৫. ফ্রাইডেকে সাবধান

ফ্রাইডেকে সাবধান করে দিলাম। যেন সূর্য ডোবার আগে কোনো কিছু না করে। হাতে এখনো অঢেল সময়। আর বেলা বাড়ছে একটু একটু করে। আমাদের খাওয়া দাওয়া মায় দৈনন্দিন কাজ সব পণ্ড। তাকিয়ে আছি একই ভাবে। দেখতে দেখতে দুপুর। গগনে রোদ। সূর্য লাফ দিয়ে মাথার উপর উঠল। আর কি পারে রোদের প্রচণ্ড তাপ অগ্রাহ্য করে ঘুরে ঘুরে দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বেড়াতে। প্রচণ্ড কাহিল তখন। শুয়ে পড়ল আটজন গাছের ছায়ায়। সেই নৌকোর ঘুমন্ত নাবিকটিও এক ফাঁকে উঠে এসেছে। বন্দী তিনজনও বসেছে এক গাছের ছায়ায়। মোটমাট কাউকে আর এতদূর থেকে দেখা যায় না। গাছের আড়ালে সবাই ঢাকা পড়ে গেছে।

তখন নামলাম পাহাড়ের মাথা থেকে। যেখানে বসে বা শুয়ে আছে ওরা সেটা এখান থেকে পোয়া মাইল মতো দুর। ঘন জঙ্গল। আর বিস্তর ঝোঁপঝাড়। ইচ্ছে করছে যাই চুপিচুপি, অন্তত কে ওরা, কী ওদের মতলব সেটা একবার জেনে আসি। আমি তো আর কথা বলব না ওদের সাথে, ওরা নিজেরা নিজেরা কিছু না কিছু বলবে, আমি আড়ি পেতে শুনব। শুনে তবে তো সেই মতো ব্যবস্থা! আগে থেকে কিছু না জেনে নিছক অনুমানের উপর নির্ভর করে কি আর কিছু সিদ্ধান্ত টানা যায়।

রওনা দিলাম। সে ভারি নিঃশব্দ নিস্ফুপ। ফ্রাইডে আসছে পিছু পিছু। বলেছি খবরদার এতটুকু শব্দ যেন না হয়। কিছুতে আমাদের কিন্তু দেখা দেওয়া চলবে না। অস্ত্র দুজনের হাতেই তৈরি। কোমরেও ঝোলানা পিস্তল আর তরবারি। আরো দুটো করে বন্দুক দুজনের পিঠে। তাতে গুলি বারুদ আর সীসে ভরা।

ভাগ্য ভালো, আরো খানিকটা এগিয়ে দেখি সেই তিনজন। বিরস বদন। শোয় নি কেউ, বসা। এ অবস্থায় পারে কি কেউ নিশ্চিন্তে শুয়ে বিশ্রাম করতে! অন্তত আমার অনুমান যদি ঠিক হয়। দেখি ওরা বেশ খানিকটা দূরে। মাঝখানে জঙ্গল আর ঝোঁপ ঝাড়। তখন পা টিপে টিপে আরো কাছে গেলাম। বলতে গেলে হাতের নাগালে তিনজন। ফ্রাইডে ঠিক আমার পাশে তারপর গলার স্বর যতদূর সম্ভব নামিয়ে স্পেনের ভাষায় বললাম, কে আপনারা? কী পরিচয়?

অমনি চমকে উঠেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল আমাদের। যেন মানুষ নই আমরা, ভূত। ভূত দেখলে যেমন হয় সেরকমই চোখ মুখের ভাব। মুখ চুপ। যেন ভুলে গেছে কথা বলতে। হয়ত এখুনি উঠে দৌড় দেবে। তখন ইংরিজিতে বললাম, ভয় নেই। আমাকে দেখে অবাক হবেন না। আমি আপনাদের বন্ধু। আমার উপর নির্ভর করতে পারেন।

তখন একজন বলল, আপনি কি দেবদূত?

বললাম, না, আমি মানুষ।

–কিন্তু আমাদের যা অবস্থা এ তো মানুষের এক্তিয়ারের বাইরে।

বললাম, মানুষ ঈশ্বরেরই প্রেরিত জীব। আপনি বলুন, কেন আপনারা এখানে? আপনাদের পরিচয়।

বলল, আমাদের অনন্ত বিপদ।

বললাম, জানি। যখন নৌকা থেকে নামলেন আমি দেখেছি। একজন আপনাকে মারবে বলে তরবারি তুলেছিল। আপনার প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও হয় নি।

তখন কান্না। সে যা চোখের জল! বিমোহিত অবস্থা তখন। আমাকে ধরেই নিয়েছে ঈশ্বরের প্রেরিত কোনো দূত। মাথার টুপি খুলে আমাকে সম্মান জ্ঞাপন করল।

বললাম, আমি ঈশ্বর নই। দেবদূতও নই। আমি আপনারই মতো রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ। ঈশ্বর বা দেবদূত হলে আমার পরনে স্বাভাবিক পোশাক থাকত। এগুলো ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। এই কোমরের বেল্ট অব্দি। সে অনেক ইতিহাস। পরে সম্ভব হলে শোনাব। বর্তমানে এইটুকু শুনে রাখুন আমি ইংরেজ। এখানে এসেছি আপনাদের সাহায্য করতে। ও আমার সহচর। আমাদের সাথে বন্দুক আছে। নির্ভয়ে বলুন এবার কি আপনাদের সমস্যা।

তখন বলল, তবে সংক্ষেপে বলি। ওরা খুনী। বেশি কিছু বলার হয়ত সময় পাব না। ঐ জাহাজের আমি কাপ্তেন। ওরা নাবিক। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। আমাকে হয়ত খুনই করত। শেষে কী মনে করে নিয়ে এসেছে এখানে। এই নির্জন নিরালা দ্বীপে। আমাদের নির্বাসিত করবে। ও আমার সহকারী। আর উনি একজন যাত্রী। এরা বিদ্রোহের প্রতিবাদ করেছিল। তাই এই শাস্তি। জানি না ভাগ্যে কী আছে।

বললাম, ওরা কি সবাই ওখানে?

–হ্যাঁ। শুয়ে আছে। বিশ্রাম করছে। বিকেল নাগাদ ফিরে যাবে জাহাজে। আমার ভয় করছে। যদি ওরা শুনতে পায় আমি কথা বলছিলাম আপনার সঙ্গে তবে হয়ত আর আস্ত রাখবে না। খুন করে ফেলবে।

–কটা বন্দুক আছে ওদের সাথে?

–দুটো। আর তলোয়ার।

বললাম, বেশ বাকিটা তাহলে আমার উপর ছেড়ে দিন। যা করার আমি করব।

করণীয় এখন দুটো। হত্যা করতে পারি একধারসে সবাইকে, নয়ত বন্দী করতে পারি। দ্বিতীয়টাই আমার বেশি মনঃপূত। কিন্তু করব কীভাবে।

কাপ্তেন বলল, দুজন আছে দলে তারা মারাত্মক। ভীষণ নিষ্ঠুর। করতে পারে না এমন কাজ নেই। যদি ঐ দুজনকে শায়েস্তা করা যায়, তবে বাকিরাও শায়েস্তা হবে। সুড়সুড় করে কাজে গিয়ে যোগ দেবে।

বললাম, কারা তারা দেখিয়ে দিন।

বলল, এতদুর থেকে তো দেখানো সম্ভব নয়। পরে সুযোগ পেলে আমি চিনিয়ে দেব।

বললাম, যা আমি করতে বলব করবেন?

বলল, একশাবার। আপনার প্রতিটি আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।

বললাম, তবে আর একটু ওধারে চলুন। কথা আছে। ফন্দী আঁটতে হবে। যাতে শুনতে না পায় ওরা সেই ব্যবস্থা আগে করা যাক।

তখন অতি সন্তর্পণে আমরা পিছিয়ে এলাম। জঙ্গলের আরো কিছুটা গভীরে। নিরাপদ এখন। অন্তত শোনা তো দূরের কথা, আমাদের দেখতেও আর পাবে না।

বললাম, একটা প্রশ্ন গোড়াতেই করে নিই। আপনাদের আমি জীবন রক্ষার দায়িত্ব নিলাম। কিন্তু দুটি শর্তে। আপনারা কি কোনোরোম শর্ত মানতে প্রস্তুত?

বলল, নিশ্চয়। জীবনের বিনিময়ে যে কোনো শর্তে তারা রাজি। তাদের জাহাজ, তারা তিনজন সব এর পর থেকে আমারই কর্তৃত্বে আসবে। অর্থাৎ আমি যা বলব তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে তারা সকলে। এর এতটুকু অন্যথা হবে না।

বললাম, তথাপি শর্ত দুটি প্রকাশ্যে বলে রাখার প্রয়োজন আছে। প্রথম শর্ত এই দ্বীপে যে কদিন বা যতদিন আপনারা থাকবেন, আমার নির্দেশ না মেনে কোনো কাজ করতে পারবেন না। যদি আমি আপনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিই তবেই পারবেন অস্ত্র ব্যবহার করতে। নিজের খেয়াল খুশিতে নয়। এককথায় দ্বীপে থাকাকালীন আপনারা আমারই একান্ত অনুগত।

দ্বিতীয় শর্ত : যদি জাহাজ উদ্ধার করতে পারি তবে আমার লোকজন সমেত আমাকে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য ভাড়া বাবদ কোনো খরচ আপনি দাবী করতে পারবেন না। এখন ভেবে বলুন, এই দুটি শর্তে আপনাদের কোনোরকম আপত্তি আছে কিনা।

মেনে নিল সব। সে যে কত ভাবে কত কথায় আমার প্রতি নিঃশর্ত আস্থা জ্ঞাপনের চেষ্টা! আমি অভিভূত। বললাম, ঠিক আছে। আমি আপনাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছি। এবার কাজের কথায় আসা যাক। এই নিন তিন জনের জন্যে তিনটে বন্দুক। এতে গুলি বারুদ ভরা আছে। এবার চলুন ওরা যেখানে আছে সেখানে যাই। যদি ঘুমিয়ে থাকে আমাদের পক্ষে মঙ্গল। সেই অবস্থাতেই এক সাথে পঁচজন গুলি ছুডব। কেউ হয়ত মারা যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা নিরুপায়। মারবার ইচ্ছে আমাদের নেই। তবে একজনের মৃত্যু যদি বাকিদের প্রভাবিত করে, যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। সেক্ষেত্রে সেটাই সবচেয়ে ভালো।

কাপ্তেনেরও দেখলাম একই ধরনের ইচ্ছে। শুধু সেই দুই পাষণ্ডকে নিয়ে অত্যন্ত ভাবিত। তারা যথার্থ পক্ষে দুষ্ট প্রকৃতির। তারা যদি মরে তবে তার বিন্দুমাত্র দুঃখ কি ক্ষোভ নেই।

বললাম, সেটা অবস্থা বুঝে ঠিক করা যাবে। ঘটনা যেমন হবে সেই মতো আমরা কাজ করব, সিদ্ধান্ত নেব। আপাতত চলুন এগোই। আর দেরি করা ঠিক নয়।

বলে এগোতে যাব, দেখি একজন ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর আরো একজন। দেখতে পাচ্ছি তাদের এখান থেকে স্পষ্ট। বললাম, এই দুজন কি সেই পাষণ্ড? বলল না। এরা নয়।–তবে এদের আমরা এতটুকু ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে পারি। আমি বললাম, কিন্তু তা বলে কারোর ক্ষতি হবে না, গায়ে একটু আঁচ লাগবে না এটা ভাবলে কিন্তু মুশকিল। সেক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী হবে না।

তখন এগোল তারা তিনজন। আমি আর ফ্রাইডে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা পিস্তলও দিয়েছি কাপ্তেনকে। খানিক দূর গিয়ে তিনজনের মধ্যে একজন হাতে তালি দিল। তাতে চকিতে ঘুরে দাঁড়াল সদ্য জাগ্রতদের একজন। চিৎকার করে ডাকল বাকিদের। ততক্ষণে বন্দুক গর্জে উঠেছে। নির্ভুল নিশানা। লুটিয়ে পড়ল একজন মাটিতে তৎক্ষণাৎ। বাকি জন যথেষ্ট আহত। ছিটকে পড়ল মাটিতে। কিন্তু পর মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াল। ডাকল প্রাণপণ চিৎকারে সবাইকে। কানে এগিয়ে গেল। হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। বলল, এবার ঈশ্বরকে ডাক। বলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারল তার মাথায়। মুহূর্তে প্রাণ হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে আরো তিনজন। বন্দুকের ছররার আঘাতে তারাও অল্পবিস্তর জখম। আর দেরি করা ঠিক না। তখন আমি আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এলাম।

অবাক তারা। স্তম্ভিত। সব জারিজুরি মুহূর্তে খতম। আতঙ্কে চোখ ছানাবড়া। সেই অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সামনে। ক্ষমা প্রার্থনা করল। কাপ্তেন বলল, ক্ষমা করতে পারে, তবে এক শর্তে। ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করতে হবে দুশমনদের সঙ্গে হাত মেলাবে এবং সেই সাথে দুশমন কর্তৃক অধিকৃত জাহাজ পুনরুদ্ধারের জন্যে যা যা করণীয় সব করতে হবে। জাহা জামাইকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্বও তাদের। তারা কি রাজি? বলল, রাজি। জীবনের বিনিময়ে তারা সব কিছু করতে রাজি। আমরা তাদের উপর পরিপূর্ণ নির্ভর করতে পারি।

বলাবাহুল্য, শুধু মুখের কথার উপর নির্ভর করা যায় না। বিশেষ করে একটু আগে যাদের ওরকম মারমুখী চেহারা। আমরা তাই সব দিক বিবেচনা করে তাদের হাত পা বেঁধে বালির উপর ফেলে রেখে দিলাম।

ফ্রাইডে আর কাপ্তেনের সহকারীকে পাঠালাম নৌকোটার দিকে। বললাম, পাল দাঁড় হাল সব যেন খুলে নিয়ে আসে। গেল তাই। ইতোমধ্যে দেখি আরো তিনজন গুটি গুটি আমাদের সামনে হাজির। কী ব্যাপার, কী চাই তোমাদের? বলে বন্দুক তুললাম। অমনি হাত জোড় করে সে কী অনুনয় বিনয়! হকচকিয়ে গেছে তো কাপ্তেনকে দেখে। সঙ্গে আবার আমার মতো একটা অচেনা মানুষ। কিছুক্ষণ আগের বন্দী এখন থেকে বন্দুক হাতে তাদেরই উপর খবরদারি করার জন্যে দণ্ডায়মান। বলল, আমাদের দয়া করুন। জীবন হানি ঘটাবেন না। আমরা আপনার হয়ে সব কিছু করতে রাজি।

তখন তাদেরও হাত পা বাঁধলাম। ফেলে রেখে দিলাম প্রথম কজনের পাশে। আমরা বিজয়ী এটা এখন নিদ্বিধায় বলা যায়। সব কটি শক্ৰই পর্যুদস্ত। বলতে গেলে খুব সামান্য রক্তপাতেই এতবড় বিজয় পর্ব সমাধা হল।

নিরুদ্বিগ্ন এখন। বসলাম আমি আর কাপ্তেন মুখোমুখি। পরস্পরের খবরাখবর নিতে। প্রথমে বললাম আমি আমার নিজের কথা। শুরু থেকে এই দীর্ঘ সাতাশ বছরের ইতিহাস। একাগ্র মনে শুনল। আর ক্ষণে ক্ষণে বিস্ময়ে বিমূঢ় ভাব। বিশেষ করে গোলবারুদ রক্ষার ইতিবৃত্ত শুনে তো রীতিমতো হতবাক। আর সত্যি বলতে কি তার মতো মানুষের পক্ষে এতটা ভাবাও যে কষ্টকর। পারবে কীভাবে সুখী সুস্থ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে এবংবিধ রোমাঞ্চকর অদ্ভুত ঘটনাবলী ভাবতে! শুনে শ্রদ্ধায় সৌজন্যে বিগলিত ভাবে বলল, আপনি না থাকলে এই শয়তানরা আমাকে মেরে ফেলত। আমি হলফ করে বলতে পারি। বলে কাঁদতে লাগল।

তখন সান্ত্বনা দিলাম। তাকে আর তার সঙ্গী দুজনকে নিয়ে গেলাম আমার আস্তানায়। খাদ্য দিলাম। পানীয়। দেখালাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু। দেখে তো তাজ্জব। যেন কথা সরে না মুখে। আর ক্ষণে ক্ষণে সে কী উচ্ছ্বসিত প্রশংস, সে কী তারিফ!

বিশেষ করে ঐ যে লোকচক্ষুর আড়াল–ঐ চারপাশে ঘন গাছগাছালি, আমি বিশ বছর আগে লাগিয়েছি গাছ, বড় হয়েছে এতদিন ধরে, এ তো আর ইংল্যান্ড নয় যে ধীরে ধীরে গাছ বাড়বে, এখানে খুব দ্রুত এর বৃদ্ধি, কুঞ্জ বলতে যা বোঝায়–বলল, এটা ভারি চমৎকার। আপনি এইভাবে নিজেকে চারদিক থেকে আড়াল করে যথেষ্ট বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন। তখন হাসতে হাসতে বললাম, এত দেখেছেন। একটা, এর চেয়ে আরো গোপন আরো লুক্কায়িত আমার আরেকটা বাড়িও আছে। সেটাকে আমি বলি বাগান বাড়ি। রাজা বাদশাদের যেমন থাকে। সেটা পরে দেখাব। তবে এখন আমাদের কাজ হল কীভাবে জাহাজটা উদ্ধার করা যায় তার একটা ফন্দী বের করা। আপনি কী কিছু ভেবেছেন?

বলল, আমি ভাবব কী! আমার তো কিছুই মাথায় খেলছে না। এখনো ছাব্বিশজন বিদ্রোহী নাবিক জাহাজে রয়েছে। ওরা কি আর সহজে আমাদের শর্ত মেনে নেবে? জানে যে মেনে নেবার হাজারো বিপদ। চক্রান্তের অভিযোগে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে প্রত্যেকের ফাঁসি অব্দি হয়ে যেতে পারে। কে আর চায় সুস্থ শরীর ব্যস্ত করতে। মোটমাট, ওরা কিছুতে ছেড়ে কথা বলবে না। সে অবস্থায় কী যে আমাদের করণীয় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

কিন্তু তা বলে তো আর বসে থাকলে চলে না। দ্রুত যাহোক একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত এই কারণে কেননা দেরি করলে ঘোর বিপদ। কিছু ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়। জাহাজে যারা আছে, তারা যখন দেখবে তাদের সাকরেদরা ফিরে আসছে না তখন ভিতরে ভিতরে ভীষণ চঞ্চল হবে। কী হল তাদের দেখার জন্যে এখানে আসবে। নির্ঘাৎ ভালো যে কিছু ঘটে নি সেটা অনুমান করেই আসবে। সঙ্গে থাকবে বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র। সে অবস্থায় আমাদের মুখোমুখি পড়ে যাবারই সম্ভাবনা যথেষ্ট এবং তার অর্থ আমাদের পরাজয়। কেমন করে আমরা চারটে মানুষ পেরে উঠব ছাব্বিশজন সশস্ত্র মানুষের সঙ্গে!

বললাম, আপাতত এই মুহূর্তে একটাই করণীয়। তা হল কূলে ওদের যে নৌকোটা পড়ে আছে, তাকে অকেজো করে দেওয়া। ফুটো করে দেব নিচে। তাতে জল উঠবে। নৌকো নিয়ে জাহাজে ফিরে যেতে পারবে না।

সেটাই করলাম। নৌকোয় উঠে যা সব জিনিস ছিল আগে নিয়ে এলাম। যেমন কটা বন্দুক। পানীয়ের বোতুল। কিছু বিস্কুট। বারুদের একটা প্যাকেট। চিনি অনেকখানি। আর এক বোতল ব্রান্ডি। এর মধ্যে ব্রান্ডি আর চিনি পেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেলাম। সাতাশ বছর এই দুটি জিনিসের স্বাদ পরখ করার সুযোগ হয় নি। হয়ত ভুলে গেছি খেতে কীরকম লাগে।

মালপত্র নামিয়ে নৌকোর খোলে করলাম মস্ত একটা ফুটো। নিশ্চিন্ত এখন। যদি অন্য নৌকোতে করে আসে এখানে এবং আমাদের যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দী করে, সে অবস্থায় সবাই মিলে একটা নৌকোয় করে জাহাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। দ্বীপে কাউকে না। কাউকে রেখে যেতেই হবে। তখন কী করা সম্ভব সেটা চিন্তা করে বের করতে হবে।

তবে অন্য একটা ব্যবস্থাও ওরা নিতে পারে। যদি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারে সঙ্গীরা পড়েছে বিপদে, সে অবস্থায় তাদের ফেলে রেখেই জাহাজ নিয়ে ওরা রওনা হয়ে যাবে। ভুলেও দ্বীপের দিকে আসার চেষ্টা করবে না। যদি সেরকম বুঝি তখন কী করব আমরা? মনে পড়ল তখন স্পেনীয় নাবিকদের কথা। দলে মোট সতের জন। খবর দিয়ে তখন নয় তাদের ডেকে আনব। আর যদি ইতোমধ্যে এসে পৌঁছয় তবে তো কথাই নেই। হল তখন মোট বাইশজন। ফ্রাইডের বাবাকে ধরে। বাইশজন পারব না কি ছাব্বিশটা দুশমনের সাথে পাল্লা দিতে?

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঠেলে ঠেলে নৌকোটাকে ভাঙার উপরে তুললাম। নিরাপদ দূরত্ব বলা যায়। প্রবল স্রোতও পারবে না ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। ভারি ক্লান্ত তখন চারজনই। বসে বিশ্রাম করছি। হঠাৎ শুনি জাহাজ থেকে গুলির শব্দ। যতদূর অনুমান নৌকোর উদ্দেশে সঙ্কেত ধ্বনি। দূরবীন লাগালাম চোখে দেখি ফের ছুড়ল গুলি। ফের। কিন্তু নৌকোর তো এক চুলও নড়ার নাম নেই। তখন দেখি কজন মিলে কি জল্পনা কনা হল। এক জন নির্দেশ দিল আরেকটা নৌকো জলে নামাতে নামাল সেটা জলে। উঠল তাতে মোট দশজন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র। আসছে সোজা এই দিকেই।

প্রতিটি মুখ এখান থেকে বলতে গেলে স্পষ্ট। চিনতে বা বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয় না। চেনে তো কাপ্তেন সকলকে। আমাকে চিনিয়ে দিল একে একে। ঐ যে দেখছেন তিনজন, ঐ পাশাপাশি, ডানদিকে–ওরা নির্দোষ। ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায়। তবে নিরুপায় এই শয়তানদের হাতে পড়ে। জোর করে ওদের বাধ্য করেছে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্তে অংশগ্রহণ করতে। বাকিরা সব বদমাশ।

বদমাশই বটে। মুখ দেখে চেনা যায়। রুক্ষ দুর্বিনীত গোছের ভাব। চোখে সারা রাজ্যের হিংসা আর শয়তনী। গায়ে শক্তি থাকুক আর না থাকুক, হাতে আছে অস্ত্র আর মনে বিদ্বেষ। এই দুটোকে সম্বল করে লড়বে আমাদের সাথে মরিয়ার মতো। আমরা কি পারব?

কিন্তু সেকথা তো আর বলা যায় না। তাতে হতাশ হয়ে পড়বে কাপ্তেন। বললাম, এই যে আসছে ওরা, কী করবেন এখন বলুন। বলল, আপনি যা বলবেন তাই। বললাম, সেটা তো নির্ভরশীলতার কথা। আপনার জীবন রক্ষা করেছি বলে কি আপনি ভাবছেন আমি ঈশ্বর? আমার অসীম ক্ষমতা আছে? বলল, তাহলে কী করণীয় এখন? বললাম, একটা কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। যে দশজন আসছে তাদের মধ্যে যারা সৎ-প্রকৃতির তাদের আমি এতটুকু আঘাত করতে চাই না। সে অবস্থায় তারা পরে আমাদেরই দল ভারি করবে। কিন্তু যারা দুশমন, তাদের সঙ্গে কোনো আপোষ নয়। হয় এসপার নয় ওসপার। দরকার হলে জান নেব। যদি মরতে হয় তা-ও সই। তবু ছাড়ব না কাউকে।

বেশ মনঃপূত হয়েছে আমার কথা। দেখি চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। কিন্তু বসে থাকা তো চলবে না। আসছে ওরা। আমাদের যা করণীয় এই বেলা করে ফেলতে হবে। লেগে পড়লাম অমনি কাজে।

বন্দীরা একইভাবে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। সবচেয়ে আগে ওদের সরাতে হবে। দুজনকে পাঠিয়ে দিলাম ফ্রাইডের সাথে। বদমাশ এরা। কানে বলল, বড় অসৎ স্বভাব। তিনজনকে রেখে এলাম গুহায়। ভিতর দিকের ঘরে। সেটা একই সঙ্গে নিরাপদ এবং নিরিবিলি। চিৎকার চেঁচামেচি করলেও কেউ শুনতে পাবে না। অবিশ্যি কানে যা বলল তাতে এরা গোলমাল পাকাবার লোক নয়। মোটের উপর শান্ত প্রকৃতির। দলে পড়ে হালফিল বদমায়েশী শিখেছে। সামান্য ভয় ডরও দেখালাম। দেখ বাপু, পালাবার চেষ্টা যদি কর, নিজেরাই বিপদে পড়বে। শাস্তি সেক্ষেত্রে মৃত্যু। গুলি করে একেকটাকে খতম করব। আর যদি চুপচাপ থাক, দু তিনদিনের মধ্যে ছাড়া পাবে। এটা মুখের কথা নয় প্রতিজ্ঞা। এই দ্বীপের অধিকারী যেহেতু আমি, আমার প্রতিজ্ঞার নড়চড় হবে না। বলে খাবার দাবার হাতের কাছে ধরে দিলাম, জল দিলাম। বলল, আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ভুলেও পালাবার চেষ্টা করব না। আপনার দয়ায় আমরা নিজেদের সঁপে দিয়েছি। হ্যাঁ, আলোও দিলাম। একটা মোমবাতি। আর সকলের অজ্ঞাতসারে ফ্রাইডেকে দাঁড় করিয়ে রাখলাম গুহার মুখে। অর্থাৎ প্রহরী। এতৎসত্বেও যদি কোনোরকম বেগড়বাই কবে, ফ্রাইডে তার উপযুক্ত জবাব দেবে।

ফ্রাইডের হাতে দিয়েছিলাম যে দুজনকে, তারা খাবার দাবার কিছু পেল না। এমনকি গুহার একটু আচ্ছাদনীও না। আমার আস্তানার একটু দূরে খোলা মাঠে পিছমোড়া করে হাত পা বাঁধা অবস্থায় তাদের ফেলে রাখা হল। এরা যেহেতু শয়তান, এটাই তাদের উপযুক্ত শাস্তি।

দেখেশুনে দুই বন্দীর অবস্থা তো কাহিল। কত অনুনয় বিনয়, কত আর্জি। বললাম, বেশ, তবে আমাদের কথা শুনবে এই প্রতিজ্ঞা কর। ঈশ্বরের নামে কসম খাও। তাই করল। তখন বাঁধন খুলে দিলাম। বলল, আপনারা যদি মরতে বলেন তা-ও আচ্ছা, তবু জানব সৎকাজের জন্যে লড়াই করে মরেছি। আমরা আর ওদের দলে নেই। তা হলাম একুনে চার। আর তিনজন তো আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছে। সব মিলিয়ে সাত । সবাইকে ভাগ করে দিলাম বন্দুক আর বারুদ। সশস্ত্র এখন। গোটা দলের নেতৃত্ব আমার হাতে। আর যা মনের জোর আমাদের–আসুক না দশ কি বিশ জন, হাসতে হাসতে পারব তাদের মহড়া নিতে।

নামল এসে কুলে। লাফ দিয়ে পড়ল একে একে দশজন। নৌকো টেনে তুলল বালির উপর। এটা আমার পক্ষে মঙ্গল। কেননা আমি ভেবেছিলাম হয় তো নোঙর ফেলে জলের উপরই রাখবে। সেক্ষেত্রে নোঙর তুলে ভেসে পড়া অনেকখানি সময়ের ব্যাপার। দুতিনজনেক দাঁড় করিয়ে রাখল নৌকোর কাছে পাহারায়। বাকিরা ছুটে গেল প্রথম নৌকোটার দিকে।

অর্থাৎ সেই যে বন্দীদের নিয়ে এসেছিল নৌকো। আমরা তো আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। দেখে তা অবাক। একি, এ যে ফুটো! দেখি কী যেন বলা বলি করছে নিজেদের মধ্যে।

তারপর ডাঙার দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে ডাক দিল। সঙ্গীদের উদ্দেশে ডাক। ফিরে এল ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে। সাড়া কেউ আর দেয় না। তখন একসাথে অনেকগুলো বন্দুক দাগল। গুড়ুম গুড়ুম–সে যেন এক ঝাক গর্জন। সেটা নিষ্ফল। যতদূর অনুমান দুজন মাত্র শুনেছে সেই আওয়াজ। যারা পড়ে আছে খোলা মাঠে। কিন্তু শুনে। লাভ কী। সাড়া দিলে তো আর এরা শুনতে পাবে না। উঠে যে চলে আসবে এদের সহায়তা করতে তারও উপায় নেই। আর গুহার মধ্যে যে তিনজন তারা তো যাবতীয় শ্রবণের বাইরে। অতগুলো দরজা ভেদ করে কিছুতে পৌঁছবে না তাদের কানে গুলির আওয়াজ।

ফলত তারা অবাক। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চোখ মুখ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব। কী যেন আলোচনা করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দেখি হুড়মুড়িয়ে উঠল গিয়ে নৌকায়।

কাপ্তেন তো থ। আমাকে কেবল বলে একি হল, চলে যাচ্ছে যে ওরা! হয়ত ভেবেছে, সঙ্গীরা সকলেই নিহত। সে অবস্থায় জাহাজে ফিরে গিয়ে বাকিদেরকে বলবে, ওরা কেউ বেঁচে নেই, চল আমরা এবার নোঙর তুলে রওনা দিই। তাতে ওদের বরং লাভ, আমাদেরই ক্ষতি। গেল তো জাহাজ! আমরা তো নির্বাসনেই পড়ে রইলাম।

চিন্তাটা যে আমার মাথাতেও নেই তা নয়। তবু ধীর স্থির আমি। অত চঞ্চল হলে আমার চলবে কীভাবে! আমি না এখন নেতা! তা বসে রইলাম একইভাবে। দেখি একটু পরে নৌকা নিয়ে আবার কূলের দিকেই ফিরে আসছে। জানি না কী মতলব। তবে দেখলাম, তিনজনকে নৌকায় বসিয়ে রাখল। বাকিরা চলল বনবাদড় ডিঙিয়ে সঙ্গীদের পাত্তা লাগাতে। অর্থাৎ গিয়ে যে বলবে সকলেই মারা গেছে, এটা অনেকের মনঃপূত হয় নি। জাহাজের বাকি লোকেরা তাতে ওদেরকেই সন্দেহ করবে। সেটা ওরা অনুমান করতে পেরেছে।

আমরা তো উভয় সঙ্কটে বলতে যা বোঝায় তাই। কী করি এখন! কোনদিকে যাই! যদি গিয়ে ভাঙার ঐ সাতজনকে ঘায়েল করি, তবে এদিকের তিনজন নৌকো নিয়ে পালাবে। জাহাজে গিয়ে জানিয়ে দেবে সব, নোঙর তুলে অমনি ওরা সটকে পড়বে। তাতে আমাদের উদ্ধারের আশা বরবাদ। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তখন সাতটা পেট বাড়ল। মারতে তো আর পারব না এদের সকলকে। তখন নাও এদের জন্যে চাষবাষ থেকে যায় রান্নাবান্না, বাসন ধোওয়া শুরু কর!

কী করণীয় তাহলে?

মন বলল, ধৈর্য ধর। দেখ অগ্রপশ্চাৎ সব কিছু বিবেচনা করে। তারপর সিদ্ধান্ত নাও।

অতএব বসে রইলাম চুপচাপ।

সাতজন গেল পাহাড়ের দিকে। সেই পাহাড়ের নিচেই আমার বসতি। বাকি তিনজন নৌকোটাকে নিয়ে গেল বেশ খানিকটা দূরে। তারপর নোঙর ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল।

সাতজনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চলছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মনে নিদারুণ ভয়। উঠবে পাহাড়ের মাথায়। সেটা একপক্ষে ভালো। আমাদের কাছাকাছি হতে হবে। গুলির নাগালের মধ্যে। তখন প্রয়োজনবোধে গুলি চালিয়ে কটাকে জখম করতে পারব।

আর যদি পাহাড় থেকে নেমে দূরে কোথাও যায়, সেটাও আমাদের পক্ষে মঙ্গল। যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ পাব তখন এই তিনজনকে কাবু করার। মনে প্রাণে সেটাই চাই।

উঠল পাহাড়ের মাথায়। ঘুরে ঘুরে দেখছে চারদিক। দূরের দিকেই নজর। তাই পায়ের গোড়ায় আমার বসতি দেখতে পাচ্ছে না। দেখার মনও বোধ হয় নেই। ডাকাডাকি শুরু করল বন্ধুদের নাম ধরে। রীতিমতো চিৎকার। কিন্তু কে দেবে সাড়া! হতাশা তখন নেমে এল ধীর পদক্ষেপে। একটা গাছের নিচে বসল। ঘুমোবে নাকি? সেই যেমন আগের দল ঘুমিয়ে পড়েছিল? তবে আর পায় কে আমাদের! অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দী করব সবাইকে। কিন্তু না, ঘুমোবার ধারকাছ দিয়েও গেল না। ভয় যে মনে। আর ত্রস্ত শঙ্কিত ভাব। কোন দিক থেকে বিপদ আসবে বলতে তো কেউ পারে না। সেই মন নিয়েই থম মেরে বসে রইল।

কাপ্তেন বলল, আমার মাথায় একটা মতলব খেলছে। ওরা হয়ত একটু পরে ফের বন্দুক ছুঁড়ে দলবলকে জানান দেবার নতুন একটা চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে আমরা যদি ওদের কাছাকাছি এগিয়ে যাই, তবে নতুন করে বন্দুকে বারুদ পুরবার আগে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ব ওদের উপর, এতটুকু রক্তক্ষরণ না করে সকলকে বন্দী করব।

মতলব হিসেবে চমৎকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ওরা বন্দুক চুডল না। তখন হতাশ হয়ে নতুন চিন্তা করতে বাধ্য হলাম। ফন্দী একটা এসেছে মাথায়। কিন্তু সেটা দিনমানে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। সন্ধে ঘনাক। ততক্ষণে যদি তারা নৌকোয় গিয়ে ওঠে, তবে আমরা যে সফল হব এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

সে যেন ধৈর্যের রীতিমতো পরীক্ষা। বসে আছি একভাবে। নড়াচড়া বন্ধ। অস্বস্তি হচ্ছে। আর ভয় যদি সন্ধের আগেই ওরা রওনা হয়ে যায়! সেটা অবিশ্যি না হবারই সম্ভাবনা। কেননা স্রোত শান্ত হতে হতে সন্ধে কাবার। তবে যদি মরিয়া হয়ে স্রোত অগ্রাহ্য করে ওরা আগে ভাগে রওনা হয়, সেটা আলাদা কথা।

করল তাই। যা ব্যতিক্রম সেটাই আপাতত ওদের কাছে বিধি, উঠে পড়ল হঠাৎ। এদিকে সন্ধেও প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। ঘোর ঘোর ভাব। এগোচ্ছে কৃলের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা যাকে বলে হতভম্ব। কিন্তু কী করা যায়? এ অবস্থায় যেমন করে হোক ওদের ফিরিয়ে আনতে হবে। কিছুতে চলে যেতে দেওয়া উচিত নয়। উঠলাম গোপন জায়গা থেকে। কাপ্তেনকে নিয়ে গেলাম ফ্রাইডের কাছে। বললাম,এক কাজ কর। তুই আর কাপ্তেনের এই সহকারী দুজন মিলে চলে যা সেই নালাটার কাছে। সেখান থেকে ইক দে। এমন ভাবে যেন ওরা শুনতে পায়। ওরা ধরে নেবে ডাকছে ওদের হারানো সঙ্গীরা। সেক্ষেত্রে যাবে না ওরা, ফিরে আসবে।

স্বভাবতই ডাক লক্ষ্য করে এগোবে তখন। ক্রমশ পিছিয়ে যাবে ডাক। এই ভাবে গহীন জঙ্গলে ওরা প্রবেশ করবে। অর্থাৎ যে কোনোভাবে হোক নৌকোর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে ওদের। সেটাই আমাদের কাজ। তারপর যা করার আমরা করব।

হল তাই। নৌকায় উঠতে যাবে ওরা,শোনা গেল ডাক। অস্পষ্ট জড়ানো সেই ধ্বনি। ওরা থমকে দাঁড়াল। সাড়া দিল। বিমূঢ় ভাব। তখন ফের ডাক। তখন তৎপর হল। শুনল কান খাড়া করে। আসছে পশ্চিম প্রান্ত থেকে। নালাটা সে দিকেই। কিন্তু যাবার যে উপায় নেই। তখন নৌকোর মুখ ঘোরাল। উঠল নৌকোয়। ছপা দুপাৎ দাঁড় ঠেলে নৌকো এগিয়ে চলল নালার দিকে।

ঢুকল নালায়। দেখতে পাচ্ছি সব। নৌকো ভেড়াল খাড়িতে। আমরা চুপ। মোট আটজন নামল। রইল দুজন। নৌকো বাঁধল শক্ত করে একটা গাছের গুঁড়িতে। তারপর আটজন জঙ্গলের দিকে এগুলো।

ফ্রাইডে আর কাপ্তেনের সহকারীকে রেখে আমরা দলবল চুপিচুপি ঘুরপথে ডিঙিয়ে এধারে এলাম। ততক্ষণে নৌকোর দুজনের একজন নেমে পড়েছে ডাঙায়, সটান চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থা। অতর্কিতে একলাফে পড়লাম গিয়ে তার সামনে। পায়ের আওয়াজে চমকে উঠল। তখন কাপ্তেন মারল বন্দুকের কুঁদে দিয়ে এক ঘা। মূহুর্তে সে চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান। তখন নৌকোর বাকি আরোহীর দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরল। বলল, নেমে আয় নয়ত এক গুলিতে তোর জান নিয়ে নেব।

নেমে আসবে না সে সাহস কি আর তার আছে। চোখের সামনে দেখল সাথীর ঐ অবস্থা। আর কি মনে এতটুকু জোর পায়! সুড়সুড় করে নেমে এল নৌকা থেকে। অস্ত্র কাপ্তেনের হাতে তুলে দিল। হাটু গেড়ে বসল তার সামনে। কসম খেল। মোটের উপর বদমাশ লোক নয়। কাপ্তেনও বলল সে কথা। তখন তাকে আমাদের দলে নিলাম।

ফ্রাইডে আর কাপেনের সহচরও কিন্তু বসে নেই। নিপুণ তাদের কাজ। ডাকতে ডাকতে গোটা দলটাকে নাকে দড়ি দিয়ে বলতে গেলে ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, এ বন থেকে ও বসে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। শেষে রীতিমতো ক্লান্ত তারা। হাঁটতে আর পারে না। এদিকে আমরা নিশ্চিন্তু যতদূরে গিয়েছে সেখান থেকে নৌকোর কাছে পথ চিনে রাত ঘোর হওয়ার আগে ফিরে আসা অসম্ভব। যদি চেষ্টা করে তব? দেখা যাক।

কিন্তু তা বলে এখনি কিছু করতে যাচ্ছি না আমরা। অন্ধকার ঘনাক। রাত হোক। তখন শুরু হবে আসল খেলা।

ফ্রাইডের ডাক সমানে চলছে। সেরকমই কথা। ডাকতে ডাকতে এদিক ফের নিয়ে আসবে ওদেরকে। আসছে। শরীর রীতিমতো দুর্বল। পা আর চলে না। তা নিয়ে কত অভিযোগ। তবু নিরুপায়। ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই নৌকা। সব দেখে তো তাজ্জব। ভাটার টানে জল ততক্ষণে সরে গেছে। কাদা মাটির উপর গেঁথে গেছে নাও। আর কোথায় সেই দুজন প্রহরী? খুঁজল কত। পেলে তো দেখা! আহত মানুষটাকেও আমরা যে ইতোমধ্যে তুলে নিয়ে গেছি। তখন দেখি যারপর নাই ঘাবড়ে গেছে। কান্নকাটি শুরু করার দাখিল। একজন বলল, দানো আছে দ্বীপে। এসব তারই ছলাকলা। তখন ত্রাস। একজন বলল, দানো নয়, নির্ঘাৎ বর্বরদের এলাকা। আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে কাহিল করে শেষে মেরে ফেলবে। তারপর কেটে কুটে মাংস খাবে। শুনে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

ডাকল সঙ্গীদের নাম ধরে অনেকবার। পেলে তো সাড়া! কী করবে তখন বুঝতে পারছে না। এই একবার গিয়ে বসে নৌকোয়, পরক্ষণেই নেমে আবার ডাঙায় এসে ঘুরাঘুরি করে। মোটমাট ভীষণ হতাশ তখন। আর দুর্বল। আর সব মিলিয়ে ভীষণ এক ব্রাস।

আমরা এই অবস্থার সুযোগ অনায়াসে নিতে পারি। রাত হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি রে রে করে। ওদের যা অবস্থা এতটুকু বাধা দেবার সুযোগ পাবে না। এতটুকুও নটঘট করলে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাবে। চাই কি আমাদেরও দু একজন মরতে পারে। সেটা আমার অভিপ্রায় নয়। বন্দী করতে চাই সবাইকে, তবে এতটুকু রক্তপাত না ঘটিয়ে। তখন সবাইকে বললাম, তোমরা পা টিপে টিপে যতদুর পার ওদের কাছাকাছি এগিয়ে যাও। গুলির নাগালের মধ্যে। তারপর যা করণীয় আমি বলব।

গেল তাই। ভেবেছিলাম বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ঘটনার জন্যে। তার আর দরকার হল না। দলের নেতা সেই শয়তানটা এদিকেই আসছে। সঙ্গে দুই সাকরেদ। কথা শুনতে পাচ্ছি স্পষ্ট। তা আমরা তো তাকে চিনি না, কানেই গলার স্বর শুনে বুঝতে পারল। অন্ধকারে আবছা তার অবয়ব। শেষে একদম হাতের নাগালের মধ্যে। তখন কি আর পারে কাপ্তেন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে? মনে যে ভীষণ জ্বালা। অমনি দুই সঙ্গীকে নিয়ে লাফিয়ে পড়ল তাদের ঘাড়ে। হাতের বন্দুক তীব্র শব্দে গর্জে উঠল।

অদ্ভুত নিশানা। মরল সেই শয়তান তৎক্ষণাৎ। একজন সাকরেদ ভীষণ ভাবে জখম। মরল যদিও আরো ঘন্টাখানেক পরে। বাকি আর একজনের গায়ে আঘাত তেমন লাগে নি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতভম্ভ মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে দৌড়ল পরিত্রাহি বেগে।

তখন আর আড়ালে বসে থাকা যায় না। ঘটনা যতদূর গড়িয়েছে তাকে সামাল দেবার প্রয়োজন আছে। দলবল সমেত অমনি এগিয়ে গেলাম। বিরাট বাহিনী এখন তো আমার। আটজনের দল। আমি সেই দলের সেনাপতি। ফ্রাইডে আমার দক্ষিণ হস্ত। আর কাপ্তেন বাঁ হাত। সকলেরই হাতে অস্ত্র। অন্ধকার ভেদ করে সোজা গিয়ে তাদের মুখোমুখি হলাম।

সে ভারি মজা। অন্ধকারে দেখতে পায় না তো আমাদের পরিষ্কার, আমরা কতজন, কী কী অস্ত্র আমাদের হাতে মজুত কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। দেখি চারধারে ঘন ঘন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। তখন নৌকো থেকে ধরে যাকে দলে নিয়েছি খানিকক্ষণ আগে, তাকে বললাম, তুমি ওদের সঙ্গে কথা বল। ওরা যদি স্বেচ্ছায় ধরা দেয় আমরা কোনো ক্ষতি ওদের করব না। কিন্তু যদি উলটোপালটা কিছু করার চেষ্টা করে, তবে মুশকিলে পড়বে।

সে তখন নাম ধরে ডাকল একজনকে, টম, টম, স্মিথ?

টম বলল, কে, রবিনসন নাকি?

বলল, হ্যাঁ, আমি রবিনসন। আমি নিরাপদেই আছি। যদি বাঁচতে চাও এক্ষুনি হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দাও। আত্মসমর্পণ কর।

–কার কাছে আত্মসমপর্ণ করব?

–আমাদের কাছে। মস্ত দল আমাদের। পঞ্চাশ জন যোদ্ধা। কাপ্তেনও আছে দলে। তোমাদের পাণ্ডা একটু আগে মারা গেছে। আরেকজন ভীষণভাবে জখম। যদি বাঁচতে চাও এইবেলা হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দাও ।

–একটু ভাবনার সময় চাইছি। ধর পনের মিনিট। তারপর তোমাকে জানাব।

–সময় দেওয়া যেতে পারে তবে এক শর্তে–যদি তোমরা সকলে আত্মসমর্পণ কর। অবিশ্যি সময় দেবার মালিক এই মুহূর্তে কাপ্তেন। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

বলে জোরে জোরেই রবিনসন কাপ্তেনের কাছে সব বলল।

কাপ্তেন বলল, স্মিথ, আমি কাপ্তেন বলছি। আমার গলার আওয়াজ শুনে নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ। যদি এই মুহূর্তে অস্ত্র ত্যাগ করে তোমরা ধরা না দাও, তবে তোমাদের জীবন সংশয়। বিশেষ করে উইল অ্যাটকিন্সের।

উইল দলের পাণ্ডার ডান হাত। পালিয়ে এসেছে জখম অবস্থায়। কাপ্তেনের কথা শেষ হতে না হতে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, দোহাই কাপ্তেন, পনেরটা মিনিট সময় আমাদের দিন। আমরা কথা দিচ্ছি অস্ত্র ত্যাগ করব। আমাকে দোষ দেবেন না। আমি অনেক অপরাধ করেছি। তার জন্যে দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি।

পরে শুনলাম অ্যাটকিন্স নাকি জাহাজে কাপ্তেনের গলা চেপে ধরেছিল। গালাগাল দিয়েছে অকথ্য ভাষায়। হাড়ে আর কি কাপ্তেন! তার সেই এক গোঁ–অস্ত্র আগে ত্যাগ কর। তারপর মালিকের সাথে কথা বলে দেখব তোমার জীবন রক্ষা করা যায় কিনা।

মালিক অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমি। কথা আছে আমার নির্দেশ ছাড়া এ দ্বীপে কোনো কিছু এরা করবে না। কাপ্তেন সেই নির্দেশ হুবহু মান্য করেছে।

তখন একে একে অস্ত্র নামিয়ে রাখল দুজন। দুজন তো মৃত, দুজন আমাদের দখলে। বন্দী করা হল প্রত্যেককে। শক্ত রশি দিয়ে বাধা হল হাত পা নিয়ে গেল তাদের গুহার দিকে। আমি আর দলের আর একজন ইচ্ছে করেই প্রকাশ্যে দেখা দিলাম না। তারও কারণ আছে। সেটা কী, পরে বলব।

কাজ এখন অনেক। ছাদা করা নৌকোটা সারাতে হবে। সেদিকে গেলাম আমরা কজন। কাপ্তেন গেল বন্দীদের সাথে। অনেক রাগ তো মানুষটার মনে। অনেক জ্বালা। বকাবকি করুক একটু ওদের। তাতে জ্বালা মিটবে।

পরে শুনেছিলাম, বন্দীদের কেউ নাকি অভিযোগের উত্তরে রা টুক কাটে নি। মাথা নিচু করে শুনেছে নিজেদের অপরাধের কথা। নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছে নিজেদের জীবন। প্রাণ ভিক্ষা যাকে বলে। কানে বলেছে, তোদের নিয়ে যাব দেশে, বিদ্রোহের অভিযোগে এক একটাকে ফাঁসিতে চড়াব। তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। বলেছে কাপ্তেনকে দ্বীপে নিবাসন দেবার আগে ভেবেছিল এটা নির্জন নিরিবিলি দ্বীপ, কিন্তু নির্জন যে নয়, তাতে তারা বরং সন্তুষ্ট। ঈশ্বর হাতে করে রক্ষা করেছেন কাপ্তেনকে। তার জন্যে তারা ঈশ্বরের প্রতি চির কৃতার্থ।

শুনে কানে বলেছে আপাতত কার প্রতি সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। অপরাধের বিচার যা কিছু হবে ইংলান্ডে ফিরে গিয়ে। তবে উইল অ্যাটকি ক্ষমার অযোগ্য। সে যেন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়। ভোর হলেই তার ফাঁসি হবে। এটা মালিকের নির্দেশ।

বলাবাহুল্য আমি এরকম কোনো নির্দেশ দিই নি। শোনামাত্র হুমড়ি খেয়ে পড়ল অ্যাটকিন্স কাপ্তনের পায়ের উপর। আর সে কী কান্না!–দোহাই আপনার, মালিককে বলুন, আমি আর এমন অপরাধ কখনো করব না। আমাকে যেন প্রাণে না মেরে ফেলেন।

শুনে বাকিরা বলল, মালিককে আমাদের হয়েও একটু বলুন। দেশে ফিরে যেতে আমরা চাই না। ফিরে যাওয়া মানেই ফাঁসি কাঠে মৃত্যু। বরং আমরা এখানেই থাকব। দোহাই আপনার । আমাদের যেন দেশে ফিরিয়ে নিয়ে না যাওয়া হয়।

মোটামুটি পরিকল্পনা মতোই কাজ এগোচ্ছে। সেটা আমাদের পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু এমতাবস্থায় জাহাজ দখলের ব্যাপারে কিছু করণীয় আছে। এবং আমার অস্তিত্ব ঘোষণারও প্রয়োজন আছে। তখন পাঠিয়ে দিলাম একজনকে। বললাম, যাও গিয়ে বল, কাপ্তেন যেন আমার সাথে একবার দেখা করে।

সে সবাইকে শুনিয়ে বলল, কাপ্তেন, আপনাকে মালিক তলব করেছেন।

অমনি তড়িঘড়ি উঠে পড়ল কাপ্তেন। বলল, যাও তুমি গিয়ে মালিককে বল, যেন অপরাধ না নেন–আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে তখন বন্দীরা। এটা ফ্রাইডের কাছ থেকে পরে আমি শুনেছিলাম। হয়ত মালিকের তরফ থেকে ফের কী নির্দেশ আসে, তারই জন্যে এই হতবিহ্বল ভাব। তা এল কাপ্তেন। আমি জাহাজ দখলের ব্যাপারে আমার পরিকল্পনার কথা সবিস্তারে ব্যক্ত করলাম। শুনে ভারি খুশি। ঠিক হল পরদিন ভোরেই আমরা কাজে লেগে পড়ব।

ভোরে উঠে প্রথম কাজ হল বন্দীদের দু ভাগে ভাগ করা। অ্যাটকিন্স সমেত বাকি দুই দুশমনকে নিয়ে যাওয়া হল গুহায়। হাত পা বেঁধে বাকিদের দলে ফেলে রাখা হল। এটা করল ফ্রাইডে আর প্রথম নৌকোয় আসা সেই দুষ্ট সাকরেদ। বাকিদের পাঠালাম আমার মাচানে। হাত পা তাদেরও শক্ত করে বাঁধা। নিরাপদ আশ্রয়। মই নেওয়া হল সরিয়ে। তদুপরি চারদিক ভাল পাতার ঘেরা। বাইরের কেউ যে দেখতে পাবে এমন সম্ভাবনা নেই।

খানিক পরে পাঠালাম মাচানে কাপ্তেনকে যাও, তুমি গিয়ে এবার ওদের সঙ্গে কথা বল।

কথা অর্থাৎ দলে টানবার চেষ্টা। যদি এদের পাঠানো যায় জাহাজে। আচমকা গিয়ে অবাক করে দেবে বাকি নাবিকদের। তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে। বন্দী হবে তারা। তারপর আমরা গিয়ে নিরাপদে জাহাজের দায়িত্ব নেব।

বলতে তো আর কোনো অসুবিধা নেই। মালিকের নাম উল্লেখ করে একেকটা কথা ছেড়ে দিলেই হল। ভয় দেখাল খুব। বলল, দেশে ফিরে যাবার অর্থই হল ফাঁসি। আর এই দ্বীপে থাকা মানে চিরতরে নির্বাসন। যদি এমতাবস্থায় তারা আমাদের মত মতো কাজ করার অঙ্গীকার করে। যদি জাহাজে গিয়ে অতর্কিতে ঘায়েল করতে পারে বিদ্রোহী নাবিকদের, তবে মালিককে বলে সে কমিয়ে দেবে তাদের শাস্তির মাত্রা। যেন তারা ভেবে দেখে।

এরকম প্রস্তাবে যে তৎক্ষণাৎ সম্মতি মিলবে এত জানা কথা। যে কোনো শিশুও বলে দিতে পারে। অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাপ্তেনের পায়ের উপর। আর প্রতিজ্ঞা। আর ঈশ্বরের নামে শপথ। তখন কানে বলল, বেশ, তবে আমি মালিককে গিয়ে জানিয়ে আসি আমাদের মনোভাব। বলি তাকে সব খুলে। দেখি তিনি কী বলেন।

বলে এল আমার কাছে। মন দিয়ে শুনলাম সব ঘটনা। বললাম, কী মনে হয় তোমার? বলল, আমার মনে হয় আর কোনো রকম গোল পাকাবার চেষ্টা করবে না। বললাম, বেশ, তাহলে ঐ পাচঁজনকে সঙ্গী হিসেবে নাও। বাকিরা বন্দী অবস্থায় থাকুক। যাদের সঙ্গে নেবে তাদের এটুকু শুধু জানিয়ে দাও, যদি ঠিক ঠিক হিসেব মতো কাজ না করে, তবে তাদের অপরাধের শাস্তি হিসেবে বাকি বন্দীদের ফাঁসি দেওয়া হবে।

কঠোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। এরকম একটা হুমকি না দিলে হিসেবে বানচাল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা। সেই ভাবেই কানে গিয়ে বোঝাল। বলল, মালিকের এটাই সংকল্প। এর অন্যথা হবার উপায় নেই। যেহেতু এই দ্বীপের তিনিইশর্ত। সুতরাং এমতাবস্থায় তোমরা যা ভালো বোঝা করবে।

শক্তিতে এখন আমরা খুব একটা কম নই। লোকবল একুনে চৌদ্দ। কাপ্তেন, তার সহকারী আর সেই নির্দোষ যাত্রী। তারপর প্রথম দলের সেই দুই বন্দী। তারা এখন পুরোপুরি আমাদেরই অনুগত। তাদের হাতে বন্দুক দিতে আমার এখন আর কোনো দ্বিধা নেই। এরপর সেই দুই বন্দী–এরাও প্রথম দলের। মাচানে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছিলাম কাল অব্দি। কাপ্তেনের কথায় এখন মুক্ত। এছাড়া বর্তমানের সর্বশেষ মুক্ত সেই পাঁচ বন্দী। মোট বার। সঙ্গে ফ্রাইডে আর আমি তো আছিই। বন্দী হিসেবে গুহার আড়ালে রইল এখনো পাঁচজন। এদেরকে মুক্ত করার বাসনা আপাতত নেই। খাবার দাবার যথারীতি হাতের কাছে পোঁছ দিই। কোনোক্রমে বাঁধা হাতে খায়। এদের আমরা অতিথি বলেই ধরে নিয়েছি।

কাপ্তেনকে বললাম, আমি আর ফ্রাইডেকে বাদে বাকি বারজনের দল নিয়ে জাহাজ দখল অভিযানে যেতে রাজি কি না। বলল কোনো ভয় নেই, নিশ্চয়ই যাব। আপনার অনুমতির শুধু অপেক্ষা। তা আমার আর অনুমতি দিতে অসুবিধা কি। বললাম একটু ধৈর্য ধরুন। আরেকটু কাজ বাকি আছে। সেটা করে নিই। ফ্রাইডেকে বললাম, এক কাজ কর। দুই বন্দীকে আমার গুহা থেকে বের করে দূরের ঐ গুহাটায় নিয়ে যা। সেখানে আমি ওদের সাথে কথা বলব।

নিয়ে গেল তাই। তখন আমি আর কানে গেলাম তাদের সঙ্গে দেখা করতে। কাপ্তেন আমাকে দেখিয়ে বলল, একেই মালিক হুকুম দিয়েছেন তোমাদের দেখা শোনা করার জন্যে। একে অমান্য করো না। বিপদে পড়বে। তাহলে ধরে ধরে নিয়ে যাবে দুর্গে। সেখানে অন্ধকূপ আছে। আর এক ঝাঁক সৈন্য। লোহার ভারী ওজন চাপা দিয়ে রাখবে তোমাদের আরো নানারকম শাস্তি দেবে। সে সাংঘাতিক। আমি ভাবতে পারছি না।

তখন সেই রেশ টেনে আমি ফেদে বসলাম নানান আজগুবি গল্প। তাতে চোখ তাদের ছানাবড়া। বলল, এতটুকু গোলমাল কেউ করবে না। শান্তি বজায় রাখবে। আমি যেন মালিককে বলি, যে প্রাণে তাদের না মারেন।

মোটমাট সবই শুভ। কাপ্তনের রওনা হতে আর কোনো অসুবিধে নেই। বন্দী সংখ্যা পাঁচ। তার থেকে তিনজনকে আমরা আলাদা করতে পারলাম। এতে সমবেত শক্তি হ্রাস পাবে। দুজন রইল এধারে। বাকি তিনজন আরেক গুহায়। চেষ্টা করে কেউ পারবে না কারো হদিস বের করতে। তো ভাবনা কী!

রওনা হল কাপ্তেন। দুটো নৌকোয় দু দল। একদলে সেই যাত্রী, চার বন্দী আর সে নিজে, আরেক দলে সহকারী আর পাঁচ বন্দী। বেরুল যখন বেশ রাত। জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বারটা। রবিনসন ডাকল একজন নাবিকের নাম ধরে। বলল লোকজ্জন নিয়ে নৌকো নিয়ে তারা ফিরে এসেছে। শুরু হল এই নিয়ে খোশ গল্প। ইত্যবসরে কাপ্তেন আর তার সহকারী পিছন দিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠল গিয়ে জাহাজে। অতর্কিতে বিদ্রোহী নাবিকদের দুই পাণ্ডাকে ঘায়েল করল। উঠে পড়ল হৈ হৈ করে বাকিরা। তখন আর পায় কে! কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো জাহাজ নিজেদের অধীনে। বিদ্রোহী সকলেই বন্দী। হাত পা বেঁধে ঘরে আটক করা হল সবাইকে।

তখনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন বিদ্রোহের প্রধান পাণ্ডা। সেও কাপ্তেনের আরেক সহকারী। তাকে হাঁকড়াক করে তোলা হল। উঠে দেখে সামনে কাপ্তেন। হাতে উদ্যত পিস্তল। তখন তো ভূত দেখার সামিল। ধাতস্থ হতে লাগল সামান্য কয়েক মুহূর্ত। তারপর প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে কাপ্তেনের দিকে দিল একলাফ। অমনি গুলি। মুখের ভিতর দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেল কানের ওপরে খুলি ফুটো করে। আর সঙ্গে সঙ্গে আছড়ে পড়ল মেঝেয় মস্তু শরীর। যেন কাটা গাছ। ব্যস, খতম সব। বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন। অমনি তোপ ঘরে গিয়ে পরপর সাবার কামান দাগল কাপ্তেন। এটা আমারই নির্দেশ! জাহাজ যে দখল হয়েছে সেটা জানান দেবার ইচ্ছা। আমার তো আর আনন্দ ধরে না। জেগে আছি সারারাত কখন শুনব এই আওয়াজ সেজন্যে। দেখি তখনো প্রায় এক প্রহর রাত বাকি। আর ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। সারা শরীরে অদম্য এক ক্লান্তি। শুয়ে পড়লাম মাটির উপরই। অমনি ঘুমে সারা শরীরে তলিয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল হঠাৎ। বন্দুক গর্জে উঠল যেন কোথায়। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। কে যেন ডাকছে আমাকে দুহাতে। হাসছে। কিন্তু চোখে জলের ধারা। বলল, ঐ দেখুন জাহাজ, আপনার জাহাজ। আপনি রক্ষাকর্তা। আপনি আমাকে না বাঁচালে আজ এই জাহাজ উদ্ধার করতে পারতাম না। আমিও সে অর্থে আপনার সেবাদাস। আদেশ করুন এবার কী করতে হবে।

তাকিয়ে দেখি মাত্র আধ মাইল দূরে জাহাজ নিয়ে এসেছে কাপ্তেন। নোঙর ফেলেছে। আবহাওয়া শান্ত। ভয়ের কোনো কারণ নেই। নৌকো বেয়ে চলে এসেছে কাপ্তেন আমাকে খবর দিতে। নৌকো নালায় বাঁধা। আমাকে সেটাও আঙুল দিয়ে দেখাল।

অর্থাৎ মুক্তি আমার আসন্ন! এটা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এই বন্দী দশা, নির্জন দ্বীপবাসের এই আঠাশ বছর প্রায়–এর থেকে মুক্তি। আমি কি জাগরণে না নিদ্রায়। গায়ে চিমটি কাটলাম জোরে। ব্যথা লাগল। তবে তো জেগেই আছি। সত্যিই তাহলে মুক্তি এবার পাব। সারা শরীরে রক্ত যেন মুহূর্তে ছলাৎ করে উঠল। মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। আকঁড়ে ধরলাম কাপ্তেনের হাত সজোরে। কে জানে, আমি হয়ত চরম উত্তেজনায় মাটিতে পড়ে যাব।

আমার যে এই অবস্থা সেটা কাপ্তেনের নজরে গেছে। অমনি পকেট থেকে চ্যাপ্টা বোতল বের করে ছিপি খুলে ঢেলে দিল আমার মুখে। ব্র্যান্ডি। শরীরে যেন বল পেলাম। পরে বলেছিল, আমার কথা ভেবেই নাকি বোতল পকেটে করে আনা।

আর সে যে কত শ্রদ্ধা, কত প্রশংসা, কত প্রাণখোলা ভালবাসার কথা! যেন ঘোরে রয়েছে মানুষটা। আশ্চর্য সেই ঘোর। কথায় পেয়ে বসেছে। বুকের মধ্যে জমাট শেষ কথার বিন্দুটি অব্দি বের না করে দিয়ে শান্তি নেই।

আমারও কথা জমে আছে বুকের মধ্যে অনেক। জড়িয়ে ধরলাম ফের। বললাম, তুমি আমার পরিত্রাতা। তোমার সহযোগীতা না পেলে আমিও কি পারতাম এই দ্বীপ থেকে মুক্তি পেতে? ঈশ্বরের প্রেরিত দূত তুমি। তোমাকে তিনিই আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। তোমার এই ভালোবাসা, এই সহযোগিতার কথা আমি জীবনে ভুলব না। বলে হাঁটু গেড়ে বসলাম মাটিতে। দেখাদেখি সেও। দুহাত শুন্যে তুলে প্রার্থনা করলাম ঈশ্বরকে। –প্রভু, তুমি সুখে দুঃখে মানুষের সঙ্গী। মানুষকে তুমিই ফেল দুঃখ সাগরে আবার তুমিই তার ত্রাণ কর। তোমাকে প্রণাম। শতকোটি প্রণাম।

কাপ্তেন বলল, এই আনন্দের দিনে জাহাজ থেকে আমার জন্যে সামান্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। যদি আমি সম্মতি দিই আমাকে দিতে পারে। বললাম, বেশ ভো, দাও না। তখন নৌকার লোকটাকে ডেকে কী যেন বলল। নিয়ে এল সে মস্ত এক কাঠের পেটি। খুলে ফেলল ঢাকনা। দেখি নানান জিনিসে বোঝাই। সুস্বাদু পানীয় থেকে শুরু করে তামাক, টিনে ভরা গরুর মাংস, বিস্তর বিস্কুট, কিছুটা শুয়োরের মাংস আর সেদ্ধ মটর, সঙ্গে এক প্যাকেট চিনি, এক বোঝাই লেবু, দু বোতল লেবুর রস, আরো কত যে টুকিটাকি আমার সব মনে নেই। সব থেকে ভালো লাগল দু প্রস্থ পোশাক দেখে। সব নতুন। তাতে শার্ট থেকে শুরু করে পান, গলাবন্ধ মায় রুমাল অব্দি আছে। জুতোও এনেছে এক জোড়া, সঙ্গে মোজা। আর একখানা জাঁদরেল টুপি। মোটমাট সাজাবে দ্বীপের মালিককে। সাজটা যাতে মালিকের মতো হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তো!

পরলাম এক প্রস্থ পোশাক। বলব কী, এতদিন পর এমন অস্বস্তি লাগছে। বেশ খানিকক্ষণ লাগল নিজেকে পোশাকের সাথে মানিয়ে নিতে। তারপর মোটামুটি খানিকটা ধাত হলাম।

পেটি পৌঁছে দিয়ে গেল আমার গুহায়। দেবে,–আমি যে মালিক। বসলাম দুজনে মুখোমুখি। বন্দীদের নিয়ে কী করব সেটা ঠিক করার প্রয়োজন আছে। রাস্তা আমাদের সামনে দুটো। এক, নিয়ে যেতে পারি তাদের সঙ্গে করে আমাদের সাথে, কিংবা এখানে নির্বাসন দিতে পারি। তবে সবাইকে নয়। আমাদের মূল নজর সেই দুই দুশমনের দিকে। এদের নিয়ে কী করব সেটাই সমস্যা। কাপ্তেন দেখি যা বলি তাতেই ইতস্তত করে। অর্থাৎ ঠিক কী করবে সেটা স্থির করতে পারছে না। তখন বললাম, বেশ তো, যদি ইচ্ছে হয় তোমার, আমি নয় দুজনকে এখানে আবার ব্যবস্থা করি। তুমি কথা বলা এমনভাবে বল যাতে ওরা নিজেরাই এখানে নির্বাসিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

কাপ্তেন রাজি। বলল, তাই ভালো। আপনি এখানে ওদের আনান। আমি কথা বলব। তবে হ্যাঁ, আপনাকেও থাকতে হবে।

তখন পার্টবন্দীকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় মাচানে নিয়ে যাবার জন্যে ফ্রাইডে আর দুই সঙ্গীকে হুকুম দিলাম। বললাম, আমি না পৌঁছানো অব্দি তাদের যেন কড়া পাহারায় রাখা হয়। কেউ যেন পালাতে না পারে। সাবধান!

হল তাই। ইচ্ছে করেই বেশ খানিকটা দেরি করে আমি গিয়ে হাজির হলাম। পরনে আমার নতুন পোশাক। পৌঁছবার সাথে সাথে ‘মালিক ‘মালিক’ বলে কাপ্তেন আর ফ্রাইডের যা ডাকাডাকি আর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঘটা! বললাম, নিয়ে আয় এবার ওদের আমার সামনে। তখন নিয়ে এল। সব বললাম আমি। তাদের দুর্ব্যবহার–সব। শেষে বললাম, বল এবার, এর শাস্তি হিসেবে কী তোরা প্রত্যাশা করিস।

বলে না কিছুই। দেখি চুপচাপ। তখন বললাম, জাহাজ আর তোদর দখলে নেই। আমরা দখল করেছি কাল রাত্রে। যাত্রার জন্যে প্রস্তুত। তোরা পাপী। পাপীরা পৃথিবীতে নিজেরাই নিজেদের কৃতকর্মের দ্বারা নিজ নিজ কবর খনন করে। তোরা এখন সেই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। ফাঁসি হবে তোদের। এক একটাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেব, তারপর আমরা এখান থেকে রওনা দেব।

একজন বলল, কাপ্তেন বন্দী করার সময় নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের জানে মারবে না। তবে এখন কেন এই ফাঁসির আদেশ? বললাম, ফাঁসি ছাড়া তোদের আর কিছুই প্রাপ্য নেই। এখান থেকে যদি তোদের বন্দী অবস্থায় দেশে নিয়ে যাই, তবে সেখানেও তোদের ফাঁসি হবে। বল এখন, কোথায় ফাঁসি যেতে তোদের ইচ্ছে।

তখন অনুনয় বিনয় করল। দয়া প্রার্থনা করল। জীবন রক্ষার জন্যে আবেদন জানাল। বললাম, বেশ তবে শেষ কথা আমার কোন। জীবন রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু দেশে নয়, এখানে। আমিও লোকজন নিয়ে জাহাজে করে ফিরে যাব বলে ঠিক করেছি। এখানে তোদের রেখে যাব। এছাড়া তৃতীয় বিকল্প আর কিছু নেই। বল সেটা তোদের মনঃপূত কিনা।

সবাই একবাক্যে আমাকে সাধুবাদ জানিয়ে আমার প্রস্তাবে সায় দিল। কানে বলল, নানা, এটা ঠিক নয়। আমার এতে মত নেই। এ আপনি কী করলেন?

শুনে ভীষণ যেন রেগে যাচ্ছি আমি, সেইরকম ভঙ্গি করে বললাম, তোমার মত আছে কি না, সেটা আমার দেখার প্রয়োজন নেই। এরা আমার বন্দী। এদের নিয়ে যা ইচ্ছে আমিই করব। আমি এদের মুক্তি দেব। যদি সেটা তোমার মনঃপূত না হয়, তবে মুক্তি দেবার পরে তুমি এদের ফের বন্দী করতে পার। তখন যা খুশি করবে, আমি বাধা দেব না।

কাজে লাগল আমার ছ রাগ। দেখি তাতে আরো সন্তুষ্ট। অজস্র সাধুবাদ জানাল আমাকে। বললাম, এদের বাঁধন খুলে দাও। তখন বাঁধন খুলে দেওয়া হল। বললাম তোমরা এবার মুক্ত। বনে বনে স্বাধীন ভাবে বিচরণের অধিকারী। আমি তোমাদের বন্দুক দেব সকলকে, আর গোলাবারুদ। অন্যান্য নানান ব্যবস্থা আছে আমার। যেমন ক্ষেত, যেমন পশুপালন। এগুলো তোমাদের দেখিয়ে দেব। তোমাদের জীবনধারণে এতটুকু অসুবিধে হবে না।

কাপ্তেনকে বললাম, তুমি জাহাজে চলে যাও। আমি আজকের রাতটুকু এখানেই থাকব। শেষ মুহূর্তের কিছু কিছু কাজ এখনো বাকি। কাল ভোরে তুমি নৌকোটা আমার জন্যে পাঠিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, জাহাজের নতুন কাপ্তেন সেই শয়তানটাকে সবার চোখের সামনে ফাঁসি দিও। যেন ভুল না হয়। আমি যেন গিয়ে তাকে জীবিত না দেখি।

বলা বাহুল্য, এটা সকলকে শুনিয়ে বলা। সে শয়তান কাপ্তেনের হাতে কাল রাতেই মছে। মরা মানুষকে নতুন করে ফাঁসি দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এদের শোনাবার প্রয়োজন আছে। এরা ভয়ে আতঙ্কে নতুন কিছু অঘটন ঘটাবার সাহস পাবে না।

কাপ্তেন চলে গেল জাহাজে। আমি বন্দীদের নিয়ে আমার ডেরায় গেলাম। আলোচনা হল অনেকক্ষণ ধরে। সব বললাম, বোঝালাম সব কিছু। মৃত্যু আর নিবার্সন–দুটোর মধ্যে যে তারা নির্বাসন মেনে নিয়েছে এতে আমি খুশি। সেটা জানালাম। তারপর শোনালাম চাবুক মারা হলো আমার দ্বীপে আগমন থেকে এ পর্যন্ত এই ছাব্বিশ বছরের ইতিবৃত্ত। ঘটনা সবই, কিন্তু এখন নিজের কানে লাগছে যেন গল্পের মতো। তারাও গল্প শোনার মতো করেই শুনল। অর্থাৎ ভয়ডর নয়, ব্যাপারটার মধ্যে যে আগাগোড়া রোমাঞ্চের ছোঁয়া আছে, সেটা মোটের উপর হাবেভাবে বুঝলাম তাদের বেশ চমৎকৃত করেছে। তারপর নিয়ে গেলাম আমার ক্ষেত দেখাতে। কীভাবে চাষ করি, কী তার যন্ত্রপাতি, আঙুর কোথায় কোথায় পাওয়া যায়। ছাগলের খোয়াড় কোথায়–সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালাম। ষোল জন স্পেনীয় নাবিকের কথাও বললাম। যে কোনো মুহূর্তে তারা এখানে হাজির হতে পারে। যেন তাদের সাথে বিন্দুমাত্র অসদাচরণ না করা হয়। বন্ধুর মতোই যেন গ্রহণ করা হয় সকলকে।

মোট আটটা বন্দুক আমার। সব তুলে দিলাম তাদের হাতে। আর তিনখানা তলোয়ার। প্রায় দেড় পিপে বারুদ এখনো মজুত। এখানে আসার বছর দুই পর থেকে তেমনভাবে বারুদ তো আর ব্যবহার করি নি। বলতে গেলে বেশির ভাগটাই রয়ে গেছে। ছাগল কীভাবে পরিচর্যা করতে হয়, ধরতে হয় কীভাবে এতটুকু বারুদ না খরচ করে–সেটাও শিখিয়ে দিলাম। আর শেখালাম দুধ দোওয়াবার কৌশল। দুধ থেকে কী কী বানাতাম, কেমন করে বানাতাম, সব শেখালাম।

অর্থাৎ বাদ কোনো কিছুই নেই। দ্বীপে আমার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, তার সংগ্রাম, আত্মরক্ষার জন্যে নানান উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া–সব কিছুর সাথে ঘটনাকে মিশিয়ে বললাম প্রতিটি খুটিনাটি বিবরণ। বললাম, কাপ্তেনকে বলে আরো দু পিপে বারুদ যাতে তোমাদের দিয়ে যাওয়া যায় আমি তার ব্যবস্থা করব। আর মটর দানার থলিটা হাতে তুলে দিলাম। বললাম, চাষ করো। ভালো ফলন হবে। এটা তোমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার নতুন সংযোজন।

আর একটা মাত্র কাজ বাকি। সবাই এক ঠাঁই বসে নৈশ ভোজ। কাপ্তেনের পাঠানো জিনিস আর সঙ্গে আমার ঘরোয়া সব কিছু মিলে মিশে জমল সে যা দারুণ! খুব হৈ হৈ হল। দ্বীপে এই আমার শেষ রজনী। কাটল সারারাত গভীর উত্তেজনার মধ্যে। ছাব্বিশ বছরের নির্বাসিত জীবনের কালই হবে তাহলে শেষ! ভোর হতে দেখি কাপ্তনের প্রেরিত নৌকো হাজির। সবার কাছে বিদায় নিয়ে আমি গিয়ে নৌকোয় উঠলাম।

রাত্রেই ছাড়ার কথা জাহাজ, ছাড়া হল না। এটাও আমাদের আগে থেকে ঠিক করা ফন্দি। পরদিন ভোর তখন। দেখি পাঁচজনের দুজন এতখানি পথ আঁতরে সাতরে এসেছে। ঘুরছে জাহাজের আশে পাশে। আর সে কী কাতর আবেদন!-দোহাই আমাদের নিয়ে চলুন। এখানে রেখে গেলে আমরা বাঁচব না। ওরা আমাদের কালই মেরে ফেলবে। হোক ফাঁসি, তাও সই, তবু দেশে যাব। ওদের হাতে কিছুতে মরব না।

শুনে কানে বলল, বুঝলাম তো সব, কিন্তু আমার যে কিছু করার ক্ষমতা নেই। মালিক মত না দিলে আমার যে হাত পা বাঁধা। তখন আমাকে তলব করে আনা হল। শুনলাম মন দিয়ে প্রতিটি কথা। কাপ্তেনকে বললাম, বেশ, এদের জাহাজে তুলে নাও। কিন্তু অপরাধী এরা। তার শাস্তি এদের প্রাপ্য। চাবুক মারো এদের। একদিন উপোস থাকুক। এতেও যদি পাপের বোঝা লাঘব না হয় তবে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

হল তাই। চাবুক মারা হল। অনাহারে রাখা হল। টু শব্দটি অব্দি করল না। তারপর খাবার দিলাম। স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলাম। কোনো দিন আর ভুল করে কখনো মাথা গরম করে নি বা অবাধ্য হয় নি।

দুজনকে জাহাজে তুলে নেবার পর নৌকো নিয়ে কজন গেল কূলে। সঙ্গে এটা ওটা নানান জিনিস। যেগুলো আর কি ওদের পাঠিয়ে দেব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলাম। অধিকন্তু কাপ্তেন নিজে দয়াপরবশ হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে এক বাক্স জামা প্যান্ট। এটা উপরি পাওনা। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি আপত্তি করি নি। সে যাই হোক, বলে পাঠালাম, যেন শান্ত ও সুস্থির হয়ে থাকে। আমি দেশে পৌঁছে এদিকে যে জাহাজ আসবে তাকে বলে দেব তাঁদের কথা। যেন ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যায়। এটা নিছক প্রতিশ্রুতি নয়। যাতে আসে কেউ, সেদিকে আমি নজর রাখব।

হ্যাঁ ভালোকথা, বলতে ভুলে গেছি,-জাহাজে ওঠার আগে কিন্তু আমার সেই বিখ্যাত ছাতা আর টুপি আর ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরী সেই বিকট দর্শন পোশাক সঙ্গে আনতে ভুলি নি। এর সাথে আমার ছাব্বিশ বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই যে দ্রা কটা কিংবা সোনা রুপোর সেই কটা টুকরো–তাও নিয়েছি সাথে। সভ্য জগতে ফিরছি যখন এগুলো এবার প্রয়োজনে লাগবে। তা দেখি জং ধরে গেছে কয়েকটা মুদ্রায়। আর বহুদিনের অব্যবহারে কেমন এক পুরানো পুরানো ছাপ। তবু মুদ্রা বলে কথা! হাজার পুরানো হলেও এর কি প্রয়োজন ফুরোয়।

এবার যাত্রা শুরু। তারিখটা দেখলাম। ষোলশ ছিয়াশি সালের ১৯শে ডিসেম্বর। অর্থাৎ ছাব্বিশ নয়, আমি এখানে আছি মোট আঠাশ বছর। কে জানে কীভাবে দুটো বছরের হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে। সর্বমোট আঠাশ বছর দু মাস উনিশ দিন। তা সব মিলিয়ে এক ইতিহাস বটে। আমার জীবনের অদ্ভুত রোমাঞ্চকর নিঃসঙ্গ এক অধ্যায়।

ইংল্যান্ডে পৌঁছলাম ১৬৮৭ সালের এগারই জুন। সিধে তো আর আসি নি। ঘুরতে হয়েছে বিস্তর। হিসেব করে দেখলাম, মোট পঁয়ত্রিশ বছর পর আমার ফের ইংল্যান্ডে পদার্পণ। বাড়ি থেকে পালাবার পর সুদীর্ঘ কাল কেটে গেছে। আমি এতদিন সেটা বুঝতে পারি নি।

এবং যা সচরাচর ঘটে থাকে। এতদিন পরে এল একটা মানুষ–সে তো অচেনা অজানা এই দেশে, যেন ভীনদেশী আগন্তুক। সবই প্রায় বদলে গেছে। আগের ছবির সঙ্গে কিছুই আর মেলাতে পারি না। তা সেই যে পুরানো কাপ্তেনের স্ত্রী, টাকা পয়সা মজুত রেখে গিয়েছিলাম যার কাছে,–দেখি এখনো তিনি বেঁচে আছেন। বড় দয়া আমার উপর। মাঝে নাকি আর একবার বিয়ে করেছিলেন। সে স্বামীও মারা গেছে। এখন একেবারে একলা। বড় কষ্টে কাটে দিন। আমাকে বললেন, বাছা আমার যে সে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য এখন নেই। বললাম, তার জন্যে কি! আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার ভালবাসা আমি জীবনে ভুলব না। এই নিন, এই সামান্য কিছু অর্থ রাখুন। বলে সঙ্গের আনা সেই অর্থ-তার বেশির ভাগটাই তাঁর হাতে তুলে দিলাম।

গেলাম তারপর ইয়র্কশায়ারে। আমাদের বাড়ি যেখানে। কোথায় সেই বাড়ি। দেখি তার চিহ্নমাত্র নেই। খোঁজখবর করে জানলাম বাবা মা দুজনেই গত হয়েছেন। বাবা আগে, মা তার পর। সবাই ধরে নিয়েছিল আমি আর বেঁচে নেই। ফলে আমার জন্যে মা কিছু উইল করে রেখে যাবারও প্রয়োজন মনে করেন নি। থাকবার মধ্যে আছে শুধু দুই বোন। তারা কেউ আমাকে দেখে নি। আমি পালাবার পর তাদের জন্ম। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। অসীম দূরত্ব যেন আমার আর তাদের মধ্যে। সেই ভাবেই দায়সারা গোছের কিছু কথা বলল। আমিও মানে মানে জবাবের পাট চুকিয়ে বেরিয়ে এলাম।

অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু অর্থাগমের সুযোগ হল। খবর দিয়ে একদিন ডেকে পাঠাল জাহাজের সেই কাপ্তেন। যেটাতে করে আমি আর কি ফিরে এলাম। দেখি একদল মানগণ্য ব্যক্তিবর্গ হাজির। বণিক সকলে। তাদেরই জাহাজ। আমার বিস্তর প্রশস্তি করল। আমি যে রক্ষা করেছি কাপ্তেনকে তথা মালপত্র বোঝাই তাদের জাহাজটাকে, সেজন্যে অজস্র সাধুবাদ দিল। এবং সবশেষে হাতে তুলে দিল দুশ পাউনেজুর নোট। এটা কৃতজ্ঞতার স্মারক। বলল, ক্ষুদ্র এই পারিতোষিক। আপনি নিন। আমি নিলাম।

ইংল্যান্ডে আর নয়, যাব এবার লিসবনে। সেখান থেকে ব্রাজিল। ক্ষেত তো ছিল সেখানে আমার, সেটার কী অবস্থা দেখার জন্যে কদিন ধরেই মন কেমন করছে। উঠে বসলাম জাহাজে, সঙ্গে আমার চিরসাথী চিরমিত্র ফ্রাইডে। আমার অনুচরও বলতে পারেন। অনুগত বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।

পৌঁছতে পৌঁছুতে পরের বছর এপ্রিল। চেনা জানা কে আর আছে এখানে। সেই কানে? আছেন কি তিনি এখনো বেঁচে। খবর নিয়ে দেখি জীবিত আছেন। বুড়ো হয়েছেন। এখন আর জাহাজ নিয়ে বেরন না। ছেলে হয়েছে এখন কাপ্তেন। সেই সমুদ্রের বুকে পাড়ি জমায়। তা আমাকে তো কিছুতেই চিনতে পারেন না। আমিও চেহারা দেখে পারি না ঠাওর করতে। শেষে পুরানো দিনের কথা তুলতে সব মনে পড়ল। তখন পরস্পরকে চিনতে পারলাম।

সে যা আনন্দ তখন! উচ্ছ্বাস! আমার ক্ষেত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন আমি চলে যাবার পর একঞ্জন অংশীদার নিয়েছিলেন তিনি ব্যবসায়। পরে তারই হাতে আমার অংশ দেখাশোনার ভার তুলে দিয়েছেন। ন বছর যান নি ব্রাজিলে। ন বছর আগে অব্দি দেখে এসেছেন, সেই অংশীদার বহাল তবিয়তে বর্তমান। আমি যেন গিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি।

মুখে মুখে হিসেব যা দিলেন, তাতে আমার ভাগে বিস্তর অর্থ জমার কথা। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন আমার কোনো খবর নেই, আমার অংশের যাবতীয় প্রাপ্তি জমা হয়েছে রাজসভা নিযুক্ত জনৈক অছির হাতে। এরকম নির্দেশ আছে, যদি আমি কোনোদিন না ফিরি তবে সমগ্র প্রাপ্তির এক তৃতীয়াংশ যাবে রাজকোষে, বাকি দুই তৃতীয়াংশ যাবে গির্জার তহবিলে। ফেরৎ এলে সব টাকাই আমার হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে টাকার যে অংশ গির্জা দরিদ্র সেবায় বা দানখয়রাতির কাজে ব্যয় করবে, সেটা ফেরৎ পাবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

বললাম, কীরকম প্রাপ্তি হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

বললেন, সঠিক ভাবে বলতে পারব না। তবে অংশীদার যে আমার, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, কয়েক বছরের মধ্যে সে বিরাট ধনীতে পরিণত হয়েছে। রাজকোষে জমা পড়ে প্রতিবছর যে এক তৃতীয়াংশ, তা নাকি দুশ মোহরের সমান। বললেন, অসুবিধা কি তোমার? তোমার নাম তো সরকারি খাতায় এখনো অংশীদার হিসেবে তোলা আছে। শুধু প্রমাণ করতে হবে এই যা সমস্যা। তাতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। অছি পরিষদে দুজন সদস্য আছেন, আমার বন্ধুস্থানীয়। আমি তাদের চিঠি লিখে দিচ্ছি, দেখ কাজ হবে।

বললাম, কিন্তু অছির হাতেই বা গেল কেন আমার অংশ? এটা তো আমি কিছুতে বুঝতে পারছি না। আমি তো যাবার আগে আপনার নামে সব উইল করে দিয়ে গিয়েছিলাম। স্পষ্ট তাতে লেখা ছিল আমার অবর্তমানে আপনি যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। সেটাকে তারা মানবে না কেন?

বললেন, মেনে ছিল, কিন্তু শেষ অব্দি সাক্ষ্য প্রমাণ মেলে নি। অর্থাৎ আমি যে মারা গেছি এটা প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। মারা গেলে তবে তো উইলের নির্দেশ বর্তাবে। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে আমি নিরুদ্দিষ্ট এবং সেই মর্মে আমার যাবতীয় সম্পত্তি অছির হস্তগত হয়েছে। আমি যদি ফের আমার দাবী পেশ করে প্রমাণ করতে পারি আমি জীবিত এবং আমিই সেই লোক, তখন ওরা সম্পত্তি আমার হাতে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।

অছির হাতে গিয়েছে আমার চলে যাবার ছ বছর পর। এই দু বছর লাভের টাকা তার হাতেই দেওয়া হয়েছে। তার হিসেবও রেখেছেন নিখুঁত ভাবে। সব মিলিয়ে প্রায় চারশ সত্তর মোহর। আক্ষেপ করলেন তাই নিয়ে। বললেন, একটি পয়সাও আমি রাখতে পারি নি। সব গৈছে। খরচ হয়েছে কিছু। যেমন ধর তোমার জমিতে কাজ করার জন্যে ক্রীতদাস কিনতে হয়েছে চারজন, আরো টুকিটাকি এটা ওটা খরচ। এই তার তালিকা। বাকি টাকা আমি জাহাজ ব্যবসায় লাগিয়েছিলাম। ডুবে গেছে সে জাহাজ। আমাকে প্রায় সর্বান্ত হতে হয়েছে। জানি না তোমাকে নগদে শোধ করতে পারব কিনা। তবে ছেলেকে বলেছি, সম্প্রতি বহু কষ্টে সামান্য সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সে যে জাহাজ কিনেছে তাতে যেন তোমাকে অংশীদার করে নেয়। যদি লাভ হয়, তুমি তার অর্ধেক পাবে। আর যদি ডুবে যায় জাহাজ, তবে গেল সব। ধরে নাও এটা তোমার লোকসান।

বললেন, সেই মর্মে অচিরে দলিল তৈরি করে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আর সিন্দুক থেকে ছোট্ট একটা গেঁজে বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, এটা রাখ। এই আমার শেষ সঞ্চয়। একশ ষাটটি মোহর আছে। আমি বহুকষ্টে জমিয়ে রেখেছি। এটা তোমারই প্রাপ্য।

বলব কী, চোখে তখন আমার জল এসে গিয়েছে। জমাট বাধা অশ্রু। আমার প্রকৃত বান্ধব এই বৃদ্ধ মানুষটি। কত কষ্ট আজ তার, তবু তুলে দিলেন হাতে আমার প্রাপ্য। কিন্তু কেমন করে নিই আমি এ টাকা? ফেরৎ দিতে চাইলাম, কিছুতে নেবেন না। তখন বললাম, বেশ, এক কাজ করুন, এই আটটা মোহর আপনি রেখে দিন আর কাগজ কলম দিন আমাকে দিলেন কাগজ। লিখলাম, আমার সমস্ত পাওনা সজ্ঞানে বুঝিয়া পাইলাম। নিচে সই করে লিখে দিলাম তারিখ।

বৃদ্ধের চোখে তখন টলটল করছে অশ্রু।

নিজেকে সংবরণ করতে কিছুটা সময় গেল। বললেন, এক কাজ কর। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। যদি বন্ধুদের দিয়ে কোনো কারণে কোনো কাজ না হয় তার জন্যে নতুন একটা ব্যবস্থা নেওয়া যাক। লিসবন থেকে কদিনের মধ্যে ব্রাজিলের দিকে চলেছে এক জাহাজ। তাতে তোমাকে যাত্রী হিসেবে দেখিয়ে দিই। যেতে হবে না তোমাকে এই মুহূর্তে ব্রাজিল। সেটা আমি ব্যবস্থা করব। আমার বন্ধুর জাহাজ। তুমি যে যাত্রী সেটা এখানকার একজন সরকারি মুখপাত্র লিখে দিক। সেটাও আমিও ব্যবস্থা করব। পরে কোনো আকস্মিক কারণে তোমার যাত্রা বাতিল হবে। জাহাজের কাপ্তেনের হাত দিয়ে ব্রাজিলের রাজদরবারে আর তোমার সেই অংশীদারের কাছে চিঠি দিয়ে দাও। তোমার যাবতীয় প্রাপ্য তারা যেন এই জাহাজেই পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন।

তাই হল। আমি তো তখন যেন ঘোরের মধ্যে আছি। চিঠি দিলাম। তার পর প্রতীক্ষা। সাত মাস পরে দেখি জাহাজ ফিরে এসেছে। তাতে আমার নামে মস্ত বড় একটা পেটি। সে একবারে বিশাল। সঙ্গে চিঠি। আর একটা খামে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।

এ পর্যন্ত আমার সমস্ত প্রাপ্য অর্থের হিসেব ওরা পাঠিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে অর্থও। সেটা পেটির মধ্যে আছে।

ছ বছরে কাপ্তেনের হাতে লাভ বাবদ যা দিয়েছিল, তা ছাড়াও আমার যা প্রাপ্তি তা এতদিনে সুদেমূলে হয়েছে ১১৭৪ মোহর।

প্রথম চার বছর অছির হাতে ছিল পুরোপুরি হিসেব নিকেশের ভার। তাতে আমার নামে সঞ্চয় একুনে সুদে আসলে মোট ৩২৪১ মোহর।

রাজকোষে সঞ্চিত অর্থ বিলিবণ্টন হয়ে তলানি হিসেবে যেটুকু পড়ে আছে তার মুদ্রামূল্য মোট ৮৭২ মোহর। এ ছাড়াও গির্জার কোষাগারে কিছু সঞ্চয় আছে। সেটা আমি যদি দাবী করি তবে তারা দিয়ে দিতে বাধ্য। কিন্তু দাবী করব কি করব না সেটা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছাধীন।

অর্থাৎ বলতে চায় আমি যেন দাবী না করি। তো বেশ আমার অত গরজ কীসের! সৎকাজে ব্যয় হবে টাকা, তাতে পাঁচজনের মঙ্গল হবে, নয় দাবী না-ই করলাম। কী এসে যায়।

আর অংশীদার বন্ধুটির চিঠিতে তো কেবল প্রশস্তি আর আপ্যায়নের ঘটা। কবে যাব আমি তারই জন্যে সে নাকি উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। আমার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করেছে বারবার। সঙ্গে ভেট। পাঠিয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিনি আর চুরুট। তারও অর্থমূল্য কম নয়।

মোটমাট এখন আমি রীতিমতো বড়লোক। শুরুটা যে এমন দারুণ হবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। চিঠি পড়ে আর সব মিলিয়ে দেখে আমার তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দাখিল। হাত পা থরথর করে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। ভাগ্যিস কাপ্তেন ছিলেন পাশে, তাই যক্ষা। আমার শুভানুধ্যায়ী সুহৃদ। তাড়াতাড়ি ব্র্যান্ডির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। তাই খেয়ে খানিকটা ধাত্রস্থ হলাম।

তবে অসুস্থ হল শরীর। সেটা অবিশ্যি পরে। আকস্মিকতা থেকেই এই অসুস্থতা। ডাক্তার ডাকা হল। দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। বললেন, রক্ত নেই শরীরে, রক্ত দিতে হবে। তখন রক্ত দেওয়া হল। তাতে খানিকটা চাঙ্গা হলাম। পরে ধীরে ধীরে অসুস্থতা সম্পূর্ণভাবে কেটে গেল।

আসলে অর্থই ঘটায় মানুষের জীবনে অনর্থ। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এলাম এদেশে,–সভ্য জগতের মাঝখানে, অমনি রক্তশূন্য হল শরীর। কই, থাকতাম যদি দ্বীপে, এসব ঝকমারি কি পোয়াতে হত। আর টাকা হয়েছে বলেই না এত গোলমাল! টাকার জোরেই না এল এতবড় ডাক্তার! ধনী মহারাজ যে আমি এখন। বিশাল বিপুল অর্থের মালিক। প্রায় ৫০০০ স্টার্লিং আমার হাতে। প্রতিবছর হেসে খেলে ফেলে ছড়িয়ে জমা হবে আরো হাজার স্টার্লিং আমার নামে। কিন্তু কী করে খরচ করব এত টাকা!

পয়লা কাজ আমার শুভানুধ্যায়ী আমার পরমাত্মীয় সেই কাপ্তেনকে একশ মোহর ফিরিয়ে দেওয়া। জীবনের শেষ সঞ্চয় বলতে গেলে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। এটা না ফেরৎ দিলে বন্ধুত্বের অসম্মান হবে। দিলাম তাই। কিন্তু এ ঢুকতেই সন্তুষ্ট নয় মন। তখন সরকারি উকিল ডাকিয়ে দলিল করলাম। আমার অংশীদার করে নিলাম। নির্দেশ দিলাম এইরকম, যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন আমার সাস্বত্সরিক আয় থেকে একশ মোহর করে পাবেন, আর তিনি মারা গেলে পঞ্চাশ মোহর করে পাবে তার ছেলে। এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হবে না।

কিন্তু তাতেও যে বিস্তর টাকা থেকে যায়! তাও কী কিছু কম! সেগুলো রাখি কোথায়। এ তো আর নির্জন নিরালা দ্বীপ নয় যে গুহার এক কোণে অবহেলায় ফেলে রাখব, কেউ দেখবে না, বা দেখলেও হাত দিতে সাহস পাবে না। এ হল খোদ শহর। এখানে নানান বিপদ। টাকা কেড়ে নেবার জন্যে লোক ওত পেতে বসে আছে। অতএব সে টাকার নিরাপত্তা তো চাই।

তা আমার তো আর ঘরবাড়ি নেই যে নিরাপদে রেখে দেব কোথাও। ভেবে চিন্তে দেখলাম কাপ্তেনেই আমার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। সেখানেই রাখব কি সব? কিন্তু তার আগে আরো কিছু করণীয় আছে।

সেই বিধবা, তারও প্রতি আমার কর্তব্য কিছু কম নয়। অসীম দারিদ্র্যের মধ্যেও আমার অর্থ ফেরৎ দেবার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন। দিয়েছিলেনও একদা । কিন্তু থাকেন যে তিনি লন্ডনে। আর আমি এতদূরে লিসবনে! কীভাবে করব কর্তব্য? তখন এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। লিসবন থেকে প্রায়ই লন্ডনে তার যাতায়াত আছে। তাকে বললাম আমার হয়ে যেন তিনি বিধবার সঙ্গে দেখা করেন, তাকে আমার এই অনুদান পৌঁছে দেন! এটা কৃতজ্ঞতার স্মারক। যেন অন্য কিছু মনে না করেন। আর যেন বলে আসেন, ভবিষ্যতেও এ জাতীয় অনুদান তিনি আমার কাছ থেকে পাবেন। নিয়মিত। যেমন করে হোক আমি পাঠিয়ে দেব।

লন্ডনের দুই বোনকেও হতাশ করলাম না। দিলাম শ পাউড করে দুজনকে। তাদের অবিশ্যি অবস্থা ভালো। সাহায্যের দরকার নেই। তবু এই যে আমি পেয়েছি এতগুলো টাকা, খরচ করতে হবে তো।

ব্যস, সব কর্তব্য শেষ। করণীয়ও। সঙ্গে বিস্তর টাকা। কী করব রেখে যাব? ঠিক করলাম, না। সঙ্গেই থাক সব। বরং কিছু আরো কমিয়ে নিই।

তখন চিঠি লিখলাম গির্জা কতৃপক্ষের কাছে। সঙ্গে পাঠালাম আটশ বাহাত্তর মোহর। বললাম, এটা আপনার অতিরিক্ত প্রাপ্য। নিয়ে নিন এটা। এর পিচশ আপনাদের গির্জার ব্যয়ে লাগুক, বাকিটা দীন দরিদ্রের সেবায় ব্যয়িত হোক।

পাঠিয়ে দেবার পর খেয়াল হল, তাইতো কেন পাঠালাম আগে ভাগে! আমি না যাব বলে ঠিক করেছি ব্রাজিলে। মনের কুয়োয় তখন নামিয়ে দিলাম ডুবুরি। খোঁজখবর করে আমাকে জানাল–মিথ্যে কথা, তোমার মোটে ব্রাজিলে যাবার ইচ্ছে নেই। আসলে মনে মনে ধর্ম নিয়ে তুমি ভারি ঘাবড়ে গেছ। ভয় আছে তোমার। সেখানে তো সবাই প্রোটেস্টান্ট। তুমি এদিকে রোম্যান ক্যাথলিক বলে পরিচিত। যদি তাইতে শেষে বাঁধে কোনো গণ্ডগোল।

কথাটা ঠিকই। ধর্ম নিয়ে মনে কিছুটা ভয় আছে বটে। ইদানীং যা সব চলছে। যদি ঘটনাচক্রে তার শিকার হয়ে পড়ি। যদি এটা বলতে সেটা বলে কাউকে চটাই। বরং থাক, ব্রাজিল নয়, আমি ইংল্যান্ডের দিকে যাই। ধনসম্পদ সব সমেত। সেখানে গিয়েই নয় থিতু হবার চেষ্টা করি।

সেই মর্মে অছি পরিষদকে একখানা চিঠি লিখলাম। আর আমার অংশীদারকে। আমার অংশ তদারকীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাকে দেওয়া হল। অছিদেরকে নির্দেশ দিলাম কোথায় কোথায় বাৎসরিক আয়ের অংশ পাঠিয়ে দিতে হবে সেই মর্মে। অংশীদারকে বললাম, হয়ত ব্রাজিলে কোনোদিনই আমার যাওয়া সম্ভব হবে না। সুস্থির ভাবে আমি জীবনের শেষ কটা দিন কাটাতে চাই। আমাকে যেন ব্যবসার এটা ওটা ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে তিনি বিব্রত না করেন। এ ব্যাপারে যা ভালো তিনিই করবেন। আমি বছরে বছরে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের অর্থ পেলেই নিশ্চিন্ত।

মোটমাট নির্ঞ্ঝাট এখন সব দিক থেকেই। আর কোনো দুশ্চিন্তা আমার মনে নেই। এবার রওনা হব। কিন্তু যাব কোন পথে? জাহাজে চড়তে কেন যেন আর মন চায় না। কী তার কারণ বুঝি না, কিন্তু ইচ্ছেটা যে বাস্তব, তার মধ্যে এতটুকু খাদ নাই- এটা টের পাই।

কি জানি হয়ত ।সৗভাগ্যের মুখ দেখেছি বলে দুর্ভাগ্যকে বরণ করতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। এটা হতে পারে। সমুদ্র যাত্রা তো আমার পক্ষে সুখকর নয়। সেটা এই নিয়ে তিন তিনবার ভালোভাবেই টের পেলাম। কেন আর তবে অনর্থক ঝঞ্ঝাট।

কাপ্তেনকে বললাম সব। তিনি আমার মতে সায় দিলেন। বললেন, এক কাজ কর। তুমি বরং হাঁটাপথে যাও। বিস্তর লোক যায় এই পথে। এখান থেকে সোজা যাবে গ্রোয়েনে, সেখান থেকে বিস্কে উপসাগর পেরিয়ে উঠবে রোশেলে। প্যারিসে যাবার এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। তারপর তো কালে, সেখান থেকে ডোভার। ব্যস, পৌঁছে গেলে তুমি ইংল্যান্ড! বা যদি মনে কর, কালের পথ না ধরে, তুমি মাদ্রিদের মধ্য দিয়েও যেতে পার। যেটা মনঃপূত হয় আর কি! মাদ্রিদ পেরিয়ে গেলেও সরাসরি ফ্রান্সে পৌঁছে যাবে।

এর মধ্যে কালে থেকে ডোভার শুধু জাহাজে পাড়ি দিতে হয়, বাকি গোটা পথটাই হাঁটাপথ। আমার তো আর কোনো তাড়া নেই। সময় অঢেল। হুন্ডি করে নিয়েছি যাবতীয় টাকাপয়সা। সেদিক থেকেও নিশ্চিন্ত। সুতরাং এটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা।

সঙ্গীও জুটে গেল। আমি আর ফ্রাইডে তো আছিই। কাপ্তেন যোগাযোগ করিয়ে দিলেন লিসবনের এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর পুত্রের সঙ্গে। তিনি ইংরেজ। যাবেন তিনি ঐ পথে। তো মন্দ কি। পরে দেখি আরো দুজন সঙ্গী হাজির। এরাও ইংবেঙ্খ এবং বণিক। হাটা পথে গোটা পথ পাড়ি দেবে। পরে আরো দুজন এসে দলে যোগ দিল। তারা পর্তুগিজ। প্যারিস অব্দি যাবে। ভদ্র সভ্রান্ত ব্যক্তি। সঙ্গে একজন আবার ভৃত্য। অর্থাৎ মোট আটজনের দল। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে!

তা রওনা হলাম। চিন্তা কীসের আমাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রও তো কিছু কম নয়। মোটমাট সব দিক দিয়েই আমরা স্বয়ং সম্পূর্ণ। আর দল হিসেবে তো অনবদ্য। সবার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ আমি। সবাই যে কোনো ব্যাপারে আগে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে। আর দুটি ভূত– সদা জাগ্রত তাদের আচরণ। সব সময় আমাকে খুশি রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা। এমন সঙ্গ কি আর কারো ভালো না লেগে পারে।

ভয় নেই আপনাদের। ভাববেন না আমি এখন সেই যাত্রার বিশদ বিবরণ দিতে বসব। সেটা আমার ইচ্ছেও নয়। দেখেছেন আপনারা, আমি আমার সমুদ্র যাত্রার গল্প পুঙ্খানুপুখ শুনিয়ে আপনাদের বিব্রত করি নি। সেটা আমার স্বভাবের বাইরে। তবে হ্যাঁ, কয়েকটি কথা অবশ্যই বলব। যাত্রাকালীন অদ্ভুত কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা। আশা করি তাতে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না।

মাদ্রিদে নিরাপদেই এসে পৌঁছলাম। পথে কোনো বিঘ্ন হয় নি। সেটা আমাদের পরম সৌভাগ্য। ইচ্ছে ছিল থাকব দুদিন সেখানে, স্পেনের রাজদরবার দেখব, ঘুরে ঘুরে দেখব এটা ওটা দর্শনীয় স্থান, কিন্তু বিধি বাম। গ্রীষ্মের সেটা শেষ পর্যায়। কদিনের মধ্যে শীত পড়বে। শীত মানে তো বরফ। রাস্তা ঘাট বনবাদাড় বরফে ছেয়ে যায়। সুতরাং সময়। থাকতে থাকতে আর দেরি না করে রওনা হওয়া মঙ্গল।

অক্টোবরের মধ্য ভাগ সেটা। এসে পৌঁছলাম নাভারে। পথে কত মানুষ যে সাবধান করল!– খবরদার, এ পথে আর এগুবেন না। বরফ পড়ছে ভীষণ। ঘুরে পাস্পেলুনা দিয়ে যাবার চেষ্টা করুন।

গোটা এলাকাটাই ফ্রান্সের পার্বত্যঞ্চল। পাস্পেনাও তাই। তবে পাহাড় সেদিকে তেমন উঁচু নয়। অর্থাৎ তুষারপাতের সম্ভাবনা কম।

তা পৌঁছে দেখি আবহাওয়া চমৎকার। গরম বেশ। গায়ে পোশাক রাখা দায়। আল্লদে আমরা তো আটখানা। ওমা, দেখতে না দেখতে পীরেনিজ পর্বতমালার দিক থেকে ছুটে এল এমন একফালি বাতাস! সে যা শীতল আর কনকনে আমি বলে বোঝাতে পারব না। গায়ে যেন হুল বেঁধায়। আঙুল টাঙুল তো রীতিমতো টনটন করতে শুরু করেছে।

আর বেচারি ফ্রাইডের যা করুণ অবস্থা! শীতের দেশে থাকে নি তো কোনোদিন। জানবে কী করে শীতের হালচাল । দেখি ঠকঠক করে কাপে অষ্টপ্রহর। তবে সে প্রথম দু চার দিন। পরে ধাতস্থ হয়ে গেল।

ভীষণ বরফ পড়া শুরু হল অকস্মাৎ। আমার ভাগ্যটাই এরকম। সুস্থ সুষ্ঠু ভাবে কোনো কাজ কি হবার জো আছে! পথঘাট দেখতে না দেখতে বরফের নিচে। কোথাও কোথাও এক কোমর সমান। এর মধ্য দিয়ে কি হাঁটা যায়! বিশদিন সেখানেই রয়ে গেলাম। যদি পরিবর্তন হয় আবহাওয়ার, যদি মেঘ কেটে গিয়ে ঝরঝরে নীল আকাশের দেখা মেলে! হল না তাও। তখন সবাই মিলে যুক্তি পরামর্শ করে ঠিক করলাম এখান থেকে ফিরে যাব ফারাবিয়ায়, সেখান থেকে জাহাজে করে যাব বোরদোতে। সামান্যই পথ। মোটমাট ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছু সমুদ্র যাত্রা নয়।

ঠিক সেই সময় জনৈক ফরাসি ভদ্রলোকের সাথে দেখা। ঘুরতে বেরিয়েছেন। গিরিব পেরিয়ে সিধে এসেছেন এদিকে। যাবেন মাদ্রিদ। বললেন, আমি তো ল্যাঙ্গুইড়ক হয়ে এলাম। ছোট্ট গ্রাম। অখ্যাত অচেনা। পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে এক গাইড। আপনারা তার সাথে যোগাযোগ করুন। ঐ পথে গেলে আপনাদের কষ্ট অনেক লাঘব হবে। অযথা ঘুরতে হবে না।

অমনি গাইডের খোঁজে লোক পাঠালাম। দেখা পাওয়া গেল। বললাম আমাদের উদ্দেশ্য। বলল, কোনো অসুবিধে নেই, চলুন, আমি নিয়ে যাব। তবে হ্যাঁ, সঙ্গে আপনাদের অস্ত্রশস্ত্র আছে তো?

বললাম, আছে।

–আর শীতের পোশাক?

–তা-ও আছে।

–তবে তো নিশ্চিন্তু! সে আশ্বাস দিল, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। বরফ পড়ে তো ভীষণ। এই সময়ে নেকড়ে গুলো বড় চঞ্চল হয়ে পড়ে। খাদ্যের যে অভাব। তারা হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ঘাড়ে। বিশেষ একরকম নেকড়ে আছে, তারা দুপায়ে চলে। আমরা বলি দুপেয়ে বাঘ। আর ভল্লুক আছে। তারাও কম হিংস্র নয়।

আরো কথা বার্তা হল। আরো বারজনের একটা দল পেলাম। সঙ্গে তাদের চাকর বাকর এটা ওটা হরেক জিনিস। দলে ফরাসি স্পেনীয় দুরকম লোকই আছে। তা মন্দ কি। দল ভারি হলে তবেই না ভালো। রওনা হলাম।

সেটা পনেরই নভেম্বর। আমার মনে আছে। প্রথমে কিছুটা পিছু হটা। মাদ্রিদ থেকে যে পথে এসেছি সেই পথ দিয়ে পিছোনো। তা বিশ মাইলের কিছু বেশি। দুটো নদী পেরুতে হল। আর গ্রাম। সমতল অঞ্চল। উষ্ণ আবহাওয়া। পর্বতশীর্ষ থেকে অনেকটা যে নিচে। তারপর ফের ওঠা শুরু। অর্থাৎ যাকে বলে আরোহণ। একটা মোড় ঘুরে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাহাড়। তাতে শুধু ঢেউয়ের পর ঢেউ। কত যে চূড়া! আর বরফে রয়েছে সব ধপধপে সাদা হয়ে। দেখলে ভয় লাগে। গাইড বলল, ঐ পাহাড়ের মাথায় না হলেও কাঁধের কাছ দিয়ে আমাদের যেতে হবে।

একদিন সমানে বরফ পড়ল। দিবা রাত্র–মুহূর্তের জন্যেও কামাই নেই। সেদিন আর এগোনো সম্ভব হল না। উঠে এসেছি এখন অনেক উঁচুতে। সাবাশ গাইড! আনল এমন পথ দিয়ে তাতে কষ্ট হয় নি এতটুকু। বুঝতে অব্দি পারি নি আমরা এত উপরে এসেছি। এবার নামা। যাকে বলে অবরোহণ। তখনি বরফের মুখে পড়লাম।

তা সে বিপদও কাটল। পরদিন বিকালে। যথারীতি আমরা চলেছি ঘোড়ার পিঠে। নামছি। রাত হতে তখনো ঘন্টা দুই বাকি। একটু ছায়া ছাড়া ভাব নিজেদের মধ্যে। গাইড চলছে সবার আগে। পিছনে আমরা ছোটো ছোটো উপদলে বিভক্ত। হঠাৎ দেখি বন থেকে বেরিয়ে এল তিনেট নেকড়ে। ভীষণ তাদের আকৃতি। পিছনে পিছনে এক ভল্লুক। সেও ঘোর দর্শন। দুটো নেকড়ে চোখের নিমেষে ঝাঁপিয়ে পরল গাইডের উপর, তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিল। তৃতীয়টা লাফিয়ে পড়ল ঘোড়াটার উপর। সে কী আর্ত চিৎকার গাইডের। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা হতবাক। বিহ্বল যাকে বলে। নইলে কোমর থেকে বের করব পিস্তল, তাক করে ঘোড়া টিপব–পারি না তা-ও!

তখন দেখলাম ফ্রাইড়ের খেল। সাবাশ ফ্রাইডে! পিস্তল নিয়ে ছুটে গেল নেকড়ের প্রায় মুখের গোড়ায়। টিপল ঘোড়া। আগুন বেরিয়ে গেল এক ঝলক। পরমুহূর্তে দেখি একটা নেকড়ে মরে পড়ে আছে আর বাকি দুটো উধাও। ভল্লুকটারও সেই মুহূর্তে আর দেখা নেই।

.

সে কী উল্লাস ফ্রাইডের। লাফাতে লাফাতে গিয়ে গাইডকে তুলল। জানি না আরেকটু দেরি হলে কি হত বেচারির। জখম হয়েছে, তবে তেমন খুব একটা নয়। হাতে আর ডান পায়ে দুটো কামড়ের দাগ। ধরেছিল সবে কামড়ে দু দিক থেকে দুই শয়তান। ঠিক সময় মতো ফ্রাইডে গুলি চালিয়েছে। এটা আমার পরম গৌরব। আমরাই অনুচর করল কিনা গাইডের প্রাণরক্ষা, প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিল। সবাই তারিফ করতে লাগল ফ্রাইডেকে।

অবে ঘোড়াটার আর পড়ে প্রাণ নেই। সব শেষ। মাথাটা পুরো খাবলে নিয়ে গেছে নেকড়ে। পড়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন মুণ্ডহীন একটা শব। গাইডকে তুলে নেওয়া হল আরেকটা ঘোড়ায়। ঘাবড়ে গেছে বেচারি ভীষণ। একা যাওয়ার আর সাহস নেই।

এদিকে তো আরেক কাণ্ড। গুলির আওয়াজ শোনামাত্র দুধারের বনভূমি যেন সরব হয়ে উঠেছে। সে যে কত গর্জন, কত ডাক, কত চিৎকার, কত অন্য রকম হাজারো শব্দ–তার আর ইয়ত্তা নেই। মনে পড়ল আফ্রিকার সেই উপকুল ভাগের কথা। গুলি করে মেরেছিলাম চিতাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে কী তর্জন গর্জন বনের ভিতরে। সঙ্গে সিংহের গুরুগম্ভীর নিনাদ। তবু রক্ষে এই বনে সিংহ নেই। থাকলে কী অবস্থা হত বলা যায় না।

নেকড়ে পর্ব সাঙ্গ হতে ফ্রাইডে এবার পড়ল ভল্লুকটাকে নিয়ে।

সে বড় চমকপ্রদ ঘটনা। চমক এই জন্যে বলি, কেননা ভল্লুক নিয়ে যে অত মজা করা যায় আমরা জানতাম না। কতকগুলো অদ্ভুত গুণ আছে ভক্ষুকের আমরা জানি। এমনিতে শান্ত সদাশয় রীতিমতো ভদ্র জীব। দেখতে বেশ নাদুসনুদুস, হাঁটেও চেহারার সাথে সঙ্গতি রেখে দুলকি চালে। নেকড়ের মতো লাফাতে পারে না। সেটা সম্ভবও নয়। অমন হালকা অমন নিপুণ নয় যে দেহ। তবে দুটি বিশেষ গুণের অধিকারী। প্রথমত যাকে তাকে আক্রমণ করে না। নিতান্ত ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও না। এটা তার ধর্ম। যদি তুমি কর আক্রমণ তখন সে প্রতি আক্রমণ করতে বাধ্য থাকবে। যদি তুমি জ্বালাতন কর তবে সে পাল্টা তোমাকে জ্বালাতন করবে। করো না কিছু সে যাবে হেঁটে তোমার পাশ দিয়ে, তোমাকে প্রক্ষেপ মাত্র করবে না। সেদিক থেকে অত্যন্ত ভদ্র। আর একটু এক বগা ধরনের। যে বরাবর চলেছে, সহসা দিক পরিবর্তন তার ধর্ম নয়। সেখানে তুমি যদি মুখোমুখি পড়ে যাও, তবে নেমে দাঁড়াও তুমি! বা পথ ছাড়ো। সে তো মহারাজেরও এক কাঠি ওপরে। সরবে কেন?

আর হ্যাঁ, বিপরীতে চলতে চলতে যদি তুমি থমকে যাও, তাকাও তার দিকে, সে-ও থমকে যাবে, তোমার দিকে তাকাবে। এটা ধর্ম। এবং সেক্ষেত্রে সে ধরে নেবে বিপদের সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ পিছনে লাগার মতলব আছে তোমার। সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে কখন তুমি পিছনে লাগো। অর্থাৎ উত্যক্ত কর। যতক্ষণ না কর সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মারো তুমি ঢেলা, সে কিছু বলবে না। কিন্তু ঢেলা যেই গায়ে এসে পড়বে, সে তোমার উপর হুঙ্কার দিয়ে লাফ ছাড়বে। সেক্ষেত্রে তোমাকে যতক্ষণ না শায়েস্তা করা হচ্ছে তার স্বস্তি বা শান্তি নেই। ভীষণ প্রতিহিংসা বোধ ভালুকের।

তা এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম গাইডকে নিয়ে, অন্য দিকে নজর দেবার আর ফুরসৎ হয় নি। হঠাৎ শুনি ফ্রাইডের গগন বিদারী চিৎকার–পেয়ে গেছি এবার, পেয়ে গেছি। ভারি উল্লাস তার কণ্ঠে। আমাকে বলল, হুজুর, মালিক, এবার খেলা দেখার আপনাদের। হাসাব। দেখুন চেয়ে ভালো করে। ছাড়ছি না একে।

তাকিয়ে দেখি সেই ভালুক। ঘোর দর্শন। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ। কোন অবকাশে আবার বেরিয়ে এসেছে জঙ্গলের মধ্য থেকে। গজেন্দ্রগমনে চলেছে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে।

বললাম, বোকামি করিস নে ফ্রাইডে। জানোয়ার কি বুঝবে তোর মজা? তোকে কামড়ে দেবে, চাই কি গিলে ফেলবে। ফ্রাইডে বলল, মালিক, আপনি দেখুন না, কী মজা হয়। আপনারা হেসে কুটিপাটি হবেন। আমাকে গিলে খাবে কি, উলটে আমিই ওকে গিলে খাব।

এই বলে চামড়ার জুতো ছেড়ে রবারের জুতো পরল। তাতে বরফের উপর দিয়ে ছুটতে সুবিধে। আর ছোটায় তো ওর তুলনা নেই। কী আর করি আমরা। রুদ্ধ নিশ্বাসে হতবিহ্বল চিত্তে তাকিয়ে রইলাম এই ডাকাত ছেলেটার পানে।

ভালুক চলেছে হেঁটে। কোনো দিকে তার ভ্রূক্ষেপ মাত্র নেই। কাউকে সে উত্যক্ত করতে চায় না। নিজেকেও কেউ উত্যক্ত করে সেটাও তার কাম্য নয়। ফ্রাইডে ছুটতে ছুটতে তার পিছু ধরল। বলল, এ্যাই, এ্যাই ভালুক। আমি কথা বলছি তোর সাথে। তুই বলবি না কথা?

বলবে কী করে? ভালুক কি বোক মানুষের ভাষা! হেঁটে চলল সে একই ভাবে। ফ্রাইডে ঠিক তার পিছন পিছন। আমারও কৌতূহলী জনতা চললাম তাদের পিছু পিছু।

সে এক ঘন জঙ্গল। ফ্রাইডে ঢিল ছুড়ল । ঠক করে পড়ল গিয়ে তার মাথায়। তেমন আঘাত না। কিন্তু ঐ–উত্যক্ত করেছ কি রক্ষা নেই। আর যায় কোথায়! অমনি চকিতে ঘুরে ফ্রাইডেকে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে ফ্রাইডে দৌড়। সে এক রীতিমতো প্রতিযোগিতা যেন। ভালুকের পায়েও সমান তেজ। আর ঘেৎ ঘোৎ করে সমানে। আমরা তো ভয়ে থ। কী হবে এখন কে পারে বলতে! ধমক দিলাম ফ্রাইডেকে ফ্রাইডে, এখনো গুলি কর। নয়ত মুশকিলে পড়বি। তুই না পারিস আমরা করছি গুলি।

ফ্রাইডে ততক্ষণে ছুটে তড়বড়িয়ে উঠে পড়েছে একটা গাছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, মালিক, গুলি করার দরকার নেই। আপনি দেখুন না কত মজা হয়। হাসতে হাসতে আপনাদের পেটে খিল ধরে যাবে।

বলে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় আরো খানিকটা উঁচুতে উঠে বসে গেল একেবারে মগ ডালে। তারপর তার এক প্রান্তে বসে মনের আনন্দে পা দোলাতে লাগল।

হঠাৎ দেখি ভালুক মহারাজও গাছ বেয়ে উঠছেন। অদ্ভুত তারও ক্ষিপ্রত্য। ঠিক মানুষ যেভাবে উঠে হুবহু সেইরকম। আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ। ভাবখানা এখন–দাঁড়াও না বাছাধন, দেখাচ্ছি তোমার মজা। ভেছ কী।

তা নিমেষের মধ্যে দেখি ফ্রাইডে যেখানে প্রায় তার কাছাকাছি হজির। মাঝখানে শুধু একখানা ডালের ব্যবধান। এগোবে বলে পা বাড়িয়েছে সবে, অমনি শুরু হল ফ্রাইডের বজ্জাতি। আমাদের বলল, দেখুন আপনারা, ভালুক মশায় কত সুন্দর নাচতে পারেন। বলে সেই ডাল ধরে সে কী নড়াবার ঘটা! বেচারা ভালুক তো এই পড়ে কি সেই পড়ে। ঘন ঘন পিছন দিকে তাকায়। আর আঁকড়ে ধরে জোরসে ডাল। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে নাচের ভঙ্গিতে শরীর। আমরা তো হেসে কুল পাই না।

তখনো শেষ হয় নি আর কি বজ্জাতি। হঠাৎ থামল ফ্রাইডে। অমনি নাচও বন্ধ। দেখি তাকিয়ে আছে দুজন চোখে চোখে। ফ্রাইডে বলল, কীরে, আসবি না আরেকটু কাছে? আয়! যেন ভালুক নয়, মানুষ ও। ফ্রাইডের সব কথা বোঝে। দেখি অবাক কাণ্ড, ডাক শোনার পর সেও গুটিগুটি এগোবার চেষ্টা করছে, তখন ফের দুলুনি। ফের নাচ। ফের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ভাব।

ফ্রাইডে বলল, কী রে, আর আসবি না? তবে দেখ এখন আমি কী করি! বলে ডালে পা রেখে নিচের দিকে নামতে নামতে ঝুলে পড়ে হঠাৎ এক লাফ। সোজা মাটির উপর। আমরা তো ধরে নিয়েছি ভালুকও পড়বে লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে। ওমা, দেখি লাফের ধার কাছ দিয়েও যায় না। গুটি গুটি ডাল আঁকড়ে ধরে পিছু হটতে নামল খুঁড়ি বেয়ে মাটিতে। ঠিক যেমন নামে বিড়াল। আগে পিছনের পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করল। দাঁড়াল শক্ত হয়ে। তারপর নামিয়ে দিল সামনের পা দুখানা।

আর ফ্রাইডে তো আগেই সেখানে হাজির। নামার সাথে সাথে কানের ফুটোয় পিস্তল ঢুকিয়ে দুম। বিশাল দেহ পপাত ধরণীতলে।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমাদের। সে যেন চরম উৎকণ্ঠা। কী হয় কী না হয় তাই নিয়ে অবিরাম সমস্যা। হেসেছি ঠিকই, কিন্তু সভয়ে। যদি একটা কিছু ঘটে যায়!

ফ্রাইডেকে বললাম, তা হ্যাঁরে ফ্রাইভে, এই যে করলি সব এতক্ষণ ধরে, যদি হঠাৎ বেফাঁস একটা কিছু হয়ে যেত! যদি ঝাঁপিয়ে পড়ত তোর ঘাড়ে!

বলল, পড়বে কী করে! আমি যে জানি সব। আমাদের ওখানে এইভাবেই তো ভালুক মারে।

বললাম, মিথ্যে কথা। তোরা পিস্তল কোথায় পাবি যে এইভাবে মারবি ভালুক?. বলল, পিস্তল ছাড়া বুঝি কিছু মারা যায় না। আমাদের যে তীর আছে। তার কি তেজ কম?

খেয়াল করিনি এতক্ষণ, দ্বিতীয় গুলির আওয়াজ হবার সাথে সাথে গর্জন যেন আরো দশগুণ বৃদ্ধি পেল। গলা খাকারির মতো ডাকে নেকড়ের দল। স্পষ্ট সে ডাক আমাদের কানে এসে পৌঁছেছে। আরো নানান ডাক। বাড়ছে ক্রমশ শব্দ। এদিকে বেলা প্রায় শেষ। গাইড বলল, চলুন আর দেরি করা ঠিক না। অনেকটা পথ যেতে হবে এখনো। তবে বিপদ কাটবে। সামনে আরো একটা ভয়ের এলাকা আছে।

ফ্রাইডে বলেছিল নিয়ে যাবে সাথে ভালুকের বিশাল চামড়াটা। আমরা রাজি হই নি। সময় লাগবে প্রচুর। ততক্ষণে এগিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

বরফের এলাকা তখনো পার হতে পারি নি। দুধারে গহীন বন। দূরে দেখা যায় সমতল ভূমি। সেখানে চাষের জমি, পুকুর, ছোটো ছোটো বাড়ি।

পরে শুনেছিলাম, বরফের সময়ে এই সব গ্রামে মানুষ বড় অসহায় অবস্থায় দিন। কাটায়। নেমে আসে বন থেকে যাবতীয় হিংস্র জন্তু জানোয়ার। ক্ষুধার তাড়নায় গরু মাষ ছাগল ভেড়া যা সামনে পায় নিয়ে যায় মুখে করে। কত মানুষ মারা যায়।

গাইড বলল, সামনে যে বন তাতে এত নেকড়ে, দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন। পৃথিবীর যাবতীয় নেকড়ে হয়ত এই বনেই আছে। চলুন তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করি।

সূর্য তখন অস্তাচলে। ঘোর ঘোর ভাব। জঙ্গলের প্রথম অংশে তখন আমরা। রুদ্ধ নিশ্বাসে চলেছি এগিয়ে। হঠাৎ সামনে দেখি পাঁচটা নেকড়ে। দল বেধে চলেছে একদিক থেকে আরেকদিকে। আমাদের প্রক্ষেপ মাত্র করল না। হয়ত সন্ধান পেয়েছে মড়ির। কোনো জানোয়ার হয়ত মরে পড়ে আছে জঙ্গলের কোনো প্রান্তে। তারই সন্ধানে চলেছে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা অবস্থায়।

গাইড বলল, সাবধান। যে যার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। বিপদ যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো দিক থেকে আসতে পারে।

সেটা অবিশ্যি বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্ধকার নামার সাথে সাথে যে যার হাতে খুলে রেখেছি অস্ত্র। আর সতর্ক সজাগ চোখ। অন্ধকারে যতটুকু দেখা যায় চেষ্টা করছি তার চেয়ে আরো বেশি দেখতে।

প্রায় এক ক্রোশ পথ নিরাপদেই পার হলাম।

একটু ফাঁকা মতো জায়গা এরপর। দুধারে বম। দেখি মন্তু ভিড় সেখানে। পড়ে আছে পথেরমাঝে মরা একটা ঘোড়া। তাকে ঘিরে প্রায় ডজন খানেক নেকড়ে। মহানন্দে চলছে তাদের ভোজ।

পাশ কাটিয়ে একটু ঘুর পথ ধরে জায়গাটা পার হয়ে গেলাম। দরকার কী বাপু ওদের বিরক্ত করার। ফ্রাইডে দু তিনবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করল,–দেব চালিয়ে গুলি? মালিক, আপনি শুধু একবার হুকুম করুন। হাত আমার নিশপিশ করছে। বললাম, না। খবরদার এদের চটিয়ে দিলে এখন বিপদের আশঙ্কা। সামনে জঙ্গল আরো ভয়ঙ্কর। তবে আর জান নিয়ে বেরুতে পারব না।

সত্যিই ভয়ঙ্কর সেই সামনের জঙ্গল। ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির তো আর বিরাম নেই। এসে পড়েছি এবার জঙ্গলের প্রায় মাঝ বরাবর। হঠাৎ ডাইনে চোখ পড়তে দেখি সে প্রায় শখানেক নেকড়ে। দল বেঁধে সশস্ত্র সৈনিকের মতো আমাদের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে। কী করি এখন! হঠাৎ মতলব খেলে গেল মাথায়। সবাইকে বললাম, তোমরাও সবাই সারি বেধে দাঁড়িয়ে পড়। দাঁড়াল তাই। কিন্তু তাতে কি আর ভবি ভালে! দেখি একই কদমে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। তখন বললাম, অস্ত্র তুলে ধর। ধরল সবাই তাক করে পিস্তল। বললাম, একজন অন্তর একজন আমি এক, দুই, তিন বলার সাথে সাথে গুলি চালাবে। তারপর খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে বাকিরা। এই অবকাশে যেন আগের তরফের পিস্তলে নতুন গুলি ভরা হয়ে যায়।

তাই হল। ছুটে গেল তিন বলার সাথে সাথে এক ঝাঁক গুলি। তাতে মারা পড়ল কটা। আর বিস্তর জখম। থমকে দাঁড়িয়েছে তখন পুরো দল। ফের বললাম তিন,–অমনি আরো একঝাঁক গুলি। মারা পড়ল আরো কটা। আর জখমের সংখ্যা এবার আগের চেয়ে বেশি। তখন দেখি একজ্জন দুজন কুরে পিছু হটতে শুরু করেছে। শেষে পুরো দলটাই মুখ ফিরিয়ে দে দৌড়। অমনি আমরাও সমবেত চিৎকার করে দিলাম তাড়া। এটা শুনেছিলাম ছোটো বেলা। জন্তুদের উদ্দেশ করে ধ্বনি দিলে নাকি তারা ভয় পেয়ে যায়। পালাতে শুরু করে। পরখ করার সুযোগ হল এতদিন পরে। ভুল নয় কথাটা। বলতে গেলে অক্ষরে অক্ষরে ঠিক।

এই অবকাশে ফের গুলি ভরে নেওয়া হল পিস্তলে। সময় তো নষ্ট করা যায় না। বিপদ যে কোন দিকে আসে কে বলতে পারে। আগাগোড়া বনটাই যে নেকড়ের বন। বলেছে গাইড। কথাটা যে নির্ভুল তার প্রমাণ তো দেখতে পাচ্ছি।

রাত আরো বেড়েছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চতুর্দিকে। আলো বলতে আমাদের হাতের মশাল আর ধপধপে সাদা বরফ। বরফের উপর দিয়ে একটা খরগোশ নড়লেও টের পাই। চলেছি চারদিকে নজর রাখতে রাখতে। হঠাৎ দেখি সামনে পিছনে ডাইনে তিন পাল নেকড়ে। তবু বাঁচোয়া ঘাড়ে এসে পড়ে নি কেউ। আমরা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম।

কিন্তু বরফের উপর দিয়ে আমরা চাইলেই তো আর দ্রুতু ছোটা সম্ভব নয়। পা ঢুকে যায় বরফে। সেইভাবেই ভয়ে ভয়ে চলেছি। সামনে আরেকটা ফাঁকা জায়গা। তারপর বন। তাতে ঢুকব এবার। দেখি পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একপাল নেকড়ে।

ঠিক তখনি কানে এল বন্দুকের আওয়াজ। মাত্র একবার তারপর সব চুপ। শুধু হাউমাউ করে ডাকছে নেকড়ের দল। আর ভারি যেন উল্লসিত। একটু পরে দেখি ছুটতে ছুটতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একটা ঘোড়া। মরণ ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে ছুটছে। তার পিছনে ষোল সতেরটা নেকড়ে। পারে কি তাদের সাথে পাল্লা দিতে। একটু পরে দেখি ঘোড়া ছিটকে পড়েছে মাটিতে, আর তাকে ছেকে ধরেছে নেকড়ের পাল। ন

কিন্তু কে ছুড়ল বন্দুক? নির্ঘাৎ আমারই মতো কোনো পথচারী। কিন্তু কোথায় সে? কী তার অবস্থা?

বেশি দূর এগোবার দরকার হল না। হাতের মশালে দেখি মাটিতে পড়ে আছে দুটি মানুষ। একজনের হাতের নাগালের মধ্যে বন্দুক। এখনো ধোঁয়া বেরুচ্ছে বন্দুকের নল দিয়ে। তবে তারা আর জীবিত নেই। একজনের মাথাটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। আরেক জনের নিম্নাঙ্গ পুরোপুরি উধাও। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। নেকড়ের পাল চারপাশে ঘিরে ধরেছে দুজনকে।

তাড়াতাড়ি সরে এলাম সেখান থেকে। ভয় করছে। বা ভয় নয়। প্রচণ্ড আতঙ্ক। বুক কাঁপছে। যদি আমাদেরও ঐ দশা হয়। সামনে এখনো সেই নেকড়ের পাল। তিনশ হবে মাখা গুনতি। দাঁড়িয়ে আছে পথ জুড়ে। করি কী এখন!

উপায় একটা হল। ঈশ্বরের দয়া ছাড়া একে কীই বা বলা যায়। দেখি অদূরে গাছ কেটে রেখেছে অসংখ্য। খুঁড়িগুলো পড়ে আছে পথে। নিয়ে যাবার হয়ত সুযোগ পায় নি। এই তো আমাদের আত্মরক্ষার একমাত্র পথ।

দলবল মিলে ঠাঁই নিলাম সেই খুঁড়ির আবেষ্টনীর মধ্যে। মশাল জ্বালোম আরো কটা। ত্রিভুজাকারে বসেছি সকলে। ঘোড়াগুলো আমাদের মাঝখানে। অর্থাৎ, মারতে হলে মারো আগে আমাদের, তারপর ঘোড়াগুলোকে না। কিন্তু আমাদের মারাটাও আর সহজ নয়। চারদিকে চোখ আমাদের। হাতে দুটো করে পিস্তল। আর প্রচুর গোলা বারুদ। তদুপরি সামনে গুঁডির বেষ্টনী। পারবে কি বাপু আমাদের সঙ্গে টক্কর দিতে?

এল তবু রাগে গর্জাতে গর্জাতে। আমরা আগের নিয়মে গুলি ছুড়লাম। অর্থাৎ সকলে একসাথে নয়, একজন অন্তুর একজন। তাতে মারা পড়লো কটা। আহত হল তার প্রায় দ্বিগুণ। তবু দেখি ভয়ে পালাবার নাম নেই। আহতদের ঘাড়ের উপর দিয়ে আসছে আরো একদল। তখন ফের গুলি ছোঁড়া হল।

গুনে দেখলাম এবার মরেছে মোট আঠার কি বিশটা। জখম প্রায় পঞ্চাশ। কিন্তু এ যে রক্তবীজের বংশ। নির্ভয় নির্বিকার। রাগে ফুঁসছে বাকিরা। মৃতদেহ ডিঙিয়ে এগিয়ে আসছে। নজর আসলে ঘোড়াগুলো। আমরা আড়াল করে আছি তাই আমাদের উপর আক্রোশ।

কিন্তু না, আর গুলি করে এদের রুখবার চেষ্টা করা বাতুলতা। অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন ভূতকে বারুদের ঠোঙাটা দিয়ে বললাম, চটপট ছড়িয়ে দে তো বারুদ চারধারের গুঁড়িগুলোর উপর। দিলো তাই। নেকড়ে দলের বাকিরা মুহূর্তের জন্যে থমকে ঈড়য়ে হয়ত ঠিক করছে তাদের পরবর্তী কর্মপদ্ধতি কী। সে যৎসামান্য অবকাশ। তারই মধ্যে আমাদের কাজ খতম। এগিয়ে এল ফের। অমনি মশাল দিয়ে বারুদের এক ধারে লাগিয়ে দিলাম আগুন। দাউ দাউ করে ব্যাপ্ত হয়ে গেল চোখের নিমেষে চারধারে। এসেছিল যে কটা তাদের বেশির ভাগ গরমের তাপ পেয়ে ঝলসে গেল বা ঠিকরে ছুটে পালাল। ভেদ করে ঢুকল তবু কটা দুঃসাহসী। আমরা গুলিতে চোখের পলকে তাদের নিকেশ করলাম। বাকিরা দেখে ভয়ে ভয়ে পিছোতে শুরু করেছে।

তখন ফের একঝাঁক গুলি আর সেই সাথে মুখে হাত নেড়ে রে রে আওয়াজ। অমনি লেজ গুটিয়ে সবাই দে দৌড়। বিশটার মতোন দেখি মাটিতে পা ঘসটাতে ঘসটাতে পালাবার চেষ্টা করছে। জখম হয়েছে পা। তাই ছুটতে অক্ষম। তখন ঝাঁপিয়ে পড়লাম তলোয়ার হাতে। কচাকচ একেকটা খতম। আর সে যেন হুটোপাটি লেগে গেছে তখন বনের মধ্যে। দুদ্দাড় শুধু ছোটার শব্দ পাই। আর ত্রাহি ত্রাহি ডাক। অর্থাৎ পালাচ্ছে দলবল। এত মৃত্যু এত জখম, সর্বোপরি আগুনের ঐ ঘেরাটোপ–ভয় না পেয়ে কি যায়! একদলকে পালাতে দেখে প্রত্যাশায় আশে পাশে যারা লুকিয়ে ছিল, তারাও লেজ গুটিয়ে দে ছুট।

মোটমাট কিছুটা নির্ভয় এখন। পালাতে যখন শুরু করেছে সহসা এদিকে যে আর আসবে না সেটা সহজে বোঝা যায়। তা হিসেব করে দেখি, মেরেছি প্রায় তিন কুড়ি ঘাটটার মতে নেকড়ে। আর জখম যে কত তার তো ইয়ত্তা নেই। দিনের আলো থাকলে মারতাম আরো ঢের। রাত বলে তবে না মাত্র এই কটা! এখনো যেতে হবে প্রায় এক ক্রোশ। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। তবে আসবে গ্রাম। হাঁকডাক চলছে চারধারে মালুম পাই, তবে ধারে কাছে কেউ আর ঘেঁষে না। অর্থাৎ খবর পৌঁছে গেছে নিজেদের মধ্যে। আমরা যে ভয়ঙ্কর, কিছুতে বাগে আনা যাবে না আমাদের এটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে ঘোড়া ছোটালাম। তবে দেখি জঙ্গল শেষ। বরফও শেষ। সামনে ছোটো ছোটো কুটির। ঝাঁক বেঁধে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের জোয়ানের দল। হাতে সকলের অস্ত্র। আর চোখে ভয়ের ছাপ। জঙ্গলের হাঁকড়াক তো তাদের কানে গেছে। ভয়ে ত্রাসে আতঙ্কে বেরিয়ে এসেছে তাই দল বেঁধে। গ্রামে যে মাঝে মাঝেই হানা দেয় নেকড়ের পাল। নিয়ে যায়, ছাগল গরু মোষ ঘোড়া, এমনকি কখনো কখনো মানুষও। তাই তো পাহারা দেবার এই প্রথা।

কাল রাত। দেখি গাইড আমাদের রীতিমতো অসুস্থ। পা আর হাত ফুলে উঠেছে ঢোল হয়ে। এগোবার সামর্থ্য আর নেই। এমতাবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। তখন রেখে গেলাম তাকে গ্রামে। নিলাম আরেকজন গাইড। সকালে রওনা হয়ে বেলা থাকতে পৌঁছে গেলাম তুলুতে। সে বড় চমৎকার জায়গা। আবহাওয়া বেশ উষ্ণ। শীতের বালাই নেই। নেই এতটুকু তুষার কি একটাও নেকড়ে। নগরবাসী দুচারজনের সঙ্গে আলাপ হল। বললাম আমাদের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের বৃত্তান্ত। বলল, অবাক কাণ্ড, কেমন গাইড ধরেছিলেন আপনারা। ভারি তো দুঃসাহস তার! আর দুঃসাহস বটে আপনাদেরও। স্রেফ বুদ্ধি আর সাহসের জোরে বেঁচে ফিরে এসেছেন। নইলে এই সময় ঐ পথে কোনো মানুষ ফিরতে পারে না। নেকড়ের পেটে যায়। আসলে নজর ওদের ঘোড়ার দিকে। ঐ যে ঘোড়া ছুটিয়ে আসে পথিক, দেখলেই ওদের জিভ লোভে চকচক করে। ক্ষিধেয় যে মরিয়া তখন। ঘিরে ধরে সাথে সাথে। সওয়ারীও একই সাথে সেই লোভের শিকার হয়।

চুপিচুপি বলি আপনাদের, ভয় যে আমিও পাই নি, এটা মোটেও হক কথা নয়। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তিনশ নেকড়ের অমন বিরাট দল, অমন লোলুপ হিংস্র চেহারা আর অত গর্জন–ডাইনে বায়ে সামনে পিছনে শুধু নেকড়ে আর নেকড়ে–আমি জীবনে কখনো দেখি নি বা দেখব যে কখনো স্বপ্নেও ভাবি নি। আরেকটু হলে আমারও বুদ্ধি প্রায় লোপ পেতে বসেছিল। নেহাৎ মনের জোর প্রবল তাই পেরেছি ঐভাবে নিজেকে এবং সেই সাথে গোটা দলটাকে রক্ষা করতে। সেটা সেই লোকটিও বলল–যদি না ঐভাবে বুদ্ধি করে ভাগে ভাগে গুলি চালাতেন, তবে আর এতক্ষণ এখানে বসে গল্প করতে হত না। হাড় কখানা পড়ে থাকত জঙ্গলের মাঝে।

ক্ষুরে ক্ষুরে দণ্ডবৎ হই বাপু নেকড়ের দল। এমন জঙ্গল আমার মাথায় থাক। আমি বরং হাজার বার যাব সমুদ্রে, ঝড়ের মুখে পড়ব, চাইকি জীবন দেব সমুদ্রের গভীরে। তবু জঙ্গলমুখো আর কখনো হব না।

জাহাজে করে গেলাম ফ্রান্সে। উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটে নি। সেখান থেকে এলাম কালেতে। তারপর ডোভার। সেটা জানুয়ারি মাসের চৌদ্দ তারিখ। আমাদের দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল।

এবং সর্বাঙ্গীণ কুশল। শরীরের দিক থেকে তো বটেই এমনকি অর্থ ইত্যাদির দিক থেকেও। হুড়ি করে এনেছি। সেটা ভাঙাতে এতটুকু অসুবিধে হল না। বিস্তর টাকার মালিক আমি এখন। গেলাম কাপ্তেনের সেই বিধবার সাথে দেখা করতে।

কী যে খুশি মহিলা! টাকা পাঠিয়েছি, পেয়েছেন, তার জন্যে কত দিলেন ধন্যবাদ। কত শুভেচ্ছা। কী যে করবেন আমার জন্যে, কী আনবেন, কী খাওয়াবেন, তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। দরদে বুক ভরে গেল আমার। আর শ্রদ্ধা। আর ভালবাসা। যেন মা আমার। মাতৃত্বের ছোঁয়াচ পাই তার প্রতিটি কাজে।

পারি তো এর জিম্মায় সব কিছু রেখে লিসবনে চলে যেতে অসুবিধে কী আমার । সেখান থেকে যাব ব্রাজিল। ব্যবসার কাজে দেখাশুনা করব। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই যে ধর্ম চিন্তা! তাই নিয়ে ভয়! যা গোলমাল লেগেছে চারধারে, যদি তার রোষে পড়ি। যদি কিছু একটা ঘটনা ঘটে।

মোটমাট এইভাবে শহীদ হতে আমি চাই না। কিছু একটা করব, তার জন্যে মরব–সে আলাদা কথা। কিন্তু করব না কিছু, আমাকে হত্যা করবে, এ আমার অভিপ্রেত নয়। চাই না কোনোরকম ঝঞ্ঝাটে জড়াতে। এখন থিতু হতে মন চাইছে। বাসা বাঁধব এখানে। এখানেই থাকব। সংসারী হব। ব্যবসা বরং বিক্রি করে দিতে বলি।

অংশীদারকে চিঠি লিখে নতুন নির্দেশ দিলাম। দিক বেচে সব কিছু। তবে দুটি মাত্র শর্ত। আমার শুভানুধ্যায়ী লিসবনের সেই কাপ্তেনকে দিতে হবে বছরে একশ মোহর করে অনুদান, তারপর সে মারা গেলে তার ছেলেকে পঞ্চাশ মোহর করে আজীবন। এর জন্যে দাম যদি কিছু কম হয়, তাও রাজি। বেশি টাকায় আমার লোভ নেই।

ক মাস পরে পেলাম চিঠির জবাব। লিখেছে শর্তে রাজি। দুজন বণিকের সঙ্গে সে কথা বলছে। তারা কিনে নেবে আমার অংশ। এক একজন দাম দেবে ব্রাজিলের মুদ্রায় চল্লিশ হাজার তংকা। আমি লিখে দিলাম, রাজি। তাড়াতাড়ি কর।

আট মাস লাগল মোট সময়। টাকা পাঠাল হুডি করে। সব জমা রাখলাম কাপ্তেনের বিধবার কাছে। নিশ্চিন্তু এখন। প্রথম জীবনের যা কিছু অভিযান, তার এতদিনে সমাপ্তি। চাষের জমি করাটাও যে পড়ে সেই অভিযানের মধ্যে। তাই তো দিলাম সে পাট চুকিয়ে।

কিন্তু চাইলেই কি পারি আমি স্থির হয়ে একজায়গায় থাকতে। এটা যে আমার অভ্যেসের বাইরে। ইচ্ছা হয় ফের ভেসে পড়ি সমুদ্রে। যাই সেই দ্বীপে। বড় দেখতে ইচ্ছে হয় কেমন করে আছে সেই কজন। স্পেনীয় নাবিকদেরও তো এতদিনে দ্বীপে আসার কথা। এল কি তারা? সহজভাবে মেনে নিতে পেরেছে তো ওরা তাদের? জানতে বড় ইচ্ছে করে।

মহিলার কাছে ব্যক্ত করলাম আমার মনের কথা। তিনি মানা করলেন। সাতটা বছর কিছুতে দিলেন না আমাকে চোখের আড়াল হতে। যাতে মন বসে এখানে আমার, আমার দুই ভাইপোকে এনে দিলেন আমার কাছে। বালক তারা। বললেন, এদের ভার এবার থেকে তোমার। এদের মানুষ কর।

তা কাটল বেশ কটা বছর ভালোই। কিছু জমি কিনলাম। এক ভাইপো ততদিনে বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। উপযুক্ত এখন। দলিল করে তার নামে দিলাম জমির কিছুটা অংশ। যতদিন বেঁচে থাকব আমি সে আমার হয়ে তত্ত্বাবধায়কের কাজ করবে। মৃত্যুর পর হবে পুরোপুরি মালিক। দলিলে সেই মর্মেই নির্দেশ থাকল। ছোটোটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে লাগিয়ে দিলাম এক জাহাজের কাজে। ঘুরল এধার ওধার বিস্তর। পাচঁবছর পর দেখি পুরোদস্তুর কাপ্তেন বনে গেছে। আর ভীষণ সাহসী। তখন সে জাহাজ থেকে সরিয়ে তাকে জুড়ে দিলাম আরেক জাহাজে। এটা দূর পাল্লার জাহাজ। সমুদ্রে যায়। তাতে তার খুব আনন্দ। ক বছর পর আমাকেও জাহাজে তার সাথী করে নিল।

বলতে ভুলে গেছি, ইতোমধ্যে আমিও সংসারী হয়েছি। বিয়ে হয়েছে আমার। তিনটি সন্তানের আমি জনক। দুটি ছেলে এক মেয়ে। হঠাৎ স্ত্রী অসুখে মারা গেল। মন তখন খারাপ। ঠিক সেই সময় ভাইপো ফিরে এসেছে জাহাজ নিয়ে। কদিনের মধ্যেই রওনা হবে স্পেনের দিকে। আমাকে বলল, যাবে নাকি তুমি? বললাম, চল্।

সেটা মোলশ চুরানব্বই সাল। আমি বৃদ্ধ তখন। তবু ঐ যে বলে মোহ। দ্বীপ দেখার অদম্য আগ্রহ। আমি যে মালিক সে দ্বীপের। রেখে এসেছি প্রজাদের। কেমন ভাবে চলছে তাদের দিন? আমার সাজানো বাগানে কী কী নতুন গাছ তারা লাগাল? ভারি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

গেলাম দ্বীপে।

দেখি দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে স্পেনীয় নাবিকের দল। আমাকে দেখে হৈ হৈ করে অভ্যর্থনা জানাল। বলল সব। আমি চলে আসার কদিন পরেই তারা এসে পৌঁছয়। প্রথমে তো সেই দুটো দুষমন–জাহাজের সেই বিদ্রোহী বদমাশ–কিছুতে রেয়াত করবে না তাদের। খটামটি লাগে মুহুর্মুহু । পরে মেনে নিল। ফের আবার ঝগড়া। ফের বিদ্বেষ। শেষে অস্ত্র ধরল নাবিকদের দল। শাসাল । তখন ঠাণ্ডা। মানতে বাধ্য হল তাদের। সেই থেকে আর নিজেদের মধ্যে কোনো গোলমাল হয় নি। ক্ষেত খামার বাড়িয়েছে। খেটেছে অক্লান্ত। সোনা ফলে যে দ্বীপে! জমি খুব উর্বর। তবে না শান্তি।

তারপর যুদ্ধ। নিজেদের মধ্যে নয়, ক্যারিবীয়দের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার। এসেছিল দল বেধে দ্বীপে দখল নিতে। পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে। তখন তারা বুদ্ধি করে গেল একদিন বর্বরদের রাজ্যে। নৌকোয়। সেখানেও যুদ্ধ। বন্দী করে আনল মোট ষোলজনকে। তাদের মধ্যে পাঁচজন স্ত্রীলোক। লোক যে দরকার তখন অনেক। তাইতো এই ফন্দি। তাতে জনসংখ্যা বেড়েছে। আমি নিজের চোখে বিশটি বালক বালিকাকে দেখে এলাম।

রইলাম বিশ দিন। আসার সময় দিয়ে এলাম একপ্রস্থ পোশাক, সঙ্গে কাজের নানান যন্ত্রপাতি, গোলা বারুদ, অস্ত্র আর দুজন মিস্ত্রী। এদের আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি এই উদ্দেশ্যেই। একজন ছুতোর আর একজন কামার। গঠনের নানান কাজ যে দরকার। উপযুক্ত লোক নাহলে তা কি করা সম্ভব!

হ্যাঁ, আরো একটা জরুরি ব্যাপার চুকিয়ে এলাম। সেটা দ্বীপের মালিকানা নিয়ে। দলিল তৈরী হল। লিখিত বিবরণ যাকে বলে। দলিলে আমিই সর্বেসর্বা। দ্বীপের অধিপতি। ওদের দিলাম ভাগে ভাগে এক একটা এলাকা। সেটাও পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে। অর্থাৎ আমি চাই সুষ্ঠু বিলিবণ্টন ব্যবস্থা। এখানে কোনোরকম অসাম্যের আমি পক্ষপাতি নই।

ফেরার পথে ব্রাজিল হয়ে ফিরলাম। মালবাহী জাহাজ কিনলাম একখানা। সেই ব্রাজিলেই। তাতে লোক তুললাম বিস্তর। বলা কওয়া করেই। লুকোচুরির কোনো ব্যাপার নেই। রওনা করিয়ে দিলাম দ্বীপের উদ্দেশে। সঙ্গে দিলাম নানান পসরা। আর সাতটি মেয়ে। এদের দরকার। দ্বীপের নানান কাজ–আরে বাপু ঘর গেরস্থালি বলেও তো একটা মিনি আছে। সেটা এরা ছাড়া কে করবে?

তাছাড়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি। বলে এসেছি স্পেনীয় আর ইংরেজদের, আমি সবার জন্যে পাঠিয়ে দেব একটা করে বউ। সঙ্গে নতুন নতুন গাছগাছালি। আর কিছু জীবজন্তু। যেমন শুয়োর, গরু আর ভেড়া। গরু অর্থে গাভী। সবৎসা। সঙ্গে দিলাম একটি বলদ। এটা দরকার।.মোটমাট চাই আমি–সবদিক থেকে মুফলা হয়ে উঠুক আমার নতুন সাম্রাজ্য।

এরপরেও আছে। সেটা পরে গিয়ে শুনেছি। তিনশ ক্যারিবীয় এসেছিল ফের দ্বীপে, লড়াই করে দ্বীপের দখল নিতে। সে যাকে বলে মহাপ্রলয়। ক্ষেত জ্বালিয়ে শস্য পুড়িয়ে সে যেন ছারখার কাণ্ড হেরে গেছে আমার প্রজার দল। সেটা প্রথমবার। পারে নি প্রতিরোধ করতে। তিনজন মারা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর হারে নি। সেবার আগে থেকে সজাগ ছিল। দিয়েছে মেরে ধরে লুটেরা শয়তানদের তাড়িয়ে। আর এমনই দুর্দশা,–ফিরে যাচ্ছে দলবল,নৌকো নিয়ে গেছে গভীর সমুদ্রে, অমনি উঠল ঝড়, আর পাহাড় সমান উঁচু একেকটা ঢেউ। চোখের নিমেষে সব নৌকো উলটে গেল রসাতলে। তখন শান্তি। পুনর্গঠনের কাজ তখন শুরু হল। শান্তি। খাটল প্রাণ দিয়ে। শান্তি। ফুলে ফুলে ভরে উঠল আবার দ্বীপ। শান্তি। অপরূপ তার স্বাদ। পূর্ণ হল আবার দ্বীপবাসীর হৃদয়।

আর আমি? ততদিনে আমি কি আর ঘরের কোণে বসে থাকার মানুষ। বেরিয়ে পড়লাম ফের। সে আর এক অভিযান। দশটা বছর কাটল সেই অভিযানে। কিন্তু সে গল্প এখানে নয়। বারান্তরে বলার চেষ্টা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *