১. গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে

ডোরিয়েন গ্রে-র ছবি / The Picture of Dorian Grey
(সম্পূর্ণ উপন্যাস) – অস্কার ওয়াইল্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ

গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে স্টুডিওটি মশগুল হয়ে ছিল, আর বাগানের ভেতরে গ্রীষ্মকালীন বাতাস ঘুরপাক খাওয়ার সময় খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে লাইল্যাক ঝাড়ের ঘন সুবাস, অথবা লাল ফুলে ভরা কাঁটাগাছের ঝোপ থেকে মিষ্টি মেভাজি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে।

স্টুডিওর এক কোণে পারিশিয়ান-গদি মোড়া নীচু একটি বসার ‘কোচ’, তার ওপরে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী লর্ড হেনরি ওটন শুয়ে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে শেষ করছিলেন। মধুর মতো মিষ্টি আর রঙিন সোঁদাল গাছের ফুলের আভা তাঁর চোখে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল গাছটির কম্পমান শাখা-প্রশাখাগুলি তাদের আগুনে সমারোহের ভার বইতে পারছে না। বিরাট জানালার ওপরে সিল্কের পর্দা ঝোলানো ছিল, সেই পর্দার ওপরে মাঝে মাঝে উড়ন্ত পাখিদের ডানার ঝাপটায় মৃদু আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ে জাপানি চিত্রকরদের চিত্রকলার সাময়িক ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এই দেখে টোকিওর চিত্রকরদের বিবর্ণ জরাজীর্ণ মুখগুলির কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। যে আর্ট অচল, গতিহীন ছাড়া আর কিছু নয়, সেই আর্টের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য আর গতির সৃষ্টি করতে তাঁরা কী আয়াসই না করেন। চারপাশে নিস্তব্ধ। লম্বা ঘাসের মধ্যে অথবা ধূলিমলিন উডবাইন গাছের জড়ানো ডালের ভেতরে আসুরিক জেদ নিয়ে ঘূর্ণায়মান মৌমাছিদের ক্লান্তু গুঞ্জন সেই নিস্তব্ধতাকে আরো ক্লান্তিকর করে তুলেছিল। লন্ডন শহরের মৃদু গর্জন শুনে মনে হচ্ছিল দূরাগত কোনো সঙ্গীতযন্ত্রের উচ্চগ্রামের সুর ধ্বনিত হচ্ছে।

ঘরের মাঝখানে ছবি আঁকার একটি খাড়াই ফ্রেম দাঁড় করানো। তার ওপরে একটি যুবকের পূর্ণ প্রতিকৃতি দেখে মনে হল, যুবকটির চেহারা অদ্ভুত সুন্দর। সেই প্রতিকৃতির সামনে, সামান্য একটু দূরে, চিত্রকর নিজে বসেছিলেন। চিত্রকরের নাম বেসিল হলওয়ার্ড। বছর কয়েক আছে এর হঠাৎ অন্তর্ধানের কাহিনিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ একটি উত্তেজনা জেগেছিল, আর সেই সঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছিল নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত গুজব।

যে মিষ্টি লাবণ্যময় প্রতিকৃতিটি তিনি দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন তার দিকে চিত্রকর তাকিয়ে ছিলেন। ছবিটিকে দেখে তাঁর মুখের ওপরে একটুকরো আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, শুধু উঠল না, মনে হল, হাসিটুকু লেগে রইল একটু। কিন্তু হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, চোখ বোজলেন; আঙুলগুলি রাখলেন বোজালো চোখের পাতার ওপরে। মনে হল একটি অদ্ভুত স্বপ্নকে তিনি মগজের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চান, ভয় হল, হয়তো তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যাবে।

অবসন্নভাবে লর্ড হেনরি বললেন, বেসিল, এটি তোমার শ্রেষ্ঠ চিত্র। এত ভালো চিত্র জীবনে তুমি আর আঁকোনি। পরের বছর এটিকে নিশ্চয় তুমি গ্রসভেনর-এ পাঠাবে। অ্যাকাডেমি হচ্ছে যেমন বড়ো তেমনি কদর্য। যখনি আমি সেখানে গিয়েছি তখনি দেখেছি যে সেখানে এত মানুষের ভিড় জমেছে যে ছবি দেখার সুযোগ পাইনি এতটুকু, ব্যাপারটা ভয়ানক সন্দেহ নেই। অথবা, এত ছবির ভিড় হয়েছে যে মানুষ দেখার সময় পায়নি। এটি আরো খারাপ। গ্রসভেনর-ই একমাত্র জায়গা যেখানে তোমার ছবি তার উপযুক্ত মূল্য পাবে।

একটু অদ্ভুতভাবে ঘাড় নাড়লেন চিত্রকর। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় এইভাবেই তিনি ঘাড় নাড়তেন। সেই ঘাড়নাড়া দেখে তাঁর সহপাঠীরা সবাই হাসতেন। সেই রকম একটি ঘাড় নেড়ে তিনি বললেন, আমার মনে হয় না এটিকে আমি কোথাও পাঠাব। না, এটিকে আমি কোথাও পাঠাব না।

এই কথা শুলে লর্ড হেনরি কেমন যেন আবাক হয়েই মুখটা তুলে আফিঙের গুঁড়ো মেশানো সিগারেটের জমাট ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, কোথাও পাঠাবে না? কেন বন্ধু? এর পেছনে কি কোনো যুক্তি রয়েছে? তোমাদের এই চিত্রকরের জাতটা সত্যিই বড়ো কিম্ভুতকিমাকার। নাম কেনার জন্যে এ দুনিয়ায় তোমরা সব কিছু করতে পার। আর নাম হওয়া মাত্র তোমরা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাও। সুনামটাকে পরিত্যাগ করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ আলোচনা করার চেয়ে খারাপ, এবং যে জিনিসটি লোকে প্রায় আলোচনা করতে চায় না এরকম একটি জিনিসই পৃথিবীতে রয়েছে। এই রকম একটি প্রতিকৃতি ইংলন্ডের সমস্ত যুবকদের ওপরে তোমাকে বসাবে, আর বৃদ্ধেরা তোমাকে হিংসা করবে, অবশ্য কোনোরকম ভাব প্রকাশের শক্তি যদি তাদের থাকে।

বেসিল বললেন, আমি জানি আমাকে তুমি উপহাস করবে। কিন্তু আমি সত্যিই বলছি এটিকে আমি বাইরের প্রদর্শনীতে পাঠাতে পারব না। এর মধ্যে আমার নিজেকে অনেকখানি মিশিয়ে দিয়েছি।

সোফার ওপরে শরীরটাকে বেশ ভালো করে ছড়িয়ে দিয়ে লর্ড হেনরি হাসলেন।

হ্যাঁ, আমি জানি তুমি হাসবে, কিন্তু কথাটা যে সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কী বলছ তুমি, বেসিল! তোমার অনেকখানি এই প্রতিকৃতির ভেতরে রয়েছে? তুমি যে এতটা অন্তঃসারশূন্য তা তো আমি জানতাম না। আর সত্যি কথা বলতে কি তোমাদের দুজনের মধ্যে আমি কোনো সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখ রুক্ষ, পুরুষ্টু চুলগুলি আলকাতরার মতো কালো; আর ওই যৌবনোদ্দল যুবকটিকে দেখলে মনে হবে যেন হাতির দাঁত আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তার দেহটি তৈরি হয়েছে। তোমার ওই প্রতিকৃতিটি আত্মপ্রেমিক নারসিসাস বলে মনে হচ্ছে আমার; অবশ্য ওর মধ্যে তুমি কিছুটা বুদ্ধির কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছ–এই যা। কিন্তু বুদ্ধির জলুস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য, সত্যিকার সৌন্দর্য বলতে অবশ্য বোঝা যায়, তা নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি জিনিসটাই হচ্ছে অতিশয়োক্তির বহিপ্রকাশ। এর কাজ হচ্ছে মুখের কমনীয়তা নষ্ট করা। যে মুহূর্তে মানুষ চিন্তা করতে বসে সেই মুহূর্তেই তার মুখের ওপর থেকে লালিত্য সরে যায়। এক কথায়, মুখের আর কোনো চিহ্নই থাকে না। মানুষ তখন একটা নাক বা কপালে রূপান্তরিত হয়। ঘটনাটা ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কিছু নয়। বিদগ্ধ পেশায় সাফল্য অর্জন করেছেন এমন যে কোনো একটি মানুষের দিকে লক্ষ কর। তাঁরা দেখতে কী ভয়ানক! অবশ্য গির্জার পাদরি ছাড়া। কিন্তু সত্যিকার চিন্তা করার বালাই পাদরিদের নেই। আঠার বছর বয়সে বিশপকে যা বলতে শেখানো হয় আশি বছর বয়সেও তিনি তাই বলতে থাকেন। ফলে, চিন্তার ভার থেকে তিনি সব সময়েই মুক্ত, সব সময়েই তিনি খুশি থাকেন। তোমার এই রহস্যময় যুবক বন্ধুটি–যাঁর নাম তুমি কোনো দিনই আমাকে বলনি এবং যিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন, কোনো দিনই চিন্তা করেন না। এদিকে থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ভদ্রলোকটি নির্বোধ, সুন্দর মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। শীতকালে তাকিয়ে দেখার মতো যখন কোনো ফুল ফোটে না তখন এখানে তাঁর উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেবে। গ্রীষ্মকালে বুদ্ধির ধার ভোঁতা করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাঁর সাহচর্য সব আমাদের কাছে উপাদেয় বলে মনে হবে। আমার কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ো না, বেসিল। কিন্তু তুমি আদৌ ওর মতো নও।

আর্টিস্ট বেসিল বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না, হ্যারি। অবশ্য ওর মতো আমি যে নই তা আমি ভালোভাবেই জানি। বাস্তবিক, ওর মতো আমাকে দেখাচ্ছে একথা কেউ বললে আমি দুঃখই পাব। বিশ্বাস হল না তোমার? আমি তোমাকে সত্যি কথাই বলছি। সমস্ত শারীরিক আর মানসিক উৎকর্ষ ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক এমনিভাবেই ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এই মরণশীলতা রাজাদের স্খলিত পদক্ষেপের পিছু ধাওয়া করেছে। সহযাত্রীদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে না থাকাটাই ভালো। যারা কুৎসিত এবং মুর্খ এ জগতে তারাই সবচেয়ে ভালো জিনিসটা ভোগ করে। তারা আরাম করে বসে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। জয় সম্বন্ধে যদি তাদের কোনো জ্ঞান না-ও থাকে, পরাজয় সম্বন্ধে কোনো ধ্যান-ধারণাও তাদের নেই। কোনো ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটই তাদের বিব্রত করে না, আর দশজনের মতো তারা শান্ত আর উদাসীনভাবেই জীবন কাটিয়ে দেয়। কোনোদিনই তারা অন্য লোকের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে না। অন্য লোকের কাছ থেকেও তারা কোনোরকম গুরুতর আঘাত পায় না। হ্যারি, তোমার পদমর্যাদা এবং অর্থ আমার মস্তিষ্ক–দাম তার যাই হোক, আমার কলা–এদের দাম যাই হোক। ডোরিয়েন গ্রে-র মিষ্টি চাহনি, ভগবান আমাদের যা দিয়েছেন তার জন্যে আমরা সবাই দুঃখ পাব–বেশ ভালো রকম দুঃখই পাব আমরা।

বেসিল হলওয়ার্ডের দিকে কয়েকটি পা এগিয়ে যেতে যেতে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, ডোরিয়েন গ্রে? কী নাম বললে?

হ্যাঁ, ওইটাই তাঁর নাম। ইচ্ছে করেই আমি তোমাকে বলিনি।

কিন্তু কেন বলনি?

তা আমি বলতে পারব না। যাদের আমার খুব ভালো লাগে তাদের নাম আমি কাউকে বলি না। এই নাম বলার অর্থই হচ্ছে তাদের কিছুটা অংশ বলে দেওয়া। সব জিনিসই গোপন রাখতে আমি কেমন যেন ভালোবাসি। আমার ধারণা, যে সব জিনিস আধুনিক জীবনযাত্রাকে রহস্যময় আর অপরূপ করে তুলেছে এটি তার মধ্যে একটি। লুকিয়ে রাখতে পারলে অতি তুচ্ছ সাধারণ জিনিসও আমাদের আনন্দ দেয়। আজকাল শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও গেলে ঠিক কোথায় আমি যাচ্ছি সে-কথা আমি কাউকেই বলি না। একথা বললে বেড়ানোর সমস্ত আনন্দ আমার নষ্ট হয়ে যেত। অভ্যাসটা প্রশংসা করার মতো নয়, তবু মনে হয় এই ধরনের গোপনপ্রিয়তা মানুষের জীবনে বেশ কিছু রোমান্সের আমদানি করে। মনে হচ্ছে এর জন্যে আমাকে বেশ বোকা-বোকা লাগছে তোমার?

লর্ড হেনরি বললেন, মোটেই তা নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি বিবাহিত। বিবাহের আকর্ষণ হচ্ছে প্রবঞ্চনা, বিবাহিত জীবনকে আকর্ষণীয় করতে হলে স্বামী আর স্ত্রী দুজনকেই প্রবঞ্চনার আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে। আমার স্ত্রী কোথায় যান তা আমি কোনো দিনই জানি না। আমি কোথায় ঘুরে বেড়াই সে বিষয়েও আমার স্ত্রী সমানভাবে অজ্ঞ। মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয়, আমরা দুজনে বাইরে খেতে যাই, তখন বেশ গম্ভীর ভাবেই পরস্পরের কাছে আমরা। নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলে যাই। মিথ্যে ভাষণে আমার স্ত্রী অত্যন্ত পটিয়সী, সত্যি কথা বলতে কি আমার চেয়ে অনেক বেশি। কবে কার সঙ্গে দেখা করার তাঁর কথা রয়েছে সে কথা। তিনি একবারও ভুলে যান না, কিন্তু আমি ভুলে যাই। ফলে, আমি যখন ধরা পড়ে যাই তখন। তা নিয়ে তিনি এতটুকু হইচই করেন না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, একটু-আধটু হইচই। করলেই হয়তো ভালো হত, কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু উপহাসের হাসি হাসেন মাত্র।

স্টুডিওর একটা দরজা বাগানের দিকে খোলা ছিল, সেই দিকে পায়চারি করতে করতে বেন্সিল বললেন, হ্যারি, তোমার বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যেসব কথা তুমি বললে তা শুনতে মোটেই ভালো লাগল না আমার। তুমি যে সত্যিকারের একজন ভালো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন স্বামী সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেকথা বলতে তোমার লজ্জা হয়। তুমি একটি চমৎকার মানুষ কোনোদিনই তোমার মুখ থেকে নীতিকথা বেরোয়নি, কিন্তু কোনোদিনই তুমি অন্যায় কাজ করনি। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বৈরাগ্যটা তোমার একটা ভান মাত্র।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আসল কথা হচ্ছে স্বাভাবিক হওয়াটাই একটা চাল, আর আমার মতে খুব একটা বিরক্তিকর চাল।

এই কথা বলে লর্ড হেনরি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে বাগানের মধ্যে বেরিয়ে এলেন। একটি দীর্ঘ লরেল গাছের ঝোপের ছায়ায় বাঁশের একটা মাচা বাঁধা ছিল। দুজনে সেই মাচায় বসলেন। মসৃণ। পাতার ওপর দিয়ে রোদ গড়িয়ে পড়ছিল। ঘাসের বলে প্রচুর পরিমাণে ফুটে ছিল ডেইজি ফুল।

একটু চুপ করে লর্ড হেনরি তাঁর পকেট-ঘড়িটা টেনে নিলেন পকেট থেকে, বললেন, আমাকে এবার যেতে হবে, বেসিল। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাই। প্রশ্নটা একটু আগেই আমি তোমাকে করেছি।

মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চিত্রকর জিজ্ঞাসা করলেন, প্রশ্নটা কী বল তো?

তুমি নিজেই তা ভালো জানো।

আমি জানি না, হ্যারি।

বেশ, আমি তোমাকে তা বলছি। আমি জানতে চাই ডোরিয়েন গ্রে-র প্রতিকৃতি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না কেন? আসল কারণটা আমি জানতে চাই।

আমি তোমাকে আসল কারণটাই বলেছি।

না, তুমি তা বলনি। তুমি কেবল বলেছিলে। ওই ছবির ভেতরে তোমার নিজস্ব সত্তার অনেকটা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কিন্তু এটা তোমার ছেলেমানুষের কথা।

বন্ধুর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বেসিল হলওয়ার্ড বললেন, হ্যারি, গভীর দরদ আর আর অনুপ্রেরণার সঙ্গে যে ছবি আঁকা হয় সেটা হচ্ছে চিত্রকরের নিজস্ব প্রতিকৃতি, মডেলের নয়। সেই বিশেষ হেষ্কত্রে মডেলটা হচ্ছে আকস্মিক, চিত্রাঙ্কনের প্রযোডনে গৌণ। চিত্রকর কোনোদিনই মডেলের সত্তাকে প্রতিফলিত করেন না, সেই রঙিন চিত্রপটের ওপরে তিনি প্রতিবিম্বিত করে নিজেকেই। এই ছবিটিকে প্রদর্শনীতে না পাঠানোর কারণটা হল আমার আশঙ্কা। ভয় হচ্ছে এই ছবির সঙ্গে আমার আত্মার অনেক গোপন বেদনা আর আনন্দ মিশে গিয়েছে।

হাসলেন লর্ড হেনরি, জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কী?

আমি তোমাকে বলব, উত্তর দিলেন চিত্রকর। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হল সব যেন তিনি গুলিয়ে ফেলছেন।

তাঁর দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমি শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, বেসিল।

চিত্রকর বললেন, বলার সত্যিই বেশি কিছু নেই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারবে না। হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতেও পারবে না তুমি।

লর্ড হেনরি হাসলেন, ঝুঁকে ঘাসের বন থেকে এখটা লাল ডেইজি ফুল তুলে সেটাকে পরীক্ষা। করতে লাগলেন। সেই ফুলটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, না, না, আমি নিশ্চয় বুঝতে পারব। আর বিশ্বাস করার কথা যদি বল আমি যে-কোনো জিনিসই বিশ্বাস করতে লাগল, এবং সেই ক্লান্ত বাতাসে লাইল্যাক ফুলের ভারী ভারী গুচ্ছগুলি এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল। দেওয়ালের পাশে একটা ঘাস ফড়িং ভনভন করতে শুরু করল, আর নীল,সুতোর মতো লম্বা রোগাটে একটা ফড়িং তার রঙিন ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। লর্ড হেনরির মনে হল তাঁর বন্ধুর বুকটা ঘন ঘন ওঠানামা করছে। বন্ধুটি এর পরে কি বলবেন তাই তিনি ভাবতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পরে চিত্রকর বললেন, ঘটনাটা হচ্ছে এই মাস দুই আগে আমি একদিন লেডি ব্র্যানডনের পার্টিতে গিয়েছিলাম। তুমি জান আমাদের মতো দরিদ্র আর্টিস্টের মাঝে মাঝে বাইরে লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় শুধু তাদের বোঝানোর জন্যে, যে আমরা। বন্যপ্রাণী নই। তোমার কথাই ঠিক।সান্ধ্য পোশাক আর সাদা গলাবন্ধনী চড়িযে যে-কোনো মানুষই এমনকি একঙন পাতি ব্যবসাদারও সভ্য আর সংস্কৃতিবান বলে পরিচিত হওয়ার সাহস রাখে। সেদিন মিনিট দশেক আমি সুবেশা বিধবা আর বিরক্তিকর পণ্ডিতদের বিরাট সমাবেশে মিনিট দশেক গল্পগুজব করেছি এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল এক৬ল আমার। দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আধখানা ঘুরে দাঁড়ালাম, সেই প্রথম ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে চোখাচোখি হল আমার চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমি যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছি। একটা অদ্ভুত ভীতি আমাকে গ্রাস করে বসল। বেশ বুঝতে পারলাম আমি এমন একজনের সংসপর্শে এসে পড়েছি যার ব্যক্তিত্বের মোহিনীশক্তি এত প্রবল যে তাকে যদি সময়ে আমি প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে সে আমার চরিত্র, আত্মা, আমার আর্ট সব গ্রাস করে ফেলবো বাইরে থেকে কেউ আমার ব্যক্তিগত জীবনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করবে এ আমি চাইনে। তুমি নিজেই ডান হ্যারি, চরিত্রের দিক থেকে আমি কতখানি স্বাবলম্বী। চিরদিনই আমি সেই রকমই ছিলাম; অন্তত ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর–কিন্তু কী করে যে ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাব বুঝতে পারছি না। কে যেন বলে দিল ভীবনে আমি একটি বিষম বিপদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কী জানি কেন আমার মনে হয়েছিল সে ভাগ্য আমার জন্যে অনির্বচনীয় আনন্দ আর অবর্ণনীয় দুঃখ জমিয়ে রেখেছে। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। বিবেক যে আমাকে এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয়, আমার সেই মানসিক অবস্থাকে তুমি বরং কাপুরুষতা। বলতে পার। সেদিন সেখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টার মধ্যে কোনো রকম যুৎসই কারণ আমি খুঁজে পাইনি।

 বিবেক এবং কাপুরুষতা, সত্যিকথা বলতে কি, একই বস্তু, বেসিলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাযিক নাম হচ্ছে বিবেক, এই যা।

হ্যারি, ওকথা আমি বিশ্বাস করি না। জানি, তুমিও তা কর না। আমার উদ্দেশ্য যাই হোক, হয়তো সেটা আমার গর্বই হবে, এবং চরিত্রের দিক থেকে গর্বিত কিছুটা আমি ছিলাম আমি। যে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই লেডি ব্র্যানডন-এর সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, মিঃ ইলওযার্ড, এত তাড়াতাড়ি আপনি নিশ্চয় পালিয়ে যাচ্ছেন না? তাঁর গলার সেই অদ্ভুত স্বরটা নিশ্চয় তোমার মনে রয়েছে।

লর্ড হেনরি বললেন, রয়েছে। সৌন্দর্য বাদ দিয়ে ভদ্রমহিলা একেবারে ময়ূরকণ্ঠী।

এই বলে দুর্বল আঙুলগুলি দিয়ে তিনি একটি ডেইডি ফুল ছিঁড়তে লাগলেন।

বেসিল বলে গেলেন, আমি তাঁকে এড়াতে পারলাম না। তিনি অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজবাডির অতিথি, খেতাবধারী পুরুষ, বড়ো বড়ো। টায়রা পরা সুঁচোল নাকধারিণী মহিলা। সকলের কাছেই তিনি আমার পরিচয় দিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু হিসাবে। এর আগে মাত্র একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমি যে। একজন মহান ব্যক্তি এই রকম একটা ধারণা তাঁর মগডে ঢুকেছিল। আমার বিশ্বাস আমার কোনো একটা ছবি সেই সময় বেশ নাম করেছিল। অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর নীতিহীন ধ্বজাবাহী সস্তা দামের কিছু সংবাদপত্র সেই ছবিটি নিয়ে বেশ হইচই করেছিল। যে যুবকটির ব্যক্তিত্ব আমাকে ওই রকম অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছিল হঠাৎ দেখলাম সেই যুবকটির সামনাসামনি এসে হাজির হয়েছিআমি খুব কাছাকাছি এসেছি আমরা, যাকে বলে স্পর্শ দূরত্বের মধ্যে। আবার আমাদের চোখাচোখি হল। হঠকারিতা সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি সেদিন লেডি ব্র্যানডনকে অনুরোধ করেছিলাম। হয়তো একেবারে হঠকারিতাও নয়। আলাপ হওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কোনোরকম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানুষ না থাকলেও, হয়তো আমরা নিজেরাই আলাপ করতাম। সেবিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। পরে, ডোরিয়েন-ও আমাকে সেই কথাই বলেছিলেন। তাঁর মলে। হয়েছিলে ভাগ্যই আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত।

তাঁর বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, এবং লেডি ব্র্যানডন তাঁর সেই অদ্ভুত বন্ধুটির কী পরিচয় দিলেন? আমি জানি অতিথিদের বর্ণনা করার সময় তিনি বেশ দ্রুত এবং সংক্ষিপ্তভাবে তাঁদের গুণের বর্ণনা দেন। বেশ মনে পড়ে ভদ্রমহিলা একবার একটি বর্বর, সমস্ত শরীরে সরকার-দেওয়া খেতাব-আঁটা এক বৃদ্ধের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার কানে ফিসফিস করে তাঁর অজস্র গুণের বর্ণনা দিয়ে গেলন। তাঁর সেই ফিসফিসানি কেবল যে ঘরের প্রতিটি লোকের কানে। গিয়ে পোঁচেছিল তা-ই নয়, ভদ্রলোকের গুণাবলীর বর্ণনা তাঁর মুখ থেকে শুনে আমিও কেমন যেন হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। এর পরেই আমি স্রেফ কেটে পড়লাম। আমার সমগোত্র, অথবা আমার পছন্দমতো মানুষ খুঁজে বার করতেই আমি চাই, কিন্তু ভদ্রমহিলার ব্যাপার স্বতন্ত্র। নিলামকারীরা যেভাবে তাদের জিনিসপত্রের দাম ধার্য করে, আমাদের ওই ভদ্রমহিলাটির কাছেও তাঁর অতিথিদের মূল্য নির্ধারণের প্রণালীটি ঠিক সেই অতীয়া হয় তিনি তাঁদের সরিয়ে রাখেন, অথবা তাঁদের সম্বন্ধে এমন কিছু নেই যা তিনি অপরকে বলেন না-বাদ দেন কেবল সেইটুকু যেটুকু আর সবাই ভয়ানতে চায়।

হলওয়ার্ড একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, ভদ্রমহিলার ওপরে অতটা কটোর হয়ো না হারি। হায়, হতভাগ্য নারী লেডি ব্র্যানডন!

অতিথিদের জন্যে তিনি একটি আপ্যায়ন ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যা করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে একটি রেস্তোরাঁ। তাঁকে আমি প্রশংসা করব কেমন করে? কিন্তু সেসব কথা থাক, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে তিনি তোমাকে কী বললেন সেইটাই আমাকে বলা

তেমন কিছু নয়। ‘চমৎকার ছেলে, ওর মা আর আমি-যাকে বলে একেবারে হরিহর আত্মা। ও যে ঠিক কী করে তা আমার স্মরণ হচ্ছে না; সম্ভবত কিছুই করে না। হ্যাঁ, হ্যাঁ, করে বটে, পিয়ানো বাজায! প্যিানো, না, বেহালা মিগ্রে?’এই কথা শুনে আমরা দুজনেই হেসে। ফেললাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে সঙ্কোচ কেটে গেল, আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।

আর একটি ডেইজি ফুল তুলে নিয়ে লর্ড হেলরি বললেন, বন্ধুত্বের শুরুতে হাসি-ঠাট্টা সূচনা হিসাবে খারাপ নয় আর বন্ধুত্বের সমাপ্তিতেও ওর চেয়ে ভালো জিনিস আর বোধ হয় নেই।

হলওয়ার্ড মাথা নেড়ে বললেন, বন্ধুত্ব আসলে জিনিসটা কী তা তুমি বোঝ না, হ্যারি, অথবা শত্রুতা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা-ও হয়তো তোমার অজানা। সবাইকেই তুমি পছন্দ কর, অর্থাৎ সকলের ওপরেই তুমি সমান ভাবে উদাসীন।

টুপিটা মাথার পেছনে একটু ঠেলে দিয়ে, নীলকান্তমণি খচিত শূন্য গ্রীষ্মকাশের বুকে সাদা দুধের ফেলার মতো যে ছোটো ছোটো মেঘের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই দিকে তাকিয়ে। লর্ড হেনরি বললেন, কী অন্যায় তোমার! নিশ্চয়, একশোবার অন্যায়। মানুষ আর মানুষের মধ্যে তফাৎ রয়েছে আমার কাছে। আমি সেই সব মানুষকে পছন্দ করি যারা দেখতে ভালো, যারা সৎ তাদের সঙ্গেই পরিচয় জমাই, আর যাদের ধীশক্তি তীক্ষ্ণ তাদেরই আমি শত্রু বলে গণ্য করি। শত্রু নির্বাচনে মানুষ খুব বেশি সতর্ক হতে পারে না। আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ মূর্খ নেই। সকলেরই কিছু না কিছু বুদ্ধি রয়েছে, ফলে, সকলেই প্রায় আমাকে পছন্দ করে। এ থেকে কি আমার কোনো দম্ভ প্রকাশ পায়, মনে হয় আমি এদিক থেকে কিছুটা দাম্ভিক।

 আমারও তাই মনে হত, কিন্তু তোমার তালিকা অনুযায়ী, আমি তোমার নিছক পরিচিত ছাড়া আর কিছু নয়।

 প্রিয় বেসিল, তুমি তার চেয়ে অনেক বড়ো।

আর বন্ধুর নীচে, মনে হয় ভায়ের মতো, তাই না?

ওঃ, ভাই, ভাই! ভাইদের নিয়ে দুর্ভাবনা করার মতো কিছু নেই। আমার দাদা মারা যাবেন না, আর আমার ছোটো ভাইদেরও সেরকম কিছু করার সম্ভাবনা নেই।

 হলওয়ার্ড বিরক্ত হয়ে বললেন, হ্যারি!

বন্ধু, আমি মোটেই সিরিয়াস হয়ে ওকথা বলিনি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের আমি ঘৃণা না করে পারি না। মনে হয় আমাদের এই মানসিক অবস্থার জন্যে দায়ী একটা;সেটা হচ্ছে, আমাদের মতো যাদের দোষ রয়েছে তাদের আমরা সহ্য করতে পারি না। ইংলিশ গণতন্ত্র উচ্চ শ্রেণির মানুষের বিকৃত রুচি বলতে যা বোঝাতে চায় তার সঙ্গে আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। জনসাধারণ মনে করে মদ্যপাযিতা, মুখতা আর চরিত্রহীনতা তাদের বিশেষ সম্পদ, এবং আমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদের সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে নাক গলাতে যায় তাহলে সে একটি গর্দভ বলে বিবেচিত হবে। যখন হতভাগ্য সাউথওযার্ক বিবাহিবিচ্ছেদ মামলায় জড়িয়ে পড়ল তখন তাদের ঘৃণা সত্যিই দেখার মতো হয়েছিল। তবু আমার মনে হয়। শতকরা দশজন সাধারণ মানুষও নির্ভুল ভাবে জীবন কাটায় না।

তুমি যা বললে তার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করি না, তার চেয়েও বড়ো কথা হ্যারি, আমার বিশ্বাস, তুমি নিজেও তা কর না।

লর্ড হেনরি তাঁর সূঁচলো কটা দাড়ির ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে পেটেন্ট চামড়ার তৈরি বুট জুতোর ওপরে তাঁর আবলুস কাঠের লাঠিটা ঠুকতে লাগলেন। তারপরে বললেন, বেসিস, তুমি একটি পাকা ইংরেজ। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তুমি ওই উক্তিটি করলো যদি কেউ কোনো। ইংরেজের কাছে নতুন কিছু বলে–যা বলাটা নিঃসন্দেহে হঠকারিতা, তাহলে সেটা ঠিক কি বেঠিক সে-সম্বন্ধে চিন্তা করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। একটি মাত্র জিনিস যা সে সত্যিই বিবেচনার যোগ্য বলে মনে করে তা হচ্ছে এই যে বক্তা নিজেই সেকথা বিশ্বাস করে কিনা। এখন কথাটা হচ্ছে নতুন কথা বলার দাম এই নয় যে বক্তা নিজে সে কথা বিশ্বাস করেন। বরং একথা বললে ঐযৌক্তিক হবে না যে যার মুখের আর মনের কথার মধ্যে ফারাক যত বেশি তার মতবাদ তত উচ্চমানের। কারণ সেই মতবাদের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তারা। প্রত্যঙ্ক্ষভাবে জড়িত নয়। যাই হোক, আমি তোমার সঙ্গে রাজনীতি, সমাজনীতি অথবা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। নীতির চেয়ে মানুষকে বেশি পছন্দ করি আমি, এবং এ জগতে নীতিহীন মানুষকে আমি যত পছন্দ করি, এত পছন্দ আর কিছুই আমি করি না। মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে আরো কিছু তুমি আমাকে বল তোমার সঙ্গে তার কেমন দেখাসাক্ষাৎ হয়?

প্রতিদিন, রোজ তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি আমার কাছে একেবারে অত্যাবশ্যকীয়।

অবাক কাণ্ড! আমার ধারণা ছিল আর্ট ছাড়া আর কিছুই গ্রাহ্য কর না তুমি।

 চিত্রকর গম্ভীরভাবেই বললেন, তিনিই এখন আমার আর্টের বিষয়। হ্যারি, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে পৃথিবীর ইতিহাসে মূল্যবান বলতে মাত্র দুটি যুগ রয়েছে। প্রথমটি হল আর্টের নতুন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব, দ্বিতীয়টি হল সেই আর্টের জন্যে নতুন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব। ভেনিসিয্যানদের কাছে তৈলচিত্রের আবিষ্কারের দাম যা, পরবর্তী যুগের গ্রিক ভাষ্কর্যের কাছে অ্যানটিনোস-এর মূল্য যেরকম, ডোরিয়েন গ্রে-র মুখও একদিন আমার। কাচ্ছে সেই রকম মূল্যবান হয়ে দেখা দেবে। সে আমার কাছে নিছক মডেল নয। প্রতিকৃতি আঁকার জন্যে তার কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার দরকার তার প্রায় সবটুকুই আমি নিয়েছি। কিন্তু নিছক মডেল-এর চেয়ে সে আমার কাছে অনেক বড়ো। আমি তোমাকে একথা নিশ্চয় বলব না যে তার কাছ থেকে আমি যেটুকু পেযেছি তাতে আমি খুশি নই, একথা নিশ্চয় বলব না যে তার কাছ থেকে আমি যেটুকু পেয়েছি তাতে আমি খুশি নই, অথবা তার সৌন্দর্য এমন একটা জিনিস যে আর্ট তা প্রকাশ করতে পারে না, আর এটাও আমি জানি যে ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি যে ছবি এঁকেছি তা সত্যিই ভালো, অথবা আমার জীবনের ওটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ছবি। কিন্তু কেন জানি না, বললে তুমি ও হয়তো তা বিশ্বাস করবে না, তার। ব্যক্তিত্ব চিত্রকলার সম্বন্ধে একটি নতুন রীতি, একটি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের সন্ধান দিয়েছে। এখন আমি প্রতিটি জিনিস অন্যভাবে দেখি, প্রতিটি জিনিসের সম্বন্ধে অন্যভাবে চিন্তা করি। এখন আমি কোনো জিনিসকে নতুনভাবে সৃষ্টি করি। এ-শক্তি এতদিন আমার ছিল না। ‘চিন্তার দিনগুলিতে কল্পনার আভাস’ একথা কে বলেছেন বল তো! আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু আমার কাছে ডোবিয়েন গ্রে ঠিক সেই ভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। বয়স তার কুডির খুব বেশি নয়। আমি তাকে বালক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। তুমি ভাবছ সে আমার। জীবনের কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে? নিজের অজ্ঞাতসারেই চিত্রকলার একটি নবদিগন্তের সন্ধান সে আমাকে দিয়েছে। এটা হল গ্রিক মানসিকতার সূর্ণ বিকাশ। আপ্পার সঙ্গে দেহের এই সমঝোতা–এর দাম কত! উন্মাদের মতো আমরা এই দুটিকে পৃথক করে রেখেছি। পৃথক করে, এমন একটি বস্তুবাদের সৃষ্টি করেছি যা সত্যিই বড়ো নিকৃষ্ট, যার আদর্শ মূল্যহীন। ডোরিয়েন সে আমার কাছে যে কত বড়ো সম্পদ তা যদি তুমি জানতে, হ্যারি! অগনিউ আমার যে ছবিটি কেনার জন্যে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিল সেটা তুমি দেখেছ। সেই। ছবিটিকে আমি বিক্রি করতে চাইনি। কয়েকটি ভালো ছবির মধ্যে এটি আমার শ্রেষ্ঠ ছবি। কিন্তু কেন বল তো? কারণ, ওই ছবিটি আঁকার সময় ডোরিয়েন গ্রে আমার পাশে বসেছিল। সেই সময়ে নিঃশব্দে তার প্রভাব আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, এবং জীবনে সেই প্রথম সহজ অরণ্যের মধ্যে আমি এমন একটি সৌন্দর্যের, ব্যঞ্জনার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম। এতদিন ধরে আমি তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, কিন্তু তাকে খুঁজে পাইনি।

বেসিল, তোমার কথা শুনে তাজ্জব লাগছে আমার। ডোরিয়েন গ্রে-কে দেখতেই হবে আমাকে।

হলওয়ার্ড তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে বাগানের ভেতরে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফিরে এসে বললেন, হ্যারি, ডোরিয়েল গ্রে আমার কাছে আর্টের প্রেরণা মাত্রা তার মধ্যে তুমি দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাবে না। আমি তার মধ্যে সব কিছু দেখতে পাই। তার ভাবমূর্তি ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে ধরা পড়ে না। তোমাকে যা বলেছি, সে একটি নতুন রীতির ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই নয়। কয়েকটি রেখার ভঙ্গিমা আর কয়েকটি বিশেষ রঙের চারুত্ব ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাকে আমি দেখতে পাই না। তার সম্বন্ধে এ ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই।

লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে, তুমি তাঁর ছবিটা প্রদর্শনীতে পাঠাচ্ছ না কেন?

কারণ, ইচ্ছে না করেই আমি এই সব অদ্ভুত চিত্রকল্পর সুচারু ইঙ্গিত ও ব্যঞ্জনাগুলি ওই প্রতিকৃতির মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছি। এ সম্বন্ধে আমি অবশ্য তাকে বলিনি। সে নিজেও এ বিষয়ে কিছু জানে না। কিছু জানবেও না কখনো। কিন্তু দর্শকরা হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারে এবং সেই সব সাধারণ অনুসন্ধিৎসুদের কাছে আমি নিশ্চয় আমার মনের কথাগুলি খুলে বুলব না। সত্যি কথা বলতে কি হ্যারি, ওই প্রতিকৃতির মধ্যে আমার নিজস্ব অনেকটা মিশে। গিয়েছে।

কবিরাও তোমার মতো দ্বিধাগ্রস্ত নয়। তাঁরাও জানেন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পেছনে তাঁদের তাগিদ কত বেশি। আজকাল হৃদয-যন্ত্রণার কাব্যের বাজার অনেক বড়ো।

একট অস্থির হয়েই হলওয়ার্ড বললেন, ঠিক এরই জন্যে আমি তাঁদের ঘণা করি। আর্টিস্টের। কাজই হচ্ছে সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করা, কিন্তু সেইগুলির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলাটা উচিত নয়। আমরা এমন একটি যুগে বাস করি যে যুগে মানুষে ললিতকলাকে আত্মজীবনী বলে মনে। করে। সৌন্দর্যের কায়াহীন সত্তাটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই সত্তাটি কী একদিন ভাতকে তা আমি দেখাব। আর সেই জন্যেই ডোরিয়েন গ্রে-র যে প্রতিকৃতিটি আমি এঁকেছি তা বাইরের মানুষ দেখতে পাবে না।

বেসিল, আমার মনে হয় তুমি ভুল করছ, কিন্তু তা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। যাদের মগজে কিছু নেই তারাই তর্ক করে। সত্যি বল দেখি, ডোরিয়েন কি তোমাকে খুব ভালোবাসে?

কয়েকটি মুহূর্ত চিত্রকর কী যেন ভাবলেন, তারপরে বললেন, আমি জানি জানি সে আমাকে পছন্দ করে। অবশ্য আমিও তার ভয়ঙ্কর রকমের প্রশংসা করি। তাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে আমার বেশ একটা আনন্দ হয়। আমি জানি, সে-সব কথা বলার জন্যে আমাকে দুঃখ করতে হবে। তাকে আমার বেশ ভালোই লাগে। আমার স্টুডিওতে বসে হাজার রকমের গল্প। করি। মাঝে মাঝে সে বড়ো বোকার মতো কাজ করে, মনে হয় আমাকে যন্ত্রণা দিতে পারলে বেশ আনন্দ হয় তার। হ্যারি, তখন আমার মনে হয় আমি যেন আমার সমস্ত সত্তা তার কাছে সমর্পণ করেছি। মানুষ যেমন তার বোতামের ঘরে ফুল গুঁজে রাখে, তার কাছে আমার আ গ্লাটিও সেই রকম ফুলের মতো। তার দম্ভের অলঙ্করণ, গ্রীষ্মের জলুসের মতো।

ধীরে ধীরে বললেন লর্ড হেনরি, গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘস্থায়ী, বেসিল। মনে হয় তার চেয়ে তুমিই তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। একথা ভাবতেও কষ্ট লাগে, কিন্তু প্রতিভা যে সৌন্দর্যের চেয়ে। বিশি দিন বেঁচে থাকে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই সেইডল্যেই বেশি জ্ঞান অর্জন করার জন্যে আমরা এত কষ্ট পাই। জীবনযুদ্ধের উত্তেজনায় আমাদের এমন কিছু দরকার যা বেঁচে থাকে। ঘাঁটি আগলে রাখার মূর্খ চেষ্টায় আমরা তাই বস্তুর জঙ্গলে আমাদের মন পূর্ণ করে রাখি। আধুনিক ঘটনাবলীর সঙ্গে যাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় যত বেশি তিনিই এ যুগে তত বড়ো আদর্শ মানুষ। আজকাল কোনো জিনিসের ব্যবহারিক দামটা তার প্রকৃত মূল্যের অনেক ওপরে। ব্যাপরটা যাই হোক, আমার ধারণা, তুমিই ক্লান্ত হবে প্রথম একদিন তুমি হয়তো। তোমার বন্ধুর দিকে তাকাবে, মনে হবে দেখে ছবি আঁকার মতো চেহারা আর তার নেই। হয়তো তার রঙটা আর তোমার ভালো লাগবে না। অথবা রোনো এরটি বিশেষ জিনিস তুমি আর তার মধ্যে খুঁজে পাবে না। মনে মনে তুমি তীব্রভাবে তাকে তিরস্কার করবে, তোমার সত্যি সত্যিই মনে হবে সে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। তারপরে তোমার সঙ্গে তার দেখা হলে আগের মতো আনন্দের সঙ্গে তুমি তাকে অভ্যর্থনা জানাবে না, উদাসীন হয়ে যাবে তুমি তোমার এই পরিবর্তনটা দুঃখজনক হয়ে দাঁড়াবে সন্দেহ নেই। আমাকে এতক্ষণ ধরে তুমি যা বললে তা রোমান্স ছাড়া আর কিছু নয়। বলতে পার চিত্রকল্পের উচ্ছ্বাস। আর যে-কোনো রঙিন উচ্ছ্বাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস হচ্ছে এই যে সে মানুষকে বড়ো অরসিক করে তোলে।

হ্যারি, ওকথা বলো না। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ডোরিয়েন গ্রে-র ব্যক্তিত্ব আমাকে গ্রাস। করে থাকবে। আমি যা অনুভব করি, তুমি তা কর না। তোমার পরির্বতন হতে সময় লাগে না বিশেষ।

সত্যি কথা বলতে কি বেসিল, ঠিক ওই কারণেই আমি তা বুঝতে পারি। যাদের আমরা বিশ্বাসী বলি প্রেমের একটি দুর্বল অংশ ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গেই তাদের পরিচয় নেই। প্রেমের ট্র্যাজিডি বলতে কী বোঝ তা একমাত্র অবিশ্বাসীরাই জানে।

পৃথিবীর অন্তর্নিহিত সত্যটিকে গুটিকতক কথায় চমৎকারভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন এই রকম একটি আত্মতুষ্টির আবেশে মাতোয়ারা হয়ে লর্ড হেনরি তাঁর সুন্দর সিগারেট কেস থেকে একটি সিগারেট বার করে ধরালেন। সবুজ গাছের পাতার ভেতরে চড়ুই পাখিদের। ডানার ঝাপটার সঙ্গে কিচর-মিচির শোনা গেল, ঘাসের ওপরে নীলচে মেঘের ছায়াগুলি। চড়ুই পাখির মতো ছোটাছুটি করতে লাগল। তাঁর মনে হল বাগানের দৃশ্যাটি বড় মনোরম, মনে হল বড়ো সুন্দর মানুষের উচ্ছ্বাস-মতবাদের চেয়ে মানুষের আবেগ অনেক বেশি সুন্দর। বেসিল হওয়ায়ার্ডের সঙ্গে থাকার ফলে তিনি যে বিরক্তিকর লাঞ্চ থেকে মুক্তি পেয়েছেন এই কথাটা ভাবতে তাঁর বেশ আমোদ লাগল। মাসির বাড়িতে লাঞ্চ খেতে গেলে নিশ্চয় লর্ড গুজবডির সঙ্গে তাঁর দেখা হত এবং তাঁদের আলোচনা চলত দরিদ্র ভোডলি আর আদর্শ আবাস বলতে কী বোঝায় তাই নিয়ে। যাঁদের নিজেদের জীবনে এই দুটি জিনিসের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই সেই দুটি জিনিসের গুণাবলী নিয়ে দু’দলেই আলোচনা করতেন সমান উত্তেজনা নিয়ে। ধনীরা মিতব্যয়িতার মূল্য কী তারই ওপরে বক্তৃতা দিতেন আর শারীরিক পরিশ্রমের সম্মান কতটা তাই যে মনোভঃ ভাষায় কথা বলতেন তাঁরা যাঁরা অলসভাবে। জীবন যাপন করেন। এই সমস্ত অহেতুক বিরক্তির পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বেশ খুশি হলেন। তাঁর মাসির কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি হলওয়ার্ড-এর। দিকে ঘুরে বললেন, বন্ধু, একটা কথা মনে পড়েছে আমার।

কী মনে পড়েছে?

ডোরিয়েন নামটা আমি যেন কোথায় শুনেছি।

সামান্য ভ্রুকুটি করে বেসিল জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়?

চটো না বেসিল। মাসি, লেডি আগাথার বাড়িতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে একটি অসামান্য যুবককে তিনি আবিষ্কার করেছেন। এই যুবকটি ইস্ট এন্ড-এ তাঁকে সাহায্য করতে। উৎসুক। তাঁর নাম হচ্ছে ডোরিয়েন গ্রে। আমি বলতে বাধ্য, ভদ্রলোক যে দেখতে সুন্দর সে কথা মাসি আমাকে জানাননি। মিষ্টি চাহনির কদর মহিলারা জানেন না অন্তত সৎ মহিলাদের সে জ্ঞান বড়ো কম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ভদ্রলোক চপলমতি নন, তাঁর চরিত্রটিও বড়ো চমৎকার। ওই কথা শুনেই আমার মনে হয়েছিল ভদ্রলোকটি চশমাধারী, তাঁর চুলগুলি লম্বা, মুখের ওপরে গুটি-গুটি দাগ, লম্বা-লম্বা পা ফেলে তিনি হাঁটাচলা করেন। সেই মানুষটি যে তোমার বন্ধু তা যদি আমি জানতাম!

তুমি যে জানতে পারনি এতেই আমি খুশি, হ্যারি।

কেন?

তার সঙ্গে তোমার দেখা হোক তা আমি চাই না।

চাও না?

না।

এমন সময় খানসামা বাগনের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, মিঃ ডোরিয়েন গ্রে স্টুডিওতে রয়েছেন, স্যার।

লর্ড হেনরি হাসতে হাসতে বেশ জোর গলাতেই বললেন, এখন আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় তোমাকে করিয়ে দিতে হবেই।

থানসামার দিকে ঘুরে চিত্রকর বললেন, পার্কার, মিঃ গ্রেকে একটু বসতে বল। আমি এখনি আসছি।

অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথাটি নুইয়ে পার্কার বেরিয়ে গেল বাগান থেকে।

বেসিল হেনরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ডোরিয়েন গ্রে আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। বড়ো সরল, বড়ো সুন্দর তাঁর চরিত্র। তাঁর সম্বন্ধে তোমার মাসিমা যা বলেছেন সেইটাই সত্যি। তাঁকে তুমি নষ্ট করে দিও না। তাঁর ওপরে তোমার প্রভাব বিস্তার করতে চেয়ো না। তোমার প্রভাব তাঁর কাছে খুব খারাপই হবে। বিশাল এই পৃথিবী, এখানে অনেক আশ্চর্য জিনিস তুমি খুঁজে পাবে। আমার কলা-লালিত্যের যিনি প্রতীক তাঁকে তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেও না। আর্টিস্ট হিসাবে আমার জীবন তাঁরই উপরে নির্ভর করছে হারি, মনে রেখো, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।

কথাগুলি বেশ ধীরে ধীরে বললেন তিনি, মনে হল, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কথাগুলি তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

লর্ড হেনরি হাসতে হাসতে বললেন, কী বোকার মতো বকছো?

এই বলে হলওয়ার্ড-এর একটা হাত ধরে একরকম টানতে টানতেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঘরের মধ্যে ঢুকেই ডোরিয়েন গ্রেকে দেখতে পেলেন তাঁরা। তাঁদের দিকে পেছন করে পিয়ানোর পাশে একটি টুলের ওপরে বসে-বসে স্কুম্যান রচিত বন্য দৃশ্যের’ একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। পায়ের শব্দ পেয়েই তিনি বললেন, এগুলি আমাকে ধার দিও, বেসিল, আমি পড়তে চাই। বইগুলি বড়ো সুন্দর।

তুমি আজ কী ভাবে বসবে তারই ওপরে তোমার বই-পাওয়া নির্ভর করছে ডোরিয়েন।

টুল থেকে পেছনে ঘুরে খেলার ছলে গ্রে বললেন, একভাবে বসে-বসে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি পূর্ণ প্রতিকৃতির ওপরে আমার আর কোনো লোভ নেই।

লর্ড হেনরিকে দেখে তাঁর গাল দুটি হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। তারপর নিজেকে সামলিযে নিয়ে তিনি বললেন, বেসিল, আমাকে ক্ষমা কর। আমি বুঝতে পারিনি যে তোমার সঙ্গে অন্য একজন আছেন।

ডোরিয়েন, ইনি হচ্ছেন লর্ড হেনরি ওটোন, অক্সফোর্ডের পুরনো সহপাঠী আমার। মডেল। হিসাবে তুমি যে কত ভালো সেই কথাই এতক্ষণ ওঁকে বলছিলাম। কিন্তু তুমি সব নষ্ট করে দিলে।

লর্ড হেনরি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর ভঙ্গিতে একটি হাত প্রসারিত করে বললেন, মিঃ গ্রে, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার ফলে আমার যে আনন্দ হয়েছে সে-আনন্দ আপনি নষ্ট করেননি। আপনার কথা মাসিমার কাছে আমি শুনেছি। আপনি তাঁর একজন প্রিয় বন্ধু এবং আমার মনে হয় আপনি তাঁর একটি শিকার-ও।

অনুশোচনার হাসি হেসে মিঃ গ্রে বললেন, লেডি আগাথার কালো খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে। গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে আমি হোয়াইট চ্যাপেলের একটি ক্লাবে যাব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সেকথা আমি একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দ্বৈত সঙ্গীত গাওয়ার কথা ছিল, তিনটি সঙ্গীত, তিনি কী বলবেন জানি না। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভয় লাগছে।

মা ভৈঃ। মাসিমার সঙ্গে আপোস করিয়ে দেব আপনার। তিনি আপনাকে বেশ ভালোবাসেন। তাছাড়া সেদিন যে আপনি যাননি তার জন্যে তিনি কিছু মনে করেছেন বলে আমার মনে হয় না। দর্শকরা ওটাকে দ্বৈত সঙ্গীত বলেই হয়তো ভেবে নিয়েছিল। মাসিমা আগাথা যখন পিয়ানোর ধারে বসে গান ধরেন তখন তাঁর গলা থেকে যে স্বর রেরোষ তা দুজনের সমান।

ডোরিয়েন হেসে বললেন, লেডি আগাথার সম্বন্ধে এই মন্তব্য যে ভয়াবহ তা-ই নয়, আমার সম্বন্ধেও বেশ সু-উক্তি নয়।

লর্ড হেনরি তাঁর দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, সত্যিই অপরূপ সুন্দরী তিনি। চারুকার্ষের মতো সুন্দর লাল দুটি ঠোঁট, দুটি নীল পরিচ্ছন্ন চোখ, কোঁকড়ানো সোনালি চুল। তাঁর মুখের দিকে তাকালে তাঁকে বিশ্বাস না করে আপনি পারবেন না। যৌবনের সমস্ত উচ্ছলতা তাঁর সর্বাঙ্গে, সেই সঙ্গে রয়েছে যৌবনের শুচিতা। দেখলে মনে হবে, পৃথিবীর সমস্ত কালিমা থেকে তিনি মুক্ত। বেসিল হলওয়ার্ড যে তাঁকে পুজো করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?

সৎকাজের পক্ষে আপনি অত্যন্ত সুন্দর, মিঃ গ্রে, অত্যন্ত সুন্দর।

এই বলে, লর্ড হেনরি সোফার ওপরে বসে পড়ে সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বার করলেন।

চিত্রকর এর মধ্যে তাঁর রঙ আর তুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এতক্ষণ তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। লর্ড হেনরির শেষ কথা শুনে তিনি একবার তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন, একটু দ্বিধা করলেন, তারপরে বললেন, হ্যারি, এই ছবিটা আজই আমি শেষ করতে চাই। তোমাকে যদি আজ আমি চলে যেতে বলি তাহলে কি আমার পক্ষে বেশি অশালীনতা প্রকাশ করা হবে?

লর্ড হেনরি হাসলেন এবং ডোরিয়েন গ্রে-র দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্রে, আমাকে কি চলে যেতে হবে।

না, না, লর্ড হেনরি। আপনি দয়া করে যাবেন না। মনে হচ্ছে, বেন্সিলের মেজাজটা খুব খারাপ আর ও যখন রেগে যায় তখন আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমি জানতে চাই সৎকাড করা আমার দ্বারা কেন সম্ভব নয়।

আপনাকে বলব কি না সে কথা জানি না, মিঃ গ্রে। জিনিসটা এতই বিরক্তিকর যে ব্যাপারটা নিয়ে মনোযাগ দিয়ে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, বিশেষ করে আপনি যখন থাকতে বললেন। বেসিল, আমি থাকলে নিশ্চয় তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। হবে কি? তুমি আমাকে প্রায়ই বল যে ছবি আঁকার সময় তৃতীয় কেউ তোমার মডেলের সঙ্গে বসে গল্প করলে তোমার কাজের সুবিধা হয়।

হলওয়ার্ড ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন, অবশ্য ডোরিয়েনের ইচ্ছে নিশ্চয় তুমি থাকবে। ডোরিয়েনের খেয়াল তার নিজের কাছে ছাড়া অন্য সকলের কাছেই আইন।

লর্ড হেনরি তাঁর টুপি আর দস্তানা তুলে নিয়ে বললেন, তোমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করা কষ্টকর, বেসিল, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। অরলিনস-এ একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, বিদায়। একদিন বিকেলে কাউন স্ট্রিটে আমার কাছে আসুন। পাঁচটার কাছাকাছি প্রতিদিনই আমি প্রায় বাড়িতে থাকি। কবে আসছেন আমাকে লিখে জানাবেন। আপনার সঙ্গে দেখা না হলে দুঃখ পাব।

ডোরিয়েন গ্রে বেশ জোর গলাতেই বললেন, বেসিল, লর্ড হেনরি যদি চলে যান আমিও তাহলে চলে যাব। ছবি আঁকার সময় একবারও তুমি মুখ খোল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে খুশি হওয়ার ভান করাটা আমার পক্ষে সত্যিই বড়ো কষ্টকর। ওঁকে থাকতে বল। আমি চাই উনি থাকুন।

ছবির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হলওয়ার্ড বললেন, ডোরিয়েন আর সেই সঙ্গে আমাকে খুশি করার জন্য তুমি থেকে যাও হেনরি। কথাটা সত্যি যে কাজ করার সময় আমি কারো সঙ্গে কথাও বলি না, কারো কথা কানেও তুলি না। আমার মডেলদের কাছে সেটা সত্যিকারের কষ্টকরই হয়ে দাঁড়ায়। আমি অনুরোধ করছি-তুমি থেকে যাও।

কিন্তু অরলিনস-এ যাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে তাঁর কী হবে?

চিত্রকর হাসলেন, বললেন আমি মনে করি না তার জন্যে তোমার কোনো অসুবিধা হবে। হেনরি, তুমি আবার বসে পড। ডোরিয়েন, এখন তুমি প্ল্যাটফর্মের ওপরে ওঠো, বেশি নড়াচড়া করো না, অথবা লর্ড হেনরির কথাতেও কান দিও না বিশেষ। একমাত্র আমি ছাড়া, সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের ওপরেই ওর প্রভাবটা বড়ো খারাপ।

ডোরিয়েন গ্রে প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে এলেন, দেখে মনে হল তিনি একজন গ্রিক যুবক, আদর্শের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। লর্ড হেনরিকে তাঁর কেমন যেন ভালো লেগেছিল, তিনি মোটেই বেসিলের মতো নন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা বড়ো মধুর। তাছাড়া, হেনরির স্বরটি কী মধুর! কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, লর্ড হেনরি, সত্যিই কি আপনার প্রভাব খারাপ?

সৎ প্রভাব বলে কিছু নেই, মিঃ গ্রে। সব প্রভাবই দুনীর্তির বাহক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দুর্নীতিমূলক।

কেন?

কারণ, কারো ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দিতে হয়। তার। স্বাভাবিক চিন্তা আর অনুভূতিকে বর্জন করতে হবে। তার নিজের গুণগুলি তার কাছে। বাস্তব নয়। তার পাপ, যদি পাপ বলে কোনো বস্তু থেকে থাকে, অপরের কাছ থেকে ধার করা। সে অন্য লোকের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি; যে-নাটক তার জন্যে লেখা হয়নি সেই নাটকেরই অভিনয়। করার জন্যে তার ডাক পড়ে। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে বিকাশ করা। নিজের স্বভাবটিকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা, অর্থাৎ কেন আমরা পৃথিবীতে এসেছি সেটা বুঝতে পারা। আজকাল মানুষ নিজেদেরই বড়ো ভয় করে। মানুষ ভুলে যায় নিজের ওপরে তার একটা কর্তব্য রয়েছে, আর সেইটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য। অবশ্য তারা উদার প্রকৃতির। ক্ষুধার্তকে তারা অন্ন দেয়, দরিদ্রকে দেয় বস্ত্র। কিন্তু তাদের নিজেদের আত্মা থাকে অভুক্ত, উলঙ্গ। মনুষ্যডাতির কথা যদি। ধরেন, তাহলে বলতে হবে আমাদের মধ্যে শৌর্য বলে কোনো পদার্থ লেই। সম্ভবত, কোনোদিনই আমাদের ও-জিনিসটা ছিল না। আমাদের শাসন করছে দুটি জিনিস, একটি হল সামাজিক ভীতি–ওটি হল নীতির গোড়ার কথা, আর একটি হল ভগবানের ভ্য, এইটি হল ধর্মের মূল কথা। এবং তবু–

গভীর ভাবে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন চিত্রকর। তাঁর মনে হল গ্রে-র মুখের ওপরে এমন একটি ভাব প্রতিফলিত হয়েছে যা তিনি আগে কখনো দেখেননি, তিনি বললেন, ডোরিয়েন, লহী ছেলের মতো ডান দিকে ঘাড়টা একটু বাঁকাও।

আস্তে আস্তে মিষ্টি গলায় এবং হাতটিকে অর্ধবৃত্তাকারে সুন্দরভাবে ঘুরিয়ে (ইটনে পড়ার সময় এইভাবে তিনি কথা বলতেন) লর্ড হেনরি তাঁর কথার সূত্র ধরে বললেন, কিন্তু তবু আমি বিশ্বাস করি যদি মানুষকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হয়, যদি তাকে প্রতিটি অনুভূতি ভালোভাবে প্রকাশ করতে হয়, যদি তার প্রতিটি চিন্তা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হয় তাহলে দুনিয়াটা আনন্দের এমন একটা সজীব উচ্ছ্বাসে ভেসে যাবে যে আমরা মধ্যযুগের সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পাব, ফিরে আসব ‘হেলেনিক’ আদর্শেতার চেয়েও সুন্দর, পবিত্র একটি আবহাওয়ায় প্রাণ ভরে বিশ্বাস নিতে পারব আমরা। কিন্তু আমাদের ভেতরে সে। সবচেয়ে বেশি সাহসী সে-ও তার নিজেকে বুড়ো ভয় করে।বর্বরতার অত্যাচার মানুষের আত্মত্যাগের মূর্তিতে তার বিষণ্ণ স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই অকারণ আত্মত্যাগই আমাদের জীবনের সুখ-সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। ত্যাগের জন্যই আমরা শাস্তি পাই। যে সব প্রবৃত্তিকে আমরা গলা টিপে হত্যা করি, সেই সব রুদ্ধ প্রবৃত্তিই আমাদের মনের মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে, বিষাক্ত করে আমাদের দেহ পাপ করে একবারই, দু’বার নয়, আর আমাদের কর্ম পবিত্র করে তাকে। তারপরে একমাত্র আনন্দের কিছু স্মৃতি, অথবা অনুতাপের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। প্রলোভন এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রলোভনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বাধা পাও, না পাওয়ার আকঙহষ্কায় তোমার আত্মা রুগ্ন হয়ে যাবে, যে বাসনাকে ভয়কর নীতিগুলো ভয়ঙ্কর বলে চিহ্নিত করেছে, প্রচার করেছে দুর্নীতি বলে, সেই বাসনার উন্মাদনায় তুমি জ্বলে পুড়ে মরবে। মানুষের বলে বিশ্বের বিরাট বিরাট ঘটনার জন্ম মানুষের মস্তিষ্কে। এই মস্তিষ্কের ভেতরই পৃথিবীর সবচেয়ে বিরাট পাপ অঙ্কুরিত হয়। আপনি, মিঃ গ্রে, নিজের কথাই ধরুন, আপনার এই গোলাপি যৌবন আর গোলাপ-সাদা। তারুণ্যের ভেতরে এমন সব আকাঙ্খা অঙ্কুরিত রয়েছে যাদের কথা ভাবতেই আপনার ভয় লাগে, জেগে জেগে অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন সব স্বপ্ন আপনি দেখেন যাদের স্মৃতিগুলি আপনার মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে দেয়।

ডোরিয়েন স্খলিত স্বরে বললেন, থামুন, থামুন। আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছেন। কী বলব আমি তা বুঝতে পারছি না, আপনার প্রশ্নের উত্তর একটা কিছু রয়েছে, কিন্তু সেটা কী তা আমি ঠিক পারছি না। আপনি আর কিছু বলবেন না। আমাকে একটু ভাবতে দিন। অথবা এ বিষয়ে কিছু চিন্তা না করাই ভালো।

ঠোঁট দুটি ফাঁক করে প্রায় দশটি মিনিট তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ দুটি তাঁর অস্বাভাবিক ভাবে জ্বল জ্বল করতে লাগল। তিনি যেন বুঝতে পারলে একেবারে নতুন ধরনের কিছু প্রভাব তাঁর মনের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে। তবু তাঁর মনে হল এগুলি তাঁর নিজেরই। যে কটি কথা বেসিলের বন্ধু তাঁকে বলেছেন, কথাগুলি নিঃসন্দেহ-হঠাৎ করেই বলা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, সেগুলি তাঁর হৃদয়ের গোপন তারে গিয়ে আঘাত করেছে। এরকম। আঘাত আগে কেউ কখনো করেনি। কিন্তু এখন তার মনে হলো একটি নতুন মূদনায় সেই তন্ত্রীগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে।

সঙ্গীত তাঁকে এইভাবেই উদ্বেলিত করেছে। অনেকবার অঙ্গীত তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু সে সঙ্গীত মুখর ছিল না, এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু ছিল না, এটি হচ্ছে আর একটি অনাবিষ্কৃত বিশৃঙ্খলা। আমাদের মনের মধ্যে ভগবান এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছেন। কথা, কেবল কথা! কী নিতুর এরা! কত সপষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং নিষ্ঠুর। এদের হাত থেকে মুক্তি নেই কারো। অথচ তাদের মধ্যে কী তীক্ষ্ণ ব্যঞ্জনা রয়েছে। একদিন যা নিরাকার ছিল তাকেই সাকার করে তোলে এরা। বেহালা অথবা বাঁশির সুরের মতো মিষ্টি এর সুর। শুধু কথা! কথার মতো বাস্তব জিনিস আর কোথাও কিছু রয়েছে?

সত্যি কথা, তাঁর বাল্যে এমন সব জিনিস ছিল যার অর্থ তিনি তখন বুঝতে পারতেন না। সেগুলিকে এখন তিনি বুঝতে পারেন। জীবন হঠাৎ তাঁর কাছে অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে তিনি যেন আগুনের ওপরে বিচরণ করছেন। একথা তিনি বুঝতে পারেননি কেন?

ইঙ্গিতমিয় হাসি হেসে লর্ড হেনরি তাঁকে লক্ষ করলেন। মনের অবস্থা ঠিক কী রকম থাকলে মানুষকে কিছু বলা উচিত নয় তা তিনি জানতেন। তাঁর কৌতহল বেশ বেড়ে উঠল। তাঁর কথাগুলি যে হঠাৎ এতটা অর্থবহ হয়ে দাঁড়াবে তা বুঝতে পেরে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ষোল বছর বয়সে তিনি একটি বই পড়েছিলেন। সেই বইটি পড়ে তিনি এমন কতকগুলি। জিনিস জানতে পেরেছিলেন যেগুলি তিনি আগে জানতেন না। ডোরিয়েন গ্রে কি সেই ধরনেরই বিশেষ কোনো অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন? তিনি তো বাতাসে একটি তীর ছুঁড়েছেন মাত্র, সেই তীর কি কোনো লক্ষ্যবস্তু ভেদ করেছে? মানুষকে মুগ্ধ করার শক্তি ছেলেটির কী সত্যিই অপরিসীম?

দুজনেই যে নির্বাক হয়ে রয়েছেন সে দিকে কোনো খেয়াল ছিল না বেসিলের। তিনি আপন মনে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ছবি এঁকে চলেছেন। সত্যিকারের নিপুণ চিত্রকর ছাড়া এ ধরনের ছবি আঁকা সত্যিই কল্পনার অতীত।

ডোরিয়েন গ্রে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, বেসিল, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি একটু বাগানে গিয়ে বসি, আমর দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।

বন্ধু, আমি খুব দুঃখিত। ছবি আঁকার সময় আমি অন্য কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু আজকের মতো ভালোভাবে আর কোনোদিনই তুমি মডেলের কাজ করতে পারনি। একেবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি আর আমি তোমর কাছ থেকে যা পেতে চেয়েছিলাম তার সবটুকুই পেযেছি–অর্ধউন্মোচিত দুটি ঠোঁট এবং চোখের ওই উজ্জ্বল আভা। হ্যারি তোমাকে এতক্ষণ কী বলছিল তা আমি জানি না, কিন্তু সে নিশ্চয় এমন কিছু বলেছিল যার প্রভাবে পড়ে তোমার মুখের ওপরে এই রকম অপরূপ একটি ব্যঞ্জনা ফুটে বেরিয়েছে। মনে হচ্ছে, তোমাকে সে প্রশংসা করছিল। ও যা বলে তার একটি বর্ণও তুমি বিশ্বাস করো না।

 উনি মোটেই আমাকে প্রশংসা করেননি। সম্ভবত সেই জন্যই উনি আমাকে যা বলেছেন তার একটুও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।

ক্লান্ত আর স্বপ্নিল চোখে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আপনি জানেন আমি যা বলেছি তার সমস্তটাই আপনি বিশ্বাস করেন। আপনার সঙ্গে বাগানে আমিও যাব চলুন। এই স্টুডিওর ঘরটিতে ভীষণ গরম লাগছে। বেসিল আমাদের ঠান্ডা কিছু খেতে দাও, স্ট্রবেরি মেশানো কিছু।

নিশ্চয়, নিশ্চয় হ্যারি। বেলটা বাজাও। পার্কার এলে তোমাদের যা যা দরকার সব এনে দিতে বলছি। আমার কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেটুকু করতে আমি যাচ্ছি ডোরিয়েনকে বেশিক্ষণ আটকে রেখ না। আজকে আমরা যে মুড এসেছে, এরকম মুড অনেকদিন আসেনি। এটা আমার সর্বোত্তম সৃষ্টি হবে, এমনিতেই এটা একটা মাস্টারপিস।

লর্ড হেনরী বাগানে বেরিয়ে গিয়ে দেখলেন লাইল্যাক ফুলের ঝাডের ঠান্ডা ছায়ার ডোরিয়েন গ্রে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন। যেমন করে মানুষ মদ্যপান করে, মনে হল ঠিক সেই রকম ভাবে ফুলের সুগন্ধ তিনি পান করছেন। তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন, একটা হাত তাঁর কাঁধের উপরে রাখলেন, এবং মৃদুস্বরে বললেন, আপনি ঠিকই করছেন। অনুভূতি ছাড়া আম্মাকে সুস্থ করা যায় না, যেমন আত্মাকে বাদ দিয়ে অনুভূতি পঙ্গু হয়ে যায়।

যুবকটি চমকে উঠে পিছিয়ে বসেন। তাঁর মাথা খোলা এবং গাছের পাতাগুলি তাঁর সেই উদ্দাম বিদ্রোহী চুলগুলির ওপরে পড়ে রঙিন জালের সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে মানুষের চোখের মধ্যে যেমন একটা ভীতিজনক বিহ্বলতা ডেংগে ওঠে, তাঁর চোখের ভেতর থেকে সেই রকম একটা ভয়ের আমেজ ফুটে বেরোল। তাঁর খোদাই করা সুন্দর নাকটি কাঁপতে লাগল, কোনো একটি গোপন দুর্বল স্নায়ুর কাঁপুনি জেগে উঠল তাঁর রঙিন ঠোঁটের ওপরে। ঠোঁট দুটি সেই আবেগে কাঁপতে লাগল।

লর্ড হেনরী বলে গেলেন, হ্যাঁ, প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মাকে নীরোগ করা, আর আত্মা দিয়ে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি করা–এটি হল জীবনের একটি প্রধান গোপন কথা। আপনি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। যতটুকু জানেন বলে আপনার ধারণা তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি জানেন, ঠিক যেমন যতটা আপনি ভানতে চান তার চেয়ে অনেক কম জ্ঞান আপনার রয়েছে।

ভ্রুকুটি করে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর মাথাটা ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর সামনে যে দীর্ঘাঙ্গ সুন্দর যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে তাঁর ভালো না লেগে উপায় ছিল না। তাঁর রোমান্টিক অলিভ রঙের। মুখ এবং ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর তাঁকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তার সেই খাদে বাঁধা এবং ক্লান্ত স্বরের মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল সেটা তাঁকে মুগ্ধ না করে পারেনি। এমন কি তাঁর ঠান্ডা, সাদা, ফুলের মতো হাতের মধ্যেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত কমনীয়তা ছিল। কথা বলার সময় লর্ড হেনরির হাতগুলি নড়ছিল। মনে হচ্ছিল সেগুলি যেন সঙ্গীতের তালে তালে দুলছে, তাদের যেন নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। কিন্তু ডোরিয়েনের কেমন যেন ভয় লাগছিল, এবং সেই ভয় পাওয়ার জন্য তিনি যেন লজ্জিত-ও হচ্ছিলেন। নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে একজন অপরিচিতের প্রয়োজন হল কেন? বেসিল হলওয়ার্ডকে তিনি অনেক দিনই জানেন, কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব কোনোদিনই তাঁর মনে কোনোরকম পরিবর্তন আনতে পারেনি। হঠাৎ তাঁর সামনে এমন একজনের আবির্ভাব হল যিনি তাঁর কাছে জীবনের রহস্যটি প্রকাশ করে দিলেন। কিন্তু তবু ভয় করার কী রয়েছে? তিনি তো স্কুলের ছাত্র অথবা ছাত্রী নন। ভয়। পাওয়াটা তো একটা হাস্যকর ব্যাপার।

লর্ড হেনরি বললেন, চলুন, ওই ছায়ায় গিয়ে বসি, পার্কার পানীয় নিয়ে এসেছে, এবং এই রোদের ঝাঁডে আপনি যদি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকেন তাহলে আপনার দফা রফা হয়ে যাবে, বেসিল আর কখনো আপনার ছবি তুলবে না। রোদে পোড়া আপনার চলবে না। এটা ঠিক উচিত হবে না আপনার।

বাগানের ধারে বসে হাসতে হাসতে ডোরিয়েন বলেলন, তাতে ক্ষতি কী?

তাতে আপনারই সমূহ ক্ষতি, মিঃ গ্রে।

কেন?

কারণ আপনার অনবদ্য যৌবন রয়েছে আর যৌবন এমন একটা জিনিস যাকে পাওয়ার জন্য মানুষ লালায়িত হয়।

লর্ড হেনরি, আমার কিন্তু সে রকম কিছু মনে হয় না।

না, এখন তা আপনারা মনে হবে না। একদিন আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন, আপনার দেহের চামড়া যখন কুঁচকে যাবে, আপনি যখন দেখতে কদাকার হয়ে যাবেন, দুশ্চিন্তা আপনার কপালের রেখাগুলিকে যখন কুঞ্চিত করে তুলবে, আর কামনায় আপনার ঠোঁট দুটি মারাত্মকভাবে জ্বলতে থাকবে, তখনি যৌবনের কথা আপনার মনে পড়বে, তখনি আপনি। এর অভাবটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। এখন যেখানেই আপনি যাবেন সেখানেই সবাইকে আনন্দ দেবেন। এটা কি সব সময়েই সম্ভব হবে? আপনার মুখটা কেবল সুন্দর নয়, অসম্ভব সুন্দর, মিঃ গ্রে, হাসবেন না। কথাটা সত্যি। আর যৌন্দর্য যে প্রতিভার এ অথবা তার চেয়েও বড়ো–সেকথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা নে আলো, বসন্তকাল, অথবা কালো জলের ওপরে চাঁদের প্রতিফলনের মতো এটাও বিশ্বের একটি বড় সত্য। এ নিয়ে তর্ক করার অবকাশ নেই। এর সার্বভৌমত্ব ঈশ্বর ঠিক করে দিয়েছেন। যাঁদের এই বস্তুটা রয়েছে তাঁরা রাজকুমারের পর্যায়ে পড়েন। হাসছেন? হায়, যখন আপনার যৌবন থাকবে না তখন কিন্তু আপনি আর হাসবেন না। লোকে মাঝে মাঝে বলে সৌন্দর্য নাকি দেহের বাইরের জিনিস। তা হতে পারে। কিন্তু চিন্তা যতটা বাহ্যিক, এ অন্তত ততটা নয়। আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে সকল বিস্ময়ের সেরা বিস্ময়। বাইরের চেহারা দেখে যারা মানুষকে বিচার করে না তাদের বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বের আসল রহস্য যা আমরা সাদা চোখে দেখতে পাই তার মধ্যে নিহিত, যা দেখতে পাই না তার মধ্যে ন্য। হ্যাঁ, মিঃ গ্রে, দোতারা আপনার ওপরে অদয়। কিন্তু দেবতারা যা দেন তা তাঁরা তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে নেন। মাত্র কয়েকটি বছরই আপনি ভালোভাবে, পরিপূর্ণভাবে বাঁচতে পারেন। যৌবন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার যৌন্দর্য শেষ হয়ে যাবে। তখনি আপনি হঠাৎ আবিষ্কার করবেন জয় করার মতো আর আপনার কিছু নেই। যেটুকু রয়েছে সে শুধু অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতি পরাজযের চেয়েও আপনার কাছে তিক্ত বলে মনে হবে। প্রতি মাসে এই ক্ষয়মান সৌন্দর্য আপনাকে এমন সব পরিবেশের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলবে সেগুলি ভয়নক ছাড়া আর কিছু নয়। সময় আপনাকে হিংসা করে, আপনার লিলি আর গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আপনার বুদ্ধিবৃত্তি কমে যাবে, গাল যাবে তুড়ে, চোখের দৃষ্টি যাবে হক্কীণ হয়ে। ভীষণভাবে দুঃখ পাবেন আপনি। হায, যতক্ষণ আপনার যৌবন রয়েছে ততক্ষণই তাকে উপলব্ধি করুন। নীরস নীতিকথা শুনে, অপরিবর্তনীয় ব্যর্থতাকে দেখার ভল্যে, অজ্ঞদের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, সাধারণ আর অশিক্ষিতদের সেবা করার বাসায আপনার সোনার দিনগুলিকে নষ্ট করবেন না। এ যুগের এইগুলিই হচ্ছে রুগ্ন আদর্শ, মিথ্যা উন্মাদনা। বাঁচুন, ভগবান আপনাকে যে সুন্দর জীবন দিয়েছেন তাকে পরিপূর্ণ ভাবেউপলব্ধি করুন। কোনো কিছুই যেন আপনার কাছে নগণ্য বলে গণ্য না নয়, সব সময় নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চযের পথে এগিয়ে যান, কিছুই ভয় করবেন না, একটি নতুন ভোগসুখবাদ–আমাদের শতাব্দী এই মতবাদেই বিশ্বাসী। আপনি হয়তো এর প্রকাশ্য প্রতীক। এমন কিছু নেই যা আপনি আপনার ব্যক্তিত্ব নিয়ে করতে পারেন না। কিছুদিনের জন্যে পৃথিবী আপনার, যখনি আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হল তখনি দেখলাম আপনি নিজে কী, এবং কী হতে পারেন সে বিষয়ে আপনি নিজেই জানেন না। আপনার মধ্যে অনেক জিনিস আমি দেখেছি যেগুলি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়েছিল আপনার সম্বন্ধে আপনাকে আমি কিছু বলব। আমার মনে হয়েছিল আপনি যদি নষ্ট হয়ে যান তাহলে ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক হবে। কারণ, খুব। অল্পদিনই আপনার যৌবন বেঁচে থাকবে। সাধারণ পাহাড়ি চুল ঝরে যায় বটে, কিন্তু আবার তারা ফোটো এখনো যেমন আগামী জুন মাসেও ল্যাবারনাম ফুল তেমনি হলুদ রঙা হয়ে ফুটবে। এখন থেকে একমাসের মধ্যে ক্লিম্যাটিস লতা গাছের পাতায় বেগনে রঙের তারকা চিহ্নগুলি ফুটে বেরোবে এবং বছরের পর বছর এর পাতার সবুভ রাত্রিগুলি বেগনে তারকা চিহ্নগুলিকে মেলে ধরবে। কিন্তু কোনো দিনই আমরা আমাদের হারানো যৌবনের ফিরে পাব না। বিশ বছর বয়সে আমাদের মধ্যে যে আনন্দের জয়ধ্বনি ওঠে সেই আনন্দ শেষ পর্যন্ত। ঝিমিযে আসে। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শিথিল হয়ে আসে, আমাদের প্রবৃত্তিগুলি পচে যায়। ভয়ঙ্কর অতলে আমরা অধঃপতিত হই। সে বাসনার জন্যে আমরা অতিমাত্রায় ভয় পাই তারই অতৃপ্তির স্মৃতি আমাদের পিছু ধাওয়া করে। যৌবন! যৌবন! এ পৃথিবীতে এ ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছু নেই।

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে, অবাক হয়ে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর কথাগুলি শোনেন। লাইল্যাক ফুলের পাপডিগুলি তাঁর হাত থেকে খসে নীচে শানুবাঁধানো জায়গায় পড়ে যায়, একটা ব্যস্তবাগীশ মৌমাছি কাছে এসে একটু ভনভন করে। তারপরে সে ফুলের ওপরে ঘোরার আশায় ছুটে বেরিয়ে যায়। সামান্য জিনিসের ওপরে কৌতূহলে নিয়ে তিনি এর দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভয়ে বড়ো জিনিসের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পেরে আমারা ঠিক এই ভাবেই ছোটোর দিকে ঝুঁকে পড়ি। কোনো নতুন ভাবধারা প্রকাশ করতে না পেরে, অথবা ভয়ঙ্কর কোনো চিন্তা যখন হঠাৎ আমাদের মগডাকে অবরোধ করে বসে, এবং তার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণের দাবী জানায়-তখন আমরা এই ধরনের ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে মেতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে মৌমাছিটা উড়ে গেল, গিয়ে বসল আর একটি ফুলের ওপরে। ফুলটি এপাশ থেকে ওপাশে ধীরে ধীরে নড়তে লাগল।

স্টুডিওর দরজার সামনে হঠাৎ চিত্রকরকে দেখা গেল, তিনি ভেতরে আসতে তাঁদের ইশারা করলেন।

তিনি বললেন, আমি অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্যে। আলো বেশ ভালোই রয়েছে। তোমাদের পানীয় নিয়ে এস।

তাঁরা দুজনে উঠে পড়লেন, তারপরে ধীরে ধীরে স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গেলেন, সবুজ আর সাদা রঙে মেশানো দুটি প্রজাপতি তাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল, বাগানের কোণে একটা পিয়ারা গাছে একটা থ্রাসপাখি গান শুরু করল।

 লর্ড হেনরি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্রে, আমাকে দেখে আপনি খুশি হয়েছেন?

 হ্যাঁ। বর্তমানে আমি খুশি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই রকম আনন্দ কি সব সময় আমি পাব?

সব সময়! শব্দ দুটো সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর। কথাটা শুনলেই আমি কাঁপতে থাকি। এই কথাটা বলতে মহিলাদের বেশ ভালো লাগে। চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে চাওযার ফলে প্রতিটি রোমান্সকেই তারা নষ্ট করে ফেলে। তা ছাড়া, কথাটা অর্থহীন, খামখোল আর জীবনব্যাপী আকাঙ্খার মধ্যে তফাৎ এই সে খামখেয়াল একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী।

স্টুডিওতে ঢোকার পরে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর একটি হাত লর্ড হেনরির কাঁধের ওপরে রেখে। বললেন, তাহলে, আমাদের বন্ধুত্ব খামখেয়াল-ই হোক।

এই বল তিনি প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে গিয়ে মডেলের ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন।

একটা বড়ো আরাম কেদারার ওপরে বসে লর্ড হেনরি তাঁকে দেখতে লাগলেন। চারপাশে। নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কেবল ক্যানভাসের ওপরে ব্রাশের মৃদু খসখসানি সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছিল, আর যখন চিত্রকর কখনো-সখনো দু-এক পা পিছিযে দূর থেকে তাঁর ছবিটিকে দেখছিলেন তখন। খোলা দরজার ভিতর দিয়ে তির্যক ভঙ্গিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছিল, সেই আলোর মধ্যে সোনালি রঙের ধূলিকণাগুলি নাচতে লাগল। গোলাপ ফুলের ভারী গন্ধ এসে ভরিয়ে দিয়েছিল ডায়গাটা।

প্রায় মিনিট পনেরো কাজ করার পরে হলওয়ার্ড থামলেন। অনেক্ষণ ধরে ডোরিয়েন গ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপরে তাঁর বিরাট একটা ব্রাশের ডগা দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে। তাকলেন তাঁর ছবিটির দিকে, ভ্রূকুটি করলেন।

প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে ছবিটা।

এই বলেই তিনি এগিয়ে গিয়ে ক্যানভাসের বাঁদিকের এক কোণে সিঁদুরে অক্ষরে নিজের নামটা লিখে দিলেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন লর্ড হেনরি। ছবিটিকে বেশ ভালো করে পরীক্কা করলেন। অপরুপ চিত্রকলাই বটে, যেন জীবন্ত, প্রাণচঞ্চল, একেবারে দ্বিতীয় ডোরিয়েন গ্রে।

তিনি বললেন, বন্ধু, আমার আন্তরিক অবিনন্দন গ্রহণ করা আধুনিক যুগের একটি সুন্দরতম প্রতিকৃতি তুমি সৃষ্টি করেছ। মিঃ গ্রে, নেমে আসুন, নিজের প্রতিকৃতির দিকে একবার তাকান।

 যুবকটি চমকে উঠলেন, মনে হল হঠাৎ যেন তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠেছন।

 প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি শেষ হয়েছে?

চিত্রকর বললেন, প্রায়। আজ তোমার বাটি হচ্ছে অদ্ভুত, চমৎকার। তোমার কাছে আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।

লর্ড হেনরি বললেন, সেই সাফল্যের মূলে রয়েছি আমি। তাই না মিঃ গ্রে?

কোনো উত্তর দিলেন না ডোরিয়েন, অন্যমনস্কভাবে একবার তাঁর প্রতিকৃতির সামনে দিয়ে হাঁটলেন। তারপরে সেই দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রতিকৃতিটির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া মাত্র তিনি পিছ ফিরলেন, আনন্দের আতিশয্যে কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে তাঁর গাল দুটি হয়ে উঠল। তাঁর চোখের মধ্যে বেরিয়ে এল আনন্দের এক টুকরো জ্যোতি, মনে হল, তিনি যেন এই প্রথম নিজেকে চিনতে পেরেছেন। সেখানে তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি। মনে হল, হলওয়ার্ড তাঁকে যেন কিছু বলছেন, কিন্তু ঠিক কী বলছেন তা তাঁর কানে ঢুকল না। তিনি যে এত সুন্দর এই কথাটা আজই যেন তিনি জীবনে প্রথম বুঝতে পারলেন। এর আগে ঠিক এমনভাবে তিনি বোঝেননি। বেসিল হলওয়ার্ড এতদিন তাঁকে যে-সব কথা বলে এসেছিলেন সেগুলিকে তিনি বন্ধুর মিষ্ট ভাষণ বলেই মনে করতেন। সে সব কথা তিনি শুনতেন, হাসতেন, এবং ভুলে। যেতেন। সেই কথাগুলি তাঁর চরিত্রের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তারপরে এলেন লর্ড হেনরি যৌবনের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি, কিন্তু সেই সঙ্গে বলে দিলেন, সাবধান, যৌবন ক্ষণস্থায়ী।

কথাটা শোনার সময় তাঁর মনে লেগেছিল সত্যি কথা, কিন্তু এখন নিজের পূর্ণ প্রতিকৃতির মাযার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলি তাঁকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেল। হেনরির বক্তব্যের আসল ব্যঞ্জনাটা তিনি বুঝতে পারলেন। হ্যাঁ, সত্যি কথাই। এমন একটা দিন আসবে যেদিন তাঁর মুখের রেখাগুলি কুঁচকে যাবে, ঝুলে পড়বে গালের চামড়া, চোখের দৃষ্টি হবে নিষ্প্রভ, বির্বণ, হ্যাঁ লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে, নিটোল প্রাণবন্ত স্বাহ্যটি ঝুরঝুর করে পড়বে ভেঙে। তাঁর ঠোঁটের লালিমা, চুলের সোনালি বর্ণ সব নষ্ট হয়ে যাবে, নিঃশব্দে মিলিয়ে যাবো আত্মার পরিপোষক যে জীবন, সেই জীবনই তাঁর দেহটিকে বিকৃত করে তুলবে। তিনি পরিণত হবেন একটি ঘৃণ্য জঘন্য, ভয়ঙ্কর মাংসপিণ্ডে।

এই কথা চিন্তা করতে করতে একটি তীক্ষ্ণ বেদনা শাণিত লৌহ শলকার মতো বুকে গিয়ে খোঁচা দিল। তাঁর দেহের প্রতিটি স্পর্শকাতর তন্ত্রী সেই আঘাতে আর্তনাদ করে উঠল। ঘোলাটে হয়ে উঠল তাঁর চোখ দুটি, ধীরে ধীরে সে দুটি অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেলা মনে হল কার যেন তুষারশীতল একটি হাত তার বুকের ওপরে এসে পড়েছে।

ডোরিয়েন গ্রে-কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন হলওয়ার্ড, ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে না পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পছন্দ হচ্ছে না?

লর্ড হেনরি বললেন, অবশ্যই ওঁর পছন্দ হয়েছে। এ ছবি কার পছন্দ হবে না?

আধুনিক চিত্রকলায় এটি হচ্ছে সর্বোত্তম চিত্র। এর জন্যে তুমি আমার কাছে যা চাও তাই দেব। ছবিটা আমার চাই।

এটা আমার সম্পত্তি নয় হ্যারি।

কার সম্পত্তি?

কার আবার? ডোরিয়েনের

ভাগ্যবান মানুষ।

ডোরিয়েন গ্রে তখনো তাঁর প্রতিকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, সেইভাবে তাকিয়ে থেকেই বিড়বিড় করে অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই তিনি বললেন, কী দুঃখের, কী দুঃখের! আমি বৃদ্ধ হব, বিকৃত আর ভয়ঙ্কর হবে একদিন। কিন্তু এই প্রতিকৃতি চিরকালই যৌবনের। আবেগে থাকবে ভরা। আজকের এই উঁচুন মাসের বিশেষ দিনটিতে সে যেমন রয়েছে, চিরকাল সে ঠিক তেমনিই থাকবে। মনে হবে এ যেন এই সেদিনের ব্যাপার। যদি ঠিক উল্টোটা হত, আমি চিরকালই যুবক থাকতাম, আর এই প্রতিকৃতিটা যেত বুডিযে। এর জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিতে পারতাম। হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমি দিতে পারতামি না। প্রয়োজন হলে, আমার আত্মাকেও বিকিয়ে দিতে পারতাম।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, এ ব্যবস্থার নিশ্চয় তুমি রাজি হবে না বেসিল। এর জন্য তুমি অনেক পরিশ্রম করে।

হলওয়ার্ড বললেন, আমার খুব বেশি আপত্তি রয়েছে হ্যারি।

ডোরিয়েন গ্রে ঘুরে তাঁদের দিকে তাকলেন, বললেন, বেসিল, আমি জানি তা তুমি করবে। বন্ধুদের চেয়ে তোমার চিত্রকলাকে তুমি বেশি ভালোবাসা একটা সবুজ ব্রোঞ্জের মূর্তি ছাড়া তোমার কাছে আমি আর কিছু নই। মনে হয় ততটুকুও নয়।

চিত্রকর অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডোরিয়েন তো ঠিক এইভাবে কথা বলেন না? ওঁর হল কী? মনে হচ্ছে যেন বেশ চটেছেন তিনি। তাঁর মুখ আর গাল দুটি লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।

ডোরিয়েন বলে গেলেন, হ্যাঁ, তোমার হাতির দাঁতের ‘হারমিস’ অথবা রুপোর ফন যা, আমার দাম তোমার কাছে তার চেয়েও কম। তুমি তাদের সব সময়েই পছন্দ করবে। কিন্তু আমকে তোমার কতদিন ভালো লাগবে? যতদিন পর্যন্ত আমার মুখে প্রথম কুঞ্চন না দেখা। দেয়। তাই না? এখন আমি বুঝতে পারছি, দেহের সৌন্দর্য, তার দাম যাই হোক, নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার সব কিছু হারিয়ে ফেলে, তোমার ছবি আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। লর্ড হেনরি খাঁটি কথা বলেছেন। পরম-পাওয়া বলে যদি মানুষের কিছু থাকে তা হল একমাত্র ওই যৌবন। যখনি আমার মনে হবে আমি বুড়ো হচ্ছি তখন আমি আত্মহত্যা করব।

হলওয়ার্ডের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলা ডোরিয়েনের একটা হাত ধরে তিনি বললেন, ডোরিয়েন, ডোরিয়েন! ওকথা বলো না। তোমা মতো বন্ধু আমার নেই, আর হবেও না। এইসব জিনিসগুলোকে নিশ্চয় তুমি হিংসে কর না। কর কি? এইসব জিনিসের চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।

পৃথিবীতে যাদের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না তাদের সকলেরই আমি হিংসে করি। আমার যে চিত্রটি তুমি এঁকে সেটিকেও হিংসা করি আমি। আমি যা হারাব তা এ ধরে রাখবে কেন? চলমান প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছ থেকে কিছু-না সরিয়ে নিচ্ছে, তার পরিবর্তে কিছু দিচ্ছে। হায়রে, এর উল্টোটা যদি হত! যদি চিত্রটারই পরিবর্তন ঘটত, আমি এখন যা রয়েছি তাই যদি আমি চিরকাল থাকতাম! তুমি এ-ছবি কেন আঁকলে? একদিন না একদিন এ আমাকে বিদ্রুপ করবে, মর্মান্তিকভাবে বিদ্রুপ করবে।

 উষ্ণ অশ্রু তাঁর চোখের ওপরে ছলছল করে উঠল। তিনি তাঁর হাতটাকে ছিনিয়ে নিলেন। তারপর ডিভানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন, মনে হল তিনি যেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছেন।

চিত্রকর তিক্তভাবে বললেন, এর জন্যে হ্যারি তুমি দায়ী।

লর্ড হেনরি চিত্রকরের তিরস্কারকে গ্রাহ্য না করে কাঁধে একা শ্রাগ করে বললেন, এ-ই হচ্ছে আসল ডোরিয়েন গ্রে-অন্য কিছু নয়।

না, এ তা নয়।

এ যদি তা-ই না হয়, তাহলে একে নিয়ে আমি কি করব?

 চিত্রকর বিড়বিড় করে বললেন, তোমাকে যখন চলে যেতে বলেছিলেন তখনি তোমার চলে যাওয়া উচিত ছিল হ্যারি।

লর্ড হেনরি বললেন, তুমি থাকতে বললে বলেই তো থাকলাম।

হ্যারি, একই সঙ্গে আমার দুটি প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আমি ঝগড়া করে থাকতে পারব না। কিন্তু আমার জীবনের যেটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তোমরা দুজনে সেটিকে ঘৃণা করতে আমাকে বাধ্য করছ আমি এটাকে নষ্ট করে ফেলব। এটা ক্যানভাস আর রঙ ছাড়া আর কী! আমাদের তিনটা ভীবলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি আর কী! আমাদের তিনটি জীবনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি একে দেব না।

এই বলে হলওয়ার্ড ভারী পর্দা দেওয়া জানালার নীচে বসানো ছবি আঁকার টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে বালিশের ওপর থেকে মাথাটা তুলে বিবর্ণ মুখে আর অশ্রুসিক্ত লোচনে তাঁর দিকে তাকালেন। হলওয়ার্ড ওখানে কী করছেন? টিনের টিউব আর শুকনো ব্রাশের জঙ্গলে তিনি কি যেন হাতড়ে বেড়াতে লাগলেন। হ্যাঁ, তিনি লম্বা পাতলা ব্লেডের স্টিলের ছুরিটা খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিনিসটা খুঁজে পেলেন তিনি, তারপরেই প্রতিকৃতিটা এফোঁড়-ওফোঁড় করার জন্য তিনি তৈরি হলেন।

একটা চাপা আর্তনাদ করে ছেলেটি সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলেন, এবং দৌড়ে গিয়ে। হলওয়ার্ড-এর হাত থেকে ছুরিটা ছিনিয়ে নিলেন। ছুরিটাকে স্টুডিওর একধারে ছুঁড়ে ফেলে তিনি বললেন, বেসিল, ও কারো না, কো না। ওটা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

ডোরিয়েনের ক্রিয়াকলাপে চিত্রকর কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। সেই বিস্ময় কাটার পরে তিনি একটু উদাসীনভাবেই বললেন, ডোরিয়েন তুমি যে শেষ পর্যন্ত আমার তৈরি প্রতিকৃতির মূল্য বুঝতে পেরেছে তা বুঝতে পেরে আমি খুশি হয়েছি। আমি ভাবতে পারিনি যে তুমি তা পারবে।

মূল্য বোঝার কথা বলছ? আমি এর প্রেমে পড়ে গিয়েছি, বেসিল। ওটা আমার অচ্ছেদ্য অংশ। এটা আমার মুখের নয়, মনের কথা।

ঠিক আছে তোমার ছবিটা শুকিয়ে গেলেই তাকে বার্নিশ করা হবে, বাঁধানো হবে ফ্রেম দিয়ে। তারপর তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন তোমার প্রতিকৃতিটা নিয়ে তোমার যা খুশি তা-ই করতে পারা।

এই কথা বলে তিনি ঘরের একপ্রান্তে এসে চা আনার জন্য বেল বাজালেন, ডোরিয়েন, নিশ্চয় তুমি চা খাবে? হ্যারি, তুমিও? অথবা এই সাধারণ আনন্দে তোমাদের কোনো আপত্তি রয়েচ্ছে।

লর্ড হেনরি বললেন, সাধারণ আনন্দকে আমি পুজো করি। জটিলতার শেষ আশ্রয় তারাই। কিন্তু একমাত্র স্টেডের ওপরে ছাড়া আমি হইচই পছন্দ করি না। তোমরা দুজনেই কি অদ্ভুত জীব বল তো? আমি ভেবে আশ্চর্য হই কে মানুষকে সামাজিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী বলে চিহ্নিত করেছেন। যত অপরিপক্ক ব্যাখ্যা রয়েছে এটি হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অর্বাচীন। মানুষ অনেক কিছু সন্দেহ নেই, কিন্তু সে আদৌ বিচারবুদ্ধিসম্মপন্ন নয়। সব দিক দিয়ে। ভাবতে গেলে সে যে মোটের ওপরে তা নয় এতে আমি খুশিই হয়েছি। যদিও আমি মনে করি একটা ছবি নিয়ে তোমাদের মতো ছোকরাদের এতটা কচকচি করা উচিত হয়নি। বেসিল, এত গোলমালে কাজ নেই। ওটা বরং আমাকে দিয়ে দাও। এই মূর্খ বালক সত্যি সত্যিই ওটা চায় না। আমি চাই।

ডোরিয়েন গ্রে চিৎকার করে উঠলেন, আমাকে না দিয়ে ও-ছবি যদি তুমি আর কাউকে তাহলে আমি তোমাকে কোনোদিনই ক্ষমা করব না, বেসিল এবং অন্য লোকে আমাকে বোকা বলবে তা-ও আমি সহ্য করব না।

ডোরিয়েন, তুমি জান এ ছবি তোমার। আঁকার আগেই এটা আমি তোমাকে দান করেছি।

এবং আপনি যে কিছুটা বোকার মতো কাজ করেছেন তা আপনি জানেন, মিঃ গ্রে। আপনাকে নিশ্চয় স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না যে আপনার বয়সটা খুব কাঁচা।

লর্ড হেনরি, আজ সকালেই আমার ভীষণ আপত্তি জানানো উচিত ছিল।

হ্যাঁ, আজকে সকাল! তখন থেকেই আপনি বেঁচে আছেন।

দরজায় একটি টোকা পড়ল, বাটলার একটা পেতলের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপরে সেটিকে একটি ছোটো জাপানি টেবিলের ওপরে রেখে দিল। চায়ের কাপ আর সসারের টুঙ-টাঙ আওয়াজ হল, একটি চাকর বয়ে নিয়ে এল দুটি গোলাকার চায়না ডিশ। ওই দুজনে অবসন্নভাবে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ঢাকনির তলায কী রয়েছে।

লর্ড হেনরি বললেন, আজকে রাত্রিতে আমরা সবাই থিয়েটারে যাই চল। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় কিছু-না-কিছু হচ্ছে। হোয়ইট-এ আভা আমার ডিনার খাওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছে আমারই এক বৃদ্ধ বন্ধু। তাঁকে আমি একটা টেলিগ্রাম করে দেব, বলব শারীরিক অসুস্থতার জন্যে যেতে পারলাম না। অথবা হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ায় যেতে পারলাম না। সেকথাও বলতে পারি। আমার ধারণা অজুহাত হিসাবে ওটা বেশ জুৎসই হবে। অকপটতার মধ্যে যত বিস্ময রয়েছে এটা হবে তাদের মধ্যে আর এক বিস্ময়।

হলওয়ার্ড বিড়-বিড় করলেন, এটা হচ্ছে নিজের পোশাক পরার মতো একঘেয়ে। পরার পরেই মনে হয় সেগুলি কত বিতিকিচ্ছিরি।

লর্ড হেনরি স্বপ্নিল চোখে বললেন, ঠিক কথা। উনবিংশ শতাব্দীর পোশাকই হচ্ছে জঘন্য এটা যেমন জাঁকালো তেমনি হতাশাব্যঞ্জক। আধুনিক জীবনে পাপই হচ্ছে একমাত্র রঙিন।

হ্যারি, ডোরিয়েনের কাছে ওই সব কথা বলা তোমার নিশ্চয় উচিত হচ্ছে না।

কোন ডোরিয়েনের কথা তুমি বলছ? যিনি এখন আমাদের জন্যে চা করছেন, তিনি? না, ওই ছবির ডোরিয়েন?

দুজনের কাছেই।

ডোরিয়েন বললেন, লর্ড হেনরি, আমি আজ আপনার সঙ্গে থিয়েটারে যাচ্ছি।

তাহলে আপনি আসুন। বেসিল, তুমিও নিশ্চয় আসছ। না কি?

না, সত্যিই যেতে পারব না। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমার।

 মিঃ গ্রে, এই পরিস্থিতিতে আমরা একাই যাব।

খুব খুশি হব আমি।

ঠোঁট কামড়ালেন চিত্রকর। তারপরে একটি কাপ হাতে নিয়ে তিনি ছবিটির দিকে এগিয়ে গেলেন। বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, আমি আসল ডোরিয়েলের সঙ্গেই থাকব।

জীবন্ত ছবিটি তাঁর কাচ্ছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই কি তোমার আসল ডোরিয়েন? আমি কি সত্যিই ওই রকম দেখতে?

হ্যাঁ, তুমি তাই।

কী চমৎকার, কী চমৎকার বেসিল!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলওয়ার্ড বললেন, অন্তত বাইরে থেকে দেখতে। তবে এটার কোনো পরিবর্তন হবে না। তারও দাম যথেষ্ট।

লর্ড হেনরি চেঁচিয়েই বললেন, আনুগত্য নিয়ে মানুষ কেন যে এত হইচই করে বুঝি না। এমনকি প্রেমের ব্যাপারেও জিনিসটা শারীরবৃত্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। যুবকরা বিশ্বাসী হতে চায়, কিন্তু তারা বিশ্বাসী নয়। বৃদ্ধেরা অবিশ্বাসী হতে চান, কি হতে পারেন না। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমাদের।

হলওয়ার্ড বললেন, তুমি আজ থিয়েটারে যোযো না ডোরিযেত। এখানে রয়ে যাও। রাত্রিতে আমরা একসঙ্গে ডিনার খাব।

না, বেসিল।

কেন?

কারণ লর্ড হেনরির কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য ওর কাছে তোমার দাম বাড়বে না। নিজের প্রতিজ্ঞাই ও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আমি অনুরোধ করছি তুমি যেয়ো না।

হেসে মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন।

আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।

 ডোরিয়েন ইতস্তত করতে লাগলেন। চায়ের টেবিলে বসে লর্ড হেনরি বেশ রসিকতার দৃষ্টি দিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন।

ডোরিয়েন বললেন, আমাকে যেতেই হবে বেসিল।

হলওয়ার্ড বললেন, ঠিক আছে।

তিনি ফিরে গিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে রেখে দিলেন, বললেন, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তোমাদের আবার পোশাক পালটাতে হবে। বিদায় হ্যারি। বিদায় ডোরিয়েন। তাড়াতাড়ি একদিন এস। কালকেই।

নিশ্চয়।

ভুলে যাবে না?

না, নিশ্চয় না।

আর…হ্যারি?

বলুন বেসিল।

আজকে সকালে তোমাকে কী বলেছিলাম মনে করে দেখা

আমার মনে নেই।

তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস রয়েছে।

 লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতাম! আসুন, মিঃ গ্রে, বাইরে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে। আপনাকে আমি যথাস্থানে নামিয়ে দেব। বেসিল, চললাম, আজকের বিকালটা বেশ ভালোই কাটল।

তাঁদের পেছলে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসিল সোফার ওপরে ঢলে পড়লেন। তাঁর চোখের ভেতর থেকে একটি ক্লিষ্ট বেদনার জ্যোতি বেরিয়ে এল।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরের দিন বেলা সাড়ে বারোটার সময় লর্ড হেনরি ওটোন কার্ডন স্ট্রিট থেকে বেড়াতে বেড়াতে তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অ্যালব্যানির দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর কাকা। হচ্ছেন লর্ড ফারমোর, বৃদ্ধ এবং অবিবাহিতা বাইরে থেকে কিছুটা রুক্ষ মনে হলেও, আসলে। তিনি ছিলেন মিষ্টি স্বভাবের। তাঁর সমাজের বাইরের লোকেরা তাঁকে স্বার্থপর বলে চিহ্নিত করত, কারণ তার কাছ তাঁরা কোনো উপকার পেত না। অথচ তাঁর নিজস্ব সমাড়ে দিলদরিযা বলে নামডাক ছিল তাঁর। কারণ যারা তাঁকে খুশি করতে পারত তাদের তিনি ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করতেন। ইসাবেলা যখন যুবতী ছিলেন সেই সময় তাঁর বাবা মাদ্রিদে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ব্যাপরটা অচিন্ত্যনীয়, কিন্তু সত্য যে প্যারিসের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের পদ না। পাওয়ায় বিরক্ত হয়ে খামাখেয়ালি করে তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন উচ্চ বংশ, আলস্য সরকারি চিঠিপত্র লেখার যোগ্যতা এবং আমোদ-প্রমোদের অযৌক্তিক সম্পৃহার দিক থেকে বিচার করলে ওই পদটির যোগ্যতম প্রার্থী ছিলেন একমাত্র তিনিই। পত্রটি ছিলেন তাঁর পিতার সেক্রেটারি। পিতার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রও চাকরিতে ইস্তফা দেন, সে সময়ে সকলেই ভেবেছিল কাজটা তাঁর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। হয়েছিল; এবং কিছুদিন পরে পিতার খেতাবের অধিকারী হয়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের যেটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কলা–সেই কিছু-না-করার চর্চার তিনি মশগুল হয়ে রইলেন। শহরে তাঁর দুটি বড়ো বাড়ি ছিল, বেশি ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি ছোটো বাড়িতে বাস করতে ভালোবাসতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন ক্লাবে। মিডল্যান্ড-এ তাঁর যে সব কয়লার খনি ছিল সেগুলি দেখাশোনা করতেন কিছুটা। পৃথিবীতে এত ডিজনিস থাকতে তিনি কলার ব্যবসাতে মেতেছেন কেন কেউ এই প্রশ্ন করলে তিনি প্রায়শই বলেন যে ওইটাই একমাত্র জিনিস যা ভদ্রলোকেরা নিজেদের বাড়িতে জ্বালানোর ভব্যতা অর্জন করেন। রাজনীতির দিক থেকে তিনি ছিলেন টোরি সম্প্রদায়ভুক্ত। যখন অবশ্য টোরিয়া সরকার গঠন করতে অসমর্থন হত, সেই সময় তিনি তাদের একদল ব্র্যাডিক্যাল বলে যথার্থই গালাগালি দিতেন। নিজের পরিচারকের কাছে তিনি ছিলেন বীরপুরুষ যদিও সেই পরিচারকটি সব সময় তাঁর কাছে তর্জন-গর্জন করত। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে রীতিমতো ভয় করত, কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁদের ধমক দিতেন। একমাত্র ইংলন্ডেই তাঁর মতো মানুষের জন্ম সম্ভব। এবং সব সময়েই তিনি অভিযোগ করতেন যে দেশটা একেবারে জাহান্নামে গিয়েছে। তাঁর সমস্ত নীতিগুলিই পুরনো যুগের, কিন্তু তাঁর যতগুলি খেয়াল অথবা বদখেয়াল রয়েছে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলা যায়।

লর্ড হেনরি ঘরে ঢুকে দেখলেন তাঁর কাকা লর্ড ফারমোর সাধারণ গোছের শিকারে-কোট গায়ে দিয়ে চুরুট খেতে খেতে টাইমস কাগজের ওপারে চোখ বুলোতে বুলোতে ঘোঁত-ঘোঁত করছেন।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি বললেন, আরে হ্যারি যে! এত সকালে? আমার ধারণা ছিল তোমাদের মতো সুখী ছোকরারা বেলা দুটোর আগে বিছানা থেকে ওঠে না। বিকাল পাঁচটার আগে টিকিট দেখা যায় না তাদের।

সত্যি বলছি কাকা, একেবারে ঘরোয়া ব্যাপার! কিছু পেতে এসেছি তোমার কাছ থেকে।

বিকৃত মুখে লর্ড ফারমোর বললেন, সম্ভবত টাকা চাই! ঠিক আছে, বসো। ব্যাপারটা কী খুলে বল আমাকে। আজকাল যুবকরা মনে করে টাকাটাই মানুষের সব।

কোটের বুকে বোতামটা লাগিয়ে লর্ড হেনরি ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক বলেছ কাকা, এবং টাকার সত্যিকার দামটা যে কী তা তারা বড়ো হলেই বুঝতে পারে। আমি কিন্তু টাকা চাইতে আসিনি। আঙ্কল জর্জ, সত্যিকার টাকার দরকার তাদেরই যাদের জিনিসপত্রের দাম মেটাতে হয়। আমি কোনদিন ক্যাশ টাকা দিয়ে জিনিস কিনি না। ছোটো ছেলের ধারটাই হচ্ছে। একমাত্র মূলধন। ওর ওপরে বেশ আরাম করে বাঁচা যায়। তাছাড়া আমি সব সময় ডার্টমুরের ব্যবসাদারদের সঙ্গে কারবার করি। ফলে টাকা-পয়সা নিয়ে কোনোদিন তারা আমাকে বিরক্ত করে না। বর্তমানে আমি এখানে এসেছি কিছু সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য। অবশ্য এমন কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ নয়, একেবারে অপ্রয়োজনীয়।

ইংলিশ ব্লু-বুক-এ যা রয়েছে তার সবটুকুই আমি তোমাকে বলতে পারি। অবশ্য আজকাল লোকগুলো যা-তা লিখে যাচ্ছে। আমি যখন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ছিলাম তখন এখানকার চেয়ে লোকে আরো অনেক ভালো লিখত। কিন্তু শুনছি ওরা আজকাল পরীক্ষা করে ওই সব চাকরিতে লোক নিচ্ছে। কী তুমি আশা কর? পরীহষ্কাটা নিছক প্রতারণা ছাড়া আর কী বল? মানুষ যদি ভদ্রলোক হয় তাহলে তার সব জিনিসই ডানা হয়ে যায়, আর যদি সে তা না হয়, তাহলে সে যতটুকু শেখে তার সবটুকুই তার ক্ষতি করে।

লর্ড হেনরি কিছুটা বিকৃত স্বরেই বললেন, তোমার ওই সব সরকারি কেতাবে মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু লেখা নেই, আঙ্কল জর্জ।

সাদা চুলে ভরা ভুরু দুটি কুঁচকিয়ে লর্ড ফারমোর জিজ্ঞাস করলেন, মিঃ ডোরিয়েন গ্রে? কে বল তো?

সেইটাই তো আমি জানতে এসেছি, আঙ্কল জর্জ। অথবা বলতেও পার আমি তা জানি, তিনি হচ্ছেন শেষ লর্ড কেলসোর নাতি। তাঁর মা ছিলেন দেবেরু, লেডি মার্গারেট দেবেরু। তাঁর আমাকে কিছু বল। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন? তিনি বিয়ে করেছিলেন কাকে? তোমার সময়কার প্রায় সকলকেই তুমি চিনতে, তাঁকেও হয়তো তুমি জানতে পার। বর্তমানে মিঃ গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু জানার কৌতূহল আমার হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে সবেমাত্র।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি লর্ড হেনরির স্বর অনুকরণ করে বললেন, কেলাসোর নাতি! কেলাসোর। নাতি! হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তার মা-কে আমি খুব ভালো করেই জানতাম। মনে হচ্ছে তার যখন খ্রিশ্চানিং হল সেই থেকেই তাকে আমি ডানি। অপরূপ সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সে ছিল সেই রকম মেয়ে–এই মার্গারেট দেবেরু। একটা কপর্দশূন্য ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেল মেয়েটা। এই দেখে সবাই তো খাপ্পা। ছোকরাটার কিছুই ছিল না, পদাতিক সেনাবাহিনীতে সামান্য বেয়ারা ছিল মাত্র, কিম্বা ওই জাতীয় সামান্য একটা চাকরি করত। নিশ্চয়। মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা। বিয়ের কয়েক মাস পরেই স্পা-তে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধে ছোকরাটা মারা যায়। এ-সম্বন্ধে একটা নোংরা কথাও অবশ্য শোনা যায়। লোকে বলে কেলসো নাকি একটা। বেলজিয়াম গুণ্ডাকে তার পেছনে লেলিয়ে দেয়। গুণ্ডাটা প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে জামাইকে অপমান করে। এর জন্যে কিছু অর্থও ঢালতে হয়েছিল তাকে। তারপরেই যা ঘটার ঘটল। লোকে যেমন ভাবে পায়রা জবাই করে সেই গুণ্ডটাও ঠিক তেমনিভাবে একদিন সেই ছোকরাকে শেষ করে ফেলল। ব্যাপারটা চেপে দেওয়া হল বটে, কিন্তু সেই থেকে বেশ কিছুদিন কেলসোর সঙ্গে বিশেষ কেউ আর মেলামেশা করত না। বেচারাকে ক্লাবে বসে একাই খাওয়া শেষ করতে হত। শুনেছি সে তার মেয়েকে আর নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিল। সেই মেয়ে কিন্তু তার বাবার সঙ্গে জীবনে আর কোনদিন কথা বলেনি। না, না, কাজটা কেলসো ভালো করেনি। মেয়েটাও মারা গেল–এক বছরের মধ্যেই। তার একটা ছেলে ছিল। তাই কি? আমার মনে নেই। কেমন দেখতে বল তো? যদি তার মায়ের মতো হয় তাহলে ছোকরাটাকে নিশ্চয় সুন্দর-ই বলতে হবে।

সায় দিলেন লর্ড হেনরি, দেখতে ছেলেটি বেশ সুন্দরই বটে।

বৃদ্ধ লোকটি বলে চললেন, আশা করি উপযুক্ত মানুষের হাতেই সে পড়বে। কেলসো যদি তার জন্যে যতটুকু করা উচিত তাই করে যায় তাহলে অনেক টাকার মালিক সে হবে। তার মায়ের ঠাকুরদার মারফৎ সেলবি-র সমস্ত সম্পত্তি তার মা পেয়েছিল। তার ঠাকুরদা। কেলসোকে ঘৃণা করতেন, তাঁর মতে কেলসো ছিল একটা ঘৃণ্য কুকুর। কথাটা মিথ্যে নয। আমি যখন মাদ্রিদে ছিলাম সেই সময় একবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সত্যি বুলছি, তাকে দেখে আমি তখন লজ্জিত হয়েছিলাম। রানি একবার আমাকে জিজ্ঞাসা। করেছিলেন, আচ্ছা, ভাড়া নিয়ে কোচোযানের সঙ্গে সব সময়ে ঝগড়া করেন ওই ইংরেজ ভদ্রলোকটি কে বলুন তো? এই নিয়ে স্থানীয় লোকেরা বেশ একটা মুখরোচক গল্পই রচনা করে বসল। তোমাকে কী বলব, মাসখানেক আমি কোর্টে মুখ দেখাতে পারিনি। আমার ধারণা নাতির সঙ্গে সে খুব একটা ভালো ব্যবহার করত না।

লর্ড হেনরি বললেন, তা আমি জানি না। আমার ধারণা, ছেলেটির যথেষ্ট অর্থ রয়েছে। তবে সে এখনো সাবালক হয়নি। সেলবি যে তাঁর আত্মীয় সেকথা আমি জানি, তিনিই আমাকে তা বলেছেন। আর…তাঁর মা খুব সুন্দরী ছিলেন, তাই না?

আমার মতে মার্গারেট দেবেরু সবচেয়ে সুন্দরী রমণী, যাকে বলে পরমা সুন্দরী। সে যে কেন। অমন কাজ করল তা আমি জানি না। কত ভালো পাত্র ছিল। তাদের যাকে খুশি তাকেই সে। বিয়ে করতে পারত। কার্লিংটন তো তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। রোমান্টিক বলতে তোমরা যা বোঝা মার্গারেট ছিল তা-ই। আর শুধু তার কথাই বা বলি কেন, ওই বংশের সব মহিলারাই ওই রকম। পুরুষ মানুষরা অতি সাধারণ, কিন্তু মেয়েরা অসাধারণ। কার্লিংটন তার কাছে নতজানু হয়ে প্রেম ভিক্ষা করেছিল, সেকথা সে আমাকে নিজেই বলেছিল। মার্গারেট তাকে বিদ্রূপ করে হাসতা বিবেচনা কর, লন্ডনে এমন কোনো যুবতী ছিল না যে কার্লিংটনকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে ছোটাছুটি না করত। আচ্ছা হ্যারি বিয়ের কথা যখন উঠলই তখন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। ডার্টমুর নাকি একটি আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? কোনো ইংরেজ যুবতীই কি তার যোগ্য নয়?

আঙ্কল জর্জ, এখন আমেরিকান বিয়ে করাই তো ফ্যাশান।

টেবিলের ওপরে ঘুষি মেরে লর্ড ফারমোর বললেন, পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের মধ্যে ইংরেজ মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ, হ্যারি। একথা আমি জোর করেই বলতে পারি।

সেদিক থেকে আমেরিকান মেয়েদেরই আমাদের দেশের ছেলেরা বেশি পছন্দ করে, একথা আমি বাজি রেখে বলতে পারি।

 তাঁর কাকা বিড়বিড় করলেন, আমি শুনেছি, আমেরিকাল মেয়েরা বেশিদিন টেকে না।

দীর্ঘদিন ধরে প্রণয়লীলা তাদের ক্লান্ত করে তোলে, কিন্তু বেড়াবাজির দৌড়ে তারা অনবদ্য। ঘোড়ার মতো সব সময়েই তারা ছুটতে ভালোবাসে। ডার্টমুর-এর কোনো আশা রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক গজগজ করে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটির আত্মীয়স্বজন কেন জান? আছে কেউ?

লর্ড হেনরি মাথা নাড়লেন, আমেরিকান মহিলারা তাদের বাপ-মায়ের পরিচয় লুকিয়ে রাখে, ঠিক যেমন ইংরেজ মহিলার লুকিয়ে রাখে তাদের অতীত জীবনের কাহিনি।

তারা শুয়োর মাংসের ব্যবসা করে, তাই না?

ডার্টমুরের দিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা সেই রকমই দাঁড়ায় বটে, আঙ্কল জর্জ, শুনেছি, আমেরিকাতে রাজলীতির পরেই যে ব্যবসাটা জমজমাট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে ওই শুয়োর মাংসের ব্যবসা।

মেয়েটি কি দেখতে ভালো? তার ধারণা সে সুন্দরী। বেশির ভাগ আমেরিকান মহিলারা নিজেদের সুন্দরী বলে মনে করে। তাদের লাবণ্যের এইটাই হচ্ছে গোপন কথা।

এই সব আমেরিকান মহিলার নিজেদের দেশে কেন থাকতে পারে না বল তো? তারা তো সব সময়েই বলে বেড়াচ্ছে যে আমেরিকা হচ্ছে স্বর্গ।

তাই বটে। লর্ড হেনরি বললেন, বিশেষ করে সেই জন্যেই ইভ-এর মতো সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল। এখন আমি চলি আঙ্কল ভর্ত। এখানে আর বেশিণ অপেক্ষা করলে লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে। আমি যে সংবাদ জানতে চাই সেইটুকু আমাকে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। নতুন বন্ধুদের সম্বন্ধে সব সময় আমি কিছু জানতে চাই। পুরনো বন্ধুদের সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই।

আজ কোথায় লাঞ্চ খাচ্ছ হ্যারি?

আনট আগাথার বাড়িতে আমি আর মিঃ গ্রে দুজনেই যাচ্ছি। তিনিই হচ্ছেন তাঁর সর্বাধুনিক অনুগৃহীত।

হুম। হ্যারি, তোমার আট আগাথাকে ডঘনিয়ে দিয়ো তিনি আর যেন চাঁদা দেওয়ার জন্যে বিরক্ত না করেন। আমি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছি। ভদ্রমহিলা মনে করেন তাঁর ওইসব বদ খেল চরিতার্থ করার জন্যে চেক কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ আমার নেই।

ঠিক আছে আঙ্কল ভক্ত, তোমার কথা আমি তাঁকে জানিয়ে দেব, কিন্তু তাতে কোনো কাভ হবে না। পরোপকারী ব্যক্তিদের মনুষ্যত্ব বলে কোনো বোধশক্তি নেই। এইটাই হচ্ছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে শব্দ করলেন, তারপরে চাকরকে ডাকার জন্যে বেল বাজালেন। নীচু খিলান পেরিযে লর্ড হেনানি বার্লিংটন স্ট্রিটে গিয়ে পড়লেন, তারপরে এগিয়ে চললেন বার্কলে স্কোয়ারের দিকে।

তাহলে ডোরিয়েন গ্রের বাবা আর মায়ের কাহিনীটা হল এই? কাহিনিটি যত অমার্জিত ভাবেই বলা হোক না কেন, একটা অদ্ভুত, যাকে বলে বলে আধুনিক রোমান্সের গন্ধে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। উন্মাদ আবেগের জন্য একটি সুন্দরী যুবতী জীবনের সবকিছু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কয়েকটি সপ্তাহের উন্মাদ আনন্দ। তারপরেই একটি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতক অপরাধ তাঁর সেই জীবনকে কেটে ছোটো করে দিল। কয়েকটি মাসের নির্বাক যন্ত্রণার পরে ৬ন্ম হল একটি ছেলের মৃত্যু ছিনিয়ে নিল মাকে, নিঃসঙ্গ শিশুটি পড়ে রইল এমন একটি মানুষের কাছে যার মনে স্নেহ ছিল না, ছিল না কোনো ভালোবাসা। হ্যাঁ, এইটিই হচ্ছে ছেলেটির জীবনের পটভূমি। এই পরিস্থিতিতেই সে মানুষ হয়েছে, সম্ভবত এইটাই যেন তাকে পূর্ণ করে তুলেছে। প্রতিটি অপরূপ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এই রকমের একটি যন্ত্রণা, একটি দাহাসামন্য একটি ফুল ফোঁটানোর জন্যেও পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়। গত রাত্রিতে ডিনার-এর সময় কী সুন্দরই না দেখাচ্ছিল তাঁকে! সন্ত্রস্ত চোখে আর ঠোঁট দুটি ফাঁক করে একটি উদ্বিগ্ন আনন্দ নিয়ে ক্লাবে ঠিক তাঁর মুখোমুখি বসে ছিলেন তিনি। বাতির লাল রঙের ঢাকনি থেকে রঙিন আলোর দ্যুতি তাঁর মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে গণ্ড দুটিকে গোলাপ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর একটি প্রথম শ্রেণির বেহালার ঝঙ্কার তোলার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। প্রতিটি কথা আর ইঙ্গিতের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন। প্রভাব বিস্তার করার মধ্যে একটি চরম দাসত্বের গন্ধ রয়েছে। আর কোনো কাজই বোধ হয় ঠিক এরকমাটি নয। এইভাবে নিজের আত্মাটিকে অপর একটি শরীরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে দাও। একটু অপেক্ষা কর, তারপরে কান পেতে শোন। যৌবনের আবেগে ঝক্ত হয়ে তোমারই চিন্তাধারা নতুনভাবে রূপায়িত হবে, নতুন তার ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা নতুন। নিজের চিন্তাধারা আর একজনের ভাবরসে সিঞ্চিত হয়ে প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে সুখকর বস্তু আর নেই। মনে হবে একটি অতীন্দ্রিয় সুবাসের জারক রসে সঙ্গীরিত হয়ে মধুর মোত তা একটু একটু করে ঝরে পড়ছে। আমাদের এই সীমিত, অশালীন যুগে, আত্মসর্বস্ব এবং দেহ আনন্দে যখন আমরা সবাই মতোয়ারা, সেই সময় এই রকম একটি অনুভূতি যে নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিই বড়ো অদ্ভুত এই ছেলেটি। বেসিল-এর স্টুডিওতে তার সঙ্গে লর্ড হেনরির নেহাৎ আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যের মতো তার গঠন, তার লালিত্যা বিশ্বে এমন কিছু নেই যা তাকে দিয়ে করানো যায় না। তাকে দিয়ে মহীরুহ সৃষ্টি করা যায় অথবা খেলার পুতুলের মতোও ব্যবহার করা যায় তাকে। এই সৌন্দর্য বিবর্ণ হয়ে যাবে–এটা কী দুঃখের কথা!

আর বেসিল! মনস্তত্ত্বের দিকে থেকে আর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করা কত কৌতুককর। আর্টের নতুন আঙ্গিকস, জীবনকে দেখার নতুন রীতি তিনি কী সুন্দরভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন। অথচ যার প্রতিকৃতির মধ্যে দিয়ে তিনি এই পরীক্ষা করলেন সে তা জানতেও পারল না। যে নির্বাক আত্মা এতদিন কুয়াশাচ্ছন্ন বনপ্রদেশে ঘুমিয়েছিল এবং উন্মুক্ত প্রান্তরে অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই আত্মাটি যেন হঠাৎ বন্য-অন্সরীর মতো নিজেকে প্রকাশ করে দিল। এই আত্মাটিকে প্রকাশ করার জন্যে তিনি কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেননি। কারণ তিনি জানতেন এরই মাধ্যমে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভব, সেই আত্মার দ্যুতিতে পৃথিবীর যা কিছু সাধারণ তাই অসাধরণত্ব লাভ করে। অসাধারণত্ব লাভ করে সত্যিকার বাস্তবে রূপায়িত হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি-কী অপরূপ সৃজন দক্ষতা!

ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্তের কথা কোথায় যেন তিনি পড়েছিলেন। চিন্তাকুশলী প্লেটোই কি এই দহষ্কতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি? কিন্তু আমাদের দেশে এর নজির নেই। চিত্রকর বেসিল-এর কাছে নিজের অজ্ঞাতসারেই ডোরিয়েন গ্রে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ঠিক সেইভাবেই হেনরি তাকে প্রতিফলিত করবেন। তিনি তার ওপরে নিজের প্রভাব বিস্তার। করবেন, সম্পূর্ণভাবে অধিকার করবেন তার চিন্তার জগৎ। অর্ধেকটা তার প্রায় অধিকার করেই ফেলেছেন। সেই অনবদ্য আত্মাটিকে তিনি তাঁর নিজস্ব করে নেবেন। ভগবানের এই অদ্ভুত সন্তানটির মধ্যে রয়েছে একটি দুর্নিবার আকর্ষণ।

 হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, চারপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি তাঁর কাকিমার বাড়ি অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছেন, একটু হেসে তিনি ফিরলেন। কাকিমার থমথমে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই বাটলার তাঁকে জানালেন যে সবাই লাঞ্চের ঘরে রয়েছেন। একটি চারককে তাঁর টুপি আর ছডিটা দিয়ে তিনি ডাইনিং ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

তাঁর দিকে মাথা নেড়ে আনট বললেন, হ্যারি, আজ-ও তোমার দেরি হয়েছে–স্বভাব যাবে কোথায়?

হেনরি একটা জুতসই কৈফিয়ৎ দিয়ে তাঁর পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় বসলেন, চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কে কে এসেছেন। টেবিলের একপ্রান্ত থেকে ডোরিয়েন তাঁর দিকে লজ্জিত ভাবে একবার তাকালেন। হ্যাঁ গালের ওপরে আনন্দের একটা মৃদু রেখা ফুটে উঠল। বিপরীত দিকে বসেছেন হার্লের ডাচেস পরিচিত মহলে ভদ্র বলে তাঁর পরিচিতি রয়েছে, এবং তাঁর শরীরের গঠন দেখে সমসাময়িক ইতিহাসকাররা ডাচেস নয় এই রকম সব মহিলাদের শক্ত-সমর্থ বলে রায় দেন। তাঁর পাশে, ডান দিকে বসেছেন স্যার টমাস বার্ডন। ইনি পার্লামন্টের ব্যাডিক্যাল সদস্য। বাইরের জগতে ইনি এঁর দলীয় নেতাকে অনুসরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করেন পাকা রাঁধুনিদের চরিত্রের দিক থেকে বিজ্ঞ মানুষ এবং বহুল প্রচারিত বিভ্র নীতির মতোই তিনি খানাপিনা করতেন টোরিদের সঙ্গে, চিন্তা করতেন। লিবারেলদের মতো। তাঁর বাঁদিকের চেযাটিতে বসেছেন ট্রেডলির মিঃ এর্কস্কিন, সুন্দর। চেহারার সংস্কৃতিবান একটি বৃদ্ধ। চুপচাপ বসে আছেন তিনি, চুপচাপ থাকার কারণটা লেডি আগাথাকে তিনি একবার বলেছিলেন। কারণটি হচ্ছে তাঁর বলার আর কিছু নেই, যা বলার ছিল তা তিরিশ বছরের মধ্যেই তিনি বলে শেষ করে ফেলেছেন। হেনরির নিজের পাশে। বসেছিলেন মিসেলস ভ্যানডেলার, ভদ্রমহিলা তাঁর আনট-এর একজন পুরনো বন্ধু, মানুষ হিসাবে একেবারে খাঁটি সোনা। কিন্তু পোশাক-আশাকে এবং চেহারায় একেবারে নিকৃষ্ট। তাঁকে দেখে রদ্দি বাঁধাই একটি প্রার্থনার বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপাল ভালো যে সেই সময় লেডি আগাথা লর্ড ফডেল-এর সঙ্গে তখন তন্ময় হয়ে কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক মধ্যবয়শী, বুদ্ধির দিক থেকে মাঝামাঝি হাউস-অফ-কমনস-এ মন্ত্রীর ঘোষণার মতো যাঁর মাথাটা ছিল টোটো। একটা তন্ময় হয়ে দুজনে কথা বলছিলেন যেটা তাঁর মতে একটি বিশেষ ত্রুটি। প্রতিটি সৎ মানুষটা এই ত্রুটির শিকার এবং এর হাত থেকে মুখ কম মানুষই নিস্তার পেয়েছে।

টেবিলের পাশ থেকে তেরচাভাবে তাকিয়ে মিষ্টি সুরে ডাচেস তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, আমরা বেচারা ডার্টমুরের সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, হেনরি। তোমার কি মনে হয় ডার্টমুরর এই কুহকিনী যুবতীটিকে সত্যিই বিয়ে করবে?

আমার বিশ্বাস, মেয়েটি ডার্টমুরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে মনস্থির করে ফেলেছে, ডাচেস।

চিৎকার করে উঠলেন লেডি অগাথা, কী ভয়ঙ্কর! সত্যি বলছি, এ ব্যাপারে কারো না কারো প্রতিবাদ করা উচিত।

স্যার টমাস বার্ডান উদ্ধতভাবে বললেন, আমি খুব ভালো জায়গা থেকে শুনেছি, মেয়েটির বারার শুকনো খাবারের দোকান রয়েছে।

স্যার টমাস, আমার কাকা বলেছেন দোকানটা শুয়োরের মাংস প্যাক করার।

শুকনো খাবার! আমেরিকান শুকনো জিনিস বলতে কী বোঝাতে চাও তোমারা! বেশ উত্তেজিত ভাবে অবাক হয়েই ডাচেস তাঁর বড়ো বড়ো হাত দুটি তুলে প্রশ্ন করলেন।

কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমেরিকান নভেল।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাচেস।

লেডি আঘাথা ফিস ফিস করে বললেন, ওর কথা তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না। ও একবিন্দু সত্যি কথা বলে না।

র‍্যাডাক্যাল সদস্যটি বললেন, যখন আমেরিকান আবিষ্কার করা হল….।

এইটুকু বলার পরেই তিনি কিছু ক্লান্তিকর একঘেয়ে ঘটনার পরিবেশন করতে লাগলেন। এবং যে-সব কথকরা ঘটনার বিশদ বর্ণানায় ক্লান্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে তিনিও তাদের মতো তাঁর শ্রোতাদের ক্লান্ত করে তুললেন। ডাচেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাধা দিয়ে বললেন, আমেরিকাকে যদি কেউ কোনো দিন আবিষ্কার না করত তাহলে কত ভালো হল। সত্যি বলছি, আমাদের মেয়েদের আর হিল্লে হবে না। এটা খুব অন্যায়।

মিঃ আরস্কিন বললেন, সম্ভবত আমেরিকা আদৌ আবিষ্কৃত হয়নি। আমার কথা যদি ধরেন তাহলে আমি বলতে পারি যে আমেরিকাকে আমরা সবেমাত্র দেখতে পেয়েছি।

ডাচেস সাধারণভাবে বললেন, তাই বুঝি? আমি কিন্তু আমেরিকার অধিবাসীদের কিছু কিছু দেখেছি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে তারা সত্যিই খুব সুন্দর। তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদও বেশ ভালো। প্যারিস থেকেই তারা তাদের পোশাক তৈরি করায়। আমি যদি তা পারতাম!

স্যারা টমাস রসিকতা করে বললেন, এবং পুরনো পরিত্যক্ত রসিকতার বাণীতে তাঁর বিরাট আলমারি একবাসে ঠাসা। লোকে বলে, সৎ আমেরিকানরা মরার পর প্যারিসে যায়।

ডাচেস প্রশ্ন করলেন, বলেন কী? তাহলে মরার সময় খারাপ আমেরিকানরা কোথায় যায়?

লর্ড হেনরি আস্তে আস্তে বললেন, আমেরিকায়।

স্যার টমাস ভ্রূকুটি করলেন, লেডি আগাথাকে বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে আপনার ভাইপোর মনে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে। সমস্ত দেশটা আমি গাড়িতে করে ঘুরেছি। অবশ্য ডায়রেকটাররাই সেই গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে ওরা বেশ ভদ্র। আমি আপনাদের নির্ভয়ে বলতে পারি যে আমেরিকাতে শেখার জিনিস অনেক রয়েছে।

মিঃ আরস্কিন করুণাভাবে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কিছু শেখার জন্যে আমাদের শিকাগোতে কি যেতেই হবে? আমার তো মনে হয় তার জন্যে যাওয়ার ঝক্কি পোষাবে না।

স্যার টমাস হাত নেড়ে বললেন, ট্রেডলির মিঃ আরস্কিনের ঘরে সারা পৃথিবী ঢোকানো রয়েছে। বাস্তববাদী আমাদের মতো মানুষ নিজেদের চোখে সব কিছু দেখতে চায়, বই পড়ে তাদের আশা মেটে না। আমেরিকানরা সত্যিকারের হৃদয়গ্রাহী মানুষ। তাদের কাজ অথবা কথার মধ্যে যুক্তিহীনতার স্থান নেই। আমার মতে ওইটিই তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ, মিঃ আরস্কিন, সত্যিকারের যুক্তিবাদী ওরা। আমি আপনাদের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বাজে কথা অথবা বাজে কাজের ধার দিয়ে তারা হাঁটে না।

লর্ড হেনরি বললেন, কী বিপদ, কী বিপদ! পাশবিক শক্তি আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু কঠোর যুক্তিবাদ আমার অসহ্য। এই যুক্তি ব্যবহার করার বিপক্ষে কিছু বলার নেই। কিন্তু যুক্তির রাজত্বে ওইটাই হচ্ছে নাভির তলায় আঘাত করার মতো অযৌক্তিক।

 চটে লাল হয়ে স্যার টমাস বললেন, আপনার বক্তব্যটা আমার মাথায় ঢুকছে না।

 মিঃ আরস্কিন হেসে বললেন, আমার মাথায় ঢুকছে, লর্ড হেনরি। ব্যারনেট যোগ দিলেন, প্যারাজকস্ অর্থাৎ কূটাভাস হিসাবে কথাটা একরকম সত্যি…

মিঃ আরস্কিন বললেন, কূটাভাস! ওঁর কথার মধ্যে কূটের আভাসটা কোথায় দেখলেন? আমার তা মনে হয়নি। হয়তো আপনার কথাই সত্যি। সত্যের রীতিটাই হচ্ছে কুটা সত্যকে যাচাই করতে গেলে আমাদের সরু শক্ত দডির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। সেই দডির ওপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হেঁটে চলার নির্ভরতা অর্জন করতে পারলেই তবে আমরা সত্য উপলব্ধি করতে পারব।

লেডি আগাথা বললেন, হায় ভগবান, পুরুষরা কীরকম তর্ক করে দেখ! সত্যি বলছি, তোমরা কী সব তর্ক করছ তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। আর হ্যারি, তোমার ওপরে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের প্রিয় ডোরিয়েন গ্রেকে ইস্ট এন্ড ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তুমি তাঁকে তাতাচ্ছে কেন? আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি এখানে তাঁর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে মূল্যবান। এখানের সবাই তাঁর পিয়ানো বাজানো শুনেতে ভালোবাসে।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি চাই তাঁর বাজনা আমি শুনবো।

এই বলেই তিনি টেবিলের দিকে তাকালেন, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্মতিনেক দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হল তাঁর।

লেডি আগাথা বললেন, কিন্তু হোয়াইট চ্যাপেলের সবাই বড়ো কষ্ট পাচ্ছে।

লর্ড হেনরি কাঁধে ত্যাগ করে বললেন, দুঃখ ছাড়া সব জিনিসের ওপরেই আমার সহানুভূতি রয়েছে। ওই দুঃখবোধের ওপরে আমার কোনো সহানুভূতি নেই। কেউ যন্ত্রণা পেলে আভকাল মানুষরা তাকে সহানুভূতি জানায়। এটাই হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর রকমের মানসিক ব্যাধি। মানুষের উচিত রঙ, সৌন্দর্য আর আনন্দের সঙ্গে সহানুভূতি জানানো। জীবনের দুঃখ সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভালো।

স্যার টমাস গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, তবু জরুরি সমস্যাটা হচ্ছে ইস্ট এন্ড।

লর্ড হেনরি বললেন, ঠিক কথা। এ সমস্যা হচ্ছে দাসত্বের। ক্রীতদাসদের মনে ফুর্তি জাগিয়ে আমরা সেই সমস্যার সমাধান করতে চাই।

রাজনীতিবিদটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আপনি কী করতে চান?

লর্ড হেনরি হাসলেন, এক আবহাওয়া ছাড়া ইংলন্ডে আর কিছুই আমি পরিবর্তন করতে চাই না। দার্শনিক চিন্তা করেই আমি খুশি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে মানুষ সহানুভূতি খরচ করে করে একেবারে দেউলে হয়ে গিয়েছে, আমি তাই বিজ্ঞানের কাছে আবেদন রাখছি সে যেন মানুষকে ঠিক পথে চালিত করে। উচ্ছ্বাস-আবেগের সুবিধে হচ্ছে এ মানুষকে বিপদে পরলিচালিত করে, আর বিজ্ঞানের সুবিধে হচ্ছে তার কাছে উচ্ছ্বাসের কোনো দাম নেই।

 মিসেস ভ্যানডেলর ভয়ে ভয়ে বলেন, কিন্তু আমাদের দায়িত্বও বড়ো কমন নয়।

লেডি আগাথা সমর্থন করলেন তাঁর কথা: গুরু দায়িত্ব।

লর্ড হেনরি মিঃ আরস্কিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষ নিজের অত্যন্ত সিরিয়াস জীব বলে মনে মনে করে। এইটি হচ্ছে পৃথিবীর আদি পাপা গুহাবাসী মানুষ যদি হাসতে জানত তাহলে মানুষের ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হত।

ডাচেস মিষ্টি সুরে বললেন, তোমার কথায় সান্ত্বনা পেলাম। তোমর আট-এর সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় আমি নিজেকে অপরাধিনী মনে করতাম, কারণ ইস্ট এন্ডের ওপরে আমার কোনো মোহ ছিল না। ভবিষ্যতে কোনো রকম লজ্জিত না হয়েই আমি তাঁর মুখের দিকে চাইতে পারব।

লর্ড হেনরি বললেন, একটুখানি লজ্জা ভালোই দেখাবে, ডাচেস।

 তিনি উত্তর দিলেন, সে কথা ঠিক, তবে ও জিনিসটা যৌবনেই ভালো মানায। আমার মতো বৃদ্ধার গাল যখন লজ্জায় লাল হয়ে যায় তখন দেখবে কুৎসিতই লাগে। হায়, লর্ড হেনরি, কী করে আবার যৌবন ফিরিয়ে পাওয়া যায় তা যদি আপনি আমাকে বলতে পারতেন!

একটু চিন্তা করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা ডাচেস, পূর্ব জীবনে আপনি কোনো দিন খুব বড়ো ধরনের ভুল করেছিলেন?

ডাচেস বললেন, একটা নয়, অনেক।

লর্ড হেনরি বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন, তাহলে সেই ভুলগুলি আবার করুন। যৌবন ফিরে পেতে প্রথম জীবনের সব ভুলগুলি আবার আবার আপনাকে করতে হবে।

চিৎকার করে উঠলেন ডাচেস, চমৎকার নীতি! ওই নীতিটাকে আবার আমাকে খাটাতে হবে।

স্যার টমাসের পাথর-চাপা ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কথাটা, অতি বিপজ্জনক নীতি!

লেডি আগাথা ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু তিনিও খুশি না হয়ে পারলেন না। মিঃ আরস্কিন শুনলেন কথাগুলি।

লর্ড হেনরি তাঁর পূর্ব কথার ডেজর টানলেন, হ্যাঁ, জীবনের গোপন রহস্যগুলির মধ্যে এ হচ্ছে একটি। আজকাল একটি নিঃশব্দ সঞ্চারী সাধারণ জ্ঞানের কবলে পড়ে অধিকাংশ মানুষই মারা যায়, তারা অনেক দেরিতে আবিষ্কার করে যে মানুষ যেগুলির জন্যে অনুতাপ করে না। সেগুলি হচ্ছে তাদের ভুল।

সারা টেবিল জুড়ে হাসির বন্যা বয়ে গেল।

কথাটা নিয়ে খেলতে লাগলেন তিনি, ইচ্ছে করেই লোফালুফি করতে লাগলেন। একটি অর্থহীন চিন্তাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন নানাভাবে-কল্পনার রঙে তুলতেন রাঙিয়ে, উড়িয়ে দিলেন আপাতবিরোধী সত্যের ডানায়। তাঁর আবেগের উচ্ছ্বাসে মূর্খতার স্তুতি দার্শনিক তত্ত্বে রুপান্তরিত হল। তারুণ্যের উন্মাদনায় সেই দর্শন জীবনের চড়াই-এর ওপরে মনের আনন্দে নৃত্য করতে লাগল। জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলি তার সামনে থেকে অরণ্যের পশুর মতো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লাগল পালাতে মনে হল যেন একটা অদ্ভুত অপরিকল্পিত কবিতা স্বতঃ উৎসারিত হয়ে তার মুখের মধ্যে থেকে ঝরে পড়ছে। তাঁর মনে হল ডোরিয়েন গ্রে-র চোখ তাঁর দিকে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সমবেত শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে এমন একডনি রয়েছেন যাঁকে তিনি মুগ্ধ করতে চান, এই সজাগ অনুভূতির ফলে তাঁর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কল্পনা হয়ে উঠল রঙিন। অপরিসীম চাতুরির মায়াজাল বিস্তার করে তিনি সবাইকে আপহষ্ক সমর্থনে বিভ্রান্ত করে দিলেন। এবং তাঁরাও সকলে হাসতে হাসতে তাঁকে সমর্থন জানালেন। ডোরিয়েন গ্রে একদৃষ্টি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন, যতক্ষণ লর্ড হেনরি কথা বলছিলেন ততক্ষণ তিনি চোখ দুটি অন্য পাশে সরাতে পারেননি। মনে হল একটি সম্মোহন মন্ত্র এসে তাঁকে একবারে গ্রাস করে ফেলেছে, অভিভুত করেছে তাঁকে। মাঝে মাঝে দুজনের স্মিত হাসি দুজনকেই অভিবাদন জানাতে লাগল। এবং ডোরিয়েনের কালো চোখের তারা দুটি একটি গভীর আবেদনা মুহ্যমান হয়ে পড়ল।

অবশেষে বাস্তব জগতে ফিরে এল সবাই। যুগের উপযোগী পোশাক পরে একটি চাকর ঘরে ঢুকে ডাচেসকে সবিনয়ে জানাল যে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর গাড়িটি দরজার সামলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সুব্ধ হয়েছেন এই রকম ভান করে নিজের হাত দুটো। মুচড়ে বললেন, কী জ্বালা! আমাকে এবার যেতেই হবে। ক্লাব থেকে আমার স্বামীকে তুলে নিতে হবে। উইলিস রুমস-এর ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ মিটিং-এ যোগ দিতে যাবেন তিনি। একটু দেরি হলেই তিনি রেগে বোম হয়ে যাবেন। আমি তাঁর সঙ্গে রাগারাগি বা হইচই করতে চাইনি। শক্ত কথা বললে তাঁর মাথাটা বিগড়ে যাবো না, না, আর আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। ডিযার আগাথা বিদায়, লর্ড হেনরি, তোমার কথা শুনে খুব আনন্দ হল আমারা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতির একটি ডিপো তুমি তোমার মতবাদের বিরুদ্ধে যে কী বলব তা আমিই জানি না। একদিন রাত্রিতে আমাদের সঙ্গে ডিনার খেতে এস, আগামী মঙ্গলবার, ওই দিন কি ডিনার খাওয়ার জন্যে কাউকে কথা দিয়েছে?

ঘাড়টা কিঞ্চিৎ নত করে লর্ড হেনরি বললেন, আপনার জন্যে ডাচেস সকলকে আমি সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করব।

ডাচেস বললেন, সুন্দর কথা, সেই সঙ্গে অন্যায়ও। যাই হোক, আমি ধরে নিলাম তুমি আসছ, আগামী মঙ্গলবার।

এই বলেই তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন, লেডি আগাথা এবং অন্যন্য মহিলারা তাঁকে এগিয়ে দিতে পিছু পিছু গেলেন।

লর্ড হেনরি আবার বসে পড়লেন। মিঃ আরস্কিল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন, লর্ড হেনরির কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। একটা হাত তাঁর হাতের ওপরে রেখে বলেলন, আপনার কথা শুনলে আর বই পড়তে ইচ্ছে করে না। আপনি বই লেখেন না কেন? আমি বই পড়তে এত ভালোবাসি যে বই লেখার কথা ভাবার সময় পাইনে, মিঃ আরস্কিন। আমার একখানা উপন্যাস লেখার নিশ্চয় বাসানা রয়েছে। উপন্যাসটি হবে পার্শিয়ান। কার্পেটের মতো ঝলমলে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার এতটুকু সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু পড়বে কে? আজকাল ইংলন্ডের পাঠক-পাঠিকারা পড়েন কেবল খবরের কাগছে, আর এনসাইক্লোপিডিয়া। পৃথিবীর মধ্যে ইংরেজরাই বোধ হয় একমাত্র জাত সাহিত্যের সৌন্দর্য বলতে ঠিক কি বোঝায় সে-সম্বন্ধে যাদের ধারণা নেই বললেই হয়।

মিঃ আরস্কিন বললেন, আমার মনে হয় আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমারও একসময় সাহিত্যিক হওয়ার বাসানা ছিল, কিন্তু সেই বাসনাকে অনেক দিন আগেই আমি পরিত্যাগ করেছি। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, যদি অবশ্য বন্ধু বলে আপনাকে সম্বোধন করার অনুমতি দেন, একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আজকে লাঞ্চের সময় যেসব কথা আপনি বললেন, সেগুলি কি আপনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন?

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, তখন কি বলেছিলাম তা আমার মনে নেই। সত্যিই কি আমার কথাগুলো খুব খারাপ লাগছিল আপনাদের?

সত্যিই খুব খারাপা আমার বিশ্বাস আপনার সঙ্গে কথা বলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের প্রিয় ডাচেসের শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তার জন্যে আমরা আপনাকেই মূলত দায়ী করব। কিন্তু সে কথা থাকজীবন সম্বন্ধে আপনি কি বোঝেন সেই সম্বন্ধে কিছু আপনার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই। যে-যুগে আমি ভন্তোছি সে যুগটা বড়ো বিরক্তিকর। কোনোদিন যদি লন্ডনের আবহাওয়ায় আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাহলে বিনা দ্বিধায় ট্রেডলেতে চলে আসবেন। আমার স্টকে কিছু প্রথম শ্রেণির বার্গেন্ডি সুরা রয়েছে। তারই গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জীবনদর্শন বলতে আপনি কী বোঝেন তাই শোনা যাবে।

 খুব খুশি হব আমি। সেদিনের আশায় দিন গুনবো আমি। ট্রেজলের আতিথ্যই কেবল প্রথম শ্রেণীর ন্য, আমি জানি আপনার লাইব্রেরিটিও উৎকৃষ্ট।

ভদ্রভাবে এবং ভদ্রসমাজের রীতি অনুযায়ী বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি তাঁর মাথা কিঞ্চিৎ অবনত করে বললেন, আবনি তাদের পূর্ণ করবেন। এখন আপনার ওই অতিথিবৎসলা আনটা-এর কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। এখন আমার অ্যাথিনিযাম-এ যাওয়ার কথা। এইখানেই আমরা ঘণ্টাখানেক দিবানিদ্রা উপভোগ করি।

মিঃ আরস্কিন, আপনারা সবাই?

চল্লিশজন, চল্লিশটি আরাম কেদারায় চুপচাপ বসে থাকি আমরা। ‘ইংলিশ অ্যাকাডেমি অফ লেটারস’-এর সভ্য হওয়ার জন্য ওইখানেই আমাদের প্রস্তুতি চলে।

হাসলেন লর্ড হেনরি, তারপরে উঠে বললেন আমি পার্কে যাচ্ছি।

দরজার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে তাঁকে আলতো ভাবে ধরে ফিসফিস করে বললেন, আমিও যাব।

কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বেসিল হলওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে আপনার।

আপনার সঙ্গেই আমি যেতে চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। আপনি অমত করবেন না। কথা দিন সব সময় আমার সঙ্গে আপনি কথা বলবেন? আপনার মতো অত সুন্দর কথা আর কেউ বলতে পারবে না।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আজ আমি অনেক কথা বলেছি। এখন আমি আসল জীবনটা কী তাই দেখতে চাই। আপনি আমার সঙ্গে আসতে পারেন, এবং ইচ্ছে হলে আমার চোখ দিয়ে রক্তমাংসের মানুষ বলতে কী বোঝায় তা-ও পারেন দেখতে।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মাসখানেক পরের কথা। সময় অপরাহ্ন। মে ফেয়ারে লর্ড হেনরির যে বাড়ি ছিল তারই ছোটো লাইব্রেরিতে একটি মোটা গদি-আঁটা ইজিচেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন ডোরিয়েন গ্রে। বলতে গেলে ঘরটি বড়ো চমৎকার। ভেতরের খিলানগুলি ওক কাঠের তক্তা দিয়ে আঁটা, এর পীত রঙের কারুকার্য করা কার্নিশ, পলেস্তারা করা উঁচু ছাদ আর মেঝে পার্শিয়ান কার্পেটি দিয়ে মোড়া। ছোটো মাটিন কাঠের টেবিলের ওপরে ক্লডিনের তৈরি একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পাশে পড়ে রয়েছে লা সাঁৎ নোভেলার একটি কপি, ক্রোভিস ইভ ভ্যালয়-এর মার্গারেটর এটি বেঁধেছেন চারপাশে ডেইডি ফুলের রঙ দিয়ে ছোপানো, রানি এই রঙটিই বড়ো পছন্দ করতেন।

কতকগুলি বড়ো বড়ো নীল রঙের চিনা জার আর প্যারটফুলের গুচ্ছ সাজানো রয়েছে অগ্নিকুণ্ডের ওপরে কারুকাজ করা তাকে। গ্রীষ্মকালে লন্ডনে কমলালেবু রঙের আলো জানালার ভেতর দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

লর্ড হেনরি তখনো ফেরেননি। সব সময়েই তিনি দেরি করে ফিরতেন। তাঁর মতে সমযানুবর্তিত হচ্ছে সময়-অপহারক। সেই জন্য ডোরিয়েন গ্রে উদাস দৃষ্টিতে বসেছিলেন মাঝে মাঝে চিত্রবহুল ম্যানন লেকট-এর একখানি বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। ঘড়ির অবিরাম টিক টিক শব্দ একঘেয়ে সুরে একটি বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্যে দু-একবার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন।

অবশেষে দরজার বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ হল, দরজা খুলে গেল। তিনি একটু বিরক্তির সুরে বললেন, হ্যারি, কত দেরি করলে বল তো!

তারপরেই তিনি চকিতে একবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভাবছিলাম…

আপনি আমাকে আমার স্বামী বলে ভুল করেছিলেন। আমি তাঁর স্ত্রী মাত্র। আমি নিজেই আমার পরিচয় দিচ্ছি। আপনার ছবি দেখেছি, সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনি। আমার স্বামীর কাছে আপনার সতেরখানা ফটো রয়েছে।

লেডি হেনরি, সতেরখানা নয়।

তাহলে, আঠারখানা। সেদিন অপেরাতে তাঁর সঙ্গে আপনাকে আমি দেখেছি।

কথা বলতে বলতে তিনি একটু হাসলেন, সেই হাসিতে একটু ভডত ছিল, হাসতে হাসতে তাঁর সেই ভুলো-না-আমায় চোখ দুটি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদ্ভুত মহিলা এই লেডি হেনরি। তাঁর পোশাক দেখলে মনে হবে সেগুলি তাঁর মানসিক অব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে তৈরি হয়েছে পরিধানের মধ্যেও বেশ হঠকারিতার লক্ষণ বিদ্যমান। সাধারণত সব সময়েই কারো না কারো সঙ্গে তিনি প্রেমে পড়েন এবং প্রতিদিন না পাওয়ার ফলে তিনি সব সময়েই ভ্রান্তির স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকেন। নিজেকে অপরুপা করে সাজানোর জন্যে চেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁর, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। তাঁর নাম ভিকটোরিয়া, গির্জায় যাওয়াটা তাঁর একটা ঝোঁকে পরিণত হয়েছিল।

আপনি বোধ হয় লোহেন গ্রিন-এর কথা বলছেন, তাই না, লেডি হেনরি?

হ্যাঁ। আমার প্রিয় লহেন গ্রিন-এর কথাই বলছি। ওযাগনারের সঙ্গীত আমার খুব ভালো লাগে। সত্যি কথা বলতে কি অত ভালো আর কারো সুরই আমার লাগে না। এ গালের লয় এত চড়া যে নিবিবাদে কথা বলা যায়, পাশের লোক সেকথা শুনতে পায়না। চড়া গানের সুবিধে এইখানে, তাই না, মিঃ গ্রে?

সেই একই রকমের ভীরু হাসি তিনি হাসলেন, তাঁর পাতলা ঠোঁট দুটি ফাঁক হল। কচ্ছপের খোলা দিয়ে তৈরি লম্বা একটা কাগজকাটা ছুরি তিনি আঙুলের মধ্যে ধরে নাড়াতে লাগলেন।

ডোরিয়েন হেসে তাঁর মাথা নাড়লেন, লেডি হেনরি, আমার তা মনে হয় না। গানের সময় আমি কথা বলি না। বিশেষ করে গান যদি ভালো হ্য। গান খারাপ হলে শ্রোতাদের কর্তব্য হচ্ছে চেঁচিয়ে সেই গান মহৎ করে দেওয়া।

ওঃ, এটা হ্যারিরই একটি মত, তাই না মিঃ গ্রে? হ্যারির সমস্ত মত-ই আমি তার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনতে পাই। তার মত ডানার এইটিই আমার একমাত্র উপায। কিন্তু আপনি নিশ্চয়। ভাববেন না। আমি ভালো গান পছন্দ করি না। ভালো গানকে আমি খুব প্রশংসা করি। কিন্তু ভয়-ও পাই যথেষ্ট। আমাকে এ অতিমাত্রায় কল্পনাবিলাসিনী করে তোলে। আমি। পিয়ানোবাদকদের পুডো করি বলতে পারেন, কখনো কখনো দুজনকে–হ্যারি সেই কথাই আমাকে বলে। তাঁদের মধ্যে কী রয়েছে তা আমি জানি না, হয়তো তাঁরা বিদেশি বলে। ভালো পিয়ানো বাজিয়েদের সবাই বিদেশি, তাই না? এমন কি যাঁরা ইংলন্ডে জন্মনি তাঁরাও একটা সময় পরে বিদেশি হয়ে যান। তাই না? তাঁরা অতি বুদ্ধিমান, এবং ললিতকলার পল্কে সেটা বেশ গৌরবের কথা। এই ধরনের রীতি বাজিয়েদের সর্বজনীন করে তোলে। আপনার তাই মনে হয় না? মিঃ গ্রে, এই ধরনের কোনো মজলিসে আপনি কখনো গিয়েছেন? আপনার যাওয়া উচিত। ওর্কিড কেনার সামর্থ্য নেই আমার, কিন্তু বিদেশিদের জন্য কিছু খরচ করতে কার্পণ্য করি না আমি। তাঁদের উপস্থিতি ঘরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। কিন্তু হ্যারি এসে পড়েছে। হ্যারি, তোমার খোঁড়ে আমি এই ঘরে ঢুকেছিলাম, তোমার সঙ্গে কিছু দরকার ছিল আমার, কী দরকার ছিল তা আমি ভুলে গেছি তোমার পরিবর্তে মিঃ গ্রে-কে দেখলাম। সঙ্গীত সম্বন্ধে আমাদের বেশ চমৎকার আলোচনা হচ্ছিল এতক্ষণ আমাদের ধারণা প্রায় একই। না, না। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে আমাদের মতবাদ পৃথক। কিন্তু আমার সঙ্গে আলোচনা করে উনি খুব খুশি হয়েছেন। ওঁকে দেখে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।

বাঁকানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভুরু তুলে, এবং দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে লর্ড হেনরি বললেন, আমিও খুব খুশি হয়েছি, প্রিয়তমে। দেরি হল বলে আমি অত্যন্ত দুখিত, ডোরিসেনা ওয়ার্ডোর স্ট্রিটে একটা পুরনো ব্রকেডের তল্লাশে যেতে হয়েছিল আমাকে, এবং দর কষাকষি করতে। অনেকটা সময় নষ্ট হল আমার। আজকাল সবাই জিনিসের বাডার দরটাই ডালে, কোনো জিনিসের মূল্যবোধ বলতে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।

হঠাৎ একটু বোকার মতো হেসে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে দিলেন লেডি হেনরি, বললেন, আমাকে এখনি বাইরে যেতে হব। ডাচেসকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, হ্যারি, আমি চললাম। সম্ভবত তুমিও বাইরেই ঘাচ্ছ? আমিও। সম্ভবত লেডি থ্রেবেরির বাড়িতে আমাদের দেখা হবে।

দরজাটা বন্ধ করতে করতে লর্ড হেনরি বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ঘরের মধ্যে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে লেডি হেনরি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, মনে হল, সারা রাত্রি ধরে বৃষ্টিতে ভিজে স্বর্গের একটা পাখি আটকে পড়েছিল, হঠাৎ দূরজা খোলা সেযে সে তীব্র বেগে উড়ে গেল। দরজা বন্ধ করে একটা সিগারেট ধরালেন লর্ড হেনরি। তারপরে সোফার ওপরে বসে পড়লেন।

সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, কটা চুল রয়েছে এরকম কোনো মহিলাকে তুমি বিয়ে করো না, ডোরিয়েন।

কেন বল তো?

তারা বড়ো ভাবপ্রবণ হয়।

কিন্তু ওই জাতীয় মানুষকেই যে আমার ভালো লাগে, হ্যারি।

কক্ষনো বিয়ে করো না। মানুষ বিয়ে করে কেন? কারণ তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কারণ তাদের কৌতূহল থাকে যথেষ্ট। এই জাতীয় মহিলাদের বিয়ে করলে দু’দিক থেকেই তাদের নিরাশ হতে হয়।

হেনরি আমার বিয়ে করার সম্ভাবনা বড়ো কম। আমি একজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। এই অদ্ভুত যুক্তি অবশ্য তোমারই সেইটাই আমি বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে যাচ্ছি, ঠিক অন্যান্য বিষয়েও আমি যেমন তোমার উপদেশ মতো চলার বা করার চেষ্টা করি।

একটু থেকে হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে তুমি ভালোবেসেছ?

 লজ্জা পেয়ে ডোরিয়েন বললেন, একজন অভিনেত্রীকে।

লর্ড হেনরি কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধে একটা শ্রাগ করে বললেন, এটা একটা সাধারণ রোমান্স ছাড়া আর কিছু নয়।

তাকে দেখলে তুমি একথা বলতে না, হ্যারি।

 তার পরিচয়?

 তার নাম সাইভিল ভেন।

ওরকম নাম তো কখনো শুনিনি।

কেউ শোনেনি, তবে একদিন সবাই শুনবে। মেয়েটি অভিনয় জগতে একটি জিনিস।

শোন বালক, শোল। কোনো নারীই কোনোদিন ডিসি–এর পর্যায়ে পড়তে পারে না। নরলোকে ওরা অলঙ্করণের পূজারিণী। কোনোদিনই ওদের বলার কিছু থাকে না, কিন্তু সেই কথাটাই ওরা বেশ মিষ্টি করে ললিতকলার ছন্দে বলে যায়। পুরুষরা যেমন নীতির ওপরে মননকে প্রাধান্য দেয়, নারীরা তেমনি প্রাধান্য দেয় মনের ওপরে নিছক বস্তুকে।

হ্যারি, এই রকম কথা বলছ কী করে?

প্রিয় বন্ধু, যেমন করেই বলি, কথাটা সত্যি। বর্তমানে আমি নারীচরিত্র বিশ্লেষণ করছি। সুতরাং নারীচরিত্র বলতে কী বোঝা যায় তা আমার জানা উচিত। বিশ্লেষণ করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে নারী মূলত দুটি শ্রেণির সাধারণ এবং রঙিনা সাধারণ অর্থাৎ ঘরোয়া মহিলারা প্রয়োজন মেটানোর দিক থেকে উৎকৃষ্ট। তুমি যদি সমাজে সম্ভ্রম পেতে চাও তাহলে এই শ্রেণির একটি মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোক। অন্য শ্রেণির মহিলারা দেখতে সুন্দরী, কিন্তু তারা একটা ভুল করে। নিজেদের যুবতী বলে জাহির করার জন্যে তারা অতিমাত্রায় প্রসাধন করে। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা প্রসাধন করতেন সুন্দর করে কথা বলার জন্যে। রুভ-পাউডারের সঙ্গে তখন মেশানো থাকত বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যবিন্যাসের কলাকৌশল। কিন্তু সে যুগকে আমরা আজ হারিয়েছি। আজকাল মহিলারা খুশি হয় কিসে জান? যদি তারা নিজেদের ব্যসটাকে তাদের মেয়েদের বয়সের চেয়ে দশটা বছর কমিযে। আনতে পারে। আর বাচনভঙ্গির কলাকৌশলের কথা যদি ধর তাহলে আমি বলব যে বর্তমানে সারা লন্ডন শহরে ওই ডাতীয়া মহিলা মাত্র পাঁচজন রয়েছেন। এবং সেই পাঁচজনের মধ্যে দুজনকে কোনো সভ্য, বিদগ্ধ সমাজে বার করা যায় না। সে যাক গে, এখন তোমার ওই ভিনিযাসটির সম্বন্ধে আমাকে কিছু বল। কদিন তোমাদের আলাপ হয়েছে?

হায় হ্যারি, তোমার কথা শুনে আমার ভয় লাগছে।

ওকথা বাদ দাও। কদ্দিন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তোমার?

তিন সপ্তাহের কাছাকাছি।

তার সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়?

তোমাকে আমি সব বলছি, হ্যারি। কিন্তু আমার কাহিনি শুনে তুমি নির্দযের মতো হাসবে না। অবশ্য তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে এ সমস্যা আমার কোনোদিনই দেখা দিত না। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ভালো করে দেখার একটা উন্মাদ কামনা তুমিই আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পরে অনেকদিন আমার শিরায়-শিরায় কৌতূহলের ঢল নেমেছিল। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে অথবা পিকাডেলির পথে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেড়াতে বেড়াতে একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে, একটি অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল নিয়ে পথচারী প্রতিটি মানুষের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। কী ভাবে তারা বেঁচে রয়েছে তাই অনুসন্ধান করে বেড়াতাম। কেউ কেউ আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কেউ কেউ বা আমাকে করে তুলেছিল ভয়ার্ত। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল লক্ষ লষ্ক বিষের অতি মনোরম কণিকা। উন্মাদ উচ্ছ্বাসের। ওপর আমার কেমন যেন একটা ঝোঁক ছিল।…তারপরে একদিন সন্ধ্যায় জীবনের সম্বন্ধে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চযের উদ্দেশ্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। আমি মনে করেছিলাম আমাদের এই ধোঁয়াটে রঙের দানব লন্ডন শহর কেবল বহু বিচিত্র মানুষেরই আবাসস্থল নয়, আদর্শহীন পাপী আর গৌরবময় পাপে একেবারে বোঝাই। লন্ডনের এই ব্যাখ্যা অবশ্য তোমারই। ভেবেছিলাম এ-হেন লন্ডন শহর আমার জন্যে কিছু সঞ্চয় করে রেখেছে হাজার রকমের কল্পনায় মন আমার উদ্বেলিত হয়ে উঠল। নিছক বিপদের সম্ভাবনা আমাকে উৎসাহিত করল। সে চমৎকার রাত্রিতে আমরা দুজনে একসঙ্গে প্রথম ডিনার খেলাম সেদিন। তুমি আমাকে যা বলেছিল তা আমার মলে ছিল। ঠিক কী চাইছিলাম তা আমি জানতাম না, কিন্তু আমি বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে পূর্বদিকে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত আমি। শক্ত দৈত্যদীঘল গাছ, কালো আর রুক্ষ পার্কের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। সাড়ে আটটার কাছাকাছি আমি একটা কিম্ভুতকিমাকার ছোটো থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, বড়ো বড়ো গ্যাসের আলো আর মোটা মোটা হরফে লেখা পোস্টারে ঝকমক করছিল তার দেওয়ালগুলি। একটি বিরাটাকার জু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সস্তাদামের সিগার খাচ্ছিল। তার গায়ের ওপরে ওয়েস্ট কোট দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। আসল কথা, ওরকম পোশাক জীবনে আর কখনো আমার চোখে পড়েনি। তার আঙুলে একটা তেল চিটচিটে ছোটো আঙটি, একটা। নোংরা শার্টের মাঝখানে বিরাট একটা হিরে বসালো। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে জিজ্ঞাসা করল, মি লার্ড, একটা বক্স চাই? এই কথা বলেই দাসত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। আমাকে অভিবাদন জানানোর উদ্দেশ্যে সে তার টুপিটা খুলে ফেলল। হ্যারি, লোকটির মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল যা আমার কাছে বেশ কৌতুকপ্রদ বলে মনে হয়েছিল। চেহারার দিক থেকে মানুষটা একেবারে দৈত্যবিশেষ। বুঝতে পারছি আমার কথা শুনে মনে মনে তুমি হাসছ, কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই ভেতরে ঢুকে এক গিনি খরচ করে একটা বক্সের টিকিট কিনে ফেললাম। কেনই বা ওই থিয়েটারে ঢুকলাম, আর কেনই বা অত দামের টিকিট কিনলাম তা আমি আজও বুঝতে পারছি না, তবু একথাও সত্যি যে আমি যদি সেদিন না যেতাম, সত্যি বলছি হ্যারি, তাহলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স থেকে বঞ্চিত হতাম আমি। দেখতে পাচ্ছি আমার কথা শুনে তুমি হাসছ। ভারি অন্যায়, ভারি অন্যায়।

না ডোরিয়েন, আমি হাসছি না, অন্তত তোমাকে উপহাস করার জন্যে হাসছি না। কিন্তু তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স বলে ওটিকে চিহ্নিত করো না। বরং বল, ওটি তোমার জীবনের প্রথম রোমান্স। সব সময়েই তোমাকে কেউ না কেউ ভালোবাসবে, তুমি ভালোবাসবে কাউকে না কাউকে করার মতো কোনো কাজ যাদের হাতে থাকে না এই রকম উচ্ছ্বাসের শিকার হওয়ার নৈতিক অধিকার নিশ্চয় তাদের রয়েছে। দেশের অলস শ্রেণির ওইটিই একমাত্র কাজ। ভয় পেযো না। অনেক অপরূপ সুন্দর জিনিস তোমার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে। এই তো সবে শুরু।

চটে উঠলেন ডোরিয়েন গ্রে, একটু চেঁচিয়েই বললেন, তোমার ধারণা আমার চরিত্র এতখানি খেলো, অগভীর?

না, আমার মনে হয় তোমার চরিত্র সত্যিকারের গভীর।

অর্থাৎ?

প্রিয় বালক, অবধান করা যারা জীবনে একবার মাত্র প্রেমে পড়ে সত্যিকারের অগম্ভীর হচ্ছে তারা। যে জিনিসটাকে তারা আনুগত্য অথবা আস্থা বলে, আমার মতে সেটা হয় সামাজিক আলস্য, অথবা সুস্থ চিন্তার অভাব। বুদ্ধিজীবীদের কাছে চারিত্রিক দৃঢ়তা যা, উচ্ছ্বাসম্য। মানুষের কাছে বিশ্বাসের দাম তাই। দুটিই পরাজযের কলঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিশ্বাস! ওটা নিয়ে বিশদ আলোচনা একদিন আমাকে করতেই হবে। এর ভেতরে রয়েছে কিছু হাতিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস রয়েছে যেগুলিকে আমরা অবহেলায় ছুঁড়ে। ফেলে দিতে পারি, ফেলে দিই না এই ভয়ে যে অন্য লোকে হয়তো সেগুলি কুড়িয়ে নেবে। কিন্তু তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না তোমার গল্পটা বলে যাও।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম: আমি একটা বিশ্রী ছোটো বক্সের ওপরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বসলাম। একটা নোংরা পর্দা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। পর্দার আড়াল থেকেই ঘরটাকে আমি পরীক্ষা করে দেখছিলাম। বিবাহের নিকৃষ্ট কেকের মতো ঘরটা খুবই চটক দিয়ে সাজানো, গ্যালারি আর নীচেটা মোটামুটি ভর্তি ছিল কেবল খালি ছিল সরু সরু দু’সারি বিবর্ণ স্টল। আর ড্রেস সার্কেলে একজন দর্শকও আমার চোখে পড়েনি। কমলালেবু আর ডিনডার ব্যিার। নিয়ে মহিলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশে বাদামের ছাড়ানো খোলায় একেবারে ভরপুর। ব্রিটিশ নাটকের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

আমারও তাই মনে হয়, কিন্তু মন-মেজাজ একেবারে বিগড়ে দেয়। নাটকের নাম শুনে তো আমি অবাক। এ কী কাণ্ড! কী অভিনয় হচ্ছিল বল তো, হ্যারি?

আমার ধারণা, নাটকের নাম হয় ‘ইডিযট বোয়’ অথবা ‘ডাম্ব বাট ইনোসেন্ট’। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ওই রকম নাটকই পছন্দ করতেন বেশি। যতই দিন যাচ্ছে ডোরিয়েন, ততই বুঝতে পারছি বাপ-কাকা-জেঠাদের কাছে যেটা ভালো ছিল সেটা আর আমাদের কাছে ভাল নয়। আর্টই বল, অথবা রাজনীতিই বল–সর্বত্র ওই একই ব্যাপার।

না, হ্যারি, নাটকটা আমাদের পক্ষে ভালোই। নাটকের নাম হচ্ছে ‘রোমিও-জুলিয়েট’। এই রকম একটা গর্তের মধ্যে সেকসপীয়রের নাটক অভিনীত হচ্ছে বুঝতে পেরে সত্যি কথা বলতে কি প্রথমেই আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। তবু ভাবলাম, দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কী রকম দাঁড়ায়। যাই হোক, প্রথম অঙ্কটা পর্যন্ত দেখতে আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। আবহসঙ্গীত কী ভয়ানক রে বাবা! একটা ভাঙা পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে একটি ইহুদি যুবক সঙ্গীত পরিচালনা করছিল। এই দেখেই চম্পট দেব ভাবছি এমন সময় সিল উঠে গেল, শুরু হল অভিনয়। একটি মোটাসোটা বয়স্ক ভদ্রলোক রোমিওর অভিনয় করছিলেন, তাঁর ভুরু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচু স্বর শ্রুতিকটু, ভারিক্কি–অনেকটা বিযোগান্ত ধাঁচের। চেহারাটা হচ্ছে বিয়ারের পিপের মতো। মারকিউরিযার চেহারাটা আরো খারাপ অভিনয় করল একটা নিম্নমানের বিদৃষকের মতে, পোশাক আর চালচলনে মনে হল মানুষটি এই গর্তের আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলীর মতো তারাও কিম্ভুতকিমাকার, তাদের দেখে মনে হল এইমাত্র তারা যেন পাড়াগাঁয়ের কোনো অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু জুলিয়েট! হ্যারি, ভেবে দেখ–একটি মেয়ে, সতের ছুঁই-ছুঁই করছে তার বয়স, ফুলের মতো ছোটো তার মুখ, তামাটে রঙের ঘন চুলের স্তবকে যার মাথাটা গ্রিক ভাস্কর্যের নিপুণ কারুকার্যের মতো দেখাচ্ছিল, চোখ দুটি তার ঢল-ঢল, দেখলেই মনে হবে ভাবের উচ্ছ্বাসে যেন তারা উপছে পড়ছে। ঠোঁট দুটি যেন গোলাপের পাপড়ির মতো। জীবনে অত সুন্দর আর কোনো যুবতী আমার চোখে পড়েনি। তুমি একবার আমাকে বলেছিলে যে মানুষের দুঃখ তোমার মনে কোনো রেখাপাত করে না, কিন্তু একটি সুন্দর ডিজনিস, তা সে যত সামান্যই হোক, তোমার চোখ জলে ভরিয়ে দেয়। তোমাকে আমি সত্যি কথাই বলছি হ্যারি, মেয়েটিকে দেখে আমার চোখ দুটিও জলে ভরে উঠল, ফলে তার দিকে ভালো করে সেদিন আমি তাকিয়ে থাকতেই পারিনি।

আর তার কণ্ঠস্বর! ওরকম স্বর আর কখনো আমি শুনিনি। প্রথমে মৃদু সুরে সে কথা শুরু করল, ধীরে ধীরে সেই সুর পরিণত হল উদাত্ত স্বরে, তারপরে সঙ্গীতের মূৰ্ছনায় আবিষ্ট করে ফেলল তোমাকে। ধীরে ধীরে সেই স্বর উচ্চগ্রামে উঠে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মনে হল অনেক দূরে কোথাও কোনো ফুট অথবা সানাই বাজছে। বাগানের দৃশ্যটাও একই রকমের উচ্ছ্বাসবিধুর, নাইটেল পাখির গানের মধ্যে দিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠার কিছু আগে প্রেমিক-প্রেমিকারা আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় যেমন মুষড়ে পড়ে–এই দৃশ্যটিও ঠিক সেই রকমের বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে বিচ্ছেদ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমতা রাখার চেষ্টায় বেহালার করুণ সুর বেশ চড়া গলায় ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে তুমি জান, মাঝে মাঝে কারো কণ্ঠস্বর মানুষকে মাতাল করে দেয়, কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে একেবারে মর্মস্থানে গিয়ে আঘাত করো তোমার স্বর আর সাইবিল ভেন-এর স্বর–এই দুটি স্বর জীবনে আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না, হ্যারি, চোখ বন্ধ করে থাকলেই আমি সেই স্বর দুটি শুনতে পাই। যদিও চরিত্রের দিক থেকে, ব্যঞ্জনার দিক থেকে তারা ভিন্ন জাতের। ওদের কোনটিকে আমি অনুসরণ করব তা আমি জানি না।

আমি তাকে ভালোবাসব না কেন? হ্যারি, তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমার জীবনে সে একটি আবিষ্কার ছাড়া আর কিছু নয়। দিনের পর দিন আমি তার অভিনয় দেখতে যাই একদিন সে রোজালিনড-এর অভিনয় করে, আর একদিন ইমোডেন-এর। প্রিয়তমের। বিষমাখা ঠোঁটে চুম্বন করে, ইটালিয়ান কবরখানার অন্ধকারে তাকে মারা যেতে আমি দেখেছি। আর্ডেন-এর বনপ্রদেশ কিশোরের পোশাক পরে কিশোরের বেশে ঘুরে বেড়াতে তাকে আমি দেখেছি। সে উন্মাদ হয়ে অপরাধী রাজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাঁকে তাঁর কৃতকার্যের জন্যে অনুশোচনা করতে বাধ্য করেছে। হিংসার কালো কুটিল হাত সেই অপাপবিদ্ধা মেয়েটির শরগাছের মতো নরম গলা চিপে ধরেছে। প্রতিটি বয়সের অভিনয় করতে নানান যুগের পোশাক পরা তাকে আমি স্টেজের ওপরে দেখেছি। সাধারণ মেয়েরা। কারো চিন্তার জগতে আবেদন জাগায় না। তাদের যুগে তাদের ক্রিয়াকলাপ অত্যন্ত সীমিত। কোনো জাঁকজমকই তাদের সৌন্দর্য বাড়ায় না, তাদের চিনে নিতে মানুষের বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। তাদের মধ্যে কোনো রহস্য নেই। সকালে গাড়িতে চড়ে তারা পার্কে বেড়াতে যায়, বিকালে চায়ের টেবিলে কিচমিচ করে। তাদের মুখের হাসি আর চমকপ্রদ পোশাক গতানুগতিকতার ছাপ মারা। তারাই অত্যন্ত সাধারণ

কিন্তু অভিনেত্রীদের কথা স্বতন্ত্র। সাধারণের কাছ থেকে তাদের পার্থক্য কত! পৃথিবীতে ভালোবাসার একমাত্র উপযুক্ত নারী যে অভিনেত্রী, একথা আগে তুমি আমাকে কেন বলনি হ্যারি?

কারণ, আমি অনেক অভিনেত্রীকে ভালোবেসেছি, ডোরিয়েন।

 হ্যাঁ, নিশ্চয়। তুমি সেই সব অভিনেত্রীদের ভালোবেসেছ যারা চুলে কলপ দিয়ে আর মুখে প্রসাধনের ছোপ লাগিয়ে বিতিকিচ্ছির দেখায়।

চুলের কলপ আর মুখের প্রসাধন ওভাবে নাকচ করে দিও না। মাঝে মাঝে তাদের ভেতরে অসাধারণ মহিলা লুকিয়ে থাকে।

এখন ভাবছি, সাইবিল ভেন-এর কথা তোমাকে না শোনালেই ভালো হত।

তার কথা আমাকে না বলে তুমি পারতে না, ডোরিয়েন। সারা জীবন ধরে যা করবে তার সবটুকুই তুমি আমাকে বলবো

হ্যাঁ, হ্যারি। মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তোমাকে কোনো কিছু না বলে আমি থাকতে পারি না। আমার ওপরে তোমার প্রভাব বিস্ময়কর। যদি আমি কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজ করি, তা-ও তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি। আমাকে বুঝতে পারবে।

ডোরিয়েন, তোমার মতো সুন্দর মানুষ ইচ্ছে করে ভুল করে না। কিন্তু তুমি এইমাত্র যা বললে তার জন্যে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন বল দেখি-তার আগে দেশলাইটা এগিয়ে দাও, লক্ষী ছেলে, এখন বল সাইবিল ভেন-এর সঙ্গে তোমার আসল সম্পর্কটা কোথায়?

হঠাৎ চটে উঠলেন ডোরিয়েন, চোখমুখ লাল হয়ে উঠল তাঁর, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তিনি বললেন, হ্যারি, সাইবিল ভেন পবিত্র, নিষ্পাপ।

কথার মধ্যে অদ্ভুত একটা দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, ডোরিয়েন, পবিত্র জিনিসকেই মানুষের স্পর্শ করা উচিত। কিন্তু তুমি এত বিরক্ত হচ্ছ কেন? আমি ধরে নিচ্ছি। একদিন সে তোমারই হবে। প্রেমে পড়লে মানুষ নিজের সঙ্গে প্রতারণা করতে শুরু করে, আর সব সময়ে শুরু করে অপরকে প্রতারণা করতো এই প্রতারণাকেই আমরা বলি রোমান্স। যাই হোক, ধরে নিচ্ছি তুমি তাকে চিনতে পেরেছ!

হ্যাঁ নিশ্চয়। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। প্রথম যেদিন আমি থিয়েটারে গিয়েছিলাম। সেইদিন নাটক ভাঙার পরে সেই ভীষণদর্শন বৃদ্ধ ইহুদি এসে আমার সঙ্গে দেখা করল, তারপরে সাজঘরে নিয়ে গিয়ে সাইবিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিল। আমি খুব চটে উঠে তাকে বললাম, জুলিয়েট কয়েকশো বছর আগে মারা গেছে, তার মৃতদেহ এখন ভেরোনার মার্বেল কবরখানার মধ্যে শুয়ে রয়েছে। সে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চাহনি দেখে মনে হল বেটা ভেবেছিল আমি প্রচুর পরিমাণ শ্যাম্পেন বা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য পান করে বেহেড হয়ে গিয়েছি।

তোমার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হইনি, ডোরিয়েন।

তারপরে সে জিজ্ঞাসা করল আমি কোনো খবরের কাগজে লিখি কিনা, আমি তাকে বললাম, লেখা দূরের কথা কোনো খবরের কাগজই আমি পডি না। আমার কথা শুনে মনে হল সে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছে। তারপরে সে আমাকে গোপনে ভাল যে সমস্ত নাট্য সমালোচকরা। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এখন ব্যবসা চালাতে গেলে তাদের সবাইকে কিনে নিতে হবে।

লোকটি যে ঠিক কথা বলেছে সেদিক থেকে আমার কোনো রকমসন্দেহ নেই। তবে একথাও আমি বলতে চাই যে, তাদের চেহারা আর হাবভাব দেখে আমার মনে হয় তাদের কিনতে বেশি কিছু খরচ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ডোরিয়েন হেসে বললেন, তার কথা শুনে মনে হল সে সামর্থ্যও তার নেই। এই সময় থিয়েটারে আলো লেবানোর সময় হয়ে এল, কয়েকটা বাতি নিবেও গেল। সুতরাং আমাকেও বেরিয়ে আসতে হল। তার ইচ্ছে আমি তার দেওয়া দু’একটা সিগার খাই, আমি তার উপহার প্রত্যাখ্যান করলাম। পরের রাত্রিতেও আমি আবার সেই আগের আসনটি দখল করলাম। আমাকে দেখেই সে মাথাটা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমার মতো অর্থশালী এবং দিলদরিযা পেট্রল তার আর নেই। লোকটা একটা দুর্বিনীত পশু, মানুষকে বৃঢ় কথা বলতে ওস্তাদ। কিন্তু শেকসপীয়রকে সে অসাধারণ ভালোবাসো একবার সে বেশ বুক ফুলিয়ে গর্ব করে আমাকে বলেছিল যে ওই ‘চারণকরিটির জন্যে সে পাঁচবার দেউলিয়ার খাতায় নাম। লেখাতে বাধ্য হয়েছিল। শেকসপীয়রকে সে চারণকবি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকতে রাজি নয়। এই নামে ডাকার মধ্যে সে তার আভিজাত্য খুঁজে পেয়েছে।

হ্যাঁ, এটা তো একটা অভিজাত-বোধ বটেই, ডোরিয়েন, বড়ো রকমের অভিজাত-বোধ। অনেক মানুষ গদ্যময় জীবন নিয়ে ফাটকাবাজি খেলতে গিয়ে দেউলিয়া হয়েছে। কাব্যের জন্যে নিজেকে ধ্বংস কার একটা সম্মান বৈকি! কিন্তু মিস সাইবিল ভেন-এর সঙ্গে তোমার প্রথম আলাপ হল কবে?

তৃতীয় রাত্রিতো সেদিন সে রোজালিনড-এর অভিনয় করেছিল। আমি তার কাছাকাছি না গিয়ে পারিনি। আমি তাকে কিছু ফুল ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। অন্তত, সেই রকমই মনে হল আমার। বৃদ্ধ ইহুদিও তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে বদ্ধপরিকর। হয়েছিল। আমিও তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। তার সঙ্গে আমি যে আলাপ করতে চাইনি সেটা অস্বাভাবিক, তাই না?

না, আমি তা মনে করি না।

কেন?

এর উত্তর আর একদিন তোমাকে আমি দেব। এখন মেয়েটির সম্বন্ধে আমি কিছু শুনতে চাই।

সাইবিল? ওঃ, সে বড়ো লাজুক মেয়ে, আর কি ভদ্র! একেবারে যাকে বলে শিশু।তার অভিনয় সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা হয়েছিল সেকথা আমার মুখ থেকে শুনে সে অবাক হয়ে চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে সোৎসাহে আামার দিকে তাকিয়েছিল। নিজের দক্ষতার সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তার ছিল না। মনে হয়, আমরা দুজনেই কেমন আমতা আমতা করতে লাগলাম। সেই ধূলিমলিন সাজঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুড়ো ইহুদি পরম কৌতুকের সঙ্গে তাকিয়ে রইল, তারপরে আমাদের দুজনের ওপরে লম্বা টানা বক্তৃতা দিল। আর আমরা নির্বাক হয়ে শিশুর মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইহুদিটি বার বার আমাকে ‘দি লার্ড’ বলে সম্বোধন করতে লাগল। সেই জন্যে সাইবিলকে নিশ্চিন্ত করতে হল যে আমি আদৌ ও-শ্রেণির মানুষ নই। সে আমাকে শুধু বলল, আপনি রাজকুমারের চেয়ে দেখতে সুন্দর, আপনাকে আমি ‘প্রিন্স চার্মিং’ বলে ডাকব।

সত্যি বলছি ডোরিয়েন, কী ভাবে মানুষকে প্রশংসা করতে হয় সাইবিল তা জানে।

হ্যারি, তুমি তাকে বুঝতে পারছ না। নাটকের একটি অভিনেতা বলেই সে আমাকে ধরে নিয়েছিল। বাস্তব জীবনের সমন্ধে কোনো ধারনাই তার নেই। সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে, সংসারের চাপে পড়ে ভদ্রমহিলা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছেন। পরিশ্রমের ক্লান্তিতে স্বাস্থ্য তাঁর ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সুদিন তাঁর জীবনে এসেছিল।

আঙুলের আংটি খুঁটতে খুঁটতে লর্ড হেনরি মন্তব্য করলেন, ওদের মুখের চেহারা কি তা আমি ভানি। ওদের দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।

 ইহুদিটি তার কাহিনি বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি তাকে বলতে দিইনি, কারণ তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

তুমি ঠিকই করেছ, অন্য লোকের দুঃখের কাহিনির মধ্যে সব সময় অসম্ভব রকমের নীচতা রয়েছে।

সাইবিলই একমাত্র জিনিস যার ওপরেই আমার আগ্রহ রয়েছে। সে কোথায় জন্মেছে তা ডেলে আমার লাভ নেই। সেই ছোটো মাথা থেকে ছোটো পা পর্যন্ত সবটাই তার স্বর্গীয়। প্রতিদিন রাত্রিতেই তার অভিনয় আমি দেখতে যাই, আর প্রতিদিনই সে আমার চোখে অপরূপা হয়ে দেখা দেয়।

আমার মনে হয় সেই জন্যেই তুমি আজকাল আমার সঙ্গে ডিনারে যাওয়ার সময় পাও না। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় কারো সঙ্গে রোমান্স করছ। করছ ঠিকই, কিন্তু আমি তোমার সম্বন্ধে যা ভেবেছিলাম তা করছ না।

শোন হ্যারি, প্রতিদিন আমরা হয় লাঞ্চ না হয় ডিনার খাই। আর তোমার সঙ্গে এর ভেতরে অনেকবারই আমি অপেরায় গিয়েছি-তাই না! অবাক হয়ে দুটি নীল চোখ বিস্তারিত করে ডোরিয়েন হেনরির মৃদু অভিযোগ নস্যাৎ করে দিলেন।

তুমি প্রায়ই অনেক দেরি করে আস।

অবশ্য সাইবিলের অভিনয় না দেখে আমি পারি না। একটা অঙ্কের জন্যে হলেও আমাকে থিয়েটারে যেতে হয়। তাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠি আমি। যখন ভাবি তার ওই হাতির দাঁতের মতো কারুকার্যমণ্ডিত ছোটো দেহটির মধ্যে অত্যাশ্চর্য একটি আত্মা লুকিয়ে রয়েছে তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।

আজ তুমি আমার সঙ্গে ডিনার খাবে চল, ডোরিয়েন। যাবে না?

ডোরিয়েন মাথা নাড়ল, আজ সে ইমোজেন-এর অভিনয় করবে। আগামীকাল সাজবে জুলিয়েট।

কখন সে সাইবিল ভেন-এর অভিনয় করবে?

কোনোদিন না।

আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাই।

কী ভয়ঙ্কর তুমি হ্যারি! বিশ্বের সমস্ত নায়িকাকে এক করলে যা দাঁড়ায় সাইবিল হচ্ছে তাই। ব্যক্তির চেয়ে অনেক বড়ো সে। তুমি হাসছ? কিন্তু আমি তোমাকে বলছি সে একটি জিনিয়াস। আমি তাকে ভালোবাসি। সে যাতে আমাকে ভালোবাসে সে চেষ্টা আমাকে অবশ্যই করতে হবে। তুমি তো জীবনের অনেক গোপন রহস্যের সন্ধান ভান। কেমন করে। সাইবিলকে আমি মুগ্ধ করব, কী করলে সে আমাকে ভালোবাসবে সে-কথাটা আমাকে তুমি। বলে দাও। রোমিওকে বাধ্য করব সে যাতে আমাকে হিংসে করে। আমি চাই বিশ্বের মৃত প্রেমিকদের আত্মা যেন আমাদের দ্বৈত হাসির শব্দ শুনতে পায়, শুনতে পেয়ে বিষণ্ণ হয়। আমি চাই আমাদের উন্মাদ ভালোবাসার নিশ্বাস ধূলায় মেশানো তাদের মৃত আত্মাগুলিকে যেন সঞ্জীবিত করে তোলে, তাদের ছাইগুলিকে বেদনার আঘাতে জর্জরিত করে। ভগবানের দিব্যি, হ্যারি, আমি তাকে পুজো করি।

এই কথা বলতে বলতে তিনি ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন, তাঁর গাল দুটি লাল টকটকে করতে লাগল। বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি।

লর্ড হেনরি তাঁকে লক্ষ করলেন, মনে মনে খুশিই হলেন তিনি। বেসিল হলওয়ার্ডের স্টুডিওতে যে লাজুক, নম্র, আর ভীতচকিত যুবকটিকে তিনি দেখেছিলেন, আজকের এই মানুষটির সঙ্গে পার্থক্য তার কত। তাঁর স্বভাবটি ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে, রক্তবর্ণ কুসুমস্তবকে ভরে উঠেছে তাঁর আবেগ। গোপন বিবর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে তাঁর আত্মা, তার সঙ্গে মিতালি করার জন্যে বিবর থেকে এগিয়ে এসেছে আকাঙ্খা।

শেষকালে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে কি করতে চাও তুমি?

আমি চাই একদিন তুমি আর বেসিল আমার সঙ্গে তার অভিনয় দেখতে এস। এর ফল কী হবে সে-সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আমার নেই। অভিনয়ে তার দক্ষতা যে তর্কাতীত সেকথা স্বীকার করতে তোমরাও বাধ্য হবে। তারপরে তাকে আমরা ইহুদির হাত থেকে ছাড়িয়ে আনব। তিন বছরের জন্যে, আজ থেকে মোটামুটি দু’বছর আট মাসের মতো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে ওখানে থাকতে হবে। অবশ্য তাকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে ইহুদিকে কিছু দিতে হবে। সব চুকেচুকে গেলে, ওযেস্ট এন্ডে আমি একটা থিয়েটার খুলব, সেইখানে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে অভিনয় করাব। আমাকে যেমন সে উন্মাদ করে সেই রকম উন্মাদ সারা বিশ্বকে সে করে তুলবে।

প্রিয় বালক, তোমার ও-আশা পূর্ণ হবে না।

হ্যাঁ, সে করবে। অভিনয় কলাটাকে সে যে বিশেষভাবে রপ্ত করেছে তা-ই নয়। ব্যক্তিত্বও তার খুব জোরালো এবং তুমি আমাকে অনেকবারই বলেছ যে আধুনির যুগকে যা নাচাতে পারে তা মানুষের নীতি নয়, ব্যক্তিত্ব।

ঠিক আছে। কবে আমরা যাচ্ছি?

দাঁড়াও, দেখি। আজ হচ্ছে মঙ্গলবার। আগামীকাল যাই চলা কাল সে জুলিযেটের অভিনয় করবে।

বহুৎ আচ্ছা। ব্রিস্টল-রাত আটটা। বেসিলকে আমি আনানোর ব্যবস্থা করব।

আটটা নয়, প্রিন্স হ্যারি। সাড়ে ছটা। পর্দা ওঠার আগেই আমাদের সেখানে পৌঁছতে হবে। প্রথম অঙ্কেই রোমিওর সঙ্গে তার দেখা হবে। সেই সময়েই তাকে তোমাদের দেখা উচিত।

সাড়ে ছটা! যা বাব্বা। ওই সময় তো লোকে হয় ‘মিট টি’ খায়, অথবা ইংরেজি নভেল পডে। সাতটা কর অন্তত। রাত্রি সাতটার আগে কোনো ভদ্রলোকই ডিনার খেতে বেরোয় না। এর মধ্যে বেসিলের সঙ্গে কি দেখা হবে তোমার? না, আমি তাকে চিঠি লিখে ডানিয়ে দেব?

প্ৰিয় বেসিল। সাত-সাতটা দিন তাকে আমি দেখিনি। কাডটা আমার খুব খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে একটি অদ্ভুত সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করে, ফ্রেমের ডিজাইন কী হবে সেটা সে নিজেই ঠিক করে দিয়েছে–সে আমার প্রতিকৃতিটা পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও আমার বয়স একমাস বেড়ে যাওয়ার ফলে ছবিটাকে আমি হিংসে করি তবু একথাও আমি স্বীকার না করে পারব না যে ছবি দেখে আমি আনন্দ পেযেছি। তুমি ও বরং তাকে চিঠি দিয়ে দাও একটা। একা তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই না। তার কথা শুনতে বিরক্ত লাগে আমারা। সে আমাকে কেবল সৎ উপদেশ দেয়।

লর্ড হেনরি হাসলেন, নিজেদের যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেইটাই বিলিয়ে দিতে মানুষ বড়ো আনন্দ পায। এই অভ্যাসটাকে আমি বলি বদান্যতার গভীরতা।

কিন্তু বেসিল আমাদের বন্ধু হিসাবে সেরা। তবে আমার মনে হয় চরিত্রের দিক থেকে মানুষটি একেবারে গোঁয়ার গোবিন্দ। তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরেই হ্যারি এ জিনিসটা আমি। বুঝতে পেরেছি।

বেসিলের সব কিছু মাধুর্য সবই তুমি তার কাজের মধ্যে দেখতে পাবে। ফলে নিজের বলতে কুসংস্কার, নীতিবোধ, আর যাকে আমরা কমনসেন্স’ বুলি এগুলি ছাড়া তার আর কিছু নেই। ব্যক্তিগত পরিচযের ফলে আমি জানি নিম্নমানের আর্টিস্টরাই হচ্ছে সত্যিকারের আলাপী। তাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। সত্যিকার ভালো আর্টিস্টরা বেঁচে থাকে তাদের সৃষ্টির মধ্যে, ফলে ব্যক্তিগত জীবনে তারা কাউকেই আকর্ষণ করতে পারে না। বড়ো কবি, অর্থাৎ যাঁকে আমরা সত্যিকার বড়ো কবি বলি-হচ্ছেন ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বের সবচেয়ে অকবি। কিন্তু নিম্নমানের কবিদের সঙ্গে মিশলে চমৎক্ত হতে হয়। তাদের ছন্দ যত খারাপ, ৩৩ই তারা সুন্দর করে নিজেদের প্রকাশ করে। যে কবি একটিমাত্র দ্বিতীয মানের চতুর্দশপদী কবিতার বই ছাপিয়েছেন, নরকুলে বাহবা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই। যে কাব্য-সৌরভ পরিবেশন করা তাঁর সাধ্যাতীত, মজার কথা হচ্ছে সেই সৌরভের মধ্যে তিনি নিজে বাস করেন। অপরে কবিতা লেখে বটে, কিন্তু সেই কাব্যরস পান করার মতো সাহস তাদের নেই।

টেবিলের ওপরে বড়ো একটা বোতলে আতর ঢালা ছিল, রুমালে সেই আতর কিছুটা ছিটিযে ডোরিয়েন বললেন, হ্যারি, তুমি যা বললে তাই কি সত্যি? তুমি যদি বল, তাহলে তাই সত্যি হতে বাধ্য। আমি এখন চললাম। ইমোডেল আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আগামীকালের কথা ভুলে যেও না। বিদায়।

ডোরিয়েন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। লর্ড হেনরির ভারী ভারী চোখের পাতাগুলি নেমে এল। তিনি ভাবতে লাগলেন। সত্যি কথা বলতে কি ডোরিয়েন গ্রে তাঁকে যেমন করে আকর্ষণ করেছিলেন তেমন আকর্ষণ আর কেউ তাঁকে করতে পারেনি। তবু ছোকরা যে একজনকে পাগলের মতো প্রশংসা করে তা তিনি যেন সহ্য করতে পারছিলেন না, তাঁর মনের কোথায়। যেন একটা কাঁটা খচখচ করে বিধছিল। তিনি খুশিও হয়েছিলেন। এর ফলে, ডোরিয়েনকে আর ভালো করে বিশ্লেষণ করার সুযোগ হল তাঁর। প্রকৃতি বিজ্ঞানকে তিনি কোনোদিনই অস্বীকার করতে পারেননি, কিন্তু বিজ্ঞানের সাধারণ শাখাগুলি কোনোদিনই তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি, সেগুলিকে তিনি অর্থহীন বলেই মনে করতেন। সেই জন্যে শুরু করেছিলেন তিনি নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে, শেষ করলেন অন্য লোককে ব্যবচ্ছেদ করে। মানুষের জীবন-তিনি মনে করতেন মানুষের জীবনটাই হচ্ছে বিচার করার, বিশ্লেষণ করার একমাত্র উপযুক্ত জিনিস। এর সঙ্গে তুলনা করলে আর সব বস্তুই তাদের ভেল্লা হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে তাদের মূল্যবোধ। এটা সত্যি যে মানুষ যখন এই বেদনা আর আনন্দের আধারটিকে বিশেষভাবে লক্ষ করল তখন মুখে কাঁচের মুখোশ পরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি দগ্ধমান সালফারের ধোঁয়া সরিয়ে রাখা, সে ধোঁয়া কেবল মস্তিষ্ককেই জখম করে ক্ষান্ত হলি, আমাদের চিন্তার জগতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, স্বপ্নকে করেছে বিকৃত। এমন কয়েকটি বিষয় রয়েছে তাদের চরিত্র কী ভালোভাবে জানতে গেলে নিজেদের অসুস্থ করতে হয়। এমন কয়েকটি ব্যাধি রয়েছে যাদের ভালোভাবে জানতে গেলে আপনাকে অসুস্থ হতে হবে। কিন্তু তবু কী পুরস্কারই না মানুষে পায়! তার কাছে পৃথিবী কী আশ্চর্য রকমের সুন্দরই না দেখায? মানুষের মনে কেন উচ্ছ্বাস ভাগে, তার চরিত্রটাই বা কী, বুদ্ধিজীবীদের রঙিন জীবনের উচ্ছ্বাস বলতেই বা কী বোঝা যায়, কোথায় তাদের মিল রয়েছে, অমিলটাই বা কোথায়, এই সব পর্যবেক্কণ করা, বিশ্বেষণ করার মধ্যে একটা আনন্দ রয়েছে। তার জন্যে মানুষকে কী দাম দিতে হবে তা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। কোনো সংবেদনের জন্যেই মানুষ খুব বেশি একটা দাম দিতে পারে না।

তিনি তা জানতেন। যে চিন্তাটা তাঁর কটা চোখের মধ্যে আনন্দের সামান্য একটু রশ্মি ফুটিয়ে তুলল–ডোরিয়েনের যে মিষ্টি কথাগুলি তাঁর কানে গিয়েছিল সেইগুলি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ডোরিয়েন গ্রে-র হৃদয় এই শ্বেতাঙ্গিনীর দিকে ঝুঁকেছে, তাকেই তিনি পুজো করছেন। ছেলেটি অনেকখানি তাঁর নিজেরই সৃষ্টি। তিনিই তাকে নাবালক করে রেখেছেন। এটা অবহেলার বস্তু নয়। জীবন তার রহস্য প্রকাশ করে না দেওয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষে অপেহষ্ক করে। কিন্তু এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই রয়েছে আর এরাই হচ্ছেন নির্বাচিত কিছু জনপ্রতিনিধি-যবনিকা তুলে নেওয়ার আগেই যাঁদের কাছে জীবনের রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। কখনো কখনো জীবনের এই ব্যঞ্জনাটি ফুটে ওঠে চিত্রকলার মাধ্যমে, বিশেষ করে সাহিত্যকলায। কারণ, উচ্ছ্বাস এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটানোই সাহিত্যের কাভ। কিন্তু মাঝে মাঝে কখনো-সখনো কোনো জটিল ব্যক্তিত্ব বিচারকের স্থান অধিকার করে বসে এবং আর্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কবিতা, ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলার মতো মানুষের জীবনও আর্টের একটি বিস্তৃত লীলাক্ষেত্র ছাড়া আর কী?

সত্যি কথাই। ছোকরাটির বুদ্ধি এখনো পর্যন্ত পোক্ত হয়নি। বসন্তকালেই সে শস্য কাটার আয়োজন মেতে উঠেছে। যৌবনের সমস্ত উন্মাদনা তাঁর মধ্যে রয়েছে, কিন্তু তিনি আজকাল আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন। তাঁর গতিবিধি লক্ষ করাটা বেশ আনন্দের। সেই সুন্দর মুখ, আর সুন্দর আত্মা-দুই-এ জড়িয়ে তাঁর যে সত্তাটি গড়ে উঠেছে তার দিকে অবাক হয়েই চেয়ে। থাকতে হয়। কী ভাবে এই জীবনের পরিণতি আসবে তা ভেবে লাভ নেই কিছু। অভিনয়ের মঞ্চে তিনি সেই ধরনের একজন আদর্শ অভিনেতা যাঁর ব্যক্তিগত সুখের সন্ধান রাখার কোনো সম্ভাবনা আমাদের নেই, অথচ যাঁর দুঃখবোধ আমাদের অভিভূত করে তোলে। যাঁর দেহের ক্ষত তাজা গোলাপের মতো লাল টকটকে।

আত্মা এবং দেহ, দেহ আর আত্মা–কী অদ্ভুত সৃষ্টি ভগবানের! আত্মার মধ্যে পশুত্ব রয়েছে দেহের মধ্যে মাঝে মাঝে অধ্যাত্ম জগতের প্রতিফলন ঘটে। আমাদের প্রবৃত্তিগুলি সুন্দর হতে পারে, এবং অধঃপতন ঘটতে পারে ধীশক্তির। জৈব উচ্ছ্বাসের সমাপ্তি কোথায় অথবা কোথা থেকে আমাদের দৈহিক সংবেদনের সৃষ্টি হয়–এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? সাধারণ। মনস্তত্ত্ববিদরা নিজেদের ইচ্ছামতো যে সব ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন সেগুলি কত অগভীর। এবং বিভিন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যে বিভিন্ন মত আর পথের সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা সে কথা কে বলবে? পাপের ঘরে যে আত্মা বসে রয়েছে সেটা কি ছায়া মাত্র? অথবা দেহটা সত্যি সত্যিই আত্মার অন্তভ? বস্তু থেকে তার শক্তির বিচ্যুতি সত্যিই বড়ো রহস্যময। আর বস্তুর সঙ্গে তার শক্তির সংহতি একই রকম রহস্যে ঘেরা। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক এ সম্বন্ধে শেষ কথা কে বলবে।

আচ্ছা, মনস্তত্ত্বই কি শেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যার মধ্যে দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের সমস্ত কিছু ছোটোখাটো চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়? তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন। ব্যাপারটা যাই হোক, আমরা সব সময় নিজেদের আর সেই সঙ্গে অপরকে ভুল বুঝেছি, নীতির দিক থেকে অভিজ্ঞতার কোনো দাম নেই। মানুষ যে সমস্ত ভুল করে সেগুলিকেই তারা অভিজ্ঞতা বলে চালিয়ে দিয়েছে। নীতিবাগীশরা যথারীতি এটিকে সতর্কবাণা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের মতো চরিত্র গঠনে এর নৈতিক দক্ষতা অনস্বীকার্য, তাঁরা এর প্রশংসা করেছেন এই জন্যে যে কী করা উচিত আর কী বর্জন করা উচিত সে বিষয়ে এ আমাদের শিক্ষা দেয়। কিন্তু পরিচালনা করার মতো কোনো শক্তি অভিজ্ঞতার নেই। বিবেকের মতো এরও কর্মক্ষমতা। নেই বললেই হয়। এ যেটুকু বলে দেয় তা হচ্ছে এই যে আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের। কোনো পার্থক্য নেইষ যে পাপ আমরা একবার করেছি এবং অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেই করেছি সেই পাপ ভবিষ্যতে আবার আমরা করব, আর বেশ আনন্দের সঙ্গেই।

এটা তাঁর কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল যে প্রায়োগিক পদ্ধতিটাই হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি যার সাহায্যে জীবনের সমস্ত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের বৈজ্ঞানিক অনুশীলন সম্ভব। সেদিক থেকে ডোরিয়েনকে নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে, এবং সম্ভবত সেই পরীক্ষায় বিশেষ ফলোভেরও সম্ভাবনা রয়েছে। সাইবিল ভেন্যকে তিনি যে হঠাৎ উন্মাদের মতো ভালোবেসে। ফেললেন, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটা কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। অবশ্য এর মূল কারণ যে কৌতূহল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কৌতূহলই নিছক নয়, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আকাঙ্খা বটে। তবু এটা সাধারণ উচ্ছ্বাস নয় এ উচ্ছ্বাস সত্যিই বড়ো জটিল। যে অনুভূতিটা প্রাথমিক পর্যায়ে নিছক শিশুসুলভ একটা কৌতূহল ছিল, সেইটাই হঠাৎ তার নিজের কাছেই ইন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল, পরিণত হল কামনায়, ভোগ-সম্ভাবনার অতৃপ্তিতে। এইটাই তার কাছে বিপজ্জনক। এই কামনাগুলিই আমাদের ওপর চিরকাল প্রভাব বিস্তার করে। এসেচ্ছে, অত্যাচার করে এসেছে আমাদের। অথচ এদের আসল বুপটি সম্বন্ধে আমরা সব সময় ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে প্রবঞ্চিত করেছি আমাদের।

লর্ড হেনরি যখন এই সব আলোচনা করছিলেন, এমন সময় দরজায় একটা টোকা পড়ল, তাঁর। চাকর ঘরে ঢুকে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল যে ডিনারে যাওয়ার সময় হয়েছে। তিনি উঠে পড়লেন, তাকিয়ে দেখলেন রাস্তার দিকে। বিপরীত দিকে বাড়িগুলির ডানালার ওপরে। অস্তগামী সূর্যের লাল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জানলার কাঁচগুলি আগুনে পোড়ানো ধাতুর মতো লাল টকটকে করছে। মাথার ওপরে আকাশের রঙ বিবর্ণ গোলাপের মতো। বন্ধুর আগুনের মতো রঙিন জীবনের কথা মেন পড়ে গেল তাঁর। কেমন করে কোথায় কোন পথ দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন এগিয়ে চলবে তা কে বলবে?

রাত্রি সাড়ে বারোটার সময় বাড়ি ফিরলেন তিনি, দেখলেন, টেবিলের ওপরে একখানা টেলিগ্রাম পড়ে রয়েছে। তিনি সেটি খুললেন, দেখলেন টেলিগ্রামটি ডোরিয়েনের কাছ থেকে এসেছে। সংক্ষিপ্ত সংবাদ: ডোরিয়েন আর সাইবিল বিয়ে করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *