২০. আরিস্ততেলেসের নীতিশাস্ত্র

২০. আরিস্ততেলেসের নীতিশাস্ত্র

আরিস্ততেলেসের রচনাসংগ্রহের ভিতরে নীতিশাস্ত্র বিষয়ে বই আছে কিন্তু আজকাল মনে করা হয় এগুলোর ভিতরে দুটি তাঁর শিষ্যদের রচনা। তৃতীয় বইটির নাম নিকোমাখীয় এথিকস (Nicomachean Ethics); এ বইয়ের অধিকাংশ সম্পর্কে গ্রন্থকারের নিজস্বতা প্রশ্নাতীত কিন্তু এমনকি এ বইয়েরও একটি অংশ আছে (৫, ৬ এবং ৭ নম্বর বই) যেগুলো অনেকের মতে শিষ্যদের লেখা একটি বই থেকে নেওয়া। আমি কিন্তু এই বিতর্কমূলক প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে পুরোটাই একটি বই বলে এবং আরিস্ততেলেসের বই বলে বিচার করব।

নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের মতামতগুলো প্রধানত তকালীন শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকেদের মতের প্রকাশ। সেগুলো প্লাতনের দৃষ্টিভঙ্গির মতো অতীন্দ্রিয় ধর্মে পরিপূর্ণ নয়। তারা রিপাবলিক-এ ব্যক্ত পরিবার এবং সম্পত্তি সম্পর্কিত অশাস্ত্রীয় ধারণাগুলো সমর্থন করে না। যাদের আচরণ শোভন এবং সদাচারী নাগরিকদের আচরণের চাইতে উচ্চ কিংবা নিম্নমানের নয় তারা এই নীতি শাস্ত্রে পাবেন-যে নীতিগুলো দিয়ে নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি নিয়মানুগ আলোচনা। যারা অতিরিক্ত কিছু চাইবেন তাঁরা নিরাশ হবেন। সম্ভ্রান্ত মধ্যবয়সী লোকেদের এই বইটি নাড়া দেয় এবং বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দির পর থেকে ঐ শ্রেণির লোকেরা এ বই ব্যবহার করেছেন তরুণদের ব্যগ্রতা ও উৎসাহ দমন করার জন্য। কিন্তু যে মানুষের অনুভূতির গভীরতা আছে তাদের এই বইটি বিকর্ষণ করার সম্ভাবনা।

আমাদের বলা হয়েছে সুখই উত্তম এবং সেটি আত্মার ক্রিয়া। আরিস্ততেলেস বলেন যে, আত্মাকে যুক্তিবাদী বা অযৌক্তিক এই দুই ভাগে ভাগ করে প্লাতন সঠিক কাজটি করেছিলেন। অযৌক্তিক এই দুইভাগে ভাগ করে প্লাতন সঠিক কাজ করেছিলেন। অযৌক্তিক অংশকে তিনি ভাগ করেছিলেন- বোধশক্তিহীন (Vegetative যা উদ্ভিদের ভিতরেও পাওয়া যায়) ও ক্ষুধাতৃষ্ণাভিত্তিক (appetitive- যা সমস্ত পশুতেই পাওয়া যায়)। ক্ষুধাতৃষ্ণাভিত্তিক অংশটা কিছু মাত্রায় যুক্তিবাদী হতে পারে, যখন তার কাম্য বস্তুগুলো এমন- যা যুক্তির অনুমোদন লাভ করে। সদগুণের ক্ষেত্রে এটা আবশ্যক, কারণ, আরিস্ততেলেসের মতে একা যুক্তি হলো শুদ্ধ চিন্তনভিত্তিক এবং ক্ষুধাতৃষ্ণার সাহায্য ছাড়া কোনো প্রয়োগীয় কাজ এর দ্বারা হয় না।

সদ্‌গুণ দুরকম- বৌদ্ধিক এবং নৈতিক, আত্মার দুই অংশের অনুরূপে। বৌদ্ধিক সদৃগুণ শিক্ষার ফল, নৈতিক সদ্‌গুণ অভ্যাসের ফল। উত্তম অভ্যাস তৈরি করে উত্তম নাগরিক তৈরি করা আইনপ্রণেতাদের কাজ। ন্যায়সঙ্গত কাজ করলে আমরা ন্যায়ী হই এবং অন্য সদ্‌গুণগুলো সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। আরিস্ততেলেস মনে করেন ভালো অভ্যাস তৈরি করতে বাধ্য হলে কালে কালে আমরা সৎ কাজ করে আনন্দ পাব। এই প্রসঙ্গে হ্যামলেট তার মাকে যা বলেছিলেন সে কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায়ঃ

সদগুণ না থাকলে থাকবার ভান করো।
 রীতি নামক দানব- যা সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি ভক্ষণ করে,
 অভ্যাসে সে শয়তান, কিন্তু একটি ব্যাপারে দেবদূত,
সৎ এবং সাধু কর্ম যারা করে তাদের তিনি দান করেন
 সে কার্যের মতোই পোশাক কিংবা চাপরাশ
যাতে তারা উপযুক্ত হয়েই সে পোশাকটা পরে।

এখন আমরা আসি মধ্যপন্থার বিখ্যাত মতবাদে। প্রত্যেকটি সদ্গুণই দুটি চরমের মধ্যবর্তী, দুটি চরমই কিন্তু দোষ। নানা সদগুণ বিচার করে এটা প্রমাণিত হয়। সাহস হলো কাপুরুষতা এবং দুঃসাহসের মধ্যবর্তী, উদারতা হলো অমিতব্যয় ও কার্পণ্যের মধ্যবর্তী, সত্যিকারের গর্ব হলো অসার আত্মশ্লাঘা ও বিনয়ের মধ্যবর্তী, উপস্থিত বুদ্ধি হলো ভাঁড়ামি ও অসভ্যতার মধ্যবর্তী, নম্রতা হলো লজ্জাশীলতা ও লজ্জাহীনতার মধ্যবর্তী। কিছু কিছু সদগুণকে এই নক্সায় মেলানো যায় না, উদাহরণ, সত্যনিষ্ঠা। আরিস্ততেলেস বলেন, এই গুণ বৃথা গর্ব ও নকল বিনয়ের মধ্যবর্তী (১১৮০৭) কিন্তু এটা শুধুমাত্র নিজের সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোনো ব্যাপকতর অর্থে সত্যনিষ্ঠা কী করে এই নক্সার সঙ্গে মেলে সেটা আমি বুঝতে অক্ষম। অতীতে একজন পুরপিতা আরিস্ততেলেসের মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন, তার কার্যকাল শেষ হওয়ার পর বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, তিনি চেষ্টা করেছেন একদিকে পক্ষপাতিত্ব, অন্যদিকে নিরপেক্ষতার মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম রেখার অনুসরণ করতে। সত্যনিষ্ঠা একটি মধ্যপন্থা- এই দৃষ্টিভঙ্গি ঐ পুরপিতার দৃষ্টিভঙ্গির চাইতে কম যুক্তিহীন নয়।

নৈতিক প্রশ্নে আরিস্ততেলেসের মতগুলো তাঁর যুগের রীতিসম্মত। কতগুলো ব্যাপারে তাঁর মতের সঙ্গে আমাদের যুগের মতের পার্থক্য রয়েছে, প্রধানত যেখানে কোনোরকম অভিজাততন্ত্রের প্রশ্ন আসে। আমরা মনে করি অন্তত নীতিশাস্ত্রের তত্ত্ব অনুসারে সবারই সমানাধিকার রয়েছে এবং ন্যায়বিচার সাম্যের সঙ্গে জড়িত। আরিস্ততেলেস ভাবেন ন্যায়বিচারের সঙ্গে সাম্য জড়িত নয় কিন্তু জড়িত সঠিক অনুপাত- সেটা শুধু কখনো কখনো সাম্য। (১১৩১৮)।

একজন মালিকের বা পিতার ন্যায়নীতি একজন নাগরিকের ন্যায়নীতির থেকে পৃথক, কারণ, পুত্র কিংবা ক্রীতদাস হলো সম্পত্তি এবং নিজস্ব সম্পত্তির উপর কোনো অবিচার হতে পারে না (১১৩৪b)। যাই হোক, ক্রীতদাসদের সম্পর্কে এই মতবাদের সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এই প্রশ্নে যে, মানুষের সঙ্গে কখনো তার ক্রীতদাসের বন্ধুত্ব সম্ভব কিনাঃ দুটি পক্ষের ভিতরে কোনো মিল নেই, ক্রীতদাস একটি জীবন্ত যন্ত্র …….সে যদি ক্রীতদাস তাহলে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যদি মানুষ হয় তাহলে একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব, অবশ্য সেই আর একজন মানুষ যদি একই ন্যায়তন্ত্রের অংশীদার হয় কিংবা একটা চুক্তির পক্ষ হয়। সুতরাং যতটুকু সে মানুষ ততটুকু পর্যন্ত তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব (১১৬১b)।

পুত্র দুবৃত্ত হলে পিতা তাকে অস্বীকার করতে পারে কিন্তু পুত্র পিতাকে অস্বীকার করতে পারে না, কারণ, পুত্রের পিতৃঋণ অপরিশোধ্য- যতটা ঋণ তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব তার চেয়ে পিতার কাছে তার ঋণ অধিক, বিশেষ করে অস্তিত্বের ঋণ (১১৬৩৮)। অসম সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা সঠিক, কারণ, প্রত্যেকের প্রত্যেককে ভালোবাসা উচিত তার যোগ্যতা অনুপাতে, ঊর্ধ্বতন অধস্তনকে যতটা ভালোবাসবে অধস্তনের উচিত উধ্বর্তনকে তার চাইতে অধিক ভালোবাসা ও স্ত্রী, সন্তান, প্রজা- এদের মনে স্বামী, পিতামাতা ও রাজাদের জন্য অধিকতর প্রেম রাখা উচিত অর্থাৎ শেষোক্তরা ভালোবাসেন। বেশি। উত্তম বিবাহে পুরুষ তার নিজের যোগ্যতা অনুসারে শাসন করবে এবং পুরুষের শাসনযোগ্য ক্ষেত্রে শাসন করবে কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে উপযুক্ত ক্ষেত্রে দায়িত্বটা সে স্ত্রীর হাতেই তুলে দেবে (১১৬০৮)। স্ত্রীর যেখানে অধিকার পুরুষ সেখানে শাসন করবে না, পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে শাসন করার অধিকার স্ত্রীর আরও কম, স্ত্রী সম্পদের উত্তরাধিকারিণী হলে অনেক সময় যেমন ঘটে।

আরিস্ততেলেসের ধারণা অনুসারে যে মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট তার সঙ্গে খ্রিষ্টান সন্তের বিরাট পার্থক্য আছে। তার থাকা উচিত উপযুক্ত অহঙ্কার এবং নিজের গুণগুলোকে সে ছোট করে দেখবে না। যে ঘৃণ্য তাকে সে ঘৃণা করবে (১১২৪৮)। গর্বিত ও মহানুভব মানুষের বিবরণ খুবই আকর্ষণীয়, বিবরণ থেকে খ্রিষ্ট্রিয় নীতি ও পৌত্তলিকদের নীতির পার্থক্য বোঝা যায় এবং কোন অর্থে নিটশে খ্রিষ্টধর্মকে ক্রীতদাসদের নীতিবোধ বলে ভাবতেন তা বোঝা যায়।

মহানুভব মানুষ সর্বাধিক পাওয়ার যোগ্য, তাই তাঁর হওয়া উচিত উচ্চতম মাত্রায় উত্তম, কারণ, যিনি শ্ৰেয় তিনি সবসময়ই অধিকতর পাওয়ার যোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ সর্বাধিক পাওয়ার যোগ্য। অতএব সত্যিকারের মহানুভব মানুষ অবশ্যই উত্তম হবেন। এবং প্রতিটি সদগুণেই শ্রেষ্ঠত্ব হবে মহানুভব মানুষের বৈশিষ্ট্য। এবং মহানুভব মানুষের পক্ষে বেমানান হবে কোনো বিপদ থেকে পলায়ন, দুহাত দুপাশে দোলানো কিংবা আর একজনের প্রতি অন্যায় করা, কারণ যার কাছে কোনো কিছুই মহৎ নয় কী কারণে কলঙ্কজনক কাজ করবেন?

মহানুভবতা মনে হয় সদগুণগুলোর একধরনের মুকুট, কারণ, এটা তাঁদের মহত্তর করে তোলে এবং এগুলো ব্যতীত মহানুভবতা পাওয়া যায় না। সুতরাং সত্যিকারের মহানুভব হওয়া কঠিন, কারণ, চারিত্রিক মহত্ত্ব ও সদগুণ ছাড়া সত্যিকারের মহানুভব হওয়া অসম্ভব। সুতরাং মহানুভব মানুষ প্রধানত সম্মান ও অসম্মানের প্রশ্নে আন্দোলিত এবং যে সমস্ত সম্মান মহৎ ও উত্তম মানুষেরা তাঁকে প্রদর্শন করবেন সেগুলো সম্পর্কে তিনি মোটামুটি সন্তুষ্ট হবেন। ভাববেন তিনি তাঁর সমমানের মানুষ কিংবা তার চাইতে কম মানের মানুষের সংস্পর্শে আসছেন। অকলুষিত সদগুণের যোগ্য কোনো সম্মান হতে পারে না, তবুও যাই হোক না কেন, তিনি তা গ্রহণ করবেন, কারণ, তাকে দেয় মহত্তর কিছু তাদের কাছে আর নেই কিন্তু গভীরতাহীন মানুষের কাছ থেকে সামান্য কারণে পাওয়া সম্মানকে তিনি চরম ঘৃণা করবেন, কারণ, তিনি যা পাওয়ার যোগ্য তা এই নয় এবং অসম্মানেরও উপযুক্ত নন, কারণ, তাঁর পক্ষে এটা ন্যায্য হতে পারে না…। ক্ষমতা এবং সম্পদের আকাক্ষা শুধুমাত্র সম্মানের জন্য এবং যার ক্ষেত্রে সম্মানও খুব সামান্য জিনিস তার কাছে অন্য জিনিসগুলোও সামান্য হবে। সেইজন্য মহানুভব মানুষকে তাচ্ছিল্যপরায়ণ মনে করা হয়…। মহানুভব মানুষ তুচ্ছ বিপদে জড়িয়ে পড়েন না… কিন্তু বিরাট বিপদের মুখোমুখি হন এবং তখন নিজের জীবনের পরোয়া করেন না। তিনি জানেন কোনো কোনো অবস্থায় জীবন অর্থহীন। এবং তিনি সেই ধরনের মানুষ যিনি পরের উপকার করেন কিন্তু উপকার গ্রহণ করতে লজ্জা পান, কারণ, প্রথমটি উন্নততর মানুষের লক্ষণ, অপরটি নিম্নতর মানুষের লক্ষণ। এবং পরিবর্তে বৃহত্তর উপকার করা তাঁর নীতি, কারণ, এইভাবে প্রথম উপকারী, ঋণ পরিশোধিত হওয়ার পর ঋণীও হয়ে পড়েন…। মহানুভব মানুষের লক্ষণ কিছু না চাওয়া কিংবা অতি সামান্য কিছু চাওয়া কিন্তু প্রয়োজন হওয়া মাত্র সাহায্য দেওয়া এবং উচ্চ স্থানাধিকারীদের সঙ্গে আত্মমর্যাদা পূর্ণ আচরণ করা কিন্তু মধ্যশ্রেণির সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করা। কারণ পূর্বোল্লিখিত মানুষ সাপেক্ষ উচ্চতর হওয়া কঠিন কিন্তু পশ্চাতে উল্লিখিতদের সঙ্গে ঐরূপ হওয়াই সহজ। পূর্বোল্লিখিত মানুষের সঙ্গে সুউচ্চ আচরণ করা কোনো কুশিক্ষার লক্ষণ নয় কিন্তু নিম্নশ্রেণির লোকেদের সঙ্গে ঐরূপ ব্যবহার করা ভদ্রজনোচিত নয়- এট দুর্বলকে ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো……। তাঁর প্রেম ও ঘৃণা লুকিয়ে রাখা অবশ্যই উচিত নয়, কারণ, নিজের মনের ভাব লুকিয়ে রাখা অর্থাৎ লোকে তাঁর সম্পর্কে কি ভাবে- সেটাকে সত্যের উপরে স্থান দেওয়া কাপুরুষতা… কথায় তিনি নিঃসঙ্কোচ, কারণ, তিনি অবজ্ঞাপূর্ণ এবং সভ্যভাষণই তাঁর অভ্যাস, একমাত্র প্রাকৃতজনের সঙ্গে ব্যঙ্গোক্তি করার সময় বাদে….। প্রশংসা করাও তাঁর স্বভাব নয়, কারণ, তাঁর পক্ষে কোনো কিছুই মহান নয় …। তিনি বাজে গুজব রটাতে অভ্যস্ত নন, কারণ তিনি নিজের সম্পর্কে কিছু বলবেন না, পরের সম্পর্কেও নয়। তিনি অপরের প্রশংসা গ্রাহ্য করেন না এবং অপরের প্রতি দোষারূপও করেন না…। তাঁর থাকবে সুন্দর এবং অলাভজনক জিনিস- কাজে লাগে কিংবা লাভ হয় এরকম জিনিসের চাইতে ঐগুলোই তার পছন্দ….। তাছাড়া ধীরগতি, গভীর কণ্ঠস্বর এবং সুসঙ্গত বাক্য একজন মহানুভব ব্যক্তির উপযুক্ত বলে মনে করা হয় …। তাহলে একজন মহানুভব ব্যক্তি এই রকমই, যিনি এর চাইতে কম, তিনি বৃথা বিনয়ী এবং যিনি এর চাইতে বেশি তিনি অসার দাম্ভিক (১১২৩b-১১২৫)।

একজন দাম্ভিক লোক কিরকম হবে সেটা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। মহানুভব ব্যক্তি সম্পর্কে যাই ভাবা যাক না কেন, একটা জিনিস স্পষ্টঃ এরকম ব্যক্তি একই সমাজে খুব বেশি থাকতে পারে না। যে অর্থে সদগুণ একটা কঠিন ব্যাপার হওয়ার দরুন সদগুণসম্পন্ন ব্যক্তি খুব বেশি থাকে না, সেই সাধারণ অর্থে আমি এই কথাটা বলছি না। আমার বক্তব্য হলো একজন মহানুভব ব্যক্তির গুণগুলো নির্ভর করে তার একটা অসাধারণ সামাজিক অবস্থানের উপর আরিস্ততেলেসের বিচারে নীতিশাস্ত্র রাজনীতিরই একটি শাখা এবং দম্ভকে প্রশংসা করার পর তিনি রাজতন্ত্রকেই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অভিজাততন্ত্রকে ঠিক তার পরেই স্থান দেবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। রাজা এবং অভিজাত বংশের লোকেরা মহানুভব হতে পারেন কিন্তু সাধারণ নাগরিকবৃন্দ যদি তাঁদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তারা হাস্যকর হবে।

এই প্রসঙ্গ একটা প্রশ্ন উত্থাপন করে, সে প্রশ্ন অর্ধেক নৈতিক, অর্ধেক রাজনৈতিক। মূল সংবিধান অনুযায়ী যদি কোনো সমাজ তার সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তুগুলো সামান্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে আবদ্ধ রাখে এবং দ্বিতীয় স্তরের বস্তুগুলো নিয়ে অধিকাংশকে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য করে তাকে কি নীতিগতভাবে সন্তোষজনক মনে করা যায়? প্লাতন এবং আরিস্ততেলেস বলছেন- হ্যাঁ যায় এবং নিটশেও তাঁদের সঙ্গে একমত। স্টোইকরা, খ্রিষ্টানরা এবং গণতন্ত্রবাদীরা বলেন না। কিন্তু তাঁদের না বলার পদ্ধতিতে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। স্টোইক এবং আদি খ্রিষ্টানদের বিচারে সদগুণ হলো সর্বোত্তম এবং বাহ্যিক পরিবেশ কারুর ধার্মিক হওয়ার পথে বাধা হতে পারে না, সেই জন্য একটি ন্যায্য সামাজিক তন্ত্র খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সামাজিক অবিচারের প্রভাব শুধুমাত্র গুরুত্বহীন ব্যাপারগুলোতেই প্রভাবিত করে। বিপরীতভাবে, গণতন্ত্রবাদীরা মনে করেন যে, অন্তত রাজনীতির ব্যাপারে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতা এবং সম্পত্তি। সুতরাং যে সমাজব্যবস্থায় এই সমস্ত ব্যাপারে অবিচার থাকে তাকে তারা মেনে নিতে পারেন না।

স্টোইক-খ্রিষ্টান দৃষ্টিভঙ্গির সদগুণ সম্পর্কে এমন একটি চিন্তাধারা প্রয়োজন যার সঙ্গে আরিস্ততেলেসের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিরাট, কারণ, এই চিন্তাধারা এমন হবে যাতে সদগুণে গুণী হওয়ার সম্ভাবনা ক্রীতদাসদের ও তাদের প্রভুদের পক্ষে সমান। খ্রিষ্টান নীতিশাস্ত্র অহঙ্কারকে অনুমোদন করে না কিন্তু আরিস্ততেলেস মনে করেন সেটা সদগুণ এবং খ্রিষ্টান নীতিশাস্ত্র বিনয়ের প্রশংসা করে কিন্তু আরিস্ততেলেস মনে করেন সেটা দোষ। প্লাতন এবং আরিস্ততেলেস বৌদ্ধিক সদগুণকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন, সেগুলো এই তালিকা থেকে সম্পূর্ণ বাদ যাবে, যাতে দরিদ্র ও বিনয় নম্ররা অন্য সবার মতো সদগুণমণ্ডিত হতে পারে। পোপ গ্রেগরী দ্য গ্রেট (Pope Gregorythe Great) ব্যাকরণ শেখানোর অপরাধে একজন বিশপকে গুরুগম্ভীরভাবে তিরস্কার করেছিলেন।

সর্বোত্তম সদগুণ শুধুমাত্র স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য আরিস্ততেলেসের এই দৃষ্টিভঙ্গি যৌক্তিকভাবে নীতি শাস্ত্রকে রাজনীতির অধীনে আনার সঙ্গে সম্পর্কিত। লক্ষ্য যদি উত্তম ব্যক্তি না হয়ে হয় উত্তম সমাজ তাহলে এটা সম্ভব যে, উত্তম সমাজ এমন হতে পারে যেখানে পরাধীনতা রয়েছে। ঐকতান বাদনে প্রথম বেহালার গুরুত্ব ওবো-র (Oboe বাঁশির মতো বাদ্যযন্ত্র) চেয়ে অনেক বেশি অথচ সম্পূর্ণ ঐকতান বাদনে উত্তর্ষের জন্য দুটিই প্রয়োজন। প্রত্যেকের পারদর্শিতা বিবেচনা করে একটি ঐকতান গঠন করা অসম্ভব। যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন, একটি বৃহৎ আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য। একটি আধুনিক গণতন্ত্র-প্রাচীনকালের গণতন্ত্রগুলোর মতো নয়-রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর মতো কয়েকজন নির্বাচিত ব্যক্তিকে বিরাট ক্ষমতা দান করে এবং অবশ্যই তাদের কাছ থেকে সাধারণ নাগরিকের চাইতে অধিক গুণ আশা করে। যখন ধর্ম কিংবা দ্বন্দ্ব নিয়ে লোকে ভাবছে না তখনও তাদের মতে একজন ভালো রাজমিস্ত্রির চেয়ে একজন ভালো রাষ্ট্রপতির সম্মান বেশি। একটি গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি ঠিক আরিস্ততেলেসের মহানুভব ব্যক্তির মতো হবেন বলে আশা করা হয় না কিন্তু তবুও সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকবে আশা করা হয় এবং তাঁর পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতকগুলো গুণ থাকবে- এইরকম আশা করা হয়। এই বিশেষ গুণগুলোকে হয়তো নীতিসম্মত বলে বিচার করা হয় না কিন্তু তার কারণ এই বিশেষণটি আরিস্ততেলেস যেভাবে ব্যবহার করেছেন তার চাইতে সঙ্কীর্ণতর অর্থে আমরা ব্যবহার করি।

খ্রিষ্টানদের গোঁড়ামির ফলে নৈতিক গুণ ও অন্যান্য গুণের ভিতর পার্থক্য গ্রিক যুগের তুলনায় তীক্ষ্ণতর হয়েছে। কোনো মানুষের বিরাট কবি কিংবা সংগীতবিদ অথবা চিত্রশিল্পী হওয়া একটা গুণ বটে কিন্তু নৈতিক গুণ নয়, এই সমস্ত ক্ষমতা থাকার দরুন তাকে আমরা অধিকতর সদ্‌গুণসম্পন্ন বলে বিচার করব না কিংবা তার স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেও ভাবব না। নৈতিক গুণ শুধুমাত্র ঐচ্ছিক কর্মের সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ সম্ভাব্য একাধিক ক্রিয়ার ভিতরে সঠিক ক্রিয়াটি বেছে নেওয়া। একটা গীতিনাট্য না লিখবার জন্য কেউ আমাকে দোষ দেবে না, কারণ, সেটা কী করে লিখতে হয় আমি জানি না। গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যেখানেই সম্ভাব্য দুটি কর্মপন্থা রয়েছে সেখানে বিবেক বলে দেবে কোনটা সঠিক এবং অপরটি নির্বাচন করা পাপ। সদ্‌গুণ হলো প্রধানত পাপ এড়ানোয় যথার্থ (positive) কিছু করায় নয়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি একজন অশিক্ষিত ব্যক্তির চেয়ে কিংবা একজন চতুর ব্যক্তি একজন বুদ্ধিহীনের চাইতে নৈতিকভাবে উত্তম- এমন আশা করার কোনো কারণ নেই। এভাবে সমাজের পক্ষে বহু বিরাট গুরুত্বপূর্ণ গুণকে নীতিশাস্ত্রের এলাকা থেকে দূরে রাখা হয়। আধুনিক ব্যবহারে অনৈতিক বিশেষণের অর্থের ব্যাপকতা অকাম্য বিশেষণের অর্থের চাইতে সঙ্কীর্ণতর। দুর্বল চিত্ত হওয়া অকাম্য কিন্তু অনৈতিক নয়।

আধুনিক অনেক দার্শনিক কিন্তু নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি। তাঁদের চিন্তন- প্রথম প্রয়োজন উত্তমের সংজ্ঞা দেওয়া এবং তাঁরা বলেন, তারপর আমাদের প্রয়োজন এমন কর্মপন্থা গ্রহণ করা যার সাহায্যে আমরা উত্তমকে পেতে পারি। এই দৃষ্টিভঙ্গি আরিস্ততেলেসের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক কাছকাছি, তার বক্তব্য- সুখই উত্তম। এটা সত্য যে, সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ শুধুমাত্র দার্শনিকরাই পেতে পারেন কিন্তু আরিস্ততেলেসের কাছে এটা তাঁর তত্ত্বের পক্ষে কোনো বাধা নয়।

সদ্‌গুণই পথের প্রান্ত- না শুধু পন্থা, এর উপর নির্ভর করে নীতিশাস্ত্রকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। মোটের উপর, আরিস্ততেলেসের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সদগুণ পথের প্রান্তে পৌঁছানোর উপায় মাত্র, সেই প্রান্ত হলো সুখ। তাহলে আকাঙ্ক্ষা যদি হয় প্রান্তে পৌঁছানো, যা নিয়ে চিন্তা করি ও যা নির্বাচন করি সেটা যদি পথ হয় তবে পথসাপেক্ষ কর্মগুলোকে অবশ্যই হতে হবে স্বনির্বাচিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। সদ্‌গুণ অভ্যাস করার প্রচেষ্টা পন্থার সঙ্গে জড়িত (১১১৩৮)। কিন্তু সদগুণের আর একটি অর্থ আছে, যে অর্থে এটা কর্মের লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্তঃ একটি পূর্ণ জীবনে আত্মার কৃত সদ্গুণসম্মত কর্মই মানুষের শ্রেয় (১০৯৮a)। আমার মনে হয়, তাঁর বক্তব্য ছিল যে, বৌদ্ধিক সদ্‌গুণই চরম লক্ষ্যে কিন্তু কর্মগত সদ্‌গুণ পন্থা মাত্র। খ্রিষ্টান নীতিবাদীদের মত হলো যদিও সদ্গুণসম্মত ক্রিয়ার ফল সাধারণ উত্তম তবুও সদ্‌গুণসম্মত কর্ম যতটা উত্তম, পল ততটা উত্তম নয়, সদগুনসম্মত কর্মের মূল্যায়ন করতে হবে সেই কর্মগুলো দিয়ে, সেগুলোর ফল দিয়ে নয়। অন্যদিকে, যারা শুধুমাত্র আনন্দকে উত্তম বলে মনে করেন তাঁরা সদগুণকে একমাত্র পন্থারূপেই দেখেন। সদগুণের সংজ্ঞা ছাড়া উত্তমের অন্য যে কোনো সংজ্ঞার একই ফল হবে অর্থাৎ সদগুণ উত্তম প্রাপ্তির পন্থা, নিজে উত্তম নয়। এই প্রশ্নে আরিস্ততেলেস, যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রধানত কিন্তু সম্পূর্ণতা নয়, তাঁদের সঙ্গে সহমত যারা মনে করেন নীতিশাস্ত্রের প্রথম কাজ হচ্ছে উত্তমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা এবং সদগুণের সংজ্ঞা হলো ঐ কর্ম যা উত্তম তৈরি করার চেষ্টা করে।

নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কের প্রশ্ন আর একটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। মেনে নেওয়া গেল, যে সঠিক কর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিত সমগ্র সমাজের মঙ্গল, কিংবা শেষ পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির মঙ্গল, এই সামাজিক উত্তম কি বিভিন্ন ব্যক্তি যে উত্তম ভোগ করেন তার যোগফল? কিংবা এটা এমন জিনিস যেটা একেবারেই সমগ্রের অধিকারে, অংশের অধিকারে নয়? মনুষ্যদেহের সঙ্গে তুলনা করে এই সমস্যার একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যেতে পারে। আনন্দ প্রধানত দেহের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে জড়িত কিন্তু আমরা মনে করি সেটা সম্পূর্ণ একটি ব্যক্তির বোধ। আমরা সুন্দর একটি গন্ধ উপভোগ করতে পারি কিন্তু আমরা জানি শুধুমাত্র নাসিকা সে আনন্দ উপভোগ করতে পারত না। তুলনীয়ভাবে, অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন একটি ঘনিষ্ঠভাবে সংগঠিত গোষ্ঠীতে ঔৎকর্ষ থাকে সম্পূর্ণ গোষ্ঠীর, একক একটি অংশের নয়। তাঁরা যদি অধিবিদ্যাবিদ হন তাহলে হেগেলের মতো তাদের যুক্তি হতে পারে- যে গুণই সদগুণ সেটা সমগ্র মহাবিশ্বের একটি গুণ, তবে এর সঙ্গে তারা সাধারণত যোগ করবেন- উত্তম এই বিশেষণ ব্যক্তিসাপেক্ষ ব্যবহার করলে যে ভুল হয় রাষ্ট্রসাপেক্ষে প্রয়োগ করলে ভুল হয় তার চাইতে কম।

যৌক্তিক দিক থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নলিখিতরূপেও উপস্থাপন করা যায়। আমরা একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে এমন অনেক বিশেষণ আরোপ করতে পারি যেগুলো পৃথকভাবে তার অংশ সম্পর্কে আরোপ করা যায় না, যেমন-এই রাষ্ট্র জনবহুল, বিস্তীর্ণ, ক্ষমতাশালী ইত্যাদি। আমাদের বিচার্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নৈতিক বিশেষণগুলো এই শ্রেণিতে পড়ে এবং বলে যে, শুধুমাত্র গৌণ অর্থে এগুলোকে ব্যক্তির উপরে আরোপ করা যায়। এক ব্যক্তি একটি জনবহুল রাষ্ট্র কিংবা উত্তম রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে কিন্তু তাদের মতানুসারে সে নিজে উত্তমও নয় কিংবা জনবহুলও নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি-যা জার্মান দার্শনিকরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন তা কিন্তু আরিস্ততেলেসের নয়, তবে সম্ভাব্য ব্যতিক্রম কিছু মাত্রায় ন্যায্যতা সম্পর্কে তার কল্পনে।

নীতিশাস্ত্রের অনেকটা জুড়ে আছে বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা, এর অন্তর্ভুক্ত আবেগের সঙ্গে জড়িত সমস্ত সম্পর্ক। নিখুঁত বন্ধুত্ব হতে পারে শুধুমাত্র উত্তমদের ভিতরে এবং বহু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া অসম্ভব। নিজের সামাজিক অবস্থানের চাইতে উচ্চস্তরে অবস্থিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়, অবশ্য নিজেও যদি উচ্চতর সদগুণের অধিকারী না হন তাহলে। সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বন্ধুর সম্মান প্রদর্শন যুক্তিযুক্ত হতে পারে। আমরা দেখেছি যে, স্বামী-স্ত্রী কিংবা পিতা-পুত্রের মতো অসম সম্পর্কের ক্ষেত্রে উধ্বর্তনের ভালোবাসা পাওয়া উচিত। ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া অসম্ভব, কারণ, তিনি। আমাদের ভালোবাসতে পারেন না। কোনো ব্যক্তি নিজের বন্ধু হতে পারেন কিনা আরিস্ততেলেস সেটা আলোচনা করেছেন এবং তার সিদ্ধান্ত- এটা শুধুমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি নিজেই একজন উত্তম ব্যক্তি তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, দুষ্ট লোকেরা অনেক সময় নিজেকে ঘৃণা করে। উত্তম ব্যক্তির নিজেকে ভালোবাসা উচিত তবে মহত্তাবে (১১৬৯৪)। দুঃসময়ে বন্ধুরা প্রাণের আরাম কিন্তু সহানুভূতি ভিক্ষা করে বন্ধুদের দুঃখ দেওয়া উচিত নয়, মেয়েরা এবং মেয়েলি পুরুষরা এরকম করে থাকে (১১৭১৮)। শুধুমাত্র দুঃখের সময়ই বন্ধুর প্রয়োজন তা নয়, নিজের সুখের অংশীদার হওয়ার জন্য সুখী লোকেরও বন্ধুর প্রয়োজন। নিঃসঙ্গ থাকার জন্য কোনো লোক সমগ্র বিশ্ব বেছে নেবে না, কারণ, মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব এবং তার স্বভাব অপরের সঙ্গে থাকা (১১৬৯b)। বন্ধুত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা সবটাই বিচক্ষণ উক্তি কিন্তু সাধারণ বুদ্ধির অতিরিক্ত কিছু এতে নেই।

আনন্দ সম্পর্কে আলোচনায় আরিস্ততেলেস আবারও সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন, এ ব্যাপারটাকে প্লাতন অনেকটা কঠোর তপস্বীর মতো বিচার করেছেন। আরিস্ততেলেসের বাগ্বিধিতে আনন্দ (pleasure) এবং সুখ (happinese) পৃথক, তবে আনন্দ ছাড়া কোনো সুখ হতে পারে না। তিনি বলেন, আনন্দ সম্পর্কে তিনটি মত আছে : (১) এটা কখনোই ভালো নয়, (২) কিছু কিছু আনন্দ উত্তম কিন্তু অধিকাংশই মন্দ, (৩) আনন্দ উত্তম তবে সর্বোত্তম নয়। প্রথমটি তিনি বাতিল করেছেন এই যুক্তিতে যে, বেদনা নিশ্চয়ই মন্দ সুতরাং আনন্দ উত্তম হতেই হবে। তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে বলেছেন, চরম দুর্দশায়ও কেউ সুখে থাকতে পারে একথা অর্থহীনঃ সুখী হতে হলে কিছু পরিমাণ বাহ্যিক সৌভাগ্য প্রয়োজন। সমস্ত আনন্দই দৈহিক এই মতও তিনি বাতিল করেছেন, সমস্ত জিনিসেই ঐশ্বরিক কিছু আছে সুতরাং তাদের উচ্চতর আনন্দের ক্ষমতাও রয়েছে। দুর্ভাগ্য না হলে ভালো মানুষ আনন্দে থাকে এবং ঈশ্বর সবসময়ই এক অসাধারণ এবং সরল আনন্দ ভোগ করেন (১১৫২-১১৫৪)।

বইয়ের পরবর্তী একটি অংশে আনন্দ নিয়ে আরও খানিকটা আলোচনা আছে কিন্তু তার সঙ্গে ইতোপূর্বের আলোচনার সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য নেই। এখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে বহু আনন্দ আছে কিন্তু সেগুলো উত্তম ব্যক্তিদের কাছে আনন্দ নয় (১১৭৩৮), তাছাড়া হয়তো আনন্দের রকমে পার্থক্য আছে (তদেব) এবং আনন্দ উত্তম কিংবা অধম সেটা নির্ভর করে সেগুলো উত্তম কিংবা অধম ক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত কিনা তার উপর (১১৭৫b)। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলোর মূল্য আনন্দের চাইতে বেশি, কেউই একটি শিশুর বৃদ্ধি নিয়ে জীবন কাটাতে চাইবে না, এমনকি যদি সেভাবে জীবন কাটানো সুখেরও হয়। প্রতিটি পশুরই নিজস্ব যথাযথ আনন্দ আছে মানুষের যথাযথ যুক্তির সঙ্গে যুক্ত।

এ থেকে উপনীত হওয়া যায় এই বইয়ে প্রাপ্ত একটিমাত্র মতবাদ, যেটা শুধুমাত্র সাধারণ বুদ্ধি নয়। সদগুণসম্পন্ন কর্মেই সুখ রয়েছে এবং নিখুঁত সুখ রয়েছে সর্বোত্তম কর্মে অর্থাৎ চিন্তনে। যুদ্ধ কিংবা রাজনীতি অথবা যে কোনো ব্যবহারিক কর্মজীবনের চাইতে চিন্তন অনেক বেশি পছন্দসই, কারণ, এ কর্মে বিশ্রাম পাওয়া যায় এবং সুখের জন্য বিশ্রাম অপরিহার্য। ব্যবহারিক সদগুণ শুধুমাত্র মধ্যম প্রকারের সুখ আনে, চরম সুখ থাকে যৌক্তিক অনুশীলনে, কারণ, যে কোনো সদগুণের চাইতে যুক্তিই হলো মনুষ্যত্ব। মানুষ সম্পূর্ণভাবে চিন্তাশীল হতে পারে না কিন্তু যে যতটুকু চিন্তা করে ততটুকু তার ঐশ্বরিক জীবনের অংশ। ঈশ্বরের যে কর্ম শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদধন্য সেও নিশ্চয়ই চিন্তন। সমস্ত মানুষের ভিতরে দার্শনিকরাই কাজে কর্মে ঈশ্বরের মতো, সেইজন্য তারা সর্বোত্তম ও সুখীতমঃ

যে নিজের যুক্তি ব্যবহার করে এবং যুক্তিচর্চা করে মনে হয় তার মনই সর্বোচ্চ স্তরের এবং সেই ঈশ্বরের প্রিয়তম। কারণ, দেবতারা যদি মানুষের কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁরা এরকম করেন বলেই মনে করা হয়, তাহলে যা সর্বোত্তম ও তাদের নিকটতম তাতেই তারা আনন্দিত হবেন (অর্থাৎ যুক্তি) এবং যারা একে ভালোবেসে ও সবচাইতে বেশি সম্মান করে তাদেরই দেবতারা পুরস্কৃত করেন। যা তাঁদের সবচাইতে বেশি প্রিয় তারই তারা যত্ন করেন এবং সেটিই সঠিক ও মহৎ কর্ম। এবং এ সমস্ত বিশেষণই যে দার্শনিকদের প্রাপ্য এটা সুপ্রকাশ। সেইজন্য তিনি দেবতাদের প্রিয়তম। যিনি এইরকম, অনুমান করা যায়, তিনিই সুখিতম, সুতরাং এভাবে দার্শনিকরাও যে কোনো অন্য মানুষের চেয়ে সুখী হবেন (১১৭৯৪)।

এই অংশটি কার্যত নীতিশাস্ত্রের দীর্ঘ পরিসমাপ্তি, অনুবর্তী যে কটি পরিচ্ছেদ আছে সেগুলো রাজনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নীতিশাস্ত্রের দোষ এবং গুণ সম্পর্কে আমরা কী মনে করব তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা যাক। গ্রিক দার্শনিকদের আলোচিত অন্য বিষয়সমূহের মতো নিশ্চিত আবিষ্কারের অর্থে নীতিশাস্ত্রের কোনো নিশ্চিত অগ্রগতি হয়নি, বৈজ্ঞানিক অর্থে নীতিশাস্ত্রের কোনো কিছু সম্পর্কেই ঠিক কিছু জানা নেই।

সুতরাং এ বিষয়ে প্রাচীন প্রবন্ধ কেন আধুনিক প্রবন্ধের তুলনায় কোনো অংশে মন্দতর হবে তার কোনো যুক্তি নেই। আরিস্ততেলেস যখন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে বলেন তখন আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তিনি ভুল করছেন কিন্তু যখন তিনি নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে বলেন তখন আমরা একই অর্থে তাঁকে সঠিকও বলতে পারি না কিংবা ভুলও বলতে পারি না। আরিস্ততেলেসের বা অন্য কোনো দার্শনিকের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে আমরা মোটামুটি তিনটি প্রশ্ন করতে পারি : (১) এর কি নিজের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে? (২) লেখকের অবশিষ্ট লেখার সঙ্গে কি এর সামঞ্জস্য আছে? (৩) আমাদের নিজেদের নৈতিক বোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নৈতিক সমস্যাগুলোর উত্তর কি এতে পাওয়া যায়? যদি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট দার্শনিক বৌদ্ধিক ভুল করার দোষে দোষী। কিন্তু যদি তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হয় তাহলে তিনি ভুল করেছেন একথা বলার কোনো অধিকার আমাদের নেই, আমাদের শুধু এটুকু বলার অধিকার আছে যে, তাকে আমাদের পছন্দ হয়নি।

নিকোমাখীয় নীতিশাস্ত্রে যা আছে তার পরিপেক্ষিতে এই তিনটি প্রশ্ন পরপর বিচার করা যাক।

(১) তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন কয়েকটি ব্যাপার ছাড়া বইটি মোটের উপর নিজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উত্তমই সুখ এবং সার্থক কাজকর্মেই সুখের অবস্থিতি-এই মতবাদ খুব ভালোভাবেই নিরূপিত হয়েছে। প্রতিটি সদগুণ দুটি প্রান্তের মধ্যবর্তী-এ মতবাদ খুব উদ্ভাবনী শক্তির সঙ্গে বিকশিত হয়েছে কিন্তু সাফল্য হয়েছে কম, কারণ, বৌদ্ধিক চিন্তনের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়, অথচ বলা হয়েছে সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। কিন্তু একথা অবশ্য বলা যায় যে, মধ্যপন্থা শুধুমাত্র ব্যবহারিক সদগুণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বৌদ্ধিক সদগুণের ক্ষেত্রে নয়। হয়তো অন্য একটি বিষয়ের বিচারে আইনপ্রণয়নকারীদের অবস্থান একটু দ্ব্যর্থবোধক। তাকে শিশু ও তরুণদের সঙ্কর্মে অভ্যস্ত করাতে হবে যাতে শেষ পর্যন্ত তারা সেই সদগুণেই আনন্দ পায় এবং তারা সদ্‌গুণসম্পন্ন কাজ করবে আইনের বাধ্যবাদকতা ছাড়াই। এটা স্পষ্ট যে, আইন প্রণেতারা একইভাবে তরুণদের মন্দ অভ্যাসও করাতে পারেন, এটা এড়াতে হলে তার প্লাতনীয় অভিভাবকদের প্রজ্ঞার সবটাই প্রয়োজন হবে এবং এটা এড়াতে না পারলে সদগুণসম্পন্ন জীবনই সুখী জীবন সেই যুক্তি ভেঙে পড়বে। হয়তো এই সমস্যা বেশির ভাগই নীতিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, অন্তর্ভুক্ত রাজনীতির।

(২) আরিস্ততেলেসের নীতিশাস্ত্র সর্বাঙ্গীণভাবে তার অধিবিদ্যার সঙ্গে সামঞ্জপূর্ণ। অবশ্যই তার অধিবিদ্যক তত্ত্বগুলো নিজেরাই একটি নৈতিক আশাবাদের ফল। তিনি অন্তিম কারণের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বে বিশ্বাস করেন এবং এর নিহিতার্থ হলো উদ্দেশ্যই ব্রহ্মাণ্ডের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিশ্বাস। তাঁর চিন্তনে পরিবর্তনগুলো এমন যা প্রধানত সংগঠন কিংবা আকারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং ভিতরে ভিতরে সদগুণসম্পন্ন ক্রিয়া এই প্রবণতাকে সমর্থন করে। একথা সত্যি যে, তার ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্রের অনেকটাই বিশেষভাবে দার্শনিক নয়, মানবিক কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার ফলমাত্র, যদিও হয়তো তাঁর মতবাদের এই অংশ তার অধিবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন কিন্তু সামঞ্জস্যহীন নয়।

(৩) যখন আমরা আরিস্ততেলেসের নৈতিক রুচির সঙ্গে আমাদের নিজেদের রুচির তুলনা করি তখন দেখতে পাই, প্রথমত, তিনি অসাম্য মেনে নিয়েছিলেন- এ তথ্য আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি কিন্তু অনেক আধুনিক মানসিকতায় এ চিন্তনের বিরোধিতা করা হয়। শুধু ক্রীতদাস প্রথা নয় স্বামী এবং পিতার, স্ত্রী এবং শিশুদের প্রতি প্রভুত্বে তিনি কোনো প্রতিবাদ তো করেনইনি বরং তাঁর মত ছিল যা শ্রেষ্ঠ তা মূলগতভাবে শুধুমাত্র স্বল্প কয়েকজনের জন্য-অর্থাৎ মহানুভব মানুষ ও দার্শনিকদের জন্য। এ থেকে মনে হয় অধিকাংশ মানুষই মূলত কয়েকজন শাসক এবং ঋষি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি। কান্ট বলেছিলেন যে, প্রতিটি মানুষই শেষ পর্যন্ত তার নিজস্ব জীবনের জন্য সৃষ্টি এবং এটা খ্রিষ্টানদের চালু করা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যাই হোক, কান্টের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি যৌক্তিক অসুবিধা আছে, কারণ, দুজনের স্বার্থের সংঘাত হলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোনো উপায় তিনি বলেননি। প্রত্যেকেই যদি শেষ পর্যন্ত নিজেরই জন্য হয় তাহলে কে পিছু হটবে? সেটা ঠিক করার মতো কোনো নীতিতে আমরা কী করে পৌঁছাব? এরকম একটা নীতি অবশ্যই একক ব্যক্তির জন্য নয় বরং গোটা সমাজের জন্য। শব্দটির বিস্তৃততম অর্থে এ নীতিকে হতে হবে ন্যায়ের নীতি। বেন্থাম (Bentham) এবং উপযোগবাদীদের ব্যাখ্যায় ন্যায় হলো সাম্য ও দুজনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসনের সঠিক পন্থা হলো যাতে সর্বাপেক্ষা সুখ উৎপন্ন হয়-দ্বন্দ্বকারীদের কে সেটা ভোগ করছে কিংবা কী করে সেটা ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে, সেটা ভাববার দরকার নেই। যদি শ্রেয়তর মানুষটিকে মন্দ মানুষটির তুলনায় বেশি দেওয়া হয় তাহলে তার কারণ, শেষ পর্যন্ত সদগুণকে পুরস্কৃত করলে এবং পাপকে শাস্তি দিলে সাধারণ সুখ বৃদ্ধি পায়- এই চরম নৈতিক মতবাদ যে উত্তম অধমের তুলনায় অধিক পাওয়ার যোগ্য, এ কারণে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ন্যায়-এর অর্থ শুধুমাত্র এর সঙ্গে জড়িত সুখের পরিমাণ বিচারে, এর সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা করার সম্পর্ক নেই। প্লাতন এবং আরিস্ততেলেস ও অন্যান্য গ্রিক দার্শনিকদের ন্যায় সম্পর্কে একটা পৃথক ধারণা ছিল এবং ধারণাটি আজও বহুল প্রচলিত। প্রাথমিকভাবে ধর্ম থেকে আহরিত যুক্তিতে তারা ভেবেছিলেন প্রতিটি ব্যক্তি কিংবা বস্তুরই সঠিক বলয় থাকে, সেটা অতিক্রম করা অন্যায়। কারও কারও চরিত্র এবং দক্ষতার জন্য অন্যদের তুলনায় বিস্তৃততর প্রভাব বলয় রয়েছে এবং তারা যদি সুখের অধিক অংশ পায় তাতে কোনো অন্যায় হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি আরিস্ততেলেস বিনা বিচারে মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু এর ভিত্তি যে আদিম ধর্ম, প্রাচীনতম দার্শনিকদের ভিতরে এটা স্পষ্ট হলেও আরিস্ততেলেসের লেখায় তা আর বোঝা যায় না।

আরিস্ততেলেসের লেখায় বদান্যতা কিংবা লোকহিতৈষণা প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষের যন্ত্রণা- অন্তত তিনি যতটা অবহিত ছিলেন- তার ভাবাবেগকে চঞ্চল করত না। বৌদ্ধিকভাবে তিনি এটাকে মন্দ বলতেন কিন্তু এর জন্য তাঁর যে কোনো দুঃখ হতো এরকম কোনো সাক্ষ্য নেই অবশ্য দুঃখভোগীরা যদি তাঁর বন্ধু না হতেন।

আরও সাধারণভাবে বলা যায় তাঁর নীতিশাস্ত্র এ ভাবাবেগের দৈন্য রয়েছে- যা প্রাচীনতর দার্শনিকদের লেখায় অনুপস্থিত। মানবিক ব্যাপারে আরিস্ততেলেসের দূরকল্পনে অনুচিত পরিমাণ অত্মতৃপ্তি এবং আরামবোধ আছে। সমস্ত যা কিছু মানুষকে পরস্পরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করে তার সবটাই যেন তিনি বিস্মৃত। এমনকি বন্ধুত্ব সম্পর্কে তাঁর লেখাও কবোষ্ণ। যে অভিজ্ঞতা হলে উন্মাদনা থেকে নিজেকে রক্ষা করা কঠিন হয় সেরকম কোনো অভিজ্ঞতার চিহ্ন তাঁর ভিতরে আমরা পাইনি। তাছাড়া নৈতিক জীবনের গভীরতর দিকগুলো তাঁর কাছে স্পষ্টতই অজানা ছিল বলে মনে হয়। বলা যায়, মানুষের যে সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ধর্ম জড়িত হয় তার সমগ্র বলয়ই তিনি বাদ দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য আরামে জীবন কাটানো মৃদু ভাবাবেগের মানুষের কাজে লাগবে কিন্তু যাদের দেবতায় কিংবা অপদেবতায় পেয়েছে অথবা যাঁদের বহির্জগতের দুর্ভাগ্য হতাশ করেছে তাদের জন্য তাঁর কিছু বলার নেই। এই সব কারণে, আমার বিচারে, তার নীতিশাস্ত্রের এত খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও স্বকীয় গুরুত্বের অভাব রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *