২১. রাজনীতি সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের চিন্তধারা

২১. রাজনীতি সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের চিন্তধারা

 রাজনীতি সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের চিন্তা-ধারা একাধারে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। আকর্ষণীয়, কারণ, সমকালীন শিক্ষিত গ্রিকদের সংস্কার এতে বোঝা যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এটা এমন অনেক নীতিরই মূল উৎস যেগুলোর প্রভাব ছিল মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত। মনে হয় না আধুনিক যুগে কোনো রাজনৈতিক নেতার ব্যবহারিক কাজে লাগে এরকম বিশেষ কিছু এর ভিতরে আছে কিন্তু আছে গ্রিক জগতের বিভিন্ন অংশের দলীয় দ্বন্দ্বের উপর আলোকপাত করার মতো অনেক কিছুই। অ-গ্রিক রাষ্ট্রগুলোর শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি সচেতনতা নেই। এটা সত্য যে, মিশর, ব্যাবিলন, পারস্য এবং কার্থেজ সম্পর্কে অনেক পরোক্ষ উল্লেখ আছে কিন্তু কার্থেজ ছাড়া অন্য উল্লেখগুলো করা হয়েছে ভাসাভাসাভাবে। আলেকজান্দ্রস সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই এবং এমনকি পৃথিবীতে তিনি যে একটা আমূল পরিবর্তন আনছিলেন সে সম্পর্কে সামান্যতম অবগতিও নেই। সম্পূর্ণ আলোচনাই নগররাষ্ট্র নিয়ে এবং সে রাষ্ট্রগুলো যে অপ্রচলিত হয়ে যাবে সে সম্পর্কে কোনো পূর্বদৃষ্টিও নেই। বহু স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার দরুন গ্রিস ছিল একটি রাজনৈতিক পরীক্ষাগার কিন্তু আরিস্ততেলেসের সময় থেকে মধ্যযুগে ইতালীয় নগরগুলো উত্থান পর্যন্ত এই পরীক্ষাগুলোর কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। অনেক দিক থেকে যে অভিজ্ঞতাগুলোর কাছে আরিস্ততেলেসের আবেদন, সেগুলো অপেক্ষাকৃত আধুনিক জগতের পক্ষে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, বরং বইটি লেখার পর পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত কোনো প্রচলিত রাষ্ট্রের পক্ষে এদের তেমন প্রাসঙ্গিকতা ছিল না।

বইটিতে অনেক সরস প্রাসঙ্গিক মন্তব্য আছে, রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে সেগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। বলা হয়েছে, মাকেদন এর রাজা আর্ভেলস (Archelaus)-এর সভাসদ থাকার সময় দেকামনিখস (Decamnichus) অভিযোগ করেছিলেন- এউরিপিদেস এর মুখে দুর্গন্ধ। এউরিপিদেসকে শান্ত করার জন্য রাজা দেকামনিখসকে শাস্তি দেওয়ার (চাবুক মারার) অনুমতি দিয়েছিলেন, এউরিপিদেস সে কাজ করেছিলেন। বহু বছর অপেক্ষা করার পর দেকামনিখস রাজাকে হত্যার একটা সফল ষড়যন্ত্রের অংশীদার হন কিন্তু ততদিনে এউরিপেদেস এর মৃত্যু হয়েছে। বলা হয়েছে, গর্ভাধান করা উচিত শীতকালে, যখন উত্তুরে হাওয়া থাকে। অশ্লীলতা সযত্নে পরিহার করা উচিত, কারণ, লজ্জাজনক কথা থেকে লজ্জাজনক কর্ম সৃষ্টি হয় এবং একমাত্র মন্দিরে ছাড়া কোথাও অশ্লীলতা সহ্য করা উচিত নয় কারণ, সেখানে এমনকি অশ্লীলতায়ও আইনের সম্মতি আছে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে করা উচিত নয়, কারণ তা করলে সন্তানরা দুর্বল হবে ও কন্যাসন্তানই জন্মাবে, স্ত্রীরা উদ্ধৃঙ্খল ও অসচ্চরিত্রা হবে আর স্বামীদের দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হবে। বিয়ের উপযুক্ত বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে সাঁইত্রিশ, মেয়েদের ক্ষেত্রে আঠারো।

আমরা জানি থালনকে তাঁর দারিদ্র্য নিয়ে বিদ্রূপ করা হতো বলে তিনি সমস্ত জলপাই পেষাই যন্ত্র কিস্তিতে কিনে নিয়েছিলেন, তারপর সেগুলো ব্যবহারের জন্য একচেটিয়া দর হাঁকতে পেরেছিলেন। তাঁর এ কাজ করার কারণ ছিল লোককে দেখানো যে, দার্শনিকরাও টাকা করতে পারেন এবং তারা যদি দরিদ্র থেকে থাকেন, তার কারণ, তাঁদের সম্পদের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবার আছে। এগুলো কিন্তু প্রাসঙ্গিক কথা, এবার আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক।

বইটি শুরু হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে; এটা উচ্চতম ধরনের গোষ্ঠী এবং এর উদ্দেশ্য সর্বাধিক মঙ্গলসাধন। কালানুক্রমে প্রথম আসে পরিবার, এর সৃষ্টি স্ত্রী এবং পুরুষের, প্রভু এবং দাসের দুটি মূলগত সম্পর্কের উপর- এই দুটি সম্পর্কই স্বাভাবিক। কয়েকটি পরিবার একত্রিত হলে তৈরি হয় একটি গ্রাম কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি রাষ্ট্র, অবশ্য এই সংযুক্তি যদি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মতো বড় হয় তবে। পরিবার যদিও কালানুসারে রাষ্ট্রের পূর্ববর্তী তবুও রাষ্ট্রই প্রাকৃতিকভাবে পুরোবর্তী এবং এমনকি ব্যক্তির চাইতেও। কারণ, প্রতিটি জিনিসই সম্পূর্ণ বিকাশের পর যা হয় তাকেই আমরা বলি তার প্রকৃতি এবং সম্পূর্ণ বিকশিত মানবসমাজই রাষ্ট্র আর সমগ্রটা অংশের পুরোবর্তী। এখানে যে ধারণা জড়িত সেটা দেহীর : বলা হয়েছে দেহ ধ্বংস হলে হাতটা আর হাত থাকে না। এর নিহিতার্থ-হাতের সংজ্ঞা তার উদ্দেশ্য নিয়ে নির্দিষ্ট- যেমন হাতের কাজ মুষ্টিতে ধারণ করা- একাজ সে করতে পারে একমাত্র একটা জীবন্ত দেহের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায়। তেমনই রাষ্ট্রের অংশ না হলে এক ব্যক্তি তার উদ্দেশ্যসাধন করতে পারে না। আরিস্ততেলেস বলেছেন, রাষ্ট্র যিনি স্থাপন করেছেন তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ উপকারী, কারণ, আইন ব্যতীত মানুষ নিকৃষ্টতম পশু এবং আইন তার অস্তিত্বের জন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র শুধুমাত্র বিনিময়ের জন্য এবং অপরাধ নিবারণের জন্য একটি সঙ্ নয় রাষ্ট্রের চরম উদ্দেশ্য উত্তম জীবন ….। এবং রাষ্ট্র, পরিবার ও গ্রামের সঙ্ঘ উদ্দেশ্য নিখুঁত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন, আমাদের কাছে তার অর্থ সুখী এবং সম্মানিত জীবন (১২৮০৮)। একটি রাজনৈতিক সমাজের অস্তিত্ব মহান কর্মের জন্য, শুধুমাত্র সাহচর্যের জন্য নয় (১২৮১a)।

রাষ্ট্র গঠিত হয় গৃহস্থালি নিয়ে, প্রতিটি গৃহে একটি পরিবার থাকে, সুতরাং রাজনীতির আলোচনা শুরু করা উচিত পরিবার নিয়ে। এই আলোচনা বিরাট অংশ দাসপ্রথা নিয়ে আলোচনা, কারণ, প্রাচীনকালে সর্বদা ক্রীতদাসদের পরিবারের অংশ বলে ধরা হতো। দাসপ্রথা সুবিধাজনক এবং সঠিক কিন্তু দাসের হওয়া উচিত স্বাভাবিকভাবে প্রভুর চাইতে নিম্নমানের। কিছু লোক জন্ম থেকে পরাধীন হওয়ার জন্যই চিহ্নিত, অন্যারা শাসক হওয়ার জন্য। যে লোক স্বভাবতই নিজের নয় কিন্তু অপরের দাস হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। ক্রীতদাসদের গ্রিক হওয়া উচিত নয় কিন্তু হওয়া উচিত নিম্ন জাতের যাদের তেজ কম (১২৫৫৪ এবং ১৩৩০৪)। মানুষের শাসনে পোষা পশুরা বেশি ভালো থাকে এবং সেরকম যারা স্বভাবত হীন তারাও যারা উচ্চতর তাদের শাসনে ভালো থাকে। প্রশ্ন তোলা যায় যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস করা যুক্তিসঙ্গত কিনা। ক্ষমতা- যার দ্বারা যুদ্ধ জয় করা যায় তার অন্তরে আছে বিজয়ীর উচ্চতর সদগুণ, কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় তা নয়। যুদ্ধ যখন এমন লোকদের বিরুদ্ধে, প্রকৃতি যাদের শাসিত হওয়ার যোগ্য মনে করেছে কিন্তু তারা নিজেরা শাসিত হতে রাজি নয়, তখন সেটা যুক্তিসঙ্গত (১২৫৬৮) এবং সেক্ষেত্রে এই অর্থ নিহিত যে, বিজিতদের ক্রীতদাস করা সঠিক হবে। যে কোনো যুগের বিজয়ী হোন না কেন, এই বক্তব্য তাদের কাজকে যুক্তিসিদ্ধ করতে পারে, কারণ, প্রকৃতির ইচ্ছা ছিল তারা শাসিত হবে- কোনো জাতিই এ কথা মেনে নেবে না এবং প্রকৃতির ইচ্ছা সম্পর্কে সাক্ষ্য আহরণ করা যাবে শুধুমাত্র যুদ্ধের ফলাফল থেকে। সুতরাং যে কোনো যুদ্ধেই বিজেতারা ন্যায়পরায়ণ এবং বিজিতরা অন্যায়কারী। খুব সন্তোষজনক।

তার পরের আলোচনা বাণিজ্য নিয়ে এ আলোচনা স্কলাস্টিকদের (scholastic মধ্যযুগীয় পণ্ডিত) কূটতর্ককে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। একটি জিনিসের দুরকম ব্যবহার হতে পারে, একটি সঠিক, অপরটি বেঠিক, যেমন, একজোড়া জুতো পায়ে দেওয়া যেতে পারে- সেটা জুতোর সঠিক ব্যবহার কিংবা সেটা বিনিময় করা যেতে পারে- সেটা বেঠিক ব্যবহার। এ থেকে বোঝা যায়, যে পাদুকা নির্মাতাকে জীবনধারণের জন্য তার জুতো বিনিময় করতে হয় তার একটা কিছু অবনতি হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, খুচরো ব্যবসা সম্পদ লাভের স্বাভাবিক উপায় নয় (১২৫৭)। সম্পদ লাভের স্বাভাবিক উপায় গৃহ এবং জমির নিপুণ পরিচালনা। এইভাবে যে বিত্ত লাভ করা যায় তার একটা সীমা আছে কিন্তু বাণিজ্যে যে বিত্তলাভ করা যায় তার কোনো সীমা নেই। ব্যবসা করতে টাকা লাগে। কিন্তু বিত্ত মুদ্রালাভ নয়। বাণিজ্য থেকে লব্ধ বিত্তকে ঘৃণা করা ঠিক, কারণ, এটা অস্বাভাবিক। সর্বাধিক ঘৃণিত হলো কুসীদজীবী হওয়া এবং এই ঘৃণা সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত। কুসীদজীবীরা মুদ্রা থেকে লাভ করেন, মুদ্রার লক্ষিত স্বাভাবিক বস্তু থেকে নয়। তার কারণ, মুদ্রার উদ্দেশ্য ছিল বিনিময় ব্যবহার কিন্তু সুদে বৃদ্ধি পাওয় নয়। বিত্তলাভের সবরকম পদ্ধতির ভিতরে এটাই অস্বাভাবিকতম (১২৫৮)।

এই অনুশাসনের ফল কী হয়েছিল সেটা আপনারা টনি-র (Tawney) ধর্ম এবং ধনতান্ত্রিক উত্থান (Religion and the Rise of Capitalism) বইয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু যদিও তার ইতিহাস বিশ্বাসযোগ্য তবুও মন্তব্যগুলোতে যা প্রাক-ধনতান্ত্রিক তা সম্পর্কে পক্ষপাতিত্ব আছে।

কুসীদজীবী হওয়ার অর্থ সবরকম সুদে টাকা ধার দেওয়া, এখনকার মতো অতিরিক্ত সুদে ধার দেওয়া নয়। গ্রিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মনুষ্যজাতি, অন্ততপক্ষে মনুষ্যজাতির অর্থনৈতিকভাবে বিকশিত অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত- অধমর্ণ এবং উত্তমর্ণ। অধমর্ণরা সুদ অনুমোদন করেননি এবং উত্তমর্ণরা অনুমোদন করছেন। অধিকাংশ সময়েই জমির মালিকরা ছিলেন অধমর্ণ এবং যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন তাঁরা ছিলেন উত্তমর্ণ। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাঁদের নিজেদের শ্রেণির আর্থিক স্বার্থের মিল ছিল। গ্রিক দার্শনিকরা ছিলেন হয় নিজেরা জমির মালিক নয়তো জমির মালিকশ্রেণির দ্বারা নিয়োজিত, সুতরাং তারা সুদ অনুমোদ করতেন না। মধ্যযুগে দার্শনিকরা ছিলেন চার্চের লোক এবং চার্চের সম্পত্তি ছিল প্রধানত জমি, সেই জন্য তাঁরা আরিস্ততেলেসের মতামত পুনর্বিবেচনার কোনো কারণ দেখেননি। তেজারতি ব্যবসাতে তাদের আপত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছিল ইহুদি বিদ্বেষ থেকে, কারণ, অধিকাংশ নগদ টাকাই ছিল ইহুদিদের হাতে। পাদ্রি এবং জমিদারদের ভিতরে কলহ ছিল, অনেক সময়ই তা ছিল অতিশয় তিক্ত কিন্তু তাঁরা দুষ্ট ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারতেন। ইহুদিরা ফসল ভালো হলে চালিয়ে নেওয়ার মতো ঋণ দিয়েছেন এবং তাঁরা মনে করতেন তাঁদের নিজেদের মিতব্যয়িতার জন্য কিছু পুরস্কার তাদের প্রাপ্য।

খ্রিষ্টিয় ধর্মসংস্কারের (Reformation) পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল। সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠাবান প্রোটেস্টান্টদের ভিতরে অনেকেই ছিলেন ব্যবসায়ী, সুদে টাকা ধার দেওয়া ছিল তাদের কাছে অপরিহার্য। সুতরাং প্রথমে ক্যালভিন (Calvin) এবং তারপর অন্যান্য প্রোটেস্টান্ট ধর্মগুরুরা সুদ অনুমোদন করেছেন। শেষ পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চও এই পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়, কারণ, পুরোনো নিষেধগুলোর আধুনিক জগতে অসঙ্গত হলো। যে সমস্ত দার্শনিকদের আয় আহরিত হতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লগ্নি করা টাকা থেকে তাঁরা যেদিন থেকে ধর্মযাজকের পেশা পরিত্যাগ করলেন এবং ফলত ভূ-সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হলো, সুদের পক্ষে গেলেন। প্রতিটি স্তরেই অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক ব্যবস্থার সপক্ষে প্রচুর তত্ত্বগত তর্ক হয়েছে।

প্লাতনের স্বপ্নরাজ্য (Utopia)-কে আরিস্ততেলেস নানা কারণে সমালোচনা করেছেন। এতে প্রথমে রয়েছে একটি অতি আকর্ষণীয় মন্তব্য, এতে রাষ্ট্রকে অতিরিক্ত ঐক্য দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রকে যেন একটি ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। তারপর আসে পরিবার বিলুপ্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যুক্তি, সেটা স্বভাবতই প্রত্যেক পাঠকের মনেই উদয় হয়। প্লাতনের ধারণা পুত্রের বয়সীদের প্রতি শুধুমাত্র পুত্র উপাধি দিলে পুত্রত্ব সম্ভব, মানুষের আসল পুত্র সম্পর্কে অধুনা বহুতর আবেগ থাকে তা এভাবেই একটি মানুষের আসবে এবং পিতা এই উপাধি সাপেক্ষ একই ধরনের ব্যাপার ঘটবে। এর বিপরীতে আরিস্ততেলেস বলেন, যা বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের পক্ষে সাধারণ সেটা স্বল্পতম যত্ন পায় এবং যদি পিতা সাপেক্ষ পুত্ররা সাধারণ হয় তাহলে সাধারণভাবে তাদের অবহেলা করা হবে। বাস্তবে প্লাতনের অর্থে পুত্র হওয়ার চাইতে কাজিন (cousin- সম্পর্কিত খুড়তুতো, মামাতো, পিসতুতো ইত্যাদি ভাই) হওয়া ভালো, প্লাতনের পরিকল্পনায় প্রেম জলবৎ তরল হয়ে যাবে। তারপর একটা অদ্ভুত যুক্তি আছে, যেহেতু ব্যভিচার থেকে মুক্ত থাকা একটা সদগুণ তাই যদি সামাজিক ব্যবস্থা এমন হয় যা এই সদগুণকে লোপ করবে তাহলে খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে এবং পাপ সম্পর্কেও একই যুক্তি প্রযোজ্য (১২৬৩৮)। তারপর আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছেঃ নারী যদি এজমালি হয় তাহলে সংসার কে চালাবে? একবার আমি স্থাপত্য ও সামাজিক তন্ত্র (Architecture and Social System) শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তাতে বলেছিলাম যারা সাম্যবাদক পরিবারের অবলুপ্তির সঙ্গে যুক্ত করেন তাঁরা চান বহুলোকের জন্য একটি সাধারণ বাসগৃহ, সাধারণ রান্নাঘর, খাবার ঘর ও আঁতুড়ঘর। এই তন্ত্রকে মঠ বলা যেতে পারে অবশ্য ব্রহ্মচর্য বাদে। প্লাতনের পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে গেলে এটা অবশ্য প্রয়োজনীয় কিন্তু অন্য যেসব জিনিস তিনি সুপারিশ করেছিলেন তার চাইতে এটা অবশ্যই বেশি অসম্ভব নয়।

প্লাতনের সাম্যবাদ আরিস্ততেলেসের কাছে বিরক্তিকর। তিনি বলেন, এর ফল হবে অলসদের বিরুদ্ধে ক্রোধ এবং সহযাত্রীদের ভিতর যেরকম কলহ থাকে সে ধরনের কলহ। প্রত্যেকের নিজের নিজের চরকায় তেল দেওয়াই ভালো। সম্পত্তি হওয়া উচিত প্রাতিজনিক (private) কিন্তু মানুষকে পরোপকারের ইচ্ছায় এমনভাবে শিক্ষিত করতে হবে যাতে প্রধানত সাধারণের স্বার্থে সে সম্পত্তি ব্যবহার হতে পারে। পরহিতৈষণা এবং মহত্ত্ব দুটি সদগুণ এবং সম্পত্তি ব্যক্তিগত না হলে সেটা অসম্ভব। শেষে বলা হয়েছে, প্লাতনের পরিকল্পনা যদি ভালো হতো তাহলে কেউ না কেউ আগে সেটার কথা ভাবত। আমি প্রতনের সঙ্গে একমত নই কিন্তু কোনো কিছু যদি আমাকে একমত করতে পারত তাহলে সেটা হতে প্লাতনের বিরুদ্ধে আরিস্ততেলেসের যুক্তিগুলো।  

আমরা ক্রীতদাসপ্রথা সাপেক্ষ দেখেছি তিনি সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। ক্রীতদাস ও নারীদের অধীনতা মেনে নিলেও একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়- সমস্ত নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবে সমান হবে কিনা। তিনি বলেন, অনেকে ভাবেন এমনই আকাক্ষা করা উচিত এই কারণে যে, সমস্ত বিপ্লবেরই মূল- সম্পত্তি সম্পর্কিত নিয়ম। এই যুক্তি তিনি মানেননি, তাঁর মতে সবচাইতে বড় অপরাধগুলোর কারণ প্রাচুর্য- অভাব নয়, শীতের ভয়ে কেউ স্বৈরাচারী হয় না।

একটি সরকার তখনই ভালো যখন সমগ্র সমাজের ভালো করা তার লক্ষ্য হয়, যখন সে শুধুমাত্র নিজের কথা ভাবে তখন সেটা মন্দ। ভালো সরকার তিন প্রকারঃ রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও শাসনতন্ত্রভিত্তিক সরকার (কিংবা রাষ্ট্রের শাসন)। মন্দ সরকার তিনরকমঃ স্বৈরাচারী, স্বল্পতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। তাছাড়া অনেক মিশ্র আকারের মধ্যবর্তী সরকার আছে। এটা লক্ষ্য করা যায়, ভালো ও মন্দ সরকারের সংজ্ঞা নির্ণীত হয় ক্ষমতাবানদের নৈতিক গুণের উপর, শাসনতন্ত্রের গঠনের উপর নয়। এটা কিন্তু শুধু মাত্র আংশিক সত্য। অভিজাততন্ত্র সদগুণসম্পন্ন মানুষদের রাজত্ব, স্বল্পতন্ত্র ধনীদের রাজত্ব, আরিস্ততেলেস সদগুণ ও সম্পদকে নির্ভুলভাবে সমার্থক মনে করেন না। মধ্যপন্থার মতবাদ অনুসারে তাঁর মত ছিল মাঝামাঝি কর্মপটুতারই সদগুণের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা সর্বাধিকঃ বাহ্যিক সম্পদ মানুষকে সদগুণ অর্জন করতে কিংবা রক্ষা করতে সাহায্য করে না। কিন্তু বাহ্যিক সম্পদ সদগুণ ও সুখের সাহায্যে পাওয়া যায়। সেই সুখের ভিতর আনন্দ অথবা সদগুণ অথবা দুই-ই থাকতে পারে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যায় সংস্কৃত মন ও চরিত্রের অধিকারীদের ভিতর যাদের বহিশ্রী মধ্যম প্রকার, যাদের রয়েছে বাহ্যিক সম্পদের নিরর্থক আধিক্য কিন্তু যারা উচ্চতর গুণে হীন তাঁদের চাইতে (১৩২৩a এবং b) সেইজন্য সর্বোত্তমের শাসন (অভিজাততন্ত্র) এবং ধনবত্তমদের শাসনে (স্বল্পত) পার্থক্য রয়েছে, কারণ, সর্বোত্তমদের সম্পদ মাঝামাঝি রকম থাকার সম্ভবনা বেশি। গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের শাসনে নৈতিক পার্থক্য ছাড়াও পার্থক্য আছে, কারণ, আরিস্ততেলেস যাকে রাষ্ট্রের শাসন বলেছেন তার ভিতরে খানিকটা স্বল্পতন্ত্রের উপাদান থেকে যায় (১২৯৩৪)। কিন্তু রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের ভিতরে একমাত্র পার্থক্য নৈতিক।

তিনি শাসকদলের আর্থিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্র এবং স্বল্পতন্ত্রের শাসনের পার্থক্য বিষয়ে খুব জোর দিয়েছেন : ধনীরা দরিদ্রের সম্পর্কে কোনো বিবেচনা না করে দেশ শাসন করলে সেই ব্যবস্থাকে বলা হয় স্বল্পতন্ত্র, শাসনক্ষমতা অভাবীদের হাতে থাকলে এবং তারা ধনীদের স্বার্থ অগ্রাহ্য করলে, সে ব্যবস্থাকে বলা হয় গণতন্ত্র।

অভিজাততন্ত্রের চেয়ে রাজতন্ত্র ভালো। অভিজাততন্ত্র ভালো রাষ্ট্রের শাসনের চাইতে। কিন্তু শ্ৰেষ্ঠর দুর্নীতি নিকৃষ্টতম, সুতরাং স্বৈরতন্ত্র স্বল্পতন্ত্রের চাইতে মন্দ এবং স্বল্পতন্ত্র মন্দ গণতন্ত্রের চাইতে। এভাবেই আরিস্ততেলেস পৌঁছেছেন গণতন্ত্রের শর্তাধীন সমর্থনে, কারণ, অধিকাংশ প্রকৃত শাসনব্যবস্থাই মন্দ, সেইজন্য বাস্তব সরকারগুলোর ভিতরে গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বলেই মনে হয়।

গণতন্ত্র সম্পর্কে গ্রিকদের ধারণা আমাদের ধারণার চাইতে অনেক দিক থেকে চরম ছিল, উদাহরণ, আরিস্ততেলেসের বক্তব্য, ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচন করা স্বল্পতান্ত্রিক কিন্তু লটারি করে তাঁদের নিয়োগ করা গণতান্ত্রিক। চরম গণতন্ত্রগুলোতে নাগরিক সভা ছিল। আইনের উর্ধ্বে এবং তাঁরা প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নিতেন স্বাধীনভাবে আথিনীয় বিচারালয়গুলোর সদস্য ছিলেন বহুসংখ্যক নাগরিক, তাঁদের বেছে নেওয়া হতো লটারির সাহায্যে, তাঁদের সাহায্য করার জন্য কোনো জুরি তৈরি থাকতে না। তাঁদের অবশ্য বক্তৃতার দ্বারা কিংবা দল সম্পর্কীয় আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যখন গণতন্ত্রের সমালোচনা হচ্ছে তখন বুঝতে হবে এই ধরনের ব্যাপারগুলো বোঝানো হচ্ছে।

বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে দীর্ঘ একটি আলোচনা ছিল। আগেকার লাতিন আমেরিকার মতো গ্রিসেও প্রায়ই বিপ্লব হতো সুতরাং আরিস্ততেলেসের অনুমিতির পক্ষে প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল। প্রধান কারণ ছিল স্বল্পতন্ত্রবাদী ও গণতন্ত্রবাদীদের দ্বন্দ্ব। আরিস্ততেলেস বলেন, যারা সমান স্বাধীন তাঁদের সব ব্যাপারেই সমান হওয়া উচিত। এই বিশ্বাস থেকেই গণতন্ত্রের উৎপত্তি। স্বল্পতন্ত্রের উৎপত্তি এই বিশ্বাস থেকে যারা কোনো বিষয়ে উত্তম তারা অত্যন্ত বেশি দাবি করেন। প্রত্যেক পক্ষেই একধরনের ন্যায় আছে কিন্তু কোনোটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধরনের নয়। সুতরাং সরকারে তাদের অংশ নিজেদের পূর্বকল্পিত ধারণা অনুযায়ী না হলে দুটি দলই বিপ্লব ঘনিয়ে তোলে (১৩০১a)। গণতন্ত্রবাদীদের তুলনায় স্বল্পতন্ত্রবাদীদের সরকারের বিপ্লবের আশঙ্কা বেশি, কারণ, স্বল্পতন্ত্রবাদীদের ভিতরে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা থাকে। স্বল্পতন্ত্রবাদীরা তেজী ছিল মনে হয়। আমাদের বলা হয়েছে, অনেক নগরে তাঁরা শপথ করে প্রতিজ্ঞা করতেনঃ আমি জনগণের শত্রু হব এবং তাদের ক্ষতি করার জন্য সাধ্যমতো সবরকম উপায় খুঁজব। আজকাল প্রতিক্রিয়াশীলরা এত স্পষ্টভাষী হন না।

বিপ্লব নিবারণে তিনটি পন্থা প্রয়োজন- শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি প্রচার, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, এমনকি ক্ষুদ্র ব্যাপারেও এবং আইন ও শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে নায্যতা অর্থাৎ অনুপাত অনুসারে সাম্য ও প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভোগের অধিকার (১৩০৭৪-১৩০৭৮, ১৩১০)। মনে হয় আরিস্ততেলেস কখনওই অনুপাত অনুসারে সাম্য-এর অসুবিধা বুঝতে পারেননি। এটা যদি সত্যিকারের ন্যায্যতা হয় তাহলে অনুপাত হতে হবে সদগুণ। সদগুণ মাপা কঠিন এবং এটা দলীয় মতভেদের ব্যাপার। সেইজন্য রাজনীতির ক্ষেত্রে সদগুণকে অর্থাগম দিয়ে মাপার প্রবণতা দেখা যায়। অভিজাততন্ত্র এবং স্বল্পতন্ত্রের ভিতরে আরিস্ততেলেস যে পার্থক্য করতে চেষ্টা করেছেন সেটা শুধুমাত্র সেখানেই সম্ভব যেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত বংশানুক্রমিক অভিজাত সম্প্রদায় আছেন। এমনকি সে ক্ষেত্রেও একটা বৃহৎ অনভিজাত ধনিকশ্রেণি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্ষমতার অংশীদার করে নিতে হয়। কারণ, ভয় থাকে তারা বিপ্লব করতে পারে। ভূমিই যেখানে প্রায় একমাত্র সম্পদের উৎস সেখানে ছাড়া বংশানুক্রমিক অভিজাততন্ত্র বেশিদিন তাদের ক্ষমতা রক্ষা করতে পারে না। সমস্ত সামাজিক অসাম্যই শেষ পর্যন্ত অর্থাগমের অসাম্য। গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তির এটা একটা অংশ ও বিত্ত ছাড়া অন্য কোনো গুণের ভিত্তিতে আনুপাতিক ন্যায্যতা করার প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবে ভেঙে পড়বে স্বল্পতন্ত্রের সপক্ষরা ভান করলে অর্থাগম হয় সদগুণের অনুপাতে। প্রার্থনাসংগীত রচয়িতা (Psalmist) বলছেন, তিনি কখনো কোনো সজ্জনকে অন্ন ভিক্ষা করতে দেখেননি এবং আরিস্ততেলেস মনে করেন, সজ্জনরা আহরণ করেন প্রায় তাঁদের নিজেদের আয়- সেটা খুব বেশিও নয়, কমও নয়। কিন্তু এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভট। সম্পূর্ণ সাম্য ছাড়া যে কোনো ন্যায্যতা কার্যক্ষেত্রে সদগুণ ছাড়া একেবারে ভিন্ন কোনো গুণকে পুরস্কৃত করবে, সুতরাং তারা নিন্দার্য।

স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে একটা আকর্ষণীয় পরিচ্ছেদ আছে। স্বৈরতন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা ধনসম্পদ, রাজার আকাঙ্ক্ষা সম্মান। স্বৈরতন্ত্রীকে রক্ষা করে বেতনভূক রক্ষীরা, রাজার রক্ষকরা নাগরিক। স্বৈরতন্ত্রীদের অধিকাংশই বক্তৃতাবাগীশ নেতা (demagogues) তারা বিশিষ্ট ব্যক্তির হাত থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ব্যঙ্গাত্মকমাকিয়াভেলীয় ঢঙ-এ আরিস্ততেলেস ব্যাখ্যা করেছেন নিজের ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য একজন স্বৈরতন্ত্রীর অবশ্যকর্তব্য কী। অসাধারণ গুণী কোনো ব্যক্তির উত্থান তাকে রোধ করতে হবে- মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কিংবা প্রয়োজন হলে ঘাতক দিয়ে হত্যা করে। যেখানে সহআহার কিংবা সহবিহার, সঙ্ঘ কিংবা যে শিক্ষায় বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়। এ সমস্তই তাকে নিষিদ্ধ করতে হবে। অবশ্যই বন্ধ করতে হবে কোনো সাহিত্যসভা কিংবা আলোচনা সভা। জনসাধারণের পারস্পরিক ভালোভাবে জানাশোনা প্রতিরোধ করতে হবে এবং তাদের বাধ্য করতে হবে নিরাভরণভাবে তার দোরগোড়ায় বসবাস করতে। সুরাকুজের মহিলা গোয়েন্দাদের মতো গোয়েন্দা তাকে নিয়োগ করতে হবে। তাকে ঝগড়া বাধাতে হবে এবং নিজের প্রজাদের দরিদ্র করতে হবে। মিশরের রাজা পিরামিড তৈরি করার জন্য যেরকম করেছিলেন। সেরকম বিরাট বিরাট কাজে সে তাদের নিযুক্ত রাখবে। সে নারীদের এবং ক্রীতদাসদের ক্ষমতা দেবে- যাতে তারা চর হয়। সে যুদ্ধ বাধাবে যাতে তার প্রজাদের কিছু করবার থাকে এবং সবসময়ই একজন নেতার প্রয়োজন হয় (১৩১৩a এবং ১৩১৩৮)।

একটি সবিষাদ ভাবনা এই যে, সমস্ত বইটির মধ্যে এই পরিচ্ছেদটিই আধুনিক যুগের সবচেয়ে উপযুক্ত। আরিস্ততেলেসের সিদ্ধান্ত কোনো দুষ্কর্মই একজন স্বৈরতন্ত্রীর কাছে বিরাট কিছু নয়। তিনি বলছেন, স্বৈরতন্ত্রকে রক্ষা করার আর একটি উপায় আছে- সে পথ মধ্যপন্থা গ্রহণ করা এবং ধর্মভীরুর রূপ গ্রহণ করা। কোন পদ্ধতি সবচাইতে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

বৈদেশিক বিজয় অভিযানই রাষ্ট্রের পরিণাম নয়- এ কথা প্রমাণ করার জন্য একটা দীর্ঘ যুক্তিজাল আছে, এ থেকে বোঝা যায় অনেকেরই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এ কথা সত্য যে, একটি ব্যতিক্রম আছেঃ যারা স্বভাব ক্রীতদাস তাদের জয় করা সঠিক এবং ন্যায়সঙ্গত। আরিস্ততেলেসের মতে- এইজন্য বর্বরদের (barbarians) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত কিন্তু গ্রিকদের বিরুদ্ধে নয়, কারণ কোনো গ্রিকই স্বভাব ক্রীতদাস নয়। সাধারণভাবে যুদ্ধ একটি উপায় মাত্র, শেষ কথা নয়। পররাজ্য জয় সম্ভব নয়- বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতিতে অবস্থিত এরকম নগরও সুখী হতে পারে। যে সমস্ত রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে তাদেরও অক্রিম হওয়ার কারণ নেই। যদিও তাদের পক্ষে পরদেশ জয় সম্ভব নয় তবুও ঈশ্বর এবং মহাবিশ্ব সক্রিয়। যদিও যুদ্ধ অনেক সময় প্রয়োজন হতে পারে তবুও একটি রাষ্ট্র যে সুখ অন্বেষণ করবে সেটা যুদ্ধ হওয়া উচিত নয়, সেটা হওয়া উচিত শান্তির জন্য ক্রিয়াকর্ম।

এ থেকে প্রশ্ন আসেঃ একটি রাষ্ট্রের কত বড় হওয়া উচিত? আমাদের বলা হয়েছে, বৃহৎ নগরগুলো কখনোই সুশাসিত হতে পারে না, কারণ, বিরাট সংখ্যক মানুষ নিয়মানুগ হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের হওয়া উচিত কমবেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মতো বৃহৎ কিন্তু সাংবিধানিক সরকার চালানোর পক্ষে অতিরিক্ত বড় হওয়া উচিত হয়। নাগরিকরা যাতে পরস্পরের চরিত্র জানতে পারে রাষ্ট্র সেরকম ক্ষুদ্র হওয়া উচিত, না হলে নির্বাচনে কিংবা বিচারশালায় সঠিক কাজ সম্ভব হবে না। রাজ্যটি এমন ছোট হওয়া উচিত যাতে একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ জরিপ করা যায়। আমাদের দুটোই বলা হয়েছে যে, রাজ্যটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে (১৩২৬b)। এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য থাকবে (১৩২৭৪)-যা মনে হয় এক অসঙ্গতি।

জীবিকার জন্য যারা কর্মে প্রবৃত্ত তাদের নাগরিক করা অনুচিত। নাগরিকদের মিস্ত্রি কিংবা ব্যবসায়ীর জীবন-যাপন করা উচিত নয়, কারণ, সেরকম জীবনহীন এবং সদ্‌গুণবিরোধী। তারা কৃষকও হবে না, কারণ, তাদের অবকাশ প্রয়োজন। নাগরিকরা সম্পত্তির মালিক হবে কিন্তু কৃষকদের হওয়া উচিত অন্য জাতীয় ক্রীতদাস (১৩৩০৪)। বলা হয়েছে, উত্তরের জাতিরা তেজস্বী, দক্ষিণের জাতিরা বুদ্ধিমান, সুতরাং ক্রীতদাসদের দক্ষিণের জাতিরই হওয়া উচিত, কারণ, ক্রীতদাসরা তেজস্বী হলে অসুবিধা আছে। একমাত্র গ্রিকরাই একাধারে তেজস্বী এবং বুদ্ধিমান, বর্বরদের তুলনায় সুশাসিত এবং ঐক্যবদ্ধ হলে সমগ্র পৃথিবী শাসন করতে পারতেন (১৩২৭৮)। আশা করা যেতে পারত এখানে আলেকজান্দ্রসের পরোক্ষ উল্লেখ থাকবে কিন্তু সেরকম কিছু নেই।

আধুনিক উদারনীতিকরা রাষ্ট্রের আকার সম্পর্কে যে ভুল করেছিলেন, আরিস্ততেলেসও সেই ভুল করেছিলেন তবে ভিন্ন মাত্রায়। যুদ্ধের সময় একটি রাষ্ট্রকে আত্মরক্ষা করতে এমনকি, যদি কোনো সংস্কারমুক্ত উদার সংস্কৃতিকে বাঁচতে হয় তাহলেও তাকে খুব বেশি অসুবিধা ছাড়া আত্মরক্ষা করতে হবে। এর জন্য কত রাষ্ট্র প্রয়োজন সেটা নির্ভর করে যুদ্ধ এবং শিল্পের প্রযুক্তির উপর। আরিস্ততেলেসের কালে নগর রাষ্ট্র অচল হয়ে গিয়েছিল, কারণ, সে মাকেনিয়ার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। আমাদের কালে মাকেনিয়া এবং সম্পূর্ণ গ্রিসই এ অর্থে অচল, ইদানীং সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যে শহর খানিকটা উচ্চতা থেকে সম্পূর্ণ পরিদৃশ্যমান সেই শহরের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি যেমন অর্থহীন তেমনি অর্থহীন গ্রিস কিংবা যে কোনো ছোট দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্র কিংবা তার মিত্রশক্তি বৈদেশিক আক্রমণের প্রচেষ্টা নিজের চেষ্টায় না হটিয়ে দিতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সত্য স্বাধীনতা সম্ভব নয়। আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সংযুক্ত আকারের চাইতে ছোট কোনো দেশই এই শর্ত পূরণ করতে পারবে না এবং হয়তো এটাও হবে অতি ক্ষুদ্র একটি একক।

বইটা যে আকারে আমাদের হাতে এসেছে তা দেখে মনে হয় এটা অসম্পূর্ণ এটা শেষ হয়েছে শিক্ষা সংক্রান্ত একটি আলোচনা দিয়ে। অবশ্যই শিক্ষা শুধুমাত্র সেই শিশুদের জন্য যারা ভবিষ্যতে নাগরিক হবে। ক্রীতদাসদের ব্যবহারিক শিল্প শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, যেমন রান্না- কিন্তু এটা শিক্ষার অঙ্গ নয়। একজন নাগরিক যে, ধরনের সরকারের অধীনে বাস করে তাকে সেই ধরনের ছাঁচেই গড়তে হবে, সুতরাং তাদের ভিতরে পার্থক্য হবে যে নগরে সে থাকে সে অনুসারে- অর্থাৎ নগরটা গণতান্ত্রিক কিংবা স্বল্পতান্ত্রিক। কিন্তু আলোচনায় আরিস্ততেলেস অনুমান করছেন নাগরিকদের সবাই হবে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার। কোনটা কাজে লাগবে তা শিশুদের শেখা উচিত কিন্তু সে শিক্ষাকে অমার্জিত রূপ দেওয়া উচিত হবে না। উদাহরণ, তাদের এমন কোনো দক্ষতা শেখানো উচিত নয় যা দেহকে বিকৃত করে কিংবা যা থেকে তাঁরা অর্থোপার্জন করতে শেখে। তারা পরিমিত পরিমাণ শরীরচর্চা করবে কিন্তু সেটা পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য নয়। যে সমস্ত ছেলে অলিম্পিক ক্রীড়ার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, সেটা দেখা এই তথ্য থেকে যারা তরুণ হিসেবে জয়লাভ করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসেবে তারা কদাচিৎ জয়ী হয়। মনুষ্যদেহের গঠন সৌকর্য সম্পর্কে শিশুদের বোধ সৃষ্টি করার জন্য চিত্রশিল্প শেখা উচিত এবং তাদের এমন চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের উৎকর্ষ উপলব্ধি করা শেখাতে হবে যেগুলো নৈতিক ধারণা প্রকাশ করে। তারা গান শিখতে পারে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখতে পারে, তবে শেখার পরিমাণ এমন হবে যাতে তারা সমালোচকের দৃষ্টিতে সংগীত উপভোগ করতে পারে কিন্তু এমন পরিমাণে শিখবে না যাতে তারা দক্ষ গায়ক কিংবা বাদক হতে পারে, কারণ, কোনো স্বাধীন মানুষ মাতাল না হলে গান কিংবা বাজনা বাজাতে পারে না। প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও তারা অবশ্যই লেখা আর পড়া শিখবে। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্যে সদগুণ শেখা, প্রয়োজনীয়তা নয়। সদগুণ বলতে আরিস্ততেলেস কি বোঝেন সেটা তিনি নীতিশাস্ত্র বইয়ে আমাদের বলেছেন, সে বইটি সম্পর্কে উল্লেখ আমাদের এ বইয়ে বার বার করা হয়েছে।

রাজনীতি বইটিতে আরিস্ততেলেসের মূলগত অনুমানের সঙ্গে যে কোনো আধুনিক লেখকের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ্য সংস্কৃতিসম্পন্ন ভদ্রলোক তৈরি করা তাদের ভিতরে থাকবে অভিজাত মনোভাবের সঙ্গে শিক্ষা এবং শিল্পের প্রতি অনুরাগ। এই সমন্বয় উচ্চতম রূপে ছিল পেরিক্লেসের আথিনাতে, সমগ্র জনসাধারণের ভিতরে নয় তবে অবস্থাপন্ন লোকেদের ভিতরে। পেরিক্লেসের শেষ জীবনে এটা ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। সাধারণ মানুষের কোনো সংস্কৃতি ছিল না, তারা পেরিক্লেসের বন্ধুদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল, বন্ধুরা বাধ্য হলেন ধনীদের সুযোগ-সুবিধা রক্ষা করতে- সে কাজ তারা করেছেন বিশ্বাসঘাতকতা, নরহত্যা, বেআইনী স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদির সাহায্যে এবং পদ্ধতিগুলো খুব ভদ্রলোকের মতো ছিল না। সক্রোতেসের মৃত্যুর পর আথিনার গণতন্ত্রের গোঁড়ামি হ্রাস পায় এবং আথিনা প্রাচীন সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে রয়ে যায় কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় অন্যত্র। প্রাচীনকালের শেষ দিকটার প্রায় সবসময়ই ক্ষমতা এবং সংস্কৃতি সাধারণত বিচ্ছিন্ন ছিল? ক্ষমতা চলে যায় অসংস্কৃত সৈন্যদের হাতে এবং সংস্কৃতি থাকে ক্ষমতাহীন গ্রিকদের হাতে, তারা অনেক সময় হতেন ক্রীতদাস। রোমের গৌরবময় যুগ সম্পর্কে এ তথ্য শুধু আংশিকভাবে সত্য কিন্তু এটা কঠোরভাবে সত্য ছিল কিকের-র আগে এবং মার্কস অরেলিয়সের পর। বর্বর হানার পর উত্তরদেশীয় বর্বররা হলো ভদ্রলোক সূক্ষ্ম সংস্কৃতিসম্পন্ন দক্ষিণীরা ছিল যাজক। এই অবস্থা কমবেশি চলতে থাকে প্রায় রেনেসাঁ পর্যন্ত, তখন সাধারণ মানুষ সম্পর্কিত গ্রিক চিন্তন ক্রমশ জয়লাভ করে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বোচ্চ স্থানে উন্নীত হয়।

অনেকগুলো শক্তির ক্রিয়া এই পরিস্থিতি লোপের কারণ- প্রথমত, ফরাসি বিপ্লবে মূর্ত গণতন্ত্র এবং তার পরবর্তী ফলাফল। পেরিক্লেসের যুগের পর সংস্কৃতিসম্পন্ন ভদ্রলোকদের সাধারণ মানুষদের আক্রমণের মুখে নিজেদের সুবিধাগুলি রক্ষা করতে হয়েছে এবং এ কাজ করতে গিয়ে তারা ভদ্রলোক কিংবা সংস্কৃতিসম্পন্ন-কোনোটাই রইলেন না। দ্বিতীয়ত, শ্রমশিল্পবাদের উত্থান, তার সঙ্গে ছিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি- এর সঙ্গে চিরাচরিত সংস্কৃতির ছিল বিরাট পার্থক্য। তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষদের ভিতরে শিক্ষার প্রসার, এর ফলে তারা লেখাপড়ার ক্ষমতা পেল কিন্তু পায়নি সংস্কৃতি। ফলে নতুন ধরনের বক্তৃতাবাগীশ নেতা সুযোগ পেল নতুন ধরনের প্রচারের, এর প্রকাশ দেখা যায় একনায়কতন্ত্র-গুলোতে।

সুতরাং ভালোর জন্যও বটে, মন্দের জন্যও বটে- সংস্কৃতিসম্পন্ন ভদ্রলোকদের দিন ফুরিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *