৪. প্রতীক্ষার পালা

শুরু হল প্রতীক্ষার পালা। হায় রে, কী আমার ভাগ্যের পরিহাস-–দেড়টা বছর পার হতে চলল, বারেকের জন্যেও পাই না ওদের দেখা গেল কোথায় সব! না কি মানুষের মাংস খাওয়া বন্ধ করে সন্ন্যাসি হল। ভেবে দেখুন আমার মনের অবস্থা। খুঁটি সাজিয়ে আমি এদিকে তৈরি, অথচ বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের এখনো দেখা নেই।

তাই বলে মিনি কিন্তু এতটুক। আগ্রহে আমার এতটুকু ভাটা পড়ে নি। রোজ নিয়ম করে পাহাড়ের মাথায় উঠে চারদিকে নজর বোলাই। খুঁটিয়ে ফুটিয়ে দেখি আশপাশ। আর বোজই আশা করি, আজ তো আর এল না, কাল আসবে। কিন্তু সেই কাল আর আসে না।

এমনি ভাবেই টানা দেড় বছর। মাসের হিসেবে আঠারটা মাস। হতাশার বীজ একটু একটু করে মনে জন্ম নিচ্ছে। সেই মন নিয়েই উঠেছি একদিন ভোরবেলা। রোজকার অভ্যেস মতা কুলের দিকে তাকিয়েছি। দেখি, অবাক কাণ্ড; একটা নয় দুটো নয়, একসাথে একবারে পাঁচ পাঁচখানা নৌকো। আর প্রচুর মানুষ। সবাই দুদ্দাড় করে কূলে নামল। আমি যে ভালো করে একটু দেখব সে অবকাশটুকুও পেলাম না। চলে গেল সবাই আমার চোখের আড়ালে এক গাছের ছায়ায়।

তখন তড়িঘড়ি পাহাড়ের মাথায় গিয়ে উঠলাম। হাতে দূরবীন। আর যতদূর সম্ভব নিজেকে রেখেছি লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম সটান পাথরের উপর। পায়ের কাছে বন্দুক জড় করে রাখা। সব নিয়েই এসেছি উপরে। হয় এসপার নয় ওসপার। কিন্তু সবার আগে পর্যবেক্ষণটা দরকার।

দেখি ত্রিশজন মোট। আগুন জ্বেলে বসেছে গোল হয়ে। মাংস কাটাকুটি চলছে। রান্না কীভাবে শেষ অব্দি হল আমি দেখতে পেলাম না। একটু পরে দেখি নাচতে শুরু করেছে সবাই। সে কী উদ্দাম উন্মাদ নাচ! কত যে তার অঙ্গভঙ্গি! দেখতে দেখতে গা আমার। শিউরে উঠল।

হঠাৎ দেখি দুই বন্দীকে ওরা নৌকো থেকে টেনে নামাচ্ছে। দূরবীনে আমি স্পষ্ট তাদের দেখতে পেলাম। আহারে কী করুণ কী দুঃখী মুখ! একজনকে নামিয়েই সঙ্গে সঙ্গে কাঠের মুগুর দিয়ে মারল মাথায়। পড়ল সে বালির উপর মুখ থুবড়ে। তখন নিয়ে গেল তাকে চ্যাংদোলা করে আগুনের কাছে। কাঠের তলোয়ার দিয়ে শুরু হল তাকে কাটাকুটির পালা। অপর বন্দীটি কিন্তু তখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত দেখছে তার সঙ্গীর নিষ্ঠুর পরিণতির দৃশ্য। ভাবছে নিজের আশু অবস্থার কথা। একবার ওরই মধ্যে চোখ তুলে চারধারে কী যেন জরিপ করল। পরক্ষণেই দেখি বাই বাই করে সে যা তার ছুট! বলব কি এমন ক্ষিপ্র গতিতে যে কোনো মানুষ ছুটতে পারে আমার ধারণার বাইরে। হরিণের চেয়েও দ্রুততর সেই গতি। আসছে আমারই আস্তানার দিকে। সঙ্গীদলেরও খেয়াল গেছে ততক্ষণে। তাদের মধ্যে তিনজন তাকে ধরবে বলে পিছনে ছুটছে। কিন্তু পারে কি ধরতে। অমন গতি কি আছে তাদের পায়ে। আমি তো হতভম্ব। তবে কি সত্যি হতে চলছে আমার স্বপ্ন? কল্পনা কি বাস্তবের রূপ ধরতে চলেছে? অস্ত্রশস্ত্র আমার হাতের কাছেই মজুত। স্ব সমেত পাহাড়ের গা ঘসটে ঘসটে অনেকটা নিচে নেমে এলাম। লুকিয়েছি এবার একটা মস্ত গাছের আড়ালে। ডালপালায় এমনই ঢাকা সহসা কেউ টের পাবে না আমার অস্তিত্ব। দূরবীন চোখে দেবার আর দরকার নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব। চারটি প্রাণী দিশেহারা হয়ে উন্মাদের মতো ছুটছে।

মাঝে ছোটো একটা নালা। ওপাশে জমি। এপাশে একটু এগিয়ে আমার আস্তানার দেয়াল। নালা বলতে সেই নদীটারই অংশ, যার বুকে ভেলা ভাসিয়ে আমি জাহাজ থেকে আনা প্রথম মালপত্র তুলেছিলাম এই দ্বীপে। বন্দী মানুষটি ছুটতে ছুটতে এসে অসীম ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই জলে। তারপর সাঁতার কাটতে লাগল। অনুসরণকারীদের একজন এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নালার মুখে। হয়ত সাঁতার সে জানে না। বাকি দুজন মরিয়ার মতো ঝাঁপ খেয়ে পড়ল জলে। সাঁতার কাটতে লাগল উদ্দাম বেগে। প্রথমজন আর একটু দাঁড়িয়ে থেকে যে পথে এসেছিল, সেই পথে ফিরে গেল। সেটা বন্দীর পক্ষে মঙ্গল। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনজনকে লক্ষ করতে লাগলাম।

দুজন তখনো সাঁতার কাটছে, বন্দী জল থেকে উঠে এসেছে ডাঙায়। ছুটছে। সামনে আমার দেয়াল। থমকে দাঁড়াল। এই আমার সুযোগ। অস্ত্র আমার হাতের গোড়ায় মজুত। তবে কি ঈশ্বরই জুটিয়ে দিলেন আমার সহচর? সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তখন মুখের কাছে হাত জড়ো করে ডাকলাম। সে চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। খুব ঘাবড়ে গেছে। তখন ডাকলাম হাতের ইশারায়। দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। তখন এক লাফে নিচে নামলাম। নালার একেবারে কাছে। অনুসরণকারীদের একজন তখন সবে জল থেকে উঠেছে। গুলি করলাম তার বুক লক্ষ্য করে। শব্দ হল। কিন্তু এমন নয় যে বিরাট একটা অওয়াজ। কুলের কাছে যারা আছে তারা শুনতে পাবে না। গুলি খেয়ে পড়ে গেল সে উপুড় হয়ে। দ্বিতীয় জন থমকে দাঁড়িয়েছে তখন। ডাঙায় এক পা। কাঁধে তীর ধনুক। হয়ত আঁচ করে থাকবে ঘটনাটা। আমাকে দেখতে পেয়েছে। ধনুকে তীর যোজনকরে আমার দিকে তাক করল। মারলাম বন্দুকের বাঁট দিয়ে এক ঘা। পড়ল ছিটকে। হাত থেকে তীর ধনুক পড়ে গেল। ঘুরে দেখি বন্দী চোখ বড় বড় করে দেখছে আমাকে। তখন ফের তাকে ডাকলাম। কাছে আসতে বললাম। এল গুটি গুটি। খানিকদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। আবার ডাকলাম। আবার কয়েক পা এগিয়ে এল। দেখি থরতর করে কাঁপছে। ইশারায় বুঝিয়ে দিলাই ভয়ের কোনো কারণ নেই। তখন হাঁটু গেড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাটিতে বসল। অর্থাৎ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আমে যে রক্ষাকর্তা ওর! হাসলাম তখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে বললাম। এল আরো একটু। মাথা নিচু করে মাটিতে ঠেকাল। সটান শুয়ে পড়ে জুড়িয়ে ধরল আমার পা। একখানা পা তুলে নিয়ে মাথার উপর রাখল। এটা বর্বর সম্প্রদায়ের রীতি, আমি জানি। অর্থাৎ আমাকে প্রভু বলে মেনে নিল। তখন হাত ধরে তুললাম। বন্দুকের ঘা মেরে যাকে ঘায়েল করেছি, তাকে দেখিয়ে দিলাম, ইশারায়! আকারে ইঙ্গিতে বললাম, ও মরে নি। ওর একটা গতি কর। কী যেন বলল তখন বিড়বিড় করে। এক বর্ণও আমার মাথায় ঢুকল না। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর এই শুনলাম প্রথম মানুষের কণ্ঠস্বর। তখন আমার কোমরের তরবারি কূলে তার হাতে দিলাম। অমনি তরবারি হাতে ছুটে গেল ক্ষিপ্র গতিতে। এক কোপে কেটে ফেলল তার মাথা। আমি তো থ। জার্মানির এমন কোনো জল্লাদ নেই যে পারবে এইভাবে এক কোপে মাথা কেটে নামাতে। আর খুব সম্ভবত নিজের কাজে নিজেও হয়ে গেছে অবাক। বারবার ঘুরিয়ে দেখতে লাগল তলোয়ারখানা। রক্ত মুছে আমার হাতে এনে দিল। আর কী হাসি তখন মুখে! ভীষণ খুশির ভাব। কত কী যে বলল তারপর। আমি এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না।

ভারি অবাক হয়ে গেছে আমার বন্দুকের ব্যবহার দেখে। দেখে নি তো আগে কোনোদিন। দুর থেকে কি এমন কারিকুরি করলাম যে ছুতে হল না, একটা ঘা অব্দি দেবার দার হল না, অথচ লোকটা পড়ে মারা গেল। আমাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, যাব ওর কাছে? বললাম, যাও না, গিয়ে দেখে এস। তখন গেল কাছে। চিৎ করে দিল। তার দেহ। ঠিক বুকের মাঝখানে গুলির ফুটো। তা দিয়ে তখনো রক্ত পড়ছে টুইয়ে চুঁইয়ে। দেখল তাই অবাক চোখে অনেকক্ষণ। আমি ডাকলাম। তখন মৃত ব্যক্তির তীর ধনুক নিয়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো আমার পেছন পেছন আসতে লাগল।

কিন্তু না, মড়া দুটো এভাবে ফেলে যাওয়া ঠিক না। যদি বাকি দলবল এসে দেখে তাহলে আমার আস্তানার হদিশ পেয়ে যাবে। তাকে বোঝালাম সে কথা। তখন বলল মাটি খুঁড়ে পুঁতে রেখে যাবে। আমি তাই করতে বললাম। তখন দ্রুত মাটি খোঁড়ার কাজে লেগে পড়ল। কী অসীম ক্ষিপ্রতা তার হাতে। শুধু যে হাত দিয়ে অত অল্প সময়ের মধ্যে দু দুটো মস্ত গর্ত খোঁড়া যায় আমার ধারণারও বাইরে। প্রমাণ আকারে হতে দেহ দুটো নামিয়ে দিল গর্তে, মাটি চাপা দিল। সময় লাগল বড় জোর আধ ঘণ্টা। তখন নিশ্চিন্ত মনে চললাম আমার বাড়ির দিকে।

মই ডিঙিয়ে দেয়ালের এধারে আনলাম। দেখে সে তো অবাক। তখন রুটি দিলাম খেতে, আর জল। খেল গোগ্রাসে। আহারে, কবে থেকে হয়ত খায় নি একফোঁটা কিছু! তার উপর মরণপণ এই দৌড়। খাওয়া দাওয়ার পর একটু সুস্থ লাগছে দেখতে। বললাম, শোও এবার, ঘুমোও। বলে পাজা করা একধারে ছিল খড়, তার উপর দিলাম একটা কম্বল বিছিয়ে। শুয়ে পড়ল অনুগত ভৃত্যের মতো। তারপর মুহূর্তের মধ্যে সে যাকে বলে গভীর ঘুম।

দেখছি আমি তখন তাকে। সুঠাম সুন্দর স্বাস্থ্য। মজবুত শরীর। পা দুখানি দীর্ঘ এবং চমৎকার গড়নের। বয়েস কত আর হবে, খুব বেশি হলে ছাব্বিশ। মুখ চোখের ভাবও ভারি মিষ্টি। উগ্রতা নেই। কোমল কমনীয় ভাব। আর হাসিটুকু খুব সুন্দর। মাথায় লম্বা কালো কুচকুচে চুল। কেঁকড়ানো নয়। উন্নত কপাল। চোখে বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ। গায়ের রং ঠিক কালো নয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলতে যা বোঝায় তাই। ছোটো নাক। মুখখানি গোলাকার। নিগ্রোদের মতো ঠোঁটও পুরু নয়, পালা। সুন্দর ঝকঝকে দু পাটি দাঁত। তা আধঘণ্টা পরেই দেখি ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে ধড়মড়িয়ে। আমি তখন দুধ দোয়ার কাজে ব্যস্ত। অমনি শুয়ে পড়ল মাটিতে উপুড় হয়ে, আমার পা তুলে মাথার উপর নিল। আবারও একদফা হাত পা নেড়ে আমার প্রতি যে অসীম কৃতজ্ঞ তাই বোঝাবার পালা। তখন উঠে বসতে বললাম। দুধ দোয়ানো শেষ। বসলাম দুজন মুখোমুখি। প্রথম কাজ আমার তাকে কথা শেখানো অর্থাৎ আমার ভাষা। নইলে তো কেউ বুঝবে না কারা মনের ভাব। তারও আগে দরকার ওর একটা নাম। কিন্তু কী নাম দিই। তখন মনে এল বারটার কথা। আজ তো শুক্রবার। ইংরিজিতে বলে ফ্রাইডে। হোক না ওর নাম তাই। অর্থাৎ ফ্রাইডে। সেটা বুঝিয়ে দিলাম। দেখি ভারি খুশি। হ্যাঁ আর না বলতে শেখালাম। শিখে নিল চটপট। বুদ্ধিতে ভারি তুখোড়। দুধ দিলাম খেতে। সঙ্গে রুটি। খেল ঢকঢক করে। আরো খুশি তখন। বুঝিয়ে দিল, ভারি তৃপ্তি পেয়েছে।

রাতটা দুজনে গুহার মধ্যে কাটালাম। দিনের আলো ফুটল। ঘুম থেকে তুললাম। উদোম ন্যাংটো একদম। একটা কিছু পরনের দরকার। দিলাম একটা প্যান্ট। আমার দ্বিতীয় জাহাজ থেকে প্রাপ্তি। বাইরে এলাম। দেখি কাল যেখানে পুঁতেছে দুটো মৃতদেহ সেইদিকেই নজর ওর। আমাকে ইশারায় বোঝাল, মাংস খাবে। অর্থাৎ নরমাংসলোভী। ওকে বোঝাতে হবে এটা আমার চরম অপছন্দ। তখন ইশারায় বললাম আমার ঘেন্না লাগছে। বমি আসছে। বলে বমির ভঙ্গি করলাম! হাতের ইশারায় কাছে ডাকলাম। এল বাধ্য শিশুর মতো। নিয়ে গেলাম পাহাড়ের মাথায়। দেখতে বললাম দূরে, কুলের দিকে। কাল যেখানে এসে ওরা নেমেছিল। ফাঁকা সব। কেউ কোথাও নেই। নৌকো বা পানসীর চিহ্নমাত্র নেই। চলে গেছে দলবল। সঙ্গী দুজনকে ফেলে রেখেই।

তবু পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারি না। মনে যে উদ্বেগ। দুটো লোককে ঘায়েল করলাম, একজনকে রাখলাম নিজের কাছে, মুখের শিকার ছিনিয়ে নিলাম মুখের গোড়া থেকে যদি বদলা নেবার কোনো রকম ফন্দী করে! যদি সত্যি সত্যি চলে না গিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকে। সেটাও তো যাচাই করে দেখা দরকার। অনুসন্ধিৎসা যাকে বলে। তখন ফ্রাইডেকে বললাম, চলত দেখি আমার সঙ্গে দেখে আসি সরেজমিনে। অর্থাৎ আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম। এখন মনে অন্য রকমের সাহস। একলা তো আর নেই, এখন মোট দুজন। সঙ্গে নিলাম দু দুটো বন্দুক। ম্লর পিস্তল তো আছেই আর সেই তরবারি। একটা বন্দুক দিলাম ফ্রাইডের হাতে। চললাম হাঁটতে হাঁটতে কুলের দিকে। অবশ্যই সতর্ক সাবধানে। গিয়ে সে যা দৃশ্য! বীভৎস বললেও এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। সুরা এলাকা জুড়ে মৃতদেহের নানান অংশ বিশেষ ছড়ানো। কোথাও মাথা, কোথাও হাত, কোথাও ধড়, কোথাও পাঘিনঘিন করে উঠল শরীর। তাকাতে পারছি না। ফ্রাইডে দেখি নির্বিকার। নরমাংস ওর কেন আমার মতো ঘেন্না হবে। অর্থাৎ যে কোনো কারণেই হোক সঙ্গী দুজন ফিরে না যেতে বা গুলির শব্দ শুনে ওরা ভয় পেয়ে গেছে রীতিমতে। সব ফেলে ছেড়ে অমনি তড়িঘড়ি পালিয়েছে। আধপোড়া অবস্থায় কত যে পড়ে আছে মাংসের টুকরা। ফ্রাইডে আমাকে ইশারায় বলল, নাকি সঙ্গে এনেছিল ওরা চারজন বন্দী। তিনজনকে মেরেছে, সে ছিল চতুর্থ, তাকে আর কায়দা করতে পারে নি। কথাটা যে ঠিক, তার প্রমাণও পেলাম। মোট তিনটে মাথা, পঁচখানা হাত, চারটে পা আমি স্পষ্ট চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কেন এই হত্যা? ফ্রাইডে আকারে ইঙ্গিতে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় এই ক্ষমতার লড়াই হয়েছিল তাদের রাজ্যে। তাতে রাজা হেরে যান। রাজার পক্ষের সকলকে বন্দী করা হয়। সে রাজার পক্ষেরই একজন। নানান জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ভোজের উদ্দেশ্যেই। তার সৌভাগ্য তাকে এই দ্বীপে আনা হয়েছিল। তাই তো সে রক্ষা পেল।

বললাম, সে নয় বুঝলাম, আপাতত এ গুলো সাফ করে ফেল দেখি। আমার বমি আসছে। সহ্য করতে পারছি না। বলে ওয়াক তুললাম। তখন বুঝতে পারল। জড়ো করল সব এক জায়গায়। আগুন জ্বালল। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল চিতা। দেখি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে দিকে। তখন বোঝালাম, আমি কিন্তু মোটে পছন্দ করি না নরমাংস ভক্ষণ। আমার সামনে এমন আচরণ আর যেন কখনো না করে। বললাম, তবে কিন্তু ভীষণ রেগে যাব আমি, প্রয়োজনবোধে রাগের মাথায় তাকে হত্যাও করে ফেলতে পারি।

তখন মাথা নাড়ল। পা দুয়ে প্রতিজ্ঞা করল। বলল, কোনোদিন আর ওসব লোভ দেখাবে না। তখন নিশ্চিন্তু মনে বাড়ির পথ ধরলাম।

রোদের বড় তাপ দিয়েছি ওকে শুধু পরনের একটা প্যান্ট। তাতে পিঠে তাপ লাগে। কষ্ট হয়। বসলাম ওর জন্যে ছাগলের চামড়ার একটা জ্যাকেট বানাতে। সে যে কী কসরৎ! তবু গায়ে বেশ মানানসই হল। টুপিও তৈরি করে দিলাম। পরে সে কী ফুর্তি। কত ভাবে যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বারবার। তবে অস্বস্তিও যে বোধ করছে এটা ঘটনা। এতদিনে অনভ্যাসের পর অস্বস্তি তো লাগবেই। তবু লাগছে কিন্তু বেশ। হারা তো ভারি চমৎকার। যা পরে তাতেই মানায়। এতক্ষণে প্রভুর উপযুক্ত সহচর বলে চিনতে অসুবিধে হয় না।

পরদিন সকাল থেকে লাগালাম কাজে। সবচেয়ে আগে ওর জন্যে একটা আলাদা থাকবার জায়গা তৈরি করতে হবে। কোথায় করি? গুহা আর তাঁবুর মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। গাড়লাম সেখানে আরেকটা তাবু। তাতে দরজাও হল। আমার গুহার সেই আরেকটা দরজা যেদিকে তারই একেবারে গোড়ায়। সে দরজাটা দিলাম ভিতর থেকে খিল দিয়ে আটকে। মনে আমার এখনো সন্দেহ আছে। কতক্ষণ বা দেখলাম মানুষটাকে! কী ওর মতলব, কী চায় বলা তো যায় না। তাছাড়া নরমাংস লোভের ব্যাপারটাও পুরোপুরি যায় নি। সেক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন। তাইতো আলাদা ব্যবস্থা। ইচ্ছে হলেও ঢুকতে পারবে না আর গুহায়। বিশেষ করে রাত্রে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকব। ও থাকবে বাইরে। আমি মই বেয়ে গুহার দরজা টপকে ভিতরে ঢুকে মইটা নেব সরিয়ে। ব্যস ঢোকার রাস্তা বন্ধ। বাইরের উঁচু দরজাটা ছাড়াও ভিতর দিকে যে আরেকটা দরজা আছে। সেটা একেবারে গুহার মুখ ঢেকে রাখে। তার খিল ভিতরের দিকে। অধিকন্তু এমনই ব্যবস্থা, প্রথম দরজা ডিঙিয়ে লাফ দিয়ে কেউ নিচে পড়লে পড়বে সটান কাঠের পাটাতনের উপর। তাতে শব্দ হবে খুব। আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

মোটমাট এবার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। হঠাৎ আক্রমণের আর কোনো ভয় নেই। ও থাকবে বাইরে, আমি ভিতরে। নিরাপত্তার অটুট ব্যবস্থা ছাড়াও হাতের গোড়ায় মজুত আমার যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র। কীসের আর ভয়!

তবে সবই যে অমূলক এটা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম। ফ্রাইডেকে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। নিপাট ভালোমানুষ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। তদুপরি অসম্ভব প্রভুভক্ত, কৃতজ্ঞ এবং আমার প্রতি প্রচণ্ড পরিমাণে শ্রদ্ধাশীল। জীবন দান করেছি সেটা ওর কাছে মস্ত ব্যাপার। ভালবাসে আমাকে হৃদয় দিয়ে। ঠিক যেমন সস্তান ভালবাসে তার পিতা-মাতাকে। জানি না আমার বুঝতে ভুল কিনা, তবে কখনো কখনো মনে হয় আমার জন্যে জীবন দিতেও তার এতটুকু কুণ্ঠা নেই।

অবাক হয়ে লক্ষ করি ওর প্রতিটি ভাবভঙ্গি। আর মুগ্ধ বিস্ময়ে মন ভরে ওঠে। কী বলব কে? এ তো ঈশ্বরেরই করুণা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণে সৃষ্টি করেছেন তিনি মানুষ। বিচিত্র তাদের আচার আচরণ, বিচিত্র তাদের অভ্যাস। তবু সবার মিল অন্তরে। একই ভালবাসা সবার হৃদয়ে প্রবাহিত। একই সুখ একই দরদ। ভুলকে সকলে মনে করে ভুল, আবার ঠিককে ঠিক বলে শ্রদ্ধা করে। একে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করার মধ্যেই নিহিত থাকে মানব জীবনের বৈশিষ্ট্য। সে শক্তিও তিনিই যুগিয়ে দেন। কখন কী করতে হবে সব নির্দেশ তার কাছ থেকেই আসে। তাই তো অবাক শ্রদ্ধায় বারবার মাথা নোয়াই তার উদ্দেশে।

মোটের উপর ফ্রাইডেকে আমি ভীষণ ভালবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু বাধা যে একটা দুরন্ত। ভাষা বোঝে না আমার। আমিও বুঝতে পারি না ওর ভাষা। কীভাবে বোঝাব ওকে সব কিছু? তখন ঠিক করলাম, আর কিছু শেখাবার আগে ওকে ভাষাটা শেখাতে হবে। শুরু হল তারই প্রচেষ্টা। অবাক কাণ্ড, ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী। যে কোনো জিনিস একবারেই বুঝে নেয়, মনেও রাখতে পারে সব। এ-ও যেন আমার এক নতুন আবিষ্কার। সেই মন নিয়েই একটু একটু করে শেখাতে লাগলাম।

আর একটা জিনিস আশু প্রয়োজন। নরমাংসের বদলে অন্য মাংসেও যে সমান তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা ওকে বোঝানো। একদিন তাই সকাল বেলা বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে ও। মারলাম একটা ছোট্ট ছাগল ছানা। বললাম, নে, এটা নিয়ে চল এবার বাড়িতে।

আসছি ফিরে, হঠাৎ দেখি পথের ধারে গাছের ছায়ায় বসে আছে একটা ছাগল, সঙ্গে তার দুটো বাচ্চা। ফ্রাইডেকে বললাম, দাঁড়া চুপচাপ। দাঁড়াল। তখন গুলি ছুঁড়ে মারলাম আরেকটা ছানা। সে অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব। কী যে আশ্চর্য ক্ষমতা আমার হয়ত সেটাই মনে মনে ভাবছে। দেখেছে তো একবার। ধারে গেলাম না শরীরে স্পর্শমাত্র করলাম না, শব্দ হল গুড়ুম করে, সটান মরে পড়ে গেল একটা মানুষ। এখন আবার পর পর এই দুটো ছাগল ছানা। দেখি কাঁপছে থরথর করে। আর চোখে মুখে মূক বিহ্বল সেই ভাব। সেই অবস্থাতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আমার পায়ের কাছে। মাথা নুইয়ে দিল। পা তুলে নিল মাথার উপর। অর্থাৎ বলতে চায়, প্রভু, তোমার অসীম ক্ষমতা। তুমি ইচ্ছে করলে যাকে খুশি বধ করতে পার। আমি তোমার অনুগত সেবক। দোহাই, আমার জীবন নাশ করো না।

তখন হাত ধরে তুললাম, হাসলাম, মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলাম। বললাম, নিয়ে আয় ওটাকে! ঐ ছাগল ছানা। তারপর বাড়ি চল। ভোকে আজ নতুন মাংস খাওয়াব।

বলেই খেয়াল হল, বন্দুকের ব্যবহার সম্বন্ধে ওকে খানিকটা সতেচন করে দেওয়া দরকার। দেখি দূরে বসে আছে মস্ত এক বনমোরগ। ঈগলের মতো দেখতে। বললাম, দেখ এবার, ঐ পাখিটাকে আমি মাটিতে ফেলব।

বলে টিপ করে ঘোড়া টিপলাম। পড়ল মোরগ মাটিতে। সে তো হতবাক। এত শক্তি এই যন্ত্রের! দূরের কাছের যে কোনো জিনিসই এর শিকার! আগুন উগড়ে দেয় মুহুর্মুহ। অসীম শ্রদ্ধা তখন সেই বন্দুকের উপর। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে যে কত মিনতি কত অনুনয় বিনয়! আমি তো হেসে কুল পাই না। কিছুতে ঘেঁষতে সাহস পায় না বন্দুকের ধারে কাছে। ছোঁয়া তো দুরের কথা। সুযোগ পেলেই বন্দুককে জানায় নিজের মনের হাজারো আকুতি। আমি দেখি আর হাসি।

মরে নি তখনো পাখিটা। বললাম, যা নিয়ে আয়। গেল দুটে। নিয়ে এল। ফিরে গেলাম বাড়িতে। ছাল ছাড়ানো হল ছাগল ছানার। পাখিটার পালক সাফ হল। চড়ালাম রান্না। সেই বলা যায়, তবে অন্যদিনের মতো নয়। আজ সুসিদ্ধ। ঘন থকথকে ঝোল। দিলাম বাটি ভরে ওর সামনে। আমিও নিলাম। খেয়ে দেখালাম নিজে। সঙ্গে নুন। সে-ও খেল। জীবনে এই প্রথম নুন খাওয়া। সে কী মুখের ভঙ্গি! ভালো যে লাগে নি সেটা আমাকে বার বার নানান ভাবে বোঝাল। তখন নুন ছাড়া আমি এক টুকরো মাংস মুখে নিলাম। ফেলে দিলাম থু থু করে। ও ভঙ্গি যেমন করেছে তাই করলাম। তখন অল্প একটু খানি তুলে মুখে দিল। সেও নিতান্ত অনিচ্ছায় দেখি মাংস খায় গপ গপ করে। তাতে তৃপ্তি। নুনে রুচি আনতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছে।

পরদিন আর সেদ্ধ নয়, ঝলসে খাওয়া হবে মাংস। আগুন জ্বালোম কাঠ কুটো জড় করে। ঝুলিয়ে দিলাম তার ওপরে কালকের মাংসের অবশেষ। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলল এই প্রক্রিয়া। দিলাম ওর হাতে এক টুকরো। দেখি ভারি খুশি। সেদ্ধ মাংসের চেয়ে ঝলসানো মাংসেই ওর তৃপ্তি বেশি। তাতে অবিশ্যি আমার কিছু যায় আসে না। আমার যাবতীয় প্রচেষ্টার মূলে ওর মাংস খাওয়ার প্রচলিত অভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা। সেটা যে সফল হয়েছে আমি তাতেই খুশি।

এদিকে আটার সঞ্চয় শেষ। যব ভাঙাতে হবে। পরদিন বসলাম এক ঝুড়ি যব নিয়ে। কেমন করে পেষাই করতে হয় দেখিয়ে দিলাম। বুদ্ধি তো তুখোড়। শিখে নিয়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই ভাঙতে বসল যব। তখন রুটি বানালাম আটা দিয়ে। দেখল অবাক চোখে খানিকক্ষণ। তারপর আমাকে সরিয়ে নিজেই বানাতে বসল রুটি।

অদ্ভুত নৈপুণ্য ওর প্রতিটি কাজে। আর ভীষণ বুদ্ধি। সব শিখে নিল অল্প কিছুদিনের মধ্যে। আমাকে আর কাজ নিয়ে ভাবতে হয় না। প্রয়োজন মতো নিজেই আটা ভাঙে, রুটি গড়ে, মাংস রাধে, খাবার টেবিলে এগিয়ে দেয় পরিপাটি করে। আমার আর চিন্তা কীসের!

তবে নেই একদম এটা বললেও ভুল হবে। ঘর সংসারের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তাই নিয়ে যে হাজারো রকমের দুশ্চিন্তা। এখন তো আর একলা আমি নই, দুজন এখন। দুজনের খোরাক যোগাড়ের চিন্তাটা কি কম

এতদিন যা চাষবাস করতাম সব তো কেবল নিজের কথা ভেবে। কিন্তু এখন যে সে অভ্যেস বদলাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ আরো জমি তৈরি করতে হবে চাষের জন্যে। আরো শস্য ফলানো দরকার। সেটা অবিশ্যি ঝকমারি কিছু নয়। ফ্রাইডেকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লাম। অদ্ভুত ক্ষমতা ওর। খাটতে পারে প্রচণ্ড। আমাকে বলল, মালিক, আপনাকে এতো খাটতে হবে না। আমি তো আছি। বলে দিন আমাকে কী কী করতে হবে। সব আমি করব। আপনি শুধু বসে বসে দেখুন।

আমার যেন হাতে স্বর্গ পাওয়ার অবস্থা। এর চেয়ে সুখ আর কী থাকতে পারে জীবনে! ছিলাম পঁচিশটা বছর একাকী, সঙ্গী পেলাম তার পরে। মনের মতো সঙ্গী। এতদিন জানত না নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে। অর্থাৎ আমাকে বোঝাতে পারত না। ইদানীং তা-ও পারে। শিখে নিয়েছে অনেক নতুন নতুন কথা। সেটা আমার কাছে বিরাট একটা ব্যাপার। আমিও জবাবে কিছু বলতে পারি। এতদিনকার বোবা জিভে আবার ভাষা ফুটতে শুরু করেছে। ভারি তৃপ্তি পাই ওর সাথে কথা বলে। এত সরল এত অকপট ওর মন। আর ভীষণ শ্রদ্ধা করে আমাকে। প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। জানি না এর আগে এত গভীর ভাবে আর কাউকে ও ভালবাসতে পেরেছে কিনা।

তবু ঐ যে বলে সন্দেহ। চট করে কাউকে বিশ্বাস করতে মন বিদ্রোহ করে। সন্দেহের বশেই ভাবলাম একদিন আচ্ছা, নিজের দেশের ব্যাপারে ওর মনের ভাবটা বর্তমানে কী, সেটা একটু পরখ করে দেখা যাক। সুযোগ পেলেই কি আমাকে ফেলে পালাবে নিজের দেশে? তখন বললাম, আচ্ছা ফ্রাইডে, তোর দেশে আগে কখনো লড়াই হয়েছে? বলল, হা হা, অনেকবার। আমরা খুব ভালো লড়াই। অর্থাৎ ভালো লড়াই করতে পারে। বললাম, তবে কী করে ওরা তোকে বন্দী করল?

বলল, খুব মার দিয়েছি আমরা। অসম্ভব। অর্থাৎ দু দলে ভীষণ লড়াই হয়েছে।

বললাম, তোর মুণ্ডু। তোরা মার খেয়েছি। তাই তো তোদের এই দশা।

বলল, কী করব? ওরা অনেক। মারল। মরল। এক দুই তিন আর আমি। বন্দী। নিয়ে এল এখানে। দু হাজার লোক আমরা। কী করবে তারা?

–তোদের চারজনকে তো বাঁচাতে পারত? শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারত।

–অসম্ভব। হঠাৎ যে আমাদের চারজনকে পাসিতে তুলে পালাল। আমরা কি জানতাম?

–আর ওদের যারা ধরা পড়ল তোদের দেশে? তাদের কী হাল? তোদের দেশের লোকও কি তাদের কেটে খাবে? সেটাই কি নিয়ম?

–হ্যাঁ। নিয়ম। আমরা মানুষ খাই। খুব।

–কোথায় নিয়ে খাবি তাদের।

–যেখানে খুশি। কত দ্বীপ। কত। দেশে খাব না।

–এখানেও আসে কি তোদের দেশের মানুষ?

–আসে।

–তুই আগে কখনো এসেছিলি এখানে? অন্য কারো সাথে?

–হ্যাঁ। একবার। বলে উত্তর পশ্চিম অংশ আঙুল দিয়ে দেখাল। অর্থাৎ সেই পায়ের ছাপ। আমার প্রথম দেখা সেই ভয়াবহ দৃশ্য। নিজের অজানতেই একবার শিউরে উঠলাম।

একেই বলে হয়ত পরিহাস। যে মানুষ আগে এসেছে এখানে নরমাংস খাবার লোভে, তাকেই কিনা পরে আসতে হল বন্দী হয়ে, তার মাংস খাবে অন্য সবাই। আরো কিছুদিন পর তাকে নিয়ে গেলাম একদিন সেইখানে। দেখে চিনতে পারল। আমাকে বলল সব। পুরো বিবরণ দিল ভোজের। সেবার নাকি মহা ভোজ। বন্দী ছিল সঙ্গে মোট তেইশ জন। তার মধ্যে কুড়িটি পুরুষ, দুটি নারী আর একটি শিশু। তা কুড়ি তো তখনো বলতে শেখে নি। আমাকে পাথরের নুড়ি জড় করে বুঝিয়ে দিল সংখ্যাটা। তখন নতুন করে আরো একবার শিউরে উঠলাম।

বললাম, হ্যাঁরে, তোদের দেশ এখান থেকে কতদূর? পানসিতে যে আসিস, ভয় করে না? সমুদ্রে ডুবে যায় না কখনো?

বলল, ডোবে না। বেশি দূর নয় দেশ। ভোর থাকতে রওনা দেয়। তখন সমুদ্রে স্রোত কম, হাওয়াও কম। আবার ফিরে যায় সন্ধে নাগাদ। তখনো আবহাওয়া অনুকূল।

অর্থাৎ সমুদ্রের গতিপ্রকৃতি ওরা বোঝে। এই যে স্রোত বা বাতাস এর মূলে রয়েছে সূর্যের তাপ। রোদ যত প্রখর হয়, বাতাস তত বাড়ে। তদুপরি জোয়ার ভাটার ব্যাপারটা কম নয়। ভাটার সময় ওরুনুকো নদীর জল গলগলিয়ে এসে পড়ে সমুদ্রে, তাতে স্রোত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এটা অবিশ্যি পরে আমি চিন্তা ভাবনা করে বের করেছি। যতদূর অনুমান, এই যে দ্বীপে আছি আমি–এটা ত্রিনিদাদ দ্বীপপুঞ্জের অংশ বিশেষ। নদীর উত্তর মুখে এর অবস্থান। সেটা আকারে ইঙ্গিতে ফ্রাইডেও আমাকে বোঝাল। কত যে প্রশ্ন করলাম এই দেশ নিয়ে! কেমন তারা মানুষ। কত তাদের সংখ্যা, কী তাদের অভ্যাস, কটি গোষ্ঠী এখানে আছে। তা সব প্রশ্নের পারে না জবাব দিতে। শুধু বলে ক্যারিব, অর্থাৎ এরা ক্যারিবীয় সম্প্রদায় ভুক্ত। ম্যাপ খুলে দেখলাম, আমেরিকা ছাড়িয়ে আরো খানিকটা গেলে এরুনুকো নদী। সেখানেই এই অঞ্চল। ফ্রাইডে বলল, নাকি সাদা চামড়ার একদল মানুষও থাকে কাছাকাছি কোন অঞ্চলে। ঠিক কোথায় সে বলতে পারে না, তবে শুনেছে বড়দের মুখে। তারা নাকি ভীষণ নিষ্ঠুর। মাঝে মাঝে সংঘর্ষ লাগে তাদের সঙ্গে। তখন নাকি নির্দয় ভাবে হত্যা লীলা চালায়। অর্থাৎ স্পেনীয়। সারা দুনিয়ায় স্পেনীয়দের নিষ্ঠুরতার কথা কে না জানে।

বললাম, আচ্ছা বলত দেখি, আমি যদি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই তাহলে কেমন করে যাব?

বলল, দুটো নৌকো লাগবে।

তার মানে? ভেবে ভেবে কিছুতে আর মানে পাই না। শেষে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করতে আকারে ইঙ্গিতে যা বোঝাল তার অর্থ এই, পানসিতে হবে না। লাগবে দু দুটো নৌকা জড় করলে যত বড় হয় ততখানি বড় একটা জাহাজ। তবেই তাদের দেশে যাওয়া সম্ভব হবে।

হোক জাহাজ, তাতে আমার কোনো আপত্তি বা অসুবিধে নেই। মোটমাট এখান থেকে বেরবার তো একটা রাস্তা জানা গেল। আজ না হোক কাল ফ্রাইডে যদি সঙ্গে থাকে, তবে বেরিয়ে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব। যদি সফল হই তবে ভালো, বিফল হলে ডুবে মরব। তা-ও তো কদ্দীদশা থেকে মুক্তি।

এই যে এতদিন ফ্রাইডে আছে আমার সঙ্গে-ছায়ার মতো পাশে পাশে ঘোরে, খায় একসাথে বসে, ঘুমোয় একবারও কিন্তু এর মনে ধর্মীয় চিন্তা জাগিয়ে তোলার এতটুকু চেষ্টা আমি করি নি। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, কে তার স্রষ্টা। কথাটার মানে সে একদম বুঝতে পারে নি, হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। তখন বললাম, আচ্ছা বলত দেখি, এই সাগর কার হাতে তৈরি, কিংবা এই পায়ের নিচের মাটি বা মাথার ওপরের আকাশ? বলল, কে আমার বনামুকি। সে থাকে ওই হোথায়? বলে দূরে আকাশটা দেখিয়ে দিল। বললাম, সে অবার কে? বলল, জানো না তুমি? সে মস্ত বড় মানুষ। তার অঢেল ক্ষমতা। আর অনেক বয়েস। এই সাগর মাটি পাহাড় চাঁদ সূর্যের চেয়েও বয়েসে অনেক বড়ো। বুড়ো থুথুড়ে। বললাম, বেশ তো, নয় মানলাম তোর কথা, ধরে নিলাম তোর বেনামুকিই সৃষ্টি করেছে সব। তবে সকলে বেনামুকিকে পুজো করে না কেন? কী গম্ভীর তখন ফ্রাইডের মুখ! যেন বিরাট এক কুট তর্কের সুচিন্তিত মতামত দিতে চলেছে, সেই রকমই ভাব। বলল, করে তে। সবাই পুজো করে। পুজো করে বলেই তো আকাশ গোল, সাগর গোল, মাটি গোল, পাথর গোল–সব গোল। পুজো মানেই গোল। বললাম, আর যারা মারা যায় তারা? কোথা যায় মৃত্যুর পর? বলল, বেনামুক্তির কাছে কী করে তখন বেনামুকি? সবাইকে পটাপট গিলে খায়? বলল, হ্যাঁ, খুব ক্ষিধে তার। তাই খায়।

তারপর থেকেই তার মনে ঈশর সম্পর্কে প্রকৃত বোধ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করি। বললাম, সত্যিকারের ঈশ্বর কোথায় থাকেন জানিস, ঐ আকাশে। ওর ওধারে স্বর্গ। তারই কর্তৃত্বে চলে এই গ্রহ নক্ষত্র তারা। ফলে এই পৃথিবী। তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থাৎ একাই অসীম শক্তির অধিকারী। কারুর সাহায্য তার দরকার লাগে না। আমাদের সব যেমন তিনি দুহাত ভরে ঢেলে দেন, আবার ইচ্ছে হলে সব কিছু কেড়েও নেন তিনিই।

দেখি শুনছে খুব মন দিয়ে। সারা চোখে মুখে অদ্ভুত আগ্রহের দ্যুতি।

তখন যীশু খ্রিস্টের গল্প বললাম। তার সৃষ্ট প্রার্থনার কথা বললাম। ঈশ্বর স্বয়ং পাঠিয়েছেন তাকে এই পৃথিবীতে তাই তো আশ্চর্য শক্তি নিয়ে রচনা করতে পেরেছেন অনবদ্য সব প্রার্থনা গীতি। সে প্রার্থনা ঈশ্বর স্বর্গ থেকেও শুনতে পান।

ফ্রাইডে বলল, তবে তো বেনামুকির চেয়ে তিনি অনেক অ-নে-ক বড়। সে তো থাকে ঐ পাহাড়ের মাথায়। তবু কই সব কথা যে শুনতে পায় না।

বললাম, তুই বুঝি পাহাড়ের মাথায় বেনামুকির সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলি?

বলল, না না, আমরা যাই নি। আমাদের যাবার নিয়ম নেই। কম বয়েস যে আমাদের। যায় বুড়োর দল। তারা উকাকী। তারা বেনামুকির সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানে।

উকাকী অর্থাৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন। এটা আমি প্রশ্ন করে জেনে নিলাম।

বললাম, তারপর?

–তারপর আর কী? সব জেনে ফিরে আসে তারা। বেনামুকী কি বলল আমাদের এসে বলে। আমরা সেই ভাবেই কাজ করি।

অর্থাৎ ধর্মের নামে বুজরুকি। সভ্য জগতের সঙ্গে নেই কিছুমাত্র সংযোগ বা সংস্পর্শ, ধর্মের নামে এখনেও চলে নানান কলা কৌশল। পৃথিবীর সব দেশেই হয়ত এটাই চিরাচরিত প্রথা।

তবে ভুল ভাঙানোটা দরকার। দরকার মন থেকে এই অন্ধ বিশ্বাস দূর করা। বললাম, দেখরে, এই যে বুড়ো মানুষদের পাহাড়ের মাথায় গিয়ে বেনামুকির সাথে কথা বলে সব জেনে ফিরে আসা গোটা ব্যাপারটাই মিথ্যে, ভুয়ো। এর মধ্যে সত্যের নামগন্ধ নেই। তোদের এইভাবে ওরা দিনের পর দিন ঠকায়। যদি সত্যি সত্যি সেই নির্জনে কারুর সঙ্গে তারা কথা বলে। তবে সে ঈশ্বর নয়, পিশাচ। পিশাচই বাস করে একমাত্র ঐ নির্জন বন্ধুর পরিবেশে।

বলে পিশাচ কী, কেমন ভাবে তার জন্ম হয়। বাইবেলে এ সম্বন্ধে কী লেখা আছে–সব বললাম। শুনল মন দিয়ে। তবু ঐ-চট করে কি আর বিশ্বাস যায়! মনে যে এতদিনের ক্লেদ গ্লানি আর কুসংস্কারের বীজ। তখন শুরু করলাম একদম গোড়া থেকে। এই বিশ্ব, তার জন্ম, তার সৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবদান, আমাদের জন্ম, আমাদের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ, আমাদের পুণ্য, আমাদের পাপ–সব একটু একটু করে ব্যাখ্যা করে, উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম। দেখি শুনছে ভারি তন্ময় হয়ে। আর চোখে বিশ্বাসের ঝিলিক। পিচাশের কথাও বললাম। তার সৃষ্টি, তার ক্রিয়াকাণ্ড কেমন করে প্রভুর সৃষ্ট দুনিয়াকে ধ্বংস করার জন্যে সে সর্বদা ফন্দি ফিকির খোঁজে। কিন্তু পারে না যেহেতু সে-ও প্রভুরই সৃষ্টি। প্রভুর ক্ষমতা তার তুলনায় অনেক বেশি। বুঝতে পারল ফ্রাইডে। বলল, তাই যদি হয়, তবে ঈশ্বর পিশাচকে বাঁচিয়ে রেখেছে কেন? মেরে ফেললেই তো পারে।

আমি অবাক। হতভম্ব যাকে বলে। কী দেব এর উত্তর? প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি এই মাএ, কিন্তু আমি কি ধর্মপ্রচারক যে প্রতিটি প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর দেবার ক্ষমতা রাখি। তাই চেষ্টা করলাম প্রথমে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে। শুনেও না শোনার ভান করলাম। ফের বলতে বালাম। হুবহু একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল! তখন বললাম। শেষ করার সময় এখনো আসে নি। শাস্তি পেতে আরো অনেক দেরি আছে। কবে পূর্ণ হবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তিনি সময় মতো সঠিক ব্যবস্থা নেবেন। এটা ঠিক মনঃপূত হল না তার। বলল, কিন্তু কবে হবে সেই সময়? কতদিন পরে? এখন মারলে অসুবিধে কী? বললাম, অসুবিধে আছে। পাপীকে অনুতাপ করার সুযোগ করতে দেয়। অনুতাপই তার শাস্তি। অনুতাপের বোঝা পূর্ণ হলে তবেই আসে বিনাশ। অর্থাৎ শেষ। তারপর তার মুক্তি।

এ জবাবে দেখি বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। ভাবল চুপচাপ বসে খানিকক্ষণ। আমারও ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। কী কুক্ষণে যে শুরু করেছিলাম ওকে এই সব বোঝাতে! কিন্তু আর নয়। এরপর নতুন কোনো প্রশ্ন করলে জানি না মুশকিলে পড়ব কিনা। তাই চটপট ব্যস্তসমস্ত ভাবে উঠে দাঁড়ালাম। যেন হঠাৎই মনে পড়ে গেছে কোনো কাজের কথা। ওকেও একটা কাজ দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম দূরে কোথাও। গেল চলে! আমারও অপ্তি!

স্বস্তি ছাড়া একে বলবই বা কী। আমার কি বাপু অত জ্ঞান গম্যি আছে। তবে হ্যাঁ, নিষ্ঠা যে অন্য কারো চেয়ে কম নেই এটা আমি নিজেও বুঝতে পারি। নিষ্ঠা দিয়েই তো চিনেছি ঈশ্বরকে। আমার দাতা, আমার ত্রাতা, আমার রক্ষককে। কিন্তু অতশত প্রশ্নের উত্তর যে জানি না। ফ্রইডের চোখে আমি এক মহান ব্যক্তিত্ব কিন্তু যদি প্রশ্নের গুতোয় সেই ধারণা ওর মন থেকে মুছে যায়। সে ভয়টাও কিছু কম নয়। মোটমাট এড়িয়ে যাওয়াই এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ। যতটুকু জানি তার বেশি এগোনো কোনোক্রমেই উচিত নয়। কী বলতে কী বলে ফেলব, তার তো কোনো ঠিক নেই। ঈশ্বর আমার কাছে কিছু অভিজ্ঞতার সমষ্টি। অভিজ্ঞতা দিয়ে চিনেছি কে এই নির্জন পরিবেশে। প্রশ্ন করলে এবার থেকে সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলব। এর বাইরে একচুল কোথাও নড়ব না।

এবং সেইভাবেই কথা হয় এরপর থেকে। প্রশ্ন করে ফ্রাইডে একের পর এক। আমি একের পর এক আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি–কেমন করে এলাম এখানে, কেমন করে বাসা বাধলাম, কী কী ধারণা জন্মাল, কেমন করে ঈশ্বরের আশীর্বাদে খাদ্যশস্য চাষ করতে শিখলাম। কীভাবে সংগ্রহ করতাম অপরাপর খাদ্য। লোভের বশবর্তী হয়ে ডোঙায় চড়ে দ্বীপ জয় করতে গিয়ে একবার কী বিপত্তি হয়েছিল–সব একটার পর একটা বলি। অবাক তন্ময় হয়ে শোনে ফ্রাইডে। আর এক একটা ঘটনাকে নিজের ইচ্ছামতো ভগবৎ চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। সেটাও আবার বলে আমাকে। আমার মতামত জানতে চায়। আমি সায় দিই। দিনের পর দিন চলে এই অদ্ভুত খেলা।

তবে আমার দৈনন্দিন বাইবেল পাঠে কিন্তু ভাটা পড়ে নি। রোজ বসি নিয়ম মতো। পড়ি একমনে, ফ্রাইডে বসে শোনে তন্ময় হয়ে! এটা ওটা প্রশ্ন করে। সাধ্যমতো জবাব দিই। স্পষ্ট বুঝতে পারি। একটু একটু করে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি ওর আসক্তি জন্মাতে শুরু করেছে। সেটা মঙ্গল। হয়ত একদিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাও গ্রহণ করবে। করুক। আমি মনে প্রাণে তাই চাই। তার পূর্ণ কৃতিত্ব হবে আমার। সেটাই সবচেয়ে বড় গৌরব।

এবং এইভাবে দুটি ভিন্ন ধরনের মানুষ আমরা পরস্পরের কাছাকাছি হয়েছি। যাকে বলে আত্মার আত্মীয়। অনেক অন্তরঙ্গ এখন আমরা। মোটামুটি ফ্রাইডে সম্পর্কে নির্ভুল একটা ধারণা আমার মনে জন্মেছে। একটু একটু করে সব ওকে শেখাতে শুরু করেছি। ঘুরে বেড়াই সঙ্গে নিয়ে দ্বীপের এ মাথা থেকে ওমাথা অব্দি। বন্দুক চালানো শিখিয়েছি। তবে দিই নি ব্যবহারের জন্যে এখনো বন্দুক। পরির্তে দিয়েছি একটা ছুরি আর ছোটো একখানা হাত কুড়ুল। আমারই মতো একটা বেস্ট করে দিয়েছি কোমরে বাধার। তাতে ঝুলিয়ে রাখে কুড়ুল। ছুরিটা প্রায় সময় হাতেই রাখে। কোনোদিন তো পায় নি এমন দুরি হাতে, এত যে ধার হতে পারে এটা ওর কল্পনার বাইরে। প্রায় সময়ই দেখি ছুরি দিয়ে একটা না একটা কিছু কাটছে।

ইউরোপ দেশট, কেমন, তারও একটা মোটামুটি বর্ণনা দিয়েছি। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের। কেমন ভাবে থাকতাম সেখানে, কী কী আমাদের রীতিনীতি, কী অভ্যাস, ঈশ্বরকে সেখানে আমরা কী চোখে দেখি, জাহাজে কী কী সওদা নিয়ে ভেসে পড়ি সমুদ্রে–সব ওর কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমার সমুদ্র যাত্রার বিবরণ দিতেও বাকি রাখি নি। তিন বারের কথাই বলেছি। এমনকি নৌকাডুবির পর সেই যেখানে এসে পড়েছিলাম বালির উপর, সেটাও একদিন ওকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এসেছি।

সেই নৌকোটাও দেখালাম। বালির মধ্যে গেঁথে থাকা সেই নৌকা। আমি পারি নি একচুল নড়াতে। ঘুরে ঘুরে ফ্রাইডে সবদিক থেকে জরিপ করল। আমি বললাম, কী ব্যাপার, এত যে দেখলি চারপাশ থেকে? কারণ কী? বলে, দেখেছি এরকম নৌকো আগেও আমাদের দেশে মাঝে মাঝে আসে।

অর্থাৎ স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে। সেটা একটু পরে প্রশ্ন করে জেনে নিলাম। সমুদ্রে ঝড় উঠলে যখন টালমাটাল হাল, তখন নৌকায় করে আত্মরক্ষার জন্যে ভেসে পড়ে নাবিক। বাতাস ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে ভেড়ায় তাদের দ্বীপে। নাবিকদের কী পরিণতি হয় সেটা সহজেই অনুমেয়। নৌকাটা ওরা নষ্ট করে না, অক্ষত ভাবে রেখে দেয়।

এটা যদি সত্যি হয় তবে ওদের দেশে এরকম নৌকো বিস্তর আছে। সেক্ষেত্রে একটা অন্তত পেলে সমুদ্রে ভেসে পড়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে আরেকটুকু বিশদ করে জেনে নেওয়া দরকার।

বললাম, কেমন সে নৌকো, আমাকে বল।

বলল, ভাল। তাতে বোঝাই সাদা চামড়ার মানুষ।

–কজন?

দুহাতের আঙুল দুবার তুলে দেখাল,–সতের জুন।

–কী করেছিস তাদের? কেটেকুটে খেয়ে নিয়েছিস নির্ঘাৎ?

–না। সাদা চামড়ার মানুষ আমরা খাই না। তারা আমাদের ওখানে থাকে। এখনো আছে।

অর্থাৎ সেই জাহাজের নাবিক এরা–সেই যে বন্দুক ছুঁড়ে বিপদের কথা জানান দিয়েছিল। আমি গিয়ে নিয়ে এসেছি এটা ওটা নানান জিনিস।

সে প্রায় চার বছর আগের কথা। তবু ভালো, নরখাদকের দল তাদের হত্যা করে নি।–তা তোদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হয় না?

বলল, না, ওরা বন্ধু। বন্ধু ভেবেই ওদের থাকবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এদের কোনোদিন কোনো বিপদ হবে না।

–যদি অন্যায় করে,– খাবি না কেটেকুটে মাংস?

বলল, না, মাংস আমরা সব সময় খাই না। মানুষের মাংস। যখন যুদ্ধ হয়, হেরে যায় কেউ-তখনি খাই। বন্দীদের মাংস খাওয়ার মধ্যে কোনো অপরাধ নেই।

এর বেশ কিছুদিন পরের কথা।

দারুণ ঝকঝকে রোদ। আর মাথার ওপরে সুনীল আকাশ। কুয়াশার লেশ মাত্র নেই। আমি আর ফ্রাইডে পুবের দিকের পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে। যতদূর চোখ চলে শুধু জল আর জল। বহুদূরে রেখার মতো একসারি গাছপালা। এটা আমেরিকা। আমি অনুমান করতে পারছি। পিছনে ফিরলাম। দেখি একটা কাছেই দ্বীপ। কাছে বলতে একেবারে হাতের গোড়ায় নয়, টানা পথে অন্তত ক্রোশ তিনেকের মতো দূর। ফ্রাইডেরও নজর গেছে সেদিকে। আর কী উল্লাস! লাফাতে শুরু করেছে দেখি শিশুর মতো। বলল, ঐ দেখুন, ঐ আমার দেশ, আমার মাটি। ঐ যে!

সে যে কী সরল কী আনন্দের মুখচ্ছবি! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। বিমূঢ় বিহ্বল আমার অবস্থা। আর মনে একটু একটু করে রাগ জন্ম নিচ্ছে। আর বিদ্বেষ। তার মানে তোমার মনের আসল কথা এই। আমার সঙ্গে থাকতে তোমার ভালো লাগে না। দেশে ফিরে যেতে চাও তুমি! সেটাই তোমার একান্ত বাসনা!

বলব কী, মুহূর্তে যেন ভারি নীচ ভারি নিষ্ঠুর মনে হল ফ্রাইডেকে। আর হিংসে।–আমি থাকব বন্দী অবস্থায় এখানে, আর তুমি দেশে ফিরে গিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাবে! তারই জন্যে এত উল্লাস। তাহলে এই যে ওর জীবন রক্ষা করলাম, এই যে এত কিছু শেখালাম ওকে ধর্মের এই এত সব কথা,–সব মিথ্যে? কোনো কিছুরই দাম নেই।

সে এমনই অবস্থা, ভালোভাবে ওর দিক আর তাকাতে পাচ্ছি না। কথা বলতে পারি না মন খুলে। কী যেন একটা বাধা সদা সর্বদা আমাদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। ওকে আমি এখন রীতিমতো হিংসে করতে শুরু করেছি। হায়, হায়, তখন কি জানি সে আমার কত বড় ভুল। আমি আমার সভ্য দুনিয়ার নিয়মের ছকে ফেলে ওকে বিচার করতে চেয়েছিলাম। সে বিচার একান্তভাবে আমারই করা বিচার। সত্যের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। অসভ্য দুনিয়ার মানুষ অন্য ধাতুতে তৈরি। তারা ভালবাসতে জানে প্রাণ দিয়ে। জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূল্যবোধ দিয়ে বারে বারে লাথি মারে আমাদের সভ্য দুনিয়ার মুখে।

ঘটনাটা খোলসা করে বলি।

হিংসেয় তো সর্বদা আমি জ্বলে পুড়ে মরছি। সেই চোখ দিয়েই বিচার করি এর প্রতিটি কার্যকলাপ। ওর কিন্তু কোনো কাজেই কোনো ভুল নেই। সেই সরলতা সেই আন্তরিকতা নিয়ে করে প্রতিটি কাজ। সারাদিন ছায়ার মতো থাকে আমার সাথে। আমাকে সন্তুষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমন কি, আমার মনে যে এই এত জ্বলুনি–এটাও ওর সহজ সরল চোখে ধরা পড়ে না।

একদিন সেই পাহাড়ের মাথায় উঠেছে গিয়ে ফের। পাশাপাশি দুজন দাঁড়িয়ে। সেদিন আবহাওয়া তেমন পরিষ্কার নয়। ধোয়ার মতো কুয়াশার একটা প্রলেপ। তির্যক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কীরে, যাবি না তোর দেশে? বলল, যাব। দেশ আমার খুব ভালো। খুব ভালো লাগবে যেতে পারলে। বললাম, গিয়ে তো ফের মানুষের মাংস খাবি। ভুলে যাবি সব কিছু তাই না? বলল, মোটেই না। আমি আর খাব না। সবাইকে বলব মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে। ঈশ্বরের কথা বলব। চাষ করব। ছাগলের দুধ খেতে বলব।তবে আর কি, আমি বললাম, তোর তো কপালে অনিবার্য মৃত্যু। ওরা সব শুনে তোকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলবে। বলল, না না, খাবে না। শুনে আমাকে ভালবাসবে। আমি যা বলব তাই করবে। নাকি সাদা চামড়ার সেই সতেরজনের কাছ থেকে তারা অনেক ভালো ভালো জিনিস শিখেছে। কই, তাদের তো মারে নি বা কেটে কুটে খেয়ে নেয় নি! বললাম, বেশ তো, যা চলে। তোর যদি ইচ্ছে হয়, এক্ষুনি যা। বলল, কেমন করে যাব? অতখানি কি সাঁতার কেটে যাওয়া সম্ভব? বললাম, ঠিক আছে, আমি নয় তোকে একটা পানসি বানিয়ে দেব। বলল, আর আপনি? বললাম, আমার আর কি, এখানে থাকব। বলল, আপনি না গেলে আমি যাব না। তখন হাসলাম, বললাম, আমি গেলে আমাকে তো তোরা কেটেকুটে খেয়ে ফেলবি। বলল, না না, ছিঃ, আপনাকে সকলে খুব ভালবাসবে। আমি বলব সবাইকে আপনার কথা। ভালবাসতে বলব।

সেই দুরাশাটা মনের মধ্যে ফের পাক খেতে শুরু করেছে। বন্দী দশা থেকে মুক্তির সেই আদিম ইচ্ছা। যাব নাকি ওর সাথে ওর দেশে! সেই সতের জনের সাথে দেখা হবে। হোক না স্পেনীয় কি পুর্তুগিজ–কী আসে যায়! তারাও তো বন্দী। দেশে ফেরার আকুলতা কি তাদের মধ্যেও কিছু কম? সবাই মিলে যুক্তি করে একটা রাস্তা বের করব। খেটে খুটে নয় তৈরি করব মস্ত একটা নৌকো। আমার ভোঙাটাও নিয়ে যাব সাথে করে। নয় আর কিছু না হোক, সেটাতে চেপেই ভেসে পড়ব।

নিয়ে গেলাম তখন তাকে আমার সেই ভোঙার কাছে। বললাম, কীরে, এতে চেপে দুজনে আমরা যেতে পারব তোর দেশে? বলল, না, এটা বড্ড ছোটো। দুজন যাওয়া যাবে না। একজন হলে হয়। বললাম, বেশ তো, আয় তবে দুজনে মিলে একটা বড় নৌকো বানাই। গাছ কেটে। তাতে খাবার দাবার সব দিয়ে দেব। আমি নয় এখানেই থাকব। আগে তুই তাতে চেপে তোর দেশ থেকে ঘুরে আয়।

শুনে অব্দি সে যে কী থমথমে মুখের ভাব, সে আমি বলে বোঝাতে পারব না। হাসি খুশি মানুষ হঠাৎ থম মেরে গেলে যে রকম হয়। দেখি চোখ তুলে তাকায় না আর আমার মুখের দিকে। বললাম, কী হল, চুপ করে গেলি কেন? কী হয়েছে?

বলল, আমি জানি না। আমি কী করেছি আপনার যে আপনি ঐসব বলছেন?

বললাম, কী আবার বললাম তোকে?

বলল, ঐতো, ঐ রাগ। আমি সব বুঝতে পারছি। আপনি আমাকে মোটে ভালবাসেন না।

আমি অবাক। বললাম, কোথায় রাগ করলাম আমি?

–রাগ না? রাগ কি আমি চিনি না? ঐ যে বললেন, তুই একলা গিয়ে ঘুরে আয়। আমি এখানে থাকব।

–তা এর মধ্যে রাগ কোথায়?

-রাগই তো। আমাকে একলা পাঠাবেন। কেন, আমি তো আপনাকে ছাড়া যাব না বলে দিয়েছি।

–কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে কী করব?

–আপনি শেখাবেন সব। ভালো ভালো জিনিস। ঈশ্বর! মাংস না খাওয়া। আমাকে যে সব শিখিয়েছেন।

–কিন্তু আমি যে শেখাব, আমি নিজেও কি ছাই সব কিছু জানি, বুঝি?

–জানেন। সব আপনি জানেন। আপনাকে যেতেই হবে।

–কিন্তু যদি তোর দেশের অন্য কারো আমাকে ভালো না লাগে? যদি বন্দী করে আমাকে? মেরে ফেলে?

–কেন মারবে? কেন করবে বন্দী? আপনার সাথে কি যুদ্ধ হয়েছে যে আপনাকে বন্দী করতে হবে?

–তবু থাক। ফ্রাইডে, তুই-ই বরং গিয়ে ঘুরে আয়।

–না, যাব না আমি। কিছুতে যাব না। আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে চান। আমাকে ভালবাসেন না। আমি যাব না। কখনো না।

বলে কাঁদতে লাগল ঝরঝর করে। সে একেবারে শিশুর মতো কান্না। আমি হতবিহ্বল। কী করব বুঝতে পারছি না। আর ঘেন্না হচ্ছে নিজের উপর। এই মানুষকে কিনা আমি ভুল বুঝেছিলাম। মিথ্যে সন্দেহ করেছিলাম। হিংসে করেছিলাম অবুঝের মতো। আমার মতো পাপী অবিবেচক হয়ত আর সারা দুনিয়ায় নেই।

আসলে আমাকে ভালবাসে ভীষণ। বুকের মধ্যে আমার জন্যে জমা আছে একরাশ দরদ। আমাকে ছেড়ে ও যে আর কোথাও যাবে না এ ব্যাপারে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। দেশে যে যেতে চায় সেটাও আমার মহিমা জনসমক্ষে জাহির করার জন্যে। আমাকে ও দেশের মানুষের কাছে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বলে সাব্যস্ত করতে চায়। ওর ঐকান্তিক অভিলাষ, আমি হয়ত ওর দেশের মানুষের প্রভূত উন্নতি করতে পারব, তাদের অনেক ভালো জিনিস শেখাতে পারব, তাদের মঙ্গল করতে পারব। তাই আমাকে নিয়ে যেতে চায় দেশে। তাই বারবার বলে, ওরা আপনার কিচ্ছুটি করবে না। আপনাকে ভালবাসবে। এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু আমি তো আর বাস্তবিক সেই উদ্দেশ্য নিয়ে যেতে চাই না। আমার ইচ্ছে সেই সতের জনের সঙ্গে দেখা করার। তাদের সাথে যুক্তি পরামর্শ করার। কেমন করে পালাতে পারা যায় তার ফী আঁটব। তবে আর দেরি কেন। ফ্রাইভে আর আমি দুজনেরই যখন ইচ্ছের অন্তত খাকিটা মিল তাহলে নৌকো বানাবার তোড়জোড় করি। পাকাঁপোক্ত নৌকো। তাতে করে দুজন জমা পাড়ি।

তখন শুরু হল বৃক্ষানুসন্ধান। এবার আর আগের বারের মতো ভুলের খপ্পরে পা বাড়াচ্ছি না। জলের ধারে ধারে বিস্তর গাছ। একেবারে বলতে গেলে কিনার ঘেঁষে। কাটব সেরকমই একটা। সেখানে বসেই প্রস্তুতির কাজ সারব। তবে আর নৌকো জলে ভাসানো নিয়ে আগের বারের মতো অত ঝকমারি হবে না।

ফ্রাইডেই খুঁজে বের করল গাছ। আমার চেয়ে এ ব্যাপারে অনেক পাকা। বৈশ পুরুষ্টু আকার। তবে নাম জানি না গাছের। ফেলল কেটে মাটিতে। ডাল পালা ছাঁটল। বলে (পাভাব এবার। পুড়িয়ে বানাব পানসি। আমি নিরস্ত করলাম। হাতুড়ি বাটালি কুড়ুল দিলাম এগিয়ে। দেখিয়ে দিলাম কেমন ভাবে কাটতে হয়। অমনি শিখে নিল চটপট। খাটল একটানা প্রায় একমাস। আমিও হাত লাগালাম। হল ভারি চমৎকার। তখন তাতে হাল বসিয়ে দিলাম। জানত না হালের কথা। বুঝিয়ে দিলাম কী এর কাজ। দেখে তো ভারি আহ্লাদ। মোটমাট ঘষে মেজে নিপুণ করতে, প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম বসাতে লাগল আরো প্রায় পনের দিন। তারপর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলাম জলে। অপূর্ব। কিন্তু এই মুহূর্তে তো আর যাচ্ছি না। তখন কাছাকাছি একটা পাথরের খাজে লুকিয়ে রাখলাম।

নামালাম যখন প্রথম ঠেলতে ঠেলতে, সে কী আনন্দ ফ্রাইডের! একলাফে চড়ে বসল পানসিতে। দাঁড় বাইল, ছুটল খানিকটা হু হু বেগে কী সাবলীল ওর দাঁড় টানবার ভঙ্গি। আর স্বচ্ছন্দ খুব। বলল, কোনো চিন্তা নেই। কোনো বাতাস পারবে না একে ডুবিয়ে ফেলতে। আমি বলে দিচ্ছি। আপনি মিলিয়ে নেবেন। তখন পানসি থামিয়ে, তৈরিই ছিল সব কিছু মাস্তুল আর পাল খাঁটিয়ে দিলাম। ফ্রাইডে তো অবাক। ফুরফুর করে বইছে বাতাস আর পান্‌সি চলেছে আপন খেয়ালে। দাঁড় বাইবার আর দরকার নেই। এরকম আবার হয় নাকি! দেখি অবাক চোখে তখনো দেখছে। তখন বুঝিয়ে দিলাম। কী আনন্দ তার!

তা বললাম যত সহজে, কাজে কিন্তু লেগেছে অনেক সময়। মাস্তুল বসানো থেকে শুরু করে পাল খাটানো, হাল জুড়ে দেওয়া, মোটমাট সব দিক থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ যাকে বলে–সময় আমার লাগল মোট দুটি মাস। তখন সে একেবারে দেখার মতো জিনিস। ডুববার আর ভয় নেই। বাতাস গ্রহণ করা থেকে শুরু করে হাল ঘুরিয়ে দিক বদল–কিছুতেই আর কমতি বলতে কিছু নেই।

কিন্তু বসালেই তো হয় না, এ সবের যথার্থ ব্যবহার জানা চাই। বুঝতে হবে কোনটা দিয়ে কী কাজ হয়। সেটা একে একে ফ্রাইডেকে হাতে কলমে শিখিয়ে দিলাম। ওর তো জ্ঞান বলতে শুধু দাঁড় টেনে পানসি বাওয়া। অকুল দরিয়া কি আর ঐ জ্ঞানে চলে। অনেক কিছু লাগে যে শিখতে। অনেক ব্যাপার। তবে না পাল্লা দেওয়া যায় স্রোতের সাথে, হাওয়ার সাথে। শিখে নিল সব। একটা কম্পাসও বসিয়েছিলাম। বলতে ভুলে গেছি। শুধু সেটা নিয়েই যা গোল। কিছুতে পারি না তার কাণ্ডাকাণ্ড বোঝাতে। বুঝবার দরকারও অবিশ্যি তেমন একটা নেই। কালেভদ্রে কুয়াশা জমে এ অঞ্চলে। আকাশ মোটের উপর নির্মল। দিকভ্রম হবার কোনো কারণ নেই। আর রাতে তো সারা আকাশ তারায় তারায় ঝলমল। দিনের চেয়ে দেখি এরা রাতের আকাশ চিনতেই বেশি অভ্যস্ত। তখন আমি আর কম্পাস শিক্ষা নিয়ে জোর জবরদস্তি করলাম না।

সাতাশ বছর চলছে এটা। আমার বন্দীদশার দীর্ঘ সাতাশ বছর। কীভাবে যে কেটে যায় সময়! ফ্রাইডেকে পেয়েছি তিনবছর আগে। দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেমন হু হু করে পার হয়ে গেল। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। তবু যাহোক ওকে পেয়ে অব্দি আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছু সাড়া পড়েছে। গল্প করার লোক পেয়েছি। নানান পরিকল্পনা করতে পারি দুজনে বসে। কাজও করি এখন চার হাতে। তাতে চটপট যে কোনো বড় বড় কাজও হয়ে যায়। তবে এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু ভুলি নি আমার দ্বীপে আসার সেই প্রথম দিনটির কথা। এখনো ফি বছর ৩০ শে সেপ্টেম্বর এলে উপবাস করি, সারাদিন তন্ময় থাকি ঈশ্বরের আরাধনায়। এদিন আমাকে দিয়ে যে বিশেষ কোনো কাজ হবে না,এটা ফ্রাইডে আজকাল ভালোমতোই বুঝে গেছে। আমাকে সেদিন আর ঘাটায় না বেশি। কত যে ধন্যবাদ দিই ঈশ্বরকে সেদিন। হিসেবে মাপা যায় না। আর কেবলই মনে হয়, আমার মুক্তির দিন বোধহয় সমাগত। আর বেশিদিন এই নির্জনে নিরালায় একটেরে হয়ে পড়ে থাকতে হবে না। একটা কিছু অদ্ভুত ঘটনা দ্রুত ঘটবে। আমি নিশ্চিত সে ব্যাপারে। কিন্তু কি সেই ঘটনা–বিস্তর ভেবেও তার কোনো হদিশ করতে পারি না।

দেখতে দেখতে বর্ষা। আমার পক্ষে বড় করুণ বড় দুঃখের সেই ঋতু। মোটে সহ্য হয় না মেঘ ধোওয়া জল। বাইরে তো বেরুতে পারব না এই দুমাস। তাই আগে ভাগেই যা করার করে ফেললাম। পানসি এনে রাখলাম বাড়ির কাছের সেই নালায়। ফ্রাইডে আর আমি দুজনে মিলে ছোটো একটা খাড়ি মতো খুড়ে ফেললাম। যাতে জলের তোড়ে নাও না ভেসে যায়। বাধ মতো দিলাম এক ধারে। বাইরের জল যাতে ঢুকতে না পারে। অর্থাৎ রক্ষণাবেক্ষণের সব বন্দোবস্তই পাকা। বৃষ্টির অবিশ্রান্ত জলে যাতে কাঠ না পচে যায় তার জন্যে ওপরে তুললাম ছোট্ট এক ফালি চালা। তাতে দিলাম যাবতীয় খড় আর ডালপালার ছাউনি। ব্যস, আর চিন্তা কীসের! থাক এইভাবে পড়ে দুটো মাস। বর্ষা কমুক। তারপর নভেম্বর কি ডিসেম্বর মাসে অভিযানে নামা যাবে। মোটমাট একটা না একটা কিছু এবার করবই।

দেখতে দেখতে নভেম্বর সমাগত। বৃষ্টি বাদল নেই। আবহাওয়া সর্বদাই পরিষ্কার। এবার যাত্রা হবে শুরু। ভিতরে ভিতরে তারই তোড়জোড় চলছে। দরকার যে অনেক জিনিস সঙ্গে নিয়ে যাবার। জল থেকে শুরু করে খাবার দাবার–সে অঢেল আর কি। যোগাড় করছি তাই একে একে। ইচ্ছে আছে দিন পনের সুরে ভেসে পড়ব দরিয়ায়। মোটমাট যাত্রার ব্যাপার নিয়ে ভারি ব্যস্ত আমি। দৈনন্দিন আহার্য অন্বেষণে সেদিন সকালে আর বেরনো হয়ে ওঠে নি। ফ্রাইডেকে বললাম, যা তো একবার, ‘দেখ দেখি নিদেন পক্ষে একটা কাছিম জোটাতে পারিস কিনা। হপ্তায় একদিন আমরা কাছিমের ডিম খাই। নিয়মরক্ষার খাতিরে তো বটেই, অধিকন্তু বেরুতে পারি নি আজ, সেই কারণে ওকে কাছিমের খোঁজ করতে বললাম। চলে গেল ফ্রাইডে। আমি গোছ গাছের কাজ করছি আপন মনে, হঠাৎ শুনি ফ্রাইডের পরিত্রাহি ডাক-মালিক, মালিক! সর্বনাশ হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন। হা ঈশ্বর, কী করি এখন! তখন বাইরে এলাম। বললাম কীরে, এমন হাঁক ডাক করছিস কেন? কী হয়েছে? বলল, ঐ দেখুন। আপনার দূরবীনটা চোখে লাগান। ছটা মোট নাও। এক, দুই, তিন। আরো এক দুই তিন। কুলে এসে ঠেকল সবে। আমি অমনি ছুটতে ছুটতে চলে এলাম। হায় হায়, এখন কী হবে!

সান্ত্বনা দিলাম। মনে সাহস যোগালাম। ভয় পেয়ে গেছে যে ভীষণ। নিজের জন্যে ভয়। ওর ধারণা, ওর খোঁজেই এসেছে ওর দেশের মানুষ। দলে ভারি হয়ে এসেছে। তাহলে আর কীভাবে বাঁচবে। এবার তো ধরার সঙ্গে সঙ্গে খতম। তারপর টুকরো টুকরো করে কেটে খাবে। আমিও কি রেহাই পাব? অতগুলো মানুষের বিরুদ্ধে পারব কি লড়াই করতে। আমি তো কোন ছাড়, স্বয়ং দেশের সেনাপতি এলেও পারবে না। তাহলে উপায়?

বললাম ধৈর্য ধরতে। চঞ্চল হলে কি আর কিছু ঠিক করে ভাবনা চিন্তা করা যায়। তবে একটা কথা, তুমি যে অবস্থাতে থাক না কেন, লড়াই তোমাকে করতে হবেই। সে পঞ্চাশ জন হোক কি দুশ। কীসের পরোয়া! মৃত্যু যখন সুনিশ্চিত তখন যে কোনো ঝুঁকি নেবার প্রয়োজন দেখা দিলে নিতে হবে বৈকি। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কেউ কি বলতে পারে কীরকম ভাবে কী করলে আত্মরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

বললাম, দেখ ফ্রাইডে, তোকে কিন্তু দরকার হলে গুলি চালাতে হবে। অন্তত জান না নিতে পারিস, গুলির শব্দে ভয় ধরিয়ে দিতে হবে। কী পারবি তো? বলল, আমি চালাব গুলি! তাহলেই হয়েছে। আপনি আর লোক পেলেন না। বললাম, ওকথা আমি একেবারে শুনতে চাই না। গুলি তোকেই চালাতে হবে, প্রয়োজনবোধে দুটো একটা মানুষও মারতে হবে। তার আগে এখন একবোতল আরক খেয়ে নে।

আরক অর্থে দ্বিতীয় জাহাজ থেকে আনা সেই পেটি বোঝাই মদ। কয়েকটা এনে রেখে দিয়েছি বাড়িতে। বাকি সব সেই লুকোনো গুহায় রয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখি বেশ চনমনে ভাব। খুব সাহস তখন মনে। দুটো পিস্তল দিলাম তখন ওর হাতে। আর একটা বন্দুক। আমার সঙ্গে তো যা থাকার আছেই। একটা কুড়ুলও দিলাম।

উঠলাম গিয়ে পাহাড়ের মাথায়। দূরবীনে চোখ রাখলাম। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সকলকে। একশ জন বর্বর। সঙ্গে তিন বন্দী। এক এক পানসিতে এক এক জন। হাত পা বাধা। ফেলে রেখেছে উপুড় করে। আর খুব যেন খুশি খুশি ভাব। যেন উৎসবের মেজাজ বর্বর দলের মধ্যে। তুমুল হট্টগোল। শব্দ এতদূর পৌঁছয় না, তবে হাত পা নাড়া দেখে অনুমান করা যায়।

নেমেছে এবার একটু এগিয়ে এদিকে। আমাদের নালাটার কাছাকাছি। কুল এখানে ঢালু হতে হতে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। একধারে ঘন জঙ্গল। এমনই বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল মন। গা ঘিন ঘিন যাকে বলে। এইখানে আমার চোখের গোড়ায় ওরা করবে নরহত্যা! আমি বসে বসে দেখব! একটা নয়, তিন তিনটে মানুষ না না, এ অসহ্য! বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে হৃদয়। একটা হেস্তনেস্ত আজ করতেই হবে।

পাহাড় থেকে নেমে ফ্রাইডেকে বললাম, চল, আজ ওদের হত্যা করব। খুনের রক্তে হাত রাঙাব। আমি এ আর সহ্য করতে পারছি না।

ফ্রাইডে বলল, চলুন। আমারও কষ্ট হচ্ছে। এর শোধ তুলতে হবে। যদি মরতে হয় মরব চলুন।

তখন অস্ত্রগুলো দুজনের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিলাম। একটা পিস্তল দিলাম ফ্রাইডেকে, আর তিনটে বন্দুক। আমিও নিলাম তাই। মদের একটা পাত্র নিলাম সাথে। ফ্রাইডের কাঁধে দিলাম মস্ত একটা ঝোলা। তাতে বারুদ, গুলি, সীসের ছররা–সব মজুত। ফ্রাইডের উপর নির্দেশ, যেন আমাকে অনুসরণ করে। কখনো আমাকে ডিঙিয়ে যেন আগে না চলে যায়। আমি না বললে যেন গুলি না চালায়। ফ্রাইডে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি, কী মনে হতে কম্পাসটাও নিয়েছি সাথে। আর জলের বোতল। তারপর ঈশ্বরের নাম করে রওনা হলাম।

চলেছি জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে সন্তর্পণে, যাতে আমাদের ওরা না দেখতে পায়। ভীষণ রাগ তখন শরীরের প্রতিটি রোমকূপে। টগবগ করে ফুটছে রক্ত। পুরানো চিন্তাটাও মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি মারছে। তাইতো, হত্যার প্রতিশোধ তুলতে চলেছি হত্যা দিয়ে। এটা কি ঠিক? কোনো পাপ নেই তো এর মধ্যে? ওরা কি জ্ঞানত কোনো পাপ করছে? হয়ত । কিন্তু অমানুষিক এই নরহত্যা, এটাও তো ঠিক নয়। বসে বসে তো আর দেখা যায় । প্রতিবাদ একটা না একটা করা উচিত। তা বলে এই ধরনের প্রতিবাদ? এটাই এক্ষেত্রে সঠিক। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। স্বাভাবিক নিয়মে এদের যদি বুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে যাই, তাহলে ওরা মানবে না। যদি ছিনিয়ে আনতে চাই বন্দীদের, তবে যুদ্ধ লাগবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরই প্রাণ নাশের সম্ভাবনা। আধুনিক কোনো অস্ত্র ওদের সাথে নেই ঠিকই, কিন্তু তীর ধনুক তো আছে। নিপুণ ওরা শরক্ষেপণে। সুতরাং অস্ত্র আমাকে এক্ষেত্রে ধরতেই হচ্ছে। হত্যা করব অহেতুক নয়। হত্যা করার মধ্য দিয়ে তিনজন বন্দীর জীবন রক্ষা করব। সেটা পাপ নয়। এক্ষেত্রে সেটাই মহা পুণ্যের কাজ।

নিঃশব্দে চলেছি। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিটুকু অব্দি না ওঠে, সেদিকে আমাদের নজর। ফ্রাইডে চলেছে আমার পিছন পিছম। একেবারে শেষ মাথায় এসে থামলাম। ফ্রাইডেকে বললাম, ঐ গাছে উঠে দেখ দেখি, স্পষ্টভাবে ওদের দেখা যায় কিনা। উঠল গাছে। ফিরে এল একটু পরেই। বলল, দেখা যায়। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে মাংস খাচ্ছে। একজন বন্দীকে ইতোমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। ওরই দেশের লোক এরা। দুই বন্দীর মধ্যে একজন সাদা চামড়া মানুষ। এবার সম্ভবত তার পালা।

তখন লাফ দিয়ে উঠলাম। দেখি সত্যিই তাই। সাদা চামড়ারই বটে। পরনে পোশাক। হাত পা বাধা দাঁড় করিয়ে দেখেছে সেইভাবে একধারে। ভোজন র্ব চলছে। আরেক বন্দী সম্পূর্ণ উলঙ্গ। মুখ দেখার উপায় নেই। হাত পা বাঁধা অবস্থায় উপুড় করে শুইয়ে রেখেছে তাকে নৌকোর খোলে। তখন গাছ থেকে নেমে পড়লাম।

সময় হাতে খুব কম। ইশারা করলাম ফ্রাইডেকে। ঘন ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা অঞ্চল। অদূরে মস্ত এক গাছ। সেটা ওরা যেখানে বসে আছে তার থেকে পঞ্চাশ গজ মাত্র দূরে। মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে অতিক্রম করলাম দূরত্বটুকু। এগিয়ে গেলাম। সামনে বড় বড় ঝোঁপ। শুয়ে পড়লাম মাটিতে। বুকে তখন হাতুড়ি পিটছে আমার।

এগিয়ে গেছে একদল ইউরোপীয় বন্দীটির দিকে। বন্দুক মাটিতে রেখে নিশানা ঠিক করলাম। ফ্রাইডেকে বললাম, আমি যা করব তুইও তাই করবি। খবরদার, ভুল যেন না হয়। ফ্রাইডেও দেখাদেখি বন্দুক নামাল। নিশানা করল। বললাম, এবার গুলি কর।

আমিও টিপেছি ঘোড়া। ছুটে গেল এক সাথে এক ঝাক ছররা। ফ্রাইডের নিশানা নির্ভুল। দেখি দলের মধ্যে দুজন এক সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বালির উপর, অর্থাৎ খতম। বাকি তিনজন ছিটকে গেল তিনদিকে। তারাও অল্প বিস্তর জখম। এদিকে গুলির শব্দে চমকে উঠেছে অন্যান্যরা। ভয় পেয়ে গেছে। ত্রাস যাকে বলে। কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারছে না। দ্বিতীয় বন্দুক তখন নামালাম। নিশানা করলাম। দেখাদেখি ফ্রাইডেও। এবার হতবিহ্বল মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে নিশানা। বললাম, চালাও গুলি। সঙ্গে সঙ্গে গুডুম গুড়ুম। অর্থাৎ আমিও ছুঁড়েছি। ছিটকে পড়ল এবারও দুজন। আহতের সংখ্যা আগেরবারের তুলনায় এবার বেশি। আর সে কী চিৎকার! ছুটছে চিৎকার করতে করতে বালির উপর দিয়ে। দরদর করে গা দিয়ে ঝরছে রক্ত। তখন ফ্রাইডেকে বললাম, চল এবার দেখা দিই।

বেরিয়ে এলাম ঝোঁপের আড়াল থেকে। ফ্রাইডে ধাওয়া করল আহতদের। আমি গেলাম বন্দীর কাছে। বালির উপর পড়ে আছে বেচারি। হতবিল ভাব। দেখি চারজন এরই মধ্যে ছুটতে ছুটতে এসে নৌকায় উঠেছে। ফ্রাইডেকে বললাম, গুলি কর। ছুটে এল একঝাক গুলি। ছিটকে পড়ল দুজন জলের মধ্যে। দুজন ভীষণভাবে জখম। দেখি সেই অবস্থাতেই চেষ্টা করছে পালাতে। ফের গুলি। মারা পড়ল আরো একজন। চতুর্থ ব্যক্তি নৌকোর খোলে শুয়ে কাত্রাতে লাগল।

ছুরি দিয়ে বাঁধন কেটে দিলাম বন্দীর। ওঠালাম হাত ধরে। পর্তুগিজ ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম তার পরিচয়। জানে না সে ভাষা। ল্যাটিনে বলল সে খ্রিস্টান। তেমন দুর্বল নয় বা মূচ্ছাও যায় নি। শুধু ঘাবড়ে গেছে ঘটনার পরম্পরায় এই যা। তখন বোতল খুলে দিলাম গলায় ঢেলে পানীয়। একটু চাঙ্গা হল। সঙ্গে রুটি ছিল। দিলাম দুখানা। খেল গোগ্রাসে। আহারে বেচারা, কতদিন বন্দী অবস্থায় ফেলে রেখেছে এইভাবে কে জানে। দেশের নাম জিজ্ঞেস করলাম। বলল স্পেন। আর সে কী শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ঘটা! আমি তার জীবনদাতা। কোনোদিন ভুলবে না আমার ঋণ। তখন যেটুকু জানি ওদের ভাষা, তাইতে বললাম, এখন আর অন্য কোনো কথা নয়। বিপদ এখনো কাটে নি। লড়তে হবে। এই নিন অস্ত্র। বলে পিস্তল দিলাম, আর সঙ্গে তরবারি। হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যা তেজ! উঠল তড়াক করে লাফিয়ে। ছুটে গেল আহত বর্বরদের দিকে, এক কোপে চোখের নিমেষে কেটে ফেলল একজনের মাথা! গুলি ছুড়ল। তাতেও মারা পড়ল দুজন। তখন আর পালাতে কেউ পথ পায় না। তিনজন যে আমরা তখন এক দলে! তিনজনের হাতেই অস্ত্র। ওরা তো অস্ত্রহীন।

আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এখানে আসা অব্দি একটাও গুলি ছুড়ি নি। হাতে আছে বন্দুক। তাতে গুলি তৈরি। শুধু ঘোড়া টিপে ছুটিয়ে দেবার অপেক্ষা। ফ্রাইডেকে বললাম, যা তো চট করে ঝোঁপের আড়াল থেকে বাকি বন্দুক কটা নিয়ে আয়। ছুটল ফ্রাইডে সঙ্গে সঙ্গে। নিয়ে এল। ওর আমার দুজনেরটাই। গুলি ভরলাম সে গুলোয় নতুন করে। ভরছি গুলি, হঠাৎ দেখি সদ্য মুক্ত বন্দীর সঙ্গে ভীষণ লড়াই লেগেছে এক বর্বরের। হাতে তার কাঠের খড়গ। আর কী তেজ মানুষটার! দু দুবার দেখলাম তরবারির আঘাত গিয়ে পড়ল মাথায়, কেটে গেল এই এতখানি, তবু দমে না। হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে। পারে কি আর বন্দী তার সঙ্গে তেমন শক্তি কি তার আছে। দেখি ফেলে দিয়েছে বালির উপর, হুঙ্কার দিয়ে আসছে সে ছুটে উদ্যত খড়গ হাতে, অমনি পিস্তল গর্জে উঠল। লাগল ঠিক বুকের মাঝখানে। আর্ত চিৎকার করে মাটিতে টাল খেয়ে পড়ল। সেই শেষ আর উঠল না।

আর ফ্রাইডেকে যেন পেয়ে বসেছে নেশায়। হাতে অস্ত্র বলতে এখন শুধু কুড়ুল। তাই দিয়ে সে যা যুদ্ধ! তাড়া করতে করতে নিয়ে যায় একেকটাকে শেষ সীমায়, তখন আর পালাতে পারে না, তাছাড়া দৌড়েও তো ভীষণ পছু। পারবে কে দৌড়ে ফ্লাইডের সাথে। মুহূর্তে ধরে ফেলে পলায়মান ব্যক্তিটিকে। তারপর দু দশবার কুড়ুলের এলোপাথাড়ি ঘা। সঙ্গে সঙ্গে পতন ও মৃত্যু। তিনজন দেখলাম তাড়া খেয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রাইডেও পড়ল ঝাঁপিয়ে। তারপর জলের মধ্যেই একের পর এক কোপ। লাল হয়ে গেল জলের রং।

ছিল মোট একুশ জন। পরে যদিও এই হিসেব আমরা করেছি তবু এখানে আগে বলে দিই।

ঝোঁপের আড়াল থেকে ছোঁড়া বন্দুকের গুলিতে নিহত — ৩

দ্বিতীয় দফার গুলিতে নিহত – ২

নৌকোর মধ্যে ফ্রাইডের গুলিতে নিহত – ২

প্রথম বারের আঘাতে জখম, পরে নিহত – ২

প্রথম বারের আঘাতে জখম, পরে জঙ্গলে গিয়ে মারা গেছে – ১

ইওরোপীয় বন্দীর হাতে হত – ৩

ফ্রাইডে তাড়া করে মেরেছে – ৪

মোট–১৭

বাকি চারজন এক ফাঁকে পানসিতে চড়ে দে চম্পট। খেয়াল করি নি আগে। হঠাৎ নজর পড়তে ফ্রাইডে গেল তেড়ে। গুলি করল। তিনজন চোখের সামনে পড়ল জলে। ওঠার আর নাম নেই। অর্থাৎ খতম। বাকি একজনকে কিছুতে কায়দা করা গেল না। ততক্ষণে সে নাগালের বাইরে। গুলি ছুড়লে অতদূর গিয়ে পৌঁছবে না। ফ্রাইডে বলল, চলুন আমরাও নৌকো নিয়ে তাড়া করি। উঠলাম লাফ দিয়ে নৌকায়। দেখি তৃতীয় বন্দীটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে পায়ের কাছে। হাত পা বাধা! এতক্ষণ ওর কথা আমাদের খেয়াল হয় নি। তখন তাড়াতাড়ি হাত পায়ের বাধন কাটলাম। ভীষণ দুর্বল শরীর। আর অসুস্থ। হয়ত গুলি গোলার শব্দে বেদম ঘাবড়ে গেছে। ধুকপুক করছে প্রাণটুকু। তাড়া করে ধেয়ে যাওয়া আর হল না। ততক্ষণে সে অনেক দূর। ভারি চিন্তা হচ্ছে। যদি দেশে ফিরে গিয়ে নিয়ে আসে দলবল! যদি আমাদের আক্রমণ করে। ফ্রাইডে তখনো যাবার জন্যে বদ্ধপরিকর। আমি নিরস্ত করলাম।

তখন নজর গেল কন্দীর দিকে। পর মুহূর্তে দেখি অবাক কাণ্ড; ঝুঁকে পড়েছে ফ্রাইডে তার মুখের উপর। আর কী কান্না, কী আনন্দ! বন্দীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে নৌকোর উপরই দেখি তা থৈ তাথৈ নাচ। পরক্ষণে পাজাকোলা করে নামিয়ে আনল নৌকো থেকে। চিৎকার করে আমাকে ডাকল। কাছে গেলাম। বলল, এই দেখুন, আমার বাবা। আমার বাবা! আমি আমার বাবাকে পেয়েছি! এই দেখুন এখনো বেঁচে আছে।

ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দিলাম গাছের ছায়ায়। পানীয় দিলাম। বড় দুর্বল শরীর। তখন ঝড় উঠেছে। সে সো হাওয়া বেগ। ভাগ্য ভালো নৌকো নিয়ে তাড়া করি নি। সমুদ্রের জল উঠেছে সে। বললাম, ফ্রাইডে, পানসি দুটো ডাঙায় তুলে রাখি চল। নইলে ভেসে যাবে। তখন তুলে রাখলাম। ঝড় আরো বেড়েছে। সঙ্গে ঢেউ। আমি নিশ্চিত সে নৌকো নিয়ে পারবে না দেশে ফিরে যেতে। ঝড়ের কবলে পড়তে বাধ্য। সে অবস্থায় সলিল সমাধি ছাড়া তার গত্যন্তর নেই।

ফ্রাইডের আর তখন অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই। কী যে করবে বাবাকে নিয়ে বুঝে উঠতে পারছে না। ডাকলাম কাছে। হাসতে হাসতে কাছে এসে পঁড়াল। বললাম, বাবাকে কিছু খেতে দিয়েছিস? রুটি টুটি? মাথা নাড়ল দুধারে। বলল, নেই কিছু। তখন ঝোলা থেকে বের করে একখানা রুটি দিলাম। এই একটিই আমার সম্বল। কিসমিস দিলাম একমুঠো। আর জল। নিয়ে গেল বাবার কাছে। দিল। দেখি একটু পরে ছুটতে ছুটতে কোথায় চলেছে। মিনিট পনের তার আর পাত্তা নেই। দেখি আসছে তারপর ছুটতে ছুটতে। হাতে জলের একটা পাত্র। অর্থাৎ যেটুকু জল দিয়েছি আমি তাতে তৃষ্ণা নিবারণ হয় নি। আরো চেয়েছে। তাই ছুটে গিয়েছিল তাঁবুতে। ফিরে এল জলের পাত্র নিয়ে।

জল খেয়ে সুস্থির হল মানুষটা। বললাম, আর কি জল আছে ফ্রাইডে? বলল, আছে। তাহলে দে এদিকে, আমরা একটু খাই। দিল পাত্র। খেলাম আমি আর স্পেনীয়। রুটিও এনেছে ফ্রাইডে সঙ্গে করে। অবশিষ্ট কটা স্পেনীয়কে দিলাম। খেল। ভারি ক্লান্ত তখন। ঝড় ঝাঁপটা তো কম-গেল না এতক্ষণ ধরে। এবার বিশ্রাম চাই। শুয়ে পড়ল গাছের ছায়ায়। অমনি ঘুম। কাছে গিয়ে দেখি হাত পা জায়গায় জায়গায় ফুলে উঠেছে। শক্ত বঁধনে বাঁধা ছিল কতক্ষণ কে জানে। খানিকক্ষণ পরে ঘুম থেকে তুললাম। দিলাম, এক মুঠো কিসমিস। খুব তৃপ্তি সহকারে খেল। আর শ্রদ্ধায় ভুক্তিতে যেন তত ভাব। কী বলে যে আমাকে ধন্যবাদ জানাবে তার আর ভাষা খুঁজে পায় না। বললাম, ওঠ এবার। এখানে থেকে আর লাভ কী। বাড়ির দিকে যাই। উঠতে আর পারে না। হাতে পায়ে জোর মোটে নেই। ক্লান্তির ভাব তখনো শরীরের ভাজে ভাজে। ফ্রাইডেও এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। টিপে দিল হাত পা। দলাই মলাই করে দিল। কত যে ভালাবসা ওর মনে! আর কাজ করে, ফাঁকে ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে। বসে আছে একইভাবে মানুষটা। এখনো বিস্ময়ের ঘোর হয়তো কাটে নি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা, তা-ও এইভাবে এ যেন কল্পনারও অতীত। সেই কথাই বোধহয় ভাবছে এখনো। বললাম, যা ফ্রাইডে, তোর বাবার কাছে যা। অমনি এক ছুটে চলে গেল। সে যে কত খুশি। কত গল্প দুজনের মধ্যে। আমি তো মুগ্ন দৃষ্টিতে দেখছি। একটু পরে বালির উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল বাবা। ফ্রাইডে ফিরে এল। বললাম, তা হারে, একে যে নিয়ে যাবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। হাঁটবার যে ক্ষমতা নেই। এক কাজ কর। তুই বরং ডোঙাটা নিয়ে আয়। কুলের ধার ঘেঁষে বাইতে বাইতে নদীর পথ ধরে নিয়ে গেলে চলবে। ফ্রাইড়ে বলল, ডোঙার দরকার নেই। পানসিতেই হবে। আমি ব্যবস্থা করছি। বলে অবলীলাক্রমে অতবড় মানুষটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বসাল পানসিতে। বাবাকেও তুলল। তারপর দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল নদীর দিকে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে, নাক বরাবর এগোলাম। নালার কাছে পৌঁছে দেখি পানসিও ততক্ষণে হাজির। নামানো হল দুজনকে। ধরাধরি করে নিয়ে চললাম বাড়ির দিকে। কিন্তু পাচিল কীভাবে ডিঙোই? সেটা যে আরেক সমস্যা। মই বেয়ে তো আর ধরাধরি করে ওপারে নিয়ে যাওয়া যায় না। তখন ঠিক করলাম, সুস্থ না হওয়া অব্দি পাচিলের বাইরেই তাবু খাঁটিয়ে ওদের থাকার বন্দোবস্ত করব। লেগে গেলাম ফ্রাইডে আর আমি কাজে। দুঘণ্টার মধ্যে তাঁবু তৈরি। চারধারে পুঁতেছি চারটে খুটিমাথায় পুরানো পাল। তার উপর কিছু শুকনো ডালপালা। যাতে হওয়ায় উড়ে না যায়। মেঝেয় বিছিয়ে দিলাম পুরু করে খড়। তার উপর কম্বল। পাশাপাশি দুটো বিছানা। গায়ে দেবার জন্যেও দুটো কম্বল দিলাম। এগুলো সব আমার দীর্ঘদিনের সঞ্চয়।

মোটমাট দ্বীপ যথার্থ অর্থে এবার রাজ্যের রূপ নিতে চলেছে। একুনে প্রজা অমার তিনজন। আমি তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এরা এক অর্থে আমারই সম্পত্তি। এই দ্বীপের যেখানে যা আছে সব আমার। এমন কোনো শক্তি নেই যে আমার হাত থেকে এসব ছিনিয়ে নেয়। অর্থাৎ রাজা হিসেবে আমি প্রভূত ক্ষমতা সম্পন্ন। সেটা আমার তিন প্রজাও বিশ্বাস করে। ভারি অনুগত তারা। তিনজনেরই জীবন রক্ষা পেয়েছে আমার দৌলতে। এটা তারা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করে এবং সে জন্য কৃতার্থও। যে কোনো মুহূর্তে বিলিয়ে দিতে পারে আমার জন্যে জীবন। ধর্মের ব্যাপারে আমি কারো ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করি না। তিনজনের ধর্ম তিন রকম। ফ্রাইডেকে বলতে পারি আধা খ্রিস্টান। তার বাবা বর্বর ধর্মাচরণে বিশ্বাসী। স্পেনীয় ধর্মমত ভিন্ন। তা নিয়ে অবশ্য নিজেদের মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য টানে না। আমিও বিশেষ মাথা ঘামাই না।

ততদিনে সুস্থ হয়েছে দুই অতিথি। সর্বাঙ্গীন সুস্থ। স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাচলা করে বেড়াতে পারে। ঠাই দিয়েছি তাদের ভিতরের তাবুতে। কিন্তু সে তো গেল শুধু বাসস্থানের সমস্যা। খাদ্য সমস্যা যে অবিলম্বে সমাধান করা প্রয়োজন। কদিন অবিশ্যি পরপর কটা ছাগল মারলাম। বঁধল ফ্রাইডে। খেয়ে তো তারা মুগ্ধ। বিশেষ করে ফ্রাইডের বাবা। তার ছেলে যে এত ভালো রাঁধতে পারে, একথা যেন সে ভাবতেও পারে না।

ফ্রাইডেকে দিয়ে ইতোমধ্যে আরা দুটো কাজ করলাম। বন্দুক কটা পড়েছিল সমুদ্রের তীরে। আনালাম । মৃতদেহগুলো জড়ো করে দাহ করল। এটা আমি হাজার চেষ্টা করলেও পারতাম না। বীভৎস সে দৃশ্য। সার সার পড়ে আছে অতগুলো মড়া। পচন ধরতে শুরু করেছে। সে যা দুর্গন্ধ! ধারে কাছে ঘেঁসতেও আমার অনীহা। ফলে ফ্রাইডেকেই সব করতে হল।

তা দুশ্চিন্তা কিন্তু পুরোপুরি কাটে নি। সেই যে পালাল একজন যদি সে দলবল নিয়ে ফিরে আসে। ফ্রাইডের বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি তো আর তার ভাষা বুঝি না। ফ্রাইডেকেই দিলাম দোভাষীর দায়িত্ব। বলল, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। যতদূর অনুমান দেশে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি, কেননা ঐ ঝড় এবং ঐ প্রবল ঢেউ অগ্রাহ্য করে সুস্থভাবে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। যদিবা তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় এগুলো অগ্রাহ্য করে সে ডাঙায় পৌঁছেছে, তবে বাতাসের যা গতি, স্বদেশে ফেরা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি, তার পানসি গিয়ে ভিড়েছে দক্ষিণের কোনো দ্বীপে এবং ডাঙায় ওঠামাত্র নরখাদক হিংস্র জন্তুর মুখে পড়ে তার এতক্ষণে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে। এ বই অনুমান যদিও, তথাপি একেবারে যে ভিত্তিহীন তা নয়। যদি ধরে নেওয়া যায় ভিত্তি এর নেই, এবং সব রকম বাধা অগ্রাহ্য করে সে দেশে পৌঁছুতে পেরেছে, তথাপি ঐ যে আমার মনে সংশয়–সে দলবল নিয়ে ফিরে আসবে, এটা অসম্ভব। ঘটনার আকস্মিকতায় সে রীতিমতো বিভ্রান্ত। সঙ্গীদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেশে গিয়ে বলবে, তারা মরেছে বজ্রাঘাতে। গুলি ছুড়বার সঙ্গে সঙ্গে যে আগুনের ঝলক বেরয় সেটাকে ওরা বজ্রপাত বলেই ধরে নিয়েছে। নিজেদের মধ্যে হতবিহ্বল অবস্থায় এই সব কথা বলাবলি করছিল। এটা ফ্রাইডের বাবা নিজের কানে শুনেছে। ফ্রাইডে এবং আমাকে ধরে নিয়েছে স্বর্গের দেবদূত। কেননা এই দ্বীপে যে অমিত শক্তিধর কোনো মানুষ থাকতে পারে এটা তাদের কল্পনার বাইরে। ফিরে গিয়ে নির্ঘাৎ সে সেই কথাই বলবে। আর দেশের মানুষ কি এত বোকা যে দেবদূতের বিরুদ্ধে, ঝড় আর বজ্রের বিরুদ্ধে আসবে তীর ধনুক নিয়ে লড়াই করতে! অতএব আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই।

মোটামুটি যুক্তি নির্ভর কথা। বেশ মনে লাগল। বাস্তবেও যাচাই করে নিলাম তার সত্যতা। এল না কেউ। রোজই সতর্ক দৃষ্টিতে চারধারে কল জরিপ করি। দেখা মেলে না কোনো নৌকো কি কোনো মানুষের। হয়ত ধরে নিয়েছে তারা, এই দ্বীপে আসার অর্থই হল বেনামুকির রোষ-নজরে পড়া এবং তার পরিণতি মৃত্যু। কে আর চায় যেচে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে!

স্পেনীয় অতিথির কাছে শুনলাম, লা প্রাটা থেকে চলেছিল তারা হাভানার দিকে। পথে ঝড়ের কবলে পড়ে। সবাই উদ্ধার পায় নি। মাত্র সতের জন নৌকায় করে উঠেছে গিয়ে ঐ দ্বীপে। মোটের উপর বর্বরদের সাথে মিলে মিশে সুখেই আছে। জাহাজে ছিল চামড়া আর রূপার পসরা। কথা ছিল মাল খালাস করে ফেরার সময় নিয়ে আসবে নানান পণ্য সামগ্রী। কিন্তু বিধি বাম। পড়তে হল এই দুর্ভোগের মুখে।

সঙ্গে পর্তুগিজ কজন নাবিকও আছে। এরা তাদের জাহাজের লোক নয়, অন্য আরেক জাহাজের। সে জাহাজও বিপর্যস্ত, উদ্ধার করতে পেরেছিল তারা মাত্র এই পাঁচজনকে। বাকি সবাই মারা গেছে। সেই পাঁচজনকে নিয়ে মোট সতেরজন। তারাও দ্বীপে বহাল তবিয়তে আছে।

কয়েকটা বন্দুক ছিল সাথে। খাকা না থাকা এখন সমান। কেননা বারুদ নেই। একটা টোটাও নেই। জলে ভেসে গেছে বারুদের পিপে। সামান্য যেটুকু ছিল তা বন্দুকে। তা দিয়ে অচেনা অজানা দ্বীপে প্রথম কদিন চলেছে খাদ্য অন্বেষণের প্রচেষ্টা। তারপর সব শেষ। এখন ফেলে দিলেও কিছু যায় আসে না।

বললাম, তা তোমরা পালাবার চেষ্টা কর নি? বলল করেছে চেষ্টা। তবে সবই মুখে মুখে। অর্থাৎ আলোচনা যাকে বলে। কার্যত কিছুই করা সম্ভব হয় নি। পালাবার জন্যে নৌকো বা খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি দরকার। কোথায় পাবে সে সব। শুধু হাতে সমুদ্রে ভেসে পড়ার অর্থই হল যেচে মৃত্যুবরণ। কেউই সেরকম কোনো প্রস্তাবে রাজি হয় নি।

বললাম, বেশ তো, আমি যদি একটা প্রস্তাব দিই। যদি সবাই মিলে এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করি। বলল, আপত্তি কীসের। বলুন না কী আপনার প্রস্তাব।

বলব কি বলব না তাই নিয়ে নিজের মনেই বিশুর দ্বিধা। আগে ঠিক করতে হবে একটা মস্ত বড় ব্যাপার। ওদের সকলকে যদি এখানে আনি, পালাবার যাবতীয় সুযোগ করে দিই–তখন যদি আমাকে ফেলে ওরা পালায়। বিশ্বাসঘাতকতায় স্পেনীয়দের তো জুড়ি নেই। মোটমাট আমার কর্তৃত্ব আগাগোড়া বজায় থাকবে। এমন নয়, আমি ওদের হাতের ক্রীড়নক। ওরা আমার দয়ায় আমার সহায়তায় পালাতে পারবে এটা ওদের সদা সর্বদা মনে রাখতে হবে। তার পরেও কথা আছে। আমাকে হয়ত্ব নিয়ে গেল স্পেনে। সেখানে আমি শুনেছি, ইংরেজ কাউকে দেখলে ওরা বলি দেয়, দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করে। হবে না তো সেরকম? সেটাও আগে ঠিক করে নিতে হবে। যদি ওদের তরফ থেকে আম্বাস পাই তবে আমার যা যন্ত্রপাতে আছে তাই দিয়ে সবাই মিলে তৈরি করব বজরা, সঙ্গে খাবার দাবার প্রচুর থাকবে। থাকবে প্রয়োজনীয় অন্যান্য যাবতীয় উপকরণ।  তখন কাজ শুধু দিনক্ষণ দেখে সবাই মিলে ভেসে পড়া। নিরাপদে কূলে যে পৌঁছুতে পারব, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ওদের হয়ে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কোনোরকম বেচাল ওরা করবে না। করবার মতো অবস্থা বা শক্তি থাকলে তো? বন্দুকের কথা তো একটু আগেই বললাম। অকেজো কতগুলো খেলনাসামগ্রী, মনোবল বলতে কিছুই আর নেই। এমন পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়েছে, সেখানে অতিকষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাই বড় কথা। মনোবল সেখানে কোনো উপকারে আসে না। পালাতে পারলে এখন সবাই বাঁচে। কী ভাবে পালাবে বা কার সাহায্যে সেটা ওদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। এটা ঠিক, কাউকে না কাউকে নির্ভর করে তবে পালানো সম্ভব হবে। তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাই থাকবে বরং এবং কৃতজ্ঞতা। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না।

বলল, বেশ তো, এত কিছুর পরও যদি আপনার মনে ভরসা না জন্মায়, তবে এক কাজ করা যেতে পারে। আমি আর ফ্রাইডের বাবা দ্বীপে ফিরে যাই। কথা বলে আসি ওদের সাথে। জবাব শুনে আসি। মানবে কি মানবে না বা আপনার সাথে কোনোরকম ছলনা করার চেষ্টা করবে কিনা সেটা স্পষ্ট বলতে বলব। শুধু বললেই হবে না, ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে হবে। সেটা যদি করে তখন এসে বলব আপনাকে তাদের মতামত। তারপর যা করণীয়, আপনি নির্দেশ দেবেন। আমি সেই মতো করব।

বলে সে নিজে আমার সামনে ঈশ্বরের নামে শপথ করল–কোনোদিন আমার অবমাননা করবে না, আমার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমাকে প্রভু বলে মানবে। আমার জন্যে প্রয়োজনবোধে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পিছপা হবে না।

একই ভাষায় বাকিরাও করবে শপথ। সে বলল বড় দুঃখজনক তাদের অবস্থা। মানুষ হিসেবে যথেষ্ট সৎ এবং বিশ্বাসী। কারোর মনে কোনো ঘোর-প্যাঁচ নেই। নেই বলেই তো পড়ে আছে ঐখানে ঐ অবস্থায়। পরনের একফালি ন্যাকড়া অব্দি নেই। ক্ষুধার অন্ন নেই পেটে। সবই বর্বরদের দয়ার উপর। অত্যাচার করে না তারা ঠিক। কিন্তু করতে কতক্ষণ! একটু বেচাল করলে কি আর রক্ষে রাখবে। আমাকে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি কথা দিলাম।

তখন ঠিক করলাম পাঠাব দুজনকে দ্বীপে। ঘুরে আসুক যত দ্রুত সম্ভব। আর আমি দেরি করতে চাই না। কথাবার্তা বলে মোটামুটি সম্মতিটুক নিয়ে আসুক। শুধু সম্মতিই বা বলি কেন, সম্ভব হলে অমনি নিয়ে আসুক নৌকোয় করে সকলকে। তারপর এখানে বসে সবাই মিলে মতলব ঠিক করা যাবে।

ঠিকঠাক যখন সব, দু চার দিনের মধ্যেই তারা রওনা দেবে–হঠাৎ বেঁকে বসল সে। কিছুতেই যাবে না। আমি যত বোঝাই যত বলি সব নিরর্থক। সেই এক গো তার–যাবে না এখন, কদিন যাক। তারপর যাবে। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তলিয়ে বিচার করে দেখি, আপত্তি যে করছে, তার পিছনে কোনো রকম মতলব বা দুরভিসন্ধি নেই। আবার পরে সময় সুযোগ হলে যে যাবার কথা বলছে, সেটাও ঐকান্তিক। একটু খাদ নেই তাতে। ফলে ছমাস দেরি হল। ঘটনাটা পুরো ব্যাখ্যা করে বোঝাবার চেষ্টা করি।

তা মাসখানেক তো হল এসেছে এই দ্বীপে, মোটের উপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেখিয়েছি এখানকার। মায় আমি কীভাবে থাকি, কী আমার খাদ্যাখাদ্য, কীভাবে করি চাষবাস, কতটুক আমার সঞ্চয় কিছুই বাদ দিই নি। সেটা বর্তমানের চারজনের পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। দেখে শুনে নিজেই মাথা নাড়ল। বলল, না না, এ অবস্থায় আমার সাথীরা যদি আসে, তবে মুশকিল। কী করে কুলোবে? তাছাড়া এতগুলো মানুষ যে রওনা হব, সঙ্গে তো প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য নেবার দরকার হবে। সেটাই বা আসবে কোত্থেকে? বরং এক কাজ করি, এই বর্ষায় বেশি করে জমিতে চাষ দিই। তাতে ফলন প্রচুর হবে। বীজের তো আর অভাব নেই। বেশির ভাগ সঞ্চয় করব যাত্রার জন্যে। বাকিটা লাগবে খেতে। এ সবের ব্যবস্থা না করে আগে থাকতে অতগুলো মানুষকে আনলে কি অসুবিধেয় পড়তে হবে না।

কথাটা ঠিক। আন্তরিকতায় এতটুকু অভাব নেই। সব দিক বিবেচনা করেই বলা। এ ব্যাপারে আমারও যথেষ্ট দুশ্চিন্তা ছিল। বললাম, বেশ তো, তবে তাই হোক। আগে খাদ্যের সংস্থান করে তবে নয় যাওয়ার কথা ভাবা যাবে।

তখন চারজনে আটহাত নিয়ে লেগে পড়লাম ফসল ফলাবার কাজে। জমি আরো বাড়ালাম। কাঠের তৈরি তো সবযন্ত্রপাতি–দেখি ফ্রাইডে আর তার বাবা ভীষণ ওস্তাদ এই কাজে। এক মাসের মধ্যে জাম চষা শেষ। একসাথে জড় করলে সে মস্ত এক মাঠ। একটি আগাছা নেই। নেই একটি কঁকর কি পাথর। শুধু ঝুরো মাটি, আর যথেষ্ট গভীর। তাতে মোট বাইশ বুশেল যব আর সোল কুড়ি ধান ছড়িয়ে দিলাম। তারপর বৃষ্টি হল। খাই খরচা বাবদ যে দানা, তার বেশিরভাগটাই দিয়েছি বীজ শস্য হিসেবে। সঞ্চয় এখন বলতে গেলে শূন্য। তা প্রথম বর্ষার জল পেয়ে অঙ্কুর গজাল। প্রায় প্রতিটি দানা থেকেই গজিয়েছে। অকুর। সে যা আনন্দ আমাদের! এখন আর কি-অপেক্ষা কেবল। অঙ্কুর থেকে চারা হবে, তাতে ফল ধরবে, পাকবে। সে কি দু চার দিনের কাজ।

চুপচাপ বসে থেকে তো আর লাভ নেই, বজরা বানাতে হবে। সেটা একটা মস্ত বড় ব্যাপার। দলবল মিলে বেরিয়ে পড়লাম। এখন আর ভয় কীসের আমাদের। দলে রীতিমতো ভারি। অস্ত্র আছে সর্বদা হাতের নাগালে; যদি একান্তই আসে বর্বরের দল ঠেকাব প্রাণপণে, লড়াই করব। সেই মন নিয়েই যত্রতত্র স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াই। ঘুরতে ঘুরতে গাছ দেখলাম পরপর বেশ কয়েকটা। খুব মোটা। ফ্রাইডে আর তার বাবাকে দেখালাম, বললাম, কাট এর যে কোনো একটা। কাটা শুরু হল। অচিরেই মস্ত গাছ পপাত ধরণীতলে। স্পেনীয়কে বললাম ওদের কাজ দেখাশুনা করতে, দরকার মতো প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে। অবশ্য তার দরকার বিশেষ নেই। ওরা দুজন একাজে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। দেখতে না দেখতে চিরে ফেলল গাছ করাত দিয়ে। বেরুল বিশাল আকৃতির তক্তা। এক একখানা প্রায় পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা, দু ফুট চওড়া আর সোয়া দু ফুট মতো পুরু। তাই দিয়ে তখন বজরা তৈরির কাজ শুরু হল।

এদিকে আমিও কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। খামার নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছি। সংখ্যা বাড়াতে হবে। একদিন ফাঁদ পেতে নতুন কটাকে ধরলাম। বেশির ভাগই বাচ্চা। ছানা পোষাই এখন আমাদের দরকার। বড় হবে দ্রুত। গায়ে গতরে যথেষ্ট মাংস হবে। মাংসটা যে এখন খুব প্রয়োজন। পাশাপাশি আঙুর শুকিয়ে কিসমিস করার কাজও চলছে। ইতোমধ্যে আশি পিপে মতো শুকিয়ে রেখেছি। আরো দরকার। সঠিক ভাবে কতটা লাগবে আমাদের সে কি ছাই জানি! যাই করি না কেন মনে হয়, কম পড়ে যাবে। তখন তড়িঘড়ি যাতে কম না পড়ে তার ব্যবস্থা করি।

দেখতে দেখতে ফসল কাটার সময় এসে গেল। যব ধান দুইই পেকেছে। কাটতে হবে এবার। আট হাতে ফের একসাথে লেগে গেলাম। তারপর ঝাড়াই মাড়াই। ওস্তাদ মানুষ বটে ফ্রাইডের বাবা। কী নিপুণ যে হাতের কাজ। ঝাড়াই মাড়াই সে-ই বলতে গেলে করল। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম। তা সব মিলিয়ে বাইশ বুশেলের মতো যব, আর সেই পরিমাণ চাল। চিন্তা কীসের। আসুক না ওরা ষোলজন। দুবেলা পেট পুরে খাওয়াবার এখন হিম্মৎ রাখি। তারপরেও যথেষ্ট মজুত থাকবে। সেটা হবে আমাদের যাত্রার অন্যতম রসদ।

কিন্তু নেব কীসে করে, সেটও এক সমস্যা। বুড়ি যা ছিল তাতে এখন আর কুলোবে না। তখন নতুন করে ঝুড়ি বোনার পালা। এ ব্যাপারে দেখলাম স্পেনীয় ভারি ওস্তাদ। টকটক বানিয়ে ফেলল বেশ কটা বুড়ি। তাতে ফসল তুলে রেখে দিলাম।

এবং আর দেরি করা ঠিক নয়, এবর রওনা হতে হবে। স্পেনীয় আর ফ্রাইডের বাবা যাবে দ্বীপে। আমি আর ফ্রাইডে এখানে থাকব। শুভক্ষণ দেখে রওনা হল। যাবার আগে মনে করিয়ে দিলাম কী কী শর্ত, কোন কোন ব্যাপারে তাকে শপথ আদায় করে আনতে হবে। দেখলাম মনে আছে সব হুবহু। একটা কথা শুধু যোগ করে দিলাম। বললাম, এই যে প্রতিশ্রুতি ওরা দেবে, সেটা কিন্তু লিখিতভাবে দেওয়া চাই। কলম কাগজ আমি যোগাড় করে দেব। তাতে রাজি হল। তখন রওনা হতে অনুমতি দিলাম।

আকাশ বেশ পরিষ্কার। ঝকঝক করছে রোদ। সমুদ্র শান্ত। কুয়াশার লেশ মাত্র নেই কোনোখানে। উঠে বসল দুজন। সেই পানসিতে যাতে করে বন্দী অবস্থায় এসেছিল ওরা দ্বীপে। আমরা হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। চলে গেছে যখন অনেকটা দূর, তখন হঠাৎ খেয়াল হল–এই যা, কবে নাগাদ ফিরবে সেটা তো জিজ্ঞেস করা হল না।

সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি নানান জিনিস। একটা করে বন্দুক দুজনের হাতে, সেই সাথে বারুদ আর ছররা। বলা আছে প্রচণ্ড প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ভুলেও বন্দুকের সাহায্য না নেয়। মূলত আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই এই বন্দুক। একে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলে অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে।

বিস্তর খাদ্যদ্রব্যও তুলে দিয়েছি সাথে। রুটি, হাতে গড়া কেক, বুড়ি বোঝাই কিসমিস-আরো কত কী। সারা দ্বীপের লোককে প্রয়োজন বোধে কিসমিস বিলোতে পারবে। চাই কি রুটিও। মোটমাট আয়োজনে কোনো ত্রুটি নাই। বলা আছে, ফেরার সময় একটু আগে থেকে বন্দুক ছুঁড়ে আমাদের যেন জানান দেয় তারা ফিরছে।

সেটা অক্টোবর মাস। তারিখ সঠিকভাবে কত আমি বলতে পারব না। তারিখের হিসেব তো আজকাল আর রাখি না। সেই গোলমাল হয়ে যাবার পর থেকে। শুধু মাসের হিটো আকাশ দেখে বুঝতে পরি। সেই সাথে ক বছর কাটল আমার দ্বীপে সেটাও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

আটটা দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। এই আট দিনে কত যে পরিকল্পনা আমার। কত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা। কী হয় কে জানে। কী সংবাদ নিয়ে আসে ওরা তারই বা ঠিক কী। যদি রাজি না হয় বাকি নাবিকের দল। যদি আমার চোখের আড়ালে কোনো ঘেঁট পাকায়। আবার এমনও হতে পারে। দ্বীপে যাওয়া মাত্র ফের ওদের বন্দী করা হল। তারপর সুলুক সন্ধান জেনে ঝাঁকে ঝাকে মানুষ প্রতিশোধ নেবে বলে এল এখানে! তখন উপায়? কীভাবে আত্মরক্ষা করব তাদের রোষের হাত থেকে? বন্দুকে কি আর তখন কাজ হবে?

জানি না এমনধারা হয়ত আরো কত কী ভাবতাম। কোথায় কোন সুদুরে ভাসিয়ে দিতাম আমার কল্পনার ভেলা। হঠাৎ ন দিনের দিন। ভোর তখন। ঘুমে তলিয়ে আছি আমি গুহার বিছানায়। ফ্রাইডের ডাকে এক লাফে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম।

–মালিক, মালিক, ওরা এসেছে। শিগগির উঠুন! বুকে তো আমার পড়ছে হাতুড়ির ঘা। ভীষণ উদ্বেগ। অমনি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম গিয়ে পাহাড়ের মাথায়। সঙ্গে যে অস্ত্র আনব তাড়াহুড়ার মাথায় সেটাও মনে নেই। দূরবীন নেই। তবে খালি চোখেই সব নজরে পড়ছে। কুল থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে একটা নৌকো–কানো জাহাজেরই নৌকো বলে অনুমান হয়–কুলের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে। তাতে অনেক যাত্রী। বেশির ভাগই নাবিক। খুব ভালো করে দেখলাম। কই চেনা তো লাগছে না কাউকে। সেই স্পেনীয় কোথায়! কোথায় ফ্রাইডের বাবা। তাছাড়া এদের পোশাক আশাক ধোপদুরস্ত। এরা কারা তবে?

ফ্রাইডেকে বললাম, নড়াচড়া করিস নে। আগে দেখে নি ওরা আমাদের বন্ধু না শত্রু। তারপর কী করব ঠিক করা যাবে।

বলে চুপিসাড়ে পাহাড়ের আড়াল দিয়ে নেমে নিয়ে এলাম দূরবীন। উঠলাম সবচেয়ে উঁচু স্থানে। পরিষ্কার দেখা যায় বহুদূর পর্যন্ত। দেখি দূরে একখানা জাহাজ। নোঙর ফেলা। কুল থেকে প্রায় ক্রোশ খানেক দূরে। ধরন দেখে মনে হয় আমারই দেশের জাহাজ। এমনকি নৌকোর নাবিকরাও ইংরেজ।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সব। আর মনের গভীরে খুশির ঝিলিক। তবে কি মুক্তি এবার আসন্ন! আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছে আমারই দেশের মানুষ। ইচ্ছে হয়, কঁপ দিয়ে পড়ি জলে, সাঁতার কেটে চলে যাই ওদের নৌকোর কাছে। আমার পরিচয় দিই। ওদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসি দ্বীপে। কিন্তু না, এত ব্যস্ততার কোনো কারণ নেই। ধৈর্য এখানে অসম্ভব প্রয়োজনীয়। আর প্রতীক্ষা। দীর্ঘ সাতাশ বছরের নির্জনতা আমাকে এই দুটি বিশেষ গুণ শিখিয়েছে। আগে বুঝতে হবে সব কিছু। দেখার এখনো অনেক বাকি। অনুধাবন করতে হবে। তবে না উচ্ছ্বাস! তবে না ছুটে যাওয়া কি জ্বলে ঝাঁপ খেয়ে পড়া!

তবু কেন জানি না, মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা বিপদের সঙ্কেতও টের পাচ্ছি। এটা সকলেরই হয়। এ হল নিছক অনুভূতির ব্যাপার। আচ্ছা, এরা তো হত্যাকারীও হতে পারে, কিংবা দস্যু! আসছে হয়ত দ্বীপে তেমনই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। কিংবা হয়ত এমনও হতে পারে, আবিষ্কার করতে বেরিয়েছে নতুন কোনো দেশ। এসে পড়েছে এখানে। সেক্ষেত্রে এই নির্জন নিরালা পরিবেশে আমাকে হঠাৎ দেখলে পারবে তো সহজ ভাবে নিতে? অবাক হবে না বা ঘাবড়ে যাবে না? আমাকে ভয়ে বিস্ময়ে হত্যা করার চেষ্টা করবে না তো?

যদি তেমন কিছু ঘটে, তবে আমি অসহায়। সামনে আমার গভীর সংকট। এ অবস্থায় আগে কখনো পড়ি নি। এরা শিক্ষিত। এরা স্ত্রধারী। সভ্য দুনিয়া থেকে এসেছে। পারব কীভাবে আমরা কটা পাখি মারা বন্দুক আর বারুদের পসরা নিয়ে এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে?

নৌকো এসে কূলে লাগাল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভাগ্য ভালো, বেশি দূর এগোল না। বালির উপর তুলে রাখল নৌকো। নামল। আমি যেখানে তার থেকে প্রায় আধ মাইল দূর। নালাটা নজরে পড়ে নি। জানি না, তবে হয়ত নালা দিয়ে সরাসরি ঢুকিয়ে দিত নৌকো। নামত আমার আস্তানার কাছে। দেখতে পেত পঁচিল। গুহার অস্তিত্ব আবিষ্কার করত। সেই সাথে আমার অস্তিত্বও। তারপর আর কি? নির্বিচারে লুটপাট। গুলি গোলা। আমি কি এঁটে উঠতে পারব ওদের চালাকির সঙ্গে?

তবে ইংরেজ সবাই নয়, দুজন সম্ভবত ওলন্দাজ। সম্ভবত এই কারণে বলছি কেননা আমার দূরবীনে মুখের আদল সেরকমই লাগছে। মোট এগার জন। তিনজন বাদে সকলেরই হাতে অস্ত্র। অর্থাৎ বন্দুক। নৌকো আমার সাথে সাথে চারজন নামল কূলে লাফ দিয়ে। অস্ত্রহীন তিনজকে হ্যাঁচকা টান মেরে নামাল। তবে কি বন্দী এরা? প্রশ্নটা হঠাৎ মনের গভীরে ঝিলিক দিয়ে উঠল। এখনি কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আগে দেখার প্রয়োজন আছে। ঐতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। থমথমে মুখের ভাব একজনের। যেন কত না বিষণ্ণ। কাতর অনুরোধ জানিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। শুনছে না অস্ত্রধারীর দল। বাকি দুজন ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে হাত। যেন ঈশ্বরের কাছে করুণ প্রার্থনা। প্রভু, তুমি এর বিচার করো । কিন্তু কীসের বিচার? তবে কি ওরা এদের হত্যা করবে?

চমক ভাঙল ফ্রাইডের প্রশ্নে। অবাক হয়ে গেছে সেও। চোখে মুখে বিস্ময় বিমূঢ় ভাব। বলল, মালিক, ইংরেজরাও কি আমার দেশের মানুষদের মতো মানুষের মাংস খায়? রীতিমতো চমকে উঠলাম। বললাম, হঠাৎ এ প্রশ্ন করার অর্থ? বলল, তাই তো দেখতে পাচ্ছি। ঐ তিনজনকে ওরা খাবে।

বললাম, খাবে না। ওরা ওদের হত্যা করবে।

তখনো মনের মধ্যে আমার দ্বিধা দোদুল্যতা। এদের উদ্দেশ্য আমার অনুমানের বাইরে। তবে সৎ যে নয় এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কু মতলব নিয়ে এসেছে। হঠাৎ দেখি একজনের হাতের তলোয়ার ঝিলিক দিয়ে উঠল। শূন্যে তোলা তার হাত। অস্ত্রহীন একজনের ঠিক মাথার উপর। বুকের রক্ত আমার হিম। ওকে কি এখুনি খুন করবে? আমার চোখের সামনে! চোখ বুজলাম। একটু পরে দেখি, করে নি খুন। মাথার উপর থেকে তলোয়ার নামিয়েছে। আর ভয়ে বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই বন্দী। হয়ত আসন্ন মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আর এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

ইস্‌ থাকত যদি এখন সেই স্পেনীয় আর ফ্রাইডের বাবা! আমি কি স্থির ভাবে এখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম! চারজনে মিলে চলে যেতাম ঝোঁপের আড়ালে। আকস্মিক গুলিতে চমক ধরিয়ে দিতাম। মরত হয়ত দু একজন। বাকিরা ভয় পেত। তখন মুক্ত করে আনতাম তিনজনকে।

একটু পরে দেখি বসেছে তিনজন বালির উপর। আর বাকিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তুত। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চাইছে চারধার। নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে এলে যেভাবে মানুষ ঘুরে ঘুরে সব দেখে। আনন্দে ডগমগ তাদের হাবভাব। শুধু তিন বন্দীর মুখে বিষাদের ছায়া। বিরস বদনে বসে আছে সমুদ্রের দিকে চেয়ে।

মনে পড়ছে পুরানো দিনের কথা। সেই স্মৃতি। দ্বীপে আমার প্রথম দিন। অবাক হয়ে এইভাবেই বসে ছিলাম আমি। আমারও চোখের দৃষ্টিতে এই হতাশা। আর কত ভয়! মনে আছে প্রথম রাতটা কাটিয়েছিলাম গাছের উপর উঠে। আতঙ্ক তখন। যদি নিচে থাকলে হিংস্র জানোয়ার এসে গিলে খায়। সে যেন দুঃস্বপ্নের দিন আমার! দুঃস্বপ্নের এক একটি

তবে একবারে যে নিরাশা তা নয়। জাহাজটা ভাঙা অবস্থায় পড়েছিল অদূরে। সেটা আমার কাছে বিরাট এক আশার ব্যাপার। সেই আশায় ভর করেই তো যেতে সাহস পেলাম পরদিন। তারপর ফের। তারপর আবার, আবার। তবেই না সংগ্রহ করে আনলাম জীবনধারণের যাবতীয় সরঞ্জাম। এই গুলি গোলা বারুদ বন্দুক খাদ্য, এরই উপর নির্ভর করে, বলতে গেলে এখনো বেঁচে আছি।

আর ওদের সামনে ভারি জমাট অন্ধকার। আশার বিন্দুমাত্র ঝিলিকও নেই। নির্জন নিরালা একটা দ্বীপ। জানে না এর অন্ধিসন্ধি। জানে না এখানে কোথায় কী রহস্য আছে লুক্কায়িত। হিংস্র জন্তু আছে কি নেই সেটাও জানে না। সব মিলয়ে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তা। তারই ধোয়াটে ছায়া মেখে মলিন মুখে বসে আছে।

জানি না আমার মতো এরাও ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে কিনা। অন্ন বস্ত্র দাঁত জগদীশ্বর। এই বিশাল বিশ্বের নিয়ন্তা। যদি বিশ্বস থাকে ঈশ্বরে, তবে আমারই মতো সাহসে বুক বাঁধতে পারবে। আমারই মতো পারবে ধৈর্য দিয়ে সময় দিয়ে প্রতিটি সমস্যা মোকাবিলা করতে। তবে আর অনিশ্চয়তার মেঘ জমবে না মনের কোণে। তবে সব সমস্যার নিরসন হবে।

দেখতে পাচ্ছি ওদের গোটা দলটাকেই। এসেছে ঢেউ ওঠার আগেই। সমুদ্র এখন মোটামুটি শান্ত। একটু পরেই উঠবে বাতাস। তখন চঞ্চল হবে। জানে নির্ঘাৎ ওরা প্রতিটি খুঁটিনাটি। বন্দীদের নির্বাসনে রেখে এখনি নিশ্চয় ফিরে যাবে না। তাতে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা। বাতাস পড়ে যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করবে। অর্থাৎ সেই বিকেল। ততক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখবে চারধার। কোথায় কীরকম জায়গায় নির্বাসন দিয়ে গেল বন্দীদের সেটা অনুমান করার চেষ্টা করবে।

একটু পরে দেখি নাবিকের দুজন গিয়ে নৌকায় উঠল। একটু যেন নেশাগ্রস্ত ভাবে। টলছে পা, শুয়ে পড়ল পাটাতনে। তারপর ঘুম।

অর্থাৎ হাতে আমার প্রায় দশ ঘণ্টার মতো সময়। এই দশ ঘণ্টায় দ্বীপ ছেড়ে ওদের পক্ষে জাহাজে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। সে চেষ্টাও তারা করবে বলে মনে হয় না। রওনা হতে হতে সেই সন্ধে। সেটা আমার পক্ষে অত্যন্ত মঙ্গল। কেননা অন্ধকারে আমাদের যে দেখতে পাবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে অবস্থায় আরো নিকটস্থ হতে পারব। বন্দুক থাকবে হাতের গোড়ায় প্রস্তুত। মোটমাট মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি আমি নিয়ে ফেলেছি। মরণজয়ী এ লড়াই। তিনটি প্রাণীকে উদ্ধার করার জন্যে যুদ্ধযাত্রা। শুধু সেটাই বড় কথা নয়। এই সমগ্র ঘটন অঘটনের পিছনে একটা কারণ আছে। তার রহস্য ভেদ করার জন্যেই আমাকে অস্ত্র ধরতে হবে। তাতে স্বজাতির প্রাণ যাক কিছু পরোয়া নেই। জয়ী হতে পারলে জাহাজে করে দেশে ফেরার একটা চেষ্টা করতে হবে। আশ্চর্য, এই সহজ সরল কথাটা এতক্ষণ মনে উদয় হয় নি। আমি তো এরদ্বারা উদ্ধারও পেতে পারি। একবার চেষ্টা করব নাকি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *