১. ১৬৩২ সালে ইয়র্কে জন্ম

[একটি দ্বীপ, একজন মানুষ আর একরাশ গাছপালা পশুপাখী, চারধারে শুধু জল আর জল। ভাগ্যাহত সেই মানুষটির নাম রবিনসন ক্রুসো। কথা বলার কোন মানুষ নেই, নেই কোন সখী কি সাথী। শুধু কাকাতুয়া একটি, তার নাম পোল্‌, সে ঘোরে ফেরে আর ডেকে বেড়ায়–রবিন ক্রুসো, রবিন ক্রুসো, তুমি কোথায়, কোথায় …।

আঠাশ বছর এই বিজন দ্বীপে বলতে গেলে একাকী কাটে মানুষটির। শেষের কবছর ফ্রাইডেকে পায় সাথী হিসেবে। সে চমকদার ঘটনা। নরখাদক বর্বরদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার আশ্চর্য লোমহর্ষক সেই কাহিনী। আরো আশ্চর্য, দ্বীপ থেকে সভ্যজগতে ফিরে আসার ঘটনা। তারপর নতুন আরেক যাত্রা। অরণ্য। নেকড়ে। হাজার হাজার। ভয়াল ভয়ার্ত তাদের ডাক। তাদের থেকে আত্মরক্ষা–পাতায় পাতায় বিস্ময়ের চমক।

আর সেই দ্বীপ। সেখানে গড়ে উঠেছে এখন নতুন জনপদ। তারও বিচিত্র কাহিনী নিয়ে ড্যানিয়েল ডিফোর এই বিস্ময়কর চিরন্তন ক্লাসিক।]

.

রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

১৬৩২ সালে ইয়র্কের এক বনেদী পরিবারে আমার জন্ম। এর মানে কিন্তু এই নয় আমরা বরাবরকার ইয়র্কেরই বাসিন্দা। আমার বাবা আগে থাকতেন ব্রিটেনে। সেখান থেকে হল-এ এসে সাময়িক আস্তানা গাড়েন। ব্যবসা করতেন তখন। তার থেকেই বিস্তর জমিজমা, অঢেল পয়সা। হঠাৎ কী খেয়াল হল–সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এলেন ইয়র্কে। থিতু হলেন। বিয়ে করলেন।

রবিনসন আমার মায়ের বংশের পদবী। আমার মামাদেরও খুব নামডাক। তারা অবিশ্যি গায়েই থাকেন। তো মায়ের পদবীর সঙ্গে আমাদেরটা মিলিয়ে আমার নাম রাখা হল রবিনসন ক্রুজেনার। সে বড় খটোমটো উচ্চারণ। ভাঙতে ভাঙতে লোকের মুখফেরতা হল গিয়ে ক্রুসো। মোটামুটি পছন্দসই। উচ্চারণেও সুবিধে। আমরা এখন সেই লিখি। সবাই। বলিও ক্রুসো। আমার বন্ধুরা আমাকে ঐ নামেই ডাকে।

আমার ওপরে দুই দাদা। তাদের মধ্যে একজন ফ্রান্ডার্সে ইংরেজ পদাতিক বাহিনীর কর্নেল। সেনাপতি তখন সেই বিখ্যাত লকহাট। স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ডানকার্কের কাছে কোনো এক স্থানে সে মারা যায়। এ হল সবার বড়। মেজ ভাইয়ের খবর আমি কিছু রাখি না। জানি না বলাই ভালো। ঠিক যেমন আমার বাবা মা জানেন না আমার খবর।

অতএব আমি যে পরিবারের তিন নম্বর বংশধর, এটা বোধহয় সকলেই অনুমান করতে পারেন। আর বলব কি ছোটোবেলা থেকেই আমার মাথায় যাবতীয় উদ্ভট চিন্তা। আমার বাবা প্রাচীনপন্থী মানুষ। আমাকে পড়াশোনা যতটা শেখানো সম্ভব শিখিয়েছেন। প্রথমাবস্থায় বাড়িতে, পরে স্থানীয় অবৈতনিক বিদ্যালয়ে। শেষ অব্দি আইন নিয়ে আমি পড়াশুনা করি। কিন্তু পড়ায় মোটে মন লাগে না আমার। সমুদ্র আমাকে টানে, ডাকে। যেতে ইচ্ছে করে সমুদ্রে। সারাক্ষণ মনের আনাচে কানাচে তোলপাড় করে বেড়ায় ভাবনা। শেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল, বাবার বিরুদ্ধতা পর্যন্ত করতে বাধ্য হলাম। মা কত অনুরোধ উপরোধ করলেন। বন্ধুরা কত বোঝাল। আমি নাছোড়। নিয়তির অলঘ্য নির্দেশে আমি যেন মরিয়া। যেন যে কোনো দুঃখ বরণ করতেও আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।

বাবাও বিস্তর উপদেশ দিলেন। ভারি বিচক্ষণ আর ভারি গম্ভীর মানুষ। একদিন সকালে আমাকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন। নড়াচড়া তো করতে পারেন না, বাত যে ভীষণ। তা সে নানান যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝানোর পালা। বললেন, কী এমন কারণ থাকতে পারে তোমার ঘর বাড়ি ছেড়ে পৈতৃক নিবাস ছেড়ে বাইরে বেড়াতে যাবার? নয় বেড়নো হলেও বুঝতাম, এ তো নিরুদ্দেশ যাত্রার সামিল। বিদেশে কে তোমাকে চিনবে? কে তোমাকে রেয়াত করবে? বরং থাক এখানে, ব্যবসা কর, সুখী হও। এই তো সার্থক জীবন। বাইরে গিয়ে নাম করবে, ধনবান হবে–এ অলীক কল্পনা। এতে ঝুঁকির ভাগটাই বেশি। সচরাচর এমন কেউ করে না। আর সেটা তোমার সাধ্যের বাইরে। বরং তোমাকে বলি কেন, আমাদের সবার। মধ্যবিত্ত ছাপোষা মানুষের ওসব হুজুগ পোষায়?

আসলে বিচার করে দেখেছি, বাবা তার মধ্যবিত্ত অবস্থান নিয়ে যৎপরোনাস্তি সুখী। এতে দুঃখদুর্দশার আধিক্য কম, আবার সুখ সম্ভোগ আড়ম্বরের ভাগটাও এমন কিছু যথেষ্ট নয়। কারুর চোখ টাটাবার ঈর্ষান্বিত হবার কোনো ব্যাপার নেই। এই জীবনই বাবার পরম প্রিয়। বললেনও সে কথা আমাকে দেখ, এই ভাবে জীবন যাপনের যে কত সুখ, তুমি বুঝবে না এখন, আমি বুঝি। এই অবস্থানটা সবার কাছেই লোভনীয়। রাজা বাদশারাও মাঝে মাঝে কাঁদুনি গায়। বলে, কী যে ঝকমারি করেছিলাম রাজবংশে জন্মে। এর চেয়ে সাধারণ বংশে জন্মালেই ভালো হত। জ্ঞানী-গুণী মানুষেরাও বিস্তর প্রশস্তি গেয়ে গেছেন মধ্যবিত্ত জীবন সম্পর্কে। তাছাড়া প্রার্থনার মধ্যে তো আছেই–হে প্রভু আমাকে দারিদ্র্য দিও না, তা বলে ধনীও আমি হতে চাই না।

আমাকে বলেছিলেন কথাগুলো খতিয়ে দেখতে, বিচার বিবেচনা করে বুঝতে। তা সত্যি কি, আমার চোখে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। জীবনের যা কিছু ঝড় ঝাঁপটা ভালো-মন্দ সব ভোগ করে একদম উঁচু আর একদম নিচুতলার মানুষ। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের গায়ে তার আঁচটুকুও লাগে না। আমাদের সব কিছুই নাপা। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভালো মন্দ হাসি কান্না–ভোগ করতে হয় সব, কিন্তু, হিসেব করে। তবু পাই যে এটা তো ঠিক। তাকে আশীর্বাদই বলতে পারি। এই যে মধ্যবিত্ত জীবন লাভ করেছি আমরা, এটা আশীবাদ ছাড়া কী। তোফাই তো আছি। ছিমছাম মসৃণ নীরব নিভৃত জীবন। কোনো হৈ চৈ-এর ব্যাপার নেই। ঝামেলাও বিশেষ নেই। এমন নয়। যে খুব একটা পরিশ্রমের দরকার হয়। আবার এমনও নয় যে মগজটাকে বেশি খাটাতে হয়। তেমন বিহ্বল চৈতন্য ভাবও কখনো আসে না। বা যেটুকু আসে তাতে আত্মার শান্তি মনের সুখ এসবের কোনো ব্যত্যয় হয় না। এমন নয় যে হিংসায় আমরা জ্বলে পুড়ে উঠি, আবার কোনো কিছু পাব বলে ভেতরে ভেতরে যে একটা তীব্র দাই, তা-ও কখনো বোধ হয় না। বেশ দুলকি চালে চলা যাকে বলে। এই ভাবেই মোটামুটি স্বচ্ছন্দ গতিতে জীবন অতিবাহিত করা। তিক্ততার ভাগ অনেক কম। স্বাচ্ছন্দ্যই তুলনামূলকভাবে বেশি। মন্দ কী! এই তো বেশ। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার একটু একটু করে পূর্ণ হয়। প্রতিদিনকার সঞ্চয় বাড়ে। এই তো আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন।

সে যাই হোক, বাবা আমাকে ভীষণ পীড়াপীড়ি করলেন। ভী-ষ-ণ। তবে খুবই মোলায়েম ভাবে, তাতে আন্তরিকতার ভাগটাই বেশি। বললেন, আমি যেন আজকালকার উঠতি ছোকরাদের মতো আচরণ না করি, যেন নিজেকে অজানা ভবিষ্যতের হাতে ফেলে দিয়ে দুর্গতির ভাগীদার না হই। এই তো বেশ–এই মধ্যবিত্ত অবস্থান। কী দরকার একে হুট করে পালটে দেবার জন্যে দুঃসাহসে ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়ার? তাছাড়া এমন তো নয়, রুটি রুজির হঠাৎ খুবই দরকার হয়ে পড়েছে, তার জন্যে এই মুহূর্তে আমার কোনো কিছু না করলেই নয়। সে সব চিন্তা ভাবনা বাবারই, তা নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। বরং এখানে থাকলেই বাবা আমাকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন। যদি সেই প্রতিষ্ঠায় আমি সুখী না হই, আমার মন না ওঠে, তবে ধরে নিতে হবে ভাগ্যটাই আমার মন্দ। অথবা নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ত্রুটি হয়েছে। সেটা তো

জীবনেরই একটা নিয়ম বিশেষ। এর জন্যে আর অনুতাপ করে লাভ কী। তবে হ্যাঁ, অনুতাপের যাতে কোনোকারণ না ঘটে সেটা তিনি জানপ্রাণ দিয়ে দেখবেন। তার জন্যে কাছে থাকাটা একান্ত দরকার। ভালোই হবে তাতে আমার। বাইরে গেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ–বাবা হয়ে কেমন করে যেতে অনুমতি তিনি দেন। সর্বশেষে আমার বড় ভাইয়ের কথা বললেন। বড় ভাইকেও এই ভাবে বারবার নিষেধ করেছিলেন তিনি, অনিশ্চিতের কোলে ঝাঁপ দিতে মানা করেছিলেন। বড় ভাই শোনে নি তাঁর কথা। জোর করে–একরকম সব কিছু অগ্রাহ্য করেই গিয়ে ভিড়ল সৈন্যদলে। পরিণতি তো মৃত্যু। বাবার কথা অগ্রাহ্য করলে ফল ভালো হয় না। বড় ভাইয়ের উদাহরণ যেন আমার কাছেও আদর্শ হয়। জেনেশুনে ভুল করলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ মেলে না। সব অগ্রাহ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়লে শেষে পস্তাতে হয়। তখন আর ফেরবার পথ থাকে না। এটাকে আমি যেন মনে রাখি, তুচ্ছ জ্ঞান করে উড়িয়ে না দিই।

সদুপদেশই বলা যায়। সাধুসন্তরা যে উপদেশ দেন অনেকটা সেই রকম। বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাবার চোখে জমাটবাধা অশ্রুও আমার নজরে পড়ল। ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছিল গাল বেয়ে। আমাকে যখন বললেন পরে অনুশোচনা করতে হবে এবং তখন কেউ আসবে না আমাকে সাহায্য করতে-দেখি বাবা কাঁপছেন থরথর করে, বুকটা যেন ভারী, যেন যে কোনো মুহূর্তে একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে এবং ফলত বাবা আর কথা শেষ করতে পারলেন না।

বড় টাল খেলাম মলে। প্রচণ্ড একটা নাড়া। এটাই হয়ত স্বাভাবিক। মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম বাইরে যাওয়ার সংকল্প। কী দরকার, এই তো বেশ! থাকি বাড়িতে বাবার চোখের গোড়ায়। বাবার কথা মতো জীবন যাপনের চেষ্টা করি। হায় রে হায়! সে আর কদিন। আবারও তো মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে সেই তোলপাড়। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই। ছটফট করে কেবল ভেতরটা। ভাবি কখন যাব বাইরে, কবে এই পরিবেশ ছেড়ে চম্পট দেব। তখন মাকে ফের বললাম। বুঝে শুনে। একদিন মা খুব হাসিখুশি, মেজাজ শরীফ, সেই দিন। বললাম দেখ মা, দুনিয়াকে দেখার ইচ্ছেটা এমনই প্রবল হয়ে চেপে বসেছে আমার মনে আমি কিছুতে বাড়িতে মন বসাতে পারছি না। আমার মুহূর্তের জন্যেও মনে স্বস্তি নেই। ছটফট করে বেড়াই সারাক্ষণ। বাবাকে বল, যদি অনুমতি দেন। তো ভালো, নইলে আমি পালাব। পালাবই। কেউ আমাকে রুখতে পারবে না। তুমি দেখে নিয়ে। তাছাড়া বাবা যে বলেছেন আমাকে থিতু হতে, কোনো কাজে ভিড়ে পড়তে চাই, কি কোনো উকিলের কেরানিগিরি করতে–সেটা এখন আর সম্ভব নয়। আঠার পেরিয়ে গেছি আমি। আগে হলে হত। এখন আর মন বসাতে পারব না। জোর করে ভিড়িয়ে দিলে সেখান থেকেও আমি পালাব। বরং বাবাকে বল, একবারের জন্যে অনুমতি দিন, মাত্র একবার, তারপর সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে আর আমি যেতে চাই না। কোনোদিন না। তখন বাবা যা বলবেন আমি করব, সব মেনে নেব। তুমি একটু বুঝিয়ে বল মাগো।

মা বললেন, বলে কোনো লাভ নেইরে। কোনো কথা শুনবেন না। তাছাড়া তোরই বা আক্কেল কীরকম বল দেখি। এত উপদেশ দিলেন, এত কিছু বুঝালেন, তারপরও বলিস সমুদ্রে যাবি? এতে আঘাত পাবেন মনে। তুই বুঝি না? এই ভাবে অজানা অনিশ্চিতের উদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে যদি নিজের সর্বনাশ করতে চাস, কর তুই। আমার কিছু বলবার নেই। তবে একটা কথা জেনে রাখ। এতে তোর বাবার কি আমার-কারুরই মত নেই। থাকতে পারে না। ভাবিস নে, তোর বাবা যাতে আপত্তি করেছেন আমি তাতে হ্যাঁ বলব। আমাকে আর জোরাজুরি করি না।

তবু শুনেছি, পরে মা বাবাকে সব নাকি বলেছিলেন। শুনে স্থির হয়ে বসেছিলেন বাবা খানিকক্ষণ। শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, বাড়িতে থাকলেই ও সুখে থাকত। কোথায় যেতে কোথায় যাবে, দুঃখে কষ্টে তোলপাড় হবে-ছেলেমানুষ, বোঝে না কিছু। তুমি বলে দিও, আমার মত নেই।

এর ঠিক এক বছর পরে আমি বাড়ি থেকে পালালাম। এই এক বছরে বহু প্রস্তাব এসেছে আমার কাছে। ব্যবসায় যোগদানের প্রস্তাব, কোনো কাজে ভিড়ে পড়ার প্রস্তাব। আমি কানে তুলি নি। মা বাবা আরো অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। আমি শুনেও শুনি নি। শেষে স্থল-এ গিয়েছি একদিন, মাঝে মাঝেই আমি যেতাম বেড়াতে,–সত্যি বলতে কি পালাবার ইচ্ছেও সেদিন ছিল না, হঠাৎ এক বন্ধুর সাথে দেখা। বলে, যাবি আমার সঙ্গে জাহাজে? আমাদের জাহাজ লন্ডন যাবে। কী যে মনে হল আমার। বন্ধুর পেছন পেছন গিয়ে উঠে পড়লাম। ভাড়াটাড়া তো লাগবে না। বন্ধুর আমি যে বন্ধু। ষোলশ একান্ন সালের পয়লা সেপ্টেম্বর সেদিন। না হল বাপ-মার আশীর্বাদ নেওয়া, না হল ঈশ্বরের প্রার্থনা, এমনকি যে বাবা মাকে খবরটা জানাব সে সুযোগটুকুও হল না। ব্যবস্থা করে গেলাম। পরে জানতে পারবেন। জাহাজে আমি ভেসে পড়ারও অনেক পরে। খচখচ করছিল মন। না জানি এভাবে ভেসে পড়ার কত বিপদ, কত ভয়! পরমুহূর্তেই সামলে নিলাম। বিপদ আবার কীসের? আমি না জোয়ান মরদ! এসব নিয়ে মাথা ঘামায় তো বুড়োর দল! তো ছাড়ল জাহাজ। হাম্বার পেরুলাম। বলব কি, তারপর থেকেই শুরু হল ঝড়। আর ঢেউ। সে যে কী বিরাট, কী ভয়ঙ্কর! আমি তো এর আগে কখনো জাহাজে চাপি নি, ঢেউয়ের দুলুনিতে একটু পরেই শরীর খারাপ হল। খুব খারাপ। ভয় ভয়ও করছে। আর বুতখুতুনি। কি জানি, ঐ যে কারুর মত না নিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ না নিয়ে চড়ে বসলাম, এ হয়ত তারই প্রতিফল। কত অপরাধই না জানি করেছি। বাবার চোখের জল, মার বারণ, অত উপদেশ পরামর্শ–সব অগ্রাহ্য করলে কি বিপদ না হয়ে যায়! এ সেই বিপদ। বা বিপদের সূত্রপাত। জানি না ভবিষ্যতে আরো কত কী হবে! হয়ত অসীম দুঃখ পাব।

কড় আরো বাড়ল। আর সমুদ্র-আগে তো আমি দেখি নি কোনোদিন–সে যা ঢেউ, যা উথাল-পাথাল। পরে অবিশ্যি এর চেয়ে আরো অনেক তোলপাড়ানি দেখেছি, আরো উঁচু উঁচু ঢেউ। তখন আর আমার শরীর খারাপ হয় নি বা চমকও লাগে নি। কিন্তু বোর সেই যে প্রথম। কতটুকু জানি আমি সমুদ্র সম্বন্ধে? ভয় তো লাগবেই। দুরন্ত সেই ভয়। এক একটা ঢেউ ওঠে আর ভাবি–এই বুঝি আসছে আমাদের গিলে খেতে। হয়ত এই বারই শেষ। জাহাজ বারবার পড়ে ঢেউয়ের মাথায় আছড়ে। মনে হয় এই হয়ত শেষবার, আর উঠব না কেউ কোনোদিন মাথা তুলে, তলিয়ে যাব সমুদ্রের গর্ভে। তখন কত দিব্যি কাটা, কত ঈশ্বরের নাম। বারবার বলি, হে ঈশ্বর এবারকার মতো আমাকে রক্ষা করো, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে দাও। আর কোনদিন আসব না সমুদ্রে, চাই কি তোমাকে অনুরোধও করব না। আর ভারি অনুতাপ হয় মনে। ছি ছি, বাবার উপদেশ অগ্রাহ্য করেছি বলেই না আমার আজ এই হাল। আর কোনোদিন করব না একাজ। দিব্যি কাটছি। ঈশ্বরের নামে শপথ। কত বিচক্ষণ মানুষ আমার বাবা, দূরদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই তো বুঝেছিলেন। এত কাট কি আমাদের সহ্য হয়। এত হ্যাপা! সুখে স্বস্তিতে বাড়িতে কাটাব দিন, নাকি এসে পড়লাম এই ঝড়ের মধ্যে। দুর্ভোগের চরম। এ আমার পাপের ফল। এর জন্যে অনুতাপ করতে হবে। বাবার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করতে হবে। নয়ত পাপ থেকে ত্রাণ নেই, শান্তি নেই আমার।

অর্থাৎ যতক্ষণ ঝড় চলে, আমার মনের মধ্যেও এইসব ভাবনা পাক খেয়ে বেড়ায়। দূরের যেন ঘনিষ্ঠ নিবিড় সংযোগ। পরদিন অবিশ্যি ঝড় আর নেই। সমুদ্র দর্পণের মতো শান্ত। আমার ভাবনাও বলতে গেলে শান্ত। তবু থম মারা একটা ভাব। যেন কিছুই ভালো লাগে না এরকম একটা মানসিকতা। একটু কাহিলও লাগছে। সে শুধু দিনমানে। সন্ধে লাগতে বাতাস আর নেই। আমার কাহিল ভাবও নেই। বেশ লাগছে এখন। ক্ৰমে রাত গম্ভীর হল। তারপর ফুটল ভোরের রোদ। সে যা মিষ্টি! আর তেমনি ঝকঝকে সমুদ্র। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। আর রোদ। আর ভুবনজোড়া আলো। অপূর্ব! যেন এমন ভাবে চোখ নিয়ে কোনোদিন আমি সমুদ্র দেখি নি।

রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। মনে বেশ স্মৃতির ভাব। তার উপর শান্ত সমুদ্র। সময় কাটছে সুখেই। এমন সময় বন্ধু এসে হাজির। আমার গলা জড়িয়ে ধরল। বলল, কীরে কাল তোর ভয় করছিল, তাই না? যখন হাওয়া উঠল? আর চারদিক তোলপাড়? বললাম, হাওয়া কী বলছিস, ঝড় বল। মারাত্মক ঝড়। বলল, তোর মুণ্ডু। একে বলে ঝড়? ঝড় তুই দেখিস নি। আমরা বিস্তর দেখেছি। তোর মাথা ঘুরে যাবে। অবিশ্যি দোষ তোর নয়। এই প্রথম এলি সমুদ্রে। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি। কী ঝকমক করছে আজ চারধার দেখ। চল, ঘরে বসে না থেকে একটু হৈ হল্লা করি। আবহাওয়া ভালো থাকলে নাবিকেরা ঘরে বসে থাকে না।

তখন গেলাম ওর সাথে। দেখি একটা ঘরে বিস্তর নাবিক। খাওয়া দাওয়া হল। মদ খেলাম। নিজের ইচ্ছেয় নয়, দলে পড়ে। নেশা হল খুব। আমার অনুতাপ পরিতাপ বলতে এখন আর কিছু নেই। পুরানো কোনো কথা আর মাথায় নাড়া খায় না। এখন শুধু ভবিষ্যতের চিন্তা। অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাই নিয়ে শুধু আশার পর আশার জাল বোনা। মোটমাট সমুদ্র শান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও সব দিক থেকে শান্ত। এই সমুদ্র যে আমাকে গ্রাস করতে পারে ভুলেও এখন আর এ চিন্তা করতে পারছি না। সমুদ্র নিয়ে যত কিছু অতীতের ভাবনা আমার, মনের গোপন গহন আশা–সব একটু করে ফিরে আসছে। দিব্যি কেটেছি কত সে সব আর মনে নেই। শপথের কথাও ভুলে গেছি। একদম ভুলে গেছি বললে অবিশ্যি বেশি বলা হয়, আসলে সামানাই মনে আছে। যৎসামান্য। তা-ও ক্ষণস্থায়ী। স্বপ্নে দেখা ছবির মতো। এই আসে। নতুন চিন্তার তাড়নায় এই আবার মুছে যায়। তাছাড়া নতুন সঙ্গী জুটেছে বিস্তর। সব বিস্মরণ। সেদিনের সেই পান ভোজনের আসরে যোগদানের পর থেকে। তাদের পাল্লায় পড়ে নেশা যখন করি, তখন আর হুঁশ থাকে না। যেন খেলা একটা। নতুন পরিবেশে পুরানো সব কিছুকে ভুলে যাবার উন্মাদ উদ্দাম এক প্রচেষ্টা। তখন তো আর বুঝি নি এসব আগামী দিনের দুর্দশারই ইঙ্গিত। ঘনিয়ে আসছে বিপদ। সেটা যেহেতু আরো ভয়ঙ্কর আরো তীব্র, তাই প্রস্তুতি নেবার কাজ চলছে। আমার ভেতরে ভেতরে। নিজের অজানতেই আমি এইভাবে একটু একটু করে প্রস্তুত হচ্ছি।

ছদিনের দিন ইয়ারমাউথে পৌঁছে আমরী নোঙর ফেললাম। সমুদ্র শান্ত। আবহাওয়া চমৎকার। শুধু বাতাস বইছে বিপরীত দিক থেকে এই যা অসুবিধে। জাহাজ নিয়ে এগোনো সমস্যা থাকতে হল একই ভাবে সাত আট দিন। শুয়ে বসে কাটানো যাকে বলে। আলস্যে গা এলিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। ততদিন আরো জাহাজ এসে ভিড়েছে। বন্দর তো। নিউক্যাসল থেকে এসেছে অনেকগুলো। সবার একই হাল। বাতাসের গতি না পালটালে কেউ আর রওনা দেবে না।

এদিকে আছি তো দিলখুশ। ভাবনা নেই চিন্তা নেই, ভয়ের তো লেশমাত্র নেই। কিন্তু সে আর কদিন। পাঁচ দিনের দিন থেকেই বাতাসের বেগ একটু একটু করে বাড়তে লাগল। তা বাড়ুক। আমাদের পরোয়া কীসের। প্রথম কথা রয়েছি বন্দরে, তার উপর নোঙরও ভারী। মাটির সঙ্গে গাঁথা বলতে গেলে। কে সরাবে কে নড়াবে আমাদের ভিত থেকে? হায় হায়, সবই দেখি মিথ্যে। আট দিনের দিন থেকে সে যা বাতাস! যা তোড়! সকাল থেকেই এই হাল। মুহূর্তের মধ্যে জল ফুলে ফেঁপে এই এত্তোখানি উঁচু। ততক্ষণে পাল গোটানো শেষ। ঝাঁপটা আটকায় এমন আর কিছুই বলতে গেলে জাহাজের পাটাতনে নেই। নোঙর নিয়েই যা ভয়। কাপ্তেন বলল, বড় নোঙর নামাও। তখন দুপুর। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নামানো হল জাহাজের সবচেয়ে ভারী নোঙর। বঁধুনির শেষ ইঞ্চিটুকু অব্দি ফতুর। সে যে কত নিচু কে জানে, তবুও দেখি সবার মধ্যে কেমন উসখুস ভাব।

আরো বেড়েছে বাতাস। হুহু হাওয়ার তোড়। তখন আর উসখুস ভাব নয়। তখন ভয় আর সন্দেহ সবার চোখে মুখে। সব চেয়ে অবাক লাগছে কাপ্তেনকে দেখে। আমার কেবিনের পাশেই তার কেবিন। দেখি বারে বারে বাইরে যায় আর ভেতরে ঢোকে। কাজকর্ম তদারক করে আর বিড় বিড় করে ঈশ্বরকে ডাকে প্রভু, দয়া কর। বাঁচাও আমাদের। নইলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমরা বাঁচব না। রক্ষা কর।

আর আমি? আমি যেন কেমন বোকা হয়ে গেছি। কী করব কী করা উচিত, কিছুই মাথায় ঢোকে না। শুধু চুপচাপ নিজের কেবিনে শুয়ে ভাবি উথাল পাথাল। ভাবনার যেন থই মেলে না। সে যে কী ঝড় আমার মনের গহনে! তবু জোর করে শান্ত রেখেছি নিজেকে। মরবার ভয় আর নেই। সেটা প্রথম দিকে ছিল। এখন কেমন এক জবুথবু ভাব। যেন নিষ্ক্রিয় নিস্পৃহ নিরাসক্ত কোনো মানুষ। আসলে করবার মতো যে আমার কিছু নেই। এই বাতাসের বিরুদেধ কী করতে পারে আমার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একজন মানুষ?

তখন বাইরে এলাম।

বলব কি সে এক অদ্ভুত অতিপ্রাকৃত দৃশ্য। সমুদ্র না, যেন পাহাড়। সে রকমই উঁচু ঢেউ। ভীষণ গর্জন করে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ভয় করে সেই দিকে তাকাতে। আমাদের পাশেই অন্য দুটো জাহাজ বাঁধা ছিল। দেখি তাদের মাস্তুল ভাঙা। গড়াগড়ি খাচ্ছে পাটাতনের উপর। আমাদের জাহাজের এক মাঝি চিৎকার করে বলল, এক মাইল দূরে বাঁধা ছিল আরেকটা জাহাজ, সেটা নাকি নোঙর ছিঁড়ে কোথায় ভেসে গেছে। যে সব জাহাজে মাল বোঝাই তাদের তবু একটু যা নির্ভয়, হালকা গুলোরই মর্মান্তিক অবস্থা। ঠেলতে ঠেলতে বাতাস দু-তিনটেকে নিয়ে এসেছে একদম আমাদের কাছের গোড়ায়। ঢেউয়ের দোলায় টালমাটাল তাদের হাল।

সন্ধের দিকে সারেং বলল, সামনের মাস্তুল. রাখা এখন বিপজ্জনক। কেটে ফেলতে হবে। কাপ্তেনের তাতে ভীষণ আপত্তি। তখন সারেং বলল, যদি থাকে তাহলে জাহাজ সামাল দেওয়া যাবে না। এবার বিবেচনা করে দেখুন। তখন রাজি হল কাপ্তেন। মাস্তুল সমেত পাল তখন নামানো হল। কিন্তু তাতে করে পিছনের বড় মাস্তুল দেখি নড়বড় করে। তাতে নতুন বিপত্তি। তখন সেটাও খুলে শুইয়ে দেওয়া হল পাটাতনের একধারে। ব্যস, পাটাতন এখন পুরোপুরি ফাঁকা।

আমার অবস্থাটা ভেবে দেখুন। এই আমি কদিনই বা আছি জাহাজে। নাবিক ঠিকই, কিন্তু নতুন যে। ভয়ে তো বুক আমার সর্বদা ধুকপুক করে। কদিন আগে যে ঝড় দেখেছি, তা ভয়ের ঠিকই তবে এতটা নয়। এ অবস্থায় পড়তে হবে আগে কি জানতাম? হায় হায়, এখন তো জীবন রক্ষা করাই দায়। পুরনো চিন্তাগুলো আবার মনের আনাচে কানাচে পাকখেতে শুরু করেছে। নিজের উপর রাগ। আর কথা শুনি নি কারুর, অগ্রাহ্য করেছি বাবার আদেশ–সব নিয়ে ভারি তোলপাড় মনের ভেতরটায়। আসলে হুবহু যে কীরকম, আমি বলে বোঝাতে পারব না, ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। সমানে ছুটে চলেছে ঝড়। ছোটোই বলব। রাগে দাপাদাপি করতে করতে ছুটে গেলে যেমন লাগে। সবাই দেখি ভয়ে তটস্থ। তবু জাহাজটা আমাদের ভালো সেই যা সান্ত্বনা। কিন্তু মালে তো বোঝাই। যে কোনো মুহূর্তে গোত্তা খেয়ে পড়তে পারে সমুদ্রে। তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। তবে তলাবার যে কী অবস্থা সেটা এখনো আমি প্রত্যক্ষ করি নি। সেটা আমার একটা সান্ত্বনা বলা যেতে পারে। তাই সে বিপদটা ওরা যেভাবে দেখছে, আমি ততটা নই। এদিকে বসে গেছে কাপ্তেন আর সারেং প্রার্থনায়। প্রার্থনা ছাড়া এই মুহূর্তে করণীয়ই বা কী। দেখতে দেখতে রাত গভীর। কেমন মন মরা ভাব চারদিকে। এরই মধ্যে কে একজন চিৎকার করে উঠল, জাহাজ নাকি ফুটো হয়ে গেছে। খোলে প্রায় চারফুট মতো জল। অমনি ছুট ছুট! জল পাম্প করে বের করে দিতে হবে। সে প্রায় যেখানে যে আছে সবাই। আমি এগোতে সাহস পেলাম না। মৃত্যুভয় একটু একটু করে চেপে বসছে আমার বুকের উপর। কেবিনেই বসা। পারি না এক পা নড়তে কি উঠতে। তখন একজন এল। বেদম ধমক লাগাল–অপোগণ্ড, এখানে বসে আছে! যা গিয়ে হাত লাগা। তখন তাড়া খেয়ে উঠলাম। নিচে গেলাম। জল বের করার কাজে হাত লাগালাম। খাটলাম জান দিয়ে। কানে এসে বলল, এক কাজ কর, কামান গর্জে বিপদের কথা সবাইকে জানিয়ে দাও। আর দেরি করা ঠিক নয়। আমার তো হাত পা তখন কাঁপতে শুরু করেছে। সেই অবস্থায় আমিও প্রর্থনায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। কারোর কি আর খেয়াল আছে আমার দিকে? নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সবাই। নিজের প্রাণটা সবার কাছে অনেক বড়। এদিকে কাজ তো বন্ধ। তখন কার যেন নজর গেল। ছুটে এসে এক লাথিতে ছিটকে ফেলে দিল আমায় একধারে। তারপর আমি যা করছিলাম সেটা করতে লাগল। আমি একইভাবে পড়ে রইলাম।

আর রক্ষা নেই। এটা কেবল আমি নই বাই জানে। জাহাজ আর বাঁচানো যাবে না। ঝড়-একটু কম। কিন্তু খোলে জলের আর কামাই নেই। যত তুলে ফেলে দেয় কিছুতেই শেষ হয় না। এদিকে বন্দরও বেশ খানিকটা দূর। এই অবস্থায় কোনোক্রমে গিয়ে যে সেখানে ভড়ব তারও উপায় নেই। সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ইতোমধ্যে পরপর কয়েকবার তোপ দাগা হয়েছে। একটু পরে দেখি ভাসতে ভাসতে ঢেউয়ের মাথায় তোলপাড় খেতে খেতে একখানা নৌকো নিয়ে কজন মাঝি হাজির। কাছেরই আর এক জাহাজ থেকে পাঠিয়েছে। তা সে কি আর পারে জাহার্জের কাছ গোড়ায় ভিড়তে। ঢেউ যে ভীষণ। চেষ্টা করে প্রাণপণ, ঢেউ সরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। সে এক যুদ্ধই বলা যেতে পারে। আমাদের জীবন রক্ষার জন্যে নৌকোর মাঝিদের মরণপণ যুদ্ধ। শেষে যখন আর কিছুতেই পারা যায় না, তখন জাহাজ থেকে কাছি ছুঁড়ে দেওয়া হল নৌকা লক্ষ্য করে। বহুকষ্টে ওরা তার নাগাল পেল। তারই সাহায্য নিয়ে নৌকো এনে লাগানো হল জাহাজের গায়ে। উঠলাম আমরা অনেকে। কিন্তু যাব কোথায়? সেটা একটা সমস্যা। এই ঢেউ অগ্রাহ্য করে বাতাসের বিপরীতে তাদের জাহাজে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে একটাই করণীয়। যেন তেন প্রকারে ফুলের নিকটবর্তী হওয়া। সেটাই সাব্যস্ত হল। তখন টালমাটাল অবস্থায় নৌকো চলল উইন্টারটন লেসের দিকে।

মিনিট পনের পর আমাদের চোখের সামনে জাহাজ তলিয়ে গেল। একটু একটু করে ডোবা, এই আমি প্রথম দেখতে পেলাম। প্রথমটা খেয়াল করি নি। পরে নাবিকেরা বলতে নজর গেল। আমি তো থ। বড় কষ্ট লাগছিল দেখতে আর ভয়। যদি থাকতাম আমি জাহাজে! যদি নৌকোয় উঠতে না পারতাম। তবে কি এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হত।

এদিকে প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাঝির দল। যুদ্ধ যাকে বলে। ঢেউয়ের সঙ্গে, সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ। ঢেউ তো না যেন পাহাড়। মুহমূহ দমকে ভেসে উঠি এক একটা পাহাড়ের মাথায়, কূল দেখতে পাই। বেশি দূর নয়, কাছেই। মনে হয় আর একটু গেলেই পৌঁছে যাব। পারি না পৌঁছাতে। আর এক দমকে ফের পিছিয়ে পড়ি। একবার তো উইন্টারটনের লাইট হাউস অব্দি দেখতে পেলাম। আর মানুষ। সে যে কত গুনে শেষ করা যায় না। ছোটাছুটি করছে হন্যে হয়ে। আমাদের হাতছানি দিয়ে উৎসাহ জানাচ্ছে। সাহায্য করতে চাইছে নানান ভাবে। সে যে কী অসহায় অবস্থা! সিধে তো পারি না যেতে, গতি এখন কোনাকুনি। তারপর আরো লড়াই, আরো যুদ্ধ, আরো সংগ্রাম। শেষে ডাঙায় গিয়ে ভিড়ল তরী। নিরাপদেই পৌঁছেছি বলা যায়। সুস্থ আমরা সকলে। এবং নিশ্চিন্ত। হাঁটতে হাঁটতে চললাম তখন ইয়ারমাউথের দিকে। সে অনেকেখানি পথ। তবে পৌঁছতে সবাই খাতির করল। ভালো জায়গা দিল থাকতে, খাবার দিল, টাকা দিল। দয়া আর কী সানা। আমরা ডোবা জাহাজের নাবিক যে। আমাদের যে মন্দভাগ্য। বলল, আর সমুদ্রপথে নয়। স্থলপথে এই টাকা নিয়ে আপনারা হয় লডন নয় তো হলে ফিরে যান।

সেই কথাই ভাবি। যদি ওদের কথা মতো হলে ফিরে আসতাম, তারপর ঘরের ছেলে ফিরে যেতাম ঘরে, তবে এত কষ্ট কি দুর্দশা কিছুই হত না। সুখী হতাম নিজ পরিবেশে। বাবারও বড় আনন্দ হত। শুনেছেন তো জাহাজ ডুবির খবর। তারপর তো কদিন ধরে দুশ্চিন্তায় অস্থির। পরে অবিশ্যি জানতে পেরেছেন আমি মরি নি, নিরাপদেই আছি।

সে যাই হোক, পারলাম না বাবাকে সুখী করতে বা নিজে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়াচ পেতে। ভাগ্য যে আমার খারাপ। তাড়া করে বেড়ায় প্রতিমুহূর্তে। তাতে যুক্তি বেশির ভাগ সময়ই থাকে না। অথবা পারি না তাকে অবহেলা করতে কি এড়াতে। একে কী বলব আমি জানি না। তবে এটুকু বুঝি এরকম যাদের ক্ষেত্রে ঘটে, তারাই দ্রুত ধ্বংসের দিকে পা বাড়ায়। চোখ কান খোলা রেখে হিসেব করে পা ফেললেও তার থেকে নিস্তার নেই পরিত্রাণ নেই। অন্তত প্রথম নিদর্শন তো হাতে হাতেই পেলাম।

তা সেই যে আমার বন্ধু-যে আর কি জাহাজে ডেকে নিয়েছিল আমায়, আমাদের কাপেনের ছেলে ইদানিং দেখি কেমন যেন মনমরা ভাব, কেমন যেন ভীরু ভীরু। ইয়ারমাউথে আসার দুদিন পর তার সঙ্গে দেখা। এক জায়গায় তো সবাই থাকি না। একটু ছাড়া ছাড়া। এক একজন এক এক বাড়িতে। তো কথাবার্তা হল। কেমন যেন উৎসাহহীন। যেন ভারি নিঃসঙ্গ মানুষ। কথা বলার চেয়ে হ্যাঁ হুঁ করেই সংক্ষেপে বেশি জবাব দেয়। বাবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। বলল কে আমি, কোথা থেকে কীভাবে জাহাজে এসেছি। আরো যে সমুদ্রযাত্রার ইচ্ছে আমার সেটাও বলল। শুনে বাবার অর্থাৎ কাপ্তেনের চোখ মুখের সে যা হাল। বললেন, শোনো ছোকরা, তোমার আর সমুদ্রযাত্রা না করাই ভালো। উচিতও নয়। নবিক হওয়া তোমাকে মানায় না। বললাম, কেন বলছেন একথা? আমাকে মানা করছেন, আপনি নিজেও কি আর সমুদ্রযাত্রায় যাবেন না? বললেন, আমার ব্যাপারটা আলাদা। সমুদ্রে যাওয়াই আমার পেশা। কিন্তু তুমি তো এই প্রথম। শুরুটা তোমার মন্দ। তুমি অপয়া। ভুলেও আর কখনো জাহাজে উঠবার নাম করো না। কখনো না। আর শুনে রাখ, তুমি যদি ফের জাহাজে ওঠ, সেই জাহাজে আমাকে যদি কেউ হাজার পাউন্ড দিয়ে বলে উঠতে–আমি উঠব না। মরে গেলেও না।

অর্থাৎ উত্তেজিত হয়েছেন ভীষণ এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। সেটা স্বাভাবিক। কেননা ক্ষতির পরিমাণ প্রচুর। পারেন নি এ অবস্থায় মাথা ঠিক রেখে কথা বলতে। আমাকে মিথ্যে দোষারোপ করতে অপয়া বলতে বাধ্য হয়েছেন। সে মনোভাব আমি আর পরিবর্তন করতে তৎপর হলাম না। মনের ঝাল মিটিয়ে তিনিও কিছুটা ধাতস্থ হলেন। আমাকে বললেন বাড়ি ফিরে যেতে। বাবার কথা মান্য করতে। বললেন, যেন মনে রাখি তার প্রতিটি নির্দেশ। ভুলেও যেন জাহাজে ওঠার নাম না করি। তবে আবারো দুর্ভোগ ভুগতে হবে। আবারো অসীম লাঞ্ছনা গঞ্জনা আমার অদৃষ্টে জুটবে।

ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তারপর। অত কথা যে বললেন আমি তো জবাব দিই নি তেমন। তাই কথার পিঠে কথা টানবার বা সেই প্রসঙ্গ নিয়ে পরে অন্য কথা বলবার অবকাশও হয়ে ওঠে নি। সেই শেষ দেখা। কোথায় তারা গেল জানি না। আমি লন্ডনের পথে রওনা হলাম। বলাবাহুল্য স্থলপথে। সঙ্গে টাকা তো রয়েছে। পথে যেতে যেতে চিন্তায় কেবল মন তোলপাড় হয়। কী করব এবার। কোথায় যাব!

বাড়ি যাওয়া অসম্ভব। লজ্জা খুব। পারি নি সমুদ্র প্রবাসে গিয়ে জীবনটাকে নতুন ভাবে সাজাতে। জাহাজডুবির পর ফিরে আসছি দুর্দশা নিয়ে, দুঃখ নিয়ে, লজ্জা নিয়ে। লোক হাসাহাসি তো এই নিয়ে খুব একচোট হবে। তাতে বাবা মাও লজ্জা পাবেন। আমার জন্যে বাবা মা লজ্জা পাবেন! হাসবেই সবাই, আমি জানি। মানুষের মুখ বন্ধ করব কীভাবে। দেখেছি যে বিস্তর মানুষ। বুঝেছি তাদের স্বভাব, অভ্যেস। আমাকে দুয়ো দেবে বিশেষ করে আমার বয়েসী ছোকরার দল। ভারি যে বেপরোয়া। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় বোঝে না। বুঝিয়ে দিলে অনুতাপ করতে জানে না। এটা বোকামিরই লক্ষণ। বোকামি করে তারা আর তাই দেখে লজ্জা পান আমার বাবা মায়ের মতো ভালোমানুষের দল।

এই সব চিন্তা মনের মধ্যে কেবলই পাক খেয়ে বেড়াতে লাগল। কী করব কিছু ঠিক করে উঠতে পারি না। বাড়ি যেতে একদম ইচ্ছে করে না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এদিকে প্রথম সমুদ্রযাত্রার সেই যে দুর্দশা, সেটাও এতদিনে একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। এখন আর নেই বললেই হয়। বরং আগেরটাকে আরেকবার যাচাই করতে নতুন করে ফের সমুদ্রে যাবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে চেপে বসেছে।

সেই জিদ। আমি আবারো ভেতরে ভেতরে টের পাই। সেই বাবার আদেশ অগ্রাহ্য করা গো। সমুদ্রযাত্রায় গিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের গোঁ। সব তুচ্ছ এর কাছে। বাবা-মা, তাদের শাসন, তাদের উপদেশ, আমার দুর্দশা–সব। অলীক অজানাই মনকে যেন বড় বেশি টানে। ঝাঁপিয়ে পড়তে মন চায়। অজানার অভিসারে। এখনো সেই টান। তারই তাড়নায় চেপে বসলাম ফের আফ্রিকাগামী এক জাহাজে। নাবিকেরা অবিশ্যি আফ্রিকা বলে না, বলে গিনি। সমুদ্রে ফের জাহাজ ভাসল।

দুর্ভাগ্য এই, নিজেকে তখনো পারি নি পুরোপুরি নাবিক করে তুলতে। কাজকর্ম অবিশ্যি অন্য সকলের চেয়ে অনেক বেশিই করি, তবু নবিকের মতো অতটা খাটতে পারি না। এরই মধ্যে মাস্তুলের কাজটা ভালো শিখেছি। হয়ত ভবিষ্যতে জাহাজের সর্বাধ্যক্ষ অব্দি হতে পারব। কাপ্তেনও বনে যেতে পারি। কিংবা সারেং। শুধু নাবিকটা বাদ। ওটা আমার ধাতের বাইরে। মাস্তুলের টঙে চড়বার মধ্যে যেন অনেক বেশি রোমাঞ্চ, অনেক বেশি উত্তেজনা। যেহেতু রোমাঞ্চ আমরা ভালো লাগে তাই এই কাজটাই আমার প্রিয়। নাবিকেরা, বলতে বাধা নেই আমাকে যেন একটু সমীহই করে। পোশাক-আশাকে ভদ্র, তার উপর টাকা পয়সাও পকেটে কিছু আছে। দুটোই ওদের এক্তিয়ারের বাইরে। তাই খাতির পাই।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি। লন্ডনে থাকাকালীন বেশ কিছু ভালো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। এমন সচরাচর হয় না। অন্তত আমার মতো ছেলেদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। বয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝায় তা আমি নই। তবে অনেকটা তো সেরকমই। এ অবস্থায় ভালো সাথী সচরাচর তেমন জোটে না। ভালো অর্থে যেমন ধরুন জাহাজের এক কাপ্তেন। তিনি গিনিতে আগে একবার গিয়েছেন। এবং তার ধারণানুযায়ী সফল সে যাত্রা। আবারও যাবেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে তো খুবই খুশি। বিশেষ করে আমি যখন বললাম, দুনিয়াটাকে দেখবার জানবার আমার খুব আগ্রহ, আমাকে বললেন, চল না আমার সাথে। কোনো খরচ তোমার লাগবে না। সঙ্গে বরং দু একটা জিনিস নিয়ে চল। ব্যবসা করার সুযোগ পেলে দু চার পয়সা আমদানিও হয়ে যাবে। মোটমাট মন্দ কী।

মন্দ তা নয়ই। আমার পক্ষে বরং যথেষ্ট। লুফে নিলাম তার আহ্বান। মানুষটাকে বড় আপন বলে মনে হতে লাগল। সরল সাদাসিধে। সৎ! ভারি মিশুকে। কথা মতো সঙ্গে কিছু খেলনাও কিনে নিলাম। স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, খেলনা বেচে সেবার বেশ কিছু অর্থের মালিক হতে পেরেছিলাম। পুঁজি মাত্র চল্লিশ পাউন্ড। সেটাও চেয়ে চিন্তে জোগাড় করা। লিখেছিলাম আত্মীয় স্বজনদের কাছে চিঠি। তারা পাঠিয়ে দিয়েছেন। হয়ত তাদেরই কাছ থেকে বাবা আমার খবরাখবর পেয়ে থাকবেন। মোটমাট সব দিক থেকেই নিশ্চিন্ত। এবং শুভও বটে। এযাবৎ যত সমুদ্রযাত্রা আমি করেছি, যত অভিযান–এই একটিমাত্র যাত্রা সবদিক থেকে চমৎকার। তার পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই আমার সেই বন্ধু কাপ্তেনের। সে ভালবাসার কথা আমি জীবনে ভুলব না। আমাকে ধরে ধরে অঙ্ক শেখালেন, সমুদ্রের নানান জ্ঞাতব্য নাবিকদের ক্ষেত্রে যেগুলো অবশ্যই জানবার প্রয়োজন আছে শেখালেন। ঐ যে বলে না হাত ধরে শেখানো–অনেকটা তাই। জাহাজে কাজ করতে গেলে কী কী দিকে নজর রাখতে হয়, কোন কোন জিনিসটা ভালো করে দেখতে হয়–তাও কদিনের মধ্যেই শিখে ফেললাম। আমি যাকে বলে কৃতার্থ। পাকাপাকি নাবিক বনে গেলাম কদিনের মধ্যে। ব্যবসাদারও। ফেরবার সময় খেলনা বেচা লাভের টাকা দিয়ে নিয়ে এলাম পৌনে ছু পাউন্ড ওজনের স্বর্ণরেণু। সেটা শুনে বিক্রী করে মোট আয় হল তিনশ। তখন একটা আশা একটা আত্মবিশ্বাস নিজের মনে জন্ম নিল।

তবে হ্যাঁ, একদম যে সুস্থ স্বাভাবিক চমৎকার ভাবে শেষ হয়েছে এই সমুদ্রযাত্রা সেটা বুক বাজিয়ে বলা যায় না। জ্বর হয়েছিল ভীষণ। বিশ্রী জ্বর। ঠাণ্ডা গরম আবহাওয়া থেকে উৎপত্তি। কদিন তো ঠায় পড়ে রইলাম বিছানায়, ঝিম মেরে, আর স্বপ্ন দেখি উদ্ভট উদ্ভট। এটা শুনি প্রথম দিকে সকলেরই হয়। বিশেষ করে এই অঞ্চলে আসা মাত্র।

বলতে দ্বিধা নেই, এখন আমি পুরোদস্তুর ব্যবসাদার। অন্তত গিনিতে গিয়ে কীভাবে কী করব সব আমার কণ্ঠস্থ। ফের যাব গিনিতে। তবে দুর্ভাগ্য এই, আমার সেই বন্ধুকে আর পাওয়া যাবে না। মারা গেছে সে হঠাৎ[ সমুদ্রযাত্রা থেকে ফেরার কদিনের মধ্যে। বড় কষ্ট সেইজন্যে। কিন্তু উপায় নেই। মন আমার এখানে থিতু হতে চায় না। একদিন জাহাজে উঠে বসলাম। সেই জাহাজ। শুধু কাপ্তেন এবার আলাদা লোক। আগে যে জাহাজের সারেং ছিল তারই হাতে এখন ন্যস্ত হয়েছে গুরুভার। অবিশ্যি তার জন্যে আমার কোনো অসুবিধে নেই। সঙ্গে টাকাও প্রায় একশ পাউড। দুশ গচ্ছিত রেখে এসেছি কাপ্তেনের স্ত্রীর কাছে। আমাকে ভীষণ ভালবাসেন, স্বামীর মতো তিনিও আমার মঙ্গল চান। কিন্তু হলে কী হয়, ঐ যে বলে কপাল। দুর্ভাগ্য যত রাজ্যের। এমন বিশ্রী অবস্থায় আমি জীবনে কখনো পড়ি নি। ভাবতেও পারি নি এতটা ঘটবে। গোড়া থেকেই বলি।

ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের দিকে চলেছে আমাদের জাহাজ। একধারে আফ্রিকা, আর একধারে দ্বীপমালা। হাওয়া ভালো। সবই চমৎকার। হঠাৎ একদিন ভোরে দেখি তুর্কিদের একখানা দস্যু জাহাজ। সালের দিক থেকে আসছে। অসীম তার বেগ। যেন তাড়া করছে আমাদের। এ অবস্থায় চটপট পালানো ছাড়া তো উপায় নেই। দিলাম অমনি সবকটা পাল তুলে। ওদেরও পাল তোলা। পারি কি আমরা ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে! একটু পরেই দেখি কাছাকাছি প্রায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ধরে ফেলবে আমাদের। তখন লড়াই করার জন্যে প্রস্তুতি নিলাম। বিনা যুদ্ধে হার মানা এক্ষেত্রে বোকামি। বারটা বন্দুক মোট আমাদের। নামানো হল। ওদেরও হাতে বন্দুক। গুনে দেখি আঠারটা। আর লোক প্রায় দুশ। একদফা গুলী চালাচালি হল। আমাদের দলে হতাহত কেউ নেই। ফের ছুড়ল ওর গুলী। আমরা তখন আত্মরক্ষা করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। তখন ষাট জন দস্যু হৈ হৈ করতে করতে আমাদের জাহাজে আচমকা উঠে এল। সে কী দাপট! এটা ভাঙে ওটা কাটে পাল, ফুটো করে দেয়–যেন চোখের নিমেষে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। পাঠক অনুমান করতে পারছেন, কত অসহায় আমরা কিছুই করার নেই। ইতোমধ্যে আমাদের তিনজন মারা গেছে, আটজন গভীরভাবে জখম। বাকিদের বন্দী করল। তার মধ্যে আমিও আছি। নিয়ে গেল সালেতে। সেটা মুরদের আস্তানা। এবং নামকরা বন্দর।

তবে বন্দী হলেও ব্যবহার খারাপ পাই নি। সেটা আমার সৌভাগ্যই বলা যায়। গোড়ায় ভয় ছিল খুবনা জানি কি না কি অত্যাচার করে আমার উপর। সবাইকে বেধে নিয়ে গেল সম্রাটের এজলাসে, শুধু আমি বাদ। দস্যুদলের সর্দারের আমাকে ভারি পছন্দ। বয়েসটা তো কম, খাটাখাটনিও করতে পারি। এটা হয়ত বুঝে থাকবে। তার কাছেই রেখে দিল আমায়। অর্থাৎ ক্রীতদাস যেরকম। ভেবে দেখুন আমার মনের অবস্থা। কোথায় হব ব্যবসাদার, তা নয় সব আশা নির্মূল করে হতে হল আমায় ক্রীতদাস। দুঃখে তো বুক আমার ভেঙে যায়। আর বাবার কথা মনে পড়ে। ঘুরে ফিরে সেই সব পুরানো চিন্তা। হায় হায় মানি নি তার নির্দেশ, কত অপ্রাধই না করেছি। আরো কত দুঃখ আছে কপালে কে জানে!

সর্দার আমাকে বাড়ি নিয়ে গেল। আশার আলো দেখতে পেলাম। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে ফের জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে যাবে পর্তুগাল কি স্পেনে। দস্যুতার প্রয়োজনেই। গৃহবন্দী তো থাকতে হবে না। তখন সুযোগ বুঝে একদিন পালাব। কিন্তু কোথায় কী! গেল ফের সমুদ্রযাত্রায়। আমাকে রেখে গেল বাড়িতে। বাগান দেখাশোনার কাজে। সঙ্গে ক্রীতদাসেদের আরো সব খুচরা কাজ। রইলাম তাই। ফিরে এসে বলল, এখানে আর তোর থাকতে হবে না। আমার জাহাজে গিয়ে শুবি। বন্দরে ভেড়ানো আছে। দেখাশোনা করবি। এটাই এখন থেকে তোর কাজ।

তবু ভালো। গৃহবন্দীত্ব তো ঘুচল। এখন শুধু ঘুরে ফিরে একটাই চিন্তা কীভাবে পালানো যায়, কত সুচতুর উপায়ে আমি এখান থেকে সটকে পড়তে পারি। ভেবে ভেবে ফুল আর পাই না। কথা যে বলব কারো সাথে, আলোচনা করব–এমন একজনও নেই। ক্রীতদাসদের মধ্যে না একজন ইংরেজ কি আইরিশ কি স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা! শুধু একলা আমি এই ভাবেই কেটে গেল টানা দুটি বছর।

আমি হতাশ প্রায়। কী লাভ আর অহেতুক ভাবনায়! ঠিক তখনি অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।

সর্দার তখন বাড়িতেই। ফিরে আসা ইস্তক একবারও বেরোয় নি। জাহাজ মেরামতির কাজ তখনো কিছু কিছু বাকি। ইত্যবসরে মাঝে মাঝেই পোকা নড়ে ওঠে মাথায়। তখন শাম্পান নিয়ে আমাকে সঙ্গে করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। সে প্রায় হায় দু-তিনবার। সঙ্গে থাকে মারেষ্কে। তারও বয়েস কম। সেও ক্রীতদাস। তা দুটিতে মিলে হৈ হুল্লোড় করে সারাক্ষণ খুশি রাখি আমরা সর্দারকে। ফলে প্রতিবারে আমাদের দুজনকেই তলব। আর আমার তো আরো একটা বাড়তি গুণ। ভালো মাছ ওঠে আমার হাতে। সেটা আমার ভাগ্য। মারেস্কো হয় তো বা বাদ গেল কোনোদিন, বদলি হিসেবে এল এক ছোকরা নিগ্রো। আমি স্বপদেই বহাল। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে। নিগ্রো আর আমাকে দিয়েছে পাঠিয়ে। মোটে দুজন আমরা। আর কেউ নেই। আমরা মাছ ধরে এনে দিতাম।

একদিন তো ভীষণ কুয়াশা। সকাল। আমি, মারেস্কো আর নিগ্রো বেরিয়েছি মাছ ধরতে। প্রায় এক ক্রোশটাক পথ পাড়ি দেবার পর দেখি সব বেভুল। কিছুই আর ঠাওর হয় না। চারধারে শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তারপর যে কত বাইলাম দাঁড়, কত পরিশ্রম তার আর সীমা সংখ্যা নেই। কূল আর আসে না। দেখতে দেখতে দিন গেল, রাত ঘনাল। তখনো সমানে পালা করে দাঁড় বাইছি এক একজন। শেষে ভোর হতে কুয়াশা কাটল। দেখি তখন চারক্রোশের মতো আমরা কূল থেকে দূরে। বাতাস উঠেছে। সে আর এক পরিশ্রম। বহু কষ্টে হন্নছাড়া অবস্থায় ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর আমরা শেষ অব্দি কুলে গিয়ে পৌঁছালাম।

সর্দারকে বলতে সর্দার বলল, তাইতো এতো বড় দুশ্চিন্তার কথা। যদি সত্যি সত্যি পথ ভুল করে আরো দূরে চলে যেতি তোরা–সেই মাঝ দরিয়ায়। তখন তো নাকালের একশেষ। শুধু তোদের কেন, আমি থাকলে আমারও হয় তো এই দশা হত। দাঁড়া, আমি ব্যবস্থা করছি। বলে বড় জাহাজের কাঠমিস্ত্রীকে বলল শাম্পানে একটা ঘর বানাতে। কম্পাস রাখার ব্যবস্থা হল। দরিয়ায় দিক নির্দেশের নির্ভুল দিশারী। তাক হল ঘরে অনেকগুলো। একটা মদের বোতল রাখার, একটা খাবার দাবার রাখার। মোটমাট বন্ধুরা যাকে বলে। ঘর অর্থে কেবিন। ওপরে সারেং বসার একটা ছোটো ঘর। সেখানে বহুকষ্টে দু-তিনজনের মতো মানুষ শুতে পারে। অর্থাৎ আমাদের যদি কখনো শোবার দরকার হয়, তারই জন্যে এই ব্যবস্থা। খাবার টেবিলও পাতা হল কেবিনের একধারে। আর ভঁড়ারে মজুত হল বিস্তর চাল, রুটি আর কফি।

এরপর থেকে মাছ ধরতে গেলে এই বজরাই আমাদের বাহন। সর্দারও সঙ্গে থাকে। আর আমি তো আছিই। মাছের ভাগ্য যে আমার খুব। একদিন দেখি আরো খাবার আরো বোতল তোলা হচ্ছে বজরায়। কী ব্যাপার? না,জিজ্ঞেস করে জানলাম, নাকি কজন মান্যগণ্য নিগ্রো বন্ধু যাবে প্রমোদ ভ্রমণে। সঙ্গে মাছ ধরার মজাও থাকবে, তারই জন্যে এই তোড়জোড়। বড় জাহাজ থেকে তিনটে বন্দুক আর কিছু গোলাবারুদও আনা হল। এগুলো অন্য কোনো কারণে নয়, আমি জানি। বালি হাঁস উড়ে বেড়ায় জলের ধারে ধারে, কখনো বা জলের বুকে। তাদেরই মারবার জন্যে এই ব্যবস্থা।

তো সব আয়োজন সম্পূর্ণ, এমনকি পরদিন সকালে ঝকঝকে তকতকে করে বজরা ধোয়াধুয়িও শেষ, পতাকা উড়িয়ে দিয়েছি মাস্তুলের মাথায়, উড়ছে পতপত করে, এমন সময় সর্দার একলা এসে হাজির। থমথমে মুখ। নাকি যাবে না বলে জানিয়েছে অতিথিরা। অন্য কী কাজে হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছে। রাত্রে বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার নেমন্তন্ন। ভালো মাছ খাওয়াবে মনে বড় সাধ ছিল। আমাকে বলল, তুই বজরা নিয়ে যা। সঙ্গে মারেস্কা আর নিগ্রো যাক। ভালো মাছ ধরে আনিস। পাওয়া মাত্র আর দেরি না করে ফিরে আসবি। বাড়িতে পাঠিয়ে দিবি। আমি অন্য সব যোগাড় করি গে।

বলে চলে গেল।

আমার বুকে তখন রীতিমতো ঝড় বইতে শুরু করেছে।

তোলপাড় …..

এই সুযোগ। এর সদ্ব্যবহার চাই। সবই আমার হাতে মজুত। একটা বজরা, প্রচুর রসদ, তিনটে বন্দুক আর কম্পাস। আর কী চাই! এত ছোটোখাটো একটা জাহাজেরই সমান। ভেসে পড়ব দরিয়ায়। তারপর আর পালাতে অসুবিধে কী।

তবে আরো কিছু রসদ দরকার। তার জন্যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটা ব্যবস্থাও করা গেল। নিগ্রোকে বললাম, দেখ ভাই, আমরা তিনজন মালিকের খাবারে ভাগ বসাব এটা তো ভালো দেখায় না। বরং আমাদের জন্যে তুমি অন্য কিছু নিয়ে এস। সে তখন এক ঝুড়ি বিস্কুট আর এটা ওটা নিয়ে এল। সঙ্গে তিন বোতল জল। বললাম, এতে হবে না, বড় জাহাজ থেকে আমাদের জন্যে কয়েক বোতল মদও আন। সব তো জানা আমার। কোথায় মদ থাকে কোথায় কী সব আমার কণ্ঠস্থ। তখন কটা দামী মদের বোতল আনল। খানিকটা মোম আমি এক ফাঁকে নিয়ে নিলাম। এটা দরকার কেননা রাত্রে মোমবাতি জ্বালবার প্রয়োজন হবে। খানিকটা সুতো নিলাম। একটা হাতুড়ি, একটা করাত আর একটা ছোট্ট কুড়ুল। তারপর নতুন এক ফন্দী করে বললাম, ইসমাইল, মালিকের বন্দুক তো রয়েছে দেখছি, কিন্তু গুলীগোলা তো নেই সব জাহাজে। গুলী থাকলে বরং কটা বেলে হাঁস মেরে আনতাম। তাতে কর্তা সন্তুষ্ট হত। তুমি বরং জাহাজ থেকে এক বাক্স গুলী নিয়ে এস। তার বুদ্ধি শুদ্ধি তো মাথায় কম। ভাবতে পারে নি আমার মতলব। সুবোধ বালকটির মতো নিয়ে এল একবাক্স গুলী আর সেই সঙ্গে অনেকখানি বারুদ। ইত্যবসরে আমি কেবিনের তাক থেকে মলিকের বারুদের বাক্সটা নিয়ে সবটুকু বারুদ দুটো খালি শিশিতে ভরে মদের তাকে তুলে রাখলাম। বাক্সটা পড়ে রইল খালি। ব্যস সব আয়োজন শেষ। তখন নোঙর তুলে বজরা দিলাম ভাসিয়ে।

ঈশান কোণ থেকে বইছে বাতাস। পাল তখন গোটানো। পাল তুলে দিলে সিধে চলে যাব স্পেন বা কাদিজের কাছাকাছি। সেটা ভালোভাবেই জানি। কিন্তু আপাতত সেই সদিচ্ছা আমার নেই। যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে সটকে পড়াই আমার মতলব। আগে এখান থেকে পালাব, তারপর ভাগ্যের হাতে আমার জীবন। যেখানে ভেসে যাবে। যাক। আমার আর কোনো পরোয়া নেই।

যথারীতি ওদের ধোঁকা দেবার মতলবে ছিপ ফেললাম জলে। মাছ ঠোকরাল, টোপ খেল। আমি ছিপ তুললাম না বা একটা টানও দিলাম না। বললাম, জানি না আজ আমাদের ভাগ্যে কি আছে, এখানে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বরং চল আরো খানিকটা এগোই।

তখন দাঁড় বাইতে বাইতে ক্রমশ কূল থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। আমার হাতে ছিপ। আমি তো এখন বজরার কতা, ওরা আমার আদেশ মানতে বাধ্য। তাছাড়া আদেশের মধ্যে ওদের বোঝাবার মতো কোনো দুরভিসন্ধিও নেই। বজরা যখন বেশ অনেকখানি দূরে, ধীরে ধীরে ছিপ রেখে আমি গিয়ে ইসমাইলের পেছনে দাঁড়ালাম। একদম জলের ধার ঘেঁসে সে দাঁড়ানো। দাঁড় বাইছে অপর ছেলেটি, তার নাম জুরি। হঠাৎ এক ধাক্কায় ফেলে দিলাম তাকে জলে। তখন তো হাবু ডুবু খেতে খেতে অস্থির। তবু ওস্তাদ সাঁতারু তো, বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলে অমনি বড় বড় হাতে জল কেটে চলে এত বজরার ধারে, আমাকে বলল তুলে নিতে। সে কী কাতর মিনতি! তখন এক ঝটকায় কেবিনে ঢুকে নিয়ে এলাম বন্দুক। বললাম, খবরদার। যদি উঠবার চেষ্টা করিস তবে এক গুলীতে জান নিয়ে নেব। বরং সাঁতার কেটে ডাঙায় ফিরে যা। ঢেউ বিশেষ নেই। তুই ভালো সাঁতার জানিস। মরবি না। আমরা চললাম। আর ফিরে আসব না কোনোদিন।

তখন ইসমাইল ধাতস্থ হল। বজরা ছেড়ে কুলের দিকে ফেরাল মুখ। জুরিকে দেখি একমনে দাঁড় বাইছে। বন্দুক নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে। বললাম কীরে, কথা শুনবি তো আমার? আল্লার নামে শপথ কর। নইলে তোরও কিন্তু একই দশা হবে। জবাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমি যেন অবিশ্বাস না করি। আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাই, অনুগত ভূতের মতো সেখানে আমার সাথে যাবে।

আমি একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিগ্রো সাঁতার কেটে ফিরে চলেছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাল খুলে দিয়েছি একটু আগে। কূল ক্রমশ দূর থেকে বহুদূর। এইবার শুরু হবে আমার আসল খেলা। হাওয়ার পাশ কাটিয়ে আমি চলে যাব ভিন্ দিকে। সবাই ভাববে গেছি বারবারার উপকূলের দিকে। পরে হয়ত সেখানেই গিয়ে খোঁজখবর করবে। ধরতে যদি পারে আমাকে আর রক্ষে নেই। এরা কত নির্দয় কত নিষ্ঠুর আমি হাড়ে হাড়ে জানি। প্রথম কাজ হবে এদের নাগাল থেকে বহু দূরে সরে যাওয়া।

সন্ধের ঘোর লাগতে বজরার মুখ ঘোরালাম দক্ষিণ পূর্ব দিকে। এটাই আমার পালাবার পথ। ওরা হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পাবে না। আর পুবে থাকার সুবিধে প্রচুর। কুলের ধার দিয়েই বলতে গেলে এগোব, তাতে হাওয়া পাব পালে। তরতর করে এগিয়ে যাবে নাও। অন্তত এক রাতের চেষ্টায় এখান থেকে প্রায় দেড়শ মাইল দূরে। মরক্কোর সম্রাটের এক্তিয়ারের বাইরে। আর কে আমার নাগাল পায়!

তবু ঐ যে বলে ভয়, মনের মধ্যে অহরহ এক আতঙ্ক। ইসমাইলের সঙ্গে শেষ অব্দি ভালো ব্যবহার তো করি নি। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নির্ঘাৎ নিশপিশ করছে ওর হাত। করুক। আমিও বেপরোয়া। থামব না একদম। কূল পেলেও না। নোঙর ফেলার প্রশ্নই ওঠে না। পাঁচদিন এইভাবে চলব নাগাড়ে। বাতাস এখন দক্ষিণমুখী। সেটা আমার পক্ষে মঙ্গল। যদি ওদের কেউ জাহাজ নিয়ে আমাকে ধরবার জন্যে এগোয়–নির্ঘাৎ বেরিয়ে পড়েছে, আমি হলফ করে বলতে পারি; সেক্ষেত্রে ততক্ষণে তারাও ভগ্নোদ্যম অবস্থায় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। তখন আর ভাবনা কী, আমি মুক্ত।

সেই হিসেবেই পাঁচদিন চললাম একটানা। ছদিনের দিন, ছোট্ট এক নদী, তার মুখে ফেললাম নোঙর। কোথায় কোন নদী, কী এই দেশের নাম, কত দ্রাঘিমা কত অক্ষাংশ কিছুই জানি না। নদীর নামও অজানা। দুটো প্রধান দরকার আপাতত। কিছুটা বিশ্রাম, আর কিছু পানীয় জল। এক ফোঁটা জল নেই বজরায়। সন্ধে নাগাদ থেমেছি এখানে, ইচ্ছে সাঁতার কেটে ডাঙায় যাব, জল আনব টিন ভরে। কিন্তু তার কি উপায় আছে! সে যা তর্জন গর্জন জঙ্গলে, যে হাঁক ডাক। সে যে কত জন্তু। কত হিংস্র প্রাণী। জুরি তো ভয়ে তটস্থ। আমাকে বলল, দোহাই আপনার, খবরদার ওদিকে যাবেন না। বললাম, দেখ, নয় রাতটুকু কাটালাম। কিন্তু দিনের বেলা তো যেতেই হবে। তখন হয়ত জন্তুর সাক্ষাৎ মিলবে না, কিন্তু মানুষ দেখতে পাব। বন্য হিংস্র মানুষ। তারা জন্তুর চেয়ে কোনো অংশে হয়ত কম নয়। জুরি বলল, তখন বন্দুক ছুড়ব, ঘায়েল করব তাদের। সেটা অসুবিধা কী। তারা ভয়ে পালাবে। মোটমাট ভারি খুশি জুরি। আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তখন গেলাম না। ডাঙায়। জুরির উপদেশই মানলাম। কেবিন থেকে নিয়ে এলাম বোতল। আর রুটি। খেলাম পেট ভরে। দেখি আবছা অন্ধকারে ডাঙার ধারে জলে নেমে খেলছে নানান আকারের জীবজন্তু। কী তাদের উল্লাস! কী গর্জন! আমি জীবনে এইসব জন্তুর ডাক শুনি নি। ঘুম আর হল না। দুটি প্রাণী নিথর হয়ে বসে রইলাম সারারাত।

জুরি যেন ভয়ে কুকড়ে আছে। আমিও। তবে সেটা প্রকাশ করতে সাহস পাই না। তাহলে জুরি আরো ঘারড়ে যাবে। হঠাৎ দেখি এক ভয়ানক আকৃতির জন্তু সাঁতরাতে সাঁতরাতে আসছে বজরার দিকে। জুরি চিৎকার করে উঠল। বলল, পালান এক্ষুনি। নোঙর তুলে চলুন এখান থেকে সরে পড়ি। বললাম, দাঁড়াও, ব্যস্ত হয়ো না। তখন কেবিন থেকে বন্দুক নিয়ে এলাম। দেখি বজরার একদম কাছে এসেছে। ছুডলাম গুলি। অমনি ভয় পেয়ে কূলের দিকে ফিরে গেল।

গুলির শব্দে দশগুণ বাড়ল তর্জন গর্জন। সে যে কী হুটোপাটি! কী বীভৎসতা। আমাদের তো ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধাবার উপক্রম। তবু অন্য কোনো ঘটনা আর ঘটল না সে রাতে। ঘুমের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। চৌপর রাত জেগে রইলাম। আর মাঝে মাঝে আলোচনা করি নিজেদের মধ্যে কেমন ভাবে যাব কাল ডাঙায়। যদি পড়ি বাঘ কি সিংহের খপ্পরে! যদি বাঘ সিংহ না এসে আচমকা চারদিক থেকে ছুটে আসে নরখাদক মানুষের দল!

ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটল। জীবজন্তুর হাঁক ডাক এখন আর নেই। যে যার ডেরা নিয়েছে জঙ্গলের গহনে। আমাদের মাথায় এখন একটাই চিন্তা–জল আনতে যেতে হবে ডাঙায়। আর তাই নিয়ে নানান সংশয়। জুরি বলল সে যাবে, আমার যাবার দরকার নেই। বললাম, কেন? বলল, যদি নরখাদক দল আসে তবে তাকে নিয়ে যাবে ধরে। সে অবস্থায় আমার তো আর কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে আমি ফিরে যেতে পারি দেশে। কী বলব, কথা শুনে এত ভালো লাগল ছেলেটাকে! কতখানি ভাবে আমার কথা! বললাম, তোমার একলা যাবার দরকার নেই। আমিও যাব। সঙ্গে থাকবে বন্দুক। তেমন বিপদ দেখলে গুলি চালাতে ইতস্তত করব না।

আরো একটু বেলা বাড়তে বজরা এগিয়ে নিয়ে গেলাম কূলের কাছে। তারপর জল ঠেলে হাতে টিন নিয়ে বন্দুক কাঁধে উঠলাম গিয়ে ডাঙায়। সামনে অনেকটা ফাঁকা মাঠ মতো। তখন ঠিক হল, মাঠের এক ধারে ডাঙার কাছ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকব আমি, বজরার দিকে নজর রাখব। জুরি যাবে জলের টিন নিয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে। জন্তুর ভয়ের চেয়েও নরখাদক মানুষের ভয় তখন সবচাইতে বেশি। যদি মারমার করে দল বেঁধে ডিঙি নিয়ে অতর্কিতে ছুটে আসে আমাদের বজরার দিকে। সব লুটপাট করে নেয়। কিন্ধা ঝাঁপিয়ে পড়ে জঙ্গলের দিক থেকে আচমকা, আমাদের ঘিরে ধরে। সেক্ষেত্রে জলে ঝাঁপ দিয়ে অন্তত একজনের তো রক্ষা পাওয়ার একটা উপায় থাকল।

দেখি একটু পরে জুরি ফিরে আসছে। হাসি হাসি মুখ। হাতে জলের টিন। কাঁধে কী যেন একটা জীবের মৃতদেহ। কাছে আসতে দেখি খরগোশ ঠিক নয়, তবে অনেকটা ঐরকম দেখতে একটা প্রাণী। বেশ লম্বাটে গড়ন। বলল, শিকার করেছে। মাংসের স্বাদ চমৎকার। বেশ জমবে আজ দুপুরের খাওয়া।

ভালোই খেলাম। বা বলা যেতে পারে অপূর্ব। সঙ্গে সদরের কেবিন থেকে আনা এক বোতল উত্তম সুরা। জল যেটুকু এনেছে তাও স্বাদু। কোনো ঘোলা ভাব বা নুন কাটা স্বাদ নেই। জুরি বলল, জল আনতে গিয়ে অন্য কোনো বন্য জন্তু বা কোনো বন্য মানুষের সাক্ষাৎ মেলে নি। পায়ের ছাপও দেখতে পায় নি। তবে ভয় ভয় করছিল সারাক্ষণ।

তা ভয় থেকে ওকে মুক্তি দেওয়া গেছে। খুব কাছেই রয়েছে আর একটা পানীয় জলের জায়গা। নদীর জল একটু বাড়লে সেখানে ফুর ফুর করে জল ওঠে। এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায়। জুরিকে এরপর ওখানেই পাঠাতাম জল আনবার জন্যে।

আগের বার সমুদ্রযাত্রায় আমি এ অঞ্চলে এসেছি। বলতে গেলে জায়গাটা আমার অচেনা নয়। কিন্তু যন্ত্রপাতি তো কিছু নেই এবার সঙ্গে। না কোনো ম্যাপ, না অন্য কিছু। সঠিক ভাবে জায়গাটার অবস্থান কী আমি জানি না। তবে এটুকু জানি এর আশে পাশেই কোথাও না কোথাও ক্যানারি দ্বীপমালা এবং ভার্দ অন্তরীপের নিকটবর্তী দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। কোথায় গেলে তার কোনো একটা দ্বীপ পাব সেটাই প্রশ্ন। এবং আমার একমাত্র চেষ্টা তার যে কোনো একটিতে পৌঁছে যাবার। ব্যস্ তবে আর চিন্তা নেই। দ্বীপগুলি বাণিজ্যিকেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। ইংল্যাড় থেকে জাহাজ আসে নানান পসরা নিয়ে। তার যে কোনো একটাতে উঠে পড়ব। ফিরে যাব স্বদেশে।

যতদূর অনুমান, সেই মুহূর্তে যে অঞ্চলে আমরা রয়েছি, সেটা মরক্কো সম্রাটের রাজ্য এবং নিগ্রোদের রাজ্য–দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো এলাকা। এটি নির্জন এবং স্বাপদ সংকুল। অনুর্বর এলাকা, চাষবাসের পক্ষে একান্ত অনুপযোগী, তাই নিগ্রোরা এখানে বসতি করে নি। চলে গেছে আরো দক্ষিণে। মরু অঞ্চলের প্রায় কাছাকাছি। আর জম্বুও এখানে অলে। চিতা থেকে শুরু করে নেকড়ে, বাঘ, সিংহ সবই আছে। এখানে নিগ্রোরা ক্কচিৎ কখনো আসে শিকার করতে। এটা তাদের মৃগয়াভূমি। আসে দল বেঁধে। এক এক দলে প্রায় হাজার খানেক মানুষ। মাইলের পর মাইল জুড়ে এই বন। অন্তত শখানেক মাইল তো আমাদেরই যেতে যেতে নজরে পড়ল। ঘন জঙ্গল। কুলের একেবারে গা ঘেঁসে। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু জন্তুর ডাক আর গর্জনের শব্দ আর পাখির কিচির মিচির। আর কোনো শব্দ কানে আসে না।

টেনেরি ফে-র চুড়োও নজরে পড়ল। ক্যানারি দ্বীপমালার সব থেকে উঁচু চুড়ো। দু দুবার চেষ্ট করলাম শিখরে ওঠার। তাতে চারদিকে নজর বোলাবার প্রচণ্ড সুবিধে। তাহলে দেখতে পেতাম কোথায় রয়েছে জাহাজ, কোথায় গ্রাম, কোথায় মানুষ–সব। কিন্তু এমনই খাড়াই, ওঠা সম্ভব হল না। দু দুবারই নেমে আসতে বাধ্য হলাম।

জল আনবার জন্যে মাঝে মাঝেই নামি ডাঙায়। টিনে করে নিয়ে আসি। একদিন সকাল তখন। বললাম, আজ আর এগিয়ে কাজ নেই, নোঙর ফেলি এই খানেই। তখন নোঙর ফেললাম। ডাঙা এখানে উঁচু। খানিকটা ফাঁকা মতো জায়গা। অদূরে পাহাড়। জল অনেক খানি নিচে। হঠাৎ জুরি বলল, ঐ দেখুন দৈত্য। ঐ পাহাড়ের গায়ে তাকিয়ে দেখি সে এক মস্ত সিংহ। দৈত্যের মতোই আকৃতি। পাহাড়টা এগিয়ে এসেছে এখানে কল অব্দি। ঝুলন্ত এক খণ্ড মস্ত পাথর। তারই উপর শুয়ে সেই সিংহ। নাগালের মধ্যেই আমাদের। বললাম, তুই যা। ওটাকে মেরে আয়। জুরির চোখ তো ছানাবড়া। বলে, বলেন কী আপনি! আমি মারব অত বড় জন্তুটাকে! কাছে গেলেই আমাকে হালুম করে গিলে খাবে। বললাম, বেশ। তাহলে আমি চেষ্টা করে দেখি। বলে বড় বন্দুকটা নিয়ে এলাম। তাতে বারুদ পুরলাম অনেকখানি, সঙ্গে দুটো টোটা। আরো দুটো বন্দুক এনে তাতেও বারুদ আর টোটা ভরে হাতের কাছে তৈরি রাখলাম। তারপর তাক করলাম। মাথা দেখা যায় না। এক পা তুলে নাকের সামনে দিয়ে আড়াল করে রেখেছে এমনভাবে যাতে মাথার মাঝখানে দৃষ্টি স্থির করতে অসুবিধা হয়। তবু সেই অবস্থাতেই ঘোড়া টিপলাম। তাতে লাগল হাঁটুর কাছে। গর্জে উঠল। উঠে দাঁড়াতে গেল তৎক্ষণাৎ। পারল না। দেখলাম সামনের ডান পাটা ভেঙেছে। তারপর সে কী ডাক! আমি জীবনে এমন সিংহ-গর্জন শুনি নি। তখন আরেকটা বন্দুক নিয়ে কপাল তাক করলাম। সে তখন বনের দিকে চলে যাবার জন্যে মুখ ফিরিয়েছে। অমনি টিপলাম ঘোড়া। ব্যস জব্দ। মাথার মাঝখানে গিয়ে বিধল। মুহূর্তে ছিটকে পড়ল মাটিতে। দেখি হাত পা দাপাচ্ছে খুব। শেষ মুহূর্তের ছটফটানি যাকে বলে। বাঁচার জন্যে সংগ্রাম। এতে লাভ নেই কোনো, আমি জানি। তখন দেখি জুরি উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, যাব এবার আমি? বললাম, যাও। তখন বাকি বন্দুকটা নিয়ে এক হাতে জল সাঁতরে গেল ডাঙায়, বন্দুকের নল কানে লাগিয়ে ঘোড়া টিপল। ব্যস শেষ। নিস্পন্দ নিথর হয়ে পড়ে রইল বিশালকায় জীবটা।

শিকারের মতো শিকারই বটে। আচ্ছা আচ্ছা শিকারিও অবাক হয়ে যাবে তার আকৃতি দেখে। কিন্তু ঐটুকই। ঐ বাহবাই সার। মাংস তো খাবার উপায় নেই। শুনেছি সিংহের মাংস কেউ খায় না। অকারণ ছ ছটা টোটা নষ্ট করলাম এই জন্যে। কত মূল্যবান আমাদের কাছে এখন টোটা বারুদ! জুরি বলল, আমাকে কুড়ুলটা দিন। বললাম, কেন? বলল, মাথাটা কেটে আনব। আমার ভারি ইচ্ছে করছে। তখন কুড়ুল দিলাম। তবে কাটল না মাথা। একখানা পা শুধু আসার সময় কেটে নিয়ে এত। আমি বললাম, শুধু পা কেন, চল না ছালটাও ছাড়িয়ে নিই। তখন দুজন মিলে বসলাম চামড়া ছাড়াতে। সে কি আর দু দশ মিনিটের কাজ! বলতে গেলে সারা বেলাটাই লেগে গেল। আমি তো আর ওস্তাদ নই, তবে জুরি কিছুটা পারে। ছালটা এনে বজরার চালে বিছিয়ে দিলাম। দুদিনেই রোদ পেয়ে শুকিয়ে একেবারে খটখটে। তখন সেটা বিছানায় পেতে দিলাম। শুতে যা আরাম।

এরপর দশ বার দিন আর বিশ্রাম নেই। নাগাড়ে চলা। চলেছি সিধে দক্ষিণ মুখো। খাবার দাবারের সঞ্চয় কমে আসছে। মাঝে মাঝে ডাঙায় নেমে জল নিয়ে আসি টিনে ভরে। ফের শুরু হয় চলা। নজর আমার যেন তেন প্রকারে গাম্বিয়া বা সেনেগাল নদীর নাগাল পাওয়া। দুটোর যে কোনোটা ধরেই যাওয়া যায় ভার্দ অন্তরীপে। সেখানে আমার স্থির বিশ্বাস ইউরোপের কোনো না কোনো জাহাজ পেয়ে যাব। আসে ওরা দল বেঁধে এখানে ব্যবসা করতে। গিনিতে যায়, ব্রাজিলে যায়, ইস্ট ইন্ডিজে যায়। যে কোনো একটা পেলেই হল। বুঝিয়ে বললে কেউ তো আর নিতে আপত্তি করবে না। এবং বোঝাতে যে পারব আমার দুরবস্থার কথা, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

বার দিন পর যে অঞ্চলে এসে পৌঁছলাম, সেখানে মানুষ থাকে। তার নানান প্রমাণ আমরা পাই। এমনকি কোনো কোনো জায়গায় আমাদের দেখবার জন্যে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম অনেক মানুষ। গায়ের রং কুচকুচে কালো আর উলঙ্গ একদম। পরনে এতটুকু ন্যাকড়া অব্দি নেই। একবার ভাবলাম যাই ওপরে, ওদের সঙ্গে একটু খাতির জমাবার চেষ্টা করি। জুরি বলল, খবরদার যাবেন না। যে কোনো বিপদ হতে পারে। কথাটা মন্দ বলে নি। চিনি না জানি না–কত কিই তো শুনি এইসব মানুষ সম্পর্কে। অবশ্যি দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে, নিদোষ ভালোমানুষ চেহারা, কোনো অস্ত্র নেই কারো সাথে, শুধু একজনের হাতে একটা লাঠি। জুরি বলল, ওটা বল্লম। ভীষণ ধার। আর অব্যর্থ ওদের টিপ। চোখের নিমেষে ধাঁ করে ছুঁড়ে দেবে। আপনি ডাইনে বাঁয়ে সরে আত্মরক্ষা করার সুযোগটুকুও পাবেন না। তা সেদিকে আমার গোড়া থেকেই নজর আছে। ডাঙার একটু দূরে ফেলেছি নোঙর। নাগালের মোটামুটি বাইরে। স্থির হয়ে আছে বজরা। ওরাও স্থির। দেখছে আমাদের কুতূহলী দৃষ্টিতে। তখন ইশারা করে বললাম, একটু কিছু খাবার কি পাওয়া যাবে? অমনি একজনকে কী যেন বলে দিল। ছুটে গিয়ে সে নিয়ে এল খানিকটা মাংস। সঙ্গে কিছুটা যব। কিন্তু নেব কীভাবে? উপরে উঠতে যে সাহস হয় না। তখন বজরা খানিকটা এগিয়ে পালটা কাত করে এগিয়ে দিলাম। অনেকটা হাতার মতো। তারই উপর ইশারায় দিতে বললাম সব। বুঝল না ইশারার মানে। রাখল ডাঙার ধার ঘেষে। কিন্তু যাই কী করে আনতে! মনে যে ভয়। হয়ত বুঝে থাকবে আমাদের মনের কথা। তখন সার বেঁধে একটু একটু করে পিছু হটে সবাই দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আমি গিয়ে নিয়ে এলাম খাবার। বজরায় ফিরে আসার সাথে সাথে ওরাও ফের আগের জায়গায় ফিরে এল।

ধন্যবাদ জানালাম মাথা ঝুঁকিয়ে। এছাড়া দেবার কিছুই নেই। খেলাম মাংস। বজরা তখনো নোঙর করা। শুয়ে আছি দুপুরে পাটাতনের উপর। হঠাৎ শুনি তুমুল কোলাহল। দেখি ভয়ে যে যার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পালাচ্ছে। আর পাহাড়ের দিক থেকে ছুটে আসছে একজোড়া অতিকায় জীব। ঝপাং করে নামল এসে জলে। একটা সঁতরাতে সঁতরাতে চলে গেল ঐ দিকে, আর একটা দেখি গুটি গুটি আমাদের বজরার দিকেই এগোয়। জুরিকে ইশারা করতে জুরি এগিয়ে দিল বন্দুক। শোয়া অবস্থাতেই বারুদ পুরলাম, তারপর বাকি দুটোতেও পোরা হল টোটা আর বারুদ। তাক করলাম মাথার দিকে। আর যখন সামান্য খানিক দূরে, তখন ঘোড়া টিপলাম। অব্যর্থ নিশানা। লাগল মাথার ঠিক মাঝখানে। একলাফে উঠল একবার জলের উপর, ভারপর ডুব। অর্থাৎ অবস্থা কাহিল। তখন দেখি জলের মধ্যে তোলপাড় খাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই এগোবার চেষ্টা করছে ডাঙার দিকে। সে কি আর পারে। প্রাণটা যে বড় ক্ষণস্থায়ী। একটু পরে জলের মধ্যে যে শেষ ডুব দিল, অর উঠল না।

এদিকে ভাঙার উপর তখন আর এক অবাক করা কাণ্ড। শব্দ শুনে সবাই তো ভিমরি খাবার যোগাড়। কয়েকজন দেখি আতঙ্কে মাটির উপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। হয়ত অজ্ঞান। বাকিরা অবাক চোখ নিয়ে বারবার দেখছে আমাদের দিকে আর গুটিগুটি এগিয়ে এসে ভিড় করছে। জন্তুটা বলতে গেলে ওদের চোখের সামনেই মরল। তখন হৈ হৈ করে নেমে পড়ল একদল জলে। খোঁজ খোঁজ। জলের মধ্যে হাতড়ানি। পায় না খুঁজে। পাবে কী করে, জানে না তো সঠিক জায়গাটা কোথায়। সেটা আমি জানি। রক্ত নিচ থেকে উঠছে ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে, ওখানেই মরে পড়ে আছে সে। তখন জায়গাটা ইশারায় দেখিয়ে দিলাম। খুঁজে পেয়ে সে যা খুশি! কিন্তু পারে না টেনে তুলতে। তখন দড়ি দিলাম ছুঁড়ে। তাই দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে ওপরে তুলল। দেখে আমিও অবাক। এ যে চিতা। এত বড় হয় নাকি চিতা বাঘ! ওরাও দেখা ইস্তক আল্লাদে আটখানা। নেচে কুঁদে ভঙ্গি করে সে যা উল্লাস, আমাদের উদ্দেশে যা অভিনন্দনের বহর।

আর একটা চিত ততক্ষণ পালিয়েছে। গুলির শব্দ, আলোর ঝলকানি আর জনগণের উল্লাসে বোধহয় মাথা ঠাণ্ডা রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পায় নি। জল থেকে তড়িঘড়ি উঠে সিধে পালিয়ে গেছে পাহাড়ের দিকে। এদিকে মরা চিতাটা নিয়ে গোল হয়ে বসে গেছে তখন যাবৎ মানুষ। কাটছে টাটকা টাটকা মাংস, তাই কাঁচা কাঁচা চিবিয়ে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করে তাকায় আবার আমার দিকে। যেন নীরব চোখের ভাষায় বলতে চায়–এই যে খাচ্ছি আমরা, আপনার সম্মতি আছে তো? আছে। আমি হাত তুলে জানান দিলাম। তখন আর এক দফা উল্লাসের ঘটা। নতুন করে আরো একবার হুল্লোড়। বলব কী, সে যা চটপট কাজ ওদের! ছুরি নেই, কাটারি নেই, শুধু কাঠের এক টুকরা ধারাল খন্তা মতো, তাই দিয়ে চোখের নিমেষে ছাড়িয়ে ফেলল পুরো ছাল। খানিকটা মাংস কেটে আমাদের দেবে বলে ইশারা করল। আমরা না করলাম। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বললাম, বরং ছালটা কি পাওয়া যেতে পারে? ওরা তো তাতে আরো খুশি। যেন কৃতার্থ। অমনি চটপট ছাল দিয়ে গেল আমাদের বজরায়। সঙ্গে আরো নানান ধরনের খাবার। তখন ইশারায় খালি জলের টিনটা উপুড় করে বললাম, একটু জল কি পাওয়া যেতে পারে? অমনি দুই মহিলাকে ডেকে কী যেন বলল। দেখি এক মুহূর্ত পরে তিনটে মাটির কলসীতে করে জল নিয়ে হাজির। রেখে চলে গেল। ব্যস, আমরাও নিশ্চিন্ত।

তবে আর না। এবার রওনা হতে হবে। বিদায় নিলাম নিগ্রো বন্ধুদের কাছ থেকে। আমাদের প্রচুর খাবার তখন মজুত। সঙ্গে দুটিন জল। এতদিন পরে যাহোক তবু মানুষের দেখা তো পেলাম। এটাও আমাদের কাছে বড় সান্ত্বনা। বলতে পারা যায় শক্তি। ভেসে পড়লাম ফের। ডাঙার ধার ঘেঁষে টানা প্রায় এগার দিন। সমুদ্র এখানে ভারি শান্ত। ডাইনে একটা দ্বীপ। আমি জানি এটাই ভার্দঅন্তরীপ অঞ্চল। অজস্র দ্বীপ এখানে মালার মতো চারধারে ছড়ানো ছিটানো। দ্বীপগুলোকে বলে ভার্দ দ্বীপপুঞ্জ। তবে দূর অনেকখানি। একদম কাছে মনেহয় যেটা, সেটাও প্রায় ডাঙা থেকে চার পাঁচ ক্রোশের মতো। যাওয়ার ভারি ইচ্ছে হল। কিন্তু নিরুপায়। হাওয়ার বিপরীতমুখে চলতে গেলে জানি না কখন পারব পৌঁছুতে। তদুপরি ভাঙা থেকে মাইলখানেক দূরে কখন ঝড় ওঠে, তুফান ছোটে–তাই বা কে বলতে পারে!

কী করব কিছুই ঠিক করতে পারছি না। নিঃশব্দে কেবিনে গিয়ে বসলাম। তোলপাড় খাচ্ছে একের পর এক ভাবনা। জুরির হাতে হাল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,-কর্তা, দেখুন একটা জাহাজ উল্লাসের চিৎকার নয়, ভয়ের। বলা যায় আর্তনাদ। ভেবেছে বুঝি সর্দার লোক পাঠিয়ে দিয়েছে জাহাজে করে, আমাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে। আমি অমনি এক লাফে বাইরে এলাম। দেখি জাহাজই বটে, পর্তুগিজদের। গিনির দিকে যাচ্ছে বলে প্রথমটা মনে হল। পরে বুঝলাম অনুমান ভুল। অন্য কোথাও চলেছে। গিনির দিকে হলে অমন মাঝ দরিয়া দিয়ে যেত না, বরং কূলের খানিকটা কাছ ঘেঁষেই চলত।

মনে আশার উন্মাদনা অথচ নিরুপায়। ভেবে দেখুন আমার অবস্থা। কথা বলব ভারি ইচ্ছে, কিন্তু সম্ভব নয়। শুনতে পাবে না এতদূর থেকে আমার ডাক। যদি সব পাল তুলে দিই, তাহলেও পারব না জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছতে। তার আগেই ওরা আরো অনেক দূর চলে যাবে। কী করি এখন, কী উপায়! তখন মরীয়ার মতো বজরার উপরে উঠে নানারকম ইশারা করতে লাগলাম। তাতে কাজ হল। দূরবীন দিয়ে দেখতে পেলো আমাকে। তখন বেগ কমাল। স্থির প্রায় তখন সমুদ্রের উপর। যেন ভাসমান ছবি। আমি উপর মুখ করে বন্দুক ছুঁড়ে জানান দিলাম আমরা এক্ষুনি যাচ্ছি। পরে শুনেছি ওদের মুখে, বন্দুকের আওয়াজ নাকি শুনতে পায় নি। ধোয়া দেখেছে। আর নৌকা দেখে ভেবেছিল ইউরোপের কোনো মাঝি। হয়ত জাহাজের সঙ্গেই ছিলাম। যে কোনো কারণে জাহাজ থেকে নেমে পথ হারিয়ে ফেলি।

সে যাই হোক, দুজনে সমানে দাঁড় বেয়ে পৌঁছলাম যখন জাহাজের কাছে, তখন আমাদের কাহিল অবস্থা। তিনটি ঘন্টা লেগেছে প্রায় আসতে। কাহিল হলেও মনে আশার আলো। যাক, এতদিন পরে ফেরার তো একটা উপায় হল।

আমাকে জিজ্ঞেস করল কে আমি, কী আমার পরিচয়। আমি তো ছাই কিছুই বুঝি না। বেশির ভাগ নাবিক জানে পর্তুগিজ ভাষা, নয়ত ফরাসি, নয় স্পেন দেশের। ইংরেজি যে বোঝে না কেউ। শেষে নিয়ে এল স্কটল্যান্ডের এক নাবিককে। ভাগ্যিস ছিল সে তাই বঁচোয়া। বললাম সব। কেমন করে দু বছর পর পালিয়েছি, প্রভুর গৃহে কী কী আমাকে করতে হত, কী সেই প্রভুর প্রকৃত পরিচয় কিছুই বাদ দিলাম না। শুনে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে আমাকে জাহাজে তুলে নিল।

সে যা খুশি আমার! যা আনন্দ! বলতে গেলে অসীম দুর্দশার হাত থেকে অব্যাহতি। মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসা। আনন্দের চোটে কী করব ভেবে পাই না। তখন কাপ্তেনকে বললাম, আমাদের বজরায় যা যা আছে সব আপনি নিয়ে নিন। আমার আর কিছুই চাই না। শুধু মুক্তি চাই। শুনে ভারি মিষ্টি করে বললেন, তার কোনো কিছুরই দরকার নেই। সব রইল বজরায়। বজরা জাহাজের সাথে বেঁধে নেওয়া হল ব্রাজিলে পৌঁছে সব আবার আমাকে দিয়ে দেবেন। বললেন, দেখ, তোমাকে যে রক্ষা করেছি তার পেছনে কোনো মতলব বা দুরভিসন্ধি নেই। এটা মানুষেরই কাজ। আগামী দিনে বলা যায় না হয়ত আমারও এই দুর্দশা হতে পারে। তখন তুমি আমাকে রক্ষা করবে। ব্যস সব শোধ। আমি তবু নাছোড়বান্দা,না না, তা হয় না, অন্তত যা আছে আমাদের তার কিছুটা নিন। বললেন, সেটাও হবে অবিবেচনার কাজ। আমি তোমাদের নামিয়ে দেব ব্রাজিলে। কিন্তু তারপর? আরো তো অনেকখানি যেতে হবে তোমাদের। সে রসদ কোথায় পাবে? বরং যা আছে সব বিক্রী করলে বিস্তর টাকা রোজগার হবে। তাই নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেও। এই আমি মনেপ্রাণে চাই।

বলব কী, সে যেন দয়ার পরাকাষ্ঠা। যেন মূর্তিমান প্রেম ভালবাসা আর ত্যাগের আশ্চর্য এক সময়। দূরদর্শিতাও খুব। যদি পাছে অন্য কোনো নাবিক আমাদের জিনিস চুরি করে নেয়! পড়ে থাকবে বজরায় সবার তো সব সময় খেয়াল থাকবে না। তখন সুব কিছু জাহাজে তুলে কী কী আছে তার একটা তালিকা বানালেন। দু দফা। একটা আমাকে দিলেন আরেকটা নিজের কাছে রাখলেন। মালপত্র সব রাখা হল জাহাজের গুদাম ঘরে। সে ভীষণ সুব্যবস্থা। বললেন, এই তালিকা মিলিয়ে সব জিনিস তুমি ব্রাজিলে গিয়ে ফেরত পাবে। এটা যত্ন করে রেখো। তালিকায় আমাদের সেই যে তিনটি মাটির কলসী পেয়েছিলাম নিগ্রোদের কাছ থেকে, দেখি তারও উল্লেখ আছে।

বজরার ব্যাপারে আমাকে বললেন, এক কাজ কর ওটা আমাকে বিক্রী করে দাও। আমার জাহাজের কাজে লাগবে। কত দাম নেবে? কী বলব দাম!এমন সদাশয় মানুষ, এত দয়া, এত উপকার করছেন আমাদের আমি কি পারি তার কাছে থেকে লাভ করতে বা কোনো মন্তু একটা দাম হাঁকতে। বললাম, আমি কিছু জানি না। আপনার যা ইচ্ছে হয় আমাকে দেবেন। চাই কি এমনিও নিয়ে নিতে পারেন। বললেন, না না, তা হয় না। দাম তোমাকে নিতেই হবে। বলে একখানা হুন্ডি লিখে দিলেন। ব্রাজিলের অফিসে সেটা দেখালে আমাকে দুশ চল্লিশ তঙ্কা দেবে। বললেন, এর চেয়ে যদি দাম কেউ দিতে চায়, তবে চিন্তা নেই, সেটাও তিনি আমাকে ব্রাজিলে পৌঁছে উশুল করে দেবেন। জুরির জন্যও দাম ধরে দিলেন চারশ আশি তঙ্কা। এটা নিতে হাত আমার মোটে উঠতে চায় না। আমার সঙ্গী, আমার দুঃসময়ের সাথী। তাকে কিনা টাকার বিনিময়ে বেচে দেব! ক্রীতদাসত্বের ভাগীদার করব। বললেন, তোমার কোনো চিন্তা নেই। সে অর্থে ক্রীতদাস আমি ওকে করব না। খাটবে জাহাজে কাজ করবে তার বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। সে-ও মোটে দশ বছরের জন্যে। তার মধ্যে যদি ও খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে, তবে ওর মুক্তির কোনো বাধাই থাকবে না। জুরিকে জিজ্ঞেস করতে বলল সে রাজি। এই শর্তে তার কোনো আপত্তি নেই। তখন জুরিকে তার হাতে তুলে দিলাম।

নির্বিঘ্নেই পৌঁছলাম ব্রাজিলে। জায়গাটার নাম সালভাদোর। বাইশ দিন মোট লাগল সময়। হিসেব নিকেশ চোকানো হল। সবই ভালো। শুধু আমার তরফে একটাই চিন্তা। ফের ভাগ্যের হাতে পড়লাম আমি। জানি না আগামী দিনে ভাগ্য টেনে নিয়ে যাবে আমাকে কোথায়।

ভুলব না কাপ্তেনের কথা। আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এমন দয়া এমন পরোপকার আমি জীবনে দেখি নি। বহু পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও এক আধলা নিলেন না আমার কাছ থেকে ভাড়া বাবদ। উলটে দিলেন আরো অঢেল। চিতাবাঘের ছালটার জন্যে দিলেন বিশ তঙ্কা, আর সিংহের ছালের জন্যে চল্লিশ। বজরার প্রতিটি জিনিস আমি তালিকা মিলিয়ে ফেরত পেলাম। বললেন, বল এবার, যা আছে তোমার তার মধ্যে কী কী জিনিস তুমি বেচতে চাও। সব আমি কিনে নেব। তখন দুটো বন্দুক, সেই মোম, শিশি বোতল সব মিলিয়ে দাম দিলেন মোট সতেরশ ষাট তঙ্কা। আমিও ঝামেলা থেকে মুক্ত। হৃদয়ের আন্তরিক ভালবাসা জানিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

তা আমি তো বাসিন্দা নই এখানকার, সবাই তাই আমাকে চেনেও না। একখানা পরিচয় পত্র দিয়েছিলেন সেই সদাশয় কাপ্তেন। তারই জোরে সজ্জন এক ব্যক্তির সাথে পরিচিত হলাম। অমায়িক এবং এক কথায় ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়। ছোটো ব্যবসা। একই সাথে আখের চাষ আর আখ থেকে চিনি তৈরির কারবার। আমাকে প্রথম দিকে তার বাড়িতেই ঠাই দিলেন। শিখলাম সব। কেমন করে চাষ করতে হয়, কেমন করে চিনি তৈরি করে, কী তার কৌশল–সমস্ত কিছু। ব্যবসা হিসেবে চমৎকার। খুব ছোটো থেকে আরম্ভ করে অনেকেই এখন বিরাট ধনী হয়ে গেছে। ঠিক করলাম, আমিও এই ব্যবসা শুরু করব। তখন সব ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। এমনকি জামি কেনা থেকে কল কিনে দেওয়া অব্দি। টাকা আমিই দিলাম। আরো টাকার দরকার। কেননা কল চালু হলে অনেক টাকা হাতে মজুত রাখতে হবে। আমার তো সেই বন্ধুর স্ত্রীর কাছে গচ্ছিত আছে তিনশ পাউড। ভাবলাম, এক কাজ করি। এই সুযোগে তার কাছে আমার প্রাপ্য টাকা চেয়ে পাঠাই।

আমার পাশেই যার জমি, সে পর্তুগিজ। লিসবনের লোক। আমারই মতো ভাগ্যতাড়িত অবস্থায় এখানে এসে পৌঁছেছে। বাবা মা কিন্তু ইংরেজ। নাম ওয়েস। ভারি খাতির জমে গেল তার সাথে। দুজনে দুজনকে ডাকতাম মিতে বলে। তা দুজনেরই আমাদের পুঁজি কম। কী আর করি, জমি তো শুধু শুধু ফেলে রাখা যায় না। খাদ্য শস্যের চাষ করতাম। একবার তামাকও বুনলাম। ক্ষতি তো কিছু নেই। বরং যা দুচার পয়সা আসে সেটাই লাভ। মন্দ হল না ফলন। অর্থাৎ চাষের উপযোগী জমি এতদিনে প্রস্তুত। এবার দেদার আখ ফলবে, সবাই বলল। কিন্তু পারি কি একলা অতখানি জমিতে একা হাতে চাষ করতে! একজন কেউ সাহায্যের লোক থাকা দরকার। তখন জুরির কথা ভেবে আফশোস হল খুব। ইস্ যদি জুরি থাকত এখন আমার কাছে!

ফলে গড়িয়ে গড়িয়ে চলা যাকে বলে সেই টানা হ্যাঁচড়া, সেই গতির নামে দুর্গতি। আমার ভাগ্যটাই যে এই রকম। খুব একটা বেশি হবে কী করে! সব ছেড়ে ছুঁড়ে এসেছি অজানার ডাকে। বাবার আদেশে কান দিই নি। বারবার বলেছিলেন বাবা, দেখরে ঘরে থাক। এখানেই যা হবার হবে। শুনি নি সে নির্দেশ। কিন্তু এখানে এসেই বা অন্য কী পেলাম। সেই তো মধ্যবিত্তের জীবন। সেই না উঁচু না নিচু মাঝখানের অবস্থা। তবে কেন মরতে এই পাঁচ হাজার মাইল দূরে রয়ে গেলাম।

অর্থাৎ দুঃখ যাকে বলে। নিজের অবস্থা নিয়ে নিজেরই মনে হাহাকার। আর যাতনা। ভালো লাগে না একদম। কাউকে বোঝাতে পারি না নিজের মনের কথা। শুধু মিতের সঙ্গে যা একটু গল্পসল্প হয়। তা তারও তো একই হাল। এ যেন নির্জন কোনো দ্বীপে বাস করার সামিল। বুদ্ধি যে দেবে এমন মানুষেরও যেন অনটন। মোটমাট সুখী নই আমি আমার অবস্থানে। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়ত জীবনটা আমার এই ভাবেই চলবে। সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্য হয়ত কোনোদিনই আসবে না।

এরই মধ্যে সান্ত্বনা এই, আমার সেই সদাশয় কাপ্তেন বন্ধুটি আবার সমুদ্র যাত্রায় যাবেন। এবারের গন্তব্যস্থল লন্ডন। তিনমাস ধরে চলছে তারই প্রস্তুতি। জাহাজে মাল বোঝাই হচ্ছে। একদিন এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, তুমি আমাকে বরং একখানা চিঠি লিখে দাও। বলেছিলে, কার কাছে যেন টাকা রাখা আছে তোমার। আমি চিঠি দেখিয়ে টাকা নিয়ে আসব। ব্যবসায় লাগালে আরো লাভ পাবে। তবে নগদে এনে তো লাভ নেই। এখানে চলে না সে টাকা। বরং কিছু মালপত্র কিনে আনব। সেগুলো এখানে বিক্রী করে তুমি নগদ পাবে। পুরোটা আনব না। লিখে দাও একশ পাউন্ড। কেননা বলা যায় না, সমুদ্রের খেয়াল, আসার পথে হয়ত আমার জাহাজডুবি হল। সে অবস্থায় তিনশর মধ্যে একশ তোমার নষ্ট হবে। বাকি দুশ তো থাকবে। সেটা পরে অন্য কাউকে দিয়ে তুমি আনিয়ে নিতে পারবে।

সদাশয় মানুষ বলেই এত চমৎকার পরামর্শ দিলেন। আপত্তি করার কী থাকতে পারে! লিখে দিলাম চিঠি। একশ পাউড দেবার কথা বলে দিলাম কাপ্তেনের হাতে। সঙ্গে আমার নিজের সম্বন্ধেও অনেক কিছু লিখে পাঠালাম।

সব। আমার সমুদ্রযাত্রার বিবরণ, দস্যুদলের আক্রমণ, আমার বন্দীদশা, দাসত্ব, সেখান থেকে পলায়ন, পর্তুগিজ জাহাজের কাপ্তেনের সঙ্গে পরিচয়, তার দয়া, আমার বর্তমান অবস্থা কোনো কিছুই বাদ দিলাম না। লিখলাম কেন আমার টাকার দরকার। তা লিসবন থেকে যখন ফিরে এলেন কাপ্তেন, দেখি সঙ্গে নানান উপহার, আর একশ পাউড দিয়ে কেনা নানান সামগ্রী। চাষের কাজের জন্যে বিস্তর যন্ত্রপাতিও এনেছেন। সেগুলো আমার খুব কাজে লাগবে। বাড়তি কিছু টাকাও দিলেন হাতে। বললেন, কাজের লোকের তো খুব দরকার তোমার। এই টাকা দিয়ে কাজের লোক রেখো। ছ বছরের চুক্তিতে মজুর পাওয়া যাবে এই টাকায়। বাড়তি দাবীর মধ্যে শুধু তামাকের নেশা। সেটা ক্ষেতের তামাক দিয়েই পূরণ হবে। এদিকে জিনিসপত্র বিক্রী করেও ভালো টাকা পেলাম। সবই ইংল্যান্ডে তৈরি। এদেশে তার ভালো বাজার। তার মধ্যে আছে কাপড়, নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি জিনিস, বাসনপত্র আরো অনেক কিছু। ভালোই আমদানি হল বিক্রী করে। প্রায় চারগুণের মতো লাভ। মিতের চেয়ে অবস্থা আমার এখন দস্তুর মতো ভালো। নিগ্রো দাস নিলাম একজন। আমার কাজে সহায়তা করার জন্যে। আর একজন ইয়োরোপীয় ভৃত্য। মোটের উপর সব দিক থেকে আমি এখন নিশ্চিন্তই বলা চলে।

তবে ঐ যে বলে না–অনেক ভালোও ভালো নয়, তাই হল আমার শেষ অব্দি। পরের বছর খুব ভালো চাষ হল। যেমন আখ, তেমন তামাক। তামাকের ইট তুলে দিলাম জাহাজে। বিনিময়ে দিল টাকা। আমার তখন খুশি আর ধরে না। নানান পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায়। নতুন করে উৎসাহ পাই। আর কেবল মন ফের কোনো সমুদ্রে ভেসে পড়ার জন্যে ছটফট করে ওঠে।

সব নষ্টের মূলে আমার এই অস্থির মতিত্ব। থিতু হয়ে যে থাকতে পারি না কোনো জায়গায়। কোনো কিছুই দীর্ঘদিন ভালো লাগে না। এ যেন জ্বলা বিশেষ। এই তো দেখুন না, ব্যবসায় লাভ হয়েছে প্রচুর, মোটামুটি দুজন কাজের লোক, জমিজমা নিয়ে সুখেই আছি, আরো সুখ আসবে আগামী দিনে। আমি যদি লেগে থাকি তবে। কিন্তু ঐ যে চঞ্চলতা। ঐ যে ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানি। সেদিক থেকে বিচার করলে আমি নিজেই আমার যাবতীয় দুর্ভাগ্যের নিয়ন্তা। ভুলের পর ভুল কেবল করেই চলি। শেষ আর হয় না। দুঃখ তাতে দ্বিগুণ হয়। কষ্ট তাতে বাড়ে। আমি নির্বিকার। হয়ত শুনে আপনারা বলবেন বোকামি। এভাবে অনির্দেশ সমুদ্রযাত্রায় ভেসে পড়াটা কোনো বুদ্ধিমান মানুষেরই কাজ নয়। জানি না কাজ কি অকাজ। তবু ঘরে বসে থাকতে মন চায় না মোটে। ঘরে বসে নিজের ভালো করতে ইচ্ছে হয় না। দুনিয়াটাকে দেখব এটাই আমার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা। আমি মনে করি আমার জীবদ্দশায় এই আমার অন্যতম কর্তব্য এবং দায়িত্ব।

মোটমাট তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে আমাকে সেই পুরানো ইচ্ছা। বাবা মাকে ত্যাগ করে চলে এসেছি যে ইচ্ছার বলে। সুখী থাকতে আর মন চায় না। একটু একটু করে বড় হব ধনী হব, একটু একটু করে আমার ব্যবসা বাড়বে, এতে আমি তৃপ্ত নই। আমি চাই চটপট নিজের ভাগ্য ফেরাতে। তার জন্যে অভিযানে যেতে চাই। তাতে ঝুঁকি অনেক, দুঃখ বিস্তর আমি জানি। তবু বেপরোয়া আমার মন। কোনো দুঃখ বরণ করতেই আমি পিছপা নই।

প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটি কথা বলে নিই।

ব্রাজিলে কাটল আমার টানা চার বছর। মোটের উপর ভালোই চলছে আমার চাষের কাজ। ভাষাটা এতদিনে বেশ রপ্ত হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে বিস্তর মানুষের সঙ্গে। তার মধ্যে কিছু কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুও আছে। তারা মূলত সালভাদোরের বাসিন্দা। বন্দর তো। মাল চালান দেবার প্রয়োজনে আমাকে প্রায় তাই যাতায়ত করতে হয়। খোসগল্পের আসর বসে। বলি আমার সমুদ্রযাত্রার কাহিনী। সুলভে স্বর্ণরেণু আনার গল্পও বলি। তাছাড়া আরো যে সব ব্যবসা চলে গিনিতে ছুরি কাচি খেলনা পুঁতি কুড়ল–তারও বিবরণ দিই। বিনিময়ে মেলে গজদন্ত প্রভৃতি নানান মূল্যবান সামগ্রী। তাছাড়া নিগ্রোও ধরে আনা যায়। ব্যবসা হিসেবে সেটাও কিছু মন্দ নয়।

খুবই মন দিয়ে শোনে আমার কথা। আগ্রহ দেখি প্রচণ্ড। তবে নিগ্রো আনার ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু আপত্তি করে। এখনো রাজার স্বীকৃতি মেলে নি এ ব্যাপারে। স্পেন বা পর্তুগালে এখনো এ ব্যবসা রমরমা নয়। তবু নিয়ে আসে কেউ কেউ নিজের প্রয়োজনে। অথবা বিক্রী করলেও তাকে প্রয়োজন বলে দেখায়। মোটমাট এভাবেই চোরাগোপ্তা পথে মানুষ বিক্রীর ব্যবসা চলে।

একদিন সকালে দেখি তিন ব্যবসাদার আমার বাড়িতে এসে হাজির। মাত্র তার আগের দিনই এক ভোজের আসরে তিনজনকে শুনিয়েছি আমার সমুদ্রযাত্রার বিবরণ। নিগ্রো প্রসঙ্গও সেখানে স্বাভাবিক নিয়মে এসেছে। তো বলে, আপনার সঙ্গে গোপন কথা আছে। বললাম, কী কথা? বলল, ঐ ব্যবসা প্রসঙ্গেই আমাদের একটা প্রস্তাব আছে। সারারাত ধরে ভেবেছি আমরা তিনজন। এই যে এত বড় বড় ক্ষেত আমাদের, তাতে পারি না একা হাতে চাষবাস করতে। পড়ে থাকে অঢেল জমি। অনেকটা আপনারই মতো। এ অবস্থায় যদি কাজের প্রয়োজনে কিছু নিগ্রো আমরা নিয়ে আসি গিনি থেকে? আপনার কী মত? ভালো জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। আপনিও আমাদের সঙ্গে থাকবেন। কেনাকাটার যাবতীয় দায়িত্ব আপনার। না না, টাকা আপনার লাগবে না, সব আমাদের। শুধু বুদ্ধি আপনার। আর কাজ হাসিল। বিনিময়ে আপনিও কিছু নিগ্রো পাবেন। এটা আপনার দস্তুরী।

প্রস্তাব লোভনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থাটাও একটু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। এই তো ক্ষেত খামার সাজিয়ে বসেছি এখন লাভ তো খুব একটা কম নয়, বরং ভালোই। বলা যায় জীবনে আমি এখন প্রতিষ্ঠিত। একশ পাউড আনিয়েছিলাম ইংল্যান্ড থেকে, বাড়তে বাড়তে তাই এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার পাউন্ডে। আমার তাবৎ সম্পত্তির এটাই এখন দাম। আরো বাড়বে ভবিষ্যতে। ব্যবসা আরো বড় হবে। সে অবস্থায় এর একটা সঙ্গতি না করে আমি নড়ি কীভাবে এখান থেকে। সেটা কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব?

অন্য কেউ হলে হয়ত এই অজুহাত তুলে যেত না। এখানেই থাকত। কালে দিনে আরো ধনী হত। একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলতো নিজের সম্পদ। কিন্তু আমি মানুষটা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। নিজেই আমি নিজের সংহার কর্তা। তদুপরি অজানার নেশা তো আছেই। বললাম, যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে আমার অনুপস্থিতিতে এই ক্ষেত খামার জমি জমা দেখাশোনার সুবন্দোবস্ত করতে হবে। বলল, সেটা তারা করবে। তখন বললাম, কিন্তু আমি যদি আর না ফিরি। তখন এইসব সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত বা বিক্রীর প্রয়োজন হবে। বলা যায় না, মারাও যেতে পারি। সে অবস্থায় দলিল করে দিয়ে যেতে চাই। বলল, ঠিক আছে, আপনার খুশিমতো তাহলে দলিল করুন। তখন লিখলাম, আমার অনুপস্থিতিতে যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হবে আমার সেই রক্ষাকর্তা কাপ্তেন এবং জমি বিলি, বন্দোবস্ত, বিক্রী চাষাবাদ ইত্যাদি যে কোনো ব্যাপারে ঠিক আমার যা অধিকার, তারও তাই থাকবে। তার উপর নির্দেশ থাকবে সব বিক্রী করে দেবার এবং তা থেকে যা অর্থাগম হবে তার অর্ধেক নিজে রেখে বাকি অর্ধেক ইংল্যান্ডে বাবা মার কাছে নিচের ঠিকানায় পৌঁছে দেবে।

বলে বাবা মার নাম ঠিকানা দিয়ে সই করে দলিল শেষ করলাম।

মোটমাট, সম্পত্তির ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। আমি জানি না, অন্য কেউ হলে এই লাভের ব্যবসা ছেড়ে অজানা অনিশ্চিতের ডাকে এইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত কিনা। আমার ক্ষেত্রে সব ব্যাপারটাই অন্যরকম। আমি তো আর সুখে থাকব বলে জন্মাই নি। দুর্ভাগ্য আমার নিত্য সহচর। দেখা যাক, কোথায় কতদূরে কোন্ অনিশ্চিতের পানে ভাগ্য টেনে নিয়ে যায় আমাকে।

এখানে যুক্তি তুচ্ছ, ভাবনাটাই আসল। অর্থাৎ আমার কল্পনা। এদিকে জাহাজও তৈরি। ষোলশ ঊনষাট সালের ১লা সেপ্টেম্বর উঠে বসলাম জাহাজে। দিনটা ভালো নয়। অন্তত আমার কাছে। এই দিনই প্রথম সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে ছিলাম আমি হু থেকে। বাবা মায়ের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে। ঠিক আট বছর আগে সেটা। ফের চলেছি নতুন এক জাহাজে। তারিখ ছাড়া আর সব কিছুই আলাদা। দেখা যাক, এর শেষ কোথায় হয়।

একশ কুড়ি টনের মালবাহী জাহাজ। সঙ্গে ছটা বন্দুক, চোদ্দ জন নাবিক, সারেং, আমি আর সারেঙের ছোটো ছেলে। মালপত্র বিশেষ নেই। শুধু কিছু খেলনা সামগ্রী-পুঁতি, মালা, কাঁচের চুমকি, শামুকের খোলা, দূরবীন, ছুরি, কাঁচি, কুড়ুল–যা আর কি চলে ওখানে, নিগ্রোরা কেনে, বিনিময়ে অনেক দামী দামী জিনিস হাতে তুলে দেয়।

পাল তুলে প্রথম দিনই রওনা হলাম। এটা বিধি নয়। দু একদিন অপেক্ষা করে তারপর ভেসে পড়ার প্রথা। সে প্রথা এখানে অগ্রাহ্য হল। চলল জাহাজ উত্তরমুখে। সামনে আফ্রিকা উপকুলের ম্যাপ খোলা। আমরা চলেছি দশ থেকে বার ডিগ্রী দ্রাঘিমা বরাবর। এভাবেই যায় সবাই। আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার। গরমটা একটু বেশি। অগস্তিনো অন্তরীপ অব্দি বলতে গেলে কূলের কাছ ঘেঁষেই গেলাম। তারপর থেকে দূরত্ব বাড়তে লাগল। এবার যাব উত্তর পূর্ব দিকে। অর্থাৎ পথে পড়বে নোরোনহার দ্বীপের সারি। পড়লও তাই। দ্বীপ রইল পূর্বদিকে, বার দিন লাগল মোট সেই এলাকা পার হতে সোয়া সাত ডিগ্রী কোনাকুনি উত্তর মুখে এগোতে লাগলাম। তখন উঠল তুফান। টর্নেডো যাকে বলে। সে যা বাতাস, হাওয়ার যা চোট। বারটা দিন আমাদের আর নিজস্ব কিছু করণীয় নেই, শুধু হাওয়ার বুকে তুফানের ঝাঁপটে অনির্দেশ ভেসে যাওয়া। কোথায় চলেছি কে জানে। পাগলা হাতির দাপট যে রকম। প্রতিমুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি মৃত্যু হয় আমাদের, জাহাজ বুঝি ডুবে যায়। সমুদ্র গ্রাস করে নেবে সব কিছু। অসহায় বলতে ঠিক যা বোঝায় আমরা তাই। আমাদের জীবন মরণ এখন ঝোড়ো বাতাসের হাতে।

কিছু অঘটনও ঘটে গেল এই বার দিনে। একজন নাবিক মারা গেল সমুদ্রপীড়ায়। সারেঙের ছেলে আর অন্য এক নাবিককে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঢেউ। বার দিনের দিন ঝড় শান্ত হতে দেখি, আমরা এগার ডিগ্রী উত্তর দ্রাঘিমা বরাবর কোনো স্থানে অবস্থান করছি। অগস্তিনো অন্তরীপ থেকে সেটা প্রায় বাইশ ডিগ্রী অক্ষাংশের তফাৎ। বরং একদিক থেকে মঙ্গলই বলতে হবে। কেননা এরই কাছাকাছি আমাদের গন্তব্যস্থল। ব্রাজিলের উত্তরাংশ সেটা। কিছু দূরে আমাজন নদী। গিনির উপকূল ভাগ। ওরোনক নদী আমাদের সামনে। এরা বলে মহানদী। সারেং বললেন, বলুন এখন কী করব। কোনদিকে যাব এবার? বেশি পথ যে পাড়ি দেওয়া সম্ভব না সেটা আমি জানি। কেননা জাহাজ ফুটো। ভাঙচুর হয়েছে বিস্তর। এ অবস্থায় কুলের ধার ঘেঁষে এগোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এটা সারেঙেরই প্রস্তাব। আমি বিরোধিতা করলাম। সামনে তখন আমেরিকার উপকূল ভাগের মানচিত্র পাতা। বললাম, এগিয়ে কোন দিকে যাব আমরা? এ অঞ্চলে কি জনবসতি আছে? ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ অব্দি যেতে হবে তাহলে আমাদের। মানুষের মুখ প্রথম সেখানেই নজরে পড়বে। বরং বারবাডোজ এখান থেকে কাছে, সে দিকে যাওয়াই মঙ্গল। মেক্সিকো উপসাগর এলাকায় পড়লে মস্ত অসুবিধে। জলের ভারি তোড়। জবরদস্তি ঢুকিয়ে নেবে ভিতরে। সে অবস্থায় আমরা অসুবিধেয় পড়ব।

মোটমাট যেখানেই যেতে চাই, অন্তত পনের দিনের পথ। এই পনেরটা দিন কারো সহায়তা ছাড়া আমরা চলতে পারব না। দুজন নাবিক মারা গেছে। সেই দুজনের ঘাটতি পূরণ অবিলম্বে প্রয়োজন। তদুপরি জাহাজ সারাই করারও দরকার আছে।

সেই প্রস্তাবই গ্রাহ্য হল। উত্তর পশ্চিম দিকে চলল আমাদের জাহাজ। পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে। ইংল্যান্ড দ্বীপ মালার দিকে এখন আমাদের মুখ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর যে কোনো একটা দ্বীপে পৌঁছলে আমরা সংকট থেকে ত্রাণ পাব। কিন্তু সমুদ্রে কি আর মানুষের বিশ্বাস কাজ করে। সবই তো অজানা অনির্দেশের খেলা। কখন ওঠে তুফান কখন ওঠে ঝড় কেউ বলতে পারে না আগে। হল তাই। আমরা তখন সোয়া বার ডিগ্রী দ্রাঘিমা। বরাবর। হঠাৎ শুরু হল তুফান। ফের সেই দুর্দশা। নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবই ঝড়ের উপর নির্ভর। জনবসতি এলাকা পার হয়ে চলেছি তীব্র গতিতে। ঘুরপাক খাচ্ছে জাহাজ। কে জানে হয়ত ভিডব গিয়ে কোনো এক অজানা দ্বীপে, সেখানে বর্বর নরখাদক মানুষ। জ্যান্ত কেটে কেটে খাবে আমাদের মাংস। আর কি নিস্তার আছে।

তখন কে যেন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–ভাঙা, ডাঙা! ঐ দেখ! দেখি বালিয়াড়ি। তাতে আটকে আছে আমাদের জাহাজ। কাত হয়ে আছে। তুফান তো তখনো চলছে সমনে। আর ঢেউ। সেই অবস্থাতেই মস্ত এক ঢেউ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাহাজের উপর। যেন গ্রাস করে নেবে সব কিছু। আর্তনাদ করে ভয়ে চোখ বুজলাম।

আমি ভাষায় সে অবস্থার কথা বোঝাতে পারব না। সেই অবস্থায় যে পড়ে নি, তাকে বোঝাবার চেষ্টা করাও বাতুলতা। জানিনা জীবন রক্ষা পাবে কী মারা যাব। জানি না এ কোন দ্বীপ, এখানে মানুষ থাকে কি থাকে না সেটাও অজ্ঞাত। জাহাজ যে চুরমার হয়ে যাবে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু করবারও কিছু নেই। স্থির ভাবে বসে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর নেই।

বাতাসের তোড় একটু কম। কিন্তু সংকট তাতে এতটুকু কমে নি। বালিতে মুখ গুজড়ে পড়ে আছে জাহাজ। কী যে ভয়ানক সেই অবস্থা তা বর্ণনার অতীত। পারব কি এই সংকট থেকে ত্রাণ পেতে? জানি না। সহায় সম্বল বলতে আমাদের আর কোনো কিছুই নেই। ছিল জাহাজের সাথে বাঁধা একটা নৌকা, সে যে কখন কোথায় জলের তোড়ে ভেসে গেছে কি খান খান হয়ে ভেঙে গেছে বা তলিয়ে গেছে জলের নিচে, আমরা কিছুই জানি না। আরেকটা আছে জাহাজের ডেকে মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু সেটা পাড়ব কি ভাবে, নামাবই বা কী করে? সবই যে আমাদের আয়ত্তের বাইরে। এই ঢেউয়ের সঙ্গে আমরা কেমন করে যুঝব? জাহাজ তো যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে। এতক্ষণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কিনা তাই বা কে সঠিক করে বলতে পারে?

শেষ চেষ্টা করল সারেং। মাস্তুলে উঠে দড়ি খুলে দিল নৌকোর। বাকিরা হাতে হাতে নামিয়ে নিল। একজন টেনে ধরে রইল এক দিক, বাকিরা উঠল নৌকায়। তারপর সেও উঠে গেল এক লাফে। মোট এগার জন আমরা। অমনি জলের তোড়ে সাঁই সাঁই করে ছুটতে লেগেছে নৌকো। সে কী ঢেউ! উঁচু একেকটা এই এত্তোখানি। আছড়ে পড়ছে মুহুর্মুহু পাড়ে। আমরা সেই আশস্ত উত্তাল সমুদ্রের উপর দিয়ে মোচার খোলার মতো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চললাম।

কিন্তু কতক্ষণ পারব এইভাবে চলতে সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে কোনো মুহূর্তে ডুবে যেতে পারে নৌকো। যে কোনো মুহূর্তে আমরা সলিল সমাধি প্রাপ্ত হতে পারি। নিস্তার যে নেই এটা অনিবার্য। কেননা এই প্রচণ্ড ঢেউয়ের মাথায় সামান্য নৌকোর কোনো মূল্যই নেই। পাল গোটাবার প্রশ্ন ওঠে না। কেননা নৌকোয় পাল নেই। আছে দাঁড়। প্রাণপণে বাইতে শুরু করেছি তাই। লক্ষ্য আমাদের কুল। কিন্তু কূলের কাছে পৌঁছলেই যে নিশ্চিন্ত সেটাই বা বলি কেমন করে। পৌঁছবা মাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে ঢেউ, আছড়ে পড়বে আমাদের নৌকোর উপর, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে চোখের নিমিষে। তখন উপায়! মৃত্যুকে তখন কি আর এড়ান যাবে? না। এবং এমতাবস্থায় ঈশ্বরকে আকুলভাবে ডাকা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। মনপ্রাণ উৎসর্গ করে দিলাম তাঁরই পদতলে। তারপর মরীয়ার মতো তিল তিল করে কুলের দিকে অথবা মৃত্যুর দিকে এগোতে লাগলাম।

কুল যে কেমন তা-ও কি ছাই জানি? অর্থাৎ সেটা পাহাড়, না পাথর, না মাটি, না বালি–সে তো এখান থেকে বোঝার উপায় নেই। একটাই আশা এখন–যদি এইভাবে ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে কোনো উপসাগর কি নদীর মুখে গিয়ে হাজির হতে পারি। সে ক্ষেত্রে ঢেউ আমাদের যতটা খুশি সরিয়ে নিক। বাতাস যদি দিকভুল করে সেটা ক্ষতি নয়, বরং আমাদের পক্ষে মঙ্গল। একমাত্র পরিত্রাণের উপায় সেটাই। নদীর মুখে পড়লে যেন তেন প্রকারেন ঢুকে পড়ব নদীতে, এগিয়ে যাব তরতর করে। তরঙ্গ আর তুফানের ভয় থাকবে না। ডাঙাও পাব দুধারে। কিন্তু কোথায় সেই নদীর মুখ; এই যে চারপাশে তাকাই, দেখবার চেষ্টা করি নজরে পড়ে না। শুধু ডাঙাটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঢেউয়ের মাথায় যখন নৌকো আচমকা লাফ দিয়ে ওঠে উপরে। সেটাও ভয় জাগায়। প্রমাদ গুনি। এই ডাঙার উপর ঢেউয়ের ঝাঁপটে আছড়ে পড়লে আমাদের আর নিস্তার নেই।

প্রায় দেড় ক্রোশ পথ এইভাবে টালমাটাল খেতে খেতে এগোলাম। সে বড় ভয়ঙ্কর। প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে ঢেউয়ের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে আমাদের লড়াই। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। এত মারমুখী ঢেউ। যা ধাক্কা তার, যা তোড়। গেল নৌকো চোখের নিমিষে উল্টে। পড়লাম জলে। কে যে কোথায় ছিটকে গেলাম জানি না। সে এমনই আকস্মিক শেষ মুহূর্তে একটু যে ঈশ্বরের নাম করব সে সুযোগটুকুও পেলাম না। মুহূর্তে আরেকটা ঢেউ এসে নিল আমাদের গ্রাস করে।

পাঠক ক্ষমা করবেন। ভাষায় সে অবস্থা আমি ব্যাখ্যা করতে অপারগ। জলের নিচে ডুবে আছি। চিন্তা গেছে তোলপাড় হয়ে। সাঁতারু হিসেবে আমি খুব একটা মন্দ নই। কিন্তু কী লাভ সেই মুহূর্তে সাঁতার জেনে। মৃত্যুর প্রহর গুনছি জলের নিচে। হঠাৎ আরেকটা ঢেউয়ের দোলায় ভেসে উঠলাম উপরে। দেখি পড়ে আছি ডাঙায়। শুকনো খটখটে সে জায়গা। কিন্তু শরীরে তাগদ নেই মোটে। বেঁচে যে আছি এটাই বড় কথা। জল খেয়েছি অনেকখানি। বড় দুর্বল আর ক্লান্তি। তবু বাঁচবার ঐ যে এক অদম্য তাগিদ। উঠলাম ভূমিশয্যা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। মনে ভয়। যদি আরেকটা ঢেউ এসে আমাকে সমুদ্রে ফেরৎ নিয়ে যায়।

গেল তাই। সে যা তোড়। পাহাড়ের মতো উঁচু সেই ঢেউ। ঝপাং করে এসে লাফিয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে। আমি দম বন্ধ করে রইলাম। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। বুক যে ফেটে যায়। তখন জল ঠেলে হাঁকু পাকু করে ভেসে ওঠার চেষ্টা করলাম। বহুকষ্টে মাথাটা তুলতে পারলাম একটুখানি। মাত্র দু সেকেন্ড তার মেয়াদ। কিন্তু সেই মুহূর্তে সেটাই অনেক। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ফের বন্ধ করলাম দম। ততক্ষণে ফেরত এসে গেছি ডাঙায়। যাক, কিছুক্ষণের জন্যে তো শান্তি!

কিছুক্ষণ এই জন্যে বললাম কেননা এই স্বল্প সময়ে আমি যে পালাব ঢেউয়ের কবল থেকে ত্রাণ পেতে নিরাপদ কোনো দূরত্বে, সে শক্তি আমার নেই। বড় দুর্বল শরীর। তার উপর মুহুর্মুহু ঢেউ। পারি কি আমি তার নাগাল থেকে সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে? এই তো আরেকটা। আবার সেই তোড়। জলে ডুবে ফের আমার দমবন্ধ। ফের বহুকষ্টে মাথা তোলা। প্রাণপণ চলেছে লড়াই। তখন দেখি পায়ের নিচে মাটি। ফিরিয়ে দিয়ে গেছে ফের কূলে। যাক, এ যাত্রাও বাঁচোয়া।

এইভাবে আরো একবার। কিন্তু না, আর নয়। এবার যে কোনো উপায়ে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে। আছড়ে ফেলেছে এবার বালির উপর। একটু বেসামলে পড়লে জানি না আমি আর এ কাহিনী লিখতে পারতাম কিনা। জল সরে গেলে দেখি একটা পাথর। বুকে ভীষণ চোট। ডান দিকটা যেন পুরোপুরি অসাড়। ঝিমঝিম করছে মাথা। এ অবস্থায় ফের যদি আসে ঢেউ, আমার আর রক্ষা নেই। তখন প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম পাথর। শরীরে যতটুকু শক্তি আছে তাই দিয়ে। একটু পরেই ঢেউ এল। কিন্তু অবাক কাণ্ড দেখি এবার আর আগের মতো তোড় নেই। একটু যেন শান্ত। তবু মরীয়ার মতো ঢেউ সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ি কি মরি করে অনেকখানি ছুটলাম। ঢেউ আসছে আবার। ফের শুয়ে চেপে ধরলাম আরেকটা পাথর। আমার পা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল গজরাতে গজরাতে। তখন উঠে ফের ছুটলাম একটুখানি। দেখি ডাঙা। আহ শান্তি । ঘাসের উপর বসে পড়লাম। ঘুম পাচ্ছে খুব। এখন আর ঢেউ আমার কিছু করতে পারবে না। আমি নিরাপদ দূরত্বে চলে আসতে পেরেছি।

এ এক অদ্ভুত রহস্য বলা যায়। একটু আগে জীবন আমার বিপন্ন। বাঁচব কি বাঁচব না এটাই তখন একমাত্র প্রশ্ন। আর একটু পরে, এখন আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেউ পারবে না আমার এতটুকু ক্ষতি কি অমঙ্গল করতে। সমুদ্র এখন যতই গজাক, যত তোলপাড় করুক, আমার আর ভয় নেই। আমি কোনো কিছুতেই আর ডরাই না।

হাঁটলাম খানিকক্ষণ। কখনো দুহাত তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। কখনো বা বালকের মতো কাঁদতে কাঁদতে। সে নানান ভঙ্গি আমার। শরীরের নানান বিভঙ্গ। হু হু করছে মন। আর কেউ বেঁচে নেই আমার সহযাত্রীদের মধ্যে। ডুবে গেছে সকলে। শুধু একা আমি জীবিত। জাহাজটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

ঐ তো জাহাজ। মুখ গুজড়ে পড়ে আছে বালির উপর, পিছনে বিশাল সমুদ্রের দৃশ্যসজ্জা। তারই পটভূমিকায় লাগছে যেন নিশ্চল নির্বাক কোনো ছবির মতো। আর অবাক কাণ্ড। কীভাবে যে পারলাম আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে । কিছুতেই হিসেবটা মেলাতে পারছি না।

ভেবে আর কিছু লাভ নেই। আমি যে সম্পূর্ণ একা এটা ঘটনা। বন্ধু নেই, সাথী নেই, পরিচিত কেউ নেই … … … কিন্তু এই যে এখানে এসে ভিড়লাম, এটাই বা কেমন জায়গা! ঘুরে ঘুরে একবার তো দেখা দরকার। তখন ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে নজর ফেললাম। সবশেষে নজর পড়ল নিজের উপর। একি, আমি তো সম্পূর্ণ ভেজা। পোশাক ছেড়ে ফেলার কথা প্রথমেই মনে হল। কিন্তু ছাড়ব যে, পরার মতো আছেটা কী? তবে থাক, ছাড়ার দরকার নেই। কিছু খাই বরং। ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু কী খাব? খাবার এখানে কোথায়? তেষ্টা মেটাব তেমন একটু জলেরই বা নাগাল কোথায় পাই? সে ভারি দুঃসহ অবস্থা। একটু একটু করে নিঃসঙ্গতা আমাকে গ্রাস করছে। আমি যে সম্পূর্ণ একা এটা টের পাচ্ছি। কিন্তু উপায়? মানুষ যখন নেই সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আছে হিংস্র জানোয়ার। একটু পরে অতর্কিতে লাফ দিয়ে পড়বে আমর ঘাড়ে। আমাকে খাবে। আত্মরক্ষা করার মতো একটা কোনো অস্ত্র কি সঙ্গে আছে আমার? হঠাৎ হুঁশ হতে পকেটে হাত দিয়ে দেখি–আছে তো ছুরিটা। আর তামাকের কৌটা। এগুলো পকেট থেকে হাজার ঢেউয়ের দাপটেও পড়ে নি। তবু শান্তি। যাক, অন্তত দুরি দিয়ে আক্রমণের প্রথম চোটটা তো ঠেকাতে পারব! কিন্তু ক্ষিধে যে এখন ভীষণ। ক্ষিধে এড়াবার জন্যে খানিকটা ছুটে এলাম। সভ্য সমাজে এমন করলে লোকে বলত পাগল। এখানে তো আর কেউ দেখার বা বলার নেই। এদিকে একটু একটু করে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে নিভে যাবে দিনের আলো। সূর্য যাবে পাট। আর দেরি করা ঠিক না। অন্তত আলো থাকতে থাকতে যে কোনো একটা গাছে উঠে রাতের জন্যে আস্তানা গাড়া ভালো। অন্তত খাই না খাই, ঘুমোই কি না ঘুমোইহিংস্র জন্তুর আক্রমণের হাত থেকে প্রাণটা তো বাঁচবে।

খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেলাম একটা গাছ। সিধে উঠে গেছে কাণ্ড। গায়ে অল্প স্বল্প কাটার আবরণ। সেটা মন্দ নয়। আমার পক্ষে বরং মল। উঠে পড়লাম উপরে। পাওয়া গেল মনের মতো একখানা ডাল। বসলাম আরাম করে পা ঝুলিয়ে। তারপর জামা খুলে জামা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলাম নিজেকে গাছের সাথে। বলতে ভুলে গেছি, এরই মধ্যে পানীয়ের সন্ধান পেয়েছি এক জায়গায়, খেয়ে এসেছি পেট ভরে অনেকখানি। কৌটা থেকে তামাক ছিঁড়ে দিয়েছি খানিকটা মুখে! তামাকের স্বাদে ক্ষিধে দূর হয়। এটা আমি জানি। এবার সব দিক থেকে শান্তি। আর পরিশ্রান্ত তো ভীষণ। তাই আরাম করে বসতে না বসতে ভীষণ ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল।

এক ঘুমে রাত কাবার চোখ মেলে দেখি ফুটফুটে দিন। আকাশ ফর্সা। ঝড় নেই। সমুদ্র যেন শান্ত শিষ্ট ভালোমানুষটি। কোথায় সেই ঢেউ! কোথায় বা সেই গর্জন। যেন দর্পণের মতো স্থির, নিথর। আরেকটা অদ্ভুত অবাক ব্যাপারকাল যে বালির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়েছিল আমাদের জাহাজটা, দেখি ঝড়ের তাড়নায় সেটা এখন উঠে খানিকটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সরেও এসেছে কূলের দিকে অনেকটা। এটা ঢেউয়ের কারসাজি–আমি চোখ বুজে বলতে পারি। মোটামুটি সেই পাহাড়টা এখন জাহাজের খুবই কাছে। তবে ডাঙা থেকে মাইলখানেক মতো দূর। ভারি ইচ্ছে করছে একবার জাহাজে উঠে নিজস্ব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতে।

গাছ থেকে নামলাম। হঠাৎ ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখি–ওমা, ঐ তো আমাদের সেই নৌকো। তা প্রায় এখান থেকে মাইল দুয়েকের মতো দূর। কুলের উপর তুলে দিয়ে গেছে ঢেউ। জল গেছে নেমে। তাই দাঁড়িয়ে আছে বালির উপর আড়াআড়ি ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে সে দিকেই এগোলাম। কাছাকাছি হতে দেখি, উপায় নেই নৌকো অব্দি যাবার। প্রায় আধ মাইল চওড়া একটা খাড়ি মতো; সেখানে টইটম্বুর জল, তার ওধার চড়া। সেখানেই আটকে আছে নৌকো। দূর থেকে জল আমার চোখে মালুম হয় নি। সে হোক গে যাক, নয় নাই (পলাম নৌকো, কিন্তু জাহাজ তো বলতে গেলে হাতের গোড়ায়। দেখি না। গিয়ে একবার। যদি পারি একবার কোনোক্রমে জাহাজে উঠতে, তবে আমার বেঁচে থাকার মতো বিস্তর রসদ মিলবে।

বেলা ততক্ষণে বেড়েছে। সমুদ্র শান্ত। চলেছি গুটি গুটি জাহাজের দিকে। মনটা ভারি খারাপ লাগছে। কী যে মতি হল তখন দুদ্দাড় করে নেমে পড়লাম সবাই জাহাজ থেকে, উঠলাম নৌকোয়।… যদি না নেমে জাহাজেই থাকতাম, তবে হয়ত এই দশা আজ হত না। নির্ঘাৎ না। বেঁচে বর্তেই থাকতাম সকলে। আমারও জীবন রক্ষা নিয়ে অত দুর্বিপাকে পড়তে হত না। সঙ্গী সাথীদের কথা ভেবে চোখে জল এল। কিন্তু কেঁদে এখন আর কোনো লাভ নেই। যা শেষ হয়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনার চিন্তা তো বৃথা। এখন নিজের জীবন রক্ষার সংগ্রাম। বাঁচতে হবে আমাকে। তার জন্যে চাই প্রয়োজনীয় রসদ। এবং সেটা যেহেতু জাহাজে আছে, আমাকে তাই জাহাজে উঠতে হবে। প্যান্ট হাঁটু অব্দি গুটিয়ে ফেললাম। কেননা সামনে বেশ খানিকটা জল। পায়ের নিচে সদ্য জমা পলি। পিছলে যাই প্রতিমুহূর্তে। বহু কষ্টে এক সময় জাহাজের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু উঠব কী করে? পাটাতন যে অনেক উঁচুতে। মসৃণ গা। অবলম্বন বলতে কিছুই নেই। কী করা যায়! চারপাশে সঁতরে বেড়ালাম অনেকক্ষণ। হঠাৎ দেখি ছোট্ট একটা কাছি। উপর থেকে ঝুলে আছে, তাও বেশ খানিকটা উঁচুতে। বিস্তর চেষ্টা করে ধরলাম চেপে তার প্রান্তদেশ। তখন বেয়ে ওঠা আর কঠিন নয়। উঠলাম। দেখি জল জমে আছে অনেকখানি। সেটা এক দিক থেকে এই মুহূর্তে মঙ্গল কেননা এত ভারি জাহাজ কাত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা এখন কম। পাটাতনের উপরিভাগ খটখটে শুকনো। অর্থাৎ কেবিনও শুকনো। সেখানে জল ঢুকতে পারে নি। এখন দেখা দরকার মালপত্র সব শুকনো এবং আস্ত আছে কিনা।

আছে। যাক শান্তি! প্রথমেই হানা দিলাম রুটি-ঘরে। যতগুলো পারলাম পকেটে পুরলাম, দু হাতে দুটো নিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে শুরু করলাম খাওয়ার কিছু বিস্কুটও নিলাম পকেটে। পানীয়ের কয়েকটা বোতল বের করে এক জায়গায় জড় করে রাখলাম। একটা বোতল খুলে খেলামও বেশ অনেকখানি। যাক আপাতত পিপাসার কবল থেকে নিশ্চিন্ত। এবার দরকারী অন্যান্য জিনিসের সন্ধান করতে হবে।

সবচেয়ে প্রথমে দরকার একখানা নৌকো। ভেলা হলেও অসুবিধে নেই। মোটামুটি মালপত্র জাহাজ থেকে নিয়ে যেতে তো হবে ডাঙায়। দেখি ভাড়ার ঘরে বিস্তর দড়ি আছে। আর কাছি, আর পাটাতনে অতিরিক্ত প্রচুর চেরা কাঠ। বাড়তি মাস্তুলও আছে খান দুই। সব জড় করে অমনি কাজে লেগে গেলাম। বাধাছাদা করে ভেলা অবশেষে তৈরি হল। জলে নামাতে হবে এবার। তখন দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিলাম জলে । দড়ির প্রদেশ জাহাজের মাস্তুলের সাথে শক্ত করে বাঁধা রইল। আড়াআড়ি ভাবে একখানা কাঠ নামিয়ে দিলাম ভেলার উপর। এটা সিঁড়ি। মালপত্র নিয়ে জাহাজ থেকে নামবার কাজে দরকার হবে। একটা সরু মাস্তুল দিয়ে করলাম লগি। এটা ভেলা বেয়ে ডাঙায় যাবার সময় আমার কাজে লাগবে।

মোটের উপর মাল বয়ে নিয়ে যাবার উপকরণ আমার মজুত। এবার দেখা দরকার কী কী জিনিস এতে করে আমি নিয়ে যাব এবং তার ওজন কী রকম। প্রথমে বাকি চেরা কাঠগুলো তুললাম। তাতে পাটাতন আরেকটু বড় হল। এবার তুললাম তিনটে কাঠের খালি পেটি। এগুলো থেকে মাল বের করে আগেই আমি খালি করে রেখেছি। একটাতে ভরলাম রুটি, চাল, পানীয়, শুকনো মাংস, বিস্কুট, কটা মুরগি ছিল সঙ্গে সেগুলো জলের ঝাঁপটায় মারা গেছে–তাও। কিছু যব আর গম নেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইঁদুর বস্তা ফুটো করায় ফুটো দিয়ে পড়ে গেছে। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নেওয়া হল না। কটা বোতল নিলাম পানীয়ের আর জলের কয়েকটা। ব্যস পেটি বোঝাই। তখন পেরেক মেরে কাঠের ঢাকনা আটকে মুখ বন্ধ করে দিলাম। দেখি জলের তোড় তখন একটু বেড়েছে। ঢেউ উঠছে মৃদু মন্দ। কুলে খুলে ফেলে এসেছিলাম জামা, কোট আর গেঞ্জি। সব চোখের সামনে জলের টানে গেল ভেসে। প্যান্ট আর মোজা পরনে আছে। সেটাই যা সান্ত্বনা। সে যাক গে, মন খারাপ করে তো কোনো লাভ নেই। পাব না আর ঐ জামা বা কোট। ফের মন দিলাম কাজে। দ্বিতীয় পেটিতে ভরলাম কাজ করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। জাহাজে ছুতোরের একটা বাক্স ছিল। বলতে গেলে বাক্স খালি করে সব মালই নিলাম। এগুলো যে বড় দরকারী। নির্জন নিরালায় আমার আত্মরক্ষার একমাত্র অবলম্বন। এখন যদি কেউ বলে আমাকে–এই নাও এক বস্তা সোনা, বিনিময়ে এই যন্ত্রপাতির বাক্স অমাকে দাও, দেব না। হাজার লোভ দেখালেও না।

বন্দুক আর গোলাবারুদ কিছু দরকার। কেবিনের তাকে দেখি দুটো পিস্তল আর দুটো বন্দুক। বারুদ রয়েছে অনেকখানি একটা পাত্রে। আর এক বস্তা মতোন টোটা। দুটো মরচে ধরা তলোয়ারও দেখতে পেলাম। সব নিলাম। বারুদের পাত্র আরো দুটো নজরে পড়ল। তুর মধ্যে একটা ভালো, আরেকটায় জল ঢুকে ভিজে গেছে। ভালোটা নিলাম। মোটমাট নিশ্চিন্ত এখন। এবার ভালোয় ভালোয় ভেলা ভাসিয়ে ডাঙায় উঠতে হবে।

তবে তেমন কিছু ঝকমারি হবে বলে মনে হয় না। সমুদ্র এখন শান্ত। আমার পক্ষে স্বপ্ন সেটা। জল কিছুটা বেড়েছে ঠিক, তবে এমন নয় যে ভয় পাওয়ার মতো বা ঘাবড়ে যাবার মতো। বাতাস আছে। তার গতি এখন কুলের দিকে। মোটমাট অনুকূল অবস্থাই বলা যায়। ভাঙা দাঁড় পেলাম একটা জাহাজের ডেকে। নিলাম। ভেলা ঠেলে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দড়ি বেয়ে নামলাম এবার ভেলায়। দড়ি খুলে দিলাম। মাইলখানেক অব্দি বলতে গেলে নিশ্চিন্ত। কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। যেমনটি চাই, তেমনই চলে ভেলা। সে একেবারে তরতর স্বচ্ছন্দ গতি। তবে মুশকিল হল আরো খানিকটা এগিয়ে দেখি ঢাঙার দিকে কিছুতেই আর নিয়ে যেতে পারি না ভেলা। সামনে একটা নদীর মুখ। সমুদ্রের সল প্রবল বেগে ঢুকছে সেই নদীতে। তারই টানে আমার সব রকম চেষ্টা অগ্রাহ্য করে ভলা সেই দিকেই এগিয়ে চলল। আমার আয়ত্তের সম্পূর্ণ বাইরে। ঘূর্ণি উঠছে নদীর মুখে। ফুর্ণির টানে পড়ে আমার তো বলতে গেলে নাজেহাল অবস্থা। ভেলা এই ওন্টায় কি সেই মুল্টায়। একদিকে কাত হবার সঙ্গে সঙ্গে পেটিগুলো সড়াৎ করে সরে সেই দিকে গিয়ে সমা হল। টাল সামলাতে সামলাতে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম গিয়ে পেটির সামনে, দুহাত দিয়ে পাণপণে ঠেলে রাখলাম। তাইতে রক্ষে। নইলে ফের কপালে ভরাডুবি।

আরো খানিকক্ষণ পর। দেখি পাক খেতে খেতে নৌকো ঢুকে পড়েছে নদীর ভিতর। লেছে স্রোতের টানে তরতর করে এগিয়ে। ঘাম দিয়ে এতক্ষণে যেন জ্বর ছাড়ল। চারপাশে তাকালাম। সেই ডাঙা। দুধারে ঘন জঙ্গল। কিন্তু থামা তো দরকার এবার। কতদূর আর যাব? সমুদ্রের নাগাল ছেড়ে বেশি ভিতরে ঢোকার আমার ইচ্ছে নেই। তাতে মুশকিল। কেননা কাছাকাছি থাকলে নজর রাখতে পারব দূরে, কোনো জাহাজ-টাহাজ যায় কিনা দেখতে পাব।

আরো খানিকটা এগিয়ে একটু ফাঁকা মতো জায়গা। মাঠই বলা যায়। জঙ্গল দূরে দূরে। লগি কাদায় গেঁথে ভেলা থামালাম। ডাঙার একেবারে গায়ে। কিন্তু ওঠার উপায় নেই। পাড় এখানে বড় উঁচু। অতএব প্রতীক্ষা করতে হবে। জল সমুদ্র থেকে যত ভিতরে ঢুকবে তত উঁচু হবে ভেলা, পাড়ের সমান সমান হবে। তখনি নামার চেষ্টা করব।

হল তাই। আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর জল উছু হল প্রায় এক ফুট মতো। দেখি পাড়ের প্রায় সমান্তরাল। তখন লগি গাখলাম শক্ত করে মাটিতে। দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। পেটিগুলো ঠেলে নামিয়ে দিলাম ডাঙায়। নিশ্চিন্তু এবার। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, আমার একটি জিনিসও নষ্ট হয় নি।

কিন্তু নামলাম যে এখানে, থাকি কোথায়? মালপত্রই বা কোথায় রাখি। এটা এবার ঠিক করা দরকার। ঘুরে ফিরে দেখতে হবে চতুর্দিক। আসলে জায়গাটা কোনো মহাদেশের অংশ না দ্বীপ এটাই এতক্ষণে আমি বুঝতে পারি নি। এখানে মানুষ বাস করে কিনা সেটাও প্রশ্ন। জীবজন্তু যে আছে এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু কী জাতীয় জন্তু তারা? হিংস্র না কি সাধারণ? মাইলখানেক দূরে একটা পাহাড় নজরে পড়ছে। খাড়া উঁচু চূড়া পাশে আরো কয়েকটা টিলা পাহাড়। আমার ধারণা পাহাড়ে উঠলে মোটামুটি চারদিক আমি দেখতে পাব। কিন্তু যাবার আগে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে। পথে কী বিপদ আপদ হয় কিছু বলা যায় না। তাই পিস্তল সাথে নিলাম। আর একটা ছররা বন্দুক। সঙ্গে বেশ খানিকটা বারুদ আর টোটা। তারপর রওনা দিলাম পাহাড়ের দিকে।

ভারি কষ্ট হল উঠতে। খাড়া উঁচু পাহাড়। কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। চারদিকে তাকালাম। শুধু জল আর জল। অর্থাৎ দ্বীপ এটা। দূরে একসার পাহাড়। আরো দূরে গোটা দুই ছোটো দ্বীপ। ব্যস, আর কিছু দেখার মতো নেই।

আরো একটা জিনিস পরিষ্কার হল। এখানে যে মানুষ বাস করে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শুধু ঘন সবুজ বনানী। আর অসংখ্য বনমোরগ। হিংস্র জন্তু যে আছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে সেটা নিতান্তই অনুমান। যাতায়তের পথে কোনো জন্তু নজরে পড়ল না বা গর্জনও শুনতে পেলাম না। ফেরার পথে একটা মস্ত পাখি মারলাম। বসে ছিল গাছে নিশ্চিন্তে। বন্দুক তাক করে ঘোড়া টিপলাম। সেই প্রথম বন্দুক গর্জন দ্বীপে। তার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী একলা আমি। আর বন্দুক গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সারা জঙ্গল জুড়ে সে যা বনমোরগের দাপাদাপি আর ডাক। তবে ঐ টুকুই। ঘন জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে বাইরে খুব একটা কেউ বেরল না। শুধু দু চারটি। তাও সুট করে ভয়ে ঢুকে পড়ল গাছগাছালির আড়ালে। ভুলে নিলাম মরা পাখিটাকে। যতদূর ধারণা, বাজপাখি জাতীয় একটা কিছু। ঠোঁটের গড়ন আর পালকের রঙ দেখে আমার অন্তত সে রকমই মনে হল। কিন্তু নখ নেই। এটা ভারি অবাক ব্যাপার। আর মাংসের স্বাদও ভারি বিশ্রী। তীব্র আঁঝাল একটা গন্ধ। বলতে গেলে অখাদ্য। শেষ অব্দি রান্না করে খাবার ইচ্ছে আর হল না।

ফিরে এলাম জায়গায়। প্রধান সমস্যা এখন মালপত্র ঠিক ঠিক গুছিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখা। কিন্তু কোথায় সেই নিরাপদ অঞ্চল? তাছাড়া রাত্রে আমিই বা থাকি কোথায়? এখানে শুয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা জীবজন্তুর ভয়। ঘুমের মধ্যে যদি এসে আমাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে।

অবশ্য পরে দেখেছি, আমার এই ভয় এবং অনুমান অমূলক। দ্বীপে হিংস্র জন্তু বলতে কিছুই নেই।

মালের পেটিগুলো চারপাশে সাজিয়ে মোটামুটি একটা ঘেরা মতো করলাম। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কুটির। ছাউনিটা অবশ্য বাদ। এটা রাতটুকু কাটাবার উপায় মাত্র। খাবার হিসেবে হাতের গোড়ায় পেলাম একটা বনমোরগ। তাকে গুলি করে মারলাম। একটা খরগোশ গুলির শব্দ শুনে বন থেকে বেরিয়ে এত। তাকে আর মারলাম না।

মোটামুটি মালপত্র যেটুকু এনেছি জাহাজ থেকে তা যথেষ্ট নয়, অরো অনেক কিছু আমাকে আনতে হবে। বিশেষ করে, পালটা দরকার, ছাউনি করার কাজে লাগবে। আরো হাজারো এটা ওটা জিনিস। জাহাজে পড়ে আছে অকেজো অবস্থায় লাভ কী? বরং নিয়ে আসি এখানে আমার কাজে লাগবে। তারজন্যে অনেকবার জাহাজে যাওয়া দরকার। এবং সেটা যত শীঘ্র সম্ভব হয় ততই মঙ্গল। কেননা এর পরে যে তুফান উঠবে, আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি, তাতে জাহাজের আর অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকবে না, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সুতরাং পড়ে রইল আর সব কাজ। এটাই প্রধান এবং জরুরি বিবেচনার পরদিনই ফের যাব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু যাব কী ভাবে? ভেলা নিয়ে? বরং থাক। যেভাবে গিয়েছিলাম প্রথমবার, সেই ভাবে পায়ে হেঁটেই যাব। ফিরে আসার সময় বরং কাঠ দিয়ে ফের একটা ভেলা বানিয়ে নেওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, এবার আর বেশি পোশাক রাখব না গায়ে। শুধু একটা সার্ট, আর প্যান্ট আর পায়ে রবীরের জুতো। এবং কোনোক্রমেই এর কোনোটা জলের ধারে বালির উপর খুলে রাখব না।

আগের বারের মতোই জল ভেঙে কখনো সঁতরিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠলাম। তৈরি হল আরেকটা ভেলা। তাতে একের পর এক মাল তুললাম। তবে এবার আর আগের মতো অতগুলো নয়। নিলাম পেরেক আর আংটার তিনটে থলি, ক্রু ড্রাইভার, ডজন দুই হাত কুড়ুল, একটা যাতা, সাত বাক্স টোটা, পাখি মারা আরেকটা বন্দুক, আরো খানিকটা বারুদ, আর সীসার মস্ত একা পাত। এত ভারী যে পাতটা তুলতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হল। টানতে টানতে জাহাজের কিনারে নিয়ে এসে ভেলায় তোলা–সে এক রীতিমতো গলদঘর্ম কাজ।

একটা বাক্সে শুধু পোশাক-আশাক। সব পুরুষদের। নিলাম ভেলায়। পাল ছিল বেশ কয়েকটা বাড়তি, সেগুলো তুলে নিলাম। ভাজ করা খাট নিলাম একটা, আর এক প্রস্থ তোষক বালিশ। আর নয়। আপাতত আজকের মতো এখানেই ইতি। তখন ধীরে ধীরে ভেলা বেয়ে নদী দিয়ে ডাঙায় এসে উঠলাম।

এসে দেখি মালপত্র যেমন যা ফেলে গেছি ঠিক সেই ভাবেই পড়ে আছে। কেউ হাত দেয় নি বা একটা টুকরো জিনিস অব্দি নষ্ট হয় নি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত কেউ না কেউ তছনছ করবে কি চুরি-চামারি করে নিয়ে যাবে। মোটমাট সেদিক থেকে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। শুধু দেখি বিড়ালের মতোই দেখতে অনেকটাশুনো একটা জীব বসে আছে আমার পেটিগুলোর কাছে ঘাপটি মেরে। আমার দিকে জুলজুল করে দেখতে লাগল। আমি বন্দুকটা ঠেলে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। প্ৰক্ষেপ মাত্র করল না। তখন একটা বিস্কুট দিলাম। দেখি কল খানিকক্ষণ, তারপর কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নিল। খেয়েই ফের দেখি প্রত্যাশীর মতো চেয়ে আছে। কিন্তু আর দেব কী করে? আমার যে বিস্কুট বা অন্যান্য খাবার জিনিসের সংগ্রহ নামমাত্র। তা থেকে কি আর এত দানখয়রাত চলতে পারে। তখন দেখি একটুকাল বসে থাকার পর নিতান্ত ব্যাজার মুখে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিল।

এবার মোটামুটি বিস্তর মালপত্র জমেছে। সেগুলোর নিরাপত্তা দরকার। আপাতত প্রয়োজন একটা তাবু খাটানো। তারই কাজে লেগে পড়লাম। খুঁটি এনেছি বেশ কয়েকটা জাহাজ থেকে। সেই সাথে ছোটো বড় নানান মাপের অনেক গুলো পাল। খানিকক্ষণ কাজ করার পর দেখি চমৎকার একটা তাঁবু তৈরি হয়েছে। তখন মালপত্র পেটি থেকে খালি করে তাঁবুর ভেতরে এনে তুললাম। তারপর খালি পেটি কটা আরো নানান এটা ওটা জিনিস দিয়ে ঘিরে দিলাম তাবুর চারপাশ। যাক এতক্ষণে বিজন বিউই দ্বীপে নিজ ঘর বলে তবু কিছু একটা তৈরি করা গেল। নিশ্চিন্ত লাগছে বেশ।

দরজাও বানিয়েছি তাঁবুর। চেরা কয়েকটা কাঠ দিয়ে আড়াল করে দিয়েছি ঢোকার মুখটা। তাতে ঠেকনা দেওয়া বোঝাই একটা পেটি। মোটমাট বাইরে থেকে ঠেলাঠেলি করে কেউ যদি ঢুকতে চায় তাকে ঝক্কি পোয়াতে হবে। সেই ফাঁকে আমিও সজাগ হবার সুযোগ পাব।

ভারি চমৎকার ঘুমোলাম সেদিন আমার নতুন ঘরে! দরজা আটকে বিছানা পেতে মাথার কাছে দু দুটো পিস্তল রেখে দে ঘুম। ক্লান্তিও তো কম নয়। সারাদিনের পরিশ্রমের একটা ধকল আছে বৈকি। এক ঘুমে রাত একেবারে কাবার।

পরদিন ভোর থেকেই নতুন আরেক প্রস্থ চিন্তা। মালপত্র যা এনেছি এ পর্যন্ত একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু এখনো যে অনেক কিছু আছে জাহাজে। ঢেউ এলে ঝড় উঠলে ভেসে যাবে জাহাজ, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে সব সঞ্চয় জমা হবে গিয়ে সমুদ্রের গর্ভে লাভ কী তাতে! বরং নিয়ে আসি না আমিই সব। একদিনে না পারি, ধীরে ধীরে, খেপে খেপে। আপাতত যথেষ্ট মনে হলেও কদিন লাগবে ফুরোতে। জানি না তো কতদিন থাকতে হবে এখানে। সে অবস্থায় যত যা আনব সেটুকুই লাভ তাই লাগবে আমার জীবন-যাপনের কাজে। তো কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। রোজই যাই একেকবার, নিয়ে আসি এটা ওটা টুকিটাকি মাল, বেশি হলে ভেলা বানাই, কম হলে নিয়ে আসি কুলের উপর ভাসয়ে ভাসিয়ে। এইভাবে দড়ি এল, মোটা সুতো এল, বেশ কয়েকখানা ত্রিপল আনলাম, সেই ভেজা বারুদের প্যাকেটটাও আনলাম,–মোটমাট প্রায় সবই। এর জন্যে দরকার হল মোট এগার বার যাতায়াত। শেষাবধি পড়ে ছিল মস্ত রুটির টিন, মদের বোতলের একটা পেটি, এক বাক্স চিনি আর এক পিপে ময়দা। এগুলো গোড়াতে আমি দেখতে পাই নি। পরে দেখি লুকানো রয়েছে একটা আলাদা জায়গায়। সব জড় করে তুললাম ভেলায়। তারপর নিরাপদে ডাঙায় নিয়ে এলাম।

পরের দিন ফের আরেক দফা যাত্রা। নেশা ধরে গেছে যে আমার। দস্যুর মতো কেবল লুঠপাট করে সব নিয়ে আসতে মন চায়। দেখি পড়ে আছে একধারে কটা খুঁটি, সেই সাথে কাছি অনেকখানি, সব মিলে তা-ও নেহাৎ কম নয়। ভালোই ওজন। ভেলায় তুললাম। আসছি বেশ জল কেটে কেটে, হঠাৎ তোড় এল। ওলট পালট ঢেউ। ভেলা গেল চোখের নিমেষে উলটে। আমি ঝপাং করে পড়লাম জলে। মালপত্র সব মুহূর্তে জলের নিচে। শুধু ভেলাটা একটু পরে ভেসে উঠল। তখন সাঁতার কেটে সেটাতে চড়ে ফিরে এলাম ডাঙায়। মনে আক্ষেপ। বসে রইলাম সমুদ্রের পাড়ে। ঢেউ একটু একটু করে কমল। ভাটার টানে জলও নেমে গেল নিচে। তখন যেখানটাতে ডুবেছিল ভেলা, সেখানে খোঁজখাজ করে কাছি গোছাটা আর তারের গোল্লাটা তুলে আনতে পারলাম। লোহাও ছোটো বড় নানান মাপের কিছু ছিল সঙ্গে। বলতে ভুলে গেছি। সেগুলো উদ্ধার করা আর সম্ভব হল না। ভারী বলে গড়াতে গড়াতে চলে গেছে সমুদ্র গর্ভে।

এবার হিসেবে বসলাম। মোট তের দিন আছি আমি এখানে। এর মধ্যে এগার বার গেছি জাহাজে। যতদূর সম্ভব মানুষের দুখানা হাত যা আনতে পারে সব এনেছি আমি জাহাজ থেকে ডাঙায়। সমুদ্র মোটামুটি শান্ত। এতটুকু উত্তাপ বা ঝড় ঝঞ্ঝার কোনো লক্ষণ নেই। যাব নাকি ফের? আর একটি বার যদি আরো কিছু নজরে পড়ে। কোনো টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস।

গেলাম ফের পরের দিন। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম প্রতিটি অংশ। কোথাও কিছু নেই। গেলাম সারেং এর কেবিনে। দেখি টেবিলের একটা দেরাজ তালা মারা। তালাটা ভেঙে ফেললাম। দেখি তিনটে ত্রুপ। বড় একটা কাচি। ডজন খানেক ছুরি আর কটা কাটা চামচ। সব পকেটস্থ হল। আরেকটু ভেতরে হাতড়ে দেখি নানান দেশের কিছু খুচরো পয়সা আর টাকা। যেমন ইংল্যান্ডের ছ পাউড নোট। ব্রাজিলের কিছু মুদ্রা, একটু সোনা, খানিকটা রুপে হাসি পেল খুব। কী হবে এসব নিয়ে অখ্যাত অজ্ঞাত জনহীন দেশে! মাটিতে পুঁতে রাখলেই বা কী আসে যায়। সে অর্থে এই একখানা ছুরির দাম আমার কাছে অনেক বেশি। তবু নিলাম সব। ছোট্ট একফালি ত্রিপলে মুড়ে পকেটে রাখলাম। ফিরব এবার। ভেলা কি আরেকটা বানাব? নাকি সাঁতার কেটে ফিরে যাব? ভাবছি এইসব। হঠাৎ দেখি আকাশ কালো করে কী মেঘের ঘনঘটা। চোখের নিমেষে যেন দৃশ্যপট পালটে গেল। উঠল ঝড়। স্পষ্ট ঝড় ওঠা দেখতে পেলাম। ডাঙার দিক থেকে আসছে হু হু হাওয়া। গাছপালা দুলছে। সে কী দুলুনি! আর দেরি নয়। ভেলা বানাবার চিন্তা বা চেষ্টা এখন বৃথা। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম অমনি জলে। সাঁতার কেটে যখন কুলে গিয়ে পৌঁছলাম তখন বাতাস আরো তীব্র, জল ফুলে ফুলে উঠতে শুরু করেছে। ঢেউ ধেয়ে আসছে দৈত্যের মতো কূলের দিকে সমুদ্রের বুক ভেঙে।

তাবুতে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বেশ নিরাপদ লাগছে। বাইরে হাওয়ার সেঁ সেঁ দাপাদাপি। রাতভর সেইভাবেই চলল। দেখি ঝড় আর নেই। জাহাজটাও নেই। কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হাওয়া কে জানে! হয়ত সমুদ্রের গর্ভে এখন তার স্থান। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। প্রয়োজনীয় যা কিছু জিনিস সব ইতোমধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি। যদি দু একদিন দেরি করতাম কী করছি করব বলে বলে দিন কাটাতাম, তাহলে। সব এতক্ষণে জাহাজের সাথে সাথে আমার নাগালের বাইরে চলে যেত। সেক্ষেত্রে আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না।

তা জাহাজের চিন্তা আপাতত মন থেকে দূর করলাম। এখন আরেক চিন্তা আমার–সেটাই এই মুহূর্তে প্রধান জিনিসপত্র সমেত নিজেকে আরো নিরাপদ করা, যাতে নরখাদক বর্বর বা বন্য হিংস্র জন্তু আমার কোনো ক্ষতি না করতে পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা। এর জন্যে দরকার নিজের আস্তানা আরো মজবুত, আরো চৎকার করা। কিন্তু কোথায় করব সেই আস্তানা? নাকি তাবুই খাঁটিয়ে রেখে দেব, না কোনো গুহাটুহার খোঁজ করব।

খুঁজতে বেরলাম জায়গা। দুটো দিকে মূলত আমার নজর। প্রথমত খুব একটা ভিতরে ঢুকব না, সমুদ্রের কাছাকাছি থাকব, দ্বিতীয়ত পানীয় জলের সরবরাহ থাকবে পর্যাপ্ত। যেন জলের খোঁজে দূরে কোথাও না যেতে হয়।

এর পাশাপাশি অবিশ্যি স্বাস্থ্যের কারণটাও আছে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এটা সবচেয়ে প্রথম কথা। নরখাদক বর্বর বা হিংস্র জন্তুর কবলে যদি পড়ি তবে তো সব চুকেই গেল। সুতরাং নজর রাখতে হবে। আরো একটা ব্যাপার এখানে আসা ইস্তক লক্ষ করেছি। সূর্যের বড় তেজ। ঝলসে যায় যেন পিঠের চামড়া। এর কবল থেকেও নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজন আছে।

খুঁজতে খুঁজতে যে জায়গাটার হদিশ মিলল বলা যেতে পারে, আমার চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য করে সেটা আদর্শ স্থান। পাহাড়ের ঢালে সমতল মতো খানিকটা এলাকা। বেশ উঁচুতে। পেছনে পাহাড়টাও বেশ খাড়া। অর্থাৎ পেছন থেকে অজানতে কোনো রকম বিপদ আসার সম্ভাবনা নেই। একটা গুহাও আছে কাছাকাছি। গুহা অবিশ্যি যথার্থ অর্থে নয়, পাহাড়েরই গায়ে একটা গর্ত মতো। তার মুখে একটা দরজা বসাতে পারলে অনেক দিক থেকেই শাস্তি।

পাহাড় ঢালু হতে হতে গিয়ে মিশেছে মাটিতে। সেখানে সবুজ মখমলের মতো ঘাস। এখানেই তাবুটা খাটালাম। প্রায় শ খানেক গজ চওড়া আর দুশ গজ মতো লম্বা মাঠ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন বাড়ির উঠোন, খেটে খুটে বহুদিনের পরিশ্রমে আমিই তৈরি করেছি। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে সমুদ্র। ঢালু হতে হতে জমি গিয়ে মিশেছে কূলে। সব দিক থেকেই পছন্দ আমার, সব দিক থেকে মনের মতো। যা যা চাই সব ব্যবস্থাই এখানে আছে।

আমার আসল লক্ষ্য কিন্তু গুহাটা। উঁবু খাটাবার সাথে সাথে গুহাটাকেও ঢেলে সাজালাম। ঝাড় পোছ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হল। তারপর ধুটো গাড়লাম দুদিকে দুটো। মাঝখানে দিলাম চওড়া চেরা কাঠ। উঁচু হল দরজা প্রায় মাটি থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট। তারপর তার দিয়ে সামনে অর্ধবৃত্তাকারে বেশ খানিকটা জায়গা বেড়ার মতো করে ঘিরে দিলাম। আর কী চিন্তা আমার। মই বানালাম একটা। সেটা একেবারে উচ্চতায় দরজার মাথা অব্দি। উঠব মই বেয়ে, গুহায় নামব, তারপর তুলে নেব মই। ভিতরে রেখে দেব। ব্যস আর কে নাগাল পায়। আসুক নরখাদক, আসুক হিংস্র জন্তু, তারের বেষ্টনী যদি বা ডিঙিয়ে আসে, কিছুতে পারবে না সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু কাঠের দরজা পার হয়ে আমাকে ধরতে বা আমার কোনো ক্ষতি করতে। নিরাপদ নিশ্চিন্তে পড়ে পড়ে আমি ঘুমোতে পারব।

তবুটা রইল নিছকই একটা আস্তানা হিসেবে, মালপত্র যতখানি সম্ভব এনে রাখলাম তারের বেষ্টনীর মধ্যে। সেখানেও চারদিকে খুটো গেড়ে অনেকটা তাবু মতো বানালাম। এটা বৃষ্টি আর রোদের হাত থেকে জিনিসপত্র রক্ষার অভিপ্রায়ে। বড় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিলাম তাবুর মাখা। ব্যস এদিক থেকেও নিশ্চিন্ত।

তারপর গুহার মধ্যে খাট পাতলাম, বিছানা পাতলাম, শুয়ে পড়লাম টান টান হয়ে। আহ শাস্তি।

কিন্তু কাজের কি আর শেষ আছে। ঘর বাধার কাজ। একটু করলে মনে হয়, আরো যে একটু করা দরকার। তাই মাটি তুলে আনলাম নিচ থেকে। তাল তাল মাটি চওড়া করে তারের বেড়ার গায়ে জমিয়ে দিলাম। উঁচু হল প্রায় দেড় ফুট। হল দেয়াল। সেটা নিরাপত্তার আরো এক ধাপ! তারের বেড়ার ফাঁক গলে যদি বা কেউ ঢুকতে পারত, দেয়াল ডিঙিয়ে এখন আর সেটা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ আমার মালপত্র নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তারও আর কারণ থাকছে না।

মোটমাট গোছগাছ করে সব কিছু নিপুণভাবে সাজিয়ে নিতে সময় লাগল যথেষ্ট। সেটাই স্বাভাবিক। চট করে তো আর কিছু হয় না। এরই মধ্যে একদিন এক কাণ্ড। দুদ্দাড় করে কালো কুচকুচে এক চিলতে মেঘ ধুয়ে নামল দারুণ বৃষ্টি। আমি তো থ। তখন সবে গুহার দরজাটা বসিয়েছি, মালপত্র তখনো কিছু বাইরে, কিছু তাঁবুর মধ্যে। হঠাৎ বৃষ্টির ধারার মধ্যেই কানের পর্দা ফাটিয়ে ত্রাহি ত্রাহি এক বজ্ৰপাত। সে যা আওয়াজ। আওয়াজটা দেখি খানিকক্ষণ ধরেও রয়ে গেছে। ব্যাপার কী! তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো কারণটা মনে উদয় হল। তাই তো, রেখেছিলাম যে বারুদের একটা প্যাকেট বাইরে খোলা জায়গায়। তাতেই কি ধরে গেল আগুন! তারই কি বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলাম!

বেরিয়ে দেখি সত্যি সত্যি তাই। তখন সে যা দুঃখ আমার, যা মনের অবস্থা। বারুদ মানে যে আমার জীবন, আমার ক্ষুধার অন্ন যোগাবার একমাত্র সম্বল। এই বিজন বিভুয়ে বারুদ নেই কিছু নেই আমি বাঁচব কী করে।

অবিশ্যি যায় নি সব। মোটে একটা প্যাকেট গেছে। আছে আরো অনেক খানি। সেই যা সান্ত্বনা। সেগুলোকে এখন আগলে রাখাটাই সবচেয়ে বড় কথা। অমনি হুড়মুড় করে অন্য সব কিছু গুছিয়ে তুলবার আগে বারুদ আর টোটার প্যাকেটগুলো নিয়ে গুহায় ঢোকালাম। মূল প্যাকেট খুলে বানালাম একশটার মতো পুরিয়া। ছোটো বড় সে নানান মাপের। প্রায় আড়াইশ পাউন্ড ওজনের যে বারুদ। পুরিয়া করা হলে রাখলাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নিশ্চিন্ত এখন। কেননা যদি কোনো কারণে বজ্বের আগুনে একটা পুরিয়া জ্বলে যায়, তবে সেটাই যাবে, বাকিগুলোতে তার ছোঁয়াচ লাগবে না এবং সেক্ষেত্রে আমার বাকি বারুদ রক্ষা পাবে।

আর এই সব টুকিটাকি কাজের ফাঁকে ফাঁকে রোজ একবার করে বেরিয়ে পড়ার ব্যাপার তো আছেই। দুটো তার উদ্দেশ্য। এক হল দ্বীপটাকে ভালো করে চেনা জানা, দুই–ছোটোবড় জীবজন্তু মেরে খাদ্যের সংস্থান করা। তা ঘুরতে ঘুরতে দেখি, ছাগল আছে জঙ্গলে বিস্তর। সেটা মোটামুটি আমার পক্ষে শুভসংবাদই বলা যায়। কিন্তু এত লাজুক এত ভীরু প্রকৃতির। আর অসম্ভব গতি পায়ে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে উধাও। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধার কারণ নেই। কেননা আমার বন্দুকের গতিও কিছু কম নয়। একবারে না পারলাম, পারব তো মারতে কখনো না কখনো। শুধু ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা আর নজরটাকে নতুন ভাবে শানিয়ে নেওয়া। সঙ্গে ফন্দি। একটা তো আমি এরই মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছি। পাহাড়ের মাথায় উঠে তাক করে বসে থাকি। সামনের ছোট্ট উপত্যকা মতো। খানিকটা ঢালা ভূমি। সেখানে কচি কচি ঘাস। দেখি ঘুরে ঘুরে সেখানেই আসে ঘাস খেতে। মাথা কালে ভদ্রে উপর দিকে তোলে। তুললেও সে অল্প একটু। আমি যেখানে বসা তত অব্দি চোখ যায় না। ফলে আমাকে দেখতে পায় না। তো দিলাম একদিন ঘোড়া টিপে। মরল একটা ছাগল। সঙ্গে তার আবার একটা বাচ্চা। দুধ খাচ্ছে। ভারি খারাপ লাগল মনটা। আহারে, বেচারার মা-টাকে মেরে ফেললাম। দেখি মরবার পরেও দুধের বাট থেকে মুখ সরায় না। তখন গিয়ে কোলে তুলে নিয়ে এলাম নিজের আস্তানায়। কিন্তু এক জ্বলাকিছুতেই অন্য কিছু মুখে তুলবে না। বাচ্চা যে একদম। ঘাসপাতা খাওয়ার অভ্যেস যে হয় নি। তা শুকিয়ে মরবে, বরং আমিই মারি; খেয়ে ফেলি। হাত উঠছিল না মারতে, তবু উপায় নেই। আমারই হাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। মা-বেটা মিলিয়ে একলার পক্ষে যথেষ্ট মাংস। খেলাম তাই কদিন পেট পুরে। যাক, অন্তুত কটা দিনের রুটি খরচ তো বাঁচল।

আস্তানা বানাবার পর এখন আমার সামনে জরুরি কাজ হল আগুন জ্বালাবার মতো একটা জায়গা তৈরি করা। সেটা গুহার কাছাকাছি থাকলেই ভালো হয়। এবং কোনো একটা ঢাকা জায়গায়। অর্থাৎ সে আগুন আমি নিভতে দেব না কোনোদিন। অনন্তকাল ধরে জ্বলবে। অন্তত আমি যতদিন এই দ্বীপে আছি ততদিন। পাঠক, এবার এই অবসরে আমার নিজের মনের অবস্থার কথা একটু শুনে নিন।

স্বভাবতই মন আমার খারাপ। ধ্বজন বিয়ে এসে উঠেছি, জানি না কবে শেষ হবে এখানকার মেয়াদ, কবে পারব এখান থেকে ফের লোকালয়ে ফিরে যেতে এই নিয়ে অহোরাত্র মনের খাজে খাজে একটা ব্যথা, একটা দুশ্চিন্তা গুমরে গুমরে বেড়ায়। এটাকে আমি নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছি আমার মন্দভাগ্য। ভাবতে বসলেই অনেক কথা মনে পড়ে যায়, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল, আমার বুক যেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চায়। তবু উপায় নেই। কেঁদে গলা চিরে ফেললেও কেউ শুনতে পাবে না আমার কাতর আহ্বান। কেউ আমার বেদনার কথা জানতেও পারবে না।

তবে হ্যাঁ, এসব চিন্তায় বুক যখন ভারি হয়ে ওঠে, তখন পালটা চিন্তাও এসে সান্ত্বনার ভাষা নিয়ে মনের আনাচে কানাচে ঘুর ঘুর করে। তখন আসে পালটা জিজ্ঞাসা। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি।–আচ্ছা ছিলে তো তোমারা মোট এগার জন একসাথে জাহাজে করে সবাই আসছিলে। বাকি দশজন কোথায় গেল; কেন তারা রক্ষা পায় নি? কেন বা একলা তুমি বেঁচে গেলে? কী এর উদ্দেশ্য? এও কি নিয়তির অমোঘ নির্দেশ নয়? ভালো না মন্দ সেটা তুমি নিজেই ঠিক করে নাও।

তখন মনে একটু বল পাই। যাকে বলে নতুন উদ্যম আর সাহস। আরো যুক্তি তখন আসে। যেমন–জাহাজটা চড়ায় এসে আটকে থাকার কথা। ছিল সেই জন্যেই তো পেরেছি আমি মালপত্র নামিয়ে আনতে। টুকিটাকি জিনিস থেকে শুরু করে খাদ্য, বস্ত্র, পানীয়, এমন কি বন্দুক, তার গোলা বারুদ-সব। এগুলো না পেলে আমার আজ কী দশা হত? আর এমনই ভাগ্যের খেলা–নামিয়ে আনলাম শেষ জিনিসটুক, দেখতে না দেখতে প্রায় চোখের সামনে কোথায় কোন্ নিরুদ্দেশে ভেসে গেল জাহাজ। এগুলো কি আমার পক্ষে মঙ্গলদায়ক নয়?

অবিশ্যি বারুদ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। সেই বজ্রপাতের ফলে। সেটাকে আমি আর নিয়তির খেলা বলে মনে করি না। ধরে নিই ওটা কাকতালীয়। তবে সেটা যাতে আর না ঘটে তার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা আমি গ্রহণ করেছি। তবু মেঘ ডাকলেই আমারও বুক দুরু দুরু করতে থাকে। ঘাবড়ে যাই। ভাবি, বাজ পড়বে না তো আবার! তাতে ফের বারুদ জ্বলে যাবে না তো? ( মোটের উপর অনন্ত নির্জন নিরালা আমার জীবন। মজা নদীর নিখর জল যেরকম। তবে তার মধ্যে একটা শৃংখলা আনা দরকার। যেমন কোথায় আছি আমি তার একটা হদিশ। কবে প্রথম এসেছি এখানে তার হিসেব। কতদিন আছি তার একটা বর্ণনা। এগুলো দরকার। অন্তত পরে কোনো না কোনোদিন আমার নিজেরই দরকার হতে পারে।

মানচিত্র এনেছিলাম জাহাজ থেকে, তার হিসেব মিলিয়ে দেখলাম–আমি যে দ্বীপে আছি, সেটা অনামী, ন ডিগ্ৰী বাইশ মিনিট উত্তর অক্ষরেখায় তার অবস্থান। আমি এসেছি এখানে ৩০শে সেপ্টেম্বর। আজ বার দিন পার হয়ে গেল। এরও একটা হিসেব রাখা দরকার। তখন একটা মস্ত গাছের গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করে লিখলাম–আমি, এই দ্বীপে ১৬৫৯ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর এসেছি। তার পাশে বারটা ক্ষুদে ক্ষুদে দাগ কাটলাম। অর্থাৎ বার দিন আছি আমি এখানে। দিন যেমন বাড়বে, দাগও একটা একটা করে বাড়বে। মোটমাট এটাই হবে আমার আগামী দিনের দিন-মাস-বছরের ক্যালেন্ডার। খুচরো অনেক কিছুই এনেছি জাহাজ থেকে। তার উল্লেখ আগে করি নি। কেননা সেগুলো মূল্যবান তেমন কিছু নয়, কিন্তু দরকারী বটে আমার কাছে। যেমন কলম, কালি, কাগজ, কাপ্তেনের নামাঙ্কিত কয়েকটা কাগজের মোড়ক, কম্পাস, জ্যামিতিক মাপ কষার কিছু যন্ত্রপাতি, কিছু নকশা, সমুদ্রে জাহাজ চালনা সংক্রান্ত কয়েকখানি বই, একখানা বাইবেল, পর্তুগিজ ভাষায় লেখা খানকতক বই, তার মধ্যে একখানা প্রার্থনাগীতি ধরনের–সব যত্ন করে আমি তুলে রেখেছি আমার অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে। ফেলি নি একটাও। কখন কোনটা দরকার লাগে বলতে পারে না কেউ! তবে লাগবে যে দরকারে কোনোদিন এটা আমি স্থির জানি। হ্যাঁ, আরো তিনটে অন্য জাতীয় জিনিস এনেছি জাহাজ থেকে। সেটা আগে বলতে আমার একেবারে মনে নেই। দুটি বেড়াল এবং একটি কুকুর। এরা জাহাজে আমাদের সাথে সাথেই ছিল। প্রথম যেদিন ভাঙা জাহাজ থেকে মাল আনতে যাই সেদিনই পরম যত্নে বন্দী বেড়াল দুটোকে ভেলায় তুলে নিয়েছিলাম। কুকুরটাকে কোলে করে নিয়ে আসার দরকার হয় নি। ভেলা ছাড়তে দেখে নিজে থেকেই লাফিয়ে পড়েছে জলে, তারপর সাঁতার কাটতে কাটতে উঠেছে এসে ডাঙায়। সেই থেকে সে আমার পরম বিশ্বস্তু অনুচর। সুখ দুঃখের সাথীও বলা যায়। ছিল একসাথে অনেক দিন। আমার তো মুস্ত সুবিধে। এমন নয় যে ওকে দিয়ে খাটাব কি কোনো কাজ করাব। বলব, এটা নিয়ে আয়। তো ওটা নিয়ে আয় তো। সে সব কিছু না। বরং বসে বসে কথা বলব ওর সাথে। সেইভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটবে। কদিন পরে দেখি ব্যাপারটা বড় একতরফা। আমি একলাই বক বক করে মরি। তার চেয়ে বরং এক কাজ করি না। কলম আছে কালি আছে কাগজ আছে বরং লিখেই ফেলি সবকিছু। তাতে অন্তত নথি বলে একটা জিনিস থাকবে। তখন তাই শুরু করলাম। কিন্তু কালি এক সময় গেল ফুরিয়ে। সে যাকগে, নতুন করে, কীভাবে কালির প্রয়োজন মেটানো যায় সেটা পরের চিন্তা। কিন্তু যে কদিন কালি ছিল দোয়াতে আমি প্রতিটি হিসেব বিবরণী নির্ভুল ভাবে লিখে ফেলেছি খাতায়। যাতে বুঝতে কারো অসুবিধে না হয়।

অর্থাৎ কালির প্রয়োজনটা এক্ষেত্রে যত তীব্র, তেমনি প্রয়োজনীয় আমার কাছে কোদাল, কুড়ুল, বেলচা, সুচ, আলপিন, সুতা ইত্যাদি। সেলাই ফোঁড়াইয়ে ইতোমধ্যেই বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছি। জামা ছিড়লে এখন আর বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে সুচ সুতো হাতে বসে যাই।

তবে হ্যাঁ, অনেক কিছু আবার নেইও। সেটা কাজ করতে গেলে মালুম পাই। সে নানান জিনিস। ফলে কাজে অহেতুক দেরি হয়। যেমন একটা শাবল খুব দরকার। নেই। তাই তাবু খাটাতে বা মাটি খুঁড়ে মাটি তুলে দেয়াল দিতে সময় লাগল প্রায় দ্বিগুণ। কী করব, অন্যরকম জিনিস দিয়ে যে কাজ করতে হয়। তাতে সময় লাগে বেশি।

যেমন ধরুন বড় করাত নেই। আছে একটা ছোটো হাত করাত। তা দিয়ে খুঁটি কাটতে হবে মাপ মতো তাবুর জন্যে। দুদিন লাগল আমার খুঁটি কটা কাটতে। শাবলের অভাবে একটা গোটা দিন গেল সেগুলোকে মাটিতে শক্ত করে পূততে। সে এক রীতিমতো ক্লেশকর অবস্থা। মাথার ঘাম পায়ে ঝরার উপক্রম। তাতে অবিশ্যি দুঃখ নেই আমার। হবেই বা কি দুঃখ দিয়ে। আমি কি এখানে কোনো সরকারি অফিসে কাজ করি যে চৌপহর আমাকে তাগাদা মেরে দু ঘণ্টার কাজ আধ ঘণ্টায় কেউ উঠিয়ে নেবে? নাকি আমার অন্য আরো নানান কিছু করার আছে যার জন্যে সময় আমার বেশি দেওয়া দরকার। দুটোর কোনোটাই না। কাজ বলতে আমার কেবল দুবেলা ভক্ষণ আর খাদ্যের রসদ সংগ্রহ করে আনা। আর বলা যায় সেই সাথে ঘুরে ঘুরে দ্বীপটা ভালো ভাবে দেখা ও চেনা। সুতরাং সময় নিয়ে আমার অত মাথাব্যথা কীসের?

মন্দভালো
ভয়ঙ্কর নির্জন দ্বীপে আমি আটকে গেছি। কোনোদিন যে উদ্ধার পাব এখান থেকে সে আশায় ছাই।কিন্তু জীবিত আছি এটা অনেক বড় কথা। আমার সহযাত্রীদের মতো আমার সলিল সমাধি হয় নি।
এই যে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা এটা আমার কাছে মর্মান্তিক।বিচ্ছিন্ন সহযাত্রী দল থেকেও। সেটা আমার পক্ষে মঙ্গল। আমি এখনো জীবিত। জানি না নিছকই মিথ্যে আশা কিনা। তবে আমার বিশ্বাস পরম করুণাময় ঈশ্বর যে আশ্চর্য উপায়ে আমাকে রক্ষা করেছেন ঠিক একই ভাবে একদিন না একদিন তিনি আমাকে এই সঙ্কট থেকে ব্রাশ করবেন।
মানব জগৎ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। বা। বলা যায় নির্বাসিত। মানুষের সঙ্গে আমার আর কোনোরকম যোগাযোগ নেই।কিন্তু তথাপি না খেয়ে আমাকে দিন কাটাতে হয় না। এমন নয় যে আমি অনাহারে মারা যাব বা কোনোভাবে আত্মরক্ষা করতে পারব না।
জীবনের প্রয়োজনে পোশাকেরও দরকার হয়। আমার সংগ্রহে পোশাক তেমন কিছু নেই।উষ্ণ আবহাওয়া মন্ডলে এখন আমার অবস্থান। পোশাক নেই তাই পোশাকের প্রয়োজনটা বেশি করে মনে হচ্ছে। থাকলে হয়ত পরবার প্রয়োজনও বোধ করতাম না।
যদি অতর্কিতে কোনো হিংস্র জন্তু বা নরখাদক বর্বরের দল আক্রমণ করে তাকে প্রতিহত করার মতো তেমন কোনো অস্ত্র আমার কাছে নেই।দরকারও নেই তেমন কোনো অস্ত্রের। ঘুরে ফিরে তো দেখলাম কদিন। বর্বর মানুষ দূরের কথা, হিংস্র জজ অব্দি এই দ্বীপে একটিও নেই। আফ্রিকার উপকূলে যদি আমার জাহাজডুবি হত–সেই যেমন বজরায় চড়ে পালাবার সময় সেবার দেখেছিলাম–তাহলে যে কী দশা হত ভাবলে শিউরে উঠি।
এমন কেউ নেই যার সাথে আমি কথা বলতে পারি বা কোনো একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।জীবন নির্বাহ করার প্রয়োজনে কথা বলাটা কি একান্তই দরকার? কথা তো বলে মানুষ প্রয়োজনে ঈশ্বরের দয়ায় ভাঙা জাহাজ থেকে প্রয়োজন মেটাবার যাবতীয় জিনিস আমি নামিয়ে এনেছি। তাতে শুয়ে বসে কেটে যাবে আমার দীর্ঘ দিন। তবে আর ভাবনা কী!

মোটমাট নিজের অবস্থা নিয়ে আমি কিন্তু বেশ গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছি। লিখেও ফেলেছি আমার বর্তমান অবস্থার বিবরণী। এমন নয় যে এটা কেউ দেখবে সেইজন্যে লেখা। কিংবা আগামী দিনে আমার লেখাটা উদ্ধার পাবে, তখন আমি হয়ত আর বেঁচে থাকব না–সেইজন্যে লেখা। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজেরই জন্যে। নিজেকে যাচাই করার প্রশ্নে। নিজেকে নিয়ে ভাববার প্রশ্নে। ভালো কী কী আমার জীবনে সেটা যেমন বুঝবার প্রয়োজন আছে, মন্দ কী কী এবং কেন সেটাও তেমনি বোঝা দরকার। তা

হলে নিজের প্রকৃত অবস্থা আমি বুঝতে পারব কীভাবে।

আমার পক্ষে ভালো কী আর মন্দ কী তার যে তালিকা করেছি সেটা এইরকম :

মোটমাট ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে এই আমার বর্তমান অবস্থা। এটা যে গভীর দুঃখের জীবন–সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু ভালো যে সব দিক, তার জন্যে নিজের ভাগ্যকে আমি হাজার সেলাম জানাই। হয়ত এই অবস্থা আমার জীবনের ক্ষেত্রে দরকার ছিল। কত দুর্দশায় মানুষ পড়তে পারে। কতখানি মর্মান্তিক হতে পারে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত-এ বোধ এরকম অবস্থায় না পড়লে আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। তবে এরই মধ্যে ভালো যেটুক সেটুকু আমার উপরি পাওনা। কথা তো নয় এই অবস্থায় কোনোরকম ভালোর দেখা পাওয়ার। তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকি।

আর একটা কথা। ভাবি না এই সব নিয়ে আর বেশি কিছু। মাঝে মাঝে ঐ যে দেখার অভ্যেস–কোনো জাহাজের দেখা পাই কিনা–সেটাও ইদানীং বন্ধ করেছি। এখন কেবল নিজেকে মানিয়ে নেবার প্রশ্ন। এই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেবার ব্যাপার। এবং একমাত্র চেষ্টা আমার কীভাবে কত নিপুণ ভাবে এখানে আমি বেঁচে বর্তে সুস্থ সবল স্বাভাবিক হয়ে থাকতে পারি।

তা আস্তানা তো একটা যা হোক খাড়া করেছি। পাহাড়ের ঢালে তাবু একটা। তার চারদিকে খুঁটি গেড়ে তারের বেড়া। কিছুটা অংশ আবার মাটি দিয়ে গাথা। অর্থাৎ দেয়াল। এটাকেই বছর দেড়েক ধরে খেটে খুটে কুটিরের আকৃতিতে নিয়ে এলাম। তুললাম চারধার দিয়ে চালা ঘর। কাঠকুটো এটা সেটা দিয়ে ছাওয়া হল চাল। তাতে একটা সান্ত্বনা বৃষ্টির হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। জল এসে তাঁবুর ভেতর অব্দি ভিজিয়ে দেয় না। সে যা ভয়ঙ্কর বৃষ্টি সেখানে! যখন হুড়মুড়িয়ে নামে আকাশ ভেঙে তখন রীতিমতো ত্রাস ধরিয়ে দেয়।

ঘর হবার পরই আসে ঘর গোছাবার ইচ্ছে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু নেই। গোছাতে গিয়ে দেখি–সে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। মালপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁবু গুহা সব একেবারে দখল করে রেখেছে। আক্ষরিক অর্থে যাকে বলে জুড়ে থাকা। তাতে জায়গা হয় না। তার উপর দরকার হলে হাতের গোড়ায় কোনো জিনিস চট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। এক কাজ করলে কেমন হয়?–যদি গুহাটা ভিতর দিকে খানিকটা বাড়িয়ে নিই! তবে দরকারী মালপত্র আরো বেশি বেশি করে গুহার মধ্যে রাখতে পারব।

তখন শুরু হল বাড়াবার কাজ। এমন একটা কিছু পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। ঝুরো বালি মাটি। প্রথমে কাটলাম ডানধার দিয়ে খানিকটা। তারপর ফের আবার ভার ডাইনে। দেখি খুঁড়তে খুঁড়তে কাটতে কাটতে সিধে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। তা মন্দ কী। এটাকে নয় একটা দরজা করি। বড় মুখটা তো কাঠ দিয়ে আড়াল। থাক ঐ ভাবেই। এই দরজা দিয়েই নয় ঢুকব বেরুব।

খিড়কি দোর নাম দিলাম সেই দরজারটার। কিছুটা পেছন দিকে ঘেঁষা তো তাই। ঢুকলে মালপত্র যেখানে রেখেছি সিধে সেখানে। জায়গাও বিস্তর। তখন সেখানে আরো অনেক মাল এনে জড় করলাম।

কিন্তু দরকার আপাতত একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। নইলে বড় অসুবিধে। বসতে পারি না দুদণ্ড। মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে খেতে কষ্ট হয়। লিখতে বসতেও বিশ্রী লাগে। মোটমাট খেতে পেলে শুতে চাওয়া যে রকম আমারও এখন একটু আরামের দরকার।

শুরু হল কাজ। কিন্তু সে কি আর চাট্টিখানি কথা! প্রথমত, যন্ত্রপাতির অভাব। দ্বিতীয়ত এসব আজ করার অভ্যেস আমার কোনোদিনই নেই। এরও তো একটা হিসেব আছে রে বাপু। জানি আমি সেই হিসেব? কাঠ কাঠি, মেলাতে যাই, দেখি টেরা-বাকা হয়ে সে যাচ্ছেতাই চেহারা। তখন সেটা বাতিল করে ফের নতুন আরেক খণ্ড কাঠ নিয়ে কাজে লাগি। তা কাঠ কি আর আমার জন্যে কেউ নিয়ে ঘসে মেজে নিপুণ করে রেখেছে। তখন কাঠের দরকারে গাছ কাটতে হয়। সেটাকে করাত দিয়ে ফালি করতে হয়। করতে গিয়ে দেখলাম হয়ত বড় পাতলা হয়ে গেল। কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পুরু। তখন। ঘসো তাকে পাতলা কর–সে এক ঝঞ্ঝাটই বলা যায়।

তবে তাতে সাময়িক অশান্তি হয় ঠিকই কিন্তু মজাও পাই। সময়ের তো এখানে আমার কোনো মূল্য নেই। কোনো কাজে বেশিক্ষণ লাগলে কেউ তো আর জবাবদিহি চাইবে না। তো ভাবনা কীসের। বস্তর খাটাখুটি করে অনেক দিন পরে বানালাম চেয়ার আর টেবিল। অমনি কটা তাকও তৈরি করলাম। সেটা অবশ্যি কম ঝঞ্ঝাটের। কেননা জাহাজ থেকে আনা চেরা কাঠগুলো সঙ্গেই ছিল। গুহার দেয়ালে তাই থাকে থাকে বসিয়ে দিলাম। নিচে দিলাম মস্ত বড় বড় পেরেক আটকে। আর চিন্তা কীসের। মাল রাখব এবার থেকে এই সব তাকে। সাজালাম তাক। দরকারী যাবতীয় জিনিস এনে রাখলাম। হাতের গোড়ায় বলতে যা বোঝায় আর কি। সে ভারি আনন্দ। খুঁজতে হয় না মোটে, জিনিস হাটুকাতে হয় না, হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায়। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।

আর টেবিল চেয়ার দুটোই যখন আছে, তখন লিখতে বসতেই বা অসুবিধা কি। শুরু। হল লেখা। একে বিবরণী বলাই ভালো। আমি তো আর লেখক নই। ঘটনা যেমন যেমন ঘটছে বা ঘটেছে, আমি লিখে রাখছি পর পর। নথিবদ্ধ করা বলতে যা বোঝায়। হয়ত এইভাবে শুরু করলে ভালো হত : ৩০শে সেপ্টেম্বর। অনিবার্য মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইয়া আমি ডাঙায় উঠিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিবার কথা সেই মুহূর্তে আমার মনে হয় নাই। কেননা পাকস্থলীতে প্রভূত পরিমাণে লবণাক্ত জল। প্রথম কাজ সেগুলি বমি করিয়া বাহির করা। তাহাই করা হইল। কিছুটা সুস্থ বোধ করিতে লাগিলাম। তখন মনের মধ্যে কেবলই অনুতাপ আর দুঃখবোধ। এ কোথায় আসিলাম আমি! কী আমার পরিণতি। অবোধ বালকের মতো তখন কেবলই ক্রন্দন আর অশ্রুপাত । কাদিতে কাদিতে কখন জ্ঞান হারাইয়াছি জানি না। জ্ঞান ফিরিয়া আসিতে দেখিলাম আমি ঘাসের উপর শুইয়া আছি। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। চোখ যেন ঘুমে জড়াইয়া আসিতে চায়। কিন্তু অদূরে যে বনরাজি দেখিতেছি–উহাতে কি হিংস্র কোনো জন্তু আছে? আমাকে কি অতর্কিতে আসিয়া গ্রাস করিবে? সেই ভয় লইয়াই আমি একটু পরে নিদ্রার কোলে ঢলিয়া পড়িলাম।

সম্ভব হয় নি এভাবে আমার পক্ষে লেখা। ভাষার এত কারিকুরি আমার জানা নেই। সাদা-মাটা ভাবেই লিখেছি যেমন কলম এগিয়েছে ঠিক তেমনি। ভাঙা জাহাজ থেকে দিনের পর দিন নানান জিনিসপত্র নিয়ে আসার বিবরণ যে ভাষায় আছে, একই ভাষায় বলা হয়েছে আমার হতাশার কথা যখন বারে বারে পাহাড়ের মাথায় উঠে একটাও জাহাজ না দেখতে পেয়ে দুঃখে বেদনায় আকুল হৃদয়ে শিশুর মতো আমি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছি। তা-ও।

মোটমাট আমি যে কথাটা বোঝাতে চাই সহজ সরল অনাড়ম্বর আমার এই বিবরণী। ৩১ অরিখ থেকেই শুরু। যদিও আরম্ভ করেছি অনেক পরে। টেবিল চেয়ারে আর কোনো অসুবিধে নেই। কাগজও বেশ কিছু আছে। তবে কালিটাই যা সমস্যা। শেষ হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে আমি জানি। তারপর আর লেখার কোনো উপায় থাকবে না। তবে যতক্ষণ দাস ততক্ষণ আশ । দেখা যাক, কবে ফুরোয় আর কতখানি অব্দি আমি লিখতে পারি।

1 Comment
Collapse Comments

Nice Story

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *