২৯. রোমক সাম্রাজ্য এবং সংস্কৃতি

২৯. রোমক সাম্রাজ্য এবং সংস্কৃতি

ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সংস্কৃতির ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল রোমক সাম্রাজ্য। প্রথমত, হেলেনায়িত চিন্তনের উপর রোমের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিংবা গভীরও নয়।

দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যের পশ্চিম অর্ধাশেংর উপর গ্রিস ও পূর্ব দেশের প্রভাব। এর ফল ছিল গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী, কারণ খ্রিষ্টধর্ম এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তৃতীয়ত, সংস্কৃতির প্রসারে ও মানুষকে একক শাসনকর্তৃত্বের সঙ্গে জড়িত একক এর সভ্যতার ধারণায় অভ্যস্ত করতে দীর্ঘ রোমক শান্তির গুরুত্ব।

চতুর্থত, মহম্মদীয়দের ভিতর হেলেনায়িত সভ্যতার প্রসার এবং সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইয়োররাপে প্রসার।

রোমের এই প্রভাবগুলো বিচার করার আগে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অতি সংক্ষিপ্তসার কার্যকর হবে।

আলেকজান্দ্রসের বিজয়গুলো পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে স্পর্শ করেনি, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে এই অঞ্চলে দুটি শক্তিশালী নগররাষ্ট্রের প্রাধান্য ছিল-কার্থেজ এবং সুরাকুজে। প্রথম এবং দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে (২৬৪-২৪১ এবং ২১৮-২০১) রোম সুরাকুজে জয় করে এবং কার্থেজকে নগণ্য রাষ্ট্রে পরিণত করে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে মাকেদনীয় রাজতন্ত্রগুলোকে রোম জয় করে। এটা সত্যি যে, ক্লিওপেট্রার মৃত্যু পর্যন্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০) মিশর সামন্ত রাষ্ট্ররূপে (vassal state) অস্তিত্ব বজায় রাখে। হানিবলের (Hannibal) সঙ্গে যুদ্ধের সময় ঘটনাক্রমে স্পেন বিজিত হয়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সীজার ফ্রান্স জয় করেন এবং প্রায় একশ বছর পর ইংল্যান্ড বিজিত হয়। গৌরবময় যুগে সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল ইয়োরোপে রাইন ও দানিয়ুব, এশিয়াতে ইউফ্রেতিস এবং উত্তর আফ্রিকাতে মরুভূমি।

রোমক সাম্রাজ্যবাদের শ্রেষ্ঠ রূপ বোধ হয় ছিল উত্তর আফ্রিকাতে (খ্রিষ্টীয় ইতিহাসে সেন্ট সাইপ্রিয়ন এবং সেন্ট অগস্তিন-এর দেশ হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ), এদেশে বিরাট অঞ্চল রোমক যুগের পূর্বে এবং পরে আকর্ষিত ছিল, এসময় সেগুলো উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় ও বহু জনবহুল নগরের ভরণ-পোষণ করে। দুই শতাব্দীর বেশি সময় পর্যন্ত অর্থাৎ অগস্তস-এর রাজ্যলাভের (৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পর থেকে তৃতীয় শতাব্দীর দুর্বিপাকগুলো পর্যন্ত রোমক সাম্রাজ্য মোটামুটি সুস্থিত এবং শান্তিপূর্ণ ছিল।

এর মধ্যে রোমক রাষ্ট্রের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হয়েছে। প্রথমে রোম ছিল একটি ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র, গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এর খুব বেশি পার্থক্য ছিল না, বিশেষ করে পার্থক্য ছিল না সেই নগররাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যেগুলো ছিল স্পার্তার মতো অর্থাৎ যেগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল না। হোমেরীয় গ্রিসের রাজাদের মতো রাজাদের উত্তরসূরি হয়েছিল অভিজাত গণতন্ত্র। সেনেটে সংগঠিত অভিজাতরা শক্তিশালী হলেও ক্রমশ গণতান্ত্রিক অংশ তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়, এর ফলে যে আপস হয় তাকে স্টোইক পানায়েতিয়স (পলিবিয়স ও কিকের তাঁর মতের পুনরুল্লেখ করেছেন) বলেছিলেন-সেটা ছিল রাজতন্ত্রী, অভিজাত এবং গণতন্ত্রীদের আদর্শ সমন্বয়। কিন্তু যুদ্ধ বিজয়ের ফলে এই অনিশ্চিত ভারসাম্য উল্টে যায়, যুদ্ধ বিজয়ের ফলে সেনেটারীয় শ্রেণির হাতে বিরাট পরিমাণে ধনাগম হয় এবং তার থেকে কিছু কম পরিমাণে ধনাগম হয় নাইটদের (Knight) হাতে, তখন উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির নাম ছিল নাইট। ইতালীয় কৃষি ছিল ক্ষুদ্র কৃষকদের হাতে, তারা নিজেদের এবং পরিবারের অন্যদের শ্রমে খাদ্যশস্য উৎপাদন করত। এই কৃষি হয়ে দাঁড়াল রোমক অভিজাতদের অধিকারে বিশাল ভূ-সম্পত্তি, সেখানে দাসশ্রমের সাহায্যে আঙুর ও জলপাই- এর চাষ হতো। এর ফল হলো কার্যত সেনেটের অসীম ক্ষমতা, এই সেনেটকে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির জন্য নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হতো-রাষ্ট্রের স্বার্থ কিংবা প্রজাদের ভালোমন্দ বিচার করা হতো না।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষদিকে গ্রাখি (Gracchi) এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন, তার ফলে পর পর গৃহযুদ্ধ হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত-গ্রিসে প্রায়ই যা হতো তাই হলো-অর্থাৎ একটা স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। গ্রিসে যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র অঞ্চলে আবদ্ধ থাকত সেরকম বিকাশের ঐ বিরাট মাত্রায় পুনরাবৃত্তি খুবই কৌতূহলজনক। সীজারের দত্তকপুত্র ও উত্তরাধিকারী অগস্তস রাজত্ব করেছিলেন ৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ১৪ পর্যন্ত, তিনি গৃহযুদ্ধ বন্ধ করলেন এবং (দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) দিগ্বিজয়ের জন্য রাজ্য বহির্ভূত যুদ্ধ বন্ধ করলেন। গ্রিক সভ্যতার শুরুর পর থেকে এই প্রথম প্রাচীন জগৎ শান্তি নিরাপত্তা উপভোগ করল।

গ্রিক রাজনৈতিক তন্ত্রকে দুটি জিনিস ধ্বংস করেছিল : প্রথম প্রতিটি নগরেরই সার্বভৌমত্ব দাবি। দ্বিতীয়, অধিকাংশ নগরের অভ্যন্তরে ধনী ও দরিদ্রের ভিতর তিক্ত এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। কার্থেজ এবং হেলেনায়িত রাজ্যগুলো বিজিত হওয়ার পর এই কারণ দুটির প্রথমটি আর পৃথিবীকে যন্ত্রণা দিতে পারত না, কারণ, রোমকে কোনো কার্যকর বাধা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি রয়ে গেল। গৃহযুদ্ধগুলোতে একজন সেনাপতি নিজেকে সেনেটের সমর্থক বলে ঘোষণা করতেন, অন্যজন করতেন জনতার সমর্থক বলে। যে সেনাপতি সৈন্যদের সর্বাধিক পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিতেন বিজয় হতো তারই। সৈন্যরা শুধুমাত্র বেতন ও লুণ্ঠনই দাবি করত না, জমির সনদও দাবি করত, সুতরাং প্রতিটি গৃহযুদ্ধই শেষ হতে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন জমির মালিকদের আইনসম্মত বহিষ্কারে। এই জমিদাররা নামেই ছিল রাষ্ট্রের প্রজা, এদের বহিষ্কার করা হতো বিজয়ী সৈন্যদের স্থান দেওয়ার জন্য। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের ব্যয়নির্বাহ করা হতো ধনীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এই পদ্ধতি সর্বনাশা হলেও সহজে বন্ধ করা যায়নি, শেষে অগস্তস সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে এমন সম্পূর্ণ জয়লাভ করলেন যে, তার ক্ষমতার দাবির বিরোধিতা করার কেউ রইল না।

রোমক জগতের কাছে গৃহযুদ্ধের যুগ শেষ হয়েছে-এই আবিষ্কার ছিল বিস্ময়ের, সেনেটীয় একটা ক্ষুদ্র দল ছাড়া এ সংবাদ ছিল সবারই আনন্দের। অগস্তসের অধীনে রোমকরা যখন স্থিরত্ব শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন অন্য সবাই গভীর স্বস্তি লাভ করেছিল। গ্রিক ও মাকেদনীয়রা এ কাজ করতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। অগস্তসের আগে রোমও চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। রস্টভস্টেফ-এর মতে রোম গ্রিসে চরম দারিদ্র্য, দেউলিয়া অবস্থা এবং সমস্ত স্বাধীন রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ করা ছাড়া নতুন কিছুই উপস্থিত করতে পারেনি।

অগস্তসের রাজত্ব রোমক সাম্রাজ্যের সুখের দিন ছিল। অবশেষে প্রদেশগুলোর শাসনব্যবস্থা জনসাধারণের ভালোমন্দের কথা বিচার করে সংগঠিত হয়েছিল, শুদ্ধ লুণ্ঠনকার্যের জন্য নয়। মৃত্যুর পর অগস্তসের উপর নগরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে দেবতা বলে মানা হয়েছিল। কবিরা তাঁর স্তুতি করেছেন, ব্যবসায়ী শ্রেণি বিশ্বশান্তিকে সুবিধাজনক ভেবেছেন, এমনকি যে সেনেটকে তিনি শুধু নিয়মমাফিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন সেই সেনেটও তার উপর সম্মান বর্ষণের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেনি।

বিশ্ব সুখী হলেও জীবনটা একটু বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল, কারণ, দুঃসাহসিক অভিযানের চাইতে নিরাপত্তাকেই পছন্দ করা হতো। আদি যুগে প্রতিটি স্বাধীন গ্রিক নাগরিকেরই দুঃসাহসিক অভিযানের সুযোগ ছিল। ফিলিপ এবং আলেকজান্দ্রস এই অবস্থা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং হেলেনায়িত যুগে শুধুমাত্র মাকেদনীয় বংশজাতরাই নৈরাজ্যের স্বাধীনতা ভোগ কর। গ্রিক জগৎ তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছিল এবং হয়ে গিয়েছিল অসূয়ক কিংবা ধার্মিক। পার্থিব প্রতিষ্ঠানগুলোতে আদর্শকে মূর্ত করার আশা মিলিয়ে গিয়েছিল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেষ্ঠ লোকেরা তাদের জীবনপ্রেম হারিয়েছিলেন। সাতেসের কাছে স্বর্গ ছিল এমন একটি স্থান যেখানে তিনি তর্ক চালিয়ে যেতে পারবেন, আলেকজান্দ্রসের পরবর্তী দার্শনিকদের কাছে তাঁদের জাগতিক জীবনের চেয়ে তা ছিল আরও পৃথক কিছু।

পরবর্তীকালে রোমে একইরকম বিকাশ ঘটেছিল এবং ঘটেছিল কম বেদনাদায়ক আকারে। গ্রিসের মতো রোম বিজিত হয়নি বরং তার বিপরীতে তার উদ্দীপক ছিল সফল সাম্রাজ্যবাদ। সমগ্র গৃহযুদ্ধের যুগে রোমকরাই ছিলেন বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। মাকেদনীয়দের অধীন হয়ে গ্রিকরা শান্তি ও শৃঙ্খলা পাননি অথচ গ্রিক ও রোমক উভয় জাতিই অগস্তসের অধীনতা স্বীকার করে দুটোই পেয়েছিলেন। অগস্তস ছিলেন রোমক, অধিকাংশ রোমকরা স্বেচ্ছায় তাঁর অধীনতা স্বীকার করেন, শুধুমাত্র তার অধিকতর শক্তির জন্য নয়। তার উপর তিনি কষ্ট করে তার শাসনের সামরিক উৎস লুকিয়ে রাখতেন এবং সেনেটের আদেশকেই শাসনের ভিত্তি করতেন। সেনেট তাঁর তোষামোদ করত, সন্দেহ নেই সে তোষামোদ অকৃত্রিম নয় কিন্তু সেনেট শ্রেণির বাইরে কেউই নিজেকে অপমানিত মনে করতেন না।

রোমকদের মেজাজ ছিল অনেকটা উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি দেশের জওম রাঁজেদের (jeune homme range-তরুণদের মালিকা-অনুবাদক) মতো, তারা কিছুদিন প্রণয়ঘটিত সুসাহসিক জীবনযাপন করার পর যুক্তিপূর্ণ স্থির বৈবাহিক জীবনযাপন করত। এই মেজাজ সন্তোষজনক হলেও সৃজনশীল নয়। অগস্তসের যুগের বড় বড় কবিদের উৎপত্তি অধিকতর অস্থির অশান্ত যুগে। হোরেস (Horace) পালিয়েছিলেন ফিলিপ্পিতে এবং তাঁর ও ভার্জিলের (Virgil)- দুজনেরই কৃষিসম্পদ বিজয়ী সৈন্যদের উপকারের জন্য বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। স্থায়িত্বের প্রয়োজনে অগস্তস প্রাচীন ধার্মিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা জাগিয়ে তোলার জন্য খানিকটা কপটভাবে হলেও কাজ শুরু করেন এবং সেইজন্য প্রয়োজনের খাতিরে তিনি স্বাধীন অনুসন্ধানের বিরোধী ছিলেন। রোমক জগৎ একঘেয়ে হতে শুরু করে এবং পরবর্তী সম্রাটদের যুগে এই ক্রিয়া চলতে থাকে।

অগস্তসের ঠিক পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা সেনেটরদের প্রতি ও রাজপদে সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের প্রতি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ছিলেন। এই যুগের অপশাসন প্রদেশগুলোতেও খানিকটা ছড়িয়েছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগস্তস নির্মিত শাসনযন্ত্র ভালোভাবে কাজ করে চলছিল।

তুলনামূলকভাবে একটা ভালো যুগ শুরু হয়েছিল ৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ত্রাজান (Trajan) এর সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে এবং এই যুগ চলতে থাকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে মার্কস অরেলিয়সের মৃত্যু পর্যন্ত। এই যুগে সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা একটি স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার যতটা ভালো হওয়া সম্ভব প্রায় ততটাই ভালো ছিল। এর বিপরীতে তৃতীয় শতাব্দী ছিল ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল। সৈন্যবাহিনী নিজেদের ক্ষমতা বুঝতে পারল এবং নগদ অর্থের বিনিময়ে ও যুদ্ধবিহীন জীবনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সম্রাট সৃষ্টি ও ধ্বংস করতে লাগল, ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আর কার্যকরী রইল না। উত্তর এবং পূর্বদেশ থেকে বর্বররা রোমক অধিকৃত অঞ্চল আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে লাগল। সৈন্যবাহিনী ব্যক্তিগত লাভ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশ রক্ষায় অপারগ ছিল। বিরাটভাবে সম্পদ হ্রাস পাওয়ার জন্য সমগ্র অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছিল এবং একই সঙ্গে বিফল যুদ্ধের জন্য ও সৈন্যবাহিনীকে ঘুষ দেওয়ার জন্য ব্যয় বৃদ্ধিও ঘটে বিরাট। যুদ্ধ ছাড়াও মহামারীতে জনসংখ্যা বিপুলভাবে হ্রাস পায়। মনে হয়েছিল সাম্রাজ্য পতনোন্মুখ।

এই ফলাফলকে প্রতিহত করেন দুজন উৎসাহী ব্যক্তি-দিঅক্লেতিয়ান (Diocletion, ২৮৬-৩০৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং কনস্তান্তিন (Constantine), যাঁর নিঃসপত্ন রাজত্ব চলে ৩১২-৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁরা সাম্রাজ্যের পূর্ব এবং পশ্চিম এই দুই অর্ধাংশে বিভক্ত করেন, ভাগটা হয়েছিল মোটামুটি গ্রিক ও ল্যাতিনভাষীদের ভিতরে। কিনস্তান্তিন পূর্ব অর্ধাংশের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন বাইজানতিয়াম (Byzantium)-এ, কনস্তান্তিন এর নামকরণ করেন কনস্তান্তিনোপল। সৈন্যবাহিনীর চরিত্র পরিবর্তন করে দিঅক্লেতিয়ান কিছুদিন তাদের বশে রেখেছিলেন, তাঁর সময় থেকে সবচাইতে কার্যকর সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়েছিল বর্বরদের দিয়ে, তারা ছিল প্রধানত জার্মান। তাদের জন্য সমস্ত উচ্চতম সেনাপতির পদগুলোও উন্মুক্ত ছিল। স্পষ্টতই এ কৌশল ছিল বিপজ্জনক এবং পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকেই এই কৌশল তার স্বাভাবিক ফল প্রসব করেছিল। বর্বররা সিদ্ধান্ত নিল রোমক প্রভুদের জন্য যুদ্ধ করার চাইতে নিজেদের জন্য যুদ্ধ করা অনেক বেশি লাভজনক। তবুও এ পদ্ধতি প্রায় এক শতাব্দীর উপর এর উদ্দেশ্য সাধন করেছিল। দিঅক্ৰেতিয়ান-এর শাসনব্যবস্থার সংস্কার কিছুদিনের জন্য একইরকম সফল হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত একইরকম সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। রোমক তন্ত্র শহরগুলোকে স্থানীয় স্বশাসনের অধিকার দান করত এবং কর আদায়ের দায়িত্ব স্থানীয় কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করত। কেন্দ্রীয় শাসনকর্তা শুধুমাত্র প্রতিটি নগরের মোট দেয় স্থির করে দিতেন। আর্থিক সুসময়ে এই তন্ত্র ভালোই চলত কিন্তু সাম্রাজ্য এখন নিঃশেষিত, ফলে যে রাজস্ব দাবি করা হতো সেটা অত্যন্ত কষ্ট না করে যা দেওয়া যায় তার চাইতে বেশি। নগরপালেরা করের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকতেন এবং অর্থ পরিশোধ করা এড়ানোর জন্য তারা পালিয়ে যেতেন। দিঅক্লেতিয়ান বিত্তবান নাগরিকদের নগরের পৌর কার্য গ্রহণ করতে বাধ্য করতেন এবং পলায়নকে বেআইনী করেছিলেন। একইরকম উদ্দেশ্যে তিনি গ্রাম্য জনগণকে ভুমিদাসে পরিণত করেন, তারা জমির সঙ্গে যুক্ত থাকত এবং অন্যত্র অভিবাসন নিষিদ্ধ ছিল। এই তন্ত্র পরবর্তী সম্রাটদের কাল পর্যন্ত রক্ষিত হয়।

কনস্তান্তিনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নবপ্রবর্তন ছিল খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম রূপে গ্রহণ করা, এর আপাতদৃষ্ট কারণ-সৈন্যবাহিনীর একটা বৃহৎ অংশ ছিল খ্রিষ্টান। এর ফলে পঞ্চম শতাব্দীতে জার্মানরা যখন পশ্চিম সাম্রাজ্য দখল করেন তখন এই ধর্মের মর্যাদার দরুন তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন, এইভাবে প্রাচীন সভ্যতার যে অংশ চার্চ আত্মস্থ করেছিল তার প্রায় সবটাই তাঁরা পশ্চিম ইউরোপের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

সাম্রাজ্যের যে অঞ্চল পূর্বদিকে পড়েছিল তার বিকাশ হয়েছিল অন্যরকম। পূর্ব সাম্রাজ্য অবিরত হ্রাসমান হলেও (ষষ্ঠ শতাব্দীতে জাস্তিনিয়ানের স্বল্পস্থায়ী বিজয় অভিযানগুলো ব্যতীত) নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তুর্কীরা তখন কনস্তান্তিনোপল জয় করে। কিন্তু পূর্বদিকে যেগুলোর অধিকাংশই ছিল রোমক প্রদেশ, পশ্চিমে আফ্রিকাকে ও স্পেনকে নিয়ে সেগুলো মহম্মদীয় হয়ে গেল। জার্মানদের মতো আরবরা ধর্মকে গ্রহণ করলেন না কিন্তু বিজিতদের সভ্যতাকে গ্রহণ করলেন। সভ্যতার দিক থেকে পূর্ব সাম্রাজ্য ছিল গ্রিক, লাতিন নয়, সেইজন্য সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তা তাই ছিল এবং আরবরা, গ্রিক সাহিত্য এবং গ্রিক সংস্কৃতির যা কিছু বেঁচেছিল সেগুলো রক্ষা করলেন লাতিন সভ্যতার বিপরীতে। একাদশ শতাব্দী থেকে, প্রথমত মূরদের প্রভাবে পশ্চিম ধীরে ধীরে হারানো গ্রিক ঐতিহ্য উদ্ধার করে।

যে চারটি উপায়ে রোমক সাম্রাজ্য সংস্কৃতির ইতিহাসকে প্রভাবিত করে এবার আমি সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

১। গ্রিক চিন্তনের উপর রোমের প্রত্যক্ষ ক্রিয়া। এটা শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতেশুরু করেছিলেন দুজন-ঐতিহাসিক পলিবিয়স এবং স্টোইক দার্শনিক পানায়েতিয়স। রোমকদের সম্পর্কে গ্রিকদের স্বাভাবিক মনোভাব ছিল ভয়মিশ্রিত ঘৃণা। গ্রিকরা ভাবতেন তারা বেশি সভ্য কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কম শক্তিমান। রোমকদের যদি রাজনীতিতে বেশি সাফল্য হয় তাতে বুঝতে হবে রাজনীতি একটা হীন কর্ম। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সাধারণ গ্রিকরা ছিলেন আরাম প্রিয়, উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন, ব্যবসায় চতুর এবং সমস্ত ব্যাপারেই নীতিবর্জিত। তবে দার্শনিক হওয়ার মতো লোক তখনও ছিলেন। এঁদের ভিতরে কেউ কেউ-বিশেষ করে কারনিয়াদেসের মতো সন্দেহবাদীরা গভীরতা নষ্ট করে চাতুর্য অনুমোদন করতেন। এঁদের মধ্যে অনেকে, যেমন এপিকুরীয়রা ও স্টোইকদের একটা অংশ সমাজ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে শান্ত ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতেন। কিন্তু কয়েকজনের অন্তদৃষ্টি ছিল, সে অন্তর্দৃষ্টি আলেকজান্দ্রস সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের যে অন্তর্দৃষ্টি ছিল তার থেকে বেশি। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন রোমের মহত্ত্বের কারণ রোমকদের এমন কতগুলো গুণ যা গ্রিকদের নেই।

২০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি আর্কাদিয়াতে ঐতিহাসিক পলিবিয়সের জন্ম। তাঁকে বন্দীরূপে রোমে পাঠানো হয়, সেখানে সৌভাগ্যক্রমে ছোট স্কিপিয় (Scipio)-র সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। পলিবিয়স তাঁর অনেক যুদ্ধের সঙ্গী হয়েছেন। গ্রিকরা সাধারণত লাতিন জানতেন না কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত রোমকরা কি জানতেন। যাইহোক, পরিস্থিতির জন্য লাতিন ভাষার সঙ্গে পলিবিয়সের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। গ্রিকদের উপকারের জন্য তিনি পরবর্তী পিউনিক যুদ্ধগুলোর ইতিহাস লেখেন, এই যুদ্ধ রোমকে বিশ্বজয় করতে সমর্থ করেছিল। তিনি যখন লিখছেন সে সময় রোমের শাসনতন্ত্রের প্রশংসা পুরানো হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তাঁর সময় পর্যন্ত অধিকাংশ গ্রিক নগরের অবিরত পরিবর্তনশীল শাসনতন্ত্রের তুলনায় স্থিরত্ব এবং দক্ষতার দিক থেকে রোমক শাসনতন্ত্র অনেক ভালো ছিল। স্বভাবতই রোমকরা তাঁর লেখা ইতিহাস আনন্দের সঙ্গে পাঠ করেছেন, কিন্তু গ্রিকরা তাই করেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

স্টোইক পানায়েতিয়স সম্পর্কে এর পূর্ব অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ছিলেন পলিবিয়সের বন্ধু এবং তারই মতো ছোট স্কিপিয়-র আশ্রিত। স্কিপিয়র জীবনকালে তিনি প্রায়ই রোমে থাকতেন কিন্তু ১২৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্কিপিয়র মৃত্যুর পর স্টোইক সম্প্রদায়ের প্রধান হয়ে আথিনাতে থাকতেন। গ্রিস যা হারিয়েছিল রোমের তখনও তা ছিল অর্থাৎ ছিল রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে জড়িত সুযোগের আশা। সেইজন্য পানায়েতিয়সের মতবাদগুলো ছিল বেশি রাজনৈতিক এবং সেগুলোর সঙ্গে সিনিকদের সাদৃশ্য ছিল কম আদি স্টোইকদের মতবাদের তুলনায়। পরিশীলিত প্লাতন সম্পর্কে যে শ্রদ্ধা পোষণ করতেন সম্ভবত তার প্রভাবে তিনি স্টোইক পূর্বসূরিদের গোঁড়ামি পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি এবং তার উত্তরসূরি পসিনিয়স এই মতবাদকে যে বৃহত্তম বিস্তার দান করেছিলেন তার ফলে রোমকদের ভিতর যারা অধিকতর চিন্তাশীল ছিলেন তাঁদের কাছে স্টোইকবাদ আরও আকর্ষণীয় হয়েছিল।

পরবর্তী যুগে, এপিকতেতস, গ্রিক হলেও, জীবনের অধিকাংশ কাটিয়েছেন রোমে। নোম তাঁকে অধিকাংশ দৃষ্টান্ত সরবরাহ করেছিল, সম্রাটের উপস্থিতিতে না কাঁপতে তিনি সবসময়ই জ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করতেন। মার্কস অরেলিয়সের উপর এপিকতেতসের প্রভাব সম্পর্কে আমরা জানি কিন্তু গ্রিকদের উপর প্রভাব সম্পর্কে অনুসন্ধান করা কঠিন।

প্লুতার্খ (৪৬-১২০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর অভিজাত গ্রিক ও রোমকদের জীবনী (Lives of the Noble Grecians and Romans) গ্রন্থে দুটি দেশের সবচাইতে বিখ্যাত মানুষদের ভিতর সাদৃশ্য অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি রোমে অনেককাল কাটিয়েছিলেন এবং সম্রাট আদ্রিয়ান (Hadrian) ও ত্রাজান (Trajan) তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন। জীবনী ছাড়াও দর্শন, ধর্ম, জীবনতন্ত্র এবং নীতি সম্পর্কে তিনি অসংখ্য বই লিখে গিয়েছেন। তাঁর জীবনী স্পষ্টতই ছিল মানুষের চিন্তনে গ্রিক ও রোমের ভিতর মিলনসাধনের প্রচেষ্টা।

মোটের উপর, এই ধরনের ব্যতিক্রমী মানুষদের বাদ দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় সাম্রাজ্যের গ্রিকভাষী অঞ্চলের উপর রোমের ক্রিয়া ছিল দুষ্ট ক্ষতের মতো। চিন্তন ও শিল্পের অবক্ষয় হয়েছিল একইরকম। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত অবস্থাপন্ন। লোকেদের জীবন ছিল আরামদায়ক ও সহজ, কঠিন পরিশ্রমের কোনো উদ্দীপনা ছিল এবং মহান কৃতিত্ব লাভের সুযোগ অল্পই ছিল। জাস্তিনিয়ান বন্ধ না করা পর্যন্ত আকাদেমি, পেরিপেটেটিক গোষ্ঠী৯২, এপিকুরীয় ও স্টোইক-স্বীকৃত দার্শনিক সম্প্রদায়গুলো বিদ্যমান ছিল। যাই হোক, খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর নব্য প্লাতনবাদীদের বাদ দিলে মার্কস অরিলিয়সের পরবর্তীকালে এগুলোর কোনোটিই কিছুমাত্র জীবনীশক্তি দেখাতে পারেনি। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা নব্য প্লতনবাদীদের সম্পর্কে আলোচনা করব এবং এই ব্যক্তিদের উপর রোমের প্রভাব ছিল সামান্য। সাম্রাজ্যের লাতিন ও গ্রিক অংশ ক্রমশই ভিন্নমুখী হচ্ছিল, সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে গ্রিক জ্ঞান ছিল দুর্লভ এবং কনস্তান্তিনের পরবর্তী যুগে পূর্ব দেশে লাতিন ভাষা জীবিত ছিল শুধুমাত্র আইন এবং সৈন্যবাহিনীর ক্ষেত্রে।

২। রোমের উপর গ্রিস ও পূর্ব দেশের প্রভাব। এক্ষেত্রে দুটি একেবারেই পৃথক বিচার্য : প্রথমত, সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত রোমকদের উপরে হেলেনীয় শিল্প, সাহিত্য দর্শনের প্রভাব। দ্বিতীয়, সমগ্র পাশ্চাত্য জগতে অ-হেলেনীয় ধর্ম ও কুসংস্কারের প্রসার।

(ক) রোমকরা যখন প্রথম গ্রিকদের সংস্পর্শে আসেন তখন তারা বুঝতে পেরেছিলেন গ্রিকদের তুলনায় তারা বর্বর এবং সংস্কৃতিহীন। অনেক দিক থেকেই তাদের তুলনায় গ্রিকদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল অপরিমেয়ঃ যন্ত্রশিল্পে ও কৃষি প্রযুক্তিতে, ভালো একজন করণিকের প্রয়োজনীয় জ্ঞানে, বাক্যালাপে ও জীবন ভোগ করার কৌশলে, শিল্পে, সাহিত্যে দর্শনে। রোমকরা শুধুমাত্র উন্নত ছিলেন সামরিক কৌশল ও সামাজিক সংযুক্তিতে। রোমক ও গ্রিকদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ১৮১৪ এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের প্রুশীয়দের সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্কের মতো কিন্তু শেষোক্তটি ছিল স্বল্পস্থায়ী অথচ অপরটি ছিল দীর্ঘস্থায়ী। পিউনিক যুদ্ধের পর তরুণ রোমকরা গ্রিকদের প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলেন। তাঁরা গ্রিক ভাষা শিখলেন, গ্রিক স্থাপত্যকে নকল করলেন, গ্রিক ভাস্করদের কাজে নিয়োগ করলেন। রোমক দেবতাদের সঙ্গে গ্রিক দেবতাদের অভিন্নতা শনাক্ত করা হয়েছিল। হোমেরীয় পুরাণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রোমকদের ট্রোজান উৎপত্তি আবিষ্কৃত হলো। লাতিন কবিরা গ্রিক ছন্দ গ্রহণ করলেন, লাতিন দার্শনিকরা গ্রহণ করলেন গ্রিক তত্ত্বসমূহ। শেষে রোম হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিকভাবে গ্রিসের পরগাছা। রোমকরা কোনো শিল্পশৈলী সৃষ্টি করেননি, সৃষ্টি করেননি কোনো মৌলিক দার্শনিক তন্ত্র এবং করেননি কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। উত্তম পথ তাঁরা প্রস্তুত করেছিলেন, বানিয়েছিলেন আইনের প্রণালীবদ্ধ সংহিতা এবং সুপটু সৈন্যবাহিনী, অন্য সব ব্যাপারের জন্য তাঁরা ছিলেন গ্রিসের মুখাপেক্ষী।  

হেলেনীয় প্রভাবের ফলে রোমের আচরণে একটু নম্রতা এসেছিল, বড় কাতো সেটাকে ঘৃণা করতেন। পিউনিক যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত রোমকরা ছিলেন গ্রাম্য, তাঁদের দোষ-গুণও ছিল চাষিদের মতোঃ অর্থাৎ কঠোরভাবে আড়ম্বরহীন, পরিশ্রমী, পাশবিক, একগুয়ে এবং বোকা। তাঁদের পারিবারিক জীবন ছিল সুস্থির এবং পিতৃ নিয়ন্ত্রণের (patria potestas) কঠিন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। নারী ও অল্প বয়সীরা ছিল সম্পূর্ণ অধীন। সহসা ঐশ্বর্যের অনুপ্রবেশে এসবই পরিবর্তিত হয়। ক্ষুদ্র কৃষিজমি অদৃশ্য হলো এবং তার পরিবর্তে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হলো কর্ষণযোগ্য বিশাল ভূ-সম্পত্তি। সেখানে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য দাসশ্রমিক নিয়োগ করা হতো। গড়ে উঠল এক বিরাট বণিকশ্রেণি এবং লুণ্ঠনের দ্বারা ধনী এক বিরাট সংখ্যক লোক, তারা ছিল অনেকটা অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের নবাবদের মতো। নারীরা ছিলেন সদ্গুণান্বিতা দাসী, তাঁরা হলেন স্বাধীন ও অসচ্চরিত্র, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়াল সাধারণ ব্যাপার, ধনীদের সন্তান হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক শতাব্দী পূর্বে গ্রিকরা এই বিকাশের ভিতর দিয়েই গিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের দৃষ্টান্তে রোমকদের উৎসাহিত করলেন, ঐতিহাসিকরা একে বলেন নৈতিক অবক্ষয়। এমনকি সাম্রাজ্যে সর্বাপেক্ষা নৈতিক শিথিলতার সময়েও সাধারণ রোমকরা ভাবতেন গ্রিসের অবক্ষয় কলুষতার বিরুদ্ধে রোম শুদ্ধতর নৈতিকতার মানদণ্ড।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী ও তার পরবর্তী যুগে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যের উপর গ্রিসের সাংস্কৃতিক প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে লাগল, প্রধান কারণ ছিল সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ের কারণ ছিল বহু কিন্তু বিশেষ করে একটির উল্লেখ অবশ্য কর্তব্য। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সরকার আগেকার তুলনায় ছিল নিরাবরণ এক সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনী সাধারণত একজন সফল সেনাপতিকে সম্রাট নির্বাচিত করত। কিন্তু এই সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পদেও যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা কেউই শিক্ষিত রোমক নয়, তারা ছিল সীমান্তবাসী অর্ধ-বর্বর। এই কাঠখোট্টা সৈন্যদের সংস্কৃতির কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং সভ্য নাগরিকদের তারা শুধুমাত্র অর্থাগমের উৎস বলেই মনে করত। বেসরকারি মানুষরা ছিলেন অতি দরিদ্র, তাঁদের পক্ষে শিক্ষার ব্যয় করা সম্ভব ছিল না এবং রাষ্ট্রের বিচারে শিক্ষা ছিল অপ্রয়োজনীয়। সেইজন্য পশ্চিমে শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যতিক্রমী শিক্ষিত মানুষই গ্রিক শিক্ষণ চালিয়ে গিয়েছেন।

(খ) এর বিপরীতে অ-হেলেনীয় ধর্ম ও কুসংস্কার সময়ের সঙ্গে পশ্চিমে ক্রমশই গভীরে প্রোথিত হতে লাগল। আমরা আগেই দেখেছি আলেকজান্দ্রসের বিজয় অভিযান কী করে ব্যাবিলনীয়, পারসিক ও মিসরীয় বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে গ্রিক জগৎকে পরিচিত করিয়েছিল। একইভাবে রোমক বিজয় অভিযান পাশ্চাত্য জগৎকে এই সমস্ত মতবাদের সঙ্গে এবং ইহুদি ও খ্রিষ্টান মতবাদের সঙ্গে পরিচিত করে। ইহুদি খ্রিষ্টান কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন তা আমি এর পরে আলোচনা করব, আপাতত নিজেকে যতটা সম্ভব আবদ্ধ রাখব পৌত্তলিকদের কুসংস্কারে।

রোমে প্রতিটি সম্প্রদায় ও প্রত্যেক প্রফেটের প্রতিনিধি ছিলেন এবং অনেক সময় সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের পৃষ্ঠপোষকতা তাঁরা পেতেন। তখনকার যুগের সরল বিশ্বাস সত্ত্বেও লুকীয় নামে একজন স্থির মস্তিষ্কের সন্দেহবাদী ছিলেন, তিনি পাফলাগোনীয় আলেকজান্দ্রস (Paphlagonian Alexander) নামে একজন প্রফেট (Prophet-দিব্য প্রেরণাপ্রাপ্ত শিক্ষক, গুরু, উপদেষ্টা, প্রচারক, কবি বা ভবিষ্যদ্বক্তা) এবং অলৌকিক কর্মী সম্পর্কে একটি মজার গল্প বলেছেন। গল্পটিকে সাধারণত সত্য বলেই মেনে নেওয়া হয়। এই লোকটি অসুস্থ লোককে সুস্থ করত ও ভবিষ্যদ্বাণী করত, এর সঙ্গে গুপ্তকথা প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে ঘুষও আদায় করত। তার খ্যাতি মার্কস অরেলিয়সের কানে পৌঁছায়, তিনি তখন দানিয়ুবের তীরে মার্কর্মানীদের (Marcomanni-একটি জার্মান উপজাতি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। কীভাবে যুদ্ধটি জয় করা যাবে সে সম্পর্কে সম্রাট তার সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং সম্রাটকে বলা হয়-তিনি যদি দুটি সিংহকে দানিয়ুবে ফেলে দিতে পারেন তাহলে তার বিরাট জয় হবে। ম্রাট ভবিষ্যদ্রষ্টার উপদেশ পালন করলেন কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কনীদের বিরাট জয় হলো। এই দুর্ঘটনা সত্ত্বেও আলেকজান্দ্রসের খ্যাতি বৃদ্ধি পেতে লাগল। রুতিলিয়ানস (Rutilians) নামে একজন কনসাল (consul-প্রাচীন রোমক সাধারণতন্ত্রের প্রধান দুজনের যে কোনো একজন) স্তরের বিখ্যাত রোমক বহু বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করার পর, অবশেষে নিজের স্ত্রী নির্বাচনের জন্য তাঁর পরামর্শ চান। এনডাইমিয়ন (Endymion-চন্দ্রের প্রেমিকা একজন সুন্দরী তরুণী)-এর মতো আলেকজান্দস চন্দ্রের প্রেম ভোগ করেন এবং তার গর্ভে আলেকজান্দ্রসের এক কন্যার জন্ম হয়, দৈবজ্ঞ তাকে রুতিলিয়ানসের জন্য সুপারিশ করেন। ষাট বছর বয়সী রুতিলিয়ানস তৎক্ষণাৎ ঐশ্বরিক নির্দেশ পালন করেন এবং তাঁর বিবাহ উৎসবে দিব্য শশ্রুমাতার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ হেকাটম্ব (hecatomb-বলিদানের স্থান, প্রাচীন গ্রিসে হেকাটম্ব এক শত বৃষ বলি দেওয়া হতো-অনুবাদক) উৎসর্গ করেন।

পাফলাগোনীয় আলেকজান্দ্রসের কর্মজীবনের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সম্রাট এলাগবালস (Elabalus) কিংবা হেলিয়গবালস (Heliogablus, ২১৮-২২ খ্রিষ্টাব্দ)-এর রাজত্বকাল। তিনি সৈন্যবাহিনীর দ্বারা উচ্চপদে নির্বাচিত হওয়ার আগে ছিলেন সূর্যপূজার একজন সিরীয় পুরোহিত। সিরিয়া থেকে রোমে ধীর অগ্রগতির সময় তার অঙ্কিত প্রতিকৃতি এসেছিল আগে-সেটা সেনেটকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে আঁকা হয়েছিল মেদেস এবং ফিনিকীয়দের ঢঙ-এ ভাঁজে ভাঁজে ঢেউ খেলানোভাবে ঝুলে ছড়িয়ে পড়া রেশম আর সোনা দিয়ে তৈরি যাজক শাসকদের পোপাশাকে। তার মাথা ঢাকা ছিল কারুকার্য করা উঁচু পাগড়ি দিয়ে অসংখ্য কণ্ঠী (collars) ও হাতের অলঙ্কারে (bracelets) সাজানো ছিল অমূল্য রত্ন। তাঁর ভ্রুতে ছিল কালো আভা আর গাল ছিল কৃত্রিম লাল আর সাদা দিয়ে রং করা। গম্ভীর সেনেটররা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বীকার করলেন-বহুদিন স্বদেশবাসীদের কঠোর স্বৈরতন্ত্র সহ্য করার পর রোম শেষ পর্যন্ত প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রীদের মেয়েলী বিলাসিতার কাছে নতিস্বীকার করল।১৪৬ সৈন্যবাহিনীর একটা বড় অংশের সমর্থনে তিনি গোঁড়া উৎসাহে রোমে প্রাচ্যদেশের ধর্মাচরণ উপস্থাপনের কাজ করতে লাগলেন। তাঁর নাম এবং এমেসা (Emesa)-তে পূজিত সূর্যদেবতার নাম ছিল অভিন্ন, সে মন্দিরে তিনিই ছিলেন প্রধান পুরোহিত। তাঁর মা কিংবা ঠাকুমা ছিলেন আসল শাসক, তিনি (মা কিংবা ঠাকুমা) বুঝতে পারলেন ঐ পুরোহিত খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আলেকজান্দ্রস (২২২-৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)-এর পক্ষে তিনি তাকে সিংহাসনচ্যুত করেন। আলেকজান্দ্রসের প্রাচ্য প্রবণতা ছিল মধ্যম প্রকার। তার যুগে ধর্মের মিশ্রণ কিরকম সম্ভব হতো তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত মন্দিরে। সেখানে তিনি আব্রাহাম, অফীয়স, তিয়না-র অ্যাপোলোনিয়স ও খ্রিষ্টের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন।

পারস্য দেশে মিথুস (Mithras)-এর ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, ঐ ধর্ম ছিল খ্রিষ্টধর্মের জোর প্রতিযোগী, বিশেষ করে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধে। ম্রাটরা সৈন্যবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেপরোয়া চেষ্টা করছিলেন, তারা ভেবেছিলেন ধর্ম বহুঁকাম্য স্থিরত্ব আনতে পারে কিন্তু এই ধর্মকে হতে হবে নব্য ধর্মগুলোর একটি, কারণ, সৈন্যদের এই ধর্মগুলোই পছন্দ। রোমে এটা স্থাপন করা হলো এবং সৈনিক মনকে আকর্ষণ করার মতো এর মধ্যে অনেক কিছুই ছিল। মিথুস ছিলেন একজন সূর্যদেবতা কিন্তু তাঁর সিরীয় সহযোগীর মতো মেয়েলী নন, তিনি ছিলেন যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত একজন দেবতা, সেই যুদ্ধ ছিল ভালো ও মন্দের মধ্যে বিরাট যুদ্ধ যা জরাথুস্ট্র-র পর থেকে পারসিক ধর্মের অঙ্গ ছিল। রস্টভস্টেফ৪৭ এই পূজার বাস-রিলিফ (bas-relief- যেন পটভূমির ভিতর প্রায় প্রোথিত এমনভাবে গঠিত মূর্তি)-এর পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ করেছিলেন, এটা পাওয়া গিয়েছিল জার্মানির হেডেনহাইম (Heddernheim)-এর একটি ভূ-গর্ভস্থ উপাসনা গৃহে। এ থেকে বোঝা যায় সৈন্যদের মধ্যে তাঁর শিষ্যের সংখ্যা শুধু পূর্বেই নয়, পশ্চিমেও ছিল অনেক।

কনস্তান্তিনের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করা রাজনৈতিকভাবে সফল হয়েছিল অথচ একটি নতুন ধর্ম উপস্থাপনের পূর্বেকার প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে। কিন্তু সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগেকার প্রচেষ্টার সাদৃশ্য ছিল খুবই বেশি। সব ধর্মই একইভাবে নিজেদের সাফল্যের সম্ভাবনা আহরণ করেছিল রোমক জগতের নানা দুর্ভাগ্য ও ক্লান্তি থেকে। গ্রিস ও রোমের ঐতিহ্যগত ধর্ম ছিল তাদেরই উপযুক্ত-যাদের আকর্ষণ ছিল পার্থিব জগতের প্রতি এবং পৃথিবীতে সুখের আশা যাদের ছিল। এশিয়া, যার হতাশার অভিজ্ঞতা ছিল দীর্ঘতর, পারলৌকিক আশা রূপে একটি অধিকতর সফল প্রতিষেধক বিবর্তিত করেছিল। সান্ত্বনা দেওয়ার পক্ষে এদের সবগুলোর ভিতরে খ্রিষ্টধর্ম ছিল সবচাইতে কার্যকর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ধর্ম হতে হতে খ্রিষ্টধর্ম গ্রিস থেকে অনেক কিছু বিশোষণ করেছে এবং এগুলো ইহুদি উপাদানের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পরবর্তী যুগগুলোতে পশ্চিমে প্রেরিত হয়েছে।

৩। সরকার ও সংস্কৃতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। মিনোয়ী যুগের কৃতিত্বগুলো হারিয়ে যাওয়ার মতো গ্রিসের মহান যুগের কৃতিত্বগুলো যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়নি তার জন্য আমরা ঋণী, প্রথমত আলেকজান্দ্রসের কাছে এবং তারপর রোমের কাছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে যদি একজন চেঙ্গিস খাঁ উদ্ভূত হতেন তাহলে তিনি হেলেনীয় জগতে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তার সবকিছুই মুছে ফেলতে পারতেন। গ্রিস সভ্যতার যে অবস্থা হয়েছিল, ক্সারক্সেস (Xerxes)-এর ক্ষমতা আর একটু বেশি হলে পরাজিত হওয়ার পর তিনি হয়তো গ্রিসের সভ্যতাকে তার চাইতে অনেক নিম্নস্তরে নামিয়ে আনতে পারতেন। আয়েসখুলস থেকে প্রাতন যুগ পর্যন্ত বিচার করুন : এই যুগে যে সমস্ত কাজ হয়েছে। তার সবটাই করেছেন কয়েকটি বাণিজ্যিক নগরের অধিবাসীদের সংখ্যালঘুদের কয়েকজন। ভবিষ্যতে দেখা গেল এই নগরগুলোর বৈদেশিক আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা খুব বেশি ছিল না কিন্তু এ অসাধারণ সৌভাগ্যের ফলে তাদের বিজেতারা অর্থাৎ মাকেদনীয় ও রোমকরা সবাই ছিলেন গ্রিস প্রেমিক। সেইজন্য তাঁরা যা জয় করেছিলেন সেগুলো ধ্বংস করেননি, যেমন করতে পারতেন ক্সারক্সেস কিংবা কার্থেজ। আসলে শিল্পে, সাহিত্যে, দর্শনে ও বিজ্ঞানে-গ্রিকদের কাজের সঙ্গে আমরা যে পরিচিত, তার কারণ, পাশ্চাত্য বিজেতাদের দ্বারা আনীত স্থায়িত্ব। যে সভ্যতার শাসনভার তাঁদের হাতে এসে পড়েছিল তার প্রশংসা করার মতো সুবুদ্ধি তাদের ছিল এবং সেগুলো রক্ষা করার জন্য তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

রাজনৈতিক নৈতিক কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীন অবস্থাতে গ্রিকরা যে দর্শনশাস্ত্রের চর্চা করতেন তার তুলনায় আলেকজান্দ্রস ও রোমকরা উন্নততর দর্শনের স্রষ্টা ছিলেন। আমরা দেখেছি স্টোইকরা মানুষের ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁদের সহানুভূতি গ্রিকদের ভিতরেই আবদ্ধ রাখেননি। রোমকদের দীর্ঘ প্রভুত্বের ফলে মানুষ একটি সরকারের অধীনে একক এক সভ্যতার চিন্তনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা এ বিষয়ে অবহিত যে, পৃথিবীর এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যেগুলো রোমের অধীন নয়-বিশেষ করে ভারত ও চীন। কিন্তু রোমকদের কাছে মনে হতো সাম্রাজ্যের বাইরে আছে শুধুমাত্র কমবেশি বর্বর উপজাতি, প্রচেষ্টার উপযুক্ত মনে হলেই তাদের জয় করা যেতে পারে। কার্যক্ষেত্র এবং ধারণায় রোমকদের সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বব্যাপী। এই কল্পন চার্চের উপরেও আরোপিত হয়; বৌদ্ধ, কনফুসীয় এবং (পরবর্তী যুগে) মহম্মদীয়দের অস্তিত্ব সত্ত্বেও চার্চ ছিল ক্যাথলিক অর্থাৎ বিশ্বজনীন। সেকুরুস যুদিকাত অর্বিস টেরারুম (Securus judicat orbis terrarum- যখন একটা মত স্বল্পসংখ্যক মানুষ ভাগ করে নেয়, তার চেয়ে যখন বহু মানুষ সহমত হয় তখন সেই মত সম্পর্কে অনেক নিশ্চিত হওয়া যায়) ১৪৮ ছিল সেন্ট অগস্তিনের একটি মতবাদ, এতে মূর্ত হয়েছিল পরবর্তী স্টোইকদের মতবাদ, এই মতবাদের আকর্ষণীয় ক্ষমতার কারণ ছিল রোমক সাম্রাজ্যের আপাতদৃষ্ট সার্বজনীনত্ব। শার্লামেন (Charlemagne)-এর যুগের পর সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে চার্চ ও পবিত্র রোমক সাম্রাজ্য কল্পনের দিক থেকে ছিল বিশ্বব্যাপী, যদিও প্রত্যেকেই জানত আসল তথ্য তা নয়। একটি মানবপরিবার, একটি ক্যাথলিক ধর্ম, একটি বিশ্বজনীন সংস্কৃতি এবং একটি বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের রোম কর্তৃক প্রায় বাস্তবায়নের পর থেকে বার বার মানুষের মনে উদিত হয়েছে।

সভ্য অঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধিতে রোমের ভূমিকার গুরুত্ব ছিল বিরাট। উত্তর ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানির কোনো কোনো অংশ সভ্য হয়েছিল রোমক সৈন্যবাহিনী বলপূর্বক অঞ্চলগুলো জয় করার ফলে। এই অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিই প্রমাণ করেছিল তারা খোদ রামের মতোই সংস্কৃতির উচ্চস্তরে উঠতে সক্ষম। পশ্চিম সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলোতে গল এমন অনেক মানুষের জন্ম দিয়েছিল যারা প্রাচীনতর সভ্য অঞ্চলের সমসাময়িকদের অন্ততপক্ষে সমকক্ষ ছিলেন। রোম সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছিল বলেই বর্বররা সংস্কৃতিকে সাময়িক রাহুগ্রস্ত করেছিল, চিরন্তন অন্ধকার আনতে পারেনি। যুক্তি দেখানো যেতে পারে গুণগতভাবে সভ্যতা কখনোই পেরিক্লেসের আথিনার স্তরে উন্নীত হয়নি কিন্তু যে বিশ্বে যুদ্ধ ও ধ্বংসই বাস্তবতা, বলা যায় সেখানে পরিমাণ শেষ পর্যন্ত উচ্চমানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিমাণের উৎকর্ষের কারণ ছিল রোম।

৪। হেলেনীয় ভাবধারার বাহকরূপে মহম্মদীয়রা। সপ্তম শতাব্দীতে ফেটের শিষ্যরা সিরিয়া, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকা জয় করেন, পরবর্তী শতাব্দীতে তাঁরা জয় করেন স্পেন। তাঁদের বিজয় অভিযান ছিল সহজ ও সামরিক সংঘর্ষ ছিল সামান্য। সম্ভবত প্রথম কয়েক বছর ছাড়া তারা গোঁড়া ছিলেন না, কর বাকি না থাকলে খ্রিস্টান কিংবা ইহুদিদের উপর কোনো অত্যাচার করা হতো না। আরবরা দ্রুত পূর্ব সাম্রাজ্যের সভ্যতা গ্রহণ করলেন কিন্তু অবক্ষয়ের ক্লান্তির পরিবর্তে তাঁদের ছিল উঠতি রাজনৈতিক দলসুলভ আশাবাদ। তাঁদের পণ্ডিতরা গ্রিক লেখকদের লেখার অনুবাদ করতেন এবং তার উপর টীকা লিখতেন। আরিস্ততেলেসের খ্যাতি প্রধানত তাঁদের জন্যই প্রাচীনকালে আরিস্ততেলেসকে প্লাতনের সমকক্ষ ভাবা হতো না।

আমরা আরবদের কাছ থেকে যে সমস্ত শব্দ পেয়েছি তার কয়েকটি বিচার করা শিক্ষাপ্রদ হবে, যেমনঃ অ্যালজেব্রা, অ্যালকেমি, অ্যালকোহল, আ্যালেম্বিক (পাতনতন্ত্র), অ্যালকালি (ক্ষার), অ্যাজিমুথ (দিগবলয়), জেনিথ (সুবিন্দু)। অ্যালকোহলকে বাদ দিলে-এর অর্থ পানীয় নয়, রসায়নশাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি বস্তু-এই শব্দগুলো থেকে আমরা আরবদের কাছে আমাদের ঋণের একটা ভালো চিত্র পাব। আলজেব্রা আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিকরা কিন্তু মহম্মদীয়দের হাতে এই বিদ্যা আরও অগ্রসর হয়েছিল। অ্যালকেমি, অ্যালেম্বিক, অ্যালকালি- এই শব্দগুলো হীন ধাতু থেকে সোনা তৈরি করার প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত, এই প্রচেষ্টা তারা গ্রহণ করেছিলেন গ্রিকদের কাছ থেকে এবং একে অনুসরণ করতে গিয়ে তাঁরা গ্রিক দর্শনের দ্বারস্থ হন। অ্যাজিমুথ এবং জেনিথ জ্যোতিষবিদ্যাভিত্তিক শব্দ, আরবদের কাছে এর প্রধান প্রয়োজন ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রে।

গ্রিক দর্শন সম্পর্কীয় জ্ঞানের ব্যাপারে আমরা আরবদের কাছে কতটা ঋণী, শব্দপ্রকরণ পদ্ধতি সেটা গোপন করে, কারণ, যখন এগুলো আবার ইউরোপে পঠিত হলো তখন প্রায়োগিক শব্দগুলো নেওয়া হয়েছিল গ্রিক কিংবা লাতিন থেকে। আরবরা দর্শনশাস্ত্রে মৌলিক চিন্তনের চাইতে টীকাকার রূপেই বেশি পটু ছিলেন। আমাদের কাছে মহম্মদীয়দের গুরুত্ব হলো, খ্রিস্টানরা নয়, তারাই গ্রিক ঐতিহ্যের সেই অংশগুলোর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী ছিলেন, যেগুলো শুধুমাত্র পূর্ব সাম্রাজ্যেই জীবিত ছিল। স্পেন-এ এবং স্বল্প পরিমাণে সিসিলিতে মহম্মদীয়দের সঙ্গে সংস্পর্শ পশ্চিমকে আরিস্ততেলেসের সঙ্গে পরিচিত করেছে, তাছাড়া পরিচিত করেছে আরবীয় সংখ্যাসূচক প্রতীক, বীজগণিত ও রসায়নশাস্ত্রকে। এই সংস্পর্শই একাদশ শতাব্দীতে বিদ্যাশিক্ষার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে, এরই ফল ছিল স্কলাস্টিক৫°দর্শনশাস্ত্র। পরে গ্রিক পাঠের ফলে ত্রয়োদশ শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে এই ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দরুন লোকে সরাসরি প্লাতন, আরিস্ততেলেস ও প্রাচীনকালের অন্যান্য গ্রিক লেখকদের লেখা পাঠ করার সামর্থ্য লাভ করে। কিন্তু আরবরা যদি এই ঐতিহ্য রক্ষা না করতেন তাহলে রেনেসাঁ-র মানুষ হয়তো ভাবতেই পারত না-প্রাচীন শিক্ষার পুনরুজ্জীবন কতটা লাভ হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *