৫. সৃষ্টিতত্ত্ব

সৃষ্টিতত্ত্ব

 টিমেউস নামক সংলাপে প্লেটোর সৃষ্টিতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে, সিসেরো যেটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন; পরম্ভ মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে এই একটি মাত্র সংলাপের কথাই জানা ছিল। তখন এবং নয়াপ্লেটোবাদের গোড়ার দিকে প্লেটোর যেকোনো রচনার চেয়ে টিমেউস-এর প্রভাব ছিল বেশি। ব্যাপারটি অদ্ভুত, কেননা প্লেটোর অন্যান্য রচনার চেয়ে এই সংলাপটির বিষয়বস্তু নিতান্তই বোকামিপূর্ণ, শিশুসুলভ। দর্শন হিসেবে রচনাটি গুরুত্বহীন, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে তা এতই প্রভাবসম্পন্ন ছিল যে এটিকে অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত খানিকটা বিশদভাবে।

সক্রেটিস আগের সংলাপগুলোতে যে স্থান অধিকার করেছিলেন টিমেউস-এ এসে সেখানে দেখা যায় একজন পিথাগোরাসবাদীকে, আর এখানে পিথাগোরাসের ধারার মতবাদগুলোই মূলত গৃহীত হয়েছে। সংখ্যাই হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাখ্যা-এই দৃষ্টিভঙ্গিটিও (একটি পয়েন্ট পর্যন্ত) গৃহীত মতবাদগুলোর অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম পাঁচটি পুস্তকের একটি সারসংক্ষেপ দেয়া হয়েছে, তারপর রয়েছে। আটলান্টিস-এর পৌরাণিক কাহিনিটি; বলা হয়েছে আটলান্টিস পিলারস অব হারকিউলিস থেকে দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা আয়তনে লিবিয়া ও এশিয়ার আয়তনের যোগফলের চেয়ে বড়। তারপর টিমেউস-যিনি একজন পিথাগোরাসবাদী জ্যোতির্বিদ-জগৎ সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস পর্যন্ত বর্ণনা করেন। তিনি যা বলেন, মোটা দাগে তা এ রকম : যা কিছু অপরিবর্তনীয় তা বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির দ্বারা উপলব্ধি করা যায়, আর যা কিছু পরিবর্তনশীল তা বোঝা যায় ধারণা বা অভিমত দ্বারা। জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়ায় তা শাশ্বত হতে পারে না এবং নিশ্চয়ই তা ঈশ্বরের হাতে সৃষ্ট। যেহেতু ঈশ্বর উত্তম, তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন শাশ্বতের আদলে; কোনো রকম ঈর্ষায় না ভুগে তিনি চেয়েছেন সবকিছু যেন, যতটা সম্ভব, তার নিজের মতো হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছে ছিল সবকিছুই হবে উত্তম, কোনো কিছুই মন্দ হবে না, যত দূর সম্ভব। সমগ্র দৃশ্যমান গোলকটিকে স্থির নয়, বরং অনিয়মিত ও বিশৃঙ্খলভাবে সঞ্চরণশীল দেখতে পেয়ে তিনি বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা আনেন। (তাহলে মনে হয় প্লেটোর ঈশ্বর ইহুদি ও খ্রিস্ট্রীয় ঈশ্বরের মতো শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেননি, আগে থেকেই অস্তি তৃমান পদার্থের পুনর্বিন্যাস করেছেন মাত্র।) তিনি আত্মার মধ্যে মেধা প্রবেশ করিয়েছেন এবং আত্মাকে দেহের মধ্যে স্থাপন করেছেন। তিনি জগৎটাকে নির্মাণ। করেছেন একটি পরিপূর্ণ জীবন্ত প্রাণীর মতো করে, যার আত্মা ও বুদ্ধি রয়েছে। জগৎ মাত্র একটিই, অনেকগুলো নয়-সক্রেটিস-পূর্ব অনেকে যেমনটা বলতেন। একটির বেশি জগৎ থাকতে পারে না, কারণ তা ঈশ্বর-পরিকল্পিত সেই আদি শাশ্বত জগতের নির্মিত কপি, যতটা সম্ভব মূলটির অনুরূপ করে নির্মিত। জগৎ সামগ্রিকভাবেই একটি দৃশ্যমান। প্রাণী, যা নিজের মধ্যে অন্য সব প্রাণীকে ধারণ করে। জগৎ একটি গোলক, কারণ অনুরূপ অন্যরূপের চেয়ে সুন্দর, আর কেবল একটি গোলকই সর্বত্র অনুরূপ। তা আবর্তিত হয়, কারণ বৃত্তাকার গতিই সর্বাপেক্ষা নিখুঁত; আর যেহেতু বৃত্তাকারে ঘূর্ণনই পৃথিবীর একমাত্র গতি, তাই তার কোনো হাত বা পায়ের প্রয়োজন হয় না।

আগুন, বায়ু, পানি ও মাটি-এই চারটি উপাদান, যেগুলোর প্রত্যেকটি একটি করে সংখ্যা দ্বারা প্রকাশিত, তারা একটি অবিরাম অনুপাত মেনে চলে, অর্থাৎ আগুনের সঙ্গে বাতাসের, বাতাসের সঙ্গে এবং পানির সঙ্গে মাটির অনুপাত সমান। বিশ্ব সৃষ্টির কাজে ঈশ্বর এই সব উপাদান ব্যবহার করেছেন এবং সেই কারণে তা নিখুঁত এবং জরা বা বার্ধকের শিকার নয়। বিশ্ব সমানুপাত দ্বারা ছন্দোবদ্ধ, যে ছন্দের কারণে তার সখ্যের চেতনা রয়েছে এবং সে কারণেই ঈশ্বর ছাড়া আর কারো দ্বারা বিভাজনযোগ্য নয়।

ঈশ্বর প্রথমে সৃষ্টি করেছেন আত্মা, তারপর দেহ। আত্মা অবিভাজ্য-অপরিবর্তনীয় এবং বিভাজ্য-পরিবর্তনীয়ের মিশ্রণে গঠিত, তা একধরনের তৃতীয় ও মধ্যবর্তী সত্তা।

গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে একটি পিথাগোরীয় বর্ণনা নিচে দেয়া হচ্ছে, যা সময়ের উৎস সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যার দিকে অগ্রসর হয়েছে : যখন পিতা ও স্রষ্টা সৃষ্টির বীজ বপন করেন-যা তিনি সৃষ্টি করেছেন জীবন্ত ও গতিশীলরূপে, শাশ্বত দেবতাদের সৃষ্ট ছবিরূপে-তখন তিনি আনন্দ লাভ করেন এবং সেই আনন্দের মধ্যে তিনি স্থির করেন যে এই কপি বা ছবিকে তিনি আদিসত্তার আরো অনুরূপ করে গড়বেন, আর যেহেতু তা ছিল শাশ্বত তাই তিনি বিশ্বজগৎকে যতটা সম্ভব, চিরন্তন করে নির্মাণের চেষ্টা করেন, এখন, আদর্শ সত্তার প্রকৃতি চিরকালীন হলেও একটি সৃষ্টিকে এই গুণ সম্পূর্ণরূপে দান করা ছিল অসম্ভব। এখান থেকে তিনি শাশ্বতের একটি গতিশীল প্রতিরূপ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, আর যখন তিনি আকাশকে সুশৃঙ্খল করেন তখন তিনি এই প্রতিরূপকে শাশ্বত কিন্তু গতিশীলরূপে সৃষ্টি করেন সংখ্যা অনুসারে, আর শাশ্বত নিজে ঐক্যের মধ্যে অবস্থান করে, এই প্রতিরূপকে আমরা বলি সময়। সে রাতে আমি শাশ্বতকে দেখেছি দিয়ে শুরু হওয়া কবিতাটি লিখবার সময় Vaughan নিশ্চয়ই এই অনুচ্ছেদটি পড়ে থাকবেন।)

তার আগে দিন বা রাত কিছুই ছিল না। শাশ্বত সত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাদের বলা উচিত নয় যে তা ছিল বা থাকবে; শুধু আছে বলাই হবে সঠিক। ইঙ্গিত করা হয় যে শাশ্বতের গতিশীল প্রতিরূপ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এ কথা বলা সঠিক যে তা ছিল এবং থাকবে। সময় ও নভোমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে একই সঙ্গে। ঈশ্বর সূর্য সৃষ্টি করেছেন যাতে প্রাণীরা পাটিগণিত শিখতে পারে-কেউ কেউ মনে করে, রাত ও দিনের পরিবর্তন ছাড়া আমরা সংখ্যার কথা ভাবতেই পারতাম না। দিন ও রাতের, মাস ও বছরের দৃষ্টি সংখ্যার জ্ঞান সৃষ্টি করেছে এবং আমাদের সময়ের ধারণা দিয়েছে; এখান থেকেই এসেছে দর্শন। এটাই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, যার জন্য আমরা দৃষ্টির কাছে ঋণী। (সামগ্রিকদপে বিশ্ব ছাড়াও) চার ধরনের প্রাণী আছে : দেবতাগণ, পক্ষীকুল, মৎস্যকুল এবং স্থলজ প্রাণীকুল। দেবতারা প্রধানত আগুনের; স্থির নক্ষত্রগুলো স্বর্গীয় ও শাশ্বত প্রাণী। সৃষ্টিকর্তা দেবতাদের বলেছিলেন যে তিনি তাদের ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু করবেন না। অমর ও স্বর্গীয় অংশটুকু নির্মাণের পর সৃষ্টিকর্তা অন্যান্য প্রাণীদের নৈতিক অংশটুকু তৈরির ভার দেবতাদের ওপর ছেড়ে দেন। (প্লেটোর রচনায় ঈশ্বর সম্পর্কে আরো সব অনুচ্ছেদের মতো এটিকেও বোধকরি গুরুত্বসহকারে নেয়া যায় না। শুরুতে, টিমেউস বলছেন যে তিনি শুধুই সম্ভাব্যতা খুঁজছেন, নিশ্চিত হতে পারছেন না। স্পষ্টতই অনেক বিবরণ কাল্পনিক এবং আক্ষরিক অর্থে বোঝানোর জন্য নয়।)

টিমেউস বলেন, সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকটা নক্ষত্রের জন্য একটি করে আত্মা তৈরি করেছেন। আত্মার চেতনাশক্তি, প্রেম, শঙ্কা ও ক্রোধ রয়েছে, যদি আত্মারা এসবকে অতিক্রম করতে পারে তাহলে তাদের জীবন হয় পুণ্যময়; যদি না পারে তাহলে হয় না। যদি একজন মানুষ উত্তম জীবনযাপন করে তাহলে মৃত্যুর পরে সে চিরকালের জন্য সুখে বসবাস করার জন্য তার নক্ষত্রে যাবে। কিন্তু যদি সে মন্দ জীবনযাপন করে তাহলে সে পরবর্তী জীবনে একজন নারীরূপে জন্ম নেবে; যদি সে তার বদকাজ অব্যাহত রাখে তাহলে সে একটি পশু হয়ে যাবে, এইভাবে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তার রূপান্তর চলতে থাকবে। ঈশ্বর কিছু আত্মাকে পৃথিবীতে, কিছু চাঁদে, কিছু অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রে স্থাপন করে তাদের দেহ তৈরির ভার ছেড়ে দিয়েছেন দেবতাদের হাতে।

উদ্দেশ্য দুই রকমের। এক ধরনের উদ্দেশ্য বুদ্ধিদীপ্ত। আরেক ধরনের উদ্দেশ্য আছে যেগুলো অন্যের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় এবং পরিণামে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে। প্রথম ধরনের উদ্দেশ্যগুলোর রয়েছে মন এবং এগুলো সুন্দর ও উত্তম বস্তুগুলোর হয়ে কাজ করে, আর দ্বিতীয় প্রকারের উদ্দেশ্যগুলো কোনো নিয়ম বা পরিকল্পনা ছাড়াই আকস্মিক ফল সৃষ্টি করে। উভয় প্রকারের উদ্দেশ্যই বিবেচনা করা দরকার, কেননা সৃষ্টি নিয়তি ও মনের মিশ্রণে গঠিত। (খেয়াল করতে হবে যে নিয়তি ঈশ্বরের ক্ষমতার অধীন নয়।) তারপর টিমেউস নিয়তির অবদানসংক্রান্ত অংশটি নিয়ে বলতে থাকেন। (কর্নফোর্ড বলেন, নিয়তি ব্যাপারটিকে নিয়মের চূড়ান্তবাদী শাসনের আধুনিক ধারণাটির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। যা কিছু নিয়তি দ্বারা ঘটে তা কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের ফল হিসেবে ঘটে না, তা বিশৃঙ্খলভাবে ঘটে, কোনো নিয়ম মেনে ঘটে না।)

মাটি, বাতাস, আগুন ও পানি প্রাথমিক নিয়ম, বর্ণ বা উপাদান নয়, এমনকি শব্দাংশ বা প্রাথমিক যৌগও নয়। উদাহরণস্বরূপ, আগুনকে বলা যাবে না যে এই হচ্ছে আগুন, বরং বলতে হবে আগুন এ রকম। অর্থাৎ তা কোনো দ্রব্য নয়, দ্রব্যের একটি অবস্থা। এই জায়গায় এসে প্রশ্ন ওঠে; বোধগম্য সত্তাগুলো কি শুধুই নাম? তখন, আমাদের বলা হয়, পাল্টা প্রশ্ন ওঠে মন ও সত্যিকারের অভিমত একই জিনিস কি না। যদি না হয় তাহলে জ্ঞান অবশ্যই সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান, আর সে কারণেই সত্তা শুধু নাম হতে পারে না। তাহলে মন ও সত্য অভিমত নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন ভিন্ন জিনিস, কারণ এ দুয়ের একটি প্রোথিত হয় নির্দেশনা দ্বারা, অন্যটি প্ররোচনা দ্বারা, একটির সঙ্গে থাকে বুদ্ধি ও যুক্তি, অন্যটির সঙ্গে তা থাকে না; সত্য অভিমত সব মানুষই মানে, কিন্তু মন হলো দেবতাদের ও খুবই অল্পসংখ্যক মানুষের সম্পদ। এটা দেশ সম্পর্কে এক অদ্ভুত ধরনের তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে দেশ সত্তার জগৎ ও ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর জগতের মধ্যবর্তী একটি কিছু।

একধরনের সত্তা আছে, যা সর্বদা একই রকম থাকে, অসৃষ্ট এবং ধ্বংসযোগ্য নয়, কখনোই বাইরে থেকে নিজের ভেতরে কিছু গ্রহণও করে না, নিজের ভেতর থেকে কিছু বেরোতেও দেয় না। তা অদৃশ্য এবং কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা বোধগম্য নয়; এই ধরনের সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে শুধুই বুদ্ধিবৃত্তি। আবার একই নামে আরো একটি প্রকৃতি আছে, যা সেটির অনুরূপও বটে, যেটাকে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। তা সৃষ্ট, সর্বদা গতিশীল; স্থানে তার আবির্ভাব ঘটে এবং স্থান থেকে বিলয় ঘটে, তাকে অভিমত ও ইন্দ্রিয় দ্বারা বোধ করা যায়। তারপর আছে তৃতীয় একটি প্রকৃতি, যা হলো দেশ, ধ্বংসযোগ্য নয়, সব সৃষ্ট বস্তুকে একটি জায়গা দান করে, ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই একে বোঝা যায়, বোঝা যায় একধরনের মেকি বুদ্ধি দ্বারা। এই দেশ বাস্তব নয়। এর মধ্যে আমরা আবদ্ধ, যেন একটি স্বপ্নের মধ্যে আটকা পড়ে থাকি; আটকা পড়ে থেকে আমরা সমগ্র অস্তিত্বের কথা বলি, বলি যে অস্তিত্ব অনিবার্যভাবে কোনো একটি স্থানে বিরাজ করে এবং একটি দেশ দখল করে থাকে; আর যা স্বর্গেও নেই মর্তেও নেই, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি একটি অত্যন্ত কঠিন অনুচ্ছেদ, সম্পূর্ণরূপে বুঝবার ভান আমি আদৌ করি না। আমার মনে হয়, প্রকাশিত তত্ত্বটি জ্যামিতি বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকবে। জ্যামিতিকে লজিকের মতো শুদ্ধ বুদ্ধির বিষয় বলে মনে করা হতো, তথাপি তার দেশ সম্পর্কে বলার ছিল, যদিও দেশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের একটি দিক। সাধারণভাবে পরবর্তীকালের দার্শনিকদের সঙ্গে এর তুলনা খোঁজা হবে খেয়ালিপনা, তবু আমি এ কথা না ভেবে পারছি না যে কান্ট তার নিজের তত্ত্বের সঙ্গে দেশ সম্পর্কিত এই তত্ত্বটির একটি মিল দেখতে পেয়েছিলেন এবং এটি পছন্দ করেছিলেন।

টিমেউস বলছেন, বস্তুজগতের প্রকৃত উপাদান মাটি, বাতাস, আগুন আর পানি নয়, বরং দুই ধরনের সমকোণী ত্রিভুজ, একটি হলো বর্গক্ষেত্রের অর্ধেক, অন্যটা হলো সমভুজ ত্রিভুজের অর্ধেক। আদিতে সবকিছুই ছিল বিশৃঙ্খল এবং বিশ্বজগৎ নির্মাণের জন্য উপাদানগুলোর প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাসের পূর্ব পর্যন্ত সেগুলোর নানা রকম অবস্থান ছিল। পরে ঈশ্বর সেগুলো আকার ও সংখ্যা অনুসারে সাজান এবং অসুন্দর ও মন্দ বস্তুগুলো থেকে তিনি যতটা সম্ভব সেগুলোকে সুন্দর ও উত্তমরূপে তৈরি করেন। বলা হচ্ছে, উপরের দুই ধরনের ত্রিভুজ হলো সর্বাপেক্ষা সুন্দর আকার এবং সে কারণে ঈশ্বর বস্তু সৃষ্টির কাজে সেগুলো ব্যবহার করেছেন। এই দুই ধরনের ত্রিভুজের ব্যবহারে চার বা পাঁচটি সুষম ঘনবস্তু তৈরি করা সম্ভব, আর এই চারটি উপাদানের প্রত্যেকটি পরমাণু একটি করে সুষম ঘনবস্তু। মাটির পরমাণুগুলো হলো কিউব; আগুনের পরমাণু টেট্রাহেড্রা, বাতাসের ওক্টাহেড্রা এবং পানির ইকোসোহেড্রা। (ডোডেকাহেড্রোন সম্পর্কে একটু পরে বলছি।) সুষম ঘনবস্তুর তত্ত্বটি-যেটি ইউক্লিডের এয়োদশ গ্রন্থে। উপস্থাপিত-প্লেটোর যুগে ছিল একটি নতুন আবিষ্কার; থিয়াটেটাস নামের সংলাপটিতে ওই নামের খুব অল্প বয়সী এক ব্যক্তি তত্ত্বটি সম্পূর্ণ করেন। ইতিহাস বলছে যে তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম প্রমাণ করেন যে সুষম ঘনবস্তু মাত্র পাঁচ প্রকারের এবং ওক্টাহেড্রোন ও ইকোসোহেড্রোন আবিষ্কার করেন। সুষম টেট্রাহেড্রোন, ওক্টাহেড্রোন ও ইকোসোহেড্রোনের পৃষ্ঠদেশের জন্য রযেছে কয়েকটি সমভুজ ত্রিভুজ; আর ডোডেকাহেড্রোনের রয়েছে সুষম পঞ্চভুজ, তাই তা প্লেটোর এই দুই ত্রিভুজ থেকে। গঠিত হতে পারে না। এই কারণে চার উপাদানের সঙ্গে তিনি তা ব্যবহার করেন না।

ডোডেকাহেড্রোন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্লেটো বলছেন, এ ছাড়াও একটি পঞ্চম সজ্জা রয়েছে, ঈশ্বর যেটি ব্যবহার করেছেন ব্রহ্মাণ্ডকে চিত্রণের ক্ষেত্রে। এটি দুর্বোধ্য এবং ইঙ্গিত করে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি ডোডেকাহেড্রোন, কিন্তু অন্যত্র বলা হয়েছে যে তা একটি গোলক। জাদুবিদ্যায় সব সময়ই পেন্টাগ্রামের বেশ গুরুত্ব আছে। তারা এটিকে সুস্বাস্থ্য বলতেন এবং ভ্রাতৃত্বের সদস্যদের স্বীকৃতি হিসেবে তারা এই প্রতীকটি ব্যবহার করতেন। মনে হয় যে ডোডেকাহেড্রোনের পৃষ্ঠদেশের পঞ্চভুজগুলোর কাছেই পেন্টাগ্রামের গুণগুলো ঋণী এবং এক অর্থে তা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি প্রতীক। এই বিষয়টি আকর্ষণীয়, কিন্তু এ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বেশি কিছু হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। ইন্দ্রিয়ানুভূতি সম্পর্কে আলোচনার পর টিমেউস মানুষের মধ্যেকার দুটি আত্মার ব্যাখ্যার দিকে অগ্রসর হন। মানুষের দুটি আত্মার একটি অমর বা অবিনশ্বর, অন্যটি নশ্বর; একটি ঈশ্বরের সৃষ্টি, অন্যটি দেবতাদের তৈরি। নশ্বর আত্মাটি ভয়াবহ ও দুর্নিবার স্নেহ মমতার অধীন-প্রথমত আনন্দের শিকার, যা মন্দের প্রতি সবচেয়ে বড় প্ররোচনা, তারপর ব্যথা-বেদনার, যা আত্মার মধ্যে শুভর প্রতি নিরুৎসাহ জন্মায়, ভালো কাজে বাধা দেয়; এই নশ্বর আত্মা হঠকারিতা এবং শঙ্কারও শিকার; হঠকারিতা ও শঙ্কা দুই নির্বোধ প্ররোচক, ক্রোধের শিকার, যা সহজে প্রশমিত হয় না, আশারও শিকার, যা। সহজেই বিপথে নিয়ে যায়; দেবতারা এইসব কিছুকে যুক্তি-বুদ্ধিহীন ইন্দ্রিয় ও প্রয়োজনীয় নিয়ম অনুসারে দুঃসাহসী ভালোবাসার সাথে মিশিয়ে মানুষকে তৈরি করেছেন।

অবিনশ্বর আত্মাটি থাকে মাথায় আর নশ্বরটি থাকে বুকে। অদ্ভুত ধরনের কিছু শারীরবৃত্ত রয়েছে, যেমন, অন্ত্রের কাজ হলো খাদ্য ধরে রেখে অতিভোজন রোধ করা, তারপর আরো একধরনের রূপান্তর আছে। কাপুরুষ ও মন্দ লোকেরা পরবর্তী জীবনে হবে মেয়েমানুষ। সুবোধ হালকা মনের মানুষ, যারা মনে করে যে, গণিতের জ্ঞান ছাড়াই জ্যোতির্বিদ্যা শেখা যায় তারকাপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে তারা হবে পাখি। যাদের কোনো দর্শন নেই তারা হবে হিংস্র স্থলজ প্রাণী, আর সবচেয়ে নির্বোধেরা হবে মাছ।

সংলাপটির শেষ অনুচ্ছেদে সংক্ষেপে বলা হয়েছে এভাবে : আমরা এখন বলতে পারি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের আলোচনার একটি শেষ আছে। জগৎ নশ্বর-অবিনশ্বর প্রাণীকুলকে পেয়েছে এবং সেগুলো নিয়ে তা পরিপূর্ণ হয়েছে; এবং দৃশ্যমান প্রাণী ও বস্তুসব নিয়ে নিজে একটি দৃশ্যমান প্রাণী হয়ে উঠেছে-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঈশ্বর হয়ে উঠেছে-যিনি বুদ্ধিমান, মহত্তম, সর্বোত্তম, সর্বসুন্দর ও সবচেয়ে নিখুঁতের ছবি-একমাত্র জন্মলব্ধ নভোমণ্ডল।

টিমেউস সংলাপটির কী গুরুত্বপূর্ণ আর কী কল্পনার খেলা তা নির্ণয় করা কঠিন। আমার মনে হয়, বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিশ্ব সৃষ্টির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেটা বেশ গুরুত্বসহকারে নেয়া উচিত; তাছাড়া চারটি উপাদানের অনুপাত, সুষম ঘনবস্তুগুলো ও তাদের গঠনকারী ত্রিভুজগুলোর সঙ্গে ওই চার উপাদানের সম্পর্কের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। দেশ ও কালের ব্যাখ্যাটি স্পষ্টতই তাই, প্লেটো যা বিশ্বাস করেন এবং সে কারণে তা সৃষ্ট জগৎকে একটি শাশ্বত আদিরূপের কপি হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। জগতে নিয়তি ও উদ্দেশ্যর মিশ্রণ বস্তুত সব গ্রিক মানুষেরই একটি সাধারণ বিশ্বাস, যা দর্শনের উত্থানের বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল; প্লেটো এটি গ্রহণ করেছেন এবং মন্দের সমস্যাটা এড়িয়ে গেছেন, যে সমস্যা খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বকে সমস্যায় ফেলেছে। আমার মনে হয় তার জগৎ-প্রাণী ব্যাপারটা তিনি সিরিয়াসভাবেই বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু রূপান্তর সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো এবং দেবতাদের ওপর আরোপিত অংশটি ও অন্যান্য গুরুত্বহীন অংশগুলো, আমার মনে হয়, আলোচনায় যতটা সম্ভব নির্দিষ্টতা আনার জন্যই বলা।

আগে যেমনটি বলেছি, সম্পূর্ণ সংলাপটি মনোযোগী পাঠ দাবি করে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তার বিরাট প্রভাবের কারণে, আর এই প্রভাব শুধু সবচেয়ে কম কল্পনাপ্রবণ বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *