২. ব্যাব্বিয়ানোর প্রাসাদের জানালা

০৬.

ব্যাব্বিয়ানোর প্রাসাদের জানালা দিয়ে নিচের আঙিনার দিকে চেয়ে রয়েছে লর্ড অভ অ্যাকুইলা ও ফ্যানফুল্লা। তুমুল হৈ-হুঁলস্থুল চলছে সেখানে, সাজ সাজ রব। লোক-লস্কর ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে জিয়ান মারিয়া চলেছে উরবিনো, লেডি ভ্যালেনটিনাকে প্রেম নিবেদন করে তার পাণিপ্রার্থনার নাটক করতে।

চিঠি পাঠিয়ে এদিকের খবর জানিয়ে পেরুজিয়া থেকে ডেকে এনেছে কাউন্ট ফ্যানফুল্লাকে। মাসুচ্চিওর মৃত্যুর ফলে বিপদ কেটে গেছে জেনে এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছে সে আর বৃদ্ধ লোডি। এখন ফ্র্যাঞ্চেস্কোর পাশে দাঁড়িয়ে খুশি মনে দেখছে বরযাত্রার আয়োজন।

যাক সুমতি হয়েছে শেষ পর্যন্ত, মস্ত একটা হাঁপ ছেড়ে বলল সে, দায়িত্বজ্ঞান ঢুকেছে এতদিনে হিজ হাইনেসের মোটা মাথায়!

তিক্ত হাসি ফুটল কাউন্টের ঠোঁটে। কোন জবাব দিল না। মনকে প্রবোধ দিল, প্রিন্স হয়ে না জন্মানোয় এই মুহূর্তে বুকের ভিতর খুব কষ্ট হচ্ছে বটে, তবে কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে আবার সব। অন্তত প্রেমহীন, ফাঁপা আঁক-জমক, মিথ্যে গরিমা আর অহমিকার দুর্বিষহ জীবনের বন্ধন থেকে তো সে মুক্ত থাকতে পারবে।

মেয়েটার দুর্ভাগ্যের কথা একটু ভেবে দেখো। এই বিয়েতে ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা পছন্দ-অপছন্দের কোনই মূল্য নেই। জিয়ান মারিয়ার একটা আসবাবে পরিণত হতে চলেছে বেচারী।

ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ চিন্তা করল ফ্যানফুল্লা। মেয়েটার সঙ্গে, সেদিন পরিচয় হয়ে যাওয়ায় আজ এসব কথা মনে আসছে আপনার, মাই লর্ড।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কাউন্ট।

কে জানে! অল্পক্ষণের দেখা, সামান্য কয়েকটা কথা-আমার জখমের শুশ্রূষা করতে গিয়ে আরও অনেক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে হয়তো মেয়েটা আমার ভিতর।

.

জিয়ান মারিয়া উরবিনো পৌঁছবার ঠিক তিনদিনের মধ্যেই কিন্তু কাউন্টের কথা ভুল প্রমাণিত করে পছন্দ-অপছন্দের প্রসঙ্গ উঠে পড়ল। জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে ভাইঝির পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে গুইডোব্যাল্ডো চমৎকার এক ভুরিভোজের আয়োজন করলেন। ভ্যালেনটিনার অসামান্য সৌন্দর্য এমনই মুগ্ধ করল জিয়ান মারিয়াকে যে, এই মুহূর্তে তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল অসংযমী লোকটা। আর ঠিক উল্টোটি ঘটল মেয়েটির মধ্যে: ধুমসো মোটা, বেঁটে, কুৎসিত লোকটাকে দেখা মাত্র খিঁচড়ে গেল, তার মনটা। কাকার মুখে বিয়ের কথা শুনেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওর, কিন্তু সামনাসামনি লোকটাকে দেখে বিগড়ে গেল সে বিলকুল। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কিছুতেই ব্যাব্বিয়ানোর ডাচেস হবে না সে, তারচেয়ে বরং সান্তা সোফিয়ার কনভেন্টে ফিরে গিয়ে সন্ন্যাসিনী হবে।

খাওয়ার টেবিলে ওর ঠিক পাশেই বসেছে জিয়ান মারিয়া। হাপুস হুপুস খাওয়ার ফাঁকে মুখভরা খাবার নিয়েই কানের কাছে ফিসফাস্ করে ওর রূপের প্রশংসা করছে। ব্যাপারটা এতই অরুচিকর ঠেকল ওর কাছে যে নিজের অজান্তেই বার কয়েক শিউরে উঠল। যতই সে চাটুকারিতার সাহায্যে ওর মন জয় করার চেষ্টা করল, ততই বেঁকে বসল মেয়েটা; একটু আধটু উঁ-হাঁ করছিল প্রথম প্রথম, শেষদিকে একেবারে বোবা বনে থাকল।

এই নিস্পৃহতা নজর এড়াল না জিয়ান মারিয়ার, ব্যাঙ্কোয়েট শেষে নালিশের ভঙ্গিতে ব্যাপারটা গোচরে আনুল হবু কাকাশ্বশুরের। শুনে উল্টে তাকেই বকা দিলেন গুইডোব্যাল্ডো। আমার ভাইঝিকে কি আপনি চাষাভুষোর মেয়ে পেয়েছেন নাকি যে আপনার প্রতিটা প্রশংসায় আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবে? আপনাকে বিয়ে করবে.ও, ব্যাস, আর কি চান?

একটু ভালবাসা, জবাব দিল জিয়ান মারিয়া বোকার মত।

একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন গুইডোব্যাল্ডো। ইয়োর হাইনেন্স যদি সুকৌশলে, শালীন ভাষায়, আন্তরিকতার সঙ্গে প্রেম নিবেদন করেন, আছে কোন মেয়ে যে-মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে? হাসলেন। মেয়েরা একটু লাজুক তো হয়ই।

গুইডোব্যাল্ডোর কথায় যুক্তি খুঁজে পেল জিয়ান মারিয়া। ধরে নিল, এই ঠাণ্ডা ভাবটা বাইরের একটা খোলস মাত্র। এই খোলসের আড়ালেই মেয়েরা লুকিয়ে রাখে তাদের হৃদয়ের কথা। এটা মাথায় আসতেই নবোদ্যমে মেয়েটার মন জয়ের চেষ্টায় লেগে গেল মোহাবিষ্ট ডিউক। মেয়েটা যতই তাকে এড়িয়ে যায়, ততই তার ধারণা হয় তার প্রেমে সাড়া দিচ্ছে বুঝি; যতই বিরক্তি প্রকাশ করে, ততই তার মনে হয়, আর কিছুই নয়, এটা প্রেমের উষ্ণতা।

পুরো একটা সপ্তাহ নানান রকম আমোদ-প্রমোদ-হুল্লোড় চলল উরবিনোয়। পার্টি হলো জলে-স্থলে-জঙ্গলে, প্রাসাদে খানাপিনা, নাচ গান। তারপর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল সব। খবর এসেছে, সীজার বর্জিয়ার কাছ থেকে এক দূত এসে হাজির হয়েছে ব্যাব্বিয়ানোতে-জরুরী সংবাদ আছে। জিয়ান মারিয়ার মনে হলো কেউ যেন বরফ-শীতল পানি ঢেলে দিয়েছে ওর গায়ে। ফ্যাব্রিৎসিও ডা লোডি লিখেছেন, ডিউক অভ ভালেনটিনোর দূতের সঙ্গে দেখা করা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরী, হিজ হাইনেস যেন অবিলম্বে ফিরে আসেন।

ভয় পেল জিয়ান মারিয়া। উরবিনোর সঙ্গে আত্মীয়তা ও মৈত্রীর আগেই কিছু করে বসার মতলব নেই তো যুদ্ধবাজ বর্জিয়ার সঙ্গে করে আনা দুজন ম্লান্ত পরিষদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করল সে, তারা দুজনই সমর্থন করল লোডির পরামর্শ-দেরি না করে যত শীঘ্রি সম্ভব দেশে ফেরা উচিত এখন। তবে তার আগে গুইডোব্যান্ডের সঙ্গে বিয়ের কথাটা পাকা করে ফেলা আরও জরুরী।

সব শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন উরবিনোর ডিউক। কারণ তারও ভয় সীজার বর্জিয়কে। এজন্যেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে এত আগ্রহ তাঁর। বললেন, ঠিক আছে, আজই বাগদানটা হয়ে যাক তাহলে। এটা ভ্যালেনটিনোর দূতের জন্যে একটা খবর হতে লাভ আর্ট আর্মস পারে। যাই হোক, দূতের বক্তব্য শোনার পর তাকে যাহোক কিছু বুঝ দিয়ে দশ দিনের মধ্যে ফিরে আসুন এখানে। আমরা ইতোমধ্যে বিয়ের সব আয়োজন সেরে রাখব। সবার আগে, যান, মোন্না ভ্যালেনটিনাকে বলৈ আসুন।

মেয়েটির অ্যান্টি চেম্বার খুঁজে নিয়ে একজন পরিচারক পাঠিয়ে সাক্ষাতের অনুমতি চাইল জিয়ান মারিয়া। চাকরটা ভিতরে অদৃশ্য হতেই আবছা ভাবে কানে এল একটা পুরুষকণ্ঠ লিউট বাজিয়ে প্রেমের গান গাইছে।

হঠাৎ থেমে গেল গান। মুচকি হাম্বল ডিউক, কানে পানি গেছে তাহলে! একটু পরেই দরজায় দেখা দিল ভৃত্য, নীলের উপর সোনালী কারুকাজ করা পর্দাটা তুলে ধরে ভিতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাল। আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে প্রবেশ করল ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক মহিলা মহলে।

ঘরটার আসবাবে শুধু ঐশ্বর্য নয়, প্রতিটি জিনিস সাজানো-গুছানোয় সুরুচির ছাপ সুস্পষ্ট। সীলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি, দেয়ালে মন্টেনার পেইন্টিং, শেলুফে প্রচুর বই, ডানদিকের জানালায় ভাইঝির জন্য ভেনিস থেকে গুইডোব্যাল্ডোর কিনে আনা চমৎকার একটা হার্প।

ভ্যালেনটিনার চারপাশে তার বান্ধবীরা, একপাশে কুঁজো ভাঁড় পেপ্পি ও জুনা দুয়েক পরিচারক, অন্যপাশে কাকার সভাসদদের ছয়জন। তাদের মধ্যে রয়েছে ভ্যালেনটিনাকে সান্তা সোফিয়ার কনভেন্ট থেকে আনতে যাওয়া সেই সুদর্শন তরুণ গন্‌ৎসাগা। সাদার উপর চমৎকার সোনালী কাজ করা পোশাক পরে রয়েছে সে, একটা নিচু টুলে বসে কোলে রাখা লিউটের তারে আঙুল বুলাচ্ছে। জিয়ান মারিয়া বুঝতে পারল, এই ভদ্রলোকের গলার আওয়াজই পেয়েছিল সে একটু আগে।

ডিউক ঢুকতেই ভ্যা্লেনটিনা ছাড়া বাকি সবাই আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। অস্বস্তি বোধ করছে জিয়ান মারিয়া, কোনও মতে আমতা আমতা করে বলল, ভ্যালেনটিনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, একা বলতে চায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সভা ভেঙে দিল ভ্যালেনটিনা। সবাই বেরিয়ে যেতে দুই পা এগিয়ে এল ডিউক।

লেডি, ধরা গলায় শুরু করল সে, ব্যাব্বিয়ানো থেকে জরুরী খবর এসেছে, এখুনি ফিরতে হবে আমাকে। আরও এক পা এগিয়ে এল সে সামনে।

বুদ্ধিমান লোক হলে টের পেয়ে যেত সে, খবরটা শোনামাত্র খুশি খুশি একটা ভাব দেখা দিল মেয়েটার চোখে-মুখে। কিন্তু মোহগ্রস্ত হিজ হাইনেস মনে করল দুঃখে নিশ্চয়ই ফেটে যেতে চাইছে মেয়ের বুকটা, যখন শুনল নিচু কণ্ঠে বলছে সুন্দরী, আপনার অভাব আমাদের সবাইকে ব্যথিত করবে, মাই লর্ড।

মেয়েটির প্রেমে একেবারে পাগল হয়ে গেছে বোকা ডিউক, দ্র সমাজের ফাপা, অর্থহীন কথাকে মনের কথা ধরে নিল। মুহূর্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে ভ্যালেনটিনার সামনে, মাংসল হাতে তুলে নিল ওর সুন্দর আঙুলগুলো। বলল, সত্যি সত্যিই ব্যথিত হবে তুমি?

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ভ্যালেনটিনা।

দয়া করে উঠে দাঁড়ালে ভাল করবেন, হিজ হাইনেস? শীতল কণ্ঠে বলল ও। কিন্তু হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখল লোকটা আরও এটে ধরছে ওটা। বলল, মাই লর্ড, আমার অনুরোধ, ভুলে যাবেন না আপনি কে এবং কোথায় আছেন।

কিন্তু জিয়ান মারিয়া মনে করল এসব কুমারীর ব্রীড়া। হাত ছাড়ল তো না-ই, কাছে টেনে আনার চেষ্টা করল ওকে জোর করে। কাব্য করে বলল, মহাপ্রলয় পর্যন্ত এখানেই থাকব আমি, যদি আমার কথা শুনতে রাজি না হও!

রাজি, কথা শুনতে আমি রাজি আছি, মাই লর্ড, বিরক্ত কণ্ঠে বলল ভ্যালেনটিনা। যদিও সেটা টের পেল না প্রেমান্ধ ডিউক। কিন্তু সেজন্যে, হাঁটু গেড়ে বসার বা আমার হাত ধরার প্রয়োজন পড়ে না, দেখতেও ভাল দেখায় না সেটা, মোটেও মানায় না।

মানায় না? অবাক হলো জিয়ান মারিয়া। কি বলো তুমি, লেডি? চাষার ছেলে হোক বা রাজপুত্র হোক, একসময় না একসময় সবাইকেই হাঁটু গাড়তে হয়।

হ্যাঁ, প্রার্থনার সময়ে, মাই লর্ড।

প্রেম প্রার্থনাও তো একরকম প্রার্থনাই, কি বলো? প্রেমিকার পদতল হচ্ছে…

হাত ছাড়ন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ভ্যালেনটিনা, এখনও হাত মোচড়াচ্ছে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্যে। ইয়োর হাইনেস মাঝে মাঝে সত্যিই বিরক্তিকর হয়ে ওঠেন।

বিরক্তিকর?

হাঁ হয়ে গেল ডিউকের মুখটা, লাল হয়ে উঠল গাল, গাঢ় নীল চোখের কঠোর দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে নীচতা ও নিষ্ঠুরতা। উঠে দাঁড়াল সে, হাত ছেড়ে এবার মেয়েটির বাহু ধরল। ভ্যালেনটিনা, কণ্ঠস্বরটা নরম রাখার চেষ্টা করল সে, কিন্তু সেটা কাঁপছে রাগে, কেন আমার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করো?

কই না তো! ডিউকের মুখটা কাছে চলে আসছে দেখে ঘৃণার সঙ্গে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। আমি শুধু ইয়োর হাইনেসকে নির্বোধের মত আচরণ করতে বারণ করেছি। আপনার ধারণা নেই…

তোমার কি ধারণা আছে তোমাকে কত গভীর, কত আন্তরিক ভাবে ভালবাসি আমি? আরও শক্ত করে চেপে ধরল সে মেয়েটির হাত।

মাই লর্ড, আপনি আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন!

আর তুমি আমাকে ব্যথা দিচ্ছ না? তোমার চোখ দুটো আমাকে যতখানি ব্যথা দিচ্ছে, সামান্য হাত মুচড়ে ধরা তো সেই তুলনায় কিছুই নয়। তুমি কি আমাকে…

অনেক কষ্টে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল ভ্যালেনটিনা। কিন্তু পশুর মত ছোট্ট একটা হুঙ্কার ছেড়ে এক লাফে এগিয়ে এসে ধরে ফেলল ডিউক, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল ঘরের ভিতর।

এইবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল মেয়েটির, ক্রোধ, ঘৃণা ও ধিক্কার এসে ছেয়ে ফেলল ওর কোমল মনটা। মনে মনে ঠিক করেছিল, এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনে কাকার সঙ্গে ঝগড়া করবে সে। কিন্তু এই লোকের আচার-আচরণ এতই অভদ্রজনোচিত যে এখনি কিছুটা শিক্ষা না দিলেই নয়। উঁচু বংশের মেয়ের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় তাই যে শেখেনি, সে কিনা গায়ে হাত দিচ্ছে ওর, যেন ও ওর চাকরানী! ঠিক আছে, একই ভাষায় উত্তর দেবে সে। এক। ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চড়াৎ করে প্রচণ্ড জোরে চড় কষিয়ে দিল ডিউকের গালে। এতই জোরে যে, প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার দশা হলো হিজ হাইনেসের।

ম্যাডোনা! ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে জিয়ান মারিয়া। আমাকে..এত বড় অপমান!

আপনিই বা কতটুকু সম্মান দেখিয়েছেন একজন ভদ্রমহিলাকে? ফুঁসে উঠল ভ্যালেনটিনা। তারপর আচ্ছামত ঝেড়ে দিল মনের বিষ। প্রতিটি বাক্য যেন চাবুক হানল হিজ হাইনেসের রাজকীয় পৃষ্ঠদেশে। মেয়েটির জ্বলন্ত ভাষা আর তীব্র ভর্ৎসনা ভরা চোখ একেবারে কুঁকড়ে দিল ডিউককে। কিন্তু মনে মনে সঙ্কল্প নিল, যেমন করে পারে একে অধিকার করবেই সে, তারপর বাধ্য করবে তার বশ্যতা স্বীকার করতে।

লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গি করে ক্ষমা চাইল ডিউক, বলল, প্রেমে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে…ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু। ততক্ষণে আবার দরজার কাছে চলে গেছে উরবিনোর ভাইঝি।

ম্যাডোনা, দয়া করে আমার কথাটা শুনে যাও। আর একঘন্টার মধ্যে ব্যাব্বিয়ানোর পথে রওনা হয়ে যাচ্ছি আমি।

বাহ্, চমৎকার খবর। এখানে আসার পর এতদিনে একটা সত্যিকার সুখবর দিলেন। বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে গেল সে দরজা দিয়ে।

এক সেকেন্ড কি করবে বুঝে উঠতে পারল না জিয়ান মারিয়া। অপমানিত হয়ে রাগে কাঁপছে সে। দরজার দিকে এগোতে গিয়ে দেখল পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে এদের কুঁজো ভাড়টা, মুখে একগাল হাসি।

দূর হও সামনে থেকে! চাপা গর্জন ছাড়ল ডিউক। কিন্তু লাল কালো বেমানান পোশাক পরা ক্লাউন যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।

ম্যাডোনা ভ্যালেনটিনাকে খুঁজছেন? বলল ভাঁড়, ওই যে, ওই ওখানে দেখুন।

পেপ্পির.আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখল জিয়ান মারিয়া; সখীদের সঙ্গে বসে আছে ভ্যালেনটিনা, বুঝল, কোনও উপায় নেই আর কথা বলার। হতাশ ডিউক ফিরে যাচ্ছিল, জেস্টারের কথায় থমকে দাঁড়াল। ও বলছে, ম্যাডোনার হৃদয়ে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই না, ইয়োর হাইনেস?

কথাটা পেপ্পি না বললেও পারত, কিন্তু মনিবকে ও এতই ভালবাসে যে এই অপছন্দের লোকটাকে একটা খামচি দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি।

কিছু তথ্য বিক্রি করতে চাও মনে হচ্ছে? কঠোর কণ্ঠে জানতে চাইল জিয়ান মারিয়া।

তথ্য আছে বটে, অনেক অনেক তথ্য, কিন্তু সেসব বিক্রির জন্য নয়, বলল জেস্টার। তবে জানতে চাইলে কিছু তথ্য দিতে পারি বিনে পয়সায়।

বলে ফেলো, আদেশ দিল ডিউক জিয়ান মারিয়া। গম্ভীর।

কুঁজো পিঠ আরও কুঁজো করে বাউ করল জেসটার।

ম্যাডোনার ভালবাসা পাওয়া খুবই সহজ হতো, হিজ হাইনেস যদি…নাটকীয় ভঙ্গিতে থামল সে।

হ্যাঁ, যদি? যা বলার বলে ফেলো, বুন্ধু! যদি..? খেঁকিয়ে উঠল জিয়ান মারিয়া।

শুধু যদি চেহারাটা আপনার একটু ভাল হতো, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ একটু মানানসই হতো, কথাবার্তা আর আচরণ সত্যিকার রাজপুত্রের মত হতো। মানে, আমি একজনকে চিনি, যদি ঠিক ওঁর মতো…

আমাকে ব্যঙ্গ করছিস, হারামজাদা? নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না ডিউক।

না, না, ইয়োর হাইনেস! আমি শুধু বলছি কি হলে আমার কত্রী আপনাকে ভালবাসতে পারতেন। সপতি একজন নাইটের সঙ্গে ম্যাডোনার পরিচয় হয়েছে, ওই ভদ্রলোকের মত যদি দীর্ঘ, সুপুরুষ, চেহারা, অভিজাত চালচলন আর মিষ্টি-মধুর কথাবার্তা হতে আপনার, খুব সহজেই মন জয় করতে পারতেন ওঁর। কিন্তু ঈশ্বর আপনাকে এমনই বিদঘুঁটে চেহারা দিয়েছেন, অ্যায়সা মোটা আর বেধড়ক…

বিকট এক গর্জন ছেড়ে তেড়ে গেল জিয়ান মারিয়া। কিন্তু জিভের মত পা দুটোও সমান চালু জেস্টারের, তিড়িং করে লাফিয়ে সরে গেল জায়গা থেকে, পরমুহূর্তে দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে হাওয়া।

.

০৭.

জিয়ান মারিয়ার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে কতবড় ভুল করেছে মেসার পেপ্পি বুঝতে পারেনি মোটেও। কারণ তার মত নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ গোটা ইটালীতে বিরল।

ভাঁড়ের কথায় এটুকু বোঝা গেছে, মেয়েটার হৃদয় জয়ের সবচেয়ে বড় বাধা অন্য এক পুরুষ। বিফল হয়ে ঈর্ষায় জ্বলছে ওর অন্তর। যেমন করে হোক জানতে হবে লোকটার পরিচয়। তারপর দেখে নেবে সে ওকে।

ঘরে ফিরে গোপনে মার্টিন আর্মস্টাডকে ডেকে পাঠাল ডিউক। আদেশ দিল, চারজন বাছাই করা লোক নিয়ে থেকে যাবে তুমি উরবিনোয়, তীক্ষ্ণ নজর রাখবে পেপ্পিনোর গতিবিধির উপর। আমি চলে যাওয়ার পর প্রথম সুযোগেই পাকড়াও করে নিয়ে আসবে আমার কাছে। দেখো আবার, কাজটা যে তোমার, কেউ যেন তা ঘুণাক্ষরেও টের না পায়।

এবার গুইডোব্যাল্ডোর কাছ থেকে বিদায় নিল ডিউক, খুব অল্পদিনেই বিয়ের জন্যে তৈরি হয়ে ফিরবে বলে কথা দিল, কিন্তু ভ্যালেনটিনার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে একটি কথাও বলল না, রওনা হয়ে গেল ব্যাব্বিয়ানোর পথে।

জিয়ান মারিয়া বিদায় নিতেই কাকার সঙ্গে গিয়ে দেখা করল ভ্যালেনটিনা। তিনি তখন নিজের ঘরে বসে পিচ্চিনিনোর একটা বই পড়ছিলেন। বয়স বেশি নয় হিজ হাইনেসের, বড় জোর ত্রিশ হবে, কিন্তু দুই গালে যন্ত্রণার দাগ দেখা যায় স্পষ্ট, বোঝা যায় কোন কঠিন রোগে ভুগছেন তিনি। বইটা পাশের টেবিলে রেখে চুপচাপ শুনলেন তিনি ভ্যালেনটিনার সব নালিশ। তারপর হাসলেন।

চাষার মত আচরণ করেছে লোকটা, সন্দেহ নেই। কিন্তু ও যে ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক তাতেও তো কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া মার্জিত ভাবে প্রেম নিবেদন সবাই রপ্ত করতে পারে না। তবে যেহেতু ওর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তোমার খুব শীঘ্রিই, রাগ না দেখিয়ে ওকে মেনে নেয়াই তোমার উচিত ছিল।

অর্থাৎ, বৃথাই বকবক করলাম এতক্ষণ, চটে গেল সে কাকার উপর। আমার কথা বুঝতে পারিনি তুমি, কাকা। তোমার বাছাই করা ক্লাউনটিকে আমার পক্ষেবিয়ে করা সম্ভব নয়।

ভুরুজোড়া কপালে উঠল গুইডোব্যারে, চোখে বিস্ময়। সামান্য কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। তারপর শান্ত, শীতল কণ্ঠে বললেন, আমি শুধু তোমার কাকা নই, এদেশের শাসকও। এই দুই ক্ষমতার বলে আমি তোমাকে হুকুম দিয়েছি জিয়ান মারিয়াকে বিয়ে করতে। অতএব দ্বিগুণ দায়িত্ব-সচেতনতা আশা করি আমি তোমার কাছ থেকে।

কিন্তু ওকে তো আমার পছন্দ নয়, কাকা?

অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন তিনি, তোমার কি মনে হয় আমি তোমার কাকীমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। পছন্দটা এসেছে বিয়ের পর, ধীরে ধীরে। রাজা-বাদশাদের বিয়ে এভাবেই হয়।

তোমাদের কথা আলাদা। তোমরা দুজনেই ভালবাসা পাওয়ার উপযুক্ত। তোমার সঙ্গে জিয়ান মারিয়ার কিসের তুলনা? কেউ কি বলতে পারবে, তুমি ওর মত নির্বোধ, কুৎসিত আর নিষ্ঠুর?

মাথা নাড়লেন গুইডোব্যাল্ডো।

এটা বিতর্কের বিষয় নয়, ভ্যালেনটিনা। রাজা-বাদশাদের ব্যাপার সাধারণ থেকে আলাদা।

কোন্ দিক দিয়ে আলাদা? তাদের কি সাধারণ মানুষের মত খিদে বা তেষ্টা পায় না? অসুখ-বিসুখে কষ্ট পায় না তারা? জন্মায় না, বা মরে না? কোনও তফাৎ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।

দুই হাত মাথার উপর তুলে বিরক্তি প্রকাশ করলেন উইডোব্যাকো, এবং সেটা করতে গিয়ে ককিয়ে উঠলেন ব্যথায়। অনেক কষ্টে ব্যথা সহ্য করে নিয়ে মুখ খুললেন তিনি।

তারা আলাদা, তার কারণ নিজের জীবন নিয়ে তারা যা-খুশি-তাই করতে পারে না। যদিও তারাই শাসন করে রাজ্য, কিন্তু আসলে তারা জনসাধারণের সম্পত্তি। বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে হাত-পা তাদের বাধা। রাজ্য রক্ষার জন্যে জনসাধারণের স্বার্থেই তাদের মৈত্রী করতে হয় প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে। এই মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় হয় বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই। এটাই নিয়ম। মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল ভ্যালেনটিনা, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন তিনি, এই মুহূর্তে এক পরাক্রমশালী শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা করছি আমরা-ব্যাব্বিয়ানো আর উরবিনো। আলাদা ভাবে আমরা কেউই ঠেকাতে পারব না, তাকে, কিন্তু মিলিত ভাবে রুখে দাঁড়ালে হয়তো তা সম্ভব। এইজন্যে জিয়ান মারিয়া যতই মোটা বা যতই অভদ্র বা কুৎসিত হোক, দেশের স্বার্থে তারই সঙ্গে মৈত্রী করতে আমরা বাধ্য।

মৈত্রীর প্রয়োজন, বুঝতে পারছি। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমেই হতে পারে, পেরুজিয়া বা ক্যামেরিনোর সঙ্গে যেমন মৈত্রী চুক্তি আছে আমাদের। আমাকে এর মধ্যে টেনে আনার কি দরকার?

ইতিহাসের দিকে তাকাও, বললেন গুইডোব্যাল্ডো, যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। রাজনৈতিক চুক্তির কি দাম? আজ যে আছে আমার সঙ্গে, কাল বেশি সুবিধে পেলেই ভিড়ে যাবে শত্রুপক্ষে। কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে যে মৈত্রী বাধা, সেটা একসময় রক্তের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়, ভাঙে না সহজে। তাছাড়া আমার ছেলে নেই, এমন হওয়া খুবই সম্ভব, একদিন হয়তো তোমার ছেলে দুই রাজ্য ব্যাব্বিয়ানো আর উরবিনোকে একত্র করে ইটালীর প্রবল এক শক্তিতে পরিণত করবে। এবার যাও, মা। শরীরটা খারাপ করছে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

মেঝের দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাক ভ্যালেনটিনা। অসুস্থ কাকার প্রতি ভালবাসা আর ওর নিজের নারী সত্ত্বার প্রতি কর্তব্য-এই দোটানায় দুলছে মনটা। ওর দিকে চেয়ে রয়েছেন ডিউক, বুঝতে পারছেন, তুমুল দ্বন্দ্ব চলছে ওর মনে। শেষ পর্যন্ত যখন মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখ চুলল, মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে কি বলবে ও এখন।

কাকা, তুমি অসুস্থ। এই অবস্থায় তোমাকে দুঃখ দিতে খুবই কষ্ট হবে আমার। কিন্তু তোমার কিছুটা প্রশ্রয় প্রার্থনা করছি। তোমার পরিকল্পনা হয়তো সঠিক এবং মহৎ, নইলে নিজের ভাইঝিকে তুমি এভাবে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে পানিতে ভাসিয়ে দিতে চাইতে না কিছুতেই। কিন্তু আমি এর মধ্যে থাকছি না। আমার আত্মা অত মহৎ নয়, এত বড় পরিবারে জন্ম নেয়া আমার উচিত হয়নি-যদিও এতে আমার নিজের কোনও হাত ছিল না। কাজেই, মাই লর্ড, ব্যাব্বিয়ানোর ডিউককে আমি বিয়ে করছি না-কোনও অবস্থাতেই না।

ভ্যালেনটিনা! রেগে গেলেন গুইডোব্যাল্ডো, চড়ে গেল গলার স্বর, ভুলে গেছ, তুমি আমার ভাইয়ের মেয়ে?

তুমিও ভুলে গেছ, কাকা।

এইসব মেয়েমানুষী খামখেয়ালিপনা…

কথায় বাধা দিল ও, এই তো, এতক্ষণে মনে পড়েছে তোমার, আমি একজন মেয়েমানুষ, নারী। আর নারী বলেই রাজনৈতিক কারণে অপছন্দের কোন লোককে বিয়ে আমি করব না।

ঘরে যাও! হুকুম করলেন ডিউক। গিয়ে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসো, যেন ঈশ্বর তোমাকে কর্তব্যজ্ঞান দেন, উচিত-অনুচিত বুঝতে সাহায্য করেন।

বেশ তো, বলল ভ্যালেনটিনা, এও প্রার্থনা করব, তিনি যেন তোমার মনে কিছুটা দয়া-মায়াও দেন।

যাও, মা, গলার স্বর নামিয়ে নিলেন গুইডোব্যাল্ডো। গুরুজনের অবাধ্য হতে নেই। সব আয়োজন করা হয়ে গেছে। যৌতুক ঠিক হয়েছে পঞ্চাশ হাজার ডুকাট, ভেনিস থেকে আসবে গহনা, ফেরেরা তৈরি করবে তোমার পোশাক। সারা ইটালীর সমস্ত রাজকন্যা হিংসায় মরে যাবে বিয়ের জাঁকজমক দেখে। তোমার সৌভাগ্য…

তুমি কি শুনতে পাওনি যে বিয়ে আমি করছি না? হাঁপাচ্ছে ভালেনটিনা।

উঠলেন গুইডোব্যাল্ডো, সোনা দিয়ে মোড়ানো ছড়িটায় ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। ভুরু জোড়া কোঁচকানো। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন, তারপর ঘোষণার ভঙ্গিতে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে তোমার বিয়ের পাকা কথা দিয়েছি আমি। ও ফিরে এলেই বিয়ে হয়ে যাবে। ব্যাস, এবার যাও, নাটুকেপনা বাদ দিয়ে ঘরে যাও। তোমাকে বলেছি, আমার শরীর খারাপ!

কিন্তু, ইয়োর হাইনেস, কাতর কণ্ঠে শুরু করেছিল ভ্যালেনটিনা, কিন্তু মাটিতে পা ঠুকে ওকে বাধা দিলেন গুইডোব্যাল্ডো।

যাও! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। তারপর নিজের সম্মান বাঁচাতে নিজেই ঘুরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

কয়েক মুহূর্ত একা দাঁড়িয়ে থাকল ভ্যালেনটিনা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা দুফোঁটা পানি মুছে নিয়ে বেরিয়ে গেল কাকার চেম্বার থেকে।

ছটফট করছে মনটা। ঘরে মন টিকল না, বাগানে ফোয়ারার ধারে গিয়ে বসল সে। বাতাসে ফুলের মিষ্টি সুবাস। কুলকুল শব্দ করছে ফোয়ারার পানি। অনেকক্ষণ বসে থেকে কিছুটা শান্ত হলো মন। উঠব উঠব করছে, এমনি সময় পায়ের আওয়াজে ঘাড় ফিরাল। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে গনৎসাগা।

একা যে, ম্যাডোনা? অবাক হলো সে। লিউটের তারে আলতো টোকা দিল, মিষ্টি সুর বেজে উঠল রিমঝিমিয়ে।

দেখতেই পাচ্ছ, বলে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল ও। একটু পবে মনে হলে ভুলেই গেছে গনৎসাগার অস্তিত্ব।

কিন্তু নানান ঘাটের পানি খাওয়া রোমিও গনৎসাগা এত সহজে দমবার পাত্র নয়। এক পা এগিয়ে এল সে, একটু ঝুঁকে তাকাল মেয়েটির মুখের দিকে।

খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তোমাকে, ম্যাডোনা, বলল সে মৃদু কণ্ঠে।

তাহলে বকবক না করে একটু একা থাকতে দলেই তো পার। নীরস কণ্ঠে বলল ভ্যালেনটিনা।

তোমার মনখারাপ দেখে খারাপ লাগল, ম্যাডোনা, বলল গনৎসাগা। ভাবলাম এই অসময়ে আমার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার।

তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো, গনৎসাগা? ওর দিকে না চেয়েই প্রশ্ন করল ভ্যালেনটিনা।

কেঁপে উঠল গাগা। ভাল-মন্দ নানান ছায়া খেলে গেল ওর টেহারায়। মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে এল মেয়েটির মাথার কাছে।

শুধু বন্ধু নয়, তার চেয়েও বেশি, বলল ও। আমাকে তোমার ক্রীতদাস ধরে নিতে পার, ম্যাডোনা।

ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল এবার ভ্যালেনটিনা। লোকটার চেহারায় প্রবল আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখতে পেল সে। চট করে সরে বসল। গনৎসাগার মনে হলো, অতি আগ্রহ প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছে বুঝি, কিন্তু দেখল, সরে গিয়ে আসলে বসার জায়গা করে দিয়েছে ওকে মেয়েটা, ইঙ্গিতে বসতে বলছে পাশে।

নিজের সৌভাগ্যে অবাক হয়ে গেল গনৎসাগা, এদিক ওদিক চেয় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে পড়ল পাশে। অস্বস্তি ঢাকার জন্যে হাসল একটু, তারপর পায়ের ওপর পা তুলে মৃদু ঝংকার তুলল লিউটে।

নতুন একটা গান বেঁধেছি, ম্যাডোনা শোনাব।

ওর বাহুতে একটা হাত রেখে নিরস্ত করল মেয়েটা। এখন না, গনৎসাগা। আজ গান শোনার মত মন নেই আমার। লোকটাকে হতাশ হতে দেখে বলল, কিছু মনে কোরো না, আজ আমার সত্যিই মন খারাপ। এরা আমার সর্বনাশ করতে চলেছে, বন্ধু। ইশশ, সাত্তা সোফিয়ার কনভেন্টে কী শান্তিতেই না ছিলাম! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ভ্যালেনটিনা।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল গনৎসাগা।

ব্যাব্বিয়ানোর ওই পাষণ্ডটার সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে এরা আমাকে। আমি কাকাকে বলেছি, এ বিয়ে আমি করব না, কিন্তু আমার কথা সে কানেই দুলছে না।

এই একটি ব্যাপারে কিছুই করার সাধ্য নেই গনৎসাগার, তাই মুখে কিছু না বলে সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অসহি ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিল ভ্যালেনটিনা।

হ্যাঁ, লম্বা করে শ্বাস ছেড়েই তুমি খালাস! কিছু করার নেই তোমার আমার জন্যে। মুখেই শুধু বড় বড় কথা তোমার, গলাগা-খরও বেশি, জাতদাস! অথচ যখন আমার সাহায্য দরকার তখন ফেলছ দীর্ঘশ্বাস!

আমার ওপর অবিচার করছ তুমি, ম্যাডোনা। এই ব্যাপারে তুমি আমার সাহায্য চাইতে পায়, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি; সাহসই পাইনি ভাবতে। আমি ধরেই নিয়েছি, তোমার দরকার একটু সহানুভূতি। কিন্তু সত্যিই যদি তুমি এই বিষাক্ত আত্মীয়তার নিগড় থেকে উদ্ধার পেতে আমার সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব একটা কিছু পথ খুঁজে বের করতে। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সব করব আমি তোমার জন্যে।

কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল গনৎসাগা, কিন্তু পুরোপুরি ফুটল না তা। আসলে ভাবজগতের ভীরু মানুষ সে, বাস্তবের সঙ্গে তেমন কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তবে অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতা সে, তাই মোটামুটি উতরে গেল। তাছাড়া, হাবুডুবু পাচ্ছে সে ভ্যালেনটিনার সৌন্দর্যসাগরে, কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর নিজের কাছেই মনে হলো, প্রয়োজনে হয়তো সত্যিই মত্ত কোনও বীরত্বের কাজ করে বসতে পারবে সে।

ওর মনে হলো, ওর কাছে সাহায্য প্রত্যাশার কারণ, যদিও কোনদিন প্রকাশ করার সাহস হয়নি তার, মেয়েটা কোনভাবে ওর গভীর, আন্তরিক ভালবাসার কথা টের পেয়েছে। ধরেই নিল, অ্যাকুয়াম্পার্টায় সেই আহত নাইটের প্রতি অযথাই ঈর্ষা বোধ করেছিল সে, তার কাছে সাহায্য চাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, সেই লোকটার কথা ভুলেই গেছে মেয়েটা।

গনৎসাগার কথা শুনে ভ্যালেনটিনার মনে হলো সত্যিই হয়তো কিছু করতে পারবে এই মানুষটা। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল, এ বিয়ে ঠেকানোর একমাত্র উপায় সন্ন্যাসিনী হয়ে যাওয়া, এখন মনে হচ্ছে আরও হয়তো কোন পথ আছে। একরাশ আশা নিয়ে চাইল সে ওর চোখের দিকে।

সত্যিই কি কোনও পথ আছে, গনৎসাগা?

ওর কল্পনাপ্রবণ কবি মনটা ইতোমধ্যেই খুঁজতে শুরু করেছে উদ্ধারের পথ। যেন দৈববাণী-একের পর এক বুদ্ধি আসতে শুরু করল ওর মাথায়।

আমার মনে হয়, মাটির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল গনৎসাগা, আমার মনে হয় একটা পথ আছে।

কী পথ? আগ্রহে ঝুঁকে এল ভ্যালেনটিনা। কাঁপছে ওর ঠোঁট। দুই চোখে প্রত্যাশা।

লিউটটা বেঞ্চের উপর রেখে সভয়ে চারদিকে একবার দেখে নিল গনৎসাগা। তারপর চাপা গলায় বলল, এখানে না, উরবিনোর প্রাসাদে অনেক কান আছে। চলো, বাগানে হাঁটতে হাঁটতে বলব।

উঠে দাঁড়াল দুজন একসাথে, পাশাপাশি হেঁটে চলে এল বাগানে। পড়ন্ত বিকেলে চুপচাপ খানিকক্ষণ হাঁটার পর মুখ খুলল গনৎসাগা।

আমার পরামর্শ হচ্ছে: সরাসরি অবাধ্যতা।

আমিও তাই ভেবেছি। কিন্তু এর ফলে কোথায় গিয়ে ঠেকব শেষে?

মুখে মুখে প্রতিবাদের কথা বলছি না আমি, ম্যাডোনা। মন দিয়ে আগে শুনে নাও আমার পরিকল্পনা। আমি যতদূর জানি, রোক্কালিয়নের দুর্গটা তোমার নিজস্ব সম্পত্তি। গোটা ইটালীর সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ ওটা। সামান্য প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেই এক বছর টিকে থাকা যাবে ওখানে।

ঝট করে ওর দিকে ফিরল ভ্যালেনটিনা। বুঝে ফেলেছে ও কি বলতে চায়। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল বটে, কিন্তু পরমুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ-মুখ। বেপরোয়া, রোমাঞ্চকর প্যান ওর মন কাড়ল, বিশেষ করে টানল ওকে এর অভিনবত্ব।

সম্ভব? জানতে চাইল ও।

খুবই সম্ভব, জবাব দিল গনৎসাগা। রোক্কালিয়নে আশ্রয় নিয়ে উরবিনো আর ব্যাব্বিয়ানোকে হুমকি দাও, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার অনুমতি না দিচ্ছে, ততক্ষণ কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবে না। 

তুমি এতে সাহায্য করবে আমাকে?

হ্যাঁ। আমার সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল গৎসাগ। এমন ব্যবস্থা করব যাতে পুরো একবছর টিকে থাকতে কোন অসুবিধা না হয়। দুর্গ রক্ষার জন্যেও জনা বিশেক ভাড়াটে সৈন্য সগ্রহ করতে হবে আমাদের।

একজন ক্যাপটেন দরকার হবে আমার।

মাথা ঝুঁকিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল গনৎসাগা।

আমাকে এই দায়িত্ব দিলে আমি আমার জীবন থাকতে তোমার কোন ক্ষতি হতে দেব না, ম্যাডোনা।

হাসি এসে যাচ্ছিল, কিন্তু তরুণ সভাসদ সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই ও দুঃখ পাবে বলে নিজেকে সামলে নিল ভ্যালেনটিনা। কিন্তু গায়ে ফুরফুরে সুগন্ধ মেখে মেয়েদের মনোরঞ্জনে অভ্যস্ত এই ফুলবাবু একদল কঠোর চরিত্রের ভাড়াটে সৈনিককে কিভাবে হুকুম দেবে, প্রয়োজনে তাদের নিয়ে দুর্গ রক্ষার জন্য কেমন যুদ্ধ করবে, ভাবতে গিয়ে হাসিই পাচ্ছে ওর। চট করে ভেবে নিল, যদি ও না পারে, প্রয়োজনের সময় সে নিজেও নেতৃত্ব দিতে পারবে। কাজেই রাজি হয়ে গেল সে। কৃতজ্ঞতায় আরও নিচু হয়ে কুর্নিশ করল গনৎসাগা। আচম্বিতে বিরাট অঙ্কের খরচের কথা মনে আসতেই দমে গেল ভ্যালেনটিনা।

কিন্তু এতসব আয়োজন করতে তো অনেক টাকা লাগবে!

বন্ধুত্বের খাতিরে এই ব্যাপারেও আমি…

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল, বাধা দিল ভ্যালেনটিনা ওর কথায়।

না, না! বলে উঠল সে। গনৎসাগা একটু যেন হতাশ হলো। মেয়েটিকে সবরকমে সম্পূর্ণ কতজ্ঞ, এবং ওর উপর নির্ভরশীল করে ফেলতে চেয়েছিল সে। কিন্তু প্রচুর মুক্তা বসানো একটা সোনার অলঙ্কার খুলল সে মাথা থেকে তুলে দিল ওর হাতে। এটা বিক্রি করলে যথেষ্ট টাকা এসে যাবে হাতে।

এরপরই ওর মনে হলো একগাদা ভাড়াটে সৈনিক আর রোমিও গনৎসাগার সঙ্গে ও একা কি করে যাবে ওই দুর্গে। চুট করে সমাধান বের করে ফেলল গনৎসাগা।

একা কেন যাবে? বলল সে। রওনা হওয়ার সময় বিশ্বস্ত তিন চারজন সখি তুমি সঙ্গে নেবে, তাছাড়া কয়েকজন চাকর-বাকরও নিতে হবে সাথে, এমন কি তোমার পুরোহিতকেও।

এই পরিকল্পনায় ব্যাব্বিয়ানোর ডিউকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে মনে করে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠল ভ্যালেনটিনা; কিন্তু ভাবতেও পারেনি, এমন হওয়া খুবই সম্ভব, শেষপর্যন্ত হয়তো মেসার রোমিও গনৎসাগার স্ত্রী না হয়ে উপায় থাকবে না ওর।

*

নানান অপকর্মের কারণে ইটালীর বিখ্যাত মানটুয়া পরিবার থেকে খেদিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের কুসন্তান রোমিও গনৎসাগাকে। বিদায়ের আগে স্নেহময়ী মায়ের দেয়া বেশ বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে বছর কয়েক আগে সে উরবিনোয় এসে জুটেছে। উরুবিনোর ডাচেস মোন্না এলিজাবেট্টার সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদে বেশ দাপটের সঙ্গেই আছে সে রাজসভায়। টাকা ফুরিয়ে আসায় ইদানীং অবশ্য বেশ চিন্তায় পড়েছে সে, উপায় খুঁজছে উপার্জনের। বাবুগিরি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই শেখেনি জীবনে। সাহসের অভাব, তাই কোনদিন ছুঁয়েও দেখেনি অস্ত্র। আশা করছে, অভাবিত কোনও সুযোগ হয়তো এসে যাবে অঢেল টাকা রোজগারের।

স্ত্রীর খাতিরে তাঁর আত্মীয়কে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে রেখেছেন প্রিন্স গুইডোব্যালল্ডো, সুনজরেই দেখেন তাকে। এটাকে সে ভুল ভাবে নিয়ে প্রায়ই উদ্ভট স্বপ্ন দেখেছে-কল্পনার জাল বুনেছে প্রিন্সের দুই ভাইঝিকে ঘিয়ে। আশাটা তার আকাশ ছুঁয়েছিল যখন সুন্দরী ভ্যালেনটিনাকে সান্তা সোফিয়ার কনভেন্ট থেকে আনার জন্যে তাকেই বাছাই করলেন ডিউক। কিন্তু এখানে ফেরার পর সব জানতে পেরে সে-আশা মিলিয়ে গিয়েছিল কর্পূরের মত। এই মুহূর্তে আবার রঙীন পাখা মেলেছে তার আশা, মেয়েটা গিলে নিয়েছে তার টোপ, আর চিন্তা কি?

একটাই শুধু ভয়, গুইডোব্যাল্ডো তাকে যতই নজরে দেখুন না কেন, মানুষটা তিনি অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয় কিন্তু যদি সে সফল হয়, যদি প্রেমের বা গায়ের জোবে, অথবা ভয় দেখিয়ে একবার মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলতে পারে, তাহলে আর অতটা ভয় নেই। গুইডোব্যাল্ডো দেখবেন, ব্যাপার বহুদূর গড়িয়ে গেছে, ওকে এখন মেরেও কোন লাভ নেই-জিয়ান মারিয়া গনৎসাগার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। নিশ্চয়ই তিনি তখন গুটিয়ে নেবেন হাত; দ্বিতীয় ভাইঝিকে বিয়ে দেবেন জিযান মারিয়ার সঙ্গে, দুই রাজ্য আবদ্ধ হবে মৈত্রী বন্ধনে, কোথাও কোন অসুবিধে থাকবে না।

আর যদি তিনি পরাক্কালিয়ন দুর্গ আক্রমণ করে ওদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চান–সে সম্ভাবনা যদিও খুবই ক্ষীণ–তাহলে মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে বিয়েতে রাজি করানো আরও অনেক সহজ হয়ে যাবে।

অনেক রাত পর্যন্ত তারার আলোয় বাগানে হেঁটে বেড়াল রোমিও গনৎসাগা, বারবার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে দেখল সব। যতই ভাবল, ততই পছন্দ হলো ওর পরিকল্পনাটা। নাহ, ভুল নেই কোথাও। হাসি ফুটল ওর মুখে, বুকের ভিতর নাচছে খুশি। ভাবল, ভাগ্যিস পুরোহিতটাকেও সঙ্গে নিতে বলেছি! দুর্গ পতনের আগেই আশাকরি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিয়ে পড়ানোর কাজ দিতে পারব ওকে।

.

০৮.

গুইডোব্যাল্ডোর হুকুমে গোটা উরবিনো যখন তাড়াহুড়ো করে ভ্যালেনটিনার বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত-পেইন্টার, খোদাইকার, স্বর্ণকার খাটছে দিনরাত; ভেনিস থেকে সোনার পাতা আর আমেরিন আনতে গেছে লোক; রোম থেকে আসছে বিয়ের খাট; ফেরারা থেকে আসছে বর-কনের গাড়ি দামী-দামী পোশাক ও আসবাব তৈরি হচ্ছে-ঠিক তখনই এই সমস্ত আয়োজন বানচাল করে দেয়ার কাজে ব্যস্ত আমাদের সুশ্রী রোমিও গনৎসাগা।

ও জানে, হুট করে দুর্গ আক্রমণ করবেন না গুইডোব্যাল্ডো। প্রথমে তাঁর কাছে খবর পৌঁছবে যে জিয়ান মারিয়ার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে না দিলে উরবিনোয় ফিরবে না ভ্যালেনটিনা। প্রথম কয়েকদিন কথা চালাচালি চলবে, ভাইঝিকে নরম-নরম কথা বলে যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবেন ড্রিউক। তারপর হুমকি দেবেন, আত্মসমর্পণ না করলে দুৰ্গটা গোলা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু এটা কার্যকর করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ, তাহলে আশপাশের সব রাজ্যের হাসির খোরাকে পরিণত হবেন তিনি। আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য দুর্গ অবরোধ করে রসদ বন্ধ করতে পারেন তিনি বড়জোর, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু ততদিনে বাজি মাত করে দেবে সে।

তাই যত্নের সঙ্গে প্রতিটা পদক্ষেপ হিসেব করে ফেলল গনৎসাগা। রসদ কি কি এবং কতখানি করে নেবে, অস্ত্র কি কি লাগবে, লোক লাগবে কয়জন-সব ভেবে বের করল। গোলা-বারুদ নিয়ে তেমন ভাবল না, কারণ প্রথম কথা, ওসবের প্রয়োজন পড়বে না; দ্বিতীয়ত:, ওসব দুর্গেই থাকবে প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু লোক সে পাবে কোথায়? ডিউকের রোষের তোয়াক্কা না করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন্ত বিশজন লোক কোথায় পাওয়া যেতে পারে তার ধারণা নেই। আসলে সে এই লাইনের লোকই না। পয়সা যতই ঢালুক না কেন, তার কথায় বিশজন লোক নিজেদের জীবন বিপন্ন করবে কেন?

এই জায়গাটায় এসে বারবার হোঁচট খেতে থাকল তরুণ প্রেমিক, কোনদিকে কোনও পথ দেখতে পেল না। শেষে তৃতীয় দিন সিদ্ধান্ত নিল ডুয়োমোর পিছনের রাস্তায় একটা শুড়িখানায় কয়েকজন সৈন্যকে ঢুকতে দেখেছিল একর, সেইখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবে লোক পাওয়া যায় কি না।

ওখানে ঢুকতেই কাঁপন ধরে গেল ওর কলজেটায়। শেষ মাথায় খাসির মাংস রান্না হচ্ছে, সেই গন্ধের সঙ্গে মিশেছে সস্তা মদের ঝাঁঝাল গন্ধ, তাছাড়া গোটা গুঁড়িখানায় গরীবমানুষের ঘর্মাক্ত পোশাকের অসহ্য দুর্গন্ধ তো আছেই; গনৎসাগার ইচ্ছে হলো ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে চলে যায়। কিন্তু একটা লোকের উপর চোখ পড়ায় এগিয়ে গেল সামনে।

কপাল ভাল, ঢুকেই বিশাল চেহারার এক ভাড়াটে যোদ্ধা ক্যাপটেনকে পেয়ে গেছে সে। এককালে মোটামুটি ভাল যোদ্ধাই ছিল লোকটা, কিন্তু এখন মন্দ ভাগ্য আব সস্তা মদ তাকে প্রায় শেষ করে এনেছে।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করল দৈত্য গনৎসাগার প্রবেশ। কাছাকাছি একটা টেবিলে ওকে বসতে দেখে ইচ্ছাকৃত ভাবেই ওর উপর থেকে আগ্রহ হারাল। হুঙ্কার ছাড়ল সরাইমালিকের উদ্দেশে। কী হলো, শুয়োর! স্যাঙ্গু ডেল্লা ম্যাডোনা এক বোতল চেয়েছি কতক্ষণ আগে? খুনহয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি, লুসিয়ানো?

ভয়ে কেঁপে উঠে বুকে ক্রস আঁকতে যাচ্ছিল গনৎসাগা, কিন্তু সামলে নিল নিজেকে যখন দেখল, যদিও কথা বলছে খুঁড়িখানার মালিকের সঙ্গে, রক্তচক্ষু মেলে ওকেই দেখছে লোকটা।

আসছি, ক্যাভেলিয়ার! এই এলাম বলে! বলেই খাসির মাংস ফেলে তড়িঘড়ি করে মদ আনতে ছুটল সরাইমালিক লুসিয়ানো।

ক্যাভেলিয়ার? মানে অশ্মরোহী নাইট! তাহলে তো ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছি! আগ্রহের সঙ্গে চাইল গনৎসাগা লোকটার দিকে। বুলেটাকৃতি মাথায় লেপ্টে আছে ঘামে ভেজা চুল, বিশাল এক নাকের দুপাশ দিয়ে চোখ তো নয়, চেয়ে রয়েছে যেন দুইটুকরো জ্বলন্ত কয়লা! তবে নাইটের কোন লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না পোশাক-আশাকে। হ্যাঁ, খাপে পোরা তলোয়ার আর ছোরা ঝুলছে বেল্টে, টেবিলের উপর একটা জং ধরা হেলমেটও আছে; কিন্তু সব মিলিয়ে ভাড়াটে খুনীর চেহারাই প্রকট গন্‌ৎসাগার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সঙ্গী দুজনের সঙ্গে গল্পে মেতে গেল লোকটা। দশ বছর আগে কী প্রচণ্ড লড়াই করেছে সে সিসিলিতে, তারই বয়ান। কান পেতে সব শুনল গনৎসাগা। ওর মনে হলো ঠিক লোকটাকেই পেয়ে গেছে কপাল গুণে।

আধঘণ্টা পর উঠে পড়ল লোক দুটো, দৈত্যের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। স্তিমিত ভঙ্গিতে টেবিলের উপর যাথা রাখল দানব, মনে হলো চোখ খুলে ঘুমাচ্ছে।

অনেক চেষ্টায় সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল গনৎসাগা দৈত্যের দিকে। সভাসদের বেমানান ভঙ্গিতে বলল, স্যার, আমার সঙ্গে এক বোতল ফ্ল্যাগন পান করে আমাকে সম্মানিত করবেন?

আধ-ঘুম অবস্থা থেকে চমকে বাস্তবে ফিরে এল দৈত্য।

অ্যাঁ? কি বললেন? মুহর্তে বুঝে নিল সে, কোনও মতলব আছে ছোকরার ওর কাছে। কিন্তু সেসব শোনা যাবে পরে, আগে বোতল আসুক। বিকট হাসি ফুটিয়ে তুলল সে ওর ভয়ঙ্কর মুখে। বলল, আপনার মত একজন সম্মান্ত ব্যক্তির অনুরোধে আপার সঙ্গে শুয়োরের মাথা কাঁচা চিবিয়ে খেতেও রাজি আছি আমি।

লোকটা কি বলতে চায় বুঝতে পারল না গনৎসাগা, ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইল, অর্থাৎ, আপনি পান করতে রাজি?

নিশ্চয়ই! যতক্ষণ আপনার পকেটে পয়সা আছে, আর এদের মদ ফুরিয়ে না যাচ্ছে, আমি আছি আপনার সঙ্গে। হাসল দৈত্য। কিছুটা বিদ্রূপ আর কিছুটা সন্তুষ্টি প্রকাশ পেল ওর হাসিতে।

মদের অর্ডার দিল গনৎসাগা। অনভ্যস্ত বলে যা করছে তা এই পরিবেশে বেমানান হচ্ছে কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিভাবে কথা শুরু করবে ও এক সমস্যা। বলল, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ, কি বলেন?

কই, রীতিমত গরম লাগছে। কে বলেছে ঠাণ্ডা? আমি বলেছি, এভাবে বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়েছে গনৎসাগা। এখনি নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে এর কথায় উঠতে-বসতে হবে। বলল, অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে আজ।

তাহলে বলব, মিথ্যা বলছেন আপনি! সাফ-সাফ জানিয়ে দিল দৈত্য। আপনাকে বলেছি, রাতটা আজ গরম। ব্যস, গরম। কথার প্রতিবাদ আমি পছন্দ করি না, জনব। আমি যদি বলি রাতটা গরম, তাহলে আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াসের ওপর বরফ জমে গেলেও রাতটা গরমই থাকবে।

লাল হয়ে গেল গনৎসাগা। তবে কিছু করে বসার আগেই এসে গেল মদের বোতল। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল দৈত্য। গেলাস ভর্তি করে নিয়ে টোস্ট করল: দীর্ঘ জীবন, অফুরন্ত পিপাসা, ভারি পকেট, আর দুর্বল স্মৃতিশক্তি! বলেই ঢকঢক করে গ্লাস শেষ করে হাতের পিঠে মুছল ভেজা ঠোঁট। বলল, কার বদান্যতা উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো, দয়া করে জানাবেন, জনাব?

রোমিও গনৎসাগার নাম শুনেছেন কখনও?

গনৎসাগা, হ্যাঁ; কিন্তু রোমিও, কোনদিন না। যাই হোক, আপনিই কি তিনি?

মাথা নোয়ান গনৎসাগা!

মহৎ পরিবারে জন্ম আপনার, এমন সুরে বলল দৈত্য যেন তারটাও কোনও দিক দিয়ে কম না। এবার তাহলে আমার পরিচয়টাও জেনে নিন। আমি এরকোল ফোর্টেমানি, নিজের নামটা এমন ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল যেন কোন ম্রাটের নাম ঘোষণা করছে।

দারুণ নাম একখানা! বলল গনৎসাগা। শুনে তো মনে হচ্ছে, ভাল পরিবার।

মুহূর্তে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল লোকটা। অবাক হওয়ার তো কিছু দেখি না। আমি বলছি, আমার নামটা যেমন দারুণ, পরিবারও তেমনি মুহান। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না?

আমি বলেছি তা?

বললে এতক্ষণে লাশ পড়ে যেত আপার, মেসার গনৎসাগা! বলেননি বটে, কিন্তু ভেবেছেন আপনি। তাহলে শুনুন আমি, ক্যাপটেন এরকোল ফোর্টেমানি। পোপর আর্মিতে ছিলাম ওই পদে। পিসানদের কাজ করেছি, পেরুজিয়ার মহান ব্যাগলিয়নির চাকরি করেছি যোগ্যতার সঙ্গে। জিয়ান্নেনির বিখ্যাত ফ্রী কোম্পানীর একশো যোদ্ধার নেতৃত্ব দিয়েছি। ফরাসীদের হয়ে যুদ্ধ করেছি স্প্যানিয়ার্ডদের বিরুদ্ধে, আবার স্প্যানিয়ার্ডদের হয়ে লড়েছি ফরাসীদের বিরুদ্ধে; আবার বর্জিয়ার হয়ে লড়াই করেছি এই দুই দেশের বিরুদ্ধে। নেপলসের রাজার আর্মিতেও ছিলাম আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে। এবার, জনাব, বুঝুন, গোটা ইটালীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত আগুনের অক্ষরে আমার নাম যদি লেখা না থাকে, তাহলে কি বুঝতে হবে? এটাই কি বুঝতে হবে না যে আমার

কীর্তির সমস্ত গৌরব চুরি করে নিয়েছে আমার নিয়োগ কর্তারা।

ঠিক। লম্বা ফিরিস্তি শুনে মুগ্ধ হয়েছে গনৎসাগা। গৌরবময়, মহৎ একটা অতীত, মানতেই হবে।

না! ফুঁসে উঠল দৈত্য। কারও কথা মেনে নেয়া তার ধাতে নেই। ভাল অতীত, বড়জোর এইটুকু বলা যায়, কিন্তু ভাড়াটে লোকের কাজকর্মকে আপনি মহৎ বলতে পারেন না।

ঠিক আছে, নাহয় না-ই বললাম, বলল গনৎসাগা। এ নিয়ে মতবিরোধ অর্থহীন।

আরও রেগে উঠল দৈত্য। কে বলেছে অর্থহীনঃ কে ঠেকাবে আমাকে, যদি আমি বিরোধিতা করতে চাই? উত্তর দিন! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল সে, কিন্তু পরমুহূর্তে বসে পড়ল আবার। বলল, না, ধৈর্য ধরতে হবে। আপনি আমার নোংরা পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করেননি, নিজে থেকেই আলাপ করেছেন, আমাকে মদ খাইয়ে সম্মানিত করেছেন, মনে হচ্ছে আমাকে আপনার দরকার। কি, ঠিক বলেছি?

ঠিক ধরেছেন।

বেশ, শুনুন তাহলে, চোখ-মুখ পাকিয়ে গলা নিচু করে ফেলল দৈত্য। মন দিয়ে শুনুন, মেসার গনৎসাগা। আমার বর্তমান দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে আপনি যদি অসৎ উদ্দেশ্যে আমাকে ব্যবহারের কথা ভেবে থাকেন– এই ধরুন, কারও ভুড়িটা ফাঁসিয়ে দেয়া, কিংবা গলাটা দুফাঁক করে দেয়া; তাহলে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, যদি নিজের চামড়ার প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া থাকে, কথাটা উচ্চারণ না করে স্রেফ কেটে পড়ন।

আপনাকে এমন কোন প্রস্তাব আমি দেব তা ভাবতে পারলেন কি করে? বলল গনৎসাগা। আসলে আমি আপনাকে একটা কাজ দিতে চাই, কিন্তু সেটা বেআইনী বা অবৈধ কিছু নয়। আমার ধারণা, এ কাজের যোগ্যতা,আপনার আছে।

আরও একটু শুনলে সেটা বোঝা যাবে, বলল এরকোল।

তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে, যদি কাজটা আপনার পছন্দ বা গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে এটা গোপন রাখবেন।

কী যে বলেন! একেবারে লাশের মত বোবা হয়ে যাব।

বেশ। কয়েক সপ্তাহের জন্যে আমাকে জনা বিশেক শক্তপোক্ত লোক যোগাড় করে দিতে হবে। কাজটা হচ্ছে: কিছুটা দেহরক্ষীর, কিছুটা যোদ্ধার। সাধারণ ভাড়াটে সৈনিকের তুলনায় চারগুণ বেশি বেতন দেব। বিনিময়ে আমার হয়ে কিছুটা ঝুঁকি নেবে তারা, এমন কি ডিউকের সৈন্যদের সঙ্গে খানিকটা ধস্তাধস্তিরও প্রয়োজন হতে পারে।

গাল ফুলিয়ে এত জোরে ফুঁ দিল একোল যে মনে হলো ঠাস করে ফাটবে গালদুটো। গলা নামিয়ে তীব্র কণ্ঠে বলল সে, বোঝা যাচ্ছে, বেআইনী কাজ! নিশ্চয়ই কোন বেআইনী কাজ!

হ্যাঁ, মেনে নিল গনৎসাগা। কিছুটা বেআইনী তো বটেই। তবে ঝুঁকি খুবই কম, এটুকু বলতে পারি।

এর বেশি আর কিছু বলা সম্ভব?

এখনই অন্তত নয়।

এক ঢেকে মদের গ্লাসটা শেষ করল এরকোল, ওটা নামিয়ে রেখে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। নাকি ঘুমিয়ে পড়ল ব্যাটা? অস্থির হয়ে বলে উঠল গনৎসাগা, কি হলো? পারবেন লোক যোগাড় করতে?

কাজের প্রকৃতিটা যদি একটু ভেঙে বলতে পারেন, তাহলে একশো লোক সংগ্রহ করতে পারব আমি অতি সহজে।

আপনাকে বলেছি, আমার দরকার বিশজন।

ভয়ানক গম্ভীর হয়ে, তোল এরকোল, তর্জনী দিয়ে চলছে লম্বা নাকটা।

পারা যায়, বলল নে শেষমেষ। তবে এমন বেপরোয়া লোক খুঁজে বের করতে হবে, যারা এমনিতেই কোন না কোন অপরাধে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে, আরও খানিকটা বেআইনী কাজ করতে যাদের বাধবে না। কবে নাগাদ লাগবে আপনার গ্রুপটাকে?

আগামীকাল রাতেই।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল এরকোল। আঙুলের কড়া গুনতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে নিঃশব্দে আউড়ে চলেছে স্যাঙাতদের নাম। দশ বারোজনকে অবশ্য দুই ঘণ্টার মধ্যেই জড়ো করতে পারব। কিন্তু বিশজন… আবার কিছুক্ষণ ভাবল চুপচাপ। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, যাই হোক, কত কি দেবেন সেটা শোনা যাক এবার। এতগুলো লোক যে অন্ধের মত ঝাঁপ দেবে অজানা একটা কাজে, তারা কি পাবে, আর এ দলনেতা হিসেবে আমিই বা পাচ্ছি কত?

প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল গনৎসাগা, তারপর পরিষ্কার জানিয়ে দিল, নেতৃত্বে থাকছি আমি নিজে।

বলেন কি! আঁৎকে উঠল দৈত্য। একদঙ্গল গুণ্ডা বদমাশের নেতৃত্ব দেবেন আপনি! হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে এপাশ-ওপাশ। বেশ তো, তাই যদি হয়, আপনিই যোগাড় করে নিন ওদের। ফেলিসিস্‌সিমা নট্টে (গুড নাইট)। হাত নেড়ে বিদায় জানাল সে গনৎসাগাকে।

খোলাখুলি জানাল গনৎসাগা, লোক যোগাড় করতে পারলে সে এরকোলের সাহায্য চাইতে এখানে আসত না।

শুনুন, স্যার, বলল এরকোল মৃদু হেসে। আমার কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি যদি আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবকে বলি, টাকার বিনিময়ে একটা কাজ করতে হবে। কি কাজ, তা জানাতে পারছি না, কিন্তু আমি থাকছি তাদের নেতৃত্বে-অর্থাৎ, বিপদ আপদ যাই ঘটুক, আমিও সমান ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি ওদের সঙ্গে; তাহলে আগামীকাল এই সময় নাগাদ আমার বিশ্বাস এক কুড়ি জোয়ান আমি সগ্রহ করতে পারব। এরকোল ফোর্টেমানির ওপর ওদের এতটুকু আস্থা আছে। কিন্তু যদি ওদের বলি, অজানা এক লোকের নেতৃত্বে অজানা এক কাজে হাত দিতে হবে, তাহলে? কেউ আসবে না। একজনও না।

অকাট্য যুক্তি। এর বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। খানিক ভেবেচিন্তে এরকোলের হাতে চুক্তির সম্মানী হিসেবে পঞ্চাশটা সোনার ফ্লোরিন খুঁজে দিল গনৎসাগা। বলল, এখন থেকে যতদিন চাকরি আছে মাসে বিশ স্বর্ণ-ফ্লারিন করে বেতন পাবে সে।

এত টাকা হাতে পেয়ে প্রথমে হতবাক হয়ে গেল দৈত্য। জীবনে কোনদিন এত বেতনের চাকরি করেনি সে। মনে হলো, এখুনি বুঝি সে ঝাঁপিয়ে পড়বে সুদর্শন তরুণের উপর, দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠবে খুশিতে।

এরপর ভারি একটা ব্যাণ ফেলল গনৎসাগা ফোর্টের্মানির সামনে টেবিলের উপর। ঝনঝন শব্দটা মধুর শোনাল এরকোলের কানে।

এখানে আরও একশো ক্লোরিন আছে সবার জিনিসপত্র আর পোশাকের জন্যে। সাজসজ্জার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবেন, রেজিমেন্টের সবাই যেন ফিটফাট জামা-জুতো পরে থাকে।

আর অস্ত্র?

হাতে বল্লম, কোমরে আরকুইবাস (পিল) থাকতে পারে, আর কিছু লাগবে না। যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রচুর অত্র আছে, তবে ওসবের প্রয়োজন হয়তো পড়বে না।

প্রয়োজন পড়বে না? তাজ্জব হয়ে গেল দৈত্য। কী মজা! খাওয়াবে, পরাবে, এত টাকা বেতন দেবে-অথচ যুদ্ধ করতে হবে না! স্বপেও সে কোনদিন ভাবতে পারেনি এত আনন্দের চাকরি আছে দুনিয়ায়।

.

লোক বাছাইয়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করল এরকোল ফোর্টেমানি। যতই হম্বিতম্বি করুক, বেয়াড়া কথাবার্তা বলুক, লোকটা সে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় মোটামুটি বিবেকবান। সন্দেহ নেই, ওর মত পাজির পা-ঝাড়া আর একটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, টানাটানির সময় অস্ত্রের মুখে রাহাজানিতেও আপত্তি নেই, মাতাল অবস্থায় সামান্য প্ররোচনাতেই বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পিছ পা হয় না; তবে এটাও ঠিক-ভাল বংশে জন্ম ওর, এবং অনেক ভাল জায়গায় সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক পদে কাজ করেছে সে কৃতিত্বের সঙ্গে। আসলে মদ্যাসক্তি ওকে অনেক নিচে টেনে এনেছে। সাধারণ জীবন যাপনে অসদাচরণ ও মিথ্যাচার ওর অভ্যাসে পরিণত হলেও কোনও কাজ নিলে আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করে সে সতোর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে।

.

০৯.

উরবিনো থেকে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে গেল জিয়ান মারিয়া, কিন্তু কাগলি পৌঁছে তার ভাড়াটে সেনাদের ক্যাপ্টেন আর্মস্টাডের জন্যে অপেক্ষা করবে বলে ভ্যালডিক্যাম্পো নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণ করল। তাকে জানাল, রাতটা এখানেই কাটাতে চায়।

খুবই সমাদর করল তাকে অভিজাত পরিবারটি। সাপারে কাগলির কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করা হলো, যেন তারা টের পায় কতবড় একজন সম্মানিত ব্যক্তি আতিথ্য গ্রহণ করেছে তাদের বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তপন দ্বিধান্বিত পায়ে ঘরে ঢুকল মার্টিন আর্মস্টাড, এগিয়ে এসে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল জিয়ান মারিয়ার পাশে যাতে বোঝা যায় কোন খবর আছে।

ঘাড় ফিরিয়ে ছোটখাট একটা গর্জন ছাড়ল জিয়ান মারিয়া, কি হলো, গভঃ খাবার সময়ে হড়মড়িয়ে ঢুকে এল যে

আরও এক পা সামনে এগোল সুইস ক্যাটেন, চা গলায় বলল, ওকে আনা হয়েছে, হাইনেস।

আরে! আমি কি সবজান্তা যে তোমার মনের কথা পড়ে ফেলব? কে এনেছে? কাকে?

আরও কাছে এসে ফিসফিস করে বলল ক্যাপ্টেন, ওই জোকারটাকে…সার পেপ্পি!

অ্যাঁ? ও। বুঝতে পেরেছে এবার। ভদ্রতা লঙ্ঘন করে জিয়ান মারিয়াও ক্যাপ্টেনের কানে ফিসফিস করে বলল, যেন লোকটাকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, আর দুজন তার পাহারায় থাকে। তুমিও উপস্থিত থেকো, মার্টিনো, আমি আসছি।

কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল মার্টিন। এতক্ষণে খেয়াল হলো জিয়ান মারিয়ার যে কাজটা ঠিক ভদ্রোচিত হয়নি। চট করে ক্ষমা চাইল গৃহকর্তার কাছে, বলল; জরুরী খবর জানাতে এসেছিল লোকটা। ডিউককে নিজ ছাদের নিচে পেয়ে সম্মানিত বোধ করছে মেসার ভ্যালডিক্যাম্পো, সামান্য বিচ্যুতিতে কিছুই মনে করল না। একটু পরেই উঠে পড়ল ডিউক, জানাল: দীর্ঘ যাত্রা করতে হবে আগামীকাল, তাই এখুনি শুয়ে পড়তে চায়।

ভ্যালডিক্যাম্পো নিজে ডিউককে শোবার ঘরে পৌঁছে দেবে বলে একটা বাতি, তুলে নিয়ে পথ দেখাল। কিন্তু অ্যান্টিরূমে পৌঁছেই তাকে বাতিটা নামিয়ে রেখে বিদায় নিতে বলল হিজ হাইনেস।

পিছু পিছু আসছিল পার্শ্বচর আলভেরি ও সানতি। একমুহূর্ত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল ডিউক, এখুনি ব্যাপারটা এদের গোচরে না আনাই ভাল-তাই বিদায় করে দিল তাদেরও।

সবাই চলে যাওয়ার পর শোবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল জিয়ান মারিয়া। জিজ্ঞাসা করল, ও আছে ভেতরে?

ইয়োর হাইনেসের জন্যে অপেক্ষা করছে, বলে দরজা মেলে ধরল মার্টিন আর্মস্টাড।

চমৎকার সাজানো-গোছানো বিশাল শয়নকক্ষে প্রবেশ করল জিয়ান মারিয়া। প্রাসাদের সবচেয়ে ভাল ঘরটা বরাদ্দ করেছে ভ্যালডিক্যাম্পে ডিউকের জন্য। ঠিক মাঝখানে বসানো রয়েছে কারুকাজ করা বিশাল খাট।

জানালার কাছে দেখা গেল দুজন সেন্ট্রির মাঝখানে বন্দী, ভয়ে আধমরা কুঁজো ভাড় পেপ্পিকে। দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওর আমোদপ্রিয় মুখটা। টের পেয়েছে কপালে খারাবি আছে আজ।

পেপ্পির কাছে কোন অস্ত্র নেই নিশ্চিত হয়ে সেন্ট্রি দুজনকে আর্মস্টাডের সঙ্গে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বলল জিয়ান মারিয়া। ওরা বেরিয়ে গেলে ভুরু কুঁচকে চাইল সে পেপ্পির দিকে, আগুন জ্বলছে দুচোখে।

সকালের সেই ঠাট্টা-তামাশা কোথায় গেল এখন? ভুরু নাচাল ডিউক।

ভয়ে শুকিয়ে গেছে জিঙ, তবু অভ্যাসবশে একটু ত্যাড়া উত্তর দিল ভাঁড়। আমার জন্যে পরিস্থিতি আর ততটা অনুকূল নেই। তবে ইয়োর হাইনেসকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই খোশমেজাজে আছেন।

একটা কিছু চোখা উত্তর দিতে পারলে ভাল লাগত জিয়ান মারিয়ার, কিন্তু বেচারার মাথাটা চলে ধীরে, উত্তর খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে কুঁজো লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল ফায়ারপ্লেসের ধারে।

তামাশা করতে গিয়ে সকালে তোমার মুখ দিয়ে যা বেরিয়েছে, তার জন্যে তোমাকে যদি চাবুকপেটা করি, বুঝতে হবে আমার অপার করুণা।

আর ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিলে বুঝতে হবে অশেষ মহব্বত! ফস্ করে বেরিয়ে গেল কথাটা ওর মুখ দিয়ে।

হ্যাঁ, স্বীকার করছ তাহলে? কথার বাঁকা দিকটা ধরতে পারল না জিয়ান মারিয়া, আসলেও আমি একজন দয়ালু প্রিন্স!

দয়ার সাগর, বলল পেপ্পি। কিন্তু চেষ্টা করেও কণ্ঠ থেকে বিদ্রূপ দূর করতে পারল না।

কী? আমাকে ব্যঙ্গ করছিস তুই, জানোয়ার? নিজের ভাল চাস তো জিভটা সামলে রাখ, নইলে এক্ষুণি কেটে নেব ওটা!

জিভ না থাকলে ভাঁড়ের কি মূল্য? আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেল ওর চেহারা। মুখে তালা মেরে যোবা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ডিউকের দিকে। ওর মনে হলো, এই লোকের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।

ওর চেহারায় ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব দেখে খুশি হলো ডিউক। বলল, হ্যাঁ, ফাসী দিলেই তোর বেয়াদবির ঠিক উপযুক্ত শাস্তি হতো। কিন্তু আমি ছেড়ে দেব তোকে, যদি যা জিজ্ঞেস করব তার ঠিক ঠিক উত্তর দিস।

লম্বা করে কুর্নিশ করল পেপ্পিনো৷ জিজ্ঞেস করুন, মাই লর্ড। আমি প্রস্তুত।

সকালে তুই বলেছিলি… যে ভাষায় কথাগুলো বলা হয়েছিল মনে পড়ে যাওয়ায় রাগে লাল হয়ে উঠল ডিউকের মুখ। তুই বলেছিলি লেডি ভ্যালেনটিনার সঙ্গে একজন লোকের পরিচয় হয়েছে।

আরও বিবর্ণ হয়ে গেল ভাঁড়ের ফ্যাকাসে মুখ। বুঝতে পারছে ব্যাপার কোনদিকে গড়াচ্ছে। কোন মতে উচ্চারণ করল, হ্যাঁ।

কোথায় এই নাইটের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ম্যাডোনার?

অ্যাকুয়াম্পার্টার জঙ্গলে, মাই লর্ড। মেটররা নদী যেখানে একটা ঝর্নার মত বইছে। সান্ত অ্যাঞ্জেলোর দুই লীগ মত এদিকে।

সান্ত অ্যাঞ্জেলো! চমকে উঠল জিয়ান মারিয়া। ওখানেই তো কদিন আগে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গোপন শলা হয়েছিল। কবেকার ঘটনা?

এই তো, ঈস্টারের আগের বুধবার। মোন্না ভ্যালেনটিনা যেদিন সান্তা সোফিয়া থেকে উরবিনোয় আসছিলেন।

স্থির দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ভাবছে জিয়ান মারিয়া। মঙ্গলবার রাতে পাহাড়ের ওপর যুদ্ধে মারা গেল মাসুচ্চিও। কোনও প্রমাণ নেই, তবু ওর মন বলছে এই লোক ছিল চক্রান্তকারীদের সঙ্গে, নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়া দুজনের একজন। শেষে জিজ্ঞেস করল, তোমার মনিবের সঙ্গে এ কথাবার্তা হলো কি করে? চেনাজানা ছিল?

না, হাইনেস; লোকটাকে আহত দেখে দয়া পরবশ হয়ে তিনি তার শুশ্রষা করেন।

অ্যাঁ? আহত লোক? চেঁচিয়ে উঠল জিয়ান মারিয়া। ঠিক যা ভেবেছিলাম! আগের রাতে সান্তা মারিয়ায় জখম হয়েছিল ব্যাটা। নামটা কি ওর, বুন্ধু। ওর নামটা বললেই তোমাকে ছেড়ে দেব আমি।

এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা ফুটে উঠল কুঁজো ভাঁড়ের চেহারায়। জিয়ান মারিয়ার নিষ্ঠুরতার অনেক কাহিনী তার জানা আছে। কিন্তু শপথ ভঙ্গ করে ওই নাইটের নাম বলে দিলে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে তার-নরকের আগুনে জ্বলতে হবে অনন্তকাল।

হায়রে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও, নামটা বলতে পারলেই ছাড়া পেয়ে যেতাম! কিন্তু কি পোড়া কপাল আমার, জানা থাকলে তো বলব। ওই লোকের নাম জানা নেই আমার, মাই লর্ড।

নির্বোধ হলে কি হবে, পেপ্পির মুহূর্তের দ্বিধা টের পেয়েছে সে। সন্দেহ হলো নামটা জানা আছে ওর, কিন্তু বলছে না। একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বেশ তো, চেহারা নিশ্চয়ই দেখেছ? বর্ণনা করো। কেমন চেহারা, কি পোশাক পরা ছিল, মুখের আদলটা কেমন?

ঠিক বলতে পারছি না, লর্ড ডিউক। পলকের জন্যে দেখেছি, মনে নেই আমার।

রাগে লাল হয়ে গেল ডিউকের কুৎসিত মুখটা, দন্ত বেরিয়ে পড়েছে আক্রমণোদ্যত হিংস্র শ্বাপদের মত।

এতই পলকের জন্যে দেখেছ যে কিছুই মনে নেই তোমার?

সত্যি, হাইনেস।

মিথ্যুক কোথাকার! গর্জে উঠল জিয়ান মারিয়া। নোংরা নর্দমার কীট! আজই সকালে বলছিলি লম্বা, সুপুরুষ চেহারা, অভিজাত চালচলন, মিষ্টি-মধুর কথাবার্তা-আর এখন কিছু মনে আসছে না? দাঁড়া, তোর মনে আনার ব্যবস্থা করছি। এমনই ওষুধ দেব, যে নিজের বাপের নাম ভুলে যাবি, কিন্তু ওর নাম মনে এসে যাবে। বল্, হারামজাদা! নামটা বলবি?

যদি পারতাম তাহলে সত্যি বলতাম…

বিরক্ত ভঙ্গিতে পিছনে ফিরে হাততালি দিল ডিউক। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে মুখ বাড়াল মার্টিন। তাকে একটা রশি আর সেন্ট্রি দুজনকে নিয়ে ভিতরে আসতে বলল জিয়ান মারিয়া।

ক্যাপটেন পিছন ফিরতেই ডিউকের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল জোকার। দয়া করুন, ইয়োর হাইনেস! আমাকে ফাঁসী দেবেন না! আমি, আমাকে…

কে বলেছে তোকে ফাঁসী দিচ্ছি? মরে গেলে তো বেঁচেই গেলি! তোকে জ্যান্ত চাই আমি বজ্জাতের হাড়। কথা বলাতে চাই।

অনেক অনুনয় করল ভাঁড়, কিন্তু কোনও লাভ হলো না। মা মেরির কাছে নালিশ জানাল, সেখান থেকেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। খাটের উপর চাঁদোয়া টাঙাবার কাঠটা টেনে টুনে দেখছে মার্টিনো, বলল, এতেই ঝোলানো যাবে, হাইনেস।

ভেলভেটগুলো সরাতে বলল জিয়ান মারিয়া। একজনকে পাঠাল অ্যান্টিরূমের দরজা বন্ধ আছে কি না দেখে আসতে। পেপ্পিনোর চিৎকার যেন কেউ শুনে না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

টেনে দাঁড় করানো হলো প্রার্থনারত পেপ্পিনোকে। শেষবারের মত জানতে চাইল ডিউক, নামটা কি বলবে?

পারছি না, হাইনেস! ককিয়ে উঠল পেনিনা।

অর্থাৎ, জানো, কিন্তু বলবে না। তাই না? তোলো ওকে মার্টিনো!

মরিয়া হয়ে এক হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে ছুটল কুঁজো ভাড়, কিন্তু সেন্ট্রিদের একজন খপ করে ওর ঘাড় চেপে ধরে ফিরিয়ে আনল।

একটা চেয়ারে বসে পড়েছে ডিউক। বলল, তুমি জানো কি ঘটতে যাচ্ছে। শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি, বলবে তুমি নামটা?

মাই লর্ড!বলল পেপ্পিনো, আতঙ্কে কাঁপছে গলা, আপনি যদি খাঁটি খ্রিষ্টান হন, অনন্ত নরকে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তাহলে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবেন।

বুঝলাম না! সাফ জবাব ডিউকের।

আমি অ্যাকুয়াম্পার্টার সেই লোকটাকে ঈশ্বরের নামে শপথ করে কথা দিয়েছি, কিছুতেই তার পরিচয় প্রকাশ করব না। এখন কি করব আপনিই বলুন। শপথ ভাঙলে অনন্ত নরকে, জ্বলতে হবে আমাকে। একটু দয়া করুন, মহান লর্ড; আমার দিকটা একটু বিবেচনা করুন।

জিয়ান মারিয়ার হাসি চওড়া হলো, ফলে আরও নিষ্ঠুর, আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে এখন। আর কোনও সন্দেহ নেই তার মনে এই বুন্ধুর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, গোপনীয়তার শপথ করিয়েছে যখন, ওই তোক নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। হয়তো ওদের নেতাই হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ডিউক, নামটা তার জানতেই হবে যেমন করে থোক। বুদ্ধ যদি নির্যাতনে মারা পড়ে তাতেও কোন ক্ষতি নেই, জানতে হবে-কে দুশমনি করছে তার সঙ্গে; প্রথমে তাকে গৃদি থেকে নামানোর ষড়যন্ত্র, তারপর ভ্যালেন্টিনার হৃদয় জয়!

তোমার অনন্ত নরকের জন্যে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না, বলল সে। এই লোক আমার চরম শত্রু। এর নাম আমার জানতেই হবে। তোমার হাড়-গোড় ভাঙলে আমার কিছুই করার নেই। কি, বলবে নামটা?

নিজের দুর্দশা টের পেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল পেপ্পি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মেঝের দিকে চেয়ে গোঁজ হয়ে পঁড়িয়ে থাকল, টু-শব্দ বের করল না মুখ দিয়ে। সেন্ট্রিদের ইঙ্গিত করল ডিউক। পিছনে বাঁধা হাতের মধ্যে দিয়ে রশি গলিয়ে ক্যানোপির উপর দিয়ে এপাশে নিয়ে আসা হলো, তারপর দুজন মিলে রশি টেনে শূন্যে তুলে ফেলল পেপ্পিনোকে। মাটি থেকে ছয়ফুট উপরে ল্যাগব্যাগ করছে পা দুটো, বেকায়দা, ভঙ্গিতে হাতের উপর ঝুলছে কুঁজো লোকটা, শরীর মোচড়াচ্ছে, ব্যথায় বিকৃত মুখ। মধুর কণ্ঠে জানতে চাইল জিয়ান মারিয়া, কী, বলবে নামটা?

জবাব না পেয়ে বিরক্ত কণ্ঠে আদেশ দিল, নামও ওকে তিনফুট।

রশি ছেড়ে দিল ওরা, ঠিক যখন পা দুটো মেঝে থেকে ফুট তিনেক উপরে আছে, হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধরে ফেলল রশিটা আবার। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল জেটার, মনে হলো কাঁধ থেকে খুলে গেছে দুই বাহু। আবার শূন্যে তুলে ফেলা হলো ওকে।

এবার বলবে? অমায়িক কণ্ঠ ডিউকের।

জবাব নেই। নিচের ঠোঁটটা এত জোরে কামড়ে ধরেছে, যে রক্ত গড়িয়ে নামছে চিবুক বেয়ে। আবার ইঙ্গিত করল ডিউক। এবার আরও একটু নামার পর হ্যাঁচকা টান মেরে থামানো হলো পড়ন্ত দেহটা।

আবার চিৎকার করে উঠল পেপ্পিনো। তারপর গোঙাতে শুরু করল। বিড় বিড় করে বলছে, ওহ, খোদা! ওহ্, খোদা! ডিউকের উদ্দেশে বলল, আপনি রাজা, মহান লর্ড! অসহায়, দুর্বল আমি, দয়া করুন! আপনার করুণা ভিক্ষা চাইছি।

মহান লর্ডের মন ভিজল না, আবার ইঙ্গিত দিল সে সেন্ট্রিদে টেনে তোলা হলো ওকে উপরে।

মরিয়া হয়ে একনাগাড়ে গালাগাল আর অভিসম্পাত শুরু করল এবার পেনিনা, আকুল মিনতি করল ঈশ্বরের কাছে যেন এই মুহূর্তে অত্যাচারী লোকগুলোকে খুন করে নরকে পাঠিয়ে দেয়।

আরও দুবার ওকে ভোলা ও নামানো হলো। চিৎকার দেয়ার শক্তিও নেই আর পেপ্পিনোর। মুখ রক্তাক্ত, চোখ উল্টে গেছে, গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। মার্টিন চাইল জিয়ান মারিয়ার দিকে, স্পষ্টতই বলতে চায় এখন থামা উচিত। কিন্তু রোখ চেপে গেছে ডিউকের। কি বুঝছ, বুন্ধু? এবার বলবে, আরও ওষুধ লাগবে? জবাব না পেয়ে ইঙ্গিত দিল সে সেন্ট্রিদের। আর টেনে তোলা হলো ওকে উপরে।

পঞ্চম ঝাঁকির পর হঠাৎ বুঝে ফেলল জেসটার, এইভাবে ওকে খুন করে ফেলছে লোকটা, কোনভাবে এ থেকে নিস্তার নেই, নামটা না বলে পার পাবে না সে কিছুতেই। আর সহ্য করাও ওর পক্ষে সম্ভব নয়। অনন্ত নরক এর চেয়ে আর কত বেশি খারাপ হবে?

ঠিক আছে, বলব! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। বলব আমি, লর্ড ডিউক! নামান আমাকে।

আগে বলো, তারপর নামানো হবে, কঠোর কণ্ঠে জবাব দিল জিয়ান মারিয়া।

রক্তাক্ত ঠোঁট চাটল একবার পেপ্পিনো, তারপর ভাঙা গলায় বলল, আপনার মামাতো ভাই, মাই লর্ড, হাঁপাচ্ছে জেসটার। অ্যাকুইলার কাউন্ট, ফ্র্যাঞ্চেস্কো ডেল ফ্যালকো।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ডিউক কয়েক মুহূর্তের জন্যে, হাঁ হয়ে গেছে মুখ, দৃষ্টিতে বিস্ময়। তারপর বলল, সত্যি বলছিস, জানোয়ার? আহত কাউন্ট অভ অ্যাকুইলারই সেবা করেছিল মোন্না ভ্যালেন্টিনা?

শপথ করে বলছি, মাই লর্ড, হাঁপাচ্ছে জোকার। এবার আমাকে নামাতে বলেন! আর পারছি না!

তেমনি বিস্মিত দৃষ্টিতে পেঞ্জিনের দিকে চেয়ে রইল জিয়ান মারিয়া আরও কিছুক্ষণ। মনে মনে খতিয়ে দেখছে সংবাদটা। ভাবছে, সত্যিই তো, ফ্র্যাঞ্চেস্কোকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে ব্যাব্বিয়ানোর জনসাধারণ-ষড়যন্ত্রকারীরা তো ওকেই বসাতে চাইবে ক্ষমতায়। এই সহজ কথাটা এতদিন কেন মাথায় আসেনি, ভেবে নিজেকে নরম দেখে ৭০

দু-একটা গালি দিল সে।

নামাও ওকে, আদেশ দিল জিয়ান মারিয়া। কয়েক ঘা লাগিয়ে বিদায় করে দাও, যেখানে খুশি চলে যাক।

নামানো হলো বটে, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারলনা জেসটার, হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। জ্ঞান হারিয়েছে।

আর্মস্টাডের ইঙ্গিতে টেনে তুলল ওকে সেন্ট্রি দুজন, বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে। শত্রু চিনিয়ে দেয়ায় হাজারো শোকর গোজার করল জিয়ান মারিয়া খোদার কাছে। তারপর উঠে পড়ল বিছানায়।

.

১০.

পরদিন রাত দশটায় রাজধানী ব্যাব্বিয়ানোয় পৌঁছল দোর্দণ্ডপ্রতাপ জিয়ান মারিয়া স্কোত্যা। পৌঁছেই টের পেল প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে প্রজাদের মধ্যে। সীজার বর্জিয়ার দূত কেন এসেছে জানে সবাই। জটলা পাকিয়ে আলাপ করছে ওরা এখানে ওখানে। উত্তেজিত, কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে দূর থেকে।

পোর্টা রোমানায় জিয়ান মারিয়াকে দেখে চুপ হয়ে গেল সবাই, অভিবাদন তো দূরে থাক, একটি শব্দও উচ্চারণ করল না কেউ। রেগে ব্যোম হয়ে গেল ডিউক। ভুরু কুঁচকে কটমট করে চাইল এদিক ওদিক, কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না ওকে।

বোর্গো ডেল অ্যান্নাৎসিয়াতায় পৌঁছে দেখল, ভিড় আরও বেশি। ঘোড়াগুলোকে এগিয়ে আসতে দেখেও সরছে না কেউ। বরং জটলার আড়াল থেকে ব্যঙ্গ করছে ডিউককে সিটি বাজিয়ে বা গাধার ডাক ডেকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল জিয়ান মারিয়ার। অবস্থা টের পেয়ে বর্শা সমান্তরাল করার নির্দেশ দিল ক্যাপটেন আর্মস্টাড। সামনের কয়েকজন সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পিছনের চাপে নড়তে পারল না জায়গা থেকে। ধরাশায়ী হলো কয়েকজন, তাদেরকে মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ঘোড়সওয়ারের দল।

চিৎকার করে নানারকম বিদ্রূপ বর্ষণ করছে ওরা অপ্রিয় শাসকের উদ্দেশে। কেউ জিজ্ঞাসা করছে শাদী হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে চাচা শ্বশুরের বাহিনী দেখা যাচ্ছে না কেন, কে রক্ষা করবে এদেশটাকে বর্জিয়ার আক্রমণ থেকে? কেউ কেউ চিৎকার করছে নতুন চাপানো কর দিয়ে সেনাবাহিনী গড়ার কথা ছিল, কি কচুটা করা হয়েছে? ডিউকের হয়ে জটলার ভিতর থেকেই কয়েকজন জবাব দিল কোন কোন বাজে খাতে খরচ হয়েছে টাকাগুলো।

হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে চিৎকার উঠল, এই ব্যাটা খুনী! বীর ফেরাব্রাচ্চিও আর দুঃসাহসী আমেরিনিকে এ খুন করেছে! কসাই ব্যাটা, দে এখন ওদের জীবন ফিরিয়ে! একটু পরেই ডিউকের অন্তর পুড়িয়ে কাউন্ট অভ অ্যাকুইলার নামে জয়ধ্বনি শুরুকরল ওরা। কেউ কেউ ইল ডিউকা ফ্র্যাঞ্চেস্কো বলেও হাঁক ছাড়ছে। রাগে অন্ধ হয়ে গেল জিয়ান মারিয়া, ভয়কে জয় করল ক্রোধ, রেকাবে উঠে দাঁড়িয়ে আদেশ দিল ক্যাপটেনকে, মার্টিনো! ওদের মধ্যে দিয়ে তলোয়ার হাতে ঘোড়া ছোটাতে বলো তোমার লোকদের, যাকে সামনে পাবে তাকেই কচুকাটা করবে!

এই হুকুম পেয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল সুইস ক্যাপটেন। সাহসের কমতি নেই তার, কিন্তু এই নিরস্ত্র লোকদের কি করে খুন করবে বুঝে পাচ্ছে না। ওদিকে সভাসদ আলভারো ভি আলভারি আর জিসমন্ডো সাতিও আদেশ শুনে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইছে এ ওর দিকে। বৃদ্ধ সাতি বলল, হাইনেস, আপনি নিশ্চয়ই চাইছেন না…

চাইছি না? গর্জে উঠল জিয়ান মারিয়া। ফিরল দ্বিধান্বিত ক্যাপটেনের দিকে, কি রে, গর্দভ? জানোয়ারের অধম! দাঁড়িয়ে আছিস কি জন্যে? কি বলেছি আমি?

আর দেরি না করে দলবল নিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যাপটেন। যারা পিছনে ছিল তারা টের পায়নি কি ঘটতে চলেছে, তাই সামনের কয়েকজন পিছাবার চেষ্টা করেও তাদের চাপে নড়তে পারল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা পড়ল অনেক লোক, আহতদের আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। জনতাকে ভেদ করে এগিয়ে গেল অশ্বারোহীর দল।

এবার পিছন থেকে শিলাবৃষ্টির মত পাথর ছুঁড়তে শুরু করল ক্ষিপ্ত জনতা। ঠুন-ঠান-ঠকাশ শব্দ করে পড়ছে সেসব সৈন্যদের হেলমেটে, বর্মে। দুটো লাগল ডিউকের গায়েও। বৃদ্ধ সাতির মাথায় পড়ল একটা, রক্তে ভিজে গেল সাদা চুল।

এমনি অপদস্থ অবস্থায় পিছনে নিহতদের লাশ আর আহতদের আহাজারি ফেলে পৌঁছল ডিউক নিজের প্রাসাদে। সোজা শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল সে, দুঘণ্টার আগে আর বের হলো না। শেষে ভ্যালেন্টিনার ডিউক সীজার বর্জিয়ার দূত দেখা করতে চায় শুনে উত্তেজিত অবস্থাতেই এসে বসল সভাকক্ষে।

প্রবল প্রতিপক্ষ, শক্তিশালী বর্জিয়ার দূতের সঙ্গে কথা বলতে হলে যে-রকম বুদ্ধিমত্তা, ঠাণ্ডা মাথা আর সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োজন, এ-মুহূর্তে তার কোনওটাই নেই তারমধ্যে; টগবগ করে ফুটছে সে ভিতর ভিতর। তবে যথাসম্ভব ভদ্রতার সঙ্গেই বসতে বলল সে দূতকে। ডিউকের পরামর্শদাতাদের মধ্যে উপস্থিত আলভারি, সাতি ও ফ্যাব্রিৎসিও ডা। লোডি। ডিউকের মা, ক্যাটেরিনা কোলোন্না বসেছেন লাল ভেলভেট মোড়া একটা আসনে-স্বর্ণের ক্ষোত্যা-সিংহ আঁটা রয়েছে তাতে।

সাক্ষাৎকার খুবই সংক্ষিপ্ত হলো। যতখানি সৌজন্যের সঙ্গে শুরু হয়েছিল, শেষদিকে তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট থাকল না। বোঝা গেল একে পাঠানো হয়েছে ব্যাব্বিয়ানোর সঙ্গে যেভাবে হোক একটা ঝগড়া বাধানোর জন্যে, যাতে আক্রমণের ছুতো পাওয়া যায়। প্রথমে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বর্জিয়ার দাবি পেশ করল সে, কিন্তু জিয়ান মারিয়া যখন সেটা অস্বীকার করল, তখন উদ্ধত ভঙ্গিতে জানাল-ফরাসী আগ্রাসন ঠেকাবার জন্যে ডিউক অভ ভ্যালেন্টিনয় যে উদযোগ গ্রহণ করেছেন তাতে পাঁচশো সশস্ত্র লোক সরবরাহের মাধ্যমে অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে জিয়ান মারিয়াকে।

জিয়ান মারিয়ার কানে কানে মন্ত্রণা দিল লোডি, কিন্তু সে মন্ত্রণা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল ডিউক। এমন কি তার বুদ্ধিমতী মায়ের কুটিও তাকে দমাতে পারল না। অগ্রপশ্চাৎ কিছু না ভেবে বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিল।

আমার তরফ থেকে ডিউকা ভ্যালেন্টিনোক জানাবে, সবশেষে বলল জিয়ান মারিয়া, আমার সৈন্যদের আমার নিজেরই দরকার। বিশেষ করে ওর মত একজন তস্করের আগ্রাসন ঠেকাবার জন্যে আমাকে লোক তৈরি রাখতে হবে। মেসার ডা লোডি, দূতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফ্যাব্রিৎসিওকে বলল, এই ভদ্রলোককে তার ঘরে পৌঁছে দিন। আর নিরাপদে যাতে আমার এলাকা পেরোতে পারে সেজন্যে একটা ছাড়পত্র দিয়ে দেবেন।

লাল হয়ে গেছে মুখ, চোখে অগ্নিদৃষ্টি-লোডির পিছু নিয়ে বেরিয়ে গেল দূত। মোন্না ক্যাটেরিনা এবার উঠে দাঁড়িয়ে কিছু কঠোর, তিক্ত, তির্যক বাক্য বর্ষণ করলেন পুত্রের উদ্দেশে।

গর্দভ! গেল তোমার ডাচি ওই লোকটার হাতের মুঠোয়! তিক্ত হেসে যোগ করলেন, আমি জানতাম, এভাবেই যাবে। কারণ, আর যাই হোক রাজ্য রক্ষার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনটাই নেই তোমার, কোনদিন ছিলও না।

মা, পুরুষের কাজে-কর্মে নাক না গলিয়ে তুমি বরং তোমার ঘর সংসারের কাজে মন দাও গিয়ে।

পুরুষের কাজ! ধিক্কার দিয়ে বললেন রাজমাতা। সেটা তুমি করছ বখাটে ছোকরা কিংবা বদমেজাজি, ঝগড়াটে মেয়েছেলের মত!

আমার মতো চালাচ্ছি আমি দেশটা, মা। ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক হিসেবে যেমন ভাল বুঝছি তেমনি ভাবে আমার কর্তব্য আমি পালন করছি। পোপের সন্তানকে আমার ভয় পাওয়ার কোনও কারণ দেখি না। উরবিনোর সঙ্গে মৈত্রী ধরতে গেলে প্রায় হয়েই গেছে। চুক্তিটা হয়ে যাক, তারপর ভ্যালেন্টিনো যদি দাঁত দেখায়, আমরাও দেখিয়ে দেব আমাদেরগুলো।

হ্যাঁ, তবে দুটোয় তফাৎ আছে। ও দেখাবে নেকড়ের দাঁত, আর তুমি দেখাবে ভেড়ার। মৈত্রী যখন হয়নি এখনও, তোমার উচিত ছিল বর্জিয়ার এই দূতকে আপাতত কিছু অনির্দিষ্ট আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠানো। তাহলে সময় পেতে উরবিনোর সঙ্গে আত্মীয়তা পাকা করে নেয়ার। কিন্তু এখন আর সে সময় পাবে না, দিন ঘনিয়ে এসেছে তোমার, বাবা। কোনও সন্দেহ নেই, তোমার উত্তর পৌঁছামাত্র, ধেয়ে আসবে সীজার। এই নির্বুদ্ধিতার ফাঁদে আটকা পড়ার কোনও ইচ্ছে আমার অন্তত নেই। আমি চলে যাচ্ছি ব্যাব্বিয়ানো থেকে, ভাবছি নেপলসে গিয়ে আশ্রয় নেব। আমার শেষ উপদেশ যদি জানতে চাও, তাহলে বলব : তুমিও তাই করো।

উঠে দাঁড়াল জিয়ন মারিয়া, নেমে এল মঞ্চ থেকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মায়ের দিকে। তারপর সমর্থনের আশায় একে একে চাইল আলভারি, সাতি আর সবশেষে সদ্য ফিরে আসা লোডির দিকে। কিন্তু কেউ একটি শব্দ উচ্চারণ করল না, গম্ভীর, চোখের দৃষ্টিতে উদ্বেগ।

ভীরুর দল! তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল জিয়ান মারিয়া। তারপর তেজোদ্দীপ্ত, জোরাল কণ্ঠে বলল, কই, আমি তো ঘাবড়াচ্ছি না! অতীতে হয়তো আমাকে অন্যরকম দেখেছ তোমরা, কিন্তু জেনে রাখো, সেই আমি আর নেই। জেগে উঠেছি আমি। ব্যাব্বিয়ানোর পথে আজ এমন একটা কথা কানে এসেছে, এমন কিছু দেখেছি যে আগুন ধরে গেছে আমার রক্তে। তোমরা যে খোশমেজাজী, নরম, ক্ষমাসুন্দর ডিউককে চিনতে, সে বদলে গেছে। সিংহ জেগে উঠেছে তার ভেতর। এখন এমন সব ঘটনা দেখবে তোমরা যা স্বপ্নেও ভাবতে পারনি।

নতুন দৃষ্টিতে দেখছে এখন সবাই ওকে। ভাবছে, চাপের মুখে মাথাটা বিগড়ে গেল নাকি লোকটার? এসব মিথ্যে বড়াইয়ের কি অর্থ?

কি? বোবা হয়ে গেলে নাকি সবাই? পাগলাটে দৃষ্টিতে চোখ বুলাল সে সবার মুখের উপর। নাকি ভাবছ, যা বলছি তা করে দেখাবার মুরোদ নেই আমার? টের পাবে শীঘ্রিই। মা, কাল তুমি যখন দক্ষিণে যাত্রা করবে, আমি তখন রওনা হব উত্তরে-উররিনোর পথে। একটা দিনও নষ্ট করবার উপায় নেই এখন। এই সপ্তাহের মধ্যেই সেরে নেব বিয়েটা। উরবিনো পক্ষে আসা মানে পেরুজিয়া, ক্যামেরিনো সব মিত্রশক্তির পক্ষে চলে আসা। শুধু তাই নয়, লেডি ভ্যালেনটিনার সঙ্গে বিরাট অঙ্কের যৌতুকও আসছে। এই টাকা কিসে ব্যয় করব আমি ভাবছ? সেনা বাহিনী তৈরির কাজে। বুঝেছ? এমন এক বাহিনী তৈরি করব যা কেউ কোনদিন দেখেনি। তারপর; বুঝলে, তারপর ওর অপেক্ষায় এখানে বসে না থেকে আমিই ধাওয়া দেব তোমাদের দুর্ধর্ষ ডিউকা ভ্যালেন্টিনোকে। ঝাঁপিয়ে পড়ব ওর ওপর বজ্রের মত। হ্যাঁ, মা, হেসে উঠল সে পাগলাটে হাসি, তোমার ভেড়াই তাড়া করে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলবে ওই নেকড়ের, যাতে আর কোন ভেড়াকে সে উত্যক্ত করতে না পারে। এমনই যুদ্ধ হবে সেটা যা স্মরণকালের মধ্যে কেউ দেখেনি।

চোখ বড় করে চেয়ে রইল সবাই ওর দিকে। ভীতু, আরামপ্রিয়, বিলাসে আসক্ত রাজকুমার আজ হঠাৎ এমন যুদ্ধপাগল হয়ে উঠল কি কারণে বুঝতে পারছে না কেউ।

আসল কথা, মামাতো ভাই ফ্র্যাঞ্চেস্কোর কারণে ঈর্ষার আগুন জ্বলে উঠেছে ওর বুকে। শুধু ভ্যালেনটিনারই নয় ওর প্রজাদেরও হৃদয় কেড়ে নিয়েছে ফ্র্যাঞ্চেস্কো, ওকেই এখন প্রজারা ব্যাব্বিয়ানোর ডিউক হিসেবে চাইছে,। যৌতুকের টাকা দিয়ে সৈন্যদল গড়ে উরবিনোর সহায়তায় যদি বর্জিয়াকে একটা আচ্ছামত বাড়ি দেয়া যায় তাহলে সবার ভুল ভাঙবে,, সবাই বুঝতে পারবে খ্যাতিমান ফ্র্যাঞ্চেস্কোর চেয়ে সে কোনও দিক থেকেই কম নয়। ফ্রাঞ্চেস্কোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সে গুঁড়িয়ে দেবে একটু পরেই, আর কিছুদিনের মধ্যে তার স্মৃতিও মুছে দেবে সবার মন থেকে।

সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন মা, ক্যাটেরিনা। তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন: উচ্চাশা ভাল, কিন্তু তার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক না থাকলে পতন অনিবার্য। কিন্তু কারও কথায় কান দেয়ার মত মানসিক অবস্থায় নেই এখন জিয়ান মারিয়া।

একজন পরিচারক এসে ঢুকল সভাকক্ষে। তাকে দেখেই মায়ের দিকে ফিরল জিয়ান মারিয়া। মনস্থির করে ফেলেছি আমি, মা। যা করছি বুঝে শুনেই করছি। সঙ্কল্প থেকে কেউ আর টলাতে পারবে না এখন আমাকে। আর কয়েকটা মিনিট, যদি অপেক্ষা করো, নিজের চোখেই দেখতে পাবে নাটকের প্রথম পর্ব। চাকরটার দিকে ফিরল সে, কি খবর, বলে ফেলো।

হিজ এক্সেলেন্সিকে নিয়ে ক্যাপটেন আর্মস্টাড অপেক্ষা করছেন, হাইনেস।

আরও বাতি নিয়ে এসো আগে, তারপর ওদের ঢুকতে বলো, হুকুম দিল জিয়ান মারিয়া। তারপর ফিরল সভাসদ ও মায়ের দিকে। তোমরা যে-যার সীটে বসে পড়ো। এখুনি বিচারে বসব আমি।

কি ঘটতে চলেছে বোঝা যাচ্ছে না, অবাক দৃষ্টিতে এ-ওর মুখের দিকে চাইল সবাই, তারপর বসে পড়ল যার যার আসনে। জিয়ান মারিয়াও মঞ্চে উঠে নিজের আসনে বসল। কয়েকটা সোনার বাতিদান এনে রাখল ভৃত্যরা। ওরা সরে যেতেই খুলে গেল দরজা। বাইরে থেকে বর্মের ধাতব শব্দ আসায় বিস্ময় বাড়ল আরও।

পরমুহূর্তে হতবাক হয়ে গেল যখন দেখল দুজন সেপাইয়ের মাঝখানে বন্দী অবস্থায় ঘরে ঢুকছে নিরস্ত্র কাউন্ট অভ অ্যাকুইলা। দ্রুত একবার নজর বুলিয়ে দেখে নিল সে সিংহাসনের আশেপাশে বসা সবাইকে, লোডিকে দেখেও বিন্দুমাত্র বিস্ময় ফুটল না তার দৃষ্টিতে; শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল ফুফাত ভাইয়ের কি বলার আছে শুনবে বলে।

বিলাসবজিত দামী পোশাক তার পরনে, সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায় একনজরেই। চেহারা আর দাঁড়াবার ভঙ্গিতেই স্পষ্ট বোঝা যায় অত্যন্ত উঁচু বংশের সন্তান। সামান্য বিরক্তি ছাড়া আর কোন ভাব নেই চেহারায়।

কয়েক মুহূর্তের নাটকীয় নীরবতা। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে জিয়ান মারিয়া . অবশেষে কথা বলে উঠল ডিউক, উত্তেজনায় গলার স্বর উঠে গেছে কয়েক পর্দা।

সান বাকোলোর তোরণের ওপর আর সবার সঙ্গে তোমার মাথাটাও কেন বর্শায় গেঁথে রাখা হবে না, তার উপযুক্ত কারণ দর্শাতে পারবে?

কপালে উঠে গেল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর ভুরু। বিস্মিত হয়েছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মৃদুহেসে বলল, একাধিক কারণ দর্শাতে পারব।

ওর নিরুদ্বিগ্ন ভাব দেখে একটু ভাঁড়কে গেল জিয়ান মারিয়া, তবে সেটা সামলে নিল মুহূর্তেই। দুই-একটা শোনা যাক, বলল সে।

তার আগে শোনা যাক আমার মাথাটা নিয়ে তোমার এমন নিষ্ঠুর অভিপ্রায়ের কি কারণ। কারও সঙ্গে যদি রূঢ় আচরণ করা হয়, যেমন আমার সঙ্গে করা হচ্ছে, নিয়ম হলো কাজটা যে করছে তাকেই কৈফিয়ত দিতে হয় কেন সে করছে এ কাজ।

জিভটা বরাবরই তোমার একেবারে পালিশ করা! বিশ্বাসঘাতক কোথাকার! বিদ্বেষে বিকৃত হয়ে গেল ডিউকের চেহারা। কাউন্টের শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন হাবভাব মাথার ভিতর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তার। তুমি জানো না কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তোমাকে জানতে চাও? তাহলে একটা প্রশ্নের জবাব দাও ঈস্টারের আগের বুধবার সকালে কি করছিলে তুমি অ্যাকুয়াস্পার্টায়?

কাউন্টের মুখটা নির্বিকার থাকলেও, কেউ লক্ষ করলেই দেখতে পেত নিজের অজান্তেই হাত দুটো মুঠো হয়ে গেছে তার। ডিউকের পিছনে দাঁড়ানো ফ্যাব্রিৎসও ডা লোডির মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে।

সেখানে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না, জবাব দিল ফ্র্যাঞ্চেস্কো। জঙ্গলে স্নিগ্ধ বসন্তের বাতাস বুক ভরে নিয়েছি, এটা মনে আছে।

আর কিছুই না? তিক্ত হাসি ডিউকের মুখে।

গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছুই না। ও-হ্যাঁ, এক মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কয়েকটা কথাও হয়েছিল; একজন ফ্রায়ার ছিলেন, কোর্ট জেসটার ছিল, একজন এসকর্ট আর কিছু সৈন্যও ছিল। কিন্তু হঠাৎ গলার স্বর চড়ে গেল কাউন্টের, যাই করে থাকি, যা ভাল বুঝেছি তাই করেছি, তার জন্যে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন বুঝতে পারছি না। তুমি এখনও আমাকে জানাওনি, স্যার, কোন অধিকারে আমাকে বন্দী করেছ।

জানাইনি, না? ঐদিন সান্ত অ্যাঞ্জেলোর অত কাছে থাকাটা কোন অপরাধ বলে মনে হচ্ছে না তোমার?

বুঝতে পারছি না, এভাবে অপমানজনক অবস্থায় আমাকে ধরে এনে আমার কাছে কিছু ধাঁধার উত্তর চেয়ে কি মজা পাচ্ছ তুমি। তবে আশাকরি তোমার জানা আছে, আমি কারও রাজসভার পেশাদার জেসটার নই।

কথা আর কথা! গর্জন ছাড়ল ডিউক। ও দিয়ে আর আমাকে ভোলাতে পারবে না। কাশির মত শব্দে হেসে উঠল সে, ফিরল সভাসদদের দিকে। আপনারা হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন-মা, তুমিও নিশ্চয়ই অবাক হয়েছ, ভাবছ কোন্ কারণে গ্রেপ্তার করেছি আমি এই বিশ্বাসঘাতককে। শুনে নাও তোমরা: ঈস্টারের আগের মঙ্গলবার রাতে সাতজন বিশ্বাসঘাতক মিলিত হয়েছিল সান্ত অ্যাঞ্জেলোয় আমাকে উৎখাত করবে বলে। ওই সাতজনের মধ্যে চারজনের মাথা বর্শায় গেঁথে সাজিয়ে রাখা আছে ব্যাব্বিয়ানোর দেয়ালের উপর। বাকি তিনজন পালিয়ে গিয়েছিল। সেই তিনজনের একজন এই যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। আমাকে হত্যা করে একেই এই সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র চলছিল।

সবার দৃষ্টি এখন তরুণ কাউন্টের উপর। নিশ্চিন্ত মনে এদিক ওদিক চাইছে সে। লোডির ফ্যাকাসে চেহারার উপর চোখ পড়তেই বুঝতে পারল, ডিউকের মনোযোগ এখন নিজের দিকে ধরে রাখতে হবে, নইলে একবার পাশ ফিরে চাইলেই বুঝে ফেলবে জিয়ান মারিয়া, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিল এই বৃদ্ধ। নীরবতা নেমে এসেছে ঘরে, টু শব্দ করবার সাহস নেই কারও। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর উত্তরের আশায় রয়েছে ডিউক, কিন্তু নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে ডিউকের মুখের দিকে, কথা বলার কোন লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত চেঁচিয়ে উঠল জিয়ন মারিয়া।

কি হলো? জবাব দিচ্ছ না কেন?

স্বীকার করছি, বলল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, পাগলের কিছু প্রলাপ আমার কানে গেছে, প্রমাণ ছাড়া কতগুলো কাল্পনিক অভিযোগ শুনতে পেয়েছি বিকৃতমস্তিষ্ক কোন উন্মাদের; কিন্তু কই, কোনও প্রশ্ন তো শুনতে পাইনি! সবার মুখের দিকে চাইল সে, আপনারা, বা ম্যাডোনা, আপনি কি হিজ হাইনেসকে কোন প্রশ্ন করতে শুনেছেন, যার উত্তর দেয়া প্রয়োজন?

প্রমাণ চাও তুমি? তেজের সঙ্গে বলতে চাইল জিয়ান মারিয়া, কিন্তু গলাটা কেমন অনিশ্চিত শোনাল। ফ্র্যাঞ্চেস্কোর শান্ত, নির্বিকার হাবভাব দেখে দ্বিধায় পড়ে গেছে সে। ওর মামাত ভাইয়ের কথায় ও আচরণে অপরাধের সামান্যতম ছাপও নেই, যেন ও নিশ্চিত ভাবে জানে, কিছুই হবে না ওর। কথাটা জোরাল করার জন্যে আবার বলল, চাও তুমি প্রমাণ? তারপর যেন অকাট্য প্রমাণ হাজির করছে এমনি ভঙ্গিতে বলল, বলো, জখমটা কিসের তাহলে? কিভাবে আহত হয়েছিলে তুমি সেদিন?

মৃদু হাসি ফুটে উঠল ফ্র্যাঞ্চেস্কোর মুখে, তারপর মিলিয়ে গেল।

প্রমাণ চেয়েছি আমি, ইয়োর হাইনেস, প্রশ্ন নয়! তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে চাইল সে জিয়ান মারিয়ার মুখের দিকে। আমার শরীরে যদি হাজারটা জখমও থাকে, তাতে কি প্রমাণ হয়?

প্রমাণ? আত্মবিশ্বাস দ্রুত কমছে ডিউকের। ঘাবড়ে গেল সে। ভাবছে, নিছক সন্দেহের বশে হয়তো বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে, অমর্যাদা করে বসেছে আপন মামাত ভাই শুধু নয়, একজন নামজাদা, সম্মানিত কাউন্টের। তবু বলল, এটাই প্রমাণ করে যে, আগের রাতের লড়াইয়ে ছিলে তুমি!

প্রথমে বিস্মিত হলো, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সবশেষে যেন অর্বাচীন ভাইয়ের অবাস্তব অভিযোগ শুনে মাথা নাড়ল ফ্র্যাঞ্চেস্কো মৃদু হেসে। তারপর আদেশের ভঙ্গিতে বলল, এদের বিদায় করো, গার্ড দুজনকে ইঙ্গিতে দেখাল সে; তারপর দেখো, কিভাবে ধূলিসাৎ করি তোমার অমূলক, বিশ্রী সন্দেহ।

তাজ্জব হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল জিয়ান মারিয়া। কাউন্টের কথাবার্তা একেবারে হতভম্ব করে দিয়েছে ওকে। আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই আর তার, অসহায় বোধ করছে ভিতর ভিতর। হাতের ইশারায় বিদায় করে দিল সে, গার্ডদের।

লোকগুলো বিদায় নিতেই শুরু করল ফ্র্যাঞ্চেস্কো, এবার, ইয়োর হাইনেস, তোমার অভিযোগ খণ্ডন করবার আগে সবটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝে নিতে দাও আমাকে। তোমার কথা থেকে যতটুকু বুঝতে পারলাম: সান্ত অ্যাঞ্জেলোতে কদিন আগে একটা চক্রান্ত হয়েছিল তোমাকে উৎখাত করে আমাকে ব্যাব্বিয়ানোর শাসক হিসেবে নিয়োগ করবার জন্যে। তোমার ধারণা, তোমার বিরুদ্ধে এই চক্রান্তে আমিও জড়িয়ে আছি আষ্টেপৃষ্ঠে। এই তো?

মাথা ঝাঁকাল জিয়ান মারিয়া।

পরিষ্কার ধরতে পেরেছ, টিটকারির ভঙ্গিতে বলল জিয়ান মারিয়া। যদি এমনি পরিষ্কার ভাবে প্রমাণ দেখাতে পার যে তুমি নির্দোষ, তাহলে মেনে নেব যে আমার অন্যায় হয়েছে।

কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমার বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত যে হচ্ছিল তা প্রমাণিত সত্য। যদিও ব্যাব্বিয়ানোর জনগণের সামনে কোনও প্রমাণ হাজির করা হয়নি। তারা যেটুকু জেনেছে, একজন লোক ইয়োর হাইনেসকে জানিয়েছে যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কোথায় সে লোক? না, মারা পড়েছে। তার কান-কথাতে নিশ্চয়ই চার-চারজন বিশিষ্ট, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে খুন করে বর্শায় গেঁথে দেয়ালের ওপর তাদের মাথা টাঙিয়ে দেয়া হয়নি? নিশ্চয়ই আরও কোনও অকাট্য প্রমাণ রয়েছে তোমার হাতে। কিন্তু তুমি সে প্রমাণ হাজির করতে পারনি, আমরা কেউ এখনও জানি না ঠিক কোন অপরাধে তারা এই চরম শাস্তি পেল।

কথা শুনে ভিতর ভিতর ঘেমে উঠল জিয়ান মারিয়া। সত্যিই তো, একজন লোকের কথা শুনেই এই কাজটা করে বসা মোটেও উচিত হয়নি। প্রমাণ চাইলে কিছুই দেখাতে পারবে না সে। কিন্তু কথার মোড়টা অন্যদিকে ঘুরে গেল দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা।

ধরে নিচ্ছি তোমার হাতে প্রমাণ আছে। নিশ্চিত না হয়ে কাউকে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু তোমার কথাবার্তায় আমার ধারণা হচ্ছে তোমার দ্বারা তাও সম্ভব। আমার বিরুদ্ধেও কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারছ না তুমি, কিছু আবছা অনুমান আর অনিশ্চিত সন্দেহের কথা বলছ কেবল। আমাকেই বলছ আমার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে। কঠোর দৃষ্টিতে চাইল ফ্র্যাঞ্চেস্কো জিয়ান মারিয়ার চোখের দিকে। যদি একান্তই শুনতে চাও, তাহলে বলি শোনো; ব্যাব্বিয়ানোর রাস্তায় আজ কিছুই কি টের পাওনি তুমি? এখনও বুঝতে পারনি, তোমাকে গদিচ্যুত করতে চাইলে চক্রান্ত করার প্রয়োজন পড়ে না আমার। আমি যদি চাইতাম, তোমার অভিযোগ যদি সত্য হতো, আজ আমি এই সিংহাসনে থাকতাম, তুমি হেঁট মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার জায়গায়। কিন্তু চাইনি। আমার নির্দোষিতার এরচেয়ে বড় আর কি প্রমাণ চাও তুমি?

ঘৃণায় জ্বলজ্বল করছে জিয়ান মারিয়ার চোখ। পাগলাটে ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠল, এটা কোনও প্রমাণ হলো না!

তাহলে প্রমাণটা তুমিই দাও না কেন? উন্মাদের প্রলাপ নয়, কল্পনা বা অনুমান নয়, অকাট্য প্রমাণ! শুনি?

হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল জিয়ান মারিয়া ওর মুখের দিকে, লাল হয়ে গেছে চেহারা, সারা শরীর কাঁপছে থর-থর করে। তার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে তারই মুখের ওপর এতবড় কথা বলার সাহস একজন লোক কি করে পায় বুঝে উঠতে পারছে না। কোন মতে বলল, সান্তি, যাও, গার্ডদের ডেকে আনে।

সবাই চেয়ে আছে জিয়ান মারিয়ার মুখের দিকে। ছাদের দিকে চেয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মামাতো ভাইকে দেখাল সে, হুকুম দিল, ওকে নিয়ে যাও! অ্যান্টিরূমে অপেক্ষা করো পরবর্তী আদেশের জন্যে।

এটাই যদি শেষ বিদায় হয়, আমি আশা করব একজন ধর্মযাজক পাঠানো হবে আমার কাছে। খ্রিস্টান হয়ে জন্মেছি, খ্রিস্টান হিসেবেই মরতে চাই।

কোনও উত্তর দিল না জিয়ান মারিয়া, মার্টিনোর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল যে চট করে একটা হাত রাখল সে ফ্র্যাঞ্চেস্কোর বাহুতে। একে একে উপস্থিত সবার মুখের দিকে চাইল বন্দী ফ্র্যাঞ্চেস্কো, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছন ফিরল, মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে ঋজু ভঙ্গিতে।

কাউন্ট বেরিয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। তারপর হেসে উঠলেন ক্যাটরিনা কোলোন্না। জিয়ান মারিয়ার মনে হলো ছুরি দিয়ে কাটছে কেউ তার স্নায়ুগুলো।

কই, সিংহ নাকি জেগে উঠেছে। এতক্ষণ তো মনে হলো গাধার ডাক শুনলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *