২. একটি বিবর্ণা শীর্ণকায়া মহিলা

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

মা, মা, আমি আজ খুশি–আনন্দে আমার মন-প্রাণ ভরে উঠেছে।

একটি বিবর্ণা শীর্ণকায়া মহিলার কোলের ওপরে মুখ লুকিয়ে মেয়েটি আনন্দে যেন ফেটে পড়ল। দেখে মনে হয়, ব্যস্থা মহিলাটি সংসার-যাঁতার মধ্যে পড়ে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছোটো বসার ঘর, আলো-হাওযার বালাই সেখানে নেই বললেই ইয। সেই ঘরের একমাত্র আসবাব ছোটো একটি আর্মচেয়ারের ওপরে বসে ছিলেন। উজ্জ্বল আলোর ধকল সহ্য করতে পারছিলেন না বলেই হয়তো আলোর দিকে বসেছিলেন পেছন করে।

মেয়েটি আবার বলল, আনন্দ রাখার আর জায়গা পাচ্ছি না আমি তোমারও আনন্দ হচ্ছে নিশ্চয়।

মিসেস ভেন ভ্রূকু টি করলেন, কিন্তু তাঁর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে রঙের একটি হাত তাঁর মেয়ের মাথার ওপরে রাখলেন।

আনন্দ! তোমাকে যখন অভিনয় করতে দেখি আমার আনন্দ হয় তখনি। অভিনয় ছাড়া বর্তমানে অন্য তোমার চিন্তা করা উচিত নয়। মিঃ আইস্যাকস আমাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। তিনি যে আমাদের ধার দিয়েছেন সে ধার এখনো শোধ হয়নি।

মেয়েটি ওপরের দিকে মুখ তুলে বলল, মা, টাকার কথা বলছ? টাকায় কি যায় আসে! ভালোবাসার টাকার চেয়ে অনেক বেশি।

ভুলে যেও না, ঋণ শোধ আর ভেমেস-এ পোশাক তৈরি করার জন্যে মি; আইসকস আমাদের পঞ্চাশ পাউন্ড অগ্রিম দিয়েছেন। সেকথা ভুলে যেও না সাইবিলা পঞ্চাশ পাউন্ড অনেক টাকা। এদিক থেকে মিঃ আইস্যাকসকে সুবিবেচক না বলে আমি পারছি না।

দাঁড়িয়ে উঠল মেয়েটি, তারপরে জানলার ধারে গিয়ে বলল, মা, ও ভদ্রলোক নয়। আমার সঙ্গে ও যেভাবে কথা বলে তাতে ওকে আমার ঘৃণা হয়।

স্বরে কিঞ্চিৎ ঝাঁকানি দিয়ে বর্ষীয়সী মহিলাটি বললেন, তাঁর সাহায্য ছাড়া কী করে যে আমাদের চলত তা আমি জানি না।

সাইবিল ভেন নিজের মাথাটা নাড়িয়ে হাসল, আর তাকে আমাদের দরকার নেই মা। এখন থেকে প্রিন্স চার্মিং-ই আমাদের সব ভার নেবেন।

এই বলে সে থামল। একটা লজ্জার ঢল নামল তার ধমনীতে, সে একটু কেঁপে উঠল, সেই রঙে ধীরে ধীরে রাঙা করে দিল তার দুটি কপোলকে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে তার পদ্মপাতার মতো নরম দুটি ঠোঁট বিভক্ত হল-কাঁপতে লাগল ঠোঁটের দুটি পাপড়ি দুহিষ্কণে বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপরে, সুন্দর পোশাকের ভাঁজগুলি দিল খুলে। সে শুধু বলল, আমি তাকে ভালোবাসি।

টিয়াপাখির মতো তাঁর মা চিৎকার করে উঠলেন–বোকা, বোকা মেয়ে! কথার সঙ্গে সঙ্গে নকল হিরে-বসালো আংটি পরা আঙুলটি তাঁর অদ্ভুতভাবে নড়তে লাগল।

মেয়েটি আবার হেসে উঠল। খাঁচায় পোরা পাখির আনন্দ তার স্বরে ধ্বনিত হল। সেই সুর ধরা। পড়ল তার চোখের মণিতে। দৃষ্টির আলোতে বিচ্ছুরিত হল তারই দ্যুতি। তারপরে তার। চোখের পাতাগুলি মুহূর্তের জন্যে বুজে এল, মনে হল, সে কিছু গোপন রহস্যকে ঢেকে রাখতে চায়। যখন সে চোখ খুলল তখন স্বপ্নের কুয়াশা কেটে গিয়েছে।

সেই জীর্ণ চেয়ার থেকে রগ্ন ভদ্রমহিলাটি তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি তাকে বিত্ত হওয়ার উপদেশ দিলেন, উপদেশ দিলেন সমঝে চলার জন্যে। কাপুরুষদের জন্যে যে সব বই লেখা হয়েছে এবং যেখানে লেখক সাধারণ জ্ঞান’ বলে শব্দটা না বুঝে বারবার উচ্চারণ করেছেন, সেই বই থেকে কিছু উপদেশ বাণী উদ্ধৃত করে তিনি তাকে শোনালেন। মেয়েটি সেদিকে কান দিল না। কামনার কারাগারে সে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন। তার রাজকুমার প্রিন্স চার্মিং, তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে তখন। তাকে মনের মতো সৃষ্টি করার চেষ্টায় সে তখন মশগুল। তাকে খুঁজে বার করার জন্যে সে তার আত্মাকে দূত করে পাঠিয়েছে, সেই দূত তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। রাজকুমারের জ্বালাময় চুম্বন আবার তার ঠোঁট দুটিকে সম্পশ করেছে। তার নিশ্বাসে মেয়েটির চোখের পাতাগুলি গরম হয়ে উঠেছে।

তারপর বিজ্ঞতা চিন্তার পদ্ধতি পরিবর্তন করল। এই যুবকটি ধনী হতে পারে। তাই যদি হয়, বিয়ের কথা চিন্তা যেতে পারে। তার কানের উপকূলে সাংসারিক জ্ঞানের ঢেউ আছাড় খেয়ে। পড়ল। ছলনার তীর ছুঁডল মেয়েটি। সে দেখতে পেল পাতলা ঠোঁটগুলি তার নড়ছে। সে হাসল।

হঠাৎ কথা বলার তাগিদ এল তার। সে চেঁচিয়ে বলল, মা, মা, সে আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আমি তাকে কেন ভালোবাসি তা আমি জানি। তাকে আমি ভালোবাসি এই জন্যে যে সে নিজেই ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু আমার মধ্যে সে কী দেখেছে? আমি তো তার যোগ্য নই। কিন্তু তবু কেন জানি না, যদিও তার কাছে আমি অনেক ছোটো তবু তার প্রেমের অযোগ্য মনে হয় না নিজেকে। তার ভালোবাসা পেয়ে গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে। মা, আমি যেমন আমার প্রিন্স চার্মিং-কে ভালোবাসি, তুমিও কি বাবাকে সেই রকমই ভালোবাসতে?

অল্প দামের প্রসাধনের নীচে বয়স্কা মহিলার গণ্ড দুটি হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। একটা যন্ত্রণার আকস্মিক আবেগে তাঁর শুকনো ঠোঁট দুটি বিকৃত হল। সাইবিল ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল এবং গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, মা আমাকে মা কর। বাবার সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে গেলে যে তোমার কষ্ট হয় তা আমি জানি। কারণ, তুমি তাঁকে ভালোবাসতে, খুব ভালোবাসতে। দুঃখ করো না মা। বিশ বছর আগে তুমি একদিন যেমন সুখী হয়েছিল আড আমি তেমনি সুখী। আমাকে চিরকাল সুখী থাকতে দাও।

বৎসে, প্রেমে পড়ার কথা চিন্তা করার মতো ব্যস তোমার এখনো হয়নি। তাছাড়া এই ছেলেটির সম্বন্ধে কতটুকুই বা তুমি ডান? তার নামটা কি তা-ও পর্যন্ত তুমি জান না। এসব কথা আলোচনা করার এতটুকু সময়, বিশেষ করে জেমস এখন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে কত জিনিস ভাবতে হচ্ছে আমাকে। আশা করেছিলাম ঠিক এখনি তুমি বুঝে শুনে চলবে। যাই হোক, তোমাকে আমি আগেই বলেছি, ছেলেটি যদি ধনী হয়…

মা, মা। টাকা-পয়সার কথা ছাড়, আমাকে সুখী হতে দাও।

 মিসেস ভেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, এবং নকল নাটকীয় ভঙ্গিমায়, যে ভঙ্গিমাটি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্টেডের ওপরে স্ববাবসিদ্ধ কলাকৌশলের সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়, তিনি মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে এল একটি যুবক, মাথার চুলগুলি তার উসকো-খুসকো, কটা রঙের। চেহারার বাঁধুনি শক্ত, হাত আর পা বেশ লম্বা, চলার ভঙ্গিমাটা বেশ সাবলীল নয়। বোনের মতো পরিচ্ছন্ন ভাবে সে মানুষ হয়ে ওঠেনি। দুজনের মধ্যে যে একটা নিকট সম্পর্ক রয়েছে হঠাৎ দেখলে তা বোঝা বেশ কষ্টকর। মিসেস ভেন ছেলেটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, মুখের ওপরে ছড়িয়ে। পড়ল সিটি। মনে মনে ছেলেটিকে তিনি রঙ্গমঞ্চের দর্শকদের ভূমিকাতে দেখতে লাগলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন যে মূকনাটকটি ভালোই জমেছে।

ছেলেটি মিষ্টি সুরে একটু বিক্ষোভ জানিয়ে বলল, তোমার কয়েকটা চুমু আমার জন্যে রেখো, সাইবিল।

সাইবিল বলল, তাই বুঝি! কিন্তু কেউ তোমাকে চুমু খেলে তো তোমার ভালো লাগে না। তুমি। একটি দুষ্ট বৃদ্ধ ভালুক।

এই বলে মেঝের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরল।

জেমস ভেন তার বোনের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, বলল, আমার সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসবে চল, সাইবিল। মনে হচ্ছে, এই বিতিকিচ্ছিরি লন্ডলে আমি ফিরব না। আমি তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারি, এখানে ফিরে আসার ইচ্ছে আমার নেই।

একটা জমকালো থিয়েটারের পোশাক তুলে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস ভেন বললেন, ওরকম ভয়ংকর কথা বলো না বাচ্চা।

ছেলেটি যে থিয়েটারে নামল না এতে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন, নামলে নাটকটা জমত ভালোই।

কেন বলব না, মা? সত্যিই বলছি, ফিরে আসার ইচ্ছে আমার নেই।

তোমার কথা শুনলে আমার বড়ো কষ্ট হয় বাচ্চা। আমি বিশ্বাস করি প্রচুর অর্থ নিয়েই তুমি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসবে। সমাজ বলতে কলোনিতে কিছু নেই, যা রয়েছে বলে শুনেছি তাকে আমরা সোসাইটি বলতে পারি না। সেই জন্যে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করার পর আর তোমার সেখানে থাকার দরকার নেই। এখানে ফিরে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে তুমি।

ছেলেটি প্রতিবাদের সুরে বিড় বিড় করে বলল, সোসাইটি! ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রচুর অর্থ রোজগার করা। তারপরে তোমাকে আর সাইবিলকে স্টেজ থেকে সরিয়ে আনা। স্টেজে অভিনয় করাকে আমি ঘৃণা করি।

সাইবিল হাসতে হাসতে বলল, ও জিম। কী নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ তুমি? কিন্তু সত্যিই কি তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে? খুব খুশি হব আমি আমার ভয় হচ্ছিল তুমি হয়তো তোমার কিছু বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিতে বেরিয়ে গিয়েছ, বিশেষ করে টম হার্ডি। যে। তোমাকে ওই বিচ্ছিরি পাইপটা দিয়েছ, অথবা নেড ল্যাঙটল, সেই পাইপ টানার জন্যে যে তোমাকে সব সময় ঠাট্টা করে। বিকেলটা আমার সঙ্গে বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে তুমি যে আমাকে ভালোবাস তারই প্রমাণ দিয়েছ। কোথায় যাবে বল তো? চুল, পার্কে যাই।

ছেলেটি একটু চটেই বলল, আমার পোশাক নোংরা। ধনী লোকরাই কেবল পার্কে যায়।

তার জামার হাতটা চাপড়াতে চাপড়াতে সাইবিল বলল, বোকা কোথাকার, জিম।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল জিম, তারপরে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু আজতে বেশি দেরি করো না। চটপট সেরে নাও।

 নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে চলে গেল সাইবিলা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সেই গানের সুর নীচেও শোনা গেল। মাথার ওপরে তার ছোট্ট পা দুটি অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করতে লাগল।

জিম দু-তিনবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করল, তারপরে চেয়ারের ওপরে নিশ্চলভাবে যে মূর্তিটি বসেছিল তার দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, মা, আমার জিনিসপত্র সব ঠিক করে রেখেছ?

নিজের কাজের দিকে চোখ রেখে মা বললেন, হ্যাঁ, জিম। সব ঠিক রয়েছে।

এই রুক্ষ, কড়া মেজাজের পুত্রটির সঙ্গে যখনি তিনি একা থেকেছেন, বিশেষ করে শেষ কটি মাস, তখনি মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভোগ করেছেন। দুজনের চোখাচোখি হলেই, তাঁর গোপন সফরী-চরিত্রটা নিজেকে বিপদাপন্ন বলে মনে করত ছেলেটি কিছু সন্দেহ করছে নাকি এই কথাটাই প্রায় তিনি অবাক হয়ে ভাবতেন। ছেলেটি কথা বলত কম, চুপচাপ থাকত বেশি। এই সময়টাই তাঁর কাছে অসহ্য লাগত। ফলে তিনি অভিযোগ করতে শুরু করলেন। ওপরকে আক্রমণ করেই মহিলারা নিজেদের রক্ষা করে, ঠিক যেমন হঠাৎ এবং অদ্ভুতভাবে আত্মসমর্পণ করার উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে।

তিনি বললেন, জেমস, আমি আশা করি, নাবিকের জীবনে তুমি সন্তুষ্ট হয়েছা স্মরণ রেখ, এ-জীবন তুমি নিজেই বেছে নিয়েছ। তুমি কোনো সলিসিটরের অফিসে চাকরি নিতে পারতে, শ্রেণি হিসাবে সলিসিটরদের আমরা সম্মানাই বলে মনে করি, এবং এদেশে তারা বেশ উঁচু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ডিনার খায়।

জেমস উত্তর দিল, চাকরির জীবনটাকে আমি ঘৃণা করি, বিশেষ করে কেরানির চাকরি। কিন্তু তুমি ঠিক কথাই বলেছ। নিজের পেশা আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, সাইবিলের ওপরে লক্ষ রেখো। তার যেন কোনো ক্ষতি না হয় মা, তার দিকে নজর রেখো।

জেমস, তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি। তার ওপরে নিশ্চয় আমি লক্ষ রাখি।

শুনলাম একটি ভদ্রলোক নাকি প্রতিদিন থিয়েটারে আসেন, আর তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। স্টেডের পিছলে যান। এ সংবাদ কি সত্যি? এ বিষয়ে কী বল তুমি?

জেমস, তুমি কি বলছ তা তুমি নিজেই জান না। আমাদের পেশায় আমাদের যাঁরা গুণমুগ্ধ তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে আমরা অভ্যস্ত। একসময় আমি নিজেও অনেক ফুলের তোড়া। উপহার পেয়েছি। সে-যুগে সত্যিকার অভিনয় কাকে বলে মানুষ তা বুঝত। সাইবিলের কথা যদি বল, আমি জানি না ওদের এই আলাপ সত্যিকার সিরিয়াস, কি সিরিঘাস নয়। কিন্তু যুবকটি যে সত্যিকার ভদ্র সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে সে খুব শ্রদ্ধা করে। তাছাড়া দেখলে মনে হয় ছেলেটি ধনী, যে সব ফুল সে আমাদের পাঠায় সেগুলিও খুব সুন্দর।

জেমস কর্কশ স্বরেই বলল, যদিও তুমি তার নাম জান না।

মুখের চেহারা কোনো রকম বিকৃত না করেই মা বললেন, না। ছেলেটি তার আসল নামটা পর্যন্ত আমাকে এখনো বলেনি। মনে হচ্ছে, এই না-বলাটাই তার একটা আনন্দ ছেলেটি সম্ভবত অভিজাত শ্রেণির

নিজের ঠোঁট কামড়াল জেমস, শুধুমাত্র বলল, ওর দিকে লক্ষ রেখো মা, ওর ওপরে লক্ষ রেখো।

বাছা, তোমার কথা শুনে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। সাইবিল সব সময় আমার বিশেষ নজরের মধ্যে রয়েছে। অবশ্য এই ছেলেটি যদি ধনী হয় তাহলে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেই বা সাইবিল ইতস্তত করবে কেন? আমার বিশ্বাস ছেলেটি অভিজাত সম্প্রদায়ের পাত্র হিসাবে সাইবিলের পহেল্ক ছেলেটি হবে পয়লা নম্বরের। দুজনে মিলবেও ভালো, যাকে বলে রাজযোটক মিলা ছেলেটি দেখতেও বেশ ভালো। সবাই তা লক্ষ করেছে।

নিজের মনে মনে বিড় বিড করতে লাগল জেমস, তারপরে জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে শার্সির ওপরে আঙুলের টোকা দিতে লাগল। কিছু বলার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখল। দরজটা খুলে গিয়েছে, সেই খোলা দরজার ভেতর দিয়ে সাইবিল দৌড়ে আসছে।

সে বলল, তোমরা দুজেনি দেখছি বেশ গম্ভীর। বলি, ব্যাপারটা কী?

জেমস বলল, ও কিছু নয়। মাঝে মাঝে মানুষের কিছুটা সিরিয়াস হওয়া উচিত। মা, আমরা চললাম। সন্ধে পাঁচটার সময় আমি ডিনার খাব। একমাত্র শার্ট ছাড়া, আর সবই গোছানো হয়ে গেছে। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।

একটু কষ্টকল্পিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে মা বললেন, এস।

জেমস যে ভাষায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছিল তাতে তিনি সত্যিই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তার চোখের মধ্যে এমন একটা জিনিস তিনি দেখছিলেন যেটা তাঁকে রীতিমতো শঙ্কিত করে তুলেছিল।

সাইবিল বলল, আমাকে একটা চুমু দাও, মা।

এই বলে সে তার ফুলের মতো নরম দুটি ঠোঁট দিয়ে তার মায়ের শুকনো গালের হাড়ের ওপর চুমু খেল। তাঁর ঠান্ডা গাল দুটিকে উষ্ক করে তুলল।

কাল্পনিক দর্শকের অন্বেষণে ওপরের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় মা বললেন, বাছা, বাছা আমার!

জেমস অস্থির হয়ে বলল, এস সাইবিল।

মায়ের এই স্নেহ প্রবণতাকে সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারল না।

বাতাসে কাঁপানো সূর্যের আলোতে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, হাঁটতে লাগল। নিরানন্দ উসটন রোড ধরে। একটি সুন্দরী পোশাকে-চললে পরিচ্ছন রুচির মেয়ের পাশে ওই রকম। বেখাপ্পা পোশাক পরা গম্ভীর মোডের বিষণ্ণ একটি যুবককে হাঁটতে দেখে পথচারীরা একটু অবাক হয়েই তাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাদের মনে হল যেন একটি গোলাপ ফুলের সঙ্গে একটা সাধারণ মালি হেঁটে চলেছে।

অপরিচিত কোনো মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির ওপরে চোখ পড়ার ফলে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জিম, মাঝে মাঝে কুটিও করল। অদ্ভুত চেহারার মানুষদের কৌতূহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস সাধারণ মানুষরা কোনো দিনই ছাড়তে পারে না। শেষ জীবনে জিনিয়াসরা এই দৃষ্টির জ্বালায তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন। সেই রকমের একটা অনুভূতি। জিমকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল। সাইবিলের অবশ্য অন্য কথা। পথচারীদের ওপরে সে যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে সে-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। প্রেমের আবেগ হাসির উচ্ছ্বাসে তার ঠোঁট দুটিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। সে তখন প্রিন্স চার্মিং-এর কথাই ভাবছিল। তার সম্বন্ধে বেশি চিন্তা করার জন্যে তাঁকে নিয়ে মুখে কোনো আলোচনা করল না। সাইবিল। আলোচনা করল কেবল জিম-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে, যে-জাহাজে চড়ে সে যাবে সেই জাহাজ নিয়ে, বিদেশে গিয়ে সে যে প্রচুর সোনা রোজগার করবে সেই সোনা নিয়ে, দুষ্টপ্রকৃতির রেড-ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে যে অপরুপ সুন্দরী রাজকুমারীকে সে উদ্ধার করবে–সেই ভাবনা নিয়ে। কারণ, একটি সাধারণ নাবিক অথবা সুপার-কারগো অথবা এখন সে যে কাজের জন্যে যাচ্ছে সেইটুকু নিয়েই সে জীবন কাটাবে না। না, না, নিশ্চয় না। নাবিকের ভীবন বড়ো কষ্টকর। একটা ডাহাড়ের খোলের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকটা কি ভীষণ কষ্টকর। চারপাশে সমুদ্রের তরঙ্গ, হাডার হাডার সেই তরঙ্গ বিরাট বিরাট ঝুটি বাগিয়ে ফুলে-ফুঁসে চারপাশে সমুদ্রের তরঙ্গ, হাজার হাজার সেই তরঙ্গ বিরাট বিরাট ঝুটি বাগিয়ে ফুলে-ফুঁসে চারপাশ থেকে ধাক্কা দিচ্ছে জাহাঙটাকে। কখনো কখনো বা কালো কালো দৈত্যদানব ঝড়ের ঝাপটায় পাল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। নাবিকের জীবন সে যে কত ভয়ঙ্কর, কত বিপজ্জঙ্ক তা একবার ভেবে দেখুন। মেলবোর্নে সে ডাহাজ থেকে নামবে, ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সোনার খনিতে হাজির হবে। এক সপ্তাহ কাটার আগেই একতাল খাঁটি সোনা সে পেয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত অত বড়ো তাল কেউ খুঁজে পায়নি। ছ‘জন সশস্ত্র অশ্বারোহী পুলিশের তত্ত্বাবধানে সেই তালটা রেলগাড়িতে চাপিয়ে। সমুদ্রোপকূলে নিয়ে আসা হবে। বনে-বাদাড়ে যে সব ডাকাতরা লুকিয়ে থাকে সেই সোনা। ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে তারা অন্তত বার তিনেক গাড়িটাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু তাদের আক্রমণ প্রতিহত হবে। অনেক হতাহতকে পেছনে গেলে পালিয়ে যাবে তারা।

অথবা, না। জিম আদৌ হয়তো সোনার খনির দিকে যাবে না। এই খনিগুলি বড়ো খারাপ জাযগা। এসব জায়গায় যারা কাজ করে তারা সব সময়ে মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে। সেই মত্ত। অবস্থায় সরাইখানায় তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, মুখ খিস্তি করে। হয়তো সে যাবে কোনো মেষপালকের খামারে। কোনো কোনো এক সন্ধ্যায় যখন সে ঘোড়ায় চড়ে খামারে। ফিরবে এমন সময় সে হয়তো দেখতে পাবে কোনো দস্যু কালো পোশাক পরে একটা কালো ঘোড়ার পিঠে চডিযে একটি ধনীর অপরুপ সুন্দরী মেয়েকে চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। সেই দেখে সে দস্যুকে তাড়া করবে, উদ্ধার করে আনবে মেয়েটিকে। তারপরে নিশ্চয় মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে যাবে, জিমও ভালোবেসে ফেলবে তাকে। শেষ পর্যন্ত সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে প্রচুর সম্পদ নিয়ে ফিরে আসবে জিম, লন্ডনে বিরাট একটি প্রাসাদ নিয়ে বসবাস করবে। হ্যাঁ, নিশ্চয় অনেক প্রাচুর্য, অনেক আনন্দ জিমের জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে কিন্তু তাকে চরিত্রের দিক থেকে ভালো হতে হবে, মেজাজটিকে রাখতে হবে শরিফ; মুখের মতো অর্থনষ্ট করলে তার চলবে না, জিমের চেয়ে সে মাত্র এক বছরের বড়ো; কিন্তু সাংসারিক অভিজ্ঞতা তার অনেক, অনেক বেশি। প্রতিটি ডাকে সে যেন তাকে চিঠি দে, আর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে যেন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। ভগবান খুব ভালো, তিনি নিশ্চয় তাঁর দিকে লক্ষ্য রাখবেন। সে নিজেও তার ভাই-এর জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাবে। কয়েকটা বছরের মধ্যে জিম বেশ ধনী আর সুখী হয়ে ফিরে আসবে।

ছেলেটি গম্ভীর হয়ে তার কথা শুনছিল; কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার চিন্তায় তার মনটা খুব খারাপ হয়েছিল।

তবু ওই একটা ব্যাপারই তাকে বিষণ্ণ করেনি। সাংসারিক অভিজ্ঞতা তার যথেষ্ট না থাকলেও, সাইবিলের পেশায় যে বিপদ রয়েছে সে-সম্ভাবনাটাও কেমন যেন তাকে বিব্রত করে তুলেছিল। ওই যে ভদ্রবেশধারী যুবকটি তার সঙ্গে প্রেম করে চলেছে সেটা তার কাছে মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। যুবকটি ভদ্রলোক; বিশেষ করে সেই জন্যেই জিম তাকে ঘৃণা করে, যদিও এর পেছনে ঠিক কী কারণ রয়েছে তা সে বুঝতে পারে না; হয়তো শ্রেণিবিদ্বেষই এর মূল কারণ। তার মায়ের বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি যে যথেষ্ট কম সে-বিষয়েও তার সন্দেহ কম ছিল না। বিশেষ করে সেই কারণে বিপদে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা সাইবিলের রয়েছে বলে সে মনে করত। শিশুরা তাদের বাবা-মাকে ভালোবেসেই জীবন শুরু করে। ব্যস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাঁদের বিচার করতে শুরু করে; কখনো-কখনো তাঁদের দোষ তারা ক্ষমাও করে।

তার মা! একটা প্রশ্ন মাকে তার করার ইচ্ছা ছিল, অনেক দিন ধরে এই প্রশ্নটা সে মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিল থিয়েটারে একদিন হঠাৎ কথাটা তার কানে গিয়েছিল, একদিন সে যখন থিয়েটারের দরজায় অপেক্ষা করছিল সেই সময় কিছু লোক কথাটা নিয়ে হাসাহাসি। করছিল। সেই হাসির টুকরো সে শুনতে পেয়েছিল। মনে হল, কে যেন তার মুখের ওপরে সুপাং করে একটা চাবুক কষিয়ে দিয়েছে। তার কপালে কুঞ্চিত হল এবং একটা মারাত্মক রকমের যন্ত্রণাকে সহ্য করার জন্যে সে তার নীচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল।

সাইবিল; আমার কথা কিছুই তোমার কানে ঢুকছে না, জিম। তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের কী সুন্দর পরিকল্পনাই তোমার জন্যে আমি তৈর করে দিচ্ছি। কিছু বল।

 কী শুনতে চাও তুমি?

সাইবিল ভাই-এর দিকে চেয়ে হেসে বলল: তুমি বেশ লক্ষ্মী ছেলে হবে, আর আমাদের ভুলে যাবে না।

জিম তার কাঁধে একট স্রাগ করল, তারপরে বলল: তুমিই বরং আমাকে তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে সাইবিল; অন্তত সেদিক থেকে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

সাইবিলের মুখ লাল হয়ে উঠল: তুমি ঠিক কী বলতে চাচ্ছ জিম?

শুনছি, তোমার একটি নতুন বন্ধু হয়েছে। সে কে? তার বিষয়ে তুমি আমাকে কিছু বলনি কেন? তাকে দিয়ে তোমার কোনো মঙ্গল হবে না।

সাইবিল চেঁচিয়ে উঠল: জিম, তুমি থাম, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা তুমি বলবে না, আমি তাকে ভালোবাসি।

জিম বলল: ভালোবাসা? সাবাস! তুমি তার নামটা পর্যন্ত জান না। কে সে? তার পরিচয় কী? এসব জানার অধিকার আমার রয়েছে।

তাকে সবাই প্রিন্স চার্মিং বলে ডাকে। এ-নামটা তোমার পছন্দ হয় না? বোকা ছেলে কোথাকার। এ নামটা ভুলে যাওয়া তোমার উচিত নয়। তাকে একবার চোখে দেখলে তোমার মনে হত অমন সুন্দর, অপরূপ মানুষ পৃথিবীতে আর বুঝি নেই। একদিন তার সঙ্গে তোমার। দেখা হবে; অবশ্য অস্ট্রেলিয় থেকে ফিরে আসার পূরে; খুব ভালো লাগবে তোমার। সবাই তাকে পছন্দ করে; আর আমি…আমি তাকে ভালোবাসি। তুমি যদি আজ থিয়েটারে আসতে পারতে! সে আজ আসছে। আজ আমি ভুলিযেট-এর ভূমিকায় অভিনয় করব। উঃ, কী রকম অভিনয় করব বল তো? ডিমি, ভেব দেখ, সত্যিকার প্রেমে পড়ে জুলিয়েট-এর অভিনয় করব আমি। সে থিয়েটারে বসে আমার অভিনয় দেখবে তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য অভিনয় করব আমি। ভয় হচ্ছে, আমি হয়তো দর্শকদের ভয় পাইয়ে দেব; প্রেমে পড়লেই মানুষ তার স্বাভাবিকতার বেড়া ডিঙিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আর ওই হতভাগ্য বদমেজাজী আইস্যাকস তার বার-এ যে সব তৃতীয় শ্রেণির মানুষরা মদ খেতে ঢোকে তাদের কাছে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করে বলবে–একটি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। এতদিন সে আমাকে প্রচার করেছিল গোঁড়া বলে এখন সে প্রচার করে আমি একটি ঐশ্বরিক শক্তিধারিণী প্রতিভা বিশেষ। আমি তা বেশ বুঝতে পারছি। আর এ-সমস্তই কেবল তারই জন্যে–সেই প্রিন্স চার্মিং-এর। কিন্তু তার উপযুক্ত আমি নই? দরিদ্র আমি! দরিদ্র? তাতে কী যায় আসে? ঘরের। দরজা দিয়ে যখন দারিদ্র্য হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে আসে, প্রেম তখন ডানালার ভেতর দিয়ে উড়ে যায়। আমাদের এই প্রবাদ বচনটিকে নতুনভাবে লিখতে হবে। মানুষের দুঃখের দিনে এই প্রবচনটি রচিত হয়েছিল; এখন সুখের দিন আমার-বসন্তের মাতাল করা দিন; নীল আকাশের বুক ফুলের সমারোহ জাগার দিন।

জিম গম্ভীরভাবেই বলল: তিনি ভদ্রলোক…

গানের ঢঙে সাইবিল বলল: ভদ্রলোক কি বলছ–বল-রাজকুমার-প্রিন্স। আর বেশি তুমি কী চাও?

তিনি তোমাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধতে চান।

তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশঙ্কায় আমি কাঁপি।

আমি চাই তাঁকে তুমি এড়িয়ে চল।

তাকে দেখা পাওয়ার অর্থই হচ্ছে তাকে পুজো করা; তাকে যে ভানে সে তাকে বিশ্বাস না করে। পারে না।

সাইবিল, তুমি উন্মাদের মতো কথা বলছ।

সাইবিল হেসে তার একটা হাত ধরে বলল: ভাই জিম, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে বয়স। তোমার একশো বছরের কাছাকাছি সময় আসবে যেদিন তুমি নিজেকেই নিজে ভালোবেসে। ফেলবে। তখন তুমি বুঝতে পারবে ভালোবাসা কী বস্তু। অতটা মুখ গম্ভীর করে রেখো না। যদিও তুমি চলে যাচ্ছ, তবু যাওয়ার সময় এই কথাট ডেনে যাও যে আগের চেয়ে এখন আমি অনেক সুখী। তোমাকে এবং আমাকে দুজনকেই বেশ কষ্টের ভিতর দিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু এখন সেই কষ্টের সমাপ্তি। তুমি পেযে একটি নতুন জগতের সন্ধান, আমি পেযেছি একটি নতুন জীবনের সন্ধান। দুটি চেয়ার আমাদের সামনে রয়েছে পাতা। এস, আমরা এদের ওপরে বসে চালাক-চতুর মানুষদের আসা-যাওয়া দেখি।

একদল উৎসুক দর্শকদরে চোখের সামনে তারা দুটি চেয়ার দখল করে বসল। রাস্তার ওপরে একরাশ আগুন রঙের লাল ফুল গোল করে কাঁপছে। মহিলাদের চকচকে রৌদ্রনিবারণী ছাতাগুলি বাতাসে কাঁপছে দেখে মনে হচ্ছে যেন বিরাট-বিরাট প্রভাপতির দল নেচে-নেচে বেড়াচ্ছে।

সাইবিলের অনুরোধে জিম তার ভবিষ্যতের অনেক আশা-ভরসার কথা বলতে লাগল। বেশ কষ্ট করেই সে ধীরে-ধীরে মুখ খুলল। তারপরে দুজনেই কথায় মেতে উঠল। বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল সাইবিল। নিজের আনন্দের কথা কিছুতেই খুলে বলতে পারছিল না। ভাই-এর কাছ থেকে কোন সহানুভূতির কথা সে শুনতে পায়নি। তার কথা শুনে সে মাঝে-মাঝে একটু আধটু ভ্রূকুটি করছিল মাত্র। কিছুক্তণ পরে সাইবিল নিজেই চুপ করে গেল। হঠাৎ ডোরিয়েন গ্রে-র সোনালি চুল আর হাসিমাখা মুখখানা তার চোখ পড়ল। একটা খোলা গাড়িতে চেপে দুটি মহিলার সঙ্গে গ্রে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল।

সাইবিল উত্তেজনায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল: ওই যে সে।

জিম জিজ্ঞাসা করল: কার কথা বলছ?

অপসৃয়মান গাড়িটির দিকে তাকিয়ে সাইবিল বলল: প্রিন্স চার্মিং।

জিম লাফিয়ে উঠল; তারপর সাইবিলের একটা হাত ধরে জোরে নাড়া দিয়ে বলল: কোথায়, কোথায়? কোনটি তোমার প্রিন্স চার্মিং? বল-বল। তাকে আমি দেখবই।

 কিন্তু দেখা বা দেখানোর সুযোগ কোনোটাই হল না। ঠিক সেই মুহূর্তে বারউইকসএর ডিউকের চার ঘোড়ার গাড়িটি দু’দলের মাঝখানে এসে হাজির হল। পথ যখন পরিষ্কার হল তখন ডোরিয়েনের গাড়িটি পার্কের এলাকা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

দুঃখের সঙ্গে সাইবিল বলল: সে চলে গিয়েছে। তাকে যদি তুমি দেখতে পেতে আমি তাহলে খুব খুশি হতাম।

দেখতে পাওয়া উচিত ছিল আমার, কারণ, ভগবানের দিব্যি করে বলছি, ওর হাতে যদি তোমার কোনো ক্ষতি হয় তাহলে ওকে শেষ করে ছাড়ব।

কথাটা শুনে সাইবিল তার ভাই-এর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জিম সেই কথাটাই আবার বলো ধারালো ছুরির মতো কথাগুলি বাতাসের বুকে কেটে-কেটে বসল। আশপাশের লোকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। সাইবিলের পাশে দাঁড়ানো একটি মহিলা তো মুখ চিপে ফিক ফিক করে হেসেই উঠল।

চারপাশের অবস্থা দেখে সাইবিল ফিসফিস করে বলল: জিম, চলে এস।

জিম ভিড়ের ভিতর দিয়ে সাইবিলের পিছু পিছু এগোতে লাগল। সে যে ওই কথাগুলি বলতে পেরেছে তাতেই সে খুশি।

 অ্যাকিলিস-এর মূর্তির কাছাকাছি আসার পরে, সাইবিল ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখের মধ্যে এতক্ষণ করুণার একটা ছায়া লুকিয়ে ছিল; সেইটাই এবারে তার ঠোঁট দুটির ওপরে হাসির। ছটায় রূপান্তরিত হল। জিম-এর দিকে তাকিয়ে মাথায় ঝাঁকানি দিয়ে সে বলল: জিম, তুমি বোকা; শুধু বোকাই নও, একেবারে যাকে বলে নিরেট গর্দভ, বদমেজাজী। এসব কথা তুমি উচ্চারণ কর কেমন করে? কী বলছ তা তুমি জান না! তুমি কেবল হিংসুটেই নও, বড়ো কঠিন। আমি চাই তুমিও প্রেমে পড়া একমাত্র প্রেমই মানুষকে ভালো করে। এইমাত্র তুমি যা বললে সে-সব কথা দুষ্ট লোকেরা বলে থাকে।

জিম বলল: আমার বয়স ষোল। আমি কি বলছি তা আমি জানি। কোনোদিন দিয়ে মা তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারছে না। তোমাকে কী ভাবে মানুষ করতে হবে সে-সম্বন্ধে মায়ের কোনো ধারণা-ও নেই। ঠিক এই সময় অস্ট্রেলিযা না যেতে পারলেই খুশি হতাম আমি। সব জিনিসটা বেশ ভালো করে তলিয়ে দেখার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু কাগজপত্র সব সই হয়ে গিয়েছে। বিপদটা সেইখানেই।

না, না জিম। অত ভাববার দরকার নেই। মা যে সব রম্য-নাটক অভিনয় করতে ভালোবাসত, তুমি সেই সব নাটকেরই নায়কের মতো কথা বলছ তোমার সঙ্গে ঝগড়া আমি করব না। আমি তাকে দেখছি, তাকে দেখেই আমার মন-প্রাণ আনন্দে ভরে উঠেছে। কোনোদিনই আমরা ঝগড়া করব না। আশা করি, আমি যাকে ভালোবাসি তার কোনো ক্ষতি করবে, না। আমার এ ধারণা ঠিক তো?

জিম গম্ভীরভাবে বলল:অবশ্য যতক্ষণ তুমি তাকে ভালোবাসবে ততক্ষণ।

 সাইবিল একটু চেঁচিয়ে আর বেশ জোর দিয়েই বলল; আমি তাকে চিরকাল ভালোবাসব।

আর সে?

সেও চিরকাল।

স্বার্থের খাতিরে তাই তার করা উচিত। সাইবিল তার কাছ থেকে একটু সরে গেল; তারপরে হেসে তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে ধরলা ভিম সত্যিই বড়ো ছেলেমানুষ।

মার্বেল আর্চের কাছে এসে তারা একটা বাস ধরল। এসটেন রোড-এ বাডির কাছাকাছি একটা জায়গায় নেমে গেল তারা। বিকাল পাঁচটার পরেই তারা ফিরে এল। থিয়েটারে যাওয়ার আগে ঘন্টা-দুই সাইবিলকে বিশ্রাম নিতে হবে, স্রেফ বিছানার ওপরে গড়াগড়ি দিতে হবে তাকে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে জিমও বারবার তাকে চাপ দিল। সে বলল তার মা একটু সরে গেলেই সে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে। অন্যথায়, মা কান্নাকাটি করে শেষ পর্যন্ত একটা কাণ্ড করে তুলবে। কান্নাকাটি করে হইচই করাটাকে সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না।

সাইবিলের ঘরেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল। ছেলেটির মনের মধ্যে হিংসার একটা বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, তাদের দুজনের মধ্যে এই তৃতীয় ব্যক্তিটির আগমন সে মোটেই বরদাস্ত করে উঠতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, আগন্তুকটির সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে খুন করে ফেলতে পারত। তবু, যখন সাইবিল দুটি হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তার চুলের ভেতর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে চুমু খেল তখনই তার মনটা নরম হয়ে গেল; সত্যিকার ভালোবাসা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল; সেও আদুরে ভাই-এর মতো বোনকে চুমু খেল। সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল তারা; চোখের জলের ভেতর দিয়ে বিদায় নিল।

তার জন্যে নীচে তার মা অপেক্ষা করছিলেন। সে ঘরে ঢুকতেই, দেরি করার জন্যে মা গজ গজ করতে লাগলেন। কোনো উত্তর না দিয়ে জিম খেতে বসল। খাওয়ার আয়োজন এমন কিছু ছিল না। কিন্তু তা-ও তার খুব ভালো লাগল বলে মনে হল না। চারপাশে মাছি ভন ভন করতে লাগল; দু’চারটে টেবিলের ওপরে লাগল ঘুরতো রাস্তায় যানবাহনের হট্টগেল; এদের মধ্যে দিয়েই তার বিদাযের শেষ কটি মুহর্ত ধীরে-ধীরে নিঃশোষিত হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে সে খাবারের থালাটা সরিয়ে রাখল; মাথাটাকে দুটো হাতের চেটো দিয়ে চেপে ধরল। তার মনে হল ওদের মধ্যে কী ঘটছে তা বিশেষভাবে জানার অধিকার তার রয়েছে এ ব্যাপারটা তাকে আরো আগেই ডানানো উচিত ছিল। তাহলে সে বুঝতে পারত সে যা সন্দেহ করেছে সেটা সত্যি কি না। ছেলের অকস্মাৎ এই ভাবালুতায় মা ভয় পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে। রইলেন। যান্ত্রিকভাবেই তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল, একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার রুমাল তিনি আঙুলে জড়াতে লাগলেন। ঘড়িতে ছটা বাজল। জিম ধীরে ধীরে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকাল। চোখাচোখি হল দুজনের। জিম দেখল মা তাকে সব জিনিসটা হন্ডুমার চোখে দেখতে অনুরোধ করছেন। এই মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সে চটে উঠল।

মা, তোমাকে কিছু বলার রয়েছে আমার।

মা-র চোখ দুটি ঘরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোনো উত্তর দিলেন না তিনি।

মা, আমাকে সত্যি কথা বলা কথাটা জানার অধিকার রয়েছে আমার বাবার সঙ্গে কি তোমার বিয়ে হয়েছিল?

ভদ্রমহিলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। বুকের বোঝা অনেকটা হালকা হয়ে গেল তাঁর। এতদিন ধরে, দিনে আর রাতে, সপ্তাহ আর মাস ধরে সে মুহর্তটির জন্যে আতঙ্কিত হৃদয়ে তিনি অপেক্ষা করে দিন গুনছিলেন সেই চরম মুহূর্তটি তাঁর সামনে এসে হাজির হয়েছে। যতই কদর্য হোক, প্রশ্নটি সোডা, সোডা উত্তরই দিতে হবে তাঁকে। এই রকম একটি অবস্থার। জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি ছিল না। জিম-এর প্রশ্নটি অকস্মাৎ; কেবল অকস্মাৎ-ই নয়, একেবারে যাকে বলে অমার্জিত; অনেকটা নাটকের খারাপ রিহার্সালের মতো।

ভীবনের সহজ বর্বর গতির কথা চিন্তা করে অবাক হয়েছিলেন তিনি। এটাই যেন জীবনের একমাত্র সত্য; কিন্তু কেন যে এই বর্বরতা মানুষ মেনে নেয়, বা মেনে নিতে বাধ্য হয়, তা ডানার মতো দই→তা তাঁর ছিল না, অনেক সহজ ডিলিসের মতো এটাও একটা বর্বর সত্য।

না; বিয়ে হয়নি।

 দুটো হাত শক্ত করে ঘুষি পাকিযে ছেলেটি চিৎকার করে উঠল: আমার বাবা তাহলে একটি স্কাউনড্রেল।

ঘাড় নাড়লেন তিনি বললেন: না, আমি জানতাম, সামাজিকভাবে বিয়ে তিনি আমাকে করতে পারতেন না। সেদিকে থেকে যথেষ্ট অসুবিধে ছিল তাঁর। কিন্তু আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতাম। বেঁচে থাকলে, নিশ্চয় তিনি আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করে যেতে পারতেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করো না, বাছা; তিনি তোমার বাব এবং ভদ্রলোক। তাছাড়া, অভিজাত ছিলেন তিনি।

ভ্রুকুটি করল জিম: আমার জন্যে কিছুই আমি গ্রাহ্য করিনে। কিন্তু সাইবিলকে তুমি কিছুতেই…এও তো একজন ভদ্রলোক-তাই ন্য-ওই যে লোকটি সাইবিলকে।

ভালোবাসে–অথবা, বলে সে ভালোবাসে? তাছাড়া, মনে হচ্ছে–বেশ অভিজাত সমপ্রদায়ের মানুষ-তাই না?

 হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। একটা ভয়ঙ্কর রকমের ক্লেদাক্ত অপমান তাঁকে স্তব্ধ করে দিল। লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ল তাঁর। হাত দুটো কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপানো হাত দিয়ে চোখ দুটো তিনি মুছলেন, বললেন: সাইবিলের মা রয়েছে। আমার মা ছিল না।

মায়ের কথা শুনে জিমের মন নরম হয়ে গেল, সে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে তাঁকে চুমু খেল; বলল: বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে তোমাকে যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্য আমি দুঃখিত, মা। কিন্তু জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। এখন আমাকে যেতেই হবে। ভুলে যেয়ো না যে এখন থেকে লক্ষ রাখার মতো একটি সন্তানই তোমার কছে রইল; আর এটাও তুমি বিশ্বাস। করো যে সেই লোকটা আমার বোনের যদি এতটুকু ক্ষতি করে, আমি নিশ্চয় খুঁজে বার করব। তাকে, তারপর কুকুরের মতো গুলি করে মারা প্রতিজ্ঞা করছি আমি।

ভয় দেখানোর এই অনাবশ্যক মূর্খতা, উচ্ছ্বাস, আর উন্মত্ত নাটকীয় ঢঙ ভদ্রমহিলার কাছে জীবনটাকে আরো স্মৃষ্ট করে তুলল। এইরকম একটি আবহাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। এই আবহাওয়ার তিনি আরো সহজ ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন; আর অনেক দিন পরে সেই প্রথম ছেলেকে তিনি সত্যি-সত্যিই প্রশংসা করলেন। উচ্ছ্বাসভরা এই পরিস্থিতি আরো কিছুক্ষণ কাটানোর ইচ্ছে ছিল তাঁর; কিন্তু সে-সুযোগ তিনি পেলন না; পুত্ৰই তাঁকে থামিয়ে। দিল। তখলো ট্রাঙ্কটা নামানো হয়নি; খোঁজা হয়নি ‘মাফলার’। বাস-করার অনেক টুকিটাকি জিনিস এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিল। গাড়োযানের সঙ্গে দর কষাকষি করতে হল; খুঁটিনাটি কাজের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। ছেলে গাড়িতে উঠে চলে যাওয়ার পরে, নতুন ব্যর্থতায ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানালা থেকে ছেঁড়া রুমালের একটা টুকরো নিয়ে নাড়তে লাগলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন একটা বড়ো রকমের সুযোগ নষ্ট হয়েছে। সাইবিলকে এই বলে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন যে বর্তমানে তাঁর আর কাজ নেই, তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন; কারণ, এখন লক্ষ রাখার মতো একটি সন্তানই তাঁর কাছে রয়েছে। ছেলের কথাটা তাঁর মনে ছিল। কথাটা তাঁকে খুশিই করেছিল। ছেলে যে ভয় দেখিয়েছিল সে-বিষয়ে মেয়েকে তিনি কিছুই বলেননি। কথাটা জিম বেশ সপষ্ট করে আর নাটকীয় ভঙ্গিতেই বলেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল এই কথাটা নিয়ে একদিন সবাই তাঁরা হাসাহাসি করবেন।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ব্রিস্টল হোটেলের একটি ছোটো কামরায় সেদিন সন্ধ্যায় কেবল তিনজনের জন্যে ডিনার দেওয়া হয়েছিল। বেসিল হলওয়ারর্ডের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে লর্ড হেনরি ডিজ্ঞাসা করলেন: বেসিল, তুমি নিশ্চয় খবরটা শুনেছ?

একজন ওয়েটার মাথা নীচু করে তাঁদের অভিবাদন জানাল; সেই ওযেটারের হাতে টপি আর কোটটা দিয়ে আর্টিস্ট হলওয়ার্ড বললেন; না, হ্যারি। কী খবর বল তো? আশা করি রাজনীতির ব্যাপার কিছু নয়? ও-সব খবরে আমার আগ্রহ নেই। হাউস-অফ-কমনস-এ এমন একজন সদস্যও নেই যার প্রতিকৃতি আঁকা চলতে পারে; যদিও অবশ্য, কিছুটা পালিশ করলে তাদের ভালোই দেখায়।

 লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন গ্রে বিয়ে করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

 চমকে উঠলেন হলওয়ার্ড; তারপরে ভ্রুকুটি করলেন, বললেন: কী বললে! ডোরিয়েন গ্রে বিয়ে করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে? অসম্ভব, অসম্ভব!

না, সত্যি; যাকে বলে নির্ভেজাল সত্যি।

কাকে বিয়ে করবে?

একটি খুদে অভিনেত্রী বা ওই জাতীয় কোনো মেয়েকে।

 আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই। এসব ব্যাপারে ডোরিয়েন অনেক বেশি বুদ্ধিমান।

প্রিয় বেসিল, বরং বলতে পার মাঝে-মাঝে বোকার মতো কাজ না করার মতো ডোরিয়েন বুদ্ধিমান।

হ্যারি, মাঝে-মাঝে করার মতো কাজ বিয়েটা মোটেই নয়।

লর্ড হেনরি ক্লান্তভাবে বললেন: আমেরিকা ছাড়া। কিন্তু আমি বলিনি সে বিয়ে করেছে আমি বলেছি নিজের বিয়ে সে নিজেই ঠিক করে ফেলেছে। দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমার কথাই ধর না কেন। কবে আমার বিয়ে হয়েছে সেকথাটা আমার সপষ্ট মনে রয়েছে, কিন্তু কবে আমি বিয়ে করব বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম সেকথা আমি স্রেফ ভুলে গিয়েছি। আমার যেন। মনে হচ্ছে, বিয়ে করতে আমি কোনোদিনই চুক্তিবদ্ধ হইনি।

কিন্তু ডোরিয়েনের সম্পদ, জন্ম, আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার কথাটা একবার চিন্তা করে দেখা তার সামাজিক পদমর্যাদার এত নীচের কাউকে বিয়ে করাটা তার পহেল্ক হাস্যকর হবে।

বেসিল, মেয়েটিকে সে বিয়ে করুক এটা যদি তুমি চাও, তাহলে সে কথাটা তাকে তুমি বলতে পার। তাহলে সে মেয়েটিকে নিশ্চয় বিয়ে করবে। যখনই মানুষ আকাট মূখের মতো কাজ করে তখনই বুঝবে তার পেছনে তার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।

আশা করি মেয়েটি ভালো। কোনো দুশ্চরিত্রাকে ডোরিয়েন বিয়ে করুক তা আমি চাই নে; তাতে তার চরিত্র নষ্ট হবে; নষ্ট হবে তার বুদ্ধি।

অরেঞ্জ-বিটার মেশানো ভারমুথের গ্লাসে চুমুক দিতে-দিতে লর্ড হেনরি বললেন: না, না; মেয়েটি ভালোর চেয়েও ভালো; সে সুন্দরী।ডোরিয়েন বলছে-মেয়েটি সুন্দরী। এসব ব্যাপারে সাধারনত তার ভুল হয় না। তুমি যে তার ছবিটি এঁকে তাই দেখে অন্য লোকের সৌন্দর্য তার চোখে ধরা পড়েছে। অনেক জিনিসের মধ্যে অপরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার মতো শক্তি তার রয়েছে। আর রাত্রিতে মেয়েটিকে দেখার কথা রয়েছে আমাদের, যদি অবশ্য ছোকরা এখানে আসার কথা বেমালুম ভুলে যায়।

তুমি কি সিরিয়াস?

নিশ্চয়, বেসিল। বর্তমানে আমি যতটা সিরিয়াস তার চেয়ে বেশি সিরিয়ান্স আর কখনো আমি হতে পারি একথা ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে

ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে-করতে ঠোঁটে কামড় দিয়ে বেসিল হলওয়ার্ড ডিজ্ঞাসা করলেন: কিন্তু এ-বিয়েতে কি তোমার মত রয়েছে? নিশ্চয় না। এটা একটা অর্থহীন মোহ ছাড়া আর কিছু নয়।

অনুমোদন অথবা অননুমোদন-বর্তমানে আমি কিছুই করিনে। জীবনের সম্বন্ধে এই ধরনের চিন্তা করাটা উদ্ভট। আমাদের নৈতিক কুসংস্কারকে ঢাক পিটিয়ে জাহির করার জন্যে পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করিনি। সাধারণে এ বিষয়ে কী বলে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই নে; আর মনোহর মানুষেরা যা করে তার মধ্যে আমরা নাক গলাই নে। মনোমুগ্ধকারী ব্যক্তি যে কাজ যে ভাবেই করুক না কেন আমি তাতে আনন্দ পাই। ডোরিয়েন একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি জুলিয়েট-এর ভূমিকায় অভিনয় করে। মেয়েটিকে সে বিয়ে করার প্রস্তাব। দিয়েছে। তাতে আপত্তি কী? সে যদি মেসালিনাকে বিয়ে করত তাতেই বা কী ক্ষতি হত। তুমি। ডান বিয়ের সমর্থক আমি নই। বিয়ের সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে এই যে বিয়ে করলে মানুষ। নিঃস্বার্থপর হয়; আর যে সব মানুষ স্বার্থের কথা চিন্তা করে না, চরিত্রের দিক থেকে তারা। বিবর্ণ। তাদের ব্যক্তিত্ব বলে কোনো বস্তু নেই। তবু এমন কয়েকটি মানসিক বৃত্তি রয়েছে বিয়ে যাদের ভটিলতর করে তোলে। এই সব মানুষরা তাদের অহমিকা বজায় রাখে; আর সেই অহমিকার সঙ্গে আরো অনেক দম্ভ মিশিয়ে দেয়। বিবাহিত ব্যক্তিরা একাধিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। বিয়ের পরে তারা বেশ ভালোভাবেই সংঘবদ্ধ হয় এবং আমার মতে, এই সংঘবদ্ধতাই হচ্ছে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। তা ছাড়া, প্রতিটি অভিজ্ঞতারই দাম রয়েছে; এবং বিয়ের বিরুদ্ধে যে যাই বলুক, নিঃসন্দেহে এটি একটি অভিজ্ঞতা। আমি আশা করি ডোরিয়েন এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে, দু’মাস পাগলের মতো ভালোবাসবে-তারপরে আর কেউ তাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। অনুশীলনের জন্যে ডোরিয়েন একটি অদ্ভুত চরিত্রে পরিণত হবে।

হ্যারি, এতক্ষণ ধরে তুমি যা বললে তার একটি বর্ণ-ও তুমি নিজে বিশ্বাস কর না। বিশ্বাস যে কর না তা তুমি নিজেই জাল। ডোরিয়েন গ্রে-র জীবন যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তোমার চেয়ে বেশি দুঃখ আর কেউ পাবে না। তুমি যা দেখাও তার চেয়ে তুমি অনেক উঁচু।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন: অন্য লোক যে ভালো একথা আমরা চিন্তা করি কেন জান? কারণ, নিজেরাই আমরা নিজেদের ভয় করি। অপরের ভালো দেখার ভিত্তি হচ্ছে নিছক ভীতি। আমাদের উপকারে আসতে পারে এই এইরকম কিছু গুণ অন্য লোকের মধ্যে খুঁজে বার করে আমরা তাদের প্রশংসা করি; ভাবি, এটাই আমাদের বিরাট একটা বদান্যতা। ব্যাঙ্কারকে আমরা প্রশংসা করি এই উদ্দেশ্যে যে আমরা প্রয়োজনমতো আমাদের সঞ্চিত অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারব। দস্যুদের বীরত্বের প্রশংসা করি এই ভরসায় যে তারা আমাদের পকেটটা রেহাই দেবে। আমি যা বললাম তা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। মানুষের ভবিষ্যৎ উজ্জল–এই আশাবাদকে আমি যথেষ্ট ঘৃণা করি। আর জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যদি বল তাহলে এটুকু আশ্বাস তোমাকে আমি দিতে পারি যে যে-জীবনের গতি রুদ্ধ হয়নি তার বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মানুষের প্রকৃতিকে যদি তুমি ধ্বংস করতে চাও তাহলে তাকে শুধু সংস্কার করে দাও। বিয়ের কথা যদি বল তাহলে অবশ্য মূর্খত হবে; কিন্তু বিয়ে বাদ দিয়েও নর-নারীর মধ্যে অনেক রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে; এই সম্পর্কগুলি। কেবল যে মনোরম তাই নয়, এগুলি আমাদের কৌতূহল-ও উদ্রেক করে যথেষ্ট। এইগুলি যারা গড়ে তোলে তাদের নিশ্চয়ই আমি উৎসাহিত করব। ফ্যাশানেবল বলে স্বীকৃতি পাওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা রয়েছে তাদের। কিন্তু ডোরিয়েন সশরীরে হাজির হয়েছে, আমার চেয়ে অনেক দক্ষতার সঙ্গে সে তোমাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারবে।

সার্টিনের পালক-দেওয়া টুপিটা মাথা থেকে খুলে এবং দুজনের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে করমর্দন করে ডোরিয়েন উৎসাহের আতিশয্যে বলে উঠল: প্রিয় হ্যারি, প্রিয় বেসিল, তোমরা নিশ্চয়। আমাকে অভিনন্দন জানাবে। এত আনন্দ জীবনে আর কোনোদিনই আমি পাইনি। অবশ্য এর জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি ছিল না; সত্যিকার সুখের জিনিসগুলি এইরকম। আকস্মিকভাবেই আমাদের কাছে হাজির হয়। তবু মনে হয় এইরকম একটি আনন্দকেই আমি এতদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

উত্তেজনায় আর আনন্দে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল; দেখতে তাকে অপরূপ দেখাল।

হলওয়ার্ড বললেন, আশা করি, ডোরিয়েন, সব সময়েই তুমি খুব সুখী হবে। কিন্তু তোমার বিয়ে যে ঠিক হয়ে গিয়েছে একথা তুমি আমাকে জানাওনি বলে আমি তোমাকে মা করতে পারব না। সে-সংবাদ হ্যারিকে তুমি দিয়েছ।

ছোকরাটির কাঁধে হাত রেখে হাসতে-হাসতে লর্ড হেনরি বললেন: এবং ডিনারে আসতে দেরি করার জন্যে আমি তোমাকে ক্ষমা করব না ডোরিয়েন। এখন এস, বসে পডি। এখানকার খাবার কীরকম খেতে তাই পরীক্ষা করি এস। তারপরে তোমার কাহিনি বলো।

ছোটো টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসতে-বসতে ডোরিয়েন বলল: বেশি বলার সত্যিই কিছু নাই। কী হয়েছিল সেইটাই সোজা কথায় বলছি। গতকাল সন্ধ্যায় হ্যারি তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে আমি পোশাক বদলালাম; রুপার্ট স্ট্রিটের যে রেস্তোরাঁতে আমাকে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে সেখানে ডিনার খেতে ঢুকলাম। ডিনার সেরে রাত প্রায় আটটা নাগাদ আমি থিয়েটারে হাজির হলাম। রোজালিনড-এর ভূমিকায় অভিনয় করছিল সাইবিলা অবশ্য দৃশ্যপট একদম জঘন্য ছিল; আর প্রায় সেইরকম ছিল অরল্যানডো। কিন্তু সাইবিল! সে-অভিনয় তোমরা দেখলে খুশি হতাম আমি। ছেলের পোশাক পরে সে যখন স্টেজে এসে নামল তখন তাকে যা দেখাচ্ছিল কী আর বলব! শ্যাওলা রঙের ফতুয়ার সঙ্গে সরু পায়জামা পরেছিল সে; মাথায় ছিল দামি পাথর বসানো বাজপাখির একটা পালক গায়ের ওপরে। উড়ানো ছিল ফিকে লাল লাইনটানা একটা ঢিলে জামা। এমন অপরুপ সাজে আর কখনো। তাকে আমি দেখিনি। বেসিল, তোমার স্টুডিওতে তানাগ্রা যুবতীর যে অপরুপ ছবি রয়েছে। ঠিক সেইরকম দেখতো একটা বিবর্ণ গোলাপের চারপাশে ঘন কালো পাতার আচ্ছাদনের মতো তার ভ্রমরকৃষ্ণ চুলের রাশি তার মুখের চারপাশে জড়ানো ছিল। তার অভিনয়ের কথা যদি বল তা সে নিজেদের চোখেই আজ তোমরা দেখতে পাবে। একেবারে ভাত আর্টিস্ট। বলতে যা বোঝা যায় সাইবিল সেই জাতীয় অভিনেত্রী। সেই ছোটো ঘিঞ্জি জাযগায় আমি তো একেবারে অভিভূতের মতো বসে রইলাম। আমি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডনে বসে রয়েছি সেকথা আমি একেবারে ভুলেই গেলাম। যে-অরণ্য কেউ কোনোদিন দেখেনি, মনে হল সেই অরণ্যের ভিতরে আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অভিনয় শেষ হওয়ার পরে আমি নীচে নামলাম; তারপরে সাজঘরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম। আমরা যখন দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম তখন হঠাৎ তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অবাক হয়ে। গেলাম। তার চোখের ওই রকম চাহনি আগে কোনোদিন আমার চোখে পড়েনি। আমার ঠোঁট দুটি তার দিকে এগিয়ে গেল। দুজনেই দুজনকে গভীর আবেগের সঙ্গে চুমু খেলাম। সেই মুহূর্তে আমি যে কেমন বিভোর হয়ে গেলাম সে কথা তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। মনে হল, আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত যৌবন গোলাপী আনন্দের একটি মুহূর্তে কেন্দ্রীভূত হল। সাদা নর্সিসাস ফুলের মতো সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তরপরে সে হাঁটু মুড়ে বসে। আমার হাতে চুমু খেল। এসব কথা অবশ্য তোমাদের বলে লাভ নেই, তবু না বলে আমি পারছি নে। অবশ্য আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা এখনো খুব গোপন রয়েছে। এমন কি, সে তার মাকেও একথা জানায়নি। জানি নে, আমার অভিভাবকরাই বা কী বলবেন। লর্ড ব্র্যাডলি নিশ্চয় খুব চটে যাবেন। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। সাবালক হতে আমার আর এক বছর-ও নেই; তারপরে খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারবা বেসিল, তোমার কি মনে হয় কাব্যলোক থেকে প্রেমিকাকে সরিয়ে এনে আমার স্ত্রীকে শেকসপীয়রের নাটকে অভিনয় করার সুযোগ দেওয়াটা আমার পষ্কে উপযুক্ত হবে না? শেকসপীয়রের বাণী যে গোপনে। আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলছে। রোজালিনড-এর দুটি বাহু যে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে, আমি যে জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেয়েছি।

হলওয়ার্ড আস্তে-আস্তে বললেন: হ্যাঁ, ডোরিয়েন, মনে হয় তুমি ঠিক কথাই বলেছ।

লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার সঙ্গে তার কি আড় দেখা হয়েছে?

ডোরিয়েন গ্রে মাথা নাড়লেন; আমি তাকে আর্ডেনের বনভূমিতে ছেড়ে এসেছি, ভেরোনার উদ্যানে আমি আবার তাকে খুঁজে পাব।

গভীর মনোনিবেশ সহকারে লর্ড হেনরি তাঁর শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলেন।

 ঠিক কোন মুহূর্তে তুমি বিয়ের কথাটা উচ্চারণ করলে ডোরিয়েন? সেই বা কী উত্তর দিল? সম্ভবত, কিছুই মনে নেই তোমার।

 প্রিয় হ্যারি, বিয়েটাকে আমি ব্যবসাদারী চোখে দেখিনি; আর এ-বিষয়ে কোনো প্রস্তাবও আমি তাকে দিইনি তাকে যে আমি ভালোবাসি এই কথাটাই কেবল তাকে আমি বলেছি। সে বলেছে, আমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। যোগ্যতা নেই! শোনো কথা! আমার কাছে পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যাকে আমি তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

 লর্ড হেনরি বিড়বিড় করে বললেন, বাস্তববুদ্ধিতে নারীজাতির সঙ্গে কারও তুলনাই চলে না। আমাদের চেয়ে তারা অনেক বেশি বুদ্ধিমতী। ওইরকম অবস্থায় বিয়ের কথাটা বলতে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই–তারা আমাদের সেই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

হলওয়ার্ড তাঁর হাতের ওপরে একটা হাত চাপিযে বললেন: থাক হারি। ডোরিয়েনকে বিরক্ত করছ তুমি। অন্য পুরুষদের সঙ্গে ওর তুলনা করো না। ও কারো জীবনে দুঃখ ডেকে আনবে না। ওরে চরিত্রটি বেশ সুন্দর, মার্জিত।

টেবিলের উলটো দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন কোনোদিনই আমার ওপরে বিরক্ত হয় না। আমার প্রশ্নের মধ্যে কোনোরকম কুটিলতা নেই; অথবা, প্রশ্নটা আমি করছি খোলা মনে। প্রশ্নের কারণটা হচ্ছে নিছক কৌতূহল। আমার ধারণা, বিয়ের ব্যাপারে মহিলারাই আমাদের কাছে প্রস্তাব তোলে প্রথম। আমরা তাদের কাছে কোনো প্রস্তাব রাখিনে। অবশ্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদাযের কাছে এ-রীতিটা খাটে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত সম্প্রদাযকে আমরা আধুনিক বলিনে।

হেসে মাথা নাড়লেন ডোরিয়েনঃ তোমাকে নিয়ে পারা গেল না, হ্যারি; কিন্তু তোমার কথায় আমি কিছু মনে করিলে। তোমার ওপরে রাগ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সাইবিল। ভেনকে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে, একমাত্র জানোয়ার ছাড়া আর কেউ তাকে দুঃখ দিতে পারে না। আমি তাকে সোনার চৌকিতে দাঁড় করিয়ে দেখতে চাই আমার স্ত্রীকে বিশ্বের লোক পুজো করছে। বিয়েটা কী বল তো? একটা চুক্তি, একটা প্রতিজ্ঞা–যাকে কোনো অবস্থাতেই ভাঙা যায় না। তুমি আমার কথা শুনে হাসছ? না, না, হেস না। একটি অপরিবর্তনীয় চুক্তিই তার সঙ্গে আমি করতে চাই। ভালোবাসাকে মানুষ কী করে যে অপমান করে তা আমি। ভঘনিলে। আমি সাইবলি ভেনকে ভালোবাসি। তার আস্থা আমাকে বিশ্বাসী করে তুলেছে, করে তুলেছে সৎ। তার পাশে বসে থাকলে তুমি আমাকে যা শিখিযে তার জন্যে অনুতাপ করি আমি। তোমরা আমাকে যা জান আমি তখন আর ঠিক সে রকমটি থাকিনে। আমার সব কিছু পালটে যায়। সাইবিল ভেন-এর একটু ছোঁওযা আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়; ভুলিয়ে দেয় তোমার মনোমুগ্ধকর চিত্তাকর্ষী, বিষাক্ত, মুখরোচক নীতিগুলি।

কিছু স্যালড নিজের দিকে টেনে নিয়ে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, এবং ওগুলি কি…

ওই জীবন, প্রেম, এবং আনন্দের ওপরে তোমার নীতিগুলির কথাই বলছি। হ্যারি, কেবল ওইগুলি নয়, তোমার যাবতীয় নীতি।

আস্তে-আস্তে সুরেলা কণ্ঠে লর্ড হেনরি বললেন, আনন্দই হচ্ছে একমাত্র জিনিস যার সম্বন্ধে কিছু নীতিকথা বলা যায়। কিন্তু এ-নীতি আমার নিজস্ব নয–প্রকৃতির। প্রতি এই আনন্দের মারফতেই মানুষকে যাচাই করে যে আনন্দ করতে ভানে তাকেই প্রকৃতি সমর্থন করে। সুখী হলেই আমরা সৎ হব, কিন্তু সৎ হলেই যে আমাদের সব সময় সুখী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

বেসিল হলওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন; কিন্তু “সৎ হওয়া” কথাটার অর্থ কী বল তো?

টেবিলের ওপরে টবে রাখা ঘন ফুলগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লর্ড হেনরির দিকে চোখ চিরে তাকাতে-তাকাতে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে ডোরিয়েন গ্রে বললেনঃ ঠিক, ঠিক, “সৎ হওয়া” বলতে কী বোঝ তুমি তাই আমাদের বল।

গ্লাসের পাতলা কাচের ওপরে নিজের সুন্দর একটি আঙুলের চাপ দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, সৎ-হওয়া আর নিজের আত্মার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া একই কথা অন্য লোকের সঙ্গে যে একাত্মতা তারই মধ্যে বিভেদের বীজ লুকিয়ে থাকে। মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হল তার নিজের জীবন। প্রতিবেশীদের কথা যদি ধর, তাহলে প্রযোভল হলে তাদের লক্ষ্ণ করে তুমি অনেক নৈতিক উপদেশের বাণী ছাড়তে পার। তা ছাড়া, উঁচু আদর্শ বলতে আমরা যা বুঝি। তা রয়েছে একমাত্র ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের। যুগের মাণদণ্ডই হচ্ছে আধুনিক নীতিজ্ঞানের মাপকাঠি। আমার মনে হয় কোনো মানুষের পহেই তার যুগের মাপকাঠি মেনে নেওয়াটা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অনৈতিক কাজ।

বেসিল হলওয়ার্ড বললেনঃ অত্যি কথা বলতে কি হ্যারি, কেউ যদি নিছক নিজের জন্যেই, বেঁচে থাকে তাহলে কি তাকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয় না?

 নিশ্চয়। আজকাল প্রতিটি জিনিসের জন্যই আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়। আমার ধারণা, দরিদ্রদের সত্যিকার ট্র্যাজিডি হচ্ছে নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকেই তারা বঞ্চিত করতে পারে না। সমস্ত কিছু সুন্দর জিনিসের মতোই সুন্দর পাপ করার অধিকার আর সুযোগ একমাত্র ধনীদেরই রয়েছে।

অর্থের কথা বাদ দিলেও, মানুষকে অন্যভাবে দাম দিতে হয়।

কী ভাবে, বেসিল?

ধর, অনুতাপের দাম, দুঃখ-যন্ত্রণার দাম… নৈতিক অবনতির দাম।

কাঁধে স্রাগ করে লর্ড হেনরি বললেন, প্রিয় বন্ধু, মধ্যযুগের কথা খুব মনোমুগ্ধকর। কিন্তু মধ্যযুগের অনুভূতিগুলি বর্তমান যুগে অচল অবশ্য, সেই অনুভূতিগুলিকে নভেল-নাটকে চালানো যায়। কিন্তু নভেল-নাটকে স্থান পায় কারা? বর্তমান যুগের বাস্তব পটভূমিকায় যারা অচল। বিশ্বাস কর, এমন কোনো সভ্য মানুষ নেই যে আনন্দের জন্যে অনুতাপ করে, আর এমন কোনো সভ্য মানুষ নেই সত্যিকার আনন্দ বলতে কী বোঝায় সে-বিষয়ে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান রয়েছে।

ডোরিয়েন গ্রে বললেন, আমি জানি আনন্দ কাকে বলে। আনন্দ হচ্ছে কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসা।

লর্ড হেনরি ফুল নাড়তে নাড়তে বললেন, ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে ভালোবাসা অবশ্যই ভালো। কারো পুজো পাওয়াটা হচ্ছে জঘন্য জিনিস। মানুষরা দেবতাদের যে চোখে দেখে, নারীরাও সেই চোখে পুরুষদের দেখে থাকে। তারা সব সময় আমাদের পুজো করে; আর সেই অজুহাতে তাদের জন্যে কিছু করার জন্যে সব সময় আমাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে।

ডোরিয়েন একটু গম্ভীরভাবেই বললেনঃ আমার ধারণা, আমাদের চরিত্রে প্রেমের প্রতিষ্ঠা করে তারা; আমাদের কাছ থেকে সেই প্রেম চাওয়ার পূর্ণ অধিকার তাদের রয়েছে।

হলওয়ার্ড বললেন; খাঁটি কথা, ডোরিয়েন।

লর্ড হেনরি বললেন, কোনো জিনিষই চিরকাল খাঁটি নয়, বেসিল।

 বাধা দিলেন ডোরিয়েন; অর্থাৎ, এ কথাটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে হ্যারি, যে নারীরা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিস পুরুষদের উপহার দেয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লর্ড হেনরি বললেন, সম্ভবত, কিন্তু টুকরো টুকরো করে সেইটাই তারা ফিরে পেতে চায়। আমাদের দুশ্চিন্তাটা সেখানেই। কোনো একজন ধীসম্পন্ন ফরাসি ভদ্রলোক একবার বলেছেন-বড়ো কাজ করার জন্যে মহিলারা সব সময় আমাদের উৎসাহিত করে। কিন্তু সেই কাজ আমরা যখন করতে যাই তখনই চরম বাধা আসে তাদের কাছ থেকে।

হ্যারি, তোমার কথাগুলি বড়ো ভয়ঙ্কর। আমি জানি নে তোমাকে আমি এত পছন্দ করি কেন।

তিনি বললেন, তুমি আমাকে সব সময় পছন্দ করবে ডোরিয়েন। একটু কফি চলবে? ওয়েটার, কফি নিয়ে এস; সেই সঙ্গে নিয়ে এস সেরা শ্যাম্পেন আর সিগারেট না, না, সিগারেট থাক। আমার কাছে কয়েকটা রয়েছে। বেসিল, আমি তোমাকে সিগার খেতে হবে না। একটা সিগারেট খাওয়া নিখুঁত আনন্দ তোমাকে একটি নিখুঁত সিগারেটই দিতে পারে। এই জিনিসটি অপরূপা খেয়েও তৃপ্তি পায় না মানুষ। আর কী চাই আমরা? হ্যাঁ, ডোরিয়েন, আমাকে তুমি সব সময় পছন্দ করবে। আজ পর্যন্ত যে সব পাপ করার সাহস তোমার হয়নি, তোমার কাছে সেই সব পাপের প্রতীক আমি।

সিগারেট ধরাতে-ধরাতে ডোরিয়েন বললেন; কী সব আবোল-তাবোল বকছো হ্যারি! চল, এবারে আমরা থিয়েটারের দিকে এগোই, সাইবিল স্টেজে এসে দাঁড়ালেই নতুন জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে তোমরা। সে এমন একটি জীবন তোমাদের সামনে তুলে ধরবে যা তোমরা আগে কোনোদিন দেখনি।

ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে লর্ড হেনরি বললেন, আমি সব জানি, কিন্তু সব সময় আমি নতুন-নতুন অনুভূতি সংগ্রহ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকি। অথচ, বলতে আমি ভয় পাচ্ছি, সেবকম। কোনো অনুভূতির সাক্ষাৎ আমি পাইনি। তবু হয়তো তোমার এই অপরুপা আমার মধ্যে কিছুটা উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারে। আমি অভিনয় ভালোবাসি। বাস্তব জীবনের চেয়ে এ অনেক বেশি সত্য। চল, আমরা যাই। ডোরিয়েন, তুমি আমার সঙ্গে এস। আমি দুঃখিত। বেসিল, কিন্তু আমার গাড়িতে দুজনের বেশি জায়গা হবে না। গাড়িতে করে আমাদের পিছুপিছু এস।

তাঁরা উঠে পড়লেন, কোট চাপালেন গায়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কফি খেতে লাগলেন। ইল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন; কী যেন ভাবছিলেন তিনি। একটা বিষাদের ছায়া তাঁর ওপরে নেমে এসেছিল। এই বিয়েটাকে কেমন যেন মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি; অথচ তাঁর মনে হল ডোরিয়েনের জীবনে যেসব ঘটনা ঘটতে পারত তাদের অনেকের চেয়ে এটা ভালো। কয়েক মিনিট পরে, তাঁরা সবাই নীচে নেমে এলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি একাই গাড়িতে। উঠলেন; সামনে দেখলেন লর্ড হেনরির গাড়িতে আলো চকচক করে উঠল। অদ্ভুত একটা। স্কৃতির অনুভূতি তাঁকে গ্রাস করে ফেলল। তাঁর মনে হল আগের মতো ডোরিয়েন আর তাঁর নিজের হবেন না। তাঁদের মধ্যে নতুন একটি জীবন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর চোখের দৃষ্টি কালো হয়ে এল; উজ্জ্বল আলোয় ভরা জনাকীর্ণ রাস্তাগুলি কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল তাঁর চোখে গাড়িটা থিয়েটারে এসে হাজির হলে তাঁর মনে হল তিনি যেন অনেকগুলি বছর পেরিয়ে এসেছেন।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

কী জানি কেন সেদিন রাত্রিতে প্রেক্ষাগৃহ লোকে গিজগিজ করছিল। মেদবহুল ইহুদি ম্যানেজার দরজার সামনে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাল; চাটুকারের ভীরু হাসি তার মুখের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে উঠল জোরে-ডোরে কথা বলতে-বলতে আর হিরের আংটি পরা হাত দোলাতে-দোলাতে বিনযের অবতার সেডে সে তাঁদের নির্ধারিত বকস-এ নিয়ে গেল। লোকটিকে ডোরিয়েন গ্রে-র কোনো দিনই ভালো লাগত না। সেদিন আরো খারাপ লাগল। তাঁর মনে হল মিরান্দার সন্ধানে এসে তিনি ক্যালিব্যানের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছেন। লর্ড হেনরির অবশ্য তাকে ভালোই লাগল। অন্তত সেই রকমের একটা ইঙ্গিত করে তার সঙ্গে করমর্দন করার বারবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সেই সঙ্গে একথাটাও বলতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না যে এমন একটি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় তিনি গর্ববোধ করছেন যে সত্যিকার প্রতিভাময়ী একটি অভিনেত্রীকে আবিষ্কার করেছে এবং একজন কবির জন্যে যে দেউলিয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে। একতলায় গতে সমবেত দর্শকবৃন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে হলওয়ার্ড দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মজা করতে লাগলেন। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়াটা সহ্য করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তাঁদের; বিরাট সূর্যটিকে মনে হচ্ছিল গাঢ় পীত রঙের দানবীয় আকৃতির একটি ডালিয়া ফুলের পাপড়ির মতো। গ্যালারিতে যে যুবকগুলি বসেছিল তাদের কোট আর ওয়েস্ট কোট খুলে হাতলের ওপরে রেখে। দিল। থিয়েটারের ভেতরে তারা নিজেদের মধ্যে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কথা বলাবলি করছিল, জমকালো পোশাক পরে তাদের পাশে যে সব মেয়েরা বসেছিল তাদের সঙ্গে তারা। কমলালেবু ভাগাভাগি করে খাচ্ছিল। গর্তের মধ্যে কয়েকটি মহিলা হাসছিল। তাদের গলার স্বর কেবল তীব্রই নয়, অনেকটা বেসুরো-ও মদের দোকান থেকে ছিপি খোলার শব্দও ভেসে আসছিল।

লর্ড হেনরি বললেনঃ প্রিয়তমা খুঁজে বার করার জায়গাই বটে! বাপরে, বাপ!

ডোরিয়েন গ্রে বললেনঃ ঠিকই বলেছ। এইখানেই তাকে আমি খুঁজে বার করেছি এবং আমার কাছে সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর চেয়ে সে অনেক বেশি স্বর্গীয়। তার অভিনয় দেখলে তোমরা সব ভুলে যাবে। সে স্টেজে নামলেই এই সব সাধারণকর্কশ স্বভাব এবং পাশবিক চরিত্রের মানুষগুলির হাবভাবও পালটিয়ে যাবে। তাদের চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যাবে; চুপ করে বসে তার

অভিনয় তারা দেখবো তারই ইচ্ছেমতো এই সব মানুষগুলি হাসবে, কাঁদবো সে তাদের বেহালার তারের মতো সুরময় করে তুলবে। তাদের আত্নিক ভাতে সে তুলবে সুর। নিজেদের রক্তমাংসের কথা ভুলে যাবে তারা।

অপেরা-কাচ চোখে বসিয়ে লর্ড হেনরি একতলার দর্শকদের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন, ডোরিয়েনের কথা শুনে তিনি বললেন, ভুলে যাবে! অর্থাৎ নিজেদের রক্তমাংসের কথা।

এবিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি একমত নই।

হলওয়ার্ড বললেনঃ ওর কথা শোনো না, ডোরিয়েন। তুমি কী বলছ তা আমি বুঝতে পারছি। এই মেয়েটির ওপরে আমার আস্থা রয়েছে। অপরূপা ছাড়া আর কাউকেই তুমি ভালোবাসতে পার না। মেয়েটির সম্বন্ধে এইমাত্র তুমি যা বললে সেই সমস্ত গুণ যার মধ্যে রয়েছে সে নিশ্চয় চরিত্রের দিক থেকে সুন্দরী এবং বুচিসম্পন্না। নিজের যুগকে উন্নত করা নিশ্চয় একটা সৎ কাভ। আত্মা বলে যাদের কিছু নেই তাদের মধ্যে মেয়েটি যদি আত্মার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যারা চিরকাল ঘৃণ্য আর কুসিত পরিবেশের মধ্যে বাস করে এসেছে তাদের মনে মেয়েটি

যদি সৌন্দর্যের পরশ বুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়, মেয়েটি যদি তাদের স্বার্থপরতার উর্ধে তুলে ধরতে, আর অপরের দুঃখে তাদের চোখে জল আনাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে সে তোমার ভালোবাসার যোগ্য–শুধু তুমি নয়, সারা পৃথিবী। তোমাদের এই বিয়ের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। প্রথমে এতটা আমি ভাবিনি; কিন্তু এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে তোমার নির্বাচনের মধ্যে কোনো গলদ নেই। কেবল তোমার জন্যেই ভাবান সাইবিল ভেনকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ওকে বাদ দিলে তোমার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

তাঁর হাতের ওপরে চাপ দিয়ে ডোরিয়েন বললেনঃ ধন্যবাদ। আমি জানতাম যে তুমি আমাকে বুঝতে পারবে। হ্যারি বড়ো সিনিক। বিশ্বের কোনো ভালোই ওর চোখে পড়ে না। ওর। কথা শুনলে আমি কেমন ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু ওই অরকেস্ট্রা শুরু হয়েছে, বাপরে, বাপ; কী। ভয়ঙ্কর শব্দ! তবে পাঁচ মিনিটের বেশি নয়; তারপরেই ওটা থেমে যাবে। তারপরেই যবনিকা। উঠবে; স্টেডের ওপরে দেখতে পাবে সেই মেয়েটিকে যাকে আমার সমস্ত জীবন আর যৌবন সমপর্ণ করতে যাচ্ছি আমার মধ্যে যা কিছু ভালো আর সুন্দর রয়েছে যাকে আমি আগেই সব দিয়ে দিয়েছি।

মিনিট পনেরো পরে ঘন-ঘন করতালির মধ্যে সাইবিল ভেন স্টেজের ওপরে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ; কথাটা ঠিক। মেয়েটির বড়ো চমৎকার দেখতে লর্ড হেনরির মনে হল এমন সুন্দর মেয়ে। জীবনে তিনি খুব কমই দেখেছেন। তার সেই লাজুক ভঙ্গিমা আর চকিত চাহনির মধ্যে একটা মাদকতা রয়েছে। উৎসাহী দর্শকে পরিপূর্ণ প্রেক্ষগৃহের দিকে একবার তাকাতেই একটা মৃদু লজ্জার আভাস তার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল; মনে হল, রুপোর আনার ওপরে একটা। গোলাপ ফুলের ছায়া পড়েছে। সামনে থেকে কয়েক পা সে পিছিয়ে গেল, মনে হল তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। বেসিল হওয়ার্ড দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে লাগলেন। তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন ডোরিয়েন গ্রে; মনে হল তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। চশমার ভেতর দিয়ে তাকাতে-তাকাতে লর্ড হেনরি বলে উঠলেনঃ চমৎকার, চমৎকার!

দৃশ্যটা ছিল ক্যাপুলেত-এর বাড়ির বড়ো একখানা বসার ঘর। মারকসিযো আর কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে দরবেশের পোশাক পরে রোমিযা সেখানে ঢুকল। স্টেজের পেছনে বাজনা বেজে উঠল, শুরু হল নাচ। একদল অতি সাধারণ, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নোংরা মলিন। পোশাক পরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাঝখানে সাইবিল ভেন লোকান্তরের মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। জলের মধ্যে বেতস লতা যেমনভাবে দোলে নাচের তালে-তালে, তার দেহটাও সেইরকম দুলতে লাগল, কখনো সামনে, কখনো পেছনে। তার গলার আদলটা সাদা শালুকের গলার মতো বাঁকানো; মৃদু হিল্লোলে দুলতে লাগল। মনে হল, হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হয়েছে তার হাত দুটি।

তবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল সাইবিল। রোমিযাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ডলিযেট-এর মলে যে আনন্দের সঞ্চার হয়েছিল সে রকম কোনো আনন্দ সাইবিলের চোখে-মুখে, চলনে-বলনে ফুটে উঠল না। কিছু কথা তাকে অবশ্য বলতে হল হে দরবেশ, হাত দুটির ওপরে তুমি যথেষ্ঠ অন্যায় করছ। এই হাত দুটি দিয়ে মানুষ তার মনের ভক্তি জানায়। কারণ, তাদের হাত দুটি সাধুদের হাত স্পর্শ করে এবং তীর্থযাত্রা শেষ করে এসে তীর্থযাত্রীরা সেই হাত ভক্তিভরে চুম্বন করে।

এর পরেও কয়েকটি কথা তার বলার ছিল; সেগুলি-ও সে বলল; কিন্তু সেই বলার মধ্যে আবেগ। দেখা গেল না–মনে হল সবটাই কৃত্রিম। কথাগুলি অপরূপ মিষ্টি; কিন্তু আবেগ প্রকাশের দিক থেকে সেগুলি ব্যর্থ, ব্যঞ্জনার দিক থেকে দ্যুতিহীন। কাব্যের সমস্ত মাধুর্যই নষ্ট হয়ে গেল তাতে, অবাস্তব মনে হল জুলিয়েতের উচ্ছ্বাস।

তার অভিনয়ে এই জড়তা দেখে ডোরিয়েনের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। কেমন যেন মাথাটা গুলিয়ে গেল তাঁর; উদ্বেগে ভরে উঠল তাঁর মূল। তাঁকে লক্ষ করে বন্ধুরাও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সাহস করলেন না। তাঁদের মনে হল, জুলিয়েত-এর ভূমিকায় অভিনয় করার যোগ্যতা মেয়েটির নেই। নিরাশ হয়ে পড়লেন তাঁরা। এই রকম একটি অভিনয় দেখার জন্যে এখানে। আসার প্রয়োজন ছিল না তাঁদের।

তবু তাঁরা ভাবলেন যে জুলিয়েত-এর শ্রেষ্ঠ অভিনয় হচ্ছে দ্বিতীয় অংকের “বারান্দার দৃশ্যে”। সেই দৃশ্যটি দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা। সেই দৃশ্যটি যদি সাইবিল জমিয়ে তুলতে না পারে তাহলে তাকে কোনোমতেই অভিনেত্রী বলা যেতে পারবে না।

চাঁদের আলোতে জুলিয়েত-এর বেশে সাইবিল যখন বেরিয়ে এল তখন তাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। সেবিষয়ে সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না কিছু। কিন্তু তার অভিনয়ের ভডতা অসহ্য মনে হল। দৃশ্যটি যতই এগোতে লাগল ততই খারাপ হতে লাগল তার অভিনয়। তার চাল-চলন, হাত আর মুখ নাড়ার ভঙ্গিমা শুধু কৃত্রিমই হল না, হাস্যকর হয়ে দাঁড়াল। সব কথাই অনাবশ্যক জোর দিয়ে সে বলতে শুরু করল।

তুমি জান আমার মুখের ওপরে রাত্রির
ছায়া এসে নেমেছে; অন্যথায় কিশোরীর
কুমারী লজ্জা আমার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়বে।
 আজ রাত্রিতে আমার মুখ থেকে এই মাত্র তুমি যা শুনলে
তার পরে আমি আমার লজ্জা ঢাকব কেমন করে!

এমন সুন্দর কথাগুলি সে উচ্চারণ করল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মনে হল সে কোনো বিদ্যালয়ের ছাত্রী; একটি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষকের কাছে আবৃত্তি করার শিক্ষা নিয়েছে। তারপরে সে বারান্দার ওপরে ঝুঁকে পড়ে বললঃ

যদিও তোমাকে দেখে আমার আনন্দ হচ্ছে
 তবু আমি বলব, আজকের এই মিলনে আমার
কোনো আনন্দ নেই, রাত্রির এই মিলন হঠকারী,
 যুক্তিহীন এবং অকস্মাৎ এ-মিলন বিদ্যুতের মতো।
চমকপ্রদ, কিন্তু ক্ষণস্থায়ীঃ ‘অন্ধকার দূর হল’
বলতে না বলতেই আবার তা অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
প্রিয়তম, বিদায়;
 আবার আমাদের যখন দেখা হবে তখন
এই বসন্তে প্রেমের যে কোরক অঙ্কুরিত হয়েছে।
তা যেন ভালোবাসার তাজা ফুল হয়ে ফুটে ওঠে।

 প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার এই সংযত অথচ গভীর প্রেমোচ্ছাস মাখা কথাগুলি গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেল সাইবিল; যেন কেবল বলার জন্যেই বলা; সেগুলি জুলিয়েত-এর নয়; সেগুলির মধ্যে প্রেমিকার হৃদয়-মাধুর্য নেই। দেখে মনে হল না, সে হঠাৎ ভয় পেয়ে নিজের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে দেখে মনে হল, সে আস্থা, কী বলছে, কী করছে তা সে জানে। অভিনয়কলার দিক থেকে ব্যাপারটা কদর্য ছাড়া আর কিছু নয। অভিনয় করার কোনো যোগ্যতা তার নেই।

গ্যালারির দর্শক, এমন কি সস্তা দামের টিকিট কেটে নীচে যারা বসেছে সেই সব অশিক্ষিত মানুষরাও কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। নাটক জমছে না। কদর্য অভিনয়ের আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল তারা, চেঁচামেচি করতে লাগল; দিতে লাগল শিসা ইহুদি ম্যানেজার এতক্ষণ সাজঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাপারটা দেখে রাগে গরগর করতে-করতে সে পা ঠুকতে লাগল। এত গোলমাল আর হই-চই-এর মধ্যে যে মানুষটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে হচ্ছে সাইবিল নিজে। প্রেক্ষাগৃহের কোনো বিশৃঙ্খলাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

দ্বিতীয় অংক শেষ হওয়ার পরে চারপাশ থেকে আবার হিস-হিস শব্দ উঠল। লর্ড হেনরি উঠে দাঁড়ালেন, তারপরে কোটটা কাঁধে ফেলে বললেন, মেয়েটি দেখতে সুন্দরী–সেদিকে থেকে তোমার সঙ্গে আমি একমত; কিন্তু ও অভিনয় করতে জানে না। এবার আমরা চলে যাই–এস।

ডোরিয়েন বললেন; শেষ পর্যন্ত আমি নাটকটা দেখব।

 স্বটা তাঁর তিক্ত কর্কশ।

তোমাদের সন্ধেটা নষ্ট করে দিলাম বলে আমি খুব দুঃখিত, হ্যারি। তোমাদের দুজনের কাছেই আমি ক্ষমা চাইছি।

হলওয়ার্ড বাধা দিয়ে বললেনঃ আমার বিশ্বাস, মিস ভেন অসুস্থ। আর এক রাত্রিতে আসব আমরা।

ডোরিয়েন বললেনঃ ও অসুস্থ হলেই খুশি হব আমি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অভিনয়ে তার। আজ মন নেই। ও সম্পূর্ণভাবে পালটিয়ে গিয়েছে। গত রাত্রিতে ও একজন উঁচু দরের অভিনেত্রী ছিল। আজ সে অতি সাধারণের পর্যায়ে।

ডোরিয়েন, যাকে তুমি ভালোবাস তার সম্বন্ধে ওভাবে কথা বলো না; বলার চেয়ে ভালোবাসা অনেক উঁচু দরের।

লর্ড হেনরি বললেনঃ আঙ্গিকের দিক থেকে ও-দুটিই হচ্ছে অনুকরণের বিশেষ রূপ। কিন্তু চল। ডোরিয়েন, তোমারও এখানে ওর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত নয। খারাপ অভিনয় দেখা। নীতির দিক থেকে কারও উচিত নয়। তাছাড়া আমার ধারণা, তোমার স্ত্রী অভিনয় করুক এটা তুমি চাইবে না। সুতরাং কাঠপুতুলের মতো সে জুলিয়েতের অভিনয় করুক, বা না করুক, তাতে তোমার কি যায় আসে? মেয়েটি দেখতে বড়ো মিষ্টি। সুতরাং অভিনয়ের মতো। জীবনের সম্বন্ধেও যদি তার জ্ঞানটা না থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। সঞ্চযের সুযোগ তুমি পাবে। সেই অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তোমাকে আনন্দ দেবে। পৃথিবীতে দু’ভাতের মানুষ রয়েছে যারা সত্যিকারের আকর্ষণীয়ঃ একদল সব ডানে, একদল কিছুই জানে না। হায় ভগবান, তুমি এতটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলে কেন? যৌবনের রহস্য কী জান? যৌবনের গোপন কথা হচ্ছে অশোভনীয় কোনো উচ্ছ্বাসকেই সে বরদাস্ত করে না। এস আমরা ক্লাবে যাই। সেখানে মেম্পন আর সিগারেট খেতে-খেতে সাইবিলের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করিগে চলা মেয়েটি সত্যিকারের সুন্দরী। আর কি চাও তুমি।

ডোরিয়েন একটু চিৎকার করেই বললেনঃ হ্যারি তুমি যাও। আমি একা থাকতে চাই। বেসিল, তোমাকেও যেতে হবে। আমার হৃদয় যে ভেঙে যাচ্ছে তা কি তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? তাঁর চোখ দুটি গরম অশ্রুতে ভরে উঠল, কাঁপতে লাগল দুটি ঠোঁট; বকস-এর পেছনে দৌড়ে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে তিনি চোখ দুটিকে হাতের চেটো দিয়ে ঢেকে দিলেন।

স্বরটাকে অদ্ভুতভাবে নরম করে লর্ড হেনরি বললেনঃ এস বেসিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দুজনে।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মঞ্চের আলো জ্বলে উঠল; যবনিকা তোলা হল শুরু হল তৃতীয় অঙ্ক। ডোরিয়েন তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। তাঁকে তখন বিবর্ণ দেখাচ্ছিল; কেবল বিবর্ণ নয়, গর্বিত; সেই সঙ্গে উদাসীন। গড়িযে-গড়িয়ে নাটক চলতে লাগল; সময় যেন আর কাটতে চায় না। হাসতে হাসতে ভারী বুট ঠুকতে-ঠুকতে প্রায় অর্ধেক দর্শক নাটক শেষ হবার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সব জিনিসটাই শেষ পর্যন্ত পরিণত হল প্রহসনে। শেষ অংক অভিনীত হল শূন্য ঘরে। শেষ পর্যন্ত অভিনয় শেষ হল; অসন্তোষের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

অভিনয় শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরিয়েন ছুটে সাজঘরে গিয়ে হাজির হলেন। বিজয়িনীর মতো সাইবিল একাই দাঁড়িয়েছিল। তার চোখের ওপরে একটা অপরূপ জ্যোতি ফুটে উঠেছিল। তার চারপাশে একটা আলোর দ্যুতি খেলা করছিল। তার ঠোঁট দুটি কী জানি একটা গভীর রহস্যে বিমুক্ত হয়ে হাসছিল।

 ডোরিয়েন ঘরে ঢুকতেই সে তাঁর দিকে তাকাল, একটা বিপুল আনন্দ তাকে নাড়া দিয়ে গেল। সে বললঃ ডোরিয়েন, আজ আমি কি রকম খারাপ অভিনয় করলাম দেখেছ?

তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বললেনঃ ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ অভিনয় আজ তুমি করেছ। তুমি কি অসুস্থ? কী রকম জঘন্য অভিনয় আজ তুমি করেছ সে সম্বন্ধে। কোনো ধারণাই তোমার নেই। সেই অভিনয় দেখে আমি কত কষ্ট পেয়েছি তা-ও তুমি জান না।

মেয়েটি হেসে বললঃ ডোরিয়েন, কেন আমি খারাপ অভিনয় করেছি তা তোমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু এখন তুমি বুঝতে পারছ তাই না?

তিনি রেগেই জিজ্ঞাসা করলেনঃ কী বুঝব?

আজ রাত্রিতে আমি এত খারাপ অভিনয় করলাম কেন? কেন আমি সব সময় খারাপ অভিনয় করব? কারণ আর আমি অভিনয় করব না।

কাঁধে একটা স্রাগ করলেন তিনি; বললেনঃ আমার ধারণা তোমার শরীর আভ্য ভালো নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে অভিনয় করতে আসাটা উচিত হয়নি তোমার এইভাবে অভিনয় করে তুমি সকলের হাসির খোরাক জুগিয়েছ। আমার বন্ধুরা বিরক্ত হয়েছেন, বিরক্ত হয়েছি আমি।

মনে হল, এই সব কথা মেয়েটির কানে ঢুকল না; আনন্দে আবেগে সে তখন মাতোয়ারা। একটা অপরূপ আনন্দের উচ্ছ্বাস তাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

তারপরে সে বললঃ ডোরিয়েন, তোমাকে জানার আগে অভিনয়টাই আমার জীবনে ছিল সত্য। এই থিয়েটারেই আমি বেঁচে ছিলেম। ভেবেছিলেম, এটাই পরম সত্য। এক রাত্রিতে

আমি রোজালিনড, আর এক রাত্রিতে পোশিয়া। পোর্শিয়ার আনন্দ, কোর্ডিলায়ার দুঃখ-সব আমার নিজস্ব। সবার উপরেই বিশ্বাস ছিল আমার। যারা আমার সঙ্গে অভিনয় করত সেই সব সাধারণ মানুষকে আমি দেবতার মতো মনে করতাম। স্টেডোর চিত্রিত দৃশ্যগুলিই ছিল আমার জগৎ। ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। সেইগুলিকেই আমি বাস্তব বলে মলে। করতাম। তারপরে তুমি এলে–ভালোবাসলে আমাকে মুক্ত করে আনলে যার কারাগার। থেকে; বাস্তুব কী জিনিস তুমি আমাকে তাই শেখালে। আজকের রাত্রিতেই–আমার জীবনে এই প্রথম–আমি সপষ্ট বুঝতে পারলাম যে জীবনের মধ্যে দিয়ে আমি এতদিন কাটিয়েছি । কতটা অন্তঃসারহীন, লজ্জাকর এবং ঘৃণ্য। আজকের রাত্রিতেই এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম রোমিঘো কত ভয়ঙ্কর; কত বৃদ্ধ এবং প্রসাধনের আড়ালে যে মানুষটা লুকিয়ে রয়েছে তার দেহ কতটা কুৎসিত। আজকেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম বাগানের এই চাঁদের আলো কত মিথ্যে, দৃশ্যটি কত কদর্য এবং যে কথাগুলি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। সেগুলি যে কেবল অবাস্তব তাই নয়, সেগুলি আমার মনের কথা নয়–সে কথাগুলি মন থেকে আমি বলতে চাইনি! তুমি আমার মধ্যে এমন একটা জিনিস এনে দিয়েছ যা অনেক উঁচু-যার কাছে সমস্ত কলাই প্রতিবিম্ব বিশেষ। ভালোবাসা কী তুমি আমাকে তা শিখিযে। প্রিয়তম, তুমিই আমার রূপকথার রাজকুমার। ছায়ার পেছনে ঘুরে-ঘুরে আমি ক্লান্ত। বিশ্বের সমস্ত কলার চেয়ে আমার কাছে তোমার দাম অনেক বেশি। মঞ্চে সাক্ষীগোপালের অভিনয় করে কী লাভ হবে আমার? আজকে যখন আমি অভিনয় করতে এলাম তখন আমি বুঝতেই পারিনি কেমন করে আমার ভেতর থেকে পূর্বের সব আবেগ আর আকাণ্ডহষ্কা নির্বাসিত হয়েছে। ভেবেছিলেম আমি অপরুপ অভিনয় করব; শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম যে কিছুই করার হুমতা আমার নেই। এই পরিবর্তন বা অমতার কারণটা কী তা যেন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম। আবিষ্কারটি আমার কাছে নিঃসন্দেহে অপরুপ; কানের কাছে কেবলই সে গুনগুন করতে লাগল। আমি হাসলাম। আমাদের প্রেম যে কত গভীর তা তাছাড়া ডানবে কেমন করে? আমাকে তুমি নিয়ে চল ডোরিয়েন, যেখানে আমরা দুজনে একলা থাকতে পারি এমন। একটা জায়গায় আমাকে তুমি নিয়ে চলা রঙ্গমঞ্চকে আমি ঘৃণা করি। যে আবেগ আমাকে মাতায না, এখানে আমি তারই একটা ব্যর্থ অনুকরণ করতে পারি মাত্র কিন্তু যে আবেগ। আমার মনের মধ্যে আগুনের মতো জ্বলছে তাকে আমি অনুকরণ করতে পারিনে। ডোরিয়েন, ও ডোরিয়েন, এর অর্থকী তা কি তুমি বুঝতে পারছ? প্রকাশ করতে পারলেও, স্টেজে অন্য লোকের সঙ্গে সত্যিকার প্রেমের অভিনয় করাটা আমার কাছে নিছক ব্যভিচার ছাড়া আর। কিছু নয়। এই সহজ কথাটা বুঝতে শিখিয়েছ তুমি।

সোফার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ডোরিয়েন; তারপরে বিড়বিড় করে বললেন, আমার ভালোবাসাকে হত্যা করেছ তুমি।

তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সাইবিল; হাসল। কোনো উত্তর দিলেন না ডোরিয়েন। সাইবিল তাঁর কাছে এগিয়ে এসে তার ছোটো-ছোটো আঙুল দিয়ে তাঁর মাথার চুলগুলিকে আস্তে-আস্তে টানতে লাগল। হাঁটু মুড়ে বসে তার আঙুলগুলি দিয়ে তার ঠোঁটের ওপরে ধরল চেপে। তিনি হাতটাকে টেনে নিলেন; তাঁর দেহটা কাঁপতে লাগল।

তারপরেই তিনি লাফিয়ে উঠে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ সত্যি কথা, তুমি আমার। প্রেমকে হত্যা করেছ। তুমি আমার কল্পনাকে উদ্বোধিত করেছিলে একদিন, আজ তুমি আমার মনে সামান্য কৌতূহল জাগাতেও অক্ষম হয়েছে। তুমি আমাকে আর নাড়া দিতে পারছ না। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলেম কারণ তুমি ছিলে অপরুপা, কারণ তোমার ছিল প্রতিভা, ছিল ধীশক্তি, মহান কবিদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মত ছিল তোমার এবং কলার যাকে আমরা ছায়া বলি তাকেই বাস্তবে রূপায়িত করতে তুমি পারতে–সেই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারিণী হয়েও তুমি তাদের ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে। তোমার গভীরতা নেই, মূর্খ তুমি! হায় ভাবান, কত ভালোই না তোমাকে আমি বেসেছিলেম! কী মুখই না আমি ছিলেম! এখন থেকে তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার। আর তোমার মুখ আমি দেখব না। আর তোমার কথা আমি চিন্তা করব না। আর তোমার নাম আমি উচ্চারণ করব না। একদিন তুমি যে আমার কাছে কি ছিলে তা তুমি জান না। ওঃ, আমি আর ভাবতে পারছিনো হারে, তোমার সঙ্গে আমার যদি কোনোদিন দেখা না হত! আমার জীবনের রোমান্স তুমি নষ্ট করে দিয়েছা ভালোবাসা তোমার আটকে নষ্ট করে দেয় এই যদি তোমার মত হয় তাহলে বুঝতে হবে ভালোবাসা কাকে বলে তা তুমি জান না। আমি তোমাকে দিঘিজয়িনী করিয়ে আনতে। পারতাম, তোমাকে বিশ্বের মানুষ পুজো করত এবং আমার স্ত্রী হিসাবে পরিচিতি পেতে তুমি, কিন্তু এখন তুমি কী? সুন্দর মুখধারিণী তৃতীয় শ্রেণির অভিনেত্রী ছাড়া আর কিছু নয়।

মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেল; কাঁপতে লাগল সে; নিজের দুটো হাত মুচড়াতে লাগল। গলার মধ্যে স্বরটা তার আটকে গেল যেন; সে বলল, ডোরিয়েন, তুমি সিরিয়াস নও। তুমি অভিনয় করছ।

তিনি তিক্তভাবে বললেন: অভিনয়! ওটা আমি তোমার জন্যে রেখে দিলাম। ওটা তুমি ভালোই করা

সাইবিল উঠে দাঁড়াল; তারপর বিবর্ণ মুখে ডোরিয়েনের সামনে এসে হাজির হল; একটা হাত তাঁর হাতের ওপরে রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।

 ডোরিয়েন তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।

চিৎকার করে কেঁদে উঠল সাইবিল: আমাকে তুমি ছোঁবে না?

একটা অস্পষ্ট কান্নায় ভেঙে পড়ল সাইবিল, ডোরিয়েনের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। সেইখানে পায়ে মাড়ানো ফুলের মতো কিছুক্ষণ সে পড়ে রইল, তারপরে ফিস ফিস করে। বলল: ডোরিয়েন, আমাকে পরিত্যাগ করো না। ভালো অভিনয় করতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত। অভিনয়ের সময় সারাটা দুষ্কণই আমি তোমার কথাই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমি চেষ্টা করব–সত্যিই আমি চেষ্টা করব। তোমাকে ভালোবাসি বলেই হঠাৎ আমার এই ভাবান্তর ঘটেছিল। যদি তুমি আমাকে চুমু না খেতে, যদি আমি তোমাকে চুমু না খেতাম, তাহলে আমরা যে দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তা আমি বুঝতে পারতাম না। আমাকে আবার চুমু খাও। আমার কাছ থেকে চলে যেয়ো না। আমার ভাই…না না, সেকথা থাক। সত্যি সত্যিই কিছু করবে বলে সে একথা বলেনি, ঠাট্টা করেই বলেছিল…কিন্তু তুমি… আজকের মতো তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার না? আমি ভালো অভিনয় করার জন্যে আবার চেষ্টা করব। পৃথিবীর মধ্যে তোমাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি বলে আমার ওপরে নিষ্ঠুর হয়ো না তুমি। মোট কথা, মাত্র একবারই আমি তোমাকে খুশি করতে পারিনি। কিন্তু। ডোরিয়েন, তুমিই ঠিক কথা বলেছ। আর্টিস্ট হিসাবেই নিজেকে আমার বেশ মনে করা উচিত ছিল। মূখের মতো কাজ করেছি আমি, না করে পারিনি বলেই করেছি। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না, ছেড়ে যেয়ো না।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল সাইবিল; ডোরিয়েন গভীর অনীহা নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপরূপ ঘৃণায় তাঁর কারুকার্যকরা ঠোঁট দুটি বি হল, ভালোবাসা নষ্ট হলে মানুষের সমস্ত উচ্ছ্বাসই কেমন যেন হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। সাইবিল ভেনকেও অদ্ভুত রকমের অতি নাটকীয় বলে মনে হল তাঁরা সাইবিলের ফোঁপানির শব্দ আর চোখের জল বিরক্ত করল তাঁকে।

শেষকালে পরিচ্ছন্ন স্বরে তিনি বললেন: আমি যাচ্ছি। আমি নিষ্ঠুর হতে চাই নে, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। তুমি আমাকে নিরাশ করে।

মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল কোনো উত্তর দিল না; কিন্তু তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে। আসতে লাগল। তার ছোটো ছোটো হাত দুটি বিস্তারিত হয়ে অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে লাগল, মনে হল তাঁকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি পিছন ফিরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পরেই থিয়েটারের বাইরে গিয়ে পড়লেন।

কোথায় যা যাচ্ছিলেন তা তিনি নিজেও জানতেন না। মনে হল, আলো-আঁধারের ভেতর দিয়ে, স্বল্প আলোকোজ্জ্বল রাস্তার ওপর দিয়ে, কালো-কালো গম্বুজ আর ভুতুড়ে বিরাট-বিরাট প্রাসাদের পাশ দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন। কর্কশভাবে হাসতে-হাসতে স্ত্রীলোকেরা তাঁকে। চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। মদ খেয়ে মাতালগুলো হনুমানের মতো কিচকিচ করতে-করতে আর গালাগালি দিতে দিতে রাস্তার ওপরে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কিম্ভুতকিমাকার চেহারার বাচ্চাদের রকের ওপরে বসে থাকতে তিনি দেখলেন, ভেতরের উঠোন থেকে অশ্লীল ভাষায় যে সব। কথাবার্তা চলছিল সে-শব্দও শুনতে পেলেন তিনি।

ভোরের দিকে তিনি বুঝতে পারলেন কোভেনট গার্ডেন-এর খুব কাছে এসে পড়েছেন। অন্ধকার অপসারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা ফিকে আগুনে রঙ দেখা দিল। তারপরেই আকাশ মুক্তোর মতো হয়ে গেল। লিলি ফুলের বোঝা নিয়ে বড়ো-বড়ো গাড়িগুলি ফাঁকা। রাস্তার ওপর দিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করতে-করতে এগিয়ে যেতে লাগলা ফুলের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। তাদের গন্ধে যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হল তাঁরা বাজারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি; বিরাট-বিরাট গাড়ি থেকে মাল খালাস করতে দেখলেন। সাদা পোশাক পরা একটি গাড়োয়ান তাঁকে কয়েকটা চেরি দিল। তিনি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন লোকটা তাঁর কাছ থেকে দাম নিল না কেন। সেই ফলগুলি নিয়ে অন্যমনস্কভাবে তিনি খেতে লাগলেন। ফলগুলিকে মধ্যরাত্রিতেই তোলা হয়েছে, রাত্রির ঠান্ডা ফলগুলির ভেতরে ঢুকে সেগুলিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছে। একদল ছেলে টিউলিপ, বেগনে আর লাল গোলাপের টুকরি নিয়ে তাঁর পাশ দিয়ে শাকসজির দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সূর্যের আলোকে চকচকে বড়ো বড়ো থাম দেওয়া গাড়িবারান্দার নীচে নিলাম ডাকা শেষ হওয়ার জন্যে একদল মেয়ে খোলা মাথায় অপেক্ষা করছে। আর সবাই পিয়াজার কফি-হাউসের ঠেলা দরজার কাছে কফি খাওয়ার জন্যে ভিড় করেছে। বড়ো-বড়ো শকটগুলো ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। কয়েকটা গাড়োয়ান খালি বস্তার ওপরে গড়াগড়ি দিচ্ছে, আবার রাস্তার ওপরে ছড়ানো খাবার খুটে খাওয়ার জন্যে পায়রার দল ঝাঁক বেঁধে উড়ছে।

কিছুক্ষণ পরে একটা গাড়ি ডেকে বাড়িতে ফিরে এলেন তিনি। কিছুক্ষণ তিনি বন্ধ দরজার সামনেই পায়চারি করতে লাগলেন; সামনেই পার্ক, পার্কের চারপাশের বাডিগুলি জানালা-দরজা বন্ধ করে তখলো ঘুমোচ্ছিল। সেইদিকে কয়েক মিনিট তিনি তাকিয়ে রইলেন।

ঘরের সামনেই বিরাট হলঘর। ওক-গাছের বিম দেওয়া তৈরি নীচের ছাদ থেকে ভেনিসের তৈরি বিরাট একটা বাতিদান ঝুলছিল। তার ভেতরে তিনটে বাতি তখনো জ্বলছিল মিটমিট করো বাতিগুলিকে নিবিয়ে দিলেন তিনি; টুপি আর ঢিলে জামাটা টেবিলের ওপরে খুলে রেখে লাইব্রেরির মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর শোওয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নীচের তলার ঘরটি তাঁর বেশ বড়োই। জীবনে নতুন ভোগের আস্বাদ পেয়ে ঘরটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন তিনি। ঘরের দরজা খোলার সময় হঠাৎ বেসিলের তৈরি তাঁর সেই প্রতিকৃতিটির দিকে নজর পড়ে গেল। সেটি তাঁর ঘরের দরজার সামনেই দাঁড় করানো ছিল। প্রতিকৃতিটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে একটু পিছু হটে গেলেন তিনি। একটু বিভ্রান্ত হয়ে তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। কোটটা খুলে একটু ইতস্তত করলেন; তারপরে বেরিয়ে এলেন। আবার প্রতিকৃতির সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঘি-রঙা মোটা সিল্কের পর্দা ভেদ করে যেটুকু আলো প্রতিকৃতিটির ওপরে এসে পড়েছিল সেই আলোতেই সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি। মনে হল কিছুটা যেন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রতিকৃতিটির আগেকার চাহনি আর নেই। মুখের ওপরে নিষ্ঠুরতার একটা ছাপ পড়েছে। ছাপটা স্পষ্ট; যে-কোনো লোকের চোখেই তা ধরা পড়ার কথা। নিশ্চয়, ওটা নিষ্ঠুরতার ছাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন, পর্দাটা দিলেন সরিয়ে। ভোরের উজ্জ্বল আলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, ঘরের রহস্যময় অন্ধকার একপা<Hard copy issue> ছিটকে পড়ল। কিন্তু প্রতিকৃতিটির মুখের ওপরে যে অদ্ভুত ছাপটি তিনি প্রথমে লক্ষ। করেছিলেন, আলোর জ্যোতিতেও তা অপসারিত হল না; মনে হল, সেটি আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। আরশির সামনে দাঁড়ালে মানুষ যেমন তার মুখের প্রতিটি অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখতে পায়, প্রভাতের আলোর দ্যুতিতেও সেই রকম পরিচ্ছন্নভাবে দেখতে পেলেন। তিনি-প্রতিকৃতির মুখের ওপরে যে ছাপটা পড়েছে সেটা নিষ্ঠুরতার মনে হচ্ছে, এইমাত্র সে কোনো পাপ করে এসেছে।

ভ্রুকুটি করলেন ডোরিয়েন। লর্ড হেনরি তাঁকে অনেক উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটা। ছিল ডিম্বাকৃতি গ্লাস। তারই মসৃণ গায়ের ওপরে তিনি তাড়াতাড়ি নিজের মুখ দেখতে লাগলেন। না, তাঁর লাল ঠোঁট দুটির ওপরে তো কোনো চিহ্ন পড়েনি। তাহলে, এর অর্থ কী?

চোখ দুটো রগড়ে নিলেন তিনি? ছবিটির খুব কাছে এসে আবার পরীক্ষা করতে লাগলেন। ছবিটার ওপরে সত্যিকার কোনো দাগ পড়েনি, তবু মনে হচ্ছে ছবিটির মুখের চেহারাটা যেন পালটিয়ে গিয়েছে। এটা তাঁর নিছক কল্পনা নয়। পরিবর্তনটা স্পষ্ট-ভীষণভাবে স্পষ্ট।

একটা চেয়ারের ওপরে বসে ভাবতে লাগলেন।

ছবিটা শেষ হওয়ার দিন বেসিলের স্টুডিযোতে বসে একটা কথা বলেছিলেন। সেই কথাটা হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, সপষ্ট মনে রয়েছে তাঁর। তিনি একটি উন্মত্ত আশা পোষণ করেছিলেন। আশাটা হচ্ছে, তিনি চিরকাল তরুণ থাকবেন। বৃদ্ধ হোক ছবিটা। তাঁর নিজস্ব সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়, তাঁর সমস্ত পাপ আর উচ্ছ্বাসের ছাপ ওই ক্যানভাসের বুকে প্রতিফলিত হোক। তাঁর সমস্ত দুঃখ আর চিন্তার রেখার জর্জরিত হোক ছবিটা। তিনি যৌবনের সমস্ত রস চিরকাল সঞ্জীবিত থাকুন। নিশ্চয় তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। এ-আশা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর সামনের ওই ছবিটির মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ পড়ল কী করে?

নিষ্ঠুরতা! সত্যিই কি তিনি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন? অপরাধ মেয়েটির; তাঁর নয়। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন মেয়েটি একজন বিরাট আর্টিস্ট, প্রতিভাময়ী ভেবেছিলেন বলেই তো তিনি তাকে ভালোবেসেছিলেন। সে তাঁকে নিরাশ করেছে। মেয়েটি সাধারণ; তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই। তবু মেয়েটি যে একটা শিশুর মতো তাঁর পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল–এই দৃশ্যটা মনে পড়তেই তিনি দুঃখ আর তীব্র অনুশোচনায়। ভেঙে পড়লেন। তিনি যে কতটা নিরাসক্তভাবে সেই দৃশ্য দেখেছিলেন সেকথাটা তাঁর মনে। পড়ে গেল। ভগবান তাঁকে কেন এমন করে সৃষ্টি করলেন? কেন তিনি তাঁকে ওই ধরনের আত্মা দিয়েছেন? কিন্তু তিনিও কম যন্ত্রণা ভোগ করেননি। অভিনয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনটি ঘন্টা তাঁর মনে হয়েছিল তিনটি শতাব্দী; আর তাদের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। তাঁকে পাওয়া তো সাইবিলের পক্ষে কম পাওয়া ছিল না। তিনি তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন এই কথাটা স্বীকার করে নিলেও তো অস্বীকার করা যায় না যে সেও তাঁকে মুহূর্তের জন্যে বিয়ে করেছিল। তাছাড়া, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা দুঃখভোগে বেশি অভ্যস্ত। প্রেমিকদের সঙ্গে কলহ করতেই মেয়েরা ভালোবাসে; একথা লর্ড হেনরি তাঁকে বলেছেন এবং মেয়েরা কী ধাতু দিয়ে গড়া তা লর্ড হেনরি ভালোভাবেই জানেন। সাইবিল ভেনের কথা চিন্তা করে তিনি এত কষ্ট পাচ্ছেন কেন? এখন থেকে মাইবিল ভেন তাঁর কাছে কেউ নয়।

কিন্তু তাঁর ছবি? ওটার সম্বন্ধে কী বলার রয়েছে তাঁর? ওই ছবিটাতেই তো তাঁর জীবনের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে; ওই ছবিটাই তাঁর জীবনের আলেখ্য। এই ছবিটাই তাঁকে তাঁর নিজের সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। নিজের আত্মাকে ঘৃণা করতেও কি ওই ছবি তাঁকে শেখাবে? আবার কি তিনি ছবিটিকে দেখবেন?

না। যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তিনি কাটিয়েছেন তারই জন্যে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে তাঁরা যে ভয়ানক রাত্রিটি তিনি অতিক্রম করে এসেছেন সেই রাত্রিটিই তাঁর পিছনে ভৌতিক ছায়াগুলিকে লেলিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ তাঁর মাথার মধ্যে এমন একটা দুশ্চিন্তার বীজ উপ্ত হয়েছে সে দুশ্চিন্তা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়। প্রতিকৃতিটির কোনো পরিবর্তন হয়নি; পরিবর্তন হয়েছে একথাটা ভাবাই তাঁর পক্ষে মূর্খতা হয়েছে।

তবু তার সুন্দর অথচ বিকৃত মুখ আর নিষ্ঠুর হাসি নিয়ে ছবিটি তাঁকে লক্ করছে। প্রভাতের সূর্যরশ্মিতে তার উজ্জ্বল চুলগুলি চিকচিক করছে। তার নীল চোখ দুটির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। তাঁর নিজের জন্যে ন্য, তাঁর ওই প্রতিকৃতিটির জন্যে তাঁর একটা অদ্ভুত মায়া হল। ছবিটির মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরো দেখা দেবে। তার গোলাপী রঙটা। ফ্যাকাশে হয়ে যাবে, শুকিয়ে যাবে তার লাল আর সাদা গোলাপগুলি। তিনি যে সব পাপ কাজ করবেন তার প্রতিটি ছাপ ওই সুন্দর মুখের ওপরে পড়ে তাকে বিকৃত করবে। কিন্তু তিনি । কোনো পাপ কাজ করবেন না। পরিবর্তন হোক আর নাই হোক, তাঁর বিবেকের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে ছবিটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রলোভন তিনি এডিয়ে চলবেন। লর্ড হেনরির সঙ্গে আর তিনি দেখা করবেন না; অন্তত, আর কোনোদিনই তাঁর কথায় কান দেবেন না। এবং এই কথাগুলিই বেসিল হলওয়ার্ডের বাগানে প্রথম তিনি তাঁর মুখ থেকে শুনেছিলেন; এবং এইগুলিই বিষাক্ত নীতির মতো তাঁর অসম্ভব বাসনা-কামনাগুলিকে নাড়া দিয়েছিল। তিনি সাইবিল ভেনের কাছেই ফিরে যাবেন, তার কাছে হমা প্রার্থনা করবেন, তাকে বিয়ে করবেন, আবার তাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করবেন। হ্যাঁ, এটাই তাঁর কর্তব্য হবে। তিনি যত কষ্ট ভোগ করেছে তার চেয়ে সাইবিল নিশ্চয় অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে। হতভাগ্য শিশু। স্বার্থপরের। মতো তিনি তার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন। আইবিলের ওপরে তাঁর যে আকর্ষণ জন্মেছিল সে-আকঙ্কণ আবার ফিরে আসবে। তাকে নিয়ে সুখী হবেন তিনি। তাকে বিয়ে করে তাঁর জীবন সুন্দর আর পবিত্র হয়ে উঠবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি; প্রতিকৃতির সামনে যে বিরাট পর্দাটা ঝুলছিল সেটাকে একপাশে টেনে দিলেন, তার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠলেন। “কী ভয়ঙ্কর!”–বিড়বিড় করে বলতে-বলতে তিনি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলেন। ঘাসের ওপরে বেরিয়ে এসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতাস তাঁর মনের সমস্ত অবসাদ দূর করে দিল। কেবল সাইবিলের কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন। ভালোবাসার একটা হীণ রশ্মি আবার তাঁর চোখে পড়ল। সাইবিলের নাম তিনি বার বার উচ্চারণ করতে লাগলেন। শিশিরভেজা বাগালের মধ্যে পাখিরা যে গান গাইছিল সেই গান সাইবিলের কথাই তাঁকে শোনাচ্ছিল।

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

তাঁর ঘুম যখন ভাঙল তখন দুপুর অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে। তিনি জেগেছেন নাকি জানার জন্যে তাঁর চাকর অনেকবারই নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে; তার যুবক মনিব এত ঘুমোচ্ছেন কেন বুঝতে না পেরে অবাক হয়েছে যথারীতি। শেষ পর্যন্ত একসময় তাঁর ঘুম ভাঙল; তিনি বেল বাজালেন। ভিকটর এক কাপ চা আর পুরনো চিনেমাটির ট্রে-তে করে একগাদা চিঠি নিয়ে ধীরে-ধীরে ঘরে এসে ঢুকল; তিনটি জানালার ওপরে যে ওলিভ-সাটিনের পর্দাগুলি ঝুলছিল সেগুলি সে টেনে একপাশে সরিয়ে দিল।

ভিকটর হেসে বলল: মলিয়ে আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন।

ঘুমচোখে ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: কটা বেজেছে, ভিকটর?

সওয়া একটা মঁসিয়ে।

 সত্যিই বড়ো দেরি হয়েছে। উঠে বসলেন তিনি; চা খেয়ে তিনি চিঠিগুলি টেনে নিলেন। একটা চিঠি এসেছে লর্ড হেনরির কাছ থেকে। সেদিনই সকালে একটি পত্রবাহক এসে সেটি দিয়ে। গিয়েছে। খুলবেন কি খুলবেন না–একটু ইতস্তত করে তিনি সেটিকে সরিয়ে রাখলেন। অন্যগুলিকে তিনি খুললেন বটে কিন্তু পড়ার আগ্রহ তাঁর একেবারে ছিল না। চিঠিগুলির মধ্যে ছিল কার্ড, ডিনারের নিমন্ত্রণ, সিনেমা, কনসার্টের টিকিট, এই সময়টা লন্ডনের কর্মহীন ফ্যাশানেবল যুবকদের কাছে এই জাতীয় চিঠিপত্র প্রায়ই আসে। একটা অনেক টাকা দামের বিল-ও এসেছিল। তিনি একটা রুপোর লুই কুইনজ টয়লেট সেট কিনেছিলেন। এই কথাটা তখনো পর্যন্ত তিনি তাঁর অভিভাবকদের জানাতে সাহস করেননি। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে তাঁর অভিভাবক একেবারে সেকেলে। তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না আধুনিক যুগে আমাদের সবচেয়ে প্রযোজনীয় জিনিসের। ভারমিন স্ট্রিটের উত্তমর্ণদের কাছ থেকে চিঠিও এসেছিল। অনেকগুলি। তারা বেশ বিনীতভাবে জানিয়েছিল যে এক মিনিটের নোটিশে এবং সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত অথবা নামমাত্র সুদ নিয়ে তারা ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পাবে। ঘুম থেকে ওঠার প্রায় মিনিট দশেক পরে, সিল্কের পাড় বসানো দামি একটা বড়ো কাশ্মীরি উলের তৈরি ড্রেসিং গাউন গায়ে চড়িয়ে তিনি স্নানের ঘরে ঢুকলেন। দীর্ঘ নিদ্রার পরে ঠান্ডা জল তাঁর অবসাদ অনেকটা দূর করে দিল। আগের দিন রাত্রি থেকে যে সব যন্ত্রণা আর হতাশার মধ্যে। দিয়ে তাকে কাটাতে হয়েছিল, স্নানের পরে সে সমস্ত তাঁর মন থেকে মুছে গেল। দু’একবার অবশ্য বিয়োগান্ত নাটকের অদ্ভুত স্মৃতিগুলি তাঁর মনের কোণে উঁকি দেয়লি সেকথা সত্যি নয়; কিন্তু তাঁর মনে হল সেগুলি সব স্বপ্ন, তাদের মধ্যে বাস্তবের কোনো ছোঁয়াচ নেই।

স্নান সেরে তিনি লাইব্রেরিতে গেলেন। এই ঘরেই খোলা জানালার ধারে ছোটো একটি টেবিলের ওপরে তাঁর জন্যে অল্প পরিমান ফ্রেঞ্চ ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছিল। সেই টেবিলের পাশে গিয়ে তিনি বসলেন। দিনটি বড়ো চমৎকার। মনে হল, গরম বাতাসের মধ্যে সুগন্ধি মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। গুনগুন করতে-করতে একটা মৌমাছি ঘরের মধ্যে ঢুকে এল; তাঁর সামনে নীল ভেস-এর মধ্যে রাখা বেগনে গোলাপ ফুলের চারপাশে ঘুরতে লাগল। আর তাঁর কোনো দুঃখ নেই। মন তাঁর আনন্দে ভরে উঠেছে।

 প্রতিকৃতির সামনে যে পর্দা ঝোলানো ছিল হঠাৎ তাঁর চোখ দুটো তার ওপরে গিয়ে পড়ল। চমকে উঠলেন তিনি।

টেবিলের ওপরে একটা ওমলেটের প্লেট দিয়ে তাঁর পরিচারক জিজ্ঞাসা করল: খুব ঠান্ডা লাগছে, মঁসিয়ে? ডানালাটা বন্ধ করে দেব?

মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন বললেন: না, না, ঠান্ডা লাগছে না।

ব্যাপারটা কি সত্যি? সত্যিই কি প্রতিকৃতিটার ওপরে পরিবর্তন দেখা দেয়েছে? প্রতিকৃতিটির মুখের যে জায়গাটায় আগে আনন্দের জ্যোতি ফুটে উঠেছিল সেইখানে একটা কলঙ্কের রেখা দেখা দিয়েছে। এটা কি সত্যি, না, তাঁর মতিভ্রম? ক্যানভাসে আঁকা চেহারার মধ্যে নিশ্চয়। কোনো পরিবর্তন দেখা দিতে পারে না। ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব ঘটনা। বেসিলকে তিনি গল্প বলার ছলে এ-কাহিনি একদিন বলতে পারেন। গল্প শুনে নিশ্চয় তিনি হাসবেন।

কিন্তু তবু কত স্পষ্টই না তাঁর সব মনে রয়েছে। প্রথমে প্রত্যুষের অস্পষ্ট আলোতে তারপরে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে ওই ছবিটির ঠোঁটের ওপরে নিষ্ঠুরতার একটি বাঁকা ভঙ্গি তিনি দেখেছেন। তাঁর পরিচারক ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে ঘরে একা থাকলেই ওই প্রতিকৃতিটিকে পরীক্ষা করার জন্যে আবার তাঁকে উঠতে হবে। পরীক্ষা করতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু সেই নির্মম ব্যঙ্গের ছায়াটি যে তিনি দেখতে পাবেন সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর। কফি আর সিগারেট দিয়ে লোকটি যখন চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে না যাওয়ার জন্যে তাকে অনুরোধ জানানোর একটা উদগ্র কামনা জাগল তাঁর। লোকটি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজা ভেড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে তিনি তাকে ডাকলেন। তাঁর নির্দেশ কী শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে। রইল লোকটি ডোরিয়েন তার দিকে এ তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন: কেউ এলে বলে দিয়ো আমি বাড়িতে নেই।

মাথাটা একটু নুইয়ে বেরিয়ে গেল লোকটি।

তারপরে তিনি উঠলেন, একটা সিগারেট ধরালেন, পর্দার দিকে মুখ করে যে ভালো গদি দিয়ে মোড়া সোফাটি পাতা ছিল তার ওপরে বসে পড়লেন। পর্দাটা পুরনো, স্পেনদেশীয় চামড়া দিয়ে তৈরি; তার ওপরে লুই কোয়টজ জাতীয় চকচকে স্ফটিক মণির নক্সা কাটা। বিশেষ কৌতূহল নিয়ে তিনি পরীক্ষা করলেন সেটিকে। সত্যিই কি মানুষের হৃদয়ের গোপন কোনো রহস্য এর আগে কোনোদিন সে লুকিয়ে রেখেছে?

 যাই হোক, এটাকে কি তিনি সরিয়ে রাখবেন? কী দরকার? ওখানেই থাক না। ও-কথা জেনে লাভ কী? ব্যাপারটা যদি সত্যিই হয় তাহলে নিশ্চয় তা ভয়ানক; যদি সত্যি না হয়, তাহলে বিষয়টা নিয়ে এত চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আর কারো চোখে যদি হঠাৎ এই পরিবর্তনটি ধরা পড়ে? বেসিল হলওয়ার্ড এসে যদি এই ছবিটির দিকে তাঁকে তাকিয়ে দেখতে বলেন তাহলে তিনি কী করবেন? বেসিল সেকথা যে তাঁকে বলবেন সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। না; জিনিসটাকে ভালো করে দেখতে হবে, এবং এখনই। এই ভয়ঙ্কর সন্দেহ মনের মধ্যে পুষে রাখার চেয়ে অন্য যে কোনো কাজ করা ভালো।

এই ভেবে তিনি উঠে পড়লেন; বন্ধ করে দিলেন দুটি দরজা। এই লজ্জার কালিমা একমাত্র তিনি নিজেই দেখবেন। তারপরে তিনি পর্দাটাকে সরিয়ে দিলেন, প্রতিকৃতিটির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। না, ব্যাপারটা সত্যি-যাকে বলে নির্ভেজাল। প্রতিকৃতিটির চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।

ভবিষ্যতে ঘটনাটিকে নিয়ে মনে-মলে তিনি অনেকবারই আলোচনা করেছেন এবং আলোচনা করতে-করতে কম অবাক হননি। প্রথমে ছবিটির দিকে তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়েই তাকিয়ে ছিলেন। এইরকম একটা পরিবর্তন যে ঘটতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু তবু ঘটনাটা সত্যি। রাসায়নিক অণু-পরমাণুগুলির মধ্যে কি চোখে দেখা যায়। না এমন কোনো সংযোগ রয়েছে? তার তারই ফলে কি ক্যানভাসের ওপরে প্রতিকৃতির। অবয়ব, রঙ, আর তার আত্মাটি প্রতিফলিত হয়? এটা কি সম্ভব যে সেই আত্মা যা চিন্তা করে সেইটাই পরমাণুগুলি বাইরে প্রকাশ করে? সেই আত্মা যা স্বপ্ন দেখে সেইটাকেই তারা পরিণত করে সত্যে? অথবা, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে এবং সে কারণগুলি ভয়ঙ্কর? ভাবতে-ভাবতে তিনি ভয়ে কেঁপে উঠলেন; তারপরে, সোফার ওপরে ফিরে গিয়ে তিনি বিহ্বল নেত্রে ছবিটির দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন চুপচাপ।

একটি জিনিস অবশ্য ছবিটি তাঁর কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। সেটা সাইবিল ভেনের ওপরে তিনি কী অত্যাচার করেছেন, তার সঙ্গে কত নির্মম ব্যবহার করেছেন সেটা তিনি বুঝ পেরেছেন। এই অন্যায়ের প্রতিকার করার সময় যায়নি এখনো। সাইবিল তাঁর স্ত্রী হতে পারে। তাঁর এই অবাস্তব আর স্বার্থপরের মতো ভালোবাসা কোনো মহৎ আদর্শের কাছে মাথা নীচু করবে, বেসিল হলওয়ার্ড তাঁর যে প্রতিকৃতিটি তৈরি করেছেন সেটি ভবিষ্যতে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে; সন্মার্গ বলতে কিছু লোকে যা বোঝে, বিবেক বলতে কিছু লোকের কাছে যা মনে হয় এবং ভগবৎ-ভীতি বলতে সকলের কাছে যা প্রতীয়মান, ছবিটিকে সেইভাবে মেনে নিয়ে তিনি চলার পথে এগিয়ে যাবেন। অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আফিও রয়েছে, নৈতিক প্রবৃত্তিগুলিকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে রয়েছে ওষুধ। কিন্তু পাপের জন্যে তাঁর যে অধঃপতন ঘটেছে তা এখানে সপষ্ট। তিনি যে তাঁর আত্মাটিকে ধ্বংস করে ফেলেছেন তারই চির ভাস্বর নিদর্শন এইখানে জলজ্বল করে জ্বলছে।

তিনটে বাজল, চারটে বাজল; সাড়ে চারটে বাডঘর দ্বৈত সংকেত শোনা গেল ঘড়িতে। কিন্তু একইভাবে বসে রইলেন গ্রে। বসে বসে জীবনের পীতাভ-লালচে সুতোগুলিকে একসঙ্গে গুটিয়ে তিনি একটি নতুন প্যাটার্ন তৈরি করছিলেন। আশা আর আবেগের যে অন্ধ গলির মধ্যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তারই মধ্যে থেকে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এর পরে কী তিনি করবেন সে। সম্বন্ধে কিছুই তিনি ভেবে পেলেন না। ভাবতে-ভাবতে তিনি টেবিলের ধারে উঠে গেলেন; যে-মেয়েটিকে তিনি ভালোবাসতেন তাকে উদ্দেশ্য করে একটি দীর্ঘ আবেগমাখা প্রেমপত্র লিখলেন; তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানালেন যে সেদিন তিনি তার সঙ্গে অপ্রকৃতিস্থর মতো ব্যবহার করছেন। দুঃখ, যন্ত্রণা, আর অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ের উচ্ছ্বাস দিয়ে। তিনি পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুললেন। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত চিঠিটি আত্ম-তিরস্কারে ভরাট হয়ে গেল। নিজেরাই যখন আমরা নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলি তখন আমরা ভাবি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আর কারো অধিকার নেই। পাদরী নয়, এই স্বীকারোক্তিই আমাদের মুক্তি দেয়। চিঠিটি শেষ করার পরে ডোরিয়েন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন তিনি যে অন্যায় করেছেন সেই অন্যায়ের প্রতিকার সুসম্পন্ন হয়েছে।

হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়ল; বাইরে থেকে লর্ড হেনরির কথা শোনা গেল ডোরিয়েন, তোমার সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে। দরজা খোল। এইভাবে দরজা বন্ধ করে তুমি বসে থাকবে এটা আমি সহ্য করতে পারব না।

প্রথমে কোনো উত্তর দিলেন না তিনি; চুপচাপ বসে রইলেন। দরজার ওপরে ধাক্কার পর ধাক্কা পড়তে লাগল; ঠিক, ঠিক–তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়াই ভালো। তিনি যে নতুন জীবনের পরিকল্পনা করেছেন সেটা তাঁকে খুলে বলতে হবে; তিনি যদি তার বিরোধিতা করেন তাহলে প্রয়োজনবোধ কলহের আসরেও নামতে হবে তাঁকে; আর সেই কলহের ফলে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ যদি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেই বিচ্ছেদকেও তাঁকে মেনে নিতে হবে। এই ভেবে তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং তাড়াতাড়ি পর্দাটি ছবির সামনে টেনে দিয়ে তিনি দরজাটা খুলে দিলেন।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে লর্ড হেনরি বললেন: যা ঘটেছে তার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, ডোরিয়েন; কিন্তু ও-সম্বন্ধে বেশি কিছু চিন্তা করো না তুমি।

ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি সাইবিল ভেনের কথা বলছ?

চেয়ারের ওপরে বসে ধীরে ধীরে হাতের দস্তানাগুলি খুলতে খুলতে লর্ড হেনরি বললেন: হ্যাঁ, নিশ্চয়। একদিন থেকে ঘটনাটা ভয়ঙ্কর, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার জন্যে তুমি দায়ী নও। বল দেখি, অভিনয় শেষ হওয়ার পরে তুমি কি নীচে নেমে তার সঙ্গে দেখা করেছিলে?

করেছিলাম।

আমিও তাই ভেবেছিলাম। তার সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি তোমার হয়েছিল?

আমি খুব নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করেছিলেম হ্যারি-পশুর মতো ব্যবহার করেছিলেম। কিন্তু সে সব এখন মিটে গিয়েছে। যা ঘটে গিয়েছে তার জন্যে আমি দুঃখিত নই। এই ঘটনার মাধ্যমে নিজেকে আমি ভালো করে বোঝার সুযোগ পেয়েছি।

বাঁচালে ডোরিয়েন। গোটা ব্যাপারটাকেই তুমি যে এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পেরেছ এতেই আমি খুশি হয়েছি। তুমি হয়তো গভীর অনুশোচনায় ডুবে নিজের মাথার সুন্দর চুলগুলি ছিডছ এই ভেবে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেম।

 মাথায় একটা ঝাঁকানি দিয়ে এবং একটু হেসে ডোরিয়েন বললেন: সে অবস্থা আমি পেরিয়ে এসেছি। এখন আমি খুশি। প্রথম কথাটা হচ্ছে, বিবেক বলতে কী বোঝায় তা আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি আমাকে যেভাবে বুঝিয়েছিলে বিবেক তা নয়; আমাদের মধ্যে যা কিছু রয়েছে। বিবেক হচ্ছে তাদের সকলের চেয়ে স্বর্গীয়। নাক সিটকিয়ো না, হ্যারি; অন্তত আমার কাছে না; আমি ভালো হতে চাই আমার আত্মা ভয়ঙ্কর হবে, বিকৃত হবে তা আমি সহ্য করতে পারব না।

নীতির ভিত্তি হিসাবে তোমার কথাটি কেবল মনোরমই নয়, সত্যিকার কলাবিদের মতো ডোরিয়েন। এই কথা বলার জন্যে তোমাকে আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। কিন্তু শুরু করবে কোথায়?

সাইবিল ভেনকে বিয়ে করে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন লর্ড হেনরি; হতভম্বের দৃষ্টি তাকিয়ে তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। কী, কী বললে? সাইবিল ভেনকে বিয়ে করে! কিন্তু প্রিয় ডোরিয়েন…

হ্যাঁ, হ্যারি; এর পরে তুমি কী বলবে তা আমি জানি। বিয়ের বিরুদ্ধে নিশ্চয় কোনো ভয়ঙ্কর কথা। না, না, ওসব কথা বলো না। আমার কাছে আর কোনোদিন বিয়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করো না তুমি। দু’দিন আগে সাইবিলকে বলেছিলেম আমাকে বিয়ে করতে। সে কথা ভাঙতে আমি রাজি নই। সেই আমার স্ত্রী হবে।

তোমার স্ত্রী হবে! ডোরিয়েন…তুমি কি আজ সকালে আমার চিঠি পাওনি? নিজের হাতে সেই চিঠি আমি তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

তোমার চিঠি। হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে বটে। আমি সেটা এখনো পড়িনি। ভঘ হচ্ছিল হয়তো সেই চিঠিতে এমন কিছু রয়েছে যা আমার পড়ে ভালো লাগবে না। তোমার বক্রোক্তিগুলি একটা। আস্তো জীবনকে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলে।

তাহলে তুমি কিছুই জান না?

কী বলছ তুমি?

লর্ড হেনরি ঘরের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন গ্রে-র পাশে গিয়ে বসলেন; তারপরে তাঁর। একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে বললেন: ডোরিয়েন, ভয় পেয়ো না; আমার চিঠিতে লেখা ছিল সাইবিল ভেন মারা গিয়েছে।

যন্ত্রণার একটা তীব্র আর্তনাদ ডোরিয়েনের ঠোঁটের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল; চট করে দাঁড়িয়ে উঠলেন তিনি; লর্ড হেনরির মুঠো থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন–মারা গিয়েছে! সাইবিল আর নেই! না, এ সত্যি নয়; এ একটা জঘন্য মিথ্যা কথা। একথা বলতে তোমার সাহস হল কেমন করে?

লর্ড হেনরি গম্ভীরভাবে বললেন: কথাটা সত্যি, ডোরিয়েন। সকালের কাগজেই এই সংবাদটা বেরিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা করার আগে আর কারো সঙ্গে তুমি দেখা করো না–বিশেষ। করে এই কথাটাই সেখান লেখা ছিল এবং অবশ্যই একটা অনুসন্ধান এর হবে–যাকে বলে ময়না তদন্ত; সেই তদন্তের সঙ্গে তোমার জড়িয়ে পড়া চলবে না। এই রকম ব্যাপার ফ্রান্সে মানুষকে ফ্যাশনেবল করে তোলে, কিন্তু লন্ডনে সাধারণ লোকেরা ছি-ছি করে। দুর্নাম রটনা হতে পারে এমন কোনো কাউকেই এখানে আমাদের প্রচারযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিচারণার সঙ্গে ওগুলিকে সঞ্চয় করে রাখা উচিত। আমার মনে হয়, থিয়েটার কেউ তোমার নাম জানে না। যদি না জেনে থাকে তো ভালোই। তার ঘরের দিকে যেতে কেউ কি তোমাকে দেখেছিল? এইটিই একটা জরুরি জিনিস।

কয়েক মিনিট কোনো কথা বললেন না ডোরিয়েন; মনে হল, হতভম্ব হয়ে পড়েছেন তিনি। তাঁর চোখ আর মুখের ওপরে ভয়ের একটা ছায়া পড়েছে। অবশেষে বুদ্ধ কণ্ঠের ভেতর থেকে একটা জড়ানো, অসপষ্ট স্বর বেরিয়ে এল তাঁর: ও, হ্যারি, ময়না তদন্তের কথা তুমি বলবে না? কেন ময়না তদন্ত? সাইবিল কি তাহলে…ও, হ্যারি, আমি সহ্য করতে পারছিলেন। তাড়াতাড়ি কী ঘটেছে সব আমাকে তাড়াতাড়ি বলা

ডোরিয়েন, আমার ধারণা ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা ন্য; যদিও সেইভাবেই বাইরের লোকের কাছে ঘটনাটা সাজাতে হবে। মনে হচ্ছে রাত্রি সাড়ে বারোটা অথবা তারই কাছাকাছি কোনো এক সময়ে তার মা যখন তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে থিয়েটারে এসেছিলেন সেই সময় কিছু। একটা জিনিস আনার জন্যে সাইবিল দোতলায় যায়। জিনিসটা নাকি ভুলে সে সেখানে ফেলে এসেছিল। কিছুক্ষণ তাঁরা নীচে অপেক্ষা করেছিলেন; কিন্তু সাইবিল আর নীচে নামেনি। খুঁজতে-খুঁজতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত সাজঘরের মেঝের ওপরে তার মৃতদেহটিকে পড়ে থাকতে দেখেন। ভুল করে বিষ জাতীয় কিছু একটা সে খেয়ে ফেলেছিল। ওই জাতীয় কিছু জিনিস থিয়েটারের কাজে লাগে। ঠিক ডানিনে বস্তুটি কী, হয়তো প্রুশিক অ্যাসিড; শ্বেত পারা-ও হতে পারে। আমার বিশ্বাস প্রুশিক অ্যাসিড-ই হবে; কারণ, খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার মৃত্যু হয়েছিল।

চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ডোরিয়েন: হ্যারি, হ্যারি, ভয়ঙ্কর এই সংবাদ!

হ্যাঁ, ঘটনাটা অবশ্যই বড়ো করুণ। কিন্তু এর সঙ্গে তোমার জড়িয়ে পড়লে চলবে না। স্ট্যান্ডার্ড কাগজ পড়ে বুঝলাম মেয়েটির বয়স সতের। আরো কম ব্যস বলেই মনে হয়েছিল আমার। দেখতে মেয়েটি ছিল বাচ্চা; আর অভিনয় করতে সে কিছুই জানত না। ডোরিয়েন, এটা নিয়ে তুমি বেশি ভেবো না। তুমি আমার সঙ্গে চল রাত্রির খাওয়াটা আমরা দুজনে একসঙ্গে সারব: তারপরে আমরা অপেরাতে যাবা আজকে পার্টির সম্মানার্থে সেখানে অভিনয়ের আয়োজন হয়েছে। গণ্যমান্য সবাইকেই সেখানে তুমি দেখতে পাবে। আমার বোনের আসনে তুমি বসবে; তার সঙ্গে কিছু অভিজাত ঘরণী রয়েছে। তার টিকিট পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।

অনেকক্ষণ নিজের মনে-মনে বিড়বিড় করতে-করতে ডোরিয়েন গ্রে বললেন: সুতরাং সাইবিল ভেনকে আমি খুন করলাম। তার ছোটো কণ্ঠটি ছুরি দিয়ে কেটে ফেলার মতন করেই তাকে আমি হত্যা করে ফেললাম। তবুও গোলাপ ফুলকে এখনো আমরা কম ভালোবাসছিনে। আমার বাগানে পাখিরা এখনো সেই আগের মতোই মিষ্টি সুরে গান করছে এবং আজ রাত্রিতে তোমরা সঙ্গে আমি ডিনার খেতে চলেছি, সেখান থেকে যাব অপেরাতে অপেরা। ভাঙলে আর কোনো জায়গায় খেতে যাব। জীবন কি অসম্ভব রকমেরই না নাটকীয। হ্যারি, এই কাহিনি কোনো বই-এ পড়লে নিশ্চয় আমি কাঁদতাম। যে-কোনো কারণেই হোক ঘটনাটি সত্যি-সত্যি ঘটেছে বলেই, অথবা, আমাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে বলেই হয়তো চোখের জল ফেলার চেয়েও অনেক বেশি চমৎকার বলে মনে হচ্ছে। জীবনে এই প্রথম আমি একটি উজ্জ্বল প্রেমপত্র লিখেছিলাম সত্যিই এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমার প্রথম প্রেমপত্র একটি মৃতা প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। আমি অবাক হয়ে ভাবি, ওই শ্বেত পোশাক পরা। মানুষগুলি, যাদের আমরা মৃত বলি, তাদের কি অনুভব করার শক্তি রয়েছে? সাইবিল সে কি অনুভব করতে পারে, জানতে পারে, শুনতে পায়? হায হ্যারি, তাকে আমি কত ভালবাসতাম! মনে হচ্ছে সে যেন কত বছর আগেকার কথা। আমার সমস্ত মন আর প্রাণ। জুড়ে বসেছিল সে। তারপরে সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটি হাজির হল। সেটই কি সত্যিই গত রাত্রি? সে খারাপ অভিনয় করল; সেই দেখে আমার হৃদয় গেল ভেঙো খারাপ অভিনয় সে কেন করেছিল সে-কথা সে আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল। কী করুণ সেই দৃশ্য! কিন্তু আমার হৃদয় তাতে একবিন্দু-ও গলেনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম অভিনয় করার ক্ষমতা তার নেই। অকস্মাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কী যে ঘটল তা ঠিক জানি নে, কিন্তু এটা। বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি যে সেটি ভয়ঙ্কর। আমি বললাম তার কাছে আমি ফিরে যাব। আমি বুঝতে পারলাম তার ওপরে আমি অন্যায় করেছি এবং এখন সে মৃত। ভগবান, এখন। আমি কী করব? তুমি জান না কী বিপদে আমি পড়েছি। নিজেকে শক্তি করে ধরে রাখার মতো অন্য কোনো অবলম্বন আমার নেই। আমাকে একমাত্র সেই ধরে রাখতে পারত। আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার তার ছিল না। সে নিতান্ত স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।

সিগারেটের বক্স থেকে একটা সিগারেট বার করলেন লর্ড হেনরি, সোনালি দেশলাই-এর খোল থেকে কাঠি বের করে সেটি ধরালেন, তারপরে বললেন: প্রিয় ডোরিয়েন, পুরুষকে সৎপথে আনার একটি কৌশলই নারীদের জানা রয়েছে, সেটি হচ্ছে তাদের তিতিবিরক্ত করে তোলা; তাতেই বাঁচার সমস্ত আকাঙ্খা পুরুষদের নষ্ট হয়ে যায়। এই মেয়েটিকে বিয়ে করলে নিজেকে তুমি হতভাগ্য বলে মনে করতে। অবশ্য তার সঙ্গে তুমি সদ্য ব্যবহার করতে পারতে। কিন্তু করা সঙ্গে মানুষ সদ্য ব্যবহার করে জান? যার ওপরে তার বিন্দুমাত্র দরদ নেই। কিন্তু মেয়েটির বুঝতে দেরি হত না যে তুমি তার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। কোনো মহিলা যদি বুঝতে পারে যে তার স্বামী তার প্রতি উদাসীন তাহলে সে কী করে বল তো? হয় সে ভয়ঙ্কর রকমের কদর্য হয়ে যায়, নতুবা, সে এমন জাঁকালো পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায় যার খরচ অন্য মহিলাদের স্বামীদের যোগান দিতে হয়। সামাজিক ভুল নর কথা আমি অবশ্য এখানে তুলছিনে-কারণগুলি মানুষের নীচতা প্রকাশ করে, এবং ওগুলিকে। কোনোদিনই আমি হমার চোখে দেখতে পারিনে; কিন্তু একটা বিষয়ে আমি তোমাকে নিশ্চিন্ত করতে পারি যে বিয়ে করলে তোমার সারা জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যেত।

ঘরের মধ্যে বিবর্ণ মুখে পায়চারি করতে-করতে ডোরিয়েন বললেন: সম্ভবত, তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু ভেবেছিলেম এটাই আমার কর্তব্য। এই ভয়ঙ্কর মৃত্যু যে আমার সেই কর্তব্যের পথে বাধার সৃষ্টি করল তার জন্যে আমার কোনো অপরাধ নেই। আমার মনে রয়েছে তুমি একবার বলেছিলে সমস্ত সৎ পরিকল্পনার মধ্যেই কোথায় যেন ধ্বংসের একটা উপকরণ লুকিয়ে রয়েছে। তুমি আরো বলেছিলে সৎ প্রচেষ্টাগুলিকে কার্যকরী করতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। আমার পক্ষে সেটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

সৎ সংকল্পগুলি সব সময় বৈজ্ঞানিক নীতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাদের উৎসই হচ্ছে নির্ভেজাল দাম্ভিকতা। সেইজন্যে আমদানির ঘরটা তাদের একেবারে শূন্য থাকে। মাঝে-মাঝে তারা অবশ্য কিছু দান করে; সেগুলি হচ্ছে বন্ধ্যা উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য। সেই দেখে দুর্বলরা কখনো কখনো যে মুগ্ধ হয় সেকথা মিথ্যা নয়। এছাড়া সৎ সংকল্পের পহে আর কিছুই বিশেষ বলার নেই। ব্যাঙ্কে টাকা না থাকা সত্ত্বেও চেক কাটলে ব্যাপারটা যে রকম দাঁড়ায় এও অনেকটা সেই জাতীয় ব্যাপার।

লর্ড হেনরির কাছে এসে পাশে বসলেন ডোরিয়েন; তারপরে বললেন, হ্যারি, বলতে পার। দুঃখটাকে যতটা গভীরভাবে আমি অনুভব করতে চাই ততটা অনুভব করতে পারছিনে কেন? আমি যে হৃদয়হীন সেকথা তো আমার মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়?

 মিষ্টি সুরে এবং বিষণ্ণ হাসি হেসে লর্ড হেনরি বললেন: বিগত পনেরোটি দিন ধরে তুমি এত বোকার মতো কাজ করে যার ফলে ওই বিশ্লেষণটি অর্জন করার যোগ্যতা তোমার হয়নি।

ভ্রূকুটি করে ডোরিয়েন বললেন: হ্যারি, তোমার বিশ্লেষণটা আমার ভালো লাগছে না; কিন্তু আমি নির্মম নই একথাটা যে তুমি স্বীকার করে এতেই আমি খুশি। সত্যিই আমি নির্মম নই। আমি তা জানি। তবু আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে যতটা আঘাত করা উচিত ছিল দুর্ঘটনাটি ততখানি আঘাত আমাকে করেনি। মনে হচ্ছে একটি অপরূপ সুন্দর নাটকের একটি অপরূপ সুন্দর সমাপ্তি ঘটেছে। গ্রীক ট্র্যাজিডির সব কিছু ভয়াল সৌন্দর্যই এখানে রয়েছে; মনে হচ্ছে, সেই নাটকে অনেকটা প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে আমাকে অথচ, একটুকুও আহত হইনি আমি।

যুবকটির অবচেতন মনের দাম্ভিকতা নিয়ে খেলা করতে বেশ মজা লাগল লর্ড হেনরির; তিনি বললেন: সমস্যাটা কৌতূহলোদ্দীপক, সন্দেহ নেই, সত্যিই বড়ো কৌতূহলোদ্দীপক। আমার ধারণা তুমি যে প্রশ্নটি রেখেছ তার যে প্রশ্নটি রেখে তার আসল উত্তর হচ্ছে এই জীবনের সত্যিকারের ট্রাজিডিগুলি প্রায়ই এমন অশিল্পীসুলভ প্রক্রিয়ায় ঘটে যে তাদের নগ্নতায় আমরা আহত হই, আহত হই তাদের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীনতায়, তাদের হাস্যকর অর্থহীনতায এবং আঘাত করার অসুন্দর আঙ্গিকে। অশ্লীলতা যেভাবে আমাদের আঘাত করে ঠিক সেইভাবেই আঘাত করে এই ট্রাজিডিগুলি। তাদের সেই আক্রমণে পশুশক্তির গন্ধ পাই বলেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। মাঝে-মাঝে অবশ্য অতি সুন্দর ভাবেই আমাদের জীবনে ট্র্যাজিডি দেখা দেয়; এই সৌন্দর্যের অবদানগুলি বাস্তব হলে তারা আমাদের নাটকীয় অনুভূতিগুলিকে স্পর্শ করে। হঠাৎ আমাদের মনে হয় আমরা আর অভিনেতা নয়, দর্শকমাত্র। অথবা, আমরা দুইই। নিজেদের লক্ষ করি আমরা এবং দৃশ্যাবলির চমৎকারিত্ব আমাদের দাসত্বে পরিণত করে, অর্থাৎ একেবারে সম্মোহিত করে ফেলে আমাদের। বর্তমান ক্ষেত্রে আসল ঘটনাটা কী বল তো? তোমার ভালোবাসা হারানোর ভয়ে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এরকম একটা অভিজ্ঞতা আমার হলে খুব খুশি হতাম। তাহলে আমার বাকি জীবনটার সঙ্গে আমি নিজেই প্রেমে পড়ে যেতাম। যারা আমাকে ভালোবাসত, আমার সঙ্গে মেলামেশা না করলে যারা অস্থির হয়ে উঠত–যদিও তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয–সামান্য তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক আমি ছিন্ন করার পরেও, অথবা, আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তারা শেষ করে দেওয়ার পরেও অনেকদিন তারা বেঁচে রয়েছে, আত্মহত্যা অথবা আত্মনির্যাতনের কথা তারা কল্পনাও করেনি। তাদের স্বাস্থ্য ফিরেছে–একঘেয়েমি বেড়েছে তাদের। হঠাৎ দেখা হলে তারা সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করেছে। নারীদের স্মৃতিশক্তি কি ভয়ানক! কি ভয়ঙ্কর! চিন্তার জগতে তারা একেবারে স্থবির। জীবনের সৌন্দর্যে মানুষের ডুবে থাকা উচিত, জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে মেতে থাকা উচিত নয়। খুঁটিনাটি সবসময়েই অশ্লীল।

ডোরিয়েন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন: আমার বাগানে পপি বুনতেই হবে।

লর্ড হেনরি বললেন: কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের হাতে সব সময়েই পপি অর্থাৎ আফিও রয়েছে। মাঝে-মাঝে অবশ্য কিছু স্মৃতি বেশিদিন ধরে বেঁচে থাকে। একটি রোমান্সের মৃত্যু না হওয়ায় শিল্পীসুলভ দুঃখ প্রকাশ করার জন্যে পুরো একটা ঋতু ধরে ভায়লেট ছাড়া অন্য কোনো ফুলই আমি ব্যবহার করিনি। শেষ পর্যন্ত সেই রোমান্সের অবশ্য মৃত্যু হয়নি; মৃত্যু কী করে হল সেকথা আজ আর আমার মনে নেই। আমার ধারণা যেদিন মেয়েটি ঘোষণা করল। যে আমার জন্যে সে পৃথিবীর সব কিছু পরিত্যাগ করতে রাজি সেই দিনই আমাদের রোমান্সের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এই সময়টাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে সঙ্কটময়; কারণ, অনন্তের ভীতি আমাদের তখন গ্রাস করে ফেলে। এক সপ্তাহ আগে লেডি হ্যাম্পশায়ারের বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল আমার। ভদ্রমহিলার পাশেই আমি খেতে বসেছিলাম। তুমি কি বিশ্বাস করবে ভদ্রমহিলা আবার সেই পুরনো দিনগুলির কথা তুলে ভবিষ্যতের অসহনীয় দিনগুলির সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য কাহিনি কপচাতে শুরু করলেন। অ্যাসফোডল ফুলের বিছানায় আমাদের রোমান্স আগেই আমি কবর দিয়ে ফেলেছিলেম তিনি আবার তাকে খুডে বার করে আমাকে সস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে আমি তাঁর জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। আমি একথা বলতে বাধ্য যে সেদিন ডিনারে তাঁর কিছু অরুচি আমার চোখে পড়েনি; সোডা কথায় ভুরিভোজনই তিনি সেদিন করেছিলেন। সেই জন্যে তাঁর সেই অভিযোগে আমার মলে কোনো আশঙ্কা জাগেলি। কিন্তু কী কুরুচির পরিচয়ই সেদিন তিনি দিয়েছিলেন বল তো! অতীতের একমাত্র সৌন্দর্য এই যে সে অতীত। কিন্তু কখন যে যবনিকা পড়ে সে-সংবাদ নারীরা রাখে না। তারা সব সময় নাটকে ষষ্ঠ অংকের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে এবং নাটকের অভিনয় যখন শেষ হয়ে যায় তখনো তারা সেটিকে চায় আরো টেনে নিয়ে যেতে। তাদের যদি সে-সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সব কমেডিই ট্র্যাজিডিতে পরিণত হবে; আর সব ট্র্যাজিডি পরিণত হবে ফার্স-এ। কৃত্রিমতার দিক থেকে তারা সত্যিই বড়ো চমৎকার, ‘আর্টিস্টিক সেনস’ বলতে সত্যিই তাদের কিছু নেই। আমার চেয়ে এদিক থেকে তুমি অনেক। ভাগ্যবান। আমি তোমাকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ডোরিয়েন, যে সাইবিল ভেন তোমার যে উপকার করেছে সেরকম উপকার আমার কোনো প্রেমিকাই আমার করতে পারেনি। সাধারণ মহিলারা সব সময়েই নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। কিছু মহিলা রয়েছে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দেয় রেগে হইচই করে। যে মহিলা ফিকে লাল রঙের পোশাক পরে, তাদের বয়স যাই হোক, কোনোদিন তাদের বিশ্বাস করো না, বিশ্বাস করো না সেই সব মহিলাদের যাদের বয়স পঁয়ত্রিশের ওপরে, যারা ফিকে লাল ফিতে দিয়ে চুল বাঁধতে ভালোবাসে। এই জাতীয় মহিলাদের দেখলেই ভেবে নিযো যে তাদের প্রত্যেকে কছু ইতিহাস রয়েছে। আর একদল মহিলা রয়েছে যারা হঠাৎ তাদের স্বামীদের সদগুণগুলি আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। লোকের নাকের ডগায় তারা তাদের বিবাহিত জীবনের সুখ এবং আড়ম্বরের সঙ্গে প্রকাশ করে যে মনে হবে জিনিসটা চমৎকার একটা পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ-কেউ আবার ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। একটি মহিলা একবার আমাকে বলেছিলেন যে রঙিন বাক-চাতুর্যের মধ্যেই নারীদের সান্ত্বনা পাওয়ার রহস্যটি লুকিয়ে রয়েছে এবং কথাটা যে সত্যি তা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া নিজেকে পাপী বলে চিহ্নিত করার মধ্যে মানুষের দম্ভ ছাড়া আর কিছু প্রকাশ পায় না। বিবেক বলে বস্তুটা আমাদের সবাইকেই আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। হ্যাঁ, আধুনিক ভাতে সান্ত্বনার উপায় খুঁজে পাওয়ার সত্যিই কোনো শেষ নেই মহিলাদের। সত্যি কথা বলতে কি এখনো আমি সবচেয়ে দামি কথাটাই বলিনি।

ডোরিয়েন কিছুটা অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করলেন: সেটা কী হ্যারি?

ওই সান্ত্বনার সম্বন্ধেই বলছি। নিজের প্রেমিককে হারিয়ে ওরা সব সময় অপরের প্রেমিককে ছিনিয়ে নেয়। সভ্য সমাজ ছিনতাইকারিণীদের চরিত্র চকচকে করে তোলে ব্যাপারটা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ডোরিয়েন, আমাদের পরিচিত মহিলাদের কাছ থেকে সাইবিল ভেনের পার্থক্য কত। তার মৃত্যুর মধ্যে এমন একটা জিনিস বুয়েছে যা আমার চোখে বড়ো। সুন্দর লাগছে। এই শতাব্দীতে যে এমন সুন্দর এবং আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে পারে তা ডেনে আমি আনন্দিত হয়েছি। রোমান্স, কামনা আর ভালোবাসা যা নিয়ে আমরা খেলা করি সেগুলি যে কতখানি বাস্তবএই থেকে তা প্রমাণিত হয়।

তুমি ভুলে যাচ্ছ, তার সঙ্গে আমি খুব নির্মম ব্যবহার করেছি।

কিছু মনে করো না, আমি বলতে বাধ্য যে পুরুষের কাছ থেকে নির্মম ব্যবহার নারীরা বেশ উপভোগ করে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রবৃত্তিগুলি তাদের মধ্যে অদ্ভুতভাবে অতো রয়েছে। দাসত্ব থেকে আমরা তাদের মুক্তি দিয়েছি বটে, কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে দাসত্বটাই তারা পছন্দ করে বেশি; তাইতো তারা সব সময় মনিব খুঁজে বেড়ায়। অপরের কর্তৃত্বে থাকতে তারা ভালোবাসো তোমার ব্যবহার যে চমৎকার সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিকার রাগতে তোমাকে আমি কোনোদিনই দেখিনি। কিন্তু তোমার ব্যবহারটা যে কত আমেডিছ তা আমি লক্ষ করেছি। তাছাড়া গতকালের আগের দিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলো তখন আমি বিশেষ গুরুত্ব দিইনি কথাটার ওপরে। কিন্তু এখন দেখছি তুমি যা বলেছিলে তা সত্যি; আর সেইটাই হচ্ছে তোমার সব।

কী কথা, হ্যারি?

তুমি বলেছিলে বিশ্বের সমস্ত রোমান্টিক নায়িকাকে একসঙ্গে করলে যা দাঁড়ায় তোমার কাছে সাইবিল তাই। এক রাত্রিতে সে দেসদিমনা, আর এক রাত্রিতে সে ওফিলিয়া; যদি জুলিয়েট হয়ে সে মারা যায়, ইমোজেন হয়ে সে বেঁচে ওঠে। দুটি হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ডোরিয়েন বললেন: এখন আর সে বেঁচে উঠবে না।

না; আর কোনোদিনই সে বেঁচে উঠবে না। সে শেষবারের মতো তার ভূমিকা অভিনয়। করেছে। কিন্তু সেই নোংরা আডঘরে তার নিঃসঙ্গ মৃত্যুকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তোমাকে ভাবতে হবে ভ্যাকবিয়ান কোনো ট্রাজিডির বিবর্ণ কোনো দৃশ্যের অভিনয় দেখছ। তুমি, ওয়েবস্টার, ফোর্ড অথবা সিরিল টুরনারের কোনো নাটকের কোনো একটি অপরূপ দৃশ্য তুমি অভিনীত হতে দেখছ। তাছাড়া, কোনোদিনই মেয়েটি বেঁচে থাকেনি; সুতরাং তার মারা যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তোমার কাছে অন্তত সে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না; তোমার কাছ তাকে অশরীরী বলে মনে হত–যে শেকসপীয়রের নাটকের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে পদসঞ্চারে ঘুরে বেড়াত-যার উপস্থিতিতে নাটকগুলি সুন্দর হয়ে উঠত, তোমার কাছে সে ছিল একটি শর গাছের মতো, যার ভেতর দিয়ে শেকসপীয়রের সঙ্গীত হয়ে উঠত মধুক্ষরা এবং আনন্দময়। যে মুহূর্তে সে বাস্তবের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল সেই মুহূর্তেই সে। সেই জীবনটাকে করে তুলল বিকৃত আর সেই জন্যেই সে মারা গেল। ইচ্ছে হলে ওফিলিয়ার জন্যে তুমি শোক করতে পার। কর্ডিলিকে কণ্ঠরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল বলে মাথার ওপরে ছাই ঢেলে তুমি শোকদিবস পালন করতে পার; ব্রাবনসিয়োর কন্যা মারা গিয়েছিল। বলে তুমি ভগবানের বিরুদ্ধে চিৎকার করে অভিযোগ জানাতে পার; কিন্তু সাইবিল ভেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তোমার চোখের জল বৃথা নষ্ট করো না। তাদের চেয়ে সে অনেক বেশি অবাস্তব।

কিছুক্ষণের জন্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। ঘরের মধ্যে নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। নিঃশব্দে আর খালি পায়ে বাগান থেকে এগিয়ে এল ছায়ারা। দৃশ্যমান জিনিসগুলি ধীরে ধীরে তাদের জেল্লা হারিয়ে ফেলল।

কিছুক্ষণ পরে ডোরিয়েন গ্রে মুখ তুললেন, তারপরে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছেন এই ধরনের একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যারি, যে কথাটা নিজেকে আমি নিজে বলতে চেয়েছিলেম সেটা তুমিই আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো তুমি যা বললে সেই সব কথা আগেই আমি ভেবেছিলেম কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক নিজের কাছে প্রকাশ করার সাহস আমার হয়নি। আমার চরিত্রটা কী সুন্দরই না তুমি বুঝতে পেরেছ। কিন্তু যা ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে তুমি আর আলোচনা করো না কখনো। এ থেকে একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হল আমার। এই-ই যথেষ্ট। আমি জানি নে আমার জন্যে এই রকম চমৎকার আরো কোনো অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে কি না।

ডোরিয়েন, তোমার জন্যে জীবন অনেক কিছু নিয়েই অপেক্ষা করছে। তোমার এই অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে করতে পারবে না পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই।

কিন্তু ধর হ্যারি, আমি যদি কুৎসিত, বৃদ্ধ হয়ে যাই, আমার দেহের ওপরে যদি বার্ধক্যের ছাপ পড়ে? তখন কী হবে?

বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আ, তখন! প্রিয় ডোরিয়েন, তখন লড়াই করে পাওনাগণ্ডা ছিনিয়ে নিতে হবে তোমাকে। বর্তমানে, তারাই তোমার কাছে এগিয়ে। আসবে। না না। এই সুন্দর চেহারাটি বজায় রাখতে হবে তোমাকে। আমরা এমন একটা যুগে বাস করি যখন মানুষ বিজ্ঞ হওয়ার জন্যে অতিরিক্ত পড়াশুনা করে, সুন্দর হওয়ার জন্যে চিন্তা করে বেশি। আমরা তোমাকে ছেড়ে দিতে পারিনে। এখন ভালো পোশাক পরে ক্লাবে যাই চল। এমনিতেই আমাদের দেরি হয়ে গিয়েছে।

হ্যারি, তোমার সঙ্গে বরং আমি অপেরাতেই দেখা করব। বড়ো ক্লান্ত আমি, খাবার বিশেষ ইচ্ছে নেই আমার। তোমার বোনের ‘বকস’ নম্বরটা কত?

সম্ভবত সাতাশা গ্রালড টায়ার-এর ওপরে তার বকস। দরজার ওপর তার নাম লেখা থাকবে। কিন্তু আমার সঙ্গে বেরোতে আর ডিনার খেতে পারছ না বলে সত্যিই আমি দুঃখিত।

ডোরিয়েন ক্লান্তভাবে বললেন, ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তুমি আমাকে যা বললে তার জন্যে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। নিঃসন্দেহে তুমি আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু তোমার মতো আজ পর্যন্ত আর কেউ আমাকে বুঝতে পারেনি।

তাঁর সঙ্গে করমর্দন করে লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন, আমাদের বন্ধুত্ব সবে শুরু হয়েছে। বিদায়। আশা করি, রাত্রি সাড়ে নটার আগেই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। মনে রেখ, প্যাটি আজ গান করছেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন লর্ড হেনরি। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরিয়েন বেল টিপলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিকটর একটা বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকল, তারপরে ঘরের। পর্দাগুলি সব নামিয়ে দিল। ভিকটরের চলে যাওয়ার জন্যে অস্থিরভাবে তিনি অপো করতে লাগলেন। সব কাজেই লোকটা কেমন যেন মাঠো।

লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পর্দার দিকে দৌড়ে গেলেন; তারপরে একপাশে টেনে দিলেন সেটি। না, ছবির ওপরে আর কোনো পরিবর্তনের চাপ পড়েনি। তাঁর আগেই সাইবিল ভেনের মৃত্যসংবাদ ও জানতে পেরেছে। জীবনের ঘটনাগুলি কী ভাবে ঘটছে সে বিষয়ে ও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। ঠিক যে-সময়ে সাইবিল বিষ অথবা ওই জাতীয় কিছু খেয়েছিল ঠিক সেই সময়ের নিষ্ঠুরতার সেই বিশেষ ছাপটি ওর মুখের ওপরে পড়েছিল। অথবা ফলাফলের বিষয়ে ও সম্পূর্ণ উদাসীন? আত্মার ভিতরে যা ঘটে ও কি কেবল সেইটুকুই গ্রাহ্য করে? তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন হয়তো একদিন তিনি চোখের ওপরেই ওর ওপরে পরিবর্তন দেখতে পাবেন; সেই সম্ভাবনায় তিনি ভয়ে পিছিয়ে এলেন।

হতভাগিনী সাইবিল! তাঁদের দুজনের মধ্যে কী অদ্ভুত রোমান্সই না গড়ে উঠেছিল! স্টেডের ওপরে প্রায়ই সে মৃতের অনুকরণ করত। তারপরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই তাকে ছুঁয়ে গেল, সঙ্গে করে নিয়ে গেল তাকে। তার জীবননাট্যের সেই ভয়ঙ্কর শেষ দৃশ্যটি সে কী ভাবে অভিনয় করল? মৃত্যুর সময় সে কি তাঁকে অভিশাপ দিয়েছে? না; তাঁর প্রতি ভালোবাসা নিয়েই সে মৃত্যুবরণ করেছে এবং এখন থেকে ভালোবাসা তাঁর কাছে পবিত্র জিনিস ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সে সব কিছুর জন্যে প্রাঘশ্চিত্ত করে গিয়েছে। থিয়েটারে সেই বীভৎস রাত্রিটিতে তার জন্যে তিনি কত কষ্ট পেয়েছেন সে-সব কথা আর তিনি মনে রাখবেন না। তার কথা যখন তিনি চিন্তা করবেন তখন মনে হবে একটি নির্ভেজাল প্রেমের প্রতীক করে ভগবান তাকে সংসার রঙ্গমঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রতীকটি সম্পূর্ণভাবে ট্রাডিক। মেয়েটির শিশুর মতো সরল চাহলি, তার চিত্তাকর্ষক রোমান্টিক চালচলন আর ভীরু লাবণ্যের কথা মনে হতেই তাঁর চোখ দুটি ভলে ভরে উঠল। সেই জল তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে তিনি ছবির দিকে আবার তাকিয়ে দেখলেন।

তাঁর মনে হল এখন থেকে তাঁর চলার পথটা তাঁকেই ঠিক করে ফেলতে হবে। অথবা তা কি আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ, ভীবনই তা ঠিক করে দিয়েছে জীবন, আর জীবন সম্বন্ধে তাঁর অনন্ত কৌতূহল। অনন্ত যৌবন, অনন্ত কামনা, ইঙ্গিতময় এবং গোপন আনন্দ, উদ্যম, উদামতর পাপ–এই সব কটির সঙ্গে মোলাকাৎ করতে হবে তাঁকে। তাঁর লজ্জা আর। অপমানের সমস্ত জ্বালা আর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ছবিটিকে। এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেননি তিনি।

ক্যানভাসের ওপরে আঁকা ছবিটির সুন্দর মুখের ওপরে ভবিষ্যতে যে কলঙ্করেখাগুলি পড়ে সেটিকে হতবিষ্কত করে তুলবে একথা ভাবতে গিয়েই তিনি আতঙ্কিত হলেন। একবার নার্সিসাসকে ব্যঙ্গ করার শিশু-চাপল্যে যে ঠোঁট দুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছিল সেই ঠোঁট দুটিকে তিনি চুম্বন করলেন, অথবা চুম্বন করার ভান করলেন। অনেকদিন প্রভাতে এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতেন। এখন থেকে তাঁর প্রতিটি কাজের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে কি ছবিটির পরিবর্তন হবে? এই ছবিটা কি শেষ পর্যন্ত দানবীর আর সেই সঙ্গে ঘৃণ্য হয়ে দাঁড়াবে? শেষ পর্যন্ত কি ছবিটিকে সূর্যকিরণ থেকে সরিয়ে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখতে হবে? হায়রে, কী দুর্ভাগ্য, কী দুর্ভাগ্য।

ছবি আর তাঁর মধ্যে যে ভয়ানক একটি আত্মিক সংযোগ দেখা দিয়েছে সেটি ছিঁড়ে ফেলার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কথা একবার তিনি চিন্তা করলেন। প্রার্থনা করার ফলে ছবিটির ওপরে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সম্ভবত সেই প্রার্থনার ফলেই ছবিটি আর ভোল পালটাবে না। কিন্তু তবু যতই আজগুবি হোক, অথবা যত ভয়ানক পরিণতিই আসুক, জীবন। সম্বন্ধে এতটুকু জ্ঞান আছে এমন মানুষ কে রয়েছে যে চির যৌবন ভোগ করার সুযোগ ছাড়তে পারে? তা ছাড়া, ছবির প্রতিটি নিয়ন্ত্রিত করার সত্যিই কি কোনো ক্ষমতা রয়েছে তাঁর? প্রার্থনা করার জন্যেই কি ছবিটি তার প্রথম পরিবর্তনকে বর্জন করেছে? এর পেছনে কি অদ্ভুত কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ নেই? জীবজগতের ওপরে চিন্তার যদি কোনো প্রভাব থাকে, তাহলে মৃত আর জডের ওপরেও কি তা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না? অর্থাৎ, গভীরভাবে চিন্তা। অথবা কামনা করলে বাইরের কোনো বস্তু কি আমাদের মনের গভীরে নিহিত বাসনা-কামনার অজস্র সম্পন্দনের মধ্যে তার অণু-পরমাণুগুলিকে সমান তালে নাচাতে পারে না? কিন্তু কারণটা নিয়ে চুলচেরা বিচার করার প্রয়োজন নেই তাঁর। আর কখনো ভয়ঙ্কর কোনো শক্তির কাছে তিনি প্রার্থনা জানাবেন না, প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করবেন না। প্রতিকৃতিটা যদি তার মর্জিমতো রঙ বদলায় তো বদলাক। তাঁর কিছু করার নেই। অত খুঁটিয়ে দেখে লাভ কী?

কারণ এটিকে লক্ষ করার মধ্যেই তো আসল আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে। একেই অনুসরণ করে তিনি তাঁর মনের গভীরে লুকানো অনেক কিছুই জানতে পারবেন। ঐন্দ্রজালিক আরশীর মতো ছবিটি তাঁকে সাহায্য করবে। এটি যেমন তাঁর দেহটাকে ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি প্রকাশ করে দেবে তাঁর আত্মাটিকে। এবং যখন ওর ওপরে শৈত্যের জড়তা এসে দেখা দেবে তখনো তাঁর দেহের ওপরে বসন্তের হিল্লোল থাকবে জেগে। যখন ওর মুখের ওপর থেকে রক্ত শুকিয়ে যাবে, যখন ওর চোখ দুটি তাদের জ্যোতি হারিয়ে কোটরের মধ্যে আশ্রয় নেবে তখনো তিনি ভরা যৌবনের জোয়ারে ভেসে বেড়াবেন। তাঁর সৌন্দর্যের একটি কণাও নষ্ট হবে না; তাঁর ধমনীর একটি সম্পন্দনও গতিহীন হবে না; গ্রীক দেবতাদের মতো তিনি শক্তিবান হয়ে থাকবেন, গতি আর আনন্দের আমেজে থাকবেন মেতো ক্যানভাসের ওপরে আঁকা ওই রঙিন প্রতিকৃতিটার কী হবে তাতে তাঁর কী আসে যায়? তিনি তো নিরাপদে থাকবেন। এ-ছাড়া, আর কিছু ভাববার নেই তার।

হাসতে-হাসতে ভারী পর্দাটা আবার তিনি প্রতিকৃতির মুখের ওপরে টেনে নিলেন; তারপরে, শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন। সেইখানে তাঁর পরিচারক ভিকটর তাঁরই জন্যে অপেষ্কা করছিল। এক ঘন্টা পরে তিনি অপেরাতে হাজির হলেন; লর্ড হেনরি তাঁর চেয়ারের ওপরে ঝুঁকে বসেছিলেন।

.

নবম পরিচ্ছেদ

পরের দিন সকালে-সকালে তিনি বসে-বসে প্রভাতকালীন ডালযোগ করছিলেন এমন সময় বেসিল হলওয়ার্ড ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। ঢুকেই গম্ভীরভাবে বললেন: তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব খুশি হয়েছি, ডোরিয়েন। কাল রাত্রিতে এসে শুনলাম তুমি অপেরাতে গিয়ে। অবশ্য আমি জানতাম কথাটা সত্যি নয় তবু তুমি ঠিক কোথায় গিয়েছ সে-সম্বন্ধে যদি সপষ্ট ভাবে। বলে যেতে তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আর একটা বিপদ ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় কাল সন্ধেটা আমার খুব খারাপ গিয়েছিল। সংবাদটা প্রথম পাওয়ার পরে আমাকে তোমার টেলিগ্রাফ করা উচিত ছিল। ক্লাবে ‘গ্লোব’ কাগজের শেষ সংস্করণটার ওপরে চোখ বুলোতে-বুলোতে হঠাৎ সংবাদটা আমার নজরে পড়ে গেল। সংবাদটা পড়েই আমি এখানে। ছুটে এসেছিলেম। তোমাকে না পেয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সমস্ত ঘটনাটা পড়ে আমি যে কত কষ্ট পেযেছিলেম তা আর তোমাকে কী বলব? আমি জানি নিশ্চয় তোমার কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তুমি কি মেয়েটির মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাদের। বাড়ি গিয়েছিলে? একবার ভাবলাম সেই দিকে আমিও এগিয়ে যাই। কাগজেই তাদের বাড়ির ঠিকানাটা দেওয়া ছিল। এসটোন রোডের কাছাকাছি একটা জায়গা, তাই না? কিন্তু যে দুঃখকে আমি এতটুকু কমাতে পারব না সেখানে অনাবশ্যক যেতে আমার কেমন সঙ্কোচ লাগছিল। হতভাগিনী নারী! নিশ্চয় তাঁর মনের অবস্থা খুব খারাপ। ওই তাঁর একমাত্র সন্তান। এ বিষয়ে তিনি কী বললেন?

ভেনিশিয়াল গ্লাস থেকে ফিকে বেগলে রঙের মদ চাকতে-চাকতে ডোরিয়েন আস্তে আস্তে বললেন: প্রিয় বেসিল, তা জানব কেমন করে?

তারপর অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে বললেন: আমি অপেরাতেই গিয়েছিলেম। তোমারও সেখানে যাওয়া। উচিত ছিল। কালই প্রথম হেনরির বোন লেডি গিনদোলেন-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হল, আমরা দুজনে একটা বকস-এ বসেছিলেম। ভদ্রমহিলা সত্যিকার সুন্দরী। প্যাটিও অদ্ভুত সুন্দর গান গাইলেন। ভয়ানক ঘটনা নিয়ে আর আলোচনা করো না। কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা না করলেই সেটা যে সত্যিই ঘটেছে তা আমাদের মনে হবে না। হ্যারি বলে, আলোচনা করলেই যে-কোনো জিনিসই বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। আমি কেবল তোমাকে এইটুকুই জানাতে পারি যে ভদ্রমহিলার ওই একমাত্র সন্তান নয়। একটি ছেলেও রয়েছে। সেটি-ও বড়ো চমৎকার ছেলে কিন্তু সে অভিনয় করে না। পেশার দিক থেকে সে নাবিক বা ওই জাতীয় কিছু একটা হবে। এখন তোমার কথা, আর বর্তমানে তুমি কী আকছ তাই আমাকে বল।

ধীরে-ধীরে এবং বেদনার্ত স্বরে হলওয়ার্ড বললেন: অপেরাতে গিয়েছিলে? একটা নোংরা ঘরে সাইবিল ভেনের মৃতদহটা যখন পড়েছিল তখন তুমি বসেছিলে অপেরাতে! যে মেয়েটিকে তুমি ভালোবাসতে সেই মেয়েটিকে নির্বিঘ্নে কবরস্থ করার আগেই অন্য মহিলারা যে কত। সুন্দরী, প্যাটি যে কেমন স্বর্গীয় গান গাইলেন সেই সব কথা আমাকে তুমি বলতে পারলে? তুমি কি জান না, সাইবিলের শ্বেতশুভ্র সেই শরীরটা নিয়ে এখনো অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে?

চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন: বেসিল, চুপ কর, চুপ কর! ওসব কথা শুনতে চাই লে। আমাকে ওসব কথা তুমি বলো না। যা হয়েছে তা হয়ে গিয়েছে। যা অতীত তা অতীতেই মিলিয়ে যাক।

গতকাল যা ঘটেছে তাকে তুমি অতীতে বলতে চাও?

ঘন্টা-মিনিট ধরে সময়ের প্রকৃতি ঠিক করা যায় না; যারা মূর্খ, মনের নদীতে যাদের চড়া পড়ে গিয়েছে, বিশেষ কোনো অনুভূতিকে ভুলে যেতে তাদেরই অনেক বছর সময় লাগে। নিজের প্রবৃত্তিগুলিকে যে আয়ত্তে রাখতে পেরেছে সে যেমন অতি সহজে নতুন আনন্দের আয়োজন। করতে পারে তেমনি সহজে ভুলে যেতে পারে দুঃখ প্রবৃত্তির দাস হতে আমি রাজি নই। আমি চাই তাদের খাটাতে, আনন্দ পেতে এবং তাদের ওপরে প্রভুত্ব করতো।

ডোরিয়েন, তুমি যে কথা বলছ সেগুলি নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। এমন কিছু ঘটেছে যা তোমার চরিত্রকে একেবারে পালটিয়ে দিয়েছে। যে অদ্ভুত সুন্দর ছেলেটি দিনের পর দিন আমার স্টুডিযোতে এসে বসে থাকত, এখনো বাইরে থেকে সেইরকমই সুন্দর তুমি দেখতে। কিন্তু তখন তুমি ছিলে সাদামাঠা, স্বাভাবিক এবং স্নেহশীল। সারা দুনিয়ায় তোমার মতো নিষ্পাপ মানুষ আমার চোখে আর পড়েনি। কিন্তু এ কী কথা শুনছি! জানি না, কী হল তোমার। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে হৃদ্য বলতে কোনো পদার্থ তোমার নেই। নেই কোনো দয়া, মায়া, অনুভূতি। বেশ বুঝতে পারছি, হ্যারির প্রভাব তোমার ওপরে পড়েছে।

লাল হয়ে উঠল ডোরিয়েনের মুখ, তিনি জানালার ধারে গিয়ে সূর্যকরোজ্জ্বল বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ; তারপরে বললেন: বেসল, হ্যারির কাছে আমি অনেক ঋণী; তোমার চেয়েও বেশি। তুমি আমাকে কেবল অনাবশ্যকভাবে দাম্ভিক হতে শিখিয়েছিলে।

সেই জন্যে আমি শাস্তি পেয়েছি, ডোরিয়েন-অথবা ভবিষ্যতে পাব।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ডোরিয়েন বললেন: তোমার কথাটা আমার মাথায় ঢুকছে না বেসিলা তুমি কী চাও তাও আমি বুঝতে পারছি না। কী চাও বল তো?

 দুঃখের সঙ্গে আর্টিস্ট বললেন, আমি চাই সেই ডোরিয়েন গ্রে-কে যার ছবি আমি এঁকেছি।

তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে এবং একটি হাত তাঁর কাঁধের ওপরে রেখে ডোরিয়েন বললেন: বড়ো দেরি হয়ে গিয়েছে বেসিল। গতকাল যখন আমি শুনলাম সাইবিল আত্মহত্যা করেছে…

তাঁর দিকে তাকিয়ে বিহ্বল নেত্রে হলওওযার্ড বললেন; আত্মহত্যা! হায় ভগবান! এ বিষয়ে আমারও কোনো সন্দেহ নেই।

প্রিয় বেসিল, এটা যে একটা নিছক দুর্ঘটনা তা নিশ্চয় তুমি মনে করনি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আত্মহত্যাই সে করেছে।

বয়স্ক মানুষটি নিজের হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে বললেন: ওঃ, কী ভয়ানক!

দেহটা তাঁর কাঁপতে লাগল।

ডোরিয়েন গ্রে বললেন: না, না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই এতো এ-যুগের এটাই হচ্ছে একটি বড়ো রোমান্টিক ট্রাজিডি। যারা অভিনয় করে তারা সাধারণত সাধারণ ভাবেই বেঁচে থাকে। তাদের স্বামী থাকে, থাকে বিশ্বাসী স্ত্রী; জীবনটা তাদের একঘেয়ে, গতানুগতিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমি কী বলতে চাই তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ? আমি বলতে চাই শ্রেণি আর । সাংস্কৃতির দিক থেকে তারা সবাই মধ্যবিত্ত ধর্ম, আচার-ব্যবহার–সব দিক থেকেই তাদের সঙ্গে সাইবিলের পার্থক্য কত। তার জীবনটাই হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর, মধুর একটি ট্র্যাজিডি সব সময়েই সে নায়িকা। গত রাত্রিতে, অর্থাৎ তোমরা তাকে যেদিন দেখেছিলে–সে খুব। খারাপ অভিনয় করেছিল, কারণ সত্যিকার ভালোবাসা বলতে কী বোঝায় তা সে বুঝতে পেরেছিল। যখন সে বুঝতে পারল এটা কতখানি অবাস্তব তখনই সে মারা গেল। ঠিক এই ভাবেই জুলিয়েট মারা গিয়েছিল। সত্যিকার আর্টের জগতে প্রবেশ করল সে তার মত্যুর মধ্যে আমি কী দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি শহিদ হওয়ার কবুণ ব্যর্থতা, বিনষ্ট সৌন্দর্যের ব্যর্থতা। কিন্তু যা তোমাকে বলছিলাম, ভেব না যে আমি কম দুঃখ ভোগ করেছি। গতকাল যদি বিশেষ একটি মুহূর্তে তুমি এখানে আসতে–ধর সাড়ে পাঁচটা অথবা পৌনে ছটার। কাছাকাছি-তাহলে আমার চোখ ভরা জল তুমি দেখতে পেতে। হ্যারি-ই এই সংবাদটা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। খবরটা পেয়ে আমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল এমন কি সেও তা। বুঝতে পারেনি। দুঃখ আর অনুশোচনায় সাময়িকভাবে ভেঙে পড়েছিলেম আমি। তারপরে সেই অবস্থাটা আমার কেটে গেল। সেই অনুভূতিকে আর আমি ফিরিয়ে আনতে পারব না; একমাত্র ভাবপ্রবণ মূর্খ ছাড়া কেউ তা পারে না। সেদিক থেকে, বেসিল, আমার ওপরে সত্যিই তুমি অবিচার করা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে তুমি এখানে এসে খুব ভালো কথা। তুমি দেখলে আগেই আমি শান্ত হয়ে গিয়েছি। দেখেই তুমি ক্ষেপে উঠলো এই কি তোমার সহানুভূতির নমুনা? হ্যারি আমাকে একটা গল্প বলেছিল। তুমি আমাকে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলে। গল্পটা হচ্ছে, একজন পরোপকারী ব্যক্তির একটি অন্যায়ের প্রতিকার করার। অ কোনো একটি আইনের ধারা পালটানোর জন্যে, ব্যাপারটা আমার ঠিক মনে নেই, তাঁর জীবনের কুড়িটি বছর তিনি নষ্ট করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর চেষ্টা সফল হয়েছিল; তার। পরেই কিন্তু তিনি নিরাশ হয়ে পড়লেন; আর কিছু করার ছিল না তাঁর; মনের এই বেকারত্ব সহ্য করতে পারলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত অপরের ক্ষতি করার উৎসাহে মেতে উঠলেন। তা ছাড়া প্রিয় বেসিল, তুমি যদি সত্যিই আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাও তাহলে কেমন করে ওই তিক্ত ঘটনাটিকে আমি ভুলে যেতে পারি সেই পথটাই তুমি আমাকে বাতলিয়ে দাও; অথবা, কেমন করে সমস্ত জিনিসটাকে আমি আর্টিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পারি সেই উপদেশই আমাকে দাও। সেদিন মারলো হোটেলে একটি যুবকের সঙ্গে তুমি আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তিনি সেদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট পীতাভ মাটিন ভুলিয়ে দিতে। পারে। আমি অবশ্য সে-মতে বিশ্বাসী নই। আমি সুন্দর জিনিস ভালোবাসি; সুন্দর আর। বাস্তব–যেগুলিকে আমি স্পর্শ করতে পারি। পুরনো ব্রোকেড, সবুজ ব্রোঞ্জের জিনিস, ল্যাকারের কাজ, খোদাই করা হাতির দাঁত, সুন্দর পারিপার্শ্ব, প্রাচুর্য, উচ্ছ্বাস, আর আনন্দ–এদের সকলের কাছ থেকেই কিছু না কিছু পাওয়ার রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে আর্টিস্টিক মানসিকতা রয়েছে, অথবা, যে আটিস্টিক রুচি তারা প্রকাশ করে, আমার বেশি আকর্ষণ সেই দিকে হ্যারির মতে নিজের জীবনটাকে মানুষ যদি দর্শকের ভূমিকা থেকে দেখতে পারে তাহলেই সে নিজের জীবনের দুঃখ ভুলে যায়।

কেমন করে আমি হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠলাম তা তুমি জান না। তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি ছিলাম স্কুলের ছাত্রএখন আমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। কিন্তু তার জন্যে আমাকে তুমি কম পছন্দ করতে পারবে না। আমি এখন অন্য জাতের আমার ভাবনা নতুন, চিন্তা নতুন, আদর্শ নতুন। এক কথায় খোলনলচে আমার পালটিযে গিয়েছে। পরিবর্তন আমার যে হয়েছে সেটা ঠিকই কিন্তু তুমি সব সময়েই আমার বন্ধু থাকবে-ঠিক আগের মতনই। অবশ্য। হ্যারিকে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু বন্ধু হিসাবে হ্যারির চেয়ে তুমি অনেক উঁচু স্তরের শক্তির দিক থেকে তার মতো সবল তুমি নও, জীবনটাকে বেশি ভয় কর তুমি কিন্তু তুমি। তার চেয়েও উঁচু মনের। আমরা দুজনে কী সুখেই না ছিলাম। বেসিল, আমাকে তুমি পরিত্যাগ করো না; আমার সঙ্গে ঝগড়া করো না তুমি এখন আমাকে যা তুমি দেখছ, আমি তাই। এছাড়া আর কিছু আমার বলার নেই।

চিত্রকরকে অদ্ভুতভাবে বিচলিত হতে দেখা গেল। ছেলেটিকে তিনি বড়ো ভালোবাসতেন এবং তাঁর চিত্রকরের জীবনে ওই ছেলেটিই বিরাট একটি সাফল্য এনে দিয়েছে। তাকে বেশি। তিরস্কার করতে কেমন যেন কষ্ট হল তাঁর। তাছাড়া, জীবনের ওপরে তার যে বিরাট নৈরাশ্য দেখা দিয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে সাময়িক কিছুণের ভেতরেই তার এই মনোভাব নষ্ট হয়ে যাবে। তার মধ্যে অনেক ভালো জিনিস রয়েছে, এমন অনেক কিছু রয়েছে যাদের মহতের পর্যায়ে ফেলা যায়।

শেষ পর্যন্ত একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে তিনি বললেন: ঠিক আছে, ডোরিয়েন, আজকের পর এই ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে আর কোনোদিনই আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করব না। আশা করি, এর মধ্যে তোমাকে কেউ ভজড়াবে না। আজ বিকেলেই হত্যার তদন্ত শুরু হবে তারা কি তোমাকে সাল্কী দেওয়ার জন্য ডেকেছে?

মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন; তদন্ত কথাটা শুনে তাঁর মুখের ওপরে বিরক্তির রেখা ফুটে বেরোল; সেই রেখার মধ্যে ফুটে উঠল একটা রুক্ষ ভাব, একটা অশ্লীল অনুভাব। তিনি শুধু বললেন: তারা আমার নাম জানে না।

কিন্তু মেয়েটি নিশ্চয় জানত?

শুধু আমার খৃস্টান নামটাই সে জানত। আমি নিশ্চিত যে এ কথাটাও সে কাউকে বলেনি। সে। একবার আমাকে বলেছিল আমার আসল পরিচয় জানার জন্যে ওখানে অনেকেই বিশেষ কৌতূহলী ছিল। সে তাদের সবাইকেই বলেছিল আমার নাম “প্রিন্স চার্মিং”, ভালোই করেছিল। বেসিল, সাইবিলের একটা ছবি এঁকে দিও আমাকে। কয়েকটি চুম্বন, করুণ কয়েকটি ভাঙা-ভাঙা কথার স্মৃতি ছাড়া তার আরো কিছু আমি সঞ্চযের ঘরে জমা করে রাখতে চাই।

তুমি চাইলে কিছু করার চেষ্টা করব, ডোরিয়েন। কিন্তু তুমি এসে আবার আমার কাছে বস তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।

হঠাৎ চমকে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন চিৎকার করে বললেন: না; আর আমি তোমার মডেল হতে পারব না–না, না; অসম্ভব।

চিত্রকর তাঁর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন; কী পাগলের মতো কথা বলছ! তুমি কি বলতে চাও তোমার জন্যে আমি যা করেছি তা তোমার ভালো লাগেনি? দেখতে পাচ্ছি, ছবিটার সামনে তুমি একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছা দেখতে দাও আমাকে আজ পর্যন্ত আমি যা এঁকেছি এটি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ডোরিয়েল, পর্দাটাকে সরিয়ে দাও। আমার ছবিকে এইভাবে ঢেকে রাখাটা তোমার চাকরদের খুব অন্যায় হয়েছে। ভেতরে ঢোকার সময় তোমার ঘরের চেহারাটাও যেন কেমন-কেমন লাগছে।

ওর সঙ্গে আমার চাকর-বাকরদের কোনো সম্পর্ক নেই, বেসিলা ভেব না, আমার ঘর কী ভাবে সাজানো হবে সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমি কোনো পরামর্শ করি না। এক কিছু ফুল সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছুতে হাত দেয় না তারা। না; ছবিটাকে আমিই ঢেকে রেখেছি। ছবিটার ওপরে বেশি আলো পড়ছিল।

বেশি আলো! নিশ্চয় নয়। এই জায়গাটাই ছবিটা রাখার সবচেয়ে ভালো জায়গা। দেখি ছবিটা।

এই বলে হলওয়ার্ড ঘরের সেই বিশেষ কোণটির দিকে এগিয়ে গেলেন।

একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ ডোরিয়েনের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল। তিনি দৌড়ে ছবি আর চিত্রকরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।

বিবর্ণ মুখে তিনি বললেন: বেসিল, ছবিটাকে তুমি দেখো না। আমি চাইলে তুমি দেখ।

 হলওয়ার্ড হাসতে হাসতে বললেন: বল কী হে! আমার নিজের আঁকা ছবি আমি দেখব না? তুমি সিরিয়াস নও, কেন দেখব না?

আমার দিব্যি, যদি তুমি ছবিটা দেখ তাহলে জীবনে আর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এদিক থেকে আমি তোমাকে খাঁটি কথাই বলছি। এর কোনো কৈফিয়ৎ তোমাকে আমি দেব না; তুমিও তা চেয়ো না। কিন্তু মনে রেখ, পর্দাটা একবার চুয়েছ কি আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

বজ্রাহতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন হলওয়ার্ড। অবাক বিস্ময়ে ডোরিয়েনের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। ডোরিয়েনের এই রকম মানসিক অবস্থার সঙ্গে তাঁর আগে কোনোদিন পরিচয় ছিল না। ডোরিয়েন সত্যি-সত্যিই রাগে টগবগ করে ফুটছিলেন। তাঁর হাত দুটি ছিল মুষ্টিবদ্ধ, দুটো চোখ আগুনের গোলার মতো বনবন করে ঘুরছিল। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক কাঁপছিলেন তিনি।

ডোরিয়েন!

কোনো কথা নয়।

কিন্তু ব্যাপারটা কী বল তো?

 পিছু ঘুরে জানালার দিকে ফিরে যেতে-যেতে বেশ বিরক্তির সঙ্গেই তিনি বললেন, অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে আমি ছবিটা দেখব না। কিন্তু আমার নিজের হাতে আঁকা ছবিটা আমি দেখতে পাব না–ব্যাপারটা নেহাতই হাস্যকর, বিশেষ করে এই শরৎ কালে প্যারিসের চিত্র প্রদর্শনীতে ছবিটা যখন আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। পাঠানোর আগে সম্ভবত ছবিটার ওপরে আর এক পোঁচ রঙ বুলাতে হবে। সেইজন্যেই ছবিটা একবার আমার দেখা দরকার। আডকে দেখার আপত্তিটা কী?

এই ছবিটাকে তুমি প্রদর্শনীতে পাঠাবে!

 চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন। একটা অদ্ভুত ভীতির ছায়া তাঁর সারা শরীরের ওপরে গুঁডি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। তাঁর জীবনের গোপন রহস্যটি সকলের কাছে দেখানো হবে? সারা বিশ্ব সেই রহস্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে? না না; সে অসম্ভব। ঠিক কী তাঁর করা উচিত তা তিনি বুঝতে পারলেন না বটে; কিন্তু এটা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না যে একটা কিছু তাঁর করা দরকার এবং এখনই।

হ্যাঁ। আমার ধারণা তাতে তোমার কোনো আপত্তি হবে না। রু দ্য সিজের বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখানোর জন্যে জর্জ পেটিন্ট আমার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলিকে সংগ্রহ করছেন। প্রদর্শনীটা শুরু হচ্ছে অকটোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে। মাত্র একমাসের জন্য ছবিটা আমি নিয়ে যাব। আমার ধারণা, এই কটা দিন ছবিটাকে যদি সব সময় তুমি পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখ তাহলে ওর উপরে যত্ন নেওয়াও তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

কপালের ওপরে হাত বুলোলেন ডোরিয়েন। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সেখানে। তাঁর মনে হল একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির একেবারে শেষ ধাপে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

তিনি বেশ জোর গলাতেই বললেন: ছবিটা তুমি কোনোদিনই প্রদর্শনীতে পাঠাবে না এই রকম একটা কথা মাসখানেক আগে আমাকে তুমি বলেছিলো তোমার মত পরিবর্তন করলে কেন? তোমাদের মতো যারা নিডদের এক কথার মানুষ বলে মনে করে তাদের সঙ্গে অন্য লোকদের কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে এই যে তোমাদের উচ্ছ্বাস অর্থহীন। তুমি যে আমাকে বলেছিলে যে পৃথিবীর কোনো কিছুর লোভেই তুমি ছবিটি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না সেকথাটা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি। হ্যারিকেও তুমি ঠিক ওই কথাই বলেছিলে।

এই বলেই হঠাৎ তিনি চুপ করে গেলেন। হঠাৎ তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল। কিছুটা সিরিয়াস আর আর কিছুটা উপহাসের ভঙ্গিতে লর্ড হেনরি একবার তাঁকে বলেছিলেন: যদি মিনিট পনেরো সময় পাও তো বেসিলকে বলতে বলো কেন সে ছবিটি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না। সে আমাকে বলেছিল সে পাঠাবে না। কথাটা শুনে অবাক লেগেছিল আমার। হ্যাঁ, তাই। বেসিলেরও তাহলে কোনো গোপন রহস্য রয়েছে। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন, জানার চেষ্টা করবেন কারণটা।

তাঁর কাছে এগিয়ে এসে এবং সোজাসুজি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ডোরিয়েন বললেন: বেসিল, আমাদের দুজনেরই একটা গোপন রহস্য রয়েছো তুমি যদি তোমার কথা আমাকে বুল…আমার কথা আমি তোমাকে বলবা কেন তুমি আমার ছবিটা প্রদর্শনীতে পাঠাতে চাওনি তখন?

নিজের অজান্তে চিত্রকর একটু কেঁপে উঠলেন; বললেন: ডোরিয়েন, সে কথা বললে তুমি হয়তো আগের মতো আর আমাকে পছন্দ করবে না; চাই কি উপহাস-ও করতে পারা ও দুটির একটাও যদি তুমি কর আমি তা সহ্য করতে পারব না। তুমি যদি ওই ছবিটি আর কোনোদিনই আমাকে দেখাতে না চাও তাতেও আমি খুশি। আমি চাই তুমিই ওটিকে সব সময় দেখা তুমি যদি মনে কর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবিটিকে তুমি লুকিয়ে রাখবে তাতেও আমি সন্তুষ্ট। যশ বা খ্যাতি-দুটোর কোনোটাকেই আমি তোমার বন্ধুত্বের ওপরে স্থান দিইনে।

ডোরিয়েন গ্রে ছাড়লেন না; বললেন: না বেসিলি; তোমাকে বলতেই হবে। মনে হয় সেকথা ডানার অধিকার আমার রয়েছে।

তাঁর আতঙ্ক সরে গেল; তার জায়গা দখল করল একটা কৌতূহল। বেসিল হলওয়ার্ডের রহস্যটা কী তা জানার জন্যে তিনি বদ্ধপরিকর হলেন।

হলওয়ার্ডের চোখমুখের চেহারা দেখে মনে হল তিনি বেশ একটা অসুবিধায় পড়েছেন।

ডোরিয়েন, এস আমরা বসি। আমি তোমাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করব। তার উত্তর দাও। ছবির ভেতরে কোনো অদ্ভুত জিনিস কি তুমি লক্ষ করেছ? এমন একটা জিনিস যা প্রথমে তোমার নজরে পড়েনি; কিন্তু হঠাৎ একদিন ধরা পড়েছে তোমার কাছে?

কম্পিত হাতে চেয়ারের একটা হাতল জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন তিনিঃ বেসিল!

চমকে উঠে ভয়-বিহ্বল চোখে তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বুঝতে পারছি তোমার চোখে তা ধরা পড়েছে। চুপ কর। এ-বিষয়ে আমি যা বলতে চাই তা তুমি মন দিয়ে শোন, ডোরিয়েন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই, তুমি। অদ্ভুতভাবে আমাকে প্রভাবান্বিত করেছিলো আমার আল্ল, মস্তিষ্ক আর শক্তি সকলের ওপরেই প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলে তুমি। অনবদ্য স্বপ্নের মতো অদৃশ্য আদর্শের যে স্মৃতিটি আমাদের মতো আর্টিস্টদের অস্থির করে তোলে তুমি আমার কাছে ছিলে তার একটি মূর্ত প্রতীক। আমি তোমাকে পূজা করতাম। তুমি কারো সঙ্গে কথা বললে আমি তাকে করতাম হিংসা। আমি তোমার সমস্ত সত্তাকে নিজের মধ্যে পেতে চেয়েছিলাম। তুমি যখন আমার কাছে বসে থাকতে কেবলমাত্র তখনই আমি সুখী হতাম। তুমি যখন চলে যেতে, আমার শিল্পের মধ্যে তখনও তোমার উপস্থিতির সপর্শ পেতাম। অবশ্য এ ব্যাপারটা তোমাকে কখনো আমি জানতে দিইনি। জানতে দেওয়াটা সম্ভব ছিল না। তুমি তা বুঝতে পারতে না। আমি নিডোও কি তা পেরেছিলাম? আমি কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, একটি নিখুঁত বাস্তব সৌন্দর্যের মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি এবং পৃথিবীটা আমার চোখে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। সম্ভবত এটাও আমি জানতাম যে এই যুক্তিহীন পূভায় বিপদ লুকিয়ে। রয়েছে–সেই বিপদটা হচ্ছে হারানোর, ঠিক যেমন বিপদ রয়েছে সেটিকে নিজস্ব করে ধরে রাখার মধ্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল; তোমার মধ্যে নিজেকে আমি হারিয়ে। ফেললাম। বিশ্বের সমস্ত রোমান্টিক নায়কের বেশে তোমাকে আমি কল্পনা করে সাজিয়ে দিলাম। সমস্ত আর্টেরই শেষ করা তাই অবচেতন মনের সমস্ত সৌন্দর্য আর রসবোধকে রঙ-তুলি দিয়ে ক্যানভাসের ওপরে ধরে রাখা। একদিন এল, যে দিনটি আমার মতে বিপদজ্জনক, আমি তোমার ছবি আকতে মনস্থ করলাম–প্রাচীন মৃত যুগের রঙে নয়, তোমার আসল রঙো তুমি যা সেই ভাবে। এটাই শিল্পকলার বাস্তব রীতি। না, তোমার অপরুপ ব্যক্তিত্বের কোনো প্রভাব আমাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা আমি জানিলে। কিন্তু এটা আমি জানি যে তোমার প্রতিকৃতি আঁকার সময় প্রতিটি রঙ আর তুলির আঁচড় আমার মনের গোপন রহস্যটি আমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাছে অন্য লোকে আমার এই মূর্তিপূজার কথা জানতে পারে এই ভয়ে শঙ্কিত ছিলাম আমি। ডোরিয়েন, আমার মনে হয়েছিল প্রতিকৃতিটির মধ্যে আমার নিজস্ব সত্ত্বার অনেকখানি আমি ঢেলে দিয়েছিলেম। তখনই আমি ঠিক করে ফেলেছিলেম এ-ছবি কোনোদিনই আমি কোনো প্রদর্শনীতে পাঠাব না। তুমি কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলে কিন্তু ছবিটা আমার কাছে কী জিনিস তা তুমি তখন। ডানতে না। হ্যারিকে বলেছিলেম। সে আমাকে উপহাস করেছিল। সেই উপহাসে আমি কিছু মনে করিনি। ছবিটি শেষ হওয়ার পরে যখন আমি একা সেটির কাছে বসে থাকতাম তখন। আমার মনে হত আমি ঠিকই করেছি। ছবিটি আমার স্টডিযও থেকে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে আমার মোহ কেটে গেল। আমার মনে হল ছবিটির মধ্যে অপরূপ কিছুর সন্ধান পাওয়াটা আমার পক্ষে মূর্খতা হয়েছে; আমার কেবলই মনে হতে লাগল যে অপরূপ অঙ্গসৌষ্ঠভ ছাড়া। আর কিছু নেই তোমার। কেবল এইটুকু ভেবেই সান্ত্বনা পেলাম যে ছবি আঁকার ক্ষমতা আমার রয়েছে। এমন কি এখনো আমার মনে হয় যে কল্পনায় আমরা যা ভাবি তা কোনোদিন বাস্তবে রূপায়িত হয় না। আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি অবাস্তব হচ্ছে আর্ট। আঙ্গিকটা আঙ্গিক সাডা আর কিছু নয়। আমার ধারণা, আট যতখানি আটিস্টকে লুকিয়ে রাখে ততটা প্রকাশ করে না। সেই জন্যে প্যারিস থেকে ছবি পাঠানোর যখন আমন্ত্রণ পেলাম তখনই আমি ঠিক করলাম ওই ছবিটাকেই আমি প্রদর্শনীতে পাঠাবা তুমি যে রাজি হবে না সে কথা আমি ভাবিনি। এখন বুজতে পারছি তুমিই ঠিক। প্রতিকৃতিটাকে লোকচহস্কৃতে প্রকাশ করা উচিত হবে না। আমি তোমাকে যা বলেছি তার জন্যে রাগ করো না ডোরিযেলা হ্যারিকে যা বলেছি তোমাকেও তাই বলছি–বিশ্বের পূভা পাওয়ার জন্যেই তোমার সৃষ্টি হয়েছে।

দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন গ্রে। তাঁর দেহের স্বাভাবিক রঙ ফিরে এল; মুখের ওপরে ফুটে উঠল হাসি। যাক, বিপদটা কেটে গিয়েছে, আপাতত তিনি নিরাপদ। কিন্তু তবু ওই যে চিত্রকরটি তাঁর কাছে একটি স্বীকারোক্তি করলেন, তারই জন্যে বেসিলের ওপরে তাঁর বুড়ো মায়া হল। তাঁর ওপরেও কি তাঁর কোনো বন্ধুর এতখানি প্রভাব রয়েছে? প্রশ্নটা অবাক হয়েই ভাবতে লাগলেন তিনি। লর্ড হেনরির প্রভাবের মধ্যে মনোহারিত্ব রয়েছে এবং সেই প্রভাবটি নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁকে নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সত্যিকার ভালোবাসা বলতে কিছু তাঁর ভেতরে নেই। মানুষের ওপরে অনাস্থাও তাঁর যথেষ্ট। এমন কেউ কি রয়েছে যে তাঁকে পূজা করে? ভাগ্য কি তাঁর জন্যে পূজার উপকরণ সাজিযে রেখেছে?

হলওয়ার্ড বললেন; ছবির ওপরে এই বিশেষ ডিজনিসটা যে তোমার চোখে পড়েছে তাতেই আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছি, ডোরিয়েন। সত্যিই কি তুমি দেখতে পেয়েছ?

তিনি বললেন: দেখেছি। এমন একটা জিনিস দেখেছি যা আমাকে অবাক করে দিয়েছে।

যাই হোক, এখন ছবিটা একবার দেখতে দিতে নিশ্চয় তোমার আপত্তি নেই?

ডোরিয়েন মাথা নেড়ে বলেন: আর ওকথা নয়, বেসিল ছবিটার সামনে দাঁড়াতে তোমাকে আমি দেব না।

 আজ না দাও, আর একদিন নিশ্চয় দেবে?

কোনোদিন দেব না।

হয়তো তুমি ঠিকই করছ। এখন আমি চলি ডোরিয়েন। আমার জীবনে একমাত্র তুমি এসেছ। যে আমার চিত্রকলাকে প্রভাবান্বিত করেছে। যত ভালো ছবি আমি এঁকেছি সেগুলির জন্যে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমাকে আমি যা বললাম সেটা বলতে আমাকে কত খেসারৎ দিতে হয়েছে তা হয়তো তুমি জান না।

ডোরিয়েন বললেন: প্রিয় বেসিল, কীই ব মি আমাকে বলে? শুধু বলেছ, আমাকে তোমার খুব ভালো লাগে। শালীনতার দিক থেকে ওটা এমন একটা উঁচুদরের নয়।

ভদ্রতা দেখানোর জন্য ওকথা আমি বলিনি। ওটাই আমার স্বীকারোক্তি ওই স্বীকারোক্তি করার পরে মনে হচ্ছে আমি কিছু হারিয়ে ফেলেছি। পূজা করার কথাটা সম্ভবত মুখ ফুটে বলতে নেই।

এই স্বীকারোক্তি মানুষের মনে আশা জাগায় না বন্ধু।

 তা ছাড়া আর কী তুমি আশা কর, ডোরিয়েন? ছবির মধ্যে আর কিছু তুমি দেখনি। দেখেছ কি? আরো কিছু দেখার জিনিস সেখানে রয়েছে?

না। আর কিছু নেই। একথা তুমি জিজ্ঞাসা করছ কেন? কিন্তু পূজার কথা বলো না। কথাটাই বোকার মতো। আমরা পরস্পরের বন্ধু বেসিল, চিরকাল আমরা বন্ধুই থাকব।

 বিষণ্ণ সুরে চিত্রকর বললেন: বন্ধু হিসাবেই তুমি হ্যারিকে পেয়েছ।

ছোটো ছোটো হাসির ঢেউ-এ ভেঙে পড়ে, ডোরিয়েন বললেন: ও, হ্যারির কথা বলছ? অবিশ্বাস্য কথা বলে সে সারাদিন কাটায়, রাত্রিতে এমন সব কাজ করে যেগুলি অবাস্তব, আমিও ঠিক ওই রকম জীবনই যাপন করতে চাই। তবু আমার মনে হয়, বিপদে পড়লে। কোনোদিনই আমি হ্যারির কাছে যাব না; তার আগে যাব তোমার কাছে।

আবার তুমি আমার মডেল হবে?

অসম্ভব।

আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমার চিত্রকরের জীবনটা তুমি নষ্ট করে দিলে, ডোরিয়েন। কোনো মানুষের জীবনে দু’বার আদর্শ আসে না; একবারই খুব কম মানুষই তার আদর্শের সংবাদ পায়।

কারণটা তোমাকে আমি বুঝিযে বলতে পারব না, বেসিল। কিন্তু তোমার ছবির মডেল হতে আর আমি পারব না। ছবিটার মধ্যে বিপজ্জনক কিছু রয়েছে। মনে হচ্ছে ছবিটা জীবন্ত। চল, তোমার সঙ্গে চা খাইগে। এ আলোচনা মধুরেণ সমাপয়েৎ করা যাক।

হলওয়ার্ড বললেন: তোমার দিক থেকে মধুরেণ হতে পারে। এখন চলি। ছবিটা যে আর তুমি আমাকে দেখতে দেবে না এই কথা শুনে দুঃখই পেয়েছি। কিন্তু উপায় নেই। ছবিটার সম্বন্ধে তোমার মনোভাব কী তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন হলওয়ার্ড। মনে-মনে হাসলেন ডোরিয়েন গ্রে। হতভাগ্য বেসিল। ছবিটা দেখতে না দেওয়ার আসল কারণটা তিনি জানতেই পারলেন না। আর কী আশ্চর্যের কথা, তাঁর নিজের রহস্য ফাঁস না করে কী অদ্ভুত উপাযেই না তিনি বেসিলের মনের গোপন কথাটি বার করে নিলেন চিত্রকরের হাস্যোদ্দীপক হিংসা, তাঁর উদ্দাম ভক্তি, অনাবশ্যক স্তুতি,–বেসিলের মনের অনেক অবচেতন মনের রহস্যই তিনি জানতে পারলেন। বেসিলের উন্যে দুঃখ হল তাঁর। রোমান্সের রঙে রঙিন বন্ধুত্বের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে হল তাঁরা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘বেল’ টিপলেন তিনি। যেমন করেই হোক প্রতিকৃতিটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর কেউ এটিকে দেখতে পারে এ-ঝুঁকি আর তিনি নিতে চাইলেন না। যে ঘরে তাঁর বন্ধুরা আসা-যাওয়া করেন সেই ঘরে ছবিটাকে এক ঘন্টার জন্যেও রাখাটা তাঁর। পাগলামি হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *