৩. চমকে চাইল জিয়ান মারিয়া

১১.

চমকে চাইল জিয়ান মারিয়া মায়ের মুখের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়াল মঞ্চের উপর। আর সবার মনোভাব বোঝার জন্যে একে একে সবার মুখ পর্যবেক্ষণ করল। কারও মুখে হাসি নেই, গম্ভীর।

সবই তো শুনলে, তোমাদের কি মত, কি শাস্তি দেয়া যায় এই বিশ্বাসঘাতকটাকে? টু-শব্দ নেই কারও মুখে। রেগে গেল ডিউক। কি? কথা নেই কেন, কারও কোনও মন্ত্রণা নেই তোমাদের?

এ বিষয়ে হিজ হাইনেস কারও পরামর্শ আশা করছেন, তাই তো আমি বুঝতে পারিনি, বললেন বৃদ্ধ লোডি। শুরু থেকে আপনি ধরেই নিয়েছেন অ্যাকুইলার লর্ড বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু আমরা যা শুনলাম তাতে মনে হলো এতক্ষণে ইয়োর হাইনেসের ভুল ভেঙে যাওয়ার কথা।

তাই নাকি? আমার ভুল? সাপের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি ডিউকের চোখে। মেসার ডা লোডি, কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছি আপনার আনুগত্য নড়ে গেছে। এখনও সাবধান না হলে পস্তাবেন পরে। আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে। হাজার হোক, মানুষ তো আমি!

অপর সভাসদদের বিচলিত মুখের দিকে চাইল এবার ডিউক।

আপনাদের নীরবতাকে আমার বিচার-বুদ্ধির প্রতি সমর্থন বলেই ধরে নিচ্ছি। জ্ঞানী মাত্রেই বুঝবে, এইমাত্র আমার মামাতো ভাইয়ের মুখ দিয়ে এমন কিছু কথা বেরিয়েছে, যা কোনও ডিউকের সামনে উচ্চারণ করে আজ পর্যন্ত কেউ পার পায়নি। লর্ড অ্যাকুইলার শিরচ্ছেদ না করে এখন আর কোন উপায় দেখছি না।

বলো কি, বাছা! চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাটেরিনা।

যা বলার বলে দিয়েছি, আঁতে দাঁত চাপল জিয়ান মারিয়া, ও না মরা পর্যন্ত দুচোখের পাতা এক করতে পারব না আমি!

তারপর আর পাতা দুটো খুলতেও পারবে না, এটুকু জেনে রেখো! তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের সাহায্যে বোঝাবার চেষ্টা করলেন তিনি, এ-কাজ করলে, কোনও সন্দেহ নেই, বিদ্রোহ করবে জনসাধারণ, প্রথম সুযোগেই খুন করবে জিয়ান মারিয়াকে।

এই তো আসল কথায় এসেছ, বলল জিয়ান মারিয়া। আমার ডাচিতে এমন লোককে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি না, যাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আমারই লোকেরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।

তাহলে তাড়িয়ে দাও, ওকে তোমার রাজত্ব থেকে। নির্বাসন দাও, তাহলেই তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ওকে হত্যা করলে যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যু ঘটবে তোমার।

কথাটা মনে ধরলেও রাজি হতে সময় নিল জিয়ান মারিয়া। মা বোঝাল অনেক, ভয় দেখাল; পারিষদরা কাকুতি-মিনতি করল, তারপর যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো সে তার প্রাণের শত্রু ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে প্রাণ ভিক্ষা দিতে। মার্টিনোক ডেকে হুকুম দিল, কাউন্টকে যেন তার তলোয়ার ফেরত দিয়ে দেয়। ফ্যাব্রিৎসিও ডা লোডিকে হুকুম দিল, যেন ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে জানিয়ে দেয় তার নির্বাসনের কথা, বলে দেয় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জিয়ান মারিয়া স্কোয়ার রাজ্য ছেড়ে দূর হয়ে যেতে হবে তাকে।

খুশি মনে লোড়ি গেলেন আদেশ পৌঁছাতে। সেই সঙ্গে আরও কিছু বললেন, যেটা জিয়ান মারিয়ার কানে গেলে তার কল্লা যেত। সময় উপস্থিত, বললেন তিনি কাউন্টকে। প্রজারা আপনাকে ভালবাসে, আপনাকে চায়, আপনার কাছে তাদের অনেক দাবি। তাদের অর্থে হলেও আপনার এই সুযোগটা গ্রহণ করা উচিত।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, ক্ষমতার লোভ নয়, প্রজাদের আস্থা ও ভালবাসার কথা ভেবে; তারপর মাথা নাড়ল।

ধৈর্য ধরুন, বন্ধু, বলল সে। আপনারা যাই মনে করুন না কেন, আমি জানি, রাজ্য শাসন করার মন-মানসিকতা আমার নেই। এই বাঁধনে জড়াব না আমি, মুক্ত-স্বাধীন জীবনই আমার পছন্দ।

লম্বা করে শ্বাস ছাড়লেন ফ্যাব্রিৎসিও। বেশি কথা বলার উপায় নেই, জিয়ান মারিয়া আবার কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে বললেন, এর ফলে ব্যাব্বিয়ানোর জনসাধারণ তো বাঁচতই, আপনিও নির্বাসনের হাত থেকে বাঁচতেন।

হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। এই নির্বাসন আমার জন্যে শাপে বর হয়েছে। অনেকদিন কাটল আলস্যে, এখন আবার রক্তে নাচন অনুভব করছি। ভবঘুরে মানুষ আমি, ঘুরে বেড়াব দুনিয়াময়। যখন ক্লান্তি আসবে অ্যাকুইলায় ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নেব। ছোট্ট এলাকা, কোনও দিগ্বিজয়ীর চোখ পড়বে না ওর ওপর। ব্যাব্বিয়ানোয় আর আসব না আমি কোনদিন। একদিন এখানকার মানুষ ভুলে যাবে আমাকে, ওদের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। হাত বাড়িয়ে ডিউকাল চেম্বারে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল সে বৃদ্ধকে। তারপর ক্যাপ্টেন আর্মস্টাডের ফিরিয়ে দেয়া তলোয়ার আর ছোরা নিয়ে প্রাসাদের উত্তরে তার জন্যে নির্দিষ্ট স্যুইটে ফিরে গেল।

ওর দেখাশোনার জন্যে ডিউকের নিযুক্ত লোকজনদের বিদায় দিয়ে নিজের দুই টুস্কান অনুচর জাক্কারিয়া ও ল্যাঞ্চিওট্টোকে এক ঘণ্টার মধ্যে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিল।

নিজের শোবার ঘরে গিয়ে সাজ-পোশাক পরে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এমনি সময়ে হন্তদন্ত হয়ে কামরায় ঢুকল তার সুদর্শন বন্ধু ফ্যানফুল্লা ডেন্নি আর্চিপ্রেটি। ওকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

করমর্দন করে বিছানার উপর বসে পড়ল ফ্যানফুল্লা, বৃদ্ধ লোডি যেখানে শেষ করেছিল, সেখান থেকে শুরু করল যুক্তিতর্ক-বলল, এই অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে ব্যাব্বিয়ানো থেকে বিদায় নেয়া চলবে না। দেশের মানুষ…ইত্যাদি ইত্যাদি।

হাসিমুখে সরস ভঙ্গিতে জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তবে কণ্ঠের দৃঢ়তা ফ্যানফুল্লাকে বুঝিয়ে দিল নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকবে সে।

আমি একজন ভ্রাম্যমাণ নাইট, রাজ্যশাসন আমার কাজ নয়, ভাই। তুমি আমার সত্যিকারের বন্ধু হলে এ নিয়ে আর চাপাচাপি কোরো না। শুধু এটুকু জেনো, নির্বাসিত হওয়ায় একটুও দুঃখিত হইনি আমি। বরং যে কর্তব্যবোধ আমাকে এখানে তাড়িয়ে এনেছিল, তা থেকে মুক্ত হয়ে খুশি মনে দূর হয়ে যাচ্ছি। কোনও কিছুর বিনিময়েই নিজের ভাইয়ের রক্ত ঝরাতে পারব না আমি, প্রজাদের শত ভালবাসা পেলেও না।

বুঝলাম, মাই লর্ড, বলল ফ্যানফুল্লা। মুক্ত বিহঙ্গ আপনি, খাঁচার ভিতর গান গাইবার পাত্র নন। তবে ভ্রাম্যমাণ নাইটদের সেইদিন কি আর আছে? কোথায় ড্রাগন, কোথায় সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য, যে রাজকুমারীকে বন্দী করে রেখেছে?

সত্যি! প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো, থাকলৈ কিন্তু মন্দ হতো না। যাই হোক, যুদ্ধ তো আছে! ভেনিশিয়ানরা প্রস্তুতি নিচ্ছে যুদ্ধের, আমাকে পেলে লুফে নেবে।

হায়রে! ব্যাব্বিয়ানোর এই দুর্দিনে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতটাকে হারাতে হচ্ছে আমাদের এক অর্বাচীন ডিউকের ধৃষ্টতায়। সত্যি বলছি, সার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এখানে আর কোন আকর্ষণ থাকল না আমার, আপনার সঙ্গে আমারও চলে যেতে ইচ্ছে করছে এদেশ ছেড়ে।

সত্যি? তাহলে চলো না। তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পেলে আমার খুব ভাল লাগবে।

কাউন্টের ডাক পেয়ে রক্ত নেচে উঠল ফ্যানফুল্লার বুকের মধ্যে। সত্যিই তো, লর্ড অভ অ্যাকুইলার সঙ্গে দেশান্তরী হলে মন্দ হয় না। চট করে তৈরি হয়ে নিল সে। মে মাসের শেষ রাতে চার জন ঘোড়সওয়ার দুটো মালবাহী খচ্চর নিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যাব্বিয়ানো থেকে। ভিনামেয়ারের রাস্তা ধরল ওরা, ওখান থেকে যাবে উরবিনো।

ঝলমলে তারার নিচ দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা সামনে, ফ্যাব্রিয়ানো যখন আর বেশি দূরে নেই একটা ঝর্না পেরিয়ে থামল ওরা বিশ্রামের জন্যে। সাদামাঠা খাবার পরিবেশন করল জাক্কারিয়া-রুটি, মুরগির রোস্ট আর ওয়াইন। খিদের সময় তাই অমৃত মনে হলো ওদের কাছে।

তারপর জলপাই গাছের নিচে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দিল ওরা।

বিকেলে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ঝর্নার ধারে একটা দীঘিতে নেমে মনের আনন্দে স্নান সারল ফ্রাঞ্চেস্কো, তারপর পোশাক পরে তৈরি হলো রওনা হবে বলে। ফ্যানফুল্লাকে বলল, এই মুক্ত জীবনের কোনও তুলনা হয়, বলো?

মনে মনে স্বীকার করল ফ্যানফুল্লা এই কথার যথার্থতা।

অগভীর নদী, বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তায় উঠল ওরা, রওনা হয়ে গেল কাগলির দিকে। সন্ধের দিকে পৌঁছল ওরা ভ্যালডিক্যাম্পোর প্রাসাদে। দুদিন আগেই জিয়ান মারিয়া আতিথ্য গ্রহণ করেছিল এখানে।

জনপ্রিয়, স্বনামধন্য বীর অ্যাকুইন্যার কাউন্টকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো মেসার ভ্যাডিক্যাম্পো, সাদর অভ্যর্থনা জানাল তার সঙ্গীদের। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর সম্মানে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করল সে। ফ্র্যাঞ্চেঙ্কোকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে জানার পরেও খাতির-যত্নে সামান্যতম কমতি হলো না।

খাওয়ার সময় ওয়াইনে চুমুক দিয়ে মন্তব্য করল সে, জিয়ান মারিয়ার আচার-আচরণ সত্যিই ভদ্রজনোচিত নয়। জানেন, আমার এখানে কি কাণ্ড করে গেছেন উনি? আমার অজান্তে আমারই বাড়িতে দুর্ভাগা এক লোককে ধরে এনে এমনই ভয়ঙ্কর নির্যাতন আর জখম করেছেন যে, আজও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে পড়ে ধুকছে লোকটা।

ব্যাপারটা খুলে বলার অনুরোধ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। উরবিনের কোর্ট জেসটার পেপ্পিকে ধরে এনে কি করেছে ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক, সব খুলে বলল ভ্যালডিক্যাম্পো।

এতক্ষণে বুঝল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, জিয়ান মারিয়া কি করে জানল ষড়যন্ত্রের সময় সে ছিল কাছেপিঠে। পেপ্পির উপর নির্যাতনের কারণটা পরিষ্কার বলতে পারল না ভ্যাডিক্যাম্পো, তবে ওর মুখে যেটুকু শুনেছে, লোকটার কাছ থেকে কিছু তথ্য আদায় করেছে ডিউক নির্যাতনের মাধ্যমে। শপথ থাকা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হয়েছে জেসটার একজন লোকের নাম-ধাম।

আর কোনও সন্দেহ রইল না। জিজ্ঞেস করল, বেচারা বুদ্ধটার কি হলো তারপর? কোথায় গেল?

এখানে, আমার আশ্রয়েই আছে। চিকিৎসা চলছে। এমনিতেই দুর্বল, বিকলাঙ্গ মানুষ…এখনও সেরে ওঠেনি বেচারা। আরও বেশ কিছুদিন হাত নাড়তে পারবে না পেপ্পি। কাঁধের কাছ থেকে হাত দুটো খসে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল!

খাওয়া শেষ হলে পেপ্পিনোর সঙ্গে দেখা করতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ফ্যানফুল্লাকে মহিলাদের সঙ্গে গল্প করার জন্যে রেখে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে অসুস্থ ভাড়ের ঘরে নিয়ে গেল ভ্যালডিক্যাম্পো।

এই দেখো, সার পেপ্পি, কে এসেছে তোমাকে দেখতে, মোমবাতিটা বিছানার পাশে একটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল গৃহকর্তা।

আগন্তুককে দেখেই ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠল জেসটারের চোখে মুখে। একলাফে উঠে বসল বিছানায়। বলল, মাই লর্ড, মহান, দয়ালু লর্ড, কৃপা ভিক্ষা চাই! আমাকে দয়া করে ক্ষমা করুন। ওরা কী। নির্যাতন করেছে আপনি ভাবতেও পারবেন না, মাই লর্ড। আমার শপথ আমি রাখতে পারিনি, অবিশ্বাসের কাজ করে ফেলেছি, শাস্তি আমার প্রাপ্য। কিন্তু আমি আপনার করুণা ভিক্ষা করছি, মাই লর্ড!

এবং পেয়েও গেছো, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো মৃদু হেসে। আগে যদি জানতাম এই পরিণতি হবে তোমার; তাহলে কিছুতেই তোমাকে দিয়ে শপথ করাতাম না।

পানি বেরিয়ে এলো পেপ্পির দুচোখে। বলল, সত্যি আমাকে ক্ষমা করছেন, মাই লর্ড? তাহলে নিশ্চয়ই ঈশ্বরও মাফ করে দেবেন আমাকে? সেই থেকে মনোকষ্টে মরে যাচ্ছি এই ভেবে যে, না জানি কি ক্ষতি করে ফেলেছি আপনার।

কিছু না, আশ্বস্ত করল ওকে ফ্রাঞ্চেস্কো। ভুলে যাও ওকথা। শাস্তি যদি কেউ পায়, তুমি না, পাবে জিয়ান মারিয়া। ঈশ্বর তো দেখেছেন সবই, তাই না?

ঠিক বলেছেন, প্রভু! ওহ, মনে হচ্ছে সেরে গেছে সব ব্যথা! বলেই দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউ-মাউ? উফল পেপ্পি।

দুর্বল মানুষটার দুইহাতের কব্জি তচিহ্ন দেখে জিয়ান মারিয়ার উপর ভয়ানক রাগ হলো ফ্র্যাঞ্চেস্কোর। নিজেকে সামলে নিয়ে পেপ্পির শরীরের এখন কি অবস্থা জানতে চাইল সে।

এখন তো মনে হচ্ছে এক্কেবারে সেরে গেছি, মাই লর্ড। কাল সকালেই রওনা হয়ে যাব আমি উরবিনোর পথে। আমার মনিব খুবই নরম মনের মিষ্টি মহিলা, আমার অনুপস্থিতিতে না জানি কত কি

ভাবনায় পড়ে গেছেন তিনি!

বেশ তো, আমার সঙ্গেই চলো তাহলে, বলল কাউন্ট। আমিও ওই দিকেই যাচ্ছি।

খুশিমনে রাজি হয়ে গেল কুঁজো ভাড়।

.

১২.

সকালে উঠে রওনা হলো ওরা। তাড়া নেই, তাই মেটরোর নয়নাভিরাম সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে অপরূপ্ত প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে ধীরেসুস্থে চলেছে ওরা উরবিনোর দিকে। রাত যখন নামল, তখনও চলছে ওরা, শহর এখনও দুই লীগ দূরে।

চাঁদের নরম আলোয় পথ দেখে আরও এক লীগ এগোলো ওরা পেপ্পিনোর মুখে বোক্কাচ্চিওর একটা গল্প শুনতে শুনতে। হঠাৎ কথার মাঝখানে থেমে গেল জেসটার।

কি হলো? জানতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। শরীর খারাপ করছে?

না, বলল জেসটার। মনে হলো মার্চের আওয়াজ পেলাম!

পাতার মর্মর, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

উঁহু! আমি স্পষ্ট শুনলাম… থেমে কান পাতল পেপ্পি। এক ঝলক দমকা হাওয়া ভেসে আসায় এবার সবাই শুনতে পেল শব্দটা।

ঠিক বলেছ, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। মার্চেরই শব্দ। কিন্তু তাতে কি, পেপ্পি? কয়েকজন মার্চ করছে তো কি হয়েছে? তুমি বরং গল্পটা শেষ করো।

কিন্তু উরবিনোয় মার্চ করে কারা, এই রাতে?

আমি জানি, না পরোয়া করি? বলল কাউন্ট। ধরো, ধরো, গল্পটা ধরো। তারপর কি হলো?

কয়েক লাইন বলার পর আবার থামল পেপ্পিনো। ব্যাপারটা আমার মোটেও ভাল লাগছে না, মাই লর্ড। এই রাতে এতলোকের মার্চ করে আসা! আমার মনে হয় একটু আড়াল নেয়া দরকার! ওরা অনেক লোক, এসে পড়ল প্রায়-ডাকাতও হতে পারে, মাই লর্ড!

তাতে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে তো মনে হয় না, কঠোর কণ্ঠে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

ভয় না, মাই লর্ড! সাবধানতা। খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা এটা, বিশেষ করে উরবিনোয়। আমাদের দেখা উচিত ব্যাপারটা কি।

এই পর্যায়ে ফ্যানফুল্লা ও দুই অনুচর সমর্থন করল পেপ্পিকে। ফলে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর গাছের ছায়ায় সরে দাঁড়াল দলটা। মোড় ঘুরে এগিয়ে এলো একদল সৈন্য। জনা বিশেক লোকের একটা কোম্পানী, কোমরে তলোয়ার, কাঁধে বর্শা-এগিয়ে আসছে কুচকাওয়াজ করে। তাদের নেতা, বিশাল চেহারার এক লোক খাড়া হয়ে বসে আছে মস্ত এক ঘোড়ার পিঠে। লোকটাকে দেখেই বিড়বিড় করে কি যেন বলল জেসটার। সৈন্যদলের মাঝখান খচ্চর-টানা চারটে গাড়ি চলেছে হাঁটার গতিতে। একটা গাড়ির পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে আসছে সুবেশী, সুশ্রী এক তরুণ। আবার বিস্ময়ধ্বনি বেরোল পেপ্পিনোর কণ্ঠ থেকে। তৃতীয়বার প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ও কালো পোশাক পরা মোটা এক লোককে দেখে, কিন্তু সামলে নিল কোনমতে। লোকটা তখন তুমুল ঝগড়া করছে এক সৈনিকের সঙ্গে।

আমার সঙ্গে বাঁদরামি! দাঁড়া, রোক্কালিয়নে পৌঁছে নিই। তোদের ওই ডাকাত-চেহারার কমান্ডারকে দিয়েই তোকে ফাঁসীতে ঝোলাব আমি! দেখে নিস, তোর…

হেসে উঠল সোলজার, তলোয়ারের বাঁট দিয়ে আবার গুলো মারল মোটা লোকটার খচ্চরের পাছায়। চমকে সামনে বাড়ল খচ্চর, পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিল মোটা, তারপর মুখটা অপবিত্র করে ফেলল গালাগালের তুবড়ি ছুটিয়ে।

মোটা ফ্রায়ার এগিয়ে যেতে দেখা গেল ছয়টা গরুর গাড়িতে করে যাচ্ছে মালপত্র, তার পিছনে একপাল ভেড়া তাড়িয়ে আনছে কয়েকজন পরিচারক। চলে গেল ওরা সামনে দিয়ে, মিলিয়ে গেল অন্ধকার ছায়ায়।

আমার যতদূর বিশ্বাস, বলল ফ্যানফুল্লা, এই সন্ন্যাসীটাকে আগেও দেখেছি আমি কোথাও।

দেখেছেন, বলল পেপ্পি। এ সেই মোটা গর্দভ, যাকে নিয়ে আপনি অ্যাকুয়াম্পার্টার কনভেন্টে গিয়েছিলেন হিজ এক্সেলেন্সির জন্যে ওষুধ আর ব্যান্ডেজ আনতে। ফ্রা ডোমেনিকো।

এদের সঙ্গে কি করছে ওই ফ্লায়ার? আর এই লোকগুলোই বা কারা? জানতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, জবাব দিল জেসটার। আন্দাজও করতে পারছি না। ওই মোটা ফ্রায়ার ছাড়া আরও এক আধজনকে চিনতে পেরেছি আমি। প্রথমেই যে দৈত্যের মত লোকটা গেল ঘোড়ায় চেপে, ও হচ্ছে এরকোল ফোর্টেমানি। নাংরা এক মস্তান। এককালে হয়তো ভাড়াটে যোদ্ধা ছিল, কিন্তু এখন ভিখারী, সারাক্ষণ মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে। মানুষের সঙ্গে ঝগড়া বাধানোর ওস্তাদ। মুখে বড়বড় বোলচাল আর কেবল নিজের বড়াই। বর্তমান পেশা হচ্ছে, সুযোগ পেলেই পথে-ঘাটে রাহাজানি, ছিনতাই। কিন্তু আজ ওর সাজ পোশাকের বাহার দেখেছেন? এ ছাড়াও আরও একজনকে চিনতে পারলাম আমি-রোমিও গনৎসাগা। ভীতুর ডিম, রাত-বিরেতে বাইরে বেরোতে ওকে এই প্রথম দেখলাম। কিছু একটা ঘটেছে উরবিনোয় সন্দেহ নেই।

আর গাড়িগুলো? ধারণা করতে পার, কারা গেল ওতে চড়ে?

নাহ! মাথা নাড়ল ভাঁড় এপাশ ওপাশ। মেসার গনৎসাগা যাচ্ছে যখন, ধরে নেয়া যায় গাড়িতে মহিলা আছে। মোটা ফ্রায়ারের কথা থেকে বোঝা গেল রোক্কালিয়নে যাচ্ছে ওরা। উরবিনোয় পৌঁছলেই আশা করি বিস্তারিত জানা যাবে সব।

.

সেই রাতে আর শহুরে ডোকা গেল না, গেট লাগিয়ে দিয়েছে ক্যাপটেন। তাই নদীর ধারের একটা বাড়িতে রাতটা কাটাল ওরা। কিন্তু সকালে গেটে পৌঁছেই গেট-ক্যাপটেনকে হেঁকে ধরল কোর্ট জেসটার, খবরের জন্য।

আচ্ছা, সার ক্যাপিটান কি বলতে পারেন, গতরাতে কারা গেল রোক্কালিয়নের দিকে?

কই, কয়েক মুহূর্ত পেপ্পিনোর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, না। তো! এরকম কিছু দেখিনি, শুনিওনি। নিশ্চয়ই উরবিনোর কেউ না।

বাহু, চমৎকার ডিউটি করছেন দেখছি! শুকনো গলায় বলল জেসটার। আমি দেখেছি। জেনে রাখুন, বিশজন যোদ্ধার একটা দল কাল রাতে উরবিনো থেকে গেছে রোক্কালিয়নে।

অ্যাঁ? রোক্কালিয়ন? একটু যেন থমকে গেল ক্যাপটেন। ওটা মোন্না ভ্যালেন্টিনার দুর্গ না?

ঠিক। কিন্তু কথা হচ্ছে, এক কোম্পানী যোদ্ধা কেন চলেছে ওদিকে? বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে?

তুমি কি করে জানলে ওরা উরবিনো থেকে রওনা হয়েছে? উৎকণ্ঠায় ঢোক গিলল ক্যাপটেন।

জানলাম, দলের আগে আগে চলেছে ঝগড়াটে ক্যাপটেন এরকোল ফোর্টেমানি; মাঝখানে একটা ঘোড়ায় রয়েছে সভাসদ রোমিও গনৎসাগা, আর পিছনে একটা খচ্চরের ওপর ছিল ফ্রা ডোমেনিকো, ম্যাডোনার পুরুত-সবাই উরবিনোর।

খবর শুনে বেগুনী হয়ে গেল অফিসারের মুখের রঙ। আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কোনও মেয়েমানুষ ছিল ওদের সঙ্গে?

না, মেয়েলোক দেখিনি, বলল জেসটার। ক্যাপটেনের চেহারা দেখে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে সে।

চারটে গাড়ি অবশ্য ছিল, পেপ্পিনো সাবধান করার আগেই ফস্ করে বলে বসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

হায়, হায়! তাহলে তো উনিই! ককিয়ে উঠল ক্যাপটেন। এই কোম্পানি, আপনারা বলছেন, চলেছে রোক্কালিয়নের দিকে…সবই মিলে যাচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে আপনারা জানলেন কি করে?

ফ্রায়ারকে বলতে শুনেছি আমরা, ঝটিতি জবাব দিল কাউন্ট।

তার মানে পালিয়েছে! কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল ক্যাপটেনের চেহারা। এই, তোমরা কোথায়? বলেই ঘুরে ছুট লাগাল গেট হাউজের দিকে। পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে ছয়জন গার্ড সহ বেরিয়ে এলো আবার। গার্ডরা ঘিরে ধরল নবাগতদের। চলো প্রাসাদে! ঘাড় ফিরিয়ে ফ্রাঞ্চেস্কোর দিকে চেয়ে বলল, চলুন, স্যার, আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। যা জানেন নিজের মুখে বলবেন ডিউককে।

জোরাজুরি কোরো না, ঠাণ্ডা গলায় বলল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। আড়ষ্ট হয়ে গেল ক্যাপটেন। অবশ্য উরবিনোয় এসেও দেখা না করে চলে গেলে দুঃখ পাবেন ডিউক গুইডোখ্যান্ডো। ঠিক আছে, চলো যাই। আমি কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা।

মুহূর্তে বদলে গেল ক্যাপটেনের ব্যবহার। বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করল সে, গার্ডদের পিছনে সরে যেতে বলল। একটা ঘোড়ায় চেপে কাউন্টের পাশে পাশে চলল সে, শোনাল এদিকের কাহিনী। উরবিনো থেকে তিনজন সঙ্গিনী নিয়ে পালিয়ে গেছে লেডি ভ্যালেনটিনা। ফ্রা ডোমেনিকো আর রোমিও গনৎসাগাকেও পাওয়া যাচ্ছে না কাল সন্ধে থেকে।

তাজ্জব হয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আরও তথ্যের জন্যে কৌশলে চাপ দিল ক্যাপটেনকে। খুব বেশি কিছু জানা নেই তার, তবে তার ধারণা ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের সঙ্গে বিয়েটা এড়াবার জন্যেই একাজ করেছে ভ্যালেনটিনা। এই বিব্রতকর ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন ডিউক গুইডোব্যাল্ডো, জিয়ান মারিয়ার কানে খবরটা যাওয়ার আগেই অবাধ্য ভাইঝিকে ফিরিয়ে আনার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন।

মনিবের জন্যে চিন্তায় পড়ে গেল পেপ্পিনো। ভাবছে বেশি কৌতূহল দেখাতে গিয়ে শেষে তাকে বিপদেই ফেলে দিল কি না। লেডি ভ্যালেন্টিনার জন্যে সে প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, অথচ সে-ই কিনা ফাঁস করে দিল কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে বেচারি। সব জানার পর ফ্র্যাঞ্চেঙ্কোকে হেসে উঠতে দেখে রেগে গেল সে। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চেস্কো হাসছে ভ্যালেনটিনার সাহস দেখে, প্রতিবাদের ধরন দেখে।

ক্যাপটেনকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এই যে সশস্ত্র লোক-লস্কর, দেহরক্ষী-এসবের কি অর্থ?

বুঝতে পারলেন না? অবাক হয়ে তাকাল ক্যাপটেন ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মুখের দিকে।.ওহ্, রোক্কালিয়ন দুর্গ সম্পর্কে বোধহয় আপনার জানা নেই।

শুধু এইটুকু জানি, ইটালীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ ওটা, বলল কাউন্ট।

ঠিকই জানেন। ওই সশস্ত্র লোকগুলোকে নেয়া হয়েছে দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্যে। কাকার আদেশ মানবেন না তিনি, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, হিজ হাইনেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চলেছেন তার ভাইঝি।

এবার রাস্তার লোকজনকে চমকে দিয়ে হো-হহা করে প্রাণ খুলে হেসে উঠল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো। কোনমতে হাসি সামলে নিয়ে ফ্যানফুল্লাকে বলল, দেখো, মেয়ে বটে একটা! কাকার আদেশ মানে জিয়ান মারিয়াকে বিয়ে করার আদেশ-বুঝতে পেরেছ? বিয়ে ঠেকাতে প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে সে! বোঝে অবস্থা! এর পরেও যদি ওকে বিয়ে করার জন্যে গুইডোব্যাল্ডো জোরাজুরি করে, তাহলে বলতে হবে হৃদয়ে তার অনুভূতি বলতে কিছু নেই। আমার তো মনে হয় এই মেয়ের জন্যে প্রিন্সের গর্ব হওয়া উচিত। যেমন কাকা, তেমনি ভাইঝি-মনে হচ্ছে সমান যুদ্ধবাজ। সাধে আর উরবিনো আক্রমণের কথা স্বপ্নেও ভাবে না বর্জিয়া। আবার হেসে উঠল সে। তুরুজোড়া কুঁচকে আছে ক্যাপটেনের, থমথম করছে পেপ্পিনোর গোমড়া মুখ।

অবাধ্য, পাজি মেয়ে! ফস্ করে বলে বসল ক্যাপটেন।

মুহূর্তে হাসি মুছে গেল কাউন্টের মুখ থেকে।

জিভটা সামলাও, সার ক্যাপিটানো, নইলে বিপদে পড়বে। যদি নাইট বা তার কাছাকাছি পদমর্যাদার কেউ হতে, তাহলে এই কথার জন্যে তোমাকে আমি ডুয়েলে চ্যালেঞ্জ করতাম। ওঁর সম্পর্কে রায় দেয়া তোমাকে সাজে না। আমার পরিবারের সঙ্গে শুধু মিত্ৰতা নয়, অন্তরঙ্গত আছে ওই মেয়ের পরিবারের।

চুপ হয়ে গেল অফিসার বকা খেয়ে।

কিছুক্ষণ পরেই ডিউকের অ্যান্টিরূমে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে অপেক্ষারত কাউন্ট চুপ হয়ে গেল পেপ্পিনোর বকা খেয়ে। সরাসরি ওকে দায়ী করল জেসটার বেশি বেশি কথা বলে ওর মনিবের বিপদ ডেকে আনায়। পেরির অভিযোগে কিছু মনে করল না ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কারণ ওর মনিবের প্রতি গভীর ভালবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে ওর প্রতিটি কথায়। সব শুনে বলল, বিপদটাকে কনায় অনেক বড় করে দেখছ, পেপ্পি। আমরা যা বলেছি, ডিউক হয়তো ইতিমধ্যেই অন্য সূত্র থেকে অনেক বেশি জেনে ফেলেছেন তার চেয়ে। বা শীঘ্রি জেনে যাবেন। কি আর হবে তাতে? বড়জোর দুর্গের পরিখার ধারে দাঁড়িয়ে তার মান রক্ষা করার অনুরোধ করবেন ডিউক ভাইঝিকে।

কিংবা দুর্গ আক্রমণ করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবেন তাকে।

উঁহু, মাথা নাড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় আপন ভাইঝির দুর্গ আক্রমণ করে গোটা ইটালীর হাসির পাত্র কিছুতেই হবেন না ডিউক গুইডোব্যাল্ডো। নির্বোধ জিয়ান মারিয়া হলে এক কথা ছিল, কিন্তু প্রিন্স এই বোকামি করতে যাবেন না।

ডিউকের চেম্বারে ডাক পড়ল ওদের। গম্ভীর, চিন্তাক্লিষ্ট ডিউক প্রথা অনুযায়ী আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে। তারপর গত রাতে কি দেখেছে জানতে চাইলেন। সব শুনে ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান পরিচারককে নির্দেশ দিলেন যেন অতিথিদের খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়।, বাইরে বেরিয়ে পেপ্পিনোকে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, দেখলে, কি রকম শান্ত ভাবে নিলেন ডিউক সংবাদটা? তুমি শুধু-শুধুই ভয় পাচ্ছ কেউ তোমার মনিবের দুর্গ আক্রমণ করবে না।

আপনি চেনেন না ওঁকে, বলল শুধু জেসটার।

.

১৩.

কথাটা ঠিকই বলেছিল পেনিনা। গুইডোব্যাল্ডো নিজে আক্রমণ না করলেও, দুদিন পর ব্যাব্বিয়ানোর ক্রুদ্ধ ডিউক যখন দুর্গাক্রমণের প্রস্তাব দিল, একটু আঁইগুঁই করে সম্মতি দিলেন তিনি।

জিয়ান মারিয়া যে রাজকুমারীর প্রেমে উন্মাদ হয়ে এমন একটা কাণ্ড করতে চাইছে, তা ঠিক বলা যাবে না তার ক্রোধের প্রধান কারণ: যৌতুকের টাকাটা মার যেতে বসেছে। মাকে ও সভাসদদের বড় মুখ করে অনেক আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা শুনিয়ে এসেছে সে, এখন খালি হাতে ফিরে গেলে সব কুল যাবে তার। বর্জিয়াকে ঠেকাবার আর কোন উপায়ই থাকবে না। ছলে-বলে-কৌশলে যেমন করে থোক, ভ্যালেনটিনাকে বিয়ে করতেই হবে তার। পাকা কথা হয়ে গেছে, এখন এমন কি জোর খাটানোরও অধিকার আছে তার।

ওকে ফিরিয়ে আনতেই হবে! চেঁচিয়ে উঠল সে।

মানি, বললেন ডিউক গুইডোব্যাল্ডো। কিন্তু জানি না কিভাবে আনা যায়।

কেন, অসুবিধেটা কোথায়?

অসুবিধে নেই, বাঁকা করে জবাব দিলেন গুইডোব্যাল্ডো। ইটালীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গে গিয়ে উঠেছে ও, জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের ব্যাপারে ওর সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিতে রাজি না হলে বেরোবে না ওখান থেকে। আমি তাতে রাজি থাকলে কোনও অসুবিধে নেই।

রাগে দাঁত বেরিয়ে পড়ল জিয়ান মারিয়ার।

আপনি অনুমতি দিলে আমি একবার আমার মত করে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

কোনও কৌশলে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে যদি রোেক্কালিয়ন থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করতে পারেন, কেবল সমর্থন নয়, আমার সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতাও পাবেন।

তাহলে আর দেরি নয়, আজই রওনা হতে চাই আমি। আপনার ভাইঝি আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তাকে বিদ্রোহী হিসেবেই দেখতে হবে আমাদের। দেশের শাসকের আদেশ অমান্য করে একটা দুর্গে সৈন্য মোতায়েন করে প্রতিরোধের হুমকি দেয়া মানে যুদ্ধ ঘোষণা, লর্ড ডিউক। যুদ্ধই করতে হবে আমাদের।

আপনি কি শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবছেন? অসন্তোষ ফুটে উঠল গুইডোব্যাল্ডোর কণ্ঠে।

নিশ্চয়ই। প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করব আমরা, ইয়োর হাইনেস। কামান দেগে একটা একটা করে পাথর খসিয়ে আনব আমি ওই দুর্গের। নরম সুরে প্রেম নিবেদন করতে রাজি ছিলাম, কিন্তু ও যখন অবাধ্যতা করছে, তখন কামানের ভাষায় প্রেম নিবেদন করব, অনাহারে রেখে বাধ্য করব আত্মসমর্পণে। আর এই আপনাকে বলে রাখছি, ওই দুর্গে প্রবেশ করার আগে আমি আর দাড়ি শেভ করব না।

কথা শুনে গম্ভীর হলো গুইডোব্যাল্ডোর চেহারা।

আমার মনে হয় আরও নরম ব্যবস্থা নেয়া আপনার উচিত হবে। বল প্রয়োগ কন, কিন্তু চরম কোন ব্যবস্থা নিতে যাবেন না। ওদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে নতি স্বীকার করাবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে আমার ধারণা, এটা করতে গেলেও গোটা ইটালী হাসাহাসি করবে আপনাকে নিয়ে।

করুক, আমি কেয়ার করি না! বলল জিয়ান মারিয়া। হাসতে ইচ্ছে করলে হেসে মরুক না ওরা, আমার কি? প্রতিরোধের কি ব্যবস্থা নিয়েছে ওরা দুর্গে?

ভুরু কুঁচকে গেল গুইডোব্যাল্ডোর। বললেন, শুনলাম জনা বিশেক লোক নিয়োগ করেছে ফোর্টেমানি নামে এক কুখ্যাত গুণ্ডা, আর এই গুণ্ডাকে নিয়োগ করেছে আমারই কোর্টের এক লোক, আমার স্ত্রীর আত্মীয় মেসার রোমিও গনৎসাগা।

ওই লোকও কি এখন ওখানে? প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল জিয়ান মারিয়া।

তাই তো মনে হচ্ছে, জবাব দিলেন উরবিনোর ডিউক।

বলেন কি! আপনি বলছেন ওরা দুজন যুক্তি করে পালিয়েছে?

মাই লর্ড! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন গুইডোব্যাল্ডো, মনে রাখবেন, আপনি আমার ভাইঝি সম্পর্কে কথা বলছেন। কয়েকজন মহিলা, ব্যক্তিগত ফ্রায়ার ও দুয়েকজন চাকরের সঙ্গে এই লোককেও সাথে রেখেছে আমার ভাইঝি। এর সঙ্গে পালাবার প্রশ্নই ওঠে না।

.

নিজের কামরায় ফিরে গেল জিয়ান মারিয়া। দুই ভুরু কুঁচকে আছে, ঠোঁট জোড়া চেপে বসেছে পরস্পরের সঙ্গে। অনেকক্ষণ পায়চারী করল সে ঘরের ভিতর। ডিউকের কথায় সে আশ্বস্ত হতে পারেনি। হাসুক ইটালীর সবাই যার যত খুশি! মেয়েটা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাকে কেটে হেঁটে নত করে সাইজে আনার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সে ভেতর ভেতর; কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, রোক্কালিয়ন দুর্গ জয় করার পরমুহূর্তেই ওই গনৎসাগা ব্যাটাকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দেবে সে দুর্গের সবচেয়ে উঁচু কড়িকাঠ থেকে।

সেইদিনই রোক্কালিয়ন দুর্গ আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল জিয়ান মারিয়া। ফ্যানফুল্লার মাধ্যমে সব খবর পৌঁছে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কাছে।

তোমার কি মনে হয় এই গনৎসাগা লোকটা মেয়েটার প্রেমিক?

তা আমি কি করে বলব বলুন? জবাব দিল ফ্যানফুল্লা। তবে পেপ্পিকে জিজ্ঞেস করায় প্রথমে ও খুব হেসেছে, তারপর বলেছে: ভ্যালেন্টিনার ওকে ভালবাসার প্রশ্নই ওঠে না। তবে, একটু থেমে নিচু গলায় বলেছে ও, কোনও সন্দেহ নেই ওই লোকটা ভালবাসে ম্যাডোনাকে। লোকটা মতলববাজ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কী বিচ্ছিরি ব্যাপার! বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। মেয়েটা দেখছি মহা দুর্ভাগ্যের শিকার। কাকার জেদ থেকে বাঁচতে গিয়ে পড়ে গেছে আর এক পাল্লায়। তুমি এক কাজ করো, পেপ্পিকে ডেকে আনো, ওর মাধ্যমে এসো দুর্গে জিয়ান মারিয়ার আক্রমণের খবরটা পাঠাই, সেই সঙ্গে সাবধান করে দিই মানচুয়ার ওই লোকটা সম্পর্কে।

দেরি হয়ে গেছে, বলল ফ্যানফুল্লা। ও তো আজ সকালেই রওনা হয়ে গেছে রোক্কালিয়নের উদ্দেশে।

আহা! বিমর্ষ কণ্ঠে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। বেচারি যাঁতাকলের মাঝখানে পড়ে গেছে। সাহসী এক তরুণী, পরিণত হয়েছে লোভাতুর দুই শিকারীর তীরের লক্ষ্যে।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কিন্তু বাইরের কোনও দৃশ্য নয়, চোখের সামনে ভেসে উঠল অ্যাকুয়াম্পার্টার সেই জঙ্গল, যেখানে শুয়ে আছে এক আহত যুবক, আর তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে স্বর্গের এক অক্ষরী। তার দুই চোখে মায়ার জাদু। বার বার ঘুরে ফিরে আসে ইদানীং এ দৃশ্যটা, কখনও মৃদুহাসি ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটে, কখনও আসে দীর্ঘশ্বাস; কখনও বা একসঙ্গে দুটোই।

হঠাৎ ঘুরে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো ফ্যানফুল্লার দিকে। ঠিক আছে, আমি নিজেই যাব।

আপনি! অবাক হয়ে গেল ফ্যানফুল্লা। তাহলে ভেনিশিয়ানদের কি হবে?

হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, যার অর্থ এই মহিলার গুরুত্ব তার কাছে ভেনিশিয়ানদের চেয়ে অনেক-অনেক বেশি।

আমি চললাম রোক্কালিয়নে, আবার বলল সে, এখন, এই মুহূর্তে রওনা হচ্ছি আমি। দরজার কাছে গিয়ে হাততালি দিয়ে ডাকল ল্যাঞ্চিওট্টোকে।

এই সেদিন তুমি বলছিলে, ফ্যানফুল্লা, এখন আর দৈত্য-ড্রাগনের হাতে বন্দী হয় না রাজকুমারী, ভ্রাম্যমাণ নাইটরা সব বেকার হয়ে গেছে। কিন্তু দেখো, সত্যিই কি মোন্না ভ্যালেনটিনা বন্দী, রাজকুমারী নয়? জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে মন-মানসিকতা আর চেহারায় মিল পাওয়া যায় না কুৎসিত দৈত্যের কুচক্রী ড্রাগনটা হলো ব্যাটা গনৎসাগা। আর উদ্ধারকারী হিরো নাইটটা কে তা নিশ্চয়ই না বললেও বুঝতে পারছ?

জিয়ান মারিয়ার হাত থেকে রক্ষা করবেন আপনি ওকে বিস্ময় চাপতে পারছে না ফ্যানফুল্লা।

চেষ্টা করব। পরিচারক এসে ঢুকতে তার দিকে ফিরল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, শোনো, ল্যাঞ্চিওট্টো, পনেরো মিনিটের মধ্যে রওনা হচ্ছি আমরা। তুমি আর আমি। যাও, ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে তৈরি হয়ে নাও। জাক্কারিয়া থাকবে মেসার ডেলি আরচিপ্রেটির সঙ্গে। ফ্যানফুল্ল, ওর দিকে খেয়াল রেখো, খুবই বিশ্বাসী আর ভাল ছেলে ও।

কিন্তু আমি? আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি না?

যেতে চাইলে আমার আপত্তি নেই, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তবে আমার মনে হয় তুমি ব্যাব্বিয়ানোতে ফিরে গিয়ে চোখ-কান খোেলা রাখলে সব দিক দিয়ে ভাল হয়। ওখানে কি ঘটছে যদি আমাকে জানাতে পার, তাহলে আমার খুবই উপকার হবে। আমার ধারণা, জিয়ান মারিয়া এখানে সময় নষ্ট করলে বেকায়দায় পড়ে যাবে, কারণ বর্জিয়ার আক্রমণ আসতে আর বেশি দেরি নেই।

কিন্তু খবরটা আপনাকে কোথায় দেব? রোক্কালিয়নে?

একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আমার কোনও সংবাদ না পেলে তুমি যোগাযোগ করবে রোক্কালিয়নে। ওখানে যদি আটকা পড়ে যাই তাহলে তোমাকে কোনও সংবাদ দেয়া সম্ভব হবে না। আর যদি অ্যাকুইলায় ফিরে যাই, তাহলে খবর পাবে তুমি।

অ্যাকুইলায় যাচ্ছেন?

বলা যায় না, যেতেও পারি। তবে কথাটা কাউকে বোলো না। এই দুই ডিউকের চোখে ধুলো দেয়ার জন্যে হয়তো এটাই প্রচার করতে হবে আমাকে। আবার হয়তো যেতেও হতে পারে, কে জানে!

আধঘণ্টা পর তরতাজা এক ক্যালাব্রিয়ান ঘোড়ায় চেপে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে ধীরে-সুস্থে রওনা হয়ে গেল অ্যাকুইলার কাউন্ট রোক্কালিয়নের পথে। পিছন পিছন খচ্চরের পিঠে চেপে চলেছে বিশ্বস্ত অনুচর ল্যাঞ্চিওট্টো।

কিছুদূর যাওয়ার পর পশ্চিমে অ্যাপেনাইনের পথ ধরল ওরা। বেশ অনেক রাতে একটা সরাইখানায় থেমে বিশ্রাম নিল ভোর-রাত পর্যন্ত। সূর্য ওঠার আগেই রওনা হয়ে গেল আবার।

প্রাচীন পাহাড়গুলোর মাথায় যখন প্রথম সূর্যের ছটা দেখা দিল, তখন পৌঁছল ওরা রোক্কালিয়ন দুর্গের পায়ের কাছে। উঁচু একটা পাহাড়ের মাথায় নির্ভীক প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে দুৰ্গটা।

ধীরে ধীরে পাহাড় ডিঙিয়ে নেমে এলো আলো। প্রথমে স্পষ্ট হলো দুর্গশীর্ষের চৌকোণ টাওয়ার, তারপর পাথুরে দেয়াল বেয়ে আলো নেমে এলো গরাদ দেয়া জানালাগুলোর উপর, ওখান থেকে জল নিষ্কাশনের পাইপ বেয়ে নামলো কামান দাগার ফোকর পর্যন্ত, তারপর খুব দ্রুত নেমে এলো পরিখার জলে। ক্রমে উপত্যকার ঘাসগুলো সবুজ হয়ে উঠছে।

ঘোড়াটাকে হটিয়ে দুর্গের পশ্চিম পাশ ঘুরে উত্তরে চলে এলো ফ্রাঞ্চেস্কো, একটা সরু সাঁকো পেরিয়ে গিয়ে থামল দুর্গের প্রবেশ দুয়ারের সামনে।

কাউন্টের ইঙ্গিত পেয়ে গলা ছেড়ে হাঁক দিল ল্যাঞ্চিওট্টো। পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলল আওয়াজটা। ভয় পেয়ে উড়ে পালাল কয়েকটা পাখি। কিন্তু দুর্গবাসীদের কোনও সাড়া নেই।

খুবই সজাগ পাহারা দিচ্ছে দেখা যায়! হেসে উঠল কাউন্ট। হ্যাঁ, ল্যাঞ্চিওট্টো, আবার ছাড়ো দেখি তোমার হেঁড়ে গলাটা।

অন্তত বিশটা ডাক দেয়ার পর একটা মাথা দেখা দিল টাওয়ারে। এলোমেলো চুল দেখে বোঝা গেল মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। ধরা গলায় জানতে চাইল সে এত হৈ-চৈ কিসের।

পেপ্পিনোকে চিনতে পেরে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, কি খবর, বুদ্ধ?

আরে! আপনি, মাই লর্ড? বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল জেসটার। ঘুমের ঘোর কাটিয়ে পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠল।

তাই তো মনে হয়, হাসল কাউন্ট। আচ্ছা ঘুম তো তোমাদের! যাও, তোমাদের অলস যোদ্ধাগুলোকে ঘুম থেকে তুলে ব্রিজটা নামাতে বলো। মোন্না ভ্যালেনটিনার জন্যে সংবাদ এনেছি।

এক্ষুণি যাচ্ছি, এক্সেলেন্সি, বলেই রওনা হচ্ছিল পেপ্পি, আবার ডাক দিল ওকে কাউন্ট।

বলবে, একজন নাইট এসেছেন। যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর অ্যাকুয়াস্পার্টায়। আমার নামটা গোপন রেখো।

মাথা ঝাঁকিয়ে ছুট দিল পেপ্পি। একটু পরেই ফোর্টেমানির দুই বদমাশ অনুচরকে সাথে নিয়ে ব্যাটলমেন্টে দেখা দিল গনৎসাগা। ঘুম জড়ানো বেজার মুখে জানতে চাইল কি চায় ওরা, কি দরকার।

মোন্না ভ্যালেনটিনাকে দরকার, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো গলা চড়িয়ে।

চিনতে পারল ওকে গনৎসাগা, মুহূর্তে বিকৃত হয়ে গেল তার চেহারা। ভ্রূকুটি করে বলল, আমি মোন্না ভ্যালেনটিনার ক্যাপটেন। আমাকে বলতে পার যা জানাতে এসেছ।

কিন্তু ওকে বলবে না ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ও-ও এই ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না ভ্যালেনটিনাকে, ব্রিজ নামিয়ে একে ভেতরে আসতেও দেবে না। দুপক্ষেরই মেজাজ চড়ছে, ভাষা কর্কশ হয়ে উঠছে ক্রমে-এমনি সময়ে পেপ্পিনোর সঙ্গে এসে হাজির হলো স্বয়ং ভ্যালেনটিনা।

কি ব্যাপার, গনৎসাগা? জিজ্ঞেস করল ভ্যালেনটিনা। কে বলে এসেছে?

কে এসেছে তা জানিয়েছে তাকে পেনিনা। বলেছে : ফ্র্যাঞ্চেস্কো নামের সেই লাইট এসেছেন, দুর্গে প্রবেশ করতে চাইছেন। নামটা শোন মাত্র প্রথমে রাঙা হয়ে উঠেছে রাজকুমারীর গাল, তারপর ফ্যাকাসে। পরমুহর্তে পড়িমরি করে ছুটেছে র‍্যাটলমেন্টের দিকে।

কেন? বলল সে, ঢুকতে দিচ্ছ না কেন ওঁকে? শুনলাম আমার জন্যে নাকি সংবাদ আছে? সুদর্শন কাউন্টের দিকে চাইল মেয়েটা ওই তো দাঁড়িয়ে ওর ত্রাণকর্তা নাইট, ওর স্বপ্নের রাজকুমার! মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খুলে সম্মান জানাচ্ছে তাকে। কী অপূর্ব, আত্মমর্যাদায় বলীয়ান সুপুরুষ! অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ফিরল সে গনৎসাগার দিকে।

কি হলো? কি বললাম শুনতে পাওনি? দেরি করছ কি জন্যে? ব্রিজ নামাতে বলো।

ভেবে দেখো, ম্যাট্রোনা, ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে দেখেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে গনৎসাগার, এ-লোককে তুমি চেনো না। ও জিয়ান মারিয়ার চর কিনা কে জানে! হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা…

বোকা! বকা দিল ভ্যালেনটিনা। দেখতে পাচ্ছ না, এ সেই আহত নাইট, উরবিনোয় যাওয়ার পথে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের।

তাতে কি? পাল্টা প্রশ্ন করল গন্‌ৎসাগা। ওটা কি ওর সতোর বা তোমার প্রতি বিশ্বস্ততার কোন প্রমাণ হলো? ও ওখান থেকেই ওর যা বলার বলুক না। ওর বাইরে থাকাটাই আমাদের জন্যে নিরাপদ।

গনৎসাগার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার নজর বুলাল মেয়েটা। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, মেসার গনৎসাগা, ব্রিজ নামাতে বলো ওদের!

কিন্তু, ম্যাডোনা, তর্ক চালিয়ে গেল লোকটা, তুমি বিপদের কথাটা একেবারেই ভাবছ না।

বিপদ! তাজ্জব হয়ে গেল ভ্যালেনটিনা। কী বলছ পাগলের মত? তুমি কাপুরুষ নাকি? দুজন লোক কি বিপদ ঘটাবে আমাদের বিশজনের গ্যারিসনের বিরুদ্ধে নামাও ব্রিজ!

কিন্তু যদি…

তর্ক করতেই থাকবে তুমি? আমার নির্দেশ কানে যাচ্ছে না তোমার? এখানে মালিকটা কে শুনি-তুমি, না আমি? তুমি ব্রিজ নামানোর হুকুম দেবে, না কি আমার নিজেকেই দিতে হবে?

অসন্তোষের সঙ্গে ঘুরল গন্‌ৎসাগা, সঙ্গের একজনকে পাঠাল হুকুম দিয়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘড়ঘড় শব্দে নেমে গেল ড্র-ব্রিজ। ঘোড়া হাঁকিয়ে উঠে এলো ফ্র্যাঞ্চেস্কো তক্তার উপর, পিছনে ল্যাঞ্চিওট্টো। দুর্গে প্রবেশ করে দাঁড়াল প্রশস্ত প্রথম আঙিনায়।

রাশটা টল দেয়ার আগেই হৈ-হৈ আওয়াজ শুনে ঘাড় ফিরাল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে অর্ধনগ্ন, বিশালদেহী ফোর্টেমানি, চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে।

অ্যাই, অ্যাই! তুমি এখানে এলে কি করে? কোন্ হারামজাদা ঢুকতে দিয়েছে তোমাকে? কার হুকুমে নামানো হয়েছে ব্রিজ, অ্যাঁ?

মোন্না ভ্যালেনটিনার ক্যাপটেনের হুকুমে, শান্ত গলায় জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ভাবছে, লোকটা পাগল নাকি?

ক্যাপটেন! থমকে দাঁড়াল লোকটা, লাল হয়ে উঠল মুখটা। ভূতের কেচ্ছা নাকি? কোন্ ক্যাপটেন? আমিই এখানে ক্যাপটেন!

অবাক হয়ে আপাদমস্তক দেখল ওকে কাউন্ট।

তাহলে তো প্রশংসাটা তোমারই প্রাপ্য দেখছি! হাসি মুখে বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, মেসার ক্যাপিটানো, তোমার সতর্ক প্রহরা এবং দুর্গ রক্ষার নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থার প্রশংসা না করে পারা যাচ্ছে না। ইচ্ছে করলেই দেয়াল বেয়ে উঠে ভিতরে চলে আসতে পারতাম আমি, টেরটি পেত না তোমার ঘুমন্ত প্রহরীদের একজনও।

ভুরু কুঁচকে বাঁকা চোখে ওর দিকে চাইল ফোর্টেমানি। গত চারদিনের সর্দারি তাকে আরও উদ্ধত করে তুলেছে। বলল, নিজের চরকায় তেল দাও, আগন্তুক! এত বড় আস্পর্দা, তুমি আমাকে কাজ শেখাতে আসো! বেশি বাড় বেড়ে গেছ, মিয়া। এমন মার খাবে, জীবনে ভুলবে না!

মার খাব…আমি? চেহারা কালো হয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর।

হ্যাঁ, খাবে! আমারই হাতে। চেনো আমাকে? আমার নাম এরকোল ফোর্টেমানি।, তোমার নাম শুনেছি আমি, বলল কাউন্ট। তবে ভাল কিছু নয়। শুনেছি, তোমার মত ভীরু, মাতাল, অকর্মা লোক গোটা ইটালীতে আর নেই। মার দেয়ার হুমকি তোমার মুখে অন্তত সাজে না, বেআদব, জানোয়ার কোথাকার! আর একবার ওকথা উচ্চারণ করলে ওই চৌবাচ্চার নোংরা পানিতে চুবিয়ে তুলব। সেটা তোমার জন্যে অবশ্য শাপে বর হবে-মানটা হয়ে যাবে। গা থেকে যে রকম বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে, মনে হয় জন্মের পর থেকে গোসল কাকে বলে জান না।

প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়ল দৈত্য। কি বললি? আয়, নেমে আয় ঘোড়া থেকে, দেখাচ্ছি মজা! খপ করে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর পা ধরে ফেলল ও টেনে নিচে নামাবে বলে।

এক ঝটকায় পাটা ছাড়িয়ে নিল কাউন্ট, রেগে গেছে ও। ইচ্ছে করেই স্পরের খোঁচা লাগিয়ে দিল দৈত্যের হাতে; সেইসঙ্গে চাবুক তুলল ওর বিশাল, নগ্ন পিঠে মারবে বলে। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ এক নারীকণ্ঠ ধমকে উঠল।

থমকে দাঁড়িয়ে নিজের হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফোর্টেমানি, বিড়বিড় করে গাল বকছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, ব্যাটলমেন্ট থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে ভ্যালেনটিনা। তার পিছু পিছু আসছে গনৎসাগা, পেপ্পি আর দুজন সেন্ট্রি।

গনৎসাগার দুএকটা কথা কানে এলো কাউন্টের। ভ্যালেনটিনাকে বলছে, দেখলে? আমি তোমাকে বলেছিলাম একে ঢুকতে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। এখন দেখতেই পাচ্ছ কী পদের মানুষ লোকটা।

নেমে এলো ভ্যালেনটিনা। কঠোর গলায় বলল, ব্যাপারটা কি, স্যার? দুর্গে ঢুকেই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন আমার গ্যারিসনের সঙ্গে?

পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ঘোড়া থেকে নেমে রাশটা ধরিয়ে দিল ল্যাঞ্চিওট্টোর হাতে। হ্যাটটা পিছনে ঠেলে দিয়ে হাঁটু মুড়ে সম্মান জানাল ভ্যালেনটিনাকে, তারপর শান্তকণ্ঠে বলল, ম্যাডোনা, এই বদমাশটা আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছিল।

নিশ্চয়ই তার কারণ সৃষ্টি করেছ তুমি! বলল গনৎসাগা।

বদমাশ? তীক্ষ্ণ ভর্ৎসনা ঝরল ভ্যালেনটিনার কণ্ঠে। আর একটু সতর্কতার সঙ্গে শব্দ চয়ন করতে হবে আপনাকে, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কাকে বদমাশ বলছেন আপনি? ও আমার গ্যারিসনের ক্যাপটেন।

মৃদু হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। নরম কণ্ঠে বলল, এই ক্যাপটেন” শব্দটা নিয়েই তো কথা কাটাকাটির শুরু। এই ভদ্রলোক, গনৎসাগার দিকে ইঙ্গিত করলও, আমাকে জানিয়েছেন তিনিই ক্যাপটেন। অথচ…

উনি আমার এই দুর্গের ক্যাপটেন, বলল ভ্যালেনটিনা।

দেখতেই পাচ্ছেন, সার ফ্রাঞ্চেঙ্কো, এখানে ক্যাপটেনের অভাব নেই। ফ্রা, ডোমেনিকো আমাদের আত্মার ক্যাপটেন-রান্নাঘরেরও। আমিও এক ক্যাপটেন…

কথার মাঝখানে ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল গনৎসাগা, তারপর ফিরল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে।

আমাদের জন্যে কিছু বার্তা আছে বলছিলেন, স্যার।

লোকটার উদ্ধত চাল এবং আমাদের শব্দটার সাহায্যে নিজেকে ভ্যালেনটিনার সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। মাথাটা সামান্য ঝোঁকাল রাজকুমারীর দিকে। কিছুটা গোপনীয়তার দরকার আছে। এতটা ভোলামেলা জায়গায় কথাটা বলতে চাই না। বলে চারদিকে চোখ বুলাল কাউন্ট। ফোর্টেমানির গোটা কোম্পানী হাজির। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসল গনৎসাগা, কিন্তু কথাটার যৌক্তিকতা টের পেয়ে ওদের দুজনকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত করে রওনা হয়ে গেল ভ্যালেনটিনা।

আঙিনা পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে ডাইনিং হলের দিকে চলল ওরা। ভাড়া করা সৈনিকদের ভ্রুকুটিতে অশুভ ইঙ্গিত টের পেল কাউন্ট, হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওরা ওর দিকে। যেন কিছুই টের পায়নি এমনি ভঙ্গিতে প্রত্যেককে মেপে নিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো অভিজ্ঞ চোখে, বুঝে নিল কার কি ওজন। হলে ঢোকার মুহূর্তে গনৎসাগাকে দাঁড় করাল ও।

দেখুন, ওই গুণ্ডাগুলোর মাঝে আমার চাকরটাকে রেখে যেতে ভয় হচ্ছে আমার। আপনি কি দয়া করে ওদের বলবেন যেন ওর কোন ক্ষতি না করে?

গুণ্ডা! কথার জবাব দিল ভ্যালেনটিনা। রেগে গেছে সে। আপনি জানেন, ওরা আমার সোলজার।

মাথা ঝুঁকাল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, শান্ত স্বরে বলল, বেশ তো। আপনার লোক বাছাইয়ের প্রশংসা করতে পারব না, তবে এ বিষয়ে আর কোন কথাও বলব না আমি।

এবার আঁতে ঘা লাগল গন্‌ৎসাগার, কারণ বাছাইয়ের দায়িত্ব ছিল তারই। বলল, ফালতু বোলচাল অনেক কষ্টে সহ্য করেছি, এবার লোকটার বার্তাটা ফালতু না হলেই বাঁচা যায়।

রেগে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এবং তা গোপন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না সে, অগ্নিদৃষ্টিতে বিদ্ধ করল মেয়েলি চেহারার তরুণটিকে-বুঝিয়ে দিল তার বৈরী মনোভাব। কথা যখন বলল, সেটা শোনাল মিছরির ছুরির মত।

তা ঠিক, তা ঠিক। এখন মনে হচ্ছে আমার ফিরে যাওয়াই উচিত। মনে হচ্ছে, সবাই মুখিয়ে আছে এখানে ঝগড়া বাধাবার জন্যে। দুর্গে প্রবেশ করতে না করতেই তেড়ে এসে ক্যাপটেন ফোর্টেমানি যা ব্যবহার করল, তাতে উপযুক্ত শাস্তি প্রাপ্য ছিল ওর। আপনি, ম্যাডোনা, রেগে যাচ্ছেন আমার লোকের নিরাপত্তার কথা তোলায়-অথচ ওদের চোখেমুখে আমি দেখেছি শয়তানীর ছাপ। আমার দশ বছরের অভিজ্ঞতার বলে চিনে নিয়েছি আমি এদের, পোশাক পরিয়ে যতই এদের আসল চেহারা ঢাকার চেষ্টা করা হোক না কেন। অথচ এদের গুণ্ডা-বদমাশ বললে আপনার রাগ হচ্ছে। আর সবশেষে, এই মিষ্টি চেহারার বীরপুরুষ বলছেন আমার ফালতু কেলচাল তিনি সহ্য করেছেন অনেক কষ্টে!

ম্যাডোনা! রাগে কাঁপছে গনৎসাগার গলা, অনুমতি দাও, উচিত শায়েস্তা করে ছেড়ে দিই ব্যাটাকে!

ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কঠোর বাক্যে রেগে উঠতে যাচ্ছিল ম্যাডোনা, কিন্তু এই সুঠামদেহী নাইটকে গনৎসাগা শায়েস্তা করতে চায় শুনে চট করে বাস্তবে ফিরে এলো সে। দুজনের চেহারার বৈপরীত্যই বলে দেয় কি ঘটবে তাহলে। কিন্তু হাসল না সে। একে একে দেখল দুজনকে। আগন্তুকের দৃষ্টিতে প্রথমে বিস্ময়, তারপর কৌতুক ফুটে উঠতে দেখল সে। বুঝে ফেলল, নাইটের বক্তব্যে সত্যতা আছে, তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেয়া হয়নি, বলা যায় রীতিমত দুর্ব্যবহারই করা হয়েছে তার সঙ্গে। অল্প দুচার কথায় সুকৌশলে দুজনকেই শান্ত করে ফেলল। ম্যাডোনা।

এইবার, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, বলল সে, যা ঘটেছে ভুলে আসুন আমরা পরস্পরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি। কোথাও বসে শোনা যাক আপনার সংবাদ। আসুন, প্লিজ।

চমৎকার সাজানো গোছানো ব্যাঙ্কোয়েট হলে ঢুকল ওরা। চামড়া মোড়া, একটা উঁচু আর্মচেয়ারে বসল মোন্না ভ্যালেনটিনা। তার কনুইয়ের পাশে দাঁড়াল গনৎসাগা, সামনে একটা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

কথা আমার অল্পই, বলল কাউন্ট। খুশি হতাম যদি এটা সুসংবাদ হতো। আপনার পাণিপ্রার্থী জিয়ান মারিয়া ফিরেছেন উরবিনোয়। পাকা কথা দেয়া হয়েছিল তাঁকে, এবার যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলতে চান। আপনার পালিয়ে এসে রোক্কালিয়নে আশ্রয় নেয়ার কথা জানতে পেরে একদল সৈন্য নিয়ে আসছেন দুর্গ আক্রমণ করে আপনাদের ধরে নিয়ে যেতে।

দুধের মত সাদা হয়ে গেল গনৎসাগার মুখ। ভয় পেয়েছে। জানে, ভ্যালেনটিনাকে অবাধ্য হওয়ার পরামর্শ দেয়ায় ধরা পড়লে কি ঘটবে তার কপালে। গোটা প্ল্যান কেঁচে যাওয়ায় গলা থেকে অদ্ভুত একটা গোঙানির মত শব্দ বেরলো ওর! মেয়েটাকে ফুসলে, ভালবাসার কথা বলে যে বিয়ে করে ফেলবে সে সময় পাওয়া যাবে না আর। শীঘ্রিই যুদ্ধ বেধে যাবে এখানে, রক্তপাত হবে-ভাবতেই শিরশির করে উঠল ওর গা। গুইভোব্যান্ডো বা জিয়ান মারিয়া ওদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সত্যি সত্যিই দুর্গ আক্রমণ করে বসবে, এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।

শান্তিপ্রিয়, নিরীহ সভাসদের চেহারায় ভীতির চিহ্ন দেখে মৃদুহাসি ফুটল কাউন্টের ঠোঁটে। চোখ ফিরিয়ে তাকাল ভ্যালেনটিনার দিকে। ভয়ের লেশমাত্র নেই তার মুখে। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আসুক না, গর্দভ ডিউকটার জন্যে প্রস্তুত থাকব আমরা। অস্ত্রশস্ত্রের অভাব নেই আমাদের, খাবার যা আছে অনায়াসে চলে যাবে অন্তত ছয়মাস। আসুক জিয়ান মারিয়া, এলেই টের পাবে ভ্যালেনটিনাকে বন্দী করা অত সহজ হবে না। যাক, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ওপর আমার কোনও অধিকার নেই, কিন্তু তারপরও এতদূর কষ্ট করে এসে আমাকে আগাম সাবধান করে দেয়ায় আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

হাসল কাউন্ট।

আমি কেবল সাবধান করতেই আসিনি, ডানা। প্রয়োজনে আপনাকে সাহায্য করতেও প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনার ওই লোকগুলোকে দেখে যারপরনাই হতাশ হয়েছি আমি। মনে মনে যে, পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম, তার প্রধান শর্তই ছিল আপনার সৈনিকদের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেসব এদের নেই।

তবু, যেন এই কথায় খড়-কুটো পেয়েছে ডুবন্ত গনৎসাগা, হাঁসফাঁস করে উঠে বলল, দয়া করে আপনার প্ল্যানটা বলবেন?

বন না শুনি? অনুরোধ করল ম্যাডোনাও।

এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আচ্ছা, ব্যাব্বিয়ানোর রাজনীতি সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে আপনাদের?

কিছুটা জানা আছে আমার, বলল ভ্যালেনটিনা।

আমি পরিষ্কার একটা ধারণা দিচ্ছি, ম্যাডোনা, বলে অল্প কথায় সীজার বর্জিয়ার আক্রমণের হুমকি; জিয়ান মারিয়ার জনপ্রিয়তার অভাব, মৈত্রীর জরুরী প্রয়োজনীয়তা, ও হাতে সময়ের স্বল্পতা-সবই বুঝিয়ে বলল। শেষে যোগ করল, এখানে বেশি সময় দিতে পারবে না ও। কয়েকটা দিন ঠেকিয়ে দিতে পারলেই নিজের রাজ্য বাঁচাতে ছুটতে হবে ওকে ব্যাব্বিয়ানোয়। এবং এই একই কারণে তীব্র, বেপরোয়া আক্রমণ করে দুর্গ জয় করতে চাইবে ও। এই সময়টাতে এখানে আপনার না থাকলেও চলে, ম্যাডোনা।

না থাকলেও চলে! ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল ভ্যালেনটিনার।

না থাকলেও চলে মানে? আশার আলো জ্বলে উঠল গনৎসাগার চোখে।

এই প্রস্তাবই দেব ভেবেছিলাম। অন্য কোথাও সরিয়ে দেব আপনাকে। অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহের পর যদি দুর্গের পতন হয়, ভিতরে ঢুকে কিছুই পাবে না জিয়ান মারিয়া, দেখবে খাঁচা খালি।

আপনি আমাকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলেন?

তাই চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনার লোকদের দেখার পর মত পাল্টেছি। এদের ওপর মোটই নির্ভর করা যায় না। প্রথম সুযোগেই আত্মসমর্পণ করবে এরা, দুএকটা গোলা পড়লেই ব্রিজ নামিয়ে খুলে দেবে দুর্গ-তোরণ। আপনার সরে যাওয়ার কথা জেনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিছু ধাওয়া করবেন ___ মারিয়া।

ম্যাডোনা কি বলবে ভেবে স্থির করার আগেই যুক্তি-তর্ক দেখাতে শুরু করে দিল গনৎসাগা। তার মতে এর চেয়ে ভাল পরামর্শ আর হয় না। ভ্যালেনটিনাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে পালানো দরকার এখান থেকে। ম্যাডোনা সরাসরি ওর দিকে চাইতেই থেমে গেল তার বকবকানি।

কি ব্যাপার, গনৎসাগা? ভয় লাগছে?

হ্যাঁ-আমি…আমি তোমার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি, ম্যাডোনা।

আমার জন্যে তোমাকে ভয় পেতে হবে না, গনৎসাগা। আমি এখানে থাকি বা না থাকি, জিয়ান মারিয়া কোনদিন ধরতে পারবে না আমাকে! ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরল সে, আমার তো মনে হচ্ছে এখানে থেকেই ওই বাজে লোকটাকে প্রাণপণে বাধা দেয়া উচিত। পালানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তার পরেও বুঝতে পারছি, আপনার পরামর্শে ভেবে দেখার মত যুক্তি আছে। ভেবে দেখব আমি।

এরপর খবর বয়ে আনার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল সে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে। সবশেষে নারীসুলভ কৌতূহল দমন করতে না পেরে জানতে চাইল, এত কষ্ট স্বীকার করে স্যার নাইটের এখানে আসা এবং সাহায্যের প্রস্তাব দেয়ার পিছনে উদ্দেশ্য বা কারণটা কি।

হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কাউন্টের মুখটা। বলল, অতি সহজ, ম্যাডোনা। কোনও নাইটের পক্ষেই নারীর বিপদে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, সে নাইট যদি আহত অবস্থায় অ্যাকুয়াম্পার্টায় আপনার সহানুভূতি ও সেবা পেয়ে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।

চট করে চাইল ম্যাডোনা ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে, কয়েকটা মুহূর্ত স্থির হয়ে কি যেন খুঁজল সুপুরুষ লোকটার চোখে, তারপর নামিয়ে নিল দৃষ্টি। দুজনেই বুঝল, কি যেন ঘটে গেল ওদের বুকের ভিতর।

সামলে নিয়ে ম্যাডোনা জিজ্ঞেস করল, আমরা যে রোক্কালিয়ন দুর্গে আশ্রয় নিয়েছি, এত তাড়াতাড়ি সেটা জানাজানি হলো কি করে?

আপনি জানেন না? অবাক হলো ফ্র্যাঞ্চেস্কো, পেপ্পিনো বলেনি কিছু?

ওর সঙ্গে কথা হয়নি আমার, বলল ভ্যালেনটিনা। গত রাতে এসেছে শুনেছি, আজ সকালে দেখা করে আপনার আসার সংবাদ দিল।

ম্যাডোনার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাইরে থেকে হৈ-হল্লার শব্দ ভেসে এলো, পরমুহূর্তে দড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল পেপ্পি।

সার ফ্র্যাঞ্চেস্কো, রক্তশূন্য চেহারা পেপ্পির, জলদি আসুন, মেরে ফেলল আপনার লোককে!

.

১৪.

নানা ভাবে ল্যাঞ্চিওট্টোকে খেপানোর চেষ্টা করেছে দুর্গরক্ষীরা, কিন্তু শান্ত থেকেছে ও। এটাকে ওরা ধরে নিয়েছে কাপুরুষতা। ফলে তাদের টিটকারি ক্রমেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। শেষে একজন এগিয়ে এসে ওর পা ধরে টেনে খচ্চর থেকে নামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে লাথি খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়তেই চারপাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই ল্যাঞ্চিওট্টোর উপর।

প্রভুর তলোয়ারটা বের করার চেষ্টা করল ল্যাঞ্চিওট্টো, কিন্তু সময় পাওয়া গেল না; চারপাশ থেকে দশ-বারোটা হাত চেপে ধরল ওকে। ধস্তাধস্তি করছে ছুটবার জন্যে, চিৎকার দেবে বলে মুখ খুলল ও। চট করে একজুন ওর মুখ চেপে ধরল, আরেকজন পেঁচিয়ে ধরল গলা।

আঙিনার পশ্চিমে একটা বড়সড় চৌবাচ্চা রয়েছে, একটা সিংহমূর্তির মুখ দিয়ে একসময় পানি এসে পড়ত ওতে। এখন বহুদিন হলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। বুক-সমান নোংরা পানি জমে আছে এখনও-ভয়ানক দুর্গন্ধ, নাড়া পড়ে না বলে কারও দৃষ্টি পড়েনি এদিকে। ফোর্টেমানির পরামর্শে কিল-ঘুসি মারতে মারতে উল্লসিত লোকগুলো ল্যাঞ্চিওট্টোকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওদিকে-ময়লা পানিতে চুবিয়ে মারবে।

প্রাণপণে লড়ছে রক্তাক্ত ল্যাঞ্চিওট্টো। কিন্তু এতগুলো বলবান লোকের সঙ্গে একা সে পারবে কেন, হিড়হিড় করে টেনে আনল ওরা ওকে চৌবাচ্চার কিনারায়।

এমনি সময়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ ব্যথায় চিৎকার করে উঠল একজন, পরমুহূর্তে আরও কয়েকজন ককিয়ে উঠল চাবুকের আঘাতে। ওদের হট্টগোল আর হাসি-তামাশা তীক্ষ্ণ চিৎকারে পর্যবসিত হয়েছে। কে যেন গরুর চামড়ার ফিতে বেঁধে তৈরি করা চাবুক দিয়ে বুকে পিঠে-মুখে মেরে চলেছে ওদের।

সর, সরে যা, জানোয়ারের দল! দূর হ এখান থেকে! গর্জে উঠল একটা গম্ভীর, জোরাল কণ্ঠ।

ল্যাঞ্চিওট্টো বুঝল, আর ভয় নেই, এসে গেছে তার প্রভু। ধমক শুনে কেঁপে গেছে ওদের বুক, তার উপর যেখানে সেখানে সপাসপ ছোবল হানছে চাবুকটা-বাধ্য হলো ওরা পিছিয়ে যেতে। ছাড়া পেয়ে ল্যাঞ্চিওট্টো দেখল চারদিকে চাবুক চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো, একা। ওই একজনের ভয়েই কে কোনদিকে পালাবে দিশে পাচ্ছে না ওরা।

কিন্তু রুখে দাঁড়াল বিশাল চেহারার এরকোল ফোর্টেমানি, জোরে শ্বাস টেনে বুক ফুলাল। হাত থেকে চাবুকটা ফেলে একহাতে লোকটার বেল্ট ধরল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, অপর হাতে চেপে ধরল ঘাড়; তারপর এক ঝাঁকিতে ওকে মাথার উপর তুলে ছুঁড়ে দিল চৌবাচ্চার দুর্গন্ধময়, নোংরা পানিতে।

বিকট এক চিৎকার দিয়ে উড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পানিতে পড়ল ফোর্টেমানি, তলিয়ে গেল নিচে। বিশ্রী দুর্গন্ধ ছুটল চারদিকে। সেদিকে লক্ষ না দিয়ে ল্যাঞ্চিওট্টোর পাশে বসে পড়ল ফ্র্যাঞ্চেঙ্কো, জিজ্ঞেস করল, লেগেছে কোথাও? জখম হয়েছ?

ল্যাঞ্চিওট্টো উত্তর দেয়ার আগেই ছোরা হাতে একলাফে এগিয়ে এলো এরকুলের একজন অনুচর, উবু হয়ে বসা ফ্র্যাঞ্চেস্কোর পিঠ লক্ষ্য করে চালাল ওটা প্রাণপণ শক্তিতে।

নারীকণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে এলো। চেঁচিয়ে ওকে সাবধান করতে চেয়েছে ভ্যালেনটিনা। এতক্ষণ হলঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিল সে আর গনৎসাগা।

ছোরাটা ফ্র্যাঞ্চেস্কোর বিশেষভাবে তৈরি পোশাক ভেদ করতে পারল না। চোখের পলকে লোকটার কব্জি চেপে ধরে মোচড় দিয়ে ছোরাটা ঘুরিয়ে দিল কাউন্ট আক্রমণকারীরই বুকের দিকে, হাতের চাপে ওকে বসতে বাধ্য করল হাঁটু মুড়ে। ছোরাটা এখন ঠেকে আছে ওরই বুকের ওপর হৃৎপিণ্ড বরাবর। দম আটকে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন, সবাই। আক্রমণকারীর দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর ছেড়ে।

ওর মুখের দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর হাসি হাসল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর ছোরার আগাটা অন্যদিকে সরিয়ে প্রচণ্ড এক থাবড়া লাগাল ওর নাকে মুখে। জ্ঞান হারিয়ে একপাশে ঢলে পড়ল লোকটা। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাবুকটা তুলে নিয়ে বাকি সবার মোকাবিলা করবে বলে উঠে দাঁড়াল কাউন্ট। কিন্তু কেউ নড়ল না ওরা।

ওদিকে দুর্গন্ধময়, দূষিত পানিতে ডুব দিয়ে উঠে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর উদ্দেশে একনাগাড়ে ওই পানির চেয়েও নোংরা বিচ্ছিরি সব গালাগালি বর্ষণ করছে এখন এরকোল ফোর্টেমানি। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে খুন না করে সে আর অন্ন স্পর্শ করবে না, কিন্তু সামনে আসার কোন লক্ষণ নেই। কাউন্টের প্রচণ্ড শক্তির নমুনা সে টের পেয়েছে, তাই নিরাপদ দূরত্বে থেকে সে মুখ ঢালাচ্ছে সমানে। অনুচরদের নির্দেশ দিচ্ছে ওই অহঙ্কারী লোকটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলতে। কিন্তু এক পা এগোবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওদের কারও মধ্যে, বরং বোঝা যাচ্ছে ওরা পালাবার জন্যে একপায়ে খাড়া। পাথুরে গ্যালারিতে দাঁড়ানো পেপ্পির গা জ্বালানো বিদ্রূপও ওদেরকে একবিন্দুস্পর্শ করছে না।

কিছু একটা করার জন্য গনৎসাগাকে বলে যখন কাজ হলো না, ভ্যালেনটিনা নিজেই এগিয়ে এলো। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল সে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর সাহসের, তারপর পাশ ফিরে চিৎকাররত এরকোলকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলল, শেষে সৈনিকদের দশ হাতের মধ্যে গিয়ে এরকোলকে দেখিয়ে হুকুম দিল, গ্রেপ্তার করো ওকে!

হুকুম শুনে মুহূর্তে চমকে চুপ হয়ে গেল এরকোল। ওর অনুচররা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এ-ওর দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা দূর হয়ে গেল ম্যাডোনার পরবর্তী নির্দেশে।

ওকে বন্দী করে গার্ডরুমে নিয়ে যাও! তা নইলে ওকে সহ তোমাদের সবাইকে দূর করে দেব আমি আমার দুর্গ থেকে! কথাটা সে এমন ভঙ্গিতে বলল, যেন একশো সশস্ত্র লোক রয়েছে ওর ইঙ্গিতের অপেক্ষায়, আঙুল নাড়ালেই বের করে দেবে ওদের সবাইকে।

ভ্যালেনটিনার পিছনে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে আছে গনৎসাগা, ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার পিছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো দীর্ঘ, সুপুরুষ ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো। তার পাশে লাঞ্চিওঠো। যেন এই কজনই ওদের সবাইকে দুর্গ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

সৈন্যদের দ্বিধা করতে দেখে ভ্যালেনটিনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। গমগমে গলায় বলল, তোমরা লেডি ভ্যালেনটিনার নির্দেশ শুনেছ। এবার তোমাদের সিদ্ধান্ত শোনা যাক। এ আদেশ তোমরা পালন করবে, না কি অমান্য করবে এখনই না নিলে পরে আর সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবে না। যদি ওঁর আদেশ মানতে না চাও, ওই দেখো, ব্রিজটা নামানো আছে এখনও, সোজা বিদায় হয়ে যাও ওই পথে।

গনৎসাগার গাটা জ্বলে গেল কাউন্টের বক্তব্য শুনে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যেমন করে থোক আজই এই লোকটাকে দুর্গ থেকে বিদায় করতে হবে। এই লোকটা আসার পর একেবারে ম্লান হয়ে গেছে তার ব্যক্তিত্ব। সবাই পদে পদে টের পাচ্ছে ওর অক্ষমতা। মনে মনে চাইছে সে সৈন্যরা এই লোকটিকে পাত্তা না দিক।

কিন্তু সৈন্যরা এর হাতে মার খেলেও বুঝতে পেরেছে সিংহের সাহস রয়েছে এর বুকে, সত্যিকারের বীর একজন, একে উপেক্ষা করা যায় না। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ গুজুর গুজুর করল ওরা, তারপর ওদের মধ্যে থেকে একজন উত্তর দিল:

মাননীয় স্যার, নিজেদের ক্যাপটেনকে গ্রেপ্তার করতে বলা হচ্ছে আমাদের।

তা ঠিক, তবে তোমাদের ক্যাপটেন তোমাদের মতই এই ভদ্রমহিলার বেতনভুক কর্মচারী। তোমাদের সর্বাধিনায়ক তিনিই। তার আদেশ পেলে ক্যাপটেনকে গ্রেপ্তার করায় কোনও বাধা নেই। এই কথাতেও ওদের দ্বিধা কাটছে না দেখে টোপ দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আজকের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে দায়িত্ব পালনের কোনও মোগ্যতা নেই ওই লোকটার। বিচারে যদি তাই সাব্যস্ত হয়, তাহলে ওর শূন্য স্থান পূরণের জন্যে তোমাদের কাউকে হয়তো দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।

আর দ্বিধা থাকল না কারও। এরকোলের পদ ও বেতনের টোপ ওদের কাছে খুবই লোভনীয়। চৌবাচ্চার ধারে গিয়ে দাঁড়াল ওরা, উঠে আসতে বলল ভিজে চুপসে যাওয়া এরকোলকে।

অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তনে ভড়কে গেছে এরকোল। গোঁজ হয়ে। দাঁড়িয়ে থাকল সে, নড়ল না একচুলও। সহজ ভঙ্গিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। এগিয়ে গিয়ে একজনকে আদেশ দিল সে, যাও, তীর-ধনুক নিয়ে এসো। উঠে না এলে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে বদমাশটাকে। তারপর তুলে আনা যাবে লাশ।

মুহূর্তে ভাবের পরিবর্তন এসে গেল এরকোলের মধ্যে। দয়া, ক্ষমা ইত্যাদি প্রার্থনা করছে এখন। কিনারার দিকে আসতে আসতে অভিযোগ করছে, ডুবে যদিও মরেনি, পচা পানির বিষক্রিয়ায় ভয়ানক কোনও রোগ হয়ে গেছে ওর।

এই ঘটনাতেই চোখ খুলে গেল ভ্যালেনটিনার। বুঝে নিল কাদেরকে সংগ্রহ করেছে গনৎসাগা, কাদের ওপর ভরসা করেছে সে দুর্গরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে। যাই হোক, ফ্র্যাঞ্চেস্কোর জন্যে একটা ঘর ঠিক-ঠাক করার নির্দেশ দিল সে, অনুরোধ করল তাকে কয়েকটা দিন এই দুর্গে কাটিয়ে যাবার জন্যে। বলল, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে কিছুটা সময় তার দরকার। আজই প্রার্থনার সময় ঈশ্বরের উপদেশ কামনা করবে সে: পালিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে, না কি এখানে থেকেই মোকাবিলা করবে জিয়ান মারিয়ার।

দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় লায়নস টাওয়ারের নিচে চমৎকার একটা ঘর দেয়া হলো কাউন্টকে।

.

১৫.

দুপুরে এত রকম সুস্বাদু খাবার পরিবেশিত হলো যে অবাক হয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ফ্রী ডোমেনিকোর রান্নার হাত চমৎকার। তাছাড়া সময় পেলেই সে তাজা মাছ ধরে আনে নদী থেকে, ফাঁদ পেতে ধরে আনে খরগোশ। এদের আচরণ দেখে মনেই হয় না কাকার সিদ্ধান্ত অমান্য করে পালিয়ে এসেছে এখানে, মনে হচ্ছে পিকনিকে এসেছে। খেতে খেতে হাসি-গল্পে মেতে উঠেছে সবাই।

খাওয়া শেষ হলে গনৎসাগার অনুরোধে হল রূমে শুরু হলো বিচার অনুষ্ঠান। ফ্র্যাঞ্চেস্কো নিজের কোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছিল, কিন্তু ভ্যালেনটিনা অনুরোধ করল ওকে, যেন বিচারের সময় পাশে থেকে তাকে অভিজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে। তোক পাঠানো হলো বন্দী ফোর্টেমানিকে হাজির করার জন্যে।

দুর্গে পৌঁছানোর পর থেকে বেয়াড়া লোকটা ড্যাম কেয়ার ভাব দেখিয়ে, আদেশ অমান্য করে এবং আরও নানান ভাবে বিরক্ত করেছে গনৎসাগাকে। এই সুযোগে তার শোধ তুলবে বলে মনে মনে স্থির করেছে গনৎসাগা। সোজাসাপ্টা নিজের মত প্রকাশ করল সে, বিচার আবার কি? এক্ষুণি ঝুলিয়ে দেয়া উচিত বদমাশটাকে। আমরা সবাই নিজ চোখে দেখেছি ওর অবাধ্যতা। একটাই শাস্তি হতে পারে এর-ফাঁসী।

কিন্তু বিচারের কথাটা তো তুমিই তুলেছ, বলল ভ্যালেনটিনা।

না, ম্যাডোনা, আমি রায় ঘোষণার কথা বলেছি। তুমি মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে এর মধ্যে টেনে আনায় ব্যাপারটাকে বিচারের মত দেখাচ্ছে।

তুমি দেখছি রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছ, গনৎসাগা! ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে ফিরে বলল, আপনারও কি এই মত, স্যার? ক্যাপিটানের বক্তব্য নাশুনেই, বিনা বিচারে ওকে ফাঁসী দিয়ে দেয়া উচিত? অবশ্য আপনি সায় দিলে আমি খুব অবাক হব না, আপনার যে রুদ্র মূর্তি দেখেছি তখন! ও যা করেছে তারপর ওর প্রতি নরম মনোভাব আপনার না থাকারই কথা।

ফ্র্যাঞ্চেস্কোর উত্তর অবাক করল ওদের দুজনকেই।

ঠিকই ধরেছেন। তবে, তারপরেও, আমার ধারণা সুপরামর্শ দেননি মেসার গনৎসাগা। ফোর্টেমানি জানে কঠিন শাস্তি হতে চলেছে ওর। এখন যদি ওর প্রতি দয়া দেখান, ভবিষ্যতে ওকে একান্ত অনুগত ভৃত্য হিসেবে পাবেন। ওর ধরনটা আমার জানা আছে।

আমরা যা জানি, সার ফ্র্যাঞ্চেস্কো তা জানেন না বলেই এ কথা বলছেন, বলল গনৎসাগা। এখুনি একটা দৃষ্টান্তমূলক কিছু না করলে ওদের আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না, কেউ আর একটা কথাও শুনবে না আমাদের।

দৃষ্টান্ত, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। ক্ষমা ও দয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরুন।

এই কথার পিঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল গনৎসাগা, বাধা দিল ভ্যালেনটিনা।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে, বলল সে। আগেওর কথা শোনা যাক। আপনার পরামর্শ আমার পছন্দ হচ্ছে, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো। গনৎসাগার কথাতেও যুক্তি আছে। তবে এ ধরনের অপরাধে কারও মৃত্যুর দায় কাঁধে না নিয়ে আমি ক্ষমার দিকেই ঝুঁকব বলে মনে হচ্ছে। এই যে, আসছে, বিচার করে দেখা যাক। চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে কাজটা করে এখন অনুশোচনায় ভুগছে লোকটা।

ঠোঁট বাকিয়ে হাসল গনৎসাগা, ভ্যালেনটিনার ডান পাশে একটা চেয়ারে বসল। ফ্র্যাঞ্চেস্কো দাঁড়িয়ে থাকল ভ্যালেনটিনার বাম পাশে।

পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দুজন সেন্ট্রির মাঝখানে শ্লথ পায়ে হেঁটে আসছে ফোর্টেমানি। মুখ-চোখ মলিন। বিচার সভায় ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে দেখে বুঝে নিয়েছে সে, আজ তার আর নিস্তার নেই, সামান্যতম ছাড় পাবে না সে এই লোকের কাছে।

ভ্যালেনটিনার ইঙ্গিতে শুরু করল গনৎসাগা।

কি দোষ করেছ ভাল করেই জানা আছে তোমার, বলল সে। কেন তোমাকে ফাঁসীতে ঝোলানো হবে না, তার কোনও কারণ দেখাতে পার, বদমাশ?

চমকে তাকাল ফোর্টেমানি। গনৎসাগার মত দুর্বল চরিত্রের; মেয়েলি স্বভাবের মানুষ যে এত প্রবল উম্মা প্রকাশ করতে পারে তা সে ভাবতেও পারেনি। ঘৃণা ফুটে উঠল ওর দুচোখে, পরমুহূর্তে বেপরোয়া একটুকরো হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। তাই দেখে লাল হয়ে উঠল গনৎসাগার ফর্সা গাল।

একে নিয়ে গিয়ে এক্ষুণি…।

না, না, গনৎসাগা, ভুল করছ তুমি, বাধা দিল ভ্যালেনটিনা। রায় আমি দেব। তার আগে অবশ্যই প্রশ্ন করব ওকে। মেসার ফোর্টেমানি, তোমাকে ক্যাপটেনের সম্মানজনক ও দায়িত্বপূর্ণ, পদে নিয়োগ করা হয়েছিল; আশা করা গিয়েছিল তুমি ও তোমার লোকজন নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। তা না করে আজ সকালে আমার মেহমানের অনুচরের উপর দলবল নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছ তুমি, আর একটু হলেই খুন করে ফেলতে। এ সম্পর্কে কি বলার আছে তোমার?

মাথা নিচু করে গোমড়া মুখে জবাব দিল ওঃ আমি তো একা করিনি।

তা ঠিক, আরও বিশজনকে সঙ্গে নিয়েছিলে। যেখানে তোমার দায়িত্ব ছিল অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না দেয়া, সেখানে তুমি আরও উস্কে দিয়েছ সবাইকে। নেতৃত্বে কে ছিল, মেসার ফোর্টেমানি? তুমি, না ওরা? ক্যাপটেন হিসেবে দায় দায়িত্ব এড়াতে পার না তুমি।

ওরা বুনো লোক, মাই লেডি।

এবং তোমারই নির্বাচিত ও নিযুক্ত। দেখো, এরই মধ্যে দুই দুইবার মেসার গনৎসাগা সাবধান করেছে তোমাকে, মদ খেয়ে রাত বিরেতে হৈ-হল্লা করতে বারণ করেছে, পাশা খেলতে গিয়ে মারপিট করা থেকে ওদের বিরত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কান দাওনি তুমি, বরং আজ বিনা উস্কানিতে নিরীহ এক লোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছ সবাইকে নিয়ে।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল দৈত্য। অনেকক্ষণ পর মিন-মিন করে বলল, ম্যাডোনা, এই রকম একটা দলের কাছ থেকে আর কি আশা করতে পারেন? মেসার গনৎসাগা আমাকে বলেছেন, জনা কুড়ি লোক সংগ্রহ করতে হবে প্রায়-অবৈধ একটা কাজের জন্যে। আমি এদের জড়ো করেছি। বলতে পারেন, কোন্ সৈন্যদলে হৈ-হল্লা নেই? তাছাড়া মদের কথা বলছেন, আমি কি করব, সেটা তো সরবরাহ করছেন স্বয়ং মেসার গনৎসাগা।

মিথ্যুক, কুকুর কোথাকার! চেঁচিয়ে উঠল গনৎসাগা। তোদের জন্যে এনেছি আমি মদ? না ম্যাডোনার ডিনার টেবিলে পরিবেশনের জন্যে আনা হয়েছে ওগুলো?

কিন্তু পৌঁছে গেছে ওদের হাতে, বলল দৈত্য। ভ্যালেনটিনার দিকে ফিরল আবার, মাই লেডি, এটা আমি দোষের বলে মনে করি না। একটু-আধটু মদ খেলে কি হয়? কাজের সময় দেখবেন আপনার জন্যে একশোবার প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না এদের কেউ।

কিন্তু একশোটা তো নেই, টিটকারির সুরে বলল গনৎসাগা, একটাই মাত্র প্রাণ। তাই ওটা ব্যয় করতে রাজি নয় কেউ!

না, এইখানে অন্যায় হচ্ছে আপনার, গম্ভীর কণ্ঠে প্রতিবাদ করল ফোর্টেমানি। আমি এটুকু বলতে পারি: শক্ত একজন নেতা দিন, যে উৎসাহ যেমন দেবে তেমনি দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করবে ওদের-এমন একজনের নির্দেশে সবকিছুই করবে ওরা।

এই তো, ফিরে এসেছ আগের প্রসঙ্গে। তুমি প্রমাণ করেছ, সে রকম নেতা তুমি নও। নিজেও অবাধ্যতা করেছ তুমি, অধীনস্থ লোকদেরও অশোভন আচরণ থেকে বিরত রাখতে পারনি। আমার মতে এর একমাত্র শাস্তি ফাঁসী। এর পেছনে আর সময় নষ্ট কোরো না, ম্যাডোনা, ভ্যালেনটিনার দিকে ফিরল সে। এখনই দৃষ্টান্ত স্থাপনের উপযুক্ত সময়।

কিন্তু, ম্যাডোনা- কিছু বলতে যাচ্ছিল ফোর্টেমানি, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর কর্কশ চেহারা, কিন্তু তীক্ষ্ণকণ্ঠে বাধা দিল তাকে গনৎসাগা।

 কাকুতি-মিনতি করে কোনও লাভ নেই। অবাধ্যতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

তর্ক করা বৃথা বুঝতে পেরে মাথাটা নিচু হয়ে গেল দৈত্যের, হাল ছেড়ে দিয়েছে। ঠিক এমনি সময়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কো।

ম্যাডোনা, মস্ত ভুল করছেন আপনার উপদেষ্টা। এই লোকের বিরুদ্ধে তিনি যে অভিযোগ করছেন সেটা মোটেও ঠিক নয়। এ কোনওঅবাধ্যতা করেনি।

চোখ বড় করে চেয়ে রইলো ওর মুখের দিকে এরকোল ফোর্টেমানি, এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না কি বলতে চায় নবাগত লোকটা। ভ্যালেনটিনাও ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ওর দিকে

কি বললেন? অবাধ্যতা করেনি?

ইশশ! সলোমন উঠে এসেছে কবর থেকে! ম্যার্তোনা, ওর সঙ্গে কথা বলা বৃথা। আমরা ফোর্টেমানির বিচার করছি।

দাঁড়াও, গনৎসাগা। হয়তো ঠিকই বলছেন উনি।

এত নরম মন নিয়ে কথা শেষ না করে থেমে গেল রোমিও গনৎসাগা, কারণ ভ্যালেনটিনা ততক্ষণে ঘুরে বসেছে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর দিকে।

বলুন। আর একটু পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলুন, প্লিজ।

 ও কি আপনার বা মেসার, গনৎসাগার বিরুদ্ধে একটা আঙুল তুলেছে কখনও, বা আপনাদের কারও আদেশ অমান্য করেছে। যদি করত, তাহলেই কেবল অবাধ্যতার প্রশ্ন উঠত। কিন্তু ও তা করেনি। ওর দোষ হয়েছে আমার চাকরের গায়ে হাত তোলা, তা মানি; কিন্তু এর জন্যে অবাধ্যতার দায় ওর ঘাড়ে চাপানো যায় না-কারণ ল্যাঞ্চিওট্টোর কাছে ও কোনরকম বাধ্যতার দায়ে আবদ্ধ নয়।

হাঁ হয়ে গেছে দৈত্যের মুখ, গনৎসাগাকে মনে হচ্ছে কোর্তা হারানো উকিল, ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে মাথা দোলাচ্ছে ভ্যালেনটিনা-ফ্র্যাঞ্চেস্কোর অকাট্য যুক্তি ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে ওদের চিন্তাধারায়। এরপরেও বেশ কিছুক্ষণ তর্ক চলল, ফোর্টেমানি ও ফ্রাঞ্চৈস্কো-দুজনের বিরুদ্ধেই বিমাোর করল গনৎসাগা, কিন্তু নিজের মত থেকে একচুল নড়ল না কাউন্ট। সবার কথা শেষ হলে কাঁধ ঝকাল ভ্যালেনটিনা, মন স্থির করে ফেলেছে সে, ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে অনুরোধ করল বিচারের রায় ঘোষণা করতে।

আপনি কি সত্যিই তাই চান, ম্যাডোনা? অপরিচিত এক লোকের ওপর ভ্যালেনটিনা এত বড় দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে দেখে অবাক হয়েছে

হ্যাঁ, তাই চাই। আপনি যা ভাল বোঝেন, যেটা উচিত মনে করেন, নিশ্চিন্তে সেই রায় দিন-আমি সেটা সমর্থন করব।

সেন্ট্রি দুজনের দিকে ফিরল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। ওর হাতের বাঁধন খুলে দাও।

পাগল হয়ে গেছে লোকটা! বলল গনৎসাগা। হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা করল সে, ম্যাডোনা, ওর কথা শুনো না!

চুপচাপ দেখে যাও, কি হয়, বলল ভ্যালেনটিনা।

ও থাক, তোমরা এবার যাও, হুকুম দিল কাউন্ট। ওরা চলে গেল, বোকাবোকা চেহারা নিয়ে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকল বাঁধনমুক্ত ফোর্টেমানি।

আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো, মেসার ফোর্টেমানি, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো ধমকের সুরে। কাপুরুষের মত একটা কাজ করে বসেছ তুমি। বিশ্বাসই হতে চায় না একজন সত্যিকারের সোলজার এই কাজ করতে পারে। যাক, আমার হাতে যা শাস্তি পেয়েছ, আমার ধারণা সেটাই তোমার জন্যে যথেষ্ট, ওতেই তোমার লজ্জা আসা উচিত। নিজের লোকেদের কাছেই তোমার সম্মান এখন ধুলোয় মিশে গেছে। যাও, সে সম্মান আবার অর্জন করে নেয়ার চেষ্টা করো গিয়ে। লক্ষ রাখবে ভবিষ্যতে যেন আবার কখনও মাথা হেঁট করতে না হয়। ফাসী হতে হতেও বেঁচে যাচ্ছ-এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে তোমার। দেখলে তো, বিপদের সময় তোমার অনুচর কেউ তোমার পাশে থাকল না। কারণটা কি? ওদের চোখে তোমার কোনও সম্মান নেই, সেটা অর্জন করতে পারনি তুমি। ওদের সঙ্গে ইয়ার-দোস্তের মত মদ খেয়েছ, আর বড় বড় বোলচাল মেরেছ এতদিন; নিজেকে একটু সরিয়ে রেখে সম্মানের আসনে তোলার চেষ্টা করনি।

মাই লর্ড, বুঝতে পেরেছি আমি, মিন মিন করে বলল দৈত্য।

তাহলে যাও, নেতৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে তোমাকে। ওদের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা আর আনুগত্য ফিরিয়ে আনাই তোমার প্রথম কাজ। আমার বিশ্বাস তোমার অপরাধ এবারের মত নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন ম্যাডোনা ও মেসার গনৎসাগা। তাই না, ম্যাডোনা? তাই না, মেসার গনৎসাগা?

অন্তর থেকে স্পষ্ট অনুভব করছে ভ্যালেনটিনা, আগন্তুক নাইট যা করছে সেটাই ঠিক, তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে আশ্বস্ত করল ফোর্টেমানিকে, যে তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। গনংসগাও কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেয়ে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুসরণ করল ম্যাডোনাকে।

আবেগে কাঁপছে ফোর্টেমানি। নিচু হয়ে ঝুঁকে অভিবাদন করল বিচারকমণ্ডলীকে। তারপর এগিয়ে এসে ভ্যালেনটিনার সামনে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে সবিনয়ে চুম্বন করল তার গাউনের হেম।

কথা দিচ্ছি, প্রাণ দিয়ে হলেও আপনার এই ক্ষমার মর্যাদা আমি রক্ষা করব, ম্যাডোনা। আর আপনারও, মাই লর্ড, চোখ তুলে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর শান্ত মুখের দিকে চাইল সে। দেখবেন, এজন্যে কোনদিন আপনাদের পস্তাতে হবে না। অসন্তুষ্ট গনৎসাগার দিকে পলকের জন্য তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল সে। উঠে দাঁড়িয়ে আবার একবার বাউ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্ৎসনার তুবড়ি ছুটাল গনৎসাগা, আক্রমণের লক্ষ্য ফ্র্যাঞ্চেস্কো। কিন্তু মাঝপথে থামিয়ে দিল ওকে ভ্যালেনটিনা।

বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছ তুমি, গনৎসাগা। কেন ভুলে যাচ্ছ, যা করা হয়েছে সেটা আমার সমর্থন ও অনুমোদন নিয়েই হয়েছে। আর এটাই যে ঠিক তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

সন্দেহ নেই? নিঃসন্দেহ, নিশ্চিন্ত..বাহ্! তুমি বুঝতে পারছ না, প্রথম সুযোগেই ও প্রতিশোধ নেবে আমাদের উপর।

মেসার গনৎসাগা, অত্যন্ত নরম, বিনীত কণ্ঠে,বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, আমি বয়সে আপনার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়, অনেক যুদ্ধ দেখেছি, এই ধরনের মানুষও দেখেছি অনেক। এসব লোকের গাল-গল্প, বড়াই, আত্মপ্রশংসা আর ঝগড়া-ফ্যাসাদের আড়ালে একজন সাহসী বীরও থাকে। আজ ক্ষমা পেল লোকটা, আমি জানি এই মুহূর্ত থেকে মোন্না ভ্যালেনটিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারীতে পরিণত হয়েছে সে।

আমারও তাই বিশ্বাস, মেসার ফ্র্যাঞ্চেস্কো। আমি জানি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি।

দাঁত দিয়ে ঠোঁটে কামড় দিল গনৎসাগা। তারপর বলল, হয়তো। হয়তো আমার ধারণা ভুল। ভুল হলেই ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *