০৮. আনাক্সাগরস

৮. আনাক্সাগরস

 পীথাগোরাস (Pythagoras), হেরাক্লিডস (Hraclitus) এবং পার্মেনিদেস (Parmenides)-এর সমকক্ষ না হলেও দার্শনিক আনাক্সাগরস (Anaxagoras)-এর যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তিনি ছিলেন ইওনীয়বাসী (Ionian) এবং ইওনীয়র বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ঐতিহ্য বহন করেছেন। আথিনীয়দের কাছে দর্শনশস্ত্র তিনিই প্রথম উপস্থিত করেন এবং ভৌত পরিবর্তনের মূলগত কারণ যে মন- এই মতও তিনি উত্থাপন করেন।

৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময় ইওনীয়র ক্লাজোমেনায়ে (Clazomenae)-তে তাঁর জন্ম কিন্তু তাঁর জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর তিনি কাটিয়েছেন আথিনাতে, মোটামুটি ৪৬২-৪৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। তিনি বোধ হয় আসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন পেরিক্লেসের দ্বারা, পেরিসে তার সহনাগরিকদের সুসভ্য করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বোধ হয় মিলেতস (Miletus) থেকে আগত আসপাসিয়া (Aspasia) তাকে পেরিক্লেসের সঙ্গে পরিচিত করান। প্লাতন তাঁর ফায়েদ্রস (Phaedrus)-এ বলছেনঃ

মনে হয়, পেরিফ্রেস বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্ব আনাক্সাগরসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তিনি নানা বস্তু সম্পর্কে উচ্চতর তত্ত্ব জেনে আপনাকে তৃপ্ত করতেন। আনাক্সাগরসে আলোচনা ছিল প্রধানত বৃদ্ধি এবং মূর্খতার সত্যিকার চরিত্র সম্পর্কে। এগুলো সম্পর্কে সে কোনো উৎস থেকে তিনি জ্ঞান সংগ্রহ করতেন এবং সাহায্যে তিনি বাকশক্তির উন্নতিসাধন কিংবা সেই শক্তিকে বিকশিত করতেন।

কথিত আছে এউরিপিদেসকে আনাক্সাগরস প্রভাবিত করেছিলেন কিন্তু এ তথ্য আরও সন্দেহজনক।

নিজেদের অভ্যস্ত সংস্কৃতির তুলনায় উচ্চতর সংস্কৃতির উপস্থাপকদের সম্পর্কে আথিনার নাগরিকরা অন্যান্য নগরের, অন্যান্য যুগের, অন্যান্য মহাদেশের মতোই একইরকম বিদ্বেষ পোষণ করতেন। পেরিক্রেসের যখন বয়স বাড়ছিল তখন তার শত্রুরা তার বন্ধুদের আক্রমণ করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। তারা, তাঁর মূর্তিগুলোর জন্য গচ্ছিত সোনা তছরূপ করার অভিযোগ আনেন ফেইদিয়স (Pheidias)-এর বিরুদ্ধে। যারা ধর্মাচরণ করেন না এবং যারা উচ্চ বিষয় (the things on high) সম্পর্কে তত্ত্বশিক্ষা দেন তাদের অভিযুক্ত করা অনুমোদন করে পেরিক্লেসের শত্রুরা একটি আইন পাস করেন। এই আইন অনুসারে তাঁরা আনাক্সাগরসকে অভিযুক্ত করেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁর শিক্ষায় সূর্য একটি তপ্ত রক্তবর্ণ প্রস্তর এবং চন্দ্র মৃত্তিকা। (সক্রাতেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তবে তিনি তদানীন্তন অভিযোগকারীদের আধুনিক জ্ঞানে অজ্ঞ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। তারপর কী ঘটেছিল সঠিক জানা যায় না তবে আনাক্সাগরসকে আথিনা পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। সম্ভবত পেরিক্লেস তাঁকে কোনোরকমে কারামুক্ত করে বাইরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ইওনীয়তে ফিরে গিয়ে সেখানে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর ইচ্ছাপত্র অনুসারে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হতো।

আনাক্সাগরসের মত ছিল সব পদার্থকে অন্তহীন ভাগে বিভক্ত করা যায় এবং পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশতেও সবকটি মৌলিক উপাদান থাকে। যে উপাদান সর্বাধিক থাকে পদার্থকে তার অনুরূপ মনে হয়। উদাহরণ, সব পদার্থেই খানিকটা অগ্নি থাকে কিন্তু অগ্নিই যদি প্রধান উপাদান হয় তাহলে তাকে আমরা অগ্নি বলি। এমপেদক্লেসের মতো তিনি শূন্যতার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, জলঘড়ি কিংবা ফোলানো চামড়া (থলি) থেকে বোঝা যায়, যেখানে কিছু নেই মনে হয় সেখানেও বায়ু রয়েছে।

মন (nous) নিয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ ছিল, তাঁর মতে মন এমন একটি পদার্থ যা সজীব বস্তুতে উপাদানরূপে প্রবেশ করে এবং নির্জীব পদার্থের সঙ্গে সজীব পদার্থের এটাই পার্থক্য। তিনি বলেন, প্রতিটি বস্তুতেই মন ছাড়া প্রতিটি উপাদান থাকে, কোনো কোনো বস্তুতে মনও থাকে। জীবিত সব বস্তুর উপরেই মনের ক্ষমতা রয়েছে, মন অসীম এবং স্বনিয়ন্ত্রিত ও অবিমিশ্র। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, মন ছাড়া সমস্ত বস্তুতেই সমস্ত বৈপরীত্যের খানিকটা অংশ থাকে, যেমন গরম এবং ঠাণ্ডা, সাদা এবং কালো। তাঁর মত ছিল তুষার কৃষ্ণবর্ণ (অংশত)।

মন হলো সমস্ত গতির উৎস। মন একটি ঘূর্ণনের সৃষ্টি করে, এই ঘুর্ণন ক্রমশ সমস্ত বিশ্বে বিস্তারলাভ করে, তার ফলে লঘুতম বস্তুগুলো পরিধিতে যায় এবং সর্বাধিক গুরুভার বস্তুর পতন হয় কেন্দ্রের অভিমুখে। মন সমরূপ (uniform) এবং পশুতে ও মানুষে অভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে মানুষকে উৎকৃষ্টতর মনে হওয়ার কারণ তার দুটি হাত। বৃদ্ধির পার্থক্য আসলে দৈহিক পার্থক্য।

প্লাতনীয় সক্রাতেস এবং আরিস্ততেলেস, দুজনেরই অভিযোগ আনাক্সাগরস মনকে উপস্থাপন করেছেন বটে কিন্তু তার ব্যবহার করেছেন সামান্য। আরিস্ততেলেস দেখিয়েছেন আনাক্সাগরস যখন অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাননি তখনই মনকে কারণরূপে বর্ণনা করেছেন। সম্ভব হলেই তিনি যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বস্তুর উৎপত্তির কারণ হিসেবে তিনি প্রয়োজন এবং আপতনকে বর্জন করেছেন কিন্তু তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বরের (Providence) কোনো স্থান নেই। মনে হয় তিনি নীতিবিদ্যা (ethics) কিংবা ধর্ম নিয়ে বেশি চিন্তা করেননি, বোধহয় তিনি নাস্তিক ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদেরও এটাই মত ছিল। পুথাগরস ছাড়া পূর্বগামী সবার প্রভাবই তাঁর উপর ছিল। পার্মেনিদেসের প্রভাব তার উপর ছিল ততটাই যতটা ছিল এমপেদক্লেসের উপরে।

বিজ্ঞানে তার কৃতিত্ব ছিল বিরাট। তিনিই প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, চাঁদের উজ্জ্বলতার কারণ প্রতিফলিত আলো, অবশ্য পার্মেনিদেসের লেখায় একটি স্বল্পব্যক্ত ইঙ্গিত আছে যা থেকে মনে হয় তিনিও এই তথ্য জানতেন। আনাক্সাগরস গ্রহণ সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি জানতেন চাঁদের অবস্থান সূর্যের নিচে। তিনি বলেছিলেন, সূর্য এবং তারকাগুলো অগ্নিময় প্রস্তর কিন্তু আমরা তারকা তাপ অনুভব করতে অক্ষম, কারণ, তাদের অত্যধিক দূরত্ব। সূর্য পেলপনেশাস (Peloponnesus)-এর চাইতেও বৃহত্তর। চাঁদে পর্বত রয়েছে, রয়েছে বাসিন্দারাও (তার মতে)। কথিত আছে, আনাক্সাগরস ছিলেন আনাক্সিমেনেসের (Anaximenes) ঘরানার। নিঃসন্দেহে তিনি ইওনীয়বাসীদের বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিবাদী ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর চিন্তায় আমরা নীতিবাদ এবং ধর্মের প্রাধান্য দেখতে পাই না, পুথাগরস থেকে সক্রাতেস এবং সক্রাতেস থেকে স্নাতন পর্যন্ত এই প্রাধান্য ছিল। তার ফলে গ্রিক দর্শনে একটি জ্ঞানোন্নতিবিরোধী ঝোঁক দেখা দেয়। তিনি ঠিক প্রথম শ্রেণির নন কিন্তু আথিনাতে দর্শনশাস্ত্র আনবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যে সমস্ত প্রভাব সক্রাতেসকে সক্রাতেস হতে সাহায্য করেছে- আনাক্সগরসের প্রভাব তার মধ্যে একটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *