২৪. প্রাচীন গ্রিসে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যাচর্চা

২৪. প্রাচীন গ্রিসে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যাচর্চা

আমার বিচার্য বিষয় গণিতবিদ্যা হলেও মূল কারণ গণিত নয়, আসল কারণ গণিতের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সম্পর্ক, বিশেষ করে প্লাতনের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। গ্রিকদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য ক্ষেত্রের চাইতে আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায় গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায়। তাদের শিল্প, সাহিত্য এবং দর্শনে কৃতিত্ব হয়তো রুচি অনুসারে ভালো কিংবা মন্দ বলা চলে কিন্তু জ্যামিতিতে তাঁদের কৃতিত্ব সম্পূর্ণ প্রশ্নাতীত। তাঁরা কিছু আহরণ করেছিলেন মিশর থেকে এবং তার চাইতে কিছু কম ব্যাবিলনিয়া থেকে কিন্তু এই সমস্ত উৎস থেকে তাঁরা যা পেয়েছিলেন তা হলো গণিতের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম এবং জ্যোতির্বিদ্যায় দীর্ঘ যুগ বিস্তৃত পর্যবেক্ষণের নথিপত্র। গাণিতিক কলাকৌশলের প্রায় সম্পূর্ণটারই উৎপত্তিস্থল গ্রিস।

কী কী ব্যবহারিক সমস্যা তাদের গাণিতিক অনুসন্ধানে উৎসাহিত করেছিল সে সম্পর্কে অনেক মজার গল্প আছে তবে গল্পগুলো হয়তো ঐতিহাসিক নয়। প্রাচীনতম ও সরলতম কাহিনী থালেস সম্পর্কে, তিনি যখন মিশরে তখন রাজা তাঁকে পিরামিডের উচ্চতা বার করতে বলেছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর নিজের ছায়ার দৈর্ঘ্য তার দেহের উচ্চতার সমান না হয় দিনের সেই সময় পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। তখন তিনি পিরামিডের ছায়ার দৈঘ্য মাপলেন, পিরামিডের উচ্চতা এবং ছায়ার দৈর্ঘ্য অবশ্যই সমান ছিল। শোনা যায়, দর্শনানুপাত (perspective) নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছিলেন জ্যামিতিবেত্তা আগাথারকস (Agatharcus), তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আয়েসখুলস-এর নাটকগুলোর দৃশ্য আঁকা। শোনা যায়, সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের দূরত্ব নির্ণয়ের সমস্যা যা নির্ভুলভাবে থালেস চিন্তা করেছিলেন। তার নির্ভুল সমাধান হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। গ্রিক জ্যামিতিবেত্তারা যে সমস্ত বিরাট সমস্যা নিয়ে নিযুক্ত ছিলেন তার ভিতরে একটা ছিল একটি ঘনক দ্বিগুণিত করা, এর উৎপত্তির কাহিনী শোনা যায়- এক মন্দিরের পুরোহিতকে দৈবজ্ঞ বলেছিলেন, দেবতার নিজের যে মূর্তি আছে তার দ্বিগুণ একটি মূর্তি দেবতা চেয়েছেন। প্রথমে তারা সরাসরি মূর্তিটির প্রতিটি মাত্রা দ্বিগুণ করার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু পরে তাঁরা বুঝতে পারলেন এর ফল হবে মূল মূর্তিটির চাইতে আট গুণ বড় একটি মূর্তি, তার ফলে দেবতার দাবির চাইতে ব্যয় বেশি হবে। সুতরাং তাঁরা প্লাতনের কাছে এক প্রতিনিধিদল পাঠালেন এই প্রশ্ন নিয়ে যে- আকাদেমির কেউ তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেন কিনা। জ্যামিতিবেত্তারা ব্যাপারটা হাতে নিলেন এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী এ নিয়ে কাজ করলেন, তাতে ঘটনাক্রমে প্রচুর প্রশংসনীয় গবেষণাও হয়েছিল। আসলে সমস্যাটা ছিল ২-এর ঘনমূল বার করা।

২-এর বর্গমূলই প্রথম আবিষ্কৃত অমূলদ সংখ্যা- এটা আদি পুথাগোরীয়দের জানা ছিল এবং এর মূল্যাঙ্কের আসন্নতায় পৌঁছানোর অনেক উদ্ভাবনী পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। শ্রেষ্ঠ ছিল নিম্নলিখিত পদ্ধতিটি সংখ্যার দুটি স্তম্ভ গঠন করুন, তাদের নাম দিন a এবং b, প্রতিটিই শুরু হবে ১ থেকে। প্রতিটি ধাপের পরবর্তী a গঠিত হয় পূর্ববর্তী a এবং b (পূর্বেই প্রাপ্ত) যোগ করে। পরবর্তী b গঠিত হলে পূর্ববর্তী a-র দ্বিগুণের সঙ্গে পূর্ববর্তী b যোগ করে। এইভাবে প্রাপ্ত প্রথম ৬ জোড়া হলো (১, ১), (২, ৩), (৫, ৭), (১২, ১৭), (২৯, ৪১), (৭০, ৯৯)। প্রতিটি জোড়েই ২a-b২ হয় ১ অথবা-১। সুতরাং তু প্রায় দুইয়ের বর্গমূলের সমান এবং প্রতিটি নতুন ধাপেই এটা নিকটতর হয়। উদাহরণ, ৯৯/৭০-এর বর্গ প্রায় ২-এর সমান- এই তথ্যে পাঠক নিজেকে খুশি করতে পারেন।

প্রক্লস (Proclus) এর বিবরণ অনুসারে পুথাগরসই- যিনি সবসময়ই একজন রহস্যাবৃত পুরুষ-প্রথম জ্যামিতিকে উদার শিক্ষার অঙ্গ করেন। স্যার টমাস হীথসহ অনেক নির্ভরযোগ্য পণ্ডিত মনে করেন সম্ভবত পুথাগরসের নামাঙ্কিত উপপাদ্যটি তাঁরই আবিষ্কার, উপপাদ্যটি হল- একটি সমকোণী ত্রিভুজের সমকোণের বিপরীত বাহুর উপরের সমচতুষ্কোণ অন্য দুটি বহুর উপরের সমচতুষ্কোণের যোগফলের সমান। সে যাই হোক না কেন, এই উপপাদ্য খুব প্রাচীনকাল থেকে পুথাগোরীয়দের জানা ছিল। একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণের যোগফল দুই সমকোণ- সে তথ্যও তাঁদের জানা ছিল।

দুই-এর বর্গমূল ছাড়া অন্যান্য অমূলদ সংখ্যা নিয়েও গবেষণা করা হয়েছিল, বিশেষ কতকগুলো ক্ষেত্রে এ কাজ করেছিলেন সাতেসের সমসাময়িক থিওদরস (Theodorus) এবং আরও সাধাণভাবে এ কাজ করেছিলেন থিয়েতেতস-তিনি ছিলেন প্লাতনের মোটামুটি সমসাময়িক কিন্তু একটু বয়োবৃদ্ধ। দেমক্রিতস অমূলদ নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন কিন্তু সে বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অতি সামান্যই জানা আছে। এ বিষয়ে স্নাতনের আকর্ষণ ছিল গভীর, তিনি বিয়েতেতস নামাঙ্কিত কথোপকথনে থিয়েতেতস এবং থিওদরসের গবেষণার উল্লেখ করেছেন। আইন-এ (৮১৯-৮২০) তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে সাধারণ অজ্ঞতা নিন্দনীয় এবং তাঁর কথায় নিহিত আছে যে, তিনি স্বয়ং এই বিষয়ে নিজের জীবনে জানতে শুরু করেছেন বেশ দেরিতে। পুথাগোরীয় দর্শনে অবশ্য এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল।

অমূলদ আবিষ্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল এউদক্সস (Eudoxus, ca ৪০৮-ca ৩৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এর অনুপাত সম্পর্কীয় জ্যামিতিক তত্ত্ব আবিষ্কার। তার পূর্বে শুধুমাত্র ছিল অনুপাত সম্পর্কীয় পাটিগণিতের তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে যদি d এর a গুণ c এর b গুণের সমান হয় তাহলে a-র সঙ্গে b এর অনুপাত c এর সঙ্গে d এর অনুপাতের সমান। অমূলদ সম্পর্কে পাটিগণিতের তত্ত্বের অভাবে এই সংজ্ঞা শুধুমাত্র মূলদ সম্পর্কে প্রযোজ্য। এউদক্সস এমন একটি নতুন সংজ্ঞা দিলেন যা এই গণ্ডির অধীন নয়, তত্ত্বটির গঠন এমন যে, তা থেকে আধুনিক বিশ্লেষণ পদ্ধতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এউক্লিদ-এ তত্ত্ব বিকাশলাভ করেছে এবং তার যৌক্তিক সৌন্দর্য বিরাট।

এছাড়া এউদক্সস নিঃশেষণ প্রণালী আবিষ্কার করেছিলেন কিংবা ত্রুটিহীন করেছিলেন, পরবর্তীকালে আখিমিদেস বিরাট সাফল্যের সঙ্গে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। এই পদ্ধতি সমাকলনের একটি পূর্বাভাস। একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলের প্রশ্নের উদাহরণ নেওয়া যাক। একটি বৃত্তের ক্ষেত্রে একটি নিয়মিত ষড়ভুজ অথবা নিয়মিত দ্বাদশভুজ অথবা সহস্র কিংবা অযুক পাশ সম্বলিত বহুভুজের ক্ষেত্র অঙ্কন করা যাক। এইরকম বহুভুজের ক্ষেত্র, যতগুলো পাশই তার থাকুক না কেন, বৃত্তের ব্যাসের বর্গের সঙ্গে আনুপাতিক। একটি বহুভুজের পাশের সংখ্যা যত অধিক হবে ততই তা বৃত্তটির প্রায় সমান হয়ে উঠবে। এটা প্রমাণ করা যায় যদি বহুভুজটির যথেষ্ট পরিমাণ পাশ থাকে, বৃত্তটির ক্ষেত্রের সঙ্গে তার ক্ষেত্রের তফাত হবে পূর্বে স্থিরীকৃত যে কোনো ক্ষেত্রের চেয়ে কম-পূর্বে স্থিরীকৃত ক্ষেত্রটি যতই কম হোক না কেন। এই উদ্দেশ্যে আখিমিদেস-এর স্বতৎসিদ্ধ ব্যবহার করা হয়। এর বক্তব্য (কিছুটা সরলভাবে)-যদি দুটি পরিমাণের মধ্যে বড়টিকে অর্ধেক করা হয় এবং সেই অর্ধেককে যদি অর্ধেক করা হয় এবং এইভাবে করেই যাওয়া হয় তবে শেষ পর্যন্ত এমন একটা পরিমাণে পৌঁছানো হবে যা প্রাথমিক দুটি পরিমাণের ছোটটির চেয়ে কম। অন্যভাবে বললে a যদি b-এর চেয়ে বড় হয় তাহলে এমন কোনো সম্পূর্ণ সংখ্যক n আছে যাতে ২n গুণ b, a-র চেয়ে বড়।

নিঃশেষণ প্রণালী অনেক সময় নির্ভুল ফলাফলে উপস্থিত করে, যেমন অধিবৃত্তকে চতুষ্কোণ করা- যা আখিমিদেস করেছিলেন। অনেক সময়, যেমন একটি বৃত্তকে চতুষ্কোণ করার বেলায় এর দ্বারা পারস্পরিক আসন্নতা হয়ে থাকে। একটি বৃত্তকে চতুষ্কোণ করার সমস্যা আসলে বৃত্তের পরিধির সঙ্গে ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় করার সমস্যা যাকে পাই (T) বলে। গণনায় আর্থিমিদেস ২২/৭ এর আসন্নতা বার করেছিলেন। একটি নিয়মিত ৯৬ পাশ সম্বলিত বহুভুজকে বৃত্তের ক্ষেত্রের ভিতরে এবং বাইরে অঙ্কন করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, পাই (T) ৩ ১/৭ এর কম এবং ৩ ১০/৭ এর চেয়ে বেশি। এই প্রণালীকে যে কোনো প্রয়োজনীয় পরিমাণ আসন্নতা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়। এবং এই সমস্যায় যে কোনো প্রণালী এই পর্যন্তই করতে পারে। বহুভুজকে ক্ষেত্রের ভিতরে এবং বাইরে প্রোথিত করে পাই এর আসন্নতা নির্ণয় করা শুরু হয় আন্তিফন-এর সময়, তিনি ছিলেন সাতেসের সমসাময়িক।

আমার তরুণ বয়সে এউক্লিদ বালকবালিকাদের জন্য স্বীকৃত একমাত্র জ্যামিতির পাঠ্যবইয়ের লেখক। মোটামুটি ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতে বাস করতেন, সেটা ছিল আলেকজান্দ্রস ও আরিস্ততেলেসের মৃত্যুর সামান্য কয়েক বছর পরের কথা। তার উপাদানগুলো নামক পুস্তকের অধিকাংশই তার নিজস্ব নয় কিন্তু প্রস্তাবগুলোর বিন্যাস এবং যৌক্তিক গঠনের সিংহভাগ ছিল তার। জ্যামিতি যতই পড়া যায় ততই এগুলো প্রশংসনীয় মনে হয়। বিখ্যাত সমান্তরালের স্বতঃসিদ্ধের দ্বারা সমান্তরাল সম্পর্কে আলোচনার দ্বৈত গুণ হলো অবরোহী সিদ্ধান্তের জন্য কঠোর শ্রম এবং আদি স্বতঃসিদ্ধগুলো সম্পর্কে সন্দেহ গোপন না করা। এউদক্সসকে অনুসৃত অনুপাতের তত্ত্ব অমূলদ সম্পর্কে সমস্ত অসুবিধাগুলো যে পদ্ধতিতে এড়ায় তা উনিশ শতকীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ভিয়ারস্ট্রাস (Weirstrass)-এ উপস্থাপিত পদ্ধতির সঙ্গে মূলত একই রকম। এরপর এউক্লিদ এক ধরনের জ্যামিতিক বীজগণিতে চলে যান এবং ১০নং বইয়ে অমূলদ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এরপর তিনি যান ঘন জ্যামিতিতে- যা শেষ হয় নিয়মিত ঘন বস্তু নির্মাণে, এটা থিয়েতেতস নিখুঁত করেন এবং এটা প্লাতনের তিমাউস এ অনুমিত হয়েছিল।

এউক্লিদের উপাদানগুলো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুস্তকগুলোর একটি এবং গ্রিক বুদ্ধির একটি নিখুঁত কীর্তিস্তম্ভ। অবশ্যই এর গ্রিক ধরনের (typical) সীমাবদ্ধতা রয়েছেঃ পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অবরোহী এবং এর মধ্যে প্রাথমিক স্বতঃসিদ্ধগুলো পরীক্ষা করে দেখার কোনো পথ নেই। এই স্বতঃসিদ্ধগুলো প্রশ্নাতীত বলে ধারণা করা হয়েছিল কিন্তু উনিশ শতকের অএউক্লিদীয় জ্যামিতি দেখাল যে, হয়তো তার অংশত ভ্রান্ত ছিলেন এবং একমাত্র পর্যবেক্ষণই দেখাতে পারে সত্যিই তারা তাই কি না।

এউক্লিদের বাস্তব উপযোগিতা সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আছে যা প্রাতন বারংবার উল্লেখ করে মনে গেঁথে নিয়েছিলেন। শোনা যায় এক ছাত্র একটি বক্তৃতা শোনার পর জিজ্ঞাসা করেছিল জ্যামিতি শিখে তার কী লাভ হবে, তখন এউক্লিদ এক ক্রীতদাসকে ডেকে বলেন, এই তরুণকে তিন পয়সা দাও, কারণ, শিক্ষণীয় থেকে এর অতি অবশ্য একটা লাভের প্রয়োজন। যাই হোক, ব্যবহার সম্পর্কে তাচ্ছিল্যকে ব্যবহারিকভাবে সমর্থন করা হয়েছিল। গ্রিক আমলে কেউই মনে করেননি কৌণিক খণ্ডের কোনো ব্যবহারযোগ্যতা রয়েছে, অবশেষে সপ্তদশ শতকে গ্যালিলিও আবিষ্কার করলেন উৎক্ষিপ্ত বস্তু অধিবৃত্তাকার পথে চলে এবং কেপলার আবিষ্কার করলেন গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার পথে চলাচল করে। বিশুদ্ধ তত্ত্ব-প্রীতি থেকে গ্রিকরা যে কাজ করেছিলেন তা হঠাই যুদ্ধবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।

এউক্লিদকে উপলব্ধি করার পক্ষে রোমকরা একটু বেশি বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যিনি প্রথম তাঁকে উল্লেখ করেন তিনি কিকের-যার আমলে সম্ভবত কোন লাতিন ভাষান্তর ছিল না। অবশ্য বয়েথিয়সের পূর্বে (-a ৪৮০ খ্রিষ্টাব্দ) কোনো লাতিন ভাষান্তরের প্রামাণ্য নথি নেই। আরবরা অনেক বেশি তারিফ করেছেনঃ বাইজানটাইন সম্রাট ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে খলিফাঁকে একটি বই উপহার দেন এবং হারুন-অর-রশিদের তত্ত্বাবধানে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে এর একটি আরবি ভাষান্তর হয়। ১১২০ খ্রিষ্টাব্দে বাথ-এর আডেলার্ড আরবি থেকে লাতিনে ভাষান্তর করেন, এই লাতিন অনুবাদটিই এখনও পর্যন্ত। অবশিষ্ট আছে। তারপর থেকে পশ্চিমে পুনরায় জ্যামিতি চর্চা ধীরে ধীরে শুরু হয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয় রেনেসাঁ-র শেষের দিকে।

এবার জ্যোতির্বিদ্যায় আসা যাক, এ ক্ষেত্রে গ্রিক কৃতিত্ব জ্যামিতির মতোই উল্লেখযোগ্য। তাঁদের আগে ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয়দের বহু শতাব্দীব্যাপী পর্যবেক্ষণ একটি ভিত্তি স্থাপন করেছিল। গ্রহদের আপাতদৃষ্ট গতি নথিভুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু সাঁঝসকালের তারা যে অভিন্ন তা জানা ছিল না। গ্রহণচক্র আবিষ্কৃত হয়েছিল ব্যাবিলনে নিশ্চিতভাবে এবং সম্ভবত মিশরে, এর ফলে চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ছিল কিন্তু সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে নয়, কারণ, একটি নির্দিষ্ট স্থানে সেটা সর্বদা দৃষ্টিগোচর ছিল না। সমকোণকে নব্বই ডিগ্রিতে বিভাজনের জন্য আমরা ব্যাবিলনীয়দের কাছে ঋণী এবং ঋণী ডিগ্রিকে ষাট মিনিটে বিভক্ত করার জন্য। ষাট সংখ্যাটিকে তাঁদের বিশেষ পছন্দ ছিল এবং একে ভিত্তি করে একটি গণতন্ত্রও পছন্দের ছিল। গ্রিকরা তাদের পথিকৃৎদের প্রজ্ঞাকে মিশর ভ্রমণের উপর আরোপ করতে ভালোবাসতেন কিন্তু গ্রিকদের পূর্বে সত্যকারের কার্য সম্পাদন খুবই কম হয়েছে। যাই হোক, থালেস-এর গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বৈদেশিক প্রভাবের একটি উদাহরণ, তিনি মিশরীয় কিংবা ব্যাবিলনীয় উৎস থেকে যা শিখেছিলেন তার সঙ্গে নিজে কিছু যোগ করেছিলেন- এ রকম অনুমানের কোনো কারণ নেই এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল সেটা নেহাই ভাগ্যের ব্যাপার।

প্রাচীনতম কিছু আবিষ্কার এবং সঠিক কয়েকটি প্রকল্প দিয়ে শুরু করা যাক। আনাক্সিমাস ভেবেছিলেন পৃথিবী অবাধে ভাসমান এবং কোনো কিছুর উপরেই তার ভর রক্ষা করতে হয় না। আরিস্ততেলেস অনেক সময়ই তার সময়কার সর্বোত্তম প্রকল্পগুলোকে বাতিল করেছেন। আনাক্সিমাসের তত্ত্বে তাঁর আপত্তি ছিল। আপত্তির কারণ, কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য পৃথিবী অচল থাকে, কারণ তার একদিক থেকে অন্য দিকে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলতেন, কোনো মানুষের অবস্থান একটি বৃত্তের কেন্দ্রে হলে বৃত্তের পরিধির নানা স্থানে খাদ্য থাকলেও খাদ্যের কোন অংশ নির্বাচন করবে সে বিষয়ে যুক্তির অভাবের দরুন সে না খেয়ে মারা যাবে। এই যুক্তির পুনরাবির্ভাব ঘটে মধ্যযুগীয়। (স্কলাস্টিক (scholastic)] দর্শনে, তবে জ্যোতির্বিদ্যা সাপেক্ষ নয় কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা সাপেক্ষ। এই যুক্তির পুনরাবির্ভাব হয় বুরিডাপানে গাধা রূপে, গাধাটার ডান দিক ও বাম দিকে দুই বান্ডিল খড় ছিল, কোন বান্ডিল নেবে সেটা ঠিক করতে না পেরে না খেতে পেয়ে মারা গেল।

খুব সম্ভবত পুথাগরসই প্রথম ভেবেছিলেন পৃথিবীটা গোলাকার কিন্তু তাঁর কারণগুলো (সেটা অবশ্যই অনুমান করতে হবে) বৈজ্ঞানিক নয় বরং নান্দনিক। যাই হোক, বৈজ্ঞানিক কারণগুলো অচিরেই পাওয়া গেল। আনাক্সাগরস আবিষ্কার করলেন চাঁদ প্রতিফলিত আলোকে আলোকিত এবং তিনি গ্রহণ সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব দান করলেন। তিনি নিজে তখনও ভাবতেন পৃথিবী সমতল কিন্তু চন্দ্রগ্রহণকালে পৃথিবীর ছায়ার আকার পুথাগোরীয়দের পৃথিবীর গোলকাকারের সপক্ষে সিদ্ধান্তমূলক যুক্তি দান করেছিল। তারা আরও এগিয়েছিলেন এবং পৃথিবীকে একটি গ্রহ ভাবলেন। শোনা যায় তাঁরা স্বয়ং পুথাগরসের কাছ থেকে জেনেছিলেন সকালের তারা ও সন্ধ্যাতারা অভিন্ন এবং তারা ভাবতেন পৃথিবীসমেত সমস্ত গ্রহই বৃত্তাকারে ঘোরে তবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না, প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় অগ্নি-কে। তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন চাঁদের একটা পৃষ্ঠই সবসময় পৃথিবীর দিকে থাকে এবং তারা ভেবেছিলেন পৃথিবীও সবসময় একই পৃষ্ঠ কেন্দ্রীয় অগ্নি-র দিকে রাখে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল কেন্দ্রীয় অগ্নিঅভিমুখী পিঠের নাম ছিল জিউসের গৃহ কিংবা দেবতাদের মা। অনুমান করা হতো সূর্য কেন্দ্রীয় অগ্নির প্রতিফলিত আলোকে আলোকিত। পৃথিবী ছাড়াও কেন্দ্রীয় অগ্নি থেকে সমদূরত্বে আরও একটি বস্তুপিণ্ড ছিল তার নাম বিপরীত-পৃথিবী। তাদের কাছে এর দুটি কারণ ছিল- একটি বৈজ্ঞানিক, অন্যটি তাদের পাটিগণিতীয় অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে আহরিত। বৈজ্ঞানিক কারণ ছিল তাঁদের একটি সঠিক পর্যবেক্ষণ- অনেক সময় সূর্য এবং চন্দ্র উভয়েই দিকচক্রবালের ঊর্ধ্বে থাকলেও চন্দ্রগ্রহণ হয়। এই পরিঘটনার কারণ প্রতিসরণ, সেটা তাঁদের অজানা ছিল এবং তারা ভেবেছিলেন এই সমস্ত ক্ষেত্রে গ্রহণের কারণ নিশ্চয়ই পৃথিবী ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুপিণ্ডের ছায়া। অন্য কারণ ছিল সূর্য এবং চন্দ্র, পাঁচটি গ্রহ, পৃথিবী এবং বিপরীত-পৃথিবী ও কেন্দ্রীয় অগ্নি- এই সমস্ত মিলিয়ে মহাকাশের বস্তুপিণ্ড হয় দশটি এবং দশ সংখ্যাটি পুথাগোরীয়দের অতীন্দ্রিয়বাদ সংক্রান্ত একটি সংখ্যা ছিল।

এই পুথাগোরীয় তত্ত্ব ফিললাঅস (Philolaus)-এ আরোপ করা হয়, তিনি ছিলেন থিবা-র অধিবাসী, তাঁর জীবনকাল খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে। ব্যাপারটা যদিও কাল্পনিক ও অংশত বেশ অবৈজ্ঞানিক তবুও এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, কোপারনিকাস-এর প্রকল্প অনুমানের জন্য যে কল্পন প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় তার বেশিরভাগই জড়িত এর সঙ্গে। পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র না ভেবে বহু গ্রহের একটি ভাবা, স্থির না ভেবে স্থানে ভ্রাম্যমাণ ভাবার ভিতরে মানবকেন্দ্রিক চিন্তন থেকে মুক্তি দেখা যায় এবং এ মুক্তি অসাধারণ। মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের স্বাভাবিক মানসচিত্রকে এভাবে আঘাত দেওয়ার পর বৈজ্ঞানিক যুক্তির নেতৃত্বে আরও নির্ভুল তত্ত্বে পৌঁছানো এমন বেশি কিছু কঠিন হয়নি।

এতে অনেক পর্যবেক্ষণেরই অবদান ছিল। অয়েনপিদেস (Oenopides), তিনি আনাক্সাগরসের সামান্য পরবর্তী ছিলেন, আবিষ্কার করেছিলেন গ্রহণের ছায়ার বক্রতা। অনতিবিলম্বে বোঝা গেল সূর্য পৃথিবীর চাইতে নিশ্চয়ই অনেক বড়, যারা পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে মানতে অস্বীকার করছিলেন এই তথ্য তাঁদের সমর্থন করেছে। প্লাতনের অনতিকাল পরেই পুথাগোরীয়রা কেন্দ্রীয় অগ্নি এবং বিপরীত-পৃথিবীর চিন্তন পরিত্যাগ করেন। পন্তস-এর হেরাক্লিদেস (Heraclides of Pontus) (যার জীবনকাল ৩৮৮-৩১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, আরিস্ততেলেসের সমসাময়িক) আবিষ্কার করেছিলেন শুক্র এবং বুধ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং পৃথিবী নিজের অক্ষে চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘূর্ণিত হয়-এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। শেষেরটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যেটা তার পূর্বগামীদের কেউই নিতে পারেননি। হেরাক্লিদেস ছিলেন প্লাতনের মতাবলম্বী এবং নিশ্চয়ই একজন মহান পুরুষ ছিলেন কিন্তু আশানুরূপ সম্মান তিনি পাননি, তাঁকে বর্ণনা করা হয় এক নাদুসনুদুস ফুলবাবু বলে।

সামস-এর আরিস্তারখস-এর জীবনকাল ৩১০-২৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং তিনি আখিমিদেসের চাইতে পঁচিশ বছরের বড় ছিলেন। প্রাচীনকালের সমস্ত জ্যোতির্বিদদের ভিতরে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ব্যক্তি, কারণ, তিনি কোপারনিকাসের সম্পূর্ণ প্রকল্প উত্থাপন করেছিলেন অর্থাৎ পৃথিবীসমেত সমস্ত গ্রহ চক্রাকারে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং পৃথিবী নিজের অক্ষে চব্বিশ ঘণ্টায় একবার আবর্তিত হয়। আরিস্তারখসের একটিমাত্র অবশিষ্ট বই চন্দ্র এবং সূর্যের আকার ও দূরত্ব বিষয়ে (On the Sizes and Distances of the Sun and the Moon), এই বইয়ে তিনি ভূ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিয়েছেন- ব্যাপারটা সামান্য হতাশাব্যঞ্জক। এ কথা সত্য যে, এই বইয়ে যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা আছে সে আলোচনায় কোন তত্ত্ব তিনি গ্রহণ করেছেন- তাতে কিছু এসে যায় না, এবং তিনি ভেবে থাকতে পারেন তাঁর গণনাকে জ্যোতির্বিদ্যার প্রচলিত মতের অপ্রয়োজনীয় বিরোধিতা দিয়ে ভারাক্রান্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কিংবা এও হতে পারে ঐ বইটি লেখার পর তিনি কোপারনিকাসের প্রকল্পে উপনীত হয়েছিলেন। স্যার টমাস হীথ (Sir Thomas Health) আরিস্তারখস সম্পর্কে তাঁর বইয়ে পরবর্তী মতের পক্ষেই ঝুঁকেছেন, সেই বইয়ে অনুবাদসমেত মূল পাঠ আছে। সে যাই হোক, আরিস্তারখস যে কোপারনিকাসের দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে সাক্ষ্য নিঃসন্দেহে চূড়ান্ত।

প্রথম এবং সর্বোত্তম সাক্ষ্য আর্শিমিদেসের, আমরা আগেই দেখেছি তিনি ছিলেন আরিস্তারখসের কমবয়সী সমসাময়িক। সুরাকুজের রাজা গেলন, (Gelon)-কে লিখবার সময় তিনি বলছেন, আরিস্তারখস বিশেষ প্রকল্পসমেত একটি বই বার করেছেন এবং তারপর বলছেন, তাঁর প্রকল্পগুলো এমন যেখানে নিশ্চল নক্ষত্ররাজি ও সূর্য অচঞ্চল থাকে, পৃথিবী একটি বৃত্তের পরিধিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সূর্য থাকে কক্ষপথের মাঝখানে। পুতার্থের লেখায় এক জায়গায় বলা হয়েছে-ক্লিন্থেস ভেবেছিলেন গ্রিকদের কর্তব্য সামস-এর আরিস্তারখসকে, মহাবিশ্বের গৃহকে (অর্থাৎ পৃথিবী) গতিশীল করার পাপের জন্য অভিযুক্ত করা, এটা হলো মহাবিশ্বকে স্থির এবং পৃথিবীকে চক্রবৃত্তে ঘূর্ণায়মান ও একই সময়ে সে নিজ কক্ষে ঘূর্ণিত হচ্ছে- এই অনুমান করে পরিঘটনাকে রক্ষার প্রচেষ্টার ফল। ক্লিন্থেস আরিস্তারখসের সমসাময়িক ছিলেন, তাঁর মৃত্যু হয় ২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। অন্য একটি লেখায় প্লুতার্খ বলেন, আরিস্তারখস এই দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপন করেন শুধুমাত্র একটি প্রকল্পরূপে কিন্তু তার উত্তরাধিকারী সেলুকস (Seleucus) এই প্রকল্পকে একটি নির্দিষ্ট নিশ্চিত মতরূপেই মেনে নিয়েছিলেন। (সেলুকসের জীবনকাল ছিল ১৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি)। আয়েতিয়স (Aetius) এবং সেক্সতস এমপিরিকসও (Sextus Empiricus) বিশেষ জোরের সঙ্গে বলেছেন সূর্যকেন্দ্রিক প্রকল্প আরিস্তারখস প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু এটা যে শুধুমাত্র একটি প্রকল্পরূপেই উত্থাপিত হয়েছিল একথা তিনি বলেননি। তিনি এ কাজ করে থাকলেও দুহাজার বছর পরের গ্যালিলিও-র মতো ধর্মীয় কুসংস্কারকে আঘাত করার ভীতি তাঁকে প্রভাবিত করেছিল-এ চিন্তন অসম্ভব মনে হয় না। ক্লিন্থেসের মনোভাব (উপরে উল্লিখিত) দেখে মনে হয় এ ভীতির যথেষ্ট ভিত্তি ছিল।

পাকাপাকিভাবে কিংবা সাময়িকভাবে, যেভাবেই হোক না কেন, কোপারনিকাসের প্রকল্পটি আরিস্তারখস উত্থাপনের পর সেলুকস গ্রহণ করেছিলেন- এটা নিশ্চিত কিন্তু অন্য কোনো প্রাচীন জ্যোতির্বিদ এটা মেনে নেননি। সার্বিকভাবে এই প্রকল্প বাতিল হওয়ার প্রধান কারণ ছিলেন হিপারখস, তাঁর জীবনকাল ১৬১-১২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। তাঁর সম্পর্কে হীথ বলেছেন, তিনি ছিলেন প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে সুসংবদ্ধভাবে লেখেন, অয়ন চলনও (precession of the equinoxes) আবিষ্কার করেন, চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য গণনা করেন- তাতে ভুলের পরিমাণ ছিল এক সেকেন্ডের কম; চন্দ্র এবং সূর্যের আকার ও দূরত্বের আরিস্তারখসকৃত গণনাকে উন্নত করেছিলেন, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সমেত আটশ পঞ্চাশটি স্থির তারকার তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি আরিস্তারখসের সূর্যকেন্দ্রিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে এপিসাইকল তত্ত্ব (epicycle-যে বৃত্তের কেন্দ্র বৃহত্তের বৃত্তের পরিধির উপরে চলনশীল) গ্রহণ করেন এবং তার উন্নতিসাধন করেন। এই তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আপনিয়স (Apollonius), তাঁর জীবনকাল ছিল প্রায় ২২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। এই তত্ত্ব বিকশিত হয়ে শেষে জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমীর নামানুসারে টলেমীয় তন্ত্র বলে খ্যাত হয়েছিল। টলেমীর জীবনকাল খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ।

কোপারনিকাস বোধহয় প্রায়বিস্মৃত আরিস্তারখসের প্রকল্পের কিছুটা জানতে পেরেছিলেন তবে সেটা হয়তো খুব বেশি নয় এবং তিনি তার নবপ্রবর্তনের সপক্ষে প্রাচীন পণ্ডিতদের সমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন। এছাড়া পরবর্তী জ্যোতি বিজ্ঞানের উপর এই প্রকল্পের কার্যকর প্রভাব ছিল প্রায় শূন্য।

প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবী, চন্দ্র এবং সূর্যের মাপ ও চন্দ্র-সূর্যের দূরত্ব গণনা করার সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন সেটা তাত্ত্বিকভাবে সঠিক কিন্তু সূক্ষ্ম মাপনের যন্ত্রের অভাবে তাঁদের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই অসুবিধা সত্ত্বেও তাদের গণনাফল আশ্চর্যজনকভাবে উত্তম। এরাতস্থেনেস-(Eratosthenes) গণনা করেছিলেন-পৃথিবীর ব্যাস ৭,৮৫০ মাইল, এর সঙ্গে সত্যের পার্থক্য শুধুমাত্র পঞ্চাশ মাইলের কাছাকাছি। টলেমী অনুমান করেছিলেন চন্দ্রের গড় দূরত্ব পৃথিবীর ব্যাসের ২৯ গুণ- সঠিক সংখ্যা প্রায় ৩০.২। তাঁরা কেউই সূর্যের আকার এবং দূরত্বের কাছাকাছি যেতে পারেননি। সে ব্যাপারে তাদের অনুমাণ ছিল গণনায় ন্যূন। পৃথিবীর ব্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের অনুমাণ ছিলঃ

আরিস্তারখস, ১৮০
হিপারখস, ১,২৪৫
পসিনিয়স, ৬,৫৪৫

সঠিক সংখ্যা হলো ১১,৭২৬। দেখা যাবে এই অনুমানের উন্নতি হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে (অবশ্য দেখা যায় টলেমীর অনুমান পশ্চাৎগামী ছিল), পসিদনিয়স এর অনুমান ছিল সঠিক সংখ্যার অর্ধেক। মোটের উপর, সৌরতন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের মানসচিত্র সত্য থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না।

গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল জ্যামিতিক, গতিশীল নয়। প্রাচীনরা ভাবতেন মহাকাশের বস্তুপিণ্ডগুলোর গতি সমরূপ ও বৃত্তাকার, কিংবা বৃত্তাকার গতির যৌগিক দিয়ে তৈরি। তাঁদের বল সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। কতকগুলো গোলকের সম্পূর্ণটাই ছিল চলমান এবং সেগুলোর উপর মহাকাশের নানা বস্তুপিণ্ড দৃঢ়ভাবে সংলগ্ন ছিল। নিউটন এবং মহাকর্ষের সঙ্গে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত করা হলো, সেই দৃষ্টিভঙ্গির জ্যামিতিকত্ব ছিল অল্প। একটা জিনিস পর্যবেক্ষণ করলে অদ্ভুত মনে হয়ঃ আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদের ব্যাপক তত্ত্বের জ্যামিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাবর্তন, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলের কল্পন নিউটনীয় চিন্তন নির্বাসিত হয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সমস্যাটা এইঃ গাগনিক গোলকে মহাকাশের বস্তুপিণ্ড-গুলোর আপাতদৃষ্ট গতি মেনে নিয়ে প্রকল্পরূপে একটি তৃতীয় মাত্রাকে অর্থাৎ গভীরতাকে এমনভাবে উপস্থিত করা যাতে পরিঘটনার বিবরণ যতটা সম্ভব সহজ সরল হয়। কোপারনিকাসের প্রকল্পের গুণ তার সত্যতা নয়, গুণ তার সারল্য। গতির আপেক্ষিকতার প্রেক্ষিতে সত্যের কোনো প্রশ্ন এখানে জড়িত নয়। গ্রিকরা এমন একটি প্রকল্প সন্ধান করছিলেন যে প্রকল্প পরিঘটনাকে বাঁচিয়ে রাখবে, ইচ্ছাকৃত না হলেও তাঁরা কার্যক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানে সঠিক বৈজ্ঞানিক পন্থাই অনুসরণ করছিলেন। তাঁদের পূর্বসূরি কোপারনিকাস পর্যন্ত ও উত্তরসূরিদের সঙ্গে তুলনা করলে প্রত্যেক ছাত্রই তাঁদের আশ্চর্যজনক প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের দুই অতি বিরাট পুরুষ-আর্থিমিদেস ও আপল্লনিয়সকে দিয়ে প্রথম শ্রেণির গ্রিক গণিতবিদদের তালিকা পূর্ণ হয়। আর্থিমিদেস ছিলেন সুরাকুজে র রাজার বন্ধু এবং সম্ভবত সম্পর্কিত ভাই এবং খ্রিষ্টপূর্ব ২১২ সালে রোমকরা যখন তাঁদের নগর অধিকার করেন তখন তিনি নিহত হন। আপল্পনিয়স তরুণ বয়স থেকে আলেকজান্দ্রিয়াতে ছিলেন। আর্থিমিদেস শুধু মাত্র গণিতবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন পদার্থবিদ্যাবিদ ও ঔদস্থিতিবিদ্যাবিদ। আপল্লনিয়স প্রধানত বিখ্যাত ছিলেন তাঁর কৌণিক তল সম্পর্কিত গবেষণার জন্য। আমি এঁদের সম্পর্কে আর কিছু বলব না, কারণ, তাঁদের আবির্ভাবে এত দেরি হয়েছিল যে, দর্শনশাস্ত্রকে প্রভাবিত করা তখন আর সম্ভব নয়।

এই দুজনের পর আলেকজান্দ্রিয়াতে যদিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছিল তবুও মহান যুগের সমাপ্তি ঘটে। রোমের অধীন হওয়ার পর গ্রিকরা তাঁদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, সেই আত্মবিশ্বাস রাজনৈতিক স্বাধীনতার অঙ্গ এবং এই স্বাধীনতা হারানোর ফলে তারা পূর্বসূরিদের সম্পর্কে অটল শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে ওঠেন। যে রোমক সৈনিক আর্শিমিদেসকে হত্যা করেছিল সে মৌলিক চিন্তার মৃত্যুর প্রতীক, রোমকরা এই মৃত্যু ঘটিয়েছে সমগ্র হেলেনীয় জগতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *