০৭. সমাজতন্ত্র কেন দরকার

অধ্যায় ৭ সমাজতন্ত্র কেন দরকার

বর্তমান কালে সমাজতন্ত্রীদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ কার্ল মার্কসের শিষ্য, যার কাছ থেকে তারা এই বিশ্বাসটা গ্রহণ করেছেন যে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য একমাত্র সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তি হলো উৎপাদনের উপায়ের অধিকারীদের প্রতি অধিকারচ্যুত সর্বহারার অনুভূত ক্রোধ। অনিবার্য প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যারা সর্বহারা নন, গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সমাজতন্ত্রকে ঠেকাতেই হবে এবং যখন তারা শুনতে পায় যে তাদের ঘোষিত শত্রুরা শ্রেণিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় থাকাকালেই নিজেরা যুদ্ধ সূচনার প্রবর্তনা অনুভব করেন। ফ্যাসিজম কম্যুনিজমের প্রত্যুত্তর মাত্র এবং কড়া প্রত্যুত্তরই বলতে হবে। যতদিন মার্কসীয় পরিভাষায় সমাজতন্ত্রের প্রচার করা হবে ততদিন এর বিরুদ্ধাচারণও হবে শক্তিশালী এবং উন্নত পশ্চিম বিশ্বে দিন দিন এর সাফল্য আরো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ধনীরা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতই, কিন্তু সে বিরোধিতা হতো কম তীব্র ও কম ব্যাপক।

নিজের সম্পর্কে বলতে পারি, অত্যন্ত আগ্রহী মার্কসবাদীর মতোই আমি যদিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রকে সর্বহারার প্রতিহিংসার বাণী গণ্য করি না। এমনকি, প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপায়ও মনে করি না। প্রাথমিকভাবে আমি সমাজতন্ত্রকে সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনার তাগিদে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সন্ধি করে চলার উপায় মনে করি। এই সমাজতন্ত্র মানুষের সুখ বাড়াবে তবে শুধু সর্বহারার নয়, মানববংশের একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশীবাদে, সবার। হিংসোন্মত্ত বিপ্লব ভিন্ন এর বাস্তবায়ন যদি বর্তমানে সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রধানত এর হিংসাব্রত প্রবক্তাদের জন্যই তা হচ্ছে না। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি সুস্থ সমর্থন দ্বারা এর প্রতি বিরোধিতা নমনীয় করা যাবে, এবং আসন্ন পরিবর্তন কম বিপর্যয়কর করে তোলা সম্ভবপর হবে।

সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। এই সংজ্ঞায় অবশ্যই দুটি অংশ থাকতে হবে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক অংশ থাকবে প্রকৃত অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। অন্তর্ভুক্ত হবে ন্যূনপক্ষে ভূমি ও খনিজসামগ্রী, পুঁজি, ব্যাংকিং ক্রেডিট এবং বৈদেশিক বাণিজ্য। রাজনৈতিক অংশ হবে প্রকৃত রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক। স্বয়ং মার্ক্স এবং ১৯১৮ সালের আগের সকল সমাজতন্ত্রী কোনো প্রশ্ন না তুলে সমাজতন্ত্রের এই সংজ্ঞার সঙ্গে সম্মত হতেন, কিন্তু বলশেভিক দল কর্তৃক রুশ গণপরিষদ বিলুপ্তির পর থেকে একটা ভিন্ন মতবাদ জন্মলাভ করেছে। এই মতবাদ অনুসারে, বিপ্লবের মাধ্যমে যখন কোনো সমাজতন্ত্রী সরকার সাফল্য অর্জন করেছে তখন এর অনড় সমর্থকদেরই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে। অবশ্য স্বীকার করতে হবে গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পরই পরাজিতদের সব সময় ভোটাধিকার প্রদান সম্ভব হয় না, কিন্তু অনুরূপ অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। যে সমাজতন্ত্রী সরকার সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মসূচি কার্যকরি করেছে, গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভব করে তোলার জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয় সমর্থন নিশ্চিত করার আগে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয় যদি আমরা একটা চরম উদাহরণ স্মরণ করি। প্রাচ্যদেশীয় একজন স্বৈরশাসক ডিক্রি জারি করতে পারেন যে, তার রাজ্যের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের তিনি একক মালিক হবেন, কিন্তু এতে সমাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা হবে না। কঙ্গোয় দ্বিতীয় লিওপোন্ড-এর শাসন অনুকরণযোগ্য মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। জনপ্রিয় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আশা করার কী যুক্তি থাকে যে রাষ্ট্র স্বীয় সমৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কোনো কাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাবে। ফলে শোষণ শুধু নবরূপ লাভ করবে। অতএব সমাজতান্ত্রিক শাসনের সংজ্ঞার অংশ হিসেবে গণতন্ত্রকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

উক্ত সংজ্ঞার অর্থনৈতিক অংশ ব্যাপারে আরো কিছু বলা দরকার; ব্যক্তিগত উদ্যোগের কোনো কোনো রূপ কারো কারো আছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হবে, কেউ কেউ বিপরীত মত পোষণ করবেন। কোনো উদ্যোগী ব্যক্তিকে কি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া একখণ্ড জমির উপর কাঠের গুদাম নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে? হা, হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ব্যক্তি বিশেষকে নিউইয়র্ক শহরে স্কাইস্ক্রাপার নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে। অনুরূপভাবে এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে একটি শিলিং ধার দিতে পারেন। কিন্তু একজন অর্থের যোগানদার কোনো কোম্পানি কিংবা বিদেশি সরকারকে দশ মিলিয়ন পাউন্ড ধার দিতে পারেন না। ব্যাপারটা পরিমাণের এবং সহজেই তা মিটিয়ে ফেলা যায়, যেহেতু বড় ধরনের লেন-দেনের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনগত নিয়ম-কানুন মেনে চলার দরকার আছে, কিন্তু ছোটোখাটো ব্যাপারে নয়। যেখানে নিয়ম-কানুন মেনে চলা অপরিহার্য, সেখানে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয়। আর একটা উদাহরণ নেয়া যাক, অর্থনৈতিক অর্থে অলংকার পুঁজি নয়, কারণ অলংকার উৎপাদনের মাধ্যম নয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি হিরক থেকে থাকে তবে সে তা বিক্রি করে কোম্পানির শেয়ার বা অংশীদারিত্ব ক্রয় করতে পারে। সমাজতন্ত্রের অধীনেও সে হিরকের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সে তা বিক্রি করে শেয়ার ক্রয় করতে পারবে না। কারণ বাজারে শেয়ার নামে কোনো বস্তু থাকবে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করার দরকার নেই। দরকার শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা। এতে যেহেতু কেউ মুনাফা লাভ করতে পারবে না, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাবে, থাকবে শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে লাগে এমন কিছু সামগ্রী। অন্যের উপর প্রয়োগযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে থাকা চলবে না। অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে।

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে যে সুবিধাগুলো আশা করা যাবে (অবশ্য ধরে নিতে হবে ধ্বংসকারী বৈপ্লবিক যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে) তা হবে বিভিন্ন ধরনের এবং তা কোনো ক্রমেই শুধু মজুর শ্রেণির জন্য হবে না। আমি একেবারেই নিশ্চিত নই এই সব সুবিধা বা এর যে কোনোটি দীর্ঘ জটিল শ্রেণিদ্বন্দ্বের ভেতর সমাজতান্ত্রিক দলের বিজয় দ্বারা লাভ করা যাবে। শ্রেণিদ্বন্দ্ব মেজাজ রুক্ষ করবে, নির্দয় সামরিক রূপ সম্মুখে নিয়ে আসবে, অনেক বিশেষ প্রতিভার অপচয় হবে মৃত্যুতে, কারাবাসে এবং নির্বাসনে; আর বিজয়ী সরকারের মানসিকতা হবে সেনানিবাসের। সমাজতন্ত্রের যে গুণাগুণ থাকবে বলে আমি দাবি করি তা থাকার জন্যই লোকজনকে আনতে হবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে ক্ষুদ্র অসন্তুষ্ট শ্রেণিকে পরাস্ত করার জন্য। আমি নিশ্চিত যে, সমাজতান্ত্রিক প্রচারণা যদি কম ঘৃণা ও তিক্ততার সঙ্গে পলিচালনা করা যায়, আবেদনটা হিংসার দরবারে করা না হয়, করা হয় আর্থিক সংগঠনের সুস্পষ্ট প্রয়োজনের কাছে, তাহলে মানুষকে বোঝনোর কাজটা অনেক সহজ হবে। একই সঙ্গে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পাবে। প্রবর্তনার ভেতর আইনগত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমন বিষয়ের রক্ষা ব্যতিরেকে অন্য কোনো ব্যাপারে শক্তি প্রয়োগ আমি অনুমোদন করি না, কারণ (ক) এটা ব্যর্থ হওয়া সম্ভব (খ) এই সংগ্রাম হবে বিপর্যয়কর এবং ধ্বংসাত্মক এবং (গ) দুর্দম্য বিবাদের পর বিজয়ীরা তাদের সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যেতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারেন একেবারে আলাদা জাতের শাসন, সম্ভবত সামরিক উৎপীড়নমূলক স্বেচ্ছাচারতন্ত্র। সুতরাং সফল সমাজতন্ত্রের শর্ত, আমার মতে, সংখ্যাগুরুকে উক্ত মতবাদ সম্পর্কে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠা করা।

সমাজতন্ত্রের পক্ষে আমি নয়টি যুক্তি উপস্থাপন করব। যুক্তিগুলোর একটিও নতুন নয় এবং সবগুলোর গুরুত্বও সমান মনে করা যাবে না। তালিকা অনির্দিষ্টভাবে দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু আমি মনে করি এই নয়টি যুক্তি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, সমাজতন্ত্র শুধু একটি শ্রেণির স্বার্থে সৃষ্ট মতবাদ নয়।

১. মুনাফার অভিপ্রায়ের মূলোৎপাটন

পৃথক আর্থিক শ্রেণি হিসেবে মুনাফা শিল্প বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে কেবল স্পষ্ট হয়। এর বীজাণু দৃশ্যমান হয় রবিনসন ক্রুসো এবং তার ম্যান ফ্রাইডের সম্পর্কের মধ্যে। ধরা যাক শরৎকালে রবিনসন ক্রুসো বন্দুকের সাহায্যে তার দ্বীপের সমগ্র খাদ্য সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। তাহলে সে এমন অবস্থায় আছে যে, সে এখন ফ্রাইডেকে দিয়ে পরবর্তী বছরের ফসল সংগ্রহের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগাতে পারবে। তবে কথা থাকবে যে ফ্রাইডের জীবন বাঁচিয়ে রাখা হবে এবং উদ্বৃত্ত শস্য নিয়োগকর্তার গোলায় উঠবে। এই চুক্তিবলে রবিনসন ক্রুসো যা পাবে তা তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি ও সুদ হিসেবে গণ্য করা চলে। তার পুঁজি হলো কতকগুলো যন্ত্রপাতি এবং তার অধিকারে সংরক্ষিত খাদ্য। কিন্তু মুনাফা, সভ্য দেশগুলোতে, এর চেয়েও অধিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঘটে। উদাহরণত একজন সুতা প্রস্তুতকারক তার নিজের এবং পরিবারের জন্য শুধু সুতা উৎপাদন করে না। আর সুতাই তার একমাত্র দরকারি সামগ্রী নয়, তৈরি সুতার একটা বড় অংশ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাকে বিক্রি করতে হয়। আবার সুতা তৈরির আগে তাকে অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করতে হয়। তুলা, যন্ত্রপাতি, শ্রম, বিদ্যুৎ। এই সব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তিনি যা ব্যয় করেন এবং তৈরি সামগ্রী বিক্রি করে যা লাভ করেন সেই ব্যবধানটা তার মুনাফা হিসেবে থাকে। কিন্তু তিনি যদি কারখানা নিজেই পরিচালনা করেন তাহলে একজন ব্যবস্থাপক রাখলে তাকে যে মাইনে দিতে হতো সেই পরিমাণটা বাদ দিয়ে ধরতে হবে; অর্থাৎ কল্পিত ব্যবস্থাপকের মজুরি বাদ দিয়ে পুরো আয়টা প্রস্তুতকারকের মুনাফা হবে। বড় বড় ব্যবসায়, যেখানে অংশীদারগণ ব্যবস্থাপনায় শ্রম দেন না, তারা যা লাভ করেন, সেটা হলো উদ্যোগের ফলে আহরিত মুনাফা। যাদের বিনিয়োগ করার মতো টাকা রয়েছে তারা মুনাফার আশায় প্রলুব্ধ হন। এই মুনাফা প্রত্যাশাই নতুন কি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং কোন উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা হবে তার নির্ধারক অভীপ্সা হিসেবে কাজ করে। বর্তমান ব্যবস্থার সমর্থকগণ মনে করেন মুনাফার প্রত্যাশাই সাময়িকভাবে সঠিক সামগ্রী সঠিক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব করে তুলবে। পূর্বে একটা সীমা পর্যন্ত এই ধারণার সত্যতা ছিল, কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম।

বস্তুত এটা আধুনিক উৎপাদনের জটিল বৈশিষ্ট্যের ফল। আমি যদি সেকেলে গ্রাম্য মুচি হই এবং প্রতিবেশীরা আমার কাছে তাদের জুতো নিয়ে আসে সংস্কার বা মেরামতের জন্য, তাহলে আমি জানবো যে আমার শ্রমের চাহিদা আছে; কিন্তু আমি যদি বড় ধরনের জুতো প্রস্তুতকারক হই, দামি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি, তাহলে আমাকে অনুমান করতে হবে কত জোড়া জুতো আমি বিক্রি করতে পারবো। এবং আমি সহজেই ভুল অনুমান করে বসতে পারি। আর অপর একজনের উন্নততর যন্ত্রপাতি থাকতে পারে এবং সে সস্তায় অধিক সংখ্যক জুতো বিক্রি করতে পারে; কিংবা আগের ক্রেতারা দরিদ্র হয়ে যেতে পারেন এবং তারা শিখে নিতে পারেন জুতো কত বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, কিংবা ফ্যাশনও বদলে যেতে পারে এবং জনগণের চাহিদা এমন ধরনের জুতোর জন্য হতে পারে যে ধরনের জুতো আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। এর কোনো একটি ঘটলে শুধু আমার মুনাফা লাভ বন্ধ হবে না। আমার যন্ত্রপাতি নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকবে এবং আমার কারখানায় নিয়োজিত কর্মীরা হয়ে পড়বে বেকার। আমার যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য যে শ্রম নিয়োগ করা হয়েছিল তা প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং ঐ শ্রম এতটা অপচয়িত হয়েছে যে, এর সঙ্গে সাগরে বালু নিক্ষেপের তুলনা চলতে পারে। যে লোকদের বেকারে পরিণত করা হলো তারা মানুষের প্রয়োজনে লাগার মতো আর কিছু সৃষ্টি করতে পারছে না এবং ঐ সম্প্রদায় এতটা দীন-দরিদ্র হয়ে পড়ে যে অতঃপর এদের পিছনে ব্যয় করা হয় শুধু তাদের অনাহার থেকে রক্ষার জন্য। লোকগুলো মজুরির পরিবর্তে বেকার ভাতার উপর নির্ভরশীল বলে আগের চেয়ে অনেক কম খরচ করে, এতে উৎপাদক শ্রেণিতে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারণ এখন আর লোকগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ে সমর্থ নয়। সুতরাং আমি যে এত জোড়া জুতো বিক্রি করে মুনাফা লাভ করতে পারবো মনে করে গোড়াতেই যে ভুল হিসেব করেছিলাম তা ক্রমান্বয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চাহিদার হ্রাস। নিজের সম্পর্কে বলা যায়, দামি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যাপারে আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আমার সমস্ত পুঁজি ও আর্থিক সামর্থ নিঃশেষ করেছি। ফলে হঠাৎ করে জুতো তৈরির ব্যবসা ছেড়ে সমৃদ্ধতর শিল্পে নিয়োজিত হওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

কিংবা আরো ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যবসার কথা ধরা যাক : জাহাজ নির্মাণ। যুদ্ধ চলাকালে, কিছুকালের জন্য যুদ্ধান্তেও, জাহাজের প্রচুর চাহিদা ছিল। যেহেতু কেউ জানতেন না যে যুদ্ধ কতদিন চলবে কিংবা ইউ-বোট কতটা কার্যকরভাবে সফল হবে, তাই অভূতপূর্ব সংখ্যক জাহাজ নির্মাণের জন্য খুবই ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে জাহাজের ঘাটতি পূরণ করা হয় এবং জাহাজের প্রয়োজনীয়তা সামুদ্রিক বাণিজ্য হ্রাসের ফলে হঠাৎ করে কমে যায়। প্রায় সকল জাহাজ নির্মাণ কারখানা অব্যবহার্য হয়ে পড়ে এবং কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বৃহত্তর অংশ বেকারে পরিণত হয়। এটা বলা যায় না যে তাদের এই দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়া উচিত ছিল, যেহেতু সরকারই চেয়েছে তারা যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ তৈরি করুক। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগপ্রথার অধীনে যারা নিঃস্ব হলো তাদের প্রতি সরকার স্বীকৃত কোনো দায়িত্ব নেই। এতে দরিদ্র সম্প্রসারিত হওয়া অনিবার্য। ঐ সময় ইস্পাতের চাহিদা কম ছিল। সুতরাং লৌহ এবং ইস্পাত শিল্প মার খায়। অস্ট্রেলীয় এবং আর্জেন্টাইন মাংসের চাহিদাও কম ছিল, কারণ বেকারত্বের জন্য ডাল-ভাত খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ফলে মাংসের বদলে অস্ট্রেলিয়া এবং আর্জেন্টিনা যেসব সামগ্রী নিয়েছে তার চাহিদা হ্রাস পায়। এবং এই ব্যাপারটা অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে।

বর্তমান কালে মুনাফা লাভেচ্ছার ব্যর্থতার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, আর সেটা হলো অপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কোনো পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা চলে, দামও কম থাকে। কিন্তু মাঝারি পরিমাণে উৎপাদন করলে দাম কম রাখা যায় না। তাহলে সেক্ষেত্রে উৎপাদনের মিতব্যয়ী উপায় হবে সারা জগতে প্রত্যেক পণ্যের জন্য একটি কারখানা থাকা। কিন্তু অবস্থাটা যেহেতু একবার নয় ক্রমে-ক্রমে সৃষ্টি হয়েছে, অতএব বাস্তবে রয়ে গেছে প্রত্যেক পণ্যের জন্য অনেকগুলো কারখানা। প্রত্যেকেই জানেন তার কারখানাটিই যদি জগতের একমাত্র কারখানা হতো তবে সেখান থেকে সবার জন্য সরবরাহ সম্ভব হতো, মুনাফাও হতো বড় রকমের। কিন্তু এখন অবস্থা যা, একাধিক প্রতিযোগী, কেউ পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না, ফলে কারো মুনাফার নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থাটাই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। যেহেতু মুনাফা লাভের একমাত্র সম্ভাবনা থেকে যায় একটা বিরাট বাজার একান্ত নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর। ইতোমধ্যে দুর্বলতার প্রতিযোগীরা হয়ে পড়ে দেউলিয়া, এদের কারখানা যত বড় হয় বন্ধ হয়ে যাবার পর স্থানচ্যুতি ঘটে তত বিরাট আকারে। প্রতিযোগিতার দরুন এত অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা হয় যে বিক্রি থেকে কোনো মুনাফা থাকে না। কিন্তু সরবরাহ হয় হ্রাস অথবা মন্থর, কারণ যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে নির্দিষ্ট কয়েক বছরের জন্য ক্ষতি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা উৎপাদন একেবারে বন্ধ করার চেয়ে কম বিপর্যয়কর।

আধুনিক বৃহদায়তন কারখানা ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের ঈপ্সা দ্বারা পরিচালিত হতে দেয়ার ফলশ্রুতি এই সব বিশৃঙ্খলা ও স্থানচ্যুতির ঘটনা।

পুঁজিবাদী শাসনে, কোন নির্দিষ্ট সামগ্রী কোন নির্দিষ্ট কারখানা উৎপাদন করবে তা নির্ণয়ের খরচ কারখানার মালিককে বহন করতে হয়, সম্প্রদায় করে না। একটা উদাহরণ সহযোগে পার্থক্যটা বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক জনৈক ভদ্রলোককে, ধরুন তার নাম মিঃ হেনরি ফোর্ড-এমন কম খরচে গাড়ি তৈরির উপায় উদ্ভাবন করেছেন যে অপর কারো পক্ষে প্রতিযোগিতায় নামা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে ফল দাঁড়ায় এই যে গাড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত বাকি সকল কারখানা দেউলে হয়ে পড়ে। নতুন সস্তা গাড়ি তৈরির সম্প্রদায়ের খরচে পৌঁছার জন্য আপনাকে মিঃ ফোর্ডকে যে পরিমাণ খরচ করতে হয় তার সঙ্গে সমানুপাতে যোগ করতে হবে বর্তমানে অকেজো অপরের মালিকানাধীন সকল কারখানা, তৎসঙ্গে যোগ করতে হবে পূর্বে অপরের কারখানায় কাজ করেছেন কিন্তু বর্তমানে বেকার কর্মী এবং ব্যবস্থাপকদের লালন পালন ও শিক্ষার খরচ। (কেউ কেউ ফোর্ডের কারখানায় কাজ নেবে। কিন্তু সম্ভবত সবাই নেবে না। কারণ নতুন পদ্ধতিতে খরচ আরো কম পড়ে সুতরাং অতিরিক্ত শ্রমিকদের দরকার করে না)। সম্প্রদায়ের আরো কিছু ক্ষেত্রে খরচের দরকার করবে-যেমন শ্রমবিরোধ, ধর্মঘট, দাঙ্গা, বাড়তি পুলিশ, বিচার ও কারাবাস। এইসব যখন হিসেবে ধরা হবে তখন হয়তো দেখা যাবে পুরাতন গাড়ি তৈরির চেয়ে নতুন গাড়ি তৈরি করতে গিয়ে প্রথম দিকে সম্প্রদায়ের খরচ অনেক বেশি পড়ছে। এখন ঘটনা হলো সম্প্রদায়ের খরচই নির্ধারণ করে সামাজিকভাবে কোনটা সুবিধাজনক। অপরপক্ষে ব্যক্তিমালিকানায় প্রস্তুতকারকের খরচ নির্ধারণ করে, আমাদের ব্যবস্থায়, যা ঘটে থাকে।

সমাজতন্ত্র এইসব সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করে তা পরবর্তী পর্যায়ে আমি ব্যাখ্যা করবো।

২. অবসরের সম্ভাবনা

 যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতার দরুন মানববংশের আরাম-আয়েশের মান মোটামুটি পর্যায়ে বজায় রাখার জন্য আগের চেয়ে অনেক কম কাজ করার দরকার হয়। কিছু সতর্ক লেখক মনে করেন প্রতিদিন ঘণ্টা খানেকের কাজই যথেষ্ট, কিন্তু এই হিসেবটা এশিয়া মহাদেশের জন্য হয়তো যথেষ্ট নয়। আমি একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করে অনুমান করছি, যদি সকল বয়স্ক লোক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করেন তবে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ বাস্তব সুখের জন্য যা কিছু কামনা করেন তা উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে।

বর্তমানে, যাহোক, মুনাফা লাভেচ্ছার জন্য অবসর সমানভাবে বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না; অনেকের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, অনেকে একেবারে কর্মহীন, বেকার। এর ফলাফল দাঁড়ায় এই রকম; নিয়োগকর্তার কাছে মজুরের মূল্য সে কতটা কাজ করেছে। তার উপর নির্ভরশীল, যা যতক্ষণ সাত কি, আট ঘণ্টা অতিক্রম না করছে, নিয়োগকর্তা কর্তৃক ধরে নেয়া হয় যে তা কর্মদিবসের দৈর্ঘ্যের সমানুপাতিক হতে হবে। অপরপক্ষে, মজুরও মনে করে কম সময় কাজ করে কম মজুরি পাওয়ার চেয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করে ভালো মজুরি পাওয়া অধিকতর লাভজনক। ফলে দীর্ঘ কর্মদিবস উভয় পক্ষের কাছে উপযোগী মনে হয়, ফলে যারা বেকার তারা থাকে অনাহারে অথবা তাদের জনগণের খরচে ভরণপোষণ করতে হয়।

যেহেতু বর্তমানে মানববংশের সংখ্যাগুরু অংশ ন্যায়সঙ্গত স্বাচ্ছন্দের স্তরে পৌঁছতে পারে না তাই এখন প্রয়োজনে এবং সাধারণ স্বাচ্ছন্দের জন্য যতটা উৎপাদন করা হয় সেই পরিমাণ সামগ্রী উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞতার সঙ্গে দিনে গড়ে চার ঘণ্টার কম সময় কাজ করলেই যথেষ্ট হবে। এর অর্থ হলো, কর্মরত ব্যক্তির গড় কর্মদিবস যদি আট ঘণ্টা হয় তাহলে অর্ধেক সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, অযোগ্যতা এবং অপ্রয়োজনীয় উৎপাদনের জন্য না হলেও। প্রথমে অযোগ্যতার ব্যাপারটা ধরা যাক; আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি প্রতিযোগিতার দরুন কী রকম অপচয় হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে বিজ্ঞাপনের জন্য যাবতীয় ব্যয় এবং বিপণনের জন্য নিয়োজিত যত দক্ষ শ্রম। জাতীয়তাবাদ আরো এক ধরনের অপচয়ের জন্য দায়ী। উদাহরণত, মার্কিনী গাড়ি নির্মাতারা শুল্কের কারণে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে কারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে, অথচ যুক্তরাষ্ট্রেই যদি তারা সুবৃহৎ কারখানায় সব কটা গাড়ি নির্মাণ করত তাহলে স্পষ্টতই প্রচুর শ্রম বেঁচে যেত। তাছাড়া সমরাস্ত্র নির্মাণে অপচয় হয়, সামরিক প্রশিক্ষণে অপচয় হয়। যেখানে সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক সেখানে তো গোটা পুরুষ জনসংখ্যা জড়িত হয়ে পড়ে। তবে এইসব অপচয় এবং আরো নানা ধরনের অপচয় এবং ধনবানের বিলাসিতার ফলে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি আজ কর্মে নিয়োজিত। তবে যতদিন চলতি ব্যবস্থা চালু থাকবে অপচয় নিবারণের প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু মজুর শ্রেণির দুরবস্থা এখনকার চেয়েও খারাপ করবে।

. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

দুনিয়ার বর্তমানে যা অবস্থা তাতে শুধু বহুসংখ্যক লোকই নিঃস্ব নয়, সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিঃস্ব নয় তারাও সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে এই ভয়তাড়িত যে তারা যে কোনো মুহূর্তে নিঃস্ব হতে পারেন। মজুরশ্রেণি সব সময় বেকার হওয়ার বিপদ দেখে; বেতনভোগীরা জানেন যে তাদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, কিংবা কোম্পানি কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পারে ব্যবসায়ী শ্রেণি, যারা ধনী হিসেবে খ্যাত, জানেন যে তাদের সমস্ত টাকা বিনষ্ট হওয়া অসম্ভব নয়। পেশাজীবীরা কঠিন সংগ্রামের ভেতর আছেন। পুত্র-কন্যাদের শিক্ষার জন্য বিরাট আত্মত্যাগ স্বীকার করার পর তারা দেখতে পাচ্ছেন তারা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন সে দক্ষতার জন্য আগে যে চাকুরি ছিল এখন তা নেই। তারা যদি আইনজীবী হন, তবে তারা দেখতে পান জনগণের আদালতে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই, যদিও গুরুতর অন্যায় প্রতিকারহীন থেকে যাচ্ছে তারা ডাক্তার হলে দেখতে পান তাদের পূর্বেকার বেশ লাভজনক বিষাদাক্রান্ত রোগীরা আর অসুস্থ হওয়ার সাহস করছেন না; যদিও প্রকৃত রোগভোগীদের অতি-প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ছাড়াই চলতে হচ্ছে। দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত নারী-পুরুষ দোকানের গোমস্তার কাজ করছেন, এতে হয়তো তারা নিঃসম্বল হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছেন, কিন্তু পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আগে উক্ত কাজগুলো যারা করতেন। নি পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ের সকল শ্রেণির অর্থনৈতিক ভীতি পুরুষ মানুষের দিনের ভাবনা ও রাতের স্বপ্ন শাসন করে। ফলে তার কাজ স্নায়ু খুঁড়ে খায়, তার কাছে অবসর প্রফুল্লকর লাগে না। আমি মনে করি সদাপ্রস্তুত এই সন্ত্রাসই পাগলাটে মেজাজের প্রধান কারণ, যা সভ্য দুনিয়ায় বিরাট অংশে বিস্তার লাভ করেছে।

প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পদের ঈপ্সা জাগে নিরাপত্তার ঈপ্সা থেকে। মানুষ টাকা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করে এই আশায় যে বৃদ্ধ বয়সে এবং হীনবল হলে তারা চলতে পারবে এবং তাদের সন্তানদেরও সামাজিক স্তরের নিচে নামতে হবে না। আগের দিনে এই প্রত্যাশা ছিল যুক্তিপূর্ণ, যেহেতু তখন নিরাপদ বিনিয়োগ নামক একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে নিরাপত্তা বিধানের কোনো ব্যবস্থা নেই; বড়-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পথে বসে; রাষ্ট্র হয় দেউলে, এবং যা কিছু এখনও অস্তিত্বশীল পরবর্তী যুদ্ধে তা ভেসে যাবে। ফলশ্রুতি, অসুখী উদাসীন মেজাজ, যা সম্ভাব্য প্রতিকার সম্পর্কে সুস্থ বিবেচনা কঠিন করে তোলে।

সম্ভাব্য যে কোন প্রকার পরিবর্তনের চেয়ে, যুদ্ধ প্রতিরোধ বাদ দিয়ে, আর্থিক নিরাপত্তা সভ্য সমাজের সুখ বৃদ্ধিতে অধিক সাহায্য করবে। সামাজিক প্রয়োজনের জন্য যতটুকু কাজ করা দরকার তা সকল স্বাস্থ্যবান বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে, কিন্তু তাদের আয় নির্ভর করবে শুধুমাত্র তাদের কাজ করার ইচ্ছার উপর এবং যখন সাময়িকভাবে কোনো কারণে তাদের কাজের দরকার হবে না তখনও তার আয় বন্ধ করা যাবে না। উদাহরণত, একজন চিকিৎসক নির্দিষ্ট মাইনে পাবে, তার মৃত্যুর পরই শুধু ঐ মাইনে বন্ধ হয়ে যাবে। এবং প্রত্যাশা করা হবে না নির্দিষ্ট বয়সের পরও সে কাজ করবে। আর তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তার সন্তানাদি উপযুক্ত শিক্ষা পাবে।

সমাজের স্বাস্থ্য যদি এতটা উন্নত হয়ে যায় যে, সব কজন যোগ্য ডাক্তারের চিকিৎসা সেবার দরকার আর করে না তাহলে কতিপয় ডাক্তারকে চিকিৎসা গবেষণা কিংবা স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের জন্য অনুসন্ধান অথবা আরো প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের উন্নতির কাজে নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি না যে এতে কোনো সন্দেহ আছে ডাক্তারদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ আগের ব্যবস্থার চেয়ে বর্তমান ব্যবস্থায় আরো সুখী হবেন। অতি সফল কতিপয় ডাক্তারের আয় যদি কিছুটা কমেও যায় তবু এর ব্যত্যয় হবে না।

অতিমাত্রায় সম্পদের লিঙ্গ কোনো মতেই কাজের উদ্দীপনা হতে পারে না। বর্তমানে অধিকাংশ লোক ধনী হওয়ার জন্য নয়, অনাহার এড়ানোর জন্য কাজ করে। একজন ডাক পিয়ন অপর ডাক-পিওনের চেয়ে বেশি ধনী হওয়ার প্রত্যাশা করে না, একজন সৈনিক কিংবা নৌসেনা দেশের সেবা করে বিরাট টাকা পয়সার মালিক হতে চায় না। সত্য যে, সমাজে কিছু লোক থাকেন যারা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে চান, এদের কাছে প্রধান লক্ষ্যই হলো আর্থিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য। কেউ সমাজের মঙ্গল করেন, কেউ অমঙ্গল, কেউ কেউ করেন তৈরি কিংবা গ্রহণ করেন ব্যবহার্য উদ্ভাবন, কেউ কেউ শেয়ার বাজার স্বীয় সুবিধার জন্য কাজে লাগান কিংবা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলেন। কিন্তু প্রধানত তাদের অভিপ্রায় হলো সাফল্য অর্জন। আর সাফল্যের প্রতীক হলো টাকা। যদি অন্য কোনো আকারে সাফল্য লাভ সম্ভব হতো যেমন সম্মান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ লাভ করে, তবু তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত উৎসাহ কাজ করত এবং বর্তমানে যা করছে তা না করে সমাজের সুবিধার জন্য কাজ করতেন। সাফল্যের বাসনা নয়, শুধু সম্পদের জন্যই সম্পদের লিপ্সা, সমাজের জন্য কোনো কাজে লাগে না, এটা অতিরিক্ত আহার কিংবা পানীয় গ্রহণের চেয়েও বেশি কিছু নয়। অতএব যে সমাজ ব্যবস্থায় এই বাসনা প্রকাশের পথ নেই সেই সমাজব্যবস্থা ততটা খারাপ নয়। অপরপক্ষে যে সমাজব্যবস্থা নিরাপত্তাহীনতা দূর করেছে যে সমাজ আধুনিক জীবনধারার বাজে ভাবাগেব অনেকটাই দূর করবে।

৪. বেকার ধনী

মজুরশ্রেণির মধ্যে বেকারত্ব দেখা দিলে যে অকল্যাণ হয় তা সাধারণভাবে স্বীকৃত। নিজেদের ভোগান্তি হয়, সমাজের জন্য তার শ্রম কাজে লাগানো গেল না এটা একটা ক্ষতির দিক, এবং অনেককাল কর্মহীন থাকার ফলে তার মনোবল নষ্ট হয়ে যায়, এগুলো এতই পরিচিত বিষয় যে এ নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার করে না।

কিন্তু বেকার ধনীরা ভিন্ন ধরনের অকল্যাণ। জগৎ অলস ব্যক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ। বিশেষ করে নারীশ্রেণি, যারা সামান্যই শিক্ষা লাভ করেছে, এদের টাকাপয়সার প্রাচুর্য, ফলে এরা বিরাট আত্মবিশ্বাসের অধিকারী। যদিও এদের প্রকৃত কৃষ্টি থাকার ঘটনা বিরল, অথচ এরাই শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই শিল্পকলা বাজে ধরনের না হলে তাদের আনন্দ লাভের সম্ভাবনা কমই থাকে। তাদের অব্যবহার্যতা তাদের অবাস্তব ভাবাবেগের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে তারা সতেজ আন্তরিকতা অপছন্দ করে এবং কৃষ্টির উপর অবাঞ্ছনীয় প্রভাব খাটায়। বিশেষত আমেরিকায় যে তোক টাকা উপার্জন করে সে নিজেই উক্ত টাকা ব্যয়ের জন্য ব্যস্ত থাকে; কৃষ্টি প্রধানত পরিচালিত হয়। মহিলাদের দ্বারা, যাদের মর্যাদার প্রতি একমাত্র দাবি এই যে, তাদের স্বামীদের আয়ত্তে রয়েছে ধনী হওয়ার কৌশল। অনেকে মনে করেন সমাজতন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদ শিল্পকলার অনেক বেশি অনুকূলে, তবে আমি মনে করি এরা শুধু স্মরণ করেন অতীত জামানার অভিজাততন্ত্র এবং চলতিকালের ধনীকতন্ত্র ভুলে থাকেন।

অলস ধনীর অস্তিত্ব আরো কিছু দুর্ভাগ্যজনক ফলাফলের জন্ম দেয়। যদিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানাগুলোতে আধুনিক ঝোঁক হলো ছোট ছোট অনেক নয়, গুটিকয় বৃহৎ উদ্যোগের দিকে, তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, লন্ডনের অপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র দোকানগুলো। যে সব এলাকায় ধনী মহিলারা কেনাকাটা করেন সেখানে অসংখ্য টুপির দোকান রয়েছে, সাধারণত এই দোকানগুলোর মালিক। রাশিয়ান কাউন্টেসরা। প্রত্যেকেই দাবি করেন তাদের টুপিগুলো অন্যান্য দোকনের টুপির চেয়ে সুন্দর। এদের খদ্দেররা এক দোকান থেকে অপর দোকনে ছোটাছুটি করে, কয়েক মিনিটের কেনাকাটার কাজে ব্যয়িত হয় কয়েক ঘণ্টা। দোকানগুলোর শ্রমিকের সময় যেমন অপচয়িত হয় তেমনি খরিদ্দারের। আরো একটা অকল্যাণ এই হয় যে, কিছু সংখ্যক লোকের জীবিকা কোনো কাজে লাগে না। অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের খরচ করার ক্ষমতা থাকার দরুন তারা বিরাট সংখ্যায় পরান্নভোজী পোষে। এরা নিজেরা সম্পদ থেকে যত দূরেই অবস্থান করুন না কেন, তবু ভয় পায় অলস ধনী না থাকলে তাদের পণ্য বিক্রি হতো না এবং তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যেত।

নির্বোধ শ্রেণির লোকের ভঙ্গুর ক্ষমতার উপর নির্ভরতার জন্য এইসব ভোগান্তি হয় নৈতিক, বুদ্ধিগত এবং শৈল্পিকভাবে।

৫. শিক্ষা

বর্তমানে উচ্চতর শিক্ষা, সর্বাংশে না হলেও, প্রধানত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সত্য যে, কখনো কখনো ছাত্রবৃত্তির বদৌলতে শ্রমিক শ্রেণির সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারে, কিন্তু এর জন্য তাদের এত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় যে তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং প্রথম জীবনের প্রতিশ্রুতি কার্যে পরিণত করতে পারে না। আমরা যে অবস্থা গড়ে তুলেছি তাতে সমর্থতার বিরাট অপচয় হয়; মজুর শ্রেণির অভিভাবকের কোনো ছেলে বা মেয়ের অংকে, সংগীতে কিংবা বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণির সমর্থতা থাকতে পারে, কিন্তু সে তার প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ কমই পেয়ে থাকে। উপরন্তু শিক্ষাদর্শ, অন্তত ইংল্যান্ডে, এখন আগাগোড়া চালবাজি সংক্রামিত: ব্যক্তি-পরিচালিত এবং প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ছাত্ররা স্কুল জীবনের প্রতি মুহূর্তে শ্রেণি চেতনা মনে গেঁথে নেয়। আর যেহেতু শিক্ষা ব্যাপারটা প্রধানত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাই রাষ্ট্র স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে, ফলে যতদূর সম্ভব যুবক শ্রেণির বিচার ক্ষমতা ভোঁতা করে দেয় এবং তাদেরকে দুঃসাহসিক ভাবুকতা থেকে রক্ষা করে। অনুমোদন করতে হবে যে, যে কোনো নিরাপত্তাহীন শাসনে এসব হতে বাধ্য এবং এই ব্যাপারটা ইংল্যান্ড ও আমেরিকার চেয়ে রুশদেশে আরো খারাপ। যদিও সমাজতান্ত্রিক শাসন এক সময় যথেষ্ট নিরাপদ হয়ে যেতে পারে, তখন সমালোচনার ভয় আর করবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনের বর্তমান অবস্থায় এটা হওয়া প্রায় অসম্ভব, ক্রীতদাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তো ভিন্ন ব্যাপার, সেখানে মজুর শ্রেণি কোনো শিক্ষাই পাবে না। সুতরাং এটা আশা করা যায় না যে, শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটিগুলোর প্রতিকার করা যাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াই।

৬. নারীমুক্তি এবং শিশু-কিশোরদের কল্যাণ

 সাম্প্রতিক কালে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও স্ত্রীদের সংখ্যাগুরু অংশ এখনও আর্থিকভাবে তাদের স্বামীদের উপর নির্ভরশীল। নারীদের এই নির্ভরতা নানাদিক থেকে মজুরশ্রেণি যে নিয়োগকর্তার উপর নির্ভরশীল তার চেয়ে আরো খারাপ। একজন চাকুরে তার চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর জন্য এটি একটি কঠিন কাজ। উপরন্তু গৃহস্থালির কাজে তিনি যতই কঠোর পরিশ্রম করুন না কেন, তিনি কোনো প্রকার মজুরি দাবি করতে পারেন না। এই অবস্থাটা যতদিন চলবে, ততদিন বলা যাবে না যে তারা অর্থনৈতিক সাম্য অর্জনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তবে এটা বোঝা কঠিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কীভাবে এই অবস্থার প্রতিকার করা সম্ভব। দরকার হলো সন্তানের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, স্বামী নয়, আর বিবাহিত মহিলারা শিশুকে স্তন্যদান এবং গর্ভধারণের শেষ অবস্থায় ছাড়া ঘরের বাইরে কাজ করে জীবিকা অর্জন করবে। এর জন্য দরকার স্থাপত্যকর্মের সংস্কার (এই গ্রন্থের অপর একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে), এবং শিশু-কিশোরদের জন্য নার্সারি স্কুল স্থাপন। শিশুদের জন্য, তাদের মায়েদের জন্যও এটা হবে বিরাট আশীর্বাদ। যেহেতু শিশু সন্তানদের জন্য চাই খোলামেলা জায়গা, আলো এবং সুষম খাদ্য, অথচ তা মজুরের বাড়িতে সম্ভব নয়, কিন্তু নার্সারি স্কুলে সস্তায় এগুলোর সরবরাহ সম্ভবপর।

স্ত্রীদের মর্যাদা এবং শিশু-সন্তানের লালন পালনের জন্য এই ধরনের সংস্কার সমাজতন্ত্র ছাড়াও সম্ভব হতে পারে, এখানে-সেখানে অসম্পূর্ণভাবে কাজটা করাও যায়। কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে এবং সম্পূর্ণভাবে কিছুতেই করা যাবে না, সমাজের সাধারণ অর্থনৈতিক রূপান্তরের অংশ হিসেবে যদি না করা হয়।

. শিল্পকলা

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর স্থাপত্যশিল্পের কতটা উন্নতি হবে সে সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমার বক্তব্য রেখেছি। আগের কালে পেইন্টিং (চিত্রশিল্প) বিরাট স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেছে এবং অলংকৃত করেছে। অবস্থাটা আবার ফিরে আসতে পারে যদি আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক ভয়ের দরুন দীন আবাসস্থল সম্প্রদায়গত সৌন্দর্যের বাসনার কাছে হার মানে। সিনেমার মতো আধুনিক শিল্প খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। কিন্তু প্রযোজকরা যদি বাণিজ্যিক অভিপ্রায় দ্বারা পরিচালিত হন তাহলে এর সুস্থ বিকাশ সম্ভব হবে না; বস্তুত, অনেকেই এই অভিমত পোষণ করেন যে ইউ এস, এস, আর এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রত্যেক লেখক জানেন বাণিজ্যিক অভিলাষের জন্য সাহিত্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; প্রায় সব প্রাণবান লেখা কোনো না কোনো গোষ্ঠীকে আহত করে, ফলে কাটতি হয় কম। লেখকদের পক্ষে নিজেদের যোগ্যতা গ্রন্থস্বত্বের জন্য প্রাপ্য অর্থ দ্বারা পরিমাপ না করা কঠিন কাজ, এবং যখন বাজে লেখা বিরাট আর্থিক উপহার বয়ে আনে তখন ভালো লেখা সৃষ্টির জন্য লেখকের দরকার করে অস্বাভাবিক চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং গরিব থাকা।

স্বীকার করতে হবে সমাজতন্ত্র অবস্থাটা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু প্রকাশনাশিল্প রাষ্ট্রের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হবে, সুতরাং অনুদারভাবে সেন্সরপ্রথা ব্যবহার রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিরোধিতা থাকবে ততদিন এটা এড়ানো যাবে না। কিন্তু সন্ধিক্ষণ বা অবস্থান্তরকাল যখন শেষ হবে তখন আশা করা যায়, যে বইগুলো যোগ্যতা বিচার করে রাষ্ট্র প্রকাশে ইচ্ছুক হবে না, সে বইগুলোও প্রকাশিত হতে পারবে যদি লেখকগণ ব্যয় নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করে হলেও প্রকাশ করা উচিত মনে করেন। যেহেতু সময়ের সাশ্রয় খুব বেশি হবে না সেহেতু অতিরিক্ত কঠোর শ্রমের দরকার করবে না। কিন্তু এতে সেই লেখকদের বই প্রকাশে বিরত করা যাবে যারা নিজেরা খুব একটা নিশ্চিত নন যে তাদের বইয়ে মূল্যবান কিছু রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বই প্রকাশ করা যেন সম্ভবপর হয়, কিন্তু কাজটা যেন অতি সহজ হয়ে না দাঁড়ায়। বর্তমানে বই খুব বেশি প্রকাশিত হয়। বইগুলোর মানও সেই পরিমাণে কম থাকে।

৮. অলাভজনক জনসেবা

সভ্য সরকার সূচিত হওয়ার পর থেকে এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে, কিছু কিছু কাজ করতেই হবে, কিন্তু কাজগুলো মুনাফা লাভের ইচ্ছা থেকে এলোমেলো পরিচালনাধীনে ন্যস্ত করা যাবে না। এই সবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুদ্ধ; এমনকি যারা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অযোগ্যতা সম্পর্কে একেবারে সুনিশ্চিত তারাও এমন ইঙ্গিত করেন না যে জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা ব্যক্তিমালিকানাধীন ঠিকাদার গোষ্ঠীর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু আরো অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো জনকর্তৃপক্ষ সমাধা করার প্রয়োজন মনে করে, যেমন পথ-ঘাট, পোতাশ্রয়, বাতিঘর, নগর-উদ্যান, আরো অনুরূপ কিছু কাজ। গত এক শ বছরে বিশেষ ধরনের কাজের জন্য একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তা হলো জনস্বাস্থ্য। প্রথম দিকে অবাধ বাণিজ্যের গোঁড়া অনুসারীরা এর বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বাস্তব যুক্তির কাছে ঐ বিরোধিতা একেবারে টেকেনি। কিন্তু যদি ব্যক্তি উদ্যোগের তত্ত্ব মেনে চলা হতো তাহলে বিরাট অর্থ লাভের সকল নতুন উপায় সম্ভব হতো। প্লেগ রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি প্রচার এজেন্টের নিকট যেতে পারতেন। উক্ত এজেন্ট রেলওয়ে, থিয়েটার কোম্পানি প্রভৃতির কাছে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি পাঠাতেন যে ঐ রোগী তাদের আস্তানায় দেহরক্ষার কথা ভাবছেন যদি না তার বিধবা পত্নীকে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে রোগীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা স্বেচ্ছামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কারণ, সুবিধাটা সর্বসাধারণের, ক্ষতিটা ব্যক্তির।

বিগত শতাব্দীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যই এই ছিল যে জনসেবার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ব্যাপারটা জটিল করা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শিক্ষাব্যবস্থা। রাষ্ট্র কর্তৃক এটা সার্বজনীনভাবে কার্যকরী করার আগে তখনকার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর অভিপ্রায় ছিল আলাদা-আলাদা। মধ্যযুগ থেকে ধার্মিক অভিপ্রায়ে গঠিত কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল, কিছু ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানও ছিল, যেমন কলেজ দ্য ফ্রান্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃতবিদ্য (আলোকপ্রাপ্ত) রেনেসাঁস সম্রাটগণ; পক্ষপাতপুষ্ট দরিদ্ৰশ্রেণির জন্য কিছু দাঁতব্য স্কুলও ছিল। এগুলোর একটিও মুনাফা লোটার জন্য পরিচালিত হয়নি। অবশ্য মুনাফা লাভেল জন্যও কিছু স্কুল পরিচালিত হয়েছে। নমুনা স্বরূপ Dotheboys Hall এবং সালেম হাউসের নাম করা যায়। মুনাফা লাভের জন্য আরো কিছু স্কুল রয়েছে। যদিও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তাদের Dotheboys Hall–এর অনুকরণ করতে বাধা দেয়। এই স্কুলগুলো পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চমান অর্জন নয়, সৎশিক্ষার উপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত। সর্বোপরি শিক্ষার উপর মুনাফা লাভের অভিলাষের প্রভাব নগণ্য।

এমনকি জনকর্তৃপক্ষ যখন প্রকৃতপক্ষে কাজ করে না, তখনও কাজ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বোধ করে। একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি রাস্তা আলোকিত করার কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু এ কাজটি করতেই হবে, এতে লাভ হোক বা না হোক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু নির্মাণকার্য স্থানীয় আইন কিংবা উপবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে সাধারণভাবে স্বীকার করা হয় যে আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। একক নগর-পরিকল্পনা, গ্রেট ফায়ারের পর লন্ডন নগরীর জন্য স্যার ক্রিস্টোফার রেন যেমন প্রকল্প তৈরি করেছিলেন, হয়তো বস্তি ও উপকণ্ঠের বিকটতা ও অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে পারে, আধুনিক শহরগুলোকেও সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং সুখকর করা যায়। এই উদাহরণ থেকে আমাদের এই অত্যন্ত গতিশীল বিশ্বে ব্যক্তি-উদ্যোগের বিরুদ্ধে আরো কিছু যুক্তির ব্যাখ্যা মেলে। যে এলাকাগুলো বিবেচনায় আসবে তার পরিধি এতই বিরাট যে বৃহত্তম বণিক শ্রেণির পক্ষেও এ ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব নয়। উদাহরণত, লন্ডন শহরকে অবশ্যই সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে, কারণ এর অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ শহরের এক প্রান্তে ঘুমায় আর কাজ করে অপর প্রান্তে। সেন্ট লরেন্স ওয়াটারওয়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিশাল স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কারণ দুটি দেশের বিভিন্ন অংশে এটি বিস্তার লাভ করেছে; এরকম ক্ষেত্রে কোনো একক সরকার পর্যাপ্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আগের দিনের চেয়ে এখন যাত্রী, সামগ্রী ইত্যাদি অত্যন্ত সহজে পরিবহন করা যায়, ফলে ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলো, ঘোড়া যখন দ্রুততম পরিবহন মাধ্যম ছিল, সে সময়ের চেয়ে কম স্বয়ম্ভর হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপনাগুলো এতটা গুরুত্ব লাভ করেছে যে, যদি সেগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে নতুন ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে দুর্গবাসী মধ্যযুগের ব্যারনদের। স্পষ্টতই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায় চলনসই আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে না যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ একচেটিয়া সুবিধাদি অপব্যবহারের স্বাধীনতা পায়। পণ্যসামগ্রীর পরিবহন এখন রেলপথের উপর নির্ভরশীল। জনগণের চলাফেরার জন্য পথ-ঘাটের উপর নির্ভরশীলতা আংশিকভাবে ফিরে এসেছে। রেলওয়ে এবং মোটরগাড়ি নগরগুলোর সৃষ্ট করেছে। এইভাবে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তর এলাকায় অধিকতর মাত্রায় জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠ করছে এবং উদ্ভাবনের অগ্রযাত্রার জন্য এর প্রয়োজন বেড়েই চলেছে।

৯. যুদ্ধ

আমি এবার সমাজতন্ত্রের পক্ষে সর্বশেষ ও সর্বাধিক শক্তিশালী যুক্তি প্রসঙ্গে আসছি; যুদ্ধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা। যুদ্ধের সম্ভাবনা কিংবা এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করে আমি সময় নষ্ট করবো না, কারণ এগুলো নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া যায়। আমার আলোচনা দুটি প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো:

১. বর্তমানে যুদ্ধের বিপদ কতটা পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কাণ্বিত?

২. সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিপদ কতটা দূর করবে?

যুদ্ধ সুপ্রাচীন ব্যাপার, পুঁজিবাদ এর সূচনা করেনি। তবে যুদ্ধের কারণ সব সময়ই প্রধানত ছিল অর্থনৈতিক। অতীতকালে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি, রাজা রাজড়াদের উচ্চাভিলাষ এবং সমর্থ জাতি কিংবা উপজাতির সম্প্রসারণবাদী দুঃসাহসিক অভিযানপ্রিয়তা। সাত বছরের যুদ্ধের মতো ঘটনায় এই উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইউরোপে এই যুদ্ধ ছিল রাজবংশীয় (dynastic), অপরদিকে আমেরিকা এবং ভারতে জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব। রোমকরা যে রাজ্য জয় করতে পেরেছে তা শুধু তাদের সমরনায়ক ও সেনাদলের (Legionaries) অর্থ লাভের আকাঙ্ক্ষার জন্য। আরব, হুন ও মঙ্গোলিয়দের মতো পশুপালক গোষ্ঠীগুলো পুনঃপুন রাজ্য জয়ে বেরিয়েছে। পূর্বেকার চারণভূমির অপর্যাপ্ততার জন্য। এবং সব সময়ই, যুদ্ধ করা সহজ হয়েছে এজন্য যে সমর্থ পুরুষরা বিজয় নিশ্চিত মনে করেছে। তারা যুদ্ধ করে আনন্দও পেতেন, অপরদিকে রমণীরা পৌরুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রশংসা করেছেন। ব্যতিক্রমও ছিল, সম্রাট যখন বলপূর্বক তাদের ইচ্ছা আরোপ করতে পারতেন চৈনিক এবং পরবর্তী রোমক সাম্রাজ্যে যেমন ঘটেছে)। যদিও যুদ্ধ আদিমকালের সূচনা থেকে বহুপথ পরিভ্রমণ করেছে, তবু সেই প্রাচীন অভিলাষ এখনও আছে, যারা যুদ্ধের অবসান চান। তাদের অবশ্যই তা স্মরণে থাকতে হবে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রক্ষাকবচ হতে পারে। কিন্তু সকল প্রধান সভ্য রাষ্ট্রে জাতীয় সমাজতন্ত্র কায়েম হলে যুদ্ধের সম্ভাবনা কেন অনেকটা হ্রাস করতে পারবে তা এখন আমি দেখাতে চেষ্টা করবো।

যদিও যুদ্ধের প্রতি দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না সভ্য দেশগুলোর এক শ্রেণির লোকের ভেতর এখনও কাজ করে, তবু শান্তির ইচ্ছা সৃষ্টিকারী অভিপ্রায় গত কয়েক শতাব্দীর তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ বুঝতে পেরেছে গত যুদ্ধ এমনকি বিজয়ী পক্ষের জন্যও সমৃদ্ধি বয়ে আনে নি। তারা বুঝতে পারে যে, পরবর্তী যুদ্ধে বেসামরিক জীবননাশের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার বিশালতার তুলনা কোনো যুগের সঙ্গে চলবে না। তিরিশ বছরের যুদ্ধের পর থেকে তীব্রতায়ও তার তুল্য হবে না, তাছড়া সম্ভবত এই ক্ষতি শুধু এক পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা ভীত যে প্রধান শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সমগ্র একটা মহাদেশের সভ্যতা হবে বিনষ্ট। বিশেষত, ব্রিটিশ জনগণ সচেতন যে তারা যুগ-যুগান্ত ধরে বহিঃআক্রমণ থেকে মুক্তি লাভের যে সুবিধা ভোগ করেছে তা হারিয়েছে। এইসব বিবেচনা থেকে গ্রেট ব্রিটেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রগাঢ় আসক্তি জন্মেছে, অন্যান্য দেশগুলোতেও অনুরূপ অনুধাবন কাজ করছে, তবে হয়তো তীব্রতা কিছুটা কম। তাহলে, এতসব সত্ত্বেও, যুদ্ধের বিপদ কেন আসন্ন? প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্যই ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা, যার জন্য জার্মানিতে সামরিক জাতীয়তাবাদ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু একটা নতুন যুদ্ধ সম্ভবত ১৯১৯ সালের চেয়ে কঠোর সন্ধির জন্ম দেবে, ফলশ্রুতিতে পরাস্ত পক্ষে আরো উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এই বিরামহীন ওঠা-নামার ভেতর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কেবলমাত্র জাতিসমূহের শত্রুতার হেতুগুলো দূরীভূত করার মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। একালে এ হেতুগুলো প্রধানত খুঁজে পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে। সুতরাং এর বিলুপ্তি মৌলিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মধ্যে নিহিত।

অর্থনৈতিক শক্তি কীভাবে যুদ্ধে ইন্ধন জোগায়, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পকে আমরা তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। মূল ঘটনা হলো, আধুনিক কৌশল অবলম্বন করে প্রচুর পরিমাণ উৎপাদন করলে প্রতি টন উৎপাদনে যে খরচ পড়ে তা স্বল্প পরিমাণ উৎপাদনের চেয়ে অনেক কম। ফলে বাজার যদি বিরাট হয় তাহলে মুনাফা আসে, অন্যথায় নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত শিল্পের দেশীয় বাজার অন্যান্য দেশের চেয়ে আকারে অনেক বড় বলে এ যাবৎকাল রাজনীতি নিয়ে কোনো প্রকার অসুবিধায় পড়েনি, কেবল প্রয়োজনে নৌশক্তি নিরস্ত্রীকরণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বন্ধে হস্তক্ষেপ করেছে, তার বাইরে কিছু করেনি। কিন্তু জার্মান, ফরাসি এবং ব্রিটিশ ইস্পাত শিল্পগুলোর বাজার তাদের কারিগরি প্রয়োজনে যে চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর। অবশ্য তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারত, কিন্তু এতে কিছু অর্থনৈতিক আপত্তি রয়েছে। ইস্পাতের চাহিদার একটা বিরাট অংশ যুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং জাতীয়তাবাদের দরুন ইস্পাত শিল্প লাভবান হয়, জাতীয় অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধিতেও তাদের লাভ। উপরন্তু Comite des Fores এবং জার্মান ইস্পাত সংস্থা আশা করে, মুনাফা ভাগাভাগি না করে, যুদ্ধ দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করতে; এবং যেহেতু যুদ্ধের ব্যয় মূলত অন্যের ঘাড়ে চাপবে, অতএব তারা মনে করে যুদ্ধের ফলাফল তাদের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক হতে পারে। হয়তো তাদের এই হিসেবে ভুল আছে। কিন্তু এই ভুল ক্ষমতামদমত্ত সুঃসাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী লোকের জন্য স্বাভাবিক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোরেন। অঞ্চলের আকরিক এক সময় জার্মানির অধিকারে ছিল, বর্তমানে ফ্রান্সের দখলে, ফলে দুদেশের মধ্যে শক্রতা বেড়েই চলেছে। এই ঘটনা সব সময় মনে করিয়ে দেয় পরবর্তী যুদ্ধে কী অর্জিত হবে। আর স্বাভাবিকভাবেই জার্মানরা একটু বেশি আক্রমণাত্মক, যেহেতু ফরাসিরা ইতোমধ্যেই গত যুদ্ধের লুষ্ঠিত ধন উপভোগ শুরু করেছে।

ইস্পাত শিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থঘটিত অন্যান্য শিল্পকারখানা, কিছুতেই তাদের উদ্দেশ্যের অনুকূলে বৃহৎ জাতিসমূহের সেবা পাবে না যদি তারা জনগণের সঠিক আবেগের কাছে আবেদন রাখতে না পারে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে তারা ভীতির কাছে আবেদন রাখতে পারে; জার্মানিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কাছে; এবং এই অভীষ্টগুলো উভয়পক্ষের জন্য সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পর্কে যদি শান্ত মাথায় বিবেচনা করা যায় তাহলে উভয় পক্ষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ন্যায়সঙ্গত চুক্তি প্রত্যেককে সুখী করবে। এমন কোনো কল্যাণকর যুক্তি নেই যে জার্মানদের অন্যায় সয়ে যেতে হবে। কিংবা অন্যায় যদি দূর করা হয় তবে তাদের যুক্তিসঙ্গত কোনো অজুহাত থাকবে না এমন আচরণ করার, যাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হবে। কিন্তু শান্ত এবং যুক্তিযুক্ত হওয়ার জন্য যখনই কোনো প্রচেষ্টা নেয়া হয় তখনই দেশপ্রেম ও জাতীয় মর্যাদার প্রতি আবেদনের রূপ ধরে অপপ্রচার হস্তক্ষেপ করে। অর্থাৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। দুনিয়াটা সুরাপানে মত্ত অবস্থায় আছে, সে মাতাল সংস্কারের জন্য উসুক, কিন্তু সে এমন দয়ালু বন্ধুদের দ্বারা পরিবৃত যারা তাকে সব সময় সুরা যোগাচ্ছে, ফলে সে স্থায়ীভাবে মত্ত অবস্থায় থাকছে। এক্ষেত্রে দয়ালু বন্ধুরা টাকার পাহাড় গড়ছে তার দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা কাজে লাগিয়ে। এখন তার প্রথম কাজ হবে এদেরকে অপসারণ করা। এই অর্থেই কেবল বলা যায় যে আধুনিক পুঁজিবাদ যুদ্ধের জন্য দায়ী বা কারণ, কিন্তু এটাই সমগ্র কারণ নয়। তবে এটা কারণগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা যোগায়। এই অবস্থাটা যদি আর না থাকত তাহলে উদ্দীপনার অনুপস্থিতির জন্য মানুষ খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধের অসঙ্গতি বুঝে যেত এবং এমন ন্যায়সঙ্গত চুক্তিতে পৌঁছাত যে, ভবিষ্যতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি সম্ভব হতো না।

ইস্পাতশিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলো যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে, অর্থাৎ এমন কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় যে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলোতে জাতীয়করণ সম্ভবত যুদ্ধের আসন্ন বিপদ দূর করার জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ ইস্পাতশিল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যদি সরকারের হাতে থাকে এবং সরকার যদি গণতান্ত্রিক হন, তাহলে এর পরিচালনা শিল্পের স্বার্থে না হয়ে জাতির স্বার্থে হবে। পাবলিক ফাইন্যান্সের লেন-দেনের হিসাবপত্রে, ইস্পাতশিল্প গোষ্ঠী সমাজের অন্যান্য অংশের ক্ষতি করে যে মুনাফা অর্জন করবে তা অন্যত্র ক্ষতি দ্বারা শোধরানো হবে, এবং যেহেতু একটি পৃথক কারখানার লাভ বা ক্ষতির জন্য কোনো ব্যক্তির আয় ওঠানামা করবে না, তাই কারো অভিলাষ হবে না জনগণের খরচে ইস্পাতশিল্পের স্বার্থ সম্প্রসারণ। বোঝা যাবে যে, যুদ্ধাস্ত্র বৃদ্ধির জন্য ইস্পাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ক্ষতি হচ্ছে, কারণ এতে জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে। এইভাবে সর্বসাধারণ এবং ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে মিলন ঘটবে, এবং ভ্রমাত্মক অপপ্রচারের অভিলাষ আর থাকবে না।

এবার আমাদের বিবেচনাধীন অন্যান্য অকল্যাণের প্রতিকার কীভাবে সমাজতন্ত্র করবে সে সম্পর্কে কিছু বলা যায়।

শিল্পে মুনাফার পিছনে ছোটার পথনির্দেশক অভিলাষের স্থান নেবে সরকারি পরিকল্পনা। সরকার হিসেবে ভুল করতে পারেন, কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে ভুলটা কম করার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সরকারের এ ব্যাপারে পূর্ণতর জানাশোনা এবং বিচারবুদ্ধি থাকবে। রাবারের উচ্চমূল্যের সময় যার পক্ষে সম্ভব সেই রাবার বৃক্ষ রোপণ করেছে, ফলে কয়েক বছর পর রাবারের মূল্য ভীষণ পড়ে যায়, তখন দেখা গেল বিশেষ প্রয়োজনে রাবার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে চুক্তিতে পৌঁছা দরকার। একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ, যার হাতে রয়েছে সকল পরিসংখ্যান, এই ধরনের ভুল হিসাব বন্ধ করতে পারে। তথাপি, নতুন উদ্ভাবনের মতো অদৃশ্য কারণসমূহ সর্বাধিক সযত্নে তৈরি হিসাবও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সমগ্র গোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে নতুন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে লাভবান হতে পারবে। সমাজতন্ত্রের অধীনে যে-কোনো সময় বেকারদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বেকারত্বের ভীতি এবং নিয়োগকর্তা ও কর্মীর ভেতর পারস্পারিক সন্দেহের জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যখন একটি কারখানায় অবক্ষয় শুরু হয় এবং অপর একটি কারখানা প্রসারিত হতে থাকে তখন কনিষ্ঠতর কর্মীদের অবনতিশীল কারখানা থেকে সরিয়ে এনে প্ৰসাৰ্যমাণ কারখানায় প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। বেকারত্বের অনেকটা দূর করা যায় শ্রমের সময় কমিয়ে। যখন কোনো ব্যক্তির জন্য কাজই খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখনও সে পূর্ণ মজুরি পাবে, তাকে মজুরি প্রদান করতে হবে তার কাজ করার ইচ্ছার জন্য। যতদূর কাজ করতে বাধ্য করার দরকার হবে, তা করতে হবে অপরাধ আইনের প্রয়োগ দ্বারা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সাহায্য নেয়।

যারা পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের উপর কাজটা ছেড়ে দিতে হবে। সবশেষে ব্যাপারটা নির্ভর করবে জনপ্রিয় মতামতের উপর, স্বাচ্ছন্দ্য এবং অবসরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটা দরকার। যদি প্রত্যেক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করে তবে দিনে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যেত ততটা করা যাবে না। তবে আশা করা যায় প্রযুক্তিগত উন্নতি অংশত অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য এবং অংশত অধিকতর অবসরের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবহার করা যাবে।

নেহাৎ অপরাধী না হলে যেহেতু সবাই মাইনে পাবে, এবং শিশুদের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, কাজেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না (যুদ্ধের বিপদ যতদিন থাকবে সেটা ব্যতিক্রম ধরে)। স্ত্রীরা স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হবে না, সন্তানদেরকে তাদের অভিভাবকদের ত্রুটির জন্য ভুগতে দেয়া হবে না। কোনো ব্যক্তি আর্থিক কারণে অপর কোনো ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হবে না, সবাই হবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।

যদি সমাজতন্ত্র কতকগুলো সভ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়, কিন্তু অধিকাংশ দেশগুলোতে নয়, তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যাবে এবং ব্যবস্থাটার পূর্ণ সুবিধা বাস্তবায়ন করা যাবে না। তবে আমি একটা কথা সুনিশ্চিত বলেই মনে করি যে দেশগুলো সমাজতন্ত্র গ্রহণ করবে সে দেশগুলো আক্রমণাত্মক সমরতন্ত্রী আর থাকবে না এবং অন্য দেশের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য আন্তরিকভাবে যোগ দেবে। গোটা সভ্য জগতে সমাজতন্ত্র সার্বজনীন হয়ে ওঠার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার যুক্তি অতিক্রম করে যুদ্ধের অভিলাষের সম্ভবত যথেষ্ট বল থাকবে না।

আমি পুনরায় বলি: সমাজতন্ত্র শুধু সর্বহারার জন্য মতবাদ নয়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ঠেকিয়ে এই তন্ত্র কিছু অতি ধনী বাদ দিয়ে সবার সুখ বর্ধন করবে; এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটা যেমন প্রথম শ্রেণির যুদ্ধ ঠেকাতে সক্ষম, তেমনি সমগ্র জগতে অপরিমেয় সমৃদ্ধি আনয়ন করবে। শিল্পপতিরা যে বিশ্বাস করে আর একটা মহাযুদ্ধ হলে তারা লাভবান হবে, সে সম্পর্কে বলা যায় যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক যুক্তি দ্বারা সত্য বলে মনে হলেও তা বাতিকগ্রস্ত লোকের অব্যবস্থচিত্ত বিভ্রম মাত্র।

বাস্তব ব্যাপারটা তাহলে কি এই যে (কম্যুনিস্টরা যেমন মনে করেন) সমাজতন্ত্র সার্বজনীনভাবে হিতকর এবং সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য; তাছাড়া প্রচলিত অর্থব্যবস্থা যেহেতু ভেঙে পড়েছে এবং আর একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হলে বিপদ আরো ঘনিয়ে আসবে, ফলে সমাজতন্ত্র জরুরি হয়ে পড়বে? ব্যাপারটা কি আমরা এই যে, সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব সর্বহারা এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশই শুধু উপলব্ধি করতে সক্ষম? এবং এই তন্ত্র একটি রক্তক্ষয়ী, অনিশ্চিত, ধ্বংসাত্মক শ্রেণি-যুদ্ধ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা যাবে না? আমি নিজের পক্ষ থেকে বলতে পারি, এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র পুরাকালীন অভ্যাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, সুতরাং আবেগগত বিরোধিতা দেখা দেয়, যা কেবল ক্রমান্বয়ে উত্তরণ সম্ভব। শুধু কি তাই, বিরুদ্ধপক্ষের মনে সমাজতন্ত্র নাস্তিক্যবাদ এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের সঙ্গে জড়িত। অথচ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। এটি একটি অর্থনৈতিক মতবাদ এবং একজন সমাজতন্ত্রী খ্রিস্টান, মুসলমান, বুদ্ধধর্মাবলম্বী কিংবা ব্রহ্মের উপসনাকারী হতে পারেন। সন্ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে বলা যায়, সম্প্রতিকালে বহু সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে, এবং যেখানে সমাজতন্ত্র এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রূপে আসে। ভয় করা হয় সমাজতন্ত্র পূর্ববর্তী শাসনের হিংস্রতা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুটা লাভ করবে। কিন্তু যে দেশগুলো এখনও কতকটা মুক্ত চিন্তা এবং বাক স্বাধীনতার অনুমতি দেয়, সেখানে উদ্দীপনা ও সহনশীলতার সম্মিলন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রও অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার কাছে বুঝেসুঝে গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা যায়। সে সময় এলে যদি সংখ্যালঘু অবৈধভাবে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে তাহলে সংখ্যাগুরুকে অবশ্যই বিদ্রোহ দমনের জন্য বল প্রয়োগ করতে হবে। যেক্ষেত্রে প্ররোচনা সম্ভব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মন এখনও তৈরি হয়নি সেখানে বলপ্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে না; সংখ্যাগুরুর মন তৈরি থাকলে ব্যাপারটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায়, যদি না যথেচ্ছাচারী লোকেরা বিদ্রোহ করে বসে। এ ধরনের বিদ্রোহ দমনের জন্য যে কোনো সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং গণতান্ত্রিক দেশে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক দলের মতো সমাজতন্ত্রীদেরও বলপ্রয়োগের অধিক সুযোগ থাকবে না এবং যদি সমাজতন্ত্রীদের অধিকারে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকেও, পূর্ববর্তী প্ররোচনার জন্যই কেবল তা অর্জন করতে পারে। কোনো কোনো মহলে যুক্তি দেখানো নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে যে, যদিও সমাজতন্ত্র হয়তো এক সময় সাধারণ প্রচারণার মাধ্যমে কায়েম করা সম্ভব হতো, ফ্যাসিজমের উদ্ভব এটা অসম্ভব করে তুলেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দেশগুলোর বেলায় এটা অবশ্যই সত্য, কারণ শাসনতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা উক্ত দেশগুলোতে সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দল রয়েছে; গ্রেট ব্রিটেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিস্টদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না যে তারা পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে। এই কিছুদিন আগেই তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু শ্রমিক দলের পুনরুজ্জীবন ঠেকানোর জন্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থা বিস্তার রোধের জন্য যথেষ্ট সন্ত্রাসমূলক ছিল না। সমাজতন্ত্রীদের অতি সত্তর গ্রেট ব্রিটেনে সংখ্যাগুরু হওয়া অসম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, অতএব তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে; এবং অতি ভীরুর দল এই অসুবিধাগুলো স্বীয় দলের কার্যক্রম পরিত্যাগের জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, সৎ প্রচারণা অনিবার্য কারণে মন্থর ব্যাপার হলেও সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা অবশ্যই দ্রুত ও হঠাৎ করে সম্পন্ন হবে। কিন্তু এখনই এমন কোনো জোরালো কারণ ঘটেনি যে ধরে নিতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে, অন্য কোনো পদ্ধতি সফল হবে এমন মনে করার যুক্তি আরো কম। অপরপক্ষে, অনিয়মতান্ত্রিক উৎপীড়নমূলক যে কোনো উপায় শুধু ফ্যাসিবাদ প্রসারেই সহায়তা করবে। গণতন্ত্রের দুর্বলতা যাই হোক না কেন, এর মাধ্যমেই এবং সমাজতন্ত্রে জনপ্রিয় আস্থার জোরেই কেবল আশা করা যায় যে গ্রেট ব্রিটেন কিংবা আমেরিকায় সমাজতন্ত্র সফল হবে। যে কেউ গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা দুর্বল করার চেষ্টা করেন, তিনি ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজম নয়, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *