একটি খারাপ ছোট ছেলের গল্প

একটি খারাপ ছোট ছেলের গল্প
The Story of the Little Boy

একদা একটি খারাপ ছোট ছেলে ছিল; তার নাম ছিল জিম-যদিও লক্ষ্য করলে আপনারা দেখবেন যে আপনাদের সব রবিবার-বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক খারাপ ছোট ছেলেদের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই জেমস্ বলে ডাকা হয়। আশ্চর্য হলেও এটা কিন্তু সত্যি যে এই ছেলেটি কে জিম বলেই ডাকা হত।

তার কোন রুগ্ন মা-ও ছিল না-এমন ধর্মপরায়ণা মা যার ক্ষয় রোগ আছে; কবরে গিয়ে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারলেই যে সুখী হত, কিন্তু ছেলের প্রতি অত্যাধিক ভালবাসার জন্য এবং সে চলে গেলে পাছে বিশ্ব-সংসার তার ছেলের প্রতি কঠোর ও উদাসীন ব্যবহার করে এই ভয়ে সে মরতেও পারছিল না। রবিবারের পাঠ্যপুস্তকে অধিকাংশ খারাপ ছেলেরই নাম থাকে জেমস্, তাদের মা থাকে রুগ্ন, তারা, ছেলেকে বলতে শেখায় এবার আমি নত হই ইত্যাদি, মিষ্টি বিষণ্ণ সুরে গান গেয়ে তাদের ঘুম পাড়ায়, তারপর চুমো খেয়ে শুভ রাত্রি জানিয়ে তাদের বিছানার পাশেই নতজানু হয়ে কাঁদতে থাকে। কিন্তু এই ছেলেটির বেলায় সবই অন্য রকম। তার নাম জিম, আর তার মায়েরও ওসব কিছুই ঘটে নি-ক্ষয়রোগ বা সে ধরনের কিছুই না। মা ছিল শক্ত-সমর্থ, ধর্মপরায়ণা মোটেই নয়; আর জিমকে নিয়ে তার কোন দুশ্চিন্তাও ছিল না। সে বলত, ছেলেটা যদি ঘাড় ভেঙে ই বসে, তাহলেই বা ক্ষতি কি। সে সব সময়ই চড়-চাপড় মেরে জিমকে ঘুম পাড়াত, আর কখনও চুমো খেয়ে তাকে শুভ রাত্রি জানাত না; বরং তাকে ছেড়ে যাবার সময় হলে তার কানে একটা চপেটাঘাত করত।

একবার এই খারাপ ছোট ছেলেটি খাবার ঘরের চুরি করে সেখানে ঢুকে বেশ কিছুটা জ্যাম বাগিয়ে নিল, আর পাত্রটাকে এমনভাবে আলকাতরা দিয়ে ভরে রাখল যাতে তার মা তফাৎটা টের না পায়; কিন্তু তাই বলে সঙ্গে সঙ্গে তার মনে কোন তীব্র ভাবের উদয় হল না এবং কেউ তার কানে কানে বলল না, মার কথা না শোনা কি ঠিক? এ কাজ করা কি পাপ নয়? ভাল মায়ের জ্যাম যারা চুরি করে খায় সেই সব ছোট খারাপ ছেলেরা কোথায় যায়? আর তার পরেও সে কিন্তু একাকী নতজানু হয়ে বসে এরকম দুষ্টুমি আর কখনও। করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল না, এবং খুসিভরা হালকা মনে উঠে মার কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল না, তার কাছে ক্ষমাও চাইল না; আর মা-ও গর্ব ও কৃতজ্ঞতার অশ্রুজলে দুই চোখ ভিজিয়ে তাকে আশীর্বাদ করল না। না; পাঠ্যপুস্তকের অন্য সব খারাপ ছেলেদের বেলায়ই তাই হয়ে থাকে; কিন্তু খুবই আশাচ র্য যে জিমের বেলায় ঘটল ঠিক অন্যরকম। সে জ্যামটা খেয়ে ফেলল, তার নিজস্ব অশালীন ভঙ্গিতে বলল যে জিনিসটা খাসা হয়েছে; তারপর আলকাতরা ফেলে দিয়ে হেসে বলল যে এ কাজটাও খাসা হল, মন্তব্য করল যে ব্যাপারটা যখন সত্যি জানতে পারবে তখন বুড়িটা খুব চেঁচামেচি করবে; মা যখন সত্যি সত্যি ব্যাপারটা জানতে পারল তখন সে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করল, মা-ও তাকে নির্মমভাবে চাবুক মারল, আর সেও নিজে নিজেই কেঁদে ভাসাল। এ ছেলেটির বেলায় সব কিছুই অদ্ভূত-পাঠ্যপুস্তকের খারাপ জেমদের বেলায় যা যা ঘটে থাকে তার বেলায় ঘটল তার ঠিক উল্টোটা।

একবার সে মালিক অ্যাকন-এর আপেল গাছে চড়েছিল আপেল চুরি করতে। তার পা ভাঙল না, গাছ থেকে পড়ে তার হাত ভাঙল না, মালিকের বড় কুকুরটা তাকে আঁচড়ে কামড়ে দিল না, আর সেও কয়েক সপ্তাহ রোগশয্যায় ধুঁকতে ধুঁকতে অনুশোচ না করে একসময়ে ভাল হয়ে গেল না। না, না; যত ইচ্ছা আপেল চুরি করে সে বহাল তবিয়তে নীচে নেমে এল; কুকুরটার মোকাবিলা করবার জন্যও সে তৈরিই ছিল; সেটা যখন তেড়ে এল তখন সে একটা ইট মেরে তাকে আচ্ছা করে ঘায়েল করল। সত্যি, খুব আশ্চর্য-যে সব ছোট মিষ্টি বইতে ঝকঝকে মলাট থাকে, আর থাকে পাখির লেজের মত কোট, ঘণ্টা-বসানো টুপি ও খাটো পালুন পরা পুরুষ এবং বগলের নীচ পর্যন্ত কোমর-তোলা বন্ধনীহীন পোশাক পরা মহিলাদের ছবি, তাতে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কখনও ঘটে না। রবিবার-বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতেও এ সবের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।

একবার সে মাস্টারমশাইয়ের পেন্সিল-কাটা ছুরিটা চুরি করেছিল। ধরা পড়লে চাবুক খেতে হবে এই ভয়ে সেটাকে জর্জ উইলসন-এর টুপির মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিল-বেচারি বিধবা উইলস-এর এই ছেলেটি খুবই নীতিবাগীশ, গ্রামের সেরা ছেলে, সব সময় মায়ের কথা শোনে, কখনও মিথ্যা কথা বলে না, ভাল ভাবে লেখাপড়া করে, আর রবিবার-বিদ্যালয়টি কে খুবই ভালবাসে। ছুরিটা যখন তার টু পির ভিতর থেকে গড়িয়ে পড়ল তখন বেচারি জর্জ যেন অপরাধীর মতই মাথাটা নীচু করে রইল, তার মুখ লাল হয়ে উঠল, আর দুঃখিত মনে মাস্টারমশাই তাকেই চুরির দায়ে দায়ী করে তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হতেই একজন পাকা-চুল শাস্তির অধিকর্তা সেখানে হাজির হয়ে বলে উঠল, এই মহৎ ছেলেটিকে ছেড়ে দিন-ভয়ে জড়সড় হয়ে ওই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আসল অপরাধী! স্কুলের বিরতির সময় আমি স্কুলের দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, আর আমাকে কেউ দেখতে না পেলেও আমি চুরিটা দেখে ফেলেছি। তারপরে কিন্তু জিমকে মারধোর করা হল না, আর সেই মাননীয় অধিকর্তাও সাশ্রনয়নে স্কুল সম্পর্কে কোন বক্তৃতা দিল না। বা জর্জের হাত ধরে বলল না যে এই সব ছেলেই তো প্রশংসার যোগ্য। অথবা সে মাননীয় ব্যক্তিটি জর্জকে সঙ্গে করে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলল না যে আজ থেকে সে এই বাড়িতেই থাকবে, আপিস ঝাড়বে, আগুন জ্বালাবে, খবর আদান-প্রদান করবে, কাঠ কাটবে, আইন পড়বে, এবং তার স্ত্রীকে সংসারের সব রকম কাজে সাহায্য করবে, এবং তার পরেও যে বাড়তি সময় তার থাকবে তখন সে খেলাধূলা করবে, মাসে চল্লিশ সেন্ট করে পাবে ও সুখে থাকবে না; এ রকমটা বইতে ঘটতে পারে কিন্তু জিম-এর বেলায় ঘটে নি। কোন শান্তির অধিকর্তা হঠাৎ উদয় হয়ে সে ব্যাপারে নাক গলায় নি; ফলে আদর্শ বালক জর্জ-এর কপালে জুট ল চাবুক, আর জিম হল খুসি, কারণ, আপনারা তো জানেন, নীতিবাগীশ ছেলেগুলোকে জিম ঘৃণা করত। জিম বলত, এই সব ম্যাদামারা ছেলেগু লোকে সে দুচক্ষে দেখতে পারে না। এই খারাপ অবহেলিত ছেলেটি এই ধরনের বাজে ভাষাই ব্যবহার করত।

কিন্তু সব চাইতে অবাক কাণ্ড ঘটল যখন রবিবারে নৌকো চালাতে গিয়েও জিম জলে ডুবে মরল না, এবং অন্য এক রবিবারে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের মুখে পড়েও তড়িতাহত হল না। আরে, রবিবার-বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে আপনি আজ থেকে আগামী বড়দিন পর্যন্ত যতই খুঁজে দেখুন না কেন এ রকম ঘটনা আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না। আরে না, না; সেখানে আপনি দেখতে পাবেন, খারাপ ছেলে গুলো যখনই রবিবারে নৌকো চালাতে যায় তখনই জলে ডুবে যায়; আর খারাপ ছেলেগুলো রবিবারে যখনই মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের মুখে পড়ে তখনই তরিতাহত হয়। নৌকোতে খারাপ ছেলেরা থাকলেই সে নৌকা রবিবারে উলেট যাবেই; আর সাবাথ দিবসে খারাপ ছেলেরা মাছ ধরতে গেলে ঝড় উঠবেই। জিম কেমন করে এর হাত থেকে রেহাই পেল সেটাই আমার কাছে এক রহস্য।

একটা মন্ত্র যেন জিম-এর জীবনকে সব সময়ই ঘিরে থাকে-নিশ্চয়ই তাই হবে। কোন কিছুই তাতে আঘাত করতে পারে না। এমন কি একবার জানোয়ারদের মেলায় গিয়ে সে একটা হাতির গুঁড়ে তামাক গুঁজে দিয়েছিল, অথচ হাতিটা শুড় দিয়ে তার মাথাটা ধরে আছাড় মারে নি। একোয়া ফোর্টি (নাইট্রিক এসিড) খেয়ে ফেলে নি। বাবার বন্দুকটা চুরি করে সাবাথ দিবসে শিকার করতে গিয়ে সে নিজের তিনটে বা চারটে আঙ্গুল গুলিতে উড়িয়ে দেয় নি। রেগে গিয়ে সে ছোট বোনটির মাথায় ঘুষি মেরেছিল, কিন্তু তার ফলে সারা গ্রীষ্মকাল যন্ত্রণায় কাতড়াতে কাতড়াতে মুখে ক্ষমার মধুর বাণী উচ্চারণ করে বোনটি মারাও যায় নি, বা তার ফলে তার ভগ্নহৃয় দ্বিগুণ দুঃখে উদ্বেলিতও হয় নি। না; বোনটি সেরে উঠেছিল। অবশেষে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে সাগরে চলে গিয়েছিল; আর ফিরে আসে নি; এ জগতে তখন সে একেবারে একা, বিষণ্ণচিত্ত। তার প্রিয়জনরা গির্জার শান্ত প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে পড়ল, তার ছেলেবেলাকার দ্রাক্ষালতা শোভিত বাড়িটা ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। না, একদিন সে বাড়ি ফিরে এল সানাইওলার মত মদে চুর হয়ে, আর প্রথমেই গিয়ে উঠল স্টেশনের ঘরে।

ক্রমে সে বড় হল বিয়ে করল, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে হল, এবং একদিন রাতে কুড়ুলের ঘায়ে সকলেরই মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দিল; তারপর সর্ব প্রকারের অসৎ উপায়ে ও ফাঁকিবাজির সাহায্যে সে অনেক টাকা করল; আজ সে নিজ গ্রামের সব চাইতে নারকীয় অসৎ ও পাজি লোক; কিন্তু সকলেই তাকে সম্মান করে; সে আইনসভার সদস্যও হয়েছে।

কাজেই দেখতে পাচ্ছেন, রবিবার বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে এমন কোন খারাপ জেমস্-এর কথা লেখা নেই যার ভাগ্য মন্ত্রপূত জীবনের অধিকারী এই পাপী জিম-এর মত অতি বিচিত্র।

[১৮৬৫]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *