম যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির যে। চিন্তা-ভাবনাগুলি আমার মাথার মধ্যে কিবি করছিল সেগুলি হাতছাড়া হয়ে না যায়, বা জট পাকিয়ে না যায়। এদিকে মনে মনে আমি চাইছিলাম যেন অপরিচিত লোকটি খড়-বোঝাই একটা নৌকোয় চাপা পড়ে খালের জলে ডুবে মরে। ফলে আমি তখন উত্তেজনায় অধীর, আর লোকটি ধীর, স্থির, ঠাণ্ডা। সে বলল, আমাকে বিরক্ত করার জন্য সে দুঃখিত, কিন্তু এই পথ দিয়ে যেতে যেতে সে লক্ষ্য করেছে যে আমার কয়েকটি বজ্রবারণ ধাতুদণ্ড প্রয়োজন। বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ,-বলে যান-তারপর কি? সে বলল, না, তারপরে তেমন কিছু নয়, তবে আমার বাড়িতে সে কয়েকটি বজ্রবারণ-দণ্ড বসিয়ে দিতে চায়। ঘর-গৃহস্থালীর কাজে আমি নতুন; সারাটা জীবন। হোটেল-বোডিংয়েই কাটিয়েছি। এ ধরনের অন্য যে কোন লোকের মতই (অপরিচিত লোকজনের কাছে। আমিও নিজেকে ঘর-গৃহস্থালীর কাজে বেশ একজন পাকা লোক বলেই চালাতে চেষ্টা করে থাকি। সুতরাং আমি আচমকাই বলে ফেললাম যে, কিছুদিন যাবৎই ছটা বা আট টা বজ্রবারণ-দণ্ড বসাবার কথা আমিও ভাবছিলাম, কিন্তু নবাগত লোকটি চমকে উঠে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি তবু অবিচলিত। ভাবলাম, হঠাৎ যদি কোন ভুল করেও থাকি, লোকটি যেন আমার মুখ দেখে সেটা বুঝতে না পারে। সে বলল, শহরের অন্য যে কোন লোকের কাজ করবার আগেই সে আমার কাজটা করে দেবে। আমি বললাম, ভাল কথা, আর তারপরেই আবার লেখা নিয়ে পড়লাম। এখন লোকটি আবার আমাকে খবর পাঠিয়ে জানতে চাইল, আমার ঠিক কটা পয়েন্ট  দরকার, বাড়ি কোন্ কোন্ অংশে সেগুলি বসাব এবং কি ধরনের দণ্ড আমার পছন্দ। গৃহস্থালীর কাজকর্মে অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে এ গুলো খুবই মুস্কিলের ব্যাপার। কিন্তু আমি বেশ ভালভাবেই কাজ চালিয়ে গেলাম, আর এ সব ব্যাপারে আমি যে একেবারেই আনকোরা সে সন্দেহ সম্ভবত তারও হল না। তাকে বলে দিলাম, আট টা পয়েন্ট  বসাতে হবে, সবগুলিই ছাদের উপর বসাতে হবে, এবং সব চাইতে ভাল দণ্ডই ব্যবহার করতে হবে। সে বলল, সাধারণ মাল ফুট প্রতি ২০ সেন্ট দামে, তামায় মোড়া মাল ২৫ সেন্ট দামে, আর দস্তায় মোড়া বাঁকানো মাল যা যে কোন সময় বিদ্যুৎ পরিবহন বন্ধ করতে সক্ষম সেটা ৩০ সেট দামে সরবরাহ করতে সে পারবে। আমি বললাম, বাঁকানো মালই আমার পছন্দ। তখন সে বলল, আড়াই শ ফুট তুলেই সে কাজ চালিয়ে দিতে পারে, কিন্তু কাজটাকে ঠিক ঠিক মত করতে হলে, এ শহরের সেরা কাজ হিসাবে করতে হলে, ভাল-মন্দ সব লোকের নজর কাড়তে হলে, এবং জন্মাবধি কেউ কখনও বজ্রবারণ দণ্ডের এ হেন সুসমঞ্জস ও সূদৃশ্য ব্যবস্থাপনা দেখে নি এ কথা বলতে সব লোককে বাধ্য করতে হলে, অন্তত পক্ষে চার শ ফুট ছাড়া সে কাজটা শেষ করতে পারবে না। অবশ্য কোন রকম জোর-জবরদস্তি করতে সে চায় না; সে শুধু একবার চেষ্টা করে দেখতে চায়। আমি বললাম, চার শ ফুঁ টের কাজেই হাত দেওয়া হোক, তার পছন্দমতই সবকিছু করা হোক; আর আমাকে আমার কাজে ফিরে যেতে দেওয়া হোক। এইভাবে শেষ পর্যন্ত তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির চিন্তা-ভাবনাগুলোকে পুনরায় ঠিকভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম]।

-তাদের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ সম্পদ, জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা-দীক্ষাকে প্রয়োগ করেছেন। জরোষ্ট্রার থেকে হোরেস গ্রীল পর্যন্ত সর্ব কালের, সকল সভ্যতার ও সকল জাতির ব্যবসায়িক আইন, আন্তর্জাতিকতা, সৌভ্রাত্র ও প্রাণীগত পথচ্যুতি সংগ্রাম করেছে

এইখানে আবার বাধা পড়ল; নীচে গিয়ে বজ্রবারণ দণ্ডের লোকটির সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। উত্তপ্ত, উচ্ছ্বসিত চিন্তা-ভাবনাগুলিকে নিয়ে তার সামনে হাজির হলাম-সে আগের মতই শান্ত, মধুর আর আমি উত্তপ্ত, উন্মত্ত। রোড়-এর বিরাট কায় পিতল-মূর্তির মত চিন্তামগ্নভাবে সে দাঁড়িয়ে আছে; তার একটি পা আমার গোলাপ-চারার উপরে, অন্য পা প্যান্সি ফুলের ঝড়ে দুই হাতে উরুর উপরে রাখা; মাথার টু পির কোণটা সামনের দিকে বাঁকানো; একটি চোখ বুজে অন্য চোখটি খুলে সে সপ্রশংসা দৃষ্টিতে আমার বড় চিমনিটার দিকে তাকিয়েছিল। সে বলল, এরকম একটা পরিস্থিতি দেখতে বেঁচে ও সুখ। একটি মাত্র চিমনির গায়ে আট টি বজ্রবারণ দণ্ডের অবস্থানের এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য কখনও দেখেছেন কিনা সেটা আপনিই বলুন।

আমি বললাম, এর চাইতে বড় কিছু দেখেছি বলে তো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সে বলল, তার মতে প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসাবে এর চাইতে মহত্তর দৃশ্য একমাত্র নায়াগারা জলপ্রপাত ছাড়া আর কোথাও নেই এ পৃথিবীতে। তার একান্ত বিশ্বাস, আমার বাড়িটি কে পরিপূর্ণ নয়নসুখকর করে তুলতে এখন একমাত্র প্রয়োজন অন্য চিমনিগুলোতে একটু হাত লাগানো; আর তাহলেই কু-দেতাত-এর। ফলে স্বভাবতই যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে থাকে সেটা শান্ত সহজ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, সে কোন বইয়ের ভাষায় কথা বলছে কি না, আর আমি সেগুলো দরকার মত অন্যত্র ব্যবহার করতে পারি কি না? স্মৃতি হাতির সঙ্গে সে বলল, তার এই সংলাপ পুঁথি থেকে শেখা নয়, এবং বিদ্যুতের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় না থাকলে এই সংলাপ-শৈলী আয়ত্ত করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন একটা মোটামুটি খরচের আন্দাজ জানিয়ে বলল, আমার ছাদের এখানে-ওখানে আরও আট টা দণ্ড বসালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর সে জন্য আরও পাঁচ শ ফুট মাল লাগবে। সে আরও জানাল, আগে যে হিসাব সে দিয়েছিল তার চাইতে কিছু বেশী মাল লেগে গেছে-মোটামুটি একশ ফুটের মত। বললাম, আমার ভয়ংকর কাজের তাড়া রয়েছে; কাজেই এ কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হলেই আমি আমার কাজ নিয়ে বসতে পারি। সে বলল, ঐ আট টা দণ্ড বসিয়ে দিয়ে আমিও কাজটা এগিয়ে নিতে পারতাম,-অন্য লোক হলে তাই করত। কিন্তু না; আমি নিজের মনে বললাম, এই লোকটি আমার অপরিচিত, কাজেই তার কোন ক্ষতি হবার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়; এই বাড়িটিতে প্রয়োজনীয় বজ্রবারণ দণ্ড নেই। আর সে কথা তাকে আমার বলা উচিত। হে অপরিচিত, আমার কর্তব্য শেষ; স্বর্গের বিদ্রোহী দূত যদি আপনার বাড়িকে আঘাত করে- আমি বলে উঠলাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে; আরও আটটি দণ্ড ও পাঁচ শ ফুট বাঁকানো মাল ব্যবহার করুন-যেমন ইচ্ছা তাই করুম; শুধু আপনার দুঃখকে প্রশমিত করুন, আর অনুভূতিগুলোকে নাগাল পেতে পারেন। এবার তো পরস্পরের মধ্যে বোঝাঁপড়া হয়ে গেল, অতএব আমি আমার কাজে চললাম।

[মনে হচ্ছে, বাধা পাবার আগে আমার চিন্তার সূত্রগুলো যেখানে ছিল সেখানে পৌঁছবার চেষ্টায় আমি পুরো একটি ঘণ্টা এখানে বসে আছি। আমার বিশ্বাস, সে কাজে সফল হয়েছি, আর তাই পুনরায় অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে পারি।]

-এই মহান বিষয়বস্তুটির সঙ্গে, আর তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তারা সকলরেই এটাকে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মেনে নিয়েছে, তার প্রতি পদক্ষেপেই দেখতে পেয়েছে তার নব নব হাস্যময় রূপ। মহান কফি উসিয়াস বলেছেন, একজন পুলিশের বড় কর্তা হওয়ার চাইতে তিনি একজন প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদই হতে চান। সিসেরো প্রায়ই বলতেন, মানুষের মন যত বড় কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম তার মধ্যে সব চাইতে মহৎ কাজ হল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি। এমন কি আমাদের নিজস্ব লোক গ্রীলও অস্পষ্টভাবে হলেও অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছেন যে রাষ্ট্রীয়–

[এইখানে বজ্রবারণ দণ্ডের লোকটি আবার আমাকে ডেকে পাঠাল, আর আমিও প্রায় ধৈর্যহারা মন নিয়ে নীচে নেমে গেলাম। সে। বলল, আমার কাজে বিঘ্ন ঘটানো অপেক্ষা তার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়, কিন্তু তাকে যখন একটা কাজ করতে দেওয়া হয়েছে এবং সে কাজটি পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে যথেষ্ট শিল্পসম্মতভাবেই সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হয়েছে, এবং কাজটি শেষ হবার পরে শান্ত দেহে যখন বিশ্রাম তার কাছে একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে এবং তদনুযায়ী সে বিশ্রাম নিতেও যাচ্ছিল, তখন মুহূর্তের দৃষ্টিপাতের ফলে সে দেখতে পেল যে পুরো পরিকল্পনাটাতেই কিছু গোলমাল হয়ে গেছে এবং এখন যদি বজ্র-বিদ্যুৎসহ ঝড় আসে তাহলে এই যে বাড়িটির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ বিশেষভাবে জড়িত তাকে বাঁচাবার জন্য আটটি বজ্রবারণ দণ্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। শুনে আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, আত্মরক্ষার সব রকম ব্যবস্থা করা হোক! দেড় শ ফুট উঁচু করুন! রান্নাঘরের মাথায় কয়েকটি দণ্ড বসান। গোলাবাড়ির উপর বসান এক ডজন! গরুটার উপর বসান দুটো-বাঁধুনির উপর একটা!-অভিশপ্ত বাড়িটার সর্বত্র দণ্ডে-দণ্ডে ছেয়ে ফেলুন! শুরু করে দিন! হাতের কাছে যা মাল পাবেন কাজে লাগান; তারপর বজ্রবারণ দণ্ড ফুরিয়ে গেলে হেন-দণ্ড, তেন-দণ্ড, সিঁড়ির দণ্ড, পিষ্টন-দণ্ড-এক কথায় আপনার কৃত্রিম দৃশ্যরচনার ক্ষুধা মেটাবার জন্য যা কিছু দরকার, এবং আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ককে শান্ত করবার জন্য ও ছিন্নভিন্ন আত্মাকে নিরাময় করবার জন্য যা কিছু দরকার-সব করুন। একটু মিষ্টি হাসি ছাড়া সম্পূর্ণ অবিচলিতভাবে সে শুধু জানাল, নিজেকে সে আর জ্বালাতন করতে ইচ্ছুক নয়। আহা, এ সবই তিন ঘন্টা আগেকার কথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মত একটা মহান বিষয় নিয়ে লিখবার মত মানসিক প্রশান্তি কি একনও আমার আছে? কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখবার বাসনাকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছি না, কারণ পৃথিবীর সমস্ত দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে এই বিষয়টি ই আমার হৃদয়ের একান্ত আপন এবং আমার মস্তিস্থের একান্ত প্রিয়।]

-অর্থনীতি মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান। বিকলমস্কিল্ক অথচ প্রতিভাদীপ্ত বায়রন ভেনিস-এ নির্বাসনে থাকার সময় বলেছিলেন, তাকে যদি ফিরে গিয়ে আবার তার উচ্ছংখল জীবন যাপন করতে দেওয়া হয়, তাহলে যতটুকু অবসর তার হাতে থাকবে সেটুকু সময় বড় বড় কথায় কাব্য রচনা না করে তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে কাটাবেন। ওয়াশিংটনও এই সুন্দর বিজ্ঞাপনকে ভালবাসতেন। বেকার, বেকউইথ, জাড় সন, স্মিথ প্রভৃতির নামও এর সঙ্গে অমর অক্ষরে বিজড়িত আছে। এমনকি মহাকবি হোমারও

ইলিয়াড়-এর নবম খণ্ডে বলেছেন:

Fiat justitia, ruat coelum,
 Post mortem unum, ante bellum,
Hic jacet hoc, ex-arte res,
 Politicum e-economico est.

প্রাচীন কবির এই সব ধ্যান-ধারণার বিশালতা ভাষার মাধুর্য ও কল্পনার মহত্ত্বের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই অনুচ্ছেদটি কে যে খ্যাতি দান করেছে তা বুঝি আর কোথাও–

না, আপনার সঙ্গে আর একটি কথাও নয়। আপনার কত পাওনা সেটা বলুন, আর এই বাড়িতে যতক্ষণ আছেন অতল নৈঃশব্দের মধ্যে চিরতরে ডুবে যান। নশ ডলার? এই সব তো? আমেরিকার যে কোন ভাল ব্যাংক থেকে এই চেকে আপনি টাকাটা তুলতে পারবেন। রাস্তায় এই অগণিত জনতা জড় হয়েছে কেন? সে কি?-সবাই বজ্রবারণ দণ্ডগুলির দিকেই যে তাকিয়ে আছে! কী আশ্চর্য, ও কি আগে কখনও বজ্রবারণ দণ্ড দেখে নি? আপনি কি বলছেন? একটা বাড়ির মাথায় এতগুলো কখনও দেখেনি? আমি নীচে নেমে যাচ্ছি; জনগণের অজ্ঞতার এই প্রচণ্ড প্রকাশকে নিজের চোখে ভাল করে দেখে আসি।

তিন দিন পরে। আমরা সকলেই শ্রান্ত, ক্লান্ত। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে আমাদের দণ্ড-কণ্টকিত বাড়িটাই ছিল সারা শহরের আলোচনা ও বিস্ময়ের বস্তু। থিয়েটারে ভিড় ছিল না। কারণ তাদের সব চাইতে ভাল দৃশ্য-সজ্জাও আমাদের বজ্রবারণ দণ্ডগুলোর তুলনায় অতীব সাদামাঠা। আমাদের রাস্তাটা দিন রাত ছিল দর্শকে ঠাসা; তাদের মধ্যে অনেকে এসেছিল গ্রামাঞ্চল থেকে। দ্বিতীয় দিনে মিলল প্রার্থিত শান্তি। একটা বাজ-ডাকা ঝড় উঠল, আর ইতিহাসবিদ জোসেফাস-এর ভাষায় বলা যায়, বিদ্যুৎ এসে হানা দিল আমার বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে যেন গ্যালারি ফাঁকা হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ির আধা মাইলের মধ্যে কোন দর্শককে দেখা গেল না; কিন্তু ততখানি দূরত্ব পর্যন্ত সবগুলো উঁচু বাড়ির জানালা, ছাদ সব লোকে লোকারণ্য। আর তা তো হতেই পারে; কারণ একটা যুগব্যাপী যত কক্ষচতি নক্ষত্র আর চৌঠা জুলাই-এর যত সব বাজি যদি এক সঙ্গে হয়ে একটি মাত্র উজ্জ্বল আলোকছটায় একটি অসহায় ছাদের উপর বৃষ্টিধারার মত ঝরে পড়ে তাহলেও তো এই ঝড়ো পরিমণ্ডলে আতসবাজির যে জমকালো প্রদর্শনী আমার বাড়িটাকে সকলের পক্ষে একান্ত দর্শনীয় করে তুলেছে তার সমকক্ষ হতে পারবে না। প্রকৃত অবস্থার পর্যালোচনায় দেখা গেল, চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়িটা সাত শ চৌষট্টি বার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে, এবং প্রতিবারেই একটি বিশেষ দণ্ডের উপর পড়ে বাঁকানো দণ্ডের মারফতে তীরবেগে মাটি পর্যন্ত চলে গেছে। আর সেই মুহুর্মুহু বজ্রপাতের মধ্যে ছাদের একটি মাত্র স্লেট পাথর ভেঙেছে, কারণ ঐ একবারই আশেপাশের দণ্ড গুলি সাধ্যমত বিদ্যুৎশক্তি টেনে নিয়েছিল।বাপরে, সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ রকমটি কেউ কখনও দেখে নি। সারা দিনমানে আমার পরিবারের যে কেউ জানালা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়েছে তারই চুল সবেগে উ ৎক্ষিপ্ত হয়ে মাথাটি কে একটি মসৃণ বিলিয়ার্ড-বলে রূপান্তরিত করেছে; আর পাঠক মহোদয়গণ বিশ্বাস করুন, আমরা কেউই বাইরে বেরিয়ে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভয়ংকর আক্রমণের অবসান হল, কারণ আমার তৃষ্ণার্ত দণ্ড গুলির ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে আকাশের মেঘে আর কোন বিদ্যুৎ অবশিষ্ট রইল না। তখন আমি বেরিয়ে এলাম, কিছু সাহসী লোকজন যোগাড় করলাম, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ির মাথায় মাত্র তিনটি দণ্ড, রান্নাঘরের মাথায় একটি দণ্ড ও গোলাবাড়ির মাথায় একটি দণ্ড ছাড়া এই ভয়ংকর সমরাস্ত্র সম্ভারের আর সব কিছুই পরিঙ্কুর করা না হল ততক্ষণ আমরা কিছু মুখে দিই নি, বা আমাদের চোখে এক পলক ঘুম আসে নি। চেয়ে দেখুন, সেই দণ্ডগুলি আরও পর্যন্ত সেখানেই রয়েছে। আর একমাত্র তখনই, তার আগে নয়, লোকজন সব আবার আমাদের রাস্তাটা ব্যবহার করতে শুরু করল। এখানে প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, সেই ভয়ংকর সময়টাতে আমি কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উপর আমার প্রবন্ধ লেখা চালিয়ে যেতে পারি নি। এমন কি সে লেখা নতুন করে শুরু করবার মত স্নায়ু ও মস্তিষ্কের অবস্থা আমি এখনও ফিরে পাই নি।

যার প্রয়োজন তারই উদ্দেশে: তিন হাজার দু শ এগারো ফুট সেরা গুণান্বিত দস্তায় মোড়া বাঁকানো বজ্রবারণ দণ্ড এবং ষোল শ একত্রিশটি রূপোয় মাথা-মোড়া পয়েন্ট -এর যদি কারও দরকার থাকে তো প্রকাশকের ঠিকানায় যোগাযোগ করে দর-দামের বিষয় জানতে পারেন; মালগুলি সবই মোটামুটি মেরামতযোগ্য অবস্থায় আছে এবং ব্যবহারে জীর্ণ হলেও যে কোন সাধারণ মালের সমকক্ষ হবার যোগ্যতা রাখে।

[১৮৭০]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *