২২. আরিস্ততেলেসের যুক্তিবিদ্যা

২২. আরিস্ততেলেসের যুক্তিবিদ্যা

আরিস্ততেলেসের বিরাট প্রভাব ছিল চিন্তাশীল ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে, আর যুক্তিবিদ্যায় তা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রাচীনকালের শেষ দিকটায় যখন প্লাতন ছিলেন অধিবিদ্যার সর্বোচ্চ শিখরে তখন আরিস্ততেলেস ছিলেন যুক্তিবিদ্যার স্বীকৃত প্রধান এবং সম্পূর্ণ মধ্যযুগ জুড়ে তিনি এই প্রাধান্য রক্ষা করেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে খ্রিষ্টান দার্শনিকরা তাঁকে অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রধান বলে মেনে নিয়েছেন- তবে তার আগে নয়। রেনেসাঁ-র পর এই প্রাধান্য প্রায় লুপ্ত হয় কিন্তু যুক্তিবিদ্যায় তাঁর প্রাধান্য যায়নি। এমনকি আজকের দিনেও দর্শনশাস্ত্রের সমস্ত ক্যাথলিক শিক্ষক এবং অন্য আর অনেক একগুয়ের মতো আধুনিক যুক্তিবিদ্যার আবিষ্কারগুলোকে অদ্ভুত জেদের সঙ্গে বর্জন করছেন এবং আশ্চর্য জেদের সঙ্গে এমন একটি তন্ত্রের সঙ্গে সেঁটে থাকেন সেটা টলেমী-র জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতোই নিশ্চিতভাবে সেকেলে। এর ফলে আরিস্ততেলেসের প্রতি ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারে অসুবিধা হয়। আজকের দিনে তাঁর প্রভাব স্বচ্ছ চিন্তনের এমনই বিরোধী যে, পূর্বগামীদের তুলনায় (প্লাতন ও তার অন্তর্ভুক্ত) তাঁর অগ্রগতি যে কী বিরাট কিংবা যুক্তিবিদ্যায় তাঁর কাজকর্ম আজও কতটা প্রশংসার যোগ্য মনে হতে পারত সেটা আমাদের স্মরণে রাখা কঠিন যদি কানাগলি এবং তার পরবর্তী দুই সহস্র বৎসরব্যাপী নিশ্চলতার কারণ না হয়ে অবিচ্ছিন্ন অগ্রগতির একটা স্তর বলে মনে করা হতো (আসল ব্যাপারটাও তাই ছিল) আরিস্ততেলেসের পূর্বগামীদের নিয়ে আলোচনার সময় পাঠকদের একথা স্মরণ করানোর দরকার নেই যে, তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে প্রভাবিত হবেন না, সেইজন্য তাদের সমস্ত মতবাদ মেনে না নিলেও তাঁদের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করা যেতে পারে। এর বিপরীতে আরিস্ততেলেস এখনও যুদ্ধক্ষেত্র বিশেষ করে যুক্তিবিদ্যায় এবং সেইজন্য বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক মানসিকতায় তার বিচার করা যায় না।

যুক্তিবিদ্যায় আরিস্ততেলেসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ন্যায় (syllogism) সম্পর্কে মতবাদ। ন্যায় তিন অংশযুক্ত একটি যুক্তি- একটি প্রধান আশ্রয়বাক্য (premiss) একটি অপ্রধান আশ্রয়বাক্য এবং একটি সিদ্ধান্ত। ন্যায় কয়েকরকমের হয়, প্রত্যেকেরই একটি করে নামকরণ করেছিলেন মধ্যযুগীয় পণ্ডিতরা (scholastics)। সর্বাধিক পরিচিত ন্যায়বাক্যটির নাম বারবারাঃ

সমস্ত মানুষ মরণশীল (প্রধান আশ্রয়বাক্য)

সক্রাতেস একজন মানুষ (অপ্রধান আশ্রয়বাক্য)

 সুতরাং : সক্রাতেস মরণশীল (সিদ্ধান্ত)।

 কিংবা : সমস্ত মানুষ মরণশীল।

সমস্ত গ্রিকরা মানুষ।

সুতরাং : সমস্ত গ্রিকরা মরণশীল।

(আরিস্ততেলেস এই দুটি আকারে কোনো পার্থক্য করেননি, পরে আমরা দেখব এটা একটা ভ্রম)

অন্য আকারগুলো হলোঃ কোনো মাছই যুক্তিবাদী নয়, সমস্ত হাঙরই মাছ, সুতরাং কোনো হাঙরই যুক্তিবাদী নয়) (এর নাম সেলারেন্ট)।

সমস্ত মানুষই যুক্তিবাদী, কোনো কোনো পশু মানুষ, সুতরাং কোনও কোনো পশু যুক্তিবাদী। (এর নাম ডেরিয়াই)।

কোনো গ্রিকই কালো নয়, কিছু কিছু মানুষ গ্রিক, সুতরাং কিছু কিছু মানুষ কালো নয়। (এর নাম ফেরিও)।

এই চারটি দিয়ে নির্মিত প্রথম নক্সা আরিস্ততেলেস দ্বিতীয় ও তৃতীয় নক্সা যোগ করেছেন এবং তার গোষ্ঠীর লোকেরা তৈরি করেছে একটি চতুর্থ নক্সা। দেখানো হয়েছে। পরবর্তী তিনটি নক্সাকে নানা কৌশলে প্রথম নক্সায় পরিণত করা যায়।

একক একটি আশ্রয়বাক্য থেকে কতকগুলো অনুমিতি করা যায়। কিছু কিছু মানুষ মরণশীল, এ থেকে অনুমিতি হতে পারে কিছু মরণশীলরা মানুষ। আরিস্ততেলেসের মতে সমস্ত মানুষই মরণশীল, এ থেকেও এই অনুমিতি সম্ভব। কোনো দেবতাই মরণশীল নন, এ থেকে আমাদে অনুমান হতে পারে কোনো মরণশীলই দেবতা নয় কিন্তু কিছু কিছু মানুষ গ্রিক নয় থেকে কিছু গ্রিকরা মানুষ নয় এই অনুমিতি সম্ভব নয়।

উপরোক্ত এরকম অনুমিতি ছাড়া আরিস্ততেলেস এবং তার অনুগামীরা ভেবেছিলেন সমস্ত অবরোহী অনুমিতিগুলো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করলে ন্যায়ানুসারী হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত বৈধ ন্যায়কে প্রকাশ করলে কিংবা অভিভাবিত সমস্ত যুক্তি ন্যায়ের আকারে সাজালে সমস্ত হেত্বাভাস (fallacy)-কে এড়ানো যায়।

এই তন্ত্র প্রথাগত যুক্তিবিদ্যার শুরু এবং সেইজন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসংসনীয় ছিল। কিন্তু প্রথাগত যুক্তিবিদ্যার শুরু না ভেবে একেই তার শেষ কথা ভাবলে ব্যাপারটার তিনরকম সমালোচনা হতে পারে?

১) তন্ত্রের ভিতর আকারগত ত্রুটি।

২) অবরোহী যুক্তির অন্য আকারের তুলনায় ন্যায়বাক্যকে অত্যধিক মূল্য দেওয়া।

৩) যুক্তির একটা পদ্ধতি হিসেবে অবরোহী পদ্ধতিকে অত্যধিক মূল্য দেওয়া। এই তিনটির প্রতিটি সম্পর্কে অবশ্যই কিছু বলার আছে।

১) আকারগত ত্রুটি। সক্রাতেস একজন মানুষ এবং সমস্ত গ্রিকরাই মানুষ এই দুটি বিবৃতি দিয়ে শুরু করা যাক। দুটি বিবৃতির ভিতরে সুস্পষ্ট পার্থক্য করা প্রয়োজন, আরিস্ততেলেসীয় যুক্তিবিদ্যায় সেটা করা হয়নি। সমস্ত গ্রিকরা মানুষ এই বিবৃতির ব্যাখ্যার সাধারণত এ নিহিতার্থ যে, গ্রিকদের অস্তিত্ব আছে- এই নিহিতার্থ ছাড়া আরিস্ততেলেসের কতকগুলো ন্যায় বৈধ নয়। উদাহরণঃ

সমস্ত গ্রিকরা মানুষ, সমস্ত গ্রিকরা শ্বেতকায় সুতরাং কিছু কিছু মানুষ শ্বেতকায়। যদি গ্রিকদের অস্তিত্ব থাকে তাহলে এই বিবৃতি বৈধ কিন্তু তা না হলে নয়। আমি যদি বলতাম।

সমস্ত সোনার পাহাড়ই পাহাড়, সমস্ত সোনার পাহাড়ই সোনার, সুতরাং কিছু পাহাড় সোনার, তাহলে আমার সিদ্ধান্ত ভুল হবে যদিও কোনো কোনো অর্থে আমার আশ্রয়বাক্যগুলো সত্য। আমাকে যদি স্পষ্টভাবে বলতে হয় তাহলে সমস্ত গ্রিকই মানুষ এই বিবৃতিকে দুভাগ করতে হবে। একটা বলবে গ্রিকদের অস্তিত্ব আছে, অন্যটি বলবে কিছুকে যদি গ্রিক বলা হয় তাহলে সেটা মানুষ। পরবর্তী বিবৃতিটি একেবারেই আনুমানিক এবং গ্রিকরা যে আছেন, প্রকল্পটির ভিতরে সে অর্থ নিহিত নেই।

সেইজন্য সমস্ত গ্রিকরা মানুষ এই বিবৃতিটি সক্রাতে একজন মানুষ এই বিবৃতির চাইতে আকারে অনেক জটিল। সক্রাতেস একজন মানুষ এই বিবৃতির কর্তা সক্রাতেস কিন্তু সমস্ত গ্রিকরা মানুষ এই বিবৃতিতে কর্তা হিসেরে সমস্ত গ্রিকরা কথাটির অবস্থান নেই, কারণ, গ্রিকরা আছে কিংবা যদি গ্রিক বলে কিছু থাকে এই দুটি বিবৃতিতে সমস্ত গ্রিকরা সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই।

এই বিশুদ্ধ আকারগত ত্রুটি ছিল অধিবিদ্যা এবং জ্ঞানতত্ত্বের ভুলগুলোর একটা উৎস। সক্রাতেস মরণশীল এবং সমস্ত মানুষ মরণশীল এই দুটি প্রস্তাবে আমাদের জ্ঞানের অবস্থা বিচার করুন। সক্রাতেস মরণশীল এই বিবৃতির সত্যতা নির্ণয়ের জন্য আমাদের অধিকাংশই সাক্ষ্যতে সন্তুষ্ট হন কিন্তু সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে আমাদের এমন লোকের কাছে যেতে হবে যিনি সাতেসকে জানতেন এবং তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখেছেন। একটি ইন্দ্রিয়ানুভূত তথ্য- সাতেসের মৃতদেহ তার সঙ্গে এই জ্ঞান যে, এর নাম ছিল সক্রাতেস সক্রাতেস মরণশীল এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু যখন আলোচ্য বিষয় হয় সমস্ত মানুষ মরণশীল তখন ব্যাপারটা অন্যরকম। এইরকম সাধারণ প্রস্তাব সাপেক্ষ আমাদের জ্ঞানের প্রস্তাব অত্যন্ত কঠিন। কখন কখনো সেগুলো শুধুমাত্র বাচনিক ও সমস্ত গ্রিকরা মানুষ এ তথ্য জানা, কারণ, মানুষ না হলে কাউকে গ্রিক বলা হয় না। এরকম সাধারণ বিবৃতিগুলোর অর্থ অভিধান থেকে জানা যায় শব্দ ব্যবহারের রীতি ছাড়া অভিধান আমাদের পৃথিবী সম্বন্ধে আর কিছুই বলে না। কিন্তু সমস্ত মানুষ মরণশীল সেরকম নয়, অমর মানুষ বিষয়ে যৌক্তিকভাবে স্ববিরোধী কিছু নেই। আমরা এ প্রস্তাব বিশ্বাস করি আরোহী পদ্ধতির ভিত্তিতে, কারণ, কোনো মানুষ (ধরুন) ১৫০ বছরের বেশি বেঁচেছে এরকম সুপ্রমাণিত কোনো তথ্য নেই। কিন্তু এর ফল প্রস্তাবটিকে শুধুমাত্র সম্ভাব্য করে তোলে, সুনিশ্চিত করে না। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত মানুষের অস্তিত্ব আছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রস্তাব নিশ্চিত হতে পারে না।

যে অর্থে সক্রোতেস-সক্রাতেস মরণশীল এই বাক্যের কর্তা, সেই অর্থে সমস্ত মানুষই মরণশীল এই বাক্যের কর্তা সমস্ত মানুষ এই অনুমান করার জন্য অধিবিদ্যক ভুল হয়েছিল। এর ফলে সক্রাতেস যেমন একটি সত্তা চিহ্নিত করে, সমস্ত মানুষও তেমনি একটি সত্তা চিহ্নিত করে- এরকম একটি মত সমর্থন করা সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে আরিস্ততেলেস বলেছিলেন একটি প্রজাতি কোনো অর্থে বস্তু। তিনি সতর্কভাবে এই বিবৃতি বিশেষিত করেছিলেন কিন্তু তাঁর অনুগামীরা, বিশেষ করে পর্চুরিরা (Porphyry) অনেক কম সাবধানী ছিলেন।

এই ভুলের ফলে আরিস্ততেলেস আর একটি ভুল করেছিলেন, তিনি ভুলভাবে ভেবেছিলেন বিধেয়-র বিধেয় মূল কর্তার বিধেয়। আমি যদি বলি সক্রাতেস গ্রিক, সমস্ত গ্রিকরা মানুষ তাহলে আরিস্ততেলেস ভাবেন মানুষ শব্দটি গ্রিক শব্দের বিধেয়, গ্রিক শব্দটি সক্রাতেস শব্দের বিধেয় এবং স্পষ্টতই মানুষ শব্দটি সক্রাতেস শব্দের বিধেয়। কিন্তু আসলে মানুষ শব্দটি গ্রিক শব্দের বিধেয় নয়। এভাবে নাম এবং বিধেয়-র পার্থক্য কিংবা অধিবিদ্যক ভাষায় বিশেষ এবং সামান্য-র পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে যায়, দর্শনশাস্ত্রে এর ফল হয় সর্বনাশা। এর ফলে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তার একটি হলো, যে শ্রেণির সভ্য মাত্র এক সেই একক সভ্য এবং সম্পূর্ণ শ্রেণিটিকে অভিন্ন অনুমান করা। এর ফলে একক সংখ্যা সাপেক্ষ কোনো সঠিক তত্ত্ব গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং ফল হয় একত্ব সম্বন্ধে অশেষ মন্দ অধিবিদ্যার সৃষ্টি।

২) ন্যায়ের অতিমূল্যায়ন। ন্যায় অবরোহী যুক্তির একটি ধরন মাত্র। গণিত সম্পূর্ণ অবরোহী কিন্তু তাতে ন্যায় প্রায় নেই বললেই চলে। অবশ্য গাণিতিক যুক্তিকে ন্যায়বাক্যের আকারে পুনর্লিখন সম্ভব কিন্তু সেটা হবে অত্যন্ত কৃত্রিম এবং তার ফলে সেটা অধিক অকাট্য হবে না। পাটিগণিতের উদাহরণ বিচার করা যাক। আমি যদি ১৬ শিলিং ৩ পেন্স-এর জিনিস কিনি এবং দাম দেওয়ার জন্য এক পাউন্ড নোট দিই তাহলে কত খুচরো আমার পাওনা? এই সরল অঙ্ককে একটি ন্যায়রূপ দেওয়া হবে একেবারেই অবাস্তব এবং তার প্রবণতা থাকবে যুক্তিগুলোর সঠিক চরিত্র ঢেকে রাখবার। তাছাড়া, যুক্তিবিদ্যায়ও ন্যায়বাক্য বহির্ভূত অনুমিতি আছে, যেমনঃ ঘোড়া একটি পশু সুতরাং ঘোড়ার মাথা একটি পশুর মাথা। আসলে বৈধ ন্যায়গুলো শুধুমাত্র বৈধ অবরোহী যুক্তিগুলোর একটি অংশ এবং তাদের অন্যগুলোর উপর কোনো যৌক্তিক প্রাধান্য নেই। অবরোহী প্রথাতে ন্যায়কে প্রাধান্য দানের প্রচেষ্টা গাণিতিক যুক্তির স্বভাব সম্পর্কে দার্শনিকদের পথভ্রষ্ট করেছে। কান্ট বুঝতে পেরেছিলেন গণিতশাস্ত্র ন্যায়বাক্য নির্ভর নয়, সেইজন্য তার অনুমান ছিল গণিতশাস্ত্র যুক্তিবিদ্যা বহির্ভূত নীতি ব্যবহার করে। তবে তিনি অনুমান করেছিলেন এ নীতি যুক্তিবিদ্যার মতোই নিশ্চিত। ভিন্ন পথে হলেও, তাঁর পূর্বগামীদের মতো তিনি আরিস্ততেলেসের প্রতি শ্রদ্ধার দরুন পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন।

৩) অবরোহী পদ্ধতির অতিমূল্যায়ন। গ্রিকরা সাধারণত জ্ঞানের উৎস হিসেবে অবরোহী পদ্ধতিকে আধুনিক দার্শনিকদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ বিষয়ে আরিস্ততেলেসের দোষ প্লাতনের চাইতে অল্প ছিল। তিনি বারবার আরোহী পদ্ধতির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন এবং এই প্রশ্নে প্রচুর মনোযোগ দিয়েছেন : যা থেকে অবরোহণ শুরু করা আবশ্যিক সেই প্রথম আশ্রয়বাক্য কী করে জানা যাবে? সে যাই হোক, অন্য গ্রিকদের মতো তার জ্ঞানতত্ত্বে তিনি অবরোহী পদ্ধতিকে অনুচিত গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা মেনে নিই মিঃ স্মিথ (ধরা যাক) মরণশীল, এবং আমরা হয়তো হাল্কাভাবে বলতে পারি, কারণ, আমরা জানি সমস্ত মানুষ মরণশীল, আমরা বরং যা জানি সেটা অনেকটা এরকম দেড়শ বছরেরও আগে যারা জন্মেছে তারা মরণশীল এবং একশ বছরেরও আগে যারা জন্মেছে তাদের প্রায় সবাই মরণশীল। মিঃ স্মিথ মারা যাবেন- আমাদের এই চিন্তনের কারণ তাই। কিন্তু এই যুক্তি আরোহী- অবরোহী নয়। এর অকাট্যতা একটি অবরোহী যুক্তির তুলনায় স্বল্প এবং এটি সম্ভাব্যতার জনক, নিশ্চিয়তার নয় কিন্তু অপরপক্ষে এটা আমাদের নতুন জ্ঞান দান করে সেটা অবরোহী পদ্ধতি করে না। যুক্তিবিদ্যা এবং শুদ্ধ গণিত ছাড়া সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুমিতি আরোহী, অবরোহী নয়। একমাত্র ব্যতিক্রম আইন এবং ধর্মতত্ত্ব- এগুলোর প্রত্যেকটিই প্রথম নীতি আহরণ করে একটি প্রশ্নাতীত গ্রন্থের মূল পাঠ থেকে অর্থাৎ একটি সংবিধি থেকে কিংবা ধর্মশাস্ত্র থেকে।

দি প্রায়র অ্যানালিটিকস (The Prior Analytics- পূর্ববর্তী বিশ্লেষণ) এর আলোচনা ন্যায় নিয়ে, এছাড়া যুক্তিবিদ্যা নিয়ে আরিস্ততেলেসের অন্য বই আছে দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে সেগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর ভিতর একটি ছোট পুস্তিকা আছে, বিষয়বস্তু দি ক্যাটেগরিজ (The Categories- নিরুপাধিক জ্ঞান)। নবপ্নাতনবাদী (নিওপ্লাতনিস্ট- Neoplatonist) পফুরি এর উপর একটি টীকা লিখেছেন, মধ্যযুগীয় দর্শনের উপর সেই টীকার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। কিন্তু আপাতত পফুরিকে অগ্রাহ্য করে আরিস্ততেলেসের মধ্যে সংহত হওয়া যাক।

ক্যাটেগরি (category) বলতে আরিস্ততেলেস কিংবা কান্ট এবং হেগেল সঠিক কী বোঝাতে চাইতেন, স্বীকার করতেই হবে সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। আমি নিজে বিশ্বাস করি না- দর্শনশাস্ত্রে (কোনো স্বচ্ছ ধারণার প্রতিনিধি হিসেবে) ক্যাটেগরি শব্দ কোনোরকম প্রয়োজন সাধন করে। আরিস্ততেলেসে দশটি ক্যাটেগরি আছে; বস্তু, পরিমাণ, গুণ, সম্বন্ধ, স্থান, কাল, অবস্থান, স্থিতি, দশা, ক্রিয়া এবং আবেগ। ক্যাটেগরি শব্দের যে একমাত্র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেটা হলো : অভিব্যক্তি যা কোনোক্রমেই যৌগিক কিছু বোঝায় না- এবং এরপর রয়েছে উপরিল্লিখিত তালিকা। মনে হয়, যে শব্দগুলোর অর্থ অন্য কতগুলো শব্দের অর্থ জুড়ে করা যায় না, তার প্রতিটি শব্দই একটি বস্তু অথবা একটি পরিমাণ কিংবা ইত্যাদি কিছু নির্দেশ করে। যে নীতি অনুসারে এই শব্দটি ক্যাটেগরি তালিকা করা হয়েছে তার কোনো ইঙ্গিত নেই।

বস্তু মূলত সেটাই যেটা কর্তার বিধেয় হতে পারে না, কর্তায় উপস্থিত থাকতে পারে না। একটি জিনিস একটি কর্তায় উপস্থিত তখনই বলা যায় যখন কর্তার অংশ না হয়েও কর্তাবিহীন তার অস্তিত্ব অসম্ভব। প্রদর্শিত দৃষ্টান্তগুলো এরকম একখণ্ড ব্যাকরণের জ্ঞান যা একটি মনের ভিতর উপস্থিত থাকে এবং বিশেষ একটি শুভ্রতা যেটা একটি বস্তুপিণ্ডে উপস্থিত থাকতে পারে। উপরিল্লিখিত প্রাথমিক অর্থে একটি বস্তু একক একটি জিনিস কিংবা ব্যক্তি কিংবা পশু। কিন্তু একটি দ্বিতীয় অর্থে প্রজাতি কিংবা বর্গ-অর্থাৎ মানুষ কিংবা পশুকে বস্তু বলা যায়। এই দ্বিতীয় অর্থকে যুক্তিহীন মনে হয় এবং তা পরবর্তী লেখকদের কাছে বহু মন্দ অধিবিদ্যার দ্বারোদঘাটন করেছে।

দি পস্টিরিয়র অ্যানালিটিকস (The Posterior Analytics-পরবর্তী বিশ্লেষণ) বইটি প্রধানত একটি প্রশ্ন নিয়ে, সে প্রশ্ন অবশ্যই যে কোনো অবরোহী তত্ত্বের অসুবিধা সৃষ্টি করবে, প্রশ্নটি হলো : প্রথম আশ্রয়বাক্যগুলো কী করে পাওয়া যায়? যেহেতু অবরোহী পদ্ধতিকে অবশ্যই কোনো একটি স্থান থেকে শুরু করতে হবে, সুতরাং আমাদের অবশ্যই অপ্রমাণিত কিছু দিয়ে শুরু করতে হবে, সেটা অবশ্যই জানা থাকবে প্রকট প্রমাণ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে। আরিস্ততেলেসের তত্ত্ব আমি বিস্তৃতভাবে দেব না, কারণ, সেটা নির্ভর করে সার সম্পর্কীয় মনোভাবের উপর। তিনি বলেন, সংজ্ঞা হলো এমন যা একটি বস্তুর সারধর্ম সম্পর্কীয় বিবৃতি। আরিস্ততেলেসের পর থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সমস্ত দর্শনশাস্ত্রেরই ঘনিষ্ঠ অংশ সার সম্পর্কীয় ধারণা। আমার মতে এটা একটা হতাশ তালগোল পাকানো মনোভাব : কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য আমাদের এই বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন।

মনে হয় একটি জিনিসের সার বলতে বোঝানো হতো সেই ধর্মগুলো- নিজের আত্মপরিচয় না হারিয়ে যার পরিবর্তন করা অসম্ভব। সক্রাতেস কখনো সুখী, কখনো বিষণ্ণ, কখনো সুস্থ, কখনো অসুস্থ হতে পারেন। যেহেতু তিনি সাতেস হয়েই এই ধর্মগুলো পবির্তন করতে পারেন সেইজন্য এগুলো তার সারধর্মের কোনো অংশ নয়। কিন্তু এটা ধরে নেওয়া হয় যে, সক্রাতেসের সার হলো- তিনি একজন মানুষ, যদিও দেহান্তরে বিশ্বাসী একজন পুথাগোরীয় এ কথা মানবেন না। বস্তু, সার সম্পর্কীয় প্রশ্ন শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি প্রশ্ন। আমরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন। ঘটনা সম্পর্কে একই নাম ব্যবহার করি। আমরা ভাবি সেটি একক একটি জিনিস অথবা ব্যক্তির প্রকাশ। আসলে কিন্তু এটা শুধু একটি বাক্য ব্যবহারের সুবিধা মাত্র। সক্রাতেসের সার এমন কতগুলো ধর্ম যার অবর্তমানে আমাদের সক্রাতেস নামটি ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রশ্নটি শুদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক ও একটি শব্দের সার থাকতে পারে কিন্তু একটি জিনিসের সার থাকতে পারে না।

সারের কল্পনের মতো বস্তুর কল্পন আসলে শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিক সুবিধাকে অধিবিদ্যায় প্রক্ষেপ করা। জগতের বিবরণ দেওয়ার সময় কতকগুলো ঘটনাকে সক্রাতেস-এর জীবনের ঘটনা বলা এবং কিছু ঘটনাকে মি. স্মিথ-এর জীবনের ঘটনা। বলা আমাদের সুবিধাজনক মনে করি। এর ফলে আমরা ভাবি সক্রাতেস কিংবা মি. স্মিথ এমন একটা কিছু যা টানা কয়েক বছর ধরে থাকে এবং কোনো না কোনোভাবে তার জীবনের ঘটনাগুলোর চাইতে ব্যক্তিটি বেশি নিরেট এবং বাস্তব। সাতেস যদি অসুস্থ হন তাহলে আমরা ভাবি অন্য সময় সক্রাতেস সুস্থ থাকেন, সুতরাং সাতেসের সত্তা তার অসুস্থতা নিরপেক্ষ। পক্ষান্তরে, অসুস্থতার অস্তিত্বের জন্য অসুস্থ হওয়ার মতো একজন মানুষ প্রয়োজন। কিন্তু যদিও সক্ৰাতেসের অসুস্থ হওয়ার দরকার নেই তবু তাঁর অস্তিত্ব মেনে নিতে হলে তাঁর জীবনে কিছু না কিছু ঘটতে হবে। সুতরাং তার জীবনে যা। ঘটছে বাস্তবে তিনি তার চাইতে বেশি সত্য নন।

বস্তুকে গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করলে দেখা যায় এ কল্পনের সঙ্গে জড়িত অসুবিধা দূর করা অসম্ভব। অনুমান করা হয় বস্তু তার ধর্মের আধার এবং তার সমস্ত ধর্মের চাইতে পৃথক। কিন্তু আমরা সমস্ত ধর্ম হরণ করে যদি শুধুমাত্র বস্তুর সত্তা কল্পনা করতে চেষ্টা করি তাহলে দেখব কিছুই অবশিষ্ট নেই। ব্যাপারটা অন্যভাবে বলা যায় : একটি বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর পার্থক্য কি করে নির্ণীত হয়? ধর্মের পার্থক্য নয়, কারণ বস্তুবিষয়ক যুক্তি অনুসারে ধর্মগুলোর পার্থক্য পূর্বাহ্নেই সংশ্লিষ্ট বস্তুগুলোর ভিতরে সংখ্যার বৈচিত্র্য অনুমান করে নেয়। সুতরাং দুটি বস্তুর শুধুমাত্র দুটি হতে হবে, তাদের ভিতর স্বকীয়ভাবে অন্য কোনো পার্থক্য থাকবে না। তাহলে তারা যে দুটি সেটা আমরা কি বুঝব?

বস্তু আসলে শুধুমাত্র ঘটনাগুচ্ছ সংগ্রহ করার একটি সুবিধাজনক পন্থা। মি. স্মিথ সম্পর্কে আমরা কি জানতে পারি? তাঁর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কতকগুলো রঙের নক্সা। তাঁর কথা শোনার সময় শুনতে পাই একটি শব্দমালিকা। আমরা বিশ্বাস করি আমাদেরই মতো তাঁর চিন্তা ও অনুভূতি আছে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনা বাদ দিলে পৃথক ভাবে মি. স্মিথ কী? একটি কাল্পনিক আংটা মাত্র, যা দিয়ে ঘটনাগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। আসলে তাদের আংটার কোনো প্রয়োজন নেই, ঠিক যেমন পৃথিবীরও পা রাখবার জন্য কোনো হাতির দরকার নেই। যে কোনো লোকই বুঝতে পারে তুলনীয় ভৌগোলিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে ফ্রান্স (ধরে নেওয়া যাক) শব্দ একটি ভাষাতাত্ত্বিক সুবিধা মাত্র এবং তার বিভিন্ন অংশ বাদ দিলে ফ্রান্স বলে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব থাকে না। মি. স্মিথ-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য অর্থাৎ মি. স্মিথ কতকগুলো ঘটনার সংযুক্ত নাম মাত্র। এর চাইতে বেশি কিছু অর্থ যদি এর উপর আরোপ করি তাহলে সেটা এমন জিনিস যা সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়, সুতরাং আমরা যা জানি সেটা প্রকাশ করার জন্য তার কোনো প্রয়োজন নেই।

এক কথায় বস্তু শব্দটি অধিবিদ্যক ভুল, যার কারণ বিষয় (predicate) এবং বিষয়ী (subject) দিয়ে গঠিত একটি বাক্যের গঠন বিশ্ব গঠনে প্রক্ষেপ করা।

আমার সিদ্ধান্ত- এই অধ্যায়ের আলোচিত আরিস্ততেলেসীয় মতবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ব্যতিক্রম শুধুমাত্র ন্যায়ের তাত্ত্বিক গঠনে, সেটাও গুরুত্বহীন। আধুনিক যুগে যুক্তিবিদ্যা শিখবার জন্য কেউ আরিস্ততেলেস কিংবা তাঁর কোনো ছাত্রের লেখা পড়লে শুধুমাত্র সময়ই নষ্ট হবে। তবুও আরিস্ততেলেসের যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক লেখায় তাঁর বিরাট ক্ষমতা বোঝা যায় এবং যে যুগে বৌদ্ধিক মৌলিকত্ব জীবন্ত ছিল সে যুগে এটা প্রকাশিত হলে মনুষ্যজাতির কাজে লাগত। দুর্ভাগ্যক্রমে এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল গ্রীক চিন্তনের সৃজনশীল যুগের অন্তিমে, সুতরাং সেগুলোকে প্রামাণিক বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল। যুক্তিবিদ্যায় মৌলিকত্ব যখন পুনর্জীবিত হলো তখন আরিস্ততেলেসের দুহাজার বছরের রাজত্বকে সিংহাসনচ্যুত করা ছিল অন্তত কঠিন। সমগ্র আধুনিক যুগ জুড়ে বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা কিংবা দর্শনশাস্ত্রের প্রতিটি অগ্রগতিকেই আরিস্ততেলেসের শিষ্যদের কঠিন বিরোধিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে অগ্রসর হতে হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *