২. নীতিশাস্ত্র

২. নীতিশাস্ত্র

অ্যারিস্টটলের রচনাপুঞ্জের মধ্যে নীতি সম্পর্কে তার তিনটি সন্দর্ভের একটি জায়গা আছে, কিন্তু এখন সাধারণভাবে মনে করা হয় যে ওই তিনটির মধ্যে দুটি রচিত হয়েছিল তার শিষ্যদের হাতে। তৃতীয়টির, অর্থাৎ Nicomachean Ethics-এর সিংহভাগের রচয়িতা যে অ্যারিস্টটলই, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকে মনে করেন যে এ গ্রন্থেরও একটি অংশ (পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম পুস্তক) সন্নিবেশিত হয়েছে তার শিষ্যদের রচনাগুলোর একটি থেকে। অবশ্য আমি এই বিতর্কিত প্রশ্নটি নিয়ে মাথা ঘামাব না, বইটিকে সমগ্রভাবে অ্যারিস্টটলের রচনা হিসেবে ধরে নিয়ে সামগ্রিকভাবে এ সম্পর্কে আলোচনা করব।

নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোতে প্রধানত উপস্থাপিত হয়েছে। তার যুগের শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ লোকদের প্রচলিত অভিমতগুলো। প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মতো এগুলো অতীন্দ্রিয়বাদী ধর্ম দ্বারা নিষিক্ত নয়। সম্পত্তি ও পরিবার সম্পর্কে প্লেটোর রিপাবলিক-এ যে ভিন্নমার্গী তত্ত্বগুলো রয়েছে সেগুলোর প্রতি অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনও নেই। ভদ্র, সদাচারী নাগরিকদের পর্যায়ের নিচে বা উপরে যারা নয়, তারা এথিক্স-এ (অর্থাৎ অ্যারিস্টটলের Nicomachean Ethics গ্রন্থ) বিধি-নিষেধের একটি প্রণালিবদ্ধ বিবরণ পাবে, যা দ্বারা তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত বলে তারা মনে করবে। এর চেয়ে বেশি দাবি যাদের, তারা হতাশ হবে। মানে মধ্যবয়সী ভদ্রলোকদের কাছে বইটির আবেদন রয়েছে, বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে তারা বইটি ব্যবহার করেছেন যৌবনের আবেগ-উদ্দীপনা অবদমনের কাজে। কিন্তু গভীর অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের কাছে বইটি বিকর্ষক মনে হতে পারে।

বলা হচ্ছে, মঙ্গল হচ্ছে সুখ, যা আত্মার একটি ক্রিয়া। অ্যারিস্টটল বলছেন, প্লেটো যে আত্মাকে যৌক্তিক আর অযৌক্তিক-এ দুটো অংশে ভাগ করেছেন, তা সঠিক। অযৌক্তিক অংশটাকে অ্যারিস্টটল ভাগ করেছেন বোধশক্তিহীন (যা সব প্রাণসম্পন্ন বস্তু, এমনকি উদ্ভিদের থাকে) এবং জৈব আকাঙ্ক্ষামূলক (যা সব প্রাণীতে দেখা যায়)-এ দুই অংশে। জৈব আকাক্ষাসম্পন্ন অংশটি কিছুমাত্রায় যৌক্তিক হতে পারে। হতে পারে তখন, যখন সে যেসব জিনিস চায় তাতে তার যুক্তিবুদ্ধির অনুমোদন থাকে। সদগুণের জন্য এটা অপরিহার্য; কারণ অ্যারিস্টটলের মতে, একমাত্র বুদ্ধিই বিশুদ্ধরূপে চিন্তাশীল এবং বুদ্ধি জৈব আকাক্ষার সহযোগিতা ছাড়া কোনো বাস্তব কাজকর্মের দিকে অগ্রসর হয় না। সদগুণ দুই ধরনের, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, অন্যটা নৈতিক। আত্মার দুটি আলাদা অংশের সঙ্গে এদের সম্পর্ক। বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণাবলি আসে শিক্ষা থেকে। নৈতিক সদগুণাবলি আসে অভ্যাস থেকে। ভালো অভ্যাস গঠনের দ্বারা নাগরিকদের উত্তমরূপে গড়াই হলো বিধায়কের কাজ। আমরা ন্যায়ানুগ হই। ন্যায়কাজ পালনের মধ্য দিয়ে; অন্যান্য সদগুণের বেলায়ও তা ঘটে। অ্যারিস্টটল মনে করেন ভালো অভ্যাস অর্জনে বাধ্য হয়ে একসময় আমরা দেখতে পাব যে ভালো কাজ করার মধ্যে আনন্দ আছে। এখানে মায়ের প্রতি হ্যামলেটের সেই কথাগুলো স্মরণ করা। যেতে পারে :

যদি তোমার কোনো সদগুণ না থাকে তবে তা ধারণ করো,
 রীতি-আচার হলো এক দানব, যা সব বোধ গিলে খায়।
সব বদভ্যাস দূর হতে পারে ভালো কাজের অভ্যাস দ্বারা
অভ্যাস শয়তানের গায়ে ফেরেশতার
জামা পরিয়ে দিতে পারে ভালোভাবে।

.

এখন আসা যাক স্বর্ণময় মধ্যপন্থার সেই বিখ্যাত মতবাদে। প্রত্যেকটি সদগুণ হলো দুই চরমপন্থার এক মধ্যবর্তী স্থান; উভয় রকম চরমপন্থাই পাপ। নানা রকম সদগুণের একটি পরীক্ষা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়। ভীরুতা আর হঠকারিতার মধ্যবর্তী হলো সাহস। অপব্যয়িতা ও সংকীর্ণতার মাঝামাঝি হলো উদারতা। অহমিকা ও দীনতার মাঝামাঝি হলো যথাযথ অহঙ্কার। ভাঁড়ামি আর অভব্যতার মাঝামাঝি চটপটে রসিকতা। লজ্জাশীলতা আর নির্লজ্জতার মাঝামাঝি হলো বিনয়। আরো কিছু সদগুণ আছে যেগুলো এই কাঠামোর মধ্যে পড়ে না। যেমন সত্যবাদিতা। অ্যারিস্টটল বলছেন, সত্যবাদিতা হলো আত্মম্ভরিতা ও মেকি বিনয়ের মধ্যবর্তী। কিন্তু এটা খাটে শুধু একজন ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে সত্যবাদিতার বেলায়। অন্য কোনো ব্যাপকতর অর্থে সত্যবাদিতা কীভাবে এই কাঠামোতে পড়ে আমি তা বুঝি না। একজন মেয়র ছিলেন যিনি একদা অ্যারিস্টটলের এই মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন; তিনি তার কাৰ্যমেয়াদের শেষে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে তিনি একদিকে পক্ষপাতিত্ব আর অন্যদিকে পক্ষপাতহীনতার মধ্যকার সংকীর্ণ রেখাঁটির দিকে গাড়ি হাঁকিয়েছেন। সত্যবাদিতাকে একটি মধ্যপন্থা মনে করার দৃষ্টিভঙ্গিটি মোটেই কম উদ্ভট নয়।

নৈতিক প্রশ্নাবলিতে অ্যারিস্টটলের অভিমতগুলো সর্বদাই তার যুগের গতানুগতিক অভিমতগুলোর মতো। কিছু কিছু পয়েন্টে সেগুলো আমাদের সময়ের অভিমতগুলো থেকে ভিন্ন, প্রধানত যেখানে অভিজাততন্ত্রের কোনো রূপের প্রসঙ্গ আছে। আমরা মনে করি, অন্ততপক্ষে নৈতিক তত্ত্বে যে সব মানুষের অধিকার সমান এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে সমতা জড়িত; আর অ্যারিস্টটল মনে করেন ন্যায়বিচারের সঙ্গে সমতা জড়িত নয়, জড়িত যথাযথ অংশীদারিত্ব, যা শুধু কখনো কখনো সমতা হয়ে থাকে।

একজন প্রভু বা একজন পিতার ন্যায়বিচার একজন নাগরিকের ন্যায়বিচারের চেয়ে ভিন্ন জিনিস; কারণ একটি পুত্রসন্তান বা একটি দাস হলো সম্পত্তি। আর কোনো ব্যক্তির নিজের সম্পত্তির মধ্যে কোনো অবিচার হতে পারে না। কিন্তু দাসদের ব্যাপারে এই মতবাদে একটি সামান্য পরিবর্তন আছে; তা এই প্রশ্নে যে, একজন মানুষ তার দাসের বন্ধু হতে পারে কি না : দুই পক্ষের মধ্যে সাধারণ কিছু নেই; দাস হলো এক জীবন্ত হাতিয়ার…দাস হিসেবে তার সঙ্গে কোনো মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে পারে; কারণ একটি আইন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী দুইজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কে কিছু ন্যায্যতা থাকে বলে মনে হয় বা একটি চুক্তিতে অংশ নেয় এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে সে রকম আরেকজন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে। সুতরাং একজন দাসকে যখন মানুষ বলে বিবেচনা করা হবে তখন দাস নয় এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হতে পারে।

পুত্র যদি দুষ্ট হয় তাহলে পিতা তাকে ত্যাজ্য করতে পারে, কিন্তু পুত্র পিতাকে অস্বীকার করতে পারে না, কারণ পুত্র পিতাকে সম্ভবপর যা দিতে পারে, পিতার কাছে পুত্রের ঋণ তার চেয়ে বেশি। বিশেষ করে পুত্র তো তার অস্তিত্বের ঋণ শোধ করতে সক্ষম নয়। এটা অসম সম্পর্কগুলোর বেলায় সঠিক। যেহেতু প্রত্যেকে ভালোবাসা পাবে নিজ নিজ হিস্যা অনুসারে, তাই ছোট যে সে বড়কে বেশি ভালোবাসবে, যতটা না বড় ছোটকে ভালোবাসবে : স্বামী, পিতামাতা, রাজাদেরর প্রতি স্ত্রী, সন্তান ও প্রজাদের ভালোবাসা বেশি হবে; উল্টোটা হবে না। অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তান ও প্রজাদের প্রতি স্বামী, পিতামাতা ও রাজাদের ভালোবাসা অপেক্ষাকৃত কম হবে, বেশি নয়। ভালো বৈবাহিক জীবনে পুরুষ কর্তৃত্ব করবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, যেসব ব্যাপারে পুরুষের কর্তৃত্ব থাকা উচিত সেসব ব্যাপারে সে কর্তৃত্ব করবে; কিন্তু যেসব ব্যাপারে মেয়েদেরকেই মানায় বা মেয়েরা যা ভালো পারে, তা সে স্ত্রীর হাতে ছেড়ে দেবে। স্ত্রীর এলাকায় সে কর্তৃত্ব করতে পারবে না। আর পুরুষের এলাকায় স্ত্রী ঢুকতেই পারবে না, স্ত্রী একজন উত্তরাধিকারিণী হলে কখনো কখনো যেমনটা হয়ে থাকে।

সর্বোত্তম ব্যক্তিকে অ্যারিস্টটল যেমন কল্পনা করেছেন তা খ্রিস্টান সাধুর ধারণার চেয়ে খুব ভিন্ন। অ্যারিস্টটলের মতে, উত্তম ব্যক্তির যথাযথ গর্ব থাকা উচিত, সে নিজের যোগ্যতা বা গুণ খাটো করে বা কম করে দেখবে না। যে ঘৃণার যোগ্য, তাকে সে ঘৃণা করবে। গর্বিত বা মহানুভব ব্যক্তির (magnanimous) বিবরণ কৌতূহলোদ্দীপক, এতে প্যাগান ও খ্রিস্টান নৈতিকতার পার্থক্যগুলো দেখতে পাওয়া যায়; এবং যে অর্থে নিটশে খ্রিস্ট ধর্মকে দাস্য নৈতিকতা মনে করেন তার যুক্তি পাওয়া যায়।

মহানুভব ব্যক্তির প্রাপ্য যেহেতু সবচেয়ে বেশি তাই সে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় উত্তম-সর্বোত্তম। সুতরাং সত্যিকারের মহানুভব ব্যক্তি অবশ্যই ভালো হবে। মহানুভব ব্যক্তির প্রত্যেকটা সদগুণের মাত্রা হবে সর্বোচ্চ। যেমন-বিপদে পড়লে দুপাশে হাত দুলিয়ে পালিয়ে বাঁচা বা অন্যের ক্ষতির করা মহানুভব ব্যক্তির পক্ষে মানায় না; কেননা যে ব্যক্তির কাছে কোনো কিছুই বড় নয় সে কী জন্যে লজ্জাজনক কাজ করবে?…তাহলে দাঁড়াচ্ছে, মহানুভবতা সব সদগুণের একটি চূড়া, মহানুভবতা অন্য সব সদগুণকে বৃদ্ধি করে, আবার সেসব সদগুণ না থাকলে মহানুভবতার দেখা মেলে না। তাই প্রকৃতপক্ষে মহানুভব হওয়া খুব কঠিন, কারণ চরিত্রের মহত্ত্ব ও ভালোত্ব ছাড়া মহানুভবতা অসম্ভব। মহানুভব ব্যক্তি তাহলে সম্মান বা অসম্মানের ব্যাপারে চিন্তিত নন। তবে তাকে যদি প্রভূত পরিমাণ সম্মান দেখানো হয় এবং তা যদি ভালো মানুষরা করে তাহলে তিনি সংযতভাবে খুশি হবেন, সে ক্ষেত্রে তার মনে হবে যে তার সমান বা এমনকি নিজের সম্মানের চেয়ে কম সম্মান তিনি পাচ্ছেন। কারণ উৎকর্ষ সদগুণের উপযুক্ত কোনো সম্মান থাকতে পারে না, তার পরেও তিনি তা কোনো না কোনোভাবে গ্রহণ করবেন কারণ তাকে দেবার মতো আরো বেশি সম্মান নেই। কিন্তু খাপছাড়া লোকজনের কাছ থেকে বা তুচ্ছ ভিত্তি থেকে সম্মান তিনি জোরেশোরে ঘৃণা করবেন, কারণ এ রকম সম্মান তার প্রাপ্য নয়; অসম্মানের বেলায়ও তাই, কারণ তার ক্ষেত্রে সেটাও ন্যায্য হতে পারে না।…সম্মানের স্বার্থে ক্ষমতা ও সম্পদ কাক্ষিত; কিন্তু যে ব্যক্তির কাছে সম্মানই একটি তুচ্ছ ব্যাপার অন্যান্য জিনিসও তার কাছে তা-ই হবে। এখান থেকেই মহানুভব ব্যক্তিদের উন্নাসিক ভাবা হয়।…মহানুভব ব্যক্তি তুচ্ছ বিপদ আপদে নিজেকে জড়াতে যান না…বরং তিনি ঝুঁকি নেবেন বড় বিপদের এবং যখন তিনি বিপদের মুখোমুখি হন তখন জীবনের পরোয়া করেন না। কারণ তিনি জানেন, এমন কতক পরিস্থিতি আসে যখন জীবন বাঁচানোর অর্থ থাকে না। তিনি এমন ধরনের মানুষ যে শুধু অন্যকে দেবে, অন্যের কাছ থেকে কিছু নিতে তার লজ্জা। কারণ যে দেয় সে বড়, যে নেয় সে ছোট। যদি কেউ তার উপকার করে তাহলে তিনি তার বিনিময়ে ওই ব্যক্তির আরো বড় উপকার করবেন। এভাবে উপকারী ব্যক্তি তার ঋণ শোধ করার বদলে আরো বেশি ঋণী হবে একজন মহানুভব ব্যক্তির কাছে। মহানুভব ব্যক্তির লক্ষণ হবে তিনি কারো কাছে কিছু চাইবেন না বা চাইলেও অতি সামান্যই কিছু চাইবেন এবং উল্টো অন্যদের সাহায্য করার জন্য সবসময় তৈরি থাকবেন। এই বিবেচনা থেকে তিনি সমাজের উচ্চপদস্থ লোকজনদের কাছে সমীহ পেতে চাইবেন কিন্তু মধ্যম শ্রেণির লোকজনদের কাছে নিরাভিমান থাকবেন। কারণ উচ্চপদস্থ লোকজনদের চেয়ে বড় হওয়া কঠিন এবং তা উঁচু ব্যাপার, কিন্তু মধ্যম শ্রেণির লোকজনদের ক্ষেত্রে তা সহজ। সে কারণে উচ্চপদস্থদের মধ্যে নিজেকে বড় করে দেখানোটা কোনো খারাপ জন্মের লক্ষণ নয় কিন্তু ছোটলোকদের মধ্যে তা করা দুর্বলের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের মতোই অরুচিকর বা অশ্লীল। মহানুভব ব্যক্তি ঘৃণা ও ভালোবাসা প্রকাশেও হবেন খোলামেলা, কারণ আবেগ লুকিয়ে রাখা অর্থাৎ লোকে কী ভাববে এই চিন্তা করে সত্য প্রকাশে পিছপা হওয়া কাপুষের কাজ…কথাবার্তায় তিনি খোলামেলা, কারণ তিনি উদ্ধত এবং তাকে সত্য বলতেই হবে, শুধু যখন অশ্লীল কথার প্রতিবাদে বক্রোক্তি করতে যাবেন তখনই তিনি মিথ্যার খপ্পরে পড়বেন…তিনি কাউকে প্রশংসা করবেনও না, কারো প্রশংসায় বিগলিতও হবেন না, কারণ তার কাছে কিছুই বড় নয়…তিনি খোশগল্পপ্রিয়ও নন, কারণ তিনি নিজের সম্পর্কেও কিছু বলবেন না, অন্যের সম্পর্কেও না…কেননা তিনি প্রশংসিত হবার ধার ধারেন না, অন্যের দোষ গাওয়াতেও তার আগ্রহ নেই…তিনি এমন একজন মানুষ, যার থাকবে সুন্দর এবং লাভহীন জিনিসপত্র, লাভজনক এবং উপকারী জিনিসপত্র নয়…তারপর, মহানুভব ব্যক্তির উপযুক্ত চলা হবে ধীর পদক্ষেপে, তিনি কথা বলবেন গভীর স্বরে এবং স্বরসঙ্গতি বজায় রেখে…তাহলে এই হচ্ছে মহানুভব ব্যক্তি যে ব্যক্তি এর চেয়ে কম সে অন্যায়রকমের বিনয়ী এবং যে ব্যক্তি এর বেশি সে নিষ্ফল গর্বোদ্ধত। তাহলে, একজন নিষ্ফল গর্বোদ্ধত মানুষ কী রকম হতে পারে তা ভেবে কেঁপে উঠতে হয়।

মহানুভব ব্যক্তি সম্বন্ধে যা-ই ভাবা হোক না কেন, একটি জিনিস পরিষ্কার যে, কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে মহানুভব মানুষের সংখ্যা খুব বেশি হতে পারে না। আমি নেহায়েত সাধারণ অর্থে এ কথা বোঝাতে চাইছি না, অর্থাৎ বলছি না যে সদগুণসম্পন্ন। মানুষের সংখ্যা খুব বেশি হতে পারে না তা হওয়া খুব কঠিন বলে। আমি বলতে চাই, মহানুভব ব্যক্তির সদগুণাবলি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল সমাজে তার একটি অসাধারণ অবস্থানের ওপরে। অ্যারিস্টটল নীতিশাস্ত্রকে বিবেচনা করেন রাজনীতির একটি শাখা হিসেবে। এবং যখন দেখতে পাই যে তিনি গর্বকে প্রশংসা করছেন তখন আর এটা আশ্চর্যের কিছু থাকে না যে, তিনি রাজ্যশাসনের সর্বোৎকৃষ্ট রূপ মনে করেন রাজতন্ত্রকে এবং তার পরেই স্থান দেন অভিজাততন্ত্রকে। রাজাগণ এবং অভিজাতগণ মহানুভব হতে পারেন; কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা যদি রাজাদের বা অভিজাতদের মতো জীবনযাপনের চেষ্টা করে তাহলে তাদের হাস্যকর দেখাবে।

এ থেকে একটি প্রশ্ন উঠে আসে, যা আধা-নৈতিক, আধা-রাজনৈতিক। প্রশ্নটা হলো, আমরা কি এমন একটি জনগোষ্ঠীকে নৈতিকভাবে সন্তোষজনক মনে করতে পারি যা তার মৌলিক কাঠামোতে সর্বোত্তম জিনিসগুলো অল্প কিছুসংখ্যক লোকের জন্য সীমাবদ্ধ রাখে এবং সংখ্যাগুরু জনতাকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভালো জিনিসগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলে? প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল বলছেন, হ্যাঁ, সে রকম একটি জনগোষ্ঠীকে নৈতিকভাবে সন্তোষজনক মনে করা যায় এবং নিটশে তাদের সঙ্গে একমত। জেনোর মতাবলম্বী স্টোইক, খ্রিস্টান এবং গণতন্ত্রীরা বলেন, না, তা মনে করা যায় না। কিন্তু যারা না বলেন, তাদের না বলার মধ্যে বিরাট সব পার্থক্য আছে। স্টোইক ও প্রাচীন খ্রিস্টানগণ মনে করেন সর্বাপেক্ষা শুভ হচ্ছে সদগুণ, এবং বাইরের পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনো মানুষকে সদগুণসম্পন্ন হতে বাধা দিতে পারে না। সামাজিক অন্যায় যেহেতু শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকেই প্রভাবিত করে তাই সদগুণসম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য একটি ন্যায়পর সামাজিক ব্যবস্থা অন্বেষণের কোনো প্রয়োজন নেই। উল্টোদিকে গণতন্ত্রীরা সাধারণত মনে করেন, অন্তত রাজনীতির ব্যাপারে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শুভ হলো ক্ষমতা ও সম্পত্তি; তাই এই দিক থেকে যে সামাজিক ব্যবস্থা ন্যায়ানুগ নয় তাতে গণতন্ত্রীরা সায় দিতে পারেন না। সদগুণ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণায় যেহেতু মনে করা হয় যে একজন মালিকের পক্ষে যতটা সদগুণ অর্জন করা সম্ভব একজন দাসের পক্ষেও ততটাই সম্ভব, তাই স্টোইক-খ্রিস্টীয় সদগুণের ধারণা থেকে অ্যারিস্টটলীয় স;গুণের ধারণা খুবই আলাদা। অ্যারিস্টটল মনে করেন গৌরব একটি সদগুণ, খ্রিস্টীয় নৈতিকতা গৌরব সমর্থন করেন না। খ্রিস্টানরা দীনতার সুখ্যাতি করেন, অ্যারিস্টটল মনে করেন দীনতা একটি দোষ। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণকে অন্য সব গুণের উপরে স্থান দেন আর খ্রিস্টীয় ধারণায় সদগুণের পুরো তালিকা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণকে বাদ দিতে হবে, যাতে করে অন্য যেকোনো মানুষের মতো গরিব এবং নগণ্য লোকেরাও সদগুণের অধিকারী হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে, মহান পোপ গ্রেগরি একজন বিশপকে বেশ ভর্ৎসনা করেছিলেন বিশপটি ব্যাকরণ শিক্ষা দিতেন বলেন।

সর্বোচ্চ সদগুণ অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য-অ্যারিস্টটলের এই দৃষ্টিভঙ্গি যৌক্তিকভাবে সম্পর্কিত নীতিশাস্ত্রের রাজনীতির অধীনতার সঙ্গে। অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র রাজনীতির অধীন-এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যৌক্তিক সম্পর্ক আছে এই দৃষ্টিভঙ্গির যে, সর্বোচ্চ সদগুণ অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য। লক্ষ্য যদি ভালো ব্যক্তি না হয়ে হয় ভালো সমাজ, তাহলে এটা সম্ভব যে, একটি ভালো সমাজ হলো সেটাই যেখানে অধীনস্ততা আছে। যেমন-একটি অর্কেস্টায় প্রথম ভায়োলিনটি ওবোটির (oboe) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যদিও সমগ্রের উৎকর্ষের জন্য উভয়েরই প্রয়োজন অনিবার্য। একেকজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম জিনিসটি দেওয়ার নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি অর্কেস্টা সংগঠিত করা অসম্ভব। একই ধরনের ব্যাপার একটি বৃহৎ আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা সে রাষ্ট্র যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন। আধুনিক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির হাতে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করে, প্রাচীনকালের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে যা ছিল না, যথা : রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এবং তাদের কাছ থেকে এমন কিছু গুণ আশা করা হয়, যা সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। মানুষ যেখানে ধর্ম বা রাজনৈতিক মতভেদের প্রেক্ষিতে ভাবে না, সেখানে তারা সাধারণত মনে করে থাকে যে একজন ভালো রাষ্ট্রপতি ইটভাটার একজন শ্রমিকের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন রাষ্ট্রপতি ঠিক অ্যারিস্টটলের মহানুভব ব্যক্তির মতো হবেন বলে আশা করা হয় না, কিন্তু তিনি গড়পড়তা নাগরিকদের চেয়ে বেশ ভিন্ন রকম হবেন এবং তার অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ কিছু গুণাবলি তার থাকবে এ রকমটি আশা করা হয়। এই বিশিষ্ট গুণাবলিকে বোধকরি নৈতিক বলা হবে না, কিন্তু সেটা এই কারণে যে, অ্যারিস্টটল যে অর্থে বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন, আমরা তার চেয়ে সংকীর্ণ অর্থে তা ব্যবহার করি।

নৈতিক গুণাবলির সঙ্গে অন্যান্য গুণাবলির পার্থক্য গ্রিক যুগে যেমন ছিল খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের ফলে পরবর্তী সময়ে তা তার চেয়ে তীক্ষ্ণণতর হয়ে উঠেছে। একজন মানুষের কবি হওয়া বা সঙ্গীত রচয়িতা হওয়া একটি গুণ বটে, কিন্তু তা কোনো নৈতিক গুণ নয়। আমরা মনে করি না যে কবি বা সঙ্গীতজ্ঞ হয়েছেন বলে একজন মানুষ সদগুণসম্পন্ন হয়েছেন বা মনে করি না যে, এরকম গুণপনার জন্য তিনি স্বর্গে যাবেন। নৈতিক গুণ একমাত্র সচেতন ইচ্ছাপ্রসূত কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, সম্ভবপর বিভিন্ন কার্যধারা থেকে সঠিকটি বেছে নেওয়ার সঙ্গে। (সত্য যে অ্যারিস্টটল এ রকম কথা বলেছেন, তবে তিনি যেভাবে তা বঝাতে চেয়েছেন তার ফল খ্রিস্টীয় ব্যাখ্যার মতো সুদূরপ্রসারী নয়। যেমন ধরা যাক, আমি একজন মানুষ যে অপেরা রচনা করে না। আমাকে এ জন্য দোষ দেবার কিছু নেই, কারণ আমি জানি না কীভাবে অপেরা রচনা করতে হয়। সাধারণ্যে প্রচলিত অভিমত হলো, যেখানে কোনো কাজের দুটো সম্ভবপর উপায় বা পথ খোলা থাকে, সেখানে বিবেক বলে দেয় কোনো পথটি সঠিক। তখন বিবেকই বলে দেয় এটা করো কারণ এটা ঠিক আর ওটা কোরো না, কারণ ওটা পাপ। ভালো কিছু করার চেয়ে মূলত পাপ এড়িয়ে চলাটাই হলো সদগুণ। একজন শিক্ষিত মানুষ একজন অশিক্ষিত মানুষের চেয়ে নৈতিকভাবে শ্রেয় হবে-এ রকমটি আশা করার কোনো কারণ নেই। একজন বুদ্ধিমান মানুষ যে একজন নির্বোধ মানুষের চেয়ে নৈতিকভাবে শ্রেয় হবে-এ রকম আশা করারও কোনো কারণ নেই। এইভাবে, সামাজিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বসম্পন্ন অনেক গুণ নীতিশাস্ত্রের জগৎ থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। অবাঞ্ছিত বিশেষণটির চেয়ে অনৈতিক বিশেষণটির পরিসর, আধুনিক ব্যবহারে, অনেক সংকীর্ণ। দুর্বলচিত্ত হওয়া অনাকাক্ষিত, কিন্তু অনৈতিক নয়।

অনেক আধুনিক দার্শনিক অবশ্য নৈতিকতার এই দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করেননি। তারা মনে করেন একজন ব্যক্তিকে প্রথমেই শুভ বা মঙ্গল নিধর্থারণ করতে হবে এবং তারপর বলতে হবে যে আমাদের কাজ এমন হওয়া উচিত যাতে শুভ বা মঙ্গলের বাস্তবায়ন ঘটে। এই দৃষ্টিকোণটি অনেকটা অ্যারিস্টটলের মতো, যিনি মনে করেন যে সুখ হচ্ছে মঙ্গল। সত্য যে সর্বোচ্চ সুখ শুধু দার্শনিকেরই লভ্য কিন্তু অ্যারিস্টটলের জন্য তা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি নয়।

সদগুণ লক্ষ্য না উপায়-এই প্রশ্নের ভিত্তিতে নৈতিক তত্ত্বগুলোকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল মোটের ওপর এই অভিমতের পক্ষে যে, সদগুণাবলি হলো একটি লক্ষ্যে পৌঁছবার পথ বা উপায়, লক্ষ্যটা হলো সুখ। তাহলে, আমাদের লক্ষ্য যখন কাক্ষিত এবং উপায় আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নেওয়ার পথ, তখন এ ব্যাপারে আমাদের কাজও হবে অবশ্যই আমাদের পছন্দ অনুসারে এবং সচেতন ইচ্ছা অনুযায়ী। তাহলে সদগুণাবলির চর্চা কাজকর্মের উপায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সদগুণের আরো একটি বোধ আছে। সেখানে তা কাজের লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত। বলা হচ্ছে : মানবিক মঙ্গল হচ্ছে একটি সমগ্র জীবনে সদগুণ অনুযায়ী আত্মার ক্রিয়াকর্ম। আমার মনে হয়, অ্যারিস্টটল বলতে চেয়েছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণাবলি হলো লক্ষ্য আর প্রায়োগিক সদগুণাবলি নেহায়েত উপায় মাত্র। খ্রিস্টান নীতিবাদীরা মনে করেন, সৎকাজের পরিণাম সাধারণত ভালো, কিন্তু সৎকাজের পরিণাম সকাজের মতো তত বেশি ভালো নয়। সৎকাজের মূল্যায়ন কাজের বিচারেই করতে হবে, ফলের বিচারে নয়। অন্যদিকে যারা মনে করেন আনন্দই হলো মঙ্গল তারা সদগুণকে শুধু উপায় বলেই বিবেচনা করেন। মঙ্গল হচ্ছে সদগুণ-এই সংজ্ঞা ছাড়া মঙ্গলের অন্য যেকোনো সংজ্ঞার পরিণতি হবে এই যে সদগুণগুলো মঙ্গলসাধনের উপায় এবং মঙ্গল আর সদগুণ আলাদা ব্যাপার। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, এই প্রশ্নে অ্যারিস্টটল সম্পূর্ণরূপে না হলেও, প্রধানত তাদের সঙ্গে একমত যারা মনে করেন নীতিশাস্ত্রের প্রথম কাজ হচ্ছে মঙ্গলের সংজ্ঞা নিরূপণ করা, যারা মনে করেন সদগুণের সংজ্ঞা নিরূপিত হবে মঙ্গলসাধনের লক্ষ্যে কৃত কাজ হিসেবে।

রাজনীতির সঙ্গে নীতিশাস্ত্রের সম্পর্ক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি নৈতিক প্রশ্ন উঠে আসে। প্রশ্নটি হলো, যে মঙ্গলের লক্ষ্যে ভালো কাজ করা উচিত তাকে পুরো সম্প্রদায়ের মঙ্গল বা শেষ পর্যন্ত পুরো মানবজাতির মঙ্গল বলে ধরে নেওয়া হলে সেই সামাজিক মঙ্গল কি আলাদা আলাদা ব্যক্তির মঙ্গলের সমষ্টি নাকি তা এমন কিছু যা একান্তভাবেই সমগ্রের মঙ্গল, সমগ্রের বিভিন্ন অংশের মঙ্গল নয়? সমস্যাটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে মানব শরীরের উপমা দ্বারা। সুখানুভূতি নানা রকম, সেগুলো সাধারণভাবে দেহের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু আমরা সেসব সুখানুভূতিকে সামগ্রিকভাবে একজন মানুষের সুখানুভূতি বলে গণ্য করি। আমরা একটি সুখকর গন্ধ উপভোগ করতে পারি, কিন্তু আমরা জানি যে, ঘ্রাণেন্দ্রিয় একা বিচ্ছিন্নভাবে তা উপভোগ করতে পারত না। কেউ কেউ মনে করেন যে, নিবিড়ভাবে গঠিত একটি সম্প্রদায়ে এ রকম কিছু বিশিষ্ট থাকে যা পুরো সম্প্রদায়ের জিনিস, কোনো অংশবিশেষের নয়। যারা এরকম মনে করেন তারা যদি হন অধিবিদ তাহলে তারা হেগেলের মতো মনে করতে পারেন যে, ভালো যেকোনো বৈশিষ্ট্য পুরো বিশ্বজগতের গুণ। তবে তারা সাধারণভাবে আরো বলবেন যে, একজন ব্যক্তিকে ভালো বলার চেয়ে একটি রাষ্ট্রকে ভালো বলা হবে কম ভ্রমাত্মক। যৌক্তিকভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো যায় এভাবে : একটি রাষ্ট্রের ওপর আমরা বিভিন্ন রকম বিধেয় আরোপ করতে পারি, যেগুলো ওই রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা সদস্যের ওপরে আরোপ করা যায় না। যেমন আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্রটি জনবহুল, রাষ্ট্রটি বিশাল, রাষ্ট্রটি শক্তিশালী ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গিটি নৈতিক বিধেয়গুলোকে এই শ্রেণিতে স্থাপন করে এবং বলে, পৃথক পৃথক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধেয়গুলো মৌলিক নয়, রাষ্ট্রের বিধেয়গুলো থেকেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধেয় উৎপন্ন হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীরা বলেন, একজন ব্যক্তি একটি জনবহুল রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে, বা সে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে, কিন্তু সে কল্যাণকরও হতে পারে না, জনবহুলও হতে পারে না। জার্মান দার্শনিকরা এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে পোষণ করতেন। এটি অ্যারিস্টটলের নয়, শুধু তার ন্যায়পরায়ণতার ধারণায় এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি কিছু মাত্রায় থাকতে পারে।

এথিক্স গ্রন্থের বেশ বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে বন্ধুত্ব সম্বন্ধে আলোচনা। এই আলোচনায় বন্ধুত্ব ছাড়াও রয়েছে স্নেহ-ভালোবাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সম্পর্ক। বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব হতে পারে শুধু ভালো লোকদের মধ্যে, বহু লোকের বন্ধু হওয়া অসম্ভব। উচ্চতর সদগুণের অধিকারী না হলে কোনো ব্যক্তির উচিত নয় তার নিজের সামাজিক অবস্থানের চেয়ে উচ্চতর অবস্থানের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। উচ্চতর সদগুণের অধিকারী হলেই কেবল তার প্রতি কোনো উচ্চতর সামাজিক অবস্থানের ব্যক্তির সম্মান দেখানো যুক্তিপূর্ণ হতে পারে। আমরা দেখেছি, স্বামী-স্ত্রী বা পিতা-পুত্রের মতো অসম সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে উপরস্থ ব্যক্তিকে বেশি ভালোবাসতে হয়। ঈশ্বরের বন্ধু হওয়া অসম্ভব, কেননা তিনি আমাদের ভালোবাসতে পারেন না। একজন মানুষ নিজের বন্ধু হতে পারে কি না এ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের আলোচনা রয়েছে। সে আলোচনায় তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একজন মানুষ নিজের বন্ধু হতে পারে কেবল তখনই, যদি সে একজন ভালো মানুষ হয়। অ্যারিস্টটল বলেছেন, দুষ্ট লোকেরা প্রায়ই নিজেদের ঘৃণা করে। একজন ভালো লোক নিজেকে ভালোবাসবে, তবে মহানুভবতার সঙ্গে। বন্ধুরা হলো দুঃসময়ের সান্ত্বনা, কিন্তু এমনভাবে তাদের সাহায্য-সহানুভূতি নেওয়া উচিত নয় যার ফলে তারা অসন্তুষ্ট হয়-মেয়েরা এবং মেয়েলি স্বভাবের পুরুষরা যা করে থাকে। শুধু দুঃসময়েই বন্ধু চাই তা নয়, সুখী মানুষেরও বন্ধুর প্রয়োজন, যার সঙ্গে সুখ ভাগাভাগি করা যায়। একা থাকতে হবে এই শর্তে কোনো মানুষই গোটা বিশ্বকেও নেবে না, কারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী, তার স্বভাব অন্যদের সঙ্গে বাস করা। বন্ধুত্ব সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার সবই যথোচিত; কিন্তু এ সংক্রান্ত আলোচনায় একটি শব্দও নেই, যা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানকে ছাড়িয়ে অসাধারণ কিছু বলে।

আনন্দ সম্পর্কিত আলোচনায় অ্যারিস্টটল আবারও তার সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। প্লেটো আনন্দকে দেখেছেন একধরনের কৃচ্ছ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। অ্যারিস্টটল আনন্দ শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে তা সুখ থেকে স্বতন্ত্র; যদিও আনন্দ ছাড়া সুখ হতে পারে না। অ্যারিস্টটল বলেছেন, আনন্দ সম্পর্কে তিন ধরনের মত আছে : ১. আনন্দ কখনোই ভালো নয়, ২. কিছু আনন্দ ভালো কিন্তু অধিকাংশই খারাপ, ৩, আনন্দ ভালো কিন্তু সর্বোত্তম নয়। প্রথম মতটি অ্যারিস্টটল নাকচ করেছেন। তার যুক্তি : বেদনা অবশ্যই খারাপ, অতএব আনন্দ অবশ্যই ভালো। খুব সঙ্গতভাবে তিনি বলেছেন, এ কথা বলা অর্থহীন যে একজন মানুষ কঠোর শারীরিক/মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে সুখী হতে পারে। তিনি মনে করেন সুখের জন্য কিছু পরিমাণ বৈষয়িক সমৃদ্ধি অবশ্যই প্রয়োজন। অ্যারিস্টটল এই মতও খারিজ করে দিয়েছেন যে সব আনন্দই শারীরিক। তার বিশ্বাস সব জিনিসের মধ্যেই ঐশ্বরিক কিছু থাকে, তাই সবকিছুর মধ্যেই উচ্চতর আনন্দ লাভের কিছু না কিছু সামর্থ্য থাকে। ভালো মানুষের আনন্দ থাকে, যদি না তারা দুর্ভাগা হয়, আর ঈশ্বর সর্বদা এক ও অবিমিশ্র আনন্দ উপভোগ করেন।

গ্রন্থটির শেষ দিকের একটি অংশে আনন্দ সম্পর্কে আরেকটি আলোচনা রয়েছে। সে আলোচনা উপরের আলোচনার সঙ্গে আগাগোড়া সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এখানে বলা হচ্ছে, খারাপ আনন্দও আছে, তবে ভালো লোকদের কাছে সেগুলো আনন্দ বলে বিবেচিত নয়। বলা হচ্ছে, সম্ভবত আনন্দের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। ভালো কাজ ও খারাপ কাজের সঙ্গে সম্পর্ক অনুসারে নির্ধারিত হয় আনন্দ ভালো না খারাপ। আনন্দের চেয়ে মূল্যবান জিনিসও আছে; যেমন-শিশুর বুদ্ধি নিয়ে কোনো ব্যক্তি সারাজীবন কাটাতে তুষ্ট হবে না, সেইভাবে কাটানো আনন্দদায়ক হলেও না। প্রত্যেক প্রাণীর রয়েছে তার উপযুক্ত আনন্দ, মানুষের উপযুক্ত আনন্দ বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত।

এইসব আলোচনা অগ্রসর হয়েছে গ্রন্থটির একমাত্র মতবাদটির দিকে, যা নেহায়েত একটি সাধারণ জ্ঞানপ্রসূত মতবাদ নয়। সুখ নিহিত থাকে সৎকাজের মধ্যে আর বিশুদ্ধ সুখ নিহিত থাকে সর্বোত্তম কাজের মধ্যে, যা গভীর চিন্তামূলক। যুদ্ধ, রাজনীতি বা যেকোনো প্রায়োগিক কাজের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তা শ্রেয়, কারণ এতে অবকাশ মেলে আর অবকাশ সুখের জন্য অপরিহার্য। প্রায়োগিক সদগুণ শুধু দ্বিতীয় স্তরের সুখ আনে। পরম সুখ থাকে বুদ্ধির অনুশীলনে। মানুষের মানুষ হওয়ার পেছনে অন্য সবকিছুর চেয়ে বুদ্ধির ভূমিকা বেশি। মানুষ সম্পূর্ণরূপে চিন্তাশীল হতে পারে না, তবে যতখানি চিন্তাশীল সে হতে পারে, ঐশ্বরিক জীবনের ততটা অংশীদার সে হয়। ঈশ্বরের কাজ, যা সুখের দিক থেকে অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে, অবশ্যই চিন্তাশীল।

মানুষের মধ্যে দার্শনিকরা তাদের কাজেকর্মে সবচেয়ে বেশি ঈশ্বর-অনুরূপ, তাই তারা সবচেয়ে সুখী এবং সবচেয়ে উত্তম : যে ব্যক্তি তার বুদ্ধির অনুশীলন করেন ও বিকাশ ঘটান তিনি একই সঙ্গে মনের সর্বোত্তম অবস্থায় থাকেন এবং দেবতাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্র হন। কেননা, মানুষের ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে দেবতাদের যদি কোনো আগ্রহ থেকে থাকে-যা তাদের আছে বলেই মনে করা হয়-তাহলে এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত হবে যে দেবতারা তাতেই আনন্দিত হবেন, যা সর্বোত্তম এবং যা তাদের সবচেয়ে সদৃশ (অর্থাৎ বুদ্ধি) এবং দেবতারা তাদেরকেই পুরস্কৃত করবেন যারা এটাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে ও মূল্য দেয়; এসব তাদের প্রিয় এবং যারা সকাজ করবে এবং মহানুভবতার সঙ্গে করবে, দেবতারা তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। এইসব গুণাবলির অধিকাংশই যে দার্শনিকদের রয়েছে তা সুস্পষ্ট। তাই দার্শনিক দেবতাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। যে ব্যক্তি দেবতাদের প্রিয়পাত্র হবেন, সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটিও সম্ভবত হবেন তিনিই। তাই এভাবেও একজন দার্শনিক অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে সুখী হবেন।

উপরের উদ্ধৃতাংশটি বস্তুত এথিক্স গ্রন্থের উপসংহার। এর পরে যে সামান্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে তাতে আলোচনা নীতিশাস্ত্র থেকে রাজনীতিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

এথিক্স গ্রন্থের দোষ-গুণ সম্পর্কে আমরা কী চিন্তা করব এখন তা স্থির করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক। গ্রিক দার্শনিকদের আলোচিত অন্যান্য অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে নীতিশাস্ত্র তেমন কোনো নির্দিষ্ট অগ্রগতি, নিরূপিত আবিষ্কার অর্থে, লাভ করতে পারেনি। বৈজ্ঞানিক অর্থে নীতিশাস্ত্রের কিছুই জানা হয়নি। কিন্তু তাই বলে নীতি বিষয়ে কোনো আধুনিক সন্দর্ভের চেয়ে সে বিষয়ে লিখিত কোনো প্রাচীন সন্দর্ভ নিচু মানের হবার কোনো কারণ নেই। অ্যারিস্টটল যখন জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে বলেন তখন আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে তিনি ভুল বলছেন। কিন্তু যখন তিনি নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে বলেন তখন আমরা সেই একই অর্থে বলতে পারি না তিনি ভুল বলছেন না ঠিক বলছেন। মোটা দাগে বললে, অ্যারিস্টটলের বা অন্য যেকোনো দার্শনিকের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে আমরা তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি। যথা : ১. নীতিবিষয়ক তত্ত্বটি কি ভেতরের দিক থেকে স্ব-সঙ্গতিপূর্ণ? ২. লেখকের অবশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতগুলোর সঙ্গে তা কি সঙ্গতিপূর্ণ? ৩. তত্ত্বটি কি আমাদের নিজেদের নৈতিক বোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সমস্যাবলির উত্তর দেয়? প্রথম বা দ্বিতীয় প্রশ্নের যেকোনো একটির উত্তর যদি না-সূচক হয় তাহলে আলোচ্য দার্শনিকের কিছু বুদ্ধিগত ভ্রান্তি আছে। কিন্তু তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর যদি না-সূচক হয়, তাহলে সে-দার্শনিককে ভুল বলার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমরা শুধু বলতে পারি যে তার কথা আমাদের পছন্দ হলো না।

অ্যারিস্টটলের নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স গ্রন্থে উপস্থাপিত নৈতিক তত্ত্বের মধ্যে এই তিনটি প্রশ্ন যাচাই করে দেখা যাক।

১. তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় এ রকম অল্প কিছু বিষয় বাদ দিলে গ্রন্থটি মোটের ওপর স্ব-সঙ্গতিপূর্ণ। মঙ্গল হলো সুখ এবং সব ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই সুখ-এই মতবাদ সবিস্তকারে উপস্থাপিত ও সুসম্পন্ন। প্রত্যেকটি সদগুণ হচ্ছে দুই চরমপন্থার মধ্যবর্তী-এই মতবাদটি যদিও বিচক্ষণতার সঙ্গে অ্যারিস্টটল গড়ে তুলেছেন, তবু তা অপেক্ষাকৃত কম সফল। কেননা এটা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাশীলতার বেলায় প্রযোজ্য নয়। অথচ আমাদের বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাশীলতাই সব মানবিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তবে মনে করা যেতে পারে যে, মধ্যপন্থার মতবাদটি শুধু প্রায়োগিক সদগুণাবলির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্যই, বুদ্ধিবৃত্তিক সদগুণাবলির জন্য নয়।

অন্য একটি পয়েন্টে, সম্ভবত বিধানসভার সদস্যের অবস্থান কিছুটা দ্ব্যর্থক। বিধায়ক শিশু ও তরুণদের ভালো কাজ করার অভ্যাস অর্জনের চেষ্টা করবেন, যাতে তারা সদগুণের মধ্যে আনন্দ লাভ করে এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সুকাজ করে। এটা স্পষ্ট যে বিধায়ক অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একইভাবে বদভ্যাসের প্রতিও প্ররোচিত করতে পারেন। এটা এড়াতে হলে বিধায়ককে প্লেটোনিক অভিভাবকের সব প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে। যদি তা এড়ানো না যায় তাহলে সৎ জীবন আনন্দময়-এই যুক্তি ব্যর্থ হবে। বোধ করি এই সমস্যাটি যতটা না নীতিশাস্ত্রের অন্তর্গত, তার চেয়ে বেশি রাজনীতির অন্তর্গত।

২. অ্যারিস্টটলের নীতিবিদ্যা সব পয়েন্টে তার অধিবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অবশ্য তার অধিবিদ্যক তত্ত্বাবলি স্বয়ং এক নৈতিক শুভবাদের প্রকাশ। তিনি চূড়ান্ত হেতুগুলোর বৈজ্ঞানিক গুরুত্বে বিশ্বাস করেন। আর এর অর্থ হলো এই বিশ্বাস যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, পরিবর্তন মূলত গঠনের বা রূপের বৃদ্ধি এবং সকাজ প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এই বৃদ্ধির প্রবণতার অনুকূল। সত্য যে অ্যারিস্টটলের প্রায়োগিক নীতিবিদ্যার একটি বড় অংশ নির্দিষ্টভাবে দার্শনিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়, বরং নেহায়েত মানবিক ক্রিয়াকলাপের পর্যবেক্ষণের ফল। কিন্তু তার মতবাদের এই অংশ তার অধিবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়-যদিও তা থেকে স্বতন্ত্র হলেও হতে পারে।

৩. যখন আমরা অ্যারিস্টটলের নৈতিক রুচি ও আমাদের নিজেদের নৈতিক রুচির তুলনা করতে যাই, তখন প্রথমেই দেখতে পাই যে অ্যারিস্টটলের নৈতিক রুচিতে একটি অসমতা মেনে নেওয়া হয়েছে যা কিনা আধুনিক মানসিকতায় অপছন্দনীয়। এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যারিস্টটলের নৈতিক ব্যবস্থায় দাসপ্রথা বা স্ত্রী ও শিশুদের ওপর স্বামী ও পিতাদের কর্তৃত্বের ব্যাপারে আপত্তি নেই, শুধু তা-ই নয়, বরং মনে করা হয় যে, যা কিছু সর্বোত্তম তা কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য নির্দিষ্ট-মহানুভব ব্যক্তিগণ ও দার্শনিকদের জন্য। দেখা যাবে, এই ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষ হলো অল্পসংখ্যক শাসক ও সাধু-সন্ন্যাসীর জন্য মূলত উৎপাদনের উপায়। কান্ট মনে করতেন প্রত্যেক মানুষ নিজে নিজের উদ্দেশ্য। তার এই মতকে খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তিত মতের একটি অভিব্যক্তি বলা যেতে পারে। কান্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্য একটি যুক্তিগত সমস্যা আছে। দুজন মানুষের স্বার্থের মধ্যে যখন বিরোধ দেখা দেয় তখন কান্টের এই দৃষ্টিভঙ্গি তা সুরাহার কোনো পথ বাতলে দেয় না। যদি প্রত্যেকটি মানুষ নিজে নিজের উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমরা কীভাবে এমন একটি নীতিতে পৌঁছতে পারি যা নির্ধারণ করবে যে কে নতি স্বীকার করবে বা ছাড় দেবে? এ ধরনের নীতি অবশ্যই একটি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ব্যক্তির সঙ্গে নয়। নীতি শব্দটির ব্যাপকতম অর্থে এই নীতি হবে ন্যায়পরায়ণতার নীতি। বেনথাম ও উপযোগবাদীগণ ন্যায়পরায়ণতাকে সমতা হিসেবে দেখেন। যখন দুজন মানুষের স্বার্থে সংঘাত দেখা দেয়, তখন সঠিক পথটি হলো তাই, যা সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ সৃষ্টি করবে, ওই দুজনের মধ্যে কে সেই সুখ ভোগ করবে বা দুজনের মধ্যে কীভাবে তা বণ্টিত হবে তা কোনো ব্যাপার নয়। যদি দুজনের মধ্যে যে শ্রেয় সে বেশি পায় এবং অধমটি যদি কম পায় তবে তা ঘটে এই জন্যে যে, শেষ পর্যন্ত সাধারণ সুখ বৃদ্ধি পায় সদগুণকে পুরস্কৃত করা ও দোষকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে। এরকম কোনো চূড়ান্ত নৈতিক মতবাদের কারণে নয় যে, ভালো লোক মন্দ লোকের চেয়ে বেশি পাবার যোগ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ন্যায়পরায়ণতা হলো কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে কেবল সংশ্লিষ্ট সুখের পরিমাণ বিবেচনা করা। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলসহ গ্রিক দার্শনিকদের ন্যায়পরায়ণতার একটি অন্যতর ধারণা ছিল, সেটা এখনো ব্যাপকভাবে প্রচলিত। মূলত ধর্ম থেকে আগত কিছু ভিত্তি থেকে তারা মনে করতেন প্রত্যেকটি জিনিসের বা ব্যক্তির উপযুক্ত জায়গা আছে, তা অতিক্রম করা অন্যায়। চরিত্র ও প্রবণতার গুণে কিছু লোক অন্যদের চেয়ে প্রশস্ত জায়গার অধিকারী হয়। আর সে রকম লোকেরা যদি বেশি পরিমাণ সুখ ভোগ করে। তাতে কোনো অবিচার নেই। অ্যারিস্টটলের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত বলে মনে করা হয়, কিন্তু এর ভিত রয়েছে আদি ধর্মে, যা একেবারে গোড়ার দিকের দার্শনিকদের মধ্যে স্পষ্ট। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি অ্যারিস্টটলের রচনায় দেখতে পাওয়া যায় না।

পরোপকার বা জনহিতকর কাজ যেটাকে বলা হয়, অ্যারিস্টটলে সে প্রসঙ্গ প্রায় সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। মানবজাতির দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে যত দূর তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন তাতে তিনি আবেগতাড়িত হতেন না। এগুলোকে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেখতেন এবং মন্দ বলে মনে করতেন, এই যা। কিন্তু দুঃখ-কষ্টভোগীরা তার ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধব না হলে এসব যে তাকে কষ্ট দিত এমন কোনো প্রমাণ মেলে না।

মোদ্দা কথায়, এথিক্স গ্রন্থটিতে আবেগানুভূতির দারিদ্র্য আছে, যা অ্যারিস্টটলের আগেকার দার্শনিকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষের জীবনযাপন, কাজকর্ম, আন্তঃসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে অ্যারিস্টটলের চিন্তা-ভাবনায় অস্বাভাবিক ধরনের এক তৃপ্তিবোধ ও আরামের ভাব আছে। যেসব কারণে মানুষ পরস্পরের প্রতি প্রবল আগ্রহ বোধ করে, তার সবকিছুই তিনি বিস্মৃত বলে মনে হয়। এমনকি বন্ধুত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বিবরণও তেমন উষ্ণ নয়। যেসব অভিজ্ঞতা মানুষের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা কঠিন করে তোলে অ্যারিস্টটলের সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছিল বলে প্রমাণ নেই। নৈতিক জীবনের গভীরতর সব দিক অ্যারিস্টটলের অজানা ছিল বলেই মনে হয়। যে কেউ বলতে পারেন ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানব অভিজ্ঞতার পুরো ক্ষেত্রটি অ্যারিস্টটল বাদ দিয়ে গেছেন। তার বলবার কথা হলো তা-ই, যা দুর্বল আবেগ অনুভূতির আয়েশি লোকজনের কাজে লাগবে; কিন্তু দেবতা-অধিকৃত বা শয়তানকবলিত ব্যক্তিদের, বা দুর্ভাগ্য যাদেরকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়, তাদের উদ্দেশে অ্যারিস্টটলের বলবার কিছু নেই। এসব কারণে আমার বিচারে অ্যারিস্টটলের এথিক্স গ্রন্থটির খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে ঘাটতি রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *