০৪. হেরাক্লিটাস

৪. হেরাক্লিটাস

 গ্রিকদের সম্পর্কে বর্তমানকালে দুটি বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে প্রচলিত। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি রেনেসাঁর যুগ থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বস্তুত সর্বজনীন ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল গ্রিকদের প্রতি প্রায়-কুসংস্কারের সমতুল্য একধরনের ভক্তি। ভাবা হতো যে তারা সব সর্বোত্তম কিছুর উদ্ভাবক, তাদের প্রতিভা ছিল এমন অতিমানবিক পর্যায়ের, যার সঙ্গে আধুনিক মানুষের সমতুলনার কথা প্রত্যাশাই করা চলে না। অন্য দৃষ্টিভঙ্গিটি অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিজ্ঞানের বিজয় আর সভ্যতার প্রগতির প্রতি আশাবাদী একধরনের বিশ্বাস দ্বারা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি এ রকম যে, চিন্তার জগতে গ্রিকদের অধিকাংশ অবদানই এখন বিস্মৃতির বিষয়। এ দুই দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটার প্রতিই ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষপাত নেই। আমি বলব, উভয় দৃষ্টিভঙ্গিই অংশত সঠিক এবং অংশত ভুল। বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশ করার আগে আমি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব, গ্রিক চিন্তাজগৎ থেকে আমরা কী ধরনের জ্ঞান এখনো পেতে পারি।

নানা ধরনের প্রকল্পই বিশ্বজগতের প্রকৃতি ও গঠন-কাঠামো সম্পর্কে সম্ভবপর। অধিবিদ্যার বিকাশ যতখানি ঘটেছে তাতে রয়েছে এসব প্রকল্পের এক ক্রমান্বয়িক পরিশীলন, রয়েছে সেসবের তাৎপর্যের বিকাশ এবং সেগুলোর বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তি মোকাবিলা করার জন্য প্রত্যেকটি প্রকল্পের পুনর্গঠন। এসব আনুমানিক তত্ত্ব অনুসারে জগতের ধারণা গঠন করতে পারার মধ্যে একধরনের কল্পনাপ্রবণ আনন্দ পাওয়া যেতে পারে এবং তা অন্ধত্ববাদের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিষেধক হতে পারে। তা ছাড়াও, এসব প্রকল্পের কোনোটাই যদি প্রমাণসাধ্য না-ও হয়, তবুও সেগুলোর মধ্যে যেগুলো স্বয়ংসঙ্গতিপূর্ণ আর জ্ঞাত তথ্যাবলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, সেগুলোর আবিষ্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর মধ্যেই জ্ঞান রয়েছে। আধুনিক দর্শনকে যেসব প্রকল্প প্রভাবিত করেছে তার প্রায় সবই প্রথমে চিন্তা করেছিল গ্রিকরা। বিমূর্ত বিষয়াবলিতে তাদের কল্পনাপ্রবণ উদ্ভাবনী শক্তির অতি-উচ্চপ্রশংসা তেমন একটি করা চলে না। গ্রিকদের সম্পর্কে আমি যা কিছু বলব তা এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলব। আমি মনে করি গ্রিকরা যেসব তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে সেগুলোর অস্তিত্ব ও বিকাশ ছিল স্বনির্ভর এবং সেগুলো-যদিও প্রাথমিক অবস্থায় ছিল বালসুলভ-দুই হাজারের বেশি সময় ধরে টিকে থাকতে ও বিকশিত হতে সক্ষম ছিল।

এ কথা অবশ্য সত্য যে, বিমূর্ত চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রিকদের অন্য আরেক রকম অবদান ছিল, সেটার অধিকতর স্থায়ী মূল্য আছে। গণিত ও অবরোহী যুক্তিমূলক চিন্তার কৌশল গ্রিকদের আবিষ্কার। বিশেষ করে জ্যামিতি এক গ্রিক উদ্ভাবন, যা ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান সম্ভব ছিল না। কিন্তু গ্রিক মনীষায় গণিতের ব্যাপারে একপেশে প্রবণতাটি ছিল এই যে, গ্রিক মনন চিন্তা করত স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রতীয়মান একটি ধারণা থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে, পর্যবেক্ষণলব্ধ কিছু থেকে আরোহী পদ্ধতিতে নয়। তাদের এই পদ্ধতি প্রয়োগের চমৎকার সাফল্য শুধু প্রাচীন জগৎকেই নয়, আধুনিক জগতেরও বৃহত্তর অংশকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। বিশেষ বিশেষ ঘটনার পর্যবেক্ষণ দ্বারা আরোহী পদ্ধতিতে সূত্রের পৌঁছার চেষ্টা করে যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, হেলেনিক জগতের দার্শনিকদের মনোকল্পিত স্বতঃসিদ্ধের প্রতি বিশ্বাসকে দূর করতে পেরেছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। অন্যান্য কারণসহ এই কারণেও গ্রিকদের প্রতি প্রায়-কুসংস্কারতুল্য ভক্তি পোষণ করা ভুল। যদিও গ্রিকদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তির ঝোঁক ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি, তবু সামগ্রিকভাবে এটা ছিল তাদের মেজাজের বিরোধী। তাদের শেষ চার শতাব্দীর বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিকে খাটো করে তাদেরকে মহিমান্বিত করার প্রয়াস আধুনিক চিন্তাজগতের ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে।

গ্রিকদের প্রতি হোক বা অন্য যে কারো প্রতি হোক, ভক্তির বিরুদ্ধে আরো সাধারণ একটি যুক্তি আছে। একজন দার্শনিককে পাঠ করার ক্ষেত্রে যথার্থ প্রবণতাটি হওয়া উচিত না-ভক্তি, না-ঘৃণা। বরং একধরনের তাত্ত্বিক সহানুভূতিসুলভ মন নিয়ে তাকে পাঠ করা শুরু করতে হবে। তারপর যখন মনে হবে যে, এই দার্শনিকের তত্ত্বগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে, কেবল তখনই একটি বিচারী দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যেতে হবে, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। তখন মনের অবস্থাটা যত দূর সম্ভব এমন হওয়া প্রয়োজন যে, এ পর্যন্ত যা কিছু সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল তা ত্যাগ করা হলো। এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটিতে বাধা সৃষ্টি করে ঘৃণা আর দ্বিতীয় ধাপটিকে বাধা দেয় ভক্তি। দুটো ব্যাপার স্মরণ রাখা দরকার : এক. যে ব্যক্তির অভিমত ও তত্ত্ব পাঠ করার যোগ্য, ধরে নিতে হবে যে তার কিছু-না-কিছু প্রতিভা আছে। দুই. কোনো বিষয় সম্পর্কেই সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সত্য ধারণায় পৌঁছে যাওয়া চলবে না। কোনো বুদ্ধিমান মানুষ যখন এমন কোনো মত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যা আমাদের কাছে স্পষ্টতই অর্থহীন বা উদ্ভট মনে হয়, তখন আমাদের উচিত হবে না সেটাকে কোনো না- কোনোভাবে সত্য প্রমাণ করতে চেষ্টা করা, কিন্তু কীভাবে তা সত্য বলে মনে হয় তা বোঝার চেষ্টা করা আমাদের উচিত। ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্পনাশক্তির এই অনুশীলন একই সঙ্গে আমাদের চিন্তার পরিধি বাড়ায় এবং উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে, আমাদের অনেক ধারণা বা সংস্কার অন্য মেজাজের একটি যুগের মানুষের কাছে কতটা নির্বোধ, বোকামিপূর্ণ মনে হতে পারে।

আমরা এ অধ্যায়ে আলোচনা করব পিথাগোরাস ও হেরাক্লিটাস সম্বন্ধে। তবে এ দুজনের মধ্যবর্তী আরো একজন দার্শনিক আছেন। তার গুরুত্ব অবশ্য অপেক্ষাকৃত কম। তিনি জেনোফেনিস। তার জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ খুবই অনিশ্চিত। তার সময়কাল নির্ধারণ করা যায় শুধু এই তথ্য থেকে যে, তার রচনায় পিথাগোরাসের উল্লেখ আছে, আর হেরাক্লিটাস উল্লেখ করেছেন তার কথা। জন্মসূত্রে জেনোফেনিস ছিলেন আয়োনীয়, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি বাস করেছেন দক্ষিণ ইতালিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব বস্তুর সৃষ্টি মাটি ও পানি থেকে। দেবতাদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব শক্তিশালী একজন মুক্তচিন্তার মানুষ। হোমার ও হেসিয়ড দেবতাদের ওপর এমন সব বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন যেগুলো নশ্বর মানবদের কাছে লজ্জাকর ও ঘৃণ্য : চুরি, ব্যভিচার, পরস্পরকে বিপথগামী করা…মানুষেরা মনে করে দেবতারা যে রকম, তাদের জন্মই হয়েছে সেই রূপে। আর মনে করে, দেবতাদেরও মানুষের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ আছে, মানুষের মতোই তাদের কণ্ঠস্বর, আকৃতি…হ্যা! যদি ষাঁড় ও ঘোড়াদের মানুষের মতো হাত থাকত আর সেই হাত দিয়ে তারা ছবি আঁকতে পারত, মানুষের মতো শিল্পকর্ম করতে পারত, তাহলে ঘোড়ারা দেবতাদের ছবি আঁকত ঘোড়ার মতো, আর ষাঁড়েরা আঁকত ষাঁড়ের মতো। আর দেবতাদের দেহগুলো তারা বিভিন্ন রকম ঘোড়া আর বিভিন্ন রকম ষাঁড়ের মতো করে আঁকত…ইথিওপিয়ার দেবতাদের রং কালো, নাক বোঁচা। থ্রেস-এর লোকেরা বলে তাদের দেবতাদের চোখ নীল আর চুল লাল। জেনোফেনিস এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, সে ঈশ্বর আকারে ও চিন্তায় মানুষের মতো নন, তিনি তার মনের শক্তিবলে সবকিছু অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ করেন। জেনোফেনিস পিথাগোরাসের দেদহান্তরবাদকে বিদ্রূপ করতেন। একদিন পথে যেতে যেতে তিনি (পিথাগোরাস) দেখতে পেলেন একটি কুকুরকে পীড়ন করা হচ্ছে। তিনি বললেন, থামো ওকে আঘাত কোরো না। সে একজন বন্ধুর আত্মা। আমি তার কণ্ঠ শুনে তা বুঝতে পেরেছি। জেনোফেনিস মনে করতেন, ধর্মতত্ত্বের বিষয়গুলোর মধ্যকার সত্য অনুধাবন করা অসম্ভব। দেবতাদের সম্বন্ধে আমি যেসব বিষয়ে কথা বলি সেসব সম্পর্কে নিশ্চিত সত্য জানে এমন মানুষ নেই, কখনো থাকবেও না। হ্যাঁ, এমনকি যদি কোনো মানুষ এমন কিছু বলে যা সম্পূর্ণরূপে সত্য, তবুও সে নিজেই সেই সত্যকে জানতে পারে না। একমাত্র অনুমান ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই। পিথাগোরাস ও অন্যদের মরমিবাদী প্রবণতার বিপরীতে যেসব দার্শনিক ছিলেন, জেনোফেনিসের স্থান তাদের ধারায়। তবে স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি প্রথম সারির নন।

আমরা যেমনটি দেখেছি, পিথাগোরাসের মতবাদগুলোকে তার শিষ্যদের মতবাদগুলো থেকে আলাদা করে শনাক্ত করা কঠিন। তা ছাড়া, পিথাগোরাস যদিও খুবই প্রাচীন, তবুও তার ধারার প্রভাব মূলত অন্য অনেক দার্শনিকের প্রভাবের পরবর্তীকালীন। তাদের মধ্যে প্রথম জন হচ্ছে হেরাক্লিটাস। তিনি একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। হেরাক্লিটাসের আবির্ভাব খ্রি.পূ. ৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। তার জীবন সম্পর্কে জানা যায় খুব সামান্যই। শুধু জানা গেছে যে তিনি ছিলেন এফেসাস-এর একজন অভিজাত নাগরিক। প্রাচীনকালে তিনি খ্যাত ছিলেন প্রধানত এই মতবাদের জন্য যে, সবকিছুই একটি নিত্য-পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। কিন্তু দেখা যাবে, এটা তার অধিবিদ্যার অনেকগুলো দিকের একটি মাত্র।

হেরাক্লিটাস ছিলেন একজন আয়োনীয়, কিন্তু মিলেসীয়দের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের অংশীদার তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন মরমিবাদী, তবে খুবই অদ্ভুত একধরনের মরমিবাদী। তিনি মনে করতেন, আদিবস্তু হচ্ছে আগুন; আগুনের মধ্যে যেমন করে অগ্নিশিখার জন্ম হয়, তেমনি প্রত্যেক বস্তু জন্ম হয় অন্য একটি কিছুর মৃত্যুর ফলে। নশ্বররা অবিনশ্বর আর অবিনশ্বরা নশ্বর-নশ্বরের জন্মের মধ্যে আছে অবিনশ্বরের মৃত্যু আর নশ্বরের মৃত্যুর মধ্যে অবিনশ্বরের জন্ম। জগতে ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য গঠিত হয় পরস্পর বিপরীতধর্মী বস্তুগুলোর মিলন থেকে। সব বস্তুর উৎপত্তি এক অভিন্ন বস্তু থেকে, আর সেই একের উৎপত্তি সব বস্তু থেকে। কিন্তু বহুর গুরুত্ব একের চেয়ে কম, এক হলো ঈশ্বর।

হেরাক্লিটাসের রচনার যেটুকু আমাদের কাল পর্যন্ত টিকে আছে, তা থেকে তার চরিত্রের যে পরিচয় মেলে তা সৌহার্দ্যময় নয়। ঘৃণা বা বিরূপ মনোভাবের প্রতি তার বেশ আসক্তি ছিল, আর তিনি ছিলেন একজন গণতন্ত্রমনার বিপরীত। সহ-নাগরিকদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এফেসাস-এর প্রত্যেকটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি গলায় দড়ি দিয়ে মরে গিয়ে নগরটাকে শশ্রুবিহীন নারীদের জন্য রেখে যায় তাহলেই ভালো হয়। কারণ তারা তাদের মধ্যেকার সর্বোত্তম ব্যক্তি হারমোডরাসকে এই বলে বিতাড়িত করেছে, আমরা এমন কাউকে রাখব না যে আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম; যদি সে রকম কেউ থাকে, তাকে অন্য কোনোখানে, অন্য লোকদের মধ্যে গিয়ে সর্বোত্তম হতে বলব। হেরাক্লিটাস তার পূর্বসূরিদের মধ্যে শুধু একজন ছাড়া সব প্রখ্যাত ব্যক্তির সম্বন্ধে মন্দ কথা বলেছেন

তাদের তালিকা থেকে হোমারকে বের করে এনে চাবকানো উচিত।

যাদের আলোচনা আমি শুনেছি তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি বুঝতে পেরেছেন যে প্রজ্ঞা সবকিছুর থেকে আলাদা।

নানা ধরনের বস্তুকে জানার বিদ্যা কোনো কিছু বুঝতে শেখায় না, শেখালে হেসিয়ড, পিথাগোরাস, জেনোফেনিস আর হেকাটিয়াস অনেক কিছু বুঝতে শিখতেন।

পিথাগোরাস দাবি করতেন…তার প্রজ্ঞা আছে। আসলে তার যা ছিল তা নেহায়েত বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান আর দুষ্টামির কলাকৌশল।

একমাত্র যে ব্যক্তিটি হেরাক্লিটাসের নিন্দার ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি টিউটেমাস। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, টিউটেমাস বলেছিলেন অধিকাংশ মানুষ খারাপ।

মানবজাতির প্রতি ঘৃণা পোষণের ফলে হেরাক্লিটাস মনে করতেন, মানুষকে নিজেদের পক্ষে মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় শুধু বল প্রয়োগের দ্বারা। তিনি বলতেন, প্রত্যেকটি পশুকে তৃণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে। তার আরো একটি মন্তব্য ছিল, গর্দভরা সোনা চায় না, খড় চায়।

এসব কারণে যেমনটি প্রত্যাশিত, হেরাক্লিটাস যুদ্ধে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধই সবকিছুর জনক, সবার রাজা। যুদ্ধই কাউকে দেবতা বানিয়েছে, কাউকে বানিয়েছে মানুষ, কাউকে করেছে বন্দি, কাউকে মুক্ত। তিনি আরো বলেন, হোমার বলেছিলেন, ঈশ্বর আর দেবতাদের মধ্যে এই বিরোধের কি অবসান হবে না! ঠিক বলেননি হোমার। তিনি বুঝতেই পারেননি যে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা করছেন। তার প্রার্থনা পূর্ণ হলে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে, আর দ্বন্দ্ব বিরোধই ন্যায়বিচার, সব বস্তুর সৃষ্টি ও বিলয় ঘটে বিরোধের মধ্য দিয়ে।

হেরাক্লিটাসের নৈতিকতা একধরনের গর্বিত কৃচ্ছসাধনা। নিটশের নৈতিকতার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। হেরাক্লিটাস মনে করেন, আত্মা আগুন ও পানির মিশ্রণ, আগুন মহৎ আর পানি হীন। যে আত্মার বেশি অংশ আগুন তাকে তিনি বলেন শুষ্ক। তিনি বলেন, শুষ্ক আত্মা সবচেয়ে প্রজ্ঞাময় ও সর্বোত্তম। আত্মা যখন আর্দ্র হয় তখন সে আনন্দ বোধ করে। একজন পুরুষ যখন মাতাল হয়, দাড়িগোঁফহীন নারীর অঙ্গুলিহেলনে চলে, টলমল করে, বুঝতে পারে না কোথায় সে পা ফেলছে, তখন তার আত্মা আর্দ্র হয়।আত্মা যখন পানি হয়ে যায় তখন তার মৃত্যু ঘটে। কোনো ব্যক্তির মনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। সে যা পেতে চায়, তা ক্রয় করে আত্মার বিনিময়ে। মানুষ যা পেতে চায় তার সবকিছু পাওয়া মানুষের জন্য ভালো নয়। কেউ বলতে পারেন, হেরাক্লিটাস আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ক্ষমতাকে মূল্য দেন, আর সেসব আবেগকে ঘৃণা করেন যেগুলো মানুষকে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে।

নিজের যুগের ধর্মগুলোর প্রতি, অন্তত বাক্কাসীয় ধর্মের প্রতি হেরাক্লিটাসের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিরূপ, কিন্তু সেটা একজন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবাদীর বিরূপতার মতো নয়। হেরাক্লিটাসের নিজের ধর্ম আছে, সমকালীন ধর্মতত্ত্বের কিছু অংশ তিনি নিজের মতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে নিতেন আর কিছু অংশ বেশ ঘৃণাভরে নাকচ করে দিতেন। তাকে বাক্কাসীয় বলা হয়েছে (কর্নফোর্ড), আবার তাকে গুহ্য বিষয়াদির ব্যাখ্যাকারী হিসেবেও মনে করা হয়েছে (ফ্লেইডেরার)। আমার মনে হয় না, এ সম্পর্কিত উদ্ধৃত্তিগুলো এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। লোকজন যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। এ কথা থেকে এমন মনে হয় যে তার মনে এমন গুহ্য বিষয়েরও ধারণা ছিল যেগুলো অপবিত্র নয়, কিন্তু সেগুলো প্রচলিত গুহ্যাচারগুলো থেকে বেশ ভিন্ন ধরনের। তিনি যদি অশ্লীল বিষয়াদির বিরুদ্ধে অত্যধিক নিন্দামুখর প্রচারণায় লিপ্ত না হতেন তাহলে একজন ধর্মসংস্কারক হতে পারতেন।

হেরাক্লিটাস সম্পর্কে নিচে বর্ণিত মতগুলো এখনো প্রচলিত আছে। এগুলো তার যুগের ধর্মতত্ত্বগুলোর ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। ডেলফি নগরীতে বর্ষিত দৈববাণী ঈশ্বরের। তিনি তার অর্থ প্রকাশও করেন না, গোপন রাখেন না, বরং প্রতাঁকের সাহায্যে তা প্রদর্শন করেন। আর সিবিল, যে সুগন্ধি মাখে না, জমকালো পোশাক পরে না, সে উত্তেজিত ঠোঁটে নিরানন্দ কথাবার্তা বলে; তার ভেতরের দেবতার কল্যাণে সে তার কণ্ঠস্বর নিয়ে সহস্রাধিক বছর অতিক্রম করে।

হাডেস-এ আত্মার গন্ধ পাওয়া যায়। মহত্তর মৃত্যু বৃহত্তর ভাগ লাভ করে (যারা এমন মৃত্যুবরণ করে তারা দেবতায় পরিণত হয়)। নিশাচর, জাদুকর, বাক্কাসের পুরোহিত এবং মদ-ভাটির যাজিকারা গুহ্য বিষয়াদির কারবারি। লোকেরা যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। আর তারা এমনভাবে এসব ছবিকে উপাসনা করে, যেন-বা তারা মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে কথা বলছে। তারা জানে না, দেবতা ও বীদের স্বরূপ কী। কারণ তারা ডায়োনিসাসের পানে শোভাযাত্রা করে আর লজ্জাকর লিঙ্গাত্মক স্তোত্ৰগীত গায়, তা যদি তারা নাও করত, তার চেয়েও লজ্জাজনক আচরণ তারা করত নিশ্চয়। কিন্তু ডায়োনিসাস আর হাডেস অভিন্ন, অথচ তারা সেই ডায়োনিসাসের জন্যই পাগল হয়, মদের ভঁটি ঘিরে ভোজনোৎসবে মেতে ওঠে। তারা রক্ত মেখে বৃথাই নিজেদের পবিত্র করার চেষ্টা করে, ঠিক যেন কেউ কাদার মধ্যে পা দিয়ে কাদায় পা ধুয়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে এভাবে কাদায় পা ধুতে দেখলে মানুষ তাকে পাগল ঠাওরায়।

হেরাক্লিটাস মনে করতেন আদি উপাদান হচ্ছে আগুন। আগুন থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। পাঠকের মনে পড়বে, থেলিস মনে করতেন সবকিছুর সৃষ্টি পানি থেকে। অ্যানাক্সিমেনিস মনে করতেন আদি উপাদান বায়ু। আর হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস ছিল আদি উপাদান আগুন। অবশেষে রাষ্ট্রনায়কোচিত একটি সমঝোতা পাওয়া যায় এম্পিডক্লিসের কাছ থেকে। তিনি মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি-এই চার উপাদানকেই স্বীকৃতি দেন। এই পর্যায়ে এসে প্রাচীন রসায়নশাস্ত্র থেমে দাঁড়ায়। যত দিন পর্যন্ত না মুসলমান আলকেমিস্টরা পরশমণি, অমরত্ব-সুধা আর নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার পদ্ধতি অনুসন্ধান আরম্ভ করেছেন, তত দিন পর্যন্ত রসায়নশাস্ত্রের আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যা এমন গতিশীল যে তা অত্যুৎসাহী আধুনিক ব্যক্তিদেরও বেশ সন্তুষ্ট করতে পারে : এই জগৎ, যা কিনা সবার কাছে অভিন্ন, তা মানুষ-দেবতা কারোর দ্বারাই সৃষ্ট নয়। বরং তা সদা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে, এ এক চিরজ্বলন্ত আগুন, ক্ষণে জ্বলছে, ক্ষণে নিভছে। আগুন প্রথমে রূপান্তরিত হয় সমুদ্রে, আর সমুদ্রের অর্ধেক মাটি, অর্ধেক ঘূর্ণিবায়ু। এ রকম জগতে নিরন্তর পরিবর্তনই প্রত্যাশিত। হেরাক্লিটাস এই নিরন্তর পরিবর্তনেই বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তার আরো একটি তত্ত্ব ছিল। সেটিকে তিনি পরিবর্তনের তত্ত্বের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। তত্ত্বটি ছিল বিপরীত বস্তুগুলোর মিলনের তত্ত্ব। হেরাক্লিটাস বলেন, মানুষ জানে না বিরোধপূর্ণ ব্যাপারগুলোর মধ্যে সমঝোতা ঘটে কীভাবে। এটা আসলে বিপরীতমুখী চাপগুলোর ঐক্যাবিধান-ধনুক ও বীণার মতো। দ্বন্দ্বের প্রতি হেরাক্লিটাসের বিশ্বাস এই তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত; দ্বন্দ্বের মধ্যে বিপরীতগুলোর মিলনের ফলে একটি গতির সৃষ্টি হয়, যা কিনা একটি ছন্দ। জগতে একটি ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য বৈচিত্র্যের ফল : জোড় বস্তুগুলো একইসঙ্গে সমগ্র, আবার সমগ্র নয়। একত্রিত, আবার বিচ্ছিন্ন। বৈরিতামুক্ত, আবার বিরোধপূর্ণ। সব বস্তু মিলে একের সৃষ্টি, আবার সব বস্তুর উৎপত্তি এক থেকে।

কখনো কখনো হেরাক্লিটাসের বক্তব্য থেকে মনে হবে ঐক্য বৈচিত্র্যের চেয়ে অধিকতর মৌলিক : শুভ ও অশুভ এক। ঈশ্বরের কাছে সবকিছুই সুন্দর, শুভ ও ন্যায্য। কিন্তু মানুষ কিছু জিনিসকে ন্যায্য আর কিছু জিনিসকে অন্যায্য মনে করে। ঊর্ধ্বমুখী পথ আর নিম্নমুখী পথ এক এবং অভিন্ন। ঈশ্বর হলেন রাত ও দিন, শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল, যুদ্ধ ও শান্তি, অরুচি (অতিপানভোজনের ফলে) ও ক্ষুধা। কিন্তু তিনি বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক আগুনের মতো; আগুনের সঙ্গে মসলা মেশালে সে মসলার স্বাদ-গন্ধ অনুসারে নাম হয় সে আগুনের। তবুও, মিলিত হবার মতো বৈপরীত্য না থাকলে কোনো ঐক্য সম্ভব হতো না : আমাদের জন্য যা ভালো তা হচ্ছে বৈপরীত্য।

হেরাক্লিটাসের এই তত্ত্বে হেগেলের দর্শনের বীজাণু রয়েছে। হেগেলের দর্শন অগ্রসর হয়েছে বিপরীতগুলোর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। অ্যানাক্সিমেন্ডারের অধিবিদ্যার মতো হেরাক্লিটাসের অধিবিদ্যায়ও মহাজাগতিক ন্যায়বিচারের একটি ধারণার প্রাধান্য রয়েছে। মহাবিশ্বে এমন একটি ন্যায়বিচার আছে যার ফলে বিপরীতগুলোর দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষই কখনো চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে না।

সব বস্তুই আগুনের বিনিময় আর আগুন সবকিছুর বিনিময়, যেমনটি সোনার বিনিময়ে সবকিছু পাওয়া যায়, আর সবকিছুর বিনিময়ে সোনা পাওয়া যায়। আগুন জীবন লাভ করে বাতাসের মৃত্যুতে, আর বাতাস বেঁচে থাকে আগুনের মৃত্যুতে। মাটির মৃত্যু হচ্ছে পানির জীবন, আর মাটির জীবন হচ্ছে পানির মৃত্যু। সূর্য অতিক্রম করবে না তার সীমারেখা। যদি করে, তাহলে এরিনাইসরা-ন্যায়ের পরিচারিকারা-ধরে ফেলবে তাকে। আমাদের জানা থাকা দরকার যে সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে। দ্বন্দ্বই ন্যায্য।

হেরাক্লিটাসে বারবার যে ঈশ্বরের কথা পাওয়া যায়, সে ঈশ্বর দেবতাদের থেকে আলাদা। মানুষের পথে কোনো প্রজ্ঞা নেই, কিন্তু ঈশ্বরের পথে প্রজ্ঞা আছে…ঈশ্বর মানুষকে বলেন বাছা, এমনকি মানুষ মানুষকে বলে শিশু…সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটিও ঈশ্বরের তুলনায় উলুক, ঠিক যেমন সবচেয়ে সুন্দর উলুকটিও মানুষের তুলনায় কুৎসিত।

সন্দেহ নেই যে হেরাক্লিটাসের ঈশ্বর তার মহাজাগতিক ন্যায্যতার ধারণাটির মূর্ত প্রকাশ। সবকিছুই পরিবর্তনশীল অবস্থায় বিরাজমান-এই তত্ত্বটি হেরাক্লিটাসের তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। প্লেটোর থিয়াটিটাস-এর বর্ণনা অনুসারে এই তত্ত্বটির ওপরেই হেরাক্লিটাসের অনুসারীগণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। তুমি এক নদীতে দুবার পা ফেলতে পারবে না কারণ তোমার উপর দিয়ে সর্বদাই নতুন জল প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি দিনের সূর্যই নতুন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, সার্বিক পরিবর্তনে বিশ্বাসের বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে হেরাক্লিটাসের এই বাক্যে : সব বস্তুই বহমান। কিন্তু তিনি যে এই বাক্যটি সত্যই বলেছিলেন তার কোনো প্রমাণ নেই, যেমন প্রমাণ নেই যে ওয়াশিংটন বলেছিলেন, বাবা, আমি তো মিথ্যে বলতে পারি না এবং অয়েলিংটন বলেছিলেন, সৈন্যরা ওঠো এবং আক্রমণ করো।

প্লেটোর পূর্ববর্তী সব দার্শনিকের বক্তব্য সম্পর্কে জানা যায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে। সে উদ্ধৃতিগুলোর বেশিরভাগই প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দেওয়া, দার্শনিকদের বক্তব্যগুলো খণ্ডন করার প্রয়োজনে তারা উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছেন। হেরাক্লিটাসের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। তার বক্তব্য সম্পর্কেও জানা যায় উদ্ধৃতি থেকে। আধুনিক কোনো দার্শনিককে জানার একমাত্র উৎস যদি হতো তার শত্রুদের বাদানুবাদ, তাহলে তার অবস্থাটা কী দাঁড়াত সে কথা ভাবলে দেখা যাবে সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দার্শনিকরা কতই না প্রশংসনীয়, তাদের শত্রুদের ছড়ানো সব প্রতিহিংসার পরেও তারা যথেষ্ট মহৎ বলে প্রতিভাত হবেন। সে যাই হোক না কেন, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল একমত যে হেরাক্লিটাসের শিক্ষা ছিল : কোনো কিছুরই অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়নি, সবকিছুই অস্তিত্বলাভের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। (প্লেটো) এবং কোনো কিছুই অপরিবর্তিতরূপে বিরাজমান নয়। (অ্যারিস্টটল)।

এই তত্ত্বের আলোচনায় আবার ফিরে আসা যাবে প্লেটো সম্পর্কিত আলোচনার সময়। প্লেটো এই তত্ত্বটি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। দার্শনিকগণ এই তত্ত্বের ব্যাপার কী বলেছেন সে অনুসন্ধানে আপাতত না গিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব এ সম্পর্কে কবিদের অনুভূতি কী এবং বিজ্ঞানের লোকজন এ ব্যাপারে কী বলেছেন।

যেসব সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর প্রবৃত্তিগুলোর একটি হচ্ছে স্থায়ী একটি-কিছুর আকাঙ্ক্ষা বা অনুসন্ধান। সন্দেহ নেই যে এ প্রবৃত্তির উৎস গৃহের প্রতি ভালোবাসা এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা। তাই দেখা যায়, এই প্রবৃত্তি সেই সব মানুষের মধ্যে বেশি তীব্র, যাদের জীবনযাপন বিপদসঙ্কুল পরিবেশে। ধর্ম স্থায়িত্বের অন্বেষণ করে দুই ভাবে : ঈশ্বরের মধ্যে অমরত্বে। ঈশ্বরে অস্থিরতার বা পরিবর্তনশীলতার ছায়ামাত্র নেই; আর মৃত্যুর পরবর্তী জীবন চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর হাসি-খুশি মনোভাব মানুষকে এসব অনড় ধারণাগুলোর প্রতি বিমুখ করে তোলে। আধুনিক উদারপন্থী ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাস করে যে স্বর্গেও প্রগতি আছে এবং ঈশ্বরের মাথায়ও চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটছে। কিন্তু এসব ধারণার মধ্যেও স্থায়ী কিছু আছে, যথা খোদ প্রগতিকে এবং তার সর্বব্যাপী গন্তব্যকে মনে করা হচ্ছে স্থায়ী। আবার এক নিমেষের বিপর্যয়েই মানুষ ফিরে যায় তার পুরোনো অপার্থিব জগতে, সব আশা-ভরসা ন্যস্ত করে তারই ওপর। সে বলে, এই পৃথিবীতে জীবন যদি হতাশায় ভরে ওঠে তাহলে কেবল স্বর্গেই শান্তির সন্ধান করা যায়। যা কিছু মানুষের প্রিয় তার সবই হরণ করে নিয়ে যায় কাল-এই নিয়ে কতই না অনুশোনা করেছেন কবিরা।

যৌবনের উদ্দামতাকে বিদ্ধ করে কাল
আর সুন্দরের কপালে এঁকে দেয় বলিরেখা
 প্রকৃতির দুর্লভ সত্য কালের আহার
কালের কাস্তে কচুকাটা করবে সব-রবে না কিছুই।

তবে সেইসঙ্গে তারা সাধারণত বলেন যে তাদের কাব্যগুলো অমর–

তবুও, কালের কাছে প্রত্যাশা, আমার কবিতা রবে।
থাক না তার নিষ্ঠুর হাত, আমি গাইব তোমার মহিমা।

যা কিছু কালের মধ্যে বিরাজমান তা ক্ষণস্থায়ী–এ কথা প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে দার্শনিকতাপ্রবণ মরমিবাদীগণ শাশ্বতের এক ধারণা উদ্ভাবন করেছেন- শাশ্বত সীমাহীন কালব্যাপী বিরাজমান কিছু নয়, বরং কাল-প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বাইরের একটি অস্তিত্ব। কিছু কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের মতে, উদাহরণস্বরূপ ডিন ইঙ্গের মতে, শাশ্বত জীবন বলতে ভবিষ্যৎকালের প্রতিটি মুহূর্তজুড়ে অস্তিত্ব বোঝায় না, বরং তারা সম্পূর্ণরূপে সময়নিরপেক্ষ সত্তার একটি অবস্থা, যেখানে আগে বা পরে বলে কিছু নেই এবং সে কারণে পরিবর্তনে কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনা নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি কাব্যিকভাবে প্রকাশ করেছেন ভগান

সে-রাতে আমি শাশ্বতকে দেখেছি
বিশুদ্ধ আর অনিঃশেষ আলোকের এক বলয় যেন
শান্ত আর উজ্জ্বল
আর নিচে তাকে ঘিরে প্রহর, দিবস, বর্ষ
গোলক-তাড়িত
 যেন এক বিপুল ছায়া চলমান
তাতে নিক্ষিপ্ত বিশ্ব ও তার সর্বস্ব।

দর্শনের সুবিখ্যাত কয়েকটি তত্ত্বে এই ধারণাটিই পরিমিত গদ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ধৈর্যসহকারে যুক্তি অনুসরণ করলে আমরা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হব।

পরিবর্তনের প্রতি সমুদয় বিশ্বাস সত্ত্বেও হেরাক্লিটাস নিজে মনে করতেন, একটি কিছু আছে যা চিরস্থায়ী। শাশ্বতের ধারণা (অসীম স্থিতিকালের বিপরীত হিসেবে) এসেছে পারমিনাইডিস থেকে; হেরাক্লিটাসে তা দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার দর্শনে কেন্দ্রীয় আগুনটি কখনোই নেভে না : বিশ্ব সর্বদা এক চিরঞ্জীব আগুন ছিল, আছে এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু আগুন অবিরামভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার স্থায়িত্ব কোনো বস্তুর স্থায়িত্ব নয়, বরং একটি প্রক্রিয়ার স্থায়িত্ব-যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গি হেরাক্লিটাসের নয়।

দর্শনের মতো বিজ্ঞানও পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চের মধ্যে কিছু স্থায়ী অধঃস্তর অন্বেষণের মাধ্যমে নিরন্তর পরিবর্তনের তত্ত্বটি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। এই আকাক্ষা রসায়নশাস্ত্রের দ্বারা পূরণ হয়েছিল বলে মনে হয়। দেখা গেছে, আগুন আপাতদৃষ্টিতে নিভে গেলেও বস্তুতপক্ষে ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয় : উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটে, কিন্তু সেই বিন্যাসের আগে যেসব পরমাণু ছিল পুনর্বিন্যাস-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার পরেও সেগুলোর প্রত্যেকটি থেকে যায়। সে অনুসারে ধারণা করা হয়েছিল যে, পরমাণু ধ্বংসযোগ্য নয় এবং বস্তুজগতে সব পরিবর্তন আসলে স্থায়ী উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস মাত্র। তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত এই মত চালু ছিল, কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হবার পরে জানা গেল, পরমাণু বিভাজিত হতে পারে।

অদম্য পদার্থবিজ্ঞানীরা নতুন নতুন এবং ক্ষুদ্রতর একক আবিষ্কার করলেন, সেগুলোকে বলা হয় ইলেকট্রন ও প্রোটন-এদের সমন্বয়েই পরমাণু গঠিত। কিছুকাল ধরে এমন ধারণা চালু ছিল যে, এই এককগুলো অবিভাজ্য, যেমন আগে পরমাণুর ক্ষেত্রে মনে করা হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা গেল, প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং তা থেকে নতুন বস্তু উৎপন্ন হয় না, বরং বিশ্বব্যাপী এমন এক শক্তি সঞ্চারিত হয় যার বেগ আলোর বেগের সমান। স্থায়ী একটি কিছু হিসেবে বস্তুর জায়গা দিতে হয়েছে শক্তিকে। কিন্তু শক্তি বস্তুর মতো নয়, একটি জিনিস সম্পর্কে কোনো সাধারণ-জ্ঞানপ্রসূত ধারণা নয়। বরং শক্তি ভৌত প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। ব্যাপারটাকে হেরাক্লিটাসের আগুনের মতো মনে করা যেতে পারে, কিন্তু তা দহনের একটি প্রক্রিয়া, দাহ্য বস্তু নয়। যা দাহ্য তা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতরের দিকে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহাশূন্যের পদার্থগুলোকে চিরস্থায়ী ভাবার কোনো সুযোগ রাখেনি। গ্রহগুলো বেরিয়ে এসেছে সূর্য থেকে, আর সূর্যের উৎপত্তি নীহারিকা থেকে। সূর্য কিছুকাল ধরে আছে, আরো কিছুকাল থাকবে, কিন্তু একদিন না একদিন-হয়তো কোটি কোটি বছর পরে-তা বিস্ফোরিত হবে এবং সেই সঙ্গে সব গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্তত এমনটাই বলেন। সেই চরম লগ্ন এগিয়ে আসতে আসতে একদিন তারা হয়তো দেখতে পাবেন যে তাদের হিসাব-নিকাশে ভুল-ত্রুটি আছে। হেরাক্লিটাসের নিরন্তর পরিবর্তনের মতবাদটি বেদনাদায়ক এবং আমরা দেখেছি, একে খারিজ করে দিতে বিজ্ঞান কিছুই করতে পারে না। বিজ্ঞান যেসব আশাকে হত্যা করেছে সেগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা দার্শনিকদের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা। তাই দার্শনিকরা এমন কিছুর অন্বেষণ করেছেন যা কালের রাজত্বের অধীনে নয়। এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে পারমিনাইডিসের হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *