কোদণ্ড পাহাড়ের বা-রহস্য

কোদণ্ড পাহাড়ের বা-রহস্য

হাথিয়াগড় বনবাংলো চৌকিদার ঘন্টারাম সাবধান করে দিয়েছিল, সম্প্রতি তল্লাটে একটা মানুষখেকো বাঘের খুব উপদ্রব। কাজেই আমরা যেন সবসময় হুঁশিয়ার থাকি।

কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের পাল্লায় পড়ে বরাবর যা হয়, এবারও তাই হল। হাথিয়াড় জঙ্গলে কোদণ্ড নামে একটা হাজার দশেক ফুট উঁচু পাহাড় আছে এবং সেই পাহাড় থেকে একটা জলপ্রপাত নেমে প্রকাণ্ড জলাশয় সৃষ্টি করে নদী হয়ে বয়ে গেছে। জলাশয়ে নাকি প্রচুর মাছ। কর্নেল ছিপ ফেলে সেই মাছ ধরবেন এবং আমাকে অসংখ্য দিব্যি কেটে বলেছিলেন, না ডার্লিং! পাখি-প্রজাপতি আর নয়। এবার মাছ–স্রেফ মাছই আমার লক্ষ্য। ছিপে গাঁথতে পারি বা না পারি, সেটা কোনো কথা নয়। ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। জলটাও খুব স্বচ্ছ। কাজেই বঁড়শির টোপের কাছে মাছের আনাগোনা স্পষ্ট দেখা যাবে। আসলে আমি মাছের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ইদানীং একটু মাথা ঘামাচ্ছি। কাজেই ডার্লিং ….।

বিশেষ করে মনস্তত্ত্বের কচকচি শোনার চেয়ে তক্ষুণি রাজি হওয়াই ভাল। তা ছাড়া বক্তৃতা শোনার চেয়ে মানুষখেকো বাঘ-টাঘের পেটে গিয়ে লুকানো আরও ভাল।

জলাশয়টি এবং পারিপার্শ্বিক অবশ্য সত্যিই সুন্দর। যেন ছবিতে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ। অক্টোবরের বিকেলের রোদ্দুরটিও খাসা। কর্নেল ছিপ ফেলে বসে আছেন। স্বচ্ছ জলের তলায় ছোট-বড় নানা জাতের মাছের আনাগোনাও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মাছগুলো বড় সেয়ানা। টোপের আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু টোপে মুখ দিচ্ছে না। এদিকে আমার বাঘের ভয়। বারবার পেছনটা এবং এদিক-ওদিক দেখে নিচ্ছি। বাতাস বন্ধ। কোথাও একটুখানি শব্দ হলেই চমকে উঠছি। কর্নেলের দৃষ্টি কিন্তু ফাতনার দিকে। প্রপাতটা বেশ খানিকটা দূরে বলে জল পড়ার শব্দ অত প্রচণ্ড নয়, আবছা।

একটু পরেই গণ্ডগোল বাধাল হতচ্ছাড়া বাউন্ডুলে একটা রঙবেরঙের প্রজাপতি। কোত্থেকে, উড়ে এসে ফাতনার ওপর বসল। অমনি যথারীতি প্রকৃতিবিদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। ক্যামেরাটি তাক করলেন। কিন্তু ধূর্ত প্রজাপতি বেগতিক বুঝে উড়ে গেল। তখন বাইনোকুলারে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর জয়ন্ত, জয়ন্ত! ছিপটা…বলে উধাও হয়ে গেলেন। আমি ডাকতে গিয়ে চুপ করলুম। রাগে, ক্ষোভে মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না। একেই বলে, স্বভাব যায় না মলে!

কিন্তু কর্নেলের অন্তর্ধানের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষখেকো বাঘটার আতঙ্ক এসে আমাকে কাঠ করে। ফেলল।

এমনই কাঠ সেই মুহূর্তে ছিপের হুইলে ঘর-ঘর শব্দ হল এবং শেষে বঁড়শিগেলা শক্তিমান

অমনি বাঁদিকে ঝোঁপের আড়াল থেকে প্রকৃতিবিদের গলা শুনতে পেলুম। তোমাকে ছিপটার দায়িত্ব দিয়েছিলুম জয়ন্ত!

ছিপটা তখন জলার মাঝখানে একবার খাড়া হচ্ছে, একবার কাত হচ্ছে। ফেস করে শ্বাস ছেড়ে বললুম, সরি! কিন্তু আপনি দিব্যি করেছিলেন, পাখি-প্রজাপতির পেছনে দৌড়বেন না।

কর্নেল ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, অভ্যাস, ডার্লিং! যাই হোক, ঘরামই এখন ভরসা। তাকে ডেকে এনে দামি ছিপটা উদ্ধার করা দরকার। আশা করি, মাছটার লোভে সে…

হঠাৎ কোথাও পরপর দুবার গুলির শব্দ শোনা গেল। কর্নেল থেমে গিয়ে কান খাড়া করে শুনলেন। ব্যস্তভাবে বললুম, কোনও শিকারি, নিশ্চয় মানুষখেকো বাঘটাকে গুলি করল।

কর্নেল বললেন, হুঁ, রাইফেলের গুলির শব্দ। এসো তো, ব্যাপারটা দেখা যাক।

উনি পা বাড়ালে বললুম, জঙ্গলে কোথায় কোন শিকারি গুলি করল, খুঁজে বের করবেন কীভাবে?

কান, জয়ন্ত, কান। কর্নেল নিজের একটা কান দেখালেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মার জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলুম। কোন শব্দ কোনদিকে কতদূরে হল, সেটা আঁচ করতে পারি। চলে এসো।

ঘন জঙ্গল আর পাথরের চাই ছড়ানো। যেতে-যেতে প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করছি, বাঘটা না মরে জখম হয়ে থাকলে দৈবাৎ তার সামনে গিয়ে পড়ি তো অবস্থা শোচনীয় হবে। তবে কর্নেল আমার আগে যাচ্ছেন, সেটাই ভরসা। জখমি বাঘ তার ওপরই ঝাঁপ দেবে। ঝাঁপ দিলে আমি চাচা আপন প্রাণ বাঁচা করে পিঠটান দেবই। কোনও মানে হয়?

ক্রমশ জঙ্গল ঘন হচ্ছিল। একে তো বিকেলবেলা, তার ওপর ঘন এবং উঁচু-নিচু গাছের ছায়া আবছা আঁধার করে রেখেছে। কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটছেন। আমি বারবার হোঁচট খাচ্ছি। একখানে একটু খোলামেলা জায়গা, ঘাসে ঢাকা জমি। জমিটার মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড পাথর। পাথরের নিচের ঘাসগুলো বেশ উঁচু। তার ভেতর কী-একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। তখন কর্নেল দৌড়ে গেলেন। আমিও।

গিয়ে দেখলুম এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

রক্তাক্ত দেহে একজন মানুষ পড়ে রয়েছে। পরনে আঁটোসাঁটো শিকারির পোশাক। পায়ে হান্টিং জুতো। একপাশে রাইফেলটা ছিটকে পড়ে আছে। ফালাফালা পোশাক আর চাপচাপ রক্ত। কর্নেল তাঁর মুখের কাছে ঝুঁকে গেলে অতিকষ্টে বললেন, বা… এবং তারপর শরীরটা বেঁকে স্থির হয়ে গেল।

কর্নেল সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখটা গম্ভীর।

উত্তেজিতভাবে বললুম, বা বললেন! মানে বাঘ, কর্নেল! মানুষখেকো বাঘটা ওকে আক্রমণ করেছিল।

কর্নেল চুপচাপ দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখছিলেন। তারপর রাইফেলটা কুড়িয়ে নিলেন। চেম্বার খুলে পরীক্ষা করে দেখে আস্তে বললেন, অটোমেটিক রাইফেল! কিন্তু…।

কর্নেল ঘাসে-ঢাকা জমিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে কিছুক্ষণ কী-সব দেখলেন-টেখলেন। জিগ্যেস করলুম, কিন্তু কী, কর্নেল?

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, তুমি বডি পাহারা দাও। এই রাইফেলটা নাও। সাবধান, আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, এটা অটোমেটিক। এই পাথরটা যথেষ্ট উঁচু আর নিরাপদ। তুমি পাথরটায় বসে বডি পাহারা দেবে। আমি আসছি।

বলে রাইফেলটা আমার হাতে দিয়ে ব্যস্তভাবে জঙ্গলে ঢুকলেন এবং নিপাত্তা হয়ে গেলেন। কোনও আপত্তি করার সুযোগই পেলুম না। হাতে রাইফেল। তাতে কী? এই ভদ্রলোকের অবস্থাটা কী হয়েছে? শিকারের বইয়ে পড়েছি, মানুষখেকো বাঘ অতিশয় ধূর্ত।

সাবধানে উঁচু পাথরটার মাথায় চড়ে বসলুম। অদূরে পাহাড়টার কাঁধ ছুঁয়েছে সূর্য। রোদ্দুর ফিকে হয়ে আসছে। এতক্ষণে পাখ-পাখালির তুমুল কলরব শুরু হল। কর্নেল কখন ফিরবেন কে জানে! কাছাকাছি জঙ্গলের ভেতর মানুষখেকোটা কোথাও নিশ্চয় ওঁত পেতে আছে। শিকারটিকে কড়মড়িয়ে খেতে আসবে। তখন ধরা যাক, গুলি করলুম। কিন্তু যদি ফস্কে যায় গুলি? বাঘটা লাফ দিয়ে আমকে…সর্বনাশ!

দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকল। জীবনে এমন সাংঘাতিক অবস্থায় কখনও পড়িনি। পাথরটার সবচেয়ে উঁচু অংশে বসে আছি। তাই নিচের রক্তাক্ত মৃতদেহ চোখে পড়ছে না। পড়লে ওই ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে আরও ভয় পেতুম।

কিন্তু কর্নেল আমাকে মড়ার পাহারায় বসিয়ে রেখে কোথায় গেলেন? বাংলো এখান থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে। চৌকিদার ঘন্টারামকে দিয়ে হাথিয়াগড় টাউনশিপে খবর পাঠাবেন কী? কার কাছে খবর পাঠাবেন। হয়তো থানায়। তা হলে এখানে কর্নেল এবং পুলিশ এসে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবে! এদিকে সঙ্গে টর্চ নেই।

এইসব দুর্ভাবনায় অস্থির হচ্ছি, এমন সময়ে সামনেকার জঙ্গল কুঁড়ে দুজন লোক বেরুল। তারা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। একজন হিন্দিতে বলল, হায় রাম! বাবুজির বরাতে এই ছিল? তারপর রক্তাক্ত দেহটির দিকে ঝুঁকে কান্নাকাটি শুরু করল।

অন্যজন বলল, অত করে বারণ করলুম। বাবুজি শুনলেন না। হায় হায়! এ কী হল?

জিগ্যেস করলুম, আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

প্রথমজন চোখ মুছে বলল, হাথিয়াগড় থেকে, বাবুজি! একজন বুড়োসায়েব খবর দিলেন, আমাদের বাবুজি বাঘের পাল্লায় পড়ে মারা গেছেন।

দ্বিতীয়জন বলল, দেরি কোরো না! হাত লাগাও। এখানে বডি পড়ে থাকলে মানুষখেকো বাঘটা বডি খেতে আসবে। ওঠাও ওঠাও!

প্রথমজন বলল, বাবুজির বন্দুক?

বললুম, এই যে!

রাইফেলটা আমার হাতে দেখামাত্র সে হাত বাড়াল। দিন স্যার! বাবুজির খুব শখের বন্দুক ওটা!

এই সময় কাছাকাছি কোথাও জঙ্গলের ভেতর বাঘটা ডাকল, আ-উ-ম। তারপর চাপা গরগর গজরানিও শোনা গেল। আমি পাথর থেকে নামতেই রাইফেলটা প্রায় ছিনিয়ে নিল প্রথম লোকটা। আবার বাঘের গরগর গর্জন শুনতে পেলুম। রাইফেল বগলদাবা করে প্রথম লোকটি তাড়া দিল, বাঘটা এসে পড়েছে। বডি ওঠাও।

দুজনেই তাগড়াই চেহারার লোক। গায়ে জোর আছে বোঝা গেল। শিকারি ভদ্রলোকের রক্তাক্ত মৃতদেহ কাঁধে তুলে ওরা ব্যস্তভাবে হাঁটতে শুরু করল।

আমি ওদের অনুসরণ করলুম। জঙ্গলের ভেতর ততক্ষণে আবছা আঁধার ঘনিয়েছে। ওরা লম্বা পায়ে দৌড়চ্ছে। নাগাল পাচ্ছি না। খানিকটা এগিয়ে গেছি, ডানদিকে আবার বাঘের গরগর গজরানি শুনতে পেলুম। একখানে গাছপালার ফাঁক গলিয়ে একটু ফিকে আলো এসে পড়েছে। সেখানে একটা ঝোঁপের ফাঁকে বাঘের মাথা দেখতে পেলুম।

অমনি আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। হ্যাঁ, মাথা খারাপই বটে। নইলে কী করে গাছে চড়ে বসলুম এর ব্যাখ্যা হয় না।

গাছটা অবশ্য তত উঁচু নয় এবং কয়েকটা ডাল নিচুতে নাগালের মধ্যেই ছিল। যতটা উঁচুতে পারা যায়, উঠে গেলুম। হাত ছড়ে গেল। জামাও একটু-আধটু ফদাফাঁই হল। ডালে বসে নিচের দিকে লক্ষ্য রাখলুম, বাঘটা মড়া হাতছাড়া হওয়ার রাগে এবার আমাকেই খাওয়ার জন্য ফন্দিফিকির করছে কি না। শিকারের বইয়ে বাঘের গাছে চড়ার কথাও পড়েছি। সেটাই দুর্ভাবনার ব্যাপার।

কিন্তু বাঘটা আর গজরাচ্ছে না। হয়তো মড়াবাহী লোকদুটোকেই চুপি-চুপি অনুসরণ করেছে। এখন কথা হল, কর্নেলের কাছেই ওরা ওদের বাবুজির খবর শুনেছে, অথচ, কর্নেল ওদের সঙ্গে এলেন না কেন? সম্ভবত ওরা দৌড়ে এসেছে এবং কর্নেল তাই ওদের নাগাল পাননি। এবার যে-কোনও মুহূর্তে এসে পড়বেন। কান খাড়া করে বসে রইলুম।

কতক্ষণ কেটে গেল। জঙ্গল অন্ধকারে ছমছম করতে থাকল। চারদিকে নানারকমের ভূতুড়ে শব্দ। কাঠ হয়ে বসে আছি, হঠাৎ নিচের দিকে টর্চের আলোর ঝলক এবং কর্নেলের গলা শুনতে পেলুম। এই যে! এদিকে।

সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া দিলুম, কর্নেল! কর্নেল!

নিচে থেকে আমার ওপর আলো এসে পড়ল। কর্নেল বললেন, তুমি গাছের ডগায় কী করছ, জয়ন্ত? তারপর ওঁর স্বভাবসিদ্ধ হা-হা অট্টহাসি।

রাগ চেপে অতি কষ্টে গাছ থেকে নেমে বললুম, কোনও মানে হয়? লোকদের খবর দিয়ে এতক্ষণে এসে জিগ্যেস করছেন, গাছের ডগায় কী করছি!

কর্নেলের সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার আর জনা-দুই কনস্টেবল এসেছেন। কর্নেল আমার কথা শুনে বললেন, লোকদের খবর দিয়ে মানে? যাঁদের খবর দিতে গিয়েছিলুম, তারা তো আমার সঙ্গে।

অবাক হয়ে বললুম, দুজন লোক বডি তুলে নিয়ে গেল! তারাই বলল…

আমাকে থামিয়ে কর্নেল বলে উঠলেন, মাই গুডনেস! আমারই বুদ্ধির ভুল! আমাকে নির্ঘাত বাহাত্তুরে ধরেছে, আগাগোড়া খুলে বললো তো জয়ন্ত!

সব শোনার পর কর্নেল বললেন, জয়ন্ত এমন বোকামি করে বসবে, ভাবিনি, যাই হোক, চলুন মিঃ সিনহা। আগে ঘটনাস্থলটা দেখাই।

পুলিশ অফিসারটির নাম মিঃ সিনহা। তিনি পা বাড়িয়ে বললেন, জয়ন্তবাবু বললেন, সত্যিই বাঘটাকে দেখেছেন। গজরানিও শুনেছেন। কাজেই ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে হয়ে গেল দেখছি।

কর্নেল এদিকে-ওদিকে টর্চের আলো ফেলেছিলেন। একখানে আলো পড়তেই বাঘের মাথাটা ঝোঁপের ফাঁকে দেখা গেল। সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কনস্টেবলরা বন্দুক তাক করল। কর্নেল তাদের বললেন, সবুর! খামোকা গুলি খরচ করে লাভ নেই।

তারপর নির্ভয়ে এগিয়ে গেলেন ঝোঁপটার দিকে। বাঘটা আর একটুও গর্জন করছিল না। কর্নেল সোজা গিয়ে বাঘের মাথাটা খামচে ধরলেন এবং হা-হা করে হেসে উঠলেন।

মিঃ সিনহা বললেন, এ কী কর্নেল!

হ্যাঁ–একটা নিছক ডামি মুন্ডু। নকল মুন্ডু। কর্নেল বাঘের মুন্ডুটা উপড়ে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। আসলে জয়ন্তকে ভয় দেখাতেই এই চালাকি করেছিল।

বললুম, কিন্তু বাঘের ডাক?

ওটাও নকল। কর্নেল সেই খোলা ঘাসজমিটায় পৌঁছে ফের বললেন, অনেক শিকারি অবিকল বাঘের ডাকের নকল করে বাঘকে আকৃষ্ট করেন। জিম করবেট বা অ্যান্ডারসনের শিকার-কাহিনিতে পড়েছি। তা ছাড়া জয়ন্ত যে অবস্থায় পড়েছিল, শেয়ালের ডাককে বাঘের ডাক বলে ভুল হতো ওর!

ক্ষুব্ধ হয়ে বললুম, আমি অত বোকা নই।

কর্নেল বললেন, মজাটা এই যে নিজের বোকামি নিজেই টের পাওয়া যায় না। ডার্লিং, কেউ এসে মড়াটা দাবি করলে সেটা না হয় দেওয়া চলে, হাতের সাংঘাতিক অস্ত্র-মানে, রাইফেলটা দেওয়া যায় না।

 খোলা জায়গাটায় কিছু আলো আছে তখনও। মিঃ সিনহা ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ টর্চের আলোয় খুঁটিয়ে দেখেছিলেন। বললেন, হুঁ তলার মাটিটা নরম। কিন্তু সত্যিই বাঘের পায়ের ছাপ নেই।

নেই। কর্নেল বললেন। সেটাই আমার সন্দেহের কারণ!

মিঃ সিনহা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বডিটা কোথায় পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলবে–এখনই ব্যবস্থা করা দরকার।

এতক্ষণে লক্ষ্য করলুম, তার হাতে একটা ওয়াকি-টকি রয়েছে। বেতারে চাপা গলায় থানায় মেসেজ পাঠালেন। তারপর বললেন, চলুন কর্নেল ফেরা যাক। আপনাদের বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে যাব।

সামান্য দূরে জঙ্গলের একটেরে পিচের রাস্তা। সেখানে পুলিশের জিপ অপেক্ষা করছিল।…

বনবাংলোর বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, ছিপটা আর মাছটার কথা ভেবে এ রাতে আমার ঘুমের বারোটা বেজে যাবে ডার্লিং! সকালে…

কথা কেড়ে বললুম, কিন্তু ওই শিকারি ভদ্রলোক পাণ্ডেজির ব্যাপারটা আমার ঘুমেরও বারোটা বাজাবে। কর্নেল হাসলেন। হুঁ, ব্যাপারটা অবশ্য রহস্যময়। তবে স্রেফ তোমার বোকামির জন্যই রহস্যটা ঘনীভূত হল। তোমার হাতে একটা রাইফেল ছিল জয়ন্ত। পাঁচটা গুলির তিনটে ভরা ছিল। তুমি ওদের বডি তুলে নিয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারতে–যতক্ষণ না আমি পৌঁছচ্ছি!

কিন্তু আপনি কোনও আভাস দিয়ে যাননি!

ঘটনার আকস্মিকতায়, ডার্লিং!কর্নেল সাদা দাড়ি চুলকে বললেন।দুবার গুলির শব্দ। তারপর পান্ডেজি বা বলেই শেষ-নিঃশ্বাস ফেললেন। বাঘের কথাই ভাবা সে-মুহূর্তে স্বাভাবিক। তারপর মনে হল, গুলি-খাওয়া বাঘ শিকারির ওপর ঝাঁপ দিলেও গর্জন করবে ক্রমাগত। অথচ গর্জনের শব্দ শুনিনি তো! তখনই প্রথম সন্দেহ জাগল। এটা কোনও হত্যাকাণ্ড নয় তো? সম্ভবত আমাদের হঠাৎ গিয়ে পড়ায় খুনিরা গা ঢাকা দিয়েছে। তা ছাড়া ঘাসের তলায় বাঘের পায়ের ছাপ নেই!

পান্ডেজি ভদ্রলোক কে?

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তারপর অভ্যাসমত চোখ বুজে বললেন, শিবচরণ পাণ্ডে হাথিয়াগড়ের বনেদি বংশের মানুষ। শিকারে প্রচণ্ড নেশা ছিল। আমার একজন পুরানো বন্ধুও বলতে পার ওঁকে। তারপর চোখ খুলে চাপাস্বরে বললেন, ফের, আসলে পাভেজির চিঠি পেয়েই এবার আমার এখানে আসা এবং প্রপাতের জলায় মাছ ধরতে যাওয়া।

চমকে উঠে বললুম, কী চিঠি?

গোয়েন্দাপ্রবর জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ভাজ করা চিঠি বের করে দিলেন। চিঠিটা পড়ে আরও অবাক হয়ে গেলুম। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটার বাংলা করলে এই দাঁড়ায় :

প্রিয় কর্নেল,

সম্প্রতি হাথিয়াগড় এলাকার একটা ধূর্ত মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। মানুষখেকো বাঘ ধূর্ত হয়। কিন্তু এ বাঘটা এমনই ধূর্ত যে, তার মানুষ মারার খবরই শুধু শুনি। কিন্তু মড়ার পাত্তা পাই না। খুব খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এটা কোনও ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপারটা হল : কোদণ্ড পাহাড়ের জলপ্রপাতের নিচে যে জলটা আছে, সেখানে বাঘটা জল খেতে আসবে ভেবে পরপর তিনটে রাত ওঁত পেতে ছিলুম। প্রতি রাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছি। প্রপাতের দিকটাতে একটা উঁচু পাথর জল থেকে মাথা তুলেছে সেটা দেখতে কাছিমের খোলের মতো। ওখানে হঠাৎ একটা আলো জ্বলে ওঠে। আলোটা কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে। তারপর নিভে যায়। এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। মাঝরাতে জ্যোৎস্নায় সব দেখতে পাই। প্রথমে আলোটা জ্বলে তারপর দেখি, একটা ছোট্ট নৌকো এগিয়ে চলেছে আলোটার দিকে। প্রথম দুটো রাত ভেবেছিলুম জেলে-নৌকো মাছ ধরছে। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব চলছে। কাদের এত সাহস হতে পারে? তৃতীয় রাতে জোরাল টর্চের আলো ফেলে নৌকোর লোকগুলোকে ডাকলুম। অমনি ওরা নৌকো অন্যদিকে ঘুরিয়ে দক্ষিণপাড়ে চলে গেল। অনেকটা ঘুরে পিচ রাস্তার ব্রিজ হয়ে সেখানে গেলুম। নৌকোটা বাঁধা আছে। লোক নেই। ব্যাপারটা রহস্যময়। সকালে আবার গেলুম সেখানে। নৌকোটা নেই। আমি এর মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। অনুগ্রহ করে রহস্যটা ফাস করে যান। শুভেচ্ছা রইল।

শিবচরণ পান্ডে

চিঠিটা ফেরত দিয়ে বললুম, রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি বটে!

হুঁ, রহস্য! কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন এবং চওড়া টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয়, শুনি জয়ন্ত!

একটু হেসে বললুম, আমি তো বোকা।

না না। বোকারা গাছে চড়তে পারলেই বুদ্ধি খোলে–চীনা প্রবাদ। তুমি গাছে চড়তে পেরেছ, ডার্লিং!

কথার ভঙ্গিতে আরও হাসি পেল। বললুম,তা ঠিক। তারপর থেকে আমার মাথা সত্যি খুলে গেছে। এখন বুঝতে পারছি, ওই জলায় কেউ বা কারা গোপনীয় কিছু করছে এবং পান্ডেজি সেটা দেখতে পেয়েছিলেন বলেই তাকে মেরে ফেলা হল।

আমরা গিয়ে না পড়লে-সরি, আপনি গিয়ে না পড়লে ওটা মানুষ-খেকো বাঘের হাতে মৃত্যু বলে চালানো সোজা ছিল।

বাঃ! অপূর্ব! খাসা বলেছ ডার্লিং! বৃদ্ধ ঘুঘুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

প্রশংসায় খুশি হয়ে বললুম, মানুষখেকো বাঘের ব্যাপারটাও রটনা বলে মনে হচ্ছে। যাতে জঙ্গলে লোকেরা না ঢোকে।

কর্নেল সায় দিলেন। ঠিক, ঠিক! বিশেষ করে ওই জলায় জেলেরা মাছ ধরতে যায়। তারাও বাঘের ভয়ে যাতায়াত বন্ধ করেছে। যাই হোক, সকাল ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই। তবে সত্যি জয়ন্ত, আমার ছিপটাও খুব দামি। আর মাছটাও নিশ্চয় বড়। দেখা যাক, ঘন্টারাম মাছটার লোভে আমার ছিপটা উদ্ধার করে দেয় নাকি। ঘন্টারাম! ঘন্টারাম! ইধার আও তুম!

কর্নেল ঘন্টারামকে ডাকতে থাকলেন। ঘন্টারামের সাড়া পাওয়া গেল কিচেন থেকে। সেই রাতের খাবার তৈরি করছিল। এই সময় হঠাৎ কর্নেল মুচকি হেসে চাপা গলায় বললেন, কিন্তু জয়ন্ত, তোমার থিওরিতে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। পান্ডেজির শেষ কথাটি বা…। এ সম্পর্কে তোমার কী বক্তব্য?

এবার একটু ঘাবড়ে গেলুম। বললুম, বা-রহস্য সত্যিই গোলমেলে। ওকে যদি মানুষেই হত্যা করে থাকে, বা… মানে, বাঘ বলছে চাইলেন কেন? বলেই ফের বুদ্ধি খুলে গেল। উত্তেজিতভাবে বললুম, হাঁ-বুঝেছি। পান্ডেজি এই নকল বাঘের মুন্ডুটা ঝোঁপের ফাঁকে দেখেছিলেন। মুন্ডুটা….

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মুন্ডুটা প্লাস্টিকে তৈরি খেলনার মুখোশ। তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ ডার্লিং! এই নকল মুন্ডু সম্পর্কেই হয়তো পাভেজির কিছু বক্তব্য ছিল। মৃত্যু সেই কথাটি শেষ করতে দেয়নি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা বা…রহস্যে আটকে যাচ্ছে দেখছি। নকল বাঘের মুভুর কথাই বা বলতে গেলেন কেন পান্ডেজি?

এতক্ষণে ঘন্টারাম সেলাম দিয়ে ঘরে ঢুকল। কর্নেল বললেন, এসো ঘন্টারাম। তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।

ঘন্টারাম বিনীতভাবে বলল, বোলিয়ে কর্নেলসাব। তাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।….

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভোরের দিকেই বোধহয় ঘুমটা আমাকে বাগে পেয়েছিল। কর্নেলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। বললেন, নটা বাজে। উঠে পড়ো ডার্লিং!

একটু অবাক লাগল। কর্নেলের প্রাতঃভ্রমণে বেরুনোর অভ্যাস আছে জানি। কিন্তু বরাবর সবখানেই সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে ঘোরাঘুরি শেষ করে এসে আমাকে ঘুম থেকে ওঠান। অথচ আজ সকালে নটা অবধি বাইরে ছিলেন।

তারপরই মনে পড়ে গেল ছিপ উদ্ধারের পরিকল্পনাটা। তাহলে ঘন্টারামকে নিয়ে প্রপাতের জলায় ছিপ উদ্ধারে গিয়েছিলেন। তাই এত দেরি? বললাম, ছিপটা পেলেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ! ঘন্টারামের ধারণা, ছিপসুন্ধু মাছটা জলার দক্ষিণে স্রোতের দিকটায় চলে গিয়েছিল। এতক্ষণ কয়েক মাইল দূরে চলে গেছে নদীর ধারে কোনও আদিবাসী বসতির কাছে গিয়ে পড়লে তাদের পেটে মাছটা হজম হয়ে গেছে। অবশ্য ছিপটা উদ্ধার করা যায়। দেখা যাক। বলে ইজিচেয়ারে বসলেন। চোখ বন্ধ। দাড়িতে আঙুলের চিরুনি কাটতে থাকলেন।

বাথরুম সেরে এসে দেখি, টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেডি। ঘন্টারামকে আরও গম্ভীর দেখাচ্ছে। সে চলে গেলে বললুম, আপনি খুব মুষড়ে পড়ছেন দেখছি। কিন্তু ঘন্টারামের মুখটা বড় বেশি তুম্বো হওয়ার কারণ আশা করি মাছ না পাওয়ার ব্যর্থতা নয়?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ জয়ন্ত! বৃদ্ধ ঘুঘু মিটিমিটি হাসতে থাকলেন। বেচারাকে সাতসকালে বঁড়শি-বেঁধা মাছের বদলে একটা মড়া ঘাঁটতে হয়েছে। তার ওপর ওর বউ ওকে মড়া ঘাঁটার জন্য আবার একদফা স্নান করিয়েছে।

চমকে উঠে বললুম মড়া?

পান্ডেজির ডেডবডি। কর্নেল টোস্টে কামড় দিয়ে বললেন, পুলিশ অফিসার মিঃ সিনহা খুব জেদি মানুষ। পুরো পুলিশবাহিনী এবং বন দফতরের সব কজন রক্ষী, মায় রেঞ্জার সাহেবকেও লড়িয়ে দিয়েছিলেন। তল্লাটের বনজঙ্গল শ্মশান-মশান সারারাত চষা হয়েছে। বেগতিক দেখে খুনিরা পান্ডেজির বডি.ওই জলায় তলার পাথর বেঁধে ডুবিয়ে রেখেছিল। ঘন্টারাম সেটা উদ্ধার করেছে। সে মোটা বখশিস পাবে সরকার থেকে! কিন্তু…

কর্নেল খাওয়ায় মন দিলেন। বললুম, কিন্তু কী?

ওই বা….।

চুপ করে গেলুম। বা-রহস্য সত্যিই নির্ভেজাল রহস্য। এই সময় দরজা দিয়ে চোখে পড়ল, বাংলোর লনে ঘন্টারামের হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা সেই নকল বাঘের মুন্ডুটা নিয়ে খেলছে। তার মা এসে বাচ্চাটাকে বকাবকি করে কোলে তুলে নিল এবং মুভুটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বুঝলাম, ঘন্টারামের বউ ওটাকে অলুক্ষুণে ভেবেছে। কিন্তু মুন্ডুটা কর্নেল কি বাচ্চাটাকে উপহার দিয়েছিলেন?

প্রখ্যাত গোয়েন্দাপ্রবর কীভাবে সেটা আঁচ করে বললেন, ঘন্টারামের বউ খুব ভয় পেয়ে গেছে, জয়ন্ত! ওর ধারণা জীবজন্তুর নকল মুন্ডু বানানো ঠিক নয়। এতে তাদের ঠাট্টা করা হয়। তার ওপর মানুষখেকো বাঘ। তার নকল মুন্ডু! মানুষখেকো বাঘটা রেগে আগুন হয়ে গেছে এতে।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। একটু পরে কফিতে মন দিলেন, ওঁর প্রিয় পানীয়। বললুম, জলার সেই কাছিমের খোলের মতো পাথরটা পুলিশ পরীক্ষা করল না? ওখানেই তো পান্ডেজি আলো দেখেছিলেন।

নিরেট পাথর। কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন।

নৌকো নিয়ে ওখানে গিয়েছিলুম। তা ছাড়া পাথরটা বেজায় পিছল। শ্যাওলা জমে আছে। ওঠা কঠিন। উঠলেও দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। মিঃ সিনহা পা হড়কে জলে পড়ে গেলেন। পুলিশের উর্দি, রিভলবার সব ভিজে কেলেঙ্কারি।

একটু ভেবে বললুম, তা হলে আলোটা অন্য কোথাও দেখে থাকবেন পাভেজি। দূর থেকে দেখা ভুল হতেই পারে!

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলো, বেরুনো যাক।

ছিপ উদ্ধারে নাকি?

ঘন্টারামকে সে-দায়িত্ব দিয়েছি। আমরা কোদন্ড পাহাড়ে জলপ্রপাতের মাথায় উঠব, ডার্লিং! একটু কষ্টকর। তবে তোমার তো মাউন্টেনিয়ারিঙে ট্রেনিং নেওয়া আছে। এসো, বেরিয়ে পড়ি….!

এই খেয়ালি বুড়োর পাল্লায় পড়ে অনেকবার ভুগেছি। কিন্তু সে-কথা বলতে গেলেই উনি আমার মাথার ঘিলুর দিকে আঙুল তুলবেন। সবই নাকি আমারই বোকামির ফল। কাজেই কথা না বাড়ানোই ভালো। তবে এবারকার কোদণ্ড পর্বতারোহণ মন্দ লাগছিল না। প্রপাতটা শুধু সুন্দর নয়, যেন একটা প্রাকৃতিক অর্কেস্ট্রাও। তাছাড়া দুধারে বৃক্ষলতা এবং রঙবেরঙের ফুলে সাজানো।

ফুল থাকলে প্রজাপতি থাকবে এবং গাছ থাকলে পাখি। প্রকৃতিবিদ প্রপাতের মাথায় চড়তে চড়তে প্রচুর ছবি তুললেন। বাইনোকুলার চোখে রেখে কতবার থেমে পড়লেন। আমি যখন মাথায় পৌঁছে গেছি তখন উনি ফুট বিশেক নিচে একটা পাথরের চাতালে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করেছেন। ওপরে আসলে একটা নদী। নদীটা এখানে এসে নিচে ঝাঁপ দিয়ে প্রপাত সৃষ্টি করেছে। গনগনে রোদ্দুর। তাতে পাহাড়ে চড়ার পরিশ্রম। হাঁপ ধরে গেছে! একটা ঝাকড়া গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালুম। যেখানে পাথর মাটি মিশে আছে। ঘন জঙ্গল। দূরে উত্তরে বনবাংলোটি দেখা যাচ্ছিল। ক্লান্তভাবে গাছের নিচে পাথরটাতে বসেছি, অমনি পেছন ঝোপে মচমচ শব্দ হল। ঘুরে দেখার সঙ্গে-সঙ্গে দুটো লোক বাঘের মতো আমার ওপর এসে পড়ল এবং মুখে টেপ সেঁটে দিল। চাচানোর সুযোগই পেলুম না। কাল বিকেলে দেখা সেই লোকদুটোই বটে।

একজন একটা ছুরি গলায় ঠেকিয়েছিল। কাজেই হাত-পা নাড়ানো বা ধস্তাধস্তির উপায় নেই। গলায় ছুরি ঢুকে যাবে।

তারপর আমার চোখে রুমাল পড়ল এবং টের পেলুম আমি ওদের কাঁধে। কাল বিকেলে পান্ডেজির মড়া যেভাবে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেভাবেই আমাকেই নিয়ে চলল ওরা।

কতক্ষণ পরে কাঁধ থেকে আমাকে নামিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর চোখ থেকে রুমাল খুলে নিল। মুখের টেপটা কিন্তু খুলল না। জায়গাটা প্রথম কিছুক্ষণ অন্ধকার মনে হচ্ছিল। একটু পরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল। তখন দেখলুম, এটা একটা মন্দির। ফাটলধরা এবং পোডড়া মন্দির। দেয়াল ছুঁড়ে শেকড়বাকড় বেরিয়েছে। সামনে বেদির ওপর শিবলিঙ্গ। বেদির একপাশে একজন গাদাগোব্দা ষন্ডামার্কা চেহারার লোক পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পেল্লায় গোঁফ। কুতকুতে চোখে ক্রুর হাসি। সে খৈনি ডলছিল। খৈনিটা দুই সাঙাতকে বিলি করে বাকিটুকু নিজের মুখে ঢোকাল। তারপর হিন্দিতে বলল, টেপ খুলে দে। কথা বের করি।

হ্যাঁচকা টানে আমার মুখের টেপ খুলল একজন। যন্ত্রণায় আঃ করে উঠলুম। বেদির লোকটা বলল, এই ছোট টিকটিকি! পাণ্ডে ব্যাটাচ্ছেলে মরার সময় কী বলেছে?

ভয়ে-ভয়ে বললুম, বা–

চো-ও-প! বলে সে পাশ থেকে একটা জিনিস তুলে দেখাল। জিনিসটা অবিকল মানুষের হাতের গড়ন। কিন্তু পাঁচটা আঙুল নখের মতো বাঁকা এবং ধারালো। দেখেছিস এটা কী? এর নাম বাঘনখ। পাণ্ডের মতো ফালাফালা করে ফেলবো। কলজে উপড়ে নেবো। সত্যি কথা বলো!

মিনতি করে বললুম, বিশ্বাস করুন। পাণ্ডেজি শুধু বা বলেই মারা যান।

শুধু বা! আর কিছু নয়? বলে সে বাঘনখটা উঁচিয়ে ধরল। আঁতকে উঠে বললুম, বিশ্বাস করুন। শুধু বা!

লোকটা তার সাঙাত দুজনকে বলল, তোমরা এবার বুড়ো টিকটিকিটাকে ধরে নিয়ে এসো। বেগড়বাই করলে ছুঁড়ে প্রপাতের তলায় ফেলে দেবে।

ওরা তখুনি বেরিয়ে গেল। কর্নেলের জন্য আঁতকে কাঠ হয়ে রইলুম। চোখে বাইনোকুলার রাখলে ওঁর আর কোনও দিকে মন থাকে না। সেটাই ভাববার কথা।

লোকটা বলল, এই উল্লুক! বা মানে কী বুঝেছিস?

আজ্ঞে, বা মানে বাঘ।

আর ওই দাড়িওলা বুড়ো বুঝেছে?

সেটা ওঁর মুখেই শুনবেন। আমাকে তো উনি খুলে কিছু বলেননি।

লোকটা উঠে দাঁড়াল। বলল, বড্ড দেরি করছে। হলটা কী? একটা বাহাত্তুরে বুড়োকে ধরে আনতে এতক্ষণ লাগছে! বলে সে মন্দিরের দরজার কাছে গেল। তারপর আপনমনে গজগজ করতে থাকল।

এই সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না। গায়ের জোরে ওর সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। তাই নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে বেদি থেকে বাঘনখটা তুলে নিলাম।

কিন্তু লোকটা কীভাবে যেন টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর আমার হাতে ওটা দেখেই পকেট থেকে ছুরি বের করল। আমার হাতে বাঘনখ ওর হাতে ছুরি। পরস্পর পরস্পরকে তাক করছি এবং দুজনের মুখ থেকেই হুমহাম গর্জন বেরুচ্ছে। দুজনে বেদী চক্কর দিচ্ছি। আমি মরিয়া, সেও মরিয়া।

হঠাৎ সেই সময় শিবলিঙ্গটা নড়তে শুরু করল। তারপর একপাশে কাত হয়ে পড়ল এবং আমাদের দুজনকেই হকচকিয়ে দিয়ে একটা মুণ্ডু বেরুল।

মুন্ডুটিতে টুপি এবং সাদা দাড়ি। সেটি প্রখ্যাত ঘুঘুবুড়ো কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের।

নাকি স্বপ্ন দেখছি?

উঁহু, স্বপ্ন নয়। এক লাফে কর্নেল বেদি ফুঁড়ে বেরিয়ে রিভলভার তাক করলেন লোকটার দিকে। সে ছুরি ফেলে দিয়ে দুহাত ওপরে ওঠাল এবং দেয়ালে সেঁটে গেল। কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। মন্দিরের ভেতর যেন বাজপড়ার শব্দ। বললেন, কী বাবুরাম! কেমন জব্দ। শাবাশ জয়ন্ত! ব্রাভো!. এই তো চাই।

বাইরে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল। পুলিশ অফিসার মিঃ সিনহাকে আসতে দেখলুম। সঙ্গে কয়েকজন কনস্টেবল। তারা এই বাবুরামের দুই সাঙাতের হাতে-হাতে দড়ি এবং সেই দড়ি কোমরেও পরিয়ে টেনে আনছে। যেন এই শিবমন্দিরে জোড়াপাঁঠা বলির জন্য আনা হচ্ছে।

কর্নেল ডাকলেন, ভেতরে আসুন মিঃ সিনহা। স্বয়ং বা-বাবাজি ধরা পড়েছে।

মিঃ সিনহা ঢুকেই দৃশ্যটা দেখে একচোট হাসলেন। দুজন কনস্টেবল বাবুরামের হাতে হাতকড়া এঁটে দিল। মিঃ সিনহা এবার ওলটানো শিবলিঙ্গ দেখে অবাক হয়ে বললেন, এ কী!

কর্নেল বললেন, ওখান দিয়ে আমার আবির্ভাব ঘটেছে। একটু দেরি হলেই রক্তারক্তি হয়ে যেত। আসলে ওটা একটা সুড়ঙ্গ পথ।

মিঃ সিনহা উঁকি মেরে দেখে বললেন, কী আশ্চর্য!

কর্নেল বললেন, প্রপাতের একধারে দাঁড়িয়ে পাথরের আড়ালে একটা ফোকর আবিষ্কার করেছিলুম। ঢুকে দেখি এটাই সেই সুড়ঙ্গপথ। ধাপে-ধাপে কোদণ্ডদেবের মন্দিরে উঠে এসেছে। হ্যাঁ, আসল কথাটা বলা দরকার। ঘন্টারামই বলেছিল এই মন্দিরের তলায় নাকি একটা সুড়ঙ্গপথ আছে। সেখানে তার মাসতুতো ভাই দাগি ফেরারি আসামি এই বাবুরাম লুকিয়ে থাকে বলে তার ধারণা। ঘন্টারাম খুব নীতিবাগীশ লোক। তাকে সরকার থেকে পুরস্কার পাইয়ে দেবেন মিঃ সিনহা। তবে আপনার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। কথামতো আপনি দলবল নিয়ে এখানে না এসে পড়লে জয়ন্ত বেচারাও….

রেগেমেগে বললুম, বাঘনখ দিয়ে বাবুরামকেও বা বলিয়ে ছাড়তুম।

কর্নেল হাসলেন। খুনের দায়ে পড়তে ডার্লিং। যাই হোক, মিঃ সিনহা, মন্দিরের তলায় একটা কুঠুরিতে পাণ্ডেজির রাইফেল আর প্রচুর ডাকাতির মাল মজুত রয়েছে। আসামিদের থানায় পাঠিয়ে দিন। আর আপনার হাতের ওয়াকি-টকিতে মেসেজ পাঠান। জিনিসগুলো উদ্ধার করা দরকার।

বলে আমার হাত থেকে বাঘনখটি নিয়ে কর্নেল মিঃ সিনহাকে দিলেন এবং আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলো ডার্লিং! খুব ধকল গেছে তোমার বাংলোয় ফেরা যাক।

সেই গাছটার কাছে এসে বললুম, বা-রহস্য ফাঁস হল। কিন্তু আলো-রহস্য?

কর্নেল বললেন, তখন আমাকে নিচে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলে, ওখান থেকেই টর্চের আলো দেখাত বাবুরাম। তখন ওর দলের লোকেরা ডাকাতি করা মাল নৌকোয় নিয়ে আসত। আসলে কোদণ্ডমন্দিরের পেছনে আদিবাসী জেলেদের একটা বসতি আছে। তারা প্রপাতের নিচের জলায় রাতবিরেতে জাল ফেলে মাছ ধরতে যেত। মানুষখেকো বাঘের ভয়ের চেয়ে পেটে খিদে নামক রাক্ষসের ভয় বেশি জয়ন্ত! বেচারারা এত গরিব যে নৌকো কেনার ক্ষমতা নেই। তো ওরা মাছ ধরে পাহাড়ি পথে বসতিতে ফিরে গেলে তখন বাবুরাম আলোর সংকেত করত।

বললুম, তাহলে পাণ্ডেজি পরে টের পেয়েছিলেন বাবুরাম ডাকুরই কীর্তি! তাই…

হ্যাঁ। বলে হঠাৎ কর্নেল বাইনোকুলার চোখে তুললেন এবং ঝোঁপঝাড় ভেঙে অদৃশ্য হলেন।

বুঝলুম, সেই সাংঘাতিক গাছটার তলায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওঁর অপেক্ষা করতে হবে! তবে আর হামলার ভয়টা নেই। অতএব সেই সুন্দর পাথরটাতে বসে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করায় বাধা নেই।….

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *